অধ্যায়ঃ ২
এক নজরে ব্যক্তিত্ব
যখন বুলাই তার মুখমন্ডলে দু’চোখ,
সেযেনো বর্ষামুখী মেঘে বিদ্যুতের চমক। [জাহেলী যুগের এই বিখ্যাত আরব কবি এই কবিতাটি তার এক প্রীতিভাজন ব্যক্তিত্বকে লক্ষ্য করে রচনা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে কোন এক প্রসংগে হযরত আয়েশা (রা) এটি রসূল (সা)এর ওপর যথার্থ প্রয়োগ করেন।]
– আবু কবীর হুযালী
এ চেহারা হতে পারেনা কোনো মিথ্যাবাদী লোকের।
– আবদুল্লাহ ইবনে সালাম
এক ঝলক
[প্রধানতঃ শামায়েলে তিরমিযীর আলোকে রচিত।]
পৃথিবীতে যারা বড় কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, বিশেষত নবীগণ আ., তারা সর্বদাই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে থাকেন। আন্দোলনের নেতৃত্বদান এবং সভ্যতার পুননির্মাণে নেতৃত্বদানকারীদের শক্তির আসল উৎস হয়ে থাকে বিশেষ ধরণের চিন্তাধারা ও চরিত্রের সমন্বয়ে গঠিত তাঁদের ব্যক্তিসত্তা। রসূল সা.- এর ব্যক্তিত্বকে যথাযথভাবে হৃদয়ংগম করাও তাঁর সীরাত অধ্যয়নের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য।
যেকোন ব্যক্তিত্বকে উপলব্ধি করার ব্যাপারে তার দৈহিক সৌন্দর্য অনেক সাহায্য করে। মানুষের আপাদমস্তক দেহের গঠন এবং তার অংগ প্রত্যংগের সুঠামতা দ্বারা বুঝা যায় সে মানসিক, নৈতিক ও চেতনাগত দিক দিয়ে কোন স্তরের মানুষ। বিশেষত চেহারা বা মুখমন্ডলে মানবীয় চরিত্র ও কীর্তিকলাপের সমস্ত ইতিবৃত্ত লেখা থাকে। তার ওপর একটা দৃষ্টি দিলেই আমরা ওটা কোন্ ধরণের মানুষের চেহারা তা আঁচ করতে পারি।
আমরা যারা পরবর্তীকালে পৃথিবীতে এসেছি, তারা এদিক দিয়ে ভাগ্যাহত যে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষটির অনুপম চেহারা আমাদের সামনে নেই এবং তা চর্মচক্ষু দিয়ে এ জগতে দর্শনের সুযোগও পাবনা। আমরা রসূল সা. এর দৈহিক সৌন্দর্যের যেটুকু ঝলক দেখতে পাই, তা কেবল তাঁর বাণী ও কীর্তির দর্পণেই দেখতে পাই।
রসূল সা. এর কোন প্রকৃত ছবি বা মূর্তি নেই। স্বয়ং রসূল সা. ওসব বানাতে ও রাখতে নিষেধ করেছেন। কেননা ছবি এত বিপজ্জনক জিনিস যে তা শেরকে লিপ্ত হওয়ার ঝুঁকি কোনভাবেই রোধ করেনা। রসূল সা. এর কোন ছবি যদি থাকতো, তাহলে তাকে যে কত অলৌকিক কর্মকান্ডের উৎস মনে করা হতো এবং নতুন নতুন কত মোজেযার কৃতিত্ব তাকে দেয়া হতো, তার ইয়ত্তা নেই। এর সম্মানে কত যে রং বেরং এর অনুষ্ঠানাদি অনুষ্ঠিত হতো তা কল্পনা করাও কঠিন। এমনকি তার পূজা শুরু হয়ে যাওয়ায় বিচিত্র ছিলনা। ইউরোপে রসূল সা. এর কাল্পনিক ছবি অনেক বানানো হয়েছে। কিন্তু এমন শিল্পী কে আছে যে, রসূল সা. এর চিন্তা ও কর্মের প্রতিটি দিকের সূক্ষ্ণ ব্যাপক ও পূর্ণাংগ ধারণা রাখে এবং সেই ধারণাকে রংতুলি দিয়ে পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে? কাল্পনিক ছবি আর যারই হোক, মুহাম্মদ সা. এর নয়। কোন অনুমান সর্বস্ব ব্যক্তিত্বের ছবি বানিয়ে তাকে রসূল সা. এর নামে চালিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। এ সব ছবি তৈরী করার সময় বিন্দুমাত্র সততার পরিচয় দেয়া হয়না। ইচ্ছাকৃতভাবে এমন ছবি তৈরী করা হয়, যা দ্বারা এক দুর্বলও অসম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের ধারণা জন্মে। সব ছবি তৈরী করার জন্য ব্যক্তিত্বের ধারণা নেয়া হয় পাশ্চাত্যেরই সেই সব বিদ্বেষপূর্ণ পুস্তকাদি থেকে, যা গোয়ার্তুমি, হঠকারিতা, বক্রচিন্তা ও অবাস্তব ধারণার ফলশ্রুতি। নবীগণ ও পূণ্যবান ব্যক্তিগণের ছবি বা চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষতি এটাই যে, তাদের আসল চরিত্র পর্দার আড়ালে হারিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু রসূল সা. এর সাহাবাগণ ন্যূনতম শব্দের মাধ্যমে তাঁর নিখুঁত ছবি এঁকে দিয়েছেন এবং সেই বর্ণনাগুলোকে বর্ণাকারীগণ অত্যন্ত সুরক্ষিত ও অবিকৃত অবস্থায় আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এখানে আমরা সেই শাব্দিক চিত্রগুলোকে তুলে ধরছি, যাতে পাঠকগণ এই মহামানবের চরিত্র অধ্যয়নের আগে তাঁর ব্যক্তিসত্তার একটা ঝলক দেখে নিতে পারেন। একে এক ধরণের সাক্ষাতও বলা যেতে পারে, কিংবা পরিচিতিও বলতে পারেন।
রসূল সা. এর পবিত্র মুখমন্ডল, তাঁর দৈহিক গঠন, চালচলন ও সৌন্দর্যের যে ছাপ চৌদ্দশো বছরের দূরত্ব পেরিয়ে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে তা এমন একজন মানুষের ভাবমূর্তি প্রতিফলিত করে, যিনি একাধারে অত্যন্ত উচ্চাংগের মেধাবী ও বুদ্ধিমান, সাহসী বীর, ধৈর্যশীল, আদর্শে অবিচল, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ, উদার ও মহানুভব, দাতা, দায়িত্ব সচেতন, বিনয়ী ও ভাবগম্ভীর এবং প্রিয়ভাষী ও শুদ্ধভাষী ছিলেন। আরো সঠিকভাবে বললে বলতে হয়, তাঁর দৈহিক কাঠামোতে নবুয়্যতের ছাপ অনেকটা লক্ষ্যণীয় ভাবে বিদ্যমান ছিল। তাঁর সুদর্শন দেহসৌষ্ঠব তাঁর উচ্চ মর্যাদার প্রতীক ছিল। এ প্রসংগে রসূল সা. এর একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেনঃ
‘‘খোদাভীতি মানুষের চেহারাকে উজ্জ্বল ও সুন্দর করে।’’
নবুয়্যত যখন ঈমান ও খোদাভীতির সর্বোচ্চ স্তর, তখন নবীর চেহারা আলোকময় না হয়েই পারেনা।
এবার আসুন, তাঁর সূর্য জ্যোতিসম চমকপ্রদ চেহারার একটু ঝলক দেখে নেয়া যাক।
দৈহিক সৌন্দর্য
‘‘আমি রসূল সা. কে দেখেই চিনে ফেলেছিলাম। তাঁর চেহারা একজন মিথ্যাবাদীর চেহারা হতে পারেনা।’’ (আব্দুল্লাহ বিন সালাম) [ইনি ইহুদীদের একজন মস্ত বড় আলেম ছিলেন। তাঁর নাম ছিল হাসীন। রসূল সা. মদীনায় এলে ইনি তাঁকে দেখতে যান এবং দেখতে গিয়ে তার যে ধারণা জন্মে সেটাই তিনি এখানে বর্ণনা করেছেন। তিনি ঈমান আনলেন এবং তার ইসলামী নাম হলো আবদুল্লাহ। (সীরাতুল মুস্তাফা, মাওলানা ইদ্রীস কান্ধুলতী। প্রথম খন্ড, পৃঃ ৩৪১-৩৫০)]
‘‘আমি আমার ছেলেকে সাথে নিয়ে হাজির হলাম। লোকেরা দেখিয়ে দিল ঐ যে, আল্লাহর রসূল। কাছে গিয়ে বসা মাত্রই আমি মনে মনে বললাম, যথার্থই ইনি আল্লাহর নবী।’’-আবু রামছা তাইমী
‘‘নিশ্চিত থাকো, আমি এই ব্যক্তির পূর্ণিমা চাঁদের মত উজ্জ্বল চেহারা দেখেছি। তিনি কখনো তোমার সাথে লেনদেনে অসততা করতে পারেননা। এ ধরনের মানুষ যদি (উটের মূল্য ) না দেয়, তবে আমি নিজের কাছ থেকে দিয়ে দের।’’-জনৈক ভদ্র মহিলা। [একটি বানিজ্যিক কাফেলা এসে মদীনার উপকণ্ঠে যাত্রা বিরতি করেছিল। ঘটনাক্রমে রসূল (সাঃ) সেদিকে গিয়েছিলেন।তিনি একটা উট বাছাই করে দামদস্ত্তও ঠিক করলেন। অতপর এই বলে উটটা নিয়ে গেলেন যে,দাম পাঠিয়ে দিচ্ছি।পরে উট বিক্রেতাদের মনে খটকা লাগলো,একজন অচেনা লোককে বাকীতে উট দিয়ে কেমন কাজ করলাম।এসময় কাফেলার নেতার স্ত্রী তাদেরকে আশ্বসত্ম করার জন্য উপরোক্ত কথা বলে। এ ঘটনা ঐ কাফেলার সদস্য তারেক বিন আব্দুলস্নাহ বর্ণনা করেন।এর কিছুক্ষন পরই রসূল (সাঃ) নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশী পরিমাণে খেজুর পাঠিয়ে দিলেন।(সীরাতুন্নবী,শিবলী নুমানী,২য় খন্ড,পৃঃ ৩৮০ আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া,১ম খন্ড,পৃঃ ২৪৪।)]
‘‘আমরা এমন সূদর্শন মানুষ আর দেখিনি। আমরা ওর মুখ থেকে আলো বিকীর্ণ হতে দেখেছি।’’ -আবু কারসানার মা ও খালা। [এই মহিলাদ্বয় আবু কারসানার সাথে রসূল সাঃ এর কাছে বায়আতের (অংগীকার প্রদান) জন্য গিয়েছিলেন। ফিরতি পথে তাঁরা এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। (আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড,পৃঃ২৫৫)]
‘‘রসূল সাঃ এর চেয়ে সূদর্শন কাউকে আমি দেখিনি। মনে হতো যেন সূর্য ঝিকমিক করছে।’’-আবু হুরায়রা
‘‘তুমি যদি রসূল সাঃ কে দেখতে, তবে তোমার মনে হতো যেন সূর্য উঠেছে।’’-রবী বিনতে মুয়াওয়ায
“ রসূল সাঃ কে যে দেখতো, সে প্রথম দৃষ্টিতেই হতভম্ব হয়ে যেতো।’’- হযরত আলী
‘‘আমি একবার জ্যোৎসণা রাতে রাসূল সাঃ কে দেখছিলাম। তিনি তখন লাল পোশাকে আবৃত ছিলেন। আমি একবার চাঁদের দিকে আর একবার তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলাম।অবশেষে আমি এই সিদ্ধামেত্ম উপনীত হলাম যে, রসূল সাঃ চাঁদের চেয়েও সুন্দর।’’-হযরত জাবের বিন সামুরা
‘‘আনন্দের সময় রসূল সাঃ এর চেহারা চাঁদের মত ঝকমক করতো।এটা দেখেই আমরা তার আনন্দ টের পেতাম। ’’-কা’ব বিন মালেক
‘‘তাঁর চেহারায় চাঁদের মত চমক ছিল।’’-হিন্দ বিন আবি হালা
মুখমণ্ডল
‘‘পূর্ণিমার চাঁদের মত গোলাকার।’’-বারা বিন আযিব
‘‘তাঁর মুখমণ্ডল পুরোপুরি গোলাকার ছিলনা।তবে প্রায় গোলাকার।’’-হযরত আলী
‘‘প্রশস্ত কপাল, বাঁকানো, চিকন ও ঘন ভ্রু, উভয় ভ্রু আলাদা, উভয় ভ্রুর মাঝখানে একটা উঁচু রগ ছিল, রাগান্বিত হলে এই রগ স্পষ্ট হয়ে উঠতো।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘কপালে আনন্দের চিহ্ন ফুটে উঠতো।’’-কা’ব ইবনে মালেক
বর্ণ
চুনের মত সাদাও নয়, শ্যাম বর্ণেরও নয়।গমের মত রং তবে একটু সাদাটে।’’-হযরত আনাস
‘‘লালচে সাদা।’’ -হযরত আলী
‘‘সাদা, তবে লাবন্যময়।’’ -আবুত তোফায়েল
‘‘সাদা দীপ্ত।’’- হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘শরীরটা যেন রূপার তৈরী।’’ – হযরত আবু হুরায়রা
চোখ
‘‘কালো চোখ, লম্বা পলক।’’ -হযরত আলী
‘‘চোখের মণি কালো, দৃষ্টি আনত, চোখের কিনার দিয়ে দেখার সলজ্জ প্রবণতা।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘চোখে সাদা অংশে লাল রেখা, লম্বা কোটর, জন্মগত সুর্ম মাখা।’’ -জাবের বিন সামুরা
নাক
‘‘খানিকটা উঁচু, তার ওপর জ্যোতির্ময় চমক-এ জন্য প্রথম দৃষ্টিতে বড় মনে হয়।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
গাল
‘‘হালকা ও সমতল, নীচের দিকে একটু মাংসল।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
মুখ
‘‘প্রশস্ত’’। -জাবের বিন সামুরা
‘‘প্রশস্ত’’। – হিন্দ বিন আবি হালা
দাঁত
‘‘চিকন, চকচকে। সামনের দাঁতে মোহনীয় ঔজ্জল্য।’’ -হযরত ইবনে আব্বাস
তিনি যখন কথা বলতেন,তখন দাঁত দিয়ে চমক ফুটে বেরুতো।’’ -হযরত আববাস
দাড়ি
‘‘মুখভরা ঘন দাড়ি।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
ঘাড়
‘‘পাতলা ও লম্বা যেন মূর্তির মত সুন্দরভাবে কেটে বানানো।’’
ঘাড়ের রং চাঁদের মত উজ্জ্বল ও মনোরম।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
মাথা
‘‘বড়-তবে সূষম মধ্যম আকৃতির।’’ – হিন্দ বিন আবি হাল
চুল
ঈষৎ কোঁকড়ানো।’’ -আবু হুরায়রা
‘‘একেবারে সোজাও নয়, খুব বেশী কোঁকড়ানোও নয়।’’ -কাতাদা
‘‘সামান্য কোঁকড়ানো’’ -হযরত আনাস
‘‘ঘন-কখনো কখনো কানের লতি পর্যমত্ম লম্বা।কখনো ঘাড় পর্যন্ত।’’ -বারা বিন আযেব
‘‘মাঝখানে দিয়ে সিথিঁ কাটা’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘শরীরে বেশী লোম ছিলনা। বুক থেকে নাভি পর্যমত্ম লোমের চিকন রেখা।’’ -হযরত আলী ও হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘ঘাড়, বাহু ও বুকের ওপরের অংশে সামান্য কিছু লোম।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
সামগ্রিক দেহ কাঠামো
‘‘শরীরটা ছিল মজবুত গঠনের। অংগ প্রত্যংগের জোড়ের হাড় বড়ও শক্ত।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘শরীর মোটা ছিলনা।’’ -হযরত আলী
‘‘শরীর বেশী লম্বাও নয়,খাটোও নয়, মধ্যম।’’ -হযরত আনাস(রাঃ)
‘‘শরীর কিছুটা লম্বা। অনেক লোকের মধ্যে দাঁড়ালে তাকে অধিকতর লম্বা মনে হতো।’’ -বারা বিন আযেব
‘‘পেট উঁচু ছিলনা।’’-উম্মে মা’বাদ
“পার্থিব সম্পদের প্রাচুর্যে লালিত লোকদের চেয়ে (ক্ষুধা ও দারিদ্র ভোগ করা সত্তেও) তরতাজা ও শক্তিশালী ছিলেন।’’ [এ ঘটনা সুবিখ্যাত যে, ওমরা করতে গিয়ে রসূল (সাঃ) একাই একশো উট হাকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তার মধ্য থেকে ৬৩টি স্বহসেত্ম জবাই করেন। বাকীগুলো হযরত আলীর (রাঃ) হাতে অর্পণ করেন। (আল মাওয়াহেব ১ম খন্ড ৩১০ পৃষ্ঠা )]
‘‘আমি রসূল (সাঃ) এর চেয়ে শক্তিশালী আর কা্উকে দেখিনি।’’-ইবনে উমার [মক্কায় রুকানা নামক একজন পেশাদার কুস্তিগীর ছিল। একবার রসূল (সাঃ) তার সাথে দেখা করে ইসলামের দাওয়াত দিলে সে নবুয়তের প্রমাণ চায়। রসূল (সাঃ) তার রুচি অনুযায়ী তার সাথে কুস্তি লড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তার সাথে তিনবার কুস্তি হয় এবং তিনবারই তিনি তাকে হারিয়ে দেন। এ ছাড়া আবুল আসওয়াদ জুহমীসহ আরো কয়েকজনকেও তিনি কুস্তি লড়াইতে হারিয়ে দিয়েছেন। (হাকেম, আবু দাউদ, তিরমিযী ও বায়হাকী, আল- মাওয়াহিবুল লাহন্নিয়া, প্রথম খ-,পৃঃ ৩০৩)]
কাঁধ ও বুক
‘‘বুক প্রশস্ত, বুক ও পেট সমতল।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘বুক প্রশস্ত।’’ -বারা বিন আযেব
‘‘দুই কাঁধের মধ্যবর্তী অংশ সাধারণ মাপের চেয়ে বেশী। -হিন্দ বিন আবি হালা, বারা বিন আযেব
‘‘দুই কাঁধের মধ্যবর্তী অংশ মাংসল।’’ -হযরত আলী
হাত ও বাহু
‘‘বাহু লম্বা, হাতের তালু প্রশস্ত, আংগুলগুলো মানানসই লম্বা।’’ -হিন্দ বিন আবি হালা
‘‘রেশমের পাতলা বা ঘন কাপড় বা অন্য কোন জিনিস এমন দেখিনি, যা রসূল (সাঃ) এর হাতের চেয়ে কোমল।’’-হযরত আববাস
পদযুগল
‘‘পায়ের থোড়া মাংসল ছিলনা,ছিল হালকা ও চুপসানো।’’-জাবের বিন সামুরা
“হাতের পাতা ও পায়ের পাতা মাংশল ছিল। পায়ের তলা কিঞ্চিত গভীর। পায়ের পাতা এত পাতলা যে, তাতে পানিই দাঁড়ায়না। ’’ – হিন্দ বিন আবি হালা
“পায়ের গোড়ালিতে গোস্ত খুবই কম।’’ –জাবের বিন সামুরা
একটা সামগ্রিক ছবি
যদিও রসূল (সাঃ) এর বহু সংখ্যক সাহাবী রসূল (সাঃ) সম্পর্কে অনেক চমকপ্রদ বিবরণ দিয়েছেন, কিন্তু উম্মে মা’বাদের বিবরণের কোন তুলনা নেই। সুর পর্বতের গুহা থেকে যখন রসূল (সাঃ) মদীনায় হিজরত করার জন্য রওনা দিলেন, তখন প্রথম দিনই খুযায়া গোত্রের এই মহিয়সী বৃদ্ধার বাড়ীতে যাত্রা বিরতি করেন। রসূল (সাঃ) ও তাঁর সাথীরা নিদারুণ তৃষ্ণা কাতর ছিলেন। আলস্নাহর বিশেষ মেহেরবানীতে বৃদ্ধার জরাজীর্ণ ক্ষুধার্ত বকরী এ সময় এত দুধ দিল যে,রসূল (সাঃ) ও তাঁর সাথীরা পেটপুরে খাওয়ার পর আরো খানিকটা দুধ অবশিষ্ট রইল। উম্মে মা’বাদের স্বামী বাড়ী ফিরে দুধ দেখে অবাক হয়ে গেল। সে জিজ্ঞাসা করলো, এ দুধ কোথা থেকে এল। উম্মে মা’বাদ সমসত্ম ঘটনা বর্ণনা করলো।তখন তার স্বামী বললো, এই করাইশী যুবকের আকৃতির বিবরণ দাও তো, সে সেই বহুল প্রত্যাশিত ব্যক্তি কিনা দেখি। তখন উম্মে মাবাদ চমৎকার ভাষায় তার একটি বিবরণ দিল। উম্মে মাবাদ তখন রাসূল (সাঃ) কে চিনতোনা, তার প্রতি হিংসা বিদ্বেষও পোষণ করতোনা। সে যা দেখেছে,হুবহু তা বর্ণনা করেছে। এই বর্ণনাটা আসল আরবীতে দেখে নেয়া উত্তম। [দেখুন যাদুল মায়াদ,১ম খন্ড,পৃঃ ৩০৭]। এখানে তার অনুবাদ দিচ্ছিঃ
‘‘পবিত্র ও প্রশসত্ম মুখমন্ডল,প্রিয় স্বভাব, পেট উঁচু নয়, মাথায় টাক নেই, সুদর্শন, সুন্দর, কালো ও ডাগর ডাগর চোখ, লম্বা ঘন চুল, গুরম্নগম্ভীর কণ্ঠস্বর। উঁচু ঘাড়, সুর্মা যুক্ত চোখ, চিকন ও জোড়া ভ্রম্ন, কালো কোকড়ানো চুল। নীরব গাম্ভীর্য,আন্তরিক, দূর থেকে দেখলে সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক। নিকট থেকে দেখলে অত্যন্ত মিষ্ট ও সুন্দর। মিষ্ট ভাষী, স্পষ্টভাষী, নিস্প্রয়োজন শব্দের ছড়াছড়ি থেকে মুক্ত কথাবার্তা। সমস্ত কথাবার্তা মুক্তার হারের মত পরস্পরের সাথে যুক্ত। মধ্যম ধরনের লম্বা, ফলে কেউ তাকে ঘৃণাও করেনা, তাচ্ছিল্যও করেনা। সুদর্শন, তরুন, সর্বক্ষণ সাহচর্য দানকারীদের প্রিয়জন। যখন সে কিছু বলে সবাই নীরবে শোনে, যখন সে কোন নির্দেশ দেয়, তৎক্ষণাত সবাই তা পালন করতে ছুটে যায়। সকলের সেবা লাভকারী, সকলের আনুগত্য লাভকারী, প্রয়োজনের চেয়ে স্বল্পভাষীও নয়; অমিতভাষীও নয়।’’ [যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড,পৃঃ ৩০৭]।
পোশাক
পোশাক দ্বারাও মানুষের ব্যক্তিত্ব প্রস্ফুটিত হয়। পোশাকের সাইজ, দৈঘ্য, প্রস্থ, রং, মান পরিচ্ছন্নতা এবং অনুরূপ অন্যান্য বিশেষত্বের পোশাক পরিহিত ব্যক্তি কেমন চরিত্র ও মানসিকতার অধিকারী তা জানিয়ে দেয়। রসূল (সাঃ) এর পোশাক সম্পর্কে তাঁর সাহাবীগণ যে তথ্য দিয়েছেন, তা থেকে রসূল (সাঃ) -এর রুচি ও মানসিকতা অনেকটা প্রকাশ পায়।
রসূল (সাঃ) আসলে পোশাক সম্পর্কে নিম্নোক্ত আয়াতের বাস্তব ব্যাখ্যা পেশ করেছেনঃ
﴿يَابَنِيآدَمَقَدْأَنزَلْنَاعَلَيْكُمْلِبَاسًايُوَارِيسَوْآتِكُمْوَرِيشًاۖوَلِبَاسُالتَّقْوَىٰذَٰلِكَخَيْرٌۚذَٰلِكَمِنْآيَاتِاللَّهِلَعَلَّهُمْيَذَّكَّرُونَ﴾
‘‘হে আদম সন্তান, আমি তোমাদের জন্য তোমাদের লজ্জা স্থান আবৃতকারী এবং তোমাদেও সৌন্দর্য উৎপন্নকারী পোশাক নির্ধারণ করেছি। তবে খোদাভীতির পোশাকই উত্তম।’’ (সূরা আ’রাফঃ ২৬)
পোশাকের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য সূরা আন নহলে বর্ণিত হয়েছে এভাবেঃ
سَرَابِيلَتَقِيكُمُالْحَرَّوَسَرَابِيلَتَقِيكُمبَأْسَكُمْ
‘‘তিনি তোমাদেরকে গরম থেকে বাঁচানো ও যুদ্ধে নিরাপদে রাখার জন্য জামা ও বর্ম সরবরাহ করেছেন।’’ (সূরা আন নহল)
সুতরাং রসূল (সাঃ) এর পোশাকের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এইযে, তা লজ্জা নিবারক ছিল, সৌন্দর্য উৎপন্নকারী ছিল এবং তাকওয়া তথা খোদাভীতি ও সততার পোশাক ছিল।এতে প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থাও ছিল, চারিত্রিক নীতিমালার আনুগত্যের নিশ্চয়তাও ছিল এবং ভদ্রজনোচিত রুচির প্রতিফলনও ছিল। রসূল (সাঃ) দাম্ভিকতা, জাঁকযমক, বিলাসিতা ও লোক দেখানোর মানসিকতা কঠোরভাবে এড়িয়ে চলতেন। তিনি বলেছেনঃ
‘‘আমি আল্লাহর একজন দাস মাত্র এবং বান্দাদের উপযোগী পোশাকই পরি।’’ [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া-১ম খ-, পৃঃ ৩২৮।] রেশম জাতীয় পোশাককে তিনি পুরূষদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছেন। একবার উপহার স্বরূপ পাওয়া রেশমী জামা পরেছিলেন। কিন্তু অস্থিরতার সাথে তৎক্ষণাত তা খুলে ফেললেন। জামা, লুংগী ও পাগড়ী বেশী দীর্ঘ হওয়া অহংকারের আলামত ছিল এবং এ ধরনের পোশাক পরার প্রথা দাম্ভিক লোকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল বিধায় এটাকে তিনি প্রচন্ডভাবে ঘৃণা করতেন। [আবুদাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজা, তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ]।
অন্যান্য জাতির পোশাক বিশেষত তাদের ধর্মীয় যাজক শ্রেণীর নির্দিষ্ট ধরনের পোশাকের অনুকরণ করাকেও তিনি নিষিদ্ধ করেছেন। [মুসনাদে আহমাদ, আবুদাউদ]। উম্মতের স্বকীয়তা ও আত্মমর্যাদাবোধ যাতে বহাল থাকে এবং পোশাক ও ফ্যাশনের অনুকরণ করতে গিয়ে চরিত্র ও আদর্শের অনুকরণও শুরু হয়ে না যায়, সে জন্যই তিনি এরূপ নিষেধজ্ঞা আরোপ করেছেন। এ জন্য তিনি ইসলামী সংস্কৃতির আওতাধীন বেশভূষা, ফ্যাশন ও কৃষ্টি সম্পর্কে সম্পুর্ণ নতুন এক রুচির প্রচলন করেন। পোশাকে আবহাওয়াগত নিরাপত্তা, লজ্জা নিবারণ, সরলতা পরিচ্ছন্নতা ও গাম্ভভীর্য কিভাবে রক্ষা করা যায়, সে দিকে রসূল সা. বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতেন। রসূল (সাঃ) এর পোশাককে আমরা যদি সমকালীন সাংস্কৃতিক ধারা, আরবের ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ও আবহাওয়াগত প্রয়োজন এবং প্রচলিত রীতিপ্রথার প্রেক্ষাপটে দেখি, তাহলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, ঐ পোশাক ছিল অত্যন্ত উঁচুমানের রুচির প্রতীক। এবারে আসুন দেখা যাক রসূল (সাঃ) এর পোশাক কেমন ছিল? [শামায়েলে তিরমিযী,যাদুল মায়াদ ও আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া দ্রষ্টব্য]।
তিনি জামা খুবই পছন্দ করতেন। জামার আসিত্মন (হাতা) বেশী চাপাও হতোনা, বেশী ঢিলাও হতোনা। মধ্যম ধরনের হতো।আসিত্মন (হাতা) কখনো কনুই পর্যমত্ম এবং কখনো কবজি পর্যমত্ম লম্বা হতো। প্রবাসে বিশেষত জেহাদেও সফরে যাওয়ার সময় যে জামা পরতেন, তার দৈর্ঘ্য ও আস্তিনের দৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত কম হতো। সামনের দিকে বুকের ওপর জামার যে অংশটা থাকতো, তা আবহাওয়াগত প্রয়োজনে খোলাও রাখতেন এবং ঐ অবস্থায় নামাযও পড়তেন। জামা পরার সময় প্রথমে ডান হাত ও পরে বাম হাত ঢুকাতেন। সাহাবীগণকেও এটাই শিক্ষা দিতেন। ডান হাতের অগ্রাধিকার এবং ভালো কাজে ডান হাতের ব্যবহার রসূলের (সাঃ) শেখানো কৃষ্টির একটা গুরত্বপূর্ণ অংশ।
লুংগি সারা জীবনই ব্যবহার করতেন। এটা নাভির সামান্য নীচে রাখতেন এবং টাখনুর সামান্য ওপর পর্যন্ত পরতেন। সামনের অংশ ঈষৎ নামানো থাকতো।
পাজামা প্রথমে দেখেই পছন্দ করে ফেলেন। সাহাবীগণ ও পরতেন। একবার নিজে কিনেছিলেন। (পরেছিলেন কিনা সে ব্যাপারে মতভেদ আছে।) সেটি তাঁর পরিত্যক্ত সম্পত্তির মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। পাজামা খরিদ করার ঘটনাটা বেশ মজার। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কে সাথে নিয়ে রসূল(সাঃ) বাজারে গেলেন এবং পোশাক বিক্রেতাদের দোকানে উপস্থিত হলেন। চার দেরহাম দিয়ে পাজামাটা কিনলেন। বাজারে পণ্য দ্রব্যাদি মেপে দেখার জন্য একজন বিশিষ্ট ওযনকারী ছিল।তার কাছে পাজামাটা ওযন করাতে নিয়ে গেছেন এবং বললেনঃ‘‘এটি ঝুকিয়ে ওযন কর।’’(অর্থাৎ প্রকৃত ওযনের চেয়ে বেশী হয়, এমনভাবে ওযন কর।) ওযনকারী বললো,এমন কথা আমি আর কাউকে বলতে শুনিনি।হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেনঃ ‘তুমি কি তোমার নবীকে চেননা?’ লোকটি তৎক্ষণাত তাঁর হাতে চুমো খেতে এগিয়ে গেলে তিনি বাধা দিলেন এবং বললেনঃ এটা অনৈসলামিক পদ্ধতি।’’ যাহোক, তিনি পাজামাটা ওযন করিয়ে কিনে নিয়ে গেলেন।হযরত আবু হুরায়রা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কজিকি এটা পরবেন? তাঁর অবাক হওয়ার কারণ সম্ভবত এই ছিল যে, একেতো প্রাচীন অভ্যাসের এমন উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তনে বিস্ময় বোধ হচ্ছিল। দ্বিতীয়তঃ পাজামা ছিল পারস্যদেশীয় পোশাক। অথচ রসূল (সাঃ) বিজাতীয় সবকিছু এড়িয়ে চলতেন। (অবশ্য অন্যান্য জাতির সংস্কৃতির ভালো উপাদানকে গ্রহন করতেন।) রসূল (সাঃ)বললেন ‘‘হাঁ, পরবো। স্বদেশে, বিদেশে, দিনে কিংবা রাতে-সর্বাবস্থায় পরবো। কেননা আমাকে ছতর ঢাকার আদেশ দেয়া হয়েছে এবং পায়জামার চেয়ে ভালো ছতর ঢাকা পোশাক আর কোনটাই নেই।’’। [আল মাওয়াহেবুল লাদুন্নিয়া,প্রথম খন্ড,পৃ ৩৩৬-৩৩৭]।
মাথায় পাগড়ি পরতে খুবই ভালোবাসতেন। পাগড়ি খুব বড়ও হতোনা, খুব ছোটও হতোনা। এক বর্ণনা অনুসারে পাগড়ি ৭ গজ লম্বা হতো। পাগড়ির লেজ পেছনের দিকে এক বিঘাত ছেড়ে দিতেন। কখনো কখনো রৌদ্রের তীব্রতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পাগড়ি এবং লেজ চওড়া করে মাথার ওপর ছড়িয়ে দিতেন। আবহাওয়ার প্রয়োজনে কখনো কখনো পাগড়ির শেষ বৃত্ত খুলে ঘাড়ের চার পাশে জড়িয়ে নিতেন। কখনো পাগড়ি না থাকলে একটা বড় রুমাল মাথায় বেঁধে নিতেন। [কারো কারো মতে,কেবল অসুস্থ অবস্থায়ই এরূপ করতেন, বিশেষত মাথা ধরলে ]। পরিচ্ছন্নতার খাতিরে পাগড়িকে তেলচিটা থেকে রক্ষা করার জন্য পাগড়ির নীচে চুলের ওপর একটা বিশেষ কাপড় ব্যবহার করতেন, যার আরবী নাম ‘কান্না’। আজ কালও অনেকে টুপির নীচে কাগজ বা সেলোলাইডের একটা টুকরা ব্যবহার করে থাকে। এই টুকরায় তেলচিটা লাগতো ঠিকই। কিন্তু পরিচ্ছন্নতার ব্যপারে এত সচেতন ছিলেন যে, বিভিন্ন বর্ণনা মতে এই টুকরাটাকে কেউ কখনো ময়লা দেখেনি। সাদা ছাড়া কখনো কখনো হলুদ, (খুব সম্ভবত মেটে রং বা ছাই রং) পাগড়িও পরতেন। মক্কা বিজয়ের সময় কালো পাগড়িও ব্যবহার করেছেন। পাগড়ির নীচে কাপড়ের টুপিও ব্যবহার করতেন এবং তা পছন্দ করতেন। কোন কোন বর্ণনা মতে, টুপির সাথে পাগড়ির এ ব্যবহার ইসলামী সংস্কৃতির বিশেষ স্টাইল হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং রসূল (সাঃ) এ স্টাইলকে মোশরেকদের মোকাবিলায় বিশেষ ফ্যাশন বলে ঘোষণা করেন।
পাগড়ি ছাড়া কখনো কখনো শুধু সাদা টুপিও ব্যবহার করতেন। ঘরোয়া ব্যবহারের টুপি মাথার সাথে লেগে থাকতো। আর প্রবাসে যে টুপি পরতেন তা হতো অপেক্ষাকৃত উঁচু। ঘন সেলাই করা কাপড়ের সূচাঁলো টুপিও পরতেন।
চার গজ লম্বা ও সোয়া দুগজ চওড়া চাদর পরতেন। কখনো তা গায়ে জড়িয়ে নিতেন, কখনো একপাশ সোজা বগলের মধ্য দিয়ে বের করে উল্টো কাঁধের ওপর নিয়ে রাখতেন।এই চাদও দিয়ে কখনো কখনো বসা অবস্থায় পা জড়িয়ে রাখতেন, আবার কখনো কখনো তা ভা’জ করে মাথার নীচে বালিশের মত ব্যবহার করতেন। অভিজাত সাক্ষাত প্রার্থীদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যও কখনো কখনো চাদর বিছিয়ে দিতেন। জাবারা নামক ইয়ামানী চাদর খুবই পছন্দ করতেন। এতে লাল বা সবুজ ডোরা থাকতো। একবার রসূলের (সাঃ) জন্য কালো চাদর (সম্ভবত পশমী) বানানো হয়। সেটা পরলে ঘামের জন্য দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। তাই পরিচ্ছন্নতার জন্য তা আর পরেননি।
নতুন কাপড় সাধারণত শুক্রবারে আল্লাহর প্রশংসা ও শোকর সহকারে পরতেন। পোশাকের বাড়তি সেট বানিয়ে রাখতেন না। কাপড়ে তালি লাগাতেন, মেরামত করতেন। সতর্কতার জন্য মাঝে মাঝে গৃহে তল্লাশী চালাতেন যে, সাধারণ মানুষের সাথে ওঠাবসার কারণে কোন উকুন বা ছারপোকা চলে এলো কিনা। (নামাযের জামায়াতে এবং বৈঠককাদিতে মাঝে মাঝে অপরিচ্ছন্ন লোকেরাও আসতো। এই অপরিচ্ছন্নতার সাধারণ মানও একাধারে বহু বছর চেষ্টার পরই তিনি খানিকটা উন্নত করতে পেরেছিলেন।)
একদিকে দারিদ্র ও সরলতা তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল। অপর দিকে বৈরাগ্যবাদ প্রতিরোধ করাও তাঁর দায়িত্ব ছিল।আবার কোন এক সচ্ছল ব্যক্তিকে অতি মাত্রায় গরীবের মত জীবন যাপন করতে দেখেই বললেন,‘‘আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার জীবনে তাঁর দেয়া নিয়ামতের প্রভাব প্রতিফলিত হোক-এটা ভালোবাসতেন। [তিরমিযী ও নাসায়ী]।
এই মূলনীতি অনুসারে রসূল সা. নিজে কখনো কখনো ভালো পোশাকও পরতেন। মধ্যম ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থায় বসা তাঁর নীতি ছিল এবং তিনি তাঁর উম্মতকে উগ্রতা ও চরম পন্থা থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। তিনি চাপা আস্তিন বিশিষ্ট রোমীয় জুব্বাও একবার পরেছিলেন। লাল ডোরা বিশিষ্ট চমকপ্রদ সেটও পরেছেন। কখনো কখনো পারস্যেও রাজকীয় তাইলাসানী জুববাও পরেছেন। [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া]। একবার ২৭ উটনীর বিনিময়ে একসেট মূল্যবান পোশাক খরিদ করে পরেন এবং সেই অবস্থায় নামাযও পড়েন। এটা আসলে কুরআনের এই আয়াতের ব্যাখ্যা স্বরূপ ছিলঃ ‘‘বল, আল্লাহর দেয়া সৌন্দর্যোপকরণকে হারাম করেছে কে?’’(সূরা আরাফ) তবে সাধারণ নিয়ম ছিল এই যে, সরল ও অনাড়ম্বর পোশাকই তাঁর অধিকতর প্রিয় ছিল।
পোশাকের বেলায় সাদা রংই ছিল তাঁর সর্বাধিক প্রিয়। তিনি বলেছেনঃ তোমাদের জন্য আল্লাহর সামনে যাওয়ার সর্বোত্তম পোশাক সাদা পোশাক।’’ [আবু দাউদ,ইবনে মাজা]। তিনি আরো বলেছেনঃ সাদা কাপড় পর এবং সাদা কাপড় দ্বারা মৃতদের কাফন দাও। কেননা এটা অপেক্ষাকৃত পবিত্র ও পছন্দনীয়। [আহমদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ]।
সাদার পরেই তাঁর পছন্দনীয় রং ছিল সবুজ। তবে তাতে হালকা সবুজ ডোরা থাকা পছন্দ করতেন। একেবারে নির্ভেজাল লাল পোশাক খুবই অপছন্দ করতেন। (শুধু পোশাক নয়, বরং অন্যান্য জিনিসে লাল রং ক্ষেত্র বিশেষে নিষিদ্ধ করেছেন। তবে হালকা লাল রং এর ডোরাকাটা কাপড় তিনি পরতেন। অনুরূপ হালকা হলুদ (মেটে রং) এর পোশাকও পরেছেন।
রসূল (সাঃ) এর জুতা প্রচলিত আরবী কৃষ্টি অনুসারে চপ্পল বা খড়মের আকৃতি বিশিষ্ট ছিল। এর দুটো ফিতে থাকতো। একটা থাকতো পায়ের বুড়ো আংগুল ও তার পার্শববর্তী আংগুলের মাঝখানে। আর অপরটা থাকতো তার পার্শববর্তী দু’ আংগুলের মাঝে। জুতোর পশম থাকতোনা। অন্যান্য সাধারণ লোকদের জুতোর মত এটি এক বিঘত ২ আংগুল লম্বা হতো। কখনো দাঁড়িয়ে এবং কখনো বসে জুতো পরতেন। পরবার সময় প্রথমে ডান ও পরে বাম পা ঢুকাতেন। আর খোলার সময় প্রথমে বাম ও পরে ডান পা বের করতেন। মোজা পরতেন সাধারণ, মধ্যম ও উৎকৃষ্ট মানের। বাদশাহ নাজ্জাসী কালো মোজা উপহার দিয়েছিলেন। সেটি পরেছিলেন এবং তার ওপর মোসেহ করতেন। অনুরূপভাবে দিহয়া কালবীও মোজা উপহার দিয়েছিলেন এবং তিনি তা ছেড়ার আগ পর্যমত্ম পরেছেন।
রূপার আংটি ব্যবহার করেছেন।এতে রূপার ফলকও ছিল। কখনো হাবশী পাথরের ফলকও থাকতো। কোন কোন বর্ণনা মতে, লোহার আংটিতে রূপার পালিশ দেয়া থাকতো। অপর দিকে তিনি যে লোহার আংটি গহনা অপছন্দ করতেন তা সুবিদিত। আংটি সাধারণত ডান হাতেই পরতেন। তবে কখনো কখনো বাম হাতেও পরেছেন। মধ্যমা ও তর্জনী আংগুলে পরতেন না। মধ্যমার পার্শববর্তী আংগুলে পরাই পছন্দ করতেন। ফলক ওপরের দিকে নয় বরং হাতের পাতার দিকে রাখতেন। ফলকে ‘‘মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’’ খোদাই করা ছিল। এ দ্বারা তিনি চিঠিতে সিল দিতেন। ঐতিহাসিকগণের মতানুসারে এ আংটি সিলের প্রয়োজনেই বানানো হয়েছিল। রাজনৈতিক পদমর্যাদার কারণে এর প্রয়োজন ছিল অপরিহার্য।
বেশভূষা ও সাজ সজ্জা
রসূল (সাঃ) চুল খুব সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেন। প্রচুর তেল ব্যবহার করতেন। চিরম্ননী দিতেন, সিথি কাটতেন, ঠোটের বাড়তি পশম ছেঁটে ফেলতেন, দাড়িও লম্বায় চওড়ায় কাঁচি দিয়ে সমান করে রাখতেন। সাথীদেরকেও এ ব্যাপারে প্রশিক্ষন দিতেন। যেমন, এক সাহাবীকে এলোকেশী অবস্থায় দেখে খুবই ভৎর্সনা করলেন। এক সাহাবীর দাড়ির বাড়তি চুল নিজেই ছেঁটে দেন।বললেন, যে ব্যক্তি মাথার চুল বা দাড়ি রাখবে, তার সেটা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা উচিত। কাতাদাহকে বলেছিলেন, দাড়িকে সুন্দরভাবে রাখো। [আবু দাউদ]।
এ ব্যাপারে রসূল সা. তাকীদ করেছেন এ জন্য যে, অনেক সময় ধর্মীয় শ্রেণীর লোকেরা পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে উদাসীন হয়ে যায়। বিশেষতঃ বৈরাগ্যবাদী তাসাউফের প্রবক্তরা নোংরা থাকাকে উচ্চ মর্যাদার আলামত মনে করে থাকে। এই বিভ্রান্তি তিনি দূর করার ব্যবস্থা করেন। প্রবাসে বা গৃহে যেখানেই থাকুক, সাতটা জিনিস সব সময় কাছে ও বিছানার নিকট রাখতেনঃ তেলের শিশি, চিরুনী, সুর্মাদানী(কালো সুর্মা), কাচি, মেসওয়াক, আয়না এবং এক টুকরো হালকা কাঠ।
রাত্রে শোবার সময় প্রতি চোখে তিনবার করে সুর্মা নিতেন। শেষ রাতে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে ওযূ করতেন, পোশাক বদলাতেন, সুগন্ধী লাগাতেন। রায়হান নামক সুগন্ধী বেশী পছন্দ করতেন। মেহেন্দীর ফুলের সুগন্ধীও ভালোবাসতেন। সবচেয়ে বেশী প্রিয় ছিল মেশক ও চন্দনের সুগন্ধী।
বাড়ীতে সুগন্ধী দ্রব্যের ধুঁয়া ছড়াতেন। একটা আতরদানীতে উচ্চমানের সুগন্ধী থাকতো এবং ব্যবহৃত হতো। (কখনো কখনো হযরত আয়েশা নিজ হাতে সুগন্ধী লাগিয়ে দিতেন)। এ কথা সুপ্রসিদ্ধ যে, তিনি যে গলি দিয়ে হেঁটে যেতেন, সে গলি দীর্ঘ সময় সুবাসিত থাকতো। বাতাসই বলে দিত এখান দিয়ে একটু আগে চলে গেছেন সেই চিরবসন্তের বার্তাবাহক। কেউ সুগন্ধী দ্রব্য উপহার দিলে তা অবশ্যই গ্রহণ করতেন। কেউ যদি তাঁর সুগন্ধী উপহার গ্রহণ না করতো, তবে অসন্তুষ্ট হতেন। ইসলামী সংস্কৃতির বিশেষ অভিরুচি অনুযায়ী তিনি পুরুষদের জন্য এমন সুগন্ধী পছন্দ করতেন যার রং অদৃশ্য থাকে এবং সৌরভ চারদিকে ছড়ায়, আর মহিলাদের জন্য এমন সুগন্ধী পছন্দ করতেন, যার রং দেখা যায় এবং সৌরব ছড়ায়না।
চলাফেরা
রসূল (সাঃ) এর চলাফেরায় গাম্ভীর্য, আত্ম সম্মানবোধ, ভদ্রতা ও দায়িত্ববোধ প্রতিফলিত হতো। দৃঢ়ভাবে পা ফেলে চলতেন। অলসভাবে পা ঘসে ঘসে চলতেননা। চলার সময় দেহ থাকতো গুটানো। ডানে-বামে না তাকিয়ে পথ চলতেন। সামনের দিকে সতেজ পা তুলতেন। চলার সময় শরীর কিছুটা সামনের দিকে ঝুকে থাকতো। মনে হতো যেন ওপর থেকে নিচে নামছেন। হিন্দ বিন আবি হালার ভাষায়, ‘তাঁর চলা দেখে মনে হতো পৃথিবী তার চলার সাথে সাথে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। কখনো দ্রুত চললে পা দূরে দূরে রাখতেন। তবে সাধারণত মধ্যম গতিতে চলতেন। কিন্তু হযরত আবু হুরায়রা রাঃ ভাষায় ‘আমাদের পক্ষে তাঁর সাথে চলাই কষ্টকর হতো।’ তাঁর চলার ধরন ছিল সূরা লুকমানের ‘যমীনের ওপর দিয়ে দম্ভভরে চলোনা।’ এই নির্দেশটির বাস্তব প্রতিফলন।
কথা বার্তা
কথাবার্তা মানুষের বিশ্বাস,চরিত্র ও মর্যাদাকে পুরোপুরিভাবে উন্মোচিত করে। কথাবার্তার বিষয় ও শব্দ চয়ন, বাক্যের গঠন, স্বরের উত্থান পতন, বলার ভংগী ও বর্ণনার তেজস্বীতা এই সব কিছু বুঝিয়ে দেয় বক্তা কোন পর্যায়ের ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
রসূল (সাঃ) এর দায়িত্ব ও পদমর্যাদা এমন ছিল যে, সেই গুরুভার অন্য কারো ওপর চাপানো হলে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যেত এবং সে নির্জনে থাকা পছন্দ করতো। কিন্তু রসূল(সাঃ) এর অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল এই যে, একদিকে তিনি পাহাড় সমান গুরুদায়িত্ব ও চিন্তার বোঝা বয়ে বেড়াতেন এবং নানা রকম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে তাঁর সময় কাটতো। অপর দিকে লোকজনের সাথে গভীরভাবে মেলামেশা করতেন এবং দিনরাত আলাপ আলোচনাও চলতো। মেযাজে গাম্ভীর্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল হাসি তামাসা ও রসিকতা। পরস্পর বিরোধী গুণাবলীতে তাঁর বিস্ময়কর ভারসাম্য ছিল। একটা বিশ্বজোড়া আন্দোলন, পুরো একটা সাম্রাজ্যের সমস্যাবলী, একটা সমাজ ও সংগঠনের নানা জটিলতা এবং নিজের একটা বিরাট পরিবারের দায়িত্ব তাঁর জন্য পাহাড় সমান বোঝা ছিল। এই বোঝা তাঁরই কাঁধে চাপানো ছিল।ইমাম হাসান (রঃ) তাঁর মামা হিন্দ বিন আবি হালার বরাত দিয়ে বলেন, ‘রসূলুল্লাহ (সাঃ) সব সময় নানা ধরনের ব্যস্ততায় থাকতেন। নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে কেবল ভাবতেন আর ভাবতেন। কখনো তিনি এক মুহূর্ত চিন্তামুক্ত থাকতে পারেননি। দীর্ঘ সময় ধরে চুপচাপ থাকতেন। বিনা প্রয়োজনে কথা বলতেন না। [শামায়েলে তিরমিযী, রসূল(সাঃ) এর কথা বলার ধরণ সংক্রান্ত অধ্যায়]।
কিন্তু তিনি একজন প্রচারক ও আহবায়ক এবং একটা আন্দোলনের নেতা ছিলেন। এ জন্য প্রচার, শিক্ষাদান, সংস্কার ও সংশোধন এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত তৎপরতা চালানোর জন্য জনগণের সাথে যোগাযোগ অত্যাবশ্যক ছিল। আর এই যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন মাধ্যম ছিল কথা বলা। তাই সব রকমের আলাপ আলোচনায় অংশ গ্রহণ করাও ছিল তাঁর রীতি। হযরত যায়েদ বিন ছাবেত বলেনঃ ‘যখন আমরা দুনিয়াবী বিষয়ে আলোচনা করতাম, তখন রসূল (সাঃ) তাতেও অংশ নিতেন। যখন আমরা আখেরাতের বিষয়ে কথা বলতাম, তখন তিনিও সে বিষয়ে বক্তব্য রাখতেন। আমরা যখন খানাপিনা সম্পর্কে কোন কথা বলতাম, তখন তিনিও তাতে যোগ দিতেন। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও রসূল (সাঃ) কসম খেয়ে বলেছেন যে, আমার মুখ দিয়ে সত্য কথা ও ন্যায্য কথা ছাড়া আর কিছুই বের হয়নি। কোরআনও সাক্ষ্য দিয়েছে যে, তিনি মনগড়া কিছু বলেননা।’
কথা বলার সময় প্রতিটি শব্দ ধীরে ধীরে ও স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতেন যে, শ্রোতা তা সহজেই মুখস্ত করে ফেলতো, এমনকি শব্দগুলো বলার সাথে সাথে গণনাও করা যেত। উম্মে মা’বাদ তাঁর প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন, “তাঁর কথা যেন মুক্তোর মালা।” প্রয়োজনের চেয়ে কথা বেশীও বলতেন না, কমও বলতেন না। বেশী সংক্ষিপ্তভাবেও বলতেন না, অতিরিক্ত লম্বা করেও বলতেন না। কথার ওপর জোর দেয়া, বুঝানো এবং মুখস্থ করার সুবিধার্থে বিশেষ বিশেষ কথা ও শব্দকে তিনবার করে উচ্চারন করতেন। কোন কোন বিষয়ে স্পষ্টোক্তি সমীচীন মনে না করে আভাসে ইংগিতে কথা বলতেন। অশোভন, অশ্লীল ও নির্লজ্জ ধরনের কথাবার্তাকে ঘৃণা করতেন। কথাবার্তার সাথে সাধারণত একটি মুচকি হাসি উপহার দিতেন। আব্দুল্লাহ বিন হারিস বলেন, ‘আমি রসূল সা. এর চেয়ে বেশী মুচকি হাসতে কাউকে দেখিনি।’ এ মুচকি হাসি তাঁর গাম্ভীর্যকে কঠোরতায় পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করতো এবং সাথীদের কাছে আকর্ষণীয়তা বাড়াতো। কথা বলতে বলতে বারবার আকাশের দিকে তাকাতেন। বক্তব্য রাখার মাঝে কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার জন্য হঠাৎ হেলান দেয়া অবস্থা থেকে উঠে সোজা হয়ে বসতেন এবং বিশেষ বাক্যকে বারবার উচ্চারণ করতেন। শ্রোতাদেরকে কোন বিষয়ে সাবধান করতে চাইলে কথার সাথে সাথে মাটিতে হাত দিয়ে থাপড়াতেন। কোন কথা বুঝানোর ব্যাপারে হাত ও আংগুলের ইশারা দিয়েও সাহায্য নিতেন। যেমন, দুটো জিনিসের একত্রে সমাবেশ বুঝাতে তর্জনী ও মধ্যমা আংগুলকে একত্র করে দেখাতেন। কখনোবা দুই হাতের আংগুলগুলোকে পরস্পরের মাঝে ঢুকিয়ে দিয়ে দৃঢ়তা ও একাত্মতার ধারণা স্পষ্ট করতেন। কোন জিনিস বা কোন দিকে ইশারা করতে হলে পুরো হাতকেই নাড়াতেন। কখনো হেলান দিয়ে বসে জরুরী বিষয়ে আলোচনা করার সময় ডান হাতকে বাম হাতের পিঠের ওপর রেখে আংগুল যুক্ত করে নিতেন। বিস্ময় প্রকাশ করার সময় কখনো হাতের তালু উল্টে দিতেন। কখনো ডান হাতের তালু দিয়ে বাম হাতের বুড়ো আংগুলের মধ্যমাংশের ওপর আঘাত করতেন। কখনো মাথা দোলাতেন এবং ঠোঁটকে দাঁত দিয়ে চেপে ধরতেন। আবার কখনো হাত দিয়ে উরু চাপড়াতেন।
মক্কার কুরাইশ গোত্রের এক মার্জিত ভদ্র পরিবারের এই বিশিষ্ট ব্যক্তিটি বনু সা’দ গোত্রের পরিবেশে বেড়ে উঠে আরবের সবচেয়ে নির্ভুল ভাষা তো রপ্ত করছিলেনই, তদুপরি ওহীর প্রাঞ্জল ভাষা তাঁরা বাক্যালাপের মাধুর্যকে আরো পরিশীলিত করে দিয়েছিল। বস্তুত তিনি ছিলেন আরবের সর্বাপেক্ষা সুভাষী মানুষ। রসূল সা. এর ভাষার সাহিত্যিক মান যেমন উচ্চ ও উৎকৃষ্ট ছিল, তেমনি তা ছিল সহজবোধ্য এবং সরলও। সহজবোধ্য ভাষা ব্যবহার করলেও তিনি কখনো নিচুমানের ও অশালীন শব্দ ব্যবহার করেননি, আর কোন কৃত্রিম ধরনের ভাষাও পছন্দ করতেননা। সত্য বলতে কি, রসূল সা. নিজের দাওয়াত ও নিজের লক্ষ্যের প্রয়োজনে একটা নিজস্ব ভাষা তৈরী করে নিয়েছিলেন এবং একটা স্বতন্ত্র বাচনভংগীও বানিয়ে নিয়েছিলেন। রসূল সা. এর একটি উক্তি ‘যুক্ত একটা কৌশল’ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ছা’লাব বলেছেন যে, এটা রসূল সা. এর বিশেষ ভাষা। তিনি বহু পরিভাষা তৈরী করছেন। বহু নতুন বাগধারা, উপমা ও উদাহরণ উদ্ভাবন করেছেন। বক্তৃতার এক নতুন পদ্ধতি প্রচলন করেছেন, এবং প্রচলিত বহু শব্দ ও পদ্ধতি বর্জন করেছেন। একবার বনু নাহদ গোত্রের কয়েক ব্যক্তি এল এবং দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর সাথে আলাপ আলোচনা করলো। এই আলোচনার সময় আগন্তুকগণ অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে, ‘হে রসূলুল্লাহ, আপনি ও আমরা একই মা বাপের সন্তান এবং একই জায়গায় লালিত পালিত হয়েছি। তবুও আপনি এমন আরবীতে কথা বলেন, যার মর্মার্থ আমাদের অধিকাংশ লোকই বুঝতে পারেনা। এর রহস্যটা কী?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ্ স্বয়ং আমাকে ভাষা ও সাহিত্য শিখিয়েছেন, তাই সর্বোত্তম ভাশাই শিখিয়েছেন। তাছাড়া আমি বনু সা’দ গোত্রে পালিত হয়েছি। এটাই এর রহস্য।’ একবার জনৈক সাক্ষাতপ্রার্থীর সাথে কথা বলছিলেন এবং হযরত আবু বকর গভীর মনোযোগ দিয়ে তা শুনছিলেন। তিনি জিজ্ঞাস করলেন, ‘এই লোক আপনাকে কী বলেছে এবং আপনি কী বলেছেন?’ রসূল সা. বুঝিয়ে দিলেন। অতঃপর হযরত আবু বকর বলতে লাগলেন, ‘আমি সমগ্র আরবের আনাচে কানাচে ঘুরেছি এবং আরবের শ্রেষ্ঠ বাগ্মীদের বিশুদ্ধ ও সাবলীল বক্তব্য শুনেছি। কিন্তু আপনার চেয়ে মিষ্টিমধুর কথা আর কারো মুখ থেকে শুনিনি।’ এখানেও রসূল সা. একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন যে, আল্লাহ্ই আমাকে ভাষা শিখিয়েছেন এবং আমি বনু সা’দ গোত্রে লালিত পালিত হয়েছি। অনুরূপভাবে একবার হযরত ওমর রা. বললেন, হে রাসূল আপনিতো কখনো আমাদের কাছ থেকে দূরে থাকেননি, তবু আপনি আমাদের সবার চেয়ে সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন কিভাবে? তিনি বললেন, ‘আমার ভাষা ইসমাঈল আ. এর ভাষা। ওটা আমি বিশেষভাবে শিখেছি। জিবরীল এ ভাষাই আমার কাছে নিয়ে এসেছে এবং আমার অন্তরে তা বদ্ধমূল করেছেন।’ অর্থাৎ রসূল সা. এর ভাষা সাধারণ আরবী ছিলনা, বরং বিশেষ নবীসুলভ ভাষা ছিল এবং তা হযরত ইসমাঈলের ভাষার অনুরূপ ছিল। আর জিবরীল যে ভাষায় কোরআন নাযিল করতেন তাও ছিল সেই নবী সুলভ ভাষা।
এখানে মনে রাখা দরকার যে, বড় বড় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, বিশেষতঃ নবীগণ, যারা একটি বিশেষ ব্রত ও লক্ষ্য নিয়ে এসে পরিবেশের সাথে দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন এবং যাদের মধ্যে সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের আবেগ বিরাজ করে, তারা যখন কথা বলেন, তখন তাতে তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের মহত্ব গভীর তাৎপর্য ফুটিয়ে তোলে, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা তার সাহিত্যিক মানকে উন্নত করে এবং তাদের চারিত্রিক শ্রেষ্ঠত্ব তাকে পবিত্রতর করে।
রসূল সা. এর অন্যতম বিশিষ্ট ছিল এই যে, তাঁকে ‘জাওয়ামিউল কামিল’ দ্বারা ভূষিত করা হয়েছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, [মুসলিমঃ আবু হুরাইয়রা (রা)] (আমাকে ‘জাওয়ামিউল কালিম’ দেয়া হয়েছে।) রসূল সা. এর সংক্ষিপ্ততম বাক্যগুলো ব্যাপক তাৎপর্য বহন করে তাকেই বলা হয় ‘জাওয়ামিউল কালিম’। স্বল্পতম শব্দে ব্যাপকতম অর্থ বুঝানোতে রসূল সা. এর জুড়ি ছিলনা এবং একে তিনি আল্লাহ্র বিশেষ দান বলে গণ্য করেছেন।
এখানে তাঁর জাওয়ামিউল কালিমের কিছু উদাহরণ দেয়া যাচ্ছেঃ-
১। (*******) মানুষ যাকে ভালোবাসে, কেয়ামতের দিন তার সাথেই থাকবে।
২। (*******) মুসলিম হও শান্তিতে থাকতে পারবে। [রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নামে প্রেরিত দাওয়াত পত্রের অংশ।]
৩। (******) নিয়ত অনুসারে কাজের বিচার হবে।
৪। (******) যে কাজ করে, সে কেবল আপন নিয়ত অনুযায়ীই তার ফল পায়।
৫। (******) সন্তান যারা গৃহে ভূমিষ্ঠ হয়, তার। আর ব্যভিচারীর জন্য পাথর।
৬। (******) যুদ্ধ একটি কৌশল।
৭। (******) দেখা ও শোনা এক কথা নয়।
৮। (******) বৈঠকের জন্য বিশ্বস্ততা জরুরী।
৯। (******) খারাপ কাজ বর্জন করাও একটা ভালো কাজ।
১০। (******) জনগণের যিনি সেবা করেন, তিনিই তাদের নেতা।
১১। (******) প্রত্যেক সৌভাগ্যশালী ব্যক্তির প্রতি ঈর্ষা পোষণ করা হয়।
১২। (******) ভালো কথা বলাও সৎ কাজের শামিল।
১৩। (******) যে দয়া করেনা, সে দয়া পায়না।
সাধারণত ভাষা, বাচনভংগী ও বিষয়বস্তু দ্বারা রসূল সা. এর উক্তি চেনা যায়। হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে রসূল সা. এর উক্তি সমূহ মুক্তার মত উজ্জ্বল। অল্প ক’টা শব্দ, শব্দগুলোর মধ্যে চমৎকার সমন্বয়, অর্থের গভীরতা ও হৃদয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারী আন্তরিকতা রসূল সা. এর কথায় উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। এ সব বৈশিষ্টে সমৃদ্ধ দু’ একটা কথা উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করছিঃ
আমি তোমাদেরকে সদা সর্বদা আল্লাহ্কে ভয় করার উপদেশ দিচ্ছি। সামষ্টিক ব্যবস্থার জন্য নেতার আদেশ শ্রবণ ও অনুসরণের জোর আহ্বান জানাচ্ছি চাই সে নেতা কোন নিগ্রো ক্রীতদাসই হোকনা কেন। কেননা তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে, তারা অসংখ্য মতভেদে লিপ্ত থাকবে। এমতাবস্থায় তোমাদের কর্তব্য আমার ও আমার সুপথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের পথ অবলম্বন করা, তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা এবং দাঁতের মাড়ি দিয়ে চেপে ধরা। সাবধান, ইসলামের মধ্যে নতুন নতুন নিয়ম চালু করা থেকে বিরত থেকো। কেননা প্রত্যেক নতুন নিয়ম বেদয়াত। আর প্রত্যেক বেদয়াত গোমরাহী।২৪ [২৪. মিশকাত- বাবুল ইতিসাম বিন কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ ]।
আমর বিন আবাসা রা. রসূল সা. এর কাছে কিছু প্রশ্ন রাখেন এবং তিনি এগুলোর খুব সংক্ষিপ্ত ও ক্ষুদ্র জবাব দেন। এই ক্ষুদ্র সংলাপটি লক্ষ্য করুন !
– এই কাজে (ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনে) প্রথম প্রথম আপনার সাথে কে কে ছিল?
– একজন স্বাধীন মানুষ (হযরত আবু বকর) এবং একজন ক্রীতদাস (হযরত যায়েদ)।
– ইসলাম কী?
– ভালো কথা বলা ও ক্ষুধার্তদের খাওয়ানো।
– ঈমান কী?
– ধৈর্য ও দানশীলতা।
– কার ইসলাম সর্বোত্তম?
– যার জিহ্বা ও হাতের বাড়াবাড়ি (অর্থাৎ মন্দ কাজ ও মন্দ কথা) থেকে মানুষ নিরাপদে থাকে।
– কার ঈমান উৎকৃষ্ট?
– যার চরিত্র ভালো তার।
– কি ধরনের নামায উত্তম?
– যে নামাযে বিনয়ের সাথে দীর্ঘ সময় দাঁড়ানো হয়।
– কি ধরনের হিজরত উত্তম?
– তোমার প্রতিপালকের অপছন্দনীয় জিনিসগুলোকে চিরতরে পরিত্যাগ করা।
– কোন জেহাদ উত্তম?
– সেই ব্যক্তির জেহাদ, যার ঘোরাও রণাঙ্গনে মারা যায় আর সে নিজেও শহীদ হয়।
– কোন সময়টা (এবাদতের জন্য) সর্বোত্তম?
– রাতের শেষ প্রহর। [মেশকাত- কিতাবুল ঈমান।]
একবার জিজ্ঞাসা করা হলো, প্রধানত কোন জিনিস মানুষের জন্য জাহান্নাম অনিবার্য করে তোলে? তিনি জবাব দিলেন, “মুখ ও লজ্জাস্থান।” [তিরমিযী- আবু হুরায়রা বর্ণিত।] মুখ দ্বারা বুঝানো হয়েছে কথা ও খাদ্য। আর লজ্জাস্থান দ্বারা বুঝানো হয়েছে অবৈধ যৌনাচার। অর্থাৎ খারাপ কথা, হারাম জীবিকা ও যৌন বিপথগামিতা মানুষের আখেরাতের ধ্বংসকারী সবচেয়ে বড় উপকরণ। অধিকাংশ যুলুম, নির্যাতন, দ্বন্দ্ব সংঘাতগুলোও এগুলো থেকেই জন্ম নেয়।
একবার হযরত আলী অনুরোধ করলেন, আপনি নিজের নীতি ব্যাখ্যা করুন। তিনি এর জবাবে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ এত অলংকার মণ্ডিত ভাষায় নিজের চিন্তাধারা, স্বভাব ও আধ্যাত্মিকতার এমন ব্যাপক চিত্র তুলে ধরলেন, যা মানুষের ভাষার ইতিহাসে এক অলৌকিক নিদর্শন। তিনি বললেনঃ
“আল্লাহ্র পরিচয় আমার পুঁজি, বুদ্ধি আমার দীনের মূল, ভালোবাসা আমার ভিত্তি। আকাংখা আমার বাহন, আল্লাহ্র স্মরণ আমার বন্ধু, আস্থা ও বিশ্বাস আমার সাথী, জ্ঞান আমার অঙ্গ, ধৈর্য আমার পোশাক, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি আমার জন্য অতিবড় নিয়ামত, বিনয় আমার সম্মান, যোহাদ তথা পার্থিব সম্পদ নিস্পৃহতা আমার পেশা, প্রত্যয় আমার শক্তি (উচ্চারণ ভেদে অর্থ খাদ্য), সত্যবাদীতা আমার সুপারিশকারী। আনুগত্য আমার রক্ষাকবচ, জেহাদ আমার চরিত্র আর নামায আমার চক্ষু শীতলকারী।” [কাজী আইয়াযঃ আশ শিফা।]
উদাহরণ ও উপমার অনেক বিরল দৃষ্টান্ত রসূল সা. এর কথায় পাওয়া যায়। এগুলোর সাহায্যে তিনি বেদুইনদেরকে অনেক বড় বড় জিনিস বুঝিয়ে দিতেন। এখানে তার একটি উপস্থাপন করছিঃ
“আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে হেদায়াত ও এলমের যে পুঁজি দান করেছেন, তার উদাহরণ এরূপ, যেন পৃথিবীতে মুষলধারে বৃষ্টি হলো। তারপর পৃথিবীর যে অংশটা সবচেয়ে উর্বর, তা পানিকে খুব চুষে নিল। এর ফলে ঢলে পড়া তরুলতা সব তরতাজা হয়ে গেল এবং নতুন নতুন গাছ গাছালি জন্ম নিল। এ ছাড়া ভূমির কিছু শক্ত অংশ এমনও ছিল, যা পানিকে তার ভেতরে সঞ্চিত করে রাখলো এবং আল্লাহ তাতে মানুষের জন্য বহু উপকার নিহিত রাখছেন। তিনি তা থেকে পানি সেচ করালেন। তারপর এই পানি তিনি অন্য একটা ভুখন্ডেও বর্ষালেন যা পাথরে পরিপূর্ণ ছিল। এই মাটি পানিকে সঞ্চয় করেও রাখলোনা, নিজের ভেতরে শুষে নিয়ে উর্বরতার লক্ষণও দেখালোনা। এর একটি হলো সেই সব লোকদের উদাহরণ যারা ইসলামের জ্ঞান অর্জন করে এবং আল্লাহ আমাকে যে নির্দেশাবলী দিয়েছেন তা দ্বারা উপকৃত হয়। তারা নিজেরাও ইসলামের জ্ঞান অর্জন করে এবং অন্যদেরকেও শেখায়। দ্বিতীয় উদাহরণটা যারা আমার দাওয়াতকে এবং আমার মাধ্যমে আল্লাহ্র পাঠানো হেদায়াতকে গ্রহণ করেনি তাদের।”
রসূল সা. এর কথা বলার নীতিকে যদি কোন শিরোনাম দিতে হয়, তবে তা কোরআনের এই বাক্য দ্বারা দেয়া চলে যে, “মানুশকে আকর্ষণীয় ভাষায় আহ্বান জানাও।” রসূল সা. এর চিত্তাকর্ষক বাক রীতিতে সরলতার ভাব নিহিত ছিল, কৃত্রিমতা থেকে তিনি থাকতেন বহুদুরে। তিনি বলেনঃ
“তোমাদের মধ্যে যারা কেয়ামতের দিন আমার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশী দূরে থাকবে তারা হলো ঐ সবলোক যারা অতিরঞ্জিত করে কথা বলে, বেশী কথা বলে এবং কথার মধ্যে দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে।”
তাছাড়া বাচালতাপূর্ণ ও অশ্লীল কথাবার্তাও তিনি খুবই অপছন্দ করতেন। তাঁর মজলিস সব সময় হাস্যোজ্জল থাকতো এবং তাঁর চেহারাই ছিল সবচেয়ে বেশী হাসিময়, যদিও কঠিন দায়িত্ব ও বিপদমুসিবতে প্রায় সর্বদাই ঘেরাও হয়ে থাকতেন।
বক্তৃতা
কথাবার্তারই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বক্তৃতা। রসূল সা. মানব জাতির জন্য একটা বিরাট ও মূল্যবান বার্তা বয়ে এনেছিলেন এবং সে জন্য বক্তৃতা ছিল অপরিহার্য। আরবরা এমনিতেও সুবক্তা হতো। বিশেষত কুরাইশগণ হতো অসাধারণ বক্তৃতা শক্তির অধিকারী। আরব ও কুরাইশদের বক্তৃতার পরিবেশ থেকে রসূল সা. অনেক ঊর্ধে থাকতেন। নেতাসূলভ কর্তব্যের তাগিদে কখনো বক্তৃতা দেয়ার প্রয়োজন হলে তিনি কাল বিলম্ব না করেই সময়োপযোগী ভাষণ দিতেন। তখন তার জিহ্বা কখনো ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসের মত, কখনো প্রবল স্রোতধারার মত এবং কখনো ধারালো তরবারীর মত সক্রিয় হয়ে উঠতো।
তবে তিনি বেশী ঘন ঘন বক্তৃতা ও ভাষণ দেয়া থেকে বিরত থাকতেন। সমাজের প্রয়োজন ও তার সার্বিক পরিবেশ অনুসারে ভারসাম্যপূর্ণ বক্তৃতা দিতেন। মসজিদে বক্তৃতা দিলে নিজের লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাড়াঁতেন, আর যুদ্ধের ময়দানে ভাষণ দিলে কামানের ওপর হেলান দিয়ে দাড়াঁতেন। কখনো কখনো বাহন জন্তূর পিঠের ওপর বসে ভাষণ দিতেন। বক্তৃতার সময় শরীর ডান দিকে ও বাম দিকে ঈষৎ ঝুঁকে যেত। প্রয়োজনমত হাত নাড়তেন। বক্তৃতার মধ্যে কখনো কখনো ‘যার হাতে আমার প্রাণ, বা যার হাতে মুহাম্মদের জীবন তার শপথ’ এই বলে শপথ করতেন। তাঁর মনের ভাবাবেগ তাঁর স্বরে ও চেহারায় সমভাবে প্রতিফলিত হতো এবং শ্রোতাদের ওপরও তার প্রভাব পড়তো। এই মহামানবের ভাষণ মানুষের মনকে প্রচন্ডভাবে আলোড়িত করতো। এখানে আমি শুধু দুটো উদাহরণ দেবো। হোনায়ন ও তায়েফ যুদ্ধের পর রসূল সা. যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বন্টন করার সময় কোরআনের সুস্পষ্ট বিধান মোতাবেক মাক্কার নওমুসলিম সরদারদেরকে বেশ বড় বড় অংশ দিলেন, যাতে তাদের মন আরো নরম হয় এবং তারা মহানুভবতার বন্ধন দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ হয়। আনসারগণের মধ্যে কেউ কেউ এতে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন। তারা বললেনঃ
“রসূল সা. কুরাইশদের অনেক পুরস্কার দিলেন, আর আমাদেরকে বঞ্চিত রাখলেন। অথচ আমাদের তলোয়ার থেকে এখনো রক্তের ফোঁটা ঝরছে’’ কেউবা বললেনঃ
“বিপদাপদে আমাদের কথা মনে পড়ে। কিন্তু যুদ্ধলব্ধ সম্পদ পেয়ে যায় অন্যরা।’’
এই সব কথাবার্তা রসূল সা. এর কানেও গেল। তখন একটা চামড়ার তাঁবু খাটিয়ে সেখানে আনসারদের সমবেত করা হলো। রসূল সা. তাদের জিজ্ঞাসা করলেনঃ “তোমরা কি এ সব কথা বলেছ?’’ জবাব দেয়া হলোঃ “আপনি যা শুনেছেন তা সত্যি। তবে এ সব কথা আমাদের দায়িত্বশীল লোকেরা বলেনি। কতক যুবক এ কথাগুলো বলেছে।’’ পুরো ঘটনার তদন্ত শেষে রসূল সা. নিম্নরূপ ভাষণ দিলেনঃ
‘এ কথা কি সত্য নয় যে, তোমরা প্রথমে পথভ্রষ্ট ছিলে, অতঃপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের সুপথে পরিচালিত করলেন? তোমরা কতটা বিচ্ছিন্ন ছিলে, আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন? তোমরা দরিদ্র ছিলে, আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের স্বচ্ছল বানিয়েছেন? (প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে আনসারগণ বলছিলেন, নিসন্দেহে আমাদের ওপর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অনেক দান রয়েছে।)
‘না, তোমরা বরং জবাবে এ কথাও বলতে পারতে যে, হে মুহাম্মদ, তোমাকে যখন সবাই প্রত্যাখ্যান করেছে, আমরা তখন তোমার ওপর ঈমান এনেছি। তোমাকে যখন লোকেরা বিতাড়িত করেছে, আমরা তখন তোমাকে আশ্রয় দিয়েছি। তুমি যখন নিসম্বল অবস্থায় এসেছিলে, আমরা তখন তোমাকে সাহায্যে করেছিলাম। তোমরা যদি জবাবে এসব কথা বল, আমি অবশ্যই বলবো যে, তোমাদের কথা সত্য। কিন্তু ওহে আনসারগণ! তোমাদের কি এটা পছন্দ নয় যে, অন্য সবাই উট ছাগল ইত্যাদি নিয়ে যাক, আর তোমরা মুহাম্মদ সা. কে নিয়ে বাড়ী চলে যাও? (বোখারী)
কথার চড়াই উৎরাই দেখুন, নাযুক ভাবাবেগ দ্বারা শানিত বক্তৃতার তেজ দেখুন, ভাষণের প্রাঞ্জলতা দেখুন এবং তারপর ভাবুন যে, বক্তা কিভাবে শ্রোতাদের মধ্যে ইপ্সিত প্রেরণার সঞ্চার করলেন। আনসারগণ স্বতস্ফূর্তভাবে চিৎকার করে বলে উঠলেনঃ “আমরা শুধু মুহাম্মদ সা. কে চাই, আর কিছু চাইনা।’’
দাওয়াতের সূচনা পর্বে সাফা পর্বতের ওপর থেকে প্রদত্ত ভাষণ ছাড়াও তিনি একাধিকবার কুরাইশদের সামনে ভাষণ দিয়েছেন। এই যুগের একটা ভাষণের উদ্ধৃতি লক্ষ্যণীয়ঃ
“কাফেলার পথপ্রদর্শক কখনো কাফেলাকে ভুল তথ্য জানায়না। আল্লাহর কসম, আমি যদি অন্য সকলের সাথে মিথ্যা বলতে রাযীও হয়ে যেতাম, তবুও তোমাদের সাথে মিথ্যা বলতামনা। অন্য সবাইকে যদি ধোকা দিতাম, তবুও তোমাদের ধোকা দিতামনা। সেই আল্লাহর শপথ যিনি ছাড়া আর কেউ এবাদত উপাসনা পাওয়ার যোগ্য নেই, আমি তোমাদের কাছে বিশেষভাবে এবং সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে সামগ্রিকভাবে আল্লাহর রসূল। আল্লাহর কসম, তোমরা যেমন ঘুমাও ও ঘুম থেকে জাগো, তেমনি তোমাদের মৃত্যু ও মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন সুনিশ্চিত। তোমাদের কাছ থেকে অবশ্যই তোমাদের কৃত কর্মের হিসাব নেয়া হবে এবং তোমাদেরকে ভালো কাজের ভালো প্রতিফলন ও মন্দ কাজের মন্দ পরিণাম তোমাদের ভোগ করতেই হবে। অতপর হয় চিরদিনের জন্য জান্নাত, নচেত চিরদিনের জন্য জাহান্নাম।’’
কত সরল ও সাবলীল বর্ণনাভংগী এবং কত যুক্তিপূর্ণ এবং আবেগপূর্ণ আবেদন। আহ্বায়কের হিতাকাংখা প্রতিটি শব্দের মধ্য দিয়ে নিসৃত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি বাক্য বিশ্বাস ও প্রত্যয় দ্বারা পরিপূর্ণ। এই ক্ষুদ্র ভাষণটিতে উদাহরণও দেয়া হয়েছে। তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের মৌলিক দাওয়াত এতে পরিপূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত।
রসূলের সা. আরো দুটো ঐতিহাসিক ভাষণ রয়েছে। একটা মক্কা বিজয়ের পর এবং অপরটি বিদায় হজ্জের সময় দিয়েছিলেন। এই ভাষণ দুটি একেবারেই বৈপ্লবিক প্রকৃতির এবং ঐ দুটোতে ঈমান, নৈতিকতা ও ক্ষমতা–তিনটেরই প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। বিদায় হজ্জের ভাষণ তো বলতে গেলে একটা নবযুগের উদ্ভোধনের ঘোষণা।