জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • দাওয়াত ও তাবলিগ
    • ঈমান ও আক্বীদাহ
    • আমল-আখলাক ও মুয়ামালাত
    • ইসলাম ও ইবাদাত
    • পারিবারিক ও সামাজিক জীবন
    • ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • নারী
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • কর্মী সিলেবাস
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • দাওয়াত ও তাবলিগ
    • ঈমান ও আক্বীদাহ
    • আমল-আখলাক ও মুয়ামালাত
    • ইসলাম ও ইবাদাত
    • পারিবারিক ও সামাজিক জীবন
    • ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • নারী
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • কর্মী সিলেবাস
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি

মুমিনের পারিবারিক জীবন

অন্তর্গতঃ পারিবারিক ও সামাজিক জীবন, রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
A A
Share on FacebookShare on Twitter

মুমিনের পারিবারিক জীবন

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী


স্ক্যান কপি ডাউনলোড


মু’মিনের পারিবারিক জীবন

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী

জিনিয়াস পাবলিশার

মুমিনের পারিবারিক জীবন
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী

প্রকাশক: মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন মোল্লা

পরিচালক
জিনিয়াস পাবলিশার

মুদ্রণে: আল-ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস

প্রকাশকের কথা

আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। আদর্শ পরিবারই পারে উন্নত নৈতিক সচেতনতামূলক একটি সমাজ উপহার দিতে। কারণ একজন মানুষের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে নৈতিক উৎকর্ষতার প্রশিক্ষণ পরিবার থেকেই শুরু হয়। এই বইটিতে কিভাবে একটি আদর্শ পরিবার গঠন করা যাবে লেখক তা অত্যন্ত যত্নের সাথে তুলে ধরেছেন। যা অনুসরণ করে একটি কাংখিত পরিবার গঠন সম্ভব যা দুনিয়া এবং আখেরাতে কল্যাণ বয়ে আনবে।

পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বাজারে বেশ কিছু বই রয়েছে। যেগুলোর কোনটির কলেবর বেশ বড় আবার কোনটি অনেক ক্ষেত্রে বিস্তারিত নয়। সেক্ষেত্রে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী রচিত মুমিনের পারিবারিক জীবন বইটি আমার কাছে বেশ গুছালো মনে হয়েছে। আশা করি পাঠক সমাজ বইটি পাঠে লাভবান হবেন। বইটির লেখক ২০০৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন পরপারে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন লেখককে জান্নাতুল ফেরদাউস এর সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন। আমীন ॥

লেখকের কথা

আমি জাত লেখক নই বরং জাতপাঠক। ছাত্র জীবন থেকেই পাঠের প্রতি ঝোঁক রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র থাকাকালে পাঠ্যবই ছাড়াও নানান বই-পত্র পড়তাম। ছাত্র জীবনের শেষের দিকে তদানীন্তন ‘জাহানে নও’য়ে আমার একটা লেখা বের হয়। এরপর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আমার কিছু কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ইতোপূর্বে আমার লেখা কোন বড় বই বের হয়নি।

আমি ছিলাম পরিবারের প্রথম সন্তান। আব্বা-আম্মা আমাকে তদানীন্তন সাধারণ শিক্ষা এবং মাদ্রাসা শিক্ষার কোনটাতে না দিয়ে বরং তখনকার ‘নিউ স্কীমে’ পড়াবার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পরেই বাড়ী থেকে একটু দূরে একটি ‘নিউ স্কীম’ জুনিয়র মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন। তখনকার ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত আমি সে লাইনে লেখাপড়া করে ইসলামিক আই.এ. পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স পড়া শুরু করি। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে কোরআন, হাদীস, ফেকাহ, উসুল ও আরবী পড়াশুনা করতে হয়। সেই সুবাদে কোরআন-হাদীস ও আরবী বুঝা আমার জন্য অনেকটা সহজ হয়েছিল।

এই বইয়ে কোরআনের বহু আয়াত উল্লেখ লক্ষ্য করা হয়েছে। কিছুদিন আগে আমি কোরআনের আয়াতের উল্লেখ করে ‘মু’মিন জীবনের বৈশিষ্ট্য’ নামে একটি পুস্তিকা রচনা ও প্রকাশ করি। তখন থেকেই মু’মিন জীবনের উপর বিস্তারিত লেখার একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আশির দশকের শেষ দিক থেকেই মু’মিন জীবনের উপর আমি লেখা শুরু করি।

মানুষের জীবনের রয়েছে বিভিন্ন দিক ও বিভাগ। মু’মিন জীবনেরও তাই। এর মধ্যে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন ও সামাজিক জীবন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমিও সেভাবে মু’মিনের ব্যক্তিগত জীবন, মু’মিনের পারিবারিক জীবন ও মু’মিনের সামাজিক জীবন- এ তিনটি বিষয়ে তিনটি বই রচনা করলাম। বই তিনটি রচনা করতে গিয়ে দেখলাম, শুধু কোরআনের উল্লেখই যথেষ্ট নয়, হাদীসের উল্লেখও প্রয়োজন। তাই একত্রে বইটির নাম ঠিক করলাম “কোরআন-হাদীসের আলোকে মু’মিনের জীবন।”

অপরদিকে কোরআনে মানুষের জীবন-অভ্যাস সম্পর্কে যে সব উক্তি রয়েছে সেগুলো অবলম্বনে ‘সাপ্তাহিক সোনার বাংলায়’ আমার একটা লেখা ছাপা হলো। সোনার বাংলা সম্পাদকের পক্ষ থেকে তার শিরোনাম দেয়া হল ‘কোরআনের আলোকে মানব জীবন’। আমার বেশ পছন্দ হলো শিরোনামটি। উক্ত শিরোনামে আমি একটি বই রচনায় হাত দিলাম। মানুষের সৃষ্টি ও জন্ম, প্রকারভেদ, কলব ও নফসের শ্রেণী বিন্যাস, হেদায়াত ও গোমরাহী, মানব জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা, শেষ পরিণতি-জান্নাত অথবা জাহান্নাম – এ সব আলোচনা সমৃদ্ধ শুধুমাত্র কোরআনের উদ্ধৃতি সম্বলিত একটি বই রচনা করি। তাই মৌলিক বই হলো দুটি :
১. কোরআন-হাদীসের আলোকে মু’মিনের জীবন।
২. কোরআনের আলোকে মানব জীবন;

প্রথমোক্ত বইয়ের পারিবারিক অংশ “মু’মিনের পারিবারিক জীবন” নামে বর্তমানে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হল।

পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বর্তমানে বাজারে কয়েকটি বই রয়েছে। মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীমের “পরিবার ও পারিবারিক জীবন”, মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর “কোরআন-হাদীসের আলোকে পারিবারিক জীবন”, মাওলানা আব্দুস শহীদ নাসিমের “ইসলামে পারিবারিক জীবন” তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য। মাওলানা আব্দুর রহীম পন্ডিত মানুষ, তাঁর বইটি উচ্চাঙ্গের ও অনেক বড়। মাওলানা থানভী সাহেবের বইটি সংকলিত, বক্তৃতার সমষ্টি, পূর্ণাঙ্গ বই নয়। মাওলানা নাসিম সাহেবের বইটি অবশ্য সময়োপযোগী, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বিস্তারিত নয়। আমি সময়ের দিকে খেয়াল রেখে পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, নারী-পুরুষের অবস্থান, বিয়ে ও দাম্পত্য জীবন, সন্তান ও পিতা-মাতার অধিকার ও দায়িত্ব, নবী-রাসূলদের ও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পারিবারিক জীবন, পারিবারিক জীবনে পর্দা ও যেনা-ব্যভিচার, দ্বীনী পরিবেশ, ভোগ-বিলাস ও ধন-সম্পদ আহরণ ও সর্বশেষে পারিবারিক জীবনের শেষ পরিণতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। চূড়ান্ত রায় দেয়ার মালিক পাঠকবর্গ।

‘আদর্শ পরিবার’ সম্পর্কিত বই লেখা বা বই পাঠ করা অনেক সহজ কিন্তু ‘আদর্শ পরিবার’ গঠন অনেক কঠিন। অবশ্য বিষয়টি খুবই প্রয়োজনীয়, জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ। আদর্শ পরিবার গঠিত হলেই সমাজে আসবে আদর্শ মানুষ। নৈতিকতা সম্পন্ন, সুরুচিপূর্ণ ভাল মানুষ সৃষ্টিতে আদর্শ পরিবারের কোন বিকল্প নেই। তাই আদর্শ পরিবার গঠনে দেশের সকল পরিবার প্রধানের মনোযোগ দেয়া দরকার। ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছা হয়ত সম্ভব হবে না কিন্তু ইতিবাচক ফলাফল লাভ করা যেতে পারে। বর্তমানে আমরা আদর্শ পরিবার গঠনে যেমন নির্লিপ্ত ও নিশ্চেষ্ট, উদ্যোগ নিলে ও সচেষ্ট হলে কিছু না কিছু অগ্রগতি তো হতে পারে। সে লক্ষ্যেই বইটি প্রণীত ও প্রকাশিত হলো।

আমার নিজের পরিবারকে ‘আদর্শ পরিবার’ গঠনে আমি তো মোটামোটি সচেষ্ট। কিন্তু কতটুকু সফল হতে পেরেছি তা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে আমি নিজে সন্তুষ্ট নই। কেননা আমার নিজের চেষ্টার উপর সব কিছু নির্ভর করে না। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই এক একটি ইউনিট। তাদের সক্রিয় সহযোগিতা ভিন্ন সাফল্য সম্ভব নয়। তাই সকল পাঠকবর্গের নিকট দোয়া কামনা করি, লেখক হিসাবে আমার পরিবারটি যেন আদর্শবান ও সুন্দর করাতে আল্লাহ সাহায্য করেন। কোরআনের শিখানো দোয়ায়ই বলি:

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ اَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ
اماما

“হে আমার পরওয়ার দিগার রব, আমাদেরকে আমাদের স্ত্রী-পরিজন ও আমাদের সন্তান-সন্ততির চোখের শীতলতা দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের ইমাম ও পরিচালক নিয়োজিত করুন।” (সুরা ফুরকান ৭৪)

বইটি প্রকাশনার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে আমাদেরই দ্বিতীয় ছেলে সালেহ মাহমুদ। সে নিজ দায়িত্বে কম্পোজ ও মেক-আপ করেছে। ছাপার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে বড় ছেলে মোঃ নেসার উদ্দিন মাসুদ ও সেজো ছেলে মোঃ শরীফুদ্দিন মওদুদ। অবশ্য লেখার ক্ষেত্রে জীবন সঙ্গিনী ও সহধর্মিনী শরীফুন্নেসার সহযোগিতা না পেলে হয়ত লেখাই হত না। আমাদের চতুর্থ ও পঞ্চম ছেলে যথাক্রমে মোঃ শফিউদ্দিন মাকসুদ ও মোঃ মুহসিন উদ্দীন মাসুম হাফিজ ট্রেডিং সেন্টারের পক্ষে কাজ করে সহযোগিতা করেছে। বইটি আগাগোড়া বাংলা ও আরবী প্রুফ দেখা ও সম্পাদনায় সহযোগিতা করেছেন বন্ধুবর অধ্যাপক সাব্বির আহমদ ও আমার ছোট ভাই কবি ও সাহিত্যিক আসাদ বিন হাফিজ। সকলকে আল্লাহ যথাযোগ্য জাযা ও খায়ের দান করুন।

বইটিতে ভুলত্রুটি যথাসাধ্য দূর করার সাধ্যমত চেষ্টা করা হয়েছে। এরপরও মানবীয় কারণে ভুলত্রুটি থেকে যেতে পারে। বিজ্ঞ পাঠকবর্গের নিকট থেকে কোরআন-হাদীসের কোন উদ্ধৃতির অসংগতি বা যে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়লে আমাদেরকে যথারীতি জানাবার অনুরোধ রইল। পরবর্তিতে যুক্তিসংগত ভুল-ত্রুটির সংশোধন করে ছাপাবার ইচ্ছা রইল। বাকী আল্লাহ তায়ালার মর্জি। বাকী বইগুলো যথাসময়ে বের করার জন্য সকলের নিকট দোয়া কামনা করছি। বইটিকে যেন আল্লাহতায়ালা আমার মৃত্যুর পর ছওয়াবের অছিলা বানান সেই দোয়া করে শেষ করছি।

আল্লাহ হাফেজ
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী

ভূমিকা

মুসলিম পারিবারিক জীবনে সবচেয়ে বড় জিনিষ হলো পরিবারের সদস্যদের জীবনবোধ, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গী ও জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ। এক্ষেত্রে সামান্যমাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া একজন মুসলিমের যে প্রকৃত জীবনবোধ, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গী ও জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য তা আধুনিক সমাজে পরিবর্তন হয়ে গেছে। কোরআন ও হাদীস মোতাবেক জীবনের যে চূড়ান্ত লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও আল্লাহর বিধান মত জীবন যাপন তা আজকের মুসলমান ভুলে গেছে, তারা দুনিয়ার প্রতারণার জালে আটকা পড়ে গেছে। ফলে নানা কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতি সমাজ জীবনের মাধ্যমে ঢুকে পড়েছে পারিবারিক জীবনে। মুসলিম মন-মানসে পরিবর্তনের হাওয়া লেগে জীবন সম্পর্কে সৃষ্টি হয়েছে নানারূপ বিভ্রান্তি। দুনিয়াবী দৃষ্টিভঙ্গী তার মন-মানসিকতাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সত্যিকার মুসলমানের যে জীবন মিশন- আল্লাহর দ্বীনের বাস্তবায়ন- একামতে দ্বীন, মুসলমান সমাজ তা ভুলে গেছে। ফলে কোরআন হাদীসের আলোকে জীবন যাপন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে মুসলিম পারিবারিক জীবন।

কোরআন ও হাদীস নারী পুরুষের যে সম্পর্ক স্থাপন করেছে, নারীকে যে মর্যাদা দান করেছে, আজ তা সমাজে নেই। বরং সমাজে আজ চলছে নারী নির্যাতন, নারী অপহরণ ও নারীকে নিয়ে দেহ ব্যবসা। নারী আজ স্ত্রী-হিসাবে পায়না যথার্থ মর্যাদা, মা হিসাবে যথার্থ সম্মান, কন্যা হিসাবে যথার্থ শিক্ষা। অধিকাংশ পরিবারে নারীরা আজ বিপর্যস্ত, দুর্দশাগ্রস্ত ও অপমানিত জীবন যাপন করছে। নারীর সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আজ প্রয়োজন ইসলামী সমাজের। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আজ যে সব নারী আন্দোলন চলছে তাও আজ বিভ্রান্ত ও সীমালংঘনকারী। কেবলমাত্র ইসলামী সমাজ ও ইসলামী বিধানই দিতে পারে নারীকে তার যথার্থ সম্মান।

পরিবার সংস্থার প্রথম পর্ব হলো বিয়ে। বিয়ে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও মুসলিম পরিবারে বহুরকম অপসংস্কৃতি, বদরসম ও নীতি-নৈতিকতা বর্জিত ব্যবস্থা ঢুকে পড়েছে। প্রথমত বিয়ের পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে দৃষ্টিভঙ্গী বদলে গেছে। রাসূল (সাঃ) যেখানে দ্বীনদারীর প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদানের কথা বলে গেছেন সেক্ষেত্রে আজ দুনিয়াদারী, শিক্ষা ও ধন সম্পদ স্থান লাভ করেছে।

বিয়ের অনুষ্ঠানে পর্দা-পুশিদার বালাই থাকে না। বিয়ের দুলহার জন্য গেইট-নিয়ন্ত্রণ, হাত ধোয়া, জুতা চুরি-এইসব অহেতুক নিয়ম-কানুনের অপসংস্কৃতি বিস্তার লাভ করেছে, বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেছে ব্যয় বহুল, অপরদিকে যেনা-ব্যভিচার হয়ে গেছে সহজসাধ্য। বিয়েতে বিরাট অংকের মোহর ধার্য করা হয় কিন্তু আদায় হয় খুব কম, পক্ষান্তরে মেয়ের কাছ থেকে যৌতুক আদায় করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এভাবে পবিত্র বিয়ে ব্যবস্থা আজ হয়ে পড়েছে কলুষিত ও শরীয়ত বিরোধী অসংখ্য কাজে অপবিত্র।

বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীতে যে গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার কথা, যে মধুর দাম্পত্য জীবনের সূচনা কাম্য, স্বামী-স্ত্রীর স্ব-স্ব অধিকার ও যে দায়িত্ববোধ প্রয়োজন, আজকের পারিবারিক জীবনে রযেছে তার অনেক ঘাটতি। বেপর্দা ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের অবাধ সম্পর্ক স্থাপনের কারণে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রে ফাটল সৃষ্টি হয়, স্বামী স্ত্রীর অধিকারের প্রতি এবং স্ত্রী স্বামীর অধিকারের প্রতি খেয়াল রাখে না এবং ঠিকমত স্ব-স্ব দায়িত্বও পালন করে না। ফলে, যে পরিবার শান্তির নীড় হওয়ার কথা- সে পরিবারে চলে মন কষাকষি, ঝগড়া-ঝাটি ও বিবাদ-বিসম্বাদ।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিলমিশ না হলে বা একের বিরুদ্ধে অপরের অভিযোগ থাকলে কোরআনে মীমাংসার তাকিদ দেয়া হয়েছে এবং এ ব্যাপারে দুই পরিবারের দুই জন সালিশ নিয়োগ করে মিলমিশ করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রেই হয় না ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পারিবারিক বিরোধ থেকেই যায়। একেবারে পারিবারিক অবস্থা অচল হয়ে পড়লে, অগত্যা অন্য কোন উপায় না থাকলে, সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসাবে নিয়ম মোতাবেক তালাক দেয়াকে ইসলাম জায়েয করেছে। কিন্তু আজকের মুসলিম সমাজে নিয়ম মোতাবেক তালাক প্রদানের ব্যবস্থা বলতে গেলে নেই। কোন ব্যাপারে স্বামী স্ত্রীতে ঝগড়াঝাটি হলো বা কথা কাটাকাটি হলো, অমনি স্বামী স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে বসল। ইসলাম যদিও এধরনের তালাককে সমর্থন করে না কিন্তু এভাবে তিন তালাক দিলে তিন তালাক বায়েন অর্থাৎ সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে যায়। ইসলাম বলেছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিলমিশ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই না থাকলে অগত্যা স্বামী স্ত্রীকে পবিত্রাবস্থায় যৌন মিলন না করে এক তালাক প্রদান করবে, এভাবে তিন মাসে তিন তালাক প্রদান করে তালাককে চূড়ান্ত করবে। অর্থাৎ পবিত্রাবস্থায় যৌন মিলনের চাহিদা হলে এবং যৌন মিলন হয়ে গেলে আর এ পবিত্রাবস্থায় তালাক দেয়া হল না। আবার এক তালাক দিলে ইচ্ছা করলে ইদ্দতকালেই স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণ করতে পারে। এভাবে তালাককে করা হয়েছে কঠিন অথচ বিয়ে সহজ। দুইজন সাক্ষীর মোকাবেলায় একজন স্ত্রী ও একজন পুরুষের ইজাব কবুল হয়ে গেলেই বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু আজকে বিয়ে হয়ে গেছে কঠিন ও তালাক হয়ে গেছে অনেক সহজ, স্বামী ইচ্ছা করলেই তা বাস্তবায়িত করে ফেলে।

স্বামী-স্ত্রী মিলনের ফলে আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তান লাভ হয়। কিন্তু আজ বিশ্বজুড়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু হয়ে যেনা-ব্যভিচার বৃদ্ধি, খোদার খোদায়ীতে খোদকারী, বেপর্দা, বেহায়াপনা ছড়িয়ে পড়ছে। মুসলিম পরিবারও এ অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারছে না। এরপর যে সব সন্তান জন্ম লাভ করছে মুসলিম পরিবারে, সে সব সন্তানের প্রতিও যথারীতি দায়িত্ব পালন হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে। শিশু সন্তানকে মায়ের দুধ পান করানো এক অপূর্ব খোদায়ী ব্যবস্থা। কিন্তু আধুনিকতার অভিশাপ স্বরূপ মায়ের দুধের পরিবর্তে আজ গরুর দুধ বা বোতলের দুধ পানে অভ্যস্ত করে তোলা হচ্ছে। অবশ্য পরে চিকিৎসা শাস্ত্রে এর ক্ষতিকারক দিক ধরা পড়লে কিছু সমাজ সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যাতে শিশুকে মায়ের দুধ পানে উদ্বুদ্ধ করতে দেখা যায়।

অনেক বাপ-মা সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে দারিদ্র্যের শিকার হয়ে তাদের সন্তানকে শিশু অবস্থায় যে ধরনের খাবার ও পোশাক সরবরাহ করা প্রয়োজন তা করতে পারে না। শিক্ষা, চিকিৎসা ও মৌলিক প্রয়োজন পূরণে অনেক শিশুর ক্ষেত্রে চরম ঘাটতি দেখা যায়। অর্থাৎ পিতামাতা তাদের যথাযোগ্য দায়িত্ব পালন করে না। তবে অনেক পিতামাতা আবার এ দায়িত্বটুকু যথারীতি পালন করে থাকেন। কিন্তু শিশু কিশোরের নৈতিক শিক্ষাদান, চরিত্র গঠন অর্থাৎ তাদেরকে মানুষ করার যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি রয়েছে পিতামাতার উপর তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যথাযথভাবে পালন করা হয় না। আজকের সমাজের যে সব বখাটে ছেলেপেলে, হাইজাকার, সন্ত্রাসী, গুন্ডা-পান্ডা, ইতর বদমায়েশ- এরা সকলেই মুসলিম পরিবারেই বড় হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পিতামাতার অবহেলা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও বাস্তব পদক্ষেপের অভাবের কারণেই এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

পিতামাতার প্রতি সন্তানের সদ্ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে আল কোরআনে। কিন্তু আজকের সমাজে অনেক সন্তানই তাদের পিতামাতার প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের পক্ষ থেকে পিতামাতার প্রতি দুর্ব্যবহার ও নিপীড়ন হয়ে থাকে। স্ত্রীকে খুশী করার জন্য মাকে কষ্ট প্রদান, ছেলে মেয়ের ভরণ পোষণের জন্য পিতামাতার খোঁজ-খবর না রাখা- অনেকের বেলায় এসব হয়ে গেছে আধুনিক ষ্টাইল। তবুও পাশ্চাত্য জগতে যেমন সন্তানের প্রতি একটু বড় হলেই পিতামাতার সম্পর্কহীনতা, তেমনি সন্তানও বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতার কোনই খোঁজ-খবর না রাখা, এমন ধরনের অবস্থা মুসলিম সমাজে এখনও দেখা যায় না। অনেক মুসলিম পরিবারে এখনও পিতামাতাকে যথাযথ সম্মান প্রদান ও যথার্থ ব্যবহার করে থাকে।

পর্দা-পুশিদার ক্ষেত্রে মুসলিম পরিবার আজ অনেক ঢিলা হয়ে পড়েছে। মুসলিম নামধারী বহু পরিবারে পর্দার কোন বালাই নেই। পাশ্চাত্য জগতের ‘ফ্রি মিক্সিং’ অবাধ মেলামেশাকে তারা আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছে। তারা পারিবারিক বন্ধনকে ডিঙ্গিয়ে সহশিক্ষা, সহচাকুরী, খোলা-মেলা রাস্তায় চলাফেরা ও কেনাকাটা সবই করে থাকে। আল্লাহর দেয়া পর্দার ফরজ বিধানকে তারা কোন পরোয়াই করে না। আবার কিছু পরিবারে আছে যারা রাস্তাঘাটে তো পর্দা মেনে চলে কিন্তু বাড়ীর চতুঃসীমায় পর্দার প্রতি ততটা মনোযোগী নয়। বিশেষ করে আজকে রেডিও, টিভি বেহায়পনা ও বেলোল্লাপনার এক শক্তিশালী হাতিয়ার। যুব চরিত্রকে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এসব কাজ করে থাকে বলে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়। ফলে আজকে সমাজের মধ্যে চলছে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য যেনা ও ব্যাভিচার।

আজকের সমাজে পারিবারিক জীবনে নবী-রাসূলদের অনুসরণ অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে না। একমাত্র দ্বীনী কাজের জন্য সন্তান কামনা, একমাত্র আল্লাহর জন্য বা দ্বীনী কাজে সন্তানকে উৎসর্গকরণ, আল্লাহর এবাদতে সন্তানদেরকে নিয়োজিতকরণ, দ্বীনের মিশন পরিচালনায় সন্তানদেরকে উত্তরাধিকার স্থাপন ইত্যাদি উদাহরণ নবী রাসূলদের জীবনী থেকে আমরা গ্রহণ করি না। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) যে আদর্শ পরিবার গঠন করেছিলেন সে আদর্শ পরিবার গঠনে আমরা তৎপর নই। আল্লাহর অনুমতিক্রমে নবী করীম (সাঃ) একত্রে দশটি বিয়ে করেছিলেন এবং দশজন স্ত্রীর মধ্যে সমতা রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে ৪ জন স্ত্রী রাখার অনুমতি রয়েছে, যদিও আজকের সমাজে ‘অধিকাংশ মুসলমানই একটি বিয়েই করে। কিন্তু যারা একাধিক বিয়ে করে, তাদের স্ত্রীদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমতা রক্ষা করা হয় না বরং অনেক ক্ষেত্রে এই ব্যক্তি একদিকে ঝুঁকে পড়ে, যা আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করেছেন। এভাবেও স্ত্রী জাতি আজ নিগৃহীত হচ্ছে।

আজকে মুসলিম পরিবার ও তার সদস্যবৃন্দ ভোগবিলাস ও ধন সম্পদের নেশায় মত্ত হয়ে পড়েছে। আখরাতের চিন্তার চেয়ে দুনিয়ার মহব্বত অনেক বেশী বেড়ে গেছে। দুনিয়াকে পাওয়ার জন্য পেরেশান ও বেকারার হয়ে পড়েছে। অন্যায়, ধোঁকা-প্রতারণা, মিথ্যা, ওজনে কমবেশ করা, শঠতা-ধূর্তামি, সূদ-ঘুষ-জুয়া ইত্যাকার এমন কোন অপরাধ নেই যাতে মুসলমানগণ আকণ্ঠ নিমজ্জিত নয়। মুসলমান নামধারী ব্যক্তিবর্গ আজকে আল্লাহকে ভুলে গেছে, আখেরাতের কথা ভুলে গেছে, হয়ে গেছে সম্পূর্ণ দুনিয়াদার। কেবলমাত্র কিছু সংখ্যক ব্যাতিক্রমধর্মী মুসলমান পারিবারিক জীবনে আজো আল্লাহর বিধানকে কিছুটা মেনে চলে, তারা নবী-রাসূলদের আদর্শ মোতাবেক তাদের পরিবার গঠনে আগ্রহী ও তৎপর। কিন্তু সামাজিক পরিবেশের কারণে তারাও তাদের পরিবারের সদস্যদের উপর সর্বদা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না।

কাজেই অধিকাংশ মুসলিম পরিবারে মৃত্যুর পূর্বে আখেরাতের যথাযথ প্রস্তুতির অভাব পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক পরিবেশ, নফসের খাহেশ ও খোদাহীন সভ্যতার বিকাশ পরিস্থিতি-পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছে। মৃত্যুর পরবর্তী ‘বরযখ’ কেয়ামত ও হাশরে আজকের মুসলমানদের কি পরিণতি হবে, তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। আজকের মুসলিম পরিবারের সদস্যদের শেষ পরিণতি জান্নাত না জাহান্নাম তার ফয়সালা হবে হাশরেরই ময়দানে।

মুসলিম পরিবার বা তার সদস্যদের শেষ পরিণতি যদি ভাল করতে হয়, যদি আমরা জান্নাত পেতে চাই, যদি আমরা পরিবারের সকল সদস্যসহ জান্নাতে একত্রে বসবাস করতে চাই তাহলে আমাদের স্ব-স্ব আমলনামাকে ভাল ও উত্তম করার প্রতি সকলকে নজর দিতে হবে। মৃত্যুর পূর্বেই আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। কোরআন ও হাদীস মোতাবেক জীবন ও পরিবারকে গঠন করতে হবে। পারিবারিক জীবনের সকল দিককে কোরআন-হাদীস ও নবী-রাসূলদের শিক্ষানুযায়ী গড়ে তুলতে হবে। আমাদের ভবিষ্যত ও কিসমত রচনার দায়িত্ব আমাদেরই। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ
“তোমাদের দায়িত্ব তোমাদের নিজেদেরই”।

কোরআন-হাদীস মোতাবেক একটি আদর্শ পরিবার গড়ে তুলতে পারলেই আমদের ইহকালীন ও পরকালীন জীবন সার্থক, সুন্দর ও আনন্দময় হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সে ধরনের আদর্শ পারিবারিক জীবন গড়ে তোলার তাওফীক দান করুন।

আমীন।
ছুম্মা আমীন।

সূচীপত্র

  1. প্রথম অধ্যায় : পারিবারিক জীবনের অপরিহার্যতা ও গুরুত্ব
    1. পরিবারের সংজ্ঞা ও বংশীয় ধারা পরিক্রমা
    2. একক পরিবার ও যৌথ পরিবার
    3. পরিবারের ধারণা ও আল কোরআন
  2. দ্বিতীয় অধ্যায় : নারী পুরুষের সম্পর্ক ও অবস্থান
    1. ইহুদী ধর্মমতে নারী
    2. খ্রিস্টীয় ধর্মমতে নারী
    3. প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র ও সমাজে নারী
    4. ইউরোপে নারীর অবস্থা
    5. প্রাচীন আরবে নারীদের অবস্থা
    6. আল-কোরআনে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা
      1. মা হিসাবে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা
      2. স্ত্রী হিসাবে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা
      3. কন্যা হিসাবে নারীর অধিকার ও মর্যাদা
      4. সমাজের সাধারণ সদস্যা হিসাবে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা
  3. তৃতীয় অধ্যায় : পরিবারের সূচনা – বিয়ে
    1. বিয়ে হল পশু ও মানুষের মধ্যে পার্থক্যসূচক একটি ব্যবস্থা
    2. বিয়ে হলো সভ্যতার নিদর্শন
    3. বিয়ের অর্থ
    4. বিয়ের গুরুত্ব
    5. মুসলিম সমাজে বিয়ের প্রতি উৎসাহ প্রদান, তাকিদ ও নির্দেশ
    6. কাদেরকে বিয়ে করা হারাম
    7. কাদেরকে বিয়ে করা যাবে
    8. বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী দেখে নেয়া
    9. বিয়ের ঘোষণা
    10. বিয়ের সাক্ষ্য
    11. মেয়ের মোহর নির্ধারণ ও আদায়
    12. মোহরের পরিমান
    13. অভিভাবকের অনুমতি
    14. বিয়ের খুতবা
    15. বিবাহের ওলীমা
    16. স্ত্রীর সংখ্যা নির্ধারণ
    17. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের দশজন স্ত্রী এক সাথে রাখা
    18. বর্তমানে মুসলিম সমাজে বিয়ে
      1. বিয়ে ও বর্তমান যুব সমাজের মনমানসিকতা
      2. বিয়ের অনুষ্ঠানাদিতে শরীয়তবিরোধী কার্যক্রম
      3. মোহরের পরিমাণ
      4. যৌতুকের প্রচলন
      5. একাধিক বিবাহ
  4. চতুর্থ অধ্যায় : পারিবারিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় – দাম্পত্য জীবন
    1. দাম্পত্য জীবনের অপরিহার্য দাবি
    2. নবদম্পতির দুটি জীবনের সার্থক সমন্বয় ও সমঝোতা সাধন
    3. পারিবারিক জীবনের সুষ্ঠু শৃংখলা বিধান
    4. পবিত্র যৌন জীবন
    5. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি
    6. জীবন যাপনের অপরিহার্য দাবি পূরণ
    7. পরিবারে দ্বীনী পরিবেশ সৃষ্টি করা
    8. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় ও অটুট রাখা
    9. সুখী দাম্পত্য জীবনের চাবিকাঠি
    10. দাম্পত্য জীবনের দাবিগুলোর যথাযথ ও সার্থক বাস্তবায়ন
    11. সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠা ও উদারতা প্রদর্শন
    12. ছোট-খাট জিনিস উপেক্ষা করা
    13. সকল পারিবারিক কাজ পরামর্শের ভিত্তিতে করা
    14. পরস্পর আপন হয়ে যাওয়া
    15. যৌন স্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে সম্পর্ক গভীর করা
    16. পারস্পারিক হাদিয়া-তোহফা প্রদান
  5. পঞ্চম অধ্যায় : স্বামীর অধিকার ও দায়িত্ব
    1. স্বামীর অধিকার
      1. পরিবার পরিচালনা ও কর্তৃত্বের অধিকার
      2. স্ত্রীর স্বাধীন চলাফেরায় বিধি-নিষেধ আরোপে স্বামীর অধিকার
      3. স্ত্রীর নফল এবাদতে বিধি-নিষেধ আরোপের অধিকার
      4. সম্ভাব্য সাহচর্য ও সার্বিক সহযোগিতা লাভের অধিকার
      5. স্ত্রীর সাজসজ্জা দেখার অধিকার একমাত্র স্বামীর
      6. স্বামীর গোপন বিষয়, আমানত ও ধন সম্পদ সংরক্ষণের অধিকার
      7. যৌন চাহিদা পূরণ ও পরিতৃপ্তি লাভের অধিকার
      8. অবাধ্য স্ত্রীকে শাসনের অধিকার
      9. তালাক প্রদানের অধিকার
    2. স্বামীর দায়িত্ব
      1. মোহর প্রদানের দায়িত্ব
      2. স্ত্রীকে খোরপোষ প্রদানের দায়িত্ব
      3. স্ত্রীর প্রতি সদ্ব্যবহার করার দায়িত্ব
      4. স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা, স্নেহ-মহব্বত ও দরদ রাখার দায়িত্ব
      5. স্ত্রীকে শিক্ষা দানের দায়িত্ব
      6. স্ত্রীকে সংশোধনের দায়িত্ব
      7. স্ত্রীকে দ্বীনমুখী করা ও দ্বীনী চেতনা সৃষ্টির দায়িত্ব
      8. স্ত্রীর যৌনতৃপ্তি দানে স্বামীর দায়িত্ব
      9. স্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া ও যথারীতি সমাদর করা
      10. নিয়ম মাফিক তালাক প্রদান এবং যথারীতি ভালভাবে বিদায় করা
      11. একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সমতা রক্ষা করা ও ইনসাফ কায়েম
  6. ষষ্ঠ অধ্যায় : স্ত্রীর অধিকার ও দায়িত্ব এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক
    1. স্ত্রীর অধিকার
      1. মোহর লাভের অধিকার
      2. খোরপোষের অধিকার
      3. স্বামীর কাছ থেকে সদ্ব্যবহার পাওয়ার অধিকার
      4. স্বামীর স্নেহ-ভালবাসা, আদর-সোহাগ পাওয়ার অধিকার
      5. যৌন তৃপ্তি লাভের অধিকার
      6. খোলা তালাকের অধিকার
    2. স্ত্রীর দায়িত্ব
      1. স্বামীর অনুগত থাকার দায়িত্ব
      2. স্বামীর গোপনীয় বিষয়সমূহ সংরক্ষণের দায়িত্ব
      3. স্বামীকে সংগদান এবং সর্বোতভাবে সম্ভাব্য সহযোগিতা প্রদান
      4. স্বামীকে প্রেম ও ভালাবাসা দিয়ে বিমুগ্ধ করার দায়িত্ব
      5. স্বামীকে যৌন তৃপ্তি দান
      6. স্বামীর বীর্য সংরক্ষণ, গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের দায়িত্ব
      7. সন্তানকে দুগ্ধদান ও সন্তান প্রতিপালন
      8. নিজের সতীত্ব সংরক্ষণের দায়িত্ব
      9. স্বামীর ধন-সম্পদ সংরক্ষণ
      10. পরিবারে দ্বীনী পরিবেশ সৃষ্টি ও পারিবারকে দ্বীনমুখী করা
      11. স্বামীর মান-সম্ভ্রম রক্ষার দায়িত্ব
      12. স্বামীর আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহার করা ও তাদের খোঁজ- খবর নেওয়া
    3. স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক
  7. সপ্তম অধ্যায় : দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নেমে আসে কেন?
    1. স্বামীর অপছন্দ হওয়া
    2. যৌতুক দাবী
    3. পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব মানার ক্ষেত্রে নারীর অবাধ্যতা
    4. স্ত্রীর প্রতি স্বামীর খারাপ ব্যবহার ও উপেক্ষা
    5. এক স্ত্রীর দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়া
    6. অধিকারে হস্তক্ষেপ অথবা দায়িত্ব পালনে অবহেলা
    7. স্বীয় অধিকারের বা সামর্থ্যের অতিরিক্ত দাবী
    8. যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থা
    9. সমন্বয় ও সমঝোতার অভাব
    10. একে অপরকে আপন করে নিতে না পারা
    11. ছোট-খাট জিনিস ধরা ও উদারতার অভাব
    12. ভুল বুঝা-বুঝি
    13. স্বামীর যথেচ্ছাচার ও মারধর
    14. যৌন চাহিদা পূরণে অসহযোগিতা
    15. সন্তান না হওয়া বা কেবলমাত্র মেয়ে সন্তান হওয়া
  8. অষ্টম অধ্যায় : বিবাহ বিচ্ছেদ ও তালাক
    1. তালাক প্রদানের অধিকার স্বামীর
    2. স্ত্রীর খোলা তালাক গ্রহণ
    3. স্বামীর তিন তালাক প্রদানের পর পুনরায় একত্র হওয়া
  9. নবম অধ্যায় : পারিবারিক জীবন : পর্দা ও যৌন পবিত্রতা
  10. দশম অধ্যায় : পারিবারিক জীবনে সন্তান ও সন্তান প্রতিপালন
    1. শিশু সন্তানের জন্ম আল্লাহর এক কুদরত
    2. সন্তানের কামনা
    3. পিতা-মাতার দায়িত্ব ও সন্তানের অধিকার
      1. মায়ের গর্ভে আসা
      2. গর্ভাবস্থায় মা’র সংযত চলাফেরা ও স্বাস্থ্যবিধি পালন
      3. যথাসময়ে নির্বিঘ্ন প্রসব ও দুনিয়ায় আগমন
      4. বুকের দুধ পান
      5. পিতা-মাতা কর্তৃক শরীয়তের কতিপয় বিধানের অনুসরণ
      6. স্নেহ-মায়া-মমতা ও দরদ লাভ
      7. উপার্জনক্ষম হওয়া পর্যন্ত ব্যয়ভার বহন
      8. সদাচরণ করা ও ইনসাফ কায়েম
      9. সন্তানকে যথার্থ শিক্ষাদান
      10. চরিত্র গঠন, নৈতিকতা শিক্ষাদান ও নামাযে অভ্যস্ত করে তোলা
      11. জীবনোদ্দেশ্য নির্ধারণ ও দ্বীন কায়েমের আন্দোলনে শরীক করে দেয়া
      12. বয়স হয়ে গেলে বিয়ে করানো
    4. কন্যা সন্তান প্রতিপালনের গুরুত্ব ও বরকত
    5. দুধমা ও দুধ ভাই- বোন
    6. সন্তান লালন পালনের স্বার্থে মা’র পরবর্তী বিয়ে না করা
    7. পোষ্য পুত্র
    8. সন্তান হত্যা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ
  11. একাদশ অধ্যায় : মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণ ও সন্তানের দায়িত্ব
    1. আল-কোরআনে বৃদ্ধ বয়সে মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ
    2. পিতা-মাতা অমুসলিম হলেও তাদের প্রতি যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে
    3. পিতা মাতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও সদাচরণ করা যাবে কিভাবে
    4. মায়ের হক পিতার হকের তিনগুণ
    5. মৃত্যুর পর পিতা-মাতার জন্য করণীয়
    6. পিতামাতার সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি সন্তানের জান্নাত ও জাহান্নামের কারণ
  12. দ্বাদশ অধ্যায় : নবী-রাসূলদের পারিবারিক জীবন
  13. ত্রয়োদশ অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের পারিবারিক জীবন
    1. প্রথম পর্যায়: জন্ম থেকে ২৫ বছরে বিয়ে পর্যন্ত
    2. দ্বিতীয় পর্যায় : বিয়ের পর থেকে মক্কায় থাকা পর্যন্ত
    3. তৃতীয় পর্যায়: হিজরতের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত
      1. সন্তান-সন্ততিদের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ-মমতা ও ভালবাসা
      2. সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে বিয়ে-সাদী
      3. স্ত্রীদের সাথে যথারীতি দাম্পত্য জীবন যাপন
      4. আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি ও তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে সম্প্রীতি বৃদ্ধি
  14. চতুর্দশ অধ্যায় : মুসলিম পরিবারে দ্বীনী পরিবেশ: আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার
    1. ভাল কাজ যা পরিবারের লোকেরা অংশগ্রহণ করে তা হলো
    2. মন্দকাজ যা এ পরিবারের লোকেরা পরিহার করে চলে তা হলো
    3. পারিবারিক আদব কায়দা
    4. ইসলামী সভ্যতার দাবী
    5. একে অপরে পারিবারিক সহযোগিতা প্রদান
    6. পারিবারিক শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও বৈঠক
  15. পঞ্চদশ অধ্যায় : পারিবারিক জীবনে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ভোগ-বিলাস ও ধন-সম্পদ আহরণ
    1. পারিবারিক জীবন ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্য
    2. পারিবারিক জীবন ও ভোগ বিলাস
    3. পারিবারিক জীবন ও ধন-সম্পদ
  16. ষষ্ঠদশ অধ্যায় : পারিবারিক জীবনের শেষ অধ্যায়
    1. মৃত্যু ও মৃত্যুর পূর্বে আখেরাতের প্রস্তুতি
    2. আখেরাতের প্রস্তুতি: করণীয়
  17. সপ্তদশ অধ্যায় : পারিবারিক জীবন : শেষ পরিণতির দিকে মহাযাত্রা
    1. মৃত্যু ও তার পরবর্তী অবস্থা, বরজখ, কেয়ামত ও হাশর
    2. কবর বা বরযখের জীবন
    3. কেয়ামত
    4. পুনরুত্থান ও হাশর
    5. আখেরাতে আত্মীয় ও পারিবারিক সম্পর্ক কোন উপকারে আসবে না
  18. অষ্টাদশ অধ্যায় : পারিবারিক জীবনের শেষ পরিণতি জাহান্নাম অথবা জান্নাত
    1. পরিবারের লোকদের সকলে মিলে একত্রে বেহেশতে গমন

প্রথম অধ্যায় : পারিবারিক জীবনের অপরিহার্যতা ও গুরুত্ব

এ দুনিয়ায় মানুষের জীবনের সূচনা তার জন্মের মাধ্যমে এবং জীবনের ইতি আসে মৃত্যুর হীম-শীতল স্পর্শে। জন্ম-মৃত্যুর মধ্যবর্তী এই সময়টুকু মানুষের জীবন। এ জীবনটা সে একাকী কাটাতে পারে না। তার জন্মও কোন একক ভূমিকার ফসল নয় বরং একজন নারী ও একজন পুরুষের সক্রিয় মেলামেশা ও যৌনমিলনের ফলেই হয় তার জন্ম। তাই তার জন্মের পর তার পিতা-মাতা, ভাই-বোন বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই সে বেড়ে উঠে।

একজন মুসলমানও এ স্বাভাবিক নিয়ম পদ্ধতিতেই দুনিয়ায় আগমন করে এবং স্বাভাবিকভাবেই পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বেড়ে উঠে। তাই একজন মুসলমানের জন্য পারিবারিক জীবন তার অস্তিত্বের জন্যই অপরিহার্য। পরিবার না থাকলে তার জন্ম হতো না।

এ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য যে আদিকাল থেকেই পৃথিবীতে কোন না কোনভাবে পারিবারিক ব্যবস্থা চালু ছিল। অতীতের সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবনে ও সময়কালে পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম আরবের বুকে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করার সময়ও সমাজে পরিবার প্রথা চালু ছিল। অবশ্য ইসলাম এসে তাতে সংস্কার সাধন করেছে। তাই মানুষ হিসাবে একজন মুসলমানের পারিবারিক জীবন অপরিহার্য।

আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়াকে সৃষ্টির পর বেহেশতে থাকতে বলেছিলেনঃ

وَيَادَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا

“হে আদম তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখান থেকে ইচ্ছা খাওয়া-দাওয়া কর।” (সূরা আরাফ: ১৯)

এখানে পারিবারিক জীবনের ধারণাই স্পষ্ট হয়ে উঠে। স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসবাস ও জীবন ধারণই পারিবারিক জীবনের প্রাথমিক কাজ।

কোরআনে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেনঃ
وَاللهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ بُيُوتِكُمْ سَكَنَا

“আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের বাড়ী-ঘরে নিশ্চিন্তে নিরাপদে বসবাসের শান্তিপূর্ণ আবাসস্থল বানিয়ে দিয়েছেন।” (সূরা আন নহল-৮০)

অর্থাৎ আল্লাহ চান মানুষ তার বাড়ীতে তার পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে বসাবাস করুক। এমনকি سَكَن শব্দের ভেতর আরাম-আয়েশ করুক – এ ধারণাও রয়েছে।

তাই আল্লাহর ইচ্ছামত (মুসলিম) জনগোষ্ঠী পারিবারিক জীবন যাপন করবে -এ এক অপরিহার্য প্রয়োজন।

বংশীয় ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য যেমন যৌন মিলন প্রয়োজন, মানুষের মানসিক প্রশান্তি আনয়নের জন্যও তেমন দরকার হয়ে পড়ে যৌন মিলনের। তাই মানব জীবনে যৌন মিলন এক অপরিহার্য প্রয়োজন। এই যৌন মিলনের বৈধ ব্যবস্থা না থাকলে সমাজে বিশৃংখলা ও অরাজকতা হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই সামাজিক শৃংখলা বিধান ও অরাজকতা বন্ধ করে সমাজে শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখতে হলে বৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সে কারণেই সমাজ জীবনে বৈধ বিয়ের প্রচলন ও পারিবারিক ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। তাই একজন মুসলমানের জীবনে বৈধ বিয়ের মাধ্যমে পারিবারিক জীবন যাপনের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

এভাবে মুসলিম সমাজ জীবনে গড়ে উঠেছে পবিত্র পারিবারিক ব্যবস্থা। মুসলিম জীবনে পতনের বহু কিছু লক্ষণ দেখা গেলেও পারিবারিক কাঠামো আজো ভেঙ্গে পড়েনি। অবশ্য হালে কিছু কিছু এনজিও অথবা ব্যক্তি বিশেষ কিছু ব্যতিক্রমধর্মী কর্মকাণ্ডের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। মুসলিম সমাজকে এ ব্যপারে হুঁশিয়ার ও সাবধান থাকতে হবে এবং পারিবারিক জীবনের এ অপরিহার্য দিকটি বহাল রাখার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা করে যেতে হবে।

প্রাচীনকালে পারিবারিক জীবন অপরিহার্য ছিল প্রধানতঃ দু’টি কারণেঃ
(১) নিরাপত্তা লাভ ও (২) অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণের জন্য।

পারিবারিক জীবনের অপরিহার্যতা এ থেকেও পরিষ্কার হয় যে ব্যক্তির জন্মের পরই তার জীবনে প্রয়োজন নিরাপত্তার। অথচ জন্মের পরপরই মানক শিশু নিজ নিরাপত্তা বিধানে একেবারেই অক্ষম। পরিবারই তার নিরাপত্তা বিধানের দায়-দায়িত্ব পালন করে থাকে। এ ছাড়া মানব শিশুর অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণেও পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হয়। তাই দেখা যায়, মানব শিশু প্রতিপালনে পিতা-মাতা দু’জনকেই নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে হয়। মায়ের ব্যাপারে কোরআন বলেঃ

وَالْوَالِدتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادُهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ

“মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দুই বছর দুধপান করাবে।”
(সূরা বাকারা: ২৩৩)

আবার পিতার ব্যাপারে কোরআন বলেঃ

وَعَلَى المَوْلُودِلَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُنَّ بِالْمَعْرُوفِ

“আর পিতার দায়িত্ব হলো তাদের (মায়েদের) ন্যায়সংগতভাবে খাওয়া পরার ব্যবস্থা করা।” (সূরা বাকারা: ২৩৩)

তাই নিরাপত্তা ও অথনৈতিক প্রয়োজন পূরণের জন্য পারিবারিক জীবন অপরিহার্য এবং তা যেমন ছিল প্রাচীনকালে, বর্তমান সময়েও তা সেরূপই অপরিহার্য রয়ে গেছে।

পারিবারিক জীবন আরো একটি দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো ব্যক্তির যৌন জীবনের পবিত্রতা সংরক্ষণ। ইসলামে যৌন জীবনের জন্য কেবলমাত্র শরীয়ত মোতাবেক বিয়ের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন নারীর যৌন সম্পর্ক স্থাপনই বৈধ রয়েছে। পারিবারিক জীবন যাপনের মাধ্যমেই তা বহাল রাখা সম্ভব। পারিবারিক জীবন বর্তমান না থাকলে এভাবে যৌন পবিত্রতা বহাল রাখা সম্ভব নয়। সমাজে নৈতিকতার বন্ধন টিকিয়ে রাখতে হলে তাই পারিবারিক ব্যবস্থা ভিন্ন কোন বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে না। পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রী সন্তানাদি নিয়ে বসবাস করা হয়, ফলে যৌন সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই বহাল থাকে। পারিবারিক ব্যবস্থা না থাকলে মানুষের স্বাভাবিক যৌন প্রয়োজন পূরণে বহুগামী হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকার কথা নয়। প্লেটোর মত দার্শনিক বা কমিউনিজমের মত আর্দশ, পারিবারিক ব্যবস্থার বিকল্প সমাজের জন্য প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন কিন্তু তা দুনিয়াতে চালু হয় নি। কাজেই আজ গোটা পৃথিবীতেই ত্রুটি-বিচ্যুতি যাই থাক না কেন, পারিবারিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এতেই পারিবারিক জীবনের অপরিহার্যতা ও গুরুত্ব পরিষ্কার হয়ে উঠে।

পরিবারের সংজ্ঞা ও বংশীয় ধারা পরিক্রমা

বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ একজোড়া নারী-পুরুষ তাদের সন্তান-সন্ততিসহ বসবাসকেই পারিবারিক জীবন বলা হয়। স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির সমষ্টিই পরিবার।

বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশে যৌথ পরিবার ও একক পরিবার এই দু’ধরনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যৌথ পরিবারে পিতা-মাতা, তাদের সন্তানদের বিশেষ করে তাদের ছেলেদের সন্তানাদি অর্থাৎ নাতি-নাতনী, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের মেয়ে- জামাই ও তাদের সন্তানাদিসহ বিরাট পারিবারিক ব্যবস্থা চালু থাকে। এক পরিবারভুক্ত না থেকেও মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনীসহ এক পরিবারের ধারণা দেখা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের জীবনে।

হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম একবার তার মেয়ে ফাতেমা (রাঃ), তার স্বামী হযরত আলী (রাঃ) ও হাসান হোসাইনকে এক চাদরের নিচে রেখে আল্লাহ নিকট দোয়া করলেন যে, হে আল্লাহ এরা তো আমার আহলে বাইত।

মোটকথা স্বামী-স্ত্রী ও তাদের সন্তান-সন্ততি মিলে এক পরিবার যা একক পরিবার; আর একই বাবা-মা থেকে উদ্ভূত গোটা কয়েক পরিবার একত্রে বসবাস করলে তা যৌথ পরিবার। ইসলাম অবশ্য একক পরিবারের ধারণাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী তার “কোরআন-হাদীসের আলোকে পারিবারিক জীবন” বইটিতে এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, ছেলে-মেয়েদের বিয়ের পর তাদেরকে পৃথক করে দিতে হবে। তারা আলাদা পরিবার গড়ে আলাদাভাবে পারিবারিক জীবন শুরু করবে। তিনি এ অভিমতও ব্যক্ত করেছেন যে, পিতা-মাতার সেবা, খেদমত ও দেখাশুনা করার দায়িত্ব সন্তানের, স্ত্রীর নয়। অবশ্য আমাদের সমাজে সামাজিকভাবে ছেলে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার পরই তাকে পৃথক করে দেয়াকে ভাল চোখে দেখা হয় না। সে ক্ষেত্রে ছেলের বউ যদি শ্বশুর-শাশুড়ী নিয়ে এক পরিবারে থাকাকে পছন্দ করে তবে তা হয়ত করা যেতে পারে কিন্তু যখনই বুঝা যাবে যে ছেলের বউ পৃথক হওয়াকে পছন্দ করছে, তখন সে ব্যবস্থাই গ্রহণ করা দরকার।

মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর মতে স্ত্রীর জন্য আলাদা ঘর ওস্তার খোরপোষের ব্যবস্থা করা স্বামীর উপর স্ত্রীর হক এবং এ হকের দাবী পূরণ করা ওয়াজেব। এ ক্ষেত্রে পিতা-মাতা স্ত্রীকে আলাদা করে রাখতে আপত্তি করলেও বা মত না দিলেও তা করা উচিৎ, ওয়াজিব আদায়ের জন্য। দলীল হিসাবে তিনি –

لا طَاعَةَ لِمَخْلُوقِ فِي مَعْصِيَةُ الْخَالِقِ

“স্রষ্টার নাফরমানী করে সৃষ্টির আনুগত্য করা যায় না।” -এ হাদীস উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেছেন পারিবারিক জীবনের উদ্দেশ্য হল প্রশান্তিময় জীবন যাপন। যে কথা বলা হয়েছে কোরআন পাকে এভাবেঃ

وَمِنْ أَيْتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَ رَحْمَةً

“এবং তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে তিনি তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের সাথে শান্তিতে বসবাস কর এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও মেহেরবানী সৃষ্টি করে দিয়েছেন।” (সূরা রূম: ২১)

তাই স্ত্রী গ্রহণের উদ্দেশ্য হলো পারিবারিক শান্তি লাভ। পিতা-মাতার খেদমত করা, পারিবারিক কাজ-কর্ম করা এসব এর উদ্দেশ্য নয়। স্বামী-স্ত্রীর প্রধান সম্পর্ক হবে পবিত্র দাম্পত্য জীবন যাপন, যাতে শান্তি ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়। অবশ্য স্ত্রী যদি সমঝদার ও বিনয়ী হয় তবে তার শ্বশুর-শাশুড়ীর খেদমত করতে আপত্তি থাকার কথা নয়। তা ছাড়া সাংসারিক কাজ-কর্ম করা এটাও অভ্যন্তরীণ দায়িত্ব হিসাবে পালন করতে পারে। এটাও পারিবারিক শান্তির অন্যতম কারণ হতে পারে, কেননা প্রত্যেক স্বামীর পক্ষেই কাজের লোক রেখে পাক-শাক করানো ও পারিবারিক অন্যান্য কাজ আঞ্জাম দেয়া সম্ভব নয়। তাই পারিবারিক শান্তির প্রয়োজনেই এসব কাজে স্ত্রীকে ব্যবহার করা যেতে পারে। অবশ্য যদি এসব কাজ পারিবারিক শান্তির ব্যাঘাত সৃষ্টি করে তাহলে স্ত্রীকে আলাদাভাবে রাখারই ব্যবস্থা করতে হবে স্বামীকে।

একক পরিবার ও যৌথ পরিবার

যৌথ পরিবারের যেমন কতক ফায়দা রয়েছে, তেমনি রয়েছে কতক অসুবিধা। যৌথ পরিবারের ফায়দাগুলো হলোঃ

(১) কোন স্বামীর আয় সীমিত হলে যৌথ পরিবারে যেহেতু সকলের আয় একত্রিত হয়, আবার খরচও হয় কম, তাই সেক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর খরচ চালানোর একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতে পারে।
(২) পিতা-মাতা যদি বৃদ্ধ হয়ে থাকেন বা কাজ-কর্ম করতে অক্ষম হন তাহলে যৌথ পরিবারে তাদের ব্যবস্থা সহজ হতে পারে।
(৩) যথাযথ সমন্বয় ও মিলমিশ থাকলে যৌথ পরিবারে শান্তি বজায় থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে যৌথ পরিবার কোন সমস্যা নয়। বরং বিয়ের পর ছেলে ও ছেলের বউ সুখে শান্তিতেই বসবাস করতে পারে।

আবার যৌথ পরিবারে নিম্নলিখিত কারণে অশান্তিও হতে পারেঃ
(১) আয়ের তারতম্যের কারণে পারিবারিক হিংসা-বিদ্বেষ, রেষারেষি সৃষ্টি হতে পারে। একত্রে থেকেও আলাদা আলাদাভাবে আয় করার এবং টাকা পয়সা জমানোর প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে।
(২) পরিবারের অভ্যন্তরীণ কাজ-কর্মে ঠেলাঠেলি ও বিশৃংখলার সৃষ্টি হতে পারে। এতে করে শুরু হয়ে যায় অনবরত ঝগড়া-ঝাটি, যা অশান্তির কারণ হতে পারে।
(৩) থাকার ঘরের অসুবিধা থাকতে পারে। যাতে নববধূর স্বাতন্ত্র্য ও গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে।

এসব কারণে স্ত্রী যদি খুবই সহনশীল না হয় তবে একত্রে চলা হয়ে উঠতে পারে খুবই কঠিন। সেক্ষেত্রে যৌথ পরিবার হয়ে উঠবে অচল। তখন স্বামীর আলাদা ব্যবস্থাই শান্তির পথ হতে পারে। অবশ্য বর্তমান সময়ে চাকুরী-বাকুরী ও অন্যান্য কারণে একত্রে না থেকে দূরে অবস্থানের কারণে পৃথক ব্যবস্থাও হয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে একক পরিবারই চালু হয়ে যায়।

মোটকথা স্রষ্টা মানুষকে স্বাভাবিক জীবনধারা পরিচালনায় পারিবারিক জীবন যাপনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এ জন্যই প্রথম মানুষ হযরত আদম (আঃ) এর সৃষ্টির পর তার জুড়ি হিসাবে বিবি হাওয়াকে সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন মহান আল্লাহ।

কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
جَعَلَ لَكُمْ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَمِنَ الْأَنْعَامِ أَزْوَاجًا يَدْرَؤُكُمْ فِيهِ

“তিনি তোমাদের স্বজাতীয়দের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য জুড়ি বানিয়েছেন এবং অনুরূপভাবে জন্তু-জানোয়ারদের মধ্যেও তাদেরই স্বজাতীয় জুড়ি বানিয়েছেন এবং এভাবেই তোমাদের বংশ বৃদ্ধি ও বিস্তার করেন।” (সূরা শুরা : ১১)

উপরের আয়াত থেকে জুড়ি সৃষ্টির মাধ্যমে পারিবারিক জীবনযাপনের ব্যবস্থার কথা আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিলেন এবং এও বলে দিলেন যে, এ পারিবারিক ব্যবস্থা হলো বংশবৃদ্ধি ও বিস্তারের মাধ্যম। প্রকৃতপক্ষে স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে পারিবারিক ব্যবস্থার কারণেই দুনিয়াতে বংশীয় ও গোত্রীয় ধারা পরিক্রমা সৃষ্টি হয়েছে। অতীতকালে তো এক পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অবর্তমানে গোত্রীয় ব্যবস্থা চালু ছিল। গোত্রীয় শাসন-শৃংখলা, গোত্রীয় আধিপত্য ও প্রাধান্য বিস্তার, গোত্রীয় মাহাত্ম্য বর্ণনা এইসব রীতি-প্রথা চালু ছিল। পরিচয়ের প্রধান বাহনই ছিল গোত্র ও বংশ। কোরআনেও একথা বলা হয়েছে:

وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ بَشَرًا فَجَعَلَهُ نَسَبًا وَصِهْرًا

“তিনিই আল্লাহ যিনি পানির উপাদান দিয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। পরে মানুষকে বংশ ও শ্বশুর-জামাতা সম্পর্ক বানিয়ে দিয়েছেন।” (সূরা আল ফোরকান: ৫৪)

يأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنثَى وَجَعَلْنَكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا

“হে মানুষ, নিঃসন্দেহে আমরা তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা পরিচিতি লাভ করতে পার।” (সূরা আল হুজুরাত : ১৩)

হযরত আদম (আঃ) এর পর পারিবারিক জীবন যাপন থেকে বংশীয় ধারা পরিক্রমা চালু হয়েছে এবং মানুষ দুনিয়ার আনাচে কানাচে পৌঁছে গেছে। এ বংশীয় ধারা থেকে কখনও কখনও চালু হয়েছে গোত্রবাদ, গোত্রীয় শাসন, গোত্রীয় জোট, গোত্রে গোত্রে বিবাদ-বিসম্বাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ। রাসূলের জন্মকালে আরবের বুকে এ ধরনের গোত্রে গোত্রে শত বছর পর্যন্ত লড়াই চলত।

এ বংশীয় ধারা ও গোত্রবাদের সূচনা হয় এক পরিবার থেকে। বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে কিন্তু গোত্রীয় শাসনের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ অবশ্য হয়ে যায়নি। স্বল্প পরিসরে এখনও কোথাও কোথাও গোত্রীয় শাসন চলে। এখনও পরিবারের সমষ্টিই রাষ্ট্র। তাই পারিবারিক জীবনকে অস্বীকার করা বর্তমান যুগেও সম্ভব নয়, স্বাভাবিকও নয়। আজও পরিবারই সন্তানের লালন-পালন ক্ষেত্রে প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র, নীতি-নৈতিকতা শিক্ষার প্রথম সোপান। সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব আজও পরিবারকেই বহন করতে হয়। তাই সমাজ জীবনে পরিবার ও পারিবারিক জীবন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।

পরিবারের ধারণা ও আল কোরআন

পবিত্র আল-কোরআনে পরিবারের ধারণা পেশ করা হয়েছে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন আয়াতে। মানব সৃষ্টির ইতিহাস প্রসংগে আলোচনা করে হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়াকে পৃথিবীতে প্রেরণ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তাতে দেখা যায়ঃ

وَقُلْنَا اهْبِطُوا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ ، وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلى حِيْنِ – فَتَلَقَّى آدَمُ مِنْ رَبِّهِ كَلِمَةٍ فَتَابَ عَلَيْهِ ، إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا * فَإِمَّا يَاتِيَنَّكُمْ مِّنِي هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ – وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِأَيْتِنَا أُولَئِكَ أَصْحُبُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَلِدُونَ

“আমরা বললাম, তোমরা (পৃথিবীতে) নেমে যাও, তোমরা এক অপরের শত্রু এবং পৃথিবীতে রয়েছে তোমাদের জন্য বসবাসের জায়গা জমি এবং একটি নির্দিষ্ট কালের জন্য সহায় সম্পদ। অতঃপর আদম (আঃ) তার রবের নিকট থেকে কতিপয় বাক্য শিখে নিলেন (মাগফেরাতের দোয়া), তখন তিনি তার তাওবা কবুল করে নিলেন, নিশ্চয়ই তিনি তাওবা কবুলকারী ও দয়ালু। আমরা বললাম তোমরা সকলে (পৃথিবীতে) নেমে যাও, অতঃপর যখন আমাদের নিকট থেকে কোন হেদায়াত আসবে তখন যারাই আমার হেদায়াত অনুসরণ করবে তাদের থাকবে না কোন ভয়-ভীতি এবং কোন প্রকার দুশ্চিন্তা এবং যারাই অস্বীকার করবে এবং কোন প্রকার আয়াতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে তারা হবে দোজখের অধিবাসী এবং সেখানে থাকবে তারা চিরকাল।” (সূরা বাকারা: ৩৬-৩৯)

এ আয়াতগুলো থেকে আমরা যে শিক্ষা লাভ করতে পারি তা হলোঃ
(১) দুনিয়াতে মানুষ শয়তানকে পরস্পরের শত্রু করে পাঠানো হয়েছে।
(২) মানুষ হিসাবে একজন পুরুষ একজন নারীকে (আদম-হাওয়াকে) দুনিয়াতে পাঠানো হল।
(৩) দুনিয়াতে মানুষের জন্য রয়েছে বসবাসের জায়গা-জমি ও কিছু সহায় সম্পদ।
(৪) দুনিয়ার জীবন নির্দিষ্ট সময় কালের জন্য; অতএব এখান থেকে বিদায় নিতে হবে।
(৫) হযরত আদম (আঃ) কে তার রব কিছু জিনিষ (মাগফেরাতের দোয়া) শিখিয়ে দিলেন অর্থাৎ মানুষের প্রকৃত ও আসল শিক্ষক আল্লাহ তায়ালা।
(৬) হযরত আদম (আঃ) তার কৃত ভুলের জন্য মাফ চেয়ে তাওবা করলে আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করলেন, আল্লাহ তায়ালা তাওবা কবুলকারী ও দয়ালু। তিনি এমন দয়ালু যে নিজে তাওবা শিখিয়ে দিয়ে তা কবুল করে নিলেন।
(৭) মানুষের নিকট এ হেদায়াতের ধারা আসতে থাকলে, যারা তা মেনে নেবে ও তা অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয়-ভীতি ও দুশ্চিন্তা থাকবে না।
(৮) যারা এ হেদায়াতকে অস্বীকার করবে এবং তাকে মিথ্যা মনে করবে তারা চিরকালের জন্য দোজখের অধিবাসী হবে- শয়তানের ফাঁদে পা দেয়ার কারণেই তাদের এ পরিণতি হবে।

মোটকথা কোরআনের এ আয়াতগুলো থেকে আমরা এ শিক্ষা লাভ করতে পারি যে, দুনিয়াতে নির্ধারিত সময়ের জন্য যে মানুষের আগমন, এ নির্ধারিত সময়ে সে আল্লাহর শিক্ষা ও হেদায়াত অনুযায়ী বসবাস ও সম্পদ আহরণ করবে এবং শয়তানের সকল প্রকার ধোঁকাবাজী, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা ও কুমন্ত্রণা থেকে আত্মরক্ষা করবে। ভুলক্রমে কোন প্রতারণায় পড়ে গেলে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তাওবা করবে।

আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতির প্রতি শিক্ষা ও হেদায়াতের সর্বশেষ গ্রন্থ আল-কোরআন। এ গ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা হেদায়াতের কথা পুনরাবৃত্তি করে বলেছেনঃ

رَبُّنَا الَّذِى اعطى كُلِّ شَيْءٍ خَلَقَهُ ثُمَّ هَدَى –

“আমাদের রব তিনিই যিনি প্রত্যেকটি জিনিষ সৃষ্টিরূপে প্রদান করেছেন অতঃপর দান করেছেন হেদায়াত (পথ নির্দেশনা)।” (সূরা ত্বাহা : ৫০)

এ কারণেই দুনিয়াতে মানুষের অবস্থা কি হয় কোরআনে বর্ণনা এসেছে এভাবেঃ

وَنَفْسٍ وَمَا سَوهَا فَالْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقُوهَا قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زيْتُهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَشْهَا –

“শপথ নফসের এবং যে তাকে সুন্দর সুঠাম করে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাতে প্রবিষ্ট করেছেন তার দুষ্কর্ম এবং তাকওয়া, নিশ্চয়ই সফলকাম হয়েছে ঐ ব্যক্তি যে তাকে করেছে পবিত্র এবং নিশ্চয়ই সে ব্যর্থ যে তাকে পাপে মিশিয়ে ফেলেছে।” (সূরা আশ শামছঃ ৭-১০)

অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে দুটি প্রবণতা – সৎ প্রবণতা ও অসৎ প্রবণতা। সৎ প্রবণতা মানুষকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করে আর অসৎ প্রবণতা মানুষকে গোমরাহীর পথে নিয়ে যায়।

এ দু’প্রবণতা নিয়েই হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়ার পারিবারিক জীবন শুরু হয় এ দুনিয়াতে। অতঃপর কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী:

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ الَيْهَا ، فَلَمَّا تَعْشُهَا حَمَلَتْ حَمْلاً خَفِيفًا فَمَرَّتْ بِهِ جِ فَلَمَّا أَثْقَلَتْ دعوا اللهَ رَبَّهُمَا لَئِنْ أَتَيْتَنَا صَالِحَالَنَكُونَنَّ مِنَ الشَّكِرِينَ ج

“তিনি সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন, পরে তার জুড়ি সৃষ্টি করেছেন যেন তার সাথে জীবন যাপন করতে পারে। অতঃপর যখন স্বামী তার স্ত্রীকে জাপটিয়ে ধরল তখন স্ত্রী হালকাভাবে গর্ভধারণ করল ও সে চলাচল করতে লাগল, এরপর যখন গর্ভ ভারী হল, তারা তাদের রবকে ডেকে বললঃ আমাদেরকে নেক সন্তান দান করুন, আমরা হব শোকরগোজার।” (সূরা আ’রাফ: ১৮৯-১৯০)

এভাবে আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়ার সন্তানাদি হল এবং কালক্রমে গোটা দুনিয়া জনমানুষে ভরে গেল। কোরআন ঘোষণা করে:

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّنْ نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً .

“হে মানব সকল, ভয় করো তোমাদের সেই রবকে যিনি তোমাদেরকে একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জুড়ি এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু সংখ্যক পুরুষ ও নারী।” (সূরা নিসাঃ ১)

এভাবেই নারী-পুরুষ সৃষ্টি ও তাদের জোড়ায় বসবাসকে আল্লাহর এক নিদর্শন রূপে বলা হয়েছে কোরআনে পাকে।

وَمِنْ أَيْتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا

“তার নিদর্শনের মধ্যে একটি হলো এই যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নিজেদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করে দিয়েছেন।” (সূরা রূম: ২১)

এ এক উত্তম নিদর্শন বরং চরম বিস্ময়ের ব্যাপার যে যুগ যুগ ধরে দুনিয়াতে মানুষের জন্ম হচ্ছে কিন্তু নারী-পুরুষের মধ্যে ভারসাম্যের কোন তারতম্য দেখা যায়নি। কোন কোন দেশে যুদ্ধের ফলে পুরুষের অধিক মৃত্যুর কারণে কিছুটা বিভ্রাট হয়ত হয়েছে কিন্তু জন্মগতভাবে তেমন কোন তারতম্য হয় নি। এক মহাশক্তির (আল্লাহর) নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কিভাবে এটা সম্ভব ভাবতেও অবাক লাগে। এই অগণিত নারী-পুরুষ স্বামী-স্ত্রীরূপে জোড়ায় জোড়ায় বসবাস করবে এটাই আল্লাহর ইচ্ছা ও বিধান। তাই এভাবে গড়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী পারিবারিক ব্যবস্থা।

আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির সকল কিছুর মধ্যে স্বাভাবিক ও ধারাবাহিক সৃষ্টি ধারা চালু রাখার জন্য দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিষের জোড়া সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَمِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ –

“এবং প্রত্যেকটি জিনিষকেই আমরা জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি যেন তোমরা স্মরণ করতে পার।” (সূরা যারিয়াত: ৪৯)

এভাবে মানুষের জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান পারিবারিক ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এতে করে পারিবারিকভাবে এক সাথে বসবাস, পারস্পরিক স্নেহ-মমতা-ভালবাসা, সমন্বয়-সমঝোতার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে শান্তি ও শৃংখলা, তমুদ্দুন ও সংস্কৃতি। পারিবারিক জীবন যাপনের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে সন্তান-সন্ততি। পরিবার আত্মনিয়োগ করেছে সন্তান-সন্ততি প্রতিপালনে, তাদের শিক্ষা-দীক্ষায়, তাদের জীবন গড়ে তোলায়।

আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আঃ)কে সৃষ্টি করে তার সংগিনী হিসাবেই বিবি হাওয়াকে সৃষ্টি করেছিলেন এবং একত্রে অর্থাৎ পারিবারিকভাবেই বেহেশতে থাকতে দিয়েছিলেন। যে কথা আল কোরআনে বলা হয়েছে এভাবে:

وَيَا دَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلًّا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا

“হে আদম তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে একত্রে বসবাস কর এবং তোমরা দু’জনেই যেখান থেকে ইচ্ছা অবাধে খাওয়া দাওয়া কর।” (সূরা আ’রাফ: ১৯)

দ্বিতীয় অধ্যায় : নারী পুরুষের সম্পর্ক ও অবস্থান

পারিবারিক জীবন-যাপন মোটামোটিভাবে দুনিয়ার সকল দেশ ও জাতিতেই প্রচলিত। কমিউনিজমের মূল প্রবক্তা ও থিউরী প্রবর্তক কার্ল মার্কস পরিবার প্রথা ভেঙ্গে দিয়ে সমাজে বাছাই করা নারী-পুরুষের মিলনের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদন করে রাষ্ট্রীয় দেখাশুনায় প্রতিপালনের প্রেসক্রিপশন প্রদান করেছিলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয় নি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও। সমাজতান্ত্রিক ও পাশ্চাত্য দেশগুলোতেও এখন পর্যন্ত পারিবারিক প্রথা চালু রয়েছে। অবশ্য সে সব দেশে পারিবারিক জীবনের পবিত্রতা ও মাধুর্য বহাল নেই। স্বামী-স্ত্রীর যৌন সম্পর্কে ফাটল ধরেছে, তালাকের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে, সন্তান প্রতিপালনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে, পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও দায়িত্ব গেছে কমে। প্রকৃতপক্ষে সে সব সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্কেই রয়েছে নাজুকতা ও দুর্বলতা। মানব জীবনের দৃষ্টিভঙ্গিই সেখানে ভিন্ন। বিষয়টি তাদের ধর্মীয় শিক্ষা ও সামাজিক ধ্যান-ধারণা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম ও দেশের নারী-ধারণা থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। এ পর্যায়ে ইহুদী ও খ্রিস্টীয় ধর্মমত এবং ভারত, প্রাচীন আরব ও প্রাচীন সভ্যদেশ এথেন্স তথা গ্রীকদের মন-মানসিকতা ও ধ্যান-ধারণা আলোচনা করব।

ইহুদী ধর্মমতে নারী

নারীদের ব্যাপারে ইহুদী ধর্মমত খুবই জঘন্য ধারণা পোষণ করে। ইহুদী ধর্মপুস্তকের বর্ণনামতে তারা দৃঢ় বিশ্বাস করে যে, বেহেশত থেকে মানুষের দুনিয়ায় পতনের ব্যাপারে শয়তানের পরামর্শ গ্রহণ করে বিবি হাওয়াই হযরত আদম (আঃ)-কে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণে প্রলুব্ধ করেছিল। এ ব্যাপারে নারী জাতির প্রতিভূ বিবি হাওয়াই একক ভাবে দোষী। ওল্ড টেস্টামেন্ট-এ (আদি পুস্ত কে) বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে এভাবেঃ

“তখন সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে ডাকিয়া কহিলেন, তুমি কোথায়? তিনি কহিলেন, আমি উদ্যানে, তোমার রব শুনিয়া ভীত হইলাম। কারণ, আমি উলঙ্গ, তাহা তোমাকে কে বলিল? যে বৃক্ষের ফল ভোজন করিতে তোমাকে নিষেধ করিয়াছিলাম, তুমি কি তাহার ফল ভোজন করিয়াছ? তাহাতে আদম কহিলেন, তুমি আমার সংগিনী করিয়া যে স্ত্রী দিয়াছ, সে আমাকে সে বৃক্ষের ফল দিয়াছিলেন, তাই খাইয়াছি। তখন সদাপ্রভু ঈশ্বর নারীকে কহিলেন, তুমি এ কী করিলে? নারী কহিলেন, সর্প আমাকে ভুলাইয়াছিল, তাই খাইয়াছি।”

(আদি পুস্তকঃ মানব জাতির পতন ১০-১১ ক্ষেত্রে)

এর অর্থ মানব জাতির বেহেশত হতে দুনিয়ায় পতনের মূল কারণ নারী, আদমের স্ত্রী হাওয়া। তাই সে সমাজে নারী জাতীয় অভিশাপ, ধ্বংস ও পতনের কারণ, চির লাঞ্ছিতা। এ জন্যই ইহুদী জাতি নারীকে পুরুষের প্রতারক রূপে অভিহিত করে তাকে দাসী বা চাকরানীর অধিক মর্যাদা দান করতে রাজী নয়। সে সমাজে পিতার কোন পুত্র থাকলে তার সম্পত্তিতে কন্যা ওয়ারিশ হতনা বরং পিতা কন্যাকে নগদ মূল্যে বিক্রি করে ফেলতে পারত। সে সমাজে মেয়েদের এমন অপমানজনক অবস্থা হয়েছিল যে, মদীনার এক ইহুদী বাদশাহ আইন জারী করেছিলেন যে, যে মেয়েকেই বিয়ে দেয়া হবে, স্বামীর ঘরে যাওয়ার আগে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে বাদশাহর সাথে একরাত্রি যাপন করতে হবে।

খ্রিস্টীয় ধর্মমতে নারী

খ্রিষ্টীয় ধর্মমতেও নারীকে চরম লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। জনৈক পাদ্রীর মতে নারী হচ্ছে শয়তানের প্রবেশস্থল। তারা আল্লাহর মান মর্যাদার প্রতিবন্ধক, তারা মানুষের জন্য বিপজ্জনক। নারী কি শুধু দেহ সর্বস্ব, না তার প্রাণ বলতে কিছু আছে- এ প্রশ্নের মীমাংসার জন্য পঞ্চম খ্রিস্টাব্দে বড় বড় খ্রিস্টান পাদ্রীদের এক কনফারেন্স হয়েছিল। তাদের সমাজের ধারণা নারী হচ্ছে পুরুষের মনে লালসা উদ্রেককারী, ঘরে ও সমাজে যত অশান্তির সৃষ্টি হয়, সব তারই কারণে। ইংল্যান্ডে ১৮০৫ সাল পর্যন্ত স্ত্রীকে বিক্রি করা পুরুষের জন্য আইন সিদ্ধ ছিল।

৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সে এক সম্মেলনে নারী জন্তু না মানুষ- এ ব্যাপারে আলোচনা ও গবেষণা হয়। বহু চিন্তা-ভাবনা ও তর্ক বিতর্কের পর সিদ্ধান্ত হয় যে নারী মানুষ। তবে সে এমন মানুষ যে সর্বদা পুরুষের সেবায় রত থাকবে। সে শয়তানের বাহন, সব অন্যায়ের উৎস ও কেন্দ্র। তার সাথে সম্পর্ক রাখা অনুচিত- এসব ধারণার কোন পরিবর্তন অবশ্য হয় নি।

প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র ও সমাজে নারী

প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু শাস্ত্রমতে নারী- মৃত্যু, নরক, বিষ, সর্প ও আগুন অপেক্ষা অধিক খারাপ ও মারাত্মক।

মনুর বিধান মতে নারীর পিতা-স্বামী-সন্তানের নিকট থেকে কোন কিছু পাওয়ার নেই। নারী নাবালেগ হোক, যুবতী হোক আর বৃদ্ধা হোক- নিজ ঘরেও স্বাধীনভাবে কোন কাজ করতে পারবে না। মহারাজ মনুর মতে মিথ্যা কথা বলা নারীর স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য। মিথ্যা বলা, চিন্তা না করে কাজ করা, ধোঁকা, প্রতারণা, নির্বুদ্ধিতা, লোভ, পংকিলতা, নির্দয়তা- এ হলো নারীর স্বভাবগত দোষ।

প্রাচীনকালে হিন্দু পণ্ডিতেরা মনে করতেন, মানুষ পারিবারিক জীবন বর্জন না করলে জ্ঞান অর্জনে সমর্থ হতে পারে না। স্বামীর মৃত্যু হলে নারীকে চির বৈধব্যের জীবন যাপন করতে হয়। জীবনে কোন স্বাদ আনন্দ-আহ্লাদ উৎসবে যোগদান তার জন্য চির নিষিদ্ধ। এমনকি স্বামীর মৃত্যুর সাথে সহমৃত্যু বরণ তথা সতীদাহ প্রথাও চালু হয়েছিল। যুবতী নারীকে দেবতার সন্তুষ্টির জন্য দেবতার উদ্দেশে বলিদান করা হত।

ইউরোপে নারীর অবস্থা

প্রাচীন গ্রীসে ও এথেন্সে সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল বহু পূর্বে। কিন্তু সেখানেও নারীর অবস্থা ছিল বড়ই করুণ। সেখানে নারীকে মনে করা হত পরিত্যক্ত বস্তু। হাটে-বাজারে প্রকাশ্যভাবে নারী বেচাকেনা হত। গ্রীকরা মনে করত আগুনে জ্বলে গেলে বা সাপে দংশন করলে তার প্রতিবিধান সম্ভব, কিন্তু নারীর দুষ্কৃতির প্রতিবিধান সম্ভব নয়। সেখানে শয়তান অপেক্ষাও অধিক ঘৃণিত ছিল নারী। সন্তান প্রসব ও তার লালন-পালন এবং ঘরের কাজকর্ম ছাড়া তার আর কোন দায়িত্ব বা অধিকার ছিল না।

শতাব্দীকাল পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপে নারীদের উপর চলত অমানুষিক নির্যাতন। নারী নির্যাতন বন্ধের মত কোন আইনও সেখানে ছিল না। নারী ছিল পুরুষের গোলাম। তার উপার্জনের উদ্দেশ্যে কাজ করার কোন অধিকার ছিল না। আর উপার্জন করলেও তা নিজে ভোগ করারও তাদের ছিল না কোন অধিকার। মেয়েরা পিতা-মাতার সম্পত্তি হিসাবেই ব্যবহৃত হত।

প্রাচীন আরবে নারীদের অবস্থা

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময়ে আরবে নারীদের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক ও দূর্দশাগ্রস্থ। মেয়ে সন্তানকে সমাজে খুবই ঘৃণার চোখে দেখা হত। কোন বাবা-মায়ের ঘরে মেয়ে সন্তান জন্মগ্রহণ করলে, তাদের মুখ মলিন হয়ে যেত এবং তারা সমাজের লোকেদের থেকে পালিয়ে বেড়াত। কোরআন অত্যন্ত সুন্দরভারে সমাজের এ অবস্থা চিত্রায়িত করেছেঃ

وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالأُنثى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًا وَهُوَ كَظِيمٌ يَتَوَارُى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَبِهِ الْمُسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التَّرَابِ الأَسَاءَ مَا يَحْكُمُونَ

“তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তান জন্মের সুসংবাদ প্রদান করা হয়, তাদের চেহারা কালো ছায়ায় মলিন হয়ে যায়, সে হয়ে পড়ে মর্মাহত। তাকে যে সংবাদ দেয়া হল সে লজ্জায় সে সমাজের লোকদের থেকে পালিয়ে বেড়ায়। সে ভাবে সে কি অপমান বয়েই চলবে নাকি তাকে মাটির নীচে লুকিয়ে ফেলবে- বুঝে দেখ, কি মন্দ ফায়সালা সে নিচ্ছে।” (সূরা আন নহল: ৫৮-৫৯)

আরবের তদানীন্তন সমাজের কোন কোন পাষণ্ড পিতা নিজ কন্যা সন্তানকে তো হত্যাই করে ফেলত। কোরআন বলে:

وَإِذَا الْمَوْعْدَةُ سُئِلَتْ بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ

“যখন প্রোথিত কন্যাদিগকে জিজ্ঞেস করা হবে, কোন অপরাধে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে?” (সূরা তাকভীর: ৮-৯)

এমনিভাবে সে সমাজে মৃত ব্যক্তির স্ত্রীদেরকে তার উত্তরাধিকারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করত, ফলে সে সমাজে সৎ মাকে বিয়ে করার রেওয়াজও চালু ছিল। তাছাড়া বিয়ে করা স্ত্রীদেরকে তালাক প্রদানের কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন ছিল না। হয়ত কাউকে এক বৈঠকেই হাজার বার তালাক প্রদান করা হয়ে যেত, আবার তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীদের কাউকে গড়িমসি করে আটকিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হত। এভাবে স্ত্রীলোকের উপর চলত অকথ্য নির্যাতন, হয়রানী ও হৃদয়হীন কার্যক্রম।

আল-কোরআনে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা

চিন্তা করে দেখুন তো সেই সপ্তম শতকে ইসলামের আবির্ভাবকালে বিশ্বজুড়ে নারী জাতির উপর কি অমানিশার অন্ধকার ছেয়েছিল! ইসলাম তথা আল কোরআন সেই সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকেই নারী জাতিকে আলোর পথে তথা মুক্তির পথে নিয়ে আসে। নারী সমাজ যদি কোরআন প্রদত্ত তাদের সেই অধিকার ও অবস্থা গভীরভাবে অনুধাবন করে তাহলে তারা উদ্বেলিত হয়ে উঠবে, আবেগে আল্লাহর দরবারে সেজদায় লুটিয়ে পড়বে।

অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে এবং উনবিংশ শতকে ইউরোপে তথা পাশ্চাত্য জগতে নারী মুক্তির আন্দোলন চলে, নারীকে রোজগারের অধিকার প্রদান করা হয়, ধাপে ধাপে নারী লাগামহীনভাবে এগিয়ে চলে, দাম্পত্য জীবনের ভীত ধ্বসে পড়ে, নীতি-নৈতিকতার বালাই থাকেনা, যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় যথেচ্ছাচার, পারিবারিক জীবনে নেমে আসে ভাঙ্গন। এভাবে সমাজে নারীদের অবস্থা এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যায়। পূর্বে তাদের ছিল না কোন স্বাধীনতা, এবার তারা হয়ে যায় মুক্ত বিহঙ্গ। সমাজকে করে তোলে তারা কলুষিত ও নোংরা। এ দুই অবস্থার মোকাবেলায় আল কোরাআনের আলোকে সেই সপ্তম শতাব্দী থেকে মুসলমানের জীবনে ও সমাজে নারীদের যে অবস্থান ও মর্যাদা সৃষ্টি হয় তা যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ ও কল্যাণমুখী।

সমাজে নারী মা হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে, কন্যা হিসাবে ও অন্যান্য আত্মীয় হিসাবে আভির্ভূত হয়ে থাকেন। এদের প্রত্যেকের বিশেষ বিশেষ অবস্থান ও মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে কোরআন ও হাদীসে। নিম্নে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল।

মা হিসাবে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা

আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বিভিন্ন স্থানে মা ও বাবাকে একই অবস্থানে বর্ণনা করেছেন। মা ও বাবা দু’জনের সাথেই এহসান- সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।

সূরা বাকারার ৮৩ আয়াতে, সূরা আনয়ামের ১৫১ আয়াতে এবং সূরা বনী ইসরাঈলের ২৩ আয়াতে পিতা-মাতার কথা একই সাথে উল্লেখ করার মাধ্যমে মা ও বাবার একই অবস্থান ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। বরং কোরআনের কোন কোন স্থানে মা’র কথা আলাদা করেও বলা হয়েছে:

حَمَلَتْهُ أُمَّهُ وَهُنَا عَلَى وَهْنٍ وَفِصْلُهُ فِي عَامِيْنِ

“তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভধারণ করেছেন এবং দুই বছর দুগ্ধপান করিয়েছেন।” (সূরা লোকমান: ১৪)

এভাবে কোরআনে মা’র উল্লেখের মাধ্যমে মা’কে সম্মানিত করা হয়েছে। এক হাদীসে জনৈক সাহাবীর এক প্রশ্নের জবাবে তার উপর কার অধিকার বেশী এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন তোমার উপর তোমার মায়ের অধিকার সর্বাধিক। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বার তিনি একই জাবাব দেন, চতুর্থবারে তিনি বলেন অতঃপর তোমার পিতার অধিকার বেশী। এভাবে ইসলামে মাকে সম্মানিত করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

الجنت تحت اقدام الامهات

“বেহেশত মায়ের পায়ের নীচে”।

অর্থাৎ মাকে খুশী ও রাজী করতে পারলেই জান্নাত লাভ করা যাবে। রাসূলুল্লাহর জীবিতকালে সাহাবী হযরত আলকামার ঘটনা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তার মা তার প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ তার মাকে যখন বলেন যে সে তাকে মাফ করে তার প্রতি সন্তুষ্ট না হলে আখেরাতে তাকে আগুনের আযাব দেয়া হবে। তখন তার মা তাকে মাফ করে দিলে সে কালেমা পাঠ করতে সক্ষম হল।

এমনিভাবে ইসলামে মাকে সম্মানিত করা হয়েছে। ইসলামে সৎ মাকে বিয়ে করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সৎ মাকে সম্পত্তি হিসাবে বর্ণনা করা বন্ধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দুধমা’কে আপন চাদর বিছিয়ে বসতে দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন।

স্ত্রী হিসাবে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা

কোরআন ও হাদীসে স্বামী ও স্ত্রীকে পরিবারের দু’টি আলাদা ইউনিট হিসাবে উল্লেখ করে দু’য়ের সমন্বয়ে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিবারের ঘোষণা দিয়েছে। স্বামী ও স্ত্রীর অবস্থান ও মর্যাদা এখানে সমান সমান। বলা হয়েছেঃ

هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ

“তোমরা একে অপরের জন্য, নারীরা পুরুষের জন্য পোশাক আর পুরুষেরা নারীর জন্য পোশাক।”

আল্লাহ তায়ালা নারী পুরুষের সম অবস্থান সম্পর্কে কোরআনে বলেছেন:

وَأَنَّهُ خَلَقَ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالْأُنثَى – مِنْ نُطْفَةٍ إِذَا تَمنى –

“নিশ্চয়ই তিনি নর-নারীকে যুগল করে সৃষ্টি করেছেন বীর্য থেকে, যখন তা (মাতৃগর্ভে) নিক্ষিপ্ত হয়।” (সূরা নজম: ৪৫-৪৬)

وَالَّذِي خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا

“তিনিই সেই সত্তা যিনি সকল কিছু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা যুখরুফ: ১২)

جَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَمِنَ الْأَنْعَامِ أَزْوَاجًا يَدْرَؤُكُمْ فِيهِ –

তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের গৃহপালিত পশুকেও জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে তোমাদের বংশধারা চালু করেছেন।” (সূরা শুরাঃ ১১)

سُبْحَنَ الَّذِي خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَهَا مِمَّا تُنْبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنفُسِهِمْ وَمِمَّا لَا يَعْلَمُونَ

“পবিত্র সেই সত্তা যিনি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন যা জমি থেকে উদ্ভিদ আকারে জন্মে, তাদের নিজেদের মধ্য থেকেও এবং তারা যা জাননা তা থেকেও।” (সূরা ইয়াসিন : ৩৬)

وَالله جَعَلَ لَكُم مِّنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِّنْ أَزْوَاجِكُمْ بَنِينَ وَحَفَدَةً

“আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের স্ত্রীদের বানিয়েছেন এবং তোমাদের স্ত্রীদের থেকে সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনী পয়দা করেছেন।” (সূরা নহল: ৭২)

আরো পরিষ্কার করে আল্লাহ তায়ালা স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসবাসের কথা বলেছেন:

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِّنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا

“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন পরে তার জুড়ি সৃষ্টি করেছেন যেন তার সাথে একত্রে জীবন যাপন করে।” (সূরা আ’রাফ: ১৮৯)

وَمِنْ أَيْته أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً

“তার নিদর্শনের অন্যতম হল এই যে তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন যেন তোমরা একত্রে শান্তিতে বসবাস কর এবং তিনি তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করে দিয়েছেন ভালবাসা ও দয়া।” (সূরা রূম: ২১)

এই আয়াতগুলোতে স্বামী-স্ত্রীর, নর-নারীর একই অবস্থানের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। কাউকেই অধিক মর্যাদা সম্পন্ন বলে আখ্যায়িত করা হয় নি। মনে হয় যেন পরিবারে ও সমাজে নারী ও পুরুষ একই গাড়ীর দু’টি চাকা, একটির অভাবে অপরটি অচল। সচল গাড়ীর জন্য দু’টি চাকাই অপরিহার্য।

ইসলামী সমাজে পরিবার গঠনের জন্য যে বিয়ে অপরিহার্য তাতে নারী ও পুরুষ দু’জনেরই সম্মতি (ইজাব-কবুল) অত্যাবশ্যকীয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সময়ে বেশ কয়েকটি ঘটনায় দেখা যায় মেয়ে রাসূলের নিকট এসে অভিযোগ করে যে তার অভিভাবক তার সম্মতি ছাড়াই তাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। রাসূল (সাঃ) সে সব ক্ষেত্রে মেয়েকে এ অনুমতি প্রদান করেন যে সে ইচ্ছা করলে এ বিয়ে রাখতেও পারে, ইচ্ছা করলে তা বাতিলও করে দিতে পারে। তাই মেয়ে ও ছেলে দু’জনের সম্মতি তথা ইজাব-কবুলের ভিত্তিতেই বিয়ে হবে। অর্থাৎ ইসলামে নারী ও পুরুষের সমমর্যাদা ও সম অবস্থান স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।

কেবলমাত্র পারিবারিক শৃংখলা বজায় রাখার জন্য স্বামী তথা পুরুষকে শৃংখলা বিধানকারী (কাইয়েম) হিসাবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। যেমনভাবে স্ত্রীর খোরপোষেরও দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে স্বামীকে, মোহরও প্রদান করতে হবে স্বামীকেই। এটুকু বুঝা যায় যে, এটা স্বামীর অতিরিক্ত দায়িত্ব। এ যেন দুই চাকা বিশিষ্ট গাড়ীর ইঞ্জিন ও ড্রাইভারের ভূমিকা। শুধু দুই চাকায় তো আর গাড়ী চলে না, ইঞ্জিনের সচলতা ও ড্রাইভারের ক্রিয়া হলেই তা চালু হয়। ইসলামী সমাজে পুরুষের অতিরিক্ত দায়িত্ব ইঞ্জিন ও ড্রাইভারের। এ অতিরিক্ত দায়িত্বটুকু ছাড়া বাকী সকল ক্ষেত্রে ইসলাম নারী ও পুরুষকে সমানাধিকার প্রদান করেছে। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা তার বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

কন্যা হিসাবে নারীর অধিকার ও মর্যাদা

জাহেলিয়াতের যুগে আরবে কন্যা সন্তান ছিল অপেয় ও পিতা-মাতার জন্য অপমানের এক সাক্ষাত বিষয়। কোরআনে যার বর্ণনা এসেছে এভাবেঃ

وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًا وَهُوَ كَظِيمٌ يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَبِهِ الْمُسِكُهُ عَلَى هُوَنِ أَمْ يُدَسُّهُ فِي التَّرَابِ الأَسَاءَ مَا يَحْكُمُونَ

“তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তান জন্মের সুসংবাদ প্রদান করা হয়, তাদের চেহারা কালো ছায়ায় মলিন হয়ে যায়, সে হয়ে পড়ে মর্মাহত। তাকে যে সংবাদ দেয়া হল সে লজ্জায় সে সমাজের লোকেদের থেকে পালিয়ে বেড়ায়। সে ভাবে সে কি অপমান বয়েই চলবে নাকি তাকে মাটির নিচে লুকিয়ে ফেলবে! বুঝে দেখ, কি মন্দ ফায়সালা সে নিচ্ছে”? (সূরা আন নহল: ৫৮-৫৯)

ইসলামে কন্যা সন্তান ও পুত্র সন্তান জন্মের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় নি। জন্ম দায়িনীকে দুই বছর স্তন্যদানের তাকিদ দেয়া হয়েছে উভয় ক্ষেত্রে। আপন মায়ের স্তন্যদান সম্ভব না হলে অন্যের স্তন্য পানের ক্ষেত্রে পিতাকে খরচ প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতেও কন্যা বা পুত্রের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা করা হয় নি। অর্থাৎ সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রে কন্যা বা পুত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় নি। কন্যা সন্তান জন্মের পর তাকে হত্যা করার কঠিন শাস্তির প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে আল কোরআনে। বলা হয়েছে:

وَإِذَا الْمَوْعِدَةُ سُئِلَتْ بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ –

“যখন প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে?” (সূরা আত-তাকভীর: ৮-৯)

ইসলাম কেবল তার জন্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হয় নি বরং পিতা-মাতার সম্পত্তিতে তাদেরকে ওয়ারিশ করেছে যা ছিল সেই যুগে কল্পনাতীত, আধুনিক যুগেও অনেক সমাজে তা অনুপস্থিত। তাদের লালন-পালন অত্যন্ত ছওয়াবের কাজ হিসাবে উল্লিখিত হয়েছে রাসূলের বাণীতে। ওয়ারিশের ব্যাপারে বলা হয়েছে পিতা-মাতার কোন পুত্র সন্তান না থাকলে এবং দুই বা ততোধিক কন্যা থাকলে তারা সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ পাবে, মাত্র এক কন্যা থাকলে পাবে অর্ধেক।

আল্লাহ অস্বীকারকারীগণ প্রশ্ন তুলেছে কন্যারা কেন পুত্রের সমান পাবে না। এ ক্ষেত্রে ইসলামের সমাজ-ব্যবস্থার প্রতি লক্ষ্য করতে হবে। ইসলাম দায়িত্ব প্রদান করেছে স্বামীকে সে যেন স্ত্রীকে মোহর প্রদান করে এবং স্ত্রীর খোরপোষের ব্যবস্থা করে। ফলে পুত্র মোহর প্রদান করে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে তার খোরপোষের ব্যবস্থা করবে আর কন্যা মোহর গ্রহণ করে অন্য এক পুরুষের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সে তার খোরপোষের ব্যবস্থা করে থাকবে। কাজেই কন্যাকে পুত্রের অর্ধেক অংশ প্রদানই ন্যায় সংগত ও ইনসাফ ভিত্তিক।

কন্যা সন্তানের লালন পালনের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তির কন্যা সন্তান রয়েছে, সে তাকে জীবন্ত প্রোথিত করেনি, তাকে ঘৃণার চোখে দেখেনি এবং তার উপর নিজের পুত্র সন্তানের অগ্রাধিকার দেয়নি, তাকে আল্লাহ তায়ালা বেহেশত দান করবেন। (আবু দাউদ, কিতাবুল আদব)

আরো কতিপয় হাদীসে বলা হয়েছে:

উত্তমভাবে দুই বা ততোধিক কন্যা সন্তান লালন পালনকারী বেহেশতে রাসূলের সাথে এমনভাবে থাকবেন যেমন দুটি আঙ্গুল একই সাথে অবস্থান নেয়। প্রকৃতপক্ষে সন্তান পুত্রই হোক আর কন্যাই হোক তাদেরকে উত্তমভাবে লালন-পালন করা, বিয়ে-সাদীর ব্যবস্থা করা পিতামাতার পবিত্র দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে পুত্র ও কন্যার মধ্যে মোটেও কোন পার্থক্য করা হয় নি। তাই পুত্র ও কন্যা ইসলামী সমাজে সম-অবস্থানেই অবস্থান করে।

সমাজের সাধারণ সদস্যা হিসাবে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা

নারী ও পুরুষ দু’জনই আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহর কাছে তাকে ফিরে যেতে হবে। তাদের স্ব-স্ব ঈমান ও আমলের ভিত্তিতেই আখেরাতে চূড়ান্ত ফয়সালা হবে, দু’য়ের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হবে না। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেনঃ

أَنِّي لَا أُضِيعَ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى بَعْضُكُمْ مِّن ؟ بَعْضٍ

“নিশ্চয়ই আমি কোন আমলকারীর আমল, সে নারী হোক বা পুরুষ, বিনষ্ট করব না- তোমরা একে অপরের জন্য।” (সূরা আলে ইমরান: ১৯৫)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেনঃ

وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصُّلِحَتِ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يُدْخَلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا –

“পুরুষ বা নারী যেই নেক আমল করবে ঐ অবস্থায় যে সে মু’মিন, তারা বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি কোনরূপ জুলুম করা হবে না।” (সূরা নিসা: ১২৪)

আল্লাহ তায়ালা পুরুষ ও নারীকে একই ধরনের আমলকারী হিসাবে কোরআনে বর্ণনা করেছেন:

إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمُتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَتِ وَالْقُنِتِينَ وَالْقَنِتُتِ وَالصَّدِقِينَ وَالصُّدِقْتِ وَالصُّبِرِينَ وَالصُّرْتِ وَالْخَشِعِينَ وَالْخُشِعْتِ وَالمُتَصَدِّقِينَ وَالمُتَصَدِّقْتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَتِ وَالْحَفِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَفِظتِ وَالذُّكِرِينَ اللهَ كَثِيرًا وَالذُّكِرُتِ * أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَّغْفِرَةً وَ اجْرًا عَظِيمًا –

“নিশ্চয়ই মুসলিম (অনুগত) পুরুষ ও নারী, ঈমান পোষণকারী পুরুষ ও নারী, বিনয়াবনত পুরুষ ও নারী, সত্য পরায়ণ পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, (আল্লাহর) ভয়ে ভীত পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, রোজাদার পুরুষ ও নারী, যৌনাঙ্গের হেফাযতকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে বেশী বেশী, স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন।” (সূরা আহযাব-৩৫)

পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে মু’মিন পুরুষ বা নারী কারোই আল্লাহ ও তার রাসূল কোন নির্দেশ প্রদান করলে সে ব্যাপারে নিজস্ব এখতিয়ার গ্রহণের কোন, অধিকার নেই। এতে এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে আল্লাহর নিকট নারী ও পুরুষের কোন পার্থক্য নেই, উভয়ে একই অবস্থানে অবস্থিত।

আল্লাহর নিকট নারী ও পুরুষের মর্যাদা তাদের স্ব-স্ব আমল অনুযায়ী নির্ধারিত। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَلَا تَتَمَنُوا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ ط لِلرِّجَالِ نَصِيبُ تِمَا اكْتَسَبُوا ط وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِّمَّا اكْتَسَبْنَ ط وَسْتَلُوا اللَّهَ مِنْ فَضْلِهِ ط إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا –

“আল্লাহ তোমাদের একজনের ওপর অপরজনের যে মর্যাদা দান করেছেন সে ব্যাপারে কোনরূপ আকাঙ্ক্ষা পোষণ করো না; পুরুষেরা যা অর্জন করেছে তা তাদের আর নারীরা যা অর্জন করেছে তা তাদের- আল্লাহর নিকট অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত।” (সূরা নিসাঃ ৩২)

মু’মিন নারী ও পুরুষ একে অপরের বন্ধু, পরস্পর নেক আমলে সহায়তাকারী। এ পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلُوةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكُوةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهُ وَرَسُولَهُ أُوْلَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ – وَعَدَ اللَّهُ المُؤمِنِينَ وَالمُؤْمِنَتِ حَنْتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْفُرُ خُلِدِينَ فِيهَا وَمَسْكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنْتِ عَدْنٍ * وَرِضْوَانٌ مِّنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

“মু’মিন নারী পুরুষগণ একে অপরের বন্ধু, তারা (মারুফ) সৎ ও নেক কাজের আদেশ করে ও (মুনকার) অশ্লীল ও মন্দ কাজের নিষেধ করে, তারা নামায কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে, তারা আল্লাহ ও রাসূলকে মান্য করে চলে, এদের প্রতি আল্লাহ শীগিরই রহমত দান করবেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ- “মহাপরাক্রান্ত ও মহা বিজ্ঞানময়। আল্লাহ মু’মিন নারী-পুরুষের জন্য ঐ জান্নাতের ওয়াদা করেছেন যার নিচে দিয়ে নদী সমূহ প্রবাহিত হয়েছে, সেখানে তারা থাকবে চিরকাল এবং জান্নাতে রয়েছে পবিত্র বাসস্থান এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সন্তুষ্টি যা সবচেয়ে বড় – এ হলো সর্বোত্তম সাফল্য।” (সূরা তওবা: ৭১-৭২)

ইসলামের বাস্তবায়নে নারী-পুরুষের উভয়ের অংশগ্রহণ, ত্যাগ, কষ্ট স্বীকার ও সাফল্য লাভ উল্লেখ করে আল্লাহ তা’আলা বলেন:

فَاسْتَجَابَ لَهُمْ رَبُّهُمْ أَنِّي لَا أَضِيعَ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ
أنثى ، بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ ، فَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَأَخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ
وَأُوذُوا فِي سَبِيلِي وَقَتَلُوا وَقُتِلُوا لَا كَفَرَنَّ عَنْهُمْ سَاتِهِمْ وَلَادْخِلَنَّهُمْ
جَنَّتٍ تَجْرِى مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ : ثَوَابًا مِّنْ عِنْدِ اللَّهِ وَاللَّهُ عِنْدَهُ
حُسْنُ الثَّوَابِ –

“অতঃপর তাদের রব তাদেরকে জবাব দিচ্ছেন যে, আমি তোমাদের আমল নষ্ট করিনা। তোমরা পুরুষ হও কি নারী, তোমরা একে অপরের জন্য। অতএব তোমাদের যে হিজরত করেছে, তাদেরকে তাদের বাড়ীঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, আমার পথে কষ্ট স্বীকার করেছে, লড়াই করেছে ও নিহত হয়েছে, আমি অবশ্যই তাদের মন্দ কাজসমূহ পরিবর্তন করে দিব, তাদেরকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাব, যার নিচে দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত, এ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান এবং আল্লাহর নিকট রয়েছে উত্তম প্রতিদান।” (সূরা আলে ইমরান: ১৯৫)

হাশরের ময়দানে একই অবস্থানে মু’মিন নারী-পুরুষের সাফল্যের কথাও কোরআনে উল্লেখ হয়েছে:

يَوْمَ تَرَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ يَسْعَى نُورُهُمْ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ
بشر كُمُ الْيَوْمَ جَنَّتٌ تَجْرِى مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خُلِدِينَ فِيهَا ذَلِكَ

هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ …

“সেদিন আপনি মু’মিন নারী-পুরুষকে দেখতে পাবেন এমন অবস্থায় যে সামনে ও ডানে তাদের নূর দৌড়াতে থাকবে এবং তাদেরকে এমন এক জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হবে যার নিচ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত, সেখানে থাকবে তারা চিরকাল- এ হলো তাদের বিরাট সাফল্য।” (সূরা হাদীদ: ১২)

এমনিভাবে দুনিয়ার সকল কাজে এমনকি আখিরাতেও মুসলমান নারী-পুরুষের সম অবস্থান ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছে কোরআনের বিভিন্ন স্থানে। এ প্রসঙ্গে মানুষের মর্যাদা সম্পর্কিত সূরা হুজুরাতের সেই প্রসিদ্ধ আয়াতটি উল্লেখ করা যেতে পারে:

إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَكُمْ

“নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক খোদাভীরু (মুত্তাকী)।”

এই সর্বাধিক খোদাভীরু ব্যক্তিটি পুরুষও হতে পারে, নারীও হতে পারে, শুধু পুরুষের জন্য এ সম্মান নির্ধারিত হয় নি। পক্ষান্তরে কোরআনের বর্ণনায় দেখা যায়, ফেরাউন পাপিষ্ঠ-খোদাদ্রোহী কিন্তু তার স্ত্রী তার আমলের কারণে সম্মানিত হয়েছে। আবার কোরআনে এ-ও বলা হয়েছেঃ

وَمَرْيَمَ ابْنَتَ عِمْرَانَ الَّتِي أَحْصَنَتْ فَرْجَهَا فَنَفَخْنَا فِيهِ مِنْ رُوحِنَا
وَصَدَّقَتْ بِكَلِمَتِ رَبِّهَا وَكُتُبِهِ وَكَانَتْ مِنَ الْقَانِتِينَ

“(অপর উদাহরণ হল) ইমরানের কন্যা মরিয়মের, যিনি তার সতীত্ব রক্ষা করেছিলেন এবং আমি তাতে ফুঁকে দিলাম আমার রূহ এবং সে তার রবের কালেমার ও কিতাব সমূহের সত্যতা প্রদান করেছেন এবং তিনি ছিলেন অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা তাহরীম: ১২)

এভাবে দেখা যায় স্বীয় আমলের কারণে নারীগণ আল্লাহর নিকট মর্যাদাবান হতে পারেন। তাই ইসলামের ধারণামতে নারীগণ কোনক্রমেই পাপের উৎস, শয়তানের প্রবেশ পথ, নিকৃষ্ট, ঘৃণিত নয়। তবে যদি কেউ নিজ আমলের কারণে পাপাচারী হয়ে যায় তো ভিন্ন কথা। কোরআনে এরূপ দু’জন মহিলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সৃষ্টির মধ্যে নবী রাসূলগণ হলেন সর্বাধিক নেক চরিত্রের অধিকারী। এরূপ দু’জন নবীর স্ত্রীগণ পাপাচারী ছিলেন বলে কোরআন জানায়:

ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلاً لِلَّذِينَ كَفَرُوا امْرَأَتَ نُوحٍ وَامْرَأَتَ لُوطٍ كَانَتَا
تَحْتَ عَبْدَيْنِ مِنْ عِبَادِنَا صَالِحِينَ فَخَانَتَهُمَا فَلَمْ يُغْنِيًّا عَنْهُمَا مِنَ اللَّهِ
شَيْئًا وَقِيلَ ادْخُلَا النَّارَ مَعَ الدَّاخِلِينَ

“যারা কুফুরী করেছিল আল্লাহ তাদের উদাহরণ হিসেবে নূহ (আঃ) ও লূত (আঃ) এর স্ত্রীদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। তারা দু’জন আমার দু’জন নেক বান্দার অধীনে ছিল। অতঃপর তারা বিশ্বাসঘাতকতা করল, তাই তাদের দু’জনের পক্ষে আল্লাহর নিকট থেকে কোন কিছুই কোন উপকারে আসল না এবং তাদেরকে বলা হল তোমরা প্রবেশকারীদের সাথে দোজখে প্রবেশ কর।” (সূরা তাহরীম: ১০)

দেখা গেল আমলের ব্যাপারে নারীরা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। স্বামী বা পিতার আমলের সাথে স্ত্রী বা কন্যার আমলের কোন সম্পর্ক নেই। এদিক থেকে নারীদের অবস্থান সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং তাদের মর্যাদার ক্ষেত্রে মৌলিক কোন তারতম্য নেই।

জান্নাতের নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে দুনিয়ায় পতনের ব্যাপারে ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্ম শাস্ত্রে নারীদের ব্যাপারে যে অভিযোগ রয়েছে কোরআনের বর্ণনা নিম্নরূপ:

وَقُلْنَا يَادَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ وَكُلًّا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ
شئتما ص وَلَا تَقْرُبَا هَذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ – فَأَزَلَّهُمَا
الشَّيْطَنِ عَنْهَا فَأَخْرَجَهُمَا فَمَا كَانَا فِيهِ

“আর আমরা বললাম, হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে শান্তিতে বসবাস কর এবং তোমরা দু’জনেই তার যেখান থেকে যা ইচ্ছা খাও এবং তোমরা এই গাছটির নিকট যেওনা, তাহলে কিন্তু তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। অতঃপর শয়তান তাদের দু’জনকেই পদদলিত করল এবং তারা যে সুখে-শান্তিতে ছিল তা থেকে তাদেরকে ঐ গাছের কারণে বের করে আনল।” (সূরা বাকারা: ৩৫,৩৬)

এ বর্ণনা থেকে জানা যায় শয়তানের ধোঁকায় দু’জনেই প্রতারিত হয়েছিল, কেউ একা দায়ি নয়। তাই বিবি হাওয়া আদমকে প্রতারিত করেছে এ কথা ‘যথার্থ নয়। এভাবে নারী জাতি প্রতারণার অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। আসলে নারী ও পুরুষ দু’জনেই মানুষ, একই তাদের অবস্থান। তাদের মর্যাদা নির্ভর করে তাদের স্ব স্ব আমলের উপর।

এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَلِكُلِّ دَرَجَةٍ مِّمَّا عَمِلُوا ط وَمَا رَبُّكَ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ

“প্রত্যেকের জন্য যে যে আমল করেছে সে অনুযায়ী শ্রেণীমত মর্যাদা রয়েছে, আর তারা যা করেছে সে ব্যাপারে আল্লাহ বেখবর নন।” (সূরা আন’আম : ১৩২)

إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ

“নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে সম্মানিত তারাই যারা তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক তাকওয়া সম্পন্ন- খোদাভীরু ও পরহেজগার।” (সূরা হুজুরাত : ১৩)

নারী ও পুরুষের মধ্যে সৃষ্টিগত পার্থক্য :

দেখা গেল মানুষের মধ্যে সে নারী হোক বা পুরুষ অবস্থানের দিক থেকে তেমন কোন পার্থক্য নেই। আমলের কারণে তার মধ্যে মর্যাদার পার্থক্য সৃষ্টি হয়। তবে সৃষ্টিগত দিক থেকে নারী ও পুরুষের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, যা বংশধারা অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বরং অপরিহার্য ও অত্যাবশ্যকীয়। আল কোরআনও সে কথা বলে:

فَاطِرُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ
أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَمِنَ الْأَنْعَامِ أَزْوَاجًاج
يَذْرَؤُكُمْ فِيهِ

“তিনিই আসমান ও জমিনের স্রষ্টা, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্যে থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং পশুর মধ্যে থেকেও জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে তোমাদের বংশধারা চালু করেছেন।” (সূরা শুরাঃ ১১)

সৃষ্টি বর্ণনায় দেখা যায় আল্লাহ তা’আলা প্রথম মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন হযরত আদম (আঃ)-কে। অতঃপর তার থেকে সঙ্গিনী হিসাবে সৃষ্টি করেছেন বিবি হাওয়াকে। অর্থাৎ মূল সৃষ্টি হযরত আদম (আঃ) এবং সহ সৃষ্টি বিবি হাওয়া, তার মূল কাজ সঙ্গ দান। অতঃপর বংশধারা চালুর জন্য প্রয়োজন যৌন মিলনের, যাতে নারী-পুরুষ উভয়ের ভূমিকা সমান। এতে পুরুষের কোন একক ভূমিকা নেই। সন্তান প্রসবের পর তাকে স্তন্য দানও নারীর দায়িত্ব। এরপর সন্তানের লালন-পালনে উভয়েই ভূমিকা রাখতে পারে। পুরুষ যেহেতু শক্তিমান, সেহেতু সে নারীর নিরাপত্তা দান ও খোরপোষ সংগ্রহে ভূমিকা রাখতে পারে। ইসলাম পুরুষকে এ দায়িত্ব প্রদান করেছে। এভাবে বংশধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষে সৃষ্টিগত ও প্রকৃতিগত পার্থক্য বিদ্যমান। প্রকৃতিগত এ পার্থক্যকে বহাল রেখেই পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শ্রম বিভাগ (division of labour) কায়েম করতে হবে।

তাই নারীকে হীন মনে করা, হেয় ও অপদস্থ করা যেমন ঠিক নয়, তাকে সৃষ্টিগত ও প্রকৃতিগত পার্থক্য বর্জন করে পুরুষের সাথে এক করে ফেলাও যথার্থ নয়। বংশধারা চালু রাখা ও সমাজ পরিচালনার জন্য নারী ও পুরুষকে একই সমাজের দুটি চাকা হিসাবেই গণ্য করতে হবে, সমাজে তাদের অবস্থান একই পর্যায়ে, যথারীতি সাম্য বজায় রেখে চলতে হবে, সমঝোতা স্থাপন করতে হবে, সহ অবস্থান করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা নারী-পুরুষের আমলের ভিত্তিতে তাদের মর্যাদা নির্ধারণ করে থাকেন।

তৃতীয় অধ্যায় : পরিবারের সূচনা – বিয়ে

আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা যে তিনি মানুষকে জোড়ায় জোড়ায় অর্থাৎ যুগল করে সৃষ্টি করেছেন, তারই বাস্তব প্রমাণ একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে বিবাহ বন্ধন সৃষ্টি করে একত্রে বসবাস। এর মাধ্যমেই পরিবারের সূচনা হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ
وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا

“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন। পরে তার জুড়ি সৃষ্টি করেছেন, যেন তারা একত্রে জীবন যাপন করে।” (সূরা আ’রাফ: ১৮৯)

আল্লাহ জুড়ি সৃষ্টি করেছেন কিন্তু বিয়ের মাধ্যমেই সে জুড়ি অস্তিত্ব লাভ করে এবং পারিবারিক জীবনে তা বাস্তবায়িত হয়।

বিয়ে হল একজন নারী ও একজন পুরুষের একত্রে বসবাসের চুক্তিপত্র, যা প্রকাশ্যে সমাজিকভাবে একজন ওয়াকিল ও দুইজন সাক্ষীর মোকাবেলায় সম্পাদিত হয়। পুরুষ মহিলাটিকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে স্বীকৃতি প্রদান করে আবার মহিলাটিও উক্ত ব্যক্তিকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করতে সম্মতি দেয়। বিয়ের মাধ্যমে একজন নারী ও একজন পুরুষের একত্রে বসবাস ও তাদের মধ্যে যৌন ক্রিয়াকর্ম বৈধ হয়ে যায়।

বিয়ে হল পশু ও মানুষের মধ্যে পার্থক্যসূচক একটি ব্যবস্থা

প্রকৃতিগতভাবে মানুষ ও পশুর জন্ম ও বয়োবৃদ্ধিতে তেমন কোন পার্থক্য নেই। মানুষ যৌবনে বা তার আগে-পরে বিয়ে করে ঘর-সংসার করে সমাজ থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য লাভ করে। কিন্তু পশুর জীবনে বিয়ে বা আলাদা পরিবার গঠন হয় না। তাই মানুষের জীবনে বিয়ে ও পরিবার গঠন তার আলাদা বৈশিষ্ট্য।

বংশধারা অব্যাহত রাখার জন্য আল্লাহ তা’আলা মানুষ ও পশু উভয়কে যুগলভাবে সৃষ্টি করেছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন:

فَاطِرُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا
وَمِنَ الْأَنْعَامِ أَزْوَاجًا جِ يَدْرَؤُكُمْ فِيْهِ

“তিনিই আসমান ও জমিনের স্রষ্টা, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য থেকেও জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং পশুর মধ্যে থেকেও জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে তোমাদের বংশধারা চালু করেছেন।” (সূরা: শুরা-১১)

বংশধারা চালুর জন্য মানুষের মধ্যে যেমন নারী-পুরুষের মিলন প্রয়োজন, তেমন পশুর মধ্যেও নর ও মাদীর মধ্যে মিলনের প্রয়োজন, ফলে যথানিয়মে সন্তান জন্ম লাভ করে। মানুষের মধ্যে তা বিয়ে ও পারিবারিকভাবে সম্পন্ন হয়, পশুর মধ্যে কোন বিয়ে ও পারিবারিক ব্যবস্থা নেই। তাই মানুষ ও পশুর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হল বিয়ে ও পারিবারিক জীবন যাপন।

বিয়ে হলো সভ্যতার নিদর্শন

পৃথিবীর আদি মানুষ হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া স্বামী-স্ত্রী হিসাবেই দুনিয়ায় আগমন করেন ও পারিবারিকভাবেই পৃথিবীতে বসবাস করেন। পরবর্তী কালে হয়ত মানুষ পশুর স্তরে নেমে যায় এবং পশুর মতো জীবন যাপন করতে থাকে। তখন বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাসের ব্যবস্থা খতম হয়ে যায়। মানুষ হয়ে যায় পশু। আবার নবী-রাসূলদের আগমনে মানুষের মধ্যে মানবীয় ব্যবস্থা চালু হয়। এভাবে সভ্যতার অগ্রযাত্রা শুরু হয়। কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রত্যেক নবীরই স্ত্রী ও সন্তানাদি ছিল।

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلاً مِّنْ قَبْلِكَ وَجَعَلْنَا لَهُمْ أَزْوَاجًا وَذُرِّيَّةً

“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের পূর্বে রাসূল প্রেরণ করেছি এবং তাদেরকে স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করেছি।” (সূরা আর রায়াদ: ৩৮)

এভাবে সভ্যতার বিকাশ সাধনে বিয়ে ও পারিবারিক জীবন-যাপন ব্যবস্থা, চালু হয়েছে। বরং আল্লাহ তা’আলা একে এক উত্তম নিদর্শন বলে আল কোরআনে আখ্যায়িত করেছেন:

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا

“এবং আল্লাহর নিদর্শন হলো এই যে তিনি তোমাদেরকে তোমাদের নিজেদের মধ্যে থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করে দিয়েছেন।” (সূরা রূম: ২১)

আল্লাহ তা’আলা স্বামী-স্ত্রীদের দু’জনকে সৃষ্টি করে পারিবারিকভাবে একত্রে ও সুখে-শান্তিতে বসবাসের ব্যবস্থা করেছেন এবং পরস্পরের মধ্যে ভালবাসার ও দয়ার সৃষ্টি করেছেন। এ হলো সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন। মহান আল্লাহরও নিদর্শন রয়েছে এতে। মানুষের মধ্যে এ ধরনের পারিবারিক জীবন এবং ভালবাসা ও মহব্বতের সম্পর্ক সৃষ্টি না হলে মানুষ তো পশুর স্তরেই থেকে যেতো। তাই মানুষের সমাজে বিয়ে ও পারিবারিক ব্যবস্থা সভ্যতার নিদর্শন, যা এক উন্নত সমাজের সৃষ্টি করেছে।

বিয়ের অর্থ

বিয়ের অর্থ একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক জীবন যাপনের চুক্তি। আরবী ভাষায় একে বলা হয় عُقْدَةُ النِّكَاحِ (বিবাহের চুক্তিপত্র)।

বিয়ের প্রধান শর্ত হলো ইজাব-কবুল, মোহরানা, সাক্ষ্য ও প্রকাশ্যে ঘোষণা। ইজাবের মাধ্যমে মেয়ে বা মহিলা নির্দিষ্ট পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে সম্মতি প্রদান করবে, নির্দিষ্ট পুরুষ সম্মতি প্রদানকারী মেয়ে বা মহিলাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে কবুল করে স্বীকৃতি প্রদান করবে এবং এই ব্যাপারে দু’জন সাক্ষী থাকবে এবং প্রকাশ্যে বিবাহ হবে। এতে করে উক্ত দুই নারী-পুরুষের মধ্যে পর্দার অন্তরাল দূর হয়ে যাবে বরং একত্রে বসবাস বৈধ ও জায়েয হয়ে যাবে। এবং তাদের মধ্যে যৌন ক্রিয়াকর্ম বৈধ বলে স্বীকৃত হবে। তাদের মধ্যে প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা ও মহব্বতের সম্পর্ক হবে প্রশংসনীয়। বিয়ে দুটি পরিবার ও তাদের আত্মীয়দের মধ্যে নতুন আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি করে এবং সমাজিকভাবে এক মধুর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

বিয়ের গুরুত্ব

সকল নবী-রাসূলদের অন্যতম সুন্নত হলো বিয়ে। আল্লাহ তা’আলা আল কোরআনে আদেশ করেছেন:

وَانْكِحُوا الْأَيَامَى مِنْكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ

“এবং বিয়ে দাও তোমাদের মধ্যকার এমন ছেলে-মেয়ের যাদের স্বামী বা স্ত্রী নেই এবং তোমাদের দাস-দাসীর মধ্যে যারা যোগ্য।” (সূরা নূরঃ ৩২)

বিয়ের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ ও সকল নবীর এ সুন্নত পালনের মাধ্যমে বিয়ের গুরুত্ব প্রকট হয়ে উঠে। বিয়ের এত গুরুত্বের কারণ হল:

(১) মানব সমাজে যৌন অনাচার বন্ধ করে পবিত্র যৌন জীবন যাপনের প্রধান মাধ্যম হলো বিয়ে। এজন্যেই ইসলামে পর্দা ব্যবস্থার এত কড়াকড়ি আরোপ করেছে, যেনা ব্যভিচারের জন্য চরম শাস্তির ব্যবস্থা করেছে এবং বিয়েকে করেছে সহজ ও স্বাভাবিক। মানুষের স্বাভাবিক যৌন প্রবণতাকে তৃপ্তি দানের জন্য প্রয়োজন যৌন-মিলন ব্যবস্থার। সমাজে বিয়ের প্রচলন না থাকলে অস্বাভাবিক পথে যৌন মিলন হওয়াই স্বাভাবিক। আর যৌন উত্তেজনামূলক ক্রিয়াকর্ম সমাজে চালু থাকলে যৌন অনাচারে সমাজদেহ কলুষিত হবে- এটাই স্বাভাবিক। তাই যৌন অনাচার থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে বিয়েকে সহজ ও স্বাভাবিক করতে হবে। এ দিক থেকে সমাজে বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।

(২) পশু সমাজ ও মানব সমাজের মধ্যে পার্থক্য তো এই যে, পশু সমাজে কোন যৌন পবিত্রতার প্রশ্ন নেই, নেই কোন পারিবারিক ব্যবস্থা আর মানব সমাজে রয়েছে বিয়ের মাধ্যমে পবিত্র যৌন জীবন যাপনের বিধান ও সুস্থ পারিবারিক জীবন। তাই পবিত্র যৌন জীবন ও সুস্থ পারিবারিক জীবনই মানব সমাজের বৈশিষ্ট্য যা পশু সমাজ থেকে তাকে করেছে ভিন্ন। এ থেকে বিয়ে ও পারিবারিক জীবনের গুরুত্বই প্রকটভাবে ধরা পড়ে। মানুষ যে নৈতিক জীব তাও এ থেকে প্রমাণিত হয়। বিয়েই মানুষকে পশুর স্তর থেকে মানুষের স্তরে পৌছে দেয়। পারিবারিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রের সদস্য হিসাবে মনুষ্যত্বের পরিচয় দান করে।

(৩) বিয়ে ও পারিবারিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই মানব সমাজে নির্ভেজাল বংশধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব। মানব সমাজে বিয়ের ব্যবস্থা না থাকলে মুক্ত যৌন জীবনে বংশীয় ধারা বহাল রাখার কোন ব্যবস্থাই থাকতো না। একই নারীর গর্ভে কতিপয় পুরুষের বীর্য নিক্ষিপ্ত হলে পিতৃ পরিচয় নির্ধারণ হয়ে পড়ত অসম্ভব। প্রাক ইসলামী যুগে এ অবস্থায় নারী যাকে শনাক্ত করত তাকেই পিতৃত্ব গ্রহণ করতে হত অথবা হয়ত সন্তানের চেহারা সুরতের আদল মিলিয়ে পিতৃত্ব নির্ধারণের চেষ্টা করা হত। মোটকথা, বংশধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে বিয়ে ও পারিবারিক ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই। মানব সভ্যতায় বংশধারা চালু রাখার গুরুত্ব যতটুকু, বিয়ে ও পারিবারিক জীবনের গুরুত্বও ততটুকু।

(৪) এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা, সন্তানের প্রতি স্নেহ-মায়া-মমতার কারণে পরিবারে যে সুখ-শান্তির ফল্গুধারা সৃষ্টি হয়, বিয়েই তার সূচনা করে, পরিবার করে তার লালন। এতে করে সামাজিক জীবনে শৃঙ্খলা কায়েম হয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে নেমে আসে শান্তি ও স্থিতিশীলতা। বিয়ের মাধ্যমেই সুখী পারিবারিক জীবনের ভিত্তি স্থাপিত হয়, যাতে করে বিয়ের অপরিসীম গুরুত্বের স্বীকৃতি পাওয়া যায়।

মুসলিম সমাজে বিয়ের প্রতি উৎসাহ প্রদান, তাকিদ ও নির্দেশ

মুসলিম সমাজে যৌন পবিত্রতা বজায় রাখা, নৈতিকতার উৎকর্ষতা সাধন ও সামাজিক সুশৃঙ্খলতা আনয়নের উদ্দেশ্যে বিয়েকে সার্বিক ভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা আল কোরআনে এরশাদ করেছেন:

وَانْكِحُوا الْأَيَامَى مِنْكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ إِنْ
ط
يَكُونُوا فُقَرَاءَ يُغْنِهِمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ

“আর তোমাদের মধ্যকার অবিবাহিতদেরকে বিবাহ করিয়ে দাও এবং তোমাদের সৎ ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসীদেরকেও। যদি তারা দরিদ্র হয় তবে আল্লাহ তার অনুগ্রহে তাদেরকে ধনী বানিয়ে দেবেন।” (সূরা নূরঃ ৩২)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদীসেও বিয়ের প্রতি উৎসাহ ও তাকীদের সন্ধান পাওয়া যায়। আবু আইয়ুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, চারটি জিনিষ নবীদের চিরাচরিত সুন্নত: লজ্জা-শরম, সুগন্ধি ব্যবহার, মেসওয়াক করা ও বিবাহ করা। (জামে আত-তিরমিযি: ১০১৮)

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সাথে বের হলাম। আমরা ছিলাম যুবক। (বিবাহের ব্যয় বহনের) সামর্থ্য আমাদের ছিল না। তিনি বললেন, হে যুবক সমাজ, তোমাদের বিবাহ করা উচিৎ। কেননা ইহা দৃষ্টি শক্তিকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে রাখে সুরক্ষিত। আর তোমাদের মধ্যে যার বিবাহ করার সামর্থ্য নেই, সে যেন রোজা রাখে, কেননা রোজা তার যৌন শক্তিকে দমিয়ে রাখবে। (জামে আত-তিরমিযি : ১০১৯)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদেরকে বিবাহ না করে চিরকুমার থাকতে অনুমতি দেননি। জামে আত তিরমিযির ১০২০ ও ১০২১ দুটি হাদীসে তার উল্লেখ করা হয়েছে।

মুসলিম সমাজে সন্তানের লালন পালনের ও উত্তম শিক্ষাদানের পর বালেগ হলে ছেলে-মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা পিতা-মাতা বা অভিভাবকের দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিয়ের ব্যাপারে খুব বেশী গুরুত্ব ও তাকীদ প্রদান করেছেন। তিনি একদিকে অবিবাহিত ও চিরকুমার থাকাকে খুব কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছেন (ইসলামে কুমারিত্ব ও অবিবাহিত নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের কোন নিয়ম নেই – হযরত ইবনে আব্বাস- মুসনাদে আহমদ); অপরদিকে বিয়েকে মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্তির শর্ত হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেনঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে ‘ইবনে মাজাহ’ হাদীস গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বিবাহ আমার সুন্নত-নীতি, অতএব যে ব্যক্তি আমার নীতি অনুযায়ী কাজ করবে না সে আমার দলভুক্ত নয়।”

কাদেরকে বিয়ে করা হারাম

কাদেরকে বিয়ে করা হালাল আর কাদেরকে বিয়ে করা হারাম, হালাল-হারাম নির্ধারণের চূড়ান্ত মালিক মহান আল্লাহই তা ঠিক করে দিয়েছেন। সূরা নিসার ২১, ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াতে একজন পুরুষের জন্য কাদেরকে বিয়ে করা হারাম তা লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন। সে অনুযায়ী যাদেরকে বিয়ে করা যাবে না তারা হলেন:

(১) পিতা, পিতামহ ও মাতামহের স্ত্রী
(২) মা
(৩) কন্যা
(৪) বোন
(৫) ফুফু
(৬) খালা
(৭) ভাতিজী
(৮) ভাগিনী
(৯) দুধ মা
(১০) দুধ বোন
(১১) শাশুড়ী
(১২) সৎ বোন
(১৩) পুত্রের স্ত্রী
(১৪) দুই বোনকে একত্রে
(১৫) সধবা মহিলা
(১৬) মু’মিন পুরুষ ও নারীর জন্য মুশরিক নারী ও পুরুষ
(১৭) মু’মিন পুরুষ ও নারীর জন্য ব্যভিচারী নারী ও পুরুষ (সূরা: নূর-৩)
(১৮) হাদীস থেকে দেখা যায় ফুফু-ভাইঝি এবং খালা-বোনঝিকে একত্রে বিয়ে দেয়া হারাম।
(১৯) তেমনিভাবে মুতা বিয়ে অর্থাৎ সাময়িক ভাবে বিয়ে করা হারাম করা হয়েছে। ইসলামের প্রথম যুগে কোন সফরে গিয়ে সাময়িকভাবে কোন মহিলাকে বিয়ে করা জায়েয করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এরূপ বিয়ে হারাম করা হয়েছে।

কাদেরকে বিয়ে করা যাবে

কোন কোন জিনিস বিবেচনা করে বিয়ে করতে হবে সে সম্পর্কে হাদীসে বিস্তারিত বলা হয়েছে। আমরা সে সব হাদীস উল্লেখ করব। তবে আল্লাহ তা’আলা কাদেরকে বিয়ে করা হালাল করেছেন তা প্রথমে জেনে নিতে হবে। এ ব্যাপারে মূল কথা আল্লাহ তা’আলা যাদেরকে বিয়ে করা হারাম করেছেন তারা ছাড়া সকল পুরুষ-মহিলার মধ্যে বিয়ে জায়েয। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

والمُحصَنَاتُ مِنَ الْمُؤْمِنَاتِ وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ
قَبْلِكُمْ إِذَا آتَيْتُمُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ

“তোমাদের জন্য হালাল করা হল সতী-সাধ্বী মু’মিনা নারীদেরকে এবং তোমাদের পূর্বেকার আহলে কিতাবদের সতী-সাধ্বী নারীদেরকে যখন তোমরা তাদের প্রাপ্য (মোহর) প্রদান কর এবং তোমরা না কর প্রকাশ্য ব্যভিচার অথবা গোপন প্রণয়।” (সূরা মায়েদা : ৫)

বিয়ের ব্যাপারে কোন কোন ইসলামী শাস্ত্রবিদ ‘কুফু’ বা সমতার কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে স্বাধীন পুরুষের জন্য স্বাধীন নারী, দাস পুরুষের জন্য দাসী নারী বিবেচনায় আসতে পারে। মু’মিন পুরুষের জন্য মোশরেক, ব্যভিচারী, ও অপবিত্র নারী বিয়ে করা নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَلَا تَنكِحُوا الْمُشْرِكْتِ حَتَّى يُؤْمِنَ ط وَلَامَةٌ مُؤْمِنَةٌ خَيْرٌ مِنْ مُّشْرِكَةٍ وَلَوْ أَعْجَبَتْكُمْ ج وَلَا تُنكِحُوا الْمُشْرِكِينَ حَتَّى يُؤْمِنُوا وَلَعَبَدُ مُؤْمِنٌ خَيْرٌ مِّنْ مُشْرِكِ وَلَوْ أَعْجَبَكُمْ

“ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা কোন মোশরেক নারীকে বিয়ে করো না, মু’মিনা দাসী মোশরেক নারী থেকে উত্তম যদিও তারা তোমাদের নিকট আকর্ষণীয় হয়; মু’মিনা নারীরা যেন মোশরেক পুরুষকে বিয়ে না করে, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে, মু’মিন দাস, মোশরেক পুরুষের থেকে উত্তম যদিও তারা।
তোমাদের নিকট আকর্ষণীয় হয়।” (সূরা বাকারা: ২২১)

الحبيتُ لِلْخَبِيثِينَ وَالْخَبِيثُونَ لِلْخَبِيثُتِ ، وَالطَّيِّبَتُ لِلطَّيِّبِينَ وَالطَّيِّبُونَ للطبيبت

“অপবিত্র নারীগণ অপবিত্র পুরুষদের জন্য আর অপবিত্র পুরুষগণ অপবিত্র নারীদের জন্য, পবিত্র নারীগণ পবিত্র পুরুষের জন্য এবং পবিত্র পুরুষগণ পবিত্র নারীদের জন্য।” (সূরা নূর: ২৬)

الزَّانِي لَا يَنْكِحُ إِلَّا زَانِيَةً أَوْ مُشْرِكَةً وَالزَّانِيَةُ لَا يَنكِحُهَا إِلَّا زَانٍ أَوْ مُشْرِكٌ وَحُرِّمَ ذَلِكَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ

“ব্যভিচারী পুরুষ যেন ব্যভিচারী নারী বা মোশরেক মহিলা ভিন্ন অন্য কাউকে বিয়ে না করে, ব্যভিচারী নারী যেন ব্যভিচারী পুরুষ বা মোশরেক ভিন্ন অন্য কাউকে বিয়ে না করে, কেননা মু’মিনদের জন্য তা হারাম করা হলো।”
(সূরা নূর ও ৩)

এসব আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মোশরেক নারী-পুরুষ, ব্যভিচারী নারী-পুরুষ, অপবিত্র নারী-পুরুষের মধ্যে যেমন বিয়ে হতে পারে, তেমনি মু’মিন নারী-পুরুষের মধ্যেও বিয়ে হতে পারে। এটাই এক সাধারণ কুফু বা সমতা। এমনি কাফের এলাকার কাফের স্বামী বা স্ত্রী ত্যাগ করে মুসলিম এলাকায় মু’মিন স্বামী বা স্ত্রী গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।

وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ أَنْ تَنْكِحُوهُنَّ إِذَا أَتَيْتُمُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ وَلَا تُمْسِكُوا بِعِصَمِ الْكَوَافِرِ وَسَتَلُوا مَا أَنْفَقْتُمْ وَلْيَسْتَلُوا مَا أَنْفَقُوا

“(যারা কাফের স্বামী রেখে মক্কা থেকে হিজরত করে আসে) তাদের বিয়ে করা তোমাদের জন্য গোনাহের কাজ নয় যখন তোমরা তাদেরকে মোহর প্রদান কর এবং তোমরা তোমাদের কাফের স্ত্রীর সম্পর্ক টিকিয়ে রেখো না এবং তাদের জন্য যা খরচ করেছ তা ফিরিয়ে নাও এবং কাফেররা যা খরচ করেছে তা ফিরিয়ে নিক।” (সূরা মোমতাহিনা: ১০)

বর্তমান সমাজে শিক্ষা-দীক্ষা, ধন-সম্পদ ও বংশীয় মর্যাদার ভিত্তিতে কুফু বা সমতা নির্ধারণেই অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। অথচ হাদীসে দ্বীনী চেতনার গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে।

আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার দ্বীনী চেতনা ও চারিত্রিক মান সম্পর্কে তোমর সন্তুষ্ট, সে যদি তোমাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তবে তার সাথে বিয়ে দাও। যদি তা না কর তবে পৃথিবীতে ফেতনা-ফাসাদ ও চরম বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। (তিরমিযি: ১০২২)

অপর কোন কোন হাদীসে তিন অথবা চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে।
জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মহিলাদেরকে তাদের দ্বীনী চেতনা, ধন-সম্পদ ও সৌন্দর্য দেখে বিয়ে করা হয়। তুমি দ্বীনদার পাত্রীকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিবে, তোমার হাত কল্যাণে পরিণত। হবে। (জামে আত-তিরমিযি: ১০২৪)

“হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ চারটি কারণ বিবেচনা করে কোন মহিলাকে বিয়ে করা হয়; ধন-সম্পদ, বংশমর্যাদা, সৌন্দর্য ও দ্বীনী চেতনা। অতএব দ্বীনী চেতনাকে অগ্রাধিকার দাও, তোমার হাত কল্যাণে পূর্ণ হয়ে যাবে।”

এসব হাদীস থেকে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম পাত্র-পাত্রীর দ্বীনী চেতনা ও নৈতিক চারিত্রিক মানের প্রতিই বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং অগ্রাধিকার দিতে বলেছেন।

বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী দেখে নেয়া

বিয়ের প্রস্তাব করা হলে, আলোচনার সময়কালে ভালভাবে পাত্র-পাত্রীর সকল দিক বিস্তারিতভাবে জেনে নিতে হবে। সব কিছু বিবেচনা না করে তাড়াহুড়ার মাধ্যমে বিয়ে সম্পাদন ঠিক নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেনঃ

وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا عَرَّضْتُمْ بِهِ مِنْ خِطْبَةِ النِّسَاءِ أَوْ أَكْنَنْتُمُ فِي أَنْفُسِكُمْ طَ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ سَتَذْكُرُوهُنَّ وَلَكِنْ لَا تُوَاعِدُوهُنَّ سِرًّا إِلَّا أَنْ تَقُولُوا قَوْلاً مَعْرُوفًا طَ وَلَا تَعْزِمُوا عُقْدَةَ النِّكَاحِ حَتَّىٰ يَبْلُغَ الكتبُ أَجَلَهُ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهُ يَعْلَمُ مَا فِي أَنفُسِكُمْ فَاحْذَرُوهُ جِ غَفُورٌ حَلِيمٌ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ .

“এতে তোমাদের কোন গুনাহ নেই যে, এসব নারীদের বিবাহের প্রস্তাব সম্পর্কে ইঙ্গিতে কোন কথা বল অথবা নিজেদের অন্তরে তা গোপন রাখ, আল্লাহ জানেন যে শিগগীর তোমরা তাদের ব্যাপারে আলোচনা করবে কিন্তু তাদেরকে গোপনে প্রতিশ্রুতি দিও না। হ্যা, তবে নিয়ম মাফিক আলোচনা করতে পার। আর যতক্ষণ না নির্দিষ্ট সময় পূর্ণ হয়ে যায় ততক্ষণ বিবাহের চুক্তির সংকল্প করো না। মনে রেখো, আল্লাহ তোমার অন্তরে কি রয়েছে তা জানেন। তাই সতর্ক থাক এবং জেনে রেখো যে আল্লাহ ক্ষমাকারী ও ধৈর্যশীল।” (সূরা বাকারা: ২৩৫)

বিয়ের পূর্বে কনে দেখে নেয়ার কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাবে বলেছেন। মুগীরা ইবনে শোয়েব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি এক মহিলার কছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন: তাকে দেখে নাও, এটা তোমাদের উভয়ের মধ্যে ভালবাসার সৃষ্টি করবে। (তিরমিযি: ১০২৫)

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেনঃ এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলেনঃ আমি আনসারীদের একটি মহিলাকে বিবাহ করতে ইচ্ছা করেছি। হুজুর বলেন- প্রথমে তাকে দেখে নাও। কেননা ‘আনসারীদের কোন কোন লোকের চোখে একটি দোষ থাকে। (মুসলিম, মেশকাত: ২৯৬৫)

হযরত জাবের (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন তোমাদের কেউ কোন নারীর বিবাহের প্রস্তাব দেয় তখন যদি তাদের পক্ষে তার এমন কোন (জায়েয) অঙ্গ দেখা সম্ভব হয় যা তাকে বিবাহের দিকে ডাকে তবে যেন সে তা দেখে। (আবু দাউদ, মেশকাত: ২৯৭৩)

কোরআনের আয়াত ও হাদীসসমূহ থেকে জানা গেল যে বিয়ের পূর্বে পাত্রীকে দেখে নেয়া উত্তম। এতে করে পারিবারিক সম্পর্ক সৃষ্টি ও ভবিষ্যত ভালবাসার সম্পর্ক দৃঢ় হয়।

ইজাব কবুলসহ বিয়ে সম্পর্কিত এ পর্যন্তকার আলোচনার পর চারটি বিষয় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।

(১) বিয়ের ঘোষণা
(২) বিয়ের সাক্ষ্য
(৩) মেয়েকে মোহরানা প্রদান
(৪) অভিভাবকের অনুমতি

বিয়ের ঘোষণা

(১) বিয়ের ঘোষণা : ইসলামের বিধানমতে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বিয়ে করতে হবে। চুরি করে বা গোপনে বিয়ে করলে বিয়ে বৈধ হবে না।
“আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা বিবাহের ঘোষণা দিয়ে বিবাহের কাজ মসজিদে সম্পন্ন করবে এবং এতে ঢোল পিটাবে।” (আত-তিরমিযি-১০২৭)

বিয়ের সাক্ষ্য

(২) বিয়ের সাক্ষ্যঃ বিয়ের জন্য দুইজন সাক্ষ্য জরুরী। সাক্ষী ছাড়া বিয়ে হতে পারেনা।
“ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে সব নারী সাক্ষ্য ছাড়া নিজেদেরকে বিবাহ দেয় তারা ব্যভিচারিণী,
যেনাকারিণী।” (আত-তিরমিযি- ১০৪০)

এর অর্থ কেবলমাত্র একজন পুরুষ ও একজন মহিলা ইজাব-কবুলের মাধ্যমে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে ফেলতে পারে না, অবশ্যই কমপক্ষে দু’জন সাক্ষী প্রয়োজন তবে কোন গোপন বিয়েতে দু’জন সাক্ষী যোগাড় হলেও প্রকাশ্যে ঘোষণা ছাড়া বিয়ে বৈধ হবে না।

মেয়ের মোহর নির্ধারণ ও আদায়

(৩) মেয়ের মোহর নির্ধারণ ও আদায়: আল্লাহর কিতাবেই (আল কোরআনে) মোহরের কথা বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। কোন মোহর নির্ধারণ ব্যতিত বিয়ে হতে পারেনা। এটা মেয়ের প্রাপ্য। যেমন বলা হয়েছে:

والْمُحْصَنَتُ مِنَ الْمُؤْمِنَتِ وَالْمُحْصَنَتْ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَبَ مِنْ قَبْلِكُمْ إِذَا أَتَيْتُمُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ

“(তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে) সতী-সাধ্বী নারীদেরকে অথবা তোমাদের পূর্বেকার আহলে কেতাবের সতী-সাধ্বী নারীদেরকে যখন তোমরা
তাদের প্রাপ্য (মোহর) প্রদান কর।” (সূরা মায়েদা : ৫)

বিয়ে যেমন নারী-পুরুষের একত্রে পারিবারিক জীবনের মাধ্যমে যৌন সম্ভোগের চুক্তিনামা, তেমনি মোহর হলো স্বামীর পক্ষে স্ত্রীর যৌনাঙ্গ ব্যবহারের অনুমতিপত্র। আল কোরআনে বলা হয়েছে:

فَمَا اسْتَمْتَعْتُمْ بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً ، وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا تَرَاضَيْتُمْ بِهِ مِنْ بَعْدِ الْفَرِيضَةِ

“আর তোমরা (দাম্পত্য জীবনে) যে স্বাদ গ্রহণ করো তার বিনিময়ে একটি অবশ্য করণীয় ফরজ হিসাবে তাদের মোহর পরিশোধ করো, আর নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর যদি তোমরা পরস্পর একমত হয়ে যাও তাতে কোন পাপ নেই।”
(সূরা নিসা: ২৪)

মোহরের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
“বিয়েতে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যা পূরণ করতে হবে তা হলো যার বিনিময়ে তোমরা যৌনাঙ্গকে হালাল কর (অর্থাৎ মোহর)”।

স্বামীকে পূর্ণ সন্তোষ সহকারে মোহর প্রদান করতে হবে। কারণ আল্লাহর বিধান মতেই তা স্ত্রীর অধিকার। তাই এ ব্যাপারে লোক দেখানো ভূমিকা গ্রহণ, মনে মনে তা পরিশোধ না করার চিন্তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

“যে ব্যক্তি কোন স্ত্রীলোককে মোহর দানের শর্তে বিয়ে করে অথচ তা না দেয়ার নিয়ত করে সে যিনাকার।”

তাই আল কোরআন মনের সন্তোষ সহকারে মোহর প্রদানের নির্দেশ প্রদান করে:

وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً طَ فَإِنْ طِبْنَ لَكُمْ عَنْ شَيْ مِنْهُ نَفْسًا
فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَرِيئًا –

“তোমরা সন্তোষ সহকারে স্ত্রীলোকদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও, তবে যদি তারা স্বেচ্ছায় কিছু অংশ ছেড়ে দেয় তবে তা আনন্দের সাথে মজা করে খেতে পার।” (সূরা নিসাঃ ৪)

মোহর স্ত্রীর প্রাপ্য, স্বামীকে ফরজ মনে করে তা আদায় করতে হবে। তবে স্ত্রী যদি কিছু অংশ ছেড়ে দেয় তাহলে স্বামী তা পরিশোধ করা থেকে মুক্ত হবে।

মোহরের পরিমান

মোহরের পরিমান স্বামীর অবস্থানুযায়ী বেশী বা কম হতে পারে। উভয় পক্ষ একমত হয়ে এ ব্যাপারে যা নির্ধারণ করবে তাই ধার্য হবে। পূর্ণ বা আংশিক আদায় হতে পারে আবার ভবিষ্যতে পরিশোধ করা হবে এ শর্তেও বিয়ে হতে পারে। সামান্য মাত্র মোহরেও রাসূলের যুগে বিয়ে হয়েছে বলে হাদীসে দেখা যায়।

আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে রাবিয়া (রাঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত, ফাযারা গোত্রের এক মহিলা এক জোড়া জুতার বিনিময়ে বিয়ে করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি এক জোড়া জুতার বিনিময়ে তোমার জীবন ও মাল সঁপে দিতে রাজী হয়ে গেলে? সে বলল, হ্যাঁ। রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এ বিয়ে অনুমোদন করেন। অপর হাদীসে দেখা যায় পুরুষ ব্যক্তিটির মোহর হিসাবে দেয়ার কিছুই না থাকায় কোরআনের সূরা পড়ানোর বিনিময়ে (মোহর) এক মহিলাকে বিয়ে দেয়া হয়। আবার খুব বেশী মোহরের মাধ্যমে বিয়েকেও সাহাবাদের আমলে পছন্দ করা হত না বলে দেখা যায়।

আবুল আজফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেছেন, সাবধান, তোমরা নারীদের মোহর উচ্চ হারে বৃদ্ধি করনা। কেননা তা যদি দুনিয়াতে সম্মানের বস্তু অথবা আল্লাহর কাছে তাকওয়ার বস্তু হত তবে তোমাদের চেয়ে আল্লাহর নবী এ ব্যাপরে বেশী উদ্যোগী হতেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বার উকিয়ার বেশী মোহরে তার কোন স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন অথবা তার কোন কন্যাকে বিয়ে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। (তিরমিযি- ১০৫১)

উপরের হাদীসসমূহ থেকে জানা গেল মোহরের পরিমাণ একবারে সামান্য হওয়া যেমন ঠিক নয় যদিও তাতে বিয়ে হয়ে যাবে, তেমনি খুব বেশী আকাশচুম্বী পরিমাণও নয় যথার্থ, বিশেষ করে তা আদায়ের কোন বাধ্যবাধকতা যদি না থাকে। বরং তা আদায়ের নিয়ত না থাকলে তো বিয়েই বৈধ হবে না।

অভিভাবকের অনুমতি

বিয়েতে অভিভাবকের অনুমতি যেমন প্রয়োজন তেমনি পাত্রীরও সম্মতি দরকার। হাদীসে দু’ব্যাপারেই স্পষ্ট কথা রয়েছে।

আবু মুসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ অভিভাবক ছাড়া বিয়ে হতে পারেনা। (তিরমিযি- ১০৩৮)

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কোন মহিলা অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ করলে সে বিবাহ বাতিল, তার এ বিবাহ বাতিল, তার এ বিবাহ বাতিল, কিন্তু তার স্বামী যদি তার সাথে সহবাস করে থাকে তবে তার লজ্জাস্থান হালাল মনে করে সংগত হওয়ার কারণে তার কাছে মোহরের অধিকারী হবে। (আত-তিরমিযি : ১০৩৯)

উপরের হাদীস দুটিতে অভিভাবকের অনুমতির কথা যেমন স্পষ্ট করে বলা হয়েছে তেমন অপর দুটি হাদীসে পাত্রীর অনুমতির কথাও বলা হয়েছে সুস্পষ্টভাবে।

“হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বালেগা বিবাহিতা নারীর অনুমতি ব্যতিত যেমন বিয়ে দেয়া যাবে না, তেমনি বালেগা কুমারীকেও তার অনুমতি ছাড়া বিয়ে দেয়া যাবে না, সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন তার অনুমতি কিভাবে নেয়া যেতে পারে (কথা না বললে)। তিনি বলেন, তার চুপ থাকাই অনুমতি।” (বুখারী ও মুসলিম, মেশকাত: ২৯৯৪)

এভাবে দেখা যায় অভিভাবকের অনুমতি যেমন প্রয়োজন তেমনি বালেগা পাত্রীর সম্মতিও প্রয়োজন। তাই এ দুটি বিষয় পূরণ হলেই বিয়ে যথার্থভাবে সিদ্ধ হবে। কোন এক পক্ষ বিয়ে দিলে সে বিয়ে সম্পূর্ণ হয় না।

: হযরত খেমশা বিনতে খিজাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তার বাপ তাকে বিয়ে দিল অথচ সে তখন পূর্ব বিবাহিতা, সে তা না-পছন্দ করল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নিকট এ ব্যাপারে আসল, তিনি এ বিয়ে ভেঙ্গে দিলেন। (বুখারী, মেশকাত-২৯৯৫)

“হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক বালেগা কুমারী মেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে জানালো যে তার বাপ তার অমতে তাকে বিয়ে দিয়েছেন। তখন নবী করীম (সাঃ) তাকে এ স্বামীর সাথে থাকা বা না থাকার অধিকার দিলেন।” (আবু দাউদঃ মেশকাত- ৩০০২)

এসব হাদীস থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে ওলী বা অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া যেমন বিয়ে যথার্থ হয় না তেমনি বালেগা মহিলার বিয়েতে সম্মতি প্রয়োজন। তার সম্মতি ছাড়া বিয়ে কার্যকর হয় না।

বিয়েতে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে।

একটি হলো বিয়ের খুতবা, অপরটি হলো বিয়ের পর ওয়ালীমা।

বিয়ের খুতবা

বিয়ের মূল ইজাব-কবুলের পর বিয়ের খুতবা পড়তে হয়। হাদীস গ্রন্থ সমূহে দেখা যায় বিয়ের খুতবায় হাজাতের তাশাহুদ ও তিনটি কুরআনের আয়াতের কথা বলা হয়েছে। জামে আত-তিরমিযির ১০৪১ নং হাদীসে উক্ত তাশাহুদ ও আয়াতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

–
الحمد لله نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ وَنُؤْمِنُ بِهِ وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْهِ
وَنَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا مَنْ يَهْدِهِ اللَّهُ فَلَا
مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ – وَنَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ
وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَنَشْهَدَ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ – أَرْسَلَهُ بِالْحَقِّ

بَشِيرًا وَنَذِيرًا اَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَخَيْرَ الْهَدْيِ
هَدْيُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَشَرُّ الْأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ
بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وَكُلُّ ضَلَالَةٍ فِي النَّارِ – مَنْ يُطِعِ اللَّهَ
وَرَسُولَهُ فَقَدْ رَشَدَ وَمَنْ يَعْصِهِمَا فَإِنَّهُ لَا يَضُرُّ إِلَّا نَفْسَهُ – أَعُوْذُ
بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ * بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ * يَا أَيُّهَا النَّاسُ
اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا
وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً – وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَأَلُونَ بِهِ
وَالْأَرْحَامَ – إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا – يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ
حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ – يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ
وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا – يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ
وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا * (أَبُو دَاوُدَ, زَادَ الْمَعَادِ
الجُزْءُ الثَّانِي ٤٠٤)
–
[কুরআনের তিনটি আয়াত হলো: সূরা আলে ইমরান- ১০২, সূরা নিসা-১, সূরা আহযাব-৭০,৭১]

বিয়ের খুতবায় তাশাহুদের মাধ্যমে বলা হচ্ছে:
১) সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর;
২) সাহায্য ও ক্ষমা কেবল মাত্র আল্লাহর নিকট চাওয়া যায়;
৩) হেদায়াত গোমরাহীর মালিক আল্লাহ;
৪) আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই
৫) মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল

আর খুতবায় দ্বিতীয় অংশ কোরআনের তিনটি আয়াতে বলা হচ্ছে:

১) তোমরা কেবলমাত্র আল্লাহকেই ভয় করো;
২) আমৃত্যু মুসলিম (অনুগত) হয়ে থাকো;
৩) দুনিয়ার অগণিত মানুষ আল্লাহরই সৃষ্টি;
৪) আল্লাহর দোহাই দিয়েই নিজেদের অধিকারের দাবি করো;
৫) আত্মীয়তার অধিকার বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকো;
৬) সঠিক কথা বলো;
৭) আল্লাহ তোমাদের আমলের সংশোধন করে দিবেন;
৮) আল্লাহ তোমাদের গোনাহসমূহ মাফ করে দিবেন;
৯) আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করো;
১০) আল্লাহ তোমাদের কাজ পর্যবেক্ষণ করছেন।

মূলকথা হলো ঈমানদার বান্দা জীবন পথে চলার ক্ষেত্রে সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে চলবে, সকল কাজ আল্লাহর উপর সোপর্দ করবে, সকল কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি খেয়াল রাখবে। পরিবার গঠনের শুভ সূচনায় আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আস্থা সৃষ্টি খুতবার লক্ষ্য।

বিবাহের ওলীমা

বিবাহের আকদ সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর বিবাহের ওলীমা অনুষ্ঠান রাসূল (সাঃ)-এর যুগেই চালু হয়েছিল বলে হাদিসে দেখা যায়। নবী করীম (সাঃ)-এর সকল বিয়েতেই তিনি ওলীমার ব্যবস্থা করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে খুব জাঁকজমকসহ উন্নত মানের খাবারের ব্যবস্থা করতেই হবে এমন কোন কথা নেই। রাসূল (সাঃ)-এর বিয়েতে ছাতু ও খেজুর দিয়েও ওলীমা হয়েছে। মোটকথা, বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে একত্রে কিছু খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হওয়া দরকার। কেবলমাত্র বাছাইকৃত কিছু ধনী আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে নয়, বরং ধনী-গরীব সকল আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত দেওয়া দরকার।

আনাছ ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ)-এর গায়ে (বা কাপড়ে) হলুদ রং-এর চিহ্ন দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ কি ব্যাপার? তিনি বলেন, আমি একটি খেজুরের আটি সম সোনার বিনিময়ে এক মহিলাকে বিয়ে করেছি। মহানবী (সাঃ) বলেনঃ আল্লাহ তোমায় বরকত দান করুন, একটি বকরী দিয়ে হলেও ওলীমার (বিবাহ ভোজ) আয়োজন কর। (তিরমিযী- ১০৩২)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিবি জয়নব বিনতে জাহাশ ও বিবি ছাফিয়ার বিয়ের পর ওলীমার ব্যবস্থা করেছিলেন বলে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। তাই বিয়ের পর যার যার সাধ্যমত ওলীমার ব্যবস্থা করা দরকার।

স্ত্রীর সংখ্যা নির্ধারণ

ইসলামের আবির্ভাবকালে সমাজে বহুবিবাহ ব্যবস্থা চালু ছিল। একজন পুরুষের শতাধিক স্ত্রীও বর্তমান ছিল। ইসলাম এ সংখ্যাকে চার এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে। কোরআনে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ

وَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تُقْسِطُوا فِي الْيَتَمَى فَانْكِحُوا مَا طَابَ لَكُمْ مِّنَ النِّسَاءِ
مثنى وَثُلُثَ وَرُبَعَ ، فَإِنْ خِفْتُمْ اَلا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً أَوْ مَا مَلَكَتْ
أَيْمَانُكُمْ ذَلِكَ أَدْنَى أَلا تَعُولُوا

“যদি তোমরা ইয়াতীম মেয়েদের মধ্যে সুবিচার করতে ভয় পাও, তাহলে অন্য স্ত্রীলোকদের মধ্যে থেকে দুই, তিন, চারজনকে বিয়ে কর, আর যদি তাদের মধ্যেও আশঙ্কা করার আশঙ্কা থাকে তবে একটাই। অথবা যে দাসীগণ তোমাদের মালিকাধীন আছে। এভাবেই সবচেয়ে কম অন্যায় হবার সম্ভাবনা রয়েছে।” (সূরা নিসাঃ ৩)

এ আয়াতের মাধ্যমেই আল কোরআনে চার বিয়ের কথা বলা হয়েছে। এখানে দেখা যায়, ইয়াতীম মেয়েদের ধন-সম্পদ, রূপ-যৌবন যা একজন ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে রয়েছে সে ব্যাপারে ইয়াতীম মেয়েকে বিয়ে করলে মোহরানা প্রদান ও যথাযোগ্য মর্যাদা দানে সুবিচার করার ভয় থাকলেই অন্য স্ত্রীলোক থেকে তিন বা চার বিয়ের কথা বলা হয়েছে। এ কোন আদেশ নয় বরং অনুমতি। এ অনুমতি দানের পর পুনরায় বলা হয়েছে দুই, তিন বা চার যতজনই বিয়ে কর তাদের মধ্যে ইনসাফ কায়েম করতে হবে, ইনসাফ করতে ভয় বা আশঙ্কা থাকলে, ইনসাফ করতে সক্ষম হবে না মনে করলে কেবলমাত্র একটি বিয়ে করেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে, প্রয়োজন তার যতই থাকনা কেন। এমতাবস্থায় একাধিক বিয়ে করলে অন্যায় করা হবে বলে আল্লাহ জানিয়ে দিয়ে বলেছেন তাই এক বিয়েই সবচেয়ে কম অন্যায়মূলক।

এ আয়াত থেকে চার বিয়ের অনুমতি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও বিবেচনা প্রসূত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে এ শর্ত পালনের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন বলে দেখা যায়। এমনকি তিনি পালাবণ্টন করে এক এক স্ত্রীর সাথে এক এক রাত কাটিয়েছেন। সর্ব ব্যাপারে সাধ্যমত ইনসাফ কায়েমের চূড়ান্ত চেষ্টা করেছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের দশজন স্ত্রী এক সাথে রাখা

রাসূলের জীবনের শেষ পর্যায়ে তার পরিবারে একত্রে দশজন স্ত্রী বর্তমান ছিল। এ নিয়ে কথা উঠে। রাসূলের সময়েও কাফের, মোশরেক ও মোনাফেকরা কথা তুলেছিল। বর্তমান সময়েও কেউ কেউ কথা তোলে নবী মোহম্মদ (সাঃ) খুব বেশী যৌন তাড়িত ছিলেন। কিন্তু পূর্ণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাসূলের জীবনের ২৫ বছর বয়স থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত দীর্ঘ ২৫ বছর যা যৌবনের ভরা মৌসুম, তিনি তার চেয়ে ১৫ বছর বয়সে বড় এক মহিলা বিবি খাদীজাকে (রাঃ) নিয়ে সংসার জীবন যাপন করেছেন। বিবি খাদীজার মৃত্যুর পর আরেকজন প্রৌঢ়া বিধবা মহিলা বিবি সওদা (রাঃ) কে বিয়ে করেন। পরবর্তী জীবনে বাস্তবে বৃদ্ধকালে বিভিন্ন পরিস্থিতি, সামাজিকতা রক্ষা, নতুন ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বৃহত্তর স্বার্থে তিনি বিয়ে করেছিলেন। হযরত আয়েশা ও হযরত হাফসা (রাঃ) কে হযরত আবু বকর ও হযরত উমরের সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে, হযরত জয়নাবকে পালিত পুত্রের তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করে আরবের প্রচলিত রসম ভঙ্গ করার লক্ষ্যে, আবু সুফিয়ানের কন্যা, ইহুদী প্রধান আখতাব বিন হুয়াইয়ের কন্যা (সাফিয়া), গোত্র প্রধানের কন্যা এসবকে সামাজিক সংহতি কায়েমের লক্ষ্যে তিনি বিয়ে করেছিলেন। তার এসব বিয়ে যৌন লালসার কারণে মোটেও ছিল না, ছিল অন্যান্য কারণে। আর আল্লাহ তায়ালা তাকে এ ব্যাপারে বিশেষ অনুমতি প্রদান করেছিলেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

خَالِصَةً لَّكَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ

“এ হলো আপনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, মু’মিনদের জন্য নয়।”
(সূরা আহযাব: ৫০)

এমনকি পরবর্তী আয়াতে রাসূলের জন্য স্ত্রীদের মধ্যে ইনসাফ কায়েম এবং পালাবণ্টনের শর্তও রহিত করেছেন।

বর্তমানে মুসলিম সমাজে বিয়ে

মুসলিম সমাজে বিয়ের ইসলামী ধারণা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম সমাজে বিয়ের চিত্র তার সম্পূর্ণ বা অনেকটা ভিন্ন রূপ। নিম্নে আমরা বর্তমান মুসলিম সমাজের বিয়ে সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পেশ করছি।

বিয়ে ও বর্তমান যুব সমাজের মনমানসিকতা

(১) বিয়ে ও বর্তমান যুব সমাজের মনমানসিকতা:
আল্লাহ তা’য়ালা বিয়ের উপযুক্ত যুবক-যুবতী যাদের স্বামী বা স্ত্রী নেই তাদের বিয়ের ব্যবস্থার কথা বলেছেন এবং এও বলেছেন যে যাদের দারিদ্র্যের ভয় রয়েছে তাদেরকে আল্লাহ তা’য়ালা বিয়ের কারণে ধনী করে দিবেন। একান্ত যারা দারিদ্রের ভয়ে বিয়ে করবে না তাদেরকে আল্লাহ তা’য়ালা সংযম অবলম্বন করতে বলেছেন। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যুব সম্প্রদায় যেন বিয়ে করে কারণ তা তাদের চোখ ও যৌনাঙ্গকে হেফাজত করবে। আর যারা দারিদ্রের কারণে বিয়ে করবে না তারা যেন রোজা রাখে। কারণ রোজা যৌন ক্ষমতাকে দমিয়ে রাখে।

বর্তমান সময়ের অবস্থা সম্পূর্ণ তার বিপরীত। বিয়ের উপযুক্ত অধিকাংশ যুবক-যুবতী আজ বিয়ে না করে নানা যৌন উত্তেজনামূলক কার্যক্রমে জড়িত হয়ে পড়ছে। অশ্লীল ছায়াছবি, ভিডিও ক্যাসেট, মেয়ে-পুরুষের মেলামেশা, অবৈধ যৌনাচারের সহজ সুযোগ-সুবিধা, প্রকাশ্য বেশ্যালয়, সহশিক্ষা, সহচাকুরী ইত্যাদি সামাজিক পবিত্রতাকে করে ফেলেছে একবারেই কলুষিত, দূষিত ও পুঁতিগন্ধময়। এহেন সমাজ চিত্রের সাথে ইসলামী সমাজচিত্রের কোন মিল নেই। আল্লাহ ও তার রাসূল যেখানে বলেছেন যে যুব সম্প্রদায় হয় বিয়ে করে ঘরসংসারী হোক অথবা সংযম অবলম্বন করে রোজা রাখুক। সেক্ষেত্রে যুব সমাজের অধিকাংশ যথাসময়ে তো বিয়ে-সাদী করবেই না অথচ সংযম বিরোধী যাবতীয় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে।

পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে যেখানে দ্বীনী চেতনা ও চারিত্রিক মানকে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে সেখানে আজকে গুরুত্ব দেওয়া হয় শিক্ষা-দীক্ষা, ধন-দৌলত ও সৌন্দর্যকে। দ্বীনী চেতনার চেয়ে দুনিয়াবী দৃষ্টিভঙ্গিই আজ অগ্রাধিকার লাভ করে, কিছু সংখ্যক ব্যতিক্রম ছাড়া।

বিয়ের অনুষ্ঠানাদিতে শরীয়তবিরোধী কার্যক্রম

(২) বিয়ের অনুষ্ঠানাদিতে শরীয়তবিরোধী কার্যক্রম:
বিয়ে অনুষ্ঠান সহ বিয়ের আগে ও পরে নানা ধরনের শরীয়তবিরোধী কার্যক্রম আজ সমাজে চালু হয়ে গেছে। সমাজে পর্দাপ্রথা যথাযথভাবে চালু না থাকার কারণে এসব অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উন্নতির কারণে ফটোগ্রাফী ও ভিডিও ব্যবস্থার প্রচলন চালু হচ্ছে। বিয়ের পূর্বে হলুদ অনুষ্ঠান, বিয়ের দিনে বিয়ের অনুষ্ঠান এবং বিয়ের পর ওলীমার বদলে বৌভাতের মাধ্যমে বধূবরণ অনুষ্ঠানে বহুবিধ ইসলামবিরোধী কাজকর্ম চালু হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো বেপর্দা ব্যবস্থা। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, হাস্যরস, কৌতুক ইত্যাদি বিয়ের পবিত্র অনুষ্ঠানকে একেবারেই শরীয়ত, ইসলাম ও নৈতিকতা বিরোধী করে ফেলেছে।

বেপর্দা ব্যবস্থা ও অবাধ-মেলামেশার কারণে নারী-পুরুষের বৈধ বিবাহের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে কমে গেছে। যখন কোন জিনিষ সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যায় তখন সে জিনিসের প্রতি আকর্ষণ কমে যাওয়া স্বাভাবিক। সে কারণেই যুবক-যুবতী বিয়ের বন্ধনের চেয়ে মুক্ত জীবনে যৌন অনাচারে লিপ্ত হতে বেশি উদ্যোগী ও উৎসাহিত হয়ে পড়েছে।

যেখানে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ

وَالْمُحْصَنَتُ مِنَ الْمُؤْمِنَتِ وَالْحُصَنْتُ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَبَ مِنْ
قَبْلِكُمْ إِذَا أَتَيْتُمُوهُنَّ اُجُورَهُنَّ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسْفِحِينَ وَلَا مُتَّخِذِى
اخدان ط

“তোমাদের জন্য হালাল করা হল সতী-সাধ্বী মু’মিনা নারীদেরকে এবং তোমাদের পূর্বেকার আহলে কিতাবদের সতী-সাধ্বী নারীদেরকে যখন তোমরা তাদেরকে তাদের প্রাপ্য (মোহর) প্রদান কর এবং তোমরা না কর প্রকাশ্য ব্যভিচার অথবা গোপন প্রণয়।” (সূরা মায়েদা : ৫)

সেখানে আমাদের যুবক-যুবতীরা বিবাহে এগিয়ে আসেনা বরং সমাজে আজ চালু হয়েছে প্রকাশ্যে বেশ্যালয়। আর গোপনে চলে কত প্রণয় ও ব্যভিচার- কে তার খবর রাখে? যেনা-ব্যভিচারের জন্য সমাজে আজ কোন শাস্তির বিধান নেই। পারস্পরিক সম্মতিপূর্ণ ব্যভিচারে আজ কোন দোষ নেই, জবরদস্তিমূলক ব্যভিচারের জেল জরিমানার কিছু শাস্তির বিধান আছে। অবাধ মেলামেশার কারণে ব্যাপকভাবে যেনা ব্যভিচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের কলা-কৌশল যেনা-ব্যভিচারকে আরও সহজ ও নিরাপদ করে তুলেছে। আজ পত্রপত্রিকায় বহু রকমের নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণের ঘটনা জানা যাচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে ধর্ষণের পর আবার হত্যার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা কত নিষ্ঠুর, মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। স্বাভাবিক গতিতে বিয়ে শাদি হওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতি বিরাট বাধাস্বরূপ। বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু রেখেছে প্রকাশ্য ব্যভিচার ও বেশ্যালয়। অশ্লীল ছায়াছবি, ফটোগ্রাফী, ডিসএন্টেনা, যেনা-ব্যভিচারকে উৎসাহিত করছে। অপরদিকে সমাজিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কারণে বিয়ে হয়ে গেছে কঠিন। এ অবস্থা সম্পূর্ণ ইসলামের বিপরীত।

মোহরের পরিমাণ

মোহরের পরিমাণের ক্ষেত্রেও আমাদের সমাজে অনেক শরীয়তবিরোধী পন্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। বর্তমান সময়ে মোহর কোরআন-হাদিস অনুযায়ী স্ত্রী অঙ্গ হালাল করার পরিবর্তে একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নগদ জেওরপাতি দেওয়া ছাড়া ৫ লাখ, ১০ লাখের দেনমোহর আজ অনেক ক্ষেত্রেই পরিশোধ করা হচ্ছে না। বরং ঘোষিত অংকের অর্থ স্ত্রীকে পরিশোধ করতে হবে এ ধারণাও অনেক ক্ষেত্রে নেই, যা না থাকলে বিয়েই হবে না বলে হাদিসে বলা হয়েছে।

যৌতুকের প্রচলন

বিয়েতে ইসলামের নিয়মানুযায়ী স্ত্রীর প্রাপ্য হলো মোহর যা স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা আদায় করতে বলেছেন। স্বামীর প্রাপ্য হিসাবে কোন কিছু রয়েছে বলে কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ নেই। এরপরও শ্বশুর পক্ষ থেকে যদি কিছু উপঢৌকন স্বামীকে দেওয়া হয় তবে তাতে কোন দোষ নেই, যদি তা হয় স্বেচ্ছায় ও বিনা দাবিতে। দাবি করে যদি স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর পক্ষের নিকট কিছু চাওয়া হয় তাই যৌতুক। এ ধরনের যৌতুক চাওয়ার কোন বিধান ইসলামে নেই। এ যৌতুকের প্রচলন এসেছে বিশেষ করে হিন্দু সমাজ থেকে। আজকে সমাজে শুধু যৌতুক চাওয়া হয় না বরং যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়, স্ত্রীকে তার বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তালাক প্রদান করা হয়। এসবই ইসলামে নিষেধ। কোনো মুসলমান স্বামী যৌতুকের দাবি করতে পারে না। তবে বিনা দাবিতে স্বেচ্ছায় স্ত্রীর পক্ষ থেকে যে কোন দান গ্রহণ করা যেতে পারে।

একাধিক বিবাহ

পাশ্চাত্য জগত ও পাশ্চাত্যের অনুসারীরা ইসলামের একাধিক বিবাহ সম্পর্কে সর্বাধিক সমালোচনা মুখর। আমার মনে হয় তারা বিষয়টি অনুধাবন করতে অক্ষম। ইসলামের অনুসারীদের জন্য একাধিক বিয়ে আদেশ করা হয় নি, বিশেষ পরিস্থিতিতে অনুমতি প্রদান করা হয়েছে মাত্র। যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যখন বহু ইয়াতীম পরিবারের সৃষ্টি হয়েছিল তখন ঐসব পরিবারের তত্ত্বাবধানকারীদের কারো কারো মধ্যে ইয়াতীম কন্যাদের রূপ-যৌবন ও ধনসম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাদের প্রতি ইনসাফ করতে পারবে না বলে মনে করলে আল্লাহ তা’য়ালা অন্য স্ত্রীলোকদের মধ্য থেকে দুই, তিন বা চার জনকে বিয়ে করার অনুমতি প্রদান করেন। অবশ্য আল্লাহ তা’য়ালা একথাও বলে দেন যে, এদের মধ্যেও ইনসাফ ও সুবিচার কায়েম করতে হবে। এভাবে আটঘাট বেঁধে একাধিক বিয়ের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। যে সমাজে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করে যথারীতি পর্দা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, যে সমাজে কোন প্রকার প্রকাশ্য ব্যভিচার বা গোপন প্রণয়ের পথ বন্ধ, সে সমাজেই কারো যৌন বা অন্য কোনো প্রয়োজনে একাধিক বিয়ের অনুমতি, যাতে আবার পূর্ণ ইনসাফের গ্যারান্টি থাকবে, এ ধরনের ব্যবস্থা কি সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত নয়? এর পরিবর্তে পাশ্চাত্য জগতে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও বেপর্দা ব্যবস্থা, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ব্যাভিচার ও প্রণয়, স্ত্রীর বর্তমানে একাধিক প্রণয়িনী থাকা, অবাধ যৌন সম্পর্ক বজায় রাখা- একাধিক স্ত্রী রাখার চেয়ে জঘন্য ও সভ্যতা বিরোধী নয় কি?

অবশ্য আমাদের সমাজে বর্তমানে একাধিক স্ত্রী রাখার ক্ষেত্রে কিছুটা নীতিহীনতা লক্ষ্য করা যায়। যেখানে কোরআনে বলা হয়েছে একাধিক স্ত্রীর মধ্যে পূর্ণ ইনসাফ বজায় রাখতে হবে, পালাক্রমে রাত যাপন করতে হবে, সে ক্ষেত্রে এক স্ত্রী নিয়ে শহরে বাস করা, অন্য স্ত্রীকে গ্রামে ফেলে রাখা কোন মতেই বৈধ হতে পারে না। সর্ব ব্যাপারে স্ত্রীদের মধ্যে পূর্ণ সাম্য ও ইনসাফ কায়েম করতে হবে। মনের দিক থেকে সকল স্ত্রীর প্রতি সমান আকর্ষণ থাকতে হবে। অথচ আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ

“আল্লাহ কোন পুরুষের জন্য তার বক্ষে দুইটি হৃদয়ের সৃষ্টি করেননি।”
(আল-কোরআন)

অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে পূর্ণ ইনসাফ কায়েম করা সম্ভব নয়। তাই এ ক্ষেত্রে যথাসম্ভব ইনসাফ কায়েম করতে হবে। যার অভাব আমাদের সমাজে একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়। অবশ্য আমাদের সমাজে একাধিক বিয়ের প্রচলন খুব কমই রয়েছে যা শতকরা একজনও হবে না।

চতুর্থ অধ্যায় : পারিবারিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় – দাম্পত্য জীবন

একজন পুরুষ যখন একজন নারীকে বিয়ে করে তখন উক্ত নারী-পুরুষকে বলা হয় নবদম্পতি। দম্পতি মানে নারী-পুরুষের জোড়া।

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا

“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদের একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন, পরে তার জুড়ি সৃষ্টি করেছেন যেন তার সাথে জীবন যাপন করে।” (সূরা আরাফ: ১৮৯)

چها
وَأَنَّهُ خَلَقَ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالْأُنثَى – مِنْ نُطْفَةٍ إِذَا تُمنى –

“এবং নিশ্চয়ই তিনি নর ও নারীকে যুগল করে সৃষ্টি করেছেন, বীর্য থেকে যখন তা (মাতৃগর্ভে) নিক্ষিপ্ত হয়।” (সূরা: আন-নজম : ৪৫-৪৬)

এই দম্পতির একত্রে বসবাস ও জীবন-যাপনকেই বলে দাম্পত্য জীবন। বস্তুত প্রত্যেকটি নারী-পুরুষই বিয়ের মাধ্যমে একত্রে দাম্পত্য জীবন যাপন করে। যার অনিবার্য ফল স্বরূপ বংশধারা চালু হয় এবং বংশপরিক্রমা চলতে থাকে। পুরুষে পুরুষে বা নারীতে নারীতে একত্রে বসবাস দাম্পত্য জীবন নয়। কারণ এতে কোন বংশ বিস্তার হবে না। তাই ইসলামের বিধান মতে যথারীতি বিয়ের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের একত্রে বসবাসের মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে বলা হয় দাম্পত্য জীবন।

দাম্পত্য জীবনের অপরিহার্য দাবি

দাম্পত্য জীবনে নারী-পুরুষে, স্বামী-স্ত্রীতে বসবাস করা ও জীবন যাপনের ক্ষেত্রে কতিপয় অপরিহার্য দাবি পূরণ করতে হয়। উক্ত দাবিগুলো যথারীতি পালিত হলে দাম্পত্য জীবন হয় সুখী, সুন্দর, সফল ও শান্তিময়। আর ঐ দাবিগুলো ঠিকমত পালিত না হলে দাম্পত্য জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অশান্তি নেমে আসে পরিবারে, পারিবারিক জীবন হয়ে ওঠে বিষাক্ত ও অসুখী। তাই প্রত্যেক নবদম্পতির বিয়ের পরপরই এই সব দাবি পূরণে বিশেষভাবে তৎপর হতে হবে।

দাম্পত্য জীবনের দাবিগুলো হলো:

নবদম্পতির দুটি জীবনের সার্থক সমন্বয় ও সমঝোতা সাধন

(১) নবদম্পতির দুটি জীবনের সার্থক সমন্বয় ও সমঝোতা সাধন:
একজন নারীর সম্মতি প্রদান ও একজন পুরুষের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত গ্রহণের স্বীকৃতির মাধ্যমে যে বিয়ে হয় তাতে দুটি প্রাণ এক হয়ে যায়, ঘুচে যায় তাদের মধ্যকার সকল প্রকার ভেদাভেদ। এতদিন তাদের মধ্যে যে পর্দার প্রাচীর দাঁড়িয়েছিল তা সহসাই সরে যায়। সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি পরিবারের দু’টি প্রাণ এক হয়ে যায়। এ পর্যায়ে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন দুজনের সমঝোতা ও সমন্বয়। তাদের মধ্যে থাকতে পারে অভ্যাসগত ও রুচিগত পার্থক্য, থাকতে পারে শিক্ষাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৈষম্য, পারিবারিক ভেদাভেদ, ঐতিহ্যগত ও পারিপার্শ্বিক জীবনে ভিন্ন ভিন্ন পথ। কিন্তু দুজনের মহামিলনে সর্বক্ষেত্রে সবকিছু ধীরে ধীরে ঐক্যের পথে এগিয়ে চলে। দুয়ের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমঝোতা সৃষ্টি হয়, সমন্বয় সাধিত হয়।

এ দুয়ের মহামিলনে যে পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, আল্লাহ তা’য়ালা তাকে একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ দিয়ে বলে দিয়েছেন, তিনি বলেনঃ

هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ

“তারা (নারীরা) তোমাদের (পুরুষদের) পোশাক, আর তোমরা (পুরুষগণ) নারীদের পোশাক।”

বস্তুত পোশাক দেহের সাথে মিল করেই তৈরি করা হয়, কারো শরীরে যে পোশাক ফিট হয় না সে পোশাক সে পরিধান করে না, পোশাক দেহের আবরণ যা দেহের সাথে একবারেই মিলেমিশে যায়। পোশাক দেহের দৃষ্টিকটু অংশ ঢেকে ফেলে, দেহের সৌন্দর্য, দেহের জিনাত বৃদ্ধি করে। তাছাড়া পোশাক দেহের সাথে সাথে তাকে অনুসরণ করে। নারী-পুরুষের অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর অবস্থাও ঠিক পোশাকের মত, স্বামী-স্ত্রীতে গভীর মিলমিশ হয়, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের আবরণ, পোশাক আর শরীরের মাঝখানে যেমন কিছু থাকে না, স্বামী-স্ত্রী যখন এক হয়ে যায় তখন তাদের মধ্যেও কিছু থাকে না বরং দেহ দেহের সাথে একবারেই মিলেমিশে যায়। তারা পোশাকের মত একে অপরের দৃষ্টিকটু অংশ ঢেকে ফেলে এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। তাছাড়া পোশাক ব্যক্তির অনুগামী হয়, ব্যক্তি যেখানে বা যেদিকে যায় পোশাকও তার সাথে সাথে যায় অর্থাৎ পোশাক হয় তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মত। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও হয় তেমনিভাবে অবিচ্ছেদ্য। স্বামী যদি কোনদিকে যায় স্ত্রী চিন্তায় থাকে, স্বামীরও মনে পড়ে বাড়িতে অবস্থানরত স্ত্রীর কথা। স্ত্রী তার বাপের বাড়ি গেলে, স্বামীও তার সাথে চলে যায় অথবা তার জন্য অস্থির থাকে।

এভাবে দুজনের মধ্যে হয় চিন্তা-চেতনার ঐক্য, পারস্পরিক সমন্বয় ও সমঝোতা। তাই দাম্পত্য জীবনের প্রথম দাবি হলো দুজনের মধ্যে সম্ভাব্য সমঝোতা ও সমন্বয় যা একত্রে বসবাসের এক চূড়ান্ত গ্যারান্টি।

এই সমঝোতা ও সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে স্বামীকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হয়। কেননা নারীরা সাধারণত অধিকতর লজ্জাশীলা ও চাপা স্বভাবের থাকে। স্ত্রী নতুন পরিবেশে এসে কোন ব্যাপারে অসুবিধা অনুভব করে, স্বামীকে তা বুঝতে হবে এবং তার প্রতিকার করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো কু-অভ্যাস থাকলে তা দূর করার জন্য পারস্পরিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। স্বামী যদি মদ খায়, নেশা করে, স্ত্রী তাকে এ থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করবে, স্ত্রী যদি নামায না পড়ে বা পর্দা না করে, স্বামী তাকে এর প্রয়োজনীয়তা বুঝাবে এবং তা পালন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। এমনিভাবে সমঝোতার মাধ্যমে ভালোর দিকে অগ্রসর হতে হবে, মন্দ কাজ থেকে সরে আসতে হবে। অর্থাৎ ভালোর সমঝোতা করে মন্দ থেকে ফিরে আসার সমন্বয় সাধন করতে হবে।

পারিবারিক জীবনের সুষ্ঠু শৃংখলা বিধান

(২) পারিবারিক জীবনের সুষ্ঠু শৃংখলা বিধানঃ

পারিবারিক জীবনে সুষ্ঠু শৃংখলা বিধানের জন্য দাম্পত্য জীবনে কিছু নিয়ম-মত মেনে চলতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কর্মবণ্টন করতে হবে এবং সুষ্ঠু নিয়ম মত স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’য়ালা একটি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ
وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ

“পুরুষেরা নারীদের উপর পাহারাদার, কেননা আল্লাহ তা’য়ালা একজনের উপর আরেক জনকে মর্যাদাবান বানিয়ে দিয়েছেন, যেহেতু পুরুষরা তাদের ধন-সম্পদ (নারীদের জন্য) খরচ করে থাকে।” (সূরা নিসাঃ ৩৪)

وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ

“নারীদের উপর পুরুষদের মর্যাদা রয়েছে।” (সূরা বাকারা: ২২৮)

অর্থাৎ পারিবারিক জীবনে পুরুষ হবে কর্তৃত্বের অধিকারী আর নারী হবে পুরুষের অনুগত। যেহেতু পুরুষের দায়িত্ব হলো নারীকে মোহর প্রদান এবং তাদের খোরপোষের ব্যবস্থা করা।

এ ব্যাপারে কিছু কিছু পাশ্চাত্যবাসী এবং ইসলাম বিদ্বেষীগণ আপত্তি তুলে বলেন যে, এ দ্বারা নারী জাতিকে হেয় করা হয়েছে। যারা আল্লাহকে আল্লাহ অর্থাৎ চূড়ান্ত ফায়সালাকারী বলে মানে না তাদের কথা আলাদা। যারা আল্লাহকে চূড়ান্ত ফায়সালাকারী বলে মানে তাদেরকে আল্লাহর অন্যান্য ফায়সালার মত এ ফায়সালাকেও মেনে নিতে হবে। আল্লাহ তা’য়ালা তার ফায়সালা মোতাবেক নারী জাতিকে গর্ভধারণ, প্রসব ও সন্তানকে দুগ্ধ দানের বিধান করে দিয়েছেন, তাদের হায়েজ-নেফাসে নামায মাফ করে দিয়েছেন, রোযা রাখতে ও হজ পালনের কিছু বিধান পালন করতে নিষেধ করেছেন। পুরুষকে মোহর প্রদান ও স্ত্রীর খোরপোষের ব্যবস্থা করতে বলেছেন আর পারিবারিক শৃংখলা বিধানের জন্য পুরুষকে করেছেন পাহারাদার, পরিচালক; আর নারীকে করেছেন পুরুষের অধীন। পারিবারিক শৃংখলা কায়েমের জন্য এ হলো এক অপরিহার্য ব্যবস্থা। উভয়ে সমান হলে, কে দেবে হুকুম আর কে হবে পালনকারী। তাই পুরুষের শাসন-শৃঙ্খলা মত দাম্পত্য জীবনে ফায়সালা হবে। অবশ্য প্রয়োজনে স্বামী-স্ত্রীতে পরামর্শ হবে এবং পরামর্শ ভিত্তিক ফায়সালা হবে তাতে কোন দোষ নেই। তবে দাম্পত্য জীবনকে সুষ্ঠু ও সুন্দর করতে হলে, দাম্পত্য জীবনে শৃংখলা বিধানের খাতিরে পুরুষকে কর্তা মেনেই ফায়সালা গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে পুরুষের চেয়ে নারী বেশি বুদ্ধিমতী, বেশি শিক্ষিতা ও বেশি দ্বীনদার হতে পারে। তবে সাধারণতঃ পুরুষই শক্তি-সামর্থ্য, বিচক্ষণতা, জ্ঞান-গরিমা, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে নারীর চেয়ে অগ্রগামী থাকে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তা’য়ালা সাধারণ নিয়ম করে দিয়েছেন যে, পুরুষ হবে পরিচালক আর নারী হবে পরিচালিত।

পবিত্র যৌন জীবন

(৩) পবিত্র যৌন জীবন :

দাম্পত্য জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পবিত্র যৌন জীবন যাপন। বিয়ের সর্ব প্রধান উদ্দেশ্যই হলো পবিত্র যৌন জীবন পরিচালনা। আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন:

والمحصنتُ مِنَ الْمُؤْمِنَتِ وَالْحُصَنَتُ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَبَ مِنْ قَبْلِكُمْ
إِذا أَتَيْتُمُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسْفِحِينَ وَلَا مُتَّخِذِى
اخدان ط

“তোমাদের জন্য হালাল করা হল সতী-সাধ্বী মু’মিনা নারীদেরকে এবং তোমাদের পূর্বেকার আহলে কিতাবদের সতী-সাধ্বী নারীদেরকে, যখন তোমরা তাদেরকে তাদের প্রাপ্য (মোহর) প্রদান কর এবং তোমরা না কর প্রকাশ্য ব্যভিচার অথবা গোপন প্রণয়।” (সূরা মায়েদা : ৫)

দাম্পত্য জীবনে যৌন স্বাদ আস্বাদনের ব্যাপারে অপর আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা আরো বলেনঃ

فَمَا اسْتَمْتَعْتُم بِهِ مِنْهُنَّ فَأْتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً ط

“অতঃপর তোমরা তাদের থেকে যে স্বাদ গ্রহণ করো সেজন্য তাদেরকে তাদের প্রাপ্য (মোহর) দান কর যা অবশ্য দেয় (ফরজ)।” (সূরা নিসা: ২৪)

উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা গেল, বিয়ের মাধ্যমে একদিকে সকল প্রকার যৌন অনাচার (প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য) বন্ধ করা হবে, অপরদিকে বিবাহিত দম্পতিকে যৌন সম্ভোগের অবাধ সুযোগ প্রদান করা হয়। এ জন্য ইসলাম অবৈধ যৌন অনাচারের তা যে প্রকারের হোক না কেন- হস্তমৈথুন বা অন্যান্য কৃত্রিম উপায়ে বীর্যপাত বা যৌন স্বাদ গ্রহণ, পুরুষে পুরুষে বা নারীতে-নারীতে যৌন ক্রিয়া, পশুমৈথুন বা অবিবাহিত নারী-পুরুষে যৌন মিলন ইত্যাদি সকল প্রকার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য যৌন অনাচার হারাম করে তার জন্য শাস্তির বিধান করেছে। আল-কোরআন মু’মিনের যৌন জীবন সম্পর্কে বলেনঃ

وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حُفِظُونَ – إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا
مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ جِ فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ
هُمُ الْعُدُونَ

“ঐসব মু’মিন সফলকাম যারা তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। তবে তাদের স্ত্রীদের ও তাদের মালিকানাধীন দাসীদের ব্যাপারে তারা তিরস্কৃত হবে না। এর বাইরে যারা কাম চরিতার্থ করতে প্রয়াসী তারাই সীমা লংঘনকারী।”
(সূরা মু’মিনুন: ৫,৬)

অর্থাৎ যৌন স্বাদ গ্রহণের ব্যাপারে কেবল মাত্র স্ত্রী ও মালিকানাধীন দাসীদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া আর কোনভাবে যৌন স্বাদ গ্রহণ করা যাবে না।

বর্তমান সময়ে যেহেতু দাসী-বাদীর প্রচলন আর নেই তাই কেবল মাত্র বিবাহিতা স্ত্রীদেরকে নিয়েই পুরুষকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে আর নারীদেরও সন্তুষ্ট থাকতে হবে কেবলমাত্র স্বামীদেরকে নিয়েই। যৌন ব্যাপারে অন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থাই গ্রহণ করা যাবে না। তাই দাম্পত্য জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নারী-পুরুষের যৌন স্বাদ গ্রহণ। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’য়ালাও মানুষের মধ্যে অদম্য আবেগ, অবাধ যৌন প্রবণতা ও সীমাহীন সুযোগ প্রদান করেছন। মানুষের জন্য পশুর মত কোন মৌসুমের প্রয়োজন নেই, নেই প্রয়োজন কোন বিশেষ সময়ের। যৌন ক্রিয়ার বিশেষ উদ্দেশ্য যদিও বংশধারা অব্যাহত রাখা কিন্তু এতে আল্লাহ তা’য়ালা এ কাজকে সীমাবদ্ধ করেননি। গর্ভধারণের পরও এ ক্রিয়া চালু থাকে, এমনকি কোন নারীর সন্তান হওয়ার সময়কাল অতীত হয়ে গেলেও এ কাজের আবেগ উচ্ছ্বাস অব্যাহত থাকে। দাম্পত্য জীবনে পবিত্র যৌন জীবন যাপনের প্রতি লক্ষ্য করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

“জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি এক মহিলাকে বিয়ে করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম। তিনি বলেন, হে জাবির! তুমি কি বিয়ে করেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, কুমারী না বিধবা। আমি বললাম, না বরং বিধবা। তিনি বললেন, তুমি একটি কুমারীকে বিয়ে করলে না কেন? তাহলে তুমিও তার সাথে আমোদ-স্ফূর্তি করতে পারতে এবং সেও তোমার সাথে আমোদ-স্ফূর্তি করতে পারত।” (আত-তিরমিযী: ১০৩৭)

“জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি স্ত্রীলোককে দেখে যয়নব (রাঃ)-এর ঘরে প্রবেশ করেন এবং নিজের প্রয়োজন পূরণ করেন (সহবাস করেন)। অতঃপর বাইরে এসে বলেনঃ কোনো স্ত্রীলোক সামনে এলে শয়তানের বেশে আসে। অতএব তোমাদের কেউ কোন স্ত্রীলোক দেখে তাকে ভাল লাগলে সে যেন নিজ স্ত্রীর নিকট যায়। কারণ ঐ মহিলার যা আছে তার স্ত্রীরও তা আছে।” (আত-তিরমিযী: ১০৯৬)

মিশকাতের ২৯৭৫ নম্বর হাদিসে হযরত ইবনে মাসউদ হতে বর্ণিত অনুরূপ হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন স্ত্রী সাওদার নিকট গিয়ে ছিলেন বলে বলা হয়েছে। মিশকাতের ২৯৭২ নম্বর হাদিসেও উপরের হাদিসের শেষাংশের মত হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

এসব হাদিস থেকে দম্পতির যৌন প্রয়োজন পূরণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এক দম্পতির সম্পর্কচ্ছেদের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলে তাঁর মন্তব্য ছিল এরূপ যে, তুমি তার মধু খাও, সে তোমার মধু খাক এরপর ফায়সালা হবে। এ দ্বারা যৌন আস্বাদের কথাই বুঝা যায়।

মোটকথা, বিয়ের মাধ্যমে অন্য সকল প্রকার যৌন সম্পর্কচ্ছেদ করে কেবলমাত্র স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হবে এবং এটাই দাম্পত্য জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এজন্যই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বামীর যৌন প্রয়োজনের ডাকে সাড়া দিতে স্ত্রীকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, স্ত্রী যদি চুলার কাজেও ব্যস্ত থাকে তবুও তাকে স্বামীর ডাকে সাড়া দিতে হবে। কোনো স্ত্রী যদি স্বামীর অনুরূপ ডাকে সাড়া না দেয়, সারারাত তার জন্য ফেরেশতাগণ অভিশাপ বর্ষণ করেন।

তাই পবিত্র যৌন জীবন-যাপন দাম্পত্য জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি

(৪) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টিঃ

দাম্পত্য জীবনের চতুর্থ দাবি হল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি হতে হবে। একে অপরকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসবে, মহব্বত করবে, ভালোবাসা-মহব্বতের প্রমাণ পেশ করবে। স্বামী স্ত্রীর জন্য সাধ্যমত হাদিয়া তোহফা বা খাবার জিনিষ নিয়ে আসবে, স্ত্রীও অনুরূপভাবে স্বামীর জন্য কিছু না কিছু বিনিময় করবে। এভাবে দুজনের মধ্যে প্রগাঢ় সম্পর্ক সৃষ্টি হবে। স্বামী স্ত্রীর মন রক্ষা করবে, স্ত্রীও স্বামীর মন রক্ষা করবে। আল্লাহ তা’য়ালা এ সম্পর্কে বলেন:

. وَمِنْ أَيْتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُو إِلَيْهَا وَجَعَلَ
بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً

“এবং তার নিদর্শনের মধ্যে অন্যতম হলো এই যে, তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই সৃষ্টি করেছেন তোমাদের স্ত্রীদের। যেন তোমরা তার সাথে একত্রে শান্তিতে বসবাস করতে পার, আর তিনি তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করে দিয়েছেন প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা, হৃদ্যতা ও মেহেরবানী।” (সূরা রূম: ২১)

বস্তুত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত স্বর্গীয় প্রেম-ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। একে অপরকে আপন করে নেয়, আত্মার আত্মীয়ে পরিণত হয়। সুখে-দুঃখে একসাথে চলে। একে অপরের সুখে সুখী হয়, দুঃখে দুঃখী হয়। যে কোন অবস্থা ও পরিস্থিতি একসাথে মোকাবেলা করে। স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লে স্ত্রী নিজেকে সম্পূর্ণরূপে তার সেবায় পেশ করে, আবার স্ত্রী অসুস্থ হলে স্বামী তার সম্পূর্ণ চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, স্ত্রীর প্রসবকালে স্বামী অস্থির হয়ে পড়ে। এমনিভাবে প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, হৃদ্যতা, মেহেরবানীর চরম নিদর্শন স্থাপিত হয় প্রতিটি দম্পতির ক্ষেত্রে।

জীবন যাপনের অপরিহার্য দাবি পূরণ

(৫) জীবন যাপনের অপরিহার্য দাবি পূরণ :

দাম্পত্য জীবনের পঞ্চম দাবি জীবন-যাপনের অপরিহার্য দাবি পূরণ। জীবন-যাপনের জন্য নবদম্পতির কিছু অপরিহার্য জিনিসের প্রয়োজন। তাদের জন্য প্রয়োজন নিরিবিলি দাম্পত্য জীবনকে উপভোগ করার জন্য একটি ঘর, কিছু কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য জিনিষপত্র এবং খাদ্য-খাবারের ব্যবস্থা। এসবের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে স্বামীকে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ

وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ طَ لَا تُكَلِّفُ نَفْسٌ إِلَّا
وسْعَهَا

“সন্তানের পিতার কর্তব্য হচ্ছে তার স্ত্রীর খাবার ও পরার ন্যায়সংগত, যথারীতি ব্যবস্থা গ্রহণ, কোন ব্যক্তির সামর্থ্যের অধিক বোঝা তার ওপর চাপানো যায় না।” (সূরা বাকারা: ২৩৩)

এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, স্বামীর দায়িত্ব হলো পরিবারের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ ইসলামের বিধানমত স্বামী বা পুরুষের দায়িত্ব হলো রুজি-রোজগারের-উপার্জনের। স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির খোরপোষের ব্যবস্থা তাকে করতে হবে। দাম্পত্য জীবনের দাবি হলো স্ত্রীর স্বাভাবিক জীবন ধারণের উপযোগী প্রয়োজন পূরণে স্বামীর দায়িত্ব গ্রহণ। এ জন্যেই স্ত্রী নিজেকে স্বামীর নিকট সোপর্দ করে দেয়। এমনকি স্ত্রীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধানও স্বামীর দায়িত্বে নিয়োজিত। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে অবশ্য স্বামীর সামর্থ্য অনুযায়ী তার দায়িত্ব। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ

لِيُنْفِقُ ذُوسَعَةٍ مِّنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقُ مِمَّا آتَاهَا اللَّهُ
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا سَيَجْعَلُ اللَّهُ بَعْدَ عُسْرِ يُسْرًا –

“যাকে যেমন অর্থ-সম্পদের মালিক করা হয়েছে, সে সে অনুযায়ী স্ত্রী পরিজনের জন্য খরচ করবে, আর যার রুজি-রোজগার ও রেযেক সীমিত করা হয়েছে, সে আল্লাহ যা দিয়েছেন তা থেকেই স্ত্রী পরিজনের জন্য খরচ করবে। আল্লাহ কাউকে তাকে যা দেয়া হয়েছে তার অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অসচ্ছলতার পর সচ্ছলতা দান করেন।” (সূরা তালাক : ৭)

অভাব-অনটনে স্বামীকে ত্যাগ করে চলে যাওয়া, তালাক নেওয়া বা খাওয়া-পরার মান বৃদ্ধির জন্য চাপ প্রয়োগ আল্লাহ তা’য়ালার নিকট অভিপ্রেত নয়। তাই আল্লাহ তা’য়ালা উপরোক্ত আয়াতে বলেছেন, কারো সামর্থ্য না থাকলে যতটুকু সামর্থ্য আছে ততটুকুরই ব্যবস্থা সে গ্রহণ করবে। সামর্থ্য ও সাধ্যের অতিরিক্ত দাবি করা যথার্থ নয়।

তিরমিযী শরীফের ১১০০ নম্বর হাদিসে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) এর বরাত দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদের ব্যাপারে সদ্ব্যবহারের উপদেশের কথা বলে হাদিসের শেষাংশে স্বামীদেরকে বলেছেন যে, তোমাদের উপর স্ত্রীদের হক হলো তোমরা তাদের উত্তম পোশাক-পরিচ্ছদ ও ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবে।

মোটকথা, পুরুষের দায়িত্ব হলো পরিবারের প্রয়োজন পূরণের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম করা এবং আল্লাহর সাহায্য কামনা করা। নারীর এ ব্যাপারে সহযোগিতা করায় কোন দোষ নেই কিন্তু তাকে এ ব্যাপারে বাধ্য করা যাবে না। সাহাবায়ে কেরামের কারো কারো স্ত্রী পরিবারের আয়-রোজগারে বা পরিবারের বাইরের কাজে সহযোগিতা করেছেন বলে ইতিহাসে নজীর রয়েছে। কিন্তু ইসলামী শরিয়ত তাদেরকে এরূপ করতে বাধ্য করেনি। তবে এ হলো দাম্পত্য জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি। এ দাবি পূরণ না হলে পারিবারিক জীবনযাপনই কঠিন হয়ে পড়ে। তাই দাম্পত্য জীবনকে মধুর ও শান্তিময় করতে হলে পারিবারিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করতেই হবে।

পরিবারে দ্বীনী পরিবেশ সৃষ্টি করা

৬. পরিবারে দ্বীনী পরিবেশ সৃষ্টি করা:

দাম্পত্য জীবনের লক্ষ্য তো ইহকালীন জীবনে একটি সুখী সংসার গড়ে তোলা আর পরকালীন জীবনে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তাই দাম্পত্য জীবনের সূচনা থেকেই সে চূড়ান্ত লক্ষ্যেকে সামনে রেখে কাজ করে যেতে হবে। দুজনেই এ লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হলে আল্লাহ তা’য়ালা বেহেশতে দুজনকে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দেবেন। এ ক্ষেত্রে একজনের মর্যাদা অন্যজনের চেয়ে বেশি হলে যিনিই উপরের মর্যাদায় মর্যাদাবান হবেন, অপরজনকেও সে মর্যাদায় উন্নীত করা হবে। তাই অনন্ত সুখ লাভের সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে দাম্পত্য জীবনে কাজ করে যেতে পারলেই দুজনের জীবন হতে পারে সাফল্যমণ্ডিত।

সে উদ্দেশ্যকে সফল করতে হলে দাম্পত্য জীবনে দ্বীনী কাজে একে অপরের সহযোগিতা করে যেতে হবে। তিরমিযী শরীফের এক হাদিসে দেখা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিঃস্ব এক পুরুষকে কোরআনের সূরা শিখাবার দেনমোহরে এক মহিলাকে বিয়ে দেন। এমনিভাবে দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক কোরআন শিক্ষা, নামায শিক্ষার ব্যবস্থা হতে পারে। অপর হাদিসে দেখা যায়, যে স্বামী-স্ত্রী একে অপরে তাহাজ্জুদের নামায পড়ার ব্যাপারে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে আল্লাহ তা’য়ালা সে স্বামী-স্ত্রীর ওপর সন্তুষ্ট হন। অর্থাৎ ইবাদতের ক্ষেত্রেও একে অপরের সহযোগী হতে পারে। তেমনিভাবে দ্বীনী আন্দোলনের দায়িত্ব পালনে একে অপরের সহযোগিতা করা যেতে পারে। শরীয়তের বিধি-বিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা হতে পারে। যৌন ক্রিয়াকর্মে নাজায়েয পথ পরিহার করার ক্ষেত্রে (যেমন রোজা রেখে সহবাস, স্ত্রীর গুহ্যদ্বারে সহবাস, হায়েজ-নেফাস অবস্থায় সহবাস, ইতিকাফ ও হজের ইহরাম বাঁধা অবস্থায় সহবাস) পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এভাবে সমস্ত হারাম কাজ থেকে দূরে থাকা এবং ভালো কাজে পারস্পরিক সহযোগিতা দাম্পত্য জীবনে দ্বীনী পরিবেশকে উন্নত করবে। স্বামীর হারাম রুজি-রোজগারে স্ত্রী উৎসাহিত করবে না বরং বাধা প্রদান করবে, স্ত্রীর বেপর্দায় চলায় স্বামী বাধা প্রদান করবে। এভাবে দাম্পত্য জীবনে দ্বীনী পরিবেশ সৃষ্টি করা ও তাকে উন্নত করার মতো দাম্পত্য জীবনের অন্যতম দাবি পূরণে দুজনেই পারস্পরিক সহযোগিতা করবে।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় ও অটুট রাখা

(৭) আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় ও অটুট রাখা:

ইসলাম আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি হয় প্রধানত দুভাবে। রক্ত সম্পর্কের কারণে ও বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে। বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে নতুন আত্মীয়তার বন্ধন সৃষ্টি হয়। শ্বশুর-শাশুড়ী, শ্যালক-ভায়রা, দেবর-ননদ ইত্যাদি সম্পর্ক রক্ষা করা, সম্পর্ককে আরো গভীর করা, দাম্পত্য জীবনের দাবি। এ দাবি পূরণে যথাসম্ভব সজাগ থাকা প্রয়োজন। দাম্পত্য জীবনে আলাদা ঘর-সংসার করা, পৃথক ব্যবস্থা গ্রহণ ইসলামের দৃষ্টিতে দোষণীয় নয় তবে আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ

يا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا
زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً جِ وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي
تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ ط إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا –

“হে মানব সমাজ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে এবং তা থেকেই সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া এবং উভয়ের মধ্য থেকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন বহুসংখ্যক পুরুষ ও নারী। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যার কারণে তোমরা নিজেদের অধিকার চাও ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে বিরত থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কাজ পর্যবেক্ষণ করছেন।” (সূরা নিসাঃ ১)

আল্লাহ তা’য়ালা নিকটাত্মীয়ের হক প্রদান করতে নির্দেশ প্রদান করেছেন, নিকটাত্মীয়দেরকে আখেরাতের ভয় প্রদর্শন করতে বলেছেন।

দাম্পত্য জীবনে বৈবাহিক আত্মীয়তার এ সম্পর্ক পুরোপুরি বজায় রাখতে হবে, আত্মীয়তার বন্ধন আরও দৃঢ় ও অটুট করতে হবে, আত্মীয়-স্বজনের বিপদে-আপদে এবং আনন্দ-উচ্ছ্বাসে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, সর্বাবস্থায় তাদের সাথে শরিক হতে হবে।

দাম্পত্য জীবনের দাবি- এ পর্যায়ে যে সব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে এক নজরে তা হলোঃ

(১) নবদম্পতির দুটি জীবনের সার্থক সমঝোতা ও সমন্বয় সাধন
(২) পারিবারিক জীবনে সুষ্ঠু শৃংখলা বিধান;
(৩) পবিত্র যৌন জীবন যাপন;
(৪) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম ও ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টি;
(৫) পারিবারিক জীবনে জীবন যাপনের অপরিহার্য দাবি পূরণ;
(৬) পরিবারে দ্বীনী পরিবেশ সৃষ্টি করা;
(৭) আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় ও অটুট রাখা।

সুখী দাম্পত্য জীবনের চাবিকাঠি

দাম্পত্য জীবনকে সুখী-সুন্দর ও সফল করার জন্য স্বামী স্ত্রী উভয়কে ইহকালীন জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করার মধ্যেই রয়েছে সুখী দাম্পত্য জীবনের চাবিকাঠি। এর মধ্যে অবিরাম যে সব কাজ করে যেতে হবে সেগুলো হলো নিম্নরূপ:

দাম্পত্য জীবনের দাবিগুলোর যথাযথ ও সার্থক বাস্তবায়ন

১. দাম্পত্য জীবনের দাবিগুলোর যথাযথ ও সার্থক বাস্তবায়ন :
স্বামী-স্ত্রী উভয়ে যদি দাম্পত্য জীবনের দাবি পূরণে সচেষ্ট, সক্রিয় ও সচেতন থাকে তাহলে দাম্পত্য জীবন অবশ্যই সুখী হবে, পূর্ণ হয়ে উঠবে প্রেম-প্রীতি ও সৌহার্দ্যে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে যদি স্বামী-স্ত্রী মিলেমিশে চলে, প্রয়োজনীয় ব্যাপারে পারস্পরিক সহযোগিতা করে, সর্ব ব্যাপারে সমন্বয় সাধনে তৎপর থাকে, স্ত্রী যদি বিনা শর্তে ও নিঃসংকোচে স্বামীর আনুগত্য করে চলে, আর স্বামীও যদি স্ত্রীর প্রতি দরদী মনের পরিচয় দেয়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে যদি স্বামী-স্ত্রীতে থাকে পূর্ণ ঐক্যমত্য ও পারস্পরিক গ্রহণযোগ্যতা, স্বামী-স্ত্রীর প্রেম-ভালোবাসা যদি থাকে অটুট, সাংসারিক জীবন যাপনে স্বামী যদি থাকে তৎপর, স্ত্রীও যদি তার যথাযথ ভূমিকা রাখে, দ্বীনী পরিবেশ সৃষ্টিতে যদি উভয়েই থাকে সচেষ্ট, আর উভয়ের আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে যথারীতি খেয়াল রাখে, যথারীতি সমাদর করে- তাহলে দাম্পত্য জীবন সুখের ও সম্প্রীতির না হয়ে পারে না। এ ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই যথাসম্ভব খেয়াল রেখে চলতে হবে।

সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠা ও উদারতা প্রদর্শন

২. সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠা ও উদারতা প্রদর্শন:
সংকীর্ণতা জীবনকে নিচু করে দেয়, উদারতা জীবনকে করে তোলে মহান, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সংকীর্ণতা পরিহারযোগ্য। মানুষ সংকীর্ণতার গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়লে জীবনে নেমে আসে নানারূপ জটিলতা, ক্লেদ ও তিক্ততা। অপরদিকে উদারতা অবলম্বন করতে পারলে, মানুষের জীবন হয়ে ওঠে ধন্য, সুখময় ও শান্তিপূর্ণ। দাম্পত্য জীবনেও উদারতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে, উঠতে হবে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন:

وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

“যে ব্যক্তি সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পেরেছে, সে সফলকাম।” (সূরা তাগাবুন : ১৬)

যেখানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সেখানে যদি সকল ব্যাপারেই ধরাধরি হয় তাহলে তো সাংসারিক জীবনে চলা মুশকিল। স্ত্রীর দায়িত্ব ঘর-সংসার দেখাশোনা করা, কিন্তু স্বামী যদি বিভিন্ন ব্যাপারেই আপত্তি তোলেন, খাদ্য তৈরির ব্যাপারে নাক সিটকান, এটা ওটা নিয়ে বকা-ঝকা করেন অথবা স্ত্রী যদি স্বামীর জিনিসপত্র, কেনাকাটা পছন্দ না করেন, সামান্য কিছু হলেই মন খারাপ করে বসে থাকেন, সবকিছু হাসিমুখে গ্রহণ করে নিতে না পারেন, বিভিন্ন ব্যাপারেই স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া-ঝাটি সৃষ্টি হয়, তাহলে বুঝা যাবে তাদেরকে সংকীর্ণতায় পেয়ে বসেছে। সুখী জীবনের পথ এটা নয় বরং দুজনেরই হতে হবে উদার ও খোলামনের। কোন ব্যাপারে মনমতো না হলে খোলামেলা বলতে পারে- এটা এমন হলে ভালো হতো অথবা উদার মনে তা মেনে নিতে পারলে মনের আকাশে কোনো কালো মেঘ জমবে না। তাই উদারতা অনেক জটিল সমস্যার সহজ সমাধান এনে দেয় এবং দাম্পত্য জীবনকে করে তোলে সুখী ও শান্তিময়।

ছোট-খাট জিনিস উপেক্ষা করা

৩. ছোট-খাট জিনিস উপেক্ষা করা:

উদারতাকে পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হলে ছোট-খাট বিষয়কে উপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করতে হবে। এভাবেই ঐক্য ও ভালোবাসা বহাল রাখা যেতে পারে। ছোট্ট ছোট্ট বৃষ্টি বিন্দু সাগর-মহাসাগর সৃষ্টি করে, ছোট্ট ছোট্ট বালুকণা সৃষ্টি করে বিরাট মরুভূমি। ছোট ছোট গুনাহ কবিরা গুনাহে পরিণত হয়। ছোট ছোট বিষয় ধরে রাখলে বড় বিষয়ে পরিণত হতে পারে। তাই স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই যদি ছোট-খাট বিষয়ে এড়িয়ে চলে, উপেক্ষা করে তাহলে পারিবারিক শান্তি বজায় থাকতে পারে। দৈনন্দিন জীবনে কত কিছু ঘটে যায়, সব কিছু ধরতে গেলে বিভ্রাট সৃষ্টি হতে পারে। তাই দু’একটা ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে হবে, অনেক ব্যাপারেই চুপ মেরে যেতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পারিবারিক জীবন থেকেও তার উদাহরণ পাওয়া যায়। একবার তিনি এক স্ত্রীর ঘরে খেতে বসেছেন। আরেক স্ত্রী একটি পেয়ালায় কিছু জিনিস পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু যে ঘরে খেতে বসেছেন সে স্ত্রী এমনভাবে হাত মারলেন যে জিনিসগুলি মাটিতে পড়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুই বললেন না, শুধু অপর একটি পেয়ালা তার হাতে তুলে দিলেন। এভাবে এত বড় বিষয়টির ফায়সালা হয়ে গেল। এমনিভাবে ছোট-খাট বিষয় নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি না করাই উত্তম। প্রবাদ আছে, লেবু বেশি চিপলে তিতা হয়ে যায়। তাই পারিবারিক জীবনের শান্তি রক্ষার্থে দাম্পত্য জীবনের ছোট-খাট বিষয়কে এড়িয়ে চলতে হবে বা উপেক্ষা করে যেতে হবে।

সকল পারিবারিক কাজ পরামর্শের ভিত্তিতে করা

৪. সকল পারিবারিক কাজ পরামর্শের ভিত্তিতে করা:

স্বামী যদিও পরিবারের কর্তা কিন্তু তিনি যদি পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করেন অথবা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করেন তাহলে পরিবেশ উন্নত হয়, স্ত্রীর মনেও প্রশান্তি নেমে আসে, স্ত্রী নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন। হোদায়বিয়ার সন্ধির পর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ব-স্ব পশু যা সাথে নিয়ে আসা হয়েছিল তা সেখানেই কোরবানি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে একথা জানিয়ে দেন, কিন্তু সন্ধির শর্তাবলীর কারণে সাহাবায়ে কেরামের মন এত খারাপ ছিল যে কেউ রাসূলের নির্দেশ সত্ত্বেও কোরবানি করতে এগিয়ে গেলেন না, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে যে স্ত্রী ছিলেন, তার কাছে গেলেন এবং একথা জানালেন। তার স্ত্রী পরামর্শ দিলেন, আপনি নিজে আপনার কোরবানি করে দিন, সাহাবায়ে কেরামও দেখবেন কোরবানি করতে এগিয়ে আসবে। ঠিকই রাসূলুল্লাহ কোরবানি করতে শুরু করলে সকল সাহাবায়ে কেরাম কোরবানি করে দিলেন। এতে প্রমাণিত হলো যে, কঠিন মুহূর্তে স্ত্রীর পরামর্শ ফলদায়ক হতে পারে। পারিবারিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বামী-স্ত্রী এমনকি সন্তানাদিসহ পরামর্শ করে কাজ করা পরিবারের জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে। বিশেষ করে পারিবারিক ঐক্য ও পরিবেশকে উন্নত করার ক্ষেত্রে পরামর্শভিত্তিক কাজ খুবই ফলদায়ক হয়ে থাকে।

পরস্পর আপন হয়ে যাওয়া

৫. পরস্পর আপন হয়ে যাওয়া:

বিয়ের পর নব দম্পত্তিকে অবিলম্বেই আপন হয়ে যেতে হবে। স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের উপর নির্ভর করবে আপনজন হিসাবে। স্বামীর যে কোনো বিপদ-আপদ স্ত্রী পতিগতপ্রাণ হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করবে। তেমনি স্ত্রীর যে কোনো সমস্যায় স্বামী এগিয়ে আসবে সমস্যার বাস্তব সমাধানে। স্বামীর আত্মীয়-স্বজনকে স্ত্রী আপন করে নিবে, আবার স্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনকেও স্বামী নিবে আপন করে। স্বামীর বাড়ীকেই স্ত্রীর আসল বাড়ী মনে করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারও তাই। স্ত্রীর সন্তান-সন্ততি হওয়ার পর কালক্রমে স্বামীর বাড়ীই হয়ে যায় স্ত্রীর বাড়ী। স্বামীসহ স্বামীর পিতা-মাতার যথাসাধ্য খেদমতে নিয়োজিত হবে। অবশ্য স্ত্রী যদি আলাদা থাকা পছন্দ করে তবে স্বামীকে তা খোলাখুলি বলবে। ইসলামী বিধানমতে আলাদা হয়ে যাওয়া কোনো দোষণীয় ব্যাপার নয় তবে স্বামীর আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক ভাল রাখতে হবে। স্বামী তার পিতা-মাতার অধিকার আদায়ে তৎপর থাকবে। স্ত্রী তাতে যথাসাধ্য সহযোগিতা করবে। অবশ্য দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক উভয়ের পিতা-মাতা, ভাই-বোন থেকে হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা দুয়ে যেন হয়ে যাবে সম্পূর্ণ এক। বিমুক্ত দু’টি প্রাণ সম্পূর্ণ একাকার হয়ে গড়ে তুলবে এক নতুন ভুবন।

যৌন স্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে সম্পর্ক গভীর করা

৬. যৌন স্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে সম্পর্ক গভীর করা:

নব দম্পতির সম্পর্ক গভীর করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে যে যৌন সম্পর্ক তাকে গভীর থেকে গভীরতর করে তুলতে হবে। যৌবনের উদ্দাম তরঙ্গে মেতে উঠতে স্বামী-স্ত্রীতে কোনো বাধা নেই কেবলমাত্র প্রাকৃতিক হায়েজ-নেফাসের সময়টুকু ছাড়া। দু’টি অবিবাহিত নারী-পুরুষে প্রেম-প্রীতি ও যৌন সম্পর্ক স্থাপন যতটাই দোষণীয় ও অপরাধমূলক, বিবাহিত দুটি নারী-পুরুষে প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা ও যৌন সম্পর্ক স্থাপন ততটাই প্রশংসনীয় ও উত্তম। এ ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বলেন:

نِسَاؤُكُمْ حَرْثٌ لَّكُمْ فَأْتُوا حَرْثَكُمْ أَنَّى شِئْتُمْ

“তোমাদের স্ত্রীগণ হলো তোমাদের কৃষিক্ষেত্র, অতএব তোমরা যেভাবে চাও তোমাদের ক্ষেত্রে গমন কর।” (সূরা বাকারা: ২২৩)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:

فَالْآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ

“এখন তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিখে রেখেছেন তা কামনা কর।” (সূরা বাকারা : ১৮৭)

উপরোক্ত দু’টি আয়াতের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীতে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে সকল প্রকার বিধি-নিষেধ বাতিল করে দেয়া হয়েছে বরং এ হালাল কাজের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়েছে। সুখী সুন্দর দাম্পত্য জীবনের চাবিকাঠি হিসাবে এ অমোঘ অস্ত্র বর্তমান রয়েছে সকল দম্পতির নিকট। এ ব্যাপারে ধনী-গরীব কোনো পার্থক্য নেই, যে কোনো সুস্থ-সবল দম্পতি যৌন স্বাদ গ্রহণ করে তৃপ্ত হতে পারে যাতে করে দাম্পত্য জীবনের সম্পর্ক সুদৃঢ় হতে পারে। এ ব্যাপারে স্বামীর ডাকে যেমন স্ত্রীকে সাড়া দিতে হবে, স্ত্রীর আকার ইঙ্গিত থেকে বুঝে নিয়ে তার প্রয়োজনও যথারীতি পূরণ করতে হবে।

পারস্পারিক হাদিয়া-তোহফা প্রদান

৭. পারস্পারিক হাদিয়া-তোহফা প্রদান:

যে জিনিসের মাধ্যমে মানুষের মনে শিহরণ সৃষ্টি হয়, মানুষ পুলকিত হয় সে সব ছোট-খাট জিনিসের বিনিময় হতে পারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। এ সব ছোট-খাট হাদিয়া-উপঢৌকন ভালবাসার বন্ধনকে করে তুলতে পারে আরো নিবিড়, আরো ঘনিষ্ঠ। স্ত্রী যদি ছোট একটি রুমালে ফুল তুলে স্বামীকে উপহার দেয় স্বামী অবশ্যি পুলকিত হবে অথবা স্বামী যদি একখানি শাড়ী বা একটা চুলের ফিতা কিনে স্ত্রীকে উপহার দেয়, স্ত্রী পুলকিত হবে। এই উপহার বিনিময় প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী হবে। সচ্ছল ও ধনী ব্যক্তি সে ধরনের উপহার বিনিময় করবে। এমনকি স্ত্রী তার মোহরের আংশিক স্বামীকে ছেড়ে দিতে পারে। যদি কারো স্ত্রী এরূপ করে তাহলে স্বামীকে তা তৃপ্তির সাথে মজা করে খেতে আল্লাহ তায়ালা অনুমতি প্রদান করেছেন:

وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً فَإِنْ طِبْنَ لَكُمْ عَنْ شَيْءٍ مِّنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَّرِيئًا –

“স্ত্রীরা যদি সানন্দে মোহরানার অংশ বিশেষ তোমাদেরকে মাফ করে দেয়, তাহলে তা তোমরা তৃপ্তির সাথে মজা করে খাও।” (সূরা নিসা : ৪)

এভাবে উপহার-উপঢৌকন দাম্পত্য জীবনকে সুখী ও সুন্দর করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে, যা হওয়া দরকার পারস্পরিক বিনিময়রূপে এবং সময়ে সময়ে।

এমনিভাবে পারিবারিক শান্তির প্রতি লক্ষ্য রেখে সুখী সুন্দর দাম্পত্য জীবন গড়ে তোলার কলাকৌশলগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। স্বামী-স্ত্রী উভয়কে এ ব্যাপারে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। সকল প্রকার ভুল বুঝাবুঝিকে পরিহার করতে হবে হেকমতের সাথে অবলীলাক্রমে।

পঞ্চম অধ্যায় : স্বামীর অধিকার ও দায়িত্ব

স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও দায়িত্ব পারস্পরিক। একজনের যা অধিকার অপরজনের অনেকাংশে তা দায়িত্ব। তাই স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও দায়িত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যাপারে আলোচনায় পুনরোল্লেখ হতে পারে। কিন্তু পৃথকভাবে বিষয়টিকে ফুটিয়ে তোলার জন্য ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাওয়াই বিধেয় হবে।

স্বামীর অধিকার

পরিবার পরিচালনা ও কর্তৃত্বের অধিকার

(১) পরিবার পরিচালনা ও কর্তৃত্বের অধিকার :

পরিবার পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী একজনের দায়িত্ব থাকা দরকার। পারিবারিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এটা অত্যন্ত জরুরী। পরিবার রূপ জাহাজের হাল তো একজনের হাতেই থাকতে হবে। অন্যথায় হবে বিশৃঙ্খলা বা দ্বৈততা। আল্লাহ তায়ালা নিজেই এ সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন:

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ –

“পুরুষরা হচ্ছে নারীদের উপর কর্তা ও পরিচালক এজন্য যে, আল্লাহ একজনকে অপরজনের উপর মর্যাদা দান করেন এবং এজন্য যে, পুরুষরা তাদের ধন-সম্পদ খরচ করে থাকে।” (সূরা নিসাঃ ৩৪)

তাই পুরুষদের রয়েছে কর্তৃত্বের অধিকার। তারা পরিবার পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করবে। পরিবারের জন্য উপার্জন ও রুজী-রোজগার করবে। পরিবারের স্ত্রী পরিজনের ব্যয়ভারের, ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবে। আর নারীকে পুরুষের আনুগত্য করে চলতে হবে। পরিবারের ভরণ-পোষণের কোনো দায়-দায়িত্ব স্ত্রীর নেই। কিন্তু স্ত্রী সর্বদা স্বামীর আদেশ মেনে চলবে।

সমাজ-জীবনে চলার ক্ষেত্রে পুরুষকে নারীর উপর মর্যাদা দান করা হয়েছে। বলা হয়েছে:

وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةً

“তাদের (নারীদের) উপর পুরুষদের রয়েছে বিশেষ মর্যাদা।” (সূরা আল বাকারা: ২২৮)

স্ত্রীর আনুগত্য লাভ করা স্বামীর অধিকার। স্বামী কোনো আদেশ প্রদান করলে স্ত্রীর কর্তব্য তা পালন করা। স্ত্রীর বৈশিষ্ট্যই হলো স্বামীর অনুগত থাকা।

“হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেন: স্ত্রীলোক যখন তার জন্য নির্ধারিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, রমজান মাসের রোযা রাখে, নিজের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে এবং তার স্বামীর অনুগত থাকে, তখন সে বেহেশতের যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে চায়, প্রবেশ করতে পারে।” (মেশকাত-৪০১৫)

অপর হাদিসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন: “আমি যদি কাউকে (আল্লাহ ছাড়া) অপর কাউকে সিজদা করার নির্দেশ দিতাম তবে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করার।” (মেশকাত- ৪০১৬)

হাদিসে আরো বলা হয়েছে: “যে নারী তার স্বামীকে সন্তুষ্ট রেখে মারা যাবে, সে বেহেশতে যাবে।” (মেশকাত- ৪০১৭)

অপর হাদিসে বলা হয়েছে: “স্বামী যদি নারাজ থাকে তাহলে স্ত্রীর নামায কবুল হবে না এবং তা আকাশের দিকে উঠবে না।”

হাদিসে এসেছে, সর্বোত্তম নারী কে? এ প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “ঐ নারী যে তার স্বামীকে আনন্দ দেয় যখন সে তার দিকে তাকায়, স্বামীর কথা মান্য করে এবং তার জীবন ও সম্পদের ক্ষেত্রে এমন কিছু করে না যা সে অপছন্দ করে।”

স্বামীর কর্তৃত্ব মানা ও স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর কর্তব্য। তাই পরিবারের সার্বিক পরিচালনা ও কর্তৃত্ব করা স্বামীর অধিকার। অবশ্য স্বামীর এ অধিকার নিরঙ্কুশ বা শর্তহীন নয়। আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের পরই স্বামীর আনুগত্য করা যাবে। আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যকে বাদ দিয়ে স্বামীর আনুগত্য করা চলবে না। অথবা আল্লাহ ও রাসূলের নাফরমানিমূলক আনুগত্যও বিধেয় নয়। কারণ, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

لاَطَاعَةَ لِمَخْلُوقِ فِي مَعْصِيَةَ الْخَالِقِ –

“স্রষ্টার নাফরমানিতে সৃষ্টির আনুগত্য করা চলবে না।”

তাই আল্লাহর দাসত্ব, ইবাদত-বন্দেগী ও আনুগত্য প্রদানে যদি স্বামী বাধা সাধেন তবে তা মানা স্ত্রীর জন্য বাধ্যতামূলক নয়। এমনকি স্বামীর শরীয়ত বিরোধী কার্যক্রমে হেকমতের সাথে বাধা প্রদান এবং তা থেকে স্বামীকে বিরত রাখাও একজন মুসলিম নারীর কর্তব্য।

স্ত্রীর স্বাধীন চলাফেরায় বিধি-নিষেধ আরোপে স্বামীর অধিকার

(২) স্ত্রীর স্বাধীন চলাফেরায় বিধি-নিষেধ আরোপে স্বামীর অধিকার:

স্ত্রীর এ ঘর থেকে ও ঘরে যাওয়াকে এবং অন্য স্ত্রীলোকের সাথে মেলামেশা করার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা থাকতে পারে কিন্তু বাড়ীর বাইরে হাটে-বাজারে, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ীতে বা যত্রতত্র যাতায়াত, পর পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশা, গল্প-গুজব ইত্যাদি মুসলিম নারীর জন্য বৈধ নয়। এ ক্ষেত্রে স্বামী বিধি-নিষেধ আরোপ করবে, চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করবে, পর্দা মেনে চলার জন্য বাধ্য করবে- এ হলো স্বামীর অধিকার। একজন মুসলিম স্বামী স্বীয় স্ত্রীর চলাফেরার ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধি-বিধানকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করবে, স্ত্রীর চলাফেরার ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধানকে কার্যকর করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।

একজন মুসলিম স্বামী তার স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সাথে চাকুরী করতে, সফরে চলে যেতে বা মেলামেশা করতে দিতে পারে না। তাকে শরীয়তের বিধানমতে পর্দার মধ্যে রাখা স্বামীর দায়িত্ব। উপরে বর্ণিত কোরআনের আয়াত ও হাদিস মোতাবেক তা মানতে স্ত্রী বাধ্য। মুসলিম সমাজে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি মোতাবেক স্বামী-স্ত্রীর এক পবিত্র সমাজ।

স্ত্রীর নফল এবাদতে বিধি-নিষেধ আরোপের অধিকার

(৩) স্ত্রীর নফল এবাদতে বিধি-নিষেধ আরোপের অধিকার :

স্ত্রীর নফল ইবাদতে স্বামীর অনুমতি প্রয়োজন। কোনো স্ত্রী যদি এশার নামায আদায় করে স্বামীকে বিছানায় রেখে নফল নামায দীর্ঘ রাত পর্যন্ত পড়তে থাকে আর স্বামী বেচারা বিছানায় শুয়ে স্ত্রীর অপেক্ষায় অস্থির থাকে তবে স্ত্রীর নফল নামায এ ক্ষেত্রে জায়েজ হবে না বরং স্ত্রীকে স্বামীর প্রয়োজন পূরণে বিছানায় যেতে হবে। তেমনিভাবে কোনো স্বামীর যদি দিনের বেলায় স্ত্রীর প্রয়োজন পড়ে, তাহলে স্ত্রীর নফল রোযা রাখা চলবে না। স্ত্রীর নফল ইবাদতে স্বামীর অনুমতি প্রয়োজন। এ বিষয়ে একটি হাদিসে দেখা যায়:

“একদা একজন স্ত্রীলোক এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে বলেন, আমার স্বামী সাফওয়ান বিন মুয়াত্তাল, আমাকে মারেন যখন আমি নামায পড়ি, আমি যখন রোযা রাখি আমাকে রোযা ভাঙতে বাধ্য করে এবং তিনি সূর্য উঠা ব্যতীত ফজরের নামায পড়েন না।

তখন সাফওয়ান (তার স্বামী) রাসূলের নিকট ছিল। তিনি তাকে তার বিবির অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে সাফওয়ান বলেন, সে যে বলেছে সে যখন নামায পড়ে আমি তখন তাকে মারি এর কারণ হল যে, সে এক সাথে (বড় বড়) দুটি সূরা পড়ে অথচ আপনি তা নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ বললেন, একটি সূরা সকল লোকের জন্য যথেষ্ট। অতঃপর সাফওয়ান বলল, সে বলেছে যে, আমি তাকে রোযা ভাঙতে বাধ্য করি এর কারণ হল সে একাধারে রোজা রাখতে শুরু করে অথচ আমি একজন যুবক পুরুষ আমি সংযম রাখতে পারিনা। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, কোনো নারী যেন তার স্বামীর অনুমতি ব্যতীত নফল রোযা না রাখে।” (হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে আবু দাউদ, ইবনে মাজা, মেশকাত – ৪০২৯)

অর্থাৎ স্ত্রীর নফল ইবাদত স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষ। তাই স্ত্রীর নফল ইবাদতে বিধি-নিষেধ আরোপে স্বামীর অধিকার রয়েছে।

সম্ভাব্য সাহচর্য ও সার্বিক সহযোগিতা লাভের অধিকার

(৪) সম্ভাব্য সাহচর্য ও সার্বিক সহযোগিতা লাভের অধিকার:

মানব সৃষ্টি রহস্য আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টির পর তার পাঁজরের হাড় থেকে সঙ্গী হিসাবে বিবি হাওয়াকে সৃষ্টি করেন। যা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, নারীর সৃষ্টির উদ্দেশ্য পুরুষের সঙ্গদান। তাই দেখা যায়, যুগে যুগে নবী-রাসূলদের সঙ্গী হিসাবে তাদের স্ত্রীগণ তাদের পাশে ছিলেন। এমনকি প্রতিটি সফর এবং যুদ্ধ-জিহাদে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) লটারী করে একজন বিবি সাথে নিতেন। স্ত্রীদের প্রধান দায়িত্ব স্বামীদেরকে সঙ্গ ও সাহচর্য দান। এজন্যই হয়ত তাদেরকে বলা হয় জীবন সঙ্গিনী।

স্বামীর অধিকার হল স্ত্রীর সঙ্গ ও সাহচর্য পাওয়া। বাড়ী ঘরে থাকা অবস্থায়ও স্বামীর উঠতে বসতে বিভিন্ন জিনিসের প্রয়োজন হয় যা সহজেই স্ত্রী সরবরাহ বা ব্যবস্থা করে দিতে পারে। স্বামী যখন ঘর থেকে বের হয় তখন অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে দেয়া, স্বামী ঘরে ফিরে আসলে তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানানো ও প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করা, খাওয়া-পরা সর্ব ব্যাপারে স্বামীর সহযোগিতা স্ত্রীর দায়িত্ব। স্বামীর কাজকর্ম, চলাফেরা, উঠাবসা সব, ব্যাপারেই সে স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল। স্ত্রী ছায়ার মত স্বামীর কাছে কাছে থাকবে এবং প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ের ব্যবস্থা করে দিবে। স্বামীর অসুখ-বিসুখে সেবা-যত্ন করা, ঔষধ-পথ্যের ব্যবস্থা করা স্ত্রীর চেয়ে উত্তম আর কেউ করতে পারে না। বিশেষ করে স্বামী অচল হয়ে পড়লে কেবলমাত্র স্ত্রীই তাকে যথাযথভাবে সেবা-যত্ন করতে পারে। স্বামীর গোপন অঙ্গ প্রকাশ তো কেবলমাত্র স্ত্রীর নিকটই করা যায়।

স্ত্রীর সাজসজ্জা দেখার অধিকার একমাত্র স্বামীর

(৫) স্ত্রীর সাজসজ্জা দেখার অধিকার একমাত্র স্বামীর:

নারী জাতি সৌন্দর্যের প্রতীক। নারী যখন বিভিন্ন অলঙ্কারে অলঙ্কৃত হয়ে সুন্দর পোশাকে ও প্রসাধনীতে মনের মত সাজে তখন তাকে অপূর্ব ও অপরূপা দেখায়। স্ত্রীর এ অপরূপ সাজ-গোজ পর পুরুষকে দেখাতে পারে না, পারে না বাজারে প্রদর্শনী করতে। বরং স্বামীর নিকট মনোমুগ্ধকর ও নয়নাভিরাম সাজে সজ্জিত হয়ে নিজেকে পেশ করে দেয়াই স্ত্রীর কর্তব্য।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম সর্বোত্তম নারীর কথা বলতে গিয়ে বলেছেন যে, “সর্বোত্তম নারীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ঐ নারী যে তার স্বামীকে আনন্দ দেয় যখন সে তার দিকে তাকায়।”

মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) তার কোরআন হাদিসের আলোকে পারিবারিক জীবন বইতে এক মহীয়সী রমণীর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন : সে প্রতি রাতে এশার নামাযের পর খুব সাজ-সজ্জা গ্রহণ করতো। সুন্দর ও পরিষ্কার পোশাক পরিধান করে, হাতে, গলায় ও কানে অলঙ্কার পরে ও চোখে সুরমা লাগিয়ে এ অবস্থায় স্বামীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতো : আমাকে আপনার প্রয়োজন আছে কি? যদি সে বলতো হ্যাঁ আছে। তাহলে সাথে সাথে তার কাছে শুয়ে যেতো। আর যদি বলতো, না আমার প্রয়োজন নেই, তখন সে বলতো তাহলে আমাকে অনুমতি দিন, আমি গিয়ে আপন প্রতিপালকের ইবাদতে মশগুল হই। স্বামীর অনুমতি লাভের পর সে পরিধেয় পোশাক ও. অলঙ্কার সমূহ খুলে ফেলে সাদা কাপড় পরে গোটা রাত নির্জন ইবাদতে কাটিয়ে দিতো।

স্ত্রীর সৌন্দর্য কেবলমাত্র স্বামীর নিকট প্রদর্শনের জন্য। এটা স্বামীর অধিকার। আজকের সমাজ হয়ে গেছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। স্বামীর সামনে থাকে সাধারণ পোশাকে ও অসাবধানভাবে, আর যখন বাইরে বেরোয় তখন সাজগোজ করে অন্যকে দেখিয়ে বেড়ায়।

এক হাদিসে বলা হয়েছে: “স্বামী ছাড়া অন্য লোকের সামনে যে নারী সাজসজ্জা করে আকর্ষণীয় পোশাকে আবির্ভূত হয় সে কিয়ামতের দিনের অন্ধকার সমতুল্য। সেদিন তার জন্য কোনো আলোর ব্যবস্থা থাকবে না।” (তিরমিযী: ১১০৫)

স্বামীর গোপন বিষয়, আমানত ও ধন সম্পদ সংরক্ষণের অধিকার

(৬) স্বামীর গোপন বিষয়, আমানত ও ধন সম্পদ সংরক্ষণের অধিকার:

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার গোপন কথা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই গোপন রাখতে হবে। তাকে প্রকাশ করে দেয়া জঘন্য অপরাধ এবং চরম দোষণীয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম একবার তার এক স্ত্রীর নিকট একটি গোপন কথা বলেন কিন্তু উক্ত স্ত্রী সে কথাটি রাসূলের অপর এক স্ত্রীর নিকট বলে দেন। আল্লাহ তায়ালা সে কথা ওহীর মাধ্যমে রাসূলকে জানিয়ে দেন এবং স্ত্রীদেরকে সতর্ক করে দেন। আল্লাহ তাদেরকে তাওবা করতে বলেন এবং জানিয়ে দেন যে, রাসূলের সাহায্যার্থে রয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ, হযরত জিবরাঈল, সৎ মু’মিন বান্দা ও ফেরেশতাগণ, তিনি তাদেরকে তালাকের হুমকিও দেন। সূরা তাহরীমের ৩ থেকে ৫ আয়াতের মধ্যে এ কথাগুলো রয়েছে।

তাই স্বামীর গোপন কথা, অপরাপর গোপন বিষয়সমূহ, স্বামীর আমানত, ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্ত্রীর। কোরআনে সতী-সাধ্বী স্ত্রীর গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে: “সতী-সাধ্বী নারীগণ হয়ে থাকে স্বামীর প্রতি অনুগত ও আনুগত্যশীলা এবং আল্লাহ যা হিফাজত করেন স্বামীর অনুপস্থিতিতে তা হিফাজতকারী।”

এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে: “যে ব্যক্তিকে চারটি জিনিস দেয়া হয়েছে তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের সমস্ত কল্যাণ দান করা হয়েছেঃ (১) কৃতজ্ঞ অন্তর (২) আল্লাহর যিকির রত জিহ্বা (৩) বিপদে ধৈর্যশীল দেহ এবং (৪) এমন স্ত্রী যে আপন ইজ্জত ও স্বামীর ধনসম্পদের কখনো খেয়ানত করে না।”

অপর হাদিসে বলা হয়েছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমার সর্বোত্তম সম্পদ হচ্ছে সেই স্ত্রী যাকে দেখলে তুমি আনন্দ লাভ কর। যাকে কোনো কাজ করতে বললে তা মেনে নেয়। তুমি যখন ঘরে অনুপস্থিত থাক তখন সে তোমার ধন-সম্পদ ও তার নিজেকে হিফাজত করে।”

* গোপনীয় বিষয় বলতে কোনো গোপন কথা, দাম্পত্য জীবনের গোপনীয় বিষয়, বংশ সংরক্ষণ, বীর্য পালন, সতীত্ব সংরক্ষণ, স্ত্রীর নিকট গচ্ছিত কোনো আমানত, সম্পদের হিফাজত, সন্তান প্রতিপালন ইত্যাদি যাবতীয় গোপনীয়তা রক্ষাকেই বোঝায়। স্ত্রী কর্তৃক এ সকল গোপনীয়তা রক্ষা করা স্ত্রীর দায়িত্ব এবং এ হলো স্বামীর অধিকার।

যৌন চাহিদা পূরণ ও পরিতৃপ্তি লাভের অধিকার

(৭) যৌন চাহিদা পূরণ ও পরিতৃপ্তি লাভের অধিকার :

বিয়ের মৌল বিষয়ই হলো স্বামী-স্ত্রীর যৌন বৈধতা অর্জন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই প্রকৃতিগতভাবে যৌন চাহিদা থাকা স্বাভাবিক। বিয়ের উদ্দেশ্য হলো স্বামীর যৌন চাহিদা পূরণে স্ত্রী এগিয়ে আসবে, স্ত্রীর চাহিদা পূরণে স্বামী এগিয়ে যাবে এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো সূত্র অবলম্বন করা যাবে না। অন্য কোনো ধরনের যৌন সম্পর্ক রক্ষা করা বা সম্পর্ক স্থাপন ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম ও পরিত্যাজ্য। তাই স্বামী-স্ত্রীর যৌন সম্পর্ক হবে পরিপূর্ণ যাতে উভয়ের পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ হয়। যেন যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অন্য কোনো দিকে স্বামী বা স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষিত না হয়। এভাবে বিয়ের মাধ্যমে একটি পবিত্র সমাজ গড়ে উঠবে। যেখানে থাকবে না কোনো অবৈধ যৌন সম্পর্ক, কোনো যেনা-ব্যভিচার। বিবাহিত নারী-পুরুষের যেনা-ব্যভিচারের কঠোরতর শাস্তির ব্যবস্থা (জনসমক্ষে পাথর নিক্ষেপে হত্যা) এজন্যই নির্ধারিত হয়েছে। তাই স্ত্রীর দায়িত্ব হলো তার স্বামীকে যৌন চাহিদা পূরণে পরিপূর্ণ তৃপ্তিদান আর স্বামীর অধিকার হলো স্ত্রী থেকে যৌন চাহিদা পূরণে পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভ। এভাবে পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত কোনো স্বামী অন্য কোনো মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া স্বাভাবিক নয়।

স্বামীর এ দাবী পূরণে স্ত্রীকে যে কোনো সময় সাড়া দিতে হবে। হাদিসে রাসূলের বলা হয়েছেঃ “যখন কোনো পুরুষ তাহার স্ত্রীকে নিজের প্রয়োজনে ডাকে তখন সে যেন তার ডাকে সাড়া দেয়- যদিও সে চুলার কাজে রত থাকে।’ ‘তালক বিন আলী-তিরমিযী-মেশকাত-৪০১৮)

রাসূলের অপর হাদিসে বলা হয়েছে: “যখন কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তার বিছানায় ডাকে আর স্ত্রী তা অস্বীকার করে এবং স্বামী নারাজ অবস্থায় রাত কাটায়, তখন ফেরেশতাগণ তাকে অভিশাপ করতে থাকে যতক্ষণ না ভোর হয়।” [বুখারী ও মুসলিম-আবু হুরায়রা (রাঃ) (মেশকাত-৪০০৮)]

অতএব স্ত্রীর কর্তব্য হলো স্বামীর যৌন প্রয়োজনের ডাকে যথারীতি সাড়া দিয়ে স্বামীকে যৌন তৃপ্তি দান এবং এ হলো স্বামীর অধিকার।

অবাধ্য স্ত্রীকে শাসনের অধিকার

(৮) অবাধ্য স্ত্রীকে শাসনের অধিকার :

স্বামী-স্ত্রী মিলে-মিশে সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করবে এটাই পারিবারিক জীবনে কাম্য। এক্ষেত্রে স্ত্রীকে স্বামীর আনুগত্য করতে হবে, মেনে চলতে হবে স্বামীর আদেশ ও নির্দেশ। কিন্তু যদি কোনো স্ত্রী স্বামীকে মেনে চলতে অপারগ হয় এবং স্বামীর অবাধ্য হয়ে পড়ে তবে আল্লাহ তায়ালা তাকে শাসনের অধিকার দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا –

“এবং যাদের ব্যাপারে তোমরা অবাধ্যতার আশংকা কর তাদেরকে উপদেশ দান কর, তাদের বিছানা আলাদা করে দাও এবং তাদেরকে মারধর কর, অতঃপর যদি তারা আনুগত্য করে তবে কোনো বাহানা তালাশ করো না, আল্লাহ অনেক উচ্চ ও অনেক বড়।” (সূরা নিসাঃ ৩৪)

এখানে আল্লাহ অবাধ্য স্ত্রীদেরকে ক্রমিক পদ্ধতিতে আনুগত্যশীল করতে বলে দিয়েছেন। প্রথমে তাদেরকে বোঝাতে হবে, উপদেশ দিতে হবে। তাতেও কাজ না হলে তাদের বিছানা পৃথক করে মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে, এতেও কাজ না হলে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে শাস্তি প্রদানের অধিকার প্রদান করেছেন। এমতাবস্থায় স্ত্রীর অবাধ্যতার কারণে এবং যেহেতু সে সংশোধনের পথে আসছে না তাকে হালকাভাবে মারধর করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ স্ত্রীদেরকে শাসন করার অধিকার রয়েছে স্বামীর।

স্ত্রীদেরকে মারধর করার ব্যাপারে রাসূলের হাদিসে অনেক কথা বলতে দেখা যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “কেউ যেন নিজের স্ত্রীকে গোলাম-বাদীর ন্যায় না পিটায় অতঃপর দিনশেষে তার সাথে শোয়।” (বুখারী ও মুসলিম-আবদুল্লাহ্ বিন জামা’আ থেকে, মেশকাত: ৪০০৪)

স্ত্রীকে মারার ব্যাপারে অপর এক হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “স্ত্রীকে তার চেহারায় আঘাত করবে না এবং তাকে অশ্লীল গালি দেবে না।” (আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজা)
কোরআনের উপরের আয়াত ও এসব হাদিস থেকে বোঝা যায় স্ত্রীর অবাধ্যতার কারণে শিক্ষামূলকভাবে মারধর করা যাবে, কিন্তু মুখে আঘাত করা জায়েজ নয়। শাসন করার এ পদ্ধতি আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন। এ হলো স্বামীর এক বিশেষ অধিকার।

তালাক প্রদানের অধিকার

(৯) তালাক প্রদানের অধিকার :

বিয়ে হলো স্বামী-স্ত্রী মিলে-মিশে বসবাস করার জন্য। কিন্তু কোনো দম্পতির যদি মিলমিশ না হয়, স্ত্রী যদি স্বামীকে মেনে চলতে না পারে, স্বামী যদি স্ত্রীকে মোটেই বরদাশত করতে রাজি না হয়, তাহলে অগত্যা ইসলামের বিধান হলো স্ত্রীকে তালাক প্রদান। তালাক প্রদানের অধিকার স্বামীর।

মনে রাখতে হবে বিয়েকে স্থায়ী করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কোরআন সুপারিশ করেছে। সূরা নিসার ৩৪নং আয়াতে বলা হয়েছে, অবাধ্য স্ত্রীকে প্রথমে বুঝানো ও উপদেশ দান, নসিহত করার কাজ করতে হবে। এতে যদি স্ত্রী না শোধরায় তার বিছানা পৃথক করে দিতে হবে, স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হবে। এতেও যদি স্ত্রীর মধ্যে কোনো রূপ পরিবর্তন না আসে তাহলে তাকে শাসন করতে হবে। তাতেও যদি তার মধ্যে পরিবর্তন না আসে, তাহলে দু’পক্ষের মধ্যে সালিশের ব্যবস্থা করে মীমাংসার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যত্র বলা হয়েছে তাদের মধ্যে সন্ধি করতে হবে। কিন্তু এতসবের কোনটাই শেষ পর্যন্ত ফলদায়ক না হলে অগত্যা একজন স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। তবে তালাকও একবারে নয় বরং তিন মাসে পবিত্র অবস্থায় তালাক দিতে হবে। দুই তালাক পর্যন্ত স্ত্রীর মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়া যাবে কিন্তু তিন তালাক দিয়ে ফেললে আর ফিরিয়ে নেয়া যাবে না বরং উত্তমভাবে বিদায় দিতে হবে কোরআনের শিক্ষা মোতাবেক। মোটকথা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে স্ত্রীকে তালাক প্রদান স্বামীর অধিকার সে এ অধিকার প্রয়োগ করে স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিতে পারে যাতে ইদ্দত শেষ করে উক্ত মহিলা অন্য কারো স্ত্রী হিসেবে নিজেকে পেশ করতে পারে।

দাম্পত্য জীবনকে সুখী ও সুন্দর করতে হলে স্বামীর এ নয়টি অধিকারকে মেনে নিতে হবে। প্রথম সাতটি অধিকার মেনে নিলে দাম্পত্য জীবনে আসবে অনাবিল সুখ ও শান্তি। অন্যথায় স্বামীর হাতে রয়েছে শাসনদণ্ড অথবা তালাকের বা বিচ্ছেদের অস্ত্র। মুসলিম স্ত্রীদেরকে বিষয়টি ভাল করে উপলব্ধি করে পারিবারিক জীবন-যাপন করতে হবে।

স্বামীর দায়িত্ব

মোহর প্রদানের দায়িত্ব

(১) মোহর প্রদানের দায়িত্ব:

স্বামীর সর্বপ্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো স্ত্রীকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মোহর প্রদান। স্বামীকে তার সাধ্যমত মোহর প্রদান করতে হবে, মোহর প্রদান করতে হবে মনের সন্তুষ্টি সহকারে। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً

“তোমরা তোমাদের স্ত্রীদেরকে মনের সন্তোষ সহকারে তাদের মোহর প্রদান কর।” (সূরা নিসা : ৪)
মোহর প্রদান ব্যতীত বিয়েই সিদ্ধ হয় না। বিশেষ করে স্বামীর জন্য স্ত্রীর যৌনাঙ্গ হালাল হয় মোহরের মাধ্যমে। স্বামীর অবস্থানুযায়ী মোহর কম বেশী হতে পারে, তবে স্বামীকে তার সাধ্যমত মোহর প্রদান করতে হবে। কিন্তু মোহর নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি করা যেমন ঠিক নয় আবার মোহর নামমাত্র ধার্য করা, আদায় না করা এ-ও ঠিক নয়। এ হলো স্বামীর দায়িত্ব আর স্ত্রীর অধিকার। এ অধিকার থেকে স্ত্রীকে বঞ্চিত করলে স্বামী গুনাহগার হবে। অবশ্য স্ত্রী যদি মোহরের আংশিক মাফ করে দেয় তাহলে তা স্বামী পরিতৃপ্তির সাথে খেতে পারে বলে কোরআনে বলা হয়েছে।

স্ত্রীকে খোরপোষ প্রদানের দায়িত্ব

(২) স্ত্রীকে খোরপোষ প্রদানের দায়িত্ব :

উপার্জন করে স্ত্রীর ও পরিবারের ভরণ-পোষণ ও খোরপোষের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব স্বামীর। অবশ্য তার এ দায়িত্ব তার সামর্থ্যানুযায়ী। সামর্থ্যের অধিক দাবী করা ন্যায়সংগত নয়। আল্লাহ তায়ালা এ প্রসঙ্গে বলেন:

وَمَتِّعُوهُنَّ عَلَى الْمُوسِعِ قَدَرُهُ وَعَلَى الْمُقْتَرِ قَدَرُهُ ، مَتَاعًا بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُحْسِنِينَ

“আর তাদেরকে (স্ত্রীদেরকে) খোরপোষ প্রদান কর, সচ্ছল ব্যক্তি তার সাধ্যানুযায়ী এবং অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি তার সাধ্যনুযায়ী ন্যায়সংগতভাবে কিছু খরচপত্রের ব্যবস্থা করে, এ হলো মোহসেনদের (সদাচারী) দায়িত্ব।” (সূরা আল বাকারা: ২৩৬)

খোরপোষ প্রদানের ব্যাপারে হাদিসে আরো পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে: “যখন আল্লাহ তায়ালা তোমাদের কাউকে মাল সম্পদ দান করেন তখন সে যেন প্রথমে তার নিজের ও তার পরিবারের জন্য খরচ করে।”
(মুসলিম -হযরত জাবের বিন সামুরা, মেশকাত- ৪০৩৪)

স্ত্রীদের ব্যাপারে আরো বলা হয়েছে: “তাকে খাওয়াবে যখন তুমি খাবে, তাকে পরাবে যখন তুমি পরবে।” (মেশকাত-৪০২০, আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজা)

“তোমাদের (স্বামীদের) উপর স্ত্রীদের অধিকার হলো তাদের জন্য পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যদ্রব্যের উত্তম ব্যবস্থা করা।” (তিরমিজি-১১০১ (শেষাংশ)

কোরআনের আয়াত ও হাদিসগুলোয় একথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, স্ত্রীর জন্য সাধ্যমত উত্তম পোশাক ও খাদ্যদ্রব্যের ব্যবস্থা করা স্বামীর কর্তব্য।

অবশ্য স্বামীর সাধ্যের অতিরিক্ত দাবী করা স্ত্রীর জন্য সমীচীন নয়। স্বামীর আয়ের মধ্যেই তাকে ধৈর্যধারণ করতে হবে। প্রিয় নবীজির জীবনেও এমন সময় এসেছিল যখন স্ত্রীদের দাবী পূরণের সামর্থ্য তার ছিল না। এজন্য তিনি একমাস স্ত্রীদের থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন করেছিলেন। এমনিভাবে জীবন মান বৃদ্ধির জন্য চাপ প্রয়োগও যথার্থ নয়।

স্ত্রীর প্রতি সদ্ব্যবহার করার দায়িত্ব

(৩) স্ত্রীর প্রতি সদ্ব্যবহার করার দায়িত্ব :

কোরআনের বহু জায়গায় এবং বহু হাদিসে স্ত্রীর প্রতি সদ্ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। আসলে স্ত্রী তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে স্বামীর নিকট চলে আসে, তার কাছে ভাল ব্যবহার না পেলে স্ত্রীর পক্ষে তার সাথে একত্রে বসবাস কঠিন হওয়াই স্বাভাবিক। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ

“তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন কর।” (সূরা নিসা: ১৯)
স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:

وَإِنْ تُحْسِنُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا –

“এবং তোমরা যদি সদ্ব্যবহার কর ও (দুর্ব্যবহার থেকে) সংযম অবলম্বন কর তাহলে আল্লাহ তোমরা কি করছ তার খবর রাখেন।” (সূরা নিসা: ১২৮)
এমনকি তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীদের প্রতিও সদ্ব্যবহারের কথা বলেছেন আল্লাহ তায়ালাঃ

وَلِلْمُطَلَّقَاتِ مَتَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِينَ

“তালাক প্রাপ্তাদের জন্য সদ্ভাবে কিছু ধন-সম্পদ প্রদান মুত্তাকীদের কর্তব্য।” (সূরা বাকারা: ২৪১)
فَإِذَا بَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمْسِكُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ أَوْ فَارِقُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ

“এরপর যখন সময় পূর্ণ হয়ে যায় তখন হয় তাদেরকে সদ্ভাবে ধরে রাখ অথবা যথানিয়মে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও।” (সূরা তালাক : ২)

এভাবে আল্লাহ তায়ালা স্ত্রীদের প্রতি সদ্ব্যবহারের কথা স্বামীদেরকে বলেছেন কোরআনের বিভিন্ন জায়গায়।

হাদিসে রাসূলেও এ ব্যাপারে বলা হয়েছে- বিভিন্ন হাদিসে। বিদায় হজের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “তোমরা স্ত্রীদের সাথে সদ্ব্যবহারের উপদেশ গ্রহণ কর।” এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল বলেনঃ “আমার নিকট থেকে নারীদের সাথে ভাল ব্যবহারের উপদেশ গ্রহণ কর, তাদেরকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং হাড়ের মধ্যে সবচেয়ে বাঁকা হলো উপরেরটা (নারীকে তা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে), অতএব তুমি যদি তাকে সোজা করতে চাও, ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি ফেলে রাখ, তবে সর্বদা বাঁকাই থেকে যাবে। সুতরাং তোমরা নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে।” (বুখারী ও মুসলিম মেশকাত-৪০০০)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ভাল যে তার স্ত্রীর নিকট ভাল।”
এই সব হাদিস থেকে জানা গেল স্বামীকে তার স্ত্রীর সাথে উত্তম ব্যবহার করতে হবে। এটা স্বামীর দায়িত্ব।

স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা, স্নেহ-মহব্বত ও দরদ রাখার দায়িত্ব

(৪) স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা, স্নেহ-মহব্বত ও দরদ রাখার দায়িত্ব :

স্ত্রী নিজ বাড়ীঘর, বাপ-মা ও আত্মীয় স্বজন ত্যাগ করে চলে আসে স্বামীর কাছে। তাই স্বামী যদি তাকে আন্তরিক ভালবাসা, স্নেহ-মহব্বত ও পূর্ণ দরদের সাথে গ্রহণ করে তাহলেই সে স্বস্তি লাভ করতে পারে। সে হয়ে যেতে পারে তার আপন। তাই স্ত্রীর প্রতি স্বামীর থাকতে হবে এক স্বাভাবিক অনুরাগ ও আকর্ষণ। স্বামী আদর, স্নেহ-সোহাগে ভরে তুলবে স্ত্রীর জীবন। ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ এটা ওটা কিনে দেবে যাতে সে হৃদয়-মন পূর্ণভাবে সপে দেয় স্বামীর নিকট।

পুরুষকে সর্ব ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হয়। তাই স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং গভীর ও আন্তরিক সম্পর্ক সৃষ্টিরও উদ্যোগ স্বামীকেই গ্রহণ করতে হবে। বিষয়টি অবশ্যই পারস্পরিক। স্বামীকে সমঝোতা স্থাপন ও সমন্বয় সাধনে ভূমিকা রাখতে হবে। তাকে হতে হবে উদার ও দরদী। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ –

“তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম হলো এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন। যেন তোমরা তাদের সাথে শান্তিতে বসবাস কর এবং তিনি তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন ভালবাসা ও দয়া। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিশ্চয়ই নিদর্শন রয়ে গেছে।” (সূরা রূম: ২১)

উক্ত আয়াতের প্রেক্ষিতে স্বামীকে ভালবাসার ডালি নিয়ে হাজির হতে হবে স্ত্রীর কাছে আর দরদ ভরা দয়া ও মেহেরবানী নিয়ে সুখী সুন্দর পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে হবে।

স্ত্রীকে শিক্ষা দানের দায়িত্ব

(৫) স্ত্রীকে শিক্ষা দানের দায়িত্ব :

প্রত্যেক মুসলমানের শিক্ষা গ্রহণ ফরজ। বিশেষ করে ইবাদত-বন্দেগীর নিয়ম-কানুন, স্বাভাবিক শিষ্টাচার, কুরআন তেলাওয়াত, সূরা শিক্ষা ও প্রাথমিক জ্ঞানার্জন তো বিশেষভাবে জরুরী। এসব ব্যাপারে স্ত্রীর কমতি থাকলে স্বামীর দায়িত্ব স্ত্রীকে এগুলি শিখিয়ে দেওয়া। এক হাদিসে দেখা যায় জনৈক সাহাবী একজন স্ত্রীলোককে বিয়ে করতে চাইলে, মোহর হিসাবে দেয়ার জন্য তার নিকট কিছু না থাকলে কোরআনের কিছু সূরা শিখানোর বিনিময়ে উক্ত স্ত্রীলোকটিকে সাহাবীর নিকট বিয়ে দেয়া হলো। এ ব্যাপারে হয় স্বামী নিজে শিক্ষা দিবে অথবা শিখানোর ব্যবস্থা করবে। মোটকথা, অত্যাবশ্যকীয় শিক্ষাসমূহ স্ত্রীকে শিখানো স্বামীর দায়িত্ব। অবশ্য ‘স্ত্রীর এ ব্যাপারে যথার্থ আগ্রহও থাকতে হবে। কোরআনের শিক্ষানুযায়ী, স্বামীর সদ্ব্যবহার, উপদেশ দান, বুঝানো এসবের সাথে শিখানোর ধারণা রয়েছে।

স্ত্রীকে সংশোধনের দায়িত্ব

(৬) স্ত্রীকে সংশোধনের দায়িত্ব:

মানবীয় দুর্বলতা হিসাবে স্ত্রীর মধ্যে কিছু দোষ-ত্রুটি থাকতে পারে। স্বভাবে, অভ্যাসে বা আন্দোলনের ক্ষেত্রে, বিরোধী মহলের সাথে যোগাযোগে তার মধ্যে এমন কিছু থাকতে পারে যা গ্রহণযোগ্য নয়। স্ত্রীর কোনো কোনো বিষয় স্বামীর অপছন্দনীয় হতে পারে, স্ত্রী স্বামীর অবাধ্য হয়ে যাবার আশংকা দেখা দিতে পারে, এমনকি স্ত্রী ইসলামী আন্দোলনের বিরোধী শক্তির সাথে হাত মিলাতে পারে এসব ক্ষেত্রে স্বামীর কি করণীয় কোরআন তা বলে দিয়েছে।

(ক) কোনো স্বামীর নিকট স্ত্রী অপছন্দনীয় হলে কোরআন বলেঃ
فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا

“তাদেরকে যদি অপছন্দ কর তবে এমন অনেক কিছু আছে যা তোমরা অপছন্দ কর অথচ আল্লাহ তাতে অনেক কল্যাণ রেখে দিয়েছেন।”
(সূরা নিসা-১৯)

অর্থাৎ স্ত্রীকে বা তার কোনো কার্যকলাপ স্বামীর অপছন্দনীয় হলেও আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যধারণ করতে বলেছেন, আশা করা যায় তার মধ্যে ভবিষ্যতে অনেক ভাল ও কল্যাণকর বিষয় পাওয়া যাবে।

(খ) যে সব স্ত্রীর মধ্যে অবাধ্যতার আশংকা রয়েছে তাদের ব্যাপারে কোরআন বলে, “তাদেরকে উপদেশ দান কর, তাদের বিছানা আলাদা করে দাও।” (সূরা নিসা : ৩৪)। এ দ্বারা তাদেরকে সংশোধন করার চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। এতেও কাজ না হলে অবশ্য শাসনের কথা বলা হয়েছে।

(গ) এমনকি স্ত্রীদের শত্রুতামূলক আচরণের ব্যাপারে সূরা তাগাবুনে তাদেরকে ক্ষমা করে সংশোধনের চেষ্টা করতে বলা হয়েছে।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَّكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ ، وَإِن تَعْفُوا وَتَصْفَحُوا وَتَغْفِرُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ –

“হে ঐসব লোক যারা ঈমান এনেছ, নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রী-পরিজন ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে কতক তোমাদের শত্রু, তাই তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকো আর যদি তোমরা তাদেরকে ক্ষমা করে দাও ও সংশোধন কর তবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” (সূরা তাগাবুন: ১৪-১৫)

এসব আয়াত থেকে বোঝা যায়, স্ত্রী কারো নিকট অপছন্দ হলেই বা স্ত্রীর অবাধ্যতার আশংকা করলেই, এমনকি স্ত্রী যদি শত্রুতায়ও লিপ্ত হয় সাথে সাথে তাকে ত্যাগ করা, তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বা তালাক প্রদান আল্লাহর কাম্য নয়। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বুঝানো, সতর্কীকরণ, ক্ষমা ও সংশোধনের পদ্ধতি অবলম্বনের কথা বলেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন الصَّلْحُ خَيْرٌ “সন্ধিই উত্তম”।

তাই স্ত্রীর সংশোধনের দায়িত্ব স্বামীর। স্বামী সর্বাত্মক চেষ্টার মাধ্যমে স্ত্রীর দোষ-ত্রুটি, অবাধ্যতা, শত্রুতা বন্ধ করে তাকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা চালিয়ে গেলে হয়ত ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে।

এ পর্যায়ে এ হাদিসটি প্রণিধানযোগ্য:
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আমার নিকট থেকে নারীদের ব্যাপারে ভাল ব্যবহারের উপদেশ গ্রহণ কর, তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে পাঁজরের হাড় থেকে, আর হাড়ের মধ্যে সবচেয়ে বাঁকা হলো উপরেরটা (আর তা থেকেই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে)। অতএব তুমি যদি তাকে সোজা করতে যাও তো ভেঙে ফেলবে, আর যদি ফেলে রাখ, তবে তা বাঁকাই থেকে যাবে, অতএব নারীদের সাথে উত্তম ব্যবহার কর।” (মেশকাত: ৪০০০)

এ হাদিসের সার কথা হলো, নারীদেরকে উপদেশ দান, বোঝানো, সমঝানোর মাধ্যমে সংশোধনের জন্য অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং এ দায়িত্ব স্বামীর।

স্ত্রীকে দ্বীনমুখী করা ও দ্বীনী চেতনা সৃষ্টির দায়িত্ব

(৭) স্ত্রীকে দ্বীনমুখী করা ও দ্বীনী চেতনা সৃষ্টির দায়িত্বঃ

স্বামী যদি দ্বীনী চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকে, দ্বীনী চেতনা যদি তার জীবনে প্রাধান্য লাভ করে থাকে, দ্বীন কায়েমের কাজকে যদি সে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তবে সে দ্বীনী আন্দোলনের সাথে জড়িত হবে, সে হবে দ্বীন কায়েমের আন্দোলনে তৎপর এবং দ্বীনী কর্মকাণ্ডে উদ্যোগী।

এ ধরনের দ্বীনী কাজ-কর্ম ও দ্বীনী আন্দোলনে তৎপর একজন স্বামী তার স্ত্রীকেও দ্বীনী কাজে ও আন্দোলনে তৎপর দেখতে চাইবেন স্বাভাবিকভাবেই। তাকে এ ব্যাপারে স্ত্রীকে উৎসাহিত ও সহযোগিতা করতে হবে। স্ত্রীর নামায-রোজা ও দান-খয়রাতের প্রতি স্বামীকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। স্ত্রীর যাকাত ফরজ হয়ে থাকলে যাকাত আদায়ে তাকে পরামর্শ দিতে হবে। দ্বীনী আন্দোলনে শরীক হতেও তাকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দানও করতে হবে তাকে।

স্বামী-স্ত্রীর এ ধরনের সহযোগিতা ও উৎসাহদান হতে হবে পারস্পরিক। একজন অপরজনকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করবে। হাদিসে বলা হয়েছে যে, স্বামী নিজে ভোর রাতে তাহাজ্জুদ নামায আদায়ের জন্য ঘুম থেকে উঠে এবং নিজে স্ত্রীকে জাগায় এমনকি ঘুম থেকে জাগানোর জন্য মুখে পানির ছিটা দেয়, অপরদিকে স্ত্রী নিজে ঘুম থেকে ভোর রাতে উঠে এবং নিজ স্বামীকে ঘুম থেকে জাগায় এবং প্রয়োজনে স্বামীর মুখে পানির ছিটা দেয় ঐ স্বামী-স্ত্রীর জন্য আল্লাহ তায়ালা অশেষ কল্যাণের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

তাই দ্বীনী কাজে পারস্পরিক সহযোগিতা, দ্বীনী চেতনা সৃষ্টি, পরিবারে দ্বীনী পরিবেশ তৈরি ও দ্বীনী আন্দোলনে শরীক হওয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রীর ব্যাপারে স্বামীর বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।

স্ত্রীর যৌনতৃপ্তি দানে স্বামীর দায়িত্ব

(৮) স্ত্রীর যৌনতৃপ্তি দানে স্বামীর দায়িত্ব :

স্বামীর যৌন চাহিদা পূরণে যেমন স্ত্রীর দায়িত্ব রয়েছে তেমনি স্ত্রীর যৌন চাহিদা পূরণেও স্বামীর দায়িত্ব রয়েছে। যৌনতৃপ্তি লাভ উভয়ের জন্য প্রয়োজনীয়। স্ত্রীকে যৌন তৃপ্তি দানের দায়িত্ব স্বামীর। স্বামী একতরফা যৌন তৃপ্তি লাভ করে যদি সরে পড়ে স্ত্রী থাকে অতৃপ্ত; তাহলে স্ত্রীর মনে ক্ষোভ ও অতৃপ্তি দানা বেঁধে উঠতে পারে। স্বামীকে এ ব্যাপারে খুব হুঁশিয়ার ও সাবধান থাকতে হবে।

বিশেষ করে নারীরা থাকে সাধারণতঃ চাপা স্বভাবের। কথায় বলে, নারীর বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। তাই ইশারা-ইঙ্গিত ও চাল-চলন থেকে তাদের চাহিদা আন্দাজ করে তাদেরকে যৌন তৃপ্তি দানের ব্যবস্থা করতে হবে। স্ত্রীর যৌন অতৃপ্তির কারণে অন্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ার বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারেও স্বামীকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে।

স্বামীর যদি যৌন অক্ষমতা বা দুর্বলতা থাকে, তাহলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে আর স্ত্রীকে যৌন তৃপ্তি দানে একেবারেই অক্ষম হলে স্ত্রীকে মুক্তি দিয়ে দেয়াই উত্তম। সে অন্য স্বামীর কাছে গিয়ে যৌন তৃপ্তি লাভ করতে পারে। মোটকথা স্বামীর দায়িত্ব হলো স্ত্রীকে যথারীতি যৌন তৃপ্তি দান করা।

স্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া ও যথারীতি সমাদর করা

(৯) স্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া ও যথারীতি সমাদর করা :

বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে নতুনভাবে আত্মীয়তার সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিকভাবে এক পক্ষ থেকে অন্যপক্ষে আত্মীয়-স্বজন যাতায়াত করে ও বেড়ায়। এ ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীর বাড়ীর আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেবে এবং যথারীতি সায়-সমাদর করবে, তেমনি স্ত্রীও স্বামীর বাড়ীর আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেবে এবং সায়-সমাদর করবে। স্বামী স্ত্রীর বাপ-মাকে বাপ-মায়ের মর্যাদা দেবে, স্ত্রীর ভাই-বোনকে আপন ভাই বোনের মত মর্যাদা ও স্নেহ-ভালবাসা দেবে, স্ত্রীও অনুরূপ ব্যবহার করবে। এমনিভাবে একটি সুন্দর পরিবেশ গড়ে উঠবে, নতুন আত্মীয়তার বন্ধন জোরদার হয়ে উঠবে।

নিয়ম মাফিক তালাক প্রদান এবং যথারীতি ভালভাবে বিদায় করা

(১০) নিয়ম মাফিক তালাক প্রদান এবং যথারীতি ভালভাবে বিদায় করা:

যদি অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, কোনোভাবেই বিয়ে টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না, তালাক দেয়া ছাড়া স্বামীর কোনো গত্যন্তর নেই, এমতাবস্থায় তালাক প্রদান করতে হলে স্বামীকে যথারীতি নিয়ম মাফিক তালাক প্রদান করতে হবে এবং তালাকের পর যথারীতি ভালভাবে স্ত্রীকে বিদায় করা স্বামীর দায়িত্ব।

তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে স্ত্রীর পবিত্র অবস্থায় দুই মাসে দুই তালাক দিয়ে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কি না। উভয়পক্ষের মন মানসিকতার যদি কোনো পরিবর্তন হয়ে থাকে, যদি ফিরিয়ে নেয়ার পরিবেশ দেখা যায় তাহলে ভালভাবে ফিরিয়ে নিতে হবে। আর যদি বোঝা যায় যে, কোনো অবস্থাতেই খাপ-খাওয়ানো যাবে না, তাহলে অনন্যোপায় হয়ে তিন তালাক দিয়ে স্ত্রীকে কিছু ধন-সম্পদসহ বিদায় দিতে হবে।

وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَبَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمْسِكُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ أَوْ سَرِّحُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ وَلَا تُمْسِكُوهُنَّ ضِرَارًا لِّتَعْتَدُوا ، وَمَن يَفْعَلْ ذَلِكَ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ

“এবং যখন তোমরা স্ত্রীলোককে তালাক প্রদান কর, আর তারা তাদের সময় (ইদ্দত কাল) পূর্ণ করে, তখন হয় তাদেরকে ন্যায়ভাবে বিবাহ বন্ধনে ধরে রাখ অথবা ন্যায়ভাবে বিদায় দাও, তাদেরকে আবদ্ধ করে রেখো না যেন সীমা লংঘন হয়। যে এরূপ করবে সে অবশ্যই নিজের উপর জুলুম করল।”
(সূরা বাকারা: ২৩১)

وَلِلْمُطَلَّقَاتِ مَتَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِينَ –

“তালাকপ্রাপ্তা নারীদেরকে কিছু ধন-সম্পদ দিয়ে (বিদায় করা) মুত্তাকীদের জন্য যথার্থ।” (সূরা বাকারা: ২৪১)

তাই স্বামীর দায়িত্ব হলো চূড়ান্ত চেষ্টা করে স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধনে রেখে দেওয়া অন্যথায় ভালভাবে বিদায় দেওয়া।

একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সমতা রক্ষা করা ও ইনসাফ কায়েম

(১১) একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সমতা রক্ষা করা ও ইনসাফ কায়েম:

আল্লাহ তায়ালা পুরুষদের এক এক জনকে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী রাখতে অনুমতি দিয়েছেন কিন্তু শর্ত আরোপ করেছেন যে, তাদের মধ্যে সমতা রাখতে হবে এবং ইনসাফ কায়েম করতে হবে। এ-ও বলে দিয়েছেন যে, একজনের প্রতি একেবারে ঝুলে পড়ে অপরজনকে লটকিয়ে রাখা যাবে না। এ প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَلَنْ تَسْتَطِيعُوا أَنْ تَعْدِلُوا بَيْنَ النِّسَاءِ وَلَوْ حَرَصْتُمْ فَلَا تَمِيلُوا كُلَّ
الميلِ فَتَذَرُوهَا كَالْمُعَلَّقَةِ * وَإِنْ تُصْلِحُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا
رَّحِيمًا
–
“তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে আদল (ইনসাফ) কায়েম করতে সক্ষম হবে না যদিও তা তোমরা কামনা কর, অতএব তোমরা একদিকে সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়ো না যাতে অপরদিক শূন্যে ঝুলে পড়ে। যদি তোমরা সংশোধিত হও এবং সংযমী হও, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” (সূরা নিসা: ১২৯)

মোটকথা যেসব স্বামীর একাধিক স্ত্রী রয়েছে এদেরকে স্ত্রীদের মধ্যে সম্ভাব্য ইনসাফ কায়েম করতে হবে, একদিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়া এবং অপর পক্ষকে ঝুলিয়ে রাখা যাবে না।

ষষ্ঠ অধ্যায় : স্ত্রীর অধিকার ও দায়িত্ব এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক

স্বামী তার অধিকার পায় স্ত্রীর কাছে আর স্বামীর দায়িত্ব হলো স্ত্রীর প্রতি, বিপরীত ক্ষেত্রে স্ত্রীর অধিকার স্বামীর নিকট আর স্ত্রীর দায়িত্ব স্বামীর প্রতি। তাই স্বামীর অধিকার হলো স্ত্রীর দায়িত্ব আর স্বামীর দায়িত্ব হলো স্ত্রীর অধিকার। আমরা এখন সংক্ষেপে স্ত্রীর অধিকার ও দায়িত্ব কি কি তা আলোচনা করে দেখি।

স্ত্রীর অধিকার

মোহর লাভের অধিকার

(১) মোহর লাভের অধিকার:
স্ত্রী স্বামী থেকে বিয়ের শর্ত স্বরূপ মোহর লাভ করবে। সে যেভাবে ইচ্ছা তা খরচ করতে পারে। অবশ্য সে ইচ্ছা করলে অংশ বিশেষ স্বামীকে মাফ করে দিতে পারে যা স্বামী তার ইচ্ছামত খরচ করতে পারে।

বর্তমান সময়ে বিয়ের সময় অলংকারাদি বাবদ মোহরের একটা অংশ সাধারণত দেয়ার প্রচলন রয়েছে কিন্তু পরবর্তী সময়ে মোহরের বাকী অংশ অনেক ক্ষেত্রেই পরিশোধ করা হয় না। এভাবে স্ত্রীকে বঞ্চিত করা হয়। শরীয়তে মোহরের যে গুরুত্ব রয়েছে আধুনিক মুসলিম স্বামীগণ অনেকেই এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক নন। স্ত্রীগণও এ ব্যাপারে তাদের অধিকার সম্পর্কে নয় যথেষ্ট সজাগ। হাদীসে মোহরের ব্যাপারে এতদূর পর্যন্ত বলা হয়েছে যে মোহর আদায় ব্যতীত যৌন মিলন যেনা ব্যভিচারে পরিণত হয়। তাই স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই মোহর আদায়ের ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক হতে হবে। মজার ব্যাপার হলো, মোহর ধার্যকরণে স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষ থেকে বেশ সোচ্চার, কিন্তু মোহর আদায়ে স্বামী পক্ষ নীরব হয়ে যায় আর সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আশংকায় বা অজ্ঞতা হেতু হয়ত স্ত্রী পক্ষ এ ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে পীড়াপীড়ি করে না।

খোরপোষের অধিকার

(২) খোরপোষের অধিকার:
স্ত্রীর খোরপোষ ও ভরণ-পোষণ স্বামীর দায়িত্ব। গোটা পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্বই বহন করতে হয় স্বামীকে। এ ব্যাপারে স্বামীকে উৎপাদনে নিয়োজিত হতে হয়, করতে হয় রুজী-রোজগার।

স্ত্রী যাতে নির্বিঘ্নে স্বামীর খেদমত ও পরিবার গঠন ও সন্তান প্রতিপালনে নিয়োজিত হতে পারে সে জন্যই স্বামীকে এককভাবে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীরও কিছু একক দায়িত্ব রয়েছে যেমন গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব, সন্তানকে দুধ খাওয়ানো ও সন্তান প্রতিপালন। তাছাড়া পরিবারের লোকদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হয় স্ত্রীকেই। অতএব দায়িত্ব এককভাবে পালনের কারণে রুজী- রোজগারের দায়িত্ব তার উপর অর্পণ করা মোটেও ইনসাফপূর্ণ নয়। তবুও যদি কোন স্ত্রী আয় রোজগারে নিজেকে পেশ করে তবে তা হলো তার অতিরিক্ত কাজ। স্ত্রীর এ আয় রোজগার সে পরিবারের জন্য খরচ করতে বাধ্য নয়। স্বামী একাই পারিবারিক খরচ-পত্র বহন করতে বাধ্য এবং স্ত্রীর যথারীতি এ অধিকার রয়েছে যে, স্বামী তার ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করবে। আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) নারীদের ভাল পোশাক ও ভাল খাদ্যের সুপারিশ করেছেন। এ হলো স্বামীর কাছে স্ত্রীদের অধিকার।

স্বামীর কাছ থেকে সদ্ব্যবহার পাওয়ার অধিকার

(৩) স্বামীর কাছ থেকে সদ্ব্যবহার পাওয়ার অধিকার :
কোরআন ও হাদীসে পুরুষদেরকে স্ত্রীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে বারে বারে। আসলেই স্বামীর সদ্ব্যবহার না পেলে স্ত্রী স্বামীর বাড়ীতে টিকতেই পারেনা। স্বামী ছাড়া অন্যদের কাছ থেকে সদ্ব্যবহার পাওয়া যাবে সকল ক্ষেত্রে এমন গ্যারান্টি নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে শাশুড়ি-ননদ নব বধূকে বিভিন্নভাবে জ্বালাতন করে থাকে। অবশ্য স্ত্রীকে তার ব্যবহার, আচার-আচরণের মাধ্যমে স্বামীর মন জয় করে নিতে হবে। স্বামীর আদেশ মান্য করা, তার সেবা- যত্ন করা, হাসিমুখে কথা বলা এসবের মাধ্যমে স্বামীকে জয় করে নিতে হবে। সুখে-দুঃখে স্বামীর সহযোগী হতে হবে, তার কাজে সম্ভাব্য সহযোগিতা দান করে যেতে হবে। স্বামী বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় তার কাছে থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দিতে হবে, সালাম জানিয়ে বিদায় দিতে হবে, আবার স্বামীর বাড়ী ফিরে আসার প্রতীক্ষায় থাকতে হবে, ফিরে আসলে হাসি মুখে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে হবে এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করতে হবে। এভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হবে, ঘনিষ্ঠতা এত বেড়ে যাবে যে স্বামী স্বাভাবিকভাবেই স্ত্রীর প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। আর যদি স্বামী স্বভাবগতভাবে বদমেজাজি হয় তাহলে স্ত্রীকে তা মেনে নেয়াই কল্যাণ। অবশ্য স্বামীকে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, স্বামীর কাছ থেকে সদ্ব্যবহার পাওয়া স্ত্রীর অধিকার।

স্বামীর স্নেহ-ভালবাসা, আদর-সোহাগ পাওয়ার অধিকার

(৪) স্বামীর স্নেহ-ভালবাসা, আদর-সোহাগ পাওয়ার অধিকার:
বিবাহ কেবল শরীয়তি ব্যবস্থা ও আইনের বিধান নয়। আইনের ঊর্ধ্বে প্রেম-ভালবাসার এক সম্পর্ক সৃষ্টি হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। যার ফলে স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে গভীরভাবে ভালবাসে, স্বামী স্ত্রীকে স্নেহ-মমতা, প্রেম-প্রীতি ও আদর সোহাগে ভরে দেয়। প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে উভয়ে ভালবাসার সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে। তাদের ভালবাসার গভীরতা যত বেশীই হোক না কেন সমাজ তাতে কোন মাথা ঘামাবে না, কোন বাধ সাধবে না। প্রেম সাগরে ভেসে ভেসে তারা এগিয়ে যায় অজানার পথে। স্বামীর এরূপ দ্বিধাহীন ভালবাসা পাবার অধিকার স্ত্রীর।

যৌন তৃপ্তি লাভের অধিকার

(৫) যৌন তৃপ্তি লাভের অধিকার:
স্ত্রীর যেমন দায়িত্ব স্বামীকে যৌন তৃপ্তি দান, স্বামীরও তেমন দায়িত্ব স্ত্রীকে যৌন তৃপ্তি দিয়ে যথার্থভাবে পরিতৃপ্ত করা। তাই স্বামীর কাছ থেকে তৃপ্তি লাভ করা স্ত্রীর অধিকার। এ অধিকার পূরণের আর কোন বিকল্প ব্যবস্থা মুসলিম স্ত্রীর নেই। স্ত্রীর যৌবনের সকল অর্ঘ্য সে স্বামীর হাতে সঁপে দেয়। তাই স্ত্রীর চরম তৃপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে স্বামীকে। এ ক্ষেত্রে স্বামীর অক্ষমতা বিবাহ স্থায়ী করণে অন্তরায়। স্বামীর যদি স্থায়ী অক্ষমতা থাকে এক্ষেত্রে তাহলে স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেওয়াই সমীচীন। স্ত্রী তখন অন্য স্বামী গ্রহণ করে যৌন তৃপ্তি লাভ করতে পারে।

খোলা তালাকের অধিকার

(৬) খোলা তালাকের অধিকার:
তালাকের অধিকার তো স্বামীর। কিন্তু স্ত্রীর পক্ষে যদি বিবাহ বন্ধনে থাকা একেবারেই অসম্ভব মনে হয় এবং মোহর ছেড়ে দিয়েই স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায় তবে স্ত্রীকে আল্লাহ তায়ালা সে অনুমতি প্রদান করেছেন।

কোরআনে বলা হয়েছে:

فلا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا فِيمَا افْتَدَتْ بِهِ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَعْتَدُوهَا

“এতে তাদের কোন গুনাহ নেই যদি স্ত্রী মোহর না নিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিতে চায়। এ হলো আল্লাহর সীমা, অতএব একে অতিক্রম করো না।”
(সূরা বাকারা: ২২৯)

হযরত ইবনু আব্বাছ (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে দেখা যায় হযরত ছাবেত বিন কায়েছের স্ত্রী মোহরানা হিসাবে পাওয়া বাগান তাকে ফেরত দিয়ে বিবাহ থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। এভাবে স্ত্রীর খোলা তালাকের অধিকার রয়েছে, যদ্বারা সে স্বামীর বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে।

স্ত্রীর দায়িত্ব

স্বামীর অনুগত থাকার দায়িত্ব

(১) স্বামীর অনুগত থাকার দায়িত্ব:
কোরআন ও হাদীসের শিক্ষানুযায়ী স্ত্রীকে স্বামীর অনুগত থাকতে হবে। স্বামী আদেশ করলে স্ত্রীকে তা মেনে চলতে হবে। কর্তৃত্ব স্বামীর থাকার কারণে স্ত্রীকে হতে হবে আনুগত্যশীল। কোরআনে সতী-সাধ্বী নারীর গুণ হিসাবে বলা হয়েছে স্ত্রী হবে আনুগত্যশীল। স্বামীকে অমান্য করা বা স্বামীর অবাধ্য হওয়ার সুযোগ একজন মুসলিম স্ত্রীর নেই। সে ইচ্ছা করলে মোহরের দাবী ত্যাগ করে খোলা তালাক নিতে পারে কিন্তু স্ত্রী হিসাবে থাকতে হলে স্বামীর আনুগত্য করেই স্ত্রী থাকতে হবে।

স্বামীর গোপনীয় বিষয়সমূহ সংরক্ষণের দায়িত্ব

(২) স্বামীর গোপনীয় বিষয়সমূহ সংরক্ষণের দায়িত্বঃ
স্বামীর গোপনীয় বিষয় স্ত্রীর নিকট আমানত স্বরূপ। এ আমানতের খেয়ানত স্ত্রী করতে পারে না। তাই স্বামীর যাবতীয় আমানত ও গোপনীয় বিষয় সংরক্ষণ স্ত্রীকে করতে হবে। স্বামীর গোপনীয় বিষয় সংরক্ষণ করা স্ত্রীর দায়িত্ব। স্বামীর অধিকার পর্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

স্বামীকে সংগদান এবং সর্বোতভাবে সম্ভাব্য সহযোগিতা প্রদান

(৩) স্বামীকে সংগদান এবং সর্বোতভাবে সম্ভাব্য সহযোগিতা প্রদান:
স্ত্রীর দায়িত্ব হলো স্বামীকে সংগদান এবং সর্বপ্রকারে স্বামীর সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান। নারীর সৃষ্টিই পরিপূরক হিসাবে। সে একা পূর্ণাঙ্গ নয়। স্বামীর সাথে যোগ হলেই স্বামী-স্ত্রী মিলে সে পূর্ণাঙ্গরূপ ধারণ করে। তাই নারী সর্বব্যাপারে স্বামীকে সহযোগিতা প্রদান করবে, স্বামীর সকল প্রয়োজনে সে থাকবে স্বামীর পাশে। স্বামীর অধিকার পর্যায়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

স্বামীকে প্রেম ও ভালাবাসা দিয়ে বিমুগ্ধ করার দায়িত্ব

(৪) স্বামীকে প্রেম ও ভালাবাসা দিয়ে বিমুগ্ধ করার দায়িত্বঃ
হৃদয়ের সমস্ত আকুতি দিয়ে স্বামীকে ভালবাসতে হবে। এ ভালবাসা হবে নিখাদ, নির্ভেজাল ও আন্তরিক। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালবাসা সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। এখানে ভালবাসা যত গভীর থেকে গভীরতর হবে ততই প্রশংসিত। মনের পূর্ণ দরদ মিশ্রিত ভালবাসার প্রতিদান বা সাড়াও পাওয়া যাবে স্বামীর কাছ থেকে। আন্তরিকভাবে এ দায়িত্ব পালন করলে সংসার সুখের হতে বাধ্য। অপরদিকে নারীর যদি অন্য কোন পুরুষের প্রতি পূর্ব থেকে আকর্ষণ থেকে থাকে তাহলে স্বামীর কথা তার ভাল লাগবে না, স্বামীকে সে ভালবাসতে পারবে না। ফলে সৃষ্টি হবে পারিবারিক সমস্যা, অশান্তিতে ছেয়ে যাবে সমস্ত পরিবেশ। তাই প্রবাদ রয়েছে:

“সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে
সংসার ধ্বংস হয় নারীর কারণে”

তাই পরিবারে সুখ-শান্তি আনয়নে নারী অনেক ক্ষেত্রে দায়ী। প্রেম ও ভালবাসা দিয়ে স্বামীকে বশ করার দায়িত্ব স্ত্রীরই।

স্বামীকে যৌন তৃপ্তি দান

(৫) স্বামীকে যৌন তৃপ্তি দানঃ
যৌন তৃপ্তি লাভ স্বামীর অধিকার আর স্ত্রীর দায়িত্ব। স্বামীর ডাকে স্ত্রী সাড়া দিবে, স্বামীর প্রয়োজন পূরণ করবে, স্বামীকে চরম তৃপ্তি দিয়ে পরিতৃপ্ত করবে। হাদীসে এ ব্যাপরে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। কোরআনেও স্বামী-স্ত্রীর স্বাদ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। হাদীসে যৌন তৃপ্তিকে মধু খাওয়া দিয়ে বুঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে- যতক্ষণ না তুমি তার মধু খাবে আর সে তোমার মধু খাবে।

স্বামীর বীর্য সংরক্ষণ, গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের দায়িত্ব

(৬) স্বামীর বীর্য সংরক্ষণ, গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের দায়িত্ব:
স্বামী-স্ত্রী মিলনের মাধ্যমে স্বামীর বীর্য স্ত্রী ধারণ করে, যে বীর্য থেকে বংশধারা সৃষ্টি হতে পারে, তাই স্ত্রীকে সযত্নে সে বীর্যকে ধারণ করতে হবে। সে বীর্যকে নষ্ট করে ফেলার কোন অধিকার স্ত্রীর নেই।

সে বীর্য থেকে যদি গর্ভ সঞ্চার হয়, তাহলে স্ত্রীকে গর্ভধারণ করতে হবে, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাকে আল্লাহর কৌশল মত পেটে ধারণ করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহর ইচ্ছায় তা ভূমিষ্ট হবে। সন্তান প্রসবের বেদনাও স্ত্রীকেই সইতে হয়। এভাবে গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের একক দায়িত্ব স্ত্রীর। এক্ষেত্রে পুরুষের কোনই ভূমিকা নেই। আল্লাহ তায়ালা এ পর্যায়ে বলেনঃ

حَمَلَتْهُ أُمَّهُ وَهُنَا عَلَى وَهْنٍ

“তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট স্বীকার করে গর্ভে ধারণ করেছে।”
(সূরা লোকমান: ১৪)

সন্তানকে দুগ্ধদান ও সন্তান প্রতিপালন

(৭) সন্তানকে দুগ্ধদান ও সন্তান প্রতিপালন:
সন্তান প্রসব করে দিয়েই মার দায়িত্ব শেষ হয় না, শিশুকে দুই বছর দুধ পান করাতে হয় বরং শিশুর প্রতিপালনের দায়িত্বও তারই। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “এবং (মা তাকে) দু’বছর পর্যন্ত দুধ খাইয়েছে”।

গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও দুধ খাওয়ানোর কাজটি স্ত্রীকে ছাড়া স্বামীর পক্ষে করা প্রকৃতিগতভাবেই অসম্ভব। এভাবে আল্লাহ তায়ালা প্রকৃতিগতভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে শ্রম বিভাগ করে দিয়েছেন।

নিজের সতীত্ব সংরক্ষণের দায়িত্ব

(৮) নিজের সতীত্ব সংরক্ষণের দায়িত্ব:
নারী-পুরুষের মধ্যে যেমন সম্পর্কের বিষয়টি কেবলমাত্র স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ, এ ক্ষেত্রে অন্য কোন বিকল্প নেই, থাকতে পারেনা। স্ত্রীকে এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক ও সাবধান থাকতে হবে। নিজেকে কেবলমাত্র স্বামীর নিকট পেশ করা যেতে পারে অন্য কারো কাছে নয়। নিজের সতীত্ব নিজেকেই সংরক্ষণের জন্য তৎপর থাকতে হবে। এ প্রসংগে নারীদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “নারীগণ হয়ে থাকে আল্লাহ যা হেফাযত করে, স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার হেফাজতকারী।”

হাদীসে বলা হয়েছে: “যে এমন স্ত্রী লাভ করেছে যে নিজের ইজ্জত ও স্বামীর ধন সম্পদ খেয়ানত করে না, সে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভকরেছে।”

অপর হাদীসে বলা হয়েছে: “যদি স্বামী তার নিকট থেকে দূরে চলে যায় তবে সে তার নিজের ব্যাপারে ও স্বামীর মালের ব্যাপারে মঙ্গল কামনা করে।” -ইবনে মাজা

স্বামীর ধন-সম্পদ সংরক্ষণ

(৯) স্বামীর ধন-সম্পদ সংরক্ষণ:
স্বামীর ধন-সম্পদ সংরক্ষণ করাও স্ত্রীর দায়িত্ব। প্রকৃত পক্ষে স্বামীর বাড়ীঘর দেখা, পারিবারিক দায়-দায়িত্ব পালন, দেখাশোনা এসবের দায়িত্ব স্ত্রীরই।

হুজুর (সাঃ) এরশাদ করেছেন:

المرءة راعية على بَيْتِ زَوْجِهَا وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ

“স্ত্রী তার স্বামীর গৃহের (সকল কিছুর) দায়িত্বশীল এবং তাকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।”

ঘরের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব স্ত্রীর। ঘরের কাজ হয়ত স্ত্রী নিজে করতে পারে অথবা চাকর-বাকর দিয়ে করাতে পারে কিন্তু পরিচালনার দায়িত্ব স্ত্রীর। স্ত্রী হলো ঘরের কর্তা বা ঘরের রাণী। ঘরের খাবার পাকানো, আসবাব পত্র সাজানো, কাপড়-চোপড় ধোয়া ও পরিপাটি করাসহ ঘরের যাবতীয় কাজ কর্মের খোঁজ-খবর রাখা স্বামীর পক্ষে সম্ভব নয়, তাই এ সব কাজের দেখাশুনা ও দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে স্ত্রীর।

এতসব দায়-দায়িত্বের পর স্ত্রীর উপর রুজী রোজগারের দায়িত্ব অর্পণ কোন ক্রমেই ইনসাফ হতে পারে না। তবু যে সব মহিলা রুজী-রোজগারে সময় দেন এসব কাজে তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন কিন্তু মূল দায়িত্ব স্ত্রীর উপরই থেকে যায়।

পরিবারে দ্বীনী পরিবেশ সৃষ্টি ও পারিবারকে দ্বীনমুখী করা

(১০) পরিবারে দ্বীনী পরিবেশ সৃষ্টি ও পারিবারকে দ্বীনমুখী করা:
একজন মুসলিম স্ত্রী তার পরিবারে দ্বীনী পরিবেশ সৃষ্টির সাধ্যমত চেষ্টা চালাবে। প্রথমে নিজে দ্বীনের সকল দায়িত্ব পালন করবে। নামায-রোজা-যাকাত আদায়ে তৎপর থাকবে, দান খয়রাত করবে যথাসাধ্য। তার স্বামীকে দ্বীনমুখী করতে সাধ্যমত চেষ্টা করবে, তার সন্তানদিগকে দ্বীনের পথে চালাবে।

সে নিজে ইসলামী আন্দোলনে দ্বীন কায়েমের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হবে। এ পথে স্বামী ও সন্তানদিগকে উদ্বুদ্ধ করবে। এভাবে স্বামী ও সন্তানদিগকে দ্বীনের পথে ও দ্বীন কায়েমের পথে উৎসাহী করে তোলার মাধ্যমে সে দ্বীনের বিরাট খেদমত ও দায়িত্ব পালন করতে পারে। স্বামী যদি দ্বীন বিরোধী কাজে লিপ্ত থাকে তাহলে প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসার পরশ দিয়ে স্বামীকে দ্বীন বিরোধী কাজ থেকে ফিরিয়ে আনার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালাবে। যদিও স্বামীই সাধারণতঃ স্ত্রীর উপর প্রভাব খাটিয়ে থাকে কিন্তু একজন মুসলিম স্ত্রী দ্বীনের ব্যাপারে স্বামীকে প্রভাবিত করার ভূমিকা পালন করবে। তাকে দ্বীনের কথা, আখেরাতের কথা শুনাবে এবং শুধরাবার চেষ্টা করবে।

স্বামীর মান-সম্ভ্রম রক্ষার দায়িত্ব

(১১) স্বামীর মান-সম্ভ্রম রক্ষার দায়িত্বঃ
একজন স্ত্রী কোনক্রমেই স্বামীর মান-সম্ভ্রমে আঘাত লাগাতে পারে এমন কিছু করতে পারে না। স্বামীর প্রতি অসম্মানমূলক আচরণ থেকে সে নিজেকে বিরত রাখবে বরং স্বামীর মান-সম্মান বজায় থাকে এমন ভূমিকা গ্রহণ করবে। যে কথা বা কাজে স্বামী অসম্মানিত ও অপমানিত হবে এমন কথা বা কাজে স্ত্রী অংশ গ্রহণ করবে না। মনে রাখতে হবে স্বামীর মান-সম্মানের সাথে তার মান- সম্মান জড়িত এবং স্বামীকে তার উপর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

স্বামীর আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহার করা ও তাদের খোঁজ- খবর নেওয়া

(১২) স্বামীর আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহার করা ও তাদের খোঁজ- খবর নেওয়া :
স্বামীর পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও বন্ধুদেরকে স্ত্রীর যথারীতি খোঁজ- খবর নিতে হবে এবং তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করতে হবে। স্বামীর অবর্তমানেও তাদেরকে যথারীতি সম্মান দান ও আদর-স্নেহ করতে হবে। এক কথায় তাদেরকে আপন করে নিতে হবে। তাদের যার যা প্রাপ্য তা যথারীতি আদায় করে দিতে হবে। স্বামী যেমন স্ত্রীর আত্মীয় স্বজনের খোঁজ-খবর নেবে, তেমনি স্ত্রীও স্বামীর আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেবে।

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক

স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও দায়িত্ব আলোচনা থেকে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এতে যা আলোচনা হয়েছে তা থেকে দেখা যায়:

(১) স্বামী পরিবারের প্রধান ও পরিচালক। তিনিই পরিবারের কর্তৃত্বের অধিকারী ও মর্যাদা সম্পন্ন। স্ত্রীকে তাকে মান্য করে চলতে হবে, স্ত্রী হবে আনুগত্যশীল। স্বামী স্ত্রীকে মোহর প্রদান করবে, খোরপোষের দায়িত্ব বহন করবে আর স্ত্রী স্বামীকে সঙ্গদান করবে, যথাসম্ভব স্বামীর কাজে সহযোগিতা করবে।

(২) স্বামী-স্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসবে, প্রেম-প্রীতি বজায় রেখে সংসার জীবন যাপন করবে, দুজনে মিলে মিশে শান্তিতে জীবন কাটাবে। যৌন জীবনে পরস্পরকে তৃপ্তি দান করবে। অন্য কোথাও যৌন সম্পর্ক স্থাপন করবে না।

(৩) স্বামী-স্ত্রীর গোপনীয় বিষয়সমূহ তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। স্ত্রী হবে আমানতদার ও স্বামীর গোপন বিষয় সমূহের সংরক্ষক। স্ত্রী স্বামীর বীর্য সংরক্ষণ করবে, গর্ভধারণ করবে ও সন্তান প্রসব করবে, সন্তানকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দুধ পান করাবে ও সন্তান প্রতিপালন করবে।

(৪) স্ত্রী হবে স্বামীর ধন সম্পদের সংরক্ষক এবং পরিবারের অভ্যন্তরীণু বিষয়ের কর্তৃত্বশীল-ঘরের রাণী।

(৫) স্বামী স্ত্রীকে পছন্দ না করলে ধৈর্যধারণ করবে, স্ত্রী অবাধ্য হলে স্বামী তাকে উপদেশ দিবে, বিছানা আলাদা করবে, সর্বশেষে শাসন করবে, এতে যদি স্ত্রী শুধরে যায় তবে আর বাড়াবাড়ি করবে না।

(৬) অগত্যা স্বামী-স্ত্রীতে মিলমিশ না হলে স্বামীর চূড়ান্ত চেষ্টার পরে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে অথবা স্ত্রী তার মোহর ছেড়ে দিয়ে খোলা তালাক নিতে পারে।
আল্লাহ তায়ালা স্বামী-স্ত্রীর মিলমিশের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তিনি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্ধির সুপারিশ করেছেনঃ

وَإِنِ امْرَأَةً خَافَتْ مِنْ بَعْلِهَا نُشُورًا أَوْ إِعْرَاضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلحًا ط وَالصُّلْحُ خَيْرٌ طَ وَأَحْضِرَتِ الْأَنْفُسُ الشُّحَّ طَ وَإِنْ تُحْسِنُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا –

“যদি কোন স্ত্রী লোক তার স্বামীর নিকট থেকে দুর্ব্যবহার বা উপেক্ষার আশংকা করে তাহলে তাদের পরস্পরের মধ্যে কোন সন্ধি করাতে কোন দোষ নেই বরং সন্ধিই উত্তম। স্বভাবতই অন্তর সমূহকে সংকীর্ণতা পেয়ে বসে, তোমরা যদি সদ্ব্যবহার কর ও সংযমী হও, তাহলে আল্লাহ তোমরা কি করছ তার খবর রাখেন।” (সূরা নিসা: ১২৮)

وَأَشْهِدُوا ذَوَى عَدْلٍ مِّنكُمْ وَأَقِيمُوا الشَّهَادَةَ لِلَّهِ – ذَلِكُمْ يُوعَظُ بِهِ مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ * وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا –

“এবং তোমাদের মধ্য থেকে দুজন ন্যায়বান সাক্ষী ঠিক করে নাও, এবং আল্লাহর ওয়াস্তে যথার্থ সাক্ষী প্রদান কর- এ হলো তোমাদের প্রতি উপদেশ যে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, আর যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ-তার মুক্তির পথ বের করে দেন।” (সূরা তালাক: ২)

وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِّنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِّنْ أَهْلِهَا
إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوفِقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا –

“আর যদি তোমরা তাদের (স্বামী-স্ত্রীর) মধ্যে ঝগড়ার আশংকা কর তবে তোমরা স্বামীর বংশ থেকে একজন মীমাংসাকারী পাঠাও এবং স্ত্রীর বংশ থেকে একজন মধ্যস্থতাকারী প্রেরণ কর- তারা যদি মীমাংসা চায়, আল্লাহ মীমাংসার তওফীক দান করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সব খবর রাখেন।”
(সূরা নিসাঃ ৩৫)

আল্লাহ তায়ালা এভাবে বিভিন্ন জায়গায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মীমাংসার সুপারিশ করেছেন, সন্ধি সমঝোতা করতে বলেছেন, নিরপেক্ষভাবে সাক্ষ্য প্রদানের কথা বলেছেন। তাছাড়া নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার, দুই তালাকের পর সদ্ভাবে ফিরিয়ে নিয়ে অথবা উত্তমভাবে বিদায় দান- এভাবে সর্বক্ষেত্রে একটি সুপরিবেশ কায়েমের কথা বলেছেন।

আল্লাহ তায়ালা চান মিলমিশ, সমঝোতা-সমন্বয়, মিলন, আল্লাহ তায়ালা বিচ্ছেদ তালাক চান না। তাই আল্লাহর নিকট সর্বাধিক অপছন্দনীয় হালাল বিষয় হলো তালাক।

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেবলমাত্র শরীয়তের আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, আইনের এ অনুমতির মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হতে পারে। এ দুনিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে আখেরাতেও এরা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করতে পারে। তাদের এ সুসম্পর্কের ফসল হিসাবে তাদের সন্তানাদি আসে এবং এভাবে চলে বংশধারা। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভিত্তিতে দুনিয়াতে চলতে থাকে বংশধারা, অপরদিকে আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনে স্বামী-স্ত্রী একত্রে থাকতে পারবে যদি উভয়ের আমলনামা বেহেশতের উপযোগী হয়। তাই স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্ক সুদূর প্রসারী ফলাফল বহন করে থাকে।

পরিবার পরিচালনার ক্ষেত্রে যদিও কর্তৃত্ব স্বামীর কিন্তু স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পরামর্শের ভিত্তিতে পরিবার পরিচালিত হবে। তাদের সন্তান প্রতিপালনে উভয়ে সহযোগিতা করবে। উভয়ে উভয়ের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে থাকবে সচেতন। স্ব-স্ব দায়িত্ব যথারীতি পালন করলে কারো অধিকার নষ্ট হতে পারে না। তাই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে অটুট রাখতে হলে স্ব-স্ব দায়িত্ব যথারীতি পালন করে যেতে হবে।

সপ্তম অধ্যায় : দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নেমে আসে কেন?

যদিও আল্লাহ তায়ালা নারী-পুরুষের মিলন ও সুখে-শান্তিতে একত্রে বসবাসের জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তির পরিবর্তে নেমে আসে অশান্তি। শুরু হয়ে যায় কলহ-বিবাদ, ঝগড়া-ঝাটি, মন কষাকষি, স্ব স্ব অধিকারে হস্তক্ষেপ, স্ত্রীর অবাধ্যতা, স্বামীর অবিচার-অত্যাচার। এরূপ অশান্তি হওয়ার কারণ কি, কিভাবে এ ধরনের অশান্তি থেকে বাঁচা যায়, কোরআন ও হাদীসে সে পথও বাতলে দেয়া হয়েছে।

প্রথমে আমরা পর্যালোচনা করে দেখি কেন এবং কিভাবে এ অশান্তির সৃষ্টি হয়। আল কোরআনের সূরা নিসায় দাম্পত্য জীবনে অশান্তি সৃষ্টির চারটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।

স্বামীর অপছন্দ হওয়া

(১) প্রথম কারণ: স্বামীর অপছন্দ হওয়া

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ، فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلُ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا – وَإِنْ أَرَدْتُمُ اسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَكَانَ زَوْجِ وأَتَيْتُمْ إِحْدُهُنَّ قِنْطَارًا فَلَا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئًا أَتَاخِذُونَهُ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مبينًا وَكَيْفَ تَأْخُذُونَهُ وَقَدْ أَفْضَى بَعْضُكُمْ إِلَى بَعْضٍ وَاخْذْنَ مِنكُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا .

(স্বামীদেরকে লক্ষ্য করে) “তোমরা তোমাদের (স্ত্রীদের) সাথে মিলেমিশে সদ্ভাবে দাম্পত্য জীবন যাপন কর তবে যদি তোমরা তাদেরকে অপছন্দ কর তাহলে হতে পারে যে তোমরা কোন জিনিষ অপছন্দ কর কিন্তু আল্লাহ তাতেই অফুরন্ত কল্যাণ নিহিত রেখে দিয়েছেন। আর যদি তোমরা এক স্ত্রীর পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণের ইচ্ছাই পোষণ করে থাক এবং তাদের কোন একজনকে রাশি রাশি ধনসম্পদ (মোহর হিসাবে) দিয়ে থাক তবে তা থেকে কিছুই ফেরত নিবে না। তোমরা একে অপরের স্বাদ গ্রহণ করেছ এবং তারা তোমাদের নিকট থেকে
পাওয়া প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে। (সূরা নিসা: ১৯-২১)

এসব আয়াত থেকে জানা গেল, দাম্পত্য জীবনের অশান্তির অন্যতম কারণ হলো স্ত্রীদের কোন ব্যাপারে স্বামীর পছন্দ না হওয়া। স্ত্রী যদি সুশ্রী ও সুন্দরী না হয়, তার আচার-ব্যবহার যদি ভাল না লাগে অথবা স্ত্রীর কোন স্বভাব বা অভ্যাস যদি অপছন্দনীয় হয় এবং এর কারণে যদি স্ত্রী স্বামীর মনঃপুত না হয়, স্বামী যদি স্ত্রীকে অপছন্দ করে তাহলে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নেমে আসতে পারে। এজন্যই হাদীসে বলা হয়েছে বিয়ের পূর্বে কনেকে দেখে নিতে যাতে বিয়ের পরবর্তী জীবনে তাদের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তায়ালা অবশ্য কোন এক কারণে স্ত্রীকে অপছন্দ হলে ধৈর্যধারণ করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, যে কোন এক কারণে তাকে অপছন্দ হলে আল্লাহ তায়ালা এমন অবস্থা করতে পারেন যাতে অশেষ কল্যাণ পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ তাফহীমুল কোরআনের টীকায় লেখা হয়েছে যে, স্ত্রীর কোন একটি বিষয় অপছন্দনীয় হলেও ধৈর্যধারণ করলে হয়ত দেখা যাবে যে তার মধ্যে এমন অপর গুণাবলী রয়েছে যাতে স্বামী মুগ্ধ হয়ে যাবে এবং তাদের দাম্পত্য জীবন হয়ে উঠবে সুখময়। তবে স্বামী যদি একান্তই তাকে পরিত্যাগ করে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা বলেন, পূর্বের স্ত্রীকে মোহরানা হিসাবে যাই দিয়ে থাক তার কিছুই ফেরত নেবে না। এ ব্যাপারে স্ত্রীদের উপর চাপ প্রয়োগ, অপবাদ দেয়া, কোনটারই সুযোগ আল্লাহ দেননি বরং আল্লাহ বলেছেন যে, তোমরা দাম্পত্য জীবনের এ কয় দিনে যে যৌন স্বাদ গ্রহণ করেছ, এরপর তাদেরকে দেয়া মোহর তোমরা ফেরত নিতে পার না। এমনিভাবে মোহর আদায় ও প্রদত্ত মোহর ফেরত নেয়া এসব ব্যাপারেও স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হতে পারে।

যৌতুক দাবী

(২) দ্বিতীয় কারণ: যৌতুক দাবী
হাল যামানায় যথারীতি মোহর আদায়ের বিপরীতে উল্টো স্ত্রী বা স্ত্রীর অভিভাবকের নিকট যৌতুক দাবী করা হয় এবং এ নিয়ে চরম তিক্ততা, মনোমালিন্য, স্ত্রীকে নির্যাতন করা, এমনকি স্ত্রীকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়। দাম্পত্য জীবনে এ এক আধুনিক অভিশাপ। কোরআন হাদীসে এর কোন উল্লেখ দেখা যায়নি। বর্তমানে বিবাহের সময়েই অনেক কিছু দাবী করা হয়। আসলে এ রেওয়াজ বোধ হয় আমাদের পার্শ্ববর্তী হিন্দু সমাজ থেকে মুসলিম সমাজে এসেছে। বিয়ের সময় কন্যার গরীব অভিভাবক কোন দান দেহাজ দিতে স্বীকৃতি প্রদান করে পরে দিতে না পারলে যেমন দাম্পত্য জীবনে কলহের সূচনা হয়, আবার কোন ওয়াদা না থাকলেও বিয়ের পর স্বামীর পক্ষ থেকে নানান কিছুর আবদার হতে পারে এবং স্ত্রী তা আদায় করতে না পারলে শুরু হয় স্ত্রীর উপর নানান ধরনের নির্যাতন। জ্বলে উঠে অশান্তির আগুন।

পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব মানার ক্ষেত্রে নারীর অবাধ্যতা

(৩) তৃতীয় কারণ: পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব মানার ক্ষেত্রে নারীর অবাধ্যতা

কোরআনের সূরা নিসায় দাম্পত্য জীবনের অশান্তির দ্বিতীয় যে কারণ উল্লেখ
করা হয়েছে, তা হলো আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

ط الرِّجَالُ قَوَّمُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا انفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ فَالصَّلِحَتْ قَنِتَتُ حُفِظَتُ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ وَالَّتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ ، فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عليا كَبِيرًا – وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِّنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِّنْ أَهْلِهَا ، إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا

“পুরুষগণ নারীদের পরিচালক এজন্য যে আল্লাহ তাদের একজনকে অপরজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এজন্য যে পুরুষগণ তাদের ধনসম্পদ খরচ করেন। অতএব সত্বী-সাধ্বী নারীগণ হয়ে থাকে আনুগত্যশীল এবং তাদের অনুপস্থিতিতে আল্লাহর হেফাজতে নিজেদের হেফাজত করে। আর তোমরা যখন নারীদের অবাধ্যতার আশংকা কর তাদেরকে উপদেশ দাও, তাদের বিছানা পৃথক করে দাও এবং তাদেরকে মার, এরপর যদি তারা বাধ্য হয়ে যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অজুহাত তালাশ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুউচ্চ ও সুমহান। আর যদি তোমরা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশংকা বোধ কর তবে স্বামীর পক্ষ থেকে একজন সালিশ এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত কর। তারা যদি মীমাংসা চায়, আল্লাহ তাদের মধ্যে মিলমিশের ব্যবস্থা করে দেবেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সব কিছু খবর রাখেন।” (সূরা নিসাঃ ৩৪-৩৫)

এসব আয়াতের মূল কথা হলো পুরুষকে তো নারীদের উপর পরিচালক করে দেওয়া হয়েছে। তাই নারীদের দায়িত্ব তাদের স্বামীদের আনুগত্য করা। কিন্তু কোন নারী যদি আনুগত্যশীল না হয়, অবাধ্যতা করে তবেই দাম্পত্য জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, অশান্তি নেমে আসবে। এ ক্ষেত্রে পুরুষকে যেমন যথেষ্ট দরদী, সহানুভূতিশীল ও স্ত্রীর মন আকর্ষণকারী হতে হবে, তেমনি নারীকেও হতে হবে আনুগত্যশীল ও পতিপরায়ণা। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা থাকলে কোন সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু স্বামীও যদি হন বেপরওয়া এবং স্ত্রীও হন অবাধ্য, তখনই সমস্যার সৃষ্টি হয়। মূলতঃ কোরআন এখানে স্ত্রীকেই অবাধ্যতার দোষে দোষী সাব্যস্ত করে। এ ক্ষেত্রে কোরআন যে পদক্ষেপের কথা বলেছে তা হলো পর্যায়ক্রমে স্ত্রীদেরকে বোঝানো ও উপদেশ প্রদান, তাতে কাজ না হলে তাদের বিছানা পৃথক করে দেওয়া যাতে তারা মানসিকভাবে আহত হয়, তাতেও কাজ না হলে তাদেরকে হালকা মারার মত মারা, মুখে আঘাত করা নয়। এতেও যদি না শোধরায় তাহলে সন্ধির জন্য সালিশ নিযুক্তির কথা বলে আল-কোরআন। মূলকথা হলো স্ত্রীর অবাধ্যতার কারণে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নেমে আসতে পারে।

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর খারাপ ব্যবহার ও উপেক্ষা

(৪) চতুর্থ কারণ: স্ত্রীর প্রতি স্বামীর খারাপ ব্যবহার ও উপেক্ষা
কোন বিশেষ কারণে- নিঃসন্তান হওয়া, রুগ্ন হওয়া বা দুর্ব্যবহারের কারণে স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি খারাপ ব্যবহার করে অথবা উপেক্ষা করে চলে তাহলে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নেমে আসতে পারে। আল কোরআনের সূরা নিসায় বর্ণিত তৃতীয় কারণ হিসাবে বলা হয়েছেঃ

وَانِ امْرَأَةً خَافَتْ مِنْ مِن بَعْلِهَا نُشُورًا أَوْ إِعْرَضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِما أَنْ يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلحًا ط وَالصُّلْحُ خَيْرٌ ، وَاحْضِرَتِ الْأَنْفُسُ الشَّحَّ ، وَإِنْ تُحْسِنُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا

“স্ত্রী যখন তার স্বামীর পক্ষ থেকে খারাপ ব্যবহার বা উপেক্ষার আশংকা করে তখন তাদের দুজনের পক্ষ থেকে তাদের দুজনের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করাতে কোনই দোষ নেই বরং সন্ধিই হলো উত্তম। নফস তো সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে টেনে নেয়। যদি তোমরা সদ্ব্যবহার কর ও তাকওয়া অবলম্বন কর তাহলে আল্লাহ তোমরা যা করছো তা জানেন।”
(সূরা নিসা: ১২৮)

এ আয়াতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের অন্তরের সংকীর্ণতাকে দাম্পত্য জীবনের অশান্তির কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে স্ত্রী যদি স্বামীর চাহিদা পূরণে অক্ষম হয়- কোন স্ত্রী হয়ত সন্তান জন্মদানে অক্ষম অথবা অসুস্থতার কারণে স্বামীর যৌন চাহিদা পূরণে অক্ষম অথবা স্ত্রীর রুক্ষ মেজাজের কারণে পরম শান্তিতে দাম্পত্য জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় স্ত্রীর উচিৎ অবস্থার প্রেক্ষিতে স্বামীর সাথে বোঝাপড়া করা, স্বামী যাতে তালাকের সিদ্ধান্ত না নেয়। সে জন্য স্বামী অপর স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে যাতে স্বামীর সন্তানের চাহিদা বা যৌন চাহিদা অথবা দাম্পত্য জীবনে একত্রে মিলেমিশে চলার চাহিদা পূরণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী যদি শারীরিক বা ব্যবহারিক দিক থেকে কোন ব্যাপারে অক্ষম হয়েও পূর্ণ অধিকার দাবী করে তবে যেমন অন্তরের সংকীর্ণতা প্রকাশ করল, তেমনি স্বামী যদি স্ত্রীর অবস্থার প্রেক্ষিতে স্ত্রী ছাড় দিতে রাজী হলেও কঠোরতা আরোপ করতে বদ্ধপরিকর হয় তবে স্বামী তার অন্তরের সংকীর্ণতা প্রকাশ করল।

অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর বিশেষ বিশেষ অবস্থা ও পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে নিজ নিজ অধিকারের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন দেখা দিলে তাতে উভয়কে রাজী থাকতে হবে। অন্যথায় দাম্পত্য জীবনে অশান্তি দেখা দিতে পারে। এ ব্যাপারে দুজনকেই সজাগ থাকতে হবে এবং অবস্থানুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারস্পরিক সমঝোতা থাকতে হবে।

এক স্ত্রীর দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়া

(৫) পঞ্চম কারণ: এক স্ত্রীর দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়া
কোন স্বামীর যদি একাধিক স্ত্রী থাকে, তাদের মধ্যে আদল ও ইনসাফ কায়েম করা কোরআনের দাবী। এ ব্যাপারে এমনকি রাত্রি যাপনের ক্ষেত্রে পালাক্রমে বন্টনের কথা বলা হয়েছে হাদীসে এবং রাসূল নিজে এরূপ পালা বন্টন করে রাত্রি যাপন করেছেন। কিন্তু সকলের পক্ষে এরূপ সম্ভব নাও হতে পারে এবং বাস্তব ক্ষেত্রেও তা হতে পারে অসম্ভব যেমন- এক স্ত্রী রুগ্‌না, অপর স্ত্রী স্বাস্থ্যবতী এক্ষেত্রে কিছু বেশ কম হয়েই যাবে কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَلَنْ تَسْتَطِيعُوا أَنْ تَعْدِلُوا بَيْنَ النِّسَاءِ وَلَوْ حَرَصَتُمْ فَلَا تَمِيلُوا كُلَّ الْمَيْلِ فَتَذَرُوهَا كَالْمُعَلَّقَةِ طَ وَإِنْ تُصْلِحُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَحِيمًا

“তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার কায়েম করতে সক্ষম নও, যদিও তোমরা তার কামনা কর। অতএব তোমরা একজনকে লটকিয়ে রেখে অন্যজনের দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়োনা, যদি তোমরা সঠিকভাবে কাজ কর ও আল্লাহকে ভয় কর তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” (সূরা নিসা: ১২৯)

এ দ্বারা জানা গেল এক স্ত্রীকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা এবং অপর স্ত্রীর প্রতি সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়া পারিবারিক অশান্তির অন্যতম কারণ। স্ত্রীদের প্রতি স্বামীর ব্যবহারে কিছুটা তারতম্য হতে পারে কিন্তু আকাশ-পাতাল পার্থক্য পারিবারিক শান্তি স্থাপনে বিঘ্ন ঘটায়। সকল স্ত্রীকেই স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তার ন্যূনতম অধিকার আদায় করতে হবে। অন্যথায় পারিবারিক জীবনে শান্তির বদলে অশান্তি নেমে আসাই স্বাভাবিক।

অধিকারে হস্তক্ষেপ অথবা দায়িত্ব পালনে অবহেলা

(৬) ষষ্ঠ কারণ: অধিকারে হস্তক্ষেপ অথবা দায়িত্ব পালনে অবহেলা

স্বামী বা স্ত্রীর অধিকারে হস্তক্ষেপ অথবা দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নেমে আসতে পারে। স্বামী বা স্ত্রী যদি তার অধিকারে হস্তক্ষেপ অথবা অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে মনে করে তবেই মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়, মনোমালিন্য হয়, কলহ বিবাদ লেগে যায়, অশান্তির আগুন জ্বলে উঠে। স্বামী যদি স্ত্রী বা পরিবারের লোকদের যথারীতি খোরপোষের ব্যবস্থা না করেন বা করতে না পারেন, তাহলে অধিকাংশ স্ত্রীর পক্ষ থেকে শুরু হয়ে যায় অনুযোগ। আবার স্ত্রীর পক্ষ থেকে আনুগত্য করা প্রয়োজন, স্বামীর খেদমতে নিজেকে পেশ করা দরকার, তা যদি যথারীতি করা না হয়, তাহলে স্বামীর মনে কালো মেঘ জমতে থাকে, অশান্তির সূচনা হয়। একজনের অধিকার না পাওয়া মানে অন্যজনের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবহেলা। তাই স্বামী বা স্ত্রীর যথারীতি দায়িত্ব পালন না করাও অশান্তির অন্যতম কারণ। কাজেই স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্বের বিষয়টি বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভাল করে জেনে নিতে হবে। তাদের উভয়ের দায়িত্ব যথারীতি বুঝে নিয়ে তা সঠিকভাবে পালন করতে পারলেই দাম্পত্য জীবনে অশান্তির পথ বন্ধ হয়ে যাবে।

স্বীয় অধিকারের বা সামর্থ্যের অতিরিক্ত দাবী

(৭) সপ্তম কারণ : স্বীয় অধিকারের বা সামর্থ্যের অতিরিক্ত দাবী

স্বীয় অধিকারের অতিরিক্ত বা স্বীয় সামর্থ্যের অতিরিক্ত দাবী করলে অশান্তির সৃষ্টি হতে পারে। বেশী বেশী পাওয়ার চাহিদা মানুষের এক স্বাভাবিক ও মজ্জাগত ব্যাপার। স্বামী বা স্ত্রী যদি সে চাহিদা পূরণ না করে অথবা তা পূরণ করতে অপারগ হয়, সেক্ষেত্রেও অনেকের বেলায় অশান্তির কারণ হতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে নেহায়েত পারিবারিক প্রয়োজনীয় জিনিষটুকু এমনকি খাওয়া-পরার ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু পূরণ অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে স্ত্রীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়। কেবল-মাত্র অল্পে তুষ্টি ও ধৈর্য ধারণই এ ক্ষেত্রে পারিবারিক শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। খোদ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পারিবারিক জীবনেও এ ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। একবার তিনি তার স্ত্রীদের দাবী-আব্দার পূরণে অক্ষম হয়ে স্ত্রীদের থেকে আলাদা হয়ে কাটান। আল্লাহর পক্ষ থেকে কোরআনে এ প্রসংগে আয়াত নাজিল হয় এবং স্ত্রীদেরকে বলা হয় যদি তোমরা দুনিয়া কামনা কর তাহলে আল্লাহর রাসূল তোমাদেরকে তালাক দিয়ে দেবেন অন্যথায় আল্লাহর উপর ছবর এখতিয়ার করে থাকতে হবে। অবশ্য নবী পত্নীগণ ছবরের পথই গ্রহণ করেন। এ ধরনের অবস্থায় কোরআন স্বামীকে সাধ্যমত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন। আর স্ত্রীদেরকে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে উপদেশ দিয়েছেন। নবীর স্ত্রীদেরকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন:

يأَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ إِنْ كُنتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيواة الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَينَ أُمَتِّعْكُنَّ وَ اسْرِّحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِيلاً – وَإِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالدَّارَ الْآخِرَةَ فَإِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْمُحْسِنَتِ مِنْكُنَّ أَجْرًا عَظِيمًا –

“হে নবী, আপনার স্ত্রীদেরকে বলে দিন, যদি তোমরা দুনিয়ার জীবন ও তার জাঁকজমক কামনা কর তবে আস তোমাদেরকে কিছু সহায় সম্পদ দিয়ে সুন্দরভাবে বিদায় করে দেই। আর যদি তোমরা আল্লাহ, রাসূল ও আখেরাতের বাড়ী চাও তাহলে তোমাদের মধ্যকার পুণ্যশীলাদের জন্য বিরাট পুরস্কার তৈরি করে রাখা হয়েছে।” (সূরা আহযাব: ২৮,২৯)

এ আয়াতের প্রেক্ষিতে নবী পত্নীগণ আখেরাতের বাড়ীকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। মুসলিম নারীদেরকেও তার অনুকরণে আখেরাতের জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে দুনিয়ার প্রাপ্তিকে পদদলিত করতে পারলে দাম্পত্য জীবনে কোন অশান্তির ছায়া পড়বে না।

যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থা

(৮) অষ্টম কারণ: যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থা

শ্বশুর-শ্বাশুড়ী, দেবর-ননদসহ পরিবারের সবার সাথে নববধূর বনিবনা না হলে পারিবারিক অশান্তি হতে পারে। এক্ষত্রে দোষ যারই থাকুক নববধূই দায়ী হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় স্বামী বেচারা খুবই সংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। সে স্ত্রীর পক্ষাবলম্বন করলে তার বাপ-মা, ভাই-বোনের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। আর বাপ-মা, ভাই-বোনের পক্ষাবলম্বন করলে তার স্ত্রী ক্ষুন্ন হয়। দু’য়ের মধ্যে ভারসাম্য বা মিলমিশ করা অনেক ক্ষেত্রে হয়ে পড়ে বেশ কঠিন। এক্ষেত্রে স্বামীকে খুবই হেকমতের সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একদিকে বাবা-মার মন রক্ষা অপর দিকে স্ত্রীর মন রক্ষা- এ দু’দিকেই তাকে খেয়াল রাখতে হবে। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী এক্ষেত্রে পৃথক হয়ে যাওয়াই উত্তম বলে মত দিয়েছেন। পারিবারিক ঝগড়া ঝাটি ও অশান্তির কারণ সৃষ্টি হয়ে পরিস্থিতি জটিলাকার ধারণ করলে পৃথক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। আসলে আধুনিককালে স্ত্রী সাধারণতঃ আলাদা হয়ে স্বামীর আয়ের উপর নির্ভর করতেই আগ্রহী হয়ে থাকে। তাই নববধূ যথেষ্ট সংযমী ও সহনশীল না হলে আলাদা সংসার গড়ে তোলার দিকেই স্বামীকে অগ্রসর হতে হবে। অবশ্য পিতা-মাতার খেদমত ও দেখাশুনা করার যে দায়িত্ব রয়েছে সন্তানের তা পালন করতে হবে। আর স্ত্রীকে আলাদা ঘরে আলাদাভাবে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় পারিবারিক অশান্তি লেগেই থাকবে।

সমন্বয় ও সমঝোতার অভাব

(৯) নবম কারণ: সমন্বয় ও সমঝোতার অভাব

স্বামী বা স্ত্রীর যে কোন একজন বা উভয়ে সমন্বয় ও সমঝোতায় না আসলে পরিণামে দাম্পত্য জীবনে নেমে আসে অশান্তি ও মনোমালিন্য। দু’জনে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের জন্য প্রয়োজন সমঝোতা ও সমন্বয়। কিন্তু যে কোন একজন বা উভয়ে যদি কোন ব্যাপারে সমঝোতা ও সমন্বয় করতে রাজী না হয়, পূর্বাবস্থায়ই থাকতে হয় বদ্ধপরিকর তাহলে দাম্পত্য জীবনে কিছুতেই শান্তি আসতে পারেনা।

স্বামী বা স্ত্রী যে কোন একজনের বা উভয়েরই যদি এমন কোন বদভ্যাস থাকে যা অন্যজন কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা তাহলে উক্ত বদভ্যাস ত্যাগ করতে হবে অন্যথায় দাম্পত্য জীবনে ঘটবে অশান্তি। দু’জনের রুচি, অভ্যাস বা যে কোন ব্যাপারে অমিল থাকলেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিয়ে হল মিলন ব্যবস্থা, তাই তাতে হতে হবে মিল-মিশ, কোনরূপ অমিল গরমিল তাতে শোভনীয় নয়। তবে যদি একে অপরকে মেনে নেয় তাহলে তো সমঝোতা হয়ে গেল। তাই সর্বাবস্থায় সমঝোতা ও সমন্বয় কাম্য। সমঝোতা ও সমন্বয় না হলে অশান্তি যা বিচ্ছেদের আলামত। ধীরে ধীরে সমঝোতা ও সমন্বয় হয়ে গেলে বিয়ে টিকে যাবে অন্যথায় অশান্তি বৃদ্ধি পেয়ে এক পর্যায়ে বিচ্ছেদের পর্যায়ে চলে যাবে।

একে অপরকে আপন করে নিতে না পারা

(১০) দশম কারণ: একে অপরকে আপন করে নিতে না পারা

একে অপরকে আপন করে নিতে না পারলে দাম্পত্য জীবনে শান্তি আসতে পারে না। স্বামী-স্ত্রী দুজনে নতুন সম্পর্কের বন্ধনে এসে দুয়ে মিলে একাকার হয়ে যায়। কিন্তু স্বামীর সম্পর্ক যদি থেকে যায় অন্য কোন মহিলার সাথে অথবা স্ত্রীর যদি সম্পর্ক থাকে অপর কোন পুরুষের সাথে, তাহলে স্বামী-স্ত্রীর অন্তর মিলে একাকার হয়ে উঠবে না, মধ্যখানে থেকে যাবে বিরাট বাধা। তাই দাম্পত্য জীবনকে অশান্তির কালো ছায়া মুক্ত করতে হলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অন্য কোন নারী-পুরুষের সম্পর্ক থাকা চলবে না। এজন্যই বেপর্দা ব্যবস্থাকে আল্লাহ তায়ালা হারাম ঘোষণা করেছেন। দেখা সাক্ষাৎ কেবলমাত্র তাদের সাথেই চলবে যাদের সাথে বিয়ের সম্পর্ক করা যাবে না। বিয়ের সম্পর্ক করা যায় এমন নারী-পুরষের মেলা-মেশা বৈধ থাকলে, এসব মেলা-মেশার কারণে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি হয়ে অন্য সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, যা দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নিয়ে আসবে। তাই শরীয়তের পর্দার ব্যবস্থা দাম্পত্য জীবনের শান্তির সাথে সহায়ক। আসলে বিয়ে হল এমন একটি ব্যবস্থা যা অন্য সকল দিক থেকে একজন পুরুষ ও একজন নারীর দৃষ্টি, আকর্ষণ সরিয়ে একমুখী করে দেয় এবং অন্য সকল সম্পর্ক অবস্থানুযায়ী বিচ্ছিন্ন বা মজবুত করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে অটুট করে তোলে। তাই স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে আপন করে নিয়ে মজবুত ও অটুট সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারলে দাম্পত্য জীবনে ফাটল সৃষ্টি ও অশান্তি নেমে আসা অবধারিত। এক্ষেত্রে এমনকি স্বামী-স্ত্রীর স্ব স্ব পিতা-মাতা, ভাই- বোন ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক কিছুটা শিথিল হয়ে যেতে পারে।

স্ত্রী যদি তার বাবা-মার বাড়ীর কথা মোটেও ভুলতে না পারে, তাহলে তার অর্থ দাঁড়ায় সে স্বামীকে আপন করে গ্রহণ করতে পারেনি। তেমনি স্বামীও যদি স্ত্রীর চাইতে তার পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনকে বেশী গুরুত্বের সাথে দেখে তার অর্থও এই দাঁড়ায় যে, সে স্ত্রীকে আপন করে গ্রহণ করতে পারে নি। অথচ ব্যাপারটা এমন হওয়া উচিত যে, স্বামী-স্ত্রীর গভীর সম্পর্কের কারণে যেন অন্যান্য সম্পর্ক কিছুটা ঢিলা হয়ে যায়। মোটকথা স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্কের চাইতে নিজ নিজ আত্মীয়তার সম্পর্ক গভীরতর থাকাও দাম্পত্য জীবনে অশান্তির কারণ হয়ে থাকে অনেক সময়।

ছোট-খাট জিনিস ধরা ও উদারতার অভাব

(১১) একাদশ কারণ: ছোট-খাট জিনিস ধরা ও উদারতার অভাব

ছোট-খাট জিনিস ধরা ও উদারতার অভাব অনেক ক্ষেত্রে দাম্পত্য জীবনে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের ছোট-খাট ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। উদার মনে এসব ছোট-খাট জিনিসকে উপেক্ষা করে যেতে পারলে দাম্পত্য জীবনের পরিবেশকে অনেক মধুর ও উন্নত রাখা যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ

وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

“যে ব্যক্তি তার নফসকে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠাতে পারল, সেই সফলকাম।” (সূরা তাগাবুন : ১৬)

দাম্পত্য জীবনেও এ রকম খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে অনেক সময় মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়ে যায়। তাই এসব ছোট-খাট বিষয়কে উপেক্ষা করে পরিবেশকে হালকা করতে হবে। এ ব্যাপারে পুরুষকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পুরুষ যদি স্ত্রীর ছোট-খাট বিষয় ধরে শায়েস্তা করতে শুরু করে, কথায় কথায় মারপিট করে, গালিগালাজ করে, তাহলে ঘরের পরিবেশ হয়ে উঠে বিষাক্ত। স্ত্রীকেও এ ব্যাপারে সাবধান ও সতর্ক থাকতে হবে। স্বামীর ছোট-খাট বিষয় নিয়ে কোন কথাবার্তা না বলে তাকে সেবা দিয়ে মুগ্ধ করে তুলতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে মধুময় আপন ভুবন। হাদীসে বলা হয়েছেঃ

“মু’মিন বান্দা আল্লাহর ভয় লাভের পর নেক স্ত্রী অপেক্ষা উত্তম আর কোন জিনিষ লাভ করতে পারে না। যদি তাকে কোন বিষয়ে আদেশ করা হয় সে তা মেনে নেয়, তার দিকে তাকালে তা তাকে খুশী করে ও আনন্দ দেয়, সে কোন শপথ করলে সে তা পূরণ করে আর যখন সে তার কাছ থেকে অনুপস্থিত থাকে তখন সে তার নিজের ব্যাপারেও তার স্বামীর ধন সম্পদের বিষয়ে মঙ্গল কামনা করে।” (ইবনে মাজা- মেশকাত: ২৯৬১)

স্ত্রী যদি হয় এর বিপরীত, তাকে কোন আদেশ করলে তা করতে যদি অস্বীকার করে, তাকে দেখে যদি স্বামী আনন্দ না পায়, কোন শপথ করলে তা যদি সে পূরণ না করে আর স্বামীর অনুপস্থিতে নিজের প্রতি ও স্বামীর ধন-সম্পদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নেমে আসবে না তো কি আসবে?

আসলে সমাজে রয়েছে দু’ধরনের নারী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “গোটা দুনিয়াটাই হলো সম্পদ, আর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো সতী-সাধ্বী নারী।” (মুসলিম: হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর থেকে)
অন্য হাদীসে তিনি বলেনঃ “পুরুষের পক্ষে নারী অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর বিপদের জিনিষ আমি আমার পর আর কিছুই রেখে যাচ্ছি না।”

প্রথম ধরনের নারীর দাম্পত্য জীবন তো সুখের হবে কিন্তু দ্বিতীয় ধরনের নারীর দাম্পত্য জীবন অশান্তিময় হওয়াই স্বাভাবিক। নেহায়েত স্বামী যদি ধৈর্যশীল হয়, মানিয়ে নেয়ার চূড়ান্ত চেষ্টা করে, সমঝোতা করে নেয় তাহলে এমন নারীর দাম্পত্য জীবনে হয়ত শান্তি আসতে পারে। অন্যথায় এ ধরনের নারীর পরিবারে ও দাম্পত্য জীবনে কলহ-বিবাদ, ঝগড়া-ঝাটি ও অশান্তির আগুন ছড়িয়ে পড়াই হবে নিত্য দিনের পরিণতি।

ভুল বুঝা-বুঝি

(১২) দ্বাদশ কারণ: ভুল বুঝা-বুঝি

ভুল বুঝা-বুঝির কারণেও অনেক ক্ষেত্রে দাম্পত্য জীবনে মনোমালিন্য সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মন খুলে কথাবার্তা বলার ব্যাপারে দুর্বলতাই প্রধান কারণ হিসাবে দেখা যায়। স্বামী বা স্ত্রীর কোন কাজের ফলে যদি কারো মনে একবার সন্দেহ সৃষ্টি হয় তবে বিভিন্ন কারণে সে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হতে থাকে। কালক্রমে যা বিরাট অন্তর্দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। কোন ব্যাপারে সন্দেহ হলে খোলামনে তা অপরজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে। সন্দেহ-অবিশ্বাস সযত্নে জিইয়ে রাখলে, কোরআন যা বলেছে যে “নিশ্চয়ই কতক অনুমান পাপ” সে পাপে দাম্পত্য জীবনের শান্তিকে বিনষ্ট করে দেয় এবং পরিণামে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সৃষ্টি হয় মন কষাকষি যা পারিবারিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

স্বামীর যথেচ্ছাচার ও মারধর

(১৩) ত্রয়োদশ কারণ : স্বামীর যথেচ্ছাচার ও মারধর

স্বামীর যথেচ্ছাচার ও মারধর দাম্পত্য জীবনের অশান্তির কারণ হতে পারে। সমাজে এমনও হৃদয়হীন ও জঘন্য প্রকৃতির স্বামী আছে যারা কারণে-অকারণে স্ত্রীকে প্রহার ও মারধর করে। গালি-গালাজ, রুক্ষ ব্যবহারে স্ত্রী অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। ফলে পারিবারিক শান্তি বিনষ্ট হয়ে যায়। কোরআন ও হাদীস স্ত্রীর অবাধ্যতা ও বিশেষ কারণে স্ত্রীকে মারার অনুমতি দিয়েছে স্বামীকে। কিন্তু দাসী-বাদীর ন্যায় নির্দয়ভাবে মারতে নিষেধ করা হয়েছে।

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কেউ যেন তার স্ত্রীকে গোলাম-বাদীর ন্যায় না পিটায়, অতঃপর দিন শেষেই তার সাথে শোয়।” (বোখারী ও মুসলিম, মেশকাতঃ ৪০০৪)

যে সব স্বামী এভাবে যথেচ্ছাচার ও মারধর চালায় স্ত্রীর উপর, সে সব পরিবারে বা তাদের দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তি আসা স্বাভাবিক নয়। হাদীসে দেখা যায়, যে সব ব্যক্তি স্ত্রীকে এভাবে মারধর করতে অভ্যস্ত তাদেরকে বিয়ে করতে নবী করীম (সাঃ) উৎসাহ প্রদান করেননি। তালাক প্রাপ্তা ফাতেমা নাম্মী এক মহিলা ইদ্দত শেষে রাসূল (সাঃ) কে জানালেন যে, মুয়াবিয়া বিন আবু ছুফিয়ান এবং জাহম তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। তখন হুজুর (সাঃ) বললেনঃ শোন, জাহম কখনো কাঁধ থেকে লাঠি ফেলে না (অর্থাৎ বউকে মারে)। আর মুয়াবিয়া খুবই দরিদ্র, তুমি উসামা বিন জায়েদকে বিয়ে কর।

যৌন চাহিদা পূরণে অসহযোগিতা

(১৪) চতুর্দশ কারণ : যৌন চাহিদা পূরণে অসহযোগিতা

স্বামী-স্ত্রীর যৌন চাহিদা পূরণে একজন অপরজনকে সহযোগিতা না করলে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নেমে আসে। আসলে বিয়ের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো স্বামী-স্ত্রীর যৌন চাহিদা পূরণ। যৌন চাহিদা একটা আবেগ, একটা উদ্যম। এ চাহিদা পূরণ হলে শরীর মনে আসে প্রশান্তি। মানসিক দিক থেকে শান্তি লাভ হয়, শারীরিক দিক থেকেও আসে প্রফুল্লতা। কিন্তু স্বামী যদি এ ব্যাপারে হয় অক্ষম ও নির্লিপ্ত, তাহলে যুবতী স্ত্রীর মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না, যৌন সুখ থেকে থাকবে বঞ্চিতা, অতৃপ্তি তার মনের আকাশকে ছেয়ে ফেলবে। আবার স্বামীর উদ্দম যৌন চাহিদা পূরণে স্ত্রী যদি হয় অপরাগ, স্ত্রী যদি স্বামীকে এড়িয়ে চলে, ধরা না দেয়, স্বামীর মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হবে স্বাভাবিকভাবেই। উভয় অবস্থায়ই মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, সৃষ্টি হবে মনোমালিন্য, মান – অভিমান। যৌন মিলন ও যৌন স্বাদ গ্রহণের প্রশ্নই যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বর্তমান না থাকে তবে কিসের আকর্ষণে তারা একত্রে বসবাস করবে? ফলে চলবে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অশান্তি। এমনকি পরিস্থিতি বিচ্ছেদের দ্বারপ্রান্তেও পৌঁছে যেতে পারে।

সন্তান না হওয়া বা কেবলমাত্র মেয়ে সন্তান হওয়া

(১৫) পঞ্চদশ কারণ: সন্তান না হওয়া বা কেবলমাত্র মেয়ে সন্তান হওয়া

যথাসময়ে সন্তান না হওয়া বা কেবলমাত্র মেয়ে সন্তান হওয়া দাম্পত্য জীবনে অশান্তি বয়ে আনতে পারে। সন্তানের জন্ম- এ হলো আল্লাহর বিশেষ দান। আল্লাহ যাকে যা ইচ্ছা করেন দিয়ে থাকেন। কোরআন বলে:

للهِ مُلْكُ السَّمُوتِ وَالْأَرْضِ – يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا ويَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ – أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا وَيَجْعَلُ مَنْ يَشَاءُ عَقِيمًا * إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرُ –

“আল্লাহর জন্যই আসমান ও যমীনের রাজত্ব, তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন, যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদের কাউকে পুত্র ও কন্যা মিশ্রিত করে দেন, আবার কাউকে ইচ্ছা করলে নিঃসন্তান রাখেন, নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান।” (সূরা শূরা: ৪৯-৫০)

এভাবে কোরআনের ঘোষণা সন্তানের জন্ম সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর হাতে, তারই ফায়সালার উপর নির্ভর করে সন্তান হওয়া বা না হওয়া, পুত্র বা কন্যা সন্তান হওয়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুনিয়ার অবুঝ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রীকেই দায়ী করে সন্তান না হওয়ার জন্য অথবা কেবলমাত্র কন্যা সন্তান জন্ম দানের জন্য। অথচ এর কোন এখতিয়ারই মানুষের নেই। আর যদি স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকা এর জন্য দায়ী থাকত, তাহলে উভয়েরই যৌথ ভূমিকাই থাকত তার জন্য দায়ী। তাই স্ত্রীকে এর জন্য দায়ী করা মোটেও যুক্তিসংগত নয়। অথচ অনেক স্বামীই এজন্য স্ত্রীকে দায়ী করে থাকে। স্ত্রীকে এর জন্য শুনতে হয়ে অনেক অপমানজনক কথা। এভাবে দাম্পত্য জীবনের শান্তি বিনষ্ট হয়। অনেক ক্ষেত্রে এজন্য স্ত্রীকে তালাক প্রদান করা হয়, হয়ে যায় পুরোপুরি বিচ্ছেদ।

এ ক্ষেত্রে স্ত্রীকেও সমঝদার হতে হবে। স্বামীর সন্তানের আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিক, আকাংখা থাকে স্ত্রীরও। কিন্তু যেহেতু আল্লাহর ফায়সালা নেই, তাই সন্তান হচ্ছে না। তাই স্বামী যদি দ্বিতীয় বিয়ে করে সন্তান পেতে চায়, স্ত্রীর তাতে খুশীতেই সম্মতি দান প্রয়োজন। কেবলমাত্র কন্যা সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে অবশ্য স্বামীকে তা মেনে নিতে হবে। যার বিনিময়ে আল্লাহ বেহেশত প্রদান করবেন বলে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।

তাই সন্তান জন্মদানের কারণে পারিবারিক অশান্তি হওয়া মোটেও বিধেয় নয়। কিন্তু তবুও বাস্তব ক্ষেত্রে এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটে থাকে।

দাম্পত্য জীবনে অশান্তি আসা সম্পর্কে মিসরীয় কারাবরণকারী ত্যাগী মহিলা যায়নাব আল গাযালী বলেন:

“নারীর কমনীয়তা, কোমলতা, স্নেহমমতার দাবীই হচ্ছে মমতা, স্নেহ, আদর-যত্ন, প্রেম-ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের পরশ দিয়ে গৃহের পরিবেশকে সুন্দর, সুখী, সমৃদ্ধি ও আনন্দময় করে গড়ে তোলা।”

“নারী-পুরুষের সহচর্যে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করাকালীন যদি তার দরদ, স্নেহ- মমতা, প্রেম-প্রীতির আবেগ অনুভূতি দিয়ে সদাসতর্ক, সচেতনভাবে স্বামীর কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য না রাখে, স্বামীর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য না দেয়, স্বামীর প্রেম মিশ্রিত হাসি ও স্বামীর স্নিগ্ধ দৃষ্টিকে স্ত্রী যদি তীর্যক দৃষ্টি ও বিদ্রূপবানে জর্জরিত করে তোলে, অসন্তুষ্ট, অবাধ্য ও বেদনাক্লিষ্ট নয়ন ও মুখ দিয়ে স্বামীর দিকে তাকায়, সুখানুভূতি ও হৃদয় জুড়ানো দৃষ্টি ও আচরণ দিয়ে স্বামীর হৃদয়ে স্বস্তি ও শান্তি প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ না করে তবে স্বভাবতঃ সে পরিবারে অশান্তির দাবানল জ্বলে উঠবে। সে পরিবার নয়, কারাগারে পরিণত হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অহরহ ঝগড়া ও বাকবিতণ্ডা সৃষ্টি হবে। এহেন পরিবেশ দাম্পত্য জীবনকে বিষাক্ত ও দুঃখময় করে তুলবে। কেননা মানুষের দাম্পত্য জীবন তথা হৃদয়ের এ বন্ধন খুবই নাজুক ও অনুভূতি প্রবণ।”

যেসব কারণে এবং যেভাবে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নেমে আসতে পারে তা আমরা সবিস্তারে আলোচনা করলাম। দাম্পত্য জীবনের অশান্তি না হোক- এটাই কাম্য। এ ধরনের অশান্তি কিভাবে দূর হতে পারে তাও সাথে সাথে আলোচনা করা হয়েছে। কোন সমাজের দম্পতিরা যদি এরূপ অশান্তি দূর করতে চায় তবে তা অসাধ্য নয়। বিশেষ করে দাম্পত্য জীবনের দাবীসমূহ পূরণ করলে এবং সুখী দাম্পত্য জীবনের চাবিকাঠি সংগ্রহ করতে পারলে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি আসতে পারে না। এ ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রী দুজনই যদি সতর্ক থাকে তবে অশান্তি দাম্পত্য জীবনের ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না। স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের স্বার্থেই এ ব্যাপারে তৎপর হওয়া প্রয়োজন। কোন একজনের কারণে যেন অপরজনের অধিকার ক্ষুন্ন না হয় সেদিকেও খেয়াল রেখে চলতে হবে। প্রতিটি স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন সুখময়, শান্তিময় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ হোক-এটাই হোক সকলের কাম্য।

অষ্টম অধ্যায় : বিবাহ বিচ্ছেদ ও তালাক

বিবাহ হলো একজন নারী ও পুরুষ একত্রে সুখে-শান্তিতে বসবাস করা ও হালাল উপায়ে যৌন জীবন যাপনের একটি চুক্তিপত্র। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক দু’ধরনের সম্পর্ক রয়েছে: এক রক্ত সম্পর্ক, দুই বৈবাহিক সম্পর্ক। রক্ত সম্পর্ক আল্লাহ প্রদত্ত যা পরিবর্তনযোগ্য নয়। মানুষের মেজাজ-প্রকৃতি, বংশধারা, পারিবারিক ও অন্যান্য পরিবেশ বিভিন্নমুখী ও বিভিন্ন ধরনের। তাই দু’পরিবারের দুটি প্রাণ বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে একত্র হয়ে মিলেমিশে একাকারও হয়ে যেতে পারে, আবার গড়মিলও হতে পারে। শতকরা একশ’ ভাগ মিলমিশ হবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। তাই কোন ক্ষেত্রে কোন ক্রমেই মিলমিশ না হলে ছাড়াছাড়ি ও বিচ্ছেদের ব্যবস্থা থাকা দরকার। অন্যথায় সেখানে চলবে অশান্তি, মনকষাকষি ও বিবাদ বিসম্বাদ।

আমাদের পার্শ্ববর্তী হিন্দু সমাজে তালাক-ব্যবস্থা নেই। সেখানে বিবাহের মাধ্যমে চিরস্থায়ী অর্থাৎ আমৃত্যু বন্দোবস্ত হয়ে যায়। কোন অবস্থাতেই বিবাহ ভেঙ্গে বিচ্ছেদের পথ অবলম্বন করা যাবে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিল না হয়ে অশান্তি হলে সে অশান্তিতেই আজীবন থাকতে হবে। আবার পাশ্চাত্য সমাজে বিচ্ছেদ ও তালাক একেবারেই সহজ। স্বামী বা স্ত্রীর সামান্য কোন ব্যাপারে যখনই মতের গড়মিল হবে তখনই তালাক প্রদানের মাধ্যমে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এতে করে পারিবারিক স্থিতি ও সুখ-শান্তি আশা করা যায় না।

ইসলামে রয়েছে এ দু’য়ের মধ্যবর্তী ব্যবস্থা। ইসলামে বিয়ে ব্যবস্থাকে করা হয়েছে সহজ। যাদের মধ্যে বিয়ে হালাল এমন দুজন নারী-পুরুষ একমত হলে দুজন স্বাক্ষীর মোকাবেলায় ইজাব কবুল হলেই বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর মিল-মিশ হয়ে গেলে তো উত্তম, আর কোন ব্যাপারে মতের গড়মিল বা অন্য কোন সমস্যা দেখা দিলে, সাধ্যমত তার মীমাংসা করার চেষ্টা ও উদ্যোগ নিতে হবে। চূড়ান্তভাবে চেষ্টা করতে হবে বিয়েকে টিকিয়ে রাখতে, একত্রে বসবাস করতে। কিন্তু একান্তই সম্ভব না হলে, স্বামীকে তালাক দেয়ার অধিকার দেয়া হয়েছে। তবে সে অধিকার প্রয়োগ করতে হবে ধীরে সুস্থে। প্রথমে হায়েজের অপবিত্র অবস্থা থেকে পবিত্র হলে স্ত্রীর সাথে যৌন মিলন না করে, এক তালাক দিতে হবে। এরপর ইচ্ছা করলে স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবে অথবা দ্বিতীয় বার হায়েজ থেকে পবিত্র হলে পুনরায় স্ত্রীর সাথে মিলিত না হয়ে দ্বিতীয়বার দুই তালাক দিতে পারে। এবারও স্ত্রীকে সে ফিরিয়ে নিতে পারে। কিন্তু তৃতীয়বার তৃতীয় পবিত্রাবস্থায় যদি তাকে তৃতীয় বায়েন (স্থায়ী) তালাক প্রদান করে তাহলে স্থায়ীভাবে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে পুনরায় বিয়ে হালাল হবে না। যদি ঐ স্ত্রী অন্য স্বামী গ্রহণ করে এবং সে স্বামীর সাথে যথারীতি ঘর সংসার করার পর যদি ঐ স্বামী তাকে তালাক প্রদান করে বা মারা যায়, তবে তার সাথে পূর্ব স্বামীর বিয়ে হতে পারে। তালাককে এমনভাবে কঠিন করা হয়েছে।

তালাকের এ বিধান, আল্লাহ প্রদত্ত বিধান। আল্লাহ তায়ালা দু’জন নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেলে তাদের মধ্যে মিলন ও মিল-মিশ পছন্দ করেন। এ বিবাহ ভঙ্গ বা বিচ্ছেদ আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন না। কোরআনের ভাষায় তার সন্ধান পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

فان كرهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَل اللَّهُ فِيْهِ –

“তাদেরকে যদি তোমরা অপছন্দ কর তবে তোমরা হয়ত কোন জিনিষ অপছন্দ কর, কিন্তু আল্লাহ তাতে অনেক কল্যাণ রেখে দিয়েছেন।” (সূরা নিসা : ২০)

এভাবে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে কোন ব্যক্তির তার স্ত্রীকে অপছন্দীয় মনে হলেও তাতেই কল্যাণ থাকতে পারে, হয়ত ঐ স্ত্রীর গর্ভে কোন নেক সন্তান জন্ম লাভ করতে পারে অথবা ঐ স্ত্রীর কারণে কোন আয় রোজগার হতে পারে অথবা কোন অকল্যাণ থেকে বেঁচে যেতে পারে। তাই আল্লাহ এ ধরনের স্বামীকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন। সূরা তালাকে তালাক প্রদানের অনুমতি ও ইদ্দত পালনের কথা বলার পর আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَاتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ لَا تُخْرِجُوهُنَّ مِنْ بُيُوتِهِنَّ وَلَا يَخْرُجْنَ إِلَّا أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ ، وَتِلْكَ حُدُودُ اللهِ وَمَنْ يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَقَدْ ظَلَم نَفْسَهُ – لَا تَدْرِي لَعَلَّ اللَّهَ يُحْدِثُ بَعْدَ ذَلِكَ أَمْرًا –

“তোমাদের রব আল্লাহকে ভয় করো, তাদেরকে তাদের ঘর থেকে বের করে দিওনা আর তারা নিজেরাও যেন বের হয়ে না যায়। তবে যদি প্রকাশ্যে নির্লজ্জতায় (ব্যভিচারে) লিপ্ত হয় তবে ভিন্ন কথা, এ হলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা, যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমা লংঘন করল সে তার নিজের উপর জুলুম করল। তোমরা জাননা যে আল্লাহ হয়ত এরপর কোন নতুন জিনিষ বের করে দেবেন।” (সূরা তালাক : ১)

তালাক প্রদানের পরও আল্লাহ তায়ালা ব্যাপারটি স্বাভাবিক ও হালকা করে দিয়ে নতুন পরিস্থিতির ইঙ্গিত প্রদান করেছেন।

তালাককে যদিও হালাল করা হয়েছে কিন্তু আল্লাহ তায়ালার নিকট খুবই অপছন্দনীয়। আল্লাহ তায়ালা পূর্বাহ্নেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিতে বলেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِّنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا –

“যদি তোমরা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন বিরোধ ও মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়েছে বলে ভয় করো, তবে তোমরা স্বামীর পরিবার থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও। তারা দু’জন যদি বাস্তবিকই অবস্থার সংশোধন করতে চায়, তাহলে আল্লাহ সেজন্য তাদেরকে তৌফিক দান করবেন।” (সূরা নিসাঃ ৩৫)

তালাক প্রদান আল্লাহ তায়ালার নিকট কতটুকু অপছন্দনীয় বিভিন্ন হাদীসে তার উল্লেখ পাওয়া যায়।

“হযরত মোয়াজ বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, মোয়াজ জেনে রাখ, আল্লাহ তায়ালা দাস মুক্ত করা অপেক্ষা অধিকতর প্রিয় কোন জিনিষ দুনিয়াতে সৃষ্টি করেন নি। আর আল্লাহ তায়ালা তালাক অপেক্ষা ঘৃণিত কোন বস্তু দুনিয়াতে সৃষ্টি করেননি।” (দারে কুতনী-মেশকাত: ৪০৬০)

হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত হালাল হলো তালাক।” (মেশকাত: ৪০৪৬, আবু দাউদ)

তালাক যদি’ও আল্লাহ তায়ালার নিকট খুবই অপছন্দনীয় ও ঘৃণ্য কিন্তু কোন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যদি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে তাদের পক্ষে আর পারিবারিক জীবন যাপন সম্ভব নয়, পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষ ও সম্পর্ক চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে, তখন নিরূপায় ও অনন্যোপায় হয়ে ছাড়াছাড়ি ও বিচ্ছেদ ছাড়া গত্যন্তর থাকে না, ফলে তখনই তালাক দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন ঘটনা ঘটল আর অমনি স্বামী ক্রোধান্ধ হয়ে একবারে তিন তালাক বায়েন দিয়ে দিলেন এটা নিয়মের খেলাফ। যদিও তাতে অধিকাংশ ফেকাহবিদের মতে তিন তালাক বায়েন ও বিচ্ছেদ হয়ে যাবে এবং স্বামী হবেন শাস্তিযোগ্য অপরাধে অপরাধী।

তালাককে স্ত্রীদের জন্য হয়রানী, উৎপীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ার বানানো আল্লাহ তায়ালা কোনক্রমেই চান না। তাই সুস্পষ্টভাবে কোরআনে বলে দেয়া হয়েছে:

فَإِذَا بَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمْسِكُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ أَوْ فَارِقُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ وَأَشْهِدُوا ذَوَى عَدْلٍ مِنْكُمْ وَاقَيْمُوا الشَّهَلَةَ لِلَّهِ ط ذُلِكُمْ يُوعَظُ بِهِ مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ط وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مُخْرَجًا –

“এরপর যখন সময় পূর্ণ হয়ে যায় তখন হয় তাদেরকে যথানিয়মে ধরে রাখ অথবা যথারীতি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও এবং আল্লাহর ওয়াস্তে যথার্থ সাক্ষী প্রদান কর, এ হলো তোমাদের প্রতি উপদেশ, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার মুক্তির পথ বের করে দেন।” (সূরা তালাকঃ ২)

সূরা বাকারার ২২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা একই কথা বলেছেনঃ
ط
الطَّلَاقُ مَرَّتَنِ فَإِمْسَاكَ لِمَعْرُوفٍ أَوْ تَسْرِيحُ بِإِحْسَانٍ

“তালাক দুইবার, অতঃপর হয় যথানিয়মে রাখা অথবা সদ্ভাবে বিদায় দান।”

এক তালাকের পর হোক বা দুই তালাকের পর হোক ইদ্দতের সময়কালের মধ্যে ফিরিয়ে নিতে হলে, বিয়েকে বহাল রাখতে হলে তা করতে হবে ভালভাবে, ন্যায়ভাবে ও নিয়ম মোতাবেক। কোন রকম তালবাহানা করা যাবে না। ইদ্দতের সময় শেষ হয়ে গেলে ফেরত নিতে হলে, পুনরায় বিয়ে পড়াতে হবে। আর যদি কোনক্রমেই মিল-মিশ বা সমন্বয়-সমঝোতা হবে না মনে করা হয়, তাহলে তৃতীয় তালাক দিয়ে যথারীতি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রেও কোনরূপ অন্যায় পদক্ষেপ, তালবাহানা, ঝুলিয়ে রাখা ইত্যাদি করা যাবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَبَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمْسِكُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ أَوْ سَرِ حُوهُنَّ بِمَعْرُوفِ وَلَا تُمْسِكُوهُنَّ صِرَارًا لِتَعْتَدُوا ، وَمَنْ يَفْعَلْ ذلِكَ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ وَلَا تَتَّخِذُوا أَيْتِ اللَّهِ هُزُوًا وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللهِ عَلَيْكُمْ وَمَا أَنْزَلَ عَلَيْكُمْ مِّنَ الْكِتَبِ وَالْحِكْمَةِ يَعِظُكُمْ بِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

“যখন তোমরা স্ত্রীলোকদেরকে তালাক প্রদান কর এবং তাদের ইদ্দত পূর্ণ হবার পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন হয় সোজাসুজি তাদেরকে রেখে দাও আর নয় তো ভালভাবে বিদায় করে দাও। নিছক কষ্ট দেবার জন্য তাদেরকে আটকে রেখো না। কারণ এটা হবে বাড়াবাড়ি। আর যে ব্যক্তি এমনটি করবে সে আসলে নিজের ওপর জুলুম করবে। আর তোমরা আল্লাহর আয়াতকে খেলা-তামাসায় পরিণত করো না। ভুলে যেয়ো না আল্লাহ তোমাদের কত বড় নিয়ামত দান করেছেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দান করছেন, যে কিতাব ও হিকমাত তিনি তোমাদের ওপর নাযিল করেছেন তাকে মর্যাদা দান করো। আল্লাহকে ভয় করো এবং ভালোভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ সব কথা জানেন।” (সূরা আল বাকারা: ২৩১)

ইদ্দত চলাকালে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীলোকদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করার কথা ও বলে দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা।

وَلِلْمُطَلَّقَتِ مَتَاعُ بِالْمَعْرُوفِ ، حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِينَ

“তালাক প্রাপ্তাদের জন্য ভরণ-পোষণ ন্যায়ভাবে, এ হলো মুত্তাকীদের জন্য দায়িত্ব।” (সূরা আল বাকারা: ২৪১)

তিন তালাক দেওয়ার পর তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীর উপর আর কোন অধিকারই পূর্বের স্বামীর থাকবে না, স্ত্রীর জিনিষপত্রও কোন কিছুই আটকে রাখতে পারবে না।

وَلَا يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَأْخُذُوا مَا أَتَيْتُمُوهُنَّ شَيْئًا

“আর তোমাদের জন্য জায়েয নয় তাদেরকে যা দিয়েছ তা থেকে কিছু রেখে দেয়া।” (সূরা আল বাকারা: ২২৯)

وَإِنْ أَرَدْتُمُ اسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَكَانَ زَوْجٍ وَأَتَيْتُمْ إِحْدُهُنَّ قِنْطَارًا فَلَا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئًا أَتَاخُذُونَهُ مُهتَنا وَإِثْماً مُّبِينًا – وَكَيْفَ تَأْخُذُونَهُ وَقَدْ أَفْضَى بَعْضُكُمْ إِلَى بَعْضٍ وَأَخَذْنَ مِنْكُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا –

“এবং তোমরা যদি এক স্ত্রীর বদলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে ইচ্ছা কর এবং তাদের একজনকে রাশি রাশি সম্পদ প্রদান কর তবে তা থেকে কোন কিছুই ফেরত নিওনা। তোমরা কি অপবাদ দিয়ে বা প্রকাশ্য পাপাচারী হয়ে তা থেকে তা নেবে? তোমরা কেমন করে তা নেবে অথচ তোমরা একে অপরে অবাধে মেলা-মেশা করেছ এবং এই নারীগণ তোমাদের থেকে একটি দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে রেখেছে।” (সূরা নিসা: ২০-২১)

তিন তালাক দেয়ার পর ইদ্দত পালন শেষে স্ত্রীলোকের পুনঃ স্বামী গ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَبَلَغَنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا تَعْضُلُوهُنَّ أَنْ يَنكِحْنَ أَزْوَاجَهُنَّ إِذَا تَرَاضَوْا بَيْنَهُمْ بِالْمَعْرُوفِ ذَالِكَ يُوعَظُ بِهِ – مَنْ كَانَ مِنْكُمْ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَالِكُمْ أَزْكَى لَكُمْ وَأَطْهَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ –

“যখন তোমরা স্ত্রীলোকদেরকে তালাক প্রদান কর এবং তারা তাদের সময়কাল পূর্ণ করে তখন তাদের স্বামীদেরকে বিবাহ করণে বাধা প্রদান করো না যদি পরস্পরে যথানিয়মে রাজী হয়ে যায়। এ ব্যাপারে উপদেশ প্রদান করা হচ্ছে তাদেরকে যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান পোষণ করে এটাই বিশুদ্ধতর ও পবিত্রতর, আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।” (সূরা বাকারা: ২৩২)

তালাক প্রদানের অধিকার স্বামীর

কোরআনের আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে তালাক প্রদানের অধিকার একমাত্র স্বামীর। কোরআনের বহু জায়গায় বলা হয়েছে যে ‘তোমরা যদি তোমাদের স্ত্রীদেরকে তালাক প্রদান কর।’ সূরা বাকারায় বলা হয়েছে “যার হাতে রয়েছে বিবাহের বন্ধন সে যদি অনুগ্রহ করে আর তোমরা যদি ক্ষমা করে দাও, তা তাকওয়ার নিকটবর্তী এবং তোমরা যা করছ, আল্লাহ তা সূক্ষ্মভাবে প্রত্যক্ষ করছেন।”

তালাকের অধিকার যে স্বামীর বহু সংখ্যক হাদীস থেকেও তা প্রমাণিত। বরং স্বামী যদি তালাক দিতে চায় তবে স্ত্রী অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়ার পর সহবাস না করে তালাক দিতে হবে।

“হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি তার এক স্ত্রীকে ঋতু অবস্থায় তালাক দিলেন। হযরত ওমর (রাঃ) তা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিকট বললেন। এতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রেগে গেলেন ও বললেনঃ সে যেন তাকে ফিরিয়ে নেয় অতঃপর রেখে দেয় যতক্ষণ না সে পাক হয়, অতঃপর ঋতু আসে অতঃপর পাক হয়। এরপর যদি সে তাকে তালাক দিতে চায়, পাক অবস্থায় সহবাসের পূর্বে তালাক দেবে।” (বুখারী ও মুসলিম-মেশকাত: ৪০৪২)

স্ত্রীর খোলা তালাক গ্রহণ

কোন স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে যদি এমন অবস্থা হয় যে, স্ত্রী কোনমতেই উক্ত স্বামীর অধীন থাকতে রাজী না থাকে এবং বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্তি চায় তবে স্বামীকে মোহরের কিছু অংশ ছেড়ে দিয়ে মুক্তি নিতে পারে, যাকে শরীয়তের ভাষায় বলা হয়েছে খোলা তালাক। হাদীসে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে আর কোরআনেও নারীদের ন্যায়ভাবে অধিকারের কথা বলা হয়েছে:

وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ * وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ –

“নারীদেরও তেমন অধিকার রয়েছে যেমন রয়েছে পুরুষদের তবে তা ন্যায়ভাবে এবং পুরুষদের রয়েছে নারীদের উপর মর্যাদা, আল্লাহ শক্তিশালী ও মহাবিজ্ঞানী।” (সূরা বাকারা: ২২৮)

হাদীসে খোলা তালাকের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে:

হযরত ইবনু আব্বাছ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ ছাবিত বিন কায়েসের স্ত্রী নবী করীম (সাঃ) এর নিকট এসে বলল: ছাবেত বিন কায়েসের ব্যবহার ও দ্বীনদারী সম্পর্কে আমার কোন অভিযোগ নেই কিন্তু আমি ইসলামে থেকে (স্বামীর) অবাধ্যতাকে পছন্দ করি না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ “তবে কি তুমি তার বাগান তাকে ফেরত দিবে যা সে তোমাকে মোহর রূপে প্রদান করেছে?” সে বলল, “হ্যা”। তখন রাসূলুল্লাহ ছাবেতকে বললেন, “তুমি তোমার বাগান গ্রহণ কর এবং তাকে এক তালাক দিয়ে দাও।” (বোখারী)

এভাবে দেখা যায় খোলা তালাক এক তালাক হিসাবে গণ্য। ইদ্দত পালনের পর ও যদি উক্ত স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসবাস করতে রাজী হয় তবে নতুনভাবে বিয়ে পড়িয়ে স্বামী-স্ত্রী রূপে বসবাস করতে পারে। এরূপই অধিকাংশ ফেকাহবিদদের মত।

স্বামীর তিন তালাক প্রদানের পর পুনরায় একত্র হওয়া

স্বামী তিন তালাক প্রদানের পর পূর্ণ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর স্বামী-স্ত্রী হিসাবে পুনরায় বসবাসের আর কোন সুযোগ থাকে না। তবে যদি স্ত্রীলোকটি অন্য স্বামী গ্রহণ করে এবং স্বামী স্ত্রী সহবাসের পর মারা যায় বা তালাক দেয় তাহলে পুনরায় পূর্ব স্বামীর নিকট বিয়ে হতে পারে। এ প্রসংগে কোরআন বলেঃ

فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يَتَرَاجَعَا إِنْ ظَنَّا أَنْ يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ * وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ –

“এরপর যদি তালাক প্রদান করে তাহলে অন্য কারো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ব্যতীত সে তার জন্য হালাল হবে না, অতঃপর যদি সে ব্যক্তি তালাক প্রদান করে তাহলে পুনরায় ফিরিয়ে নেয়াতে কোন দোষ নেই যদি মনে করে যে আল্লাহর সীমা সংরক্ষণ করতে পারবে, এসব বর্ণনা করা হচ্ছে আল্লাহর জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য।” (সূরা বাকারা: ২৩০)

আল্লাহ কৃত্রিমতা ও লোক দেখানো কাজ পছন্দ করেন না। যদি স্বাভাবিকভাবেই এরূপ হয় তাহলে তা হালাল কিন্তু কৃত্রিমভাবে বা লোক দেখানোর জন্য কাউকে স্বামী বানিয়ে একত্রে রাত কাটানোর পর তালাক দিয়ে পূর্ব স্বামীর বিবাহ বন্ধনে পুনরায় নিয়ে নেওয়া, কোরআনের আয়াতের সাথে তামাশা করা মাত্র।

আমরা তালাক সম্পর্কে উপরের আলোচনা থেকে যা জানতে পেলাম তার সার-সংক্ষেপ হলোঃ

১. মিলমিশ, মিলন ও সমন্বয় না হলেও বিয়েকে চিরস্থায়ী করা বিধেয় নয়, আবার কথায় কথায় তালাক দেয়া এটাও ঠিক নয়। তাই ইসলাম মাঝামাঝি ব্যবস্থা করেছে;
২. কোন স্বামী-স্ত্রীতে মিল-মিশ না হলে প্রথমে সমন্বয়ের সাধ্যমত চেষ্টা চালাতে হবে, কেবলমাত্র অনন্যোপায় হয়েই তালাকের পথে যেতে হবে;
৩. তালাক দিতে হবে পর্যায়ক্রমে-এক, দুই, তিন করে, এক এক পবিত্রাবস্থায় একটি করে;
৪. লক্ষ্য করার বিষয় হলো, অপবিত্র অবস্থা থেকে পবিত্রাবস্থায় আসার পর সহবাস না করে তালাক দিতে হবে, অথচ এ সময় স্বামীর সহবাসের চাহিদা হয়ে যেতে পারে যাতে তালাকের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
৫. তালাক আল্লাহর নিকট সবচেয়ে অপছন্দনীয় হালাল কাজ।
৬. তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে স্ত্রীদেরকে হয়রানী, নির্যাতন ও সীমালংঘন করা যাবে না;
৭. এক বা দুই তালাকের পর ফিরিয়ে নিলেও ভালভাবে নিতে হবে, আর বিদায় করে দিলেও ভালভাবে বিদায় করে দিতে হবে;
৮. তিন তালাক দিয়ে দিলে মোহরানার সময় প্রদত্ত কোন জিনিষই ফেরত রাখা যাবে না;
৯. তালাকের পর ইদ্দত চলাকালে থাকার জায়গা ও ভরণ-পোষণ দিতে হবে;
১০. তিন তালাকের পর স্ত্রীদের ইদ্দত পালন শেষে অন্য স্বামী গ্রহণের পূর্ণ সুযোগ থাকবে;
১১. স্ত্রীলোক স্বামী থেকে আলাদা বা মুক্ত হতে চাইলে মোহরানা থেকে কিছু ছেড়ে দিয়ে খোলা তালাকের মাধ্যমে মুক্ত হয়ে যাবার অধিকার রাখে;
১২. তিন তালাকের পর কেবলমাত্র অন্য স্বামী তালাক দিলে বা মারা গেলে পুনরায় পূর্ব স্বামীর নিকট ফিরে আসতে পারবে।

নবম অধ্যায় : পারিবারিক জীবন : পর্দা ও যৌন পবিত্রতা

পারিবারিক জীবনের মূল উৎস স্বামী-স্ত্রী ও তাদের দাম্পত্য জীবন। দাম্পত্য জীবনের মূল উদ্দেশ্য যৌন পবিত্রতা ও সন্তান প্রজননের মাধ্যমে বংশধারা অব্যাহত রাখা এবং মানব সমাজের অগ্রগতি সাধন। বংশধারাকে পবিত্র রাখার জন্য যৌন পবিত্রতা অপরিহার্য।

নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও অবাধ যৌনক্রিয়া (Free sex) যৌন পবিত্রতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অবাধ যৌনক্রিয়া চালু থাকলে বংশধারা পবিত্র থাকতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা মানব সমাজে পবিত্র বংশধারা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে খুব জোর দিয়েছেন। সেজন্যঃ

১. নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন এবং একে করা হয়েছে খুবই সহজ ও সার্বজনীন;
২. কতক নির্দিষ্ট নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়েকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে;
৩. বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ নারী-পুরুষ ও যাদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ তাদের ছাড়া বাকী নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে করা হয়েছে নিষিদ্ধ, তাদের মধ্যে পর্দা করা হয়েছে ফরয;
৪. বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য সকল প্রকার যৌন ক্রিয়াকে করা হয়েছে হারাম ও অবৈধ;
৫. অবৈধ যৌনক্রিয়া তথা যেনা-ব্যভিচারের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে কঠোর শাস্তির বিধান।

লজ্জা-শরম ও পোশাক থেকেই আসে পর্দার প্রশ্ন। অর্থাৎ কার কোন পরিমাণ দেহ আচ্ছাদন করে রাখতে হবে, কে কার সাথে কতদূর মেলামেশা করতে পারবে তাই পর্দার বিষয়। এ ব্যাপারে শরীয়তে ৩টি শ্রেণী করা হয়েছে:

১. স্বামী-স্ত্রী
২. মোহাররম ও মোহাররমা
৩. গায়ের মোহাররম স্ত্রী-পুরুষ

১. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পর্দার ব্যাপারে শরীয়তের বিধান হলো তাদের মধ্যে কোন পর্দা নেই। স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই উভয়ের পূর্ণ দেহ দেখতে পারে তবে সাধারণভাবে তো তারা কাপড় পরিধান করেই থাকে। কেবলমাত্র যৌন মিলনের সময়ই তারা আচ্ছাদনহীন বা নগ্ন হয়। কিন্তু যৌন মিলনের সময়ও একে অপরে যৌনাঙ্গের প্রতি তাকানো ছাড়া তাদের মধ্যে আর কোন পর্দা নেই।

২. মোহাররম স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে পর্দার ব্যাপারে শরীয়ত নারী-পুরুষের পর্দার যে হুকুম দিয়েছে তাতে পুরুষের ছতর (আচ্ছাদনীয় অংশ) হল নাভী থেকে হাঁটুর নীচ পর্যন্ত, আর নারীর ছতর হল মুখমণ্ডল, হাতের কজী ও পায়ের গোড়ালী বাদে বাকী শরীর। তবে নারীরা মোহাররম ব্যক্তির সামনে তাদের সৌন্দর্য অর্থাৎ চেহারা ও অলংকারাদি (ছতরের বাইরের) প্রকাশ করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَانِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّبِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَتِ النِّسَاءِ –

“(মু’মিন নারীরা) তাদের সৌন্দর্য যেন প্রকাশ না করে তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, ছেলে, সৎ ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, স্ত্রীলোক অথবা তাদের মালিকানাধীন দাস-দাসী অথবা ঐ সব পুরুষ যাদের নারীদের গুপ্ত বিষয়ে জানার আগ্রহ প্রকাশ পায়নি তাদের ছাড়া।” (সূরা নূর: ৩১)

মোহাররম নারী-পুরুষ হল ঐসব নারী-পুরুষ যাদের মধ্যে বিয়ে হারাম, তাদের সাথে পর্দাও শিথিল। তবে শরীয়ত নারী পুরুষের ছতরকে পর্দার অন্তর্ভুক্ত করেছে। হাদীসে এসেছে যে, পুরুষের উরু পর্দার অন্তর্ভুক্ত, তেমনি নারীর সারা শরীর (উপরোল্লিখিত তিন স্থান ছাড়া) পর্দার অন্তর্ভুক্ত। তবে পর্দার ব্যাপারে কোরআনে যে কথা বলা হয়েছে اِلَّا مَا ظَهَرَ “তবে যা প্রকাশ হয়ে যায়” এ দ্বারা সাংসারিক কাজকর্ম করতে গিয়ে স্বতই যা প্রকাশ হয়ে পড়ে তাই বুঝায়, অতএব তা ধর্তব্য নয়।

কিন্তু আমাদের সমাজ জীবনে যা লক্ষ্য করা যায় তাতে দেখা যায়, অধিকাংশ মোহাররম নারী-পুরুষের মধ্যে এ ধরনের পর্দার লংঘন হয়ে থাকে। এটাকে যেন পর্দার বিষয়ই গণ্য করা হয় না, ফলে ছেলে বা পিতার সামনে মাথার চুল, পেট, পিঠ, হাটুর নিম্নাংশ খোলা যেন পর্দার মধ্যে গণ্য নয়। যারা বাইরে পর্দা মেনে চলে তারাও বাড়ীর ভেতরে এ ধরণের পর্দার লংঘনে মোটেও সংকোচ বোধ করে না। যারা পর্দা মানতে আগ্রহী তাদেরকে এ ব্যাপারে আরও সচেতন হওয়া দরকার।

লজ্জা-শরম মানুষের এক স্বাভাবিক প্রবণতা। লজ্জা-শরম থেকেই আসে পর্দার প্রশ্ন। মানুষকে আল্লাহ তায়ালা নিরাবরণ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু মানুষের জন্য পোশাকও সৃষ্টি করেছেন। হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া (আঃ)কে সৃষ্টি করে বেহেশতে পোশাক পরেই থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। শয়তানের প্ররোচনায় তাদের সে বেহেশতের পোশাক খসে পড়ে। তখন স্বাভাবিক লজ্জার কারণেই তারা গাছের পাতা দিয়ে তাদের লজ্জাকে ঢাকার চেষ্টা করে। আল্লাহ তায়ালা সে কথা কোরআনে বলেছেন এভাবে:

ط
يُبَنِي آدَمَ قَدْ أَنْزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْا تِكُمْ وَرِيْشًا وَلِبَاسُ التَّقْوَى ذَلِكَ خَيْرٌ ذَالِكَ مِنْ أَيْتِ اللَّهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ – يُبَنِي آدَمَ لَا يَفْتِنَكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُما لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَواتِهِمَا إِنَّهُ يَرَكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ، إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيْطِيْنِ أَوْلِيَاءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ –

“হে বনী আদম, নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের জন্য পোশাক পাঠিয়েছি যা দ্বারা তোমরা তোমাদের নগ্ন দেহকে আচ্ছাদিত কর এবং সৌন্দর্যও প্রকাশ কর। আর তাকওয়ার পোশাকই সর্বাধিক উত্তম, এ হলো আল্লাহর নিদর্শনের অন্যতম যেন তোমরা স্মরণ কর। হে বনী আদম, শয়তান যেন তোমাদেরকে কোন মন্দ কাজের পরীক্ষায় না ফেলে, যেমনিভাবে তোমাদের আদি পিতা-মাতাকে এভাবে বেহেশত থেকে বের করে এনেছিলেন যে তাদের পোশাক তাদের দেহ থেকে চ্যুত করে দিয়েছিলেন যেন তারা দু’জনেই তাদের নগ্ন দেহ দেখতে পায়, সে এবং তার দলবল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যেভাবে তোমরা দেখতে পাওনা। নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনেনি, আল্লাহ তাদেরকে শয়তানের বন্ধু বানিয়ে দিয়েছেন।” (সূরা আরাফ: ২৬-২৭)

উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে জানা গেল, পোশাক হল মানুষের আচ্ছাদন বা আবরণ ও সৌন্দর্য প্রকাশক। তবে তাকওয়া অবলম্বন করে আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত সীমা মোতাবেক পোশাক পরিধান করা উত্তম, আর আল্লাহর দেয়া সীমাকে লংঘন করার অর্থ শয়তানের অনুসরণ, যে শয়তান চায় মানুষকে লজ্জাহীন করে বেপর্দা করতে।

فوسوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَنُ لِيُبْدِيَ لَهُمَا مَاوِرِيَ عَنْهُمَا مِنْ سَواتِهِمَا وَقَالَ مَا لَهُكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ إِلَّا أَنْ تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَلِدِينَ – وَقَاسَمَهُمَا إِنِّي لَكُمَا لَمِنَ النَّصِحِينَ – فَدَهُمَا بِغُرُورٍ ، فَلَمَا ذَاقَا الشَّجَرَةَ بَدَتْ لَهُمَا سَوَاتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفُنِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ وَنَادُهُمَا رَحما ألم أنهكما عن تلكما الشَّجَرَةِ وَأَقُل لَّكُما إِنَّ الشَّيْطَنَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُّبِينٌ – قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا اَنْفُسَنَا سكنت وَإِنْ لَّمْ تَغْفِرُ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَسِرِينَ –

“অতপর শয়তান তাদেরকে বিভ্রান্ত করল যেন তাদের লজ্জা স্থানসমূহ যা তাদের পরস্পরের নিকট গোপনীয় করল, তা তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ে। সে তাদেরকে বলল, তোমাদের রব তোমাদেরকে ঐ গাছের নিকট যেতে নিষেধ করেছেন এ জন্য যে, তোমরা যাতে ফেরেশতা হয়ে না যাও অথবা এখানে তোমরা চিরস্থায়ী হয়ে না যাও। এবং সে কসম করে বলল যে আমি অবশ্যি তোমাদের কল্যাণকামী। এভাবে তারা দু’জনই ঐ গাছের স্বাদ গ্রহণ করল, তখন তাদের গোপনীয় স্থান পরস্পরের নিকট উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং তারা জান্নাতের পাতা দিয়ে নিজেদের লজ্জাস্থান ঢাকতে লাগল। তখন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে ঐ গাছের ব্যাপারে নিষেধ করিনি আর তোমাদেরকে আমি কি একথা বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন? তখন তারা বলল, হে আমাদের রব, আমরা আমাদের নিজেদের উপর জুলুম করেছি, এখন যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর, আর আমাদের প্রতি রহম না কর তবে অবশ্যি আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত হয়ে পড়ব।” (সুরা আরাফ: ২০-২৩)

কোরআনে বর্ণিত মানব সৃষ্টি ও শয়তান সম্পর্কিত এ কাহিনীতে মানুষের লজ্জা-শরম ও পর্দা সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে সে সম্পর্ক এ যুগের প্রসিদ্ধ তাফসীর লেখক মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী লিখেছেন:

“মানুষের মধ্যে স্বভাবতই লজ্জা ও শরম লুক্কায়িত রয়েছে। নিজ দেহের বিশেষ অংশসমূহ অপর মানুষের সম্মুখে উন্মুক্ত ও উলংগ করার ব্যাপারে মানুষ যে লজ্জা অনুভব করে, তাই তার স্বভাব নিহিত লজ্জা-শরমের প্রথম প্রকাশ। কোরআন বলে: “এই লজ্জা- শরম মানুষের মধ্যে সভ্যতার ক্রমবিকাশের দরুণ কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি হয় নাই, ইহা কোন চেষ্টায় অর্জিত গুণও নহে, যেমন শয়তানের কোন শিষ্য শাগরেদ কল্পনা করিয়া লইয়াছে বরং ইহা মানুষের স্বভাব নিহিত গুণ, প্রথম দিন হইতে ইহা মানুষের মধ্যে রহিয়াছে।

মানুষকে মানবীয় স্বভাব-প্রকৃতির সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ সহজ, সোজা-সরল পথ হইতে বিচ্যুত ও গোমরাহ করার জন্য শয়তান সর্বপ্রথম যে কৌশল চালে, যে অপকৌশল অবলম্বন করে, তাহা এই ছিল যে, সে মানুষের লজ্জা-শরমের উপর আঘাত হানিল এবং উলংগতার পথে তাহার সম্মুখে অশ্লীল ও কুৎসিৎ কাজের দুয়ার উন্মুক্ত করিয়াছিল এবং যৌন কাজে, তাহাকে পাপ কাজে লিপ্ত করিতে চাহিয়াছিল। অন্য কথায় প্রতিপক্ষের যৌন জীবনকে তাহার দুর্বলতম স্থান হিসাবে গণ্য করিয়া উহার উপর আঘাত হানিল। আর মানব প্রকৃতিতে রক্ষা প্রাচীর হিসাবে যে লজ্জা-শরম নিহিত রহিয়াছে, তাহা নষ্ট করার জন্য সে হামলা চালাইয়াছিল। বস্তুতঃ শয়তান ও তাহার শাগরেদগণ আজ পর্যন্ত এই পথেই কাজ করিয়া যাইতেছে। নারী জাতিকে পর্দাহীন, উন্মুক্ত, উলংগ না করা পর্যন্ত উন্নতি আর প্রগতির ক্ষেত্রে তাহাদের কোন কাজই শুরু হইতে পারেনা।

‘নিষিদ্ধ বৃক্ষের’ স্বাদ গ্রহণ করার সংগে সংগেই আদম ও হাওয়ার লজ্জাস্থান উলংগ হইয়া গেল, ইহা উক্ত বৃক্ষের নিজস্ব কোন গুণের কারণেই সংঘটিত হইয়াছিল, এমন কথা মনে করার কোন যুক্তি সংগত কারণ নাই। মূলতঃ ইহা আল্লাহ তায়ালার নাফরমানী ছাড়া আর কোন কারণ ছিল না। আল্লাহ তায়ালা প্রথমে তাহার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আদম ও হাওয়াকে সতর ঢাকার ব্যবস্থা করিলেন, যখন খোদার এই ব্যবস্থাপনা শেষ ইহা হইয়া গেল, তাহাদের দেহাবরণ খুলিয়া গেল এবং আল্লাহর হেদায়াত খতম হইয়া গেল। তাহাদের শরীর ঢাকার দায়িত্ব তাহাদের নিজেদের উপরই ছাড়িয়া দেওয়া হইল। ইহা হইতে চিরদিনের জন্য এই সত্য উদঘাটিত হইল যে, মানুষ যখনই খোদার নাফরমানী করিবে তখন বিলম্বে কিংবা খুব তাড়াতাড়ি তাহার আবরণ বা আচ্ছাদন খুলিয়া যাইবে। আর সেই সংগে এই কথাও প্রতিষ্ঠিত হইল যে, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ খোদার আনুগত্যের সীমা লংঘন করিয়া বাহিরে চলিয়া যাওয়ার পর খোদার বিশেষ তায়ীদ ও মদদ লাভ করা তাহাদের পক্ষে সম্ভব হইবে না।”

সূরা আরাফের ১৫ ও ১৬ নম্বর টীকায়ও মাওলান মওদূদী (রহঃ) লেবাস, তাকওয়ার লেবাস, লজ্জা-শরম ও শয়তানের চক্রান্ত এবং মানুষকে বিপদগামী করার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ১৫ নম্বর টীকার উপসংহারে তিনি বলেছেন: “শয়তান মানুষকে মানবীয় স্বভাব-প্রকৃতি সম্মত পথ হইতে বিচ্যুত করিয়া চরম নির্লজ্জতায় নিমজ্জিত করিয়াছে। আর মানুষ নবী-রাসূলদের নেতৃত্ব ও আদর্শ গ্রহণ ব্যতীত প্রকৃতির প্রাথমিক দাবী-দাওয়াকে উপলব্ধি পর্যন্ত করিতে পারিবে না আর তাহা পূর্ণ করাও সম্ভব হইবে না।”

(৩) গায়ের মুহাররম স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে পর্দার ব্যাপারে ইসলামী শরীয়ত খুব বেশী কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ইসলামী শরীয়তের মতে এসব নারী-পুরুষের মধ্যে অবাধ মেলামেশা, দৃষ্টি বিনিময়, একান্ত ও নিরিবিলি সাক্ষাত, সামানা-সামনি কিছু চাওয়া বা রসালো আলাপ-আলোচনা করা বৈধ নয়। যাদের মধ্যে বিয়ে হারাম নয়, তারা সবাই গায়ের মোহররম এবং তাদের ক্ষেত্রেই পর্দা জরুরী। পর্দার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

يايُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنْتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمًا –

“ওহে নবী, আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাদেরকে ও মু’মিন নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের চাদরকে (মাথার উপর থেকে) নিচের দিকে ঝুলিয়ে দেয়, এতে শিগগিরই তাদের পরিচিতির ব্যবস্থা হবে এবং তারা নির্যাতিত হবে না, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান।” (সূরা আহযাব : ৫৯)

এ আয়াতের ভিত্তিতেই মু’মিন নারীদেরকে গায়ের মুহাররম পুরুষের সামনে যাওয়ার ক্ষেত্রে চাদর দিয়ে মাথা থেকে সর্বাঙ্গ ঢেকে চলার নির্দেশ প্রদান করেছেন। এ নির্দেশের ফলেই পরবর্তী যুগে মু’মিন নারীদের মধ্যে বোরকা ব্যবহারের প্রচলন হয়েছে। গায়ের মুহাররম স্ত্রী-পুরুষ একে অপরের নিকট কিছু চাইতে হলে পর্দার আড়ালে থেকে চাওয়ার কথাও আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন।

وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَسَتَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ ، ذُلِكُمْ
أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ

“যখন তোমরা নারীদের নিকট কিছু চাও, তখন তা পর্দার আড়ালে থেকে চাও, এটা তোমাদের অন্তরের জন্য ও তাদের অন্তরের জন্য অধিক পবিত্রতর।” (সূরা আহযাব: ৫৩)

নবীর স্ত্রীদেরকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, যা মুসলিম মহিলাদের জন্যও প্রযোজ্য।

فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلاً
مَعْرُوفًا – وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَجْنَ تَبَرُّجَ الْجَهِلِيَّةِ الْأُولى
–

“অতএব, তোমরা পুরুষদের সাথে কোমলভাবে কথা বলোনা, যাতে যাদের অন্তরে রোগ আছে তাদের লালসার সৃষ্টি হয়। বরং কথা বল স্পষ্টভাবে। তোমরা তোমাদের ঘরেই মর্যাদার সাথে অবস্থান কর এবং পূর্ববর্তী জাহেলী যুগের প্রদর্শনী করে বেড়িওনা।” (সূরা আহযাব: ৩২-৩৩)

পর্দা সম্পর্কে আরো কিছু কথা আল্লাহ তায়ালা বলেন সূরা নূরের ৩০ ও ৩১ আয়াতেঃ

قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ
از کی لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ – وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَتِ يَغْضُضْنَ مِنْ

أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ الأَمَا ظَهَرَ مِنْهَا
وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِ هِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ ص وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ
أوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي
إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَاهُنَّ أَوِ التَّبِعِينَ غَيْرِ
أولِي الْأَرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطَّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَتِ
النِّسَاءِ ص وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا
إلى اللهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
ط
–

“মু’মিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে; এ হলো তাদের জন্য পবিত্রতম, তারা যা কিছু করে আল্লাহ তার খবর রাখেন। আর মু’মিন নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, তাদের সৌন্দর্যকে যেন প্রকাশ করে না বেড়ায়। তবে যা স্বতঃই প্রকাশ হয়ে পড়ে, আর তাদের চাদর যেন বক্ষের উপর জড়িয়ে রাখে আর তাদের সৌন্দর্যকে যেন প্রকাশ হতে না দেয়। তাদের স্বামীদের, তাদের পিতাদের, তাদের স্বামীর পিতাদের, তাদের পুত্রদের, তাদের স্ত্রীদের পুত্রদের, তাদের স্ত্রীদের অথবা তাদের মালীকানাধীন দাসদের অথবা ঐ সব পুরুষদের যাদের নারীর ব্যাপারে কোন আকর্ষণ নেই অথবা ঐ সব শিশু যারা নারীর গোপনীয় বিষয়ে অনভিজ্ঞ তাদের ছাড়া (অন্যদের), আর তারা যেন সজোরে পা ফেলে না চলে যাতে তাদের গোপন সৌন্দর্য শোনা যায়; হে মু’মিনগণ তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তৌবা কর যেন তোমরা সফলকাম হও।”

উপরে উল্লেখিত কোরআনের আয়াতগুলো থেকে পর্দা সম্পর্কিত আল্লাহ তায়ালার যেসব নির্দেশ পাওয়া গেল তা হলো:

১. মুসলিম মহিলাগণ গায়ের মুহাররম পুরুষের সামনে আসবে চাদর দিয়ে মাথা থেকে সমস্ত শরীর ঢেকে;
২. গায়ের মুহাররম মহিলাদের নিকট কিছু চাইলে তা পর্দার আড়াল থেকে চাইবে;
৩. মুসলিম মহিলারা পুরুষদের সাথে কোমলভাবে কথা বলবে না বরং স্পষ্টভাবে কথা বলবে;
৪. মুসলিম মহিলাদের তাদের নিজ নিজ ঘরে অবস্থানই উত্তম;
৫. মুসলিম মহিলারা যেন জাহেলী যুগের মত প্রদর্শনী করে না বেড়ায়;
৬. নারী-পুরুষ উভয়েই যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে একে অপরের দিকে না তাকায়;
৭. নারী-পুরুষ উভয়েই যেন তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে;
৮. মুসলিম মহিলারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করে না বেড়ায়;
৯. মুসলিম মহিলারা যেন সজোরে তাদের পা না ফেলে যাতে তাদের গোপন সৌন্দর্য শোনা যায়।
১০. তাদের কৃত ত্রুটির জন্য যেন তারা সকলে তৌবা করে।

উপরের আয়াতসমূহ থেকে আমরা উপরে বর্ণিত দশটি নির্দেশ পেয়ে থাকি যা মুসলিম সমাজে এবং পরিবারের লোকদের অবশ্য পালনীয়। এ ছাড়া পরিবারের অভ্যন্তরীণ পর্দার ব্যাপারে ইতিপূর্বে আলোচনা হয়েছে। উপরে বর্ণিত দশটি বিষয়ে আলোচনা করলেই পর্দা সম্পর্কিত আলোচনা মোটামুটি হয়ে যায়।

১. মুসলিম মহিলাদের গায়ের মুহাররম পুরুষদের সামনে আসতে হলে,

তা ঘরের ভিতরেই হোক আর বাইরেই হোক, মাথা থেকে গায়ে চাদর ঝুলিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ সাধারণভাবে ব্যবহৃত পোশাক পরে পরপুরুষের সামনে আসা মুসলিম মহিলাদের জন্য জায়েয নয়। বর্তমান সময়ে প্রচলিত পেট-পিঠ, গলা-হাত খোলা অবস্থায় পুরুষের সামনে বের হওয়া তো কিছুতেই মুসলমান নারীরা করতে পারে না। এভাবে তো মুহাররম ব্যক্তির সামনে আসাও জায়েয নয়। মুসলিম নারীদের মধ্যে কোরআনের এ হুকুমের ভিত্তিতেই বোরকা পরিধানের ব্যবস্থা চালু হয়েছে। কতক মুসলিম মা-বোন এভাবে পর্দা মেনে চলে, আবার কতক তা মোটেও মানে না, আবার কতক বাইরে বেরুবার সময় তো ঠিকই মেনে চলে কিন্তু ঘরের ভেতরে মুহাররম পুরুষের সামনে গা খোলা অবস্থায়ও চলাফেরা করে। কেউ বোরকা ছাড়া বাইরে বেরুতে লজ্জা বোধ করে, আবার কেউ বোরকা পরিধান করতেই লজ্জাবোধ করে। মুসলিম মহিলাদের আল্লাহকে ভয় করা উচিৎ, আল্লাহর হুকুম মোতাবেক পর্দা করে চলা উচিৎ।

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: “মুসলিম মহিলাদের পর পুরুষের সামনে চাদর দিয়ে মাথাসহ শরীর ঢেকে চলাফেরা করতে হবে, আর মুহাররম পুরুষের সামনেও তার সতর ঢেকে রাখতে হবে।”

২. গায়ের মুহাররম কোন পুরুষ মহিলাদের নিকট কিছু চাইলে তা পর্দার আড়াল থেকে চাইবে।

অর্থাৎ গায়ের মুহাররম নারী পুরুষের একত্র মেলা-মেশা নিষিদ্ধ। এ ধরনের নারী-পুরুষের একান্তে বা গোপনীয় সাক্ষাৎ একেবারেই পরিত্যাজ্য। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার কোন ব্যক্তিই যেন এমন কোন মেয়েলোকের সাথে গোপনে মিলিত না হয়, যার সাথে তার আপন মুহাররম কোন পুরুষ নেই। কেননা গোপনে মিলিত এমন দু’জন নারী-পুরুষের সাথে শয়তান তৃতীয় জন হিসাবে উপস্থিত থাকে।” (বুখারী)

এজন্যেই সতী-সাধ্বী নারীর অন্যতম গুণ হলো স্বামীর অনুমতি ছাড়া অন্য কোন পুরুষকেই ঘরে প্রবেশ করতে না দেয়া। এ পর্যায়ে স্বামীর ভাইয়ের সাথে স্ত্রীর সাক্ষাতের বিষয়ে নবী (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেছিলেন তাদের সাথে সাক্ষাৎ তো মৃত্যুতুল্য। সাহাবায়ে কেরাম স্বামীর অনুপস্থিতিতে মহিলাদের ঘরে প্রবেশ করতেন না। রাসূল (সাঃ) কড়া ভাষায় তা নিষেধ করেছিলেনঃ

أَيَّاكُمْ وَالدُّخُولِ عَلَى النِّسَاءِ

“তোমরা গায়ের মুহাররম পুরুষেরা মেয়েলোকের কাছে যাওয়া-আসা থেকে দূরে থাক, সাবধান থাক।” (বুখারী)

বর্তমান সময়ে মুসলিম সমাজে অনেক বিপর্যয় চলে এসেছে। দেবর-ভাসুর, ভগ্নিপতিসহ অন্যান্যদের সাথে সাক্ষাৎ, মেলামেশা বা শ্যালিকা-বন্ধুপত্নির সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও মেলামেশাকে আজকে যেন পর্দার অন্তর্ভুক্তই গণ্য করা হয় না। তাদের সাথে মুহাররম ব্যক্তির মতই আচরণ করা হয়। অথচ তা আল্লাহর সুস্পষ্ট নিষেধ। তাদের সাথে কোন লেনদেন করতে হলে পর্দার আড়ালে থেকেই হতে হবে, এটাই আল্লাহর ফায়সালা।

৩. কথা বলার ব্যাপারে মুসলিম মহিলাদেরকে পরপুরুষের সাথে কোমলভাবে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। এর কারণ হিসাবে আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেছেনঃ

فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلاً مَعْرُوفًا –

“অতএব তোমরা পুরুষদের সাথে কোমলভাবে কথা বলোনা যাতে যাদের অন্তরে রোগ আছে তাদের লালসার সৃষ্টি হয়, বরং কথা বল স্পষ্টভাবে।” (সূরা আহযাবঃ ৩২)

যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা মেয়েলোকের কোমল কথায় প্রলুব্ধ হয়ে পড়তে পারে, এই আশংকায় কোমলভাবে কথা না বলে মহিলাদেরকে স্পষ্টভাবে কথা বলতে বলা হয়েছে। গায়ের মুহাররম নারী-পুরুষের মধ্যে গোপন কোন কথা-বার্তা, আলাপ- আলোচনাই তো নিষিদ্ধ, প্রকাশ্যভাবে প্রয়োজন ছাড়া কোন কথা বলার প্রশ্ন উঠে না। অপ্রয়োজনে হাস্য-রস করা, বাজে ও অনর্থক কথা- বার্তা বলা, প্রেমালাপ করা বা এমনি কথা বলে কাটানো এসব তো মোটেও বিধেয় নয়। তাই কেবলমাত্র প্রয়োজনে জরুরী কথাবার্তা স্পষ্টভাবে বলতে হবে, পর্দার আড়াল থেকে।

৪. আল্লাহ তায়ালা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মুসলিম মহিলাদেরকে ঘরের বাইরে না গিয়ে ঘরেই অবস্থান করতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ “তোমরা তোমাদের নিজেদের ঘরেই অবস্থান কর।” (সূরা আহযাব-৩৩) কেবলমাত্র বিশেষ প্রয়োজনেই নারীদেরকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।

এ পর্যায়ে নারীদের অর্থোপার্জন, ব্যবসা ও চাকুরী করা, পারিবারিক ব্যয়ভার বহনে অংশগ্রহণ ইত্যাদি প্রসঙ্গ আসে। ইসলাম পুরুষদেরকেই এসব দায়-দায়িত্ব দিয়েছে। নারীকে দেয়া হয়েছে ঘরের শৃংখলা বিধান, সন্তান জন্মদান, তাদের লালন-পালন ও তাদেরকে গড়ে তোলার দায়িত্ব। পারিবারিক দিক থেকে এ দায়িত্ব কোন ক্রমেই কম দায়িত্বপূর্ণ ও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পুরুষদের এতটুকু পৌরুষত্ব থাকা প্রয়োজন যে, সে নিজ পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বহন করতে পারে। তবে বিশেষ প্রয়োজনে পুরুষকে সহযোগিতা প্রদানের জন্য নারীরা ঘরের মধ্যে পর্দায় থেকে যদি কোন আয়-উপার্জন করতে পারে, তা নিষিদ্ধ নয়। অবস্থার চাপে যদি তাকে ঘরের বাইরে বের হয়েই উপার্জন করতে হয়, তবে অবশ্যই তাকে পর্দা মেনে চলতে হবে। পর্দার খেলাফ করে, বেপর্দা হয়ে নারী-পুরুষের একত্রে চাকুরী বা ব্যবসা কোন অবস্থাতেই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। কোন মুসলিম সমাজ-ব্যবস্থা এ ধরনের ব্যবস্থা চালু করতে পারে না। অর্থাৎ যে সমাজে এ ধরনের নারী-পুরুষের যৌথ ব্যবস্থা চালু রয়েছে সে সমাজ আল্লাহর বিধান মোতাবেক রাসূল প্রদর্শিত সমাজ-ব্যবস্থা নয়।

৫. মুসলিম মহিলাদেরকে জাহেলী যুগের মত প্রদর্শনী করে বেড়াতে নিষেধ করা হয়েছে।

অর্ধউলঙ্গ, অশালীন ও বেহায়াভাবে রাস্তাঘাটে, হাটে-বাজারে, ক্লাবে-রেস্তোরাঁয়, মাঠে-ময়দানে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো কোন মুসলিম মহিলার কাজ হতে পারে না। যেসব মহিলা আল্লাহর আইন বিধানের কোন পরোয়া করে না, কোন ধার ধারেনা; কেবলমাত্র তারাই চলাফেরার ক্ষেত্রে এরূপ বেপরোয়া হতে পারে। এসব পরিবারের পুরুষ, পিতা বা স্বামী যদি এদেরকে কোনরূপ নিয়ন্ত্রণ না করে তবে এসব পিতা বা স্বামীরাও এ জন্য দায়ী হবে। এদের অবস্থা তো এই যে স্ত্রী হয়তো অফিসে বসে পরপুরুষের পাশে, তার সাথে সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে নানারূপ রসালাপ করে, চাকুরীর সময় শেষে চলে যায় ক্লাব-রেস্তোরায় বা মার্কেটিংয়ে স্বামী বেচারা স্ত্রীকে তো কাছে পায়ই না, পায় অন্য স্বামীর স্ত্রীকে। সেও গল্প গুজব করে এবং দিনশেষে পরের স্ত্রীর সাথে চলে যায় পার্কে বা সিনেমায়। এভাবে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আকর্ষণ কমে যায়। তারা একে অপরের প্রতি নির্ভরশীলও নয়, যেহেতু দু’জনেই উপার্জন করে। এভাবে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যে কোন অঘটন ঘটে যাওয়া মোটেও বিচিত্র নয়। এর ফলে পারিবারিক পরিবেশ ধীরে ধীরে বিষিয়ে উঠতে পারে, সন্তানাদির লালন-পালন ও গঠন বিঘ্নিত হতে পারে এবং পারিবারিক ও সামজিক জীবনে চরম ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

৬. আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন গায়ের মুহাররম নারী-পুরুষ যেন চলার পথে ও সমাজ জীবনে একে অপরের প্রতি না তাকায়। প্রকৃতপক্ষে দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সকল অনাসৃষ্টির মূল উৎস। মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ “চক্ষুদ্বয়ের যেনা হচ্ছে পরস্ত্রী দর্শন, কর্ণদ্বয়ের যেনা হচ্ছে পরস্ত্রীর কথা লালসা-উৎকণ্ঠিত কর্ণে শ্রবণ করা, জিহ্বার যেনা হচ্ছে পরস্ত্রীর সাথে রসালো কন্ঠে আলাপ করা, হাতের যেনা হচ্ছে পরস্ত্রীকে স্পর্শ করা, হাত দিয়ে ধরা এবং পায়ের যেনা হচ্ছে যৌন মিলনের উদ্দেশ্যে পরস্ত্রীর কাছে গমন। প্রথমে মন লালসাসক্ত হয় ও কামনা করে, পরে যৌনাঙ্গ তা সত্যে পরিণত করে অথবা মিথ্যা প্রমাণ করে। এ হাদীস থেকে দেখা গেল দৃষ্টিপাত হল যেনার সূচনা পর্ব। অনিয়ন্ত্রিত দৃষ্টি সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

النَّظْرَة سَهُمْ مَّسْمُومٌ مِنْ سَهَامٍ إِبْلِيسِ

‘অনিয়ন্ত্রিত দৃষ্টি হল ইবলিসের বিষাক্ত বাণ বিশেষ” আল্লাহ তায়ালা এবং রাসূল (সাঃ) উভয়েই বলেছেন, দৃষ্টিকে অবনত রাখ এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত কর। অর্থাৎ লজ্জাস্থানের হেফাজত করতে হলে দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত ও অবনমিত রাখতেই হবে। দৃষ্টিকে যথেচ্ছাচারে ছেড়ে দিলে মন কলুষিত হবে এবং পরিণামে লজ্জাস্থানের হেফাজত করা সম্ভব হবে না।

তাই মনের আকর্ষণ নিয়ে পরস্ত্রীকে দেখা, তার প্রতি তাকিয়ে থাকা, ইসলামে জায়েয রাখা হয় নি। ঘটনাচক্রে তার প্রতি দৃষ্টি পড়ে গেলে সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে বলেছেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। হযরত আলীকে (রাঃ) বলেছেন, “পরনারীর প্রতি প্রথম দৃষ্টি তো তোমার। দ্বিতীয়বার দৃষ্টি নিক্ষেপ করো না, কারণ সে দৃষ্টি শয়তানের।”

অবশ্য নারী-পুরুষ উভয়কেই দৃষ্টি অবনত রাখতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ কোন নারীও পর পুরুষকে চোখ ভরে দেখতে পারবে না। অন্ধ সাহাবী উম্মে মাকতুম রাসূলের কাছে আসতে চাইলে নবী করীম (সাঃ) তার দুজন স্ত্রীকে এই বলে সেখান থেকে সরিয়ে দেন যে উম্মে মাকতুম অন্ধ হলেও নবীর স্ত্রীগণ তো উম্মে মাকতুমকে দেখতে পাবে।

প্রকৃতপক্ষে পারস্পরিক দৃষ্টি-বিনিময় নারী-পুরুষ উভয়কেই আকৃষ্ট করতে পারে যা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বিঘ্ন সৃষ্টির কারণ হতে পারে এবং নারী-পুরুষ উভয়েরই লজ্জাস্থানের হেফাজতকে করে দিবে ভণ্ডুল, যা যৌন পবিত্রতাকে নষ্ট করে ফেলবে।

৭. নারী-পুরুষ উভয়কেই নিজ নিজ লজ্জাস্থানের হেফাজত করতে বলা হয়েছে। আসলে পর্দা প্রথার মূল উদ্দেশ্যই হলো লজ্জাস্থানের হেফাজত তথা যৌন পবিত্রতা। যৌন পবিত্রতা সংরক্ষণে নারী-পুরুষ উভয়কেই সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য যে কোন প্রকারে কাম চরিতার্থকে আল্লাহ তায়ালা হারাম করে দিয়েছেন।

স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলনের ক্ষেত্রে যৌন পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য যে বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে, তা হলো:
(১) যথানিয়মে স্ত্রীর যৌনাঙ্গ ব্যবহারই যৌন মিলনের পথ ও পন্থা। এর কোন ব্যতিক্রম করা চলবে না। স্ত্রীর গুহ্যদ্বারে যৌন মিলন সম্পূর্ণ হারাম।

হযরত ইবনু আব্বাছ (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি ওহী নাযিল হলঃ “তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের ক্ষেতস্বরূপ, অতএব তোমরা তোমাদের ক্ষেতে যেভাবে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পার।” সামনে থেকে অথবা পেছন থেকে, তবে বেঁচে থাকিবে গুহ্যদ্বার ও হায়েজ অবস্থা হতে। (তিরমিযি, ইবনে মাজা ও দারেমী, মেশকাত ৩০৫৩) মিশকাত শরীফে এতদসংক্রান্ত পর পর ৫টি হাদীস (৩০৫৩-৩০৫৭) বর্ণিত হয়েছে।

(২) মহিলাদের হায়েজ ও নেফাস-এ (মাসিক ঋতুস্রাব ও সন্তান প্রসবের পরবর্তী সময়ে) যৌন মিলন নিষিদ্ধ;
(৩) রোযা অবস্থায় দিনের বেলায় যৌন মিলন হারাম;
(৪) এ’তেকাফ অবস্থায় যৌন মিলন নিষেধ,
(৫) হজ্জের সময় এহরাম বাঁধা অবস্থায় যৌন মিলন নিষিদ্ধ।

এ কয়টি অবস্থাকে পরহেয করে স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলন সম্পূর্ণ জায়েয। আল্লাহ তায়ালা স্বামী-স্ত্রীর এ যৌন মিলনকে কোন মৌসুমে বা কোন নির্দিষ্ট সময়ে সীমাবদ্ধ করেননি। এর মাধ্যমে মানব সভ্যতাকে বিকশিত করে তুলতে চান।

একমাত্র স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলনকেই আল্লাহ তায়ালা হালাল করেছেন, কেবল মাত্র এ পথেই যৌন পবিত্রতা বজায় রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া অন্য সকল প্রকার যৌন কাজকে হারাম করা হয়েছে। তাই লজ্জাস্থানের হেফাজত শরীয়ত মোতাবেক বিয়ের মাধ্যমে যৌন মিলনের ব্যবস্থা করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প পথ নেই।

মুহাররম ও গায়ের মুহাররম নারী-পুরুষের মধ্যে কোন প্রকার যৌন মিলনই বৈধ ও হালাল নয়। এ ছাড়া কৃত্রিম উপায়ে যৌন কাজ সম্পন্ন করা, সমলিঙ্গের মধ্যে যৌন কাজ হারাম ও পরিত্যাজ্য।

আল্লাহ তায়ালা মু’মিনের গুণাবলী উল্লেখ করতে গিয়ে সূরা ‘মু’মিনুন’ এ অন্যান্য গুণের সাথে বলেছেন: “সফলকাম মু’মিন তো তারাই যারা তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে, তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাধীন দাসীদের ছাড়া, এদের ব্যাপারে তারা তিরষ্কৃত হবে না। কিন্তু যারাই এর বাইরে যাবে তারা সীমালংঘনকারী।” অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর বাইরে যৌন সম্পর্ক স্থাপনই যৌন অপবিত্রতা। আর এ যৌন অপবিত্রতা থেকে ইসলামী সমাজকে রক্ষা করার জন্যই বিয়েকে করা হয়েছে সহজ ও সার্বজনীন। এবং যে কোন ধরনের যৌন অপবিত্রতাকে করা হয়েছে কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পর্দা ব্যবস্থাই যৌন অপবিত্রতার বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ, যুক্তি সংগত ও উত্তম হাতিয়ার এবং যৌন পবিত্রতা অর্জনের এক মোক্ষম পদ্ধতি।

যে সব সমাজে পর্দা প্রথা চালু নেই সে সব সমাজে যৌন পবিত্রতারও নেই কোন গ্যারান্টি। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার কারণে গোটা সমাজের যৌন জীবন কলুষিত হয়ে পড়ে, সে সমাজ পশুর সমাজে পরিণত হয়। কওমে লুতের সমাজে যে যৌন অনাচার শুরু হয়েছিল, সভ্যদেশ আমেরিকায় আজ তা আইনসিদ্ধ হয়ে গেছে, আমাদের পার্শ্ববর্তী হিন্দু সমাজে দেব-দেবীর প্রেমলীলার গল্প-গাঁথা প্রচারিত হয়। সে সমাজে মা তার ছেলের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে তাকে বনে নিয়ে গিয়ে যৌন কাজে লিপ্ত করে ইত্যাকার কাহিনী শোনা যায়। গল্প-উপন্যাসে কত জঘন্য যৌন কার্যক্রমের উল্লেখ করা হয়। পর্দা প্রথা চালু থাকলে অবশ্যি মুসলিম সমাজ ইত্যাকার অনাচার ও যৌন অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থাকত। কিন্তু মুসলিম সমাজেও এ ধরনের নানারূপ অনাচারের ঘটনার কথা শোনা যায়। আজ সমাজে নারী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ ইত্যাদি সমাজ বিরোধী কার্যক্রম ঘটে চলছে অহরহ। এর প্রধানতম কারণ পর্দা প্রথা সমাজে চালু না থাকা। তাই যৌন উচ্ছৃংখলতা ও যৌন অনাচার বন্ধ করতে হলে কঠোর হস্তে পর্দা প্রথাকে সমাজে চালু করতে হবে।

৮. মুসলিম মহিলাদেরকে বলা হয়েছে তারা যেন জাহেলী যুগের মত তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করে না বেড়ায়।

নারী জাতির সৌন্দর্যের মধ্যে রয়েছে:
(১) তাদের চেহারা ও দেহকান্তি;
(২) তাদের পরিধেয় পোশাক যা তাদের সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করে;
(৩) তাদের পরিধেয় অলংকারাদি।।

তাদের এসব সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে বাইরে বেড়াতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে যা স্বতঃই প্রকাশ হয়ে পড়ে, তা ধর্তব্য নয়। মুসলিম মহিলাদের চেহারাসহ ছতর বা তার অংশ বিশেষ পেট-পিঠ-গলা-হাত বা মাথার চুল, তাদের পরিধেয় পোশাক ও অলংকারাদি পরপুরুষের নিকট প্রকাশ করা বা প্রকাশ করে বেড়ানো সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এ জন্য মুসলিম মহিলাদেরকে বাইরে বেরুবার সময় মাথা থেকে শরীরে চাদর ঝুলিয়ে নিতে বলা হয়েছে, যা আজকের সমাজে বোরকায় রূপান্তরিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চেহারার ব্যাপারে ফেকাহবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কিছুটা মতভেদ দেখা যায়। যারা চেহারাকে সৌন্দর্যের আকর মনে করেন তাদের অবশ্যি শুধু মাত্র চোখ খোলা রেখে চেহারা ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করা উচিৎ। আর কেউ যদি মতভেদের ভিত্তিতে চেহারা খোলাই রাখতে চান, তাদের ব্যাপারটার ফায়সালা আল্লাহর হাতেই ছেড়ে দেয়া ভাল। তবে স্বতঃই যা প্রকাশিত হয়ে পড়ে বলতে হঠাৎ করে যা বেরিয়ে পড়ে তাই বুঝায়, এর দ্বারা চেহারা বুঝানো যেতে পারে না। কারণ চেহারা তো ইচ্ছাকৃতভাবেই খোলা রাখা হয়। তাই তাকওয়া ও পরহেযগারীর দাবী চেহারা ঢেকে রাখা, এটাই বুঝা যায়।

৯. মুসলিম মহিলারা যেন সজোরে পা না ফেলে, যাতে তাদের গোপন সৌন্দর্য শোনা যায়। গোপন সৌন্দর্য বলতে গোপন অলংকারাদিকেই বুঝায়। এসব গোপন অলংকারাদির আওয়াজ যেন পরপুরুষের কানে না যায় এভাবে মুসলিম মহিলাকে হাঁটা-চলা করতে হবে। গোপন অলংকারাদির আওয়াজ পর-পুরুষের কানে পৌঁছানোও পর্দার খেলাফ। তাই গোপন অলংকারাদির আওয়াজকেও পর্দার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

মুসলিম মহিলা ও পুরুষদের নিয়ম মাফিক পর্দা করা ফরয। এ হলো আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত বিধান। এর খেলাফ করা কঠিন গুনাহ। একটি মুসলিম সমাজে অবশ্যই এ নিয়ম বিধান মোতাবেক পর্দা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যে সমাজে এ ধরনের পর্দা ব্যবস্থা চালু নেই সে সমাজ একটি মুসলিম সমাজ বলে গণ্য হতে পারেনা।

মুসলিম পারিবারিক জীবনকে পবিত্র করতে ও পবিত্র রাখতে হলে এ ধরনের পর্দা ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। অন্যকথায় সে সমাজে যৌন জীবন দূষিত, কলুষিত ও অপবিত্র হয়ে পড়বে। যেনা-ব্যভিচারে সমাজ জীবন ভরে যাবে। যার কিছু হবে প্রকাশ্য, আবার কিছু হবে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেনা-ব্যভিচারের জন্য ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থায় কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়েছে। যেনা-ব্যভিচার তা যে ধরনেরই হোক না কেন, তা ঘৃণ্য ও নির্লজ্জ কাজ। কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছেঃ

وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً طَ وَسَاءَ سَبِيلاً –

“যেনার নিকটবর্তীও হয়ো না, এ হলো বড় নির্লজ্জ কাজ ও অসৎপন্থা।” (সূরা বনী ইসরাইল : ৩২)

وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ أَتَاتُونَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُمْ بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِّنَ
العَالَمِينَ – إِنَّكُمْ لَتَاتُونَ الرِّجَالَ شَهْوَةً مِنْ دُونِ النِّسَاءِ طَ بَلْ أَنْتُمْ
قوم مشرفون

“এবং লুতের সময় যখন তিনি তার সম্প্রদায়কে বললেন: তোমরা এমন নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত হচ্ছ যা তোমাদের পূর্বে জগৎবাসীর মধ্যে কেউ করেনি। তোমরা স্ত্রী জাতিকে বাদ দিয়ে পুরুষদের নিয়ে কাম-বাসনায় লিপ্ত হচ্ছ, তোমরা তো সীমা অতিক্রমকরী এক জাতি।” (সূরা আরাফ: ৮০-৮১)

যেনা ব্যভিচারের শাস্তির কথা কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। হাদীসেও তার বিধান নির্ধারণ করা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছেঃ

الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا مِئَةَ جَلْدَةٍ ص وَلَا
تَأْخُذَكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ج
وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ

“ব্যভিচারী নারী ও পুরুষ প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত কর, আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে তাদের প্রতি তোমাদের যেন কোন দয়া অনুগ্রহ না হয়, তোমরা যদি আল্লাহর প্রতি ও আখেরাতের দিনের প্রতি ঈমান এনে থাক এবং একদল মু’মিন যেন তাদের উভয়েরই শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।” (সূরা নূরঃ ২)

وَالَّتِي يَأْتِينَ الْفَاحِشَةَ مِنْ نِّسَاءِكُمْ فَاسْتَشْهِدُوا عَلَيْهِنَّ أَرْبَعَةَ
مِنْكُمْ ج فَإِنْ شَهِدُوا فَأَمْسِكُوهُنَّ فِي الْبُيُوتِ حَتَّى يَتَوَفَّهُنَّ الْمَوْتُ أَوْ
يجعل الله لَهُنَّ سَبِيلاً –

“তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যে স্ত্রীলোক অশ্লীল কাজ (ব্যভিচার) করে তাঁদের বিরুদ্ধে চারজন সাক্ষী যোগাড় কর। তারা যদি সাক্ষ্য প্রদান করে তাহলে তাদেরকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘরে আবদ্ধ রাখ অথবা আল্লাহ তাদের জন্য অন্য কোন পথ বের করে দেবেন।” (সূরা নিসা: ১৫)

কোরআনের এসব আয়াত ও সহীহ হাদীস মোতাবেক যেনা ব্যভিচারের যে শাস্তি শরীয়ত নির্ধারণ করেছে তা হল অবিবাহিত নারী-পুরুষের জন্য একশত বেত্রাঘাত এবং বিবাহিত নারী-পুরুষের জন্য কোমর পর্যন্ত মাটির নিচে গেড়ে প্রস্তর নিক্ষেপে মৃত্যু, যা একদল মু’মিন নারী-পুরুষ প্রত্যক্ষ করবে।

যেনা-ব্যভিচারের মূলোৎপাটনের উদ্দেশ্যেই পর্দা ব্যবস্থা চালু করা হয়। সেজন্যই পর্দার বিস্তারিত নিয়ম-কানুন বর্ণিত হয়েছে কোরআন ও হাদীসে। কোরআনে পর্দার বিস্তারিত নিয়ম কানুন বর্ণনার শেষে বলা হয়েছে তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তৌবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। অর্থাৎ পর্দার ব্যাপারে তোমাদের তো ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে যেতে পারে, তাই আল্লাহর নিকট তৌবা কর। তৌবার শর্ত হল, অতীত কাজের জন্য অনুশোচনা, ভুল স্বীকার, ক্ষমা চাওয়া, অতীতের ত্রুটির প্রতিবিধান যদি সম্ভব হয় এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ পাপকাজ আর না করার প্রতিজ্ঞা। তাই এ ধরনের তৌবার জন্য একটি পর্দাপূর্ণ সমাজ তো প্রথমে গড়ে তুলতে হবে। পর্দাহীন সমাজ চালু রেখে, বেপর্দা চলাফেরা করে, পর্দার কোন ধার না ধেরে তৌবার প্রশ্ন অবান্তর। তবে ব্যক্তিগতভাবে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করে যথাসাধ্য চেষ্টা জারী রাখলে এবং ব্যক্তিগত ভাবে পর্দার বিধি-বিধান মেনে চললে, আল্লাহর নিকট তৌবা করে মাফ চাওয়া যেতে পারে। আল্লাহ তায়ালা হয়ত মাফ করে দিতে পারেন।

দশম অধ্যায় : পারিবারিক জীবনে সন্তান ও সন্তান প্রতিপালন

বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র যৌন জীবন যাপন। বয়স ও তারুণ্যের কারণে প্রকৃতিগতভাবেই যুবক-যুবতী যৌন মিলনে আকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠে। বিয়ের মাধ্যমে সে যৌন মিলনকে জায়েয করে দেয়া হয় এবং এ ছাড়া অন্য সকল প্রকার যৌন মিলনকে আল্লাহ তায়ালা হারাম করে দিয়েছেন। তাই আপাতত: উদ্দেশ্য যদিও দেখা যায় স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলন, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এ যৌন মিলনের মাধ্যমে গর্ভ সঞ্চার ও সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করে রেখেছেন এবং এভাবে সন্তান প্রসবের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানব বংশধারা অব্যাহত রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আঃ)-কে সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি করলেন, আর আদম থেকে সৃষ্টি করলেন বিবি হাওয়াকে। অতঃপর হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়াকে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করে সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে দুনিয়ায় বংশধারা সৃষ্টির কারণে সারা দুনিয়া মানুষে ভরে গেছে। পাক কোরআনে বলা হয়েছে:

ياَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ
وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهَا رِجَالاً كَثِيرًا وَنِسَاءَ

“হে লোক সকল, ভয় করো তোমাদের সেই রবকে যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক প্রাণ থেকে এবং তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের দু’জন থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু সংখ্যক পুরুষ ও নারীকে।” (সূরা নিসাঃ ১)

মানব বংশধারা অব্যাহত রেখে দুনিয়াটা অসংখ্য মানুষে ভরে দেয়াই যে মানব জন্মের উদ্দেশ্য এ আয়াত থেকে সে কথা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়।

শিশু সন্তানের জন্ম আল্লাহর এক কুদরত

মানব শিশু তথা সকল প্রাণীর বাচ্চা এমনকি গাছ-পালার জন্ম ও সৃষ্টি কৌশল আল্লাহর এক কুদরত। প্রকৃতিগত ও স্বাভাবিকভাবেই জন্ম-মৃত্যুর এ ধারা অবিরাম গতিতে এগিয়ে চলছে। এতে কোন মানবীয় বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় না। স্বাভাবিকভাবেই যখন স্বামী-স্ত্রীর মিলন হয়, কোন কোন মিলনে গর্ভসঞ্চার হয়ে যায়, ভূমিষ্ঠ হয় সন্তান। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ
ج
إِلَيْهَا ، فَلَمَّا تَغَشُهَا حَمَلَتْ حَمْلاً خَفِيفًا فَمَرَّتْ بِهِ :

“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন, পরে তার জুড়ি সৃষ্টি করেছেন যেন তারা একসাথে জীবন যাপন করতে পারে। অতঃপর যখন স্বামী- স্ত্রীতে উপগত হল তখন স্ত্রী হালকাভাবে গর্ভধারণ করলো, অতঃপর সে তা নিয়ে চলাফেরা করতে লাগল।” (সূরা আরাফ: ১৮৯)

কিন্তু নারী-পুরুষের সকল মিলনে তো গর্ভসঞ্চার হয় না। তাহলে কার ফায়সালায় গর্ভসঞ্চার হয় আর কার ফায়সালায় গর্ভসঞ্চার হয় না! নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালাই গর্ভসঞ্চারের ফায়সালার মালিক। আর সন্তান স্ত্রী হবে না পুরুষ, নর না মাদী সে ফায়সালাও করেন আল্লাহ তায়ালা। হাজার হাজার বছর ধরে দেশে দেশে নারী-পুরুষের সংখ্যাসাম্য কে ঠিক করে দেয়? সে তো আল্লাহই।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

للَّهِ مُلْكُ السَّمَواتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ
إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَن يَشَاءُ الذُّكُورَ – أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا وَيَجْعَلُ
مَنْ يَشَاءُ عَقِيمًا إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ –

“আল্লাহর জন্যই আসমান ও জমীনের রাজত্ব, তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন, যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দেন আর তাদের কাউকে কন্যা ও পুত্র মিশ্রিত করে দেন, আবার কাউকে রাখেন নিঃসন্তান। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান।” (সূরা শুরা : ৪৯-৫০)

নারী-পুরুষের ভারসাম্য আল্লাহ তায়ালাই তার কুদরতে ধরে রেখেছেন। পৃথিবীর কোন পর্যায়ে বা কোন দেশে যদি এক সময়ে শুধু-মাত্র পুরুষ বা শুধুমাত্র নারী জন্ম লাভ করত তাহলে সৃষ্টিধারা ব্যাহত হয়ে যেত।

সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা এই যে, তিনি যখন কোন ব্যাপারে বলেন যে, হয়ে যাও, তা হয়ে যায়। এ ছাড়া সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়ম তিনিই চালু করে ‘দিয়েছেন, আবার ব্যতিক্রমও তিনিই করে থাকেন। তিনি সরাসরি মাটি থেকে হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেছেন, বিবি হাওয়াকে আদমের পাঁজর থেকে, হযরত ঈসা (আঃ)-কে পুরুষের মিলন ছাড়াই শুধু মায়ের পেট থেকে, আবার বৃদ্ধ হযরত জাকারিয়া (আঃ)-এর বন্ধা স্ত্রীর গর্ভ থেকে হযরত ইয়াহইয়াকে।

হযরত মরিয়মের হযরত ঈসা (আঃ)-কে জন্মদানের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের ধারণার উল্লেখ করে বলেনঃ

وَبِكُفْرِهِمْ وَقَوْلِهِمْ عَلَى مَرْيَمَ بُهْتَانًا عَظِيمًا –

“এবং তারা তাদের কুফুরী ও কথায় এতদূর এগিয়ে গেল যে মরিয়মের ব্যাপারে কঠিন মিথ্যা দোষারোপ করে বসল।” (সূরা নিসা: ১৫৬)

অর্থাৎ হযরত ঈসা (আঃ)-এর পিতা না থাকা ঐতিহাসিক সত্য যা আল্লাহ তায়ালা নিজে ঘোষণা করছেন। হযরত ইয়াহইয়ার জন্মের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

قَالَ رَبِّ إِنِّي وَهَنَ الْعَظْمُ مِنّي وَاشْتَعَلَ الرَّأْسُ شَيْبًا وَلَمْ أَكُن ؟
بِدُعَائِكَ رَبِّ شَقِيًّا وَإِنِّي خِفْتُ الْمَوَالِيَ مِنْ وَرَاعِي وَكَانَتِ امْرَأَتِي
عَاقِرًا فَهَبْ لِي مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا – يَرِثُنِي وَيَرِثُ مِنْ آلِ يَعْقُوبَ في صلى
وَاجْعَلْهُ رَبِّ رَضِيًّا – يُزَكَرِيَّا إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَم وَ اسْمُهُ يَحْيَى لَا لَمْ يَجْعَلْ
لَّهُ مِنْ قَبْلُ سَمِيًّا – قَالَ رَبِّ أَتَى يَكُونُ لِي غُلَمُ وَكَانَتِ امْرَأَتِي عَاقِرًا
وَقَدْ بَلَغَتْ مِنَ الْكِبَرِ عِتِيًّا – قَالَ كَذَلِكَ ، قَالَ رَبِّكَ هُوَ عَلَى هَيِّنٌ
وَقَدْ خَلَقْتُكَ مِنْ قَبْلُ وَلَمْ تَكُ شَيْئًا –
و

“হযরত জাকারিয়া প্রার্থনা করলেন, হে আমার রব আমার হাড্ডিসমূহ দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং আমার চুলের শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়েছে কিন্তু আমি আপনার নিকট দোয়া করতে নিরাশ হইনি। আমি ভয় করছি আমার পর আমার দ্বীনী কাজ সম্পর্কে অথচ আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। অতএব আপনার পক্ষ থেকে আমাকে একজন অলী (ওয়ারিছ) দান করুন। আমাকে ও ইয়াকুব বংশকে একজন ওয়ারিশ দান করুন, এবং তাকে করুন সন্তুষ্টচিত্ত। হে জাকারিয়া, নিশ্চয়ই আমরা তোমার জন্য একজন ছেলে সন্তানের সুসংবাদ প্রদান করছি যার নাম হবে ইয়াহইয়া। ইতিপূর্বে আমি তার সমকক্ষ কাউকে পয়দা করিনি। তিনি বললেন, হে আমার রব কিভাবে আমার সন্তান হবে অথচ আমার স্ত্রী বন্ধ্যা আর আমি বার্ধক্যের চরম সীমায় পৌঁছে গেছি। তিনি বললেন, এভাবেই হবে। তোমার রব বলেন, আমার জন্য তা সহজ। নিশ্চয়ই ইতিপূর্বে আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি এবং তুমি কিছুই ছিলে না।” (সূরা মরিয়ম : ৪-৯)

অর্থাৎ আল্লাহর জন্য কোন বৃদ্ধার গর্ভে সন্তান জন্মদান আর স্বাভাবিকভাবে জন্মদান কোন ব্যাপার নয়, আল্লাহ ইচ্ছা করলে সবই পারেন। তাই সন্তানের জন্মদান একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা, তাই এ হলো আল্লাহর এক কুদরত।

কিন্তু মানুষ বড়ই নির্বোধ। সন্তান জন্মদানের জন্য মানুষ পীর ফকিরের ধর্ণা দেয়, শেরক করে। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

فَلَمَّا انْقَلَتْ دَعَوا اللَّهُ رَبَّهُمَا لَئِنْ أَتَيْتَنَا صَالِحًا لَنَكُونَنَّ مِنَ الشَّكِرِينَ
فلما أنهما صَالِحاً جَعَلَالَهُ شُرَكَاءَ فِيمَا الْهُمَا
يُشْرِكُونَ
ج فَتَعَلَى اللهُ عَمَّا

“এরপর যখন গর্ভ ভারী হল, তারা তাদের রবকে ডেকে বলল, আমাদেরকে নেক সন্তান দান করুন, আমরা হব শোকর গোজার। অতঃপর যখন তাদেরকে নেক সন্তান দিলাম, তখন আমরা তাদেরকে যা দিলাম তাতে তারা শেরক করল, অতএব তারা যে শেরক করল আল্লাহ তা থেকে মুক্ত।” (সূরা আরাফ : ১৮৯-১৯০)

সন্তানের কামনা

মানব মনে সন্তানের কামনা সহজাত। প্রতিটি বাপ-মা যথাসময়ে সন্তান কামনা করে। নির্দিষ্ট সময়ে সন্তানের অস্তিত্ব টের না পেলে বাপ-মা সন্তানের জন্য অস্থির হয়ে উঠে। ডাক্তার-কবিরাজ দেখানো হয়। মা তার কোল উজালা করা সন্তানের জন্য অহর্নিশ চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ে। শয়নে-স্বপনে কেবলমাত্র একটি শিশুর জন্য বেকারার হয়ে উঠে। আর মার কোলে যদি একটি শিশু আসে তবে সে কি খুশী। গর্ভধারণ ও প্রসবের যে কষ্ট ও বেদনা মুহূর্তেই সে সব ভুলে যায়।

অবশ্য আধুনিক ভোগবাদী চিন্তাধারা মানুষের সুখ-শান্তি ও ভোগের আকাঙ্ক্ষায় সন্তান পাওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও লক্ষ্য করা যায়। এসব দম্পতি স্বাস্থ্যহানী ও ভোগের সুযোগ কমে যাবে মনে করে সন্তান পেতে চায় না। বরং তারা তো বিয়েই করতে রাজী নয়। তারা চায় বিয়ে-বন্ধনহীন উচ্ছৃংখল জীবন। বিয়ের বন্ধন ছাড়াই তারা যৌন স্বাদ গ্রহণে আগ্রহী। জন্ম নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশলের কারণে এসব অবৈধ কাজ অনেক সহজ ও নিরাপদ হয়ে গেছে।

একজন মুসলমান মা’র নেক সন্তান কামনাই স্বাভাবিক। সে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করে। কত স্বপ্ন সে দেখে। মনের গহীনে কত বড় আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সে সন্তান লালন-পালন করে। যদি সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়, সে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আর যদি স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হয়, তার সন্তান হয় বিপথগামী, যদি সে নাফরমানিমূলক কাজ-কর্মে জড়িয়ে পড়ে, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার না করে, পিতা-মাতার খোঁজ-খবর না নেয় অথবা হয়ে পড়ে বিভ্রান্ত, অন্যায় ও অসৎ পথের যাত্রী, তখন বাপ-মায়ের দুঃখের আর সীমা-পরিসীমা থাকে না। সে ক্ষেত্রে দোষ কি শুধু সন্তানেরই, না কি পিতা-মাতাও এ ব্যাপারে দায়ী- তা পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। পিতা-মাতা কি সন্তানকে যথার্থ দয়া-স্নেহ-মমতা দিয়ে বড় করে তুলেছিলেন, যথার্থ শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন না কি এ ব্যাপারে বাপ-মায়ের ত্রুটি ছিল। বাপ-মার ত্রুটি থাকলে সন্তানকে এজন্য সম্পূর্ণ দায়ী করা চলে না।

হযরত উমর ফারুক (রাঃ)-র সময়কার এক ঘটনায় জানা যায়:

এক লোক হযরত উমর ফারুকের কাছে তার ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে বললেনঃ এ আমার ছেলে, কিন্তু আমার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তখন হযরত উমর (রাঃ) ছেলেটিকে বললেনঃ তুমি কি আল্লাহকে ভয় করনা? পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা বড়ই গোনাহের কাজ- তা কি তুমি জাননা? সন্তানের উপর পিতা-মাতার যে অনেক হক রয়েছে তা তুমি কিভাবে অস্বীকার করতে পার? ছেলেটি বললঃ হে আমীরুল মু’মিনীন, পিতা-মাতার উপরও কি সন্তানের কোন হক আছে? হযরত উমর (রাঃ) বললেন: নিশ্চয়ই এবং সেই হক হচ্ছে এই যে,

১। পিতা নিজে সৎ ও ভদ্র মেয়ে বিয়ে করবে, যেন তার সন্তানের মা এমন কোন নারী না হয়, যার দরুন সন্তানের সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হতে পারে বা লজ্জা অপমানের কারণ হতে পারে।
২। সন্তানের ভাল নাম রাখা,
৩। সন্তানকে আল্লাহর কিতাব ও দ্বীন ইসলাম শিক্ষা দেয়া।

তখন ছেলেটি বলল, আল্লাহর শপথ, আমার এ পিতা-মাতা আমার এ হকগুলোর একটিও আদায় করেন নি। তখন হযরত উমর (রাঃ) সেই লোকটিকে লক্ষ্য করে বললেন : তুমি বলছ তোমার ছেলে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, আসলে তো তোমার সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন করার আগে তুমিই তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছ। উঠো, এখান থেকে চলে যাও।”

অর্থাৎ পিতা-মাতা যদি চান যে সন্তান তার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নেক সন্তানরূপে গড়ে উঠুক, নাফরমানিমূলক কোন কাজ না করুক এবং পিতা-মাতার হক আদায় করুক, তাহলে সন্তানের প্রতি পিতামাতার হকসমূহ যথারীতি আদায় করতে হবে। পিতা মাতা উভয়েরই যদিও সন্তানের প্রতি হক রয়েছে কিন্তু মা-ই সন্তানের নিকট থাকে সদা-সর্বদা। মা-ই তাকে গর্ভে ধারণ করে, জন্মের পর বুকের দুধ খাওয়ায়, তাকে লালন-পালন করে, তাই মার নিকটই সন্তানের হক বেশী। মা যদি সন্তানকে আল্লাহর ওয়াস্তে ও দ্বীনের নিয়তে লালন-পালন করেন তবে এ সন্তান তার আখেরাতের নাজাতের ওসিলা হতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ

কোন স্ত্রীলোক যখন গর্ভধারণ করে তখন পুরো সময়টি সে এমন ছওয়াব ও প্রতিদান পায় যেমন একজন রোযাদার, রাত জাগরণকারী, আনুগত্যকারী ও আল্লাহর রাস্তায় জেহাদকারী বান্দাহ পেয়ে থাকে। এবং শিশু ভূমিষ্ঠ হবার সময়কার কষ্টের বিনিময়ে যে ছওয়াব ও প্রতিদান পায় তার অনুমান সৃষ্ট জীব করতে পারে না। সে ছওয়াব যে কি তা ধারণাই করা যায় না এবং যখন সে দুধ খাওয়ায় তখন দুধের প্রতিটি ঢোকে সে যে ছওয়াব পায় তা একজনকে জীবন দানের জন্য পাওয়া যায় এবং (নির্দিষ্ট সময়ে) যখন দুধ ছাড়ানো হয় তখন আল্লাহর ফেরেশতা তার কাঁধে হাত রেখে বলতে থাকে- এখন দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুতি নাও।” (মাতা-পিতা ও সন্তানের অধিকারঃ পৃষ্ঠা ৫৯)

মুসলমান মা যদি এ ধরনের নিয়ত করে সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব ও দুধপান করান তাহলে তার জন্য এ এক বিরাট সৌভাগ্য।

পিতা-মাতার দায়িত্ব ও সন্তানের অধিকার

প্রত্যেক বাপ-মায়ের বিশেষ করে মুসলমান বাপ-মায়ের ভাল করে জেনে নেয়া দরকার যে তাদের সন্তানের প্রতি তাদের কতটুকু অধিকার বা সন্তানের অধিকার কি কি? বাপ-মায়ের যথারীতি সে দায়িত্ব পালন করে সন্তানকে তার অধিকার আদায় করে দেয়া দরকার। পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের অধিকার কি তা আলোচনা করতে গেলে কয়েকটি পর্যায়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।

পর্যায়গুলো হলো যথাক্রমে:
১. স্বামী-স্ত্রীর মিলনের মাধ্যমে গর্ভধারণ থেকে সন্তান প্রসব পর্যন্ত;
২. সন্তান প্রসবের পর দুধপান পর্যন্ত;
৩. সন্তানের বুঝ হওয়া শুরু থেকে কৈশোর পর্যন্ত;
৪. কৈশোর থেকে যুবক হওয়া পর্যন্ত;

পিতা-মাতাকে এই চারটি পর্যায়ে সন্তানের বিভিন্ন ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমরা চারটি পর্যায়ে সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব আলোচনা করে দেখব এসব পর্যায়ে সন্তানের অধিকার কি কি?

প্রথম পর্যায়:

স্বামী-স্ত্রীর মিলনের মাধ্যমে গর্ভধারণ থেকে সন্তান প্রসব পর্যন্ত:

মা এবং শিশু উভয়ের জন্য এ সময়টি অত্যন্ত নাজুক ও জটিল। সন্তান গর্ভধারণে যেমন বাপ-মায়ের ভূমিকা থাকে তেমনি প্রসব পর্যন্ত মায়ের জীবনে থাকে নানা প্রকার ঝুঁকি ও বিপদাপদ। এ পর্যায়ে পিতামাতার দায়িত্ব যেমন তিনটি, সন্তানের অধিকারও তিনটি।

মায়ের গর্ভে আসা

(১) সন্তানের প্রথম অধিকার: মায়ের গর্ভে আসা

স্বামী-স্ত্রীর সকল মিলনেই গর্ভ সঞ্চার হয় না। মিলনের ফলে নির্দিষ্ট পুরুষ শুক্রকীট যদি স্ত্রী শুক্রকীটের সাথে মিলিত হতে পারে তাহলেই গর্ভ সঞ্চার হয়। এ ক্ষেত্রে যদি স্বামী-স্ত্রী এমন কোন পন্থা অবলম্বন করে যাতে এ দু’য়ের মিলনে বাধা সৃষ্টি হয় তাহলে গর্ভসঞ্চার হবে না। তাহলে সন্তানের অস্তিত্ব আসবে না। এ ক্ষেত্রে বর্তমান জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক পন্থা আবিস্কার করেছে যাতে সন্তানের জন্মেই বাধা সৃষ্টি করে জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বর্তমানে এ কাজকে জন্মনিরোধ, জন্ম শাসন এই সব নামেও অভিহিত করা হয়। মোটকথা সন্তানের বাপ-মা যদি সন্তানটিকে গর্ভে আসাকেই নস্যাৎ করে দিতে চায় তাহলে সে এ ধরনের বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। প্রাচীনকালেও এ ধারণা বলবৎ ছিল। তখন আজল ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মিলনের চরম মুহূর্তে স্বামী পুরুষাঙ্গকে স্ত্রী যোনীর বাইরে নিয়ে এসে বাইরে বীর্য ফেলত, যাতে সন্তানের অস্তিত্ব না আসে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অবশ্য বলেছেন, “তোমরা এরূপ কর বা না কর আল্লাহ যা সৃষ্টি করতে চান তা করবেনই।”

সন্তানের অধিকার স্বামী-স্ত্রীর মিলনের পর কোন বাধা-প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে নিরাপদে ও নিষ্কণ্টকভাবে গর্ভে আসার অধিকার। স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলন শুধুমাত্র আনন্দ ফুর্তির জন্য নয় বরং তা হতে হবে বংশধারা অব্যাহত রাখার জন্য। তাই সন্তানকে এ দুনিয়ার মুখ দেখার সুযোগ দিতে হবে। এ হলো তার জন্মের অধিকার।

গর্ভাবস্থায় মা’র সংযত চলাফেরা ও স্বাস্থ্যবিধি পালন

(২) দ্বিতীয় অধিকার: গর্ভাবস্থায় মা’র সংযত চলাফেরা ও স্বাস্থ্যবিধি পালন

সন্তান যখন গর্ভে আসে, প্রসব হওয়া পর্যন্ত সন্তানের অস্তিত্ব মা’র সাথে সম্পর্কিত। মা’র খাদ্য থেকে সে খাদ্য লাভ করে, মা’র স্বভাব-চরিত্র, চলাফেরা থেকে শিশুর চরিত্র গড়ে উঠে। তাই মা’কে –
(ক) এ সময়টাতে গর্ভস্থ সন্তানের খাতিরে সংযতভাবে, শরীয়ত মত পর্দা-পুশিদা করে চলাফেরা করতে হবে, দ্বীনী কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। মা যদি এ সময়ে বেপর্দা, বেহায়াভাবে চলাফেরা করে, নাচ-গানে মত্ত থাকে, সন্তানের উপরও তার প্রভাব পড়া স্বাভাবিক।
(খ) সন্তান গর্ভাবস্থায় থাকাকালে মা’কে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে যাতে গর্ভস্থ সন্তানের স্বাস্থ্য ঠিক থাকে।
(গ) গর্ভস্থ সন্তানের মা’কে পুষ্টিসম্মত ভাল খাবার খেতে হবে যাতে গর্ভস্থ সন্তানের স্বাস্থ্যও ভাল থাকে।

পিতা এসব ব্যাপারে সন্তানের মাকে সাহায্য করবে। মাকে শরীয়ত মত চলা, স্বাস্থ্যবিধি পালন ও ভাল খাবার খাওয়ার ব্যাপারে সন্তানের পিতা যথারীতি সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে বরং তার সাথে যে খরচপত্রের প্রয়োজন পিতাকে তা যোগাড় করে দিতে হবে।

গর্ভাবস্থায় সন্তানের এ অধিকারের প্রতি পিতা-মাতা উভয়েরই সজাগ ও যত্নশীল থাকা বাঞ্ছনীয়। এ প্রসংগে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বামী-স্ত্রী মিলনের সময় যে দোয়া শিখিয়েছেন তা লক্ষণীয়:

للهِ اللهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنِبِ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا بِسْمِ اللهِ اللهُمَّ

“আল্লাহর নামে, হে আল্লাহ আমাদেরকে শয়তান থেকে রক্ষা কর এবং আমাদেরকে যে সন্তান দিবে তাকেও শয়তান থেকে রক্ষা কর।”

এখানে আমাদেরকে শয়তান থেকে রক্ষা কর মানে সন্তান গর্ভাবস্থায় থাকাকালে বাপ-মা যেন শয়তানের কু-প্রভাব অর্থাৎ শয়তানী আচরণ থেকে বেঁচে থাকে এবং যে সন্তান আসছে সে শয়তানের কু-প্রভাব থেকে রক্ষা পায় অর্থাৎ তার জীবনেও শয়তানী আচার আচরণ দেখা না যায়। তাই গর্ভাবস্থায় মাকে বিশেষ করে শয়তানী আচার-আচরণ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।

এমনিভাবে মা নেক চিন্তা ও নেক পরিবেশে থাকলেই রাসূলুল্লাহর যে হাদীসে “যে কোন স্ত্রীলোক যখন গর্ভাবস্থায় থাকে তখন পুরো সময়টাই সে একজন রোযাদার, রাত জাগরণকারী, আনুগত্যকারী ও আল্লাহর রাস্তায় জেহাদকারী বান্দাহ যেরূপ ছওয়াব ও প্রতিদান পায় সেরূপ ছওয়াব ও প্রতিদান পেয়ে থাকে,” তা বাস্তবায়িত হতে পারে। তাই গর্ভস্থ সন্তানের দ্বিতীয় অধিকার হল মা’র শরীয়তসম্মত চলাফেরা ও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন।

যথাসময়ে নির্বিঘ্ন প্রসব ও দুনিয়ায় আগমন

(৩) তৃতীয় অধিকার : যথাসময়ে নির্বিঘ্ন প্রসব ও দুনিয়ায় আগমন

গর্ভস্থ সন্তানের গর্ভসঞ্চার মায়ের পেটে অবস্থানের জন্য নয় বরং নির্দিষ্ট সময়ে সে মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে দুনিয়ার আলো বাতাস দেখবে। এর জন্য মায়ের প্রসব বেদনা সহ্য করতে হয়। প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হয়। ধাত্রী বা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার সহযোগিতা নিতে হয়। প্রয়োজনে সিজারিয়ান করে মায়ের পেট কেটে সন্তান বের করে আনতে হয়। মাকে এর যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যথাসময়ে প্রসব হলে সন্তান মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে আসবে। তাই মায়ের পেট থেকে যথাসময়ে বেরিয়ে আসা গর্ভস্থ সন্তানের তৃতীয় অধিকার। এর জন্য মাকে সীমাহীন কষ্ট স্বীকার করতে হয়। এর জন্য মা যে ছওয়াব ও প্রতিদান পাবেন হাদীসের ভাষায় সৃষ্ট জীব তা অনুমানও করতে পারবে না, সে ছওয়াব ও প্রতিদানের ধারণাও করা যায় না।

গর্ভস্থ সন্তানের তৃতীয় অধিকার নির্বিঘ্নে মায়ের পেট থেকে দুনিয়ার আলো-বাতাসে বেরিয়ে আসা। অবশ্য মহান আল্লাহই তার কুদরতে এ ব্যবস্থা করে থাকেন। কিন্তু এর জন্য মাকে যে কষ্ট স্বীকার করতে হয়, যে ধৈর্য ধারণ করতে হয়, যে সব মানবীয় উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হয়, তা যেন যথারীতি করা হয় তা মা-বাবার দায়িত্ব।

দ্বিতীয় পর্যায়:

সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর দুই-তিন বছর সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার করণীয় বা এ সময়ে সন্তানের অধিকার:

বুকের দুধ পান

(৪) সন্তানের চতুর্থ অধিকার: বুকের দুধ পান

ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সন্তানের প্রথম অধিকার মায়ের স্তনের দুধ খাওয়া। সন্তানের পিতা যদি ইতিমধ্যে সন্তানের মাকে তালাকও প্রদান করে থাকে তবুও সন্তানকে দুই বছর দুধ খাওয়াতে হবে অথবা সন্তানের পিতা অন্য কোন স্ত্রীলোককেও সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর জন্য নিয়োজিত করতে পারেন। সূরা বাকারার ২৩৩ নম্বর আয়াতে এ প্রসংগে বিস্তারিত বলা হয়েছেঃ

وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَدَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يَتِمَّ الرَّضَاعَةَ ….. وَإِنْ أَرَدْتُمْ أَنْ تَسْتَرْضَعُوا أَوْلَدَكُمْ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ

“যে দুগ্ধপান পূর্ণ করতে চায় তার জন্য মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করাবে। আর যদি তোমরা তোমাদের সন্তানদিগকে অন্য কোন ধাত্রীর দুধ পান করাতে চাও, তাতেও কোন গোনাহ নেই।”

এ হলো তালাকপ্রাপ্তা মায়েদের ব্যাপারে আল্লাহর কথা। সাধারণ মায়েদের ব্যাপারে আল্লাহ অবশ্য কোন কথা বলেননি। কেননা মায়ের দুধ সন্তান খাবে এটা তার স্বাভাবিক পাওনা, তাই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদি পিতা মাকে তালাক দিয়ে দেয় তবুও সন্তানের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে পিতাকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আধুনিক সমাজ পরিবেশে মায়েরা সন্তানদেরকে বুকের দুধ খাওয়াতে আগ্রহী নয়। এ জন্য বিকল্প হিসাবে গরুর দুধ ও অন্যান্য কৃত্রিম দুধের আবিষ্কার হয়েছে। শিশুর জন্য গরুর দুধ বা অন্য যে কোন কৃত্রিম দুধ যে মায়ের দুধের বিকল্প হতে পারেনা তা আজ বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, মায়ের দুধের প্রথম ফোঁটাই শিশুর বহু রোগ নিরোধক। তাছাড়া এমনিতেও মায়ের দুধ শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য যে সব উপাদান যে পরিমাণে দরকার সে পরিমাণে রয়েছে। যাতে মায়ের দুধে শিশুর মস্তিষ্কের উৎকর্ষতা সাধন শরীরের বৃদ্ধি ও রোগ নিরোধের ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা রয়েছে। তাই শিশুকে মায়ের দুধ পান করানোর মধ্যে রয়েছে বিরাট কল্যাণ ও ফায়দা। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “মা যখন শিশুকে দুধ খাওয়ায় তখন তার প্রতি ঢোকে এ পরিমাণ ছওয়াব পাওয়া যায় যা একজনকে জীবন দান করলে পাওয়া যায়।” তাই মায়ের দুধ খাওয়া সন্তানের অধিকার।

পিতা-মাতা কর্তৃক শরীয়তের কতিপয় বিধানের অনুসরণ

(৫) পঞ্চম অধিকার : পিতা-মাতা কর্তৃক শরীয়তের কতিপয় বিধানের অনুসরণ

(ক) শিশুর জন্মের পরপরই শিশুর কানে আজানের আওয়াজ পৌঁছাতে হবে। জন্মের পরপরই আজানের আওয়াজ শোনানোর মাধ্যমে শিশুর মনে দ্বীনের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিই যে উদ্দেশ্য তা স্পষ্টতই বুঝা যায়।
(খ) ভালো নাম রাখা: শিশুর ভালো একটি নাম রাখতে হবে। শিশুর নাম যেন অর্থপূর্ণ হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আল্লাহর জাত ও ছেফাত সম্পর্কিত নামই উত্তম। তাছাড়া নবীদের নাম রাখা যেতে পারে। সাহাবায়ে কেরাম বা মিল্লাতের স্মরণীয় ব্যক্তিদের নামেও নাম রাখা যেতে পারে। মোটকথা নাম যেন সুন্দর ও অর্থপূর্ণ হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ ব্যক্তির উপর নামের প্রভাব অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দর নামে আবেগ অনুভূতি সৃষ্টি হয়। খারাপ নাম নিজের কাছেও খারাপ লাগে, অন্যের কাছেও। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সুন্দর নাম শুনে খুশী হতেন আবার খারাপ নাম শুনে মলিন হতেন। তিনি বহু লোকের এবং বহু এলাকার নাম পরিবর্তন করে রাখতেন। যেমন একজন বলল, তার নাম আবদুল উজ্জা, রাসূল (সাঃ) তার নাম পরিবর্তন করে রাখলেন আব্দুর রহমান। তৌহীদি ধ্যান ধারণায় আঘাত লাগে, গর্ব, অহংকার প্রকাশ পায় এবং অনৈসলামী চিন্তা ধারণার প্রকাশ ঘটায় এমন নাম রাখা উচিৎ নয়। কেয়ামতের দিন নিজের নাম ও পিতার নাম ধরে ডাকা হবে। তাই ভাল নাম হওয়া দরকার। আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় নাম সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে: হযরত আবু ওয়াহাব নবী করীম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন: তিনি বলেছেন, নবীদের নামে নাম রাখো এবং আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় নাম হলো আব্দুল্লাহ এবং আব্দুর রহমান। প্রিয় নাম হলো হারেছ এবং হাম্মাম এবং অত্যন্ত অপছন্দনীয় নাম হলো হারব ও মুররাহ। (আবু দাউদ ও নাসায়ী)

(গ) আকীকা করা: আকীকা করা একটি সুন্নত অনুষ্ঠান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার সন্তানদের আকীকা করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত হাসানের পক্ষ থেকে আকীকায় একটি বকরী জবেহ করেছিলেন। এটা কোন ফরজ এবাদত নয়। সচ্ছল ব্যক্তিদের জন্য এ অনুষ্ঠান করা উত্তম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:

كُلُّ غُلَامُ رَهِينَ بِعَقِيقَتِهِ تَذْبَحُ عَنْهُ يَوْمَ سَابْعِهِ وَيُسَمًّى فِيْهِ وَيَخْلُقُ رأسه – جامع ترمذى

“প্রত্যেক শিশুই আকীকার বিনিময়ে রেহেন পেয়েছে। সপ্তম দিনে তার তরফ থেকে পশু জবেহ করতে হবে। সেই দিনই তার নাম রাখতে হবে এবং তার মাথার চুল কাটতে হবে।” (তিরমিযী)

আকীকা সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে অথবা চতুর্দশ দিনে অথবা একুশতম দিনে বা তার পরেও করা যেতে পারে। ছেলের জন্য দু’টি পশু এবং মেয়ের জন্য একটি পশু জবেহ করা সুন্নত। ছেলের জন্য একটিও করা যায়।

হযরত আলী (রাঃ) এর বর্ণনা থেকে জানা যায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত হাসানের জন্মের পর সপ্তম দিনে একটি বকরী জবেহ করে আকীকা দিয়ে হযরত ফাতেমাকে (রাঃ) বলেছিলেন তার মাথার চুল কেটে সমপরিমাণ রৌপ্য ছদকা দিতে।

আকীকা একটি সুন্নত অনুষ্ঠান। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। বিরাট ধুমধাম করে এ অনুষ্ঠান করা, অপচয় ও বিলাসিতামূলক অনুষ্ঠান করা জায়েয নয়। সম্ভব হলে নিজের সামর্থ্যানুযায়ী এ অনুষ্ঠান করতে হবে।

(ঘ) খতনা: খতনা একটি মুসলমানী রীতি ও নবীদের সুন্নত। মুসলিম সমাজে এ কাজকে মুসলমানীও বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: (মুসলমানের) ফিতরাতের বা সুন্দর স্বভাবের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি বিষয়: খতনা করা, নাভির নীচের লোম পরিষ্কার করা, বগলের চুল উঠানো, মোচ কাটা ও নখ কাটা। এগুলো নবীদের সুন্নত এবং প্রত্যেক নবীর শরীয়তেই এগুলো যথারীতি চালু ছিল।

খতনা শিশুকালেই করা উচিৎ। বেশী বয়সে খতনা করলে একেত চামড়া মোটা হয়ে যাওয়ার ফলে কষ্ট বেশী হতে পারে, ছেলের লজ্জার কারণও হতে পারে। তাই সাত বছরের মধ্যে খতনা করে ফেলা দরকার।

খতনার অনুষ্ঠানকে বিরাট জাঁকজমকপূর্ণ করার কোন প্রয়োজন নেই। সাধারণভাবে নিকটাত্মীয়দেরকে দাওয়াত দিয়ে খানাপিনার ব্যবস্থা করা দোষণীয় নয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময় এ জাতীয় কোন অনুষ্ঠান চালু ছিল না। তাই একে কোন প্রথা হিসাবে চালু করা যাবে না। বরং প্রথা হিসাবে যাতে চালু না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

সন্তানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার তিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয় যা প্রকারান্তরে সন্তানের অধিকারে পরিণত হয়ে পড়ে:

ক. স্নেহ- মায়া-মমতা ও দরদ দিয়ে সন্তান প্রতিপালন;
খ. জন্ম থেকে নিয়ে উপার্জনক্ষম হওয়া পর্যন্ত সন্তানের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন।
গ. সন্তানের প্রতি সদাচরণ।

স্নেহ-মায়া-মমতা ও দরদ লাভ

৬. সন্তানের ষষ্ঠ অধিকার: স্নেহ-মায়া-মমতা ও দরদ লাভ

পিতা-মাতা তাদের পূর্ণ স্নেহ-মায়া-মমতা ও দরদ দিয়ে সন্তানের প্রতিপালন করবে। আসলে দীর্ঘদিনের কষ্ট স্বীকার করে গর্ভধারণ করে কঠিন প্রসব বেদনাকে সহ্য করে মা যখন তার নয়নমনি সন্তানকে কোলে তুলে নেয় সে তখন সকল বেদনা নিমিষে ভুলে যায়। সন্তানের সকল অত্যাচার, তার সময়ে-অসময়ে পেশাব-পায়খানা মাকে বিরক্ত, রাগান্বিত ও ক্ষুন্ন করে না বরং এসবকে সে হাসিমুখে সহ্য করে যায়। সন্তানের কোন অসুখ-বিসুখ হলে মা আশংকাগ্রস্ত ও চিন্তিত হয়ে পড়ে, আল্লাহর নিকট বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করার জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া করে। প্রকৃতপক্ষে মায়ের স্নেহ মায়া-মমতা ও দরদভরা সেবা শুশ্রুষার কোন বিকল্প হতে পারে না। মা তার শ্রম ও পরিশ্রম দিয়ে তিলে তিলে সন্তানকে বড় করে তোলে।

সন্তানকে স্নেহ-মমতা করার ক্ষেত্রে পিতাও যথার্থ ভূমিকা রেখে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শিশুদেরকে খুবই আদর ও স্নেহ করতেন। তিনি তার নাতি হযরত হাসান-হোসাইনকে নজীরবিহীন ভালবাসতেন, হযরত যয়নবের এক কন্যাকেও তিনি খুবই ভালবাসতেন। নিজের সন্তান ইব্রাহীমের মৃত্যুতে তার চোখ দিয়ে পানির ফোয়ারা ছুটেছিল।

সন্তানের ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ সন্তানকে আদর করে চুম্বন করা একটি সাধারণ রীতি। রাসূলুল্লাহর জীবনেও তার নিদর্শন দেখা যায়ঃ “হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেছেন, নবী করীম (সাঃ) নাতি হযরত হাসান ইবনে আলীকে (রাঃ) চুম্বন দিলেন এবং আদর করলেন। সে সময় আকরা বিন হারিসও সেখানে বসেছিলেন। বলতে লাগলেন, আমার তো দশটি সন্তান কিন্তু আমি তো কখনও আমার কোন সন্তানকে আদর করিনি। নবী করীম (সাঃ) তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, যে রহম করে না, আল্লাহও তার প্রতি রহম করেন না।”

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কন্যা ফাতেমাকে এত ভালবাসতেন যে কোন সফরে যাওয়ার কালে সর্বশেষে তার সাথে সাক্ষাত করতেন, আবার সফর থেকে ফিরে এসে মসজিদে নামায আদায় করে প্রথমেই তার ঘরে যেতেন। হযরত হাসান, হোসাইন ও হযরত ওসামা বিন যায়েদকে অত্যন্ত ভালবাসতেন, তাদেরকে কোলে তুলে নিতেন, চুমো দিতেন ও বুকে লাগাতেন এবং বলতেন, হে আল্লাহ এদের উপর রহম করো, আমি এদের প্রতি দয়া দেখিয়ে থাকি। তিনি ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ তোহফা হিসাবে প্রাপ্ত হার যয়নব কন্যা উমামাহকে নিজ হাতে গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন।

উপার্জনক্ষম হওয়া পর্যন্ত ব্যয়ভার বহন

৭. সন্তানের সপ্তম অধিকার: উপার্জনক্ষম হওয়া পর্যন্ত ব্যয়ভার বহন

শিশুর জন্ম হওয়ার পর থেকে সে উপার্জনক্ষম হওয়া পর্যন্ত তার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা পিতার দায়িত্ব। এ হলো সন্তানের অধিকার। প্রত্যেক পিতাকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী সন্তানের ব্যয়ভার বহন করতে হবে। কেবলমাত্র আইনের মাধ্যমে এ কাজ তো বেশ কঠিনই হতো যদি না আল্লাহ তায়ালা পিতার অন্তরে সন্তানের জন্য খরচ করার আবেগ সৃষ্টি করে দিতেন। তাই দেখা যায় পিতা কঠোর পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে আয়-উপার্জন করেন তা দ্বিধাহীন চিত্তে সন্তানের জন্য খরচ করে থাকেন এবং সন্তানের হাসিমুখ দেখে প্রশান্ত চিত্তে তা মেনে নেন। অবশ্য নবী করীম (সাঃ) ঘোষণা করেছেন:

إِذَ انْفَقَ الرَّجُلُ عَلَى أَهْلِهِ نَفَقَةٌ يَحْتَسَبُهَا فَهِيَ لَهُ صَدَقَةٌ

“যখন কোন ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে হিসাব-নিকাশের সাথে পরিবারের জন্য কোন টাকা খরচ করে তখন তা তার পরিবারের জন্য ছদকা হিসাবে গণ্য হয়।” (বুখারী ও মুসলিম)

এ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য যে, এমনকি তালাকপ্রাপ্তা মাকে দিয়ে যদি সন্তানকে দুধ খাওয়ানো হয় তবে মাকে যথারীতি দুধপান করানোর সময় পর্যন্ত খোরপোষ প্রদান করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَالْوَالِدَتْ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرضاعَةَ وَعَلَى الْمَوْلُودِلَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ لا تكلف نفس الا وسعها ، لا تضار والدة ؟ بولدها ولا مولود له بولده ق وعلى الوارث مثل ذلك فان ارادا فصالا عن تراض منهما وتشاور فلا جناح عليهما

“(সন্তানের) পিতার দায়িত্ব হলো ন্যায়ভাবে স্তন্যদানকারীর খোরপোষের ব্যবস্থা করা, কাউকে তার সাধ্যের অতীত কষ্ট প্রদান করা যাবে না, না মাকে তার সন্তানের জন্য কষ্ট দেয়া যাবে, না পিতাকে তার সন্তানের জন্য কষ্ট প্রদান করা যাবে। অভিভাবকেরও অনুরূপ দায়িত্ব।”

তেমনিভাবে ধাত্রী দ্বারা দুধপান করালে “যদি তোমরা ন্যায়ভাবে যা দেওয়া সাব্যস্ত করেছ তা দিয়ে সম্মত করে দাও তাহলে তাতে তোমাদের কোন দোষ নেই।” (সূরা বাকারা: ২৩৩)

এ আয়াত থেকে জানা গেল সন্তানের পিতাকে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে দিয়ে বা অন্য কোন ধাত্রীকে দিয়ে সন্তানকে দুধ খাওয়ালে সে জন্য পিতাকে খরচ দিতে হবে।

সন্তানের ব্যয়ভার বহন করা শুধুমাত্র আবেগ ও সন্তানের প্রতি ভালবাসার দাবীই নয় বরং এ এক দ্বীনী দায়িত্ব। মুসলমান পিতা এ কাজের জন্য আখেরাতে বিরাট পুরষ্কার পাবেন এ বিশ্বাস পোষণ করে। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি হালালভাবে দুনিয়াকে তালাশ করলো এবং পরিবার-পরিজনের রুজীর ব্যবস্থা করল এবং নিজের প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণ করলো সে কেয়ামতে আল্লাহর সাথে এমনভাবে মিলিত হবে যেন তার চেহারা পুর্ণিমার চাঁদের মত ঝলমল করছে।”

হাদীসে এও বলা হয়েছে, মানুষ দান খয়রাতে যে খরচই করুক না কেন তার উত্তম খরচ হবে পরিবারের জন্য খরচ। হাদীসে এও বলা হয়েছে যে, সন্তানের ব্যয়ভার বহনে অবহেলা করা কঠিন গুনাহ।

“নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, মানুষের গুনাহগার হওয়ার জন্য এই যথেষ্ট যে সে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে যাদের সে খানা-পিনা করায়।” (রিয়াদুস সালেহীন, আবু দাউদ)

মোটকথা, সন্তানের জন্ম থেকে বালেগ হওয়া পর্যন্ত তার যাবতীয় খরচ বহনের দায়িত্ব পিতার। আল্লাহ তায়ালা এ জন্য পিতা-মাতার অন্তরে সন্তানের জন্য গভীর মহব্বত ও দরদ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এছাড়া এ খরচকে বিরাট সওয়াবের কাজ বলেও হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ ক্ষেত্রে সন্তানের জন্য খরচ করতে কোরআনে বলা হয়েছে। সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষা এবং বিয়ে-সাদীর জন্য পিতা-মাতাকে খরচ করতে হয়।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “উত্তম ছদকা তা যার পরও সচ্ছলতা অবশিষ্ট থাকে এবং সর্বপ্রথম তাদের উপর খরচ করো যাদের ব্যয়ভার তোমার উপর অর্পণ করা হয়েছে।” (বুখারী)

সদাচরণ করা ও ইনসাফ কায়েম

৮. সন্তানের অষ্টম অধিকার: সদাচরণ করা ও ইনসাফ কায়েম

সন্তানের প্রতি সদাচরণ পিতা-মাতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান যতই বিগড়ে যাক, নাফরমানিমূলক আচরণ করুক, সে যতই বিপথগামী হয়ে পড়ুক না কেন তাকে সদুপদেশ দিয়ে বুঝাতে হবে। কারণ আপনার সন্তান তো আপনারই, তাকে ফিরিয়ে দেবার কোন ব্যবস্থা নেই। তার সাথে দুর্ব্যবহার করলে তাকে আপনার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হবে। সে আরো খারাপ হয়ে যাবে। সন্তান যদি শত্রুতায়ও লিপ্ত হয়ে পড়ে তবুও তাকে ক্ষমা করে সংশোধনের প্রচেষ্টা জারী রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। সূরা তাগাবুন এ বলা হয়েছে:

إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلَدِكُمْ عَدُوًّا لَكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ وَإِنْ تَعْفُوا وَتَصْفَحُوا وَتَغْفِرُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

“নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রী-পরিজন ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে তোমাদের কতক শত্রু রয়েছে। তাই তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকো। আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করো, সংশোধন করো, অনুকম্পা প্রদর্শন করো তাহলে আল্লাহও ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” (সূরা তাগাবুন: ১৪)
সন্তান যদি শত্রুতার ভূমিকায়ও চলে যায় তবুও আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে রাগ করে বাড়ী থেকে বের করে দিতে বা তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে সুপারিশ করেননি, সাবধান ও সতর্ক হতে বলেছেন।

সন্তানদেরকে কথায় কথায় রাগ করা, ধমকানো, গালাগালি করা ও কঠোরতা অবলম্বন করা সংশোধনের পথ নয় বরং এতে সন্তানের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়, সন্তান পিতা-মাতা থেকে দূরে সরে যায়, বাড়ী থেকে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, খারাপ পরিবেশের সাথে মিশে আরো খারাপ হয়ে যায়।

সন্তান চায় স্নেহ-মায়া-মমতা, হামদরদী, সাহায্য ও পথপ্রদর্শন। এর বদলে ধমকান ও বিরক্তি প্রকাশ পেলে সন্তান খুবই মনোকষ্ট পায়। ফলে অন্য কারো কাছে স্নেহ- মমতা ও হামদরদী পেলে তার কাছেই সে আত্মসমর্পণ করে। এভাবে হয়ত কেউ বিপথগামী করে ফেলতে পারে।

আরবের মশহুর সর্দার আহনাফ সন্তানদের ব্যাপারে বলেছেন:

“সন্তান আমাদের অন্তরের আকাঙ্ক্ষার ফল এবং কোমরের শক্তি। আমরা তার জন্য জমিনের মত, যা অত্যন্ত নরম ও সম্পূর্ণ ক্ষতিহীন। আমাদের অস্তিত্ব তার জন্য সেই আকাশের মত যা তার উপর ছায়া করে আছে। আমরা তার সাহায্যেই বড় বড় কাজের হিম্মত করি। অতএব সন্তান যদি আপনার নিকট কিছু দাবী করে তাহলে হৃষ্টচিত্তে তা পূরণ করুন। যদি সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয় তাহলে তার দুশ্চিন্তা দূর করুন’। আপনি দেখবেন সে আপনাকে ভালবাসবে। আপনার পিতৃসুলভ প্রচেষ্টাকে পছন্দ করবে। আপনি কখনো তার অসহ্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবেন না, যাতে সে আপনার প্রতি বিরক্ত হবে, আপনার মৃত্যু কামনা করবে এবং আপনার নিকট আসতে ঘৃনা করবে।” (পিতা-মাতা ও সন্তানের অধিকারঃ ইউসুফ ইসলাহী, পৃঃ ১৩০)

সন্তানের প্রতি সদাচরণের আরেকটি দিক হলো সকল সন্তানের প্রতি সমব্যবহার, কোন রকম বৈষম্য না করা। শিক্ষা-দীক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রেও সমতা রাখার চেষ্টা করা উচিত। তবে মেধা ও আগ্রহের কারণে এক্ষেত্রে বৈষম্য ও বিভিন্নতা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বিষয়-বিত্ত দেয়ার ক্ষেত্রে কোনরূপ বৈষম্য করা ইনসাফের খেলাফ। এ ব্যাপারে ইনসাফ কায়েম করতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময়কার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

নুমান বিন বশীর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতা আমাকে একটি তোহফা দিয়েছিলেন। এতে (আমার মা) উমরাহ বিনতে রাওয়াহা বললেন, তুমি যদি এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কে সাক্ষী বানাও তাহলে আমি রাজী হব। অতঃপর আমার পিতা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট এলেন এবং বললেন: উমরাহ বিনতে রাওয়াহার পক্ষ থেকে আমার যে পুত্র রয়েছে তাকে আমি একটি তোহফা দিয়েছি। এতে উমরাহ আপনাকে সাক্ষী রাখার দাবী জানিয়েছে। একথা শুনে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি কি তোমার সকল সন্তানকেই এ ধরণের তোহফা দিয়েছ? তিনি বললেন, “না, সবাইকে তো দেইনি।” অতঃপর নবী (সাঃ) বললেন, “আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজের সন্তাদের মধ্যে ইনসাফ কর।” অতঃপর তিনি ফিরে গেলেন এবং নিজের তোহফা ফেরত নিলেন। অন্য রেওয়ায়েতে আছে রাসূল (সাঃ) বললেনঃ “আমি যুলুমের উপর সাক্ষী হই না। অন্য রেওয়ায়েতে আছে তিনি বশীর (রাঃ) কে বললেনঃ “তোমার সকল সন্তান তোমার প্রতি সমান আচরণ করুক, এটা তুমি চাও?” হযরত বশীর (রাঃ) বললেন, “কেন নয়।” “তাহলে তুমি এ ধরনের করো না।” (বুখারী ও মুসলিম)

উপরোক্ত হাদীস থেকে জানা গেল অন্য সন্তানদেরকে না দিয়ে কোন এক সন্তানকে কিছু তোহফা দেয়া বা অন্য স্ত্রীর সন্তানকে না দিয়ে এক স্ত্রীর সন্তানকে কিছু দেয়াকে নবী নিষেধ করেছেন, একে জুলুম আখ্যায়িত করেছেন, ইনসাফের খেলাফ বলেছেন। তাই সন্তানদেরকে কিছু দেয়ার ব্যাপারে ইনসাফ করতে হবে। এমনকি কন্যা সন্তান ও পুত্র সন্তানের মধ্যেও কোন পার্থক্য করা যাবে না।

সন্তান পুত্র হোক বা কন্যা হোক সবই আপনার সন্তান। সন্তান হলো আল্লাহর দান। এ দানকে খুশী মনে গ্রহণ করা উচিৎ। এ ক্ষেত্রে পুত্র ও কন্যা সন্তানের মধ্যে পার্থক্য করা সমীচীন নয়। এ প্রসংগে রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন:

“যার ঘরে কন্যা সন্তান হলো, সে তাকে (জাহেলী যুগের মত) জীবিত দাফন করলো না, তাকে অপাংক্তেয় মনে করলো না এবং ছেলেদেরকে তার উপর প্রাধান্য দিল না, তাহলে এ ধরনের লোককে আল্লাহ পাক বেহেশতে প্রবেশ করাবেন।” (আবু দাউদ-ইবনে আব্বাছ)
বর্তমান সমাজে জাহেলী যুগের মত জীবিত কন্যা সন্তান দাফন করার রেওয়াজ নেই কিন্তু কন্যা সন্তানকে অপাংক্তেয় মনে করা বা পুত্র সন্তানকে কন্যা সন্তানের উপর প্রাধান্য দেয়ার রেওয়াজ চালু আছে। অথচ ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় তা গ্রহণযোগ্য নয়। পুত্র ও কন্যা উভয় সন্তানকে সমান প্রাধান্য দিতে হবে। একই ধরনের স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে তাদেরকে লালন পালন করতে হবে। তাদের পেছনে একই ধরনের খরচপত্র করতে হবে। শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রেও তারতম্য করা ঠিক নয় বরং যার যার মেধানুযায়ী তাকে সুযোগ দেয়া প্রয়োজন।

সন্তানকে যথার্থ শিক্ষাদান

৯. সন্তানের নবম অধিকার: সন্তানকে যথার্থ শিক্ষাদান

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের হক তিনটি বিষয়ে: যখন সন্তান জন্ম গ্রহণ করে তার ভাল নাম রাখতে হবে, বুদ্ধি-জ্ঞান হলে কিতাব তথা দ্বীনী ইলম শিক্ষা দিতে হবে এবং পূর্ণ বয়স্ক হলে, তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।” (পরিবার ও পারিবারিক জীবন, মাওলানা আব্দুর রহীম, পৃষ্ঠা-৩৬৫)

উপরোক্ত হাদীসের আলোকে সন্তানের দ্বীনী শিক্ষা দান পিতা-মাতার দায়িত্ব। সন্তানের জ্ঞান-বুদ্ধি কিছুটা হলেই সন্তানকে দ্বীনী শিক্ষায় নিয়োজিত করা উচিত। আমাদের দেশে ফুরকানিয়া শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবশ্য এর যথাযথ ব্যবস্থা নেই। দাখিল মাদ্রাসায় এর কিছুটা ব্যবস্থা রয়েছে। যেভাবেই হোক কোরআনের ছহীহ তেলাওয়াত ও কোরআন বুঝার ব্যবস্থা করা পিতা-মাতার দায়িত্ব।

সন্তানকে জন্মের পর থেকেই শিক্ষার দিকে খেয়াল দিতে হবে। মায়ের বুকের দুধ খাওয়া শিক্ষা, বসতে-হাঁটতে শিক্ষা, ডান হাতে খাওয়া শিক্ষা ইত্যাদি সাধারণ শিক্ষা সন্তান মায়ের কাছ থেকেই শেখে। আল্লাহ তায়ালা সে কথা বলেছেন:

وَاللَّهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

“আল্লাহ তোমাদেরকে মায়ের পেট থেকে এমন অবস্থায় বের করে আনেন যে তোমরা কিছুই জানতে না। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের কান, চোখ ও অন্তর দিয়েছেন যেন তোমরা হও শোকর-গোজার।” (সূরা নহল: ৭৮)

অর্থাৎ শিশু মায়ের পেট থেকে কিছুই না শেখা অবস্থায় বের হয়ে আসে, অতঃপর তার শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে শিখতে শুরু করে ও অন্তর দিয়ে তা আত্মস্থ করে।
সন্তানের বৈষয়িক শিক্ষার ব্যবস্থা করাও পিতা-মাতার দায়িত্ব। সন্তান যাতে ‘পেশাগত যোগ্যতা অর্জনের উপযুক্ত হয়, উপার্জনক্ষম হয় তার ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে। যার যেটাতে আগ্রহ দেখা যায় সে ব্যাপারে তাকে আরো যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ দেয়া দরকার। এ ব্যাপারে পিতামাতা তাদের সামর্থানুযায়ী আর্থিক সহযোগিতা না করলে সন্তান নিজের পায়ে হয়ত দাঁড়াতে সক্ষম হবে না। তাই সাধ্যমত এ ব্যাপারে আর্থিক সহযোগিতা করতে হবে।

চরিত্র গঠন, নৈতিকতা শিক্ষাদান ও নামাযে অভ্যস্ত করে তোলা

১০. সন্তানের দশম অধিকার: চরিত্র গঠন, নৈতিকতা শিক্ষাদান ও নামাযে অভ্যস্ত করে তোলা

সন্তানের চরিত্র গঠনে পিতা-মাতাকে কুশলী ভূমিকা পালন করতে হবে। এজন্য অল্প বয়স থেকে সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দান করতে হবে। মুসলমান ছেলে-মেয়েদেরকে সাত বছর বয়স থেকে নামাযের প্রতি তাকিদ দিতে হবে, দশ বছর বয়সে তো নামাযের জন্য প্রয়োজনে মারতে নির্দেশ দিয়েছেন নবী করীম (সাঃ)।

আসলে সন্তানের চরিত্র গঠন ও নৈতিক মানোন্নয়ন একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক কাজ। অত্যন্ত হেকমতের সাথে পিতামাতাকে এ দায়িত্ব পালন করতে হয়। শিশুমনে মায়ের ভাল ভাল কথা, সৎ উপদেশ, আম্বিয়ায়ে কেরামের ভাল ভাল গল্প কাহিনী রেখাপাত করে থাকে যা তার চরিত্র গঠনে সহায়তা করে থাকে। আবার খারাপ ছেলে ও বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে অনেক সন্তান নষ্ট ও বিপথগামী হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে হেকমতের সাথে উক্ত খারাপ পরিবেশ থেকে সন্তানকে হেফাজত করতে হবে। অন্যথায় নৈতিক অধঃপতনের সমূহ আশংকা রয়েছে।

সন্তানকে নামাযের পাবন্দ বানানোরও যথাযথ কোশেশ করে যেতে হবে। নামাযের জন্য তাকিদ অব্যাহত রাখতে হবে। নামায শিক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। রাসূলের (সাঃ) হেদায়াত অনুযায়ী সাত বছর থেকে নামাযের জন্য তাকিদ প্রদান করতে হবে, দশ বছর থেকে শাসন করতে হবে। নামাযের সাথে সাথে রমজানের রোযার জন্যও তাকিদ প্রদান করতে হবে। সন্তানকে নেক সন্তানরূপে গড়ে তোলার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা সাধনা করে যেতে হবে।

সন্তানদেরকে নিয়ে মাঝে মধ্যে পারিবারিক বৈঠক করে সৎ উপদেশ দান ও তাদের আমলের খোঁজ-খবর নিলে সন্তানদের সংশোধনের ব্যবস্থা হতে পারে। সন্তানদেরকে কেরআন-হাদীস ও দ্বীনী বইপত্র পড়তে দিতে হবে। ভাল ভাল সাহিত্য- সাময়িকী পড়তে দিতে হবে। এভাবে দ্বীনী পরিবেশে তাকে গড়ে তুলতে পারলেই সন্তানকে নেক সন্তান করা যেতে পারে। তার শিক্ষা জীবনেও যেন সে লাইনচ্যুত না হয়ে যায় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এভাবে নিজের সন্তানকে চরিত্রবান সন্তানরূপে গড়ে তোলা পিতামাতার পবিত্র দায়িত্ব।

জীবনোদ্দেশ্য নির্ধারণ ও দ্বীন কায়েমের আন্দোলনে শরীক করে দেয়া

১১. সন্তানের একাদশ অধিকার: জীবনোদ্দেশ্য নির্ধারণ ও দ্বীন কায়েমের আন্দোলনে শরীক করে দেয়া

সন্তানের ইহকালীন জীবনের ইতি একদিন হবে। তাকে আখেরাতে আল্লাহর সামনে হিসাব-নিকাশ দিয়ে আখেরাতের শাস্তি অথবা পুরষ্কার পেতে হবে। পিতা-মাতার যেমন এর জন্য প্রস্তুতি নেয়া দরকার, সন্তানকেও এর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সৎভাবে জীবন যাপন, দ্বীনী এবাদত যথাযথভাবে পালন ও দ্বীন কায়েমের আন্দোলনে শরীক হওয়া। সন্তানকে এভাবে গড়ে তোলার স্বার্থে তাকে দ্বীন কায়েমের আন্দোলনে শরীক করে দিতে হবে। কারণ তার জীবনের উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তার জীবন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে তা পিতামাতার জন্য হবে অতীব দুঃখের কারণ। নিজেদের জীবনকে যেমন সাফল্যমণ্ডিত করার সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে, নিজের সন্তানের জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করারও তেমনি চূড়ান্ত চেষ্টা চালাতে হবে। জীবনের উদ্দেশ্য ধনৈশ্বর্য লাভ, বড় চাকুরী এসব হওয়া কাম্য নয়। প্রত্যেকের যোগ্যতানুযায়ী তা লাভ করা যেতে পারে কিন্তু আখেরাতের সাফল্যকেই চূড়ান্ত লক্ষ্য বানাতে হবে।

পিতা-মাতা যদি সন্তানকে আখেরাতের কামিয়াবীর যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারেন তাহলেই তার সন্তানের যথার্থ দায়িত্ব পালন করলেন।

বয়স হয়ে গেলে বিয়ে করানো

১২. সন্তানের দ্বাদশ অধিকার: বয়স হয়ে গেলে বিয়ে করানো

সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে হোক বয়স হয়ে গেলেই তার বিয়ের তদ্বির শুরু করা দরকার। উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী নির্ধারণে কিছুটা সময় যেতে পারে কিন্তু উপযুক্ত ছেলে- মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে পিতামাতার উদাসীন থাকা কোনক্রমেই ঠিক নয়। ছেলে-মেয়ের পরিণত বয়সে তার নৈতিক মান বজায় রাখার প্রতি পিতা-মাতাকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। বায়হাকীতে উল্লিখিত এক হাদীসে বলা হয়েছে:

“আল্লাহ যাকে সন্তান দিয়েছেন তার কাজ হলো, তার ভাল নাম রাখা, তাকে ভালভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং যখন সে বালেগ হবে তখন তার বিয়ে দেয়া। বালেগ হওয়ার পর যদি সে সন্তানের বিয়ে না দেয় এবং সে কোন গুনাহে লিপ্ত হয় তাহলে তার শাস্তি পিতার উপর আরোপিত হবে।”

অন্যত্র নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন, তাওরাতে লিপিবদ্ধ আছে, “যে ব্যক্তির কন্যার বয়স ১২ বছর হলো এবং সে তার বিয়ে দিল না এবং সে কোন খারাপ কাজ করে বসলো তাহলে তার সে খারাপ কাজের শাস্তি পিতার উপর আরোপিত হবে।”

তাই পিতা-মাতাকে ছেলে-মেয়ের বিয়ের জন্য যথাসময়ে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। অবশ্য আজকালকার ছেলে-মেয়েরা যথাসময়ে বিয়ের ব্যাপারে অনেকে রাজী হয় না। সে ক্ষেত্রে যথাসাধ্য ছেলে-মেয়েকে রাজী করাতে চেষ্টা চালাতে হবে। পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের শর্তাবলী বিয়ে অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে রাসূল (সাঃ) বলেছেন:

“যখন তোমাদের নিকট কোন ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাব প্রেরণ করে যার দ্বীন ও আখলাক সম্পর্কে তোমরা সন্তুষ্ট ও খুশী, তাহলে তার সাথে নিজের কলিজার টুকরাকে বিয়ে দিয়ে দাও। যদি তোমরা তা না কর, তাহলে যমীনে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। (হযরত আবু হোরায়রা থেকে বর্ণিত)

তাই দ্বীন ও আখলাকের চেয়ে ধনসম্পদ, শিক্ষা ও পেশাকে অধিক গুরুত্ব প্রদান ঠিক হবে না। আসলে দুনিয়াবী উচ্চাকাঙ্ক্ষা আখেরাতের জন্য ক্ষতিকর হলে তা অবশ্যই বিবেচনা যোগ্য। সকল ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য।

শরীয়তে বিয়ের জন্য বালেগ হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের দেশে আইন করা হয়েছে মেয়ের বয়স ১৮ ও ছেলের বয়স ২২। এক্ষেত্রে মুসলমান হিসাবে শরীয়তকে গুরুত্ব প্রদান করা উচিত। অবশ্য বাল্যবিবাহ ও শিশু বিবাহের প্রচলন না থাকাই ভাল। কেননা সে বয়সে স্বামী-স্ত্রীর শর্ত মেনে চলা স্বাভাবিক নয়।

আমরা উপরে বর্ণিত ১২টি পয়েন্টে সন্তানের অধিকার তথা সন্তানের প্রতি পিতা মাতার দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করলাম। পিতা-মাতা যদি যথাযথভাবে এ দায়িত্বগুলো পালন করেন তাহলে সন্তানগণ যেভাবে গড়ে উঠার সুযোগ পাবে তাতে একটি সুন্দর সমাজ গড়ে উঠতে পারে। পক্ষান্তরে সন্তানকে যথাযথভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পিতামাতার উদাসীনতা, কোন বিষয়ে অবহেলা বা গাফলতি সমাজ জীবনে চরম বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে পারে। তাই পিতা-মাতাকে সকল বিষয়ে যথার্থ গুরুত্ব দিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা দরকার। একজন মুসলমান তার সন্তানকে এমনভাবে গড়ে তুলবে যাতে তার মৃত্যুর পর নেক সন্তান হিসাবে ছদকায়ে জারিয়ারূপে গণ্য হয়। রাসূল (সাঃ) বলেছেন:

“মানুষ যখন মরে যায়, তার আমল শেষ হয়ে যায় কিন্তু তিন বিষয়ে ছওয়াব শেষ হয় না: (১) ছদকায়ে জারিয়া (সমাজ সেবামূলক কাজ), (২) এমন কোন এলম যা থেকে জনগণ উপকৃত হতে থাকে, (৩) নেক সন্তান যে তার জন্য দু’আ করে।” (মাতাপিতা ও সন্তানের অধিকার: পৃঃ ৭২)

কন্যা সন্তান প্রতিপালনের গুরুত্ব ও বরকত

রাসূলের (সাঃ) যুগে আরবের বুকে কন্যা সন্তান জন্মদান ছিল গ্লানিকর ও অপমানজনক। অথচ সন্তান দান নেহায়েতই আল্লাহর কাজ বরং এ আল্লাহর এক মহাদান বিশেষ। কিন্তু তখনকার সমাজে কন্যা সন্তানের জন্মে পিতার যে মনোভাব প্রকাশ পেত তা কোরআনে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে:

وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًا وَهُوَ كَظِيمٌ يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَبِهِ طَ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُوَنٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التَّرَابِ طَ الأَسَاءَ مَا يَحْكُمُونَ

“তাদের কাউকে যখন কন্যা জন্মের সুসংবাদ প্রদান করা হয়, তাদের চেহারা কালো ছায়ায় মলিন হয়ে যায় এবং তারা হয়ে যায় মর্মাহত। তাকে যে সুসংবাদ দেয়া হল, তাতে লজ্জায় সে সমাজের লোকদের থেকে পালিয়ে বেড়ায়, সে ভাবে সে কি এ অপমান সয়েই চলবে না কি তাকে মাটির নিচে লুকিয়ে ফেলবে। বুঝে দেখ! কি মন্দ সিদ্ধান্ত সে নিচ্ছে।” (সূরা নহল: ৫৮-৫৯)

কি সুন্দরভাবে কন্যার পিতার মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে। আজো সমাজে কিছু কিছু পিতা রয়েছে এ মনোভাবের। আজো কোন কোন পিতার মুখ কালো হয়ে যায় কন্যা সন্তানের জন্মের খবর পেয়ে। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য পুত্র ও কন্যার জন্মের মধ্যে যে কোন পার্থক্য নেই ইসলাম এ কথা বলেছে। হাদীসে রাসূলে কন্যা সন্তানের জন্ম ও তার প্রতিপালনের প্রতি যথার্থ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আল কোরআনে হযরত মরিয়ম ও বিবি আছিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে পুত্র সন্তান কন্যা সন্তানের মত নয়। হযরত আদম (আঃ) ছাড়া অন্য সকল নবী (আঃ) ও দুনিয়ার তাবৎ মণীষীবৃন্দ স্ত্রী জাতির ঔরসেই জন্মগ্রহণ করেছেন।

নবী করীম (সাঃ) চার কন্যার পিতা ছিলেন। তিনি নিজ কন্যাদেরকে অত্যন্ত স্নেহ-মহব্বত করতেন ও যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন, কন্যার সন্তানদেরকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। উম্মতের পিতাদেরকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন:

لا تَكْرَهُوا الْبَنَاتِ فَإِنِّي أَبُوا الْبَنَاتِ –

“তোমরা কন্যাদেরকে ঘৃণা করো না, কেননা আমি নিজেই কন্যাদের পিতা।”

কন্যাদের সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেনঃ “যখন কারো গৃহে কন্যা জন্ম গ্রহণ করে তখন আল্লাহ সেখানে ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তারা এসে বলে, হে গৃহের বাসিন্দারা, তোমাদের উপর সালাম। ফেরেশতারা ভূমিষ্ঠ কন্যাকে নিজের পাখার ছায়াতলে নিয়ে নেন এবং তার মাথার উপর নিজের হাত রেখে বলতে থাকে, এটি একটি দুর্বল দেহ যা একটি দুর্বল জীবন থেকে জন্ম নিয়েছে। যে ব্যক্তি এ দুর্বল জীবনের প্রতিপালনের দায়িত্ব নেবে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য তার সাথে থাকবে।”

কন্যা সন্তান লালন পালন জাহান্নামের আগুনের প্রতিবন্ধক হবে বলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন। “হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমার নিকট দু’কন্যাসহ একজন মহিলা ভিক্ষার জন্য আসল। সে সময় আমার নিকট কিছুই ছিল না। শুধুমাত্র একটি খেজুর ছিল। খেজুরটি আমি তার হাতে দিলাম। সে খেজুরটি দু’ভাগ করে দুকন্যাকে দিল এবং নিজে তা চেখেও দেখল না। অতঃপর উঠে দাঁড়াল ও চলে গেল। এরপর নবী (সাঃ) যখন ঘরে আসলেন তখন আমি তাকে এ ঘটনা শুনালাম। তিনি বললেন, যে ব্যক্তিকেই এ কন্যার মাধ্যমে পরীক্ষায় নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং সে তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করছে। তাহলে এ কন্যারাই তার জন্য জাহান্নামের আগুনের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে।” (বোখারী ও মুসলিম)

কন্যা প্রতিপালনের জন্য বেহেশতের সুসংবাদও দিয়েছেন নবী করীম (সাঃ)। তিনি বলেছেন: “যে ব্যক্তির তিনটি মেয়ে এবং সে তিনটি মেয়েকেই নিজের অভিভাবকত্বে রেখেছে। তাদের প্রয়োজনাবলী পূরণ করেছে এবং তাদের প্রতি রহম করেছে। তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে। কোন গোত্রের এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল যদি দু’কন্যা হয়। রাসূল (সাঃ) জবাব দিলেন যদি দু’কন্যা হয় তাহলেও এ সওয়াব পাওয়া যাবে।”

রাবী বলেন যে, মানুষ যদি এক কন্যার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেন, তাহলে একের ব্যাপারেও রাসূল (সাঃ) এ সুসংবাদ দিতেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অসহায় কন্যাদের ব্যয়ভারের ব্যাপারে বলেছেন:

“আমি তোমাদেরকে উত্তম সাদকার কথা কেন বলে দেব না? তা হলো তোমাদের সে কন্যা যাকে তোমাদের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তোমরা ব্যতীত তাকে কামাই করে খাওয়ানেওয়ালা আর কেউ নেই।” (ইবনে মাজা)

এ কন্যা যেই হোক না কেন, স্বামী মারা যাওয়ার কারণে শ্বশুর বাড়ী থাকতে না পেরে অথবা স্বামী কোন কারণে তালাক দিয়ে বিদায় করে দেওয়ায় অথবা অন্য কোন কারণে।

এভাবে দেখা গেল কন্যা সন্তান প্রতিপালনে একদিকে তারা হবে জাহন্নামের প্রতিবন্ধক, বেহেশতের ওসীলা এবং কন্যাদের জন্য খরচ হবে বিরাট সদকা স্বরূপ।

দুধমা ও দুধ ভাই- বোন

দুধ মা যদিও জন্মদায়িনী মা নন কিন্তু তিনি তো আপন সন্তানের মত শিশুকে তার বুকের দুধ পান করান, শিশুর পিতা বা অভিভাবককে এই দুধ পান করানোর জন্য যথারীতি নির্ধারিত খরচ প্রদান করতে হয়। কিন্তু এরপরও এই দুধ পান করানোর জন্য দুধ মাকে যথেষ্ট মর্যাদা দান করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পরবর্তী যুগে তাঁর দুধমাকে সম্মান দিয়ে নিজের চাদর বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করেছেন। দুধ মাকে বিয়ে করা হরাম করা হয়েছে, এমনকি মার নছব অনুযায়ী যাদেরকে বিয়ে করা হারাম, শরীয়তে দুধ ভাই-বোনসহ নছব অনুযায়ী সকলকে বিয়ে করা হারাম করেছে। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন:

إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ مِنَ الرَّضَاعَةِ مَا حَرَّمَ مِنَ النَّسَبِ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা দুধপান করানোর কারণে ঐসব ব্যক্তিকে হারাম করেছেন যাদেরকে নছবের কারণে হারাম করেছেন।” (মুসলিম)

এ পর্যায়ে যে সব স্ত্রীলোক বিয়ে করা হারাম এ প্রসংগে বলা হয়েছে:

وَامَّهَتِكُمُ الَّتِي أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتِكُمْ مِنَ الرَّضَاعَةِ

“এবং তোমাদের সেই সব মা (হারাম) যারা তোমাদেরকে দুধ পান করিয়েছেন এবং দুধপানের দিক থেকে তোমাদের বোনেরাও (অনুরূপভাবে) হারাম।”

তাই দেখা যায় দুধপান করানোর কারণে আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্যে পুরোপুরি মা ও সন্তানের সম্পর্ক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাই দুধমাকে দুধপান করানোর সাথে সাথে সন্তানকে যথাযথভাবে লালন পালন, চরিত্র গঠন ও শিক্ষা প্রদানেও ভূমিকা রাখতে হবে।

সন্তান লালন পালনের স্বার্থে মা’র পরবর্তী বিয়ে না করা

কোন মহিলার স্বামী মারা গেলে বা স্বামী তাকে তালাক দিলে যদি পূর্ব স্বামীর সন্তান থেকে যায় তবে সন্তানের স্বার্থে পরবর্তী পর্যায়ে বিয়ে না করা বিরাট সওয়াবের কাজ বলে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সা) মেরাজের রাতে বেহেশতে প্রবেশ করে এমন একজন মহিলার শব্দ শুনতে পান যে মহিলা যৌবনে বিধবা হয়ে সন্তান লালন পালনের স্বার্থে সন্তান যবক না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করেননি। রাসলল্লাহ (সাঃ) বলেন:

دَخَلْتُ الْجَنَّةَ فَسَمِعْتُ خَشَفَةِ فَقُلْتُ مَا هُذَا فَقِيلَ الرُّمَيْصَا بِنْتِ
مِلْحَانِ

“আমি বেহেশতে প্রবেশ করলাম তখন একটি শব্দ শুনতে পেলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম এ কিসের শব্দ? বলা হল এ হলো মিলহানের কন্যা রুমাইসার আওয়াজ।”

রুমাইসা উম্মে সুলাইম নামে পরিচিত ছিলেন। তার শিশু সন্তান আনাছ শিশু থাকা অবস্থায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন কিন্তু তার স্বামী ইসলাম গ্রহণ করলো না বরং গোস্বাভরে বিদেশ চলে গেল। সেখানে সে আততায়ীর হাতে মারা গেল। ফলে যৌবন কালেই উম্মে সুলাইম বিধবা হয়ে গেল। অতঃপর তার নিকট বিয়ের প্রস্তাব আসতে লাগলো। কিন্তু তিনি এই বলে সকল প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন: “আমি ততক্ষণ পর্যন্ত বিয়ে করব না যতক্ষণ পর্যন্ত আমার পুত্র মজলিসে উঠাবসা এবং কথাবার্তা বলার যোগ্যতা অর্জন না করবে। এমনকি যখন আনাসই আমার বিয়ের ব্যাপারে রাজী হবে তখন বিয়ে করব।”

অতঃপর হযরত আনাছ (রাঃ) যুবক হলে আবু তালহার সাথে তার বিয়ে হয়। হযরত আনাছ (রাঃ) তার মায়ের জন্য এভাবে দোয়া করতেন:

“আল্লাহ আমার আম্মাজানকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। তিনি আমার লালন-পালন ও অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন।”

এ প্রসংগে রাসূলুল্লাহর চাচা আবু তালিবের কন্যা উম্মে হানির ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। রাসূলুল্লাহ যখন উম্মে হানির নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন, উম্মে হানি এই বলে এ প্রস্তাব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করলেন যে:

“হে আল্লাহর রাসূল। আপনি আমার এ দু’চোখ থেকেও প্রিয়। কিন্তু স্বামীর অধিকার অনেক বেশী। বিয়ে করতে গিয়ে আমি ভয় পাই যে, যদি স্বামীর খেদমতের অধিকার আদায় করি তাহলে এসব অন্তরের মণিদের (সন্তান) অধিকার আদায় করতে সক্ষম হব না। আর যদি সন্তানের খেদমতে লেগে থাকি তাহলে স্বামীর খেদমতের হক আদায় করতে পারব না।” (তারকাতে ইবনে সাদ: উম্মে হানি প্রসংগে)

কি অপূর্ব ত্যাগের মহিমা! সন্তানের অধিকার রক্ষার্থে রাসূলে পাকের সহধর্মিনী হতে স্বেচ্ছায় বিরত রইলেন।

যে সব মহিলা স্বামীহারা হয়ে সন্তান লালন-পালনের খাতিরে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখে কষ্ট ও দুর্ভোগ সয়ে যায় তাদেরকে আল্লাহর নবী (সাঃ) যে সুসংবাদ প্রদান করেছেন তা উল্লেখযোগ্য।

নবী (সাঃ) বলেছেন: আমি ও যে সব মহিলার গণ্ড ঝলসিত (স্বামী মারা
যাওয়ার দুশ্চিন্তায়) কেয়ামতের দিন আমরা দু’আঙ্গুলের মত থাকবো (রাবি নিজের মধ্যমা ও শাহাদত আঙ্গুলের দিকে ইশারা করলেন)। একজন উঁচু বংশের সম্ভ্রান্ত ও রূপবতী মহিলা যিনি নিজের ইয়াতীম শিশুদের (লালন-পালনের) খাতিরে দ্বিতীয় বিয়ে করা থেকে বিরত থাকেন। এমনকি যে পর্যন্ত না সে শিশু তার অভিভাবকত্ব থেকে পৃথক হয়ে গেল অথবা দুনিয়া থেকে বিদায় নিল।” আল্লামা ইউসুফ ইসলাহীর মাতা-পিতা ও সন্তানের অধিকার (পৃঃ -৯১)।

উপরে বর্ণিত ঘটনাবলী ও হাদীস থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, যে মহিলার স্বামী মারা যায় অথবা স্বামী তাকে তালাক দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, তাদের যদি লালন-পালনযোগ্য সন্তান থাকে এবং সন্তানের খাতিরে সে সব মহিলার রূপ-যৌবন থাকা সত্তেও দ্বিতীয় বিয়ে না করে সন্তান যুবক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তবে তা অত্যন্ত ছওয়াবের কাজ বলে গণ্য হবে এবং এসব মহিলা নবী করীম (সাঃ) এর সাথে বেহেশতে অবস্থান করবে।

পোষ্য পুত্র

নিজের ঔরসজাত সন্তানই প্রকৃতপক্ষে নিজের সন্তান। বাপ ডাকা পোষ্য সন্তান কোন অবস্থাতেই প্রকৃত সন্তান নয়। রাসূলের যুগে পোষ্য পুত্রকে অত্যধিক অগ্রাধিকার প্রদান করা হত। পোষ্য পুত্রকে ওয়ারিশ করা হত, পোষ্য পুত্রের বিবাহিত স্ত্রীকে তালাকের পর বা তার মৃত্যুর পর মুখ-ডাকা পিতা কোন অবস্থায়ই বিয়ে করত না। আপন পুত্রের স্ত্রীকে এমতাবস্থায় বিয়ে করা যেমন দোষনীয় মনে করত, তেমনি পালক পুত্রের স্ত্রীকেও বিয়ে করা চরম দোষণীয় মনে করতো। আল্লাহ তায়ালা এ বদ রসমকে মিটিয়ে দিতে চাইলেন। তাই এরশাদ হলো:

مَا جَعَلَ اللَّهُ لِرَجُلٍ مِّنْ قَلْبَيْنِ فِي جَوْفِهِ ، وَمَا جَعَلَ أَزْوَاجَكُمُ إِلَى تُظْهِرُونَ مِنْهُنَّ أُمَّهَتِكُمْ ، وَمَا جَعَلَ أَدْعِيَاءَكُمْ أَبْنَاءَكُمْ ذَلِكُمْ

قَوْلُكُم بِأَفْوَاهِكُمْ وَاللَّهُ يَقُولُ الْحَقَّ وَهُوَ يَهْدِي السَّبِيلَ – أَدْعُوهُمْ لا بَائِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِنْدَ اللَّهِ ، فَإِنْ لَمْ تَعْلَمُوا أَبَاءَهُمْ فَإِخْوَانِكُمْ فِي الدِّينِ وَمَوَالِيْكُمْ وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ فِيمَا أَخْطَاتُمْ بِهِ * وَلَكِنْ مَا تعمدت قلوبكم وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا –

“আল্লাহ কোন ব্যক্তির জন্য তার অন্তরে দুটি হৃদয় সৃষ্টি করেননি এবং তোমরা যেহার (স্ত্রীকে মায়ের পিঠ বলা) করার কারণে তোমাদের স্ত্রীদেরকে তোমাদের মা বানিয়ে দেননি, তিনি তোমাদের পোষ্য ছেলেকে তোমাদের পুত্র বানিয়ে দেননি। এ হলো তোমাদের মুখের ডাক এবং আল্লাহ সত্য কথা বলেন এবং প্রকৃত পথ দেখান। তাদেরকে তাদের পিতার নামে ডাকো, এটাই আল্লাহর নিকট অধিক ন্যায়সংগত, অতঃপর যদি তাদের পিতাকে না জানো তাহলে তারা দ্বীনের দিক থেকে তোমাদের ভাই এবং তোমাদের বন্ধু। এ ব্যাপারে তোমাদের যে ভুলত্রুটি হয়ে গেছে, তাতে কোন পাপ নেই তবে তোমাদের আন্তরিক ইচ্ছা যা হবে (তাতে পাপ হবে), আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” (সূরা আহযাবঃ ৪-৫)

আল্লহ তায়ালা চেয়েছিলেন সমাজের এ কুসংস্কারকে মিটিয়ে দিতে। তাই তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পোষ্য পুত্র যায়েদের বিবাহিতা স্ত্রী জয়নাবের সাথে যখন বনিবনা হল না ও বিবাহ ভেঙ্গে গেল, ইদ্দত পালনের পর আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে যায়েদের তালাক দেয়া স্ত্রীকে বিয়ে করতে আদেশ করলেন। সামাজিক প্রথার কারণে রাসূল এ কাজে ইতস্ততঃ করছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তায়ালার তাকিদের কারণে শেষ পর্যন্ত জয়নবকে বিয়ে করতে বাধ্য হলেন। এভাবে আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং নবীকে দিয়ে এ বদরসমের মূলোৎপাটন করলেন।

আজকের দিনেও পালিত পুত্র বা পালিত কন্যাকে নিজের ঔরসজাত পুত্র-কন্যা বলে গণ্য করার রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে, যা মোটেও শরীয়ত সম্মত নয়। এ ব্যাপারে শরীয়তের বিধানকে পূর্ণরূপে মেনে চলতে হবে।

সন্তান হত্যা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ

যে সন্তান মানুষের একান্ত কামনার ধন, যে সন্তানকে মানুষ এত ভালবাসে, স্নেহ ও মমতাভরা হৃদয় দিয়ে লালন-পালন করে সে সন্তানকে আবার কিছু মানুষ হৃদয়হীনভাবে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। পাষাণ হৃদয়ের মানুষ এ জঘন্য মনোবৃত্তি গ্রহণ করে প্রধানতঃ তিনটি কারণে। কোরআনে তা যথাযথভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সন্তান হত্যার প্রথম কারণ:

সন্তানকে দেব-দেবীর নামে উৎসর্গ করার জন্য বলীদান। যুগ যুগ ধরে গোমরাহ-পথভ্রষ্ট মানুষ তাদের সন্তানদেরকে দেব-দেবীর নামে উৎসর্গ করার মানসে বলীদান করার প্রথা চালু করে রেখেছে। এদেরকে লক্ষ্য করেই হয়ত আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন:

قَدْ خَسِرَ الَّذِينَ قَتَلُوا أَوْلَادَهُمْ سَفَهَا بِغَيْرِ عِلْمٍ وَحَرَّمُوا مَا رَزَقَهُمُ اللَّهُ افْتِرَاء عَلَى اللَّهِ قَدْ ضَلُّوا وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ

“নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা যারা কোন জ্ঞান ব্যতীত নির্বোধের ন্যায় তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করেছে এবং আল্লাহ যেসব রেজেক প্রদান করেছেন তা হারাম করে নিয়েছে এবং আল্লাহ সম্পর্কে মনগড়া কথা বলে, নিশ্চয়ই তারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে এবং তারা হেদায়াতের পথে নেই।” (সূরা আনয়াম : ১৪০)

মানুষের বংশধারা অব্যাহত রাখার জন্য আল্লাহ তায়ালা সন্তান দান করে থাকেন কিন্তু নির্বোধ মানুষেরা তা ক্ষমতাহীন, অনুভূতিহীন দেব-দেবীর নামে উৎসর্গ করে বলীদান করে। অথচ আল্লাহ তায়ালা তো মানুষকে আল্লাহর নামে পশু কোরবানী করতে বলেছেন, মানুষ নয়। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহীমকে তার ছেলে হযরত ইসমাইলকে (আঃ) কোরবানী দিতে বলেছিলেন কিন্তু যখন পিতা-পুত্র স্বেচ্ছায় সে হুকুম পালনে একমত হয়ে গেলেন, আল্লাহ তার কুদরতে হযরত ইসমাইলকে বাঁচিয়ে তদস্থলে পশু কোরবানীর ব্যবস্থা করলেন। মানুষ কোরবানীর রেওয়াজ করা হালাল নয়। মানুষ হত্যাকে আল্লাহ তায়ালা কবীরা গুনাহ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। মানুষ হত্যা নিষেধ করে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ

“আর তোমরা মানুষ হত্যা করো না যা আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন, তবে (শরীয়তের বিধানমত) ন্যায়ভাবে হত্যা করা যেতে পারে।”
(সূরা বনী ঈসরাইল: ৩৩)

সন্তান হত্যার দ্বিতীয় কারণ:

কন্যা সন্তানের জন্মকে সামাজিকভাবে অপমানজনক মনে করে আরব জাহেলিয়াতে কন্যা সন্তানকে জন্মলগ্নেই অথবা পরবর্তীকালে হত্যা করে ফেলার রেওয়াজ চালু হয়ে গিয়েছিল। বহু পিতা তার কন্যা সন্তানকে এভাবে নির্দয়ভাবে হত্যা করে ফেলত।

বর্তমান সময়ে কন্যা সন্তান হত্যা করে ফেলার মানসিকতার পরিবর্তন তো হয়েছে কিন্তু এখনো অনেক পিতা কন্যা সন্তানের জন্মকে কুলক্ষুণে ও অপাংক্তেয় মনে করে এবং পুত্র সন্তানের জন্মকে অগ্রাধিকার দান করে।

সন্তান হত্যার তৃতীয় কারণঃ

অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার ভয়ে সন্তান হত্যার রেওয়াজ সেই সুদূর অতীত থেকে সমাজে চালু ছিল। সে জন্য অতীতে আজল (স্বামী-স্ত্রী মিলনের চরম মূহূর্তে পুরুষাংগ স্ত্রী যোনী থেকে বের করে বীর্য বাইরে নিক্ষেপ করার ব্যবস্থা) করার পদ্ধতি চালু ছিল বর্তমানে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফসল হিসাবে সর্বাধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বের হয়েছে। এ হলো মানুষ হত্যার সর্বাধুনিক পদ্ধতি। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে পুরুষ শুক্রকীটকে নারী ডিম্বের সাথে মিলনেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাদেরকে পথিমধ্যেই হত্যার করা হয়। জন্মনিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য ভবিষ্যত খাদ্যের ঘাটতি দূরীকরণ। তা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে সরকারীভাবে এ প্রচার-প্রপাগান্ডা হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী এ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এক বিরাট সয়লাবের আকারে আজ ছড়িয়ে পড়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ দ্রব্যাদির উৎপাদন, এর প্রচার-প্রপাগান্ডায় আজ কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে দেশে দেশে। অথচ খাদ্য ঘাটতির ভয়ে হত্যাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে আল কোরআনে।

وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ :
“তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না, আমরাই তাদের রিজিক প্রদান করি এবং তোমাদেরও।” (সূরা বনী ইসরাইল: ৩১)

একই কথা বলা হয়েছে সূরা আনয়ামে :

وَلَا تَقْتَلُوا أَوْلَادَكُمْ مِنْ اِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ

“তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে দারিদ্র্যের কারণে হত্যা করো না, তোমাদের রিজিকও আমিই প্রদান করি এবং তাদেরও” (সূরা আনয়াম : ১৫১)

আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কেবলমাত্র সন্তান হত্যার ভূমিকাই পালন করে না, সাথে সাথে নির্লজ্জতা, বেহায়াপনা ও যেনা-ব্যভিচারকেও উৎসাহিত ও সহজতর করে তোলে। জন্মনিয়ন্ত্রণ দ্রব্যাদির সহজলভ্যতার ফলে অবিবাহিত যুবক-যুবতীরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়ে যৌন সম্ভোগ করার অবাধ সুযোগ পেয়ে যায়, যাতে জন্মনিয়ন্ত্রণ দ্রব্যাদির ব্যবহার করে সন্তান আসার পথে বাধা সৃষ্টির সুযোগ গ্রহণ করে। কোরআনে এ কথার প্রতিই দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এভাবে:

وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ مِنْ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ ، وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ جِ وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللهُ إِلَّا بِالْحَقِّ ط ذُلِكُمْ وَضُكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ –

“এবং তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে দারিদ্র্যের কারণে হত্যা করো না, আমরাই তোমাদেরও রিজিক প্রদান করি এবং তাদেরও এবং তোমরা প্রকাশ্য বা গোপনীয় কোন প্রকার নির্লজ্জতার কাছেও যেওনা, আর তোমরা মানুষ হত্যা করো না যা আল্লাহ হারাম করেছেন, তবে ন্যায়সংগতভাবে ছাড়া, এ হলো আল্লাহর নির্দেশ, আশা করা যায় যে তোমরা (সঠিক বিষয়) বুঝবে।”
(সূরা আনয়াম : ১৫১)

আযল বা জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যে শয়তানী চক্রান্ত তা এ কথা থেকে বুঝা যায় যে আল্লাহর সৃষ্টিকে বাধা দেয়ার জন্য এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

অথচ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে, কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ যাকে সৃষ্টি করার জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন তাকে আল্লাহ সৃষ্টি করবেনই।

এক হাদীসে দেখা যায়, জনৈক সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট এসে বলল: আমার একটি দাসী আছে, সে আমার খেদমত করে, আমি তাকে উপভোগ করি কিন্তু তার গর্ভধারণকে আমি পছন্দ করি না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন: ইচ্ছা করলে আযল করতে পার কিন্তু তার জন্য যা নির্ধারিত রয়েছে তা হবেই। কিছুদিন পর সে ব্যক্তি পুনরায় রাসূলের নিকট এসে বলল, ঐ দাসীটি গর্ভধারণ করেছে। হুজুর বললেন, আমি তো তোমাকে পূর্বেই বলেছি, তার যা হবার নির্দিষ্ট আছে তা হবেই।

হযরত আবু ছায়ীদ খুদরী (রাঃ) বর্ণিত এক হাদীসে বনি মুস্তালিক যুদ্ধ বন্দিনীদের সাথে আযল করা সম্পর্কিত ব্যাপারে জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, না করলেও তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না। কেননা কেয়ামত পর্যন্ত যে সকল লোক হবার আছে তারা হবেই।

অপরদিকে আজল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে, এ হলো প্রচ্ছন্নভাবে জীবন্ত কন্যা সন্তান পুতে দেয়া এবং তা হলো “যখন জীবন্ত পোতা কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে তোমার কোন অপরাধে তোমাকে হত্যা করা হয়েছে। (কোরআন) (মেশকাত-৩০৫১) (মুসলিম শরীফ হযরত জুদামা বিনতে ওহাব থেকে বর্ণিত)

হযরত আসমা বিনতে ইয়াজীদ বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ তোমরা গুপ্তভাবে তোমাদের সন্তান হত্যা করো না। (আবু দাউদ, মেশকাত-৩০৫৭)

এসব হাদীস থেকে যা জানা যায় তাতে দেখা গেল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আযল বা জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে প্রথমতঃ খুব শক্তভাবে তা নিষেধ করেননি কারণ আল্লাহ যাকে দুনিয়াতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাকে তো পাঠাবেনই। তবে সন্তানের জন্মকে রোধ করার যে ব্যবস্থা নেয়া হবে তাকে তিনি গুপ্ত হত্যা বলে আখ্যায়িত করে প্রকারান্তরে আযল বা জন্মনিয়ন্ত্রণকে কঠিন অপরাধ হিসাবেই উল্লেখ করেছেন। মানুষের উচিৎ জন্ম রোধের কোন ব্যবস্থা অবলম্বন না করে তাকে স্বাধীনভাবে সুযোগ দেয়া। তবে অসুস্থতা বা অন্য বিশেষ কোন কারণ থাকলে ভিন্ন কথা।

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে একমাত্র নারী-পুরুষের জন্ম ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়া ব্যতীত অন্য কোন পদ্ধতিই ষোল আনা কার্যকর নয় বলে আধুনিক বিজ্ঞানের রায় প্রকাশিত হয়েছে এবং তা প্রমাণিত। দেখা যায় জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরও অনেকের সন্তান হয়। সে জন্যই দেখা যায় ইসলামী শরীয়ত যে সব দেশে অবলম্বন করা হয় না, সে সব দেশে জারজ সন্তানের সংখ্যা বেশী। তাছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু থাকা সত্ত্বেও জনসংখ্যা বেড়েই চলছে। সেই সপ্তম শতাব্দী থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত পৃথিবীর জনসংখ্যা কতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ তখন থেকেই আযল পদ্ধতি এবং পরবর্তীকালে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যাপকভাবে চালু হয়ে আসছে।

তা ছাড়া ম্যালথাস যে জনসংখ্যাতত্ত্ব প্রকাশ ও প্রচার করে বললেন যে, জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে- তাতে দুনিয়ায় খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে। অথচ খাদ্য উৎপাদন কেবলমাত্র দুনিয়ার সম্পদের উপর নির্ভর করে না, খাদ্য উৎপাদন নির্ভর করে উৎপাদন পদ্ধতির উপর। আর প্রযুক্তি সর্বদাই পরিবর্তিত হচ্ছে যাতে উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। দুনিয়ায় আসা মানুষ কেবলমাত্র পেট নিয়েই জন্মগ্রহণ করে না, সে হাতপাও নিয়ে আসে এবং তার মধ্যে থাকে সুপ্ত প্রতিভা ও মেধা। এ মেধার মাধ্যমে প্রযুক্তি-জ্ঞান উন্নত থেকে উন্নততর হতে পারে। যাতে করে খাদ্য সমস্যার কোন প্রশ্নই উঠতে না। বর্তমান যুগের ইলেক্ট্রোনিকস ও কম্পিউটার আবিষ্কারের মাধ্যমে আজ তা প্রমাণিত। ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী ম্যালথাসের নিজ দেশে তার সময় থেকে আজ পর্যন্ত জনসংখ্যা কতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে? তাতে কি সত্যিই খাদ্য সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে? তাছাড়া কোন এক দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে সে দেশে অন্য দেশ থেকে খাদ্য আমদানি করা যেতে পারে।

এছাড়া বিষয়টি হলো ঈমান সংক্রান্ত। আল্লাহ তায়ালা যদি রিযিকদাতাই হন তাহলে তো তারই দায়িত্ব রিযিকের ব্যবস্থা করা। বেশী মানুষ হলে রিযিকের সমস্যা হবে এ হলো নাস্তিক্যবাদী ধারণা। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا

এমন কোন প্রাণী নেই যার রেযেকের দায়িত্ব আল্লাহর নয়। (সূরা হুদ-৬)

তাই রেযেকের ভয়ে সন্তানের জন্মরোধ করা হারাম। কাজেই আল্লাহর সৃষ্টি বিরোধী জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মানব জাতির প্রতি এক শয়তানী চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়।

একাদশ অধ্যায় : মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণ ও সন্তানের দায়িত্ব

এ সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা মহান আল্লাহ। তিনি মানুষকে দুনিয়াতে চলার জন্য দিয়েছেন প্রকৃতি রাজ্যের অসংখ্য নেয়ামত ও প্রাকৃতিক আইন ও বিধান। হেদায়াতের পথে চলার জন্য দিয়েছেন ফেরেশতা, নবী-রাসূল ও আল্লাহর কেতাবের মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষা ও প্রকৃত জ্ঞান। আর এ দুনিয়ায় মানুষকে পাঠানোর মাধ্যম করেছেন পিতা-মাতা। পিতা-মাতার মাধ্যমেই মানুষ জন্মলাভ করে, এ দুনিয়ার আলো-বাতাসের মুখ দেখে। তাই আল্লাহ তায়ালা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে যেন তার বন্দেগী, দাসত্ব ও গোলামী করে এবং পিতামাতার সাথে যেন মানুষ সদাচরণ ও সদ্ব্যবহার করে।

পারিবারিক জীবনে পিতামাতার যেমন সন্তানের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, রয়েছে সন্তানের অধিকার। তেমনি সন্তানেরও রয়েছে পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং পিতামাতার অধিকার। পিতামাতা দুঃখ-কষ্ট করে সন্তানকে বড় করে তোলেন, আদর-সোহাগ, মায়া-মমতায় সন্তানের লালন পালন করেন, সন্তানের জন্য খরচ-পত্র করেন, তাকে শক্তি-সামর্থ্য অর্জন ও যোগ্যতার্জনে সহযোগিতা করেন, তার দ্বীনী আমল ও নৈতিক চরিত্র গঠনে তাকে সমৃদ্ধ করে বিয়ে-শাদী দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে দেন।

সেই সন্তানের বুঝ-সমঝ হওয়ার পর থেকেই পিতা-মাতার একান্ত বাধ্য ও অনুগত থাকা প্রয়োজন। পিতা-মাতার আদেশ ও নির্দেশ মেনে চলা উচিত। কোন অবস্থায়ই তাদের অবাধ্য হওয়া সমীচীন নয়। পিতামাতাকে যথারীতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। ইসলামী সমাজে এ হলো শরীয়তের বিধান। আধুনিক কালে পাশ্চাত্য সমাজ ও ইসলামী সমাজে পিতামাতার প্রতি সন্তানের আচরণে বিরাট পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। পাশ্চাত্য সমাজে পিতামাতা যেমন সন্তানের লালন পালনের দায়িত্ব বহন করে না, কেয়ারটেকার বা হাসপাতাল, ক্লিনিকের হাতে ছেড়ে দেয়, একটু বড় হলেই লেখাপড়ার খরচের দায়িত্বও তাদের নিজের উপর অর্পণ করে, তেমনি সন্তানেরাও পিতা-মাতার কোন দায়িত্ব বহন করে না। তারা মনে করে আমরা তো পিতা-মাতার আনন্দ-স্ফূর্তির ফসল, তাই পিতা-মাতার প্রতি আমাদের আর দায়িত্ব কি? তাই নিজ নিজ রাস্তা দেখে। ফলে বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতাকে দেখা-শোনার মত কেউ থাকে না। তারা নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে।

আল-কোরআনে বৃদ্ধ বয়সে মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ

ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থার অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ। এখানে পিতা-মাতার যেমন সন্তানের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তেমনি সন্তানেরও দায়িত্ব রয়েছে পিতা-মাতার প্রতি। বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতাকে দেখাশোনা করা সন্তানের দায়িত্ব, যা কোরআনে বিশেষ তাকিদ দিয়ে বলা হয়েছে। আল-কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَقَضَى رَبُّكَ اَلا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا طَ رَامَا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ اَحَدَهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلاً كَرِيماً وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيْنِي صَغِيرًا –

“তোমার রব তোমাকে আদেশ করেছেন যে কেবলমাত্র তাকে ছাড়া অন্য কারো যেন বন্দেগী, দাসত্ব ও গোলামী না করো এবং পিতামাতার সাথে সদাচরণ ও সদ্ব্যবহার করো, যদি তাদের একজন অথবা দুইজনই বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হয় তবে তাদের কোন ব্যাপারে উহ্ পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না, তাদের সাথে সম্মানের সাথে কথা বলো। তাদের জন্য তোমার বিনয়াবনত রহমতের ডানা ঝুলিয়ে দাও এবং বলো “হে রব আপনি তাদের প্রতি রহম করুন যেমন ভাবে তারা আমাকে ছোটকালে লালন-পালন করেছে।” (সূরা বনী ইসরাইল: ২৩-২৪)

এ হলো পিতা-মাতার প্রতি বৃদ্ধকালে সন্তানের দায়িত্ব সম্পর্কিত কোরআনের শিক্ষা। বৃদ্ধকালে পিতা-মাতার সাথে ব্যবহারের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা যা বলেন তা হলো:

ক) তাদের কোন ব্যাপারে ‘উহ্’ পর্যন্ত বলো না। বৃদ্ধাবস্থায় মন-মেজাজ অনেক সময় খিটখিটে হয়ে যায়। অল্প কিছুতে রাগান্বিত হয়ে যায়, অনেক কিছু ভুলে যায়। তাছাড়া অচল হয়ে পড়লে বিছানায় পায়খানা-প্রস্রাব করে দিতে পারে অথবা এমন কিছু করে বসতে পারে যা আসলেই বিরক্তিকর। এমতাবস্থায় বিরক্ত হয়ে পিতা-মাতাকে কিছু বলা, দুঃখ প্রকাশ করা, আহ্-উহ্ বলা কিছুতেই ঠিক নয় বরং নীরবে সব কিছু সহ্য করে যেতে হবে। ছোটকালে কত বিরক্তিকর কাজ আপনি করেছেন তা খেয়াল করতে হবে।

খ) তাদেরকে ধমক দিও না। কোন ব্যাপারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে তাদের প্রতি রাগ করে বা গোস্বা ভরে তাদেরকে ধমক দিতে আল্লাহ-তায়ালা নিষেধ করেছেন। কোন অবস্থাতেই তাদের প্রতি রাগ করা বা বিরক্তিকর মন্তব্য করা যাবে না।

গ) ‘তাদের প্রতি সম্মানসূচক কথা বলো।’ তাদের সাথে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে কথা বলতে হবে, সর্বদা তাদের প্রতি বিনয়াবনত থাকতে হবে। শুধু প্রদর্শনী নয়, মন থেকেই শ্রদ্ধা পোষণ করতে হবে। হতে পারে পিতামাতা নিরক্ষর, সন্তান মহাজ্ঞানী, মহাবিদ্যান। কিন্তু পিতামাতা ও সন্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেসব প্রযোজ্য হবে না। সম্মান ও শ্রদ্ধা পিতা-মাতারই।

ঘ) ‘তোমার বিনয়াবনত রহমতের ডানাকে ঝুলিয়ে দাও।’ অতঃপর পরওয়ারদেগার আল্লাহর নিকট সন্তানের হাত তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাকে হতে হবে বিনয়াবনত, কাতর কণ্ঠে আল্লাহর নিকট বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য ফরিয়াদ জানাতে হবে। দয়ার্দ্র কন্ঠে কায়মনোবাক্যে পিতা-মাতার জন্য দোয়া করতে হবে।

ঙ) বলো : ‘হে রব তাদের উপর রহম করুন যেমনিভাবে তারা আমাদেরকে ছোট বেলা লালন- পালন করেছেন।’ ছোটবেলা শিশু কতভাবে না বাপ-মাকে জ্বালাতন করে। শিশুর যাবতীয় অত্যাচার কোনরূপ বিরক্তি প্রকাশ না করে পিতা-মাতা অম্লান বদনে সব কিছু সহ্য করে যায়। গভীর স্নেহ মমতায় সন্তানকে লালন-পালন করে। সন্তান আল্লাহর দরবারে হাত তুলে ফরিয়াদ জানায়, হে রব তাদের উপর রহম করুন যেভাবে তারা আমাকে ছোটবেলায় গভীর মহব্বতে লালন পালন করেছেন।

পিতা-মাতার বৃদ্ধাবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এভাবে বলেছেন।

আবার সন্তানের জন্ম ও স্তন্যদানে মায়ের কষ্টের কথা কোরআনপাকে এভাবে বলা হয়েছে:

وَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمَّهُ وَهُنَا عَلَى وَهْنٍ وَفِصْلُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَى الْمَصِيرُ –

“আমি মানুষকে পিতা-মাতার ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করেছি; তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট স্বীকার করে গর্ভে ধারণ করেছে এবং দু’বছর পর্যন্ত দুধ খাইয়েছে, অতএব আমার ও তোমার পিতামাতার শোকর আদায় কর। আমারই নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে।” (সূরা লোকমান: ১৪)

وَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا حَمَلَتْهُ أُمَّهُ كُرْهًا وَوَضَعَتْهُ كُرْهًا وَحَمْلُهُ وَفِصْلُهُ ثَلْثُونَ شَهْرًا

“এবং আমরা মানুষকে পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছি, তার মা তাকে কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করে এবং কষ্ট করে প্রসব করে এবং তাকে গর্ভে ধারণ ও দুধ খাওয়াতে ত্রিশ মাস সময় কাটিয়ে দেয়।” (সূরা আহকাফ : ১৫)

সন্তান জন্মের ব্যাপারে মায়ের তিনটি কষ্টকর নাযুক অবস্থা তুলে ধরেছেন আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতটিতেঃ
(ক) নয় মাস ধরে সন্তান গর্ভে ধারণ;
(খ) অপরিসীম কষ্টের সাথে সন্তানের প্রসবকরণ;
(গ) গর্ভধারণ ও বুকের দুধ খাওয়ানোতে ত্রিশ মাস কাটানো।

মার এহেন কষ্টের বদলা দেয়া সন্তানের পক্ষে সম্ভব নয়। কোন ব্যক্তি মাকে তার পিঠে বহন করে যদি হজ্জও করায় তবু তার বদলা দেয়া হবে না।

এক হাদীসে দেখা যায় : জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর খেদমতে হাযির হয়ে অভিযোগ করল যে তার মা খারাপ মেজাজের লোক। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ

“নয় মাস পর্যন্ত অব্যাহতভাবে যখন সে তোমাকে পেটে ধারণ করে ঘুরে বেড়িয়েছিল তখনতো সে খারাপ মেজাজের ছিল না।”

লোকটি বলল, “হুজুর আমি সত্য বলছি, সে খারাপ মেজাজের।” হুজুর (সাঃ) বললেন: ‘তোমার খাতিরে যখন সে রাতের পর রাত জাগতো এবং তোমাকে দুধ পান করাতো তখন তো সে খারাপ মেজাজের ছিল না।’ সেই ব্যক্তি বললো, “আমি আমার মাতাকে সেইসব কাজের প্রতিদান দিয়ে ফেলেছি।” রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি সত্যিই তার প্রতিদান দিয়ে ফেলেছো?” জবাবে লোকটি বলল, “আমি আমার মাকে কাঁধে চড়িয়ে হজ্জ করিয়েছি।”

নবী করীম (সাঃ) এবার সিদ্ধান্তকারী রায় দিয়ে বললেন: “তুমি কি তার সেই কষ্টের বদলা বা প্রতিদান দিতে পারো যা তোমার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় সে স্বীকার করেছে?”

অর্থাৎ মাকে পিঠে বহন করে হজ্জ করালেও তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় মা যে কষ্ট স্বীকার করেছে তার বদলা বা প্রতিদান হবে না।

হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণিত অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: “মাতাপিতার স্নেহ, ভালবাসা, লালন-পালন এবং কষ্ট-সহ্যের বদলা যদি সন্তানের পক্ষ থেকে কিছু হয় তাহলে সে ব্যক্তি যদি তার পিতাকে কারোর গোলামীর অবস্থায় পায় অথবা মাকে কারো দাসী অবস্থায় পায় তাহলে তাদেরকে ক্রয় করে আযাদ করে দিতে হবে।”

এ পর্যন্ত বৃদ্ধাবস্থায় পিতা-মাতার প্রতি করণীয় সংক্রান্ত কোরআনের নির্দেশ এবং সন্তান গর্ভে ধারণ, প্রসব করা ও বুকের দুধ খাওয়ানো সম্পর্কিত কোরআনের এবং এ সবের বদলা সংক্রান্ত হাদীসসমূহ আলোচনা করা হল।

এবার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ ও সদ্ব্যবহার এবং সাধারণভাবে পালনীয় কতিপয় উপদেশ যা মহাজ্ঞানী লোকমান তার ছেলেকে প্রদান করেছিলেন, যার উল্লেখ রয়েছে আল-কোরআনে, কোরআনের সে উদ্ধৃতি পেশ করছি।

وَإِذْ قَالَ لَقْمَنُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يُبْنَى لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ طَ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ جِ حَمَلَتْهُ أُمَّهُ وَهَنَا عَلَى وَهْنٍ وَفِصُلُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَى الْمَصِيرُ – وَإِنْ جَاهَدُكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبُهُمَا

فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا ۚ وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ ۖ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ – يُبْنَى إِنَّهَا إِنْ تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ فَتَكُنْ فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَوتِ أَو فِي الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ طَ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ يُبْنَى أَقِمِ الصَّلوةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ طَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ وَلَا تُصَعِرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا طَ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ – وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ طَ إِنَّ انْكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ –

স্মরণ কর (সেই সময়ের কথা) যখন লোকমান নিজের ছেলেকে উপদেশ প্রদান করছিলেন, তখন তিনি বললেন, হে আমার সন্তান, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। প্রকৃতপক্ষে এই শেরক একটি বড় ধরনের যুলুম।

আরো সত্য কথা এই যে, আমরা মানুষকে তাঁর পিতা-মাতার হক সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছি। তার মা দুর্বলতার উপর দুর্বলতা সহ্য করে তাকে বহন করেছেন নিজ পেটে। আর দু’টি বৎসর লেগেছে তাকে দুধ ছাড়াতে। (এ কারণে আমরা তাকে নসীহত করেছি যে) আমার শোকর কর এবং নিজের পিতা-মাতার শোকর আদায় কর। আমারই দিকে তোমাদের ফিরে আসতে হবে।

যার সম্বন্ধে তোমার কোন জ্ঞান নেই, এমন কাউকে যদি তারা আমার সাথে শরীক করার জন্য চাপ দেয় তাহলে কিছুতেই তাদের কথা মানতে পারবে না। দুনিয়ার জীবনে তাদের খেদমত করে যাও, ভালো ব্যবহার করে যাও। কিন্তু অনুসরণ করবে সেই লোকের পথ, যে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পরে তোমাদের সকলকেই আমার দিকে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদের জানাব তোমরা কি রকম কাজ করছিলে।

(আর লোকমান বলেছিল যে) হে আমার পুত্র। কোন জিনিস যদি রেণু কণার মতও হয়, কোন প্রস্তর খন্ডের মধ্যে কিংবা আকাশ-মন্ডলে বা যমীনের কোথাও লুকিয়েও থাকে, আল্লাহ তাকে বের করে আনবেন। তিনি তো সূক্ষ্মদর্শী ও সব বিষয়ে অবহিত।

হে পুত্র! নামাজ কায়েম কর, সৎ কাজের আদেশ কর, খারাপ কাজ থেকে নিষেধ কর। আর যে কোন বিপদই আসুক না কেন, সেজন্য ধৈর্য ধারণ কর। এ কথাগুলি এমন, যে বিষয়ে খুবই তাকিদ করা হয়েছে।

লোকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলো না, এবং যমীনের উপর অহংকারের সাথে চলাফেরা করো না। আল্লাহ কোন আত্ম-অহংকারী দাম্ভীক মানুষকে পছন্দ করেন না।

নিজের চালচলনে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো এবং নিজের কণ্ঠস্বর কিছুটা খাটো-রাখো। গর্দভের আওয়াজই হচ্ছে সব আওয়াজের মধ্যে নিকৃষ্ট।” (সুরা লোকমান: ১২-১৯)

এখানে যে সব উপদেশের উল্লেখ করা হয়েছে, তা হলোঃ
১. আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না- এ হলো বিরাট যুলুম;
২. পিতা-মাতার হক সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে, মা তাকে কষ্ট করে পেটে ধারণ করে ও দুই বৎসর দুধ খাওয়ায়;
৩. আল্লাহর শোকর আদায়ের সাথে সাথে পিতা-মাতারও শোকর আদায় করতে হবে;
৪. পিতা-মাতা শেরক করার জন্য চাপ প্রয়োগ করলে তা মান্য করা যাবে না;
৫. তবে, দুনিয়ার জীবনে পিতা-মাতার খেদমত করে যেতে হবে ও ভালো ব্যবহার করতে হবে;
৬. সেই লোককেই অনুসরণ করতে হবে যে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে;
৭. আল্লাহ ছোটখাট সব বিষয়ই নিয়ে আসবেন;
৮. নামাজ কায়েম করতে হবে, সৎ কাজের আদেশ দান, মন্দ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখা, বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে হবে;
৯. লোকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না, জমীনে অহংকারের সাথে চলাফেরা করা যাবে না;
১০. চালচলনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে হবে;
১১. কণ্ঠস্বরকে নিচু ও মোলায়েম রাখতে হবে;

লোকমান পারিবারিক পরিবেশে তার ছেলেকে এ সব উপদেশ দিয়েছিলেন। তাই এ সব উপদেশ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

কোরআনে এ উদ্ধৃতির পর আমরা পিতামাতার প্রতি সন্তানের আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করব।

পিতা-মাতাকে মান্য করা:

সন্তানের বুঝ সমঝ হওয়ার পর থেকেই সন্তানকে পিতামাতার বাধ্য ও অনুগত থাকতে হবে। ছাত্র জীবনে বা কিশোর বয়স থেকেই সন্তানকে একজন নেক ও ভাল সন্তানের পরিচয় দিতে হবে। বাপ বা মা কোন কিছুর নির্দেশ দিলে, কোন কিছু দিতে বললে তা হাসিমুখে মানতে হবে। কেবলমাত্র আল্লাহর অবাধ্যতা করা বা শরীয়ত বিরোধী কোন কাজের হুকুম পিতামাতা দিলে তা মানা যাবে না। কোরআন বলে:

وَقَضَى رَبُّكَ اَلَا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا

“তোমার রব নির্দেশ দিচ্ছেন যে কেবলমাত্র তাকে ছাড়া আর কারো এবাদত, বন্দেগী ও দাসত্ব করো না, পিতামাতার সাথে সদাচরণ ও সদ্ব্যবহার কর।” (সূরা বনী ইসরাইল: ২৩)

وَإِنْ جَاهَدُكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا

“আর তারা যদি আমার ব্যাপারে তোমাকে কোন বিষয়ে চাপ দেয় যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তাদেরকে মান্য করো না।” (সূরা লোকমান: ১৫)

পিতামাতার প্রতি ‘এহসান’ করতে বলা হয়েছে, যার অনুবাদ করা হয়েছে সদাচরণ ও সদ্ব্যবহার। অর্থাৎ পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণ ও উত্তম ব্যবহার করতে হবে।

কিন্তু আল্লাহর সাথে শেরক করতে বা শরীয়ত বিরোধী কোন কিছু করতে বললে তা মানা যাবে না। বান্দার আমলের মধ্যে মাতা-পিতার প্রতি সুন্দর আচরণ ও সুন্দর ব্যবহার করা উত্তম আমল।

এক হাদীসে দেখা যায় সর্বোত্তম আমলের মধ্যে এক নম্বরে ওয়াক্ত মত ছালাত আদায়ের পর দুই নম্বরেই পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারের কথা বলেছেন নবী করীম (সাঃ)। জনৈক সাহাবী হযরত আমর ইবনুল আছ এর পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) হিজরত ও জিহাদের বাইয়াত করে জেহাদে শরীক না হয়ে আল্লাহর নিকট তার প্রতিদান পেতে চাইলে নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করলেন, “তাহলে মাতা-পিতার নিকট চলে যাও এবং তাদের সাথে সুন্দর আচরণ কর।” (মুসলিম)

জেহাদে যোগদানে ইচ্ছুক অনেক সাহাবীকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পিতা-মাতার খেদমতে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে তাতেই জেহাদের সওয়াব পাওয়া যাবে বলেছেন।

পারিবারিক জীবনে ছেলে-মেয়ের বিয়ের বয়স হলে পিতামাতা তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে বিয়ে দিয়ে দেন। মেয়েরা তো সাধারণতঃ স্বামীর বাড়ী চলে যায় ছেলেরা বিয়ের পর বউ ঘরে নিয়ে আসে। অনেক সময় ছেলের মা ও বউয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক হয় না, ফলে পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে যদি শাশুড়ী ও বউয়ের সাথে মিল মহব্বত থাকে তবে তো খুবই উত্তম, আর যদি ব্যতিক্রম হয় তবে ছেলের উচিৎ তার স্ত্রীর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করে পৃথক হয়ে যাওয়া। তবে এ অবস্থায়ও পিতামাতার সাথে যথারীতি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। ছেলে যদি যথেষ্ট কর্মক্ষম ও রোজগার করে তবে পিতামাতাকে সাধ্যমত টাকা পয়সা দিয়ে সহায়তা করতে হবে, খোঁজ-খবর নিতে হবে, সেবা-যত্ন করতে হবে। স্ত্রীকে পৃথকভাবে রেখে তার প্রয়োজন পূরণ করতে হবে কিন্তু পিতামাতাকে সেবা যত্ন করে তাদেরকে খুশী রাখা সন্তানের দায়িত্ব।মাওলানা আশরাফ আলী থানভী তার ‘কোরআন হাদীসের আলোকে পারিবারিক জীবন’ বইতে এ ব্যাপারে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। স্ত্রীরও মুরুব্বী হিসাবে শ্বশুর শাশুড়ীর প্রতি যথারীতি সম্মান দেখানো ও শ্রদ্ধা পোষণ করা উচিৎ।

পিতা-মাতা অমুসলিম হলেও তাদের প্রতি যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে

পিতামাতা দু’জনেই অথবা একজন যদি অমুসলিম থাকে তবে তাদেরকে অথবা তাকে যথারীতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।

কোরআন যেখানে পিতামাতার শেরক অথবা শরীয়ত বিরোধী কাজের হুকুম অমান্য করতে বলেছে সেখানেই দুনিয়ার জীবনে সদ্ব্যবহার করতে আদেশ করছে।

وَصَاحِبُهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَى

“তাদের সাথে দুনিয়ার জীবনে সদ্ব্যবহার কর এবং অনুসরণ কর তাদের যারা আমার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।” (সূরা লোকমান: ১৫)

পিতামাতা সব সময়ই পিতা-মাতা। তারা কাফের মোশরেক হলেও জন্মদাতা ও জন্মদায়িনী। গর্ভধারণ ও প্রসবকালীন কষ্ট মা ঠিকই করেছেন, বুকের দুধ খাইয়েছেন ও লালন-পালন করেছেন, তাই আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যাই হোক, দুনিয়ার জীবন যাপনে তাদের সহযোগিতা করা, সেবা-যত্ন করা, প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য করা এসবই করতে হবে। কেবলমাত্র আল্লাহর সাথে শেরক করা যাবে না, এ ব্যাপারে যারা ইসলামের অনুসারী, আল্লাহর পথের পথিক তাদেরকে অনুসরণ করতে হবে।

হযরত আবু বকর (রাঃ) দুহিতা হযরত আসমা (রাঃ) তার মোশরেক মায়ের সাথে আত্মীয়তা সম্পর্কিত ব্যবহারের কথা নবী করীমকে (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তিনি তাকে তার মায়ের সাথে আত্মীয়তাজনিত ব্যবহার করার অনুমতি প্রদান করেন।

পিতা মাতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও সদাচরণ করা যাবে কিভাবে

১. পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও সদাচরণ করার ব্যাপারে কিশোর বয়স থেকে বুঝ-সমঝ হওয়ার পর পরই তাদের আদেশ ও নির্দেশ যদি তা শেরক করা বা শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ না হয় তবে তা মেনে চলতে হবে। অল্প বয়সে সাধারণত পিতা-মাতা ফাই-ফরমায়েশ দিয়ে থাকেন বা লেখা পড়া করা, নামায পড়া, খারাপ ছেলে-মেয়েদের সাথে মিশতে নিষেধ করা, এসব কাজ করতে বলেন যা সন্তানের জন্যই কল্যাণকর- এসব বিষয় যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে।

২. কৈশোর থেকে নিয়ে বাকী জীবনে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ পিতামাতার পরামর্শ নিয়ে করতে হবে। এমন কোন কাজ করা ঠিক হবে না যাতে পিতামাতার মনে আঘাত লাগে। বিয়ে-সাদী করা, চাকুরিতে যোগদান, ব্যবসা করা- এ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে পিতামাতার পরামর্শ নিতে হবে। পিতামাতা যদি নিরক্ষরও হন তবু তাদের সাথে আলাপ- পরামর্শ হওয়া দরকার।

৩. পিতামাতা ও আপনার অবস্থান যদি একত্রে হয় তবে সময়-সুযোগ মত পিতামাতার সাথে সাংসারিক বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হওয়া দরকার। যদি আপনি পিতামাতা থেকে দূরে অবস্থান করেন তবে মাঝে মধ্যে তাদের সাথে দেখা- সাক্ষাৎ করতে হবে। কাছে গিয়ে বসতে হবে এবং বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময় করতে হবে। পিতা মাতাকে ভালবাসার দৃষ্টিতে দেখাও বিরাট সওয়াবের কাজ। “হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যে সু-সন্তানই ভালবাসার দৃষ্টিতে তার পিতামাতার দিকে তাকাবে, আল্লাহ তাকে তার প্রতি নজরেই একটি কবুল হজ্জের সওয়াব দান করবেন। লোকজন জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল, যদি প্রতিদিন শতবার এভাবে তাকায়? তিনি বললেন, হ্যাঁ যদি শতবার তাকায় তবে শতবারই এ রকম সওয়াব দিবেন, আল্লাহ (তোমাদের ধারণা থেকে) অনেক বড় ও সম্পূর্ণ পবিত্র।” তাই পিতা-মাতার দিকে শ্রদ্ধা, রহমত ও ভালবাসার দৃষ্টিতে তাকাতে হবে এবং তাদের কাছে সময় নিয়ে বসতে হবে।

৪. পিতা-মাতাকে তাদের প্রয়োজন ও নিজের সামর্থানুযায়ী আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। আপনার রোজগারে কেবলমাত্র আপনার নিজের ও স্ত্রী-সন্তানেরই হক নয়, পিতামাতারও তাতে হক রয়েছে। এ প্রসংগে কোরআনে বলা হয়েছে:

يَسْتَلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَ ۖ مَا انْفَقْتُم مِّنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ وَالْيَتَمَى وَالْمُسْكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۗ

“লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে যে তারা কি খরচ করবে। তাদেরকে বলে দাও, যা কিছু উত্তম তা তারা খরচ করবে তাদের পিতামাতা, তাদের আত্মীয়স্বজন, ইয়াতীম, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য।” (সূরা বাকারা: ২১৫)

এখানে আল্লাহ তায়ালা প্রথমেই পিতামাতার জন্য খরচ করতে বলেছেন, তারপর আত্মীয় স্বজন ও অন্যান্যের জন্য।

কিন্তু আমাদের সমাজে আজকে স্ত্রী ও সন্তানের জন্য প্রথমে খরচ করা হয়, এরপর পীরসাহেব বা নেতৃবৃন্দের জন্য। অনেকেই পিতামাতার জন্য খরচ করতে এগিয়ে আসে না।

৫. পিতামাতা আপনার কাছে কিছু চাইলে বা আবদার করলে তা সরবরাহ করা আপনার উপর দায়িত্ব। সাধ্যমত তা সরবরাহের চেষ্টা করতে হবে।

এছাড়া সময় সময় পিতামাতাকে তাদের পছন্দসই জিনিষ কিনে দিতে হবে। ভাল ও সুস্বাদু খাবার, ফল-ফলাদি, নতুন কাপড় ইত্যাদি কিনে দিয়ে পিতামাতার মন জয় করার ভূমিকা রাখতে হবে। অর্থাৎ পিতামাতাকে খুশী করার একটা অবিরাম চেষ্টা থাকবে আপনার। দূরে থাকলে সময়মত দেখা করতে যেতে না পারলে যথাসময়ে চিঠি পত্র দিতে হবে।

৬. বৃদ্ধ বয়সে যদি পিতামাতা অচল হয়ে পড়েন, তাদেরকে যথারীতি দেখাশোনা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাদের খাওয়া-দাওয়া, প্রয়োজনে পায়খানা-প্রস্রাব পরিষ্কার করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি সকল কাজে আপনাকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। কোন অবস্থায়ই বিরক্ত হওয়া যাবে না। কোরআনের ভাষায় ‘উফ’ বলা যাবে না।

৭. তারা যদি কোন বেহুদা ও অর্থহীন কথাও বলে, কোন বিরক্তকর ও অসহনীয় কাজও করে বসে তবুও তাদেরকে তিরস্কার করা বা ধমক দেয়া যাবে না। যথারীতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে এবং আল্লাহর কাছে মিনতিভরা হাত তুলে দোয়া করতে হবে।

৮. পিতামাতার মৃত্যুর পর ভেঙ্গে না পড়ে, তাড়াতাড়ি তাদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ছেলেদের মধ্যে কেউ জানাযার নামাযের ইমামতি করে কবরে নামাতে হবে।

৯. অমুসলিম পিতামাতাকে ঈমানের পথে আসার জন্য সর্বদা ও সাধ্যমত চেষ্টা সাধনা করে যেতে হবে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তার পিতা আজরকে দ্বীনের দাওয়াত প্রদান করেছিলেন। যার উল্লেখ পবিত্র কোরআনের বেশ ক’টি সূরায় পাওয়া যায়:

إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا هَذِهِ التَّمَاثِيلُ الَّتِي أَنتُمْ لَهَا عَاكِفُونَ – قَالُوا وَجَدْنَا آبَاءَنَا لَهَا عَابِدِينَ – قَالَ لَقَدْ كُنتُمْ أَنتُمْ وَ آبَاؤُكُمْ فِي ضَلَلٍ مُّبِينٍ –

“ইব্রাহীম তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বললেন: এই মূর্তিগুলি কি, যার প্রতি তোমরা অনুরক্ত? তারা বললো: আমারা আমাদের পূর্ব পুরুষকে এগুলোর এবাদত করতে পেয়েছি। তিনি বললেনঃ নিশ্চয়ই তোমরা ও তোমাদের পূর্ব পুরুষগণ সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত ছিলে।” (সূরা আম্বিয়া: ৫২-৫৪)

এ ছাড়া সূরা মরিয়মের ৪২-৪৫, সূরা শুয়ারার ৬৯-৭৭ ও সূরা যুখরূকে হযরত ইব্রাহীম ও তার পিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর চাচা আবু তালেবকে দ্বীনের পথে আনার কত না চেষ্টা করেছেন। মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও কালেমার দাওয়াত দিয়েছেন। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) তার মাকে দ্বীনের পথে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত নবী করীম (সাঃ) এর দোয়ার বদৌলতে ঈমানের নেয়ামত লাভে ধন্য হন। এভাবে যার পিতামাতা কাফের তার সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা হবে তাদেরকে ঈমানের নেয়ামত লাভে ধন্য করা।

মায়ের হক পিতার হকের তিনগুণ

সন্তানকে লালন-পালনের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা উভয়েরই বিরাট ভূমিকা থাকে। মা-বাবা দু’জনের সম্মতিতেই আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তান লাভ করে। পিতা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মা ও তার সন্তানের খরচপত্র বহন করে এবং পিতামাতা গভীর মমতায় এবং স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে সন্তানকে বড় করে তোলে। তাই সন্তানকে উভয়েরই সেবা-যত্ন ও আনুগত্য করতে হবে। কিন্তু সন্তান জন্মদান ও প্রতিপালনে মায়ের বিশেষ ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে সন্তান গর্ভে ধারণ, প্রসব করা ও বুকের দুধ পান করানোর ব্যাপারে পিতার তেমন কোন ভূমিকা থাকে না। সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে মা-ই প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। কোরআন বলেঃ

حَمَلَتْهُ أُمَّهُ كُرْهًا وَوَضَعَتْهُ كُرْهًا وَحَمْلُهُ وَفِصْلُهُ ثَلْثُونَ شَهْرًا

“তার মা তাকে কষ্ট করে পেটে বহন করেছে, তাকে কষ্ট করে প্রসব করেছে এবং তাকে পেটে ধারণ ও দুধ পান করানোতে ত্রিশটি মাস কাটিয়েছে।” (সূরা আল আহকাফ : ১৫)

হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল। আমার সুন্দর আচরণের সবচেয়ে হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার পিতা। (বুখারী ও মুসলিম)

এ হাদীসে দেখা যায়, সন্তানের উত্তম আচরণের হকদার পিতার চেয়ে মা বেশি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) লোকটির প্রশ্নের জবাবে তৃতীয়বার পর্যন্ত বললেন, তোমার মা। চতুর্থবারে বললেন, তোমার পিতার। অর্থাৎ পিতার চেয়ে মায়ের হক তিনগুণ।

সন্তান জন্মের ব্যাপারে মায়ের তিনটি কষ্টকর কাজ আঞ্জাম দেয়ার কারণে তার অধিকার তিনগুণ হতে পারে।

তবে এর অর্থ এ নয় যে, সন্তানের প্রতি পিতার অধিকারের গুরুত্ব কম। বরং আদব ও শিষ্টাচারের প্রশ্নে পিতার মর্যাদা-ই বেশী। পিতা যেহেতু মারও মুরুব্বী তাই তাকে সেভাবেই সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। অর্থসংস্থান করে তাকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পিতার যে ভূমিকা সে ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। কিন্তু মা যেহেতু দুর্বল এবং তার জন্মদানে তার ভূমিকা ও কষ্ট পাওয়া অধিক, তাই তার যথাযোগ্য মর্যাদা সব সময়ই দিতে হবে।

মৃত্যুর পর পিতা-মাতার জন্য করণীয়

জীবনভর যেমন পিতামাতার সাথে সদাচরণ ও সদ্ব্যবহার করে যেতে হবে তেমনি তাদের একজন বা দু’জনেরই মৃত্যুর পরও তাদের সাথে সদাচরণ করা যায়। এ সম্পর্কিত এক হাদীসে জানা যায় ব্যক্তির আমল তার মৃত্যুর সাথে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে জানা যায় তিনটি আমল থেকে মৃত্যুর পরও মৃতব্যক্তি সওয়াব পেতে থাকে : (১) সদকায়ে জারিয়া (২) ঐ এলেম যা থেকে ব্যক্তির মৃত্যুর পরেও লোকেরা উপকার পেতে থাকে এবং (৩) নেক সন্তান যারা পিতামাতার জন্য আল্লাহর নিকট মাগফেরাতের দোয়া করতে থাকে। এ ছাড়া সন্তানের নেক আমল ও সৎ পথে চলার কারণেও পিতামাতা ভাল ফল পাবে, যার বিপরীত হল সন্তানের বদ আমল ও অসৎপথে চলা, যাতে মৃত পিতামাতার আমলনামা আরো খারাপ হতে পারে, যদি এর জন্য পিতামাতা দায়ী হয়।

মৃত্যুর পর মৃত পিতামাতার জন্য সন্তান কি করতে পারে এ সংক্রান্ত হাদীসে দেখা যায়:

হযরত আবু উসাইদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী করীম (সাঃ) এর নিকট হাজির ছিলাম তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল, মাতাপিতার মৃত্যুর পরও কি এমন কোন পদ্ধতি সম্ভব যে আমি তাদের সাথে সুন্দর ব্যবহার অব্যাহত রাখতে পারি? নবীজী বললেন, হ্যাঁ, চারটি পদ্ধতি আছে যাতে তুমি এ কাজ করতে পারো: (১) মাতাপিতার জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার (২) তাদের কৃত ওয়াদাসমূহ ও বৈধ ওয়াদা পূরণ (৩) পিতার বন্ধু-বান্ধব ও মায়ের বান্ধবীদের ইজ্জত ও সম্মান প্রদর্শন এবং (৪) পিতা-মাতার সম্পর্কের দিক থেকে যারা তার আত্মীয় হয় তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ও সুন্দর ব্যবহার করা।

পিতা-মাতা ইন্তেকাল করে গেলেও তাদের নাজাত ও তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শননার্থে রাসূলের শিখানো উপরোক্ত চারটি কাজের আমল যথারীতি করা সন্তানের জন্য কর্তব্য। সাহাবায়ে কেরাম ও পূর্ববর্তী নেক লোকেরা এসব আমল করে গেছেন। বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিম্নে দেয়া গেল।

১. মৃত পিতামাতার জন্য ইস্তেগফার ও দোয়া : মৃত্যুর পর পিতা-মাতা তো নিজের গোনাহের মাফ চাওয়ার কোন ক্ষমতা রাখে না। সন্তান তাদের পক্ষ হয়ে আল্লাহর নিকট তাদের কৃত গোনাহের মাফ চেয়ে ফরিয়াদ জানাতে পারে। ফরয নামায ও তাহাজ্জুদ নামায পড়ে আল্লাহর নিকট হাত তুলে তাদের মাগফেরাত চেয়ে দোয়া করা যায়। এ ছাড়া সময় সময় বা সব সময় দোয়ার কাজ জারী রাখা যায়।

২. পিতামাতার ওয়াদা ও অছিয়ত পূর্ণ করা: পিতা-মাতা যদি মৃত্যুর পূর্বে কারো কাছে কোন ওয়াদা করে কিন্তু সে ওয়াদা পূরণ করার পূর্বেই মারা যায় তবে সন্তান পিতা-মাতার পক্ষ থেকে সে ওয়াদা পূরণ করে দেবে। অনুরূপভাবে কোন মানত করে থাকলে তাও পালন করবে। মৃত্যুর পূর্বে পিতা-মাতা কোন অছিয়ত করে গেলে সন্তান সে অছিয়ত মত কাজ করবে।

৩. পিতামাতার বন্ধু ও মায়ের বান্ধবীর সাথে উত্তম আচরণ ও সদ্ব্যবহার : পিতামাতার মৃত্যুর পর পিতার বন্ধু ও মায়ের বান্ধবীদের সু-আচরণ ও তাদেরকে যথারীতি সম্মান প্রদর্শন করা হলো মৃত পিতামাতার সথে সদাচরণের আরেকটি পন্থা। সাহাবায়ে কেরামের জামানায় পিতার বন্ধুদের সাথে এ ধরনের উত্তম আচরণের বহু উদাহরণ পাওয়া যায়।

৪. পিতামাতার সম্পর্কের আত্মীয়ের হক আদায় : পিতামাতার মৃত্যুর পর তাদের আত্মীয়তায় যারা সন্তানের আত্মীয়, তাদের সাথে যথারীতি সম্পর্ক বহাল রাখার মাধ্যমে তাদের প্রতি সদাচরণ করা যায়। পিতার স্থলাভিষিক্ত চাচা এবং মায়ের স্থলাভিষিক্ত খালা পিতার সম্পর্কিত আত্মীয় ও মায়ের সম্পর্কিত আত্মীয়র সাথে যথারীতি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে পিতামাতার সাথে সদাচরণ অব্যাহত রাখা যায়। এ ব্যাপারে সন্তানদেরকে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

পিতামাতার সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি সন্তানের জান্নাত ও জাহান্নামের কারণ

পিতামাতার সেবা-যত্ন, খেদমত ও আনুগত্য এত গুরুত্বপূর্ণ যে, তা আখেরাতের নাযাতের উপায় এবং দুনিয়াতেও অশেষ কল্যাণ লাভ হয়। “হযরত আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি, রাসূলকে (সাঃ) জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল, পিতামাতার সন্তানের উপর কি অধিকার? তিনি ইরশাদ করলেন, পিতা-মাতা তোমাদের বেহেশত ও দোজখ।” (মেশকাত)

আল্লাহ তায়ালা সন্তানকে পিতামাতার সাথে সদাচরণ করতে বলেছেন, সেক্ষেত্রে যদি সন্তান পিতামাতার অবাধ্য হয়ে যায় ও নাফরমানী করে, তাহলে আল্লাহর হুকুম লংঘনের কারণে সে আল্লাহরও নাফরমানী করে। তাই হাদীসে এসেছে:

“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যে রয়েছে।” (তিরমিযী)

যে ব্যক্তি তার পিতামাতা দুজনকে অথবা একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেলো কিন্তু তাদের খেদমতের মাধ্যমে সন্তুষ্টি অর্জন করে বেহেশতে যেতে পারল না, সে অপমানিত হোক। এ কথা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তিনবার বলেছেন।

রাসূলের অন্যতম সাহাবী হযরত জাহিমা রাসূলের নিকট জেহাদের অনুমতি চাইলে, তিনি তাকে তার মার কাছে ফিরে গিয়ে তার খেদমত করতে বললেন এবং বললেন যে তার মায়ের পায়ের তলায় তার বেহেশত। (ইবনে মাজাহ)

বৃদ্ধ বাপ-মায়ের সেবা-যত্ন ও দেখাশোনা করার মধ্যেই সন্তানের উত্তম পুরস্কার রয়েছে, এমনকি রাসূল বলেছেন যে মায়ের পদতলেই সন্তানের বেহেশত। তাই বৃদ্ধ পিতামাতার খেদমত করে বেহেশতের যোগ্য হতে না পারা বড়ই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার তাই এমন সন্তান সত্যিই অপমানিত ও দুর্ভাগা।

মাতাপিতার খেদমত ও বাধ্য থাকার কারণে পিতামাতার সন্তুষ্টি অর্জন করে আখেরাতে বেহেশত লাভ করে সন্তান ধন্য হতে পারে। এ ছাড়া দুনিয়ার জীবনেও আল্লাহ তায়ালা তাকে পুরস্কৃত করে অশেষ নেয়ামত দান করতে পারেন। হাদীসে দেখা যায় পিতামাতার সাথে ভাল ব্যবহারের কারণে বান্দার হায়াত দারাজ হয় ও রুজী প্রশস্ত হয়।

হযরত আনাস বিন মালিক (রাঃ) বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ “যদি কোন ব্যক্তি নিজের পিতামাতার সাথে ভাল ব্যবহার করল, তার জন্য সুসংবাদ হলো যে, আল্লাহ পাক তার হায়াত দারাজ করবেন। পিতামাতাকে গালমন্দ করা, কাঁদানো ও অভিশাপ দেয়া জঘন্য অপরাধ, বিরাট গুনাহের কাজ।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: “পিতামাতাকে গালি দান বড় গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। লোকজন বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ), কেউ কি পিতামাতাকেও গালি দেয়! তিনি বললেন, মানুষ অন্যের মাতাপিতাকে গালি দেয়। তাহলে তার মাতাপিতাকে ফিরতি গালি দেয়া হয়। সে অন্যের মাকে গালি দেয় ফলে তার মাকেও গালি দেয়া হয়।” (বুখারী ও তিরমিযী)

এ হাদীস থেকে জানা গেল অন্যের পিতামাতাকে গালি দেয়া যাবে না যাতে অন্য লোক উত্তেজিত হয়ে তার পিতামাতাকে গালি দেয়।

সর্বাবস্থায় নিজের পিতামাতার মান-ইজ্জতের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। সন্তানের পক্ষে পিতামাতকে কাঁদানো এক মহা যুলুমমূলক কাজ।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেছেন: পিতামতাকে কাঁদানো হলো তাদের নাফরমানী করা এবং এ হলো বিরাট গুণাহের কাজ। এছাড়া পিতামাতার প্রতি অভিশাপ দেয়াও বড় গুনাহ।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে নিজের পিতামাতার উপর অভিশাপ দেয় তার উপর আল্লাহর লানত।’

তিনটি গুনাহকে খুব বড় গুনাহ বলে রাসূলুল্লাহ উল্লেখ করেছেনঃ
(১) আল্লাহর সাথে শিরক করা
(২) পিতামাতার অবাধ্যতা ও নাফরমানী এবং
(৩) জেহাদ থেকে পলায়ন।
উপরোক্ত তিনটি গুনাহের সাথে নেক কাজ কোনরূপ ফল দেয় না অর্থাৎ যে ব্যক্তি উপরোক্ত তিনটি কাজের কোন একটি করল তার নেক কাজ আল্লাহর নিকট কবুল হয় না।

এ ছাড়া পিতামাতার নাফরমানীর শাস্তি দুনিয়াতেই পাওয়া যায় বলে হাদীসে জানানো হয়েছে।

“হযরত আবু বকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ “আল্লাহ যে শাস্তি চান তা কেয়ামত পর্যন্ত বিলম্ব করেন। কিন্তু পিতামাতার নাফরমানীর শাস্তি মৃত্যুর পূর্বে জীবিতাবস্থায় তড়িঘড়ি করে প্রদান করেন।” (রাওয়াহুল হাকীম)

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সময়কার একটি ঘটনায় জানা যায়, জনৈক যুবক যে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করত তার মুমূর্ষু অবস্থায় লোকেরা চেষ্টা করেও তার মুখে দিয়ে কালেমা উচ্চারণ করাতে পারছিল না। বিষয়টি নবী করীমকে (সাঃ) জানানোর পর তিনি নিজে চেষ্টা করেও তাকে দিয়ে কালেমা পড়াতে পারলেন না। অতঃপর তিনি জানতে পারলেন যে ঐ ব্যক্তির মা তার প্রতি অসন্তুষ্ট। তিনি তার মাকে আনিয়ে বললেন, তুমি যদি তোমার পুত্রকে মাফ করে সুপারিশ না কর তবে তোমার পুত্র জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হবে। তখন তার মা তাকে মাফ করে দিয়ে তার জন্য সুপারিশ করে দোয়া করলেন। এরপর ঐ যুবক কালেমা পাঠ করতে সক্ষম হলো।

এভাবে পিতামাতার নাফরমানীকারী অনেক সন্তানের শাস্তি এ দুনিয়াতে হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা যেন এধরনের নাফরমানীমূলক আচরণ থেকে আমাদেরকে হিফাজত করেন।

দ্বাদশ অধ্যায় : নবী-রাসূলদের পারিবারিক জীবন

দুনিয়ার পথভ্রষ্ট মানুষকে হেদায়াত দান ও পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবী রাসূলদের প্রেরণ করেছিলেন। তাঁরা পারিবারিক জীবনও যাপন করেছেন। দুনিয়ার প্রথম মানুষ হযরত আদম (আঃ) নবী ছিলেন, সাথে সাথে তিনি যাপন করেছিলেন পারিবারিক জীবন। আল্লাহ তায়ালা বিশেষ কুদরতে বিবি হাওয়াকে সৃষ্টি করে তার জীবন সংগীনী করে দেন এবং জানা যায় দুনিয়ার জীবনে তাদের বিশ জোড়া সন্তান-সন্ততি জন্মগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে হাবিল-কাবিল দুই ভাইয়ের নাম কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। নবী-রাসূলদের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে:

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِّنْ قَبْلِكَ وَجَعَلْنَا لَهُمْ أَزْوَاجًا وَذُرِّيَّةً

“এবং নিশ্চয়ই আমি তোমাদের পূর্বে রাসূল প্রেরণ করেছি এবং তাদেরকে স্ত্রী ও সন্তানাদি দিয়েছি।” (সূরা আর রায়াদ: ৩৮)

নবী-রাসূলদের স্ত্রী, সন্তানাদি ও পিতামাতা সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আদম (আঃ) এর বিশ জোড়া সন্তান-সন্ততির মধ্যে হাবিল-কাবিল সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে:

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَى آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُتِلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يَتَقَبَّلْ مِنَ الْأُخِرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَى يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَلَمِينَ إِنِّي أُرِيدُ أَنْ تَبُوا بِإِثْمِي وَإِثْمِكَ فَتَكُونَ مِنْ أَصْحُبِ النَّارِ وَذُلِكَ جَزَاؤُا الظَّلِمِينَ – فَطَوَّعَتْ لَهُ نَفْسُهُ قَتْلَ أَخِيهِ فَقَتْلَهُ, فَأَصْبَحَ مِنَ الْخَسِرِينَ

“আর আপনি তাদেরকে (আহলে কিতাবদেরকে) যথার্থভাবে আদম (আঃ) এর পুত্রদ্বয়ের ঘটনা শুনিয়ে দিন, যখন তারা উভয়েই এক একটি কোরবানী উপস্থিত করল, আমরা তাদের একজনের কুরবানী কবুল করে নিলাম, অপর জনেরটা কবুল করা হল না, তখন অপরজন বলল নিশ্চয়ই আমি তোমাকে হত্যা করব। প্রথমজন বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকীদের নিকট থেকেই কবুল করে থাকেন। যদি তুমি তোমার হাত আমাকে হত্যা করার জন্য প্রসারিত কর, তবে আমি আমার হাত তোমাকে হত্যা করার জন্য প্রসারিত করব না, আমি বিশ্বজগতের প্রভু আল্লাহকে ভয় করি। আমি ইচ্ছা করি যে আমার পাপ ও তোমার পাপের বোঝা তুমি বহন কর এবং তুমি দোজখের বাসিন্দা হয়ে যাও, যালেমদের প্রতিফল এরূপই হয়ে থাকে। অতঃপর তার নফস তার ভাইকে হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করল এবং তাকে হত্যা করে ফেলল এবং সে হয়ে গেল ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা মায়েদা : ২৭-৩০)

এভাবে দেখা যায় আদম (আঃ) এর দু’সন্তানের মধ্যে একজন হলেন পুণ্যবান, মুত্তাকী, অপরজন যালেম ও ক্ষতিগ্রস্ত। পরবর্তীকালে দুনিয়াতে এই পুণ্যবান ও ক্ষতিগ্রস্তদের ধারাবাহিকতাই চলছে। হযরত আদম (আঃ) এর এক ছেলে শীষ (আঃ) নবী ছিলেন বলে জানা যায়। নবী হিসাবে দুনিয়ার তদানীন্তন মানব সমাজকে দ্বীনের পথে ডাকার দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। পরবর্তীতে তাদের মধ্যকার পুণ্যবান মৃত মানুষের মূর্তি বানিয়ে তার পূজা-উপাসনা শুরু করল তারা। হযরত আদম (আঃ) এর পঞ্চম পুরুষ হযরত নূহ (আঃ) কে নবী করে পাঠানো হলো। দীর্ঘদিন তিনি তার সম্প্রদায়ের মধ্যে দাওয়াতের কাজ করলেন। তার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে যতটুকু কোরআনে বর্ণিত হয়েছে তাতে দেখা যায় তার স্ত্রী বিরোধীদের দলভুক্ত ছিলেন, তাঁর এক পুত্র কেনানও ছিলেন আল্লাহ বিরোধীদের সাথে। কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

وَنَادَى نُوْحُ يَا ابْنَهُ وَكَانَ فِي مَعْزِلٍ يُبْنَى ارْكَبْ مَعَنَا وَلَا تَكُنْ مَعَ الْكَفِرِينَ – قَالَ سَاوِى إِلَى جَبَلٍ يَعْصِمُنِي مِنَ السَّمَاءِ قَالَ لَا عاصِمَ الْيَوْمَ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ إِلَّا مَنْ رَحِمَ ، وَحَالَ بَيْنَهُمَا الْمَوْجُ فَكَانَ مِنَ الْمُغْرَقِينَ

“এবং নূহ (আঃ) তাঁর পুত্রকে ডেকে বললেন, যে তার পার্শ্বেই ছিল, হে বৎস, আমাদের সাথে আরোহণ কর। কাফেরদের সাথে থেকো না। সে বলল, এক্ষুণি আমি কোন পাহাড়ে আশ্রয় নিব যা আমাকে পানি থেকে রক্ষা করবে। নূহ (আঃ) বললেন, আজ আল্লাহর হুকুম থেকে কেউ রক্ষা পাবে না, একমাত্র আল্লাহ যার উপর রহমত করবেন এবং একটি তরঙ্গ তাদের মাঝখানে আঘাত হানলো এবং সে ছিল ডুবন্তদের দলভুক্ত। (সূরা হুদ- ৪২-৪৩)”

وَنَادَى نُوحٌ رَبَّهُ فَقَالَ رَبِّ إِنَّ ابْنِي مِنْ أَهْلِي وَإِنَّ وَعْدَكَ الْحَقِّ وَأَنْتَ احْكُمُ الْحَكِمِينَ – قَالَ يُنُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ ، إِنَّهُ عَمَل غَيْرُ صَالِحٍ ، فَلَا تَسْتَلْنِ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنِّي أَعِظُكَ أَنْ تَكُونَ مِنَ الْجَهْلِينَ –

“নূহ (আঃ) তাঁর রবকে ডেকে বললেন, হে আমার রব, আমার ছেলেতো আমারই পরিবারভুক্ত এবং নিশ্চয়ই আপনার ওয়াদা সত্য এবং আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক। আল্লাহ তায়ালা বললেন, হে নূহ সে তো আপনার পরিবারভুক্ত নয়। তার আমল অসৎকর্মশীল। অতএব যা সম্পর্কে আপনার জ্ঞান নেই সে সম্পর্কে কোন আবেদন করবেন না, আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, আপনি অজ্ঞ মূর্খদের দলভুক্ত হবেন না।” (সূরা হুদ: ৪৫-৪৬)

এ আয়াতগুলো থেকে জানা গেল হযরত নূহ (আঃ) এর এক ছেলে বিরোধী কাফেরদের দলভুক্ত ছিলেন। আর হযরত নূহ (আঃ) তাকে তাঁর পরিবারভুক্ত বলে তাকে রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালে আল্লাহ তায়ালা বলে দিলেন যে, সে তার পরিবারের ভুক্ত নয় বরং সে অসৎকর্মশীল। অর্থাৎ মু’মিন পরিবারের অসৎকর্মশীল ব্যক্তি মু’মিন পরিবারভুক্ত নয়।

হযরত নূহ (আঃ) এর পরবর্তীকালে তার বংশধরদের মধ্য থেকে হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর আবির্ভাব হয়। প্রথমদিকে তার পরিবারে ছিলেন তার স্ত্রী বিবি সারা ও তাঁর ভাতিজা হযরত লুত (আঃ)। হযরত ইবরাহীম (আঃ) তার পিতাকে দ্বীনের পথে আহবান জানিয়েছিলেন। আল কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে:

إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ يَابَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لَا يَسْمَعُ وَلَا يُبْصِرُ وَلَا يُغْنِي عَنْكَ شَيْئاً – يَابَتِ قَدْ جَاءَنِي مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِي اهْدِكَ صِرَاطًا سَوِيًّا يَا بَتِ لَا تَعْبْدِ الشَّيْطَنَ إِنَّ الشَّيْطَنَ كَانَ لِلرَّحْمَنِ عَصِيًّا – يَابَتِ إِنِّي أَخَافُ أَنْ يَمَسَّكَ عَذَابٌ مِّنَ الرَّحْمَنِ فَتَكُونَ لِلشَّيْطَنِ وَلِيًّا –

“যখন ইবরাহীম তার পিতাকে বললেন, হে পিতা আপনি এমন বস্তুর ইবাদত করেন যা না কিছু শোনে, না কিছু দেখে এবং না আপনার কোন কাজে আসে। হে আমার পিতা, আমার নিকট এমন জ্ঞান আছে যা আপনার নিকট আসেনি, অতএব আমার অনুসরণ করুন। আমি আপনাকে সোজা পথ দেখাব। হে আমার পিতা, শয়তানের ইবাদত করবেন না, শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য। হে আমার পিতা, আমি ভয় করি দয়াময়ের শাস্তি না আপনাকে পাকড়াও করে বসে এবং আপনি শয়তানের সাথী হয়ে যান।” (সূরা মরিয়ম : ৪২-৪৫)

পিতাকে এভাবে আল্লাহর ইবাদতের দাওয়াত দিয়ে বিফল মনোরথ হয়ে, অগ্নিকুণ্ডের পরীক্ষায় আল্লাহর কুদরতে রক্ষা পেয়ে, তিনি স্ত্রী বিবি সারা ও ভাতিজা লুত (আঃ) কে নিয়ে অজানার পথে রওয়ানা দিলেন। পরবর্তীতে অনেক দেশ ঘুরে তিনি বার্ধক্যে উপনীত হলেন। কিন্তু বিবি সারার গর্ভে তাঁর কোন সন্তান এলো না। তখন বিবি সারা তাঁকে তাদের দাসী হাযেরাকে বিয়ে করার পরামর্শ দিলেন এবং সে মতে বিবি হাযেরাকে তিনি বিয়ে করলেন এবং তার গর্ভে হযরত ঈসমাইল (আঃ) এর জন্ম হল। কিন্তু তাঁর প্রথমা স্ত্রী বিবি সারা তাকে ভাল নজরে দেখতে পারল না ফলে স্ত্রী হাযেরা ও নবজাতক পুত্র ঈসমাইলকে তার বাসস্থান থেকে বহুদূরে মক্কায় নির্বাসন দিয়ে চলে গেলেন। পরবর্তীকালে বৃদ্ধ বয়সে বিবি সারার গর্ভে হযরত ইসহাক (আঃ) এর জন্ম হয়।

পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও পুত্র ঈসমাইল (আঃ) এর ঘটনার অনেক বিবরণ এসেছে আল কোরআনে।

رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّلِحِينَ . فَبَشِّرْتُهُ بِغُلْمٍ حَلِيمٍ – فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعَى قَالَ يُبْنَى إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ إِنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ

يَابَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصُّبِرِينَ – فَلَمَّا اسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْخَبِيْنِ . وَنَادَيْنَهُ أَنْ يَابْرَاهِيمَ . قَدْ صَدَّقْتَ الرُّوا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ –

“(হযরত ইবরাহীম) দোয়া করলেন, হে আমার রব আমাকে একজন নেক সন্তান দান করুন। অতএব তাঁকে একজন ধৈর্যশীল ছেলের সুসংবাদ দেয়া হল। তারপর যখন সে সন্তান তার সাথে দৌড়াদৌড়ির বয়সে পৌঁছল, তিনি বললেন, হে বৎস আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে যবেহ করছি, এ ব্যাপারে তোমার কি মত? ছেলে বলল, হে আমার পিতা আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা করে ফেলুন, ইনশাল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। অতঃপর তারা যখন আত্মসমর্পণ করলেন এবং তাকে যবেহর জন্য কাত করে শোয়ালেন, তখন আল্লাহ ডাক দিয়ে বললেন, হে ইবরাহীম, আপনি আপনার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছেন, এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি।” (সূরা আস সাফফাত : ১০০-১০৫)

পিতা-পুত্রের অপূর্ব মহিমাময় ঘটনা ও আচরণ ফুটে উঠেছে উপরোক্ত আয়াত সমূহ থেকে। বৃদ্ধ বয়সে লাভ করা একমাত্র সন্তানের মায়া-মোহ ত্যাগ করে তাঁকে আল্লাহর নামে কোরবানী করতে মনস্থ করলেন হযরত ইবরাহীম (আঃ)। আর শিশু ঈসমাইল অম্লান বদনে তা মেনে নিলেন আল্লাহরই জন্য। মহান আল্লাহ পিতা-পুত্রের এহেন ত্যাগের মনোভাব লক্ষ্য করে এক জন্তু যবেহর ব্যবস্থা করে বাঁচিয়ে দিলেন হযরত ঈসমাইলকে।

অতঃপর হযরত ঈসমাইল (আঃ) যৌবন প্রান্তে পৌঁছে কাবা তৈরিতে সাহায্য করলেন পিতা ইবরাহীম (আঃ)কে আর তারা উভয়ে দোয়া করলেন আল্লাহর নিকট। এর বর্ণনা এসেছে কোরআন মজিদে :

وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَاسْمَعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا ط إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ – رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أمَّةً مُسْلِمَةً لَكَ من وَآرِنَا مَنَا سِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا

“এবং যখন ইবরাহীম ও ঈসমাইল কাবার প্রাচীর উত্তোলন করছিলেন, (তারা উভয়ে তাদের রবের নিকট দোয়া করলেন): হে আমাদের রব, আমাদের নিকট থেকে কবুল করুন, নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী। হে আমাদের রব আমাদের সন্তানদেরকেও আপনার একটি অনুগত (মুসলিম) দল বানান এবং আমাদেরকে হজ্জের নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দিন এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হোন।” (সূরা বাকারা: ১২৭-১২৮)

এভাবে পিতা-পুত্রের কর্মময় জীবনের নানা ঘটনা বর্ণিত হয়েছে আল কোরআনে। হযরত ইবরাহীমের অপর সন্তান হযরত ইসহাক (আঃ) সম্পর্কে আল কোরআনে বলা হয়েছে:

وَبَشَّرْنَهُ بِاسْحَقَ نَبِيًّا مِنَ الصَّلِحِينَ . وَبُرَكْنَا عَلَيْهِ وَعَلَى اسْحَقَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِمَا مُحْسِنٌ وَظَالِمُ لِنَفْسِهِ مُبِينٌ .

“আমি ইসহাকের সুসংবাদ প্রদান করলাম, যিনি হবেন নবী, নেক ও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত। আমরা বরকত প্রদান করলাম তার প্রতি ও ইসহাকের প্রতি, তাদের সন্তানদের মধ্যে কতক হবে ন্যায়বান ও সদাচারী আর কতক হবে নিজেদের উপর সুষ্পষ্টভাবে জুলুমকারী। (সূরা আস সাফফাত : ১১২-১১৩)

وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَق وَيَعْقُوبَ نَافِلَةً وَكُلاً جَعَلْنَا صُلِحِينَ – وَجَعَلْنَهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِمْ فِعْلَ الْخَيْرَاتِ وَإِقَامَ الصَّلُوةِ وَابْتَاءِ الزَّكُوةِ ، وَكَانُوا لَنَا بِدِينَ –

“আমি ইবরাহীমকে দান করলাম পুত্র ইসহাক এবং আরও পৌত্র ইয়াকুবকে এবং প্রত্যেককে বানালাম নেক ও সৎকর্মশীল। আমি তাদেরকে ইমাম বানিয়েছিলাম, তারা আমার আদেশক্রমে হেদায়াত দান করেছিলেন কল্যাণকর কাজের, নামায কায়েমের এবং যাকাত প্রদানের, তারা ছিল আমার প্রতি ইবাদতকারী।” (সূরা আম্বিয়া: ৭২,৭৩)

হযরত ঈসমাইলও এমনিভাবে তার পরিবারবর্গকে নামায ও যাকাতের নির্দেশ প্রদান করতেন বলে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে:

وَأَذْكُرْ فِي الْكِتَبِ إِسْمَعِيلَ رَ إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ وَكَانَ رَسُولًا نَبِيَّاً – وَكَانَ يَأْمُرُ أَهْلَهُ بِالصَّلُوةِ وَالزَّكُوةِ ص

“এবং আপনি এ কিতাবে ঈসমাইলের বর্ণনা করুন, তিনি ছিলেন অঙ্গীকারে সত্যবাদী এবং নবী ও রাসূল। তিনি তার পরিবারবর্গকে নামাযের ও যাকাতের আদেশ প্রদান করেছিলেন।” (সূরা মরিয়ম: ৫৪-৫৫)

হযরত ইবরাহীম (আঃ) তার দুই ছেলে হযরত ঈসমাইল ও হযরত ইসহাক ও তার পৌত্র ইয়াকুব ও তাদের সন্তানাদি সকলেই দ্বীনের অনুসারী ছিলেন। কোরআনে বলা হয়েছেঃ

وَوَى بِهَا إِبْرَاهِمُ بَنِيهَ وَيَعْقُوبَ – يُبَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ . أَمْ كُنتُمْ شُهَدَاءَ إِذْ خَضَرَ يَعْقُوبَ الْمَوْتُ إِذْقَالَ لِبَنِيْهِ مَا تَعْبُدُونَ مِنْ بَعْدِي قَالُوا نَعْبُدُ الهَكَ وَإِلَهَ آبَائِكَ إِبْرَاهِيمَ وَاسْمَعِيلَ وَإِسْحَقَ الهَا وَاحِدًا ، صلى

“এবং ইবরাহীম তার সন্তানদিগকে এরই নির্দেশ প্রদান করেছিলেন এবং (অনুরূপভাবে) ইয়াকুবও, হে সন্তানগণ আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দ্বীনকে মনোনীত করেছেন, অতএব তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। আর যখন ইয়াকুবের মৃত্যু উপস্থিত হয়েছিল, তখন কি তোমরা তা প্রত্যক্ষ করেছিলে, যখন তিনি তার সন্তানদিগকে বলেছিলেন, তোমরা আমার পর কার ইবাদত করবে? এরা বলেছিল, আমরা আপনার ও আপনার পিতা ইবরাহীম, ঈসমাইল ও ইসহাকের ইলাহের ইবাদত করব, সেই এক ইলাহের এবং আমরা তাঁরই অনুগত।” (সূরা বাকারা: ১৩২-১৩৩)

এমনিভাবে অনেক সময় বংশ পরস্পরায় নবুয়তের ধারা অব্যাহতভাবে চলছে আবার কখনো হয়েছে তার ব্যতিক্রম।

হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর ছেলেদের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে কোরআনের সূরা ইউসুফে। গোটা সূরা ইউসুফে বর্ণনা করা হয়েছে হযরত ইউসুফের জীবন কাহিনী। হযরত ইউসুফ (আঃ) কে যখন তার সৎ ভাইয়েরা ষড়যন্ত্র করে কূপের ভেতর নিক্ষেপ করে তাদের পিতা হযরত ইয়াকুব (আঃ)কে জানাল যে হযরত ইউসুফকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে এবং পরবর্তীকালে ইউসুফের অপর ভাইকে যখন হযরত ইউসুফ (আঃ) চুরির অপরাধে আটক করে তার কাছে রেখে দিলেন এবং তা তার পিতাকে জানানো হল। উভয় অবস্থায়ই হযরত ইয়াকুব (আঃ) বলেছিলেন : فصبر جميل “অভিযোগহীন ধৈর্যধারণ করছি।” হযরত ইয়াকুব (আঃ) দুই পুত্র হারিয়ে শোক ও দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়েও কেবলমাত্র আল্লাহকেই স্মরণ করেছিলেন। যে কথা এসেছে কোরআনে এভাবে:

قَالَ إِنَّمَا أَشْكُوا بَنِي وَحُزَنِي إِلَى اللَّهِ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ يُبِي اذْهَبُوا فَتَحَسَّسُوا مِنْ يُوسُفَ وَأَخِيهِ وَلَا تَايْتُسُوا مِنْ رُوحِ اللَّهِ ۖ أَنَّهُ لَا يَا نَسُ مِنْ رُوحِ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَفِرُونَ

“ইয়াকুব বললেন, আমি আমার শোক ও দুঃখের অভিযোগ কেবলমাত্র আল্লাহর সমীপেই পেশ করছি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানি তোমরা তা জান না। হে আমার ছেলেরা, যাও ইউসুফ ও তার ভাইয়ের অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, নিশ্চয়ই কাফের সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য কেউ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না।” (সূরা ইউসুফ: ৮৬-৮৭)

হযরত আইয়ুব (আঃ) কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে এক পর্যায়ে পরিবারের লোকজনও তাকে ছেড়ে চলে গেলেও হযরত আইয়ুব (আঃ) আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করতে থাকলে আল্লাহ তায়ালা পুনরায় তাঁকে তার পরিবারবর্গকে ফিরিয়ে দিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَأَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّحِمِينَ فَاسْتَجِبْنَا لَهُ فَكَشَفْنَا مَا بِهِ مِنْ ضُرّ وَآتَيْنَهُ أَهْلَهُ وَمِثْلَهُمْ مَعَهُمْ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنَا وَذِكْرَى لِلْعَبِدِينَ –

“আর আইয়ুবের (কথা শুনুন) যখন তিনি তার রবকে ডেকে বললেন, আমি কষ্ট ভোগ করছি আর আপনি সকল দয়ালু অপেক্ষা অধিক দয়ালু। তখন আমি তার জবাব দিলাম, অতএব তার যে কষ্ট হচ্ছিল তা দূর করে দিলাম এবং তাকে দিয়ে দিলাম তার পরিবারবর্গকে এবং তাদের সাথে আরো অনুরূপ দিলাম আমার পক্ষ থেকে রহমত স্বরূপ এবং ইবাদতকারীদের জন্য স্মরণীয় হিসেবে।” (সূরা আম্বিয়া: ৮৩,৮৪)

সূরা কাসাসে হযরত মুসা (আঃ) এর পারিবারিক বিষয়াদি বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত মুসার (আঃ) জন্ম, তার মা তাকে বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া, ফেরাউনের পরিবারে তার লালন-পালন এসব বলা হয়েছে সূরার প্রথম দিকে। অতঃপর হযরত মুসা (আঃ) এক ব্যক্তিকে হত্যা করার কারণে মিসর থেকে পলায়ন করে মাদায়নে গমন এবং এক কূপের নিকট পৌঁছা ও পরবর্তী ঘটনাবলী সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছেঃ

وَلَمَّا وَرَدَ مَاءَ مَدْيَنَ وَجَدَ عَلَيْهِ أُمَّةٌ مِّنَ النَّاسِ يَسْقُوْنَ وَوَجَدَ مِنْ دُونِهِمُ امْرَأَتَيْنِ تَدُوْدَانِ ، قَالَ مَا خَطْبُكُمَا قَالَتَا لَا نَسْقِي حَتَّى يُصْدِرَ الرِّعَاءُ وَأَبُونَا شَيْخٌ كَبِيرُ – فَسَقَى لَهُمَا ثُمَّ تَوَلَّى إِلَى الظِّلّ فَقَالَ رَبِّ إِنِّي لَمَا أَنْزَلْتَ إِلَى مِنْ خَيْرٍ فَقِيرٌ فَجَاءَتْهُ إِحْدُهُمَا تَمْشِي عَلَى اسْتِحْيَاءِ ، قَالَتْ إِنَّ أَبِي يَدْعُوكَ لِيَجْزِيَكَ أَجْرَ مَا سَقَيْتَ لَنَا فَلَمَّا جَاءَهُ وَقَصَّ عَلَيْهِ الْقَصَصَ قَالَ لَا تَخَفْ نَحَوْتَ مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ قَالَتْ إِحْدُهُمَا يَابَتِ اسْتَأْجِرُهُ إِنَّ خَيْرٌ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْأَمِينُ – قَالَ إِنِّي أُرِيدُ أَنْ أُنْكِحَكَ إِحْدَى ابْنَتَيَّ هَاتَيْنِ عَلَى أَنْ تَأْجُرَنِي ثَمَانِيَ حِجَجٍ ، فَإِنْ أَتْمَمْتَ عَشْرًا فَمِنْ عِنْدِكَ وَمَا أُرِيدُ أَنْ أَشُقَّ عَلَيْكَ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّالِحِينَ – قَالَ ذَلِكَ بَيْنِي وَبَيْنَكَ أَيُّمَا الْأَجَلَيْنِ قَضَيْتُ فَلَا عُدْوَانَ عَلَيَّ وَاللَّهُ عَلَى مَا نَقُولُ وَكِيلٌ – فَلَمَّا قَضَى مُوسَى الْأَجَلَ وَسَارَ بِأَهْلِهِ أَنَسَ مِنْ جَانِبِ الطُّورِ نَارًا قَالَ لِأَهْلِهِ امْكُثُوا إِنِّي أَنَسْتُ نَارًا لَعَلَّى آتِيَكُمْ مِنْهَا بِخَيْرٍ أَوْ جَذْوَةٍ مِّنَ النَّارِ لَعَلَّكُمْ تَصْطَلُونَ –

“আর যখন তিনি মাদইয়ানের পানির (কূপের) নিকট পৌঁছলেন, তখন তথায় একদল লোককে দেখতে পেলেন (তাদের পশুগুলোকে) পানি পান করাতে, আর তাদের সকলের এক পার্শ্বে দু’জন স্ত্রীলোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের ব্যাপার কি? তারা দু’জন বলল, এই সব রাখালরা যতক্ষণ তাদের পশুগুলিকে পানি খাওয়ায়ে সরে না যাবে ততক্ষণ আমরা (আমাদের পশুগুলোকে) পানি খাওয়াতে পারি না, আমাদের পিতা অত্যন্ত বৃদ্ধ। অতঃপর তিনি তাদের পক্ষে তাদের পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে দিলেন, অতঃপর ছায়ায় ফিরে গেলেন। অতঃপর দোয়া করলেন, হে আমার রব আপনি আমার জন্য যে নোয়মতই পাঠান আমি তার আকাঙ্ক্ষী। তখন তাদের একজন সলজ্জভাবে তার সন্নিকটে এসে বলল, আপনি যে আমাদের পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে দিলেন তার প্রতিদান দেয়ার জন্য আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন। যখন তিনি তার নিকট গেলেন এবং সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন, তিনি বললেন, ভয় পেয়ো না, তুমি যালেম সম্প্রদায়ের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে গেছ। তাদের একজন বলল হে পিতা, তাকে চাকুরিতে নিযুক্ত করুন, নিশ্চয়ই চাকুরির ক্ষেত্রে উত্তম তো সেই ব্যক্তিই যে শক্তিশালী-বিশ্বস্ত। তিনি বললেন, আমি আমার এ দুই মেয়ের এক মেয়েকে তোমার নিকট বিয়ে দিতে চাই এই শর্তে যে তুমি আমার চাকুরি করবে আট বছর কাল, আর দশ বছর পূরণ করা তোমার পক্ষ থেকে, আমি তোমার উপর কোন প্রকার চাপ দিব না এবং তুমি আমাকে আল্লাহ চাহেত একজন সদাচার ব্যক্তি হিসাবেই পাবে। হযরত মুসা (আঃ) বললেন, এই হল আপনার ও আমার মধ্যে (চুক্তি), এ দু’য়ের মধ্যে যে সময়ই আমি পূরণ করি আমার উপর কোন বাধ্যবাধকতা থাকবে না এবং আল্লাহ হলেন আমাদের মধ্যকার সাক্ষী। এরপর হযরত মুসা (আঃ) যখন সময় পূর্ণ করলেন এবং তুর পর্বতের পার্শ্বে আগুন দেখতে পেলেন, তিনি তার পরিবারকে বললেন, তোমরা এখানে অপেক্ষা কর, আমি এক অগ্নি দেখতে পাচ্ছি, আশা করছি তোমাদের জন্য কোন খবর নিয়ে আসব অথবা তোমাদের জন্য আগুনের কয়লা খণ্ড নিয়ে আসব যাতে তোমরা আগুন পোহাতে পার।” (সূরা কাসাস: ২৩-২৯)

এভাবে হযরত মুসা (আঃ) এর পারিবারিক জীবন যাপনের ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে আল কোরআনে। হযরত মুসা (আঃ) এর ভাই হযরত হারুন (আঃ)ও নবী ছিলেন।

হযরত দাউদ (আঃ) ও তার পুত্র হযরত সুলায়মান (আঃ) এর বর্ণনাও এসেছে আল কোরআনে। তবে তাদের পারিবারিক জীবনের তেমন কোন উল্লেখ নেই। তাফসীর থেকে এতটুকু জানা যায় যে তাদের অনেক স্ত্রী ছিল।

ইমরানের বংশধরদের মধ্যে যে সব নবী ছিলেন তাদের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে টুকিটাকি বর্ণিত হয়েছে আল কোরআনে।

قَالَ رَبِّ إِنِّي وَهَنَ الْعَظمُ مِنّي وَاشْتَعَلَ الرَّأْسُ شَيْبًا وَلَمْ أَكُنْ بِدُعَائِكَ رَبِّ شَقِيًّا . وَإِنِّي خِفْتُ الْمَوَالِيَ مِنْ وَرَاءِ وَكَانَتِ امْرَأَتِي عَاقِرًا فَهَبْ لِي مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا . يَرِثُنِي وَيَرِثُ مِنْ آلِ يَعْقُوبَ ، وَاجْعَلْهُ رَبِّ رَضِيًّا – يُزَكَرِيَّا إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَم نِ اسْمُهُ يَحْى لَا لَمْ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ قَبْلُ سَمِيًّا – قَالَ رَبِّ إِنِّى يَكُونُ لِي غُلَمٌ وَكَانَتِ امْرَأَتِي عَاقِرًا وَقَدْ بَلَغَتْ مِنَ الْكِبَرِ عِتِيًّا – قَالَ كَذَلِكَ جِ قَالَ رَبُّكَ هُوَ عَلَى هَيِّنٌ وَقَدْ خَلَقْتُكَ مِنْ قَبْلُ وَ لَمْ تَكُ شَيْئًا .

“(যাকারিয়া) প্রার্থনা করলেন, হে আমার রব, আমার হাড্ডিসমূহ দুর্বল হয়ে পড়েছে, আমার চুলের শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়েছে কিন্তু আমি আপনার নিকট দোয়া করে তো নিরাশ হইনি। আমি ভয় করছি আমার পর আমার দ্বীনি কাজ সম্পর্কে অথচ আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। অতএব আপনার পক্ষ থেকে আমার একজন ওলী (ওয়ারিশ) দান করুন। আমাকে ও ইয়াকুব বংশকে একজন ওয়ারিশ দান করুন এবং তাকে করুন সন্তুষ্টচিত্ত। হে যাকারিয়া, নিশ্চয়ই আমরা তোমার জন্য একজন ছেলে সন্তানের সুসংবাদ প্রদান করছি যার নাম হবে ইয়াহইয়া, ইতিপূর্বে তার সমকক্ষ আমি কাউকে পয়দা করিনি। হে আমার রব, কিভাবে আমার সন্তান হবে অথচ আমার স্ত্রী বন্ধ্যা আর আমি বার্ধক্যের চরম সীমায় পৌঁছে গেছি। তিনি বললেন এভাবেই হবে, তোমার রব বলেন আমার জন্য তা সহজ, নিশ্চয়ই ইতিপূর্বে আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি এবং তুমি কিছুই ছিলে না।” (সূরা মরিয়ম : ৪-৯)

হযরত যাকারিয়া (আঃ) ও হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) এর ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

انَّهُمْ كَانُوا يُسْرِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَيَدْعُونَنَا رَغَبًا وَرَهَبًا طَ وَكَانُوالَنَا خُشِعِينَ

“নিশ্চয়ই তারা কল্যাণের দিকে দৌড়াচ্ছিল এবং আশা ও ভয়ের অবস্থায় আমাদেরকে ডাকছিল এবং তারা ছিল আমাদের প্রতি বিনয়ী ও অবনমিত।” (সূরা আম্বিয়া: ৯০)

হযরত ইমরানের কন্যা মরিয়ম ও মরিয়মের পুত্র হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্ম সম্পর্কওে কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে:

إِنَّ اللهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوحًا وَآلَ إِبْرَاهِيمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعُلَمِينَ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, ইবরাহীমের বংশধর ও ইমরানের বংশধরদের বিশ্ব জগতের উপর মনোনীত করেছিলেন।” (সূরা আলে এমরান: ৩৪)

সূরা আনয়ামের ৮৪-৮৬ আয়াতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সতের জন নবীর নামের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَكُلَّا فَضَّلْنَا عَلَى الْعُلَمِينَ . وَمِنْ آبَائِهِمْ وَذُرِّيَّتِهِمْ وَإِخْوَانِهِمْ . وَاجْتَبَيْنَهُمْ وَهَدَيْنَهُمْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ –

“এদের প্রত্যেককে আমি বিশ্বজগতের উপর মর্যাদা দান করেছি। এবং তাদের পিতৃবর্গ, সন্তানাদি ও ভাইদের মধ্য থেকে তাদেরকে বাছাই করে নিয়েছি এবং সরল সোজা পথে হেদায়াত দান করেছি।” (সূরা আনয়াম : ৮৬-৮৭)

এভাবে নবী রাসূলদের পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তাদের সৎগুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে কেবলমাত্র দু’জন নবীর স্ত্রী সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করা হয়েছে। তারা হলেন হযরত নূহ (আঃ) ও হযরত লুত (আঃ) এর স্ত্রীর ব্যাপারে। বলা হয়েছে:

ضَرَبَ اللهُ مَثَلًا لِلَّذِينَ كَفَرُوا امْرَأَتَ نُوحٍ وَامْرَأَتَ لُوطٍ ، كَانَتَا تَحْتَ عَبْدَيْنِ مِنْ عِبَادِنَا صَالِحَيْنِ فَخَانَتْهُمَا فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمَا مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَقِيلَ ادْخُلاَ النَّارَ مَعَ الدُّخِلِينَ –

“যারা কুফুরী করেছিল আল্লাহ তাদের উদাহরণ হিসেবে নূহ (আঃ) ও লুত (আঃ) এর স্ত্রীদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। তারা দু’জন আমার দু’জন নেক বান্দার অধীনে ছিল। অতঃপর তারা বিশ্বাসঘাতকতা করল তাই তাদের দু’জনের পক্ষে আল্লাহর নিকট থেকে কোন কিছু কোন উপকারে আসল না বরং তাদেরকে বলা হলো প্রবেশকারীদের সাথে তোমরাও দোজখে প্রবেশ কর।” (সূরা তাহরীম : ১০)

আল কোরআনে নবী-রাসূলদের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় নি বরং টুকিটাকি কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করা হয়েছে। নবীর ছেলেদের মধ্যে দু’জন ও স্ত্রীদের মধ্যে দু’জন শয়তানের অনুসারী, গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট ছিল। তারা হলো হযরত আদমের (আঃ) এক ছেলে ও হযরত নূহের এক ছেলে আর হযরত নূহের (আঃ) স্ত্রী ও হযরত লুত (আঃ) এর স্ত্রী। নবীদের ছেলেদের মধ্যে যারা নেক ও সত্যপন্থী ছিলেন:

১. তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন নবী ও পথ প্রদর্শক – দুনিয়ার গোমরাহ মানুষকে তারা ডেকেছেন হকের পথে;
২. তাঁরা ছিলেন মুত্তাকী ও আল্লাহর নিকট তওবাকারী;
৩. তাঁরা জনগণের নিকট দাওয়াত দিয়ে গেছেন আজীবন;
৪. তাঁরা ছিলেন আল্লাহর অনুগত ও ধৈর্যশীল;
৫. তাঁরা ছিলেন নেক, সৎকর্মশীল ও সদাচারী;
৬. তাঁরা তাদের প্রতি কল্যাণকর কাজ, নামায কায়েম, যাকাত প্রদান ও ইবাদতকারী হওয়ার যে ওহী এসেছিল তা পালন করেছেন;
৭. তাঁরা তাদের পরিবারবর্গকে নামাযের ও যাকাতের আদেশ প্রদান করেছেন;
৮. তাঁরা ছিলেন আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনের অনুসারী;
৯. তাঁরা সবাই আল্লাহর অনুগত হয়ে এক ইলাহের ইবাদত করেছেন;
১০. বিপদ-আপদে তাঁরা ধৈর্যধারণ করেছেন, শোক-দুঃখে তা আল্লাহর সমীপে পেশ করেছেন;
১১. তাঁরা শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসাবে চাকরি করেছেন;
১২. তাঁরা পরিবারের প্রয়োজন পূরণ করেছেন;
১৩. তাঁরা ছিলেন সন্তুষ্টচিত্ত ও দ্বীনের কাজের ওয়ারিশ;
১৪. তাঁরা সন্তান কামনা করতেন তাদের পরিচালিত দ্বীনি কাজের ওয়ারিশ করার জন্য;
১৫. তাঁরা কল্যাণের দিকে দৌড়াচ্ছিলেন, আশা ও ভয় নিয়ে আল্লাহকে স্মরণ করছিলেন এবং তাঁরা ছিলেন আল্লাহর প্রতি বিনয়ী ও অবনমিত;

নবী-রাসূলদের পারিবারিক জীবন থেকে উপরোক্ত গুণাবলী অনুসরণ করে প্রতিটি মুসলমান তাদের পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে পারে।

ত্রয়োদশ অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের পারিবারিক জীবন

ইতিপূর্বে আলোচিত নবী-রাসূলদের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য বিস্তারিত আলোচনা আমাদের জানা না থাকায় কোরআনে বর্ণিত তাদের সন্তানাদি ও স্ত্রীদের সম্পর্কে টুকিটাকি আলোচনা করেই আমাদের ক্ষান্ত থাকতে হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পবিত্র পারিবারিক জীবন সম্পর্কে ইতিহাসে বিস্তারিত বিবরণ রয়ে গেছে। আমরা সে সম্পর্কে যথাসম্ভব বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব।

রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পবিত্র পারিবারিক জীবন এক আদর্শ পারিবারিক জীবন। দুনিয়ার মুসলমানগণ তাঁর পারিবারিক জীবনকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে এবং তা অনুকরণ ও অনুসরণ করে তাদের পারিবারিক জীবনকে সুখী-সুন্দর, পবিত্র ও পরিমার্জিত করতে পারে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পারিবারিক জীবনের তিনটি পর্যায় লক্ষণীয়।

প্রথম পর্যায় রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্ম থেকে ২৫ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে পর্যন্ত, দ্বিতীয় পর্যায় হযরত খাদিজা (রাঃ) এর সাথে তার বিয়ে থেকে হিজরত পূর্ব পর্যন্ত মক্কায় থাকাকাল এবং তৃতীয় পর্যায় হিজরতের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মদিনায় থাকাকাল।

প্রথম পর্যায়: জন্ম থেকে ২৫ বছরে বিয়ে পর্যন্ত

আরবের সম্মানিত কোরায়েশ বংশে তাঁর জন্ম। জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। মা আমেনা ও দাদা আব্দুল মুত্তালিবের তদারকি, স্নেহ-বাৎসল্য নিয়ে তাঁর শিশু ও বাল্যকাল। আরবের তদানীন্তন প্রথানুযায়ী তাঁকে তার দুধ মা তায়েফের হালিমার গৃহে লালন-পালন করা হয়। পাঁচ বছর বয়সে মার কাছে ফিরে আসার পর, ছয় বছরের সময় তাঁর মাও মারা যান। অতঃপর দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাকে লালন-পালন করেন। এর কিছু কাল পরে দাদার মৃত্যু হলে চাচা আবু তালিবের তদারকিতে তিনি বড় হয়ে উঠেন।

দেখা যায় তাঁর শৈশব ছিল নেহায়েতই দুঃখের জীবন। পিতা-মাতার অপত্য স্নেহ-ভালবাসা তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। দাদার স্নেহের পরশও দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। সর্বশেষে চাচার স্নেহের পরশ দীর্ঘস্থায়ী হয়। তার চাচারা ছিলেন আটজন। ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করলে তার চাচা আবু লাহাব তাঁর চরম বিরোধিতা করে। তবে চাচা হযরত হামজা (রাঃ) ও হযরত আব্বাস (রাঃ) কালক্রমে ইসলাম গ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হযরত হামজা (রাঃ) বদরের যুদ্ধে অসম সাহসের প্রমাণ দিলেও উহুদের যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। হযরত আব্বাস (রাঃ) রাসূলের মৃত্যুর পরও দীর্ঘদিন বেঁচেছিলেন। চাচা আবু তালেব রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ইসলাম প্রচারের কাজে আজীবন সহযোগিতা করা সত্ত্বেও মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। অবশ্য রাসূল (সাঃ) আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তাকে ইসলাম গ্রহণ করাতে। এ ব্যাপারে তাঁর আকুলিবিকুলি লক্ষণীয়।

যৌবনের প্রারম্ভে এই পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত রাসূলের ব্যক্তিত্বে ও চরিত্রে যেসব বিষয়গুলো ফুটে উঠে, তাতে দেখা যায়, তিনি তদানীন্তন মক্কার সমাজে একটি উদাহরণীয় একক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। কাবা তৈরির ক্ষেত্রে হাজরে আসওয়াদ বসানো নিয়ে যে ঝগড়ার সূত্রপাত হয় তার মীমাংসায় রাসূলের প্রত্যুৎপন্ন পদক্ষেপ, সমাজ সেবা ও সমাজ সংশোধনে ‘হিলফুল ফুজুল’ সমিতিতে অংশগ্রহণ ইত্যাকার কার্যক্রম তাঁকে করে তোলে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাঁর আমানতদায়ী, সত্যবাদিতা ইত্যাদি চারিত্রিক গুণাবলীর কারণে সমাজ তাকে আল-আমিন, আস-সাদেক উপাধিতে ভূষিত করে।

যৌবনের প্রারম্ভে তিনি চাচার বাণিজ্য কাফেলায় যোগদান করে সিরিয়া গমন করেন। পরবর্তীকালে হযরত খাদিজা (রাঃ) তাঁর গুণাবলীর কথা শুনে তাঁকে তার ব্যবসায় নিয়োজিত করেন। হযরত খাদিজার ব্যবসায় তার প্রচুর লাভ হয়। এভাবে তিনি একজন সফল ব্যবসায়ীরূপে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি কখনো সমাজের মন্দ, নিন্দনীয় ও লজ্জাকর কাজে অংশগ্রহণ করেননি, মূর্তিপূজার শিরকে লিপ্ত হননি। বরং সেই জাহেলী-সমাজেও একজন পুণ্যাত্মা ও ভাল মানুষ হিসাবে শ্রদ্ধার্জন করেন।

দ্বিতীয় পর্যায় : বিয়ের পর থেকে মক্কায় থাকা পর্যন্ত

হযরত খাদিজা (রাঃ) তদানীন্তন আরব সমাজে একজন ধনাঢ্য মহিলা হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর বাণিজ্য পরিচালনা করে প্রভৃত মুনাফা অর্জন করেন। হযরত খাদিজা (রাঃ) ব্যবসায়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আমানতদারী, সৎ চরিত্র ও নানাবিধ গুণের সন্ধান পেয়ে তাঁর সাথে নিজের বিয়ের প্রস্তাব পাঠান এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তা গ্রহণ করলে বিয়ে হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহর বয়স তখন পঁচিশ বছর আর হযরত খাদিজার বয়স চল্লিশ বছর। বয়সের এ তারতম্য থাকা সত্ত্বেও তাদের দাম্পত্য জীবন খুবই সুখের হয়। হযরত খাদিজার (রাঃ) মৃত্যু পর্যন্ত ২৫/২৬ বছর দাম্পত্য জীবনে কোন কলহ বিবাদের ঘটনা জানা যায় না। এই সময়ের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অন্য কোন বিয়ে করেননি। এ সময়ের মধ্যে তাদের দুই ছেলে ও চার মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। দুই ছেলে কাসেম ও আব্দুল্লাহ উভয়েই শিশু বয়সেই মৃত্যুবরণ করে। চার মেয়েকেই যথানিয়মে বিয়ে সাদী দেয়া হয়। তারা হলেন হযরত জয়নব, হযরত রোকাইয়া, হযরত উম্মে কুলসুম ও হযরত ফাতেমা (রাঃ)। পঁচিশ বছর বয়স থেকে নবুয়তের দশম বছর পর্যন্ত, দীর্ঘ পঁচিশ বছর তাদের দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয়। তাদের দাম্পত্য জীবনের সূচনা থেকে তাদের মধ্যে অপূর্ব ভালবাসার নিদর্শন পাওয়া যায়। হযরত খাদিজা তাঁর ভালবাসা ও পতিভক্তির নিদর্শন স্বরূপ তার সকল সম্পত্তি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে প্রদান করেন, তাঁর জন্য কেনা গোলাম হযরত যায়েদকেও তাঁকে দান করে দেন।

বিবাহিত জীবনের পনের বছরের মাথায় গিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নবুয়ত প্রাপ্ত হন। এই সময়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও হযরত খাদিজা (রাঃ) যথারীতি সংসার জীবন যাপন করেন। চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বেই হযরত কাসিম ও হযরত জয়নব (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও হযরত খাদিজা (রাঃ)র মধ্যে উত্তম সম্পর্কের নমুনা হিসাবে দেখা যায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন কয়েকদিনের জন্য হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন হতেন তখন হযরত খাদিজা (রাঃ) যথারীতি তার খোঁজ-খবর রাখতেন এবং খাবার দাবার সরবরাহ করতেন। এতে উত্তম দাম্পত্য সম্পর্কের প্রমাণই পাওয়া যায়। হেরা গুহায় নবুয়ত প্রাপ্তির পর বাড়ি ফিরে হযরত খাদিজার নিকট নবুয়ত প্রাপ্তির সুসংবাদ জানালে হযরত খাদিজাই হলেন প্রথম মুসলমান। স্বামীর প্রতি কি পরিমাণ গভীর ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আস্থা থাকলে এরূপ হতে পারে তা উপলব্ধি করা যেতে পারে। অতঃপর আজীবন নবুয়তের দায়িত্ব পালনে সর্বতোভাবে সর্বদা সহযোগিতা করে গেছেন হযরত খাদিজা (রাঃ)। নবুয়তের সময়কালে তাদের আরো চারটি সন্তান হয়। তাদের একজন হযরত আব্দুল্লাহ তো শিশুকালেই মৃত্যুবরণ করে। বাকী তিনজন হযরত রোকাইয়া, হযরত উম্মে কুলসুম ও হযরত ফাতেমা (রাঃ) বেঁচেছিলেন পরবর্তী সময়েও। নবুয়তের দশম বছরে পঁয়ষট্টি বছর বয়সে হযরত খাদিজা মৃত্যুবরণ করেন। হযরত খাদিজাবিহীন পারিবারিক জীবন নবীর জন্য ছিল খুবই কষ্টকর। তাকে অনেক সময় নিজের হাতেই পারিবারিক কাজ-কর্ম করতে হত। ছোট ছোট সন্তানের লালন-পালনও ছিল বেশ কষ্টকর। এমতাবস্থায় প্রৌঢ়া, পঞ্চান্ন বছর বয়স্কা বিধবা মহিলা হযরত সওদাকে (রাঃ) তিনি বিয়ে করেন। তিনি বেশ যোগ্যতার সাথে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) পারিবারিক জীবনের হাল ধরেন। এর সমসাময়িক কালেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ) কে বিয়ে করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। ৩/৪ বছর পর তিনি তাকে ঘরে উঠান। তাই হিজরত পর্যন্ত অর্থাৎ রাসূলুল্লাহর জীবনের তিপ্পান্ন বছর বয়স পর্যন্ত দাম্পত্য জীবন যাপন করেছেন তার চেয়ে বয়সে বড় বিবি খাদিজা ও বিবি সওদা (রাঃ)র সাথে। এতে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে তিনি কোন কামুক পুরুষ ছিলেন না, যেমন করে কিছু পাশ্চাত্য লেখক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। নবুয়তের কঠিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি পারিবারিক জীবনকে ত্যাগ করেননি বা পারিবারিক দায়িত্ব ভুলে যাননি। এ ভাবেই এসে যায় হিজরতের নির্দেশ। তিনি হিজরত করে মদিনায় চলে যান।

তৃতীয় পর্যায়: হিজরতের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত

হিজরতের পর নবী করীম (সাঃ) এর পারিবারিক জীবনের গতিধারা পরিবর্তন হয়ে যায়। কারণ হিজরতের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দশটি বছর তাঁকে বিভিন্নমুখী দায়িত্ব পালন করতে হয়।

প্রথমতঃ নবুয়তের দায়িত্ব;
দ্বিতীয়তঃ নবুয়তের দায়িত্বের কারণে সামাজিক সংস্কারের দায়িত্ব;
তৃতীয়তঃ বিরোধী শক্তির মোকাবেলা ও বিশ্বব্যাপী দাওয়াতী কাজ;
চতুর্থতঃ এরই সাথে পারিবারিক দায়িত্ব পালন।

তাঁর এ দশটি বছর ছিল খুবই কর্মমুখর ফলে তাঁকে অত্যন্ত ব্যস্ত জীবন কাটাতে হয়েছে। এর মধ্যেও পারিবারিক জীবনে ছিল উল্লেখযোগ্য অবদান। এ সময়ে তাঁর পারিবারিক জীবনে যে সব বিষয়গুলো লক্ষণীয়ঃ
(ক) সন্তান-সন্ততিদের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ-মমতা ও ভালবাসা;
(খ) সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে বিয়ে-সাদী;
(গ) স্ত্রীদের সাথে যথারীতি দাম্পত্য জীবন যাপন ও
(ঘ) আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি ও তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে সম্প্রীতি বৃদ্ধি।

সন্তান-সন্ততিদের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ-মমতা ও ভালবাসা

(ক) সন্তান-সন্ততিদের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ-মমতা ও ভালবাসা :

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবনে তাঁর সন্তানদের প্রতি গভীর মমতা ও স্নেহ-ভালবাসার নিদর্শন পাওয়া যায়। রাসূলের প্রথম সন্তান হযরত জয়নবের বিয়ে হয়েছিল নবুয়তের পূর্বেই তার খালাত ভাই আবুল আছের সাথে। আবুল আছ প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেননি। বদরের যুদ্ধে তিনি বন্দী হন। অন্যান্যের মত মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তিলাভের সুযোগ লাভ করেন। তার স্ত্রী হযরত জয়নব বিয়ের সময় হযরত খাদিজা (রাঃ) প্রদত্ত হারটি বিনিময় মূল্য হিসাবে পাঠিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন ঐ হারটি দেখে চিনতে পারলেন তখন কিরূপ আনমনা ও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন তা ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ হারটি ফিরিয়ে দিয়ে হযরত জয়নবকে মদিনায় পাঠিয়ে দেয়ার শর্তে জামাতা আবুল আছকে মুক্তিদানের প্রস্তাব রাখলে সাহাবাগণ সানন্দে তাতে রাজী হন।

হযরত জয়নবের কন্যা হযরত উমামাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্যন্ত স্নেহ করতেন। অনেক সময় রাসূল (সাঃ) উমামাকে কাঁধে নিয়েই নামায আদায় করতেন, সেজদার সময় নামিয়ে নিতেন, নামায শেষে পুনরায় কোলে নিতেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একবার হাদিয়া স্বরূপ একটি হার গ্রহণ করেন। তিনি বলেন হারটি আমি আমার পরিবারের স্নেহভাজন কাউকে উপহার দিব। দেখা গেল, রাসূল মৃত জয়নবের কন্যা উমামার গলায় নিজ হাতে হারটি পরিয়ে দিলেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার কন্যা হযরত রোকাইয়া ও হযরত উম্মে কুলসুমকে পর পর হযরত উসমান (রাঃ)র সাথে বিয়ে দেন। কিন্তু দুজনেই নবীর (সাঃ) জীবিতাবস্থায়ই মারা যান। অতঃপর রাসূলুল্লাহর (সাঃ) মৃত্যু পর্যন্ত কেবল বেঁচে ছিলেন হযরত ফাতেমা (রাঃ)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত ফাতেমা (রাঃ)কে অত্যধিক ভালবাসতেন। আপন চাচত ভাই হযরত আলীর (রাঃ) সাথে বিয়ে দেন। বিয়ের পর হযরত ফাতেমা যে বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেন তা রাসূলের বাড়ি থেকে দূরে থাকায় পরবর্তীকালে হযরত ফাতেমার জন্য রাসূলের বাড়ির সন্নিকটে একটি বাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রায়ই তার বাড়িতে যাতায়াত করতেন। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিয়ম ছিল যখনই তিনি মদিনার বাইরে সফরে যেতেন, সর্বশেষে হযরত ফাতেমার বাড়িতে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করতেন, আবার সফর থেকে ফিরে এসে প্রথমে মসজিদে দু’রাকাত নামায পড়ে হযরত ফাতেমার সাথে দেখা করতেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘ফাতেমা আমার পরিবার পরিজনের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয়তমা।’

ফাতেমা (রাঃ) এর প্রতি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ভালবাসা এত গভীর ছিল যে, যে কোন বৈরী ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফাতেমার (রাঃ) উপস্থিতি দেখে তাঁর চেহারা মুবারক উজ্জ্বল হয়ে উঠত ও পরিবেশ হয়ে উঠত স্বাভাবিক।

সহীহ বুখারী শরীফের বর্ণনায় দেখা যায়, একবার হযরত আলী (রাঃ) আবু জাহলের কন্যা গোরাকে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ কথা জানতে পেরে খুবই দুঃখ পেলেন। তিনি এ বিয়েকে অনুমোদন করলেন না। অবশ্য বললেন, আলী ইচ্ছা করলে আমার মেয়েকে তালাক দিয়ে আবু জাহলের কন্যাকে বিয়ে করতে পারে। ফাতেমা (রাঃ) আমার শরীরের একটি অংশ, যে তাকে কষ্ট দেয়, সে আমাকে কষ্ট দেয়, যে তাকে দুঃখ দেয়, সে আমাকে দুঃখ দেয়। আমি হালালকে হারাম করতে চাই না। কিন্তু আল্লাহর কসম! তার রাসূলের কন্যা এবং তার দুশমনের কন্যা উভয়ে একস্থানে একত্রিত হতে পারে না।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত ফাতেমা (রাঃ)র দাম্পত্য জীবনের মান-অভিমানের ক্ষেত্রে মীমাংসাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। একবার হযরত আলী (রাঃ) হযরত ফাতেমার সাথে অভিমান করে মসজিদে গিয়ে মাটিতে শুয়ে থাকলে রাসূলুল্লাহ তাকে সেখান থেকে উঠিয়ে বাড়ি নিয়ে যান এবং তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিয়ে হাসিমুখে ফিরে আসেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার নাতি হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হুসাইনকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। তাদেরকে পিঠে চড়িয়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলতেন। হযরত ইমাম হাসানকে কাঁধে নিয়ে বেড়াতেন। হযরত ইমাম হুসাইনকে চুমু খেতেন। হাদীসে দেখা যায় জনৈক বেদুইন তা দেখে বলেছিল, আমার দশটি ছেলে-মেয়ে কিন্তু আমি কোনদিন চুমু খাইনি। রাসূল (সাঃ) একথা শুনে মন্তব্য করেছিলেন, আল্লাহ যদি কারো অন্তরে রহমত না দেন তো কিই বা করার আছে।

হোসাইন (রাঃ) সম্বন্ধে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে হোসাইনকে ভালবাসে সে যেন আমাকে ভালবাসে, যে হোসাইনের সাথে শত্রুতা করে সে যেন আমার সাথে শত্রুতা করে। তিনি আরো বলেছেন, হোসাইনের উৎপত্তি আমা হতে, যে হোসাইনকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে আল্লাহ তাকে গ্রহণ করেন বন্ধু হিসাবে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পালিত পুত্র জায়েদের ছেলে উমামাকেও অত্যন্ত ভালবাসতেন। এভাবে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজ সন্তান ও নাতি-নাতনীদেরকে অত্যন্ত ভালবাসতেন, গভীরভাবে আদর স্নেহ করতেন এবং শত ব্যস্ততার মাঝেও তাদেরকে সময় দিতেন।

সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে বিয়ে-সাদী

(খ) সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে বিয়ে-সাদী

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার জীবনের তিপ্পান্ন বছর বয়স অর্থাৎ হিজরত পর্যন্ত তার চেয়ে বয়সে বড় প্রৌঢ়া এক সময় একজন মাত্র স্ত্রী নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। হিজরতের পূর্বে আল্লাহ পাকের নির্দেশ মোতাবেক হযরত আয়েশাকে বিয়ে করেন। তবে তাকে হিজরতের পূর্বে ঘরে তোলেননি। হিজরতের পর মৃত্যু পর্যন্ত দশ বছর নবুয়তি জিন্দেগীতে তাঁকে অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। তাকে এসব কারণে অনেকগুলো বিয়ে করতে হয়। এসব বিয়েতে অনেক ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ এবং সব কটিতে আল্লাহর অনুমোদন ছিল। এক পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আর কোন মহিলাকে বিয়ে না করার নির্দেশ আসে। এ ক্ষেত্রে পরিষ্কার হয়ে যায়, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বিয়েগুলো ছিল আল্লাহরই ইচ্ছা মোতাবেক।

এ পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে সব বিয়ে করেন, সমসাময়িক পরিস্থিতি ও বিয়ের কারণ নিম্নরূপঃ

১. হযরত হাফসা (রাঃ) : তার পূর্বতন স্বামী ছিলেন হযরত খোনাইস (রাঃ)। বদর যুদ্ধে আহত হয়ে কিছুদিন পর তার মৃত্যু হয়। বিধবা হয়ে তিনি তার পিতা হযরত ওমর (রাঃ)র ঘরে চলে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শহীদের বিধবা স্ত্রী ও হযরত ওমরের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর লক্ষ্যে তৃতীয় হিজরীতে হযরত হাফসা (রাঃ)কে বিয়ে করেন।

২. হযরত জয়নব (রাঃ) : উহুদ যুদ্ধে শাহাদাতপ্রাপ্ত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশের বিধবা স্ত্রীর পুনর্বাসনের লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের তিন মাস পরেই তার মৃত্যু হয়।

৩. হযরত উম্মে সালামা (রাঃ)ঃ স্বামী হযরত আবু সালমা উহুদ যুদ্ধে আঘাত প্রাপ্ত হন এবং এরপর আরেকটি যুদ্ধে সে আঘাতে পুনরায় আহত হয়ে কয়েক দিন পর মারা যান। তাদের নাবালক কয়েকটি সন্তান নিয়ে উম্মে সালামা খুবই অসহায় হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় সম্পূর্ণ পুনর্বাসনের স্বার্থে রাসূল (সাঃ) উম্মে সালামাকে ৪র্থ হিজরীতে বিয়ে করেন।

৪. হযরত জয়নব বিনতে জাহশ (রাঃ) : তার প্রথম বিয়ে হয় রাসূলের পালক পুত্র হযরত জায়েদের সাথে। হযরত জায়েদ তাকে তালাক দিলে, পালক পুত্রের তালাক দেয়া স্ত্রীকে বিয়ে করা যায় না, আরবের এ কুসংস্কার প্রথাকে ভেংগে দেয়ার জন্য আল্লাহর নির্দেশে রাসূল (সাঃ) ৫ম হিজরীতে তাকে বিয়ে করেন।

৫. হযরত জুয়াইরিয়া (রাঃ) : বনু মুস্তালিকের যুদ্ধের পর গোত্র অধিপতি হারেসের কন্যা জুয়াইরিয়া মুসলমানদের হাতে বন্দী হন এবং সাবিত ইবনে কায়েসের ভাগে পড়েন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রাজনৈতিক কারণে তার মুক্তিপণ দিয়ে তাকে বিয়ে করে বনু মুস্তালিকের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

৬. হযরত উম্মে হাবিবা (রাঃ) : হযরত উম্মে হাবিবা (রাঃ) হলেন আবু জাহেলের পর কোরায়েশদের নেতা আবু সুফিয়ানের কন্যা। তিনি স্বামী ওবায়দুল্লাহ বিন জাহাশসহ ইসলাম গ্রহণ করার পর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে স্বামী খ্রিস্টান হয়ে তাকে ছেড়ে চলে যায়। তিনি বিদেশ বিভুঁইয়ে সন্তানাদিসহ সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েন। রাসূল (সাঃ) ইসলামের জন্য তার ত্যাগ-কোরবানী, অসহায়ত্ব এবং সর্বোপরি আবু সুফিয়ানের কন্যা হিসাবে তাকে বিয়ে করেন।

৭. হযরত সুফিয়া (রাঃ) : ইহুদী নেতা হুয়াই ইবনে আখতাবের কন্যা খয়বর যুদ্ধে বন্দী হয়ে শেষ পর্যন্ত রাসূলের ভাগে পড়ে। রাসূল (সাঃ) ইহুদীদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে হিজরী সপ্তম সালে তাকে বিয়ে করেন।

৮. হযরত ময়মুনা (রাঃ) : বিধবা ৫১ বছর বয়স্কা ময়মুনাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পুনর্বাসনের স্বার্থেই বিয়ে করেন। হিজরী সপ্তম সালে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

৯. হযরত রায়হানা (রাঃ) : তিনি ইহুদী বনু নাযীর গোত্রের মেয়ে। মুসলমানরা ইহুদীদের সব কিছু দখল করে নেয়ার সময় বন্দী হয়। রাসূল (সাঃ) ইহুদীদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে তাকে বিয়ে করেন।

১০. হযরত মারিয়া কিতবিয়া: মিসরের খ্রিস্টান শাসক মুকাউকিউস রাসূলুল্লাহর (সাঃ) চিঠির প্রেক্ষিতে সৌহার্দ্য ও শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ অন্যান্য অনেক উপঢৌকনের সাথে নিজের চাচাত বোন মারিয়া কিতবিয়াকে রাসূলের (সাঃ) দরবারে উপহার স্বরূপ প্রেরণ করেন। আন্তর্জাতিক রীতি স্বরূপ রাসূল (সাঃ) তা গ্রহণ করেন এবং মারিয়া কিতবিয়া ইসলাম গ্রহণ করলে ইসলামী রীতি অনুযায়ী রাসূল (সাঃ) উপহারের সঠিক মূল্যায়নের স্বার্থে তাকে বিয়ে করেন। সপ্তম হিজরীর শেষ দিকে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

হিজরত পরবর্তী সময়ে রাসূল (সাঃ) এর দশটি বিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় –
(অ) পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তিনি বিয়ে করেন –
(১) হযরত হাফসা (রাঃ)
(২) হযরত জয়নব (রাঃ)
(৩) হযরত উম্মে সালামা (রাঃ)
(৪) হযরত উম্মে হাবিবা (রাঃ)
(৫) হযরত ময়মুনা (রাঃ), মোট ৫ জনকে;

(আ) সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্যে তিনি বিয়ে করেন –
(১) জয়নব বিনতে জাহাশকে; এবং

(ই) রাজনৈতিক ও গোত্রীয় সম্প্রীতি সৃষ্টির লক্ষ্যে বিয়ে করেন –
(১) হযরত জুয়াইরিয়া (রাঃ)
(২) হযরত উম্মে হাবিবা (রাঃ)
(৩) হযরত সুফিয়া (রাঃ)
(৪) হযরত রায়হানা (রাঃ) ও
(৫) হযরত মারিয়া কিতবিয়া, মোট ৫ জনকে।

এদের মধ্যে হযরত উম্মে হাবিবাকে (রাঃ) পুনর্বাসন ও রাজনৈতিক উভয় উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছিলেন। এভাবে মোট দশটি বিয়ে তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসব কারণে করেছিলেন। রাসূলের বয়স তখন পঞ্চান্ন ও তার উপরে। হযরত হাফসা (রাঃ) ও হযরত জয়নবের সাথে রাসূলের বিয়ে হয় চতুর্থ হিজরীতে, রাসূলের বয়স তখন সাতান্ন বছর, হযরত জয়নব বিনতে জাহাশ ও হযরত জুয়াইরিয়ার সাথে বিয়ে হয় পঞ্চম হিজরীতে, রাসূলের (সাঃ) বয়স তখন আটান্ন। এছাড়া হযরত সুফিয়া (রাঃ), হযরত ময়মুনা (রাঃ), হযরত রায়হানা (রাঃ) ও হযরত মারিয়া কিতাবিয়াকে বিয়ে করেন সপ্তম হিজরীতে অর্থাৎ রাসূলের বয়স তখন ষাট বছর। পঞ্চান্ন থেকে ষাট বছর বয়সের মধ্যে দশটি বিয়ে করা কোনক্রমেই যৌনতাড়িত হতে পারেনা বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণেই এসব বিয়ে তা দিবালোকের মত সত্য।

স্ত্রীদের সাথে যথারীতি দাম্পত্য জীবন যাপন

(গ) স্ত্রীদের সাথে যথারীতি দাম্পত্য জীবন যাপন

নবুয়তের দায়িত্বের কারণে দাওয়াতী, সামাজিক ও রাজনৈতিক শত ব্যস্ততার মধ্যেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার পঞ্চাশোত্তর বয়সে যথারীতি দাম্পত্য জীবন যাপন করেছেন। পালাক্রমে তিনি স্ত্রীদের সাথে রাত্রি যাপন করতেন। আল্লাহ তায়ালা যদিও তাকে স্ত্রীদের মধ্যে ইনসাফ করার দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি সাধ্যমত স্ত্রীদের সাথে ইনসাফ করার চেষ্টা করতেন, স্ত্রীদের সাথে গোপন আলাপ করতেন, যে কথা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। স্ত্রীদের সাথে প্রয়োজনে পরামর্শ চাইতেন, হোদাইবিয়ার সন্ধির পর রাসূল (সাঃ) সাহাবাদেরকে কোরবানীর নির্দেশ প্রদান করলে সাহাবাগণ কেউ তা পালন না করলে নবী পত্নী উম্মে সালামার নিকট তিনি পরামর্শ চান, উম্মে সালামা নবীকে নিজ কোরবানী করার পরামর্শ দেন। নবী নিজে কোরবানীর কাজ সমাধা করলে দেখা যায় সাহবাগণ নিজ নিজ কোরবানী করতে এগিয়ে আসছেন। নবী (সাঃ) সফরে এক বা একাধিক স্ত্রীকে সফর সংগী করতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) কে নিয়ে তিনি দৌড়ের প্রতিযোগিতা করেছেন, হাবশীদের খেলা দেখিয়েছেন। রাসূলের পারিবারিক জীবনের কিছু কিছু ঘটনা কোরআনেও বর্ণিত হয়েছে। জয়নব বিনতে জাহাশের বিয়ে প্রসংগে, মধু খাবেন না বলে ওয়াদা করা প্রসংগে, হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে দুর্নাম রটনা প্রসংগে এবং স্ত্রীদের খোর-পোষের দাবী দাওয়া ও স্ত্রীদের পর্দার প্রসংগে বিভিন্ন আয়াত কোরআনে বর্ণিত হয়েছে।

এখানে বিশেষ করে স্ত্রীদের খোর-পোশের দাবী দাওয়ার প্রেক্ষিতে নাযিলকৃত আয়াতটি উল্লেখযোগ্য। আল্লাহ তায়ালা নবী পত্নীদের লক্ষ্য করে নবীকে বলেনঃ

يَأَيُّهَا السَّبِي قُلْ لِأَزْوَاجِكَ إِنْ كُنتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيُوةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيْنَ أُمَتِّعْكُنَّ وَأَسْرَحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِيلاً – وَإِنْ كُنتُنَّ تُرِدْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالدَّارَ الْآخِرَةَ فَإِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْمُحْسِنَتِ مِنْكُنَّ أَجْرًا عَظِيمًا –

“হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে বলে দিন, যদি তোমরা দুনিয়ার জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা কর, তাহলে আস আমি তোমাদেরকে কিছু ধন-সম্পদ প্রদান করি এবং তোমাদেরকে সদ্ভাবে বিদায় করে দেই। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখেরাতের বাড়ী কামনা কর তাহলে আল্লাহ তোমাদের মধ্যকার মু’মিনদের (সৎকর্মশীলদের) জন্য বিরাট পুরস্কারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।” (সূরা আহযাব: ২৮-২৯)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্ত্রীদের দাবী-দাওয়ার প্রেক্ষিতে এমন অবস্থার সম্মুখীন হন যে, তিনি স্ত্রীদের থেকে এক মাস বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার প্রতিজ্ঞা পালনের পর একে একে তাদেরকে এ আয়াত শুনিয়ে তাদের মত জানতে চান। সকলেই আল্লাহ, তাঁর রাসূল (রাঃ) ও আখেরাতের পক্ষে মত দেন। এভাবে পুনরায় নবীর পারিবারিক জিন্দেগী চলতে থাকে। দেখা যায় নবী পত্নীদের মধ্যে কেউই হযরত নূহ (আঃ) ও হযরত লূত (আঃ) এর পত্নীর মত নবীর মিশন বিরোধী ছিলেন না। বরং তারা ছিলেন আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি আনুগত্যশীল, এবাদত গুজার, রোজাদার, ধৈর্যশীল, দানশীল ও বিভিন্ন গুণে গুণান্বিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে তাদেরকে নিয়ে পারিবারিক জীবন যাপন করতেন। তাদের মধ্যে যেমন ছিল উদারতা, উদাহরণ স্বরূপ হযরত সওদা তার জন্য পালাবন্টিত রাতটি হযরত আয়েশা (রাঃ) কে দান করেন, তেমনি মানবীয় ঈর্ষা ও ক্রোধও ছিল। উদাহরণঃ রাসূল (সাঃ) একবার এক স্ত্রীর ঘরে খেতে বসলে অন্য স্ত্রী একটি পেয়ালায় করে কিছু পাঠান। এতে সে স্ত্রী জেদের সাথে সে পেয়ালাটি হেঁচকা টান দিলে তা পড়ে ভেঙ্গে যায়। এমতাবস্থায় রাসূল (সাঃ) তাকে কিছুই না বলে আরেকটি পেয়ালা এনে সমস্যা মিটিয়ে দেন।

আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি ও তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে সম্প্রীতি বৃদ্ধি

(ঘ) আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি ও তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে সম্প্রীতি বৃদ্ধিঃ

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পারিবারিক সম্পর্কের মাধ্যমে আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি ও সম্প্রীতি বৃদ্ধির সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি তার নিকটতম সাহাবায়ে কেরামকে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত ওমরের (রাঃ) কন্যা বিয়ে করা এবং হযরত ওসমান (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ)র নিকট নিজ কন্যা বিয়ে দেয়ার মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টি করেন।

কোরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবিবা (রাঃ) কে বিয়ে করার মাধ্যমে আবু সুফিয়ানের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি, হযরত জুয়াইরিয়াকে বিয়ে করে বনু মুস্তালিকের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি, ইহুদী কন্যা হযরত সুফিয়া ও হযরত রায়হানাকে বিয়ে করে ইহুদীদেরকে ইসলাম বিরোধিতায় নমনীয় করা ও হযরত মারিয়া কিতবিয়াকে বিয়ে করে খ্রিস্টানদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করেন। দেখা যায় এভাবে তিনি আত্মীয়তার সম্পর্ককে ইকামতে দ্বীনের স্বার্থে কাজে লাগান।

এভাবে রাসূলের (সাঃ) গোটা জিন্দেগীর পারিবারিক দিকটি দুনিয়ার মানুষের নিকট একটি উদাহরণ ও আদর্শ হয়ে রয়েছে। তাঁর শৈশব কৈশোর গেছে দুঃখে-কষ্টে, যৌবনে এসে জীবনে এসেছে প্রাচুর্য ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। নবুয়তী জিন্দেগীতে পারিবারিক জীবন যাপন করে গেছেন যথারীতি, হিজরতের পরবর্তী পারিবারিক জীবন, সামাজিক সংস্কার, পুনর্বাসন ও রাজনৈতিক ও গোত্রীয় সম্প্রীতি সৃষ্টি ও বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) পারিবারিক জীবনে মুসলমানদের জন্য শিক্ষণীয় রয়েছে অনেক কিছু।

চতুর্দশ অধ্যায় : মুসলিম পরিবারে দ্বীনী পরিবেশ: আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার

একটি মুসলিম পরিবার পিতামাতা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে গঠিত। পিতামাতার একজন বা দুইজন বৃদ্ধাবস্থায় থাকতে পারেন অথবা এক বা দুইজনই মৃত্যুবরণ করতে পারেন, অন্যদের মধ্যেও কেউ মৃত্যুবরণ করতে পারেন। যারা জীবিত রয়েছেন তাদেরকে নিয়েই পরিবার।

একটি মুসলিম পরিবার হবে দীন ইসলামের অনুসারী, ইসলামের ঐতিহ্যে ঐতিহ্যবান, ইসলামের পরিচয়ে পরিচিত। শুধুমাত্র নামসর্বস্ব মুসলমান নয়, সত্যিকার কোরআন-হাদীস মোতাবেক মুসলমান। এখানে সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী সকলেই হবে ইসলামী শিক্ষার আলোকে চরিত্রবান, আদব-কায়দা ও আচার-আচরণে ইসলামী চরিত্রের অধিকারী, শরীয়তের পাবন্দ এবং দুনিয়ায় ইসলামী জীবন বিধান বাস্তবায়নে তৎপর।

মুসলিম পরিবারে থাকবে একটি দ্বীনী পরিবেশ। পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানাদি এই তিন প্রজন্মের সকলের মধ্যেই থাকবে ঈমান ও আকিদাগত স্বচ্ছতা। মহান আল্লাহ আমাদের স্রষ্টা। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, তিনি মালিক, মনিব এবং আইন ও বিধানদাতা, তিনি ছাড়া ইবাদত-বন্দেগী, দাসত্ব ও গোলামী পাওয়ার যোগ্য আর কেউ নেই। কেবলমাত্র তাঁরই দাসত্ব ও গোলামী করতে হবে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁকেই মেনে চলতে হবে, তাঁরই আনুগত্য করে যেতে হবে। আর তাঁকে মেনে চলার ক্ষেত্রে একমাত্র হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) কে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ও সর্বাবস্থায়। রাসূল (সাঃ) আল্লাহ প্রদত্ত ঐশীগ্রন্থ আল-কোরআনের আলোকে জীবন ও সমাজকে গড়ে তুলেছিলেন। সেই কোরআনের আলোকেই পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোরআনের আলোকে যদি দুনিয়ার জীবনকে গড়ে তোলা যায়, পরিবারের লোকদের আমল যদি কোরআন মোতাবেক হয়, তাহলে আখেরাতের জীবনে পরিবারের লোকেরা সুখে-শান্তিতে চিরকাল বেহেস্তে থাকবে। আর যদি পরিবারের সদস্যবৃন্দ কোরআনের আইন ও বিধানকে উপেক্ষা করে, অন্যভাবে দুনিয়ায় জীবনযাপন করে, আল্লাহ প্রদত্ত কোরআনের আইন-বিধানকে পরোয়া না করে নফসের খাহেশমত অথবা শয়তানের ফর্মুলা মত বা অন্য কোন মানুষের উদ্ভাবিত জীবন-বিধান মত দুনিয়ার জীবন পরিচালনা করে তবে আখেরাতের অনন্ত জীবন কাটাবে দোজখের অনলে। পরিবারের সদস্যবৃন্দ দৃঢ়ভাবে উক্ত ঈমান আকিদা পোষণ করবে, কোন অবস্থাতেই শেরকের আকিদা পোষণ করবে না। কারণ শেরক হলো সবচেয়ে বড় জুলুম। হযরত লোকমান তার ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন “হে পুত্র, আল্লাহর সাথে শেরক করো না, কারণ শেরক হলো সবচেয়ে বড় জুলুম”- আল কোরআন। এভাবে পরিবারের লোকদের জীবনের কামিয়াবীর মূল ভিত্তি হলো শেরক মুক্ত নির্ভেজাল ঈমান।

এরূপ নির্ভেজাল ঈমানের সাথে সাথে পরিবারের লোকদের ইসলামী জ্ঞানে জ্ঞানবান করে তুলতে হবে। কোরআন, হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য পড়ার সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে পরিবারের লোকদের জন্য। জ্ঞান হলো আলো, এই আলোতে পরিবারের লোকদের আলোকিত করতে না পারলে পরিবারের লোকেরা তো অন্ধকারেই নিমজ্জিত হয়ে থাকবে। অন্ধকার মুক্তির পথ নয়, মুক্তির পথ হলো আলো। এই আলো বিকিরণের জন্য প্রতিটি পরিবারে একটি ছোট-খাট পাঠাগার কায়েম করতে হবে। সেখানে থাকবে কোরআনের তাফসীর, হাদীসের তরজমা ও ব্যাখ্যা এবং অন্যান্য ইসলামী সাহিত্য, মনীষীদের জীবনী, মাসলা-মাসায়েলের বইপত্র ইত্যাদি। কেবলমাত্র বইপত্র থাকাই যথেষ্ট নয়, বইপত্র পড়ার পরিবেশও থাকতে হবে। ফজরের নামাযের পর এবং মাগরিব বা এশার নামাযের পর বাড়ীর সকলেই যেন কিছু সময় পড়াশুনায় ব্যয় করে তার তাগিদ প্রদান করতে হবে। অবশ্য যারা ছাত্র বা ছাত্রী জীবন কাটাচ্ছে তাদেরতো মুখ্য কাজই হবে লেখাপড়া।

পরিবারের নিয়মিত ও অনিয়মিত খরচপত্রের জন্য পরিবারের কিছু সংখ্যক সদস্যকে আয়-রোজগারে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আয় রোজগার করতে হবে সৎ ও ন্যায়ভাবে। কৃষি, শিল্প-ব্যবসা বা চাকুরী যাই করুন না কেন হালাল উপার্জনের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। কোন অবস্থাতেই হারাম উপার্জনের পথে রওয়ানা দেয়া যাবে না। বরং পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের সকলেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও গাফলতি পরিবারের জন্য বয়ে আনে দুঃখ, বিপদ ও ক্ষতি। উপার্জনের ব্যাপারে পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান হওয়া জরুরী। কবি কত সুন্দরভাবে বলেছেন:

“পরিশ্রমে ধন আনে, পুণ্যে আনে সুখ
আলস্যে দারিদ্র্য আনে, পাপে আনে দুঃখ।”

নবী রাসূলদের জীবনী থেকে এ ব্যাপারে আল-কোরআনে কয়েকটি গুণের সন্ধান পাওয়া যায়। হযরত মুসা (আঃ) এর ব্যাপারে বলা হয়েছে: ‘স্বাস্থ্যবান, শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’ ব্যক্তিই কাজের ব্যাপারে উত্তম। আর হযরত ইউসুফ (আঃ) নিজের ব্যাপারে বলেছেন, আমি সংরক্ষক ও বিশ্বস্ত। তাহলে চাকুরী, ব্যবসা বা কৃষি কাজের জন্য:

১. স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী হতে হবে;
২. সংরক্ষক হেফাজতকারী হতে হবে, অপব্যয়ী নয় মিতব্যয়ী হতে হবে;
৩. সর্বক্ষেত্রে বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাপূর্ণ হতে হবে;

পরিবারের উপার্জনের সদস্যগণ উপরোক্ত গুণাবলী সম্পন্ন হলে পরিবারে রুজি- রোজগারের সমস্যা হতে পারে না। উপার্জন আল্লাহর মেহেরবানীতেই যথেষ্ট হয়। পরিবারের সদস্যদের উপার্জিত আয়কে যথাযথভাবে খরচ করতে হবে। তা কোন হারাম পথে, অন্যায় পথে খরচ করা যাবে না, অপব্যয় অপচয় করা যাবে না। প্রয়োজীয় খরচপত্র করার সাথে সাথে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর হকের প্রতি যথারীতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং তাদের হক আদায় করতে হবে, গরীব-মিসকীনের আবেদন পূরণ করতে হবে, সম্ভব মত তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি সাধ্যমত আল্লাহর পথে খরচ করতে হবে, ইকামতে দ্বীনের প্রয়োজনে সাধ্যমত শরীক হতে হবে। হিসাবমত যাকাত, ফেতরা আদায় করতে হবে। কুরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকলে তা পালন করতে হবে। কারো উপর হজ্ব ফরয হয়ে থাকলে হজ্ব আদায় করতে হবে। এভাবে নিজ নিজ শক্তি-সামর্থ্য, মেধা ও যোগ্যতানুযায়ী যেমন হালালভাবে আয়-উপার্জন করতে হবে, তেমনি হালালভাবে পারিবারিক, সামাজিক ও দ্বীনী খরচপত্র করতে হবে। কোনরূপ বেহুদা খরচ করে, বিলাসিতা অপব্যয় করে, উপার্জিত সম্পদ নষ্ট করা যাবে না।

পরিবারের সদস্যদের চারিত্রিক সংশোধন ও নৈতিক উন্নয়নের জন্য সদা সতর্ক থাকতে হবে। উত্তম চরিত্র মানে উত্তম আমল অর্থাৎ পরিবারের সদস্যরা যেন ভাল কাজ বেশী করে আর মন্দ কাজ পরিহার করে তার সমূহ প্রয়াস নিতে হবে। এজন্য আমাদেরকে ভাল কাজ কোনগুলি আর মন্দকাজ কোনগুলি তা যথাযথ ভাবে জেনে নিতে হবে।

ভাল কাজ যা পরিবারের লোকেরা অংশগ্রহণ করে তা হলো

১. যথার্থ দ্বীনী আদব সম্মত যথা- নামায, রোজা, দান-খয়রাত ইত্যাদি কাজসমূহ নিয়মিত আদায় করা। বিশেষ করে ফরয নামায সমূহ গুরুত্বমত যথারীতি জামাতে আদায় করা অর্থাৎ ওযুসহ গড়পড়তা ভাবে। নদিদের প্রস্রবণ কোরআন বলা হয়েছে, তারা তাদের পরিবারের লোকজনকে নামাজ আদায়ের হুকুম প্রদান করে। নামাজের মাধ্যমে সরাসরি আল্লাহর সাথে রক্তপাত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিবারে বলে থাকে পরিবারের লোকেরা তাদের শিশুদের নামাজ আদায় করা উচিত।

২. পিতামাতার খেদমত করা দ্বিতীয় উত্তম আমল। যাদের পিতামাতা দু’জনই অথবা একজন জীবিত আছেন এবং বৃদ্ধাবস্থায় পৌঁছে গেছেন তাদের যথার্থ খেদমত ও সেবা-শশ্রূষা করে যেতে হবে। হাদীসে বলা হয়েছে ৪ উত্তম আমল সম্পর্কে নবী (সাঃ) বলেছেন, বায়ু গাম্বুয় ফরয নামায, পিতামাতা খেদমত করা ও জেহাদ ওয়াজেব। মুসলিম পরিবারে বৃদ্ধ পিতামাতার খেদমত করা এক ঐতিহ্যবাহী আমল। তাদেরকে কোন প্রকার কষ্টও দেওয়া বলা হয় না। কোনভাবে কষ্ট দেওয়া হয় না বরং তাদের সাথে সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে কথা বলা হয়, প্রয়োজনীয় খেদমতও করা হয়, তাদের মনতুষ্টির জন্য যা যা করার দরকার তা করা হয়। বৃদ্ধ পিতামাতার সেবা-যত্ম করা সর্বতোভাবে সম্পন্ন করা।

৩. পরিবারের সকল বালেগ সদস্য আল্লাহর দ্বীন বাস্তবায়নের (জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহর) কাজে আত্মনিয়োগ করে। প্রত্যেকে নিজ নিজ পর্যায়ে সংগঠনে শামিল হয়ে দায়িত্ব পালন করে। কিশোর সংগঠন, ছাত্র বা ছাত্রী সংগঠন, বড়দের সংগঠন, মহিলা সংগঠন ইত্যাদি যার যার স্তরে সে শামিল হয়ে যথারীতি নিজ নিজ করণীয় কাজ যথারীতি প্রত্যেকেই করে যায়। সংগঠন যেভাবে নিজকে গড়ে তুলতে বলে সেভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে প্রয়াস পায়। সংগঠনের কর্মসূচী বাস্তবায়নে যথাসাথ্য তৎপর হয়। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে সংগঠনের দায়িত্বও যথারীতি আঞ্জাম দিয়ে যায়। কঠিন কর্মসূচী বাস্তবায়নেও পিছিয়ে যায় না। রাসূলের যুগে সাহবায়ে কেরাম এমনভাবে ইসলামী আন্দোলনের কাজে সর্বদা শরীক ও তৎপর থাকতেন। সে আদর্শকে সামনে রেখে প্রতিটি মুসলিম লোকেরা যথারীতি কাজ করে যায়।

৪. ইসলামী আন্দোলনে তথা জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজেও তৎপর থাকতে গিয়ে জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহর অংশ হিসেবে দুনিয়ার মানুষকে ডাকতে হবে আল্লাহর পথে, দ্বীনের পথে এবং ইসলামের পথে। নিজ পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও আশে পাশের লোকসহ যাদের সংস্পর্শে পরিবারস্থ লোকেরা মেলামেশা করবে তাদেরকে ডাকতে হবে আল্লাহর পথে। হেকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে লোকদেরকে আল্লাহর পথে ডেকে যাওয়া মানুষের কর্তব্য বরং হুকুম।

اُدْعُ إِلى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ

“ডাকো রবের পথে হেকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে”- আল কোরআন।
তাই পরিবারের সকল সদস্য নিজ নিজ পরিবেশে আল্লাহর পথে ডাকার এ দায়িত্ব পালন করে যায় অবিরাম ও সদা-সর্বদা।

৫. অপর একটি সৎ আমল হলো লোকদের সাথে ভাল ব্যবহার। একটি মুসলিম পরিবারের লোকেরা সংশ্লিষ্ট লোকদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করে, গর্ব ও অহংকার করে না বরং বিনয়ী ও আপোষমূলক ব্যবহার করে। এভাবে তাদের সাথে সু-সম্পর্ক স্থাপন হয়। ঝগড়া-ঝাঁটি, মারামারি ও হিংসা বিদ্বেষ করে পরিবেশকে বিষময় করে তোলে না বরং শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান করে। প্রতিবেশীর সাথে সু-সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ধনী-গরীব সকল প্রতিবেশীর সাথে মিলে মিশে চলে। প্রতিবেশীর সাথে সীমানা নিয়ে ঝগড়া করে না বরং মীমাংসা করে নেয়। প্রতিবেশীর ছেলে-মেয়েদের সাথে ঝগড়াঝাঁটি হয়ে গেলে মীমাংসার পথ তালাশ করে, ঝগড়াকে আরো বাড়িয়ে তোলে না। প্রতিবেশীর সাথে হাদিয়া তোহফা বিনিময় করে, উৎসবাদিতে শরীক হয়, অসুখে-বিসুখে দেখতে যায়, বিপদ-আপদ ও মৃত্যু বেদনায় শরীক হয় ও সমবেদনা জ্ঞাপন করে।

৬. ওয়াদা-আমানত, লেনদেনে পরিবারের লোকেরা স্বচ্ছতা ও সততার পরিচয় দেয়। ওয়াদা ভংগ করে না, আমানতের খেয়ানত করে না, লেনদেন থাকে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ। এসব ব্যাপারে পরিবারের লোকদের থাকে সুনাম ও সুখ্যাতি। এলাকার লোকেরা এই মুসলিম পরিবারটিকে একটি আদর্শ পরিবার বলে মনে করে। একটি শরীফ ও ভদ্র পরিবার হিসাবে পরিবারটি পরিচিতি লাভ করে।

৭. পরিবারটির বাড়ী-ঘর, সদস্যদের লেবাস-পোষাক, বাড়ীর ভিতর বাহির সর্বত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার একটি ছাপ পাওয়া যায়। একটা পরিচ্ছন্ন রুচিবোধের প্রকাশ ঘটে সর্বক্ষেত্রে। ‘পবিত্রতা ঈমানের অংগ’, ‘আল্লাহ তায়ালা পবিত্রতা অবলম্বনকারীদেরকে ভালবাসেন’- এসব যথার্থ কথার প্রমাণ মিলে পরিবারটির সকল দিক থেকে।

৮. এছাড়া সকল প্রকার ভাল কাজে পরিবারের লোকেরা অংশগ্রহণ করে। ভাল ও নেক কাজের মাধ্যমে তারা সদাচারী বলে পরিচয় লাভ করে। ভাল ও নেক কাজে তারা সহযোগিতা করে। ইয়াতীম-মিসকিন, অসহায় এ বাড়ীর দ্বারস্থ হয়ে ধমক খেয়ে ফিরে যায় না বরং সাধ্যমত সহযোগিতা লাভ করে। বাড়ীর চাকর-বাকর বকুনী ও মারপিট খেয়ে অপদস্থ হয় না বরং তাদের স্ব-স্ব অবস্থায় তারা মান ইজ্জত নিয়ে তাদের কাজ করে ও যথারীতি মজুরী পেয়ে যায়।

৯. সকল প্রকার সামাজিক ভাল ও কল্যাণের কাজে এ পরিবারের পক্ষ থেকে আর্থিক ও জনবলের সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করা হয়। পরিবারের সদস্যগণ সামাজিক কাজে যথারীতি অংশগ্রহণ করে বরং বিভিন্ন সামাজিক কাজে তারা নেতৃত্ব প্রদান করে। সংকাজ ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে এ পরিবারের লোকেরা সহযোগিতা করে।

মন্দকাজ যা এ পরিবারের লোকেরা পরিহার করে চলে তা হলো

১. এ পরিবারের লোকেরা আকিদাগত বিভ্রান্তি, শেরক, বেদায়াত, কবর পূজা, গোমরাহীমূলক আচার-অনুষ্ঠান, বর্বরসম ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকে। এ জাতীয় কাজকর্মে কখনো অংশগ্রহণ করে না বরং লোকদেরকে যথাসাধ্য এসব থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। এসব কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও কলুষিত পরিবেশ থেকে এ পরিবার থাকে মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন।

২. এ পরিবারের লোকেরা মিথ্যা, ধোঁকা, প্রতারণা ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত ও সম্পর্কহীন। যাবতীয় অসৎচরিত্র ও অসৎকাজ এ পরিবারের লোকেরা পরিহার করে চলে। আয়-উপার্জনে তারা কোন হারাম পথ অবলম্বন করে না। তারা কোন অবস্থাতেই সুদ-ঘুষের সাথে জড়িত হয় না।

৩. পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সু-সম্পর্ক বজায় থাকে, সুন্দর সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিবার পরিচালিত হয়। পারস্পরিক মনোমালিন্য, রেষারেষী, বিবাদ-বিসম্বাদ থাকেনা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। থাকেনা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া ও মনোমালিন্য, পিতা-পুত্রে কোন্দল, শাশুড়ী-বৌয়ে বিবাদ, ভাবী-ননদে কাদা ছোড়াছুড়ি। এসব অশান্তিমূলক পরিবেশের বদলে সে পরিবারে থাকে চমৎকার সমন্বয়, সৌহার্দ্য ও শান্তি।

৪. এ পরিবারের যুবক ছেলেরা সন্ত্রাস, হাইজাক করে বেড়ায়না, জুয়া ও মদের আসরে যায় না, চুরি-ডাকাতিতে লিপ্ত হয় না। তাস পিটানো, রেডিও, টিভির বাজে-অশ্লীল ও সময়ক্ষেপণকারী অনুষ্ঠান দেখে সময় নষ্ট করে না।

৫. এ পরিবারের লোকেরা সমাজ বিধ্বংসী কাজকর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বিরত থাকে। মদ, নেশা, হিরোইন, চোরাচালান এইসব সমাজ বিরোধী কাজ থেকে তারা দূরে থাকে। তারা যেনা-ব্যভিচার বেপর্দা-বেহায়াপনা থেকে সযত্নে দূরে থাকে।

এভাবে পরিবারের লোকদের মধ্যে ভাল ও নেক কাজের প্রচলন, মন্দ ও পাপ কাজ পরিহার করার অভ্যাস সৃষ্টি করতে হবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:

يايُّهَا النَّبِيُّ إِذَا جَاءَكَ الْمُؤْمِنَتُ يُبَايِعْنَكَ عَلَى أَنْ لَا يُشْرِكْنَ بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا يَسْرِقُنَ وَلَا يَرْنِينَ وَلَا يَقْتُلْنَ أَوْلَادَهُنَّ وَلَا يَأْتِينَ بِبُهْتَانٍ يفترينه بَيْنَ أَيْدِيهِنَّ وَأَرْجُلِهِنَّ وَلَا يَعْصِيَنَكَ فِي مَعْرُوفٍ فَبَايِعُهُنَّ وَاسْتَغْفِرْ لَهُنَّ اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ –

“হে নবী যখন মু’মিন নারীগণ আপনার নিকট এসে এই বলে প্রতিজ্ঞা করে যে- তারা আল্লাহর সাথে শরীক করবে না, চুরি করবে না, জিনা করবে না, তাদের সন্তানদের হত্যা করবে না এবং তাদের হাত ও পা সমূহের মধ্যবর্তী কোন অপবাদের অপবাদ আনবে না এবং ভাল (মারুফ) কাজে তারা আপনার বিরুদ্ধাচরণ করবে না তখন তাদের বাইয়াত (প্রতিজ্ঞা) গ্রহণ করুন এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” (সূরা মুমতাহিনা : ১২)

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَتْ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ مـ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلوةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكُوةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهِ وَرَسُولَهُ ط أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ طَ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ –

“মু’মিন নারী পুরুষগণ একে অপরের বন্ধু, তারা ন্যায় ও সৎ কাজের আদেশ করে, অপছন্দনীয় ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, আল্লাহ ও রাসূলকে মান্য করে। এদের প্রতি শিগগীরই আল্লাহ রহমত দান করবেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত ও মহাবিজ্ঞানময়।” (সূরা তাওবা : ৭১)

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغِى يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ –

“নিশ্চয়ই আল্লাহ আদেশ করছেন ইনসাফ ও সদাচার করতে এবং নিকট আত্মীয়কে দান করতে এবং নিষেধ করেছেন নির্লজ্জতা, অপছন্দনীয় (মন্দ) কাজ এবং বিদ্রোহ করতে; আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দেন যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।” (সূরা নাহল : ৯০)

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَمَى وَالْمَسْكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَنْكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالاً فَخُورًا –

“আর এবাদত কর আল্লাহর এবং কোন কিছুর সাথে তাকে শরীক করো না ও পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর, সদ্ব্যবহার কর আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকিনদের সাথে, নিকট প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর সাথে, পার্শ্ববর্তী বন্ধু-বান্ধবের সাথে, পথিকের সাথে এবং তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের সাথে, নিশ্চয়ই আল্লাহ যারা নিজেদেরকে বড় মনে করে, অহংকার করে তাদেরকে ভালবাসেন না।” (সূরা নিসাঃ ৩৬)

এভাবে আল্লাহ তায়ালা পরিবারের লোকদেরকে সদ্ব্যবহার ও সদাচরণের শিক্ষা দান করেছেন। এসব নেক কাজের যে সওয়াব ও প্রতিদান পাওয়া যাবে তাও আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেছেনঃ

ذَالِكَ الَّذِي يُبَشِّرُ اللَّهُ عِبَادَهُ الَّذِينَ أَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ قُلْ لا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةِ فِي الْقُرْبَى وَمَنْ يَقْتَرَفْ حَسَنَةً نَزِدْلَهُ فِيهَا حُسْنًا إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ شَكُورٌ

“এ হলো তা যা আল্লাহ তাঁর ঐ সব বান্দা যারা ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে তাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছেন, আপনি বলুন, আমি তো তোমাদের নিকট আত্মীয়তার ভালবাসা ভিন্ন কোন প্রতিদান চাই না, যে ব্যক্তি কোন ছওয়াবের কাজ করে, আমরা তার ছওয়াব আরো বাড়িয়ে দেই, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও প্রতিদানকারী।” (সূরা শুরাঃ ২৩)

একটি মুসলিম পরিবারে এমনিভাবে একটি চমৎকার দ্বীনী পরিবেশ সৃষ্টি হবে। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও সকল মানুষের সাথে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সু-সম্পর্ক কায়েম হবে।

পারিবারিক আদব কায়দা

পরিবারের বৃদ্ধ পিতামাতাকে যেমন তাদের ছেলে-মেয়ে, বধূ-জামাই, নাতি-নাতনী সম্মান-শ্রদ্ধা, খাতিরযত্ন, সেবা-শশ্রূষা করবে, তেমনি বৃদ্ধ পিতা-মাতা সকলকে মহব্বত ও স্নেহ-আদর করবেন। পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে থাকবে গভীর মহব্বত ও ভালবাসা। স্ত্রী স্বামীকে যথারীতি সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে, স্বামীও স্ত্রীকে দিবে যথাযথ মর্যাদা। তাদের ছেলে-মেয়েরা পিতামাতাকে যথারীতি সম্মান জানাবে, তাদের কথানুযায়ী কাজ করবে, তাদের অনুগত ও বাধ্য থাকবে। পিতামাতাও যথারীতি তাদের প্রতি ভাল ব্যবহার করবে, তাদেরকে আদব-লেহাজ শিক্ষা দেবে, কোরআন-হাদীসের জ্ঞানার্জনে সহায়তা করবে। যথাসময়ে লেখা পড়ার ব্যবস্থা করবে, উপযুক্ত বয়সে বিয়ে-সাদীর ব্যবস্থা করবে। মোটকথা পরিবারে বড়দেরকে সম্মান করা ও ছোটদেরকে ভালবাসা ও স্নেহ করা যথারীতি চালু থাকবে এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব যথারীতি আঞ্জাম দিবে। চাকর-চাকরানীদের সাথেও সদ্ব্যবহার বজায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে তারাও আমাদের মত মানুষ, আল্লাহ তাদেরকে আমাদের অধীন করে দিয়েছেন – রাসূলেরও সে কথা। তাদেরকে তাই খেতে দিতে হবে যা পরিবারের সকলে খায় এবং তাদেরকে তাই পড়তে দিতে হবে যা পরিবারের অন্য সকলে পরিধান করে। তাদেরকে তাদের সাধ্যমত কাজ দিতে হবে। সাধ্যের অতিরিক্ত কাজে নিয়োগ করলে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। এসব হাদীসের শিক্ষা। এ শিক্ষানুযায়ী আমল করতে হবে।

পরিবারের লোকদের মধ্যে সালামের প্রচলন করতে হবে। সালাম দানকারীর চেয়ে উত্তমভাবে সালামের জবাব দিতে হবে। কোরআন ও হাদীসে সালাম বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে।

فَإِذَا دَخَلْتُمْ بُيُوتًا فَسَلِّمُوا عَلَى أَنفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِّنْ عِنْدِ اللَّهِ مُبَارَكَةً طَيِّبَةً “

“যখন তোমরা কোন বাড়ীতে প্রবেশ কর, তখন তোমরা তোমাদের নিজেদের লোকদেরকে সালাম দাও, আল্লাহর নিকট থেকে দোয়া স্বরূপ যা বরকতময় ও পবিত্র।” (সূরা নূর: ৬১)

পরিবারের মাহরাম লোকদের মধ্যেও যথারীতি পর্দাব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। স্বামী- স্ত্রী ছাড়া পরিবারের অন্যান্য মাহরাম নারী-পুরুষের মধ্যে নারীদের চেহারা, হাতের কব্জি পর্যন্ত ও পায়ের টাকনু পর্যন্ত দেখা জায়েয। শরীরের বাকী অংশের পর্দা করতে হবে, তবে কোন অংশ যদি স্বাভাবিক ভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে তবে ভিন্ন কথা। মুসলিম পরিবারে যারা পর্দা ব্যবস্থা মানেন তাদের মধ্যেও এ ব্যাপারে ত্রুটি হয়ে থাকে। তাই এ ব্যাপারে সাবধান ও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া তিনটি সময় বাড়ীর চাকর-চাকরানী ও নাবালেগ বাচ্চাদেরও স্বামী-স্ত্রী রূপে বসবাসকারীদের ঘরে যেতে আল কোরআন নিষেধ করেছে। অবশ্য পর্দা যোগ্য পুরুষ চাকরের ক্ষেত্রে তো পর্দা মেনেই চলতে হবে সব সময়।

يايُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِيَسْتَاذِنُكُمُ الَّذِينَ مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ وَالَّذِينَ لَمْ يَبْلُغُوا الْحُلُمَ مِنْكُمْ ثَلَاثَ مَرَّتَ مِنْ قَبْلِ صَلَاةِ الْفَجْرِ وَحِيْنَ تَضَعُونَ ثِيَابَكُمْ مِنَ الظَّهِيرَةِ وَمِنْ بَعْدِ صَلَاةِ الْعِشَاءِ ثَلَاثُ عَوْرَاتٍ لَكُمْ لَيْسَ عَلَيْكُمْ وَلَا عَلَيْهِمْ جُنَاحٌ بَعْدَهُنَّ

“হে ঐসব লোক যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের মধ্যে যারা তোমাদের মালিকানাধীন (দাস-দাসী) এবং যারা এখনও বালেগ হয় নি তারা যেন তিন সময় তোমাদের কাছ থেকে অনুমতি নেয়: ফজরের নামাযের পূর্বে, জোহরের সময় যখন তোমরা তোমাদের পোশাক খুলে রাখ এবং এশার নামাযের পর, এ তিনটি সময় তোমাদের পর্দার সময়, এ ছাড়া অন্য সময় তোমাদের বা তাদের যাতায়াতে কোন গোনাহ নেই।” (সূরা নূর: ৫৮)

মুসলমানদের পারিবারিক জীবনে এসব আদব-কায়দা মেনে চলতে হবে। মুসলিম পারিবারিক জীবনে আরেকটি বিষয় আলোচনাযোগ্য, তা হলো পারিবারিক মেহমান। মুসলমান পারিবারে আত্মীয়-স্বজন (নতুনই হোক বা পুরানো) এসে থাকে। মেহমানদের মেহমানদারী করা মুসলিম পরিবারের একটি ঐতিহ্য। জামাইর শ্বশুড় বাড়ী বেড়ানো, নাতি নাতনীদের দাদা-নানার বাড়ী বেড়ানো এতো খুব সাধারণ কথা, বেহাই-বেহাইনের বাড়িতেও পারস্পরিক বেড়ানো হয়ে থাকে। এছাড়া কখনও কখনও অপরিচিত কোন মেহমান বা মুসাফিরও আসতে পারেন। সম্ভব হলে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। ইসলামের বিধান মত তিনদিন পর্যন্ত মেহমান অবস্থান করতে পারে। এর বেশী বাড়ীর মালিকের দায়িত্ব নেই। মেহমানদের সাথে সৌজন্যমূলক ব্যবহার ও আচরণ করা দরকার। সাধ্যমত তাদের খেদমত ও সেবা করতে হবে।

ইসলামী সভ্যতার দাবী

পরিবারের লোকদেরকে সর্বক্ষেত্রে ও সর্বাবস্থায় যথাযথভাবে ইসলামী আচরণ মেনে চলতে হবে। এ পরিবারের লোকেরা যথারীতি বড়দেরকে সম্মান প্রদর্শন করবে, ছোটদেরকে আদর-স্নেহ করবে, যথারীতি সালাম বিনিময়-করবে। বাড়ী থেকে বেরুবার সময় গুরুজনের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে দোয়া পড়ে বের হবে। হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলবে, হাই দেয়ার পর ‘লাহাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউল আজীম’ এই দোয়া পড়বে। খাওয়ার আগে পিছে, ঘুমাবার জন্য শুতে গিয়ে এবং ঘুম থেকে জেগে যথারীতি দোয়া পড়বে। নামাযের আযান হয়ে গেলে পুরুষরা মসজিদমুখী হবে, মহিলারা ঘরে নামায আদায়ে মগ্ন হবে। বাইরে থেকে কোন মানুষ বাড়ীতে এলে তাকে সাদরে গ্রহণ করা হবে, তার প্রয়োজন যথারীতি পূরণ করে তাকে বিদায় দিতে হবে।

পরিবারে ইসলামী পরিবেশ, আদব-কায়দা ও আচার-আচরণে ইসলামী রীতিনীতি মেনে চলার শিক্ষা ও চেষ্টা প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে জারী থাকা দরকার। এ পর্যায়ে দুটি বিষয় ফলপ্রসূ ভূমিকায় রাখতে পারে।

একে অপরে পারিবারিক সহযোগিতা প্রদান

১. একে অপরে পারিবারিক সহযোগিতা প্রদান। বিভিন্ন ব্যাপারে একে অপরে সহযোগিতা প্রদান করা যেতে পারে, কেউ কোন বিষয়ে অবহেলা করলে বা শিষ্টাচারের খেলাফ কোন কিছু করে বসলে অন্যে তা শুধরিয়ে দেবেন, মৌলিক ইবাদত আদায়ে পারস্পরিক সহযোগিতা করবে। স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, পিতা-মাতা ও সন্তানদের মধ্যে এরূপ সহযোগিতা হতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর সহযোগিতার ব্যাপারে হাদীসে উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির প্রতি করুণা বর্ষণ করেন যে ব্যক্তি রাত জেগে নফল নামায আদায় করে এবং তার স্ত্রীকে জাগিয়ে তোলে এবং সেও নামায আদায় করে আর সে যদি ঘুম থেকে জেগে উঠতে না চায় তাহলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। অনুরূপভাবে আল্লাহ করুণা বর্ষণ করেন ঐ স্ত্রীলোকের প্রতি যে স্ত্রীলোক রাত জেগে নফল নামায আদায় করে এবং তার স্বামীকে জাগিয়ে তোলে এবং সেও নামায আদায় করে এবং যদি স্বামী ঘুম থেকে উঠতে না চায় তবে তার চেহারায় পানি ছিটিয়ে দেয়। (আবু দাউদ)

পারিবারিক শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও বৈঠক

২. পারিবারিক শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও বৈঠক:

পরিবারের সদস্যদের দ্বীনী জিন্দেগী যাপন, আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার এর যথারীতি পারিবারিকভাবে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। মানুষ আপনা আপনি কোন কিছু জেনে বা শিখে ফেলে না। কোরআন-হাদীস ও ইসলামী ইবাদতের শিক্ষার জন্য ফুরকানিয়া মক্তব-মাদ্রাসার সাহায্য নেয়া যেতে পারে। কিন্তু এরপরও দ্বীনী জিন্দেগী, আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার শিক্ষার প্রতি বাপ-মায়ের বিশেষ নজর দেয়া দরকার। বাস্তব প্রশিক্ষণের ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন মা। পিতাও এ ক্ষেত্রে কম-বেশী ভূমিকা রাখতে পারেন। এ ব্যাপারে সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক পারিবারিক বৈঠক বিশেষ সহায়ক ও উপকারী হতে পারে। পারিবারিক বৈঠকে কোরআন-হাদীসের শিক্ষার সাথে সাথে আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার সম্পর্কেও শিক্ষা দেয়া যেতে পারে।

পঞ্চদশ অধ্যায় : পারিবারিক জীবনে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ভোগ-বিলাস ও ধন-সম্পদ আহরণ

পারিবারিক জীবন ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্য

মানুষ পারিবারিক জীবনে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কামনা করে। আসলে মানুষের নিকট পার্থিব জীবনটাই খুব লোভনীয় ও আকর্ষণীয়। মানুষ তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়ের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারে খুবই তৎপর ও পরিশ্রমী। তার জীবনের রুজি-রোজগার পরিবারের পিছনেই সে খরচ করে। আল কোরআনে খুবই সুন্দরভাবে দুনিয়ার মায়া-মোহের কথা বলা হয়েছেঃ

زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمَقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ

“মানুষের নিকট মনোমুগ্ধকর ও আকর্ষণীয় করা হয়েছে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির ভালবাসার আকাঙ্ক্ষাকে, সোনা ও রূপার স্তূপ, চিহ্নযুক্ত ঘোড়া এবং গৃহপালিত জন্তু-জানোয়ার ও শস্য ফসলাদিকে।” (সূরা আলে এমরান: ১৪)

দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:

اعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَهُوَ وَزِينَةً وَتَفَاخُرُ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرُ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ

“জেনে রাখো, দুনিয়ার জীবন হলো খেল-তামাশা ও সৌন্দর্য এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যে গর্ব ও অহংকার এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির আধিক্য মাত্র।” (সূরা হাদীদ: ২০)

মানুষ সৃষ্টির আদিকালেই আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছিলেন, তোমাদের জন্য দুনিয়াতে রয়েছে দ্রব্য সামগ্রী, সম্পদাদি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেনঃ

وَلَقَدْ مَكَّنكُمْ فِي الْأَرْضِ وَجَعَلْنَا لَكُمْ مَعَايِشَ قَلِيلاً مَا تَشْكُرُونَ –

“নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে পৃথিবীতে থাকার জায়গা দিয়েছি এবং দিয়েছি জীবিকার উপকরণ, তোমরা খুব কমই শুকরগোজার হয়ে থাক।” (সূরা আরাফ: ১০)

– وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيهَا مَعَايِشَ وَمَنْ لَسْتُمْ لَهُ بِرَازِقِينَ
“আমি তোমাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছি এবং তোমরা যাদের রেযেকের ব্যবস্থা করোনি তাদের জন্যও রেযেকের ব্যবস্থা করেছি।” (সূরা হিজর : ২০)

هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولاً فَامْشُوا فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُوا مِنْ رِزْقِهِ وَإِلَيْهِ النُّشُورُ –
“আল্লাহ জমিনকে বশীভূত করেছেন, কাজেই তোমরা তাতে চলাফেরা কর এবং তার রেযেক খাও, তোমাদেরকে পুনরায় জীবিত হয়ে উঠতে হবে।” (সূরা মুলক: ১৫)

দুনিয়াতে চলার জন্য মানুষের কিছু অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের প্রয়োজন। তার বাঁচার জন্য প্রয়োজন খাবারের, থাকার জন্য প্রয়োজন বাসস্থান ও ঘরের, তার পরার জন্য প্রয়োজন কাপড়ের, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন ঔষধের। ব্যক্তিকে পরিবারের জন্য এসব জিনিষপত্র যোগাড় করতে হয়। তার দরকার সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য। সেজন্য তাকে আরো অতিরিক্ত জীবনের আরামের সামগ্রী সংগ্রহ করতে হয়। বাড়ীঘর, পোশাক-অলংকারের সৌন্দর্য ও আরামের উপকরণ সংগ্রহে মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এজন্য মানুষের আরো বেশী বেশী রুজি-রোজগারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এসব নিত্য প্রয়োজনীয় ও আরামের জিনিষপত্র সংগ্রহে তাকে রুজি-রোজগার করতে হয়। যার উপকরণ আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে দিয়ে রেখেছেন এবং সৎভাবে এগুলো থেকে উপার্জন করতে বলেছেন। কিন্তু মানুষের মধ্যে কেউ হয়ত সৎভাবেই তা উপার্জন করে আবার কেউ তা উপার্জনে অসৎ পথ অবলম্বন করে, কেউ হয়ত বা কষ্ট পরিশ্রম করেও কষ্টেই দিনাতিপাত করে, কেউ বা আবার লাভ করে অঢেল সম্পদ রাশি।

পরিবারের জন্যই এসব সম্পদ তার প্রয়োজন। কোন পরিবার কষ্টে সৃষ্টে বসবাস করে আবার কেউ সম্পদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করে। যে সম্পদ সে লাভ করে তা থেকে পাক-পবিত্র জিনিষ খেতে আল্লাহ মু’মিনদিগকে বলেছেন:

يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَتِ مَا رَزَقْنَكُمْ وَاشْكُرُوا لِلَّهِ إِنْ كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ

“হে মু’মিনগণ, আল্লাহ তোমাদেরকে যে রেজেক প্রদান করেছেন তা থেকে পাক ও পবিত্র জিনিষগুলো তোমরা খাও আর আল্লাহর শোকর আদায় কর যদি তোমরা কেবলমাত্র তাঁরই গোলামী করে থাক।” (সূরা বাকারা: ১৭১)

কোরআনে বলা হয়েছে:
وَاللَّهُ يَقْبِضُ وَيَبْسُطُ
“আল্লাহ তায়ালা মানুষের সম্পদ কমান ও বাড়ান।”

মানুষের সচ্ছলতা প্রদান ও সংকীর্ণতা দেয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ক্রিয়াশীল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন অঢেল জীবন সামগ্রী দিয়ে থাকেন। আসলে দুনিয়ার দ্রব্য সম্ভার, স্বাচ্ছন্দ্য আল্লাহর অনুগ্রহের উপর নির্ভর করে আর আল্লাহ তা যাকে ইচ্ছা প্রদান করেন:

قُلْ إِنَّ الْفَضْلَ بِيَدِ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

“নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট রয়েছে অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা তা প্রদান করেন তিনি বিশাল প্রশস্ত ও মহাজ্ঞানী।” (সূরা আলে এমরান: ৭৩)

আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার ফলাফল কামনা করে আল্লাহ তাকে তা প্রদান করেন। তবে চূড়ান্ত কথা আল্লাহ তায়ালা কোরআনে যা বলেছেন তা হলো আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেশুমার রেযেক প্রদান করেন, আর যাকে ইচ্ছা সংকীর্ণ করে দেন।

اللهُ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ –

তবে এক্ষেত্রে ব্যক্তির চেষ্টা-তৎপরতা, সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা, বণ্টননীতি ইত্যাদি কার্যকর থাকে।

আল্লাহ তায়ালা পারিবারিক সমৃদ্ধির জন্য রেযেক ও দ্রব্য সামগ্রী সংগ্রহে সৎপথ অবলম্বনের তাকীদ প্রদান করেছেন। কিন্তু মানুষ আল্লাহর বিধানকে পরওয়া না করে অসৎপথ অবলম্বন করে সম্পদ আহরণে তৎপর হয়ে উঠে। প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ার জীবনের সুখ-ভোগ চূড়ান্ত নয়, মানুষকে এসব ছেড়ে আখেরাতের জীবনে চলে যেতে হবে। একথা স্মরণ করে দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

افَرَيْتَ إِنْ مَتَعَنْهُمْ سِنِينَ – ثُمَّ جَاءَ هُمْ مَّا كَانُوا يُوعَدُونَ – مَا اَغْنَى عَنْهُمْ مَا كَانُوا يُمْتَعُونَ

“তুমি কি খেয়াল করেছ যে, আমি যদি তাদেরকে কয়েক বছরের উপভোগের জীবন দেই, এরপর তাদের নিকট আমার প্রতিশ্রুতি এসে যায় তাহলে তারা যা উপভোগ করেছে তা কি কোন উপকারে আসবে?” (সূরা শুয়ারা: ২০৫-২০৭)

দুনিয়ার জীবনে এসব দ্রব্য সামগ্রী কোন রকমে দুনিয়ার জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার জন্য। এর জন্য অতিরিক্ত পেরেশানী, হা-হুতাশ করা ঠিক নয়। আল্লাহ তায়ালা এ ব্যাপারে বলেন:

الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَوةَ الدُّنْيَا ، وَالْبَقِيتُ الصَّلِحْتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلاً

“ধন সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্যমাত্র। আর নেক কাজ অবশিষ্ট থেকে যাবে যা তোমার রবের নিকট পূণ্য হিসাবে এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা হিসাবে অনেক উত্তম।” (সূরা কাহাফ: ৪৬)

ذَالِكَ مَتَاعُ الْحَيَوَاةَ الدُّنْيَا ، وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَابِ – قُلْ أَو نَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذُلِكُمْ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّتُ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَكْرُ خُلِدِينَ فِيهَا

“এ হলো দুনিয়ার জীবনে সামান্য সম্বল মাত্র, আর আল্লাহর নিকট রয়েছে উত্তম আশ্রয়। বলে দিন আমি কি তোমাদেরকে এর চেয়ে উত্তম জিনিসের সংবাদ দিব? যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্যে তাদের রবের নিকট রয়েছে জান্নাত যার নাঁচ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত এবং সেখানে তারা থাকবে চিরকাল।” (সূরা আলে ইমরান- ১৩-১৪)

নবীকে (সাঃ) দুনিয়ার এসব উপভোগের জিনিসের প্রতি নজর দিতে নিষেধ করা হয়েছে:

لَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلى مَا مَتَعَنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْهُمْ وَلَا تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ –

“আপনি চোখ তুলে তাকাবেন না ঐসব উপভোগের জিনিসের প্রতি যা আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে দিয়ে রেখেছি এবং এ ব্যাপারে কোন দুঃখবোধ করবেন না বরং মু’মিনদের জন্য আপনার ডানাকে উত্তোলন করুন।” (সূরা হিজরঃ ৮৮)

নবী জীবনের আদর্শ অবলম্বন করে মু’মিনদেরকে এসব উপভোগের জিনিষের প্রতি আকর্ষণ কমিয়ে আনতে হবে।

পারিবারিক জীবন ও ভোগ বিলাস

পারিবারিক জীবনে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য তো কাম্য কিন্তু এ সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে ভোগ বিলাসে পরিণত করা মানুষের স্বভাব। মানুষ বেশী বেশী পেতে চায়। অর্থনীতিতে বলে চাহিদা সীমাহীন। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, বনী আদমের পেট মাটি ছাড়া আর কিছুতে ভরে না। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

الْهُكُمُ التَّكَاثُرُ – حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ –
“(সম্পদের) আধিক্য তোমাদের ভুলিয়ে দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এমনকি তোমরা কবর পর্যন্ত পৌঁছে যাও।” (সূরা তাকাসুর: ১-২)

মানুষ প্রথমে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ, এরপর আরামপ্রদ দ্রব্যাদি এবং তারপর বিভিন্ন বিলাস দ্রব্য সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কারণ তার পাওয়ার শেষ নেই। আধুনিক যুগের থিউরী মোতাবেক তার জীবন যাপনের মান (Standard of living) বাড়াতে থাকে। দুনিয়াটাকে সে বেহেস্ত বানিয়ে ফেলতে চায়। এক একটি পরিবারে চলে দ্রব্য সম্ভারের সমারোহ আহরণের প্রতিযোগিতা। আর এজন্য ন্যায়-অন্যায়, সৎ-অসৎ, হালাল-হারামের পরওয়া না করে চলে সম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতা। বিলাসী জীবন যাপনের জন্য বিলাস দ্রব্যের সমারোহ ও বন্যা বয়ে যায় এক একটি পরিবারে।

মু’মিনের জন্য এ ধরনের বিলাসী জীবন মোটেও শোভনীয় নয় এবং কখনো সে এ ধরনের বিলাসী জীবনে মত্ত হয়ে পড়তে পারে না। অবশ্য তাকে সৌন্দর্য পিয়াসী হওয়া ও আরামের জিনিষ ভোগ করা দোষণীয় নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَوَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمِ الْقِيِّمَةِ ط

“আপনি বলুন, তোমাদের জন্য আল্লাহর সে সৌন্দর্য যাকে তিনি তার বান্দাদের জন্য বের করেছেন এবং রেযেকের মধ্যে পবিত্র জিনিষগুলোকে কে হারাম করল, বলে দিন এসব তো তাদেরই জন্য যারা দুনিয়ার জীবনে ঈমান এনেছে এবং বিশেষ ভাবে কেয়ামতের দিনের জন্য।” (সূরা আরাফ: ৩২)

যারা দুনিয়ার জীবনে কৃচ্ছ-সাধনা করে এসব হালাল জিনিষকে নিজেদের ও নিজ পরিবারের জন্য হারাম করে নিয়েছে তাদেরকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ তায়ালা এ কথা বলে দিয়েছেন। তাই মু’মিন ব্যক্তি সৌন্দর্য ও হালাল জিনিষ ভোগ করতে পারে বরং প্রকৃতপক্ষে এসব জিনিষ ঈমানদারদেরই জন্য। কিন্তু অপব্যয় ও বেহুদা খরচ নিষিদ্ধ। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا – إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيْطِينِ –

“অপব্যয় করো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা বনী ঈসরাইল: ২৭)

মু’মিনের দৃষ্টি থাকে আখেরাতের প্রতি। দুনিয়ার জীবনে ধন-সম্পদ, আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসে মত্ত হলেই পরিবারের চাহিদা বেড়ে যায়, অসৎ পথ অবলম্বনে নিমগ্ন হয়ে পড়ে, যাতে তার আখেরাত নষ্ট হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلى مَا مَتَعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّنْهُمْ زَهْرَةَ الحَيَوةَ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيْهِ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَ ابْقَى –

“তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে আমি যে উপভোগের সামগ্রী দিয়েছি তার প্রতি আপনি চোখ তুলেও তাকাবেন না, এসব হলো দুনিয়ার জীবনের চাকচিক্য, এতে রয়েছে তাদের পরীক্ষা, আপনার রবের রেযেক উত্তম ও স্থায়ী।” (সূরা তাহা: ১৩১)

পারিবারিক জীবন ও ধন-সম্পদ

ধন-সম্পদ মানুষের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। তার এ প্রয়োজন বিশেষ করে পরিবারের খরচপত্র বহনের জন্য। পরিবারের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী, আরামের জিনিষপত্র ও অপ্রয়োজনীয় বিলাস দ্রব্যাদি সংগ্রহের জন্য তার প্রয়োজন অঢেল বিত্ত বৈভবের। তাই সে ন্যায় ও অন্যায়ভাবে, সৎপথে বা অসৎপথে টাকা-পয়সা উপার্জনে মত্ত। তাই ব্যক্তি সুদ-ঘুষ, ধোঁকা-প্রতারণা, ওজনে বেশ-কম করা, ভেজাল-মওজুতদারী, কালোবাজারী, চোরাকারবারী, আমানতের খেয়ানত ইত্যাকার অসাধু পথে আয়-উপার্জনে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এভাবে অন্যায়ভাবে সম্পদ কুক্ষিগত করে সমাজের কিছু লোক সম্পদের পাহাড় গড়ে আবার কিছু লোক হয়ে পড়ে নিঃস্ব অসহায়।

কমিউনিজমের প্রবক্তা কার্ল মার্কস পরিবারের কারণে প্রলুব্ধ ও উদ্বুদ্ধ হয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সম্পদ কিছু লোকের হাতে জমা হয়ে যাওয়ায় সমাজতন্ত্রের কথা চিন্তা করেন এবং পরিবার প্রথা ও ব্যক্তি মালিকানা বন্ধ করে সমাজতন্ত্র চালু করার প্রেসক্রিপশন প্রদান করে। এতে একথা প্রমাণিত হয় যে, পরিবারই হলো সকল অনর্থের মূল। অথচ কার্ল মার্কসের আবির্ভাবের বহু পূর্বেই মহান আল্লাহ এর প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আল্লাহর দৃষ্টিতে পরিবার ও সম্পদ অনর্থের কারণ নয় বরং ব্যক্তি চরিত্রকে পরিশোধিত করে তাকে হালাল পথে, সৎ ও ন্যায় ভাবে আয়-উপার্জন করতে হবে এবং হারাম পথে, অন্যায়-অপব্যয় বন্ধ করতে হবে। যারা ঈমান এনেছে এবং এ রকম সৎ ভাবে চলে তাদেরকে লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেনঃ

وَمَا أَمْوَالُكُمْ وَلا أَوْلَادُكُمْ بِالَّتِي تُقَرِّبُكُمْ عِنْدَنَا زُلْفَى إِلَّا مَنْ أَمَنَ وَعَمِلَ صَالِحاً فَأُولَئِكَ لَهُمْ جَزَاءُ الضّعْفِ بِمَا عَمِلُوا وَهُمْ فِي الْغُرُفْتِ آمِنُونَ –

“তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদিগকে মর্যাদায় আমার নিকটবর্তী করে দেয় না তবে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে, তারা যা করেছে তাদের সে কাজের জন্য দ্বিগুণ ছওয়াব এবং তারা প্রাসাদসমূহে শান্তিতে ও নিরাপদে অবস্থান করবে।” (সূরা সাবা: ৩৭)

আল্লাহতে অবিশ্বাসী সমাজ ন্যায়-অন্যায় পথে ধনসম্পদ অর্জন করে সম্পদশালী হয়ে গর্ব-অহংকারে মত্ত হয়ে উঠে। আবার ধন-জন লাভ করে মনে করে তারা অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয়েছে এবং আখেরাতে তারা আল্লাহর অনুগ্রহ প্রাপ্ত হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَقَالُوا نَحْنُ أَكْثَرُ أَمْوَالًا وَأَوْلَادًا * وَمَا نَحْنُ بِمُعَذِّبِينَ – قُلْ إِنَّ رَبِّي يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ –

“তারা (অবিশ্বাসীরা) বলেঃ আমরা ধনে-জনে অনেক বেশী, আমাদেরকে আযাব দেয়া হবে না। আপনি বলে দিন, নিশ্চয়ই আমার রব যাকে ইচ্ছা প্রচুর রেযেক দিয়ে থাকেন, আর যাকে ইচ্ছা সংকীর্ণ করে দেন কিন্তু অনেক লোকই তা জানে না।” (সূরা সাবা: ৩৫,৩৬)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেনঃ

إنما أموالكم وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَاللَّهُ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ –

“তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য একটি পরীক্ষা মাত্র আর আল্লাহর নিকট রয়েছে বিরাট প্রতিদান।” (সূরা তাগাবুন: ১৫)

সূরা আনফালের ২৮ নম্বর আয়াতে একই কথা বলা হয়েছে।

মানুষের জন্য দুনিয়ার জীবন, তার ধনসম্পদ ও পরিবার পরিজনের কারণে ধোঁকা ও প্রতারণায় পরিণত হয়। এরই কারণে সে হয়ে পড়ে বিপথগামী। কেবল মাত্র যারা হেদায়াতের পথে এসে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত করে, রক্ষা করে অসৎ উপায়ে ধন-সম্পদ আহরণ থেকে সেই রক্ষা পায়। কাফেরদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَنْ تُغْنَى عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَأُولَئِكَ أَصْحُبُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خُلِدُونَ –

“নিশ্চয়ই যারা আবশ্বাস করেছে, তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর নিকট কোনই উপকার দিবে না, এরা হলো দোযখের বাসিন্দা আর সেখানে থাকবে তারা চিরকাল।” (সূরা আলে এমরান: ১১৬)

وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّمَا تُمْلَى لَهُمْ خَيْرٌ لِأَنْفُسِهِمْ إِنَّمَا تُمْلَى لَهُمْ لِيَزْدَادُوا إِثْماً ، وَلَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ –
“যারা কুফুরী করেছে তারা যেন মনে না করে যে আমরা তাদেরকে যে ঢিল দিয়েছি তা তাদের জন্য কল্যাণকর, আমি তো তাদেরকে এ জন্য ঢিল দেই যেন তাদের পাপ বৃদ্ধি পায়, তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।” (সূরা আলে এমরান: ১৭৮)

وَمَا الْحَيُوةُ الدُّنْيَا الأَمَتَاعُ الْغُرُورِ – لَتَبْلُونَ فِي أَمْوَلِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ قف
“নিশ্চয়ই দুনিয়ার জীবন প্রতারণার সামগ্রী ছাড়া কিছুই নয়, অবশ্যই আমি তাদের ধন-সম্পদ ও তাদের নিজেদেরকে পরীক্ষা করে নিব।” (সূরা আলে এমরান: ১৮৬)

এসব আয়াত থেকে পারিবারিক জীবন ও ধন-সম্পদ আহরণ ও ব্যয় ব্যবহারে আল্লাহর বিধানকে মেনে না চলার ভয়াবহ পরিণতির সাবধানবাণী পাওয়া যায়। তাই দুনিয়ার জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার ক্ষেত্রে অবশ্যই হালাল হারামের বাছ বিচার মত ধন-সম্পদের আয় উপার্জন ও ব্যয়-ব্যবহার করতে হবে।

পারিবারিক সুখ-শান্তির অন্বেষায়ই মানুষ ধন-সম্পদের নেশায়, লোভ-লালসায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে। ফলে দুনিয়ার জীবনের প্রতারণায় নিমজ্জিত হয়ে বিভ্রান্তির পথে চলা শুরু করে। অসৎ ও অসাধু পথে ধন-সম্পদ আহরণে নিজেকে সোপর্দ করে দেয়। এভাবে আল্লাহ থেকে গাফেল হয়ে পড়ে, এভাবে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَكَايِّنْ مِّنْ قَرْيَةٍ أَمْلَيْتُ لَهَا وَهِيَ ظَالِمَةٌ ثُمَّ أَخَذْتُهَا وَإِلَى الْمَصِيرُ –

“এমন বহু জনপদবাসী রয়েছে যাদেরকে আমি ঢিল অবকাশ প্রদান করেছি কিন্তু তারা অবাধ্যাচরণ করেছে। পরে তাদেরকে পাকড়াও করা হয়েছে, অতঃপর তো তাদেরকে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে।” (সূরা হজ্জ্ব: ৪৮)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেনঃ
وَأَنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللهِ وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ

“তোমরা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করো, নিজরা নিজেদেরকে ধ্বংসের পথে নিক্ষেপ করো না।” (সূরা বাকারা: ১৯৫)

তাই পারিবারিক জীবনে
১. হালাল পথে আয়-উপার্জন করতে হবে;
২. হালাল পথে ব্যয়-ব্যবহার করতে হবে;
৩. আয়-উপার্জন ও ব্যয়-ব্যবহারে কোন অবস্থাতেই শরীয়ত বিরোধী পন্থা অবলম্বন করা যাবে না;
৪. ব্যয়-ব্যবহারে বিলাসিতার পথ অবলম্বন ও অপচয় অপব্যয় করা যাবে না;

এসব নীতিমালা ও বিধিবিধান মেনে কেউ যদি যথেষ্ট ধনসম্পদ উপার্জন করতে পারেন, যদি অঢেল ধনসম্পদেরও মালিক হয়ে বসেন, তাতে কোন দোষ নেই তবে খেয়াল রাখতে হবে সম্পদ যেন কোন ব্যক্তির কুক্ষিগত হয়ে না পড়ে। সেজন্য এভাবে অঢেল ধনসম্পদ উপার্জনকারীর অতিরিক্ত ব্যয় ব্যবহারের নির্দেশ ও তাকিদ প্রদান করা হয়েছে:

১. তাকে ফেতরা, কোরবানী ও পূর্ণ হিসাব মত যাকাত প্রদান করতে হবে, হজ্জ সম্পন্ন করতে হবে;
২. তাকে গরীব আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীর আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে,
৩. সাধারণভাবে ইয়াতীম, মিসকীন ও অসহায়দের যথাসাধ্য সহযোগিতা প্রদান করতে হবে;
৪. দ্বীন কয়েমের আন্দোলনে, জেহাদ ফি-সাবিলিল্লাহর খাতে বড় অংকের দান করতে হবে,

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তার পরবর্তী যুগে অনেক ধনী সাহাবীর ইতিহাসও পাওয়া যায়। হযরত ওসমান (রাঃ) ও হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফের (রাঃ) কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের অঢেল ধন-সম্পদ তারা দ্বীনের পথে, দ্বীনী আন্দোলন ও জেহাদ ফি-সাবিলিল্লাহর পথে অকাতরে ও বিরাট পরিমাণে খরচ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। সাথে সাথে তারা দ্বীনী আন্দোলনেও যথাযথ ভূমিকা রাখতেন। যে কোন জেহাদে তারা রাসূলুল্লাহর সাথে শরীক হতেন। হযরত ওসমান (রাঃ) রাসূলের পরবর্তী সময়ে মুসলিম জাহানের খলীফা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

আজকের দিনেও যদি কেউ এমনি হালাল ভাবে যথেষ্ট উপার্জন করে উপরোক্ত ভাবে খরচ পত্র করেন ও দ্বীনী আন্দোলনে যথারীতি অংশ গ্রহণ করেন তবে তা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য ভূমিকা বলে গণ্য হবে। তবে অবশ্যই তাকে হারাম পথে আয়-উপার্জন ও ব্যয়-ব্যবহার, বিলাসিতা ও অপচয় পরিহার করে চলতে হবে। পারিবারিক প্রয়োজন পূরণ এমনকি প্রয়োজনীয় আরামপ্রদ দ্রব্যাদিও ব্যয়-ব্যবহার করা যেতে পারে।

ষষ্ঠদশ অধ্যায় : পারিবারিক জীবনের শেষ অধ্যায়

মৃত্যু ও মৃত্যুর পূর্বে আখেরাতের প্রস্তুতি

পারিবারিক জীবনে যতই মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালবাসা, সম্মান-শ্রদ্ধা থাকুক না কেন, একদিন এ মায়ার বন্ধন কেটে যাবেই। দুনিয়ার এ জীবন চিরস্থায়ী নয় বরং এ জীবন ক্ষণস্থায়ী এক প্রতারণামূলক বিষয় মাত্র। আল কোরআনে যাকে বলা হয়েছে متاع الغرور এক প্রতারণামূলক সামান্য সম্পদ।

পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যুর হীমশীতল হাত থেকে কেউ রক্ষা পাবে না বরং পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকেই যথাসময়ে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের মৃত্যুর ব্যাপারে বলেছেনঃ

وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ مِّنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُّطْفَةٍ ثُمَّ جَعَلَكُمْ أَزْوَاجًا وَمَا تَحْمِلُ مِن أنثى وَلَا تَضَعُ الإِبِعِلْمِهِ وَمَا يُعَمَّرُ مِنْ مُعَمَّرٍ وَلَا يُنْقَصُ مِنْ عُمُرِة الا فِي كِتَبٍ إِنَّ ذُلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرُ

“এবং আল্লাহ তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করছেন, অতঃপর সৃষ্টি করেছেন শুক্র থেকে, অতঃপর তোমাদের জোড়া জোড়া করেছেন এবং কোন নারীই আল্লাহর অবগতি ছাড়া কোন গর্ভধারণ করে না, না তা প্রসব করে, আর কারো আয়ু না বর্ধিত করা হয়, না হ্রাস করা হয় বরং তা সুনির্দিষ্ট ভাবে কিতাবে লিখিত রয়েছে, আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজ।” (সূরা ফাতের: ১১)

আরো স্পষ্ট করে মৃত্যু সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ
والله خَلَقَكُمْ ثُمَّ يَتَوَفَّكُمْ من وَمِنْكُمْ مَنْ يُرَدُّ إِلَى أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْ لَا يَعْلَمَ بَعْدَ عِلْمٍ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ قَدِيرٌ

“এবং আল্লাহ তোমাদিগকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদেরকে মৃত্যুদান করেছেন এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে অকর্মন্য বয়স পর্যন্ত পৌঁছে দেন, যাতে কোন কিছু জানার পর তা আর জানে না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান।” (সূরা নহল: ৭০)

বিভিন্ন বয়সে মৃত্যু প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِّنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ يُخْرِجُكُمْ طفلاً ثُمَّ لِتَبْلِغُوا أَشُدَّكُمْ ثُمَّ لِتَكُونُوا شُيُوخًا جِ وَمِنْكُمْ مَنْ يُتَوَفَّى مِنْ قَبْلُ وَلِتَبْلِغُوا اَجَلاً مُسَمَّى وَلَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর শুক্র থেকে, অতঃপর মাংসপিণ্ড থেকে, অতঃপর তোমাদিগকে শিশু হিসাবে বের করে এনেছেন, অতঃপর তোমরা যেন যৌবনে পদার্পণ কর (সে ব্যবস্থা করেছেন), অতঃপর তোমরা বৃদ্ধ হয়ে যাও, তোমাদের মধ্যে কেউ এর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করে, আর কেউ তার জন্য নির্ধারিত সময়ে পৌঁছে যায়, যেন তোমরা বুঝ।” (সূরা আল মু’মিনঃ ৬৭)

কোরআনের এসব আয়াত থেকে জানা যায় পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের মৃত্যু আল্লাহর সিদ্ধান্ত মোতাবেক পূর্বে নির্ধারিত যথা সময়েই হয়ে থাকে। তাই হয়ত কেউ অল্প বয়সে মারা যায়, আবার কেউ পরিণত বয়সে, কেউ আবার অনেক বেশী বয়সে। মানুষ কখন কিভাবে মারা যাবে নিজে বা অন্য কেউ তা জানে না বরং তা জানেন আল্লাহ তায়ালা এবং তারই অনুমতিক্রমে মানুষের মৃত্যু হয়।

وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضِ تَمُوتُ طَ

“কোন প্রাণীই জানেনা কোন স্থানে কিভাবে তার মৃত্যু হবে।”
(সূরা লোকমান: ৩৪)

وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَنْ تَمُوْتَ الَّا بِإِذْنِ اللَّهِ كِتُبَا مُؤَجَلاً ط

“কোন প্রাণীই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মৃত্যুবরণ করে না যা নির্দিষ্টভাবে লিখিত রয়েছে।” (সূরা আলে ইমরান: ১৪৫)

মোটকথা হল পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য আগে হোক বা পরে হোক মৃত্যুর মাধ্যমে তার জীবনের শেষ পরিণতিতে পৌঁছে যাবে, সে যতই মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়াক না কেন।

قُلْ إِنَّ الْمَوْتَ الَّذِي تَفِرُّونَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مُلْقِيْكُمْ

“হে নবী এদের বলে দাও, তোমরা মৃত্যু থেকে যতই পালিয়ে বেড়াওনা কেন, তার সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ ঘটবেই।” (সূরা জুমুয়া: ৮)

যত মজবুত অবস্থানেই সে থাকুক না কেন, মৃত্যু তার কাছে পৌঁছবেই।

أَيْنَ مَا تَكُونُوا يُدْرِ كُكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنتُمْ فِي بُرُوجٍ مُشَيَّدَةٍ

“তোমরা যেখানে যে অবস্থায়ই থাকনা কেন, মৃত্যু তোমাদের ধরবেই যতো মযবুত কিল্লার মধ্যেই তোমরা অবস্থান করনা কেন।” (সূরা নিসা: ৭৮)

তাই পরিবার তথা সারা দুনিয়ার প্রতিটি মানুষই মরণশীল এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্যের শেষ অধ্যায় মৃত্যু।

আমাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো মৃত্যুর পূর্বে ইহকলীন এ দুনিয়ার জীবনে মৃত্যু পরবর্তী আখেরাতের জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কি কি করণীয়, যাতে আখেরাতের জীবন হয় সুখী, সুন্দর ও আনন্দদায়ক হয়। আখেরাতের যথাযোগ্য ও যর্থাথ প্রস্তুতি গ্রহণে যদি ত্রুটি থেকে যায়, যদি কেউ সে ব্যাপারে থাকে সম্পূর্ণ গাফেল ও নির্বিকার তাহলে তার আখেরাতের জীবন হবে দুঃখময়, বিষাদপূর্ণ ও খুবই কষ্টদায়ক।

আমরা দুনিয়ার জীবনে ছোট-খাট সফরে বের হলে, কেউ হজ্জে বা বিদেশে রওয়ানা দিলে প্রয়োজনীয় সামানপত্র, টাকা-পয়সা ও যথার্থ কাগজপত্র নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই বাড়ী থেকে রওয়ানা দেই। তাছাড়া বিদেশে অনেক বন্ধু-বান্ধব ও সাহায্যকারী ব্যক্তি বা সংস্থা থাকে। তাই মৃত্যুর পরবর্তী যে সফরে আমাদেরকে রওয়ানা দিতে হবে তা বড়ই কঠিন, নিঃসঙ্গ, এক দুস্তর পারাবার। এ সফরের প্রস্তুতি ভিন্ন রওয়ানা দেয়া নেহায়েতই বোকামী, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও বন্ধুর। তাই আমাদেরকে জেনে নিতে হবে আখেরাতের জীবনের প্রস্তুতি পর্বে আমাদেরকে কি কি করতে হবে।

আখেরাতের প্রস্তুতি: করণীয়

(১) আখেরাতের জ্ঞান লাভ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ :
আখেরাতের প্রস্তুতির জন্য সর্বপ্রথম আখেরাতের জ্ঞানার্জন করে আখেরাতের প্রতি যথার্থ ঈমান পোষণ করা দরকার। আখেরাতের জ্ঞানই যার নেই, সে হতে পারে দুনিয়ার জীবনে মহাপণ্ডিত, মহাবিদ্বান কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে মহামূর্খ। এমন ব্যক্তির থাকতে পারে না আখেরাতের প্রতি কোন ঈমান। তাই কোরআন ঘোষণা করেঃ

لكِنِ الرَّسِخُونَ فِي الْعِلْمِ مِنْهُمْ وَالْمُؤْمِنُونَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَالْمُقِيمِيْنَ الصَّلوةَ وَالْمُؤْتُونَ الرَّكُوةَ وَالْمُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أُولَئِكَ سَنُؤْتِيهِمْ أَجْرًا عَظِيمًا –

“কিন্তু যারা জ্ঞানে অগ্রসর এবং মু’মিন তারা ঈমান আনে যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি এবং তারা নামায কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে এবং ঈমান রাখে আল্লাহর প্রতি ও আখেরাতের দিনের প্রতি, তাদেরকে শিগগিরই মহা পুরষ্কার প্রদান করা হবে।”
(সূরা নিসা: ১৬২)

রাসূলের (সাঃ) শিক্ষার আলোকে যারা আখেরাতের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখে তারাই যথার্থ জ্ঞানী আর যাদের আখেরাতের জ্ঞান নেই তাদেরকে বলা হয়েছে অন্ধ।

وَإِنَّ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ عَنِ الصِّرَاطِ لَنُكِبُونَ –

“এবং যারা আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষন করে না তারা পথ থেকে সরে যাচ্ছে।” (সূরা আল মু’মেনুন: ৭৪)

إِنَّ الَّذِينَ لَا يَؤْمِنُونَ بِالآخِرَةِ زَيَّنَّا لَهُم أَعْمَالَهُم فَهُم – أُولئِكَ الَّذِينَ لَهُم سوء العذاب وَهُم في الآخرة هم الاخسرون –

“যারা আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে না তাদের নিকট তাদের আমল সমূহ চাকচিক্য করে তোলা হয় এবং তারা বিভ্রান্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়। এদের জন্য রয়েছে মন্দ আযাব এবং এরাই আখেরাতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা নমল: ৪,৫)

(২) আখেরাতের জ্ঞানার্জন ও যথার্থ ঈমান পোষণের জন্য প্রয়োজন কোরআন অধ্যয়ন ও কোরআনের আয়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন:

আখেরাতের প্রকৃত জ্ঞান ও যথার্থ চিত্র পাওয়া যায় আল কোরআন ও হাদীসে। তাই কোরআন অধ্যয়নের মাধ্যমেই আখেরাতের যথার্থ জ্ঞানার্জন করা যায়। গভীর মনোনিবেশ সহকারে কোরআন অধ্যয়ন করে আখেরাতের জ্ঞান লাভ ও আখরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। কোরআনের আয়াত ও আখেরাত অবিশ্বাসই আখেরাতের আযাবের কারণ।

وَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِايْتِنَا وَلِقَايِ الْآخِرَةِ فَأُولَئِكَ فِي الْعَذَابِ مُحْضَرُونَ –

“যারা কুফরী (অবিশ্বাস) করেছে এবং আমার আয়াত ও আখেরাতের সাক্ষ্যকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে তারা আযাবে গ্রেফতার হবে।” (সূরা রূম: ১৬)

وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُونَ يَوْمَ الْقِيمَةِ أَعْمَى – قَالَ رَبِّي لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنتُ بَصِيرًا – قَالَ كَذَلِكَ اَتَتَكَ أَيْتُنَا فَنَسِيتَهَا ، وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنسى – وَكَذَلِكَ نَجْزِى مَنْ اَسْرَفَ وَلَمْ يُؤْمِنُ بِايْتِ رَبِّهِ وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَشَدُّ وَابْقَى –

“যে ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে, নিশ্চয়ই আমি তার রেজেক সংকীর্ণ করে দেব এবং কেয়ামতের দিন তাকে অন্ধ করে উঠাব। সে বলবে কেন আমাকে অন্ধ করে উঠালে অথচ আমি ছিলাম চক্ষুষ্মান। বলা হবে, এমনি ভাবে তোমার নিকট আমার আয়াত সমূহ এসেছিল এবং তাকে তোমরা ভুলে গিয়েছিলে, সেভাবেই তোমাকে আজ ভুলে যাওয়া হবে। এমনিভাবে আমি শাস্তি দেব তাদেরকে যারা সীমালংঘন করে ও তার রবের আয়াতের প্রতি ঈমান পোষণ করে না এবং অবশ্যি আখেরাতের আযাব কঠিনতম ও স্থায়ী।” (সূরা তাহা: ১২৭)

আখেরাতের অবিশ্বাসীরা কোরআনকে জানা ও বুঝার কোন সুযোগই পায়না। তাদের সামনে কোরআন পাঠ করা হলেও কোরআন পাঠ ও তাদের মধ্যে পর্দা থাকে যার ফলে কোরআনের আয়াতকে তারা উপলব্ধি করতে পারেনা।

وَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ جَعَلْنَا بَيْنَكَ وَبَيْنَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ حِجَابًا مُسْتُورا –

“যখন আপনি কোরআন পাঠ করেন তখন আপনি ও যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না তাদের মধ্যে এক গোপনীয় পর্দার ব্যবস্থা করি।” (সূরা বনী ঈসরাইল: ৪৫)

মৃত্যুর পূর্বে আখেরাতের প্রস্তুতির জন্য তাই আখেরাতের জ্ঞান, আখেরাতের প্রতি ঈমান, কোরআনের আয়াতের প্রতি বিশ্বাস তথা গভীর অনুধাবনের সাথে কোরআন অধ্যয়ন অপরিহার্য।

(৩) সদা-সর্বদা আখেরাতের স্মরণ:

পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের নিশ্চিতভাবে যথাসময়ে মৃত্যু হবে। কিন্তু মৃত্যুর সে নির্ধারিত সময়ক্ষণটি কারো জানা নেই। যে কোন সময় যে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে। তাই সদা-সর্বদা মৃত্যুকে স্মরণ রাখতে হবে, মনে রাখতে হবে মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে। কারণ মানুষের মৃত্যুর পর মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায় না। কেয়ামতের দিন আবার তার পুনরুত্থান হবে। হাশরের ময়দানের ব্যক্তির কৃত ভাল-মন্দ কাজের হিসাব-নিকাশ হবে এবং সে হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে চূড়ান্ত ফায়সালা হবে- হয় পুরষ্কার অথবা শাস্তি হবে তার অনন্তকালীন জীবনের শেষ পরিণতি।

সাদ্দাম ইবনে আওস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: সেই ব্যক্তিই বুদ্ধিমান যে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মৃত্যুর পরবর্তী পর্যায়ের প্রতি খেয়াল রেখে কাজ করে। আর অক্ষম ও দুর্বল সেই ব্যক্তি যে নিজের নফসের অনুসরণ করে চলে আর আল্লাহর উপর প্রত্যাশা করতে থাকে।” (তিরমিযি)

তাই আখেরাতের প্রস্তুতি হিসাবে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে সদা-সর্বদা আল্লাহ ও আখেরাতের খেয়াল ও তা স্মরণ রাখতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

اِنَّا اَخْلَصْنَهُمْ بِخَالِصَةٍ ذِكْرَى الدَّارِ وَإِنَّهُمْ عِنْدَنَا لَمِنَ الْمُصْطَفَيْنَ الْأَخْيَارِ –

“আমি তাদেরকে বিশিষ্ট করেছি এক বিশেষ বিষয়ে তা হলো আখেরাতের স্মরণ এবং তারা আমার নিকট নির্বাচিত সর্বাপেক্ষা উত্তম লোকদের মধ্যে গণ্য।” (সূরা সোয়াদ: ৪৬-৪৭)

মৃত্যুর পূর্ববর্তী প্রস্তুতির জন্য আখেরাতকে এভাবে সব সময় স্মরণ রাখার মাধ্যমে নিজেকে আখেরাতের শাস্তি থেকে আত্মরক্ষা করা যেতে পারে। নীতিহীন, শরিয়ত বিরোধী, অন্যায় ও অসামাজিক কাজ-কর্ম থেকে পাক-পবিত্র থেকে আখেরাতের জীবনকে সুখময় ও শান্তিময় করে তোলা যেতে পারে।

(৪) আখেরাতের ব্যাপারে গাফেল না হওয়া বরং সতর্কতা অবলম্বন :
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দুনিয়ার জীবনে আখেরাতের ব্যাপারে কোন অবস্থায় গাফেল না হতে বার বার বলেছেন বরং তিনি আখেরাতের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছেন। মানুষ তার শেষ পরিণতির ব্যাপারে গাফেল হতে পারে না। আর মানুষের শেষ পরিণতি হলো আখেরাত। আখেরাতের শব্দটির উৎপত্তি হলো আখের থেকে যার অর্থ শেষ। মানুষ যদি তার শেষ পরিণতি আখেরাত সম্পর্কে গাফেল হয়ে গোমরাহী ও বিভ্রান্তির পথ অবলম্বন করে, সতর্কতা অবলম্বন না করে তাহলে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত যা চলবে অনন্তকাল ধরে। তাই আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সে ব্যাপারে সতর্ক করে বলেন:

وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ عَلى لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَذَانُ لا يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَئِكَ كَالأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَفِلُونَ –

“নিশ্চয়ই আমি অনেক জ্বীন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য, তাদের অন্তর আছে কিন্তু তদ্বারা অনুধাবণ করে না, তাদের চক্ষু আছে কিন্তু তদ্বারা তারা দেখে না, তাদের কান আছে যদ্বারা তারা শুনে না, তারা পশুর ন্যায় বরং তার চেয়েও অধম, এরাই গাফেল।” (সূরা আরাফ: ১৭৯)

يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلَتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ ، وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ – وَلَا تَكُونُوا كَالَّلَّذِينَ نَسُوا اللَّهَ فَانْسَهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفُسِقُونَ –

“হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং আগামী কালের (আখেরাতের) জন্য কি প্রেরণ করছ সে ব্যাপারে সতর্ক হও, ভয় কর আল্লাহকে, তোমরা কি করছ, সে ব্যাপারে আল্লাহ খবর রাখছেন। ওদের মতো হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে যায়, তারপর নিজেরা নিজেদেরকেই ভুলে যায়, এরাই ফাসেক।” (সূরা হাশর: ১৮-১৯)

يَعْلَمُونَ ظَاهِرًا مِّنَ الْحَيَوةِ الدُّنْيَا صلى وَهُمْ عَنِ الْآخِرَةِ هُمْ غُفِلُونَ – أَوَلَمْ يَتَفَكَّرُوا فِي أَنْفُسِهِمْ لَفَ مَا خَلَقَ اللَّهُ السَّمُوتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَاجَلٍ مُّسَمًّى وَإِنَّ كَثِيرًا مِّنَ النَّاسِ بِلِقَاي رَقِيمٌ لَكُفِرُونَ –

“তারা দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক দিকগুলোকেই কেবলমাত্র জানে, আখেরাত সম্পর্কে এরা গাফেল। তারা কি নিজে নিজে এ চিন্তা করে যে আল্লাহ তায়ালা আসমান ও যমীন এবং এ দু’য়ের মধ্যে যা আছে তা সত্যসহ ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সৃষ্টি করেননি এবং অধিকাংশ লোকই তাদের রবরে সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে অবিশ্বাসী।” (সূরা রূম: ৭-৮)

আখেরাত সম্পর্কে গাফেল লোকেরা আখেরাতের চেয়ে দুনিয়াকে অধিক ভালবাসে এবং হেদায়াতের পথ পায় না। ফলে তারা আল্লাহর আয়াতের প্রতি ঈমান পোষণ করে না, ঈমান আনার পর পুনরায় কুফুরী করে এবং কুফুরীতেই লিপ্ত থাকে, তাদের জন্য আল্লাহর গজব ও মহা আযাব।

ذلِكَ بِأَنَّهُمُ اسْتَحَبُّوا الْحَيَوةَ الدُّنْيَا عَلَى الْآخِرَةِ ، وَأَنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِى الْقَوْمَ الْكَفِرِينَ – أُولَئِكَ الَّذِينَ طَبَعَ اللَّهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ وَسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ وَأَوْلَئِكَ هُمُ الْغَفِلُونَ – لَا جَرَمَ أَنَّهُمْ فِي الْآخِرَةِ هُمُ الْخَسِرُونَ –
“এটা এজন্য যে, তারা আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াকে অধিক ভালবাসে আর তা এজন্য যে, আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে হেদায়াত দান করেন না। এরা তারা যাদের অন্তরে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন, তাদের শ্রবণশক্তি ও দর্শন শক্তিতে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন, এরাই গাফেল। কোন সন্দেহ নেই আখেরাতে এরা হবে ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা নহলঃ ১০৭-১০৯)

যারা মৃত্যুর পূর্বেই আখেরাতের প্রস্তুতি নিতে চায়, তারা কখনো আখেরাতের ব্যাপারে এরূপ গাফেল হয় না বরং যথার্থ সতর্কতা অবলম্বন করে। তারা যথারীতি আল্লাহর বিধানকে মেনে চলে, রাসূলের অনুকরণ ও অনুসরণ করে, তারা হয় হকের ধারক ও বাহক, দ্বীনের বাস্তবায়নে সদা তৎপর।

(৫) দুনিয়ার চেয়ে আখেরাতকে অধিক গুরুত্ব প্রদান:

মৃত্যুর পূর্বে আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহণকারী ব্যক্তি দুনিয়ার চেয়ে আখেরাতকেই অধিক গুরুত্ব প্রদান করে। নিজের সময়, অর্থ, মেধা ও যোগ্যতাকে দুনিয়ার আয়-রোজগারের চেয়ে দ্বীনের কাজে অধিক নিয়োজিত করে, আখেরাতকেই অগ্রাধিকার দেয়। অপরদিকে যে ব্যক্তি আখেরাতের প্রাধান্য দানের পরিবর্তে দুনিয়াকে প্রাধান্য দেয় সে আখেরাতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

إِنَّ الَّذِينَ لَا يَرْجُونَ لِقَاءَنَا وَرَضُوا بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاطْمَانُوا بِهَا وَالَّذِينَ هُمْ عَنْ ابْتِنَا غُفِلُونَ – أُولَئِكَ مَاؤُهُمُ النَّارُ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ –

“নিশ্চয়ই যারা আমাদের সাক্ষাতের আশা করে না এবং দুনিয়ার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে এবং তাতে পরিতৃপ্ত হয়ে গেছে এবং যারা আমার আয়াতের

ব্যাপারে গাফেল তাদের স্থান হবে জাহান্নাম, যা তারা অর্জন করেছে।” (সূরা ইউনুছঃ ৭-৮)

مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ تُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ ج يَصْلُهَا مَذْمُومًا مَّدْحُورًا – وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَشْكُورًا –

“যে ব্যক্তি তাড়াতাড়ি (অর্থাৎ দুনিয়া) কামনা করে, আমরা যাকে ইচ্ছা করি এবং যতটুকু ইচ্ছা করি সত্তরই তা প্রদান করি। অতঃপর তার জন্য নির্ধারিত করি জাহান্নাম এবং সেখানে সে বিতাড়িত ও দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় পৌঁছে যায়। আর যে ব্যক্তি আখেরাত কামনা করে আর সেজন্য সাধ্যমত চেষ্টা-সাধনা করে এই অবস্থায় যে সে মু’মিন, তার চেষ্টা- সাধনা কবুল হবে।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ১৮-১৯)

مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْلَهُ فِي حَرْثِهِ ، وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ –

“যে ব্যক্তি আখেরাতের ফসল কামনা করে, তাকে আমি আখেরাতের ফসলে উন্নতি দান করি এবং যে ব্যক্তি দুনিয়ার সম্পদের কামনা করে তাকে আমি তা থেকে কিছু প্রদান করি এবং আখেরাতে তার কোন অংশ নেই।” (সূরা শুরা: ২০)

অবিশ্বাসীরা রাসূলকে (সাঃ) মানে না, বিশ্বাস করে না বরং রাসূলের দেয়া ওয়াদাকে মিথ্যা মনে করে এবং মনে করে এ দুনিয়ার জীবনই প্রকৃত জীবন। অবিশ্বাসীরা বলে:

هَيْهَاتَ هَيْهَاتَ لِما تُوعَدُونَ – إِنْ هِيَ الأَحَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا نَحْنُ بِمَبْعُوثِينَ –

“তোমাদেরকে যে ওয়াদা করা হয়েছে তা বহুদূর। এ দুনিয়ার জীবনই তো জীবন, আছে মৃত্যু ও জীবন। আমাদের কখনো পুনরুত্থান হবে না।” (সূরা মু’মিনুন: ৩৬-৩৭)

দুনিয়ার জীবন ও আখেরাতের জীবন সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

ارْضِيْتُمْ بِالْحَيَوةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآخِرَةِ ج فَمَا مَتَاعُ الْحَيَوةِ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ –

“তোমরা কি আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট? অথচ দুনিয়ার জীবনের সামান্য জিনিষপত্র আখেরাতের তুলনায় খুবই নগণ্য।” (সূরা তাওবাঃ ৩৮)

“যারা দুনিয়ার জীবন ও তার জীব-জাম্প কামনা করে তাদেরকে তাদের কৃত আমার ফলাফল এই দুনিয়ায়ই দান করি এবং তাতে কিছুই কম করা হয় না। এরা তো তারাই যারা আখেরাতে মোক্ষম ছড়াছড়ি পাইবে না, তারা এখানে যা কিছু করেছে তা নষ্ট হয়ে গেছে এবং তারা যা আমল করেছে তা বিফল হয়ে গেছে।” (আল কুরআন)

অতএব যারা দুনিয়াকে আখেরাতের চেয়ে অগ্রাধিকার দেয়, আখেরাতকে এবং আল্লাহকে ভুলে যায়, দুনিয়া নিয়ে মত্ত হয়ে পড়ে, আখেরাতে তাদের আয়াতের সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। তাই মৃত্যুর পূর্বে আখেরাতের প্রস্তুতি নিতে হলে আখেরাতকে দুনিয়ার চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। দুর্বল মু’মিনদের লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেন:

بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَوةَ الدُّنْيَا – وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى –

“বরং তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই অগ্রাধিকার দাও, অথচ আখেরাত উত্তম ও স্থায়ী।” (সূরা আ’লা: ১৬-১৭)

(৬) নফসের খাহেশে দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়কে নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন:

মানুষ দুনিয়াতে নফসের খাহেশে নিজে মত্ত হতে ভালবাসে। অথচ মানুষের উচিত হৃদয়-মনে আল্লাহর ভয় পোষণ করে এবং দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতার প্রতি মোহমুক্ত হয়ে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সিরাতাল মুস্তাকিম পথে দুনিয়াতে চলা, জীবন যাপন করা। মৃত্যুর পূর্বে আখেরাতের প্রস্তুতি পর্বে মানুষকে নফসের খাহেশের পরিবর্তে আল্লাহর আইন ও বিধান মত জীবন-জিজ্ঞেসী পরীক্ষা করতে হবে। এ প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ وَالْمُقْنَطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ المُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذُلِكَ مَتَاعُ الحَيُوةِ الدُّنْيَا ، وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَابِ – قُلْ أَوْ نَبِئُكُمْ بِخَيْرٍ مِّنْ ذلِكُمْ ط لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّتُ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْفُرُ خُلِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجُ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِّنَ اللَّهِ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ –

“মানুষের নিকট মনোমুগ্ধকর করা হয়েছে নারী ও সন্তান-সন্ততির ভালবাসা, সোনা-রূপার স্তুপ, চিহ্নযুক্ত ঘোড়া, গৃহপালিত পশু ও শস্য-ফসল। এসব হলো দুনিয়ার জীবনের নগণ্য জিনিষ মাত্র আর আল্লাহর নিকট রয়েছে উত্তম আশ্রয়। আপনি বলে দিন, আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের জন্য এর চেয়ে উত্তম জিনিসের কথা বলে দিব? (তা হলো) যারা তাদের রবরে নিকট তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যারা নিচে দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত, তাতে তারা থাকবে চিরদিন, সেখানে থাকবে সতী-সাধ্বী স্ত্রীসমূহ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহ বান্দাদের প্রতি খুবই সূক্ষ্মদর্শী।” (সূরা আলে ইমরান- ১৩-১৪)

আখেরাতে মুত্তাকীদের পরিণাম ও পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:

تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادَ – وَالْعَاقِبَةِ لِلْمُتَّقِينَ –

“এই হলো আখেরাতের বাড়ী। এটা আমি তাদের জন্যই করেছি যারা দুনিয়ায় কোন গর্ব-অহংকার ও উচ্চ মর্যাদার কামনা করেনি এবং কোন প্রকার ফাসাদ-বিশৃংখলা চায়নি, উত্তম পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য।” (সূরা কাছাছঃ ৮৩)

নফসের খাহেশে দুনিয়াকামী এসব লোকের অবস্থা এমন হয় যে,

الْهُكُمُ التَّكَاثُرُ – حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ –

“অধিক পাওয়ার নেশা তাদেরকে ভুলিয়ে ফেলে। এমনকি তাদেরকে কবর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।” (সূরা তাকাসুর: ১-২)

(৭) সৎ আমল, দান-খয়রাত ও আল্লাহর পথে দানের মাধ্যমে পূর্বাহ্নে আখেরাতের পুঁজি পাঠিয়ে দেয়াঃ

উপরোক্ত বিষয় সমূহের মাধ্যমে মৃত্যুর পূর্বে আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহণকারী ব্যক্তি আখেরাতের সম্বল যোগাড় করে নেয়। সৎ আমল সমূহ, দান-খয়রাত ও আল্লাহর পথে দান পূর্বাহ্নেই আখেরাতে পাঠিয়ে দেয়। কোরআনে বলা হয়েছেঃ

عَلِمَتْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ وَأَخَّرَتْ –

“(তখন) প্রত্যেক ব্যক্তি জানতে পারবে সে পূর্বাহ্নে কি পাঠিয়েছে এবং পরে কি পাঠিয়েছে।” (সূরা ইনফেতার : ৫)

মৃত্যুর সময়ে ব্যক্তি দান-খয়রাত ও নেক আমলের জন্য যেভাবে আহাজারী করে তার বর্ণনা এসেছে সূরা মুনাফেকুনে:

وَأَنْفِقُوا مِنْ مَّا رَزَقْنَاكُمْ مِّنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَّرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ ، فَأَصَّدَّقَ وَأَكُنْ مِّنَ الصَّالِحِينَ –

“আমি তোমাদেরকে যে রেযেক প্রদান করেছি তা থেকে খরচ কর তোমাদের কারো নিকট মৃত্যু এসে যাওয়ার পূর্বেই। যখন সে বলে হে আমার রব, আরেকটু অবকাশ যদি আমাকে দিতে, তাহলে আমি একটু দান-খয়রাত করে নিতাম এবং আমি নেক লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।” (সূরা মুনাফেকুন: ১০)

আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনে বলেছেন ধন-সম্পদ বা সন্তান-সন্ততি নয় আখেরাতে উত্তম সাহায্যকারী হলো নেক কাজ।

اَلمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَوةِ الدُّنْيَا وَالْبَقِيَّاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرُ أَمَلاً –

“ধন সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি হলো দুনিয়ার জীবনের শোভা ও সৌন্দর্য এবং অবশিষ্ট থাকবে কেবলমাত্র সৎকাজ যা আপনার রবের নিকট পূণ্য হিসাবে উত্তম এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা হিসাবে শ্রেয়।” (সূরা কাহাফ : ৪৬)

তাই মৃত্যুর পূর্বে আখেরাতের প্রস্তুতি হিসাবে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে নেক আমল ও দান খয়রাত বেশী বেশী করে যাবার অভ্যাস করে যেতে হবে। তাহলেই তার আখেরাত হবে সুন্দর ও সাফল্যময়।

আমরা এ পর্যন্তকার আলোচনায় মৃত্যুর পূর্বে পরিবারের সদস্যদের আখেরাতের প্রস্তুতিমূলক যেসব কাজ করা প্রয়োজনীয় বলে জানতে পেলাম সংক্ষেপে তা হলোঃ

১. আখেরাতের যথার্থ জ্ঞানার্জন ও আখেরাতের প্রতি দৃঢ় ঈমান পোষণ;
২. কোরআন অধ্যয়ন ও কোরআনের আয়াতের প্রতি যথার্থ বিশ্বাস স্থাপন;
৩. সদা-সর্বদা আখেরাতের স্মরণ, কোন অবস্থায়ই আল্লাহ ও আখেরাতকে না ভোলা;
৪. আখেরাতের ব্যাপারে গাফেল না হওয়া এবং যথার্থ সতর্কতা অবলম্বন;
৫. দুনিয়ার জীবনের চেয়ে আখেরাতকে অধিক গুরুত্ব প্রদান;
৬. নফসের খায়েশের পরিবর্তে আল্লাহর আইন ও বিধান মত দুনিয়ায় জীবন যাপন;
৭. বেশী বেশী সৎ আমল, দান-খয়রাত ও আল্লাহর পথে দানের মাধ্যমে পূর্বাহ্নেই আখেরাতের সম্বল সংগ্রহ।

মৃত্যুর পূর্বেই আখেরাতের জন্য আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের লোকদেরকে সাবধান ও সর্তক করার ব্যাপারে আল কোরআনে তাকিদ করা হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে লক্ষ করে।

وَانْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ –

“আপনি আপনার নিকট আত্মীয়দেরকে সর্তক করুন।” (সূরা শুয়ারা: ২১৪)
“আপনি বলে দিন, ক্ষতিগ্রস্ত তো তারাই যারা কেয়ামতের দিনে নিজেরা ও পরিবারবর্গসহ ক্ষতিগ্রস্ত হলো, আহা, এ হলো সুস্পষ্ট ক্ষতিগ্রস্ততা।” (সুরা যুমার : ১৫)

প্রথম আয়াতের প্রেক্ষিতে রাসূল (সাঃ) তার আত্মীয়দেরকে ডেকে বলেন: আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন এই আয়াত “আপনি আপনার নিকট আত্মীয়দেরকে সর্তক করে দিন” নাযিল হয়, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম কুরাইশ বংশের সকল শ্রেণীর লোকদেরকে সমবেত করে বললেন : হে কাব ইবনে লুওয়াই এর বংশধরগণ, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও, হে মুররা ইবনে কাব এর বংশধরগণ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। হে বনী আবদে শামছ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। হাশেম! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। হে বনী আব্দুল মোত্তালেব! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। হে ফাতিমা, তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। কেননা আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা আমার নেই। তবে তোমাদের সাথে যে আত্মীয়তার সম্পর্ক আমার রয়েছে তা অবশ্যই আমি অটুট রাখবো। (মুসলিম)

অর্থাৎ রাসূল (সাঃ) তাঁর নিজের নিকটাত্মীয়দেরকে সাবধান ও সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, নিজেই নিজেকে দোজখের আগুন থেকে রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ কর। কারণ এ ব্যাপারে তাঁর কোন কিছুই করণীয় নেই বা তাঁর কোন ভূমিকা থাকবে না। তাই পরিবারের কোন ব্যক্তি বা নিকটাত্মীয় কেয়ামতের দিন কোন নিকটাত্মীয় বা পরিবারের সদস্যর জন্য কিছুই করতে পারবে না। কাজেই মৃত্যুর পূর্বেই নিজ নিজ প্রস্তুতি গ্রহণ করে আখেরাতে হাযির হতে হবে।

সপ্তদশ অধ্যায় : পারিবারিক জীবন : শেষ পরিণতির দিকে মহাযাত্রা

মৃত্যু ও তার পরবর্তী অবস্থা, বরজখ, কেয়ামত ও হাশর

জীবনের শেষ পরিণতি অবধারিত মৃত্যু। এ মৃত্যু এসে যাবে কোন এক অজানা মুহূর্তে। তবে পরিবারের সদস্য নেক্কার বান্দাহ হলে তার মৃত্যু হবে এক রকম আর বদকার হলে তার মৃত্যু হবে অন্য রকম। মৃত্যু যাতনা ও ফেরেশতাদের ব্যবহারের মধ্যে যথেষ্ট তারতম্য দেখা দেবে এই দুই অবস্থায়। যারা দুনিয়ার জীবনে সৎ আমল করেছে, সৎভাবে জীবন যাপন করেছে, আল্লাহর আইন ও বিধানকে মেনে চলেছে এবং আল্লাহর আইন ও বিধান প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেছে, তাদের প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন:

الَّذِينَ تَتَوَفَّهُمُ الْمَلَئِكَةُ طَيِّبِينَ يَقُولُونَ سَلَمٌ عَلَيْكُمُ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ –

“যাদেরকে ফেরেশতা মৃত্যু দান করবেন তারা যদি হন পবিত্র জীবনের অধিকারী তাদেরকে বলা হবে জান্নাতে প্রবেশ করে যাও, তোমরা যে আমল করেছ তার বিনিময়ে।” (সূরা নহলঃ ৩২)

আল্লাহ তায়ালা মু’মিনদেরকে এজন্য দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন যা তারা মৃত্যুর পূর্ব থেকেই করে আসছিল:

رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ –

“হে আমাদের পরোয়ারদেগার রব, আমাদেরকে মাফ করে দিন, আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে দিন আর আমাদের মৃত্যু দান করুন নেককার লোকদের সাথে।” (সূরা আলে ইমরান : ১৯৩)

নেককার লোকদের অবস্থান তো নায়ীম নামক জান্নাতে।

إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِي نَعِيمٍ

“নিশ্চয়ই নেককার লোকেরা থাকবে নায়ীমে (জান্নাতে)।” (সূরা ইনফেতার)

পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের এভাবে নেককার লোকদের সাথে মৃত্যু হওয়া একান্তভাবে কাম্য। কে জান্নাতী হবে আর কে হবে জাহান্নামী মৃত্যুর দুয়ার-অতিক্রম করলেই তা টের পাওয়া যাবে।

জাহান্নামী লোকদের মৃত্যু হবে খুবই কঠিন ও ভয়াবহ। মৃত্যুদানকারী ফেরেশতা তার সাথে অত্যন্ত কঠোর ব্যবহার করবেন। কোরআনে বর্ণনা এসেছে:

فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتَهُمُ الْمَلَئِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ – ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ اتَّبَعُوا مَا أَسْخَطَ اللَّهَ وَكَرِهُوا رِضْوَانَهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ –

“যখন ফেরেশতা তাদের মৃত্যু ঘটাবে, তাদের চেহারায় ও পিঠে আঘাত করতে থাকবে, তখন তাদের অবস্থা কি হবে? তাদের এ অবস্থা হবে এজন্য যে তারা ঐসব পথ অনুসরণ করেছে যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করেছে আর তারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অপছন্দ করত, অতএব তাদের আমলকে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে।” (সূরা মুহাম্মদ: ২৭-২৮)

وَلَوْ تَرَى إِذْ يَتَوَفَّى الَّذِينَ كَفَرُوا الْمَلَئِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ ج وَذُوقُوا عَذَابَ الْحَرِيقِ – ذَلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيكُمْ وَإِنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِلْعَبِيدِ –

“তোমরা যদি দেখতে পেতে ফেরেশতা যখন যারা কাফের তাদের মৃত্যুদান করবে তাদের চেহারায় ও পিঠে আঘাত করবে এবং বলতে থাকবে, যাও এবার আগুনে জ্বলার আযাব আস্বাদন কর। এ হলো তাদের হাত যা কামাই করেছে তার ফলাফল এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি সামান্যমাত্র জুলুম করেন না।” (সূরা আনফাল: ৫০-৫১)

পাপী লোকদের মৃত্যুর সময় এমনি আচরণ করা হবে ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে। পরিবারের সদস্যদের যেই এরূপ আমলের অভিশাপে অভিশপ্ত হবে তাকে মৃত্যুর সময় এমনি কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, তাদের প্রতি আসবে আযাবের নোটিশ। তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী –

وَإِنَّ الْفُجَّارَ لَفِي جَحِيمِ

“পাপীরা অবশ্যি থাকবে জাহান্নামে।” (সূরা ইনফেতার)

কোরআন ও হাদীসের আলোকে দেখা যায় মৃত্যুর পর ব্যক্তির রূহকে ইল্লিন অথবা সিজ্জিন ঘুরিয়ে পুনরায় তার নিজ দেহে ফেরত পাঠানো হয়। এরপর কেয়ামত পর্যন্ত সে মাটির মধ্যেই অবস্থান করবে। এ প্রসংগে কোরআনে বলা হয়েছে:

كَلَّا إِنَّ كِتَبَ الْفُجَّارَ لَفِي سِجِّينٍ وَمَا أَدْرَاكَ مَا سِجِّينٌ كِتَابٌ مَرْقُومٌ – وَيْلٌ يَوْمَئِذٍ لِلْمُكَذِّبِينَ –

“কখনো নয়, নিশ্চয়ই পাপাত্মার আমলনামা সিজ্জিনে রক্ষিত থাকবে। আপনার কি জানা আছে সিজ্জিনে রক্ষিত আমলনামা কি জিনিষ? এ হলো এক চিহ্নযুক্ত লিখিত কিতাব। সেদিন মিথ্যাবাদীদের জন্য ধ্বংস।” (সূরা মুতাফফিফিন : ৭-১০)

كَلَّا إِنَّ كِتَبَ الْأَبْرَارَ لَفِي عِلِّيِّينَ وَمَا أَدْرَاكَ مَا عِلِّيُّونَ – كِتَابٌ مَرْقُومٌ – يَشْهَدُهُ الْمُقَرَّبُونَ إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِي نَعِيمٍ –

“কখখনো নয়। নিশ্চয়ই পুণ্যাত্মার আমলনামা রক্ষিত থাকবে ইল্লিনে। আপনি কি জানেন ইল্লিন কি জিনিষ? তা হলো চিহ্নযুক্ত লিখিত এক জিনিষ। যা (আল্লাহর) নিকটবর্তী ফেরেশতাগণ দেখে থাকেন। নিশ্চয়ই পুণ্যাত্মাগণ থাকবে নায়ীমে (জান্নাতে)।” (সূরা মুতাফফিফিন: ১৮-২২)

কবর বা বরযখের জীবন

ব্যক্তির লিখিত আমলনামা ইল্লিনে অথবা সিজ্জিনে অবস্থান করবে। আর ব্যক্তির মৃত্যু থেকে কেয়ামত পর্যন্ত অবস্থানকে কোরআনে বলা হয়েছে ‘বরযখ’ এবং হাদীসে বলা হয়েছে কবর। এই ‘বরযখ’ বা কবরের জীবনেও ব্যক্তির সুখ-শান্তির ব্যবস্থা বা দুঃখ- বেদনা ও শাস্তি হবে বলে হাদীসে দেখা যায়। বরযখের ব্যাপারে কোরআন বলে: “এবং তাদের পেছনে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত রয়েছে একটি বরযখ।”

হাদীসে বলা হয়েছেঃ “প্রত্যেক ব্যক্তির কবর হবে হয়তো জান্নাতের বাগান সমূহের একটি বাগান কিংবা জাহান্নামের গহ্বর সমূহের একটি গহ্বর।” (জামে আততিরমিযী: আবু সাইদ খুদরী।)

অবশ্য প্রত্যেক ব্যক্তির আমলনামায় কেয়ামত পর্যন্ত কিছু কিছু নেক আমল অথবা বদ আমল যোগ হতে পারে। কেউ যদি তার জীবনকালে এমন কোন আমল করে যায় যা তার মৃত্যুর পরও জারী থাকে, তাহলে তার সওয়াব বা পাপের অংশ তার আমলনামায় যোগ হবে। হাদীসে রয়েছে:

“আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল (চলতে থাকে): সকায়ে জারিয়া অথবা এমন এলম যা দ্বারা কল্যাণ লাভ করা যায় অথবা নেককার সন্তান, যে তার পিতামাতার জন্য দোয়া করে।” (মুসলিম, রিয়াদুল জান্নাত: ১১৩)

অনুরূপভাবে যে সব বদ আমলের ধারাবাহিকতা মৃত্যুর পরও চলতে থাকে সে সব আমলের পাপের অংশও সে ব্যক্তির আমলে যোগ হতে থাকে। তাই মৃত্যুর পরে পরিবারের সদস্য নেককার হলে তার সম্পর্ক স্থাপিত হবে বেহেশতের সাথে এবং তার জীবদ্দশায় কৃত চালু নেক আমলের অংশ পেতে থাকবে আর যদি উক্ত সদস্য বদকার হয় তাহলে তার সম্পর্ক স্থাপিত হবে দোযখের সাথে এবং তার কৃত চালু বদ আমলের অংশ পেতে থাকবে।

হাদীসে দেখা যায় মৃত্যুর পর ব্যক্তির আত্মাকে আলাদা করে আল্লাহর সমীপে পেশ করা হয়। পরে তা কবরে তার দেহে সংস্থাপন করা হয়। তখন তাকে ফেরেশতাগণ কয়েকটি প্রশ্ন করেন:

১. তোমার রব কে?
২. তোমার দ্বীন কি?
৩. তোমার নিকট যিনি প্রেরিত হয়েছিলেন, তিনি কে?
৪. তোমার আমল কি ছিল?

নেককার বান্দা প্রথম প্রশ্নের জবাবে বলে: আমার রব মহান আল্লাহ; দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে বলে: আমার দ্বীন ইসলাম; তৃতীয় প্রশ্নের জবাবে বলে: তিনি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম;

এবং চতুর্থ প্রশ্নের জবাবে বলে: আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি, তা বিশ্বাস করেছি এবং সত্য বলে জেনেছি (অর্থাৎ সে অনুযায়ী আমল করেছি)।

অপরদিকে বদকার বান্দা ফেরেশতাদের প্রশ্নের জবাবে শুধু বলতে থাকবে আমি কিছুই জানি না।

অতঃপর নেককার বান্দার কবরের সাথে বেহেশতের সুবাতাস ও সু-ঘ্রাণের সম্পর্ক স্থাপিত হবে, কবর প্রশস্ত করা হবে এবং সে ব্যক্তি কেয়ামত পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকবে। অপরদিকে বদকার বান্দার সম্পর্ক স্থাপিত হবে দোযখের সাথে এবং কেয়ামত পর্যন্ত সে আযাবে কাটাবে।
পরিবারের সদস্য যেই কবরবাসী হবে, সে যদি নেককার বান্দা হয় কবরে তার সুখের খবর তার পরিবার ও আত্মীয় স্বজনকে জানাতে আগ্রহ প্রকাশ করবে।

কেয়ামত

পারিবারিক জীবনে চলছে জন্ম মৃত্যুর এক ধারাবাহিক পরিক্রমা, এমনিভাবে কোন কোন ক্ষেত্রে পারিবারিক ধারাবাহিকতা এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। এ ধারাবাহিকতা শেষ হবে কেয়ামতের মাধ্যমে। কেয়ামত কি এবং কখন তা অনুষ্ঠিত হবে এ প্রশ্ন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সময়ও এসেছে। কেয়ামত কি এ প্রসংগে কোরআনের বহু জায়গায় বলা হয়েছে:

إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ – وَإِذَا النُّجُومُ انْكَدَرَتْ – وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ – وَإِذَا الْعِشَارُ عُطِّلَتْ – وَإِذَا الْوُحُوشُ حُشِرَتْ – وَإِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ

“যখন সূর্য আলোহীন হয়ে পড়বে, তারকাসমূহ খসে পড়বে। এবং যখন পাহাড় সমূহকে চালিত করা হবে এবং দশ মাসের গর্ভবতী উষ্ট্রী পরিত্যক্ত অবস্থায় বিচরণ করবে আর পশু সকল একত্রিত হবে। এবং সাগর সমূহকে উত্থলিত করা হবে।” (সূরা তাকভীর: ১-৬)

إِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ – وَإِذَا الْكَوَاكِبُ انْتَثَرَتْ – وَإِذَا الْبِحَارُ فُجِّرَتْ –

“যখন আসমান ফেটে চৌচির হয়ে যাবে এবং যখন তারকাসমূহ খসে পড়বে এবং যখন সাগরসমূহ প্রবাহিত হবে।” (সূরা ইনফেতার: ১-৩)

يَوْمَ تَرْجُفُ الرَّاجِفَةُ – تَتْبَعُهَا الرَّادِفَةُ

“কেয়ামতের দিন কম্পনকারী বস্তু কম্পন করে উঠবে এবং তা অনুসরণ করবে অপর পশ্চাদগামী বস্তু।” (সূরা নাজিয়াত: ৬-৭)

الْقَارِعَةُ مَا الْقَارِعَةُ – وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْقَارِعَةُ – يَوْمَ يَكُونُ النَّاسُ كَالْفَرَاشِ الْمَبْثُوثِ – وَتَكُونُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ الْمَنْفُوشِ –

“কেয়ামতের ঘটনা। কি সেই কেয়ামতের ঘটনা? এবং আপনি কি জানেন সে কেয়ামতের ঘটনা কী? সেদিন মানুষ উদভ্রান্ত ঘোড়ার ন্যায় হয়ে যাবে, পর্বতসমূহ হয়ে যাবে ধুনিত তুলার ন্যায়।” (সূরা কারিয়া: ১-৪)

কেয়ামত মানে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুরমার করে এক প্রলয়কাণ্ড ঘটানো। কোরআনের উপরের উদ্ধৃতিসমূহ থেকে সে চিত্রই ভেসে উঠেছে। অর্থাৎ কেয়ামতের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুরে নতুন এক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। পরিবার সংস্থাও কেয়ামতের ফলে ভেঙ্গে যাবে। আজকের পৃথিবীর সূচনা পর্ব থেকে আসা পরিবার সংস্থার সকল সদস্য সেদিন পুনরায় জেগে উঠবে। সকলকে হাজির করা হবে হাশরের ময়দানে। ইস্রাফিলের প্রথম শিংগা ফুঁকে আকাশ- মহাকাশ, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত সকল কিছু ভেঙ্গে-চুরে একাকার করে ফেলা হবে। আর ইস্রাফিলের দ্বিতীয় ফুঁকে প্রশস্ততর পৃথিবীতে পুনরুত্থান হবে আজকের পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল মানুষের।

يَسْئَلُ أَيَّانَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ – فَإِذَا بَرِقَ الْبَصَرُ – وَخَسَفَ الْقَمَرُ – وَجُمِعَ الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ – يَقُولُ الْإِنْسَانُ يَوْمَئِذٍ أَيْنَ الْمَفَرُّ –

“সে জিজ্ঞেস করবে কেয়ামতের দিবস কবে আসবে, সেটা হলো যেদিন মানুষের চক্ষু বিস্ফোরিত হবে আর চাঁদ নিষ্প্রভ হয়ে যাবে এবং সূর্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে। মানুষ বলবে এখন কোন দিকে পলায়ন করি।” (সূরা কিয়ামাহ: ৬-১০)

ইস্রাফিলের ২য় ফুঁকের পরবর্তী অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে সূরা ইনশিকাকের শুরুতে:

إِذَا السَّمَاءُ انْشَقَّتْ – وَأَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَحُقَّتْ – وَإِذَا الْأَرْضُ مُدَّتْ – وَأَلْقَتْ مَا فِيهَا وَتَخَلَّتْ – وَأَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَحُقَّتْ –

“যখন আসমান দীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে যাবে এবং যথার্থভাবে তার রবের নির্দেশ পালন করবে এবং জমীনকে টেনে বাড়ানো হবে এবং যখন সে ভিতরকার সবকিছু উদগীরণ করে খালি হয়ে যাবে এবং যথার্থভাবে তার রবের নির্দেশ পালন করবে।” (সূরা ইনশিকাক: ১-৫)

وَإِذَا الْقُبُورُ بَعْثَرَتْ – عَلِمَتْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ وَأَخَّرَتْ –

“এবং যখন কবরসমূহ পুনরুত্থিত হবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি পূর্বাহ্নে যা পাঠিয়েছে এবং পরে যা পাঠিয়েছে তা জানতে পারবে।” (সূরা ইনফেতার: ৪-৫)

يَأَيُّهَا الْإِنْسَانُ إِنَّكَ كَادِحٌ إِلَى رَبِّكَ كَدْحًا فَمُلْقِيهِ – فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَبَهُ بِيَمِينِهِ – فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا – وَيَنْقَلِبُ إِلَى أَهْلِهِ مَسْرُورًا – وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَبَهُ وَرَاءَ ظَهْرِهِ – فَسَوْفَ يَدْعُوا ثُبُورًا – وَيَصْلَى سَعِيرًا –

“হে মানব সম্প্রদায়, তোমরা তোমাদের রবের নিকট পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত চেষ্টা সাধনা করে যাচ্ছ, অতঃপর তোমরা তোমাদের রবের সাক্ষাৎ লাভ করবে। অতঃপর যাদেরকে তার আমলনামা ডান হাতে প্রদান করা হবে তার হিসাব নেয়া হবে সহজভাবে এবং সে ফিরে যাবে আনন্দের সাথে তার পরিবারবর্গের নিকট। আর যার আমলনামা দেয়া হবে তার পিছন দিক থেকে, সে সাথে সাথেই মৃত্যুকে ডাকতে শুরু করবে এবং দোযখে পৌঁছে যাবে।” (সূরা ইনশিকাক: ৬-১২)

পুনরুত্থান ও হাশর

কেয়ামতের পর যখন পুনরায় নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা স্থাপিত হবে, তখন শুরু থেকে কেয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের পুনরুত্থান হবে এবং সকলকে হাশরের ময়দানে একত্রিত করা হবে। এমতাবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তিকে স্ব-স্ব আমলনামা প্রদান করা হবে। যাদের আমলনামা ভাল হবে তা ডান হাতে প্রদান করা হবে এবং তারা হাশরের ময়দানে পুনরায় পারিবারিক সংস্থায় একত্রিত হবে- কোরআনের ভাষ্য থেকে একথা স্পষ্ট ভাবে জানা যায়। আর যার আমলনামা খারাপ হবে, সে আযাবে নিক্ষিপ্ত হবে, তার পারিবারিক পরিচয় বহাল থাকবে কি-না তার কোন প্রমাণ কোরআনের পাওয়া যায় না। তাই ইহকালীন পারিবারিক জীবনকে আখেরাত পর্যন্ত বহাল রাখতে হলে পরিবারের সদস্যদের ইহকালীন জীবনে এমন আমল করে যেতে হবে যাতে হাশরের ময়দানে আমলনামা ডান হাতে পাওয়া যায়।

পরিবারের কোন সদস্য যদি তার ইহকালীন জীবনের আমলের কারণে আমলনামা বাম হাতে ও পিছন দিক থেকে পায়, তাহলে সে পারিবারিক সংস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আযাবে গ্রেফতার হবে। আর যদি কোন পরিবার থেকে একজন নেক আমলের অধিকারী হয় এবং ডান হাতে আমলনামা পায় সেও বিচ্ছিন্নভাবে বেহেশতে যাবে। কিন্তু গোটা পরিবারের সকল সদস্যই বদ আমলের অধিকারী ও পেছন থেকে আমলনামা প্রাপ্ত হলে আখেরাতে পুনরায় পারিবারিকভাবে মিলনের সুযোগ আর হবে না বরং প্রত্যেকেই আযাবে নিক্ষিপ্ত হবে। তাই পাক কোরআনে বলা হয়েছে:

قُلْ إِنَّ الْخَسِرِينَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ وَأَهْلِيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ –

“আপনি বলে দিন, ক্ষতিগ্রস্ত তারাই যারা নিজেরা ও তাদের পরিবারবর্গ কেয়ামতের দিন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটা হলো সুস্পষ্ট ক্ষতিগ্রস্ততা।” (সূরা যুমার: ১৫)

আসলে পারিবারিক জীবন হলো সুখ ও শান্তিতে বসবাস করার একটি খোদা প্রদত্ত ব্যবস্থা। আখেরাতে যারা বেহেশত লাভ করবে কেবলমাত্র তারাই সুখ ও শান্তির অধিকারী হবে, তাই পরিবারের সকল বা বেশীর ভাগ সদস্য বেহেশতি হলে তারা পারিবারিকভাবেই বেহেশতের সুখ ভোগ করবে। আর পরিবারের সদস্যগণ দোযখের অধিবাসী হলে যেহেতু এখানে সুখের কোন অবকাশ নেই, তাই তারা পারিবারিক সুখও পাবে না বরং দোযখের আযাবেই গ্রেফতার হয়ে যাবে।

আখেরাতে আত্মীয় ও পারিবারিক সম্পর্ক কোন উপকারে আসবে না

মৃত্যুর পর থেকে কেয়ামত পর্যন্ত বরযখের জীবনে বা কেয়ামতের পরবর্তী হাশরের ময়দানে অথবা হাশরের বিচার ফায়সালার পর পুরস্কার স্বরূপ জান্নাত লাভ বা জাহান্নাম প্রাপ্তিতে পরিবারের সকল সদস্যের স্ব-স্ব আমলনামাই কেবল কার্যকর হবে, কোন আত্মীয়তার বা পারিবারিক সম্পর্কের কোন ফলাফল ব্যক্তির কোন কাজে আসবে না। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে তা সুস্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছেন:

فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلَا أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُونَ –

“অতঃপর যখন শিঙ্গাঁয় ফুঁক দেয়া হবে, সেদিন তাদের মধ্যে থাকবে না কোন প্রকার আত্মীয়তার সম্পর্ক এবং কোন কিছু জিজ্ঞাসাবাদও করা হবে না।” (সূরা মু’মিনুন: ১০১)

لَنْ تَنفَعَكُمْ أَرْحَامُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ ، يَوْمَ الْقِيَامَةِ ، يَفْصِلُ بَيْنَكُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ –

“কেয়ামতের দিন তোমাদের আত্মীয়তা ও তোমাদের সন্তান সন্তুতি কোনই উপকারে আসবে না, সেদিন তোমাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেয়া হবে, আর আল্লাহ তোমরা যা কিছুই করছ তা প্রত্যক্ষ করছেন।” (সূরা মুমতাহিনা: ৩)

فَإِذَا جَاءَتِ الصَّاخَّةُ – يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ – وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ – وَصَاحِبَتِهِ – وَبَنِيهِ – لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ –

“অতঃপর সেদিন শিঙ্গা ফুঁকের কারণে কানফাটা আওয়াজ এসে যাবে, তখন মানুষ তার ভাই, পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি থেকে পালাতে থাকবে। প্রত্যেকেই এমন ব্যস্ত হয়ে পড়বে যে কারোর দিকে লক্ষ্য করবে না।” (সূরা আবাসা: ৩৩-৩৭)

يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ وَاخْشَوْا يَوْمًا لَا يَجْزِي وَالِدٌ عَنْ وَلَدِهِ وَلَا مَوْلُودٌ هُوَ جَازٍ عَنْ وَالِدِهِ شَيْئًا إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُم بِاللَّهِ الْغَرُورُ –

“হে লোক সকল! তোমাদের রবের ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন কর এবং ভয় কর সেই দিনকে যেদিন কোন পিতা তার পুত্রকে কোন প্রতিদান দেবে না, আর না কোন পুত্র তার পিতাকে কিছু দেবে। নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য, কাজেই দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে প্রতারণায় না ফেলে এবং আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারক যেন তোমাদেরকে প্রতারণায় না ফেলে।” (সূরা লোকমান: ৩৩)

وَلَا يَسْأَلُ حَمِيمٌ حَمِيمًا – يُبَصَّرُونَهُمْ – يَوَدُّ الْمُجْرِمُ لَوْ يَفْتَدِي مِنْ عَذَابِ يَوْمَئِذٍ بَنِيهِ –

“বন্ধু সেদিন প্রাণের বন্ধুকে জিজ্ঞাসাও করবে না, যদিও তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষৎ হবে। সেদিন পাপী ব্যক্তি (অপরাধী) সেদিনের আযাব থেকে মুক্তির জন্য তার পুত্রগণকে, তার সংগিনীকে, তার ভাইকে এবং সে যে পরিবারবর্গ নিয়ে বসবাস করত তাদেরকে এবং দুনিয়ার সকল মানুষকে মুক্তিপণ দিয়ে নাযাত পেতে চাইবে।” (সূরা মায়ারিজ: ১০-১১)

يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِنَفْسٍ شَيْئًا وَالْأَمْرُ يَوْمَئِذٍ لِلَّهِ –

“সেদিন কোন ব্যক্তি তার নিজের কোন কিছুরই অধিকারী থাকবে না এবং সেদিন সকল নির্দেশই হবে একমাত্র আল্লাহর।” (সূরা ইনফেতার: ১৯)

يَوْمَ لَا يَنْفَعُ مَالَ وَلَا بَنُونَ –

“সে দিন ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনই উপকারে আসবে না। (সূরা: ৮৮)

সেই চূড়ান্ত ফায়সালার দিন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি কোনই কাজে আসবে না। কাজে আসবে কেবলমাত্র নিজ নিজ সৎ আমল। আমলনামাই নিজ নিজ ভাগ্যের ফায়সালা করে দেবে। নেক আমলের অধিকারী ব্যক্তি পাবে চিরস্থায়ী জান্নাত, আর বদ আমলের অধিকারী ব্যক্তি পাবে চিরস্থায়ী জাহান্নাম। পরিবারের সদস্যগণ শেষ পরিণতির দিকে মহাযাত্রা করবে হাশরের পরেই।

অষ্টাদশ অধ্যায় : পারিবারিক জীবনের শেষ পরিণতি জাহান্নাম অথবা জান্নাত

মৃত্যুর মাধ্যমেই পরিবারিক জীবনের ইতি ঘটে। কিন্তু জীবনের পরিণতি এখানেই শেষ নয়। এরপর বরযখ, কেয়ামত, হাশর পার হয়ে চূড়ান্ত ফলাফল প্রাপ্তির মাধ্যমে শেষ পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। এভাবে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের শেষ পরিণতি শাস্তি স্বরূপ জাহান্নাম অথবা পুরস্কার স্বরূপ জান্নাত লাভ। পৃথিবীর সকল মানুষের সৃষ্টির সূচনাতেই কিন্তু সে কথা বলে দেয়া হয়েছে।

وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى ، شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيمَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غُفِلِينَ . أَوْ تَقُولُوا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِنْ بَعْدِهِمْ أَفَتَهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ –

“আর যখন আপনার রব আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের সন্তানদের বের করলেন এবং তাদের নিজেদের ব্যাপারে তাদের নিকট থেকেই স্বীকারোক্তি নিলেন আমি কি তোমাদের রব নই, তারা সকলে বলল হ্যাঁ। আমরা এ কথার সাক্ষী হলাম যেন কেয়ামতের দিন বলতে না পার যে আমরা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ বেখবর ছিলাম অথবা এ কথা বলতে না পার যে ইতিপূর্বে আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা শেরক করেছিল এবং আমরা তাদের পরবর্তী পর্যায়ের বংশধর (সন্তানাদি), অতএব আমাদেরকে কি বিপথগামীদের মতো ধ্বংস করবেন? (সূরা
আরাফ: ১৭২-১৭৩)

উপরের আয়াত থেকে এ কথা জানা গেল যে, সৃষ্টির সূচনা পর্বে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় সৃষ্ট সকল মানুষের কাছ থেকে এ স্বীকৃতি গ্রহণ করেন যে মহান আল্লাহই তাদের সকলের রব, তারই বিধানমত সকলে দুনিয়াতে জীবন যাপন করবে এবং কেয়ামতের দিন তা অস্বীকার করবে না। কিন্তু দুনিয়াতে এসে অনেকে সে কথা ভুলে যায়, আল্লাহকে অস্বীকার করে। তাঁর বিধানকে করে অমান্য, আর তাদের শেষ পরিণতি হবে জাহান্নাম। আর যারা আল্লাহ আমাদের রব একথা মনে রেখেছে, আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাঁরই বিধান ও আইনকে তারা জীবনভর মেনে চলেছে, তাদের শেষ পরিণতি হবে জান্নাত। কোরআনের পাতায় পাতায় তাদের শেষ পরিণতির কথা উল্লেখ রয়েছে।

وَسِيقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَى جَهَنَّمَ زُمَرًا حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا فُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِنْكُمْ يَتْلُونَ عَلَيْكُمْ آيَتِ رَبِّكُمْ وَيُنْذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَذَا قَالُوا بَلَى وَلَكِنَّ حَقَّتْ كَلِمَةُ الْعَذَابِ عَلَى الْكَافِرِينَ – قِيلَ ادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ – وَسِيقَ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا وَفُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوهَا خَالِدِينَ –

“কাফেরদেরকে দলে দলে জাহান্নামের দিকে হাকিয়ে নেয়া হবে, যখন তার দরজাসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং তার দ্বাররক্ষীরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে ‘তোমাদের নিকট কি তোমাদেরই মধ্য থেকে কোন রাসূল আসেনি যারা তোমাদের নিকট তোমাদের রবের আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করছিল এবং আজকের এই দিনের সাক্ষাতের ব্যাপারে তোমাদেরকে সতর্ক করছিল, তারা বলবে, হ্যাঁ, কিন্তু কাফেরদের ব্যাপারে আযাবের ফায়সালা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে বলা হবে, দোযখের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে যাও, এতেই থাকতে হবে তোমাদের চিরকাল, অহংকারীদের জন্য এ স্থান খুবই নিকৃষ্ট। তাদের রবের ব্যাপারে যারা সতর্ক, সচেতন এবং ভয় করে চলে, তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা সেখানে পৌঁছবে ঐ অবস্থায় যে দরজা সমূহ খোলা থাকবে, দাররক্ষীরা বলবে, আপনাদের প্রতি সালাম, পরমানন্দে, চিরদিনের জন্য এতে প্রবেশ করুন।” (সূরা জুমার: ৭১-৭৩)

بَلَى مَنْ كَسَبَ سَيِّئَةً وَأَحَاطَتْ بِهِ خَطِيئَتُهُ فَأُوْلَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ –

“যে ব্যক্তি মন্দ আমল উপার্জন করল এবং তার পাপ তাকে ঘিরে রাখল, এরা হলো দোজখের অধিবাসী তথায় থাকবে তারা চিরকাল।” (সূরা বাকারা: ৮১)

وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُوْلَٰئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ، وَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ –

“তোমাদের মধ্য থেকে যে তার দ্বীন থেকে সরে গেল এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল, তার ইহকালীন ও পরকালীন আমলসমূহ নষ্ট হয়ে গেল, তারা হবে দোযখের অধিবাসী, সেখানে থাকবে তারা অনন্তকাল।” (সূরা বাকারা: ২১৭)

وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُّهِينٌ –

যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলকে অমান্য করবে এবং তার সীমাসমূহ লংঘন করবে, সে দোযখে প্রবেশ করবে, সেখানে থাকবে সে অনন্তকাল এবং তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাময় শাস্তি। (সূরা নিসা: ১৪)

أَلَمْ يَعْلَمُوا أَنَّهُ مَنْ يُحَادِدِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدًا فِيهَا ذَلِكَ الْخِزْيُ الْعَظِيمُ –

“তারা কি জানে না যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের সীমা লংঘন করে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন, তাতে থাকবে তারা চিরদিন, এ হলো চরম অপমান।” (সূরা তওবা: ৬৩)

জাহান্নামী হবে দুর্ভাগা লোকেরা:

فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ – خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِّمَا يُرِيدُ –

“অতএব যারা দুর্ভাগা, তারা যাবে দোযখে, সেখানে থাকবে তাদের জন্য চিৎকার ও আর্তনাদ। সেখানে থাকবে তারা চিরদিন, যতদিন আসমান ও যমীন বর্তমান থাকে। তবে যদি তোমার রব অন্য কিছু চান তাহলে ভিন্ন কথা, নিশ্চয়ই তোমার রব যা ইচ্ছা তাই করে থাকেন।” (সূরা হুদ: ১০৬-১০৭)

এমনিভাবে আল কোরআনের হাজারো আয়াতে জাহান্নামীদের জাহান্নামে যাওয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। উপরের আয়াত কটি থেকে জানা গেল লোকদের মন্দ আমল, দ্বীন থেকে সরে যাওয়া, আল্লাহ ও তার রাসূলকে অমান্য করা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সীমা লংঘন ইত্যাদি কারণে যারা দূর্ভাগ্যবান হয়ে পড়বে তাদের স্থান হবে জাহান্নাম। পরিবারের কোন সদস্য বা গোটা পরিবার উপরোক্ত কারণে দূর্ভাগা হয়ে পড়লে জাহান্নাম ছাড়া আর কোন স্থান হবে না। এইভাবে এ ধরনের ব্যক্তিদের শেষ পরিণতি হবে জাহান্নাম যা হবে অনন্তকালীন ও চিরস্থায়ী। জাহান্নামীদের জন্য পারিবারিক জীবনের কোন সুযোগ বা অবকাশ নেই। তাদের পারিবারিক জীবনের ইতি ইহকালেই। তবে কেউ জান্নাতি হলে সেখানে তার ভিন্ন স্ত্রী বা স্বামীর ব্যবস্থা হবে।

অপরদিকে জান্নাতের অধিবাসীদের কথাও কোরআনের অসংখ্য আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করছি।

وَأَمَّا الَّذِينَ سُعِدُوا فَفِي الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ عَطَاءً غَيْرَ مَحْدُودٍ –

“এবং যারা হবে সৌভাগ্যবান, তাদের অবস্থান হবে জান্নাতে, সেখানে থাকবে তারা চিরদিন, যতদিন আসমান ও যমীন বর্তমান থাকে তবে যদি তোমার রব অন্য কিছু চাহেন তবে ভিন্ন কথা, এ হবে এমন এক দান যা কোন দিন কর্তন করা হবে না।” (সূরা হুদ: ১০৮)

এ আয়াত থেকে বুঝা গেল যারা সৌভাগ্যবান তারাই জান্নাতে যাবে। তবে জান্নাত লাভের জন্য কোরআন কিছু শর্ত আরোপ করেছে। দু’টি প্রধান শর্ত হলো মু’মিনদের মধ্য থেকে জেহাদে অংশগ্রহণ করা ও ধৈর্যশীল হয়ে দৃঢ়ভাবে দ্বীনকে ধারণ করা।

أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمُ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ –

“তোমরা কি মনে করেছ এমনি এমনি তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে অথচ আল্লাহ জেনে নেবেন না তোমাদের মধ্যে কারা জেহাদ করেছে এবং ধৈর্যশীল।” (সূরা আলে ইমরান: ১৪২)

فَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَأُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأُوذُوا فِي سَبِيلِي وَقَاتَلُوا وَقُتِلُوا لَأُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَأُدْخِلَنَّهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ، ثَوَابًا مِّنْ عِنْدِ اللَّهِ وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الثَّوَابِ –

“অতএব যারা হিজরত করেছে তাদের বাড়ীঘর থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে, আমার পথে নির্যাতিত হয়েছে এবং আমার পথে লড়াই করেছে ও শহীদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আমি তাদের ত্রুটিসমূহ দূর করে দেব এবং অবশ্যি তাদেরকে এমন বেহেশতে প্রবেশ করাব যার নিচে দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত। এ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া প্রতিদান। বস্তুতঃ আল্লাহর নিকট রয়েছে উত্তম প্রতিদান।” (সূরা আলে ইমরান: ১৯৫)

وَمَنْ يُقَاتِلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا

“যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে লড়াই করে, সে নিহত হোক বা জয়লাভ করুক, আমি তাকে মহাপ্রতিদান প্রদান করব।” (সূরা নিসা: ৭৪)

إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের নিকট থেকে জান্নাতের বিনিময়ে তাদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন।” (সূরা তওবা: ১১১)

إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَعُيُونٍ – آخِذِينَ مَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ إِنَّهُمْ كَانُوا قَبْلَ ذَلِكَ مُحْسِنِينَ – كَانُوا قَلِيلاً مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ – وَبِالْأَسْحَارِهِمْ يَسْتَغْفِرُونَ – وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ –

“নিশ্চয়ই মুত্তাকীগণ থাকবেন জান্নাতে ও নহরসমূহের মধ্যে। তাদের রব তাদেরকে যা প্রদান করবেন তা তারা (আনন্দচিত্তে) গ্রহণ করবেন। ইতিপূর্বেও তারা মুহসেন (সদাচারী) ছিলেন। তাঁরা রাত্রি বেলায় কমই ঘুমাতেন এবং তারা শেষ রাতে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। এবং তাদের ধনসম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার ছিল। (সূরা জারিয়াত: ১৫-১৯)

الَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَاتِهِمْ دَائِمُونَ – وَالَّذِينَ فِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَعْلُومٌ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ – وَالَّذِينَ يُصَدِّقُونَ بِيَوْمِ الدِّينِ – وَالَّذِينَ هُمْ مِّنْ عَذَابِ رَبِّهِمْ مُشْفِقُونَ – إِنَّ عَذَابَ رَبِّهِمْ غَيْرُ مَأْمُونٍ – وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ – إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ – فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُوْلَٰئِكَ هُمُ الْعَادُونَ – وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمُنْتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ – وَالَّذِينَ هُمْ بِشَهَادَاتِهِمْ قَائِمُونَ – وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ – أُوْلَٰئِكَ فِي جَنَّاتٍ مُكْرَمُونَ –

“যারা সদা-সর্বদা নামাযে রত থাকে, যারা তাদের ধনসম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক নির্ধারিত রাখে। এবং যারা বিচারদিনের প্রতি বিশ্বাস পোষণ করে আর যারা তাদের রবের আযাবকে ভয় করে, নিশ্চয়ই তাদের রবের আযাবে নির্ভয় থাকা যায় না। আর যারা তাদের লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করে কিন্তু তাদের স্ত্রীসমূহ বা মালিকানাধীন দাসীদের থেকে নয়। কেননা এ ব্যাপারে তিরষ্কার করা হয় না। যে ব্যক্তি এর বাইরে কামনা করে তারাই সীমালংঘনকারী। যারা তাদের আমানত ও ওয়াদা সমূহ রক্ষা করে এবং যারা তাদের সাক্ষ্যের ব্যাপারে দাঁড়িয়ে থাকে। আর যারা তাদের নামাযকে সংরক্ষণ করে। এরাই স-সম্মানে বেহেশতে অবস্থান করবে।” (সূরা মায়ারিজ: ২৩-৩৫)

وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى – فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى –

“আর যে নিজের রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করেছে এবং নফসকে প্রবৃত্তি থেকে বিরত রেখেছে তার স্থান হবে জান্নাতে।” (সূরা নাজিয়াত: ৪০-৪১)

এভাবে বলা হয়েছে জান্নাত লাভের প্রাথমিক পুঁজি হলো ঈমান ও আমলে সালেহ (সৎকাজ):

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلاً –

“যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য মেহমানদারী স্বরূপ রয়েছে ফেরদাউস জান্নাত।” (সূরা আল কাহাফ : ১০৭)

কোরআনে বলা হয়েছে আখেরাতের বাসস্থান তাদের জন্যই উত্তম যারা তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করে অর্থাৎ যারা সৎ নীতিবান।

وَالدَّارُ الْآخِرَةُ خَيْرٌ لِّلَّذِينَ يَتَّقُونَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ –

“আর আখেরাতের বাসস্থান তাদের জন্যই উত্তম যারা তাকওয়া অবলম্বন করে চলে, তোমরা কি কিছুই বুঝ না।” (সূরা আরাফ: ১৬৯)

কোরআন ঘোষণা করছে পরিণাম ফল ভাল মোত্তকীদেরই।
পরিবারের সদস্য যারা উপরোক্ত গুণাবলীতে গুণান্বিত হবেন, তারাই হবেন জান্নাতী। সেসব গুণাবলী হলোঃ

(অ) ঈমান পোষণ ও সৎ আমল করণ,
(ই) তাকওয়ার নীতি অনুযায়ী দুনিয়ার জীবন যাপন,
(ঈ) হাশরের ময়দানে আল্লাহর সামনে দাঁড়াবার ভয় পোষণ,
(উ) নিজের নফসকে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে নিয়ন্ত্রণ,
(ঊ) সদা-সর্বদা নামায আদায়,
(ঋ) ধনসম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক নির্ধারণ,
(এ) আল্লাহর আযাবকে ভয় করা,
(ঐ) লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ,
(ও) আমানত ও ওয়াদা রক্ষা করা,
(ঔ) যথাযথ ভাবে সাক্ষ্য প্রদান,
(ক) নামাযের যথাযথ সংরক্ষণ,
(খ) সদাচরণ,
(গ) আল্লাহর এবাদতে রাত্রি জাগরণ ও শেষরাতে ক্ষমা প্রার্থনা,
(ঘ) আল্লাহর মর্জিমত জান-মালের ব্যবহার,
(ঙ) আল্লাহর পথে লড়াই করে শহীদ হওয়া অথবা বিজয় লাভ,
(চ) দ্বীনের বাস্তবায়নে হিজরত করা,
(ছ) বাড়ীঘর থেকে বহিষ্কৃত ও নির্যাতিত হওয়া,
(জ) সর্বোপরি একামতে দ্বীনের সংগ্রামে অংশ গ্রহণ ও দৃঢ়ভাবে তাতে অবস্থান গ্রহণ।
পরিবারের যে সব সদস্য এসব গুণাবলী অর্জন করবে তারা জান্নাতে স্থান লাভ করবে, তারা হবেন সৌভাগ্যবান।

পরিবারের লোকদের সকলে মিলে একত্রে বেহেশতে গমন

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যারাই নেক আমল করবে, সৎ পথে চলবে, দ্বীনের বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করবে এবং যথারীতি পরিস্থিতির মোকাবলা করবে তারা সকলেই একই সংগে বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং ফেরেশতাগণ তাদেরকে খোশ আমদেদ জানাবে।

جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُونَهَا وَمَنْ صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ وَالْمَلَائِكَةُ يَدْخُلُونَ عَلَيْهِمْ مِنْ كُلِّ بَابٍ – سَلَامٌ عَلَيْكُمْ بِمَا صَبَرْتُمْ فَنِعْمَ عُقْبَى الدَّارِ –

“এ হলো সেই চিরস্থায়ী জান্নাত। যাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের সাথে থাকবে তাদের সন্তান-সন্ততি যারা নেক কাজ করেছে। প্রতি দ্বারদেশ দিয়ে ফেরেশতাকুল তাদেরকে খোশ আমদেদ জানাতে এগিয়ে আসবেঃ তোমাদের প্রতি সালাম, যে অপরিসীম ধৈর্য তোমরা ধারণ করেছ সে জন্য। পরকালের এ বাসস্থান কতই না উত্তম।” (সূরা আর-রা’দ : ২৩-২৪)

বস্তুতঃ ফেরেশতাগণ ঈমানদার পরিবারের জন্য এরূপ দোয়াই করতে জানাবে:

رَبَّنَا وَأَدْخِلْهُمْ جَنَّاتِ عَدْنٍ الَّتِي وَعَدْتَهُمْ وَمَنْ صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ –

“হে আমাদের রব, তাদেরকে সেই চিরন্তন জান্নাতে প্রবেশ করাও যার ওয়াদা তুমি তাদের সাথে করেছ। আর তাদের পিতামাতা, স্ত্রী ও সন্তান সন্ততির মধ্যে যারা নেককার তাদেরকেও সেখানে পৌঁছে দাও। তুমি অবশ্যি মহাপরাক্রমশালী ও মহাবিজ্ঞ।” (সূরা আল মু’মেন: ৮)

এভাবে মু’মিন ব্যক্তি, তার পরিবারের সদস্যবৃন্দসহ বেহেশতে পৌঁছে যাবে কেবলমাত্র যাদের আমলনামা বাম হাতে ও পেছন দিক থেকে পাবে তারা তাদের সংগী হতে পারবে না। বেহেশত যে সুখের অবস্থান, সে অবস্থান এরূপ পারিবারিক সদস্যবৃন্দসহ বেহেশতে গমনের মাধ্যমেই পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। বেহেশতে পৌঁছে বেহেশতের অনাবিল ও অনন্তকালীন সুখে-শান্তিতে পারিবারিক জীবন যাপনের মাধ্যমে পারিবারিক জীবনের চরম উৎকর্ষতা লাভ হবে।

পারিবারিক জীবনে এই চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছতে হলে পরিবারের সদস্যদের শ্রেণীগত পার্থক্য থাকা চলবে না। তাই আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানী করে পরিবারের সদস্যদের এই শ্রেণীগত পার্থক্য ঘুচিয়ে দেবেন। তিনি নিম্ন শ্রেণীর বেহেশতীকে উপরের শ্রেণীতে উন্নীত করে এ সমস্যার সমাধান করে দেবেন।

وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّاتُهُمْ بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّاتِهِمْ وَمَا أَلَتْنَاهُمْ مِنْ عَمَلِهِمْ مِنْ شَيْءٍ كُلُّ امْرِئٍ بِمَا كَسَبَ رَهِينٌ –

‘এবং যারা ঈমান এনেছে ও তাদের সন্তান-সন্ততি যারা তাদেরকে ঈমানের ব্যাপারে অনুসরণ করেছে, তাদের সেই সন্তানকেও আমি তাদের মর্যাদায় শামিল করে নেব এবং তাদের আমলে কোনরূপ কমতি করা হবে না।” (সূরা তুর: ২১)

এভাবে একই পরিবারের নিম্ন শ্রেণীর বেহেশতীকে উন্নীত করে উপরের শ্রেণীতে নিয়ে একত্রে পারিবারিক জীবন যাপনের সুযোগ করে দেয়া হবে সেদিন স্বামী-স্ত্রী যারা উভয়েই বেহেশতী হবে তাদেরকে কত সুন্দর সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে সূরা যুখরূফে :

الْأَخِلَّاءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا الْمُتَّقِينَ – يَا عِبَادِ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ وَلَا أَنتُمْ تَحْزَنُونَ – الَّذِينَ آمَنُوا بِآيَاتِنَا وَكَانُوا مُسْلِمِينَ – ادْخُلُوا الْجَنَّةَ أَنتُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ تُحْبَرُونَ – يُطَافُ عَلَيْهِمْ بِصِحَافٍ مِنْ ذَهَبٍ وَأَكْوَابٍ ، وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ الْأَنفُسُ وَتَلَذُّ الْأَعْيُنُ وَأَنْتُمْ فِيهَا خَالِدُونَ – وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ – لَكُمْ فِيهَا فَاكِهَةٌ كَثِيرَةٌ مِّنْهَا تَأْكُلُونَ –

“সেদিন বন্ধুগণ একে অপরের শত্রু হয়ে যাবে কেবলমাত্র মুত্তাকীগণ ব্যতীত। (তাদেরকে বলা হবে) হে আমার বান্দাগণ, আজ তোমাদের কোন ভয়ের বা কোনরূপ দুশ্চিন্তার কারণ নেই, যারা আমার আয়াতের প্রতি ঈমান পোষণ করেছো এবং অনুগত (মুসলিম) ছিলে। তোমরা এবং তোমাদের স্ত্রীগণ আনন্দচিত্তে বেহেশতে প্রবেশ কর। সেখানে তাদের সামনে স্বর্ণনির্মিত প্লেট, বাটি ও পানপাত্র সমূহ পরিবেশন করা হবে এবং তাদের মন যা চায় এবং তাদের চোখ যাতে পরিতৃপ্ত হয় তাই প্রাপ্ত হবে এবং সেখানে তোমরা থাকবে চিরদিন। এ হলো সেই জান্নাত যার মালিক হবে তোমরা, তোমরা যে কাজ করেছিলে তার বিনিময়ে। সেখানে রয়েছে অসংখ্য ফলফলাদি যা থেকে তোমরা খাচ্ছ।” (সূরা যুখরুফ: ৬৭-৭৩)

إِنَّ أَصْحَابَ الْجَنَّةِ الْيَوْمَ فِي شُغُلٍ فَاكِهُونَ – هُمْ وَأَزْوَاجُهُمْ فِي ظِلَالٍ عَلَى الْأَرَائِكِ مُتَّكِئُونَ – لَهُمْ فِيهَا فَاكِهَةٌ وَلَهُمْ مَا يَدَّعُونَ – سَلَامٌ قَوْلًا مِّنْ رَبٍّ رَّحِيمٍ –

“নিশ্চয়ই বেহেশতবাসীরা সেদিন আপন কাজে সন্তুষ্ট থাকবে। তারা এবং তাদের স্ত্রীগণ স্নিগ্ধ ছায়াতলে পালংকের উপর বসা থাকবে। তাদের জন্য:

সেখানে থাকবে ফল-ফলাদি এবং যাই তারা কামনা করবে। দয়ালু রবের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি সালাম।” (সূরা ইয়াসীন: ৫৫-৫৮)

এভাবে বেহেশতী পরিবারের পারিবারিক জীবন আখেরাতে কত সুন্দর, আনন্দদায়ক ও শুভ পরিণতির হবে, তার ঘোষণা এসেছে আল কোরআনে। প্রকৃতপক্ষে পরিবারের সকলে মিলে বেহেশতের যোগ্য হলে যথার্থভাবে আখেরাতের জীবনেও পারিবারিক জীবন অটুট ও স্থায়ী থাকবে, অন্যথায় পারিবারিক জীবন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে দোযখের আযাবে কোথায় হারিয়ে যাবে তার খবর রাখবে কে?

তাই ইহকালীন জীবনের স্নেহময় পরিবেশের পারিবারিক জীবনকে আরো আনন্দময়, আরো সজীব ও স্থায়ী করার জন্য এমনভাবে পরিবারকে গড়ে তুলতে হবে যেন আখেরাতে সকলে মিলে বেহেশতে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করা যায়।

© Bangladesh Jamaat-e-Islami

  • আমাদের সম্পর্কে
  • প্রাইভেসি পলিসি
  • যোগাযোগ
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • দাওয়াত ও তাবলিগ
    • ঈমান ও আক্বীদাহ
    • আমল-আখলাক ও মুয়ামালাত
    • ইসলাম ও ইবাদাত
    • পারিবারিক ও সামাজিক জীবন
    • ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • নারী
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • কর্মী সিলেবাস
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস

@BJI Dhaka City South