নতুন মানুষ
অসংখ্য সংস্কারমূলক ,গঠনমূলক ও বৈপ্লবিক আন্দোলনের নজীর আমাদের সামনে রয়েছে। কিন্তু এর কোন একটি আন্দোলনই মানুষকে বদলায়নি। প্রতিটি আন্দোলনই যেমন আছে তেমন রেখে শুধু বাইরের পরিবেশটা বদলাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এমন প্রতিটা পরিবর্তন মানবজীবনের সমস্যাবলী সমাধানে একেবারেই ব্যর্থ হয়ে গেছে, যা মানুষের ভিতর থেকে পরিবর্তন আনতে পারেনি। বিশ্বনবী সাঃ এর কৃতিত্বের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো, মানুষ ভিতর থেকে বদলে গিয়েছিলো। শুধু বদলে যায়নি বরং তার জীবনে সংঘটিত হয়েছিল আমূল পরিবর্তন। মানুষের আকৃতিতে যে প্রবৃত্তি পূজারী পশুরা ঘুরে বেড়াত, একটি মাত্র কলেমার প্রভাবে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। সাথে সাথে তাদের ধ্বংস স্তূপ থেকে আবির্ভূত হোল আল্লাহভক্ত একদল সৎ মানুষ। এই নতুন মানুষের চরিত্রের ঔজ্জ্বল্য দেখলে চোখ ঝলসে যায়। হযরত ওমর(রাঃ), যিনি ছিলেন মক্কার এক উচ্ছৃংখল মদখোর যুবক – তাঁর জীবনে যখন পরিবর্তন এলো তা ভেবে দেখুনতো। ফুযালার মধ্যে যখন পরিবর্তন এলো, তখন সেটাইবা কেমন অভাবনীয় পরিবর্তন ছিল ভাবুনতো! যুল বিজাইদানকে দেখুন, কিভাবে নিজের বিলাসি জীবনের মুখে পদাঘাত করে দরবেশের জীবন যাপন করতে শুরু করলেন। হযরত আবু যরকে দেখুন, কি বিপ্লবী উদ্দীপনায় উজ্জীবিত হয়ে কা’বার সামনে দাঁড়িয়ে জাহেলিয়াতকে চ্যালেঞ্জ করলেন এবং গণপিটুনি খেলেন। কা’ব ইবনে মালেক ও আবু খাসিমার অবস্থা দেখুন। লুবাইনা ও সুমাইয়ার মতো ক্রীতদাসির বৈপ্লবিক বীরত্ব ও মনোবল দেখুন। মাগের বিন মালেক আসলামি ও গামেদি গোত্রের মহিলাটির দিকে লক্ষ্য করুন। নাজ্জাশীর দরবারে জাফর তাইয়ারের বীরত্ব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। ইরানী সেনাপতির দরবারে রবি’ বিন আমেরের বেপরোয়া আলাপচারিতা থেকে প্রেরণা অর্জন করুন। নক্ষত্ররাজির এই সমারোহের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে ঈমানী জ্যোতিতে ঝিকমিক করছেনা?
এহেন ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়েই সেই গোটা সমাজটা গড়ে উঠেছিলো এবং এহেন নেতা কর্মীদের নিয়েই সেই সৎ ও সত্যনিষ্ঠ রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, যার প্রতিটি নির্দেশ জারি হওয়া মাত্রই বাস্তবায়িত হতো। এদিকে মদ খাওয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, ওদিকে তৎক্ষণাৎ ঠোঁটে লাগানো পানপাত্র পর্যন্ত দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে এবং উৎকৃষ্ট মানের মদের মটকা ভেঙ্গে রাজপথ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে নারীদের মাথা ও বুক ঢাকার নির্দেশ জারি হয়েছে , ওদিকে তৎক্ষণাৎ ওড়না বানিয়ে ব্যবহার করা শুরু হয়ে গেছে। এদিকে জেহাদের ডাক এসেছে, ওদিকে সঙ্গে সঙ্গেই অল্প বয়স্ক কিশোর পর্যন্ত পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে নিজের জেহাদে যাওয়ার যোগ্যতা প্রমান করার চেষ্টা শুরু করেছে। এদিকে জেহাদের জন্য সাহায্য চাওয়া হয়েছে, ওদিকে ওসমানের ন্যায় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পন্য বোঝাই গোটা উটের বহর এনে হাজির করেছেন, হযরত আবু বকরের ন্যায় ত্যাগী ব্যক্তিগণ গৃহের যাবতীয় সহায় সম্বল আন্দোলনের নেতার সামনে স্তূপ করে রেখে দিয়েছেন এবং এমনকি এক একজন দিন মজুর সারাদিনের শ্রমের মজুরী বাবদ প্রাপ্ত খেজুরগুলো এনে ঢেলে দিয়েছে। এদিকে মোহাজেরদের পুনর্বাসনের জন্য আনসারদের কে সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছে, ওদিকে তার সাথে সাথেই আনসারগণ নিজেদের ঘরবাড়ী, ক্ষেতখামার ও বাগবাগিচা আধা আধি বন্টন করে ভ্রাতৃত্বের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যখন দায়িত্বশীল পদ গুলোতে চাকুরির মনোভাবের উর্দ্ধে উঠে কাজ করার জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারিগণ কে আহ্বান করা হয়েছে, তখন দৈনিক এক দিরহাম ভাতার বিনিময়ে প্রাদেশিক শাসনকর্তার দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সেনাপতির কাছে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তখন তা এমন নিখুঁত ভাবে করা হয়েছে যে, প্রত্যেক সৈনিক একটা সূচ পর্যন্ত নিজ নিজ সেনাপতির কাছে জমা দিয়েছে। ইতিহাসে এ ঘটনা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে যে, মাদায়েনের যুদ্ধলব্ধ সম্পদের একটা অমূল্য রত্ন আমের নামক একজন সিপাহীর হস্তগত হলে তিনি তার কথা ঘুনাক্ষরেও কাউকে জানতে না দিয়ে রাতের আঁধারেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গোপনে নিজ সেনাপতির কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এই সব লোকই সেই পুত পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, যেখানে অপরাধ ছিল অত্যন্ত বিরল ঘটনা। রসূল সাঃ এর মক্কী জীবনের পুরো এক দশকে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র অভিযোগ আদালতে এসেছিল। এটি ছিল এমন এক নির্মল নিষ্কলুষ সমাজ, যেখানে কোন গোয়েন্দা পুলিশ নিয়োগ করা হয়নি, বরং মানুষের বিবেকই তাদের প্রহরী ও তত্বাবধায়ক রুপে নিয়োজিত ছিল। এই ছিল মুহাম্মদ সাঃ এর বিপ্লব। এ বিপ্লব শুধু বাইরের পরিবেশই বদলে দেয়নি বরং ভেতর থেকে মনমগজকেও পাল্টে দিয়েছে এবং নতুন চরিত্র গড়ে তুলেছে। তাই এই বিপ্লব ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের সমস্ত মৌলিক ও প্রকৃত সমস্যা সমাধানে সফল হয়েছে এবং এর মাধ্যমে সমকালীন সভ্যতার সংকট থেকে মুক্তির পথ সৃষ্টি হয়।
বিশ্বনবীর অসাধারণ আত্মত্যাগ
এ বিপ্লব আরও এক দিক দিয়ে নজিরবিহীন। সেটা হোল, যিনি এই বিপ্লব সংঘটিত করেছিলেন, তিনি যদিও অবর্ণনীয় ত্যাগ ও কুরবানীর বিনিময়ে পূর্ণতা সাধন করেছিলেন, কিন্তু তিনি এর জন্য কোনও পুরষ্কার ও প্রতিদান গ্রহণ করেননি। মানবতার কল্যানের জন্য নিজের সমস্ত সহায় সম্বল অকাতরে বিলিয়ে দিলেন, অথচ তার বিনিময়ে যতটুকু প্রতিদান গ্রহণ করা যুক্তি, আইন, নৈতিকতা ও সমাজরীতি – কোন দিক দিয়েই অন্যায় বা অবৈধ হতো না ,ততটুকু ও গ্রহণ করলেন না। এতবড় কীর্তি ও অবদান রাখার পর সামান্য কিছু বিনিময় গ্রহণ করলে স্বার্থপরতার বিন্দুমাত্র কলঙ্কও তাঁকে স্পর্শ করতোনা। তবু তিনি তা গ্রহণ করলেন না। এমন ত্যাগের তুলনা কোথাও আছে কি? প্রথমে অর্থনৈতিক দিকটি বিবেচনা করা যাক। রসূল সাঃ নিজের লাভজনক ব্যবসা বানিজ্য কুরবানী করলেন, তা থেকে উপার্জিত সমস্ত পুঁজি এই মহৎ কাজের জন্য উৎসর্গ করলেন। আর যখন সাফল্যের যুগ এলো , তখন অঢের ধন সম্পদ স্বহস্তে বিলি বন্টন করলেন এবং নিজের জন্য ক্ষুধা দারিদ্র ও অনাড়ম্বর জীবন বেছে নিলেন। নিজের পরিবার পরিজনের জন্য একটু সঞ্চয় ও রেখে গেলেন না, এক টুকরো জমিও রেখে গেলেন না, তাদের কোন অর্থনৈতিক অধিকার ও প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন না, তাদের জন্য উত্তরাধিকার সুত্রে কোন স্থায়ী ক্ষমতার গদি রেখে গেলেন না এবং চাকর নকর, পাইক পেয়াদা, রঙ বেরঙের বাহন জন্তু ও বিলাসী সামগ্রী দিয়ে বাড়ী ভরে তুললেন না।
রাজনৈতিক দিক দিয়ে দেখলে দেখা যায় , তিনি নিজের জন্য কোন অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করেননি, কারো বিরুদ্ধে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘন করে কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করেননি, এবং নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তিকে উঁচু করে তুলে ধরার জন্য স্বৈরাচারী আইন জারি করেননি। মদীনায় সবসময় তীব্র উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করতো। ইহুদী ও মোনাফেকদের নিত্য নতুন চক্রান্তের মোকাবেলা করতে হতো। তবুও কাউকে তিনি গ্রেফতার করেননি। কারো চলাফেরার উপর বিধি নিষেধ আরোপ করেননি। ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণকারী কোন আদেশ জারি করেননি। কোন সংক্ষিপ্ত আদালত বসাননি। আর বেত্রাঘাত করেও কারো চামড়া খসাননি। বরঞ্চ মানুষকে সমালোচনা করার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছেন, ভিন্ন মতো অবলম্বনের স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং তাঁর মহৎ পরামর্শকে গ্রহণ না করারও অধিকার দিয়েছেন। এসব অধিকার কেবল কাগুজে অধিকার ছিলনা। লোকেরা এসব অধিকারকে বাস্তবে প্রয়োগ করেছে। অনেক সময় রসূল সাঃ নিজের মূল্যবান মত পরিত্যাগ করে ভিন্ন মতকে গ্রহণ করে নিয়েছেন। কাউকে কোন স্বতন্ত্র সুযোগ সুবিধা দিতে চাইলে নিজের সহযোগীদের কাছে অনুমতি চেয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে নিজের জামাই আবুল আস যুদ্ধবন্দী হয়ে এলে তার মুক্তিপণ হিসেবে যয়নব যে হার পাঠান, তা ছিল হযরত খাদিজার (রাঃ) স্মৃতি। ঐ হার ফেরত দেয়ার জন্য রসূল সাঃ সাহাবায়ে কেরামদের অনুমতি চান। অনুরূপভাবে আবুল আসের জিনিস পত্র গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী) হিসেবে হাজির করা হলে তাও তিনি সাহাবাদের অনুমতি নিয়ে ফেরত পাঠান। জা’রানা নামক স্থানে হোনায়েনের যুদ্ধবন্দীদেরকে মুক্ত করার আবেদন জানাতে একটি প্রতিনিধি দল এল এবং রসূল সাঃ এর দূর সম্পর্কের আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে আবেদন জানালো। ততক্ষনে যুদ্ধবন্দীদের ভাগ বাটোয়ার সম্পন্ন হয়ে গেছে। রসূল সাঃ নিজ গোত্র বনু হাশেমের অংশের বন্দিদের মুক্তি দিতে সম্মত দিলেন। কিন্তু অবশিষ্টদের সম্পর্কে বললেন যে, সাহাবাদের প্রকাশ্য সমাবেশে তোমরা আবেদন জানাও। সাহাবাগণ যখন জানতে পারলেন রসূল সাঃ নিজ গোত্রের অংশের বন্দীদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন, তখন সবাই বন্দীদেরকে ছেড়ে দিলো। এরূপ ক্ষেত্রে তিনি কখনো চাপ প্রয়োগ বা জবরদস্তিমূলক ভাবে কাজ সম্পন্ন করতেন না।
সামাজিক ও বৈঠকি দিক দিয়ে দেখা যায়, তিনি নিজের জন্য সমানাধিকারই পছন্দ করতেন। কোন স্বতন্ত্র মর্যাদা পছন্দ করতেন না। পানাহার, পোশাক পরিচ্ছেদ ও বাসস্থানে নিজের জন্য কোন অসাধারণ বা অভিজাত সুলভ স্বাতন্ত্র সৃষ্টি করেননি। মজলিসে নিজের বসার জন্য কোন স্বতন্ত্র জায়গাও তিনি মনোনীত করেননি। লোকেরা তাঁর সামনে ভক্তি ভরে উঠে দাঁড়াক, কিংবা প্রভু বা স্যার ইত্য্যাদি বলে সম্বোধন করুক তাও তাঁর মনোপুত ছিলনা। যুদ্ধ কালে ও প্রবাসে ট্রেঞ্চ খনন ও মসজিদ নির্মানের জন্য সঙ্গীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাটি কাটা , মাটি তোলা , পাথর ভাঙ্গা ও কাঠ চেরাইয়ের কাজ তিনি স্বহস্তেই করতেন। পাওনা পরিশোধের জন্য তাঁর উপর কঠোর ভাষা প্রয়োগ করতে ঋণ দাতা যাতে কুন্ঠিত না হন, সে জন্য তাকে তিনি অনুমতি দিতেন। এমন কি প্রকাশ্য জনসমাবেশে নিজেকে প্রতিশোধ গ্রহনের জন্য উপস্থাপন করেন এবং বলেন, আমি কারো উপর কোন জুলুম করে থাকলে সে যেন এসে আমার কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।
আমাদের অবস্থান কোথায়?
এই ছিল রসূল সাঃ এর সূচিত মহান বিপ্লব। আমাদেরকে এই বিপ্লবেরই প্রহরী ও তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়েছে। এটি ছিল সেই মহান বাণী, যার জন্য আমাদেরকে ‘মানবজাতির’ কাছে ‘সাক্ষী’ এবং ‘মধ্যমপন্থী উম্মাহ’ বানানো হয়েছে। এ পদটা হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ পদ। এই ছিল সেই সত্য কালেমা, যার দায়িত্ব আমাদের ঘাড়ে ন্যস্ত করা হয়েছে। ন্যস্ত করার উদ্দেশ্য রসূল সাঃ এর প্রতিনিধি হিসেবে আমরা যেন কেয়ামত পর্যন্ত মানবতার মুক্তিদূত হই। যখনই মানব জীবন সমস্যা ও সংকটে পতিত হবে এবং মানব সভ্যতা ঘোরতর অরাজকতার কবলে নিক্ষিপ্ত হবে, তখন যেন আমরা তার সহায়ক হই। কিন্তু কার্যত আমরা তা হতে পারিনি। এই সত্য কলেমার মশাল প্রজ্জ্বলিত রাখতে আমরা উদাসীনতা দেখিয়েছি এবং আমরা নিজেদের হাতেই এই সত্য বিধানের সর্বনাশ সাধন করেছি। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, এ যুগের চিন্তাশীল মহল যখন বিপথগামী হতে আরম্ভ করলো, তখন আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করার যোগ্য থাকলাম না। আর আজ আমাদেরই অযোগ্যতা ও অক্ষমতার কারণে গোটা মানবজীবন সংকট ও অরাজকতার শিকার। পরস্পর বিরোধী বস্তুবাদী মতবাদ সমূহের সৃষ্ট দ্বন্দ্ব সংঘাত বিশ্ববাসীর মানসিক শান্তি বিনষ্ট করে চলেছে। বিশ্ব নেতৃত্ব আল্লাহ বিমুখ শক্তির হাতে নিবদ্ধ এবং আমরা এখন এই সব শক্তিরই মুখাপেক্ষী হয়ে গিয়েছি। প্রতিকূল অবস্থার সাথে প্রতিনিয়ত ঠোকর খেয়েও আমরা সম্বিত ফিরে পাইনি। ক্রমাগত অবমাননা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েও আমাদের মধ্যে অনুতাপ ও অনুশোচনার সৃষ্টি হয়নি। মুসলিম বিশ্বের কলহ কোন্দল ও বিবাদ বিসম্বাদ এবং মানবতার শোচনীয় দুর্যোগ দুর্বিপাক দেখেও আমরা এই আসল করণীয় কাজটির প্রতি মনোযোগী হতে পারিনি।
আসুন বিচার বিবেচনা করে দেখি, মানব জাতি এখন ইতিহাসের কোন্ স্তর অতিক্রম করছে এবং আমাদের অবস্থানটা কোথায়?
আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনকালে নিজেকে, নিজের সন্নিহিত পরিবেশের মানুষকে এবং গোটা দুনিয়ার মানুষকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে এক ধরণের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা, সংকট ও ভীতি জনিত পরিস্থিতির শিকার দেখতে পেয়েছি। গৃহ থেকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ পর্যন্ত সর্বত্র অন্যের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ, উত্তেজনা, অবনিবনা, দ্বন্দ্ব কলহ, ও সংঘাতের পরিবেশ বিরাজ করতে দেখেছি। এই গোটা সময়টা জুড়ে আমার মনে হয়েছে যেন ইতিহাস জ্বলন্ত চুলোর ওপরের ফুটন্ত হাড়ির ন্যায় ক্রমাগত উদ্বেলিত হচ্ছে। এই হাড়িতে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ন্যায় আমিও যেন একটা ক্ষুদ্র চাল বা ডালের ন্যায় ওলট পালট হচ্ছি। আমাদের এই পৃথিবী পর পর দুটো বিশ্ব যুদ্ধে পিষ্ট হয়ে এবং অসংখ্য আঞ্চলিক যুদ্ধে দলিত মথিত হয়ে এখনো সামলে উঠতে পারেনি। অথচ আরো একটা প্রলয়ংকারী যুদ্ধের তরবারী তার মাথার ওপর ঝুলছে। এই ক্ষুদ্র সময়ে কত যে ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা চোখে পড়লো, কত যে অভ্যুত্থানের প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে যেতে দেখলাম, কত যে সম্রাজ্যের পতন ও আবির্ভাব ঘটতে দেখলাম, কত যে মতবাদের সংঘাত, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত হতে দেখলাম, কত দেশ ও অঞ্চলকে খন্ড বিখন্ড হতে এবং লক্ষ কোটি জনতাকে বাস্তুচ্যুত হতে দেখলাম,তার ইয়ত্তা নেই। খোদ এই উপমহাদেশে স্বাধীনতার ঊষালগ্নে মাথার ওপর দিয়ে রক্তের সয়লাব বয়ে যেতে দেখেছি, আর এই সয়লাবে মানুষের জানমাল সম্ভ্রম এবং মূল্যবান ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে ভেসে যেতে দেখেছি।
বিশ্বব্যাপী চলমান জড়বাদী সভ্যতার জমকালো পর্দার আড়ালে উঁকি দিয়ে দেখলে মানবতার এমন শোচনীয় দৃশ্য চোখে পড়ে যে, মানুষ মাত্রেরই আত্মা কেঁপে ওঠে। সমগ্র মানবজাতি গুটিকয় কামনা বাসনার অক্টোপাস বন্ধনে আবদ্ধ। সর্বত্র সম্পদ ও গদির জন্য যুদ্ধ চলছে। মনুষ্যত্বের নৈতিক চেতনার দীপ শিখা নিভে গেছে। নগর সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে অপরাধ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। মনস্তাত্বিক অস্থিরতা প্রবল হয়ে উঠেছে এবং মানসিক শান্তি একেবারেই উধাও হয়ে গেছে। মানুষের মনমগজে ও চরিত্রে এমন মৌলিক বিকৃতি জন্ম নিয়েছে যে, জীবনের কোন দিক এ ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। দর্শন থেকে সত্যের প্রাণশক্তি বেরিয়ে গেছে। আকীদা বিশ্বাস ও মতাদর্শগুলো ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলোর বিলুপ্তি ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় আইন কানুনে ন্যায় বিচারের অস্তিত্ব নেই। রাজনীতিতে সেবামূলক মানসিকতার পরিবর্তে স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা ঢুকে পড়েছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে শোষক ও শোষিত নামে দুটি শ্রেণী জন্ম নিয়েছে। ললিত কলায় সৌন্দর্যের যে সব বিচিত্র প্রকাশভংগি রয়েছে, তার সবগুলোকে যৌন সুড়সুড়ি ও অরুচিকর ভাবভংগি দিয়ে ভরে তোলা হয়েছে। সভ্যতার জগতে সর্বত্র পরস্পর বিরোধিতা ও সংঘাত বিরাজ করছে এবং গোটা ইতিহাস একটা ভয়াল নাটকে পরিণত হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তির প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিমানদের নির্বুদ্ধিতা এখনো আমাদেরকে নিদারুণ কষ্ট দিয়ে চলেছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের কত নতুন নতুন শাখা আবিস্কৃত হচ্ছে। কিন্তু এর লালিত অজ্ঞতা ও মূর্খতা আদম সন্তানকে অতিষ্ট করে তুলেছে। অঢেল ধন সম্পদ চারদিকে ছড়িয়ে আছে। অথচ মানুষ ক্ষুধা ও বঞ্চনার আযাব ভোগ করে চলেছে। হাজারো রকমের সংগঠন, রাজনৈতিক সংস্থা, আদর্শগত ঐক্য ও চুক্তিভিত্তিক বন্ধন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক নেই, আছে কেবল হিংস্র জন্তু সুলভ সম্পর্ক। বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার উন্নয়নের পক্ষে অনেক গালভরা বুলি আওড়ানো হয়। অথচ নির্যাতন ও নিপীড়নের চরম হঠকারী ও ঘৃণ্য কৌশল মানব জাতির বিরুদ্ধে আজও বাস্তবায়িত হচ্ছে। গোটা পৃথিবী আজ এক মল্লযুদ্ধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কোথাও সাম্রাজ্যবাদ ও স্বাধীনতা প্রেমিকদের মধ্যে, কোথাও কম্যুনিজম ও পুঁজিবাদের মধ্যে, কোথাও গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে, কোথাও ব্যক্তি ও সামষ্টিকতার মধ্যে এবং প্রাচ্যবাদ ও পাশ্চাত্যবাদের মধ্যে ঘোরতর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে।
এহেন পৃথিবীতে আমরা জীবন যাপন করছি। কৃত্রিম উপগ্রহ ও ক্ষেপণাস্ত্রের এই যুগে বিজ্ঞান আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের আজ্ঞাবহ জিনের মত মানুষের এক এক ইশারায় বস্তুগত শক্তি নতুন নতুন ভান্ডার প্রতিনিয়ত সরবরাহ করে চলেছে। স্মরণাতীত কাল থেকে অর্গলবদ্ধ প্রকৃতির গুপ্ত রহস্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চাবি দিয়ে উন্মোচিত হচ্ছে। বিস্ময়কর দ্রুতগতি সম্পন্ন যানবাহন ও যোগাযোগ যন্ত্র মানুষকে স্থান ও কালের ওপর ব্যাপকতার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিচ্ছে। আনবিক শক্তি সর্বনাশা দানবদের এক বিরাট বাহিনীকে বশীভূত করে মানুষের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখছে। তারা কেবল একটা চোখের ইশারার অপেক্ষায় রয়েছে। অপর দিকে স্বয়ং মানুষের অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে, সে শয়তানী শক্তি ও নাশকতাবাদী শক্তি সমূহের মুঠোর মধ্যে আগের চেয়েও বেশি অসহায় অবস্থায় রয়েছে। এই শক্তিগুলো তাকে বারবার নিজেরই বিরুদ্ধে লড়াই করতে উস্কে দিয়ে আসছে। এসব শক্তি যুগে যুগে তার বড় বড় কীর্তিগুলোকে এবং তার চমকপ্রদ সভ্যতাগুলোকে স্বয়ং তারই হাত দিয়ে ধ্বংস করিয়ে ছেড়েছে।
এমন একটা কাফেলার কথা কল্পনা করুন, যে কাফেলা একটা পাহাড়ের চূড়ার ওপর শিবির স্থাপন করেছে। জমকালো শামিয়ানার নীচে তারা পাহানারে, নাচগানে ও মদ্যপানে বিভোর। অধিকন্তু তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্যিক পণ্য, নগদ অর্থ, যানবাহন ও গবাদিপশুও রয়েছে। অথচ তাদের শিবিরের মেঝের মাত্র কয়েক ফুট নীচে এক ভয়ংকর আগ্নেয়গিরি লাভা উদগীরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু পরেই গোটা পাহাড় বিস্ফোরিত হবে এবং দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে সব কিছুকে ভস্মীভূত করে দেবে। আমাদের বর্তমান সভ্যতার কাফেলাটির অবস্থা অনেকটা এ রকম। ইতিহাসের বর্তমান পর্যায়ে যে পাহাড়ের ওপর তার অবস্থান, তার অভ্যন্তরে সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট ও দুর্যোগের লাভার উদগীরণ আসন্ন।
অদৃষ্ট আমাদেরকে এক বিরাট বিশ্ব সংকটের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে। এ সংকট থেকে পাশ কাটিয়ে পেছনে পালানোর সুযোগ নেই। আর এ চ্যালেঞ্জের জবাব দেয়ার যোগ্যতাও বর্তমান সভ্যতার ও তার নির্মিত মানুষের নেই। নতুন কোন দর্শনেরও উদ্ভব হচ্ছে না, যা অন্তত সাময়িক সান্ত্বনার উপায় হতে পারে। কোন দিকেই কোন পথ উন্মুক্ত হবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
অস্থিরতার এই ক্রান্তি লগ্নে আমি যখন চার দিকে দৃষ্টি দিই, তখন দেখি অন্ধকারের এক অথৈ সমুদ্র সর্বদিক থেকে আমাকে ঘেরাও করে রেখেছে। এই মহা সমুদ্রে অনেক দূরে, চৌদ্দ শো’ বছরের দূরত্বে, একটা উজ্জ্বল আলোর বিন্দু জ্বল্ জ্বল্ করতে দেখতে পাই।
এটা আর কিছু নয়-মানবতার সবচেয়ে বড় বন্ধু, সবচেয়ে বড় অনুগ্রাহক, এবং সবচেয়ে বড় ত্রাণকর্তা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর মশাল। এটা সেই প্রদীপ যার জ্যোতিকে আমরা তাঁর উম্মাত হয়েও নিজেদের উদভ্রান্ত চিন্তা ও উচ্ছৃংখল কর্মের আবর্জনার মধ্যে হারিয়ে বসে আছি।
সীরাত অধ্যয়নের দৃষ্টিভংগি
আমার মতে, রসূল সা. এ জীবনী অধ্যয়নের উদ্দেশ্য একটাই। সেটি হলো, রসূলের সা. বাণীর মশাল আর একবার আমাদেরকে ও সমগ্র বিশ্ববাসীকে আলোকিত করুক। মানব সমাজ এ যুগের অন্ধকারের মধ্যে সেই মুক্তিরে পথের সন্ধান পাক, যেমন পেয়েছিল খৃষ্ঠীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর সংকট উত্তরণের পথ।
দুর্ভাগ্যবশত, আমরা এই ইপ্সিত দৃষ্টিভংগী ও প্রেরণা নিয়ে রসূল সা. এর জীবনী অধ্যয়ন করতে খুব কমই সফল হচ্ছি। রসূলের জীবনী থেকে জীবন যাপনের একটা পদ্ধতি খুঁজে নিয়ে তদনুসারে জীবনকে গড়ে তুলতে হবে-এরূপ মনোভাব দ্বারা আমরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছি না; বরং এর মাঝে অন্যান্য মনোভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং তা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
এমন মুসলমানদের সংখ্যা নেহাত কম নয় যারা শুধু সওয়াব হাসিল করার জন্যই সীরাত তথা রসূলের সা. জীবনী চর্চার আগ্রহ পোষণ করে থাকে। (অবশ্য রসূল সা. এর নৈকট্য অর্জনের প্রতিটি চেষ্টাই যে আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং তার জন্য সওয়াব পাওয়ার আশা করা উচিত, তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এ ধরণের প্রতিটি চেষ্টার উদ্দেশ্য যে জীবনকে আরো সুন্দর করে সাজানোও হওয়া উচিত, তা কেমন করে অস্বীকার করা যায়?) খুবই ধুমধামের সাথে মীলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা এরূপ বিশ্বাসের ভিত্তিতে করা হয়ে থাকে যে, ঐ সব মাহফিলে রসূল সা. এর জ্যোতির্ময় আত্মা উপস্থিত হয় এবং ভক্তদের ভক্তি ও ভালোবাসার প্রকাশ দেখে প্রীত হয়। কোথাও মিষ্টি মন্ডা বিতরণ, কোথাও ফুলের ছড়াছড়ি, কোথাও আগরবাতি ও আতর-লোবানের মাত্রাতিরিক্ত ছড়াছড়ি, এবং কোথাও বিচিত্র আলোক সজ্জা দ্বারা উক্ত বিশ্বাসেরই অভিব্যক্তি ঘটে। মীলাদুন্নবী বা সীরাতুন্নবীর প্রতি এ ধরণের ভক্তির বাড়াবাড়িতে যে ভাবমূর্তি প্রতিফলিত হয়, তা কোন রক্তমাংসের তৈরী মানুষের ভাবমূর্তি নয়, বরং এক অতি মানবিক জ্যোতির্ময় সত্তার ভাবমূর্তি। এ সত্তার দেহের কোন ছায়া থাকেনা, তাঁর যাবতীয় কর্মকান্ড মোজেযা তথা অলৌকিক ও অতি প্রাকৃতিক, তাঁর সমস্ত কাজ ফেরেশতারা সমাধা করে, এবং তাঁর প্রতিটি জিনিস রহস্যময়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, রসূল সা. এর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা সমগ্র মানবজাতির চেয়ে বহুগুণ বেশি। তাঁর জীবনে অতি প্রাকৃতিক অনেক কিছু ছিল, তাঁর বহু মোজেযাও ছিল। অনেক সময় ফেরেশতারাও তাঁর সাথে নানা কর্মকান্ডে শরীক হতো। কিন্তু এ কথা মানতেই হবে যে, তাঁর এই পুণ্যময় জীবন একজন মানুষেরই জীবন। তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কারণই এই যে, মানুষ হয়েও তিনি এমন অতুলনীয় জীবনের নমুনা পেশ করেছেন। প্রাকৃতিক নিয়ম এবং সমাজ ও সভ্যতার রীতিনীতির আওতার মধ্যেই তাঁর যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হতো। আর সাফল্যের পথের প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে কুরবানী ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হতো। সে জীবন একজন মানুষের জীবন ছিল বলেই তা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে রয়েছে এবং এই সুবাদেই তাঁর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় আদর্শ রয়েছে। তিনি আমাদের মত মানুষ ছিলেন বলেই তাঁর কাছ থেকে আমরা দৃঢ়তা ও সাহসিকতার শিক্ষা নিতে পারি, নীতি ও আদর্শের আনুগত্য এবং দায়িত্ব সচেতনতার শিক্ষা নিতে পারি, মানবতার সেবার প্রেরণা সঞ্চয় করতে পারি, এবং দুস্কৃতিকারী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য একটা জোরদার উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারি। রসূলের জীবনীকে যদি পুরোপুরি মোজেযায় পরিণত করা হয় এবং তাকে একটা অতিমানবিক কীর্তিতে রূপান্তরিত করা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষদের জন্য তাতে আদর্শ কী থাকবে? এ ধরণের ব্যক্তিত্বের সামনে মানুষ হতবুদ্ধি ও অভিভূত হয়ে যেতে পারে, কিন্তু নিজের মধ্যে তার কোন প্রভাব প্রতিফলিত করতে পারেনা। তার প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ও শ্রদ্ধা পোষণ করতে পারে, কিন্তু তার অনুকরণ ও অনুসরণ করতে পারেনা। এ জন্যই দেখা যায়, যেখানে যেখানে এই বিশেষ ধরণের ভক্তির উদ্ভব হয়েছে এবং যেখানে এটা যত গভীর হতে থাকে, সেখানে বাস্তব জীবন নবীর অনুসরণ থেকে ততই মুক্ত হতে থাকে। এমনকি পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে, জঘন্যতম সামাজিক অপরাধে যারা লিপ্ত, তারা এরূপ সস্তা ভক্তি মহড়া দেখিয়ে নিজেদের অস্থির চিত্তকে এই বলে খানিকটা সান্ত্বনা দেয় যে,
‘‘আমরা যা-ই হয়ে থাকিনা কেন, তোমার প্রিয় নবীর উম্মাতের অন্তর্ভু্ক্ত।’’
অপরদিকে আমাদের সমাজে পাশ্চাত্য থেকে আসা অন্য একটা প্রবণতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যাকে বলা হয় ব্যক্তিপূজা। এ প্রবণতা মূলত জাতীয়তাবাদী মনোভাব ও প্রেরণা থেকে উৎসারিত। এটা এক ধরনের জাতীয় অহমবোধের প্রকাশ, যা অন্যদের সামনে নিজেদের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের প্রদর্শনী করায়। এ প্রবণতার বক্তব্য হলো, দেখ, আমাদের কাছে কত বড় বড় ব্যক্তিত্ব রয়েছে, আমাদের ইতিহাসে কত বড় বড় মর্যাদাবান নেতা অতিক্রান্ত হয়েছেন, এবং তারা অমুক অমুক স্মরণীয় কীর্তি রেখে গেছেন, যা আমাদের গৌরবজনক উত্তরাধিকার। এই প্রবণতার আলামত হলো, এগুলো সব সময় অন্তসারশূণ্য হয়ে থাকে। এর আওতায় বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের জন্ম দিবস, মৃত্যু দিবস এবং অন্যান্য স্মরণীয় দিন অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে উদযাপন করে থাক। অথচ এ দিনগুলো কোথাও ঐ সব মহান ব্যক্তিত্বের জীবন থেকে জাতির শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ এনে দেয়না। মানবতার নমুনা স্বরূপ যে সব ব্যক্তিত্বকে অত্যন্ত গর্বের সাথে তুলে ধরা হয়, তাদের নীতি ও আদর্শের কোন ছাপ উদযাপনকারীদের জীবনে দেখা যায়না এবং এরূপ ছাপ গ্রহণ করার কোন আগ্রহও পরিলক্ষিত হয়না। এই প্রবণতার অধীন রসূল সা. এর স্মৃতি জাগরুক করার জন্য যেসব উৎসবাদি পালন করা হয়, সেখানেও সব সময় একই ধরণের কথাবার্তা বলা হয়ে থাকে। অথচ বক্তা ও উদ্যোক্তাদের জীবনে তার কোন প্রভাব চোখে পড়েনা।
তৃতীয় ভ্রান্ত দৃষ্টিভংগি হলো, রসূল সা.-এর বাণীকে একটা পূর্ণাংগ জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তে অন্যান্য ধর্মের ন্যায় একটা ধর্ম মনে করা। এই দৃষ্টিভংগী দ্বারা যারা প্রভাবিত, তাদের ধারণা হলো, রসূল সা. কেবলমাত্র কিছু আকীদা বিশ্বাস, কয়েক প্রকারের আনুষ্ঠানিক এবাদত, কিছু দোয়াকালাম, কিছু নৈতিক উপদেশ এবং কিছু আইনগত নির্দেশ পৌঁছিয়ে দেয়া বা শিখিয়ে দেয়ার জন্য এসেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এমন কিছু মানুষ তৈরী করা, যারা ব্যক্তিগতভাবে মুসলমান সুলভ বেশভূষা ধারণ করবে, অথচ যেখানে যত নোংরা সমাজ ব্যবস্থাই চালু থাকনা কেন, তারা তার সর্বোত্তম কর্মী সাব্যস্ত হবে। এ ধরণের লোকেরা রসূল সা. এর কাছ থেকে শুধু নামায, রোযা, নফল কাজ, যিকির, এবং ব্যক্তিগত চরিত্র ও আচরণের শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু সামষ্টিক জীবনের ব্যাপকতর কর্মকান্ডে তারা একেবারেই নির্দ্বিধায় প্রত্যেক বাতিল শক্তির সহায়ক হয়ে যায় এবং সবধরণের অপকর্মের সাথে সহযোগিতা করে। তারা রসূল সা. এর জীবনীর পবিত্র পুস্তকের অসংখ্য সোনালী অধ্যায়কে ভুলে কেবল একটি অধ্যায়ের মধ্যে এমনভাবে মনোনিবেশ করে যে, সেখানেই তারা হারিয়ে যায়। এই গোষ্ঠটি এ যাবত রসূল সা. এর অনুকরণের যে নমুনা পেশ করেছে, তা দেখে কোন অমুসলিম তো দূরের কথা, কোন শিক্ষিত মুসলিম যুবক পর্যন্ত ভাবতে পারেনা যে, রসূল সা. তাদের নেতা হতে পারেন এবং তাঁর কাছ থেকে সাম্প্রতিকতম কঠিন সমস্যাবলীর কোন সন্তোষজনক সমাধান পাওয়া যেতে পারে। এই দৃষ্ঠিভংগিও রসূল সা.-এর সত্তার সঠিক উপলব্ধি ও তার আদর্শের অনুসরণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসব ভ্রান্ত দৃষ্ঠিভংগী টিকে থাকতে পারার একমাত্র কারণ হলো,পরিবেশ এরই অনুকূল। যে রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে আমাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে, তার জন্য একটা বিশেষ ধরণের মানুষ প্রয়োজন। এটা এমন একটা কারখানা, যার জন্য বিশেষ ধরণের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। এ সমাজ ব্যবস্থা তার সদস্যদের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের চরিত্র দেখতে চায়। এ কার্যকলাপ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের মানসিকতা ও চরিত্র সম্পন্ন লোকদের দ্বারাই সম্পন্ন হতে পারে। অন্যকথায় বলা যায়, এখনকার বাস্তব কর্মকান্ডে মানবতার সেই মডেলের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই, যা মুহাম্মাদ সা.-এর জীবন চরিতে প্রতিফলিত হয়। এখনকার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সেই চিন্তা ও কর্মের কোনই চাহিদা নেই, যা রসূল সা. এর জীবন থেকে গৃহীত হয়ে থাকে। বর্তমান দুনিয়ার সামষ্টিক ব্যবস্থায় যে ধরনের মন্ত্রী, আমলা, বিচারক, উকিল, নেতা, সাংবাদিক, সেনাপতি, সৈনিক, কোতোয়াল, পেয়াদা, তহশীলদার, প্রশাসন, জমিদার, কৃষক, লেখক, সাহিত্যিক এবং শ্রমিক মজুরের চাহিদা রয়েছে,তাদের মানবিক মান সেই মানুষদের মানবিক মানের সম্পূর্ণ বিপরীত, রসূল সা. যাদেরকে তৈরি করে ইতিহাসের মঞ্চে প্রদর্শন করেছিলেন। আজকের পিতামাতা ঘরে ঘরে যে সন্তান স্নেহে আদরে লালন পালন করে গড়ে তুলছে, তা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার চাহিদার আলোকেই গড়ে তুলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পনেরো বিশ বছর ধরে যে এক কোটি মানুষ তৈরি করছে, তা চলমান সমাজের প্রয়োজন মোতাবেকই তৈরি করছে। চলমান সমাজের দাবী অনুসারেই প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তি নিজের চরিত্র ও মানসিকতাকে একটা বিশেষ রুপ দানের কাজে সারা জীবন নিয়োজিত থাকে। এই সমাজ ব্যবস্থা যে যে জিনিসকে ভালবাসে, সেই সেই জিনিসই সমাজ তার সদস্যদের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রস্তুত করতে থাকে। আর যে যে জিনিসকে সে অপসন্দ ও ঘৃণা করে, পরিবেশের সকল উপকরণ সর্বশক্তি দিয়ে তাকে উত্খাত ও নিশ্চিহ্ন করতে সচেষ্ট থাকে। চলমান সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যে ধরনের বুলি ভালবাসে, সে বুলি আপনা থেকেই সকলের মুখে মুখে চালু হয়ে যায়। সে যে পোষাক ভালবাসে, সে পোষাক স্বতস্ফূর্তভাবে সকলের পরিধানে শোভা পেতে থাকে। এর এক ইশারায় প্রাচীন লজ্জাশীল পরিবারের বৌ ঝিদের মুখমন্ডল থেকে পর্যন্ত নিকাব উঠে যায়। চলমান সমাজ যাকে সম্মানজনক আচরণ বলে চালাতে চায়, সেটাই সম্মানজনক বিবেচিত হয়। আর চলমান সমাজ যাকে অপসন্দ করে সেটাই বিবেচিত হয় অবাঞ্ছিত, অসম্মানজনক। যে শিল্প-কলাকে সে পসন্দ করে, সেটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে, আর যে সব কর্মকান্ডকে সে প্রত্যাখান করে, তা হয়ে যায় সবার উপেক্ষিত। এ সমাজ নিজের মূল্যবোধ নিজেই তৈরি করে এবং সকলকে তা মেনে নিতে বাধ্য করে। আর অন্যসব মূল্যবোধ ও এতিহ্য হয়ে যায় ম্রিয়মান ও নির্জীব। কিছু কিছু আত্মাভিমানী ব্যক্তি ও পরিবার পরিবেশের বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু অর্থনৈতিক বঞ্চনা সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা ও হীনমন্যতার চাপ এত প্রবল হয়ে থাকে যে, কালক্রমে তারা নিস্তেজ হয়ে পরিবেশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে। আর তারা আত্মসমর্পণ না করলেও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম হতোদ্যম হয়ে পড়ে। এভাবে সচেতনভাবেই হোক কিংবা অবচেতনভাবেই, গোটা পৃথিবীটাই যখন পরিবেশের দাবী অনুসারে নিজের জীবন ও চরিত্র গঠনে নিয়োজিত, তখন সেই পৃথিবী যদি রসূলের জীবনী নিয়ে হাজারো বই পুস্তকও রচনা করে এবং ওয়ায নসিহতের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও করে, তবে তাঁর সুমহান আদর্শ অনুসরণের উদ্দীপনা জনগণের মধ্যে আসবে কোথা থেকে?
প্রকৃত ব্যাপার হলো, যারা কোন অনৈসলামিক ব্যবস্থার সাথে আপোষ রফা করে নেয় এবং বাতিল শক্তির সাথে যাদের স্বার্থের ব্যাপারে সমঝোতা হয়ে যায়, তাদের জন্য রসূলের জীবনীতে কোন শিক্ষাই নেই। সীরাতের গ্রন্থাবলী পড়ে তারা হয়ত মাথা দোলাবে,মানসিক আনন্দ ও তৃপ্তি পাবে। তাদের জ্ঞানও হয়তো বাড়বে,কিন্তু রসূলের সীরাত বা জীবনীর আলোকে আপন জীবন গড়ে তোলার প্রেরণা তারা কোথা থেকে পাবে? তাদের জড়তা ও স্থবিরতা দূর হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু আমার বক্তব্য এই যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন বৃত্তান্ত কোন সোহরাব রোস্তমের কাহিনী নয়, আরব্য উপন্যাসের উপাখ্যানও নয়, এবং কোন কিংবদন্তির নায়কের কল্পকাহিনীও নয়। তাঁর অবস্থান কখনো এত নিম্নে নয় যে,তাঁকে আমরা নিছক বিনোদনমূলক সাহিত্য চর্চা বা বিদ্যা চর্চার একটা উপকরণ বানিয়ে রাখবো। তাঁর মূল্য ও মর্যাদা এত উঁচু যে, তা আমাদেরকে নিছক মানসিক তৃপ্তি লাভের জন্য সীরাতকে ব্যবহার করার অনুমতি দেয়না। তাঁর প্রতি আমাদের প্রগাঢ় ভক্তি ও শ্রদ্ধা, তাঁর জীবনেতিহাসকে নিছক জাতীয় গৌরব বোধের বাসনা চরিতার্থ করার মাধ্যম বানাতেও আমাদেরকে বাধা দেয়।
এই সব রকমারি ভ্রান্ত দৃষ্টিভংগী আমাদের সমাজে মিলিতভাবে সক্রিয় রয়েছে এবং এগুলো আসল লক্ষে উপনীত হবার পথে অন্তরায় হয়ে রয়েছে। প্রতি বছর কত শত মীলাদুন্নবী ও সীরাতুন্নবীর সভা ও মাহফিল আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত হয়, কে তার হিসাব রাখে? একমাত্র রবিউল আওয়াল মাসেই কত যে ওয়ায নসিহত ও বক্তৃতায় আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়, কত বইপুস্তক ও নিবন্ধ লেখা হয়, কত পত্র পত্রিকায় বিশেষ সংখ্যা এই বিষয়ে প্রকাশিত হয়, কবিরা কত বিপুল সংখ্যক কবিতা ও না’ত গযল লেখেন, গায়করা কত যে সভা-সমিতিতে কত না’ত, গযল ও কাওয়ালী গেয়ে বেড়ান, নেতৃবৃন্দ ও রাষ্ট্রনায়কদের পক্ষ থেকে কত যে বানী ও বিবৃতি প্রচারিত হয়, কত মিষ্টি বিতরণ ও কত জাঁকজমকের ভোজের আয়োজন হয় এবং তোরণ নির্মাণ ও বর্ণাঢ্য মিছিল সমাবেশের আয়োজনে কত টাকা যে খরচ হয়, কে রাখে তার হিসাব? [কোন কোন অঞ্চলে রসূল (সা) এর মীলাদ ও সীরাত উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানাদিতে আমোদ উল্লাস ও বিনোদনের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এমনকি খোলাখুলি গুনাহর কাজ এবং হাংগামা ও হট্টগোল পর্যন্ত সংঘটিত হচ্ছে। এর অর্থ হলো সমাজ নবী জীবনের শিক্ষা ও আদর্শের ঠিক বিপরীত দিকেই যাত্রা শুরু করেছে।]
কিন্তু অন্যদিকে এটাও দেখা দরকার যে,একটা মহৎউদ্দেশ্যে শক্তি ও অর্থের এই বিপুল ব্যযের সত্যিকার ফল ও স্বার্থকতা কী দাঁড়াচ্ছে? পর্যালোচনার এক পাল্লায় প্রতি বছরের এই সব তৎপরতাকে রাখুন, আর অপর পাল্লায় অর্জিত ফলাফল রেখে যাচাই করুন যে, সঠিক ফল পাওয়া যাচ্ছে কিনা? এই সব মহৎ কর্মকান্ড দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নবী জীবনের অনুকরণে আপন জীবন গড়া ও তাতে পরিবর্তন ও সংশোধন আনার সাধনায় প্রতি বছর কতজন আত্মনিয়োগ করে থাকে? এক একটা সভা সমাবেশ, এক একটা প্রবন্ধ, ও এক একটা না’ত বা গযল দ্বারা যদি মাত্র এক একজন লোকের মধ্যেও পরিবর্তন আসতো, তাহলে অনুমান করুন যে, বিগত দুই-আড়াইশো বছরে আমাদের কতখানি সুফল অর্জিত হতে পারতো। সেই ইপ্সিত সাফল্য যদি অর্জিত না হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের চেষ্টায় কোন ত্রুটি অবশ্যই রয়েছে এবং সে ত্রুটি অত্যন্ত মৌলিক ধরনের। দু:খ শুধু এজন্য নয় যে, ইপ্সিত সুফল অর্জিত হয়নি। বরং আমাদের সমাজে রসূল সা. এর আদর্শ ও কীর্তির সম্পূর্ণ পরিপন্থী এক অশুভ প্রবণতার প্রাদুর্ভাব ঘটতে দেখে বিলাপ করতে ইচ্ছা হয়। আমাদের সমাজে আজ এমন মানুষও জন্ম নিচ্ছে, যারা রসূল সা. এর আদর্শকে এ যুগের জন্য অচল ও অকার্যোপযোগী বলে আখ্যায়িত করছে। রসূল সা. এর শিক্ষা নিয়ে উপহাস করছে, সীরাত, সুন্নাহ ও হাদীসের সমগ্র ভান্ডারকে বর্জন করার আহ্বান জানাচ্ছে। এ যারা কুরআন উপস্থাপনকারীর ২৩ বছর ব্যাপী অবিস্মরণীয় আন্দোলন ও সংগ্রাম থেকে কুরআনকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে এবং রসূল সা. এর সত্তাকে আদর্শ ও পূর্ণাংগ মানুষের একটি বাস্তব নমুনা হসাবে আমাদের দৃষ্টিপথ থেকে উধাও করে দিতে চাইছে। আরো পরিতাপের বিষয়, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, বাক স্বাধীনতা ও মুক্ত বুদ্ধি চর্চার নামে করআন ও হাদীসের প্রত্যক্ষ জ্ঞান থেকে বঞ্চিত এক শ্রেণীর ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীর পক্ষ থেকে রসূল সা. এর ব্যক্তিত্ত, আদর্শ ও অবদানকে চলমান বিকারগ্রস্ত সভ্যতার চিন্তাগত কাঠামোর সাথে সংগতিশীল প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে এবং প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব শক্তিসমূহের অভিরুচি অনুসারে রসূল সা. এর সম্পূর্ণ নতুন ভাবমূর্তি প্রস্তুত করার ধৃষ্ঠতা দেখানো হচ্ছে। আমি যতদূর পড়াশুনা ও চিন্তা গবেষণা করেছি তা থেকে আমার এই উপলদ্ধি জন্মেছে যে, আমরা সীরাত অধ্যযনের নির্ভূল মৌলিক দৃষ্টিভংগী হারিয়ে ফেলেছি এবং উপরোক্ত ভ্রান্ত দৃষ্টিভংগীই আমাদের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে। এ জন্যই রসূল সা. এর প্রতি অগাধ ভক্তি ও ভালবাসার অসংখ্য প্রমাণ ও আলামত থাকা স্বত্তেও এবং তাঁর জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে প্রচুর চিন্তা গবেষণা চালানো সত্ত্বেও মুসলিম বিশ্বের পূর্ব গগন থেকে সেই রকম নতুন মানুষের আবির্ভাব এখনও ঘটছেনা, যার পূর্ণাংগ নমুনা রসূল সা. জগদ্বাসীকে দেখিয়েছিলেন।
রসূল সা. এর জীবন চরিত আমাদের মধ্যে তার যথার্থ প্রতিফলন ঘটাতে পারে কেবল তখনই, যখন আমরা রসূলের সমগ্র জীবন যে মহান কাজ সমাধা করা ও যে লক্ষ্য বাস্তবায়নের সর্বাত্মক সংগ্রামে উৎসর্গিত ছিল, সেই একই লক্ষ্যে একই সংগ্রামে আমাদের জীবনকেও উৎসর্গ করতে পারবো। রসূল সা. যে ধরনের ইসলামী আন্দোলন ও সংগ্রাম পরিচালনা করে গেছেন, একমাত্র সে ধরনের আন্দোলন-সংগ্রামই রসূল সা. এর অনুসারী জীবন গড়ার একমাত্র উপায়। আর সে ধরনের অনুসারী ব্যক্তিত্ব দ্বারাই নতুন করে সফল ইসলামী আন্দোলন গড়া ও পরিচালনা করা সম্ভব।
মুহাম্মদ সা. এর জীবনী নিছক জনৈক ব্যক্তির জীবনী নয়, বরং তা হচ্ছে এমন এক ঐতিহাসিক শক্তির জীবন বৃত্তান্ত, যা একজন মানুষের আকারে আবির্ভূত হয়েছিল। এটা জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এমন কোন দরবেশের কাহিনী নয়, যিনি লোকালয়ের এক প্রান্তে বসে কেবল নিজের সংশোধন ও আত্মগঠনের কাজে নিয়োজিত। বরং এ হচ্ছে এমন এক ব্যক্তির জীবন কাহিনী, যিনি ছিলেন একটা সামষ্টিক আন্দোলনের চালিকা শক্তি। এটা শুধু একজন মানুষের নয়, বরং মানুষ গড়ার এক কারিগরের জীবন কাহিনী। এ জীবন কাহিনীতে রয়েছে এক নতুন বিশ্ব নির্মাতার কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের বিস্তারিত বিবরণ। বস্তুত বিশ্বনবীর জীবনকাহিনী হেরা গুহা থেকে নিয়ে সূর গুহা পর্যন্ত, পবিত্র কা’বার চত্তর থেকে নিয়ে তায়েফের বাজার পর্যন্ত, এবং উম্মুল মুমীনীনদের কক্ষ থেকে রণাঙ্গন পর্যন্ত চতুর্দিকে বিস্তৃত। তাঁর জীবন চরিত শুধু তাঁর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং অসংখ্য ব্যক্তির জীবনকে সুষমা মন্ডিত করেছে। আবু বকর, উমর, উসমান, আলী, আম্মার, ইয়াসার, খালেদ, খয়াইলিদ, বিলাল ও সুহাইব- সকলেই এই একই সীরাত গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়। তাঁরা সবাই একই বাগানের গাছ গাছালি, যারা প্রতিটি পত্রপল্লবে এই বাগানের মালির জীবর চরিত লিপিবদ্ধ রয়েছে।
পৃথিবীর এই মহত্তম ও শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্বকে যদি জীবনী লেখাচ্ছলে নিছক একক একজন ব্যক্তি রুপে তুলে ধরা হয়, এবং জীবনী লেখার প্রচলিত পদ্ধতিতে তাঁর জীবনের প্রধান প্রধান কীর্তি, তাঁর উল্লেখযোগ্য অভিযান, এবং তাঁর স্বভাবচরিত্র ও আদত অভ্যাসের বিস্তৃত, পুংখানুপুংখ ও তারীখওয়ারি বর্ণনা দেয়া হয়, তবে এ ধরনের সীরাত লেখা দ্বারা সীরাতের সঠিক উদ্দেশ্য কখনো পূরণ হবেনা। রসূল সা. এর জীবন কোন পুষ্করিনীর স্থির পানির মতও নয় যে তার এক কিনারে দাঁড়িয়ে এক নজরেই তা পর্যবেক্ষণ করা যাবে। বরং এটা একটা বহমান নদী, যাতে বেগবান স্রোত রয়েছে, গতি ও সংঘাত রয়েছে, তরংগ ও ফেনা রয়েছে, ঝিনুক ও মুক্তা রয়েছে, এর পানির কল্যাণে মৃত ভূমি প্রাণ ফিরে পায় এবং এ নদীর রহস্য বুঝবার জন্য এর স্রোতের সাথে সাথে চলতে হয়। এ কারণে সীরাত বিষয়ক রকমারি গ্রন্থ পড়লে দূর্লভ তথ্যাবলি পাওয়া গেলেও পাঠকদের মধ্যে প্রেরণা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়না, আবেগ জাগ্রত হয়না, সাহস ও সংকল্পে নতুন উদ্যমের জোয়ার আসেনা, কাজের অভিরুচিতে নতুন উত্তাপ ও নতুন প্রেরণার উজ্জীবন ঘটেনা এবং আমাদের জীবনের স্থবিরতা ও দূর হয়না। সীরাত বিষয়ক গ্রন্থ পড়ে ক্ষণিকের জন্য হৃদয়ে ভক্তির ঢেউ হয়তো ওঠে এবং চোখে অশ্রুর বানও হয়তো ডাকে, কিন্তু আকাংখার সেই স্ফুলিংগ আমাদের হস্তগত হয়না, যার উত্তাপ একজন নি:সংগ, নিসম্বল ও আশ্রয়হীন ব্যক্তিকে শত শত বছরের পুঞ্জীভূত বাতিল সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, আর ঈমানের সেই তেজ ও তীব্রতা আমরা অর্জন করতে পারিনা, যা একজন নি:স্ব এতীমকে সমগ্র আরব অনারব বিশ্বের ভাগ্য নিয়ন্তায় পরিণত করেছিল।
আসল কথা হলো, রসূল সা. প্রচলিত পরিভাষায় সীমিত অর্থে কেবল একজন ‘অসাধারণ’ ও ‘খ্যাতনামা’ ব্যক্তিই ছিলেন না এবং তাঁর সীরাত তথা জীবন চরিত কেবল এ ধরনের কোন ‘অসাধারণ’ ও ‘খ্যাতনামা’ ব্যক্তির জীবন বৃত্তান্তই নয়, যে ধরনের জীবন চরিত খ্যাতনামা ব্যক্তিগণের জন্য লিখিত হয়ে থাকে। মহানবীর সত্তা ও ব্যক্তিত্ব এ ধরনের অসাধারণ ও খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গের চেয়ে অনেক উর্দ্ধের।
পৃথিবীতে অসাধারণ মানুষ অনেক জন্মেছে এবং জন্মে থাকে, যারা কোন ভাল শিক্ষা ও কোন গঠনমূলক চিন্তা সমাজে উপস্থাপন করে। এদেরকে অসাধারণ মানুষ বলা হয়। যারা নৈতিকতা ও আইনের বিধান নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে তাদেরকেও মহৎ ও অসাধারণ মানুষ বলা হয়। যারা সমাজ সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেছে, তাদেরকেও অসাধারণ মানুষ বলা হয়। এই ‘অসাধারণ’ খেতাবটি সেই সব লোককেও দেয়া হয়,যারা দেশ জয় করেছে, বীরোচিত কীর্তির উত্তরাধিকার রেখে গেছে, যারা সম্রাজ্য পরিচালনা ও শাসন করেছে,যারা দারিদ্র ও অভাবের বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং যারা বিশ্ববাসীর সামনে ব্যক্তিগত চরিত্রের অত্যন্ত উঁচুমানের মানদন্ড স্থাপন করেছে, তাদেরকেও। কিন্তু এ ধরণের অসাধারণ ও খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের জীবনী যখন আমরা অধ্যয়ন করি, তখন সাধারণত আমরা এটাই দেখতে পাই যে, তাদের সমস্ত শক্তি সামর্থ যেন জীবনের কোন একটা ভালই চুষে খেয়ে ফেলেছে, আর বাদবাকী সবগুলো ডালপালা যেন শুকিয়ে গেছে। তাদের জীবনের একটা দিক যদি খুবই উজ্জ্বল দেখা যায়, তবে তার অন্যদিক একেবারেই অন্ধকার প্রতীয়মান হয়। একদিকে চরম বাড়াবাড়ি, অপর দিকে চরম উদাসীনতা। কিন্তু রসূল সা. এর জীবনের প্রতিটি দিক অন্যান্য দিকের সাথে পুরোপুরি ভারসাম্যপূর্ণ এবং প্রতিটি দিক একই রকম পূর্ণতা ও উৎকৃষ্টতা দ্বারাও শোভিত। যেখানে গুরু গম্ভীরতার প্রতাপ রয়েছে সেখানে সৌন্দর্যের চমকও রয়েছে। সেখানে আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি রয়েছে বৈষয়িকতার সমন্বিত অবদান। পরকালের চর্চার পাশে হাত ধরাধরি করে রয়েছে অর্থনৈতিক চিন্তাধারা। দ্বীনের সাথেই রয়েছে দুনিয়াও। এক ধরণের আত্মনিবেদিত ভাব থাকলেও সেই সাথে আত্মমর্যাদাবোধও রয়েছে অম্লান। আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীর পাশাপাশি বিরাজ করছে আল্লাহর বান্দাদের প্রতি স্নেহ মমতা ও তাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। কঠোর সামষ্টিক শৃংখলার সাথে রয়েছে ব্যক্তির অধিকারের প্রতি সম্মানও। প্রগাঢ় ধর্মীয় চেতনা ও আবেগের সাথেই অবস্থান করছে সর্বাত্মক রাজনীতিও। জাতির নেতৃত্ব প্রদানে অষ্টপ্রহর ব্যস্ততা থাকলে ও সেই সাথে দাম্পত্য জীবনের কর্মকাণ্ডও সম্পাদিত হচ্ছে সুচারুভাবে। মজলুমদের সাহায্যের পাশাপাশি যালেমদের প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
রসূলের জীবন চরিতরূপী এই পাঠশালা থেকে সমভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে একজন প্রশাসক, একজন শাসনকর্তা, একজন মন্ত্রী, একজন কর্মকর্তা, একজন মনিব, একজন চাকুরে, একজন ব্যবসায়ী, একজন শ্রমিক, একজন বিচারক, একজন শিক্ষক, একজন সিপাহী, একজন বক্তা, একজন নেতা, একজন সংস্কারক, একজন দার্শনিক এবং একজন সাহিত্যিকও। সেখানে একজন পিতা, একজন সহযাত্রী ও একজন প্রতিবেশীর জন্য একই রকম অনুকরণীয় আদর্শ রয়েছে। একবার কেউ যদি এই পাঠশালায় পৌঁছে যায়, তাহলে তার আর অন্য কোন পাঠশালায় যাওয়ার প্রয়োজন হয়না। মানবতার যে সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম উৎকর্ষ অর্জন করা সম্ভব, তা এই একক, ব্যক্তিত্বেই পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান। এজন্যই আমি এই ব্যক্তিকে ‘‘শ্রেষ্ঠমানুষ’’ বা ‘‘মহামানব’’ বলে আখ্যায়িত করতে বাধ্য হয়েছি। সমগ্র মানবেতিহাসে ‘‘শ্রেষ্ঠমানুষ’’ কেবল এই একজনই। তাঁকে মশাল বানিয়ে আমরা আমাদের জীবনকে উজ্জ্বল করতে পারি। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ তাঁর কাছ থেকে আলো গ্রহণ করেছে। অনেকে তাঁর কাছ থেকে জ্ঞানের ভান্ডার গড়ে তুলছে। আজ পৃথিবীর দিকে দিকে তাঁর বাণী গুঞ্জরিত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সভ্যতা সংস্কৃতিতে তাঁর প্রদত্ত শিক্ষার গভীর প্রভাব রয়েছে। পৃথিবীর এমন কোন মানুষ নেই, যে এই শ্রেষ্ঠ মানুষ থেকে কোন না কোন পর্যায়ে উপকৃত হয়নি। কিন্তু তাঁর দ্বারা যারা উপকৃত, তাঁরা তাঁকে চেনেনা এবং তাঁর পরিচয় জানেনা।
রসূল সা. এর ব্যক্তিত্বের পরিচয় এবং তাঁর বাণীর বিশ্বময় প্রচার ও প্রসারতাঁর প্রতিষ্ঠিত দল তথা মুসলিম জাতিরই দায়িত্ব ছিল। কিন্তু এই জাতি নিজেই তাঁর ও তাঁর বাণী থেকে অনেক দূরে পড়ে রয়েছে। মুসলমানদের কাছে রক্ষিত ধর্মগ্রন্থের পাতায় পাতায় জীবনের সকল দিক সম্পর্কেই দিকনির্দেশনা রয়েছে, কিন্তু তাদের জীবনে এই মহামানবের জীবনীর কোন প্রভাব পড়ছে বলে মনে হয়না। এই জাতির ধর্মীয় জীবনে, রাজনীতিতে, সমাজ জীবনে, নৈতিকতায়, আইন ব্যবস্থা ও সংস্কৃতিতে নবী জীবনের আদর্শের খুব কমই ছাপ অবশিষ্ট রয়েছে। যা রয়েছে তাও অনেক নতুন নতুন ছাপের সাথে মিশে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। এই জাতির সামাজিক পরিবেশ পৃথিবীর কোন একটি ক্ষুদ্রতম অংশেও এমন অবস্থায় নেই, যা দ্বারা বুঝা যায় যে তারা মুহাম্মদ (সাঃ) এর নীতি, আদর্শ, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের প্রতিনিধি। বরঞ্চ এ জাতি পৃথিবীর বিভিন্ন বিভ্রান্ত ও বাতিল ব্যবস্থার দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা চেয়ে বেড়াচ্ছে এবং প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত শক্তির ভয়ে নিজেদের গৌরবময় ঐতিহ্য সম্পর্কে লজ্জিত বলে মনে হয়। তারা কোরআনকে গেলাফ দিয়ে মুড়ে রসূল (সাঃ) এর সীরাতকে ফুলের তোড়া বানিয়ে তাকের ওপর তুলে রেখে দিয়েছে।
উপরন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) কে সংকীর্ণ অর্থে একজন ধর্মীয় ও জাতীয় নেতায় পরিণত করে নিজেদেরকে একটা ধর্মীয় ও জাতীয় সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত করেছে। এভাবে এই বিশ্ব ব্যক্তিত্বের বাণী ও জীবনাদর্শকে গোষ্ঠীগত ও সাম্প্রদায়িক একচেটিয়া সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তিনি এসেছিলেন সমগ্র মানব জাতির নেতা হয়ে এবং সমগ্র মানব জাতির জন্য বাণী ও আদর্শ নিয়ে। তাঁর জীবনেতিহাসকে এমনভাবে উপস্থাপন করা দরকার ছিল যে, মনুষ্যত্বের একটা নমুনা ও আদর্শ। মানুষ এর ছাঁচে ঢালাই হয়ে তৈরি হলে সে নিজের ও সমগ্র মানব জাতির কল্যানের উপকরণ হতে পারে এবং রকমারি সমস্যার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে একটা পবিত্র নিষ্কলুষ ও নিষ্কণ্টক জীবন অর্জন করতে পারে। রসূল (সাঃ) এর বাণী ও জীবনাদর্শ প্রকৃত পক্ষে সূর্যের কিরণ,বৃষ্টির পানি ও বাতাসের মত সার্বজনীন কল্যাণের উৎস। অথচ আমরা তাঁকে নিজেদের অজ্ঞতার দরুণ একটা গোষ্ঠীগত বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছি। আজ প্লেটো, সক্রেটিস, ডারউইন, মেকিয়াভেলী, মার্কস, ফ্রয়েড ও আইনস্টাইন থেকেও সকল দেশ ও সকল ধর্মের লোকদেরকে কমবেশী উপকৃত হতে ও শিক্ষা গ্রহন করতে দেখা যায়। তাদের বিরুদ্ধে কোন জাতি বা গোষ্ঠীর অন্ধ বিদ্বেষ নেই। কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) এর জ্ঞান, আদর্শ ও নেতৃত্ব থেকে শিক্ষা গ্রহণে এত আপত্তি ও এত বিদ্বেষ যে,তার ইয়ত্তা নাই। লোকেরা ভাবে যে, মুহাম্মদ (সাঃ) তো মুসলমানদের নেতা। আর আমরা মুসলমানদের থেকে আলাদা এবং মুসলমানরাও আমাদের থেকে ভিন্ন জাতি। কাজেই মুসলমানদের নেতা ও পথ প্রদর্শকের সাথে আমাদের কী সম্পর্ক? দুঃখের বিষয় হলো, এরূপ ধারনা সৃষ্টিতে এবং এর এতটা অস্বাভাবিক পর্যায়ে উপনীত হওয়াতে আমাদের নিজস্ব কর্মকান্ডেরও যথেষ্ট হাত রয়েছে। সমগ্র মানবজাতির বন্ধু মুহাম্মদ (সাঃ) এর উম্মত হয়েও আমরা তাঁর অনুকরণের অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি বলেই অমুসলিম জনগনের মধ্যে এরূপ চিন্তা ধারার জন্ম নিতে পেরেছে।