অধ্যায়ঃ ৬
আলো ছড়িয়ে পড়লো সবখানে
ইসলামী আন্দোলন অগ্রযাত্রার প্রাণশক্তি
এ বিশ্বে অনেকেই তরবারীর জোরে বহু ভূখন্ডের মালিক হয়েছে। অনেক রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র নিছক অস্ত্রবল ও বাহুবলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বার্থ সংক্রান্ত টানাপোড়েনের অনেক ফায়সালা রণাঙ্গনেও হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের যে কোন বিপ্লবী আন্দোলনকে নিজের ভাগ্যের ফায়সালা সব সময় জনমতের আওতায় থেকেই করতে হয়। মানুষের হৃদয় যতক্ষণ ভেতর থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে কোন দাওয়াতের সহযোগীতা করতে প্রস্তুত না হয় এবং নিজের চরিত্র ও মানসিকতাকে তার আলোকে গড়ে তুলতে রাজি না হয়, ততক্ষণ নিছক বলপ্রয়োগ করে সমর্থন আদায় করা লাভজনক হতে পারেনা। বরঞ্চ সেটা হয় তার মারাত্মক ধ্বংসের কারণ। তাই প্রত্যেক আদর্শবাদী আন্দোলনের আসল প্রকৃতি ও মেজাজ হয়ে থাকে আবেদন ও শিক্ষামূলক। আর তার পরিচালকেদের মধ্যে সক্রিয় থাকে মুরব্বী সুলভ ও গুরুজন সুলভ স্নেহ মমতা ও প্রেরণা। আদর্শবাদী আন্দোলনের দৃষ্টিতে জীবন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তুল্য এবং সমাজের সব মানুষ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র স্বরুপ। এই ছাত্রদের সার্বিক কল্যান নিশ্চিত করার জন্য এবং দুর্বৃত্তদের সংশোধন এবং কু-প্রভাব থেকে সমাজের ভদ্র ও মধ্যমপন্থী শ্রেণীর লোকদের নিরাপদে রাখার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও মাঝে মাঝে গৃহীত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সামগ্রিক পরিবেশ সব সময় ছাত্রদের জন্য স্নেহ-মমতা ও করুণার পরিবেশ হয়ে থাকে এবং উস্তাদের শাস্তিমূলক পদক্ষেপেও মুরুব্বীসুলভ মনোভাবই প্রধান্য বিস্তার করে থাকে। সত্যের বানী ও সততার দাওয়াত নিয়ে আল্লাহর যে পবিত্র বান্দারা ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন, তাঁরা অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও দুস্কৃতি, দুর্নীতি ও অসততার উচ্ছেদের জন্য যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং তরবারীকে আংশিকভাবে শিক্ষা দানের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তাদের সামগ্রিক কাজ সব সময় মুরব্বী ও স্নেহময় শিক্ষকের মনোভাব নিয়ে অবিকল শিক্ষাদানের ভংগীতেই অব্যাহত থেকেছে। তারা যে আসল যুদ্ধটা করেছেন, তা যুক্তির অস্ত্র দিয়ে জনমতের বিশাল ও বিস্তৃত রণাঙ্গনেই করেছেন। সব সময় তাদের নীতি এই ছিল যে, কেউ যদি নতুন জীবন লাভ করতে চায় তবে সে য্নে তা যুক্তির মাধ্যমেই লাভ করে, আর যদি কেউ জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজের জন্য মৃত্যু পছন্দ করে, তবে সে যেন যুক্তির আলোকেই মৃত্যু বরণ করে।
রসূল সা.- এর সামরিক পদক্ষেপগুলোকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে,বদর থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত (খয়বরবিজয়সহ) মোট পাঁচটি বড় আকারের যুদ্ধ হয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে এই সব ক’টা যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক। তন্মদ্ধে প্রথম তিনটে তো হয়েছে শত্রুরা আগ্রাসন চালিয়ে মদিনার ওপর হানা দেয়ার কারণে। মদিনা থেকে সৈন্য নিয়ে গিয়ে নিজের উদ্যোগে রসূল সা. বড়জোর দুটো অভিযানই চালিয়েছেন একটা মক্কা বিজয়ের (হোনায়েন যুদ্ধসহ) অভিযান অপরটা খয়বর বিজয়ের অভিযান।
আর এই দুটো অভিযানেই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। সময়ের দিক দিয়ে দেখলে বদরের যুদ্ধ থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত মোট ছয় বছরের ব্যবধান। রসূল সা. তাঁর মহান শিক্ষামূলক, প্রচারমূলক, গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক কাজে মোট ২৩ বছর সময় কাটিয়েছেন। এর মধ্যে মাত্র ছ’টা বছর ছিল এমন, যখন শিক্ষা মূলক কাজের পাশাপাশি বিরোধীদের যুদ্ধাংদেহী মনোভাব ও আচরণের মোকাবিলাও করতে হয়েছে। সর্বাধিক অতিরঞ্জিত করেও যদি অনুমান করা হয়, তবুও মনে হয়, সব ক’টা যুদ্ধে সর্বমোট ১৫ হাজারের চেয়ে বেশী লোক রসূল সা. এর মোকাবিলায় আসেনি এবং তাদের মধ্য থেকে মাত্র ৭৫৯ জীবনকে পথ থেকে সরানোর মাধ্যমে আরবের কয়েক লক্ষ মানুষ সম্পূর্ণরুপে শুধরে যায়। দশ বছর ইতিহাসে অত্যন্ত ক্ষুদ্র সময়। এত অল্প সময়ে আরবের ন্যায় মরুভূমিকে মানুষের জীবনের সঠিক কল্যানের লক্ষ্যে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাসকারী, চরম উচ্ছৃঙ্খল, হিংস্র ও দাঙ্গাবাজ গোত্র ও ব্যক্তিবর্গকে এর আওতাভূক্ত করা, তারপর তাদেরকে সুমহান নৈতিক শিক্ষা দানে সাফল্য অর্জন করা এবং শুধু শিক্ষা দেয়া নয়, বরং সমগ্র মানব জাতির জন্য তাদেরকে শিক্ষক ও উস্তাদে পরিণত করা সম্ভবত রসূল সা. – এর নবুয়তের সবচেয়ে বড় বাস্তব ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অলৈৗকিক প্রমাণ।
সুতরাং এ বিষয়টি সকল সন্দেহ ও বিতর্কের উর্ধ্বে যে, ইসলামের বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব সংঘাতের নিষ্পত্তিতে যুদ্ধ ব্গ্রিহের যতটুকু অবদানই থাকুক না কেন, জনমতের অবদানই ছিল সর্বাধিক এবং জনমতের অংগনই ছিল নিষ্পত্তির আসল অংগন। কিছুটা আধ্যাত্মিক ভাষায় যদি বলি তবে বলা যায়, মানুষের হৃদয় জয় করাই ছিল রসূল সা.- এর আসল বিজয় ও আসল সাফল্য। আরবের লক্ষ লক্ষ নর নারীকে তিনি যদি জয় করে থাকেন, তবে তাদের হৃদয়ই জয় করেছেন এবং তা করেছেন যুক্তি ও চরিত্রের অস্ত্র দিয়ে। এ বিষয়টা যে, সর্বদিক থেকে নিত্য নতুন প্রতিবন্ধকতার মুখেও অল্প দিনের মধ্যে দশ বারো লক্ষ বর্মাইল এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক আদম সন্তানকে ইসলামের অনুসারী বানানো কিভাবে সম্ভব হলো? আসল ব্যাপার হলো, দাওয়াত যদি সত্য ও সঠিক হয়, আন্দোলন যদি মানব কল্যানের লক্ষ্যে পরিচালিত হয় এবংএর পতাকাবাহীরা যদি ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান হয়, তবে বিরোধিতা ও প্রতিরোধ বিপ্লবী কাফেলার জন্য অধিকতর সহায় হয়ে থাকে। প্রত্যেক বাধা এক একটা পথ প্রদর্শক হয়ে আসে।
এই জন্যেই যদিও সংখ্যালঘু দিয়েই সত্যের সূচনা হয়ে থাকে, কিন্তু তা সংখ্যাগুরুকে জয় করে থাকে। আসুন, এবার দেখা যাক, ইসলামী আন্দোলন কোন্ কোন্ শক্তিকে ব্যবহার করে জনমতের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা লাভে দ্রুত সাফল্য লাভ করেছিল।
যুক্তি প্রমাণের শক্তি
ইসলামী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল যুক্তি প্রমাণের শক্তি। ইসলামী আন্দোলনের পরিবর্তে রসূল সা. পীর মুরুদীর কোন ব্যাবস্থা চালু করতেন, তাহলে শ্রোতাদের বিবেক বুদ্ধিকে অবশ করে দিতেন। প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের মত নিছক ব্যাক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ কোন ধর্ম যদি প্রবর্তন করতেন, তাহলে অলীক কল্পনা ও ভিত্তিহীন ধ্যানধারণার প্রতি মানুষের ঝোঁক ও আগ্রহ বৃদ্ধি করতেন, আর বৈরাগ্যবাদী আধ্যাত্মিক দরশন শিক্ষা দানের কোন ব্যাবস্থা যদি চালু করতেন, তাহলে তো চোখ কান ও মুখ সম্পুর্ণরূপে বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু রসূল স. যে ইসলামী আন্দোলন চালু করেন, তাতে এমন সচেতন লোকদের প্রয়োজন ছিল, যারা আল্লাহ্র আনুগত্যের ভিত্তিতে পুরো একটা সভ্যতাকে গড়ে তুলতে ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে। এজন্যই ইসলামী আন্দোলন যখন শুধু দাওয়াত পর্যায়ে ছিল, তখন সে মানুষের সুপ্ত বিবেকবুদ্ধিকে জাগিয়ে তুললো। চোখ খুলে দেখতে ও কান খুলে শুনতে উদ্ভুদ্ধ করলো। বিশ্বপ্রকৃতিকে নিয়ে চিন্তাগবেষণা করতে উৎসাহ যোগালো। মানব সত্তার অভ্যন্তরের ও তার পারিপার্শিক জগতের পরিস্থিতির সুক্ষ পর্যালোচনা করার শিক্ষা দিল। নিত্য নতুন প্রশ্ন তুলে চিন্তাধারাকে শানিত ও গতিশীল করলো। অন্ধ অনুকরণের বন্ধন ছিন্ন করলো। অর্থহীন রসম রেওয়াজের বিলুপ্তি ঘটালো। অতীত পূজা ও পুরুষানুক্রমিক রীতি প্রথার অন্ধ নুগত্য বাতিক করল। পশুর মত নির্বোধ মানুষের ভেতর থেকে বিবেকবান ও চিন্তাশীল মানুষ সৃষ্টির কৌশল উদ্ভাবন করলো। অন্ধ বোবা ও বধির শ্রেণীর লোকদের ঠোকা দিয়ে সচেতন করে তুললো এবং বিবেকবুদ্ধির মরিচা দুর করে দিল। এক কথায়, ইসলামী আন্দোলনের সর্বপ্রধান কৃতিত্ব হলো, তা মানুষের ওপর জাহেলিয়াতের চাপিয়ে দেয়া বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতার অবসান ঘটায়। এর ফলে যাদের বিবেকবুদ্ধি জাগ্রত ও সচেতন হয়, তাদের সামনে সে জীবনের মৌলিক সত্যগুলোকে পেশ করে এবং নিজের শানিত যুক্তিপ্রমাণ দ্বারা তাদের প্রভাবিত করে এবং সত্যগুলোর প্রতি তাদের অটুট বিশ্বাস গড়ে তোলে।
ইসলামী আন্দোলন যখন একমাত্র আল্লাহ্কেই সৃষ্টিকর্তা, মালিক, জীবিকাদাতা, হুকুমদাতা ও সুপথ প্রদর্শক হিসেবে পেশ করলো, তখন এমন বলিষ্ঠ যুক্তি সহকারে পেশ করলো যে, এর বিপরীত ভিত্তিহীন ও অলীক কল্পনার হাতিয়ারগুলো ভোতা ও অকার্যকর হয়ে গেল। সে মানুষের বিবেচনা শক্তিকে উদ্দীপ্ত করে দাওয়াত দিল যে, আকাশ ও পৃথিবীর বিচিত্র সৃষ্টি, গ্রহ নক্ষত্রের আবর্তন, ঋতু ও আবহাওয়ার বিবর্তন, বৃষ্টি ও বাতাসের নিয়মবিধি, তরুলতার জন্ম ও বিকাশ বৃদ্ধির দৃশ্য, পশুপাখীর বংশবৃদ্ধি ও লালনপালন, মানবগোষ্ঠী সমূহের বৈচিত্র, সভ্যতা সমূহের উত্থান পতন এবং আপন সত্তা সমূহের গভীরতা পর্যবেক্ষণ করো ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো। দেখবে, সর্বত্র অটল আইন-কানুন চালু রয়েছে। সৃষ্টি জগতের প্রতিটি অংশে একটা সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল শাসন কার্যকর রয়েছে। ছোট কিংবা বড় প্রতিটি ঘটনার কোন না কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও পরিণতি নির্দিষ্ট রয়েছে। বিচিত্র সব পরস্পর বিরোধী বস্তু পরস্পর সহযোগী ও পরিপূরক হিসেবে কাজ করে চলেছে। সমগ্র সৃষ্টির কারখানায় একধরনের সমন্বয় ও একাত্মতা বিরাজ করছে। একের মধ্যে বাঁধা রয়েছে অনেক। প্রতিটি জিনিস গতিশীলও বিকাশমান। কোথাও স্থবিরতা ও গতিহীনতা নেই। প্রতিটি বস্তু উৎকর্ষের দিকে ধাবমান। প্রতিটি উপকরণ ও কার্যকারণ কোন গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলের জম্ম দিয়ে চলেছে। অতঃপর প্রতিটি ফলাফল আবার আরেকটি ফলাফলের জন্য উপকরণে পরিণত হচ্ছে। প্রাকৃতিক জগতের এই আইন, এই শৃঙ্খলা, এই সমন্বয়, এই সহযোগিতা, এই ঐকতান এবং এই বিকাশ ও বিবর্তনের ধারা আপনা আপনি একটা আকস্মিক দুর্ঘটনার আকারে উদ্ভুত হয়নি। জিনিসগুলো নিজের পরিকল্পনা নিজে করেনা, নিজেকে নিজে সৃষ্টি করে না এবং পরস্পর পরামর্শের মাধ্যমেও পরস্পরকে সহযোগিতা করেনা। বরং সর্বোচ্চ, সদাসক্রিয়, স্বয়ম্ভূ, সার্বভৌম, মহাজ্ঞানী ও বিজ্ঞানময় স্রষ্টা আল্লাহই এগুলোর একমাত্র পরিচালক, ব্যবস্থাপক, শাসক ও আইন রচয়িতা হিসেবে কাজ করে চলেছেন। মহাবিশ্বের সকল শক্তি ও বস্তু তাঁরই গুণগানে নিয়োজিত। সকল বস্তু তাঁরই সামনে সিজদারত। সকল সৃষ্টি তাঁরই প্রাকৃতিক আইনের অনুগত। বিশালাকায় সূর্য থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুপরমাণু পর্যন্ত প্রতিটি জিনিস তাঁরই দরবারে মাথা নুইয়ে রেখেছে। ইসলাম এ কথাও বলেছে যে, এত বড় সৃষ্টির এই বিশাল কারখানায় যদি একাধিক মালিক ও ব্যবস্থাপক থাকতো, তাহলে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যেত এবং যে পারস্পরিক সহযোগিতা, একাত্মতা, ঐক্যতান তোমরা মহাবিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান দেখতে পাচ্ছ, তা কোনক্রমেই কায়েম থাকতোনা। বিশ্ব প্রকৃতির এই বিশাল পুস্তকের পাতায় পাতায় শুধু তাঁর অস্তিত্বের নয়, বরং সেই সাথে তাঁর একত্ব ও তাঁর গুণাবলীর অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।
ইসলামী আন্দোলন যুক্তি প্রমাণের সাহায্যে এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, এই মহাবিশ্ব সর্বোতভাবে আল্লাহ্র আইন ও বিধানের আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ এবং এর প্রতিটি অণুপরমাণু তাঁর সামনে ‘মুসলিম’ বা আত্মসমর্পিত দাস। কোন সৃষ্টির পক্ষে আল্লাহ্র সামনে আনুগত্য, দাসত্ব বা আত্মসমর্পণের ভূমিকা ছাড়া অন্য কোন ভূমিকা অবলম্বনের অবকাশ নেই। মানুষ যদি আল্লাহ্র অনুগত হয়, তবে সে সমগ্র বিশ্বজগতের সাথে একাত্ম হয়ে যাবে। তাদের সমাজ ও সভ্যতা ঠিক তেমনি নিরাপত্তা ও সহযোগিতার প্রতীকে পরিণত হবে, যেমন রয়েছে বস্তুর জগতে। আর যদি তারা আল্লাহ্র অবাধ্য তথা কাফের হয়, তাহলে বিশ্বপ্রকৃতির সাথে তাদের সমাজ সভ্যতা বেখাপ্পা, বেমানান ও সংযোগহীন হয়ে যাবে এবং আকাশ ও পৃথিবীতে যে ভারসম্য, ঐকতান ও সহযোগিতা বিরাজমান রয়েছে, মানব সমাজে তা থাকবেনা। অথচ এরই কারণে বিশ্বের সকল সৃষ্টি শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে উন্নতি, উৎকর্ষ ও বিকাশ লাভ করেছে। এ বিশ্বে মানুষের জন্যেও শান্তি ও নিরাপত্তার পথ এটাই যে, সে আল্লাহ্র দ্বীন ও আল্লাহ্র আইনের অনুগত থাকবে। মানুষ আল্লাহরই সৃষ্টি, তাঁরই দেয়া জীবিকায় লালিত পালিত, তার দেহের প্রতিটি অঙ্গ, এবং অঙ্গের প্রতিটি অণুপরমাণু মুসলিম হিসেবে আল্লাহ্র প্রাকৃতিক আইনের আনুগত্যের অটুট শৃঙ্খলে আবদ্ধ। সুতরাং মানুষের জন্য জীবন যাপনের কোন সরল ও সঠিক পথ যদি থেকে থাকে, তবে তা আল্লাহ্র দাসত্ব ও আনুগত্যেরই পথ। মানুষ জম্ম সূত্রেই আল্লাহ্র দাস ও গোলাম এবং দাসত্বের অনুভূতি ও চেতনা তার মনমগজে আজম্ম লালিত।
ইসলামী আন্দোলন একই বলিষ্ঠটা ও তেজস্বিতাসহ অকাট্য যুক্তি প্রমাণ দিয়ে এ কথাও প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, আল্লাহ্র পক্ষ থেকে হেদায়াত বা দিক নির্দেশনা লাভ করা প্রত্যেক সৃষ্টিরই প্রয়োজন। কেননা তিনিই সকল জিনিসের ভাগ্যবিধাতা এবং মহাকাশে বিচরণশীল প্রতিটি বস্তুর কক্ষপথ ও গতিবিধি নির্ধারক। তিনিই বিভিন্ন জিনিসকে বিভিন্ন রকম বৈশিষ্ট্য দান করেন। প্রত্যেক শক্তিকে তার উপযুক্ত কাজে নিয়োগ করেন। প্রত্যেক সৃষ্টির জন্য কর্মপন্থা স্থির করেন। অন্যান্য সৃষ্টির ন্যায় মানুষও আল্লাহ্র দিকনির্দেশনার ঠিক তেমনি মুখাপেক্ষী, যেমন আলো, বাতাস ও পানি মুখাপেক্ষী। আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টিকে নিজের পথনির্দেশনা জানানোর জন্য ওহীর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন। এই ওহী নিষ্প্রাণ পদার্থের জন্য প্রাকৃতিক বাধ্যবাধকতা, উদ্ভিদের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃদ্ধির ক্ষমতা এবং জীবনের জন্য সহজাত প্রক্রিয়া। কিন্তু মানুষ যেহেতু চেতনা বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী, তাই তার জন্য ওহীর সেই পূর্ণাঙ্গ রূপই নির্ধারিত হয়েছে, যা দ্বারা তার বিবেকবুদ্ধি ও চেতনাকে সম্বোধন করা হয়।
ইসলামী আন্দোলন স্বীয় আদর্শিক দাওয়াতের এ অংশটাকেও যুক্তির বলেই গ্রহণযোগ্য করেছে যে, এই বিশ্ব জগতে যখন কারণ ও ফলাফলের নিয়ম চালু রয়েছে, তখন মানুষের নৈতিক কর্মকাণ্ডেরও এই সর্বব্যাপী নিয়মের আওতায় একটা পরিণতি ও ফলাফল থাকা অবশ্যম্ভাবী। ইতিহাসে যে প্রতিফল বিধান কার্যকর রয়েছে, সেটা দেখিয়ে সে প্রমাণ করেছে যে, মানুষের সামাজিক কর্মকাণ্ডও এই বিধানের আওতাধীন হওয়া অনিবার্য। এই সাথে সে এটাও দেখিয়েছে যে, মানুষের সীমিত পরিসরের ইহকালীন জীবনে সীমিত প্রতিফল বিধানের অধীন পরিপূর্ণ কর্মফল প্রকাশ পায়না। এমনকি অনেক সময় একটামাত্র কর্মধারারও পূর্ণতা অর্জিত হয়না। তাছাড়া অনেক সময় মানুষকে একেবারে বিপরীত ফলাফলও ভোগ করতে হয়। সুতরাং আল্লাহ্র এই সুবিচারপূর্ণ ব্যবস্থার কাছ থেকে আশা করা উচিৎ যে, পার্থিব জীবনের পর একটা নতুন জীবনের আবির্ভাব ঘটবে এবং তখন মানুষকে তার পূর্ণ কর্মফল ভোগ করতে হবে। সর্বত্র ক্রিয়াশীল আল্লাহ্র এই ন্যায় বিচারের যৌক্তিক দাবী এই যে, যে যেমন কাজ করবে, সে তার তেমনই ফল ভোগ করবে। এভাবে সে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন, আখেরাতের বিচার এবং শাস্তি ও পুরষ্কারের ধারণা দিয়েছে।
এইসব মৌলিক সত্যকে অকাট্যভাবে প্রমাণ করার জন্য ইসলাম মানবজাতির সমগ্র অতীত ইতিহাস তুলে ধরেছে। এক একটা জাতির ইতিবৃত্ত বর্ণনা করেছে এবং দেখিয়েছে, যেসব জাতি ও গোষ্ঠী ঐ সত্য গুলোকে মেনে নিয়ে সেগুলোর ভিত্তিতে নিজেদের জীবনকে গড়ে তুলেছে, তারা সফলতা লাভ করেছে। আর যারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। যে সব ব্যক্তি ঐ সত্যগুলোকে গ্রহণ করেছে, তাদের মন মগজ আলোকিত হয়েছে এবং তাদের চরিত্র দেদীপ্যমান হয়েছে। আর যারা ঐ সত্যের বিরোধিতা করছে, তাদের অধপতন ঘটেছে। সে দেখিয়েছে যে, এই মহাসত্যের দাওয়াত প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক জাতির সামনে যারা পেশ করেছে, তারা মূলত একই ধরনের স্বভাব চরিত্রের অধিকারী। তারা শুধু পেশ করেই ক্ষান্ত থাকেনি বরং তাকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা এবং জানমালের সর্বাধিক ত্যাগ ও কুরবানী সহকারে চেষ্টা সাধনা করেছে।
ইসলামী আন্দোলনের এই মৌলিক দাওয়াত তার সমস্ত অকাট্য যুক্তিপ্রমাণ সহকারে কোরআনে সবিস্তারে বিবৃত হয়েছে। চমৎকার বর্ণনা ভঙ্গিতে একে বারবার পেশ করা হয়েছে। সাথে সাথে বিরোধীদের আপত্তি, ব্যংগবিদ্রুপ ও উপহাসেরও জবাব দেয়া হয়েছে শান্তশিষ্ট ও স্বাভাবিক ভাষায়। তারপর কোথাও উপদেশ দেয়া হয়েছে, কোথাও সতর্ক করা হয়েছে, কোথাও হুমকি দেয়া হয়েছে, কোথাও লজ্জা দেয়া হয়েছে, কোথাও চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, কোথাও কোমলতা ও নম্রতা দ্বারা মানুষের মনকে গলিয়ে দেয়া হয়েছে। মোটকথা বিভিন্ন ভংগীতে মানুষের মনমগজকে এমনভাবে ঘিরে ফেলা হয়েছে যে, বুদ্ধিমান ও সচেতন লোকদের জন্য পালানোর কোন পথ রাখা হয়নি।
বস্তুত বিজয় যদি তরবারীর জোরেই অর্জন করা হবে, তাহলে যুক্তিপ্রমাণ পেশ করার উপর এত গুরুত্ব দেয়ার কী দরকার ছিল যে, কোরানের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশী জায়গা জুড়ে এর অবস্থান?
সত্য কোথা হলো, ইসলামী আন্দোলনের ক্ষুরধার যুক্তির সামনে শ্রোতাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। যারা ভাগ্যবান, তারা একে খোলা মনে গ্রহণ করেছে। আর যারা বুদ্ধির বক্রতার কারণে গ্রহণ করেনি, তারা যুক্তির প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে হিংস্র প্রতিরোধে নেমেছে। যেই আন্দোলন শ্রোতাদেরকে এই পর্যায়ে পৌছে দেয়, সে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত জয়লাভ না করে ছাড়েনা।
হিতাকাংখী সুলভ আবেদনের শক্তি
কোরআনের যুক্তিগুলো শুধু যুক্তি নয়, বরং তার সাথে সাথে মন গলিয়ে দেয়া, পলায়নপর লোকদের আকৃষ্ট করে কাছে ডেকে আনা এবং বদ্ধ হৃদয়কে খুলে দেয়ার আবেদনও যুক্ত হয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের এ জাতীয় আবেদনগুলো পাষাণ হৃদয় মানুষকেও মোমের মত গলিয়ে দিত। কোরআন খুললেই দেখা যাবে তার প্রতিটি বাক্যে কীভাবে যুক্তির আলোর সাথে আবেগের উষ্ণতা মিশ্রিত রয়েছে। এ জন্যই তো ইসলামের বড় বড় পাষাণ হৃদয়ের শত্রুও সত্যের সেবকে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া এর সাহিত্যিক মান এতো উন্নত ও জাদুকরী শক্তি সম্পন্ন যে, তা তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আরব কবি সাহিত্যিকদের পর্যন্ত হতবাক করে দিয়েছিল। কোরআনের এ ধরনের প্রাঞ্জল, সহজবোধ্য ও হৃদয় জয়কারী কিছু আবেদন এখানে উদ্ধৃত করছিঃ
“(হে নবী, আমার পক্ষ থেকে তাদের) বলঃ হে আমার বান্দারা যারা নিজের উপর যুলুম করেছ, আল্লাহ্র রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা। নিশ্চই আল্লাহ্ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তোমরা তোমাদের প্রভুর দিকে ফিরে আসো এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ কর, যে সময় তোমাদের ওপর আযাব এসে যাবে এবং তোমরা কোন সাহায্য পাবে না সেই সময় আসার আগেই। আর এই সর্বোত্তম হেদায়েতের অনুসরণ কর, যা তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেই সময়ের পূর্বেই হেদায়েতের অনুসরণ কর যখন তোমাদের উপর আকস্মিকভাবে আযাব আসবে, অথচ তোমরা টেরও পাবেনা। তখন কোন ব্যক্তি আক্ষেপ করে বলবে, হায় আফসোস! আমার এই ত্রুটির জন্য যা আমি আল্লাহর সামনে করেছি এবং আমি বিদ্রূপ করেছিলাম। অথবা সে (হতাশ হয়ে) বলবে, আল্লাহ যদি আমাকে হেদায়েত করতেন, তবে আমি পরহেজগার হয়ে যেতাম। অথবা যখন সে আযাব দেখবে, তখন বলবে, আবার যদি আমি সুযোগ পাই, তাহলে আমি সৎ লোক হয়ে যাবো।” (সূরা আয যুমার, ৫০-৫৮)
এই কটা আয়াতে সংক্ষেপে সেই মৌলিক সত্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে, যা রাসুল (সা) এর দাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এতে যুক্তিও প্রদর্শন করা হয়েছে, তার পাশাপাশি মন গলানো আবেদনও রয়েছে। এতে সুসংবাদও আছে, সতর্কবাণীও আছে। কোরআনের এ ধরনের রকমারি আবেদন অনেক রয়েছে। মাটির তৈরি মানুষ এহেন বৈপ্লবিক ভাষার শক্তি সামনে তিষ্ঠাতে পারতোনা, বিশেষত এ ধরনের আহবান যখন প্রতিদিন সকালে, দুপুরে ও সন্ধ্যায় আসতো। তেইশ বছর ধরে এভাবে ওহীর সয়লাব আসতে থাকে। এ ধরনের আরো কয়েকটা আবেদন লক্ষ্য করুনঃ
“হে আদম সন্তানেরা! আমি কি তোমাদের সাবধান করে দেইনি যে, শয়তানের দাসত্ব করো না? সে তো তোমাদের প্রত্যক্ষ শত্রু। আমি কি বলিনি যে, আমারই দাসত্ব কর? কেননা এটাই সঠিক পথ। তথাপি সে তোমাদের অনেককে বিপথগামী করেছে। তবুও কি তোমরা বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করবে না?” (সূরা ইয়াসিনঃ ৬০-৬২)
“(হে নবী) বলে দাওঃ হে জনগণ তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সত্য এসে গেছে। কাজেই যে ব্যক্তি সুপথপ্রাপ্ত হবে, সে নিজের কল্যাণের জন্যই সুপথপ্রাপ্ত হবে। আর যে বিপথগামী হবে, সে নিজের ক্ষতির পথই প্রশস্ত করবে। তোমাদের ভালো মন্দের ব্যাপারে আমি দায়িত্বশীল নই।”(সূরা ইউনুসঃ ১০৮)
যারা বিরোধিতার ফ্রন্ট খুলে বসেছিল, তাদেরও সর্বোত্তম অনুভূতির কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। মোশরেক হোক বা আহলে কিতাব হোক, প্রত্যেক গোষ্ঠীর উত্তম মানুষদের উত্তম ভংগীতে আহবান জানানো হয় এবং তাদের সর্বোত্তম ভাবাবেগকে সক্রিয় করার চেষ্টা করা হয়। এমনকি মোনাফেকদেরও সংশোধনের আহবান জানানো হয়। এ পর্যায়ের উদাহরণগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে পেশ করা হল।
মক্কার মোশরেকদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণ
“আল্লাহ একটা জনপদের উদাহরণ দিচ্ছেন। ঐ জনপদের লোকেরা সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিল। চারদিক থেকে তার জীবিকা আসছিল পর্যাপ্ত পরিমাণে। তারপর তার অধিবাসীরা আল্লাহর নেয়ামতের নাশোকরী করলো। তাই আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের ফল স্বরূপ তাদের ক্ষুধা ও নিরাপত্তাহীনতার স্বাদ আস্বাদন করালেন। তাদের মধ্য থেকেই একজন নবী এসেছিল। কিন্তু তারা তাঁকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করলো। তাই আযাব তাদের পাকড়াও করলো। তারা আসলে জুলুমবাজ ছিল।” (সূরা আন-নাহলঃ ১১২-১১৩)
আহলে কিতাবের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণ
“হে আহলে কিতাব! আমার রসূল তোমাদের কাছে এসে গেছে। তোমরা যে সব জিনিস গোপন কর, তার অনেকগুলো এই রসূল প্রকাশ করে। আর অনেকগুলো জিনিস থেকে তোমাদের অব্যাহতি দেয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে আলো ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। তার মাধ্যমে আল্লাহ এমন সব লোককে শান্তির পথে চালিত করেন, যারা তার মর্জি মোতাবেক চলে এবং তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে তাঁর বিশেষ নির্দেশ মোতাবেক আলোতে নিয়ে আসে। আর তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।” (সূরা আল-মায়েদাঃ ১৬)
“হে নবী! বলঃ হে আহলে কিতাব, নিজেদের ধর্ম নিয়ে অন্যায় বাড়াবাড়ি করোনা। যারা পথভ্রষ্ট, যারা অন্যদেরকে বিপথগামী করে এবং সোজা পথ থেকে দূরে সরে যায়, তাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করোনা।” (সূরা আল মায়েদাঃ ৭৭)
“হে আহলে কিতাব! নবী রসুলদের আগমনের ধারায় দীর্ঘ বিরতির পর আমার রসূল তোমাদের কাছে এসেছে। সে প্রকৃত সত্য কে সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরে। যেন তোমরা বলতে না পার যে, আমাদের কাছে সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা আসেনি। এখন তোমাদের কাছে সতর্কবাণী ও সুসংবাদদাতা এসেছে।” (সূরা আল-মায়েদাঃ ১৯)
“আমি বনী ইসরাইল সম্পর্কে কিতাবে ফয়সালা করে দিয়েছি যে, তোমরা পৃথিবীতে দু’বার অরাজকতা ছড়াবে এবং খুবই মারাত্মকভাবে অহংকার করবে। সুতরাং, হে বনী ইসরাইল! প্রথম প্রতিশ্রুতির সময় যখন সমাগত হলো, তখন আমি তোমাদের উপর আমার যুদ্ধংদেহী বান্দাদের চাপিয়ে দিলাম। তারা শহরে ছড়িয়ে পড়লো। বস্তুত সেই ওয়াদা পূরণ হওয়ারই কথা ছিল। এরপর আমি তাদের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে আরো একটি সুযোগ দিলাম এবং ধনসম্পদ ও সন্তানাদি দিয়ে তোমাদের শক্তিশালী করলাম ও তোমাদের সংখ্যা বাড়ালাম। (তোমাদের পুনর্বার সুযোগ দিলাম এ জন্য যে) তোমরা ভালো কাজ করলে নিজেদেরই উপকার সাধন করবে, আর মন্দ কাজ করলে তাও নিজেদের জন্যই করবে। তারপর যখন দ্বিতীয় ওয়াদার সময় এল, যাতে তারা তোমাদের মুখমণ্ডলকে (দুঃখ ও লাঞ্ছনার কালিমা দ্বারা) কলংকিত করতে পারে, (বায়তুল মাকদিসের) মসজিদে প্রথমবার যেভাবে ঢুকেছিল, সেইভাবে ঢুকতে পারে এবং যেখানে তাদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়, সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে, (তখন তো তোমরা তার স্বাদ ভালোভাবেই উপভোগ করলে)। (এখন মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতের অভ্যুত্থান ঘটায় তোমাদের সামনে আরো একটা চূড়ান্ত সুযোগ হাজির হয়েছে, তাই) তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের উপর অনুগ্রহ করতে চান। তবে তোমরা যদি পুনরায় আগের মতই কাজ কর, তাহলে আমিও আগের মতই শিক্ষা দেব। আর (আখিরাতে) আমি অবাধ্য লোকের ঠিকানা বানিয়েছি জাহান্নাম।” (সূরা বনী ইসরাইলঃ ৪-৮)
“(হে নবী,) বলঃ হে আহলে কিতাব, এসো তোমাদের ও আমাদের মধ্যে যে কথাটা অবিসংবাদিত, সেই কথাটা আমরা মেনে নেই। সেই কথাটা হল এই যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম মানবো না, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবো না এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেরাই পরস্পরকে প্রভুর আসনে বসাব না।” (আল ইমরান-৬৪)
খৃস্টানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ
“আর যারা বলে, আমরা নাসারা, তাদেরকে তুমি (ইহুদীদের চেয়ে) মুসলমানদের ভালোবাসার ক্ষেত্রে নিকটতর পাবে। কেননা তাদের মধ্যে বহু আলেম ও দরবেশ রয়েছে, যারা দাম্ভিক নয়। তারা যখন রসূলের কাছে নাযিল হওয়া বাণী শোনে, তখন তুমি তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে দেখবে। তারা বলে, হে আমাদের প্রভু, আমরা ঈমান এনেছি। কাজেই আমাদের নাম সত্যের সাক্ষীদের সাথে লিখে নাও।” (আল মায়েদা)
মোনাফেকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ
“তারা (মোনাফেকরা) কি দেখে না যে, তারা প্রতি বছর একবার কি দু’বার পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হয়? তবুও তারা তওবাও করে না এবং শিক্ষাও গ্রহণ করে না। আর যখনই কোন সূরা নাযিল হয়, তখন তারা একে অন্যের দিকে তাকায় আর জিজ্ঞেস করে, কেউ কি তোমার দিকে তাকাচ্ছে? অতঃপর সে উঠে চলে যায়। তাদের মনকে আল্লাহ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। কারণ তারা বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করে না। শোনো, তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল তোমাদের কাছে এসেছে। তোমাদের যে কোন কষ্টই তার মনোকষ্টের কারণ হয়ে থাকে। তোমাদের প্রতি সে অত্যন্ত উদগ্রীব। মুমিনদের প্রতি সে অত্যন্ত দয়ালু ও স্নেহময়।” (সূরা তওবাঃ ১২৬-১২৮)
এ ধরনের আরো অনেক মর্মস্পর্শী বক্তব্যে কোরআন পরিপূর্ণ। হৃদয়ে বদ্ধমূল হওয়ার মত, বিবেকে সাড়া জাগানোর মত এবং চেতনাকে উদ্দীপিত ও শাণিত করার মত এ ধরনের আরো কত চমকপ্রদ কথা যে কোরআনের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে, তা বলে শেষ করা কঠিন। বস্তুত কোরআন যে কত শক্তিশালী গ্রন্থ এবং সত্যের দাওয়াত যে কত প্রতাপশালী তা উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকেই আঁচ করা যায়। সত্যের এই তীব্র আলোকরশ্মীগুলো যখন একের পর এক নাযিল হয়েছে, তখন মধ্যপন্থী মানুষের পক্ষে চিন্তা ও কর্মের অন্ধকারকে আঁকড়ে ধরে থাকা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। যুক্তির সাথে আবেগময় আবেদন যখন মিলিত হয় তখন এই শক্তির সম্মিলনে এমন দোধারী তলোয়ার তৈরী হয়, যা পাথরও কেটে ফেলতে পারে। তাছাড়া কোরআনের পাশাপাশি রসূল সা. এর বাণীগুলোও বিভিন্ন ভাষণ বা বৈঠকি বক্তব্যের আকারে অনবরতই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ সব বাণী হাদীস গ্রন্থাবলীতে সংরক্ষিত রয়েছে। ছোট ছোট বাক্যে এত ব্যাপক তাৎপর্যবহ, প্রভাবশালী ও জাগরণ সৃষ্টিকারী বক্তব্য পৃথিবীতে আর কোন ব্যক্তি দিতে পারেনি। ইসলামী আন্দোলনের কবি, সাহিত্যিক ও বক্তাদের বিপ্লবী বক্তব্যগুলিও জনমনে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আজও সেকালের হাসসান বিন ছাবেত ও কা’ব বিন মালেকের ইসলামী কবিতাগুলো পড়ে দেখলে বুঝা যায়, তা জনতার আবেগের সমুদ্রে কী সাংঘাতিক ঢেউ তুলেছিল! মোট কথা, সত্যের বাণীই ছিল আসল অপ্রতিরোধ্য শক্তি, যার সামনে বাতিলের টিকে থাকার সাধ্যই ছিল না। “বাতিলের উচ্ছেদ অবধারিত” কোরআনের এই শাশ্বত বাণীটির প্রকৃত মর্মার্থ এখানেই নিহিত।
সমালোচনার শক্তি
ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত যুক্তির সাথে শুধু আবেদনেরই সমাবেশ ঘটায়নি, বরং আবেদনের সাথে সাথে তীব্র সমালোচনাও করেছে। সুফীবাদী মতাদর্শে তো দাওয়াতের একটাই পদ্ধতি চলে। অর্থাৎ অনুরোধ, আবেদন, তোষামোদ ও মিনতি করার পদ্ধতি। যেখানে ব্যক্তির সংকীর্ণ ব্যক্তিগত জীবনের পরিশুদ্ধির মধ্যেই দাওয়াত সীমাবদ্ধ এবং সামষ্টিক জীবনের সংস্কার ও পুনর্গঠনের কোন প্রশ্নই ওঠে না, সেখানে বিনীত আবেদন নিবেদনের বাইরে আর কোন পদ্ধতির প্রয়োজনই বা কী? সুফীবাদী মতাদর্শ ও ব্যক্তিমুখী ধর্মগুলিতে শুধুমাত্র এতটুকু লক্ষ্য রাখা হয় যেন শিষ্যদেরকে কিছু আকীদা বিশ্বাস ও কিছু ব্যক্তিগত গুণাবলী শিক্ষা দেয়া হয় এবং তাদেরকে অপশক্তি থেকে আত্মরক্ষা করার উপদেশ দেয়া হয়। কিন্তু সংঘবদ্ধ সামষ্টিক অপশক্তি ও দুষ্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং বিকৃত পরিবেশের সাথে টক্কর দেয়ার কোন প্রেরণা তাদের মধ্যে জন্মে না। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের মসনদে বসে যুলুমবাজরা দোর্দণ্ড প্রতাপে শোষণ ত্রাসণ চালিয়ে যায় তো যাক, আর তাদের বেদীতে মানবতা যবাই হতে থাকে তো থাক। এ সব দুনিয়াবী ঝামেলায় আল্লাহর পাগল সুফী দরবেশদের কী করার আছে? এ ধরনের সংকীর্ণ আধ্যাত্মিক ব্যবস্থায় এটাই মানুষের সবচেয়ে বড় সদগুণ বিবেচিত হয় যে, সে দুনিয়াবী কায়কারবার ও রাজনীতির ঝামেলা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখবে। সবার সাথেই সমান বিনয় ও তোষামোদী আচরণ করবে। মুসলমানদের সাথে “আল্লাহ আল্লাহ” আর ব্রাহ্মণের সাথে “রামরাম” জপ করতে থাকবে। সবার সাথেই নম্র ব্যবহার করবে, কারো সাথেই কঠোরতা প্রয়োগ করবে না। এ ধরনের মতাদর্শে যেহেতু মানুষকে সংঘাত সংঘর্ষে নামানোর কোন পরিকল্পনাই থাকে না, বরং তাকে সমাজ ও সভ্যতামুখী তৎপরতা থেকে বের করে নিভৃত স্থানে ও খানকায় নিয়ে বসানোই লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাই সমালোচনার কোন প্রশ্নই ওঠে না। কেননা সমালোচনা তো মানস জগতে দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনার সৃষ্টি করে। তাই সংকীর্ণ আধ্যাত্মিকতা ও ব্যক্তিগত পরিসরে সীমিত ধার্মিকতার দৃষ্টিতে কারো বিরুদ্ধে সমালোচনা করা অপেক্ষাকৃত নিন্দনীয় কাজ বিবেচিত হয়ে থাকে। অনেকটা তাকওয়া বিরোধী কাজের মতই গণ্য হয়ে থাকে, যা কিনা আত্মার শান্তি বিঘ্নিত করে।
কিন্তু যে মতাদর্শ ও দাওয়াত সভ্যতার বিপ্লব সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়, তার বাহকদের চিন্তার কারখানায় যুক্তি ও আবেদনের মত সমালোচনাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু সত্যের প্রতিষ্ঠাই যথেষ্ট নয়, বরং বাতিলের বিলুপ্তি সাধনও জরুরী। কেননা বাতিলের বিলুপ্তি ছাড়া সত্যের প্রতিষ্ঠাও পুরোপুরি সম্ভব হয়ে ওঠে না। এখানে আল্লাহর ওপর ঈমান আনা ও তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করা পরস্পর নির্ভরশীল। একটা না করে অপরটা করা যায় না। পাশাপাশি অসৎকাজ প্রতিহত না করলে সৎকাজের আদেশ দেয়া ফলপ্রসূ হয় না। এখানে ‘ইল্লাল্লাহ’ বলবার আগে ‘লা-ইলাহা’ বলতেই হয়।
ইসলামী আন্দোলনের অভ্যুদয় যখনই ঘটে, তখন তা জনগণের চিন্তাধারা পাল্টে দেয়ার জন্য প্রচলিত সভ্যতা সংস্কৃতি, সামাজিক পরিবেশ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বিশেষত প্রচলিত চিন্তাধারা, আকীদা বিশ্বাস ও মূল্যবোধের কঠোর সমালোচনা করে। ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আধিপত্যশীল শ্রেণীগুলো, যারা জনগণকে নিজেদের দাসত্বের জালে আবদ্ধ করে আয়েশী জীবন কাটায়, তাদের মুখোশ খুলে না দিয়ে সে পারে না। সামষ্টিক জীবনের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব যাদের হাতে নিবদ্ধ, সাধারণ জনতার কাছে তাদের আসল পরিচয় ফাঁস করে দেয়া ছাড়া তার উপায়ান্তর থাকে না। অন্যায়কে অন্যায়, বাতিলকে বাতিল এবং ভুলকে ভুল না বলা পর্যন্ত সত্য ও ন্যায়ের চাহিদাও সৃষ্টি হয় না এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাও জন্মে না। যে কোন নবীর দাওয়াত ও কার্যবিবরণী দেখুন। দেখবেন, তাতে শুধু যে সমাজের খারাপ ধ্যান ধারণা ও পরিস্থিতির সমালোচনা করা হয়েছে তা নয়, বরং প্রত্যেক নবী তৎকালীন প্রতাপশালী শাসকদেরকে তাদের দরবারে যেয়েই বিপথগামী বলেছেন। ইসলামী আন্দোলনে সমাজ ব্যবস্থার প্রচলিত গঠন প্রণালী সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক দেশে ও জাতিতে কিছু “রাঘব বোয়াল অপরাধী” থাকে যারা প্রতারণার রাজনীতির মাধ্যমে নিজেদের মতলব উদ্ধার করে। (সূরা আল আনয়াম, ১২৪) তাদেরকে স্বপদে বহাল রেখে তাদের সংশোধন সম্ভব নয়।
জাহেলী সমাজ ব্যবস্থার উচ্ছেদ ও ইতিহাসে নতুন স্বর্ণালী অধ্যায়ের উদ্বোধনকল্পে যখন আরবে ইসলামের অভ্যুদয় ঘটলো, তখন সে সর্বপ্রকারের মিথ্যা, যুলুম ও অসততার নির্মম সমালোচনা করলো। তৎকালে যত রকমের লোক জাহেলী সমাজব্যবস্থা ও তাগুতী পরিবেশের রক্ষক, সমর্থক ও সহযোগী হয়ে সমাজের ওপর চেপে বসেছিল এবং যারা নিজেদের মর্যাদা ও কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্য মানবজাতির কল্যাণ বিধানকারী এই দাওয়াতের কণ্ঠরোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, ইসলাম অভাবনীয় দুঃসাহসিকতার সাথে তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছিল এবং তাদের চমকপ্রদ পোশাকে আবৃত অপকর্মগুলোকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে তুলে ধরেছিল। এভাবে মানবতাবিরোধী কুফরি শক্তির আসল পরিচয় সমাজের কাছে স্পষ্ট হয়ে যেতে থাকে এবং জনমতে সচেতনতা বিস্তার লাভ করতে থাকে। আর সেই সাথে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাও তীব্রতর হতে থাকে। ইসলামী আন্দোলনের সমালোচনা সোচ্চার জনগণের ভেতর সুষ্ঠু চিন্তা, উপলব্ধি, যাচাই-বাছাই, তুলনামূলক পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণের যোগ্যতা সৃষ্টি ও বিকশিত করে। দাওয়াতের এই দিকটাই হক ও বাতিল, ভালো ও মন্দ এবং ন্যায় ও অন্যায়ের বাছবিচার করে। এ দ্বারাই সুপথ ও বিপথগামিতার মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়। বাতিল শক্তির যুলুম নির্যাতন তো ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা মুখবুজে সহ্য করতে থাকে। কিন্তু যুলুমবাজদের জঘন্য চরিত্রের ওপর থেকে সুদৃশ্য আভরণ খুলে ফেলতে তারা কোন ভুল করেনি। তাদের তৎপরতা সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে দিয়ে পরিচালিত হতো না। জাহেলী ব্যবস্থার সামাজিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বকে তারা কখনো এ আশ্বাস দেয়নি যে, তোমরা নিশ্চিন্তে তোমাদের পদমর্যাদায় বহাল থেকে পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ চালিয়ে যাও। আমরা আল্লাহওয়ালা মানুষ। আমরা তোমাদের কাজে হস্তক্ষেপ এবং তোমাদের স্বার্থে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবো না। আমরা তো কেবল আল্লাহর নাম জপ করবো এবং মানুষকে তাঁর কলেমা শেখাবো। এভাবে ইসলাম বিরোধী নেতৃত্বের সামনে সবিনয়ে কিছু চাটুকারসুলভ কথাবার্তা বলে তাদের যুলুম থেকে অব্যাহতি লাভ নিশ্চিত করার পর সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠাকামী এই বিপ্লবী কলেমা উচ্চারণ করা তাদের পক্ষে কখনো সম্ভব হতো না।
ইসলামী আন্দোলন তার প্রধান আহবায়কের পবিত্র মুখ দিয়েই সর্বপ্রথম এই তিক্ত দায়িত্ব পালন করেছে। ওহির ভাষার অস্ত্র দিয়েই সমাজের রোগাক্রান্ত অংগে অপারেশন চালিয়েছে। এই সমালোচনা শুধু আদর্শ ও মূলনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং প্রতিরোধরত প্রভাবশালী শক্তি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ-সবই এর আওতায় এসেছে। এই সমালোচনা দৈনন্দিন ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটেই করা হতো এবং শত্রুপক্ষের কৃত কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনাও সাথে সাথেই করা হতো। এভাবেই গণসচেতনতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কাজ যদি না করা হতো, তবে কিছু পুণ্যবান ও মনোমুগ্ধকর সৎ ব্যক্তি তৈরী হওয়া হয়তো সম্ভব হতো, সমকালীন দুনিয়া হয়তো তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতো এবং অনাগতকালেও হয়তো তাদের স্মৃতি মানুষকে অভিভূত করতো। কিন্তু সমাজ পরিবেশ জাহেলিয়াতের অন্ধকারে যেমন আচ্ছন্ন ছিল, তেমনি থেকে যেত। মুসলিম জনগণের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা এবং সংগ্রামী প্রবণতা কখনো সৃষ্টি হতো না। হেরার গুহার মধ্যেই ইসলাম সীমাবদ্ধ থেকে যেত। আরব জয় করে ফের মক্কায় প্রবেশ করা তার পক্ষে কখনো সম্ভব হতো না।
মানবতার মুক্তিদূত রসূল সা. কোরআনের ভাষায় সমালোচনা করে সমকালীন সমাজপতিদেরকে শুধু যে যুক্তি প্রমাণের দিক দিয়ে দেউলে প্রমাণ করেছেন তা নয়, বরং জগতবাসীর সামনে এটাও ফাঁস করে দিয়েছেন যে, বড় বড় পদমর্যাদা ও নেতৃত্বের আসনে আসীন প্রতাপশালী ব্যক্তিবর্গ অত্যন্ত নোংরা ও ঘৃণ্য চরিত্র নিয়েও সমাজের ওপর কর্তৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। এই সমালোচনার ফলেই জনগণ বুঝতে পেরেছে, ইসলামী আন্দোলনের সাথে সহযোগিতা করে এই সব ঘৃণ্য অপশক্তিকে সক্রিয় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব থেকে অপসারণ না করা পর্যন্ত জনজীবনে সৌন্দর্য, শৃংখলা ও সৌষ্ঠব ফিরে আসার কোনই সম্ভাবনা নেই।
ইসলাম কোরায়েশ ও মোশরেকদের সমালোচনা যখন করেছে, তখন তাদের পৌত্তলিক কৃষ্টি, তাদের কু-সংস্কার ও অলীক ধ্যান-ধারণা, তাদের হাস্যকর ধর্মীয় রীতিপ্রথা, তাদের হীন ও নিকৃষ্ট চরিত্র এবং তাদের নেতৃত্বের দম্ভ ও আস্ফালন সব কিছুরই মুখোশ খুলে দিয়েছে। তাদের প্রাণপ্রিয় উপাস্যদের অসহায়ত্ব তুলে ধরার জন্য উদাহরণ দিয়ে বলেছে যে, এই সব উপাস্যরা মিলিত হয়েও একটা মাছি পর্যন্ত তৈরী করতে পারে না। এমনকি একটা মাছি যদি তাদের কোন জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে যায়, তবে ওরা সেটা ফিরিয়ে আনতেও সক্ষম নয়। হযরত ইবরাহীমের উত্তরাধিকারী হওয়া নিয়ে তাদের যে গর্ব ও দম্ভ ছিল, কোরআন সেই দম্ভ চূর্ণ করেছে এভাবে যে, হযরত ইবরাহীমের গোটা জীবনেতিহাসকে বারবার তাদের সামনে বিবৃত করে তাঁর আসল পরিচয় তুলে ধরেছে। কোরআন বলেছে, যে মহান কাজ সমাধা করার জন্য তিনি নিজের গোটা জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, ঘরবাড়ী ত্যাগ করেছিলেন, নিজের জন্য সংরক্ষিত পুরোহিতের গদিতে লাথি মেরেছিলেন, নমরুদের সামনে বিদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আগুনে পুড়ে মৃত্যুদণ্ড লাভের লোমহর্ষক রায় পেয়েছিলেন, তারপর আল্লাহর অপার অনুগ্রহে আগুন থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে আল্লাহর মোহাজের হয়ে নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন, তারপর তিনি একটা জনহীন মরুপ্রান্তরে নিজের দাওয়াত ও আল্লাহর এবাদতের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যাকে তোমরা নিজেদের অর্থোপার্জন ও ধর্মীয় পৌরহিত্যের মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছ, সেই মহান কাজের ধারে কাছেও না গিয়ে তার উত্তরাধিকারী হবার গালভরা দাবি তোলা কোরায়েশদের পক্ষে সম্পূর্ণ বেমানান। আপাদমস্তক শেরক ও জাহেলিয়াতে ডুবে থেকে কোন অধিকারে তারা তাওহীদের সেই মহান আহবায়কের উত্তরাধিকারী সাজে এবং তাঁর নাম মুখে আনে? কোরআন দেখিয়েছে কিভাবে তারা হারাম হালালের মনগড়া শরীয়ত বানিয়ে নিয়েছে। পূজার বেদিতে বিভিন্ন জিনিস উৎসর্গ করার কী অদ্ভুত সব নিয়ম তৈরী করে নিয়েছে, পাশা ও জুয়া খেলাকেও কিভাবে ধর্মীয় পবিত্রতার মর্যাদা দিয়ে রেখেছে, কিভাবে তারা মেয়ে জন্ম নিলে লজ্জায় পালিয়ে বেড়ায়, কিভাবে তারা সীমাহীন নিষ্ঠুরতা নিয়ে মেয়ে সন্তানকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলে, আর ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর মেয়ে বলে আখ্যায়িত করতে তাদের কিছুমাত্র লজ্জাবোধ হয় না। এভাবে তাদের প্রতিটি অর্থহীন ও হাস্যকর কার্যকলাপকে তাদের সামনে তুলে ধরে কোরআন বলেছে, তোমরা মসজিদুল হারাম ও কা’বা গৃহের অভিভাবকত্ব নিয়ে গর্বিত। অথচ নিজেদের কুফর ও শেরকের কারণে তোমরা তার যোগ্য নও। তোমরা জনগণকে আল্লাহর পথ থেকে ও কা’বা শরীফ থেকে ফিরিয়ে রাখ, নিজেদের ভাইদেরকে মাতৃভূমি থেকে বের করে দাও এবং ইসলামের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি কর।
কোরআন যখন আহলে কিতাবের সমালোচনা করেছে, তখন তাদের শত শত বছরের কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি দিয়ে বলেছে, তোমরা হযরত মূসা আ. কে পদে পদে যন্ত্রণা দিয়েছ, বারবার তার নাফরমানী করেছ, বারবার ভ্রষ্টতা ও বিকৃতির পথে পা বাড়িয়েছ, কলহ কোন্দলে লিপ্ত থেকেছ, দাঙ্গাহাঙ্গামা করেছ, বাছুর পূজা করেছ, জেহাদ থেকে পালিয়েছ, পরস্পরের রক্তপাত করেছ, আত্মীয় স্বজনকে দেশান্তরিত করেছ, তাদের ওপর যুলুম ও আগ্রাসন চালিয়েছ, আল্লাহর কিতাবকে বিকৃত করেছ, সত্য কথাকে লুকিয়েছ, দরবেশ ও আলেমদেরকে খোদার আসনে বসিয়েছ, এমনকি স্বহস্তে মনগড়া কথা লিখে বলেছ যে এটা আল্লাহর কালাম, মানুষকে ধোঁকা দিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছ, নিজেরাও আল্লাহর পথে চল না, অন্যদেরকেও চলতে দাও না, কেউ যদি মানব কল্যাণের জন্য কাজ করতে চায়, তবে তাকে সহযোগিতা দেয়ার পরিবর্তে বাঁধা দাও। মুহাম্মদ সা. এর আগমনের পূর্বে তোমরা আল্লাহর কিতাবে লেখা প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে সবাইকে সুসংবাদ দিতে যে, শেষ নবীর আগমনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু সেই নবী যখন সত্যই এল, তখন তোমরা সবাই তার বিরুদ্ধে সারিবদ্ধ হয়ে গেলে। মুসলমানরা নানা দিক দিয়ে তোমাদের নিকটতর, তারা তোমাদের নবীদেরকে এবং পূর্ববর্তী সকল কিতাবকে মান্য করে। অথচ তোমরা মোশরেকদের সাথে দহরম মহরম পাতাও। তোমাদের কাছে আল্লাহর কিতাব থাকা সত্ত্বেও তোমরা এ সব অপকর্মে লিপ্ত থেকেছ।
গাধার পিঠে আল্লাহর কিতাবের স্তুপ থাকলেও সে যেমন তার কিছুই পরোয়া করে না, তোমরাও তেমনি আচরণ করছ। তোমরা যদি তোমাদের দাবিতে সত্যবাদী হতে, তাহলে তোমরা আল্লাহর কিতাব তাওরাতকে নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে। তোমরা যতক্ষণ আল্লাহর কিতাবকে অবজ্ঞা করতে থাকবে, ততক্ষণ তোমাদের এ দাবির কোন মূল্য নেই যে, তোমরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা। তোমাদের চরিত্রের এমন অধোপতন ঘটেছে যে, একটা মুদ্রাও যদি তোমাদের কাছে আমানত রাখা হয়, তবে তা ফেরত পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। এই আচরণের কারণে তোমরা আল্লাহর গযবের শিকার হয়েছ এবং তোমাদের জন্য লাঞ্ছনা ও মিসকিনী বরাদ্দ হয়েছে।
এরপর মোনাফেকদের সমালোচনা যখন করা হয়েছে, তখন তাদের সর্বাত্মক মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাদেরকে তাদের ত্রুটি দেখিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে যে, তোমরা প্রতিটি জিনিসকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে থাক, তোমরা যখন নির্জনে মিলিত হও, তখন ইসলামী আন্দোলনের অবস্থা ও ঘটনাবলীর বিরুপ সমালোচনা করে থাক, জনসমক্ষে এলে তোমাদের হাবভাব পাল্টে যায়, পরস্পরকে ইশারা ইংগিতে কথা বল, কখনো নীরব হয়ে যাও, কখনো যুদ্ধ বিগ্রহের খবরে তোমাদের চোখ ভয়ে ছানাবড়া হয়ে যায়। কখনো চুপে চাপে সটকে পড়। মুসলমানদের সাথে থাকার সময় এক রকম আর কাফেরদের সাথে থাকার সময় আর এক রকম কথা বল। সকল ব্যাপারে তোমাদের ভূমিকা মুসলমানদের সামষ্টিক ভূমিকা থেকে ভিন্নতর হয়ে থাকে। অন্যেরা যদি ওহির বাণী থেকে জীবনের জন্য শিক্ষা পায় এবং প্রবোধ পায়, তাহলে তোমরা তাতে খুবই বিরক্ত হও। অন্যদের কাছে রসূল সা. এর সত্তা হলো পরম ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র। অথচ তোমরা তাঁর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকা পসন্দ কর। অন্যরা উৎসাহের সাথে নামায পড়ে। আর তোমরা নামাযের জন্য আস এমন বিরক্তির সাথে, যেন তোমাদেরকে ধরে বেঁধে আনা হয়েছে। অন্যান্য মুসলমানরা ইসলামের জন্য যথাসর্বস্ব উৎসর্গ করতে উদগ্রীব থাকে। অথচ তোমরা নিজেরাও আল্লাহর পথে ব্যয় করো না, অন্যদেরকেও করতে বাধা দাও। অন্যেরা স্বতঃস্ফূর্ত ঈমানী আবেগের বশেই জেহাদ করতে যায়। তোমরা সব সময় কেবল জান বাঁচাতে চাও এবং নানা রকম খোঁড়া অজুহাত দিয়ে পালাতে চেষ্টা কর। অন্যেরা যে ঘটনায় খুশি হয়, তাতে তোমরা হও অসন্তুষ্ট। অন্যেরা যে ঘটনায় কষ্ট পায়, তোমরা তাতে আনন্দিত হও। সাধারণ মুসলমানদের সাথে কোনভাবেই তোমাদের মিল হয় না। এভাবে ইসলামী আন্দোলন মোনাফেকদের চিহ্নিত করেছে।
যে সব জাহেলী কবি ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও কুৎসা সম্বলিত কবিতা লিখতো, এবং খোদ রসূল সা. সম্পর্কে নিন্দা রটাতো, অতি সংক্ষেপে তাদের এমন বিবরণ দেয়া হয়েছে, যা তাদের ব্যাপারে পুরোপুরি সত্য ও বাস্তব এবং তা দেখে একজন সাধারণ আরবও তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নৈতিক অধোপতনের মাত্রা বুঝতে পারতো। জাহেলী কবিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, একমাত্র বিপথগামী লোকেরাই তাদের অনুসারী। তারা তাদের নীতিহীনতার কারণে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় এবং মুখে যা ভালো কথা বলে, তদনুসারে কাজ করে না।
ইসলামী আন্দোলন সমকালে বিশেষ বিশেষ ঘৃণ্য চরিত্রের লোকদেরকেও অত্যন্ত উঁচু মানের সাহিত্যিক বর্ণনা দ্বারা চিহ্নিত করেছে এবং সমাজে তা দ্বারা গণচেতনা সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছে, যাতে করে যে কেউ তাদেরকে দেখতে পারে, বুঝতে পারে ও বাস্তবতার জগতে নিজেরাই তাদেরকে চিনতে পারে। কোথাও এদের মধ্য থেকে এমন ব্যক্তিকে দেখিয়েছে যে অত্যধিক বাগাড়ম্বর দ্বারা মানুষকে হতচকিত করে দেয়। কিন্তু কর্মের জগতে নিজের ভালো ভালো কথাকে বেমালুম ভুলে গিয়ে মানব সমাজে নিত্য নতুন গোলযোগ ছড়ায় এবং ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়। কোথাও এমন ব্যক্তিকে দেখিয়েছে, যে গোত্রীয় ও নেতৃসুলভ আভিজাত্যের অহংকারে মাতোয়ারা থাকে এবং অতিমাত্রায় সম্ভ্রম সচেতন। কেয়ামতের দিন তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। আবার কোথাও সেই মানবীয় চরিত্রটাকে তুলে ধরা হয়েছে, যে লোভের আতিশয্যে কুকুরের মত হয়ে গেছে, যাকে তাড়া দিলেও জিভ বের করে, আর তাড়া না দিলেও জিভ বের করে। এ সব চরিত্র সমাজে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান ছিল। এই সমালোচনার কারণে তাদের হীনতা ও নিকৃষ্টতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা জনগণের জন্য মোটেই কষ্টকর থাকেনি।
এ সমালোচনা নিছক তাত্ত্বিক ছিল না, বাস্তব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। এতে ইসলামী আন্দোলনের মঞ্চ থেকে বিরোধী শক্তিকে সম্বোধন করে কথা বলা হতো। বক্তাও জানতেন কাকে বলছে, আর শ্রোতারাও জানতো কার সম্পর্কে বলা হচ্ছে। এ সমালোচনা আকাশ থেকে মাইক যোগে করা হতো না বরং রসূল সা. এর মুখ দিয়ে প্রচারিত হতো। মুসলমানরা এগুলো সমাজের কোণে কোণে ছড়িয়ে দিত। তাই তাদের আবেগ অনুভূতিও এর অন্তর্ভুক্ত হতো এবং তাদের অন্তরাত্মা এর সাথে মিলে একাকার হয়ে যেত। এ সমালোচনা বাস্তব ঘটনা প্রবাহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবেই করা হতো আর শ্রোতারাও তাকে চলতি ইতিহাসের সাথে খাপ খাইয়ে নিত। জনগণ বুঝতো, এটা আমাদের মধ্যে নব আবির্ভূত গঠনমূলক বিপ্লবী আন্দোলনেরই বক্তব্য। এ সমালোচনা প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে এবং তা বিপ্লব বিরোধীদের ওপরই আঘাত হানছে। জনগণ উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনা ও উভয় পক্ষের তুলনামূলক পর্যালোচনা করার সুযোগ পেত। এভাবেই তাদের চেতনা গড়ে উঠেছে।
যুক্তি প্রমাণ উপলব্ধির সহায়ক হতে পারে, কিন্তু তা আবেগকে উদ্দীপিত করে না। আবেদন আবেগকে নাড়া দিয়ে দাওয়াতে উষ্ণতার সৃষ্টি করে। তবে আবেদন ইতিহাসে কার্যকর সংগ্রামের সৃষ্টি করে না। একমাত্র সমালোচনাই এমন শক্তি যা যুক্তি ও আবেদনের সাথে মিলিত হয়ে যখন কাজ করে, তখন সভ্যতার সকল উপাদান একসাথে সক্রিয় হয়ে ওঠে। একমাত্র সমালোচনাই সমাজ জীবনে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
সার কথা হলো, ইসলামী আন্দোলন মুহাম্মদ সা. এর মাধ্যমে যুক্তি, আবেদন ও সমালোচনা- এই তিন ধরনের উপকরণকে কাজে লাগিয়েছে এবং তেইশ বছর ধরে অবিরাম কাজে লাগিয়েছে। এই তিনটে শক্তিই বিরোধীদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তারা যুক্তির দিক দিয়ে দুর্বল, উদ্দেশ্যের প্রতি আবেগ সৃষ্টিতে পশ্চাদপদ এবং চরিত্রের দিক দিয়ে খুবই নিম্নস্তরের। এ কারণে বিরোধীদের মধ্যে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি এবং নিজেদের হীনতার অনুভূতি অবচেতনভাবে বেড়ে গেছে। অপর দিকে জনগণও উভয় পক্ষকে সর্বদিক দিয়ে যাচাই বাছাই করে উভয়ের পার্থক্য বুঝতে পেরেছে। ইসলামী আন্দোলনের আসল শক্তি ছিল এটাই এবং এটাই আরবের লক্ষ লক্ষ অধিবাসীর মন জয় করেছিল। ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলন যদি সত্যকেন্দ্রিক না হতো, জনগণের মনকে আকৃষ্ট করতে না পারতো, আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদেরকে হক ও বাতিলের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে উদ্বুদ্ধ করতে না পারতো এবং যুক্তি, আবেদন ও সমালোচনা দ্বারা নিজের শক্তি ও পরাক্রমের স্বীকৃতি আদায় করতে না পারতো, তাহলে মুসলমানরা রাজনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রেও জয়লাভ করতে পারতো না, রণাঙ্গনেও বিজয় অর্জন করতে পারতো না। এই সব ময়দানেও যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, তা এ জন্যই হয়েছে যে, জনমতের বিশাল অঙ্গনে ইসলামের অগ্রযাত্রা ছিল অত্যন্ত বিজয়মুখী।
মুসলমানদের নৈতিক শক্তি
যে কোন দাওয়াত, যদি শুধু শাব্দিক দাওয়াত হয় এবং তার সাথে নৈতিক জোর না থাকে, তবে তা যতই মনোমুগ্ধকর হোক না কেন এবং সাময়িকভাবে যতই যাদুকরি প্রভাব সৃষ্টি করে ফেলুক না কেন শেষ পর্যন্ত ধোঁয়ার কুণ্ডলির মত বাতাসে মিলিয়ে যায়। ইতিহাসের ওপর কেবল কথা দ্বারা প্রভাব বিস্তার করা যায় না। শুধু কথা দিয়ে কোন কালেই কোন বিপ্লব সাধিত হয় না। কথা দ্বারা তখনই কিছু প্রভাব সৃষ্টি হয়, যখন কাজের মাধ্যমে তার কিছু অর্থ নির্ণীত হয়। ভাষার যাদু সাবানের মত সুদর্শন ফেনা ও রংগীন বুদবুদ সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু এই সব বুদবুদ মাটির একটা কণাকেও তার জায়গা থেকে সরাতে সক্ষম হয় না। বরং তা সংগে সংগেই বিলীন হয়ে যায়।
যুক্তি যখন আচরণ ছাড়াই আসে, আবেদন যখন আন্তরিকতাহীন হয় এবং সমালোচনা যখন নৈতিক দিক দিয়ে শূন্যগর্ভ হয়, তখন তা মানুষকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় না। নৈতিক শক্তিই কোন আন্দোলনকে প্রভাবশালী ও কার্যকর করে। কর্মের সাক্ষ্য ছাড়া মুখের সাক্ষ্য নিষ্ফল হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে “মানুষ যা করে না, তা যখন বলে, তখন তা আল্লাহর কাছে প্রচণ্ড বিরাগভাজনের কারণ হয়ে থাকে।”
ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত নিছক তাত্ত্বিক বা যুক্তিভিত্তিক দাওয়াত ছিল না। ইসলামের দাওয়াত ছিল পুরোপুরি কর্মের আহবান। এ দাওয়াত এক বিশেষ ধরনের নতুন মানুষ তৈরী করার জন্য এসেছিল। প্রথম দিন থেকেই সে তার এই ইপ্সিত মানুষ তৈরীর কাজ শুরু করেছিল। এই মানুষের চিন্তাধারা, চারিত্রিক গুণাবলী এবং মনোমুগ্ধকর আচরণই তার যুক্তিকে যথার্থ গুরুত্ববহ, তার আবেদনকে সত্যিকার আর্কষণীয় এবং তার সমালোচনাকে কার্যকর করেছিল। ইসলামী আন্দোলনের সৃষ্টি করা এইসব নতুন মানুষ নিজেরাই একটা অকাট্য যুক্তি ছিল। তারাই সবচেয়ে শক্তিশালী আবেদন ছিল। এই মানুষগুলোর সমগ্র সত্তা পুরানো সমাজব্যবস্থা, পাশবিক প্রকৃতির মানুষ, বিকারগ্রস্ত জাহেলী পরিবেশ, স্থবির সমাজ, এবং তার অযোগ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটা সর্বাত্মক মূর্তিমান সমালোচনা ছিল। এই জ্যান্ত যুক্তি, জ্যান্ত আবেদন ও জ্যান্ত সমালোচনার কোন জবাব জাহেলিয়াতের কাছে ছিল না। এসব জ্যান্ত যুক্তির কাছে জাহেলিয়াত ছিল একেবারে অসহায়। সেই নতুন মানুষ, যার সবচেয়ে পূর্ণাংগ নমুনা ছিলেন স্বয়ং রসূল সা. এবং যার প্রেরণায় আরো বহু মানুষ তৈরী হচ্ছিল, এক বাস্তব ও অকাট্য সত্য ছিল। সে সত্যের সামনে চোখ বন্ধ করে রাখাও তার আলোরই তীব্রতার প্রমাণ বহন করতো। যারা এ সত্যকে অস্বীকার করতো, প্রত্যাখ্যান করতো এবং তার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতো, তারাও তাদের আচরণ দ্বারা এর শ্রেষ্ঠত্বই ঘোষণা করেছিল। মক্কায় এই নতুন মানুষ তার ব্যক্তিগত রুপ বিকশিত করেছিল, আর মদিনায় এসে সে নিজের সামষ্টিক রুপ দেখিয়েছিল।
ইসলামী আন্দোলন ও রসূল সা. এই নতুন মানুষ তৈরীর আসল কাজ থেকে কখনো উদাসীন হননি, অন্যদের সংশোধনের উৎসাহে ইসলাম এ কাজকে ভুলে যায়নি। অন্যদের সংশোধনের চেয়ে আত্মশুদ্ধির গুরুত্বই এখানে বেশি ছিল। অন্যের সমালোচনার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আত্মসমালোচনা। বাইরে পরিবর্তন আনার আগে তার কাছে নিজের ভেতরে পরিবর্তন আনা ছিল অধিকতর জরুরী।
যে সমাজের দৃষ্টিতে উপার্জন করা ও পানাহার করার চেয়ে উচ্চতর ও মহত্তর কোন লক্ষ্য ছিল না। যার প্রতিটি মজলিস ছিল এক একটি মদ্যশালা, এক একটি জুয়ার আড্ডা এবং এক একটি নৃত্যক্লাব। যেখানে বীরত্ব কেবল দাঙ্গা ফাসাদ, হত্যা, লুটতরাজ ও প্রতিশোধ গ্রহণেই ব্যবহৃত হতো। যেখানে সমাজ একটা জংগলে পরিণত হয়েছিল, সেই জংগলে মানুষরুপী হিংস্র জন্তু গর্জন করে বেড়াতো এবং ভদ্র ও দুর্বল লোকেরা তাদের সহজ শিকারে পরিণত হতো, সেখানে রসূল সা. একদল সৎ, শুদ্ধ ও সুসভ্য মানুষকে সাথে নিয়ে আবির্ভূত হলেন। এই দলটা প্রথম দিন থেকেই সমাজে খুব লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল এবং সকলের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল। মানবতার এই নতুন নমুনাগুলোকে লোকেরা অবাক হয়ে দেখতো এবং তাদেরকে সমাজের অন্য সবার থেকে সর্বদিক দিয়েই ভিন্নতর ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বোধ করতো। এই দলটির আবির্ভাব ও বিকাশ বৃদ্ধি সম্পূর্ণরুপে তাদের সামনেই হয়েছিল। তাদের শিক্ষাদীক্ষা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জনগণ খুব ভালোভাবেই দেখেছে।
সর্বশ্রেণীর মানুষ প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় দেখতো, ইসলামের কলেমা একের পর এক ভালো ভালো লোকদের আকৃষ্ট করে চলেছে। সহসা এক একজন মানুষ নিজের বিবেকের চাপে বাধ্য হয়ে এই বিপ্লবী আন্দোলনের কাছে আত্মসমর্পণ করতো। যে ব্যক্তি কয়েকদিন আগেও মুহাম্মাদ স. এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করেছে, সে সহসাই মাথা নত করে দিয়েছে, যেন কেউ যাদু করেছে। আর যে ব্যক্তিই ইসলাম গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে তৎক্ষণাত শুভ পরিবর্তন আসতে থাকে। তার বন্ধুতা ও শত্রুতা পাল্টে যায়। তার আদত অভ্যাস ও রুচিতে বিপ্লব এসে যায়। তার ব্যস্ততা ভিন্নরুপ ধারণ করে। ইতোপূর্বে যে সব বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল, সেগুলো পাল্টে গিয়ে নতুন বিষয়ে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। আর সে সাথেই সে অত্যন্ত সক্রিয় ব্যক্তিতে রুপান্তরিত হয়। তার মধ্যে একটা নতুন শক্তির উন্মেষ ঘটে। তার সুপ্ত যোগ্যতা ও প্রতিভা জেগে ওঠে। তার বিবেক নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়। তার মধ্যে উত্তম চরিত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে। যে ব্যক্তি কাফের থেকে মুসলমান হতো, তার ভেতর থেকে যেন একেবারেই নতুন মানুষের আবির্ভাব ঘটতো। সে নিজেও অনুভব করতো, আমি পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম এবং নতুন। পরিবেশও তাকে দেখে অনুভব করতো, সে পাল্টে গেছে। খুনী সন্ত্রাসী ইসলাম গ্রহণ করে জীবনের রক্ষক হয়ে যেত। চোর ইসলাম গ্রহন করে আমানতদারে পরিণত হতো, ব্যভিচারী ইসলাম গ্রহণ করে নারীদের সম্ভ্রমের রক্ষকে পরিণত হতো। ডাকাত ইসলাম গ্রহণ করে শান্তি ও সমঝোতার মূর্ত প্রতীক হয়ে যেত। বদমেজাজী ও বক্র স্বভাবের লোক ইসলামের ছায়াতলে এসে সহনশীল বিনয়ী ও অমায়িক মানুষ হয়ে যেত। সুদখোর এসে দানশীল হয়ে যেত। নির্বোধ ও মেধাহীন লোক এসে উচ্চ প্রতিভা ও যোগ্যতার পরিচয় দিত। নিম্ন সামাজিক স্তর থেকে এসে মহত্বের উচ্চ স্তরে উন্নীত হতো, যেন সে অন্য কোন জগতের প্রাণী। মনে হতো যেন মাটি দিয়ে তৈরী নয় বরং অন্য কোন উপাদানে গঠিত।
আল্লাহর এবাদতে একনিষ্ঠভাবে নিয়োজিত, রসূলের প্রেমে পাগল, সত্যের একনিষ্ঠ সেবক, সৎকাজের উদ্যোক্তা, কল্যাণের আহবায়ক, অন্যায় ও অসত্যের দুশমন, যুলুমের কট্টর বিরোধী, রুকু ও সিজদায় বিনীত, অভিনিবেশ সহকারে কোরআন পাঠকারী, দিনের বেলায় সংগ্রামে লিপ্ত, রাতের বেলায় আল্লাহর সাথে একনিষ্ঠ সংলাপে নিয়োজিত, মিসকীনদের খাদ্য দানকারী, পথিকের আতিথেয়তাকারী, এতিম ও বিধবার সেবক, আড্ডাবাজি ও অবৈধ খেলাধুলা থেকে সংযম অবলম্বনকারী, বিলাসিতা ও আমোদ ফূর্তি থেকে আত্মরক্ষাকারী, বেহুদা তর্ক বিতর্ক থেকে সংযত, গাম্ভীর্য ও আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন জীবনের প্রতীক, জনারণ্যে একাকী এবং আপন জনপদে প্রবাসী- এ সব অসাধারণ গুণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারীরা সমগ্র আরবের মানুষের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত না হয়ে পারে কিভাবে?
ইসলামের নিশানবাহী, ইসলাম প্রতিষ্ঠার মহান ব্রত বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত এই নিঃস্বার্থ সৈনিকেরা ছিল আন্দোলনের অবৈতনিক সার্বক্ষণিক কর্মী। তারা আখেরাতের কল্যাণের লক্ষ্যে নিজের দুনিয়াবী স্বার্থকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করতে অভ্যস্ত ছিল। নিজের পবিত্র লক্ষ্যের জন্য মস্তিষ্কের যাবতীয় যোগ্যতা, শরীরের যাবতীয় শক্তি, পকেটের টাকা কড়ি, এমনকি প্রয়োজনের সময় নিজের ও নিজের সন্তানদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে তারা কুণ্ঠিত হতো না। তাদের না ছিল জীবিকার চিন্তা, না ছিল দৈহিক নিরাপত্তার দিকে খেয়াল, না ছিল রাতের ঘুমের চিন্তা, না ছিল স্ত্রী ও সন্তানদের দিকে মনোযোগ দেয়ার কোন অবসর, না ছিল খেলাধুলা ও চিত্ত বিনোদনের সুযোগ। তাদের একমাত্র পেশা, একমাত্র ব্যস্ততা, একমাত্র চিত্ত বিনোদন ও আমোদ ফূর্তির উপকরণ ছিল ইসলামকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম। তারা হাসিমুখে শত্রুদের গালি শুনেছে, বীরত্বের সাথে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ সহ্য করেছে, আনন্দের সাথে উপোষ করেছে এবং হাসিমুখে নির্বাসনে গেছে। যখন ধৈর্য্যের প্রয়োজন হয়েছে সর্বোচ্চ মাত্রার ধৈর্য্য ধারণ করেছে, সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে দৃপ্ত মনে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, আহাদ আহাদ বলতে বলতে তপ্ত বালুতে শুয়ে পড়েছে, আবেগময় কবিতা আবৃত্তি করতে করতে শূলে চড়েছে, আহত হয়ে পড়ে গিয়েও উড়ন্ত আত্মা শেষ বারের মত উচ্চারণ করেছেঃ
*****আরবী*****
“কা’বার প্রভুর শপথ, আমি সফল হয়েছি।”
এই যাদের নৈতিক চরিত্র ও ভূমিকা, তাদের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা হবে না কেন? তাদের সামনে বিশ্ব মাথা নোয়াবে না কেন?
এই মুসলিম চরিত্র প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যে, তা কেয়ামত পর্যন্ত মুসলিম জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই চরিত্রের দীক্ষাগুরু বধ্যভূমি থেকে বিদায় হবার সময় নিজের হত্যাকারীদের গচ্ছিত আমানত ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করে গেছেন। এই চরিত্র লাভকারীরা ব্যভিচারের অপরাধ সংঘটিত করার পর উপযাচক হয়ে অপরাধের স্বীকারোক্তি করেছে এবং ইসলামী আদালতের কাছ থেকে নিজের জন্য মৃত্যুদণ্ড আদায় করে ছেড়েছে, যাতে করে তারা আল্লাহর কাছে পবিত্র অবস্থায় উপস্থিত হতে পারে। এই চরিত্রকে ইসলাম গ্রহণের কয়েক মিনিট পরই যখন জনৈকা সুন্দরী যুবতী তার প্রমোদসংগী হবার আহবান জানিয়েছে তখন সে এই বলে ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেছে যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হতে পারিনা। এক জেহাদী সফরে মুসলিম বাহিনী উয্দ গোত্রের আবাসের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় জনৈক মুসলিম সৈনিক একান্ত প্রয়োজনে তাদের ওখান থেকে একটা বদনা এনেছিল। কিন্তু মুসলিম চরিত্রই তাকে তা ফেরত দিতে বাধ্য করেছিল। এ ধরনের শত শত দৃষ্টান্ত যে সমাজে প্রতিদিন সংঘটিত হতো, সে সমাজে তো প্রতিদিনই ভূমিকম্প সংঘটিত হতো।
আনসাররা নিজেদের ঘরবাড়ী ও ধনসম্পত্তি সমান দুই ভাগ করে অর্ধেক নিজের জন্য রেখে অর্ধেক নিজের মোহাজের ভাইকে দিয়ে যে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা দেখে কি তৎকালীন সমাজের সাধারণ মানুষ হতভম্ব হয়নি? এমন বিস্ময়কর সাম্য কি জনমনকে আকৃষ্ট না করে পেরেছে, যা একজন নগন্য দাস অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সাথে, দরিদ্র লোকেরা ধনীদের সাথে এবং বাস্তুচ্যুত লোকেরা মদিনার স্থানীয় বাসিন্দদের সাথে একই কাতারে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে? প্রত্যেকে গুরুত্ব পেয়েছে, প্রত্যেকে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছে, প্রত্যেকের মতের মূল্য দেয়া হয়েছে, প্রত্যেককে দায়িত্ব বহনের ও যোগ্যতা প্রদর্শনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ যেন এমন এক পরিবার, যার সকল সদস্য সুখ দুঃখ সমানভবে ভাগ করে নেয় এবং চিন্তা ও চেতনায় ও কাজ কর্মে সমানভাবে অংশ গ্রহণ করে। ক্ষুধার সময় এলে তাতে সবচেয়ে অংশ গ্রহণকারী হন দলনেতা। সচ্ছলতা এলে দলনেতাই হন তাতে সবচেয়ে কম অংশ গ্রহণকারী। জাহেলী দৃষ্টিকোণ থেকে যারা উঁচু ও নিচু, তাদের মধ্যে বিয়ে শাদী হতে দেখে সমাজ অভিভূত হয়েছে। রসম রেওয়াজের ভারী বোঝা হালকা করার যে সহজ সরল পন্থা ইসলাম উদ্ভাবন করেছিল, তার দিকে জাহেলী সমাজের সাধারন মানুষের মন আকৃষ্ট না হয়ে পারেনা। কত ভালোবাসাপূর্ণ, হালকা, সাদাসিদে, শান্তিপূর্ণ জীবন ছিল! সত্যিকার অর্থে তা ছিল ‘হায়াতান তাইয়্যেবা পবিত্র জীবন’।
মুসলমানদের মধ্যে কী ধরনের যোগ্যতা ও প্রতিভার স্ফূরণ ঘটছে, তাও সমাজ প্রত্যক্ষ করেছে। তারা দেখেছে, ইসলাম গ্রহণকারীদের মনমগজে বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে মেধার বিকাশ ঘটে চলেছে। সারা আরব অবাক হয়ে দেখেছে, তাদের মধ্যে কেউ আইনশাস্ত্রে, কেউ কৃষিতে, কেউ ব্যবসায় বাণিজ্যে, কেউ যুদ্ধ বিদ্যায়, কেউ প্রশাসনে, কেউ কূটনীতিতে, মোটকথা প্রত্যেকেই কোন না কোন বিষয়ে পারদর্শিতা লাভ করে এক নতুন ব্যক্তিত্ব অর্জন করেছে।
এই চরিত্রের ছবি এঁকে কোরআন বারাবার ইসলামের শক্রদেরকেও জনগণকেও বুঝিয়েছে যে, দেখ, সত্যের আদর্শ থেকে মানবতার যে নমুনা তৈরী হয়, তা কত সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ নমুনা। শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করা এভাবেই সম্ভব। এই চরিত্রকে ইসলাম নিজের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। অতপর বারবার এর তুলনা জাহেলী চরিত্রের সাথেও করেছে। আহলে কিতাব ও মোনাফেকদের চরিত্রের সাথেও করেছে। দুটোকে পাশাপাশি রেখে দেখিয়েছে যে, তোমরা নিজেরাই বল কোন্টা ভাল। বাস্তবতার ময়দানে এভাবেই তুলনা হচ্ছিল। তাছাড়া জীবনের প্রতিটি অংগনেও আপনা থেকেই তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ চলছিল।
সংঘাত-সংঘর্ষের পরিস্থিতি একই সাথে দুটো উল্লেখযোগ্য ফলাফল বয়ে আনে। দ্বন্দ-সংঘাতে পড়লে কিছু লোকের চরিত্র গড়ে ওঠে আবার কিছু লোকের চরিত্র ভেঙ্গে তলিয়ে যায়। ইসলামী আন্দোলন সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে যাতে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে পড়ে মুসলমানের চরিত্রে আরো সুন্দর, সুষমা মন্ডিত ও পরিশোধিত হয়। প্রশিক্ষণ পরিশুদ্ধি ও শিক্ষাদানের কঠোর ব্যবস্থার কারণে মুসলিম চরিত্রের ক্রমেই উন্নতি হয়েছে। অপর দিকে জাহেলী চরিত্র দ্বন্দ্ব সংঘাতে ক্রমশ অধোপতনের দিকে ধাবিত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তলিয়ে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। মুসলিম চরিত্রকে বারবার ধৈর্যের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে সহনশীলতার শক্তি ও নীতির ওপর অবিচল থাকার যোগ্যতা গড়ে তোলা হয়েছে। কখনো কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে, উস্কানিতে পড়ে উত্তেজিত হয়োনা। কখনো উপদেশ দেয়া হয়েছে, জাহেলী শক্তির নিশানবাহীদের সাথে জড়িয়ে পড়োনা, হতাশ হয়োনা, খারাপ ব্যবহারের জবাব ভালো ব্যবহার দ্বারা দাও, যুলুম ও বাড়াবাড়িকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখ, কারো সাথে শক্রতার কারণে বেইনসাফী করোনা, দুনিয়াদারদের সংশোধনের আশা পোষণ করোনা এবং তাদের পেছনে নিজের সময় নষ্ট করোনা, শক্রদের প্রাচুর্য ও জাঁকজমক দেখে ঘাবড়ে যেওনা, তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিওনা। তাদের প্রতিটি মনস্তাত্মিক উত্থান পতনের ওপর দৃষ্টি রাখা হয়েছে এবং সাথে সাথে তাদের কিসে ভালো হবে তা বুঝানো হয়েছে। রসূল সা. নিজে তাঁর জামায়াতের প্রত্যেক সদস্যের প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন এবং উত্তম সুযোগ বুঝে কখনো উপদেশ দিয়ে, কখনো ধমক দিয়ে, কখনো অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং কখনো সন্তোষ প্রকাশ করে মুসলিম চরিত্রের বিকাশ সাধন করেছেন। যার মধ্যে যেমন যোগ্যতা দেখেছেন, যার যেমন মেযাজের গঠন দেখেছেন, তাকে তারই প্রয়োজন মোতাবেক পরামর্শ দিয়েছেন। আর যার মধ্যে যেমন দুর্বলতা দেখেছেন, তার সামনে ইসলামের ঠিক সেই ধরনের দাবী তুলে ধরেছেন। তা ছাড়া সামষ্টিক তৎপরতার ক্ষেত্রে মুসলিম জামায়াত যে ধরনের আচরণ প্রদর্শন করেছে, তার ওপর প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পর কড়া সমালোচনা করেছেন। বদর ওহুদের যুদ্ধই হোক, বা হোদাইবিয়ার সন্ধিই হোক, কেবলা পরিবর্তনের ঘটনাই হোক, কিংবা অপবাদের ঘটনা হোক, প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ন ঐতিহাসিক ঘটনার পর একদিকে তিনি শক্রদের তৎপরতার বিবরণ জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন, অপর দিকে নিজের জামায়াতের বেপরোয়া সমালোচনা করে তাদের ভুলক্রটিও ধরে দিয়েছেন একং তার প্রতিকারের উপায়ও বলে দিয়েছেন। তাঁর সাথীরা যদি তাদের শক্রর সাথে অন্যায় কিছু করে তাহলে তাদের সে অন্যায়কে ঢেকে রাখতে বা সঠিক প্রমাণ করতে চেষ্টা করেননি। বরং শক্রর সামনে ভুল স্বীকার করেছেন, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়ে থাকলে তার ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। নাখলার ঘটনার জন্য তিনি সাহাবীগণকে তিরস্কার করেছেন। হযরত খালেদ যুদ্ধের সময় উচ্চস্বরে কালেমা পাঠকারীকে আন্তরিকতার সাথে নয় বরং প্রাণ রক্ষার্থে পাঠ করেছে ভেবে সন্দেহ বশত হত্যা করলে রসূল সা. তার ঐ কাজকে অপছন্দ করেছেন এবং তার দায়দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি জানিয়েছেন। ইসলাম রসূল সা. ব্যতীত বাদবাকী সাহাবীগণকে নিষ্পাপ ও নির্ভুল বলে আখ্যায়িত করেনি। শুধু সামগ্রিকভাবে তাদেরকে পবিত্র, সৎ ও সংশোধনযোগ্য বলে অবিহিত করেছেন। মুসলিম চরিত্রকে সে সামগ্রিকভাবে জাহেলী চরিত্রের চেয়ে স্পষ্টতই উৎকৃষ্টতর, মহত্তর ও বিকাশমান বলেছে।
প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব কর্তৃত্ব ও বিরাজমান পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করা কোন খেলা নয়। এটা দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ কাজ। এতে অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় এবং খুবই ঠান্ডা ও উত্তেজনাহীন মস্তিস্ক নিয়ে কাজ করতে হয়। প্রতিকূল পরিবেশের শক্তি অগ্রসরমানদেরকে কোমর ধরে পেছনে টানতে থাকে এবং সংশোধনকামীদেরকে নতুন করে বিগড়ে দিতে চায়। তাদের মনের ভেতর প্রভাব বিস্তার করার জন্য ফাঁক ফোকর খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে, যাতে নিজের বাতিল আকিদা বিশ্বাস, রসম রেওয়াজ ও আদত অভ্যাসকে কোন রকমে পুনরায় তার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া যায় এবং মানসিক গোলামী ও আপোষের কোন পথ খুঁজে বের করে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। প্রতিকূল পরিবেশেও লড়াই করতে করতে যখন প্রবল শক্তিধর মানুষের শক্তি ও হিম্মত থেতিয়ে যায় এবং নিষ্ঠাবান লোকদেরও পা পেছন দিকে সরতে আরম্ভ করে, তখন মানষ বিপ্লবী ধ্যান-ধারণাকে ছেড়ে পুরানো ধ্যান-ধারণাকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। মূলনীতি ও আকীদা বিশ্বাসে না হলেও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, চালচলন ও বেশভূষায় বিজাতীয় প্রভাব গ্রহণ করতে প্রস্তত হয়ে যায়। শুধু এতটুকু পথ খুলে গেলেই বিদ্যমান পরিবেশ তাকে ক্রমশ প্রশস্ত করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার সব কিছুই নিজের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে নেয়। এক প্রজন্মের যুগে যদি সমাপ্ত করা না যায়, তবে পরবর্তী প্রজন্মের যুগে সমাপ্ত করে। কিন্ত ইসলামী আন্দোলন মুসলিম চরিত্র গঠন করার সময় এই বিপদের কথা পুরোপুরি খেয়াল রেখেছে। তাই সে চরিত্রকে ইস্পাত কঠিন রূপ দিয়েছে এবং সংরক্ষণের সর্বাত্মক ব্যবস্থা করেছে। একদিকে তাকে ‘আশিদ্দাউ আলাল কুফফার’ অর্থাৎ ইসলাম বিরোধীদের মোকাবিলায় দুর্জয় শক্তি গড়ে তোলার এবং অন্যদিকে ‘রুহামাউ বাইনাহুম’ অর্থাৎ পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও দয়ালু হবার শিক্ষা দিয়েছে। বিজাতির অনুকরণ, বিজাতির মানসিক গোলামী এবং বিজাতির সাথে গোপন আন্তরিক সম্পর্ক রাখতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। মুসলমানদের মধ্যে এই মানসিক স্থিতি ও অবিচলতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই নও মুসলমানদেরকে হিজরত করে মদিনায় চলে আসার আহ্বান জানানো হয়েছিল। আর কোথাও যদি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক একত্রিত হতো এবং তাদের কাছ থেকে ‘বেদুঈন সুলভ’ বায়য়াত গ্রহণ করা হতো (অর্থাৎ হিজরতের শর্ত আরোপ করা হয়না এমন বায়য়াত) তবে তাদেরকে এ নির্দেশ দেয়া হতো যে, মোশরেকদের কাছ থেকে দূরে থাক এবং তাদের সাথে বন্ধুতা ও বিয়েশাদীর সম্পর্ক স্থাপন করোনা। নিজেদের আলাদা সমাজ গড়ে তোল। অমুসলিম পিতামাতার আনুগত্যের আদেশ দেয়ার সাথে সাথে এ কথাও বলা হয়েছে যে, পিতামাতা যদি ইসলাম পরিত্যাগ করার আদেশ দেয়, তবে কখনো তা মানা চলবেনা। ইসলামের বিরুদ্ধে কারো আনুগত্য চলেনা। এই চরিত্রের দৃঢ়তা এত বেশী ছিল যে, তা ইরানের জাঁকজমকপূর্ণ সভ্যতা দেখেও প্রভাবিত হয়নি এবং রোমের বিলাসবহুল জীবন দেখেও হীনমন্যতায় আক্রান্ত হয়নি। মুসলমানরা বড় বড় রাজ দরবারে নিজেদের বেদুঈন সুলভ চালচলন নিয়েই মূল্যবান কার্পেট পদদলিত করে মাথা না ঝুঁকিয়েই হাজির হয়েছে এবং পূর্ণ সাহসিকতার সাথে নিজ বক্তব্য পেশ করেছে। এই চরিত্রকে যখন মানসিকভাবে পুরোপুরি মজবুত ও স্থিতিশীল করা হয়েছে এবং সব ধরনের হীনমন্যতার উর্ধে তুলে দেয়া হয়েছে, তখন রণাঙ্গনেও তারা বীরত্ব ও দৃঢ়তার অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখেছে যে, এ চরিত্র সংখ্যায় কম ও সাজসরঞ্জামে অপ্রতুল হলেও তাকে ধ্বংস করা এবং তার অগ্রযাত্রা প্রতিহত করা সম্ভব নয়।
অসংখ্য কট্টর দুশমন মুখে ব্যংগ বিদ্রুপ, গালাগাল, নিন্দাবাদ, অপপ্রচার ইত্যাদি করা সত্ত্বেও মনে মনে এই মুসলিম চরিত্রের প্রতি নিশ্চয়ই ঈর্ষা করতো, মুসলমানদেরকে নিজেদেও চেয়ে উত্তম মনে করতো। আফসোস করতো যে, আমরাও যদি এই দলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারতাম। বিভিন্ন সময় বিরোধীরা তা স্বীকারও করেছে। ওহুদ যুদ্ধের পর যখন পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আবু সুফিয়ান হজরত ওমরকে জিজ্ঞেস করলো, মুহাম্মদ সা. কি নিহত হয়েছেন? হজরত ওমর জবাব দিলেন, আল্লাহর কসম তিনি জীবিত এবং তোমাদের কথা শুনছেন। তখন আবু সুফিয়ান বলেছিল, আবু কায়মা যদিও বলেছে যে মুহাম্মদ সা. নিহত হয়েছে, কিন্তু আমরা তোমাদেরকে ওর চেয়ে সত্যবাদী মনে করি। অনুরূপভাবে, হোদাইবিয়ার সন্ধির পর কোরায়েশ দূত উরওয়া ইবনে মাসউদ মুসলমানদের অভ্যন্তরে যে দৃশ্য দেখেছে এবং যেভাবে তা কোরায়েশ নেতাদের কাছে ব্যক্ত করেছে, তা থেকে প্রমাণিতত হয়, অমুসলিমরা সব সময়ই মুসলমানদেরকে নৈতিক দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করতো। ইসলামের কট্টর বিরোধী হয়েও আবু সুফিয়ান রোম সম্রাটের সামনে মুহাম্মদ সা. ও তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছিল তাও সাক্ষ্য দেয় যে, শক্রতা করা সত্ত্বেও শক্ররা মুহাম্মদ সা. ও ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব খোলাখুলিভাবে স্বীকার করতো। মদিনার তহশীলদার যখন খায়বারের ইহুদীদেও কাছে রাজস্ব আদায় করতে গেল, তখন তার বন্টনের নির্ভুলতা দেখে তারা সাক্ষ্য দেয় যে, এটাই যথার্থ ন্যায়বিচার, যার ওপর আকাশ ও পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে।
প্রতিনিয়ত আরবের কোণে কোণে নবগঠিত মুসলিম সমাজের আশ্চার্য হাল হাকীকত নিয়ে আলোচনা চলতো। আন্দোরনের নেতা ও কমীদের নিয়ে কথাবার্তা হতো। মোটকথা, দু’জন মানুষ একত্রিত হলেই মুহাম্মদ সা., ইসলামী সমাজ, ইসলামী আন্দোলন ও মদিনার সরকারের সুকীর্তি ও সুখ্যাতিই হতো প্রথম ও প্রধান আলোচ্য বিষয়।
ইসলামী আন্দোলনের এই নৈতিক শক্তিই তার যুক্তি ও আবেদনকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতো। এটা ছিল মুসলিম চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্বের গণস্বীকৃতি এবং এই গণ-স্বীকৃতিই সবৃস্তরের মানুষকে ইসলামের অনুগত বানিয়ে দিত। ইসলামের দুর্বার আকর্ষণ কিভাবে চারদিকের জন মানুষকে আকৃষ্ট করছিল, তার কিছু উদাহরণ উল্লেখ করছি।
প্রথমে মক্কী যুগ প্রসংগে আসা যাক। খ্যাতনামা কবি তোফায়েল দাওসী যখন মক্কায় এলেন, তখন কোরায়েশরা তাকে রাসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করতে নিষেধ করে। অবশেষে তিনি নিজেই সাক্ষাত করেন এবং কেবল কয়েকটা আয়াত শুনেই ইসলাম গ্রহণ করেন। আমর বিন আবাসা রাসূল সা. এর সুখ্যাতি শুনে সাক্ষাত করতে আসেন এবং ইসলামে দীক্ষিত হন। রাসূলের সা. বাল্যবন্ধু দামাদ বিন সা’লাবা পরামর্শদাতা হয়ে আসেন এবং রাসূলের মুখ থেকে কয়েকটা কথা শুনেই ইসলাম গ্রহণ করেন। একটা মরুচারী দস্যু গোত্রের যুবক আবু যর ইসলামের সুখ্যাতি শুনে মক্কায় আসেন এবং বিরোধী পরিবেশ থেকে কোন রকমে গা বাঁচিয়ে রসূলের সা. সাথে দেখা করেন, দাওয়াতী বক্তব্য শোনেন এবং সত্যকে গ্রহণ করেন। তাঁর ভেতরে সহসা এক আবেগ জেগে ওঠে এবং তিনি কা’বার সামনে গিয়ে সত্যের বাণী ঘোষণা করেন। তারপর এই সত্য প্রেমের অপরাধের শাস্তি ভোগ করেন। এভাবে যারা ইসলামী আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে, তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রভাব বলয়ে এক একজন দাওয়াতদাতা হয়ে যায়। কারো কারো দাওয়াতে তার পুরো গোত্র মুসলমান হয়ে যান। সুয়াইদ বিন সামেত রাসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করেন এবং গভীরতম প্রভাবে প্রভাবিত হয়। আয়াস বিন মুয়াযও মদিনা থেকে এসে রসূল সা.এর দাওয়াতের সমর্থক হয়ে যান এবং মদিনায় ইসলামের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। নাজরান থেকে ২০ জন খৃষ্টানের এক প্রতিনিধিদল এসে রসূল সা. এর কাছ থেকে ইসলামের জ্ঞান লাভ করে এবং কোরায়েশদের অনেক অপচেষ্টা সত্ত্বেও তারা ইসলামের আলো বুকে ধারণ করে বিদায় হয়। আবিসিনিয়ায় যারা হিজরত করে গিয়েছিলেন, তাদের কাছ থেকে কিছু সংখ্যক ইয়ামানবাসী ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করে এবং তাদের মাধ্যমে স্বয়ং বাদশাহ নাজ্জাশীর মনও ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়। মদিনায় আওস ও খাজরাজের লোকেরা তো রসূল সা. এর আগমনের আগে থেকেই দ্রুত গতিতে ইসলাম গ্রহণ করছিল। রসূল সা. হিজরত করে আসার পর তো এমন একটি বাড়ীও অবশিষ্ট ছিলনা, যেখানে ইসলমের আলো পৌঁছেনি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, খ্যাতনামা ইহুদী আলেম আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রসূল সা. এর একটা সহজ সরল মামুলী ক্ষুদ্র ভাষণ শুনে এতই অভিভূত হয়ে যান যে, শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেন। সেই ভাষণটা ছিল এইঃ “হে মানব সকল, তোমরা সমাজে শান্তির বা সালামের বিস্তার ঘটাও, মানুষকে খাদ্য খাওয়াও, রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখ এবং গভীর রাতে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়।” অনুরূপভাবে, আবু কায়েস সারমা বিন আবি আনাস নামাক খৃষ্টান দরবেশ ইসলামী আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেন। জুবাইর ইবনে মুতয়িম এসেছিলেন বদরের যুদ্ধ বন্দীদেরকে মুক্ত করতে। এই সময় রসূল সা. এর মুখে কয়েকটি আয়াত শুনেই হেদায়াত লাভ করেন। কোরায়েশদের দাস আবু রাফে দূত হঢে মদিনায় এসে ইসলামে দীক্ষিত হয়ে যায়। সে ফিরে যেতে চাইছিলনা। রাসূল সা. বুঝালেন যে, দূতকে রেখে দেয়া যায়না। তুমি আগে মক্কায় ফিরে যাও। তারপর যদি মনে চায় মদিনায় চলে এস। আবু রাফে মক্কায় গিয়ে পরে আবার মদিনায় হিজরত করে চলে আসে। বনু কুরায়যার অপরাধের কারণে তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হলে তাদের মধ্যকার আমর বিন সা’দ ইসলাম গ্রহণ করে।
ইয়ামামার নেতা ছামামা বিন আছাল হানাফী বন্দী হয়ে আসেন এবং রসূলের সা. আচরণে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। ওহদ যুদ্ধ চলছে। ঠিক সেই সময় বনু আব্দুল আশহাল গোত্রের আমর বিন ছাবেত ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সাথে সাথে রণাঙ্গনে গিয়ে যুদ্ধ করে শাহাদাত লাভ করেন। খন্দক যুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতিতে নাঈম বিন মাসউদ ইসলামী আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। আবুল আ’স মদিনায় এসে একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। খয়বরের ইহুদীদের যুদ্ধ প্রস্তুতি দেখে তাদের এক রাখাল আসওয়াদ জিজ্ঞেস করে, কার সাথে এবং কোথায় যুদ্ধ হবে? সে যখন যখন জানতে পারলো, মুহাম্মাদ সা. এর সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে, তখন সে ইসলাম গ্রহণ করে। হযরত খালেদ ও আমর ইবনু আ’স হোদাইবিয়ার সন্ধি ও মূতার যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় কোরায়েশদের দল ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরা জাহেলিয়াতের ঘাঁটি থেকে লড়াই করতে করতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই সহসাই ইসলামী আন্দেলন তাদের আকৃষ্ট করে। ফুযালা মক্কা বিজয়ের সময় এবং শায়বা হুনায়েন যুদ্ধের সময় রাসূল সা. কে হত্যা করার ইচ্ছা নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু নিজেরাই সত্যের তরবারীতে ঘায়েল হয়ে গেলো। হাওয়াযেন ও বনু সা’দ গোত্রের লোকেরা এসে ইসলাম গ্রহণ করলে রসূল সা. মালেক বিন আওফের কথা স্মরণ করলেন এবং তাঁর ইসলাম গ্রহণের আশা ব্যক্ত করলেন। রসূল সা. এর মনোভাব জানতে পেরে মালেক বিন আউফ গোপনে এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তাঈ গোত্রের ওপর মুসলিম বাহিনী জয় লাভ করলে হাতেম তাঈ এর মেয়ে বন্দিনী হয়ে মদিনায় এল। সে রসূল সা. এর কাছে সদাচারের আবেদন জানালো। রসূল সা. তার আবেদন গ্রহণ পূর্বক তাকে বাহনের ব্যবস্থা করে বিদায় করলেন। সে ইসলামের বিরুদ্ধে ভীষণ ক্ষিপ্ত নিজের ভাই আদী বিন হাতেমকে পুরো ঘটনা জানিয়ে মদিনায় উপস্থিত হবার উপদেশ দিল। আদী এল এবং সচোক্ষে পরিস্থিতি যাচাই করে যখন বুঝলো যে, রসূল সা. সত্যই আল্লাহর রসূল, তখন সে ইসলাম গ্রহণ করলো। কবিতার মাধ্যমে ইসলমের বিরুদ্ধে ও রসূলের সা. বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কবি কা’ব বিন যুহায়ের স্বেচ্ছায় মদিনায় আসেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ইতিহাস খ্যাত কবিতা “বানাত্ সুয়াদ” রচনা ও আবৃত্তি করেন। আব্দুল্লাহ যুলবিজাদাইনকে দেখুন। এই যুবক ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত হলেও নিজের চাচার ভয়ে কিছুদিন যাবত তা গোপন করে রেখেছিল। যখন দেখলো চাচার অনুমতি পাওয়ার আশা নেই, তখন চাচা, তার ধনসম্পত্তি, তার দেয়া পোষাক পরিচ্ছদ ও ঘরোয়া পরিবেশকে বিদায় জানিয়ে কম্বল পরিধান করে মদিনায় আসেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। বাহরাইনের আব্দুল কায়েস গোত্রের জনৈক ব্যবসায়ী মুনকিয বিন হাব্বান বাণিজ্যিক সফরে এসে কয়েকদিন মদিনায় অবস্থান করেন। বিদেশে ইসলামী আন্দোলনকে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রসূল সা. এর ছিল। সেই অনুসারে মুনকিযের সাথে নিজেই এগিয়ে গিয়ে দেখা করলেন ও দাওয়াত দিলেন। মুনকিয ইসলাম গ্রহণ করলেন। বাড়ী গিয়ে পিতাকে দাওয়াত দিলে তার পিতাও ইসলাম গ্রহণ করেন। পরে তার গোত্রের সাধারণ লোকেরাও ইসলাম গ্রহণ করে। বেশ কিছু লোক এমনও ছিল, যারা রাজত্ব নেতৃত্ব ও বড় বড় পদমর্যাদা ত্যাগ করে আল্লাহর দাসত্ব অবলম্বন করেন।
এসব উদাহরণ থেকে বুঝা যায়, ইসলামের জন্য ময়দান কিভাবে পর্যয়ক্রমে অনুকূল ও উর্বর হয়ে উঠেছিল। প্রথমে একজন, তারপর দু’চারজন, তারপর শত শত, তারপর হাজার হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করতে করতে পুরো একটা দুনিয়া গড়ে ওঠে।
একটা বিশেষ পর্যায়ে গিয়ে তো দ্রুত ও সার্বজনীনভাবে দলে দলে ইসলাম গ্রহণের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। এখারে কেবল সেই সব বিশিষ্ট ব্যক্তির কথাই উল্লেখ করছি, যারা নিজ নিজ পরিবেশে অগ্রণী হয়েছিলেন। এদের একজন যখন ইসলাম গ্রহণ করতেন, তখন তারা নিজ নিজ গোত্র এবং এলাকায়ও দাওয়াত দাতা হয়ে যেতেন। তারা নিজেদের কথা ও কাজ দ্বারা অন্য অনেককে এমনকি পুরো এক একটা গোত্রকেও আকৃষ্ট করতেন। তাছাড়া খোদ মদিনার দাওয়াতী কেন্দ্রের তৎপরতা ও আন্তর্জাতিক কর্মীদের তৎপরতা বহু লোককে তাৎক্ষণিকভাবে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতো কিংবা তার সমর্থক ও সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল। এ ধরনের সহানুভূতিও ইসলামী আন্দোলনের জন্য অত্যন্ত উপকারী প্রমাণিত হয়ে থাকে। এ ধরনের সমর্থক ও সহানুভূতিশীল লোকেরা বিরোধীদের মধ্যে বসেও ইসলামের পক্ষে কথা বলতে পারতো এবং তাদের কথা শুনতে কারো মধ্যে কোন ধরনের বিদ্বেষ ও সংকীর্ণতা বাধা হয়ে দাঁড়াতোনা। এ ধরনের সমর্থক ও সহানুভূতিশীল লোক কোরায়েশ, ইহুদী ও বেদুঈনদের মধ্যেও ছিল এবং প্রধানত তারাই হোদাইবিয়ার সন্ধির সময় কোরায়েশদেরকে চুক্তি সই করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এ ধরনেরই এক ব্যক্তি ওহুদ যুদ্ধের পর আবু সুফিয়ানকে ফিরে এসে পুনরায় মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করতে নিষেধ করেছিল। এ ধরনেরই এক ব্যক্তি রাসূল সা. ‘আবু তালেব গিরী উপত্যকায়’ (শিয়াবে আবু তালেব) বন্দী থাকাকালে তাঁদের কাছে খাদ্যের একটা চালান যেতে বাধা দেয়ার বিরোধিতা করেছিল। এ ধরনের লোকেরাই এই অন্যায় বয়কট চুক্তির অবসান ঘটিয়েছিল। ইহুদী হয়েও যে মুখাইরিক ইসলামী আন্দোলনের স্বার্থে জীবন দিয়েছিল, সেও এই ধরনেরই এক ব্যক্তি ছিল। মোটকথা, ইসলাম গ্রহণকারীদের পাশাপাশি এ ধরনের সমর্থক – সহানুভূতিশীলদেরও একটা গোষ্ঠী সৃষ্টি হতে থাকে। ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের পথ সুগম করার পেছনে এই গোষ্ঠীরও কিছুটা অবদান ছিল। এদের অধিকাংশই পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করে। সারকথা হলো, ইসলামী বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আহবায়কদের গোষ্ঠী সারা আরবে ছড়িয়ে পড়েছিল। মদিনা ছিল তাদের সবার প্রেরণার উৎস। তার কাছ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা সত্যান্বেষীরা ইসলামের সর্বত্র কলেমার জ্যোতি নিজ নিজ বৃত্তে পৌঁছে দিচ্ছিল। মদিনা ছিল যেন সূর্য, আর তার আশ পাশে বহুদূর পযন্ত ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহ তার কাছ থেকে আলো লাভ করে পরিবেশকে করছিল আলোকিত।
এখানে আমি সংক্ষেকে এমন কয়েকটা উদাহরণ তুলে ধরেছি, যা দ্বারা বুঝা যাবে যে, এক বা গুটিকয় ব্যক্তি কিভাবে পুরো এক একটা গোত্রকে বা অঞ্চলকে প্রভাবিত করেছে। একটা উদাহরণ, সম্ভবত সবচেয়ে বড় ও উজ্জ্বল উদাহরণ হলো মদিনার যুবক সুয়াইদ বিন সামেত মক্কায় যেয়ে রসূল সা. এর কাছ থেকে কালেমায়ে তাইয়েবার আলো অর্জন করে এবং তারপর তার কাছ থেকে মদিনার অনেকে প্রভাবিত হয়। এভাবে এক পর্যায়ে মদিনা ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। তোফায়েল দাওসী যদিও নিজের মেজাজের কারণে পুরো গোত্রকে তাড়াতাড়ি প্রভাবিত করতে পারেননি, কিন্তু তার কারণে ইয়ামানে ইসলামী আন্দোলন পরিচিতি লাভ করে। আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীদের দ্বারা প্রভাবিত ও উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্য কারো প্রেরণা ছাড়াই আশয়ার গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। দামাদ বিন সা’লাবার দাওয়াতে তার পুরো গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। হযরত আবু যর গিফারী ইসলামের বিপ্লবী মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে মক্কা থেকে ফিরলে তার দাওয়াতে তাঁর গোত্রের অর্ধেক লোকই ইসলাম গ্রহণ করে। বাকী অর্ধেক রসূল সা. মদিনায় যাওয়ার পর
মুসলমান হয়। তারপর গিফার গোত্রের কাছ থেকে আসলাম গোত্রেও ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং ক্রমে ক্রমে পুরো গোত্র ইসলামে দীক্ষিত হয়। মুনকিয বিন হাব্বানের মাধ্যমে বাহরাইনে ইসলামের বিস্তার ঘটে। কিছুকাল পর মুনকিয ১৪ জন সাথী নিয়ে মদিনায় এসেছিলেন। মোটকথা, ব্যাপারটা ইনজীলের সেই উক্তিটার মতই প্রতিভাত হয় যে, ‘আল্লাহর রাজত্বের (সত্যের দাওয়াতের) উদাহরণ খামিরের মত। এক মহিলা আটার সাথে একটু খামির মিশিয়ে দিলে আটাই খামিরে পরিণত হয়।”
ইসলাম যেখানেই পৌঁছতো এবং কিছু লোক তা গ্রহণ করতো, সেখানেই অনিবার্যভাবে একটা সমাজই তৈরী হতো। মসজিদ শুধু নামাজের ঘর হতোনা, বরং ইসলামের যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র হতো। তা হতো একাধারে শিক্ষাঙ্গন, পরামর্শস্থল, সামাজিক সমাবেশস্থল ও মেহমানখানা। মসজিদ হতে আসলে ইসলামী আন্দোলনের প্রতীক এবং মসজিদের অস্তিত্ব গোটা এলাকায় এ কথা ঘোষণা করে দেয়ারই নামান্তর হতো যে, এ জায়গা এখন “ইসলামের ঘাঁটি।” এ জন্য রসূল সা. সদ্য মুসলমান হওয়া গোত্রগুলোকে মসজিদ বানানোর নির্দেশ দিতেন। আর সৈন্যদেরকে নির্দেশ দিতেন, যে এলাকায় আযানের শব্দ শোনা যায়, সেখানে যেন অস্ত্র চালানো বন্ধ রাখা হয়। এ নির্দেশ আসলে আরো মসজিদ নির্মাণের উৎসাহ প্রদানের শামিল। মুসলিম বসতিতে লোকেরা তাদের নতুন বিপ্লবী আদর্শ প্রচারের একটা উপযুক্ত পন্থা হিসাবে মসজিদ বানাতো। সেখান থেকে আযানের আকারে ইসলামী আকিদা প্রচার করা হতো এবং জামায়াতে নামায আদায়ের মাধ্যমে ইসলামী সংঘবদ্ধতার প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। রসূল সা. এর উৎসাহ দানের ফলেই তাঁর জীবদ্দশাতেই মসজিদ নির্মিত হতে থাকে। বাহরাইনে শুরুতেই একটা মসজিদ নির্মিত হয়। মসজিদে নববীর পর প্রথম জুমা এখানেই পড়া হয়। মসজিদগুলো জনগণের প্রতিষ্ঠান হতো এবং তা সরকারী অভিভাবকত্বে চলতো। মদিনা থেকে যাদেরকে কোন এলাকায় কর্মকর্তা বানিয়ে পাঠানো হতো, তারাই হতো সেখানকার মসজিদের ইমাম। যে সব গোত্র মদিনার প্রশাসনের আওতার বাইরে থাকতো, তারা তাদের মসজিদের ইমাম নিয়োগের ব্যাপারে রসূল সা. এর পরামর্শ নিত। অতপর রসূলের নির্দিষ্ট করে দেয়া মাপকাঠি অনুসারে ইমাম নিয়োগ করতো। যে সব জায়গায় রাসূল সা. কোন যুদ্ধে বা সফরে থাকাকালে অবস্থান করেছেন, বা নামায পড়েছেন বা কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, সে সব জায়গায় অনেক মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।
চুক্তি ও সমঝোতার শক্তি
জনগণের মধ্যে দাওয়াত ও তাবলীগের যে ব্যাপক কাজ উপরোক্ত প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয় তার সাথে আরো কিছু বড় বড় সহায়ক পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়। এগুলোর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল মদিনার রাজনৈতিক প্রভাব সম্প্রসারণ। এই প্রভাব সম্প্রসারণের কাজটা অনেকাংশে সমাধা করা হয় চুক্তি ও মৈত্রী সম্পর্কের মাধ্যমে। চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে রাসূল সা. কর্তৃক সরকারের প্রভাব বলয় সম্প্রসারণ এবং এ ব্যাপারে অস্বাভাবিক মনোযোগ দান থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি যতদূর সম্ভব, যুদ্ধবিগ্রহ এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন এবং চারদিকে শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছিলেন, যাতে করে এধরনের শান্ত পরিবেশে দাওয়াতের কাজ ভালোভাবে করা যায় এবং সামরিক উত্তেজনা মাঝখানে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। যেখানে ইসলাম, ইসলামী রাষ্ট্র ও শান্তি রক্ষার জন্য সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ অনিবার্য হয়ে পড়েছে, সেখানে তো তিনি কোন রকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেননি। কিন্তু যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে অব্যাহতি লাভ করা যদি সম্ভব হতো এবং শান্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে যদি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক রক্ষণাবেক্ষণ, স্থিতিশীলতা ইসলামের দাওয়াত দেয়ার বাধাহীন পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হতো, তাহলে তিনি সন্ধি ও সমঝোতার পথ কখনো পরিহার করেননি। খোদ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তরবারীর শক্তি দিয়ে নয়, বরং সাংবিধানিক চুক্তির জোরে সম্পন্ন হয়েছিল। তারপর রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও তার প্রভাব সম্প্রসারণের জন্য তিনি মিত্রতার সম্পর্ককে এত ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন যে, তার তুলনায় সামরিক ব্যবস্থার অনুপাত ছিল নিতান্তই কম।
চুক্তি ও মৈত্রী ভিত্তিক সম্পর্ক গড়া সহজ কাজ নয়। বিশেষত, ধর্মীয় মতভেদ ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ যখন বিদ্যমান থাকে, পরস্পর বিরোধী শক্তিগুলো মাঝখানে হস্তক্ষেপ করে এবং ব্যাপারটা যদি সাধারণভাবে একেবারেই পূর্ব পরিচয়বিহীন গোত্র ও ব্যক্তিবর্গের সাথে সম্পৃক্ত হয়, সেক্ষেত্রে এ কাজে অত্যধিক রাজনৈতিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়। শ্রোতার অবস্থা, মানসিকতা ও শক্তি সম্পর্কে জানা, সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে কোন বিশেষ সময়ে বিরাজমান শক্তির ভারসাম্যকে উপলব্ধি করা, বিরোধী জনগোষ্ঠী সমূহের প্রভাব প্রতিপত্তি পর্যবেক্ষণ করা, এমন শর্ত চিহ্নিত করা, যা কোন প্রতি পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে আলাপ আলোচনাকে প্রভাবশালী করা ইত্যাকার বহু অত্যাকশ্যকীয় শর্ত পূরণ করতে হয়। প্রকৃত পক্ষে রসূল সা. এই ক্ষেত্রে যে পর্যায়ের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, নেতাসুলভ দক্ষতা ও কূটনৈতিক যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, তার নজীর কোথাও পাওয়া যায়না। নজীর পাওয়া যায়না এ জন্য যে, রসূল সা. এত সুদূরপ্রসারী সম্পর্ক গড়ে তুলতে গিয়ে ইসলামী আদর্শের, নিজের নৈতিক মূলনীতির এবং নিজের রাজনৈতিক মর্যাদার এক বিন্দু পরিমাণও ক্ষতি হতে দেননি। নচেত কূটনৈতিক অংগনে যেমন মারাত্মকভাবে নৈতিকতার অপমৃত্যু ঘটানো হয়, তার কারণে ‘ডিপ্লোমেসী” শব্দটার দুর্নাম রটে গেছে। স্বয়ং রাজনীতি আজ একটা অবাঞ্ছিত ব্যাপারে পরিণত হয়ে গেছে। বলা হয়ে থাকে, রাজনীতির কোন চরিত্র নেই, এর কোন শেষ কথা নেই। রাজনীতি এমন এক ট্যাংক, যা যেদিকে চলে সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ পদদলিত করতে করতে চলে। কিন্তু রসূল সা. ডিপ্লোমেসি ও রাজনীতির অর্থ একেবারেই পাল্টে দিয়েছেন। এ কাজ দুটোকে শুধু নোংরামী থেকেই মুক্ত ও পবিত্র করেননি, বরং তাতে সততা ও এবাদতের প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করেছেন। ইসলামী নীতিমালা অনুসারে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো, তাতে অসাধারণ সাফল্য লাভ করা এবং এর মাধ্যমে বিক্ষিপ্ত গোত্রগুলোকে সংঘবদ্ধ করে নিজের চারপাশে সমবেত করা আজ পুস্তকাদিতে পড়ার সময় সহজ কাজ বলে মনে হয়। কিন্তু আরবের মরুভূমিতে বাস্তবে এসব কাজ যিনি করছিলেন, তিনিই জানতেন যে, তা কত কঠিন কাজ ছিল।
চুক্তিভিত্তিক মৈত্রীর এই প্রক্রিয়ায় শুধু যে মুসলিম প্রচারকদের যাতায়াত, জনগণের সাথে অবাধ মেলামেশা এবং চুক্তিবদ্ধ গোত্রের লোকজনের মদিনার সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের অবারিত সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামের ব্যাপকতর প্রসারের পথ সুগম হয়েছিল তা নয়, বরং তা এদিক দিয়েও ইসলামী আন্দোলনের প্রভাব সম্প্রসারণে সহায়ক হয়েছিল যে, এর কারণে ইসলামী নেতৃত্বের কাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দুরদর্শিতা জনগণের আস্থা অর্জন করেছিল। সীমিত ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণার সৃষ্ট পূন্যবান মানুষদের প্রতি জনসাধারণ যতই ভক্ত ও অনুরক্ত হোক না কেন এবং তাদের পবিত্রতায় যতই আস্থাশীল হোক না কেন, সামষ্টিক জীবনের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের চাবিকাঠি কখনো তাদের হাতে অর্পণ করেনা। সামষ্টিক জীবনের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব চিরকাল সেই সব লোকের হাতেই অর্পিত হয়েছে, যাদের সম্পর্কে জনগণের ধারণা রয়েছে যে, তারা সামষ্টিক দায়িত্ব পালনে যোগ্যতা ও দক্ষতার অধিকারী। অনেক সময় এমনও হয়ে থাকে যে, জনগণ কোন দলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলে যে, তারা তো খুবই ভালো মানুষ, অনেক ভালো কাজ করে, জনসেবা করে ইত্যাদি। কিন্তু তাদের এই প্রশংসার মাধ্যমে তারা বুঝাতে চায় যে, দুনিয়ার কায়কারবারের জন্য ঐ ভালো মানুষেরা খুবই অযোগ্য। জনসাধারণের প্রশংসা শুনে এই শ্রেণীর লোকেরা প্রায়শ এরূপ ভ্রান্ত ধারণায় লিপ্ত হয় যে, আমাদের পক্ষে জনমত খুবই ভালো। তৎকালীন মুসলিম সংগঠন যদি এমন মানবীয় চরিত্র তৈরী করতো, যা ধর্মীয় দিক দিয়ে অত্যন্ত পুন্যবান ও পরহেজগার বটে, কিন্তু দুনিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাবলীতে কোন প্রকার যোগ্যতা প্রদর্শন করতে অক্ষম, তা হলে জনগণের প্রতিক্রিয়া এই হতো যে, ওরা ভালো মানুষ, ভালো ভালো কথা বলে এবং মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করে। কিন্তু তাদের দ্বারা নতুন কোন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনা ও সমাজের নেতৃত্ব দানে তারা সক্ষম হবে – এমন আশা কখনো জনগণ করতে পারতোনা। ইসলামী আন্দোলন এমন “আল্লাহ ওয়ালা” লোক তৈরী করার জন্য আসেনি, যারা ব্যক্তি হিসেবে শুধুই আল্লাহ ওয়ালা, ভালো মানুষ ও সরলমতি, কিন্তু সামষ্টিক জীবনে কর্তৃত্বশীল হবার মত রাজনৈতিক দক্ষতার অধিকারী নয়, যাদেরকে জনগণ বিকল্প ও উন্নততর নেতৃত্বের যোগ্যতাসম্পন্ন বলে গ্রহণ করেনা এবং যাদের দ্বারা কোন উজ্জ্বলতর ভবিষ্যত তৈরী হবে বলে আশা করতে পারেনা। ইসলামী আন্দোলনের সৃষ্টি করা মুসলিম নেতা ও কর্মীরা যতবেশী খোদাভক্ত ও খোদাভীরু ছিল, ততই রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দক্ষতার অধিকারীও ছিল। এ ব্যাপারে তারা নিজ নিজ কাজের মধ্যে দিয়েই নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিল। সমকালীন জনতা এভাবে পর্যায়ক্রমে রসূল সা. ও তাঁর নেতৃত্বে কর্মরত মুসলিম শক্তির নেতৃত্বসুলভ যোগ্যতা দ্বারা প্রভাবিত হতে থেকেছে, মদিনা তাদের আশার কেন্দ্রবিন্দু হতে থেকেছে এবং এর ফলে তাদের মনও ক্রমাগত ইসলামের জন্য উন্মুক্ত হতে থেকেছে। মোটকথা, দ্বীনের দাওয়াত ও রাজনৈতিক প্রভাবের সম্প্রসারণ- এই দুটো কাজ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এবং এতদোভয়ের সম্মিলিত প্রাণশক্তিই ইসলামী আন্দোলনকে গতিশীল করেছিল দুর্বার অগ্রযাত্রার দিকে। আসুন, এই মূল তত্ত্বকে মনে রেখে রসূল সা. এর প্রতিষ্ঠিত সুদূর প্রসারী চুক্তি ভিত্তিক সম্পর্কগুলোর পর্যালোচনা করি। এ সম্পর্কগুলো তিনি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে প্রতিষ্ঠিত করেন, যদিও তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল।
১. আকাবার চুক্তি
চুক্তিভিত্তিক সর্ম্পকের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয় আকাবার চুক্তির কথা। এ চুক্তি একাধারে ধর্মীয় অঙ্গীকার এবং রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞাও। আকাবার প্রথম বৈঠকে রসূল সা. এর হাতে হাত দিয়ে মদিনার একদল টগবগে যুবক রসূল সা. এর রিসালাতের প্রতি ঈমান আনয়নের স্বীকৃতি দেয়। দ্বিতীয় বৈঠকে রসূল সা. এর রাজনৈতিক নেতৃত্বের আনুগত্যের ওয়াদাও অন্তর্ভুক্ত হয়। মক্কা থেকে মিনা যাওয়ার পথে রাস্তার দু’দিকে পাহাড়ের সমান্তরাল উঁচু প্রাচীর অবস্থিত। মিনা থেকে এক ফার্লং আগে বাম দিকের পাহাড়ে অর্ধবৃত্তাকার একটা ছোট উপত্যকা দেখতে পাওয়া যায়। এটাই সেই সুরক্ষিত জায়গা, যেখানে রাতের নিস্তব্ধ অন্দ্বকারে আকাবার চুক্তি সংঘটিত হয়। মদিনায় ইহুদীদের উপস্থিতির কারণে আনসাররা ঐশী ধর্মের সাথে এবং নবুয়তের ধারাক্রমের সাথে মোটামুটি পরিচিত ছিল। প্রতিশ্রুত শেষ নবী সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীগুলো তাদের জানা ছিল। ইহুদীরা যে তাদেরকে বিভিন্ন সময় ভয় দেখাতো, “সেই প্রতিশ্রুত শেষ নবী এলে আমরা তাকে সাথে নিয়ে তোমাদের পরাভূত করবো”, এ কথাও তাদের মনে ছিল। এভাবে আনসারদের মধ্যে একদিকে যেমন ঐশী হেদায়াতের চাহিদা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, অপরদিকে অবচেতনভাবে এই আবেগও জন্মে দিয়েছিল যে, প্রতিশ্রুত সেই নবী এলে আমরাই সর্ব প্রথম তার প্রতি ঈমান আনবো। এই সাথে আওস এবং খাজরাজের মধ্যে পারষ্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যে ধারা চলে আসছিল, তাতে তারা ক্লান্ত হয়ে শান্তি ও নিরাপত্তার একটা সুযোগের জন্য অপেক্ষমান ছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল এইযে, সাবেক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিবেশের কারণে দুই গোত্র একে অপরের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলনা। তৃতীয় কোন শক্তি তাদের জন্য অপরিহার্য ছিল। এ সমস্ত কারণে মদিনার বুদ্ধিমান ও শান্তিপ্রিয় লোকেরা যখনই রসূল সা. এর সাথে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হলো এবং রসূল সা. এর দাওয়াত শুনার সুযোগ পেল, অমনি তাদের মন ঐ দাওয়াত গ্রহণের জন্য উৎসুক ও উদগ্রীব হয়ে উঠল। নবুয়তের খবরাখবর তো তাদের কাছে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। প্রত্যক্ষ আলোচনায় তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। রসূল সা. এর সুদর্শন চেহারা ও ব্যক্তিত্বের প্রভাব তাঁর দাওয়াতী বক্তব্যের সাথে যুক্ত হয়ে সেই মানসিক বিপ্লবকে চূড়ান্ত রূপ দিল। সেই মুহূর্তটা ছিল একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যখন কতিপয় আনসার ( প্রথম বায়াতের সময় ) কোরায়েশদের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে রওনা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্য সফল হলে ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস সম্পূর্ন অন্য রকম হতো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাদের ইচ্ছা পাল্টে যায়। তারা কোরায়েশদের চিন্তা মন থেকে দূর করে দিয়ে মক্কার সেই উদীয়মান সূর্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়, যে সূর্য ইতিহাসের উদয়াচল থেকে নতুন আলোকরশ্মি নিক্ষেপ করে দিগন্ত উদ্ভাসিত করছিল।
প্রথম বারের বায়য়াতে রসূল সা. কয়েকটি আকীদাগত ও নৈতিক বিয়য়ে অংগীকার গ্রহণ করেন। তারা আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করবেনা, চুরি করবেনা, ব্যভিচার করবেনা, সন্তানদের হত্যা করবেনা, কারো বিরুদ্ধে কোন অপবাদ আরোপ করবেনা এবং সৎকাজের ব্যাপারে রসূল সা. এর আদেশ অমান্য করবেনা- এই মর্মে তাদের অংগীকার গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয় বায়য়াতে আনসারগণ যে ক’টা কথা সংযোজন করেন তা হলোঃ “আমরা সর্বাবস্থায় রসূল সা. এর আদেশ শুনবো ও আনুগত্য করবো, চাই পরিস্থিত অনুকূল হোক কিংবা বিপদ সংকুল হোক, কোন আদেশ আমাদের পছন্দ হোক বা অপছন্দ হোক, অথবা কোন আদেশ আমাদের মতের বিরুদ্ধে যাক। আমরা আমাদের নেতার সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হবোনা এবং কোন নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবোনা।
এই সংক্ষিপ্ত অংগীকারের মাধ্যমে মুহাম্মদ সা. ও আনসারদের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল এবং খোলাখুলিভাবে এই দল একটা রাজনৈতিক দলে পরিণত হলো। রসূলের সা. নেতৃত্বকে তারা সর্বতোভাবে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হিসাবে গ্রহণ করলো। তারা এই মর্মেও প্রতিজ্ঞা করলো যে, নেতৃবৃন্দের সাথে দ্বন্দ্ব সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া বা পদমর্যাদা ছিনিয়ে নেয়ার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবেনা। পরামর্শের মূলনীতি এরূপ স্থির হয়ে গেল যে, প্রত্যেক বিষয়ে যা সঠিক ও ন্যায়সংগত, তাই উপস্থাপন করা হবে। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ব্যাপারে অংগীকার করা হলো যে, আমাদের উপর যে যে দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপিত হবে, তা সারা দুনিয়ার সমালোচনাকে উপেক্ষা করেও বাস্তবায়িত করবো। এটা এমন একটা অংগীকার ছিল যে, এরপর এই দলের কর্তৃত্বে যে কোন ভূ-খন্ড আসুক না কেন, তার ওপর অন্য কোন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব না থাকলে এবং নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব পুরোপুরি তার হাতে কেন্দ্রীভূত থাকলে সেই দল তাক্ষণাত একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাবে।
এই বিষয়গুলোর সাথে সাথে আরো স্থির হয় যে, রসূল সা. মদিনায় হিজরত করার পর চুক্তিবদ্ধ আনসারগণ রসূল সা. ঠিক এমনিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করবে, যেভাবে তারা আপন স্ত্রী ও সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। অন্যকথায় বলা যায়, মদিনার ইসলামী দলের সাথে রসূল সা. এর প্রতিরক্ষামূলক ঐক্যের চুক্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এদিক দিয়ে আকাবার চুক্তির রাজনৈতিক মূল্য আরো বেড়ে গিয়ে ‘বিপ্লবী’ হয়ে যায়।
এরপর রসূল সা. এর নির্দেশে মদিনার আনসারদের ইসলামী সংগঠনের পক্ষ থেকে বারোজন প্রতিনিধি বা নকীব নিযুক্ত করা হয়, যারা রসূল সা. এর কাছে দায়ী থাকবে। ইসলামী দাওয়াতের বিস্তার ও সম্প্রসারণ ছাড়াও রাজনৈতিক দায়িত্বও তাদের ওপর অর্পণ করা হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকরের বর্ণনা অনুযায়ী রসূল সা. এই নকীবগণকে বলেন, “তোমরা তোমাদের জনগণ সম্পর্কে ঠিক সেইভাবে দায়িত্বশীল থাকবে, যেমন হযরত ঈসার সামনে তার সঙ্গী হাওয়ারীগণ দায়িত্বশীল ছিল। আর আমিও আমার জনগোষ্ঠি অর্থাৎ মক্কাবাসী সম্পর্কে দায়িত্বশীল। ( সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃঃ ৩৬-৫৭, আহদে নববীকে ময়দানহায়ে জং, ডক্টর হামীদুল্লাহ সিদ্দীকী, পৃঃ ৭-১০)
নকীবদের নিযুক্তির পর মদিনার যে প্রশাসনিক কাঠামো তৈরী হয়, তা শুধু ধর্মীয় ছিলনা, বরং তা হয়ে গিয়েছিল রাজনৈতিক এবং বিপ্লবীও। এ ধরনের অবকাঠামোর স্বতস্ফূর্ত ও স্বভাবসুলভ দাবী, তা যেন যত শীঘ্র সম্ভব, বরং প্রথম সুযোগেই রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। বাস্তবেও হলো তাই, রসূল সা. এর হিজরতের কয়েক মাস পরই ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
এ থেকে বুঝা গেল, ইসলামী আন্দোলন প্রাথমিক দাওয়াতের যুগ পূর্ণ করে রাষ্ট্রীয় যুগে প্রবেশ করেছিল চুক্তিরই মাধ্যমে, সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নয়।
২. সাংবিধানিক চুক্তি
রসূল সা. এর নেতৃত্বে পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম চুক্তি ছিল মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি পত্তনকারী চুক্তি। সম্ভবত সারা পৃথিবীর ইতিহাসে কোন একটা রাষ্ট্রও কমবেশী শক্তি প্রয়োগ ছাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়নি, একটা আদর্শিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তো আরো বেশী অসম্ভব। কেননা তার মূল আদর্শ গোটা পরিবেশে অসাধারণ উত্তেজনার সৃষ্টি করে থাকে এবং একটা অজানা পরিবেশ ও রকমারি মানুষের সহযোগিতা নিয়ে তা প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে প্রচন্ড সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি অনিবার্য হয়ে ওঠে। মদিনার এই সাংবিধানিক চুক্তি রসূল সা. এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও নেতা সুলভ দক্ষতার এমন উদাহরণ তুলে ধরে, যার তুলনা কোথাও নেই। এই চুক্তির পক্ষগুলোর মধ্যে মোহাজেরগণ, আনসারদের প্রধান দুটি গোত্র আওস ও খাজরাজের মুসলিম মোশরেক ও ইহুদী ব্যক্তিগণ এবং পরষ্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জর্জরিত ইহুদী গোত্রগুলো অন্তর্ভুক্ত।
আসলে রসূল সা. নিজের মামা বাড়ির দেশ হিসাবে মদিনাকে শিশুকাল থেকেই চিনতেন। শিশুকালে সেখানে গিয়েছেন এবং অবস্থান করেছেন। তারপর ইসলামের আহ্বায়ক হিসেবে মক্কার জীবনেরই শেষ দু’তিন বছর মদিনার সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানকার ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থা সম্পর্কে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। এরপর সেখানকার অধিবাসীদের পারষ্পরিক সম্পর্ক ও অন্যান্য বিষয়ে সাম্প্রতিকতম তথ্যাদি সরাসরি জানার যেটুকু কমতি ছিল, তিনি হিজরত করে মদিনায় আসার পর সেই কমতিও দূর হয়ে গিয়েছিল। গোটা মদিনার জনসংখ্যা তখন আনুমানিক পাঁচ হাজার ছিল এবং তারও প্রায় অর্ধেক ছিল ইহুদী। এই অধিবাসীদের মধ্যে আনসার ও মোহাজের সমেত মুসলমানদের সংখ্যা পাঁচশোর বেশী ছিলনা। এই সক্রিয়, সদাজাগ্রত, সচেতন ও সুসংগঠিত সংখ্যালঘুকে সাথে নিয়েই রসূল সা. পাঁচহাজার অধিবাসীকে নিজ নেতৃত্বের আওতায় নিয়ে আসেন। আনসারদের দুটো প্রধান গোত্র ১২টি শাখাগোত্রে বিভক্ত ছিল এবং তাদের মধ্যে ছিল এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। সাধারণ অধিবাসীরাও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জর্জরিত ছিল। কেননা আরব ও ইহুদী উভয় জনগোষ্ঠীই দু’ভাগে বিভক্ত থাকতো এবং সব সময় কোন না কোন ব্যাপারে দু’পক্ষের কোন্দল লেগেই থাকতো। এভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও কোন্দল-কলহে সব ক’টা জনগোষ্ঠীই অতিষ্ঠ ও শান্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। শান্তির এই সার্বজনীন পিপাসা মেটাতে একটা গঠনমূলক নেতৃত্বের চাহিদা তীব্র হয়ে উঠেছিল। নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণের জন্য অল্প কিছুদিন আগেই আব্দুল্লাহ বিন উবাইকে মুকুট পরানোর আয়োজন চলছিল। কিন্তু সহসা রসূল সা. ও তাঁর দাওয়াতের কথা শুনে আনসারদের মনোযোগ সেদিকেই আকৃষ্ট হয়।
ইহুদীদের অবস্থাও এমন হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের দুটো বড় গোষ্ঠী অভ্যন্তরীণভাবে দশটা উপগোত্রে বিভক্ত ও পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।
স্বজাতির বাসভূমি থেকে দূরে অবস্থিত এই ইহুদীরা নিজেদের অস্তিত্ব নিপাতের আশংকায় জর্জরিত ছিল। তারপর সহসা যখন রসূল সা. আনসারদেরকে নিজের সাথে যুক্ত করে নিলেন এবং তাদের সাথে ইহুদীদের সাবেক মৈত্রী সম্পর্ক ছিন্ন হতে লাগলো, তখন ইহুদীরা অনুভব করলো, তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি যেন সরে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রসূল সা. আল্লাহর ওহীর আওতায় ইহুদীদের মনকে জয় করা ও তাদের উত্তম ভাবাবেগকে আকৃষ্ট করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। এই চেষ্টার ফলে রাজনৈতিক ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার জন্য পরিবেশ অনুকূল হয়ে যায়। মদিনার সর্বশ্রেণীর অধিবাসীকে জানা, তাদের স্বার্থ, সমস্যা ও মনস্তত্ব সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়া এবং সবাইকে একই লক্ষ্যের দিকে চালিত করার মত বিরাট রাজনৈতিক কীর্তি এত অল্প সময়ে সমাধা করা রসূল সা. কে রাজনৈতিকভাবে এত উঁচু মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে যে, তা ভাবতে গেলেও আমরা দিশেহারা হয়ে যাই। মুসলিম দল এমনিতেই আকীদা বিশ্বাস ও নৈতিকতার দিক দিয়ে মুহাম্মদ সা. এর নেতৃত্বে একটা অত্যন্ত অটুট ও সুদৃঢ় সংগঠনের অধিকারী ছিল। তদুপরি আকাবার বায়য়াত তাকে একটা রাজনৈতিক বিপ্লবী দলে পরিণত করেছিল। তাছাড়া আদর্শবাদী দল হওয়ার কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিকাশ ও বিবর্তনের যোগ্যতাও তার ছিল, তাই এ দল সহজেই মদিনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব লাভ করে। আনসার গোত্রগুলোতে কোন বিকল্প আদর্শও ছিলনা। নেতৃত্বও ছিলনা। কেননা তাদের সরদারদের বেশীর ভাগ আগেই ইসলামী আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েগিয়েছিল। এ সব গোত্রের ভেতরে যে সব মোশরেক বা ইহুদী ব্যক্তি ছিল, তারা সংখ্যায় নেহাত কম না হলেও কোন বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত ছিলনা। তারা ছিল নীরব এবং নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের অনুসারী। একটা দুটো আরব বা ইহুদী গোত্র মুসলমানদের সামনে তেমন গুরুত্বের অধিকারী ছিলনা। মদিনার অধিবাসীদের এই বিন্যাস রসূল সা. এর কর্ম পরিকল্পনার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তাই তিনি প্রাথমিক সমস্যাবলীর সমাধান করে কয়েক মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলেন। আলোচ্য চুক্তি ইউরোপীয় ওরিয়ন্টালিস্টদের পর্যালোচনা অনুসারে ৫৩টা ধারা সম্বলিত। ঐতিহাসিক রেকর্ডের আলোকে এই চুক্তি সম্পর্কে একটা বিষয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এই চুক্তিটা হিজরী ১ সালে পুরোপুরিভাবে লিপিবদ্ধ হয়। অন্যদের মতে, এর একাংশ ১ সালে এবং অপরাংশ বদর যুদ্ধের পর লিপিবদ্ধ হয়। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে ১ থেকে ২৩ নং ধারা এবং ২৪ থেকে ৪৭ নং ধারা পর্যন্ত এর দুটো পৃথক অংশ। আমরা যদি এই দ্বিতীয় মতটাকে গ্রহণ করি, তাহলে এতেও রসূল সা. এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার নিদর্শন দেখতে পাই। রসূল সা. প্রথমে মোহাজেরগণ ও সমস্ত আনসার (অমুসলিমসহ) দের নিয়ে রাজনৈতিক অবকাঠামো গঠন করেন। এরপর ইহুদী গোত্রগুলো নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন রেখে দূর্বল ও বিপন্ন অনুভব করে থাকতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তারা একেবারেই ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ অবস্থায় পতিত হয়েছিল। তারপর তারা যখন মুসলমানদেরকে বদরের ময়দান থেকে বিজয়ী হয়ে ফিরতে দেখলো, যা তারা আশাই করতে পারেনি, তখন তারা হয়তো ভেবেছে যে, সময় থাকতে এখনো আমাদের মদিনার অবকাঠামোতে উপযুক্ত স্থান গ্রহণ করা উচিত।
এই সাংবিধানিক চুক্তি সম্পর্কে ডঃ হামীদুল্লাহ সিদ্দীকীর মন্তব্য হলো, ইতিহাসে কোথাও এর নজীর নেই। এটি অত্যন্ত উচ্চাংগের রাজনৈতিক দক্ষতার সাথে ও অত্যন্ত সতর্ক দালিলিক ভাষায় লিখিত। এতে রসূল সা. নিজের ইপ্সিত আদর্শিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলোর পক্ষে সর্বশ্রেণীর ও সকল সম্প্রদায়ের লোকদের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন। এই দলীলের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য গুলো নিয়ে আলোচনা করা এখানে প্রাসংগিক হবে বলে মনে হয়, যাতে এর রাজনৈতিক মূল্য ও মর্যাদা সম্পর্কে সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়।
এই দলীল শুরু করা হয়েছে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” দিয়ে। এর শিরোনাম হলোঃ “এই লিখিত দলীল নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে জারীকৃত।”
এভাবে এর সূচনাতেই ইসলামের মৌলিক রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হলো। এই দলীলের ভিত্তিতে যে রাজনৈতিক অবকাঠামো গঠিত তার কেন্দ্রীয় উপাদান মুসলমানদেরকেই রাখা হয়েছে। যেমন প্রারম্ভেই বলা হয়েছেঃ
“কোরাইশ এবং ইয়াসরেব মুমিন এবং মুসলমান এবং যারা তাদের অনুসরণ করে এবং যারা তাদের অনুগামী হয় আর যারা তাদের সংগে জেহাদে অংশ নেয় (তাদের সকলের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্যে)”
এতে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মক্কা থেকে আগত ও মদীনার মুমিনগণ। বাদবাকীরা তাদের অনুসারী হিসেবে নাগরিকত্ব লাভ করবে। ইহুদী গোত্রগুলোকে চুক্তির অংশীদার করে “মুমিনদের সংগে” শব্দ প্রয়োগ করে রাজনৈতিকভাবে একই উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (ধারা ২৫ থেকে ৩৫ পর্যন্ত)।
এতে আরো বলা হয়েছে যে, ‘মুমিনরা পরষ্পরের ভাই’ (ধারা-১৫)। যুদ্ধ ও সন্ধিতে সকল মুসলমানকে সমান অংশীদার ঘোষণা করা হয়েছে (ধারা- ১৭)। মুসলমানদেরকে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন তারা কিসাস (হত্যাকারীকে মৃত্যুদন্ড প্রদান) বাস্তবায়িত করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং খুনীকে কখনো আশ্রয় না দেয়। তাই বলে কেউ যেন বাড়াবাড়ি না করে এবং যে বাড়াবাড়ি করে তার ওপর যেন প্রতিশোধ নেয়া হয় (ধারা- ১৯, ২১, ৩২)। কোন মুমিন কোন কাফেরের বদলায় কোন মুমিনের প্রাণ সংহার করতে পারবেনা। কোন মুমিনের বিরুদ্ধে কোন কাফেরকে সাহায্যও করতে পারবেনা (ধারা- ১৪)। যে কোন নগন্য মুসলমানও যে কোন ব্যক্তিকে আশ্রয় দিতে পারে এবং তাকে আল্লাহর অর্পিত দায় হিসেবে সবাইকে বহন করতে হবে (ধারা- ১৫)। যখন কোন মতভেদ হয়, তখন আল্লাহ ও মুহাম্মাদ সা. এর কাছ ফায়সালা নিতে হবে (ধারা- ২৩)। খোদাভীরু মুমিনদের কর্তব্য, তারা যেন প্রত্যেক পাপাচার, অপরাধ ও অত্যাচারের প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হয় ( ধারা- ১৩)। প্রাথমিক অংশে সংবিধানের আদর্শিক প্রেরণাকে উজ্জীবিত করার জন্য বারবার বলা হয়েছে যে, অমুক অমুক (মুসলমান) গোত্রকে ফিদিয়া ইত্যাদির ব্যাপারে ‘ন্যায় নীতি’ ও ‘ইনসাফ’ অবলম্বন করতে হবে। আর তা করতে হবে “মুসলমানদের মধ্যে সাধারণভাবে এর যে অর্থ প্রচলিত আছে সেই অর্থে” (ধারা ৩ থেকে ১২)। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী পরিভাষা ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ এই সংবিধানের অন্তভূক্ত করা হয়েছে (ধারা-১৯)। অনুরুপভাবে ‘যুলুম’, ‘গুনাহ’ ও ‘সৎকাজ’ এই তিনটে পরিভাষাও এর অন্তর্ভূক্ত হয়েছে (ধারা-৩৬ )। সংবিধানে এ কথাও অন্তর্ভূক্ত হয়েছে যে, খোদাভীরু ও সংযমী মুমিনরা সবচেয়ে সঠিক পথে আছে (ধারা-২০ )। ‘সাহায্য পাওয়া মজলুমের অধিকার, এই কথা দ্বারা একটা বিশুদ্ধ ইসলামী মূলনীতি তুলে ধরা হয়েছে, যা একটা আন্তমানবিক মূলনীতিও বটে। এই মূলনীতির পক্ষে সকল পক্ষের স্বীকৃতি আদায় করা হয়েছে এবং একথাও বলা হয়েছে যে, এই সংবিধানের বক্তব্যগুলোকে যে ব্যক্তি সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও আনুগত্যবোধ সহকারে পালন করবে, আল্লাহ তার সহায় থাকবেন (ধারা-৪২,৪৬ ও ৪৭ )।
এই দলীলে রাজনৈতিক বিষয়গুলো কত সুস্পষ্টভাবে নিস্পত্তি করা হয়েছে, তাও দেখুন। দলীলে সাক্ষরদাতাদের আবাসিক এলাকা অর্থাৎ মদিনা শহরের প্রায় একশো বর্গমাইল সম্বলিত মধ্যবর্তী এরলাকাকে (মদিনার ভৌগলিক পরিচিতি ইতিপূর্বে দেয়া হয়েছে।) ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাথমিক ভূ-খন্ড (Territory) বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাকে পবিত্র এলাকা হিসাবেও ঘোষণা করা হয়েছে (ধারা-৩৯)। আগে থেকেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে, ইহুদী সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে যারা আমাদের অনুসারী হবে, তারা যাবতীয় নাগরিক অধিকার সহকারে সাহায্য ও সমানাধিকার লাভ করবে। যে ধারাটায় এ কথা বলা হয়েছে, তাতে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা প্রতিফলিত হয়েছে। এ ধারায় একাধারে ইসলাম গ্রহণের উৎসাহ দেয়া হয়েছে, আবার যে কোন রাজনৈতিক সংকটের প্রতিবিধানও করা হয়েছে (ধারা-১৬ )। এই চুক্তির সাক্ষরদাতাদের সকলকে একটা রাজনৈতিক একক হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছেঃ *********** (ধারা-১)। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন এর ২৩নং ধারা, যাতে যে কোন মতভেদের নিস্পত্তির অধিকার দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রসূল মুহাম্মদ সা. কে আর কোন কলহ বিবাদ বা হত্যাকান্ড সংঘটিত হলে তাও আল্লাহ ও আল্লাহ রসূল মুহাম্মদ সা. এর নিকট উপস্থাপন করতে হবে (ধারা-৪২ )। কোন আঘাত বা হত্যার বদলা গ্রহণে বাধা দেয়া যাবে না (ধারা-৩৬)। অত্যাচারীর অত্যাচার ও হত্যাকারীর অপরাধের দায়দায়িত্ব শুধু অপরাধীর নিজের ওপর বা তার পরিবারের ওপর পড়বে ( আগে অপরাধীর গোত্র গোষ্ঠী সমেত দায়ী হতো) অন্য কারে ওপর নয় (ধারা-২৫,২৬)। রাজনৈতিক অবকাঠামোর প্রাথমিক একক ধরা হয়েছে প্রতিটি গোত্রকে এবং এটাকে মেনে নিয়েই তার ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে।
প্রতিরক্ষা নীতির ব্যাপারে স্থির হয়ে যে, ইয়াসরিবের ওপর আক্রমণ হলে স্বাক্ষরকারী পক্ষগুলোর জন্য পারস্পরিক সাহায্য করা জরুরী হবে (ধারা-৪৪)। চুক্তির স্বাক্ষরকারী কোন পক্ষের সাথে যদি কেউ যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে স্বাক্ষরকারীকে আন্তরিকতা সহকারে সাহায্য করা সাক্ষরকারীদের সকলের কর্তব্য (ধারা-৩৭ )। এই দলীল একটি ধারার মাধ্যমে প্রতিরক্ষার কর্তৃত্বও রসূল সা. এর হাতে অর্পণ করেছে। এতে বলা হয়েছে, রসূল সা. এর অনুমতি না নিয়ে কেউ কোন সামরিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হবেনা (ধারা-৩৬)। কোন পক্ষের নিজস্ব ধর্মীয় লড়াইতে শরীকদের কোন দায়দায়িত্ব থাকবেনা (ধারা-৪৫ )। শরীকদেরকে কোন সন্ধির জন্য ডাকা হলে সকলের সাথে তারাও সন্ধি করবে (ধারা-৪৫ )। কোরায়েশদের সাথে যে কোন মৈত্রীর সম্ভাবনা্ চুড়ান্তভাবে রোধ করার জন্য এ কথাও সবাইকে স্বীকার করানো হয়েছে যে, মদিনার কোন মোশরেক অমুসলিম নাগরিক) কোরায়েশদের জান ও মালের নেরাপত্তা দেবেনা এবং এ ব্যাপারে কোন মুমিনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেনা (ধারা ২০ )। কোরায়েশকে এবং কোরায়শের আশ্রয়দানকারীকে আশ্রয় দেয়া হবেনা (ধারা ৪৩ ) সামরকি ব্যয় নির্বাহ সম্পর্কে অত্যন্ত বিজ্ঞতার সাথে রসূল সা. এই ধারা সংযোজন করেন যে, প্রত্যেক পক্ষ নিজ নিজ যুদ্ধের ব্যয় নিজই নির্বাহ করবে ( ৩৭-৪৪ )। কেননা তিনি জানতেন, ইহুদীরা নিজেদের অংশ দিতে কার্পণ্য করবে এবং সমষ্টিক তহবিল তাদের হাতে গেলে তারা তহবিল তছরুপ করবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একদিকে খুনের অর্থদন্ড ও যুদ্ধবন্দীর মুক্তিপণ প্রদানের দায়িত্ব আরবের প্রচলিত রীতি মোতাবেক সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির গোত্রের ওপর অর্পণ করা হয়। তদ্রুপ যে ঋণগ্রস্থ ব্যাক্তি ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, তার ঋণের ভারও সমষ্টিক করে দেয়া হয়।
ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য বলা হয়, মুসলমানদের জন্য মুসলমানদের ধর্ম আর ইহুদীদের জন্য ইহুদীদের ধর্ম রইল (ধারা-২৫)। আসলে মুসলমান জাতি তো ধর্ম ও রাজনীতি উভয় দিক নিয়েই একটা মাত্র একক ছিল এবং তাদের ওপর দ্বিগুণ দায়িত্ব অর্পিত ছিল। কিন্তু খালেস রাজনৈতিক যোগযোগের ক্ষেত্রে সকল শরীক দলকে নিজ নিজ ধর্মের অনুসরণের স্বাধীনতা দেয়া হয়। (সীরাতে ইবনে হিশাম,২য় খন্ড, পৃ-১১৯-১২৩, আহদে নববী কা নেযামে হুকুমরানী, ডাঃ হামীদুল্লাহ সিদ্দীকী, পৃঃ)৭৬-১১১।
এবার উল্লিখিত ধারাওয়ারি বক্তব্যগুলোকে দলীলের সংক্ষিপ্ত সার হিসাবে পর্যালোচনা করুন এবং প্রতিটি অংশ নিয়ে ভাবুন যে রসূল সা. কত নৈপুন্য ও বিচক্ষণতার সাথে নিজের আদর্শকে মদিনার বহুজাতিক ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানের ভিত্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত সামরিক ও বিচার বিভাগীয় সকল দিক দিয়েই নিজের নেতৃত্ব ও কর্তত্বকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। কোরায়েশদের মোকাবিলা করা সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব স্থির করলেন এবং সবাইকে তা মেনে নিতে সম্মত করলেন। উপরন্তু বহু সংখ্যক সম্ভাব্য আশংকার পথ আগে ভাগেই রোধ করলেন। উল্লেখ্য যে, এই চুক্তি একটা সাংবিধানিক দলীলের মর্যাদা রাখতো। এতে সাক্ষরকারীদের কারো যখন ইচ্ছা এই চুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বা চুক্তি ভংগ করার অধিকার ছিলনা। এরূপ করলে তার সেই নাগরিক অধিকারই বিলুপ্ত হয়ে যেত, যা এই ইসলামী রাষ্ট্রের সীমার ভেতরে এই চুক্তির ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণে যে সব ইহুদী গোত্র পরবর্তীকালে এই চুক্তিকে সম্পূর্নরুপে পদদলিত করে, তাদের বিরুদ্ধে অবিকল সেই পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়, যা বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতকদের প্রাপ্য।
প্রসংগত এখানে এই দলীলের আলোকে হিজরত ফরয হওয়ার তাৎপর্য বুঝে নেয়া দরকার। মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি যে মুসলিম জাতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেই জাতি অধিকতর মজবুত হোক- এটাই ছিল হিজরত ফরয হওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য। এ কথা সত্য যে, আরবের গোত্রীয় ব্যবস্থায় বিক্ষিপ্তভাবে এখানে ওখানে দু-একজন করে মুসলমান পড়ে থাকলে তাদের পরিণতি এমনও হতে পারতো যে, কিছু কিছু প্রতিরোধ ও সংঘাত করার পর অবশেষে একদিন জাহেলী সমাজ ব্যবস্থায় বিলীন হয়ে যাবে অথবা যুলুম নির্যাতননের কবলে মারা পড়বে। এ কারণেও প্রত্যেক মুসলমানকে কুড়িয়ে এনে সংঘবদ্ধ করা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু এই সাথে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্যও সব জায়গা থেকে সকল বিচ্ছিন্ন মুসলমানের মদিনায় এসে সমবেত হওয়া জরুরী ছিল। পরে যখন এ দুটো প্রয়োজনের একটাও অবশিষ্ট রইলনা, তখন ঘোষণা করা হলো যে, “পূর্ন বিজয় অর্জিত হওয়ায় আর হিজরতের প্রয়োজন নেই।” অর্থাৎ সমগ্র আরব উপদীপ যখন ‘ইসলামের দেশ’ (দারুল ইসলাম) হয়ে গেল, মদিনার কর্তৃত্বের অধীন এসে গেল এবং ইসলাম গ্রহণকারীদের জন্য কোন এলাকাতেই কোন অবরোধ বা বাধাবিঘ্ন অবশিষ্ট থাকল না, তখন মদিনায় হিজরত করার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করা হলো।
এই চুক্তির ভিত্তিতে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো এবং মুহাম্মাদ সা. এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। প্রথমবারের মত মুসলমানরা পাঁচ হাজার লোক অধ্যুষিত একশো বর্গমাইল এলাকায় অবাধে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার সুযোগ পেল। সেখানে ইসলামের রাজনৈতিক ক্ষমতাও দাওয়াতের কাজে আপনা থেকেই সহায়ক ছিল। উপরন্তু ইসলামী সরকারের উপস্থিতি মুসলমানদের জন্য মদিনার আশপাশেও দাওয়াত বিস্তারের সহায়ক হলো।
৩. বিভিন্ন গ্রোত্রের সাথে চুক্তি
মাদিনাকে একটা রাজনৈতিক একক বানানো ও ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের চেষ্টার পাশাপাশি রসূল সা. আশপাশের গোত্রগুলোকেও সংঘবদ্ধ করতে সচেষ্ট হন। দু-তিনবার সাহাবায়ে কেরামের সমন্বয়ে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করলেন। হিজরতের দ্বাদশ মাসে অর্থাৎ সফর মাসে রসূল সা. সশরীরে ওয়াদ্দান (মদিনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে একটা জায়গা) গমন করেন। এখানে তিনি বনু হামযা বা বনু যামরা গোত্রের সাথে একটা চুক্তি সম্পাদন করেন। ঐ গোত্রের পক্ষ থেকে আমর বিন ফাহশী আয যামরী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। (ইবনে হিশাম,২য় খন্ড, পৃঃ ৪-২২৩; যাদুল মায়াদ ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৩৪ ; রহমাতুল্লিল আলামীন, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৮)।
এর আগে মোহাজেরদের একটা দল পার্শ্ববর্তী স্থান ‘ঈস’ পর্যন্ত গিয়েছিল এবং তাতে মৈত্রী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। (রসূলে আকরাম সা.কী সিয়াসী যিন্দিগী, ডঃ হামীদুল্লাহ সিদ্দীকী, পৃঃ ৩৫৯) তারপর ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে (হিজরতের ত্রয়োদশ মাস) রসূল সা. পুনরায় বুয়াত (ইয়ামবু এলাকায় জুহায়নার অন্যতম পাহাড়) এলাকা সফর করেন। এখানকার জনগণের সাথেও সফল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং মৈত্রীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। (রহমাতুল্লিল আলামীন,১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৯, যাদুল মায়াদ, পৃঃ ঐ) এরপর জমাদিউস সানীতে (ইয়ামবু এলাকার) যুল উশায়রা সফর করেন। সেখানে দীর্ঘদিন বনু মুদলাজ ও তাদের মিত্র বনু যামরার সাথে আলাপ আলোচনা চলে এবং তাদের সাথেও চুক্তি সম্পন্ন হয়। (ইবনে হিশাম,২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৯; রহমাতুল্লিল আলামীন,১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৯)।
পূর্বতন ঐতিহাসিকদের কারো কারো অভিমত হলো, এই সব চুক্তির ফলে এ সব গোত্র ও এলাকা প্রকৃতপক্ষে মদিনার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হয়েছিল। এর প্রমাণ হলো, ঐ সব চুক্তির কিছু কিছু অংশ এবং পরিভাষার সাংবিধানিক (অর্থাৎ মদিনা) চুক্তির সাথে মিল রয়েছে। কিন্তু জিরতের একবারে প্রাথমিক যুগ সম্পর্কে এ অভিমত যদি মেনে নাও নেওয়া হয়, তথাপি এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, পরবর্তীকালে জুহাইনা গোত্রের আগেই ইসলাম গ্রহণ করে। এক হাজার ব্যক্তির এক বিশাল প্রতিনিধি দল মদিনায় এসে রসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করে এবং সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। তারা বিভিন্ন যুদ্ধেও অংশ নেয়। এই গোত্রের বিভিন্ন শাখার সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের যোগাযোগের যে রেকর্ড রয়েছে, তা এরই প্রমাণ বহন করে। উদাহরণ স্বরূপ, বনুল জুরমযকে (জুহায়নার শাখা) রসূল সা. লিখিতভাবে শান্তি ও নিরাপত্তার সনদ প্রদান করেন। জুহায়নার অপর এক শাখা বনু শামাখ বা শাখকে তাদের পুরো এলাকা স্থায়ীভাবে জাইগীর হিসেবে বরাদ্দ করে দেন। অনুরুপভাবে আওসাজা বিন হারমাল জুহানীকেও তিনি তার বাসস্থান যুলমিররার নিকটে জাইগীর প্রদান করেন। আবু বসীর ও তার সাথীদের জন্য যখন হোদাইবিয়ার চুক্তির কারণে মদিনা যাওয়ার সুযোগ রইলনা, তখন তারা মক্কা থেকে হিজরত করে এই উপকুলীয় এলাকায় এসে ছিলেন। বিচিত্র নয় যে, আজুসার ন্যায় সরদারগণ তাদেরকে সাহায্য করতো এবং তারা স্থানীয় লোকদের সহায়তা নিয়েই কোরায়েশী কাফেলাগুলোর প্রতিরোধ করতো। (সিয়াসী জিন্দেগী, ডঃ হামীদুল্লাহ সিদ্দীকী)
সম্পর্কের আরো অগ্রগতি হলো এবং পারস্পরিক মেলামেশার কারণে দাওয়াতের কাজ অব্যাহত থাকলো। এর ফল দাড়ালো এই যে, গোত্রগুলো সামগ্রিক ভাবে ইসরামী আন্দোলনের নিশানাবাহী হয়ে গেল। উকবা জুহানীর ইসলাম গ্রহণের বিবরণ আমাদের জানা। রসূল সা. এর জীবনের শেষভাগে বনী জুরমুয, বনীল হারকা এবং আমর ইবনে মা’বাদের সাথে একটা নতুন শান্তি চুক্তি সাক্ষরিত হরো। এতে অন্যান্য মুসলিম গোত্রের ন্যায় শর্ত আরোপিত হলো যে, নামায ও যাকাত ঠিক মত আদায় করতে হবে। গনীমতের এক পঞ্চমাংশ যথারীতি দিতে হবে, ইসলাম বিরোধীদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে এবং ঋণের সুদ পরিত্যাগ করতে হবে। মদিনায় জুহাইনা গোত্রের নামে একটি মসজিদও নির্মিত হয়ে গিয়েছিল নবুয়তের যুগেই। এ থেকে বুঝা যায়, বিপুল সংখ্যক জুহায়না গোত্রীয় মুসলমান হয়ে মদিনায় এসেছিল।
যে ক’টি গোত্রের বিপুল সংখ্যক লোক অনেক আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল, বনু গিফার তাদের অন্যতম। এ গোত্রটি তার অন্যতম সদস্য ও আদর্শ যুবক আবু যর গিফারী দ্বারা প্রভাবিত হয়। বদর যুদ্ধের কাছাকাছি সময় তারা রসূল সা. এর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির মুল কথাটা ছিলঃ “তারা মুসলমান এবং তাদের দায় দায়িত্বও মুসলমানদের মতই।“ এই চুক্তির একাংশে যদিও এই গোত্রের অমুসলিম সদস্যদের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে, কিন্তু আমার মতে, এই গোত্র প্রকৃত পক্ষে মদিনার সামাজিক অবকাঠামোর অংশে পরিণত হয়েছিল। কাজেই তাদের এলাকাকে মদিনার আওতাধীন মনে না করার কোন কারণ নেই।
বনু যামরার এক শাখা বনুগিফার এবং আরেক শাখা বনু আবদ ইবনে আদী। এই শেষোক্ত গোত্র হারাম শরীফের সীমানার মধ্যেই বাস করতো। এই শাখা কোরায়েশদের সাথে বাধ্য হয়ে সমঝোতার সম্পর্ক বজায় রাখলেও মুসলিম সরকারের সাথে মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তোলে। শুধুমাত্র একটি বিষয় বাদে অন্য সব বিষয়ে তারা রসূল সা. এর সাথে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করে। বাদ যাওয়া বিষয়টি ছিল কোরায়েশদের সাথে যুদ্ধ করা।
বনু আশজা’ গোত্রটা ছিল বনু গিতফান গোত্রের একটা শাখা। তারাও বাণিজ্যিক মহাসড়কের সন্নিহিত অঞ্চলে বসবাস করতো। মহাসড়ক অবরুদ্ধ হওয়ার কারণে যখন কোরায়েশদের বাণিজ্যই থেমে গেল, তখন তাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হলো। কেননা এ সব গোত্র বাণিজ্যিক কাফেলাগুলোর সেবা করেই জীবিকা উপাজন করতো। অর্থনৈতিক সংকটে বাধ্য হয়ে তাদের প্রতিনিধিদল মদিনায় আসে। অতরপর খন্দক যুদ্ধের আগেই তারা ইসলাম গ্রহণ করে চুক্তি সাক্ষর করে। তাদের পক্ষ থেকে চুক্তিতে সাক্ষর করেন নঈম বিন মাসউদ। নঈম বিন মাসউদ খন্দক যুদ্ধের সময়ই ইসলামী আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হন। এই জন্যই চুক্তির সময় সমগ্র গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেনি। তবুও চুক্তির ভিত্তি কেমন ছিল, সেটা একটা বাক্য থেকেই বুঝা যায়। বাক্যটা হলোঃ
*********** “সাহায্য করা ও হিত কামনা করার ব্যাপক ভিত্তিক সম্পর্ক স্থাপিত হলো।” এই গোত্রের একটা শাখা বনু আমের কাফেলাগুলোর যাত্রা বিরতিতে সহায়তা করার বষিয়ে একচেটিয়া অধিকারের লাইসেন্স রসূল সা. এর কাছ থেকে লাভ করে। বনু আমের গোত্রের জনৈক সরদারকেও খন্দক যুদ্ধের আগে জায়গীর দেয়া হয়।
এবার উল্লেখ করবো খন্দক যুদ্ধের পর যে সব মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হয় তার কথা। খুযায়া গোত্রটা ইয়ামানের কাহতানের বংশধর ছিল এবং এর অনেক শাখা ছিল। মক্কার পাশে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করতো। একমাত্র বনুল মুসতালিক ছাড়া এ গোত্রের অধিকাংশ শাখা মুসলমানদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতো। এর অন্যতম কারণ ছিল, জনাব আব্দুল মুত্তালিব তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেন। এই গোত্র হোদাইবিয়ার চুক্তির সুযোগ গ্রহন করে প্রকাশ্যে কোরায়েশকে পরিত্যাগ করে মদিনার ইসলামী সরকারের সাথে মৈত্রী স্থাপন করে। এই মৈত্রীর সুবাদেই একদিকে এই গোত্র রসূল সা. কে আহযাব যুদ্ধ তথা খন্দক যুদ্ধের ব্যাপারে কোরায়েশদের প্রস্তুতির খবরাখবর জানায়। অপর দিকে রসূল সা. মক্কা বিজয়ের পূর্বে তাদেরকে একটা চিঠি দিয়ে আশ্বাস দেন যে, তাদের কোন অসুবিধা হবেনা। তিনি এই খবরও জানান যে, বনু কিলাব ও বনু হাওয়াযেন ইসলাম গ্রহন করেছে। কিন্তু সময় হওয়ার আগেই এই দুটি গোত্র বনু বকরের যুলুম নিপীড়নের শিকার হয় এবং এই যুলুম নিপীড়নই মক্কা বিজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
খুযায়া গোত্রেরই একটা শাখা ছিল বনু আসলাম। তাদের নামে রাসূল সা. এর প্রদত্ত যে নিরাপত্তা সনদ পাওয়া যায়, তা থেকে বুঝা যায়, তারা অপেক্ষাকৃত আগেই ইসলাম গ্রহন করেছিল এবং ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত হয়ে গিয়েছিল। এদের একাংশ মদীনায় হিজরত করে এসে বসতি স্থাপন করে। এদের সরদার আলহাসীন বিন আওসকে রসূল সা. জায়গীরও দিয়েছিলেন। এটা মৈত্রী সম্পর্কের দৃঢ়তারও প্রমাণ, আবার এ দ্বারা এটা মদীনার সাথে সংশ্লিষ্ট এলাকার সংযুক্তিও প্রমাণিত হয়।
তবুকের উত্তরাঞ্চলে জুযাম, কুযায়া ও আযরা নামক গোত্রগুলো বসবাস করতো, তারা তাদের বিরোধী তৎপরতা দ্বারা ইসলামী সরকারের জন্য বেশ খানিকটা সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। তারা মদীনার দূতের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল। তারপর তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহিত হয়। ভূলক্রমে কিছু নিরাপরাধ লোকও এই ব্যবস্থার কবলে পড়ে। তারা মদীনায় এসে ফরিয়াদ জানায় এবং তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। এভাবে সম্পর্কের পথও উন্মুক্ত হয়। রসূল সা. এর যে সব চিঠিপত্র পাওয়া গেছে, তার মধ্যে একটা রিফায়া বিন যায়দ জুযামীর নামে লিখিত। এতে অত্যান্ত কঠোর চরমপত্র দেয়া হয়েছে। এই সরদারকে সম্বোধন করে লেখা চিঠিতে তার পুরো গোত্রকে হুশিয়ারী প্রদান করা হয়েছে, হয় তারা ইসলামের দাওয়াতকে গ্রহন করে আল্লাহ ও রসূলের দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাক, নচেত দাওয়াত প্রত্যাখান করলে দু’মাস নিরাপদে জীবন যাপন করতে পারবে। পরিস্থিতি এভাবে গড়িয়ে শেষ পর্যন্ত যে আকার ধারণ করে তা ছিল এই যে, রসূল সা. তাবুক থেকে ফেরার পর ৯ম হিজরীতে মালেক বিন আমের জুযামী মদীনায় এসে রসূলের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং নিরাপত্তার সনদ লাভ করে। এই সনদে শুধুমাত্র মুসলিম গোত্রগুলোর উপযোগী শর্তাবলীর উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ তারা ইসলাম গ্রহন করেছিল। অনুরূপভাবে কুযায়া গোত্রের জনৈক সরদার বারীদা বিন আলখাসীর কোন এক অভিযান কালে রসূল সা. এর সাথে মদীনার বাইরে দেখা করে এবং রসূল সা. এর কাছে নিজ গোত্রের ইসলাম গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিরাপত্তা সনদ অর্জন করে।
৬ষ্ঠ হিজরীতে কালব গোত্রের কাছে রসূল সা. আব্দুর রহমান বিন আওফকে একটা দাওয়াতী অভিযানে পাঠান। এর ফল যেমন আশা করেছিলেন, তেমনই হয়েছিল। ঐ গোত্রের সরদার নিজের আনুগত্য প্রকাশ ও সম্পর্ক স্থিতিশীল করার মানসে নিজ কন্যাকে আব্দুর রহমান বিন আওফের সাথে বিয়ে দেন। একইভাবে রসূল সা. দুমাতুল জুনদুলের আশেপাশের মালব গোত্রের নও মুসলম সরদার হারেসা বিন বুতুনের নামেও একটা নিরাপত্তা সনদ জারী করেন। দুমাতুল জুন্দুলের শাসক উকাইদিরের সাথেও শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। তবে সে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, না ইসলাম গ্রহণ ছাড়াই জিজিয়া দিতে সম্মত হওয়ায় সরদারীতে বহাল থাকতে পেরেছিল, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অবশ্য পরবর্তীতে সে বিদ্রোহী হয় এবং হযরত খালেদের হাতে নিহত হয়। পরে তার দূর্গ ও জমি উক্ত কালবি সরদার হারেসা বিন কুতুনের কর্তৃত্বে সমর্পণ করা হয়।
তায়েফবাসীর সার্বজনীন ইসলাম গ্রহণের পূর্বে সারদ বিন আব্দুল্লাহ ইয়ামানী ইসলামী আন্দোলনে যোগদান করে। রসূল সা. তাকে ঐ অঞ্চলে সামরিক তৎপরতা পরিচালনার জন্য সেনাপতিত্ব প্রদান করেন। রসূল সা. এর অনুমতিক্রমে সে জারাসের দূর্গ অবরোধ করে। এই অবরোধের ফলে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং আবু সুফিয়ানকে তায়েফের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।
ওমান নগরীতে বসবাসকারী গোত্র বনু ইজদের কাছে রসূল সা. এর দাওয়াতী চিঠি নিয়ে ৮ম হিজরীতে যান আমর ইবনুল আ’’স। ওবায়েদ এবং জাফর নামক দুই ব্যক্তি তাদের সরদার ছিল। বনু ইজদ ইসলাম গ্রহণ করে।
ব্যাপকভাবে প্রতিনিধি দল আগমনের বছর যে সব গোত্র স্বেচ্ছায় প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে অথবা কমের পক্ষে মদীনার সরকারের আনুগত্য অবলম্বন করে, সে সব গোত্রের সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করব।
এ ছাড়া সামরিক অভিযানের ফলে যেখানে কোন গোষ্ঠী আনুগত্য বা সন্ধি করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, সেখানে তাৎক্ষনাত সে সুযোগ দেয়া হয়েছে। মদীনার রাষ্ট্রের স্থায়ী নীতি এই যে, যুদ্ধরত কোন ব্যক্তি যখনই সন্ধির আকাংখা ব্যক্ত করবে, তখনই তার ইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে। একাধিক গোত্র যুদ্ধের ময়দানে নামার পর হয় রাজনৈতিক বশ্যতা ও অধীনতা মেনে নিয়েছে, নতুবা ইসলাম গ্রহণ করেছে। খয়বর ও সন্নিহিত এলাকার অধিবাসী ইহুদীদের ঘটনা এ প্রসংগে উল্লেখযোগ্য। তারা বিজিত হবার পর যখন ওখানেই থাকতে চাইল, তখন শর্ত স্থির করে থাকতে দেয়া হলো।
এই সমস্ত ঘটনা পর্যালোচনা করলে স্বীকার না করে উপায় থাকেনা যে, সংঘর্ষ এড়িয়ে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তোলা মদীনা সরকারের কর্মকান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি ছিল। এ জন্য একটি বিভাগ ছিল। রসূল সা. ও তাঁর সাথীরা এই বিভাগের জন্য বহু তৎপরতা চালান ও সফর করেন। এসব তৎপরতা ইসলামী রাষ্ট্রের শান্তপ্রিয় দৃষ্টিভঙ্গির জ্বলন্ত প্রমাণ। তা ছাড়া এ ব্যাপারে একটা আদর্শবাদী রাষ্ট্রের দাবী ও চাহিদা জানা থাকা সত্ত্বেও রসূল সা. নীতি নির্ধারণে এত উদারতা দেখিয়েছেন যে, যে সকল গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেনি তাদের পক্ষ থেকে শুধু রাজনৈতিক মৈত্রীও মেনে নিয়েছেন। আর একাধিক ক্ষেত্রে অমুসলিম শাসক বা সরদারদেরকে নিজের পক্ষ থেকে নিযুক্ত করেছেন বা স্বপদে বহাল রেখেছেন। এর উদ্দেশ্যও এটাই ছিল যে, সংঘাতের সম্ভাবনা যেন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়। পরে অবশ্য অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যে, অন্তত পক্ষে যে জমিটুকু ইসলামী আন্দোলনের মূল আবাসভূমির পর্যায়ে আছে, তার পারিপাশ্বিকতাকে পবিত্র ও শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য তাকে বিরোধী লোকজন থেকে মুক্ত করতে হবে। নচেত তাদের বিশ্বাসঘাতকতা সর্বনাশ ঘটিয়ে ছাড়বে।
যে মৈত্রী সম্পর্কগুলোর বর্ণনা দেয়া হলো, তার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলাম যেখানেই পৌঁছেছে, সেখান থেকেই মদীনার রাষ্ট্র আপনা থেকেই রাজনৈতিক আনুগত্য লাভ করেছে। অনুরূপভাবে, যেখানেই রাজনৈতিক মৈত্রীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানেও অনতিবিলম্বেই ইসলামের পতাকা উড্ডিীন হয়েছে। এর কারণ স্পষ্ট। গোত্রগুলো যখন মদীনার মুসলমানদের সাথে বেশী করে মেলমেশার সুযোগ পেয়েছে, তখন তারা ইসলামী জীবন বিধানের চমকপ্রদ বৈশিষ্ট স্বচোক্ষে দেখে অভিভুত হয়ে গেছে, আর ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরাও তাদের মধ্যে দাওয়াতী কাজ করার জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পেয়েছে। ধর্ম ও রাজনীতি এই ঐক্যের কারণেই দশ বারো লাখ বর্গমাইল এলাকাকে মাত্র কয়েক বছরে ইসলামের রঙে রঞ্জিত করা সম্ভব হয়েছে।