মানবীয় প্রয়োজন
প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের জন্য সেকালে পায়খানার প্রথা না থাকায় তিনি মাঠে জংগলে চলে যেতেন। সাধারণত এত দূরে চলে যেতেন যে চোখের আড়াল হয়ে যেতেন। কখনো কখনো দু’মাইল পযন্ত চলে যেতেন। এজন্য এমন নরম মাটি খুজতেন, যাতে ছিটে না আসে। প্রয়োজন পূরণের জায়গায় প্রথমে বাম পা ও পরে ডান পা রাখতেন। বসার সময় ভূমির অতি নিকটে গিয়েই কাপড় খুলতেন। কোন টিলা বা গাছ ইত্যাদির আড়ালেই বসতেন। এ সময় পায়ে জুতো ও মাথায় আচ্ছাদন নিয়েই বেরুতেন। কেবলার দিকে মুখ বা পিঠ দিয়ে বসতেন না। প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের সময় হাতের আংটি খুলে নিতেন। (কারণ তাতে আল্লাহ ও রসূলের সা. নাম খোদিত ছিল।) সব সময় বাম হাত দিয়ে শৌচক্রিয়া সম্পন্ন করতেন। প্রয়োজনের জায়গা থেকে বেরুবার সময় প্রথমে ডান পা ও পরে বাম পা ফেলতেন।
গোছলের জন্য পর্দাকে অপরিহার্য গণ্য করেছিলেন। ঘরে গোছল করলে কাপড়ের পর্দা টানিয়ে নিতেন। বৃষ্টিতে গোছল করলে মাথায় লুংগি বেঁধে নিতেন। হাঁচি দেয়ার সময় স্বল্প শব্দ করতেন এবং হাত বা কাপড় মুখে চেপে নিতেন।
প্রবাস
প্রবাসে বা সফরে রওনা হবার জন্য বৃহস্পতিবারটা অধিক পছন্দ করতেন। বাহনকে দ্রুত চালাতেন। বিরতিস্থল থেকে সকাল বেলা যাত্রা করাটাই তাঁর অভ্যাস ছিল। প্রবাসকালে যে সব সামষ্টিক কাজ থাকতো, তাতে অবশ্যই অংশগ্রহণ করতেন। একবার রান্নার আয়োজন ছিল। সঙ্গীরা যখন নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিল, তখন তিনিও জ্বালানী কাঠ সংগ্রহের দায়িত্বে ঘাড়ে নিলেন। সবাই বললো, আপনার কষ্ট করার দরকার নাই। আমরাই যথেষ্ট। তিনি বললেন, আমি তোমাদের মধ্যে পৃথক মর্যাদা নিয়ে বসে থাকা পছন্দ করি না। [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া (১ম খন্ড, পৃঃ ২৯৪)] ভ্রমণকালে পালাক্রমে কোন কোন পদাতিক সহযাত্রীকে নিজ বাহনে আরোহণ করাতেন। রাতের বেলা প্রবাস থেকে ফেরা পছন্দ করতেন না। ফিরলে সোজা বাড়ীতে যাওয়ার পরিবর্তে আগে মসজিদে গিয়ে নফল নামাজ পড়ে নিতেন। বাড়ীতে খবর পৌঁছার পর বাড়ীতে যেতেন।
আবেগ ও অনুভূতি
আবেগ ও অনুভূতির কথা বাদ দিয়ে আমরা মানবতার কথা ভাবতে পারি না। রসূল সা. এর মধ্যেও মানবীয় অনুভূতি সর্বোত্তম পর্যায়ে বিদ্যামান ছিল। তিনি ছিলেন তীব্র অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ। আনন্দে আনন্দিত ও দুঃখ বেদনায় ব্যথিত হতেন।
যারা সারা দুনিয়ার দুঃখশোকে মুহ্যমান হন, কিন্তু পরিবারের দুঃখশোকে পাষাণ ও নিরুদ্বেগ থাকেন, সেই সব তথাকথিত মহামানবদের কাতারে তিনি শামিল ছিলেননা। মহিয়ষী জীবন সংগিনীদের প্রতি তাঁর আন্তরিক ভালবাসা ছিল। হযরত আয়েশা রা. সাথে একই পাত্রে পানি পান করতেন। আনসারদের মেয়েদেরকে ডেকে আনাতেন তারঁ স্ত্রীদের সাথে খেলা করার জন্য। নিগ্রোদের ক্রীড়া নৈপুন্য দেখতে দেখতে হযরত আয়েশা রা. এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, রসূল সা. এর কাঁধের উপর ভর দিয়ে দেখছিলেন। এরপরও তিনি যখন আয়েশাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কি তোমার তৃপ্তি হয়েছে? তখন হযরত আয়েশা বললেন, ‘না আরো দেখবো’। এভাবে দীঘ সময় ধরে এ অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া (১ম খন্ড, পৃঃ ২৯৬)।] হযরত সাফিয়া রা. কে উটের ওপর আরোহণ করানোর জন্য তিনি নিজের হাঁটু এগিয়ে দেন এবং সেই হাঁটুর উপর দাঁড়িয়ে সাফিয়া রা. উটে আরোহণ করেন। একবার উষ্ট্রী পা পিছলে পড়ে গেলে রসূল সা. এবং হযরত সাফিয়া মাটিতে পড়ে যান। হযরত আবু তালহা সাথে ছিলেন। তিনি রসূল সা. এর কাছে ছুটে গেলে তিনি বললেন, আগে মহিলাকে উদ্ধার কর। একবার কাফেলার তত্ত্বাবধায়ক উটগুলোকে দ্রুত চালালে রসূল সা. বললেন, ‘সাবধান, কাঁচের পাত্রে রয়েছে কাঁচের পাত্র। একটু ধীরে, সাবধান।’ [বুখারী ও মুসলিম, (কাঁচের পাত্র দ্বারা নারীদের বুঝিয়েছেন)।] এই ভালবাসার কারণেই একবার মধু না খাওয়ার কসম খেয়ে ফেলেছিলেন। এবং সে জন্য ‘হালাল জিনিসকে হারাম করোনা’ বলে কুরআনে তাঁকে ভৎসনা করা হয়েছিল। [পাশ্চাত্যের লেখকরা রসূল (সা) এর এই পবিত্র ও নির্মল দাম্পত্য জীবনের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। অথচ তাদের সভ্যতায় সর্বাপেক্ষা দায়িত্বশীল ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন যে কয়জন মানুষ জন্মেছে, তারা শুধু যে ঘরোয়া জীবনেই পংকিলতার পর্যায়ে পৌঁছেনি বরং এই পরিমন্ডলের বাইরেও তারা জঘন্য কলংকময় জীবন যাপন করে থাকেন। রসূল (সা) এর বৈশিষ্ট্য ছিল, তাঁর সমস্ত আবেগ অনুভূতি ও কামনাবাসনা নিজের স্ত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তাও ছিল পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতায় সুষমামন্ডিত। তিনি প্রকৃতির দাবীগুলোকে শালীনতার সীমার মধ্যে রেখে অধিকতর সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন এবং দাম্পত্য প্রেমের এক পরিশীলিত রীতির পত্তন করেন।]
নিজের সন্তানদের প্রতিও রসূল সা. এর স্নেহ মমতা ছিল অত্যন্ত গভীর। হযরত ইবরাহীমকে মদীনার উপকন্ঠে এক কামার পরিবারের ধাই এর কাছে দুধ খাওয়াতে দিয়েছিলেন। তাকে দেখতে অনেক দূরে হেটে চলে যেতেন। ধূয়ায় আচ্ছন্ন ঘরে বসতেন এবং ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করতেন। হযরত ফাতেমা রা. এলে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করতেন। কখনো কখনো নিজে যেতেন। নিজের অবস্থা বলতেন এবং তাঁর অবস্থা শুনতেন। তাঁর দু’ছেলে ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেন রা. কে অত্যধিক স্নেহ করতেন। তাদের কোলে নিতেন, ঘাড়ে ওঠাতেন এবং নিজে ঘোড়া সেজে পিঠে চড়াতেন। নামাযের সময়ও তাদের ঘাড়ে উঠতে দিতেন। একবার হযরত আকরা বিন হাবিস তাঁকে হযরত হাসানকে চুমু খেতে দেখে অবাক হয়ে বললেন, আমার তো দশটা ছেলে রয়েছে। কিন্তু কাউকেও এভাবে আদর করিনি। অথচ আপনি চুমু খান। রসূল সা. বললেন, যে দয়া স্নেহ করেনা সে দয়া স্নেহ পায়না।
ছেলে ইবরাহীম যখন মারা গেল, তখন শোকে তাঁর চোখ ছলছল করে উঠলো। আরো এক মেয়ে তাঁর সামনেই মারা গেল। চাকরানী উম্মে আইমান চিৎকার করে কাদঁতে লাগলো। রসূল সা. তাকে নিষেধ করলেন। সে বললো, আপনি ও তো কাদঁছেন। রসূল সা. বললেন, এভাবে (নিঃশব্দে বা মৃদু শব্দে) কাঁদা নিষিদ্ধ নয়। মনের যে কোমলতা ও মমত্বের কারণে এই (মৃদু) কান্না আসে, সেটা আল্লাহর রহমত স্বরুপ। তাঁর মেয়ে উম্মে কুলসুমের কবরে যখন দাঁড়ান, তখনও তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। হযরত উসমান বিন মাযউনের লাশের সামনেও তাঁর চোখ অশ্রু সজল ছিল। তিনি তাঁর কপালে চুমু খেয়েছিলেন। [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৯৭]। নিজের কান্নার স্বরূপ বর্ণনা করে তিনি বললেন, ‘চোখ অশ্রুসজল, হৃদয় মর্মাহত, কিন্তু তবুও আমরা মুখ দিয়ে এমন কোন কথা উচ্চারণ করবোনা, যা আল্লাহ পছন্দ করেন না। দুঃখ শোকের সময় প্রায়ই পড়তেন حسبنااللهونعمالوكيل উচ্চশব্দে কখনো কাঁদতেন না, কেবল দীর্ঘ শ্বাস ছাড়তেন এবং বুকের মধ্য থেকে হাড়িতে সিদ্ধ হওয়ার শব্দের মত শব্দ বেরুতো।
এহেন দরদী হৃদয় যখন আল্লাহর কাছে কোন আকুতি জানাতো তখন সে সময়েও চোখের পাতায় অশ্রু মুক্তার মত চিক চিক করতো। একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে কোরআন তেলাওয়াতের অনুরোধ করলেন। তিনি যখন সুরা নিসার এই আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলেনঃ ‘যখন আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্য থেকে একজন সাক্ষী হাজির করবো এবং তোমাকে এদের ওপর সাক্ষী বানাবো তখন কী উপায় হবে?’ এ সময় রসূলের সা. চোখ দিয়ে অশ্রুর স্রোত বয়ে গেল। [অধিকাংশ ঘটনা শামায়েলে তিরমিযী থেকে সংকলিত]
সমগ্র মানব জাতির প্রতি এবং বিশেষত মুসলিম জামায়াতের সদস্যদের প্রতি রসূল সা. এর যে গভীর স্নেহ মমতা ও সহানুভূতি ছিল, তাঁর হৃদয়ের এই কোমলতাই ছিল তাঁর উৎস। এত কোমল হৃদয় এবং এত আবেগ ভরা মন নিয়েও রসূল সা. কঠিন বিপদ মুসিবতে যে ধৈয ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন, সেটা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার।
রসিকতা
আমি আগেই বলেছি, রসূল সা. সদা হাসিমুখ ছিলেন। তিনি বলেছেনঃ ‘তোমর ভাই-এর দিকে মুচকি হাসি নিয়ে তাকানোটাও একটা সৎ কাজ।’ রসূল সা. এর সম্পর্কে এ কথাও বর্ণিত হয়েছে যে, ‘তিনি অত্যন্ত হাসিমুখ ও সদাপ্রফুল্ল ছিলেন।’
পৃথিবীতে বড় বড় কীর্তি সম্পাদনকারী ব্যক্তিগণের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো, তাঁরা জীবনের কঠিন দায়িত্বের বোঝাকে নিজেদের মুচকি হাসির সাহায্যে সহনীয় করে নেন। এবং সাথীদের হৃদয়ের গভীরে নিজেদের আসন প্রতিষ্ঠিত করে নেন। তিনি এমন অকৃত্রিম রসিকতা করতেন যে, তাঁর সাথীদের হৃদয়ে তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা বদ্ধমূল হয়ে যেত।’ তিনি হাস্য কৌতুকের মাধ্যমে মজলিসে আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলতেন। তবে সব সময় ভারসাম্য বজায় থাকতো। কথাবার্তায় রসিকতার মাত্রা থাকতো খাদ্যে লবণের মাত্রার সমান। তাতে কোন অন্যায় ও অসত্য কথাও আসতোনা, তা দ্বারা কারো মনে কষ্ট ও দেয়া হতো না এবং কেউ অট্টহাসিতে ফেটেও পড়তোনা। সামান্য মুচকি হাসির সৃষ্টি করতো, যাতে শুধু দাঁত বের হতো মুখগহ্বর বা কন্ঠনালি দেখা যেতনা।
একবার হযরত আবু হুরায়রা অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি দেখি আমাদের সাথে রসিকতাও করেন!’ রসূল সা. বললেনঃ হাঁ, তা করি।তবে আমি কোন অন্যায় ও অসত্য কথা বলিনা।’
এখানে আমরা রসূল সা.এর কিছু রসিকতার নমুনা তুলে ধরছি, যা হাদীসের গ্রন্থাবলীতে সংরক্ষিত রয়েছেঃ [অধিকাংশ ঘটনা শামায়েল তিরমিযী থেকে সংকলিত]
জনৈক ভিক্ষুক তাঁর কাছে একটা বাহক উট চাইল।রসূল সা. বললেনঃ আমি তোমাকে একটি উটনীর বাচ্চা দেবো।ভিক্ষুক অবাক হয়ে বললো, ‘আমি ওটা দিয়ে কি করবো? রসূল সা. বললেন, ‘প্রত্যেক উটই কোন না কোন উটনীর বাচ্চা হয়ে থাকে।
এক বুড়ি এসে বললো, ‘আমার জন্য দোয়া করুন যেন আল্লাহ আমাকে জান্নাত দান করেন।’রসূল সা. রসিকতা করে বললেনঃ‘কোন বুড়ি জান্নাতে যেতে পারবেনা।’বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে চলে যেতে উদ্যত হলো।রসূল সা. উপস্থিত লোকদের বললেন, ‘ওকে বলো যে, আল্লাহ ওকে বুড়ি অবস্থায় নয় বরং যুবতী বানিয়ে জান্নাতে নেবেন।আল্লাহ বলেছেন, আমি জান্নাতের নারীদের নতুন করে সৃষ্টি করবো,তাদেরকে কুমারী সমবয়সী যুবতী বানাবো।’ মোট কথা জান্নাতে গমনকারীনীদের আল্লাহ নব যৌবন দান করবেন।
যাহের বা যোহায়ের নামক এক বেদুইনের সাথে রসূল সা. এর সখ্য ছিল।তিনি তাঁর এই বেদুইন বন্ধুকে শহর সংক্রান্ত কাজে সাহায্য করতেন এবং বেদুইন রসূল সা. কে গ্রাম সংক্রান্ত কাজে সাহায্য করতো।কখনো কখনো সে আন্তরিক আবেগ সহকারে উপহার দিত।রসূল সা.অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে ঐ উপহারের দাম দিয়ে দিতেন।তিনিবলতেন, যাহের গ্রামে আমাদের প্রতিনিধি এবং আমরা শহরে তার প্রতিনিধি।এই যাহের একদিন বাজারে নিজের কিছু পন্য বিক্রি করছিল।রসূল সা.পেছন থেকে চুপিসারে যেয়ে তার চোখ চেপে ধরলেন এবং বললেন, বলতো আমি কে।বেদুইন প্রথমেতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।পরক্ষনেই বুঝতে পেরে আনন্দের আতিশয্যে রসূল সা. এর বুকের সাথে মাথা ঘষতে লাগলেন।অতপর রসূল সা. রসিকতা করে বললেন, এই দাসটা কে কিনবে? যাহের বললো, হে রসুলুল্লাহ, আমার মত অকর্মন্য দাসকে যে কিনবে,সেই ঠকবে।রসূল সা. বললেন, আল্লাহর চোখে তুমি অকর্মন্য নও।
একবার এক মজলিশে খেজুর খাওয়া হলো।রসূল সা. রসিকতা করে খেজুরের আটি বের করে হযরত আলীর সামনে রাখতে লাগলেন।অবশেষে আটির স্তুপ দেখিয়ে বললেন,তুমি তো অনেক খেজুর খেয়েছো দেখছি।হযরত আলী বললেন, আমি আটি সুদ্ধ খেজুর খাইনি।
খন্দক যুদ্ধের সময় একটা ঘটনায় রসূল সা. এত হেসেছিলেন যে, তাঁর মাড়ির দাঁত পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল।আমেরের পিতা সাঈদ তীর নিক্ষেপ করেছিলেন।শত্রুপক্ষের জনৈক যোদ্ধা তীরের আক্রমনের লক্ষ্য ছিল।সে খুবই ত্বরিত গতিতে ঢাল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলতো,তাই সা’দের তীর কোনমতেই তাকে বিদ্ধ করতে সক্ষম হচ্ছিলনা।শেষবারে পুণরায় সা’দ তীর ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং সুযোগ খুঁজতে থাকলেন।শত্রু সৈন্যটি যেই ঢালের বাইরে মাথা বের করেছে,আর যায় কোথায়।সা’দের তীর সোজা তার কপালে গিয়ে বিঁধলো,সে এমন যোরে মাথা ঘুরে পড়লো যে, তার ঠ্যাং দুটো ওপরের দিকে উঠে গেল।
পরবর্তীকালের লোকেরা তাঁর এ ধরনের রসিকতার কথা শুনে অবাক হয়ে যেত।কেননা একেতো ধর্মের সাথে সবসময় একধরনের নিরস জীবনের ধারনা যুক্ত থাকতো এবং খোদাভীরু লোকদের কাঁদো কাঁদো মুখ ও সুক্ষ কঠিন মেজাজ থাকার কথা সবার জানা ছিল।তদুপুরি রসুল সা. এর সার্বক্ষনিক এবাদত মুখিতা, খোদাভীরুতা ও অসাধারণ দায়িত্বসচেতনতার বিষয়টি লক্ষ্য রাখলে একথা বুঝাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায় যে, এ ধরনের একজন অসাধারন মানুষ আপন জীবন কাঠামোতে এমন কৌতুক ও হাস্যরসের অবকাশ কিভাবে সৃষ্টি করলেন।হযরত ইবনে ওমরকে রা. জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে রসূল সা. এর সাথীরা কি হাসতেন? তিনি বললেন, ’হ্যাঁ হাসতেন।অথচ তাদের অন্তরে পাহাড়ের চেয়ে বড় ও মজবুত ঈমান ছিল। (অর্থ্যাৎ কৌতুক ও রসিকতা ঈমান ও খোদভীতির প্রতিকূল নয়।) তাঁরা তীর নিক্ষেপের প্রশিক্ষন নিতে গিয়ে ছুটোছুটি করতেন আর পরস্পর হেসে লুটুপুটি খেতেন। (কাতাদার বর্ণনা)
একথা আগেই উল্লেখ করেছি যে, ফজরের নামাজের পর নিয়মিত বৈঠক হতো, তাতে জাহেলী যুগের প্রসঙ্গ উঠতো এবং সাহাবী গনের সাথে সাথে রসূল সা. ও খুব হাসতেন।শিশুদের সাথে ও স্ত্রীদের সাথে তিনি যে হাস্য কৌতুক করতেন তা ও ইতিপূর্বে আলোচনা করে এসেছি।
বিনোদন
ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংগ হলো (বৈধ সীমার মধ্যে) বিনোদন।রসিকতার ন্যায় এ অংশটা ও যদি বিলুপ্ত হয়ে যায়,তাহলে জীবন একটা বোঝা হয়ে উঠবে।যে জীবন ব্যাবস্থায় বিনোদনের স্থান নেই, তা কোন সমাজ বেশী দিন বহন করতে পারেনা।রসূল সা. কিছু কিছু বিনোদন ভালবাসতেন এবং বৈধ সীমার মধ্যে এর ব্যবস্থা করতেন।
ব্যাক্তিগত ভাবে তাঁর বাগানে ভ্রমনের শখছিল।কখনো একা আবার কখনো সাথীদের নিয়ে বাগানে যেতেনে এবং সেখানে বৈঠকাদিও করতেন।
সাঁতারকাটা ও তাঁর সখের অন্তর্ভূক্ত ছিল।বন্ধুবান্ধবের সাথে কখনো কখনো পুকুরে সাঁতার কাটতেন।এজন্য দু’জনের এক একটা জোড় গঠন করতেন।প্রত্যেক জোড় দূর থেকে সাঁতরে পরস্পরের দিকে আসতো।একবার রসূল সা. হযরত আবু বকরকে নিজের সাঁতারের সাথী মনোনীত করেছিলেন।
কিছুদিন বিরতির পর বৃষ্টি হলে লুংগি বেঁধে ফোয়ারায় গোসল করতেন।কখনো কখনো চিত্তবিনোদনের লক্ষ্যে কোন কূয়ার মুখে বসে ভেতরে পা ঝুলিয়ে রাখতেন। [শামায়েলে তিরমিযী]
দৌড় ও তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগীতার আয়োজন করতেন এবং নিজে পূর্ণ আগ্রহ নিয়ে শরীক হতেন।এরূপ পরিস্থিতিতে প্রচুর হাসাহাসি ও হতো।
উৎসবাদিতে ঢোল বাজানো ও শিশু মেয়েদের গান গাওয়া পছন্দ করতেন।একবার ঈদের দিন দুটো মেয়ে হযরত আয়েশার কাছে গান গাইছিল।রসূল সা. তার কাছেই শায়িত ছিলেন।হযরত আবুবকর এসে এই দৃশ্য দেখে ধমক দিয়ে উঠলেন যে, আল্লাহর রসূলের বাড়িতে এসব শয়তানী কান্ড কারখানা কেন? একথা শুনে রসূল সা. বললেন, ওদেরকে গাইতে দাও। [মুসলিম, হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত]
বিয়ে শাদীর সময় ও ঢোল বাজাতে উৎসাহ দিয়েছেন। (হযরত আয়েশা ও মুহাম্মদ বিন হাতে আল জুহমীর বর্ণনা) হযরত আয়েশা বলেন, আমার কাছে জনৈক আনসারীর মেয়ে থাকতো।আমি তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলাম।বিয়ের সময় রসূল সা. বললেন, ‘আয়েশা তুমি গানের ব্যবস্থা করলেনা? আনসার গোত্র তো গান পছন্দ করে।’ অন্য এক বর্ণনায় (সম্ভবত এই ঘটনা প্রসঙ্গেই) রয়েছে যে, রসূল সা. বলেছেন, ‘তোমরা কনের সাথে একজন গায়ককে পাঠালে ভাল করতে।সে গাইত, আমরা তোমার কাছে এসেছি, কাজেই তোমরা সুখী হও, আমরা ও সুখী হই।এ ধরনেরই এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ছোট ছোট মেয়েরা গান গাইছিল।হযরত আমের বিন সা’দ কতিপয় শ্রোতাকে আপত্তি জানিয়ে বললেন, ‘হে রসূলের সাহাবীগন,হে বদরের যোদ্ধাগন!তোমাদের সামনে এসব কর্মকান্ড হচ্ছে? উপস্থিত সাহাবীগন জবাব দিলেন, ‘তোমার ইচ্ছা হলে বসে শোন,নচেত চলে যাও।আল্লাহর রসূল আমাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছেন।’
বিনোদনের উপায় হিসেবে রসূল সা.কবিতার প্রতি ও আগ্রহ দেখিয়েছেন।তবে আরবে যে ভাবে কবিতার পুজা করা হতো, তা তিনি এড়িয়ে চলতেন।ওহীর সুমিষ্ট সুরের তীব্র আকর্ষন তাকে কবিতার প্রতি আকৃষ্ট করার তেমন সুযোগ দিতনা।কিন্তু কবিতার রুচি থেকে তিনি একদম বঞ্চিত ও ছিলেননা।বক্তব্যের দিক দিয়ে ভাল কবিতার যথেষ্ট কদর করতেন।বরঞ্চ বলা যায় যে, রসূল সা. সমাজকে এদিক দিয়ে এক নতুন রুচি দিয়েছেন এবং বাছ বিচারের এক নতুন মানদন্ড নির্ধারন করেছেন।হযরত জাবের বিন সামুরা বলেন, আমি রসূল সা. এর উপস্থিতিতে একশোর বেশী বৈঠকে যোগদান করেছি।এসব বৈঠকে জাহেলী যুগের কিচ্ছা কাহিনী যেমন বলা হতো তেমনি সাহাবীগন কবিতা ও পাঠ করতেন।একবার আরব কবি লাবীদের কবিতার নিম্নের চরন দুটির তিনি প্রশংসা করলেনঃ (আরবী***********)
‘সতর্ক হয়ে যাও, আল্লাহ ছাড়া সবকিছুই ধংসশীল,দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামত একদিন বিলীন হয়ে যাবে।’
একবার প্রবাসে থাকাকালে হযরত শরীদকে অনুরোধ করে কবি উমাইয়া ইবনে আবিসসালাতের একশোটা কবিতা পড়িয়ে শোনান।পরে মন্তব্য করেন,এই ব্যক্তি ইসলাম গ্রহনের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।কোন কোন সময় তিনি নিজে ও, বিশেষত যুদ্ধের ময়দানে, স্বতস্ফূর্তভাবে ও বিনা ইচ্ছায় কবিতার মত করে কথা বলতেন।ইসলামের শত্রুরা ইসলামের বিরুদ্ধে নিন্দা সূচক যেসব কবিতা পাঠ করতো, হযরত হাসসান ও কা’ব বিন মালেককে দিয়ে তার জবাব কবিতা রচনা করাতেন।কখনো কখনো হযরত হাসসানকে নিজের মিম্বরে বসিয়ে কবিতা পাঠ করাতেন এবং বলতেন, ‘এ কবিতা শত্রুর বিরূদ্ধে তীরের চেয়ে ও কঠোর।’ তিনি একথা ও বলেছেন, ‘মুমিন তরবারী দিয়ে যেমন জেহাদ করে, তেমনি মুখ দিয়ে ও জেহাদ করে।’ আমি কবিতা, সাহিত্য ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক বিষয়ে আলাদা একটা প্রবন্ধের মাধ্যমে বিষদ ভাবে আলোচনা করে দেখাতে চাই,রসূল সা. মানুষের রুচিকে কেমন গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করতেন।