জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • দাওয়াত ও তাবলিগ
    • ঈমান ও আক্বীদাহ
    • আমল-আখলাক ও মুয়ামালাত
    • ইসলাম ও ইবাদাত
    • পারিবারিক ও সামাজিক জীবন
    • ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • নারী
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • কর্মী সিলেবাস
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • দাওয়াত ও তাবলিগ
    • ঈমান ও আক্বীদাহ
    • আমল-আখলাক ও মুয়ামালাত
    • ইসলাম ও ইবাদাত
    • পারিবারিক ও সামাজিক জীবন
    • ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • নারী
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • কর্মী সিলেবাস
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি

আর্‌ রিবা

অন্তর্গতঃ ইসলাম ও ইবাদাত, রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
A A
Share on FacebookShare on Twitter

আর্‌ রিবা

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম


স্ক্যান কপি ডাউনলোড


আর্ রিবা

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম

বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা

প্রকাশক

ড. মোঃ ছামিউল হক ফারুকী পরিচালক, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার

প্রকাশকের কথা

আর্ রিবা বা সুদ সমাজ বিধ্বংসী এক অনন্য হাতিয়ার। পৃথিবীতে সমাজ শোষণের যত কলাকৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে তন্মধ্যে সুদ অন্যতম। সুদের ভয়াবহতা ও অনিষ্ট নিয়ে পূর্বেকার আসমানী কিতাবেও কথা আছে। তাই এটি মানব সমাজে বিদ্যমান একটি প্রাচীনতম ভ্রান্ত নীতি। কোনো আসমানী কিতাবেই এ নীতিকে সমর্থন করা হয়নি এবং এর বৈধতাও দেয়া হয়নি।

সর্বশেষ আসমানী কিতাব মহাগ্রন্থ আলকোরআনে একে সুদূর প্রসারী শাইতানী মন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর যারা জেনে শুনে এই নীতি বর্জন না করবে তাদেরকে মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার চ্যালেঞ্জ ছোড়া হয়েছে। সুদের ভয়াবহ পরিণতি ও এর কুফল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার অভাবে অনেকে নিজের অজান্তেই এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। আমাদের জানা মতে বাংলা ভাষায় সুদ সম্পর্কে তথ্য সমৃদ্ধ লেখা খুবই অপ্রতুল।

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম ২০১৩ সালে ‘আর্ রিবা’ শীর্ষক একটি পান্ডুলিপি বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারের গবেষণা বিভাগে জমা দেন। সেন্টারের পক্ষ থেকে পান্ডুলিপিটি রিভিউ করার জন্য কয়েকজন বিশিষ্ট গবেষকের কাছে পাঠানো হয়। তাঁরা হলেন- ড. মুহাম্মদ আব্দুল মাবুদ, ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম ভূঁইয়া, ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ, ড. মুহাম্মাদ মতিউল ইসলাম, ড. আ. ন. ম. রফিকুর রহমান, শাইখ আব্দুল হাকীম মাদানী, ড. মুহাম্মদ ছাইদুল হক ও মুহাম্মদ আতহার উদ্দীন। রিভিউ সমাপ্তির পর সম্মানীত গবেষক তার গবেষণাপত্রটিকে আরো সমৃদ্ধ করে পূণরায় জমা দেন।

গবেষণাপত্রটিতে স্বল্প পরিসরে সুদের সকল দিক আলোচনা করা হয়েছে। সুদের সঠিক পরিচয় ও এর ভয়াবহ অভিশাপ সম্পর্কে অবহিত হয়ে উহা থেকে পরিত্রাণের যথাযথ উপায় এখান থেকে জানা যাবে। এটি বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার থেকে প্রকাশিত পঁচিশতম গবেষণাপত্র সংকলন। বিশ্বব্যাপী যখন মানব সমাজে সুদের সয়লাব বয়ে যাচ্ছে তখন সুদ বিষয়ক এ গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করে পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারায় আমরা মহান রাব্বুল ‘আলামীনের অশেষ শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। এটি সম্মানীত পাঠক-পাঠিকাদেরকে সুদের করাল গ্রাস থেকে রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম ভূঁইয়া

লেখকের কথা

প্রথমে মহান আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের শুকরিয়া আদায় করছি। তিনি তাঁর অশেষ রাহমাতে আমাকে রিবা/সুদ সম্পর্কে অধ্যায়ন করা এবং তা সংক্ষিপ্তাকারে লিখার তাওফীক দান করেছেন। এক্ষণে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হচ্ছে। গ্রন্থটিতে রিবা বা সুদ হারাম হওয়ার কোরআন সুন্নাহসম্মত প্রকৃত কারণসমূহ এবং সুদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ধ্বংসাত্মক পরিণতির ব্যাখ্যা পেশ করা হয়েছে। এ পুস্তকটি ব্যাপক গভীর অধ্যয়ন ও দীর্ঘ গবেষণার ফল।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে সুদ সম্পর্কে মানুষকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। শুধু মুসলিম মনীষীগণই নন, অনেক অমুসলিম অর্থনীতিবিদও সুদের কুফল ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে কেবল সচেতনই নন, তাঁরা সুদভিত্তিক লেনদেন বাতিল করে এ বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন।

বর্তমান পৃথিবীতে সুদের লেনদেন অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। সুদের ভয়াবহ ধ্বংসকর পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মানবজাতিকে বহুপূর্বেই সতর্ক করে দিয়েছেন। কোরআন সুদকে হারাম ঘোষণা করেছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় রিবা সমৃদ্ধি আনে কিন্তু রিবার আসল পরিণতি হলো অভাব ও সংকোচন (মুসনাদে আহমদ হাদীস নং ৩৭৫৪)। অপর এক হাদীসে মহানাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যিনা ও সুদ যে কোনো জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। (মুসনাদে আহমদ)।

পুস্তকটিতে সুদের সংজ্ঞা, সুদ সম্পর্কে কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা, ঋণ ও সুদ, সুদের কুফল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি লেখার সময় বিশ্লেষণ পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উৎস থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। পাতায় পাতায় তথ্য সূত্র প্রদান করা হয়েছে। স্বনামধন্য লেখকদের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

পুস্তকটি প্রকাশের জন্য বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের ঐকান্তিক সহযোগিতার জন্য তাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। সবশেষে যাদের সমীপে এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাখানি নিবেদিত তাদের উপকারে এলে আমার শ্রম সার্থক হয়েছে মনে করে প্রশান্তি অনুভব করব।

আল্লাহপাক এ গ্রন্থখানিকে কবুল করুন এবং আমাদের সকলকে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ দান করুন। আমিন!

ঢাকা , জানুয়ারী-২০১৬

ড. মুহাম্মাদ নুরুল ইসলাম

দ্বিতীয় সংস্করণে লেখকের কথা

আলহামদুলিল্লাহ। এই সংস্করণে “আর রিবা” নতুন নতুন তথ্য সম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হলো। এর পরেও কোন আগ্রহী পাঠক যদি এর মানোন্নয়নে কোন সুপারিশ পেশ করেন তাহলে তা সাদরে গৃহীত হবে। আল্লাহ এ গ্রন্থকে কবুল করুন। আমীন।

ঢাকা , নভেম্বর-২০২২

ড. মুহাম্মাদ নুরুল ইসলাম

 

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ.

সূচীপত্র

  1. ১. ভূমিকা (Introduction)
  2. ২. রিবার পরিচয়/ রিবার ধারণা (Concept of Riba)
    1. ২.১ রিবা বা সুদের আভিধানিক অর্থ (Lexical Meaning of Riba)
    2. ২.২ সুদের সংজ্ঞা (Definition of Riba)
  3. ৩. রিবা বা সুদের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Riba – Interest)
  4. ৪. ঋণ বা করদ (Loan or Qard)
    1. ৪.১ ঋণের শর্তাবলি বা বৈশিষ্ট্য (Conditions or Characteristics of Loan)
  5. ৫. রিবার প্রকারভেদ (Classification of Riba)
    1. ৫.১ রিবা আল-নাসীয়া (Riba an-Nasiyah)
    2. ৫.২ রিবা আল ফাদল (Riba al Fadl )
    3. ৫.৩ রিবা আল ফদল নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ ( Causes of Prohibition of Riba Al Fadal )
    4. ৫.৪ রিবা আন্ নাসীয়া ( ربا النسيئة ) ও রিবা আল ফাদলের ( ربا الفضل ) মধ্যে পার্থক্য ( Differences between Riba an-Nasiyah and Riba al-Fadl )
  6. ৬. আল কোরআনে রিবা (Riba in AL Quran)
    1. ৬.১ সুদ সম্পর্কে নাযিল হওয়া প্রথম অহী (1st Revelation on Riba )
    2. ৬.২ সুদ সম্পর্কে নাযিল হওয়া দ্বিতীয় অহী ( 2nd Revelation on Riba )
    3. ৬.৩ সুদ সম্পর্কে নাযিল হওয়া তৃতীয় অহী ( 3rd Revelation on Riba )
    4. ৬.৪ সুদ সম্পর্কে নাযিল হওয়া চতুর্থ ও সর্বশেষ অহী ( Fourth and Final Revelation on Riba )
  7. ৭. সুদ সম্পর্কে আল-হাদীস (Riba in Al-Hadith)
  8. ৮. অন্যান্য ধর্মের দৃষ্টিতে সুদ (Interest in other Religions)
    1. ৮.১ ইহুদী ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ (Prohibition of Riba by Judaism)
    2. ৮.২ খ্রিস্টান ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ ( prohibition of Riba by Christianity )
    3. ৮.৩ হিন্দু ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ (Prohibition of Riba by Hinduism)
    4. ৮.৪ বৌদ্ধ ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ ( Disapproved of Riba by Buddism )
  9. ৯. দার্শনিকদের দৃষ্টিতে সুদ (Philosophers view about Interest)
  10. ১০. ইসলামে সকল প্রকার রিবা হারাম ( All kinds of Riba is prohibited in Islam )
  11. ১১. রিবা হারাম হওয়ার কারণ (Reasons of Prohibition of Riba)
  12. ১২. ইসলামে রিবার ব্যাপারে কঠোর নিন্দা জানানোর কারণ
  13. ১৩. সুদের কুফলসমূহ (Effects / Impacts of Riba)
    1. ১৩.১ সুদের নৈতিক কুফল (Moral Impact of Riba)
    2. ১৩.২ সুদের সামাজিক কুফল (Social Impact of Riba)
    3. ১৩.৩ সুদের অর্থনৈতিক কুফল (Economic Impact of Riba)
    4. ১৩.৪ সুদের রাজনৈতিক কুফল (Political Impact of Riba)
    5. ১৩.৫ সুদের আন্তর্জাতিক কুফল (International Impact of Riba)
  14. ১৪. সুদ ও মুনাফা (Interest and Profit)
    1. ১৪.১ মুনাফার অর্থ(Meaning of Profit)
    2. ১৪.২ মুনাফার সংজ্ঞা (Definition of Profit)
    3. ১৪.৩ মুনাফার গুরুত্ব (Importance of profit)
    4. ১৪.৪ মুনাফার বৈশিষ্ট্য (Features of profit)
    5. ১৪.৫ সুদ ও মুনাফার পার্থক্য (Distinction between Riba and Profit)
  15. ১৫. ব্যবসা ( بیع ) ও সুদ ( ربوا ) (Business & Interest/Riba)
    1. ১৫.১ ব্যবসা ও সুদের মধ্যে পার্থক্য (Difference between Business & Interest)
  16. ১৬. সুদ ও ভাড়া (Riba and Rent)
    1. ১৬.১ সুদ ও ভাড়ার পার্থক্য (Difference between Riba & Rent)
  17. ১৭. সুদের অভিশাপ থেকে পরিত্রাণের উপায়: কতিপয় সুপারিশমালা
  18. ১৮. উপসংহার

১. ভূমিকা (Introduction)

প্রতিটি মানুষই কোন না কোন উৎপাদনের উপকরণের মালিক। যেমন: শ্রমিক শ্রমশক্তির মালিক, পুঁজিপতি পুঁজির মালিক, ভূস্বামী ভূমির মালিক ইত্যাদি। মানুষ তার মালিকানাধীন উপকরণ বিক্রি করে যে অর্থ পায় তা-ই তার আয়। যেমন: শ্রমিক তার শ্রমশক্তি বিক্রি করে মজুরি পায়, ভূস্বামী ভূমি ভাড়া দিয়ে খাজনা পায়, ভাড়া পায়, পুঁজিপতি তার পুঁজি বিনিয়োগ করে, ব্যবসায়ে অর্থ উপার্জন করে অথবা তার পুঁজি ধার দিয়ে গতানুগতিক অর্থনীতিতে সুদ পায়, তেমনি উদ্যোক্তার (Entrepreneur) আয় হচ্ছে মুনাফা।

উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যেসব উপকরণের ব্যবহার হয় তার মধ্যে কতকগুলো স্থির এবং কতকগুলো পরিবর্তনশীল। সনাতন গতানুগতিক অর্থনীতিতে উপকরণ-গুলোকে মোট চার শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। যেমন: ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠন। মূলধন হচ্ছে উৎপাদনের মূল উপাদান। মূলধন ছাড়া অতিরিক্ত সম্পদ অর্জন করা কঠিন। শেষোক্ত উপাদানটিকে অধুনা উদ্যোগ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে। উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবা থেকে প্রত্যেকটি উপকরণ তাদের প্রাপ্য অংশ পেয়ে থাকে।

ইসলামী অর্থনীতিতে এরূপ শ্রেণীবিভাগ হুবহু গ্রহণ করা হয় না। এর পেছনে যে কারণটি কাজ করে তাহলো মূলধনের প্রাপ্য, যা সনাতন অর্থনীতিতে সুদ নামে পরিচিত। এ সুদ বা রিবা ইসলামে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, পুরোপুরি অবৈধ, হারাম ( حرام )। সুদ মানব সভ্যতার সবচেয়ে নিষ্ঠুর শত্রু। সুদের পাওনা পরিশোধে অপারগতার কারণে বাড়ী ঘর থেকে উচ্ছেদ, মালামাল ক্রোক, এমনকি স্ত্রী সন্তানকে তুলে নেয়ার অগনিত ঘটনা ইতিহাস হয়ে রয়েছে। সুদ শোষণ ও যুলমের (Injustice) উপর প্রতিষ্ঠিত একটি অন্যায় ও অমানবিক ব্যবস্থা। পুঁজিগঠন, বিনিয়োগ ও উৎপাদনের গতিকে শ্লথ করে দিয়ে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণের হাতিয়ার হয়ে সুদ সমাজের ভিতরে ও বাইরে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা আনয়ন করে। সুদ প্রথার উপরই পুঁজিবাদ দন্ডায়মান। এই জন্যই ইসলাম সুদ বা রিবা হারাম করে পুঁজিবাদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছে।

বলাবাহুল্য রিবা বন্ধ করা বিশ্বসভ্যতায় পবিত্র কোরআনের এক মহান অবদান। [মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, ইসলামী অর্থনীতির রূপরেখা, ন্যাশনাল পাবলিশার্স, ঢাকা, আগষ্ট ১৯৬৯, পৃ. ২০ ]

ইসলামের দৃষ্টিতে রিবা একটি জঘন্য অপরাধ, কোরআনে এই অপরাধে যারা অপরাধী তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে যুদ্ধে জন্য তৈরি থাকতে বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে সুদী কারবার ছেড়ে দিতে হবে, ছেড়ে না দিলে পরিনামস্বরূপ জাহান্নামে যেতে হবে। রিবামুক্ত অর্থনীতি শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের পূর্বশর্ত। পবিত্র আল-কোরআন ও আস্ সুন্নাহ্ মোতাবেক সুদ সন্দেহাতীতভাবে হারাম। ইসলামী শারী’আতে হারাম ঘোষিত কাজের মধ্যে সুদ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা সবচেয়ে বেশি কঠোর। রিবার ব্যাপারে ইসলামের এই অবস্থান একটি স্বতন্ত্র আর্থ-সামাজিক দর্শনের নির্দেশক।

২. রিবার পরিচয়/ রিবার ধারণা (Concept of Riba)

২.১ রিবা বা সুদের আভিধানিক অর্থ (Lexical Meaning of Riba)

সুদের আরবি পরিভাষা হচ্ছে রিবা )رب Riba)। আরবী রিবা শব্দকে উর্দু ও ফারসিতে সুদ বলে। হিব্রুতে রিবিত। বাংলা ভাষায় বর্তমানে সুদ শব্দটি রিবার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পবিত্র কোরআনেও রিবা শব্দের ব্যবহার হয়েছে। হাদীসেও রিবা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ইংরেজী প্রতিশব্দ Interest এবং Usury। Interest শব্দের উৎপত্তি মধ্যযুগীয় ল্যাটিন শব্দ Interesse থেকে। এর অর্থ ঋণ দিয়ে আসলের উপর বেশি নেওয়া। Usury ইউজারী ল্যাটিন শব্দ Usura থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। [ ড. আনোয়ার ইকবাল কোরেশী, ইসলাম এন্ড দি থিওরী অব ইন্টারেস্ট (লাহোর: আশরাফ পাবলিকেশন্স, ১৯৯১,পৃ.২ ] ।

Usura মানে হচ্ছে প্রদত্ত ঋণ থেকে অর্জিত উপভোগ (enjoyment); ক্যানন ল’তে এর মানে হচ্ছে অর্থ ধার দিয়ে তার বিনিময়ে আসল পাওনার ওপর অতিরিক্ত গ্রহণ করা। [ H. Harvey Cohn, Usury: ncyclopaedia Judaica, (Jerusalem: Keter Publishing House), P.17. অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, আল কোরআনের দৃষ্টিতে সুদ, থটস অন ইকনমিকস, খ. ১৯, নম্বর ২, এপ্রিল-জুন ২০০৯, পৃ.৫৯ ]।

অর্থাৎ ঋণ দিয়ে আসলের উপর বেশি নেয়া, উপরি পাওয়া, মূলধন থেকে বেড়ে যাওয়া। Encyclopedia of Religions and Ethics এ বলা হয়েছে Usury ও Interest শব্দ দুটি এক ও অভিন্ন অর্থে অতীতে ব্যবহার করা হতো। [ শহীদ হাসান সিদ্দিকী, Riba, Usury and Interest-Historical and Quranic concept, Journal of Islamic Banking and Finance, Oct.-Dec., 1993, P. 44.] ।

সুদকে ব্যবহারিক অর্থে বাংলায় কুসিদও বলা হয়। ইংরেজিতে যাকে ইন্টারেষ্ট (Interest) বা ইউজারী বলা হয় রিবার অর্থও ঠিক তাই। আল কোরআনে সুদকে বলা হয়েছে ‘রিবা’। কোরআনে উল্লেখিত রিবা শব্দটি প্রনিধানযোগ্য। রিবা শব্দের অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি, আধিক্য, অতিরিক্ত, স্ফীতি, বিকাশ, সম্প্রসারণ ইত্যাদি। আরবি রিবার সমার্থক হিসেবে ‘সুদ’ পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রচলিত ‘সুদ’ বা ইন্টারেস্ট এর তুলনায় আল কোরআনের রিবা ব্যাপক অর্থবোধক। প্রচলিত সুদ সেই ব্যাপক অর্থের একটি অংশ মাত্র। আল-কোরআন ও আস-সুন্নাহ’য় ব্যবহৃত রিবা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে প্রবৃদ্ধি (Growt), পরিবৃদ্ধি, পরিবর্ধন, পরিবর্ধক, সম্প্রসারণ (Expansion), স্ফীতি বা বাড়তি, আধিক্য, উদ্বৃত্ত (Surplus), বৃদ্ধি (Increase), বিকাশ, অতিরিক্ত (Excess) বা বেশি হওয়া (Additional), মূল থেকে বেড়ে যাওয়া (Expansion), উঁচু হওয়া, ফুলে উঠা, লাভ (gain), বহুগুণ হওয়া, ছাড়িয়ে যাওয়া, পাওনার চেয়ে বেশি নেয়া, বিকাশ ঘটা ইত্যাদি [ সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী, সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং, আব্বাস আলী খান ও আবদুল মান্নান তালিব অনুদিত (ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, ১৯৭৯), পৃ. ৮৪ ] ।

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯) লিখেছেন, কোরআন মজীদে সুদের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘রিবা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর মূলে আছে আরবী ভাষায় ( رب و )রা-বা-ওয়াও তিনটি হরফ। এর অর্থের মধ্যে বেশি, বৃদ্ধি, বিকাশ, চড়া প্রভৃতি ভাব নিহিত [ সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৪ ] ।

সুপরিচিত আরবী অভিধান লিসান আল আরব রিবার শাব্দিক অর্থ লিখেছে, ‘বৃদ্ধি, বাড়তি, অতিরিক্ত, সম্প্রসারণ বা প্রবৃদ্ধি [ ইবনে মনযুর, লিসান আল আরব, ১৯৬৮। তু. অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, আল-কোরআনের দৃষ্টিতে সুদ, ঘটস অন ইকনমিকস, খ. ১৫, নম্বর ৩, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০৫, পৃ.৬৭ ] ।

অ্যাডভান্স লারনার ডিকশনারী (Advance Learner Dictionary)-তে রিবার অর্থ লিখা হয়েছে, অতিরিক্ত (excess), অতিরিক্ত সংযোজন ও উদ্বৃত্ত (Addition and surplus)। আল্লামা ইমাম রাগিব আল ইস্পাহানী লিখেছেন, রিবা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে প্রবৃদ্ধি, বেশী, স্ফীত, ক্রমশ: বড় হওয়া, কয়েকগুণ বেশি হওয়া, আসলের বাড়তি ও বৃদ্ধি হওয়া, বিনিময় ছাড়া বৃদ্ধি ইত্যাদি [ আল্লামা রাগিব আল ইস্পাহানী, আল মুফরাদাত ফি গারীব আল-কোরআন (করাচী), তু. অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, পূর্বোক্ত পৃ.৬৯ ] ।

তাফসীরকার ও ফিকাহবিদগণ রিবার অর্থ করেছেন অতিরিক্ত, বৃদ্ধি (excess), বিনিময়হীন বৃদ্ধি (excess without counter value), একদিকে বৃদ্ধি অপরদিকে বৃদ্ধি ছাড়াই ইত্যাদি। বিশিষ্ট কতিপয় বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘প্রতিমূল্য (পড়হঃবৎ াধষব) নেই এমন প্রতিটি বৃদ্ধিই হচ্ছে রিবা [ আল সারাখসী, আল মাসবুত, খ.-১২, পৃ. ১০৯, তু. ই.এম. নূর পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬০-১৬৪ ] ।

ড. এম. উমর চাপরা লিখেছেন, ‘রিবার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি (Increase), অতিরিক্ত (Addition), সম্প্রসারণ (Expansion) বা প্রবৃদ্ধি (Growth) [ ড. এম. উমর চাপরা, Towards a Just Monetary System (UK: The Islamic Foundation, Leicester, 1995), P. 56. অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, পূর্বোক্ত পৃ.৬৯ ] ।

আল্লামা মুহাম্মাদ আসাদের (১৯০০-১৯৯২) মতে, ‘ভাষাগত দিক থেকে রিবা শব্দ দ্বারা কোন জিনিসের মূল আয়তন বা পরিমাপের ওপরে বেশি হওয়া (Addition) বা বৃদ্ধিকে (Increase) বুঝায় [ অধ্যাপক মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন, পূর্বোক্ত পৃ.৬৯। আল্লামা মুহাম্মদ আসাদের পূর্বতন নাম লিওপোল্ড উইস। তিনি ছিলেন অস্ট্রিয়ার ইহুদী বংশোদ্ভূত। ইসলামের সৌন্দর্য উপলব্ধি করে তিনি ১৯২৬ সালে ইসলাম গ্রহন করার পর মুহাম্মদ আসাদ নাম ধারন করেন। তিনি ইংরেজী ভাষায় The Message of the Quran নামে আল-কোরআনের তাফসীর রচনা করেন। এই তাফসীরে তিনি সংশ্লিষ্ট আয়াত সমূহের ব্যাখ্যায় রিবা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ] ।

ড.এম.এ. মান্নান লিখেছেন, রিবার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি পাওয়া বা প্রবৃদ্ধি। তবে আভিধানিক অর্থ আমাদের বিশ্লেষনের জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ ব্যবসা বানিজ্যে যে কোন প্রবৃদ্ধিই নিষিদ্ধ নয় [ ড.এম.এ. মান্নান, ইসলামী অর্থনীতি: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, ইসলামিক ইকনমিক্স রিসার্চ বুরো, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃ. ৯৭ ] ।

ড. ইমরান আশরাফ ওসামানি লিখেছেন, আরবি শব্দ রিবার অর্থ হলো আধিক্য বা বৃদ্ধি। উর্দু ও ফারসি ভাষায় একে সুদ বলা হয় [ ড. ইমরান আশরাফ ওসমানি, ব্যাংকিং ও আধুনিক ব্যবসা বানিজ্যের ইসলামী রূপরেখা, মাদানী কুতুবখানা, বাংলাবাজার, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ডিসেম্বর ২০১৪, পৃ. ২৩ ] ।

কিন্তু আল কোরআনে যে কোনো প্রবৃদ্ধিকে রিবা বলা হয়নি এর দ্বারা সুনির্দিষ্ট লেনদেনের ক্ষেত্রে বৃদ্ধিকে বুঝানো হয়েছে। রিবা শব্দটি আল (The) প্রত্যয়যোগে এমন এক লেনদেনকে বুঝানো হয়েছে যা কোরআন নাজিলের সময় আরব ও অন্যান্য জাতির কাছে সুপরিচিত ছিল। তাই আল কোরআনে রিবা শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে ‘আল’ প্রত্যয় ব্যবহার করে। এই লেনদেন করা হতো দু’ভাবে:

১. ঋণের অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এই শর্তে, বিদ্যমান অথবা বকেয়া পড়েছে এমন ঋণ পরিপক্কতার নতুন সময় নির্ধারণ বা ঋণ ফেরত বিলম্বিতকরণ,
২. কোন ঋণ নির্ধারিত সময়ের পর বৃদ্ধিসহ ফেরত প্রদান [ ড. মনজের কাহফ, ‘মাকাসিদে শারী’আহ আধুনিক ইসলামী অর্থায়নব্যবস্থায় প্রয়োগ’ (প্রবন্ধ) ইসলামী ব্যাংকিং, সেপ্টেম্বর ২০১৫, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রকাশিত, পৃ. ৯ ] ।

আল বিশেষণের মাধ্যমে আল্লাহ তৎকালীন আরব সমাজে ঋণ দাতা কর্তৃক ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণের প্রচলিত রীতিকে নির্দিষ্ট করেছেন। যেহেতু আল কোরআন তৎকালীন আরব সামাজে ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণেল প্রচলিত রীতিকে নির্দিষ্ট করেছেন। যেহেতু আল কোরআন তৎকালীন আরববাসীদের কাছেই সর্বপ্রথম নাযিল হয়, কাজেই তৎকালীন আরববাসীদের বুঝার সুবিধার্থে তাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দই আল্লাহ ব্যবহার করেছেন। [ ১৫. ড. এম এ মান্নাব, ইসলামী অর্থনীতি তত্ত্ব ও প্রয়োগ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৭ ] ।

অন্যকথায় ইসলামে সকল বৃদ্ধিকেই ‘রিবা’ বলা হয়নি। এক বিশেষ অর্থে ইসলামে ‘রিবা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামে ঐ বৃদ্ধিকে ‘রিবা’ বলা হয় যা প্রদত্ত ঋণের উপর ঋণের শর্ত হিসেবে অতিরিক্ত কিছু আকারে বা কোন সুবিধা ধার্য করে আদায় করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের/ঋণের বিনিময়ে পূর্ব নির্ধারিত হারে বা পূর্ব নির্ধারিত না থাকলেও প্রদত্ত ঋণের অধিক অর্থ বা সুবিধা আদায় করলে এবং সামগ্রীর ক্ষেত্রে সমজাতীয় পণ্যের কম পরিমাণের বিনিময়ে বেশি পরিমাণ নেয়া হলে অর্থ বা পণ্যের ঐ অতিরিক্ত অংশকে রিবা (Riba) বা সুদ (Interest) বলা হয়। সুদের ফলে ঋণের আসল
পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং সময়ের অনুপাতে আসল বৃদ্ধির পরিমাণ বা হার নির্ধারিত হয়। সুতরাং রিবা, সুদ, Interest, Usury এর অর্থ এক ও অভিন্ন।

আল্লাহ সুদকে হারাম করেছেন। সুদ মানবতার জন্য এক চরম অভিশাপ, অর্থনৈতিক শোষণের এক জঘন্য হাতিয়ার। রিবা আল কোরআনের দৃষ্টিতে একটি বড় জুলুম। আল কোরআনের লক্ষ্য হচ্ছে, মানব সমাজ থেকে এ জুলুমকে নির্মূল করে ক্রয়-বিক্রয়ে পূর্ণ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। জুলুম শুধু রিবার ক্ষেত্রেই নয়; বরং ব্যবসা-বানিজ্যসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রেই জুলুম নিষিদ্ধ। সুদি ব্যবস্থা অর্থনীতিকে ভারসাম্যহীন করে। মানুষে মানুষে সৃষ্টি করে বৈষম্য। এ জন্যই সকল মানুষের স্রষ্টা মহান আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন সুদকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছেন। সকল নাবী-রাসূলই সুদি ব্যবস্থার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন এবং এর বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছেন।

২.২ সুদের সংজ্ঞা (Definition of Riba)

ইসলামী পরিভাষায় সুদকে রিবা বলা হয়। মহাগ্রন্থ আল-কোরআন ‘রিবা’র কোন সংজ্ঞা দেয়নি। এটা শুধু এ কারণে যে, আল-কোরআন যাদের সম্বোধন করেছে তারা রিবা বা সুদের সাথে ছিল অতি পরিচিত। তারা সবাই জানত সুদ কি। তাদের কাছে সুদের ধারণা সুস্পষ্ট ছিল। রিবা পরিভাষাটি আরববাসীর কাছে মোটেই অপরিচিত ছিল না। তাদের পারস্পরিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সুদের প্রচলন ছিল এবং তারা হামেশাই এ শব্দ ব্যবহার করত। তদানীন্তন আরববাসীদের মধ্যে রিবা পরিভাষা নিয়ে বিন্দুমাত্র অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি ছিল না। শুধু আরববাসী নয়; পূর্ববর্তী সকল সমাজেই মানুষ তাদের আর্থিক লেনদেনে রিবা নিত এবং দিত। রিবার প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে কারও মধ্যেই কোন প্রকার অস্পষ্টতা বা বিভ্রান্তি ছিল না। [ আল-কোরআনে ‘রিবা’র সংজ্ঞা নেই, এটা এভাবেই মেনে নেয়া উচিত; এবং একে আল্লাহর অনুগ্রহ মনে করতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবেই বাঁধাধরা (Rigid) কোন সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। এ অবস্থায় মুসলমানদেরকে স্থান-কাল পরিস্থিতি অনুসারে জুলুম চিহ্নিত করায় তাদের নিজস্ব পথ নির্দেশ ও নীতিমালা উদ্ভাবনে উদ্বুদ্ধ করবে। অর্থনৈতিক অবস্থা কখনও স্থিতিশীল নয়, তেমনি হচ্ছে মানবিক পরিস্থিতিও।-মুফতি মুহাম্মাদ তাকী উসমানী, সুদ নিষিদ্ধ পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের ঐতিহাসিক রায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৩ ] ।

পারিভাষিক অর্থে আরবরা রিবা বলতো এমন বর্ধিত অংকের আদায়কে, যা ঋণদাতা ঋণ গ্রহীতার নিকট থেকে একটি ধার্যকৃত হারে মূল অর্থের (পুঁজির) অতিরিক্ত হিসাবে আদায় করতো।
এডওয়ার্ড লেইন এর মতে, পারিভাষিক অর্থে রিবা হচ্ছে সেই বাড়তি অংশ যা কোন ঋণ চুক্তির অধীনে মূলধনের উপর প্রদান করা হয়। [ এডওয়ার্ড ডব্লিউ লেইন, এন এরাবিক-ইংলিশ লেক্সিকন, খ. ৩, উইলিয়ামস এন্ড নরগেট, লন্ডন, ১৯৬৩, পৃ. ১০২৩ ] ।

প্রচলিত অর্থনীতিতে সুদকে বলা হয়েছে ‘পুঁজির মূল্য’। সুদ পুঁজির ব্যবহার মূল্য। সুদ হল সময় বা অপেক্ষার মূল্য। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অবদানের জন্য পুঁজিকে দেয় পারিতোষিক। রিবার পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে ঋণ দিয়ে আসলের উপর বেশি নেওয়া। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণ দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের পরে যদি ঐ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের উপরে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয় তবে আদায়কৃত ঐ অতিরিক্ত অর্থকে সুদ বলা হয়।

তাই পরিভাষায় রিবা হলো এমন অতিরিক্ত অর্থ বা পন্য যার বিপরীতে কোনো বিনিময় থাকে না। অন্যভাবে বলা যায় ‘রিবা’ হলো সুনির্দিষ্ট বৃদ্ধি যা কোনো এক পক্ষ অপর পক্ষকে বিনিময় বা কাউন্টার ব্যালু (Counter Value) না দিয়েই গ্রহণ করে। প্রচলিত অর্থে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণ দিয়ে চুক্তির শর্ত মোতাবেক আসলের উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অতিরিক্ত গ্রহণকে সুদ বলা হয়। এটিও রিবার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু রিবা শুধু ঋণের ক্ষেত্রে আসলের অতিরিক্ত গ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর পরিধি আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। কেননা এ ধারণার বাইরেও এমন কিছু কেনাবেচা ও লেনদেন রয়েছে যার সঙ্গে সুদের সম্পর্ক রয়েছে।

সুদের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ঋণ দেয়া মূল অর্থ যাই উৎপন্ন করুক না কেন তার বিচার না করে ঐ ঋণের উপর পূর্ব নির্ধারিত পরিশোধিতব্য অর্থই হলো সুদ। অন্যকথায় ঋণের উপর ঋণের শর্ত হিসেবে অতিরিক্ত কিছু লেনদেন করা হলে সে অতিরিক্তকে বলা হয় রিবা বা সুদ।

রিবার সংজ্ঞায় ‘আলী (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ঋণ কোনো মুনাফা টানে তাই রিবা (সুদ) [ জামে আল সগীর, খ.২, পৃ. ২৮৪, হাদীস নং- ৬৩৩৬; তু. ব্যবসায়-বাণিজ্য সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সম্পাদিত, এপ্রিল ২০০৫), পৃ.৭০ ] ।

আলী (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘লাভ (অতিরিক্ত) বহনকারী প্রত্যেক ঋণই রিবা (Any ‘Loan’ repaid with any benefit is Riba)’। হারিস ইবন আবি উসামাহ তাঁর মুসনাদে উক্ত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন [ জালাল উদ্দীন আল-সুযুতি, জামে আল সগীর, খ.২, পৃ. ৯৪ ] ।

উসামা ইবন যায়িদ (রা.) হতে বর্ণিত মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রতীক্ষাতেই রিবা রয়েছে ……. [ সহীহ বুখারী, কিতাবুল বুয়্যু; ইমাম আবুল হুসায়ন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল কুশায়শী আন নিশাপুরী (রহ.) সহীহ্ মুসলিম; ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং-৩৯৪৩ (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, এপ্রিল ২০০৩), পৃ.৫২৪ ] ।

সোনার বিনিময়ে সোনা, রূপার বিনিময়ে রূপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবণের বিনিময়ে লবণ আদান-প্রদান করলে তা সমান সমান ও হাতে হাতে হতে হবে। অর্থাৎ নগদ হতে হবে। বেশ-কম করলে, তা সুদি লেনদেন বলে গণ্য হবে। এতে দাতা-গ্রহীতা সমান অপরাধী হবে [ সহিহ মুসলিম, কিতাবুল বুয়্যু; মিশকাতুল মাসাবিহ, কিতাবুল বুয়্যু, জামে আত তিরমিযী, কিতাবুল বুয়্যু, হা/১২৪০ ] ।

আল্লামা ইবনুল আরাবীর মতে, ‘রিবার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি। কোরআন মাজীদে ঐ বৃদ্ধিকে রিবা বলা হয়েছে যার বিপরীতে কোন বিনিময় নেই [ আল্লামা ইবনুল আরাবী, আহকামুল কোরআন, খ.১, কায়রো, মিশর, ১৯৫৭, পৃ.২৪২; তু. ড. মুহাম্মদ ইমরান আশরাফ ওসমানী, ব্যাংকিং ও আধুনিক ব্যবসায়-বাণিজ্যের ইসলামী রূপরেখা, এম.এন. ছলিমুল ওয়াহেদ অনূদিত, পৃ.২৩] ।

প্রখ্যাত তাফসীরকারক ইমাম ফখরুদ্দীন আল রাযীর মতে, ‘জাহিলিয়াতের যুগে আরববাসী সকলেরই রিবা সম্বন্ধে জানা ছিল এবং তাদের মধ্যে এটি বহুল প্রচলিত ছিল। সে যুগেও তারা প্রথাসিদ্ধভাবে ঋণ দিত এবং শর্ত অনুসারে তার উপর মাসে মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায় করত কিন্তু আসলের পরিমাণ থাকত অপরিবর্তিত। যখন ঋণের মেয়াদ শেষ হত এবং ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হতো তখন সুদ বাড়িয়ে দেয়ার শর্তে পরিশোধের সময়ও বাড়িয়ে দেয়া হতো [ ফখরউদ্দীন আল রাযী, তাফসীর কবীর, খ.২, পৃ.৩৫১ ] ।

প্রাক নবুয়তী আরবে সুদখোরী ব্যবসা ছিল একটি সাধারণ পেশা। সুদখোর আরবরা দাবী করতো, সুদ এক ধরনের লেনদেন ছাড়া আর কিছু নয়। আল্লাহ তাদের এ কথা খন্ডন করে বলেছেন,

قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا، وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا .

তারা বলে: ‘ব্যবসাও তো রিবার মতোই।’ অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল, আর রিবাকে করেছেন হারাম ( সূরা ২ আল বাকারা: আয়াত ২৭৫ )।

আল্লামা আহমাদ ইবনে আলী আবু বাকর আল জাসসাস (মৃ. ৩৮০ হিজরী) এর মতে, একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য প্রদেয় ঋণের পূর্বশর্ত অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আসলের অতিরিক্ত যে অর্থ আদায় করা হয় তাই হচ্ছে সুদ [ আল্লামা আবু বকর আল জাসসাস, আহকামুল কোরআন, খ.১, (ইস্তাম্বুল: ১৩৩৫ হিজরী সাল), পৃ.৪৬৯ ] ।

(Riba is the loan given for a specified period on condition that on the expiry of the period, the borrower will repay it with some excess.)

“আল মু’জামু লুগাতিল ফুকাহা” গ্রন্থে সুদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘শারী’আহ্ সম্মত বিনিময় ব্যতিত চুক্তির শর্তানুযায়ী যে অতিরিক্ত মাল আদায় করা হয় তাকে সুদ বলে [ ব্যবসায়-বাণিজ্য সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সম্পাদিত, এপ্রিল ২০০৫), পৃ. ৭১ ] ।

মুহাম্মদ ইবনে জারির আত তাবারি (মৃত্যু ৩১০ হিজরি) এর মতে, জাহেলিয়াত আমলে প্রচলিত ও আল কোরআনে নিষিদ্ধ রিবা হলো কাউকে নিদিষ্ট মেয়াদের জন্যে ঋণ দিয়ে মূলধনের অতিরিক্ত নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ গ্রহণ করা। আরবরা তাই করতো এবং নির্দিষ্ট মেয়াদে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে সুদ বাড়িয়ে দেয়ার শর্তে পরিশোধের মেয়াদও বাড়িয়ে দেয়া হতো [ উদ্ধৃত অধ্যাপক শাহ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান, সুদ: এক ভয়াবহ অভিশাপ পরিত্রানের উপায়, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, ২০২২, পৃ. ৬ ] ।

হানাফী মাযহাবে রিবার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘রিবা হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়ে প্রতিমূল্যের (counter value) ওপর ধার্যকৃত অতিরিক্ত যার কোন প্রতিমূল্য নেই’। ‘Riba is the excess which lacks a counter value in sale [ আল সারাখসী, আল মাসবুত, খ.-১২, পৃ. ১০০, তু. যাকী আল দীন বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১ ] ।

হানাফী স্কুলের প্রখ্যাত ‘ফাকীহ’ ইমাম সারাখসী সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘শারী’আহতে রিবা হচ্ছে ক্রয় বিক্রয়ে দু’টি প্রতিমূল্যের কোন একটির ওপর ধার্যকৃত অতিরিক্ত যার কোন বিনিময় নেই’।
(Riba in shariah stipulated excess in one of the two counter values without counter value in transaction of exchange) [ আল সারাখসী, আল মাসবুত, খ.-১২, পৃ. ১০৯, তু. ই.এম.নূর পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৪ ] ।

আল্লামা ইমাম রাগীব আল ইস্পাহানীর মতে, ‘রিবার পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে একদিক দিয়ে বৃদ্ধি পাওয়া, অন্যদিক দিয়ে নয়। ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে ঋণের শর্ত হিসেবে বা ফেরতের মেয়াদ বৃদ্ধির বিনিময়ে মূল পরিমাণের অতিরিক্ত যাই গ্রহণ করে তাই রিবা [ আল্লামা রাগিব আল ইস্পাহানী, পূর্বোক্ত, পৃ.৬৯ ] ।

সানাউল্লাহ্ পানিপথির মতে, ‘প্রদত্ত ঋণের আসলের চেয়ে বেশি গ্রহণ করাই রিবা [ তু. অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, পূর্বোক্ত পৃ.৬৮ ] ।

মুফতি সাইয়িদ আমীমুল ইহসানের (১৯১১-১৯৭৪) মতে, ‘চুক্তিবদ্ধ দু’পক্ষের যে কোন এক পক্ষ কর্তৃক পারস্পরিক লেনদেনে শারী’আহ সম্মত বিনিময় ব্যতিত শর্ত মোতাবেক যে অতিরিক্ত আদায় করা হয় তাকে সুদ বলে [ সাইয়িদ আমীমুল ইহসান, কাওয়াইদুল ফিকহ, তু. মাওলানা মো. ফজলুর রহমান আশরাফী, সুদ ও ইসলামী ব্যাংকিং (ঢাকা: মাহিন পাবলিকেশন্স, অক্টোবর ১৯৯৮), পৃ.৪৯ ] ।

ফতোয়ায়ে আলমগীরী গ্রন্থে সুদের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “ইসলামী শারী’আহয় ঐ মালকে সুদ বলা হয় যা মালের পরিবর্তে মালের লেনদেনকালে অতিরিক্ত অংশ হিসেবে প্রদান করা হয়, যার কোন বিনিময় নেই [ মাওলানা মো. ফজলুর রহমান আশরাফী, পূর্বোক্ত, পৃ.৪৯ ] ।

প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ আবু ইসহাক আল যাজ্জাজের মতে, ‘কাউকে ঋণ দিয়ে আসলের অতিরিক্ত কিছু নেয়া হলে তাই সুদ [ তাজুল আরুস, তু. মাওলানা মো. ফজলুর রহমান আশরাফী, পূর্বোক্ত, পৃ.৪৮ ] ।

সাহীহ আল বুখারীর প্রখ্যাত ব্যাখ্যাতা হাফিয ইবনু হাজার আল ‘আসকালানীর মতে, ‘অর্থ বা পণ্যের বিনিময়ে নেয়া অতিরিক্ত অর্থ বা পণ্যই হচ্ছে রিবা [ অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, সুদ সমাজ অর্থনীতি (ঢাকা: ইসলামিক ইকনমিকস রিসার্চ বুরো, এপ্রিল ১৯৯২), পৃ. ২ ] ।

বিশ্বখ্যাত ইসলামী স্কলার, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ‘আল্লামা মুহাম্মাদ আসাদ (১৯০০-১৯৯২) এর মতে, ‘কোন ব্যক্তি কর্তৃক অন্য কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ঋণ হিসেবে প্রদত্ত অর্থ বা পণ্য-সামগ্রীর উপর সুদ (Interest) হিসেবে ধার্যকৃত অবৈধ অতিরিক্তই হচ্ছে রিবা [ মুহাম্মাদ আসাদ, দি মেসেজ অব দি কোরআন, তু. অধ্যাপক মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন, আল-কোরআনের দৃষ্টিতে সুদ, থটস অন ইকনমিকস, খ.১৯ নম্বর ২, এপ্রিল-জুন ২০০৯, পৃ. ৮৬ ] ।

এম.এ.খান বলেছেন, ‘রিবা হচ্ছে দেনার ওপর এমন অতিরিক্ত যাকে ঋণদাতার অধিকার হিসেবে বলা হয়েছে, কিন্তু এর বিনিময়ে ঋণদাতা দেনাদারকে কিছুই দেয় না [ এম.এ.খান, Glossary of Islamic Economics (London: Mansell Publishers, 1989), তু. অধ্যাপক মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন, আল-কোরআনের দৃষ্টিতে সুদ, থটস অন ইকনমিকস খ.১৯ নম্বর ২, এপ্রিল-জুন ২০০৯, পৃ. ৮৬ ] ।

শেখ এম. মুস্তাফা শিবলির মতে, ‘রিবা হচ্ছে ঋণের আসল পরিমাপের ওপর যে কোন অতিরিক্ত, এ অতিরিক্ত প্রথমে পরিশোধ করা হোক বা শেষে দেয়া হোক [ ড.এম.আলী, ব্যাংক কা সুদ, উর্দু অনুবাদ-আত্তিকুজ্জাফর, (ইসলামাবাদ: ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ, ১৯৯৬), পৃ. ৬৯-৭০ ] ।

ড. ‘আলী আল-সালোসি বলেছেন, ‘ঋণের ওপর শর্ত হিসেবে সময়ের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দেয় যে কোন অতিরিক্তই হচ্ছে রিবা [ ড.এম.আলী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৯-৭০ ] ।

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ.) (১৯০৩-১৯৭৯) এর মতে, ‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্ত সাপেক্ষে মূলধনের উপর যে নির্দিষ্ট পরিমাণ বাড়তি অর্থ গ্রহণ করা হয় তাকেই সুদ বলে [ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, ইসলামী অর্থনীতি (ঢাকা: সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রিসার্চ একাডেমী, অক্টোবর, ১৯৯৭), পৃ.১৭৮ ] ।

ড. এম. উমর চাপরার মতে, “শারী’আহতে রিবা বলতে ঐ অতিরিক্তকে (চৎবসরস) বুঝায় যা ঋণের শর্ত হিসেবে অথবা ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধির দরুন ঋণগ্রহীতা অবশ্যই মূল অর্থসহ ঋণদাতাকে পরিশোধ করতে বাধ্য।” (In the Shariah, Riba technically refers to the ‘premium’ that must be paid by the borrower to the lender alongwith the principal amount as a condition for the loan or for an extention in its maturity) [ ড. এম. উমর চাপরা, Towards A Just Monetary System, দি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, লেস্টার, ইউকে, ১৯৮৫, পৃ. ৫৬-৫৭ ] ।

অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইনের মতে, “ঋণের উপর ঋণের শর্ত হিসেবে অতিরিক্ত কিছু লেনদেন করা হলে সে অতিরিক্তকে বলা হয় রিবা বা সুদ।

তিনি আরো বলেন, ধারকৃত মূলধনের উপর সময়ের অনুপাতে প্রদত্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ অতিরিক্ত দেয়াই হচ্ছে ‘রিবা’ বা সুদ [ অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, সুদ সমাজ অর্থনীতি, ইসলামিক ইকনমিকস রিসার্চ ব্যুরো প্রকাশিত, এপ্রিল ১৯৯২, পৃ. ২ ] ।

ক্রয়-বিক্রয়ে দাম নির্ধারণের বিধান লংঘন করে কোন এক পক্ষের দেয় প্রতিমূল্যের উপর অতিরিক্ত ধার্য করা হলে এবং সেই অতিরিক্ত অংশের বিনিময় দেয়া না হলে তাই হয় রিবা। ঋণের শর্তানুযায়ী ঋণগ্রহীতা কর্তৃক ঋণদাতাকে মূলধনের সাথে প্রদেয় বাড়তি অর্থই হলো রিবা।

এমরান এন. হোসাইনের মতে, ‘অন্যদের ক্ষতির বিনিময়ে, অবৈধ এবং ভ্রান্ত উপায়ে মূলধনের বৃদ্ধি হচ্ছে সুদ [ এম.এন. হোসাইন, ইসলামে রিবা নিষেধ করার গুরুত্ব, মহিউদ্দিন আহমেদ অনূদিত, সিকাগো, ইলিনয়, ইউএসএ, ২৫ জুলাই, ২০০১, পৃ.২০ ] ।

মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানীর মতে, [ পাকিস্তানের খ্যাতিমান গবেষক ‘আলিম, পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের শারী’আহ্ অ্যাপিলেট বেঞ্চের সাবেক বিচারপতি, বিশিষ্ট স্কলার, ওআইসি’র কেন্দ্রীয় ফিকহ একাডেমীর স্থায়ী সদস্য ও ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শারী’আহ বোর্ডের চেয়ারম্যান বা সদস্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন- ইসলামিক ফাইন্যান্স, সেন্ট্রাল শরী’আহ্ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ এর নিয়মিত বুলেটিন প্রথম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০০৪, পৃ.১১ ] ।

ঋণের চুক্তিতে মূলধনের উপর অতিরিক্ত ধার্য করাকে রিবা বলে যা আল কোরআনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। (Any additional amount over the principal in a contract of loan is the riba prohibited by the Holy Quran) [ উদ্ধৃত এম. শামসুদ্দোহা, ইসলামী ব্যাংকিং এর দৃষ্টিকোণ থেকে রিবা, বাই, মুশারাকা, মুদারাবা, ইজারা, মুনাফা, ভাড়া ইত্যাদির ধারণা (প্রবন্ধ), পৃ. ৩ ] ।
সংজ্ঞাটি পবিত্র কোরআনের বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়।

ড. ইউসুফ আল-কারযাভী (জীবনকাল ৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৬-২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২)র মতে, ‘শুধুমাত্র সময়ের বিনিময়ে মূলধনের উপর শর্তানুযায়ী অতিরিক্ত যা কিছু আরোপ করা হয় তাই হচ্ছে সুদ [ উদ্ধৃত এম. শামসুদ্দোহা, পূর্বোক্ত, পৃ.৩ ] । যাকী আল দীন বাদাবীর মতে, ‘রিবা হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের অতিরিক্ত [ যাকী আল দীন বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৪ ] । রিবা হচ্ছে এক বিশেষ ধরণের বৃদ্ধি।

প্রখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার এম. আযীযুল হক (জীবনকাল, ২৬ অক্টোবর ১৯৫৩-১২ নভেম্বর-২০২০) লিখেছেন, ‘ঋণ দেওয়া মূল অর্থ যাই উৎপন্ন করুক না কেন তার বিচার না করে ঐ ঋণের উপর পূর্ব নির্ধারিত পরিশোধিতব্য অর্থই হলো সুদ [ এম. আযীযুল হক, পূর্বোক্ত, পৃ. ১ ] ।

প্রখ্যাত ইসলামী ব্যাংকার এ.কে.এম. ফজলুল হকের মতে, ‘ঋণের লেন-দেনে ঋণের আসলের উপর যদি ‘অতিরিক্ত কিছু’ ধার্য করা হয় তবে ঐ ‘অতিরিক্ত কিছু’কে সুদ (রিবা) বলে। সেই অতিরিক্ত কিছু অর্থও হতে পারে, দ্রব্যও হতে পারে, সেবাও হতে পারে। ঋণের উপর অতিরিক্ত যাই নেয়া হোক না কেন তাই সুদ [ এ.কে.এম. ফজলুল হক, ইসলামী ব্যাংকিং-এ বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের একুশ বছর পূর্তি সংখ্যা, দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ জুলাই ২০০৪, পৃ. ৩৪৩ ] ।

ড. মনজের কাহফ-এর মতে, ঋণ দেয়া বা বিদ্যমান ঋণ ফেরত দানের সময়সীমা বাড়াতে ঋণ গ্রহীতা ঋণদাতাকে যে বাড়তি পরিশোধ করেন তাই সুদ [ ড. মনজের কাহফ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯-১০ ] ।

মাওলানা মো. ফজলুর রহমান আশরাফী বলেন, পরিভাষাগত দিক দিয়ে রিবা হচ্ছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্ত সাপেক্ষে কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিপরীতে পূর্ব নির্ধারিত হারে যে অধিক পরিমাণে অর্থ আদায় করা হয় এবং একই শ্রেণীভুক্ত মালের পারস্পরিক লেন-দেন কালে চুক্তি মোতাবেক অতিরিক্ত যা গ্রহণ করা হয় তাকে সুদ বলা হয় [ মাওলানা মো. ফজলুর রহমান আশরাফী, ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংকিং- এর রূপরেখা (ঢাকা: আর.আই.এস. পাবলিকেশন্স, এপ্রিল, ২০০১), পৃ.১৪৫ ] ।

ড. মোহাম্মাদ হায়দার আলী মিয়ার মতে, ‘ঋণের উপর ঋণের শর্ত হিসেবে অতিরিক্ত কিছু লেন-দেন করাকেই রিবা বা সুদ বলে ( ড. মোহাম্মাদ হায়দার আলী মিয়া, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬ ) ।

নওয়াজেশ আলী জায়েদীর মতে, ‘যে কোন ধরনের ঋণের উপর ধার্যকৃত অতিরিক্তই রিবা’ (Interest charged on any kind of loan is Riba) [ নওয়াজেশ আলী জায়েদীর সংজ্ঞা, মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী, Federal Shariat Court Judgement on interest (Lahore: P.L.D. Publishers, 1992), Volume XLIV. P. 136.] ।

উপরের সংজ্ঞাসমূহে বর্ণিত সুদকে আল্লাহ হারাম করেছেন। আল্লাহ সব ধরনের সুদই হারাম করেছেন। ভোগ্য ঋণের সুদ, ব্যাংকিং সুদ বা বিনিয়োগের সুদ বা ব্যবসার জন্য গৃহীত ঋণের সুদ এসবই হারাম। রিবা আরোপের প্রকৃতি ও পদ্ধতি যাই হোক না কেন ইসলামে সকল ধরনের রিবা’ হারাম। জাহিলি সমাজে প্রচলিত রিবা যেমন হারাম এবং সময়ের ব্যবধানে নতুন নতুন পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত সকল ধরনের রিবা হারামের অন্তর্ভুক্ত। কোরআন বলছে: আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম ( সূরা ২ আল বাকারা: আয়াত ২৭৫ ) ।

বিনিময় হীনতাই সুদ বা রিবা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ। ঋনদাতা কোন শ্রম না দিয়ে এবং ঝুঁকি বহন না করেই নিশ্চিত সুদের সুবিধা পায়। তাই সুদ বর্জন করতে হবে। আর সুদ বর্জনের পর আয়ের বিকল্প হালাল উৎস দরকার। এ জন্যই আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে ব্যবসায়কে হালাল ঘোষণা করেছেন। ব্যবসায়লব্ধ মুনাফা তাই সম্পূর্ণ হালাল।

৩. রিবা বা সুদের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Riba – Interest)

রিবা বা সুদের সংজ্ঞার আলোকে সুদের শর্তাবলি বা বৈশিষ্ট্য সমূহ নিম্নরূপ:

১। ঋণ হতে হবে: সুদের উদ্ভব হয় ঋণের ক্ষেত্রে (Origin of Riba is loan); রিবাকে অবশ্যই ঋণের সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে (it must be related to loan)। ঋণ নগদ অর্থে হতে পারে অথবা পণ্যদ্রব্যের আকারেও হতে পারে। অন্যকথায় সেটা অর্থ ঋণ হোক অথবা পন্য ঋণ হোক সে ঋণের সাথে সুদ জড়িত।

২। মালে ফানি ( مال فاني = Fungible goods )-এর ঋণ হতে হবে: সুদ সবখানে হয় না। সুদ হতে হলে মালে ফানি বা ফানজিবল পণ্য (Fungible goods) [ মালে ফানি বা ফানজিবল গুডস (Fungible goods) বলতে এমন পণ্যকে বলা হয় যা নিঃশেষ না করে তা থেকে উপকারিতা (Benefit) লাভ করা সম্ভব নয়। যেমন: টাকা, খাদ্যসামগ্রী ইত্যাদি। এসব পণ্য ব্যবহার করে তা থেকে উপকার নেয়া হলে সংশ্লিষ্ট পণ্যটি নিঃশেষ বা রূপান্তর হয়ে যায়। এর অস্তিত্ব বহাল থাকে না । ফানজিবল পণ্যের বৈশিষ্ট্য ৩টি যেমনঃ (১) একবার ব্যবহার করলেই নিঃশেষ বা রূপান্তর হয়ে যাওয়া। (২) এসব পণ্যের সেবা প্রবাহ (Flow of Service) নেই। (৩) পণ্যের সেবা ও সার্ভিসকে পণ্য থেকে পৃথক করতে না পারা ]
এর ঋণ হতে হবে। মালে গায়রে ফানি ( مال غير فاني ) বা নন-ফানজিবল পণ্য Non-Fungible goods [ মালে গায়রে ফানি বা নন-ফানজিবল গুডস (Non-Fungible goods) কাউকে ব্যবহার করতে দিয়ে ফেরত নেয়া যায়, পণ্যটি নিঃশেষ বা রূপান্তর হয় না। অন্যকথায় যেসব সম্পদ বারবার ব্যবহার করা সত্ত্বেও বর্তমান থাকে এবং যার ব্যবহার থেকে উপকার পাওয়া যায় সেগুলো Non-Fungible goods। যেমনঃ বাড়ি, গাড়ি, ফ্লাট, মেশিনারিজ, কোদাল, করাত, দা ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে সেবার দাম নেয়া হলে সেটা সুদ নয়, সেটা ভাড়া, আরবি ‘উজরাত’। এখানে ক্রয়-বিক্রয় আছে। প্রাপ্ত সেবার মূল্য হচ্ছে প্রদত্ত ভাড়া। এ ক্ষেত্রে সেবার মূল্য এবং প্রদত্ত ভাড়ার মূল্য সমান হয় ] । হলে সুদ হবে না।

৩। ঋণের শর্তে অতিরিক্ত কিছু হতে হবে: অন্যকথায় ঋণের শর্ত হিসেবে আসলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া বা ঋণের শর্ত হিসেবে আসলের উপর অতিরিক্ত ধার্য করা। ঋণের শর্ত হিসেবে আসলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবেই। ঋণ পরিশোধের সময়ে পূর্ব নির্ধারিত হারে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়। এ ব্যাপারে আল কোরআন, আস সুন্নাহর নির্দেশ অতি স্পষ্ট যে, ঋণের শর্ত হিসেবে আসলের উপর পূর্ব নির্ধারিত যে কোন অতিরিক্ত, তা যত কমই হোক, তা হচ্ছে রিবা।

৪। পরিশোধের জন্য পূর্বেই একটি সময় সীমা নির্ধারিত হওয়া (a time is fixed for repayment): রিবা পরিশোধের জন্য পূর্বেই একটি সময়সীমা নির্ধারিত হবে। অন্যকথায় পরিশোধের একটি সময়সীমা
পূর্বেই নির্ধারিত থাকে। প্রদেয় অতিরিক্ত অর্থও গৃহীত ঋণ গ্রহণের সময়েই নির্ধারিত হয়।

৫। সময়ের অনুপাতে বৃদ্ধির পরিমাণ বা সীমা নির্ধারিত হওয়া (Riba is related with time): হাফিজ ইবনু হাজার আল ‘আসকালানী বলেন, সময়ের অনুপাতে আসল বৃদ্ধির পরিমাণ বা হার নির্ধারিত হয়। অন্য কথায় সময়ের অনুপাতে বৃদ্ধির পরিমাণ বা সীমা নির্ধারিত হওয়া। পরিশোধের জন্যে পূর্বেই একটা সময়সীমা নির্ধারিত হবে। সময়ের গতির সাথে বৃদ্ধি পাওয়া সুদের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। সুদ অর্জিত হয় ঋণ ও সময়ের ওপর ধার্যকৃত অর্থের মাধ্যমে।

৬। ঋণ ফেরত কালে অতিরিক্ত নেয়া: ঋণ ফেরত নিতে গিয়ে যদি অতিরিক্ত নেয়া হয় এ অতিরিক্ত যাই কিছু নেয়া হোক না কেন তা সুদে পরিণত হবে। এককথায় ঋণের উপর প্রদত্ত যে কোন অতিরিক্ত অংশকেই সুদ বলে।

৭। অতিরিক্তের জন্য বিনিময় না দেয়া: সুদ হচ্ছে বিনিময় না দিয়ে নেওয়া। রিবা হচ্ছে কেবল সেই অন্যায় ভক্ষণ যা ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রে একদিকের কাউন্টার ভ্যালুর ওপর ধার্য করে বিনিময় না দিয়ে নেওয়া হয়। অন্য কথায় আসলের অতিরিক্তের জন্য কোন বিনিময় বা Counter value না দেয়া। বাড়তি অংশের কোন বিনিময় না থাকা বা equality না থাকা। মোটকথা সুদে পারস্পরিক কোন বিনিময় নেই পারস্পরিক লেনদেন নেই (No reciprocity)।

৮। লেন-দেন হওয়া: ঋণের লেন-দেন হওয়া। লেন-দেন হওয়া সুদের শর্ত।

৯। ব্যবসায়ের ফলাফলের সাথে সম্পৃক্ত নয় (Riba is not related with the result of business): কারবার বা কারবারের ফলাফলের সাথে সুদের কোন সম্পর্ক নেই। সুদ বিনিময় বা কারবারের বা ব্যবসায়ের ফলাফলের সাথে সম্পৃক্ত নয়। অন্যকথায় বিনিময় বা কারবারের সাথে সম্পর্ক না থাকা সুদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ঋণগ্রহীতার কোন ক্ষয়-ক্ষতি, লাভ-লোকসান বা ঝুঁকি কোনভাবেই বিবেচনার বিষয় বলে গন্য হয় না।

১০। সুদ অবৈধ চুক্তির ফলঃ রিবা চুক্তির ফলে এক পক্ষের ওপর ধার্যকৃত অতিরিক্ত হয়ে পড়ে বিনিময়হীন বা মাগনা। আর এজন্যই তা হয় সুদ বা রিবা। বস্তুত সুদ ধার্য ও পাওনা হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি হচ্ছে রিবা চুক্তি। এই চুক্তির বলেই অনধিকারকে অধিকার বলে চালানো হয়। সুতরাং সুদ হচ্ছে অবৈধ চুক্তির ফল। সুদ প্রদানের পাপ তো সুদ প্রদানের চুক্তি সম্পাদনের সাথেই জড়িত।

১১। সুদ নির্ধারিত ও নিশ্চিত (Riba is fixed and certain): সুদী লেনদেনে এক ধরনের চুক্তি হয়; আর চুক্তিতে সুদ নির্ধারিত থাকে। এজন্যই বলা হয় সুদ পূর্বনির্ধারিত ও নিশ্চিত। বর্তমান যুগের প্রচলিত সুদের ভাসমান হার (Floating rate) সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। কারণ, এরূপ ক্ষেত্রে চুক্তিতে একথাই বলা হয় যে, এই ঋণে ভাসমান হার অনুসারে সুদ ধার্য করা হবে। এক্ষেত্রে ভাসমান হারই সুদের পূর্বনির্ধারিত হার, যা অবশ্যই ঋণাত্মক ও নিশ্চিত। সুতরাং সুদ পূর্ব নির্ধারিত ও নিশ্চিত। সুদ পূর্বনির্ধারিত হওয়ায় ঋণদাতার আয়ে অনিশ্চয়তা থাকে না।

১২। সুদে বাণিজ্যিক ঝুঁকি নেই (No business risk): সুদ হচ্ছে কাউন্টার ভ্যালুর ওপর আরোপিত বৃদ্ধি যা সর্বদাই ধণাত্মক (Positive)। সুতরাং সুদে বাণিজ্যিক ঝুঁকি নেই। সুদখোর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠাণ কোনো ঝুঁকি বহন করে না।

১৩। মুদ্রাস্ফীতি (inflation): সুদের কারণে মুদ্রাস্ফীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়। সুদের কোন বিনিময় নেই। বিনিময় ছাড়া বা বিনামূল্যে অন্যের মাল নেয়া যুগ্ম ( ظلم )। রিবার অন্যতম মৌল উপাদান হলো অবিচার, শোষণ বা যুগ্ম। কোরআন এটাকে যুগ্ম বলেছে। আল-কোরআনের ভাষায়:

لا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ

তোমরা যুগ্ম করবে না; তোমাদের প্রতিও যুগ্ম করা হবে না ( আল-কোরআন, সূরা ২: আল বাকারা: আয়াত ২৭৯ ) ।

সুদ সমস্ত অর্থনৈতিক সমস্যার জন্মদাতা মা স্বরূপ। এজন্য ইসলামী অর্থনীতিতে সুদ বা রিবাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সুদের হারাম হওয়ার বিধান জানার পরও যারা সুদ পরিহার করে না তাদের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহ যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। সুদ মারাত্মক পাপ। এজন্যই সুদ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল কোরআনে আর কোন গুনাহের ব্যাপারেই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তরফ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া হয়নি। আল্লাহর রাসূলের অনেক হাদীসে রিবার নিন্দা জানানো হয়েছে এবং সুদের লেনদেনকে কঠিনতম গুনাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে যা আল্লাহর অভিশাপ ও ক্রোধ উদ্রেক করে। সুদ আল্লাহতা’আলা স্বয়ং হারাম করে দিয়েছেন এবং ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ আইন কাঠামো তিনিই নাযিল করেছেন। সুদের সাথে অর্থনৈতিক কারবারের কোন সম্পর্ক নেই।

ঋণ সংক্রান্ত যে কোন লেন-দেনের ক্ষেত্রে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া গেলে তা নিঃসন্দেহে সুদী লেন-দেনে পরিণত হবে। এ ক্ষেত্রে ঋণের উদ্দেশ্য এবং ঋণ-গ্রহীতা ধনী বা দরিদ্র যাই হোক, তাতে সুদের আসল চরিত্রে কোন পার্থক্য হবে না [ অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, সুদ সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী, দৈনিক ইত্তেফাক, ২৮ জুন ২০০২, পৃ.১৮ ] ।

ব্যাংকিং সুদ, ভোগ্য ঋনের সুদ, বিনিয়োগ সুদ, সরল সুদসহ সকল প্রকার সুদই হারাম। ইসলাম উচ্চহার-নিম্নহার, উৎপাদনশীল-অনুৎপাদনশীল, ব্যাংক সুদ ও মহাজনী সুদ নির্বিশেষে সকল প্রকার সুদকেই হারাম করেছে [ ৫৯. অধ্যাপক মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন, পূর্বোক্ত, পৃ.১৮ ] ।

শতকরা হার বা Percentage কোনো সুদ নয় বরং এটি অংকের একটি পদ্ধতি মাত্র, হিসাবের একটি পদ্ধতিমাত্র। সুদের হিসাব শতকরা হারে করা হয় বলে অনেকে শতকরা হার শুনলেই তাকে সুদ মনে করেন, এটি ঠিক নয়। দেখতে হবে এর প্রয়োগ কোথায় কিভাবে হচ্ছে। এর ব্যবহার মুনাফার ক্ষেত্রে হতে পারে আবার সুদের ক্ষেত্রেও হতে পারে। যেমন- শিক্ষামন্ত্রণালয় বলে থাকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেছে ৮৫%। এখানে ফলাফল শতকরা হারে প্রকাশ করা দোষের কিছু নয়। তেমনি লাভকে শতকরা হারে প্রকাশ করা সুদ নয়। পণ্য বেচাকেনার সময় শতকরা হারে লাভ নির্ধারণ করা সুদ নয়। একজন ব্যবসায়ী বছর শেষে হিসাব করতে গিয়ে ব্যবসায় কি পরিমাণ লাভ করেছেন, তার শতকরা হার হিসাব করতে পারেন। কত টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয়েছে, এতে লাভ বা লোকসান হয়েছে, এটা হিসাব করাতে শারী’আতের কোন নিষেধ নেই। একইভাবে মালামাল ক্রয়ে কতটাকা খরচ হয়েছে, শতকরা কত লাভ করলে তার পোষাবে, সে চিন্তা করে তিনি পণ্যের লাভ নির্ণয় করতে পারেন-এতে শারী’আহ বিরোধী কিছু নেই।

৪. ঋণ বা করদ (Loan or Qard)

[ কারদ কোরআনের একটি পরিভাষা। কোরআনের সূরা ২: আল বাকারার ২৪৫, সূরা ৫: আল মায়িদার ১২, সূরা ৫৭; আল হাদীদের ১১, ১৭ ও ১৮ এবং সূরা ৭৩: আল মুযযামমিলের ২০ নং আয়াতে করদ শব্দটি উল্লিখিত হয়েছে ] । ( قرض )

সুদের উৎস হচ্ছে ঋণ যার আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে করদ, কর্জ অর্থাৎ ধার বা হাওলাত। ঋণ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Loan। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে ‘ঋণ ছাড়া আর কোথাও সুদ নেই [ সাহীহ্ বুখারী; সাহীহ মুসলিম, মুযারা’আ, বাব ১৮, হাদীস নং ৪০৮৯, পৃ. ১০২ ] ।

ঋণ হলো একটি আন্ত:ব্যক্তিক সম্পর্ক, যা এক ব্যক্তির জন্য দায় এবং অন্যজনের জন্য বিমূর্ত সম্পদ। প্রকৃতিগত ও বাস্তব ক্ষেত্রেও কোনো ঋণ বাড়তে বা কমতে পারে না; এর বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষমতা নেই। কারণ, সম্পদের উপাদান হওয়া ছাড়া এর কোনো সহজাত উপযোগিতা নেই [ ড. মনজের কাহফ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০ ] ।

করদ-এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ঋণ Loan বা Credit। কিন্তু সকল ধরনের পণ্যের বেলায় করদ হয় না। করদ হয় কেবল মালে ফানি বা Fungible goods-এর বেলায়। সাধারণ অর্থে ঋণ বা করদ হচ্ছে কোন ফানজিবল পণ্য সমপরিমাণ ফেরতের শর্তে কাউকে ব্যবহার করতে দেয়া। কোন ফানজিবল পণ্য কোন নির্ধারিত বা অনির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুরূপ পণ্য সমপরিমাণে ফেরত দেয়ার শর্তে কোন বিনিময় বা প্রতিদান ছাড়া কাউকে ব্যবহার করতে দেয়াই হচ্ছে ঋণ বা করদ।

ইসলামী পরিভাষায় কোন ব্যক্তি কর্তৃক তার কোন অর্থ, পণ্য বা বস্তু অন্য কোনো ব্যক্তিকে ফেরতের শর্তে প্রদান করাকে ঋণ বা কারদ বলা হয়। মুসলিম ফাকীহগণ ঋণকে ‘বিশেষ চুক্তি’ হিসেবে গণ্য করেছেন এ চুক্তিপত্রে ঋণদাতাকে প্রদত্ত অর্থ, পণ্য বা বস্তুর অনুরূপ সম্পদ ফেরত প্রদানে ঋণগ্রহীতা সংকল্পবদ্ধ হয়। ঋণ এমন এক ধরনের লেনদেন যেখানে শর্ত থাকে যে, ঋণদাতা যে পরিমাণ অর্থ, পণ্য বা বস্তু ঋণ দেবে, ঋণ গ্রহীতা সে পরিমাণ অর্থ, পণ্য বা বস্তু ঋণদাতাকে এক সময় ফেরত দেবে। অন্যকথায় কর্জ যাকে দেওয়া হয় সে তা তার কাজে-কারবারে খাটাতে পারে এবং খরচ করতে পারে, কিন্তু যখন কর্জদাতা ফেরত চায় তখন তার অর্থের অনুরূপ অর্থ তাকে ফেরত দিতে বাধ্য থাকে। ইসলামে কল্যাণকর ঋণকে ‘কারদে হাসানা’ বলা হয়েছে এবং করদ প্রদানের জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। ইসলামী নীতিমালায় ঋণ তখনই নিষিদ্ধ যখন ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে ঋণের শর্ত হিসেবে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করেন। কেননা শর্ত মুতাবিক অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করাই সুদ। ঋণের বিপরীতে গৃহীত অতিরিক্ত টুকু অর্থ বা পণ্যও হতে পারে আবার সেবাও হতে পারে। প্রচলিত ব্যাংক, বিনিয়োগ কোম্পানী, মাইক্রো ক্রেডিট ইনস্টিটিউশন ও গতানুগতিক এনজিওর ঋণের সঙ্গে সুদ যুক্ত হওয়ায় তা হারাম লেনদেনে পরিণত হয়েছে। আধুনিক কালে সুদী ঋণ ব্যবস্থা যেমন ব্যাপক, এর কুফল জুলুম ও বেইনসাফীও তেমনি বিস্তৃত। এই ঋণের কুফল ছড়িয়ে পড়ছে গোটা অর্থনীতিতে, বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে।

৪.১ ঋণের শর্তাবলি বা বৈশিষ্ট্য (Conditions or Characteristics of Loan)

ঋণের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে নিম্নবর্ণিত বৈশিষ্ট্যাবলী বেরিয়ে আসে।

১। বিনিময়ের পণ্য মালে ফানি বা ফানজিবল পণ্য (আঁহমরনষব মড়ড়ফং) হওয়া।
২। ঋণগ্রহীতাকে পণ্যটি ব্যবহার করতে দেয়া।
৩। অনুরূপ পণ্য সমপরিমাণে (Counter value) ফেরতের শর্ত থাকা।
৪। ঋণদাতা কর্তৃক প্রদত্ত ঋণের কোন প্রকার ঝুঁকি বহন না করা।
৫। ঋণদাতা কর্তৃক ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে প্রদত্ত ঋণের জন্য কোন প্রকার উপকার, বিনিময় বা প্রতিদান আশা না করা।
৬। সময় বা অবকাশ থাকা।

উপরোক্ত শর্তাবলী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিম্নরূপ:

১. মালে ফানি বা ফানজিবল পণ্য হওয়া: আরবী مال فاني মালে ফানির ইংরেজী অর্থ হচ্ছে Fungible goods। মালে ফানি বা Fungible goods বলতে এমন পণ্যকে বুঝায় যা নিঃশেষ না করে তা থেকে উপকারিতা (benefit) লাভ করা সম্ভব নয়। যেমন- টাকা, দিরহাম, দিনার, খাদ্য-সামগ্রী ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে পণ্যটি নিঃশেষ (consume) করা ব্যতীত এগুলো থেকে কোন উপকার লাভ করা যায় না। মালে ফানি বা Fungible goods -এর বৈশিষ্ট্য ৩ টি:

১) একবার ব্যবহার করলেই তা নিঃশেষ বা রূপান্তর হয়ে যাওয়া; একবার ব্যবহার করলেই পরবর্তীতে তার কোন অস্তিত্ব থাকে না বা রূপান্তরিত হয়।
২) এসব পণ্যের সেবা প্রবাহ বা Flow of Service নেই এবং
৩) পণ্যের সেবা বা Service কে পণ্য থেকে পৃথক করা যায় না।

উদাহরণস্বরূপ- ১ কেজি চাল কাউকে দিয়ে একথা বলা যায় না যে, এই চাল দিয়ে ৩ দিন ধরে যতবার দরকার ভাত রেঁধে খাবেন; ৩ দিন পর এই চাল গুলো হুবহু ফেরত দেবেন। কারণ এক চালে ভাত একবারই পাওয়া যায়, বার বার পাওয়া যায় না। আর ব্যবহারের পর চালের অস্তিত্ব থাকে না। সুতরাং সেই চাল হুবহু ফেরত দেয়া সম্ভব নয়; বরং একবারই ব্যবহার করার সাথে সাথে চাল নিঃশেষ হয়ে যায় এবং গ্রহীতার উপর এর ঋণজনিত দায় বর্তায় এবং তা বোঝা হয়ে তার ঘাড়ে চেপে থাকে। পুনরায় চাল যোগাড় করে ফেরত না দেয়া পর্যন্ত এ দায়ের বোঝা থেকে মুক্ত হওয়া গ্রহীতার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং সেই মালে ফানি বা Fungible goods কাউকে ঋণ দিলে হুবহু সেই জিনিস ফেরতদানের শর্ত করা যায় না। সমপরিমাণে ফেরতের শর্ত করতে হয়। অর্থ, যেমন- টাকা, রূপি, রিংগিত, ইয়েন, দিনার, দিরহাম, পাউন্ড স্টালিং, রুবল, ইউরো, ডলার ইত্যাদির ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। কারণ, অর্থ একবার ব্যবহার করলে আর অর্থ থাকে না, এ থেকে একাধিকবার উপকার (Benefit) নেয়া সম্ভব নয়। আর হুবহু একই অর্থ ফেরত দেওয়াও সম্ভব নয়। যোগাড় করে সমপরিমাণ অর্থ ফেরত দিতে হয়; অন্যথায় দায়মুক্ত হওয়া যায় না। মালে ফানি বা খঋহমরনষব মড়ড়ফং -এর এ দায়ই হচ্ছে করদ বা ঋণ (Loan, Credit)। সুতরাং কোন লেন-দেনকে ঋণ হতে হলে লেন-দেনের পণ্যটি অবশ্যই ফানজিবল হতে হবে। মালে গাইরে ফানি বা Non-Fungible goods-এর ক্ষেত্রে ঋণ বা কর্জ হয় না।

২. ঋণগ্রহীতাকে পণ্য ব্যবহার করতে দেওয়া: ঋণগ্রহীতা তার প্রয়োজনের প্রেক্ষিতেই ঋণ গ্রহণ করে এবং গৃহীত পণ্য ব্যবহার করে তার প্রয়োজন পূরণ করে। সুতরাং ঋণ বাবদ কোন পণ্য দেওয়ার অর্থই হচ্ছে গ্রহীতাকে উক্ত পণ্য ব্যবহার করে তার প্রয়োজন পূরণ করার অধিকার দেওয়া। কেউ কেউ বলেছেন যে, পণ্যটির মালিকানাই গ্রহীতাকে দিতে হবে অর্থাৎ গ্রহীতাকে পণ্যের মালিক বানিয়ে দিতে হবে যাতে সে আসল মালিকের মতই নিজের ইচ্ছামাফিক পণ্যটি ব্যবহার করতে বা কাজে লাগাতে পারে। কেউ কেউ আবার মালিকানা প্রদানের ব্যাপারে দ্বিমত করেছেন। এ বিতর্কে না গিয়েও বিনা দ্বিধায় একথা বলা যায় যে, গ্রহীতাকে পণ্যটি ব্যবহার করার পূর্ণ অধিকার অবশ্যই দিতে হবে। অন্যথায় তা ঋণ বলে গণ্য হবে না; বরং আমানতে পরিণত হবে। কারণ ব্যবহারের অধিকার ছাড়া কোন পণ্য কারও কাছে রাখলে তা আমানত হয়; ঋণ হয় না।

৩. অনুরূপ পণ্য সমপরিমাণে পরিশোধের শর্ত থাকা: ঋণের ক্ষেত্রে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতাকে যে পণ্য দেয় গ্রহীতা সেটি একবার ব্যবহার করার পরই তা নিঃশেষ হয়ে যায়, এর অস্তিত্বই থাকে না। সুতরাং ঋণ ফেরতের যে শর্ত থাকে তার অর্থ হচ্ছে অনুরূপ পণ্য সমপরিমাণে ফেরত প্রদান। কেউ যদি ১ কেজি পোলাওর চাল ঋণ নেয়, তাহলে পরবর্তীতে ১ কেজি পোলাওর চাল যোগাড় করে ফেরত দেবে। এক্ষেত্রে কেবল জাত নয়, গুণ-মানের পার্থক্য হওয়াও বাঞ্চনীয় নয়; বরং পরিমাণ বা গণনার দিক থেকেও পার্থক্য করা বৈধ নয়। একথা ঠিক যে, ঋণ লেন-দেনের সময় এসব কথা একটি একটি করে বলা বা লেখা হয় না; বরং কেবল ফেরত দেওয়ার কথাটাই লেখা হয়। আসলে ফেরত শব্দের মধ্যেই একই জাতের সমমানের অনুরূপ পণ্য এবং সমপরিমাণ কথাগুলো রয়েছে অর্থাৎ ফেরত বললেই অনুরূপ পণ্য এবং সমপরিমাণ বুঝা যায়। উল্লেখ্য যে ঋণের বেলায় ভিন্নজাতের পণ্য বা সেবা ফেরতের শর্ত করলে তা আর ঋণ বলে গণ্য হয় না; তেমনি পণ্যের গুণ-মান ও পরিমাণে পার্থক্য করা হলেও তা ঋণের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে।

৪. ঋণদাতা কর্তৃক কোন ঝুঁকি বহন না করা: ঋণের অতি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে ঋণদাতা কর্তৃক প্রদত্ত ঋণের কোন ঝুঁকি বহন না করা। ঋণের চুক্তিতে উল্লেখ থাকুক বা না থাকুক তাতে এ শর্তের কোন ব্যত্যয় হয় না। কারণ ‘ফেরত’ কথার মধ্যেই একথা রয়েছে। ঋণ গ্রহণ করার পরই যদি গৃহীত পণ্য হারিয়ে যায়, চোর-ডাকাতে নিয়ে যায়, কোন দুর্যোগে বিনষ্ট বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় অথবা লোকসানের দরুন খোয়া যায়, কোন অবস্থাতেই ঋণদাতা এর কোন ঝুঁকি বহন বা দায়িত্ব নেয় না। অর্থাৎ ঋণগ্রহীতার নিয়ন্ত্রণভুক্ত বা নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত যে কোন কারণে হোক অথবা তার অবহেলা ও ত্রুটির কারণে হোক অথবা সকল ত্রুটিমুক্ত এবং সংরক্ষণের যাবতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যদি গৃহীত ঋণের পণ্য বা অর্থ বিনষ্ট, ধ্বংস বা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, এর সকল দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হয়; ঋণদাতা এর কোন দায়িত্ব নেয় না।

ঋণের বেলায় উল্লেখিত এ শর্তটি আমানতের চেয়েও কঠিন। কারণ আমানত গ্রহণকারীর নিয়ন্ত্রণে নেই এমন কোন কারণে যদি আমানতের বস্তু বিনষ্ট বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তাহলে আমানত গ্রহীতাকে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হয় না। কিন্তু ঋণের ক্ষেত্রে তা হয় না; বরং সকল অবস্থাতেই ঋণের সাকুল্য দায়-দায়িত্ব ঋণ গ্রহীতার উপর বর্তায় এবং তাকে এ ঋণ অবশ্যই পরিশোধ করতে হয়। ঋণ গ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার উত্তরাধিকারীগণ পরিশোধ করবে; তারা না পারলে ইসলামী সরকার বাইতুলমাল থেকে পরিশোধ করবে; তাও না হলে আখিরাতে আল্লাহ তা’আলা ঋণগ্রহীতার সৎকাজগুলো দিয়ে ঋণ পরিশোধ করবেন। এরপরই কেবল যোগ্য হলে সে জান্নাতে যেতে পারবে। অন্যথায় তাকে জাহান্নামের কঠিন আযাবে নিক্ষেপ করা হবে।

ঋণের এই কঠিন শর্তের কারণেই ঋণগ্রহীতার উপর ঋণের আসলের অতিরিক্ত আর কিছু চাপাতে নিষেধ করা হয়েছে। আর ঋণদাতা ঋণের কোন ঝুঁকি বা দায়িত্ব বহন করে না বলে এতে লাভ হলে, তাতে ভাগ বসানোর কোন অধিকার তাকে দেয়া হয়নি। ‘ধ্বংস, খোয়া বা লোকসান সব তোমার; কিন্তু লাভ হলে অংশ চাই’- এ নীতি ইনসাফ বা সুবিচারের পরিপন্থী এবং মানবতা বিরোধীও।

৫. কোন বিনিময় বা প্রতিদান আশা না করা: ঋণের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে প্রদত্ত ঋণ বা আসলের অতিরিক্ত কোন বিনিময় বা প্রতিদান দাবী, এমনকি আশাও করতে পারবে না। ঋনদাতা দেয় ঋনের অতিরিক্ত কোনো অর্থ আদায় করতে পারবে না কিংবা আদায় করার শর্তও করতে পারবে না। শর্তের মাধ্যমে দেয় ঋনের অতিরিক্ত কিছু আদায় করা ইসলামী শরীয়ায় তা সুদ বলে গন্য হবে। কোনো ধরনের লাভ বা সুবিধা নিলে তা হবে অবশ্যই সুদ।

ইসলামী শারী’আহ বিশেষজ্ঞ ‘আলিমগণ এ ব্যাপারে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করে গেছেন। ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.) (৬৯৯-৭৬৭) সম্পর্কে বর্ণিত আছে, “একবার তিনি তাঁর কাছ থেকে ঋণ গ্রহণকারী এক ব্যক্তির বাড়ির কাছ দিয়ে সফর থেকে ফিরছিলেন। দীর্ঘ সফরের কারণে তিনি খুবই ক্লান্ত ছিলেন। সে বাড়ির সুন্দর ছায়ায় তিনি বিশ্রাম নেয়ার ইচ্ছা করলেন। কিন্তু এ বাড়ির মালিক তাঁর কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে জানতে পেরে তিনি তার বিশ্রাম গ্রহণের ইচ্ছা পরিত্যাগ করে চলে গেলেন [ উদ্ধৃত, অধ্যাপক মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন, থটস অন ইকনমিকস্, ভলিউম ৩, নম্বর ৩-৪,
জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৩, পৃ. ৫৪ ] ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবা ফাদালাহ ইবন ‘উবাইদ (রা.) বলেছেন, “ঋণ থেকে গৃহীত যে কোন উপকারিতা (benefit) হচ্ছে সুদের বিভিন্ন রূপের মধ্যে একটি রূপ [ অধ্যাপক মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৪ ] ।

এক হাদীসে আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত আছে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন ঋণ দেয়, অতঃপর ঋণ গ্রহীতা তার সামনে খাবার ডিশ পেশ করে, তাহলে ঋণদাতার তা গ্রহণ করা উচিত নয়; আর ঋণ গ্রহীতা যদি তার বাহন পশুর উপর আরোহণ করার প্রস্তাব করে, তাহলেও ঋণদাতার উচিত তা গ্রহণ না করা, যদি না তারা পূর্ব থেকে পরস্পর অনুরূপ সুবিধা বা আনুকূল্য বিনিময়ে অভ্যস্ত হয় [ সুনান আল বাইহাকী, কিতাব আল বুয়্যু, তু. অধ্যাপক মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন, সুদ, মুনাফা, ভাড়া, থটস অন ইকনমিকস্, ভলিউম ১৩, নম্বর ৩-৪, জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৩, পৃ. ৫৪ ] ।

অপর একটি হাদীসে আনাস ইবন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন ব্যক্তি যদি কাউকে ঋণ দেয়, তাহলে কোন উপহার (gift) গ্রহণ করা তার উচিত নয় [ মিশকাত, কিতাব আল বুষ্যু, তু. অধ্যাপক মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৪ ]

৬. সময় বা অবকাশ থাকা: ঋণ গ্রহণ এবং পরিশোধের মধ্যে সময়ের ব্যবধান থাকা জরুরী। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন যে, এ সময় নির্ধারিত হওয়া আবশ্যক। কেউ কেউ আবার এ বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। এ বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় যে, নির্ধারিত হোক বা অনির্ধারিত হোক ঋণ পরিশোধের জন্য সময় থাকাতেই তা ঋণ হয়। অবকাশ ছাড়া ঋণ হয় না। ঋণ পরিশোধের জন্য যে সময় দেয়া হয় আরবিতে তাকে বলা হয় নাসায়া। আর এই অবকাশের বিনিময় দাবী করলে তাকেই বলা হয় ‘রিবা নাসীয়া’। ইংরেজীতে ধিরঃরহম বা অপেক্ষাকে ঋণ অর্থে ব্যবহার করা হয়। ঋণ দেয়ার পর তা ফেরত পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তাই ঋণ মানে waiting। সুতরাং সময় বা অবকাশ ঋণের অপরিহার্য শর্ত।

উল্লেখিত শর্তগুলোর কোন এক বা একাধিক শর্ত অনুপস্থিত থাকলে ঋণ এর যথার্থ অর্থে আর ঋণ থাকে না। এসবগুলো শর্ত অনুসারে লেন-দেন হলে তবেই তা হয় ঋণ। সুতরাং ঋণের সংজ্ঞায় এ শর্তগুলো সমন্বিত হওয়া উচিত। এসব শর্ত সমন্বয়ে ঋণের একটি পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা নিম্নরূপ হতে পারে:

কোন ফানজিবল পণ্য কোন প্রকার বিনিময় বা প্রতিদান ছাড়া কোন নির্ধারিত বা অনির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফেরত দান বা পরিশোধের শর্তে কাউকে ব্যবহার করতে দেয়ার নাম হচ্ছে কর্জ বা ঋণ ( অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, সুদ, ক্রয়-বিক্রয়, মুনাফা, ভাড়া, থটস অন ইকনমিকস্, ভলিউম ১৩, নম্বর ৩-৪, জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৩, পৃ. ৫২-৫৫ [ অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, সুদ, ক্রয়-বিক্রয়, মুনাফা, ভাড়া, থটস অন ইকনমিকস্, ভলিউম ১৩, নম্বর ৩-৪, জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৩, পৃ. ৫২-৫৫ ] ।

৫. রিবার প্রকারভেদ (Classification of Riba)

আল কোরআন ও আস সুন্নাহ’য় দু’প্রকার রিবা বা সুদের উল্লেখ রয়েছে। তা হচ্ছে:

১। রিবা আন-নাসীয়া ( ربا النسيئة ) = Riba an-Nasiyah
২। রিবা আল-ফাদল ( ربا الفضل ) = Riba al-Fadl

৫.১ রিবা আল-নাসীয়া (Riba an-Nasiyah)

ربا النسيئة

কোরআন মাজীদে উল্লেখিত রিবাই রিবা আন নাসীয়া। এটিকে রিবা আল কোরআনও ( ربا القرآن ) বলা হয়। নাসীয়া শব্দের মূল হচ্ছে ‘নাসায়া’ যার আভিধানিক বা ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে স্থগিত (postpone), বিলম্ব-বিলম্বিত (Delay) বা প্রতীক্ষা (Procrastinate)। পারিভাষিক অর্থে ঋণের সে মেয়াদকালকে নাসায়া বলা হয় যা ঋণদাতা আসল ঋণের উপর নির্ধারিত পরিমাণ অতিরিক্ত প্রদানের শর্তে ঋণগ্রহীতাকে নির্ধারণ করে দেয়। সুতরাং রিবা আন নাসীয়া হচ্ছে ঋণের উপর সময়ের প্রেক্ষিতে ধার্যকৃত অতিরিক্ত অংশ। এই অতিরিক্ত অংশ সময়ের সাথে বৃদ্ধি পায়। ঋণ পরিশোধের জন্য প্রদত্ত সময় রিবা নয় বরং ঋণ পরিশোধের জন্য সময় থাকা প্রকৃতি সম্মত, স্বাভাবিক ও অপরিহার্য; তবে ঋণের আসলের ওপর ধার্যকৃত অতিরিক্ত হচ্ছে রিবা নাসীয়া। কেবল ঋণের ক্ষেত্রেই রিবা নাসীয়ার উদ্ভব ঘটে। সে ঋণ নগদ অর্থে হোক বা পণ্য আকারে হোক, তার উপর ধার্যকৃত রিবা হচ্ছে রিবা নাসীয়া। ইমাম ফখরুদ্দীন আল রাজি রিবা নাসীয়া সম্পর্কে বলেছেন, জাহিলিয়াতের যুগে রিবা আন নাসীয়া ছিল সুপরিচিত ও স্বীকৃত। সে সময় তারা অর্থ ঋণ দিত এবং মাসিক ভিত্তিতে একটা অতিরিক্ত পরিমাণ আদায় করত কিন্তু আসল ঠিক থাকত। অত:পর মেয়াদ শেষে ঋণদাতা-ঋণগ্রহীতার কাছে ঋণের আসল অর্থ ফেরত চাইত। ঋণ গ্রহীতা আসল অঙ্ক ফেরত দিতে না পারলে ঋণদাতা আসলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দিত এবং মেয়াদ বাড়িয়ে দিত [ উদ্ধৃত মুফতি মুহাম্মদ তাকী উসমানী, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫ ] ।

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আকরাম খানের মতে, কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির নিকট থেকে কোন জিনিস নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে ফেরত দেয়ার শর্তে গ্রহণ করার পর, মেয়াদ শেষে চুক্তি মোতাবেক উক্ত জিনিসের সাথে যে অতিরিক্ত পরিমাণ তাকে প্রদান করে সে অতিরিক্ত পরিমাণকে ‘রিবা আল নাসীয়া’ বলে [ অধ্যাপক মুহাম্মাদ আকরাম খান, মহানবীর (স.) অর্থনৈতিক শিক্ষা, মুহাম্মাদ মূসা অনূদিত (ঢাকা: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, মে ২০০৮), পৃ. ২২৮ ] ।

হানাফী ফাকীহগণ রিবা নাসীয়ার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, রিবা নাসীয়া হচ্ছে, মেয়াদ বা সময়গত বৃদ্ধি যা তাৎক্ষনিক বিনিময়ের চেয়ে বাকীতে বিনিময়ে প্রদত্ত বর্ধিত সময় বা মেয়াদ এবং দেনার পরিমাণের বৃদ্ধি, যখন ভিন্ন ভিন্ন জাতের ওজন বা পরিমাপযোগ্য পণ্য, অথবা কখনও জ্ঞান ও পরিমাপ করা হয় না এমন সমজাতের পণ্য বাকীতে ক্রয়-বিক্রয় করা হয় এবং দেনার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়। (Riba Nasiah is the excess in the period over immediate exchange and excess of the debt over the thing in measurable or weightable items when there is a lack of unity of species or in things that are neither measured non weighted when there is a unity of species.) [ ৭০. আল কাসানী, বাদাই’ আস্ সানাই’, খ. ৫, পৃ. ২৫৮ তু. বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১ ] ।

ধরা যাক, ‘আবদুর রহিম’ একজন ঋণদাতা এবং ‘আবদুল করিম’ একজন ঋণগ্রহীতা। ‘আবদুর রহিম’ যদি ‘আবদুল করিমকে ১০০ টাকা এক বছরের জন্য এ শর্তে ধার দেয় যে, এক বছর পর আবদুল করিম উক্ত ১০০ টাকার সাথে অতিরিক্ত আরও ২০ টাকা ফেরত দেবে, তাহলে এ অতিরিক্ত ২০ টাকাই হবে ‘রিবা নাসীয়া’। এভাবে ঋণদাতা যদি ঋণগ্রহীতাকে ১ কিলোগ্রাম লবণ এ শর্তে ধার দেয় যে, একমাস পর ঋণগ্রহীতা দেড় কিলোগ্রাম ফেরত দেবে তাহলে এ অতিরিক্ত আধা কিলোগ্রাম লবণ হবে ‘রিবা নাসীয়া’। অনুরূপভাবে একমন ধান ঋন দিয়ে একবছর পরে দুই মন ধান নেয়া হলে অতিরিক্ত একমন ধান হবে রিবা নাসিয়া। রিবা নাসীয়া, রিবা আল জাহিলিয়া ( ربا الجاهلية = Riba Al Zahilia), রিবা আল জলী ( ربا الجلى = Obvious riba), স্পষ্ট প্রকট, রিবা আল মুবাশশির ( ربا المبشر = Direct Riba), রিবা আল দুয়ূন (দ( الديون = Riba on loans), রিবা আল করদ ( ربا القرض = Riba Al Qard), রিবা আল কোরআন ( ربا القرآن = Riba Al Quran) ইত্যাদি নামেও অভিহিত হয়ে থাকে।

বর্তমান যুগে ঋণের বিনিময়ে সুদের আদান-প্রদান ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ‘আল্লামা ড. ইউসূফ আল-কারদাভীর মতে, ঋণের বিনিময়ে সুদ বা কোরআনে উল্লেখিত সুদই বর্তমান যুগের ইস্যু। আধুনিক অর্থনীতিতে রিবা নাসীয়ার প্রচন্ড দাপট। মানুষের সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ঘিরে বিষধর সাপের মত পেচিয়ে রয়েছে এই রিবা নাসীয়া। রিবা নাসীয়ার অক্টোপাসে আটকা পড়ে আছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানীর মতে, ‘ঋণ বা দেনার আসলের ওপর চুক্তি অনুসারে ধার্যকৃত যে কোন অতিরিক্ত হচ্ছে রিবা আন্ নাসীয়া। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে এই রিবাকেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে [ মুফতি মুহাম্মাদ তাকী উসমানী, সুদ নিষিদ্ধ পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের ঐতিহাসিক রায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৫ ] ।

তিনি আরো লিখেছেন, ভোগ বা উৎপাদন যে উদ্দেশ্যেই হোক, নির্বিশেষে সকল ঋণ বা দেনার চুক্তিতে আসলের ওপর ধার্যকৃত, কম হোক বেশি হোক, যে কোন অতিরিক্তই হচ্ছে আল কোরআনে ঘোষিত হারাম ‘রিবা [ মুফতি মুহাম্মাদ তাকী উসমানী, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৭ ] ।

৫.২ রিবা আল ফাদল (Riba al Fadl )

ربا الفضل

সমজাতীয় জিনিস বিনিময়ের সুদ। ফাদল অর্থ অতিরিক্ত, বাড়তি ইত্যাদি। একই জিনিস লেনদেনে কম- বেশি করা হলে এবং অতিরিক্ত অংশের কোনো বিনিময় বা মূল্য না দেয়া হলে সেই অতিরিক্ত অংশের নাম রিবা আল ফাদল। একই জাতীয় পন্য বা মুদ্রার লেনদেনের সময় একপক্ষ আরেক পক্ষের কাছে থেকে চুক্তি মোতাবেক শারীয়া’আহসম্মত বিনিময় ব্যতীত যে অতিরিক্ত পন্য বা অর্থ গ্রহণ করে তাকে রিবা আল ফাদল বলে। একে মালামালের সুদও বলা হয়।

রিবা আল ফাদলের ( ربا الفضل ) উদ্ভব হয় হাতে হাতে বিনিময়ের (Hand to hand transfer) থেকে। রিবা ফাদল হচ্ছে সাদৃশ্যপূর্ণ দু’টি জিনিসের হাতে হাতে তাৎক্ষণিক বিনিময়ে বাড়তি নেয়া, যেমন- স্বর্ণের বিনিময়ে বেশি স্বর্ণ, দিরহামের বিনিময়ে বেশি দিরহাম। এইভাবে একই জিনিসের বিনিময়ে একই জিনিস বেশি নেওয়া। যেহেতু একই জিনিস সে জিনিসের অতিরিক্ত জন্ম দিল, তাই এখানে সুদী লেনদেনের মনোবৃত্তি কাজ করেছে ( সাইয়েদ কুতুব শহীদ, তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন, বাংলা অনুবাদ, খ.২, [ ঢাকা: আল কোরআন একাডেমী লন্ডন, খ. ৪, ২০০১), পৃ. ৪৬৯-৪৭২ ] ।

ছয়টি বিশেষ পণ্য আদান প্রদানে কম-বেশি করা কিংবা কোনো একটি পণ্য পরিশোধে বিলম্ব করা থেকে রিবা আল ফাদল ছড়িয়ে পড়ে [ এম উমার চাপরা, দ্যা ন্যাচার অব রিবা ইন ইসলাম দ্যা জার্নাল অব ইসলামিক ইকোনমিকস এন্ড ফাইন্যান্স, খ. ২, নং ১, জানুয়ারী- জুন ২০০৬, পৃ. ৯-১১ ] ।

আবু সাঈদ আল খুদরী রা. বর্ণিত একটি হাদীসে নবী (সা) বলেন,

الذهب بالذهب و الفضة بالفضة والبر بالبر والشعير بالشعير و التمر بالتمر و الملح بالملح مثلا

“স্বর্ণ দিয়ে স্বর্ণ, রৌপ্য দিয়ে রৌপ্য, গম দিয়ে গম, যব দিয়ে যব, খেজুর দিয়ে খেজুর ও লবন দিয়ে লবন বিনিময়ের ক্ষেত্রে উভয় পণ্য সমান সমান ও নগদ হতে হবে। (এরূপ বিনিময়ের ক্ষেত্রে) যে বেশি প্রদান করে অথবা বেশি গ্রহণ করে- সে (এরূপ করার মাধ্যমে) সুদী কারবারে লিপ্ত হয়। দাতা ও গ্রহীতা উভয়েই সমান (অপরাধী) [ ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, অধ্যায় আল মুসাকাত, অনুচ্ছেদ: বাইউস সারফি ওয়া বাইউয় যাহাবি বিল ওয়ারাকি নাকুদান, হাদীস নং-১৫৮৪ ] ।

এ হাদীসে স্পষ্টভাবে ছয়টি পণ্য (স্বর্ণ, রৌপ্য, গম, যব, খেজুর ও লবন) উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, এগুলো বিনিময়ের ক্ষেত্রে উভয় পণ্য সমান সমান ও নগদ হতে হবে। এ নির্দেশ উপরোক্ত ছয়টি পণ্যের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি অপরাপর পণ্য সামগ্রীর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হবে- এ নিয়ে ইসলামী আইনবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। হানাফী মাযহাবের আইনবিদগণের মতে, এ নির্দেশটি উপরোক্ত ছয়টি পণ্যের বাইরেও এমন প্রত্যেকটি পণ্যের আন্তঃবিনিময়ে প্রযোজ্য হবে, যেগুলো ওজন ( وزن ) / Weight) কিংবা পরিমাপ ( كيل / Measure of capacity) করে বিক্রি করা হয় [ নেইল বি ই বেইলী, দ্যা মোহামেডান ল অব সেইল এক্কোরডিং টু দ্যা ফাতাওয়া আলমগীরী, লন্ডন: স্মীথ, এল্ডার এন্ড কোঃ, ১৮৫০, পৃ. ১৬৪ ] ।

পক্ষান্তরে শাফিঈ আইনবিদগণ মনে করেন, এ হাদীসের নির্দেশ এমন প্রত্যেকটি পণ্যের আন্তঃবিনিময়ে প্রযোজ্য হবে, যা বিনিময়ের মাধ্যম ( ثمن / Medium of exchange) ও খাদ্যদ্রব্যের ( طعام / Eatable things) অন্তর্ভুক্ত [ ড. ওয়াহবাহ আল-যুহাইলী, আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু, দামেশক: দারুল ফিকর, ১৯৮৫, খ. ৪, পৃ. ৪৯৫ ] ।

অন্যকথায়, পণ্য বিনিময় কালেও সুদ হতে পারে। একই জাতীয় পণ্যের নগদ হাতে হাতে উপস্থিত বিনিময়ে (Spot-Transaction) কমবেশি করা হলে বেশিটা রিবা ফাদল [ উদ্ধৃত মুহাম্মাদ রহমাতুল্লাহ খন্দকার, ইসলামী ব্যাংকিং ও বানিজ্যিক পরিভাষা, বিআই এল আর এল এ জি, ঢাকা, পৃ. ২৫৯ ] ।

বিশিষ্ট স্কলার আবদুর রহমান আল জাযিরি এর মতে, লেনদেনের মধ্যে সময়ের ব্যবধান না থাকা সত্ত্বেও একই জাতীয় পণ্য কম পরিমানের বিনিময়ে বেশি পরিমাণ নেয়া এবং যে বেশি পরিমাণের কোনো বিনিময় মূল্য নেই তা হলে সে বাড়তি পরিমাণই হলো রিবা আল ফাদল। অধ্যাপক মুহাম্মাদ আকরাম খানের মতে, সমজাতীয় পণ্যদ্রব্য ও মুদ্রার লেন-দেন কালে এক পক্ষ চুক্তি মোতাবেক অপর পক্ষকে শারী’আহসম্মত বিনিময় ব্যতিত যে অতিরিক্ত মাল প্রদান করে তাকে রিবা আল ফাদল বলে [ অধ্যাপক মুহাম্মাদ আকরাম খান, পূর্বোক্ত, পৃ. ২২৮ ] ।

হাফিয ইবনু হাজার আল ‘আসকালানী বলেছেন, ‘পণ্য বা অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত পণ্য বা অর্থই হচ্ছে রিবা। যেমন, এক দিনারের বিনিময়ে দুই দিনার [ অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, থটস অন ইকনমিকস্, ভলিউম ১৯, নম্বর ২, এপ্রিল-জুন ২০০৯, পৃ. ৯২ ] ।

এখানে বিনিময় বলতে তিনি হাতে হাতে বিনিময়কে বুঝিয়েছেন। এছাড়া এক জাতের মুদ্রা, অর্থাৎ দিনারের সাথে দিনারের বিনিময়ের কথা বলেছেন। সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (রহ.) (১৯০৩-১৯৭৯) লিখেছেন, ‘একই জাতিভুক্ত দুটি জিনিসের হাতে হাতে লেন-দেনের ক্ষেত্রে যে বৃদ্ধি হয় তাকে বলা হয় রিবা আল ফাদল [ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৬ ] ।

মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রিবা আল ফাদলকে হারাম ঘোষণা করেছেন।

উদাহরণস্বরূপ এক কিলোগ্রাম উন্নতমানের খেজুরের সাথে দুই কিলোগ্রাম নিম্নমানের খেজুর বিনিময় করা হলে, নিম্নমানের খেজুরের ঐ অতিরিক্ত এক কিলোগ্রামই হবে রিবা ফাদল।

حديث أبي سَعِيدٍ الْخُدْرِي رضي الله عنه، قَالَ : جَاءَ بِلَالٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِتَمْرٍ بَرْنِي، فَقَالَ لَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مِنْ أَيْنَ هَذَا قَالَ بِلَالٌ: كَانَ عِنْدَنَا ثَمَرَ رَدِيٌّ، فَبِعْتُ مِنْهُ صَاعَيْنِ بِصَاعٍ لِنُطْعِمَ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِنْدَ ذَلِكَ أَوَّهُ أَوَّهُ عَيْنُ الرِّبَا عَيْنُ الرِّبَا لَا تَفْعَلْ وَلَكِنْ إِذَا أَرَدْتَ أَنْ تَشْتَرِي، فَبِعِ التَّمْرَ بِبَيْعِ آخَرَ ثُمَّ اشْتَرِهِ

আবু সা’ঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা বিলাল (রা.) মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কিছু উন্নতমানের খেজুর নিয়ে এলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথা থেকে এ খেজুর আনলে। বিলাল (রা.) উত্তরে বললেন, আমাদের খেজুর নিম্নমানের ছিল, তাই আমি দুই সা’ পরিমাণ নিম্নমানের খেজুরের পরিবর্তে ভাল মানের এক সা’ খেজুর বদলিয়ে নিয়েছি। মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা শুনে বললেন; এতো হচ্ছে খাঁটি নির্জলা রিবা। একেবারে নির্জলা রিবা বা সুদ। কখনো এরূপ করো না বরং তুমি কিনতে চাইলে অন্য আরেক জনের কাছে বিক্রি কর, তারপর যে পয়সা পাও তা দিয়ে খরিদ কর [ সাহীহ বুখারী; সাহীহ মুসলিম, কিতাবুল বুয়্যু, বাব ১৮, হাদীস নং ৪০৮৩, পৃ. ৯৬ ] ।

আবু হুরাইরা (রা.) ও আবু সা’ঈদ খুদরী (রা.) হতে আর একটি বর্ণনায় এসেছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু আদী আল আনসারী গোত্রের এক ব্যক্তিকে রাজস্ব আদায়ের জন্য খাইবারে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দান করেছিলেন। তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ভাল মানের খেজুর নিয়ে এলেন। তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, খাইবারের সমস্ত খেজুর কি এ রকম? তিনি বললেন না, আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা এ মানের এক সা’ খেজুর সংগ্রহ করি সাধারণ মানের দুই সা’ খেজুরের বিনিময়ে এবং দুই সা’ সংগ্রহ করি তিন সা’এর বিনিময়ে। তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ রকম করো না। প্রথমে সবগুলো (তোমাদের নিকট যে মানের খেজুর রয়েছে তা) দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করবে, অতঃপর (প্রাপ্ত) দিরহাম দিয়ে উন্নতমানের খেজুর ক্রয় করবে [ সাহীহ বুখারী; সাহীহ মুসলিম, কিতাবুল বুষ্যু, বাব ১৮, হাদীস নং ৪০৮১, পৃ. ৯৪; মাওলানা নূর মোহাম্মাদ আজমী (রহ.), মেশকাত শরীফ, কিতাবুল বুয়্যু, হাদীস নং ২৬৮৯ (ঢাকা: এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ১৯৮৭), পৃ. ২৯ ] ।

এ ক্ষেত্রে সাধারণভাবে মনে হতে পারে দুই কেজি নিম্নমানের খেজুর দিয়ে এক কেজি উন্নতমানের খেজুর বিনিময়ে দোষের কিছু নেই। কারণ গুণগত মান ভাল হওয়ায় এরূপ বিনিময় হতেই পারে। কিন্তু লেনদেনটি সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হবে। কেননা গুণগত মান একটি অতি সূক্ষ্ম জিনিস। স্বাদ, গন্ধ, দেখার সৌন্দর্য ইত্যাদি অনেক বিষয় এর সাথে সম্পৃক্ত। সমজাতীয় পণ্য বিনিময় করে এর গুণগতমান পরিমাপ করা কঠিন। এছাড়াও পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে সকলের অভিজ্ঞতা থাকে না বিধায় ঠকার আশংকা থাকে। অধিকন্তু পণ্য বিনিময় করার সময় গুণ অনুমান করা যায় আর নিশ্চিত হওয়া যায় কেবল ভোগ ব্যবহারের পরেই। এ কারণেই মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পণ্য সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিকে ধোঁকা দেয়ার কারণে অতিরিক্ত গ্রহণ করা যা রিবা (সুদ)। সমজাতীয় পণ্য বিনিময় না করে তা প্রচলিত বাজার দরে নিম্নমানের পণ্যটি বিক্রি করে প্রাপ্ত মূল্য দিয়ে প্রচলিত বাজার মূল্যে উন্নতমানের সমজাতীয় পণ্য খরিদ করলে ঠকার আশংকা থাকে না। তাই পণ্যের বিনিময়কালে প্রচলিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত গ্রহণ বা প্রদান করার ফাঁক-ফোকর বন্ধ করার জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমজাতীয় পণ্য বিনিময়কালে কমবেশি করতে নিষেধ করেছেন। আল কোরআনের সর্বজনীন ব্যাখ্যাতা হিসেবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রিবা আল ফাদলকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনে এর সকল লেনদেন পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (১২৬২-১৩২৮) রিবা ফাদলকে রিবা আল খাফী ( رب الخفى ) বা সুপ্ত সুদ বা অস্পষ্ট ও প্রচ্ছন্ন সুদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সমজাতীয় পণ্য বিনিময়কালে কমবেশি করাকে সকল ইসলামী অর্থনীতিবিদ ‘রিবা ফাদল’ বলেছেন। প্রাসঙ্গিক হাদীসসমূহ বিশ্লেষণ করে ড. এম. উমর চাপরা রিবা ফাদলের চমৎকার সুন্দর এক সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছেন, “Anything that is unjustifiably received as an extra by one of the two counter parties in a transaction of trading is Riba al Fadl. [ Dr. M. Umer Chapra, Towards A Just Monetary System, (Uk: The Islamic Foundation 1985), P.59. ] ।

মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আন্দালুসি এর মতে, কোন লেনদেনে বা কারবারে রিবা আল ফাদল দ্বারা এমন প্রত্যেকটি অতিরিক্ত অংশকে বুঝানো হয় যার কোন বিনিময় (عوض / Counter Value) প্রদান করা হয়নি [ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আন্দালুসি, আহকামুল কুরআন, দারুল কুতুবুল ইলামিয়‍্যাহ, বৈহৃত, লেবানন, ২০০৩, পৃ. ৩২১ ] ।

হানাফী ফাকীহগণ রিবা ফাদলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, রিবা ফাদল হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়ে কোন এক দিকের সম্পদের ভিত্তিতে আইনত গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড তথা ওজন ও পরিমাপের ভিত্তিতে আরোপিত অতিরিক্ত। (Riba fadl is the excess stipulated in the sale in the corpus of wealth or the basis of a legal standard, which is measure on weight) [ আল কাসানী, বাদাওয়ী আল সানায়ী, খ. ৫, পৃ. ২৫৮। তু. বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১ ] ।

এছাড়া নাবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও কতিপয় লেনদেনকে রিবা আখ্যায়িত করেছেন যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১. অর্থের বিনিময়ে অর্থ লেনদেনে উভয় পক্ষের অর্থ যদি একই জাত ও শ্রেণীভুক্ত হয় এবং উভয় পক্ষ যদি সমান সমান পরিমাণের অর্থ লেনদেন না করে, তাহলে বিনিময় তাৎক্ষণিক হাতে হাতে (Hand to Hand (ইয়াদান বি ইয়াদিন) নগদে (spot transaction) হোক, সে লেনদেন হবে ‘রিবা ।

২. বার্টার বা পণ্যের সাথে পণ্য বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলো যদি ওজন বা পরিমাপ যোগ্য হয় এবং একই জাত ও শ্রেণীভুক্ত হয় এবং যদি উভয় পক্ষের পণ্যের পরিমাণ অসমান হয় অথবা কোন এক পক্ষ যদি তার পণ্য প্রদান ভবিষ্যতের জন্য স্থগিত বা বাকী রাখে তাহলে এরূপ লেনদেন ‘রিবা’ লেনদেনে পর্যবসিত হবে।

৩. বার্টার বা পণ্যের সাথে পণ্য বিনিময়ে পণ্য যদি ভিন্ন ভিন্ন জাত ও শ্রেণীভুক্ত হয় এবং সেগুলো যদি ওজন বা পরিমাপযোগ্য হয় আর কোন পক্ষ যদি তার পণ্য প্রদান স্থগিত বা বাকী রাখে তাহলে তা ‘রিবা’ লেনদেনের অন্তর্ভুক্ত হবে।

ইসলামী আইন শাস্ত্রে উল্লেখিত এই তিন ধরনের লেনদেনকে বলা হয়েছে ‘রিবা আল-সুন্নাহ্ ( ربا السنة ) কারণ এরূপ লেনদেন নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নাবীর হাদীস বা সুন্নাহ দ্বারা । [ মুফতি মুহাম্মাদ তাকী উসমানী, সুদ নিষিদ্ধ পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের ঐতিহাসিক রায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৭-১২৮ ] ।

শাফি’ঈ আইনবেত্তাদের মতে, “It is an exchange with an increase in one of the trade items over the other”, অর্থাৎ “ক্রয়-বিক্রয়ে দু’টি পণ্যের কোন একটির পরিমাণ অপরটির চেয়ে বেশি করে ক্রয়-বিক্রয় করাই হচ্ছে রিবা ফাদল”। [ ই.এম.নূর, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৬ ] ।

হাম্বলী মাযহাবের ফাকীহদের দৃষ্টিতে, “It is an exchange in one of the exchange items identical in kind of measurable and weightable goods.” অর্থাৎ “রিবা ফাদল একই জাতের পরিমাণ ও ওজনযোগ্য পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ে কোন একটি পণ্যের পরিমাণ বেশি করা”। [ মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ কুরতবি, তাফসীর আল কুরতুবী, খ.৩, পৃ. ৩৫৭, তু. বাদাবী, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৪ ] ।

রিবা আল ফাদল এ জড়িয়ে পড়ার আরো কিছু কারবার পদ্ধতি নিম্নরূপ:

গাবনুল মুস্তারসিল আনাড়ি বিক্রেতাকে ভুল তথ্য দিয়ে কম মূল্যে পণ্য কিনে নেয়া: কোন আনাড়ি বিক্রেতাকে ভুল তথ্য দিয়ে তার নিকট থেকে কম মূল্যে পণ্য কিনে নেয়ার মাধ্যমে ক্রেতা যেটুকু লাভবান হয়, তা রিবার অন্তর্ভুক্ত। কারণ, ভুল তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সে যেটুকু লাভবান হয়েছে- তা তার অবৈধ লাভ।

নবী স. বলেন, من استرسل الى مؤمن فغبنه كان غبنه ذلك رباء

“যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে লোক পাঠায়, তার প্রতারণাটি এক প্রকার সুদ। [ আলী মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়ালি ওয়াল আফ’আল, বৈরূত: মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৯৮৬, পৃ. ৪, পৃ. ৬২, হাদীস নং ৯৫২১ ] ।

নাজাশ-নিলামে কৃত্রিম উপায়ে দাম বাড়িয়ে দেয়া

নিলামে সাধারণত সর্বোচ্চ দাম হাঁকিয়ের (Highest bidder) নিকট পণ্য বিক্রি করা হয়। অনেক সময় নিলাম বিক্রেতা তার গোপন প্রতিনিধির (secret agents) মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে বেশি দাম হাঁকতে থাকে, যাতে নিলামে অংশগ্রহণকারী ক্রেতারা এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আরো বেশি দামে কিনতে রাজি হয়। এ প্রক্রিয়ায় বেশি দামে বিক্রি করার মাধ্যমে যে বাড়তি লাভটুকু করা হল-তা সুদ। নবী স. বলেন,

الناجش اكل ربا ملعون.

“যে ব্যক্তি নিলামে কৃত্রিমভাবে দাম হাঁকে, সে একজন অভিশপ্ত সুদখোর” [ আলী মুত্তাকী হিন্দী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৫, হাদীস নং ৯৫৮৮ ] ।

বর্তমান যুগে সীমিতভাবে রিবা ফাদলের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। যেমন: ছেঁড়া-ফাটা-পুরাতন টাকা ও নতুন টাকা বিনিময়কালে কমবেশি করা, লেন-দেনের ক্ষেত্রে অন্যকে প্রতারিত করে অন্যায়/অনৈতিক উপার্জন ইত্যাদি। রিবা আল ফাদল অন্যান্য নামেও আখ্যায়িত হয়ে থাকে। যেমন- রিবা আস-সুন্নাহ, ( ربا السنة = Riba al Sunnah), রিবা আল হাদীস ( رب الحديث = Riba in the Hadith), রিবা আল বু ( ربا البيوع = Riba in trade), রিবা গায়ের আল মুবাশশির ( المبشر غير ربا = Indirect Riba), রিবা আল খাফী ( ربا البيوع = Hidden Riba), রিবা আন নগদ ( ربا النعد ) নগদ সুদ, (spot riba) ইত্যাদি।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী (রহ) (১৭০৩-১৭৬৩ খ্রি.) বলেন, রিবা দুই প্রকার। যেমন:

(১) রিবা হাকিকী ( ربا الحقیقی ) বা প্রকৃত রিবা (Real Riba)

(২) রিবা আল ফাদল ( رب الفضل )। প্রকৃত বা হাকিকী রিবা কেবল ঋণের উপরই হয়। (Real riba is only on Loan) [ শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ দেহলবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ্, খ. ২, (লাহোর: কাওমী কুতুবখানা, ১৯৫৩), পৃ. ৪৭৪-৭৫ ] ।

৫.৩ রিবা আল ফদল নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ ( Causes of Prohibition of Riba Al Fadal )

আল কোরআন রিবা আল ফাদলের উপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করলেও কোরআনের বাস্তবায়নকারী ও ব্যাখ্যাতা হিসেবে মহানবী (স) এ ধরণের লেনদেন- কারবারের উপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এর উদ্দেশ্য হল, রিবার পরোক্ষ রাস্তাসমূহ (Back Doors) আগেভাগেই বন্ধ করে দেয়া। কারণ সমজাতীয় পণ্যের আদান প্রদানে বেশি নেয়ার সুযোগ রাখা হলে তা ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে বিনা কারন বিনা পরিশ্রমে ‘অতিরিক্ত’ (Excess) পাওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করে- যা পরিশেষে সুদী কারবারের ক্ষেত্রে প্রস্তত করে। এ বিষয়ে বিশ্বখ্যাত মুফাসসির ইমাদুদ্দিন ইসমাইল ইবনে উমর ইবনে কাসির দিমাস্কি (মৃত্যু ৭৭৪ হিজরি) একটি মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। তা হলো,

ما أمضى الى الحرام حرام كما ان مالا يتم الواجب الا به فهو واجب

যা কিছু অবৈধতার দিকে টেনে নিয়ে যায় তাও অবৈধ বাস্তবায়নের উপর কোন ফরযের বাস্তবায়ন নির্ভরশীল- তাও ফরয; যেমন সালাত সম্পাদন, অযুর উপর নির্ভরশীল হওয়ায় সালাত সম্পাদনের মত অযু করাও ফরয। [ ইবনে কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আযিম বা তাফসিরে ইবনে কাসির, খ.২, মুয়াসসাতু কুরতুবা, আল কাহেরা, ২০০০, পৃ. ৪৮৭ ] ।

৫.৪ রিবা আন্ নাসীয়া ( ربا النسيئة ) ও রিবা আল ফাদলের ( ربا الفضل ) মধ্যে পার্থক্য ( Differences between Riba an-Nasiyah and Riba al-Fadl )

 

রিবা আন্ নাসীয়া ও রিবা আল ফাদলের মধ্যে পার্থক্যসমূহ নিম্নরূপ:

পার্থক্যের বিষয়

রিবা আন্ নাসীয়া (Riba an-Nasiyah) ও রিবা আল ফাদল (Riba al-Fadl)

১। উৎস

কোরআন মাজীদে উল্লেখিত রিবাই হচ্ছে রিবা আন্ নাসীয়া।

রিবা আল ফাদল হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে।

২। উৎপত্তির ক্ষেত্র

কেবল ঋণের ক্ষেত্রেই রিবা আন্ নাসীয়ার উদ্ভব ঘটে (Arises out of debt)। সে ঋণ নগদ অর্থে হোক বা পণ্য আকারে হোক।

হাতে হাতে বিনিময়ের ক্ষেত্রে রিবা আল ফাদল উদ্‌গত হয় (Arises out of hand to hand transaction)।

৩। লেনদেনের ধরন

নগদ অর্থ ও পণ্যসামগ্রী (Cash and kinds)।

শুধু পণ্যসামগ্রী (Goods)।

৪। বেড়ে যাওয়ার ধরন ।

বেড়ে যাওয়া বা বৃদ্ধির ধরন সরল সুদ এবং চক্রবৃদ্ধি সুদ উভয় ধরনেরই হতে পারে।

চক্রবৃদ্ধির কোন সুযোগ নেই (No scope of compounding)।

৫। বিবেচনা

ঋণ সময়ের প্রেক্ষিতে যে অর্থ বা পণ্য জন্ম দেয় তাই হচ্ছে ‘রিবা আন্ নাসীয়া’।

একই জাতীয় পণ্যের কম পরিমাণের সাথে বেশি পরিমাণ হাতে হাতে বিনিময় করা হলে পণ্যের অতিরিক্ত পরিমাণকে বলা হয় রিবা আল ফাদল।

৬। নিষিদ্ধ হওয়া

কোরআন মাজীদ দ্বারা নিষিদ্ধ।

হাদীস সুন্নাহ দ্বারা নিষিদ্ধ।

৭। নিষিদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি

এ ধরনের সুদের বহুবিধ অপকারিতা, শোষণ, নিষ্ঠুরতা ও অনিষ্টকারিতার জন্য তা নিষিদ্ধ।

অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছে।

৮। সংজ্ঞা

নাসীয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে অবকাশ। ঋণ পরিশোধ করার জন্য যে সময় বা অবকাশ দেয়া হয় তাকে বলা হয় ‘নাসায়া’; আর এ অবকাশের জন্য যে বাড়তি ধার্য করা হয় তাই হচ্ছে রিবা আন্ নাসীয়া।

ফাদল শব্দের অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত। একই জাতীয় জিনিসের অসম বিনিময়ের মধ্যে আল ফাদল নিহিত। একই জাতীয় দ্রব্য বা মুদ্রার লেনদেনকালে এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষের কাছ থেকে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করাকে রিবা আল ফাদল বলে।

৯। স্পটে লেনদেন

স্পটে লেন-দেনের প্রয়োজন নেই (Not required)।

স্পটে লেন-দেন প্রয়োজনীয় (Required)।

১০। প্রভাব

আধুনিক অর্থনীতিতে রিবা আন্ নাসীয়ার প্রচণ্ড দাপট। মানুষের সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ঘিরে বিষধর সাপের মত পেঁচিয়ে রয়েছে। এই রিবা আন্ নাসীয়া। রিবা আন্ নাসীয়ার অকটোপাসে আটকা পড়ে। আছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ।

আধুনিক মনিটরি ইকোনমিতে রিবা আল ফাদলের তেমন প্রচলন নেই।

৬. আল কোরআনে রিবা (Riba in AL Quran)

ইসলামে রিবা নিষিদ্ধ। ইসলামী শরীয়াতের মূল উৎস আল-কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় রিবাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যকথায় রিবা বা সুদ নিষিদ্ধ করেছে আল কোরআন। কোরআন মাজীদে অকাট্যভাবে রিবাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিলকৃত সকল আসমানী কিতাবেই সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বলে জানা যায় [ মহান আল্লাহর নাযিলকৃত সকল কিতাবই (দীনই) হচ্ছে মূলত ইসলাম। অন্যকথায় ইসলামই হচ্ছে পৃথিবীর মানুষের জন্য আদি এবং একমাত্র জীবনবিধান; আর এ ইসলামেই সুদ নিষিদ্ধ। বিস্তারিত দেখুন অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, সুদ সমাজ অর্থনীতি, ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ বুরো, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ডিসেম্বর ২০১২, পৃ. ২৫ ] ।

ইসলাম যেসব গুনাহর ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে তার শীর্ষে রয়েছে সুদ। সুদ মানব সভ্যতার সবচেয়ে নিষ্ঠুর শত্রু। সুদের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। বস্তুত শব্দগত দিক থেকেই হোক কিংবা অর্থগত দিক থেকেই হোক, আল-কোরআন-আস্ সুন্নাহয় এমন কঠোর ভাষা আর কোন গুনাহর ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়নি। সুদের কারবার ছেড়ে না দিলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে [ আল-কোরআন, সূরা ২: আল বাকারা: আয়াত: ২৭৯ ] ।

আল-কোরআনে সুদ হারাম হওয়া প্রসঙ্গ (AL Quran on Prahibition of Riba)

কোরআন মাজীদ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আল্লাহ-পাক হঠাৎ করে সুদকে হারাম করেননি। পর্যায়ক্রমে ধারাবাহিকভাবে আল্লাহ সুদকে হারাম করেছেন। আল-কোরআনের চারটি সূরার মোট ১৫টি আয়াতকে রিবা সংক্রান্ত আয়াত বলা হয় [ ড.এম. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী, Riba, Bank interest and the Rationale of its prohibition, Islamic Research and Training Institute (IRTI), Islamic Development Bank, Jeddah, 2004, পৃ.৩৫; অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, সুদ সমাজ অর্থনীতি, ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ বুরো, দ্বিতীয় সংস্করণ, ডিসেম্বর ২০১২, পৃ. ২৫ ] ।

তবে সুদ সম্পর্কিত সরাসরি আয়াত হচ্ছে ছয়টি। সুদ সম্পর্কে আল কোরআনের ধারাবাহিক আলোকপাত নিম্নরূপ:

সুদ সম্পর্কে নাযিলকৃত আয়াতসমূহের নাযিলের ধারাক্রম: (Chronological revelation of Quranic verses relating to Riba):

সুরা নং – ৩০, 8 , ৩ , ২ ।

সূরার নাম – সূরা আর রূম, সূরা আন্ নিসা , সূরা আলে ইমরান , সূরা আল বাকারা ।

আয়াত নং – ৩৯, ১৬০-১৬১ , ১৩০-১৩৪ , ২৭৫-২৮১ ।

মোট আয়াতে র সংখ্যা – ১, ২, ৫, ৭ ।

নাযিল হওয়ার সময়কাল – নুবুয়াতের পঞ্চম বর্ষে, ৬১৫ খৃ. , হিজরাতের পর: ১-৪ হিজরী সালের মধ্যে , উহুদ যুদ্ধের পর , দশম হিজরী- মক্কা বিজয়ের পর ।

সর্বমোট – ৪টি সূরা , ১৫টি আয়াত [ বিস্তারিত দ্রষ্টব্য, ড. এম. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী, Riba, Bank Interest and the Rational of its prohibition, IRTI, Islamic Development Bank, Jeddah, 2004, page-35. ] ।

উপরোক্ত আয়াত গুলোতে ‘রিবা’ শব্দটির উল্লেখ আছে মোট ‘আটবার’। সূরা আর রূমের ৩৯ নম্বর আয়াতে ১ বার, সূরা আন নিসার ১৬১ আয়াতে ১ বার, সূরা আলে-ইমরানের ১৩০, আয়াতে ১ বার, এবং সূরা আল-বাকারার ২৭৫ আয়াতে ৩ বার, ২৭৬ আয়াতে ১ বার ও ২৭৮ আয়াতে ১ বার [ ৯৮. ড. এম. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী, পূর্বোক্ত, পৃ.৩৫ ] ।

৬.১ সুদ সম্পর্কে নাযিল হওয়া প্রথম অহী (1st Revelation on Riba )

সুদ হারাম করার প্রথম ধাপ

সুদ সম্পর্কে কোরআন মজীদের প্রথম যে আয়াত নাযিল হয় তা হচ্ছে সূরা আর রূমের ৩৯ নম্বর আয়াত। নুবুয়াতের পঞ্চম বর্ষে আবিসিনিয়ায় হিজরাতের বছর মাক্কী জিন্দেগীতে সূরা আর রূম নাজিল হয়। সে হিসেবে ৬১৫ খৃস্টাব্দের কোন এক সময়ে এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল বলে মনে করা হয় [ মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, সূরা আল বাকারার ২৭৫-২৮১ আয়াতের উপর প্রবন্ধ, আল-কোরআনে অর্থনীতি, খ.১ (ঢাকা ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, এপ্রিল ১৯৯০), পৃ.২৬৫ ] ।

এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:

وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ رِبًا لِيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلا يَرْبُو عِنْدَ اللَّهِ وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ

লোকদের অর্থের সাথে শামিল হয়ে বৃদ্ধি পাবে, এ জন্যে তোমরা যে সুদ দাও,

তা আল্লাহর নিকট বৃদ্ধি পায় না। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তোমরা যে যাকাত দাও; মূলত এ যাকাত দানকারীরাই তাদের অর্থ বৃদ্ধি করতে থাকে [ আল-কোরআন, সূরা ৩০ আর রুম: আয়াত: ৩৯ ] ।

এ আয়াতে আল্লাহ সরাসরি সুদকে হারাম ঘোষণা না করে সুদের প্রতি মানুষকে নিরুৎসাহিত করেছেন। মানুষের মধ্যে সুদ ও যাকাত সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণার ভ্রান্তি ধরিয়ে দেয়া এবং এর অন্তর্নিহিত আসল অবস্থা তুলে ধরে মানবজাতিকে শিক্ষাদান ও এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় মনমানসিকতা গড়ে তোলাই এ আয়াতের মুখ্য উদ্দেশ্য। এ আয়াতে আল্লাহ মানুষের ভুল ধারণা দূর করে দিয়েছেন। কিছু মানুষ মনে করে, সুদ সম্পদ বাড়ায় আর এজন্য সুদ লেন-দেন করে। কিন্তু আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, এ ধারণা ভ্রান্ত। সুদ প্রকৃতপক্ষে সম্পদ বৃদ্ধি করে না- এ আয়াতে এ সত্য কথাটি জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সুদের কারণে সম্পদ বাড়ে না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে সুদে সম্পদ বাড়ে অর্থাৎ যারা সুদ খায় তাদের সম্পদ বাড়ে, কিন্তু মানুষের এ ধারণা যে সঠিক নয় আল্লাহ এ আয়াতের মাধ্যমে তা তুলে ধরেছেন। সম্পদের মূল উৎস ও মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। সে উৎসে আল্লাহর কাছে কোন সম্পদ বাড়ে না। সুদ সম্পদ হস্তান্তর করে। সুদের মাধ্যমে সুদপ্রদানকারীদের সম্পদ সুদ গ্রহীতাদের কাছে চলে যায় এবং তারা আরও ধনী হয়। সুদখোরের সম্পদ বাহ্যত বৃদ্ধি পেলেও তা বৃদ্ধি পায় অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে নিয়ে নেয়ার কারণে। এতে গোটা সমাজের সম্পদ অপরিবর্তিতই থেকে যায়। এই বৃদ্ধি সত্যিকারভাবে বৃদ্ধি নয়, সম্পদের হস্তান্তরমাত্র। সুদ সম্পদ হস্তান্তরের একটি মস্তবড় হাতিয়ার।

এ আয়াতে আরো বলা হয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সুদ নয় যাকাতই উত্তম পন্থা। যাকাত দিলে আল্লাহ তা’আলা সন্তুষ্ট হন। তৎকালে সুদখোর পুঁজিপতিরা মনে করত যাকাত দিলে বা দান-খয়রাত করলে তাদের সম্পদ কমে যাবে। উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যাকাতের অবদানের কথা তাদের জানা ছিল না। কারণ যাকাতের মাধ্যমে সমাজের গরিব, অসহায়, দুঃস্থদের হাতে অর্থ বা ক্রয়ক্ষমতা দিলে এরা নিজেদের অভাব পূরণার্থে বেশি করে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করবে। ফলে বাজারে পণ্যসামগ্রীর কার্যকর চাহিদাও পূর্বের তুলনায় বেশি হবে। বর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য বিনিয়োগ বাড়বে, উৎপাদন ও যোগান বৃদ্ধি পাবে। বিক্রি বেশি হবে। উৎপাদনকারীর লাভের পরিমাণ বেড়ে যাবে। যাকাত এভাবে ক্রয়ক্ষমতা সৃষ্টির মাধ্যমে চাহিদা, উৎপাদন ও মুনাফা বৃদ্ধি করে থাকে। কাজেই যে যাকাত দেয়া হয় তা আবার বর্ধিত মুনাফা হয়ে দানকারীর হাতেই ফিরে আসে। আল্লাহর ঘোষণা কত যথার্থ। দেখা যাচ্ছে সূরা আর রূমের এই আয়াতে আল্লাহ সুদ ও যাকাতের প্রকৃত অর্থনৈতিক তাৎপর্য মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। একদিকে সুদ সম্পদ বাড়ায় বলে প্রচলিত ধারণার ভ্রান্তি তুলে ধরা হয়েছে যাতে মানুষ তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং সতর্ক হয়। অপরদিকে যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতির সুফলের কথা জানিয়ে সেজন্য মন-মানসিকতা তৈরী ও যাকাত প্রদানের আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। মোটকথা আল্লাহ এ আয়াতের দ্বারা সুদ ও যাকাতের প্রকৃত অর্থনৈতিক তাৎপর্য তুলে ধরেছেন।
এ পর্যায়ে সুদ সরাসরি হারাম না করার কারণ হচ্ছে মুসলিমগণ তখনও মানসিকতার দিক থেকে সুদের কুফল সম্পর্কে অবহিত ছিল না। এতদ্ব্যতীত তদানীন্তন সমাজে সুদের এত প্রচলন ছিল যে তা তাড়াহুড়া করে নিষিদ্ধ করলে তার বাস্তবায়ন ব্যাহত হতে পারতো। তবে এ আয়াতে এ সূক্ষ্ম ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, সুদী কারবার আল্লাহর আনুকূল্য ও অনুগ্রহ (favour) থেকে বঞ্চিত হয়।

৬.২ সুদ সম্পর্কে নাযিল হওয়া দ্বিতীয় অহী ( 2nd Revelation on Riba )

সুদ হারাম করার দ্বিতীয় ধাপ

অতঃপর সুদ সম্পর্কে দ্বিতীয় পর্যায়ে যে আয়াত নাযিল হয় তা সূরা আন্ নিসার ১৬০-১৬১ আয়াত। এখানে ইহুদীদের নানা অপরাধ, অন্যায় ও অপকর্মের বিবরণ দিতে গিয়ে তাদের সুদ খাওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এ আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে:

فَبِظُلْمٍ مِنَ الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ طَيِّبَاتٍ أُحِلَّتْ لَهُمْ وَبِصَدِّهِمْ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ كَثِيرًا. وَأَخْذِهِمُ الرِّبَا وَقَدْ نُهُوا عَنْهُ وَأَكْلِهِمْ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ مِنْهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا

‘ইহুদিদের যুগ্মমূলক কাজের কারণে এবং এ কারণে যে তারা আল্লাহর পথ হতে (লোকদের) বিরত রাখে এবং সুদ গ্রহণ করে যা করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল এবং লোকদের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করার কারণে আমরা এমন অনেক পাক-পবিত্র জিনিসই তাদের প্রতি হারাম করে দিয়েছি এবং তাদের মধ্যে যারা কাফির, তাদের জন্য আমরা কষ্টদায়ক আযাব নির্দিষ্ট করে দিয়েছি [ আল-কোরআন, সূরা ৪ আন নিসা: আয়াত ১৬০-১৬১ ] ।

দ্বিতীয় পর্যায়ে নাযিলকৃত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ ইহুদীদের কৃত পাপ ও অপকর্ম সমূহের বিবরণ দিতে গিয়ে তাদের সুদ লেন-দেনের ইতিহাস এবং এর ফলে দুনিয়ায় তাদের পরিণতি এবং অখিরাতের আযাবের কথা বলে মানুষকে সতর্ক করেছেন। ড. এম. উমর চাপরা বলেছেন, সুরাতুন নিসার আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ সুদকে স্পষ্ট ভাষায় অন্যায় ভক্ষণের মধ্যে শামিল করেছেন [ ড.এম. উমর চাপরা, The Nature of Riba, Journal of Islamic Banking and Finance, Vol. 6, No. 3, July-Sept.; Summer Issue, 1989, P. 7 ] .

অর্থাৎ সুদও এক ধরনের অন্যায় ভক্ষণ ও যুগ্ম। শুধু তাই নয়, সুদ এমন এক ধরনের অন্যায় ভক্ষণ যা ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত সময়ের গতির সাথে গুণে গুণে বেড়ে যেতে থাকে, এমনকি, তা অসীম পর্যায়ে বাড়তে পারে। সুদখোররা সুদ একবার নিয়েই শেষ করে না; বরং সময়ের গতির সাথে তারা তাদের অন্যায় ভক্ষণের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে যেতে থাকে, ফলে অধিকাংশ ঋণগ্রহীতা তাদের সর্বস্ব দিয়েও জীবনে এ সুদ পরিশোধ করে যেতে পারে না।

এ আয়াতে সরাসরি সুদকে হারাম ঘোষণা না করে বলা হয়েছে যে, ইহুদিদের জন্য ইতোপূর্বে সুদ হারাম করা হয়েছিল। কিন্তু ইহুদিরা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছিল, তারা সুদ খেতো, যদিও তাদেরকে তা খেতে নিষেধ করা হয়েছিল। ইহুদিরাই সর্বপ্রথম রিবাভিত্তিক কারবার আরম্ভ করে এবং এ জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। একইভাবে পরবর্তীকালেও যারা সুদের কারবার করবে তাদের জন্যও আল্লাহর শাস্তি অবধারিত। ইহুদীদের চালু করা সুদ প্রথা আল্লাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

৬.৩ সুদ সম্পর্কে নাযিল হওয়া তৃতীয় অহী ( 3rd Revelation on Riba )

সুদ হারাম করার তৃতীয় ধাপ

তৃতীয় পর্যায়ে সুদ সম্পর্কে কোরআন মাজীদের যে আয়াত নাযিল হয় তা সূরা আলে ইমরানের ১৩০-১৩১ নম্বর আয়াত। ১৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُضَاعَفَةً وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ .

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা দ্বিগুণ-বহুগুণ বর্ধিত হারে সুদ খেয়ো না; এবং আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায় যে তোমরা কল্যাণ লাভ করবে [ আল-কোরআন,সূরা-৩: আলে ইমরান: আয়াত: ১৩০ ]।

তৃতীয় পর্যায়ে পরিবেশ তৈরী ও অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সুদ পরিহার করে চলার উপদেশ দিয়েছেন আল্লাহ। সুদের পরিমাণ বেশি হোক বা কম হোক তা অবৈধ। এ আয়াত দ্বারা সুদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এ আয়াতে কেবল ঈমানদারদের চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খাওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং এ জন্য তাদেরকে কল্যাণ দেবার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এ আয়াতটি উহুদ যুদ্ধের [ সূরা আলে ‘ইমরানের ১৩০-১৩১তম আয়াতের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আয়াত সমূহে ওহুদ যুদ্ধের পর্যালোচনা করা হয়েছে। আর ওহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে ] পর হিজরী তৃতীয় সালের কোন এক সময়ে নাযিল হয়েছে। সুদ সংক্রান্ত প্রথম আয়াত নাযিলের প্রায় ১১ বছর পর এ আয়াত নাযিল হয়। এ পর্যায়ে মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয় এবং সুদের বিরুদ্ধে আইন করে বাস্তবে সকল পর্যায় থেকে সুদকে উচ্ছেদ করার

পরিবেশ তখনও সৃষ্টি হয়নি। তাই এ পর্যায়ে আল্লাহ তা’আলা ক্রমবর্ধমান হারে বা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ পরিত্যাগ করার নির্দেশ দিলেন। সময়ের চাকা ঘুরে আসলেই যেটা বাড়ে সেটাই চক্রবৃদ্ধি। সুদের প্রকৃতিই হচ্ছে বারবার বাড়া। এ আয়াতে মূলত সুদকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুদ বারবার ঘুরে ঘুরে বৃদ্ধি পায়। এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কিরাম সর্বতোভাবে সুদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। ড. এম. উমর চাপরা লিখেছেন, তৃতীয় পর্যায়ে নাযিলকৃত (৩:১৩০-১৩১) আয়াতদ্বয় দ্বিতীয় হিজরী সালে নাযিল করা হয়েছে। এতে মুসলিমদের সুদ খাওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যদি তারা নিজেদের কল্যাণ চায় [ ড. এম. উমর চাপরা, The Nature of Riba, Journal of Islamic Banking and Finance, Vol. 6, No. 3, July-Sept.; Summer Issue, 1989, P. 7.]

সাইয়েদ কুতুব শহীদ (১৯০৬-১৯৬৬) লিখেছেন, উহুদ যুদ্ধের ঘটনাবলী নিয়ে কোরআন যে পর্যালোচনা করেছে তার সবচেয়ে লক্ষণীয় ও আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এই যে… কোরআন একটি যুদ্ধের পর্যালোচনা করতে গিয়ে সুদ সম্পর্কে বক্তব্য দিয়েছে, সুদ খেতে নিষেধ করেছে [ সাইয়েদ কুতুব শহীদ, তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন, বাংলা অনুবাদ, খ.৩ (ঢাকা: আল কোরআন একাডেমী লন্ডন, খ. ৪, ২০০১), পৃ. ৪৬৯-৪৭২ ] ।

আর সুদ হচ্ছে এমন একটি দেয় যা সময়ের সাথে গুণে গুণে বৃদ্ধি পায়। ‘আল্লামা শাব্বির আহমদ ওসমানী (১৮৮৭-১৯৪৯) লিখেছেন, ‘সুদ খাওয়ায় কোন কল্যাণ নেই; আল্লাহকে ভয় করে সুদ খাওয়া ত্যাগ করার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে [ শাব্বির আহমদ ওসমানী, তাফসীরে ওসমানী, সম্পাদনা হাফেজ মুনীর উদ্দীন আহমদ, (ঢাকা: আল কোরআন একাডেমী লন্ডন, খ. ১, ১৯৯৬), পৃ. ৩২৫ ]।

৬.৪ সুদ সম্পর্কে নাযিল হওয়া চতুর্থ ও সর্বশেষ অহী ( Fourth and Final Revelation on Riba )

সুদ হারাম করার চতুর্থ ও শেষ ধাপ

সর্বশেষে ইসলামের পরিপূর্ণ বিস্তৃতি লাভের পর সুদ হারাম ঘোষিত হয়। এ পর্যায়ে আইন নাযিল করে ইসলামী রাষ্ট্র থেকে সুদ উচ্ছেদ করার ব্যবস্থা করা হয়। সুদ নেয়া যেমন হারাম, সুদ দেয়াও তেমনি হারাম। সূরা আল বাকারার ২৭৫ থেকে ২৭৮ নম্বর আয়াতে সুদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও উচ্ছেদ করার কথা বলা হয়। এখানে রিবার উপর নিষেধাজ্ঞার কঠোরতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। এ সূরার ২৭৫ নম্বর আয়াতে সুদকে শয়তানী উম্মাদনা বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে:

الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا فَمَنْ جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَانْتَهَى فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ وَمَنْ عَادَ فَأُولَئِكَ

أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

যারা (রিবা) সুদ (Usury) খায়, (কিয়ামাতের দিন) তারা দাঁড়াতে পারবে না, তবে দাঁড়াবে সেই ব্যক্তির মত যাকে শাইতান তার স্পর্শ দ্বারা পাগল ও সুস্থ জ্ঞানশূন্য করে দিয়েছে। তাদের অবস্থা এরূপ হওয়ার কারণ এই যে, তারা বলে: ব্যবসায় তো সুদেরই মত। আর আল্লাহ ব্যবসায়কে হালাল করেছেন, আর সুদকে করেছেন হারাম। কাজেই যে ব্যক্তির নিকট তার রবের তরফ থেকে এ নির্দেশ পৌঁছবে এবং ভবিষ্যতে সুদ (গ্রহণ) হতে বিরত থাকবে, তবে সে পূর্বে যা কিছু খেয়েছে তো খেয়েছেই সে ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর বিবেচনাধীন। আর যারা এ নির্দেশ পাওয়ার পরও এর পুনরাবৃত্তি করবে, তারা নিশ্চিতরূপে আসহাবুন্নার (আগুনের অধিবাসী) জাহান্নামী হবে, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে [ আল-কোরআন, সূরা ২: আল বাকারা: আয়াত ২৭৫ ] ।

এ আয়াতে আল্লাহ সুদের পক্ষে যুক্তি প্রদানকারীদের অসুস্থ মানসিকতার লোক বলে উল্লেখ করেছেন। এরা এমন যে ব্যবসায় এবং সুদের পার্থক্য বুঝার মত জ্ঞান-বুদ্ধি এদের নেই অথবা স্বার্থ চিন্তায় অন্ধ হয়েই তারা সুদকে ব্যবসার মত বলে আঁকড়ে থাকতে চায়। এদের এ উক্তিকে পাগলের প্রলাপের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

এ আয়াতে সুদের লেনদেন নিষিদ্ধ করার সাথে সাথে অতীতের সুদ সম্পর্কেও ফায়সালা দেয়া হয়েছে। অতীতে খাওয়া সুদের ব্যাপারটি আল্লাহর উপর ন্যস্ত করার মাধ্যমে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।

এ আয়াতে রিবা এবং বাই’ এর সাথে ‘আল’ যোগ করে আর রিবা الربوا এবং البيع আল-বাই’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। পরিভাষাদ্বয়ের সাথে ال বসল কেন।
আরবিতে ১। চারটি অর্থে ব্যবহৃত হয়।

(১) استغراقي ইস্তেগরাকী সামগ্রিক অর্থে সবকিছুকে বুঝাবে;
(২) عهد خارجی আহদে খারিজী নির্দিষ্ট অর্থে;
(৩) عهد ذهن আহদে জিহনী পূর্ব থেকে ধারণা অর্থে;
(৪) جنسی জাতি বুঝানোর জন্য।

এ আয়াতে আল ইস্তেগরাকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ আয়াতে সকল ‘বাই’ বা ব্যবসা’কে হালাল করা হয়েছে যাতে বাই’য়ের আর কোন ধরনই বাকি থাকেনি। আর সকল রিবাকে হারাম করা হয়েছে বিধায় রিবার সকল ধরনই হারাম। এই মর্মে রায় দেয়া যাচ্ছে যে, প্রচলিত সকল প্রকার সুদই, তা ব্যাংকিং লেনদেনে হোক অথবা ব্যক্তি পর্যায়ের লেনদেন হোক, সব ধরনই ‘রিবা’র সংজ্ঞার আওতাভুক্ত। তেমনি সরকারী ঋণ, অভ্যন্তরীণ বা বহির্বিশ্ব যে কোন উৎস থেকেই নেয়া হোক না কেন, এ ঋণের ওপর ধার্যকৃত সুদও হচ্ছে রিবা যা আল-কোরআনে সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে [ মুফতি মুহাম্মাদ তাকী উসমানী, সুদ নিষিদ্ধ পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের ঐতিহাসিক রায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৮ ] ।

আয়াতে সুদের ভিত্তিতে লগ্নি হতে ঋণের যে সুদ পাওনা আছে, তা ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মানে পাওনা সুদ যাই কিছু থাকুক ছেড়ে দিতে হবে। রাষ্ট্রকে এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে, এভাবে পাওনা সুদ যারা ছেড়ে দেবে তাদের আসল ফিরে পাবার ব্যবস্থা যেন করা হয়। আর যারা পাওনা সুদ ছেড়ে দেবে না আবারও সুদ খাবে, তাদেরকে শাস্তিদান ও আল্লাহর বিধান মানতে বাধ্য করার ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দেয়া হয়েছে।

সূরা আল বাকারার ২৭৬নং আয়াতে সুদকে অকল্যাণের আকর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে:

يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْنِي الصَّدَقَاتِ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ.

আল্লাহ তা’আলা সুদ নির্মূল করেন, (অপর দিকে) দান সাদাকা (যাকাত ও দান)-কে তিনি (উত্তরোত্তর) বৃদ্ধি করেন; আল্লাহ তা’আলা (তাঁর নিয়ামাতের প্রতি) অকৃতজ্ঞ, দুর্নীতিবাজ, পাপিষ্ঠ ব্যক্তিদের কখনো পছন্দ করেন না [ আল-কোরআন, সূরা ২: আল বাকারা: আয়াত ২৭৬ ] ।

সুদ হারাম করে আইন নাযিলের সাথে সাথে আলোচ্য আয়াতে আল্লাহপাক একদিকে সুদের ধ্বংসকর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। অপরদিকে সাদাকাহর সুফল হচ্ছে সমৃদ্ধি- এ কথা জানিয়ে মানুষকে সাদাকাহ প্রদানে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সেই সাথে আল্লাহ সুদখোরদের অকৃতজ্ঞ ও পাপী ঘোষণা করেছেন এবং আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন না বলে সতর্ক করে দিয়েছেন।

এই আয়াতে আল্লাহ ‘ইয়ামহাকু’ শব্দ ব্যবহার করেছেন যার মূল হচ্ছে ‘মাহক’। ড. এম. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী মাহক শব্দের অর্থ করেছেন, ‘Decrease after decrease a continuous process of diminishing’- হ্রাসের পর হ্রাস, ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত হ্রাস পাওয়া [ ড. এম. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী, পূর্বোক্ত, পৃ-৪৩ ] ।

আল্লাহ এভাবে সুদকে নিশ্চিহ্ন বা ধ্বংস করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় সুদ সমৃদ্ধি আনে কিন্তু সুদের আসল পরিণতি হলো অভাব ও সংকোচন [ মুসনাদে আহমদ ] ।

ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন,

ما أَحَدٌ أَكْثَرَ مِنْ الرِّبَا إِلَّا كَانَ عَاقِبَةُ أَمْرِهِ إِلَى قِلَّةٍ

“যে ব্যক্তি বেশি পরিমাণে সুদ খায় অবশ্যই তার শেষ পরিণাম হয় সম্পদ স্বল্পতা [ ইবনে মাজাহ, খ-৩, পৃষ্ঠা-৩৮২, হাদীস-২২৭৯; নাসির উদ্দীন আলবানী বলেন, হাদীসটি সহীহ ] ।

এই আয়াতের শেষ বাক্যে আল্লাহ সুদখোরদের অকৃতজ্ঞ পাপী আখ্যায়িত করেছেন। সুদখোররা অকৃতজ্ঞ পাপী এ জন্য যে তারা আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার পরিবর্তে আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদের দ্বারাই আল্লাহর বান্দাহদের শোষণ করে। আর আল্লাহ পছন্দ করেন না বলে সুদখোররা যে দুনিয়া আখিরাতে ঘৃনিত, লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে সে দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বস্তুত আল্লাহ যাদের পছন্দ করেন না, দুনিয়া আখিরাতে কেউই তাদের পছন্দ করে না; সর্বত্র তারা ঘৃণিত, লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। এটাই আল্লাহর চিরন্তন ও শাশ্বত বিধান। ইহুদী জাতির পরিণতি পেশ করে খোদ কোরআন মাজীদ এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছে।

সুদের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে ২৭৮-২৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ. فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ.

“হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর আর তোমাদের যে সুদ পাওনা (বাকী) রয়েছে তা ছেড়ে দাও (giveup), যদি বাস্তবিকই তোমরা ঈমান এনে থাক। কিন্তু তোমরা যদি তা না কর তবে জেনে রাখ, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা রয়েছে। এখনও যদি (তোমরা তাওবা কর এবং সুদ পরিত্যাগ কর) তবে মূলধন ফিরে পাবার অধিকারী হবে। তোমরা জুলুম করবে না; তোমাদের প্রতিও জুলুম করা হবে না [ ১১৪. আল-কোরআন, সূরা ২: আল বাকারা: আয়াত ২৭৮-২৭৯ ] ।

২৭৮ নং আয়াতে মুমিনদেরকে পূর্ব থেকে করে আসা সুদী লেনদেন পরিহার করার আদেশ দেয়া হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, তোমরা মুমিন হলে অবশ্যই তা ছেড়ে দেবে। এটাই ঈমানের দাবী। অতপর সুদ পরিহার না করলে তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সুদী কারবারের অপরাধের দরুন পার্থিব জগতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। মানব জীবনে নেমে আসে নানা অশান্তি ও দুর্ভোগ। পবিত্র কোরআনে এবং মহানবী (সা) এর হাদীসে আরো অনেক অপরাধের কথা বলা হলেও সে সব অপরাধের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। একমাত্র সুদের বিরুদ্ধেই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কাজেই সুদের ভয়াবহতা কত বেশি তা সহজেই অনুমেয়।

এসব আয়াত নাযিল হওয়ার পর ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে সুদি কারবার একটি ফৌজদারি অপরাধে পরিণত হয়। সুদখোরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ইসলামী রাষ্ট্রে সুদখোরদের এ জঘন্য কাজ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা হবে এবং তাওবা করতে বাধ্য করা হবে। সুদি কারবারে জড়িতরা যদি তাওবা করে অর্থাৎ সুদি কারবার ছেড়ে দেয় তাহলে আসল ফেরত নিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে এটি পরিষ্কার যে আসলের অতিরিক্ত কিছু নেয়া যাবে না।

উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেন,

إنَّ آخر ما نزلت آية الربا وإنَّ رسولَ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ قُبِضَ ولم يفسرها لنا فدعوا الربا والريبة

“কোরআনের (বিধি-বিধান সংক্রান্ত) সর্বশেষ নাযিলকৃত আয়াতটি হলো রিবা বিষয়ক। সুদ সংক্রান্ত প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয় আমাদের সামনে ব্যাখ্যা করার আগেই আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সা)-কে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। অতএব রিবা (সুদ) ও রীবাহ (অর্থাৎ কোন বিষয়ের বৈধতার ব্যাপারে সংশয়) উভয়টিই পরিহার করো [ ইমাম ইবনে মাজাহ, আস-সুনান অধ্যায়, আত তিজারাত, অনুচ্ছেদ: আত তাগলীয ফির রিবা, আল কাহেরা দারুল হাদীস, ২০০৫, খ-২, পৃ-৩০৯, হাদীস নং-২২৭৬ ] ।

সুদ বিষয়ক জ্ঞান ছিল তার নিকট সমগ্র পৃথিবী ও তার সম্পদরাজীর তুলনায় অধিক প্রিয় [ জারীবাহ ইবনে আহমাদ হারিসী, ফিকহুল ইকৃতিসাদী লি আমীরিল মুমিনীন উমার ইবনিল খাত্তাব, জেদ্দা দারুল আন্দালুস আল খাদরা, ২০০৩, পৃ-৬৩ ] ।

খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছিলেন যাদের দায়িত্ব ছিল বাজার থেকে সেসব লোককে উঠিয়ে দেয়া, যারা রিবা সংক্রান্ত আইন কানুনের ব্যাপারে ওয়াকিফহাল নয় [ আব্দুল হাই কাত্তানী, নিযামুল হুকুমাতিন নাবাবিয়‍্যাহ আল মুছাম্মা আত-তারাতীবুল ইদারিয়‍্যাহ, বৈরুত: দারুল আরকাম, তা.বি. খ-২, পৃ-১৭ ] ।

সুদ সম্পর্কে কোরআনের নির্দেশনার আলোকে এটি সুস্পষ্ট যে লেনদেনে প্রচলিত সকল প্রকার সুদ হারাম, সুদের কোন প্রকারই আর জায়িয নেই, নানা বাহানায় সুদ নেয়ার আর কোন উপায় নেই।

৭. সুদ সম্পর্কে আল-হাদীস (Riba in Al-Hadith)

রিবা সম্পর্কিত মশহুর হাদীসসমূহ নিম্নরূপ:

عَنْ جَابِرٍ قَالَ لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَكِلَ الرِّبَا وَمُؤْكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ وَقَالَ هُمْ سَوَاءٌ.

জাবির ইবনু ‘আবদিল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদদাতা, সুদগ্রহীতা, সুদের কাগজপত্র লেখক (চুক্তি সম্পাদনকারী), হিসাবরক্ষক এবং সাক্ষীদের উপর অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন,গুনাহর ব্যাপারে এরা সবাই সমান [ আবুল হুসাইন ইবনুল হাজ্জাজ বিন মুসলিম আল-কুশাইরী, সাহীহ মুসলিম, মুষারা’আ, বাব ১৯, হাদীস নং ৪০৯২, পৃ. ১০৫]।

আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা) সুদখোর, সুদদাতা, এর সাক্ষী, সুদের হিসাব লেখক সকলকে অভিশাপ দিয়েছেন। আর তিনি এদের সবাইকে সমান অপরাধী বলেছেন [ আবু দাউদ, হাদীস নং-৩৩০০ ] ।

এ হাদীসের মর্মানুযায়ী সুদ সংক্রান্ত হিসাবপত্র লেখার কাজে সম্পৃক্ত হওয়া জায়িয নয়। সুদ ব্যভিচারের চেয়েও নিকৃষ্ট।

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ حَنْظَلَةَ غَسِيلِ الْمَلَائِكَةِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: دِرْهَمْ رِبَا يَأْكُلُهُ الرَّجُلُ وَهُوَ يَعْلَمُ، أَشَدُّ مِنْ سِتَّةٍ وَثَلَاثِينَ زَنْيَةٌ .

আব্দুল্লাহ ইবন হানযালা গাসীলুল মালাইকা (রা) থেকে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জেনে বুঝে সুদের একটি দিরহাম গ্রহণ করা ৩৬ বার ব্যভিচারের চাইতেও জঘন্য অপরাধ [ মুসনাদে আহমদ, খ-১৬, হাদীস নং ২১৮৫৪, তিবরানী; তু, দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫১৪ ] ।

আবদুল্লাহ ইবনু হানযালা (রা.) বর্ণনা করেছেন, মহানবী (স.) বলেন, কোন ব্যক্তি যদি এক দিরহাম রিবা জ্ঞাতসারে গ্রহণ করে তবে তা ছত্রিশবার ব্যভিচার করার চেয়েও অনেক ভয়াবহ [ মুসনাদে আহমদ; মিশকাত শরীফ, হাদীস নং ২৮২৫ ] ।

আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রিবার গুনাহ সত্তর প্রকার, তার মধ্যে সবচেয়ে নিম্নতমটি হলো একজন লোক তার নিজ মায়ের সাথে ব্যভিচার করার সমান। [ আবু আবদুল্লাহ্ মুহাম্মাদ ইবন ইয়াজীদ ইবন মাজাহ্, সুনানু ইবনে মাজাহ; সুনান আল বাইহাকী; মেশকাত শরীফ, খ. ৬, হাদীস নং ২৭০২ (ঢাকা: এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ফেব্রুয়ারী ১৯৮৭),
পৃ. ৩৭ ]।

عَنْ عَبْدِ اللهِ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ الرِّبَا ثَلَاثَةٌ وَسَبْعُوْنَ بَابًا.

‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস’উদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সুদের গুনাহের তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে [ সুনান ইবন মাজাহ, খ-২, কিতাবুত তিজারাত, হাদীস নং-২২৭৪ ] । তার মধ্যে নিম্নতম স্তরের অপরাধের পরিমাণ হলো নিজের মায়ের সাথে যিনায় লিপ্ত হওয়ার সমান [ মুসতাদরাকি হাকিম, খ. ২, পৃ. ৩৭ ] ।

এ হাদীস ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস’উদ (রা.) ছাড়াও অন্যান্য যাঁরা বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে আবু হুরাইরা (রা.), ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রা.), ‘আবদুল্লাহ ইবনু সালাম (রা.), বারা ইবনু ‘আযিব (রা.) প্রমুখ রয়েছেন। এ ধরনের হাদিস সংকলিত হয়েছে তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্, বাইহাকী, হাকিম প্রমুখের সংকলিত হাদীস গ্রন্থে।

কোন নামাযি ঈমানদার ব্যক্তির সুদি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে ব্যবসায়-বাণিজ্য করা, হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন বা অন্য কোন সুদি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঘরবাড়ি, দালান নির্মাণ, ফ্যাট ক্রয় তথা সুদি ব্যাংকের সাথে লেন-দেন করা মায়ের সাথে যিনার সমান এবং এটা সুদের সর্বনিম্ন অপরাধ। অথচ অনেকে ইসলামী ব্যাংকে লেন-দেন করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সুদি ব্যাংকের সাথেই ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং লেন-দেন করেন।

পাশ্চাত্যের পত্র-পত্রিকায় নিকট আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যিনার খবর প্রকাশিত হলে বাংলাদেশের মুসলমানরা আশ্চর্য হয়। কিন্তু আমরা আশ্চর্য হই না এ জন্য যে ইসলামী উম্মাহর একটি অংশ সুদি ব্যাংক ব্যবস্থার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এমনভাবে লিপ্ত যে, তারা মায়ের সাথে যিনার [ মায়ের সাথে যিনার হাদিসটি শুনে অনেকে আশ্চর্য হতে পারেন, তদানীন্তন আরবে এ ধরনের পাপ ছিল। পিতার মৃত্যুর পর মহানবী (সা) এর নুবুওয়াতের পূর্বে আরবে স্থাবর সম্পত্তির মত ভাগ-ভাটোয়ারা করে নিয়ে সন্তানগণ সৎ মায়েদেরকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করত। রোম সম্রাট নিরো পিতাকে হত্যা করে মাকে বিয়ে করেছিলেন। বর্তমানে পাশ্চাত্যের পশুসভ্যতায় এ ধরনের পাপ অতিসাধারণ ও নিত্যনৈমিত্তিক ] । মতই পাপ করে যাচ্ছে। অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে-যিনা ও সুদ যে কোন জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।

أَتَيْتُ لَيْلَةَ أَسْرِيَ بِي عَلَى قَوْمٍ بُطُونُهُمْ كَالْبُيُوةِ فِيْهَا الْحَيَّاتُ تُرَى مِنْ خَارِجِ بُطُونِهِمْ فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرَائِيلُ قَالَ هَؤُلَاءِ أَكَلَةُ الرِّبَا.

আবু হুরাইরাহ (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মি’রাজ রজনীতে আমি সপ্তম আকাশে পৌঁছে যখন উপরের দিকে তাকালাম তখন বজ্রধ্বনি, বিদ্যুৎ ও প্রকট শব্দ শুনতে পেলাম। অতঃপর আমি এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে এলাম যাদের পেট ছিল একটি ঘরের ন্যায় ফোলা ও বিস্তৃত। তাদের পেট ছিল সর্পে ভরপুর। সর্পগুলো বাহির থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাঈল! এরা কারা? তিনি বললেন, তারা হলো সুদখোর সম্প্রদায় [ সুনানু ইবনু মাজাহ, খ-৭, পৃ-৪৭, হাদীস নং-২২৬৪; সুনান আল বাইহাকী; মিশকাত শরীফ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৮]।

عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «مَا أَحَدٌ أَكْثَرَ مِنَ الرِّبَا، إِلَّا كَانَ عَاقِبَةُ أَمْرِهِ إِلَى قِلَّةِ»

আবদুল্লাহ ইবনু মাস’উদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি কেউ বেশি বেশি সুদের লেনদেন করে, অতিরিক্ত সম্পদ উপার্জন করে, তবে তার পরিণতি লাঞ্ছনা ছাড়া আর কিছুই নয় [ মুসনাদে আহমাদ; সুনানু ইবনু মাজাহ; খণ্ড ২, কিতাবুত তিজারাহ, হাদীস নং-২২৭৯; মেশকাত শরীফ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৮ ] ।

এ ছাড়াও মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরো অনেক হাদীস রয়েছে যেখানে তিনি সুদ সম্পর্কে আরো অনেক কঠোর ভাষা প্রয়োগ করেছেন।

ইসলামী সমাজব্যবস্থায় ও অর্থনীতিতে যাবতীয় অসৎকাজের মধ্যে সুদকে সবচেয়ে বড় পাপ বলে গণ্য করা হয়েছে। যে সুদকে কোরআনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলা হয়েছে অনেকে নিয়মিত নামায রোযা করেও সে সুদই খাচ্ছেন বা দিচ্ছেন। বহু ধর্মপ্রাণ ধনী ব্যক্তিকে দেখা যায় তাঁরা সারা বছর লাখ লাখ টাকা সুদ অর্জন করছেন, এরপর বছর শেষে কয়েক হাজার টাকা যাকাত দিচ্ছেন। এসব ধনী ব্যক্তিদের আল্লাহভীতি, আখিরাত-চিন্তা যদি আরো শাণিত হতো তাহলে তাঁরা নিজেদের ব্যবসায়-বাণিজ্যের পুরো লেনদেন ইসলামী ব্যাংকের সাথে করতেন, সুদি ব্যাংককে সর্বোতভাবে পরিহার করে চলতেন। কারণ সুদ ও সুদভিত্তিক লেনদেন চিরকালের জন্য হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বস্তুত সুদের মতো সমাজবিধ্বংসী অর্থনৈতিক হাতিয়ার আর দ্বিতীয়টি নেই।

সুদের পরিণাম এত ভয়াবহ যে, কেবল সুদ গ্রহীতা নয়; সুদ দাতা, এর লেখক ও সাক্ষীরাও এর ভয়াবহ পরিণতি থেকে রেহাই পাবে না।

সুদের জঘণ্য ও ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুবই স্পষ্ট কথা বলেছেন। এতদসংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস রেফারেন্সসহ নিচে উদ্ধৃত হলো:

عَنِ عَبْدِ اللهِ بنِ مَسْعُودٍ، قَالَ لَعَنَ رَسُوْلُ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَكِلَ الرِّبَا وَمُؤْكِلَهُ وَكَتِبَهُ وَثَاهِدَيْهِ.

‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস’উদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদখোর, সুদদাতা, সুদের সাক্ষীদ্বয় ও সুদের (চুক্তি বা হিসাব) লেখককে অভিসম্পাত করেছেন [ ইমাম আবু ‘ঈসা তিরমিযী (রহ.), জামি আত-তিরমিযী, খ. ২, আবওয়াবুল বুয়্যু, হাসীস নং ১১৪৪ (ঢাকা: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, সেপ্টেম্বর ২০০২), পৃ, ৩৬২; সুনানু আবু দাউদ, খ. ৫, কিতাবুল বুয়্যু, অনুচ্ছেদ ৪, হাদীস নং ৩৩৩৩, (ঢাকা: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার প্রকাশিত, জানুয়ারী ২০১০), পৃ, ২৩; সুনান ইবনু মাজাহ, খণ্ড ১, কিতাবুত ভিজারাহ, হাদীস নং ২২৮০ ] ।

জাবির ইবনু ‘আবদিল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ গ্রহীতা, সুদ দাতা, সুদের লেখক এবং সুদী লেনদেনের সাক্ষীদ্বয়ের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন। তিনি বলেছেন (পাপের দিক থেকে) তারা সকলেই সমান অপরাধী [ ইমাম আবুল হুসাইন ইবনুল হাজ্জাজ বিন মুসলিম আল-কুশাইরী, সহীহ মুসলিম, খ.৪, মুশাকাত ও মুযারা’আত অধ্যায়, হাদীস নং ৩৯৪৮, (ঢাকা: ই ফা বা, এপ্রিল ২০০৩) পৃ. ৫২৫ ] ।

এ হাদীস অনুসারে সুদের হিসাব লেখা ও সুদের সাক্ষী থাকাও কবীরা গুনাহ। এ জন্য ঈমানদারদের সিদ্ধান্ত হবে তারা সুদ নেবে না, দেবে না, খাবে না এবং খাওয়াবে না; সুতরাং সুদের হিসাব রাখা বা সাক্ষী থাকারও প্রয়োজন হবে না।

عَنْ عَلِي، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَعَنَ آكِلَ الرِّبَا، وَمُوكِلَهُ، وَكَاتِبَهُ، وَمَانِعَ الصَّدَقَةِ، وَكَانَ يَنْهَى عَنِ النَّوْحِ»

আলী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সুদখোরের প্রতি, সুদদাতার প্রতি এবং সুদের ঋণপত্র লেখকের প্রতি অভিসম্পাত করতে শুনেছেন। তিনি আরো অভিসম্পাত করেছেন দান খয়রাতে বাধাদানকারীর প্রতি। আর তিনি নিষেধ করতেন মৃতের জন্য বিলাপ করে ক্রন্দন করতে [ সুনান আন নাসাঈ, খ-৪, কিতাবুষ যী-নাহ, হাদীস নং-৫১১৮ ] ।

عَنْ عَوْنُ بْنُ أَبِي جُحَيْفَةَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: «لَعَنَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الوَاشِمَةَ وَالْمُسْتَوْشِمَةَ، وَآكِلَ الرِّبَا وَمُوكِلَهُ، وَنَهَى عَنْ ثَنِ الكَلْبِ، وَكَسْبِ الْبَغِيِّ وَلَعَنَ الْمُصَوِّرِينَ»

আউন ইবনে আবি জুহাইফা (রা) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শরীরে উল্কিগ্রহণ ও অঙ্কনকারিণী, সুদগ্রহীতা ও সুদদাতার ওপর অভিসম্পাত করেছেন। কুকুরের মূল্য গ্রহণ করতে এবং পতিতাবৃত্তির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে নিষেধ করেছেন। আর ছবি অঙ্কনকারীদের ওপর অভিসম্পাত করেছেন [ সহীহ আল বুখারী, খ-৩, কিতাবুত তালাক, হাদীস নং-৫৩৪৭]।

عَنْ عَلِيِّ، قَالَ: لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَشْرَةً: آكِلَ الرِّبَا، وَمُوكِلَهُ، وَكَاتِبَهُ، وَشَاهِدَيْهِ، وَالْحَالَّ، وَالْمُحَلَّلَ لَهُ، وَمَانِعَ الصَّدَقَةِ، وَالْوَاشِمَةَ وَالْمُسْتَوْشِمَةَ .

আলী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশ শ্রেণির লোককে অভিশাপ প্রদান করেছেন
১। সুদখোর,
২। সুদদাতা,
৩। সুদের লেখক,
৪ ও ৫। সুদের দু’জন সাক্ষী,
৬। হালালাকারী,
৭। যার জন্য হালালা করা হয়,
৮। সাদকা প্রদানে অস্বীকারকারী,
৯। উল্কি অঙ্কনকারিণী,
১০। উল্কিগ্রহণকারিণী [ মুসনাদে আহমাদ, খ-১, হাদীস নং-৬৩৫ ] ।

عَنِ الْحَارِثِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ: «آكِلُ الرِّبَا وَمُوكِلُهُ وَكَاتِبُهُ، وَشَاهِدَاهُ إِذَا عَلِمَا، وَالْوَاشِمَةُ وَالْمُوتَشِمَةُ لِلْحُسْنِ، وَلاوِي الصَّدَقَةِ، وَالْمُرْتَدُّ أَعْرَابِيًّا بَعْدَ هِجْرَتِهِ مَلْعُونَ عَلَى لِسَانِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ»

হারিস ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আও’য়ার (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ বলেছেন, জেনে-বুঝে সুদগ্রহীতা, সুদদাতা, ও সুদের লেখক, সুদের সাক্ষীদ্বয়, সৌন্দর্যের জন্য নিজ শরীরে উল্কিগ্রহণ ও অঙ্কনকারিণী, যাকাত প্রদানে গড়িমসিকারী এবং হিজরতের পর বাড়িতে ফিরে আসা ব্যক্তিরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যবানে কিয়ামতের দিন অভিসম্পাতকৃত [ সুনান আন নাসাঈ, খ-৪, কিতাবুষ যী-নাহ, হাদীস নং-৫১১৭; মুসনাদে আহমাদ, খ-৪, হাদীস নং-৩৮৮১ ] ।

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তা’আলা চার ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ না করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তাদেরকে জান্নাতের কোন নি’মাত ভোগ করার সুযোগও দেবেন না। এরা হলো:
(১) মদ্যপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি,
(২) সুদখোর,
(৩) অন্যায়ভাবে ইয়াতীমের মাল ভক্ষণকারী এবং
(৪) পিতামাতার অবাধ্য সন্তান [ সুনান আল বাইহাকী; তু. দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫১৪ ] ।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا هُنَّ قَالَ الشَّرْكُ بِاللَّهِ وَالسِّحْرُ وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَكْلُ الرِّبَا وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ وَالتَّوَلِّي يَوْمَ الرَّحْفِ وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلَاتِ.

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ক্ষতিকর সাতটি বিষয় থেকে তোমরা বিরত থাকবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সে সাতটি বিষয় কি? জবাবে তিনি বললেন,

(১) আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা,
(২) জাদু বিদ্যা শিক্ষা ও প্রদর্শন করা,
(৩) অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা,
(৪) সুদ ভক্ষণ করা,
(৫) ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ করা,
(৬) জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা এবং
(৭) কোন সতী-সাধ্বী রমণীকে মিথ্যা অপবাদ দেয়া [ সাহীহ আল বুখারী; সাহীহ্ মুসলিম, ঈমান, বাব ৩৮, হাদীস নং ২৬২, পৃ. ১৪৫; আবু দাউদ ও নাসায়ী ] ।

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সুদখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না [ মুসতাদরাক আল হাকিম; খ.৪, হাদীস নং ২৮, তু. ড. মো. আমীর হোসাইন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬ ] ।

সামুরা ইবনু জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আজ রাতে (মি’রাজ রজনীতে) আমি স্বপ্নে দু’জন লোককে দেখলাম। তারা আমার নিকট এসে আমাকে নিয়ে একটি পবিত্র ভূমিতে গেল, আমরা চলতে চলতে একটা রক্ত নদীর তীরে পৌঁছে গেলাম। নদীর মধ্যখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল আর নদীর তীরে অন্য একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল যার সামনে ছিল কিছু পাথর। এরপর নদীর মাঝে দাঁড়ানো ব্যক্তি তীরের দিকে অগ্রসর হলে তীরে দাঁড়ানো লোকটি তার মুখমণ্ডল লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করল এবং সে আগে যেখানে ছিল সেখানে ফিরে যেতে বাধ্য করল। এভাবে যখনই সে উঠে আসার চেষ্টা করছে তখনই তীরের লোকটি তার মুখ লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারছে, যার ফলে সে (পূর্ব স্থানে) ফিরে যাচ্ছে এবং পূর্ববৎ অবস্থান গ্রহণ করছে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই লোকটি কে? (কি কারণে তার এ শাস্তি হচ্ছে বা তার এ অবস্থা কেন?) তারা (আমার সাথের লোক দু’জন) বলল, নদীর মধ্যে দাঁড়ানো যে লোকটিকে দেখলেন, সে একজন সুদখোর [ সাহীহ আল বুখারী, খ.২, কিতাবুল বুয়্যু, বাব ২৪, হাদীস নং ১৯৪০ (ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, মে ১৯৯৮), পৃ. ৩১৩-৩১৪ ] ।

বিদায় হজ্জের ভাষণেও রাসূল (সা) রিবার বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এ দিন সুদ নিষিদ্ধের ঘোষণায় তিনি বলেন, জাহিলী যুগের সমস্ত সুদ বাতিল করে দেয়া হলো। সর্বপ্রথম আমি আমার চাচা আব্বাস ইবন আব্দুল মুত্তালিবের সুদ বাতিল করলাম।

৮. অন্যান্য ধর্মের দৃষ্টিতে সুদ (Interest in other Religions)

পৃথিবীর সকল ধর্মেই সুদ নিষিদ্ধ। সুদ সকল ধর্মেই ঘৃণিত বিষয়। সুদ মানবতার দুশমন এবং মানুষের কল্যাণের পথে একটি বড় অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এজন্য বিভিন্ন ধর্ম সুদ নিষিদ্ধের ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছে। নিম্নে প্রধান কয়েকটি ধর্মের সুদ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা আলোচনা করা হলো:

৮.১ ইহুদী ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ (Prohibition of Riba by Judaism)

বনি ইসরাইলীদের মধ্যে আল্লাহ বহুসংখ্যক নাবী ও রাসূল প্রেরণ করেছিলেন, এই নাবী-রাসূলদের কাছে আল্লাহ তিনটি আসমানী কিতাবও নাযিল করেছেন। মূসার (আ) উপর নাযিল করেছিলেন তাওরাত এবং দাউদ (আ)-এর উপর নাযিল করেছিলেন যাবুর এবং ঈসা (আ) এর উপর ইনজিল। সকল আসমানী কিতাবেই সুদের লেনদেনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। কোরআনে বনি ইসরাইলীদের / ইহুদীদের ভর্ৎসনা করা হয়েছে, কেননা তারা সুদ খেতে নিষেধ করা সত্ত্বেও সুদ খেতো। আল্লাহ বলেন,

وَأَخْذِهِمُ الرِّبَا وَقَدْ نُهُوا عَنْهُ وَأَكْلِهِمْ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ

“তাছাড়া তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, যা থেকে তাদের নিষেধ করা হয়েছিল। আর অন্যায়ভাবে মানুষের অর্থ সম্পদ গ্রাস করার কারণে [ সূরা ৪: আন নিসা: আয়াত ১৬১ ] ।

বনী ঈসরাইলীগণ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সুদ গ্রহণ করতো। তারা অন্যায়ভাবে মানুষের অর্থসম্পদ গ্রাস করতো। তাদের কাছে নাযিলকৃত গ্রন্থে সুদ নিষিদ্ধ ছিল। এছাড়া ইহুদীদের মৌলিক আইন গ্রন্থ ‘তালমুদ’ এবং ‘মিশনাহ’- তে ইহুদিদের সুদি লেনদেন করতে নিষেধ করা হয়েছে; এমনকি, ইহুদিদের মধ্যে পরস্পর সুদ লেনদেনের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করা, গ্যারান্টি প্রদান করা অথবা সাক্ষী হতেও নিষেধ করা হয়েছে [ Hassan, Mabbob ul An Explanation of Rationale behind the prohibition of Riba in the Dotrines of three major Religions with special reference to Islam, [email protected] 0.75 ] ।

মূসার (আ) কাছে নাযিলকৃত তাওরাতের ৫টি পুস্তকের মধ্যে ৩টিতেই সুদ নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত আয়াত পাওয়া যায়।

সেগুলো হচ্ছে:

১। লেভিটিকাস (Leviticus) ৪ ২৫ ৪ ৩৫-৩৭ (তাওরাত): “If your brother meets with difficult times, you shall give him shelter and lodging, though he be a stranger or a sojourner, that he may live with you. Do not exact from him any interest (riba) over and above that which you have spent on him. You have the anger of God to fear. See to it that your brother has freedom to live with you. It is not permissible for you to receive interest (riba) on what you spend, or what you write off.[ উদ্ধৃত, ইমরান, এন, হোসাইন, The prohibition of Riba in the Quran and Sunnah, p. 64.]

“তোমার ভাই যদি দুঃসময়ে নিপতিত হয় তাহলে তুমি তাকে বাসস্থান ও আশ্রয় দেবে, সে যদি বিজাতীয় হয় অথবা অতিথি হয় তবুও। তাকে তোমার সাথে বাস করতে দাও। আর তার জন্য যা কিছু ব্যয় করবে তার উপর সুদ গ্রহণ করবে না। প্রভুকে ভয় কর। তোমার ভাই-এর অধিকার আছে তোমার সাথে বাস করার। তুমি যা খরচ কর বা মাফ করে দাও, তার উপরে সুদ গ্রহণ করা বৈধ নয়।” (লেভিটিকাস-এ ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে টারবিট অথবা মারবিট: এর অর্থ হচ্ছে ঋণদাতা কর্তৃক ঋণের উপর আদায়কৃত সুদ।)

২। এক্সোডাস (Exodus) ২২: ২৪ (তাওরাত) : “তোমরা যদি আমার কোন লোককে অর্থ ধার দাও, যারা গরিব, তবে তোমরা তার উত্তমর্ণ (মহাজন) হবে না এবং তার কাছ থেকে সুদ আদায় করবে না। [ উদ্ধৃত, মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন ও শাহ মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান, ইসলামী ব্যাংক কি ও কেন, বাংলায় অনুদিত, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ, পৃঃ ৮৬ ] ।

৩। ডিটারোনমি (Deuteronomy) : ২৩৪ ১৯-২০ (তাওরাত) ৪ “তোমরা তোমাদের স্বজাতীয় ভাইকে সুদে ধার দিবে না-অর্থের উপর সুদ, খাদ্য-সামগ্রীর উপর সুদ এবং অন্য যে কোন জিনিস যা ধার দেওয়া হয়, তার উপরে সুদ [ উদ্ধৃত, মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন ও শাহ মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৮৬ ] ।

ইহুদিদের কাছে প্রেরিত আল্লাহর নাবী দাউদ (আ) কে দেয়া হয়েছিল যাবুর কিতাব। ইহুদিরা এই গ্রন্থকে বলে ‘সামস’। এই গ্রন্থেও সুদ নিষিদ্ধ করার প্রমাণ পাওয়া যায়।

৪। Psalms: ১৫: ১,২,৫ ৪ “প্রভু। আপনার তাবুতে স্থান পাবে কে? আপনার পবিত্র পর্বত গিরিতে কে বাস করবে? যে ন্যায় পথে চলে, পুণ্যের কাজ করে এবং সর্বান্তকরণে সত্য কথা বলে; যে তার অর্থ সুদে খাটায় না অথবা নিরীহ লোকদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করে না [ উদ্ধৃত, তকি ওসমানী, পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৩ ] ।

৫। Proverbs: ২৮: ৮: “যে সুদ খায় এবং অন্যায় উপার্জনের দ্বারা তার সম্পদ-সম্পত্তি বৃদ্ধি করে, সে তা নিজের জন্য পুঞ্জিভূত করে, যা দরিদ্রদের দুর্দশা বাড়ায় [ উদ্ধৃত, তকি ওসমানী, পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৩ ] ।

৬। Nehemiah ৫: ৭: “অতঃপর আমি বিবেকের সাথে বুঝাপড়া করেছি এবং সম্ভ্রান্তদের ভৎসনা করেছি এবং তাদের নীতিব্যবস্থাকেও; তাদের বলেছি, তোমরা জবরদস্তি সুদ আদায় কর, তার সব ভাই থেকে এবং আমি তাদের বিরুদ্ধে এক মহা-সম্মেলনের ব্যবস্থা রেখেছি [ উদ্ধৃত, তকি ওসমানী, পুর্বোক্ত, পৃঃ ২৪ ] ।

বানি ইসরাইলের নিকট প্রেরিত আল্লাহর আর এক নাবী ছিলেন যুলকিফল, যাকে এযিকেল বলা হয়। তার কাছে আল্লাহ যে বিধান নাযিল করেন তাতেও সুদ নিষিদ্ধ ছিল। কেউ কেউ মনে করেন যুলকিফল একজন আর এযিকেল আর একজন নাবী ছিলেন।

৭। ক. এযিকেল (Ezekiel): ১৮:৮: “যে সুদে ধার দেয় না এবং সুদ গ্রহণও করে না, যে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে, যে বিবাদমান পক্ষের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতার সাথে মীমাংসা করে দেয়, যে আমার নির্দেশিত পথে চলে এবং আমার বিধি-নিষেধ পরিপালনে যত্নবান হয়, সেই হচেছ পুন্যবান, নিশ্চয়ই সে পরিত্রাণ লাভ করবে, বললেন সদা প্রভু [ উদ্ধৃত, তকি ওসমানী, পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৪ ] ।

খ. এযিকেল (Ezekiel): ২২: ১২: “এখানে তারা রক্তপাত করার জন্য উপঢৌকন গ্রহণ করেছে, তারা সুদ খেয়েছে এবং বৃদ্ধি আদায় করেছে, তারা লোভাতুর ও স্বার্থপর হয়ে জোর পূর্বক প্রতিবেশীদের সম্পদ কেড়ে নিয়েছে এবং তারা আমাকে ভুলে গেছে, বললেন সদা প্রভু [ উদ্ধৃত, তকি ওসমানী, পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৪ ] ।

৮.২ খ্রিস্টান ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ ( prohibition of Riba by Christianity )

ঈসা (আ) ছিলেন আল্লাহর নাবী। খ্রিস্টানগণ তাকে যীশু খ্রিস্ট বলে থাকে। তাঁর কাছে নাযিলকৃত গ্রন্থ ইনজীল- The Gospel of Jesus-তে সুদ নিষিদ্ধ ছিল।

(ধ) Gospel of St. Luke: ৬: ৩৫: “না, তোমাদের শত্রুদের অবশ্যই ভালবাসবে এবং তাদের সাহায্য করবে; এবং তাদের ধার দিবে তবে কোন বিনিময় নেবে না; আর তোমরা ‘অতি বড়’ পুরস্কার লাভকরবে। আর তোমাদের অবস্থান হবে ‘অতি উচ্চে’। কেননা তিনি বড়ই দয়াশীল, এমনকি অকৃতজ্ঞ ও পাপীদের প্রতিও [ উদ্ধৃত, ইমরান, এন, হোসাইন, পূর্বোক্ত। পৃঃ ৬৯ ] ।

আবার বলা হয়েছে, “ধার দাও, তার বিনিময়ে কিছু আশা না করে।” (Lend, hopping for nothing again) [ উদ্ধৃত, আফজালুর রহমান, ইকোনমিক ডকট্রিনস অব ইসলাম, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ২১]।

(ন) Gospel of St. Mathew: ২১: ১২-১৩: “যীশু আল্লাহর ঘরে (মাসজিদুল আকসায়) প্রবেশ করলেন এবং সেখানে যা কিছু বেচাকেনা হচ্ছিল তা সব বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং অর্থ বিনিময়কারীদের টেবিলগুলো উল্টিয়ে ফেললেন (যারা মানুষের সম্পদ শোষণ (ripping off) করে নিচ্ছিল) এবং বললেন, “এটা লিখিত আছে যে, আমার ঘরে ‘ইবাদাত করা হবে, কিন্তু তোমরা একে
চোরদের আড্ডাখানা বানিয়ে নিয়েছ।”

“উল্লেখ্য যে, তৎকালে দুই রকমের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। এক ধরনের মুদ্রা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রোমান মুদ্রা; এর উপর রোমান সম্রাটের মুর্তি খোদাই করা ছিল; এজন্য মসজিদের ভিতরে বসে এ মুদ্রা লেনদের করা বৈধ ছিল না। আর দ্বিতীয় প্রকার মুদ্রা ছিল যার উপর কোন ছবি ছিল না। অর্থ বিনিময়কারীরা এই উভয় মুদ্রা পরস্পর বিনিময় করত এবং মানুষকে প্রতারণা করে (রেশিও কম- বেশি করে) লাভবান হতো। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল সুদ। এজন্য যীশু এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন [ ইমরান, এন, হোসাইন, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৭০-৭১ ] ।

বাইবেলে বলা হয়েছে, তোমরা তোমাদের ভাইকে সুদে ঋন দেবেনা; অর্থের সুদ, খাদ্য-সামগ্রীর সুদ এবং অন্য যে কোন জিনিস, যা সুদে ধার দেয়া হয়, তার সুদ [ ১৫২. বিচারপতি ওয়াজিউদ্দীন, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৮ ] ।

৮.৩ হিন্দু ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ (Prohibition of Riba by Hinduism)

হিন্দু ধর্মে সুদকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে।

(a) হিন্দু ধর্মে ‘মনু’-এর (খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দী) বিধিমালায় সুদ লেনদেন অবৈধ বা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে [ উদ্ধৃত, তকি ওসমানী, পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৪ ] ।
(b) বেদঃ (২০০০-১৪০০ খ্রিস্টপূর্ব) বেদে কুষীন্দিনব (সুদখোর) শব্দটি বেশ কয়েকবার উল্লেখ আছে। এর দ্বারা ঋণদাতা কর্তৃক সুদ গ্রহণকে বুঝানো হয়েছে।
(c) সূত্র : (৯০০-১০০ খ্রিস্টপূর্ব) এতে বার বার এবং বিস্তৃতভাবে সুদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে।
(d) ভাসিশখা: তদানীন্তন কালের একজন প্রখ্যাত হিন্দু আইন প্রণেতা একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করেন; এতে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রীয়দের জন্য সুদ খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

প্রাচীন হিন্দু সমাজে একটি প্রবাদ চালু ছিল যে, “নগচ্ছেৎ শুন্ডিকায়লং”, অর্থাৎ সুদখোরের বাড়িতে যেয়ো না।

৮.৪ বৌদ্ধ ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ ( Disapproved of Riba by Buddism )

জাতাকাস’-এ (৬০০-৪০০ খৃস্টপূর্ব) (বৌদ্ধ ধর্মে) সুদকে ঘৃণা করা হয়েছে এবং সুদখোরদের ‘ভণ্ড তপস্বী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “Hypocritical ascetics are accused of practicing it.”

উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হচ্ছে যে, কেবল ইসলামই সুদ নিষিদ্ধ করেনি, বরং পৃথিবীর প্রধান প্রধান সকল ধর্মই সুদ নিষিদ্ধ করেছে।

৯. দার্শনিকদের দৃষ্টিতে সুদ (Philosophers view about Interest)

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো-এরিস্টটল থেকে শুরু করে আধুনিক দার্শনিকদের অনেকেই সুদকে ক্ষতিকর মনে করেছেন, একে ঘৃণা করেছেন এবং এর নিন্দা করেছেন। সুদের অশুভ পরিণাম নিয়ে যুগে যুগে সচেতন স্কলার দার্শনিক চিন্তাবিদগণ বিচলিত ছিলেন। নিচে কতিপয় দার্শনিকদের অভিমত পেশ করা হলো:

প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রিঃ পূঃ): প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক প্লেটো তাঁর ‘লজ’ (Laws) নামক পুস্তকে সুদের অনুশীলন তথা সুদ লেনদেনের নিন্দা করেছেন। তিনি সুদকে মানবতা বিরোধী, অন্যায় ও জুলুম এবং কৃত্রিম ব্যবসা বলে তীব্রভাবে সুদের বিরোধিতা করেছেন [ প্লেটো ‘দি লজ’, বুক-৫ ] ।

প্লেটো মনে করতেন টাকার নিজস্ব অন্তর্নিহিত কোনো শক্তি নেই এবং ঋণের উপর নির্দিষ্ট লাভ করা তথা সুদ নেয়া বেআইনি।

এরিস্টটল: প্লেটোর ন্যায় দার্শনিক এরিস্টটলও (৩৬৪-৩২২ খ্রি. পৃ.) কঠোর ভাষায় সুদের নিন্দা ও বিরোধীতা করেছেন। তিনি অর্থকে বন্ধ্যা মুরগির সাথে তুলনা করেছেন যা ডিম দিতে পারে না। তিনি বিশ্বাস করতেন, “A piece of money cannot beget another piece” অর্থাৎ “অর্থ কোনো অর্থ সৃষ্টি করতে পারে না”। তাঁর মতে, অর্থের একমাত্র স্বাভাবিক কাজ হচ্ছে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মানুষের পারস্পরিক অভাব পূরণে সাহায্য করা। তাঁর বিবেচনায় অর্থ ধার দিয়ে তার উপর সুদ আদায়ের মাধ্যমে সম্পদ পুঞ্জিভূত করার জন্য অর্থের ব্যবহার করা উচিত নয়। তিনি সুদকে কৃত্রিম মুনাফা আখ্যায়িত করে বলেছেন, “অন্যান্য পণ্যের ন্যায় অর্থ ক্রয়-বিক্রয় করা একটি কৃত্রিম ও জালিয়াতি ব্যবসা।” তিনি তাঁর পলিটিক্স শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, “The most hated sort (of wealth), and with the greatest reason, is usury, which makes gain out of money itself, and form the natural objects of it. For money was intended to be used in exchange, and not increase at interest of all modes of getting wealth, this is the most unnatural.[ এরিস্টটল, দি পলিটিকস, পৃঃ ১২৫৮ ] ।

অর্থঃ ‘সঙ্গত কারণেই সবচেয়ে ঘৃণিত হচ্ছে সুদ যার দ্বারা অর্থ নিজ থেকে অর্থ উপার্জন করে। কারণ অর্থের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা, সুদের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি করা নয়। সম্পদ অর্জনের পন্থা ও পদ্ধতিসমূহের এ পদ্ধতিটি সবচেয়ে অস্বাভাবিক।

সেন্ট টমাস একুইনাস (১২২৫-১২৭২): সুদের বিরুদ্ধে সেন্ট টমাস একুইনাসের যুক্তি বিশেষ প্রনিধানযোগ্য। তিনি The positive theory of interest গ্রন্থে বলেছেন, অর্থ থেকে অর্থের ব্যবহার পৃথক করা যায় না। তাই অর্থ ব্যবহার করা মানে অর্থকে নিঃশেষ বা খরচ করে ফেলা। এক্ষেত্রে একবার অর্থের দাম নেওয়ার পর পুনরায় অর্থের মূল্য নেওয়া হলে, একই পন্যকে দু’বার বিক্রয় করার অপরাধ হবে, অথবা দ্বিতীয়বার এমন জিনিসের দাম নেওয়া হবে, যা প্রকৃতপক্ষে বিক্রেতার দখলে নেই। তাঁর মতে, নিঃসন্দেহে এটি একটি অতি বড় অবিচার ও জুলুম।

সুদকে যারা সময়ের মূল্য বলে দাবি করেন তাদের যুক্তি খণ্ডন করে তিনি বলেছেন, “সময় হচ্ছে একটি সাধারণ (Common) সম্পদ; সময়ের উপর ঋণদাতার যেমন অধিকার আছে, ঋণগ্রহীতারও ঠিক তেমনি অধিকার রয়েছে; অন্যান্য সকল মানুষেরই সময়ের উপর একই সমান অধিকার আছে। এমতাবস্থায় ঋণদাতা কর্তৃক ঋণগ্রহীতার নিকট সময়ের মূল্য দাবি করা একটা ভণ্ডামি ও অসাধু ব্যবসা।[ রোম বাওয়ার্ক: দি পজিটিভ থিওরি অব ইন্টারেষ্ট, পৃঃ ৩৪ ] ।

মিসাব্যু: ইটালীয় লেখক মিসাব্যু সুদকে অযৌক্তিক বলেছেন; তিনি বলেছেন, “একদিকে অর্থ হচ্ছে একটি প্রতীক মাত্র, এর নিজস্ব কোন ব্যবহার নেই; অপরদিকে বাড়ি-ঘর ও আসবাবপত্রের ন্যায় অর্থের কোন ক্ষয়-ক্ষতিও নেই।” সুতরাং তার মতে অর্থের উপর সুদ ধার্য করার কোন যুক্তি নেই [ বোম বাওয়ার্ক, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩৪ ] ।

হাম্মুরাবি (১৮১০-১৭৫০ খ্রিস্টপূর্ব): প্রাচীন বেবীলনে প্রথম রাজবংশের ষষ্ঠ শাসক হাম্মুরাবি মতবাদেও সুদ নিষিদ্ধ ছিল। তাঁর প্রণীত শাসন বিধিতে সুদী লেনদেনকে নিষিদ্ধ করা হয়।

মহাকবি দান্তে (১২৬৫-১৩২১): ইতালীয় সাহিত্যের মহাকবি দান্তে তাঁর ডিভাইন কমেডিতে- ‘সুদখোরদের ঠাঁই দিয়েছেন নরকের অগ্নিবৃষ্টিময় সপ্তম বৃত্তে।’

জন লক: পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তাবিদ জনলক (১৬৩২-১৭০৪) বলেছেন, সুদ ব্যবসা-বাণিজ্যকে ধ্বংস করে দেয়, মুনাফার চেয়ে সুদ বেশি সুবিধাজনক। ব্যবসায়ীরা হারাম সুদ প্রাপ্তির নিশ্চিত লোভে ব্যবসা পরিহার করে সুদে অর্থ লগ্নী করে। (High interest decays trade. The advantage from interest is greater than the profit from trade which makes the rich merchants give over and put out their stock to interest and lesser merchants break.)[ উদ্ধৃত, কীনস, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩৪৪ ] ।

জাস্টিনিয়ান: রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ান তাঁর কর্পাস জুরিস (Corpus juris) গ্রন্থে মূলধনের ওপর সুদ আরোপের মাধ্যমে তা বৃদ্ধি করতে নিষেধ করেছেন [ আর পি মেলোনী, Usury in Greck, Roman and Rabbinical thought, ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটি প্রেস, ট্রাডিশিও, নিউইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৭১, পৃ. ৯৫] ।

থিউডোজিয়াস: খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৬ সালে থিউডোজিয়াস (Theodosius) ইউজারী গ্রহীতা বা সুদখোরদের ওপর অবৈধভাবে নেয়া সুদের জন্য এর চারগুণ জরিমানা আদায়ের ডিক্রি জারি করেন [ আর পি মেলোনী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৪ ] ।

লর্ড জন মেনার্ড কিনস (১৮৮৩-১৯৪৬): গ্রেটব্রিটেনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা লর্ড জে. এম কিনস অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলার জন্য সুদের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা প্রমাণ করে তিনি বলেছেন- এভাবেই পুঁজিবাদী সমাজের অনেক দোষত্রুটি দূর করা সম্ভব। সুদভিত্তিক বিনিয়োগের পরিবর্তে উৎপাদনমুখী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন [ জে. এম. কিনস, দি জেনারেল থিওরী অব এমপ্লয়মেন্ট, ইন্টারেস্ট এ্যান্ড মানি, ম্যাকমিলান, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, পৃ. ১৬৬ ] ।

কিনস দেখিয়েছেন সুদের জন্যই বিনিয়োগ সীমিত হয়ে পড়ে। তাঁর মতে, বিশ্বের সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক বিপর্যয় এমনকি বেকার সমস্যার সৃষ্টি হয় সুদখোরীর কারণে। যে দেশে সুদের হার যত কম সে দেশের সভ্যতা-সংস্কৃতি তত উন্নত এবং স্থায়ী বলে ধরে নিতে হবে। যেখানে সুদ একেবারে নিষিদ্ধ, সেখানকার অবস্থা সন্তোষজনক পর্যায়ে উপনীত হতে বাধ্য [ উদ্ধৃত ডক্টর মুহাম্মদ ইউসুফুদ্দীন, ইসলামের অর্থনৈতিক মতাদর্শ, দ্বিতীয় খন্ড, আব্দুল মতীন জালালাবাদী অনুদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, মে ২০০৫, পৃ. ৫৩ ] ।

কার্ল মার্কস: আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদের উদগাতা কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) সুদের কারবারী বা ব্যবসায়ীদেরকে বিকট শয়তান হিসেবে অভিহিত করেছেন। সুদখোরদেরকে তিনি তুলনা করেছেন ডাকাত ও সিঁধেল চোরের সাথে। তিনি লিখেছেন, ‘সুদখোর হচ্ছে একটি বিকট শয়তান।… সে প্রত্যেকটি জিনিসকে লন্ডভন্ড করে দেয়। আমরা যেমন চোর, ডাকাত এবং সিঁধেল চোরকে কঠিন শাস্তি দেই তেমনি সুদখোরও কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য'[ কার্ল মার্কস, ডাস ক্যাপিটাল, খ. ২, পৃ. ৬৫২; উদ্ধৃত ডক্টর মুহাম্মদ ইউসুফুদ্দীন, ইসলামের অর্থনৈতিক মতাদর্শ, দ্বিতীয় খন্ড, আব্দুল মতীন জালালাবাদী অনুদিত, মে, ২০০৫, পৃ. ৪৪ ] ।

জেমস রবার্টসন: প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জেমস রবার্টসন তাঁর বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থে লিখেছেন, সুদ ক্ষতিকর, ভয়াবহ অভিশাপের নাম। সুদে ঋণ দিয়ে অর্থ বাড়াতে হবে (Money must grow) এই অনুজ্ঞা পরিবেশগত দিক থেকে (ecologically) ধ্বংসাত্মক। এরফলে মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ও সেবা উৎপাদনের কাজ থেকে বিমুখ হয়ে যায় এবং অর্থ থেকে অর্থ উপার্জনে মগ্ন হয়ে পড়ে [ ১৬৩. জেমস রবার্টসন, Transforming Economic Life: A Millennial challenge, Green cook, Devon, 1998, উদ্ধৃত অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, সুদ সমাজ অর্থনীতি, পূর্বোক্ত, পৃ-২৩০ ]
অন্যান্য দার্শনিক : ক্যাটোস, কাইসীরো, সেনেকা এবং পোটাস প্রমূখ দার্শনিকগণও অর্থকে বন্ধ্যা আখ্যায়িত করেছেন এবং অর্থের উপর সুদ ধার্য করাকে অযৌক্তিক বলে অভিমত দিয়েছেন।

এছাড়া রোমের আইন প্রণেতাগণ, হিন্দু দার্শনিকবৃন্দ, ইহুদি ও খ্রিস্টান যাজকগণও সুদকে ঘৃণা করতেন। খ্রিস্টান ধর্মের শুরু থেকে সংস্কার আন্দোলনের অভ্যুদয় এবং রোমে পোপ নিয়ন্ত্রিত চার্চ হতে অন্যান্য চার্চের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সুদ নিষিদ্ধ ছিল। সম্প্রতি পাশ্চাত্যের দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদগণও সুদের ধ্বংসকারী ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করে শিউরে উঠেছেন। তারা সুদের ধ্বংসাত্মক পরিণতি দেখে আতকে উঠেছেন; তারা সমস্বরে আওয়াজ তুলেছেন সুদের এই ভয়াবহ পরিণতি থেকে মানব সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য।

১০. ইসলামে সকল প্রকার রিবা হারাম ( All kinds of Riba is prohibited in Islam )

ইসলামী শারী’আতে হারাম ঘোষিত বিষয়ের মধ্যে সুদ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা সবচেয়ে বেশী কঠোর।

মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জের ভাষণে সব ধরনের রিবা সম্পর্কে সাবধান করেছেন। মহানবী (সা) এর শাসনামল থেকেই মুসলিম বিশ্বে সুদ এর ধ্বংসকর প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে শত শত বছর (প্রায় ১২শ) উন্নত সমৃদ্ধ মুসলিম বিশ্ব সুদ বিহীন লেনদেন আর লাভ-ক্ষতি, বাই এবং ইজারা ভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে বৃটিশ আর ফরাসীরা মুসলিম বিশ্ব কব্জা করে নিয়ে চালু করে দেয় মুসলিমদের চুষে খাওয়ার জাল সুদ প্রথা। বিংশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্ব তাদের উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলেও মানসিক ও আদর্শিক গোলামী প্রথা সমূহ থেকে মুক্ত হয়নি। সুদ সেগুলোর অন্যতম। তবে কুড়ি শতকে শ্লথ গতিতে হলেও পুনরায় চালু হতে শুরু করেছে ইসলামী অর্থনীতি। এরি মধ্যে অনেক দেশেই চালু হয়েছে ইসলামী ব্যাংক, তাকাফুল ও অ-ব্যাংক ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রেক্ষিতেই আধুনিককালে কেউ কেউ বলেন যে, আল কোরআনে যে রিবার কথা বলা হয়েছে তা প্রাক নুবুওয়াতী যুগের প্রচলিত এক ধরনের ‘ধার’ পদ্ধতি। তারা রিবা ও ইউজারির মধ্যে পার্থক্য এবং রিবার ‘ব্যক্তিগত’ ও ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ ধরন সৃষ্টি করেন। আসলের উপর যে কোন হ্রাস-বৃদ্ধিই হলো রিবা এবং তা নিষিদ্ধ। যে কোন ধরনের রিবা ইসলামের অনুসারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কঠোরভাবে এড়িয়ে চলতে হবে।

ইসলামে সকল প্রকার রিবা হারাম হওয়ার কয়েকটি দিক নিম্নরূপ:

১। আধুনিক ব্যাংকিং সুদ হারাম। আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থায় ঋণের সঙ্গে সুদ যুক্ত হওয়ার কারণে তা হারাম লেনদেনে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে রিবার বিলোপ ইসলামী ব্যবসার একটি অপরিহার্য অংশ।
২। ব্যবসার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ঋণের ক্ষেত্রে গৃহীত সুদ হারাম।
৩। ভোগ ও ব্যয় ব্যবহারের জন্য গৃহীত ঋণের বিপরীতে গৃহীত সুদ হারাম।
৪। রিবা আন্ নাসীয়া কিংবা রিবা আল ফাদল যাই হোক অল্প পরিমাণে হোক বা বেশি সুদ হোক সুদ মাত্রই হারাম।
৫। রিবা ভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থা আসলে টাকা দিয়ে টাকা ধরার একটি ন্যাক্কারজনক কৌশল। এই ব্যবস্থা মানুষকে সাধারণভাবে দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করে রিয়েল সেক্টর ইকোনোমিকে দুর্বল করে এবং আর্থিক সেক্টরে ফটকা লেনদেন বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকটকে ঘনীভূত করে।
৬। সুদের লেনদেনে সহযোগিতা করা হারাম।

সকল মাযহাবের ফাকীহগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, সুদ সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয়। সাইয়েদ কুতুব শহীদ (১৯০৬-১৯৬৬) এর উদ্ধৃতি দিয়ে ড. শহীদ হাসান সিদ্দিকী বলেন, Interest (Riba) and Islam cannot remain together in a Muslim Society.[ Shahid Hasan Siddiqui, Islamic Banking (Karachi: Royal Book
Company, 1994), P.15-17.] আল-কোরআন ইতোপূর্বে উল্লেখিত জাহেলী যুগে প্রচলিত সকল প্রকার ‘রিবা’কে হারাম ঘোষণা করেছে। ‘রিবা’ ঋণের লেনদেন থেকে উদ্ভূত হোক বা বাকী ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতার দেনার ওপর ধার্যকৃত অতিরিক্ত হোক অথবা এসব ‘রিবা’ আরোপ করার পদ্ধতি যাই হোক না কেন, আল-কোরআন একে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু ‘রিবা’র আয়াতসমূহ নাযিলের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও কিছু এমন লেনদেনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন যাকে আরববাসীরা ইতোপূর্বে ‘রিবা’ বলে জানতো না। মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপলব্ধি করলেন যে, আরবে বিদ্যমান বাণিজ্যিক পরিবেশে এমন কিছু দ্রব্য বিনিময় (ইধৎঃবৎ) প্রথা চালু আছে যা মানুষকে ‘রিবা’র দিকে ঠেলে দিতে পারে অথবা এর মাধ্যমে ‘রিবা’র অনুপ্রবেশ ঘটার আশংকা রয়েছে [ মুফতি মুহাম্মাদ তাকী উসমানী, সুদ নিষিদ্ধ পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের ঐতিহাসিক রায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩০ ] ।

রিবার নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঋণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তাছাড়া ঋণের আসল বা দেনার ওপর ধার্যকৃত অতিরিক্ত কম বা বেশি হোক কোন অবস্থায়ই রিবার নিষেধাজ্ঞার কোন ব্যতিক্রম করা হয়নি। মোটকথা প্রচলিত সকল প্রকার সুদ চাই তা ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রে হোক অথবা ব্যক্তি পর্যায়ের লেনদেনে হোক, রিবার সংজ্ঞার আওতাভুক্ত। অনুরূপভাবে সরকারী ঋণের উপর ধার্যকৃত সব ধরনের সুদ ঋণ অভ্যন্তরীণ হোক বা বহির্বিশ্বের কোন উৎস থেকে হোক, রিবার মধ্যে গণ্য এবং আল কোরআনে সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ [ পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৫-১২৬ ] ।

মনিষীদের গবেষণায় দেখা যায় যে, ইসলাম কোন বিশেষ ধরনের সুদকে হারাম করেনি বরং সকল প্রকার সুদকেই নিষিদ্ধ করেছে; সুদের হার উচ্চ হোক বা নিম্ন হোক, চক্রবৃদ্ধি সুদ হোক বা সরল সুদ হোক, ইসলামে সব সুদই হারাম। গবেষকগণ প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, তদানীন্তন আরবে কেবল ভোগ্য ঋণের সুদই চালু ছিল তা নয়, বরং বাণিজ্যিক ঋণ তথা উৎপাদনশীল ঋণের উপরও সুদের প্রচলন ছিল। বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদকে হারাম ঘোষণার সাথে সাথে তাঁর চাচা ‘আব্বাস ইবন ‘আবদুল মুত্তালিবের পাওনা যাবতীয় সুদ ছেড়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ‘আব্বাস (রা.) এর কাছ থেকে বানু সাকিফ গোত্র যেসব ঋণ নিয়েছিল তা ভোগের জন্য নয় বরং ব্যবসার উদ্দেশ্যেই নিয়েছিল। মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সুদকেও নিষিদ্ধ করেছেন। গবেষকগণ এটাও প্রমাণ করেছেন যে, মহাজনী সুদী কারবার আর আধুনিক ব্যাংকের সুদী কারবারের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে কোন পার্থক্য নেই; বরং বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন মহাজনী সুদের তুলনায় আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার সংগঠিত সুদ অনেক বেশী ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক। বর্তমানে সুদী ব্যাংকগুলো নতুন নতুন পন্থায় তাদের সুদী কারবার চালিয়ে যাচ্ছে।

১১. রিবা হারাম হওয়ার কারণ (Reasons of Prohibition of Riba)

ইসলামী চিন্তাবিদ, ফাকীহ, ইসলামী অর্থনীতিবিদ ও গবেষকগণ সুদ হারাম হওয়ার কারণ সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন ও ব্যাপক গবেষণা করেছেন। তাঁরা সুদকে মানবতার জন্য একটি জঘন্য অভিশাপরূপে চিহ্নিত করেছেন। রিবা এক ভয়াবহ অভিশাপ। রিবা বা সুদ হারাম হওয়ার কারণসমূহ নিম্নরূপ:

১. রিবা সমাজকে কলুষিত করে- Riba corrupts Society.

২. বিনিময় না দিয়ে অন্য মানুষের সম্পদ রিবার মাধ্যমে নিয়ে নেয়া হয়। Riba implies improper appropriation of other people’s property. বিনিময় ছাড়া মূলধনের অতিরিক্ত গ্রহণ করাই সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ। বিনিময়হীনতাই রিবা নিষিদ্ধ হওয়ার প্রধানতম কারণ। আল্লাহ তা’আলা সুদকে মূলত: বিনিময় না দিয়ে পরের সম্পদ খাওয়া বা ভক্ষণ বা গ্রাস বা আত্মসাৎ করার বড় হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরেছেন।

৩. সুদ প্রবৃদ্ধির উপর সীমারেখা টেনে দেয়। Riba’s ultimate effect is negative growth.

8. সুদ মানুষের ব্যক্তিত্ব, মনুষত্ব বিনষ্ট করে, Riba demeans and diminishes human personality.

৫. রিবা বেইনসাফীর অন্য নাম Riba is unjust.[ ড. মুহাম্মাদ নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী, Riba, Bank Interest and the Rationale of its prohibition, visiting Sholars Research series No. 2, IDB & IRTI, Jeddah, 2004, P. 41 ] . রিবা নিষিদ্ধ হওয়ার মৌলিক কারণ হচ্ছে যুলম বা অবিচার ও বেইনসাফী (Injustice)। সুদ নিদারুণ বে-ইনসাফীর জন্ম দেয়। সুদের শোষণ ও যুলুম অনেক বেশি বিস্তৃত ও ব্যাপক; আর এর ক্ষতি এবং ধ্বংসও ব্যাপক এবং মারাত্মক।

৬. সুদ স্বার্থপরতা, হিংসা ও ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। ইসলাম কঠোর পরিশ্রম ও ব্যক্তিগত তৎপরতার মাধ্যমে সম্পদ আহরণের বিপরীতে রিবার মাধ্যমে সম্পদ সঞ্চয়কে স্বার্থপরতা বলে মনে করে।

৭. সুদ অর্থনীতি ও সমাজ ধ্বংস করে। সুদের ধ্বংসকারিতা বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে আলোচিত। বস্তুত সুদের মতো সমাজ বিধ্বংসী অর্থনৈতিক হাতিয়ার আর দ্বিতীয়টি নেই।

৮. সুদ গযব ও আযাবের বাহন-সুদ পৃথিবীতে আল্লাহর গযব নিয়ে আসে।

৯. ভয়াবহ পাপ: ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় যাবতীয় অসৎ কাজের মধ্যে সুদকে সবচেয়ে বড় পাপের জিনিস বলে গণ্য করা হয়েছে। রিবা লেনদেনের পাপ হচ্ছে সর্বাধিক জঘণ্য, কুৎসিত এবং বীভৎস ধরনের। মহানবী (সা) বলেন, জেনে বুঝে সুদের এক দিরহাম গ্রহণ করা ছত্রিশবার ব্যভিচার করার চেয়েও জঘণ্য অপরাধ [ মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং- ২১৮৫৪ ] ।

১০. জাতীয় বিপর্যয় সুদের বিদ্যমানতা একটি জাতিকে বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেয়।

১১. জান্নাত লাভে ব্যর্থতা সুদী লেনদেন যারা করবে, তাদের স্থান জাহান্নামে হবে বলে আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন:

وَمَنْ عَادَ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ.

“কিন্তু যারা (সুদের) পুনরাবৃত্তি করবে, তারা হবে ‘আসহাবুন নার’ (আগুনের অধিবাসী), সেখানে তারা থাকবে চিরকাল [ সূরা আল বাকারা, আয়াত-২৭৫ ] ।

আল্লামা ‘আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইব্রাহীম আল বাগদাদী সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ বলতে গিয়ে লিখেছেন, সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ, বিনিময় ছাড়াই মূলধনের অতিরিক্ত গ্রহণ [ তাফসীরে খাযেন, খ.১, পৃ. ২৯৬-৩০০, তু. অধ্যাপক মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন, আল-কোরআনের দৃষ্টিতে সুদ, থটস অন ইকনমিকস্, ভলিউম ১৫, নম্বর ৩, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০৫, পৃ. ৬৮ ] ।

আল মারাগী বলেছেন, “সুদ বিনিময় ছাড়াই পরের ধন কেড়ে নেয়, এর চেয়ে বড় যুগ্ম আর কি হতে পারে। প্রত্যেকটি সম্পদেরই একটা হক রয়েছে, মর্যাদা রয়েছে। তা অন্যায় পথে জোরপূর্বক নিয়ে নেওয়ার কোন অধিকারই কারও থাকতে পারে না। ঋণ বাবদ গৃহীত মূলধন ঋণগ্রহীতার কাছে থাকলে সে তা দিয়ে কোন না কোন ফায়দা লাভ করেছে, কিংবা ব্যবসা করে লাভ করেছে এই কারণ দেখিয়ে ঋণদাতার জন্য প্রদত্ত ঋণ পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত গ্রহণ জায়েয করতে চাওয়া একটা ভিত্তিহীন ব্যাপার। কারণ প্রথম কথাটি অনিশ্চিত অর্থাৎ মুনাফা নাও হতে পারে। আর দ্বিতীয় কথাটি নিশ্চিত, তা দিতেই হবে। নিশ্চিত দ্বারা একটি অনিশ্চিত জিনিসকে বাস্তব মনে করানো কোনক্রমেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না [ আল মারাগী, তাফসীরে মারাগী, খ.৩, পৃ. ৮৪-৮৭; তু. মাহাম্মাদ আবদুর রহীম, আল-কোরআনের অর্থনীতি, খ.১, (ঢাকা: ইফা বা, ১৯৯০), পৃ. ২৫৩-২৫৪ ] ।

১২. ইসলামে রিবার ব্যাপারে কঠোর নিন্দা জানানোর কারণ

বর্তমান পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই রিবা বা সুদকে আইনগত বৈধতা দেয়া হয়েছে। শুধু বৈধতা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করা হয়নি বরং আইন আদালতের মাধ্যমে কিভাবে জোর জবরদস্তিমূলক ভাবে সুদ আদায় করতে হবে তার সব ধরনের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ মানব জাতিকে সুদের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য তা হারাম করেছেন।

ইসলামে রিবার বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা জানানোর কারণ সমূহ নিম্নরূপ:

১. সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ: রিবা গুটিকতক মানুষের হাতে সম্পদ সঞ্চিত হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করে। এতে অপরাপর মানুষের প্রতি তাদের মানবিক মনোভাব মুছে যায়। অন্যের সমস্যাকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় না।
২. উপকারভোগীর ঝুঁকি না নেয়া ইসলাম এমন কোনো আর্থিক কর্মকান্ড অনুমোদন করে না, যেখানে উপকারভোগী সম্ভাব্য ক্ষতির ঝুঁকি বহনের অংশীদার হয় না।
৩. স্বার্থপরতা: ইসলাম কঠোর পরিশ্রম ও ব্যক্তিগত তৎপরতার মাধ্যমে সম্পদ আহরণের বিপরীতে সুদ বা ইউজারির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনকে স্বার্থপরতা বলে মনে করে।
৪. অভাব সংকোচন: মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সুদ সমৃদ্ধি আনে কিন্তু সুদের আসল পরিণতি হলো অভাব ও সংকোচন (ঝপধৎপরঃ ধহফ ঈড়হঃৎধপঃরড়হ) [ মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং-৩৭৫৪ ] ।
৫. জুলুমের দায়ভার সাধারণ জনগণ কর্তৃক বহন সুদী ব্যবস্থা সকল জুলুমের চূড়ান্ত দায়ভার মূলত: সাধারণ জনগণকেই বহন করতে হয়।

১৩. সুদের কুফলসমূহ (Effects / Impacts of Riba)

বর্তমান যুগের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সামাজিক অস্থিরতার মূলে রয়েছে সুদের কুপ্রভাব। সুদ প্রকৃতপক্ষে অনিশ্চয়তারই একটি প্রকার। যা ফটকাবাজি, নিষ্ঠুরতা, লোভ, অনৈতিকতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের দুয়ার খুলে দেয়। সুদ মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, অবিশ্বাস, অস্থিরতা ও অপচয় সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। মানব জাতির ইতিহাস অধ্যয়ন করে এবং আর্থ সামাজিক গবেষণা হতে সুদের নানাবিধ কুফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। সুদের আর্থ সামাজিক ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি প্রমাণিত।

সুদের কুফল অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, যুগশ্রেষ্ঠ শরীয়াহ বিশেষজ্ঞ ও ধর্মীয় চিন্তাবিদগণ সুদের কুফল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, সুদের অশুভ কালো হাত বা অনিষ্ট কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এর কুফল ও ধ্বংসকারিতা মানবজীবনের নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়। সুদের কুফলগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলেই বুঝা যাবে কেন সুদ চিরতরে হারাম করা হয়েছে। বস্তুত সুদের নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষতির সর্বনাশা সয়লাব থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করতে ইসলাম সকল প্রকার সুদকে চিরতরে হারাম ঘোষণা করেছে।

সুদের কুফলসমূহ: সুদের কুফলসমূহকে ৫টি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। যেমন:

১। নৈতিক কুফল।
২। সামাজিক কুফল।
৩। অর্থনৈতিক কুফল।
৪। রাজনৈতিক কুফল।
৫। আন্তর্জাতিক কুফল।

১৩.১ সুদের নৈতিক কুফল (Moral Impact of Riba)

সুদ নৈতিকতা বিরোধী। সুদের নৈতিক কুফল সমূহ নিম্নরূপ:

১। সুদ মানুষের মধ্যে লোভ, স্বার্থপরতা ও কার্পণ্য সৃষ্টি করে (Riba nurtures greed, selfishness and misery among human beings): সুদ মানুষের মধ্যে লোভ-লালসা, অর্থলিপ্সা, নির্মমতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, কৃপণতা, নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতা জন্ম দেয়। সুদের কারবারিরা স্বার্থপর, অর্থলিম্পু ও কৃপণ হয়ে থাকে। সুদখোরদের মধ্যে ক্রমান্বয়ে স্বার্থপরতা, লোভ ও কৃপণতা ইত্যাকার অসৎ দিকসমূহ এমনভাবে বিকাশ হতে থাকে যে তারা সমাজের অন্যান্য লোকের সাথে সাইলকের [ মধ্যযুগে সেক্সপিয়ারের বিখ্যাত মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকের অন্যতম চরিত্র সাইলক। নির্দিষ্ট সময়ে সুদে-আসলে টাকা ফেরত না পেলে গায়ের গোশত কেটে নেবে- এ শর্তে সাইলক ঋণ দিয়েছিল। সুদ মানুষকে কত নির্মম এবং সংকীর্ণ করে তোলে সাইলক চরিত্রটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যতদিন পৃথিবী টিকে থাকবে ততদিন সুদখোর সাইলককে মানুষ ঘৃন্যতম ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করবে ] । মত আচরণ করতেও কুণ্ঠিত হয় না। ড. আনোয়ার ইকবাল কোরেশী যথার্থই বলেছেন যে, সুদভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থা সুদখোরদের মধ্যে অর্থলিপ্সা, লোভ, স্বার্থপরতা ও সহানুভূতিহীন দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করে। ১৭৪ সুদ কৃপণতা বাড়ায়। সুদ গ্রহীতারা প্রায়শই স্বার্থপর, কৃপণ ও চরম ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়। সুদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, অর্থ সঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষা থেকে শুরু করে সুদী কারবারের বিভিন্ন পর্যায়ে যাবতীয় কর্মকাণ্ড, স্বার্থান্ধতা, কার্পণ্য, সংকীর্ণতা, মানবিক কাঠিণ্য ও অর্থপূজার পারদর্শিতার প্রভাবাধীনে পরিলক্ষিত হয়। ফলে সুদ মানুষের মধ্যে অর্থলিপ্সা, লোভ, স্বার্থপরতা ও সহানুভূতিহীন মানসিকতার জন্ম দেয় [ ড. আনোয়ার ইকবাল কোরেশী, ইসলাম এন্ড দি থিওরি অব ইন্টারেস্ট, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৮ ] ।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে সুদ ব্যক্তি, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কত মারাত্মক। এ ছাড়াও সুদের আরও বহু ক্ষতিকর দিক রয়েছে। সুদ এক বড় ধরনের অপরাধ যা আল্লাহর ক্রোধকে প্রজ্জ্বলিত করে এবং সুদখোররা আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।

২। অপরের অসহায়ত্বই টার্গেট সুদের অন্যতম নৈতিক কুফল হচ্ছে সুদখোর ব্যক্তি অপরের উপকার করা তো দূরের কথা অপরকে বিপদ-মুসিবতে অসহায় দেখতে চায় যাতে অধিক সুদ পেতে পারে। সুদী কারবারে নিয়োজিত ব্যক্তিরা সব সময় অধিক সুদ প্রান্তীর পিছনে ছোটে। দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে শোষণই প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়। সুদ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের দুর্দশা আরো বাড়িয়ে দেয়।

৩। প্রত্যয়, ঈমান ও নৈতিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সুদ ব্যক্তির প্রত্যয়-বিশ্বাস-ঈমান ও নৈতিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সুদের পেছনে ছুটে ব্যক্তি নীতি- নৈতিকতা ও মূলবোধ হারিয়ে ফেলে। সুদখোর নিশ্চিত ও নির্ধারিত আয় পেয়ে খুশী হয়। অথচ কারবারে যারা নিজেদের শ্রম, যোগ্যতা খাটায় তাদের মুনাফার কোন নিশ্চয়তা থাকে না। এটি ইনসাফ ও নৈতিকতা বিরোধী।

৪ । বিবেকহীন জনগোষ্ঠী তৈরি: রিবা বিবেকহীন একটি জনগোষ্ঠী তৈরি করে। এরা সম্পদের লালসায় এতোটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে যে, তারা তাদের হিতাহিত জ্ঞানও হারিয়ে ফেলে। এদের ভালো-মন্দ বিচার করার অনুভুতি লোপ পায়। অর্থের লিন্সায় সুদখোর আত্মস্বার্থ প্রণোদিত প্রাণীতে পরিণত হয়। অধিক সুদ প্রান্তীর আশায় সুদখোররা এতোই মত্ত হয়ে ওঠে যে, মন্দই তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে। এতে অন্য মানুষের প্রতি তাদের মানবিক মনোভাব মুছে যায়।

৫। রিবার সাথে জড়িত সবাই অপরাধী হাদীসে সুদের সাথে জড়িত সবাইকে অপরাধী গণ্য করা হয়েছে।

৬। লোভ সৃষ্টি: সুদখোররা লোভের বশবর্তী হয়ে সুদের কারবার করে। সুদ ব্যবস্থায় ঋণগ্রহীতা সুদখোরকে নির্দিষ্ট হারে সুদ দেয়। পাশাপাশি মূলধনও ফেরত দেয়। এতে সুদখোরদের লোভ বেড়ে যায়।

৭। মন্দ চরিত্রের ফলশ্রুতি: সুদ মন্দ চরিত্রের ফল। মন্দ চরিত্রের দিকগুলো সুদ মানুষের মধ্যে বিকশিত করে। সুদ মানুষকে চরিত্রবান হতে দেয় না। কেননা চরিত্রবানের পক্ষে শোষণ করা সম্ভব নয়।

৮। জনকল্যাণে ভূমিকা না থাকা জনকল্যাণে সুদের কোন ইতিবাচক ভূমিকা নেই। কোন হত দরিদ্র অসহায় মানুষের প্রতি সুদখোরদের মনে একবিন্দু দয়া-মায়া জাগে না। তারা হয় নির্দয়-নির্মম। সৌজন্য এবং দানশীলতা বলতে যা বুঝায় তা তাদের মধ্যে থাকে না।

১৩.২ সুদের সামাজিক কুফল (Social Impact of Riba)

রিবা বা সুদ একটি সামাজিক ব্যাধি। সমাজে সুদের কুফল অত্যন্ত ব্যাপক। রিবা সমাজে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করে। সুদ সমাজকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়। সুদের সামাজিক কুফলসমূহ নিম্নরূপ:

১। সুদ সমাজে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে (Riba enhances hatred and enmity in Society): সুদখোর মহাজন ও পুঁজিপতিরা সুদের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষদের সম্পদ কুক্ষিগত করে নেয়। ঋণগ্রহীতারা দিবা-রাত্র পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে সামান্য অর্থ উপার্জন করে, তার প্রায় সবটাই ঋণদাতাদের সুদ পরিশোধ করার জন্য ব্যয় করতে বাধ্য হয়।

কখনো কখনো সুদআসলে ঋণ শোধ দিতে গিয়ে ভিটেমাটি পর্যন্ত সুদখোরদের হাতে তুলে দিতে হয়। এ জন্য সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠী সুদখোর ঋণদাতাদেরকে বন্ধু ভাবার পরিবর্তে শত্রু মনে করে। সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) (১৯০৩-১৯৭৯) লিখেছেন, ‘যে সমাজে ব্যাপকভাবে সুদখোরী প্রচলিত থাকে তাতে এই সুদখোরীর কারণে দুই প্রকারের নৈতিক রোগ দেখা দেয়, তা হলো সুদগ্রহীতাদের মধ্যে লোভ-লালসা, কার্পণ্য ও স্বার্থপরতা; আর সুদদাতাদের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা [ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৭ ] ।

সাইয়েদ কুতুব শহীদ (১৯০৬-১৯৬৬) এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, সুদী কারবারের ফলে মানুষের অন্তর থেকে দয়া-মায়া-মমতা ও উদারতার প্রস্রবণ শুকিয়ে যায় এবং সমাজ জীবনে নেমে আসে অশান্তি ও বিশৃংখলা, পৃথিবীতে নেমে আসে উশৃংখলতা, হিংসা-বিদ্বেষ এবং মানবতা ধ্বংসের অতলে নেমে যেতে থাকে [ সাইয়েদ কুতুব শহীদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৭৬-৪৮২ ] ।

অর্থনীতিবিদ আফজালুর রহমান লিখেছেন, সুদ মানুষের মধ্যে কৃপনতা, স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, সম্পদের মোহ ইত্যাদি ঘৃন্য অভ্যাস গড়ে তোলে; সমাজে ঘৃনা বিদ্বেষ ও শ্রেণী সংগ্রামের জন্ম দেয় এবং পারস্পরিক সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার ন্যায় মহৎগুণাবলীর বিকাশ ও উৎকর্ষতাকে বাধাগ্রস্ত করে। (Interest inculcates habit of miserliness, selfishness, cruelty, love of money, greed for accumulation of wealth etc. among individuals. It spreads class struggle and class hatred among people and checks the growth of ideals of mutual help and cooperation.)[ আফজালুর রহমান, ইকোনমিক ডকট্রিন্স অব ইসলাম, খন্ড, ৩, পৃ.-১২৭, উদ্বৃত অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, সুদ সমাজ অর্থনীতি, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০৭ ] ।

২। সুদ সঞ্চয়কারীদের মধ্যে অলসতা সৃষ্টি করে (Riba creates idleness among the depositors): সুদের নির্দিষ্ট হার আমানতকারীদের আরও অলস করে তোলে। সুদ মানুষকে কর্মবিমুখ করে। কারণ বিনা পরিশ্রমে সুদ পাওয়া যায় বিধায় বিত্তবানরা পুঁজিকে ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে ব্যাংকে জমা রাখে। সুদী ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে বিনাপরিশ্রমে বিনা ঝুঁকিতে নির্ধারিত সুদ পাওয়া যায়। সুদের নিশ্চিত উপার্জন সুদখোরকে শ্রমবিমুখ ও অলস করে। এ অবস্থা যোগ্যতাসম্পন্ন ও উদ্যোক্তা হতে পারেন এমনসব সঞ্চয়কারীকে অলস ও অকর্মণ্য বানিয়ে দেয়। সুদ অর্জনের পথকেই তারা নিরাপদ ও সহজ মনে করে। এভাবে সুদের কারণে সমাজে ব্যাপক সংখ্যক যোগ্য আমানতকারী মেধা, শ্রম ও ঝুঁকি গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। মোটকথা রিবা আলস্য সৃষ্টি করে। এতে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৩। সুদ সমাজ শোষণের কার্যকরী শক্তিশালী মাধ্যম: সুদ শোষণ ও বৈষম্য সৃষ্টি করে। সুদনির্ভর প্রতিষ্ঠান বা সুদের কারবারিরা সুদের মাধ্যমে সমাজের মানুষকে শোষণ করে। সুদ শোষণ (exploitation) ও বৈষম্যের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার [ মুহাম্মাদ আকরাম খান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৯ ] ।

সুদ অতিবড় অবিচার, যুগ্ম ( ظلم ) অভিশাপ ( لعنة = Curse) ও শোষণ। সুদ অত্যন্ত বড় ধরনের যুলম মূলক ব্যবস্থা। সুদ মানুষকে শুধু শোষণই করে। সুদের সাহায্যে একদল কারবারি বিনা শ্রমে অন্যের উপার্জনে ভাগ বসায়। ঋণগ্রহীতা যে কারবারের জন্য ঋণ নেয় সে কারবারে তার লাভ হোক বা লোকসান হোক তাকে সুদের অর্থ দিতেই হবে। এর ফলে অনেক সময় ঋণগ্রহীতাকে আগের স্থাবর অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে হলেও সুদাসলে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। পরিণামে ঋণগ্রহীতারা দরিদ্র ও অসহায় হয়ে পড়ে। সমাজে শ্রেণী বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পায়। সুদখোররা সমাজের পরগাছা। এরা অন্যের উপার্জন ও সম্পদে ভাগ বসিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখে। এ ছাড়াও বিনাশ্রমে অর্থসম্পদ অর্জনের ফলে সমাজের প্রত্যক্ষ উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে এদের কোন ভূমিকা থাকে না।

৪। সুদ বিত্তবানকে আরো বিত্তবান এবং দরিদ্রকে আরো দরিদ্র করে: সুদের কারণে দরিদ্র আরও দরিদ্র এবং ধনী আরও ধনী হয়। সুদের লেনদেন প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে দেখা যায়, সুদের মাধ্যমে সুদদাতাদের সম্পদ ক্ষুদ্র গ্রহীতাদের কাছে চলে যায় এবং তারা আরো ধনী হয়। সুদের প্রভাবে সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য বেড়ে যায়। অসহায়-দরিদ্র-অভাবগ্রস্ত মানুষ একান্ত প্রয়োজনে সাহায্যের কোন উপায় না পেয়ে নিরূপায় হয়ে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। সে ঋণ উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল উভয় প্রকার খাতেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশেষ করে অনুৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে ঋণের অর্থ ব্যবহারের ফলে গ্রহীতার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাই লোপ পায়। পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতিতে করযে হাসানা-র কোন সুযোগ না থাকায় অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ তো দূরের কথা উৎপাদনী খাতেও বিনা সুদে ঋণ মেলে না। বোঝার উপর শাকের আঁটির মত তাকে সুদ পরিশোধ করতে হয়। এর ফলে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তার শেষ সম্বল যা হাতের কাছে পায় তাই বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়। সুদের অর্থ পেয়ে ধনী আরো ধনী হয়। ঋণগ্রহীতা হয় আরও দরিদ্র। গরীবকে আরো গরীব করে। ফলে বৃদ্ধি পায় সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য। অর্থনীতিবিদ জেমস রবার্টসনের মতে, অর্থনৈতিক পদ্ধতিতে সুদের ব্যাপক ও বিস্তৃত ভূমিকার ফলে যাদের সম্পদ কম তাদের কাছ থেকে যাদের সম্পদ বেশি তাদের কাছে অর্থ নিয়মিতভাবে হস্তান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়া সর্বত্র সক্রিয়। (The pervasive role of interest in the economic system results in the systematic transfer of money from those who have less to those who have more…. it applies universally.)[ ১৭৯.James Robertson, Future Wealth: A New Economics for the 21st Century, Castle Publications, London, 1990, p. 130-131; উদ্বৃত অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, সুদ সমাজ অর্থনীতি, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৮ ] ।

৫। সুদ পরিবেশ ধ্বংস করে (Riba vitiating and polluting the environment): মুহাম্মাদ আকরাম খান দেখিয়েছেন, পরিবেশ ধ্বংস, পরিবেশ অবক্ষয় (environment degradation) ও দূষণের ক্ষেত্রেও সুদ বিরাট ভূমিকা পালন করে। দরিদ্র দেশগুলো যেহেতু তাদের ঋণ সুদসহ পরিশোধের জন্য প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকে সেহেতু রপ্তানী বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তাদের জমিগুলো অতিরিক্ত ব্যবহার করতে বাধ্য হয় অথবা বন কেটে সাবাড় করে। ফলে তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ (খনিসহ) আরো ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়।

৬। সুদ মানুষকে ঋণের ভারে জর্জরিত করে সুদ ঋণগ্রহীতাকে ঋণভারে জর্জরিত করে। সুদখোররা, সুদী ব্যাংকগুলো সুদ কষে লোন দেয়। ঋণ গ্রহীতার ব্যবসা যদি ফেল (Fail) করে; সে অবস্থায় ঋণগ্রহীতাকে ব্যবসার সাকুল্য লোকসান তো বহন করতেই হয় একই সাথে ঋণদাতার পাওনা সম্পূর্ণ সুদসহ পরিশোধ করতে হয়। অন্যকথায় ঋণভারে জর্জরিত ঋণ গ্রহীতাকে সর্বস্ব খুইয়ে হলেও ঋণদাতার সুদের নিশ্চয়তা বিধান করতে হয়।

৭। সুদ জীবনীশক্তি ক্ষয় ও কর্মক্ষমতা হ্রাস করে: সুদের একটি কুফল হচ্ছে এই যে, তা মানুষকে প্রকৃত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ থেকে ফিরিয়ে রাখে। এতে তার কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। এটা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও প্রচেষ্টার লক্ষ্যকে ঘুরিয়ে দেয়; যার জন্য প্রকৃত পণ্যসামগ্রী ও সেবা যোগানের পরিবর্তে অর্থ দিয়ে অর্থ লাভ করার লক্ষ্যেই যাবতীয় প্রচেষ্টা পরিচালিত হয় [ মুফতি মুহাম্মাদ তাকী উসমানী, সুদ নিষিদ্ধ পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের ঐতিহাসিক রায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৫ ] ।

৮। সুদ সমাজ জীবনের উপর ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনে। শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তায় বিঘ্নিত হয় সুদ সমাজের দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা কেড়ে নেয়। সুদে যারা ঋণ নিয়েছে তারা সর্বদা চিন্তা, উদ্বেগ, হতাশায়, দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকে। সুদের কিস্তি আর মূল টাকা পরিশোধের তাগাদা তাদেরকে দিবা-রাত্র তাড়া দেয়। দুর্ভাবনা, দুশ্চিন্তা তাদের কলব ও মনের শান্তি কেড়ে নেয়।

৯। সুদ নৈতিক অবক্ষয় সাধন করে (Riba creates moral disaster): সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে ঋণভারে জর্জরিত দরিদ্র জনসাধারণ তাদের কষ্টার্জিত স্বল্প উপার্জন দ্বারা সুদখোর মহাজনের সুদ পরিশোধ করার পর নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। এ অবস্থা তাদের নৈতিক চরিত্রের ধ্বংস সাধন করে এবং তাদেরকে অপরাধ প্রবণতার দিকে ঠেলে দেয়। অভাবের তাড়নায় তারা হয়ে উঠে অপরাধপ্রবণ। তাছাড়া অর্থাভাবে সন্তান-সন্ততিরা বঞ্চিত হয় সুশিক্ষার আলো থেকে। অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তাদের মধ্যে জন্ম দেয় এক ধরনের প্রতিশোধ স্পৃহা যা তাদেরকে অমানুষ বানিয়ে দেয়। সর্বোপরি সুদ লগ্নীকারী নিশ্চিত মুনাফা পাওয়ার লোভে অনেকে অহিতকর ও কদর্য খাতেও মূলধন বিনিয়োগ করে। সুদী ঋণ ব্যবস্থা সুদের হারের চেয়ে অধিক হারে মুনাফা অর্জনের প্রবণতা সৃষ্টি করে যা সাধারণভাবে বিনিয়োগকে নৈতিকতা পরিপন্থী খাতে ঠেলে দেয়। এর স্বাভাবিক পরিণতিতে সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়, এমনকি কখনো কখনো স্বাভাবিক নৈতিকতা বোধও লোপ পায়। সুদের কারণে ব্যবসায়ীর নৈতিকতা নষ্ট হয়। অন্যকথায় সুদী কারবারের স্বাভাবিক পরিণতিতে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে, কখনও কখনও স্বাভাবিক নৈতিকবোধটুকুও লোপ পায় বা বিকৃত হয়ে যায়। সে অধিক মুনাফা করার মানসে পণ্যে ভেজাল মেশায়, ওযনে কম দেয় এবং অস্বাভাবিক বাড়তি মূল্য দাবি করে। ফলে ক্রেতা সাধারণ নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হন। সুদখোর ব্যবসায়ীরা অধিক অর্থ প্রাপ্তির আশায় হারাম পণ্য যেমন-মদ, গাঁজা, হিরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবা বিপণনে অর্থ খাটায়। তারা অশ্লীলতা ও চরিত্র ধ্বংসকারী ছায়াছবি, পর্ণো পত্রিকা, মানব পাচার, নারী ব্যবসা ইত্যাদি নৈতিকতা বিধ্বংসী খাতে অর্থ বিনিয়োগ করে। ফলে যুব সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সমাজে নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি হয়।

১৩.৩ সুদের অর্থনৈতিক কুফল (Economic Impact of Riba)

সুদের অর্থনৈতিক কুফল অনেক। সুদের ভয়াবহ ধ্বংসকর প্রতিক্রিয়া দেশে দেশে অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত ও লণ্ড-ভণ্ড করে দিচ্ছে। সঞ্চয় ও পুঁজি গঠন থেকে শুরু করে বিনিয়োগ, উৎপাদন, বাজার বিনিময় বরাদ্দ, বন্টন ও ভোগ তথা অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রেই সুদের কুফল অত্যন্ত ব্যাপক ও ভয়াবহ। সুদের অর্থনৈতিক কুফলসমূহ নিম্নরূপ:

১। পুঁজিবাদের বিকাশে সহায়তা করা (Riba helps the growth of capitalism): সুদ পুঁজিবাদী শোষণ, বৈষম্য ও জুলুমের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। সুদের কারণেই সমাজের দরিদ্র শ্রেণী আরো দরিদ্র এবং ধনী আরো ধনী হয়। পরিণামে সামাজিক শ্রেণীগত বৈষম্য বেড়েই চলে। দরিদ্র অভাবগ্রস্ত মানুষ সাহায্যের আর কোন দরজা খোলা না পেয়ে উপায়ান্তর না দেখে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। সুদী অর্থনীতিতে পুঁজিপতি ও ব্যাংকারগণ সর্বদাই অধিক সুদ পাবে এ লক্ষ্য সামনে রেখে ঋণ দিয়ে থাকে। সে ঋণ উৎপাদনী ও অনুৎপাদনী দু’রকম কাজেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশেষ করে অনুৎপাদনশীল কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহারের ফলে তার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাই লোপ পায়। বোঝার উপর শাকের আঁটির মত তাকে সুদ শোধ করতে হয়। এর ফলে সে তার শেষ সম্বল যা থাকে তাই বিক্রি করে ঋণদাতার ঋণ শোধ করে থাকে। এতে সুদখোর ধনীরা আরো ধনী হয়।

২। সুদ বেকারত্ব বৃদ্ধি করে (Riba creates unemployment problems): সুদী অর্থায়ন ও বিনিয়োগ ব্যবস্থার অনিবার্য ফল হিসেবে সমাজে আশংকাজনক হারে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। যেহেতু এ ব্যবস্থায় পুঁজির মালিক বা ব্যাংক উৎপাদনের কোন ঝুঁকিই বহন করেন না এবং সকল ঝুঁকিই কার্যত উদ্যোক্তার ঘাড়েই চাপে ফলে নতুন উদ্যোক্তারা শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সাথে তাল রেখে শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে না পারার অর্থ বেকারত্বের হার বৃদ্ধি। পাশাপাশি বিরাজমান শিল্পের মধ্যে অনেকগুলো আবার সুদের জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে। ফলে বেকারত্ব আরো বেড়ে যায়। সুদভিত্তিক ব্যবস্থায় পুঁজির এক বিরাট অংশ অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োজিত থাকে বলে শ্রমিক ও সম্পদ বেকার থেকে যায়। যাতে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায়। সুদী অর্থনীতিতে পুঁজির প্রান্তিক দক্ষতা যেখানে প্রচলিত সুদের হারের সমান হয় বিনিয়োগ সেখানেই থেমে যায়। ফলে দেশে বিনিয়োগ হলে যে পরিমাণ শ্রমিক কাজ পেত তারা বেকার থেকে যায়। তাই সুদ বেকারত্ব সৃষ্টি করে শ্রমিকদের আয়হীন করে রাখে। সুদ মজুরী বৃদ্ধির অন্যতম প্রতিবন্ধক।

৩। সুদ সঞ্চয় বাড়ায় না (Riba decreases deposit/savings):
নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ জে.এম. কেইন্সের মতে, উচ্চতর সুদের হার প্রকৃত সঞ্চয়কে অবশ্যই কমিয়ে দেয়। তিনি লিখেছেন, That it is the rate of Interest which sets a limit to the rate of growth of real capital.[ জে. এম. কেইনস, জেনারেল থিওরী অব এমপশ্চয়মেন্ট, ইন্টারেস্ট এন্ড মানি, পৃ. ৩৫৫ ] ।

কারণ মোট সঞ্চয় নিয়ন্ত্রিত হয় মোট বিনিয়োগের দ্বারা, সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ হ্রাস পায়। সুতরাং সুদ বৃদ্ধি পেলে তা অবশ্যই আয়কে কমিয়ে দেবে এতে বিনিয়োগ যতটা কমবে, সঞ্চয়ও ততটাই হ্রাস পাবে। সুদের কারণে বিভিন্নভাবে উৎপাদন ও আয় হ্রাস পায়। অনেকে দেউলিয়া হয় আর বহুলোক কর্মহারা বেকার হয়ে পড়ে। ফলে সঞ্চয় ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। মানুষ অধিক সুদ পাওয়ার জন্য সঞ্চয় করে না। বরং তারা সঞ্চয় করে ভবিষ্যতের চিন্তায়, অজানা বিপদ-আপদ মুকাবিলার জন্য, সন্তান-সন্ততির শিক্ষা, বিয়ে-শাদী ইত্যাদির কারণে। সুদ না থাকলেও এসব কারণে মানুষ সঞ্চয় করবেই। অর্থনীতিবিদ প্যারেটো তাই বলেছেন, সঞ্চয় সুদের হারের দ্বারা প্রভাবিত হয় না, বরং সুদের হারকে যদি শূন্যেও নামিয়ে আনা হয়, তাহলেও সঞ্চয়ের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে [ গাইড এন্ড রিস্ট, এ হিস্ট্রি অব ইকোনোমিক ডকট্রিন্স, পৃ.-৬৩২, উদ্ধৃত অধ্যাপক মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন, সুদ সমাজ অর্থনীতি, পূর্বোক্ত, পৃ.- ২১২ ] ।

৪। সুদ পুঁজিতে অলস রাখতে প্রলুব্ধ করে সুদখোর ঋণদাতা ও পুঁজিপতিগণ মনে করে যে, কোন নির্দিষ্ট সুদের হারে ঋণ দেয়া হলে মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে না এবং ইতোমধ্যে সুদের হার বেড়ে গেলে সেই ঋণের উপর অতিরিক্ত হারে সুদ পাওয়া যাবে না। ফলে এ সময়ে তাদের ঠকতে হবে। কারণ ঋণ হিসেবে প্রদত্ত অর্থ হাতে থাকলে তারা তা বর্ধিত সুদের হারে ধার দিয়ে বেশি আয় করতে পারতো। এ কারণে ভবিষ্যতে যে কোন সময়ে সুদের হার বেড়ে গেলে সে সুযোগে অধিক সুদ পাবার লোভে সুদখোরগণ তাদের পুঁজির একটি বিরাট অংশ অলসভাবে ধরে রাখে।

৫। সুদ কল্যাণকর খাতে বিনিয়োগ কমিয়ে দেয় সুদের কারণে কল্যাণকর খাতে বিনিয়োগ কম হয়। অর্থনীতিতে এমন কিছু কাজ আঞ্জাম দিতে হয় যাতে প্রভূত সামাজিক কল্যাণ সাধিত হতে পারে; কিন্তু অর্থের সাহায্যে এর মুনাফা নিরূপণ করা সম্ভব নয় অথবা তা কাম্য নয়। শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, অভাবীদের জন্য গৃহ নির্মাণ ইত্যাদি সাধারণ জনকল্যাণমূলক খাতে অর্থ বিনিয়োগ করা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। সুদী সমাজে স্বাভাবিক ভাবে জনকল্যাণমূলক এবং জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় খাতসমূহ উপেক্ষিত ও অবহেলিত হয়। সুদী সমাজে সমাজের লাভ ও স্বার্থ চরমভাবে উপেক্ষিত হয়।

৬। সুদ পুঁজিপতিদের স্বেচ্ছাচারী আচরণে উদ্বুদ্ধ করে সুদ ভিত্তিকঅর্থনীতিতে প্রায় গোটা মূলধন পুঁজিপতি ও ব্যাংকারদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে তারা যখন খুশি ঋণ সংকোচন এবং যখন খুশি সম্প্রসারণ করতে পারে। তারা যখন মনে করে যে, ঋণের পরিমাণ বাড়লে তারা বেশি ফায়দা পাবে তখন তারা ঋণ বাড়িয়ে দেয়; আবার যখন ঋণ কমিয়ে দিলে বেশি লাভবান হবে বলে তাদের ধারণা হয় তখন তারা ঋণ কমিয়ে দেয়। এভাবে যখন ঋণ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলেই তাদের স্বার্থ রক্ষা পাবে বলে মনে করে, তখন তারা ঋণ দেয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। তাদের এই স্বেচ্ছাচারী আচরণের ফলে অর্থনীতি ও সমাজের কি লাভ বা ক্ষতি হলো সেদিকে দৃষ্টি দেবার কোন প্রয়োজনই তারা বোধ করে না। অর্থনীতির স্বাভাবিক চাহিদা এবং যথার্থ প্রয়োজনের দিকটি তারা আদৌ বিবেচনা করে না। পুঁজিপতিগণ অতিমাত্রায় সুদের লোভে স্বেচ্ছাচারি আচরণের মাধ্যমে অর্থনীতির ক্ষতি করে থাকে [ সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী, সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৭৯, পৃ-৬৩ ] ।

৭। সুদ বিনিয়োগ কমিয়ে দেয় (Riba lessens investment): অর্থনীতির গবেষকগণ সুদের হারের সাথে বিনিয়োগের বিপরীতধর্মী সম্পর্ক রয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছেন। সুদের হার বেড়ে গেলে বিনিয়োগকারীগণ ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করাকে কম লাভজনক মনে করে এবং ঋণ কম নেয়। ফলে বিনিয়োগ কমে যায়। বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ লর্ড কেইন্সের মতে, বিনিয়োগ নির্ধারিত হয় সুদের হার ও মূলধনের প্রান্তিক দক্ষতার পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে। তাঁর মতে, সুদের হার মূলধনের প্রান্তিক দক্ষতার সমান হলে কাম্য বিনিয়োগ হবে। সুদের হার কমলে বিনিয়োগ বাড়ে। এভাবে সুদের হার কমে শূন্য হলে বিনিয়োগ সর্বাধিক হবে। সুতরাং সুদ ভিত্তিক অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কম হয়। বিশেষ করে সুদ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। লর্ড কেইনস শূন্য সুদের হারকে পূর্ণ বিনিয়োগ ও পূর্ণ কর্মসংস্থানের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুদের হার যাতে শূন্য হয় সেজন্য তিনি সরকারকে আইনী ক্ষমতা প্রয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন [ জে. এম. কেইন্স, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫১ ] ।
সুদ ভিত্তিক অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কখনো সর্বাধিক হয় না।

৮। সুদের কারণে উৎপাদন কম হয় (Riba prevents production): সুদ উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে। সুদের হার উৎপাদনকে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছতে দেয় না। সুদী অর্থনীতিতে উৎপাদন সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছতে পারে না। একক প্রতি উৎপাদন ব্যায় এবং দাম বেশি হয়। তাছাড়া উৎপাদন কম হওয়ায় যোগান কম হয় এবং একক প্রতি গড় দাম বেড়ে যায়। এভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় তা চাহিদা ও উৎপাদনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

৯।সুদ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কমিয়ে দেয় (Riba diminishes long- term investment): সুদি অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কম হয়। ব্যাংকার ও পুঁজিপতিগণ অধিক পুঁজি দীর্ঘকাল ধরে আটক রাখতে আগ্রহী নয় বলে বড় বড় ব্যয়বহুল শিল্প কারখানায় বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসে না। আবার বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের ঋণ সুদের ভিত্তিতে নেয়া হলে প্রতি বছর বিরাট অংকের সুদের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কমে যায়।

১০। সুদের কারণে ঝুঁকিবহুল বিনিয়োগ হয় না (Riba does not sponsor risky investment): সুদী ব্যবস্থা সাধারণত অস্থির ও অনিশ্চিত। অত্যধিক ঝুঁকি থাকার কারণে বিনিয়োগকারীগণ সুদি ঋণের ভিত্তিতে ব্যয়বহুল শিল্প কারখানায় বিনিয়োগ করতে অনীহা প্রদর্শন করে। বড় বড় শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠায় যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয় তা সুদের ভিত্তিতে ধার নেয়া হলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ সুদের বোঝা বহন করতে হয়। তাছাড়া শিল্প স্থাপনের শুরুর দিন থেকে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করা পর্যন্ত অবকাশ সময় লাগে প্রায় ২ থেকে ৫ বছর। এর মধ্যে সুদের বোঝা বেড়ে এমন আকার ধারন করে যে, উৎপাদন লাভজনক হলেও সুদের এ বোঝা বহন করা শিল্প প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব হয় না। তদুপরি সেসব কারবারে ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত বেশি বলে যে কোন সময় বড় ধরনের লোকসানের সম্মুখীন হওয়া অসম্ভব নয়। লোকসান হলে সুদে-আসলে ঋণের যে অংক দাঁড়ায়, তা পরিশোধ করা আর কখনো সম্ভব হয় না। ফলে উদ্যোক্তা দেউলিয়া হতে বাধ্য হয়।

১১। সুদ বিনিয়োগকে অনুৎপাদনশীল খাতে ঠেলে দেয়ঃ সুদ ভিত্তিক অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ কমে যায়। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে সুদ পুঁজিকে অনুৎপাদনশীল বিনিয়োগের দিকে ঠেলে দেয়। সুদ ভিত্তিক ব্যবস্থায় সঞ্চয়কারীগণ তাদের সঞ্চয় ব্যাংকে জমা রাখে অত:পর ব্যাংক এই অর্থ শিল্প, বাণিজ্য ও অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে বলে মনে হয়। কিন্তু সত্যিকার অবস্থা তা নয়। সুদী ব্যাংক নির্ধারিত, ঝুঁকিমুক্ত এবং নিশ্চিত আয় পাবার আশায় আমানতকারীদের জমাকৃত আমানতের এক বিরাট অংশ সরকারি সিকিউরিটি ক্রয়, বিনিয়োগ বিল ভাঙ্গানো, ফটকামূলক কারবার ইত্যাদি অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে। ফলে উৎপাদনশীল এরিয়াতে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজণীয় পুঁজির অভাব দেখা দেয়। এতে পুঁজির সুদের হার বেড়ে যায়। সঞ্চয়কারীগণ উৎসাহ বোধ করে এবং অধিকহারে সুদ পাবার লোভে তাদের সঞ্চয় ব্যাংকে জমা রাখে। ব্যাংকের আমানত বেড়ে যায়। ব্যাংক অনুৎপাদনশীল খাতে আরো অর্থ বিনিয়োগ করে। পুঁজির প্রান্তিক আয় ও দক্ষতা হ্রাস পায়। বিনিয়োগ ও উৎপাদনের পরিমাণ আবার কমে যায়। বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, দ্রব্যমূল্য আরো একদফা বেড়ে যায়।

১২। সুদের কারণে বরাদ্দ দক্ষতাপূর্ণ হয় না (Riba does not facilitate skilled allocation): সুদ পুঁজির দক্ষতাপূর্ণ বরাদ্দে বাধা সৃষ্টি করে। সুদি ব্যাংকগুলো ঋণ বরাদ্দের ক্ষেত্রে কারবারের দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা ও লাভজনীনতা অপেক্ষা সুদসহ আসল ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তার উপরই অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। সুদী ব্যাংকাররা সুদ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা তথা যথাযথ সিকিউরিটি, মর্টগেজ পেলেই ঋণ বরাদ্দ ও মনজুর করেন।

১৩। সুদ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে (Riba reduces consumers purchasing power): সুদি অর্থনীতিতে সুদের কারণে স্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্য বেশি হয়। এ ছাড়া সুদ মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করে বলে দ্রব্যমূল্য স্তর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ফলে সুদি অর্থনীতিতে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে ক্রেতাদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয় এবং এভাবে অধিক অর্থ ব্যয় করতে হয় বলে ক্রেতাসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। এ ছাড়া বেকারদের কোন আয় না থাকায় তাদেরও ক্রয়ক্ষমতা থাকে না।

১৪। সুদ চাহিদা হ্রাস করে (Riba reduces the flow of demand): সুদি অর্থনীতিতে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কম থাকা বা না থাকার কারণে পণ্যসামগ্রীর কার্যকর চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যায়। ফলে উৎপাদনকারীদের উৎপাদিত পণ্যের বিরাট অংশ অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে থাকে এবং পরবর্তী পর্যায়ে উৎপাদন হ্রাস করতে হয়। এতে শ্রমিক ছাটাই করা হয়, বেকার সমস্যা তীব্রতর হয়।

১৫। সুদ সম্পদ ধ্বংস করতে বাধ্য করে (Riba propells destroy of property): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯৩০-এর দশকে ইউরোপে ‘মহামন্দা’ (Great Depression) দেখা দেয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে বেকারত্ব ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয় বিভিন্ন দেশের। সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে মন্দা (Depression) এক অনিবার্য পরিণতি। ১৯২৯-১৯৩৬ এর মহামন্দার কারণ অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে প্রখ্যাত নয়া ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ লর্ড জে.এম. কেইন্স এই মতবাদ প্রকাশ করেন যে, সুদ ভোগ ও বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়। ফলে সামগ্রিক চাহিদার হ্রাস হেতু অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়। এ মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হলে মহামন্দায় পরিণত হয় যা ১৯২৯ সালে ঘটেছিল বলে কেইন্স মনে করেন। বিশ্বে বার বার এরূপ মন্দা ও মহামন্দা দেখা দিয়েছে। আর এ মন্দা ও মহামন্দার মূল কারণ হলো সুদ। কেইন্স তাই সুদ প্রথা বিলুপ্ত করে শূন্য সুদের হার চালু করার প্রস্তাব করেছেন। কেইন্সের এ প্রস্তাব কেউ আমলে নেয়নি। ১৯৯৭-১৯৯৮ সালের এশিয় আর্থিক সংকট-বিপর্যয় এ অঞ্চলকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে থাইল্যান্ডের মুদ্রা থাই বাথ-এর মূল্য পতনের মাধ্যমে বিপর্যয়ের সূচনা হয় এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও থাইল্যান্ড। হংকং, মালয়েশিয়া, লাওস এবং ফিলিপাইনও বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ২০০৭-২০১০ সালে বিশ্বব্যাপী আবারো মন্দা সৃষ্টি হয়েছে। এ মন্দা হচ্ছে সুদেরই পরিণতি। প্রফেসর আবু আহমেদ লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮ সালে যে আর্থিক বিপর্যয় ঘটে গেল এটা অন্য অর্থে সুদী ব্যবস্থারই ধ্বস [ প্রফেসর আবু আহমেদ, সুদ, লোভ এবং আর্থিক বিপর্যয়, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ৫ম বর্ষ পূর্তি ক্রোড়পত্র- ২০০৯, ৩০ জুন ২০০৯, পৃ. ১৮ ] ।

মন্দার সময়ে ক্রেতার কাছে ক্রয়ক্ষমতা থাকে না বলে তারা পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারে না। ক্রেতার অভাবে বিপুল পরিমাণ পণ্য অবিক্রীত অবস্থায় গুদামজাত হয়। এসব পণ্য উৎপাদনকারীগণ কম দামে বাজারে ছাড়তে রাজি হয় না। পণ্য গুদামে পঁচে নষ্ট হয় কিংবা সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হয়; তবুও কিছুতেই উৎপাদনকারীগণ পণ্যসামগ্রী অভাবী মানুষের কাছে কমদামে বিক্রি করে না, দান করে দেয়া তো দূরের কথা। এ প্রক্রিয়ায় বিশ্বে সম্পদ ধ্বংসের ঘটনা বহুবার ঘটেছে। সুদ মন্দা ও মহামন্দা সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনীতিকে ধ্বংসের মধ্যে ঠেলে দেয়।

১৬। সুদ স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে (Riba destructs stability): অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা হচ্ছে উন্নয়নের পূর্বশর্ত। কিন্তু সুদ অর্থনীতিকে অস্থির করে তোলে, বিনিয়োগ ও উৎপাদনের পরিবেশ ব্যাহত করে এবং অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দেয়।

১৭। সুদ মুদ্রানীতিকে বিকল করে দেয় (Riba spoils monetary policy): কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা আর্থিক কর্তৃপক্ষ দেশে প্রয়োজনীয় পরিমাণ মুদ্রা সরবরাহের মাধ্যমে অর্থের মূল্যকে স্থিতিশীল রাখা, দ্রব্যমূল্যকে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার সীমার মধ্যে নামিয়ে আনা এবং বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মুদ্রানীতি চালু করে থাকে। কিন্তু সুদ এই মুদ্রানীতির কার্যকারিতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করার লক্ষ্যে মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যাংক হার (Bank Rate) বা বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি হার (Statutory Reserve Ratio) বাড়িয়ে দেয়, তখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও তাদের সুদের হার বৃদ্ধি করে। এতে মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস পায় এবং মুদ্রাস্ফীতি কমে আসে বটে কিন্তু সুদের হার বেড়ে যায় এবং বিনিয়োগ কমে যায়। এতে দ্রব্যমূল্যও বেড়ে যায়। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে সুদের হার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় এবং বিনিয়োগে বাধার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে ব্যাংক হার বা বিধিবদ্ধ সঞ্চিতির হার হ্রাস করে তাহলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সুদের হার কমিয়ে দেয়। ফলে ফটকামূলক কারবারে ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় এবং বাজারে অর্থের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে মুদ্রাস্ফীতিকে ফাঁপিয়ে তোলে, দ্রব্যসামগ্রীর দাম জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে মুদ্রার পরিমাণের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ড. উমর চাপরা তাই যথার্থই লিখেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেবল সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে অথবা কেবল মুদ্রার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে….। অভিজ্ঞতা বলে যে, একই সাথে সুদের হার ও মুদ্রার পরিমাণ এমন ভারসাম্যপূর্ণ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব যাতে বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করা ছাড়াই মুদ্রাস্ফীতি সংযত থাকবে। এভাবে সুদ মুদ্রানীতিকে বিকল করে দেয়।

১৮। সুদ মুদ্রাস্ফীতি ঘটায় (Riba causes inflation): মুদ্রাস্ফীতি ও সুদ সরাসরি সম্পৃক্ত। সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে স্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্য বেশি থাকে। পণ্যের উপর সুদের বাড়তি মূল্য যোগ হওয়ায় বাজারে পণ্যের দাম বাড়ে। এরপর আবার মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টির মাধ্যমে সুদ দ্রব্যমূল্যকে আকাশচুম্বী করে দেয় এবং জনগণের দুঃখ-দুর্দশাকে দুঃসহ করে তোলে।

১৯। সুদ বিনিময় হারকে অস্থির করে তোলে (Riba excites exchange rate): সুদের হারের ঘনঘন উঠানামা মুদ্রার বিনিময় হারকে অস্থির করে তোলে এবং বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের সকল প্রচেষ্টা নিষ্ফল হয়।

২০। সুদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করে সুদী অর্থনীতিতে উদ্যোক্তাকে কারবারে লাভ বা লোকসান যা-ই হোক প্রথমে সুদ পরিশোধ করতেই হয়। এরপর আবার যদি সুদের হার পরিবর্তনশীল হয়, সে হিসেবে সুদের হার বেড়ে গেলে তাকে আরো অধিক সুদ পরিশোধ করতে হয়। সুতরাং সুদের হার পরিবর্তণশীল হলে উদ্যোক্তাকে দু’ধনের ঝুঁকি সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। প্রথমত: তিনি যে পণ্য উৎপাদন করবেন সে পণ্যের বাঞ্ছিত দাম বাজারে থাকবে কি না। দ্বিতীয়ত: সুদের হার বেড়ে গিয়ে তার মুনাফা কমিয়ে দেবে কিনা। বস্তুত: সুদের হার বৃদ্ধি পেলেই উদ্যোক্তার প্রাপ্ত মুনাফা হ্রাস পায়। অভন্তরীণ নগদ অর্থের প্রবাহ (Internal cash flow) কমে যায় এবং তারল্য ঘাটতি দেখা দেয়। উদ্যোক্তাকে অধিক সুদের হারে ঋণ গ্রহণে বাধ্য হতে হয়। অধিক হারে সুদ প্রদান মুনাফাকে আরো সংকুচিত ও নিঃশেষ করে দেয় এবং ক্রমে কারবার দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এই অবস্থা দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগের পরিবেশকে দূষিত করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিকে রুদ্ধ করে দেয়।

২১। সুদের কারণে মুষ্টিমেয় বিত্তবানদের মধ্যেই পুঁজি আবর্তিত হয়: সুদ দেয়া ও পরিশোধের সামর্থ্যের কারণেই ধনী ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতাদের মধ্যেই পুঁজি আবর্তিত হতে ও বৃদ্ধি পেতে থাকে। রিবা গুটি কতক মানুষের হাতে সম্পদ সঞ্চিত হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করে। সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে গতানুগতিক ব্যাংক, বিনিয়োগ কোম্পানি তথা ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং ধনী বিত্তবানদের মধ্যে একটা অদৃশ্য সেতুবন্ধন বা যোগসাজস লক্ষণীয়। এছাড়াও অবৈধ পন্থায় বা অন্য কোন উপায়ে প্রচুর অর্থবিত্ত সঞ্চয় করতে পারলে সুদের কারবারের মাধ্যমেই সে তা ক্রমাগত বৃদ্ধি করে যেতে পারে। অন্যদিকে অতিরিক্ত জামানত দিতে না পারায় বিত্তহীনদের এ প্রক্রিয়ায় ঠাঁই হয় না। ফলে ধনীরা একাধারে সমাজ শোষণ করে এবং একচেটিয়া কারবারের প্রসার ঘটায়। ফলে অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয় বহুবিধ বিপর্যয়। এ জন্যই মহান আল্লাহ বলেছেন,

كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ *مِنكُمْ

‘সম্পদ যেন কেবলমাত্র (তোমাদের) ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়’ [ আল-কোরআন, সূরা ৫৯: আল হাশর, আয়াত: ৭ ] ।

২২। সুদ আমানতকারীদের বঞ্চিত করে: সুদভিত্তিক ব্যবস্থায় ঋণগ্রহীতা বিনিয়োগকারীদের নিজস্ব পুঁজি থাকে খুবই কম, পুঁজির বৃহদাংশ তারা নেয় ব্যাংক থেকে যার প্রকৃত মালিক হচ্ছে আমানতকারীগণ। তাছাড়া আমানতকারীগণ ব্যাংক থেকে আমানতের উপর যে হারে সুদ পায়, ভোক্তা হিসেবে পণ্য সামগ্রীর দামের সাথে তার চেয়ে অধিক হারে সুদ তাদেরকে আবার দিতে হয়। ফলে আমানতকারীদের নীট আয় দাঁড়ায় আসলে ঋণাত্মক। অন্তিম বিশ্লেষণে এটি সুস্পষ্ট হচ্ছে যে, যারা সঞ্চয় করে ব্যাংকে জমা রাখে তারা পায় ঋণাত্মক আয়, আর যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় তারা হয় ৮০-৮৫ বা ৯০% মুনাফার ভাগীদার।

২৩। সুদের চূড়ান্ত বোঝা ভোক্তাদের উপরই চাপে: সুদের চূড়ান্ত বোঝা ক্রেতাদের উপরই চাপে, চূড়ান্তভাবে দ্রব্যমূল্য আকারে সুদের সাকুল্য বোঝা কার্যত ক্রেতা সাধারণের ওপরই নিপতিত হয়। অন্যকথায় এতে উৎপাদিত পণ্যের স্বাভাবিক মূল্যের সাথে সুদের একটা অংশ যুক্ত হয়। ফলে পণ্যের স্বাভাবিক দামের চেয়ে বাজার দর বৃদ্ধি পায়।

২৪। সুদ ভোক্তাদের ঋণের জালে আবদ্ধ করে: সুদভিত্তিক ঋণ গ্রহণকারী গ্রাহক দু’ভাবে সুদ পরিশোধে বাধ্য হয়। একবার তাকে গৃহীত ঋণের ওপর ধার্যকৃত সুদ পরিশোধ করতে হয় আবার সে ঋণের অর্থ দ্বারা ক্রীত পণ্য সামগ্রীর দামের সাথে সুদ প্রদান করতে হয়। ফলে একদিকে ঋণের অর্থ পুরোপুরি ভোগ করা তাদের ভাগ্যে জোটে না, আবার ঋণের বোঝা ক্রমেই বড় হয়। এ ঋণের জাল থেকে বেরিয়ে আসা আর কখনই সম্ভব হয় না।

২৫। সুদ ভোক্তাদের অভাব অপূর্ণ রাখতে বাধ্য করে সুদী অর্থনীতিতে ভোক্তাগণ ক্রমে ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যায়। ক্রয় ক্ষমতার অভাবে তারা অতি প্রয়োজনীয় অভাবও অপূর্ণ রাখতে বাধ্য হয়।

২৬। সুদ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করার সুযোগ করে দেয় সুদী ব্যবস্থায় সুদ প্রদানে রাজী হলেই ঋণ পাওয়া যায়। আধুনিক সময়ে সুদী ঋণপ্রাপ্তিকে আরো সহজ করা হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ, ক্রেডিট কার্ড, ই-কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং ইত্যাদির মাধ্যমে ঋণকে প্রত্যেক ভোক্তার হাতের মুঠোয় পৌঁছে দেয়া হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ আয় বুঝে ব্যয় করার নীতি বাক্য ভুলে গেছে এবং প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঋণ নিয়ে আয়ের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

২৭। সুদ বিলাসিতামূলক ব্যয় বাড়িয়ে দেয়: একদিকে সুদভিত্তিক সহজলভ্য ঋণ অন্যদিকে নানারূপ আকর্ষণীয় ও উত্তেজনাকর বিজ্ঞাপন ভোক্তাদেরকে কেবল বাহুল্য ব্যয় নয় বরং নৈতিকতা পরিপন্থী ব্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়।

২৮। সুদ নিদারুণ বে-ইনসাফী, যুলমের জন্ম দেয় সুদী অর্থব্যবস্থায় ঋণদাতা, ঋণগ্রহীতা, ব্যাংকার ও আমানতকারী সকলেই ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে বে-ইনসাফী ও যুলুমের স্বীকার হয়। তবে সকল বে-ইনসাফী ও যুলুমের চূড়ান্ত দায়ভার জনগণকেই বহন করতে হয়।

২৯। সুদ ঋণদাতা ও ব্যাংকারের উপর বে-ইনসাফী করে: ঋণ গ্রহীতার কারবারে যদি বিপুল পরিমাণ লাভ হয়, তাহলে ঋণ দাতা কেবল নির্ধারিত হারেই সুদ পায়, আর পুরো লাভ ঋণ গ্রহীতা একাই নিয়ে নেয়। এতে আবার ব্যাংকার ঋণদাতার উপর যুলম করা হয়।

৩০। সুদ শ্রমজীবীদের মজুরী হ্রাস করে সুদ ভিত্তিক অর্থনীতিতে শ্রমিকের মজুরী সর্বদাই কম থাকে। সুদের ফলে একদিকে বিপুল সংখ্যক জনশক্তি বেকার থাকে, অন্যদিকে যারা কাজ পায় তারাও তাদের শ্রমের ন্যায্য মজুরী থেকে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হয়। একে তো বিনিয়োগ কম হওয়ার দরুণ শ্রমের চাহিদা কম থাকে, তার উপর আবার বেকারত্বের ব্যাপ্তির কারণে শ্রমের সরবরাহ থাকে অনেক বেশি। চাহিদার তুলনায় যোগানের আধিক্যের দরুণ শ্রমের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। তাছাড়া সুদের বোঝা বহন করার পর উদ্যোক্তাদের পক্ষে আবার মজুরী বাড়ানো সম্ভব হয় না। সুদের কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ ও দাম বেড়ে যায়। এরপর আবার মজুরী বেশি দিতে হলে উৎপাদন আর লাভজনক থাকে না বলেই উৎপাদকগণ মজুরি বৃদ্ধি করতে পারে না। তদুপরি কম মজুরীতে যখন প্রচুর শ্রমজীবী পাওয়া যায়, তখন আর বেশি মজুরী দেবেই বা কেন?

পুঁজি গঠন, বিনিয়োগ ও উৎপাদনের গতিকে শ্লথ করে দিয়ে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণের হাতিয়ার হয়ে সুদ অর্থনীতিতে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা আনয়ন করে। রিবামুক্ত অর্থনীতি শোষণহীন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের পূর্বশর্ত।

১৩.৪ সুদের রাজনৈতিক কুফল (Political Impact of Riba)

সুদের রাজনৈতিক কুফলসমূহ নিম্নরূপ:

১। সুদ রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে (Riba creates political instability): সুদ দেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে বিশৃংখল ও অস্থিতিশীল করে তোলে। সুদের বোঝা মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে জনজীবনে নাভিশ্বাস সৃষ্টি করে। জনরোষের মুখে কখনওবা ক্ষমতার পালাবদল চলতে থাকে। কিন্তু সুদের বিদ্যমানতার কারণে সমস্যার প্রকৃত সমাধান খুব কমই হয়।

২। সুদ সরকারের সমাজকল্যাণধর্মী কাজে বাধা সৃষ্টি করে (Riba prevents welfare activities of government): সুদভিত্তিক অর্থনীতি রাষ্ট্র ও সরকারকে সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে অর্থ ব্যয়ে নিরুৎসাহিত করে। অন্য কথায় সুদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকার সমাজ কল্যাণমূলক কাজে উৎসাহ বোধ করে না।

৩। জাতীয় জরুরি প্রয়োজনে সুদভিত্তিক ব্যাংক থেকে সুদমুক্ত ঋণ পাওয়া যায় না (Riba oriented Bank never allowes interest free loan even in national crisis): সুদের উপস্থিতির দরুণ জাতীয় দুর্যোগ মুহূর্তেও সুদমুক্ত ঋণ (Profit free loan) পাওয়া যায় না।

৪। সুদ ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতা সৃষ্টি করে (Riba causes centralisation of power): সুদ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে পুঁজিপতি কোটিপতি লুটেরা কালো টাকার মালিকদের হাতে তুলে দেয় এবং ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতা সৃষ্টি করে। নানা কূটকৌশলে দেশের যাবতীয় সম্পদ পুঁজিপতিরাই কুক্ষিগত করে নেয়। অতঃপর এ অর্থনৈতিক ক্ষমতার বলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা একচ্ছত্র প্রভাবশালী হয়ে উঠে। পার্লামেন্ট তাদেরই নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রিন্ট মিডিয়া, পত্রপত্রিকার, ইলেক্ট্রিক মিডিয়ার মালিক তারাই হয়। সম্পাদক-সাংবাদিক হয় তাদেরই হুকুম বরদার। জনগণ হয় সর্বহারা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুঁজিপতিদের মুখাপেক্ষী দাসানুদাস।

১৩.৫ সুদের আন্তর্জাতিক কুফল (International Impact of Riba)

সুদের আন্তর্জাতিক কুফল পৃথিবীব্যাপী সুদের প্রচলন তথা বৈদেশিক ঋণে সুদের লেনদেনেরই স্বাভাবিক পরিণতি। আন্তর্জাতিক ঋণের ক্ষেত্রে সুদের লেনদেন এর সকল কুফলকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সুদী ঋণ ব্যবস্থা এখন কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যা অধিকতর ভয়াবহ।

সুদের আন্তর্জাতিক কুফল সমূহ নিম্নরূপ:

১। সুদ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে সমস্যা সৃষ্টি করে (Riba creates problems in the case of foreign loan payment): সুদ বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়ায়। অন্যকথায় সুদ সরকারের উপর বৈদেশিক ঋণের বোঝা ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে দেয়।

২। সুদ বিদেশনির্ভরতা বাড়িয়ে দেয় (Riba increases foreign dependency): সুদ জাতিরাষ্ট্র (ঘধঃরড়হ ংঃধঃব) কে পরনির্ভরশীল করে তোলে। কারণ, জাতীয় প্রয়োজনে অনেক সময় সরকারকে বিদেশী ঋণ গ্রহণ করতে হয়; কিন্তু দাতারা ঋণ দেয়ার সময় কতকগুলো শর্ত জুড়ে দেয়। ফলে সরকারকে গৃহীত ঋণের বৃহৎ অংশই অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করতে হয়। সুদ আন্তর্জাতিক ঋণ দাসত্বের জন্ম দেয়। সুদ একটি জাতি রাষ্ট্রকে পরনির্ভরশীল করে তোলে।

৩। সুদ দাতাদেশের স্বার্থ হাসিল করে (Riba looks after the interest of the donor Countries): ঋণগ্রহীতা দেশের পক্ষে ঋণ পরিশোধ অসম্ভব হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একমাত্র ধনী দেশসমূহই দরিদ্র দেশকে ঋণ দিতে সক্ষম। দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে ঋণ দিয়ে ধনী দেশ যে সুদ দাবী করে তা বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও মানবতাবোধের পরিপন্থী। ধনী দেশগুলো যখন দরিদ্র দেশকে কোন ঋণ দেয় তখন ঋণের ব্যবহার, প্রযুক্তি আমদানি, প্রযুক্তি নির্বাচন ইত্যাদি অনেক বিষয়ে দাতা দেশের নির্দেশনা মেনে চলার জন্য ঋণ গ্রহীতা দেশকে বাধ্য করা হয়। যা দাতা দেশের স্বার্থই রক্ষা করে থাকে। সুদী ঋণ বরাদ্দ ও বিতরণের ক্ষেত্রে ধনী দেশের প্রধান মানদণ্ড হচ্ছে তাদের শিল্পের জন্য কাঁচামাল প্রাপ্তীর নিশ্চয়তা বিধান এবং শিল্প পণ্য রফতানীর জন্য বাজার ঠিক রাখা ও নতুন বাজার সৃষ্টি করা। এরা এমন কৌশল ও শর্ত আরোপ করে যাতে ঋণ গ্রহীতা দেশ স্ববলম্বী হওয়ার পরিবর্তে ক্রমে ঋণদাতা দেশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপর আরো বেশি নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয় এবং দাতা দেশ ও প্রতিষ্ঠান যেন অধিক স্বার্থ হাসিল করতে সামর্থ হয়। উন্নত দেশসমূহ প্রতিনিয়ত বিপুল অস্ত্র-শস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামাদি তৈরি করতেই থাকে। এ সবের বিক্রয় নিশ্চিত করা জরুরি। উন্নত দেশ সমূহ তাদের বরাদ্দকৃত ঋণের এক বিরাট অংশ অস্ত্র আকারে দিয়ে থাকে। আসলে সুদী ঋণ বৈদেশিক ঋণদাতা দেশ সমূহের স্বার্থই হাসিল করে। গ্রহীতা দেশের উপকার এর দ্বারা খুব স্বল্পই হয়।

৪। সুদ বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত করে (Riba destroys world peace): সুদ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঝগড়া ফাসাদ ও যুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি করে। সুদ ধ্বংস বয়ে আনে। সুদের শোষণের ফলে পরাশক্তি এবং বৃহৎ ধনী দেশগুলো নিজেদের মধ্যেই বিভেদ, বিদ্বেষ বাড়ায়। ফলে তা কখনো কখনো যুদ্ধ ও ধ্বংস বয়ে আনে। ধনী দেশগুলোর আধিপত্যবাদী নীতির কারণে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছে। জি. ফেবো বলেন, সুদখোরদের অশুভ তৎপরতাই রোম সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করেছে [ মো. হেদায়েত উল্লাহ্, ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং, সৃজন ঘোষ প্রকাশিত, ২২ জুলই ২০০৭, পৃ. ১২৪ ] ।

৫। সুদ আন্তর্জাতিক শোষণ ও বৈষম্য সৃষ্টি করে (Riba creates international oppression and discrimination): ধনী দেশের শোষণ প্রক্রিয়া ঋণের মাধ্যমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঋণগ্রহীতা দেশের সমস্ত সম্পদ দাতা দেশগুলি কুক্ষিগত করে। সুদী অর্থনীতির কারণে ধনী দেশগুলো আরো ধনী, গরীব দেশগুলো আরো গরীব হতে থাকে। তারা ক্রমে নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে পড়ে। ড. এম. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী (জীবনকাল ১৯৩১ ১১ নভেম্বর ২০২২) লিখেছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আয় ও সম্পদ বণ্টনে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সুদ [ ড. এম. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী, Issues in Islamic Banking: selected papers, The Islamic Foundation, UK, 1980, page. 82.] ।

৬। সুদ কেন্দ্র-প্রান্ত সম্পর্ক সৃষ্টি করে (Riba creates centre pheriphery relationship): সুদের কারণেই উন্নত ও উন্নয়নশীল-স্বল্পোন্নত দেশের প্রকৃত সম্পর্ক হয় কেন্দ্র-প্রান্ত সম্পর্ক, শোষক-শোষিত সম্পর্ক। সুদের ফলশ্রুতিতেই উন্নত দেশসমূহ দরিদ্র, স্বল্পোন্নত দেশসমূহের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়। সুদ অনুন্নত, স্বল্পোন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোকে চিরকাল ধনী দেশগুলোর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে বাধ্য করে।

দরিদ্র দেশগুলো খুব কমই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি ও সাহস পায়। যে দেশ একবার সুদী বৈদেশিক ঋণের বোঝা ঘাড়ে তুলে নেয়, সে দেশের পক্ষে সুদের এ বোঝা নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানো আর কখনো সম্ভব হয় না। নতুন বিনিয়োগের জন্য না হলেও পুরাতন ঋণ পরিশোধের প্রয়োজনে অন্য সরকার অথবা কোন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতেই হয় এবং দেয়া শর্তাদী অবশ্যই মেনে চলতে হয় এবং যতই দিন যায় এ ঋণ ও সুদের বোঝা ততোই ভারী হতে থাকে। অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে জনসমর্থনহীন সরকার বড় অংকের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে দেশের বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের অনাগত ভবিষ্যৎ সুদী ঋণের কাছে বাঁধা (Mortgage) রাখা হয় [ বিস্তারিত মুহাম্মদ তাকী উসমানী, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৮-১২২ ] ।

৭। ধনী ও গরীব দেশের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি: সুদ ধনী তথা ঋণদাতা ও গরীব তথা ঋণগ্রহীতা দেশের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিকভাবে ঋণগ্রহীতা দেশ ঋণদাতা দেশের গোলামে পরিণত হয়। যে দেশ একবার সুদী ঋণের বোঝা ঘাড়ে তুলে নেয় সে দেশের পক্ষে এই বোঝা নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানো সম্ভব হয় না। সুদের কারণেই ধনী ও দরিদ্র দেশের সম্পর্ক শোষক-শোষিতের পর্যায়ে উপনীত হয়।

৮। সুদ সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও বিলাসিতা বাড়িয়ে দেয়: সুদ বিশ্বব্যাপী অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও বিলাসিতা বাড়িয়ে দেয়। বর্তমান পৃথিবীতে সুদসহ ঋণ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিলেই ঋণ পাওয়া যায়। ঋণের অর্থ কি প্রকল্পে ব্যবহার করা হবে এবং এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে কোন সম্পদ উৎপাদন করা হবে কি না, ঋণদাতা সংস্থা বা রাষ্ট্র তা অনেক ক্ষেত্রেই খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। ফলে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো অনেক সময় সামর্থের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ এবং ঋণের অর্থ অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসিতামূলক কাজে ব্যবহার করে থাকে। তারা আয় অনুযায়ী ব্যয় করার পরিবর্তে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জীবনযাত্রার মান বাড়িয়ে তোলে। নাগরিকদের একাংশ পরিশ্রমের পথ পরিহার করে সহজ ও বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠে।

বর্তমান বিশ্বে সুদভিত্তিক আন্তর্জাতিক ঋণ ব্যবস্থা দরিদ্র-উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঋণ করার প্রবণতা সৃষ্টি করে। এই ব্যবস্থা অপরিনামদর্শী এবং স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের ঋণ গ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। বস্তুত সুদভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থার কারণেই কোন কোন রাষ্ট্র বিপুল ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে আবার ঋণ গ্রহণ করতে পারে। পুরাতন ঋণ পরিশোধের জন্য নতুন ঋণ নেয় এবং ঋণ পরিশোধের তারিখ বার বার পিছিয়ে বছরের পর বছর সুদসহ ঋণের বর্ধিত বোঝা বহন করে চলে।

সুদের নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক কুফল-ক্ষতির সর্বনাশা সয়লাব থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করতে ইসলাম সকল প্রকার সুদকে চিরতরে হারাম ঘোষণা করেছে। সমাজ শোষণের যতগুলো উপায় এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত হয়েছে, ধনীকে আরো ধনী এবং গরীবকে আরো গরীব করার যত কৌশল প্রয়োগ হয়েছে সুদ সেই গুলোর মধ্যে সেরা। মোটকথা কৌশল, পদ্ধতি, ফলাফল, অর্থনীতির চূড়ান্ত অনিষ্ট সাধন-সকল বিচারেই সুদের কাছাকাছি কোন সমাজ বিধ্বংসী হাতিয়ার নেই।

১৪. সুদ ও মুনাফা (Interest and Profit)

১৪.১ মুনাফার অর্থ(Meaning of Profit)

মুনাফা শব্দের অর্থ হচ্ছে উদ্বৃত্ত (Surplus), প্রবৃদ্ধি (Growth), অবশিষ্টাংশ (Resedue)। মুনাফার উৎস হচ্ছে বিনিয়োগ (Investment)। অন্যকথায়, মুনাফা আসে বিনিয়োগ থেকে। কিন্তু ক্রয়-বিক্রয় ছাড়া বিনিয়োগ করা যায় না। বিনিয়োগের সংজ্ঞা হচ্ছে, লাভ করার উদ্দেশ্যে কোন পণ্য-সমাগ্রী ও সেবা উৎপাদন বা ক্রয় করা যাতে লোকসানের ঝুঁকিও বর্তমান থাকে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও ইসলামী অর্থনীতিতে মুনাফার সংজ্ঞা ভিন্ন। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মোট আয় থেকে মোট উৎপাদন খরচ, অর্থাৎ জমির খাজনা, শ্রমের মজুরি ও পুঁজির সুদ বাদ দেয়ার পর উদ্যোক্তার হাতে যে উদ্বৃত্ত থাকে, তাকে মুনাফা বলে। উদ্বৃত্ত বেশি থাকলে মুনাফা বেশি হয়। উদ্বৃত্ত কম হলে মুনাফা কম হয়। উদ্বৃত্ত শূন্য হলে মুনাফা শূন্য হয়। উদ্বৃত্ত ঋণাত্মক হলে লোকসান হয়। সুতরাং মুনাফার কোন পূর্ব নির্ধারিত হার নেই।

অন্যভাবে বলা যায় যে, মুনাফা হচ্ছে বিনিয়োজিত পুঁজির বর্ধিত অংশ, আর লোকসান হচ্ছে পুঁজির ক্ষয়প্রাপ্ত বা খোয়া যাওয়া অংশ। পুঁজিবাদী অবাধ ও মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে মুনাফা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতিরিক্ত মুনাফা লাভের মূল ধারণাটা সচল না থাকলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল ভীত টা-ই ধ্বসে পড়ে। সীমাতিরিক্ত মুনাফা অর্জন এ অর্থনীতিতে স্বীকৃত। ইসলামী অর্থনীতিতে মুনাফার সংজ্ঞা ভিন্ন, কারণ ইসলামে রিবা নিষিদ্ধ। সুতরাং ইসলামী অর্থনীতিতে মোট আয় থেকে খাজনা ও মজুরি বাদ দিলেই মুনাফা পাওয়া যায়। অর্থাৎ কোনো বিক্রয়লব্ধ আয় থেকে খাজনা ও মজুরী বাবদ মোট খরচ বাদ দেয়ার পর যদি বিনিয়োজিত পুঁজি বৃদ্ধি পায়, তাহলে পুঁজির সেই বর্ধিত অংশকে মুনাফা বলে। আর পুঁজি হ্রাস পেলে তাকে লোকসান বলে। মুনাফা হলো উৎপাদনের মূল্য ও উৎপাদন খরচের পার্থক্য। ব্যবসায়ের মাধ্যমেই মুনাফা অর্জিত হয়। ইসলামী অর্থনীতিতে মুনাফা হচ্ছে সম্পদের এমন বৃদ্ধি, যা কোনো অর্থনৈতিক কারবারে সম্পদ বিনিয়োগ করার ফলে অর্জিত হয়। উদ্যেক্তা প্রথমে বিনিয়োগকৃত অর্থকে পণ্যে রূপান্তরিত করে। মুনাফা পণ্যের বিক্রয় ও ক্রয় মূল্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। মুনাফা হচ্ছে পণ্যের উৎপাদন কিংবা ক্রয়মূল্য ও বিক্রয়মূল্যের পার্থক্য। মুনাফার সাথে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় জড়িত। মুনাফা পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসায়ের স্বাভাবিক ফল স্বরূপ অর্জিত হয়। লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে পণ্য ক্রয় বিক্রয় করে পুঁজির অতিরিক্ত যে আয় হয় তাই মুনাফা। বিক্রয়-ক্রয় লাভ/মুনাফা। ইসলামে মুনাফা পুঁজির প্রতিদান (Reward) হিসাবে স্বীকৃত। ইসলামী শারী’আহ মেনে কোন গ্রহণযোগ্য ব্যবসায় যদি পুঁজি খাটানো হয় তবে এর মালিকের জন্য প্রতিদান দাবি করা ন্যায়সংঙ্গত ও বৈধ। আবার লাভ বা প্রতিদান কেবল তখনই দাবি করা যেতে পারে যখন ঝুঁকি বা ক্ষতির আশঙ্কা থাকে বা শ্রম ব্যয় করা হয়। ই. এম. নূর দেখিয়েছেন যে, মুনাফার উৎস হচ্ছে বাড়তি উপযোগ। আর তা আসে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে। ব্যবসায় প্রথমে একটি পণ্য দ্বারা ভিন্নতর কোন পণ্য ক্রয় করে একে রূপান্তর করা হয়। পরে আবার বিক্রয়ের মাধ্যমে সেই পণ্যকে মূল পণ্যে ফিরিয়ে আনা হয়। এতে মূল পণ্যটির পরিমাণ পূর্বের তুলনায় বেড়ে যায়। এই বৃদ্ধিটাই হচ্ছে মুনাফা [ ই.এম.নূর, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৯; তু. অধ্যাপক মুহাম্মাদ শরীফ হুসাইন, আল কোরআনে সুদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৩ ] ।
ক্রয়-বিক্রয় ছাড়া বিনিয়োগ ও ব্যবসায় হয় না। মুনাফা ক্রয়-বিক্রয় থেকে উদ্ভূত হয়। এর অর্থ হচ্ছে:

১। প্রথমে অর্থকে/পুঁজিকে মালে রূপান্তর। উদ্যোক্তা প্রথমে বিনিয়োজিত অর্থকে পণ্যে রূপান্তরিত করে।
২। দ্বিতীয়ত মালকে আবার অর্থ বা পুঁজিতে রূপান্তর। অতঃপর উপরোক্ত পণ্যকে বিক্রি করে পণ্যকে অর্থে রূপান্তরিত করে।
৩। রূপান্তরের ঝুঁকি গ্রহণ। মুনাফাকে ঝুঁকি গ্রহণের ফল বলা যায়। রূপান্তরের ঝুঁকি গ্রহণের স্বাভাবিক ফলস্বরূপ বিনিয়োজিত পুঁজি বর্ধিত হয়; আর পুঁজির এই বর্ধিত অংশই হচ্ছে মুনাফা।

এ রূপান্তর প্রক্রিয়ায় ফেরত প্রাপ্ত-অর্থ বা পুঁজি পূর্বের চেয়ে বেশি হলে অতিরিক্ত অংশ লাভ। কম হলে খোয়া যাওয়া অংশ লোকসান (Loss)। লাভ-লোকসান বিনিয়োগ ও ব্যবসায়ের স্বাভাবিক ফল (Result)। বিনিয়োগের মাধ্যমে মূলধন বৃদ্ধি পেলে তাকে মুনাফা বলে। পুঁজি বিনিয়োগ, শ্রম নিয়োগ এবং ঝুঁকি গ্রহণের ফল স্বরূপ মুনাফা অর্জিত হয়।

১৪.২ মুনাফার সংজ্ঞা (Definition of Profit)

মুনাফার কয়েকটি প্রামাণ্য সংজ্ঞা নিম্নরূপ: মনিষী ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) এর মতে, ব্যবসায়ে কম মূল্যে পণ্য ক্রয় করে বেশি মূল্যে তা বিক্রয় করে মূলধনের প্রবৃদ্ধি সাধনের মাধ্যমে উপার্জন করা যায়। এ বাড়তি পারিমাণটাকেই বলা হয় লাভ বা মুনাফা [ উদ্ধৃত মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, ইসলামী অর্থনীতিতে ক্রয়-বিক্রয়, ব্যাবসায় ও মুনাফা (প্রবন্ধ), আল কুরআনে অর্থনীতি, খ-১, ইফাবা প্রকাশনা, এপ্রিল ১৯৯০, পৃ-৬৬৯ ] ।

ইমাম রাগেব ইস্পাহানী লিখেছেন, লাভ বা মুনাফা বলতে সে বাড়তি সম্পদ বোঝায় যা ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়।… পরে তা পরোক্ষ অর্থে কর্মের ফল হিসেবে যা ফিরে আসে তা বুঝায়। [ ইমাম রাগেব, আল মাবাদি, আল ইকতিসাদিয়াতি ফিল ইসলামী, পৃ-২৯, উদ্ধৃত, আল কুরআনে অর্থনীতি, খ-১, পূর্বোক্ত, পৃ-৬৬৯ ] ।

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ.) (১৯০৩-১৯৭৯) ব্যবসায় ও মুনাফার আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ব্যবসায় বলতে বুঝায়, যেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা দু’টি পক্ষ আছে। বিক্রেতা একটি পণ্য বা বস্তু বিক্রির জন্য পেশ করে।

ক্রেতা ও বিক্রেতা মিলে এ পণ্যের একটি মূল্য স্থির করে। এ মূল্যের বিনিময়ে ক্রেতা বস্তুটি কিনে নিয়ে নেয়। এ ক্ষেত্রে বিক্রেতা নিজে পরিশ্রম করে ও অর্থ ব্যয় করে ঐ পণ্যটি তৈরি করেছে অথবা সে কোথাও থেকে পণ্যটি কিনে এনেছে-এ দু’টোর কোন একটি অবস্থার অবিশ্যি সৃষ্টি হয়। এ উভয় অবস্থায়ই সে বস্তুটি কেনা বা সংগ্রহ করার ব্যাপারে নিজের যে মূলধন খাঁটিয়েছে তার সাথে নিজের পরিশ্রমের অধিকার সংযুক্ত করেছে। পণ্যটি বিক্রি করে ফেরত প্রাপ্ত অর্থ বেশি হলে অতিরিক্ত অংশই মুনাফা [ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, ইসলামী অর্থনীতি (ঢাকা: সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী রিসার্চ একাডেমী, অক্টোবর, ১৯৯৭), পৃ.১৭৮ ] ।

ড. সামি হাসান হামুদের মতে, মুনাফা হচ্ছে সম্পদের এমন প্রবৃদ্ধি যা কোন অর্থনৈতিক কারবারে সম্পদ বিনিয়োগ করার ফলে অর্জিত হয়। উদ্যোক্তা প্রথমে বিনিয়োজিত অর্থকে পণ্যে রূপান্তরিত করে অতঃপর উক্ত পণ্য বিক্রি করে পণ্যকে অর্থে রূপান্তরিত করে। এভাবে রূপান্তরিত অর্থ বিনিয়োজিত অর্থের তুলনায় বেশি হলে উদ্যোক্তার লাভ/মুনাফা হয়, কিন্তু যদি প্রাপ্ত অর্থ পূর্বের তুলনায় কম হয়, তাহলে তার পুঁজি কমে যায় বা তার লোকসান হয়। মুনাফা তাই পুঁজিকে রূপান্তরিত করে ঝুঁকি গ্রহণের ফল [সামি হাসান হামুদ, ইসলামী ব্যাংকিং, (লন্ডন: এরাবিয়ান ইনফরমেশন লিমিটেড, ১৯৮৫), পৃ.১৩৮]।

অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইনের মতে, মুনাফা হচ্ছে মানবীয় শ্রমের সাহায্যে পুঁজি খাটিয়ে ঝুঁকি গ্রহণ করার ফল [ অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, ইসলামী ব্যাংকিং: একটি উন্নততর ব্যাংক ব্যবস্থা (ঢাকা: জনসংযোগ বিভাগ, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, অক্টোবর, ১৯৯৬), পৃ.৪০ ] ।

ড. এম.এ. হামিদের মতে (১৯৩৯-২০০২), অর্থের বিনিময়ে দ্রব্য সামগ্রী ও সেবা ক্রয় এবং পুনরায় অর্থের বিনিময়েই তা বিক্রয় করা বৈধ। এই ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যের পার্থক্যই ‘মুনাফা’ হিসেবে স্বীকৃত [ ড. এম.এ.হামিদ, ইসলামী অর্থনীতি, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৭ ] ।

ড. মুহাম্মাদ হায়দার আলী মিয়ার মতে, লাভ লোকসানের ভিত্তিতে ব্যবসায়িক উপার্জনকে মুনাফা বলা হয়। ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতা, লাভ- লোকসানের সম্মতির ভিত্তিতে বিক্রেতা তার ক্রয় মূল্যের সাথে আনুষঙ্গিক খরচসহ উৎপাদন খরচের অতিরিক্ত যে অর্থ পায় তাকেই মুনাফা বলে [ ড. মোহাম্মাদ হায়দার আলী মিয়া, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭ ] ।

মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী লিখেছেন, অর্থ দ্বারা যে মুনাফা অর্জিত হয় তা মূলত কারবারের ঝুঁকি গ্রহণের পারিতোষিক। দক্ষতা দ্বারা এবং কারবারকে বহুমুখী করার মাধ্যমে এ ঝুঁকি নিম্নতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা যেতে পারে, কিন্তু একে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা সম্ভব নয়। কেউ মুনাফা অর্জন করতে চাইলে তাকে ঝুঁকি নিম্নতম পর্যায়ে রাখতে হবে [ মুহাম্মাদ তাকী উসমানী, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০৯ ] ।

১৪.৩ মুনাফার গুরুত্ব (Importance of profit)

মুনাফা মানবসমাজের মুয়ামালাতী কর্মকান্ডের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুনাফার গুরুত্বসমূহ নিম্নরূপ:

১. মুনাফা অর্থনৈতিক কার্মকান্ডের প্রাণশক্তি

মুনাফা হচ্ছে যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের চালিকাশক্তি; কেবল কামাই-রুজি-জীবিকা অর্জন করা নয় বরং উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির বাহনও হচ্ছে মুনাফা। একজন উদ্যেক্তা, একজন শিল্পপতি তার মেধা ও মুলধন বিনিয়োগ করে কারখানা গড়ে তোলে, কারখানায় তৈরি পণ্য বিক্রি করে মুনাফা করাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। সে ব্যবসায়ী পণ্য-সামগ্রী ক্রয় করে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়ার কষ্টসাধ্য কাজ করেতো মুনাফা পাবার উদ্দেশ্যেই। অন্যদিকে লক্ষ্য করা যায় যে, মুনাফার সম্ভাবনা নেই এমন ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে কেউ উৎসাহবোধ করে না; সেসব কাজে বিনিয়োগ করতে কেউ এগিয়ে আসে না।

২. মুনাফা কল্যাণকর

জীবিকা আহরণ ও সম্পদ অর্জনের পথ হিসেবে ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্য ও মুনাফার উপর গুরুত্বারোপ করেছে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ব্যবসাকে সর্বাধিক লাভজনক, কল্যাণকর এবং সবচেয়ে মহৎকাজ বলে ঘোষণা করেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমেই মুনাফা অর্জিত হয়।

৩. মুনাফা উন্নতি ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি

অবাধ বাজার অর্থনীতিতে মুনাফার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুনাফাই হচ্ছে জীবিকা অর্জনের হালাল ও সম্মানজনক পথ। অনিশ্চয়তার মুখে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পুরস্কার হলো মুনাফা। উদ্যেক্তা পরিচালিত ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠানের মৌলিক ছকের (Classic model) যৌক্তিকতাও এর মধ্যে নিহিত। ব্যবসা-বানিজ্যেও মূলধন বৃদ্ধি পায়, যা মুনাফা নামে আখ্যায়িত। মুনাফাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহ যোগায় এবং উদ্যোক্তাকে উদ্বুদ্ধ করে। দক্ষতা বৃদ্ধি ও নতুন আবিষ্কার উদ্ভাবনের মূল প্রেরণাই হচ্ছে মুনাফা। মুনাফা ছাড়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির ও অচল হয়ে পড়তে বাধ্য।

৪. মুনাফা মহান আল্লাহর অনুগ্রহ

মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন মুনাফাকে আল্লাহর অনুগ্রহ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং মানবজাতির উপকারার্থে নদ-নদী, সাগর ও মহাসাগরে নৌকা, জাহাজের মাধ্যমে, কন্টেইনার ভ্যাসেলের মাধ্যমে মালামাল পরিবহনের ওপর বারবার গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং মুনাফাকে জীবিকা অর্জনের অন্যতম উপায় বলে ঘোষণা করেছেন। মুনাফায় আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বরকত দেন।

৫. মুনাফা অর্জন অত্যাবশ্যকীয়

আল-কোরআনের বহুসংখ্যক আয়াতে আল্লাহপাক মানুষকে মুনাফা অর্জনে তাগিদ দিয়েছেন। মানুষ যাতে জীবনোপকরণ সংগ্রহ করতে পারে সেজন্য আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার জমীনকে মানুষের অধীন করে দেয়ার কথাও বলেছেন। সূরা আল মুলকে বলা হয়েছে- “সেই আল্লাহই তো তোমাদের জন্য ভূ-গোলককে অধীন বানিয়ে রেখেছেন, যাতে তোমরা এর বক্ষের উপর চলাচল কর এবং তা থেকে আল্লাহর দেয়া রিজিক খাও [ ৬৭: সূরা আল মুলক, আয়াত-১৫ ] ।

১৪.৪ মুনাফার বৈশিষ্ট্য (Features of profit)

মুনাফার বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ:

১. মুনাফা হচ্ছে বিক্রয়মূল্য ও ক্রয়মূল্যের পার্থক্য

বেচা-কেনার সাথে মুনাফা প্রত্যয়টি অনিবার্যভাবে জড়িত। বেচা-কেনা থেকেই মুনাফা অর্জিত হয়। কোন পণ্য বিক্রি করে বিক্রেতার মোট যে আয় হয়, আর পণ্যটি প্রস্তুত করতে যা ব্যয় হয়, এতদুভয়ের পার্থক্য হচ্ছে মুনাফা।

২. মুনাফা পুঁজি রূপান্তরের ফল

মুনাফা হচ্ছে পুঁজি রূপান্তরের ফল।

৩. মুনাফা সংযোজিত মূল্যের বিনিময়

বিনিয়োগের মাধ্যমে সংযোজিত উপযোগের মূল্যই হচ্ছে মুনাফা যা মোট মূল্যের মধ্যেই থাকে।

৪. মুনাফা ঝুঁকিপূর্ণ

ব্যবসা লাভ-লোকসান সাপেক্ষ। ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য এটিই যে কখনও কখনও এতে লোকসানও হতে পারে। এতে উদ্যেক্তাকে ঝুঁকি বহন করতে হয়। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে একজন ব্যবসায়ী যে অনিশ্চয়তার ঝুঁকি গ্রহণ করেন সেই অনিশ্চয়তার ঝুঁকি গ্রহণের জন্যেই তিনি মুনাফা গ্রহণের উপযুক্ত বিবেচিত হন। ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসায়ে মুনাফা অর্জন ও লোকসান উভয়েরই সমান সম্ভাবনা।

৫. মুনাফা পূর্বনির্ধারিত হয় না

মুনাফা কখনও পূর্বনির্ধারিত হয় না। মুনাফা অনির্ধারিত ও অনিশ্চিত।

৬. মুনাফা বাজারের দান

মুনাফা-লোকসানের বিষয়টি আসলে বাজারের ওপরই নির্ভরশীল।

৭. মুনাফা প্রতিমূল্যের অন্তর্ভুক্ত

বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে দর কষাকষির দ্বারা পণ্য সামগ্রীর যে দাম নির্ধারিত হয়, মুনাফা বা লোকসান তার অন্তর্ভুক্ত, দাম বহির্ভূত বা অতিরিক্ত কিছু নয়।

৮. মুনাফা বিনিময়হীন নয়

কারবারে অর্জিত মুনাফার প্রতিমূল্য সর্বদাই আছে। ক্রেতা বিক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি করেই মুনাফা অর্জন করে। বিক্রেতা মূল্য গ্রহণের বিনিময়ে ক্রেতাকে পণ্য বা সেবা দেয়। আর ক্রেতা পণ্য সরবরাহের বিনিময়ে দাম দেয়। বিক্রেতা দাম পায়, ক্রেতা পণ্য পায়।

৯. মুনাফা হালাল

‘বায়’ বা ক্রয়-বিক্রয়কে আল্লাহ হালাল করেছেন। তাতে ক্রয় মূল্যের বাড়তি যা পাওয়া যায় তাও অনিবার্যভাবে হালাল। সম্পূর্ণ হালাল।

১৪.৫ সুদ ও মুনাফার পার্থক্য (Distinction between Riba and Profit)

রিবা/সুদ ও মুনাফার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। অনেকে আছেন যারা স্বেচ্ছায় বা জ্ঞাতসারেই অথবা অনিচ্ছায় বা অজ্ঞাতসারে সুদকে মুনাফার সাথে এক করে দেখার চেষ্টা করেন। তারা সুদ ও মুনাফাকে অভিন্ন মনে করে থাকে। দুঃখের বিষয় যে, অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিসহ সাধারণ মানুষ সুদ ও মুনাফার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেন না। অতীতে এক শ্রেণির লোক বলতো ‘বাই’ তো সুদের মতোই। আজও এক শ্রেণির লোক একইভাবে বলে যে, তারাও ১২%, আমরাও ১২% তফাৎ কোথায়? এরূপ কথা যারা বলে তাদেরকে আল্লাহ নির্বোধ, বুদ্ধিহীন, পাগল বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ বলেন, “শয়তান তার স্পর্শ দ্বারা তাদের বুদ্ধিহীন, পাগল বানিয়ে দিয়েছে [ সূরা আল বাকারা, আয়াত-২৭৫ ] ।

এখানে শয়তানের স্পর্শ বলতে অর্থ-সম্পদের মোহকে ধরে নেয়া যেতে পারে। সম্পদের মোহ এমন যে, এজন্য তারা অযৌক্তিক ধারণার বশবর্তী হয়ে নির্বোধের মতো বাই-মুনাফা ও সুদের পার্থক্য পর্যন্ত স্বীকার করতে চায় না। অভিশপ্ত অর্থনীতির পক্ষপাতিরা বলে বেড়ায় যে, ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসায় থেকেও ধন-মালের প্রবৃদ্ধি হয় মুনাফার মাধ্যমে, সুদও তো এ প্রবৃদ্ধি জনিত এক প্রকারের মুনাফা-ই। তাহলে ক্রয়-বিক্রয় ব্যবসায় হালাল হওয়ার আর সুদ হারাম হওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। বিশেষ করে ব্যক্তি পর্যায়ে একজন সুদখোর এবং একজন ব্যবসায়ীর পার্থক্য বুঝতে সক্ষম হলেও সনাতন সুদি ব্যাংক ব্যবস্থা ও ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য করতে অনেক সময়ই ব্যর্থ হন। অর্থনীতিতে সুদ ও মুনাফা এ দু’টো ধারণাতেই মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এ দু’য়ের মাঝে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক পার্থক্য রয়েছে। ‘সুদ’ একটি উর্দু শব্দ। ‘রিবা’ শব্দ দিয়ে আল কুরআনে যা ব্যক্ত করা হয়েছে বাংলাভাষায় এর উপযুক্ত প্রতিশব্দ না থাকায় এর অনুবাদ করা হয় ‘সুদ’ শব্দ দিয়ে। সুদ ও মুনাফার পার্থক্য সংক্ষেপে নিম্নরূপ:

পার্থক্যের বিষয়

১। আভিধানিক অর্থ

রিবা/সুদ Riba – রিবা দ্য বা সুদ এর শাব্দিক অর্থ আধিক্য, বৃদ্ধি, বিকাশ, অতিরিক্ত সংযোজন, সম্প্রসারণ, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি। কোরআনে ব্যবহৃত ‘রিবা’ পরিভাষাটি আরবি শব্দমূল ‘রাবউন’ থেকে উদগত। যার বাংলা অর্থ হচ্ছে বেশি হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া, অতিরিক্ত সম্প্রসারণ, মূল থেকে বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

মুনাফা/লাভ Profit – আরবি রিবহ (স) এর বাংলা মুনাফা বা লাভ। এর শাব্দিক অর্থ কারবারে সাধিত প্রবৃদ্ধি। কারো কারো মতে রিবাহুন অর্থ অর্জিত সম্পদ। ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসায়-বাণিজ্য ব্যাপদেশে সযত্ন উদ্যোগ, আয়োজন, কর্মতৎপরতার মাধ্যমে যে ধনসম্পদ অর্জিত হয়ে থাকে, তাই রিবাহুন তথা মুনাফা (Profit) হিসেবে পরিচিত।

২। সংজ্ঞা

সংজ্ঞা অনুসারে রিবা হলো ঋণের শর্ত অনুযায়ী ঋণগ্রহীতা কর্তৃক ঋণদাতাকে মূলধনের সাথে প্রদেয় বাড়তি অর্থ। সুদ হলো কাউকে ঋণ দিয়ে সময়ের উপর ধার্যকৃত মূলধনের অতিরিক্ত অর্থ বা সম্পদ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্তে কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা অর্থের বিপরীতে পূর্ব নির্ধারিত হারে যে অধিক পণ্য বা অর্থ আদায় করা হয়, তাই সুদ ঋণের শর্ত অনুযায়ী মূলধনের অতিরিক্ত আদায় করা সুদ।

ঋণের সংজ্ঞা অনুসারে মুনাফা হলো উৎপাদনের মূল্য ও উৎপাদন খরচের মধ্যে পার্থক্য। উৎপাদন কিংবা ক্রয়-বিক্রয়ের ফলে অথবা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মূলধন বিনিয়োগের ফলশ্রুতিতে মূলধনের অতিরিক্ত উপার্জিত অর্থ বা সম্পদকে মুনাফা বলা হয়। ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসার ফলস্বরূপ অর্জিত অর্থ বা সম্পদই মুনাফা। পণ্যের ক্রয়মূল্য থেকে বিক্রয়মূল্য বেশি হলে তা মুনাফা।

৩। ভিত্তি

সুদের সম্পর্ক ঋণের সাথে। সুদের ভিত্তি হলো ঋণ। ঋণ থেকেই সুদের উৎপত্তি। অন্যকথায় সুদমুক্ত ঋণ সম্ভব কিন্তু ঋণ ব্যতিরেকে সুদের উদ্ভব সম্ভব নয়।

মুনাফা বা লাভের সম্পর্ক ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সাথে। মুনাফা আসে বিনিয়োগ থেকে। কিন্তু ক্রয়-বিক্রয় ছাড়া বিনিয়োগ করা যায় না। মুনাফার ভিত্তি হলো প্রত্যক্ষভাবে দ্রব্য উৎপাদন ও
বিক্রয় কিংবা লাভ-লোকসান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অর্থ ও সম্পদ বিনিয়োগ করা।

৪। উৎপত্তি

এক জাতীয় খাঁহমরনষব মড়ড়ফং লেনদেনে সুদ হয়। সুদের বেলায় ক্রয়-বিক্রয় রূপান্তর সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সুদ অর্জিত হয় ঋণ ও সময়ের উপর ধার্যকৃত হস্তান্তরিত আয়ের মাধ্যমে। সুদের ক্ষেত্রে মুদ্রার বিনিময়ে একই জাতীয় মুদ্রার লেনদেন হয়।

দু’টি বা দুপ্রকার পণ্যের লেন-দেন, ক্রয়-বিক্রয় এবং তা থেকে লাভ বা মুনাফা আসে। মুনাফা মূলত দ্রব্য-সামগ্রী ও সেবার ক্রয়-বিক্রয় তথা ব্যবসার স্বাভাবিক ফলস্বরূপ অর্জিত হয়। এক্ষেত্রে নগদ অর্থকে প্রথমে পণ্যে এবং এরপর পণ্যকে আবার নগদ অর্থে রূপান্তর করতে (transformation হয়। of money into goods and goods into money.) রূপান্তরের ঝুঁকি গ্রহণের স্বাভাবিক ফল স্বরূপ পুঁজির বর্ধিত অংশই মুনাফা।

৫। উপাদান নির্ধারক

রিবার নির্ধারক উপাদান হলো তিনটি; সময়, সুদের হার ও মূলধনের পরিমাণ। নির্দিষ্ট সুদের হারে ঋণ দেয়া কোন মূলধনের সুদ ঋণের সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়।

মুনাফা হওয়া না হওয়া কিংবা কম বেশি হওয়া নির্ভর করে অনুকূল ব্যবসায়িক লেনদেন, ব্যয় সাশ্রয় ও অনুকূল বাজার চাহিদার উপর।

৬। প্রক্রিয়া

সুদ Fungible goods-এর দাম, ঋণের বর্ধিত অংশ। সুদ অর্জিত হয় ঋণের ওপর।

মুনাফা পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়ায় পুঁজির/ মূলধনের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অংশ।

৭। আরোপন

সুদ ঋণের উপর আরোপিত। সুদ প্রকৃত পক্ষে কোন উৎপাদনশীল কাজের বিনিময় নয়; বরং এক ধরনের অনুপার্জিত আয় মাত্র।

মুনাফা বিনিয়োগ/ ব্যবসায় রূপান্তরের স্বাভাবিক ফল যা বাজার থেকে উদ্ভূত।

৮। সুবিধা প্রাপক

ঋণদাতাকে শ্রম দিতে হয় না, সে অর্থ ধার দেয় মাত্র। সুদ বিনা শ্রমে পাওয়া যায়। ঋণদাতা নিজেই কেবল সুদের সুবিধা ভোগ করে থাকেন। অর্থাৎ সুদের সব টাকাই চলে যায় ঋণদাতার পকেটে।

সময়, ব্যবসায়ী/উদ্যোক্তাকে শ্রম, মেধা, পুঁজি নিয়োজিত করতে হয়। মুনাফা অর্জনে পরিশ্রম করতে হয়।

৯। বিনিময়

সুদের বিনিময় দেয়া হয় না। সুদের ক্ষেত্রে মূলধনের অতিরিক্ত যে অর্থ গ্রহণ করা হয় এর কোন বিনিময় দেয়া হয় না। সুদ একটি অনুপার্জিত হস্তান্তরিত আয়। এর কাউন্টার ভ্যালু বা বিনিময় নেই।

মুনাফা মূল্য সংযোজন থেকে আসে-এর মূল্য দেয়া হয়। মুনাফা বিনিময়হীন নয়। বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদিত বা সংযোজিত উপযোগ হচ্ছে মুনাফার কাউন্টার ভ্যালু।

১০। মূল্য প্রদান

সুদে ঋণগ্রহীতা বেশি মূল্য দেয়।

ক্রয়-বিক্রয়ে উভয়ে সমান মূল্য দেয় ও নেয়। ব্যবসায় ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সমান সমান মূল্যের বিনিময় হয়। ক্রেতা বিক্রেতার কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করে মুনাফা অর্জন করে। অন্যদিকে বিক্রেতা যে বুদ্ধি,
শ্রম ও মেধা ব্যয় করে ক্রেতার জন্য পণ্যটি যোগাড় বা উৎপাদন করে সে তারই মূল্য গ্রহণ করে।

১১। নির্ধারণ

সুদ পূর্ব (prefixed), নির্ধারিত তবে অনির্ধারিতও হতে পারে। তবে ঋণ দেয়ার সময়ই সুদে-মূলে কত পরিশোধ করতে হবে তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।

মুনাফা পরে নির্ধারিত হয় (Profit is post determined)। অন্যকথায় মুনাফার হার পূর্বনির্ধারিত (Predetermined) নয়। মুনাফা পূর্ব নির্ধারিত হয় না। মুনাফা অনির্ধারিত।

১২। নিশ্চয়তা

সুদ নিশ্চিত-সুদের হার ও সময় পূর্ব নির্ধারিত বিধায় এতে ঋণদাতার আয় নিশ্চিত। কিন্তু ঋণগ্রহীতার লাভের কোন নিশ্চয়তা নেই। অন্যকথায় সুদের কারবারে অনিশ্চয়তার কোন উপাদান থাকে না। ঋণদাতা নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণের বিপরীতে নির্দিষ্ট সময়ান্তে কত সুদ পাবেন তা আগে থেকেই জানতে পারেন।

মুনাফা অনিশ্চিত- বিক্রেতার লাভ হতেও পারে আবার লাভনাও হতে পারে। সময় যেহেতু মুনাফা নির্ধারণের কোন নিয়ামক উপাদান নয় এবং মুনাফার হার যেহেতু পূর্ব নির্ধারিত হয় না সেহেতু একজন বিনিয়োগকারী নির্দিষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগে আদৌ মুনাফা পাবে কিনা অথবা কি পরিমাণ পাবেন তার কোন নিশ্চয়তা লাভ করা সম্ভব নয়।

১৩ ঋণাত্মক /ধনাত্মক

রিবা কখনই ঋণাত্মক হতে পারে না, হয় না। বড় জোর খুবই কম বা শূন্য হতে পারে। Riba cannot be negative, it can at best be low or zero.

মুনাফা ধনাত্মক, শূন্য এমনকি ঋণাত্মকও হতে পারে। Profit can be positive, zero or even negative.[ আবদুর রহমান আল জাবিরী, কিতাব আল ফিকহ আলা আল মাযাহিব আল আরবায়ী, আল মাকতাবাহ আস তেজারিয়‍্যায়, আল কুবরা, ২য় খণ্ড, কায়রো, মিশর, ১৯৩৮, পৃ.২৪৫ ] ।

১৪। ঝুঁকি

(ক) সুদের ক্ষেত্রে মূলধনদাতাকে কোন ঝুঁকি বহন করতে হয় না। অন্যকথায় সুদের ক্ষেত্রে ঋণদাতার কোন ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তা নেই। সুদে লোকসানের ক্ষেত্রে হুমকি নেই। এখানো বেচাকেনা ও ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয় না। অন্য কথায় সুদে লোকসানের ঝুঁকি বহন করতে হয় না।

(খ) একটি ফার্মের মূলধন কাঠামোতে সুদমুক্ত ঋণের পরিমাণ যত বৃদ্ধি পায় ফার্মটি ততবেশি ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হয়। নতুন বিনিয়োগকারীগণ ঋণভারাক্রান্ত ফার্মে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হয়।

(ক) মুনাফায় ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়। মুনাফার ক্ষেত্রে মূলধন সরবরাহকারী ও উদ্যোক্তা উভয়ের জন্যই ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তা বিদ্যমান। মুনাফায় লোকসানের ঝুঁকি বহন করতে হয়। অন্য কথায় মুনাফা অর্জনে লোকসানের ঝুঁকি আছে। ব্যবসায় বা কেনাবেচার ক্ষেত্রে মূলধনদাতাকে ঝুঁকি বহন কতে হয়। মুনাফায় লোকসানের হুমকি রয়েছে। এটাই হচ্ছে ব্যবসার প্রকৃতি, স্বভাবধর্ম ও বৈশিষ্ট্য যে কখনও কখনও এতে লোকসানও হতে পারে।

(খ) লাভ-লোকসানে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে যে কোন পরিমাণ বিনিয়োগ ফার্মের আর্থিক ঝুঁকি বৃদ্ধি করে না। ঋণমুক্ত ফার্মে অর্থ বিনিয়োগে নতুন বিনিয়োগকারীগণ উৎসাহবোধ করে।

১৫। ফলাফলের গণনা ধারা

একই মূলধনের উপর সুদ বারবার নির্ধারণ ও আদায় করা যায়। অন্যকথায় কোন ঋণের উপর সুদ বারবার ধার্য করা যায়। একটামাত্র চুক্তিপত্রের অধীনে ঋণদাতা দীর্ঘকালব্যাপী একই পরিমাণ সুদ বারবার পেতে থাকে। সময় বাড়িয়ে দিয়ে ঋণের উপর একাধিকবার সুদ নেয়া যায়।

কেনাবেচায় পণ্যের উপর একবারই মুনাফা আরোপ করা যায়। লাভ একবারই অর্থাৎ ব্যবসায় কোন পণ্যের উপর লাভএকবারই করা যায়। কেননা ব্যবসায় বিক্রেতা ব্যবসায় পণ্য একবারই বিক্রি করতে পারে। বিক্রয় চুক্তির অধীনে মুনাফা অর্জন সাপেক্ষে পাওয়া যায় বিধায় একই ফল বারবার পাওয়ার প্রশ্ন আসে না।

১৬। মূলধন বেড়ে যাওয়া- কমে যাওয়া

সুদী ব্যবসায় মূলধন সর্বাবস্থায় সুরক্ষিত থাকে। অন্যকথায় ঋণ গ্রহীতার ব্যবসায় উদ্যোগ ব্যর্থ হলেও ঋণদাতার মূলধনের উপর তার বিন্দুমাত্র আঁচড় লাগে না।

ব্যবসায়-বাণিজ্যে কিংবা লাভ-লোকসানে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগের বেলায় লোকসান হলে বিনিয়োজিত মূলধন আনুপাতিক হারে হ্রাস পায়। লোকসান হলে মূলধন কমে যায়।

১৭। ইসলামী দৃষ্টিকোণ/বৈধতা

ইসলামী শরী’আহ্ দৃষ্টিকোণ থেকে সর্ব প্রকারের সুদ অবৈধ বা হারাম (Haram) ইসলামে সুদ নিষিদ্ধ। সুদ বিনিময় না দিয়ে নেওয়া হয় এজন্য সুদ হারাম।

ইসলামী শারী’আহ্ দৃষ্টিকোণ থেকে মুনাফা বৈধ বা হালাল (Halal)। মুনাফা ইসলামে অনুমোদিত। মুনাফার বিনিময় আছে এজন্য মুনাফা হালাল।

১৮। দাম স্তরের উপর প্রভাব

সুদ একটি স্থির ব্যয় হিসেবে বিবেচিত হয় বলে অনিবার্যভাবে দাম স্তরের বৃদ্ধি ঘটায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে মূল্যস্ফীতির প্রসার ঘটায়।

মুনাফা ব্যয় হিসাবে বিবেচিত হয় না বলে অনিবার্যভাবে দামের বৃদ্ধি ঘটায় না, ফলে মূল্যস্ফীতির প্রসারে সরাসরি কোন প্রভাব রাখে না।

১৯। মূলধন সংরক্ষন

সুদ ভিত্তিক ব্যবস্থায় মূলধন সর্বদা সুরক্ষিত। অন্যকথায় ঋণগ্রহীতার ব্যবসায় উদ্যোগ ব্যর্থ হলেও ঋণদাতার মূলধনের উপর তার বিন্দুমাত্র আঁচড় লাগে না।
ব্যবসায় কিংবা লাভ-লোকসানে অংশীদারিত্বের বিনিয়োগের বেলায় লোকসান হলে বিনিয়োগকৃত মূলধন আনুপাতিক হারে হ্রাস পায়।

২০। স্থবিরতা ও প্রগতি

সুদ হচ্ছে স্থবিরতার বাহন। উদ্যোগের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিই হচ্ছে মুনাফা ও সুদের মধ্যে পার্থক্যের মূল কারণ।

মুনাফা হচ্ছে প্রগতির পুরস্কার [ ড.এম.এ. মান্নান, ইসলামী অর্থনীতি: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০৮ ] ।

২১। বারাকা

আল্লাহ সুদখোরকে এবং সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন।

আল্লাহ মুনাফায় বরকত দেন।

উদ্যোগের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিই মুনাফা ও সুদের মধ্যে পার্থক্যের মূল কারণ।

সুদ ও মুনাফার মধ্যে পার্থক্যটুকু খুবই সুক্ষ্ম এবং এই পার্থক্য শুধু ফলশ্রুতির (impact) নয় বরং তা মূলনীতির (Principle) পার্থক্যও বটে।

বর্তমান সুদভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থা আল-কোরআন ও আস সুন্নাহয় বিঘোষিত ইসলামী নীতিমালা ও বিধিবিধানের পরিপন্থী। সুদ ঈমানদারদের পরিহার করতেই হবে। রিবার পরিবর্তে ব্যবহৃত বিকল্পের নির্দেশনাও
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন। দেশে দেশে ইসলামী ব্যাংকগুলো এ বিকল্পসমূহ অনুসরণ করছে। মানবতার অর্থনৈতিক মুক্তি ও কল্যাণ সাধনে পুঁজিবাদী সুদি ব্যাংকের ব্যর্থতা এবং ইসলামী ব্যাংকের শ্রেষ্ঠত্বই সুদ পরিহার করে ইসলামী বিকল্পসমূহ অনুসরণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ড. আনাস যারকাকে উদ্ধৃত করে শেষ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, সুদ বিলোপ করে লাভ-লোকসান অংশীদারিভিত্তিক ব্যবসায়-বাণিজ্য চালু করা হলে কারবারে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের মধ্যে ঝুঁকি বষ্টিত হবে এবং কারবারের আগ্রহ-উদ্যম বহাল থাকবে ও বৃদ্ধি পাবে [ ড. আনাস যারকা, Stability in an Interest Free Islamic Economy, Pakistan Journal of Applied Economics, winter 1983, Р.8.] ।

তাছাড়া মুনাফার হার সুদের হারের ন্যায় নিত্যদিন উঠানামা করবে না। ফলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য মূলধন পাওয়া সহজ হবে এবং বিনিয়োগ ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে শৃংখলা ফিরে আসবে। অভ্যন্তরীণ মুদ্রামান ও বিনিময় হারে অস্থিরতা হ্রাস পাবে। অর্থনীতি উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। সুদ পরিহার করার মাধ্যমেই তা সম্ভব হবে।

১৫. ব্যবসা ( بیع ) ও সুদ ( ربوا ) (Business & Interest/Riba)

মক্কায় মহানাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইসলাম প্রচারের সময়ে কাফির ও মুশরিকরা বলত ব্যবসাতো সুদের মত। তারা এরকম বক্তব্য উদ্ধৃত করে প্রমাণ করার অপচেষ্টা করতো যে, যেহেতু ব্যবসা অনুমোদিত এবং মূলধনের কারবারও এক ধরনের ব্যবসা, কাজেই সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার কোন কারণ নেই। বর্তমানেও অনেক জাহিল ও সুদখোর একই বক্তব্য আউড়িয়ে থাকে। অথচ ব্যবসা ও সুদ এক জিনিস নয়। আল-কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন-وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا – “আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল সুদকে করেছেন হারাম [ আল কোরআন, ২ সূরা আল বাকারা, আয়াত-২৭৫ ] ।

এই আয়াতে আল্লাহ সুস্পষ্টভাষায় সর্বকালের জন্য, সকল বনি আদমের জন্য একদিকে যেমন ব্যবসাকে বৈধ ঘোষণা করেছেন অন্যদিকে সুদ ও সুদভিত্তিক সকল কার্যক্রমকে চিরতরে নিষিদ্ধ করেছেন। মহান আল্লাহর হালাল ঘোষিত উপার্জন পন্থাসমূহের শীর্ষস্থানে রয়েছে- ‘বায়’ ( بیع ) বা ক্রয়-বিক্রয়, বেচা কেনা। আর হারাম ঘোষিত উপায়, পন্থাসমূহের প্রধান হচ্ছে- ‘রিবা’ ( رب ) বা সুদ। অর্থাৎ সুদ সম্বলিত ক্রয়-বিক্রয় হারাম এবং সুদমুক্ত ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণ হালাল। ইসলামে সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে আর ব্যবসাকে হালাল ঘোষণা করা হয়েছে।

১৫.১ ব্যবসা ও সুদের মধ্যে পার্থক্য (Difference between Business & Interest)

ইসলাম এমন কোন আর্থিক কর্মকাণ্ড অনুমোদন করে না যেখানে উপকারভোগী সম্ভাব্য ক্ষতির ঝুঁকি বহনের অংশীদার হয় না।

নিম্নে ব্যবসা ও সুদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য চার্টে উপস্থাপন করা হলো-

ব্যবসা বা ক্রয় – বিক্রয়

১. ব্যবসা বৈধ বা হালাল। হাদীসের মতে সৎ ব্যবসায়ী জান্নাতবাসী হবে।
২. ব্যবসায় লাভের সাথে সাথে লোকসানও আছে। অন্যকথায় ব্যবসায়ী তার নিয়োজিত মূলধনের উপর লাভকরতে পারে কিংবা লোকসানও দিতে পারে।
৩. ব্যবসায়ের ক্রেতা ও বিক্রেতা দ্রব্য ও অর্থ বিনিময় করে মুনাফা মাত্র একবার পায়।
৪. ব্যবসায়ীর শ্রম, চিন্তা, উদ্যোগ, যোগ্যতা, দক্ষতা, নিষ্ঠা, বুদ্ধি ও সময় ইত্যাদির ব্যয় করতে হয়
৫. ব্যবসার সম্পর্ক পণ্যের সাথে।
৬. ব্যবসায় কোনো শোষণ থাকে না।
৭. ব্যবসার বুনিয়াদ হচ্ছে সহযোগি তামুলক।
৮. ব্যবসা থেকে মুনাফা শূন্য, ধণাত্মক ও ঋণাত্মক হয়।
৯. ব্যবসায় ঝুঁকি বিদ্যমান এবং এ জন্যে তা অনুমোদিত।
১০. ব্যবসায়ে মূলধন বিনিয়োগ করলে যে মুনাফা অর্জিত হয় তা উদ্যোগ, যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রতিফলন।
১১. ক্রয়-বিক্রয় মানব সমাজের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য।

রিবা বা সুদ

১. সুদ হারাম। সুদ যারা খায়, তাদের কঠোর শাস্তির বিধান কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে।
২. সুদের মধ্যে কোনো লোকসান নেই। সুদে অর্থ লগ্নি করলে তার অতিরিক্ত প্রাপ্য পূর্ব থেকেই নির্ধারিত থাকে এবং লোকসানের সম্ভাবনা আদৌ থাকে না।
৩. সুদের ক্ষেত্রে ঋণদাতা সুদ বারবার ও একাধিকবার পেতে পারে।
৪. সুদের ক্ষেত্রে কেবল সময় অতিক্রান্ত হয়। অন্য কোনো পরিশ্রম নেই।
৫. সুদের সম্পর্ক, ঋণ ও সময়ের সাথে।
৬. সুদের মধ্যে শোষণ অনিবার্য। সুদ একটা মারাত্মক শোষণমূলক নীতি।
৭. সুদের বুনিয়াদ হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করণ মাত্র।
৮. সুদ সর্বদাই ধণাত্মক হয়।
৯. সুদে কোন ঝুঁকি নেই এবং তা মুনাফার মত পরিবর্তনশীল নয়।
১০. সুদের ক্ষেত্রে তা হয় না; কারণ ঋণদাতা কোন উদ্যোগ ও যোগ্যতা ছাড়াই নির্দিষ্ট হারে সুদ আদায় করে।
১১. সুদ মানব সমাজের জন্য অকল্যাণ ও ধ্বংসের বাহন। সুদের ভয়াবহতা অত্যন্ত বেশি।

১৬. সুদ ও ভাড়া (Riba and Rent)

ভাড়াকে আরবিতে বলা হয়েছে ‘আজর'( اجر অলৎ) যার অর্থ হচ্ছে বিনিময় বা consideration. এটি আসলে সেবা বা service- এর দাম। মানুষ তার শ্রম বিক্রি করে যে বেতন বা পারিশ্রমিক পায় তাকে বলা হয় মজুরী বা উজরাহ যা আসলে ‘আজর’ (রা) থেকে উদ্ভূত। ব্যবহারের মূল্য নিয়ে অন্যকে কোন মালে গায়রে ফানি বা Non-Fungible goods ব্যবহার করতে দিলে একে বলা হয় ‘মাজুর’ ( ماجور ) বস্তুর মালিককে বলা হয় ‘মুজির’ (مجر ) বা গ্রহীতা বা ব্যবহারকারীকে বলা হয় ‘মুনতাজির’ ( منتجر ) বা ষবংংবব।

উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ইজারা হচ্ছে ‘বাইয়ুন’ ( بیع ) বা ক্রয়-বিক্রয়ের একটি বিশেষ ধরন। ইজারায় পণ্য নয়, বরং Non Fungible পণ্যের সেবা বিক্রয় করা হয়। এখানে বিক্রীত সেবাটির Counter Value হচ্ছে জবহঃ।

ভাড়া বা Rent হচ্ছে Non-Fungible goods এর সেবার দাম। ভাড়ার ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতা বা ‘মুজির-মুনতাজির’ উভয়ের মধ্যে সমমূল্যের বিনিময় হয় এবং তাদের পরস্পর ক্ষতিপূরণ হয়, কারও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয় না।

অন্যকথায়, মালে গায়রে ফানি ঋণ দিলে, গ্রহীতা তা ব্যবহার করলে পণ্যটি বর্তমান থাকে এবং তা ফেরত দেওয়া যায় কিন্তু তা থেকে উপকার, service বা সেবা পাওয়া যায়। এই সেবার বিনিময়ে দাম নেওয়া হলে সেটা সুদ নয়। বরং ক্রয়-বিক্রয়; সেবা নেয়া হয়, দাম দেওয়া হয়। এখানে সমমূল্যের দু’টি পণ্য অর্থাৎ সেবা ও তার মূল্য বিনিময় হয়। এতে কোন পক্ষের ঠকা- জেতা নেই, এটা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই হালাল।

মোট কথা ভাড়া হচ্ছে মালে গায়রে ফানি বা Non-Fungible goods এর ব্যবহার বা সেবার দাম। এখানেও ক্রয়-বিক্রয় আছে। প্রাপ্ত সেবার মূল্য হচ্ছে প্রদত্ত ভাড়া। ভাড়ার বিনিময় হচ্ছে সমমূল্যের সেবা বা সেবার বিনিময় হচ্ছে সমমূল্যের ভাড়া।

১৬.১ সুদ ও ভাড়ার পার্থক্য (Difference between Riba & Rent)

রিবা বা সুদ ও ভাড়ার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। অর্থনীতিতে সুদ ও ভাড়া এ দু’টো প্রত্যয়েরই মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সুদ ও ভাড়ার পার্থক্য সংক্ষেপে নিম্নরূপ:

সুদ ও ভাড়ার পার্থক্য (Distinction between Riba and জবহঃ)

রিবা ( ربو ) / সুদ

১। রিবা বা সুদ এর শাব্দিক অর্থ বা আভিধানিক অর্থ আধিক্য, বৃদ্ধি, বিকাশ, অতিরিক্ত সংযোজন, সম্প্রসারণ, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি।
২। সংজ্ঞা অনুসারে রিবা হলো ঋণের শর্ত অনুযায়ী ঋণগ্রহীতা কর্তৃক ঋণদাতাকে মূলধনের সাথে বাড়তি অর্থ। প্রদেয়
৩। সুদের উৎস অবৈধ চুক্তি।
৪। একজাতীয় ফানজিবল পণ্যের লেন-দেনে সুদ হয়।
৫। সুদ ফানজিবল পণ্যের দাম- ঋণের সাথে সম্পৃক্ত- ঋণের বর্ধিত অংশ।
৬। সুদ ঋণের উপর আরোপিত।
৭। সুদের বিনিময় দেওয়া হয় না।
৮। সুদে ঋণগ্রহীতা বেশি মূল্য দেয়।
৯। ঋণদাতা আসল রূপান্তরের ঝুঁকি নেয় না।
১০। সুদ নির্ধারিত অনির্ধারিত দুই-ই হতে পারে।
১১। ইসলামী শারী’আহর দৃষ্টিকোণ থেকে সুদ হারাম। সুদ অকাট্যভাবে হারাম।

ভাড়া – ( اجر )

১। আরবী আজর (রা) এর বাংলা ভাড়া। এর আভিধানিক অর্থ সেবার দাম, সেবার মূল্য। সকল নন ফানজিবল পণ্য, মানুষ ও পশুর সেব্য।
২। সংজ্ঞা অনুসারে ভাড়া হচ্ছে মালে গায়রে ফানির (Non-Fungible goods) সেবার দাম।
৩। ভাড়ার উৎস বৈধ চুক্তি।
৪। দুই প্রকার পণ্যের বিনিময়ে ভাড়া হয়।
৫। ভাড়া বিনিয়োগ, উৎপাদন ও বিক্রয়ের ফল।
৬। ভাড়া পণ্যের দাম নয়, পণ্যের সেবার দাম।
৭। ভাড়ার বিনিময় হচ্ছে সমমূল্যের সেবা।
৮। উভয়ে সমান সমান মূল্য দেয় ও নেয়। এতে পূর্ণ ইনসাফ বহাল থাকে। ক্রেতা ও বিক্রেতার কেউ ঠকে না, কেউ জিতে না।
৯। পুঁজি রূপান্তর করেই ভাড়ার পণ্য হয়-রূপান্তরের ঝুঁকি আছে।
১০। ভাড়া নির্ধারিত হয়। কাউন্টার ভ্যালু নির্ধারিত হওয়া আবশ্যকীয়।
১১। ইসলামী শারী’আহর দৃষ্টিকোণ থেকে ভাড়া বৈধ বা হালাল।

১৭. সুদের অভিশাপ থেকে পরিত্রাণের উপায়: কতিপয় সুপারিশমালা

কুরআন মাজীদ সুদকে হারাম করেছে। ঈমানদারদের জন্য এই শরয়ী নির্দেশনাই যথেষ্ট। সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ মানুষের জ্ঞানে বুঝে আসুক বা না আসুক, সকল প্রকার সুদ হারাম। আল্লাহ প্রদত্ত এ বিধান মানতেই হবে এবং সকল প্রকার সুদের লেনদেন পরিহার করতে হবে। এটি ঈমানের দাবী। সুদের অভিশাপ অত্যন্ত ভয়াবহ। ইসলামে আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপর যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা নিশ্চিত করার ভালো উপায় হলো রিবা মুক্ত অর্থনীতি বিনির্মাণ। এক্ষেত্রে কিছু করণীয় নিম্নরূপ:

সামাজিক কর্মসূচীঃ

১। গণসচেতনতা সৃষ্টি: সমাজ হতে সুদ উচ্ছেদের জন্য গণসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই সুদ উচ্ছেদের লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে।

২। জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি: পরকালীন জীবনে জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগ্রত করা। অন্যান্য হারাম উপার্জনের পন্থার মত সুদও অবশ্যই বর্জন করতে হবে। সুদের ভিত্তিতে পরিচালিত সব কার্যক্রম হারাম এবং তার সহযোগিতা করাও হারাম। সুদ থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য ঈমানদারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

৩। পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ: ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়কে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য তালিকাভুক্ত করতে হবে।

৪। সামাজিক প্রতিরোধ সৃষ্টি: সুদের মত সমাজবিধ্বংসী অক্টোপাসের খপ্পর থেকে মুক্তি লাভের জন্য প্রয়োজন মজবুত সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এ লক্ষ্যে-

(ক) সুদখোরদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা যেতে পারে।
(খ) সুদখোরদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত না করা।
(গ) সুদখোরদের সামাজিকভাবে বয়কট করা।
(ঘ) অনাবশ্যক সামাজিক ব্যয় পরিহার।

অর্থনৈতিক কর্মসূচি:

১। শারী’আভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রসার।
২। ইসলামী ব্যাংকার ও গ্রাহকদের মধ্যে শরিয়াহ, ইসলামী অর্থনীতি, ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ে প্রকৃত জ্ঞান প্রসারের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩। ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শহর ও গ্রামবাসীর মধ্যে ইসলামী অর্থনীতির কল্যাণবার্তা পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
৪। মুদারাবা পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তোলা। সুদের কার্যকর বিকল্প হিসেবে ‘লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে’ কারবার পদ্ধতি, দক্ষতা নিষ্ঠা, দৃঢ়তা, এবং সর্বোপরি আন্তরিকতার সাথে চালু করতে হবে।
৫। করজে হাসানার ব্যাপক প্রচলন।
৬। মাইক্রো ফাইন্যান্সের ইসলামী কৌশল কার্যকরী করা।
৭। প্রচলিত অর্থায়ন ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে ইসলামী অর্থায়ন ব্যবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা গণমানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে।
৮। আর্থিক লেনদেনকে উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পর্কিত করতে হবে।
৯। সুদের কুফল থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করে প্রকৃত পণ্যভিত্তিক লেনদেন নিশ্চিত করে একটি স্বভাবসম্মত কল্যাণধর্মী অর্থব্যবস্থার ভিত্তি রচনা করতে হবে।
১০। সুদের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যে সকল লেনদেন সন্দেহজনক এবং যেগুলোতে সুদের অনুপ্রবেশ ঘটার সম্ভাবনা থাকবে সে সকল লেনদেন অবশ্যই পরিহার করতে হবে। মহানবী (সা) বহুসংখ্যক হাদীসে সুদের সন্দেহ হয় এমন সব লেনদেন ও বেচাকেনাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
১১। হালাল ব্যবসায়ে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
১২। গ্রামীণ দারিদ্র বিমোচনে ইসলামী অর্থনীতির সকল টুলস ব্যাবহার করতে হবে।
১৩।পরিবেশ বান্ধব বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
১৪। জনগণকে আস্থায় ও ভালোবাসায় নিয়ে আর্থিক সেবা দিয়ে সুদী কারবারের খপ্পর থেকে বের করতে হবে।
১৫। অন্তর্ভুক্তিমূলক ইসলামী অর্থনৈতিক এপ্রোচ এবং দীনী ও কল্যাণমূলক প্রণোদনা বাড়াতে হবে।

১৮. উপসংহার

সুদি অর্থায়নের ফলে একটি মেকি অর্থনীতি (false economy) জন্ম নেয় যা অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং ধারাবাহিক অবক্ষয় সৃষ্টি করে।

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যে আকারেই সুদ খাওয়া হোক সুদখোররা আল্লাহর অপছন্দের মধ্যে পড়বেই। দুনিয়ার সুদখোরীর ইতিহাস এ সাক্ষ্যই দিচ্ছে। সুদ উচ্ছেদে সচেষ্ট হওয়া নিঃসন্দেহে নেক কাজ। আল্লাহ ঘোষিত হারাম বর্জনের জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে। এ জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে ঈমানদারদের তৈরি থাকতে হবে। তবে সুদের ভয়াবহ জুলুম ও শোষণ থেকে মানবতা মুক্তি পাবে। সুদের মত একটি মারাত্মক অভিশাপ ও জঘন্য গুনাহ থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য অর্থনীতির সকল পর্যায় থেকে সুদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং যাকাত-ওশরসহ ইসলামের সকল সম্পদ হস্তান্তর ম্যাকানিজম, ট্রান্সফার ম্যাকানিজম চালু করতে হবে। সর্বোপরি জনপ্রিয় ও সকলের জন্য কল্যাণকর ইসলামী অর্থনীতি চালু করার জন্য সকল বিবেকবান নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। সুদের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেলে ইহজাগতিক কল্যাণের পাশাপাশি পারলৌকিক সাফল্যও নিশ্চিত হবে।

– সমাপ্ত –

© Bangladesh Jamaat-e-Islami

  • আমাদের সম্পর্কে
  • প্রাইভেসি পলিসি
  • যোগাযোগ
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • দাওয়াত ও তাবলিগ
    • ঈমান ও আক্বীদাহ
    • আমল-আখলাক ও মুয়ামালাত
    • ইসলাম ও ইবাদাত
    • পারিবারিক ও সামাজিক জীবন
    • ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • নারী
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • কর্মী সিলেবাস
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস

@BJI Dhaka City South