মোরা বড় হতে চাই
আহসান হাবীব ইমরোজ
কে সবচেয়ে বড়?
আল্লাহ তায়ালা
আর মাখলুকের ভিতর?
আকৃতিতে বড় – তিমিমাছ, হাতি।
দ্রুততায় বড় – সুইফট বার্ড আর লেপার্ড।
সৌন্দর্যে বড় – প্রজাপতি, ময়ূর, হরিণ।
শৃঙ্খলা, একতা আর পরিশ্রমে বড় -মৌমাছি, পিঁপড়া।
কিন্তু মানুষ হচ্ছে সকল মাখলুকের ভেতর সবচেয়ে বড় এবং শ্রেষ্ঠ; কিন্তু কেন? জ্ঞান,চরিত্র আর যোগ্যতায়। আর মানুষের ভেতর সবচেয়ে বড় মানুষ তারাই – যাদের জ্ঞান, চরিত্র আর যোগ্যতা সবচেয়ে বেশি।
আমরা প্রথমতঃ ক্যারিয়ার গঠন বা মানবীয় উন্নতির কিছু মৌলিক ফর্মুলার কথা আলোচনা করবো- অতঃপর ক্যারিয়ারের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। চলোই না তাহলে, আর দেরী না করে শুরু করা যাক আত্মোন্নয়নের পথ পরিক্রমা।
সুদৃঢ় আকাঙ্ক্ষা
কোন পরিকল্পনা তা যতই সুন্দর হোক না কেন ততক্ষণ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয় না যতক্ষণ না তার সাথে যোগ হবে সুদৃঢ় আকাঙ্ক্ষা। নবুয়ত পাওয়ার পরপরই যখন রাসূল (সাঃ) -এর ওপর নেমে এলো বিপদের পর্বত; এমনকি কুরাইশ নেতৃবৃন্দ জোটবেঁধে দাঁড়িয়ে গেল বাধার পাহাড় হয়ে। এমনি সময়ে, সিংহপুরুষ আবু তালিবও ঘাবড়ে গিয়ে ভাতিজা মুহাম্মদ (সাঃ) কে বললো, কুরাইশ নেতৃবৃন্দের সাথে একটি আপোস রফা করে চলার জন্যে। তখন,তখন কি হলো? আমাদের প্রিয় নবী কি ঘাবড়ে গেলেন? না, মোটেই না। বরং দ্বিগুণ তেজে বললেন, “ওরা আমার এক হাতে যদি চন্দ্র এবং আরেক হাতে সূর্যকেও এনে দেয় তবু আমার পথ থেকে আমি এক চুল পরিমাণও বিচ্যুত হবো না।” জীবনে এমন কঠিন অঙ্গীকার ছিল বলেই মক্কার সেই কিশোর রাখাল বালকটি বড় হয়ে সমগ্র জাহানের অধিপতি হয়েছিলেন। যার জীবন অধ্যয়ন করে নেপোলিয়নের মত বিশ্ববিখ্যাত সেনাপতিও আশ্চর্য হয়ে বলেছিলেন,” মুহাম্মদের যুদ্ধবিজয়ের ঘটনাগুলি দেখলে মনে হয় তিনি কোন মানুষ নন;বরং স্বয়ং খোদা। কিন্তু আবার তাকে খোদাও বলা যায়না কারণ তিনি যুদ্ধে নিজে আহত হয়েছেন তার সৈন্যরা মারা গেছে; তাই কোন মানবীয় বুদ্ধি দিয়ে তার এই অত্যাশ্চর্য বিজয়কে বিশ্লেষণ করা যায়না।” এত অল্প সময়ে রাসূল (সাঃ) এর অবিস্মরনীয় সাফল্যের পেছনে শুধুমাত্র আল্লাহর সাহায্যই নয় বরং তার সুদৃঢ় আকাঙ্ক্ষা এবং সাধনাও মূল কার্যকারণ হিসাবে কাজ করেছে। আর তাই তো আমেরিকার সবচেয়ে সফল প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছেন,” যদি কেউ গভীরভাবে উকিল হওয়ার ইচ্ছা করে তবে অর্ধেক ওকালতি পড়া হয়ে যায়, আর বাকি অর্ধেকটা তাকে বই পড়ে শিখতে হয়।” ঠিক তেমনি আটলান্টিকের ওপর দিয়ে সবার আগে উড়ে যাওয়া অ্যামেলিয়া আরহার্ট বলেছেন,” আমি আটলান্টিকের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়েছিলাম কারণ আমি উড়তে ইচ্ছা করেছিলাম।” ব্রিটেনের টাউনশেন্ড অফিসের এক ক্যাশিয়ার, কলম পিষতে পিষতে হঠাৎ ভাবলেন,হায়! এভাবেই কি জীবনটা শেষ হয়ে যাবে? যেই ভাবা সেই কাজ, চাকুরি ছেড়ে দিলেন তিনি। যাত্রা হলো শুরু। শেক্সপীয়রের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন নিজকে এবং ভাবীকালে সত্যিই তিনি শেক্সপীয়রের সমকক্ষ, সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী জর্জ বার্নার্ড শ হয়েছিলেন। সুতরাং বলা যায়, সুদৃঢ় ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে সফলতার পূর্বশর্ত। আল্লাহ পাক কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, “ যারা সুদৃঢ় প্রত্যয়ী তারাই সফলকাম” ।
সাধনা আর সাধনা
শুধু সুদৃঢ় আকাঙ্ক্ষা করে চুপটি করে সোফায় বসে থাকলেই সাফল্য আসবে? না এক্কেবারে না,এমনকি একরত্তি আলপিনও একচুল পরিমাণ নড়বে না। তাহলে উপায়? হ্যাঁ, আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে চাইলে দরকার সাধনা আর সাধনা। যেমনটি রাসূল (সাঃ) বিজয়ের জন্যে সব ছেড়েছুড়ে পনের বছর শুধু ধ্যান করেছেন, তের বছর প্রচন্ড ধৈর্য্য ধরে দাওয়াত দিয়েছেন, আর দশ বছর এমন কি মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে গেছেন। ইমাম বুখারী (রহ) কুরআনের পর সবচেয়ে সেরা গ্রন্থ বুখারী শরীফ রচনা করতে গিয়ে, একটি হাদিস সংগ্রহে তিনশ মাইল হেঁটেছেন। ঠিক তেমনি স্কটল্যান্ডের রবার্ট ব্রুস তার দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে শক্তিশালী বৃটেনের বিরুদ্ধে পাঁচবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে প্রতিবারই পরাজিত হন। অতঃপর এক গুহায় আত্মগোপন অবস্থায় দেখতে পান একটি মাকড়সা জাল বুনতে গিয়ে পাঁচবার ব্যর্থ হয়ে ছয়বারের বার সফল হয়। তিনি লজ্জিত হয়ে এই ক্ষুদে মাকড়সা থেকে শিক্ষা নিয়ে ষষ্ঠ বার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বৃটেনের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। প্রায় এক হাজার নতুন বিষয়ের আবিষ্কারক বৈজ্ঞানিক এডিসনের মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক পত্রিকায় লেখা হয় “মানুষের ইতিহাসে এডিসনের মাথার দাম সবচেয়ে বেশি। কারণ এমন সৃজনশক্তি অন্য কারো মধ্যে দেখা যায়নি। অথচ ১৮৭৯ সালের ২১অক্টোবর তার আবিস্কৃত পৃথিবীর প্রথম বৈদ্যুতিক বাতিটি যখন জ্বলে উঠলো তখন ক’জন জানতো যে বিগত দু’বছরে তিনি এটি নিয়ে প্রায় দশ হাজার বার ব্যর্থ চেষ্টা করে আজ সফল হয়েছেন! সত্যি সাফল্যের পেছনে কি নিদারুণ সাধনা। বিটোফেন সম্ভবত সাধনায় সকল সুরকারকে ছাড়িয়ে যাবেন। তার স্বরলিপিতে এমন একটি দাঁড়ি নেই,যা অন্তত বারো বার কাটাকাটি করা হয়নি। গিবন তার আত্মজীবনী নয়বার লিখেছিলেন। তিনি শীতগ্রীষ্ম সবসময়ই ভোর ছয়টায় পড়ার ঘরে ঢুকতেন। এভাবে ত্রিশ বছরের চেষ্টায় বিশ্ববিখ্যাত ‘দি ডিক্লাইন এন্ড ফর অফ রোমান এম্পায়ার’ গ্রন্থটি লেখেন। বাটলার তার এনালজি লিখেছেন বিশবার। আমরা মানুষের সংগ্রামী জীবনে দেখি সাধনার মাধ্যমে পৃথিবীর ইতিহাসে সবাইকে চমকে দিয়ে কিভাবে অন্ধ মানুষ মিল্টন বিশ্ববিখ্যাত কবি হলেন। একজন অন্ধ, বধির মানুষ বিটোফেন কিভাবে সঙ্গীত রচয়িতা হলেন। একজন বোবা আর বধির মেয়ে হেলেন কিলার কিভাবে সাধনা করে চব্বিশ বছর বয়সে তার কলেজে সর্বোচ্চ মার্ক নিয়ে বি,এ পাস করলেন এবং পরবর্তীতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করলেন। কিভাবে একজন কাঠুরিয়ার ছেলে আর মুদি দোকানদার বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন হলেন। এসব কিছুর পিছনে যাদুর মতই যে বিষয়টি কাজ করেছে তা হচ্ছে সাধনা- নিরবচ্ছিন্ন সাধনা। আর তাইতো বৈজ্ঞানিক এডিসন বলেছেন, “প্রতিভা – একভাগ প্রেরণা আর নিরানব্বই ভাগ পরিশ্রম ও সাধনা।” লংফেলো আরো বলেছেন, “প্রতিভা মানে অপরিসীম পরিশ্রম” সবাইকে চমকে দিয়ে একটি কথা বলেছেন স্পেলার “প্রতিভা বলে কিছু নেই। সাধনা করো-সিদ্ধিলাভ একদিন হবেই।”
সময়-এখনই উপযুক্ত সময়
সেকেন্ড,মিনিট,ঘন্টা, দিবস, মাস আর কিছু বছরের সমষ্টি হচ্ছে আমাদের জীবন। যেমন কেউ যদি সত্তর বছর বাঁচে তবে তা ঘন্টার হিসাবে হবে ৬,১৩,৬৩২ ঘন্টা; সংখ্যাটা অনেক বড় মনে হয় তাই না? কিন্তু হিসাব কষলেই বুঝবা জীবনটা কত ছোট! যেমন শৈশবের অপরিপক্কতা ও বার্ধক্যের দুর্বলতার জন্যে যথাক্রমে পাঁচ ও দশ বছর হিসাব থেকে বাদ দিলে মোট বছর থাকে পঞ্চান্ন। এর ভিতর ঘুম ও বিশ্রামে যাবে প্রতিদিন কমপক্ষে আট ঘন্টা। দাঁতব্রাশ থেকে শুরু করে টয়লেট,ওযু, নামায, গোসল, খাওয়া, পত্রিকা পড়া, কাপড় পরা, যাতায়াত, গাড়ির জন্যে অপেক্ষা, যানজট, চা-নাস্তা, খেলাধুলা, টিভি দেখা, গল্পকরা ইত্যাদি দৈনন্দিন আনুষঙ্গিকতায় কমপক্ষে প্রতিদিন যায় ছয় ঘন্টা। সুতরাং মৌলিক কাজের সময় থাকলো প্রতিদিন মাত্র দশ ঘন্টা। অর্থাৎ পঞ্চান্ন বছর মানে সারা জীবনে মাত্র ২,০০,৮৯০ কর্মঘন্টা। তার ভিতর আবার প্রায় পঁচিশ বছর কেটে যায় লেখাপড়ায় অর্থাৎ প্রস্তুতিমূলক কাজে। অতঃপর মূলকাজের জন্যে থাকে ত্রিশবছরে মাত্র ১,০৯,৫৮০ কর্মঘন্টা। দশ বছর বয়স থেকে প্রতিদিন এক ঘন্টা করে টিভি দেখলে মোট সময় যাবে ২১,৯১৫ ঘন্টা, যা জীবনের মোট কর্মসময়ের ৫ ভাগের এক ভাগ। সুতরাং কর্মের তুলনায় জীবনের পরিধি খুবই কম। আর তাই সময় নষ্ট করা মানে জীবনকেই ধ্বংস করা। আর তাই আল্লাহপাক সময় (আছর ) নামক সূরায় বলেন “ সময়ের কসম; নিশ্চয়ই সমস্ত মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত (যারা সময়ের মূল্যায়ন করেনা)।” সুতরাং আমাদের প্রতিটি মুহূর্তকে অত্যন্ত হিসেব করে কাজে লাগাতে হবে। আর এ জন্যে চাই একটি পরিকল্পিত রুটিন, আর গোছালো জীবন।
কিন্তু তা কখন থেকে? অবশ্যই এখন থেকে। কেননা প্রবাদ আছে, “সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়” ।আর জীবনে বড় কিছু করতে হলে তা শুরু করার এখনই উপযুক্ত সময়। কারণ, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সমাজ সংস্কারে হিলফুল ফুযুল গড়ে তুলেছিলেন মাত্র সতের বছর বয়সে। আলী রা: সমগ্র আরবের বিরুদ্ধে রাসূলের সঙ্গী হয়েছিলেন এগার বছর বয়সে। নেপোলিয়ন ইটালী জয় করেছিলেন মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে। আইনস্টাইন ষোল বছর বয়সেই আপেক্ষিক মতবাদ নিয়ে প্রথম চিন্তা করেন যা পরবর্তীতে ছাব্বিশ বছর বয়সে প্রমাণ করেন। ১৯৩৫ সালে, নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র সম্মেলনে দশম শ্রেনীর চৌদ্দ বছরের যে বালকটি তার বিশ/পঁচিশ মিনিটের ভাষনে সকল জাদরেল বক্তাকে মাত করে দিয়েছিলেন সাইত্রিশ বছর পর তিনিই হয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ১৯৩১ সনে সপ্তম শ্রেণীর যে ছেলেটি ‘বোম্বাই ক্রনিক্যাল ‘পত্রিকা আয়োজিত সারা ভারতবর্ষব্যাপী চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম হন তিনিই উত্তরকালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন হয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে যে ছেলেটি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম কিশোর পত্রিকা ‘মুকুল’এর পাঠক নয় সম্পাদক হয়েছিলেন, তিনি হন পরবর্তীতে ইউনেস্কোর সম্মানজনক আর্ন্তজাতিক কলিঙ্গ পুরস্কার পাওয়া এশিয়দের দু’জনের একজন ডঃ আব্দুল্লাহ আল মুতি। সুতরাং আজ থেকেই শুরু হোক বিজয়ের অভিযাত্রা। চলো কবি তালিম হোসেনের ভাষায় আমরাও গেয়ে উঠি:
“আমরা জাতির শক্তি -সৈন্য, মুক্তবুদ্ধি বীর,
আমাদের তরে শূন্যে আসন জাতির কান্ডারীর।”
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা
রাসূল (সাঃ) তাঁর শত ব্যস্ততার ভিতরও প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় থেকে আট ঘন্টা আল্লাহর ইবাদাতে কাটাতেন। এমনকি বদর যুদ্ধের সেই কঠিন মুহূর্তে কাফেরদের তিন ভাগের এক ভাগ নিরস্ত্র প্রায় মুসলমানদের যুদ্ধক্ষেত্রে রেখে তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় বসে গেলেন। আর আল্লাহ দিলেন তাকে চূড়ান্ত বিজয়। নামাজরত অবস্থায় পায়ে বিদ্ধ তীর টেনে বের করার পরও টের পাননি যিনি, তিনিই হয়েছিলেন কাফিরদের ত্রাস শেরে খোদা হযরত আলী হায়দার। আর তাইতো খেলাফতের যুগে চীনের এক গোয়েন্দা চীন সম্রাটের কাছে মুসলমানদের ব্যাপারে রিপোর্ট করেছিল-“এদের রাত কাটে জায়নামাজে কেঁদে কেটে, আর দিনের বেলার আকাশ অন্ধকার হয়ে যায় এদের ঘোড়ার খুরের দাপটে, উড়ন্ত ধুলায়; সুতরাং এদের কেউ পরাস্ত করতে পারবে না।” ঠিক তেমনি যুদ্ধের বিজয়ের মতোই আত্মগঠনের সাফল্যের জন্যেও দরকার আল্লাহর কাছে অবিরত প্রার্থনা। যেমন আল্লাহই শিখিয়েছেন দোয়া “হে প্রভু আপনি আমাদের জ্ঞান বাড়িয়ে দিন।” আধুনিক বিজ্ঞানীরাও ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। বিজ্ঞানীদের ভিতর সবচেয়ে বড় নোবেল পাওয়া বিজ্ঞানী অ্যালেঙ্গী কমরেখ পৃথিবীর সর্বাধিক প্রচারিত ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লেখেন, “প্রার্থনা একজন মানুষকে সবচেয়ে বড় শক্তি দান করতে পারে। এই শক্তি কাল্পনিক শক্তি নয় মাধ্যাকর্ষণের মতোই তা অত্যন্ত বাস্তব। একজন ডাক্তার হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা হল সমস্ত ওষুধ ও চিকিৎসা যেখানে ব্যর্থ সেখানে প্রার্থনার জোরে মানুষ নবজীবন লাভ করেছেন। রেডিয়ামের মতই আলো এবং শক্তি ছড়ায় প্রার্থনা। মানুষের শক্তি সীমিত, কিন্তু প্রার্থনার দ্বারা সে অসীম শক্তিকে ডাকতে পারে নিজের শক্তি বাড়াবার জন্যে। প্রার্থনা এমন একটি শক্তি যার দ্বারা মানুষ উপকার পায়ই।” সুপ্রিয় মণিমুক্তার হিরকখন্ডরা, এসো আমরা সবাই অসীম করুণাময় আল্লাহর কাছে হাত তুলি আর দোয়া করি তাঁরই ভাষায় আমাদের জন্যে তিনি বাধ্যতামূলক করেছেন প্রতিদিন যেটি কমপক্ষে সতেরবার “ . . . ওগো আমাদের প্রভু আমাদের সহজ সরল, আর সফলতার পথ দেখাও. . . .।” ছোট্টমণি ভাই-বোনেরা, এবার এরই ধারাবাহিকতায় তোমাদের নিয়ে কিছু মৌলিক আলোচনায় যেতে চাই। চলোই না দেখি অনেক অ-নে-ক বড় হওয়ার জন্য আমাদের আর কি কি দরকার!
পড়লেখা আর পড়ালেখা
আমরা আমাদের ছোট বেলায় শুনতাম পড়ালেখা করে যে গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে। আর দুষ্টু ছেলেরা ফাঁকি দেয়ার জন্যে বলতো পড়ালেখা করে যে গাড়ি চাপা পড়ে সে। আজ বড় হয়ে দেখছি শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই গাড়ি চাপা পড়ে। আর শিক্ষিতরা গাড়ি কিনে যেসব গাড়িতে চড়ে ঠিক তেমনি লেখাপড়া না করেও আজকালকার মাস্তানরা নানা ভাবে গাড়ি হাকায়। এতে কি আমরা হতাশ হবো? নাহ্ কক্ষনোই না। কারণ আমরা জানি মাস্তানরা গাড়ি চালালেও তারা মানুষের ভালবাসা পায় না, তবে এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নিজের পিতামাতারও না। তবে একটা জিনিস তারা সবসময় বেশি পায়- সমাজের সকলের কাছ থেকেই পায়, সেটি হলো ঘৃণা আর ঘৃণা। কাজেই আমরা লেখাপড়া করবো শুধু গাড়িতে চড়ার জন্যেই নয়- বরং বড় অনেক বড় মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্যে। স্বয়ং বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ তাঁর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ফেরেশতা জিবরাইলের মাধ্যমে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে সর্বপ্রথম এ আসমানী নির্দেশটি পাঠালেন, তোমরা জান সেই মহান গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশটি কি ছিলো? সেই পবিত্রতম বাণীটি ছিল -‘ইক্করা’ মানে ‘পড়’। তোমরা কি জান? কেন আমাদের আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়? সে এক মজার কাহিনী, আদম (আ) কে সৃষ্টির পরপরই একটি চমৎকার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। একদিকে সকল ফেরেশতা অপর দিকে আদম (আ) একা। আল্লাহ ছিলেন প্রধান বিচারক। প্রতিযোগিতায় বিষয়বস্তু ছিল ‘জ্ঞান’। আমাদের আদি পিতা আদম (আ) সে প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলেন বলেই আমরা আশরাফুল মাখলুকাত খেতাব পেয়েছি। রাসূল (সা) জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানার্জন করো।’এর আগে পরে কোন সময় জ্ঞান অর্জন থেকে বাদ দেয়া যায় কি? জ্ঞানের শক্তিতেই একদিন মুসলমানরা সারা পৃথিবীকে শাসন করেছে। ১২৫০ সালে স্পেনের টলেডোতে আজকের সভ্য ইউরোপের শিক্ষক মুসলমানেরা প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র school of Oriental Studies স্থাপন করেন। কর্ডোভাতে পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় মুসলমানরা স্থাপন করেন। যেখানে সব সময়ে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় দশ হাজার ছাত্র অধ্যয়ন করতো। যার ব্যাপারে যোশেফহেলের মন্তব্য হলো :
Cordova Shone like lighthouse on the the darkness of Europe. আমি সেই সময়ের কথা বলছি যখন ইউরোপে খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিটি ছিল রানী ইসাবেলার যাতে বইয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ২০১ টি। অপরদিকে তৎকালীন ফাতেমীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী কায়রোতে মুসলমানদের পাঠাগারে জমা ছিল ১০ লক্ষ বই।
ঠিক সেই সময় অসভ্য ইউরোপে মুসলমানদের আবিষ্কার পৃথিবী গোল বলার অপরাধে মিঃ ব্রুনোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়, গ্যালিলিওকে বিজ্ঞানের প্রচারের জন্যে কারাগারে আটক করা হয় অবশেষে অন্ধ, বধির হয়ে তিনি সেখানেই মারা যান। কাগজ, ঘড়ি, বারুদ, মানচিত্র, ইউরোপ থেকে ভারতের রাস্তা এমনকি আমেরিকার আবিষ্কর্তা মুসলমানেরা। দুর্ভাগ্য-আজকে তারাই বিশ্বে সবচেযে পশ্চাদপদ জাতি। কারণ এক সময় পৃথিবীর শিক্ষক হলেও এখন তারাই সবচেয়ে কম লেখাপড়া করে। অথচ রাসূল (সা) বলেছেন- ‘জ্ঞান হচ্ছে মুসলমানদের হারানো সম্পদ’।
সুতরাং বড় হতে হলে এ বিশ্বটাকে আবারো জয় করতে চাইলে অনেক অ-নে-ক বেশি পড়ালেখা করতে হবে। মুসলিম ছাড়াও বিশ্বে যারাই বড় হয়েছেন তারাই প্রচন্ড পড়ালেখা করেই বড় হয়েছেন। যিনি দারিদ্রতার কারণে ঘড়ি বিক্রি করে দিয়ে দিনে আধপেট খেয়ে, সারাদিন লাইব্রেরিতে পড়ে থাকতেন আর পৃথিবীকে পরিমাপ করতেন। তিনিই পরবর্তীতে রূপকথাকেও ছাড়িয়ে গিয়ে জগৎবিখ্যাত নেপোলিয়ান হয়েছিলেন। হেলেন কিলার ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধ; কিন্তু চক্ষুষ্মান অনেক অনেক লোকের চাইতেও তিনি অধিক সংখ্যক বই পড়েছেন। সাধারনের চাইতে কমপক্ষে একশ গুণ এবং নিজেই লিখেছেন এগারোটি গ্রন্থ। আর নোবেল বিজয়ী বার্নার্ড’শ, দারিদ্রতার কারণে মাত্র পাঁচ বছর স্কুলে লেখাপড়া করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনিই ছিলেন বিশ্বে তার যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। তিনি মাত্র সাত বছর বয়সে সেক্সপিয়র, বুনিয়ান,আলিফ লায়লা, বাইবেল প্রভৃতি অমর গ্রন্থ শেষ করেন আর বারো বছর বয়সে ডিকেন্স, শেলীর বইগুলি হজম করে ফেলেন তিনি। আমরাও যদি বড় হতে চাই পড়া লেখার কোন বিকল্প নেই। আমাদের উপমহাদেশেও যে সকল ব্যক্তিত্বকে মানুষ সর্বদা স্মরণ করে তারা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন মহাজ্ঞানী আর সুউচ্চ ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ। আল্লামা ড. ইকবাল মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে ব্যারিস্টার ও ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে ব্যারিস্টার হন। ভারতের জনক মহাত্মা গান্ধী, প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ব্যারিস্টার ছিলেন। আমাদের নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী এরাও তাদের সময়ের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও ব্যারিস্টার ছিলেন। তাদের কথা চিন্তা করে এসো, গোলাপ কলিরা আমরা শ্লোগান দেই ‘বিশ্বটাকে গড়তে হলে সবার আগে নিজেকে গড়ো \’একজন মহান ব্যক্তির মহান কথা। তিনি যখন অসহায়ভাবে রাশিয়ার এক রেলস্টেশনে মারা যান তখন তার ওভারকোটের পকেটে পাওয়া যায় মূল্যবান এক বই ‘দ্যা সেইং অফ প্রোফেট মোহাম্মদ ’। সেই নোবেল বিজয়ী লিও টলস্টয়কে বলা হয়েছিল জাতীয় উন্নয়নের জন্যে আপনি যুব সমাজের প্রতি কিছু বলুন। তিনি বলেছিলেন আমার তিনটি পরামর্শ আছে:
১। পড়
২। পড়
৩। আর পড়।
এটি যেন মহান আল্লাহর সেই প্রথম বাণী ‘পড় তোমার সে প্রভুর নামে’এর প্রতিফলন।
প্রতিভা : জন্মগত? নাকি সাধনালব্ধ?
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন: অনেক সময় আমাদের মনে হয় আল্লাহ বোধহয় কিছু মানুষকে জন্মগতভাবেই প্রতিভা দিয়েছেন সুতরাং আমাদের চেষ্টা করলেও খুব একটা লাভ হবে না। এতে করে নিজেদের ভিতর অজান্তেই এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা জেঁকে বসে, আত্মোন্নয়নের গতি হয়ে যায় শ্লথ। এই তো সেদিন একটি বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা অহরহতে দেখলাম কিছু নিউরোলজিস্ট গবেষণা করে বলেছেন, বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনের সংরক্ষিত মগজ সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা, অনেকটা বড়। এটাকে সত্য ধরে নিয়েও বলা যায়, এটি হচ্ছে একটি আশ্চর্যজনক ব্যতিক্রম ইংরেজিতে যাকে বলা হয় মিরাকল আর ইসলামের দৃষ্টিতে বলা হয় মোজেজা। আল্লাহ তার কুদরতি ব্যবস্থাপনায় মানুষের শিক্ষার জন্যই কদাচিৎ এমনটি করে থাকেন। আমার ধারণা কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদ দিলে সাধারণভাবে সকল মানুষের প্রতিভাই আল্লাহ প্রদত্তভাবে সমান। অতঃপর সাধনার কম বেশির কারণে প্রতিভার স্ফুরণের ক্ষেত্রে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। আমরা অনেকেই প্রায়ই বলি ‘আমার কোন যোগ্যতা নেই ..’। আমার মনে হয় ইসলামের দৃষ্টিতে আমাদের এটা বলার কোন সুযোগ নেই। কেননা আল্লাহ বলেছেন ‘…নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা (মানুষকে) প্রেরণ করবো।’ খলিফা মানে হচ্ছে মহান আল্লাহর প্রতিনিধি কিন্তু শুধুমাত্র নিজের পাড়া, গ্রাম, থানা, জেলা বা দেশের জন্যে নয় বরং সমগ্র পৃথিবীর জন্যে। সুতরাং প্রিয় বন্ধুরা বুঝতেই পারছো, প্রতিটি মানুষ বিশেষ করে মুসলিমদের জন্মগতভাবেই আল্লাহপাক কত বড় দায়িত্ব দিয়েছেন। সুতরাং এটা কি ভাবা যায় যে এত বড় বিশাল দায়িত্ব আল্লাহ যাদের দিলেন তাদের তিনি যোগ্যতা কম দিয়েছেন? অথবা তিনি জানতেনই না যে এ মানুষটার যোগ্যতা কম। (নাউজুবিল্লাহ!) আল্লাহর ওপর এত বড় অভিযোগ কেউ কি করতে পারে? সুতরাং যারা বলেন “ ..আমার কোন যোগ্যতা নেই …” । অথবা ‘..আমার যোগ্যতা কম ..’। তারা প্রকারান্তরে আল্লাহকেই অভিযুক্ত করেন, কেননা তিনিই তো আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং সর্বজ্ঞ হিসেবেই এই বিশাল দায়িত্ব আমাদের দান করেছেন। আমাদের কারো যোগ্যতা তুলনামূলক ভাবে অন্যদের চাইতে কম মনে হলে আমরা এতটুকু বলতে পারি যে, …” আমি এখনো আমার যোগ্যতার বিকাশ ঘটাতে পারিনি।’ জন .ডি . রকফেলার প্রথম জীবনে ঘন্টায় মাত্র চার সেন্ট (মার্কিন চার পয়সা ) বিনিময়ে আলুক্ষেতে কাঠফাটা রোদের ভিতর লোহার কোদাল দিয়ে কাজ করেছেন। অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের বিনিময়ে তিনি পরিণত হয়েছিলেন সেই সময়কার আমেরিকার সবচেয়ে সেরা ধনীতে। প্রায় ষাট বৎসর আগে মৃত্যুর পূর্বে তিনি দু ’বিলিয়ন ডলার (প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা ) এর মালিক হয়েছিলেন। যার সম্পদ এখনও বেড়ে চলেছে প্রতি মিনিটে প্রায় একশ ডলার অর্থাৎ দিনে প্রায় ৭২ লক্ষ টাকা করে। যদিও তিনি মুসলিম ছিলেন না তবুও তিনি নিয়মিত প্রার্থনা করতেন, নাচতেন না,থিয়েটারে যেতেন না, কখনও মদ্পান এমন কি ধুমপান পর্যন্ত করতেন না।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ সুপার কম্পিটার
কিশোর বন্ধুরা, এই শিরোনাম দেখে তোমরা কি বিস্ময়ে থ’হয়ে গেলে? নাকি ভাবছো যে, আমার মাথাটি এক্কেবারে খারাপ হয়ে গেছে! নাহ্ বিলকুল সব ঠিক হ্যায়। হ্যাঁ,অবশ্য আমি তোমাদেরকে এখন তোমাদের আর সব মানুষের মাথার কথাই বলবো। ভাবছি এ বিশ্লেষণ শুনে তোমাদের মাথাই আবার খারাপ হয়ে যায় কি না? যাক। আল্লাহ ভরসা। আমাদের দেহের ভিতর মাত্র তিন পাউন্ড ওজনের মস্তিস্কের গঠন সবচেয়ে জটিল। এমনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার কম্পিউটারের চেয়ে হাজার হাজার কোটি গুণ জটিল। ডাক্তার ওয়াল্টারের মতে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে মানুষের মত সমক্ষমতার একটি বৈদ্যুতিক বা এটমিক মস্তিস্ক তৈরি করতে চাইলে পনের শত কোটি, কোটি টাকারও বেশি প্রয়োজন হবে। সংখ্যাটিকে অংকে লিখলে দাঁড়ায় ১৫০০,০০০০০০০,০০০০০০০ টাকা। অর্থাৎ যে পরিমাণ টাকা দিয়ে বর্তমান সময়ের অত্যাধুনিক প্রায় দশ হাজার কোটি কম্পিউটার কেনা সম্ভব।……..এ্যাই থামো, শরীরে একটু চিমটি কেটে দেখোতো স্বপ্ন দেখছো কিনা? আরো মজার খবর … এই মস্তিষ্ককে চালাতে এক হাজার কোটি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ এর প্রয়োজন হবে। দৈনিক চালু রাখার জন্যে প্রয়োজন হবে কর্নফুলির কাপ্তাইয়ের মতো তিন হাজার আড়াইশত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সামগ্রিক উৎপাদন। সাবধান তোমরা কিন্তু ভয় পেয়ে যেও না, এই যান্ত্রিক মস্তিস্কের আয়তন হবে আঠারোটি এক’শ তলা বিল্ডিংয়ের সমান। আমাদের মস্তিষ্কের সবচেয়ে ওপরের সাদা ঢেউ খেলানো অংশকে কর্ট্রেক্স বলে। স্তরে স্তরে বিন্যস্ত এই কর্ট্রেক্সকে সমান্তরালভাবে সাজালে এর আয়তন হবে দু’হাজার বর্গমাইলেরও বেশি অর্থাৎ প্রায় ব্রুনাই দেশের সমান। চৌদ্দশত কোটি নিরপেক্ষ জীবকোষ দিয়ে কর্ট্রেক্স গঠিত। এ সকল পরস্পর বিচ্ছিন্ন সম্পূর্ণ একক জীবকোষকে নিউরন বলা হয়। এগুলি এতই ক্ষুদ্র যে কয়েকশত একত্রে একটি আলপিনের মাথায় স্থান নিতে পারে। প্রতি সেকেন্ডেই শত শত হাজার হাজার নিউরন এসে ব্রেইনের প্রাথমিক স্তরে জমা হতে থাকে। এরা একেকটি ইলেক্ট্রনিক সিগনাল যা শরীরের বিভিন্ন অংশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং মূল নিয়ন্ত্রণের আদেশ অতি দ্রুত হাজার কোটি সেলে ছড়িয়ে দেয়। ব্রেইনের এ সকল প্রতিক্রিয়া অনেক সময় সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের মাত্র একভাগ সময়ে ঘটতে পারে। আমাদের দেহের মেরুদন্ডের মাধ্যমে নিউরনগুলি সারা শরীরের যন্ত্রপাতিগুলিকে সজীব ও তৎপর রাখে। এগুলির আবার অনেক স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে যার সংখ্যা প্রায় ২৫০টি। যেমন কোন অংশ শোনার জন্যে. কোন অংশ বলার জন্য, কোন অংশ দেখার জন্য আবার কোন অংশ অনুভূতিগুলিকে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল টাওয়ারে ট্রান্সমিট করার জন্য ব্যস্ত থাকে। এতে আবার বসানো হয়েছে একটি স্বয়ংক্রিয় শক্তিশালী ‘মেমোরি সেল’। যার কাজ হলো নিত্য নতুন সংগ্রহ গুলিকে যথাযথভাবে সংরক্ষন করা এবং প্রয়োজনের সময় তাকে ‘রি ওয়াইন্ড’করে মেমোরি গুলিকে সামনে নিয়ে আসা। এই স্মৃতি সংরক্ষণশালা প্রতি সেকেন্ড ১০টি নতুন বস্তুকে স্থান করে দিতে পারে। পরম আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বপ্রকারের যাবতীয় তথ্য ও তত্ত্বকে একত্র করে এক জায়গায় করে যদি এই মেমোরি সেলে রাখা যায় তাতে এর লক্ষ ভাগের একভাগ জায়গাও পূরণ হবে না। সুবহানআল্লাহ! আমরা আল্লাহর এ মহিমার শুকরিয়া কিভাবে আদায় করবো ভেবে কূলকিনারা পাই না। প্রিয় বন্ধুরা, তোমরা কি অনুধাবন করতে পারছো কত শক্তিশালী আমাদের এ মস্তিষ্ক! তবে দুঃখের বিষয়, আমরা এর হাজার ভাগের একভাগও কাজে লাগাইনা বা লাগাতে পারি না। আধুনিক বিজ্ঞান এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমাদের প্রত্যেকের আল্লাহ প্রদত্ত এই মহাশক্তিশালী কম্পিউটার (মস্তিস্ক) কে কাজে লাগাতে পারবো। সুপ্রিয় কিশোর বন্ধুরা, আমরা এ আলোচনাটা শেষ করতে চাই একজন মহামনীষীর বক্তব্য দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, “ নো দাই সেলফ’অর্থাৎ নিজেকে জানো।’এ যেন সেই আরবি প্রবাদেরই প্রতিধ্বনি ‘মান আরাফা নাফসাহু ফাক্বাদ আরাফা রাব্বাহু’অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজকে চিনতে পারলো সে তার প্রভুকে চিনতে পারলো।
বড় যদি হতে চাও
বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে মেধাবী মানুষটি হচ্ছে আমেরিকার পেনসিলভিনিয়া রাজ্যের ফেরিস এলগার। ৮৬ বৎসর বয়সী এ অসাধারণ মানুষটি স্কুল কলেজের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না নিয়েও অনেক বিস্ময়কর কান্ড করেছেন। আই.কিউ. টেস্ট বা বুদ্ধিমাপক পরীক্ষায় ফেরীসের বুদ্ধাংক ২০০ এর মধ্যে ১৯৭। প্রতি একশ কোটি মানুষের ভিতর মাত্র একজন বুদ্ধাংক ১৯৩ এর উপর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে হিসাবে পৃথিবীর বর্তমান প্রায় ৬শ কোটি মানুষের ভিতর ফেরীসের মতো মাত্র ৬ জন লোক থাকার কথা। কিন্তু জন্মগতভাবে বুদ্ধি ও মেধার ক্ষেত্রে ফেরীসের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বললেই চলে। প্রকৃতপক্ষে ফেরীস একজন সুপার জিনিয়াস, ওর বুদ্ধি সাধারণ একজন মানুষের তিনগুণ, প্রতিভাবানদের দ্বিগুণ। প্রতিভা সম্পর্কে তিনি যা বলেন তা তার মত অদ্বিতীয় মেধাবী ব্যক্তির কাছ থেকে আশা করা যায় না। তিনি বলেন, ‘প্রতিভা আর কিছু নয় পরিশ্রম। প্রতিভার বিকাশে কঠোর পরিশ্রমই গুরুত্বপূর্ণ।’ সুপ্রিয় বন্ধুরা, আমরা দেখেছি সকল জিনিয়াসই প্রতিভা অর্জনের জন্যে পরিশ্রমের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তাদের জীবনে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করি তা হচ্ছে সুন্দর পদ্ধতি বা কৌশল। আমরা এখন অধ্যয়নের ক্ষেত্রে তাদের সেই সকল মূল্যবান পদ্ধতি সমূহ আলোচনার চেষ্টা করবো।
অধ্যয়নের পূর্বে প্রস্তুতিমূলক বিষয়সমূহ
অধ্যয়নের টেকনিক নয় বরং যে সকল পূর্ব প্রস্তুতির মাধ্যমে আমরা নিজেদের প্রতিভাকে আরো শাণিত করতে পারবো সে বিষয়গুলি এখানে আলোচনা করা হয়েছেঃ
১. খাবার : খাবারের পরিমাণের ওপর মস্তিস্ক চালনা নির্ভর করে। ভালভাবে মস্তিস্ক কাজে লাগাতে চাইলে পেটে একটু ক্ষুধা রেখে খেতে হয়। রাসূল (সা) যে নিজে অল্পাহার করেছেন ও আমাদের করার জন্যে বলেছেন তা অত্যন্ত বিজ্ঞান ভিত্তিক। অতিভোজনের ফলে রক্ত মাথা থেকে পাকস্থলীতে হজম ক্রিয়ার জন্যে নেমে আসে। তার ফলে মস্তিস্কের ক্রিয়ার ব্যাঘাত হয়। তদ্রুপ অনাহারও মস্তিস্কের ক্রিয়ায় সমস্যা করে।ভি .এইচ .মর্টাম তার ‘‘হিউম্যান নিউট্রিশান” গ্রন্থে ছাত্রদের মোট পাঁচবার খেতে বলেছেন। এর অর্থ হচ্ছে ছাত্রদের বারে বেশি খেতে হবে কিন্তু পরিমাণে কম।
২. কোষ্ঠশুদ্ধি : নিয়মিত কোষ্ঠশুদ্ধি না হলে পেটে জমা খাদ্যের অংশগুলি পচে যে গ্যাস হয় তা মস্তিস্কের উপর সরাসরি বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। এজন্যে যাদের বদহজম আছে তারা মাথার কাজ বেশি করতে পারে না।
৩. চাই প্রচুর অক্সিজেন : মস্তিস্ক চালনাকালে কর্টেক্সের বিশেষ বিশেষ কেন্দ্রের নিউরনপুঞ্জের মধ্যে অত্যন্ত প্রবলবেগে বৈদ্যুতিক প্রবাহের ন্যায় এক প্রকার তীব্র প্রবাহ চলতে থাকে। বৈজ্ঞানিকগণ এই প্রবাহের গতি মেপে দেখেছেন। নিউরন-সৃষ্ট তরঙ্গ প্রবাহের আঁকাবাঁকা রেখাগুলি সেকেন্ডে দশ থেকে পনের বার পর্যন্ত স্পন্দিত হয়। এতে যে কি পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয় তা সহজেই অনুমেয়। তাই যখনই মস্তিস্কের বিশেষ কেন্দ্র সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন রক্ত সেখানে এসে সর্বপ্রকার শক্তি যুগিয়ে দেয়। রক্ত যে শক্তি দেয় তার প্রধান দুটি অংশের একটা হলো শর্করা এবং অন্যটা হলো অক্সিজেন। মস্তিষ্কের কঠোর স্নায়ুবিক কাজের জন্য যে পরিমাণ বাড়তি অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় তার পরিমাণ স্বাভাবিক দেহ ধারণের জন্যে যেটুকু অক্সিজেন প্রয়োজন হয় তার চাইতে দশ থেকে বিশগুণ বেশি। সুতরাং এই অতিরিক্ত অক্সিজেন যাতে রক্ত সংগ্রহ করতে পারে তার জন্যে প্রত্যেক মস্তিষ্কজীবীকে প্রত্যহ অন্তত দু’ঘন্টা মুক্তবাতাসে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র একাজটি না করায় পরিণত বয়সে খুবই অসুস্থ হয়ে যান। আর আমরা দেখি রাসূল (সা) সহ আরো যে সকল মনীষী ধ্যান করেছেন তারা প্রত্যেকেই বেছে নিয়েছেন বিশুদ্ধ বায়ুময় নিরিবিলি জায়গা। অর্থাৎ বিশুদ্ধ অক্সিজেন মগজের ক্ষমতাকে শাণিত করে।
৪. শরীরের জন্য ঘুম : ঘুম মস্তিষ্কজীবীদের এক অমূল্য ঔষধ। অনেকেই মনে করেন যারা বেশি পড়ালেখা করে তাদের কম ঘুমালেই চলে। কিন্তু ধারনাটি ভুল। বরং তাদেরই ঘুমের দরকার হয় বেশি। দু’টি কারণে তাদের ঘুমের দরকার হয় বেশি। প্রথমতঃ এতে কর্টেক্সের নিউরনগুলির পরিপূর্ণ বিশ্রাম ঘটে, দ্বিতীয়তঃ নিদ্রাকালে রক্ত নিজে বিশোধিত হয় এবং বাতাস থেকে প্রচুর পরিমাণে বাড়তি অক্সিজেন সংগ্রহ করে নেয়। আর তাই চার্চিল নব্বই বৎসর বয়সেও বারো থেকে পনের ঘন্টা করে মানসিক পরিশ্রম করতে পারতেন। কেননা তিনি সেই বয়সে নয় ঘন্টা করে নিদ্রা যেতেন।
৫. সময় ও পরিবেশ : পড়ালেখার জন্যে সময় ও পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহাগ্রন্থ আল কুরআন অধ্যয়নের জন্য শেষরাতের সময়টিকে বেশি উৎসাহিত করা হয়েছে। কেননা সে সময়ে সারা পৃথিবী থাকে নিস্তব্ধ আর পরিবেশটা থাকে অনেকটা ঠান্ডা। সুতরাং কোলাহলমুক্ত পরিবেশ আর অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা আবহাওয়া মগজকে কার্যকরী করার জন্যে বেশি উপযোগী। আর তাই গরম দেশের চাইতে শীতপ্রধান দেশের মানুষ তুলনামূলকভাবে বেশি মেধাবী হয়।
একজন কিশোরের গল্প বলবো, সে মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে বই ধার করে এনে পড়তো। তার পড়ার সময় ছিল দিনের কাজের শেষে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়তো, কামরার মধ্যে চুল্লিতে একটা নতুন কাঠ জ্বালিয়ে সেই আলোয় সে পড়তো, ঘুমে ঢুলে না পড়া পর্যন্ত। কালক্রমে সেই হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের মহান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন।
সর্বকনিষ্ঠ বৈমানিক
এ পর্যায়ে তোমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই আমাদেরই এক নতুন বন্ধু বাংলার দামাল কিশোর,যার কৃতিত্বে সবার বুক ভরে যায়। আর চোখে আসে আনন্দের অশ্রু। ছেলেটির নাম আলী রাকিব। ১৯৯৯ সালের ২২শে এপ্রিল, তখন তার বয়স সবে মাত্র তের বছর পাঁচ মাস। ঐ দিনেই রোদ ঝলমল সকালে জীবনে প্রথমবার বিমানে চড়ে নয়, এক্কেবারে নিজে বিমান চালিয়ে আকাশে উঠেছিল সে। আমেরিকার ফ্লোরিডার অর্মন্ডবিচ ডোমেস্টিক এয়ারপোর্ট। ছোট্ট রাকীব, গ্রাউন্ডচেকিং শেষে, কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ক্লিয়ারেন্স পেয়ে রানওয়ের ওপর দিয়ে ৯৯ নট বেগে সা-সা ছুটে চলা সেসনা-১৭২ কে এক ইঞ্চি পরিমাণ থ্রটল টেনে ভূমির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তুলে এনেছিল ঊর্ধ্বপানে। হয়তো তখন তার পেটটা চিনচিন করছিল, রক্তিম গালদুটি ফ্যাকাশে হয়েছিল, চোখ দুটোও হয়েছিল স্থির- আর একটু একটু ভয় লেগেছিল বৈকি। কিন্তু তার পরই দুরন্ত ঈগলের ডানা মেলে ওড়ার অপার আনন্দ। বিক্ষুব্ধ ভয়াল আটলান্টিকের দু’হাজার ফিট ওপর দিয়ে (এর ওপরে ওঠার অনুমতি তার ছিল না)। সে উড়েছিল প্রায় পৌনে দু’ঘন্টা। (ওহ! গা ছমছম করে ওঠার মতো ঘটনা; তাই না?) সাথে সাথে সেই পিচ্চি দস্যি ছেলেটি সৃষ্টি করলো এক নতুন রেকর্ড, সে হলো আটলান্টিকের ওপর দিয়ে ওড়া সর্বকনিষ্ঠ বাংলাদেশী বৈমানিক। এর পরের দু’সপ্তাহের মোট ষাট ঘন্টা ওড়ে, সে নানা করসৎ রপ্ত করে। মনে হয় চিৎকার করে আটলান্টিকের ওপারে খোদ আমেরিকায় পৌঁছে দেই আমাদের বুলন্দ আওয়াজ সাবাস! রাকিব,সাবাস!!
মাকে নিয়ে ওরা চার ভাইবোন থাকে আমেরিকায়। বাবা আলীমুল্লাহ কুয়েত এয়ারলাইন্সের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার, মামা সেখানেই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, বড়ভাই আলীরেজা আমেরিকান এয়ারলাইন্সে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মরত। কিশোর বন্ধুরা তোমরা কি ভাবছো এতকিছুর সুবাদেই কি সে পেয়েছিল বর্ণাঢ্য সুযোগ? কিন্তু না, আসল ঘটনা অন্য রকম। কেম্বারল্যান্ড স্কুলের জুনিয়র লেভেল পরীক্ষায় সে কৃতিত্বপূর্ণ জিপি এ ৪.০ পয়েন্ট অর্জন করে। প্রতিটি বিষয়ের পরীক্ষাতেই ৯৪ থেকে ১০০ নম্বর পেলেই কেবল তা অর্জন করা সম্ভব। তার মূল কৃতিত্ব এখানেই, সে এই জিপিএ পয়েন্টের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মার্কসধারী প্রথম বাংলাদেশী। শুধু কি তাই? কাউন্টি বোর্ড অব এডুকেশনের পক্ষ থেকে তাকে দেয়া হয় ন্যাশনাল জুনিয়ার অনার্স সোসাইটির পদক। আরো আছে, আমেরিকার সেরা তিনশ মেধাবী ছাত্রের সাথে ওয়াশিংটন ডিসি সফরের আমন্ত্রণ, এমনকি খোদ হোয়াইট হাউসেও ভ্রমন। কিন্তু রাকিবের জন্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরস্কার ছিল এমব্রেরিডাল এরোনটিক্যাল ইউনিভার্সিটির ইয়ং ঈগল প্রোগ্রামের আমন্ত্রণটি। এ প্রোগ্রামে প্রতি বছর আমেরিকার স্কুল পর্যায়ের মেধাবী ছাত্রদের ভিতর থেকে সেরা পাঁচজনকে বাছাই করা হয় বিনা খরচায় বিমান চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যে। আমাদের আলী রাকীব হলো, এ বছর সমগ্র আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেই সেরা পাঁচজনের একজন। আমাদের দেশের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য চলো আমরা সবাই তাকে জানাই বুকভরা ভালবাসা আর অভিনন্দন। রাকিবদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রুপগঞ্জ থানার মুড়াপাড়া গ্রামে। ইস ভুমিকাতেই কত্তো কথা হলো, জানি না তোমাদের এত্তো প্যাচাল ভাল লাগে কিনা? নাকি রেগেমেগে, আমার কল্পিত আকৃতি বেচারার প্রতি বারবার চোখ রাঙ্গাও! যাক্ চলো, আর দেরি নয়, ঝটপট শুরু করি কিছু কাজের কাজ।
চব্বিশ ঘন্টা পড়া
হেডিং দেখেই তোমরা হৈ চৈ করো না কিন্তু। আমাকে আগেভাগে একটু খোলাসা করতে দাও। আচ্ছা বলোতো, প্রতিদিন আমাদের কত ঘন্টা সময়? সবাই বলবে ক্যানো, চব্বিশ ঘন্টা! এটা কি ইলাস্টিকের মতো টেনেটুনে এক-আধটু বড় করা যায়? হয়তো হেসে কুটিকুটি হয়ে বলছো নাহ, এক্কেবারে না। এটা অসম্ভব ব্যাপার। আসলেও ঠিক তাই। তাহলে উপায়? চলোই না চেষ্টা করে দেখা যাক, কোন সমাধান বের করা যায় কিনা? আমরা চব্বিশ ঘন্টায় অর্থাৎ সারাদিনে মোটামুটি প্রধান প্রধান কি কি কাজ করি? পড়া লেখা, গোসল, খাওয়া, নামাজ, ঘুম, খেলাধুলা ইত্যাদি …তাই না? এবার এসো, আমরা একটু বিশ্লেষণ করি …গান্ধিজী যেখানে গোসল করতেন সেখানে প্রতিদিন একটি করে গীতার শ্লোক লিখে রাখতেন। অতঃপর গোসলের সময় তা গানের সুরে সুরে মুখস্ত করে ফেলতেন। আমরাও এভাবে প্রতিদিন একটি করে মহামনীষীদের বাণী শিখতে পারি। আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট অন্য লোকদের সাথে কথোপকথনের সময়ও ফাঁক দিয়ে বই পড়তেন এবং গ্রাম ভ্রমণের সময় প্রতিদিন প্রায় তিনটি করে বই পড়তেন। আর নেপোলিয়ান যুদ্ধে গেলেও তার সাথে থাকতো একটি চলমান লাইব্রেরি এবং যুদ্ধক্ষেত্রেও তিনি বই পড়তেন। রাসূল (সা) এর ওপর প্রচন্ড রণাঙ্গনেও নাজিল হতো মহাগ্রন্থ আল-কুরআন; আর তিনি তা যথাযথভাবে আত্মস্থ করতেন। হযরত আলী (রা) এর ব্যক্তিগত হাদিস সংকলন ‘সহীফা ‘সংরক্ষিত থাকতো সর্বদা তার তলোয়ারের খাপের ভিতর। ক্যাডম্যান বারো বৎসর বয়সে খনির মজুর হিসাবে জীবন আরম্ভ করেন। ঝুড়ি থেকে কয়লা খালাসের পর প্রতি দুই মিনিট অবকাশে খনির অন্ধকারে মৃদু আলোতে দাঁড়িয়ে একটু বই পড়ে নিতেন। আহারের সময়ও তিনি পড়া চালিয়ে যেতেন। (আমরা অন্তত বড় ভাই বা আব্বা, আম্মার সাথে এ সময় কঠিন বিষয়গুলি পর্যালোচনা করতে পারি)। এভাবেই তিনি নিজকে স্বশিক্ষিত করে যশ ও খ্যাতি অর্জন করেন। সোহরাওয়ার্দির কোষ্ঠকাঠিন্য ছিল, টয়লেটে বেশি সময় লাগতো তাই কমোডে বসেই তিনি সেদিনের পত্রিকাগুলি পড়ে শেষ করতেন। মহাকবি শেখ সাদী ঘুমের ঘোরেই স্বপ্নযোগে পেয়েছিলেন তার জগৎ বিখ্যাত নাতে রাসূল (সা) এর সর্বশেষ শ্লোক “ সাল্লু আলাইহি ওয়া আ’লিহি” । অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী ঘুমের ঘোরেই তাদের বিখ্যাত আবিষ্কারের তত্ত্ব পেয়েছেন। সুতরাং প্রমাণ হলো, বই সাথে না থাকলেও চব্বিশ ঘন্টা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পড়ালেখায় থাকা যায়। তাহলে আমরা কি সারাদিন শুধুমাত্র পাঠ্যবই নিয়ে পড়ে থাকবো? ভাবছো ওহ! এটাতো কুইনাইনের চেয়েও তেতো। আসলে আমি কিন্তু তোমাদের সর্বক্ষণ বইয়ের পোকা বা গোবরেপোকার মত পাঠ্যবই নিয়ে পড়ে থাকতে বলবোনা। খোঁজ নিয়ে দেখ, এবার যারা এস.এস.সি ও এইচ .এস .সি পরীক্ষায় জিপিএ 5 পেয়েছে বা বোর্ড স্ট্যান্ড করেছে তারা সর্বোচ্চ ১০/১২ ঘন্টা করে পাঠ্যবই পড়েছে। আর বাকি সময় পত্রিকা বা অন্যান্য বই পড়েছে। সারাদিন যারা শুধু পাঠ্যবই নিয়েই থাকে তাদের চিন্তার জগৎ হয়ে যায় সংকীর্ণ। তারা কখনো খুব ভাল রেজাল্ট করতে পারেনা। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মায়ের কোলের শিশুটিই থেকে যায়। সময় নষ্ট হবে বলে সাঁতার কাটতে জানে না, সাইকেল চালাতে জানে না। এমন কি অনেকে বলতে পারবেনা চেচনিয়া,কসোভো এগুলি কি? কোন ব্যক্তির নাম? কোন ট্যাবলেটের নাম? নাকি কোনো দেশের নাম? তাই অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবনটা হয়ে যায় সেই নৌযাত্রীর মতো “ষোল আনাই মিছে”। সুতরাং আমাদের পাঠ্যবইয়ের ফাঁকে ফাঁকে কিছু সময় চরিত্রগঠনের জন্য ধর্মীয় গ্রন্থ,সাধারণ জ্ঞানের জন্য পত্রিকা,অনুপ্রেরণার জন্য মহামনীষীদের জীবনী পড়ার সময় রাখতে হবে। এতে করে পাঠ্যবিষয়টি ভাল করে রপ্ত হবে। যেমন শুধু গোশত রান্না করলে খাওয়া যায় না, তার সাথে দিতে হয় তেল, মরিচ, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, গরম মশলা ইত্যাদি। তবেই তা হয় মুখরোচক আর হজমকারক। স্পিনোজা বলেছেন,“ভালো খাদ্যবস্তুতে পেট ভরে, কিন্তু ভালো বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে।” দেকার্তে বলেছেন,“ভালো বই পড়াটা যেন গত শতকগুলির সেরা মানুষদের সাথে কথা বলা।” ইউরোপ কাঁপানো নেপোলিয়ান কি বলেছেন জানো?
তিনি বলেছেন,“অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল।” ভারতে বৃটিশ শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তক জন মেকলে বলেছেন আরও মজার কথা,“বরং প্রচুর বই নিয়ে গরীব হয়ে চিলোকোঠায় থাকবো,তবু এমন রাজা হতে চাইনা যে বই পড়তে ভালোবাসে না।” আর সবচাইতে চরম কথাটি বলেছেন নর্মান মেলর, “আমি চাই বই পাঠরত অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়।” আর রাসূল (সা) বলেছেন সবচাইতে মূল্যবান কথাটি,“জ্ঞান হচ্ছে তোমাদের হারানো সম্পদ, সুতরাং যেখানে তা পাও কুড়িয়ে নাও।’’