ইসলামী জাগরণের তিন পথিকৃৎ
এ.কে.এম. নাজির আহমদ
স্ক্যান কপি ডাউনলোড
ভূমিকা
বিংশ শতাব্দীতে ইসলামী জাগরণের জন্য যাঁরা বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হচ্ছেন শায়খ হাসানুল বান্না (রহ), বাদীউয্যামান সাঈদ নুরসী (রহ) ও সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ)। নাস্তিকতাবাদ, অংশীবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ-সৃষ্ট তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি দূরকরণে তাঁরা মূল্যবান অবদান রেখেছেন। সৃষ্টি করেছেন ইসলামী জাগরণ।
ইউরো-আমেরিকান জীবন দর্শনে বিশ্বাসী শাসকগোষ্ঠী তাঁদেরকে স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। বারবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে তাঁদের চলার পথে। বারবার তাঁদেরকে পাঠানো হয়েছে কারাগারে। আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল রেখে, উচ্চমানের ছবর অবলম্বন করে, নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় তাঁরা প্রতিটি বাধার মুকাবিলা করেছেন অকুতোভয় বীরের মতো।
তাঁরা ছিলেন ইসলামী জাগরণের পথিকৃৎ। তাঁদের জীবন থেকে অনেক কিছু শেখার রয়েছে আমাদের। তাঁদের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো অতিসংক্ষেপে এই বইতে তুলে ধরেছি সম্মানিত পাঠকদের জন্য।
একবিংশ শতাব্দীতে যাঁরা ইসলামের বিজয় প্রত্যাশী তাঁদের জন্য মূল্যবান পাথেয় রয়েছে এই তিনজন মহানায়কের অনুসৃত কর্ম-কৌশলে।
এ.কে.এম. নাজির আহমদ
শায়খ হাসানুল বান্না (রহ)
জন্ম
১৯০৬ সনে শায়খ হাসানুল বান্না মিসরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আব্বা আবদুর রাহমান আল বান্না একজন উঁচু মাপের ইসলামী ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
শিক্ষা জীবন
আট বছর বয়সে শায়খ হাসানুল বান্নার আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় মাদরাসা আর রাশাদ আদ দীনিয়াহ নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। একই সাথে তিনি আল কুরআন হিফয করতে থাকেন।
কিছুকাল পর তিনি মাহমুদিয়ার মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র হন। বছর খানেকের মধ্যেই শায়খ হাসানুল বান্না দামানহুর টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পান। এই স্কুলে লেখাপড়া কালে তিনি দামানহুরের বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিদের নিকট যাতায়াত করতেন। তাঁদের কাছ থেকে তিনি দীনের তালিম হাছিল করেন। এই সময় ব্যাপকভাবে ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়নের দিকেও তিনি মনোযোগ দেন।
টিচার্স ট্রেনিং ডিপ্লোমা পরীক্ষায় তিনি তাঁর স্কুলে প্রথম ও সারাদেশে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন।
অতপর তিনি কায়রো যান এবং আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দারুল উলুমে ভর্তি হন। এই সময় তাঁর আব্বা সপরিবারে মাহমুদিয়া থেকে কায়রোতে স্থানন্তরিত হন।
কায়রোতে অবস্থানকালে শায়খ হাসানুল বান্না মিসরের অন্যতম সেরা ইসলামী ব্যক্তিত্ব শায়খ মাহমুদ কর্তৃক পরিচালিত জামিয়াতুল মাকারিমিল আখলাক আল ইসলামিয়াহ নামক সংস্থার সদস্য হন। এখানে তার আমর বিল মা’রূফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার (সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ) তৎপরতার হাতেখড়ি।
১৯২৭ সনের জুলাই মাসে দারুল উলুম থেকে তিনি ডিপ্লোমা লাভ করেন। এখানেই তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
কর্মজীবন শুরু
১৯২৭ সনের সেপ্টেম্বর মাসে শায়খ হাসানুল বান্না সরকারী স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তাঁকে পোস্টিং দেয়া হয় ইসমাঈলিয়াতে।
ইসমাঈলিয়া সুয়েজখালের সাথে সংযুক্ত তিমসাহ ঝিলের সন্নিকটে অবস্থিত একটি শহর। স্কুলের শিক্ষক হিসেবে তিনি কর্তব্য পালন করতে থাকেন। আর সময় সুযোগ মতো তিনি নিকটবর্তী ক্লাব ও কফি হাউসে গিয়ে দীনী বক্তব্য পেশ করা শুরু করেন।
আল ইখওয়ানুল মুসলিমূন গঠন
শায়খ হাসানুল বান্নার সংক্ষিপ্ত অথচ জ্ঞানগর্ভ ইসলামী ভাষণ চিন্তাশীল লোকদেরকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। ১৯২৮ সনের মার্চ মাসে ছয়জন ব্যক্তি তাঁর বাসায় আসেন তাঁর সাথে আলাপ করতে।
শায়খ হাসানুল বান্না তাঁদের সামনের তাঁর চিন্তাধারা পেশ করেন এবং সমাজ অংগনের সর্বত্র ইসলামের প্রধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠিত প্রয়াসের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। দীর্ঘক্ষণ আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে।
এই মিটিংয়ে আগত ছয়জন ব্যক্তি হচ্ছেন-
১. হাফিয আবদুল হামীদ, ২. আহমাদ আল হাসরী, ৩. ফুয়াদ ইবরাহীম, ৪. আবদুর রাহমান হাসবুল্লাহ, ৫. ইসমাইল ইযয ও ৬. যাকী আল মাগরিবী।
শায়খ হাসানুল বান্না চাইলে তখনই আরো অনেককে ডেকে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রতিটি গঠনমূলক আন্দোলনের শুরুতে থাকেন মাত্র একজন লোক। তারপর আরো কিছুসংখ্যক সমমনা লোক যুক্ত হয়ে সংগঠিত তৎপরতা শুরু করেন। গোড়ার দিক কার এই ব্যক্তিদের চিন্তার ঐক্য সংগঠনের ভিতকে দৃঢ়তা দান করে। তাঁদের অভিন্ন বক্তব্য পরবর্তীতে যারা সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হয় তাদের চিন্তার ঐক্য নিশ্চিত করে। আর চিন্তার ঐক্যই যদি না থাকে একটি প্লাটফরমে অসংখ্য লোকের ভীড় জমিয়েও কোন সুফল আশা করা যায় না।
আলোচনান্তে একটি সংগঠন কায়েমের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘আল ইখওয়ানুল মুসলিমূন’। আর এর আলমুরশিদুল আম নির্বাচিত হন শায়খ হাসানুল বান্না। এইভাবে ১৯২৮ সনের মার্চ মাসে মিসরের অন্যতম শহর ইসমাঈলিয়াতে সাতজন সদস্য নিয়ে আল ইখওয়ানুল মুসলিমূন গঠিত হয়। উল্লেখ্য যে তখন শায়খ হাসানুল বান্না ছিলেন ২২ বছরের একজন দীপ্তিমান যুবক।
শায়খ হাসানুল বান্না ভালো করেই জানতেন যে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আল জিহাদু ফিল ইসলাম বা ইসলামী আন্দোলনের প্রধান কাজ হচ্ছে আদ্দা’ওয়াতু ইলাল্লাহ বা আল্লাহর দিকে লোকদেরকে ডাকা। এই কাজ করতে হলে লোকদের সামনে প্রথমেই তুলে ধরতে হয় আল্লাহর পরিচয়, তারপর আল্লাহর পথের তথা ইসলামের পরিচয়। এরপর তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হয় ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর বিধান অনুসরণের সাথে সাথে সামষ্টিক জীবনে আল্লাহর বিধান কায়েম করার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে।
আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের সাংগঠনিক বিস্তৃতি
শায়খ হাসানুল বান্না ইসমাঈলিয়া শহর চষে বেড়াতে থাকেন। তিনি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে লোকদের সাথে আলাপ করতেন ও ইসলামের আলো ছড়াতেন। এইভাবে কাজ চলে তিনটি বছর। বেশ কিছু লোক তাঁর ডাকে সাড়া দেয়।
আল ইখওয়ানের সদস্যগণ তাঁদের নেতার অনুকরণে লোকদের বাড়িতে বাড়িতে যেতেন। বিশিষ্ট সদস্যগণ মাসজিদে সমবেত লোকদের সামনে বক্তব্য পেশ করতেন। তাঁরা কফি-খানাতেও যেতেন। উপস্থিত লোকদেরকে নিজেদের বক্তব্য শুনাতেন। সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে তাঁরা যেতেন, তাদের সাথে মিশতেন, তাদের কথা শুনতেন ও তাদেরকে দীনের কথা শুনাতেন।
মাত্র চার বছরের মধ্যেই আল ইখওয়ান খুবই পরিচিত একটি সংগঠনে পরিণত হয়। ইসমাঈলিয়াতে অনেকগুলো শাখা কায়েম হয়। আর নিকটবর্তী শহর পোর্ট সাঈদ, সুয়েজ, আবু সুয়াইর ও সুবরাখিতেও শাখা সংগঠন কায়েম হয়। তখন ইসমাঈলিয়াতেই অবস্থিত ছিলো আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
এখানে নির্মাণ করা হয় একটি মাসজিদ। কিছুকাল পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশে বালকদের জন্য একটি ও বালিকাদের জন্য আরেকটি স্কুল স্থাপিত হয়। এই স্কুল গুলোতে এমন শিক্ষাপদ্ধতি চালু করা হয় যাতে একজন শিক্ষার্থী পার্থিব বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের সাথে সাথে ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে উঠে। আরো কিছুকাল পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সন্নিকটে গড়ে তোলা হয় ক্লাব। এই ক্লাবে শরীর চর্চা ও নির্মল আনন্দদানের বিভিন্ন আয়োজন ছিলো। লোকদের কর্মসংস্থানের জন্য নিকটেই গড়ে তোলা হয় কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান।
কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিলো মডেল। শাখা-সংগঠনগুলো শক্তিশালী হাতেই মাসজিদ নির্মাণ, শিক্ষালয় স্থাপন, ক্লাব গঠন ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতো।
শায়খ হাসানুল বান্নার বিরুদ্ধে অভিযোগ
এই সময় মিসরের মসনদে আসীন ছিলেন কিং ফুয়াদ। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইসমাঈল সিদকী পাশা। আল ইখওয়ান তখনো কোন শক্তিধর সংগঠন ছিলো না। তথাপিও প্রধানমন্ত্রী ইসমাঈল সিদকী পাশা এইটিকে বাঁকা চোখে দেখতেন।
শায়খ হাসানুল বান্না একটি সরকারী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা শরু হলো এই বলে যে তিনি সরকারী টাকা খরচ করে দল গঠন করেছেন। তাঁরা কার্যাবলী পরীক্ষা করার জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটি তদন্ত করে আপত্তিকর কিছুই পেলোনা। আসলে তাঁকে হয়রানি করার ছিলো এই অভিযোগের আসল উদ্দেশ্য।
সরকারী মহল থেকে প্রচারণা শরু হলো যে হাসানুল বান্না কিং ফুয়াদকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও রাজতন্ত্র খতম করার জন্য এই সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
শায়খ হাসানুল বান্না কায়রোতে বদলি
১৯৩২ সনের অক্টোবর মাসে শায়খ হাসানুল বান্না কায়রোতে বদলি হন। এই বদলি আল ইখওয়ানের জন্য কল্যাণকর হয়েছিলো। আল ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় কার্যালয় স্থানান্তরিত হয় কায়রোতে। এখানে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হয়। বুঝা যাচ্ছিলো, আগামী দিনগুলোতে আল ইখওয়ান একটি শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
উল্লেখ্য যে কায়রোতে বদলি হওয়ার পর শায়খ হাসানুল বান্না বিয়ে করেন। একটি মাসজিদে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর বিয়ে সম্পন্ন হয়।
প্রধানমন্ত্রী ইসমাঈল সিদকী পাশা আল ইখওয়ানের ওপর বিশেষ দৃষ্টি রাখছিলেন। কিন্তু তিনি আল ইখওয়ানকে ভালো চোখে দেখতেন না। তবে নৈতিক ভাবে দুর্বল করে ফেলার জন্য তিনি আল ইখওয়ানকে অর্থ সাহায্যের প্রস্তাব করেন। বিচক্ষণ শায়খ হাসানুল বান্না এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
শায়খ হাসানুল বান্না কেন্দ্রীয় কার্যালয়টিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন। স্কুলে যাবার আগে তিনি কার্যালয়ে আসতেন। সেই দিনের করণীয় কাজের ফিরিস্তি তৈরী করে সহকারীদের হাতে দিয়ে যেতেন। স্কুল থেকে ফেরার পথে তিনি আবার আসতেন কার্যালয়ে। বিকালের সময়টাতে সাধারণত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। এই সভায় তিনি আল কুরআনে উপস্থাপিত বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করে বক্তব্য রাখতেন।
আল আখাওয়াত আলমুসলিমাত গঠন
শায়খ হাসানুল বান্না মহিলাদেরকে স্বতন্ত্রভাবে সংগঠিত করা ও তাদের মাধ্যমে মহিলা অংগনে দীনের মর্মবাণী পৌঁছিয়ে দেয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। আল ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিকটে স্থাপিত উম্মাহাতুল মুমিনীন মাদরাসার শিক্ষিকাদেরকে নিয়ে তিনি আল ইখওয়ানের মহিলা শাখা গঠন করেন। এর নাম রাখা হয় ‘আল আখাওয়াত আল মুসলিমাত’। মহিলাদের মধ্যে কিভাবে ও কি কি উপকরণ ব্যবহার করে দাওয়াত সম্প্রসারিত করতে হবে, তাও নির্ধারিত করে দেয়া হয়।
আল ইখওয়ানের সাধারণ সম্মেলন
১৯৩৩ সনে শায়খ হাসানুল বান্নার আহ্বানে কায়রোতে অনুষ্ঠিত হয় আল ইখওয়ানের প্রথম সাধারণ সম্মেলন। মিসরে তখন খৃস্টান মিশনারীদের ব্যাপক তৎপরতা চলছিলো। এই সম্মেলনে এই বিষয়ে বিশেষভাবে আলোচনা হয়। সম্মেলন শেষে কিং ফুয়াদকে একটি চিঠির মাধ্যমে খৃস্টান মিশনারীদের তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
এই সনের শেষের দিকে আরেকটি সাধারণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে দাওয়াত সম্প্রসারণের উপায় নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় একটি প্রিন্টিং প্রেস স্থাপনের।
এই সম্মেলনের পর আল ইখওয়ানের সাপ্তাহিত পত্রিকা ‘মাজাল্লাতুল ইখওয়ানুল মুসলিমূন’ প্রকাশনা শুরু হয়। শায়খ হাসানুল বান্নার বক্তব্য মুদ্রিত হয়ে একের পর এক আত্মপ্রকাশ করতে থাকে।
শায়খ হাসানুল বান্না দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে প্রবন্ধ লিখতেন। সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য পরিবেশিত হতো। শায়খ হাসানুল বান্না শাখা সংগঠনগুলো সাপ্তাহিক আলোচনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন।
১৯৩৫ সনে শায়খ হাসানুল বান্নার আহ্বানে আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের তৃতীয় সাধারণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সাংগঠনিক বিষয়াদি আলোচনা প্রাধান্য পায়। সদস্যদের মান, বৈশিষ্ট্য, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রোভার স্কাউট গঠনের সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়।
১৯৩৭ সনে মিসরের মসনদে বসেন কিং ফারুক। তরুণ ফারুক একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটার মুসতাফা আল মারাগীর প্রভাব ছিলো তাঁর ওপর। তাঁর শাসনকালে মিসরে ইসলামের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে, এটাই ছিলো সকলের আশা। এই আশা নিয়েই আল ইখওয়ানুল মুসলিমূন কিং ফারুকের অভিষেক উৎসব পালন করে। এই উৎসব পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় আল ইখওয়ানের চতুর্থ সাধারণ সম্মেলন। উল্লেখ্য যে, পরবর্তী সময়ে কিং ফারুক দীনের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন।
আলী মাহির পাশার সরকারের প্রতি সমর্থন
কিং ফারুক প্রধানমন্ত্রী বানান আলী মাহির পাশাকে। আলী মাহির পাশা আল ইখওয়ানের বর্ধিষ্ণু শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন। তিনি তাঁর পরিচালিত সরকারের প্রতি আল ইখওয়ানের সমর্থন চান। আলী মাহির পাশা ইসলামের প্রতি খুবই অনুরাগী ছিলেন। তাঁকে সমর্থন দেয়ার অর্থ ছিলো সরকারের ইসলাম প্রিয় অংশটিকে শক্তিশালী করা। শায়খ হাসানুল বান্না পরামর্শ পরিষদে বিষয়টি তোলেন। দীর্ঘ আলোচনার পর আলী মাহির পাশার সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিছু সংখ্যক সদস্য এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন নি। তাঁরা তাদের ভিন্নমত ব্যক্ত করেন। তাঁরা শায়খ হাসানুল বান্নার সহকারী আহমাদ আশ্শুককারীর পদত্যাগ দাবি করেন। তাঁদের ধারণা ছিলো যে এই ব্যক্তিটিই সরকারের সাথে আল ইখওয়ানের সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম। শায়খ হাসানুল বান্না আহমাদ আশ শুককারীর বরখাস্তের দাবী মেনে নেননি। এতে উক্ত সদস্যগণ নাখোশ হন।
১৯৩৯ সনের জানুয়ারী মাসে শায়খ হাসানুল বান্নার আহ্বানে আল ইখওয়ানের পঞ্চম সাধারণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কায়রোতে।
ইতোমধ্যে আল ইখওয়ান সারাদেশে বিপুল সাংগঠনিক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। আল ইখওয়ান মিসরের রাজনীতিতে একটি গণ্য শক্তিতে পরিণতে হয়। নতুন সদস্যগণ যাতে আল ইখওয়ান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে পারে সেই জন্য তিনি এই সম্মেলনে তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন,
‘‘আল ইখওয়ানুল মুসলিমূন একটি সালাফীয়া আহ্বান, একটি সুন্নীপথ, একটি সুফী বাস্তবতা, একটি রাজনৈতিক দল, একটি ক্রীড়া সংস্থা, একটি শিক্ষা-সংস্কৃতি পরিষদ, একটি অর্থনৈতিক সংগঠন ও একটি সমাজ দর্শন’’।
ত্বরা–প্রবণ কিছু লোকের ভূমিকা
ইতোমধ্যে আল ইখওয়ানের একটি অতি উৎসাহী গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠে। এরা ছিলো রোভার স্কাউটদেরই একটি অংশ। এরা মনে করলো যে বিপ্লবের সময় এসে গেছে। এখন দেরি করা কাপুরুষতার নামান্তর। ক্ষমতা দখল করে নিলেই হয়। তারা যুক্তি দেখালো যে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘‘যদি তোমাদের কেউ কোন গর্হিত কাজ হতে দেখে তবে সে তার হাত দ্বারা তার প্রতিরোধ করবে, যদি তা করতে সক্ষম না হয় তবে জবান দ্বারা তার প্রতিবাদ করবে, যদি তাও করা সম্ভব না হয় তা হলে হৃদয়ে তার প্রতিরোধের চিন্তা-ভাবনা করবে। অবশ্য শেষটি হচ্ছে ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।’’
এদের বক্তব্যের জবাবে শায়খ হাসানুল বান্না আল কুরআনের আয়াত বিশেষের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘‘তুমি লোকদেরকে তোমার রবের পথে ডাক হিকমাহ ও সুন্দর বক্তব্য সহকারে। আর তাদের সাথে আলাপ কর অতীব সুন্দর পদ্ধতিতে। তোমার রব জানেন কে তাঁর পথ ছেড়ে বিভ্রান্ত হয়েছে, আর জানেন কে হিদায়াত অনুসরণ করে চলেছে।’’
এই আয়াত উদ্ধৃতির মাধ্যমে শায়খ হাসানুল বান্না ইসলামী বিপ্লবের সুস্থ ও স্বাভাবিক পদ্ধতি কী তা তাদের সামনে তুলে ধরেন।
শায়খ হাসানুল বান্না হাওয়ার দোলায় আন্দোলিত হবার মতো ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি স্রোতের সাথে ভেসে যাবার পাত্র ছিলেন না। হঠকারিতার পরিণতি কী হতে পারে তাও তিনি বুঝতেন। তাই তিনি স্বীয় মতে অটল থাকেন।
কিছু লোক সংগঠন ছেড়ে চলে যায়।
সরকারের ওপর ইংরেজদের ও আল ইখওয়ানের চাপ
১৯৩৯ সনে শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। গ্রেট বৃটেন চাচ্ছিলো মিসর তার পক্ষাবলম্বন করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করুক। অথচ গ্রেট বৃটেনের পক্ষাবলম্বন করার মানে ছিলো তুর্কীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা। অর্থাৎ মুসলিম সৈন্যগণ মুসলিম সৈন্যদেরকে আহত ও নিহত করা। এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ ব্যাপার ছিলো না। শায়খ হাসানুল বান্না এই বিষয়ে সরকারকে পূর্বাহ্নে হুঁশিয়ার করে দেন।
প্রধানমন্ত্রী আলী মাহির পাশা ও প্রধান সেনাপতি জেনারেল আযীয আলী আল মিসরীও ইংরেজ তোষণ নীতি গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না।
ইংরেজদের বিরাট স্বার্থ তখন সুয়েজে। মিসরের স্বাধীনচেতা সরকার গ্রেট বৃটেনের স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপ নিতে পারে, এই আশংকা তাদেরকে পেয়ে বসে। ইংরেজগণ গোপনে কিং ফারুকের ওপর কুটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। দুঃখের বিষয়, কিং ফারুক ইংরেজদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করেন।
১৯৪০ সনে কিং ফারুক প্রধান সেনাপতি জেনারেল আযীয আলী আল মিসরীকে দীর্ঘ ছুটিতে পাঠিয়ে দেন। এই ছুটি আর কোনদিন শেষ হয়নি।
কিছুদিন পরে আলী মাহির পাশাকেও পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। মিসরে ইংরেজদের কূটনীতি বিজয় লাভ করে।
১৯৪০ সনের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন হাসান সাবরী পাশা। তাঁর নেতৃত্বে মিসর আফ্রিকার রণাঙ্গনে গ্রেট বৃটেনের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ঐ বছরের নভেম্বর মাসে হাসান সাবরী পাশা মৃত্যুবরণ করলে নতুন প্রধানমন্ত্রী হন হুসাইন সিররী পাশা।
১৯৪১ সনে শায়খ হাসানুল বান্না আল ইখওয়ানের ষষ্ঠ সাধারণ সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলন কায়রোতে অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে আগামীতে জাতীয় নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আগেই বলেছি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আলী মাহির পাশা ও প্রাক্তন প্রধান সেনাপতি আযীয আলী আল মিসরী গ্রেট বৃটেনের তাবেদারী করতে প্রস্তুত ছিলেন না। জনগণের ওপর তাঁদের বেশ প্রভাব ছিলো। পাছে শায়খ হাসানুল বান্না তাঁদের সাথে মিলিত হয়ে সরকার বিরোধী কোন মোর্চা গড়ে তোলেন এই আশংকায় শায়খ হাসানুল বান্নাকে অন্যত্র বদলি করা হয়। গৃহবন্দী করা হয় আলী মাহির পাশাকে। আর গ্রেফতার করা হয় আযীয আলী আল মিসরীকে।
শায়খ হাসানুল বান্নার প্রথম গ্রেফতারী
অল্প কাল করেই শায়খ হাসানুল বান্না কায়রোতে আসেন ইংরেজ বিরোধী জনমত গড়ে তোলার জন্য। সরকার আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সরকার শায়খ হাসানুল বান্না ও সংগঠনের সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল হাকীম আবিদীনকে গ্রেফতার করে। আল ইখওয়ানের পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। অন্য সব পত্রিকায় আল ইখওয়ানের কোন খবর ছাপানো যাবে না বলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মিছিল ও জনসভা নিষিদ্ধ হয়। সরকারের এই পদক্ষেপ গণ-মনে দারুণ অসন্তোষ সৃষ্টি করে। জনমতের দিকে লক্ষ্য করে সরকার শায়খ হাসানুল বান্না ও আবদুল হাকীম আবিদীনকে মুক্তি দেয়। গ্রেট বৃটেন বরাবরই ইসলামের প্রতি বৈরি মনোভাব পোষণ করে আসছিলো। মিসরে ক্রমবর্ধমান ইসলামী জাগরণ গ্রেট বৃটেনকে শংকিত করে তোলে। কূট-কৌশলের মাধ্যমে ইসলামী শক্তিকে বশে আনা যায় কিনা সেই চেষ্টাও তারা করে। গ্রেট বৃটেনের দূতাবাস থেকে শায়খ হাসানুল বান্নার সাথে যোগাযোগ করা হয়। দূতাবাসের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের লক্ষ্য, কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি জানতে চান। তাঁকে সব জানানো হয়।
সব শুনে তিনি বাহ্যতঃ সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি আল ইখওয়ানকে আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব দেন। বিচক্ষণ শায়খ হাসানুল বান্না ধন্যবাদ সহকারে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। প্রধানমন্ত্রী হুসাইন সিররী পাশা নির্বিঘ্নে শাসন চালাতে পারছিলেন না। ইংরেজদের সাথে তাঁর মাখামাখি জনমনে ক্রোধের সঞ্চার করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে হুসাইন সিররী পাশা পদত্যাগ করেন। কিং ফারুক ওয়াফদ পার্টির নেতা মুসতাফা আন্নাহাস পাশাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।
এই সময় সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। তারা একদিকে কিং ফারুক ও অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী পরিচালিত প্রশাসনের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাদেরকে বিরক্ত করে তোলে। কিছু সংখ্যক তরুণ অফিসার ‘‘ফ্রি অফিসারস’’ নামে একটি গোপন সংস্থা গড়ে তোলে। তারা একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা আঁটছিলো। এই অফিসারগণ দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। আনোয়ারুস সা’দাত ও আবদুন মুনীম আবদুর রউফ শায়খ হাসানুল বান্নার সাথে যোগাযোগ করেন।
শর্ত সাপেক্ষে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো
এই দিকে প্রধানমন্ত্রী মুসতাফা আন্ নাহাস পাশা পার্লামেন্টের নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। আল ইখওয়ান নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিতে থাকে। সিদ্ধান্ত হলো শায়খ হাসানুল বান্না ইসমাঈলিয়া নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
প্রধানমন্ত্রী মুসতাফা আন নাহাস পাশা দেখলেন যে আল ইখওয়ান নির্বাচনে নামলে তাঁর দল ওয়াফ্দ পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই জন্য তিনি শায়খ হাসানুল বান্নাকে তাঁর কাছে ডেকে নেন এবং আল ইখওয়ান যাতে নির্বাচনে না নামে তার জন্য চাপ দেন। অনেক বাদানুবাদ হয়। অবশেষে কতগুলো শর্ত সাপেক্ষে আল ইখওয়ান নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করতে সম্মত হয়। প্রধানমন্ত্রী ওয়াদা করেন যে আল ইখওয়ানকে নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে দেয়া হবে। মদ ও বেশ্যাবৃত্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আল ইখওয়ানের পত্র-পত্রিকাগুলোর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে।
১৯৪২ সনের শেষ ভাগে প্রধানমন্ত্রী মুসতাফা আন্ নাহাস পাশা বেঁকে বসেন। আল ইখওয়ানের প্রতি তিনি আবার বৈরি মনোভংগি দেখাতে শুরু করেন। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা আল ইখওয়ানের শাখাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। কেবল কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়।
মুসতাফা আন্ নাহাস পাশার সরকার ইংরেজদের সমর্থন পুষ্ট ছিলো। এই সরকার শায়খ হাসানুল বান্নাকে তাদের পথে সবচে’ বড়ো কাঁটা মনো করতো। শুনা যাচ্ছিলো, শায়খ বান্নাকে অচিরেই কোথাও নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হবে। তিনি এর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে থাকেন। আর একটি সার্কুলার লেটারের মাধ্যমে তিনি কর্মীদের জন্য বিশেষ হিদায়াত পাঠান। এই চিঠির একাংশে তিনি লেখেন, ‘‘তোমরা নানাবিধ কষ্ট ও বাধার সম্মুখীন হবে। আর প্রকৃতপক্ষে তখনি তোমরা এই মিশনের ধারক বাহকদের পথে অগ্রসরমান বুঝতে হবে। …ইসলামের প্রকৃত তাৎপর্য সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা তোমাদের পথে বাধার সৃষ্টি করবে। তোমরা দেখবে ধর্মধারী ও সরকারী আলিমগণ তোমাদের ইসলাম সম্পর্কিত ধারণাকে আজগুবী বলে আখ্যায়িত করবে। তোমরা যে ইসলামের সৈনিক তা-ই অস্বীকার করবে। নেতৃস্থানীয়, সম্মানিত ও অন্যান্য ব্যক্তিগণ তোমাদেরকে ঈর্ষা করবে। একটির পর একটি সরকার এসে তোমাদেরকে বাধা দেবে। এদের প্রত্যেকে তোমাদের কাজ ব্যাহত করতে চাইবে ও তোমাদের অগ্রগতি রোধ করতে চাইবে। …..এইভাবে তোমরা কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তোমাদেরকে ধরপাকড় করা হবে। বন্দী করে রাখা হবে। নির্বাসিত করা হবে। তোমাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। তোমাদের বিশিষ্ট কাজগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। তোমাদের গৃহে তল্লাশী চালানো হবে। তোমাদের এই পরীক্ষার কাল দীর্ঘ হতে পারে। …কিন্তু আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে যারা তাঁর পথে সংগ্রাম করে ও কল্যাণকর কাজ করে তিনি তাদেরকে সাহায্য করবেন। …ওহে আমার ভাইয়েরা, তোমরা কি আল্লাহর দীনের রক্ষক হতে দৃঢ় সংকল্প?’’
শায়খ হাসানুল বান্নাকে নির্বাসিত করা হয়নি। তবে চলার পথের কাঠিন্য সম্পর্কে তিনি যেই চিত্র অংকন করেছেন তা তাঁর সাথীগণ প্রত্যক্ষ করেছেন পদে পদে।
সালিহ আশমাওয়ীর গুপ্ত বাহিনী
১৯৪৩ সনের গোড়ার দিকে আল ইখওয়ানের কতিপয় সদস্য এক অনাকাংখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা একটি গুপ্ত বাহিনী গঠন করে। এই বাহিনীর প্রধান হন সালিহ আশমাওয়ী। এই গুপ্ত বাহিনী অস্ত্র প্রয়োগ করে বিপ্লব আনয়নে বিশ্বাসী ছিলো। গঠিত হবার পর থেকেই এই বাহিনী এখানে ওখানে বারবার পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
এই গুপ্ত বাহিনীর তৎপরতার সকল বদনাম আল ইখওয়ানের ওপর চাপানো হয়। আল ইখওয়ানকে বারবার দারুণ মুসীবাতের সম্মুখীন হতে হয়।
১৯৪৪ সনে কিং ফারুক ওয়াফদ পার্টির মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেন। সা’দিষ্ট পার্টির নেতা আহমাদ মাহির পাশা প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি দেশে সাধারণ নির্বাচনের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন।
পার্লামেন্ট নির্বাচনে আল ইখওয়ান
১৯৪৫ সনের জানুয়ারী মাসে মিসরে সাধারণ নির্বাচন অনষ্ঠিত হয়। পার্লামেন্ট গঠনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে আল ইখওয়ানুল মুসলিমূন অংশগ্রহণ করে। শায়খ হাসানুল বান্না ইসমাঈলিয়া থেকে ও অন্য নেতৃবৃন্দ অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জনমত এতোখানি অনুকূল ছিলো যে নেতৃবৃন্দের সকলেই নির্বাচিত হওয়ার কথা।
চরম দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বহুমুখী কারসাজি করে শায়খ হাসানুল বান্না ও তাঁর সহকর্মীদের নিশ্চিত বিজয়কে পরাজয়ে রূপান্তরিত করা হয়। আহমাদ মাহির পাশার দলকে জয়ী করা হয়।
শায়খ হাসানুল বান্নার দ্বিতীয় গ্রেফতারী
নির্বাচনের পর আহমাদ মাহির পাশা শক্ত হয়ে বসেন। তিনি ইংরেজদের ইচ্ছা পূরণের উদ্যোগ নেন। সিদ্ধান্ত নেন জার্মেনী ও তুর্কীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার।
১৯৪৫ সনের ২৪ শে ফেব্রুয়ারী আহমাদ মাহির পাশা যুদ্ধে নামার সিদ্ধান্ত সম্বলিত ঘোষণাটি পাঠকালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। প্রচার করা হলো, এটি আল ইখওয়ানের কাজ। শায়খ হাসানুল বান্না, আহমাদ আশ্ শুককারী ও আবদুল হাকী আবিদীনকে গ্রেফতার করা হয়।
আততায়ী ধরা পড়েছিলো। জিজ্ঞাসাবাদের সময় সে স্বীকার যে সে ন্যাশনালিস্ট পার্টির লোক। অতপর শায়খ হাসানুল বান্না ও তাঁর দুইজন সহকর্মীকে মুক্তি দেয়া হয়।
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন মাহমুদ ফাহমী আন্ নুক্রাশী পাশা। শায়খ হাসানুল বান্না তাঁর সাথে দেখা করেন। আহমাদ মাহির পাশার হত্যাতে দুঃখ প্রকাশ করেন। এই সুযোগে তিনি তাঁকে আল ইখওয়ানের লক্ষ্য কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি অবহিত করেন। মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশা আল ইখওয়ানকে ঘৃণা চোখে দেখতেন। শায়খ হাসানুল বান্নার সাক্ষাত ও আলাপের পরও তাঁর মনোভংগির কোনই পরিবর্তন হয়নি। বরং তিনি আল ইখওয়ানের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি আরো বাড়িয়ে দেন। মিসরের জনমত ছিলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে। সুয়েজে ইংরেজদের অবস্থান জনগণ মেনে নিতে পারছিলো না। গ্রেট বৃটেনের প্রতি নতজানু নীতি দেশের গণ-মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তরুণ সমাজ সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মুসতাফা মুমিনের নেতৃত্বে ছাত্রগণ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতার মুখে মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশা পদত্যাগ করেন। উল্লেখ্য যে মুসতাফা মুমিন আল ইখওয়ানের ছাত্র-শাখার একজন নেতা ছিলেন।
১৯৪৬ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন ইসমাইল সিদকী পাশা। তিনিও ইংরেজদের বশংবদ ছিলেন। আল ইখওয়ান গ্রেট বৃটেনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ও আপোসহীন মনোভাব গ্রহণ করার জন্য সরকারের উপর চাপ দিতে থাকে। একই দাবি উত্থাপিত হয় ছাত্র ও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে। দেশে দারুণ রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এই অবস্থাতেই ইসমাইল সিদকী পাশা ইংরেজদের সাথে চুক্তির একটি খসড়া প্রকাশ করেন। মিসরের গণ-মানুষ বিক্ষোভের মাধ্যমে তা প্রত্যাখ্যান করে। ৮ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশা আবার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
আল ইখওয়ানে মত পার্থক্য
ওয়াফ্দ পার্টির সাথে আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের সম্পর্ক ভালো ছিলো না। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের একাংশ মত পোষণ করতেন যে, জাতীয় স্বার্থে আল ইখওয়ান ও ওয়াফ্দ পার্টির মধ্যে সমঝোতা হওয়া উচিত। আহমাদ আশ্শুককারী দাবি করলেন যে মিসরের রাজনৈতিক প্রয়োজনে আল ইখওয়ান শুধু লোক তৈরীর কাজ করবে আর রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে ওয়াফ্দ পার্টি। এটি ছিলো আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের অভ্যন্তরে বড়ো রকমের মত পার্থক্য। অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তি ইবরাহীম হাসান দল ত্যাগ করেন। কিছুকাল পর বহিষ্কৃত হন আহমাদ আশ্শুককারী। এই মত পার্থক্য অবশ্যই আল ইখওয়ানকে বেশ খানিকটা দুর্বল করতে সক্ষম হয়।
এই দিকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন আস্থা হারিয়ে যারা গুপ্ত বাহিনী গঠন করেছিলো, তারা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। সালিহ আশ্মাওয়ীর পর গুপ্ত বাহিনীর পরিচালক হন আবদুর রাহমানুস্ সানাদী।
রণাংগনে আল ইখওয়ান
১৯৪৭ সনের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিন বিভক্তকরণের প্রস্তাব গ্রহীত হয়। ফিলিস্তিনের বুকে একটি ইয়াহুদী রাষ্ট্র পত্তনের জন্যই গৃহীত হয় এই প্রস্তাব। দুনিয়ার মুসলিমদের পক্ষে এই প্রস্তাব মেনে নেয়া সম্ভব ছিলো না। ফিলিস্তিনের গ্র্যান্ড মুফতী আমীন আল হুসাইনী ইয়াহুদীদের মুকাবিলার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। আল ইখওয়ানের অন্যতম সদস্য ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার মাহমুদ লাবীব। শায়খ হাসানুল বান্না তাঁকে ফিলিস্তিন পাঠান। মাহমুদ লাবীব মুফতী আল হুসাইনীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে ফিলিস্তিনী যুবকদের সমন্বয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। তিনি এই কাজ বেশি দিন করতে পারেননি। ইংরেজগণ তাঁকে ফিলিস্তিন ত্যাগ করতে বাধ্য করে।
এই সময় আরব লীগের উদ্যোগে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছিলো। আল ইখওয়ানের কর্মীগণ ব্যাপক হারে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দেয়।
১৯৪৮ সন।
মুসলিম উম্মাহর জন্য এটি ছিলো আরেকটি কঠিন বছর। ইয়াহুদীরা ফিলিস্তিনে জেঁকে বসে। ইসলামী চিন্তা নায়কগণ জিহাদের ডাক দেন। এই দুর্দিনে ফিলিস্তিনের মুসলিম ভাইদের পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য ছিলো দুনিয়ার সকল মুসলিমের। শায়খ হাসানুল বান্না মিসর থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের সদস্যদেরকে ফিলিস্তিন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। আহমাদ আবদুল আযীযের কমাণ্ডে একদল স্বেচ্ছাসেবক অচিরেই আল আরিস গিয়ে পৌঁছে। সেনাবাহিনী ছেড়ে আসা কামালুদ্দীন হুসাইন ও সালাহ সালিম স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগদান করেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ইয়াহুদীদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
ফালুজা অঞ্চলে মিসরীয় সেনাবাহিনীর একটি দল ইয়াহুদীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গিয়েছিলো। আল ইখওয়ানের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তাদের সাহায্যে এগিয়ে যায়।
রণাংগনে আল ইখওয়ানের বীরত্ব ও দেশময় তাদের জনপ্রিয়তা দেখে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলেন ইংরেজদের প্রিয়পাত্র প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশা। কিং ফারুকের মনেও ভয় ঢুকে গেলো। এই বুঝি আল ইখওয়ান গোটা মিসর দখল করে বসে!
আল ইখওয়ানের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নিরস্ত্রীকরণ
ফিলিস্তিন রণাংগনে আল ইখওয়ানের স্বেচ্ছাসেবকগণ বীরের মতো লড়ছিলো ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে। ইয়াহুদীরা এদেরকে ভীষণ ভয় করতো। দুঃখের বিষয় তাদের সাফল্যই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ালো। একদিন রাতে মিসরের সেনাবাহিনী স্বেচ্ছাসেবকদের শিবিরগুলো ঘিরে ফেলে। প্রধান সেনাপতি ফুয়াদ সাদিক তাদেরকে নির্দেশে দেন অস্ত্র ত্যাগ করে দেশে ফিরে যেতে অথবা সরাসরি মিসরীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডে থেকে যুদ্ধ করতে। ক্ষুণ্ন মনে কেউ দেশে ফিরে গেলো। কেউ বা কোন না কোনভাবে যুদ্ধের ময়দানে থেকে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করলো।
আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনকে বেআইনী ঘোষণা
ইতোমধ্যে সারাদেশে আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের শাখা সংখ্যা দুই হাজারে উন্নীত হয়। জনশক্তির সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় বিশ লাখ।
আল ইখওয়ানের অব্যাহত শক্তি বৃদ্ধি সরকারকে ভীত-শংকিত করে তোলে।
মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশা আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনকে বে-আইনী ঘোষণার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে শুরু করেন। বিভিন্ন স্থানে বোমা ও অস্ত্রশস্ত্র রেখে বলা হতে থাকে যে এইগুলো আল ইখওয়ানের কাণ্ড। বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তি আততায়ীর হাতে প্রাণ হারায়। বলা হলো, এইসব হত্যাকাণ্ড আল ইখওয়ান সংঘটিত করেছে।
১৯৪৮ সনের ৮ ই ডিসেম্বর।
রাত এগারোটা। শায়খ হাসানুল বান্না তাঁর সহকর্মীদেরকে নিয়ে কায়রোতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসে রেডিওতে প্রচারিত খবর শুনছিলেন। খবর প্রচারিত হলো, আল ইখওয়ানুল মুসিলিমূনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হলো যে আল ইখওয়ান দেশে একটি সশস্ত্র বিপ্লব ঘটাবার প্রস্তুতি নিয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে পুলিশের গাড়ি। উপস্থিত সবাইকে গ্রেফতার করা হলো। গ্রেফতার করা হলো না শুধু শায়খ হাসানুল বান্নাকে। আল ইখওয়ানের সব সম্পদ বাজেয়াফত করা হয়। আল ইখওয়ান পরিচালিত স্কুল, ক্লাব, হাসপাতাল, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়।
ডিসেম্বর মাসে ঘটে আরেক ঘটনা। আবদুল মাজীদ আহমাদ হাসান নামক ২৩ বছর বয়সী একজন ছাত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশাকে হত্যা করে। এবারও উদোরপিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হয়। আল ইখওয়ানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার তীব্রতর করা হয়।
নতুন প্রধানমন্ত্রী হন ইবরাহীম আবদুল হাদী। আল ইখওয়ান তো দূরে থাক, তিনি কোন রাজনৈতিক দলের প্রতিই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তবুও শায়খ হাসানুল বান্না তাঁর সাথে দেখা করেন। তাঁকে নানাভাবে বুঝাতে থাকেন যাতে আল ইখওয়ানের ওপর থেকে তিনি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। কিন্তু কোন ফল হলো না।
শায়খ হাসানুল বান্না আশা ছাড়লেন না। সরকারী মনোভাব পরিবর্তনের জন্য তিনি ধৈর্যসহকারে প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন।
এই সময় ঘটে গেলো আরেক বিপর্যয়। জীপে রক্ষিত বোমা সংক্রান্ত মামলার কাগজপত্র রক্ষিত ছিলো কোর্ট বিল্ডিংয়ের একটি কক্ষে। সেখানে একটি বিস্ফোরণ ঘটাবার চেষ্টা হয়। কিন্তু বোমাটি যথাস্থানে রাখা হয়নি। যথাসময়ে বোমা ফুটলো। কোর্ট বিল্ডিংয়ের বেশ ক্ষতি হয়। বিস্ফোরণের পর শফিক ইবরাহীম আনাস নামক এক ব্যক্তি বন্দী হয়। প্রচার করা হলো যে এই ব্যক্তি আল ইখওয়ানের সদস্য।
সন্ত্রসী তৎপরতার বিরোধিতা
শায়খ হাসানুল বান্না সরকারকে জানালেন যে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে তাঁর বা তাঁর সহকর্মীদের কোনই সম্পর্ক নেই। এই সময় তিনি আল ইখওয়ানের সদস্যদের প্রতি গোপনে একটি চিঠি পাঠান। এই চিঠিতে তিনি সুস্পষ্টভাবে সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে লিখেন যে, ‘‘এরা আল ইখওয়ানও নয়, আল মুসলিমূনও নয়।’’
ব্যাপক গ্রেফতারী ও নির্যাতন
সারা দেশ থেকে আল ইখওয়ানের লোকদেরকে গ্রেফতার করা হয়। বন্দীদের সংখ্যা কয়েক হাজারে দাঁড়ায়। জেলখানায় তাদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন।
কেন্দ্র থেকে শুরু করে গ্রাম-পর্যায়ের সদস্যদেরকে গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু শায়খ হাসানুল বান্নাকে গ্রেফতার করা হয়নি। শায়খ বলতেন তাঁকে গ্রেফতার না করার অর্থ হচ্ছে যে তাঁর মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়েছে।
শায়খ হাসানুল বান্নার শাহাদাত
১৯৪৯ সনের ১২ই ফেব্রুয়ারী।
এই দিন কায়রোতে ইয়াং মুসলিমস এসোসিয়েশানের একটি মিটিংয়ে শায়খ হাসানুল বান্না মেহমান বক্তা হিসেবে আসেন। মিটিং শেষে তিনি উক্ত সংস্থার কার্যালয় থেকে বের হন। রাস্তায় নেমে তিনি ট্যাকসীতে উঠতে যাচ্ছিলেন এমন সময় আততায়ীর গুলি এসে বিঁধে তাঁর বুকে। রক্ত রঞ্জিত দেহ নিয়ে শায়খ হাসানুল বান্না ঢলে পড়েন। সংগীরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। আল্লাহর দীনের সৈনিক আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে চলে যান।
লাশ পাঠানো হয় তাঁর বাসায়। পুলিশ এসে বাড়ির চারদিক ঘেরাও করে ফেলে। নিকট আত্মীয় ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দেয়া হলোনা তাঁর বাড়িতে। ট্যাংক বাহিনী ও সাঁজোয়া বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীসহকারে তাঁর লাশ কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ দূরে অবস্থান করে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে। সরকার তাদেরকে তাঁর জানাযা ও দাফন কাজে অংশগ্রহণ করতে দিলোনা।
শায়খ হাসানুল বান্নার উত্তরসূরী
ইতোমধ্যে আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়েছিলো। ১৯৫১ সনের ১৭ই সেপ্টেম্বর মিসরের সুপ্রীম কোর্ট নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে রায় দেয়। আল ইখওয়ান আবার বৈধ সংগঠনরূপে কাজ শুরু করে।
অক্টোবর মাসে হাসান ইসমাঈল আল হুদাইবী আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের আল মুর্শিদুল আম নির্বাচিত হন। তাঁর ডেপুটি নিযুক্ত হন আবদুল কাদির আওদাহ। কিছুকাল পর ভাইস মুর্শিদ নামে আরেকটি পদ সৃষ্টি করা হয়। এই পদে নিযুক্ত হন মুহাম্মাদ খামিস হুমাইদা। হাসান ইসমাইল আল হুদাইবীও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন।
তিনিও গুপ্ত বাহিনীকে স্বীকৃতি দেননি। শায়খ হাসানুল বান্নার মতো তিনিও ছিলেন সন্ত্রাসবাদের ঘোর বিরোধী।
উপসংহার
শায়খ হাসানুল বান্নার (রহ) প্রতিষ্ঠিত সংগঠন আল ইখওয়ানুল মুসলিমূন পথের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সামনে এগিয়ে চলছে। বিভিন্ন আরব দেশে তাদের বিভিন্নমুখী তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিমের দেশগুলোতে শায়খ হাসানুল বান্নার চিন্তাধারার অনুসারীদের সংখ্যা নগণ্য নয়।