জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি

জামায়াতে ইসলামীর কার্যবিবরণী – ২য় খণ্ড

অন্তর্গতঃ uncategorized
Share on FacebookShare on Twitter

জামায়াতে ইসলামীর কার্যবিবরণী – ২য় খণ্ড


স্ক্যান কপি ডাউনলোড


(মূল কার্যবিবরণীর তৃতীয় খণ্ডের অনুবাদ)

অনুবাদ: আবদুল মান্নান তালিব

প্রকাশনা বিভাগ
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

প্রকাশকঃ
আবুতাহের মুহাম্মদ মাছুম
চেয়ারম্যান, প্রকাশনা বিভাগ
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

ভূমিকা

জামায়াতে ইসলামী আজ এক বিশ্বব্যাপি আন্দোলন। এক মযবুত সাংগঠনিক ভিত্তির উপর এ সংগঠন দাঁড়িয়ে আছে। এ সংগঠনের ইতিহাস আজও অম্লান, দিক দর্শনকারী ও প্রেরনাদায়ক। এ ইতিহাস লিখিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে রোয়েদাদে জামায়াতে ইসলামী নামে। ১ম ও ২য় খন্ড বাংলায় কার্যবিবরণী ১ম খন্ড ও ৩য় খন্ড বাংলায় কার্যবিবরণী ২য় খন্ড নামে প্রকাশিত হয়েছে।

২য় খন্ড প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। অনুবাদ করেন সুসাহিত্যিক জনাব আব্দুল মান্নান তালিব। সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন মরহুম জনাব আব্বাস আলী খান। বইটি জামায়াতের অগ্রসর কর্মী, রুকন ও দায়িত্বশীলদের জানার অনেক চাহিদা পূরণ করবে, তাদের জ্ঞান রাজ্যে সমৃদ্ধি আনবে এবং সাংগঠনিক মযবুতি অর্জন করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়তা দান করবে। এ সংস্করণটিও পাঠকবর্গের কাছে সমাদৃত হবে বলে আশা পোষণ করে তৃতীয় সংস্করণ বের করা হলো।
– প্রকাশক

জামায়াতে ইসলামীর প্রথম নিখিল ভারত সম্মেলনের কার্যবিবরণী

লাহোরের ‘কাওসার’ পত্রিকার মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় যে, দারুল ইসলাম পাঠানকোটে (পাঞ্জাব) ১৬, ১৭, ও ১৮ই জমাদিউল উলা মুতাবেক ১৯, ২০ ও ২১ শে এপ্রিল (১৯৪৯) রোজ বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিযার সমগ্র ভারতের জামায়াতে ইসলামীর রুভদদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এতে জামায়াতের সকল রুফনকে অংশ গ্রহণ করতে হবে। তবে কোন শরয়ী ওজর থাকলে ভিন্ন কথা। উপরক্ত আমারাকের গুতাকাংখীদের মধ্যে যদি কেউ আমাদের কাজ নিকট থেকে দেখতে চান, তাহলে তিনিও আসতে পারেন। ১৮ই এপ্রিল রাত পর্যন্ত অধিকাংশ আরকান ও শুভাকাংখী এসে পড়েন এবং অবপিষ্টয়া ১৯শে এপ্রিল রেলগাড়ী ও বাসে এসে পৌছেন।

সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা আটশ’য়ের অধিক ছিল। স্থানীয় মসজিদে, অফিসগৃহে অন্যান্য গৃহে এবং কতিপয় ক্যাম্পে ও শামিয়ানার নীচে তাঁদের খাতার ব্যবস্থা করা হয়। অংশগ্রহণকারীগণের সংখ্যাধিক্যের কারণে লাউড স্পীকার ও সাময়িকভাবে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা হয়।

সূচীপত্র

  1. প্রথম অধিবেশন
  2. দ্বিতীয় অধিবেশন
  3. তৃতীয় অধিবেশন
  4. চতুর্থ অধিবেশন
  5. পঞ্চম অধিবেশন
  6. ষষ্ঠ অধিবেশন
  7. সপ্তম অধিবেশন

প্রথম অধিবেশন

১৩১৪ হিজরীর ৬ই জমাদিউল আউয়াল (১৯৪৫ সালের ১৯শে এপ্রিল) বৃহস্পতিবার যোহরের নামাযের পর প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রাম অনুযায়ী আমীরে জামায়াতের পক্ষ থেকে জামায়াতের প্রধান সম্পাদক যথারীতি সভার কার্য শুরু করার উদ্দেশ্যে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের নিকট দারুল ইসলাম মসজিদে একত্র হবার জন্যে আবেদন জানান। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সবাই সভাস্থলে উপস্থিত হন এবং আমীরে জামায়াতের ভাষণ শুনবার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকেন। এক হাজার জনতার এই মহতী সম্মেলনে চতুর্দিকে প্রশান্ত নীরবতা বিরাজ করছিল।

অতঃপর আমীরে জামায়াত উঠে খুতবায়ে মাসনুনার পর তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতা শুরু করেন।

আমীরে জামায়াতের উদ্বোধনী বক্তৃতা

বন্ধুগণ! সম্ভবত আপনাদের স্মরণ থাকতে পারে, যে সম্মেলনে জামায়াতের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, সেখানে একথা ঘোষণা করা হয়েছিল যে, প্রতি বছর জামায়াতের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু যুদ্ধাবস্থার কারণে বিগত পৌনে চার বছরের মধ্যে আমরা কোনো সাধারণ সভার অনুষ্ঠান করতে পারিনি। অবশ্যি এই অন্তর্বর্তীকালে বিভিন্ন হালকা বা বিভাগ ভিত্তিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হ’তে থাকে এবং তার রিপোর্টও প্রকাশিত হ’তে থাকে। যার ফলে জামায়াত তার কর্ম চাঞ্চল্যের জন্যে এমন আলোক লাভ করতে থাকে যার জন্যে সাধারণ সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয়। এতদসত্ত্বেও সাধারণ সম্মেলন অনুষ্ঠান অপরিহার্য ছিল এবং বিভাগীয় সম্মেলন তার স্থলাভিষিক্ত হ’তে পারতো না। এ কারণে অবশেষে আমাকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলো যে, যুদ্ধের দরুণ যতই কঠিন সমস্যার সৃষ্টি হোক না কেন এবং দূর-দূরান্ত থেকে আসার ব্যাপারে যতই অসুবিধা ও কষ্টের সম্মুখীন হতে হোক না কেন এ সম্মেলনটি অবশ্যি অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত।

আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ যে, আমার একটি মাত্র ডাকে আপনারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা থেকে বর্তমান কালের বিপদসংকুল সফরের কষ্ট উপেক্ষা করে এখানে একত্র হয়েছেন। এভাবে আমার ডাকে সাড়া দিয়ে আপনারা আমার শক্তি বুদ্ধি করেছেন এবং সেই সঙ্গে আপনাদের নিজেদের শক্তিও বৃদ্ধি করেছেন। এমনটি না হলে আমি স্বস্থানে দুর্বল হয়ে যেতাম এবং আপনারাও দুর্বল হয়ে যেতেন। ফলে একটি বৃহত্তম সংকল্পের বহিঃপ্রকাশ আমাদের এ আন্দোলনটি মাঝপথেই নীরব হয়ে যেতো। আপনারা যখনই কোন ব্যক্তিকে কোনো বৃহত্তর উদ্দেশ্যে নিজেকে আমীর পদে অধিষ্ঠিত করেন, তখন তার আনুগত্য করে আপনারা আসলে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেন। আপনাদের মধ্যে যে পরিমাণ আমিত্ব ও আত্মপ্রিয়তা স্থান লাভকরবে এবং আপনাদের আনুগত্যের প্রকাশ যে হারে হ্রাসপ্রাপ্ত হবে, আপনাদের নির্বাচিত আমীর ঠিক সেই অনুপাতে দুর্বল হয়ে যাবে এবং ঠিক সেই অনুপাতেই তার দুর্বলতার কারণে আপনাদের দলীয় শক্তিও নিস্তেজ হয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে আপনাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্যপ্রীতি আপনাদের মন-মস্তিষ্ককে যে পরিমাণ আচ্ছন্ন করবে এবং এই প্রেমের সাগরে আপনারা নিজেদের আমিত্বকে যত অধিক বিলীন করতে সক্ষম হবেন এবং নিজেদের উদ্দেশ্যের খাতিরে আপনারা যে হারে আমীরের আনুগত্য করবেন ঠিক সেই অনুপাতেই আপনাদের কেন্দ্র শক্তিশালী হবে এবং আপনাদের দলীয় শক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে।

আমাদের এ জামায়াতে ব্যক্তিপূজা ও মানসিক দাসত্বের অবকাশ নেই, আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি তীক্ষ্ণ সমালোচনা শক্তির অধিকারী এবং আপনাদের এ সমালোচনা দৃষ্টি সবচাইতে বেশী আমার ওপর নিপতিত হয়, এ সত্য প্রত্যক্ষ করে আমি অনেক সময় আনন্দ অনুভব করি। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনারা আমার ওপর যেমন তীক্ষ্ণ সমালোচনা দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন- এটি অবশ্যি আপনাদের কর্তব্য-তেমনি আমিও তীক্ষ্ণ সমালোচকের দৃষ্টিতে আপনাদেরকে নিরীক্ষণ করি এবং এটি আমার কর্তব্য। আমীরের নির্দেশ ও নিয়ম-শৃঙ্খলার আনুগত্য এবং স্বেচ্ছাসেবা অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আপনারা যে পরিমাণ দূর্বলতা প্রকাশ করেন আমি নিজেকে ঠিক সেই পরিমাণ অসহায় মনে করি। তখন আমি অনুভব করতে থাকি, আমি এমন সব বন্দুক ব্যবহার করছি যেগুলির ঘোড়া টিপলেও ফায়ার হয় না। বলা বাহুল্য, এমন কোনো নাদান আছে কি যে এই ধরণের অস্ত্র নিয়ে কোন বিরাট অভিযান পরিচালনার সংকল্প করতে পারে? পক্ষান্তরে যখন আমি আপনাদের মধ্যে আনুগত্য, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার গুণাবলী প্রত্যক্ষ করি এবং দেখি যে, একটি মাত্র আওয়াজে আপনাদেরকে একত্রিত করা যেতে পারে, একটি মাত্র ইশারায় আপনারা আন্দোলিত হতে পারেন এবং আপনাদের ওপর যে কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় আপনারা আন্তরিকতা ও একাগ্রতার সাথে তা সম্পাদন করেন, তখন আমার মন শক্তিশালী ও আমার হিম্মত বুলন্দ হতে থাকে এবং আমি অনুভব করতে থাকি যে, এখন আমি এমন শক্তি অর্জন করছি যার সাহায্যে আমি এই মহান উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যে অধিক কাজ করতে পারবো।

এখন আমার এই উদ্বোধনী ভাষণের মাধ্যমে আপনাদেরকে কয়েকটি কথা সংক্ষেপে জানিয়ে দেবার প্রয়োজন বোধ করছি।

(১) আপনাদের সভা-সম্মেলনে যত বিপুল সংখ্যক জনতার সমাবেশ হোক না কেন, সেখানে কোনোক্রমেই ভীড়, শোরগোল ও হৈ-হাংগামা সৃষ্টি না হওয়া উচিত। যদিও এখনো আমি এমন কোনো ব্যাপার অনুভব করিনি তবুও এ দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। আমরা যে কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি অর্থাৎ নৈতিক বিধানের পরিপ্রেক্ষিতে দুনিয়ার সংশোধন ও পরিশুদ্ধি এবং দুনিয়ার পরিচালনা ব্যবস্থা সংস্কার সাধন, তার অনিবার্য তাকিদেই নৈতিক দিক দিয়ে আমাদেরকে দুনিয়ার সবচাইতে সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ দল হিসেবে নিজেদেরকে প্রমাণ করতে হবে। আমাদের যেমন দুনিয়ার বর্তমান বিকৃতির সমালোচনা করার অধিকার আছে, দুনিয়ারও তেমনি সমালোচনার নিরিখে আমাদের জীবনকে যাচাই করার অধিকার আছে। আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের স্বরূপ কি? আমরা কিভাবে মানুষের সাথে ব্যবহার করি? আমরা কিভাবে একত্রিত হই ও আমাদের সভা-সম্মেলনসমূহ পরিচালনা করি? এ সমস্ত বিষয় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার অধিকার দুনিয়ার আছে। যদি দুনিয়া প্রত্যক্ষ করে যে, আমাদের সভা-সম্মেলনসমূহে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, আমাদের বৈঠক ও মাহফিলসমূহে শোরগোল ও হৈ-হাংগামা হয়, আমাদের আবাস ও উঠাবসার স্থানসমূহ অসভ্যতা ও রুচি বিকৃতির দৃশ্য পেশ করে, যেখানে আমরা আহার করতে বসি তার চতুষ্পার্শ্বের স্থানসমূহ নোংরা ও আবর্জনাপূর্ণ হয়ে উঠে, যেখানে আমরা পরামর্শ করার জন্যে একত্রিত হই, সেখানে হাসি-তামাশা ও বিবাদ শুরু হয় এবং নীতি-নিয়ম বিরোধী কার্যাবলীর প্রদর্শনী হয়, তাহলে দুনিয়া আমাদের ও আমাদের দ্বারা অনুষ্ঠিতব্য সংস্কার থেকে খোদার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং অনুভব করবে যে, দুনিয়ার পরিচালনার দায়িত্ব যদি এই ধরণের লোকদের হাতে সোপর্দ করা হয়, তাহলে এরা সমগ্র দুনিয়াকেও নিজেদের পর্যায়ে নামিয়ে আনবে। তাই আমি চাই, আপনারা নিজেদের সভা সম্মেলনসমূহে শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, গাম্ভীর্য, পরিচ্ছন্নতা, সুরুচি ও উন্নত নৈতিক বৃত্তির এমন পরিপূর্ণ প্রদর্শনী পেশ করুন, যা দুনিয়ায় আদর্শস্থানীয় বিবেচিত হতে পারে। আপনাদের এখানে সহস্র ব্যক্তি একত্রিত হলেও যেন কোনো প্রকার শোরগোল না হয়, কোথাও নোংরা ও আবর্জনা ছড়িয়ে না থাকে, ঝগড়া-বিবাদ শুরু না হয়, ভীড় ও হৈ-হাংগামা সৃষ্টি না হয়। একটি সুসংগঠিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ দলের ন্যায় ওঠাবসা করুন, আহার-বিহার করুন, একত্রিত হোন ও আবার চারদিকে ছড়িয়ে পড় ন। যাঁরা হাদীস অধ্যয়ন করেছেন তাঁরা জানেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই ব্যাপারে তাঁর জামায়াতকে কত দায়িত্ববোধসম্পন্ন, মর্যাদাশালী, সুসভ্য ও সুশৃংখল করে গড়ে তুলেছিলেন। আরব দেশের ওপর ইসলামী জামায়াতের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে এ অবস্থাটির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সক্রিয় ও বিরাট। একদিকে আরবের মুশরিকদের অবস্থা ছিল এই যে তাদের একটি ক্ষুদ্র সেনাদলও কোনো এলাকা অতিক্রম করলে সেখানে ভীষণ হৈ-হাংগামা শুরু হয়ে যেতো, অন্যদিকে সাহাবাগণের অবস্থা এই ছিল যে, তাঁদের বিরাট সেনাদল শত শত মাইল পথ অতিক্রম করতো কিন্তু কোথাও সামান্যতম হৈ-হাংগামা হতো না। একবার এক জেহাদে পরিস্থিতি ও পরিবেশের প্রভাবে সাহাবাগণ জোরে আল্লাহু আকবর ধ্বনি উচ্চারণ করেন। এ শ্লোগান শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, তোমরা যাঁকে ডাকছ, তিনি শ্রবণশক্তিহীন নন। এহেন উন্নত শিক্ষা লাভের ফল এই হয় যে, মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দশ হাজার সেনাদল নিয়ে অগ্রসর হন কিন্তু মক্কাবাসীরা ততক্ষণ পর্যন্ত ঘুণাক্ষরেও এ সংবাদ পায়নি যতক্ষণ না তিনি উন্মুক্ত তরবারি হস্তে তাদের শিয়রে এসে দাঁড়ান এবং আগুন তৈরি করার নির্দেশ দেন। আমাদেরও এই পদ্ধতির অনুসরণ করতে হবে। আমাদের সভা-সম্মেলনেও এই ধারা ও অবস্থার সর্বাধিক প্রকাশ হওয়া উচিত।

(২) দ্বিতীয় যে বস্তুটি আমি আপনাদের সম্মেলনের বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখতে চাই তা হচ্ছে এই যে, যেখানে আপনারা একত্রিত হন, সেখানে সততা ও আমানতদারির মূর্তিমান চেহারা দৃষ্টিগোচর হওয়া উচিত। আমি চাই এখানে কোনো ব্যক্তির যেন তার জিনিসপত্র পাহারা দেবার প্রয়োজন না হয়। যার জিনিসপত্র যেখানে পড়ে আছে কোনো রক্ষক, পাহাহানার এবং তালা-চাবি ছাড়া তা যেন সেখানেই সুরক্ষিত থাকে। কারো কোনো বস্তু কোথাও পড়ে থাকলে তিনি যেন খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে তা কুড়িয়ে নেন। কোথাও কোনো দোকান বা স্টল থাকলে বিক্রেতা ছাড়াই যেন জিনিসপত্র সুষ্ঠুভাবে বিক্রয় হতে থাকে। কোনো ব্যক্তি সেখান থেকে কোনো বন্ধু ক্রয় করলে বিক্রেতা থাক বা না থাক যথাযথ হিসেব করে আর দাম যেন সেখানে রেখে দেন।

(৩) তৃতীয় বস্তুটি আপনাদের জামায়াতের আমীর পদের সাথে সম্পর্কিত। আপনাদের মনে আছে, যখন আমায়াত গঠিত হয়েছিল এবং আপনারা আমাকে আমীর নির্বাচিত করেছিলেন, তখন আপনাদের দাবী হাড়াই আমি নিজে ওয়াসা করেছিলাম যে, প্রত্যেক সাধারণ সভায় আমি ঘোষণা করতে থাকবো যে, যদি আপনারা এখন আমার চাইতে কোনো যোগ্যতর ব্যাক্তির সন্ধান পেয়ে থাকেন, তাহলে আমি তার জন্যে আসন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত, আপনারা তাকে আমীর নির্বাচিত করুন। যেহেতু তারপর থেকে আর কোনো সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়নি, তাই আমি নিজের এ ওয়াদাটি পূর্ণ করতে পারিনি। আজ এটি প্রথম সাধারণ সম্মেলন। তাই আমি নিজের ওয়ালা অনুযায়ী এ ঘোষণাও করে দিলাম। অন্য কোনো ব্যক্তি এ দায়িত্ব গ্রহণ করুন এটি অবশ্যি আমি চাই। তার আনুগত্য করে আমি দেখিয়ে দেবো যে, আমীরের আনুগত্য কিভাবে করা উচিত। কিন্তু আমার এ ঘোষণার এ ভুল অর্থ গ্রহণ করবেন না যে, আমি নিজে পশ্চাৎপদ হতে এবং এ দায়িত্বকে এড়িয়ে যেতে চাই। আমার এ কথা বলার উদ্দেশ্য কেবল এতটুকু যে, এ পদের প্রতি আমার কোন মোহ নেই, কোনো যোগ্যতর ব্যক্তির আগমনে বাধা সৃষ্টি করতেও আমি চাই না এবং এই আন্দোলনের উন্নতি ও এই সলের কল্যাণের পথে নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রতিবন্ধক রূপে সাঁড় করানোও আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি পূর্বেও বলেছিলাম এবং আজও বলছি যে, যদি আর কেউ এ কার্য সম্পাদনের জন্যে অগ্রসর না হয়, তাহলে আমি একাকী অগ্রসর হবো এবং নিজের অযোগ্যতা সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও আমি নিজে কাজ করবো না এবং অন্য কেউই করবে না, এ পরিস্থিতির জন্যে কখনো প্রস্তুত থাকবো না। কাজেই যতদিন পর্যন্ত আমি কোনো যোগ্যতর ব্যক্তি না পাই এবং বজমিন আপনারাও কোনো যোগাতের ব্যক্তি না পান, ততদিন পর্যন্ত আমি এ কাজটি করতে থাকবো। ততদিন আমাকে যত কিছু কষ্ট ও বিপদের সম্মুখীন হতে হোক না কেন, নিজের হাত থেকে এ পতাকা আমি কখনো দূরে নিক্ষেপ করবো না।

এই সঙ্গে আমি একথাও ঘোষণা করতে চাই যে, গত তিন বছরে যদি আমার বিরুদ্ধে কারুণ্য কোনো অভিযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে, ফারুর অধিকার আনার করায় বা কারুর সংগে ইনসাফ কথার ব্যাপারে যদি আমি কোনো প্রকার ত্রুটি করে থাকি অথবা আমার কাজের মধ্যে যদি আপনারা অন্য কোনো প্রকার ভুল-ত্রুটি দেখে থাকেন, আহলে নির্দ্বিধায় আ প্রকাশ করুন। তা আমার সমুখে পেশ কররেত পারেন বা সমগ্র জামায়াতের সম্মুখে, এতে কোনো আপত্তি নেই। কারুর অভিযোগ পেশ করতে আমি বাধা দেবো না, নিজের ভুল-ত্রুটি স্বীকার করতে কোনো প্রকার দ্বিধা করবো না এবং নিজের সংশোধন না কোনো বৈধ অভিযোগ দূর করার ব্যাপারে আমি বিন্দুমাত্রও ইতস্তত করবো না। তবে যদি ভুল বুঝাবুঝির দরুন কোনো অভিযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে আমি বিষয়টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করবো, যাতে কয়ে এ কাজে আমার ও জামায়াতী বন্ধুদের মধ্যে ফোনের মনোমালিন্যের অস্তিত্ব না থাকে।

এই উদ্বোধনী বক্তৃতার পর আমীরে জামায়াত জেনারেল সেক্রেটারীকে (মিয়া তোফায়েল মুহম্মদ) তাঁর রিপোর্ট পেশ করার নির্দেশ দেন। কাজেই তিনি আমায়াত পঠদের পর থেকে এই সম্মেলনের পূর্ব পর্যন্তকার জামায়াতের কার্যবিবরণী পেশ করেন।

জামায়াত গঠনের পর থেকে এপর্যন্তকার কার্যবিবরণী

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। ওয়াস্স্সালাতু ওয়াসসালামু আলা রাসূলিহিল কারীম।

আমীরে জামায়াত, সম্মানিত বন্ধুবর্ণ ও উপস্থিত অদ্র মহোদরগণ।
আপনারা জানেন, দুনিয়ায় ‘হকুমাতে ইলাহিয়া’ প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রচেষ্টা চালানো এবং আখেরাতে খোদায় সন্তুষ্টি হাসিল করাই হচ্ছে আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, মানুষ ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, তামাদ্দুনিক, অর্থনৈতিক যা অন্য কোনো দিক দিয়ে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারুয় খাদ্য হিসেবে অবস্থান করবে না, তার সমগ্র জীবনকে আল্লাহর নির্দেশের অনুগত করবে এবং এই সঙ্গে অন্যান্য লোকদেরকেও কার্যত এই পথ অবলম্বন করতে উদ্বুদ্ধ করবে। কেননা আসলে বন্দেগী এটিই দাবী করে এবং আখেরাতে সাফল্যের এই একটি মাত্র পথ নির্ধারিত। অন্য কথায় বলা যায়, আদম আলাইহিসসালাম থেকে নিয়ে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেকটি পয়গাম্বর যে নাওয়াত ও উদ্দেশ্য নিয়ে দুনিয়ায় আগমন করেছিলেন আমরা সেই দাওয়াত ও উদ্দেশ্যেয় পতাকাবাহী। প্রগতিবাদিতা বা নিছক কোন নতুন আন্দোলন পরিচালনার জন্যে আমরা এ পথ অবলম্বন করিনি। বরং আমাদের এ পথ অবলম্বন করার কারণ হচ্ছে এই যে, আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও মুহাম্মদকে (সাঃ) আল্লাহর রাসূল (মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ) হিসেবে স্বীকার করার অর্থই হচ্ছে কার্যতঃ এই পথ অবলম্বন করে অগ্রসর হওয়া। কালেমায়ে তাইয়্যেবার স্বীকারোক্তি এবং দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার পথ পরিহার করা সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী বিষয়। একমাত্র পয়গম্বরগণের পদ্ধতিই এই দাওয়াত নিয়ে কার্যতঃ অগ্রসর হবার, একে নিজের অন্যান্য ভাইদের নিকট পৌছাবার এবং এদ্বারা প্রভাবিত ব্যক্তিবর্গকে একত্রিত ও সংঘবদ্ধ করার নির্ভুল পদ্ধতিরূপে পরিগণিত হতে পারে। তারাই ছিলেন। এই দাওয়াতের আসল নিশান বরদার এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নেতৃত্বে তাঁরা এই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। কুরআন মজীদ আমাদেরকে জানিয়েছে যে, সে পদ্ধতি হচ্ছে মাত্র একটি এবং প্রতি যুগে এই একটি মাত্র পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে। কাজেই আমরাও এই কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছি এবং আমরা বিশ্বাস করি যে, এই একটি মাত্র দাওয়াত ও কর্মপদ্ধতি ছাড়া অন্যান্য যাবতীয় দাওয়াত ও কর্মপদ্ধতির ভিত্তি মূলত বাতিলের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কর্মের দিক দিয়ে আমরা অবশ্য কোনো উন্নত ও শ্রেষ্ঠ স্থান লাভের দাবী করি না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও এ সত্যটিকে অবশ্য মেনে নিতে হবে যে, আমরা আমাদের এ দাওয়াত, এর দাবী ও চাহিদাসমূহ এবং এর কর্মপদ্ধতির ক্ষেত্রে নবীগণের অনুসরণ ও স্থলাভিষিক্তির দাবী করি। ঐ সকল ব্যাপার নিজেদের বুদ্ধি-বিবেক অনুযায়ী প্রতিটি প্রশ্নে ও প্রতি পর্যায়ে আমরা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে পথ নির্দেশ লাভ করি। কোনো পর্যায়ে ঐ বস্তুগুলির মধ্যে কোনটির পূর্ণ আনুগত্য যদি আমাদের দ্বারা সম্ভব না হয়ে থাকে, তাহলে তা আমাদের মানবিক দুর্বলতা, স্বল্প ইসলামী জ্ঞান ও অপরিপক্ক বুদ্ধিবৃত্তির ফল হতে পারে কিন্তু আমাদের দুঃসাহসিকতা, বিদ্বেষ, হঠধর্মীতা এবং খোদা ও রাসূল ছাড়া অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের ফল হতে পারে না। তাই জামায়াতের ভিতরের ও বাইরের প্রত্যেকটি মানুষের ওপর আমরা নিজেদের এ অধিকার মনে করি যে, যদি তারা আমাদের মধ্যে বা আমাদের কারুর মধ্যে কোনো বিকৃতি বা আপত্তিকর বস্তু দেখে বা অনুভব করে, তাহলে তাকে ফিতনা সৃষ্টির মাধ্যম রূপে ব্যবহার করার পরিবর্তে নীরবে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি ও বিদ্রূপবাণ নিক্ষেপ না করে তাঁর দুর্বল ভাই বা ভাইদের নিকট পেশ করবেন এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহানুভূতি ও কোমলতার সাথে তা দূর করার চেষ্টা করবেন। المسلم مرأة المسلم (মুসলমান তার মুসলমান ভাইয়ের জন্যে আয়না স্বরূপ হাদীসটি একথাই ব্যক্ত করে।

প্রকৃতিগতভাবে আমাদের এ দাওয়াত ও কর্মপদ্ধতি প্রদর্শনস্পৃহা ও অতিরঞ্জনের আবিলতা মুক্ত। কেননা, টক যেমন দুধকে নষ্ট করে দেয়, অনুরূপভাবে এ বস্তুগুলিও সৎকর্মকে নষ্ট করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে যেন প্রদর্শনেচ্ছা থেকে মুক্ত রাখেন এটিই তাঁর নিকট আমাদের দোয়া। উপরন্তু বর্তমানকালে অভিরঞ্জন ও প্রদর্শনী প্রায় প্রত্যেক আন্দোলনের সৃষ্টি ও পরিচালনার অপরিহার্য মাধ্যমে পরিণত হয়েছে এবং পরিবেশের এই সর্বব্যাপী প্রভাবে আমাদের সহযোগীদের প্রশ্নবিত হওয়াও মোটেই আশ্চর্যের বিষয় নয়। তাই আমরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক থাকি এবং নিজেদের সভা-সমিতির কার্যাবলী পর্যন্ত অত্যধিক প্রয়োজন দেখা না দিলে প্রকাশ করি না। এবং ভাও মাত্র নিজেদের আরকান ও সমর্থকবৃন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি।

কিন্তু একথাও সত্য যে, জামায়াতের সদস্য ও সমর্থকবৃন্দ বদি মাঝে মাঝে আখোলদের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত না হতে থাকে, তাহলে একটি ব্যাপক নিষ্ক্রিয়তা জড়তা, হতাশা ও নৈরাশ্য সৃষ্টির পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান পর্যায়ে জামায়াত ও আমাত্তাকের সদস্যবৃন্দ মান প্রারম্ভক অবস্থায় বিয়াজিত, বাতিল জীবন ব্যবস্থা পূর্ণ শক্তি ও প্রতিপত্তি সহকায়ে সমগ্র পৃথিবীতে আধিপত্যশালী এবং
বর্তমান বিশ্বব্যাপী সর্বগ্রাসী অন্ধকারের মধ্যে আলেম সমাজের যে ক্ষুদ্রতর ও পতখা বিচ্ছিন্ন দলটির মধ্যম পথাবলম্বী উন্নত ও সত্যের সাক্ষ্যদানকারীর দায়িত্ব সম্পাদন করার প্রয়োজন ছিল, তারা সত্যের দাওয়াতে অংশ গ্রহণ করার পরিবর্তে ফাসেক ও দুশ্চরিত্র ব্যক্তিদের নেতৃত্বে নিজেদের ধন, প্রাণ, মন-মস্তিষ্কের সমুদয় শক্তি নই করছেন বরং সাধারণ মুসলমানদের গোমরাহী, জাদেকী ও নৈতিকতাবিরোধী কার্যকলাপের বোঝা নিজেদের শিরে স্থাপন করছেন। কাজেই এ পর্যায়ে জামায়াতের সমস্য ও সমর্থকবৃন্দকে যদি মাঝে মাঝে আন্দোলনের তৎপরতা ও অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত না করা হয়, তাহলে তারা অনুভব করতে থাকবেন যে, সম্ভবত জামায়াতের মধ্যে কোনের কাজ হচ্ছে না। এর ফলে ব্যাপক নিষ্ক্রিয়তা ও জরাগ্রস্ততা সৃষ্টি হবে। তাই সভা-সম্মেলনের সময় জামায়াতের আরকান ও সমর্থকবৃন্দকে আমায়াতের কার্যাবলী সম্পর্কে অবহিত করা প্রয়োজন। এর ফলে কেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থানকারী জামায়াত কর্মীগণ যেমন জামায়াতের কার্যাবলী অবগত হতে পারেন, তেমনি আমাদের কর্মী ও সমর্থকগণ আমাদের কাদের সমালোচনা করার সুযোগ লাভ করে থাকেন এবং তাদের উত্তম ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ যারা আমরা লাভবান হবার সুযোগ পাই। কাজেই এই উদ্দেশ্যকে সম্মুখে রেখেই এখন আমি জামায়াত গঠন থেকে নিয়ে জামায়াতের এ পর্যন্তকার কাজের সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট পেশ করছি। কারণ জামায়াত পঠনের পর এটি আমাদের প্রথম সম্মেলন।

জামায়াত গঠন

১৩৬০ হিজরীর ওরা শাবান তারিখে (১৯৪১ ইংরেজী সালের ২৬শে আগস্ট) ‘আমায়াতে ইসলামী’র ভিত্তি স্থাপিত হয়। ‘জামায়াতে ইসলামী’র কার্যবিবরণী প্রথম খন্ডে এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। আমায়াত গঠনের সময় এর সমস্য সংখ্যা ছিল মাত্র পচাত্তর। দু’তিন বছরের মধ্যে এ সংখ্যা সাড়ে সাতশো পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কিন্তু নিয়মিত সংগঠন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত না হবার কারণে জামায়াতের সদস্যবৃন্দ ও কেন্দ্রের মধ্যে যথারীতি যোগাযোগের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি এবং আমীরে জামায়াত ও অন্যানা দায়িত্বশীল কর্মীগণ জামায়াত সদস্যদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করার তেমন কোনো সন্তোষজনক উপায়ও অবলম্বন করতে সক্ষম হননি। ফলে এমন বহু লোক জামায়াতে প্রবেশ করেছেন, যাদেরকে আমরা সম্ভবত এখন আমাদের নিবটবর্তী সমর্থকবৃন্দের মধ্যেও শামিল করতে পারবো না।

সংগঠন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত না হযায় একটি কারণ হচ্ছে কর্মীর অভাব এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে জামায়াতের আর্থিক অনন্তীন। এই দুই কারণে প্রায় পৌনে তিন বছর পর্যন্ত এয়াবেই চলতে থাকে। অবশেষে গত বছর যখন দারুল ইসলামে (১৯৪৪ সাল) ২৬ ও ২৭ শে মার্চ পাঞ্জাব, নিন্ধু, নীমান্ত প্রদেশ, কাশ্মীর ও বেলুচিস্তানের জামায়াত সদস্যগণের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তখন বিভিন্ন জামায়াত ও রুকনদের পক্ষ থেকে নিয়মিত সংগঠন বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্যে জোর দাবী উত্থাপন করা হয়। আমীরে জামায়াতও বলেন যে, তিনি প্রথম থেকেই এ প্রয়োজনটি অনুভব করছেন। এ প্রস্তাব গৃহীত হবার পর নিয়মিত সংগঠন বিভাগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত করা হয় এবং ১৯৪৪ সালের ১৭ই এপ্রিল এ বিভাগটি কার্যতঃ প্রতিষ্ঠিত হয়।

স্থানীয় জামায়াত ও সদস্যগণের সংখ্যা

সংগঠন বিভাগ প্রতিষ্ঠার সময় সমগ্র দেশে এ৭টি স্থানীয় জামায়াত ছিল। তন্মধ্যে জামায়াতী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ৬টি জাযায়াতের কাজ শূন্যের ফোঠায় পৌঁছে গিয়েছিল এবং পরে সেগুলিকে বাতিল করে দিতে হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় সদস্যবৃন্দের সংখ্যা ছিল আনুমানিক সাতশো পঞ্চাশ। কিন্তু তাদের যথারীতি তালিকা প্রণয়নের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। উপরন্তু ঐ সকল স্থানীয় জামায়াত ও একক রুকনদের বিরাট অংশ নিছক আমায়াতের বইপত্রগুলি পছন্দ করা অথবা নিছক জামায়াতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে আবর্গিক ঐক্য থাকাকে আমায়াতের রুকন যথায় জন্যে যথেষ্ট মনে করেছিলেন। অথবা যারা এর চাইতেও অতিরিক্ত কিছু মনে করেছিলেন তারা কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ রাখার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা না থাকার কারণে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে যান এবং সম্পূর্ণ প্রাথমিক পর্যায়ে নেমে আসেন। সংগঠন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হবার পর স্থানীয় জামায়াত ও রুকনগণকে যাচাই করার কাজ শুরু হয়ে যায়। এক বছরের অনবরত যাচাই-পরখের পর বর্তমানে রুকনদের মোট সংখ্যা সাড়ে চারশোর চাইতেও কম হয়ে গেছে। এ যাচাই-পরখের কাজ এখনো জারী আছে। কতিপয় জামায়াতকে তাদের নীরবতা এবং সর্বনিম্ন জামায়াতী গুণাবলী ও কর্মের তুলনায় নিম্নমানের অধিকারী হবার কারণে ভেঙ্গে দিতে হয়েছে। আলহামদুল্লিাহ! এতদসত্ত্বেও স্থানীয় জামায়াত সমূহের সংখ্যা ৩৭ থেকে বৃদ্ধি হয়ে বর্তমানে ৫৩তে পৌঁছে গেছে।

আমাদের এ সমস্ত করার উদ্দেশ্য কি? একটা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বিরাট জনতাকে একত্রিত করে অন্যকে প্রভাবিত করা অথবা পার্লামেন্ট বা কর্পোরেশনে নিজেদের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বরং আমরা এমন কিছু সংখ্যক কর্মী তৈরী করতে চাই; যারা বিশ্ববাসীকে মুসলমানের ন্যায় জীবন ধারণ করার ও মুসলমানের ন্যায় মৃত্যুবরণ করার শিক্ষা দেবে। যেসব লোক ও মনীষীবৃন্দ বলে থাকেন, এ যুগে ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে কার্যকরী করা সম্ভব নয়, আমাদের কর্মীরা তাদেরকে দেখিয়ে দেবে যে, ইসলামী জীবন ব্যবস্থা সর্বকালের ন্যায় বর্তমানেও কার্যকরী হতে পারে, তবে এজন্যে একমাত্র ঈমান ও দৃঢ় সংকল্পের প্রয়োজন।

বিশ্বাস করুন, আমরা যে ধরনের কর্মী তৈরী করতে চাই এবং এ উদ্দেশ্যে তাদের যে ধরনের ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন, সে জন্যে এ সংখ্যাও অনেক বেশী। তবে এই সাড়ে চারশো আরকানের সাথে যথাযথ যোগাযোগ ও নিকটতম সম্পর্ক স্থাপন করার জন্যে আমাদের বর্তমান উপায়-উপকরণ ও স্টাফ যথেষ্ট নয়। আমাদের একজন সামান্য কর্মী থেকে নিয়ে আমীরে জামায়াত পর্যন্ত একই রঙে রঞ্জিত ও একই উন্মাদনায় পরিপূর্ণ কর্মী প্রয়োজন। তাই আমাদের অত্যন্ত সতর্কতার সাথে রুকনদেরকে গ্রহণ করতে ও জামায়াতে স্থান দিতে হবে।

অবশ্যি যারা একবার আমাদের সাথে সম্পর্কিত হয়ে যান, তাদেরকে আমরা চূড়ান্ত সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের সঙ্গে জড়িত রাখতে চাই এবং তাদের দুর্বলতা ও ত্রুটিসমূহকেও যথাসম্ভব বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে দূর করার চেষ্টা করি। কিন্তু যখন আমরা জানতে পারি যে, আর সংশোধনের কোনো আশা নেই অথবা জামায়াতের সদস্য পদের সর্বনিম্ন মান থেকেও তারা নীচে নেমে গেছেন, তখন আমরা নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেহের কোনো অঙ্গ পচে গেলে যেমন প্রত্যেক বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি অন্যান্য অংগসমূহকে পচন থেকে বাঁচাবার জন্যে তাকে কেটে ফেলতে সম্মত হন, তেমনি কষ্ট ও আক্ষেপ সহকারে তাদেরকে জামায়াত থেকে পৃথক করতে বাধ্য হই। এ অবস্থায়ও আমাদের নীতি হচ্ছে এই যে, এ ধরনের ব্যক্তিবর্গকে স্বেচ্ছায় পৃথক হয়ে যাবার পরামর্শ দেই। এ পর্যন্ত যারা জামায়াত থেকে পৃথক হয়ে গেছেন, তাদের প্রায় সবাই এ পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। এ কারণেই তাদের মধ্যে কদাচিৎ কেউ থাকবেন যিনি নিজের ত্রুটি ও দুর্বলতা অনুভব করেন না এবং রুকনদের দায়িত্ব থেকে পৃথক হবার পরও বর্তমানে আমাদের সমর্থক শ্রেণীভূক্ত হননি।

স্থানীয় জামায়াতসমূহ ও সদস্যবর্গের অবস্থা

ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে যে, রুকনগণের বর্তমান সংখ্যা হচ্ছে সোয়া চারশো থেকে সাড়ে চারশোর মধ্যে এবং জামায়াতসমূহের মোট সংখ্যা হচ্ছে তিপ্পান্ন। তন্মধ্যে অর্ধেকেরও বেশী রুকন ও জামায়াত বলিষ্ঠ সত্তার অধিকারী। কোন না কোন পর্যায়ে তারা নিজেদের পায়ের উপর দাঁড়াতে পারে এবং মাসের পর মাস তাদের বাঁধন ঢিলে করে দিলেও তারা দায়িত্ব সহকারে কাজ করে যেতে থাকবে। কিন্তু তবুও আমাদের প্রত্যাশিত মানের বহু নিম্নে তাদের অবস্থান এবং তাদের কোনো একটি বা একজনও পাওয়ার হাউস তো দূরের কথা একটি সাবস্টেশনেরও কাজ করতে পারবে বলে আমরা মনে করি না। প্রত্যেকটি রুকন ও জামায়াতকে আত্মনির্ভর হয়ে কাজ করার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

জামায়াতে প্রবেশের মানদন্ড ও পদ্ধতি

যে সব লোক বস্তুগত বা পার্থিব শক্তি-প্রতিপত্তির কারণে নয় বরং দ্বীনী ও নৈতিক দৃষ্টিতে যথার্থই আমাদের সমাজের মাখন (Cream of Society) রূপে পরিগণিত হতে পারে আন্দোলনের এ পর্যায়ে আমরা তাদেরকেই অধিক সংখ্যায় নিজেদের রুকন ও সমর্থকবৃন্দের শ্রেণীভুক্ত করতে চাই। বর্তমানে আমরা বিশেষ করে এমন সব লোকের সন্ধানে আছি, যারা হযরত খাদীজাতুল কুবরা ও হযরত সিদ্দীকে আকবরের ন্যায় হকের দাওয়াত শুনার পর পূর্ণাংগরূপে তার মধ্যে শামিল হয়ে যাবেন। অর্থাৎ এ পর্যন্ত আমরা এহেন ব্যক্তিদের সন্ধানে ছিলাম।

তাই বর্তমানে কোন ব্যক্তিকে জামায়াতে শামিল করার পূর্বে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ সম্পর্কে সন্তোষজনক জবাব লাভ করার চেষ্টা করা হয়:

১. তিনি আমাদের দাওয়াত ও কর্মপদ্ধতিকে এবং হিন্দুস্তানে [টিকা: তখন উপমহাদেশ বিভক্ত হয়নি।] প্রচলিত অন্যান্য দল ও মতবাদের দাওয়াত ও কর্মপদ্ধতিকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করেছেন কিনা এবং এতদুভয়ের পার্থক্য অনুধাবন করে আমাদের দিকে অগ্রসর হয়েছেন কিনা।
২. তিনি আমাদের দাওয়াত দ্বারা প্রভাবিত হবার পর দ্বীন ও নৈতিকতার দিক দিয়ে কোন সুস্পষ্ট উন্নতি লাভ করেছেন কিনা এবং তাঁর বাস্তব জীবনে এ উন্নতির চিহ্ন সুস্পষ্টভাবে অনুভূত হয় কিনা।
৩. এ ব্যাপারে তার মনোভাব (Attitude) নিষ্ক্রিয় (Passive) নয়, সক্রিয় (Active) হতে হবে এবং এই দাওয়াতের কাজ করার জন্যে তাকে কার্যত অস্থির থাকতে হবে।

এ সকল বিষয়ে সন্তোষজনক জবাব লাভ করার পরও তাঁদেরকে সাধারণত রুকন পদপ্রার্থী অবস্থায় রাখা হয় এবং তাদেরকে বলা হয় যে, তাঁরা নিজেদেরকে রুকনে জামায়াত মনে করে কিছু কাজ করে যান। এভাবে তাঁদের কাজ দেখার পর তাদেরকে রুকন শ্রেণীভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ফলে তাঁরা যদি নিছক সাময়িকভাবে জামায়াত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকেন, তাহলে জামায়াতের মধ্যে প্রবেশ করে জামায়াতের শৃংখলা নষ্ট করতে সক্ষম হবেন না।

রুকন ও সমর্থক বৃন্দের দ্বারা কার্য সম্পাদনের পদ্ধতি

বর্তমানে আমাদের সমস্ত কার্য স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে সম্পাদিত হচ্ছে। অর্থাৎ কারুর দ্বারা আদেশ করে কোনো কাজ করানো হয় না। বরং দেখা হয় যে, এক ব্যক্তি এই দাওয়াতের সঙ্গে তার আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপন করার পর এবং ঈমানের পুনরাবৃত্তি করার ফলে তার নিজের উপর যে সকল দায়িত্ব অর্পিত হয়, তার অনুভূতির তাড়নায় বাধ্য হয়ে কি ও কত পরিমাণ কার্য সম্পাদন করতে উদ্যোগী হয়। তবে পরোক্ষভাবে ঈমানের চাহিদা সমূহকে সুস্পষ্ট করার ও সত্যের সাক্ষ্য দানের দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করার সকল সম্ভাব্য প্রচেষ্টা চালানো হয়। এ পদ্ধতি অবলম্বন করার ফলে প্রথমত কর্মীদের মধ্যে দাস-মানসিকতার পরিবর্তে আহ্বায়কসুলভ প্রেরণা ও কর্মস্পৃহা লালিত হয় এবং এই ধরনের প্রেরণা ও কর্মস্পৃহা প্রতিটি বিপ্লবী আন্দোলনের নিশান-বরদারদের জন্যে মৌলিক গুরুত্বের অধিকারী। এই ধরনের কোন আন্দোলনের কর্মীবৃন্দের মধ্যে যদি এই প্রেরণা সৃষ্টি না হয় তাহলে তার সাফল্য তো দূরের কথা অধিককাল জীবিত থাকাও সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, এর ফলে কর্মী ও সমর্থকবৃন্দের দ্বীনী ও নৈতিক পরিবর্তনের গতিধারা সম্পর্কে সকল সময় অবহিত থাকা সম্ভব হয় এবং আমীরে জামায়াতও প্রতি মুহূর্তে জামায়াতের যথার্থ শক্তি ও যোগ্যতার সঠিক ধারণা রাখতেও সক্ষম হন। তৃতীয়ত, এর ফলে বিভিন্ন রকমের শ্রেণী বিভাগ এবং দাওয়াতের সংগে তাদের সম্পর্কের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্যে কোন দীর্ঘ অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয় না, বরং এ সম্পর্কিত প্রতিটি জোয়ার-ভাটার খবর অনবরত গোচরীভূত হতে থাকে।

উপরন্তু আমরা মৌখিক দাবীর মাধ্যমে আমাদের সমর্থকবৃন্দের সমর্থনের পরিমাণ নির্ণয় করি না বরং দাওয়াতের জন্যে তাদের কার্যাবলী এবং ধন, প্রাণ ও সময়ের কোরবানীর মাধ্যমে নির্ণয় করে থাকি। বলা বাহুল্য, যে ব্যক্তির মধ্যে তার মুসলমান হবার চেতনা সৃষ্টি হয় এবং সে জানতে পারে যে, নবীগণের স্থলাভিষিক্ত হবার কারণে তার উপর কতবড় দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, তার পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব হয় না। আর এর পরেও যে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকে, সে নিজেই অচেতনতা বা কর্মশক্তিহীনতার প্রমাণ পেশ করে।

জামায়াত প্রভাবিত এলাকাসমূহ

আমাদের আওয়াজ পাঞ্জাবের প্রায় সকল এলাকায় পৌঁছে গেছে। হায়দ্রাবাদ (দাক্ষিণাত্য) ও মাদ্রাজের অধিকাংশ এলাকায় এবং উত্তর প্রদেশ ও বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলেও পৌছে গেছে। অতঃপর বোম্বাই, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশের স্থান। বাংলার রাজধানী কলিকাতা [টিকা: ভারত বিভাগের পূর্বে ১৯৫৫ সালের কথা।] ও তার আশেপাশে বর্তমানে আমাদের বইপত্র কিছু কিছু যাওয়া শুরু হয়েছে। কলিকাতার পুস্তক ব্যবসায়ীরাও আমাদের বইপত্র নিচ্ছেন। এ থেকে বুঝা যায়, সাধারণ মানুষের মধ্যে এর চাহিদা দেখা দিয়েছে। উড়িষ্যা, মধ্যা আবত, আসাম ও বেলুচিস্তানে এখনো আমাদের কাজ শূন্যের কোঠায়। কোথাও কোনো ব্যক্তি এককভাবে দু-একটি বই যা পত্রিকার অর্ডার দিচ্ছেন। অন্যথায় সামগ্রিকভাবে এসব এলাকা আমাদের দাওয়াতের দিক দিয়ে পুরোপুরি অনুর্বর। বাংলা, দিছু ও দক্ষিন ভারতের সবচাইতে বড় বাধা হচ্ছে আষা। এ প্রদেশগুলোয় উর্দু ভাষার প্রচলন নেই এবং এখানকার স্থানীয় ভাষাসমূহে এখনো আমাদের বইপত্র তৈরী হয়নি।

বর্তমানে কোন ধরনের লোকেরা জামায়াতের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন?

আধুনিক শিক্ষিত সমাজের সুস্থ ও বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিগণ অতি দ্রুত আমাদের দাওয়াতের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। তাদের মধ্য থেকে এ পর্যন্ত যতগুলি লোক বের হয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত পোখরা, বলিষ্ঠ কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছেন। আরবী মাদ্রাসা শিক্ষিত ব্যাক্তিরা যদিও এখন আমাদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে শুরু করেছেন, তবুও তাদের একটি বিরাট অংশ কোনো না কোনো বাক্তির প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধানত হয়ে নিজেদের ব্যক্তি-সত্ত্বাকে এত অধিক বিলুপ্ত করে দিয়েছেন যে, আমাদের প্রতিটি কথাকে সত্য ও ন্যায়ানুগ বলে স্বীকার করে নেবার পরও কোনো ‘হযরত’ বা ‘হুযুরের’ জালে আটকে যান। এই এক বছরের সাংগঠনিক কাজের মাধ্যমে আমি এ কথাও অনুভব করেছি যে, একজন আধুনিক শিক্ষিত ব্যক্তি যিনি শয়তানী ব্যবস্থার যাঁতাকলের নিষ্পেষণে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হননি তার মনে আমাদের এ যাওয়াত যত দ্রুত ও সহজে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে এবং জামায়াতী ব্যবস্থার মধ্যে যত শীঘ্র তাকে বিলুপ্ত করতে সক্ষম হয়, আরবী শিক্ষিত ব্যক্তিদেরকে নিছক এ নাওয়াজটি বুঝতে গিয়েও তার চাইতে অনেক বেশী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বরং আমাসের অনেক বন্ধুর এ অভিজ্ঞতাও হয়েছে যে, তাঁরা গ্রাম্য কৃষকদের নিকট এ দাওয়াত পেশ করার সংগে সংগেই তারা এর সর্বশেষ দাবীসমূহও উপলব্ধি করতে পেরেছে। কিন্তু ভালো ভালো আলেম এ সাওয়াত পাওয়ার পর চুলচেরা পর্যালোচনার গোলকধাঁধা থেকে বের হতে পারেন নি। এর বৃহত্তম কারণ হচ্ছে এই যে, আমাদের আরবী শিক্ষিত আইগণ একদিকে প্রত্যক্ষভাবে কুরআন ও হাদীস থেকে দ্বীনকে গ্রহণ করার পরিবর্তে কতিপয় বিশেষ, ব্যক্তির নিকট থেকে নিজেদের দ্বীনের জ্ঞান লাভ করতে অত্যন্ত হয়ে পড়েছেন এবং অন্যদিকে সকল প্রকার দলীয় বিষেষও ব্যক্তিগ্রীতিকে দ্বীনদারীর অপরিহার্য অংগে পরিণত করে এমনভাবে তাদের মনের গতীরে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এরপর তারা নিজেদের দলের চৌহদ্দীর বাইরে কোনো প্রকার দ্বীনদারী আছে বলে স্বীকার করতে প্রস্তুত হন না। বিপরীতপক্ষে আধুনিক শিক্ষিত শ্রেনী তাদের সকল দোষ-ত্রুটি ও পাশ্চাত্যপ্রীতি সত্ত্বেও অবশ্যি এ গুণের অধিকারী যে, দাওয়াত দানকারীর চেহারার সাথে সাথে তার কথা ও তার অন্তর্নিহিত অর্থ সম্পর্কেও তারা চিন্তা করে, অতঃপর যখন তার দিকে অগ্রসর হয়, তখন এমন দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে অগ্রসর হয় যে, ইতিপূর্বে তাদের নিকট ইসলামবিরোধী বিষয় ছাড়া আর কিছুই ছিল না কিন্তু এখন তারা নিজেদের পূর্ববর্তী জীবনের প্রাসাদটিকে সমূলে উৎখাত করে তাকে নতুন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে যত্নবান হয়ে ওঠে।

অমুসলিমদের মধ্যে আমাদের দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া

অমুসলিম জাতিসমূহের মধ্যে এখনো আমরা নিয়মিতভাবে কাজ করার কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি। তবুও নিজেদের আভ্যন্তরীণ শক্তির জোরে আমাদের কিছু বই-পত্র তাদের মধ্যে প্রবেশ করছে। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে যদি আময়া সঠিক পদ্ধতিতে কাজ করতে থাকি, তাহলে পার্থিব ও বস্তুগত স্বার্থে দীর্ঘকাল পরস্পর সংঘর্ষরত থাকার কারণে মুসলমান ও অমুসলিমদের মধ্যে যে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছে, তা ইনশাআল্লাহ বেশীক্ষণ আমাদের পথ আটকে থাকতে পারবে না। একনা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আজ সমগ্র দুনিয়া বর্তমান জীবন ব্যবস্থার প্রতি অভ্যন্ত বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং নিজেদের বিপদ-আপদ থেকে যুক্তিলাভ ও অড়বাসী সভ্যতা সৃষ্ট জটিল সমস্যাবলীর সমাধান অনুসন্ধানের জন্যে সর্ব প্রযত্নে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে যদি আমরা সৎলোকদের এমন একটি দল গঠনে সক্ষম হই, যারা হবেন একনিকে যথার্থই সত্যানুসায়ী ও খোদাভীরু এবং অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বর্তমান পরিচালফলের তুলনায় অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন, তাহলে সুনিয়া তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ না করে থাকতে পারবেনা।

আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই যে, যখনই এ সাধারণ দাওয়াত মানুষের সম্মুখে (সে অনুগত মুসলমান হোক বা বিদ্বেষশূন্য ও মুক্তচিন্তার অধিকারী অমুসলিম) সুস্পষ্ট ও দ্বার্থহীন ভাষায় পেশ করা হয়েছে তখনই সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এর সত্যতা স্বীকার করেছে। কুরজান মজীদ সভ্য ও হেদায়াতকে যিকির’ অর্থাৎ ‘স্মরণ’ নামে আখ্যায়িত করেছে। অবশ্যি আমাদের এই সাওয়াত এই সকল সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তির সিলের আওয়াজ এবং একটি অতি পরিচিত কিন্তু বিস্তৃত সত্যরূপে প্রতীয়মান হয়েছে। বরং অমুসলিমদের মধ্যে এমন অনেকের সাথে সাক্ষাত হয়েছে, যারা এতদূরও বলেছেন ‘দুঃখের বিষয়। হিন্দুস্তানে যদি এই ইসলামকে পেশ করা হতো এবং মুসলমানরা এই ইসলাম অনুযায়ী জীবন যাপন করতো, তাহলে আজ হিন্দুস্তানের চিত্রই সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ ধারণ করতো’। উপরন্তু তারা আমাদেরকে এ নিশ্চয়তাও দান করেছেন যে, আপনারা যদি সত্যিই নিজেদেরকে দাওয়াতের উপর অবিচল থাকেন এবং প্রমাণ করে দেন যে, আপনারা একমাত্র সত্যের অনুসারী ও সমর্থক এবং এর সংগে আপনাদের কোন ব্যক্তিগত বা জাতীয় স্বার্থ জড়িত নেই, তাহলে বর্তমান যুগের মুসলমানদের চাইতে অমুসলিমরাই এতে বেশী শরীক হবেন। কিন্তু জাতীয় ও বংশ বিদ্বেষের প্রাচীর ধূলিস্মাৎ হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন।

আমাদের যে সকল বন্ধু অমুসলিম সমাজে যাতায়াত করেন ও সেখানে কিছুটা প্রভাব রাখেন, তাদের নিকট আমার আবেদন হচ্ছে এই যে, আপনারা অমুসলিম ভাইদের মধ্যে ‘পর্দা ও ইসলাম’, ‘ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ’, ‘জবর ও কদর’ ‘ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ ‘অর্থনৈতিক সমস্যার ইসলামী সমাধান,’ ‘শান্তিপথ’ প্রভৃতি পুস্তকের মাধ্যমে ধীরে ধীরে কাজ শুরু করে দিন।’

আমাদের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট হওয়া উচিত যে, হিন্দুস্তানের বর্তমান ইতিহাস আসলে তুর্কী ও আফগান বাদশাহ এবং হিন্দু রাজাদের পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহ, দেশজয় ও পার্থিব স্বার্থোদ্ধারের ইতিহাস। কিন্তু এ ইতিহাসকে এমনভাবে পেশ করা হয়েছে যার ফলে তা হিন্দু ও মুসলমানদের জাতীয় অথবা হিন্দুধর্ম ও ইসলামের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ অনুষ্ঠানের করুণ কাহিনীতে পরিণত হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন হিন্দু রাজারা হিন্দুধর্মের আধিপত্য বিস্তারের জন্যে এবং তুর্কী ও আফগান বাদশাহরা সত্য দ্বীন ইসলামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্যে পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। এ ইতিহাসকে আজ আবার নতুন করে লিখতে হবে। আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট হওয়া উচিত। উপরন্তু ইসলামের ন্যায় আল্লাহর নেয়ামত থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে হিন্দুস্তানের অধিবাসীদের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তারও বিস্তারিত আলোচনা হওয়া উচিত।

বর্তমান রাজনৈতিক দলসমূহের উপর আমাদের দাওয়াতের প্রভাব

আমাদের দাওয়াতের প্রভাব কেবল মুসলমান ও অমুসলমান ব্যক্তিবর্গের ওপর পড়েনি। বরং দেশের সমগ্র রাজনৈতিক পরিবেশ কোনো না কোনো পর্যায়ে এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের শিক্ষিত সমাজের মুষ্টিমেয় কতিপয় ব্যক্তি এমন থাকতে পারেন যারা ‘হুকুমাতে ইলাহিয়া’, ‘দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম’, ‘ইসলামী জীবন ব্যবস্থা’, ‘ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বতন্ত্র জীবন ব্যবস্থা’ প্রভৃতি শব্দ সম্পর্কে অবগত নন। মুসলমানদের মধ্যে এ দাওয়াত বর্তমানে এমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে যে, প্রকৃতপক্ষে এখন তাদের মধ্যে এমন কোনো দল বা আন্দোলন প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে না যার পরিচালকরা কমপক্ষে কুরআনী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকে তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মৌখিক দাবী না জানাবে। অথচ আজ থেকে পাঁচ-ছয় বছর পূর্ব পর্যন্ত কুরআনী জীবন ব্যবস্থার নাম মুখে উচ্চারণ করে কোনো ব্যক্তি রাজনৈতিক মহলে হাস্যাস্পদ না হয়ে থাকতে পারতেন না। এ কারণে অনেক রাজনৈতিক দল নিছক মৌখিক হলেও এ আদর্শ ও উদ্দেশ্যটি গ্রহণ করার কথা সাড়ম্বর ঘোষণা করছে আর অন্যান্য দলগুলিও বাধ্য হয়ে এর প্রতি নিজেদের সমর্থনের কথা ঘোষণা করছে এবং তারা নিজেরাও এই একই উদ্দেশ্যের অনুসারী বলে মুসলমানদেরকে নিশ্চয়তা দান করার চেষ্টা করছে।

আমাদের দাওয়াত প্রভাবিত ব্যক্তিদের মধ্যে কোন ধরনের নৈতিক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে?

যে সকল ব্যক্তি আমাদের দাওয়াত দ্বারা প্রভাবিত হন, তাদের জীবনে যে সর্বপ্রথম পরিবর্তন সূচিত হয় তা হচ্ছে এই যে, তাদের উদ্দেশ্যহীন জীবনের পরিসমাপ্তি সূচিত হয় এবং একটি উদ্দেশ্য ভিত্তিক দায়িত্বশীল জীবনের শুভ সূচনা হয়। ইতিপূর্বে তাঁরা কিভাবে নিজেদের আসল জীবনোদ্দেশ্য বিস্তৃত হয়ে পশুর ন্যায় নিছক এদিক-ওদিক চরে বেড়াবার জন্যে তাদের সমস্ত সময় ও উপায়-উপকরণ নিয়োগ করেছিলেন, একথা তাঁরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে থাকেন। তাঁদের সকল শক্তি, যোগ্যতা ও উপায়-উপকরণ আসলে সত্য দ্বীনের সেবা ও তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে দান করা হয়েছিল কিন্তু সেগুলিকে তাঁরা আত্মসেবা ও শয়তানকে বিজয়ী করার কাজে নিয়োগ করেছিলেন বলে এ বিষয়টি তাদেরকে ভীষণভাবে দংশন করতে থাকে। অতঃপর তাদের তাকওয়া ও খোদাপ্রীতির মানদন্ডও সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এবং ইতিপূর্বে কোনো বড় ও মূল্যবান বস্তু আত্মসাৎ করার পরও যাদের দ্বীনদারী ও ধার্মিকতায় কোনো পার্থক্য সূচিত হতো না এরপর থেকে অন্যের এক গজ পরিমাণ দড়িও অন্যায়ভাবে ও বিনা অনুমতিতে গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। উপরন্তু তাদের দ্বীন ও ধর্ম সম্পর্কিত ধারণা কতিপয় বিশেষ অনুষ্ঠানের সীমা পেরিয়ে সমগ্র জীবনে পরিব্যাপ্ত হতে থাকে এবং ছোট-বড় প্রতিটি ব্যাপারে পার্থিব লাভ-ক্ষতিকে বাদ দিয়ে একমাত্র খোদা ও রাসূলের পছন্দ ও অপছন্দকে গ্রহণ ও বর্জনের মানদন্ডরূপে গ্রহণ করে। কাজেই বর্তমানে আখেরাতে জবাবদিহির চিন্তা রুকনদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে। সাম্প্রতিককালে আমাদের জনৈক চাকরীজীবী বন্ধু এম.এ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় তিনি অনুভব করলেন যে, তাঁর মনে অনৈসলামী শাসকের চাকরিতে উন্নতি ও মোটা বেতনের চিন্তা ভীড় জমাচ্ছে। এটিকে তিনি অবৈধ ও ঈমানের পরিপন্থী মনে করলেন। এজন্য তিনি পরীক্ষার চিন্তাই পরিত্যাগ করলেন, যাতে করে শয়তান তাঁর উপর বিজয় লাভ করে তাকে প্রতারণার মুখে নিক্ষেপ করতে সক্ষম না হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ এই একটি ঘটনা আমি আপনাদের সম্মুখে পেশ করলাম। খোদার মেহেরবানীতে এখন আমাদের রুকনগণের মধ্যে সঠিক ইসলামী তাকওয়া সৃষ্টি হচ্ছে এবং তাঁরা আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন।

উপরন্তু যেখানেই আমাদের প্রভাব পড়েছে, সেখানেই খোদার মেহেরবানীতে দ্বীন ও দুনিয়ার পার্থক্য মিটে যাচ্ছে এবং লোকেরা একথা ভালোভাবে বুঝতে পারছে যে, নিজেদের যাবতীয় বিষয় ও দুনিয়ার ব্যবস্থাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে পরিচালনার নামই হচ্ছে দ্বীন। তারা আরো উপলব্ধি করছে যে, দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে যে সংগ্রাম পরিচালিত হয়, তাতে সজ্ঞানে কোনো প্রকার গাফলতি করার পর তাকওয়া ও খোদাভীতির প্রদর্শনী সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট তা পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে পড়ে।

আমাদের পথের প্রতিবন্ধক

তবে যে দ্রুততা ও নিপূণতার সাথে এ কার্য সম্পাদিত হওয়া উচিত ছিল এবং এতদিন পর্যন্ত যা কিছু হওয়া উচিত ছিল সে তুলনায় অনেক ত্রুটি ও অভাব রয়ে গেছে এবং কাজের সাধারণ গতিও অতি শ্লথ, একথা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু এজন্যে যদি একদিকে কর্মীদের নিজেদের দূর্বলতা ও অনভিজ্ঞতাকে দায়ী করা হয়, তাহলে অন্যদিকে এমন অনেক বিষয়ের কথাও উল্লেখ করতে হয়, যেগুলির উপর আল্লাহ তাআলা এখনো আমাদেরকে কর্তৃত্ব দান করেননি। আমাদের নিজেদের ত্রুটির জন্যে আমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাচ্ছি এবং এগুলি দূর করার জন্যে তাঁর নিকট থেকে সুযোগ ও হিম্মত কামনা করছি আর আমাদের কর্তৃত্ব সীমা বহির্ভূত বিষয়সমূহের ওপর কর্তৃত্বদানের জন্যে তার নিকট দোয়া করছি ও তা লাভ করার জন্যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।

১. এ ব্যাপারে আমাদের বৃহত্তম সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে সত্যিকার কর্মতৎপর ও যথার্থ কর্মীর অভাব। দুনিয়ার অন্য সকল আন্দোলন ও তাদের বৃহত্তম কার্যাবলী ভাড়াটিয়া লোকদের দ্বারা সম্পাদিত হতে পারে। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃতিই হচ্ছে এমন যে, কোনো ভাড়াটিয়া লোক এর মধ্যে প্রবেশ করার সাথে সাথেই এ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। আমাদের আরকান ও অধিকাংশ কর্মীগণ প্রায় সকল দিক থেকে এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে অবস্থান করছেন। যদিও তাঁদের অধিকাংশই বর্তমানে অতি দ্রুত সংশোধনের পথে অগ্রসর হয়েছেন কিন্তু এ আন্দোলনকে অগ্রসর করার জন্যে যে দৃঢ়তা, হিম্মত, যোগ্যতা, নৈতিক পরিপক্কতা ও ঈমানী শক্তির প্রয়োজন, তা সৃষ্টি হতে এখনো দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। মানুষ ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে পরিবর্তিত হয়। তাদেরকে ইট-পাথরের ন্যায় হাতুড়ি মেরে মেরে আকাংখিত রূপদান করা যায় না। একটি ছোট চারাগাছের বর্ধিত হবার এবং পত্র-পল্লব ও ফল-ফুলে সুশোভিত হবার জন্যেও আল্লাহ তাআলা একটি সময় নির্ধারিত করেছেন। পক্ষান্তরে মানুষ চারাগাছের ন্যায় প্রাকৃতিক বিধানের সম্মুখে সম্পূর্ণ অক্ষম হবার পরিবর্তে ইচ্ছা-বাসনা ও নানাবিধ দুর্বলতার অধিকারী।

আমি বিনা দ্বিধায় স্বীকার করছি যে, আমার উপর যে বিরাট কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, সেজন্যে যে জ্ঞান, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও বিচারবুদ্ধির প্রয়োজন, তার এক-দশমাংশও আমার মধ্যে নেই।

জামায়াত এখনো নিজের প্রস্তাব অনুযায়ী কেন্দ্রে শিক্ষাশিবির কায়েম করে আরকান ও কর্মীদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে পারেনি। এখানে জায়গার অভাবই এর প্রধান কারণ।

এ ছাড়াও যেহেতু আমাদের জামায়াতের শতকরা ৯৮ জন আরকান গরীব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, তাই তাদের কারুর সম্পূর্ণ সময় জামায়াতের কাজে ব্যয় করতে চাইলে তার ভরণ-পোষণের নিম্নতম ব্যবস্থা করাও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আর এ ধরনের বোঝা বহন করার ক্ষমতা এখনো জামায়াতের হয়নি।

২. আমাদের পথের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিবন্ধক হচ্ছে বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্ট সমস্যাবলী। যার ফলে জামায়াত গঠনের পর থেকে দীর্ঘ চার বছরের মধ্যে এই সর্বপ্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং সমগ্র দেশের আরকান ও সমর্থকগণ এ সম্মেলনে হাযির হতে পেরেছেন। আপনারা জানেন, এ পর্যন্ত আমাদের দাওয়াত ও তাবলীগের বৃহত্তম বরং একমাত্র মাধ্যমের কাজ করেছে জামায়াতের বইপত্রগুলি। কিন্তু এই মহাযুদ্ধের ফলে কাগজেরও ভীষণ অভাব দেখা দিয়েছে, যার ফলে বহুদিন পর্যন্ত বইপত্র ছাপাবারও কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। জামায়াতের সমস্ত বইপত্র প্রায় এক বছর কাল অপ্রকাশিত (out of print) থাকে। বর্তমানেও যে পরিমাণ কাগজ পাওয়া যাচ্ছে, তা আমাদের বইপত্রের চাহিদার তুলনায় অনেক কম। যুদ্ধারম্ভ হবার পর থেকে এ পর্যন্ত এমন একটি দিনও আসেনি, যখন এক সংগে আমাদের সমস্ত বইপত্র মওজুদ থাকা সম্ভব হয়েছে। বইপত্রগুলির চাহিদা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, প্রত্যেকটি বই যদি দশ হাজার করে ছাপানো হয়, তাহলেও সম্ভবত কয়েক মাসের মধ্যেই সব নিঃশেষ হয়ে যাবে। কয়েকটি বই এমন আছে, যেগুলি এখনো একবারও ছাপানো সম্ভব হয়নি। অথচ দেশের প্রত্যেক এলাকা থেকে এগুলির অর্ডার আসছে। এই যুদ্ধের ফলে আমাদের আরো বহু কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় এ কাজগুলি যথাযথভাবে সম্পাদিত হতো।

৩. আমাদের পথের তৃতীয় বাধা হচ্ছে উপায়-উপকরণের অভাব। জামায়াতের বুক ডিপোসমূহ হচ্ছে তার আয়ের বৃহত্তম মাধ্যম। এ পর্যন্ত জামায়াতের প্রায় সমুদয় কাজ এই আয়ের ভিত্তিতেই চলছে। আর এই মাত্র আপনারা এর আসল অবস্থা শুনেছেন। সাহায্য ও যাকাত বাবদ অতি অল্প অর্থই পাওয়া যায়। এর কারণ হচ্ছে এই যে, আমাদের রুকনদের অধিকাংশই দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক। তাদের পক্ষে এই বিশ্বজনীন অভাবের যুগে বিশেষ করে যখন যথাসম্ভব হারাম ও হালাল উপায়ের কথাও চিন্তা করতে হয় এবং এভাবে নিজেদের ভরণ-পোষণ করাও কষ্টকর হয়, তখন বায়তুলমালের জন্যে সাহায্য প্রদান করাও অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। যদিও একথা অস্বীকার করা যেতে পারে না যে, এখনো আমাদের অধিকাংশ রুকনদের মধ্যে আদর্শ ও উদ্দেশ্যের প্রতি এত অধিক একনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়নি যার ফলে তারা প্রত্যেকটি কঠিন কাজে অগ্রসর হতে ও প্রতিটি বিপদ বরদাশত করতে এবং নিজেদের পেট কেটে দ্বীনের জমিতে পানি সিঞ্চন করতে প্রস্তুত হতে পারেন।

৪. আমাদের চতুর্থ বাধাটি হচ্ছে কতিপয় আলেমের কর্মপদ্ধতি। এটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক। আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন, কতিপয় আলেম ছাড়া আর কেউ আমাদের আন্দোলনের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেননি। আবার এ বিরোধিতাও কোনো যুক্তি বা হাদীস-কুরআনের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়নি বরং এ স্বীকারোক্তির সংগে এ বিরোধিতা করা হয়েছে যে, এ মতবাদ সম্পূর্ণ নির্ভুল, এটি ইসলামের চাহিদা এবং দ্বীনের দাবী কিন্তু বর্তমানে এটি কার্যকরী হতে পারে না, বর্তমানে আন্দোলন সাফল্য লাভ করার সুযোগ ও পরিবেশের অভাব, বিশেষ করে বর্তমান অবস্থায় আপনারা যা পেশ করেন (অর্থাৎ দ্বীন ইসলাম) তাকে কার্যকরী করা অসম্ভব। এটি কোনো গ্রাম্য মসজিদের মওলবী সাহেব, কোনো পাশ্চাত্যবাদী বাবু বা কোনো খান বাহাদুরের মত নয় বরং এটি মুসলিম জাতির এমন সব নেতৃস্থানীয় আলেমের মত যাদের নেকী, তাকওয়া ও দ্বীনদারীর ডংকা সমগ্র দুনিয়ায় বেজে চলছে এবং যাদের কেবল দ্বীনী মতের সংগে নয় বরং পার্থিব ও রাজনৈতিক মতের সংগে বিরোধ করাও তাদের ভক্তবৃন্দের নিকট কুফরীর সমপর্যায়ভুক্ত। জনগণের মধ্যে সত্যপ্রীতির প্রেরণা জাগ্রত করার পরিবর্তে ব্যক্তিপ্রীতির রোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই আমাদের দাওয়াত সম্পর্কে সর্বপ্রথম এ প্রশ্ন দেখা দেয় যে, এ দাওয়াত অবশ্যি সত্য কিন্তু অমুক হযরত সাহেব অমুক মাওলানা সাহেব ও অমুক শাহ সাহেব এতে শরীক হচ্ছেন না কেন? অনুরূপ আরো বহু সন্দেহ ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়। অবশ্যি এর ভালো দিকও আছে। অর্থাৎ যারা বিশেষ ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে ইসলাম গ্রহণ করার পক্ষপাতী তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায় এবং যে সকল লোক এ আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে ভালোবাসে একমাত্র তারাই আমাদের সহযোগী হয়। কিন্তু এর দ্বারা যে ফিতনা সৃষ্টি হয়, তাও কম মারাত্মক নয়। আমরা দোয়া করছি, আল্লাহ তাআলা যেন এ সকল লোককে হিদায়াত দান করেন, তাঁরা যেন নিজেদের মর্যাদা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন এবং সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে সত্য দ্বীনের পথে তাঁরা যে কত বিরাট বাধার সৃষ্টি করছেন, তা অনুভব করতে পারেন।

৫. আমাদের পথের পঞ্চম বাধা হচ্ছে আমাদের কতিপয় সহযোগীর একনিষ্ঠতার অভাব। এর আসল কারণ হচ্ছে এই যে, তাঁরা এখনো আমাদের দাওয়াত ও তার কর্মপদ্ধতি এবং এদেশে অন্যান্য যে সকল দাওয়াত পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলিও তাদের কর্মসূচীসমূহের মধ্যকার পার্থক্যকে ভালোভাবে অনুধাবন করেননি। এ কারণে তাঁরা জামায়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও বার বার অন্যান্য কাফেলাসমূহের দিকে দৃষ্টিপাত করছেন। তাঁরা মনে মনে কষ্ট অনুভব করছেন যে, অন্যান্য আন্দোলনের প্রাসাদের ন্যায় এখানেও রাতারাতি সম্পূর্ণ প্রাসাদটিকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় না কেন? তাঁদের নিজেদের জ্ঞানের সীমানা আরো বর্ধিত করা উচিত এবং স্থির মস্তিস্কের চিন্তা করার ও কাজ করার অভ্যাস করা উচিত।

আন্দোলনের এ পর্যায়ে আমরা সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করতে চাই যে,
প্রথমত, আমাদের সংগে একমাত্র তাঁরাই শরীক হোন এবং শরীক হবার পর একমাত্র তাঁরাই আমাদের সংগে চলুন, যারা আমাদের আদর্শ ও কর্মপদ্ধতিতে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন।

দ্বিতীয়ত, একমাত্র তাঁরাই আমাদের সংগে শরীক হোন, যারা আমাদের আদর্শ ও কর্মপদ্ধতিকে ভালোভাবে অনুধাবন করে ও এ দুটি সম্পর্কে পুরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করার পর এ জন্যে পূর্ণ আগ্রহ সহকারে কাজ করতে প্রস্তুত হোন।

তৃতীয়ত, যাদের আগ্রহের মধ্যে বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে কেন্দ্রমুখিতার ভাব সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ যারা সকল দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে একমাত্র এই দাওয়াতের সঙ্গেই তাদের সকল প্রকার আগ্রহ ও কর্মতৎপরতাকে সংশ্লিষ্ট করতে পেরেছেন এবং নিজেদের সবকিছুই এ কাজে নিয়োজিত করতে প্রস্তুত হয়েছেন একমাত্র তারাই আমাদের সঙ্গে শরীক থাকুন।

কোন বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর কাজের ধরন ও মুসলমানদের অন্যান্য দলসমূহের কাজের ধরনের পার্থক্যকে মাত্র কয়েকটি কথায় বিবৃত করছি। অন্যান্য দলগুলি মুসলিম জাতির কোনো নিয়মিত ও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা করার পরিবর্তে তাকে নিছক ফার্স্ট এইড (FIRST AID) দেবার কাজে ব্যস্ত। তাদের নিকট এ কাজটিই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অথচ তাদের অনেকের নিকট পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা করার মতো সাজ-সরঞ্জাম ও চিকিৎসালয় আছে। কিন্তু তারা কেবল ওপর থেকে কিছু ব্যান্ডেজ করে দিয়ে নিজেদের কর্মকান্ড দেখাবার জন্যে উদগ্রীব। বিপরীত পক্ষে, আমরা মুসলমানদের ও সমগ্র বিশ্বের নৈতিক ও সামগ্রিক রোগসমূহের চিকিৎসা ঠিক সেই পদ্ধতিতে করতে চাই, যে পদ্ধতিতে এ রোগ বিশেষজ্ঞগণ (খোদার নবীগণ) আজ পর্যন্ত দুনিয়ার নৈতিক ও সামগ্রিক রোগের চিকিৎসা করে এসেছেন। কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে এ চিকিৎসা ছাড়া অন্য সকল প্রকার চিকিৎসা পদ্ধতি অর্থহীন ও নিষ্ফল। আর এ পদ্ধতি একমাত্র তারাই অবলম্বন করতে পারে, যারা নবীগণের শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ অথবা কাঁচা কাজ করার জন্যে দৃঢ়সংকল্প।

আমাদের রুকনদের ব্যক্তিগত সমস্যা

দ্বীনের দাওয়াত ও ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে কার্যত প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম শুরু করার পর আমরা জানতে পারলাম যে, প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত যেমন সত্য দ্বীন হচ্ছে মাত্র একটি, তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন সূচিত হয়নি, তেমনি জাহেলিয়াত ও কুফরীর প্রকৃতিতেও তিল পরিমাণ পরিবর্তন সূচিত হয়নি। বর্তমান সমাজের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও সদ্ব্যবহারের পর্বত প্রমাণ দাবী সত্ত্বেও বাতিলের নিকট হক পূর্ববৎ অসহনীয় রয়ে গেছে। যদি আপনি কোথাও দেখে থাকেন যে, কর্তৃত্ব ও আধিপত্য সত্ত্বেও বাতিল হকের কিছুটা বাহ্যিক রূপকে বরদাশত করে যাচ্ছে, তাহলে বুঝতে হবে যে, হক একটি প্রাণহীন দেহরূপে বাতিলের অধীনস্থ হয়ে থাকতে সম্মত হয়েছে। তাই আমরা দেখেছি, যে সকল স্থানে আমাদের সহযোগীরা প্রকৃত দায়িত্ববোধের সাথে এ দাওয়াত গ্রহণ করেছেন এবং খোদার বন্দেগীকে মসজিদের চারি দেয়ালের বাইরে নিজেদের জীবন ক্ষেত্রে বিস্তৃত করতে শুরু করেছে, সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঐ একই সমাজে খান্দানে ও পরিবারে যেখানে কাল পর্যন্ত তাঁরা খাদ্যে লবণের ন্যায় প্রিয় ও প্রয়োজনীয় ছিলেন সেখানে আজ ফোঁড়ার ছুরি বিদ্ধ হবার ন্যায় অনুভূত হচ্ছেন এবং সবাই মিলে তাদেরকে জোরপূর্বক বাইরে নিক্ষেপ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ ব্যাপারটা শুধুমাত্র এই সামান্য কারণে সংঘটিত হয়েছে যে, আমাদের সহযোগীরা বর্তমানে সমাজের পছন্দ ও অপছন্দ এবং আর্থিক লাভের কমবেশীর পরিবর্তে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পছন্দ ও অপছন্দকে সবকিছু গ্রহণ ও বর্জনের মানদন্ডে পরিণত করেছেন। কাজেই এ কারণে অনেক পিতা-মাতা তাদের একমাত্র পুত্রকে গৃহ থেকে বের করে দিয়েছেন এবং তাদের চেহারা না দেখার জন্যেও কসম খেয়েছেন। অনেক বেদ্বীন পুত্র তাদের দূর্বল শুভ্র শ্মশ্রুধারী পিতাকে মেরে গৃহ থেকে বের করে দিয়েছেন। কারণ তাঁরা পুত্রদের ফাসেকসুলভ জীবনের পথে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন। অনেক বেদ্বীন স্বামী তার নির্দোষ স্ত্রীদেরকে তালাক না দিয়ে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে। অনেক বাতিলপন্থী পিতা-মাতার সন্তানরা যখন পিতা-মাতার ইচ্ছানুযায়ী কুফরীর সেবায় আত্মনিয়োগ করতে রাযী হয়নি, তখন তাদের শিক্ষাখাতে ব্যয়িত অর্থকে ঋণ ঘোষণা করে তা আদায় করার জন্যে তাদের নিকট তাগাদা শুরু করেছেন এবং অবশেষে বিবাহের ফাঁদে ফেলে তাদেরকে গৃহহীন করার ফন্দী এঁটেছেন। অনেক ধনী পুত্রকে তাদের সহোদর ভাইরা লাঞ্ছনার শেষ স্তরে পৌছিয়ে দেবার প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং সম্পত্তির অংশ থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করার জন্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। আমাদের অনেক রুকন অনেক খোদা বিরোধী লোকের ভাই ও পুত্রদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছেন যার ফলে তারা হারাম ধন সম্পদ ও অবৈধ উপার্জনে অধিক মাত্রায় অংশ গ্রহণে ক্ষান্ত হয়েছেন, কেবলমাত্র এই অপরাধেই তাদেরকে (রুকনদেরকে) বড় রকমের ক্ষতি সাধনের ধমকি দেয়া হয়েছে।

এই সামান্য ক’টি দৃষ্টান্ত আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত করলাম। এথেকে আন্দাজ করা যাবে যে, এই তথাকথিত মুসলিম জাতি দ্বীনের দিক থেকে বর্তমানে কোন পর্যায়ে অবস্থান করছে এবং তাদের দৃষ্টিতে দ্বীনের মর্যাদা কতটুকু।

কিন্তু বন্ধুগণ! এই বিশ্বজনীন পথভ্রষ্টতা ও গোমরাহীর সূচীভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে খোদার যে বান্দা দুনিয়াকে পুনর্বার হকের সংগে পরিচিত করিয়েছেন, তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন এবং এমন সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন পদ্ধতিতে দুনিয়ার সম্মুখে এই দ্বীনের পর্দা উন্মোচন করেছেন যে, এথেকে দূরে পলায়নকারীরাও একথা স্বীকার না করে থাকতে পারেনি যে, তারা তার নিকট থেকেই দ্বীন গ্রহণ করেছে, তার চাইতে সৌভাগ্যবান আর কে হতে পারে? অতঃপর আপনারা ও আপনাদের ন্যায় লোকেরাই সৌভাগ্যবান। কেননা আপনারা প্রতিকূল অবস্থার বরং ভীষণ বিরোধিতার মধ্যে এই দাওয়াত শুনেছেন, একে গ্রহণ করেছেন ও কার্যত প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন। আপনারা নিজেদের এই কর্ম ও আল্লাহ প্রদত্ত এই সুযোগের জন্যে অবশ্যি গর্ব করতে পারেন। কিন্তু মুমিনের গর্বের প্রকাশ হয় খোদার শুকরিয়া আদায় ও তাঁর পথে প্রাণ উৎসর্গ করার মধ্য দিয়ে। জেনে রাখুন। হকের দাওয়াতের এ পর্যায়ে তার জন্যে যে একটি পয়সা ব্যয়িত হয়, যে এক বিন্দু রক্ত প্রবাহিত করা হয় এবং যে একটি রজনী বিনিদ্র যাপন করা হয়, তা পরবর্তী পর্যায়ের বিরাট বিরাট কর্ম ও ত্যাগের তুলনায় অনেক উন্নত মর্যাদার অধিকারী হতে পারে। আপনারা জানেন, হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রাঃ) রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সংগে সূর গুহায় একটি রজনী অবস্থান করে যে নেকী অর্জন করেছিলেন হযরত উমর ফারুকের (রাঃ) ন্যায় বিরাট মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবী নিজের সমগ্র জীবনের আমল তার বিনিময়ে দান করার জন্যে সারা জীবন দুঃখ ও আক্ষেপ করে গেছেন। আরো জেনে রাখুন। দাওয়াতের এই পর্যায়েই খোদার নৈকট্য লাভ ও তাঁর নিকট উন্নত মর্যাদা লাভের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী। কেননা, মক্কা বিজয়ের পর সবাই

يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا দৃশ্যের অবতারণা করেন।

অন্যান্য ভাষায় জামায়াতের বইপত্র প্রকাশ

এতদিন পর্যন্ত আমাদের আওয়াজ অন্যের নিকট পৌছাবার জন্যে আমরা একমাত্র উর্দু ভাষাকে মাধ্যম রূপে ব্যবহার করেছি। এ কারণেই যে সকল এলাকায় উর্দুর প্রচলন নেই, সেখানে আমাদের দাওয়াতের কাজ শূন্যের কোঠায়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এই যে, শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এই আন্দোলন ও জামায়াতের সকল কাজের বোঝা সকল দিক থেকে একমাত্র আমীরে জামায়াতের উপর ন্যস্ত রয়েছে। বলা বাহুল্য, এক ব্যক্তি সকল কার্য সম্পাদন করতে পারেন না। বর্তমানে অন্যান্য ভাষায় এ দাওয়াতের বইপত্র কেবল অনুবাদ করার ব্যবস্থা করাই হচ্ছে না বরং কয়েকটি ভাষায় বর্তমানে কার্যত কাজও শুরু হয়ে গেছে।

আরবী ভাষায় বইপত্র তৈরী করার জন্যে মওলানা মাস’উদ আলম নদভীর নেতৃত্বে ও পরিচালনাধীনে জালিন্ধরে দারুল আরুবা নামে একটি আরবী প্রতিষ্ঠান কায়েম করা হয়েছে। মওলানা তাঁর শারীরিক অসুস্থতা ও অন্যান্য অসুবিধা সত্ত্বেও তাঁর জন্মভূমি বিহার প্রদেশ থেকে হিজরত করে স্থায়ীভাবে দারুল আরুবায় স্থানান্তরিত হয়েছেন এবং নিজের সমস্ত সময়, মনোযোগ ও শ্রম এ কাজে নিয়োগ করেছেন। দুঃখের বিষয়, দারুল ইসলামের আবহাওয়া তাঁর স্বাস্থ্যের অনুকূল নয়, তাই এখান থেকে দূরে অন্যত্র তাঁর জন্য ব্যবস্থা করতে হয়েছে। দোয়া করুন! আল্লাহ যেন মওলানার এই ত্যাগ ও প্রচেষ্টাকে কবুল করেন এবং তাঁকে পরিপূর্ণরূপে সুস্থ করে তোলেন।

দারুল আরুবা থেকে আরবী বইপত্র ছাড়া একটি উন্নতমানের আরবী পত্রিকা প্রকাশ করার প্রস্তাব বিবেচনা করা হচ্ছে।

তুর্কী ভাষায় বইপত্র তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন দারুল ইসলামে অবস্থিত তুর্কিস্তানী মুহাজির আমাদের প্রিয় ভাই আযম হাশেমী সাহেব। এ পর্যন্ত ‘ইসলাম পরিচিতি’ ও ‘খুতবাত’ পুস্তকদ্বয়ের তর্জমা শেষ হয়েছে।

মালয়ালম ভাষা হচ্ছে মাদ্রাজ প্রদেশের বৃহত্তম ভাষা। এ ভাষায় বইপত্র তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন হাজী ভি,পি, মুহাম্মদ আলী মালাবারী সাহেব। তিনি এ পর্যন্ত ইসলাম পরিচিতি, ‘খুতবাত’ এবং অন্যান্য ছোট-বড় দু’তিনটি পুস্তকের তর্জমা শেষ করেছেন। এগুলি প্রকাশের জন্যে দক্ষিণ ভারতের জামায়াতসমূহ সম্মিলিতভাবে কিছু অর্থও সংগ্রহ করেছে। এগুলি প্রকাশের জন্যে প্রচেষ্টা চলছে কিন্তু বর্তমান যুদ্ধ-সৃষ্টি অসুবিধাসমূহের কারণে এখনো এ ব্যাপারে সাফল্য লাভ করা সম্ভব হয়নি।

তামিল ভাষায় দাওয়াতের কাজ করার জন্যে দক্ষিণ ভারতের জামায়াতসমূহ সম্মিলিতভাবে মওলবী শায়খ আবদুল্লাহকে নির্বাচিত করেছেন। তিনি তামিল ভাষাভাষী এলাকায় অবস্থান করে এ ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করবেন। তাঁর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব এ জামায়াতগুলি বহন করবে। এ কাজটি শুরু হয়ে গেছে। এটি অত্যন্ত শুভ ও অনুকরণযোগ্য পদক্ষেপ এবং নির্বাচনটিও বড় উপযোগী হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এ প্রচেষ্টাটিকে সাফল্য দান করুন।

গুজরাটি ভাষা হচ্ছে বোম্বাই প্রদেশের বৃহত্তম ভাষা। এ ভাষায় আমাদের বইপত্র তর্জমা করার দায়িত্ব আমাদের বোম্বাইয়ের স্থানীয় জামায়াত গ্রহণ করেছে। এ সৎ কাজের জন্যে ইসমাঈল এখলাস একজন অত্যন্ত আন্তরিকতাসম্পন্ন গুজরাটি সাহিত্যিকের সাহায্য লাভ করতে তারা সক্ষম হয়েছেন। এ পর্যন্ত তাঁরা গুজরাটী ভাষায় খুতবাতের কতিপয় বক্তৃতা প্রকাশ করেছেন। অন্যান্য বক্তৃতা ও ‘সিয়াসী কাশমাকাশ’ পুস্তকের তর্জমা শেষ হয়েছে। এখলাস সাহেব বর্তমানে জামায়াতে শরীক হয়েছেন।

আল্লাহ তাঁকে দৃঢ়তা ও পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে দ্বীনের খেদমত করার তৌফিক দান করুন!

হিন্দী ভাষায় তর্জমার কাজ এলাহাবাদ জামায়াতের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশের অন্যান্য জামায়াতের সহযোগিতায় তাঁরা এ কার্য সম্পাদন করবেন। এখনো নিয়মিতভাবে এ কাজ শুরু না হলেও আশা করা যায় শীঘ্রই এর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যোগ্য অনুবাদকের অভাব। ‘শান্তিপথ’ পুস্তকটির অনুবাদ হয়েছে কিন্তু এখনো তা প্রকাশিত হয়নি।

সিন্ধী ভাষায় বইপত্র তর্জমা করার এখনো কোনো নিয়মিত ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। অবশ্যি এমন কিছু লোক পাওয়া গেছে, যারা ট্রেনিং লাভের পর এ কার্য সম্পাদনে সক্ষম হবে। তবে ইসলাম পরিচিতি পুস্তকটি সম্পর্কে জানা গেছে যে, আমাদেরকে না জানিয়েই দু’তিন বছর থেকে সিন্ধী ভাষায় তার অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু এ অনুবাদ সন্তোষজনক নয়।

ইংরেজী ভাষায় জামায়াতের জনৈক রুকন সামান্য অনুবাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে ‘কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা’ পুস্তকটির অনুবাদ চলছে। ইংরাজী অনুবাদের জন্যেও যোগ্য অনুবাদক পাওয়া একটি বিরাট সমস্যা।

বর্তমানে জামায়াতের যে সকল নতুন পুস্তক যন্ত্রস্থ আছে

জামায়াতের নিম্নলিখিত নতুন পুস্তকসমূহ বর্তমানে যন্ত্রস্থ আছে। ইনশাআল্লাহ অতিশীঘ্র এগুলির মুদ্রণকার্য সমাপ্ত হবে।

১. ‘কুরআন কি চার বুদিয়াদী ইস্তিলাহে’- এটি ইলাহ, রব, দ্বীন ও ইবাদত ইসলামের এ চারটি মৌলিক পরিভাষার অর্থ ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত আমীরে জামায়াত মওলানা মওদূদীর কতিপয় প্রবন্ধের সমষ্টি। প্রবন্ধগুলি ধারাবাহিকভাবে ‘তর্জমানুল কুরআন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কুরআনের মৌলিক শিক্ষা অনুধাবন করার ক্ষেত্রে এ পুস্তকটি মৌলিক গুরুত্বের অধিকারী।
২. ‘ইসলামী ইবাদত পর এক তাহকীকী নযর’-এটিও আমীরে জামায়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। নাম থেকেই এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার পরিচয় পাওয়া যায়।
৩. ‘হাকীকাতে তাওহীদ’- এটি মওলানা আমীন আহসান ইসলাহীর একটি সাম্প্রতিক রচনা। এটি তাঁর ‘হাকীকাতে’ শিরক এর পরবর্তী পর্যায়ের পুস্তক।
৪. ‘দাওয়াতে ইসলামী আওর উসকে মুতালিবাত’-এ পুস্তকে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ সংযোজিত হয়েছে:
ক. ‘ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি’- এটি আমীরে জামায়াতের একটি বক্তৃতা, আজকের অধিবেশনের এই রিপোর্টের পর তিনি এ বক্তৃতাটি পেশ করবেন।
খ. মওলানা আমীন আহসান ইসলাহী সাহেব শিয়ালকোটে ও এলাহাবাদ সম্মেলনে সাধারণ সভায় যে বক্তৃতা দুটি, পেশ করেছিলেন। এ বক্তৃতা দু’টিকে একত্রিত করা হয়েছে।
গ. ‘কাওসার’ পত্রিকার ১৯৪৫ সালের ১৬ই জানুয়ারী সংখ্যায় জামায়াতের প্রধান সম্পাদকের যে পয়গাম প্রকাশিত হয়েছিল, এ পুস্তকে ঐ পয়গামটিকে প্রায় তিনগুণ বড় করা হয়েছে।
ঘ. মওলানা আমীন আহসান ইসলাহী এলাহাবাদ সম্মেলনে মহিলাদেরকে সম্বোধন করে যে ভাষণ দান করেছিলেন।

প্রদেশসমূহে পৃথক পৃথক সম্পাদক নিয়োগ

সমগ্র দেশের সাংগঠনিক কার্য সম্পাদন যেহেতু এক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়, বিশেষত যখন তিনি নিজেও প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছেন এবং তাঁর কোনো সহকারীও নেই, উপরন্তু জামায়াতের রুকনগণের প্রতি অনবরত দৃষ্টি দেবারও প্রয়োজন, তাই দূরবর্তী এলাকাসমূহের জন্যে পৃথক পৃথক সম্পাদক নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মুহাম্মদ হাসানাইন সাইয়েদ জামেয়ীকে বিহার প্রদেশের সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনি বর্তমান অবস্থা ও উপায়-উপকরণের পরিপ্রেক্ষিতে সন্তোষজনক কাজ করে যাচ্ছেন। উত্তর প্রদেশের জন্যেও পৃথক সম্পাদক নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। কিন্তু এখনো যোগ্য ব্যক্তির নির্বাচন সম্ভব হয়নি। এ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করা হবে। অনুরূপভাবে দক্ষিণ ভারতের জন্যেও পৃথক সম্পাদক নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে এবং দক্ষিণ ভারতের করুনগণ সম্মিলিতভাবে মওলানা সাইয়েদ সিবগাতুল্লাহ বখতিয়ারীকে এজন্যে নির্বাচিত করেছেন। কিন্তু তাঁরা সবাই আবার কেন্দ্রের দৃষ্টি এদিকেও আকর্ষণ করেছেন যে, এ দায়িত্বটি তাঁর ওপর নিয়মিতভাবে সোপর্দ করার পূর্বে তাঁকে কিছুদিনের জন্যে কেন্দ্রে অবস্থান করার সুযোগ দিতে হবে, যাতে করে তিনি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পুরোপুরি বুঝে নিতে সক্ষম হন। আপাতত তিনি ১৩৬৪ হিজরীর শাবান মাসের পূর্বে এখানে আসতে পারছেন না এবং বর্তমানে গৃহ-সমস্যার কারণে আমরাও এখানে তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে সক্ষম নই। তাই এ বিষয়টি বর্তমানে কয়েক মাসের জন্যে স্থগিত রাখা হয়েছে।

প্রাদেশিক সম্পাদকগণের দায়িত্ব হবে নিম্নরূপ

১. নিজের হালকার আরকান ও জামায়াতসমূহের মধ্যে শৃংখলা ও সংগঠন কায়েম রাখা এবং আন্দোলনকে জীবিত রাখার ও অগ্রসর করার জন্যে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা।
২. নিজের হালকার আরকান ও জামায়াতসমূহের সাথে অনবরত যোগাযোগ রক্ষা করা, তাঁদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে অবগত থাকা এবং কেন্দ্রকে নিজের হালকার অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করা।
৩. রুকনদের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করার জন্যে মাঝে মাঝে নিজের হালকার বিভিন্ন এলাকা সফর করা এবং যেখানেই জামায়াতের সংগঠনের মধ্যে কোনো প্রকার ত্রুটি দেখা দেয়, সেখানেই ঘটনাস্থলে পৌছে যথাসময়ে পরিস্থিতি শুধরিয়ে নেয়া।

প্রাদেশিক সম্পাদকগণের অধীনস্থ হালকাসমূহের জামায়াতসমূহ ও একক রুকনগণের দায়িত্ব হবে নিম্নরূপ

১. নিজের হালকার সম্পাদকের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করা এবং হালকার সম্পাদকের নিকট নিজের কার্যাবলীর মাসিক রিপোর্ট প্রেরণ করা যাতে করে তিনি যথা সময়ে নিজের হালকার রিপোর্ট কেন্দ্রে পাঠাতে পারেন।
২. কেন্দ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের বিবেচনাযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে কেন্দ্রকে অবহিত করা।
৩. কোথাও কোনো প্রকার বিশৃংখলা বা অনাগ্রহ দেখা গেলে সংগে সংগেই হালকার সম্পাদকের নিকট ও কেন্দ্রে তার সংবাদ পৌছিয়ে দেয়া। যাতে করে তাঁরা যথা সময়ে সে সম্পর্কে যথাযোগ্য ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারেন।
৪. হালকার জামায়াত ও রুকনগণকে নিজেদের সম্পাদকের সাংগঠনিক প্রয়োজন পূর্ণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সফর খরচ অবশ্যি তাঁদেরকেই বহন করতে হবে।

সম্পাদক নির্বাচনের ব্যাপারে নিম্নোক্ত গুণাবলীকে সম্মুখে রাখা অপরিহার্য

১. তাঁকে কর্মঠ (active) হতে হবে।
২. চিন্তাশীল, ধীরস্থির, বুদ্ধিমান ও সুবিবেচক হতে হবে।
৩. তাঁর মধ্যে সংগঠনমূলক কার্যাবলী সম্পাদন করার যোগ্যতা থাকতে হবে।
আমি খোদার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং একথা বর্ণনা করতে অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করছি যে, সংগঠন বিভাগ প্রতিষ্ঠা ও তার প্রসারের পর জামায়াতের সংগঠনের কাজ যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। এরপর যে সকল রুকনকে জামায়াতের মধ্যে শামিল করা হয়েছে এবং যতগুলি নতুন জামায়াত গঠন করা হয়েছে, তাদের প্রায় সবগুলি পোস্তা ও শক্তিশালী এবং তাদের কাজের গতিও সন্তোষজনক। কতিপয় স্থান ছাড়া প্রায় সকল স্থান থেকে নিয়মিত মাসিক রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও আমি জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ৪,৫,৬,৭, ও ১০ম ধারার প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এই ধারাগুলোয় যে সকল কথা আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলি এত অধিক গুরুত্বপূর্ণ যে রুকনদের মাঝে মাঝে সেগুলি পাঠ করা উচিত এবং তার আলোকে নিজেদের ঈমান ও আমলের বিচার করা উচিত। তাহলে শপথ ভংগ করে কেবল আমীরের নয় বরং খোদা ও রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও খেয়ানতের অভিযোগে অভিযুক্ত হবার সম্ভাবনা কমে যাবে।

উপরন্তু এ বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য যে, অনেক স্থানীয় জামায়াতের রুকনগণ স্থানীয় আমীরকে কোনো সংস্থা বা সমিতির প্রধানের চাইতে অধিক গুরুত্ব দেন না। তাঁদের জেনে রাখা উচিত যে যখন তাঁরা নিজেদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে যোগ্যতর বিবেচনা করে তাঁকে আমীর নির্বাচন করেছেন, তখন ন্যায় ও সৎকর্মের ক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্য করা ও তাঁর নাফরমানীকে গোনাহ মনে করা তাদের জন্যে ওয়াজিব। রুকন ও আমীরের পারস্পরিক সম্পর্ক, অধিকার ও দায়িত্ব কি হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে জামায়াত গঠনের প্রাক্কালে এ দায়িত্ব গ্রহণ করার সময় আমীরে জামায়াত যে বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াতের কার্যবিবরণী ১ম খন্ডে উল্লিখিত এ বক্তৃতার এতদসম্পর্কিত অংশের প্রতি আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এ বক্তৃতাটি গভীরভাবে অনুধাবন করে ভবিষ্যতে উল্লিখিত বক্তৃতার ভিত্তিতে আপনাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করুন।

দারুল ইসলাম শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা

যদিও দারুল ইসলাম শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিলম্বের কারণ বর্ণনা করার জন্যে মওলানা আমীন আহসান ইসলাহী ও গাজী আবদুল জব্বার সাহেবকে অগ্রসর হওয়া উচিত, কেননা তাঁরাই ছিলেন এ কাজের ইনচার্জ, কিন্তু যেহেতু এ বিলম্বের জন্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জামায়াত ও অন্যান্য কতিপয় বিষয় দায়ী, তাই ইসলাহী সাহেব ও গাজী সাহেবের পরিবর্তে আমাকে এ ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হচ্ছে।

বলা বাহুল্য, শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠার জন্যে পাকাবাড়ী না হলেও কমপক্ষে বড় বড় বাড়ীর প্রয়োজন এবং ক্লাস রুম ও ছাত্রাবাসের পূর্বে শিক্ষকদের জন্যে কোয়ার্টারের প্রয়োজন অত্যধিক। কারণ তাদেরকে এখানে বসে নিজেদের কাজের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে আমাদের নিকট যে সকল গৃহ আছে সেগুলি আমাদের স্থানীয় কর্মীদের জন্যেও যথেষ্ট নয়। উপরন্তু গৃহ নির্মাণের পথে যে সকল বাধার সৃষ্টি হয়েছে তন্মধ্যে-

১. প্রথম ও বৃহত্তম বাধা হচ্ছে এই যে, আমরা এমন কোনো যোগ্য ব্যক্তি পাচ্ছি না, যিনি আমাদের গৃহ নির্মাণ পরিকল্পণার দায়িত্বভার স্বহস্তে গ্রহণ করতে পারেন। এ জন্যে এমন ব্যক্তির প্রয়োজন, যিনি এব্যাপারে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রাখেন, আমাদের ও জামায়াতের প্রতি সহানুভূতি রাখেন, উত্তম পরিচালক ও সততার অধিকারী এবং কার্যত এ দায়িত্ব সম্পাদনের যোগ্যতা রাখেন। এ ব্যাপারে আমরা যেন তার উপর নির্ভর করতে পারি এবং তিনি পূর্ণ দায়িত্ববোধের সাথে এ কার্যটি সম্পাদন করতে পারেন।

২. দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে গৃহ নির্মাণের রসদপত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সীমাতিরিক্ত দুর্মূল্য ও অভাব। আমরা মনে করেছিলাম, আপাতত পাকা দালানের পরিবর্তে বাঁশ-খড় দিয়ে কয়েকটা কাঁচা ঘর তৈরী করে কাজ শুরু করে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু সরকার এর উপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রেখেছেন।

৩. শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠার পথে তৃতীয় বাধা হচ্ছে অর্থাভাব। এ ব্যাপারে বলতে গেলে প্রথমতঃ আমাদের উপায়-উপকরণ এখনো সীমিত। দ্বিতীয়ঃ যেমন ইতিপূর্বে বলা হয়েছে আমাদের রুকন ও সমর্থকবৃন্দ, যাদের সহযোগিতায় আমাদের একটি কার্য সম্পাদন করা উচিত, তাঁদের অধিকাংশই গরীব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এই দুর্মূল্যের বাজারে তাদের পক্ষে জীবিকার সংস্থান করাই নিতান্ত কষ্টসাধ্য। তৃতীয়তঃ তাঁদের মধ্যে নিজেদের আদর্শ ও জীবনোদ্দেশ্যের সংগে প্রকৃতপক্ষে এখনো তেমন কোনো একাত্মতার সৃষ্টি হয়নি, যার ফলে তারা সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হতে পারেন।

উপরন্তু যে সকল পদ্ধতিতে সাধারণভাবে অন্যান্য লোক ও প্রতিষ্ঠানসমূহ অর্থ সংগ্রহ করে, সে সকল উপায়ে ও পদ্ধতিতে অর্থ সংগ্রহ করা তো দূরের কথা আমরা তো সাধারণভাবে জনগণের নিকট আবেদন জানাতে এবং ব্যাপকভাবে বিজ্ঞাপন দেয়াকেও নিজেদের নীতি ও কর্মপদ্ধতির বিরোধী মনে করি। এমনকি জামায়াতের রুকনদের ওপর কোনো চাঁদা নির্ধারণ করাকেও আমরা এ কার্য সম্পাদনের যথার্থ পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করি না। এ কাজের জন্যে আমরা দাতার নিকট থেকে তার অর্থের পরিবর্তে তার মনকে প্রথমে গ্রহণ করতে চাই। তার পকেট থেকে যা কিছু বের হয়, তা যেন হয় তার মানসিক প্রেরণা, দ্বীনী একাগ্রতা ও নিছক খোদাকে সন্তুষ্ট করার ফলশ্রুতি। আসলে এহেন অর্থই একটি সঠিক দ্বীনী শিক্ষায়তনের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত স্বচ্ছ রক্তের কাজ করতে পারে। এবং একমাত্র এহেন শিক্ষায়তনেই রাব্বুল আলামীনের বান্দা হবার যোগ্যতাসম্পন্ন সত্যসেবী ও খোদাভীরু মানুষ তৈরির আশা করা যেতে পারে।

এ ব্যাপারে আমাদের পদ্ধতি এই যে, আমাদের নিজেদের প্রয়োজনসমূহ নিজেদের আরকান ও সমর্থকবৃন্দের সম্মুখে পেশ করি। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তির দ্বীনের প্রতি ভালবাসা, হৃদয়ের প্রশস্ততা ও উপায়-উপকরণের সম্ভাব্যতার ওপর এ বিষয়টি নির্ভর করে। তাঁরা চাইলে আবু বকর সিদ্দীকের (রাঃ) ন্যায় তাঁদের সব কিছু এমন কি সূঁচটি পর্যন্ত খোদার পথে উৎসর্গ করার জন্যে হাযির করতে পারেন, আর ইচ্ছা করলে উমর ফারুকের (রাঃ) ছোট-বড় প্রত্যেকটি বস্তুর অর্ধেক খোদার পথে দান করতে পারেন, আবার ইচ্ছা করলে কারুনের ন্যায় নিজেদের অর্থ ভান্ডারের উপর সাপের ন্যায় জেঁকে বসে থাকতে পারেন।

কিন্তু এ অর্থাভাব ও উপায়-উপকরণের অভাব সত্ত্বেও আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি যে, যদি আমরা যোগ্য ব্যক্তি লাভ করতে পারি এবং আমাদের অন্যান্য কাজের ন্যায় এ কাজটিকেও একবার আল্লাহর নামে শুরু করতে পারি, তাহলে ইনশা আল্লাহ অর্থাভাবে একাজ কোথাও আটকে থাকবে না।

এই অর্থ সংগ্রহ প্রসংগে আমাদের সহযোগী ও সমর্থকবৃন্দের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করতে চাই যে, বর্তমানে আমাদের আয়ের বৃহত্তম মাধ্যম হচ্ছে আমাদের লাইব্রেরী। কাজেই যে সকল ব্যক্তি বা জামায়াত এখান থেকে বই ক্রয় করেন, তাঁদের অতিসত্বর নিজেদের বকেয়া পরিশোধ করে হিসাব পরিষ্কার করা উচিত এবং প্রত্যেক মাসে নতুন অর্ডার পাঠাবার আগে পূর্বের বকেয়া পরিশোধ করার চেষ্টা করা উচিত। তাহলে জামায়াতের অন্যান্য কাজও কোনো প্রকারে বাধাপ্রাপ্ত হবে না।

কেন্দ্রীয় বায়তুলমালের হিসাব

যেহেতু জামায়াত গঠনের পর সমগ্র জামায়াতের এটি প্রথম সম্মেলন, তাই আমি ১৯৪১ সালের ২৬শে আগস্ট থেকে ১৯৪৫ সালের ১৬ই এপ্রিল পর্যন্ত কার্যকালের আয়-ব্যয়ের হিসাব এ সম্মেলনে পেশ করছি। এর ফলে আপনারা যথাযথরূপে জামায়াতের অর্থশক্তি ও তার বস্তুগত উপায়-উপকরণের পরিমাণ আন্দাজ করতে পারবেন।

১৩৬০ হিজরীর ৩রা শাবান (১৯৪১ সালের ২৬শে আগস্ট) যে পরিমাণ অর্থ ও উপকরণের সাহায্যে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার এ প্রচেষ্টার ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল, তার বিস্তারিত হিসাব হচ্ছে নিম্নরূপ:

নগদ ৭৪ টাকা ১৪ আনা।
তর্জমানুল কুরআন লাইব্রেরীতে পুস্তকাকারে: প্রায় ৬ হাজার টাকা।
তর্জমানুল কুরআন লাইব্রেরীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন পুস্তক ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের নিকট প্রাপ্য: ১৭২২ টাকা ১ আনা ৬ পাই।

বর্তমান আমীরে জামায়াত মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী জামায়াতের কাজ শুরু করার জন্যে জামায়াতের বায়তুলমালে এ নগদ অর্থ, বইপত্র ও বাজারে প্রাপ্য অর্থের হিসাব স্থানান্তরিত করেন। এর পরবর্তী হিসাব হচ্ছে নিম্নরূপঃ

এছাড়াও জামায়াতে ইসলামী প্রকাশনীতে বর্তমানে প্রায় ২৫ হাজার টাকার পুস্তক মওজুদ আছে। এ পরিসংখ্যান থেকে যথার্থরূপে অনুমান করা যাবে যে, এদেশের লোকেরা আমাদের দ্বারা কি পরিমাণ প্রভাবিত হচ্ছে এবং এর গতি সম্পর্কেও একটি সুস্পষ্ট ধারণা জন্মাবে। কেননা, এই ব্যাপক বস্তুবাদী যুগে আমাদের নীরস ও দুনিয়ার প্রচলিত রুচি বিরোধী সাহিত্যের ক্রেতা ও আমাদের এই কাজের সাহায্যকারী হিসাবে একমাত্র তারাই অগ্রসর হতে পারেন, যারা সত্যিই এ ব্যাপারে আগ্রহ ও এর সংগে আন্তরিক সম্পর্ক রাখেন।

প্রধান সম্পাদক কর্তৃক রিপোর্ট পেশ করার পর আমীরে জামায়াত ‘ইসলামী দাওয়াত ও’ কর্মনীতি’ শিরোনামায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দান করেন। এ বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি ইসলামী দাওয়াত ও তার কর্মনীতির উপর অত্যন্ত বিস্তারিত ও সুস্পষ্টভাবে আলোকপাত করেন। এই একটি পথ ও কর্ম পদ্ধতি ছাড়া অন্যান্য সকল পথ মুসলমানদের জন্যে ত্রুটিপূর্ণ ও ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য কেন এবং এ ব্যাপারে কোন প্রকার গাফলতি করার ফলে তারা কিভাবে দ্বীনের ভিত্তিমূল থেকে দূরে সরে গেছে, তা তিনি বর্ণনা করেন। এ ব্যাপারে সাধারণভাবে যে সকল প্রশ্ন ও সন্দেহের অবতারণা করা হয়, তিনি অত্যন্ত যুক্তিসংগত পদ্ধতিতে তার জবাব দেন। (এজন্যে ‘ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি’ নামক পুস্তকটি পাঠ করুন।)

দ্বিতীয় অধিবেশন

[১৩৬৪ হিজরীর ৬ই জমাদিউল আউয়াল (১৯শে এপ্রিল ১৯৪৫ সাল) মাগরিবের নামাযের পর।

এ অধিবেশনে বিহার প্রাদেশিক জামায়াতের সম্পাদক সাইয়েদ মুহাম্মদ হাসানায়েন সাহেব বিহার প্রদেশের এবং জনাব তাজুল মুলুক সীমান্ত প্রদেশের রিপোর্ট পেশ করেন। অতঃপর আমীরে জামায়াত এ রিপোর্টদ্বয়ের উপর মন্তব্য প্রসংগে বলেন:

আমীরে জামায়াতের মন্তব্য

১. যে সকল স্থান থেকে জামায়াতের রুকনগণ সম্মেলনে হাযির হননি এবং এজন্যে তাঁরা কোনো ওজরও পেশ করেননি, তাঁদের সম্পর্কে একথা মনে করা উচিত যে, তারা বিনা ওজরে এখানে আসেননি। স্থানীয় জামায়াতের আমীরগণের এ ধরনের রুকনদের নিকট এর কারণ জিজ্ঞাসা করা উচিত। যদি ইতিপূর্বে জামায়াতে সঠিকভাবে কাজ করে থাকেন, তাহলে তাঁদেরকে নিছক সতর্ক করে দেওয়া উচিত, যাতে করে ভবিষ্যতে তাঁরা এমনটি আর না করতে পারেন, আর যদি পূর্ব থেকেই তাঁরা জামায়াতের কাজকর্মে আগ্রহ প্রকাশ না করে থাকেন, তাহলে তাঁদেরকে পরিস্কার বলে দেয়া উচিত যে, আপনারা জামায়াতের রুকনের দায়িত্ব থেকে পৃথক হয়ে যান। ওজরের জন্যে আমরা ‘শরীয়ত অনুমোদিত ওজরের’ যে শর্ত আরোপ করেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবসায়ের বা আর্থিক ক্ষতির ওজর পেশ করা সম্পূর্ণ অর্থহীন। আমাদের সহযোগীরা যদি বর্তমানে এতটুকুন ত্যাগ স্বীকার করতে না পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে তাদের নিকট থেকে কি আশা করা যেতে পারে? আমাদের সহযোগীদের মধ্যে এমন অনেক লোকও তো আছেন, যাঁরা চাকরি করেন এবং ছুটি লাভ করতে পারেননি, কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাঁরা সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছেন এবং এখন তাঁরা এর পরিণাম ভোগ করতে প্রস্তুত। আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এহেন লোকেরাই নির্ভরশীল বিবেচিত হতে পারেন। যে সকল রুকন নিছক ব্যবসায়ে ক্ষতি হবার ভয়ে সম্মেলনে যোগদান করেননি, তাদেরকে পরিস্কার বলে দেয়া উচিত যে, এখন আপনারা নিজেদের ব্যবসায়ের খেদমত করতে থাকুন, এই বিরাট আদর্শ ও লক্ষ্যের নামোচ্চারণ করা আপনাদের জন্যে শোভা পায় না। তবে যে সকল রুকন আর্থিক সংকটের কারণে উপস্থিত হতে পারেননি, তাদের ওজর সংগত। কিন্তু অন্য যে সকল রুকন তাদের ব্যয় নির্বাহ করতে পারতেন এবং এই সকল ভাইয়ের অক্ষমতা সম্পর্কে অবগতও ছিলেন, এতদসত্ত্বেও তাঁরা নিজেদের ভাইদেরকে সংগে আনার চেষ্টা করেননি আইনগত দিক দিয়ে জামায়াতের এই সকল রুকনের অংশগ্রহণ না করার জন্য তারা দায়ী না হলেও নৈতিক দিক দিয়ে তাঁরা অবশ্যি দায়ী। এহেন ভাইদের নিজেদের সংকীর্ণমনতা দূর করার জন্যে চেষ্টা করা উচিত। অন্যথায় যাঁরা আজ এই সামান্য আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করতে পারলেন না, আগামীকাল তাঁদের নিকট থেকে কোনো বড় রকমের ত্যাগের আশা কেমন করে করা যেতে পারে?

২. যে সকল হালকায় সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়েছে, সেখানকার জামায়াতসমূহ নিজেদের রিপোর্ট সরাসরি কেন্দ্রে পাঠাবার পরিবর্তে নিজেদের হালকার সম্পাদকগণের নিকট পাঠান এবং সম্পাদকগণ সমগ্র হালকার রিপোর্ট কেন্দ্রে পাঠান।
৩. যেখানে যেখানে জামায়াত কায়েম হয়েছে, সেখানকার রুকনগণ নিজেদের যাকাত স্থানীয় বায়তুলমালে পাঠান এবং তাদের সম্পদ কত ছিল এবং তার উপর তারা কত পরিমাণ যাকাত আদায় করলেন, তার যথারীতি হিসাব পেশ করুন। জামায়াতের বায়তুলমালের উপস্থিতিতে লোকদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজেদের যাকাত বের করে বিতরণ করা উচিত নয়। যাঁরা সাহেবে নেসাব হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত যাকাত আদায় করেন না, শরীয়তের দৃষ্টিতে তাঁরা নামায ত্যাগকারীদের সমপর্যায়ভুক্ত। এমন লোক আমাদের জামায়াতে থাকতে পারেন না।
৪. যাঁরা কতিপয় আলেমের সংগে নিজেদের আলোচনার কথা উল্লেখ করেছেন,
তাদের দৃষ্টি আমি জামায়াত গঠনের সময়ে যে পরামর্শ দিয়েছিলাম, সে দিকে আকর্ষণ করতে চাই। জামায়াতের কার্যবিবরণীর প্রথম খন্ডে এ বিষয়টি পুনর্বার পাঠ করা যেতে পারে। আমি সেখানে বলেছিলাম, যে ব্যক্তি যে শ্রেণীর লোকদের সংগে আলোচনা করার যোগ্যতা রাখেন, তাকে সেই শ্রেণীর মধ্যে যাওয়া উচিত। বিশেষ করে অ-আলেমদের আলেমগণের সম্মুখে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করার ব্যাপারে অনেক বেশী সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কেননা, তাঁদের সমস্যা হচ্ছে অত্যন্ত জটিল ও নাযুক এবং ফেতনা তাঁদের নিকট সব সময় হাযির থাকে। তাঁদের মনস্তত্ত্ব একমাত্র তাঁরাই বুঝতে পারেন, যাঁরা দ্বীনের গভীর জ্ঞান রাখার সাথে সাথে তাঁদের দ্বীনী জ্ঞান’ সম্পর্কে অবগত। তাঁদেরকে সত্য পথের দিকে দাওয়াত দেয়া আধুনিক শিক্ষিত লোকদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁরা ঐ সকল আলেমগণের নিকট গিয়ে সাফল্য লাভের পরিবর্তে বিপদ ডেকে আনবেন।
৫. আজকের রিপোর্টে একথা বলা হয়েছে এবং ইতিপূর্বে আমি প্রায়ই এ অভিযোগ শুনতে পেয়েছি যে, কোনো কোনো মহলে যখনই আমাদের দাওয়াত পৌঁছেছে, তখন তার জবাবে বলা হয়েছে, তোমাদের এ আন্দোলনের মধ্যে কোন না কোন কিছু অবশ্যই রয়েছে। তা না হলে তোমরা এ দাওয়াত দিচ্ছ এবং অমুক শক্তি তা ঠান্ডা মাথায় বরদাশত করে নিচ্ছে, এটা কেমন করে সম্ভব? আসলে এই ধরনের কথা তারাই বলে থাকেন, যাদের মধ্যে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করার মতো কোনো ক্ষমতা নেই এবং তারা হককে জানবার দায়িত্ব,, কোনো শত্রু শক্তির হস্তে সোপর্দ করেছেন। নিশ্চিন্তে তাঁরা মনে করেন, যে বস্তুর উপর কোনো দুশমন বিক্ষুদ্ধ হয়, সেটি হক আর যেটিকে তারা বরদাশত করে, সেটি হচ্ছে বাতিল। হক ও বাতিলের এই মানদন্ডের ওপর নির্ভর করে যাঁরা বসে রয়েছেন, আলেমদের একটি বিরাট অংশ তাদের অন্তর্ভুক্ত। এ দৃশ্য আমাদেরকে অবশ্যি মর্মাহত করে। তাঁদের নিকট আমাদের আরয হচ্ছে এই যে, যদি প্রকৃতপক্ষে আপনাদের নিকট দ্বীনের ইলম থেকে থাকে, তাহলে সর্বপ্রথম কুরআন ও হাদীসের কষ্টিপাথরে আমাদের দাওয়াতের সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখুন। অতঃপর চিন্তা করুন, যদি এ দাওয়াত হক হয়ে থাকে, তাহলে শয়তান ও তার সংগী-সাথীরা একে বরদাশত করছে কেন? হকের প্রকৃতি কি পরিবর্তিত হয়ে গেছে? অথবা পূর্বের শয়তান আর নেই? এ দিক দিয়ে চিন্তা করলে একথা আপনাদের নিকট দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এতবড় বিপ্লব অর্থাৎ নির্ভেজাল তাওহীদের দাওয়াত শয়তানের জন্যে সহনীয় হয়েছে আপনাদের নিজেদেরই ভুলের কারণে। কুরআন ও সুন্নাতে যে সকল শব্দ ও পরিভাষার মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করা হয়েছিল আপনারাই সেগুলির প্রাণবায়ু নির্গত করেছেন। ইলাহ, রব, দ্বীন, ইবাদত, শের্ক, তাওহীদ, তাগুত, ফেতনা-ফাসাদ, মারূফ, মুনকার, খায়ের ও সালাহ প্রভৃতি যে সকল শব্দ ইসলামের প্রাণশক্তিকে পেশ করার জন্যে শরীয়তে অবলম্বিত হয়েছিল, আজ আপনাদেরই বদৌলতে সেগুলি এতই অর্থহীন হয়ে পড়েছে যে, ইসলাম বিরোধী শক্তির সেনাবিনাসে প্রতিদিন পাঁচ বার আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর ঘোষণা বাণী উচ্চারিত হয় অথচ এর ফলে সেখানে সামান্য চাঞ্চল্যও পরিলক্ষিত হয় না। বরং ইসলাম বিরোধী শক্তি নিজেই তার একনিষ্ঠ খাদেমদের জন্যে ইমাম, মুয়াযযিন ও খতীব সংগ্রহ করে। এবং তার একনিষ্ঠ খাদেমদের মধ্যে বিনামূল্যে কুরআন মজীদ বিতরণ করলেও সে একে কোন বিপদ মনে করে না। এভাবে দ্বীনকে শয়তানের জন্যে সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত করার পর আপনারা এবার আর একটি মহৎ কার্য সম্পাদক করতে চান। অর্থাৎ কুরআনের উল্লিখিত পরিভাষা সমূহের মাধ্যমে যদি দ্বীনের দাওয়াত দান করা হয় এবং এর ফলে শয়তান ও তার দল-বলরা যদি বিক্ষুব্ধ না হয়, তাহলে আপনারা এটি যে দ্বীনের দাওয়াত বা হক নয় তার প্রমাণ স্বরূপ এ বিষয়টিকে পেশ করতে চান। ইসলামের ঐ সকল পারিভাষিক শব্দের মধ্যে আসলে যে অর্থ প্রচ্ছন্ন ছিল, আমরা বর্তমানে সেগুলির মধ্যে সেই অর্থ সৃষ্টি করতে চাই। উপরন্তু আমরা এও চাই যে, ইসলামের কালেমাকে যারা স্বীকার করেন ও মুখে উচ্চারণ করেন, তাঁরা কেবল এই পূর্ণ অর্থ সহকারে একে স্বীকার ও উচ্চারণ করবেন না বরং নিজেদের সমগ্র জীবনে এই চেতনাবোধের প্রকাশও করবেন। বলা বাহুল্য, আমাদের এ প্রচেষ্টার পূর্ণাঙ্গ সাফল্য যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ আর যতদিন পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে সাফল্য লাভে সক্ষম হবো না, ততদিন শয়তান ও তার দলবল নিশ্চিন্ত থাকবে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজেদের শক্তি ব্যয় করতে থাকবে। বিশেষ করে যখন তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে যে, ইসলামী পুনরুজ্জীবনের এ প্রচেষ্টাটিকে নির্মূল করার জন্যে আপনারাই যথেষ্ট, তখন তারা নাহক শহীদের রক্তে হাত রঞ্জিত করতে প্রস্তুত হবে কেন? তবে যদি এ প্রচেষ্টায় আমরা সাফল্য লাভ করি এবং আপনাদের ফেতনার মধ্য থেকেও অক্ষত শরীরে বের হয়ে আসতে পারি, তাহলে আপনারা যে পর্যায়ে দেখার প্রত্যাশা করেন পরিস্থিতি তার চাইতেও ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে এবং আল্লাহ তাআলা এ সন্দেহকে যেন মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন যে, আপনারা আজকের ন্যায় তখনো আমাদের সাথে সহযোগিতা না করার জন্যে অন্য কোনো বাহানা তালাশ করে নেবেন।

৬. সীমান্ত প্রদেশের রুকনগণ তাদের যে সকল বাধা-বিপত্তির উল্লেখ করেছেন, সেগুলি অবশ্যি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন। যে সকল এলাকায় বিদ্বেষ, হঠধর্মিতা, গোঁড়ামি ও ক্রোধশক্তির বিপুল প্রসার, সেখানে এ ধরনের বাধা-বিপত্তির উপস্থিতিই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার সহযোগীদেরকে আমি একথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে চাই যে, ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা ও অনবরত পরিশ্রমের মাধ্যমে জ্ঞানপূর্ণ পদ্ধতিতে তাবলীগ এতবড় শক্তিশালী অস্ত্র যে, তার সাহায্যে বিরোধিতার বিশাল পর্বতসমূহকেও চূর্ণ-বিচূর্ণ করা যেতে পারে এবং এর ফলে পথও স্বাভাবিকভাবে পরিষ্কার হয়ে যায়। সোভিয়েত তুর্কিস্তানের ঘটনা সম্পর্কে যারা ওয়াকিফহাল, তারা অবশ্যি জানেন যে, আজ থেকে পঁচিশ বছর পূর্বে সেখানে ইসলামের বিরুদ্ধে সামান্য মন্তব্য করাও সম্ভবপর ছিল না। কিন্তু কম্যুনিস্টরা এমন বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্যের সাথে সেখানে নিজেদের খোদা বিরোধী ও বস্তুবাদী আদর্শের প্রচার করেছে যে, তার ফলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ইসলামের এই সুপ্রাচীন দুর্গটির ভিত নড়ে উঠেছে এবং যারা বাহ্যত পাকা মুসলমান ছিল, তারা নিজেরা কম্যুনিস্টদের প্রচারে প্রভাবিত হয়ে নিজেদের হাতেই ইসলামকে সমাধিস্থ করেছে। যদি বাতিল বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্যসহকারে এসব কিছু করতে পারে অথচ মানব প্রকৃতি থেকে তার অবস্থান বহু দূরে, তাহলে আমি মনে করি হক কমপক্ষে এতটুকুও করতে পারবে না কেন, যখন মানব প্রকৃতির সাথে তার সম্পর্ক অতি নিকটবর্তী? কাজেই অবস্থা বর্তমানে যতই প্রতিকূল হোক না কেন, এ ব্যাপারে হিম্মতহারা হওয়া উচিত নয়। কুরআন ও সুন্নাত এবং দুনিয়ার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে দ্বীন প্রচারের পদ্ধতি শিক্ষা করুন এবং নিজের মধ্যে এমন গুণাবলী সৃষ্টি করুন, যার সাহায্যে অনুর্বর জমিকেও ফসল উৎপাদনের উপযোগী করা যেতে পারে। অতঃপর দেখবেন, খোদার অনুগ্রহে সমস্ত অসুবিধা বিদূরিত হয়েছে।

বিঃ দ্রঃ- এ অধিবেশনের আগ পর্যন্ত সীমান্ত প্রদেশে কোনো নিয়মিত জামায়াত ছিল না। মাত্র কতিপয় একক আরকান ছিলেন। কিন্তু এ অধিবেশনের পর আমীরে জামায়াতের নির্দেশক্রমে সেখানে যথারীতি জামায়াত গঠিত হয় এবং জনাব সরদার আলী খান (পেশোয়ার) এ প্রদেশের সম্পাদক নিযুক্ত হন।

তৃতীয় অধিবেশন

(৭ই জমাদিউল আউয়াল, ১৩৬৪ হিঃ শুক্রবার সকাল- ৯টা)

এ অধিবেশনটি যথা সময়ে মসজিদে শুরু হয়। সর্বপ্রথম চৌধুরী গোলাম মুহাম্মদ সাহেব সংক্ষেপে সিন্ধু প্রদেশের অবস্থা বর্ণনা করেন এবং যে সব কারণে সিন্ধু এখনো আমাদের আন্দোলন থেকে দূরে অবস্থান করছে, সেগুলিও বর্ণনা করেন। অতঃপর জে, বশীর আহমদ সাহেব বোম্বাই প্রদেশের রিপোর্ট পেশ করেন। তারপর হায়দরাবাদ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের রিপোর্ট পেশ করা হয়। অতঃপর মাদ্রাজ, মালাবার ও মহীশূর প্রদেশের রিপোর্ট পাঠ করা হয়। সর্বশেষে আমীরে জামায়াত রিপোর্টগুলি সম্পর্কে নিম্নলিখিত মন্তব্য করেন।

আমীরে জামায়াতের মন্তব্য

১. রাত থেকে এ পর্যন্ত যতগুলি রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে, তা শুনার পর আমার ধারণা জন্মেছে যে, আমাদের সহযোগীরা রিপোর্টে অনেক অপ্রয়োজনীয় বিষয় শামিল করে থাকেন এবং অনেক সময় অনেক প্রয়োজনীয় বিষয় রিপোর্ট থেকে বাদ দিয়ে দেন। এ বিষয়টির সংশোধন হওয়া দরকার। রিপোর্টে এমন কোনো বস্তু শামিল করা উচিত নয়, যা নিছক কোনো স্থানীয় ব্যাপার এবং তা রিপোর্টে শামিল করা বা না করার ওপর আসল বিষয়টির উপলব্ধি নির্ভর করে না। অনুরূপভাবে রিপোর্টে ব্যক্তি ও জামায়াতসমূহের নামও অতি অল্পই আসা উচিত। অভিযোগ বা প্রশংসা যে কোনো দিক থেকেই হোক না কেন, তার উল্লেখ কম করা উচিত। কেন্দ্রের নিকট যে রিপোর্ট পাঠানো হয়, তাতে এগুলির উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু সম্মেলনে যে রিপোর্ট পঠিত হয়, তাতে এর উল্লেখ না থাকা উচিত। আসলে আমাদের সম্মেলনে এ সকল রিপোর্ট পেশ করার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায় আমাদের এ আন্দোলন কি গতিতে অগ্রসর হচ্ছে, কোথায় কোন ধরনের প্রতিবন্ধক সৃষ্টি হয়েছে, বিভিন্ন এলাকার রুকনগণ কোন পদ্ধতিতে কাজ করে যাচ্ছেন, কোন এলাকায় ও মহলে আমাদের চিন্তাধারা বিস্তার লাভ করছে এবং কোথায় অবস্থা আশাপ্রদ বা নৈরাশ্যজনক, এ সম্পর্কে আমাদের রুকনগণকে অবহিত করা।

২. যেখানে আমাদের স্থানীয় জামায়াতসমূহ বা এককভাবে আমাদের কোনো স্থানীয় রুকন পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেখানে তাঁদের কেবল বইপত্র পড়িয়েই ক্ষান্ত থাকা উচিত নয়, বরং এদিকেও দৃষ্টি রাখা উচিত যে, কোন ব্যক্তি কি পড়ছে এবং কতটুকু আগ্রহ সহকারে পড়ছে? অতঃপর তাদের সংগে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাত করে চিন্তার আদান-প্রদান করা উচিত। এভাবে তাদেরকে ধীরে ধীরে নিজেদের দৃষ্টিভংগীর নিকটতর করা সম্ভবপর হতে পারে। তাদের কোনো সন্দেহ বা প্রশ্ন থাকলে তার জবাব দেয়া যেতে পারে। কোন ধরনের লোক আমাদের চিন্তায় কতটুকু প্রভাবিত হয়েছে এবং তাদের সহানুভূতি ও সমচিন্তাকে কিভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত করা বীজ বপন করার ন্যায়। কিন্তু আপনি কেবল বাতাসের ন্যায় বীজ ছড়িয়ে যাবেন না, বরং কৃষকের ন্যায় জমিতে বীজ বপন করার পর তার রক্ষণাবেক্ষণ, তার গোড়ায় পানি সিঞ্চন ও আগাছা-পরগাছা দূর করার জন্যে অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যান। অবশেষে একদিন শস্য পেকে যাবে।

৩. আমার মনে হচ্ছে কোনো কোনো স্থানীয় জামায়াতের আমীর নির্বাচনের ব্যাপারটিকে সাধারণ আঞ্জুমান ও সমিতিসমূহের সভাপতি নির্বাচনের ন্যায় হালকাভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এটি আসলে স্থানীয় নেতৃত্বের পদ। জামায়াতের মধ্যে যে ব্যক্তি যোগ্যতম বিবেচিত হয়, তাকেই নির্বাচিত করা উচিত। কিন্তু কারুর মাথায় জবরদস্তি এ বোঝা চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে এ দায়িত্ব পালন করার যোগ্যতা আছে বলে মনে করে অথবা অনুভব করে যে, তার মধ্যে যতটুকু যোগ্যতা আছে, ততটুকু আর কারুর মধ্যে নেই, তার অনর্থক সংকোচ করে দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করা উচিত নয়। একাজ অবশ্যি করতে হবে এবং আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এ প্রেরণা থাকা উচিত যে, আর কেউ এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে অগ্রসর না হলে তাকে অবশ্যি অগ্রসর হতে হবে।

৪. সিন্ধু প্রদেশের অবস্থা গভীরভাবে পর্যালোচনা করার পর আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, যতদিন সিন্ধু ভাষায় যথেষ্ট বইপত্র তৈরী না হয়, ততদিন আমাদেরকে উর্দু ভাষার মাধ্যমে সিন্ধু প্রদেশে বসবাসকারী পাঞ্জাবী ও উর্দুভাষী সিন্ধীদেরকে প্রভাবিত করার জন্যে প্রচেষ্টা চালানো উচিত। অতঃপর তাদের দ্বারাই সিন্ধী ভাষাভাষীদের মধ্যে দাওয়াত ছড়ানো যেতে পারে। সিন্ধী জনগণের অশিক্ষা, গোত্রীয় বিদ্বেষ ও তাদের অত্যধিক পীরপরস্তি নিঃসন্দেহে ইসলামী দাওয়াতের পথে বিরাট বাধা স্বরূপ। কিন্তু এগুলো দেখে ভীত হওয়া উচিত নয়। কাজ করার নীতি ও তাবলীগের বুদ্ধি সম্মত পদ্ধতি রপ্ত করার পর যদি আপনারা ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও অনবরত পরিশ্রম করতে থাকেন, তাহলে দেখবেন যে, এ প্রতিবন্ধকগুলো একটার পর একটা দূর হয়ে যাচ্ছে এবং যে জনসাধারণ আজ আপনাদের কথা শুনতে প্রস্তুত নয়, তারা নিজেরাই এই বাধাগুলো দূর করার ব্যাপারে আপনাদেরকে সাহায্য করবে।

৫. জনগণের নিকট থেকে নিজেদের কাজের জন্যে কোন অবস্থায় আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করা যেতে পারে, সে সম্পর্কে আমি পুনর্বার জামায়াতের নীতি বর্ণনা করতে চাই। কেননা, কতিপয় রিপোর্ট থেকে জানা গেলো যে, আমাদের রুকনরা এখনো এ নীতিকে পুরোপুরি হৃদয়ংগম করতে পারেন নি। আমরা আর্থিক সাহায্য কেবল তাদের নিকট থেকে গ্রহণ করতে পারি যারা প্রথমত আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত এবং এর সাথে পূর্ণাংগ সহানুভূতি পোষণ করেন। দ্বিতীয়ত, যারা আমাদের কর্ম পদ্ধতির সাথে একমত এবং ব্যক্তি ও জামায়াত হিসেবে আমাদের উপর আস্থা রাখেন। তৃতীয়ত, যারা টাকা বা অন্য কোনো আকারে আমাদেরকে অর্থ প্রদান করার পর নিজের পক্ষ থেকে কোনো শর্ত আরোপ করেন না বা নিজেদের অর্থের মাধ্যমে আমাদের কাজের মধ্যে কোনো প্রকার দখল দেবার চেষ্টা করেন না অথবা তাদের অর্থের দ্বারা আমাদের পরিকল্পনার বাইরে কোনো কার্য সম্পাদন করার প্রস্তাব দেন না। তবে আমাদের পরিকল্পনাধীন কাজগুলোর মধ্য থেকে কোনো একটি সম্পর্কে বলতে পারে যে, তার অর্থ এই বিশেষ খাতে ব্যয়িত হতে হবে। চতুর্থত, তাদের নাম প্রচার হোক না আমাদের কোনো কাজ তাদের নামের সাথে যুক্ত হোক অথবা ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কেউ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুক বা জামায়াত হিসেবে আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকি, এমন কোনো খাহেশ তাদের মনে জাগে না। আমাদের এ কাজে যারা অর্থ সাহায্য করতে চান, তাদেরকে একমাত্র খোদার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তা করতে হবে, খোদার নিকট থেকে একমাত্র তার প্রতিদান লাভের আশা পোষণ করতে হবে এবং খোদার কালেমা বুলন্দ করা ছাড়া অন্য কোনো বস্তুকে তারা নিজেদের আর্থিক কোরবানীর প্রতিদান হিসাবে গ্রহণ করতে পারবেন না। এটি আমাদের স্থায়ী নীতি এবং এর মধ্যে কোনো বিরাট বা মহান ব্যক্তির খাতিরে কোনো প্রকার পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যেতে পারে না।

৬. দেশে যে সকল শিক্ষা, প্রচার ও সংস্কারমূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে বা ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত হবে, সেগুলি সম্পর্কেও আমি জামায়াতের নীতি ব্যাখ্যা করতে চাই। কেননা, এ ব্যাপারেও জামায়াতের অনেক রুকনের কর্মনীতির সংশোধন হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এ ধরণের প্রতিষ্ঠানকে যদি পুরোপুরি আমাদের হাতে সোপর্দ করে দেয়া হয় এবং তা আমাদের নীতি অনুযায়ী পরিচালিত হতে পারে, এমন কি তাকে অপ্রয়োজনীয় বা অনুপকারী প্রমাণিত হয়েছে দেখে বন্ধ করে দিতে চাইলে যদি আমরা বন্ধ করে দিতে পারি, তাহলে আমাদের জামায়াতের কোনো রুকন তার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন। অন্যথায় জামায়াতের কোনো রুকনের এ দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত নয়। আর্থিক কারণে বাধ্য হয়ে তিনি এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরি গ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু তার দায়িত্বশীল কর্মীর পদ গ্রহণ করতে পারেন না। কেননা, এ প্রতিষ্ঠান অনর্থক আমাদের সাথে সম্পর্কিত বলে প্রচারিত হবে। তার কার্যাবলী সম্পর্কে জবাব দানের দায়িত্ব জামায়াতের ওপর অর্পিত হবে। উপরন্তু এ ধরনের প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালনার ক্ষেত্রে সাধারণত যে সকল অসংগত পদ্ধতি অবলম্বিত হয়ে থাকে, আমাদের রকনকেও অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা অবলম্বন করতে হবে এবং তার ফলে জামায়াতের নৈতিক মর্যাদা প্রভাবিত হবে।

অতঃপর অধিবেশন মূলতবী হয় এবং লোকেরা জুময়ার নামায ও খাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেন।

জুমআর খুত্বা

দেড়টার সময় জুময়ার দ্বিতীয় আযান হয় এবং আমীরে জামায়াত হাম্দ ও সানার পর নিম্নোক্ত জুমআর খুতবা পাঠ করেন।

প্রিয় দ্বীনী ভ্রাতৃবৃন্দ। আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র কিতাবে বলেছেন:

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِينَ لأَشَرِيكَ لَهُ * وَبِذلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ

অর্থাৎ হে মুহাম্মদ। বলে দাও, আমার নামায, আমার ইবাদতের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সব কিছুই আল্লাহর জন্যে, তিনি সমগ্র বিশ্বজাহানের মালিক। তাঁর কোনো শরীক নেই। আমাকে এরই নির্দেশ দান করা হয়েছে এবং তাঁর আনুগত্যে আমিই সর্বপ্রথম নিজের মস্তক অবনত করছি।’ (আন’আম: ১৬২-১৬৩)

রাসূলুল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীটিই এ আয়াতটির ব্যাখ্যাঃ

مَنْ أَحَبُّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيْمَانَ – (بخاری)

– ‘যে ব্যক্তি একমাত্র খোদার জন্যে কাউকে ভালোবেসেছে, একমাত্র খোদার জন্যে কারুর সংগে শত্রুতা করেছে, একমাত্র খোদার জন্যে কাউকে দান করেছে এবং একমাত্র খোদার জন্যে কাউকে দান করা থেকে বিরত হয়েছে, সে তার ঈমানকে পরিপূর্ণ করেছে অর্থাৎ- সে পূর্ণ মুমিন হয়েছে।’ (বুখারী)

প্রথমে যে আয়াতটি আমি আপনাদের সম্মুখে পেশ করেছি তা থেকে জানা যায় যে, ইসলাম চায় মানুষ তার বন্দেগী ও জীবন-মৃত্যুকে একমাত্র আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত করবে এবং আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে এর মধ্যে শরীক করবে না। অর্থাৎ সে আল্লাহ ছাড়া আর কারুর বন্দেগী করবে না এবং আর কারুর জন্যে তার জীবন-মৃত্যুকে নির্ধারিত করবে না। এর যে ব্যাখ্যা আমি রসূলুল্লাহর (সঃ) ভাষায় আপনাদেরকে শুনিয়েছি তাথেকে বুঝা যায় যে, মানুষের ভালোবাসা ও শত্রুতা এবং ব্যবহারিক জীবনে তার লেন-দেন একমাত্র খোদার জন্যে নির্ধারিত হওয়াই হচ্ছে ঈমানের দাবী। এছাড়া ঈমানের উন্নত পর্যায়ে পৌছা তো দূরের কথা ঈমান পরিপূর্ণই হতে পারে না। এ ব্যাপারে যে পরিমাণ অভাব থাকবে মানুষের ঈমানের মধ্যেও ঠিক সেই পরিমাণ খুঁত দেখা যাবে। আর যখন এদিক দিয়ে মানুষ পুরোপুরি খোদার হাতে নিজেকে সোপর্দ করবে, তখন তার ঈমান পূর্ণতা লাভ করবে। অনেকে মনে করে থাকেন এ বস্তুগুলি কেবল উন্নত পর্যায় ও মর্যাদার দ্বার উন্মুক্ত করে, অন্যথায় ঈমান ও ইসলামের জন্যে মানুষের মধ্যে এ গুণাবলী সৃষ্টির প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ এ গুণাবলী ছাড়াও মানুষ মুমিন ও মুসলিম হতে পারে। কিন্তু এটি একটি ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এ ভ্রান্তি সৃষ্টির কারণ হচ্ছে এই যে, সাধারণত লোকেরা আইন ও ফিকাহর ইসলাম এবং খোদার নিকট নির্ভরযোগ্য আসল ইসলামের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না। আইন ও ফিকাহর ইসলামে মানুষের মনের অবস্থা দেখা হয় না এবং দেখা যেতে পারে না। বরং কেবল তার মৌখিক স্বীকৃতিকে এবং মৌখিক স্বীকৃতির প্রমাণের জন্যে যে সকল অপরিহার্য আলামতের প্রয়োজন সেগুলি তার মধ্যে সুস্পষ্ট কি না তা দেখা হয়। যদি কোনো ব্যক্তি মুখে আল্লাহ, রাসূল, কুরআন, আখেরাত ও ঈমানের অন্যান্য বিষয়সমূহকে স্বীকার করে অতঃপর এগুলি প্রমাণের জন্যে অপরিহার্য শর্তসমূহও পূর্ণ করে, তাহলে তাকে ইসলামের সীমানার মধ্যে স্থান দেয়া হবে এবং মুসলমান মনে করেই তার সংগে সকল প্রকার ব্যবহার করা হবে। কিন্তু এ বিষয়টি কেবল দুনিয়ার জন্যে নির্ধারিত এবং যে আইনগত ও তামাদ্দুনিক ভিত্তির উপর মুসলিম সমাজের প্রাসাদ নির্মিত হয়েছে পার্থিব দিক দিয়ে কেবল সেগুলি সংগ্রহ করাই এর কাজ। এর উদ্দেশ্য এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে, এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে যতগুলি লোক মুসলিম সমাজের মধ্যে প্রবেশ করবে, তারা পরস্পরের নিকট নৈতিক, সামাজিক, আইনগত ও শরীয়তের অধিকারসমূহ লাভকরবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে, মীরাস বন্টন হবে এবং অন্যান্য তামাদ্দুনিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে। কিন্তু আখেরাতে মানুষের নাজাত লাভ ও তার মুসলিম ও মুমিন গণ্য হওয়া এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দার শ্রেণীভুক্ত হওয়া এই আইনানুগ স্বীকারোক্তির উপর নির্ভরশীল নয়, বরং সেখানে আসল বস্তু হচ্ছে মানুষের আন্তরিক স্বীকারোক্তি, তার হৃদয়ের নম্রতা ও স্বেচ্ছায় নিজেকে খোদার হাতে পূর্ণরূপে সোপর্দ করা। দুনিয়ায় যে মৌখিক স্বীকারোক্তি করা হয় তা একমাত্র শরীয়তের কাজী এবং সাধারণ মানুষ ও মুসলমানের জন্যে। কেননা, তারা কেবল বাইরেরটাই দেখতে পারেন, কিন্তু আল্লাহ তাআলা মানুষের অন্তর ও ভিতরের অবস্থা দেখেন এবং তার ঈমানের পরিমাপ করেন। তিনি মানুষকে যেভাবে যাচাই করেন তা হচ্ছে এই যে, তার জীবন-মৃত্যু, তার বিশ্বস্ততা, তার আনুগত্য ও বন্দেগী এবং তার জীবনের সমগ্র কর্মকান্ড আল্লাহর জন্যে অথবা অন্য কারুর জন্যে নির্ধারিত? যদি আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে সে মুসলিম ও মুমিন। আর যদি আল্লাহর জন্যে না হয়ে থাকে, তাহলে মুসলিম নয় এবং মুমিনও নয়। এদিক দিয়ে যে যতটা অপরিপক্ক হবে, তার ঈমান ও ইসলামও ততটা অপরিপক্ক হবে, দুনিয়ায় সে যত বড় মুসলমান বলেই পরিচিত হোক না কেন এবং তাকে যত বড় মর্যাদাই দান করা হোক না কেন, তার এ অবস্থার মধ্যে কোনো পার্থক্য সূচিত হবে না। আল্লাহর নিকট মর্যাদা লাভের একটিমাত্র ভিত্তি আছে এবং তা হচ্ছে এই যে, তিনি আপনাকে যা কিছু দান করেছেন তার সবকিছুই আপনি তাঁর পথে ব্যয় করেছেন কিনা। যদি করে থাকেন, তাহলে বিশ্বস্ত ও বন্দেগীর হক আদায় কারীদেরকে যে অধিকার দান করা হয় আপনাকেও সেই অধিকার দান করা হবে। আর যদি আপনি কোনো বস্তুকে খোদার বন্দেগী থেকে পৃথক করে রেখে থাকেন, তাহলে আপনার ইসলামের স্বীকারোক্তি অর্থাৎ আপনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে খোদার হাতে সোপর্দ করে দিয়েছেন এটা নিছক একটি মিথ্যা স্বীকারোক্তিতে পরিণত হবে। মানুষ এর দ্বারা প্রতারিত হতে পারে, এভাবে প্রতারিত হয়ে মুসলিম সমাজ আপনাকে তার বুকে স্থান দিতে পারে এবং এর ফলে আপনি দুনিয়ায় মুসলমানের প্রাপ্য যাবতীয় অধিকার লাভ করতে পারেন, কিন্তু খোদা কখনো এভাবে প্রতারিত হয়ে তাঁর বিশ্বস্তদের মধ্যে আপনাকে স্থান দিতে পারেন না।

এই আইনগত ও আসল ইসলামের মধ্যে যে পার্থক্য আমি বর্ণনা করেছি, সে সম্পর্কে যদি আপনারা চিন্তা করেন তাহলে জানতে পারবেন যে, এর ফলাফল কেবল আখেরাতেই বিভিন্ন হবে না বরং দুনিয়ায়ও অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়ে থাকে। দুনিয়ায় যে সকল মুসলমান দেখা গেছে বা আজ দেখা যায়, তাদের সবাইকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে। এক শ্রেণীর মুসলমান খোদা ও রাসূলকে (সাঃ) স্বীকার করে ইসলামকে নিজেদের ধর্ম হিসাবে মেনে নিয়েছে কিন্তু নিজেদের এ ধর্মকে নিজেদের সমগ্র জীবনের নিছক একটি অংশ ও বিভাগে পরিণত করেছে। এই বিশেষ অংশে ও বিভাগে ইসলামের প্রতি তাদের আন্তরিক বিশ্বাস আছে, ইবাদত-বন্দেগী করছে, তাসবীহ ও যিকির করছে, আহার ও কতিপয় সামাজিক বিষয়ে হালাল-হারাম মেনে চলছে এবং ধর্মীয় কার্য বলতে যা কিছু বুঝায় সব কিছুই সম্পন্ন করছে; কিন্তু এ বিভাগটি ছাড়া তাদের জীবনের অন্যান্য সকল বিভাগ তাদের মুসলমানিত্ব থেকে দূরে অবস্থান করছে। তারা নিজেদের জন্যে বা নিজেদের স্বার্থে অথবা নিজেদের দেশ, জাতি বা অন্য কিছুর জন্যে কাউকে ভালবাসে। অনুরূপভাবে তারা নিজেদের কোন পার্থিব বা ব্যক্তিগত স্বার্থে কারুর সংগে শত্রুতা বা যুদ্ধ করে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেন, মানুষের সাথে সম্পর্ক ও ব্যবহার তাদের সন্তান-সন্ততি, পরিবার সমাজ ও নিজেদের আত্মীয়-পরিজনদের সাথে ব্যবহার সমস্তই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্বীনের বন্ধনমুক্ত ও পার্থিব স্বার্থের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। একজন জমিদার, ব্যবসায়ী, শাসক, সৈন্য ও পেশাদার হিসাবে তাদের একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা থাকে, হয়তো তাদের মুসলমানিত্বের মর্যাদার সাথে এর কোন আংশিক সম্পর্ক থাকতে পারে কিন্তু আসলে ইসলামের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকে না। আর এক শ্রেণীর মুসলমান নিজেদের সমগ্র ব্যক্তিত্ব ও অস্তিত্বসহ পুরোপুরি ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করে। তাদের জীবনের সমস্ত দিক তাদের মুসলমানিত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। তারা মুসলমান হিসাবে পিতা, পুত্র, স্বামী, স্ত্রী, ব্যবসায়ী, জমিদার, মজুর, কর্মচারী বা পেশাদারের ভূমিকা গ্রহণ করে। তাদের ইচ্ছা, প্রেরণা, আবেগ, অনুরাগ, ঘৃণা, পছন্দ, অপছন্দ, চিন্তা, আদর্শ সমস্তই ইসলামের অনুগত হয়। তাদের চোখ, কান, পেট, লজ্জাস্থান, হাত, পা এবং দেহ ও প্রাণের উপর ইসলামের পূর্ণ আধিপত্য থাকে। তাদের ভালোবাসা ও শত্রুতা ইসলামের বাঁধনমুক্ত হয় না। তারা ইসলামের খাতিরে মানুষের সাথে সম্পর্ক জোড়ে এবং ইসলামের খাতিরে বিবাদ করে। ইসলামের তাগিদেই কাউকে কিছু দান করে এবং ইসলামের তাগিদেই কাউকে কিছু দান করা থেকে বিরত থাকে। তাদের এ কর্মপদ্ধতি কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তাদের সমাজ জীবনও পুরোপুরি ইসলামের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি জামায়াত হিসাবে তাদের অস্তিত্ব কেবল ইসলামের জন্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং তাদের সমস্ত সামাজিক আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।

এই দুই শ্রেণীর মুসলমান আসলে পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের। আইনগত দিক দিয়ে উভয়কে সমানভাবে মুসলমান বলা হলেও তাদের এ পার্থক্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীর মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য বা গর্ব করার মতো কোনো অবদান নেই। প্রকৃতপক্ষে তারা এমন কোনো কাজ করেননি, যা ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা যেতে পারে। এই শ্রেণীর লোকেরাই ইসলামের অবনতি ডেকে এনেছে। মুসলিম সমাজে এই ধরনের লোকের সংখ্যা বেড়ে যাবার কারণে দুনিয়ার জীবন ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব কাফেরদের হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে এবং তার অধিনে মুসলমানরা নিছক সীমিত ধর্মীয় জীবনের স্বাধীনতা লাভ করে সন্তুষ্ট হয়েছে। খোদা কখনো এ ধরনের মুসলমান চাননি। তিনি কেবল এ ধরনের মুসলমান তৈরি করার জন্যে তাঁর পয়গাম্বরদেরকে দুনিয়ায় পাঠাননি এবং তাঁর কিতাবগুলিও এ জন্যে নাযিল করেননি। এ জাতীয় মুসলমান দুনিয়ায় না থাকার কারণে সত্যিকার মূল্যবান ও মর্যাদাসম্পন্ন কোনো বস্তুর অভাব ঘটেনি, যা পূর্ণ করার জন্যে ওহী ও নবুয়াতের সিলসিলা জারী করার প্রয়োজন দেখা দেয়। আসলে খোদা যে ধরনের মুসলমান তৈরি করতে চান, যাদেরকে তৈরি করার জন্য নবীগণ পাঠানো হয়েছে ও কুরআন নাযীল করা হয়েছে এবং যারা ইসলামের দৃষ্টিতে কখনো কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে অথবা আজ করতে পারে তারা হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণীর মুসলমান।

এটি কেবল ইসলামের বৈশিষ্ট্য নয়। বরং যে আদর্শের অনুসারীরা কেবল মুখে ঐ আদর্শের স্বীকৃতি দেয়, তার বিধি-বিধানের আনুগত্যকে নিজেদের সমগ্র জীবনের নিছক পরিশিষ্টরূপে গণ্য করে এবং নিজেদের আদর্শ ছাড়া অন্য কোনো বস্তুর জন্যে তাদের জীবন-মৃত্যুকে নির্ধারিত করে দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত এ ধরনের অনুসারীদের দ্বারা কোনো আদর্শের ঝাণ্ডা সমুন্নত হয়নি। আপনারা আজো দেখবেন, কোনো আদর্শের আসল ও সত্যিকার অনুসারী কেবল তারাই হয় যারা সমগ্র হৃদয়-মন দিয়ে ঐ আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ততা পোষণ করে, যারা নিজেদের সমগ্র ব্যক্তিসত্তাকে তার মধ্যে বিলুপ্ত করে দেয় এবং যারা নিজেদের প্রতিটি বস্তুকে এমন কি নিজেদের সন্তান-সন্ততিকেও তার মুকাবিলায় প্রিয় মনে করে না। দুনিয়ার প্রতিটি আদর্শ এই ধরনের অনুসারী চায়। এই ধরনের অনুসারীদের মাধ্যমেই তারা বিজয়ী হয়। তবে এই ক্ষেত্রে অন্যান্য আদর্শ ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য আছে। অন্যান্য আদর্শ যদি আদর্শের খাতিরে মানুষের নিকট থেকে এ ধরনের আত্মোৎসর্গ, আত্মবিলুপ্তি ও বিশ্বস্ততা দাবী করে, তাহলে আসলে তাদের এ অধিকার নেই বরং এটি মানুষের নিকট তাদের একটি অন্যায় দাবী রূপে পরিগণিত হবে। বিপরীতপক্ষে, ইসলাম যদি মানুষের নিকট এ দাবী জানায়, তাহলে এটি তার চিরন্তন অধিকার বলে বিবেচিত হবে। অন্যান্য আদর্শ মানুষের সমগ্র জীবন, তার সমগ্র সত্তা ও ব্যক্তিত্বকে যে সকল বস্তুর খাতিরে উৎসর্গ করতে বলে তন্মধ্যে কোনো একটি বস্তুরও এ অধিকার নেই যে, মানুষকে তার জন্যে তার সব কিছু ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু ইসলাম যে খোদার জন্যে মানুষের নিকট থেকে এ কোরবানী চায়, তিনি মূলত তাঁর জন্যে সব কিছু কোরবানী করার অধিকার রাখেন। আল্লাহ তাআলাই হচ্ছেন আকাশ ও পৃথিবীর সকল বস্তুর মালিক। মানুষ নিজেই আল্লাহর মালিকানাধীন। যা কিছু মানুষের নিকটে আছে বা যা কিছু তার মধ্যে আছে সব কিছুর মালিক হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা। মানুষ দুনিয়ায় যে সকল বস্তু ব্যবহার করে, সেগুলিও আল্লাহর মালিকানাধীন। তাই ন্যায়নীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির দাবীও হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাআলা যে সকল বস্তুর মালিক, সেগুলি তাঁর জন্যেই নির্ধারিত হবে। অন্যের জন্যে বা নিজের প্রবৃত্তি ও স্বার্থপূর্তির জন্যে মানুষ যা কিছু কোরবানী করে, তা আসলে আমানত খেয়ানতের নামান্তর। তবে তা খোদার অনুমতিক্রমে সম্পাদিত হলে অবশ্যি স্বতন্ত্র কথা। আর খোদার জন্যে কোরবানী করে সে আসলে তাঁর অধিকার আদায় করে। কিন্তু এ দিকটি বাদ দিলেও বাতিল মতাদর্শের অনুসারীদের কর্মপদ্ধতি থেকেও মুসলমানরা বিরাট শিক্ষা লাভ করতে পারে। তারা নিজেদের বাতিল মতাদর্শ ও মিথ্যা খোদাদের জন্যে সব কিছু কোরবানী করছে এবং এ ক্ষেত্রে তারা এমন দৃঢ়তার পরিচয় দিচ্ছে যে মানবেতিহাসে যার নজীর পাওয়া দুস্কর। বাতিলের জন্যে মানুষ যদি এতটুকু আত্মোৎসর্গ করতে পারে এবং হকের জন্যে এর হাজার ভাগের এক ভাগও করতে না পারে, তাহলে তা অবশ্যি বিস্ময়ের কথা সন্দেহ নেই।

কুরআনের উল্লিখিত আয়াত ও হাদীসে ইসলামের যে উন্নতমানের কথা বিবৃত হয়েছে, তার নিরিখে আমাদের প্রত্যেকের নিজেকে যাচাই করা উচিত এবং তার আলোকে নিজের হিসাব গ্রহণ করা উচিত। যদি আপনি বলেন যে, আপনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন ও ঈমান এনেছেন, তাহলে ভেবে দেখুন, সত্যিই আপনার জীবন-মৃত্যু একমাত্র আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত হয়েছে কিনা। আপনি কি তাঁরই জন্যে জীবন যাপন করেছেন? আপনার হৃদয় ও মস্তিস্কের সমস্ত যোগ্যতা, আপনার দেহ ও প্রাণের সমস্ত শক্তি, আপনার সমস্ত সময় ও শ্রম কি আপনার মাধ্যমে খোদার ইচ্ছা পূর্ণ হবার ও খোদা তাঁর মুসলিম উম্মতের দ্বারা যে কার্য সম্পাদন করতে চান, আপনার মাধ্যমে তা সম্পাদিত হবার কাজে ব্যয়িত হচ্ছে? অতঃপর আপনি নিজের বন্দেগী ও আনুগত্যকে কি একমাত্র খোদার জন্যে নির্ধারিত করেছেন? নফসের বন্দেগী, পরিবারের বন্দেগী, গোত্রের বন্দেগী, বন্ধুর বন্দেগী, সমাজের বন্দেগী ও সরকারের বন্দেগী কি আপনার জীবন থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে? আপনার পছন্দ ও অপছন্দকে কি আপনি পুরোপুরি খোদার সন্তুষ্টির অনুগত করেছেন? উপরন্তু আপনি কি কারুর সংগে একমাত্র খোদার জন্যেই মহব্বত করেন? কাউকে কি একমাত্র খোদার জন্যে ঘৃণা করেন? এ ঘৃণা ও ভালোবাসায় আপনার হৃদয়ে কোন আবেগ সংযুক্ত হয় না কি? তাছাড়া আপনি কি একমাত্র খোদার জন্যে কাউকে দান করেন এবং খোদার জন্যেই কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকেন? আপনি নিজেকে ও দুনিয়ার যাকে যা কিছু দান করেন, তা কি একমাত্র খোদা তার অধিকার নির্ধারণ করেছেন বলে দান করেন এবং এর দ্বারা আপনি খোদার সন্তুষ্টি লাভ করতে চান? অনুরূপভাবে যাকে আপনি যা কিছু দান করা থেকে বিরত থাকেন, তা কি কেবল এজন্যে যে, খোদা তাকে দান করতে নিষেধ করেছেন এবং তাকে দান না করে আপনি খোদার সন্তুষ্টি অর্জন করতে চান? যদি আপনি নিজের মধ্যে এ অবস্থা লক্ষ্য করেন, তাহলে খোদার শুকরিয়া আদায় করুন, কেননা তিনি আপনার ঈমানকে পূর্ণতা দান করেছেন। আর যদি এদিক দিয়ে আপনি নিজের মধ্যে অভাব অনুভব করে থাকেন, তাহলে সকল চিন্তা বাদ দিয়ে এ অভাব পূর্ণ করার চেষ্টা করুন এবং নিজের সমস্ত প্রচেষ্টা ও শ্রম এরই মধ্যে কেন্দ্রীভূত করুন। কেননা, এ অভাবটি পূর্ণ হবার ওপর দুনিয়ায় আপনার কল্যাণ ও আখেরাতে নাজাত নির্ভরশীল। আপনি দুনিয়ায় যাই কিছু লাভ করুন না কেন, এ অভাবের কারণে আপনার যে ক্ষতি হবে, তা পূরণ করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। কিন্তু যদি এ অভাব আপনি পূর্ণ করতে পারেন, তাহলে দুনিয়ায় কিছু অর্জন করতে সক্ষম না হলেও আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।

চতুর্থ অধিবেশন

জুমআর নামাযের পর পুনরায় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। আমীরে জামায়াতের শরীর খারাপ থাকায় মওলানা আমীন আহসান ইসলাহীর নেতৃত্বে অধিবেশন শুরু হয়। এ অধিবেশনে দক্ষিণ ভারতের অবশিষ্ট রিপোর্টসমূহ পেশ করা হয়। উক্ত রিপোর্টগুলির ওপর মন্তব্য প্রসংগে মওলানা আমীন আহসান ইসলাহী বলেন:

দক্ষিণ ভারতের জামায়াতগুলি যে সকল বাধা-বিপত্তির উল্লেখ করেছেন, সেগুলির তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। এবং সে জন্যে পেরেশান হবারও কোনো কারণ নেই, বরং প্রকৃতপক্ষে এ ধরণের বাধা-বিপত্তিকে হাসিমুখে বরণ করে নেয়া উচিত। আমাদের বই-পত্র পড়তে যারা অন্যদেরকে বাধা দেয়, তারা আসলে এভাবে আমাদের বই-পত্রের ব্যাপক প্রচারে সহায়ক হয়। কেননা, যে কার্যে বাধা দেয়া হয়, সেদিকে অধিক মাত্রায় অগ্রসর হওয়াই হচ্ছে মানুষের স্বভাব।

অতঃপর এক ব্যক্তি তাঁর জনৈক কম্যুনিস্ট বন্ধুর পত্র পাঠ করে শুনান। উক্ত পত্রে তিনি জামায়াতের বই-পত্র দ্বারা প্রভাবিত হবার পর নিজের চিন্তা ও মনোজগতে পরিবর্তনের অবস্থা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। ইত্যবসরে আমীরে জামায়াত আগমন করেন এবং অবশিষ্ট কার্যক্রম তাঁর নেতৃত্বে চলতে থাকে।

অতঃপর দিল্লী ও উত্তর প্রদেশের রিপোর্ট পেশ করা হয়। এই রিপোর্ট প্রসংগে কতিপয় বিশিষ্ট ওলামায়ে কেরামের ফতোয়া পাঠ করেও শোনানো হয়। ‘ইসলাম পরিচিতি’ পুস্তক সম্পর্কে এ ফতোয়া দান করা হয়। বিভিন্ন শিক্ষায়তনের পাঠ্য তালিকা হতে এ পুস্তকটিকে বাদ দেবার জন্যে একটি দল এ ফতোয়াগুলিকে ব্যবহার করেছে।

এ রিপোর্টগুলি সম্পর্কে মন্তব্য প্রসংগে আমীরে জামায়াত বলেন:

আমীরে জামায়াতের মন্তব্য

১. আপনারা রিপোর্টে একথা বর্ণনা করেছেন এবং আমিও লক্ষ্য করছি, কোনো কোনো দল অনর্থক মনে করছে যে, তাদের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ আছে এবং এজন্যে তারা বিভিন্ন স্থানে আমাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে ও কুধারনা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ তাদের সংগে আমাদের কোনো বিরোধ নেই এবং তাদেরকে আমরা কখনো নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করি না। অবশ্যি এতে সন্দেহ নেই যে, আমরা নিজেদের বই-পত্রে মুসলমানদের বিভিন্ন দলের কর্মপদ্ধতি ও তাদের রাজনৈতিক পলিসির সমালোচনা করেছি। কিন্তু তাদের সংগে বিরোধ করা এ সমালোচনার উদ্দেশ্য ছিল না। বরং এর উদ্দেশ্য ছিল এই জামায়াতগুলিকে আমাদের দৃষ্টিভংগী সম্পর্কে অবহিত করা আর আমাদের দৃষ্টিভংগীর নির্ভুলতা স্বীকার করে নিলে সেই পরিপ্রেক্ষিতে তারা কর্মপদ্ধতির মধ্যে পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হবে। বলা বাহুল্য, সংশোধনের জন্যে এ ধরনের সমালোচনা অপরিহার্য। এ পদ্ধতি অবলম্বন না করে দুনিয়ায় কোথাও অবস্থার পরিবর্তন সূচিত হয়নি। প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী দলগুলো হামেশা এ ধরনের সমালোচনাকে বরদাশত করে থাকেন। বরং তারা এ দ্বারা উপকৃত হবার চেষ্টাও করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, হিন্দুস্তানে সমালোচনাকে হামেশা শত্রুতা মনে করা হয়েছে। আপনি কারুর ওপর কোনো আন্তরিকতা ও সহানুভূতিপূর্ণ সমালোচনা করলেও এবং আপনার উদ্দেশ্য নিছক সংশোধন হলেও কারুর ওপর সমালোচনা করার পর এর জবাবে সে আপনাকে গিলে ফেলতে উদ্যত হবে না এ আশা কদাচিত করা যেতে পারে।

এ সমস্তই হিন্দুস্তানের নৈতিক ও বুদ্ধিগত অবনতির ফলশ্রুতি। এর কারণসমূহ যথাযথভাবে হৃদয়ংগম করার পর এ ধরনের পরিস্থিতি দেখে আমরা কখনো ক্রোধ ও উষ্মা প্রকাশ করতে উদ্যত হবো না, বরং আমরা তাদের সম্মুখে সহানুভূতি ও ধৈর্যের দৃষ্টান্ত পেশ করতে সক্ষম হবো। আমি লক্ষ্য করেছি, আপনাদের রিপোর্টের কোথাও কোথাও ঐ সকল বিরোধিতার বিরুদ্ধে ক্রোধ ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। এ বস্তুটিকে নিজেদের মনের মধ্য হতে বের করে দিন। যেখানে আপনারা এ ধরনের বিরোধিতার সম্মুখীন হন, সেখানে যুক্তি সহকারে ধীর-স্থিরভাবে বিরোধীদেরকে বুঝিয়ে দিন যে, আমাদের আসল বিবাদ আপনাদের সংগে নয়, বরং বাতিল জীবন ব্যবস্থার সংগে। আমরা তাকে ভ্রান্ত মনে করি এবং তাকে আঘাত হানতে চাই। যদি আপনারা নিজেদেরকে ঐ জীবন ব্যবস্থার সাথে জড়িত করে থাকেন তাহলে যে পর্যায়ে তার সংগে জড়িত আছেন, সেই পর্যায়ে পরোক্ষভাবে আপনাদের ওপর আঘাত আসবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও আপনারা আমাদের আসল আঘাতস্থলে পরিণত হবেন না, বরং আসল আঘাত বাতিল জীবন ব্যবস্থার ওপরই আসবে। কিন্তু যদি এই জীবন ব্যবস্থার সাথে আপনাদের কোনো সম্পর্ক না থাকে, তাহলে আমাদের কোনো তৎপরতার ফলে আপনাদের উদ্বিগ্ন হবার কোনো কারণ নেই। যে তীর অন্যদিকে নিক্ষেপ করা হচ্ছে, সেগুলিকে আপনারা কেন খামাখা নিজেদের বুকের দিকে টেনে আনতে চান? এ কথা বলার পরও যারা নিজেদের বিরোধিতাপূর্ণ কথা ও কর্ম থেকে বিরত না হয়, তাদেরকে তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দিন। তাদের কথার জবাব দেবেন না এবং তাদের ওপর বিক্ষুদ্ধ হবেন না। জেনে রাখুন, তাদের বিরোধিতামূলক কার্যাবলী, তাদের প্রচার-প্রপাগান্ডা, তাদের মিথ্যা দোষারোপ এবং যাবতীয় বিরোধিতাপূর্ণ কৌশল তাদের নিজেদের জন্যেই ক্ষতিকর প্রমাণিত হবে। তবে এ জন্যে শর্ত হচ্ছে এই যে, তাদের সংগে আপনাদের ব্যবহার হতে হবে অত্যন্ত ভদ্রজনোচিত, আপনাদের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করবেন এবং রসূল ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তির ন্যায় নিশ্চিন্তে নিজেদের কাজ করে যাবেন। যখন একদিকে আপনাদের ব্যবহার এ পর্যায়ে পৌঁছবে এবং অন্যদিকে তাদের বিরোধিতাপূর্ণ ব্যবহার সততা ও নৈতিকতার সীমা ছাড়িয়ে যাবে, তখন আপনারা দেখবেন তাদের কার্যক্রমের ফলে জনগণের বিবেক জেগে উঠবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করবে। লোকেরা তাদের দল থেকে পৃথক হয়ে আপনাদের সাথে যোগদান করবে। কিন্তু যদি আপনারা ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের সংগেই হাতাহাতি শুরু করে দেন, তাহলে আপনারাও তাদের ন্যায় হয়ে যাবেন এবং এ যুদ্ধে তাদের ন্যায় আপনারাও বিলুপ্ত হয়ে যাবেন। আসলে শয়তান হকের আহ্বায়কদেরকে তাদের পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্যে উস্কানি প্রদান করে ও স্বার্থবাদী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এ প্রসংগে তাফহীমুল কুরআনের সূরায়ে আরাফের শেষ রুকুর ব্যাখ্যায় আমি যা লিখেছি, তা আপনারা মনোযোগ সহকারে পড়বেন। ইনশাআল্লাহ তা আপনাদের জন্যে অনেক উপকারী প্রমাণিত হবে।

(২) ইতিপূর্বে বহু পত্রের মাধ্যমে এবং এখানে পঠিত রিপোর্টসমূহ থেকে অনুমিত হচ্ছে যে, আমাদের সহযোগী ও এই চিন্তার অনুসারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কম্যুনিজমের বর্ধিষ্ণু শক্তির ফলে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে সন্দেহ নেই যে, রাশিয়ার সাফল্যের বদৌলতে কমুনিস্ট আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং সরকার নিজের স্বার্থের খাতিরে তাকে শক্তি অর্জন করার যে সুযোগ দিয়েছেন, তাও তার জন্যে যথেষ্ট উপকারী প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এর ফলে অস্থির ও ভীত হবার কোনো কারণ নেই এবং অস্থিরতা ও ভীতির সাথে যদি কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়, তাহলে তা লাভজনক হবার পরিবর্তে ক্ষতিকর প্রমাণিত হবে। একথা সত্য যে, জনগণের নিম্নতম বস্তুগত আবেগ ও ইন্দ্রিয় লালসার প্রতি আবেদন জানাবার কারণে কম্যুনিজম আগুনের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে। একথাও সত্য যে, দীর্ঘকাল থেকে এ সম্পর্কে প্রচারণা চলছে। কম্যুনিজম শক্তিশালী সাহিত্য ও বিপুল সংখ্যক কর্মীর অধিকারী। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে তার সাফল্যজনক প্রচার হয়েছে এবং একটি বিরাট সাম্রাজ্য তার নিশান-বরদার। সাম্প্রতিক বিজয় এই সাম্রাজ্যের প্রভাবকে অপ্রতিহত করেছে। এসব কারণে এ ধারণা খুব বেশী অযৌক্তিক নয় যে, একবার এ আন্দোলনটি বন্যার ন্যায় আমাদের দেশে বিস্তার লাভ করবে। কিন্তু এ দিকগুলির সাথে সাথে এর আরো কয়েকটি দিক আছে, সেগুলিকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। হিন্দুস্তানও এ পর্যায়ের মানসিক গোলামীর রোগে আক্রান্ত দেশসমূহে এ আন্দোলনের সাফল্য মূলত রাশিয়ার শক্তির ওপর নির্ভরশীল। যে সময় রাশিয়া জার্মানীর হাতে মার খাচ্ছিল, তখন আপনারা দেখেছেন হিন্দুস্তানে কম্যুনিজমও মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। আবার যখন রাশিয়া আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হলো এবং জার্মানীর মুকাবিলায় সাফল্য অর্জন করতে লাগলো তখন এ দেশেও কম্যুনিজম চাংগা হয়ে উঠলো। তাই এথেকে এ সিদ্ধান্তে পৌছানো যায় যে, কম্যুনিজমের উত্থান-পতন রাশিয়ার সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু রাশিয়ার অবস্থা হচ্ছে এই যে, এ দেশটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলনের স্থান থেকে সরতে সরতে এমন এক স্থানে এসে পৌঁছেছে, যেখানে নাৎসী জার্মানী দাঁড়িয়েছিল। অর্থাৎ তার কম্যুনিজম বর্তমানে জাতীয়তাবাদীর কম্যুনিজম (National socialism) পরিণত হয়েছে এবং তা অতি দ্রুত সাম্রাজ্যবাদিতার (imperialism) ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের প্রতিযোগী হতে চলেছে। এ বস্তুটি একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন হিসেবে অবশ্যিই কম্যুনিজমের আবেদনকে প্রভাবহীন করে দেবে। একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের সাফল্য মূলত তখনই অবধারিত হয়, যখন তার নিশানবরদাররা ব্যক্তিগত, জাতীয় ও শ্রেণী স্বার্থের উর্ধে উঠে কোনো প্রকার জাতীয় পার্থক্য ও বিদ্বেষ ছাড়াই সমগ্র মানব জাতিকে সমানভাবে নিজেদের শরীকে পরিণত করে এবং সাফল্যের যুগে তারা যে সকল সুবিধা লাভ করে, তাদের সকল আদর্শানুসারীকেও তাতে সমানভাবে অংশীদার করে। এমনকি তাদের মানসিক প্রশস্ততা এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে, কাল পর্যন্ত যার সংগে তাদের যুদ্ধ চলছিল, সে যদি তাদের আদর্শকে গ্রহণ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে শত্রুতা ও প্রতিশোধ গ্রহণের সমস্ত প্রেরণাকে নিমেষেই খতম করে দিয়ে তার সংগে ভাইয়ের ন্যায় ব্যবহার করে। বলা বাহুল্য, এ জন্যে অতি উচ্চমানের নৈতিক বৃত্তিক প্রয়োজন। কিন্তু বস্তুবাদীরা বিশেষ করে ডাল ভাতই হচ্ছে যে সকল বস্তুবাদীর বৃহত্তম আবেদন, তারা এত উচ্চমানের নৈতিক বৃত্তি কোথা থেকে আনতে পারে? এ কারণেই রাশিয়া পার্থিব সাফল্যের যত অধিক মঞ্জীল অতিক্রম করছে, ততই অধিক জাতীয়তাবাদীতে পরিণত হচ্ছে। আর আজকের রুশীয় কম্যুনিস্টদের মধ্যে এতটা প্রশান্ত চিন্তা ও বুলন্দ হিম্মত নেই যে, সামরিক সাফল্যের মাধ্যমে তারা যে সকল সুবিধা লাভ করেছে, তাতে নিজেদের জাতির সাথে সাথে অন্যদেরকেও সমানভাবে শরীক করতে পারে। এখন তারা যা কিছু চায় কেবল নিজেদের জন্যেই চায়। তবে কম্যুনিজমের আন্তর্জাতিক আবেদনকে বর্তমানে তারা কেবল নিজেদের একটি জাতীয় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এভাবে তারা এর মাধ্যমে বিভিন্ন জাতির মধ্যে পঞ্চম বাহিনী (Fifth column) সৃষ্টি করে চলেছে এবং এই পঞ্চম বাহিনীকে তল্পীবাহকে পরিণত করে নিজেদের জাতীয় সাম্রাজ্যের শিকড় সম্প্রসারণ করছে। গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিরা এখন থেকেই তা প্রত্যক্ষ করছেন। কিন্তু শীঘ্রই এমন এক সময় আসবে, যখন রাশিয়ার রাজনীতি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উলংগ হয়ে যাবে এবং পরাধীন জাতিসমূহের যেসব লোক আজ তাকে নিজেদের পরিচালক ও নেতায় পরিণত করে রেখেছে এবং তাকে মজলুমের সহায় ও পরাধীনদের আজাদীর নিশানবরদার মনে করেছে, তখন তারা তার থেকে নিরাশ হয়ে যাবে।

আমার এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য এ নয় যে, আপনারা কম্যুনিজমের বিপদ থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকবেন। বরং আমার বক্তব্য শুধু এতটুকু যে, আপনাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ কম্যুনিস্ট বিপদের ফলে যত বেশী অস্থিরতা অনুভব করছেন, তত বেশী অস্থির হবার কোনো প্রয়োজন নেই। এই বিপদকে যারা দ্রুত নিকটবর্তী হতে দেখছেন তারা চাচ্ছেন তাড়াতাড়ি কোনো জবাবী প্রচারণা শুরু করতে অথবা কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে ও পুস্তক প্রকাশ করতে। অথবা তাঁরা চাচ্ছেন আমাদের কর্মীরা দ্রুত কৃষক-মজুরদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে কাজ শুরু করে দেবেন, যার ফলে তাদেরকে কম্যুনিস্টদের ক্রোড় থেকে মুহূর্তের মধ্যে ছিনিয়ে নেয়া সম্ভবপর হবে। আমি গত বছর বয়স্ক শিক্ষার যে পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম তার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, আমাদের যে সকল রুকন জনগণের মধ্যে কাজ করার যোগ্যতা রাখেন, তারা শক্তিশালী ও মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এমন একটি গণ-আন্দোলনের ইমারত নির্মাণ করবেন, যা কেবল শ্রমজীবীদের নৈতিক ও মানসিক সংশোধন করেই ক্ষান্ত হবে না, বরং তাদেরকে এই সকল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ফিতনা সৃষ্টিকারী আন্দোলন থেকেও সংরক্ষিত রাখবে। উপরন্তু ধীরে ধীরে জনগণের মধ্য থেকে নির্ভরযোগ্য কর্মীদের এমন একটি বিরাট দল সৃষ্টি করবে, যারা ব্যাপকভাবে আমাদের এই গণ-আন্দোলনকে সমগ্র দেশে সম্প্রসারিত করবে। ইতিপূর্বে আমি দারুল ইসলাম সম্মেলন ও দিল্লী সম্মেলনের বক্তৃতায় এ কাজের পদ্ধতি বর্ণনা প্রসংগে বলেছি যে, আমাদের শিক্ষিত কর্মীরা তাদের আশেপাশের জনগণের মধ্য থেকে আট-দশটি লোকের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ সৃষ্টি করবেন এবং তাদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাদান করতে অগ্রসর হবেন। এই শিক্ষার কোনো প্রকার ব্যয় তারা বহন করবে না, সময় নির্ধারণের ব্যাপারে আপনার নিজের সুবিধার পরিবর্তে তাদের সুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে, স্থানও তাদের নিকট চাওয়া যাবে না, বরং আপনি নিজে তার ব্যবস্থা করবেন। প্রথমে কিছু সময় ব্যয় করে তাদের মধ্যে লেখার ও পড়ার যোগ্যতা সৃষ্টি করুন। অতঃপর জামায়াতের সাহিত্যের মধ্য থেকে সহজ সহজ বিষয়গুলি তাদেরকে পাঠ করান। এ সময়ে নিজেদের চিন্তার সাহায্যে কেবল তাদেরকে প্রভাবিত করেই ক্ষান্ত থাকবেন না, বরং তাদের সংগে এমন সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার করুন, যার ফলে তাদের হৃদয় জয় করতে পারেন। তাদের দুঃখ-দুর্দশায় শরীক হবার চেষ্টা করুন। তাদের প্রত্যেক বিপদ-আপদে সম্ভব হলে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করুন, অন্যথায় কমপক্ষে সহানুভূতি প্রকাশ করুন।

নিজের কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে তাদের নিকট একথা প্রমাণ করুন যে, আপনি তাদের সাথে কোনো প্রকার পৃথক ব্যবহার করার পক্ষপাতী নন এবং শিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে যে মিথ্যা অহংকার দৃষ্টিগোচর হয়, তার ছিটে-ফোঁটাও আপনার মধ্যে নেই। এই সংগে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তাদের দুর্বলতাসমূহ দূর করার জন্য প্রচেষ্টা চালান। তাদের মধ্যে যে ‘মানবতা’ সুপ্ত আছে, যাকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, অশিক্ষা এবং সমাজের নৈতিক ও মানসিক অবনিত নিদ্রাবিভোর করে রেখেছে, তাকে জাগ্রত করুন এবং তাদের মধ্যে মানসিক শ্রেষ্ঠত্বের এমন চেতনা সৃষ্টি করুন যার ভিত্তি ইসলাম ও ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর তাদেরকে একথাও বুঝান যে, আধুনিক সভ্যতা তাদেরকে যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও দুর্গতির সম্মুখীন করেছে, তার একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে জীবনের সমগ্র ব্যবস্থাকে নির্ভেজাল ইসলামের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা। এভাবে যে আট-দশজন লোককে আপনি তৈরি করবেন, তারা জনগণের মধ্যে আপনার ট্রেনিংপ্রাপ্ত কর্মীর ন্যায় কাজ করে যাবে। তাদেরকে আপনি তাদেরই শ্রেণীতে আপনার নৈতিক ও মানবিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে পরিণত করতে পারবেন। এ পদ্ধতি অবশ্যি অতিদ্রুত ফল লাভের সম্ভাবনা নেই। যেমন একজন কম্যুনিস্ট কর্মী অর্থনৈতিক আবেদন জানিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি শ্রমিক সভা বা কৃষক সভা গঠন করতে পারে অথবা ট্রেড ইউনিয়নের (Trade union) ভিত্তি স্থাপন করতে সক্ষম হয়। এভাবে তাদের ন্যায় দ্রুত আপনি নিজের চতুর্দিকে বিপুল জনতার সমাবেশ করতে পারবেন না। কিন্তু আমি আপনাদেরকে যে কর্মপদ্ধতির সন্ধান দিলাম, তাকে কার্যকরী করতে সক্ষম হলে আপনারা দেখবেন মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এমন একটি বিপুল শক্তিশালী গণ-আন্দোলনের উদ্ভব হবে, যার মুকাবিলা করা অন্যান্য আন্দোলনের জন্য হবে অত্যন্ত কঠিন। উন্নত শ্রেণীর নৈতিক বৃত্তির ভিত্তিতে পরিচালিত মুষ্টিমেয় কতিপয় ব্যক্তি যে দৃঢ়তা দেখাতে পারে, ডাল-ভাতের আবেদনের ভিত্তিতে একত্রিত বিপুল জনতা কখনো তার ধারে-কাছেও ঘেঁষতে পারে না। এবং সত্যিকার খোদাপরস্ত ব্যক্তিবর্গ জনগণের ওপর যে নৈতিক প্রভাব বিস্তার করে, পেটপূজারী কখনো তা করতে সক্ষম হয় না।

(৩) কোনো কোনো স্থানের রিপোর্ট থেকে একথা জানতে পেরে অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছি যে, যখন আমাদের কর্মীরা মজুর শ্রেণীর মধ্যে কম্যুনিস্ট কর্মীদের ছড়ানো বিষ নষ্ট করার চেষ্টা করে, তখন সেখানকার মুসলমানরা এর জবাবে বলে যে, আলেম সমাজ এ সকল কম্যুনিস্ট কর্মীদের সাথে সহযোগিতা করছেন এবং আমাদেরকে এ নিশ্চয়তা প্রদান করছেন যে, কুম্যুনিজম আমাদের ধর্মের কোনো ক্ষতি করবে না। কাজেই আপনারা আমাদেরকে তয় দেখাচ্ছেন কেন? আপনারা কেমন করে বলছেন কম্যুনিজম আমাদেরকে নাস্তিকতার দিকে অগ্রসর করবে এবং কম্যুনিজম ইসলাম বিরোধী?

আসলে ইতিপূর্বে তুর্কীস্তানের ওলামায়ে কেরাম যে ধরনের ভুল করেছিলেন এবং তার ভয়াবহ পরিণতিও প্রত্যক্ষ করেছিলেন, আমাদের হিন্দুস্তানের কতিপয় আলেমও অনুরূপ ভুল করছেন। রুশীয় তুর্কীস্তানের কম্যুনিস্ট বিপ্লব কোনো অতি প্রাচীন যুগের কথা নয়। মাত্র বিশ-পঁচিশ বছর আগে এ বিপ্লব সাধিত হয়েছে। দুনিয়াবাসী সেখানে এ বিপ্লবের ভয়াবহ পরিণতি প্রত্যক্ষ করেছে। যে দেশটি দীর্ঘ হাজার-বার শো বছর থেকে ইসলামের শক্তিশালী দুর্গ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, যেখানে হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রের বড় বড় ইমাম ও সুফী সিলসিলার (চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া) বড় বড় নেতা জন্মগ্রহণ করেছেন, সেখানে ইসলাম আজ নাম মাত্রও অবশিষ্ট নেই। মসজিদ ও খানকাহসমূহ ক্লাব, নৃত্যাগার ও নাস্তিক্যের শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সাবেক মুসলমানদের বংশে দক্ষ নাস্তিক কম্যুনিস্ট জন্মগ্রহণ করছে। তাদের মতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিছক পুঁজিপতিদের একজন এজেন্ট ছিলেন এবং তিনি নিজের সমকালীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধর্মীয় ও নৈতিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে ওহী ও রিসালাতের মিথ্যা কাহিনী রচনা করেছিলেন। কুম্যুনিজম এমন এক দেশে এই বিরাট সাফল্য লাভ করেছে, যেখানে আজ থেকে পঁচিশ বছর পূর্বে [টিকা: উল্লেখযোগ্য যে ১৯৪৫ সালে মওলানা মওদূদী (র) এ মন্তব্য করেন।] পর্যন্ত প্রাচীন যুগীয় ধার্মিকতা হিন্দুস্তানের চাইতে অনেক গভীরভাবে জনজীবনে বিদ্যমান ছিল এবং ইসলামের প্রতি জনগণের ভক্তি এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে, পঁচিশ বছরের মধ্যে এদেশে ইসলামের নাম উচ্চারণকারী একটি ব্যক্তিরও অস্তিত্ব থাকবে না, একথা তখন কোনো ব্যক্তি চিন্তাও করতে পারতো না। কিন্তু আপনারা জানেন কি কম্যুনিস্ট প্রচারকরা এ বিপুল সাফল্য কিভাবে অর্জন করেছে? এর একটি মাত্র উপায় ছিল। কম্যুনিস্ট প্রচারকরা সাফল্যের মূর্তিমান প্রতীক ও দুর্দশাগ্রস্ত মানবতার সহায়ক সেজে ওলামায়ে কেরামের নিকট হাযির হয় এবং সর্ব প্রথম তাদের আস্থাভাজন হয়। তুর্কীস্তানের নব্য শিক্ষিত নির্ভুল আকীদা-বিশ্বাসের অধিকারী যে গুটিকয় মুসলমান ছিল, তারা ওলামায়ে কেরামকে অবহিত করার চেষ্টা করে যে, এই কম্যুনিস্ট আন্দোলন আসলে ইসলাম বিরোধী। কিন্তু আলেমগণ ‘বিসমিল্লাহর’ মিনারে বসে ছিলেন এবং আধুনিক আন্দোলনগুলো সম্পর্কে তারা সরাসরি কিছুই জানতেন না, উপরন্ত তাঁরা এই নতুন আলোকপ্রাপ্ত মুসলমানদের প্রতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিলেন। কারণ এরা শারহে জামী ও মুতাউওয়ালের ন্যায় কিতাবসমূহকে পাঠ্য তালিকা বহির্ভূত করে নতুন পাঠ্য তালিকা প্রস্তুত করতে চাচ্ছিল তাই তাঁরা শারহে জামী বাতিলকারী মুসলমানদের কথা মেনে নেয়ার পরিবর্তে কুরআনকে বাতিল করার জন্যে যে সকল নাস্তিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল, তাদের প্রতি নিজেদের পূর্ণ নৈতিক সমর্থন দান করেন। অতঃপর যখন আলেমদের মাধ্যমে কম্যুনিস্টরা তুর্কীস্তানী জনগণের আস্থাভাজন হয়ে গেল, তখন দেখতে দেখতে তারা জনসাধারণকে হাতের মুঠোয় নিয়ে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করলো। অতঃপর তারা সর্বপ্রথম যে দলটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করলো সেটি হচ্ছে এই আলেম ও মাশায়েখদের দল। অথচ এদের আস্থার ভিত্তিতেই তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। কম্যুনিস্ট বিপ্লব পূর্ণতা লাভের পর তুর্কীস্তানের সর্বত্র যেভাবে ওলামা ও সুফীগণকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হলো এবং ধর্মপ্রাণ শ্রেণীকে যে ভীষণ অত্যচারে জর্জরিত করে ধ্বংস করা হলো, তার কাহিনী এতই মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক যে, চেংগীজী জুলুমের ইতিহাসও তার সম্মুখে ম্লান হয়ে পড়ে। এ সবকিছুমাত্র এই বিশ-পঁচিশ বছরের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে এবং এমন একটি ভূ-খন্ডে সংঘটিত হয়েছে যেটি হিন্দুস্তানের সীমান্ত থেকে মাত্র পাঁচ-সাতশো মাইলের মধ্যে অবস্থিত। কিন্তু আমাদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এর কোনো খবরই রাখেন না। এবং তাঁরা হিন্দুস্তানে আজ সমরকন্দ ও বুখারার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করার প্রস্তুতি চালাচ্ছেন। তাদের বড় বড় সভা-সম্মেলনে কম্যুনিস্ট ও কম্যুনিজম প্রভাবিত নেতৃবৃন্দকে সম্বর্ধনা ভাষণ পাঠ করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। তাঁদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ কম্যুনিস্ট কর্মীদের সাথে জনগণের মধ্যে কাজ করার জন্যে ঘুরে বেড়ান। বড় বড় প্রসিদ্ধ আলেমদেরকে বলতে শুনা গেছে যে, ইসলাম ও কম্যুনিজমের মধ্যে পার্থক্য শুধু এতটুকুন যে, একটিতে খোদা আছে এবং অন্যটিতে নেই, নয়তো কম্যুনিস্ট ব্যবস্থা ইসলামী জীবন ব্যবস্থারই একটি আধুনিক সংস্করণ। আল্লাহ না করুন, এ অজ্ঞতার যে পরিণতি তুর্কীস্তানে দেখা গেছে, হিন্দুস্তানেও যেন তার পুনরাবৃত্তি না হয়। হিন্দুস্তানে এদের ভ্রান্তির পরিণাম থেকে রেহাই পেলেও আল্লাহর কাছে এরা নিজদের দায়িত্ব থেকে কোনোক্রমেই নিষ্কৃতি পাবেন না।

(৪) যে সকল আলেম আমার ‘ইসলাম পরিচিতি’ পুস্তকের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছেন, আমি ব্যক্তিগতভাবেও তাঁদের নিকট ঋণী। তাঁদের নিকট আমার এ গুজারিশ পৌছিয়ে দিন যে, ফতোয়া লিখে তা ফেতনাবাজদের হাতে তুলে দেয়ার পরিবর্তে তাঁরা যেন মেহেরবানী করে আমার কিতাবসমূহের তত্ত্বগত সমালোচনা করেন। আমার কোনো ভুলকে ভুল বলে স্বীকার করার ব্যাপারে আমি আগেও কখনো ইতস্তত করিনি এবং আজো ইতস্তত করবো না। তবে আমি পূর্বেও একথা বলেছি এবং আজও তার পুনরাবৃত্তি করছি যে, ভুলটিকে নির্দেশিত করা হোক, যাতে করে তার সংশোধন করা সম্ভবপর হয়। অস্পষ্ট আপত্তি থেকে একথা জানা অত্যন্ত কঠিন যে, আসলে আপত্তি কোন বস্তুটি সম্পর্কে।

অতঃপর এ অধিবেশন সমাপ্ত হয় এবং মাগরিবের নামাজের পর পঞ্চম অধিবেশন শুরু হয়। আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত বিশ্রামের জন্যে নির্ধারিত হয়।

পঞ্চম অধিবেশন

(মাগরিবের নামাযের পর)

সর্বপ্রথম ঘোষণা করা হলো যে, এশার নামাযের পর মজলিসে শূরার অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে এবং এই সঙ্গে শূরার সদস্যবৃন্দের নামও ঘোষণা করা হলো। অতঃপর আলীগড়, শাজাহানপুর, বেনারস, সিংগাহী, লাক্ষ্ণৌ, মীরাট ও বারাবাংকীর রিপোর্ট পেশ করা হলো। শাজাহানপুরের স্থানীয় আমীর তাঁর রিপোর্ট পেশ করার সময় একথাও ঘোষণা করলেন যে, তাঁর এলাকার জনৈক কর্মী তার ধন-প্রাণ ও প্রত্যেকটি বন্ধু জামায়াতের হাতে সোপর্দ করেছেন এবং আমীরে জামায়াত তাকে যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করার অধিকার রাখেন।

এই রিপোর্টসমূহ সম্পর্কে মন্তব্য প্রসংগে আমীরে জামায়াত বলেন:

আমীরে জামায়াতের মন্তব্য

(১) শাজাহানপুরের কর্মী যা পেশ করেছেন, তা অবশ্যি অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। আমি কাউকে নিরুৎসাহিত করতে বা এমন উত্তম কার্য থেকে বিরত রাখতে চাই না। বরং দোয়া করি, আল্লাহ তাআলা যেন তাঁর এই উৎসর্গকে গ্রহণ করেন এবং তাঁকে এর ওপর অটল রাখেন। কিন্তু আমি চাই, তিনি এই সম্মেলন থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তন করার পর নিজের সমগ্র অবস্থা পর্যালোচনা করে দু’তিন মাসের মধ্যে পুনর্বার স্থির মস্তিষ্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। অতঃপর যদি তাঁর সংকল্পের কোনো পরিবর্তন না হয় তাহলে তিনি লিখে জানাবেন। তাঁর কি করা উচিত, তা তখনই আমি জানাবো। একথা আমি এ জন্যে বলছি যে, অনেক সময় মানুষ বিশেষ অবস্থার প্রভাবে সাময়িকভাবে নিজের হিম্মত ও সহ্যশক্তির যথাযথ পরিমাপ না করেই একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং পরে বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন হলে তার পক্ষে নিজের সিদ্ধান্তের ওপর অবিচল থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

(২) এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, অনেক লোক আপত্তি করে যে, মানুষ নিজে প্রথমে উচ্চমানের মুসলমানে পরিণত হয়ে তারপর অন্যের সংশোধনের প্রতি দৃষ্টি দেয়া উচিত। এটি একটি বিরাট ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়। শরীয়তে এ চিন্তার কোনো ভিত্তি নেই এবং বুদ্ধিও এর সমর্থক নয়। কুরআন ও হাদীস থেকেও আমরা জানতে পারি যে, নিজে সৎ হওয়া ও অন্যকে সৎবৃত্তির দিকে আহ্বান করার কাজ এক সঙ্গে চলা উচিত। এবং বুদ্ধিও প্রত্যাশা করে যে, যখনই মানুষের ওপর সত্য প্রকাশিত হবে, তখন থেকেই সে নিজে সত্যসেবী হবার চেষ্টা করবে এবং অন্যকেও সত্যের দিকে আহ্বান করবে। বলা বাহুল্য, যখন আপনার সঙ্গে আরো বহু লোক একটি গৃহে বাস করে এবং আপনি জানতে পারেন যে, ঐ গৃহে আগুন লেগেছে, তখন কেবল এটিই আপনার কর্তব্য হবে না যে, আপনি একাই ঐ গৃহ থেকে বের হবার চেষ্টা করবেন, বরং এই সঙ্গে অন্য ভাইদেরকেও ঐ আগুন সম্পর্কে অবহিত করা এবং তাদেরকে গৃহ থেকে বের করার জন্যে পূর্ণ প্রচেষ্টা চালানোও আপনার কর্তব্য বিবেচিত হবে। যারা প্রথমে নিজেরা উন্নতমানের মুসলমানে পরিণত হবার শর্ত আরোপ করে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, তাদের দৃষ্টিতে কি এমন কোনো সীমা আছে, যেখানে পৌঁছে মানুষ নিজের সম্পর্কে এ মত পোষণ করতে পারে যে, এবার তারা উন্নতমানের মুসলমানে পরিণত হয়েছে। সম্ভবত একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, যখনই আপনার মধ্যে নিজের সম্পর্কে এ ভুল ধারণা সৃষ্টি হবে যে, আপনি কামেল হয়ে গেছেন, তখন থেকেই আপনার মধ্যে গলদ শুরু হয়ে যাবে এবং অন্যকে কামেলে পরিণত করার জন্যে এ সময়টিই সবচাইতে অনুপযোগী বিবেচিত হবে।

(৩) রিপোর্ট সম্পর্কে আর একটি কথা আমার নিকট শ্রুতিকটু ঠেকেছে। রিপোর্টের যেখানে-সেখানে অপ্রয়োজনীয় নম্রতার আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। নিজেদের কার্যাবলী ও তৎপরতাকে বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বিরাট আকারে পেশ করা যেমন ঠিক নয়, তেমনি সেগুলিকে অযথা সংকুচিত করে তুচ্ছভাবে পেশ করাও ঠিক নয়। যা কিছু হয়েছে ও হচ্ছে কোনো প্রকার কম-বেশী না করে তা হুবহু বিবৃত করা উচিত। নিজের ও অন্যের পর্যালোচনা করার ব্যাপারে কখনো কখনো কম-বেশী না করা উচিত যাতে আপনাদের কার্যাবলী, আপনাদের রুকন, সমর্থক ও এলাকার অন্যান্য ব্যক্তিবর্গেরও অবস্থার হুবহু চিত্র প্রতিভাত হবে।

আমীরে জামায়াতের মন্তব্যের পর অধিবেশন সমাপ্ত হয় এবং এশার আযান দেয়া হয়।

মজলিসে শূরার অধিবেশন
(এশার নামাযের পর)

এশার নামায ও আহার শেষে আমীরে জামায়াতের অফিসে মজলিসে শূরার অধিবেশন শুরু হয়। উক্ত অধিবেশনে নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন।

১. আমীর জামায়াত মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী।
২. মওলানা আমীন আহসান ইসলাহী।
৩. মওলানা মাসউদ আলম নদভী।
৪. মওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল, মাদ্রাজী।
৫. গাযী মুহাম্মদ আবদুল জাব্বার, দিল্লী।
৬. মওলবী হাকিম মুহাম্মদ আবদুল্লাহ রোড়ী।
৭. মালিক নসরুল্লাহ খান আযীয (কাওসার সম্পাদক, লাহোর)।
৮. মওলানা নাযীরুল হক মীরাটী।
৯. মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদ (জামায়াতের প্রধান সম্পাদক)
১০. সাইয়েদ মুহাম্মদ হাসানাইন (বিহার প্রাদেশিক জামায়াতের প্রধান সম্পাদক)
১১. কাযী হামিদুলাহ, শিয়ালকোট।
১২. চৌধুরী মুহাম্মদ আকবর, শিয়ালকোট।
১৩. মওলবী মুহাম্মদ ইউনুছ হায়দারাবাদ (দাক্ষিণাত্য)
১৪. সাইয়েদ আবদুল আযীয শারকী।
১৫. হাকীম মুহাম্মদ খালেদ, এলাহাবাদ।
১৬. জে, মুহাম্মদ বশীর, বোম্বাই।

এ অধিবেশনে কেন্দ্রে গৃহ নির্মাণ ও শিক্ষা পরিকল্পনা সম্পর্কিত সমস্যাবলী আলোচিত হয়। সমগ্র পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বর্তমান অবস্থা প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করার উপযোগী নয়। কাজেই আপাতত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার কাজ শুরু করার ব্যাপারে পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করা উচিত। আর এই সংগে প্রাথমিক শিক্ষার পরিকল্পনাকে কার্যকরী করার জন্যেও প্রচেষ্টা চালানো উচিত।

ষষ্ঠ অধিবেশন

১৩৬৪ সালের ৮ই জমাদিউল আউয়াল তারিখে (১৯৪৫ সালের ২১শে এপ্রিল) শনিবার সকাল ৮টায় নির্ধারিত কার্যসূচী অনুযায়ী মসজিদে এ অধিবেশন শুরু হয়। এ অধিবেশনে শিয়ালকোট, সীমান্ত প্রদেশ, গুজরানওয়ালা, লালমুসা গুজরাট, লাহোর, লাহোর জেলা, অমৃতসর, ফিরোজপুর শহর ও সেনানিবাস, রাহু, ফুল্লোর, জাজাহ, হুশিয়ারপুর, লুধিয়ানা, কাপুরথলা, কিথাল (কর্ণাল) হেসার, শাহপুর জেলা ও লায়ালপুর জেলার রিপোর্ট পেশ করা হয়। আরো কতিপয় এলাকার রিপোর্ট তখনো পর্যন্ত পেশ করা না হলেও সময় স্বল্পতার দরুণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, অবশিষ্ট রিপোর্টসমূহ সাধারণ সভায় পেশ করা হবে না বরং সম্মেলনের পর আমীরে জামায়াতের সম্মুখে পেশ করা হবে।

এ রিপোর্টসমূহের ওপর মন্তব্য প্রসংগে আমীরে জামায়াত বলেন:

আমীরে জামায়াতের মন্তব্য

অনেক সময় মানুষ যাকে খারাপ মনে করে খোদার পক্ষ থেকে তার মধ্যে ভালোর অনেক দিকও প্রতিভাত হয়। আমি দুঃখ করছিলাম যে, সময়-স্বল্পতা ও অসুস্থতার দরুন সম্মেলনের পূর্বে আমি রিপোর্টগুলি পাঠ করার সুযোগ পাইনি। রিপোর্টগুলি পাঠ করার সুযোগ পেলে আমি এ গুলির বিভিন্ন স্থানে দাগিয়ে দিতাম এবং দাগানো বাক্যগুলি সম্মেলনে পাঠ না করার নির্দেশ দিতাম। কিন্তু এখন আমি অনুভব করছি যে, এ সুযোগ লাভ না করার ফলে বরং ভালোই হয়েছে। গত দু’দিনে এখানে যে সকল রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে, তার ফলে জামায়াত ও রুকনগণের অবস্থা হুবহু আপনাদের সম্মুখে প্রকাশিত হয়েছে। ভালো-মন্দ সকল দিকের পর্দা অপসারিত হয়েছে। আমাদের কর্মীদের মেজাজ, চিন্তাধারা ও নৈতিক অবস্থার হুবহু চিত্র সম্মুখে উপস্থাপিত হয়েছে। এখন এ সম্পর্কে আমি যে মন্তব্য করবো এবং আমার পর মওলানা আমীন আহসান ইসলাহী যে বক্তৃতা করবেন, তার মাধ্যমে আমি আশা করি রুকনগণ তাঁদের দুর্বলতাসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন এবং সেগুলি দূর করার চেষ্টা করবেন।

(১) আজ আমার নিকট বহু অভিযোগ এসেছে যে, বিভিন্ন স্থানের রিপোর্টে ওলামা ও অন্যান্য দল ও পার্টির সমালোচনার ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছে। এ অভিযোগ অনেকটা সত্য। মতবৈষম্য ও বিরোধের কারণে মনে বিরক্তির উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আসলে এটি একটি দুর্বলতা। যারা কোনো উন্নত নৈতিক আদর্শের জন্যে কাজ করে যান, তাদের নিজেদের মধ্য থেকে অবশ্যি এ দূর্বলতাটি দূর করা উচিত। আমি একথা বলি না যে, সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে যারা এই ভালো ও ন্যায়ের দাওয়াতের পথে বাধা দিচ্ছে, তাদেরকে আপনারা উৎসাহ দিন বা তাদের এ কাজটিকে খারাপ মনে করবেন না। তাদের ভুলকে ভুল বলতে আমি নিজে বিরত হইনা এবং আপনাদেরকেও বিরত রাখতে চাই না। যথার্থ পরিস্থিতি উপলব্ধি করার জন্যে প্রয়োজনীয় ঘটনাবলীর বর্ণনা থেকেও আমি কাউকে বিরত রাখার পক্ষপাতী নই। যেখানে কোন দলের ভ্রান্ত কার্যাবলীর সমালোচনা করার যথার্থ প্রয়োজন দেখা দেয়, সেখানে মুখ বন্ধ করে রাখার পরামর্শও আমি দেই না। কিন্তু যে বিষয়টি থেকে আমি আপনাদেরকে বিরত রাখতে চাই তা হচ্ছে কেবল এই যে, এই ধরনের বিরোধিতার ফলে আপনাদের মেজাজে ক্রোধ ও ভাষায় কর্কশভাব লক্ষ্য করা যায় এবং তার জবাবে অন্য পক্ষ থেকে কথা আরো বেড়ে যায়। এ বস্তুগুলিই হচ্ছে যাবতীয় ফিতনার মূল। এ ছাড়াও আমাদের রুকনগণকে এদিকেও দৃষ্টি রাখা উচিত যে, আমাদের জামায়াতে যারা শামিল হয়েছেন, তারা বিভিন্ন দল থেকে বিচ্যুত হয়ে এসেছেন এবং এখনো পর্যন্ত পূর্ববর্তী দলসমূহ ও সেগুলির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রতি তাদের কিছু না কিছু শ্রদ্ধা ও আগ্রহ রয়ে গেছে। এ অবস্থায় এক দলের লোকেরা যদি অন্য দলের লোকদের সম্পর্কে কোনো তিক্ত মন্তব্য করে, তাহলে এর ফলে ঐ সংশ্লিষ্ট দলটির উপর কোনো ভালো প্রভাব পড়বে না, বরং এই সংগে ঐদল থেকে বিচ্যুত হয়ে যে সকল লোক আমাদের জামায়াতে প্রবেশ করেছে, তাদের মনেও অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। আপনাদের সম্মুখে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) আমলের দৃষ্টান্ত উপস্থিত। ইসলাম গ্রহণ করার কিছুকাল পর পর্যন্তও আনসারদের মধ্যে ‘আউস’ ও ‘খাযরাজ’দের পুরাতন শত্রুতার চিহ্ন পরিস্ফুট ছিল এবং ইহুদী ফেতনাবাজরা ঐ সকল শত্রুতার স্মৃতি জাগরুক করে ফেতনা সৃষ্টিতে তৎপর হতো। ঐ সকল ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আপনাদের সমালোচনা ও অভিযোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, যাতে করে দলীয় বিদ্বেষ আপনাদের নিজেদের দলের মধ্যে প্রবেশ করে ফেতনা সৃষ্টি করতে সক্ষম না হয়।

এই সংগে বিভিন্ন দল ও ব্যক্তির প্রতি যারা শ্রদ্ধা পোষণ করেন এবং এ জন্যে তাদের প্রতি সমালোচনার তীব্রতার অনুযোগ করেন, তাঁদের প্রতি আমার সুপারিশ হচ্ছে এই যে, যখন আপনারা এই জামায়াতের মধ্যে প্রবেশ করেছেন, তখন নিজের মধ্যে ন্যায়নিষ্ঠতার গুণাবলী সৃষ্টি করুন এবং সত্যের প্রতি সর্বাধিক শ্রদ্ধা পোষণ করুন।

আপনারা অভিযোগ করেছেন, এখানে কতিপয় মহান ব্যক্তির ভ্রান্তির কথা উল্লেখ করার পর লোকেরা হেসে ফেলেছে। নিঃসন্দেহে এ হাসি ভালো নয়। অবশ্যি আমাদের প্রত্যকে ব্যক্তিকে কমপক্ষে ততটুকু মর্যাদা দান করা উচিত, যতটুকু আমরা নিজেদের জন্যে প্রত্যশা করি। কিন্তু আপনারা চিন্তা করুন, যারা যথার্থই হাসির যোগ্য কাজ করেন, তাদের এই কাজের ওপর কতদিন পর্যন্ত দুনিয়াকে হাসি থেকে বিরত রাখা যেতে পারে? আমি হাসি বা না হাসি কিন্তু হাসির যোগ্য কাজ করার পর কোনো ব্যক্তির ওপর লোকেরা হাসবে না এমনটি হতে পারে না। নিজের মর্যাদাকে তিনি নিজেই যেখানে ক্ষতিগ্রস্থ করেছেন, সেখানে আপনার ভক্তি-শ্রদ্ধা তাকে কোনক্রমেই রক্ষা করতে পারে না। অনুরূপভাবে আপনারা অভিযোগ করেছেন যে, অনেক ব্যক্তি ও দলের সমালোচনার ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছে। এ কঠোরতা আমিও পছন্দ করি না। কিন্তু এই সঙ্গে আপনাদেরও চিন্তা করা উচিত যে, যে সকল বিষয়ের অভিযোগ করা হয়েছে, সেগুলি কি যথার্থ নয়? আর যদি এগুলি যথার্থ হয়ে থাকে, তাহলে যারা এই হকের পথে বাধা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন, তাদের এ কার্যাবলী কি সমর্থনযোগ্য? আর যদি সমর্থনযোগ্য না হয়ে থাকে, তাহলে দুনিয়ায় তাদের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যে আপনারা যতটুকু চেষ্টা করে থাকেন, তাদের এই দৃষ্টিভংগীর পরিবর্তনের জন্যে কমপক্ষে তার অর্ধেক চেষ্টা করুন। যেখানে একদিকে হক এবং অপরদিকে মহান ব্যক্তিবর্গের অবতারণা হয়, সেখানে যদি আপনার মন ব্যক্তির দিকে অধিক আকৃষ্ট হয়, তাহলে এটি এমন একটি ভয়াবহ অবস্থা, যার ফলে আপনার হকপরস্তি ক্ষুণ্ণ হবার আশংকা আছে। একজন সাচ্চা মুসলমানকে যে বস্তুটির জন্যে সর্বাধিক চিন্তা করা উচিত সেটি হচ্ছে এই যে, তার মধ্যে হকপ্রীতি আর সকল প্রীতির ওপর আধিপত্যশালী হবে এবং তার দিলে যে কোনো সময় হতপ্রীতির মুকাবিলায় দাঁড়াতে পারে এমন কোনো শ্রদ্ধা-প্রীতির অস্তিত্ব থাকবে না। এই হকের দাওয়াত সম্পর্কে আমি পূর্ণ বিশ্বাস রাখি যে, কারুর বিরোধিতা একে বিন্দুমাত্রও দমাতে পারবে না। বরং যে এর ক্ষতি সাধনে তৎপর হবে, সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই আমি যা কিছু বলছি, তা এজন্যে বলছি না যে, কোনো মহান ব্যক্তির বিরোধিতার কারণে একাজ ধ্বংস হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে, বরং আমার উদ্দেশ্য কেবল এতটুকু যে, কোন ব্যক্তি হকের বিরোধিতা করা সত্ত্বেও তার সংগে আপনারা যে ভক্তি ও প্রীতির সম্পর্ক রক্ষা করছেন এহেন ভক্তি ও প্রীতির বিষবাষ্প থেকে আপনাদের হকপরস্তিকে রক্ষা করার চিন্তা করুন। অন্যদিকে যাদের সংগে আপনারা ভক্তি ও প্রীতির সম্পর্ক রাখেন, তাদেরকে সৎ ও ন্যায়ের পথে বাধা সৃষ্টি করার ভয়াবহ পরিণাম থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার পরামর্শ দিন।

(২) এই মাত্র আমি যে বিষয়টির দিকে ইংগিত করলাম। একটি অদ্ভুত অভিযোগের আকারে তারই একটি মর্মান্তিক প্রমান এখনই আমার নিকট পৌঁচেছে। আপনাদের স্মরণ থাকবে গতকাল কম্যুনিস্টদের সঙ্গে কতিপয় আলেমের সহযোগিতার ওপর আমি আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করে রুশীয় তুর্কীস্তানে কম্যুনিস্ট প্রচারকদের সাথে আলেম সমাজের সহযোগীতার কারণে কেবল আলেম সমাজই নয়, বরং ইসলামও যে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হয়েছিল, তার উল্লেখ করেছিলাম। আজ আমার সেই বক্তৃতার বরাত দিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে যে, একদিকে আপনি আলেমদের কঠোর সমালোচনা করা থেকে মানুষকে বিরত রাখেন, আবার অন্যদিকে আপনি নিজেই অনুরূপ সমালোচনা করেন। এ ধরনের কথা থেকে আমার মনে হয় আপনাদের মধ্যে অনেকে সত্যপ্রীতির তুলনায় ব্যক্তিপ্রীতির মধ্যে অধিকতর নিমজ্জিত হয়ে আছেন। আমি আপনাদেরকে প্রমাণিত ঘটনা শুনাচ্ছি যে, কম্যুনিস্ট কর্মীদের সংগে রুশীয় তুর্কীস্তানের আলেম সমাজ প্রথমে যে সহযোগিতা করেছিলেন, তার ফলে তাঁরা কি ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং এর ফলে বার শো’ বছর অবধি যে দেশটি ইসলামের কেন্দ্রভূমির মর্যাদা লাভ করেছিল, সেখান থেকে কিভাবে ইসলামকে সমূলে উৎখাত করা হয়েছিল। এই সংগে আমি আপনাদের সম্মুখে এ ঘটনাবলীও পেশ করছি যে, হিন্দুস্তানের কতিপয় দায়িত্বশীল আলেম কিভাবে এ ভুলের পুনরাবৃত্তি করছেন। আপনারা আমার একথা দু’টির একটিরও প্রতিবাদ করছেন না এবং করতে পারেনও না, কিন্তু তবুও নিজেদের অজ্ঞতার দরুন যারা ইসলামকে এ বিপদের সম্মুখীন করছে, তাদের বিরুদ্ধে আপনারা কোনো অভিযোগ করছেন না, বরং যে ব্যক্তি তাদেরকে এই অজ্ঞতা সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে চায়, তার বিরুদ্ধে অভিয়োগ আনছেন। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আপনাদের ভক্তি ও প্রীতির প্রতিমূর্তিগুলোর গায়ে একটু আঁচড় লাগলেও আপনারা যতটুক কষ্ট অনুভব করেন ইসলামের মূলে কুঠারাঘাত করা হলেও ততটুকু কষ্ট আপনরা অনুভব করেন না। “ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন।”

আপনারা যদি সত্যি এমন অবস্থায় পৌঁছে গিয়ে থাকেন, তাহলে আপনাদেরকে আমাদের এ জামায়াতে শামিল হবার পরামর্শ দিল কে? এ জামায়াত এই নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সকল প্রকার শ্রদ্ধা-প্রীতির মূলোৎপাটন করে একমাত্র খোদা, রাসূল ও তাঁর দ্বীনের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রীতিকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। আর এরপর যদি কোনো শ্রদ্ধাপ্রীতি থাকে, তাহলে তাকে ঐ আসল ও সত্যিকার শ্রদ্ধা-প্রীতির প্রতিযোগী নয় বরং তার অনুগত হতে হবে। কিন্তু ঐ আসল ও সত্যিকার শ্রদ্ধা-প্রীতির প্রতিযোগী হতে পারে এমন কোনো শ্রদ্ধা-প্রীতির মধ্যে যদি আপনারা এখনো নিমজ্জিত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাদের স্থান আমাদের জামায়াতের মধ্যে নয়, বরং তার বাইরে।
(৩) আপনাদের রিপোর্ট কদাচিৎ বয়স্ক শিক্ষার উল্লেখ দেখলাম। আমি বুঝতে পারছি না, এর গুরুত্ব আমি আপনাদেরকে কিভাবে অনুধাবন করাবো। প্রথমতঃ আমার নিকট কোনো ক্ষমতা নেই আর যদি ক্ষমতা থাকেও, তাহলে এটি কারুর দ্বারা ক্ষমতা- বলে করিয়ে নেবার কাজ নয়। এটি হচ্ছে একটি স্বেচ্ছাসেবা। আপনি নিজেই যখন এর পূর্ণ গুরুত্ব অনুভব করবেন এবং নিজের আন্তরিক প্রেরণা সহকারে এ কাজ সম্পাদনের চেষ্টা করবেন, একমাত্র তখনই এটি সম্পাদিত হতে পারে। এর ফলে যে উপকার সাধিত হবে, সে সম্পর্কে আমি ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আপনাদের মধ্যে যারা শিক্ষিত আছেন তাদের এখন থেকে এভাবে চিন্তা করা উচিত যে, তারা নিজেদের কতটুকু সময় এবং নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তি ও দৈহিক শক্তির কতটুকু অংশ নিজেদের দৈহিক ও আত্মিক গঠনে নিয়োজিত করেছেন এবং কতটুকু অংশ খোদার কাজে সমর্পণ করেছেন। এর যথাযথ হিসাব লাগালে আপনারা দেখতে পাবেন যে, খোদার কাজে আপনারা সবচাইতে কম অংশ সমর্পণ করেছেন অথচ আপনাদের আকীদা হচ্ছে এই যে, সবকিছু খোদার জন্যে। অতঃপর যদি সত্যিই আপনারা চিন্তা করেন যে, খোদার হকও কিছু আদায় করা উচিত, তাহলে কমপক্ষে তার যে সকল বান্দা গাফলতি, মুর্খতা ও নৈতিক অধঃপতনের মধ্যে নিমজ্জিত, তাদের সংশোধনের জন্যে আপনি নিজের সময়ের একটি অংশ স্থায়ীভাবে ব্যয় করুন।

(৪) অনেকে বলেছেন, আমাদের আদর্শ ও কর্মপদ্ধতি উপলব্ধি করা জনগণের পক্ষে কঠিন, একথা যথার্থ নয়। আপনারা জানেন, সর্বপ্রথম আরবের মরুচারী বেদুইন ও অশিক্ষিত লোকেরাই এ দ্বীনকে বুঝেছিল। তাদের কোনো পুঁথিগত বিদ্যা ছিল না। তারা কেবল এ দ্বীনকে উপলব্ধিই করেনি, বরং এর গভীরে প্রবেশ করেছিল এবং তাদের নিকট থেকে যারা এ দ্বীনের শিক্ষা গ্রহণ করেছে, তারা দুনিয়ার শিক্ষকে পরিণত হয়েছে। তাহলে আপনারা আজ কেমন করে এ সন্দেহ পোষণ করেন যে, হিন্দুস্তানের কৃষক-মজুর-সাধারণ মানুষ একে বুঝতে সক্ষম হবে না? এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই যে, যারা পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করেন, তাদের মস্তিষ্কে অবশ্যি এমন প্যাঁচ পড়ে যায়, যার ফলে দ্বীনের সহজ কথাগুলোও তাদের মধ্যে প্রবেশ করানো যথেষ্ট কঠিন হয়। এজন্যে তাদেরকে বুঝাবার জন্যে আমদের লম্বা-চওড়া তাত্ত্বিক আলোচনা প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের মস্তিষ্ক বহুলাংশে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকায় তারা অতি সহজে এ দ্বীনকে বুঝতে সক্ষম হয়। তবে এখানে শর্ত হচ্ছে এই যে, যারা এ দ্বীনকে বুঝাবার জন্যে অগ্রসর হন, তাদের সাধারণ ও সহজবোধ্য প্রকাশভংগী অবলম্বন করতে হবে এবং তাদের নিজেদের জীবনক্ষেত্রও এমন হতে হবে, যা থেকে একথা প্রমাণ হয় যে, তারা যে সকল কথা বলছেন তারা নিজেরা তার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখেন। আপনাদের কথা বুঝা যদি জনগণের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়, তাহলে তার দু’টি মাত্র কারণ থাকতে পারে। এক. আপনারা যদি তাদের সম্মুখে এমনভাবে কথা বলেন, যেমন আরবী মাদ্রাসা বা কলেজের ছাত্রদের সম্মুখে বলে থাকেন। দুই. যদি আপনারা বলেন এক কথা আর করেন তার বিপরীত। আপনাদের তাবলীগ যদি এ দু’টি দোষমুক্ত হতে পারে, তাহলে জনগণ অতি সহজে এ দ্বীনকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।

(৫) অনেকে অভিযোগ করেছেন যে, যখন আমরা সাধারণ লোকদের মধ্যে সংস্কার ও তাবলীগের কাজ করতে অগ্রসর হই, তখন কোনো ফেতনাবাজ ব্যক্তি বলে ওঠে, ‘এরা তো ওহাবী’। অতঃপর আর কেউ আমাদের কথা শুনতে রাজী হয় না। এ অভিযোগ যারা করেছেন, তারা সম্ভবত এটিকে নিজেদের পথের বিরাট বাধা মনে করেন। অথচ যদি এই ‘ওহাবী’ শব্দটির ইতিহাস ও প্রচারণার এই অস্ত্রটি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়, তাহলে অতি সহজে এর প্রতিবিধান করা যেতে পারে। আসলে উনবিংশ শতকে কতিপয় রাজনৈতিক কারণে মিসর ও তুরস্কের মুসলিম ও হিন্দুস্তানের অমুসলিম সরকার হিন্দুস্তান ও আরবে যে সকল সংস্কারমূলক আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছিল, সেগুলোকে দমন করার জন্যে এই ‘ওহাবী’ শব্দটি আবিষ্কার করে। প্রচারণার একটি সাফল্যজনক পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, যে দলটিকে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত করতে চান প্রথমে তাকে একটি নাম দিন এবং যে সকল দোষত্রুটিকে তার সাথে সম্পর্কিত করতে চান, সেগুলোর অর্থ ঐ বিশেষ নামটির মধ্যে ভরে দিন। অতঃপর ঐ নামটিকে এত বেশী করে প্রচার করুন, যার ফলে ঐ নামটি উচ্চারণ করার সাথে সাথেই যেন শ্রোতার চোখে তার সাথে সম্পর্কিত সমস্ত দোষত্রুটির চিত্র ভেসে ওঠে। এর ফলে বড় বড় বক্তৃতা ও লেখার প্রয়োজন থাকে না। বরং তার পরিবর্তে কেবল একটি শব্দ উচ্চারণ করলেই যথেষ্ট। বর্তমান যুগে বিভিন্ন দল এ প্রচারণা পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। মোল্লা, টেডী, রক্ষণশীল, বুর্জোয়া ও এ ধরনের আরো বিভিন্ন শব্দ এই উদ্দেশ্যেই আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এগুলোকে বেশ ভালোরূপেই ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ওহাবী’ শব্দটি এ ধরনেই একটি অস্ত্র। প্রথমে কতিপয় স্বার্থান্ধ সরকার রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে এ শব্দটি আবিষ্কার করে। অতঃপর মুসলমানদের যে সকল দল জনগণের মধ্যে কোনো প্রকার দ্বীনি জাগরণকে নিজেদের পার্থিব স্বার্থের পরিপন্থী মনে করে, তারা এটিকে ব্যবহার করতে শুরু করে। এখন এর প্রতিবিধান এভাবে করা সম্ভব নয় যে, আপনারা নিজেদের ওহাবী হবার দোষ খন্ডন করে ফিরবেন এবং যেখানে আপনাদের বিরুদ্ধে এ অস্ত্র ব্যবহার করা হবে, সেখানে পরাজিত হয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবেন। বরং এর একমাত্র প্রতিবিধান হচ্ছে এই যে, আপনারা খাঁটি মুসলমানের জীবন যাপন করুন এবং খোদার বান্দাদেরকে নির্ভেজাল তাওহীদ ও কুরআন-হাদীসের আনুগত্য করার দাওয়াত দিতে থাকুন। উপরন্তু যারা আপনাদেরকে ওহাবী বলে, তাদেরকে এই নামের তসবীহ পাঠ করতে দিন। অবশেষে ফল এই দাঁড়াবে যে, ধীরে ধীরে আপনাদের কর্মপদ্ধতি ও তাদের ওহাবী সম্পর্কিত প্রচারণা মিশ্রিত হয়ে ওহাবী শব্দটির মধ্যে একটি নতুন অর্থ সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ ওহাবী হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে খাঁটি মুসলমানের ন্যায় জীবন যাপন করে, কারুর সাথে ঝগড়া করে না, বিবাদ-বিতর্ক করে না, নিষ্কলুষ চরিত্র ও স্বচ্ছ ব্যবহারিক জীবনের অধিকারী এবং মানুষকে তাওহীদ বিশ্বাস ও কুরআন-সুন্নাহর আনুগত্যের দাওয়াত দেয়। অতঃপর আপনাদের নিকট যা কিছু পাওয়া যায়, যে ব্যক্তি একমাত্র ঐ বস্তুগুলোর সন্ধান করবে আপনাদেরকে ওহাবী খেতাব দান করার পরও সে ঐ বস্তুগুলোর জন্যে আপনাদের নিকট আসতে ইতস্তত করবে না বরং এ খেতাবের বদৌলতে তারা আরো আপনাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং তারা ওহাবীদেরকেই খুঁজে বেড়াবে। তবে যারা ইসলামকে তার প্রকৃতরূপে দেখতে পছন্দ করে না, তারা অবশ্যি আপনাদের নিকট থেকে দূরে পালিয়ে যাবে। কিন্তু এই সব লোকেরা যদি আপনাদের নিকট থেকে দূরে সরে যায়, তাহলে তাতে কোনো প্রকার দুঃখ করা উচিত নয়।

প্রস্তাবাবলী

অতঃপর বিভিন্ন জামায়াত ও সদস্যবর্গের পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রস্তাবসমূহ পেশ করা হয়। আমীরে জামায়াত নিজেই প্রতটি প্রস্তাব পাঠ করে শুনান। অতঃপর সংক্ষেপে সে সম্পর্কে নিজের মত প্রকাশ করেন এবং প্রস্তাবকদেরকেও সুযোগ দান করা হয় যে, আমীরে জামায়াতের জবাব তাদের মতে সন্তোষজনক না হলে প্রস্তাব সম্পর্কে তাঁরা নিজেদের দৃষ্টিভংগী প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করার প্রয়োজনই কেউ অনুভব করেননি। নীচে আমীরে জামায়াতের মতামতসহ সংক্ষেপে প্রতিটি প্রস্তাব পেশ করা হলো।

প্রস্তাব

যথাশীঘ্র পরিকল্পিত শিক্ষায়তনটি প্রতিষ্ঠিত করা উচিত। যুদ্ধাবস্থার দরুন যদি স্থায়ী গৃহনির্মাণ সম্ভব না হয়, তাহলে সাময়িকভাবে গৃহনির্মাণ করেও কাজ শুরু করে দেয়া উচিত।

আমীরে জামায়াতের জবাব

রাত্রে মজলিসে শূরায় এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যেহেতু সাময়িকভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার জন্যে অধিক গৃহের প্রয়োজন নেই এবং বর্তমান গৃহটি সামান্য পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের পর এজন্যে যথেষ্ট হতে পারে, তাই অতি সত্বর এ কাজটি জারি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। আর প্রাথমিক শিক্ষার জন্যে প্রস্তুতি চলতে থাকবে। সাময়িক গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে যে অসুবিধা আছে তা সহজে দূর করা সম্ভব নয়।

প্রস্তাব
শিক্ষিত জামায়াত সদস্যদের জন্যে একটি শিক্ষা শিবিরের ব্যবস্থা করা উচিত।

আমীরে জামায়াত
বর্তমানে আমরা যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি শিক্ষা শিবিরের প্রোগ্রামও তার অন্তর্ভুক্ত।

প্রস্তাব

মসজিদের ইমাম, গ্রাম্য প্রাথমিক মাদ্রাসাসমূহের জন্যে শিক্ষক ও গ্রামে কাজ করার উপযোগী মুবাল্লিগের ব্যবস্থা করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

এ প্রস্তাবে যে প্রয়োজনের দিকে ইংগিত করা হয়েছে আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার দ্বারা তা পূর্ণ হতে পারে। কিন্তু প্রস্তাবটি দেখে মনে হচ্ছে, বিগত কয়েক বছর থেকে মসজিদের ইমামগণের ট্রেনিং, মুবাল্লিগ তৈরী, মাদ্রাসা শিক্ষকগণের ট্রেনিং ও এই ধরনের আরো বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে যে সকল চিন্তা প্রসার লাভকরেছে, তার কিছুটা প্রভাব এর পেছনে সক্রিয়। আমাদের দেশে এমন একদল লোকও আছেন, যারা পরিস্থিতির সংশোধনের প্রয়োজন অনুভব করেন কিন্তু তারা পরিস্থিতির প্রকৃত ত্রুটি অনুধাবন ও তার সংশোধনের জন্যে যথাযথ উপায় অবলম্বন করার উপযোগী গভীর জ্ঞান ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী নন। তারা কতিপয় সস্তা ওষুধ নির্ধারণ করে সেগুলোর প্রচার শুরু করে দেন। অতঃপর কিছুকাল পর্যন্ত এই প্রচারণায় চারিদিক এমনভাবে মুখরিত হয়ে ওঠে এবং মানুষের মন-মস্তিষ্কের ওপর এমন বিপুল প্রভাব বিস্তার করে যে, তারপর যখনই কোথাও কোনো ব্যক্তি পরিস্থিতি সংশোধনের চিন্তা করে সঙ্গে সঙ্গেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মুখে মসজিদের ইমামগণের ট্রেনিং, মুবাল্লিগ তৈরী ও এই ধরনের আরো কতিপয় শব্দ উচ্চারিত হয়। আমার আশংকা হচ্ছে সম্ভবত আপনারাও যুগের এই প্রচারণায় প্রভাবিত হয়েছেন। যদি একথা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আপনাদের মনকে প্রচারণার প্রভাবশূন্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করুন। চিন্তা করুন, মসজিদে ইমাম তৈরি করা হবে কেন? আপনারা কি মনে করেন যোগ্য ইমামের অভাবেই মসজিদসমূহে অযোগ্য ইমামগণ নিয়োজিত হয়েছেন অন্যথায় যদি যোগ্য ইমাম সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে দেশের সমস্ত মসজিদ তাদেরকে লুফে নেবে এবং কিছু দিনের মধ্যে মসজিদসমূহ মুসলিম সমাজের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হবে? সমস্যা যদি এতটুকুই হতো, তাহলে কোনো মাথা ব্যথাই থাকতো না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অযোগ্য ইমামগণ নিজেরাই মসজিদে আসেননি বরং মুসলমানরা তাঁদেরকে এনেছে। মুসলমানরা আসলে এমন ইমাম চায় না, যারা নগরে-গ্রামে সত্যিকার ইমামের দায়িত্ব পালন করে মসজিদসমূহকে ইসলামী জীবনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করতে পারে। তারা নিজেদের বিকৃত রুচি, দ্বীনি অচেতনতা, নৈতিক অবনতি, দুনিয়ার মধ্যে আকণ্ঠ ডুবে থাকা এবং খোদার সাথে মুনাফেকীর কারণে কেবল সেই সকল ইমামকে পছন্দ করে, যারা নগরে-গ্রামে নিম্নশ্রেণীর পেশাদার লোকদের ন্যায় তাদের মসজিদে অবস্থান করবে এবং তাদের প্রদত্ত ভাতরুটি খেয়ে তারা যেভাবে চায় ঠিক সেইভাবে ইমামের অবস্থান করবে এবং তাদের প্রদত্ত ভাতরুটি খেয়ে তারা যেভাবে চায় ঠিক সেইভাবে ইমামের দায়িত্ব পালন করবে। কাজেই সমস্যা এ নয় যে, দেহ (অর্থাৎ মুসলিম সমাজ) জীবিত আছে কিন্তু কোনো দুর্ঘটনায় তার দিল (অর্থাৎ মসজিদ) স্তব্ধ হয়ে গেছে। বরং আসল সমস্যা হচ্ছে এই যে, দেহ নিজেই হিম হয়ে গেছে এবং সে অবশেষে দিলকেও হিমশীতল করে দিয়েছে। এখন এই বিকৃত সমাজ যে ধরনের ইমাম ও খতীব চায়, আপনারা যদি সেই ধরনের ইমাম ও খতীব তৈরি করতে শুরু করেন এবং যেখান থেকে তাদের অর্ডার আসে, সেখানে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করে তাদেরকে পাঠিয়ে দিতে থাকেন, তাহলে এই ধরনের ইমামতির পেশা সম্পর্কে শিক্ষাদান করা ও এজন্যে একদল বিশেষজ্ঞ তৈরি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর যদি আপনারা একটি জীবিত মুসলিম সমাজের উপযোগী সত্যিকার ইমাম তৈরি করতে চান, তাহলে বলা যায় যে, সেই জীবিত সমাজের অস্তিত্বই যখন নেই, তখন তার জন্যে ইমাম তৈরি করা এমন কনের বর সাজানোর সমতুল্য, যার অস্তিত্বের সম্ভাবনা এখনো মাতৃগর্ভেও দেখা দেয়নি। আমাদের শিক্ষায়তনে আমরা যে সকল লোক তৈরি করবো, তাদের আসল কাজ হবে একটি মুসলিম সমাজ তৈরি করা। অতঃপর তাঁদের দাওয়াতের মাধ্যমে ধীরে ধীরে যখন এমন সমাজ গঠিত হতে থাকবে, তখন এই দাওয়াত দানকারীরাই স্বাভাবিকভাবে তার নেতায় (ইমাম) পরিণত হতে থাকবেন এবং যে সকল মসজিদকে তারা নিজেদের স্পন্দমান দিলে পরিণত করবেন, সেগুলোর ইমাম ও সমগ্র লোকালয়ের ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাদেরকেই গণ্য করা হবে।

মাদ্রাসা শিক্ষক তৈরি করার ব্যাপারেও আপনারা একইরূপ বিভ্রান্তির সম্মুখীন হয়েছেন। লোকেরা ইসলামী শিক্ষার প্রত্যাশী এবং কেবল শিক্ষকের অভাব, আসল ব্যাপার এ নয়। বরং আসল সমস্যা হচ্ছে এই যে, লোকদের মধ্যে সত্যিকার ইসলামী শিক্ষার চাহিদাই নেই। তারা যে বস্তুটি চায়, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সেটি সরবরাহ করার জন্যে যদি আপনারা শিক্ষা শ্রমিক তৈরি করতে চান, তাহলে এ কার্য আমাদের দ্বারা সম্পাদিত হওয়া সম্ভব নয়। আর যদি আপনারা এমন শিক্ষক তৈরি করতে চান, যারা ভবিষ্যত বংশধরদেরকে ইসলামী আদর্শ অনুযায়ী গঠন করতে সক্ষম, তাহলে এ ধরনের শিক্ষক সরবরাহের আগে বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করুন। অনুরূপভাবে মুবাল্লিগ তৈরীর অর্থও সম্ভবত আপনাদের নিকট সুস্পষ্ট নয়। দেশের বিভিন্ন আঞ্জুমানে যে ধরনের বেতনভুক পেশাদার মুবাল্লিগের প্রয়োজন, তা সরবরাহ করার জন্যে আপনারা কি কিছু সংখ্যক লোককে এখন থেকে তাবলীগের পদ্ধতি শেখাতে চান? যদি আপনাদের উদ্দেশ্য এ না হয়ে থাকে, তাহলে মুবাল্লিগ তৈরীর জন্যে একটি স্থায়ী প্রস্তাবের প্রয়োজন কেন? আমাদের শিক্ষায়তনে যে শিক্ষা দান করা হবে এবং সেখানে ছাত্রদের মধ্যে যে প্রাণস্পন্দন সৃষ্টি করা হবে, তার ফলে এখান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ যেখানেই থাকেন এবং যে কাজই করেন না কেন, তারা নিজেদের স্বভাব, চরিত্র, ব্যবহার, কথাবার্তা, চলাফেরা প্রভৃতি প্রতিটি কর্ম ও অংগভংগীর দ্বারা সত্য দ্বীনের তাবলীগ করতে থাকবেন।

প্রস্তাব
জামায়াদের রুকনদের নিজেদের ও নিজেদের ছেলেমেয়েদের বিবাহ কেবল দ্বীনদার ছেলেমেয়েদের সাথে সম্পন্ন করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

এটি প্রস্তাব হিসেবে পেশ করার বন্ধু নয়। বরং এটি হচ্ছে সত্যিকার দ্বীনী চেতনা সৃষ্টি হবার স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী ফল। যে ব্যক্তির মধ্যেই এ চেতনা জাগ্রত হবে সে অবশ্যি দ্বীন বিবর্জিত ও নৈতিক অধঃপতনের গভীরে নিমজ্জিত লোকদের সংগে বিয়ে-শাদীর সম্পর্ক তো দূরের কথা তাদের সংগে বন্ধুত্ব স্থাপন ও ওঠা-বসা করাও পছন্দ করবে না। আর যদি কোন ব্যক্তি দ্বীনী চেতনাবোধের দাবী করে, কিন্তু বিয়ে-শাদীর জন্যে দ্বীন ও নৈতিকতার প্রতি লক্ষ্য করার পরিবর্তে ধন-দৌলত ও পার্থিব সম্পদ-সম্পত্তির প্রতি দৃষ্টি দেয়, তবে তার দাবী প্রতারণা বা নিজের সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা বৈ আর কিছুই নয়। খোদানাখাস্তা এমন লোক যদি আমাদের জামায়াতে পাওয়া যায়, তাহলে তাদেরকে অবশ্যি জানিয়ে দেয়া উচিত যে, এখানে আপনাদের কোনো স্থান নেই, কারণ আপনাদের এ কার্য প্রমাণ করে যে, আপনাদের মধ্যে চেতনার অভাব রয়েছে এবং আপনাদের মূল্যমান এখনো দুনিয়াপ্রীতিতে পরিপূর্ণ। কাজেই যে বস্তুটি নিজেই একটি দ্বীনি অনুভূতির পরিমাপ-যন্ত্র, তাকে এখানে প্রস্তাবাকারে পেশ করে তাকে জামায়াত কর্তৃক গৃহীত একটি সিদ্ধান্তরূপে প্রবর্তন করা আমার মতে, ‘আগামীকাল আমাদের এই সম্মেলনে জামায়াতের প্রত্যেক রুকনকে নামায পড়তে হবে এই মর্মে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করার ন্যায়।’ যেমন আমরা জামায়াতের রুকনগণের দ্বীনি চেতনাবোধের কারণে তাদের নিকট আশা করি যে, তারা নিজেরা জামায়াতের প্রস্তাবের চাপে নয়, বরং স্ব-স্ব দায়িত্বে নামায পড়বেন, অনুরূপ আমরা তাদের নিকট এ আশাও পোষণ করি যে, আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব ও অন্যান্য যাবতীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা দ্বীনদারী ও নৈতিক পরিচ্ছন্নতাকে অন্য সব কিছুর ওপর অগ্রাধিকার দান করবেন।

প্রস্তাব

প্রত্যেক রুকনকে দৈহিক কষ্ট বরদাশত করার অভ্যাসের জন্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দান করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

যদি জামায়াতের মধ্যে প্যারেড ও ব্যায়ামের ব্যবস্থা করা এবং সামরিক শিক্ষা লাভ করার আখড়া কায়েম করা এ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে এটি হবে আমাদের কর্মপদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। আর যদি লোকদেরকে কৃত্রিমভাবে কিছুটা কষ্টসহিষ্ণু, করার পদ্ধতি অবলম্বন করার জন্যে নির্দেশ দান এর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে তা সম্পূর্ণ অর্থহীন। এই নীতিগত সত্যটিকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করুন যে, জীবনে অসংখ্য বস্তুর প্রয়োজন দেখা দেয়, কিন্তু তন্মধ্যে প্রত্যেকটিকে যদি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে পরিণত করা হয় এবং প্রত্যেকটির জন্যে লোকদেরকে উস্কানি দিয়ে পৃথক পৃথক ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে এভাবে সমগ্র প্রচেষ্টা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। বরং প্রকৃত পক্ষে ঐ অসংখ্য উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো একটির সংগেও লোকদের সম্পর্ক ও আগ্রহ অধিক্ষণ অব্যাহত থাকবে না। বিপরীত পক্ষে, লোকেরা যদি একটি বৃহত্তর ও উন্নততর লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং তাদের দিলে যদি ঐ লক্ষ্যের প্রতি প্রগাঢ় প্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়, তাহলে লোকেরা ঐ উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্যে প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি বস্তুর জন্যে কাজ করতে থাকবে। এভাবে বিভিন্ন কাজের জন্যে তাদেরকে পৃথক পৃথক ভাবে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করার প্রয়োজন হবে না। বর্তমানে আমরা মানুষের সম্মুখে যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পেশ করছি এবং যার আকর্ষণে আপনারা একত্রিত হয়েছেন নিজেদের ও অন্যদের দিলে তার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা সৃষ্টি করার জন্যে পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করুন। অতঃপর যদি এজন্যে দৈহিক শক্তি নিয়োগ করার প্রয়োজন অনুভূত হয়, তাহলে যথা সময়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যদি সে কষ্ট-সহিষ্ণুতার প্রত্যাশী হয়, তাহলে শত আয়েশ-আরামের মধ্যে লালিত ব্যক্তিরাও তার প্রেমের আকর্ষণে কষ্টসহিষ্ণু হয়ে উঠবে। আর যদি সে কোনো শিল্প বা কোনো বিদ্যা অর্জনের দাবী করে, তাহলে লোকেরা ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে সেদিকে অগ্রসর হবে। এগুলোর কোনো একটির জন্যেও স্বতন্ত্র আন্দোলনের প্রয়োজন হবে না। বরং আন্দোলন তার অগ্রগতির প্রতি পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবে তার প্রয়োজনসমূহ আপনাদের সম্মুখে তুলে ধরবে এবং আপনাদেরকে তা পূর্ণ করার জন্যে বাধ্যও করবে। কিন্তু যদি আমরা যথার্থ সময়ের পূর্বে আন্দোলনের মধ্যে কোনো বস্তুর চাহিদা সৃষ্টি করার এবং প্রয়োজন অনুভূত হবার পূর্বে কৃত্রিমভাবে তার জন্যে আন্দোলন শুরু করার চেষ্টা করি, তাহলে তার ফল হবে এই যে, একটি কাজ জবরদস্তি শুরু করা হবে, কিছু দিন পর্যন্ত অনিচ্ছায় তা চলতে থাকবে, তারপর ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে।

প্রস্তাব

জনসাধারণ ও অমুসলিমদের জন্যে সহজবোধ্য ভাষায় বইপত্র প্রকাশ ও প্রচার এবং গ্রামবাসীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজন।

আমীরে জামায়াত

অবশ্যি আমাদের বইপত্রে সাধারণ মানুষ ও অমুসলিমদের উপযোগী আলোচনার পরিমাণ অতি অল্প। এর কারণ হচ্ছে এই যে, এ পর্যন্ত বইপত্র লেখার কাজ মাত্র এক ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে এবং তিনি বিশেষ শিক্ষিত শ্রেণীর উপযোগী বইপত্র লেখারই যোগ্যতা রাখেন। এখন জামায়াতের যে সকল লোক লেখার যোগ্যতা রাখেন, তাদেরকে নিজেদের কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতা বিশ্লেষণ করে তাঁরা কোন শ্রেণীর উপযোগী কোন ধরনের রচনা পেশ করতে পারেন, তা অনুমান করতে হবে। উপরন্তু তাঁদের সমগ্র শক্তিকে কার্যত এ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে হবে।

বইপত্র প্রকাশ সম্পর্কে এতদূর বলা যেতে পারে যে, যে সমস্ত বই সরাসরি জামায়াতী বই হিসেবে গণ্য হতে পারে আমাদের নিজস্ব প্রকাশনীই সেগুলো প্রকাশ করতে পারে। আর আমাদের দাওয়াতের সাথে যে সকল বইয়ের নিকট সম্পর্ক থাকে সেগুলো প্রকাশের জন্যে জামায়াতের রুকনগণ সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে প্রকাশনী কায়েম করতে পারেন অথবা পূর্ব থেকেই জামায়াতের বিভিন্ন রুকন যে সকল প্রকাশনী কায়েম করে রেখেছেন, সেগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন।

বয়স্ক শিক্ষার যে কাঠামো আমি পেশ করেছি, সেটিই হচ্ছে জনগণের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সর্বোত্তম পদ্ধতি। আর গ্রামে কাজ করা সম্পর্কে আমি ইতিপূর্বে কয়েকবার বলেছি এবং লিখেছিও যে, একাজ একমাত্র তাদের করা উচিত, যারা এর যোগ্যতা রাখেন এবং এর চাইতে মূল্যবান কাজ করতে অক্ষম। প্রত্যেক ব্যক্তিকে গ্রামের পথ ধরা নিছক একটি অজ্ঞতা ও প্রচলিত ধারার অনসৃতি বৈ আর কিছুই নয়। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি গ্রামের পথে ঘুরাফিরার চাইতে অন্য কোনো অধিকতর মূল্যবান কাজ করার যোগ্যতা রাখেন, তিনি যদি নিছক এজন্যেই গ্রামের পথ ধরেন যে, আজকাল একাজটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, তাহলে এটি নিজের শক্তি-সামর্থকে অপাত্রে ব্যবহারের নামান্তর হবে এবং এজন্যে খোদার নিকট পুরস্কার লাভের পরিবর্তে জবাবদিহীর সম্মুখীন হবার আশংকা আছে। তবে যারা পল্লীর অধিবাসীদেরকে সম্বোধন করার যোগ্যতা রাখেন এবং জন্মগতভাবে এ কাজের সাথে যাদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, তাদের অবশ্যি এদিকে দৃষ্টিপাত করা উচিত। কিন্তু এজন্যে একটি দল মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে দেশের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বহু গ্রাম সফর করে আসবে, এ পদ্ধতিও ঠিক নয়। বরং এর সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, একটি গ্রাম নির্বাচন করে সেখানে বেশ কিছু কাল অনবরত কাজ করতে হবে, এমন কি শেষ পর্যন্ত সেখানে আপনার একটি শক্তিশালী সমর্থক দল সৃষ্টি হবে, তাদের নৈতিক অবস্থা যথেষ্ট পরিবর্তিত হবে এবং আমাদের আন্দোলনের কাজ করার জন্যে যোগ্য প্রমাণিত হবে। অতঃপর তাদেরকে তাদের নিজেদের পল্লীতে একই পদ্ধতিতে সংশোধন ও দাওয়াতের কাজ করার জন্যে ব্যবহার করতে হবে।

[বিঃ দ্রঃ জনাব মুহাম্মদ শফী গাযী আবাদী ও জনাব সাইয়েদ নকী আলি বয়স্ক শিক্ষার জন্যে পাঠ্য তালিকা প্রণয়ন ও দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহের পাঠ্য তালিকা হতে প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ নির্বাচন করার ভার নিজেদের ওপর নিয়েছেন।]

প্রস্তাব

কেন্দ্র কোনো কেন্দ্রীয় স্থানে হওয়া উচিত।

আমীরে জামায়াত

কেন্দ্র যেখানে স্থাপিত হয়, সেটিই হচ্ছে কেন্দ্রীয় স্থান। বর্তমানে এ প্রশ্নটি বাদ দেয়াই ভালো। যখন আমরা সবাই মিলে চিন্তা করে একবার এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে, আমাদেরকে এখানে কাজ করতে হবে, তখন এ প্রশ্নটিকে বার বার উত্থাপন করা বৃথা। এ ছাড়াও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা এও জানতে পেরেছি যে, এ ধরনের প্রস্তাব অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিছক ইচ্ছার আকারে প্রতিভাত হয়। অথচ ইচ্ছার বুকে না কোনো ব্যক্তি থাকতে পারে, না সেখানে বুকডিপো কায়েম করা যায় আর না কোন প্রেস স্থাপন করা যেতে পারে। এ বস্তুগুলোর জন্যে স্থান ও গৃহের প্রয়োজন এবং এগুলো এখানে বহুলাংশে উপস্থিত।

প্রস্তাব

মেয়েদের মধ্যে আন্দোলনের দ্রুত প্রসারের জন্যে সক্রিয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও এ জন্যে হেদায়াত দান করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

প্রকৃতপক্ষে মেয়েদেরকে আমাদের সহযোগী করার প্রশ্নটি আমাদের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা বাহুল্য, যতদিন পর্যন্ত মেয়েরা আমাদের সাথে সম্পর্কহীন থাকবে, ততদিন দেশের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ অধিবাসী স্থায়ীভাবে আমাদের সাথে সম্পর্কহীন থাকবে। আর এই পঞ্চাশ ভাগ অধিবাসীর ক্রোড়ে অবশিষ্ট পঞ্চাশ ভাগ অধিবাসী লালিত হয়। কাজেই আমাদের এ আন্দোলনের সাফল্যের জন্যে পুরুষদের সাথে মেয়েদের অংশগ্রহণও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অন্যান্য আন্দোলনের ন্যায় এ কাজটি আমাদের জন্যে ততটা সহজ নয়। অন্যান্য আন্দোলন নারী স্বাধীনতার ধুয়া তুলে মেয়েদেরকে বাইরে বের করে আনে এবং পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদেরকে কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর করে। কিন্তু আমাদেরকে ইসলামী নীতি অনুসরণ করে শরীয়ত নির্ধারিত সীমানার মধ্যে অবস্থান করে এ কার্য সম্পাদন করতে হবে। এ কারণেই বর্তমান অবস্থায় আমরা এ ব্যাপারে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আপাতত আমার মতে এ আন্দোলনকে মেয়েদের মধ্যে বিস্তৃত করার একটি মাত্র পথ আছে এবং তা হচ্ছে এই যে, আমাদের সমর্থক ও সহযোগীদেরকে তাদের নিজেদের মাতা, ভগ্নী, কন্যা ও পরিবারের অন্যান্য মেয়েদের মধ্যে নিজেদের চিন্তার বীজ বপন করতে হবে এবং নিজেদের বাস্তব চরিত্র দ্বারা তাদেরকে প্রভাবিত করতে হবে। তাদের মধ্যে শিক্ষিতা মেয়েদেরকে বই পড়াতে হবে এবং যারা শিক্ষিতা নয়, তাদেরকে শিক্ষাদান করতে হবে। এভাবে দীর্ঘকাল প্রচেষ্টা চালাবার পর যখন বেশ কিছু সংখ্যক মহিলা আমাদের মতবাদ গ্রহণ করবে, তখনই মেয়েদের মধ্যে আমরা এমন একদল কর্মী মহিলা লাভ করার আশা করতে পারি, যারা অন্যান্য পরিবারেও আমাদের চিন্তা ও নৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অর্থাৎ জামায়াতের রুকনগণ তাঁদের স্ত্রীদেরকে কেবল তাঁদের স্ত্রী হবার কারণেই জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত করবেন না। ঐ আন্দোলনের ব্যাপারে স্বামীসুলভ কর্তৃত্ব খাটানো উচিত হবে না। অন্যথায় এভাবে বহু স্ত্রী নিছক তাদের স্বামীদের নিষ্ক্রিয় অনুগত হয়ে জামায়াতে প্রবেশ করবে অথচ তাদের চিন্তায় ও জীবনক্ষেত্রে কোনো সত্যিকার পরিবর্তন সূচিত হবে না। আপনারা বাইরে যেভাবে তাবলীগ করেন অনুরূপভাবে গৃহেও তাবলীগ করুন। ধৈর্যসহকারে অনবরত প্রচেষ্টা চালাতে থাকুন যেন অবশেষে আপনাদের স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য মেয়েদের চিন্তা, চিন্তা পদ্ধতি, দৃষ্টিভংগী ও চরিত্রে এই আন্দোলনের কাজ করার উপযোগী সত্যিকার পরিবর্তন সূচিত হয়। এই পরিবর্তন এবং চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে শক্তিশালী চারিত্রিক সত্তার অধিকারী না হলে যেমন আমরা পুরুষদেরকে জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত করি না, তেমনি মেয়েদেরকেও এ গুণাবলী ছাড়া জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নয়।

প্রস্তাব

শয়তানী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও শরীয়ত বিরোধী জীবিকার্জন থেকে যারা নিজেদেরকে পৃথক করে নিয়েছেন, তাদের সাহায্যের ব্যবস্থা করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, আমাদের চিন্তা ও মতবাদ গ্রহণ করে যারা শরীয়ত বিরোধী জীবিকার্জন পরিহার করে, তাদেরকে অন্য কোনো সংগত জীবিকার সন্ধানদানের ব্যাপারে আমাদের দ্বারা যতটুকুন সাহায্য করা যেতে পারে, তা করা উচিত। কিন্তু এ সাহায্য কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাদের নৈতিক দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। একে জামায়াতী কার্যসূচীতে পরিণত করা এবং জামায়াতের ওপর এর ব্যবস্থা করার দায়িত্ব অর্পণ করা নীতিগতভাবে ঠিক নয়। জামায়াত মানুষের সম্মুখে হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়া ও তাদের মধ্যে হালাল ও হারামের পার্থক্য সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। অতঃপর যে ব্যক্তি হককে হক বলে স্বীকার করতে ও বাতিল থেকে পৃথক হতে চায়, উপরন্তু হারামকে হারাম মনে করে পরিহার করতে ও হালালকে গ্রহণ করতে চায়, জীবিকার্জনের জন্যে বৈধ পথ অবলম্বন করা ও নিজের জীবনকে অবৈধ বিষয়সমূহের মিশ্রণ থেকে রক্ষা করা তার নিজের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। যদি সচ্চরিত্রতার দাওয়াত দানকারী কোনো জামায়াত মানুষকে ব্যভিচার পরিহার করে বিবাহ করার পরামর্শ দেয়, তাহলে একটি বিবাহ এজেন্সি খোলার দায়িত্বও তার ওপর অর্পিত হয় না। অনুরূপভাবে সত্য দ্বীনের দাওয়াত দানকারী কোনো জামায়াত যেহেতু মানুষকে হারাম পদ্ধতি পরিহার করে হালাল পদ্ধতিতে জীবিকা অর্জনের পরামর্শ দান করে, নিছক এ জন্যে জীবিকার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হতে পারে না। অবশ্যি এহেন জামায়াতের ব্যক্তিবর্গ যে ক্ষেত্রে হারাম পথ থেকে বাঁচবার ও হালাল পথ অবলম্বন করার জন্যে নিজেরা প্রচেষ্টা চালাতে থাকে, সেক্ষেত্রে এ উদ্দেশ্যে তাঁদের ন্যায় আরো যারা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের সাহায্য করাও এহেন জামায়াতের ব্যক্তিবর্গের নৈতিক দায়িত্ব হিসাবে পরিগণিত হয়। জামায়াত হিসাবে আমরা বড় জোর এতটুকুন করতে পারি যে, ক্ষুদ্র শিল্প ও বিভিন্ন ব্যবসায় সম্পর্কে যদি কোনো তথ্য আমাদের নিকট সংগৃহীত থাকে, তাহলে বর্তমান অর্থ ব্যবস্থায় যারা তুলনামূলকভাবে কোনো হালাল জীবিকা অবলম্বন করতে চায়, তাদেরকে সেগুলো সরবরাহ করতে পারি। অনুরূপভাবে আমরা এ কাজটিও করতে পারি যে, জামায়াতের যে সকল রুকন কোনো শিল্প বা ব্যবসায় পরিকল্পনাকে কার্যকরী করতে চান, তারা যদি আমাদেরকে তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করেন, তাহলে অন্যান্য রুকনদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে আমরা চেষ্টা করতে পারি।

প্রস্তাব

পীর সাহেবান ও গদ্দীনসীনদেরকে এবং আন্দোলনের দিকে আহ্বান করার জন্যে কোনো বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। কেননা, তাঁদের কোনো এক জনের অংশগ্রহণ হাজার হাজার ব্যক্তি অংশ গ্রহণের নামান্তর।

আমীরে জামায়াত

নিঃসন্দেহে আমাদের দেশে এ শ্রেণীটি অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি লোক এ শ্রেণীর সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু তাঁদের মধ্যে অতি অল্প সংখ্যক লোকই সত্যিকার খোদাভীরু, সতপ্রিয় ও সৎকর্মশীল। এ শ্রেণীর সাথে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ লোকের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তাদের চাইতে অধিক খোদাবিস্মৃত লোক সম্ভবত সমগ্র দুনিয়ায় আর পাওয়া যাবে না। তারা হকের জন্যে কেবল নিজেদের কানই বন্ধ করেননি বরং নিজেদের মুরিদ ও ভক্ত-অনুরক্তদের কান ও দিলে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। তাঁদেরকে দাওয়াত দিলে তাঁরা হকের আওয়াজে সাড়া দেবেন না এবং নিজেদের নিমখোদায়ী পরিহার করতে উদ্যত হবেন না। উপরন্তু এর ফল এই দাঁড়াবে যে, ভীমরুলের চাকে ঢিল মেরে আমরা নিজেরাই তাদেরকে কামড়াবার জন্যে উস্কানি দেবো। কাজেই পীর সাহেবানকে সম্বোধন করার পরিবর্তে আপনাদের উচিত তাঁদের ভক্ত-অনুরক্তদের মধ্যে সঠিক চিন্তা বিস্তার করা এবং তাদের দুর্বলতাকে সম্মুখে রেখে নিজেদের তাবলীগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। ঐ পীর সাহেবদের মায়াজাল অবশ্যি ছিন্ন হওয়া উচিত। আমাদের হাতে তাদের মায়াজাল ছিন্ন না হলে কম্যুনিজমের হাতে অবশ্যি ছিন্ন হবে। কিন্তু আমরা দোয়া করি, এটি যেন আমাদের হাতে ছিন্ন হয়। কেননা, কম্যুনিজমের হাতে ছিন্ন হলে পীর সাহেবদের সংগে সংগে তারা দ্বীনকেও ধ্বংস করবে।

প্রস্তাব

জনগণের মধ্যে কাজ করার জন্যে মরহুম মওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াসের তাবলীগী পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

এ সম্পর্কে আমার প্রথম বক্তৃতাসমূহে আমি নিজের চিন্তাধারা পেশ করেছি। মরহুম মওলানা ইলিয়াসের কর্মপদ্ধতির নিন্দা করতে আমি চাই না। যারা তাঁর কর্মপদ্ধতিতে সন্তুষ্ট হতে পারেন, তারা তাঁর দলের কর্মীদের সাথে শামিল হয়ে কাজ করতে পারেন। বলা বাহুল্য, এটিও একটি সৎকাজের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এই জামায়াতের (জামায়াতে ইসলামী) জন্যে আমি যে কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছি তার সংগে অন্য কর্মপদ্ধতি সংযুক্ত করা আমি পছন্দ করি না। তাঁর তবালীগ পদ্ধতি সম্পর্কে আমি যতদূর ওয়াকিফহাল হয়েছি, তাতে আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি এবং আমাদের সম্মুখে যে ধরনের সার্বিক বিপ্লব সৃষ্টির পরিকল্পনা আছে, তাতে এ কর্মপদ্ধতি কোনো প্রকার সাহায্য করতে সক্ষম হবে না।

প্রস্তাব

হিন্দুস্তানের সমগ্র আলেম সমাজকে একত্রিত করে তাঁদের সম্মুখে এ দাওয়াত পেশ করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

এটি একটি কাল্পনিক প্রস্তাব এ ব্যাপারে যে ব্যক্তির কিছুটা বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে, তিনি কখনো এটি বাস্তবায়িত হতে পারে বলে মনে করেন না। আপনাদের মধ্য থেকে কোনো ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় এ ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে চান, তাহলে আমি তাঁকে বাধা দিতে চাই না। কিন্তু আমি নিজে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি না। আমার নিজের কোনো স্বার্থের খাতিরে আমি একথা বলছি না। বরং এর কারণ হচ্ছে এই যে, আমি এটা অনর্থক মনে করি এবং এর দ্বারা কোনো ভালো ফলাফল প্রকাশের আশা আমি করি না। তবে দাওয়াত পৌছার ব্যাপারে আমি জানি যে, এ দেশের আলেম ও শিক্ষিত সমাজের অধিকাংশের নিকট এ দাওয়াত পৌঁছে গেছে। যদি কোনো ব্যক্তি এ দাওয়াতকে সঠিক ও সত্য বলে মনে করে থাকেন, তাহলে কেউ তাঁর নিকট গিয়ে সরাসরি তাঁকে দাওয়াত না দেয়া সত্ত্বেও তিনি এ দাওয়াতে সাড়া দেবেন।

হকপন্থীদের ব্যাপারে কখনো এ আশা পোষণ করা যেতে পারে না যে, তারা কোথাও হকের ডাক শুনার ও তার সত্যতার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার পর তাঁদের গৃহপ্রাঙ্গণে এসে এ দাওয়াত দান করা হয়নি কেন কেবল এজন্যে স্বস্থানে জেঁকে বসে থাকতে পারেন।

প্রস্তাব

জামায়াতে যে সকল আলেম আছেন, তাঁদের নিজেদের চতুষ্পার্শ্বের এলাকার স্থানীয় জামায়াতসমূহের মধ্যে সফর করে তাদেরকে জীবিত রাখার জন্যে চেষ্টা করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

এটি অবশ্যি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব। যে সকল আলেম এ দলে শামিল হয়েছেন তাঁদের নিজেদেরকেই নিজেদের দায়িত্ব অনুভব করা উচিত। নিজেদের আশেপাশের এলাকা সফর করে স্থানীয় জামায়াতসমূহকে সক্রিয়া রাখা ও রুকনদের নৈতিক ও দ্বীনি অবস্থা উন্নত থেকে উন্নততর করার চেষ্টা করার জন্যে তাদেরকে স্থায়ীভাবে নিজেদের সময়ের একটি অংশ ব্যয় করা উচিত। কিন্তু এ ধরনের কাজ নির্দেশ দিয়ে করাবার পরিবর্তে আমি স্বেচ্ছাকৃতভাবে করাতে চাই। মানুষ নিজের আন্তরিক প্রেরণা ও দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে কাজ করে, সেটি হচ্ছে সর্বোত্তম খেদমত। আমি লোকদেরকে স্বেচ্ছাকৃত খেদমতে উদ্বুদ্ধ করার এবং তাঁদের মধ্যে এতটুকু দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করার জন্যে পূর্ণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যার ফলে তারা নিজেরাই নিজেদের শক্তি ও যোগ্যতাসমূহ পর্যালোচনা করে নিজেরাই সেগুলোকে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে আল্লাহর দ্বীনের কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারে।

প্রস্তাব

হিন্দুস্তানের বাইরেও দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ সম্প্রসারিত করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

শুরু থেকে এদিকে আমাদের লক্ষ্য ছিল এবং মহাযুদ্ধ সংঘটিত না হলে এতদিনে এ ব্যাপারে আমরা অবশ্যি কিছু না কিছু অগ্রসর হতাম। আপাতত এ উদ্দেশ্যেই আমরা দারুল আরুবা কায়েম করেছি। এ প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে আরবীতে দাওয়াতী বই-পত্র তৈরি করে আরব দেশসমূহে প্রচার করা। যুদ্ধজনিত সংকট অতিক্রম করার পর ইনশাআল্লাহ আমরা আরবী বই-পত্র প্রকাশ শুরু করে দেবো এবং আরবী ভাষায় একটি মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করবো। উপরন্তু আমি এ সংকল্পও করেছি যে, আরবীতে কিছু বই-পত্র তৈরী হয়ে যাবার পর জামায়াতের একটি প্রতিনিধিদলসহ আমি নিজে হজ্জ সম্পাদনে যাবো এবং সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হাজীদের সম্মুখে এ দাওয়াত পেশ করার চেষ্টা করবো। এভাবে আশা করা যায় বর্হিগতের কতিপয় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করা হবে এবং ব্যাপকভাবে কাজ করার পথও উন্মুক্ত হবে। উপরন্তু ইংরেজী ভাষাকেও আমাদের দাওয়াত প্রচারের মাধ্যমে পরিণত করার জন্যে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি।
এভাবে একটি আন্তর্জাতিক ভাষার সাহায্য গ্রহণ করতে আমরা সক্ষম হবো।

প্রস্তাব

পরিকল্পিত বিদ্যায়তনে ভর্তির জন্যে এ শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, ছাত্রদের পিতা-মাতাকে আমাদের উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভংগীর কেবল সমর্থক হলে চলবে না, বরং যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্যে আমরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছি, তাঁদের সন্তানদেরকে একমাত্র ঐ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের জন্যে আমাদের হাতে সমর্পণ করার ওয়াদা করতে হবে। এ শর্তটি এখান থেকে উঠিয়ে দিয়ে সকল প্রকার ছাত্রদের জন্যে দরজা উন্মুক্ত রাখা উচিত। তাহলে বিপুল সংখ্যক ছাত্র আমাদের শিক্ষায়তনে প্রবেশ করবে এবং আমরা তাদের চিন্তা, মানসিকতা ও চরিত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবো।

আমীরে জামায়াত

অনেক চিন্তা-বিবেচনার পর এ শর্ত আরোপ করা হয়েছে এবং এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সময় এর সকল দিকে ভালোভাবে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। এতে সন্দেহ নেই যে, সকল প্রকার ছাত্রদেরকে আমরা নিজেদের বিদ্যায়তনে স্থান দেবো এবং নিজেদের শিক্ষা ও ট্রেনিংয়ের দ্বারা তাদেরকে এতদূর প্রভাবিত করবো যার ফলে তারা আকীদা-বিশ্বাস ও কর্মের দিক দিয়ে আমাদের পথের অনুসারী হবে, এ কথাটি বাহ্যত বেশ জোরালো মনে হয়। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এ পদ্ধতিতে আমরা খুব বেশী লাভবান হতে পারবো না এবং লাভ যতটুকুন হবে তার তুলনায় আমাদের সময় ও শক্তির অপব্যবহারজনিত ক্ষতি হবে অনেক বেশী। আজকাল লোকেরা সাধারণত অর্থনৈতিক স্বার্থকে সম্মুখে রেখে নিজেদের ছেলেমেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে। এ ব্যাপারে দ্বীনী শিক্ষার প্রতি যদি তাদের কোনো আগ্রহ থেকে থাকে, তাহলে তা কেবল এতটুকুন যে, তাদের ছেলেমেয়েরা যেন নামায-রোযাও কিছু কিছু পড়তে থাকে এবং দ্বীন সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান অর্জন করতে পারে, ব্যস তাহলেই যথেষ্ট। এ থেকে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তারা কদাচিৎ এমন কোনো দ্বীনদারীর সমর্থক হতে পারে, যা তাদের সন্তানদের পার্থিব স্বার্থোদ্ধারের পথে-তা যে কোনো পথেই হোক না কেন- অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের লোকেরা তাদের সন্তানদেরকে যদি আমাদের শিক্ষায়তনে পাঠায়, তাহলে আমাদের পরিশ্রমের সুযোগে তাদেরকে প্রাথমিক কয়েকটি জামায়াত পর্যন্ত সাধারণ মাদ্রাসাসমূহ থেকে উত্তম শিক্ষা দান করবে অতঃপর তাদেরকে সেখান থেকে বের করে সরকারী স্কুলসমূহে ভর্তি করে দেবে, সেখান থেকে পরীক্ষা দান করাবে এবং সামান্য বা অধিক বেতনের বিনিময়ে শয়তানের হাতে বিক্রয় করে দেবে। ছাত্রদের একটি বিরাট অংশ আমাদের শিক্ষায় প্রভাবিত হওয়া সত্ত্বেও পিতা-মাতার চাপে বাধ্য হয়ে এ পথে অগ্রসর হবে। অতি অল্প সংখ্যক বড় জোর শতকরা পাঁচজন ছাত্র শক্তিশালী চরিত্রের অধিকারী হতে পারে। তারা আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে তাদের জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে পরিণত করতে পারে এবং পিতা-মাতার চাপকে অস্বীকার করে কোনো ভ্রান্ত পথে অগ্রসর হবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, মাত্র এই শতকরা পাঁচজনকে লাভ করার জন্যে আমরা শতকরা ৯৫ জনের ওপর নিজেদের শক্তি নষ্ট করি কেন? অথচ তারা দ্বীনের কোনো কাজে লাগার পরিবর্তে শয়তানের কাজে লাগার জন্যে লালিত হবে। অতঃপর কার্যত ঐ শতকরা ৯৫ জন ছাত্রকে সৎ পথ থেকে সরাবার জন্যে যেভাবে প্রচেষ্টা চালানো হবে, যেভাবে তাদের ওপর চাপ প্রদর্শন করা হবে, তাদেরকে ঘর থেকে বের করে দেয়ার ও খরচ বন্ধ করার জন্যে যেভাবে ধমকি দেয়া হবে, তাদের নিজেদের ভাই, বেরাদার ও পিতা-মাতা যেভাবে তাদেরকে অতিষ্ঠ করে তুলবে ও তাদের ওপর জুলুম করবে, অতঃপর ভালো ভালো সৎ স্বভাবসম্পন্ন ও উন্নত সংকল্প বিশিষ্ট ছাত্রগণ পরিশেষে যেভাবে পরাজিত হয়ে পশ্চাৎপদ হবে এবং নিজেদের পবিত্র সংকল্প ও আকাংখাসমূহকে বিসর্জন দেবে- অন্যান্য ছাত্রদের ওপর তার অত্যন্ত খারাপ প্রভাব পড়বে। এই অনবরত পশ্চাৎপদতার অশুভ দৃষ্টান্ত অন্যান্য ছাত্রদের নৈতিক শক্তিকেও দুর্বল করে দেবে। কাজেই আমরা নিজেদের বিদ্যায়তন ও তার পরিবেশকে এই স্থায়ী বিপদের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে চাই না। আমরা চাই, প্রথম থেকে একমাত্র তারাই যেন আমাদের এখানে ছেলেমেয়েদেরকে পাঠায়, যারা জানে যে, আমরা কোন উদ্দেশ্যে ঐ ছেলেমেয়েদেরকে তৈরি করতে চাই এবং তারা নিজেরাও এ উদ্দেশ্যে ছেলেমেয়েদেরকে তৈরি করতে চায়। এ জাতীয় লোকদের ছেলেমেয়েরা যত কম সংখ্যক হোক না কেন, তারা পুরোপুরি আমাদের উদ্দেশ্যের অনুকূল এবং আমাদের লক্ষ্য অর্জনে অধিকতর সহায়ক হবে। হতে পারে এভাবে হয়তো আমরা বেশী সংখ্যক ছাত্র লাভ করতে পারবো না, কিন্তু এজন্যে আমাদের কোনো চিন্তা নেই। যদি আপনি এমন পাঁচ একর জমি লাভকরেন, যেখানে নিশ্চিন্তে চাষবাস করে ফসল কাটতে পারেন, তাহলে তা এমন এক হাজার একর জমির চাইতেও উত্তম, যেখানে চাষাবাদ করার পর তার বিরাট অংশ আপনার কষ্টোপার্জিত সোনালী শস্যসহ আপনার নিকট থেকে যে কোনো মুহূর্তে ছিনিয়ে নেবার আশংকা থাকে। কিন্তু হিন্দুস্তানে এ উদ্দেশ্যে নিজের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাবার মতো লোকের সংখ্যা অতি অল্প এবং এই অল্প সংখ্যক লোকের দ্বারা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়, এ ধারণা করা ভুল। আমার অনুমান হচ্ছে এই যে, হিন্দুস্তানের মুসলমানদের শোচনীয় অবস্থা সত্ত্বেও বর্তমান সময়ে যথেষ্ট সংখ্যক মুসলমান তাদের সন্তানদেরকে খোদার জন্যে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত আছেন এবং এজন্যে তাদের সন্তানরা পার্থিব দিক দিয়ে লাভবান হবে কিনা সে সম্পর্কে চিন্তা করতেও তারা প্রস্তুত নন।

যে সকল ছাত্র দ্বীনের প্রশ্নে নিজের পিতা-মাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এখানে আসে এবং পিতা-মাতার ইচ্ছানুসারে চলে নিজেদের পরকাল নষ্ট করতে প্রস্তুত হয় না, কেবল এমন ছাত্ররাই আমাদের এই শর্তের আওতামুক্ত হতে পারে। কেবল এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে পিতা-মাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা বৈধই নয়, বরং অনেক সময় ফরয হয়ে পড়ে। এমন ছাত্ররা তাদের পিতা-মাতার সন্তুষ্টি লাভকরার পর এখানে প্রবেশ করতে পারবে, এ শর্ত আমরা তাদের ওপর আরোপ করতে পারি না।

প্রস্তাব
প্রত্যেক রুকনকে তর্জমানুল কুরআন ও কাওসার পত্রিকা অবশ্যি ক্রয় করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

সম্ভবত আপনারা ভুলে গেছেন যে, আপনারা হিন্দুস্তানের ন্যায় একটি দেশে বাস করেন। এখানকার নৈতিক অবস্থা হচ্ছে এই যে, চরম নিঃস্বার্থপরতার সাথে কাজ করার পরও কোনো ব্যক্তিকে স্বার্থপরতার অভিযোগ ও সন্দেহ থেকে রেহাই দেয়া হয় না। এখনো পর্যন্ত আমরা যে সতর্কতার সাথে কাজ করে এসেছি, তা সত্ত্বেও আমাদেরকে ‘পুস্তক বিক্রেতা’ ও ‘ব্যবসায়ী’ প্রভৃতি উপাধি দ্বারা ভূষিত করা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে এই যে, পুস্তকগুলি আমাদের বুক ডিপোয় বিক্রি হয়। এখন এ অভিযোগের লেবেলগুলি কি সত্যি আমাদের গায়ে এঁটে দিতে চান? অনুগ্রহ করে এ ধরনের প্রস্তাব উত্থাপন করবেন না এবং মনে মনে এ কথা চিন্তাও করবেন না। তর্জমানুল কুরআন ও কাওসারের ব্যাপারে জামায়াতের লোকদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত। তারা ইচ্ছা করলে এগুলি কিনতে পারেন এবং ইচ্ছা করলে নাও কিনতে পারেন। এবং এগুলি ক্রয়ের জন্যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করার কোনো সংগত কারণ নেই। তবে জামায়াতের কার্যাবলী ও তার চিন্তা সম্পর্কে অবহিত থাকার জন্যে এ পত্রিকা দু’টি পাঠ করা উচিত। কিন্তু এ উদ্দেশ্যে কারুর নিকট থেকে চেয়ে নিয়েও পাঠ করা যেতে পারে।

প্রস্তাব
প্রত্যেক রুকনকে বায়তুলমালের জন্যে প্রতিদিন চার আনা করে পয়সা জমা করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

যেহেতু শরীয়ত অনুযায়ী এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করার অধিকার আমাদের নেই এবং রাসূলুল্লাহর (সাঃ) জামানায় যাকাত ও ওয়াজিব সাদকা ছাড়া খোদার পথে অন্য কোনো ব্যয়কে বাধ্যতামূলক করা হয়নি, তাই আমরাও নিজেদের জামায়াতের মধ্যে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে এভাবে বাধ্যতামূলক করলে খোদার পথে ব্যয় করার আসল লাভটাই নষ্ট হয়ে যায়। সামাজিক প্রয়োজনের জন্যে যতটুকু অপরিহার্য ছিল আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তির ওপর সেই পর্যায়ের ব্যয়কে বাধ্যতামূলক গণ্য করেছেন। অতঃপর এ বিষয়টিকে প্রত্যেক ব্যক্তির খোদার সাথে সম্পর্ক, তার সৎকার্য অনুষ্ঠানের আকাংখা ও সত্য দ্বীনের সাথে আন্তরিক সম্পর্কের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে যে, সে যত অধিক শক্তিশালী হবে, তত অধিক নিজের আন্তরিক প্রেরণা সহকারে খোদার পথে ব্যয় করবে এবং যত দুর্বল হবে, তত খোদার পথে তার ব্যয়ও হ্রাস পাবে। শরীয়তের নীতি হচ্ছে এই যে, আইনত মানুষের নিকট অতি অল্প পরিমাণ নেকীর দাবী জানানো হয়েছে এবং অধিক সংখ্যক নেকী রাখা হয়েছে আইনগত দাবীর সীমার বাইরে। এর ফলে মানুষ স্বেচ্ছায় সেগুলি অবলম্বন করতে পারবে। দুনিয়ায় মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ও আখেরাতে আল্লাহর নিকট তার সাফল্য পূর্ণত স্বেচ্ছাকৃত নেকীর ওপর নির্ভরশীল। এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারলে আপনারা এ ধরনের প্রস্তাব চিন্তা করার পরিবর্তে নিজেদের ও নিজেদের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে এমন প্রেরণা সৃষ্টির ও বিকাশের জন্যে সমস্ত শক্তি-সামর্থ ব্যয় করতে সক্ষম হবেন, যার ফলে মানুষ খোদার জন্যে ও তার দ্বীনের জন্যে নিজের সময়, অর্থ ও শক্তি ব্যয় করে থাকে।

প্রস্তাব

জামায়াতের যে সকল লোক বিভিন্ন টেকনিক্যাল কাজ জানেন অন্য সহযোগীদেরকে তা শেখাবার জন্য তাদের চেষ্টা করা উচিত এবং অর্থশালী রুকনদের বিভিন্ন কাজে গরীব রুকনদেরকে কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

এ সকল বিষয়কে স্বতন্ত্রভাবে প্রস্তাবের রূপ দান করার ফলে এ আশংকা দেখা দিতে পারে যে, আমরা নিজেদের আদর্শ, লক্ষ্য ও তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে প্রচেষ্টা চালানো বাদ দিয়ে ছোট ছোট কাজে আত্মনিয়োগ করতে থাকবো। এবং এ কাজগুলিই আমাদের আসল প্রোগ্রামে পরিণত হবে। তাই এ ধরনের প্রস্তাবাবলী সভায় পেশ করার পরিবর্তে জামায়াতের রুকনদের মধ্যে নিজের ভাইকে যে কোনো প্রকারে সাহায্য করার সুযোগ থাকলে তাকে কার্যকরী করার স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা জাগ্রত হওয়া উচিত।

প্রস্তাব

বই-পত্রের প্রচারের জন্যে পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া ও দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলগুলির সভা-সম্মেলনে আমাদের বই-পত্রের স্টল লাগানো উচিত।

আমীরে জামায়াত

বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই যে, যে দৈনিক বা সাময়িক পত্র নিজের বিশেষ চিন্তার একটি দল সৃষ্টি করেছে, তার গ্রাহক-অনুগ্রাহকদের মধ্যে তার ঐ বিশেষ চিন্তার সাথে কোনো না কোনো প্রকারে সামঞ্জস্যশীল বস্তুসমূহের চাহিদা দেখা দেয়। যদি আমরা এমন সব পত্রিকায় নিজেদের বই-পত্রের বিজ্ঞাপন দেই, যারা জনগণের নিকট ভিন্ন ধরনের আবেদন জানায়, তাহলে তাদের গ্রাহক-অনুগ্রাহকদের নিকট থেকে আমাদের বিজ্ঞাপনের খরচ উঠবার মতো অর্ডারও আসার আশা নেই। তাই ধৈর্যসহকারে আমাদেরকে নিজেদের প্রচার ক্ষেত্রকে ব্যাপকতর করার জন্যে চেষ্টা চালাতে হবে। খোদার অনুগ্রহে আমাদের বই-পত্র নিজের জন্যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে এবং নিজের চুম্বক শক্তির সাহায্যে সে দিনের পর দিন অধিক সংখ্যক লোককে নিজের প্রতি আকর্ষণ করছে। এই সঙ্গে আমাদের রুকন ও সমর্থকবৃন্দ এবং আমাদের চিন্তা ও কর্মের প্রতি আগ্রহী ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গ যদি অনবরত প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের কখনো বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন অনুভূত হবে না।

সভা-সম্মেলনে স্টল লাগাবার ব্যাপারে অধিকতর সংগত পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, যে এলাকায় কোনো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তৎসংশ্লিষ্ট হাল্কা অথবা নিকটবর্তী হাল্কা বা কোনো স্থানীয় জামায়াত সেখানে স্টল লাগাতে পারে। কেন্দ্রীয় প্রকাশনীর প্রতিনিধিবৃন্দ প্রত্যেকটি সভা-সম্মেলনে বই-পত্র নিয়ে পৌছে যাবে, এটা তাদের মর্যাদার উপযোগী কাজও নয়।

প্রস্তাব
আধুনিক পদ্ধতিতে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানসমূহ সংকলন ও মুসলিম দেশসমূহের অবস্থা অনুযায়ী বই-পত্র তৈরি করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

প্রস্তাবটির প্রথমাংশ আমাদের একাডেমী প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। আর এর দ্বিতীয় অংশটিকে ইন্‌শাআল্লাহ আমাদের দারুল আরুবা অনেকাংশে কার্যকরী করতে সক্ষম হবে। কিন্তু বাইরের প্রত্যেকটি দেশের রাজনৈতিক, তামাদ্দুনিক, নৈতিক ও মানসিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেকের জন্যে পৃথব পৃথক বই-পত্র লেখা বড় কঠিন কাজ। দুনিয়ার প্রত্যেকটি বিশ্বজনীন আন্দোলন কোনো একটি এলাকা থেকে শুরু হয় এবং সূচনায় সংশ্লিষ্ট এলাকার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যে নীতিসমূহের ওপর ঐ আন্দোলনের ভিত্তি রচিত হয়, সেগুলিকে সমালোচনা, ব্যাখ্যা ও বাস্তব প্রয়োগ সহকারে পেশ করা হয়। অতঃপর যখন অন্যান্য দেশে ঐ আন্দোলনের প্রভাব পৌঁছে এবং স্থানীয় লোকেরা তদ্বারা প্রভাবান্বিত হয় তখন তারা নিজেরাই নিজেদের এলাকার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বই-পত্র রচনা করতে থাকে। কুরআন মজীদেও এই পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে। তাই বর্হিদেশের জন্যে তাদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পৃথক পৃথক বই-পত্র রচনার পরিবর্তে যে দেশটির অবস্থাকে আমরা উত্তমরূপে জানি তার অবস্থাকে সম্মুখে রেখে আমাদের কেন্দ্র থেকে বই-পত্র রচনা করে তা অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করাই অধিকতর সংগত ও বাস্তবানুগ পদ্ধতি বলে আমি মনে করি।

প্রস্তাব
রুকনদের ছোটখাটো বিষয়ে বিতর্ক ও এ ব্যাপারে ভারসাম্যহীন পন্থা অবলম্বন থেকে দূরে থাকা উচিত।

আমীরে জামায়াত

জামায়াত প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এ কাজটি সম্পাদন করা হচ্ছে। গঠনতন্ত্রে এ সম্পর্কে নির্দেশ রয়েছে এবং আমি সর্বদা নিজের লেখায় ও বক্তৃতায় এর ওপর জোর দিয়ে থাকি। কিন্তু রীতিমতো নির্দেশ দিয়ে এ কাজটি প্রতিরোধ করায় লাভের চাইতে ক্ষতির সম্ভাবনাই অধিক। যতই মানুষের মানসিকতা পরিবর্তিত হতে থাকবে এবং নতুন চিন্তাধারা তাদের পুরাতন চিন্তাধারার স্থান দখল করবে, ততই দ্রুত এ রোগটি স্বাভাবিকভাবে হ্রাস প্রাপ্ত হবে।

প্রস্তাব

প্রত্যেক স্থানীয় জামায়াতের নিজের শহরের ছাত্রবৃন্দ ও জনতাকে প্রতিমাসে একবার সভা-সম্মেলনে আহ্বান করা উচিত।

আমীরে জামায়াত

এ প্রস্তাবটি যদিও উপকারী তবুও আপাতত আমরা এটিকে গ্রহণ করতে পারছি না। কারণ, বহুস্থানে আমিদের জামায়াতসমূহের মধ্যে জনগণকে সম্বোধন করার যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী নেই। যেখানে এহেন যোগ্যতাসম্পন্ন রুকন আছেন, সেখানকার স্থানীয় আমীরগণকে এদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত। কিন্তু এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার পূর্বে আপনারা নিজেরা জনসভায় ও সুধী সমাবেশে বক্তৃতা করার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে পরীক্ষা করুন এবং তাদের সম্পর্কে আমাদের নিকটও প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করুন। উপরন্তু তাদের ওপর জনসমাবেশে বক্তৃতা করার দায়িত্ব অর্পণ করার পর তারা জামায়াতের ভুল প্রতিনিধিত্ব করবেন না এ ব্যাপারে আমাদেরকে নিশ্চিন্ত করুন।
সপ্তম অধিবেশন পর্যন্ত এ প্রস্তাবসমূহের জের চলতে থাকে। অতঃপর আমীরে জামায়াত মওলানা আমীন আহসান ইসলাহীকে বক্তৃতা করার জন্যে আহ্বান জানান।

সপ্তম অধিবেশন

(১৩৬৪ হিজরীর ৮ই জমাদিউল আউয়াল যোহরের নামাযের পর)

রিপোর্টসমূহের ওপর মন্তব্য প্রসঙ্গে মওলানা আমীন আহসান ইসলাহীর বক্তৃতা

বন্ধুগণ!

আপনাদের এই সম্মেলনে আমি আজ একটি অপ্রীতিকর কর্তব্য সম্পাদনে আদিষ্ট হয়েছি। আপনারা যে সকল রিপোর্ট পেশ করেছেন আমি তার ওপর মন্তব্য করবো, সেগুলির ত্রুটি সম্পর্কে আপনাদেরকে অবহিত করবো এবং আপনাদেরকে নিজেদের ভুল থেকে সতর্ক করবো। ঐ রিপোর্টগুলির ভালো ও প্রশংসনীয় দিকগুলি `বাদ দিয়ে আমাকে তাদের দোষ-ত্রুটির প্রতি দৃষ্টিপাত করতে হবে। এই দোষ অনুসন্ধান সম্ভবত আপনাদের অনেকের বিরক্তি উৎপাদন করবে, কিন্তু তবুও আমাকে এ দায়িত্ব সম্পাদন করতে হবেই। যদিও আমি আনন্দিত যে, আমীরে জামায়াত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আপনাদের কার্যাবলী সম্পর্কে মন্তব্যও করেছেন এবং আপনাদেরকে প্রয়োজনীয় পথ-নির্দেশও দান করেছেন, যার ফলে আমার কাজ অনেকটা হাল্কা হয়ে গেছে, তবুও কতিপয় বিষয়ে আমিও আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

রিপোর্ট লেখা

সর্ব প্রথম রিপোর্ট লেখা সম্পর্কে আমি আলোচনা করতে চাই। রিপোর্টে অপ্রয়োজনীয় ও অসম্পর্কিত আলোচনা মোটেই হওয়া উচিত নয়। রিপোর্ট লেখার সময় এ বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত যে, আপনি কোথায় থাকেন? সেখানে কার অবস্থা কি? জামায়াতের আদর্শ প্রচার ও প্রসারের সম্ভাবনা সেখানে কতটুকু? এতদিন পর্যন্ত আপনি কি করেছেন? ভবিষ্যতে কি করার সম্ভাবনা আছে? আপনার সাথীদের অবস্থা কি? সমর্থকদের সমর্থনের স্বরূপ কি? আপনাকে কোন কোন ধরনের ও কোন কোন পর্যায়ের বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে? এ সমস্ত বিষয় জানাই হচ্ছে রিপোর্টের মূল লক্ষ্য। তাই এই ধরনের প্রশ্নাবলীর জবাব দানের জন্য আপনার সমগ্র চেষ্টা নিয়োজিত হওয়া উচিত। কেন্দ্র ও এই ধরনের প্রশ্নাবলীর জবাব আপনার নিকট থেকে চায়। জামায়াতের রুকনগণও এ কথাগুলি জানার প্রত্যাশী। এছাড়া যে সকল অপ্রয়োজনীয় ও অসম্পর্কিত কথা আপনারা রিপোর্টে উল্লেখ করেন তার ফলে সময়ের অপচয় ও এই সংগে বহুবিধ ক্ষতিও হয়। বিশেষ করে ব্যক্তিগত অবস্থা ও ব্যক্তির প্রশংসা বা মর্যাদা সম্পর্কিত কোনো কথা এতে থাকা উচিত নয়। অবশ্যি সকল প্রকার প্রয়োজনীয় আলোচনার পরিপূর্ণ ও অপ্রয়োজনীয় আলোচনার লেশমুক্ত সুষ্ঠু ও সর্বাংগ সুন্দর রিপোর্ট লেখা চাট্টিখানি কথা নয়। এজন্যে যথেষ্ট পারদর্শীতার প্রয়োজন। কিন্তু আপনাদের মধ্যে যদি কেবল প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখার মানসিকতা সৃষ্টি হয়ে যায়, আপনাদের মন যদি আত্মপ্রশংসা ও অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রেরণামুক্ত হয় এবং অতিকথন ও চটকদার আলোচনায় প্রলুব্ধ না হয়, তাহলে একদিকে যেমন আপনাদের কাজ সহজ হয়ে যাবে, তেমনি অন্যদিকে আমাদের আসল উদ্দেশ্যও উন্নততর পদ্ধতিতে সম্পাদিত হবে।

দোষ স্বীকারের ফেতনা

আপনাদের রিপোর্ট থেকে একটি জিনিস আমি বিশেষভাবে অনুভব করেছি। দোষ স্বীকারের আকাংখা আপনাদের মধ্যে অত্যন্ত প্রবল। কোনো ব্যক্তি যদি সত্যই তার ত্রুটি স্বীকার করে, তাহলে তা অবশ্যি একটি সুঅভ্যাস কিন্তু এর একটি বিপজ্জনক দিকও আছে তা থেকে সতর্ক থাকা উচিত। এর ফলে এ বিষয়টি আপনাদের অভ্যাসে পরিণত হবার ও এর চাপে কর্তব্য সম্পাদনের চেতনা পিষ্ট হবার আশংকা রয়েছে। দ্বিতীয় আশংকা হচ্ছে এই যে, এর ফলে মানুষের মধ্যে অনেক সময় নম্রতাসুলভ আত্মস্তরিকতার সৃষ্টি হয় এবং এ ধরনের আত্মন্তরিকতা একটি ভয়াবহ ফেতনার দ্বারোদঘাটন করে। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক মুসলমানকে এ ফেতনা থেকে রক্ষা করুন, এটিই আমাদের কাম্য। কোনো ব্যক্তি যখন কোনো সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে, তখন তার জন্যে সকল প্রকার কষ্ট সহ্য করা ও সব রকমের নির্যাতন-নিপীড়নের পরোয়া না করা তার কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। যে ব্যক্তি সত্যকে ধ্বংস হতে দেখে এবং এ জন্যে তার মনে কোনো প্রকার উত্তেজনা সৃষ্টি হয় না, সে অবশ্যি দুটি অবস্থার মধ্যে যে কোনো একটির অন্তর্ভুক্ত হয় হকের সত্যিকার মূল্য ও মর্যাদা তার নিকট পরিষ্কার হয়নি এবং এটি জ্ঞান ও উপলব্ধির ত্রুটির কারণে হতে পারে আর নয়তো বাতিলের ভয় তার মনে আসন গেঁড়ে বসেছে এবং এটি হৃদয়বৃত্তির বিকৃতির ফলে সম্ভব। একজন সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির নিকট সর্বপ্রথম যে বস্তুটির আশা করা যেতে পারে তা হচ্ছে এই যে, সে কখনো হককে নির্যাতিত ও ধ্বংস হতে দেখে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। যে ব্যক্তি হককে নির্যাতিত হতে দেখে নীরব থাকে, তার মধ্যে মানবতার লেশ মাত্রও নেই। তার জন্মের জন্যে আফসোস করতে হয়। অধিকন্তু সে জীবিত আছে এটি এর চাইতেও বড় আফসোসের কথা। যদি মানুষের মধ্যে জ্ঞান ও বিদ্যার অভাব থাকে, তাহলে খোদার কিতাবের মাধ্যমে নিজের জ্ঞান বাড়ানো উচিত। আর যদি হিম্মতের অভাব থাকে, তাহলে আল্লাহর নিকট দোয়া করা উচিত যেন আল্লাহ তাকে আমল করার তৌফিক দান করেন এবং দুর্বল হিম্মত ও কাপুরুষতার ব্যাধি থেকে রক্ষা করেন।

জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠার পরও যদি আমাদের জ্ঞান নির্ভুল না হয়, আমাদের মনে কাপুরুষতার শয়তান ওঁৎ পেতে বসে থাকে এবং আমরা নিছক ত্রুটি স্বীকারের অন্তরালে নিজেদের দুর্বলতাগুলো ঢেকে রাখি, তাহলে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। মানুষের নিকট হককে আবরণমুক্ত করার জন্য আমরা বই-পত্র প্রকাশ করছি। একের দৃঢ়তা অন্যের দুর্বলতার ক্ষতিপূরণে সহায়ক হবে। তাই বর্তমানে হকের খেদমতের জন্যে যে প্রচেষ্টা ও তৎপরতার প্রয়োজন পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে তা সৃষ্টি করার জন্য আমরা জামায়াতী জীবন অবলম্বন করেছি। এখন জ্ঞান ও অনুসন্ধানের স্পৃহা সৃষ্টি করা ও জামায়াতী জীবনের বরকত হাসিলের চেষ্টা করা হচ্ছে আপনাদের কাজ। কিন্তু আমরা অত্যন্ত বিস্মিত হই যখন দেখি যে, লোকেরা নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কেও কামনা করে যে, তা যেন কেন্দ্র থেকেই পূর্ণ করা হয়। কেন্দ্র যেন বই-পত্র ছাপিয়ে তাদের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ করে। অতঃপর হস্ত ও পদের রূপ ধারণ করে যেন তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বও সম্পাদন করে। যারা এই ধরনের আশা পোষণ করেন, তাদের জেনে রাখা উচিত যে, যে কাজ তাদের করবার মতো তা অবশ্যি তাদেরকে করতে হবে। এবং সে কাজ কেবল আশা পোষণ করলে নয়, বরং বাস্তবে সম্পাদনে ব্রতী হলেই সম্পাদিত হতে পারে। আমরা এমন কোনো যাদুমন্ত্র জানি না, যার ফলে আমরা এখান থেকে বসে বসে ফুঁক দিলে সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। আমরা হককে আবরণমুক্ত করতে এবং তার খেদমতের ক্ষেত্রে নিজেদের ভূমিকা পালন করতে পারি, কিন্তু অন্যের মধ্যে এজন্যে হিম্মত সৃষ্টি করা আমাদের ক্ষমতার বাইরে।

অনেকে এও কামনা করেন যে, জামায়াতের কাজকে দ্রুততর করার জন্যে কোনো দ্রুতগতি সম্পন্ন জামায়াতের সাথে সহযোগিতা করা উচিত। তার দ্রুতগতি যে কোনো দিকেই হোক না কেন, তাতে কিছু চিন্তা করার নেই। যাদের মনে এ ধরনের চিন্তার উদয় হয়, তারা জামায়াতে ইসলামীর প্রকৃতি সম্পর্কে এখনো একেবারেই অনভিজ্ঞ। তাঁদের জামায়াতের বই-পত্র ভালো করে পড়া উচিত। এর ফলে তাদের চিন্তা জটিলতামুক্ত হবে। আমরা কেবল দ্রুতগতি চাই না, বরং যথার্থ দিকে দ্রুতগতি চাই। কোনো ভুল দিকে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হবার পরিবর্তে সঠিক দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকাই আমরা অধিক পছন্দ করি। যে ব্যক্তি কোনো ভুল পথে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছে, তার অবস্থা দেখে হিংসা করা নির্বুদ্ধিতা এবং তাকে অনুসরণযোগ্য মনে করা ধ্বংসের নামান্তর। যাদের মনে এ ধরনের চিন্তা উদয় হয় জামায়াতে ইসলামীতে প্রবেশ করার পরিবর্তে তাঁদের দ্রুতগতিবান জামায়াতসমূহের দ্রুতগতির কেরামতি আর কিছুদিন দেখে নেওয়া উচিত ছিল। এরপর যদি তারা আমাদের সংগে যোগ দিতেন, তাহলে হয়তো আমাদের এত বেশী সমস্যায় পড়তে হতো না।

বিরোধিদেরকে সাদরে গ্রহণ করতে হবে

অত্যন্ত আনন্দের কথা, জামায়াতের বিরোধিতার কারণে আমাদের রুকনদের মনে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল, তা অনেকটা কমে আসছে। এখন লোকদের মধ্যে বিরোধিতার মুকাবিলা করে সম্মুখে অগ্রসর হবার হিম্মত সৃষ্টি হচ্ছে। এটি হচ্ছে জামায়াতী জীবনের বরকত। এ বরকতের প্রকাশ এ কথার সাক্ষ্যবহ যে, আমাদের জামায়াতী জীবন সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু এ কথা জানা উচিত যে, আমরা যে পথে অগ্রসর হয়েছি, সেখানে চলার জন্যে কেবল বিরোধিতার ভীতি হ্রাস হয়ে যাওয়াই যথেষ্ট নয়, এটি হচ্ছে এ পথে চলার প্রথম দাবী। এগুণ সৃষ্টি করা ছাড়া এ পথে এক পদ অগ্রসর হওয়াও সম্ভব নয়। এ-পথের আসল দাবী এর চাইতে অনেক বড় এবং তা হচ্ছে এই যে, আমাদের মধ্যে বিরোধিতাকে সাদরে গ্রহণ করার মতো মানসিকতা থাকতে হবে। আল্লাহর নীতি হচ্ছে এই যে, মানুষ হক ও বাতিলের মধ্যে যে কোনো পথই অবলম্বন করুক না কেন সে পথে তাকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। আর হকের পথের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল পরীক্ষায় পরিপূর্ণ। একজন মেধাবী অংকের ছাত্র যেমন কোনো কঠিন অংক কষতে বসে আনন্দিত হয় এবং মনে করে যে, সে নিজে বুদ্ধিমত্তাকে পরীক্ষা করার আর একটি সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেছে, তেমনি একজন সত্যিকার দৃঢ়চেতা মু’মিন কোনো নতুন পরীক্ষার মুকাবিলা করে আনন্দিত হয়। কেননা, সে মনে করে যে, হকের প্রতি নিজের বিশ্বস্ততা প্রমাণের আর একটি সুযোগ সে লাভ করেছে। টিমটিম প্রদীপ অবশ্যি বাতাসের ঝাপটায় নিবে যায় কিন্তু প্রজ্বলিত অগ্নিকুন্ড বাতাসের ঝাপটায় দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। আপনারা নিজেদের মধ্যে এমন যোগ্যতা ও গুণাবলী সৃষ্টি করুন, যার ফলে একটি প্রজ্বলিত অগ্নিকুন্ডে ভিজে কাঠ নিক্ষেপ করলে যেমন তা নিবে যাওয়ার পরিবর্তে কাঠগুলিকে নিজের ইন্ধনে পরিণত করে, তেমনি আপনারা বিরোধিতা দেখে ভয় করার পরিবর্তে তা থেকে নিজেদের আহার ও শক্তি সংগ্রহ করুন। আমাদের মধ্যে এই যোগ্যতা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের দ্বারা আল্লাহর দ্বীনের কোনো উত্তম খেদমত সম্ভব নয়।

আপনারা যে সকল বিরোধিতার উল্লেখ করেছেন, সেগুলি বিভিন্ন ধরনের। কিন্তু তাদের মধ্যে ভয় করার মতো কিছুই নেই। দুনিয়ায় হকের খেদমতের জন্যে যখনই কোনো প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, তখনই সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিরোধিতাও সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে কুরআন আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে যে, এগুলি খোদার হিকমাত অনুযায়ী সৃষ্টি হয় এবং সাচ্চা মুমিন ও প্রবৃত্তির দাসের মধ্যে এগুলিই হচ্ছে পার্থক্য সৃষ্টির মানদন্ড। এবং এগুলির মাধ্যমে পর্দান্তরালে মানুষের স্বাধীন ক্ষমতার পরীক্ষা হয়। কাজেই এ বিরোধিতাগুলি দেখে ভীত হওয়া উচিত নয়। তবে আল্লাহর নিকট দোয়া করা উচিত যেন তিনি সকল পর্যায়ে আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখেন এবং আমাদের ঈমান ও হিম্মত সংরক্ষণ করেন।

একটি প্রশ্নের জবাব

জামায়াতের রুকনদের মনে সাধারণভাবে একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত যখন সম্পূর্ণরূপে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে গৃহীত বরং কুরআন ও সুন্নাহর আনুগত্যই এ দাওয়াতের মূল কথা এবং বিরোধীরাও চরম প্রচেষ্টা চালাবার পর এখনো এর কোনো কথা কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধী বলে প্রমাণ করতে পারেনি, তখন মুসলমানরা এ দাওয়াতটি গ্রহণ করার ব্যাপারে এত বিলম্ব করছে কেন? এ প্রশ্নটি আমাদের অনেককে বিস্ময়াবিষ্ট করেছে এবং অনেক সময় আমাদের অনেকের নিকট হক আবরণমুক্ত হয়ে যাবার পরও নিছক অন্যের অগ্রাহ্যের কারণে তা আবার তাদের চোখে মূল্যহীন প্রতিপন্ন হয়। তাই এ প্রশ্নটি সম্পর্কে চিন্তা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আমরা যতদূর চিন্তা করেছি তাতে উপলব্ধি করেছি যে, এই নির্ভেজাল দ্বীনী দাওয়াতের প্রতি মুসলমানদের নির্লিপ্ততার পিছনে গভীর কারণ রয়েছে। মুসলমানরা দু-একদিনে তাদের বর্তমান অবস্থায় পৌছেনি। তারা পর্যায়ক্রমে এ অবস্থায় আনীত হয়েছে এবং প্রতিটি মঞ্জিলে তাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে এই বলে নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, এ অবস্থাটিই বর্তমান কালে ইসলাম ও ঈমানের উপযোগী। তাদের হক থেকে সরে আসার পর দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়েছে এবং এই ভ্রান্ত পথের প্রতিটি মোড়ে তারা দীর্ঘকাল এই মনে করে অবস্থান করেছে যে, এটিই হচ্ছে দ্বীন ও শরীয়তের সরল-সোজা পথ। তাদের এই ভ্রান্ত ধারণাকে মজবুত করার ব্যাপারে আলেম সমাজও অংশগ্রহণ করেছেন এবং এই পথভ্রষ্টতাকে কেবল বৈধ নয়, বরং একে উত্তম প্রমাণ করার সপক্ষে ফিকাহ ও কালাম শাস্ত্রে বিরাট বিরাট পুস্তক রচনা করা হয়েছে। এমন কি তারা বিশ্বাস করে যে, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ শরীয়তের গন্ডির মধ্যে গৃহীত হয়েছে এবং আজো তারা শরীয়তেরই একটি স্থানে অবস্থান করছে, তা থেকে পৃথক কোনো স্থানে নয়। বলা বহুল্য, যে জামায়াতকে পর্যায়ক্রমে এভাবে অধঃপতিত করা হয়েছে এবং পতনকে এভাবে প্রচ্ছন্ন রাখা হয়েছে, যার অবনতির ইতিহাস এত দীর্ঘ, যাকে বলা হয়েছে যে, তার এ পতন নয় বরং উত্থান, যে এ বিভ্রান্তির মধ্যে যুবে আছে, সে তার বর্তমান অবস্থায়ও শরীয়ত থেকে পৃথক অবস্থান করছে যে, বরং শরীয়ত অনুযায়ী জীবন পথে অগ্রসর হচ্ছে, সে আপনাদের দাওয়াতকে কেমন করে সহজে গ্রহণ করতে পারে? আপনাদের এ দাওয়াত তো তার নিকট কোন আংশিক সংস্কার ও সংশোধনের দাবী জানায় না বরং যথার্থ তওবা ও পরিপূর্ণ সংশোধন দাবী করে যখন আপনারা তার নিকট দাবী জানান।

-يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا آمِنُوا

(অর্থাৎ তোমরা যারা ঈমানের দাবী করো, তারা সত্যিকারভাবে ঈমান আনো।)

এবং এই সঙ্গে তার আমল থেকে শুরু করে আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যেও খুঁত ধরিয়ে দেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে এতে মর্মাহত হয় এবং তার দ্বীনদারীর পুরাতন প্রাচীরে ফাটল দেখা দেয়। সে যে এ পর্যন্ত একটি ভুল পথে ছুটে চলছিল, একথা সহজে মানতে প্রস্তুত হয় না। মানুষের প্রকৃতি হচ্ছে এই যে, সে নিজেকে সর্বাধিক সুবিধা লাভের হকদার মনে করে। আর মুসলমানদের মধ্যে এ ভুল ধারণাও আছে যে, ইসলাম হচ্ছে বড় সহজ ধর্ম, একে যে কোনো অবস্থা অনুযায়ী ঢেলে সাজানো যায়। তাই আপনারা তাদেরকে যে সংকীর্ণ পথ দেখাচ্ছেন, তার ওপর আসতে তারা ভয় পাচ্ছে এবং মনে করছে যে, তারা যে অবস্থার মধ্যে আছে, সেটিও দ্বীনদারীর বাইরে নয়, তাই বিনা কারণে জীবনকে গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে লাভ কি? কাজেই যতদিন না আপনারা তাদের ওপর এ সত্যটি সম্পূর্ণরূপে উদঘাটিত করে দেবেন যে, তাদের বর্তমান জীবন ইসলাম থেকে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং এ সত্যটি স্বীকার করার জন্যে আপনাদের যুক্তি-প্রমাণের দ্বারা তাদের হৃদয় দুয়ার উন্মুক্ত করে দেবেন না, ততদিন পর্যন্ত তারা আমাদের দাওয়াত গ্রহণ করবে এ আশা করা যেতে পারে না। কিন্তু এটা মোটেই সহজ কাজ নয়। আমাদের দাওয়াতের এই দিকটিকে লোকেরা ভয় করে এবং এখান থেকে নানান বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি হয়। উপরন্তু বিরুদ্ধবাদীরা লোকদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করার জন্যে এখান থেকেই মাল-মসলা সংগ্রহ করে। তাই কমপক্ষে আমাদের জামায়াতের আমীরগণের আমাদের দাওয়াতের এদিকটিকে ভালোভাবে বুঝে নেয়া উচিত এবং যারা এদিকটিকে ভালোভাবে বুঝতে পারেননি, তাদের কমপক্ষে এদিকটি সম্পর্কে লোকদের সংগে কোনো প্রকার আলোচনা করার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। অন্যথায় অনর্থক আমাদের কাজে বাধার সৃষ্টি হবে।

আলেম সমাজের উদাসীনতা

আমাদের দাওয়াত থেকে সাধারণ মুসলমানের নির্লিপ্ত থাকার কারণ ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। আর আলেমগণের নির্লিপ্ততা সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, তাঁদের সম্পর্কে প্রত্যেক ব্যক্তিই জানে যে, তাঁরাই মুসলমানদেরকে তাদের বর্তমান অবস্থায় উপনীত করেছেন। বর্তমান কালে দ্বীনদারী, তাকওয়া, ঈমান, ইসলাম, তাওহীদ ও রিসালাতের যে অর্থ জনগণের মনে স্থান লাভ করেছে তা তাঁদেরই সৃষ্ট। তাঁরা আন্তরিকতার সাথে একথা মনে করেন যে, সকল প্রকার বিপদ-আপদ থেকে ইসলামকে বাঁচিয়ে রাখা তাঁদের কর্তব্য ছিল এবং এখনো তাঁরা ইসলামকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এহেন সুদীর্ঘ সুধারণার মধ্যে যারা অবস্থান করছেন, তাদের সম্পর্কে আপনারা কেমন করে আশা করতে পারেন যে, তারা আজ খোলা মনে একথা স্বীকার করবেন যে, এ পর্যন্ত তারা ভুল পথ দেখিয়ে এসেছেন এবং অমুক জামায়াত সঠিক পথের দিকে দাওয়াত দিচ্ছে। নিঃসন্দেহে এই সত্যের দ্ব্যর্থহীন স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে লজ্জা অনুভব না করাই হচ্ছে হকপরস্তির দাবী। কুরআন হকপন্থীদের শ্রেষ্ঠতম গুণ বর্ণনা প্রসংগে বলেছে যে, ‘হককে স্বীকার করা ও ঘোষণা করার ব্যাপারে তারা কোনো নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করে না’। কিন্তু মানব প্রকৃতির দুর্বলতা সাধারণ মানষের ন্যায় বিশেষ শ্রেণীর মধ্যেও বিদ্যমান। আমাদের জনগণ যেমন তাদের দ্বীনদারীর অহংকারের কারণে ঈমানকে নতুন করে গ্রহণ করাকে লজ্জাকর মনে করে, অনুরূপ আমাদের বিশেষ শ্রেণীও নেতৃত্বের অহংকারের কারণে নিজের মুখে নিজের নেতৃত্বের ভ্রান্তিকে স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত নন। তাঁরা ভুল পথে এতদূর অগ্রসর হয়ে গেছেন যে, সেখান থেকে ফিরে আসা তাঁদের পক্ষে মোটেই সহজ নয়। আপনাদের এই সত্যটিকেও সম্মুখে রাখা উচিত যে, দ্বীনদারীর অনুভূতির ফেতনা দুনিয়াদারীর ফেতনার চাইতে অনেক বেশী কঠিন হয়ে থাকে। দুনিয়াদারীর পথ দিয়ে অগ্রসর হয়ে যারা কোনো প্রবৃত্তিপূজায় লিপ্ত হয়, তাদের হৃদয় মুকুরে হকের আলোকস্ফুরণ হবার সাথে সাথেই তাদের চোখ খুলে যায় এবং সঠিক পথরেখা তাদের দৃষ্টি সমক্ষে জেগে ওঠে। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাফলতি, দুর্বল হিম্মত ও এই ধরনের বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়ে থাকে। মানসিক অবস্থার সামান্য পরিবর্তনের সাহায্যে এগুলো দূর হতে পারে। কিন্তু যারা এই ভুলগুলিকে দ্বীন ও তাকওয়ার রূপদান করে এগুলো পূজা করে ও অন্যের নিকট থেকে পূজা লাভ করে, এই প্রিয় বুতগুলিকে ভেঙ্গে চুরমার করে একটি নতুন দ্বীন গ্রহণ করা তাদের জন্যে মোটেই সহজ নয়। এটিই হচ্ছে বৃহত্তম জিহাদ এবং অতি অল্পসংখ্যক লোকের মধ্যে এর যোগ্যতা থাকে। আমাদের আলেম সমাজের মধ্যেও এ দুর্বলতা আছে বলে বিস্মিত হবার কোনো কারণ নেই। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেককে পরীক্ষার মধ্যে নিক্ষেপ করেন। যাদের দৃষ্টি যত তীক্ষ্ণ ও প্রখর তাদের পরীক্ষার জালও ততই সুক্ষ্ম ও প্রচ্ছন্ন।

আমাদের দাওয়াতের মধ্যে ভ্রান্তি কোথায়-একথা তাদের একজনও আজ পর্যন্ত বলতে পারলেন না। বরং আমরা যা কিছু করছি এটিই হচ্ছে ইসলামের আসল দাবী, একথা তাদের প্রত্যেকেই স্বীকার করেছেন। যেহেতু তাদের দিল একথা মানতে প্রস্তুত নয় তাই তারা এর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু অভিযোগ তৈরি করে নেন। আর শিক্ষিত লোকেরা যদি সূর্যের চাইতেও উজ্জ্বল হকের বিরুদ্ধে কিছু বলতে উদ্যত হয়, তাহলে অবশ্যি তারা সেখানে কিছু না কিছু খুঁত বের করেই নেয়। কাজেই এরাও কিছু না কিছু খুঁত বের করে নিয়েছেন। আসল দাওয়াতের মধ্যে কোনো খুঁত বের করতে না পারলে তারা আহ্বায়কের মধ্যে কোনো খুঁত বের করেন ও বলেনঃ যদিও এ দাওয়াত কুরআন ও সুন্নাহর দাওয়াত কিন্তু এর আহ্বায়কদের ওপর যেহেতু কোনো আস্থা নেই, তাই তাদের পিছনে চলার পরিবর্তে অমুক অমুক ব্যক্তির পিছনে চলো। এই শেষোক্ত লোকদের দাওয়াতের মধ্যে যদিও খুঁত আছে, কিন্তু তারা নিজেরা মুত্তাকী এবং আস্থা লাভের যোগ্য। কী মর্মান্তিক ব্যাপার। তারা ব্যক্তিকে হকের স্থান দান করেছে। ব্যক্তি কাবার পরিবর্তে গির্জার পথ অবলম্বন করলেও সে যেখানেই যাবে হক হবে তার সহযোগী। জাহেলী বিদ্বেষ ও ব্যক্তিপ্রীতির এর চাইতে মারাত্মক দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে। হকপরস্তির দাবীদার হবার কারণে তাদের কাজ এই হওয়া উচিত ছিল যে, আমরা যা বলছি তা যদি হক হয়ে থাকে এবং তাকে গ্রহণ করার ব্যাপারে নিছক আমাদের দুর্বলতা তাদের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে থাকে, তাহলে তারা নিজেরাই অগ্রসর হয়ে এর আহ্বায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন এবং ইনশাআল্লাহ তাদের পিছনে চলতে আমরা কোনো প্রকার লজ্জা অনুভব করতাম না। কিন্তু এই অদ্ভুত যুক্তি বুঝতে আমরা অক্ষম যে, তারা জেনেশুনে একটি ভুল পথে চলতে পারেন যদি তার আহ্বায়ক তাদের মতানুযায়ী দ্বীনদার হয়ে থাকেন। অথচ একটি নির্ভুল পথে চলতে তারা অক্ষম যার নির্ভুলতা তারা নিজেরাও স্বীকার করেন যেহেতু তার আহ্বায়কের গায়ে পারিভাষিক দ্বীনদারীর লেবেল আঁটা নেই। মনে হয় এরা ক্যাথলিক চার্চের ন্যায় নিজেদের ক্ষেত্রের বাইরে আর কোথাও দ্বীনদারীর অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। নিজেদের এই যুক্তির সমর্থনে তাঁরা কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারেন না। আমরা বিশ্বাস করি নিজেদের এই অবস্থার ওপর তারা নিজেরাও নিশ্চিন্ত, নন এবং অতি শীঘ্র তারা নিজেদের ভুল ধরতে পারবেন। আজ নয় তো কাল তারা দেখতে পাবেন যে, হক ব্যক্তি ও দলের মুখাপেক্ষী নন এবং মানুষ হকের স্থলে ব্যক্তিকে কেন্দ্রস্থলে পরিণত করে হকের নয় কেবল নিজের ক্ষতি সাধন করে।

রাজনৈতিক দলসমূহের পক্ষ থেকে বাধা

জনগণের নির্লিপ্ততা ও আলেম সমাজের বেপরোয়া দৃষ্টিভংগীর সাথে সাথে কতিপয় রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেও আপনারা অভিযোগ করেছেন। ঐ দলগুলির বিরোধিতা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের ও তাদের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। আমাদের সাফল্য ও উন্নতির মধ্যে আসলে তাদের মৃতু নিহিত। এ কারণে যদি তারা আমাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে পারে এবং এই সংগে নিজেদেরকেও বুঝতে পারে, তাহলে তারা আমাদের বন্ধু নয়- শত্রু হওয়া উচিত। এবং তাদের পক্ষ থেকে সবকিছু বরদাশত করার জন্যে আমাদের প্রস্তুত থাকা উচিত। সমকালীন রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে এমন একটি দলও নেই- আমাদের দাওয়াত ও সাহিত্যের আঘাত যার ওপর সরাসরি পড়েনি। আপনারা তাদের প্রত্যেকের কাজকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করেছেন এবং প্রত্যেকের অস্তিত্বকে বাতিল গণ্য করেছেন। অতঃপর আপনারা কেমন করে আশা করতে পারেন যে, তারা আপনাদেরকে ভালো বাসবে? রাজনৈতিক দলসমূহ জীবন ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম করে। প্রতিযোগীদেরকে ভেঙ্গে ফেলা বা আপন করে নেয়াই হচ্ছে তাদের নীতি। তাদের নিকট থেকে কোনো নরম নীতির আশা করা ভুল। কিন্তু তাদের বিরোধী ভূমিকা দেখে আতংকিত হবারও কোনো কারণ নেই। প্রত্যেক বিরোধিতা ভয়ের কারণ হয় না। কোনো আদর্শবাদী দলের পক্ষ থেকে যে আদর্শভিত্তিক বিরোধিতা হয় একমাত্র সেই বিরোধিতাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে। মুসলমানদের মধ্যে কোনো আদর্শবাদী দলের কথা আমি এখনো জানতে পারিনি। তাদের অবস্থা বন্যার প্রবাহে ভাসমান খড়কুটোর চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাতিলও যদি হিম্মত ও সাহসের ভিত্তিতে অগ্রসর হয় এবং তার কথা ও কর্মের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে তাহলে সেও একটি বিরাট শক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলসমূহ যে হকের ছদ্মবেশধারী বাতিলকে নিয়ে অগ্রসর হয়েছে, তা এক মুহূর্তকালও ময়দানে তিষ্ঠাতে পারবে না। তাদের দুর্বলতাসমূহ সম্পর্কে তারা নিজেরাই ওয়াকিফহাল, আর যদি তারা এখনো ওয়াকিফহাল না হয়ে থাকে, তাহলে আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে, অতিশ্রীঘ্রই তারা সে সম্পর্কে অবগত হবে। এবং সেদিনও দূরে নয় যেদিন এই দলগুলো তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যে আমাদের শেখানো বুলির মধ্য থেকে কোনো একটি বুলি আওড়াতে এবং নিজেদের অচল মুদ্রাকে আমাদের নির্ভেজাল মুদ্রার সাথে মিলিয়ে চালাবার জন্য চেষ্টা করতে বাধ্য হবে। আপনাদের মধ্য থেকে যারা যুগের গতিধারার প্রতি লক্ষ্য রাখেন, তারা আমার এ ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা স্বীকার করবেন। কেননা, বর্তমানে আমাদের বহু শব্দ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এইসব শব্দের ধর্মীয় আকর্ষণের সাহায্যে তারা নিজেদের পতনশীল মর্যাদাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে। আমাদের অনেক রুকন এ পরিস্থিতিকে আশংকাজনক মনে করেন। তাদের ধারণা, আমাদের পরিভাষাসমূহ যদি ঐ দলগুলি গ্রহণ করে নেয়, তাহলে অতিশীঘ্রই জনগণের মনে ঐ পরিভাষাসমূহের এমন ভুল অর্থ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, যার ফলে তার সংশোধনের জন্যে আমাদেরকে পৃথকভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। উপরন্তু লোকদের মধ্যে এ ধারণাও বিস্তার লাভ করবে যে, ঐ রাজনৈতিক দলগুলি যা চায়, আমরাও তাই চাই। কিন্তু আমি এতে কোনো প্রকার আশংকার কারণ দেখি না। জামায়াতের জন্যেও এর মধ্যে কোন বিপদ নিহিত নেই। ‘তবে ঐ দলগুলি যদি সদিচ্ছার সাথে এই পরিভাষাগুলি ব্যবহার না করে, বরং নিছক জনগণকে ধোকা দেবার জন্যে ব্যবহার করে থাকে, তাহলে এর মধ্যে আমি তাদের মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করছি। বর্তমানে যখন আমাদের কাজ জারী আছে, আমাদের বইপত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং আমরা সুধী সমাজ থেকে জনগণের মনের নিকটে পৌঁছাবার জন্যে চেষ্টা করছি, তখন আমরা এ ভয় করি না যে, লোকেরা আমাদের পরিভাষার অন্তরালে আশ্রয় নেবে। বেশী দিন নয়, অতি অল্পকালের মধ্যেই আমাদের কথা অট্টালিকার ওপর থেকে ঘোষিত হবে, গলি-কুচার মধ্যে শ্রুত হবে এবং সাধারণ লোকেরাও তার সেই অর্থ গ্রহণ করবে, যা আমরা তাদেরকে বুঝাবো। তখন পর্দান্তরালে লুকানো কারুর পক্ষে সম্ভব হবে না। হয় লোকদেরকে আমাদের পেশকৃত সত্যকে দ্ব্যর্থহীন স্বীকৃতি দিতে হবে আর নয়তো ময়দান থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। এখনো আমরা নিজেদের সম্পূর্ণ কথা বলতে পারিনি এবং লোকেরাও তা পুরোপুরি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি। একারণে প্রতারণা করার ও প্রতারিত হবার উভয়েরই সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এ সকল সম্ভাবনার প্রতিরোধের জন্যে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি, ইনশাআল্লাহ আমরাই বিজয় লাভ করবো। খোদার নীতি হচ্ছে এই যে, হক ময়দানে না আসা পর্যন্ত বাতিল জীবন ধারণের অবকাশ লাভ করে। কিন্তু যখন হক ময়দানে অবতরণ করে, তখন আল্লাহ তাআলা তাকেই বিজয় দান করেন। আমি মুসলমানদের দ্বারা গঠিত বর্তমান রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলগুলোর কোনো একটির মধ্যেও আমাদের নির্মিত বটিকাসমূহ হজম করার যোগ্যতা আছে বলে মনে করি না। তাদের কোনো একটি দলেরও কোনো রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মনীতি নেই এবং যে চরিত্রের ভিত্তিতে একটি দল বিজয় লাভ করতে পারে, তাদের কারুর মধ্যেই সে চরিত্র নেই। নেই নাৎসী, কম্যুনিস্ট ও তথাকথিত গণতন্ত্রের নিশানবরদাররা যে যোগ্যতার প্রদর্শনী করেছে বাতিল-পন্থীদের মধ্যে তা উপস্থিত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইসলামের ন্যায় মহান সত্যের দাবীদারদের মধ্যে আজ কোনো শক্তি ও যোগ্যতার অস্তিত্ব নেই। তাদের অস্তিত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যের নিকট থেকে ধার করা বরং চুরি করা শব্দাবলীর ওপর প্রতিষ্ঠিত।

খেলাফাতে রাশেদা সম্পর্কে একটি সাধারণ বিভ্রান্তি

বন্ধুগণ। আপনাদের অনেকেই এ, প্রশ্নও উত্থাপন করেছেন যে, জামায়াতে ইসলামী যে আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তা দুনিয়ার সর্বোত্তম ব্যক্তিদের দ্বারাও মাত্র ৩০ রছরের অধিককাল প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারেনি। কাজেই আজ এই. আদর্শকে কায়েম করার মতো লোক কোথেকে আসবে এবং তাদের হাতে এ আদর্শ অধিককাল প্রতিষ্ঠিত থাকবেই বা কেমন করে? যদিও আপনাদের মধ্যে থেকে মাত্র কয়েকজন এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, তবুও এটি একটি সাধারণ প্রশ্ন, বহু লোকের মনে এ প্রশ্ন দোলা দিচ্ছে এবং এ কারণে অনেকে মনে করে যে, যথার্থ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা কোনো কালে সম্ভব নয়। আর যদি সম্ভব হয়েও, থাকে, তাহলেও এটি একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টায় পর্যবসিত হবে। কেননা, সর্বোত্তম ব্যক্তিদের সাহায্যে যখন তা মাত্র স্বল্পকাল প্রতিষ্ঠিত ছিল, তখন বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্ব সম্পর্কে কি আশা করা যেতে পারে?

অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, একথা আজ অরাও বলছেন, যারা আলেম নামে খ্যাত। সম্ভবত তাঁরা জানেন না যে, এ কথা বলার, অর্থ হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে ভোট দেয়া। যদি ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মধ্যে এই প্রকৃতিগত দুর্বলতা থেকে থাকে যে, তা সর্বোত্তম হয়েও মাত্র কয়েক দিনের অধিক কায়েম থাকতে সক্ষম না হয়, তাহলে কেবল ইসলামী জীবন ব্যবস্থার চিন্তা পরিহার করা উচিত নয় বরং মূলত ইসলাম থেকেও নিরাশ হয়ে যাওয়া উচিত। কেননা, ইসলামের জীবন ব্যবস্থার বাইরে তার জীবনের ধারণাই করা যেতে পারে না। কাজেই কোনো সত্যিকার ও খাঁটি মুসলমানের মনে এ ধরনের চিন্তার উদয় হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আপনারা প্রকাশ করেছেন যে, এ সন্দেহটি সাধারণভাবে মানুষের মনে দেখা দিয়েছে এবং এ কারণে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সাধারণ ভাবে নৈরাশ্য দেখা যায়। এজন্যে এ বিভ্রান্তিটি দূর করা অপরিহার্য।

বন্ধগণ। আপনারা জানেন, আল্লাহ তাআলা আমাদের নিকট দাবী করেননি যে, আমাদেরকে হযরত আব বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও হযরত উমরের (রাঃ) ন্যায় আদর্শ রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে। বান্দাদের এ শক্তি নেই এবং খোদা তাদেরকে এ জন্যে কষ্ট দেননি। তবে আমাদের নিকট দাবী করা হয়েছে যে, আমাদেরকে খোদার দ্বীন কায়েম করার জন্যে প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং এজন্যে নিজেদের জীবনের সমস্ত সম্পদ নিয়োগ করতে হবে। এজন্যে আমাদের ধন, প্রাণ ও সকল প্রকার প্রিয় ও মূল্যবান বস্তু নিয়োগ করতে হবে। আর দ্বীন অর্থ তার কোনো একটি অংশ নয়, তা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, বরং সম্পূর্ণ দ্বীনকে কায়েম করাই উদ্দেশ্য। তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ থেকে নিয়ে বৃহৎ অংশসমূহ আকীদা-বিশ্বাস ও কর্ম সমস্ত কায়েম করাই এখানে উদ্দেশ্য। এ প্রচেষ্টা পরিপূর্ণ প্রেম ও আবেগের সাথে চালাতে হবে। আল্লাহর নিকটও এ বস্তুটিই হচ্ছে আমাদের ঈমান ও নেফাকের কষ্টিপাথর। এই আবেগ ও প্রেরণাশূন্য বক্ষে কোনো দিন ঈমান স্থান লাভ করতে পারে না। এবং এই বেদনার সাথে অপরিচিত বক্ষ কোন দিন খোদার গৃহে পরিণত হতে পারে না। যতই তসবীহ জপা হোক, যতই ওযীফা পাঠ করা হোক এবং যতই যিকির করা হোক না কেন, তা কোনো দিন এই প্রেমের প্রতিবদলে পরিণত হতে পারে না। এটিই হচ্ছে সমগ্র দ্বীনদারীর প্রাণ। খোদা সর্বপ্রথম আমাদের দিলের মধ্যে এ বস্তুটির সন্ধান করবেন। উপরন্তু এ প্রচেষ্টা ব্যক্তিগতভাবে নয় দলবদ্ধভাবে চালানোরও শর্ত লাগানো হয়েছে। নিজের মধ্যে সর্বপ্রথম এই উষ্ণতা সৃষ্টি করা অতঃপর এ অগ্নি থেকে যেন সমগ্র হৃদয় জ্বলে ওঠে, এ জন্যে প্রচেষ্টা চালানোই হচ্ছে প্রত্যেকটি সত্যানুসারী মানুষের কর্তব্য। এ প্রচেষ্টার ফলাফল কি হবে, এ প্রশ্ন আলোচনার কোনো অবকাশ এখানে নেই। আমাদেরকে করাত দ্বারা দ্বিখন্ডিত করা যেতে পারে, গলিপথে টেনে-হিঁচড়ে আহত করা যেতে পারে, আগুনের ওপর শায়িত করা যেতে পারে, চিল ও কাকের দল আমাদের দিল ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করতে পারে এবং এতসব ব্যাপারের পরও হয়তো আমরা বর্তমান বাতিল ব্যবস্থাকে হক ব্যবস্থার দ্বারা পরিবর্তিত করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারব না। কিন্তু এ ব্যর্থতা ব্যর্থতা নয় এবং এ ব্যর্থতার আশংকাই নয় বরং একে নিশ্চিত জানার পরও খোদা আমাদের নিকট তাঁর দ্বীন কায়েম করার জন্যে যে দাবী জানিয়েছেন, তা থেকে আমরা নিষ্কৃতি লাভ করতে পারি না। এটি হচ্ছে একটি অপরিহার্য কর্তব্য, যে কোন মূল্যে ও যে কোন অবস্থায় আমাদের এ কর্তব্য সম্পাদন করতে হবে। যদি হিন্দুস্তানের সকল খানকা আপনাদেরকে এ নিশ্চয়তা দান করার চেষ্টা করে যে, অমুক অমুক কাজ আপনাদেরকে এ দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি দান করতে পারে, তাহলে আমি আপনাদেরকে নিশ্চয়তা দান করতে চাই যে, এটি হচ্ছে শয়তানের প্রতারণা। যতক্ষণ আপনারা সশরীরে বিদ্যমান আছেন, যতক্ষণ খোদার দ্বীনের ইমরতের একটি ইটও তার নিজস্ব স্থান থেকে সরে আছে এবং যতক্ষণ খোদার দুনিয়ায় একটি ক্ষুদ্রতম স্থানও গায়রুল্লাহর আনুগত্যের খপ্পরে পিষ্ট হচ্ছে, ততক্ষণ আপনাদের জন্যে আরাম হারাম হয়ে গেছে। এই প্রচেষ্টার পরিণাম কি হবে তা আমরা বলতে পারি না। পরিণামের খবর একমাত্র আল্লাহ তাআলাই জানেন। এই প্রচেষ্টার ফলে যদি আমরা একটি সৎ ও সুন্দর ব্যবস্থা কায়েম করতে সক্ষম হই, তাহলে তা আল্লাহ তাআলার পুরস্কাররূপে বিবেচিত হবে। অনেকে বিদ্রুপ করে বলেন যে, আমরা রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করার জন্যে এসব প্রচেষ্টা চালাচ্ছি এবং ইসলামের মূলকথা যে খোদার সন্তুষ্টি লাভ তা আমাদের সম্মুখে নেই। এ চিন্তা আগাগোড়াই ভ্রান্ত। খোদার দ্বীনের প্রতিষ্ঠা ও একটি সৎ-সুন্দর খোদায়ী ব্যবস্থা কায়েম করার জন্যেই আমরা যাবতীয় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ প্রচেষ্টা চালানো কোনো অপরাধ নয় এবং এজন্যে আমাদের লজ্জিত হবারও কোনো কারণ নেই। আমরা যখনই হুকমাতে ইলাহিয়ার নাম উচ্চারণ করি, সেখানে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থাই হয় আমাদের উদ্দেশ্য এবং এ রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রিয় ও আকাংখিত হবার ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। খোদার সন্তুষ্টি অর্জন থেকে এ বস্তুটি কেমন করে পৃথক থাকতে পারে? খোদার দুনিয়ায় খোদার নির্দেশাবলী প্রবর্তিত হবে এর চাইতে অধিক আর কোন বিষয়ের মধ্যে খোদার সন্তুষ্টি নিহিত থাকতে পারে? আর তাদের চাইতে অধিক খোদার সন্তুষ্টির প্রত্যাশী আর কে হতে পারে, যারা খোদার যমীন থেকে গায়রুল্লাহর কর্তৃত্ব সমূলে বিনাশ সাধনের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করে? এ প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম যদি দুনিয়াদারী হয়ে থাকে, তাহলে রাত জেগে আল্লাহর যিকির করা ও দিনে খোদার দুনিয়ায় শয়তানের রাজত্ব বিস্তারের জন্যে প্রচষ্টা চালানোই কি দ্বীনদারী? যারা এ ধরনের কথা বলে থাকেন, তাদের মনে দ্বীনের অত্যন্ত বিকৃত চিন্তা স্থান লাভকরেছে এবং তাদেরকে দ্বীনের যথার্থ অর্থ উপলব্ধি করার জন্যে অবকাশ দান করাই উত্তম নিবেচিত হবে।

যদি যথার্থ ইসলামী ব্যবস্থা মাত্র ৩০ বছর কায়েম থেকে থাকে, তাহলে এর বিনিময়ে আমাদের সমগ্র জীবন বিকিয়ে দিলেও অন্যায় হবে না। বরং যে উত্তম ও সত্য-সুন্দর ব্যবস্থার অধীনে খোদার বান্দা মাত্র একটি রাত খোদার গোলাম হয়ে থাকার সুযোগ পায়, তা খোদা ছাড়া অন্যের গোলামীতে অতিবাহিত হাজার হাজার বছর ও মাসের চাইতে উত্তম। আপনারা ৩০ বছর বলছেন, কিন্তু আমি তো তার ৩০টি মিনিটও অনেক বেশী মনে করি এবং আমার ও আমার ন্যায় আরো লক্ষ লক্ষ জীবনকে এর বিনিময়ে কিছুই মনে করি না। চিন্তা করুন, দুনিয়ার সকল রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে গণতন্ত্রকে শ্রেষ্ঠ মনে করা হয় কিন্তু এর সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে একথা বলা যেতে পারে যে, মূলত দুনিয়ায় প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা নেই এবং বাস্তবে কোনো দিন এক মুহূর্তের জন্যেও কোথাও তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং কোনো দিন তা প্রতিষ্ঠিত হবে বলে চিন্তাও করা যায় না। তবু আপনরা দেখছেন, এই মরীচিকার জন্যে মানুষ কত বিরাট বিরাট কোরবানী দিয়ে যাচ্ছে। তাহলে এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আপনারা কেমন করে নৈরাশ্যের শিকার হতে পারেন, যেটি আপনাদের কথা মতো ৩০ বছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং যার শাস্তি স্থাপন, শৃংখলা বিধান ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে স্বপক্ষ-বিপক্ষ উভয়ই সাক্ষ্য প্রদান করে?

কিন্তু ইমলামী ব্যবস্থা মাত্র ৩০ বছর প্রতিষ্ঠিত ছিল এ কথা বলা ইতিহাসের নিতান্ত অগভীর অধ্যয়নের পরিচায়ক। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবের কারণে ব্যক্তির পরিবর্তন ও ব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্যে লোকেরা পার্থক্য করেন। অথচ উভয়ের মধ্যে আসমান যমীনের তফাৎ। খেলাফাতে রাশেদার অবসানের পর যে পরিবর্তন সূচিত হয়, তা শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন ছিল না, বরং ব্যক্তি ও শাসকের পরিবর্তন ছিল। দেশে পূর্বের আইন অব্যাহত ছিল, রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র অপরিবর্তিত রইলো, আল্লাহর রচিত দন্ডবিধিই দেশে প্রচলিত ছিল, আল্লাহর নির্ধারিত ভালো-মন্দের সীমানাই দেশে প্রতিষ্ঠিত ছিল। কুরআন প্রবর্তিত আইন অনুযায়ী সম্পত্তি বণ্টন করা হতো। কেবল এই ব্যবস্থার পরিচালকদের মধ্যে এই পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল যে, তারা সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) ফারূকে আযমের (রাঃ) ন্যায় মুত্তাকী ও খোদাভীরু ছিলেন না। তবুও তাদের মধ্যে কারুর জন্যে খোদার আইনের পরিবর্তে নিজের আইন প্রবর্তন করা সম্ভব ছিল না। তাদের কেউ যদি খোদার কোনো নির্দেশের দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে চাইতেন, তাহলে তাকে নানা প্রকার ধর্মীয় বাহানাবাজির আশ্রয় গ্রহণ করতে হতো। তাদের মধ্যে নিকৃষ্টতর ব্যক্তিও খোদার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ করার সাহস করতেন না। এ কারণেই পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি যে, খেলাফতের মসনদে যখনই কোনো খোদাভীরু লোকের আবির্ভাব ঘটেছে, তখনই রাতারাতি দুনিয়া ফারুকে আযমের (রাঃ) শাসনামলের ন্যায় শান্তি ও শৃংখলায় ভরপুর হয়ে উঠেছে এবং মনে হয়েছে বুঝিবা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আদতে কোনো প্রকার ত্রুটি সৃষ্টি হয়নি। এবং একথা সত্য যে, আসলে রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে দীর্ঘকালীন সংশোধনের উপযোগী কোনো মৌলিক পরিবর্তন সাধিতই হয়নি। কেবল তার উপরিভাগে বিকৃতি দেখা দিয়েছিল এবং মামুলি পরিবর্তনের মাধ্যমে তা দূর হতে পারতো। ইসলামী খেলাফতের আমলে এ ধরনের সংশোধন বার বার সাধিত হয়েছে এবং যতদিন পর্যন্ত তার বুঝিয়াদের মধ্যে কোনো প্রকার ত্রুটি দেখা দেয়নি অর্থাৎ খোদার হুকমাতের পরিবর্তে শয়তানের হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হয়নি, ততদিন দুনিয়ায় বার বার খেলাফতে রাশেদার কল্যাণ ও বরকতের জামানা উপস্থিত হয়েছে এবং আজো যদি তার জন্যে প্রচেষ্টা চালানো হয়, তাহলে আল্লাহ তাআলা সেজন্যে যে আমাদেরকে কোনো সাহায্য করবেন না তার কোনো কারণ নেই। এই পৃথিবীতে সকল প্রকার কার্য সম্পাদিত হচ্ছে এবং যে কাজের জন্যে যে পর্যায়ের প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন, তা চালাবার পরই আমরা সে কাজটি সম্পাদিত হতে দেখছি। তা হক বা বাতিল যাই হোক না কেন, তাতে কোনো পার্থক্য সূচিত হয় না। এই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলা বাতিলপন্থীদের চালবাজিকেও যখন ব্যর্থ করেন না, তখন হকের সাথে তাঁর শত্রুতা করার কি কারণ থাকতে পারে যে, হককে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে একদল প্রাণ-উৎসর্গকারী সৃষ্টি হয়ে গেলেও তিনি তদেরকে সাফল্যমন্ডিত করবেন না?

কাজের প্রয়োজনীয় শর্তাবলী

কিন্তু প্রত্যেক কাজের একটি বিশেষ পদ্ধতি থাকে। ঐ পদ্ধতিতে তাকে সম্পাদন করতে হয়। যদি আপনি কোনো কাজ ভুল পদ্ধতিতে সম্পাদন করতে থাকেন, তাহলে আপনার উদ্দেশ্য যতই সৎ হোক না কেন, ঐ ভুলের ফল ব্যর্থতা রূপে আপনার সম্মুখে উপস্থিত হবে। খোদার রচিত বিধান সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত ও নিরপেক্ষ হয়ে থাকে। অতি সৎ ব্যক্তিও যদি মধুর পরিবর্তে মাকাল ফল আহার করে, তাহলে তার সততার কারণে মাকাল ফলের মধ্যে মধুর স্বাদ সৃষ্টি হবে না। অনুরূপভাবে মুসলমান যদি কোন কাজ ভুল পদ্ধতিতে সম্পাদন করতে থাকে, তাহলে সে মুসলমান এবং তার মতে সে খোদার নিকট উচ্চ মর্যাদার অধিকারী কেবল এ কারণেই তার কাজ নির্ভুল হতে পারে না। বিরপীত পক্ষে, কোনো অমুসলিম যদি কোনো কাজ সঠিক পদ্ধতিতে সম্পাদন করার জন্যে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে তাহলে নিছক অমুসলিম হবার কারণে সে তার নির্ভুল প্রচেষ্টার ফল লাভে ব্যর্থ হতে পারে না। আল্লাহর রচিত বিধানে এ ধরনের অন্যায়ের স্থান নেই। মুসলমানদের মধ্যে এ অনুভূতি অত্যন্ত প্রবল যে, মুসলমান হবার কারণে তারাই আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রাষ্ট্র কর্তৃত্বরূপে নেয়ামত লাভের হকদার। এ অনুভূতির সাথে সাথে নিজেদের বর্তমান অবস্থার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তারা কুরআনের ওয়াদা ও খোদার পক্ষ থেকে নিরাশ হতে থাকে। তারা মনে করে যেহেতু তারা মুসলমান কাজেই তারাই পৃথিবীর কর্তৃত্ব লাভের হকদার আর যদি তারা এ কর্তৃত্ব লাভে সক্ষম না হয়, তাহলে এ জন্যে তাদের কোনো দোষ নেই বরং ওয়াদাকারীর পক্ষ থেকে কোনো গাফলতি করা হয়েছে কিন্তু এ চিন্তাটি আগাগোড়া ভুলে পরিপূর্ণ। বক্তিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা যে সকল বন্ধু দানের ওয়াদা করেছেন, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই তিনি সেগুলি দান করে থাকেন। কিন্তু জামায়াতের জন্যে তিনি যেগুলি ওয়াদা করেছেন, সেগুলির জন্যে জামায়াতী পর্যায়ে প্রচেষ্টা চালানো অপরিহার্য। যদি সেগুলির জন্যে জামায়াতী পর্যায়ে প্রচেষ্টা চালানো না হয়, তাহলে আপনাদের ব্যক্তিগত তাকওয়া ও পরহেযগারী যতই উচ্চ পর্যায়ের হোক না কেন, আপনাদের মধ্যে জুনায়েদ, শিবলী, সালমান (রাঃ) ও আবু যার (রাঃ) পর্যায়ের লোক যত অধিক সংখ্যায় বিরাজিত থাক না কেন, আল্লাহ তাআলা জামায়াতী পর্যায়ের নেকীর বিনিময়ে যে সকল পুরস্কার নির্ধারণ করেছেন, ব্যক্তিগত নেকীর বিনিময়ে তা কোন দিন অর্জিত হতে পারে না। আমরা একথা অস্বীকার করি না যে, মুসলমানদের মধ্যে আজো বহু নেক ও সৎ কর্মশীল ব্যক্তি রয়েছেন। কিন্তু এই নেক ও সৎ ব্যক্তিরা একত্রিত হয়ে কখনো এদেশে একটি সৎ ও সুন্দর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেননি। বরং নিজেদের ব্যক্তিগত নেকীকে সম্মুখে রেখে তাঁরা হামেশা খোদার নিকট অভিযোগ করেছেন যে, খোদা তাদের জন্যে তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করেননি। খোদা জামায়াত সমূহের নিকট তাদের জামায়াতী পর্যায়ের নেকীর ভিত্তিতে যে ওয়াদা করেছেন তা এমনই নির্ধারিত যে, কোনো জামায়াতের মধ্যে খোদার অস্বীকৃতির সাথেও যদি ঐ নেকীগুলি সৃষ্টি হয়ে যায়, তাহলেও তারা তার ফল লাভ করে থাকে। কাজেই ঈমান ও ইসলামের শক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে কোনো জামায়াত যদি একটি সৎ-সুন্দর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে তার পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করবেন, এর কোনো কারণ দেখা যায় না।

জামায়াতে ইসলামী মুসলমানদের এই ভুলের সংশোধন করছে। জামায়াত জাতির সমস্ত নেক লোককে সংগঠিত করে তাদেরকে একটি সৎ-সুন্দর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত করতে চায় এবং এ কাজটি সম্পাদন করার যে সঠিক পদ্ধতি নির্ধারিত আছে কেবলমাত্র ঐ পদ্ধতিতেই তা সম্পাদন করতে চায়। যদিও পরিণাম আল্লাহর হাতে, তবুও খোদার নিকট আমরা এ আশা করি যে, আমাদের প্রচেষ্টা সাফল্যমন্ডিত হবে এবং আমরা লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবো। কিন্তু দীর্ঘকাল জামায়াতী জীবন থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে আমরা জামায়াতী জীবনের বৈশিষ্ট্য ও দায়িত্বসমূহ সম্পর্কে অজ্ঞ হয়ে পড়েছি। তাই আজ যখন আমরা জামায়াতী জীবনের পুনর্গঠনের ওয়াদা করছি, তখন এ দায়িত্বসমূহ উপলব্ধি ও আদায় করার জন্যে আমাদের বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন করার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

জামায়াতী জীবনের বৈশিষ্ট্য

জামায়াতী জীবনের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শৃংখলা ও জামায়াতী সংগঠনের আনুগত্য। এই সংগঠনের আনুগত্যের অভিলাসেই জামায়াত অস্তিত্ব লাভ করে। তাই এ ব্যাপারে চুল পরিমাণ নির্লিপ্ততা জামায়াতের মৃত্যুর নামান্তর। এই শৃংঙ্খলা ও সংগঠনকে কায়েম রাখার জন্যে জামায়াতের প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত আশা-আকাংখা ও ব্যক্তিগত মত বিসর্জন দিতে হয়। এ জীবনের নম্রতা হচ্ছে একটি অপরিহার্য শর্ত। ব্যক্তিরা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ইটের ন্যায়, তাদের সাহায্যে একটি ইমারত তৈরি করতে হলে তাদের অবশ্যি কিছুটা আঘাত সহ্য করতে হবে। যদি প্রত্যেকটি ইট জিদ ধরে যে, সে কোনো আঘাত সহ্য করতে প্রস্তুত নয়, তাহলে ইমারত নির্মিত হতে পারে না। অনুরূপভাবে আপনাদের প্রত্যেক ব্যক্তিই যদি নিজের মতের ওপর জোর দিতে থাকেন এবং স্বাধীনতার ওপর কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ বরদাশত না করেন, তাহলে জামায়াত গঠিত হতে পারে না। আর যদি গঠিত হয়েও যায়, তাহলে তা কায়েম থাকতে পারবে না। এ কথা চিন্তা করা উচিত নয় যে, জামায়াতী জীবন মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ব্যাহত করে। অবশ্যি এ জন্যে মানষকে নিজের স্বাধীনতার একটি অংশকে বিসর্জন দিতে হয়। কিন্তু এই সামান্য অংশ বিসর্জন দিয়ে মানুষ তার সমগ্র স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করে। আর যদি কোনো ব্যক্তি এই সামান্য কোরবানী করতে প্রস্তুত না হয়, তাহলে তাকে নিজের সমগ্র স্বাধীনতাটুকুই হারাতে হয়। যেমন কোনো ধনভান্ডারের মালিক তার ভান্ডারের একটি অংশ রক্ষক ও প্রহরীদের ওপর ব্যয় না করলে সমগ্র ধন-ভান্ডারটিই বিপদের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়, তেমনি ব্যক্তি যদি জামায়াতের সপক্ষে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে এক পর্যায় পর্যন্ত কোরবানী করতে প্রস্তুত না হয়, তাহলে তার সমগ্র স্বাধীনতাই বিপদের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। আপনাদের রিপোর্ট থেকে অনুমিত হয় যে, এখনো আমাদের মধ্যে এ চেতনার অভাব আছে। লোকদের মধ্যে এ চেতনা সৃষ্টির চেষ্টা করুন। এর সৃষ্টি নিছক একটি নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ নয়, বরং এটি একটি দ্বীনী প্রয়োজন। যাদের মধ্যে এ বস্তুটির অভাব আছে, তারা তা পূরণ করেই এ ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পেতে পারে। কোনো বিশেষ পরিমাণ নফল এর প্রতিবদল হতে পারে না। এজন্যে জামায়াতী সংগঠনে বিশৃংখলা সৃষ্টি করার শাস্তি ইসলামে. অত্যন্ত কঠোর। যারা এ ব্যাপারে কোনো ত্রুটি করে, তারা নিজেদের সমস্ত নেকীর সওয়াব হারিয়ে বসে। কাজেই জামায়াতের রুকনদের প্রতি আমার নসীহত হচ্ছে এই যে, এ ব্যাপারে সামান্যতম গাফলতিরও সুযোগ দেয়া উচিত নয়। আমি পূর্বেও বলেছি এবং আবারও বলছি, আল্লাহ তাআলা জামায়াতের সংগে যে ওয়াদা করেছেন, তা ব্যক্তিদের জন্যে পূর্ণ হবে না এবং ইসলাম এমন কোনো দ্বীন নয়, যার দাবীসমূহ ব্যক্তি জীবনের বিপুল তাকওয়া ও দ্বীনদারীর দ্বারা পূর্ণ হতে পারে।

এই সঙ্গে আর একটি বিষয়ও প্রণিধানযোগ্য। দ্বীনের কতিপয় খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েও মুসলমানদের কয়েকটি দলের মধ্যে অনর্থক মাত্রাতিরিক্তি বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছিল। এই বিদ্বেষ এতই কঠোর ও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল যে, ঐ খুঁটিনাটি বিষয়গুলি নিয়ে লোকেরা হানাহানি শুরু করে দিয়েছিল। এর মধ্যে তারা এতই নিমগ্ন হয়েছিল যে, তাদের সম্মুখে আসল দ্বীনের সমস্ত দাবী চাপা পড়ে গিয়েছিল। আমাদের কতিপয় রুকনদের মধ্যেও এ পুরাতন রুচির প্রভাব রয়ে গেছে, যার ফলে জামায়াতের এই সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আপনাদের মূল শাখা প্রশাখার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা উচিত এবং শাখাকে সঞ্জীবিত রাখার ব্যাপারে এত অধিক নিমগ্ন থাকা উচিত নয়, যার ফলে গাছের মূল শুকিয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। দ্বীনের এমন চেতনা সৃষ্টি করা উচিত, যা আপনাদের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে পারে এবং প্রত্যেক বস্তুকে তার যথার্থ স্থান দান করার মতো রুচি ও মননের সৃষ্টি করে। যদি আপনাদের মধ্যে এ বস্তুটির অভাব থাকে, তাহলে জানি না আপনারা কোন শাখাকে মূলে পরিণত করে তার জন্যে সমগ্র জামায়াত ও সমগ্র দ্বীনকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবেন।

এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা জেনে রাখাও অত্যন্ত প্রয়োজন। বর্তমান যুগে দ্বীনদারী সম্পর্কে মানুষের মনে এমন ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, কোনো দ্বীনী কাজ করতে অগ্রসর হলে লোকেরা এ কাজ সম্পাদনে উদ্যোগী কর্মীদের মধ্যে এমন সব বিষয়ের তালাশ শুরু করে দেয় দ্বীনের মধ্যে যার কোনো ভিত্তি নেই এবং ঐ বিষয়গুলি তাদের মধ্যে খুঁজে না পেলে সমগ্র জামায়াতকে একটি বেদ্বীন জামায়াত বরং একটি ক্ষতিকর অস্তিত্ব গণ্য করে। এ কারণেই অনেক লোক বলে থাকে, জামায়াতে ইসলামী তার উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে অত্যন্ত সৎ ও উন্নতমানের জামায়াত, কিন্তু এর নেতৃবৃন্দের মধ্যে তাকওয়া নেই। যেহেতু এ প্রচারণায় কোনো না কোনো পর্যায়ে আমাদের রুকনগণও প্রভাবিত হয়ে পড়েন, তাই এ সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা জরুরী মনে করছি। তবে এ কথাগুলির দ্বারা আমাদের নিজেদেরকে সংরক্ষণ করাই উদ্দেশ্য নয়, বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যিকার তাৎপর্য বিশ্লেষণ। এ জামায়াতের নেতৃবৃন্দের মধ্যে একজনও তাকওয়ার দাবীদার নয়। তবে তাদের তাকওয়ার ওপর আমরা অবশ্যি বিস্মিত, যারা জামায়াতে ইসলামীর কাজকে নির্ভুল মনে করেন কিন্তু আমাদের মধ্যে তাকওয়ার অভাবের কারণে সাধারণ মুসলমানদেরকে পরামর্শ দেন যে, যারা ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছে কিন্তু মুত্তাকী, তাদের পিছনে চলো। আমরা খোদার নামে তাদেরকে নিজেদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, সত্যপথ যদি তাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে এবং তাদের মধ্যে তাকওয়াও বিদ্যমান থাকে, তাহলে তাদের অগ্রসর হয়ে নেতৃত্বের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়া উচিত। কিন্তু জেনে-বুঝে মুসলমানদেরকে ভুল পথে চলার জন্যে পরামর্শ দেয়া উচিত নয়। তাদের একথাও স্মরণ রাখা উচিত যে, এই তাকওয়ার জন্যে একদিন তাদেরকে খোদার সম্মুখে হিসাব দিতে হবে। জেনে-বুঝে মুসলমানদেরকে ভুল পরামর্শ দেবার জন্যে সেদিন তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কেন তারা পথভ্রষ্ট মুত্তাকীদের পিছনে চলে মুসলমানদেরকে গোমরাহ হবার পরামর্শ দিয়েছিলেন- এ জবাবদিহি থেকে সেদিন তারা রেহাই পাবেন না।

এ প্রসঙ্গে পূর্ণ আন্তরিক নিশ্চিন্ততার সাথে আমি এ সত্যটি তুলে ধরতে চাই যে, বর্তমান কালে তাকওয়ার যেসব অপরিহার্য আনুষ্ঠানিক বিষয়াবলী সৃষ্টি হয়ে গেছে, তাকওয়ার ভরা বসন্তে অর্থাৎ ইসলামের সর্বোত্তম স্বর্ণ যুগে তার নাম-নিশানাও ছিল না। বর্তমান কালের তাকওয়ার দৃষ্টিতে কেবল হারামকে হারাম গণ্য করা এবং তা থেকে দূরে থাকাই যথেষ্ট নয়, বরং আল্লাহর সৃষ্টি হালাল বস্তুগুলি পরিহার করে চলাও আজকের তাকওয়ার অপরিহার্য অংগে পরিণত হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, কতিপয় মুবাহ বস্তু পরিহার করার ওপর এত বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তির মধ্যে এ গুণটির সামান্যতম গন্ধ পেলেই তাকে সূফী নামে অভিহিত করা হয়। অথচ অন্যদিকে হয়তো তিনি বড় বড় হারাম বস্তুর সাথে জড়িত রয়েছেন এবং অনুভূতি তাঁকে মুহূর্তের জন্যও বিচলিত করে না। যদি কোনো ব্যক্তি যথারীতি পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করেন, তাহলে তিনি সূফী বা ওলী নামে অভিহিত হন না। কিন্তু যে ব্যক্তি খোদাদ্রোহী শক্তির সাহায্য-সমর্থনে দিবারাত্র নিজের সমস্ত যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা নিয়োজিত রেখেছে, সে নিছক নিয়মিতভাবে কতিপয় আনুষ্ঠানিক রীতি পালন করার কারণে প্রতিদিন আল্লাহর নৈকট্যের অতি উন্নত পর্যায় ও স্থানসমূহ অতিক্রম করতে থাকে এবং তার আধ্যাত্মিক অগ্রগতির পথে কোনো কিছুই বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম সম্ভবত এই তাকওয়াকেই মশা বেছে ফেলে দিয়ে উট গিলে ফেলা বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর এ বক্তব্য একটি জ্বলন্ত সত্যে পরিণত হয়েছে। এ তাকওয়ায় দাড়ি ও গোঁফের সামান্য অনিয়ম বরদাশত করা হয় না। কিন্তু আল্লাহর সমগ্র শরীয়তের ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করেও এই মুত্তাকীদের চেহারায় কোনো বেদনার চিহ্ন ফুটে ওঠেনা।

এ যুগে কোনো খানকাহর সনদ লাভ করা তাকওয়ার একটি অপরিহার্য শর্ত হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই সনদ ছাড়া কোনো ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহর যতই আনুগত্য করুক না কেন, কোনোক্রমেই তাকওয়ার মর্যাদায় পৌছুতে পারে না। অথচ এ শর্তটি দ্বীনের মধ্যে একটি অতিরিক্ত বস্তু। কুরআনে যে তাকওয়ার প্রশংসা করা হয়েছে, তা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা সংরক্ষণ, তাঁর দ্বীনকে নিজের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে নেয়া এবং অন্যদেরকে তার দাওয়াত দেয়ার চাইতে আর বেশী কিছু নয়। যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহ নির্ধারিত সীমাকে ভয় করে, আল্লাহর শরীয়তের পুরোপুরি আনুগত্য করে এবং হারাম ও বেদয়াতসমূহ থেকে দূরে থাকে, তাহলে কোনো খানকাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত না থাকলেও সে মুত্তাকী। লোক দেখানো নম্রতা, অযথা কাশফ ও কেরামতির প্রকাশ করা, দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে নির্লিপ্ত থাকা, অপ্রামাণ্য যিকির ও তাসবীহের মধ্যে আত্মনিমগ্ন থাকা এবং এ জাতীয় আরো অন্যান্য বিষয় আমাদের এখানে নেই। যারা এসব জিনিস তালাশ করে ফিরছেন, তাদের আমাদের কাছে এ সবের দাবী না করে কোনো খানকাহর পথ দেখা উচিত। আমাদের কাছে এমন সব বিষয়ের দাবী করা উচিত, যেগুলোর ভিত্তি আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাতে বিস্তৃত। ঐগুলি ছাড়া আর কোনো জিনিসই আমাদের কাছে গ্রহণীয় বলে প্রমাণ পেশ করতে পারে না। আমাদের সম্পর্কে যাতে কারুর মনে কোনো প্রকার ভুল ধারণা না জন্মে, সেজন্য আমি এ কথাগুলো স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করলাম। আমরা যেমনটি আছি, তার চাইতে এক চুলও নিজেদের বাড়িয়ে প্রকাশ করতে আমি রাজি নই।

আমি নির্দ্বিধায় এ সত্যটি প্রকাশ করে দিতে চাই যে, আজকাল তাকওয়ার যেসব অপরিহার্য আনুষ্ঠানিকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আসল সংগ্রামকে পর্দান্তরালে রাখাই তার উদ্দেশ্য। দ্বীনের আসল দাবীগুলো যখন তাদের কাছে কঠিন মনে হলো এবং তারা বুঝতে পারলেন যে, এ পথে বেশ কিছু ভীতিপ্রদ ও দূরূহ মনযিল আছে আর এই সংগে তারা নিজেদেরকে হিম্মতহারা হিসাবে অভিযুক্ত হবার লজ্জাও মেনে নিতে রাজি হলেন না, তখন তারা দ্বীনের আসল দাবীসমূহের বিভিন্ন বিকল্প নির্ণয় করলেন। দুনিয়াকে ফিতনা হিসেবে আখ্যায়িত করে তারা প্রকাশ্য ময়দানে কাজ করা পরিহার করলেন এবং খানকাহে বসে যিকির ও ওযীফার পরিমাণ বাড়িয়ে দিলেন। এরপর তৈরী হলো তাকওয়ার একটি বিশেষ কাঠামো। অস্তিত্ব লাভ করলো মুত্তাকীসুলভ জীবনের একটি বিশেষ পদ্ধতি এবং ধীরে ধীরে অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে এসে পৌছুল, যেখানে আজ তাদের হাতে দেখা যাচ্ছে তাকওয়ার একটি বিশেষ ধরনের পরিমাপ। আমাদের আশংকা হচ্ছে, এই পরিমাপ দিয়ে প্রথম যুগের মুসলমানদেরকে যাচাই করা হলে তারাও সম্ভবত মুত্তাকী প্রমাণিত হবে না। আমরা এই তাকওয়ার সমর্থক নই। আমাদের মতে সরল ও নিষ্ঠাবান মুসলমানের জীবন যাপন করুন। আল্লাহ ও রসূলের কোনো নির্দেশ জানতে পারলে। لا أزيد وَلَا أَنْقُضُ )আমি কিছুই বাড়াবো না এবং কিছুই কমাবো না) বলে তার ওপর অবিচল হয়ে যান। অনবরত নিজের জীবনের সমস্ত কার্যাবলী পর্যালোচনা করতে থাকুন। লোক দেখানো ও খ্যাতি অর্জন করা যেন আপনার কাজের উদ্দেশ্য না হয়। আল্লাহর বান্দাদের ওপর একমাত্র আল্লাহর আইনকে কর্তৃত্বশালী করার জন্যে দিবারাত্র সংগ্রাম- সাধনায় লিপ্ত থাকুন। আমাদের সংগ্রাম যেন এমন পর্যায়ে উপনীত হয়, যার ফলে মানুষের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাবীদার গোষ্ঠীগুলি পরাভূত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অথবা তাদেরকে পরিবর্তন করার বা তাদের পরিবর্তিত না হবার সংগ্রামে আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। আমি চাই, আপনারা একথাগুলো এখন মনোযোগ সহকারে শুনবেন। যুগের পরিবর্তন হচ্ছে অতিদ্রুত গতিতে। আমাদের সামনে এসে যাচ্ছে অত্যন্ত কঠিন কাজ। আমরা কোনো কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হবো আর আমাদের সেনাদল ভুলের রাজ্যে পথ হারাবে, এমনটি হতে পারে না। আপনাদের হাতে কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়া অন্য কোন পরিমাপ ও মানদন্ড থাকা উচিত নয়। এই মানদন্ডে আপনার দলের লোকদের যাচাই করতে থাকুন। আপনার আমীরকে এবং আমীরের আনুগত্যকারীদেরকেও। এই যাচাই, সমালোচনা ও পর্যালোচনাই হচ্ছে জামায়াতের জীবন। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রকার কোমলতা ও এড়িয়ে যাবার নীতি অবলম্বন করবেন না। ভিত্তিহীন ভাবনা চিন্তাগুলো পরিহার করুন আর যদি সেগুলো আপনাদেরকে এমনভাবে আষ্টে-পৃষ্টে বেঁধে থাকে, যার বাঁধন কেটে বেরিয়ে আসা আপনাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাহলে আপনারা মেহেরবানী করে আমাদেরকে রেহাই দিলে আমাদের মনে একটুও দুঃখ থাকবে না। আমরা নিজেরা প্রতারিত হতে এবং কাউকে প্রতারণা করতে চাইনা।

আমীরে জামায়াতের সমাপ্তি ভাষণ

অতঃপর আমীরে জামায়াত মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহঃ) তাঁর সুদীর্ঘ সমাপ্তি ভাষণ পেশ করেন। এ ভাষণ “ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি” শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সমাপ্তি ভাষণের পর সম্মেলন শেষ হয়।

সমাপ্ত

© Bangladesh Jamaat-e-Islami

  • আমাদের সম্পর্কে
  • প্রাইভেসি পলিসি
  • যোগাযোগ
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস

@BJI Dhaka City South