পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবে
ইসলামের সহজ পরিচয়
অধ্যাপক গোলাম আযম
বইটির অডিও শুনুন
লো কোয়ালিটি ডাউনলোড হাই কোয়ালিটি ডাউনলোড
উৎসর্গ
অনেক লেখক তাদের লেখা বই কারো না কারো নামে উৎসর্গ করেন। কেউ পিতা-মাতার নামে, কেউ কোনো বিখ্যাত লোকের নামে, কেউ প্রিয়জনের নামে, কেউ আদরের সন্তানদের নামে উৎসর্গ করেন।
আমার লেখা প্রিয় বইগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ প্রিয় বই হলো ‘পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবে ইসলামের সহজ পরিচয়’। বইটি যাদের জন্য লিখেছি, তাদের উদ্দেশ্যেই অত্যন্ত আনন্দ ও আবেগের সাথে উৎসর্গ করলাম।
তারা কারা? তারা ঐসব মানুষ, যারা অল্পশিক্ষিত। তারা মাতৃভাষা কোনো রকমে পড়তে পারেন। তাদের পক্ষে অনেক বই পড়া সম্ভব নয়। বড় বই পড়তে তারা সাহস পান না; কঠিন ভাষা বুঝতে পারেন না। সহজ বাংলায় ছোট বা মাঝারি সাইজের বই পেলে তারা পড়েন। পড়ে মজা পেলে অন্যদেরকে পড়ে শোনান।
তারা দেশের কোটি কোটি জনগণের সাথেই গ্রামে-গঞ্জে বসবাস করেন। জনগণের মধ্যে খুব কম লোকই বই পড়তে পারেন। যে কয়েকজন বই পড়তে পারেন, তারাই জনগণের নেতার দায়িত্ব পালন করেন। তারাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা। ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনে তারাই প্রার্থী হন। সকল নির্বাচনেই তারা জনগণকে নিজ নিজ দলের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করেন।
জনগণের এ নেতাদের উদ্দেশ্যেই আমার অতি প্রিয় বইটি উৎসর্গ করলাম। তারা যে দলের লোকই হোন, ইসলাম সম্পর্কে তাদের জানার অধিকার আছে। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করেন, রাসূল সা. কে ভালোবাসেন এবং কুরআন মাজীদ কে ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন। তারা যদি ইসলামের জ্ঞান লাভ করেন, তাহলে তাদের মাধ্যমেই জনগণের মধ্যে ইসলামের আলো পৌঁছবে। যারা বই পড়তে পারেন না তাদেরকে তারাই বইটি পড়ে শোনাবেন ও বোঝাবেন।
আল্লাহর দরবারে দোআ করি, যেন আমার এ আশা পূরণ হয়। আমীন!
গোলাম আযম
জুলাই, ২০০৬
বইটির ইতিকথা
আমি অনেকদিন থেকে চিন্তা-ভাবনা করছিলাম যে, সাধারণ মানুষের বোঝার মতো সহজ-সরল ভাষায় দীন ইসলামের পরিপূর্ণ ধারণা একটিমাত্র মাঝারি আকারের বইয়ে পরিবেশন করা খুবই জরুরি। কোনো রকমে মাতৃভাষা পড়তে পারে এমন লোকও যাতে বইটি পড়লে ইসলাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সন্তোষজনক ধারণা লাভ করতে পারে। এমনটি যারা বই পড়তে পারে না, তাদেরকে বইটি পড়ে শোনালে তারাও যেন তৃপ্তির সাথে দীনের আলো উপভোগ করতে পারে।
শুধু বাংলাদেশেই বর্তমানে কমপক্ষে তেরো কোটি জন্মগত মুসলমান রয়েছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই মাতৃভাষা পর্যন্ত পড়তে জানে না। উচ্চশিক্ষিত লোকের সংখ্যাও খুবই কম। যারা কোনো রকমে বাংলাভাষা পড়তে পারে তাদের জন্য অতি সহজ ভাষায় ইসলাম সম্পর্কে এমন জ্ঞান পরিবেশন করতে চাই, যা তারা তৃপ্তির সাথে বুঝতে পারবে এবং যারা পড়তে জানে না তাদেরকেও পড়ে শোনানো দরকার মনে করবে।
আমি অবশ্য স্বল্পশিক্ষিতদের বোধগম্য ভাষায়ই লিখি; কিন্তু আমার লেখা উচ্চশিক্ষিতগণও অপছন্দ করেন না। তারা অল্পশিক্ষিত লোকদের নিকট দীনের দাওয়াত দেন। হয়তো আমার লেখা এ দিক দিয়ে তাদের জন্য সহায়ক হতে পারে। আমি এমন একটি বই রচনা করতে চেয়েছি, যা থেকে জনগণ ইসলামের এ পরিমাণ জ্ঞান হাসিল করতে পারবে- যা তাদেরকে খাঁটি মুসলিম হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তোলার জন্য উৎসাহ যোগাবে এবং অন্যদের নিকটও দীন ইসলামের আলো বিতরণ করার জন্য তাদের মধ্যে জযবা পয়দা করবে।
২০০৫ সালের এপ্রিলে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বরে লেখা সমাপ্ত হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ! আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্নসাধ পূরণ হলো। যাদের উদ্দেশে লিখলাম তাদের পক্ষে অনেক বই পড়া অসম্ভব মনে করেই এক বইয়ে গোটা ইসলামকে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
ইসলামী গবেষণামূলক মাসিক পত্রিকা ‘পৃথিবী’র সম্পাদক অধ্যাপক এ.কে.এম. নাজির আহমদ অত্যন্ত আগ্রহের সাথে এ লেখাগুলোকে ২০০৫ সালের জুন থেকে ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ৯ কিস্তিতে প্রকাশ করে আমাকে বাধিত করেছেন।
পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবে ইসলামের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আন্তর্জাতিক জীবন সম্পর্কে বইটিতে আলোচনা করেছি। অর্থনীতির মতো কঠিন, সংস্কৃতির মতো সূক্ষ্ণ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো জটিল বিষয়ে স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ পাঠক-পাঠিকাকে বোঝানো যে কত কঠিন, তা লিখতে গিয়ে টের পেলাম।
যাদের জন্য লিখলাম তাদের বোঝার মতো সহজ হয়েছে কি না, এ বিষয়ে বেশ কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত সুধীজনের সার্টিফিকেট পেয়ে আল্লাহ তাআলার প্রতি শুকরিয়া জানালাম। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তাঁর মাহফিলসমূহে ‘এক বই থেকে ইসলামকে শিখুন’ বলে বইটির ঘোষণা দিয়ে থাকেন।
হাইস্পিড গ্রুপ অব কোম্পানিজ-এর চেয়ারম্যান একান্ত স্নেহভাজন কে. এম. মাহমুদুর রহমান বইটিতে ALL IN ONE আখ্যা দিয়ে ৫০০০ কপি বিনামূল্যে বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন।
এ বই লেখার উদ্দেশ্যে যেন সফল হয়, আল্লাহর দরবারে এ দোআই করছি। বইটিকে আরো উন্নত করার জন্য যারা পরামর্শ দিয়েছেন তাদের প্রতি শুকরিয়া জানাই।
বইটি ২০০৫ সালের নভেম্বরে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ৮ম মুদ্রণ শেষ হয়েছে। আল্লাহর রহমতে বইটির প্রচার আশাব্যঞ্জক। আল্লাহর দরবারে যেন বইটি কবুল হয়, এ দোআই চাই।
গোলাম আযম
জুন, ২০০৮
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবে ইসলামের সহজ পরিচয়
সাধারণ মুসলিম জনগণ ইসলামকে শুধু একটা ধর্ম হিসেবেই জানে। যারা নিয়মিত নামায-রোযা করে তাদের মধ্যেও অনেকে বাস্তব জীবনে ইসলামের কোনো প্রভাব থাকতে পারে এমন ধারণা রাখে না। জনগণ আলেমসমাজ থেকে ইসলামের যে আলো পেয়েছে এবং তাঁরা দীন ইসলাম সম্পর্কে তাদেরকে যেটুকু ধারণা দিয়েছেন, ঠিক ততটুকুই তারা জানে।
মানুষের জীবনের বহু দিক রয়েছে- ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতির ইত্যাদি। কিন্তু সাধারণভাবে এসব দিক থেকে ধর্মীয় দিককে আলাদা মনে করা হয়। অন্যান্য ধর্মে অবশ্য ঐ সব দিক থেকে ধর্ম আলাদাই, কিন্তু ইসলামে ধর্মীয় দিকটি অন্যান্য দিক থেকে আলাদা নয়; বরং সকল দিকের উপরই ধর্মীয় দিকের এমন ব্যাপক প্রভাব রয়েছে যে, মনে হয় সকল দিকই ধর্মীয় দিকের অধীন রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এই ধর্মীয় দিকটিই গোটা মানবজীবনের চালিকাশক্তি। আল্লাহ তাআলার দাসত্ব, রাসূল সা. এর আনুগত্য ও আখিরাতের জবাবদিহিতা- এ তিনটি ধর্মীয় নীতি হলেও মুসলমানদের গোটা জীবনের সাথেই এগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মুমিনের জীবনে দীনদারী ও দুনিয়াদারীতে কোনো তফাৎ নেই। ঐ তিনটি ধর্মীয় নীতি অনুযায়ী কাজ করলে দুনিয়াদারী বলে গণ্য সকল কাজও দীনদারীতে পরিণত হয়।
দুনিয়ায় নবী পাঠানোর উদ্দেশ্য
মানুষকে দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু করতে হয়, সে সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করার জন্য আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে যাবতীয় আইন-কানুন পাঠিয়েছেন; কিন্তু এসব বিধি-বিধান মেনে চলতে তিনি মানুষকে বাধ্য করেননি। আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন যে, যারা তাঁর দেওয়া আইন-বিধান মেনে চলবে তারা দুনিয়ায়ও শান্তি ভোগ করবে এবং আখিরাতেও পুরস্কার পাবে। আর যারা তা মানবে না এবং মানুষের মনগড়া নিয়ম মেনে চলবে তারা দুনিয়ায়ও অশান্তি ভোগ করবে, আখিরাতেও শাস্তি পাবে।
আল্লাহর নবীগণ মানুষকে দুনিয়া ত্যাগ করে বৈরাগী বা সন্ন্যাসী বানাতে আসেননি; বরং তাঁরা মানুষকে দুনিয়ার সকল দায়-দায়িত্ব আল্লাহর তৈরী নিয়মে পালন করার শিক্ষা দিতে এসেছেন। দুনিয়ার সব কাজ নবীদের শেখানো নিয়মে করলে দুনিয়াদারীর কাজও দীনদারী হিসেবে গণ্য হয় এবং সবই ইবাদতে পরিণত হয়।
দীনদারী বনাম দুনিয়াদারী
এক হাদীসে আছে, রাসূল সা. বলেছেন, কোনো লোক ইশার নামায জামাআতের সাথে আদায় করার পর ঘুমিয়ে গেল। সে যদি ফজরের নামায জামাআতের সাথে আদায় করে তাহলে তার সে ঘুমটাও ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহর দেওয়া নিয়মে ঘুমালে ঘুমও ইবাদতে পরিণত হয়। এভাবেই আল্লাহর দেওয়া নিয়মে বিয়ে-শাদি, ঘর-সংসার, রুজি-রোজগার, চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, খাওয়া-দাওয়া এমনকি পেশাব-পায়খানা করাও ইবাদতের মধ্যে গণ্য। তাই খাঁটি মুমিনের পার্থিব জীবনের সব কাজকর্মই দীনদারী।
সুতরাং দীন ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতো শুধু কতক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের নাম নয়। হিন্দুরা কতক পূজা-উপাসনা ও উপবাসের মাধ্যমে ধর্ম পালন করে। খ্রিস্টানরা প্রতি রোববার গির্জায় গিয়ে উপাসনা করে। এসব পূজা-উপাসনার সাথে দুনিয়ার অন্য সব কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম এ জাতীয় কোনো ধর্মই নয়। ইসলামের ধর্মীয় কাজগুলোর মাধ্যমে দুনিয়ায় জীবনযাপনের শিক্ষা দেওয়া হয়। মুসলমানদের ধর্মীয় জীবন দুনিয়ার জীবন থেকে মোটেই আলাদা নয়।
মুসলিম পরিবারে জন্মিলেই কি মুসলিম হয়ে যায়?
এই যে ইসলামের এ চমৎকার পরিচয় তা আমাদের সমাজের খুব কম লোকেরেই জানা আছে। যারা নিজেদেরকে মুসলমান মনে করে তাদের সবারই ইসলামের এ সুন্দর পরিচয় জানা খুবই জরুরি। ইসলামকে এভাবে না জানলে কেমন করে খাঁটি মুসলমান হওয়া যাবে? আর খাঁটি মুসলমান হতে না পারলে দুনিয়ায় শান্তি ও আখিরাতে দোযখ থেকে নাজাত পাওয়ার কোনো উপায়ই থাকবে না।
লোকেরা মনে করে যে, মুসলিম পরিবারে জন্মিলেই মুসলিম হয়ে যায়- এ ধারণা একেবারেই ভুল। মুসলমানের সন্তানও কাফির হয়ে যেতে পারে। আবার কাফিরের সন্তানটাও খাঁটি মুসলমান হতে পারে। অতীতকালে কাফিরের সন্তানও নবী হয়েছেন। হযরত ইবরাহীম আ. এর পিতা আযর কাফির ছিল। আবার নূহ আ. এর এক ছেলেও কাফির ছিল। জন্মগতভাবে কেউ মুমিন বা কাফির হয় না। মুমিন হওয়ার জন্য প্রথম শর্তই হলো ঈমান। ঈমান আনা ও না আনার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। ঈমান বা বিশ্বাস মনের ব্যাপার। মনের উপর জোর খাটে না। তাই ঈমান আনার জন্য জোর করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। যখন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি কাজে লাগানোর বয়স হয় তখন নিজের ইচ্ছায় কাফিরের সন্তানও ঈমানদার হয়ে যেতে পারে, আবার মুমিনের সন্তানও কাফির হয়ে যেতে পারে। মুসলিম হওয়ার জন্য কতক জরুরি গুণের প্রয়োজন। সর্বপ্রথম তাকে তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাসী হতে হবে। এরপর তাকে মুসলিম হিসেবে জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে কুরআন ও হাদীসের কিছু ইলম হাসিল করতে হবে এবং ঈমান ও ইলম অনুযায়ী মুসলিম চরিত্র গঠন করার মতো আমল করতে হবে।
কাফিরের কোনো সন্তান যদি ঈমান, ইলম ও আমলের গুণের কারণে মুসলিম হয়, তাহলে কোনো মুসলিম সন্তানের মধ্যে এসব গুণ না থাকলে তাকে কী কারণে আল্লাহ মুসিলম হিসেবে গণ্য করবেন?
একজন ডাক্তারের সন্তান যদি ডাক্তারি বিদ্যা না শেখে, তাহলে ডাক্তারের সন্তান বলেই কি তাকে কেউ ডাক্তার বলে স্বীকার করবে? কোনো মাস্টারের মূর্খ সন্তান যদি নিজেকেও মাস্টার বলে দাবি করে তাহলে কি কেউ এ দাবি মেনে নেবে?
মুসলিম পরিবারে পয়দা হওয়াও আল্লাহর মেহেরবানী
আল্লাহ তাআলা যদি আমাকে মুসলমানের ঘরে পয়দা না করতেন তাহলে আমার নিজের চেষ্টায় ইসলাম গ্রহণ করার কোনো সুযোগ পেতাম কি না- জানি না। তাই আল্লাহ তাআলার বিরাট মেহেরবানী যে, তিনি আমাকে মুসলমান পিতা-মাতার ঘরে পয়দা করেছেন। আমার পিতা যদি আলেম না হতেন এবং তিনি যদি মুসলিম নামধারী হয়েও ঈমান, ইলম ও আমলের ধার না ধারতেন, তাহলে আমাকে তিনি ছোট সময় থেকে মুসলমান হিসেবে গড়ে তুলতেন না। আমাকে আলেমের ঘরে পয়দা করাটাও মা’বুদের বিরাট মেহেরবানী।
তাহলে বোঝা গেল, যারা মুসলমাননের ঘরে জন্ম নিয়েছেন, তাদেরকেও আল্লাহর দরবারে মুসলিম হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য ঈমান, ইলম ও আমলের চর্চা করতে হবে। যারা লেখাপড়া জানে না, তাদেরকেও যেমন আয়-রোজগার করতে হয়, ঘর-সংসার করতে হয়, তেমনি মুসলিম হওয়ার জন্যও তাদেরকে চেষ্টা করতে হবে। এর জন্য সর্বপ্রথম তাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে বুনিয়াদি জ্ঞান হাসিল করতে হবে- যাতে মুমিন ও মুসলিম হিসেবে আল্লাহর দরবারে গণ্য হওয়া যায়। তা না হলে আখিরাতে কী দশা হবে সে চেতনাও তারা হারিয়ে ফেলবে।
তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের সরল অর্থ
ঈমানের মূল বিষয়কে ইসলামী পরিভাষায় তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত বলা হয়। মুসলমানদের জীবনের সকল দিক এ তিনটি মূলনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হতে হবে। কালেমা তাইয়েবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’- এর প্রথম অংশ তাওহীদ এবং দ্বিতীয় অংশ রিসালাত। এ কালেমা বেহেশতে যাওয়ার কোনো মন্ত্র নয়। না বুঝে শুধু এ কালেমা উচ্চারণ করলেই বেহেশতে যাওয়া যাবে বলে মনে করা একেবারেই ভুল।
যে ব্যক্তি এ কালেমা বুঝে-শুনে কবুল করে, সে আসলে তার জীবনের নীতি বা পলিসি ঘোষণা করে। প্রথম অংশ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ দ্বারা সে ঘোষণা করে- ‘‘আমি একমাত্র আল্লাহর হুকুমমতো সবকিছু করব এবং আল্লাহর হুকুমের বিরোধী আর কারো হুকুম মানব না।’’ দ্বিতীয় অংশ ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বলে সে ঘোষণা করে- ‘‘মুহাম্মদ সা. যেভাবে যে তরীকা বা নিয়মে আল্লাহর হুকুম পালন করেছেন, আমি একমাত্র ঐ নিয়মেই আল্লাহর হুকুম পালন করব। তাঁর তরীকা ছাড়া আর কারো তরীকা আমি মানব না।’’
মুমিনকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি সকল দিকে যা কিছু করতে হয় তা সবই এ দুটো নীতি অনুযায়ীই করতে হবে। এছাড়া দুনিয়ায় যা কিছু করা হয় তার হিসাব আদালতে-আখিরাতে দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা সকল কাজের হিসাব নিয়ে পুরস্কার বা শাস্তি দিবেন- এ বিষয়ে পূর্ণ ইয়াকীন রেখেই মুমিনকে দুনিয়ার সবকিছু করতে হয়।
এতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, মুমিনের জীবনে ধর্মীয় দিক অন্য সব দিক থেকে আলাদা নয়; জীবনের সকল দিকই ধর্মীয় নীতি অনুযায়ী চলবে। তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত মুমিনের জীবনের আসল চালিকাশক্তি।
‘ইসলাম’ শব্দের অর্থ
ইসলাম আরবী শব্দ। এর অর্থ আত্মসমর্পণ। আত্ম মানে নিজ, সমর্পণ মানে স্বত্ব ত্যাগ করে দিয়ে দেওয়া। আত্মসমর্পণ অর্থ- নিজেকে অন্য কারো অধীন করে দেওয়া।
কুরআন ও হাদীসে ‘ইসলাম’ শব্দ দ্বারা আল্লাহর তাআলার নিকট আত্মসমর্পণ বোঝানো হয়েছে। আর যে আল্লাহ তাআলার নিকট নিজেকে সমর্পণ করে তাকে ‘মুসলিম’ বলা হয়। এর সহজ অর্থ হলো নিজের মর্জি ও ইচ্ছামতো না চলে আল্লাহ তাআলার হুকুমমতো চলা। যে এভাবে চলে সে-ই মুসলিম বা আত্মসমর্পণকারী।
ইসলাম শব্দ থেকেই ‘আসলামা’ শব্দ তৈরী হয়েছে। এর অর্থ সে ইসলাম কবুল করেছে বা আত্মসমর্পণ করেছে। এভাবেই ‘আসলামতা’ মানে আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম বা আত্মসমর্পণ করলাম। যেমন- ইবরাহীম আ. এর কথা কুরআনে আছে,
أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ
অর্থাৎ, ‘‘আমি সারাজাহানের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করেছি।’’ (সূরা বাকারাঃ ১৩১)
ইসলাম শব্দের আরেকটি অর্থ হলো শান্তি। ‘আস্সালামু আলাইকুম’ অর্থ আপনার উপর শান্তি নাযিল হোক। আস্সালাম ও ইসলাম একই ক্রিয়ামূলের শব্দ। আল্লাহর হুকুমমতো চললেই শান্তি পাওয়া যায়। সকল মানুষই শান্তি চায়। শান্তি পেতে হলে ইসলামের বিধানমতো চলতে হবে। তাই আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য যে জীবনবিধান পাঠিয়েছেন তার নাম রেখেছেন ইসলাম।
‘দীন’ শব্দের অর্থ
আল কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ
অর্থাৎ, ‘‘নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত দীন (হিসেবে গণ্য)।’’
সূরা মায়িদার ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
অর্থাৎ, ‘‘তোমাদের জন্য আমি ইসলামকে দীন হিসেবে দিয়ে খুশি হলাম।’’
এ দুটো আয়াতে ইসলামকে ‘দীন’ বলা হয়েছে। আমরা ‘দীন ইসলাম’ কথাটি বলেও থাকি। অনেকেই দীন ইসলামের বাংলা অর্থ ‘ইসলাম ধর্ম’ মনে করে। এটা একেবারেই ভুল অর্থ। ‘দীন’ শব্দের অর্থ না জানার কারণেই এ ভুল করা হয়।
‘দীন’ অর্থ যদি ‘ধর্ম’ মনে করা হয় তাহলে ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের মতোই একটা ধর্ম বলে বোঝা যাবে। ইসলাম শুধু মানুষের ধর্মীয় দিকের বিধান দেয়নি, জীবনের সবদিকের বিধানই ইসলাম দিয়েছে। তাই ‘ইসলাম ধর্ম’ কথাটি সঠিক নয়। ‘আল্লাহ’ শব্দের যেমন কোনো অনুবাদ দরকার হয় না, তেমনি আরবী ‘দীন’ শব্দেরও অনুবাদের দরকার নেই। আমরা ‘দীন ইসলাম’ই বলব। যেহেতু ‘দীন’ শব্দের অর্থ ‘ধর্ম’ বললে আসল অর্থ বোঝা যায় না, তাই ‘ইসলাম ধর্ম’ কথাটি বলা ঠিক নয়।
কিন্তু ইসলামকে যখন আল্লাহ ‘দীন’ বলেছেন, তখন দীন অর্থ জানা খুবই জরুরি। ‘দীন’ শব্দের আসল অর্থ আনুগত্য করা বা মেনে চলা। আমরা বাপ-মায়ের কথা মেনে চলি। দেশের আইন মেনে চলি। আল্লাহকে মেনে চলাই হলো দীন। আর এ দীনের নাম আল্লাহ-ই রেখেছেন ‘ইসলাম’। আল্লাহকে মেনে চলার জন্য ইসলাম নামে মানুষকে যে নিয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান তিনি দিয়েছেন তা-ই ‘দীন ইসলাম’।
সব সৃষ্টির জন্যই আল্লাহ নিয়ম–কানুন দিয়েছেন
আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য যেমন বিধি-বিধান দিয়েছেন, তেমনি যত কিছু পয়দা করেছেন ছোট-বড় প্রতিটি সৃষ্টির জন্যই বিধান তৈরী করেছেন। একটা ঘাসের বেঁচে থাকার জন্য কী কী দরকার তা তিনিই ফায়সালা করে দিয়েছেন। পিঁপড়া থেকে হাতি পর্যন্ত সকল জীব, এটম (পরমাণু) থেকে সূর্য পর্যন্ত সকল বস্তুই কতক নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। এসব নিয়ম কে বানিয়েছেন? কোনো সৃষ্টি কি এসব নিয়ম নিজে বানাতে পারে? মানুষের শরীরে যত নিয়ম আছে-রক্ত চলাচলের নিয়ম, নিঃশ্বাস নেওয়ার নিয়ম, প্রস্রাব-পায়খানার নিয়ম, ঘুমের নিয়ম ইত্যাদি কি মানুষ নিজেরা বানিয়ে নিয়েছে?
পশু-পাখি, গাছপালা, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, ধুলা-বালি পর্যন্ত আল্লাহর বানানো নিয়ম মেনে চলছে। এদের কারো ঐ নিয়ম অমান্য করার শক্তি নেই। বস্তু হোক আর প্রাণীই হোক কেউ নিজের মর্জিমতো চলার ক্ষমতা রাখে না। স্বাধীনভাবে চলার সাধ্য থাকলে একই নিয়মে চলতে বাধ্য হতো না।
ইসলাম কাকে বলে?
এর সহজ উত্তর হলো, সৃষ্টির জন্য স্রষ্টা যে নিয়ম-কানুন বানিয়েছেন তারই নাম ইসলাম। যে সৃষ্টির জন্য যে নিয়ম তিনি দিয়েছেন তা-ই ঐ সৃষ্টির ইসলাম। সবার জন্য একই নিয়ম তিনি দেননি। যার জন্য যে নিয়ম দিয়েছেন সে নিয়মটাই তার ইসলাম।
মানুষের জন্য যে নিয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান তিনি দিয়েছেন তা মানুষের ইসলাম। সূর্যের জন্য যে বিধান দেওয়া হয়েছে তা সূর্যের ইসলাম। পানির জন্য দেওয়া বিধান পানির ইসলাম। এভাবে ছোট-বড় সব জিনিস ও জীবেরই নিজস্ব ইসলাম রয়েছে।
ইসলাম দু’রকম
মানুষের ইসলাম ও অন্যান্য সৃষ্টির ইসলামের মধ্যে দু’দিক দিয়ে বেমিল আছে। যেমন-
১. মানুষের ইসলাম নবীর মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছেছে। অন্যান্য সৃষ্টির ইসলাম নবীর কাছে পাঠানো হয়নি। এমনকি মানুষের শরীরের জন্য যে ইসলাম তা-ও নবীর মাধ্যমে আসেনি। আল্লাহ তাআলা মানুষ ছাড়া অন্যান্য সৃষ্টির ইসলাম নবীর মাধ্যমে না পাঠিয়ে প্রত্যেক সৃষ্টির উপর তার জন্য তৈরীকৃত ইসলাম তিনি নিজে সরাসরি চালু করেন।
২. নবীর মাধ্যমে মানুষের জন্য যে ইসলাম পাঠানো হয়েছে তা আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে নিজে সরাসরি চালু করেন না। যদি তিনি সরাসরি চালু করতে চাইতেন, তাহলে নবী না পাঠিয়ে অন্যান্য সৃষ্টির ইসলামের মতোই মানুষের ইসলামও তিনি নিজেই জারি করতেন। তা না করে তিনি মানুষের ইসলাম নবীর কাছে পাঠিয়ে নবীকেই তা চালু করার দায়িত্ব দিয়েছেন। মানুষের ইসলাম আল্লাহ নিজে চালু করবেন না বলেই নবীর উপর সে দায়িত্ব দিয়েছেন।
এ দায়িত্বটাই খিলাফতের দায়িত্ব
ইসলাম আল্লাহর দেওয়া বিধান। তিনি নিজে তা জারি না করে তাঁর পক্ষ থেকে জারি করার দায়িত্ব নবীকে দিয়েছেন। কারো পক্ষ থেকে অন্য কেউ কোনো কাজ করলে তাকে প্রতিনিধি বা নায়েব বলা হয়। যার পক্ষ থেকে কাজটি করা হয় তিনি হলেন মনিব বা মালিক। খলীফা বা প্রতিনিধি তো মালিক নয়; মালিকের মর্জিমতোই প্রতিনিধিকে কাজ করতে হয়। খলীফা বা প্রতিনিধির কাজটিকেই খিলাফত বলা হয়।
প্রতিনিধিকে আরবীতে খলীফা বলে। মানুষের জন্য আল্লাহ তাআলা যে ইসলাম রাসূল সা. এর নিকট পাঠালেন তা তিনি খলীফা হিসেবে চালু করার দায়িত্ব রাসূল সা. কেই দিলেন। আল্লাহ নিজে যখন জারি করবেন না, তখন জারি করার দায়িত্ব তো অন্য কাউকেই পালন করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ঘোষণা করেছেন, ‘‘তিনি মানুষকে দুনিয়ায় খলীফার দায়িত্ব পালনের জন্যই পয়দা করেছেন।’’ তাই যে ব্যক্তি রাসূল সা. এর উপর ঈমান আনবে, তাকেও ঐ দায়িত্ব পালন করতে হবে। ঐ দায়িত্ব পালন না করলে কেউ-ই আল্লাহর খলীফা হিসেবে গণ্য হবে না।
এখানে একটা বড় কথা বুঝতে হবে- আল্লাহ মানুষকে শুধুমাত্র খলীফা হিসেবেই পাঠিয়েছেন। তাই দুনিয়ায় মালিক বা মনিব হওয়ার কোনো ক্ষমতা মানুষের নেই। যদি কোনো মানুষ আল্লাহর খলীফার দায়িত্ব পালন করতে না চায়, তাহলে সে যা করবে তাতে সে শয়তানের খলীফা বলেই গণ্য হবে। কারণ, আল্লাহর বিধান যে পালন করে না যে অন্য যে বিধানই মেনে চলে, তা শয়তানের বিধান হিসেবেই কুরআন মাজীদের সূরা আল বাকারা ২০৮ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে। দুনিয়ায় মানুষকে খলীফাই হতে হবে; অন্য কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। হয় আল্লাহর খলীফা, আর না হয় শয়তানের খলীফা।
মানুষের দুটো সত্তা
মানুষের শরীর তার আসল সত্তা নয়। আসল মানুষ হলো রূহ। মায়ের পেটে মানুষের শরীরটা তৈরী হওয়ার অনেক আগে আসল মানুষটি পয়দা হয়েছে। কুরআনের মতে পয়লা মানুষ আদমের দেহ তৈরী হওয়ার পর আল্লাহ তাআলা এর মধ্যে তাঁর রূহ থেকে ফুঁ দিয়ে দিলেন। আল্লাহ নিজে যে জিনিসটা ফুঁ দিয়ে দিলেন সেটাই আসল মানুষ। কুরআন আরো বলে যে, আদমের পিঠ থেকে সকল রূহকে একসাথে পয়দা করা হয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ পয়দা হবে সবাইকে এক সাথেই সৃষ্টি করা হয়েছে। দুনিয়ায় কাউকে আগে কাউকে পরে পাঠানো হয়।
এ রূহ কোনো বস্তু নয়। এ রূহের কারণেই মানুষ কোন্টা ভালো এবং কোন্টা মন্দ তা বুঝতে পারে। মানুষ যখন কোনো মন্দ কাজ করে ফেলে তখন মনে খারাপ লাগে। এটাকে আমরা বিবেক বলি। এটা ভালো-মন্দের চেতনা। এটাকে নৈতিক চেতনা বলা হয়। ভালো-মন্দের ধারণা থেকেই এ চেতনা সৃষ্টি হয়। এটাই আসল মানুষ এবং এটাই মনুষ্যত্ব। এ কারণেই খুব বেশি মন্দ চরিত্রের মানুষ সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়, ঐ লোকটা মানুষই নয়; পশুর চেয়েও মন্দ। কুরআনেও এ রকম লোক সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘‘এরা পশুর মতো; বরং পশুর চেয়েও অধম।’’
মানুষের দেহসত্তাটি নৈতিক সত্তা নয়; বস্তুসত্তা মাত্র। আমরা যেসব জিনিস খাই সেসবের মধ্যে যেসব বস্তুসত্তার উপকরণ রয়েছে তা দিয়েই মানুষের শরীর তৈরী হয়েছে। এ কারণেই এসব খাবার দেহের মধ্যে খাপ খায়। মায়ের পেটে এ দেহ তৈরী হওয়ার পর একসময় তাতে রূহকে সওযার করিয়ে দেওয়া হয়।
দেহের দাবিগুলোকে কুরআনে নাম দেওয়া হয়েছে ‘নাফ্স’। দেহের দাবি হলো খিদা লাগলে খাবার চাওয়া, পিপাসা লাগলে পানি চাওয়া, গরম লাগলে ঠান্ডা চাওয়া, যা সুন্দর তা-ই দেখতে চাওয়া, যা শুনতে মিষ্টি তা-ই শুনতে চাওয়া। আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার সবকিছু মানুষের জন্যই সৃষ্টি করেছেন বলে সূরা আল বাকারার ২৯ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন। তাই যত কিছু ভোগ করার জিনিস আছে, তার সবই দেহ বা নাফ্স পেতে চায়। এসবের দিকে দেহের বিশেষ ঝোঁক আছে।
পশুর ভালো-মন্দের চেতনা নেই। মানুষের দেহটাও পশুর মতোই। কারণ, এরও নৈতিক চেতনা নেই। হাদীসে দেহটাকে ঘোড়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে যে, ঘোড়ায় চড়ে সে যদি লাগাম কষে ঘোড়াকে কাজে লাগাতে পারে তাহলে অল্প সময়ে অনেক দূরে যেতে পারবে; কিন্তু ঘোড়া যদি নিজের মর্জিমতো চলে তাহলে সওয়ারীর মহাবিপদ। তেমনিভাবে রূহ যদি শরীআতের লাগাম লাগিয়ে নাফ্সকে চালাতে পারে তবেই মানুষ সফল হয়। আর যদি না পারে তাহলে সে পশুর চেয়েও অধম হতে বাধ্য হয়।
আমরা সবাই এ বিষয়ে সাক্ষী। আমার নাফ্সের দাবিতে যখন আমি কোনো মন্দ কাজ করতে চাই, আমার রূহ (বিবেক বা নৈতিক চেতনা) তখন আপত্তি জানায়। রূহ যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে নাফ্সকে দমন করতে পারে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। যদি রূহ দুর্বল হয়, তাহলে মন্দ কাজ থেকে ফেরাতে পারে না।
নাফ্স ও রূহের মধ্যে এ লড়াই চলার কারণেই মানুষের নাফ্সের তিন রকম অবস্থা হয় বলে কুরআনে বলা হয়েছে। যেমন-
১. নাফ্সে আম্মারাহ (১৩ পারার পয়লা আয়াত): নাফ্স ও রূহের লড়াইয়ে যদি নাফ্স সব সময় জয়ী হয় এবং সব সময়ই রূহ হেরে যায় তাহলে এ নাফ্সকে ‘নাফ্সে আম্মারাহ’ বলা হয়।
২. নাফ্সে লাওয়ামাহ (সূরা কিয়ামার ২ নং আয়াত): এ অবস্থা তখন হয়, যখন এক সময় রূহ জিতে যায় আবার এক সময় নাফ্স জিতে যায়।
৩. নাফ্সে মুতমাইন্নাহ (সূরা আল ফাজরের ২৭ নং আয়াত): এ অবস্থা তখন হয়, যখন রূহ সবসময় জয়ী হয় এবং নাফ্স সবসময় পরাজিত হয়।
ইসলাম মানুষকে এমন শিক্ষাই দেয়, যাতে তার রূহ শক্তিশালী হয় এবং নাফ্সের উপর জয়ী হতে পারে। নামায-রোযার উদ্দেশ্যও এটাই।
আল্লাহ যতকিছু সৃষ্টি করেছেন সেসবের পরিচয়
আল্লাহ তাআলা কত কিছু পয়দা করেছেন-তা হিসাব করার সাধ্যও কারো নেই। আমরা কয়েক ভাগে ভাগ করে তাদের পরিচয় জানতে পারিঃ
১. প্রাণহীন সৃষ্টিঃ যেমন- ইট, পাথর, বালি, চাঁদ, সুরুজ, তারা ইত্যাদি। এসবের মধ্যে জীবন নেই। তাই এরা মরেও না।
২. প্রাণী বা জীবঃ এদের জীবন আছে বলে মরণও আছে।
প্রাণী আবার দু’রকমঃ
১. যেসব প্রাণীর ভালো-মন্দ বোঝার নৈতিক চেতনা আছে। যেমন-ফেরেশতা, জিন ও মানুষ।
২. যেসব প্রাণীর ঐ চেতনা নেই। ফেরেশতা, জিন ও মানুষ ছাড়া অন্য কোনো জীবের নৈতিক চেতনা নেই।
ফেরেশতা নূরের তৈরী, জিন ‘নার’ বা আগুনের তৈরী আর মানুষ মাটির তৈরী।
ফেরেশতাদের ভালো-মন্দের চেতনা থাকলেও তারা শুধু যা ভালো তা-ই করতে পারে, যা মন্দ তা করার ইখতিয়ার কিংবা ক্ষমতা তাদের নেই। মন্দ করার ক্ষমতা নেই বলে তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার দরকার হবে না। আর বাধ্য হয়ে তারা ভালো কাজ করে বলে তাদের কোনো বাহাদুরী নেই। তাই তারা পুরস্কারও পাবে।
জিন ও মানুষকে ভালো ও মন্দ দু’রকম কাজ করারই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাই ভালো কাজ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মন্দ কাজ করলে তারা শাস্তির যোগ্য হয়। আর মন্দ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মন্দ না করে ভালো কাজ করাটা তাদের কৃতিত্ব। তাই তারা কৃতিত্বের বদলায় পুরস্কার পাবে। এদিক দিয়ে জিন ও মানুষের মিল থাকলেও একটি দিক দিয়ে জিনের চেয়ে মানুষের মার্যাদা আলাদা। তা হলো, মানুষকে আল্লাহ তাআলা খলীফার দায়িত্ব দিয়েছেন; জিনকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। দুনিয়ায় আল্লাহর খিলাফত কায়েমের দায়িত্ব মানুষকে দেওয়ার কারণেই জিন জাতির ইবলিস হিংসা করে শয়তানে পরিণত হয়।
মানুষের জন্য জ্ঞান জরুরি
জ্ঞান মানে জানার বিষয়। মানুষ ও জিন ছাড়া অন্য যত জীব আছে, তাদের যা কিছু জানা দরকার সেজন্য নিজেদের চেষ্টা করা লাগে না। আল্লাহ তাদের জন্য যে নিয়ম-কানুন বানিয়েছেন তা তিনি নিজেই তাদেরকে শিখিয়ে দেন। তাই তাদেরকে চেষ্টা করে কিছুই শিখতে হয় না। তাদের জন্য কোন্টা দরকার, কোন্টা ভালো ও কোন্টা মন্দ- এর কোনোটাই অন্যদের কাছ থেকে জানতে হয় না। মানুষকে চেষ্টা করে সাঁতার শিখতে হয়। হাঁসকে আল্লাহ তাআলা জন্মগতভাবেই সাঁতার শিখিয়ে দেন।
মানুষকে নিজের ইচ্ছামতো সবকিছু করতে হয়। তাকে জানতে হয় যে, কোন্টা কীভাবে কখন করা দরকার। তাকে নিজের ইচ্ছার ফায়সালা করতে হয় যে, সে আল্লাহর খলীফা হতে চায়, নাকি শয়তানের খলীফা। খিলাফতের এ ইখতিয়ার থাকার কারণেই তাকে নিজের ইচ্ছায় সবকিছু জানার চেষ্টা করতে হয়।
কুকুর মানুষের পায়খানাও খায়; কিন্তু কুকুরের বাচ্চা কখনো নিজের পায়খানা মুখে নেয় না। মানব-শিশু জানার অভাবে নিজের পায়খানাও মুখে দিতে পারে। তাই মানুষকে বাধ্য হয়ে জ্ঞান হাসিল করার চেষ্টা করতে হয়।
জ্ঞানের মূল উৎস কী কী
জ্ঞান তো তালাশ করতেই হবে। কোথা থেকে তা পাওয়া যায় তাও তো জানা জরুরি। যেখান থেকে জ্ঞান হাসিল করা যায় তাকেই জ্ঞানের উৎস বলে। কোন্ কোন্ উৎস থেকে জ্ঞান যোগাড় করতে হবে সর্বাগ্রে তা জানা দরকার। জ্ঞানের উৎস চারটি। যথা- ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, ইলহাম ও ওহী। এ উৎসগুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা খুবই জরুরি।
ইন্দ্রিয়ঃ চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও চামড়া- পাঁচটির সাহায্যে মানব-শিশু পয়লা জ্ঞান লাভ করে। এটা হলো সরাসরি জ্ঞান। যা দেখা যায়, শোনা যায়, যার গন্ধ পাওয়া যায়, স্বাদ নেওয়া যায় তা সবই সরাসরি জ্ঞান।
বুদ্ধিঃ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সামান্য জ্ঞানই হাসিল করা যায়। মানুষ বুদ্ধির সাহায্যেই সবচেয়ে বেশি জ্ঞান পায়। বুদ্ধি মানে যুক্তি বা কার্যকারণ। যেমন- চোখ দূরে কোথাও ধোঁয়া দেখতে পেল। বুদ্ধি বলে দিল, সেখানে আগুন লেগেছে; চোখের আগুন দেখার প্রয়োজন হয়নি। যুক্তি বলে দিল যে, আগুন হলেই ধোঁয়া হয়। তাই আগুন না দেখেও বুদ্ধি বলে দিল, আগুন লেগেছে। আরবীতে বুদ্ধিকে ‘আক্ল’ বলে।
ইলহামঃ ইলহাম শব্দটি আরবী। সহজ বাংলায় এর অর্থ পাওয়া গেল না। ইংরেজিতে এ উৎসটিতে Intuition বলা হয়। এর অর্থ অভিধানে লেখা হয়েছে ‘স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান’। যে জ্ঞান চেষ্টা-সাধনা ও গবেষণা করা ছাড়া হঠাৎ পাওয়া যায়। অবশ্য এ রকম জ্ঞান তারাই পায়, যারা চিন্তা-সাধনা করে। কবি, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, ইসলামী গবেষক ও চিন্তাবিদগণ কোনো কোনো সময় এমন বিষয়েও ইলহামী জ্ঞান পান, যে বিষয়ে তাঁরা চেষ্টা-সাধনা করেননি।
ওহীঃ আল্লাহর নিকট থেকে নবী-রাসূলগণের নিকট যে জ্ঞান আসে, তাকেই ওহীর জ্ঞান বলা হয়। ওহীর জ্ঞান আল্লাহর নিজের ভাষায়ও আসতে পারে। যেমন- কুরআন মাজীদের ভাষা। নবী-রাসূলের মনে আল্লাহ তাআলা ভাষা ছাড়াও জ্ঞান বা বুঝ দেন, যা তাঁরা নিজের ভাষায় প্রকাশ করেন। নবী-রাসূলগণ নিজের মনগড়া জ্ঞান দান করেন না। তাঁরা যে জ্ঞান দান করেন তা ভাষাসহ বা ভাষাছাড়া আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। এ জ্ঞানই হলো ওহীর জ্ঞান।
জ্ঞানের এ চার রকমের উৎসের মধ্যে একমাত্র ওহীর জ্ঞানেই কোনো ভুল থাকে না। আল্লাহর তো ভুল হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই আল্লাহর কাছ থেকে নবীর নিকট আসা জ্ঞানও অবশ্যই নির্ভুল। কিন্তু বাকি তিনটি উৎস থেকে পাওয়া জ্ঞান শুদ্ধও হতে পারে, ভুলও হতে পারে। তাই ঐ তিনটির সাহায্যে পাওয়া জ্ঞান ওহীর জ্ঞানের মাপকাঠিতে যাচাই করেই জানতে হবে- কোন্টা শুদ্ধ এবং কোন্টা ভুল। ওহীর জ্ঞানই শুদ্ধ ও অশুদ্ধ চেনার একমাত্র মাপকাঠি।
ইসলাম কবুল করার নিয়ম
কোনো লোক যদি ইসলাম কবুল করতে চায় তাহলে তাকে কয়েকটি নিয়ম পালন করতে হয়। সে মুসলিম পরিবারে পয়দা হলেও তাকে এসব নিয়ম মানতে হবে; তা না হলে আল্লাহর দরবারে মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে না।
‘ইসলাম’ শব্দ থেকেই ‘মুসলিম’ শব্দ তৈরী হয়েছে। যে ইসলাম কবুল করল সে-ই মুসলিম হলো। ইসলাম মানে আত্মসমর্পণ। মুসলিম মানে যে আত্মসমর্পণ করল বা আত্মসমর্পণকারী। ‘মুসলিম’ আরবী শব্দ। ফারসি ভাষায় মুসলমান বলা হয়।
সঠিকভাবে ইসলাম কবুল করতে হলে-
১. প্রথমেই মনে মনে ফায়সালা করতে হবে যে, আমি আমার মর্জিমতো চলব না; যা করলে আল্লাহ খুশি হন তা-ই করব।
২. এরপর বুঝে-শুনে কালেমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করতে হবে- ‘‘আশহাদু আল্ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহূ ওয়া রাসূলুহূ।’’ এর তরজমা হলো- ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মা’বুদ নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সা. আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।’’ ইলাহ ও মা’বুদ মানে হুকুমকর্তা, প্রভু বা মনিব।
‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’’ কথাটি কালেমায়ে তাইয়েবা নামে পরিচিত। কালেমা মানে কথা। তাইয়েবা মানে পবিত্র। কালেমা তাইয়েবা মানে পবিত্র কথা।
৩. এ কালেমার অর্থ ভালোভাবে বুঝতে হবে। না বুঝে শুধু কালেমা উচ্চারণ করলেই চলবে না। কারণ, কোনো শব্দের অর্থটাই আসল; শব্দটা আসল নয়। যেমন- ‘আগুন’ একটা শব্দ। এ শব্দের মধ্যে আগুন নেই। আগুন একটা জিনিস। ‘আগুন’ শব্দ বলে আমরা ঐ জিনিসকেই বুঝি। কালেমা তাইয়েবার মধ্যে যে ক’টি শব্দ আছে, এগুলোর অর্থই আসল। তাই ঐ শব্দগুলো উচ্চারণ করার সময় যে অর্থ বুঝতে হবে তা-ই হলো আসল কালেমা।
৪. কালেমা তাইয়েবার অর্থ
ক. ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ কথাটি উচ্চারণ করে ঘোষণা করা হয় যে, ‘‘আমি শুধু আল্লাহর হুকুম মেনে চলব; তাঁর হুকুমের বিরোধী কারো হুকুম মানব না।’’
খ. ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ কথাটি উচ্চারণ করে ঘোষণা করা হয় যে, ‘‘মুহাম্মদ সা. যে নিয়মে আল্লাহর হুকুম পালন করেছেন, আমি ঠিক সে নিয়মেই পালন করব; অন্য কারো নিকট থেকে কোনো নিয়ম কবুল করব না।
আসল কথা হলো, কালেমা তাইয়েবা এমন কোনো মন্ত্র নয় যে, না বুঝে শুধু উচ্চারণ করলেই বেহেশতে যাওয়া যাবে। এ কালেমা হলো জীবনে চলার ২ দফা নীতি বা পলিসি। ঐ দুটো কথা উচ্চারণ করে ২ দফা নীতি ঘোষণা করা হয়, যা আসলে সরাসরি আল্লাহর সাথে ২ দফা ওয়াদা। যে এ ক’টি নিয়ম পালন করে সে-ই ইসলাম কবুল করে মুসলিম হয়ে যায়।
মুসলিমের করণীয় কী?
মানুষ হিসেবে দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হলে যা কিছু করতে হয় সেসবই মুসলিম হওয়ার পর আল্লাহ তাআলার হুকুম ও রাসূল সা. এর শেখানো নিয়মে করতে হবে। কারণ, কালেমা তাইয়েবার মাধ্যমে জীবনে চলার যে ২ দফা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে, এর দাবি এটাই। এ নিয়মে চলার জন্যই আল্লাহ তাআলার সাথে ওয়াদা করা হয়েছে।
এক দিনের ২৪ ঘন্টায় আমরা যা করি তা শুরু হয় সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময়। রাসূল সা. কী নিয়মে ঘুম থেকে উঠেছেন এবং ওঠার পরে কী নিয়মে পেশাব-পায়খানা করেছেন, তা জেনে সে নিয়মেই এসব করতে হবে। তিনি যে নিয়মে ওযূ করেছেন এবং নামায আদায় করেছেন সে নিয়মেই আমাদেরকে করতে হবে।
এভাবে সারাদিন যা কিছু করতে হয়, সবই আল্লাহ তাআলার হুকুম ও রাসূল সা. এর শেখানো নিয়মে করতে হবে। খাওয়া-দাওয়া, আয়-রোজগার, ব্যবসা-বাণিজ্য করা ইত্যাদি সবই আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা বা নিয়মমতো করতে হবে। রাতে ঘুমানোর সময়ও রাসূলের শেখানো নিয়মে ঘুমাতে হবে।
মুসলিমের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব কী?
যেহেতু কালেমা তাইয়েবায় জীবনে চলার ২ দফা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে, সেহেতু মুসলিমের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো আল্লাহ তাআলার হুকুম ও রাসূল সা. এর তরীকা জানার চেষ্টা করা। মুসলিম হিসেবে যা-ই করা হবে, সবই ২ দফা নীতি মেনেই করতে হবে। তাই যে কাজই করা হোক, তা আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের শেখানো তরীকা বা নিয়মে করতে হলে তা জানতেই হবে। প্রতিটি কাজের বেলায় আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা না জানলে কাফিরের মতোই চলতে হবে। এ কারণেই মুসলিমের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব জানা বা ইলম তালাশ করা। ইলম মানেই জ্ঞান। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা ওহীর মারফতে রাসূল সা. এর কাছে যে জ্ঞান পাঠিয়েছেন, সে জ্ঞান হাসিল করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয বলে রাসূল সা. ঘোষণা করেছেন।
ওহীর জ্ঞান বিশাল। ৩০ পারা কুরআন ও লাখ লাখ হাদীস সবই ওহীর জ্ঞান। ওহীর সব জ্ঞান হাসিল করা ফরয নয়। নবী ছাড়া অন্য কেউ ওহীর সব জ্ঞান হাসিল করতে পারবে না। তাহলে ওহীর কতটুকু জ্ঞান হাসিল করা ফরয?
যার উপর যে কাজের দায়িত্ব আসে ঐ কাজ যেহেতু আল্লাহ তাআলার হুকুম রাসূল সা. এর তরীকা অনুযায়ী করতে হবে, সেহেতু ঐ বিষয়ে যতটুকু ইলম দরকার তা জানা ফরয। যে ব্যবসায় করে না তার ব্যবসায় বিষয়ক ওহীর জ্ঞান হাসিল করা ফরয নয়। যে বিয়ে করেনি তার উপর স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে কীভাবে চলতে হবে, সে জ্ঞান হাসিল করা ফরয নয়। বিয়ে করার সাথে সাথে তা ফরয হয়ে যাবে। যার উপর হজ্জ ফরয নয় তার উপর হজ্জের জ্ঞান অর্জনও ফরয নয়। আবার যার সন্তান আছে তার পিতা বা মাতা হিসেবে কী করণীয়, সে বিষয়ে ওহীর জ্ঞান তালাশ করা ফরয।
বিশেষ জরুরি কথা
মুসলিম পরিবারে পয়দা হলে বাপ-মা যদি নামাযী হয় তাহলে ছোট বয়স থেকেই ছেলে-মেয়ে কুরআন পড়া শেখে, নামাযে অভ্যস্ত হয় এবং নিজেকে মুসলমান বলে বুঝতে শুরু করে; কিন্তু বয়স যখন ১৪/১৫ বছর হয় তখন তাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা-ভাবনা করার যোগ্যতা হয়। তখন দেখা যায় যে, ছোট সময়ে পাক্কা নামাযী হওয়া সত্ত্বেও তারা নামাযে অবহেলা শুরু করে এবং একসময় নামায ছেড়েই দেয়।
এ কারণেই বোঝার বয়স হলে সচেতনভাবে নিজের ইচ্ছায় কালেমা তাইয়েবাকে বুঝে ঐ ২ দফা নীতি অনুযায়ী চলার সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। ঐ ২ দফা পলিসি ঘোষণার মাধ্যমে যে ওয়াদা করা হয়েছে, সে অনুযায়ী চলার জন্য মযবুত ফায়সালা না করলে সে কিছুতেই ঐ পলিসি মেনে চলতে পারবে না।
যারা বুঝে-শুনে এ ফায়সালা করে না তারা ছোট বয়সে নামাযী হওয়া সত্ত্বেও বুঝের বয়সে বেনামাযী হয়ে সারা জীবনই এভাবে কাটিয়ে দিতে পারে। অল্প বয়সে নামাযী হলে যুবক বয়সে বেনামাযী হয়ে গেলেও বয়স বাড়লে অনেককে আবার নামাযী হতে দেখা যায়।
কিন্ত যে পরিবারে বাবা-মা-ই নামাযী নয় সে পরিবারে যাদের জন্ম, তারা তো ছোট সময়ে কুরআন পড়া ও নামায আদায় করা শেখেই না; বড় হলে তো তাদের মধ্যে মুসলিম চেতনাই দেখা যায় না।
নামায ও রোযা কালেমার ওয়দামতো চলার যোগ্য বানায়
কালেমা তাইয়েবায় আল্লাহ তাআলার হুকুম ও রাসূল সা. এর তরীকা অনুযায়ী চলার যে ওয়াদা করা হয় সে ওয়াদা পালন করা সহজ নয়। নাফ্সের তাড়না, শয়তানের ওয়াসওয়াসা (কুপরামর্শ) ও মন্দ পরিবেশের চাপে পড়ে মানুষ বিবেকের বিরুদ্ধে চলে। নাফ্সকে বিবেকের অধীনে আনা খুবই কঠিন। এ কঠিন কাজটি সহজ করার জন্যই আল্লাহ তাআলা নামায ও রোযার ব্যবস্থা করেছেন।
নামাযের মাধ্যমে কালেমার ওয়াদা পালনের অভ্যাস হয়
নামায এমন এক আমল, যেখানে নামাযীর মন-মগজ, মুখ, হাত-পা, চোখ-কান সবই ব্যবহার করতে হয়। নামাযের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব সময় সর্বাবস্থায় যা কিছু করা বা বলা হয়, তা সবই আল্লাহ তাআলার হুকুম ও রাসূল সা. এর তরীকামতো করতে হয়। কোনো একটা কাজও নামাযীর নিজের ইচ্ছা বা খাহেশ মতো করা চলে না। এভাবে প্রতিদিন পাঁচ বার নামাযে আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকামতো মন-মগজ ও শরীরের সব অঙ্গকে কাজে লাগিয়ে কালেমার ২ দফা ওয়াদা পালনের অভ্যাস করানো হয়।
এর উদ্দেশ্য কী?
আসল উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তাআলার হুকুম ও রাসূল সা. এর তরীকামতো চলার অভ্যাসটাকে নামাযের বাইরেও কায়েম রাখা। নামাযে যেমন মুখে যা ইচ্ছা তা-ই বলা চলে না- আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকামতো বলতে হয়, তেমনি নামাযের বাইরেও মুখে এমন কথা বলা যাবে না, যা আল্লাহ পছন্দ করেন না। নামাযে যেমন দাঁড়ানো, বসা, রুকু ও সিজদায় হাত নিজের খুশিমতো যেখানে-সেখানে রাখা যায় না, নামাযের বাইরেও হাতকে আল্লাহ তাআলার হুকুম ও রাসূল সা. এর তরীকাবিরোধী কাজে ব্যবহার করা যাবে না। নামাযে যেমন চোখ দিয়ে কয়েকটা নির্দিষ্ট জায়গায় দেখতে হয়-উপর দিকে বা ডানে-বাঁয়ে দেখা চলে না, তেমনি নামাযের বাইরে সারাদিন চোখকে এমন কিছু দেখা থেকে ফিরিয়ে রাখতে হবে, যা দেখা নিষেধ।
যদি কেউ নামাযের এ চমৎকার উদ্দেশ্য বুঝে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে আল্লাহ তাআলার হুকুম ও রাসূল সা. এর তরীকা পালনের অভ্যাস গড়ে তোলে এবং সারাদিনের কাজ-কর্ম ও চলা-ফেরার সময় ঐ অভ্যাসকে তার মন-মগজ, মুখ, চোখ-কান ও হাত-পায়ে চালু রাখে তাহলে সে নামাযের মতোই নামাযের বাইরেও কালেমার ২ দফা ওয়াদা পালন করতে পারবে।
এ কারণেই আল্লাহ তাআলা সূরা আনকাবূতের ৪৫ নং আয়াতে বলেন,
إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ
অর্থাৎ, ‘‘নিশ্চয়ই নামায ফাহেশা (লজ্জাকর) কাজ ও খারাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে।’’ নামাযের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার এ কথাটি তাদের জীবনেই সত্য হয়, যারা নামাযে কালেমার ওয়াদা পালনের অভ্যাস করে এবং সে অভ্যাসকে নামাযের বাইরেও কায়েম রাখে।
আল্লাহ তাআলা কিন্তু নামায পড়তে হুকুম করেননি; নামায কায়েম করার হুকুম করেছেন। আমরা নামায পড়ি; কায়েম করি না। নামাযে যে অভ্যাস করানো হয়, সে অভ্যাস যদি নামাযের বাইরের জীবনেও চালু রাখা যায় তাহলে আমাদের জীবনে নামায কায়েম হবে। এভাবে নামাযকে বুঝলে এবং জীবনে মেনে চললে আমাদের নামায আল্লাহর ঐ ঘোষণা অনুযায়ী আমাদেরকে লজ্জাকর ও মন্দ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে।
নামায আল্লাহকে ভুলতে দেয় না
আল্লাহ তাআলা সূরা তোয়াহা’র ১৪ নং আয়াতে বলেন,
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي
অর্থাৎ ‘‘আমাকে মনে রাখার জন্য নামায কায়েম কর।’’
মসজিদে জামাআতের সাথে আদায় করাই নামাযের সঠিক নিয়ম। জামাআতে হাজির হওয়ার চেষ্টা না করে সবসময় ফরয নামায একা একা পড়ার অভ্যাস করলে এ নামায আল্লাহর দরবারে কবুল নাও হতে পারে। কোনো কারণে জামাআতে ফরয নামায আদায় করতে না পারলে তো ঐ নামায বাধ্য হয়ে একাকীই পড়তে হবে; কিন্তু জামাআতে নামায আদায় করার জন্য রাসূল সা. কঠোর তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘আমার ইচ্ছা হয় যে, অন্য একজনকে নামাযে ইমামতি করতে দিয়ে আমি (মহল্লায়) ঘুরে দেখি- কারা জামাআতে আসল না; এরপর ঐ সব লোকের ঘর পুড়িয়ে দিই, যারা জামায়াতে হাজির হলো না।’’
রাসূল সা. আরও বলেছেন, মসজিদে নামায আদায় করলে কমপক্ষে ২৭ গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে। আর ফরয নামায ছাড়া বাকি নামায বাড়িতে পড়লে বেশি সওয়াব। তিনি আরও বলেন, ‘‘হাশরের দিন যখন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না, তখন সাত রকম মানুষ ঐ ছায়ায় আশ্রয় পাবে। তাদের একজন ঐ লোক, যার দিল মসজিদের দিকে ঝুলে থাকে।’’
এর অর্থ হলো, সে মসজিদে নামায আদায় করার পর বাইরে যখন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে তখনও তার মনটা মসজিদমুখী থাকে এবং কখন আযান হয় সেদিকে খেয়াল রাখে ও সময়মতো জামায়াতে হাজির হয়।
নামায তাকে সব সময় মনে করিয়ে দেয় যে, তুমি সব সময়ই আল্লাহর গোলাম। তুমি আল্লাহ যা অপছন্দ করেন তা করতে পার না। এভাবেই পাঁচ ওয়াক্ত নামায যে মসজিদে জামায়াতে আদায় করার অভ্যাস করে নেয়, সে আল্লাহকে ভুলে থাকতে পারে না।
খাঁটি নামাযীর ২৪ ঘন্টার রুটিন
খাঁটি নামাযীর দিনের ২৪ ঘন্টার কাজ শুরু হয় নামায দিয়ে, শেষও হয় নামায দিয়ে। ঘুম থেকে ওঠার পরে নামাযের আগে আর কোনো কাজ নেই। পেশাব-পায়খানা ও ওযূ-গোসল তো নামাযের জন্য তৈয়ার হওয়ার উদ্দেশ্যেই করতে হয়। ইশার নামায পড়ে আবার ঘুমিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দিনের কাজ শেষ হয়। রাসূল সা. বলেন, ‘‘যে ইশার নামায জামায়াতের সাথে আদায় করার পর ঘুমিয়ে গেল আবার ফজরের জামায়াতে শামিল হলো, তার আমলনামায় ঘুমকেও ইবাদাত হিসেবে লেখা হবে।’’
চার ওয়াক্ত নামায সময়ের শুরুতে আদায় করলে বেশি সওয়াব হয়; কিন্তু ইশার নামায রাতের তিন ভাগের এক ভাগ পার হওয়ার পর পড়লে বেশি সওয়াব। এর উদ্দেশ্য একটাই, যাতে ইশার নামাযের পর তাড়াতাড়ি ঘুমানো যায়। যাতে নামাযে মনটা যে অবস্থায় থাকে, ঐ অবস্থায়ই ঘুমিয়ে পড়া যায়।
এ কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, খাঁটি নামাযীর ২৪ ঘন্টার রুটিন নামাযের অধীন থাকবে; নামায অন্য কাজের অধীন থাকবে না। যেমন- কোনো কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে নামাযের সময় মসজিদে না গিয়ে যদি পরে একা নামায পড়া হয় তাহলে নামাযকে কাজের অধীন করা হলো। নামাযের সময় হয়ে গেলে কাজকে মুলতবি করে নামাযে যেতে হবে। তবেই রুটিন নামাযের অধীন হবে।
রোযা নাফ্সকে দমন করার হাতিয়ার
আল্লাহ তাআলা সব মানুষকেই কোন্টা ভালো আর কোন্টা মন্দ, তা বোঝার যোগ্যতা দিয়েছেন। এরপরও মানুষ কেমন করে মন্দ কাজ করে? ইতঃপূর্বে ‘নাফ্স ও রূহের লড়াই’ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। রূহ যদি দুর্বল থাকে তাহলে নাফ্সের তাড়নায় মানুষ মন্দ কাজ করে। দেহের দাবিকে নাফ্স বলা হয়। দেহের নৈতিক চেতনা নেই বলেই দেহ মন্দ কাজের দিকে টানে। এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো-রূহকে এমন শক্তিশালী করা, যাতে সে নাফ্সকে দমন করতে পারে। নামাযও নাফ্সকে দমন করতে সাহায্য করে। যেমন- শীতের মৌসুমে শরীরটা ফজরের সময় লেপ ছেড়ে উঠতে চায় না। কিন্তু নামাযের অভ্যাস হলে রূহের এতটা শক্তি হয় যে, শরীর বা দেহকে লেপ ছেড়ে উঠতে বাধ্য করতে পারে।
আল্লাহ তাআলা নাফ্সকে দমন করে এর উপর রূহকে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে রোযাকে সবচেয়ে মযবুত হাতিয়ার হিসেবে দিয়েছেন।
দেহের দাবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কড়া দাবি হলো পেটের ক্ষুধা ও যৌনক্ষুধা। পেটে বেশি ক্ষুধা লাগলে মানুষ অস্থির হয়ে যা পায় তা-ই খায়। কঠিন পিপাসা লাগলে পানির জন্য পাগল হয়ে যায়। যৌনক্ষুধা যখন তীব্র হয় তখন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ধর্ষণের মত খবর পত্রিকায় দেখা যায়, তা ঐ যৌনক্ষুধারই ফল।
রমযান মাসের রোযা ঐ রোগেরই আসল ওষুধ। রমযানে দিন শরু হওয়ার আগে থেকে সূর্য ডোবার সময় পর্যন্ত পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকতে হয়। পেটের ক্ষুধা ও যৌনক্ষুধার মতো তীব্র দুটো ক্ষুধাকে দমন করতে পারলে নাফ্সের অন্য সব দাবিকে দমন করা সহজ হওয়ারই কথা।
গরমের মৌসুমে রাতের চেয়ে দিন অনেক বড় থাকে। দুপুরের পরে খুব খিদা লাগে। কোনো কোনো সময় খুব পিপাসা লাগে। কিন্তু যে রোযা রাখে সে ক্ষুধা ও পিপাসার ক্ষ্ট সহ্য করে নাফ্সকে দমন করে। এভাবে তার রূহের শক্তি বেড়ে যায়।
রোযা ছাড়া এত লম্বা সময় একটানা কিছুই না খেয়ে কেউ থাকে না। তাই শেষবেলায় ভয়ানক খিদা লাগে। ক্ষুধার জ্বালা কেমন, তা ধনীরা রোযার মাধ্যমে টের পায়। আল্লাহ তাআলার হুকুম ও রাসূল সা. এর তরীকা পালনের ওয়াদা করে যারা মুসলিম হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা কখনও রোযা অবস্থায় গোপনে কিছু খেয়ে ফেলে না। আর কেউ না দেখলেও আল্লাহ যে দেখছেন, সে চেতনার কারণেই এভাবে ভুখ-পিপাসায় কষ্ট পেলেও তা তারা সহ্য করে। রমযানের গোটা মাসটায় একটা কঠিন ট্রেনিং চলে। আল্লাহকে খুশি করার জন্য দেহের দাবিকে অগ্রাহ্য করে যারা রোযা রাখে তাদের নৈতিক বল বেড়ে যায়। নাফ্সকে দমন করার এ ট্রেনিং মানুষকে নাফ্সের গোলাম হওয়া থেকে বাঁচায় এবং আল্লাহর গোলাম হওয়ার যোগ্য বানায়।
একটা কথা ভালো করে বুঝে নেওয়া দরকার, আল্লাহ রোযাদারকে অনেক বেশি সময় ভুখা রেখে কষ্ট দিতে চান না। তাই শেষরাতে দেরি করে খেলে সওয়াব বেশি। ফজরের সময় শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত খাওয়া যায়। ওদিকে সূর্য ডোবার সাথে সাথে দেরি না করে ইফতার করলে সওয়াব বেশি। ক্ষুধায় বেশি সময় কষ্ট দেওয়া আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়।
রোযার হুকুম দিয়ে আল্লাহ রোযাদারকে শিক্ষা দিচ্ছেন যে, তুমি নাফ্সের গোলাম না হয়ে আমার গোলাম হও। আমি যখন খেতে বলি তখন খাও; যখন খাওয়া বন্ধ করতে বলি তখন বন্ধ করো। তোমার দেহ যখন খেতে চায় তখনই খেতে দেবে না। দেহ দিনের বেলায়ও খেতে চাইতে পারে।
ক্ষুধা মানে খাওয়ার ইচ্ছা। রোযার সময় দুপুরের পর দেহ খেতে চায়; কিন্তু রোযাদার তখন খেদে দেয় না। ভাবখানা এমন যে, আমি আল্লাহর গোলাম; তোর গোলাম নই। আমার মনিবের হুকুমমতো বেলা ডোবার পর খেতে দেব, এর আগে নয়।
এভাবে রোযার মাধ্যমে দেহের দাবিকে অগ্রাহ্য করে আল্লাহর হুকুম পালন করার অভ্যাস হয়। রোযাদার নাফ্সকে রূহের অধীনে আনার যোগ্য হয়। নামায ও রোযা এমন চমৎকার ট্রেনিং, যা মানুষকে কালেমার ওয়াদা অনুযায়ী চলার যোগ্য বানায়।
যাকাত ও হজ্জ
আল্লাহ যেসব খারাপ কাজ করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকতে টাকা-পয়সা লাগে না; কিন্তু ঐ নিষিদ্ধ কাজগুলো করতে অনেক খরচ করা লাগে। মদ-জুয়া, যিনা, নাচ-গান ও অন্যান্য ফাহেশা কাজের দিকে নাফ্সের সাংঘাতিক ঝোঁক। এসবই আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন। যাদের টাকা-পয়সা বেশি আছে তাদেরই এসব মন্দ কাজ করার সুযোগ হয়।
তাই ধনী লোকদেরকে কালেমার ওয়াদামতো চলার যোগ্য বানানোর জন্য নামায ও রোযা যথেষ্ট নয়। তাদেরকে নাফসের গোলামি থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ তাআলা তাদের উপর যাকাত ও হজ্জ ফরয করেছেন। যাকাতের আসল উদ্দেশ্য হলো সমাজের গরীব লোকদের অভাব দূর করা। যাকাত ধনীকে শেখায় যে-
১. ধনের আসল মালিক আল্লাহ। তাই হালাল পথে আয় করতে হবে। কারণ, যাকাত হালাল মাল থেকেই দিতে হয়।
২. আল্লাহর হুকুমমতো যাকাত আদায়ের পর ধনীর হাতে যে মাল থাকে তা যেমন-খুশি তেমন খরচ করা চলবে না; এর আসল মালিকের মর্জিমতো খরচ করতে হবে।
হজ্জের উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর মহব্বতে দুনিয়ার সবকিছু কুরবানী দেওয়ার জযবা পয়দা করা। হজ্জের সময় সেলাইছাড়া দু’টুকরা কাপড় পরে অতি দীনহীনভাবে আল্লাহর প্রেমে পাগলপারা হতে হয়। হজ্জ ধনীকে শেখায় যে-
১. ধন বেশি আছে বলেই বিলাসিতা করে ‘ননীর পুতুল’ হয়ে যেও না। হজ্জ করার কষ্ট সহ্য করার যোগ্য হও।
২. যত বড় লোকই হয়ে থাক, সেলাইবিহীন দু’টুকরা কাপড় পরে মক্কা, মিনা ও আরাফাতে আল্লাহপ্রেমিকদের সাথে এক হয়ে নিজের বড়ত্ব ভুলে যাও।
৩. আরাফাতের ময়দানে মহান মনিবের সামনে মাথা নত করে অপরাধীর মতো দাঁড়াও, ধনের অহঙ্কার বাদ দাও। তুমি রাজা-বাদশাহ, শাসন বা বড় কর্তা যা-ই হয়ে থাক- এ কথা খেয়ালে রাখ যে, মরার পর তোমার গায়ের দু’টুকরা কাপড়ের মতো কাফন পরিয়েই তোমাকে কবরে রাখা হবে। তোমার ধন ও মান কোনোটাই সাথে যাবে না।
এভাবে যাকাত ও হজ্জ ধনীদেরকে যা শেখায় যদি তারা তা খেয়ালে রাখে, তাহলে তাদের ধন থাকা সত্ত্বেও তারা কালেমার ওয়াদা পালন করে চলতে পারবে। ধন আছে বলেই নাফ্সের গোলাম হবে না; আল্লাহর গোলাম হওয়ার যোগ্যই থাকবে।
ইসলামের পাঁচটি ভিত
রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘ইসলাম পাঁচটি ভিতের উপর কায়েম আছে-
১. এ সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ সা. আল্লাহর বান্দাহ ও রাসূল,
২. নামায কায়েম করা,
৩. যাকাত আদায় করা,
৪. হজ্জ,
৫. রমযানের রোযা।’’ (বুখারী ও মুসলিম)
কোনো দালান তৈরী করতে হলে পয়লা এর ভিত বা বুনিয়াদ গড়তে হয়। ঐ বুনিয়াদের উপর দেয়াল তোলা হয়। দেয়ালের উপর ছাদ তৈরী করা হয়। ভিত মযবুত না হলে দেয়াল ও ছাদ টেকে না। তাই দালানের জন্য মযবুত ভিতই পয়লা জরুরি।
শুধু ভিতটুকুই দালান নয়, দেয়াল ও ছাদ মিলেই দালান। ঠিক তেমনি ইসলামের ভিত হলো এ পাঁচটি- কালেমা, নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত। এ ভিতগুলো মযবুত হলে ইসলামের দালানও মযবুত হবে। তাই এ পাঁচটি ভিত সম্পর্কে এত লম্বা আলোচনা করলাম।
কিন্তু এই পাঁচটি ইসলামের দালানের ভিত মাত্র। ইসলামের দালান ও ছাদের আলোচনা সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ। রাসূল সা. মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার কায়েম করে ইসলামের পুরা দালান তৈরী করেছিলেন। পরিবার, সমাজ আইন, শাসন, বিচার ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সবই তিনি কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী গড়ে তুলেছিলেন। তিনি ইসলামের দালান পুরোপুরি কায়েম করে সবচেয়ে শান্তির সমাজ ও দেশ হিসেবে মদীনাকে দুনিয়ার মানুষের সামনে প্রমাণ করেছিলেন।
আমরা এ পর্যন্ত ইসলামের ভিত সম্পর্কে জানলাম। ইসলামের গোটা দালান সম্বন্ধে আমাদেরকে ভালো করে জানতে হবে।
আদম ও ইবলিসের কাহিনী
আল্লাহ তাআলা দুনিয়ায় হযরত আদম আ. কে প্রথম মানব ও বিবি হাওয়া আ. কে প্রথম মানবী হিসেবে পাঠালেন। ওহীর মাধ্যম ছাড়া মানুষ সঠিক জ্ঞান লাভ করতে পারে না বলেই আল্লাহ প্রথম মানুষটিকেই নবীর দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর সন্তানদেরকে ওহীর জ্ঞান অনুযায়ীই পরিচালনা করেছেন।
আল্লাহ কিন্তু মানুষকে ওহীর জ্ঞান অনুযায়ী চলতে বাধ্য করেননি। তিনি মানুষকে তাঁর মর্জিমতো চলার ইখতিয়ার যেমন দিয়েছেন, তেমনি তাঁর হুকুম অমান্য করার ক্ষমতাও দিয়েছেন। এ কারণেই আল্লাহর বিধানকে অগ্রাহ্য করে চলার উদাহরণ আদমসন্তানদের মধ্যে শুরু থেকেই দেখা গেছে। আদম আ. এর ছেলে কাবিল তার ভাই হাবিলকে কতল করে আল্লাহর বিধান অগ্রাহ্য করেছিল।
আল্লাহর হুকুমকে অমান্য করার জন্য শয়তানই মানুষকে উসকিয়ে দেয়। শয়তান যে বড় চালাক দুশমন সে কথা বোঝার জন্যই আদমকে দুনিয়ায় পাঠানোর আগে বেহেশতে পাঠানো হয়েছিল। শয়তান বন্ধু সেজে ধীরে ধীরে কীভাবে আদমকে আল্লাহর নাফরমানি করাতে পারল, সে কাহিনী কুরআনের সাতটি সূরায় আছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, আদম আল্লাহর হুকুম অমান্য করার নিয়তে তা করেনি, শয়তান তাকে এ ভুল ধারণা দিয়েছে যে, আল্লাহর নিষেধ করা গাছের ফল খেলে চিরকাল বেহেশতে থাকতে পারবে; দুনিয়ায় এসে কষ্ট করতে হবে না। এ ধোঁকায় পড়ে আদম আল্লাহর হুকুম অমান্য করে ফেলেছে।
কে এই শয়তান? সে জিন জাতির একজন। তার আসল নাম আযাযীল। সে আল্লাহর ইবাদত করতে করতে এত উন্নতি করেছিল যে, আল্লাহ তাকে ফেরেশতার মধ্যে গণ্য করেছিলেন। আদমকে পয়দা করে আল্লাহ যখন সকল ফেরেশতাকে হুকুম দিলেন, ‘তোমরা আদমকে সিজদা কর’, তখন সকল ফেরেশতাই সিজদা করল কিন্তু আযাযিল সিজদা করতে অস্বীকার করল। সে ফেরেশতার মধ্যে গণ্য ছিল বলেই তারও সিজদা করা উচিত ছিল। আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞেস করলেন, কেন আমার হুকুম পালন করলে না? সে জবাবে বলল, আমি আদমের চেয়ে বড়। তাকে তুমি মাটি দিয়ে বানিয়েছ আর আমাকে আগুন দিয়ে বানিয়েছে; আমি তাকে সিজদা করতে পারি না। আল্লাহ তাকে অভিশাপ দিলেন, তার উপর লা’নত নাযিল করলেন। এরপর থেকে তার নাম হয়ে গেল শয়তান ও ইবলিস। শয়তান শব্দের অর্থ অবাধ্য, দুষ্ট আর ইবলিস শব্দের অর্থ হতাশ।
শয়তান আল্লাহকে বলল, আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত সময় দাও। তোমার খাস বান্দাহদেরকে অবশ্য আমি ধোঁকা দিতে পারব না; কিন্তু বেশিরভাগ মানুষকেই আমি তোমার নাফরমান বানিয়ে ছাড়ব। আল্লাহ তাকে সময় দিয়ে বললেন, আমি তোকে ও তোর ধোঁকায় যারা পড়বে, সবাইকে দোযখে দেব।
আল্লাহ কুরআনে মানুষকে সাবধান করে দিলেন যে, শয়তানকে সবসময় দুশমন মনে করবে। সে বন্ধু সেজে যে পরামর্শই দিক তা কখনও মেনে নিও না। আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে মানুষের মনে যত খেয়াল, চিন্তা ও ধারণা পয়দা হয় সেসবই শয়তানের কুপরামর্শ মনে করবে।
কুরআন মাজীদের সর্বশেষ সূরা ‘আন নাস’-এ বলা হয়েছে, আল্লাহর দেওয়া বিধানের বিরোধী কুপরামর্শ দেওয়ার জন্য শয়তানের চেলা বহু জিন ও মানুষ আছে। মানুষের মনগড়া যত মতবাদ ও যত খেয়াল আল্লাহর বিধানের বিরোধী, তা সবই শয়তানের তৈরী এবং শয়তানের চেলারাই তা অন্য মানুষের কাছে পৌঁছায়। ইসলামবিরোধী চিন্তাবিদরা সবাই শয়তানের খলীফা।
এ কাহিনী থেকে বোঝা গেল যে, দুনিয়ায় খলীফার মর্যাদা আদমকে না দিয়ে ইবলিসকে দেওয়া উচিত ছিল বলে সে মনে করত। তাই আদমের বিরুদ্ধে সে হিংসায় জ্বলতে লাগল। মানুষ এ মর্যাদার যোগ্য নয় বলে প্রমাণ করার জন্যই সে তার জিন ও মানুষ চেলা-চামুণ্ডাদের নিয়ে রাত-দিন মানুষকে ফুসলাচ্ছে ও উসকাচ্ছে। কিন্তু আদম ও ইবলিসের আচরণ থেকে এ কথাই প্রমাণিত হলো যে, খলীফার মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য আদম; ইবলিস নয়। আল্লাহর হুকুম অমান্য করার সাথে সাথেই আদম লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে কাতরভাবে তওবা করলেন ও মাফ চাইলেন। আর ইবলিস আল্লাহর হুকুম অমান্য করার নিয়তেই নাফরমানি করল। সে চ্যালেঞ্জ দিয়ে দাবি করল যে, আদমকে সিজদা করার হুকুম দিয়ে আল্লাহই অন্যায় করেছে। অনুতপ্ত না হয়ে সে দাপট দেখিয়ে বিদ্রোহ করেছে। তাই সে আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার সম্পূর্ণ অযোগ্য।
শয়তানের রাজত্ব বনাম আল্লাহর খিলাফত
আল্লাহ তাআলা তখনই নবী পাঠিয়েছেন, যখন মানবসমাজে শয়তানের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। আল্লাহ নবীর কথা মানার জন্য মানুষকে বাধ্য করেননি। মানুষকে ইখতিয়ার দিয়েছেন যে, ইচ্ছা না হলে সে নবীর কথা মানবে না। তাই ইবলিশ মানুষকে ভুল পথে চলার কুপরামর্শ দিয়ে আল্লাহর নাফরমান বানানোর মহাসুযোগ পেয়েছে। এভাবেই দুনিয়ায় শয়তানের রাজত্ব কায়েম হয়ে আসছে।
আল্লাহ তাআলা নবীকে শয়তানের রাজত্ব উৎখাত করে আল্লাহর খিলাফত কায়েমের দায়িত্ব দিয়েই পাঠিয়েছেন। আল্লাহ কোনো অযোগ্য লোককে নবী বানাননি; কিন্তু তিনি যত যোগ্যই হোন ঐ কাজটি তাঁর একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। জনগণ নবীর ডাকে সাড়া না দিলে তাদেরকে বাধ্য করার ক্ষমতা নবীকে দেওয়া হয়নি। তাই যে নবীর যুগে জনগণ সাড়া দিয়েছেন, সে নবীর যুগেই আল্লাহর খিলাফত কায়েম করা সম্ভব হয়েছে। হযরত মূসা আ. দাউদ আ., ইউসুফ আ. ও মুহাম্মদ সা.-এর যুগে জনগণের প্রয়োজন পরিমাণ সাড়া পাওয়ার ফলেই তাদের হাতে ইসলাম বিজয়ী হয়েছে বা আল্লাহর খিলাফত কায়েম হয়েছে। হযরত নূহ আ., ইবরাহীম আ., শোয়াইব আ. এবং আরও অনেক নবীর যুগে জনগণের সমর্থন না পাওয়ায় আল্লাহর খিলাফত কায়েম হতে পারেনি; শয়তানের রাজত্বই বহাল ছিল। অবশ্য আল্লাহ তাআলা তাঁদের বিদ্রোহী কাওমকে বিভিন্ন রকম আযাব দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
আল্লাহর খিলাফত কায়েমের মানে কী?
আগেই আলোচনা করেছি যে, মানুষের জন্য আল্লাহ তাআলা যে নিয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান ওহীর মাধ্যমে নবীর কাছে পাঠিয়েছেন তা তিনি নিজে চালু করেন না। তাঁর পক্ষ থেকে তা জারি করার জন্য নবীগণ ও ইমানদারদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এ দায়িত্বটিই হলো খিলাফতের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করলেই আল্লাহর খলীফা ও প্রতিনিধির মর্যাদা হাসিল হয়।
আল্লাহ মানুষকে যে দেহ দান করেছেন তাতে অনেক শক্তি দিয়েছেন- বলার শক্তি, শোনার শক্তি, দেখার শক্তি ইত্যাদি। আরও দিয়েছেন চিন্তাশক্তি, বোঝার শক্তি, ভালো মন্দকে চেনার শক্তি ইত্যাদি। আরও দিয়েছেন- ভালোবাসার, ঘৃণা করার, উপকার করার, ক্ষতি করার ইচ্ছা ও শক্তি ইত্যাদি। মানুষের মগজে যে কত শত রকম চিন্তা ভাসে এবং তার মনে যে কত রকম ভাব জাগে এ সবের কোনো শেষ নেই।
এসব শক্তি যদি আল্লাহর দেওয়া বিধান অনুযায়ী ব্যবহার করা হয় তাহলে দেহের উপর আল্লাহর খিলাফত কায়েম হয়। আর যদি মনগড়া খেয়াল অনুযায়ী ব্যবহার করা হয় তাহলে শয়তানের রাজত্বই কায়েম হয়।
তেমনিভাবে পারিবারিক জীবনে যদি আল্লাহর বিধান চালু করা হয় তাহলে পরিবারের উপর আল্লাহর খিলাফত কায়েম হয়। সমাজ রাষ্ট্র অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি সকল ময়দানে কি শয়তানেরই রাজত্ব কায়েম থাকবে, না আল্লাহর খিলাফত কায়েম করতে হবে- এর ফায়সালা করার দায়িত্ব মানুষেরই।
আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য নবীর মাধ্যমে যে বিধান পাঠিয়েছেন তা যদি তিনি নিজেই কায়েম করতে চাইতেন তাহলে নবী পাঠাতেন না। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-তারা, গাছপালা, পশু-পাখি ও অন্য সকল সৃষ্টির জন্য তিনি যেসব বিধান তৈরী করেছেন, তা তিনি নিজে জারি করেন বলেই এসব বিধান নবীর কাছে পাঠাননি। তাই মানুষের জন্য আল্লাহ তাআলা নবীর মাধ্যমে যে বিধান পাঠিয়েছেন তা আল্লাহ নিজে চালু করেন না, তাঁর পক্ষে যারা তা চালু করার চেষ্টা করেন তারাই খলীফাতুল্লাহর দায়িত্ব পালন করেন।
ব্যক্তিজীবনে আল্লাহর খিলাফত
আমি যদি চাই- আমার দেহের উপর শয়তানের রাজত্ব কায়েম হতে দেব না তাহলে আমি মিথ্যা কথা বলব না, যা দেখা আল্লাহ নিষেধ করেছেন তা দেখব না, যা শুনতে তিনি নিষেধ করেছেন তা শুনব না,যা করতে তিনি নিষেধ করেছেন তা করবনা, মগজে কোনো কুচিন্তা আসতে দিবনা, মনে কোনো কুভাব জাগতে দেব না, যেসবকে ভালোবাসতে তিনি আদেশ করেছেন সেসবকেই আমি ভালোবাসব, যেসবকে তিনি ঘৃণা করতে বলেছেন, সেসবকে ঘৃণাই করব এবং হাত ও মুখ দিয়ে কোনো মানুষকে কষ্ট দেব না, যতটুকু পারি উপকার করব। এভাবে যদি আমার দেহকে আল্লাহর পছন্দমতো ব্যবহার করতে পারি তাহলে আমার দেহের উপর আল্লাহর খিলাফত কায়েম হয়েছে বলে প্রমাণ হবে। আর যদি এ চেষ্টা না করি তাহলে আমার দেহের উপর শয়তানের রাজত্বই কায়েম হবে।
মানবদেহের ইসলাম
মানুষের জন্য তৈরীকৃত দেহের মধ্যে যেসব নিয়ম-কানুন আল্লাহ তাআলা নিজেই জারি করেছেন তা-ই দেহের ইসলাম। এ নিয়ম যখন ঠিকমতো চালু থাকে তখন দেহে কোনো অশান্তি থাকে না। শরীরে রক্ত চলাচলের নিয়ম, নিঃশ্বাস আসা-যাওয়ার নিয়ম, খাবার হজম হওয়ার নিয়ম, পেশাব-পায়খানার নিয়ম, ঘুমের নিয়ম আল্লাহই বানিয়েছেন; এসব নিয়ম নবীর মাধ্যমে আসেনি। তাই আল্লাহ তাআলা নিজেই তা চালু করেন। এসব নিয়মই হলো দেহের ইসলাম। প্রতিটি সৃষ্টির জন্যই তিনি কতক নিয়ম দিয়েছেন। সৃষ্টির জন্য স্রষ্টার রচিত নিয়ম বা বিধানই হলো ইসলাম।
দেহের জন্য আল্লাহর দেওয়া নিয়ম সঠিকভাবে চলতে থাকলে দেহে পূর্ণ সুখ-শান্তি বোধ হয়। কেউ যদি কোনো নিয়ম ভঙ্গ করে তাহলে অসুখ হয়, দেহে অশান্তি বোধ হয়। অসুখ মানেই সুখের অভাব। অসুখ হলে ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখে যে, শরীরের জন্য আল্লাহর দেওয়া নিয়মে কী কী অনিয়ম হয়েছে। চিকিৎসা মানে আল্লাহর দেওয়া নিয়মটাকে আবার বহাল করা। ডাক্তারি বিদ্যা হলো শরীরের জন্য আল্লাহর দেওয়া নিয়মগুলোকে জানা এবং কোনো কারণে অনিয়ম হয়ে গেলে সে নিয়ম বহাল করার বিদ্যার্জন। এ থেকে এ কথা প্রমাণ হয়ে গেল যে, দেহে আল্লাহর দেওয়া নিয়ম ঠিকমতো চালু থাকলেই সুখ-শান্তি ভোগ করা যায়। আল্লাহর দেওয়া নিয়মে গোলমাল হলেই অসুখ ও অশান্তি হয়।
প্রকৃতির জগতে কোনো অশান্তি নেই কেন?
প্রকৃতির জগৎ বলতে বোঝায় মহাশূণ্যের কোটি কোটি গ্রহ-উপগ্রহ, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, নদী-নালা, জঙ্গল-গাছ-পালা, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, আকাশ-বাতাস, মেঘ-বৃষ্টি ইত্যাদি। এসব সৃষ্টির প্রত্যেকটির জন্যই আল্লাহ তাআলা আলাদা আলাদা বিধান তৈরী করেছেন। সেসব বিধান আল্লাহ নিজেই জারি করেন। এ কারণেই প্রকৃতির জগতে কোনো অশান্তি নেই। নিয়মমতো সবকিছু চললে অশান্তি হতে পারে না।
অশান্তি হয় মানুষের জীবনে। পরিবারের জন্য আল্লাহ যে নিয়ম-কানুন দিয়েছেন, তা না মানার কারণেই অশান্তি হয়। তেমনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে, সামাজিক জীবনে এবং লেনদেনের কর্তব্য পালনে অবহেলার কারণে মানবসমাজে অশান্তি লেগেই আছে। এসব বিষয়ে নবীর মাধ্যমে আল্লাহ যে নিয়ম-কানুন পাঠিয়েছেন তা পালন না করার কুফলই হলো বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি।
একজনের সাথে আরেকজনের সম্পর্ক, এক পরিবারের সাথে আরেক পরিবারের সম্পর্ক, এক দলের সাথে আরেক দলের সম্পর্ক, এক গ্রামের সাথে অপর গ্রামের সম্পর্ক, এক দেশের সাথে অন্য দেশের সম্পর্ক কেমন থাকা উচিত, সে বিষয়ে আল্লাহর দেওয়া বিধি-বিধান মেনে চললে অশান্তি হতেই পারে না।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, পিতা-মাতার সাথে সন্তানদের সম্পর্ক, ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের সম্পর্ক, ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক, ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক, ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক, সরকারের সাথে জনগণের সম্পর্ক- এসব বিষয়ে আল্লাহর বিধান মেনে না চললে অশান্তি হবে না কেন?
এতসব বিষয়ে আল্লাহর দেওয়া বিধান না জানলেও বিবেক-বুদ্ধিতে সবাই যা করা উচিত বলে জানে তা কয়জন পালন করে চলে? তাহলে শান্তি কোথা থেকে আসবে?
যত রকম সম্পর্কের কথা উপরে লিখলাম এর প্রতিটিতেই দুটো পক্ষ আছে। যেমন-স্বামী ও স্ত্রী। স্বামীর যেমন অধিকার আছে, স্ত্রীরও তেমনি অধিকার আছে। স্বামীর যেমন কর্তব্য আছে, স্ত্রীরও তেমনি কর্তব্য আছে। এ অধিকার ও কর্তব্য নিয়েই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বামীর যা অধিকার তা-ই স্ত্রীর কর্তব্য। আর স্ত্রীর যা অধিকার তা-ই স্বামীর কর্তব্য। স্ত্রী যদি তার কর্তব্য ঠিকমতো পালন করে তাহলে স্বামী তার অধিকার পেয়ে যাবে। তেমনি স্বামী যদি তার কর্তব্য যথাযথ পালন করে তাহলে স্ত্রী তার অধিকার পেয়ে যাবে।
তাই আল্লাহ তাআলা যার যার কর্তব্য পালন করার তাগিদ দিয়েছেন, যাতে উভয়েই তাদের অধিকার পেয়ে যায়। কিন্তু দেখা যায়, স্বামী তার অধিকার পাওয়ার জন্য স্ত্রীর উপর চাপ দিচ্ছে, কর্তব্য পালনের ধার ধারছে না কিংবা স্ত্রী তার অধিকার আদায় করার দাবি জানাচ্ছে, নিজের কর্তব্য পালন করছে না। ফলে দু’জনই অশান্তি ভোগ করছে। শুধু যার যার অধিকার আদায় করার ধান্দায় থাকলে কি কর্তব্য আপনা-আপনিই পালিত হয়ে যাবে? অথচ দু’জনই যার যার কর্তব্য পালনে মনোযোগ দিলে যার যার অধিকার আপনা-আপনিই পেয়ে যাবে।
সব সম্পর্কের বেলায়ই এ নিয়মটি সত্য। আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতাকে তাগিদ দেননি যে, তোমরা সন্তানদের কাছ থেকে তোমাদের অধিকার পাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাক। তিনি সন্তানদেরকে বলেননি যে, তোমরা তোমাদের অধিকার পাওয়ার জন্য বাপ-মায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন কর। তিনি দু’পক্ষকেই তাদের কর্তব্য পালনের তাগিদ দিয়েছেন, যাতে সবাই যার যার অধিকার সহজেই পেয়ে যায়। সব মানুষই শান্তি চায়। সুখ-শান্তি দেওয়ার যিনি মালিক, তিনি যা করতে বলেছেন তার উল্টা কাজ যে করে, সে কি আসলে শান্তি চায়? সবাই যা কিছু করে নিজের সুখ-শান্তি ও কল্যাণের নিয়তেই করে। এমনকি যে আত্মহত্যা করে সেও তার ভালো হবে মনে করেই তা করে। অথচ এটা যে চরম ভুল, তা সে জানে না।
আমরা যখন কোন যন্ত্রপাতি কিনি তখন দেখা যায়, কিভাবে যন্ত্রটি ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যাবে সে বিষয়ে লেখা ‘নির্দেশিকা’ (ক্যাটালগ) সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয়। যে যন্ত্রটি তৈরী করেছে সেই ভালো জানে যে, কীভাবে তা ব্যবহার করতে হবে। যদি কেউ ঐসব নিয়মের ধার না ধারে যেমন-তেমন ব্যবহার করে, তাহলে সুফল পাওয়া তো দূরের কথা; মহাবিপদেও পড়তে পারে। এমনকি যন্ত্রটিও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে গোটা বিশ্বজগত ব্যবহার করার অধিকার দিয়েছেন এবং সৃষ্টিজগতকে ব্যবহার করার যোগ্য হাতিয়ার হিসেবে দেহ দান করেছেন। সৃষ্টিজগত ও দেহকে কেমনভাবে ব্যবহার করতে হবে তা তিনি নবীর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। নবী নিজে ঐ সব নিয়ম পালন করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। মানুষ যদি তা মেনে না চলে তাহলে যা হওয়ার তা-ই ঘটছে। দুনিয়ায় এত অশান্তির কারণ এটাই।
আল্লাহ দুনিয়াতেও শাস্তি দেন
আল্লাহর বিধান অমান্য করার ফলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষ অশান্তির শাস্তি তো পাচ্ছেই, আখিরাতেও চরম শাস্তি পেতে থাকবে। দুনিয়াতেও আল্লাহ বিরাট আকারে শাস্তি দিয়ে থাকেন। ভূমিকম্প, সুনামি, ঝড়-তুফান, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, ব্যাপক অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি মানুষকে জানিয়ে দেয় যে, এমন একটি বিরাট শক্তি রয়েছে, যার মোকাবিলা করার সাধ্য কারো নেই।
মাটি, পানি, বাতাস, আগুন মানুষের খিদমতের জন্যই আল্লাহ তাআলা দান করেছেন। এসবকে ব্যবহার করেই মানুষ দুনিয়ায় বেঁচে থাকে। কিন্তু মানুষের নাফরমানি চরমে পৌঁছলে আল্লাহ এসব খিদমতের জিনিসকে দিয়েই শাস্তি দিয়ে থাকেন। এসব জিনিসের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। তিনিই এসবকে মানুষের খিদমতে লাগিয়ে রেখেছেন। আবার তিনিই আযাব দেওয়ার জন্য এগুলো ব্যবহার করেন।
আমরা সব তাঁরই রাজ্যে বাস করছি। তিনি যদি আমাদের আচরণে সন্তুষ্ট থাকেন তাহলে দুনিয়া ও আখিরাতে আমরা সুখ-শান্তি পাব। আর তিনিই যদি অসন্তুষণ্ট হন তাহলে উভয় জায়গায়ই দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হবে।
মযবুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে
আমি দুনিয়াতে শান্তি ও আখিরাতে মুক্তি পেতে চাই কিনা- এ বিষয়টি আমার জীবনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আখিরাতের অনন্ত অসীম জীবনে যদি আল্লাহর রহমত না পাই তাহলে কোনো উপায় থাকবে না। বিষয়টা মোটেই হালকা নয়। যদি আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, আমি দুনিয়ার অশান্তি থেকে বাঁচতে চাই এবং আখিরাতের শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে চাই, তাহলে আমাকে এ কয়টি কাজ করতে হবেঃ
১. ঈমানকে মযবুত করতে হবে।
২. সহীহ ইলম হাসিল করতে হবে।
৩. নেক আমল করতে হবে।
কেউ যদি নিজেকে ঠিকভাবে গড়ে তুলতে চায় তাহলে তাকে তিন দিক দিয়ে গড়ে উঠতে হবে। তার মন, মগজ ও চরিত্র গড়তে হবে। মনের সাথে ঈমানের সম্পর্ক মগজের সাথে ইলম বা জ্ঞানের সম্পর্ক আর চরিত্রের সাথে আমলের সম্পর্ক। বাংলায় মন-মগজ-চরিত্র বললে আরবীতে ঈমান-ইলম-আমল বোঝায়।
এ তিনটি দিক দিয়েই মানুষ গড়ে ওঠে। তাহলে সবার আগে ঈমান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি।