এহেন বিন্যাসের কারণ
যে ক্রমিকধারয় কুরআন নাযিল হয়েছিল একে গ্রন্থ আকারে বিন্যস্ত ও লিপিবন্ধ করার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই ধারা অক্ষুণ্ন রাখেননি কেন এ প্রশ্নের জবাব একটু চিন্তা করলে আমাদের এ বর্ণনায়ই পাওয়া যাবে।
ওপরের আলোচনায় আপনারা জেনেছেন, তেইশ বছর ধরে কুরআন নাযিল হয়েছে। যে ক্রমানুসারে ইসলামী দাওয়াতের সূচনা ও অগ্রগতি হয়েছে সেই ক্রমানুসারেই কুরআন নাযিল হতে থেকেছে। এখন সহজেই অনুমান করা যায়, দাওয়াত পূর্ণতা লাভ করার পর কুরআনের নাযিলকৃত অংশগুলোর এমন ধরনের বিন্যাস যা কেবল দাওয়াতের ক্রমোন্নাতির সাথে সন্পর্কিত ছিল – কোনক্রমেই সঠিক হতে পারে না। এখন তাদের জন্য দাওয়াত পূর্ণতা লাভের পর সৃষ্ট অবস্থার অধিকতর উপযোগী একটি নতুন ধরনের বিন্যাসের প্রয়োজন ছিল। কারণ শুরুতে সে এমন সব লোককে সর্বপ্রথম দাওয়াত দেয় যারা ছিল ইসলামের সাথে সন্পূর্ণরূপে অপরিচিত। তাই তখন একেবারে গোড়া থেকেই শিক্ষা ও উপদেশ দানের কাজ শুরু হয়। কিন্তু দাওয়াত পরিপূর্ণতা লাভ করার পর তার প্রথম লক্ষ্য হয় এমন সব লোক যারা তার ওপর ঈমান এনে একটি উম্মাতের অন্তরভুক্ত হয়েছে এবং যাদের ওপর এই কাজ জারী রাখার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দাওয়াতকে চিন্তা ও কর্মধারা উভয় দিক দিয়ে পূর্তা দান করার পর তাদের হাতে সোপর্দ করেছিলেন। এখন নিশ্চিতরূপে সর্বপ্রথম তাদের নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, নিজেদের জীবন যাপনের জন্য আইন-কানুন এবং পূর্ববর্তী নবদের উম্মাতদের মধ্যে যে সমস্ত ফিতনা সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলো সন্পর্কে ভালোভাবে জানার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তারপর ইসলামের সাথে অপরিচিত দুনিয়াবাসীদের কাছে আল্লাহর বিধান পেশ করার জন্য তাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া ক্রুআন মজীদ যে ধরনের কিতাব কোন ব্যক্তি গভীর মনোযোগ সহকারে তা পাঠ করার পর সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, একই ধরনের বিষয়বস্তুকে এক জায়গায় একত্র করার বিষয়টি কুরআনের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। কুরআনের প্রকৃতিই দাব করে, তার পাঠকের সামনে মাদানী পর্যায়ের কথা মক্কী যুগের শিক্ষর মধ্যে, মক্কী পর্যায়ের কথা মাদানী যুগের বক্তৃতাবলীর মধ্যে এবং প্রাথমিক যুগের আলোচনা শেষ যুগের উপদেশালীর মধ্যে এবং শেষ যুগের বিধানসমূহ সূচনাকালের শিক্ষাবলীর পাশাপাশি বার বার আলোচিত হবে। এভাবে ইসলামের পূর্ণ, ব্যাপকতর ও সামগ্রিক চিত্র তার চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে। ইসলামের একটি দিক তার চোখের সামনে থাকবে এবং অন্য দিকটি থাকবে তার চোখের আড়ালে, কখনো এমনটি যেন না হয়।
তারপরও কুরআন যে ক্রমানুসারে নাযিল হয়েছিল যদি সেভাবেই তাকে বিন্যস্ত করা হতো তাহলে পরবর্তীকালে আগত লোকদের জন্য তা কেবল সেই অবস্থায় অর্থপূর্ণ হতে পারতো যখন কুরআনের সাথে সাথে তার নাযিলের ইতিহাস এবং তার এক একটি অংশের নাযিল হওয়ার অবস্থা ও পরিপ্রেক্ষিত লিখে দেয়া হতো। মহাণ আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে তাঁর বাণী একত্র করে বিন্যস্ত ও সংরক্ষণ করেছিলেন এটি ছিল তার পরিপন্থী। আল্লাহর কালামকে নির্ভেজাল অবস্থায় অন্য কোন কালাম, বাণী বা কথার মিশ্রন বা অন্তরভুক্ত ছাড়াই সংক্ষিপ্ত আকারে সংকলিত করাই ছিল আল্লাহর উদ্দেশ্য। এ কালাম পাঠ করবে যুবক, বৃদ্ধ, শিশু, নারী, পুরুষ, নগরবাসী, গ্রামবাসী, শিক্ষিত সুধী, পন্ডিত, সাধারণ শিক্ষিত নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ। সর্বস্তরের বুদ্ধি-জ্ঞানসন্পন্ন মানুষ কমপক্ষে এতটুকু কথা অবিশ্যি জেনে নেবে যে তাদের মহান প্রভু তাদের কাছে কি চান এবং কি চান না। বলা বাহুল্য যদি এই সমগ্র কালামের সাথে একটি সুদীর্ঘ ইতিহাসও জুড়ে দেয়া থাকতো এবং তা পাঠ করাও সবার জন্য অপরিহার্য গণ্য করা হতো তাহলে এ কালামকে সুবিন্যস্ত ও সুসংরক্ষিত করার পেছনে মহান আল্লাহর যে উদ্দেশ্য ছিল তা ব্যর্থ হয়ে যেতো।
আসলে কুরআনের বর্তমান বিন্যাসকে যারা আপত্তিকর মনে করেন তারা এই কিতাবের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সন্পর্কে কেবল অনবহিতই নন বরং তারা এই বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন বলে মনে হয় যে, এ কিতাবটি কেবল মাত্র ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য অবর্তীণ হয়েছে।
ক্রুআনের বর্তমান বিন্যাস সন্পর্কে পাঠকদের আর একটি কথা জেনে নেয়া উচিত। এই বিন্যাস পরবর্তীকালের লোকদের হাতে সাধিত হয়নি। বরং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই কুরআনের আয়াতগুলোকে এভাবে বিন্যস্ত ও সংযোজিত করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর চিরাচরিত নিয়ম ছিল, কোন সূরা নাযিল হলে তিনি তখনই নিজের কোন কাতেবকে(কুরআন লেখক) ডেকে নিতেন এবং সূরার আয়াতগুলো যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করাতেন। এরপর নির্দেশ দিতেন, এ সূরাটি অমুক সূরার পরে বা অমুক সূরার আগে বসাও। অনুরূপভাবে কখনো কুরআনের কিছু অংশ নাযিল হতো। এটাকে স্বতন্ত্র সূরার পরিণত করার উদ্দেশ্য থাকতো না। সে ক্ষেত্রে তিনি নির্দেশ দিতেন, একে অমুক সূরার অমুক সন্নিবেশ করো। অতপর এই বিন্যাস অনুযায়ী তিনি নিজে নামাযেও পড়তেন। অন্যান্য সময় কুরআন মজীদ তেলাওয়াতেও করতেন। এই বিন্যাস অনুযায়ী সাহাবায়ে কেরাম কুরআন মজীদ কন্ঠস্থও করতেন। কাজেই কুরআনের বিন্যাস একটি প্রমানিত ঐতিহাসিক সত্য। যেদিন ক্রুআন মজীদের নাযিলের কাজ সন্পূর্ণ হয়ে যায় সেদিন তার বিন্যাসও সন্পূর্ণ হয়ে যায়। যিনি এটি নাযিল করছিলেন তিনি এটি বিন্যস্তও করেন। যাঁর হৃদয়ের পরদায় এটি নাযিল করছিলেন তাঁরই হাতে এটি বিন্যস্তও করান। এর মধ্যে অনুপ্রবেশ বা হস্তক্ষেপ করার অধিকার ও ক্ষমতাই কারোর ছিল না।
কুরআন কিভাবে সংকলিত হলো
যেহেতু নামায শুরু থেকেই মুসলমানদের ওপর ফরজ ছিল [উল্লেখ্য, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত লাভের কয়েক বছর পর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ হয়। কিন্তু সাধারণভাবে নামায ফরজ ছিল প্রথম দিন থেকেই। ইসলামের জীবনের এমন একটি মুহূর্তও অতিক্রন্ত হয়নি যখন নামায ফরয হয়নি।] এবং কুরআন পাঠকে নামাযের একটি অপরিহার্য অংশ গণ্য করা হয়েছিল, তাই কুরআন নাযিল হওয়ার সাথেসাথেই মুসলমানদের মধ্যে কুরআন কন্ঠস্থ করার প্রক্রিয়াও জারী হয়ে গিয়েছিল। কুরআন যতটুকু নাযিল হয়ে যেতো মুসলমানরা ততটুকু কন্ঠস্থও করে ফেলতো। এভাবে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের কাতেবদের সাহায্যে খেজুর পাতা, হাঁড় ও পাথর খন্ডের ওপর কুরআন লেখার যে ব্যবস্থা করেছিলেন কেবলমাত্র তার ওপর কুরআনের হেফাযত নির্ভরশীল ছিল না বরং নাযিল হবার সাথে সাথেই শত শত থেকে হাজার হাজার এবং হাজার হাজার থেকে লাখো লাখো হৃদয়ে তার নকশা আঁকা হয়ে যেতো। এর মধ্যে একটি শব্দেরও হেরফের করার ক্ষমাতা কোন শয়তানের ছিল না।
নবী সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর আরবদেশে বেশ কিছু লোক ’মুরদাত’ হয়ে গেলো। তাদের দমন করা এবং একদল মুসলমানের ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করার জন্য সাহাবায়ে কেরামকে কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হতে হলো। এসব যুদ্ধে এমন অনেক সাহাবা শহীদ হয়ে গেলেন যাদের সমগ্র কুরআন কন্ঠস্থ ছিল। এ ঘটনায় হযরত উমরের (রা) মনে চিন্তা জাগলো, কুরআনের হেফাযতের ব্যাপারে কেবলমাত্র একটি মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল থাকা সংগত নয়। শুধু দিলের ওপর কুরআনের বাণী। অংকিত থাকলে হবে না তাকে কাগজের পাতায়ও সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। তদানীন্তন খলীফা হযরত আবু বকরের (রা) কাছে তিনি বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করলেন। কিছুটা চিন্তা-ভাবনা করার পর তিনিও তাঁর সাথে একমত হলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাতেব (সেক্রেটারী) হযরত যায়েদকে (রা) এ কাজে নিযুক্ত করলেন। এ জন্য যে পদ্ধতি নির্ধারণ করা হলো তা হলো এই: একদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব বিচ্ছিন্ন বস্তুর ওপর কুরআন লিখে গেছেন সেগুলো সংগ্রহ করা। অন্যদিকে সাহাবীদের মধ্যে যার যার কাছে কুরআনের যেসব বিচ্ছিন্ন অংশ লিখিত আছে তাদের কাছ থেকে সেগুলোও সংগ্রহ করা। [নিভরযোগ্য সূত্র জানা যায়, রসূলের (সাঃ)জীবদ্দশায়ই বিভিন্ন সাহাবী কুরআন বা তার বিভিন্ন অংশ লিখে নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে হযরত উসমান (রা), হযরত আলী (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা), হযরত সালেম মাওলা হুযাইফা (রা), হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত(রা), হযরত হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা), হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা) এবং হযরত আবু যায়েদ কায়েদ ইবনিস সাকান রাদিয়াল্লাহু আনহুর নাম পাওয়া যায়।] এই সাথে কুরআনের হাফেযদের থেকেও সাহায্য নেয়া। এই তিনটি মাধ্যমেকে পূর্ণরূপে ব্যবহার করে নির্ভুল হবার ব্যাপারে শতকরা একশ’ ভাগ নিশ্চয়তা ও নিশ্চন্ততা লাভ করার পর কুরআনের এক একটি হরফ, শব্দ ও বাক্য গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কুরআন মজীদের একটি নির্ভুল ও প্রামাণ্য সংকলন তৈরি করে উম্মল মু’মেনীন হযরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে রেখে দেয়া হলো। সবাইকে তার অনুলিপি করার অথবা তার সাথে যাচাই করে নিজের পান্ডুলিপি সংশোধন করে নেয়ার সাধারণ অনুমতি দেয়া হলো।
একই ভাষা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের বিভিন্ন শহর ও জেলার কথ্যভাষার মধ্যে যেমন পার্থক্য দেখা যায় আরবের বিভিন্ন এলাকার ও গোত্রের কথ্যভাষার মধ্যেও তেমনি পার্থক্য ছিল। মক্কার কুরাইশরা যে ভাষায় কথা বলতো কুরআন মজীদ সেই ভাষায় নাযিল হয়। কিন্তু প্রথম দিকে বিভন্ন এলাকা ও গোত্রের লোকদের তাদের নিজ নিজ উচ্চারণ ও বাকভংগী অনুযায়ী তা পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কারন এভাবে পড়ায় অর্থের মধ্যে কোন পার্থক্য হতো না। কেবলমাত্র বাক্য তাদের জন্য একটু কোমল ও মোলায়েম হয়ে যেতো। কিন্তু ধীরে ধীরে ইসলাম বিস্তার লাভ করলো। আরববাসীরা নিজেদের মরুভূমির এলাকা পেরিয়ে দুনিয়ার একটি বিশাল বিস্তীর্ণ অংশ জয় করলো। অন্যান্য দেশের ও জাতির লোকেরা ইসলামের চতুঃসীমার মধ্যে প্রবেশ করতে লাগলো। আরব ও অনারবের ব্যাপকতর মিশ্রণে আরবী ভাষা প্রভাবিত হতে থাকলো। এ সময় আশংকা দেখা দিল, এখনো যদি বিভিন্ন উচ্চারণ ও বাকরীতিতে কুরআন পড়ার অনুমতি অব্যাহত রাখা হয়, তাহলে এর ফলে নানা ধরনের ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। যেমন, এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে অপরিচিত পদ্ধতিতে কুরআন পড়তে শুনে সে সেচ্ছাকৃতভাবে কুরআনে বিকৃতি সাধন করেছে বলে তার সাথে বিরোধে ও সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। অথবা এই শাব্দিক পার্থক্য ধীরে ধীরে বাস্তব বিকৃতির দ্বার উন্মুক্ত করে দেবে। অথবা এই আরব অনারবের মিশ্রণের ফলে যেসব লোকের ভাষা বিকৃত হবে তারা নিজেদের বিকৃত ভাষা অনুযায়ী কুরআনের মধ্যে হস্তক্ষেপ করে তার বাক সৌন্দর্যের বিকৃতি সাধন করবে। এ সমস্ত কারণে হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু অন্যান্য সাহাবয়ে কেরামদের সাথে পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, সমগ্র ইসলামী দুনিয়ায় একমাত্র হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর নির্দেশে লিখিত কুরআন মজীদের নোস্খা(অনুলিপিই) চালু করা হবে। এ ছাড়া অন্যান্য সমস্ত উচ্চারণ ও বাকরীতিরে লিখিত নোস্খার প্রকাশ ও পাঠ নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হবে।
আজ যে কুরআন মজীদটি আমাদের হাতে আছি সেটি হযরত আবু বকর সিদ্দীকের (রা) নোস্খার অনুলিপি। এই অনুলিপিটি হযরত উসমান (রা) সরকারী ব্যবস্থাপনায় সারা দুনিয়ার দেশে দেশে পাঠিয়েছিলেন। বর্তমানেও দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে কুরআনেকর সেই প্রামান্য নোস্খাগুলো পাওয়া যায়। কুরআন মজীদ সঠিকভাবে সংরক্ষিত হবার ব্যাপারে যদি কারোর মনে সামান্যতমও সংশয় থাকে তাহলে মানসিক সংশয় দূর করার জন্য তিনি পশ্চিম আফ্রিকার দিয়ে সেখানকার কোর বই বিক্রতার দোকান থেকে এক খন্ড কুরআন মজীদ কিনে নিতে পারেন। তারপর সেখান থেরক চলে আসতে পারেন আফ্রিকা ইন্দোনেশিয়ার জাভায়। জাভার কোন হাফেযো মুখে কুরআনের পাঠ শুনে পশ্চম আফ্রিকা থেকে কেনা তাঁর হাতের নোসখাটির সাথে তা মিলিয়ে দেখতে পারেন। তারপর দুনিয়ার বড় বড় গ্রন্থাগারগুলোয় হযরত উসমানের (রা) আমল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্তকার যতগুলো কুরআনের নোস্খা রক্ষিত আছে সবগুলোর সাথে সেটি মিলাতে পারেন। তিনি যদি তার মধ্যে কোন একটি হরফ নোকতার পার্থক্য দেখতে পান তাহলে সারা দুনিয়াকে এই অভিনব আবিস্কারের খবরটি জানানো তাঁর অবশ্যি কর্তব্য। কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহকারী সন্দেহ করতে পারেন। কিন্তু যে কুরআনটি আমাদের হাতে আছে সেটি সামান্যতম হেরফের ও পরিবর্তন ছাড়াই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর যে কুরআনটি নাযিল হয়েছিল এবং যেটি তিনি দুনিয়ার সামনে পেশ করেছিলেন তারই হুবহু অনুলিপি, এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই। এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য। এমন অকাট্য সাক্ষ্য –প্রমান সন্বলিত সত্য দুনিঢার ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। এরপরও যদি কেউ এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন তাহলে বলতে হয়, দুনিয়ায় কোন কালে রোমান সাম্রাজ্য বলে কোন সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল এবং মোগল রাজবংশ কোন দিন ভারত শাসন করেছেন অথবা দুনিয়ায় নেপোলিয়ান নামক কোন ব্যক্তি ছিলেন – এ ব্যাপারেও তিনি অবশ্যি সন্দেহ পোষণ করবেন। এ ধরনের ঐতিহাসিক সত্য সন্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা জ্ঞানের নয়, বরং অজ্ঞতারই প্রমাণ।
কুরআন অধ্যায়নের পদ্ধতি
কুরআন একটি অসাধারণ গ্রন্থ। দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ অসংখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে কুরআনের দিকে এগিয়ে আসে। এদের সবার প্রয়োজন ও উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে কোন পরামর্শ দেয়া মানুষের পক্ষে সন্ভবপর নয়। এ বিপুল সংখ্যক অনুসন্ধানীদের মধ্যে যারা একে বুঝতে চান এবং এ কিতাবটি মানুষের জীবন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে কোন্ ধরনের ভূমিকা পালন করে এবং তাকে কিভাবে পথ দেখায় একথা যারা জানতে চান আমি কেবল তাদের ব্যাপারেই আগ্রহী। এ ধরনের লোকদের কুরআন অধ্যয়নের পদ্ধতি সন্পর্কে আমি এখানে কিছু পরামর্শ দেবো। আর এই সংগে সাধারনত লোকেরা এ ব্যাপারে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় তারও সমাধান করার চেষ্টা করবো।
কোন ব্যক্তি কুরআনের ওপর ঈমান রাখুন আর নাই রাখুন তিনি যদি এই কিতাবকে বুঝতে চান তাহলে সর্বপ্রথম তাঁকে নিজের মন-মস্তিস্ককে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধারা ও মতবাদ এবং অনুকুল –প্রতিকুল উদ্দেশ্য ও স্বার্থচিন্তা থেকে যথাসন্ভব মুক্ত করতে হবে। এ কিতাবটি বুঝার ও হৃদয়ংগম করার নির্ভেজাল ও আন্তরিক উদ্দেশ্য নিয়ে এর অধ্যয়ন শুরু করতে হবে। যারা মনের মধ্যে বিশেষ ধরনের চিন্তাধারা পুষে রেখে এ কিতাবটি পড়েন তারা এর বিভিন্ন ছত্রের মাঝখানে নিজেদের চিন্তাধারাই পড়ে যেতে থাকেন। আসল কুরআনের সামান্য বাতাসটুকুও তাদের গায়ে লাগে না। দুনিয়ার যে কোন বই পড়ার ব্যাপারেও এ ধরনের অধ্যয়ন রীতি ঠিক নয়। আর কুরআন তো এই ধরনের পাঠকের জন্য তার অন্তর্নিহিত সত্য ও গভীর তাৎপর্যময় অর্থের দুয়ার কখনোই উন্মুক্ত করে না।
তারপর যে ব্যক্তি কুরআন সন্পর্কে ভাসাভাসা জ্ঞান লাভ করতে চায় তার জন্য সন্ভবত একবার পড়ে নেয়াই যথেষ্ট। কিন্তু যে এর অর্থের গভীরে নামতে চায় তার জন্য তো দু’বার পড়ে নেয়াও যথেষ্ট হতে পারে না। অবশ্যি তাকে বার বার পড়তে হবে।প্রতি বার একটি নতুন ভংগীমায় পড়তে হবে। একজকন ছত্রের মতো পেন্সিল ও নোটবই সাথে নিয়ে বসতে হবে। এভাবে যারা কুরআন পড়তে প্রস্তুত হবে, কুরআন যে চিন্তা ও কর্মধারা উপস্থাপন করতে চায় তার সামগ্রিক ব্যবস্থাপনটা যেন তাদের সামনে ভেসে ওঠে কেবলমাত্র এই উদ্দেশ্যেই তাদের অন্ততপক্ষে দু’বার এই কিতাবটি পড়তে হবে। এই প্রাথমিক অধ্যয়নের সময় তাদের কুরআনরে সমগ্র বিষয়বস্তুর ওপর ব্যাপকভিত্তিক জ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করতে হবে। তাদের দেখতে হবে, এই কিতাবটি কোন্ কোন্ মৌলিক চিন্তা পেশ করে এবং সেই চিন্তাধারার ওপর কিভাবে জীবন ব্যবস্থার অট্টালিকার ভিত্ গড়ে তোলে, এ সময়-কালে কোন জায়গায় তার মনে যদি কোন প্রশ্ন জাগে বা কোন খট্কা লাগে, তাহলে তখনি সেখানেই সে সন্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং সেটি নোট করে নিতে হবে এবং ধৈয্য সহকারে সামনের দিকে অধ্যয়ন জারী রাখতে হবে। সামনের দিকে কোথাও না কোথাও তিনি এর জবাব পেয়ে যাবেন, এরি সন্ভাবনা বেশী। জবাব পেয়ে গেলে নিজের প্রশ্নের পাশাপাশি সেটি নোট করে নেবেন। কিন্তু প্রথম অধ্যয়নের পর নিজের কোন প্রশ্নের জবাব না পেলে ধৈয্য সহকারে দ্বিতীয় বার অধ্যয়ন করতে হবে। আমি নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারে, দ্বিতীয়বার গভীর মনোয়োগ সহকারে অধ্যয়ন করার পর কালেভদ্রে কোন প্রশ্নের জবাব অনুদঘাটিত থেকে গেছে।
এভাবে কুরআন সন্পর্কে একটি ব্যাপক দৃষ্টিভংগী লাভ করার পর এর বিস্তারিত অধ্যয়ন শুরু করতে হবে। এ প্রসংগে পাঠককে অবশ্যি কুরআনের শিক্ষার এক একটি দিক পূর্ণরূপে অনুধাবন করার পর নোট করে নিতে হবে। যেমন মানবতার কোন্ ধরনের আদর্শ তার কাছে গৃণার্হ ও প্রত্যাখ্যাত – একথা তাকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। এ বিষয়টিকে ভালোভাবে নিজের মনের মধ্যে গেঁথে নেয়ার জন্য তাকে নিজের নোট বইতে একদিকে লিখতে হবে ‘পছন্দনীয় মানুষ ’ এবং অন্যদিকে লিখতে হবে ‘অপছন্দনীয় মানুষ’ এবং উভয়ের নীচে তাদের বৈশিষ্ট ও গুণাবলী লিখে যেতে হবে। অথবা যেমন, তাকে জানার চেষ্টা করতে হবে, কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের কল্যাণ ও মুক্তি কোন্ কোন্ বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল এবং কোন্ কোন্ জিনিসকে সে মানবতার জন্য ক্ষতিকরক ও ধ্বংসাত্মক গণ্য করে –এ বিষয়টিকেও সুস্পষ্ট ও বিস্তারিতবাবে জানার জন্য আগের পদ্ধতিই অবলন্বন করতে হবে। অর্থাৎ নোট বইতে কল্যাণের জন্য অপরিহার্য বিষয়সমূহ এবং ‘ক্ষতির জন্য অনিবার্য বিষয়সমূহ ’ এই শিরোনামে দু’টি পাশাপাশি লিখতে হবে। অতপর প্রতিদিন কুরআন অধ্যয়ন করার সমকয় সংশ্লিষ্ট বিষয় দু’টি সন্পর্কে নোট করে যেতে হবে। এ পদ্ধতিতে আকিদা-বিশ্বাস, চরিত্র-নৈতিকতা, অদিকার, কতর্ব্য, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, আইন, দলীয় সংগঠন-শৃংখলা, যুদ্ধ, সন্ধি এবং জীবনের অন্যান্য বিষয়াবলী সন্পর্কে কুরআনের বিধান নোট করতে হবে এবং এর প্রতিটি বিভাগের সামগ্রিক চেহারা কি দাড়ায়, তারপর এসবগুলোকে এক সাথে মিলালে কোন্ ধরনের জীবন চিত্র ফুটে ওঠে, তা অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে।
আবার জীবনের বিশেষ কোন সমস্যার ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাতে হলে এবং সে ব্যাপারে কুরআনের দৃষ্টিভংগী জানতে হলে সেই সমস্যা সন্পর্কিত প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। এই অধ্যয়নের মাধ্যমে তাকে সংশ্লিষ্ট সমস্যার মৌলিক বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে জেনে নিতে হবে। মানুষ আজ পর্যন্ত সে সন্পর্কে কি কি চিন্তা করেছে এবং তাকে কিভাবে অনুধাবন করেছে? কোন্ কোন্ বিষয় এখনো সেখানে সমাধানের অপেক্ষায় আছে? মানুষের চিন্তার গাড়ি কোথায় গিয়ে আটকে গেছে? এই সমাধানযোগ্য সমস্যা ও বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে। কোন বিষয় সন্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভংগী জানার এটিই সবচেয়ে ভালো ও সুন্দর পথ। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, এভাবে কোন বিষয়ে গবেষণাও অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে কুরআন অধ্যয়ন করতে থাকলে এমন সব আয়াতের মধ্যে নিজের প্রশ্নের জওয়াব পাওয়া যাবে যেগুলো ইতিপূর্বে কয়েকবার পড়া হয়ে থাকলও এই তত্ত্ব সেখানে লুকিয়ে আছে একথা ঘুণাক্ষরেও মনে জাগেনি।
কুরআনের প্রাণসত্তা অনুধাবন
কিন্তু কুরআন বুঝার এই সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যে কাজ করার বিধান ও নির্দেশ নিয়ে কুরআন এসেছে কার্যত ও বাস্তবে তা না করা পর্যন্ত কোন ব্যক্তি কুরআনের প্রাণসত্তার সাথে পুরোপুরি পরিচিত হতে পারে না। এটা নিছক কোন মতবাদ ও চিন্তাধারার বই নয়। কাজেই আরাম কেদারায় বসে বসে এ বইটি পড়লে এর সব কথা বুঝতে পারা যাবার কথা নয়। দুনিয়ায় প্রচলিত ধর্ম চিন্তা অনুযায়ী এটি নিছক একটি ধর্মগ্রন্থও নয়। মাদরাসায় ও খানকাহে বসে এর সমস্ত রহস্য ও গভীর তত্ত্ব উদ্ধার করাও সন্ভব নয়। শুরুতে ভূমিকায় বলা হয়েছে, এটি একটি দাওয়াত ও আন্দোলনের কিতাব। সে এসেই এই নীরব প্রকৃতির সৎ ও সত্যনিষ্ট ব্যক্তি নির্জন ও নিঃসংগ জীবন ক্ষেত্র থেকে বের করে এনে আল্লাহ বিরোধী দুনিয়ার মোকাবিলায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তার কন্ঠে যুগিয়েছে বাতিলের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের ধ্বনি। যুগের কুফরী, ফাসেকী ও ভ্রষ্টতার পতাকাবাহীদের বিরুদ্ধে তাকে প্রচন্ড সংঘাতে লিপ্ত করেছে। সচ্চরিত্র সন্পন্ন সত্যনিষ্ঠ লোকদেরকে প্রতিটি গৃহাভ্যন্তর থেকে খুঁজে বের করে এনে সত্যের আহবায়কের পতাকাতলে সমবেত করেছে। দেশের প্রতিটি এলাকার ফিতনাবাজ ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে বিক্ষুদ্ধ ও উত্তেজিত করে সত্যানুসারীদের সাথে তাদের যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। এক ব্যক্তির আহবানের মাধ্যমে নিজের কাজ শুরু করে খিলাফতে ইলাহীয়ার প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত পূর্ণ তেইশ বছর ধরে এই কিতাবটি এই বিরাট ও মহান ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেছে। হক ও বাতিলের এই সদীর্ঘ ও প্রাণান্তকর সংঘর্ষকালে প্রতিটি মনযিল ও প্রতিটি পর্যায়েই সে একদিকে ভাঙ্গার পদ্ধতি শিখিয়েছে এবং অন্যদিকে পেশ করেছে গড়ার নকশা। এখন বলুন, যদি আপনি ইসলাম ও জাহেলিয়াত এবং দীন ও কুফররি সংগ্রামে অংশগ্রহণই না করেন, যদি এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মনযিল অতিক্রম করার সুযোগই আপনার ভাগ্যে না ঘটে, তাহলে নিছক কুরআনের শব্দগুলো পাঠ করলে তার সমুদয় তত্ত্ব আপনার কেমন করে উদঘাটিত হয়ে যাবে? কুরআনকে পুরোপুরি অনুধাবন করা তখনই সন্ভব হবে যখন আপনি নিজেই কুরআনের দাওয়াত নিয়ে উঠবেন, মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করার কাজ শুরু করবেন এবং এই কিতাব যেভাবে পথ দেখায় সেভাবেই পদক্ষেপ নিতে থাকবেন। একমাত্র তখনই কুরআন নাযিলের সময়কালীন অভিজ্ঞতাগুলো আপনি লাভ করতে সক্ষম হবেন। মক্কা, হাব্শা (বর্তমান ইথিয়োপিয়া) ও তায়েফের মনযিলও আপনি দেখবেন। বদর ও ওহোদ থেকে শুরু করে হুনাইন ও তাবুকের মনযিলও আপনার সামনে এসে যাবে। আপনি আবু জেহেল ও আবু লাহাবের মুখোমুখি হবেন। মুনাফিক ও ইহুদিদের সাক্ষাতও পাবেন। ইসলামের প্রথম যুগের উৎসর্গীয় প্রাণ মু’মিন থেকে নিয়ে দুর্বল হৃদয়ের মু’মিন পর্যন্ত সবার সাথেই আপনার দেখা হবে। এক ধরনের ‘সাধনা’। একে আমি বলি “কুরআনী সাধনা। ” এই সাধন পথে ফুটে ওঠে এক অভিনব দৃশ্য। এর যতগুলো মনযিল অতিক্রম করতে থাকবেন তার প্রতিটি মনযিলে কুরআনের কিছু আয়াত ও সূরা আপনা আপনি আপনার সামনে এসে যাবে। তারা আপনাকে বলতে থাকবে –এই মনযিলে তারা অবতীর্ণ হয়েছিল এবং সেখানে এই বিধানগুলো এনেছিল। সে সময় অভিধান, ব্যাকরণ অলংকার শাস্ত্রীয় কিছু তত্ত্ব সাধকের দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেতে পারে কিন্তু কুরআন নিজের প্রাণসত্তাকে তার সামনে উম্মুক্ত করতে কার্পণ্য করবে, এমনটি কখনো হতে পারে না।
আবার এই সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত কুরআনের বিধানসমূহ, তার নৈতিক শিক্ষাবলী, তার অর্থনৈতিকও সাংস্কৃতিক বিধি বিধান এবং জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সন্পর্কে তার প্রণীত নীতি-নিয়ম ও আইনসমূহ বুঝতে পারবে না যতক্ষণ না সে বাস্তবে নিজের জীবনে এগুলো কার্যকর করে দেখবে। যে ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে কুরআনের অনুসৃতি নেই সে তাকে বুঝতে পারবে না। আর যে জাতির সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠান কুরআন বিবৃত পথ ও কর্মনীতির বিপরীত দিকে চলে তার পক্ষেও এর সাথে পরিচিত হওয়া সন্ভব নয়।
কুরআনী দাওয়াতের বিশ্বজনীনতা
কুরআন সমগ্র বিশ্ব মানবতাকেব পথ দেখাবার দাবী নিয়ে এগিয়ে এসেছে, একথা সবাই জানে। কিন্তু কুরআন পড়তে বসেই কোন ব্যক্তি দেখতে পায়, সে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার নাযিল হবার সমকালীন আরববাসীদেরকে লক্ষ্য করেই তার বক্তব্য পেশ করেছে। তবে কখনো কখনো মানব জাতি ও সাধারণ মানুষকেও সন্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে এমন সব কথা বলে যা আরববাসীদের রুচি-অভিরুচি, আরবের পারিপার্শিক পরিবেশ, ইতিহাস ও রীতিনীতির সাথেই সন্পর্কিত। এসব দেখে এক ব্যক্তি চিন্তা করতে থাকে, সমগ্র মানব জাতিকে পথ দেখাবার জন্য কিতাবটি অবতীর্ন হয়েছিল তার মধ্যে সাময়িক, স্থানীয় ও জাতীয় বিষয়বস্তু ও উপাদান এত বেশী কেন? এ বিষয়টির তাৎপর্য অনুধাবন না করার কারণে অনেকের মনে সন্দেহে জাগে। তারা মনে করেন, সন্ভবত এ কিতাবটি সমকালীন আরববাসীদের সংশোধন ও সংস্কারের জন্য অবতীর্ণ হয়েছিল কিন্তু পরবর্তীকালে জোরপূর্বক টানা হেঁচড়া করে তাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য জীবন বিধান গণ্য করা হয়েছে।
যে ব্যক্তি নিছক অভিযোগ হিসেবে নয় বরং বাস্তবে কুরআন বুঝার জন্য এ ধরনের অভিযোগ আনেন তাকে আমি একটি পরামর্শ দেবো। প্রথমে কুরআন পড়ার সময় সেই সমস্ত স্থানগুলো একটু দাগিয়ে রাখুন যেখানে কুরআন কেবল মাত্র আরবদের জন্য এবং প্রকৃতপক্ষে স্থন –কাল ও সময় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ এমন আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা বা ভাবধারা অথবা নৈতিক বিধান বা কার্যকর নিয়ম-কানুন উপস্থাপন করেছে। কুরআন একটি বিশেষ স্থানে একটি বিশেষ যুগের লোকদেরকে সন্বোধন করে তাদের মুশরিকী বিশ্বাস ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং তাদেরই আশেপাশের জিনিসগুলোকে ভিত্তি করে তাওহীদের পক্ষে যুক্তি ও প্রমাণ দাঁড় করায় – নিছক এতটুকু কথার ভিত্তিতে কুরআনের দাওয়াত ও তার আবেদন স্থানীয় ও সাময়িক, একথা বলা যথেষ্ট হবে না। এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে, শিরকের প্রতিবাদে সে যা কিছু বলে তা কি দুনিয়ার অন্যান্য প্রতিটি শিরকের ব্যাপারে ঠিক তেমনিভাবে খাপ খেয়ে যায় না যেমন আরবের মুশরিকদের শিরকের সাথে খাপ খেয়ে গিয়েছিল? সেই একই যুক্তি প্রমাণগুলোকে কি আমরা প্রতিটি যুগের ও প্রতিটি দেশের মুশরিকদের চিন্তার পরিশুদ্ধি করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারি না? আর তাওহীদের প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠার জন্য কুরআনী প্রমাণ পদ্ধতিকে কি সামান্য রদবদল করে সবসময় ওসব জায়গায় কাজে লাগানো যেতে পারে না? জবাব যদি ইতিবাচক হয়ে থাকে, তাহলে একটি বিশ্বজনীন শিক্ষা কেবল মাত্র একটি বিশেষ কালে একটি বিশেষ জাতিকে সন্বোধন করে দান করা হয়েছিল বলেই তাকে স্থানীয় ও সাময়িক বলার কোন কারণই থাকতে পারে না। দুনিয়ায় এমন কোন দর্শন, জীবন, জীবন ব্যবস্থা ও চিন্তা দর্শন নেই যার প্রথম থেকে নিয়ে শেষ অবধি সমস্ত কথাই বস্তুনিরপেক্ষ (অনংঃৎধপঃ) বর্ণনাভংগীতে পেশ করা হয়েছে। বরং কোন একটি বিশেষ অবস্থা বা পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে তার ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। এ ধরনের পূর্ণ বস্তু নিরপেক্ষতা সন্ভব নয়। আর সন্ভব হলেও তা নিছক কাজীর গরুর মতো খাতাপত্রেই থাকবে, গোয়ালে তার নামনিশানাও দেখা যাবে না। কাজেই মানুষের জীবনের সাথে সংযুক্ত হয়ে তার পক্ষে কোন বাস্তব বিধানের রূপ নেয়া কোন দিনই সন্ভব হবে না।
তাছাড়া কোন চিন্তামূলক, নৈতিক, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে সন্প্রসারিত করতে চাইলে তার আদৌ এর কোন প্রয়োজন নেই। বরং যথার্থই বলতে হয়, শুরু থেকেই তাকে আর্ন্তজাতিক বানাবার চেষ্টা করা তার জন্য কল্যানকরও নয়। আসলে তার জন্য সঠিক ও বাস্তবসম্মত পন্থা একটিই। এই আন্দোলনটে যেসব চিন্তাধারা, মতবাদ ও মূলনীতির ভিত্তিতে মানুষের জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাকে পূর্ণ শক্তিতে সেই দেশেই পেশ করতে হবে যেখান থেকে তার দাওয়াতের সূচনা হয়েছে। সেই দেশের লোকদের মনে এই দাওয়াতের তাৎপর্য অংকিত করে দিতেহবে, যাদের ভাষা, স্বভাব, প্রকৃতি, অভ্যাস ও আচরণের সাথে আন্দোলনের আহবায়ক নিজে সুপরিচিত। তারপর তাঁকে নিজের দেশেই ঐ মূলনীতিগুলো বাস্তবায়িত করে তার ভিত্তিতে একটি সফল জীবন ব্যবস্থা পরিচালনার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে আদর্শ স্থাপন করতে হবে। তবেই তো দুনিয়ার অন্যান্য জাতিরা তার প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী স্বতস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসে তাকে অনুধাবন করতে ও নিজের দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হবে। কাজেই কোন চিন্তা ও কর্মব্যবস্থাকে প্রথমে শুধুমাত্র একটি জাতির সামনে পেশ করা হয়েছিল এবং কেবলমাত্র তাদেরকেই বুঝাবার ও নিশ্চিন্ত করার জন্য যুক্তি প্রদর্শনের পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল বলেই তা নিছক একটি জাতীয় দাওয়াত ও আন্দোলন – একথা বলার পেছনে কোন যুক্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে একটি জাতীয় ও একটি আর্ন্তজাতিক এবং একটি সাময়িক ও একটি চিরন্তর ব্যবস্থার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তার বিশেষত্বগুলোকে নিম্নোক্তভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে : জাতীয় ব্যবস্থা হয় একটি জাতির শ্রেষ্ঠত্ব, আধিপাত্য বা তার বিশেষ অধিকারসমূহের দাবিদার। অথবা তার নিজের মধ্যে এমন কিছু নীতি ও মতাদর্শ থাকে যা অন্যান্য জাতির মধ্যে ঠাঁই পেতে পারে না। বিপরীত পক্ষে আর্ন্তজাতিক ব্যবস্থা আর্ন্তজাতিক ব্যবস্থা সকল মানুষের মর্যাদা হয় সমান, তাদের সমান অধিকার দিতেও সে প্রস্তুত হয় এবং তার নীতিগুলোর মধ্যেও শ্বিজনীনতার সন্ধান পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে একাটি সাময়িক ব্যবস্থা অবশ্যি এমন কিছু নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় যেগুলো কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে তার সমস্ত কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। আর এর বিপরতি পক্ষে একটি চিরন্তন ব্যবস্থার নীতিগুলো সব রকমের পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খেয়ে চলে। এই বৈশিষ্ঠ্যগুলো দৃষ্টির সামনে রেখে যদি কোন ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করেন এবং যে বিষয়গুলোর কারণে সত্যি সত্যিই কুরআন উপস্থাপিত ব্যবস্থাকে সাময়িক বা জাতীয় হবার ধারণা পোষণ করা যেতে পারে তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হবেন, এতে সন্দেহ নেই।
পুর্ণাঙ্গ জীবন বিধান
কুরআন সন্পর্কে সাধারণ পাঠকও শুনেছেন যেমন এটি একটি বিস্তারিত পথনির্দেশনা, জীবন বিধান ও আইন গ্রন্থ। কিন্তু কুরআন পড়ার পর সেখানে সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সন্পর্কে বিস্তরিত নির্দেশনা ও বিধি-বিধানের সন্ধান সে পায় না। বরং সে দেখে, নামায ও যাকাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরযও – যার ওপর কুরআন বার বার জোর দিয়েছে, তার জন্যও এখানে যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিধান বিস্তারিতভাবে দান করা হয়নি। কাজেই এ কিতাবটি কোন্ অর্থে একটি পথনির্দেশনা ও জীবন বিধান তা বুঝতে মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে। পাঠকের মনে এ সন্পর্কে সন্দেহ জাগে।
সত্যের একটি দিক মানুষের দৃষ্টির সন্পূর্ন আড়ালে থেকে যাওয়ার কারণেই এ ব্যাপারে যাবতীয় সমস্যা ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ কেবল এই কিতাবটিই নাযিল করেননি, তিনি এই সাথে একজন পয়গান্বরও পাঠিয়েছেন। আসল পরিকল্পনাটাই যদি হতো লোকদের হাতে এবং কেবলমাত্র একটি গৃহনির্মাণের নক্শা দিয়ে দেয়া এবং তারপর তারা সেই অনুযায়ী নিজেদের ইমারতটি নিজেরাই বানিয়ে নেবে, তাহলে এ অবস্থায় নিসন্দেহে গৃহনির্মাণ সংক্রান্ত ছোট বড় প্রতিটি খুটিনাটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ আমাদের হাতে দিয়ে দিতে হতো। কিন্তু গৃহনির্মাণের নির্দেশের সাথে সাথে যখন একজন ইঞ্জিনিয়ারও সরকারীভাবে নিযুক্ত হয় এবং তিনি ঐ নির্দেশ অনুযায়ী একটি ইমারতও তৈরি করে ফেলেন তখন ইঞ্জিনিয়ার ও তাঁর নির্মিত ইমারতটিকে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র নক্শার মধ্যে সমগ্র ছোট বড় খুটিনাটি বিষয়ের বিস্তারিত চিত্র সন্ধান করা এবং সেখানে তা না পেয়ে নক্শাটার বিরুদ্ধে অসন্পুর্ণতার অভিযোগ আনা কোনক্রমেই সঠিক হতে পারে না। কুরআন খুঁটিনাটি বিষয়রে বিস্তারিত বিবরণ সন্বলিত কোন কিতাব নয়। বরং এই কিতার মূলনীতি ও মৌলিক বিষয়গুলোই উপস্থাপিত হয়েছে। এর আসল কাজ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার চিন্তাগত ও নৈতিক ভিত্তিগুলোর কেবল পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ সহকারে উপস্থাপনাই নয় বরং এই সংগে বৈজ্ঞানিক যুক্তি –প্রমান ও আবেগময় আবেদনের মাধ্যমে এগুলোকে প্রচন্ড শক্তিশালী ও দৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ করা। অন্যদিকে ইসলামী জীবনধারার বাস্তব কাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে কুরআন মানুষকে জীবনের প্রত্যেকটি দিক ও বিভাগ সন্পর্কে বিস্তারিত নীতি –নিয়ম ও আইন বিধান দান করে না করং জীবনের প্রতিটি বিভাগের চৌহদ্দি বাতলে দেয় এবং সুস্পষ্টভাবে এর কয়েকটি কোণে নিশান ফলক গেঁড়ে দেয়। এ থেকে আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর গঠন ও নির্মাণ কোন্ পথে হওয়া উচিত, তা জানা যায়। এই নির্দেশনা ও বিধান অনুযায়ী বাস্তবে ইসলামী জীবনধারার কাঠামো তৈরি করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাজ ছিল দুনিয়াবাসীদের সামনে কুরআন প্রদত্ত মূলনীতি ভিত্তিতে গঠিত ব্যক্তি চরিত্র এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তব আদর্শ উপস্থাপন করার জন্যই তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন।
বৈধ মতপার্থক্য
আর একটি প্রশ্ন এই প্রসংগে সাধারণভাবে লোকদের মনে জাগে। প্রশ্নটি হচ্ছে, একদিকে কুরআন এমন সব লোকের কঠোর নিন্দা করে যারা আল্লাহর কিতাব অবতীর্ণ হবার পরও মতবিরোধ, দলাদলি ও ফেরকাবন্দির পথে পাড়ি জমায় এবং এভাবে নিজেদের দীনকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত ও খন্ডিত করে। অথচ অন্যদিকে কুরআনের বিধানের অর্থ বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র পরবর্তীকালের আলেমগণই নন, প্রথম যুগের ইমামগণ, তাবেঈন ও সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যেও বিপুল মতবিরোধ পাওয়া যায়। সন্ভবত বিধান সন্বলিত এমন একটি আয়াতও পাওয়া যাবে না যার ব্যাখ্যায় সবাই একমত হয়েছেন। তাহলে কুরআনে উল্লেখিত নিন্দা কি এদের ওপর প্রযোজ্য হবে?যদি এরা ঐ নিন্দার পাত্র না হয়ে থাকেন, তাহলে কুরআন কোন্ ধরনের মতবিরোধ ও দলাদলির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে?
এটি একটি বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ বিষয়। এখানে এ ধরনের আলোচনার সুযোগ নেই। কুরআনের একজন সাধারণ পাঠক ও একজন প্রাথমিক জ্ঞানার্জনকারীর সংশয় দূর করার জন্য এখানে কেবল সামান্য একটু ইংগিত দেয়াই যথেষ্ট মনে করি। দীন ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একমত এবং ইসলামী দলীয় সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ থেকেও নিছক ইসলামী জীবন বিধান ও আইনের ব্যাখ্যা –বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যে আন্তরিক মতবিরোধের প্রকাশ ঘটে কুরআন তার বিরোধী নয়। বিপরীত পক্ষে কুরআন এমন ধরনের মতবিরোধের নিন্দা করে, যার সূচনা হয় স্বার্থন্ধতা ও বক্র দৃষ্টির মাধ্যমে এবং অবশেষে তা দলাদলি ও পারস্পরিক বিরোধে পরিণত হয়। এই দুই ধরনের মতবিরোধ মূলত একই পর্যায়ের নয় এবং ফলাফলের দিক দিয়েও উভয়ের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই। কাজেই একই লাঠি দিয়ে উভয়কে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া এবং উভয়ের বিরুদ্ধে একই হুকুম জারী করা উচিত নয়। প্রথম ধরনের মতবিরোধ উন্নতির প্রাণকেন্দ্র ও মানুষের জীবনে প্রাণস্পন্দন স্বরূপ। বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল লোকদের সমাজে এর অস্তিত্ব পাওয়া যাবেই। এর অস্তিত্বই জীবনের আলামত। যে সমাজে বুদ্ধির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে বরং সেখানে রক্তমাংসের মানুষের পরিবর্তে কাঠের মানুষেরা বিচরণ করছে একমাত্র সেখানেই এর অস্তিত্ব থাকতে পারে না আর দ্বিতীয় ধরনের মতবিরোধটির ব্যাপারে সারা দুনিয়ার মানুষই জানে, যে দেশে ও যে সমাজে তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তাকেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। তার অস্তিত্ব স্বাস্থ্যের নয়, রোগের আলামত। কোন উম্মাতকে সে শুভ পরিণতির দিকে এগিয়ে দিতে পারেনি। এই উভয় ধরনের মতবিরোধের পার্থক্যের চেহারাটি নিম্নোক্তভাবে অনুধাবন করুনঃ
এক ধরনের মতপার্থক্যে আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্যর ক্ষেত্রে সমগ্র ইসলামী সমাজে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত থাকবে। কুরআন ও সুন্নাহকে সর্বসম্মতিক্রমে জীবন বিধানের উৎস হিসাবে মেনে নেয়া হবে। এরপর দু’জন আলেম কোন অমৌলিক তথা খুঁটিনাটি বিষয়ের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অথবা দু’জন বিচারক কোন মামলার সিদ্ধান্ত দানে পরন্পরের সাথে বিরোধ করবেন, কিন্তু তাদের কেউই এই বিষয়টিকে এবং এর মধ্যে প্রকাশিত নিজের মতামতকে দীনের ভিত্তিতে পরিণত করবেন না। আর এই সাথে তার সংগে মতবিরোধকারীকে দীন থেকে বিচ্যুত ও দীন বহির্ভূত গণ্য করবেন না। বরং উভয়েই নিজেদের যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ পেশ করে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী অনুসন্ধানের হক আদায় করে দেবেন। সাধারণ জনমত, অথবা বিচার বিভাগীয় বিষয় হলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অথবা সামাজিক বিসয় হলে ইসলামী সমাজ সংগঠনই উভয় মতের মধ্য থেকে যেটি ইচ্ছা গ্রহণ করে নেবে অথবা চাইলে উভয়মতই গ্রহণ করে নেবে –এটা তাদের নির্বাচনের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
দ্বিতীয় ধরনের মতপার্থক্য করা হবে দীনের মৌলিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে। অথবা যে বিষয়টিকে আল্লাহ ও তাঁর রসূল দীনের মৌলিক বিষয় বলে গণ্য করেননি এমন কোন বিষয়ে কোন আলেম, সুফী, মুফতী, নীতি শাস্ত্রবিদ বা নেতা নিজে একটি মত অবলন্বন করবেন এবং অযথা টেনে হেঁচড়ে তাকে দীনের মৌলিক বিষয়ে পরিণত করে দেবেন, তারপর তার অবলন্বিত মতের বিরোধী মত পোষনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকেই দীন ও মিল্লাত বহির্ভূত গণ্য করবেন। এই সংগে নিজের একটি সমর্থক দল বানিয়ে এই মর্মে প্রচারণা চালাতে থাকবেন যে, আসল উম্মাতে মুসলিমা তো এই একটি দলই মাত্র, বাদবাকি সবাই হবে জাহান্নামের ভাগীদার। উচ্চকন্ঠে তারা বলে যেতে থাকবে ঃমুসলিম হও যদি এই দলে এসে যাও, অন্যথায় তুমি মুসলিমই নও।
কুরআনের আলোচনায় এই দ্বিতীয় ধরনের মতবিরোধ, দলাদলি ও ফেরকাবন্দির বিরোধিতা করা হয়েছে। আর প্রথম ধরনের মতবিরোধের কতিপয় ঘটনা তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের সামনেই উপস্থাপিত হয়েছিল। তিনি এটিকে কেবল বৈধই বলেননি বরং এর প্রশংসাও করেছেন। কারণ এ মতবিরোধ প্রমাণ করছিল যে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে চিন্তা-ভাবনা করার, অনুসন্ধান –গবেষণা চালাবার এবং সঠিকভাবে বুদ্ধি প্রয়োগ করার যোগ্যতা সন্পন্ন লোকের অস্তিত্ব রয়েছে। সমাজের বুদ্ধিমান ও মেধা সন্পন্ন লোকেরা নিজেদের দীন ও তার বিধানের ব্যাপারে আগ্রহী। তাদের বুদ্ধিবৃত্তি দীনের বাইরে নয়, তার চৌহদ্দির মধ্যেই জীবন সমস্যার সমাধান খুঁজতে তৎপর। ইসলামী সমাজ সামগ্রিকভাবে মূলনীতিতে ঐক্যবদ্ধ থেকে নিজের ঐক্য অটুট রেখে এবং নিজের জ্ঞানবান ও চিন্তাশীল লোকদেরকে সঠিক সীমারেখার মধ্যে অনুসন্ধান চালাবার ও ইজতিহাদ করার স্বাধীনতা দান করে উন্নতি ও অগ্রগতির পথ খোলা রাখার স্বর্ণোজ্জল ঐতিহ্যের পতাকাবাহী
আমি যা সত্য মনে করলাম তা এখানে প্রকাশ করলাম। আর আমল সত্যের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে আছে। আমার সমস্ত নির্ভরতা একমাত্র তাঁরই ওপর এবং তাঁরই কাছে আমাকে ফিরে যেতে হবে।]
কুরআন অধ্যয়নকালে একজন পাঠকের মনে যতো রকমের প্রশ্নের উদয় হয় তার সবগুলোর জবাব দেয়ার জন্য আমি এ ভূমিকা ফাঁদিনি। কারণ এ প্রশ্নগুলোর মধ্যে এমন বহু প্রশ্ন রয়েছে যেগুলো কোন না কোন আয়াত বা সূরা পাঠকালে মনে জাগে। সেগুলোর জবাব তাফহীমুল কুরআনের সংশ্লিষ্ট অংশে যথাস্থানেই দেয়া হয়েছে। কাজেই এ ধরনের প্রশ্নগুলো বাদ দিয়ে আমি এখানে কেবলমাত্র এমন সব প্রম্নের জবাব দিয়েছি সামগ্রিকভাবে যা সমগ্র কুরআনের সাথে সন্পর্কিত। কাজেই পাঠকবৃন্দের কাছে অনুরোধ, শুধুমাত্র এই ভূমিকাটুকু পড়েই একে অস্পূর্ণ হবার ধারণা নিয়ে বসে থাকবেন না। বরং সমগ্র গ্রন্থখানি পাঠ করুন। তারপর দেখুন আপনার মনে এমন কোন প্রশ্ন রয়েছে কি –না যার জবাব পাওয়া যায়নি অথবা জবাব যথেষ্ট বলে আপনার মনে হয়নি। এ ধরনের কোন প্রশ্ন থাকলে গ্রন্থকারকে জানাবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।*
*গ্রন্থাকার ইন্তেকাল করেছেন। কাজেই তাঁর কাছে প্রশ্ন করার আর কোন সুযোগই নেই। তবে আমার মনে হয় এ গ্রন্থ পাঠ করার পর পাঠকদের যদি কোথাও কোন অতৃপ্তি থেকে যায়, তাহলে গ্রন্থকারের বিশাল সাহিত্য ভান্ডারের মধ্যে খুঁজলে তার জবাব পাওয়া যাবে। কারণ ইসলামী আন্দোলনের জন্য গ্রন্থকার যে সাহিত্য ভান্ডার সৃষ্টি করে গেছেন তার উৎস এই কুরআন এবং তাফহীমুল কুরআন। জীবনের সূচনা লগ্ন থেকে নিয়ে যেদিন থেকে তিনি কলম হাতে নিয়েছেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই কুরআনী দাওয়াতের সন্প্রসারণের কাজই করে গেছেন। কাজই এ ক্ষেত্রে তাঁর সাহিত্য ভান্ডার তাঁর মূর্তমান প্রতিনিধি।
— সমাপ্ত —