মনটাকে কাজ দিন
আপনার দেহকে শোয়া, বসা, দাঁড়ানো বা হাঁটা-চলা ইত্যাদি যে অবস্থায়ই রাখুন, সর্বাবস্থায়ই আপনার মন কাজ করতে থাকে। এমনকি দেহ যখন ঘুমে অচেতন থাকে তখনো মন কাজ করতে থাকে। এমনকি দেহ যখন ঘুমে অচেতন থাকে তখনো মন কাজ করতে থাকে। কারণ, সে ঘুমায় না। মনোবিজ্ঞানীরা স্বপ্নকে মনের কর্মব্যস্ততা বলে ব্যাখ্যা করেছেন। দেহ যখন ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ে, মন তখন আরো সক্রিয় হয়। সে ক্লান্ত ও হয় না, বিশ্রামও নেয় না।
মনোবিজ্ঞানীরা মনের বিশ্লেষণ এবং চেতন, অবচেতন ও অচেতন মনের ব্যাখ্যা নিয়ে ব্যাপক চর্চা করেছেন। আমার আলোচ্য বিষয় তা নয়। আমরা সবাই এর ভুক্তভোগী যে, আমাদের সজাগ-সচেতন পরিকল্পনা ছাড়াই মনে হাজারো কথা জাগে। সুচিন্তা, কুচিন্তা, দুশ্চিন্তা সব সময়ই মনে ভীড় করেই থাকে। গাড়িতে হোক আর বাড়িতেই হোক, চুপ করে হয়তো বসে আছেন; মন কিন্তু চুপ নয়। কত আজেবাজে, খেইছাড়া, খেইহারা, অগণিত কথা সে বুনেই চলেছে। হাতে কাজ করছেন, আর আপনার বিনা ইচ্ছায় এমনসব কথা মনে জাগছে, যা হয়তো আপনি মন থেকে তাড়াতেই চান। শুদ্ধ উচ্চারণে নামাযে সূরা-কিরাআত পড়ছেন, আর মন কোথায় যে ছুটাছুটি করছে তার হিসাব নেই। কোনো কোনো সময় এমন সব খেয়াল মনে জাগে যা বিবেকের নিকট লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়- এ সবই আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা।
আমরা যখন মনোযোগ দিয়ে বই পড়ি তখন বই এর আলোচ্য বিষয়ের বাইরের কোন কথা মনে ঢুকবারই ফাঁক পায় না। যখন একাগ্রচিত্তে কারো বক্তৃতা শুনি তখন অন্য কোন ভাব মনে জাগে না। যখন কোন কাজের পরিকল্পনা করতে বসি তখন মনে ভিন্ন চিন্তা স্থান পায় না। কোন বিষয়ে যখন গবেষণায় লিপ্ত হই তখনো বাইরের চিন্তা জাগার সুযোগ পায় না। কোনো বিশেষ ভাব যখন লিখে প্রকাশ করার চেষ্টা করি তখন ভিন্ন ভাব মনে কোনো পাত্তাই পায় না। এ দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, মনকে সচেতনভাবে কোন কাজে ব্যস্ত রাখলে সে অনুগত হয়ে ঐ কাজ করতে থাকে; কিন্তু যখনই তাকে অবকাশ দেওয়া হয় তখনই সে নিজে কাজ যোগাড় করে নেয়। কারণ, সে কখনো অবসর থাকতে পারে না।
বিখ্যাত ইংরেজী প্রবাদ: “Empty mind is devil’s workshop” (শূন্য মন শয়তানের কারখানা) কথাটি বড়ই তিক্ত সত্য। অর্থাৎ মনকে কর্মহীন অবস্থায় রাখা হলে সে খালি থাকবে না। ইবলিশ তাকে কাজ দেবেই। যেহেতু সে বিনা কাজে থাকতে পারে না সেহেতু ইবলিশের দেয়া কাজই সে করতে থাকে। রাসূল (সা.) বলেছেন, মানুষ এমন এক ঘোড়া যার পিঠ কখনো খালি থাকেনা। যদি সে সব সময় আল্লাহকে তার পিঠে সওয়ার করিয়ে রাখে তাহলে সে নিরাপদ। যখনই তার পিঠ খালি হয় তখনই ইবলিশ চেপে বসে। তাই ইবলিশ থেকে বেঁচে থাকতে হলে পিঠ কখনো খালি রাখা চলবে না। সর্বাবস্থায় সচেতনভাবে কথা, কাজ ও চিন্তায় আল্লাহর আনুগত্য করতে থাকলে ইবলিশের আনুগত্য করার সুযোগ পায় না।
আমরা যদি আমাদের মনকে শয়তানের কারখানা হওয়ার শোচনীয় পরিণাম থেকে রক্ষা করতে চাই তাহলে মনটাকে হামেশা কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, সচেতনভাবে তাকে সব সময় কাজ দিতে থাকব। বিনা কাজে কোন সময়ই তাকে থাকতে দেব না।
কথাটা বলা যত সহজ, বাস্তবে করা ততই কঠিন। এর জন্য রীতিমতো অনুশীলন ও অভ্যাস গড়ে তোলা ছাড়া সফলতা সম্ভব নয়। কিন্তু অনুশীলন ও অভ্যাসের জন্য যে নির্দেশনা দরকার তা কোথায় ও কিভাবে পাওয়া যাবে সে প্রশ্নটিই প্রধান। এত বড় একটা বিষয় নিয়ে বহু বছর চিন্তা-ভাবনা করেও কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। মনকে অনুগত করার চেয়ে কঠিন কাজ আর নেই। যে কাজ দেবো তাই করতে হবে,আর কোন কাজ করতে দেবো না,এমন কর্তৃত্ব মনের উপর হাসিল করা অসাধ্য ব্যাপার। মনকে সব সময়ই ইতিবাচক কাজ দেবার সাধ্য কার? ২৪ ঘন্টার জন্য এ বিষয়ে রুটিন তৈরি করে সে অনুযায়ী মনকে পরিচালনা চরম দুঃসাধ্য সাধন বলেই আমার অভিজ্ঞতা।
মন কি চায়?
মানবসত্তা বড় বিচিত্র। অনেক সময় বা কোন কোন সময় মন এমন কিছু পেতে চায় যা বিবেক সমর্থন করে না। এতে স্পষ্ট বুঝা গেল যে,মানব সত্তা একক নয়। মানুষের দুটো সত্তা রয়েছে- একটি দেহসত্তা, অপরটি নৈতিক সত্তা। দেহ হলো বস্তুসত্তা। দুনিয়াটাও বস্তুসত্তা। বস্তুজগতের কতক উপাদানেই মানব দেহ গঠিত। তাই বস্তুজগতের প্রতি মানবদেহের প্রবল আকর্ষণ থাকাই স্বাভাবিক। এ পৃথিবীতে ভোগ করার মতো যা কিছু আছে তা-ই দেহ পেতে চায়। দেহের মুখপাত্রই হলো মন। দেহ যা চায় তাই মনের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সুতরাং বুঝা গেল যে, মন যা চায় তা দেহেরই দাবি।
কুরআন মাজিদে দেহের দাবীর নাম দেয়া হয়েছে ‘নাফস’। নাফস মানে দেহের দাবী। নাফসের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّ النَّفسَ لَأَمّارَةٌ بِالسّوءِ
‘নিশ্চয়ই নাফস মন্দের দিকে প্ররোচনা দেয়।’ (সূরা ইউসুফ ৫৩ আয়াত)
অর্থাৎ দেহের যেহেতু কোন নৈতিক চেতনা নেই সেহেতু সে দাবী জানাবার সময় উচিত বা অনুচিত কিনা তা বিবেচনা করতে পারে না। তাই এটা নিশ্চিতভাবে ধরেই নিতে হবে যে দেহের সব দাবীই মন্দ। অবশ্য বিবেক যদি দেহের কোন কোন দাবীকে মন্দ নয় বলে স্বীকার করে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই।
ভাল-মন্দের বিচার কে করবে?
মানুষের বিবেক বা নৈতিক সত্তাই দেহের দাবী সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করে। এ বিবেকই হলো আসল মানুষ। কুরআনের ভাষায় একেই বলা হয় ‘রূহ’। দেহ হলো বস্তুগত হাতিয়ার যা মানুষকে ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছে। এ বস্তুজগতকে কাজে লাগাবার জন্য বস্তুগত হাতিয়ার জরুরি; কিন্তু হাতিয়ার সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে উদ্দেশ্য সফল হয়না।
দেহ হাজারো দাবি করতে পারে; কিন্তু তাকে কষে লাগাম লাগানোর যোগ্যতা যদি রূহ বা বিবেকের থাকে, তবে এ দেহরুপী ঘোড়াই দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেবে। ঘোড়াকে বাদ দিয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। ভালভাবে ঘোড়ার যত্ন নিতে হবে, ওকে সুস্থ ও সবল রাখতে হবে। কিন্তু ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্যতা না থাকলে আরোহীর জীবনই ব্যর্থ।
মনের উপর লাগাম লাগানোর উপায় কী?
এ বিষয়ে ইতিপূর্বেই মন্তব্য করেছি যে,বহু বছর চিন্তা করেও কোন কুল-কিনারা পাচ্ছিলাম না। কেমন করে কুল-কিনারা পাব? এ সমস্যার সমাধান দেবার জন্য যে আল্লাহর রাসূল প্রয়োজন। যে সমস্যার সমাধানের জন্য আল্লাহ তা’আলা রাসূল পাঠাবার প্রয়োজন মনে করেছেন, সে সমস্যা আর কে সমাধান করতে পারে?দেহযন্ত্র যে আল্লাহ তৈরী করেছেন, তিনিই এর ব্যবহার পদ্ধতি রাসূলের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। মনের উপর লাগাম লাগাবার ইচ্ছা কারো থাকলে রাসূল (সা) এর কাছ থেকেই শিখতে হবে। এর আর কোন বিকল্প নেই।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু মনীষী তাদের প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, চিন্তাবিদ, রাষ্ট্রনায়ক, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, সংগঠক, সমাজসেবক বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন, তারাও মনকে নিয়ন্ত্রণ করার বিজ্ঞানসম্মত বাস্তব কোন উপায় আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি। কারণ এ কাজটির জন্য গবেষণা ও সাধনা যথেষ্ট নয়। এর জন্য রিসালাত ও নবুওয়াত প্রয়োজন। নবী ও রাসূলগণ যে জ্ঞান লাভ করেন তা তাদের সাধনা ও গবেষণার ফসল নয়; তা আল্লাহর দান, যা তিনি নবী-রাসূলগণকেই দিয়ে থাকেন।
নবী-রাসূলগণের বাস্তব শিক্ষার নাগাল না পেয়ে যারা এ সমস্যার সমাধানে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তারা বৈরাগ্যের মাঝেই এর একমাত্র সমাধান তালাশ করেছেন; কিন্তু এটা তো আসলে কোনো সমাধানই নয়। তারা দেহের দাবিকে অস্বীকার করে মনকে মেরেই ফেলেন। মরা ঘোড়া কি কাজে আসবে?
নবী-রাসূলগণ মানুষকে বৈরাগী বানাতে আসেননি। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন যে ‘গোটা বস্তুজগৎকে তিনি মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি করেছেন’ (সূরা আল বাকারাহ ২৯ আয়াত)। আর এ জগৎকে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যেই মানুষকে দেহযন্ত্রটি দেয়া হয়েছে। বৈরাগ্য আল্লাহর উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিরোধী। রাসূলগণ মানুষকে এ বস্তুজগত ও দেহযন্ত্রকে আল্লাহর পছন্দনীয় পন্থায় ব্যবহার করার পদ্ধতিই শিক্ষা দিয়েছেন। এ শিক্ষা সকল মানুষের পক্ষেই গ্রহণ করা সম্ভব। তাঁরা কোন অবাস্তব শিক্ষা দেননি।
বিভিন্ন ধর্মের একনিষ্ঠ সাধকগণ বৈরাগ্য সাধনের মাধ্যমে এ কথাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, দেহকে বস্তুজগতের সকল প্রকার ভোগ থেকে বঞ্চিত করা ছাড়া আত্মার বা নৈতিকতার উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তারা কেবল দুনিয়ার সকল আকর্ষণ পরিত্যাগ করার মাধ্যমেই মনকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব মনে করেন। এ অবাস্তব পদ্ধতি গুটিকতক লোক গ্রহণ করতে পারে। এটা মানুষের প্রকৃতির বিরুদ্ধে আসার বিদ্রোহ মাত্র।
তারা ধরেই নিয়েছেন যে, বিবাহিত জীবনের স্বাদ ভোগ করে মনকে পরনারীর লোভ থেকে রক্ষা করা অসম্ভব। সুস্বাদু খাদ্য খেয়ে হারাম কামাই থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাদের এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা অস্বীকার করার মতো নয়। রাসূলের শিক্ষা গ্রহণ করার সৌভাগ্য যাদের হয়নি তাদের পক্ষে পবিত্র জীবন লাভের উদ্দেশ্যে বৈরাগ্য সাধনের পথ বেছে নেয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই বৈরাগ্য সাধকদের প্রতি আমি অশ্রদ্ধা পোষণ করি না। রূপ, রস, গন্ধে ভরা দুনিয়ার আকর্ষণ ত্যাগ করা কোন খেলা নয়। অন্য একটি প্রবল আকর্ষণ না থাকলে এটা করা সম্ভব হতো না। অবশ্য এ পথ মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।
মুসলিম ধর্মসাধকদের মধ্যেও এ প্রবণতা বিভিন্নরূপে লক্ষ্য করা যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ায় আল্লাহর খেলাফত কায়েমের যে আদর্শ রেখে গেছেন সে কঠিন পথ ত্যাগ করে এবং বাতিল শক্তির সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে আল্লাহর ওলী হওয়ার সাধনা যারা করেন, তাদের পথ আর যাই হোক রাসূলের সত্যিকার অনুসরণ নয়।
রাসূল (সাঃ) এর শেখানো পথ
আল্লাহ পাক মানুষের মধ্যে এ যোগ্যতা দান করেছেন যে, সে জীবনের জন্য যখন কোন একটা লক্ষ্য স্থির করে নেয় তখন ঐ লক্ষ্য হাসিলের জন্য যত শ্রম, সাধনা ও ত্যাগ তিতিক্ষা প্রয়োজন তা সে হাসিমুখে বরণ করে নিতে পারে। এ যোগ্যতা না থাকলে মানুষ জীবন সংগ্রামের কোন স্তরই অতিক্রম করতে পারতো না।
স্বাধীনতার সংগ্রামে দীর্ঘ কারাযন্ত্রণা ভোগ করা, এমনকি মৃত্যুর পরওয়া পর্যন্ত না করা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও সাধনায় সকল আরামকে হারাম করে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করা, বড় ব্যবসায়ী হবার জন্য রাত দিন এক করে কঠোর পরিশ্রম করা ইত্যাদি এ কথাই প্রমাণ করে যে, লক্ষ্য স্থির করার সিদ্ধান্ত নিলে তা হাসিল করতে সবরকম কষ্ট বরণ করা সম্ভব।
আল্লাহর রাসূলগণ তাই প্রথমেই গোড়ায় হাত দিয়েছেন। মানুষকে তার জীবনের মূল লক্ষ্য স্থির করার ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ডাক দিয়েই তাঁরা কাজ শুরু করেছেন। কুরআন পাকের কয়েকটি সূরা বিশেষ করে সূরা আল আ’রাফ ও সূরা হুদে বেশ কয়েকজন রাসূলের নাম উল্লেখ করে প্রমাণ করা হয়েছে যে, সকল রাসুল মানব সমাজকে একই কথা কবুল করার দাওয়াত দিয়েছেন। সে কথাটি হলো-
يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ
‘হে আমার কাওম! একমাত্র আল্লাহর হুকুম মেনে চল। কারণ তিনি ছাড়া আর কেউ হুকুমকর্তা হবার যোগ্য নেই।’ এ দাওয়াতই হলো তাওহীদের দাওয়াত।
এ ডাকে তারাই সাড়া দিয়েছে যারা আল্লাহকে একমাত্র হুকুমকর্তা মেনে চলার জন্য প্রস্তুত হয়েছে এবং আল্লাহর হুকুম বিরোধী কারো হুকুম না মানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যারা রাসূলগণের এ প্রথম দফা দাওয়াত কবুল করেছে তাদেরকে যে দ্বিতীয় দাওয়াত দেয়া হয়েছে, তা বিভিন্ন সূরায় উল্লেখ রয়েছে। বিশেষ করে সূরা আশ-শুয়ারায় বিভিন্ন নবীর নাম উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে যে, সকল নবীই এ দাওয়াত দিয়েছেন। এ দ্বিতীয় দফা দাওয়াতের ভাষা হলোঃ
فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطيعونِ
‘আল্লাহকে ভয় কর, তিনি যা অপছন্দ করেন তা থেকে বেঁচে থাক এবং আমাকে মেনে চল।’
দ্বিতীয় দফা দাওয়াতের মাধ্যমে রাসূলের নেতৃত্ব মেনে নেয়ার জন্যে ঐসব লোককে নির্দেশ দেয়া হলো যারা তাওহীদকে কবুল করে নিয়েছে। এ দ্বিতীয় দাওয়াতটি হলো রিসালাতের দাওয়াত। যে রিসালাতকে কবুল করলো সে এ সিদ্ধান্তেই নিল যে, আমি আল্লাহর হুকুম একমাত্র রাসূল থেকেই জেনে নেব এবং তিনি যেভাবে ঐ হুকুম পালন করা শিক্ষা দেন একমাত্র ঐ তরীকাই মেনে চলব। আল্লাহর হুকুম পালন করার জন্য রাসূল ছাড়া আর কারো কাছ থেকে ভিন্ন কোন তরীকা গ্রহণ করব না।
যারা তাওহীদ ও রিসালাতকে কবুল করে নিল তাদেরকে সংগঠিত করে রাসূল (সা) এ দুটো দাওয়াত জনগণের মধ্যে প্রসারিত করতে লাগলেন। রাসূল (সা) নিজে এবং যারা তাঁর দাওয়াত কবুল করলেন তারা সবাই রাসূলের নেতৃত্বে তাওহীদ ও রিসালাতের দাওয়াতকে একটি আন্দোলনে রূপদান করেন। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো সমাজে আল্লাহর প্রভুত্ব ও রাসুলের নেতৃত্ব কায়েম করা অর্থাৎ দেশ ও সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব এমন লোকদের হাতে আনা প্রয়োজন, যারা আল্লাহর মর্জিমতো দেশকে চালাবে। যারা এভাবে রাসূলের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে রাজি হলেন তাদেরকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়া হলো যে, এ পথে সংগ্রাম করা ও আসল উদ্দেশ্য হলো আখিরাতের সাফল্য। দুনিয়ার সাফল্য আসল টার্গেট নয়। আখিরাতের টার্গেটকে সামনে রেখে যারা এ পথে চলবে একমাত্র তাদের উপরই আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন এবং পরকালে তারাই বেহেশতের চিরস্থায়ী সুখ শান্তি লাভ করতে পারবে।
তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত হলো রাসূলগণের মূল দাওয়াত। মানব সমাজ এর ভিত্তিতে পরিচালিত হলেই মানুষ দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি লাভ করতে পারবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তর ও পর্যায়ে যারা আগে থেকেই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব দখল করে আছে তাদেরকে তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের দাওয়াত দেয়া হল। কারণ তারা এ দাওয়াত কবুল করলে বিনা বাধায় সমাজ রাসূলের দেখানো পথে চলতে পারবে। সব যুগেই নবীগণ নেতৃস্থানীয়দের এ উদ্দেশ্যেই বিশেষভাবে দাওয়াত দিয়েছেন।
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যে, নেতৃত্বের অধিকারীরা এ দাওয়াত কবুল করতে রাজি হয়নি বলে তাদের সাথে নবীদের সর্বাত্মক সংঘর্ষ হয়েছে। নবী ও তাঁর সাথীদের উপর হাজারো রকমের নির্যাতন চালানো হয়েছে। হক ও বাতিলের এ সংঘর্ষের মাধ্যমেই ইসলামী আন্দোলনে শরীক জনশক্তির মধ্যে প্রয়োজনীয় গুনাবলী সৃষ্টি হয়েছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন।
একটু ভেবে দেখুন
নবী রাসূলগণের দাওয়াত কবুল করে ঐ পদ্ধতিতে যারা ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং বাতিল শক্তির মোকাবিলায় সদা সতর্ক থাকতে বাধ্য হয়, তাদের মন স্বাভাবিক কারণেই ভিন্ন চিন্তার জন্য কমই খালি থাকে। ইসলামী আন্দোলনের দেয়া পদ্ধতি অনুযায়ী তাদের ২৪ ঘন্টার রুটিন প্রণয়ন করতে হয়। নিজেদের জীবনকে এভাবেই আল্লাহর সৈনিক হিসাবে তারা গড়ে তুলবার চেষ্টা করেন। এর ফাঁকেই পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। পেশার ঝামেলা তো পোহাতে হয়ই। বাতিল শক্তির সৃষ্ট বাধা বিপত্তির প্রতিকারের উদেশ্যে আন্দোলন হঠাৎ করেই যেসব কর্মসূচী ঘোষণা করে তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে শ্রম, সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হয়। তাদের মনে বাজে চিন্তা ঢুকবার অবকাশ কোথায়? যে পথে চলার সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছেন তা তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
যারা আন্দোলনে শরীক নয়, তাদের পক্ষে আল্লাহর পথের এ মুজাহিদের দৈহিক ও মানসিক ব্যস্ততা সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা কঠিন। তাদের মনে কুচিন্তা, বাজে খেয়াল, ভিন্ন ভাব ঢুকাবার জন্য ইবলিশের পক্ষে তেমন সুযোগ পাওয়ার কথা নয়।
তবু অনৈসলামী সমাজব্যবস্থার দরুণ তাদের ঈমান, আকীদা, রুচি ও পছন্দের বিরোধী পরিবেশে তাদের মনকে পবিত্র, রাখার জন্য সদা সতর্ক থাকতে হয়। পরিবারে, সামাজিক অনুষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, পথে-ঘাটে, যানবাহনে, হাটে-বাজারে তাদেরকে বিপরীত পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়। আর দশজনের মতোই রক্ত মাংসে গড়া দেহের দাবি তাদেরকেও তাড়া করে স্বাভাবিক। তাই এসব অবস্থায় মনকে পবিত্র রাখার জন্য বিশেষ যত্ম নিতে হয়। এখানে কবি রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা-আবিষ্কার’ নামক কবিতাটি থেকে চমৎকার উদাহরণ পাওয়া যায়। এক রাজা তার রাজ্যের ধুলাবালি থেকে পা দুটোকে রক্ষা করার জন্য রাজ দরবারে পরামর্শ চাইলেন। চামড়া দিয়ে সব রাস্তাঘাট ঢেকে দেয়ার পরামর্শসহ বিভিন্ন রকম মতামত প্রকাশ করা হয়। এভাবেই জুতা আবিষ্কার করা হয় বলে ঐ কবিতায় একটা রূপক গল্পের অবতারনা করা হয়েছে।
সমাজের সর্বত্র যে অপবিত্রতা বিরাজ করছে, তা থেকে মনকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যে পবিত্রতার চামড়া দিয়ে মনের জন্য মোড়ক তৈরি করাই একমাত্র উপায়। এ ব্যাপারে রাসূল (সা) নিম্নরূপ ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন যা সত্যিই অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তবভিত্তিক।
মনকে বশে আনার উপায়
১. পাঁচ ওয়াক্ত জামায়াতে নামায আদায় করা। দিন রাতে ২৪ ঘন্টার যাবতীয় কার্যক্রম নামাযকে কেন্দ্র করে রচনা করতে হবে। ফযরের নামায দিয়ে রুটিন শুরু। এর আগে আর কোন কাজ নয়। টয়লেট, অযু – গোসল তো নামাযেরই প্রস্তুতি।
কালেমা তাইয়্যেবার মাধ্যমে জীবনের যে পলিসি ঠিক করা হয়েছে তা হলো আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা অনুযায়ী চলার সিদ্ধান্ত। নামায এ সিদ্ধান্ত অনুসারে চলারই ট্রেনিং। মন, মগজ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা নামাযে যা কিছু করা হয় তা সবই আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা অনুযায়ী। এর অন্যথা হলে নামায বাতিল বলে গণ্য হয়।
নামাযের মাধ্যমে প্রধানতঃ তিনটি শিক্ষা দেয়া হয়ঃ
(ক) তুমি আল্লাহর গোলাম হিসাবে সব সময় সর্বাবস্থায় জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছ। তাই নামাযে যেভাবে তোমার মন, মগজ, দেহ আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকায় পরিচালনা করেছ নামাযের বাইরেও সেভাবে চলতে হবে।
(খ) তুমি যে আল্লাহর দাস সে কথা হামেশা মনে রাখার প্রয়োজনেই নামায আদায় করতে হয়। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَأَقِمِ الصَّلاةَ لِذِكري
‘আমার কথা স্মরণ রাখার জন্য নামায কায়েম কর’। (সূরা তোয়াহা: ১৪)
নামায শেষে হালাল রোজগারের জন্য যখন কর্মব্যস্ত হবে তখন আল্লাহকে ভুলে যাবে না। বরং وَاذكُرُوا اللَّهَ كَثيرًا ‘আরও বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো’। (সূরা জুমআ : ১০)
আল্লাহকে স্মরণ রাখার উদ্দেশ্যেই ২৪ ঘন্টার কার্যক্রমে প্রতিটি ফরয নামায জামায়াতে আদায় করতে হবে। এর জন্যই বাইরে কর্মব্যস্ত থাকা কালেও মনটাকে মসজিদেই ঝুলিয়ে রাখতে হবে। হাদীসে আছেঃ ৭ ব্যক্তি হাশরের ময়দানে আল্লাহর রহমতের ছায়ায় থাকবে। তাদের একজন হলো
وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ بِالمَسَاجِدِ
‘ঐ ব্যক্তি যার মন মসজিদে ঝুলন্ত।’ অর্থাৎ শত কাজের ঝামেলার মধ্যেও মসজিদে জামায়াতে ফরয নামায আদায়ের নেশায় লেগে থাকতে হবে। এভাবে ৫ ওয়াক্ত জামায়াতে নামায তার মনে আল্লাহর যিকর তাজা রাখে। নামায তাকে আল্লাহকে ভুলতে দেয় না। নামাযে মনকে আটকে রাখার চেষ্টা করতে থাকাই আমাদের কর্তব্য। বারবার মনোযোগ ছুটে গেলেও নিরাশ হওয়া উচিত নয়। ইচ্ছা করে অন্য চিন্তা না করলে এবং মনোযোগকে ধরে রাখার সাধ্য মতো চেষ্টা করতে থাকলে আশা করা যায় যে, অনিচ্ছাকৃতভাবে মনোযোগ ছুটে গেলেও আল্লাহ পাক ক্ষমা করবেন। কারণ আল্লাহ পাক সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপান না।
(গ) নামাযের তৃতীয় বড় শিক্ষা হলো অশ্লীল ও হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকার যোগ্যতা অর্জন করা।
إِنَّ الصَّلاةَ تَنهىٰ عَنِ الفَحشاءِ وَالمُنكَرِ ۗ
‘নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল ও হারাম কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে।’ (সূরা আনকাবুত: ৪৫)
নামাযীকে তাই সব সময় সচেতন থাকতে হয় যে, অশ্লীল ও হারাম কাজ যেন হয়ে না যায়, তাহলে তো আল্লাহ তার নামায কবুল করবেন না। ঐ নামাযই আল্লাহর নিকট কবুল হবার যোগ্য যে নামায অশ্লীল ও হারাম কাজ থেকে ফিরাতে পারে। উপরের আয়াতে এ কথাই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
২. শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামায পড়া: এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ ناشِئَةَ اللَّيلِ هِيَ أَشَدُّ وَطئًا وَأَقوَمُ قيلًا
“আসলে রাত জাগা নাফসকে দমন করার জন্য খুব বেশি ফলদায়ক এবং কুরআন ঠিকমতো পড়ার জন্য বেশি উপযোগী।” (সূরা আল মুজ্জাম্মিল ৬ আয়াত) তাহাজ্জুদের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে মহব্বতের যে ঘনিষ্ঠতা জন্মে এর কোন বিকল্প নেই। এ মহব্বতের হাতিয়ারই মনকে ইবলিশের হামলা থেকে রক্ষা করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
দুনিয়া যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন ঘুমের মজা ত্যাগ করে যে মনিবের দুয়ারে ধরণা দেয়, তার মনে আল্লাহর মহব্বত বৃদ্ধি পায়। রাসূল (সা) তাহাজ্জুদের নামায সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন ‘এটা সালেহ লোকদের তরীকা, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়, অতীত-গুনাহর কাফ্ফরা ও ভবিষ্যৎ-গুনাহর নিরাপত্তা।’
তাহাজ্জুদের নামায আদায়ের ফাঁকে ফাঁকে বা শেষে নিজের গুনাহ মাফের জন্য তাওবা করলে চোখের পানির বৃষ্টিতে মনের আকাশে জমাট গুনাহর মেঘ কেটে যায় এবং ঈমানের সূর্য আগের চেয়েও উজ্জ্বল হয়। আল্লাহর দরবারে কাঁদতে পারার স্বাদই আলাদা। তাওবার পর মনিবের কাছে চাওয়ার পালা। দ্বীন ও দুনিয়া এবং আখিরাতের সবকিছুই চাইতে হবে।
বিশেষ করে মাবুদের নিকট গোলাম হিসাবে স্বীকৃতি দাবী করে কাঁদতে আরও মজা লাগে।
৩. রমযানের রোযা, প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ এ তিন দিনের রোযা, শাওয়াল মাসে এ তিনটি ছাড়া আরও তিনটি রোযা, আশুরার দুটো এবং আরাফার দিনের রোযা সারা বছর রোযাদারকে নাফসের উপর নিয়ন্ত্রণের যোগ্য বানায়।
৪. সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ রাখাঃ এর জন্য রাসূল (সা) যে সহজ পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন তা হলো প্রত্যেক অবস্থায় এর উপযোগী দোয়া পড়া। রাসূল (সা) এর শেখানো আরবী দোয়া অর্থসহ শিখতে পারলে তো কোন কথাই নেই। অন্ততঃ দোয়ার অর্থটুকু মনে জাগরুক রাখা দরকার। ঘুমানোর আগে ও ঘুম থেকে জাগার সময়, টয়লেটে যাবার ও ফিরে আসার সময়, অযুর শুরু ও শেষে, খাওয়ার শুরু ও শেষে, বাড়ি থেকে বের হবার ও বাড়িতে ফিরে আসার সময়, বাজারে চলার সময়, যানবাহনে উঠার ও নামার সময় ইত্যাদি সর্বাবস্থায়ই রাসূল (সা) দোআ পড়তেন।
৫. রাসূল (সা) মনকে সব সময় আল্লাহর যিকরে (স্মরণ ) মশগুল রাখার উপায় হিসাবে জিহ্বাকেও যিকরে ব্যস্ত রাখার উপদেশ দিয়েছেন। যখনি ইতিবাচক চিন্তা -ভাবনা থেকে মনটা খালি হয়ে যায় তখনি তিন তসবীহ, কালেমা তাইয়্যেবা, দরূদ ইত্যাদি মুখে জারি রাখার সাথে সাথে মনে ও সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এভাবে মনকে সব সময় কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে। শয়তান থেকে মনকে বাঁচানোর জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।
মুখ ও মনকে একসাথে কাজ দিতে হবে
এ তিক্ত অভিজ্ঞতা সবারই আছে যে নামায পড়া, তাসবীহ জপা এবং যিকর করার সময় মুখে ঠিকই উচ্চারণ করা হচ্ছে, কিন্তু মনে অন্য কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। দেহ জায়নামাযে দাঁড়িয়ে সূরা পড়ছে আর মন কোথায় ছোটাছুটি করছে। মুখে তসবীহ উচ্চারণ করা হচ্ছে এবং হাতের আঙ্গুলও তসবীহ দানা টেনে নিচ্ছে বটে কিন্তু মন অন্য বিষয় ভেবে চলেছে।
অথচ বক্তৃতা করার সময় মুখ যা বলছে মনও তা-ই বলছে। বই পড়ার সময় মুখ ও মন একসাথেই চলে। কারো বক্তৃতা বা কথা শোনার সময় মন দিয়েই শোনা হয়। এই যে এখন আমি লিখছি মন দিয়েই লিখছি। মন যা লিখতে বলছে তাই লিখছি। এ সব ব্যাপারে মনোযোগ ঠিকই থাকে। কিন্তু নামায, তসবীহ, যিকরের বেলায় মন বিয়োগ হয়ে যায় কেন?
এটা আমাদের শিক্ষার ত্রুটি। নামাযে যা যা মুখে পড়তে হয় তা শেখানোর সময় মনে কী ভাবতে হবে সে কথা শেখান হয় না। মুখে যা পড়া হয় এর অর্থ জানা থাকা সত্ত্বেও মনোযোগের অভাব হতে পারে ঐ শিক্ষার ত্রুটির কারণে। তেমনি তসবীহ ও যিকরের ব্যাপার। মুখ ও মনকে একই সাথে চলতে হবে। মুখে যা উচ্চারণ করা হচ্ছে মনে এর ভাব জাগরুক থাকতে হবে। নইলে নামায, তসবীহ, ও যিকর প্রাণহীন হয়ে থাকবে। মৃত নামায দ্বারা উপরে বর্ণিত শিক্ষা লাভ হতে পারে না।
মুখে যা উচ্চারণ করা হয় তা মনকে দিয়েও বলাবার পদ্ধতি সম্পর্কে একটু আলোচনা প্রয়োজন। মুখে যা পড়া হয় এর অর্থের দিকে খেয়াল রাখলে মনে অন্য ভাব জাগার পথ পায়না। কিন্তু এ খেয়াল স্থায়ী রাখা কঠিন। এর জন্য মনের আবেগ যোগ হওয়া বিশেষ জরুরি। রাসূল (সা.) ইবাদতের সময় ইহসান এর যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাই আবেগের ভিত্তি। তিনি ইহসানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, এমনভাবে ইবাদত কর যেন তুমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ। যদি এমনটা নাও পার, তাহলে অন্তত খেয়াল কর যে, তিনি তো তোমাকে অবশ্যই দেখছেন।
এ আবেগ সৃষ্টির প্রয়োজনেই নামাযের শুরুতে তাওয়াজ্জুহ (ইন্নি অজ্জাহাতু… মুশরিকীন ) পড়া হয়। পড়ার সময় মনে এ ভাব জাগ্রত করতে হবে যে, আমার মা’বুদ আমার সামনেই হাজির আছেন। সিজদায় মুখে যখন বলা হয় ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা’ তখন এর অর্থের দিকে খেয়াল করলে আবেগ সৃষ্টি হবে যে, আমি তো আমার মহান রবের কোলেই আশ্রয় পেলাম। এভাবে নামাযের প্রতিটি অংশে আবেগ যুক্ত হলে মন নামাযের বাইরে ছুটাছুটি করার ফুরসতই পাবে না।
এমন নামাযই জীবন্ত। জীবন্ত নামাযই মুমিনের জীবনকে গড়ার যোগ্যতা রাখে। শুধু অনুষ্ঠান হিসেবে নামায আদায় করা হলে তা দ্বারা নামাযের কোন উপকারই পাওয়া সম্ভব নয়। অনেকের জীবনে এ কারণেই নামাযের উদ্দেশ্য সফল হতে দেখা যায় না। রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নেক আমলের কমপক্ষে ১০ গুণ এবং বেশির পক্ষে ৭০০ গুণ বদলা দেবেন। একই জামায়াতে নামায আদায় করেও কেউ ১০, কেউ ৫০, কেউ ১০০, কেউ ৭০০ পাওয়ার কারণ কী? একই কাজের মজুরী এত বেশ-কম করে কেন দেওয়া হবে? নামাযে কে কতটা মনকে হাজির রাখতে সক্ষম হলো, কার জযবা ও আবেগ কী পরিমাণ ছিল,কে কতটা মহব্বতের সাথে মনিবের নিকট নিজেকে সমর্পণ করল ইত্যাদির তারতম্যের ভিত্তিতে পুরস্কারের পরিমাণ কম বেশি হবে।
নামায, তসবীহ ও যিকরের ব্যাপারে কমপক্ষে এতটুকু চেষ্টা করতে হবে যে, মুখে যখন উচ্চারণ করা হয়, তখন যেন তা মনের অগোচরে না হয়। মনের দিকে খেয়াল রেখেই মুখে পড়তে হবে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যে, বুকের বাম পাশে যেখানে হার্ট বা হৃদপিন্ড থাকে সেদিকে খেয়াল রেখে ধীরে ধীরে মুখে পড়তে থাকলে মনকে নামাযের মধ্যেই আটক রাখা সহজ হয়। এ দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে মনকে নামাযের বাইরে যেতে দেব না। আমার এ অভিজ্ঞার ভিত্তি হলো সুফী সাধকদের ‘কালবী যিকর’ সম্পর্কে ধারণা। তাঁরা কালবের অবস্থান বুকের বামদিকেই নির্ধারণ করেন। মুখে যেমন আল্লাহ উচ্চারণ করা হয় তেমনি তারা কালবেও তা উচ্চারণ করা অনুশীলন করে থাকেন। এমনকি সেখান থেকে এ উচ্চারণের আওয়াজও বের হয়। এটা তো দীর্ঘ অনুশীলনের বিষয়। রাসূল (সা) সাহাবায়ে কেরামকে এ অনুশীলনের শিক্ষা দিয়েছেন বলে আমি এখনও জানতে পারিনি। কিন্তু কালবে উচ্চারণ না করেও কালবের দিকে খেয়াল রেখে মুখে উচ্চারণ করলে যে একাগ্রতা সৃষ্টি হয় এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ খেয়াল যত গভীর হয় মনোযোগ ততই মযবুত হয়। গভীর মনোযোগকেই সুফীগণ মুরাকাবাহ বলেন।