হাদীসের আলোকে মানব জীবন
প্রথম খন্ড
ফাযায়েল অংশ
আবুল কালাম মুহাম্মাদ ইউসূফ
(মুমতাজুল মুহাদ্দেসীন)
খেলাফত পাবলিকেশন্স
ষষ্ঠদশ সংস্করণের ভূমিকা
হযরত মুহাম্মাদ (স:) একদিকে যেমন আখেরী নবী, তেমনি তিনি সারা বিশ্বের সমগ্র মানবমন্ডলীর নবী। প্রতিটি মুসলিম আমরা যারা নবীর (স:) উম্মত হওয়ার দাবী করি, আমাদের কর্তব্য হলো রসূলের যাবতীয় হুকুম আহকাম সম্পর্কে ওয়াকেফহাল হওয়া, হুজুরের সারা জিন্দেগীর কাজ-কর্মই হলো তাঁর সুন্নত। আর হাদীসের মাধ্যমেই আমরা সুন্নত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারি। সুতরাং পবিত্র কোরআনের সাথে সাথে হাদীসের জ্ঞান অর্জন করাও আমাদের জন্য অপরিহার্য ও জরুরী।
উক্ত জরুরতের অনুভূতিই আমাকে এই কিতাবখানা সংকলনে প্রেরণা যুগিয়েছে। এখানে একখানা গ্রন্থেই আমি জরুরী বিষয় সমূহের উপরে রসূলের (স:) হেদায়েত সমূহকে এক জায়গায় করতে চেষ্টা করেছি। অবশ্য বইয়ের এই প্রথম খন্ডে প্রতিটি বিষয়ের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আর ২য় খন্ডে আলোচনা করেছি মাসায়েল সম্পর্কে। ৩য় খন্ডে নৈতিক বিষয় সম্পর্কীয় হাদীস সমূহের উপরে আলোকপাত করেছি। আর ৪র্থ খন্ডে আলোকপাত করেছি রসূলের অছিয়ত সম্পর্কীয় হাদীস সমূহের উপরে।
মহানবীর হেদায়েত সম্পর্কে যারা জ্ঞান লাভে আগ্রহী, এ কিতাবখানা তাদের কিছুমাত্র সাহায্য করলেও আমার শ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করব। মহান আল্লাহ আমার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কবুল করুন। আমিন!
আবুল কালাম মুহাম্মাদ ইউসুফ
ধানমন্ডি, ঢাকা।
অধ্যায়: ১ হাদীস
হাদীসের সংজ্ঞা ও পরিচয়
রসূলের (স:)-কথা, কাজ ও সমর্থনকে হাদীস বলা হয়, অর্থাৎ রসূল হিসেবে হুযুর যে কথা বলেছেন, যে সব কাজ করেছেন এবং ছাহাবীদেরকে যে সব কাজ করতে দেখে সমর্থন দিয়েছেন তা হলো হাদীস।
হাদীসের পরিচয় দিতে গিয়ে বুখারী শরীফের ভূমিকায় বলা হয়েছে,
وَهُوَ عِلْمٌ يُعْرَفُ بِهِ أَقْوَالُ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَفْعَالُهُ وَأَحْوَالُهُ
“হাদীস এমন এলমকে বলা হয় যার মাধ্যমে নবী করীমের (স:) কথা, কাজ এবং তাঁর অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়।”
মেশকাত শরীফের ভূমিকায় মুহাদ্দিস শেখ আবদুল হক দেহলভী হাদীসের নিম্ন বর্ণিত সংজ্ঞা দিয়েছেন,
عِلْمُ الْحَدِيْثِ فِي اصْطِلاحِ جَمْهُورِ الْمُحَدِّثِيْنَ يُطْلَقُ عَلَى قَوْلِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَفِعْلِهِ وَتَقْرِيْرِهِ
“মুহাদ্দিসীনের পরিভাষায় ইলমে হাদীস এমন এক ইলমকে বলা হয়, যা দ্বারা নবী করিমের (স:)-কথা ও অনুমোদনকে জানা যায়।”
অনুমোদন বলা হয় এমন কথা ও কাজকে যা কোন ছাহাবী কর্তৃক নবী করিমের (স:)-সামনে বলা কিংবা করা হয়েছে, অথচ নবী (স:) তাঁর কোন প্রতিবাদ করেননি। কেননা উপরোক্ত কথা কিংবা কাজটি যদি শরীয়তের দৃষ্টিতে গর্হিত হতো, তাহলে হুযুর (স:)-প্রতিবাদ করতেন। সুতরাং হুযুরের এ ধরনের সমর্থনও শরীয়তের নির্দেশ জানার অন্যতম সূত্র।
হাদীসের সংজ্ঞা দান প্রসংগে ইমাম সাখাভী বলেছেন,
الْحَدِيثُ فِي اللُّغَةِ ضِدُّ الْقَدِيمِ وَفِي اصْطِلاحِهِمْ قَوْلُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَفِعْلُهُ وَتَقْرِيْرُهُ وَصِفَتُهُ حَتَّى فِي الْحَرَكَاتِ وَالسَّكَنَاتِ فِي الْيَقْظَةِ وَالنَّوْمِ
অভিধানে ‘হাদীস’ (নূতন) শব্দ হলো “কাদীম” (পুরাতন) শব্দ-এর বিপরীত অর্থবোধক। আর মুহাদ্দেসীনদের পরিভাষায় হাদীস বলা হয় নবী করীমের (স:)-কথা, কাজ, সমর্থন ও তাঁর গুণ বৈশিষ্ট্যকে। এমনকি জাগরণ ও নিদ্রাবস্থায় হুযুরের গতিবিধিও হাদীসের অন্তর্ভুক্ত।
বিষয়বস্তুর দৃষ্টিতে হাদীসের প্রকারভেদ
শাহ অলীউল্লাহ দেহলভী তার মশহুর গ্রন্থ হুজ্জাতুল্লাহিল বলিগায়ে হাদীসের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, “হুযুর (স:) থেকে যে সব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা সাধারণত দু’ প্রকার।
১) যাতে তাঁর নবুয়ত ও রেসালাতের দায়িত্ব সম্পর্কীয় বিষয়াদি বর্ণিত হয়েছে। যেমন যে সব হাদীসে পরকালীন জীবনের বিভিন্ন বিষয়াদি ও অবস্থা এবং উর্ধ্ব জগতের অভিনব অবস্থানসমূহের বর্ণনা দান করা হয়েছে। এ ধরনের হাদীসসমুহের উৎস একমাত্র অহী। আর এই প্রকারের হাদীসের ব্যাপারেই আল্লাহ নিম্নরূপ নির্দেশ দিয়েছেন।
مَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
“রসূল তোমাদেরকে যা কিছু নির্দেশ করেন তা মেনে নাও। আর যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।”
শরীয়তের বিধি-বিধান, ইবাদতের নিয়ম-প্রণালী এবং এমন সব জন-কল্যাণমূলক বিধিবিধান যা সুদূর প্রসারী এবং যার জন্য কোন সময়সীমা নির্ধারন করা হয়নি, এ ধরনের হাদীসও ১ম পর্যায়ভুক্ত। তবে এর কিছু অংশ অহীর সূত্রে প্রাপ্ত এবং কিছু অংশ স্বয়ং রসূলের ইজতেহাদ। অবশ্য নবী করিমের ইজতেহাদও অহীর সম-মর্যাদা সম্পন্ন। কেননা নবীর ইজতেহাদ কখনও ভুলের পরে স্থায়ী হতে পারে না। আমলসমূহের ফযীলত, আমলকারীদের গুণ ও মর্যাদা সম্পর্কীয় হাদীসও প্রথম শ্রেণীভুক্ত। আমার মতে এর অধিকাংশই অহীসূত্রে প্রাপ্ত। আর কিছু কিছু অংশ হুযুরের ইজতিহাদের ফলশ্রুতি।
২) যাতে হুযুরের নবুয়ত ও রেসালাতের দায়িত্বের বিষয়াদি বর্ণনা করা হয়নি বরং অন্যান্য বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন চাষাবাদ ও জীবজন্তুর গুণাগুণ সম্পর্কীয় কথাবার্তা। যেমন, হুযুর (স:) বলেছেন, তোমরা সাদা কপোল বিশিষ্ট গাঢ় কালো রংয়ের ঘোড়া রাখবে। অনুরূপ যে সব হাদীসে এমন সব কাজের বর্ণনা আছে যা হুযুর অভ্যাস বশত করেছেন, ইবাদতরূপে নহে এগুলোও দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত। বৈষয়িক ও কারিগরী ব্যাপারে হুযুরের আলাপ-আলোচনাও এই পর্যায়ের। এর মধ্যে কোনটির উৎস অভিজ্ঞতা, কোনটির উৎস দেশ প্রথা ও অভ্যাস, আবার কোনটির উৎস সাক্ষ্য প্রমাণ। এর সবগুলো আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক নহে, তবে অনুকরণীয়।”
হাদীসের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে মুহাদ্দেসীনের মত হলো নিম্নরূপ,
مَوْضُوعُ عِلْمِ الْحَدِيْثِ هُوَ ذَاتُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ حَيْثُ هُوَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
“রসূলে করীমের (স:)-মহান সত্তাই হলো হাদীস শাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়। অর্থাৎ হুযুর নবীর পদ মর্যাদায় থেকে নবী হিসেবে যা কিছু করেছেন, বলেছেন এবং করার অনুমতি দিয়েছেন, আর এর মাধ্যমে হুযুরের যেসব মহান সত্তা রসূল হিসেবে বিকশিত হয়ে উঠেছে তাই হাদীসের আলোচ্য বিষয়।”
হাদীস অধ্যয়নের উদ্দেশ্য হল রসূলের আহকাম ও দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনের তাৎপর্য অনুধাবন করে উভয় জাহানের কল্যাণ লাভ করা। “উমদাতুলকারী” গ্রন্থে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেন:
وَأَمَّا فَائِدَتُهُ فَهِيَ الْفَوْزُ بِسَعَادَةِ الدَّارَيْنِ
“উভয় জাহানের পরম কল্যাণ লাভই হচ্ছে হাদীস অধ্যয়নের স্বার্থকতা।”
সুন্নত
সুন্নত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো চলার পথ, কর্মের নীতি ও পদ্ধতি। আর হাদীসের পরিভাষায় সুন্নত বলা হয় সেই পথ ও মতকে যে পথ ও মত অবলম্বন করে হুযুর (স:) চলতেন। এটা ফিকাহ শাস্ত্রের প্রচলিত সুন্নত নয়। ইমাম রাগেব তাঁর “মুফরাদাত”
নামক গ্রন্থে লিখেছেন: سُنَّةُ النَّبِيِّ طَرِيقَتُهُ الَّتِي يَتَحَرَّهَا
“যে পথ ও নিয়ম পদ্ধতিকে নবী করীম (স:) বাছাই করে নিতেন তাকে-ই সুন্নত বলা হয়।” আল্লামা ইব্রাহীম ইবনে মুসা সরনাতি তার মশহুর কিতাব “আল-মুয়াস্কাকাতে” লিখেছেন, “নবী করিম (স:) থেকে বর্ণিত ও প্রমানিত বিষয়াদিকেই সুন্নত বলা হয়। বিশেষ করে যেসব বিষয়ে কুরআনে স্পষ্ট কোন হুকুম নেই। বরং নবী করীমই কেবল সে সব বিষয়ে স্বীয় মতামত ও নির্দেশ ইত্যাদি দিয়েছেন।
কখনও কখনও সুন্নত বিদয়াতের বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন বলা হয় অমুকে সুন্নতের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে, যখন তার কাজ-কর্ম রসূলের কাজ-কর্মের অনুরূপ হয়। (সে কাজ-কর্মের পরিষ্কার বর্ণনা কুরআনে থাকুক বা না থাকুক তাতে কিছু আসে যায় না।) আবার বলা হয় অমুক ব্যক্তি বিদয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে, যখন তার কাজ কর্ম সুন্নতের বিপরীত হয়। এখানে হুযুরের আমলকেই সুন্নত বলা হয়েছে।
সুন্নত শব্দের ব্যবহার ছাহাবীদের আমলের উপরও হয়ে থাকে। কেননা একথা সর্বসম্মত যে ছাহাবায়ে কেরাম প্রমাণ্য সুন্নতেরই অনুসরণ করেছেন।
আল্লামা আব্দুল আযীয তাঁর “তাওযীহুন্নজর” নামক কিতাবে সুন্নতের নিম্নরূপ পরিচয় দিয়েছেন:
وَلَفْظُ السُّنَّةِ شَامِلٌ لِقَوْلِ الرَّسُوْلِ وَفِعْلِهِ عَلَيْهِ السَّلَامُ وَتُطْلَقُ عَلَى طَرِيقَةِ الرَّسُوْلِ وَالصَّحَابَةِ
“সুন্নত শব্দ যেমন রসূলের কথা ও কাজের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়, তেমনি ব্যবহৃত হয় রসূল ও ছাহাবীদের অনুসৃত নীতি ও কর্ম-পদ্ধতির ব্যাপারে।”
কখনও কখনও সুন্নতকে শুধু হাদীসের অর্থেও ব্যবহার করা হয়।
হাদীসের উৎস
হাদীসের উৎস হয় অহী নতুবা হুযুরের ইজতেহাদ, হুযুরের প্রতি যে অহী নাযিল হতো তা ছিল দু’প্রকারের।
১) যা হুযুরকে তেলাওয়াত করে শুনান হতো এবং যার শব্দ ও বাক্য হুবহু বজায় রাখার জন্য হুযুর (স:) আদিষ্ট ছিলেন, এই শ্রেণীর অহীকে “অহীয়ে মাতলু” বলা হয়। নামাযে কেবলমাত্র এই শ্রেণীর অহীরই তেলাওয়াত চলে। আর তা-ই হলো কুরআন।
২) দ্বিতীয় শ্রেণীর অহীর শব্দ ও বাক্য হুবহু বজায় রাখার জন্য হুযুর (স:) আদিষ্ট ছিলেন না। বরং হুযুর নিজের ভাষায় তা বর্ণনা করেছেন এবং তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ শ্রেণীর অহীকে “অহীয়ে গায়ের মাতলু” বলা হয়। আর তা-ই হলো “হাদীস”
যেমন হুযুরকে (মেরাজের রাতে) আলমে মালাকুতের বিষয়াদি দেখান হয়েছে এবং হুযুর তা নিজের ভাষায় বর্ণনা করেছেন। কখনও কখনও জিবরীল (আ:) হুযুরের নিকট উপস্থিত হয়ে দ্বীন-শরীয়তের ব্যাপারে আল্লাহর মর্জি ও ইচ্ছা বাতলিয়ে দিয়েছেন। আর হুযুর তা ছাহাবীদেরকে নিজের ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। হুযুর কর্তৃক কুরআনের আয়াত ও আমলসমূহের ব্যাখ্যা ও বর্ণনা দানও (যেমন নামাযের রাকায়াত ও যাকাতের পরিমাণ যা কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি) হাদীসের পর্যায়ভুক্ত। আর এ সবটার উৎসই অহী।
কেননা কুরআন ছাড়াও অন্য প্রকারের অহী হুযুরের প্রতি নাযিল হতো। যেমন হুযুর (স:) বলেছেন,
إِنِّي أُوتِيْتُ الْقُرْآنَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ
“আমাকে যেমন কুরআন দেয়া হয়েছে তেমনি কুরআনের অনুরূপ আরও একটি বস্তু দেয়া হয়েছে।
হুযুরের ইজতেহাদও হাদীসের পর্যায়ভুক্ত এবং তাও ইসলামী শরীয়তের উৎস। কেননা হুযুরের ইজতেহাদ যদি আল্লাহর মরজী মোতাবেক না হতো তাহলে আল্লাহ অহীর মাধ্যমে তা সংশোধন করে দিতেন।
অধ্যায়ঃ ২ ঈমান
নিয়তের বিশুদ্ধতা
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ
(سورة البينة :٥)
“আর তাদেরকেতো একমাত্র এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যেন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করে। (আল বাইয়েনা: ৫)
(۱)
وَعَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِامْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَإِلَى رَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَإِلَى رَسُولِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ (بخاري – مسلم)
১) হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রসূলুল্লাহ (স:) ইরশাদ করেছেন, যাবতীয় কাজের ফলাফল নিয়তের উপরেই নির্ভর করে। প্রতিটি লোক (পরকালে) তাই পাবে যা সে নিয়ত করেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উদ্দেশ্যে হিজরত (দেশত্যাগ) করে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উদ্দেশ্যেই হবে, আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার কোন লোভ লালসা কিংবা কোন রমনীকে পাওয়ার মতলবে হিজরত করে, ফলত: তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই হবে। (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: মানব সন্তান ইহকালে যেসব ক্রিয়া-কর্ম করে তার ফলাফল পরবর্তীকালে আল্লাহ তায়ালা কিসের ভিত্তিতে দিবেন সে সম্পর্কেই মহানবীর উক্ত হাদীসটি। নবী করীম (স:) বলেন, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তার কাজের ফলাফল নিয়তের ভিত্তিতে দিবেন কাজের ভিত্তিতে নয়। অর্থাৎ যে সংকল্প বা মনোবৃত্তি তাকে উক্ত কাজটি করতে বাধ্য করেছে সেই সংকল্পের ভিত্তিতেই দেয়া হবে তাকে তার কাজের প্রতিফল। সুতরাং যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে তাঁর নির্দেশাবলী পালনের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে হিজরত করবে, পরকালে সে তার উক্ত হিজরতের পূর্ণ ছওয়াব প্রাপ্ত হবে পক্ষান্তরে কোন ব্যক্তি যদি পার্থিব কোন স্বার্থের (যেমন কোন সুন্দরী নারীকে বিয়ে করা, কিংবা কোন সম্পদ লাভ করার) মোহে হিজরত করে, সে পার্থিব স্বার্থই লাভ করবে। পরকালে আল্লাহর কাছে তার কিছুই পাওনা থাকবে না।
মনে করুন, এক ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি বিধানের মানসে হজ্জ সমাধা করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বাড়ী হতে রওয়ানা হলো। কিন্তু পথিমধ্যে কোন দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে তার জীবন সূর্য অস্তমিত হলো। এমতাবস্থায় তার হজ্জ কার্য সমাধা না হলেও মনের কলুষহীন সংকল্পের কারণে সে হজ্জের সওয়াবের অধিকারী হবে। পক্ষান্তরে অন্য এক ব্যক্তি দেশ ভ্রমণের মনোভাব নিয়ে হজ্জ কার্য সামাধা করলেও সওয়াব হতে বঞ্চিত হবে।
(۲)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوْبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ (مسلم)
(২) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, আল্লাহ তোমাদের সৌন্দর্য ও সম্পদের দিকে লক্ষ্য করেন না, বরং তোমাদের অন্তকরণ ও কাজের দিকে লক্ষ্য করেন।” (মুসলিম)
ব্যাখ্যা: উপরোক্ত হাদীসটির সারমর্ম এই যে, আল্লাহর নিকট মানুষের শারীরিক সৌন্দর্য ও ধন-সম্পদ ইত্যাদির বিশেষ কোন গুরুত্ব নেই। আল্লাহর কাছে গুরুত্ব হলো মানুষের অন্তর ও কাজের। অর্থাৎ মানুষ অন্তরে নেক নিয়ত রেখে যে কাজটি করে তা-ই আল্লাহর নিকট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য দুটি শর্ত পূরণ হওয়া প্রয়োজন। একটি হলো ঈমান, আর দ্বিতীয়টি বিশুদ্ধ নিয়ত। আল্লাহ যেমন বেঈমানের ইবাদত বা উত্তম কাজ কবুল করেন না, তেমনি কবুল করেন না ত্রুটিপূর্ণ নিয়তের অধিকারীর ইবাদত।
ইসলাম ও ঈমান
مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ
(سورة البقرة :٦٢)
“যারা আল্লাহ ও পরকালে ঈমান আনবে ও নেক আমল করবে, তাদের প্রতিদান আল্লাহর কাছে রক্ষিত থাকবে। তাদের ভয় ও চিন্তার কোন কারণ থাকবে না।” (সূরা বাকারা – ৬২)
(۳)
وَعَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ إِذْ طَلَعَ عَلَيْنَا رَجُلٌ شَدِيدُ بَيَاضِ الثَّيَابِ شَدِيدُ سَوَادِ الشَّعَرِ لَا يُرَى عَلَيْهِ أَثَرُ السَّفَرِ وَلَا يَعْرِفُهُ مِنَّا أَحَدٌ حَتَّى جَلَسَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَسْنَدَ رُكْبَتَيْهِ إِلَى رُكْبَتَيْهِ وَوَضَعَ كَفِّيْهِ عَلَى فَخِذَيْهِ، وَقَالَ: يَا مُحَمَّدًا أَخْبِرْنِي عَنْ الإِسْلَامِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الإِسْلَامُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَتُقِيمَ الصَّلاةَ، وَتُؤْتِي الزَّكَاةَ، وَتَصُومَ رَمَضَانَ، وَتَحُجَّ الْبَيْتَ إِنْ اسْتَطَعْتَ إِلَيْهِ سَبِيلاً، قَالَ: صَدَقْتَ، قَالَ: فَعَجِبْنَا لَهُ يَسْأَلُهُ وَيُصَدِّقُهُ، قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنْ الإِيمَانِ، قَالَ: أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ، قَالَ:
صَدَقْتَ، قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنْ الْإِحْسَانِ، قَالَ: أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ، قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنْ السَّاعَةِ، قَالَ: مَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ منْ السَّائِلِ، قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنْ أَمَارَتِهَا ، قَالَ: أَنْ تَلِدَ الأَمَةُ رَبَّتَهَا وَأَنْ تَرَى الْحُفَاةَ الْعُرَاةَ الْعَالَةَ رِعَاءَ الشَّاءِ يَتَطَاوَلُوْنَ فِي الْبُنْيَانِ، قَالَ: ثُمَّ انْطَلَقَ فَلَبِثْتُ مَلِيًّا ، ثُمَّ قَالَ لِي: يَا عُمَرُ أَتَدْرِي مَنْ السَّائِلُ؟ قُلْتُ: اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: فَإِنَّهُ جِبْرِيلُ أَتَاكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُمْ.
(مسلم)
(৩) “হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমরা মহানবীর দরবারে উপস্থিত ছিলাম। হঠাৎ আমাদের নিকট এমন এক ব্যক্তি আবির্ভূত হলেন, যাঁর পরিচ্ছদ ছিল সাদা ধবধবে আর চুলগুলো ছিল কাল মিচমিচে। সফরের কোন চিহ্নই তাঁর শরীরে ছিল না, অথচ আমাদের মধ্যে কেউ তাঁকে চিনতেও পারল না।
[টিকাঃ ১ হযরত উমর (রাঃ) বলেন, আগন্তুককে আমরা মদীনাবাসীরা কেউ চিনতে পারলাম না। ফলে তাঁর বিদেশী হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু একজন বিদেশী মুসাফিরের বস্ত্র ও চেহারায় সফরের যে চিহ্ন পরিলক্ষিত হওয়া প্রয়োজন ছিল, আগন্তুকের শরীরে তারও কোন লক্ষণ ছিল না। ফলে আমাদের কাছে লোকটিকে একটি অদ্ভুত লোক বলেই মনে হচ্ছিল।]
অত:পর তিনি হুযুরের কাছে এসে এমনভাবে বসলেন যে, তাঁর জানুদ্বয় ছিল হুযুরের জানুদ্বয়ের দিকে, আর তাঁর হস্তদ্বয় ছিল তাঁর উরুদ্বয়ের উপর।
[টিকাঃ ২. নামাযের তাশাহুদে নামাজী ব্যক্তি যেভাবে উরুর উপরে হাত রেখে আদবের সাথে বসে, আগন্তুক লোকটি হুযুরের সামনে অনুরূপ আদবের সাথে বসেছিলেন।]
অত:পর তিনি বললেন, হে ‘মুহাম্মদ’, (স:) আপনি আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বাতলিয়ে দিন।’ হুযুর (স:) বললেন, ‘ইসলাম হলো তুমি আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (স:) তাঁর রসূল এ কথার সাক্ষ্য দিবে। অত:পর নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে, রমযান মাসের রোযা রাখবে এবং সামর্থ থাকলে বায়তুল্লাহর হজ্জ করবে।’ লোকটি বললেন, হাঁ আপনি ঠিক বলেছেন। তাঁর এ ধরনের প্রশ্নোত্তরে আমরা আশ্চার্য হলাম।
[টিকাঃ ৩. আশ্চর্য হওয়ার কারণ ছিল এই যে, লোকটির প্রশ্ন ছিল অজ্ঞের ন্যায় কিন্তু তাঁর সমর্থনটা ছিল বিজ্ঞের ন্যায়। অর্থাৎ প্রশ্নের সময় মনে হতো যেমন একজন ছাত্র শিকক্ষের কাছে প্রশ্ন করছে। অন্যদিকে সমর্থনের সময় মনে হতো একজন শিক্ষক ছাত্রের জওয়াব ঠিক হয়েছে বলে সমর্থন দিচ্ছে।]
তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন যে, আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলে দিন। হুযুর (স:) উত্তর দিলেন, “ঈমান হলো এই যে, তুমি আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতা, কিতাব, পয়গম্বর ও পরকালের উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করবে। আর তাকদীরের ভালমন্দের উপরেও ঈমান আনবে।” লোকটি বললেন, হাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন। অত:পর তিনি বললেন, আমাকে ইহসান সম্পর্কেও বলে দিন। হুযুর (স:) বললেন, ইহসান হলো তুমি এই মনে করে আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। আর তুমি যদি তাঁকে নাও দেখতে পাও তাহলে মনে করবে যে, তিনি তোমাকে দেখছেন।” আগন্তুক বললেন, এবার তাহলে আমাকে কিয়ামত সম্পর্কে বলে দিন।
হুযুর জওয়াব দিলেন, “কিয়ামতের (দিন-তারিখ) সম্পর্কে যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, তিনি প্রশ্নকারীর অপেক্ষা অধিক কিছু জানেন না।” লোকটি বললেন, তাহলে আমাকে তার নিদর্শনগুলো বলে দিন। হুযুর (স:) বললেন, “দাসীরা তাদের প্রভুকে জন্ম দিবে, আর তুমি দেখতে পাবে (এক কালের) পাদুকাহীন, বস্ত্রহীন, লম্বা ঘাড়ওয়ালা রাখালেরা দালান-কোঠার অভ্যন্তরে স্বগর্বে বসবাস করছে।” হযরত উমর (রা:) বললেন, অত:পর লোকটি চলে গেলেন। কিছুক্ষণ অবস্থানের পর হুযুর (স:) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘উমর, প্রশ্নকারী লোকটিকে চিনতে পারলে? আমি বললাম, আল্লাহ এবং তাঁর রসূলই জানেন। (আমি জানি না)। হুযুর বললেন, ইনি হলেন হযরত জিবরিল (আ:)। তোমাদেরকে (প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে) দ্বীন তা’লীম দেয়ার জন্য এসেছিলেন। (মুসলিম)
(ইমাম মুসলিম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া ইমাম বুখারীও সামান্য রদ-বদলসহ তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থে উক্ত হাদীসটি লিপিবদ্ধ করেছেন।)
ব্যাখ্যা: প্রশ্নকারী হযরত জিবরিল (আ:) ছিলেন বলে হাদীসটিকে “হাদীসে জিবরিল” বলা হয়। হাদীসটিতে দ্বীন সম্পর্কীয় তিনটি মৌলিক বিষয় (ইসলাম, ঈমান ও ইহসানের) ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে।
ইসলাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো আত্মসমর্পণ করা, আনুগত্য করা, নিজেকে সুপে দেয়া। আর শরীয়তের পরিভাষায় ইসলাম হলো আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করা এবং আল্লাহর দ্বীনের কাছে নিজেকে পুরাপুরি সুপে দেয়া।
ইসলামের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হুযুর (স:) যে পাঁচটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন তা হলো ইসলামের পাঁচটি মৌলিক অঙ্গ বা বুনিয়াদ।
ফলত: কালেমার ঘোষণাসহ হাদীসে বর্ণিত পাঁচটি বিষয় যার ভিতরে পাওয়া যাবে মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্র অবশ্যই তাকে মুসলমান হিসেবে স্বীকার করে নিবে এবং মুসলামনের যাবতীয় অধিকার তাকে দিতে বাধ্য থাকবে।
ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো নিগূঢ়-বিশ্বাস, দৃঢ় প্রত্যয়, গভীর আস্থা। আর পারিভাষিক অর্থ হলো আল্লাহ তাঁর রসূলের মাধ্যমে মানব জাতির নিকট যে দ্বীন পেশ করেছেন, তাকে মনে-প্রাণে মেনে নেয়া এবং তার সত্যতার উপর গভীর আস্থা স্থাপন করা। যে ছয়টি বিষয়ের প্রতি ঈমান না আনলে মানুষকে প্রাথমিক ইমানদার রূপেও গণ্য করা হয় না, হাদীসে সেই ছয়টি মৌলিক বিষয়ের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে।
উপরোক্ত বিষয়গুলোর সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান। আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ হলো আল্লাহকেই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, বিধান দাতা, রিযিক দাতা, পালনকর্তা এবং সমগ্র বিশ্বের প্রকৃত মালিক বলে আন্তরিকভাবে স্বীকার করে নেয়া। আর এসব ব্যাপারে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক বা অংশীদার না করা। ঈমানের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার উপরোক্ত গুনাবলী একক ও অভিভাজ্য। যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর সৃষ্টিকর্তা হওয়াকে অন্তরের সাথে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁর বিধানদাতা হওয়ায় সন্দেহপোষণ করে। অর্থাৎ আল্লাহর বিধান যে জীবনের সব ক্ষেত্রে মেনে চলতে হবে তা সে স্বীকার করে না, তাহলে সে মুমিন নয়।
দ্বিতীয় হলো ফিরিশতাদের প্রতি ঈমান। ফিরিশতাদের প্রতি ঈমানের অর্থ হলো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে যে, ফিরিশতাগণ হলো আল্লাহর মহান সৃষ্টিকুলের একটি জীব। আল্লাহ তায়ালা এদেরকে নূর দিয়ে তৈরী করেছেন। এরা পুরষও নন, স্ত্রীও নন। প্রয়োজনবোধে ফিরিশতারা নানা ধরণের রূপ ধারণ করতে পারেন। আল্লাহ সৃষ্টি পরিচালনার যাবতীয় কাজে এদের নিয়োগ করে রেখেছেন। এরা কখনও আল্লাহর আদেশ অমান্য করে না।
তৃতীয় হলো কিতাবের প্রতি ঈমান। অর্থাৎ আল্লাহ যুগে যুগে মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য পয়গম্বরদের উপর যে কিতাব নাযিল করেছেন, তা সঠিক, সত্য ও নির্ভুল বলে আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করা।
আল্লাহ তায়ালার নাযিল করা অসংখ্য কিতাবের মধ্যে চারখানা হলো প্রধান। যথা: তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল, ফোরকান। ফোরকান বা কোরআন হলো আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ গ্রন্থ। কোরআনের ভিতরে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের যাবতীয় সত্য এবং কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির হেদায়েতের যাবতীয় বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করা হয়েছে। অত:পর আর কোন আসমানী কিতাব নাযিল হবে না। অতএব কোরআন পরবর্তী যুগে কারও পক্ষে কোরআনকে অনুসরণ ব্যতীত পরকালের মুক্তি সম্ভব নয়।
মানব জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিষয় সম্পর্কে কোরআনে যেসব নির্দেশ দান করা হয়েছে তার সবটুকুকেই অবশ্য করণীয় মনে করতে হবে। অন্যথায় কেউ মুমিন হতে পারবে না।
ঈমানদার হওয়ার জন্য চতুর্থ যে বিষয়টির উপর বিশ্বাস স্থাপন করা একান্ত অপরিহার্য, তা হলো রসূলদের প্রতি ঈমান। রসূল শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো প্রেরিত। আর শরীয়তের পরিভাষায় রসূল বলা হয় তাঁদেরকে, যাদেরকে মহান আল্লাহ যুগে যুগে জগতের বিভিন্ন অংশে মানব জাতির হেদায়েতের নিমিত্ত অহী ও কিতাব দিয়ে পাঠিয়েছেন। মানব জাতির সূচনা হতে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত দুনিয়ায় অসংখ্য নবী রসূলের আবির্ভাব ঘটেছে। তন্মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (স:) হলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসূল।
রসূলদের প্রতি ঈমানের অর্থ এই যে, আল্লাহর প্রেরিত সকল নবী রসূলদের প্রতি এই মর্মে ঈমান আনতে হবে যে, তাঁরা সকলেই ছিলেন মাছুম এবং আপন আপন যুগের সবচেয়ে জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি। আর যে হেদায়েত তাঁরা বহন করে এনেছিলেন তা ছিল নির্ভুল ও আল্লাহর তরফ থেকে প্রাপ্ত। সমগ্র পয়গম্বরদের ভিতরে হযরত মুহাম্মাদ (স:) যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ, তেমন তিনি সর্বশেষ পয়গম্বরও। পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণ বিশেষ কোন গোত্রের, যুগের কিংবা এলাকার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সঃ) প্রেরিত হয়েছিলেন সারা বিশ্বের সমগ্র মানব মন্ডলীর উদ্দেশ্যে। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ (سورة السبأ : ۷۸)
“হে রসূল, অবশ্যই আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির পয়গম্বর
করে পাঠিয়েছি।” (সূরা সাবা-৭৮)
পঞ্চম হলো পরকালের প্রতি ঈমান। অর্থাৎ অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করতে হবে যে, মৃত্যুর ভিতর দিয়ে জীবনের সমাপ্তি ঘটেনা বরং জীবনের অন্য আর একটি স্তরে প্রবেশ করে, যার নাম পরকাল। এই পরকালেরই এক পর্যায়ে পার্থিব জীবনের যাবতীয় কাজের হিসাবান্তে মানুষকে তার ফলাফল প্রদান করা হবে। ফলে কেউ বেহেশতী হবে, আবার কেউ হবে দোযখী। হাদীসে উল্লেখিত ‘সায়াত’ শব্দ দ্বারা উক্ত বিচারের দিনটি বুঝানো হয়েছে। এ দিনটিকে হাশর বা কিয়ামতের দিনও বলা হয়। কোরআন হাদীস ও নবীদের তালীমে পরকাল বিশ্বাসের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কেননা পরকাল বিশ্বাসই প্রকৃতপক্ষে মানুষকে দুনিয়ার জীবনে সৎকাজ করতে বাধ্য করে। পক্ষান্তরে যে পরকাল বিশ্বাস করে না সে হয় স্বেচ্ছাচারী ও দায়িত্বহীন। কেননা কিয়ামতে আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে ভাল-মন্দ কাজের যে জওয়াবদিহী করতে হবে এ বিশ্বাস সে রাখে না।
কিয়ামতের দিনটি কবে অনুষ্ঠিত হবে তার সঠিক তারিখ (দিন, মাস, সন) আল্লাহ কাউকে জানাননি। তবে কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার কতকগুলো নিদর্শন তিনি তাঁর প্রিয় পয়গম্বরকে জানিয়ে দিয়েছেন। বর্ণিত হাদীসে জিবরিল (আ:) উক্ত নিদর্শন সম্পর্কেই হুজুরকে জিজ্ঞেস করলেন যে, আপনি তাহলে আমাকে কিয়ামতের নিদর্শনগুলো বলে দিন। হুজুর (স:) বললেন, “যখন তুমি দেখতে পাবে যে, দাসীরা তার প্রভুকে জন্ম দিয়েছে, আর পাদুকাহীন, বস্ত্রহীন রাখাল শ্রেণীর লোকেরা দালান-কোঠার ভিতরে অহঙ্কারে লিপ্ত, তখনই মনে করবে যে কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে।”
অর্থাৎ সন্তানেরা যখন মায়ের সাথে দাসীর ন্যায় ব্যবহার করবে এবং সমাজের অযোগ্য ও নীচ শ্রেণীর লোকেরা নেতা সেজে অহংকারে লিপ্ত হবে, তখনই মনে করতে হবে যে, কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে।
হাদীসটিতে নবী করীম (স:) কিয়ামতের অসংখ্য নিদর্শনের মধ্যে মাত্র দুটির কথা উল্লেখ করেছেন।
ষষ্ঠ হলো তাকদীরের ভাল মন্দের উপর ঈমান আনা। তাকদীরকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় “কাযা ও কদর”। আর এ কাযা ও কদরকেই সংক্ষেপে বলা হয় তাকদীর।
তাকদীর বলা হয় কোন ঘটনা ঘটার পূর্বে সম্ভাব্য ঘটনা সম্পর্কে অনুমান করে স্থির করা। এমন বহু ঘটনা আছে যার সম্পর্কে মানুষ পূর্ব হতেই অনুমান করে কর্মপন্থা ঠিক করে, ইহাকেই বলা হয় তাকদীর। তবে মানুষের জ্ঞান ত্রুটিমুক্ত নয় বলে কখনও কখনও তার এ আন্দাজ ও অনুমানের ব্যতিক্রম ঘটে। পক্ষান্তরে আল্লাহর জ্ঞান ত্রুটিমুক্ত ও পূর্ণাঙ্গ বলে তাঁর তাকদীরে কোন ব্যক্তিক্রম ঘটে না। তবে তিনি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ব্যতিক্রম ঘটান সেকথা আলাদা।
মোহাক্কেক আলেমদের অনেকেই তাকদীরের ব্যাখ্যা নিম্নরূপ দিয়েছেন,
“মহান আল্লাহ সৃষ্টির বহু পূর্বে যাবতীয় সৃষ্টি বস্তু, তার আকৃতি প্রকৃতি, রূপ-গুণ, স্থিতিকালের পরিমাণ, স্থিতিকালীন অবস্থান, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, ধ্বংস, লয় ও পরিণাম ইত্যাদি নিরূপন করে রেখেছেন। সৃষ্টিকর্তার এই আগাম নিরূপণ নীতিতে দৃঢ় প্রত্যয় রাখাকেই বলা হয় তাকদীরে ঈমান স্থাপন করা।”
আল্লাহ তায়ালার ইলম অনাদি। অর্থাৎ যা ঘটেছে, যা ঘটছে এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবে সবই আল্লাহর নিকটে বর্তমান। সুতরাং আল্লাহর এই অনাদি ইলমের ভিত্তিতেই ভবিষ্যতে যা ঘটবে তা তিনি বিধিবদ্ধ করে রেখেছেন। এর অর্থ নিশ্চয়ই এ নয় যে, তিনি বিধিবদ্ধ (মোকাদ্দার) করে রেখেছেন বলে আমরা করি, বরং আমরা করব বলেই তিনি বিধিবদ্ধ করে রেখেছেন।
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, হাদীসটিতে দ্বীনের তিনটি প্রধান ও মৌলিক বিষয়ের যথা: ইসলাম, ঈমান ও ইহসানের অবতারণা করা হয়েছে। কোন ব্যক্তি যখন আল্লাহর দ্বীনকে কবুল করে দ্বীনের পথে চলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তখনই তাঁর প্রথম মনযিলে সে মুসলিম, দ্বিতীয়
মনযিলে মুমিন এবং তৃতীয় মনযিলে মুহসীন। যখন কোন একজন লোক আল্লাহ ও রসূলের স্বীকৃতির ঘোষণাসহ ইসলামের প্রধান প্রধান অনুষ্ঠানগুলো বাহ্যিকভাবে পালন করে তখন সে মুসলিম। ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র তার সাথে মুসলমান রূপেই আচরণ করবে। তার অন্তর যে অবস্থায়ই থাকুক তা দেখা সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য নয়।
উপরোক্ত ঘোষণা ও বাহ্যিক আমলের প্রভাব যখন কোন ব্যক্তির অন্তরে প্রবেশ করে, অর্থাৎ বাহ্যিক ইসলামী ঘোষণা ও আমল যখন অন্তরের অনুমোদন লাভ করে তখন সে মুমিন হয়।
অত:পর ঈমানের ক্রমবর্ধমান অনুপ্রবেশ তার অন্তরকে যখন আল্লাহ, রসূল এবং দ্বীনের জন্য আসক্ত করে তোলে তখন সে মহসীন হয়।
আল্লাহর খাঁটি বান্দারা এই ইহসানের দরজা লাভ করার জন্য অবিরাম পেরেশান থাকেন।
রসূলের প্রতি ঈমানের তাৎপর্য
(٤) وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ (بخاري – مسلم)
(৪) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ
(স:) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তার পিতা, সন্তান ও যাবতীয় লোকজন থেকে আমাকে অধিক ভালবাসতে না পারবে সে পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: একজন ঈমানদার ব্যক্তির পক্ষে রসূলের প্রতি সাধারণভাবে ঈমান আনাই যথেষ্ট হবে না। বরং প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার জন্য রসূলকে নিজের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সকল প্রিয়জন হতে অধিক মহব্বত করতে হবে।
মহব্বত বা ভালবাসা সাধারণত: দুই প্রকারের। এক প্রকার হচ্ছে
১) محبت اختياري স্বেচ্ছাকৃত ভালবাসা।
২) محبت اضطراري প্রকৃতগত ভালবাসা।
প্রথমটি মানুষের ইচ্ছাধীন, আর দ্বিতীয়টি মানুষের আয়ত্বের বাইরে। মনে করুন একজন ঈমানদার ব্যক্তি তার পিতাকেও ভালবাসেন এবং রসূলকেও ভালবাসেন। এমতাবস্থায় তার পিতা তাকে এমন একটি কাজের নির্দেশ দিলেন যা রসূলের (স:) নির্দেশের বিপরীত। সে যদি তখন পিতার ভালবাসার উপর রসূলের ভালবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে নির্দেশ লংঘন করে, তাহলেই তার রসূলের ভালবাসা পিতার ভালবাসার উপর প্রাধান্য লাভ করেছে বলে ধরে নিতে হবে।
হাদীসে উল্লেখিত ভালবাসা দ্বারা প্রথম প্রকারের (স্বেচ্ছাকৃত) ভালবাসাই বুঝান হয়েছে। তবে কারও অন্তরে যদি রসূলের প্রকৃতিগত ভালবাসার আধিক্য ঘটে তাহলে সেটা আরও উত্তম।
(٥) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ
(مشكوة)
(৫) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি
বলেন, নবী করীম (স:) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তার কামনা-বাসনাকে আমার উপস্থাপিত দ্বীনের অধীন করতে না পারবে সে ঈমানদার হতে পারবে না।” (মিশকাত)
ব্যাখ্যা: রসূলের প্রতি ঈমানের প্রকৃত মর্ম হচ্ছে যে, আল্লাহর তরফ থেকে রসূল যে শরীয়ত মানব জাতির জন্য বহন করে এনেছেন, নিজের ইচ্ছা প্রেরণা ও কামনা-বাসনাকে সম্পূর্ণরূপে সে জীবন বিধানের অধীন করে দেয়া।
(٦) وَعَنْ أَبِي أُمَامَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الإِيمَانَ (بخاري)
(৬) “হযরত আবু উমামাহ (রা:) হতে বর্ণিত, হযুর (স:) বলেছেন,
যে ব্যক্তির ভালবাসা ও শত্রুতা, দান করা ও না করা নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যেই হয়ে থাকে, সে ব্যক্তিই পূর্ণ ঈমানদার।”
(বুখারী)
ব্যাখ্যা: একজন ঈমানদার ব্যক্তি ঈমানের পথে চলতে চলতে যখন এমন এক স্তরে গিয়ে উপনীত হয়, যেখানে পৌঁছে তার যাবতীয় কাজ কর্ম একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছানুসারেই সামাধা হতে শুরু করে তখনই বুঝতে হবে ঈমানের ক্ষেত্রে সে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।
وَعَنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (V)
صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ذَاقَ طُعْمَ الْإِيمَانِ مَنْ رَضِيَ بِاللَّهِ
رَبَّا وَبِالإِسْلَامِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولاً (بخاري – مسلم)
(৭) “হযরত আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল করীম (স:) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে কবুল করেছে, সেই ব্যক্তি ঈমানের প্রকৃত স্বাদ লাভকরেছে।” (বুখারী মুসলিম)
জীবনের ক্রিয়া-কর্মের উপর ঈমানের প্রভাব
(۸)
وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَلَّمَا خَطَبَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَّا قَالَ: لَا إِيْمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ ، وَلَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ (بيهقي)
(৮) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন যে, হুজুর (স:) আমাদেরকে এমন নসীহত খুব কমই করেছেন, যার ভিতর তিনি একথা বলেননি যে, খেয়ানতকারী ব্যক্তির ঈমান নেই এবং ওয়াদাভঙ্গকারী ব্যক্তির দ্বীন নেই।” (বায়হাকী)
ব্যাখ্যা: উপরোক্ত হাদীসটিতে প্রিয় নবী (স:) দ্বীন ও ঈমানের পরিপন্থী দুটি মারাত্মক অপরাধমূলক কাজের কথা উল্লেখ করেছেন। এর একটি হচ্ছে আমানতের খেয়ানত, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ওয়াদা ভঙ্গ।
এ হাদীসে আমানত শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তির আমানত, সমাজের আমানত, জাতির আমানত ইত্যাদি সব শ্রেণীর আমানতই এতে শামিল। অনুরূপভাবে অর্থসম্পদের আমানত, দায়িত্ব কর্তব্যের আমানত, ইজ্জত আবরুর আমানত প্রভৃতিও এর অন্তর্ভূক্ত। ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতিও এখানে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তির ওয়াদা হতে আরম্ভ করে জাতীয় আন্তর্জাতিক ওয়াদা, চুক্তি, প্রতিজ্ঞা প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি সবই এতে শামিল।
(۹)
وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبُّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ (بخاري – مسلم)
(৯) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত নবী করীম (স:) ইরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্য হতে কেহই মুমিন হতে পারবে না, যে পর্যন্ত না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে তা তার মুমিন ভাইয়ের জন্য পছন্দ করবে।” (বুখারী-মুসলিম)
ব্যাখ্যা: একজন লোক ঈমান গ্রহণ করার পর স্বাভাবিকভাবেই ঈমানের চাহিদা মোতাবেক তার ওপর কতকগুলো দায়িত্ব অর্পিত হয়। এ দায়িত্ব সমূহের মধ্যে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বসমূহও শামিল। হাদীসে উল্লেখিত দায়িত্বটি একজন মুমিন ব্যক্তির সামাজিক দায়িত্ব। অর্থাৎ একজন ঈমানদার ব্যক্তি তার নিজের স্বার্থ ও অধিকারকে যে চোখে দেখে, সমাজে বসবাসকারী তার মুমিন ভাইয়ের স্বার্থ ও অধিকারকেও ঠিক সেই চোখে দেখবে, অন্যথায় সে পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না।
(۱۰)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ، وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَاجَرَ مَا نَهَى اللَّهُ عَنْهُ (بخاري)
(১০) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, মুসলমান সেই ব্যক্তি যার হস্ত ও জিহবা হতে মুসলমান নিরাপদে থাকে। আর মুহাজির হলো সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু হতে হিজরত করে।” (বুখারী)
ব্যাখ্যা: বর্ণিত হাদীসটিতে একজন প্রকৃত মুসলিম ও একজন প্রকৃত মুহাজিরের চরিত্র কি ধরণের হওয়া উচিত সে দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইসলামকে নিজের জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করবে, সে তার হস্ত কিংবা জিহবা দ্বারা কোন মুসলমানকেই তকলীফ দিবে না। অনুরূপভাবে হিজরতের পূর্ণ ফযিলত তিনিই প্রাপ্ত হবেন, যিনি আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু হতে হিজরত করবেন।
পার্থিব স্বার্থে দেশ ত্যাগ করা হিজরত নয়।
ইসলামের বুনিয়াদ
(۱۱)
وَعَنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: بُنِيَ الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، وَإِقَامِ الصَّلاةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ (بخاري – مسلم)
(১১) “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রসূল (স:) বলেছেন: পাঁচটি জিনিসের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো হলো আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বান্দাহ ও রসূল একথার সাক্ষ্য দেয়া, নামায কয়েম করা, যাকাত দেয়া, হজ্জ করা ও রমযান মাসের রোযা রাখা।” (বুখারী, মুসলীম)
ব্যাখ্যা: এ হাদীসে ইসলামকে একখানা ঘরের সাথে এবং কালেমা, নামায, যাকাত, হজ্জ ও রমযান মাসের রোযাকে তার খুঁটির সাথে তুলনা করা হয়েছে। হুযুর (স:) ইসলামকে বুঝার জন্য একটি সুন্দর উপমা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, খুঁটি ছাড়া যেমন ঘরের কল্পনা করা যায় না, তেমনি নিছক খুঁটিকেও ঘর বলা হয় না। হাদীসে উল্লেখিত পাঁচটি জিনিস হলো ইসলামের ভিত্তি মাত্র, পূর্ণ ইসলাম নয়। কাজেই কেউ যদি উপরোক্ত পাঁচটি কাজ সমাধা করে মনে করে যে, ইসলামের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করে ফেলেছে, তাহলে সেটা সেই ধরণেরই ভূল হবে, যেমন একটা লোক খুঁটি পুতে দিয়ে মনে করল সে ঘর তুলে ফেলেছে।
শুধু কয়েকখানা (চালা বিহীন) খুঁটি যেমন মানুষকে রোদ বৃষ্টি হতে বাঁচাতে পারে না, তেমনি নিছক এ পাঁচটি কাজ সমাধা করেই মানুষ পরকালের জওয়াবদিহী হতে বাঁচতে পারবে না। যে জীবন বিধান মহানবী (সা:) মানব জাতির নিকট পেশ করেছেন তার সবটুকুই ইসলাম। একে পুরাপুরি গ্রহণ করে মানুষ ইহকাল পরকালে সর্বাত্মক কল্যাণ লাভ করতে পারে।
কবীরা গুনাহ
إِنْ تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلاً كَرِيمًا (سورة النساء : ٣١)
অর্থ: যদি তোমরা নিজেদেরকে নিষিদ্ধ কবীরা গুনাহসমূহ হতে বাঁচিয়ে রাখ, তাহলে তোমাদের (ছোট-খাট) অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেব। আর তোমাদেরকে সম্মানজনক অবস্থানে প্রবেশ করাব।” (সূরা নিসা-৩১)
তবে কেউ যদি বিনা দ্বিধায় হরহামেশা সগীরা গুনাহ করতে থাকে, তাহলে তার এই সগীরাহ শেষ পর্যন্ত কবীরা গুনায় পরিণত হবে।
তাছাড়া কেহ যদি সারা জীবন পাপের কাজে লিপ্ত থেকে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে (মৃত্যুর লক্ষণ অনুভব করে) তওবা করে, তার তওবা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না। এ সম্পর্কে কোরআনের ঘোষণা হলো নিম্নরূপ:
إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِنْ قَرِيبٍ فَأُولَئِكَ يَتُوْبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا ، وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُوْنَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الآنَ وَلَا الَّذِيْنَ يَمُوْتُوْنَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
(سورة النساء : ۱۷ – ۱۸)
অর্থ: “প্রকৃতপক্ষে তাদের তাওবাই গ্রহণীয় যারা অজ্ঞাতে পাপের কাজ করে, অত:পর কালবিলম্ব না করে তওবা করে। এ ধরণের লোকের তওবাই আল্লাহ কবুল করে থাকেন। আর আল্লাহ হলেন মহাজ্ঞানী ও বিজ্ঞ। পক্ষান্তরে যারা অবিরাম পাপের কাজে লিপ্ত থাকে, অত:পর যখন মৃত্যুর মুখোমুখী হয়, তখন বলে এবারে আমি তওবা করলাম। আল্লাহর কছে এদের তওবা একেবারে-ই মূল্যহীন; যেমন মূল্যহীন কাফের অবস্থায় মৃত্যু বরণকারীর তওবা।
(সূরা নিসা-১৭, ১৮)
(۱۲)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْكَبَائِرُ الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ، وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ، وَقَتْلُ النَّفْسِ، وَالْيَمِينُ الْغَمُوسُ (بخاري)
(১২) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি
বলেন নবী করীম (স:) বলেছেন, কবীরা গুনাহ হচ্ছে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা ও মিথ্যা শপথ করা।” (বুখারী)
ব্যাখ্যা: আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অপছন্দনীয় কাজকে বলা হয় গুনাহ। গুনাহ ফারসী শব্দ। এর আরবী হলো ‘মাসীয়াত’। গুনাহ সাধারণত: দু’প্রকার। সগীরা ও কবীরা। যে সমস্ত অপরাধ সম্পর্কে কোরআন হাদীসে শাস্তির বিধান আছে, তাহলো কবীরা। আর যে সব গুনাহ সম্পর্কে কোরআন হাদীসে কোন শাস্তির বিধান নেই তাহলো সগীরা। শিরক ব্যতীত অন্যান্য কবীরা গুনাহ দ্বারা মুমিন কাফির হয় না বটে, তবে তাকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। মানুষের ঋণ ব্যতীত অন্যান্য কবীরা গুনাহ হতে যদি ঈমানদার ব্যক্তি খালেছ তওবা করে, তাহলে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দিবেন। ‘তওবা’ শব্দটি আরবী। এর আভিধানিক অর্থ হলো ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। আর শরীয়তের পরিভাষায় তওবা বলা হয় অনুতপ্ত মনে শরীয়ত বিরোধী কাজ হতে ফিরে আসা এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ কাজে লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করত আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। সুতরাং কেউ যদি মুখে হাজার বারও তওবা উচ্চারণ করে, আর গুনাহের কাজে লিপ্ত থাকে, তাহলে তার এ মৌখিক তওবা প্রকৃতপক্ষে তওবা-ই নয়। আল্লাহর প্রিয় নবী রসূলগণ ব্যতীত অন্যান্য মুসলমানদের পক্ষে সমস্ত সগীরা গুনাহ হতে বেঁচে থাকা অসম্ভব। কবিরা গুনাহ একমাত্র খালেস তওবা দ্বারাই আল্লাহ রব্বুল আলামিন মাফ করে থাকেন। তবে আল্লাহর দরবারে তওবা কবুল হওয়ার জন্য তিনিট শর্ত আছে, ১নং শর্ত হলো যে পাপ করেছে সে ঐ পাপের জন্য চরমভাবে অনুতপ্ত হবে। ২য় শর্ত হলো আল্লাহর কাছে ওয়াদা করবে সে জিন্দেগীতে ঐ পাপ কাজ করবে না। এটা হলো ঐ কাজের ব্যাপারে যেটা শুধু আল্লাহর হকের সাথে সংশ্লিষ্ট। তবে ঐ পাপ কাজ যদি বন্দার হক সংশ্লিষ্ট হয়, তাহলে ৩য় আর একটি শর্ত উপরোক্ত দুটির সাথে যোগ হবে। তাহলো যে বান্দাহ বা লোকের হক সে নষ্ট করেছে ঐ হক তাকে আদায় করে দিবে, অথবা তার কাছে থেকে মাফ করিয়ে নিবে।
(۱۳)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ
اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُويقَاتِ،
قَالُوا : يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا هُنَّ؟ قَالَ: الشَّرْكُ بِاللَّهِ، وَالسِّحْرُ، وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ،
وَأَكُلُ الرِّبَا، وَأَكُلُ مَالِ الْيَتِيمِ، وَالتَّوَلِي يَوْمَ
الزَّحْفِ، وَقَدْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلَاتِ
(بخاري – مسلم)
(১৩) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল
(স:) বলেছেন, তোমরা সাতটি ধবংসাত্মক পাপ হতে বিরত থাকবে। ছাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল, সে সাতটি পাপ কি কি? তিনি বললেন, এগুলো হলো আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, যাদু করা, শরীয়তের অনুমোদন ব্যতীরেকে কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎ করা, জিহাদের ময়দান হতে পলায়ন করা এবং অচেতন পবিত্র ঈমানদার মহিলাদের বিরূদ্ধে ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগ আনা। (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: উপরোক্ত হাদীসটিতে নবী করীম (স:) কবীরা গুনাহ হতে
কয়েকটি গুনাহের কথা উল্লেখ করেছেন মাত্র। কবীরা গুনাহ সম্পর্কীয় যাবতীয় কাজের উল্লেখ করেননি।
(١٤) وَعَنْ مُعَادٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: أَوْصَانِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِعَشْرِ كَلِمَاتٍ، قَالَ: لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ شَيْئًا وَإِنْ قُتِلْتَ وَحُرِّقْتَ، وَلَا تَعُقِّنَّ وَالِدَيْكَ، وَإِنْ أَمْرَاكَ أَنْ تَخْرُجَ مِنْ أَهْلِكَ وَمَالِكَ، وَلَا تَتْرُكُنَّ صَلَاةً مَكْتُوبَةً مُتَعَمِّدًا؛ فَإِنَّ مَنْ تَرَكَ صَلَاةً مَكْتُوبَةٌ مُتَعَمِّدًا فَقَدْ بَرِئَتْ مِنْهُ ذِمَّةُ اللَّهِ، وَلَا تَشْرَبَنَّ خَمْرًا ؛ فَإِنَّهُ رَأْسُ كُلِّ فَاحِشَةٍ، وَإِيَّاكَ وَالْمَعْصِيَةَ؛ فَإِنَّ بِالْمَعْصِيَةِ حَلَّ سَخَطُ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَإِيَّاكَ وَالْفِرَارَ مِنَ الزَّحْفِ وَإِنْ هَلَكَ النَّاسُ، وَإِذَا أَصَابَ النَّاسَ مَوْتٌ
وَأَنْتَ فِيْهِمْ فَاثْبُتْ، وَأَنْفِقْ عَلَى عِبَالِكَ مِنْ طَوْلِكَ، وَلَا تَرْفَعْ عَنْهُمْ عَصَاكَ أَدَبًا وَأَخِفُهُمْ فِي اللَّهِ (رواه أحمد )
(১৪) “হযরত মুয়ায (রা:) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন যে, রসূল (স:) আমাকে দশটি বিষয় সম্পর্কে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, হে মুয়ায, যদি তোমাকে হত্যা করা কিম্বা পুড়িয়েও ফেলা হয়, তবু তুমি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আর তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে তোমার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ হতে তাড়িয়েও দেয়, তবু তাদের অবাধ্য হবে না। ইচ্ছাকৃতভাবে কিছুতেই তুমি ফরয নামায ত্যাগ করবে না। কেননা স্বেচ্ছায় যে ফরয নামায ত্যাগ করে তার ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কোন দায়িত্ব থাকে না। কিছুতেই তুমি শরাব পান করবে না, কেননা শরাব হলো সমস্ত অশ্লীল কাজের মূল। আর তুমি সব রকমের পাপকার্য হতে নিজকে দূরে রাখবে। কেননা পাপ কার্যের কারণে আল্লাহর গযব অবতীর্ণ হয়। চরম কাটাকাটির মুহুর্তেও তুমি জিহাদের ময়দান পরিত্যাগ করবে না। আর তুমি যেখানে অবস্থান করছ, সেখানে যদি মহামারী (সংক্রামক ব্যাধি) দেখা দেয়, তাহলে তুমি সেখানে অবস্থান করবে। তুমি তোমার সাধ্যমত পরিবার পরিজনের প্রয়োজনে খরচ করবে। তাদেরকে আদব শিখাতে তাদের উপর থেকে শাসনের ডাণ্ডা সরাবে না এবং তাদের অন্তরে আল্লাহভীতি সৃষ্টি করবে।” (আহমদ)
ব্যাখ্যা: হাদীসের রাবী (বর্ণনাকারী) হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা:) ছিলেন নবী করীমের (স:) বিশিষ্ট সহাবীদের অন্যতম। হুযুর (স:) তাঁকে ইয়ামেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। বর্ণিত হাদিসটি দ্বারা হুযুরের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্কের সন্ধান মেলে।
নবী করিম (স:) হযরত মুয়াযকে প্রাণ নাশের সঙ্কটময় মুহূর্তেও শিরক হতে পবিত্র থাকার উপদেশ দিয়েছেন। কেননা তাওহীদের উপর অটল অচল থাকার কারণে যদি বিধর্মী কর্তৃক নিহতও হয়, তাহলে সে শাহাদতের মর্যাদা প্রাপ্ত হবে। উপরোক্ত অবস্থাটাকেই শরীয়তের পরিভাষায় ‘আযীমত’ বলা হয়। আর হযরত মুয়াযের মতো বিশিষ্ট সাহাবীর পক্ষে আযীমতের উপর আমল করাই শোভনীয়। পক্ষান্তরে সাধারণ কোন মুসলমান যদি কাফির দুশমন হতে জান বাঁচাবার উদ্দেশ্যে অন্তরে তওহীদের বিশ্বাস স্থির রেখে মুখে কালেমায়ে শিরক উচ্চারণ করে, তাহলে তাকে এ ব্যাপারে অবকাশ দেয়া হয়েছে। অবশ্য সেও যদি আযীমতের উপর আমল করে মুত্যুবরণ করে, তবে সে শাহাদাতের মর্যাদা প্রাপ্ত হবে।
হুযুরের (স:) উপদেশ হতে আরও জানা গেল যে, কোন এলাকায় যদি ওবায়ী ব্যাধি (মহামারী) দেখা দেয়, তাহলে সেখানকার লোকেরা সে স্থান ত্যাগ করবে না। কেননা সেখানকার লোক যদি অন্যত্র চলে যায়, তাহলে রোগীর সেবা-শুশ্রষাও হবে না এবং রোগ প্রতিরোধেরও কোন প্রচেষ্টা হবে না। অবশ্য কোন এলাকায় মহামারী দেখা দিলে বাইরের লোককেও সেখানে আসতে নিষেধ করা হয়েছে।
বিদয়াত
(١٥) وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا (مسلم – بخاري) لَيْسَ فِيهِ، فَهُوَ رَدُّ
(১৫) হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, যে,
রসূল (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনের ভেতর এমন কিছু সংযোজন করবে যার কোন ভিত্তিই দ্বীনে নেই তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: আল্লাহ তদীয় নবী হযরত মুহাম্মাদের (স:) মাধ্যমে যে দ্বীন
মানব জাতির উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছেন তা পূর্ণাংগ। গোটা মানব জীবনের যাবতীয় বিষয়সমূহের মৌলিক ব্যবস্থা এতে শামিল। সুতরাং কেউ যদি দ্বীনের ভেতর এমন কোন অভিনব বস্তু আমদানী করতে চায় যার কোন অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোরআন হাদীসে নেই, সেটা-ই বিদয়াত এবং তা বর্জন করতে হবে।
রসূলকে অনুসরণ করার সঠিক তরীকা
(١٦) وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: جَاءَ ثَلَاثَةُ رَهْطٍ إِلَى أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْأَلُونَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَلَمَّا أُخْبِرُوا بِهَا كَأَنَّهُمْ تَقَالُوْهَا ، فَقَالُوا : أَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ۚ وَقَدْ غَفَرَ اللَّهُ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ، فَقَالَ أَحَدُهُمْ : أَمَّا أَنَا فَأُصْلِي اللَّيْلَ أَبَدًا ، وَقَالَ الآخَرُ: إِنِّي أَصُوْمُ الدَّهْرَ فَلَا أُفْطِرُ، وَقَالَ الْآخَرُ: أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ وَلَا أَتَزَوَّجُ أَبَدًا، فَجَاءَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَيْهِمْ فَقَالَ : أَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا ،
أَمَا إِنِّي لَأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ وَأُصَلِى وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي (بخاري – مسلم)
(১৬) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন একদা রসূলের (স:) ইবাদত সম্পর্কে অনুসন্ধান করার জন্যে তিন ব্যক্তি তাঁর বিবিদের কাছে উপস্থিত হলো। অত:পর রসূলের (স:) ইবাদত সম্পর্কে যখন তাদেরকে জনান হলো, তখন যেন তারা তা অপ্রতুল মনে করল এবং বলল, আমাদের সাথে হুযুরের (স:) কি তুলনা হতে পারে? আল্লাহ স্বয়ং তাঁর অগ্র-পশ্চাতের অপরাধ মাফ করার ঘোষণা দিয়েছেন। অত:পর তাদের একজন বলল, আমি কিন্তু সারা রাত নামাযে কাটাব। দ্বিতীয় জন বলল, আমি সারা বছরই রোযা রাখব এবং কোন দিনই রোযা ত্যাগ করব না। তৃতীয় জন বলল, আমি মেয়েদের সম্পর্ক হতে দূরে থাকব এবং কখনও বিয়ে-শাদী করব না। হঠাৎ হযুর (স:) সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ওহে, তোমরা কি এসব কথা বলেছ,
[টিকাঃ নবী করীম (স:) কি করে তাদের এ কথা-বার্তার খবর পেলেন সে সম্পর্কে দুটি মত আছে। একটি হলো এই যে, হুজুর তখন মসজিদে নববীতে অবস্থান করছিলেন। আর এ কথা-বার্তা হচ্ছিল মসজিদ সংলগ্ন উম্মুল মোমেনীনদের ঘরে। সুতরাং হুযুর মসজিদে বসেই এসব আলাপ শুনতে পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় মতটি হলো এই যে, স্বয়ং জিবরাঈল (আ:) হুযুরকে উক্ত কথোপকথনের খবর দিয়েছিলেন। কেননা ইসলামী ইবাদত সম্পর্কে একটি ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনটি লোক হুযুরের বাড়ী হতে ফিরে যাচ্ছিলেন। সুতরাং নবী করীমের দ্বারা যদি তাদের এ ভুল সংশোধন করে না দেয়া হতো, তাহলে তারা এই ভুল মতেরই প্রচার ও তবলীগ করত।]
সাবধান আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আমি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহকে ভয় করি এবং তাঁর উদ্দেশ্যে সবচেয়ে বেশী পরহেজ করি। এতদসত্ত্বেও আমি কোন দিন রোযা রাখি, আবার কোন দিন (নফল রোযা) ছেড়েও দেই। কখনও নামায পড়ি, আবার কখনও ঘুমাই। আর আমি বিয়ে-শাদিও করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার এ সুন্নত অনুসরণ করবে না সে আমার উম্মত নয়।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: পরম করুণামায় আল্লাহ নবীদের মাধ্যমে যে দ্বীন বা জীবন-বিধান মানবজাতির জন্য নাযিল করেছেন, তা যথাযথ মেনে চলার মধ্যেই ইহকাল পরকালের কল্যাণ নিহিত। নবীরা জীবনভর উক্ত দ্বীন মোতাবেক আমল করে দ্বীনের একটি বাস্তবরূপ উম্মতের জন্যে রেখে যান। শরীয়তের পরিভাষায় তাকে বলা হয় সুন্নতে রসূল।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) তার সারা জিন্দেগীর ক্রিয়াকর্ম দ্বারা দ্বীনের যে নিখুঁত আকৃতি আমাদের জন্য রেখে গেছেন, তা-ই তার সুন্নত বা তরীকা। তা হতে যেমন কোন কিছু বাদ দেয়ার কোন অধিকার কারো নেই, তেমনি অধিকার নেই তাতে নূতন কিছু যোগ করার। কাজেই নামায-রোযা ও হালাল হারামের বন্ধনমুক্ত উচ্ছৃংখল জীবন যেমন আল্লাহর কাছে অপছন্দীয়, তেমনি অপছন্দনীয় সংসার-ধর্ম ও দুনিয়ার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব ত্যাগ করে দিন রাত নফল ইবাদতে মশগুল হওয়া। এ উভয় পথের মাঝখানে হলো নবীর পথ। আর এ পথে চলেই মানুষ পেতে পারে দুনিয়া-আখেরাতের চিরন্তন কল্যাণ। আলোচ্য হাদীসে হুযুর (স:) এ পথের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন যে এটাই হলো আমার সুন্নত। আর যে ব্যক্তি আমার সুন্নত অনুসরণ করবে না সে আর যা-ই হোক আমার উম্মত নয়।
হযরত ঈসা (আ:) এর উম্মতের ভেতর একদল খোদাভীরু লোক দুনিয়ার যাবতীয় কাজ-কারবার ছেড়ে হুজরা, জংগল, পর্বত ও গুহা ইত্যাদিতে আশ্রয় নিয়ে দিন-রাত আল্লাহর ধ্যানে মশগুল ছিল। তাদের বিষয় উল্লেখ করে আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মদীকে সাবধান করে বলছেন,
وَرَهْبَانِيَّةٌ ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا
(سورة الحديد : ۲۷)
“এ দরবেশী জীবন তাদের মনগড়া। আমি তাদের জন্যে তা ফরয করিনি। তারা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যেই এ পথ অবলম্বন করেছিল। কিন্তু সীমা লংঘন করে ফেলেছে।”
(সূরা আল-হাদীদ-২৮)
(۱۷)
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا صَنَعَ رَسُولُ اللَّهِ صلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ شَيْئًا، فَرَخَّصَ فِيْهِ، فَتَنَزَّهَ عَنْهُ قَوْمٌ، فَبَلَغَ ذَالِكَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَخَطَبَ فَحَمِدَ اللَّهَ ثُمَّ قَالَ: مَا بَالُ أَقْوَامٍ يَتَنَزَّهُوْنَ عَنِ الشَّيْءِ أَصْنَعُهُ، فَوَاللَّهِ إِنِّي لَأَعْلَمُهُمْ بِاللَّهِ وَأَشَدُّهُمْ لَهُ خَشْيَةٌ (بخاري – مسلم)
(১৭) “হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রসূল (স:) একটি কাজ করে অন্যকেও তা করার অনুমতি দিলেন। এতদসত্ত্বেও কিছু লোক তা করা হতে বিরত থাকল। একথা হুযুরের (স:) কানে পৌঁছালে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে একটি খোতবা দিলেন। প্রথমে হুযুর (স:) আল্লাহর প্রশংসা করলেন। অত:পর বললেন, যে কাজটি আমি স্বয়ং করেছি, তা হতে বিরত থাকাটা তারা কি করে পছন্দ করতে পারল? আল্লাহর শপথ, তাদের চেয়ে আমি আল্লাহকে অধিক জানি ও অধিক ভয় করি। (বুখারী, মুসলীম)
ব্যাখ্যা: শরীয়তের কোন কোন অনুষ্ঠান বা আমল অবস্থা ভেদে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ আছে। যেমন রোগী কিংবা মোসাফিরের জন্যে রমযান মাসের রোযা বাধ্যতামূলক নয়। ইচ্ছা করলে রাখতেও পারে অথবা কাযাও করতে পারে। কিন্তু রোগী ব্যক্তি কিংবা মোসাফিরের রোযা রাখার কারণে যদি জীবন নাশের সম্ভাবনা থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই রোযা ত্যাগ করতে হবে। কেননা ইবাদত হলো আল্লাহ-রসূলের মর্জি মোতাবেক কাজ করা। শরীয়তের বিধি-নিষেধের পরওয়া না করে নিজের খোয়াল খুশী মত কাজ করা ইবাদত নয়।
(۱۸)
وَعَنْ أَبِي ثَعْلَبَةَ الْخُشْنِيِّ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ فَرَضَ فَرَائِضَ فَلَا تُضَيّعُوهَا ، وَحَرَّمَ حُرُمَاتٍ فَلَا تَنْتَهِكُوهَا، وَحَدَّ حُدُودًا فَلَا تَعْتَدُوهَا ، وَسَكَتَ عَنْ أَشْيَاءَ مِنْ غَيْرِ نِسْيَانٍ فَلَا تَبْحَثُوا عَنْهَا (الدار قطني)
(১৮) “হযরত আবু ছায়ালাবাহ খোসানী (রা:) বলেন, নবী করীম (স:) বলেছেন, আল্লাহ কতকগুলি বিষয় ফরয করেছেন, তা তরক করবে না। আর কতকগুলি বিষয় হারাম করেছেন, তোমরা তাতে লিপ্ত হবে না। আর ইচ্ছাকৃতভাবেই তিনি কতক বিষয় সম্পর্কে কিছু
বলেননি, তা নিয়ে তোমরা তর্ক করবে না।” (দার কতুনী)
(۱۹)
وَعَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْأَمْرُ ثَلَثَةٌ أَمْرٌ بَيْنَ رُشْدُهُ فَاتَّبِعْهُ – وَأَمْرٌ بَيْنٌ غَيُّهُ فَاجْتَنِبُهُ وَأَمْرٌ اخْتُلِفَ فِيهِ فَكِلْهُ إِلَى اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ
(احمد)
(১৯) “হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, শরীয়তের যাবতীয় বিষয়সমূহ তিন ধরনের। এক ধরনের বিষয় হলো যার সঠিক হওয়া একেবারেই স্পষ্ট, সুতরাং তা মেনে চলবে। আর এক ধরনের বিষয় হলো যার ভ্রান্ত হওয়া একেবারেই সন্দেহাতীত, সুতরাং তা পরিহার করবে। আবার কতক বিষয় এমনও আছে যা সন্দেহপূর্ণ, সেগুলি আল্লাহর উপর সোপার্দ করবে। (সন্দেহ নিরসন না হওয়া পর্যন্ত তাতে লিপ্ত হবে না।)
(আহমদ)
(۲۰)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَزَلَ الْقُرْآنَ عَلَى خَمْسَةِ أَوْجُهِ – حَلَالٌ وَحَرَامٌ وَمُحْكَمْ وَمُتَشَابِةٌ وَأَمْثَالُ فَاحِلُّوا
الْحَلَالَ وَحَرِّمُوا الْحَرَامَ وَاعْمَلُوْا بِالْمُحْكَمِ وَامِنُوْا بِالْمُتَشَابِهِ وَاعْتِيرُوا بِالْأَمْثَالِ (احمد)
(২০) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, নবী করীম (স:) বলেছেন, কোরআনে পাঁচ প্রকারের বিধান নাযিল হয়েছে। (অর্থাৎ কোরআনের যাবতীয় আয়াতসমূহ পাঁচ ভাগে বিভক্ত) হালাল, হারাম, মোহকাম, মোতাশাবেহ ও আমছাল। সুতরাং হালালকে হালাল বলে গ্রহণ করবে, হারামকে হারাম হিসেবে প্রত্যাখ্যান করবে, মোহকাম অনুসারে আমল করবে, মোতাশাবেহের উপর ঈমান আনবে এবং আমছাল হতে উপদেশ গ্রহণ করবে। (আহমদ)
ব্যাখ্যা: উপরোক্ত হাদীসে হুযুর (স:) পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ পাঁচভাগে বিভক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। প্রথম আয়াতে হালাল। অর্থাৎ, যাতে কোন বস্তু হালাল হওয়া সম্পর্কে ঘোষণা করা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে হারাম। অর্থাৎ, যাতে কোন বিষয়ে হারাম হওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে। তৃতীয় হলো আয়াতে মোহকাম। মোহকাম ঐ সমস্ত আয়াতকে বলা হয় যার বিবরণসমূহ শব্দ ও অর্থসমূহ সাধারণভাবে বোধগম্য। চতুর্থ হলো মোতাশাবেহ। মোতাশাবেহ কোরআনের সেইসব আয়াত বা শব্দসমূহকে বলা হয় যার অর্থ ও ব্যাখ্যা দুর্বোধ্য ও অস্পষ্ট। পঞ্চম হলো আয়াতে আমছাল, যার মাধ্যমে আল্লাহ বিভিন্ন দৃষ্টান্ত পেশ করে মানব জাতিকে উপদেশ দিয়েছেন।
বর্ণিত হাদীসটিতে হুযুর (স:) উপরোক্ত পাঁচ প্রকারের আয়াত সম্পর্কে আমাদের কি করণীয় তার-ই উল্লেখ করেছেন। হুযুর (স:) বলেছেন যে, তোমরা কোরআনের হালালকে হালাল বলে গ্রহণ করবে, আর হারামকে হারাম হিসেবে প্রত্যাখ্যান করবে, মোহকাম অনুসারে কাজ করবে, মোতাশাবেহের উপর এই মর্মে ঈমান আনবে যে, এ সবের অর্থ মহাজ্ঞানী আল্লাহ বিশেষ কোন উদ্দেশ্যে আমাদের জ্ঞান বহির্ভূত রেখেছেন। আর কোরআনের আমছাল (দৃষ্টান্তসমূহ) হতে উপদেশ গ্রহণ করবে।
উপরোক্ত তিনটি হাদীসে একটি বিশেষ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাহলো এই যে, শরীয়তের যাবতীয় করণীয় বিষয়সমূহ স্পষ্ট এবং সন্দেহাতীত। সুতরাং বিনা দ্বিধায় সেগুলি মেনে চলবে। পক্ষান্তরে অস্পষ্ট দুর্বোধ্য ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের অবতারণা করে অহেতুক সন্দেহে লিপ্ত হবে না। সমাজে এক ধরনের লোক দেখা যায় যারা শরীয়তের করণীয় স্পষ্ট নির্দেশাবলীর বিশেষ কোন ধার ধারে না। কিন্তু অপেক্ষাকৃত জটিল, দুর্বোধ্য ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের অবতারণা করে মানুষের ভেতর একটা গোলক ধাঁধার সৃষ্টি করতে চায়। সত্য সন্ধান আদৌ তাদের উদ্দেশ্যে থাকে না। বরং নিজেদের পাণ্ডিত্য প্রকাশ, কিংবা মানব মনে দ্বীন-শরীয়ত সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টিই থাকে তাদের আসল উদ্দেশ্য। এ ধরনের কাজ যে শরীয়তের দৃষ্টিতে দোষণীয়, হাদীসে তারই উল্লেখ করা হয়েছে।
অধ্যায়: ৩ ইবাদত
নামাযের গুরুত্ব
إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوْتًا
(سورة النساء – (۱۰۳)
“অবশ্য নামায মুমিনদের উপরে ওয়াক্তসহ ফরজ করা হয়েছে।”
(সূরা নিসা – ১০৩)
(۲۱)
وَعَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خَمْسُ صَلَوَاتٍ افْتَرَضَهُنَّ اللَّهُ تَعَالَى، مَنْ أَحْسَنَ وُضُوءَهُنَّ وَصَلَاهُنَّ لِوَقْتِهِنَّ وَأَتَمَّ رُكُوْعَهُنَّ وَخُشُوْعَهُنَّ، كَانَ لَهُ عَلَى اللَّهِ عَهْدٌ أَنْ يَغْفِرَ لَهُ ، وَمَنْ لَمْ يَفْعَلْ فَلَيْسَ لَهُ عَلَى اللَّهِ عَهْدٌ إِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ (أبو داود)
(২১) “হযরত উবাদাহ ইবনে সামেত (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, নবী করীম (সঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের উপরে পাঁচ ওয়াক্তের নামায ফরজ করে দিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অযু করে সময়মত নামায পড়বে এবং রুকু সিজদার খেয়াল রেখে মনোনিবেশ সহকারে নামায আদায় করবে, অবশ্যই আল্লাহ তাকে মাফ করে দিবেন। আর যে তা করবে না তার অপরাধসমূহ মাফ করে দেয়া সম্পর্কে আল্লাহর কোন দায়িত্ব নেই। ইচ্ছা করলে তিনি ক্ষমা করতে পারেন, নাও করতে পারেন।” (আবু দাউদ)
ব্যাখ্যা: ইসলামের পরিভাষায় একটি সুনির্দিষ্ট ইবাদতের নাম সালাত। নামায তার ফারসী অনুবাদ। ইবাদত সাধারণতঃ দুই প্রকারের। এক প্রকারের ইবাদত যা মানুষ তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা আদায় করে, তাকে বলা হয় ইবাদতে বদনী। আর এক প্রকারের ইবাদত আছে যা মানুষ তার সম্পদ ব্যয় করে আদায় করে, তাকে বলা হয় ইবাদতে মালী। ইবাদতে বদনীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো নামায। আর ইবাদতে মালীর ভিতর সর্বশ্রেষ্ঠ হলো যাকাত। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বহুবার এ দু’টি শ্রেষ্ঠ ইবাদতের কথা এক সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। মানব সৃষ্টির সূচনা হতে আজ পর্যন্ত দুনিয়ায় যত নবীরই আগমন ঘটেছে, উম্মতসহ তাঁদের সকলের উপর নামায কোন না কোন রূপে ফরয ছিল। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) এবং তার উম্মতের উপর দিন-রাতে মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়েছে। উক্ত নামায কখন ও কিভাবে আদায় করতে হবে তার বাস্তবরূপ স্বয়ং জিবরিল (আ:) নিজে ইমাম হয়ে দশ ওয়াক্ত নামায আদায় করে হুযুরকে (স:) তা’লীম দিয়েছিলেন।
নামাযের জন্য কিভাবে অযু-গোসল করে দেহকে পবিত্র করতে হবে, কোন কোন সময় নামায আদায় করতে হবে, রুকু সিজদা কিভাবে করবে, কওমা জলসার পরিমাণ কি হবে, কিভাবে বিনয় ও মনোনিবেশ সহকারে নামায আদায় করবে, এর যাবতীয় তা’লীমই হুযুর (স:) দিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি হুযুরের তা’লীম মোতাবেক যথাযথভাবে নামায আদায় করবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন। আর যে তা আদায় করবে না, তার ক্ষমা সম্পর্কে আল্লাহর কোন দায়িত্ব নেই।
(۲۲)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ ذَكَرَ الصَّلَاةَ يَوْمًا فَقَالَ: مَنْ حَافَظَ عَلَيْهَا كَانَتْ لَهُ نُورًا وَبُرْهَانًا وَنَجَاةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ ، وَمَنْ لَمْ يُحَافِظُ عَلَيْهَا لَمْ يَكُنْ لَهُ نُوْرٌ وَلَا بُرْهَانٌ وَلَا نَجَاةٌ، فَكَانَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَعَ قَارُوْنَ وَفِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَأُبَيِّ بْنِ خَلَفٍ
أحمد – دارمي – بيهقي)
(২২) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা:) হতে বর্ণিত, একদিন নবী করীম (স:) নামায সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বললেন, যে ব্যক্তি নামাযের সঠিকভাবে হেফাযত করবে তার এই নামায কিয়ামতের দিন তার জন্যে আলো, প্রমাণ ও মুক্তির কারণ হবে এবং যে তার সঠিক হেফাযত করবে না, তার জন্যে নামায কিয়ামতের দিনে রোশনী, প্রমাণ কিম্বা মুক্তির কারণ হবে না। আর ঐ ব্যক্তি হাশরের দিনে কারুণ, ফেরাউন, হামান ও উবাই-ইবনে-খালফের ন্যায় কাফেরদের সাথে উঠবে। (আহমদ, দারেমী, বায়হাকী)
ব্যাখ্যা: হাদীসে হুযুর (স:) নামাযকে সঠিক ভাবে হেফাযত করতে বলেছেন। অর্থাৎ নামাযকে যে ধরনের নিয়ম-পদ্ধতির সহিত মনোনিবেশ সহকারে আদায় করতে বলা হয়েছে, যদি কেউ সেই ভাবে জীবনভর নামায আদায় করে, তাহলে এ নামাযই কিয়ামতের অন্ধকারে তার জন্য আলো দান করবে, আল্লাহর নিকটে তার নেককার হওয়া সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবে এবং জাহান্নামের আযাব হতে তাকে মুক্ত করিয়ে দিবে। কেননা এ ধরনের নামাযী ব্যক্তি সাধারণত: কখনও কোন পাপে লিপ্ত হতে পারে না।
(۲۳)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ فِي ظِلِهِ يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ؛ الإِمَامُ الْعَادِلُ، وَشَابٌ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ رَبِّهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلِّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ، وَرَجُلَانِ تَحَابًّا فِي اللَّهِ اجْتَمَعًا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ طَلَبَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ أَخْفَى حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ
-(بخاري – مسلم)
(২৩) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে রসূল (স:) বলেছেন, যে দিন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না, সে দিন মহান আল্লাহ সাত ধরনের লোককে তার ছায়ায় আশ্রয় দিবেন। (১) সুবিচারক বাদশা, (২) ঐ যুবক, যার যৌবন আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত হয়েছে, (৩) সেই নামাযী ব্যক্তি যার মন সদা মসজিদে আবদ্ধ থাকে এমনকি সে মসজিদ হতে ফিরে আসার পর পুনরায় মসজিদে প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যাকুল থাকে, (৪) ঐ দুই ব্যক্তি যাদের ভালবাসা ও বিচ্ছেদ ছিল নিছক আল্লাহর ওয়াস্তে। অর্থাৎ যাদের মিলন ও বিচ্ছেদ আল্লাহকে কেন্দ্র করেই ঘটেছিল, (৫) যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে, (৬) যে ব্যক্তি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন কোন সুন্দরী যুবতী দ্বারা (প্রেম নিবেদন) আহুত হয়ে এই বলে তা প্রত্যাখান করেছে যে, আমি আল্লাহকে ভয় করি, (৭) আর যে ব্যক্তি এমন গোপনে দান করে যে তার ডান হাতের খবর বাম হাতে জানে না।
(বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: যে ভয়াবহ দিনে হাশরের ময়দানে আল্লাহর নিজস্ব নিয়ন্ত্রিত ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না। আর মানুষ অসহ্য গরম ও প্রখর তাপে ছটফট করতে থাকবে। সেদিন আল্লাহ সাত ধরনের লোককে তার মেহেরবানীর সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় দিবেন। প্রথম ব্যক্তি হলো সেই সুবিচারক বাদশাহ যে মানব সম্প্রদায়ের কোন এক অংশের উপর শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয়ে নিয়তই সুবিচার করেছে। দ্বিতীয় হলো ঐ যুবক যে তার যৌবনকাল আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করেছে। যৌবনকালে মানুষের যাবতীয় শক্তি ও প্রতিভার বিকাশ ঘটে। সুতরাং মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো তার যৌবনকাল। যৌবনেই মানুষের পদস্খলনের সম্ভাবনা থাকে অত্যধিক। কাজেই জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে যে যুবক তার যৌবনরূপ তরীকে আল্লাহর দ্বীনের নিয়ন্ত্রণাধীন করেছে, কিয়ামতের দিনে আল্লাহ তাকে তার নিজ ছায়ায় আশ্রয় দিবেন। তৃতীয় হলো ঐ নামাযী ব্যক্তি যার মন সদা মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে। অর্থাৎ পূর্ণ ঐকান্তিকতা সহকারে জামায়াতের সহিত মসজিদে নামায আদায় করে। চতুর্থ যারা আল্লাহর ছায়ায় আশ্রয়প্রাপ্ত হবে, তারা হলো ঐ দুই ব্যক্তি যাদের ভালবাসা ও শত্রুতা ছিল নিছক আল্লাহর ওয়াস্তে। অর্থাৎ যাদের শত্রুতা ও মিত্রতা কোনরূপ পার্থিব স্বার্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো না। আল্লাহর অনুগ্রহের ছায়ায় আশ্রয়প্রাপ্ত পঞ্চম ব্যক্তি হবে তিনি, যিনি লোক চক্ষুর অন্তরালে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন। কিয়ামতের ভয়াবহ দিনে ষষ্ঠ যে ব্যক্তিটি আল্লাহর সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় পাবে, সে হলো এমন চরিত্রবান খোদাভীরু ব্যক্তি যে আল্লাহর শাস্তির ভয় মর্যাদাশীল সুন্দরী যুবতীর কামনা পূরণের আকর্ষণীয় আহবানকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সপ্তম আশ্রয় প্রাপ্ত হবে সেই দানশীল ব্যক্তি যিনি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধান মানসে অতি গোপনে দান করেছেন।
নামায কায়েম করা ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব
(٢٤) وَعَنْ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّهُ كَتَبَ إِلَى عُمَّالِهِ: إِنَّ أَهَمَّ أَمْوْرِكُمْ عِنْدِي الصَّلَاةُ، فَمَنْ حَافِظُ وَحَافَظَ عَلَيْهَا حَفِظَ دِينَهُ ، وَمَنْ ضَيَّعَهَا فَهُوَ لِمَا سوَاهَا أَصْيَع (موطا إمام مالك)
(২৪) “হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা:) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি তার সমস্ত গভর্ণরদের কাছে এই মর্মে নির্দেশ জারি করেছিলেন যে, তোমাদের যাবতীয় দায়-দায়িত্বের মধ্যে নামাযই হলো আমার কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং যে সতর্কতার সাথে নিজের নামায আদায় করবে এবং যে নামাযের তত্ত্বাবধান করবে সে যেন তার দ্বীনের পূর্ণ হেফাযত করল। আর যে নামাযের খেয়াল রাখবে না, তার পক্ষে অন্যান্য দায়িত্ব পালনে খেয়ানত আদৌ অসম্ভব নয়”
(মুয়াত্তা ইমাম মালেক)
ব্যাখ্যা: নামায কায়েম করা হলো ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন্তর্গত। রাষ্ট্র প্রধান এবং তার অধীনস্থ শাসকমণ্ডলী যেমন নিজ নিজ এলাকার শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে দায়িত্বশীল, তেমনি দায়িত্বশীল তার আপন আপন এলাকায় নামাযের ব্যবস্থাপনা ও নামায কায়েম করার ব্যাপারে। হুযুর (স:) এবং তাঁর সুযোগ্য খলিফাগণ এই উভয়বিধ দায়িত্বই একত্রে পালন করেছেন। আর দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা:) এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির দিকে একটি নির্দেশ মারফত তাঁর অধীনস্থ শাসক মণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কেননা এটি হলো ইসলামী রাষ্ট্রের একটি অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। আল্লাহ এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলেছেন,
“আমার খাঁটি বান্দারা যখন দুনিয়ার কোন ভূখন্ডের উপর শাসন অধিকার পায়, তখন তাঁরা সেখানে নামায কায়েম করে, যাকাত চালু করে এবং (নাগরিকদেরকে) সৎকাজের নির্দেশ দান করে ও অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখে।” (সূরা হজ্জ, আয়াত-৪১)
হযরত উমর (রা:) তাঁর অধীনস্থ শাসকগণকে বিশেষভাবে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, আল্লাহ তায়ালার এই প্রথম ফরজটি সম্পর্কে যদি তোমরা উদাসীনতা দেখাও, তাহলে অন্যান্য দায়িত্ব পালনেও তোমরা উদাসীন হবে।
নামায আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ইবাদত
(٢٥) وَعَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، سَأَلْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَيُّ الْأَعْمَالِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: الصَّلَاةُ لِوَقْتِهَا ، قُلْتُ : ثُمَّ أَيُّ؟ قَالَ: بِرُّ الْوَالِدَيْنِ، قُلْتُ
ثُمَّ أَيُّ؟ قَالَ: الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، قَالَ حَدَّثَنِي بِهِنَّ وَلَوْ اسْتَزَدْتُهُ لَزَادَنِي (بخاري – مسلم)
(২৫) “হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি নবী করীমকে (স:) জিজ্ঞেস করেছিলাম মানুষের যাবতীয় নেক আমলের মধ্যে কোনটি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়? হুযুর (স:) জওয়াব দিলেন, ওয়াক্ত মোতাবেক নামায আদায় করা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, অত:পর কোনটি? হুযুর (স:) বললেন, পিতা-মাতার সাথে সদ্বব্যবহার করা। আমি পুনরায় প্রশ্ন করলাম, অত:পর কোনটি? হুযুর (স:) জওয়াবে বললেন আল্লাহর রাহে জিহাদে অবতীর্ণ হওয়া। হযরত ইবনে মাসউদ বলেন উপরোক্ত কথাগুলি নবী করীম (স:) আমাকে বলেছিলেন। আমি যদি হুযুরকে আরও প্রশ্ন করতাম তাহলে আরও অধিক বলতেন।” (বুখারী, মুসলীম)
সন্তানদেরকে কখন নামাযের তাকীদ করবে
(٢٦) وَعَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيْهِ عَنْ جَدِّهِ قَالَ، قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بالصَّلاةِ، وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرِ سِنِينَ، وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ
(أبو داود)
(২৬) “হযরত আমর ইবনে শোয়ায়েব (রা:) তার পিতা হতে এবং তাঁর পিতা তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, নবী করিম (স:) বলেছেন, তোমাদের সন্তানদের বয়স যখন সাত বছর হবে, তখন তাদেরকে নামাযের আদেশ করবে। আর দশ বছর হলে নামাযের জন্য তাদেরকে শাস্তি দিবে এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দিবে।” (আবু দাউদ)
ব্যাখ্যা: প্রকৃতপক্ষে সাবালিগ হওয়ার সাথে সাথে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য নামায রোযা ইত্যাদি আমল ফরয হয়ে যায়। কিন্তু পূর্বাহ্নেই যদি ছেলে মেয়েদেরকে নামায না শিখান ও নামাযের অভ্যাস না করান হয়, তাহলে সাবালিগ হওয়ার সাথে সাথেই কারও পক্ষে নামায আদায় করা সম্ভব না। তাই হুযুর (স:) ছেলে-মেয়েদেরকে সাত বৎসর বয়সে নামাযের জন্যে উৎসাহিত করতে এবং দশ বৎসরের সময় নামাযের জন্য বাধ্য করতে পিতা-মাতাকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশ অভিভাবকদের জন্য। সুতরাং অভিভাবকরা যদি এ নির্দেশ পালন না করে, তাহলে আল্লাহর কাছে দায়ী হবে।
কিয়ামতের দিন প্রথম নামাযের প্রশ্ন করা হবে
(۲۷)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنَّ أَوَّلَ مَا يُحَاسَبُ بِهِ العَبْدُ يَوْمَ القِيَامَةِ مِنْ عَمَلِهِ صَلَاتُهُ ، فَإِنْ صَلُحَتْ فَقَدْ أَفْلَحَ وَأَنْجَحَ، وَإِنْ فَسَدَتْ فَقَدْ خَابَ وَخَسِرَ، فَإِنْ انْتَقَصَ مِنْ فَرِيضَةٍ ، قَالَ الرَّبُّ: انْظُرُوا هَلْ لِعَبْدِي مِنْ تَطَوُّع
فَيُكَمَّلَ بِهَا مَا انْتَقَصَ مِنَ الفَرِيضَةِ، ثُمَّ يَكُونُ سَائِرُ
أَعْمَا لِهِ عَلَى هَذَا (ترمذي)
(২৭) হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন নবী করীম (স:) বলেছেন, কিয়ামতের ময়দানে বান্দাহকে সর্ব প্রথম তার নামাযের হিসাব দিতে হবে। যদি নামাযের প্রশ্নে বান্দাহ উত্তীর্ণ হতে পারে তাহলে সে সফলকাম হবে। আর যদি সে নামাযের প্রশ্নে আটকে যায়, তাহলে আর তার উপায় থাকবে না। তবে তার ফরয নামাযে কোন ত্রুটি পাওয়া গেলে আল্লাহ ফিরিশতাদেরকে বলবেন, আমার বান্দাহর নফল নামায থাকলে তা হতে ফরযের ত্রুটি পূরণ করে দাও। অত:পর তার যাবতীয় আমল সম্পর্কে উক্ত পন্থা গ্রহীত
হবে।” (তিরমিযী)
ব্যাখ্যা: পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবাদতে বাদানীর ভিতরে সর্ব প্রধান হলো নামায। আর নামায সমস্ত পয়গম্বর (আ:) এবং তাদের উম্মতের জন্যে কোন না কোনরূপে ফরয ছিল। সুতরাং কিয়ামতের দিন প্রথমেই বান্দাহকে নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অত:পর যে বান্দাহ তার এই প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, তার পক্ষে পরবর্তী পরীক্ষাগুলি কঠিন হবে না।
হাসরের দিন যদি আল্লাহর অনুগত বান্দাহর ফরয নামাযে কোন ত্রুটি ধরা পড়ে, তাহলে আল্লাহ তাঁর করুণায় নফল নামাযের সাহায্যে সে ত্রুটি পূর্ণ করে দিবেন। অত:পর তার পরবর্তী আমল সম্পর্কেও উক্ত পন্থা গৃহীত হবে। অর্থাৎ ফরযের ত্রুটি নফল দিয়ে পূরণ করে দেওয়া হবে।
জামায়াতে নামায আদায় করার গুরুত্ব
(۲۸)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: صَلَاةُ الْجَمَاعَةِ تَفْضُلُ صَلَاةَ الْفَدَّ بِسَبْعٍ وَعِشْرِيْنَ دَرَجَةً
(بخاري – مسلم)
(২৮) “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সঃ) ইরশাদ করেছেন, জামায়াতের সহিত নামায একাকী নামায হতে সাতাশ গুণ বেশি ফজিলতের অধিকারী।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মদীর উপর পাঁচ ওয়াক্তের নামায জামায়াতের সহিত ফরজ করেছেন। হযরত জিবরিল (আ:) স্বীয় ইমামতীতে হুযুরকে (স:) দু’দিনের যে দশ ওয়াক্ত নামাযের তা’লীম দিয়েছেন, তাও ছিল জামায়াতের রূপে। সুতরাং ফরয নামায জামায়াতের সহিত আদায় করলেই পূর্ণতা সহকারে আদায় হবে। একাকী (বিনা ওযরে) ফরয নামায পড়লে পূর্ণতাসহকারে আদায় হবে না, বরং কাযা নামাযের সাথে মুসাবাহ হয়ে যাবে। খ্যাতনামা আলেম মোল্লা জিয়ন সাহেবও তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব “নুরুল আনওয়ারে” একথা উল্লেখ করেছেন। বর্ণিত হাদীসটিতে হুযুর (স:) জামায়াতের সহিত নামায পড়ায় যে অফুরন্ত সওয়াব তারই উল্লেখ করেছেন। কেননা জামায়াতের নামাযই পূর্ণ নামায। একাকী ফরয নামায পড়লে নামায হবে বটে, তবে পূর্ণতা সহকারে নয়।
(۲۹)
وَعَنْ أَبِي دَرْدَاءِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَا مِنْ ثَلَاثَةٍ فِي قَرْيَةٍ وَلَا بَدْوِ لَا تُقَامُ فِيهِمُ الصَّلَاةُ إِلَّا قَدِ اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَعَلَيْكَ بِالْجَمَاعَةِ فَإِنَّمَا يَأْكُلُ الذِّئْبُ القاصية
(أحمد – أبو داود – نسائي)
(২৯) “হযরত আবু দারদাহ (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূল
(স:) বলেছেন, যদি কোন গ্রাম বা প্রান্তরে তিন ব্যক্তি থাকে, আর তারা জামায়াতে নামায আদায় না করে, তাহলে অবশ্যই তাদের উপর শয়তান প্রভাব বিস্তার করবে। সুতরাং জামায়াত তোমাদের জন্যে অপরিহার্য। কেননা পাল ছাড়া পশু বাঘের শিকার হয়।”
(আহমদ, আবু দাউদ, নাসাঈ)
ব্যাখ্যা: জামায়াতের অপরিহার্যতা সম্পর্কে হাদীসটিতে হুযুর (স:) একটি সংক্ষিপ্ত সুন্দর উপমা দিয়েছেন। পর্বতের পাদদেশে কিংবা চারণভূমিতে পশুপাল যখন একসঙ্গে চলে তখন বাঘ তাদেরকে আক্রমণ করেনা। কেননা পাহারারত রাখাল এবং শিকারী কুকুরের দৃষ্টি নিয়তই পালের উপর থাকে। কিন্তু ঘাস খেতে খেতে কোন একটি পশু যখন রাখালের দৃষ্টির বাহিরে চলে যায়, তখনই সুযোগমত বাঘ তাকে আক্রমণ করে। অনুরূপভাবে জামায়াত বিহীন মুসলমানও শয়তানের শিকারে পরিণত হয়।
(۳۰)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ أَمَرَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كُنْتُمْ فِي
الْمَسْجِدِ فَنُوْدِيَ بِالصَّلَاةِ، فَلَا يَخْرُجْ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُصَلِّي (أحمد)
(৩০) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (স:) আমাদেরকে এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা যখন মসজিদে অবস্থান করবে আর সেই অবস্থায় আজান হয়ে যাবে, তখন তোমরা নামায সমাপ্ত না করে সেখান হতে বের হবে না।
(আহমদ)
(۳۱)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَوْلَا مَا فِي الْبُيُوتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالذُّرِّيَّةِ ، أَقَمْتُ صَلَاةَ الْعِشَاءِ، وَأَمَرْتُ فِتْيَانِي يُحْرِقُوْنَ مَا فِي الْبُيُوتِ بِالنَّارِ. (أحمد)
(৩১) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) নবী করীম (স:) হতে এ মর্মে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, একদা হুযুর (স:) বললেন, গৃহে যদি শিশু সন্তান ও নারীরা না থাকতো, তাহলে আমি ইশার নামাজ শুরু করে যুবকদেরকে পাঠিয়ে দিতাম, তাদের ঘরে যেন (যারা নামাযে
না আসে) আগুন দিয়ে আসে। (আহমদ)
ব্যাখ্যা : জামায়াতের সহিত নামায আদায় করা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, নবী করীমের (স:) উপরোক্ত হাদীসে তার সন্ধান পাওয়া যায়। তবে তিনটি কারণে জামায়াত তরক করতে পারে। (১) যদি মসজিদে যাওয়ার পথে শত্রু কিংবা বাঘ, ভাল্লুক ও সাপ বিচ্ছুর ভয় থাকে।
(২) যদি নামাযী ব্যক্তি রোগী হয়। (৩) যদি এমন ঝড় তুফান শুরু হয়, যার ফলে জামায়াতে হাজির হওয়া সম্ভব নয়।
(۳۲)
وَعَن عَبْدِ اللَّهِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّهُ أَذَّنَ بِالصَّلَاةِ فِي لَيْلَةٍ ذَاتِ بَرْدٍ وَرِيحٍ، ثُمَّ قَالَ: أَلَا صَلُّوْا فِي الرِّحَالِ، ثُمَّ قَالَ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَأْمُرُ الْمُؤَذِّنَ إِذَا كَانَتْ لَيْلَةٌ ذَاتُ بَرْدِ وَمَطَرٍ يَقُولُ أَلَا صَلُّوْا فِي الرِّحَالِ (بخاري – مسلم)
(৩২) “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত, একদা তিনি এক শীত ও ঝড়ো আবহাওয়া রাতে নামাযের উদ্দেশ্যে আযান দিলেন। অত:পর তিনি বললেন, ওগো হে তোমরা সকলেই যার যার বাড়ীতে নামায আদায় করে নাও। তিনি আরও বলেন, যে রাতে (অতিরিক্ত) শীত ও বর্ষা হতো, হুযুর (স:) মোয়াজ্জিনকে সে রাতে একথা বলতে আদেশ দিতেন যে, প্রত্যেকেই যার যার নামায স্বীয় জায়গায় আদায় করে নাও।” (বুখারী, মুসলিম)
মহিলাদের ঘরে নামায পড়া উত্তম
(۳۳)
وَعَنِ عَبْدِ اللَّهِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تَمْنَعُوْا نِسَاءَكُمُ الْمَسَاجِدَ، وَبُيُوتُهُنَّ خَيْرٌ لَهُنَّ (أبو داود)
৩৩) “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, তোমরা তোমাদের মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে বারণ করোনা। তবে তাদের (নামাযের) জন্য ঘরই উত্তম।” (আবু দাউদ)
(٣٤) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : صَلَاةُ الْمَرْأَةِ فِي بَيْتِهَا أَفْضَلُ مِنْ صَلَاتِهَا فِي حُجْرَتِهَا، وَصَلَاتُهَا فِي مَخْدَعِهَا أَفْضَلُ مِنْ صَلَاتِهَا فِي بَيْتِهَا (أبو داود)
(৩৪) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) হতে বর্ণিত রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, স্ত্রী লোকদের জন্যে তাদের ঘরের ভিতরের নামায তাদের ঘরের বাহিরের নামায হতে উত্তম। আর তাদের কোঠার ভিতরের নামায ঘরের নামায হতে উত্তম।” (আবু দাউদ)
ব্যাখ্যাঃ উপরোক্ত হাদীসের মর্মানুসারে মহিলাদের জন্যে পর্দাসহকারে মসজিদে হাজির হয়ে পুরুষের কাতার হতে আলাদা হয়ে জামায়াতের সহিত নামায আদায় করার অনুমতি দেয়া হলেও তাদের জন্যে যে স্বীয় গৃহে নামায আদায় করা অতি উত্তম তার দিকেই হুযুর (স:) ইঙ্গিত করেছেন।
নফল নামায ঘরে পড়া উত্তম
(٣٥) وَعَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا قَضَى أَحَدُكُمُ الصَّلَاةَ فِي
مسْجِدِهِ فَلْيَجْعَلْ لِبَيْتِهِ نَصِيبًا مِنْ صَلَاتِهِ، فَإِنَّ اللَّهَ جَاعِلٌ فِي بَيْتِهِ مِنْ صَلَاتِهِ خَيْرًا (مسلم)
(৩৫) “হযরত জাবির (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম
(স:) বলেছেন, যখন তোমাদের কেহ মসজিদে নামায আদায় করবে, তখন যেন সে তার নামাযের কিছু অংশ (অর্থাৎ নফল বা সুন্নাত নামায) তার ঘরের জন্যে রেখে দেয়। কেননা আল্লাহ এই নামাযের কারণে তার ঘরে কল্যাণ দান করবেন। (মুসলিম)
(٣٦) وَعَنْ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: صَلَاةُ الْمَرْءِ فِي بَيْتِهِ أَفْضَلُ مِنْ صَلَاتِهِ فِي مَسْجِدِي هَذَا إِلَّا الْمَكْتُوبَةَ
(أبو داود – ترمذي)
(৩৬) “হযরত যায়েদ ইবনে ছাবেত (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
নবী করীম (স:) বলেছেন, কোন ব্যক্তির ঘরে নামায আদায় করা আমার এই মসজিদে নামায আদায় করা হতে উত্তম, অবশ্যই তা ফরয নামায ব্যতীত।” (আবু দাউদ, তিরমিযী)
ব্যাখ্যা: রিয়া মানুষের ইবাদতকে বরবাদ করে দেয়। রিয়াকার ব্যক্তি তার ইবাদতের কোন সওয়াব তো আল্লাহর কাছে পাবেই না। বরং রিয়ার (প্রদর্শণীর) উদ্দেশ্যে কৃত এ ইবাদত তাকে গুনাহগারও করতে পারে। জনসমক্ষে প্রকাশ্য যায়গায় অতিরিক্ত (নফল) নামায পড়ার কারণে নামাযী ব্যক্তির অন্তরে রিয়ার ভাব জাগরিত হতে পারে বলে আল্লাহর নবী (স:) নফল নামাজ গোপনে ঘরে পড়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন।
রাত্রি জাগরণ ও তাহাজ্জুদ নামাযের ফজিলত
(۳۷)
وَعَنْ مُغِيرَةً بِنْ شُعْبَةٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَامَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى تَوَرَّمَتْ قَدَمَاهُ، فَقِيلَ لَهُ لِمَ تَصْنَعُ هَذَا؟ وَقَدْ غُفِرَ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ، قَالَ : أَفَلَا أَكُونُ عَبْدًا شَكُورٌ
(بخاري – مسلم)
(৩৭) “হযরত মুগীরা ইবনে শো’বা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নবী করীম (স:) (তাহাজ্জুদ নামাজে) এত অধিক দাঁড়ালেন যে, তাঁর দুই পায়ের পাতা ফুলে গেল। তখন বলা হলো, হুযুর আপনি কেন এরূপ করেন? অথচ আল্লাহতো আপনার অগ্রপশ্চাতের যাবতীয় গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন। হুযুর (স:) জওয়াব দিলেন,
আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দাহ হব না?” (বুখারী, মুসলীম)
ব্যাখ্যা : যাবতীয় নফল নামাযের মধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত অত্যধিক। নবী করীমের (স:) জন্যে তাহাজ্জুদের নামায ছিল ফরয। উম্মতের জন্যে যদিও আইনত তাহাজ্জুদকে ফরয করা হয়নি। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা যে, উম্মতে মুহাম্মদী তাহাজ্জুদ নামায বিশেষ গুরুত্ব ও যত্নসহকারে আদায় করুক। পবিত্র কোরআনেও তাহাজ্জুদ নামাযের উল্লেখ আছে। যেমন, আল্লাহপাক নবীকে লক্ষ্য করে বলেছেন,
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُوْدًا (بني إسرائيل: ۷۹)
অর্থঃ “রাত্রের এক অংশে তুমি তাহাজ্জুদের নামায আদায় কর, এ হলো তোমার জন্যে অতিরিক্ত। অচিরেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে মাকামে মাহমুদায় প্রেরণ করবেন।”
(বনী ইসরাঈল, আয়াত: ৭৯)
হুযুর (স:) কখনও কখনও এতো অধিক সময় তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তাঁর দুই পায়ের পাতা ফুলে যেত। ফলে সাহাবীদের মধ্য হতে কেউ বলেছিলেন যে, হুযুর আপনিতো মা’সুম, আপনার তো গুনাহ নেই। এতদসত্ত্বেও আল্লাহ আপনার আগে পিছের যাবতীয় ত্রুটি মাফ করার ওয়াদা করেছেন। সুতরাং আপনার এত অধিক পরিশ্রমের প্রয়োজন কি? হুযুর (স:) জওয়াবে বললেন, কেন আমি কি আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ হব না? হুযুর (স:) বিতরসহ তাহাজ্জুদ নামায ৭, ৯ ও ১১ রাকায়াত আবার কখনও ১৩ রাকায়াত পড়েছেন।
(۳۸)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُوْلَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ، يَقُولُ : مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيْبَ لَهُ، مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، وَمَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ (بخاري – مسلم)
(৩৮) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলে করীম (স:) বলেছেন, যখন রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, তখন স্বয়ং আমাদের প্রভু পরওয়ারদেগার তাবারাক ওয়া-তায়ালা দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হন এবং বলতে থাকেন, ওগো কে আছো, যে (এসময়) আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দিব। ওগো কে আছো, যে আমার কাছে কিছু চাবে, আমি তাকে তা দিয়ে দিব। ওগো কে আছো, যে (এসময়) আমার কাছে গুনাহ হতে ক্ষমা চাবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দিব।”
(বুখারী, মুসলিম)
(۳۹)
وَعَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّ فِي اللَّيْلِ لَسَاعَةً لَا يُوَافِقُهَا رَجُلٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ اللَّهَ خَيْرًا مِنْ أَمْرِ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ إِلَّا أَعْطَاهُ إِيَّاهُ وَذَالِكَ كُلَّ لَيْلَةٍ (مسلم)
(৩৯) “হযরত জাবির (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহকে (স:) এ কথা বলতে শুনেছি যে, নিশ্চই রাতের ভিতর এমন একটি সময় আছে, যদি কোন মুসলমান ঐ সময়টি পায়, আর তখন দুনিয়া আখেরাতের কল্যাণ হতে কোনকিছু প্রার্থনা করে, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তাকে তা দেন। আর এসময়টা প্রতি রাতে আসে।” (বিশেষ কোন রাতের সাথে সংশ্লিষ্ট নহে) (মুসলিম)
(٤٠) وَعَنْ أَبِي أُمَامَةَ بَاهِلِي رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيُّ الدُّعَاءِ أَسْمَعُ ؟ قَالَ: جَوْفَ اللَّيْلِ الآخِرِ، وَدُبُرَ الصَّلَوَاتِ الْمَكْتُوبَاتِ (ترمذي)
(৪০) “হযরত আবু উমামা বাহেলী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা (হুযুরকে) জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর নবী কোন সময়ের দোয়া অধিক শ্রবণযোগ্য? হুযুর (স:) বললেন, রাতের শেষার্ধের দোয়া এবং ফরজ নামাযের পর যে দোয়া করা হয়।”
(তিরমিযী)
(٤١) وَعَنْ ابْنِ مَالِكِ الأَشْعَرِي رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ فِي الْجَنَّةِ غُرَفًا يُرَى ظَاهِرُهَا مِنْ بَاطِنِهَا ، وَبَاطِنُهَا مِنْ ظَاهِرِهَا ، أَعَدَّهَا اللَّهُ لِمَنْ أَلَآنَ الْكَلَامَ، وَأَطْعَمَ الطَّعَامَ، وَتَابَعَ الصِّيَامَ، وَصَلَّى بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ (بيهقي – ترمذي)
(৪১) “হযরত ইবনে মালেক আশয়ারী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলে করীম (স:) বলেছেন, বেহেশতে এমন সব (স্বচ্ছ ও ঝকঝকে) বালাখানা আছে, যার ভেতর হতে বাহিরের সবকিছু এবং বাহির হতে ভিতরের সবকিছু (পরিষ্কার) দেখা যায়। এসব বালাখানা আল্লাহ তাঁর জন্যে তৈরী করে রেখেছেন যিনি (লোকের সাথে) কথাবার্তায় নম্রতা দেখিয়েছেন, (ক্ষুধার্তকে) খেতে দিয়েছেন, রোযা রেখেছেন এবং রাতের এমন অংশে নামায পড়েছেন, যখন (সাধারণভাবে) লোকজন ঘুমিয়ে থাকে।” (বায়হাকী, তিরমিজী)
ব্যাখ্যা: রাতের শেষাংশে সাধারণভাবে যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়ে এবং জগতের সকল কলরব কোলাহল স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন আল্লাহর যে বান্দাহ আরামকে হারাম করে প্রভুর দরবারে নিজের গুনাহ মাফির জন্য তওবা ইস্তেগফার ও যিকির আযকারে মশগুল থাকে, নামায পড়ে ও আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করে, সে যে আল্লাহর মকবুল বান্দাহ তাতে আর সন্দেহ কি? রাতের শেষ অংশে যখন সারা জগত ঘুমিয়ে থাকে, তখন জেগে যে ইবাদত করা হয়, তাতে যেমন অত্যধিক মানসিক প্রশান্তি অনুভূত হয়, তেমনি তাতে রিয়ারও (লোক দেখানোরও) কোন প্রবনতা থাকে না। ফলে এহেন ব্যক্তিকে আল্লাহ যেমন পছন্দ করেন, তেমনি তার দোয়াও তিনি কবুল করে থাকেন। উপরে উল্লেখিত হাদীসগুলোতে আল্লাহর নবী বিভিন্নরূপে একথাই ব্যক্ত করেছেন।
শেষের হাদীসটিতে যে রোযার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাহলো নফল রোযা। আর রাতের নামায দ্বারা নফল অর্থাৎ তাহাজ্জুদ নামায বোঝানো হয়েছে। কেননা ফরয সকলের জন্যেই বাধ্যতামূলক। আর কোন ব্যক্তি যাবতীয় ফরয-ওয়াজীব আদায় করার পরে যখন আল্লাহর নৈকট্য ও রেযামন্দীর উদ্দেশ্যে এ অতিরিক্ত ইবাদত করবে, তখন আল্লাহ তাকে উক্ত বালাখানা দান করবেন।
(٤٢) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ أَبَاهُ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ كَانَ يُصَلِّي مِنَ اللَّيْلِ مَا شَاءَ اللَّهُ ، حَتَّى إِذَا كَانَ مِنْ آخِرِ اللَّيْلِ أَيْقَظَ أَهْلَهُ للصَّلاةِ، يَقُولُ لَهُمُ الصَّلاةَ الصَّلَاةَ، ثُمَّ يَتْلُو هَذِهِ الْآيَةَ : وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْأَلُكَ رِزْقاً نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوَى (موطأ إمام مالك)
(৪২) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত, তাঁর পিতা হযরত উমর (রা:) রাত্রে আল্লাহর তওফীক মোতাবেক নামায পড়তেন। এমনকি যখন রাত শেষ হয়ে আসতো, তখন তিনি নিজ পরিবারের লোকদেরকে নামাযের জন্য জাগিয়ে দিতেন। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করতেন,
وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا تَسْأَلُكَ رِزْقاً نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوَى (سورة طه : ۱۳۲)
অর্থঃ “(হে মুহাম্মদ (স:) আপনার পরিবারকে নামাযের জন্য আদেশ করুন এবং নামায আদায়ের ব্যাপারে ধৈর্য অবলম্বন করুন। আমি আপনার কাছে রিযিক চাচ্ছি না বরং আমি আপনাকে রিযিক দান করি। আর পারিণাম পরহিজগারদের ভাগ্যে।”
(সূরা ত্বা-হা, আয়াত-১৩২)
জুময়ার নামাযের গুরুত্ব
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَالِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ (سورة الجمعة : ٩)
অর্থঃ “হে ইমানদারেরা, জুময়ার দিন যখন নামাযের জন্য ডাকা হবে তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের জন্যে ধাবিত হও এবং কেনা-বেচা পরিত্যাগ কর। আর এটা হলো তোমাদের জন্যে সর্বোত্তম যদি তোমরা জানতে।” (সূরা- জুময়া, আয়াত-৯)
(٤٣) وَعَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ
فَعَلَيْهِ الْجُمُعَةُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ إِلَّا مَرِيضٌ أَوْ مُسَافِرٌ أَوِ امْرَأَةٌ أَوْ صَبِيٌّ أَوْ مَمْلُوكٌ فَمَنِ اسْتَغْنَى بِلَهْوِ أَوْ تِجَارَةٍ اسْتَغْنَى اللَّهُ عَنْهُ وَاللَّهُ غَنِيٌّ حَمِيدٌ (دار قطني)
(৪৩) “হযরত যাবির (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে, তার অবশ্যই জুময়ার দিনে জুময়ার নামায আদায় করা কর্তব্য। তবে রোগী, মুসাফির, মহিলা, শিশু ও কৃতদাস এ কর্তব্য হতে মুক্ত। যদি কোন লোক খেল-তামাশা কিংবা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত হয়ে এ নামায হতে গাফেল থাকে, তাহলে আল্লাহ তায়ালাও তার ব্যাপারে বিমুখ থাকবেন। আর আল্লাহ হলেন মুখাপেক্ষীহীন ও প্রশংসিত।”
(দারে কুতনী)
ব্যাখ্যা: জুময়ার নামায হিজরতের পূর্বক্ষণে ফরয হয়। হুযুর (স:) মক্কা শরীফ হতে হিজরত করে প্রথমত মদিনার উপকন্ঠে কোবা নামক স্থানে সোমবারের দিন উপস্থিত হন এবং সেখানে তিনি চার দিন অবস্থান করেন। অতঃপর পঞ্চম দিনে মদিনার দিকে রওয়ানা হন। এদিনটি ছিল শুক্রবার। পথে বনি সালেম ইবনে আওজ গোত্রের বস্তিতে উপস্থিত হলে নামাযের সময় হয়ে যায় এবং হুযুর (স:) সেখানেই সর্বপ্রথম জুময়ার নামায আদায় করেন। জুময়ার নামায যে অবশ্য পালনীয় ফরয, উল্লেখিত হাদীসে তার উল্লেখ করা হয়েছে।
জাহেলিয়াতের যুগে জুময়ার দিন বলে কোন দিন ছিল না। আরবরা এদিনটিকে ইয়াওমূল আরুবা বলতো। জুময়ার নামাযের নির্দেশ দানের পরই এ দিনটির নামকরণ করা হয় ‘ইয়াওমুল জুমুয়া’ বা জুময়ার দিন। কেননা এ দিনটিতে মুসলমানেরা এলাকার সবচেয়ে বড় মসজিদে (কেন্দ্রীয় যায়গায়) জুময়ার নামায আদায়ের এবং খোতবা শোনার জন্য একত্রিত হয়। আনুষ্ঠানিক ইবাদতের দৃষ্টিতে জুময়ার এ সম্মেলনটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সামাজিক 3 রাজনৈতিক দৃষ্টিতেও এ সম্মেলনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। জুময়।ব নামায অবশ্য পালনীয়। শরীয়ত সম্মত ওযর ব্যতিত কিছুতেই এ নামায ত্যাগ করা যাবে না। তবে নারী, শিশু, রোগী, মুসাফির ও কৃতদাসকে এ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরা যদি আদায় করে, তাহলে তাদের জুময়ার নামায আদায় হবে, যোহর পড়তে হবে না।
(٤٤) وَعَنْ سَمُرَةَ بْنِ جُنْدُبٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: احْضُرُوا الْجُمُعَةَ وَادْنُوْا مِنَ الْإِمَامِ، فَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَتَخَلَّفُ عَنِ الْجُمُعَةِ حَتَّى إِنَّهُ لَيَتَخَلَّفُ عَنِ الْجَنَّةِ وَإِنَّهُ لَمِنْ أَهْلِهَا
(مسند أحمد)
(৪৪) “হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (স:) বলেছেন, তোমরা জুময়ার নামাযে হাযির হও এবং ইমামের নিকট দাড়াও। কেননা যে ব্যক্তি জুময়ার নামাযে সকলের পিছনের হাযির হবে, পরিণামে সে জান্নাতে প্রবেশের ব্যাপারেও সকলের পিছনে থাকবে। অথচ সে অবশ্যই জান্নাতের উপযুক্ত।”
(মুসনাদে আহমদ)
(٤٥) وَعَنْ أَبِي الْجَعْدِ الضَّمْرِي رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ تَرَكَ ثَلَاثَ جُمَع تَهَاوُنًا بِهَا طَبَعَ اللَّهُ عَلَى قَلْبِهِ
(أبو داود – ابن ماجة – دارمي – موطأ إمام مالك)
(৪৫) “হযরত আবু জায়াদ যমরী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযুর (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি গাফলতি করে পর পর তিনটি জুময়ায় অনুপস্থিত থাকবে। (অর্থাৎ জুময়ার নামায আদায় করবে না) আল্লাহ তার দিলে মোহর লাগিয়ে দিবেন।
(আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ, দারেমী, মালেক)
ব্যাখ্যা: জুময়ার নামায যে কত গুরুত্বপূর্ণ এ হাদীসে তার-ই ইঙ্গিত রয়েছে। বিনা ওযরে পর পর তিনটি জুময়ায় অনুপস্থিত থাকলে আল্লাহ তার দিলকে গাফেল ও মোহরাঙ্কিত করে দেয়, ফলে তার দিল কঠোর হয়ে যায়।
জুময়ার দিনের ফযীল
(٤٦) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خَيْرُ يَوْمٍ طَلَعَتْ عَلَيْهِ الشَّمْسُ يَوْمُ الْجُمُعَةِ فِيْهِ خُلِقَ آدَمُ، وَفِيهِ أُدْخِلَ الْجَنَّةَ، وَفِيْهِ أُخْرِجَ مِنْهَا ، وَلَا تَقُوْمُ السَّاعَةُ إِلَّا فِي يَوْمِ الْجُمُعَةِ (مسلم)
(৪৬) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) ইরশাদ করেছেন, সুর্যোদয় হওয়া দিন সমূহের মধ্যে সর্বোত্তম দিন হলো জুময়ার দিন। জুময়ার দিনেই হযরত আদম (আ:) কে তৈরী করা হয়েছে। এ দিনেই তাঁকে বেহেশতে প্রবেশ করান হয়েছে। আর এ দিনেই তাঁকে বেহেশত হতে বের করে পৃথিবীতে পাঠান হয়েছে। আর কিয়ামত জুময়ার দিনই অনুষ্ঠিত হবে।” (মুসলিম)
(٤٧) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ فِي الْجُمُعَةِ لَسَاعَةً لَا يُوَافِقُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ اللَّهَ مِنْهَا خَيْرًا إِلَّا أَعْطَاهُ إِيَّاهُ
(بخاري – مسلم)
(৪৭) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল
(স:) বলেছেন অবশ্য অবশ্য জুময়ার দিনে এমন একটা সময় আছে, যখন কোন মুসলিম বান্দাহ আল্লাহর কাছে কল্যাণকর কিছু কামনা করলে অবশ্যই তাকে তা দেওয়া হয়।” (বুখারী, মুসলিম)
ঈদ ও ঈদের নামায
(٤٨) وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَدِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ وَلَهُمْ يَوْمَانِ يَلْعَبُونَ فِيهِمَا فَقَالَ: مَا هَذَانِ الْيَوْمَانِ؟ قَالُوا : كُنَّا نَلْعَبُ فِيهِمَا فِي الْجَاهِلِيَّةِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَدْ
أَبْدَلَكُمْ اللَّهُ فِيهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا يَوْمَ الْأَضْحَى وَيَوْمَ الْفِطْرِ (أبو داود)
(৪৮) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (স:) মদীনায় এসে দেখতে পেলেন যে, মদীনাবাসীরা বিশেষ দুটি দিনে খেলাধুলা (আনন্দ-উৎসব) করে। হুযুর (স:) জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের এ বিশেষ দিন দুটির তাৎপর্য কি? তারা জবাব দিল, জাহেলিয়াতের (ইসলাম পূর্ব) যুগে আমরা এ দুটি দিনে খেলা-ধূলা (আনন্দ উৎসব) করতাম। হুযুর (স:) বললেন দেখ, আল্লাহ তোমাদেরকে এ দুটি দিনের পরিবর্তে উত্তম দুটি দিন দিয়েছেন। তাহলো ঈদুল আযহার দিন ও ঈদুল ফিতরের দিন। (আবু দাউদ)
ব্যাখ্যা: ঈদ শব্দের অর্থ হলো খুশী বা আনন্দ। যেহেতু এ বিশেষ দিন দুটিতে আল্লাহ মুসলমানদের আনন্দ উৎসব করার অনুমতি দিয়েছেন, তাই এ দিন দুটিকে ঈদের দিন বলা হয়। তবে মুসলমানদের পর্ব পালন ও আনন্দ-উৎসব যাতে নীতি নৈতিকতার বন্ধনহীন নিছক একটি আনন্দ মেলা না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আল্লাহ ও তাঁর রসূল (স:) এর নিয়ম নীতি ঠিক করে দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, বরং এ আনন্দ-উৎসবের সিলেবাস এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে, যার দ্বারা মুসলমানদের অন্তরে পবিত্র ধর্মীয়বোধ ও মানবতার প্রতি তাদের দায়িত্ব অনুভূতি জাগ্রত হয়। ঈদুল ফিতরে প্রত্যেক ধনী ব্যক্তির ঈদের নামায আদায়ের আগেই গরীবদেরকে ফেতরা দান, ঈদুল আযহার কোরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরীব মিসকীনদের মধ্যে বন্টনের বিধান এ জন্যেই করা হয়েছে। যাতে ঈদের আনন্দ শুধু স্বচ্ছল ও ধনবান লোকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং গরীব ধনী নির্বিশেষে সকলেই যেন ঈদের আনন্দে শরীক হতে পারে। সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের এমন সুন্দর দৃষ্টান্ত অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কোন পর্ব বা অনুষ্ঠানে পাওয়া দুষ্কর।
(٤٩) وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَغْدُو يَوْمَ الْفِطْرِ حَتَّى يَأْكُلَ تَمَرَاتٍ وَيَأْكُلُهُنَّ وِتْرًا (بخاري)
(৪৯) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (স:) ঈদুল ফিতরের দিনে অন্তত কয়েকটি খোরমা না খেয়ে বের হতেন না। আর তা তিনি বেজোড় সংখ্যায় খেতেন।” (বুখারী)
ব্যাখ্যা: ঈদুল ফিতরের দিন নামাযে বের হওয়ার আগেই হুযুর (স:) কিছু খেয়ে নিতেন। কিন্তু ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহে যাওয়ার আগে তিনি কিছু খেতেন না। আর খোরমা বেজোড় খাওয়ার কারণ ছিল যে, হুযুর (স:) বলতেন “আল্লাহ বেজোড় এবং তিনি
বেজোড়কে ভালবাসেন।
(٥٠) وَعَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَ يَوْمُ عِيْدِ خَالَفَ الطَّرِيقَ
(بخاري)
(৫০) “হযরত জাবির (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযুর (স:) ঈদের দিনে রাস্তা পরিবর্তন করে চলতেন।”
(বুখারী)
ব্যাখ্যা: ঈদের দিন যাতায়াত বিশেষ করে ঈদগাহে যাতায়াতের ব্যাপারে রাস্তা পরিবর্তন করে চলা মোস্তাহাব। কেননা ঈদের দিন উত্তম পোশাকে সজ্জিত হওয়া এবং রাস্তা চলার সময় তকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করার নির্দেশ রয়েছে। যার ফলে মহল্লা বা পাড়ার বিভিন্ন রাস্তা ও এলাকায় মুসলমানদের শান শওকতের যেমন প্রদর্শনী ঘটে, তেমনি বিভিন্ন এলাকা আল্লাহর গুণকীর্তন ও তকবীর ধ্বনিতে মুখরতি হয়ে ওঠে।
(٥١) وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْرُجُ يَوْمَ الْفِطْرِ وَالْأَضْحَى إِلَى الْمُصَلَّى فَأَوَّلُ شَيْءٍ يَبْدَأُ بِهِ الصَّلَاةُ ثُمَّ يَنْصَرِفُ فَيَقُوْمُ مُقَابِلَ النَّاسِ وَالنَّاسُ جُلُوسٌ عَلَى صُفُوفِهِمْ فَيَعِظُهُمْ وَيُوْصِيْهِمْ وَيَأْمُرُهُمْ وَإِنْ كَانَ يُرِيدُ أَنْ يَقْطَعَ بَعْثًا قَطَعَهُ أَوْ يَأْمُرَ بِشَيْءٍ أَمَرَ بِهِ ثُمَّ يَنْصَرِفُ
(بخاري – مسلم)
(৫১) “হযরত আবু সাইয়েদ খুদরী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
নবী করীম (স:) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হয়ে যেতেন এবং সেখানে গিয়ে প্রথম যে কাজটি করতেন, তাহলো নামায। অতঃপর তিনি মুখ ফিরিয়ে জনতার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে যেতেন, আর জনতা তখন তাদের কাতারেই বসা থাকত। তিনি তাদেরকে উপদেশ দিতেন, নসীহত করতেন ও নির্দেশ দিতেন। যদি কোথাও সৈন্য পাঠাবার ইচ্ছা রাখতেন, তাহলে তাদেরকে (ঐ সময়েই) বাছাই করে নিতেন, অথবা কাউকে কোন নির্দেশ দেয়ার থাকলে দিতেন। (বুখারী, মুসলিম)
(٥٢) وَعَنْ جَابِرٍ بْنِ سَمُرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، صَلَّيْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْعِيْدَيْنِ غَيْرَ مَرَّةٍ وَلَا مَرَّتَيْنِ بِغَيْرِ أَذَانٍ وَلَا إِقَامَةٍ
(مسلم)
(৫২) “হযরত জাবির ইবনে সামুরাতা (রা:) বলেন, আমি হুযুরের
(স:) সাথে দুই ঈদের নামায আযান একামত ছাড়াই এক দুইবার নয়, বহুবার পড়েছি।” (মুসলিম)
(٥٣) وَعَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ خَطَبَنَا النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ النَّحْرِ قَالَ: إِنَّ أَوَّلَ مَا نَبْدَأُ بِهِ فِي يَوْمِنَا هَذَا أَنْ تُصَلِّي ثُمَّ نَرْجِعَ فَتَنْحَرَ، فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدْ أَصَابَ سُنَّتَنَا ، وَمَنْ ذَبَحَ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّي فَإِنَّمَا هُوَ لَحْمٌ عَجَّلَهُ لِأَهْلِهِ لَيْسَ مِنَ النُّسُكِ فِي شَيْءٍ
(بخاري – مسلم)
(৫৩) “হযরত বারা বিন আযেব (রা:) বলেন, একদা ঈদুল আযহার
দিন হুযুর (স:) আমাদের উদ্দেশ্যে খোৎবা দিয়ে বললেন, আজকের এ দিনে আমাদের প্রথম কাজ হলো নামায আদায় করা। অত:পর আমরা (ঈদগাহ হতে) ফিরে গিয়ে কোরবানী করব। যে এরূপ করবে সে আমাদের সুন্নতেরই অনুসরণ করবে। আর যে নামাযের আগেই জবেহ করবে, তা তার গোশত খাওয়ার (উদ্দেশ্যে) একটি বকরী হবে, যা সে তার পরিবারের জন্যে তাড়াহুড়া করে জবাই করেছে, এতে আদৌ কোরবানীর কোন লক্ষণ নেই।”
(বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: প্রকৃতপক্ষে রসূলের (স:) নির্দেশ মোতাবেক যে কোরবানী হবে, তা-ই হবে সঠিক কোরবানী। আর রসূলের নির্দেশের পরওয়া না করে নিজেদের খেয়াল-খুশিমত কোরবানী করলে তাতে গোশত খাওয়া হতে পারে কিন্তু কোরবানী হবে না।
(٥٤) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّهُ أَصَابَهُمْ مَطَرٌ فِي يَوْمِ عِيْدٍ فَصَلَّى بِهِمُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَاةَ الْعِيدِ فِي الْمَسْجِدِ
(أبو داود – ابن ماجة)
(৫৪) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, একদা এক ঈদের
দিনে তাদের সেখানে বর্ষা হয়েছিল। ফলে হুযুর (স:) তাদেরকে নিয়ে মসজিদে (ঈদের) নামায আদায় করেছিলেন।”
(আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ)
ব্যাখ্যা: ঈদের নামায ওয়াজিব এবং তা বড় ময়দানে পড়া সুন্নত। তবে যদি বর্ষা ও পানির কারনে মাঠে পড়া সম্ভব না হয়, তাহলে মসজিদে পড়া যেতে পারে। যেমন উপরে বর্ণিত হাদীসটিতে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
(٥٥) وَعَنْ ابْنِ الْحُوَيْرِثِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَتَبَ إِلَى عَمْرِو بْنِ حَزْمٍ وَهُوَ بِنَجْرَانَ أَنْ عَجِّلِ الْأَضْحَى وَأَخِرِ الْفِطْرَ وَذَكَرِ النَّاسَ
(شافعي)
(৫৫) “হযরত আবুল হোয়াইরেছ (রা:) হতে বর্ণিত, একদা রসূলুল্লাহ (স:) নাযরানে নিয়োজিত (তার কর্মচারী) আমর ইবনে হাযামকে এই মর্মে লিখিত নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তুমি ঈদুল আযহার নামায জলদি করে (প্রথম ওয়াক্তে) আদায় করবে এবং ঈদুল ফিতরের নামায বিলম্ব করে পড়বে। আর লোকদেরকে (নামায বাদ) উপদেশ দিবে।” (শাফেঈ)
ব্যাখ্যা: প্রকৃতপক্ষে ঈদের নামাযের ওয়াক্ত ইশরাকের ওয়াক্তের পরপরই শুরু হয়ে সূর্য স্থির হওয়ার আগ পর্যন্ত থাকে। উপরোক্ত সময়ের মধ্যে অবশ্যই ঈদের নামায আদায় করতে হবে। তবে হুযুর (স:) ঈদুল আযহার নামায ওয়াক্তের প্রথম দিকেই আদায় করতে বলেছেন, যাতে নামাযের পরপরই কোরবানীর জানোয়ার যবেহ করে তার গোশত দ্বারা সত্বর খাদ্য গ্রহন করা যায়। কিন্তু ঈদুল ফিতরের নামায একটু বিলম্ব করে পড়া উত্তম। কেননা ঈদুল ফিতরের আগেই কিছু খাওয়া মোস্তাহাব। ফলে বিলম্ব হওয়া স্বাভাবিক।
যাকাত
فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَاعْتَصِمُوا بِاللَّهِ
(سورة الحج – ۷۸)
অর্থ: “অতএব নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাও।” (সূরা হজ্জ, আয়াত: ৭৮)
(٥٦) وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَ مُعَاذَا إِلَى الْيَمَنِ فَقَالَ: إِنَّكَ
تَأْتِي قَوْمًا أَهْلَ كِتَابٍ فَادْعُهُمْ إِلَى شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوكَ لِذَالِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوكَ لِذَالِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِي أَمْوَالِهِمْ تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوكَ لِذَالِكَ فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهَا لَيْسَ
بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ
(بخاري – مسلم)
(৫৬) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সঃ) হযরত মুয়াযকে ইয়ামনের শাসনকর্তা রূপে প্রেরণ করার সময় এ মর্মে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, হে মুয়াষ, তুমি এমন এক জায়গায় যাচ্ছ যেখানকার অধিবাসীরা হলো আহলে কিতাব (ইহুদী-নাসারা)। সুতরাং তুমি তাদেরকে সর্বপ্রথম (আল্লাহর দীনের দিকে) এ মর্মে দাওয়াত দিবে যে, তারা সাক্ষ্য দিক, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নাই এবং মুহাম্মদ (স:) অবশ্যই তাঁর রসূল।” যদি তারা একথা মেনে নেয়, তাহলে তাদেরকে বলবে যে, আল্লাহ তাদের উপর দিন রাতে মোট পাঁচ ওয়াক্তের নামায ফরয করেছেন। যদি তারা এ কথা মেনে নেয়, তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দিবে যে, “আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা ধণীদের কাছ থেকে আদায় করে দরিদ্রের মধ্যে বন্টন করা হবে।” যদি তারা এটা মেনে নেয়, তাহলে সাবধান তাদের সর্বোত্তম মাল (যাকাত হিসেবে)
গ্রহন করবে না। আর মযলুম লোকদের বদ-দোয়াকে অবশ্যই ভয় করবে। কেননা নিপীড়িত লোকের ফরিয়াদ ও আল্লাহর মাঝখানে কোন পর্দা থাকে না।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: যাকাত হলো এমন একটি ইবাদাত, যা মালী ইবাদাতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট। নামাযের ন্যায় যাকাতের কথাও পবিত্র কোরআনে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। পূর্ববর্তী পয়গম্বর এবং তাদের উম্মতের উপরও যাকাত কোন না কোন রূপে ফরয ছিল।
ইসলামী রাষ্ট্রে যাকাত রাষ্ট্র কর্তৃক আদায় করে শরীয়তের বিধান মোতাবেক তার নির্দিষ্ট খাতে বন্টন করতে হবে। রসূল (স:) এবং তাঁর পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনের কার্যক্রম ছাড়াও হযরত মুয়াযকে ইয়ামানের শাসকরূপে প্রেরণের মুহূর্তে রসূল (স:) কর্তৃক যাকাত সম্পর্কে উপদেশ দান রাষ্ট্রীয় দায়িত্বেরই ইঙ্গিত বহন করে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি ইসলামী না হয়, তাহলে ধনবান ব্যক্তিরা নির্ভরযোগ্য কোন ইসলামী সংস্থার মাধ্যমে যাকাত একত্রিত করে উপযুক্ত খাতে বন্টন করে দিবে। আর যদি এ ধরনের কোন সংস্থাও না থাকে, তাহলে ধনী ব্যক্তিরা নিজস্বভাবেই যাকাত বের করে শরীয়ত মোতাবেক বন্টন করে দিবে।
যাকাত বৎসরান্তে একবার আদায় করতে হয়। স্বর্ণ, রৌপ্য, নগদ টাকা ও ব্যবসায়ী পণ্যের শতকরা আড়াই টাকা হিসেবে যাকাত দিতে হবে। গৃহপালিত পশুর যাকাত হলো বিশটিতে একটি। এছাড়াও ক্ষেতের ফসল ফল-ফলাদির উপরও যাকাত ধার্য হবে।
হুযুর (স:) যাকাতে সর্বোত্তম মাল গ্রহণ না করে, বরং মধ্যম মানের মাল গ্রহণ করতে বলেছেন। অর্থাৎ যাকাত দানকারীর পশু পাল হতে উত্তম পশু এবং উৎপাদিত শস্য হতে উত্তম শস্য গ্রহণ না করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
হুযুরের এ প্রসিদ্ধ হাদীসটি হতে আমরা এও জানতে পারি যে, মুসলমানরা কখনও তাদের অধীনস্ত অমুসলিমদেরকে জবরদস্তি ধর্মান্তরিত করেনি। বরং তাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করার পর যদি তারা স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ করে, তাহলেই পরবর্তী পর্যায় তাদেরকে ইসলামী আমলের তা’লীম দেয়া হয়েছে। অন্যথায় তারা রাষ্ট্রের অধীনে যাবতীয় রাজনৈতিক, নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার ভোগ করেছে।
যাকাত আদায় না করার পরিণাম
(٥٧) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ آتَاهُ اللَّهُ مَالاً فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثْلَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَهُ زَبِيْبَتَانِ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ يَعْنِي شَدْقَيْهِ ثُمَّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ ثُمَّ ثَلَا : وَلَا يَحْسِبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ الآية (بخاري)
(৫৭) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, যাকে আল্লাহ মাল দিয়েছেন অথচ সে তার যাকাত আদায় করে না, কিয়ামতের দিন তার ঐ মাল এমন একটি ভয়াবহ বিষধর সর্পের রূপ ধারণ করবে যার মাথায় থাকবে দু’টি কালো বর্ণের ফোটা। (কালো ফোটা হলো ভয়াবহ বিষধর সাপের চিহ্ন।) উক্ত সাপ তার গলদেশে হাসলীর ন্যায় জড়িয়ে দেয়া হবে। তৎপর সাপ উক্ত ব্যক্তির চোয়াল কামড়িয়ে ধরে বলবে, আমি তোমার মাল, আমি তোমার জমাকৃত সম্পদ। অত:পর হুযুর (স:) কোরআনের নিম্নলিখিত আয়াত তেলওয়াত করলেন:
وَلَا يَحْسِبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ …. الآية
অর্থঃ “আল্লাহ যাদের সম্পদ দান করেছে অথচ কৃপণতা করে তারা যেন এ কথা মনে না করে যে, তাদের এ কৃপণতা তাদের জন্য কল্যাণ আনয়ন করবে। বরং তা তাদের জন্য চরম অকল্যাণকরই হবে।” (বুখারী)
(٥٨) وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ، سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: مَا خَالَطَتِ الزَّكَاةُ مَالاً قَطُّ إِلَّا أَهْلَكَتْهُ (شافعي – بخاري)
(৫৮) “হযরত আয়েশা (রা:) বলেন, আমি আল্লাহর নবীকে এ কথা বলেতে শুনেছি যে, যে মাল (হতে যাকাত বের করা হয় না, বরং) যাকাতের সাথে মিশ্রিত হয়ে যায়, পরিণামে তা ধ্বংস হয়।” (শাফেঈ, বুখারী)
যাকাত আদায়কারী কর্মচারীর মর্যাদা
(٥٩) وَعَنْ رَافِعِ بْنِ خَدِيجٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْعَامِلُ عَلَى الصَّدَقَةِ بِالْحَقِّ كَالْغَازِي فِي سَبِيلِ اللَّهِ حَتَّى يَرْجِعَ إِلَى بَيْتِهِ
(أبو داود – ترمذي)
(৫৯) “হযরত রাফে ইবনে খাদিজা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (স:) বলেছেন, সঠিকভাবে যাকাত আদায়কারী কর্মচারীর মর্যাদা আল্লাহর রাহে জিহাদরত ব্যক্তির সমতুল্য। এমনকি সে বড়ীতে ফিরে না আসা পর্যন্ত উক্ত মর্যদায় ভূষিত থাকে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী)
ব্যাখ্যা: যাকাত রাষ্ট্র কর্তৃক ধার্য কোন ট্যাক্স নয়। বরং তা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত একটি সুনির্দিষ্ট মালী ইবাদাত। ইসলামী রাষ্ট্র যদিও যাকাত আদায়কারী কর্মচারী নিয়োগ করে থাকে, তবুও তার মর্যাদা নিছক একজন সরকারী কর্মচারীর মর্যাদা নয়। বরং আল্লাহর ধার্যকৃত উক্ত যাকাতের মাল আদায় রত অবস্থায় সে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদরত একজন মুজাহিদ সমতুল্য।
মালের উপর যাকাত কখন ফরয হয়
(٦٠) عَنِ عَبْدِ اللَّهِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنِ اسْتَفَادَ مَالاً فَلَا زَكَاةَ فِيْهِ حَتَّى يَحُولَ عَلَيْهِ الْحَوْلُ (ترمذي)
(৬০) “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) বলেন, নবী করীম (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন মালের মালিক হয়েছে, যে পর্যন্ত না উক্ত মাল তার কাছে এক বছর থাকে সে পর্যন্ত তাকে তার যাকাত দিতে হবে না।” (তিরমিযী)
ব্যাখ্যা: যাকাত পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া মাত্রই যাকাত ফরয হবে না। যাকাত ফরয হওয়ার জন্য মাল মালিকের মালিকানায় পূর্ণ এক বছর কাল থাকা শর্ত। তবে কেউ যদি বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই যাকাত আদায় করে দেয়, তাহলে তা আদায় হয়ে যাবে।
(٦١) وَعَنْ عَلِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ الْعَبَّاسِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ سَأَلَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي تَعْجِيلِ صَدَقَتِهِ قَبْلَ أَنْ تَحِلَّ فَرَخَّصَ لَهُ فِي ذَالِكَ
(أبو داود ، ترمذي)
(৬১) “হযরত আলী (রা:) হতে বর্ণিত, একদা হযরত আব্বাস (রা:) বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই যাকাত আদায় করা সম্পর্কে হুযুরকে (স:) জিজ্ঞেস করেছিলেন। ফলে হুযুর (স:) তার অনুমতি দিয়েছিলেন।” (আবু দাউদ, তিরমিযী)
ফিতরা
(٦٢) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ:
فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيْرٍ عَلَى الْعَبْدِ وَالْحُرِّ وَالذَّكَرِ وَالْأُنْثَى وَالصَّغِيرِ وَالْكَبِيرِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ وَأَمَرَ بِهَا أَنْ تُؤَدَّى قَبْلَ خُرُوجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلَاةِ
(بخاري – مسلم)
(৬২) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) বলেন, নবী করীম (স:) প্রতিটি মুসলমান কৃতদাস, আযাদ নারী-পুরুষ, ছোট বড় নির্বিশেষে সকলের জন্য সদকায়ে ফিতর এক ছায়া পরিমান খেজুর কিম্বা যব নির্ধারণ করেছেন। আর ঈদগাহে রওয়ানার আগেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: ফিতরা প্রকৃতপক্ষে রোযার যাকাত। অর্থাৎ যাকাত যেমন মালকে পবিত্র করে, তেমনি ফিতরাও রোযাকে পবিত্র করে। অর্থাৎ রোযার ভিতর যেবস ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটে ফিতরা দ্বারা তা পূরণ হয়ে যায়।
ফিতরা ওয়াজিব। প্রতিটি মালদার ব্যক্তি তার ও তার পোষ্যদের পক্ষ হতে ঈদের দিন নামাযে রওয়ানা হবার আগেই তা আদায় করবে। যাকাতের জন্য যেমন যাকাত দেয় পরিমান মালের পুরা এক বছর মালিক থাকা প্রয়োজন, ফিতরার জন্যে তা নয়। বরং ঈদের দিন সকালে যাকাত দেয় পরিমাণ মালের মালিক হলেই তাকে অবশ্যই ফিতরা আদায় করতে হবে।
ইসলামে যে সব পর্ব বা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা আছে তা সর্বজনীন। অর্থাৎ অনুষ্ঠান পালন ও তার আনন্দ উৎসব গরীব ধনী নির্বিশেষে যাতে সকলেই উপভোগ করতে পারে, ইসলাম তার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে। ফলে ঈদের আনন্দ যাতে স্বচ্ছল ঘরেই সীমাবদ্ধ না থাকে সে জন্যে হুযুর (স:) নির্দেশ দিয়েছেন যে, ঈদের নামাযে রওয়ানা হওয়ার আগেই যেন স্বচ্ছল লোকেরা প্রত্যেকেই নিজ ও তার পোষ্যদের পক্ষ হতে ফিতরা অবশ্যই গরীব মিসকীনকে আদায় করে দেয়, যাতে করে ঈদের আনন্দটা শুধু ধনীদের ঘরেই সীমাবদ্ধ না থাকে।
ফিতরার পরিমাণ হলো প্রতিটি এলাকার প্রধান খাদ্য অর্থাৎ আটা কিম্বা চাল জন প্রতি এক সের সাড়ে বার ছটাক।
(٦٣) عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَكَاةَ الْفِطْرِ طُهْرَةُ لِلصَّائِمِ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَتْ وَطُعْمَةً لِلْمَسَاكِينِ (أبو داود)
(৬৩) “হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেছেন যে, হুযুর (স:)
বাজে কথা ও অশ্লীলতা হতে রোযাকে পবিত্র করার ও মিসকিনদেরকে অনুদানের উদ্দেশ্যে সদকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন।” (আবু দাউদ)
রমযানের ফযীলত
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
(سورة البقرة : ۱۸۳)
“হে ইমানদারেরা তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হলো। যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরে। যার ফলে তোমরা পাপ হতে বাচতে পার।” (সূরা বাকারা-১৮৩)
(٦٤) وَعَنْ سَلْمَانَ الْفَارْسِي رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ
خَطَبَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي آخِرِ يَوْمٍ مِنْ شَعْبَانَ، فَقَالَ: أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ أَظَلُكُمْ شَهْرٌ عَظِيمٌ، شَهْرٌ مُبَارَكٌ فِيْهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، جَعَلَ
اللَّهُ صِيَامَهُ فَرِيْضَةٌ وَقِيَامَ لَيْلِهِ تَطَوُّعًا ، مَنْ تَقَرَّبَ فِيهِ بِخَصْلَةٍ مِنَ الْخَيْرِ كَانَ كَمَنْ أَدَّى فَرِيضَةً فِيْمَا سوَاهُ، وَمَنْ أَدَّى فِيْهِ فَرِيضَةً كَانَ كَمَنْ أَدَّى سَبْعِينَ فَرِيضَةً فِيْمَا سِوَاهُ، وَهُوَ شَهْرُ الصَّبْرِ وَالصَّبْرُ ثَوَابُهُ الْجَنَّةُ، وَشَهْرُ الْمُوَاسَاةِ، وَشَهْرٌ يُزَادُ فِي رِزْقِ الْمُؤْمِنِ فِيهِ، مَنْ فَطْرَ فِيْهِ صَائِمًا كَانَ لَهُ مَغْفِرَةٌ لِذُنُوبِهِ وَعِتْقَ رَقَبَتِهِ مِنَ النَّارِ، وَكَانَ لَهُ مِثْلَ أَجْرِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِهِ شَيْءٌ (الدعوات الكبير للبيبهقي)
(৬৪) “হযরত সালমান ফারসি হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা সা’বান মাসের শেষ দিনে রসূল (স:) আমাদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দিলেন, হুযুর (স:) বললেন, হে মানব মণ্ডলী, তোমাদের উপরে ছায়া বিস্তার করছে একটি মহান মুবারক মাস। এমাসে একটি রাত আছে যেটা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসের রোযাকে আল্লাহ ফরয করেছে আর রাত জেগে নামায পড়াকে করেছে নফল। যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এ মাসে একটি নফল কাজ করবে সে ঐ ব্যক্তির সমতুল্য হবে যে অন্য মাসে একটি ফরয কাজ করল। আর যে এই মাসে একটি ফরয কাজ করবে সে ঐ ব্যক্তির সমতুল্য হবে যে অন্য মাসে সত্তরটি ফরয কাজ করল। এটা হলো সবরের মাস আর সবরের প্রতিদান হলো জান্নাত। এটা হলো পরস্পরের সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস। এটা হলো সেই মাস যে মাসে মুমেনের রিযিক বাড়িয়ে দেয়া হয়। এ মাসে কেউ যদি কোন রোযাদারকে ইফতার করায়, তাহলে তার গুনাহ মাফ করা হবে এবং তাকে জাহান্নাম থেকে বাচান হবে। আর রোযাদার ব্যক্তির ন্যায় তাকে সওয়াব দেয়া হবে। আর একারনে রোযাদার ব্যক্তির সওয়াব হতে কিছু কমানো হবে না। (দাওয়াতুল কবির, বায়হাকী)
(٦٥) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِ مِئَةِ ضِعْفٍ، قَالَ اللَّهُ تَعَالَى إِلَّا الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ، يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلِي لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ، وَلَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ، وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ، وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمٍ أَحَدِكُمْ فَلَا يَرْفُتْ، وَلَا يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ (بخاري مسلم)
(৬৫) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (স:) বলেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের ফলাফল দশ গুণ হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু রোযার ব্যাপারে এর ব্যতিক্রম হবে। কেননা আল্লাহ স্বয়ং বলেন, বান্দাহ আমার সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে রোযা রেখেছে, আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব। সে তো আমার কথা মতই খানা-পিনা ও কামনা-বাসনা ত্যাগ করেছে।” রোযাদারের জন্য আনন্দের সময় হলো দু’টি। একটি হলো ইফতারের সময়, অপরটি হলো (বেহেশতে) আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। আর রোযা হলো (শয়তানের হামলা হতে বাচার জন্যে) ঢাল স্বরূপ। সুতরাং তোমরা যখন রোযা রাখবে, তখন অশ্লীল কথা বলবে না এবং ঝগড়া ফাসাদও করবে না। হাঁ কেউ যদি রোযাদারকে গালি দেয়, কিংবা তার সাথে ঝগড়া ফাসাদ করে তাহলে তার এ বলে জওয়াব দেয়া উচিত যে, আমি রোযাদার।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: শারীরিক ইবাদত সমূহের মধ্যে রমযান মাসের রোযা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হিজরী দ্বিতীয় সনে রমযান মাসের রোযা উম্মতে মুহাম্মদীর উপর ফরয করা হয়েছে। নামায এবং যাকাতের ন্যায় রোযাও স্মরণাতীত কাল হতে পূর্ববর্তী পয়গম্বর এবং তাদের উম্মতের উপর কোন না কোন রূপে ফরয ছিল।
বর্ণিত হাদীসটিতে রোযার বিশেষ মর্যাদা সম্পর্কে বলতে গিয়ে রসূল (স:) বলেছেন, অন্যান্য ইবাদতের প্রতিফল দশ গুণ হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু রোযার ব্যাপারে আল্লাহ এর ব্যতিক্রম করবেন। অর্থাৎ রোযার প্রতিদান সাতশত গুণ হতেও বাড়িয়ে দেয়া হবে।
(٦٦) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: الصَّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ، يَقُولُ الصِّيَامُ: أَيْ رَبِّ إِنِّي مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفَعْنِي فِيهِ، وَيَقُولُ الْقُرْآنُ: مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَيُشَفَعَانِ (بيهقي – مشكوة)
(৬৬) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (স:) বলেছেন, রোযা এবং কোরআন উভয়ই বান্দার জন্যে (কিয়ামতের দিন) সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, পরওয়ারদেগার, আমি এ লোকটিকে (রমযান মাসে) দিবাভাগে খানা-পিনা ও যৌন লালসা হতে বারণ করেছিলাম, (সে তা মেনে নিয়েছিল) আমাকে এর ব্যাপারে সুপারিশকারী হওয়ার অনুমতি দাও। আর কোরআন বলবে, হে প্রতিপালক, আমি একে রাতের নিদ্রা হতে বারণ করেছিলাম, সে তা শুনেছিল (অর্থাৎ রাতের নিদ্রা ভংগ করে তারাবীর নামাযে কোরআন তেলাওয়াত করেছে) আমাকে এর বেলায় সুপারিশকারী মনোনীত কর। আল্লাহ তখন উভয়কে সুপারিশের অনুমতি দিলে তারা উভয় সুপারিশ করবে।”
(বায়হাকী, মেশকাত)
(٦٧) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، وَ مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
(بخاري – مسلم)
(৬৭) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) বলেন, নবী করীম (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে রমযানের রোযা রাখবে, তার পূর্বকৃত যাবতীয় (সগীরা) গুনাহ মাফ করা হবে এবং যে রমযানের রাতে ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে নামায আদায় করবে, তার অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করা হবে। আর যে কদরের রাতে ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে ইবাদাত করবে, তার পূর্বকৃত যাবতীয় (সগীরা) গুনাহ মাফ করা হবে।” (বুখারী, মুসলিম)
(٦٨) وَعَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فِي الْجَنَّةِ ثَمَانِيَةُ أَبْوَابٍ فِيهَا بَابٌ يُسَمَّى الرَّيَّانَ، لَا يَدْخُلُهُ إِلَّا الصَّائِمُونَ (بخاري – مسلم)
(৬৮) “সাহাল ইবনে সায়াদ (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, বেহেশতের আটটি গেট রয়েছে। তন্মধ্যে একটি গেটের নাম হলো “রাইয়্যান”। উক্ত (বিশেষ) গেট দিয়ে শুধু রোযাদাররাই বেহেশতে প্রবেশ করবে।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: রোযাদারদের বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের কারণে তাদের বেহেশতে প্রবেশের জন্যে রব্বুল আলামীন বিশেষ ধরণের একটি গেট বা দরজা ঠিক করে রেখেছেন।
(٦٩) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ النُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ، فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ (بخاري)
(৬৯) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা কাজ করা পরিত্যাগ করতে পারল না, তার খানা-পিনা ত্যাগ করায় (রোযা রাখায়) আল্লাহর কোন-ই প্রয়োজন নেই।” (বুখারী)
(۷۰)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: كَمْ مِنْ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلَّا الْجُوعُ، وَكَمْ مِنْ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إلا السَّهَرُ (دارمي – مشكوة)
(৭০) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) বলেন, নবী করীম (স:)
বলেছেন, এমন বহু রোযাদার আছে যাদের রোযা দ্বারা উপবাস ছাড়া কিছুই পায় না। আবার এমন অনেক নামাযীও আছে, যাদের নামায দ্বারা রাত জাগরণ ছাড়া কিছু হয় না।” (দারেমী, মেশকাত)
ব্যাখ্যা: বর্ণিত হাদীস দু’টিতে রসূলুল্লাহ (স:) রোযার উদ্দেশ্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। কুরআনে রোযার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “তোমরা তাকওয়ায় ভূষিত হবে, এ জন্যই রোযা তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে।” (আল কোরআন)
রমযানের পূর্ণ একটি মাস দিবাভাগে মুমিন ব্যক্তি খানা-পিনা ও কামনা বাসনা ইত্যাদি হতে নিজেকে বিরত রেখে অন্তরে এমন একটি বিশেষ গুণ লাভ করে, যা তাকে রমযান পরবর্তী বাকী এগারো মাসও আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু পরিত্যাগ করতে উৎসাহিত করে। ইসলামের পরিভাষায় এই বিশেষ গুণটির নামই “তাকওয়া”।
কাজেই রোযা রেখে যার ভিতর তাকওয়া সৃষ্টি হলো না। বরং রোযা রাখা অবস্থায়ই লোককে গালি-গালাজ করে ও মিথ্যা বলে, তার রোযা নিছক উপবাস এবং তার তারাবী মূল্যহীন। অর্থাৎ এ হতভাগ্য ব্যক্তির উপবাস ও রাত জাগরণ কোন কাজেই আসবে না।
শবে কদরের ফযীলত
(۷۱)
وَعَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: دَخَلَ
رَمَضَانُ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ هَذَا الشَّهْرَ قَدْ حَضَرَكُمْ، وَفِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَهَا فَقَدْ حُرِمَ الْخَيْرَ كُلُّهُ، وَلَا يُحْرَمُ خَيْرَهَا إِلَّا مَحْرُومٌ (ابن ماجة)
(৭১) “হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা:) বলেন, একবার রমযান মাসের আগমনে রসূলুল্লাহ (স:) বললেন, দেখ এ মাসটি তোমাদের নিকট এসে উপস্থিত হয়েছে। এতে এমন একটি রাত আছে, যেটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এর কল্যাণ হতে বঞ্চিত হলো, সে যাবতীয় কল্যাণ হতেই বঞ্চিত। আর চির বঞ্চিত ব্যক্তিই কেবল এর
সুফল হতে বঞ্চিত হয়।” (ইবনে মাযাহ)
ব্যাখ্যা: শবে কদরের ফযীলত বর্ণনা প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামীন কোরআনের সূরা “কদর” নামীয় সূরাটি অবতীর্ণ করেছেন। এ রাতটি খুবই মর্যাদাসম্পন্ন রাত। এ এক রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। সুতরাং যে ব্যক্তি এ বিশেষ রাতটিতে জেগে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে অফুরন্ত কল্যাণের (সওয়াব) অধিকারী হবে। আর যে এর কল্যাণ হতে বঞ্চিত হবে, তার মত হতভাগ্য আর কেউ হতে পারে না।
(۷۲)
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ، قَالَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ (بخاري)
(৭২) “হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:)
বলেছেন, তোমরা “শবে কদর” রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতসমূহে অনুসন্ধান কর।”
(বুখারী)
হজ্জ
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلاً
অর্থ: “আর এ ঘরের হজ্জ করা মানুষের উপরে আল্লাহর অধিকার,
যার সামর্থ আছে এ ঘর পর্যন্ত পৌঁছার।” (আলে-ইমরান: ৯৭)
(۷۳)
وَعَنِ عَبْدُ اللَّهِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللَّهَ كَتَبَ عَلَيْكُمُ الْحَجَّ، فَقَامَ الْأَقْرَعُ بْنُ حَابِسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، فَقَالَ: أَفِي كُلَّ عَامٍ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: لَوْ قُلْتُهَا لَوَجَبَتْ، وَلَوْ وَجَبَتْ لَمْ تَعْمَلُوا بِهَا أَوْ لَمْ تسْتَطِيعُوا أَنْ تَعْمَلُوا بِهَا ، الْحَجُّ مَرَّةً فَمَنْ زَادَ فَتَطَوُّع
(أحمد – نسائي – دارمي)
(৭৩) “হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা হুযুর (স:) ইরশাদ করলেন, হে জনমন্ডলী, অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের জন্যে হজ্জ ফরয করে দিয়েছেন। আকরা ইবনে হাবেছ (নামক একজন সাহাবী) তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল, প্রতি বছরের জন্য? হুযুর (স:) বললেন, এখন যদি আমি বলে দেই হাঁ, তাহলে তা তোমাদের জন্যে বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে। আর যদি তা বাধ্যতামূলক-ই হয়ে যায়, তাহলে তোমরা তা করতে পারবে না এবং করার ক্ষমতাও রাখবে না। হজ্জ জীবনে একবারই করতে হবে। তবে কেউ যদি অতিরিক্ত করে তাহলে তার জন্যে তা নফল হবে।” (আহমদ, নাসাঈ, দারেমী)
ব্যাখ্যা: ইসলামী ইবাদতসমূহের মধ্যে হজ্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটা শারীরিক ও মালী উভয় ইবাদতের সংমিশ্রণ। হজ্জ সমাধা করতে যেমন শারীরিক কষ্ট-ক্লেশের প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন অর্থ ব্যয়ের। রোযা এবং যাকাতের ন্যায় হজ্জও হিজরত পরবর্তীকালে উম্মতে মুহাম্মদীর উপর ফরয হয়েছে।
প্রতিটি স্বচ্ছল মুসলমান, যে তার পোষ্যদের যাবতীয় জরুরী খরচ বাদে মক্কা শরীফ যাতায়াতের খরচ বহন করতে পারে এবং শারীরিক দিক হতেও সে সফরের যোগ্য হয়, তার উপরই জিন্দেগীতে একবার হজ্জ পালন করা ফরয। বর্ণিত হাদীসটিতে হুযুর (স:) সে কথাই বলেছেন। আলোচ্য হাদীসটি হতে আমরা এও জানতে পারি যে, দ্বীন-শরীয়তের ব্যাপারে অহেতুক অতিরিক্ত প্রশ্ন করতে নেই। এ সম্পর্কে কোরআনে আল্লাহ পাক ছাহাবাদের নিম্নরূপ সাবধান করে দিয়েছিলেন,
“হে ঈমানদারেরা, প্রতিটি বিষয়ে নবীকে প্রশ্ন করতে যেয়ো না। কেননা এর ফলে তোমাদের জন্যে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।”
(আল কোরআন)
(٧٤) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ حَجَّ لِلَّهِ فَلَمْ يَرْفُتْ وَلَمْ (بخاري – مسلم) يَفْسُقُ، رَجَعَ كَيَوْمٍ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ
(৭৪) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর নবী বলেছেন, যে ব্যক্তি কামনা-বাসনা (স্ত্রী সঙ্গম) ও আল্লাহর নাফরমানী হতে বিরত থেকে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে হজ্জ কার্য সমাধা করবে, সে যেন মাতৃগর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হয়ে বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করল।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: মাতৃগর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ লগ্নে শিশু যেমন নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ থাকে, আল্লাহর রেযামন্দী হাসিলের নিয়তে হজ্জ আদায়কারী ব্যক্তিও অনুরূপ নিষ্পাপ হয়ে বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করে।
কখন হজ্জ ফরয হয়
(٧٥) وَعَنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا يُوْجِبُ الْحَجَّ ؟ قَالَ: الزَّادُ وَالرَّاحِلَةُ (ترمذي – ابن ماجة)
(৭৫) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি নবী করীমের (স:) দরবারে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী, কোন বস্তু হজ্জকে ফরয করে? হুযুর (স:) বললেন, (নিজের এবং পোষ্যদের) যাবতীয় খাওয়া-পরার খরচ এবং সফর খরচ।” (অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজ পোষ্যদের যাবতীয় প্রয়োজনীয় খরচ ও মক্কা শরীফ পর্যন্ত যাতায়াত খরচ বহন করতে সক্ষম, তার উপর-ই হজ্জ ফরয হয়।)
(তিরমিযী, ইবনে মাযাহ)
মহিলারা হজ্জের দ্বারা জিহাদের মর্যাদা পাবে
(٧٦) وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: اِسْتَأْذَنْتُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْجِهَادِ، فَقَالَ: جِهَادُكُنَّ الْحَجَّ (بخاري – مسلم)
(৭৬) “হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হুযুরের (স:) কাছে জিহাদে শরীক হওয়ার অনুমতি চেয়েছিলাম। হুযুর (স:) বললেন, তোমাদের (মহিলাদের) জিহাদ হলো হজ্জ।” (অর্থাৎ তোমরা হজ্জের মাধ্যমেই জিহাদের সওয়াব পাবে।
(বুখারী, মুসলিম)
অক্ষম ব্যক্তির পক্ষ হতে অন্য লোক হজ্জ করবে
(۷۷)
وَعَنْ أَبِي رَزَيْنِ الْعُقَيْلِي أَنَّهُ أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أَبِي شَيْخٌ كَبِيرٌ، لا يَسْتَطِيعُ الْحَجَّ وَلَا الْعُمْرَةَ وَلَا الضَّعْنَ، قَالَ: حُجَّ عَنْ أَبِيكَ وَاعْتَمِرْ (ترمذي – أبو داود – نسائي)
(৭৭) “হযরত আবু রাযীন উকায়লী (রা:) হতে বর্ণিত, একদা তিনি নবী করীমের (স:) খেদমতে হাযির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী, আমার পিতা একেবারেই বৃদ্ধ। হজ্জ উমরা করতে যেমন তিনি অক্ষম, তেমনি সফর করার শক্তিও আর নেই। হুযুর (স:) বললেন, তুমি তোমার পিতার পক্ষ হতে হজ্জ ও উমরা আদায় কর।” (তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ)
কোরবানী
وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيْهَا خَيْرٌ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ فَإِذَا وَجَبَتْ جُنُوبُهَا فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ كَذَالِكَ سَخَّرْنَاهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ (سورة الحج : ٣٦)
অর্থ: “আর কোরবানীর জানোয়ারগুলোকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনের মধ্যে শামিল করেছি। তোমাদের জন্যে এতে কল্যাণ নিহিত রয়েছে। সুতরাং তোমরা ওগুলোকে কোরবনীর উদ্দেশ্যে দাঁড় করিয়ে আল্লাহর নাম স্মরণ করবে। অত:পর যখন তা কাত হয়ে জমিনের উপর পড়বে, তখন তোমরা তা হতে খাবে এবং তা হতে ঐসব অভাবী লোককে খাওয়াবে, যারা তোমাদের কাছে সওয়াল করে এবং যারা সওয়াল করে না। আর তোমরা আমার শোকর করবে, এই জন্যেই আমি এগুলোকে এভাবে তোমাদের বাধ্যগত করে দিয়েছি।” (সূরা হজ্জ ৩৬)
(۷۸)
عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، ضَحَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ ذَبَحَهُمَا بِيَدِهِ وَسَمَّى وَكَبَّرَ، قال: رَأَيْتُهُ وَاضِعًا قَدَمَهُ عَلَى صِفَاحِهِمَا ، وَيَقُولُ : وَقَالَ: بِسْمِ اللَّهِ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ
(بخاري – مسلم)
(৭৮) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রসূল
(স:) দু’টি ধূসর বর্ণের শিংওয়ালা দুম্বা কোরবানী করেছিলেন। তিনি “বিসমিল্লাহে আল্লাহু আকবার” বলে তা নিজ হাতেই জবেহ করেছিলেন। হযরত আনাস (রা:) বলেন, আমি হুযুরকে এর পাঁজরের উপর পা রাখতে দেখেছি এবং জবেহের সময় “বিসমিল্লাহে
আল্লাহু আকবার’ বলতে শুনেছি।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: আল্লাহর নামে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট দিনে যে জানোয়ার জবেহ করা হয় ‘তাকে কোরবানী বলা হয়। কোরবানীর নির্দিষ্ট দিন হলো জিলহজ্জ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ।
নামায রোযার ন্যায় কোরবানীও পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতের জন্যে অবশ্য করণীয় ছিল। এখনও দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির মধ্যে কোরবানীর বিকৃত রূপ দেখতে পাওয়া যায়।
উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর কোরবানী ওয়াজিব। প্রতিটি স্বচ্ছল মুসলমানকে অবশ্যই কোরবানী করতে হবে।
(۷۹)
وَعَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: الْبَقَرَةُ عَنْ سَبْعَةِ وَالْجَزُورُ عَنْ
سبعة (مسلم – أبو داود)
(৭৯) “হযরত জাবির (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, গরু সাত জনের পক্ষ হতে এবং উট সাত জনের পক্ষ হতে কোরবানী করা যাবে।” (মুসলিম, আবু দাউদ)
ব্যাখ্যা: কোরবানীর ব্যাপারে গরু ও উটে এক হতে সাত জন পর্যন্ত শরীক হতে পারে। তবে দুম্বা ও ছাগল অবশ্যই একজনের পক্ষ হতে হবে। কোরবানীর জন্যে উট পাঁচ বছরের, গরু দু’বছরের, ছাগল এক বছরের এবং দুম্বা ছ’মাসের হতে হবে। এর কম বয়সের হলে তাতে কোরবানী হবে না।
عَنْهُ : أَنَّ رَسُولَ
(۸۰) وَعَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ رَضِيَ اللَّهُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُئِلَ مَاذَا يُتَّقَى مِنَ الضَّحَايَا؟ فَأَشَارَ بِيَدِهِ وَقَالَ: أَرْبَعاً، الْعَرْجَاءُ الْبَيِّنُ طَلْعُهَا، وَالْعَوْرَاءُ الْبَيِّنُ عَوَرُهَا، وَالْمَرِيضَةُ الْبَيِّنُ مَرَضُهَا، وَالْعَجْفَاءُ الَّتِي لَا تُنْقِي
(موطأ إمام مالك – أحمد – ترمذي – نسائي – ابن ماجة)
(৮০) “হযরত বারায়া ইবনে আযেব (রা:) হতে বর্ণিত, একদা হুযুরের (স:) খেদমতে আরয করা হলো যে, কোরবানীতে কি ধরনের পশু হতে পরহিজ করতে হবে? হুযুর (স:) হাত দ্বারা ইশারা করে বললেন, তোমরা চার রকমের পশু হতে পরহিজ করবে। খোঁড়া, যার খোঁড়ামী সুস্পষ্ট, অন্ধ, যার অন্ধত্ব সুস্পষ্ট, রোগা, যার রোগ সুস্পষ্ট এবং শক্তিহীন যার হাড়ের মজ্জা শুকিয়ে গেছে।”
(মালেক, আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ, দারেমী)
ব্যাখ্যা: কোরবানীর জানোয়ার মোটা তাজা ও স্বাস্থ্যবান হওয়া চাই। অঙ্গহীন এবং দুর্বল জানোয়ার যার পক্ষে চলাফেরা করা মুশকিল, তাতে কোরবানী হবে না।
(۸۱)
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ، قَالَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ مِنْ عَمَلٍ يَوْمَ النَّحْرِ أَحَبَّ إِلَى اللَّهِ مِنْ إِهْرَاقِ الدَّمِ، وَإِنَّهَا لَتَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقُرُونِهَا وَأَشْعَارِهَا وَأَظْفَارِهَا وَإِنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنَ اللَّهِ بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَقَعَ مِنَ الْأَرْضِ فَطِيبُوا
بِهَا نَفْسًا
(ترمذي – ابن ماجة)
(৮১) “হযরত আয়েশা (রা:) বলেন, রসূলে করীম (স:) বলেছেন, কোরবানীর দিনে মানব সন্তানের কোন নেক কাজই আল্লাহর নিকটে অত প্রিয় নয় যত প্রিয় রক্ত প্রবাহিত করা। (অর্থাৎ কোরবানী করা।) কোরবানীর জানোয়ারগুলো তাদের শিং, পশম ও ক্ষুরসহ কিয়ামতের দিন (কোরবানীদাতার পাল্লায়) এনে দেওয়া হবে। কোরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকটে সম্মানিত স্থানে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দ চিত্তে কোরবানী
করবে।” (তিরমিযী, ইবনে মাযাহ)
(۸۲)
قَالَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ وَجَدَ (ابن ماجة) سَعَةٌ وَلَمْ يُضَحٌ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلانَا
(৮২) “রসূলে করীম (স:) ইরশাদ করেছেন, সামর্থ থাকতে যারা কোরবানী করে না, তারা যেন আমার ঈদগাহের কাছেও না আসে।” (ইবনে মাযাহ)
ব্যাখ্যা: স্বচ্ছল মুসলমানদের উপর কোরবানী করা ওয়াজেব, হুযুরের (স:) উপরোক্ত ঘোষণা তার-ই প্রমাণ।
আল্লাহর রাহে দান
مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيْلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
(سورة البقرة : ٢٦١)
অর্থ: “যারা আল্লাহর পথে তাদের ধন-সম্পদ খরচ করে, তাদের তুলনা এরূপ, যেমন বপণকৃত একটি শস্য-বীজ থেকে সাতটি শীষ বের হয় এবং প্রত্যেকটি ছড়ায় (শীষে) একশটি শস্য থাকে। আল্লাহ যাকে চান এভাবে প্রচুর দান করেন এবং আল্লাহ উদার হস্তও বটে
এবং সর্বাভিজ্ঞও।” (সূরা বাকারা: ২৬১)
(۸۳)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لَوْ كَانَ لِي مِثْلُ أُحُرٍ ذَهَبًا
مَا يَسرَّنِي أَنْ يَمُرَّ عَلَيَّ ثَلَاثُ لَيَالٍ وَعِنْدِي مِنْهُ شَيْءٌ إِلَّا (بخاري) شَيْا أَرْصِدُهُ لِدَيْنِ
(৮৩) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, আমার নিকট যদি অহুদ পাহাড়
পরিমাণও স্বর্ণ থাকে, তাহলে তিন রাত অতিবাহিত হওয়ার পরও তার সামান্য কিছু আমার কাছে অবশিষ্ট থাকুক তা আমি পছন্দ করি না। তবে হাঁ আমার দেনা পরিশোধের জন্যে সামান্য যেটুকু প্রয়োজন। (কেবল মাত্র সেটুকু রেখে বাকী আল্লাহর রাহে দান করে
দিব।)” (বুখারী)
(٨٤) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَيُّ الصَّدَقَةِ أَعْظَمُ أَجْرًا؟ قَالَ: أَنْ تَصَدَّقَ وَأَنْتَ صَحِيحٌ شَحِيْحٌ تَخْشَى الْفَقْرَ وَتَأْمُلُ الْغِنَى، وَلَا تُمْهِلْ حَتَّى إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُوْمَ قُلْتَ لِفُلَانٍ كَذَا وَلِفُلَانٍ كَذَا وَقَدْ كَانَ لِفُلَانٍ
(بخاري – مسلم)
(৮৪) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি হুযুরের (স:) কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী, কোন অবস্থার দান ফলাফলের দিক দিয়ে সর্বোত্তম? রসূল (স:) বললেন, তোমার সুস্থ ও উপার্জনক্ষম অবস্থার দান।
যখন তোমার দরিদ্র হওয়ার ভয় থাকে এবং ধনী হওয়ার আশা থাকে, তুমি নিয়তই দান খয়রাত করতে থাকবে। এমনকি তোমার প্রাণ গ্রীবাদেশে পৌঁছা পর্যন্ত বলতে থাকবে অমুকের জন্য এটা, তমুকের জন্য এটা, আর তোমার বিশ্বাস আছে যে, তা পৌঁছানো হবে।”
(বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: আল্লাহ ও তাঁর নবী স্বচ্ছল-ধনবান মুসলমানকে দরিদ্র অভাবীর অভাব মোচনে ও আল্লাহর দ্বীনের প্রয়োজনে সারা জীবনই দান খয়রাত করতে বলেছেন। এমনকি মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত। তবে যৌবন অবস্থার দানই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশি প্রিয়।
(٨٥) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ سُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَا مِنْ يَوْمٍ يُصِيحُ الْعِبَادُ فِيْهِ إِلَّا مَلَكَانِ يَنْزِلَانِ، فَيَقُولُ أَحَدُهُمَا : اللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا وَيَقُولُ الآخَرُ: اللَّهُمَّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا
(بخاري – مسلم)
(৮৫) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) বলেন, রসূল (স:) বলেছেন, যখনই আল্লাহর বান্দারা প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করে, তখনই দু’জন ফেরেশতা অবস্থিত হন। তন্মধ্যে একজন বলতে থাকেন, হে আল্লাহ, তুমি দাতা ব্যক্তিকে প্রতিদান দাও। আর অন্যজন বলতে থাকেন, হে আল্লাহ, কৃপণ ব্যক্তিকে লোকসান দাও।” (বুখারী, মুসলিম)
(٨٦) وَعَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِي بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ، قَالَ لِي رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَنْفِقِي وَلَا تُحْصِي فَيُحْصِيَ اللَّهُ عَلَيْكِ، وَلَا تُوْعِي فَيُوْعِيَ اللَّهُ عَلَيْكِ، ارْضَخَيْ مَا اسْتَطَعْت (بخاري – مسلم)
(৮৬) “হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, (হে আসমা) তুমি দান করতে থাকবে এবং হিসাব করবে না। অন্যথায় আল্লাহ তোমাকে দেয়ার ব্যাপারে হিসাব করবেন। আর (সম্পদ) ধরে রাখবে না, অন্যথায় আল্লাহ তোমার ব্যাপারে ধরে রাখবেন। তোমার শক্তি অনুসারে সামান্য হলেও দান করবে।” (বুখারী, মুসলিম)
(۸۷)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : قَالَ اللَّهُ تَعَالَى أَنْفِقْ يَا ابْنَ آدَمَ، يُنْفَقُ عَلَيْكَ (بخاري – مسلم)
(৮৭) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, আল্লাহ বলেন হে আদম সন্তান, তুমি দান করতে থাক, আমিও তোমাকে দান করব।” (বুখারী, মুসলিম)
(۸۸)
وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَفْرِسُ غَرْسًا،
وَيَزْرَعُ زَرْعًا فَيَأْكُلُ مِنْهُ إِنْسَانٌ أَوْ طَيْرٌ أَوْ بَهِيمَةً إِلَّا كَانَ لَهُ بِهِ صَدَقَةٌ (بخاري – مسلم)
(৮৮) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, যদি কোন মুসলমান একটি বৃক্ষ রোপণ করে কিম্বা শস্য বপন করে, অতঃপর তাহতে কোন মানুষ, পাখি কিম্বা জানোয়ার কিছু ভক্ষণ করে, তাহলে অবশ্যই তা তার জন্যে দান রূপে পরিগণিত হবে।”
(বুখারী, মুসলিম)
(۸۹)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ وَمَا زَادَ اللَّهُ عَبْدًا بِعَفْوِ إِلَّا عِرًّا وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلَّا رَفَعَهُ اللهُ
(مسلم)
(৮৯) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, দান খয়রাতে সম্পদ কমেনা এবং ক্ষমা দ্বারা আল্লাহ বান্দাহর ইজ্জত-সম্মানই বাড়িয়ে দেন। আর যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাকে উন্নত করেন।” (মুসলিম)
ব্যাখ্যা: বর্ণিত হাদীসে আল্লাহর নবী (স:) বিশেষ ধরণের তিনটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। দান, ক্ষমা ও বিনয়। কোন বস্তুবাদি স্বল্প বুদ্ধির লোক হয়তো মনে করতে পারে যে, দান দ্বারা সম্পদ কমে যায়, ক্ষমা দ্বারা সম্মানের লাঘব হয় এবং বিনয় দ্বারা মর্যাদার হানি ঘটে।
নবী করীম (স:) বলেন, এরূপ নয়, বরং বিপরীত। দান সম্পদ বৃদ্ধি করে, ক্ষমা সম্মান দান করে এবং বিনয় মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
দরিদ্রকে অন্ন দান
(۹۰)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ صَائِمًا؟ قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: أَنَا، قَالَ: فَمَنْ تَبِعَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ جَنَازَةً؟ قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: أنَا، قَالَ: فَمَنْ أَطْعَمَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مِسْكِينًا ۚ قَالَ أَبُوْ بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ : أَنَا ، قَالَ: فَمَنْ عَادَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مَرِيضًا؟ قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ : أَنَا ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا اجْتَمَعْنَ فِي امْرِئٍ إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ (مسلم)
(৯০) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ (স:) জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে আজ কে রোযা রেখেছে? আবু বকর (রা:) বললেন, আমি। হুযুর (স:) পুনঃরায় প্রশ্ন করলেন, তোমাদের মধ্যে কে অদ্য জানাযার অনুসরণ করেছে? হযরত আবু বকর (রা:) জওয়াব দিলেন, আমি। হুযুর (স:) আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কে আজ দরিদ্রকে খাদ্য দিয়েছে? (এবারেও) আবু বকর (রা:) জওয়াব দিলেন, আমি।
হুযুর (স:) পুনরায় প্রশ্ন করলেন, তোমাদের মধ্যে কে আজ রোগীর সেবা শুশ্রুষা করেছে? হযরত আবু বকর (রা:) বললেন, আমি। অত:পর হুযুর (স:) বললেন, এতগুলো উত্তম কাজের সমাবেশ যার মধ্যে ঘটে, সে অবশ্যই বেহেশতে প্রবেশ করবে।” (মুসলিম)
(۹۱)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اعْبُدُو الرَّحْمَنَ وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ، وَأَفْشُوا السَّلَامَ، تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ بسلام (ترمذي – ابن ماجة)
(৯১) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, আল্লাহর ইবাদত কর, (দরিদ্রকে) খাদ্য দান কর এবং উচ্চ শব্দে সালাম কর। নিরাপত্তা সহকারে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (তিরমিযি, ইবনে মাযাহ)
(۹۲)
وَعَنْ ثَوْبَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَفْضَلُ دِينَارٍ يُنْفِقُهُ الرَّجُلُ دِينَارٌ يُنْفِقُهُ عَلَى عِبَالِهِ ، وَدِيْنَارٌ يُنْفِقُهُ الرَّجُلُ عَلَى دَابَّتِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ، وَدِيْنَارٌ يُنْفِقُهُ عَلَى أَصْحَابِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ
(مسلم)
(৯২) “হযরত ছাওবান (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহর (স:) বলেছেন, মানুষের ব্যয়কৃত দীনারের মধ্যে সর্বোত্তম দীনার স্বামীর মাল হতে মহিলারা কোন ধরণের মাল ব্যয় করতে পারবে হলো তা, যা সে তার পরিবারের প্রয়োজনে ব্যয় করে, আর জেহাদের উদ্দেশ্যে রক্ষিত পশুর জন্যে ব্যয় করে এবং জিহাদরত তার সঙ্গীদের জন্যে ব্যয় করে।” (মুসলিম)
(۹۳) وَعَنْ ابْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا أَنْفَقَ الْمُسْلِمُ نَفَقَةً عَلَى أَهْلِهِ وَهُوَ يَحْتَسِبُهَا كَانَتْ لَهُ صَدَقَةٌ (بخاري – مسلم) (৯৩) “হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, যখন কোন মুসলমান ছওয়াবের নিয়তে তার আল-আওলাদের প্রয়োজনে ব্যয় করে, তখন তা (আল্লাহর নিকট) সদকা হিসেবে গণ্য হয়।” (বুখারী, মুসলিম)
স্বামীর মাল হতে মহিলারা কোন ধরণের মাল ব্যয় করতে পারবে
(٩٤) وَعَنْ سَعْدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، لَمَّا بَايَعَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ النِّسَاءَ، قَامَتِ امْرَأَةٌ جَلِيلَةٌ كَأَنَّهَا مِنْ نِسَاءِ مُضَرَ، فَقَالَتْ يَا نَبِيَّ اللَّهِ ۚ إِنَّا كَلَّ عَلَى آبَائِنَا وَأَبْنَائِنَا وَأَزْوَاجِنِنَا، فَمَا يَحِلُّ لَنَا مِنْ أَمْوَالِهِمْ، قَالَ: الرَّطْبُ تَأْكُلْنَهُ وَتُهْدِينَهُ (أبو داود)
(৯৪) “হযরত সা’দ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রসূলুল্লাহ (স:) (ইসলামের উপর) মহিলাদের বয়াত (শপথ) গ্রহণ করেছিলেন, তখন সম্ভবত মোযের গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা দাঁড়িয়ে হুযুরকে (স:) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী, আমাদের ভরণ পোষণের দায়িত্বতো আমাদের পিতা, সন্তান ও স্বামীদের। সুতরাং আমাদের জন্যে তাদের সম্পদ হতে কি পরিমাণ মাল তাদের বিনা অনুমতিতে খরচ করা বৈধ? হুযুর (স:) বললেন, তাজা পঁচনশীল মাল। (অর্থাৎ পাকানো খানা, ফল-মূল ও তরি-তরকারী পঁচনশীল। এ সবের জন্যে অনুমতির প্রয়োজন হবেনা।) তা হতে তোমরা খেতেও পারবে, কাউকে দিতেও পারবে।” (আবু দাউদ)
অকারণে সওয়াল করার পরিণাম
(٩٥) وَعَنْ حَكِيمِ بْنِ حِزَامٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَعْطَانِي، ثُمَّ سَأَلْتُهُ فَأَعْطَانِي، ثُمَّ سَأَلْتُهُ فَأَعْطَانِي ، ثُمَّ قَالَ: يَا حَكِيمُ إِنَّ هَذَا الْمَالَ خَضِرَةٌ حُلْوَةٌ فَمَنْ أَخَذَهُ بِسَخَاوَةِ نَفْسٍ بُوْرِكَ لَهُ فِيْهِ، وَمَنْ أَخَذَهُ بِإِشْرَافِ نَفْسٍ لَمْ يُبَارَكْ لَهُ فِيْهِ كَالَّذِي يَأْكُلُ، وَلَا يَشْبَعُ الْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السُّفْلَى، قَالَ حَكِيمٌ: فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَا أَرْزَأُ أَحَدًا بَعْدَكَ شَيْئًا حَتَّى أُفَارِقَ الدُّنْيَا (بخاري – مسلم)
(৯৫) “হযরত হাকীম বিন হেযাম (রা:) বলেন, একদা আমি হুযুরের (স:) নিকট কিছু চাইলে তিনি আমাকে তা দিলেন। আমি আবার চাইলে তিনি আবার আমাকে তা দিলেন। অত:পর হুযুর (স:) আমাকে বললেন, হাকীম! মনে রেখ, অবশ্যই এ মাল হলো সবুজ সুস্বাদু ঘাসের ন্যায়, যে তা বিনা লোভে প্রয়োজনের তাগিদে গ্রহণ করবে, তার জন্য তাতে বরকত দেয়া হবে। আর যে তা লোভের সাথে গ্রহণ করবে, তার জন্য তাতে বরকত দেয়া হবে না। আর তার অবস্থা হবে সেই ব্যক্তির ন্যায়, যে খাচ্ছে অথচ তৃপ্তি পাচ্ছে না। (মনে রেখ) উপরের হাত নীচের হাতের তুলনায় উত্তম। হযরত হাকীম (রা:) বললেন, তখন আমি হুযুরকে (স:) বললাম, হে আল্লাহর নবী, যিনি আপনাকে সত্য দিন দিয়ে পাঠিয়েছেন, তাঁর শপথ। আপনার পর দুনিয়া ত্যাগ করা পর্যন্ত আমি কারও কাছে কিছু
চাব না।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: সম্পদের জন্যে অতিরিক্ত লোভ করা, পরিশ্রম ব্যতীত সওয়াল করে লোকের কাছ হতে হাসিল করা যে শরীয়তের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয়, উপরোক্ত হাদীসে হুযুর (স:) তারই ইঙ্গিত করেছেন।
(٩٦) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ وَهُوَ عَلَى الْمِنْبَرِ، وَهُوَ يَذْكُرُ الصَّدَقَةَ وَالتَّعَفُفَ عَنِ الْمَسْأَلَةِ الْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السُّفْلَى، وَالْيَدُ الْعُلْيَا هِيَ الْمُنْفِقَةُ وَالسُّفْلَى هِيَ السَّائِلَةُ (بخاري – مسلم)
(৯৬) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত, একদা হুযুর (স:) মিম্বরে দাঁড়িয়ে সদকাহ এবং সওয়াল হতে বিরত থাকা সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। তিনি বললেন, উপরের হাত নীচের হাত হতে উত্তম। উপরের হাত হলো প্রদানকারী, আর নীচের হাত হলো গ্রহণকারী।
(বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: দাতার হাত কোন কিছু দেওয়ার সময় যেহেতু উপরে থাকে, সে জন্যেই হুযুর (স:) উপরের হাত বলে দাতাকেই বুঝাবার চেষ্টা করেছেন। আর গ্রহীতা বা ভিক্ষুকের হাত যেহেতু গ্রহণ করার সময় নীচে থাকে, তাই নীচের হাত দ্বারা সায়েল বা গ্রহীতাকে বুছিয়েছেন।
(۹۷)
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، إِنَّ أُنَاسًا مِنَ الْأَنْصَارِ سَأَلُوا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَعْطَاهُمْ حَتَّى نَفِدَ مَا عِنْدَهُ، فَقَالَ: مَا يَكُوْنُ عِنْدِي مِنْ خَيْرٍ لَا أَدَّخِرْهُ عَنْكُمْ، وَمَنْ يَسْتَعِفَّ يُعِفُهُ اللَّهُ، وَمَنْ يَسْتَغْنِ يُغْنِهِ اللَّهُ، وَمَنْ يَتَصَبَّرْ يُصَبِّرْهُ اللَّهُ، وَمَا أُعْطِيَ أَحَدٌ عَطَاءٌ خَيْرًا وَأَوْسَعَ مِنَ الصَّبْرِ
(بخاري – مسلم)
(৯৭) “হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) বলেন, একদা আনসারদের কিছু লোক হুযুরের (স:) কাছে কিছু চাইলেন। হুযুর তাদেরকে সে সব দিলেন, এমন কি যা কিছু হুযুরের কাছে ছিল সবই তাতে শেষ হয়ে গেল। অত:পর নবী করীম (স:) বললেন, আমার কাছে কিছু সম্পদ থাকলে তোমাদেরকে না দিয়ে তা আমি জমা রাখি না। (কিন্তু মনে রেখ,) যে সওয়াল হতে বেঁচে থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রাখেন। আর যে কারও মুখাপেক্ষী না হতে চায়,
আল্লাহ তাকে কারও মুখাপেক্ষী করেন না। যে কেউ সবর ইখতেয়ার করতে চায়, আল্লাহ তাকে সবরের তওফীক দেন। মনে রেখ, সবরের চেয়ে উত্তম ও প্রশস্ততার কোন দানই কেউ লাভ করতে পারে না।” (অর্থাৎ পরমুখাপেক্ষী হওয়া অথবা কারও কাছে কিছু সওয়াল করার চেয়ে ধৈর্য অবলম্বন করাই শ্রেয়। কেননা আল্লাহ ধৈর্যধারণকারীকে সাহায্য করেন)। (বুখারী, মুসলিম)
(۹۸)
وَعَنْ سَمُرَةَ بْنِ جُنْدُبٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْمَسَائِلُ كُدُوحٌ يَكْدَحُ بِهَا الرَّجُلُ وَجْهَهُ، فَمَنْ شَاءَ أَبْقَى عَلَى وَجْهِهِ، وَمَنْ شَاءَ تَرَكَ إِلَّا أَنْ يَسْأَلَ الرَّجُلُ ذَا سُلْطَانٍ أَوْ فِي أَمْرٍ لَا يَجِدُ مِنْهُ بُدا (أبو داود – ترمذي – نسائي)
(৯৮) “হযরত ছামুরা বিন জুনদুব (রা:) বলেন, রসূল (স:) বলেছেন, সওয়াল হলো ক্ষতস্বরূপ, যাদ্বারা সওয়ালকারী ব্যক্তি নিজের মুখমণ্ডলকে ক্ষত-বিক্ষত করে, সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে স্বীয় মুখমণ্ডলকে অক্ষত রাখতে পারে, আবার যে চায় সে ক্ষত-বিক্ষত করতেও পারে। তবে সরকারের কাছে কিছু চাওয়া কিংবা উপায়হীন ব্যক্তির কারো কাছে কিছু চাওয়া দোষণীয় নহে।”
(আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ)
হালাল রোযগারের গুরুত্ব
يَسْأَلُونَكَ مَاذَا أُحِلَّ لَهُمْ قُلْ أُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبَاتُ
(سورة المائدة : ٤)
“লোকেরা আপনাকে প্রশ্ন করে যে, তাদের জন্য কি কি বস্তু হালাল করা হয়েছে আপনি বলে দিন, তোমাদের জন্য উত্তম পবিত্র বস্তু হালাল করা হয়েছে।” (সূরা মায়েদা : ৪)
(۹۹)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا ، وَإِنَّ اللَّهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ، فَقَالَ: يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا، وَقَالَ تَعَالَى: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ، ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَالِك (مسلم)
(৯৯) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল
(স:) বলেছেন, আল্লাহ স্বয়ং পবিত্র এবং কেবলমাত্র পবিত্র বস্তুই তিনি গ্রহণ করে থাকেন। আর আল্লাহ মুমিনদেরকে সে নির্দেশ দিয়েছেন, যা তিনি দিয়েছেন পয়গাম্বরদেরকে। আল্লাহ বলেছেন, “হে রসূলগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু হতে খাদ্য গ্রহণ কর এবং নেক আমল কর।” (অনুরূপভাবে) তিনি মুমিনদেরকে বলেছেন, “হে ঈমানদারেরা আমার দেয়া পবিত্র খাদ্য হতে আহার গ্রহণ কর।” অত:পর হুযুর (স:) এমন এক ব্যক্তির প্রসঙ্গ তুললেন, যিনি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ধুলি-মলিন অবস্থায় (কোন পবিত্র স্থানে হাযির হয়ে) দু’হাত আকাশের দিকে তুলে (দোয়া করে আর) বলে, হে আল্লাহ, হে আল্লাহ, অথচ তার খাদ্য, পানীয় ও লেবাস সব কিছু হারামের। এমন কি সে এ পর্যন্ত হারাম খাদ্য দ্বারাই জীবন ধারণ করেছে। সুতরাং তার দোয়া কি করে কবুল হবে।” (মুসলিম)
ব্যাখ্যা: উপরোক্ত হাদীসে মুমিনদেরকে হালাল উপায় উপার্জিত পবিত্র ও শরীয়ত অনুমোদিত খাদ্য গ্রহণ করার জন্যে বলা হয়েছে। সুতরাং হারাম উপায়ে উপার্জিত হালাল খাদ্য কিম্বা হালাল উপায়ে অর্জিত হারাম খাদ্য এর কোনটাই মুমিন ব্যক্তি গ্রহণ করতে পারে না।
উপরোক্ত হারাম উপায় উপার্জিত খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করে এবং হারাম টাকার কাপড় পরিধান করে, যে কোন পবিত্র স্থানে গিয়ে যত কাকুতি-মিনতি করে দোয়া করা হোক না কেন, আল্লাহ তা কবুল করবেন না।
(۱۰۰)
وَعَنْ أَبِي بُرْدَةَ الْأَسْلَمِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ،
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تَزُولُ قَدَمَا عَبْدِ يَوْمَ القِيَامَةِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ: عَنْ عُمُرِهِ فِيْمَا أَفْنَاهُ، وَعَنْ عِلْمِهِ فِيْمَا فَعَلَ، وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكتَسَبَهُ، وَفِيْمَا أَنْفَقَهُ، وَعَنْ حِسْمِهِ فِيْمَا أَبْلَاهُ
(ترمذي)
(১০০) “হযরত আবু বোরদাতা আসলামী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর নবী ইরশাদ করেছেন যে, কিয়ামতের দিন পাঁচটি বিষয়ের হিসাব দান ব্যতীত কাউকে পা নাড়তে দেয়া হবে না। মানুষকে তার হায়াত (জীবন) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে কিভাবে তা ব্যয় করেছে। আর ইলমকে কি কাজে লাগিয়েছে এবং তার সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে ও কোন পথে ব্যয় করেছে। আর তার শরীর-স্বাস্থ্যকে সে কি কাজে লাগিয়েছে।” (তিরমিযি)
ব্যাখ্যা: ইসলাম তার অনুসারীদেরকে অর্থোপার্জনের যাবতীয় অন্যায় ও গর্হিত পন্থা পরিত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে, যেমন চুরি-ডাকাতি, ধোঁকা-প্রতারণা, সুদ-ঘুষ ও জোর-জবরদস্তীর মাধ্যমে উপার্জন। অনুরূপভাবে ব্যয় নির্বাহের ব্যাপারেও মানুষকে খোলা হাতে ছেড়ে দেয়া হয়নি। বরং সেখানেও হালাল হারামের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।
বর্ণিত হাদীসটিতে আল্লাহর নবী মুসলমানদেরকে তার রোযী-রোযগার ও ব্যয় নির্বাহের ব্যাপারে সাবধান করতে গিয়ে বলেছেন যে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দাহকে যে পাঁচটি বিষয়ে জওয়াবদিহি করতে হবে তার মধ্যে একটি হলো তার সম্পদ। অর্থাৎ সে তার সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে এবং কোন পথে ব্যয় করেছে।
(۱۰۱)
وَعَنِ مِقْدَامِ بْنِ مَعْدِيُكَرِب رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ، وَإِنَّ نبيَّ اللَّهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلَامُ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِيهِ
(بخاري)
(১০১) “হযরত মেকদাম ইবনে মায়াদী কারেব (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (স:) বলেছেন, মানুষের খাদ্যের মধ্যে সেই খাদ্যই সবচেয়ে উত্তম যে খাদ্যের ব্যবস্থা সে নিজ হস্তে উপার্জিত সম্পদ দ্বারা করে। আর আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত দাউদ (আঃ) আপন হাতের কামাই হতে খাদ্য গ্রহণ করতেন। (বুখারী)
ব্যাখ্য: হাতের কামাই ও কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে যারা অন্ন সংগ্রহ করে, তাদের সংগ্রহীত অনুকে হযুর (স:) সর্বোৎকৃষ্ট অন্ন বলে আখ্যায়িত করেছেন। এবং এ ব্যাপারে হুযুর হযরত দাউদের (আ:) দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। কেননা হযরত দাউদ (আ:) বিরাট সাম্রাজ্যের শাসক হওয়া সত্ত্বেও এক কপর্দকও রাজকোষ হতে নিজের জন্যে গ্রহণ করতেন না বরং নিজ হস্তে লৌহাস্ত্র ইত্যাদি তৈরী করে তার বিক্রয়লব্ধ অর্থ দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন।
আলোচ্য হাদীসটিতে নবী করীম (স:) মুসলমানদেরকে পরিশ্রমী ও উপার্জনশীল হওয়ার জন্যে উৎসাহ দান করেছেন। মুসলমান অন্যের দয়ায় জীবিকা নির্বাহ করুক, কিংবা ভিক্ষাবৃত্তি করুক তা ঠিক নয়। হুযুর স্বয়ং বলেছেন الْكَاسِبُ حَبِيْبُ الله “উপার্জনশীল ব্যক্তি আল্লাহর বন্ধু।”
(۱۰۲)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يُبَالِي الْمَرْءُ مَا أَخَذَ مِنْهُ أَمِنَ الْحَلَالِ أَمْ مِنَ الْحَرَامِ (بخاري)
(১০২) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (স:) বলেছেন, মানব জাতির কাছে এমন একটি যামানা আসবে, যখন মানুষ কামাই-রোযগারের ব্যাপারে হালাল-হারামের কোন পরওয়া করবে না।” (বুখারী)
হারাম খাদ্যে প্রতিপালিত শরীর জাহান্নামী হবে
(۱۰۳)
عَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ السُّحْتِ وَكُلُّ لَحْمٍ نَبَتَ مِنَ السُّحْتِ كَانَتِ النَّارُ أَوْلَى بِهِ
أحمد – دارمي – بيهقي)
(১০৩) “হযরত জাবির (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (স:)
বলেছেন, যে গোস্ত হারাম খাদ্যে প্রতিপালিত হয়েছে, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর হারাম খাদ্যে বর্ধিত প্রতিটি গোস্তপিন্ড জাহান্নামেরই যোগ্য।” (আহমদ, দারেমী, বায়হাকী)
অধ্যায়: ৪ মোয়ামালাত
ব্যবসা বাণিজ্য (তেজারত)
(١٠٤) وَعَنْ رَافِعِ بْنِ خَدِيجٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قِيلَ يَا رَسُولَ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ الْكَسْبِ أَطْيَبُ قَالَ عَمَلُ الرَّجُلِ بَيَدِهِ وَكُلُّ بَيْعٍ مَبْرُورٍ (مسند أحمد)
(১০৪) “হযরত রাফে ইবনে খাদিজ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা হুযুরকে (স:) জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর নবী, (মানুষের) যাবতীয় উপার্জনের মধ্যে কোনটি সবচেয়ে পবিত্র? হুযুর (স:) বললেন, মানুষ নিজ হাতে যা কামাই করে এবং হালাল ব্যবসার মাধ্যমে যা উপার্জন করে। (আহমদ)
ব্যাখ্যা: ইসলাম তার অনুসারীদেরকে ধন উপার্জনের অবাধ অধিকার দান করেনি। বরং জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিতে উপার্জনের পন্থা ও উপায়সমূহের উপর হালাল হারামের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। জুয়া-ছাট্টা, ধোঁকা-প্রতারণা, সুদ-ঘুষ, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি অসংখ্য হারাম পথে যেমন ধনোপার্জন সম্ভব, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরী-বাকরী, শ্রম-সাধনা, ধার-কর্জ, দান-দক্ষিণা ইত্যাদি অসংখ্য হালাল পথেও ধনোপার্জন সম্ভব।
হালাল উপার্জনের যতগুলো পন্থা আছে, তন্মধ্যে হুযুর (স:) শ্রমলব্ধ ও ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত আয়কে সর্বোত্তম বলে আখ্যায়িত করেছেন।
(١٠٥) وَعَنْ أَبِي سَعِيدِ الْخُدْرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : التَّاجِرُ الصَّدُوقُ الأَمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
(ترمذي)
(১০৫) “হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (স:) বলেছেন, সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দীক এবং শহীদানদের সাথে থাকবে।” (তিরমিযি)
ব্যাখ্যা: যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে ব্যবসা একটি দুনিয়াদারী কাজ। কিন্তু কোন একজন মুসলমান যখন মিথ্যা ও খেয়ানতের আশ্রয় না নিয়ে পূর্ণ সততা সহকারে সৎ উদ্দেশ্যে ব্যবসা করে, তখন তার এ ব্যবসা একটি পবিত্র ইবাদাতে পরিণত হয়। যার ফলে সে কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দীক ও শহীদানের মত মর্যাদাশীল লোকদের সাথে অবস্থান করবে।
ব্যবসায় মিথ্যা শপথ
(١٠٦) وَعَنْ أَبِي ذَرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ، قَالَ أَبُو ذَرِّ : خَابُوا وَخَسِرُوا مَنْ هُمْ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: المسيلُ وَالْمَنَّانُ وَالْمُنْفِقُ سِلْعَتَهُ بِالْحِلْفِ الْكَذِبِ
(مسلم)
(১০৬) “হযরত আবু যার গিফারী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (স:) বলেছেন, তিন ধরণের লোকের সাথে কিয়ামতের দিন আল্লাহ কোন কথা বলবেন না, তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না এবং তাদেরকে গুনাহ হতে পবিত্রও করবেন না। আর তাদেরকে অত্যন্ত বেদনাদায়ক শাস্তি দেয়া হবে। আবু যার (রা:) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল, এই বিফল মনোরথ হতভাগা ও বিপর্যয় নিপতিত লোকগুলো কারা? হুযুর (স:) বললেন, যারা গর্বভরে পরিধানের বস্ত্র পায়ের গোড়ালীর নীচে ঝুলিয়ে দেয়, যারা দান করে খোঁটা দেয় এবং যারা মিথ্যা শপথ দ্বারা পণ্য বস্তুর কাটতি বাড়ায়। (মুসলিম)
ব্যাখ্যা: “মুসবিল” বলা হয় সেই ব্যক্তিকে যে গর্বভরে পরিধানের বস্ত্র পায়ের গোড়ালীর নীচ পর্যন্ত ঝুলিয়ে দেয়। সাধারণত রাজা-বাদশাহ, গোত্র সরদার, সামন্তরাজ ইত্যাদি ধনবান ও প্রভাবশালী লোকেরা সে যুগে মাটি পর্যন্ত ঝুলিয়ে কাপড় পরিধান করত। আর এটা ছিল অহংকারের লক্ষণ। আর অহংকার হলো শরীয়তের দৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর দোষণীয়। হুযুর (স:) বলেছেন, যার অন্তরে বিন্দুমাত্র অহংকার থাকবে সে কিছুতেই আল্লাহর বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। “মান্নান” বলা হয় সেই ব্যক্তিকে যে দান করার পর সময় সুযোগ বুঝে দান গ্রহীতাকে খোঁটা দেয়। ইসলাম ও মানবতা উভয়ের দৃষ্টিতে এটি একটি জঘন্যতম অপরাধ। প্রকৃতপক্ষে ধনবান ব্যক্তি যাকাত সদকা কিংবা দান খয়রাত দ্বারা দান গ্রহীতার প্রতি কোন অনুগ্রহ করেছে না। বরং তার সম্পদের মধ্যে দরিদ্র ব্যক্তির যে হিচ্ছা আছে, তাই পরিশোধ করছে মাত্র। সুতরাং এ ক্ষেত্রে দান গ্রহীতাকে খোঁটা দেয়ার নূন্যতম সুযোগও নেই বরং সে যে হকদারের হক যথাযথ আদায় করতে পেরেছে, এ জন্যে আল্লাহর শোকর আদায় করা উচিত।
হাদীসে উল্লেখিত তৃতীয় হতভাগ্য ব্যক্তি হলো সেই ব্যবসায়ী যে খরিদ্দারকে ধোঁকা দেয়ার জন্য মিথ্যা শপথের মাধ্যমে মালের কাটতি বাড়ায়।
উপরোক্ত তিন ধরণের লোকের সাথে আল্লাহর কথা না বলা, কিংবা দৃষ্টি না করার অর্থ হলো, কিয়ামতের দিন আল্লাহ এই তিন ধরণের লোকের প্রতি ভয়ংকর অসন্তুষ্ট থাকবেন।
(۱۰۷)
وَعَنْ أَبِي قَتَادَةَ الْأَنْصَارِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِيَّاكُمْ وَكَثْرَةً الْحَلِفِ فِي الْبَيْعِ فَإِنَّهُ يُنَفِّقُ ثُمَّ يَمْحَقُ (مسلم)
(১০৭) “হযরত আবু কাতাদাতা আনসারী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (স:) বলেছেন, তোমরা বেচা-কেনায় অবিরাম কসম করা থেকে বেচে থাক। এটা সাময়িক (ব্যবসায়) সুফল দিলেও পরিণামে ক্ষতি সাধন করে।” (মুসলিম)
পরিণামে কম বেশী করা
(۱۰۸)
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَأَصْحَابِ الْمِكْيَالِ وَالْمِيزَانِ: إِنَّكُمْ قَدْ وَلَّيْتُمْ أَمْرَيْنِ هَلَكَتْ فِيهِمَا الْأُمَمُ السَّابِقَةُ قَبْلَكُمْ (ترمذي)
(১০৮) “হযরত আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে সমস্ত ব্যবসায়ীরা পরিমাণকৃত বস্তুর ব্যবসা করে, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে হুযুর (স:) বললেন, তোমরা এমন দুটি কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেছ যার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী কয়েকটি জাতি ধ্বংস হয়েছিল।”
(তিরমিযী)
ব্যাখ্যা: ব্যবসায়ী পণ্যের মধ্যে বহু পণ্য এমনও আছে, যার বেচা-কেনা পরিমাণের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সমাজে কিছু সংখ্যক অসৎ ব্যবসায়ী দেখা যায়, যারা খরিদ করার সময় পরিমাণে বেশী গ্রহণ করে। আবার বিক্রির সময় প্রতারণা করে ওজনে কম দেয়। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটা একটি মারাত্মক পাপ। পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় আল্লাহ এ পাপ সম্পর্কে মানব জাতিকে সাবধান করে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِينَ الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ، وَإِذَا كَالُوهُمْ أَوْ وَزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ
(سورة التطفيف : (١-٣)
অর্থ: পরিতাপ সে সকল পরিমাণকারীদের জন্যে, যারা লোকের কাছ থেকে পরিমাণে পুরোপুরিই গ্রহণ করে। কিন্তু তাদেরকে দেয়ার বেলায় পরিমাণে কম দেয়।” (সূরা তাতফীফ: ১-৩)
কোরআন মজীদের আর এক জায়গায় উল্লেখ রয়েছে,
وَالسَّمَاءَ رَفَعَهَا وَوَضَعَ الْمِيزَانَ، أَلَا تَطْغَوْا فِي الْمِيزَانِ، وَأَقِيمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلَا تُخْسِرُوا الْمِيزَانَ (سورة الرحمن (۹۷)
অর্থ: আর সেই মহান আল্লাহ-ই আকাশকে উন্নত করেছেন এবং পরিমাণ যন্ত্রের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে করে তোমরা পরিমাণে কম-বেশী না কর। আর ইনসাফের সাথে পরিমাণ কর, এবং তোমরা পরিমাণে কম দিও না। (সূরা আর রহমান: ৭-৯)
হযরত শোয়ায়েবকে (আ:) আল্লাহ তায়ালা নবী হিসেবে এমন একটি জাতির কাছে প্রেরণ করেছিলেন, যারা ছিল ব্যবসায়ী এবং পরিমাণে কম-বেশী করার পাপ তাদের মধ্যে সংক্রামক ব্যধির ন্যায় প্রসারিত হয়েছিল। আল্লাহ হযরত শোয়ায়েবের জবানে নিম্নলিখিত মর্মে তাদেরকে সাবধান করে দিয়েছিলেন,
قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهِ غَيْرُهُ وَلَا تَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ إِنِّي أَرَاكُمْ بِخَيْرٍ وَإِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ مُحِيطِ، وَيَا قَوْمِ أَوْفُوْا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ
(سورة الهود : ٨٤ – ٨٥)
অর্থ: “আর শোয়ায়েব (আ:) বললেন, হে আমার স্বজাতি, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কবুল করে তার ইবাদাত কর। একমাত্র তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন মাবুদ নেই। তোমরা পরিমাণে কম করো না। আমি তো তোমাদেরকে স্বচ্ছল অবস্থায় দেখছি, আর আমি তোমাদের জন্যে এক ভয়াবহ দিনের শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করছি। হে আমার স্বজাতি, ইনসাফ সহকারে পরিমাপ ও পরিমান কর এবং লোককে তাদের জিনিস কম করে দিও না, আর আল্লাহর জমিনে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে সীমা লংঘন করোনা।”
(সূরা হুদ: ৮৪-৮৫)
হযরত শোয়ায়েবের (আ:) উপরোক্ত সাবধান বাণী সত্ত্বেও মাদায়েনের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়েরা এ পাপ কার্য হতে বিরত হলো না। ফলে আসমানী গযব তাদেরকে একেবারেই ধ্বংস করে দিয়েছিলো। বর্ণিত হাদীসটিতে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) নিজ উম্মতকে এ ভয়াবহ পাপ হতে পরহিজ করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন।
ব্যবসায় খেয়ানত
(۱۰۹)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ أَنَا ثَالِثُ الشَّرِيكَيْنِ مَالَمْ يَخُنْ أَحَدُهُمَا صَاحِبَهُ فَإِذَا خَانَهُ خَرَجْتُ مِنْ بَيْنِهِمَا ، وَفِي رِوَايَةٍ وَجَاءَ الشَّيْطَانُ
(أبو داود)
(১০৯) “হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (স:) বলেছেন, আল্লাহ স্বয়ং বলেন, কারবারের দুই অংশীদারের কোন একজন যে পর্যন্ত খেয়ানতে লিপ্ত না হয় সে পর্যন্ত আমি তাদের সাথেই অবস্থান করি। কিন্তু তাদের কেউ যখন খেয়ানত শুরু করে, তখন আমি তাদেরকে পরিত্যাগ করি। (অন্য এক বর্ণনা মতে) তখন তাদের মাঝখানে শয়তান এসে যায়।”
(আবু দাউদ)
ব্যাখ্যা: উপরোক্ত হাদীসটির মর্ম এই যে, ব্যবসার অংশীদারেরা পরস্পর যতদিন ঈমানদারীর সাথে ব্যবসা করে এবং একে অপরকে না ঠকায় ততদিন আল্লাহ তাদের ব্যবসায় বরকত দান করেন। কিন্তু. যখন এক অংশীদার অন্য অংশীদারের সাথে খেয়ানত শুরু করে, তখন শয়তানের অবির্ভাব ঘটে এবং বরকত চলে যায়। পরিণামে তাদের ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যায়।
মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে জরুরী পণ্য গুদামজাত করে রাখা
(۱۱۰)
وَعَنْ مُعَادٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ بِئْسَ الْعَبْدُ الْمُحْتَكِرُ إِنْ إِرْخَصَ اللَّهُ الْأَسْعَارَ حَزِنَ وَإِنْ أَعْلَاهَا فَرِحَ
(مشكوة)
(১১০) “হযরত মুয়ায (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলকে (স:) বলতে শুনেছি যে, বড়ই অভিশপ্ত সেই ব্যক্তি যে মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পণ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখে। অতঃপর আল্লাহ যদি পণ্য সস্তা করে দেয়, তাহলে সে চিন্তিত হয়। আর যদি মূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে আনন্দিত হয়।” (মিশকাত)
(۱۱۱)
وَعَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ مَنِ احْتَكَرَ عَلَى الْمُسْلِمِينَ طَعَامَهُمْ ضَرَبَهُ اللَّهُ بِالْجُذَامِ وَالإِفلاس (ابن ماجه، بيهقي)
(১১১) “হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর নবীকে একথা বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি খাদ্য দ্রব্য গুদামজাত করে রেখে অতিরিক্ত মূল্যে মুসলমানদের হাতে বিক্রি করে, আল্লাহ তাঁকে দরিদ্রতা ও জুযাম নামক ব্যাধি দ্বারা শায়েস্তা করেন।” (ইবনে মাযাহ, বায়হাকী)
ঋণদান ও অভাবী ঋণগ্রস্তকে অবকাশ দেয়া
(۱۱۲)
وَعَنْ أَبِي قَتَادَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُنْجِيَهُ اللَّهُ مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلْيُنَفِّسَ عَنْ مُعْسِرٍ أَوْ يَضَعْ عَنْهُ
(مسلم)
(১১২) “হযরত আবু কাতাদাতা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিনের দুঃখ কষ্ট হতে বাঁচতে চায়, সে যেন দরিদ্র ঋণ গ্রহীতাকে অবকাশ দেয় অথবা তার ঋণ মাফ করে দেয়।” (মুসলীম)
ব্যাখ্যা: ইসলাম তার অনুসারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছে যে, অভাবী লোককে প্রয়োজনবোধে কোন রকম স্বার্থ ছাড়াই ঋণ দিবে এবং ঋণ গ্রহীতা যদি সংকীর্ণ হস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তাকে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে অবকাশ দিবে। আর সে যদি একান্ত অপারগ হয় তাহলে তাকে ঋণ হতে অব্যহতি দিবে। এ সম্পর্কে কোরআনে নিম্নরূপ নির্দেশ দান করা হয়েছে:
وَإِنْ كَانَ ذُو عُسْرَةٍ فَنَظِرَةٌ إِلَى مَيْسَرَةٍ وَأَنْ تَصَدَّقُوْا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ (سورة البقرة : ۲۸۰)
অর্থ: আর ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি যদি অভাবী হয়, তাহলে তাকে স্বচ্ছল হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দিবে। আর যদি তাকে মাফ করে দাও, তাহলে সেটা তোমাদের জন্যে অশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা জানতে। (বুদ্ধি থাকলে তা তোমরা অনুধাবন করতে পারবে)
(সূরা আল বাকারা: ২৮০)
(۱۱۳)
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ كَانَ الرَّجُلُ يُدَايِنُ النَّاسَ فَكَانَ يَقُولُ لِفَتَاهُ إِذَا أَتَيْتَ مُعْسِيرًا تَجَاوَزْ عَنْهُ لَعَلَّ اللَّهُ أَنْ يَتَجَاوَزَ قَالَ فَلَقِيَ اللَّهَ
فَتَجَاوَزَ عَنْهُ (بخاري – مسلم)
(১১৩) “নবী করীম (স:) বলেছেন, এক ব্যক্তি সাধারণত: লোককে ঋণ দিত। অতঃপর সে তার কর্মচারীকে বলে দিত যে, তুমি (ঋণ আদায়ের ব্যাপারে) যখন কোন দুর্দশাগ্রস্থ ঋণ গ্রহীতার কাছে যাবে, তখন তাকে ঋণ হতে অব্যহতি দিবে। হতে পারে এর কারণে আল্লাহ আমাকেও (আমার গুনাহ হতে) অব্যাহতি দিবেন। হুযুর (স:) বলেন, অত:পর যখন সে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করেছিলো, আল্লাহ তখন তাকে মাফ করে দিয়েছিলেন।”
(বুখারী মুসলীম)
ঋণ পরিশোধের গুরুত্ব
(١١٤) وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: أُتِيَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِجَنَازَةٍ لَيُصَلِّي عَلَيْهَا فَقَالَ هَلْ عَلَى صَاحِيكُمْ دَيْنٌ؟ قَالُوا : نَعَمْ، هَلْ تَرَكَ
لَهُ مِنْ وَفَاءِ؟ قَالُوا : لَا ، قَالَ: صَلُّوا عَلَى صَاحِيكُمْ، قَالَ عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: عَلَى دَيْنُهُ يَا رَسُولَ اللَّهِ ، فَتَقَدَّمَ فَصَلَّى عَلَيْهِ (شرح السنة)
(১১৪) “হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নবী করীমের (স:) খেদমতে এক মৃত ব্যক্তিকে হাযির করা হলো। উদ্দেশ্য হলো নবী করীম (স:) তার নামাযে জানাযা আদায় করবেন। হুযুর (স:) জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের এ সঙ্গীর কাছে কারো কোন কর্জ আছে কি? লোকেরা বললো, হাঁ। হুযুর (স:) বললেন কর্য পরিশোধ করার মত কোন সম্পদ কি সে রেখে গিয়েছে? লোকেরা বললো না, হুযুর (স:) বললেন, তাহলে তোমরা তোমাদের সঙ্গীর জানাযা আদায় কর। (আমি পড়ব না) হযরত আলী ইবনে আবু তালিব বললেন, হে আল্লাহর নবী, (স:) আমি এর দেনা পরিশোধের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। অত:পর হুযুর (স:) অগ্রসর হয়ে তার নামাযে জানাযা আদায় করলেন।” (শরহে সুন্নাহ)
(١١٥) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: يُغْفَرُ لِلشَّهِيدِ كُلُّ ذَنْبٍ إِلَّا الدَّيْنَ (مسلم)
(১১৫) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, আল্লাহ একমাত্র দেনা ব্যতীত শহীদের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দিবেন।” (মুসলিম)
ব্যাখ্যা: উপরোক্ত দুটি হাদীসেই কর্জ আদায়ের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সুতরাং যারা দেনা পরিশোধের ক্ষমতা রাখে তাদের উচিত ওয়াদা মোতাবেক দেনা পরিশোধ করা। কেননা কর্য হলো বান্দার হক আর তা সে বান্দাহই মাফ করতে পারে যিনি কর্জ দিয়েছেন। এমন কি যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাতের মৃত্যুবরণ করেছেন তার যাবতীয় গুনাহ মাফ করা সত্ত্বেও আল্লাহ কর্জের গুনাহ মাফ করবেন না, যে পর্যন্ত ঋণদাতা ব্যক্তি তা মাফ করে না দেয়।
তবে কেউ যদি প্রাণান্ত চেষ্টা করেও অভাবের তাড়নায় ঋণ পরিশোধ করতে না পারে, তাহলে আশা করা যায় ঋণদাতা দ্বারা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে মাফ করিয়ে দিবেন।
ঋণ পরিশোধের নিয়ত পোষণকারীকে আল্লাহ সাহায্য করেন
(١١٦) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ أَخَذَ أَمْوَالَ النَّاسِ يُرِيدُ أَدَاءَهَا أَدَّى اللَّهُ عَنْهُ، وَمَنْ أَخَذَ يُرِيدُ إِخْلَافَهَا أَتْلَفَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ (بخاري)
(১১৬) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:)
বলেছেন, যে ব্যক্তি পরিশোধ করার ইচ্ছা নিয়ে কারো কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে আল্লাহ তার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন। (অর্থাৎ আল্লাহ ঋণ গ্রহীতার অন্তর্নিহিত নেক নিয়তের কারণে তাকে এমন স্বচ্ছলতা দান করেন, যার ফলে সে ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়।) আর যে আত্মসাৎ করার মনোভাব নিয়ে কারো কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে আল্লাহ তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করেন। (অর্থাৎ তার অন্তরের কুটিলতার কারণে আল্লাহ তাকে অর্থ কষ্টে নিপতিত করেন, ফলে সে তার ঋণ তো পরিশোধ করতে পারেই না উপরন্তু তার দুনিয়া আখেরাত সবই বরবাদ হয়।)” (বুখারী)
জবরদস্তী জমীনের সীমানা ভাঙ্গা
(۱۱۷)
وَعَنْ سَعِيدِ بْنِ زَيْدِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ أَخَذَ شَيْرًا مِنَ الْأَرْضِ ظُلْمًا فَإِنَّهُ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ سَبْعِ أَرَضِينَ
(بخاري – مسلم)
(১১৭) “হযরত আবু সাঈদ ইবনে যায়েদ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি
বলেন, নবী করীম (স:) বলেছেন, যদি কেউ কারো এক বিঘাত পরিমাণ জমিও জবরদস্তী দখল করে, তাহলে আল্লাহ কিয়ামতের দিন সপ্ত জমীনের হাসুলী তার গলদেশে ঝুলিয়ে দিবেন।”
(বুখারী, মুসলিম)
(۱۱۸)
وَعَنْ يَعْلَى بْنِ مُرَّةٍ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ أَخَذَ أَرْضًا بِغَيْرِ حَقَّهَا كُلِّفَ أَنْ يَحْمِلَ تُرَابَهَا إِلَى الْمَحْشَرَ (أحمد)
(১১৮) “হযরত ইয়ালা ইবনে মোররাহ্ (রা:) বলেন, আমি রসূলকে
(স:) বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি না হক কারও জমি দখল করে নিবে, কিয়ামতের দিন উক্ত জমির সমস্ত মাটি তার মাথায় তুলে দেয়া হবে।” (আহমদ)
মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির মালিক হবে তার উত্তারাধিকারীরা
(۱۱۹)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أَنَا أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ، فَمَنْ تُوُفِّيَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَيْهِ دَيْنٌ وَلَمْ يُتْرَكْ وَجَاءٌ فَعَلَيَّ قَضَاؤُهُ ، وَمَنْ تَرَكَ مَالاً فَلِوَرِثِهِ (بخاري – مسلم)
(১১৯) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) বলেন, নবী করীম (স:) বলেছেন, আমি মুমিনদের কাছে তার জান হতেও প্রিয়। সুতরাং কোন মুমিন ব্যক্তি যদি দেনা রেখে মৃত্যুবরণ করে, আর তা পরিশোধ করার মত কোন সম্পদ না রেখে যায়, তাহলে তা পরিশোধ করার দায়িত্ব হবে আমার। কিন্তু সে যদি কোন সম্পদ রেখে যায় তার মালিক হবে তার উত্তরাধিকারীরা।”
(বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: ইসলামী বিধান মোতাবেক মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ হতে তার দাফন-কাফন অসীয়ত পূর্ণ করার পর, বাকী স্থাবর ও অস্থাবর সকল সম্পদ তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন করে দিতে হবে। উক্ত বন্টন পদ্ধতি কুরআন ও হাদীসে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে।
আর মৃত ব্যক্তি যদি আদৌ কোন সম্পদ না রেখে যায়। বরং কারও দেনা থাকে, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান হিসেবেই রসূল একথা ঘোষণা করেছেন যে, মৃত মুমিন ব্যক্তির দেনা পরিশোধের মত কোন সম্পদ যদি না থাকে তাহলে আমিই “বায়তুল মাল” হতে তা পরিশোধ করে দিব।
মীরাছ হতে বঞ্চিত করার অভিশাপ
(۱۲۰)
وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ قَطَعَ مِيْرَاثَ وَارِثِهِ، قَطَعَ اللَّهُ مِيرَاثَهُ مِنَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ (ابن ماجة)
(১২০) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি ওয়ারেছকে তার মীরাছ হতে বঞ্চিত করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে বেহেশতের মীরাছ হতে বঞ্চিত করবে।” (ইবনে মাযাহ)
(۱۲۱)
وَعَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا اسْتَهَلَّ الصَّبِيُّ، صَلِّيَ عَلَيْهِ وَوُرِّتَ (ابن ماجة – دارمي)
(১২১) “হযরত জাবির (রা:) বলেন, রসূল (স:) বলেছেন, যদি বাচ্চা ভূমিষ্টের পর কেঁদে ওঠে। অতঃপর মরে যায় তাহলে তার জানাযার নামায আদায় করতে হবে এবং সে ওয়ারেছও (উত্তরাধিকারী) হবে।” (ইবনে মাযাহ, দারেমী)
(۱۲۲)
وَعَنْ أَسَامَةَ بْنِ زَيْدِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ، وَلَا الْكَافِرُ الْمُسْلِمَ (بخاري – مسلم)
(১২২) “হযরত উসামাহ ইবনে যায়েদ (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, মুসলমান কাফেরের উত্তরাধিকারী হবে না এবং কোন কাফেরও মুসলমানের উত্তরাধিকারী হবে না।”
(বুখারী, মুসলীম)
ব্যাখ্যা: কোন মুসলমান পিতার সন্তান যদি অন্য ধর্ম গ্রহণ করে দ্বীন ইসলাম ত্যাগ করে, তাহলে সে তার মৃত মুসলমান পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে না। অনুরূপভাবে কোন অমুসলমান পিতার সন্তান যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে সেও তার অমুসলিম পিতার সম্পত্তির অংশীদার হবে না।
(۱۲۳)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْقَاتِلُ لَا يَرِثُ
(ترمذي – ابن ماجة)
(১২৩) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হবে না।” (তিরমিযী, ইবনে মাযাহ)
অছিয়তের গুরুত্ব
(١٢٤) وَعَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ مَاتَ عَلَى وَصِيَّةٍ مَاتَ عَلَى سَبِيلٍ وَسُنَّةٍ، وَمَاتَ عَلَى تُقِّى وَشَهَادَةٍ، وَمَاتَ مَغْفُورًا لَهُ (ابن ماجه)
(১২৪) “হযরত জাবির (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি (আল্লাহর রাহে তার সম্পত্তি হতে কিছু অংশের) অছিয়ত করে মারা গেল, সে সিরাতুল মোসতাকীম ও সুন্নত তরীকার উপর মারা গেল, পরহিযগারী ও শাহাদতের উপর মারা গেল। সে এমন অবস্থায় মারা গেল যে, তার যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছে।” (ইবনে মাযাহ)
ব্যাখ্যা: প্রতিটি স্বচ্ছল মুসলমানের উচিত তার সম্পত্তি হতে কোন একটি অংশ আল্লাহর রাস্তায় অছিয়ত করা। তবে এ অছিয়তের পরিমাণ তার গোটা সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। অন্যথায় ওয়ারেছীনদেরকে বঞ্চিত করার দোষে দোষী হবে। তাছাড়া যারা শরীয়ত মোতাবেক সম্পত্তির অংশীদার তাদের জন্যও অছিয়ত জায়েয নেই।
(١٢٥) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا حَقُّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ لَهُ شَيْءٌ يُوصِي فِيهِ يَبِيتُ لَيْلَتَيْنِ إِلَّا وَوَصِيَّتُهُ مَكْتُوبَةٌ عِنْدَهُ (بخاري – مسلم)
(১২৫) “হযরত ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, যদি কোন একজন মুসলমানের লেনদেন ও সম্পর্ক ইত্যাদি ব্যাপারে অছিয়তযোগ্য কোন বস্তু থাকে, তাহলে তার উচিত, দুই রাত্রি অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে যেন সে তা লিখে রাখে।”
(বুখারী, মুসলিম)
যুলুমের পরিণাম
(١٢٦) قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَلَا لَا تَظْلِمُوا ، أَلَا لَا تَظْلِمُوا ، أَلَا لَا تَظْلِمُوا ، أَلَا لَا يَحِلُّ مَالُ امرئ إلا بطيب نَفْسٍ مِنْهُ
(بيهقي)
(১২৬) রসূল (স:) ইরশাদ করেছেন, সাবধান তোমরা যুলুম করবে না। সাবধান তোমরা জুলুম করবে না। সাবধান সন্তুষ্ট চিত্তে এজাযত দান ব্যতীত কারো মাল কারো জন্যে হালাল হবে না।” (বায়হাকী)
(۱۲۷)
وَعَنْ أَوْسِ بْنِ شُرَحْبِيْلَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: مَنْ مَشَى مَعَ ظَالِمٍ لِيُقَوِيَهُ وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهُ ظَالِمٌ فَقَدْ خَرَجَ مِنَ الْإِسْلَامِ
(بيهقي)
(১২৭) “হযরত আওস ইবনে সুরাহবীল (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি নবী করীমকে (স:) বলতে শুনেছেন যে ব্যক্তি যালিমকে যালিম বলে জানা সত্ত্বেও তাকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হবে, সে ইসলাম হতে বের হয়ে যাবে।” (বায়হাকী)
ব্যাখ্যা: যালিমকে বাধা দান এবং মযলুমকে সাহায্য করা হলো মুসলমানদের পবিত্র দায়িত্ব। উক্ত দায়িত্ব পালন না করে বরং যে এর বিপরীত করে, অর্থাৎ মযলুমের কোন সাহায্য না করে যালেমেরই সাহায্য করে, সে ইসলামের নিয়ামত হতে বঞ্চিত হবে।
ঘুষের পরিণাম
(۱۲۸)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قال ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الرَّاشِي وَالْمُرْتَشِي (بخاري – مسلم)
(১২৮) “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, ঘুষ গ্রহণকারী এবং ঘুষ প্রদানকারী উভয়ের উপরই আল্লাহর লা’নত। (বুখারী, মুসলিম)
মুজরী পরিশোধের বিলম্ব না করা
(۱۲۹)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَعْطُوا الأَجِيرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَجِفَّ عَرَقُهُ (ابن ماجه)
(১২৯) “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (র:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, তোমরা মজুরের শরীরের ঘাম শুকাবার আগেই তার মজুরী দিয়ে দিবে।” (ইবনে মাযাহ)
ব্যাখ্যা: যারা দিন মজুরী করে পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে, তাদের মজুরী কাজ সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই দিয়ে দেয়া উচিত। যাতে করে তাদের বাচ্চা-কাচ্চা ও পরিবারের লোকের উপবাস করতে না হয়। হাদীসে দিন মজুরের মজুরী দানে টালবাহানা করা কিংবা বিলম্ব করাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
(۱۳۰)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ اللَّهُ تَعَالَى ثَلَاثَةٌ أَنَا خَصْمُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ أَعْطَى بِي ثُمَّ غَدَرَ وَرَجُلٌ بَاعَ حُرًّا فَأَكَلَ تُمَنَهُ، وَرَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أَجِيرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِ أَجْرَهُ (بخاري)
(১৩০) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির সাথে আমার ঝগড়া হবে। প্রথম ঐ ব্যক্তি যে আমার নামে কোন চুক্তি করে তা ভঙ্গ করেছে। দ্বিতীয় সেই ব্যক্তি যে কোন মুক্ত মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করেছে। আর তৃতীয় ব্যক্তি হলো সেই, যে মজুরের দ্বারা কাজতো পুরোপুরি করিয়ে নিয়েছে, কিন্তু তার পারিশ্রমিক দেয় নাই। (বুখারী)
অধ্যায়: ৫ সামাজিক সম্পর্ক
বিবাহ
وَأَنْكِحُوا الْأَيَامَى مِنْكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ إِنْ يَكُونُوا فُقَرَاءَ يُغْنِهِمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (سورة النور : ۲۲)
অর্থ: “তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত তাদের বিবাহ দিয়ে দাও। আর তোমাদের চাকর-চাকরাণীর মধ্যে যারা সৎকর্মশীল তাদেরও। যদি তারা অভাবী হয়, তাহলে আল্লাহ্ স্বীয় অনুগ্রহে অভাবমুক্ত করে দিবেন। আল্লাহ উদারহস্ত ও সর্বজ্ঞানী।” (সূরা নূর: ৩২)
(۱۳۱)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجُ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ (بخاري – مسلم)
(১৩১) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন, একদা নবী করীম (স:) (যুবকদের লক্ষ্য করে) বললেন, হে নওজোয়ানেরা, তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহের দায়িত্ব পালন করার যোগ্যতা রাখে, তাদের উচিত বিবাহ করা। কেননা বিবাহ দৃষ্টিকে সংযত করে এবং লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। আর যে বিবাহের দায়িত্ব পালন করার যোগ্যতা রাখে না, তার উচিত (কামভাব দমনের জন্য) রোযা রাখা। কেননা রোযা কাম-ভাব দমন করে।” (বুখারী, মুসলিম)
দ্বীনদার পাত্রীর প্রাধান্য
(۱۳۲)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: تُنْكَحُ الْمَرْأَةُ لأَرْبَعِ لِمَالِهَا وَلِحَسَبِهَا وَلِجَمَالِهَا وَلِدِينِهَا، فَاغْفِرْ بِذَاتِ الدِّينِ تَرِبَتْ يَدَاكَ (بخاري، مسلم)
(১৩২) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:)
বলেছেন, মেয়েদেরকে সাধারণত চারটি বিষয় দেখে বিয়ে করা হয়। তার সম্পদ, বংশ মর্যাদা, রূপ ও সৌন্দর্য এবং তার দ্বীনদারী দেখে। তবে তোমরা দ্বীনদার মেয়ে লাভ করার চেষ্টা কর, তোমাদের কল্যাণ হবে।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: বর্ণিত হাদীসটির মর্ম এই যে, বিয়ের ব্যাপারে সাধারণত: লোকেরা পাত্রীর ধন-সম্পদ, বংশ-মর্যাদা ও রূপ লাবণ্য দেখে থাকে। আবার কেউ পাত্রীর তাকওয়া পরহেযগারীর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। হুযুর (স:) বলেছেন, বিবাহ করতে গিয়ে তোমরা দ্বীনদার পাত্রীকে প্রাধান্য দিবে, তাহলে তোমরা দুনিয়া-আখেরাতে কল্যাণ লাভ করতে পারবে। তবে হ্যাঁ কোন পাত্রীর মধ্যে যদি দ্বীনদারীসহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোও বর্তমান থাকে, সেটা আরও উত্তম। কিন্তু কোন মুসলমানের পক্ষেই পাত্রীর তাকওয়া পরহেযগারীর খেয়াল না করে অন্য কোন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিয়ে করা তা ঠিক হবে না।
(۱۳۳)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الدُّنْيَا كُلُّهَا مَتَاعٌ، وَخَيْرُ مَتَاعِ الدُّنْيَا الْمَرْأَةِ الصَّالِحَةِ (مسلم)
(১৩৩) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, সমগ্র দুনিয়াটাই হলো সম্পদ। (অর্থাৎ দুনিয়ার যাবতীয় বস্তু সম্পদ স্বরূপ) আর দুনিয়ার যাবতীয় সম্পদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো নেককার বিবি। (মুসলিম)
(١٣٤) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا خَطَبَ إِلَيْكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَزَوِّجُوهُ إِنْ لَا تَفْعَلُوا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ كَبِيرٌ. (ترمذي)
(১৩৪) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:)
বলেছেন, যদি তোমাদের কাছে এমন কোন বরের পক্ষ হতে বিবাহের প্রস্তাব আসে, যার দ্বীনদারী ও নৈতিকতা সম্পর্কে তোমরা আস্থাবান, তাহলে তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করবে। অন্যথায় পৃথিবীতে ফেতনা ফাসাদ ও বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।” (তিরমিযি)
চরিত্রের হেফাযতের উদ্দেশ্যে বিবাহকারী যুবককে আল্লাহ সাহায্য করেন
(١٣٥) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : ثَلاثَةٌ حَقٌّ عَلَى اللَّهِ عَوْنُهُمُ
الْمُكَاتَبُ الَّذِي يُرِيدُ الأَدَاءَ، وَالنَّاكِحُ الَّذِي يُرِيدُ الْعَفَافَ وَالْمُجَاهِدُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ
(ترمذي – نسائي – ابن ماجة)
(১৩৫) “হযরত আবু হেরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:)
বলেছেন, তিন ব্যক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহ তায়ালা নিজের দায়িত্ব মনে করেন। এক ঐ খতদাতা ব্যক্তি, যে তার খতের মূল্য পরিশোধের চেষ্টা করে। দ্বিতীয় সেই বিবাহিত যুবক, যে চরিত্রের হেফাযতের উদ্দেশ্যে বিবাহ করে। তৃতীয় সেই মুজাহিদ যে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদরত।” (তিরমিযি, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ)
বিবাহের পূর্বে পাত্রী দেখার অনুমতি
(١٣٦) وَعَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا خَطَبَ أَحَدُكُمُ الْمَرْأَةَ فَإِنِ اسْتَطَاعَ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى مَا يَدْعُوهُ إِلَى نِكَاحِهَا فَلْيَفْعَلْ (أبو داود)
(১৩৬) “হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে হতে কোন ব্যক্তি যখন কোন মহিলাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করবে, সম্ভব হলে সে যেন তাকে (মহিলাকে) একবার দেখে নেয়।” (আবু দাউদ)
বিবাহের মোহর ও তার গুরুত্ব
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةٌ (سورة النساء : ٤)
অর্থ: “মেয়েদেরকে তাদের মোহর সন্তুষ্টচিত্তে আদায় করে দাও”
(সূরা নিসা: ৪)
(۱۳۷)
وَعَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَحَقُّ الشَّرُوطِ أَنْ تُوْفُوْا بِهِ مَا اسْتَحْلَلْتُمْ بِهِ الْفُرُوْجَ (بخاري – مسلم)
(১৩৭) “হযরত উকবা ইবনে আমের (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (সঃ) বলেছেন, চুক্তিসমূহের মধ্যে সেই চুক্তিই পূর্ণ করা সবচেয়ে বেশী জরুরী, যার ফলে তোমরা স্ত্রী লোকের গোপনাঙ্গকে হালাল করে নাও। (বুখারী, মুসলিম)
(۱۳۸)
وَعَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خَيْرُ الصَّدَاقِ أَيْسَرَهُ نيل الأوطار)
(১৩৮) “হযরত উব্বা ইবনে আমের (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, মোহরের মধ্যে সেই পরিমাণ মোহরই উত্তম, যা আদায় করা সহজসাধ্য।” (নায়লুল আওতার)
অলীমা অনুষ্ঠানে দরিদ্রকে দাওয়াত না দেয়া অপরাধ
(۱۳۹)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: شَرُّ الطَّعَامِ طَعَامُ الْوَلِيمَةِ يُدْعَى لَهَا الأَغْنِيَاءُ وَيُتْرَكُ الْفُقَرَاءُ، وَمَنْ تَرَكَ الدَّعْوَةَ فَقَدْ عَصَى اللَّهَ وَرَسُولَهُ (بخاري – مسلم)
(১৩৯) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:)
বলেছেন, সবচেয়ে নিকৃষ্ট খাদ্য হলো সেই অলীমা খাদ্য, যেখানে শুধু ধনীদেরকেই দাওয়াত দেয়া হয় এবং দরিদ্রদেরকে উপেক্ষা করা হয়। আর যে ব্যক্তি দাওয়াত অস্বীকার করে সে আল্লাহ ও তার রসূলের নাফরমানী করে।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: বিবাহের পর বিবাহ উপলক্ষ্যে বরের বাড়ীতে যে খানা-পিনার ব্যবস্থা করা হয়, তাকে বলা হয় অলীমা। অলীমা সুন্নত, তবে অলীমা অনুষ্ঠানে অবশ্যই দরিদ্রদেরকে দাওয়াত দিতে হবে, নতুবা তা আল্লাহ রসূলের দৃষ্টিতে অভিশপ্ত অলীমা।
পর্দার গুরুত্ব
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا
(سورة النور: ۳۱)
অর্থ: ঈমানদার মহিলাদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে, যৌনাঙ্গের হেফাযত করে এবং তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। তবে যা সাধরণত প্রকাশমান।” (সূরা নূর: ৩১)
(١٤٠) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: الْمَرْأَةَ عَوْرَةٌ، فَإِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ (ترمذي)
(১৪০) “আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, মহিলারা হলো পর্দায় থাকার বস্তু। সুতরাং তারা যখন (পর্দা উপেক্ষা করে) বাহিরে আসে, তখন শয়তান তাদেরকে (অন্য পুরুষের চোখে) সুসজ্জিত করে দেখায়।” (তিরমিযী)
ব্যাখ্যা: নারী পুরুষের স্বাধীন ও অবাধ মিলনের ফলে সমাজে নৈতিক অধঃপতনের যে মারাত্বক ব্যাধি দেখা দেয়, তা হতে মুসলিম সমাজকে হেফাযত করার মানসে আল্লাহ মহিলাদের জন্য পর্দা প্রথাকে বাধ্যতামূলক করেছেন। মহানবীর হিজরতের পরবর্তী পর্যায় মদীনা শরীফে পর্দা সম্পর্কীয় বিধান অবতীর্ণ হয়। একমাত্র মোহাররম (যাদের সাথে শরীয়ত মোতাবেক বিবাহ নিষিদ্ধ) ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে অবশিষ্ট সকলের থেকেই মহিলাদেরকে অবশ্যই পর্দা করতে হবে। বর্ণিত হাদীসটিতে হুযুর (স:) মহিলাদেরকে পর্দাহীন হয়ে বের হতে নিষেধ করেছেন। অন্যথায় সে শয়তানের খপ্পরে পতিত হতে পারে।
(١٤١) وَعَنْ جَرِيرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ نَظَرِ الْفُجَاءَةِ فَأَمَرَنِي أَنْ أَصْرِفَ بَصَرِي (مسلم)
(১৪১) “হযরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলকে (স:) এই মর্মে প্রশ্ন করেছিলাম যে, হঠাৎ যদি কোন মহিলার উপর দৃষ্টি নিপতিত হয়, তাহলে কি করতে হবে? হুযুর (স:) আমাকে নির্দেশ দিলেন যে, তুমি তোমার দৃষ্টিকে কাল বিলম্ব না করে ফিরিয়ে নিবে।” (মুসলিম)
(١٤٢) وَعَنْ أُمِّ سَلَمَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا أَنَّهَا كَانَتْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَيْمُونَةُ إِذَا أَقْبَلَ ابْنُ أُمِّ مَكْتُومٍ فَدَخَلَ عَلَيْهِ، فَقَالَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: احْتَجِبَا مِنْهُ، فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلَيْسَ هُوَ أَعْمَى، لَا يُبْصِرُنَا وَلَا يَعْرِفُنَا، فَقَالَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَفَعَمْيَاوَانِ أَنْتُمَا أَلَسْتُمَا تُبْصِرَانِهِ
(أحمد – ترمذي – أبو داود)
(১৪২) “হযরত উম্মে সালমাহ (রা:) হতে বর্ণিত, একদা তিনি এবং হযরত মায়মুনা (রা:) রসূলের (স:) নিকট বসা ছিলেন। হঠাৎ সেখানে ইবনে উম্মে মাকতুম এসে প্রবেশ করলেন। হুযুর (স:) হযরত উম্মে সালমাহ ও মায়মুনাকে (রা:) বললেন, তোমরা (আগন্তুক) লোকটি থেকে পর্দা কর। আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী, (স:) লোকটি তো অন্ধ আমাদেরকে দেখতে পাচ্ছে না। তখন রসূল (স:) বললেন, তোমরা দু’জনও কি অন্ধ যে, তাকে দেখতে পাচ্ছ না? (আহমদ, তিরমিযী, আবু দাউদ)
পারস্পরিক হুকুক (অধিকারসমূহ)
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالاً فَخُورًا (سورة النساء : ٣٦)
অর্থ: “তোমরা আল্লাহর বন্দেগী কর এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করোনা। উত্তম আচরণ কর পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয়, ইয়াতিম, মিসকিন ও প্রতিবেশীদের সাথে, উত্তম আচরণ করবে অসহায় মুসাফির ও তোমাদের চাকর-চাকরাণীদের সাথেও। অবশ্য আল্লাহ
দাম্ভিক গর্বিত লোককে পছন্দ করেন না। (সূরা নিসা: ৩৬)
পিতা-মাতার হক
(١٤٣) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: رَعْمَ أَنْفُهُ رَغِمَ أَنْفُهُ رَغِمَ أَنْفُهُ ، قِيلَ مَنْ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: مَنْ أَدْرَكَ وَالِدَيْهِ عِنْدَ الْكِبَرِ أَحَدَهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا ثُمَّ لَمْ يَدْخُلِ الْجَنَّةَ (مسلم)
(১৪৩) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, তার নাক ধূলা-মলিন হোক, তার নাক ধূলামলিন হোক।
[টিকাঃ ১. আরবি ভাষার একটি পরিভাষা। এর শাব্দিক অনুবাদ হতে তার নাক ধুলায় মলিন হোক। “আর বাংলা ভাষায় এর ভাবার্থ হবে: বড়ই হতভাগ্য সেই ব্যক্তি।”]
তার নাক ধূলামলিন হোক।’ ছাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল, সে (হতভাগ্য ব্যক্তিটি) কে? হুযুর (স:) বললেন, সে হলো সেই লোকটি, যে তার পিতা-মাতা উভয়কে অথবা কোন একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও বেহেশতে যেতে পারল না।
(মুসলিম)
ব্যাখ্যা: ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মুসলমানের নিকট আল্লাহ ও রসূলের পর তার পিতা-মাতার স্থান। কোরআন ও হাদীসে পিতা-মাতার সেবা শুশ্রুষা ও মনতুষ্টির ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়াকে (যে পর্যন্ত না তাদের আদেশ আল্লাহ ও রসূলের আদেশের বিপরীত হয়।) গুনাহে কবীরার শামিল করা হয়েছে। বর্ণিত হাদীসটিতে আল্লাহর রসূল (স:) এরশাদ করেছেন যে, যে ব্যক্তি পিতা-মাতা উভয়কে অথবা তাদের কোন একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও সেবা-শুশ্রুষার মাধ্যমে তাদেরকে সন্তুষ্ট করে বেহেশত লাভ করতে পারল না, তার মত হতভাগা ব্যক্তি আর কেউ হতে পারে না।
(١٤٤) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ أَحَقُّ بِحُسْنِ صَحَابَتِي؟ قَالَ: أُمُّكَ، قَالَ : ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ : أُمُّكَ، قَالَ ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ : أُمُّكَ، قَالَ ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: أَبُوكَ
(بخاري – مسلم)
(১৪৪) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল (স:) আমার সর্বোত্তম ব্যবহারের হকদার কে? হুযুর (স:) বললেন তোমার মা। লোকটি পুনরায় প্রশ্ন করল, অত:পর কে? হুযুর (স:) বললেন, তোমার মা। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, অত:পর কে? হুযুর (স:) (এবারও) জওয়াব দিলেন, তোমার মা। লোকটি পুন: জিজ্ঞেস করল, অত:পর কে? এবারে নবী করীম (স:) জওয়াব দিলেন তোমার বাপ।”
(বুখারী, মুসলিম)
মৃত্যুর পর সন্তানদের উপর পিতা মাতার হক
(١٤٥) وَعَنْ أَبِي أُسَيْدِنِ السَّاعِدِي رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، بَيْنَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذْ جَاءَهُ رَجُلٌ مِنْ بَنِي سَلَمَةَ ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، هَلْ بَقِيَ مِنْ بِرِّ أَبَوَيَّ شَيْءٌ أَبَرُّهُمَا بِهِ بَعْدَ مَوْتِهِمَا؟ قَالَ: نعَمْ الصَّلَاةُ عَلَيْهِمَا، وَالاسْتِغْفَارُ لَهُمَا، وَإِنْفَاذُ عَهْدِهِمَا مِنْ بَعْدِهِمَا ، وَصِلَةُ الرَّحِمِ الَّتِي لَا تُوصَلُ إِلَّا بِهِمَا ، وَإِكْرَامُ صَدِيقِهِمَا (أبو داود)
(১৪৫) “হযরত আবু উসাইদিস সায়িদী (রা:) বলেন, একদা আমরা রসূল (স:) খেদমতে বসা ছিলাম। হঠাৎ বনী সালমা গোত্রের এক ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হয়ে হুযুরকে (স:) প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রসূল (স:) পিতা-মাতার ইন্তেকালের পরেও কি তাদের কোন হক আমার উপর আছে, যা পুরণ করতে হবে? হুযুর (স:) বললেন হ্যাঁ, তাদের জন্য দোয়া ইসতেগফার করবে, তাদের কোন অসীয়ত থাকলে তা পূরণ করবে, পিতৃ ও মাতৃকুলের আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করবে এবং পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধবকে সম্মান করবে।”
(আবু দাউদ)
স্বামীর হক
(١٤٦) وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا صَلْتِ الْمَرْأَةُ خَمْسَهَا ، وَصَامَتْ شَهْرَهَا ، وَأَحْصَنَتْ فَرْجَهَا، وَأَطَاعَتْ بَعْلَهَا ، فَلْتَدْخُل مِنْ أَيِّ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ شَاءَتْ (مشكوة)
(১৪৬) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, যে
মহিলা পাঁচ ওয়াক্তের নামায (নিয়মিত) আদায় করবে, রমযানের রোযা রাখবে, নিজের ইজ্জত আবরুর হেফাযত করবে এবং স্বামীর অনুগত থাকবে। বেহেশতের যে কোন দরজা হতে প্রবেশ করার অধিকার তার থাকবে।” (মিশকাত)
ব্যাখ্যা: সাধরণভাবে মহিলাদের উপর হজ্জ ও যাকাত ফরয থাকে না, এমতাবস্থায় উক্ত পাঁচটি কাজ যদি কোন মহিলা যথাযথ আদায় করে, তাহলে তার বেহেশতী হওয়া যে অনিবার্য, হাদীসে সে কথারই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে কোন মহিলার উপর যদি যাকাত ও হজ্জ ফরয হয়, তাহলে তাকে বেহেশতী হওয়ার জন্য উপরোক্ত ফরয দুটিও আদায় করতে হবে।
(١٤٧) عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قِيلَ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ النِّسَاءِ خَيْرٌ؟ قَالَ: الَّتِي تَسُرُّهُ
إِذَا نَظَرَ، وَتُطِيعُهُ إِذَا أَمَرَ، وَلَا تُخَالِفُهُ فِي نَفْسِهَا وَمَالِهَا بِمَا يَكْرَهُ (نسائي)
(১৪৭) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, একদা রসূলকে (স:) প্রশ্ন করা হলো যে, মহিলাদের মধ্যে কোন মহিলাটি সবচেয়ে উত্তম? হুযুর (স:) বললেন, ঐ মহিলাটি, যার দিকে দৃষ্টি করে স্বামী আনন্দ পায়, যাকে কোন হুকুম করলে সে তা মান্য করে এবং স্বামীর মন মত নয় এমন কোন কাজ সে নিজের কিংবা নিজের সহায় সম্পদের ব্যাপারে করে না।” (নাসাঈ)
ঈমানদার বিবি সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদ
(١٤٨) عَنْ تَوْبَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ لَمَّا نَزَلَتِ وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي بَعْضِ أَسْفَارِهِ، فَقَالَ بَعْضُ أَصْحَابِهِ نَزَلَتْ فِي الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ. لَوْ عَلِمْنَا أَيُّ الْمَالِ خَيْرٌ فَنَتَّخِذَهُ، فَقَالَ: أَفْضَلُهُ لِسَانٌ ذَاكِرٌ وَقَلْبٌ شَاكِرٌ وَزَوْجَةٌ مُؤْمِنَةٌ تُعِينُهُ عَلَى دِينِهِ (ترمذي)
(১৪৮) “হযরত ছাওবান (রা:) বলেন, আমরা রসূল (স:) এর সাথে সফরে ছিলাম, এমতাবস্থায় নিম্নলিখিত আয়াত অবতীর্ণ হয়।
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ (سورة التوبة : ٣٤)
“আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে, আর তা আল্লাহর পথে খরচ করেনা। তাদেরকে বেদনাদায়ক শস্তির সুসংবাদ দাও।”
(সূরা তওবা: ৩৪)
আমাদের কেউ কেউ বলল, এ আয়াত তো স্বর্ণ রৌপ্য সম্পর্কে অবতীর্ণ হলো। (সুতরাং তা জমা করা যাবে না) আমরা যদি জানতে পারতাম কোন মাল সবচেয়ে উত্তম, তাহলে তা আমরা সংগ্রহ করে রেখে দিতাম। হুযুর (স:) বললেন, সবচেয়ে উত্তম সম্পদ হলো, আল্লাহর যিকিররত জিহবা, আল্লাহর নেয়ামতের কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ অন্তর এবং ঈমানদার বিবি, যে দ্বীনের কাজে স্বামীকে সাহায্য করে।” (তিরমিযী)
(١٤٩) وَعَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَيُّمَا امْرَأَةٍ مَاتَتْ وَزَوْجُهَا عَنْهَا رَاضٍ دَخَلَتِ الْجَنَّةَ (ترمذي)
(১৪৯) “হযরত উম্মে সালমাহ (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, যে মহিলা স্বামীকে সন্তুষ্ট রেখে মৃত্যুবরণ করে, সে অনায়াসে বেহেশতে প্রবেশ করবে।” (তিরমিযী)
(١٥٠) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا دَعَا الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ إِلَى فِرَاشِهِ فَأَبَتْ فَبَاتَ غَضْبَانَ عَلَيْهَا لَعَنَتْهَا الْمَلَائِكَةُ حَتَّى تُصبح (بخاري – مسلم)
(১৫০) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (স:) বলেছেন, যখন কোন স্বামী তার স্ত্রীকে শয়নের বিছানায় ডাকে, আর স্ত্রী অস্বীকার করে, ফলে স্বামী রাত্রিভর স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট থাকে, ভোর পর্যন্ত ফিরেশতারা সে নারীকে লা’নত করতে থাকে।” (বুখারী, মুসলিম)
স্ত্রীর হক
(١٥١) وَعَنْ أَبِي مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا أَنْفَقَ الرَّجُلُ عَلَى أَهْلِهِ يَحْتَسِبُهَا فَهُوَ لَهُ صَدَقَةٌ (بخاري – مسلم)
(১৫১) “হযরত আবু মাসউদ (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, পরকালের ছওয়াবের নিয়তে যখন কোন ব্যক্তি আপন পরিবার পরিজনের প্রয়োজনে ব্যয় করে, তখন তা তার জন্য সদকাস্বরূপ হয়।” (অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় সদকা বা দান করে যেভাবে মানুষ ছওয়াবের অধিকারী হয় উপরোক্ত ব্যক্তিও নেক নিয়তের ফলে আপনজনের জন্য ব্যয় করেও অনুরূপ ছওয়াবের অধিকারী হবে।)
(বুখারী, মুসলিম)
(١٥٢) وَعَنْ عَمْرِو بْنِ الْأَحْوَصِ الْجُسْمِي رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، أَنَّهُ سَمِعَ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي حَجَّةَ الوَدَاعِ يَقُولُ بَعْدَ أَنْ حَمِدَ اللَّهَ، وَأَثْنَى عَلَيْهِ، وَذَكِّرَ، وَوَعَظَ، ثُمَّ قَالَ: أَلَا وَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ
خَيْرًا ، فَإِنَّمَا هُنَّ عَوَانٌ عِنْدَكُمْ، لَيْسَ تَمْلِكُونَ مِنْهُنَّ شَيْئًا غَيْرَ ذَلِكَ، إِلَّا أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ (ترمذي)
(১৫২) “হযরত আমর ইবনে আহওয়াস যোশামী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বিদায় হজ্জের দিন প্রথমত নবীকে (স:) হামদ-ছানা পাঠ করতে, তৎপরে জনতাকে উদ্দেশ্য করে ওয়ায নসীহত করতে এবং শেষে এ কথা বলতে শুনেছিলাম যে, হে জনমন্ডলী, তোমরা মহিলাদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। কেননা তোমাদের মহিলারা সংসারে বন্দিনীর ন্যায়। তারা প্রকাশ্যে তোমাদের অবাধ্য না হওয়া পর্যন্ত তোমরা তাদের সাথে কঠোরতা করতে পার না।” (তিরমিজি)
ব্যাখ্যা: বিদায় হজ্জের দিন নবী করীম (স:) তার উম্মতের উদ্দেশ্যে যে নীতি নির্ধারক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করেছিলেন, সে ভাষণের এক অংশে তিনি তার উম্মতকে নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার করার এবং তাদের হক যথাযথ আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। উপরোক্ত হাদীসের রাবী সেই ভাষণের কথাই উল্লেখ করেছেন।
(١٥٣) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يَفْرَكُ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةٌ إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِيَ مِنْهَا آخَرَ (مسلم)
(১৫৩) “হয়রত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, কোন ঈমানদার পুরুষের পক্ষে ঈমানদার নারীকে ঘৃণা করা ঠিক হবে না। কেননা ঈমানদার স্ত্রীর মধ্যে কোন একটি বিষয় খারাপ থাকলেও বহু উত্তম গুণও থাকে” (যা স্বামীর নিকট খুবই পছন্দনীয়)। (মুসলিম)
(١٥٤) وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خَيْرُكُمْ مِنْكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ، وَأَنَا خَيْرُكُمْ لِأَهْلِي، وَإِذَا مَاتَ صَاحِبُكُمْ فَدَعُوهُ (ترمذي – دارمي)
(১৫৪) “হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে উত্তম, যে তার পরিবার পরিজনের নিকট উত্তম। আমি আমার পরিজনের কাছে তোমাদের সকলের চেয়ে উত্তম। আর তোমাদের কোন সঙ্গী যখন মৃত্যু বরণ করবে, তখন তাকে তোমরা ক্ষমা করে দিবে।” (অর্থাৎ তার সম্পর্কে খারাপ উক্তি করবে না) (তিরমিযী, দারেমী)
(١٥٥) وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ مِنْ أَكْمَلِ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا ، وَأَلْطَفُهُمْ بِأَهْلِهِ (ترمذي)
(১৫৫) “হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, পূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র উত্তম এবং যে তার পরিবার পরিজনের (স্ত্রী-পুত্রদের) প্রতি সদয়।” (তিরমিযী)
ব্যাখ্যা: যে ব্যক্তি চরিত্রবান, তার চরিত্র মাধুর্য প্রথমত: তার আপন জনের নিকটই প্রকাশিত হবে। বিশেষ করে তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিকট। কেননা পরিবারের যে সব লোকের সাথে তাকে দিবা রাত্রি উঠা বসা করতে হয়, তাদের থেকে তার চরিত্রের প্রকৃত রূপ সে বেশী দিন গোপন করে রাখতে পারে না। কাজেই পরিবারে লোকেরা যে ব্যক্তিকে চরিত্রবান ও সদয় বলে অনুভব করে প্রকৃতপক্ষে সে সেই রূপই। ফলে ইসলামের দৃষ্টিতেও সে উত্তম। উপরের বর্ণিত হাদীসে হুজুর (স:) সেই কথারই ইঙ্গিত করেছেন।
সন্তান সন্ততিদের হক
(١٥٦) وَعَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ أَبَاهُ أَتَى بِهِ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ إِنِّي نَحَلْتُ ابْنِي هَذَا غُلَامًا كَانَ لِي، فَقَالَ رَسُولِ اللَّهِ : أَكُلَّ وَلَدِكَ نَحَلْتَهُ مِثْلَ هَذَا ، فَقَالَ : لَا ، فَقَالَ رَسُولِ اللَّهِ : فَارْجِعْهُ، وَفِي رِوَايَةٍ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَفَعَلْتَ هَذَا بِوَلَدِكَ كُلِهِمْ؟ قَالَ : لَا ، قَالَ: اتَّقُوا اللَّهَ وَاعْدِلُوا فِي أَوْلَادِكُمْ، فَرَجَعَ أَبِي فَرَدَّ تِلْكَ
الصدقة
(بخاري – مسلم)
(১৫৬) “হযরত নোমান ইবনে বশীর (রা:) হতে বর্ণিত, একদা হযরত নোমানের পিতা তাকে সঙ্গে করে রসূলুল্লাহর (স:) দরবারে হাযির হলেন এবং বললেন, হুজুর আমি আমার এই ছেলেটিকে আমার নিজস্ব একটি গোলাম দান করেছি। আল্লাহর রসূল (স:) বললেন, তুমি কি তোমার অন্যান্য ছেলেমেয়েদেকেও অনুরূপ একটি দান করেছ? তিনি জওয়াব দিলেন না। হুজুর (স:) বললেন, তাহলে এ গোলমটিকে তুমি ফেরৎ নিয়ে নাও। অন্য এক বর্ণনা মতে হুজুর (স:) তাকে বললেন, তুমি কি তোমার সব ক’টি সন্তানকে অনুরূপ এক একটি গোলাম দিয়েছ? তিনি বললেন না। হুজুর (স:) বললেন, খোদাকে ভয় কর এবং সন্তানদের মধ্যে ইনসাফ কর। অত:পর আমার পিতা বাড়ী ফিরে এসে দানকৃত উক্ত গোলামটিকে ফেরৎ নিলেন।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: হুজুর (স:) মদীনা শরীফে হিজরত করার পর মুসলমানদের ঘরে যে প্রথম সন্তানটি জন্ম নেয়, তিনিই হলেন উপরোক্ত হাদীসের রাবী হযরত নোমান ইবনে বশীর। মদীনায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী হুকুমতের প্রথম সন্তান হিসেবে আনসার মুহাজির নির্বিশেষে সকলেই হযরত নোমানকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন। তার পিতার অতিরিক্ত আকর্ষণের হয়তো এটাও একটি কারণ ছিল। এতদসত্ত্বেও হুজুর (স:) তার অন্যান্য ভাইদের থেকে অতিরিক্ত কিছু দেয়াকে অনুমোদন করেননি। কেননা সন্তানদের পরস্পরের মধ্যে ইনসাফ না করে যদি কাউকে অতিরিক্ত কিছু দেয়া হয় তা হবে শরীয়তের দৃষ্টিতে দোষনীয়। তাছাড়া এর দ্বারা ভাইদের পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া ফাসাদ সৃষ্টি হবে, ফলে পিতা-মাতার প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মাবে।
(١٥٧) وَعَنْ سَعِيدِ بْنِ الْعَاصِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَا نَحَلَ وَالِدٌ وَلَدَهُ مِنْ نَحْلٍ أَفْضَلَ مِنْ أَدَبٍ حَسَنٍ (جامع الأصول – مشكوة)
(১৫৭) “হযরত সাঈদ ইবনে আস (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, সন্তানদের জন্য পিতার সর্বোত্তম দান হলো উত্তম তালীম ও তরবীয়ত।” (জামেউল-উসূল, মিশকাত)
ব্যাখ্যা: পিতা স্বীয় সন্তানদের জন্য বাড়ী-ঘর-জায়গা জমি ইত্যাদি যত সম্পদ-ই রেখে যাক না কেন, যদি সন্তানদেরকে উপযুক্ত তালীম-তরবীয়ত না দিয়ে যান, তাহলে তার এ সব সম্পদ ইসলামের দৃষ্টিতে মূল্যহীন। কেননা উপযুক্ত তালীমের অভাবে সে দ্বীন দুনিয়ার সঠিক পরিচয়ের ব্যাপারে থাকবে অজ্ঞ। ফলে কোন সম্পদই তার এ অভাব মোচন করতে পারবে না। কাজেই সন্তানদের তালীম ও তরবীয়ত পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব।
(١٥٨) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ (مسلم)
(১৫৮) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সঃ) বলেছেন, মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তার যাবতীয় কর্ম তৎপরতা রহিত হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি বিষয় এমন আছে যার তৎপরতা মৃত্যুর কারণে রহিত হয় না। একটি হলো সদকায় জারীয়া, দ্বিতীয়টি হলো কল্যাণকর ইলম, আর তৃতীয়টি হলো নেক সন্তান, যে নিয়তই পিতা-মাতার জন্য দোয়া করে।” (মুসলিম)
ব্যাখ্যা: ছদকায় জারীয়া বলা হয় এমন কোন সুদূর প্রসারী মহৎ কাজকে, যার ফলাফল দাতার মৃত্যুর পরেও সাধারণ লোক দীর্ঘদিন ধরে ভোগ করতে থাকে। যেমন জনগণের কল্যাণার্থে রাস্তা তৈরী করে দেয়া, মাদ্রাসা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। যদি কোন ব্যক্তি অনুরূপ কোন কাজ করে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে মৃত্যুর পরেও তার আমলনামায় এর ছওয়াব জমা হতে থাকবে। অনুরূপভাবে কোন লোক যদি কাউকে কল্যাণকর ইলম শিক্ষা দান করে থাকে, যাদ্বারা সে দুনিয়া আখেরাতের সঠিক পরিচয় লাভ করতে পারে, তাহলেও উক্ত শিক্ষক মৃত্যুর পরে এর ছওয়াব পেতে থাকবে। কেননা তার কল্যাণকর শিক্ষা দ্বারা লোক দীর্ঘদিন উপকৃত হবে। তদ্রুপ যদি কোন পিতা-মাতা এমন কোন সু-সন্তান রেখে মৃত্যুবরণ করে যে সন্তান মৃত্যুর পর তার পিতা-মাতার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করে। উক্ত পিতা-মাতা মৃত্যুর পরেও উক্ত সন্তানের দোয়ার কারণে ছওয়াব পেতে থাকবে।
(١٥٩) وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ كَانَتْ لَهُ أُنثَى فَلَمْ يَئِدْهَا وَلَمْ يَهِنْهَا وَلَمْ يُؤْثِرُ وَلَدَهُ عَلَيْهَا يَعْنِي الذَّكُورَ أَدْخَلَهُ الْجَنَّةَ (أبو داود)
(১৫৯) “হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:)
বলেছেন, কোন ব্যক্তির ঘরে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সে যদি তাকে (জাহেলিয়াতের যুগের ন্যায়) জীবিত কবর না দেয় এবং তাকে তুচ্ছ মনে না করে, আর পুত্র সন্তানকে উক্ত কন্যা সন্তানের উপর প্রাধান্য না দেয়, তাহলে আল্লাহ তাকে বেহেশত দান করেবেন। (আবু দাউদ)
(١٦٠) وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ، جَاءَتْنِي امْرَأَةٌ وَمَعَهَا ابْنَتَانِ لَهَا تَسْأَلُنِي، فَلَمْ تَجِدُ عِنْدِي غَيْرَ ثَمَرَةٍ وَاحِدَةٍ، فَأَعْطَيْتُهَا إِيَّاهَا ، فَقَسَّمَتْهَا بَيْنَا ابْنَتَيْهَا ولَمْ تَأْكُلْ مِنْهَا ، ثُمَّ قَامَتْ فَخَرَجَتْ، فَدَخَلَ النَّبِيُّ
صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَحَدَّثْتُهُ، فَقَالَ: مَنِ ابْتُلِيَ مِنْ هَذِهِ الْبَنَاتِ بِشَيْءٍ فَأَحْسَنَ إِلَيْهِنَّ، كُنَّ لَهُ سِتْرًا مِنَ
النَّارِ (بخاري – مسلم)
(১৬০) “হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা একজন বিপন্না মহিলা তার দুটি কন্যা সন্তানসহ আমার কাছে কিছু পাওয়ার আশায় এসেছিল। কিন্তু আমার কাছে তখন একটি খোরমা ব্যতীত অন্য কোন খাদ্য বস্তু ছিল না। আমি তাই তাকে দিলাম। মহিলাটি খোরমাটি দু’ভাগ করে দুই কন্যাকে দিল এবং নিজে কিছু খেল না। অতঃপর সে চলে যাওয়ার পর পরই নবী (স:) ঘরে প্রবেশ করলেন এবং আমি তাকে ঘটনাটি আদ্য পান্ত বললাম, হুজুর (স:) শুনে বললেন, যাকে আল্লাহ এ ধরনের কন্যা সন্তান দ্বারা পরীক্ষায় ফেলেছে, অত:পর সে কন্যাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে। কিয়ামতে এই কন্যা তার জন্য দোযখের ঢাল স্বরূপ হবে।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: মানুষ সাধারণভাবে পুত্র সন্তানদেরকে কন্যা সন্তানদের উপর প্রধান্য দিয়ে থাকে। কেননা কন্যা সন্তানরা বিবাহের পর স্বামীর বাড়ীতে চলে যাবে। অতঃপর তার দ্বারা পিতা মাতার এবং তাদের সংসারের বিশেষ কোন উপকার হবে না। ফলে কন্যা সন্তানদের ব্যয়ভারকে একটি অপ্রয়োজনীয় বোঝা বলে মনে করা হয়। উপরে উল্লেখিত হাদীসটিতে পিতা মাতার উক্ত মনোভাবকে ইঙ্গিতে গর্হিত বলা হয়েছে এবং কন্যা সন্তানদের ব্যয়ভারকে একটি মহৎ কাজ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এমনকি সন্তুষ্ট চিত্তে কন্যাদের ব্যয়ভার বহন করাকে দোযখ হতে নাজাতের কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্ণিত হাদীসটির মাধ্যমে আমরা একটি বিষয়ের সন্ধান পাই। তা এই যে কখনও দোজাহানের সর্দার হযরত মুহাম্মদের (স:) ঘরে একটি খোরমার বেশী কিছু থাকত না। আবার সে ক্ষেত্রেও ক্ষুধার্ত ব্যক্তির প্রয়োজনে ঐ একটি মাত্র খোরমাও দান করে দিতে আদৌ কুণ্ঠাবোধ করা হতো না।
ইয়াতিমের হক
(١٦١) وَعَنْ سَهْلِ بْنِ سَعَدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ لَهُ وَلِغَيْرِهِ فِي الْجَنَّةِ هَكَذَا ، وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى وَفَرَّجَ بَيْنَهُمَا
(بخاري – مسلم)
(১৬১) “হযরত সাহাল ইবনে সায়াদ (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) এরশাদ করেছেন, আমি এবং ইয়াতিমের ও কাঙ্গালের লালন পালনকারী বেহেশতে এভাবে অবস্থান করব। এ বলে হুজুর (স:) তাঁর শাহাদাত এবং মধ্যাঙ্গুলির মধ্যে সামান্য ফাঁক করে সেদিকে ইঙ্গিত করলেন।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: ইয়াতীমের প্রতিপালক যে বেহেশতে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হবে, সে কথার-ই উল্লেখ করা হয়েছে।
(١٦٢) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خَيْرُ بَيْتٍ فِي
الْمُسْلِمِينَ بَيْتٌ فِيهِ يَتِيمٌ يُحْسَنُ إِلَيْهِ، وَشَرُّ بَيْتٍ فِي الْمُسْلِمِينَ بَيْتٌ فِيهِ يَتِيمٌ يُسَاءُ إِلَيْهِ (ابن ماجة)
(১৬২) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (স:) বলেছেন, মুসলমানদের ঘরের মধ্যে সেই ঘরটি সবচেয়ে উত্তম যে ঘরে ইয়াতীম বাস করে এবং তার সাথে উত্তম ব্যবহার করা হয়। আর মুসলমানদের সেই ঘরটি হলো সবচেয়ে নিকৃষ্ট যেখানে কোন ইয়াতীম বাস করে এবং তার সাথে নির্দয় ব্যবহার করা হয়। (ইবনে মাযাহ)
(١٦٣) وَعَنْ خُوَيْلِدِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اللَّهُمَّ إِنِّي أُحَرِّجُ حَقَّ الضَّعِيفَيْنِ الْيَتِيمِ وَالْمَرْأَةِ (نسائي)
(১৬৩) “হযরত খোয়াইলেদ ইবনে আমর (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, হে আমার পরওয়ারদেগার, আমি দুই শ্রেণীর দুর্বল লোকের হককে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকি, ইয়াতীম এবং নারী।” (নাসাঈ)
ব্যাখ্যা: ইসলামের পূর্বে ইয়াতীম ও নারীর প্রতি চরম অবিচার করা হতো। সাধারণত ইয়াতীমের প্রতি দুর্ব্যবহার করা হতো এবং তাদের সম্পদ আত্মসাৎ করা হতো। নারী জাতিকেও তদানীন্তন সমাজে বিশেষ কোন মর্যাদা দেয়া হতো না এবং তাদেরকে নানারূপ নির্যাতন করা হতো। হুজুর (স:) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে পয়গাম্বর ও ইসলামী হুকুমতের প্রধান হিসেবে এই উভয় শ্রেণীর দুর্বল লোকের হক প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। হুজুর (স:) উপরোক্ত উক্তি হতে তার-ই প্রমাণ মিলে।
প্রতিবেশীর হক
(١٦٤) وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ، قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَا زَالَ جِبْرِيلُ يُوْصِينِي بِالْجَارِ حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوْرِتُهُ (بخاري – مسلم)
(১৬৪) “হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, জিব্রাঈল (আ:) নিয়তই আমাকে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে তাকীদ দিচ্ছিলেন। এমনকি আমার ধারণা জন্মেছিল হয়ত প্রতিবেশীকে সম্পত্তিতে হকদার (ওয়ারেছ) করা হবে।” (বুখারী, মুসলিম)
(١٦٥) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: وَاللَّهِ لَا يُؤْمِنُ وَاللَّهِ لَا يُؤْمِنُ وَاللَّهِ لَا يُؤْمِنُ، قِيلَ: مَنْ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: الَّذِي لَا يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ (بخاري – مسلم)
(১৬৫) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, একদা রসূল (স:) (ছাহাবাদের মজলিসে) বললেন, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, সে লোকটি কিছুতেই ঈমানদার নয়, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, সে লোকটি কিছুতেই ঈমানদার নয়, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি সে লোকটি কিছুতেই ঈমানদার নয়, সাহাবীদের মধ্যে হতে একজন জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল (এমন হতভাগ্য) লোকটি কে? হুজুর (স:) বললেন, যার অনিষ্ট হতে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না।” (বুখারী, মুসলিম)
(١٦٦) وَعَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: لَيْسَ الْمُؤْمِنُ الَّذِي يَشْبَعُ وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلَى جَنْبِهِ (مشكوة)
(১৬৬) “হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলকে (স:) এ কথা বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তৃপ্তি সহকারে পেটপুরে ভক্ষণ করে, আর তারই পার্শ্বে তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে ঈমানদার নয়।” (মিশকাত)
ব্যাখ্যা: কোরআন হাদীসে প্রতিবেশীর হক ও অধিকারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যে সমাজের লোকেরা পরস্পর প্রতিবেশীর প্রতি সদয় থাকে, ক্ষুধার্ত প্রতিবেশীকে খাদ্য দান করে, প্রতিবেশীর অনিষ্ট সাধন হতে বিরত থাকে এবং নিয়তই প্রতিবেশীর মঙ্গল কামনা করে, সে সমাজটি যে একটি আদর্শ সমাজ তা নি:সন্দেহে বলা চলে। আর এই ধরণের আদর্শ সমাজই ইসলামের কাম্য। বর্ণিত হাদীসসমূহে হুজুর (স:) তার উম্মতকে প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতিশীল উপরোক্ত ধরনের একটি আদর্শ সমাজ গঠনে উৎসাহ দিয়েছেন।
(١٦٧) وَعَنْ أَبِي ذَرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا طَبَخْتَ مَرَقَةً فَأَكْثِرْ مَاءَهَا وَتَعَاهَدْ جَيرَانَكَ (مسلم)
(১৬৭) “হযরত আবুযার (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, যখন তুমি সালুন পাকাবে, তখন তাতে কিছু অতিরিক্ত পানি দিবে, যাতে করে তুমি তোমার প্রতিবেশীর খবর নিতে পার।” (অর্থাৎ গোস্ত, মাছ বা তরি-তরকারি যা কিছু তোমরা পাকাও তাতে অতিরিক্ত কিছু ঝোল দিবে যাতে তা থেকে কিছু তোমার প্রতিবেশীকে দিতে পার।” (মুসলিম)
(١٦٨) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا نِسَاءَ الْمُسْلِمَاتِ لَا تَحْقِرَنَّ جَارَةٌ لِجَارَتِهَا وَلَوْ فِرْسَنَ شَاةٍ (بخاري – مسلم)
(১৬৮) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, হে মুসলিম রমণীরা, তোমরা প্রতিবেশীর বাড়ীতে সামান্য বস্তু পাঠানকে তুচছ মনে করবে না। এমনকি তা যদি বকরীর পায়ের সামান অংশও হয়।” (বুখারী, মুসলিম)
(١٦٩) وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ لِي جَارَيْنِ فَإِلَى أَيِّهِمَا أُهْدِي؟ قَالَ إِلَى أَقْرَبِهِمَا مِنْكِ بابا (بخاري)
(১৬৯) “হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, একদা তিনি নবী করীমকে (স:) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী (সঃ), আমার দুজন প্রতিবেশী আছে, এর মধ্য হতে কাকে আমি হাদীয়া প্রেরণের ব্যাপারে প্রাধান্য দিব? হুজুর (স:) বললেন, তোমার দ্বার হতে যার দ্বার বেশী নিকটবর্তী, তাকে।” (বুখারী)
ব্যাখ্যা: যদিও সব শ্রেণীর প্রতিবেশীর প্রতিই সদয় ব্যবহার করতে এবং সকলের অধিকারের খেয়াল রাখতে হবে। কিন্তু প্রতিবেশীর মধ্যে অধিকারের তারতম্য আছে। যেমন আত্মীয় প্রতিবেশীর অধিকার অনাত্মীয় প্রতিবেশী হতে অধিক। তেমনি প্রতিবেশীর মধ্যে যার বাড়ী বা ঘর বেশী নিকটে তার হক বেশী। অর্থাৎ নিকটতম প্রতিবেশীকে দূরের প্রতিবেশীর তুলনায় অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
চাকর চাকরাণীর হক
(۱۷۰)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِخْوَانُكُمْ جَعَلَهُمُ اللَّهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ فَمَنْ جَعَلَ اللَّهُ أَخَاهُ تَحْتَ يَدِهِ فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ، وَلْيُلْبِسَهُ مِمَّا يَلْبَسُ، وَلَا يُكَلِّفُهُ مِنَ الْعَمَلِ مَا يَغْلِبُهُ فَإِنْ كَلْفَهُ مَا يَغْلِبُهُ فَلْيُعِنْهُ عَلَيْهِ (بخاري – مسلم)
(১৭০) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, (তোমাদের চাকর নকর বা দাস দাসী প্রকৃত পক্ষে) তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করেছেন। সুতরাং আল্লাহ যার ভাইকে তার অধীনস্থ করেছেন, তার উচিত সে যা খায় তাই তাকে খাওয়াবে এবং সে যা পরিধান করে তাই তাকে পরিধান করাবে আর তার উপরে ক্ষমতা বহির্ভূত কোন কাজ চাপাবে না। একান্ত যদি চাপান হয়, তাহলে কাজটি সমাধা করার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করবে।” (বুখারী, মুসলিম)
(۱۷۱)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا صَنَعَ لأَحَدِكُمْ خَادِمُهُ طَعَامَهُ ثُمَّ جَاءَهُ بِهِ وَقَدْ وَلِيَ حَرَّهُ وَدُخَانَهُ فَلْيُقْعِدَهُ عِنْدَهُ، فَلْيَأْكُلْ فَإِنْ كَانَ الطَّعَامُ مَشْفُوْهَا قَلِيلاً فَلْيَضَعْ فِي يَدِهِ مِنْهُ أُكَلَةً أَوْ أُكَلَتَيْنِ (مسلم)
(১৭১) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, যখন তোমাদের চাকর খানা তৈরী করে তোমাদের সামনে হাযির করবে, তখন তোমরা নিজের সাথে বসিয়ে তাকে খাওয়াবে। কেননা সে (রান্না ঘরের) ধুয়া ও তাপ সহ্য করেছে। আর যদি খানা কম হয়, তাহলে অন্তত: এক দুই লোকমা তার হাতে দিবে।” (মুসলিম)
গরীব মিসকিনের হক
(۱۷۲)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ : يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ
تُطْعِمْنِي، قَالَ: يَا رَبِّ وَكَيْفَ أُطْعِمُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ، قَالَ: أَمَا عَلِمْتَ أَنَّهُ اسْتَطْعَمَكَ عَبْدِي فُلَانٌ فَلَمْ تُطْعِمْهُ، أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ أَطْعَمْتَهُ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عنْدِي، يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَسْقَيْتُكَ فَلَمْ تَسْقِنِي، قَالَ: يَا رَبِّ كَيْفَ أَسْقِيكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ، قَالَ: اسْتَسْقَاكَ عَبْدِي فُلَانٌ فَلَمْ تَسْقِهِ أَمَا إِنَّكَ لَوْ سَقَيْتَهُ وَجَدْتَ ذَالِكَ عِنْدِي (مسلم)
(১৭২) “হররত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিনে (আদম সন্তানকে লক্ষ্য করে) বলবেন, হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাদ্য দাওনি। আদম সন্তান বলবে, হে পরওয়ারদেগার, আমি কি করে তোমাকে খাওয়াতে পারি, অথচ তুমিই সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক? আল্লাহ বলবেন, তোমার কি মনে নেই তোমার কাছে আমার অমুক বান্দাহ খাদ্য প্রার্থনা করেছিল, কিন্তু তুমি তাকে খাদ্য দাওনি? তুমি কি জানতে না যে, সেদিন যদি তুমি তাকে খাদ্য দিতে তাহলে অবশ্যই তা তুমি আমার কাছে পেয়ে যেতে। আল্লাহ (অত:পর অন্য একজনকে লক্ষ্য করে) বলবেন, হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি। আদম সন্তান বলবে হে পরওয়ারদেগার, আমি কি করে তোমাকে পানি পান করাতে পারি, তুমিই তো সমগ্র বিশ্বের রক্ষক। আল্লাহ বলবেন, তোমার কাছে আমার কোন এক বান্দাহ পানি পান করতে চেয়েছিলো, কিন্তু তুমি তাকে পানি পান করাওনি। যদি তুমি সেদিন তাকে পানি পান করাতে, তাহলে আজ তা তুমি আমার কাছে পেতে।” (অর্থাৎ তার প্রতিদান আজ তোমাকে দেয়া হত) (মুসলিম)
(۱۷۳)
وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَفْضَلُ الصَّدَقَةِ أَنْ تُشِيعَ كَيدًا جَائِعًا (مشكوة)
(১৭৩) “হযরত আনাস (রা:) বলেন রসূল (স:) বলেছেন, সর্বোত্তম দান হলো কোন ক্ষুধার্তকে পেট পুরে খাওয়ানো। (মেশকাত)
(١٧٤) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : السَّاعِي عَلَى الْأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِينِ كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، وَأَحْسِبُهُ قَالَ: كَالْقَائِمِ لَا يَفْتُرُ وَكَالصَّائِمِ لَا يُفْطِرُ (بخاري – مسلم)
(১৭৪) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রসূল (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিধবা ও মিসকিনের সমস্যা নিয়ে ছুটা-ছুটি করে, সে যেন আল্লাহর রাহে জিহাদে লিপ্ত। (বর্ণনাকারী বলেন) আমার ধারণা হুজুর (স:) যেন একথাও বলেছিলেন যে, সে যেন ঐ সব ব্যক্তির ন্যায়, যে সারা রাত নামাযে কাটায় এবং সারা বছরই রোজা রাখে।” (বুখারী, মুসলিম)
(١٧٥) قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَيْسَ الْمِسْكِينُ الَّذِي يَطُوفُ عَلَى النَّاسِ تَرُدُّهُ اللُّقْمَةُ وَاللُّقْمَتَانِ وَالتَّمْرَةُ وَالتَّمْرَتَانِ، وَلَكِنِ الْمِسْكِينُ الَّذِي لا يَجِدُ غِنِّى يُغْنِيهِ وَلَا يُفْطَنُ لَهُ فَيُتَصَدَّقُ عَلَيْهِ وَلَا يَقُومُ
فَيَسْأَلُ النَّاسَ (بخاري – مسلم)
(১৭৫) “নবী করীম (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এক মুঠো দু মুঠো অন্ন কিংবা একটি দুটি খোরমা ভিক্ষা করে বেড়ায় সে মিসকিন নয়। প্রকৃত পক্ষে মিসকিন হলো সেই ব্যক্তি; যে তার প্রয়োজন পূরণ করার মত সম্পদ রাখে না। অথচ (লজ্জা ও শালীনতার কারণে) সে কারও কাছে কিছু প্রার্থনাও করে না এবং কেউ তার দরিদ্রতার খবরও রাখে না যে সে তাকে দান করবে।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ বর্ণিত হাদীস সমূহে আল্লাহর নবী মুসলমানদেরকে সমাজের অসহায়, গরীব, মিসকীন, ইয়াতীম, বিধবা ইত্যাদি অভাবী লোকদের খোজ খবর নিতে, তাদের অভাব মোচন করতে এবং তারা ক্ষুধার্ত থাকলে তাদেরকে খাদ্য দান করতে আদেশ করেছেন। এমনকি যারা অভাবী লোকের সাহায্যের ব্যাপারে চেষ্টা সাধনা করে, তাদের এ কাজটা যে নফল ইবাদতের চেয়েও উত্তম বরং কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহর পথে জিহাদের সমতুল্য, নবী (স:) তারও উল্লেখ করেছেন। শেষোক্ত হাদীসটিতে আল্লাহর নবী মিসকিনদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে পরোক্ষ মুসলমানদেরকে হেদায়েত দিয়েছেন যে, তোমাদের উচিত সেই সমস্ত অভাবী (মিসকিন) লোককে খুঁজে খুঁজে দান করা, যারা লজ্জার কারণে তাদের অভাবের কথা প্রকাশ করে না। অথচ অভাব মোচনের মত প্রয়োজনীয় সম্পদ তাদের কাছে নেই।
রোগগ্রস্ত মুসলিম ভাইয়ের হক
(١٧٦) وَعَنْ أَبِي مُوسَى الْأَشْعَرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَطْعِمُوا الْجَائِعَ وَعُودُوا الْمَرِيضِ، وَقُكُوا الْعَانِي (بخاري)
(১৭৬) “হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, তোমরা ক্ষুধার্তকে খেতে দিবে, রোগীর পরিচর্যা করবে এবং বন্দীকে মুক্ত করে দিবে।” (বুখারী)
(۱۷۷)
وَعَنْ ثَوْبَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا عَادَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ لَمْ يَزَلْ فِي خُرْفَةِ الْجَنَّةِ حَتَّى يَرْجِعَ (مسلم)
(১৭৭) “হযরত ছাওবান (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, একজন মুসলমান যখন তার কোন রুগ্ন মুসলমান ভাইকে দেখতে যায়, তখন যেন সে বেহেশতের বাগানে ফল আহরণ করতে থাকে, বাড়ী ফিরে না আসা পর্যন্ত।” (মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ পবিত্র কোরআন ও হাদীসে মুসলমানদের পরস্পরের সম্পর্ককে ভাইয়ের সম্পর্কের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মুসলিম সমাজ একে অপরের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল হবে এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাম্য। সুতরাং একজন মুসলমান যখন রোগগ্রস্ত হয়, তখন অন্য মুসলমান ভাইয়ের তার খোঁজ খবর নেয়া ও তার পরিচর্যা করা উচিত।
(۱۷۸)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ ست، قِيلَ : مَا هُنَّ يَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ؟ قَالَ: إِذَا لَقِيتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ، وَإِذَا دَعَاكَ فَأَجِبْهُ، وَإِذَا استنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ ، وَإِذَا عَطَسَ فَحَمِدَ اللَّهَ فَشَمِّتْهُ، وَإِذَا مَرِضَ تَعُدْهُ وَإِذَا مَاتَ فَاتَّبَعْهُ (مسلم)
(১৭৮) “হযরত আবু হোরায়রা হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন মুসলমানের একের উপর অন্যের ছয়টি হক রয়েছে। জিজ্ঞেস করা হলো হে আল্লাহর নবী সেগুলো কি? হুজুর (স:) বললেন, যখন তুমি (কোন মুসলমানের) দেখা পাবে, তখন সালাম দিবে। যখন কেহ তোমাকে দাওয়াত দেয়, তার দাওয়াত কবুল করবে। কেহ উপদেশ চাইলে তাকে উপদেশ দিবে। হাচি দিয়ে যখন “আলহামদুলিল্লাহ” বলে তুমি তার জওয়াবে “ইয়ারহামুকাল্লাহ” বলবে। রোগাক্রান্ত হলে তাকে দেখতে যাবে। আর কেহ মরে গেলে তার জানাযা ও দাফনে শরীক হবে।” (মুসলিম)
(۱۷۹)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَا ابْنَ آدَمَ مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِي، قَالَ: رَبِّ كَيْفَ أَعُودُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ، قَالَ: أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِي فُلَانًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ عُدْتَهُ لَوَجَدْتَنِي عِنْدَهُ (مسلم)
(১৭৯) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ (কোন এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলবেন, হে আদম সন্তান আমি রোগাক্রান্ত হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে যাওনি। সে বলবে হে আমার প্রতিপালক, তুমি কি করে রোগাক্রান্ত হলে যে, আমি তোমাকে দেখতে যাব অথচ তুমি সারা বিশ্বের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দাহ পীড়িত হওয়া সম্পর্কে তুমি অবগত ছিলে, অথচ তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে, তাহলে আমাকে তুমি সেখানে পেতে।” (মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসের আলোচনা হতে বুঝা যায় যে, আর্তের সেবা, ক্ষুধার্তকে অন্নদান এবং তৃষ্ণার্তকে পানি পান করান আল্লাহর নিকট অতীব প্রিয় কাজ। আর এসব কাজে লোক যা কিছু ব্যয় করে তা আল্লাহর নিকট মওজুদ থাকে।
মুসলমানের পরস্পরের উপর পরস্পরের হক
(۱۸۰)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ:
إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يُسْلِمُهُ، وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللَّهُ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْيَةً فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
(بخاري – مسلم)
(১৮০) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, মুসলমান পরস্পরের ভাই। সুতরাং সে তার উপরে কোন প্রকার যুলুমও করতে পারে না এবং তাকে অসহায় অবস্থায়ও ফেলতে পারে না। আর যে তার মুসলমান ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন। অনুরূপভাবে যে কোন মুসলমানের দুঃখ দূর করে দিবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দুঃখ দূর করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের ত্রুটি গোপন করে রাখবে, আল্লাহ হাশরের দিন তার ত্রুটিও গোপন করে রাখবেন।” (বুখারী, মুসলিম)
(۱۸۱)
وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ صلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُومًا ،
فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَنصُرُهُ مَظْلُومًا فَكَيْفَ نَنْصُرُهُ ظَالِمًا؟ قَالَ: تَمْنَعْهُ مِنَ الظُّلْمِ، فَذَالِكَ نَصْرُكَ إِيَّاهُ (بخاري – مسلم)
(১৮১) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, তোমার মুসলমান ভাই যালেম হোক, কিংবা মযলুম হোক, তাকে তুমি সাহায্য করবে। একজন ছাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী, মযলুমকে তো আমি সাহায্য করতে পারি, কিন্তু যালেমকে আমি কি করে সাহায্য করব? হুজুর (স:) বললেন, তুমি তাকে যুলুম হতে বিরত রাখবে, এটাই হবে তোমার জন্য তাকে সাহায্য করা।” (অর্থাৎ একজন মুসলমানকে যখন যুলুম হতে বিরত রাখা হয়, তখন তাকে একটি ভয়ংকর পাপ কার্য হতে ফিরান হয়, যে পাপ কার্যটি তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করত। আর এটাই হবে তাকে সাহায্য করা।) (বুখারী, মুসলিম)
(۱۸۲)
وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَا يُؤْمِنُ عَبْدٌ حَتَّى يُحِبُّ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ (بخاري – مسلم)
(১৮২) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, যে মহা-মহীয়ান আল্লাহর হাতে আমার জান, আমি তার শপথ করে বলছি, কোন লোকই প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যে পর্যন্ত না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, তা তার অন্য ভাইয়ের জন্য পছন্দ করবে।” (বুখারী, মুসলিম)
(۱۸۳)
وَعَنْ أَبِي أَيُّوبَ الأَنْصَارِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ،
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يَحِلُّ لِرَجُلٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلَاثِ لَيَالٍ يَلْتَقِيَانِ فَيُعْرِضُ هَذَا وَيُعْرِضُ هَذَا وَخَيْرُهُمَا الَّذِي يَبْدَأُ بِالسَّلَامِ
(بخاري – مسلم)
(১৮৩) “হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, কারও পক্ষে তার (মুসলমান) ভাইয়ের সহিত তিন দিন ও রাত্রি সম্পর্ক ছিন্ন করে রাখা বৈধ হবে না, এমনভাবে যে পরস্পর পরস্পর হতে মুখ ফিরিয়ে নিবে। হ্যাঁ তাদের এ নীরবতা প্রথমে যে সালাম দিয়ে ভঙ্গ করবে সেই উত্তম।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ যদি কোন কারণে দু’জন মুসলমানের মধ্যে মনোমালিন্য
ঘটে, আর তার ফলে তাদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তাদের এ অবস্থাটা তিন দিনের বেশী বজায় থাকাটা ইসলামের দৃষ্টিতে দোষণীয়। তিন দিনের মধ্যেই তাদের মনোমালিন্য মিটিয়ে ফেলা উচিত। আর এ ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে যে ব্যক্তি প্রথম তার রাগ প্রশমিত করে অন্য ভাইয়ের প্রতি মিলনের হাত প্রসারিত করবে, তাকেই হুযুর (স:) উত্তম ব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন।
পশু-পক্ষীর হক
(١٨٤) وَعَنْ سُهَيْلِ بْنِ الْحَنْظَلِيَّةِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: مَرَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَبَعِيْرٍ قَدْ لَحِقَ ظَهْرُهُ بِبَطْنِهِ، فَقَالَ: اتَّقُوا اللَّهَ فِي هَذِهِ الْبَهَائِمِ الْمُعْجَمَةِ فَارْكَبُوهَا وَكُلُوهَا صَالِحةً (أبو داود)
(১৮৪) “হযরত সোহাইল ইবনে হানযালিয়া (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নবী করীম (স:) এমন একটি উটের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, (ক্ষুদায়) যার পেট-পিঠ এক হয়ে গিয়েছিল। হুযুর (স:) বললেন, এ বাকহীন পশুগুলোর ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা উত্তম অবস্থায় এর উপর আরোহণ করবে এবং উত্তম অবস্থায় তাকে ছেড়ে দিবে। (অর্থাৎ সুস্থ সবল অবস্থায় এর উপর আরোহণ করবে এবং ক্ষুধায় কাতর হওয়ার পূর্বেই পিঠ হতে অবতরণ করবে)।” (আবু দাউদ)
(١٨٥) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا سَافَرْتُمْ فِي الْخِصْبِ فَأَعْطُوا الإِيلَ حَقَّهَا مِنَ الْأَرْضِ وَإِذَا سَافَرْتُمْ فِي السَّنَةِ فَأَسْرِعُوا عَلَيْهَا السَّيْرَ (مسلم)
(১৮৫) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, প্রাচুর্যের পথে তোমরা যখন সফর করবে, তখন তোমরা তোমাদের উটগুলোকে মাটি থেকে তার হক (ঘাস-পানি) নিতে অবকাশ দিবে। আর তোমরা যখন অজন্মার সময় (ঘাস-পানি বিহীন এলাকা হতে) সফর করবে, তখন তড়িৎ উটগুলোকে চালাবে। (যাতে উটগুলো পথিমধ্যে ঘাস পানির অভাবে কষ্ট না পায় এবং মনযিলে পৌঁছে খাদ্য ও বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারে।” (মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ ইসলাম একটি কল্যাণকর ও সুবিচার পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। যেখানে শুধু মানবজাতির ক্ষেত্রেই সুবিচার করার আদেশ দেয়া হয়নি। বরং পশুপক্ষী প্রভৃতি বাকহীন জীবের বেলায়ও সুবিচার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
উপরের বর্ণিত হাদীস দু’টিতে আল্লাহর নবী ভারবাহী পশুর যত্ন নেয়া, তাকে ঠিক মত খাদ্য-পানীয় দেয়া এবং তার থেকে সাধ্যের অতীত কোন কাজ না নেয়ার জন্যে আমাদেরকে হেদায়েত দিয়েছেন। সুতরাং যারা লাঙ্গল চষা, গাড়ী টানা এবং সোয়ারী ইত্যাদি কাজে গরু-মহিষ, উট-ঘোড়া ইত্যাদি জানোয়ার ব্যবহার করে তাদের উচিত এসব বাকহীন পশুগুলোর যথাযথ সেবা শুশ্রুষা করা এবং এগুলোকে সাধ্যের অতীত কোন কষ্ট না দেয়া।
(١٨٦) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْنَمَا رَجُلٌ يَمْشِي
بِطَرِيقِ اشْتَدَّ عَلَيْهِ الْعَطَشُ فَوَجَدَ بَتْرًا فَنَزَلَ فِيهَا
فَشَرِبَ ثُمَّ خَرَجَ فَإِذَا كَلْبٌ يَلْهَثْ يَأْكُلُ الثَّرَى مِنَ
الْعَطَشِ، فَقَالَ الرَّجُلُ لَقَدْ بَلَغَ هَذَا الْكَلْبَ مِنَ الْعَطَشِ مِثْلُ الَّذِي كَانَ بَلَغَنِي فَنَزَلَ الْبَشْرَ فَمَلأَ خُفْهُ
ثُمَّ أَمْسَكَهُ بِفِيهِ فَسَقَى الْكَلْبَ فَشَكَرَ اللَّهُ لَهُ فَغَفَرَ لَهُ، فَقَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ وَإِنَّ لَنَا فِي الْبَهَائِمِ أَجْرًا؟ فَقَالَ : نَعَمْ، فِي كُلِّ ذَاتِ كَيدٍ رَطْبَةٍ أَجْرًا.
(بخاري – مسلم)
(১৮৬) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, একদা এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার ভয়ংকর পিপাসা হল। সামনে সে একটি পানির কূপ পেয়ে তাতে নেমে পানি পান করে যখন উপরে আসল, তখন সে একটি তৃষ্ণার্ত কুকুরকে হাঁপাতে এবং (পিপাসার জ্বালায়) ভিজা মাটি চাটতে দেখল। লোকটি মনে মনে ভাবল একটু আগে আমার যেরূপ পানির পিপাসা হয়েছিল। এ কুকুরটিও ঠিক অনুরূপ পানির পিপাসা হয়েছে। লোকটি তৎক্ষণাৎ কূপের ভিতর অবতরণ করে তার চামড়ার মোযায় পানি ভরে মুখে কামড়িয়ে ধরে উঠে আসল এবং তৃষ্ণার্ত কুকুরটিকে তা পান করায়ে আল্লাহর শোকর আদায় করল। প্রতিদানে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দিলেন। ছাহাবায়ে কেরামগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল (সঃ), চতুষ্পদ জন্তুর প্রতি দয়া করলেও কি আমরা ছওয়াবের অধিকারী হবো? হুযুর (স:) বললেন, হ্যাঁ, যে কোন জীবের প্রতি দয়া করলে তোমরা ছওয়াবের অধিকারী হবে।”
(বুখারী, মুসলিম)
অধ্যায়: ৬ চারিত্রিক ত্রুটিসমূহ
মিথ্যা
(۱۸۷) وَعَنْ أَبِي بَكْرَةً رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: كُنَّا عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ ثَلاثًا الإِشْرَاكَ بِاللَّهِ وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ وَشَهَادَةُ الزُّورِ أَوْ وَقَوْلُ النُّورِ، وَكَانَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُتَّكِنًا ، فَجَلَسَ مَا زَالَ يُكَرِّرُهَا حَتَّى قُلْنَا : لَيْتَهُ سَكَتَ
(بخاري – مسلم)
(১৮৭) “হযরত আবু বাকরাতা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা নবী করীমের (স:) দরবারে উপস্থিত ছিলাম। হঠাৎ তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহের কথা বলে দিব না? কথাটা তিনি তিনবার বললেন। অত:পর তিনি বললেন, তা হচ্ছে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া কিম্বা মিথ্যা কথা বলা। হুযুর (স:) হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় কথাগুলো বলতেছিলেন হঠাৎ তিনি (কথার গুরুত্ব উপলব্ধি করাবার নিমিত্তে) সোজা হয়ে বসলেন এবং উক্ত কথাটি বারবার বলতে থাকলেন। এমন কি আমরা মনে মনে বলছিলাম, আহা! হুযুর যদি এখন থেমে যেতেন।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ আলোচ্য হাদীসটিতে নবী করীম (সঃ) কবীরা গুনাহসমূহের মধ্য হতে তিনটি মারাত্মক গুনাহের কথা উল্লেখ করেছেন। এর একটি হল আল্লাহর সাথে শরীক করা। দ্বিতীয় হল পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া এবং তৃতীয়টি হল মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া অথবা মিথ্যা কথা বলা। মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া ও মিথ্যা কথা বলা উভইয়টাই কবীরা গুনাহ। তবে মিথ্যা বলার চেয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া অধিক দোষণীয়।
(۱۸۸) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا ، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا، إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ، وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ (بخاري – مسلم)
(১৮৮) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, চারটি স্বভাব যার মধ্যে পাওয়া যাবে সে সন্দেহাতীতভাবে খাঁটি মোনাফেক। আর চারটি স্বভাবের কোন একটি যদি কারও মধ্যে পাওয়া যায়, তাহলে তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মোনাফেকের একটি স্বভাব আছে বলে ধরে নিতে হবে। উক্ত চারটি কু-স্বভাব হল, তার কাছে আমানত রাখা হলে সে তা খেয়ানত করে, সে যখন কথা বলে তখন মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে সে তা ভঙ্গ করে এবং ঝগড়ার সময় সে অশালীন কথা বলে।” (বুখারী, মুসলিম)
(۱۸۹) وَعَنْ سُفْيَانَ بْنِ أَسِيدٍ الْحَضْرَمِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: كَبُرَتْ خِيَانَةً أَنْ تُحَدِّثَ أَخَاكَ حَدِيثًا هُوَ لَكَ بِهِ مُصَدِّقٌ وَأَنْتَ لَهُ بِهِ
(أبو داود)
د كاذب
(১৮৯) “হযরত সুফিয়ান ইবনে উসায়িদ হাযরামী (রা:) বলেন, আমি রসূলকে (স:) এ কথা বলতে শুনেছি যে, সবচেয়ে বড় খেয়ানত হলো তুমি তোমার ভাইয়ের কাছে এমন কথা বলবে, যা সে সত্য বলে গ্রহণ করবে, অথচ তুমি তাকে মিথ্যা বলেছ।”
(আবু দাউদ)
ব্যাখ্যাঃ মিথ্যা কথা বলা গুনাহে কবীরা। কুরআন-হাদীসে একে শিরকের সমতুল্য পাপ বলে আখ্যায়িত করা করা হয়েছে। হুযুর (স:) মিথ্যা কথাকে মোনাফেকীর লক্ষণ বলে অভিহিত করেছেন। সরলমনা লোককে মিথ্যা বলে ধোকা দেয়া আল্লাহর নবী সবচেয়ে বড় খেয়ানত বলে অভিহিত করেছেন। সুতরাং আমাদের উচিত মিথ্যা পরিহার করে আল্লাহর গযব হতে বাঁচা।
(۱۹۰) وَعَنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: لا يَصْلُحُ الْكَذِبُ فِي جَدٌ وَلَا هَزْلٍ، وَلَا أَنْ يُوْعَدَ أَحَدُكُمْ وَلَدَهُ شَيْئًا ، ثُمَّ لَا يُنْجِزُهُ لَهُ (الأدب المفرد)
(১৯০) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেছেন কৌতুক ছলে ও গৌরব প্রদর্শন কোন অবস্থায়ই মিথ্যা সমীচীন নয়। আর তোমাদের সন্তানদের সাথে তোমরা এমন কোন ওয়াদা করবে না, যা তোমরা পূরণ করতে পারবে না।” (আল আদাবুল মোফরাদ)
ব্যাখ্যাঃ বাচ্চাদের ফাঁকি দেয়া এবং তাদের সাথে মিথ্যা বলাকে মানুষ সাধারণভাবে দোষণীয় মনে করে না। অথচ হাদীসে নবী করীম (স:) বাচ্চাদের সাথে মিথ্যা কথা বলা, বাচ্চাদেরকে ফাঁকি দেয়া এবং তাদেরকে কোন জিনিস দেওয়ার ওয়াদা করে তা না দেয়াকে অপরাধ বলে গণ্য করেছেন। কেননা এর ফলে পিতা মাতার ব্যাপারে বাচ্চাদের মনে খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
গীবত
(۱۹۱) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أَتَدْرُونَ مَا الْغِيبَةُ؟ قَالُوا : اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ، قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ؟ قَالَ: إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ، وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ
(مسلم)
(১৯১) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, একদা নবী করীম (স:) বললেন, তোমরা কি জানো, গীবত কাকে বলে? সাহাবীরা জওয়াব দিলেন, আল্লাহ এবং তাঁর রসূলই সবচেয়ে ভাল জানেন। (এ ছিল ছাহাবায়ে কেরামের একটি বিনয় সূচক বাক্য, যা দ্বারা তাঁরা রসূলের কাছে নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশ করতেন।) হুযুর (স:) বললেন, গীবত হলো তুমি তোমার মুসলমান ভাইয়ের বর্ণনা (তার অসাক্ষাতে) এমনভাবে করবে যে, সে তা শুনলে অসন্তুষ্ট হবে। অতঃপর হুযুরকে (স:) প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর নবী, আমি যা কিছু বলব তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রেও কি তা গীবত হবে? হুযুর (স:) জওয়াব দিলেন, তুমি যা বলছ তা যদি তার মধ্যে পাওয়া যায় তাহলে সেটা হবে গীবত। আর যদি না পাওয়া যায় তাহলে হবে বোহতান।” (মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ যদি কেহ কোন মুসলমানের ত্রুটির কথা সমাজে প্রচার করে তাকে লোক চক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করতে চায়, তাহলে সেটা গীবত এবং গীবত হলো শরীয়তের দৃষ্টিতে একটি মারাত্মক পাপ। কোরআন মজীদে গীবতকারীকে মৃত মানুষের গোশত ভক্ষণকারীর সাথে তুলনা করা হয়েছে। তাবে সংশোধনের নিয়তে তার উর্ধ্বতন কোন দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তিকে বলা গীবত নয়। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি খোলাখুলি আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত এবং মানুষের উপর যুলুম অত্যাচার করে তার দোষ ত্রুটি প্রচার করে লোককে সাবধান করে দেওয়াও গীবত নয়। বরং এটা একটি প্রয়োজনীয় কাজ।
(۱۹۲) وَعَنْ أَبِي سَعْيْدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْغِيبَةُ أَشَدُّ مِنَ الزِّنَا، قَالُوا : يَا رَسُولَ اللهِ وَكَيْفَ الْغِيبَةُ أَشَدُّ مِنَ الزِّنَا؟ قَالَ: إِنَّ الرَّجُلَ لَيَزْنِي فَيَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِ، وَإِنَّ صَاحِبَ الْغِيبَةِ لَا يُغْفَرُ حَتَّى يَغْفِرَهَا لَهُ صَاحِبُهُ
(بيهقي – مشكوة)
(১৯২) “হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, গীবত হল ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক? ছাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রসূল (স:) গীবত কি করে ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক? হুযুর (স:) বললেন, কোন ব্যক্তি যেনা করার পর যখন তওবা করে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন। কিন্তু গীবতকারীকে যার গীবত করা হয়েছে সে যদি মাফ না করে আল্লাহ মাফ করবেন না।” (বায়হাকী, মেশকাত)
চোগলখোরী
(۱۹۳) وَعَنْ أَنَسِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ مِنْ كَفَّارَةِ الْغِيبَةِ أَنْ تَسْتَغْفِرَ لِمَنِ اغْتَبْتَهُ، تَقُولُ: اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَنَا وَلَهُ
(بيهقي – مشكوة)
(১৯৩) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, গীবতের কাফফারা হলো এই যে, তুমি যার গীবত করেছ তার জন্য মাগফেরাতের দোয়া করবে। তুমি দোয়ায় এই বলবে যে, হে আল্লাহ, তুমি আমার এবং তার গুনাহ মাফ কর।”
(বায়হাকী, মেশকাত)
ব্যাখ্যা: যার গীবত করা হয়েছে সে ব্যক্তি যদি জীবিত থাকে, তাহলে তার কাছ থেকে মাফ নিতে হবে। আর যদি সে জীবিত না থাকে, তাহলে গুনাহ মাফীর জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে।
(١٩٤) وَعَنْ حُذَيْفَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ نَمَّامٌ
(بخاري – مسلم)
(১৯৪) “হযরত হোযায়ফা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম বলেছেন, চোগলখোর বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (স:)
(বুখারী, মুসলিম)
(١٩٥) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ النَّمِيمَةِ، وَنَهَى عَنِ الْغِيْبَةِ، وَعَنِ الاسْتِمَاعِ إِلَى الْغَيْبَةِ
(১৯৫) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) বলেন, নবী করীম (স:) চোগলখোরী করতে নিষেধ করেছেন, অনুরূপভাবে তিনি গীবত বলা ও গীবত শোনা থেকেও লোকদের নিষেধ করেছেন।”
ব্যাখ্যাঃ চোগলখোরী বলা হয় একের কথা অপরকে বলে উভয়ের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি করা ও ঝগড়া লাগিয়ে দেয়া। সমাজের বেশিরভাগ ঝগড়া ফাসাদ চোগলখোরী বা কূটকথার কারণেই সৃষ্টি হয়ে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা মারাত্মক পাপ। কেননা ইসলাম যে ধরনের আদর্শ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ কামনা করে, তাতে চোগলখোরের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। এ জন্যই আল্লাহর রসূল (স:) মুসলমানদেরকে এ জঘন্য পাপটি পরিহার করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং চোগলখোর যে আল্লাহর বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না, এ সাবধান বাণীও উচ্চারণ করেছেন।
(١٩٦) وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: مَرَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى قَبْرَيْنِ، فَقَالَ: إِنَّهُمَا يُعَذِّبَانِ، وَمَا يُعَذِّبَانِ فِي كَبِيرٍ، أَمَّا أَحَدُهُمَا يَمْشِي بِالنَّمِيمَةِ، وَأَمَّا الْآخَرُ فَكَانَ لَا يَسْتَنْزِهُ مِنَ الْبَوْلِ (بخاري)
(১৯৬) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আল্লাহর নবী (স:) দু’টি কবরের কাছ দিয়ে যাবার সময় বললেন, এই কবরের লোক দু’টি আযাবে লিপ্ত আছে। তাদের এ আযাব এমন কোন কাজের জন্য নয়, (যা পরিত্যাগ করা তাদের জন্যে সম্ভব ছিল না।) তবে অপরাধের বিবেচনায় তা খুব মারাত্মক। এই দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন চোগলখোরী করে (কূট-কথা বলে) বেড়াত এবং অন্যজন পেশাব করে উত্তমরূপে পবিত্র হত না।
(বুখারী)
অহংকার
(۱۹۷) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ، فَقَالَ
رَجُلٌ: إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ تَوْبَهُ حَسَنًا وَنَعْلَهُ حَسَنَةً، قَالَ: إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ، الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ (مسلم)
(১৯৭) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। এক ব্যক্তি বলল, হুযুর কেহ যদি তার লেবাস পোশাক ও জুতা উত্তম হওয়া পছন্দ করে? (তাহলে সেটাও কি অহংকার।) হুযুর (স:) জওয়াব দিলেন, অবশ্যই আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। প্রকৃতপক্ষে অহংকার হল আল্লাহর গোলামী হতে বেপরোয়া হওয়া এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা।” (বুখারী)
ব্যাখ্যাঃ যে সমস্ত চরিত্রগত ত্রুটি মানুষকে মানবতাহীন করে, তার মধ্যে আত্মাভিমান বা অহংকার হল অন্যতম। মানুষ সৃষ্টিকর্তার মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়াও পৃথিবীতে সে পদে পদে অন্যের মুখাপেক্ষী। সুতরাং যে নিয়তই অন্যের মুখাপেক্ষী বা মোহাজ, তার পক্ষে আত্মাভিমানী বা অহংকারী হওয়া আদৌ শোভা পায় না। অহংকারী ব্যক্তি যে আল্লাহর করুণা হতে বঞ্চিত থাকে, এ কথাটি হযরত লোকমান (আ:) তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে সুন্দর রূপে ব্যক্ত করেছেন, পবিত্র কোরআনে সূরা লোকমানে আল্লাহ তা নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন,
وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (سورة لقمان: ۱۸)
“(হে প্রিয় বৎস,) তুমি মুখমন্ডলকে কারো উদ্দেশ্যে গম্ভীর করবে না। (যেমন অহংকারী লোকেরা কারও সাথে আলাপ করার সময় মুখের অবস্থা করে থাকে।) আর জমীনের উপর দিয়ে দাম্ভিকতা সহকারে চলবে না। কেননা আল্লাহ কোন দাম্ভিক ও গর্ভিতকে ভালবাসেন না।” (সূরা লোকমান: ১৮)
উপরে উল্লেখিত হাদীসটিতে আল্লাহর নবী অহংকার এবং পরিচ্ছন্নতা বোধের পার্থক্যটাও সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। নবী করীম (স:) বলেছেন, কোন একটি লোকের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা কিম্বা সুন্দর ও উত্তম জুতা ইত্যাদি পরিধান করা অহংকার নয়। বরং অহংকার হলো মনের এমন একটি অবস্থা, যার ফলে অহংকারী ব্যক্তি নিজেকে উত্তম ও অপরকে অধম বলে মনে করে। পবিত্রতা বা পরিচ্ছন্নতাবোধ অহংকার নয়। কেননা আল্লাহ স্বয়ং পবিত্র এবং তিনি পবিত্রতাকে পছন্দ করেন।
(۱۹۸)
وَعَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا كُلِّ مَا شئْتَ، وَالْبَسُ مَا شِئْتَ، مَا أَخْطَأَتْكَ اثْنَتَانِ سَرَفٌ وَ مَخِيلَةٌ (بخاري)
(১৯৮) “হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, বাহুল্য ব্যয় এবং অহংকার হতে বেঁচে তুমি (হালাল খাদ্য এবং লেবাস হতে) যে কোন খাদ্য গ্রহণ করতে এবং যে কোন লেবাস পরিধান করতে পার।” (বুখারী)
ঈর্ষা (হসদ)
(۱۹۹) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ ، فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ (أبو داود)
(১৯৯) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সঃ) বলেছেন, তোমরা অবশ্যই ঈর্ষা হতে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে। কেননা অগ্নি যেভাবে কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়, অনুরূপভাবে ঈর্ষাও মানুষের নেক আমলকে নষ্ট করে দেয়।” (আবু দাউদ)
ব্যাখ্যাঃ অন্যের নেয়ামতের ধ্বংস কামনাকে বলা হয় ঈর্ষা। সামাজে কিছু লোক দেখা যায় যারা অপরের স্বচ্ছলতা কর্মকুশলতা, পদমর্যাদা ও ধন-সম্পদ দেখে নিদারুণ অন্তর্জালা অনুভব করে এবং মনে মনে তার ধ্বংস কামনা করে, নিজে অনুরূপে নেয়ামত হাসিলের প্রচেষ্টা দোষনীয় নয়। তাকে হসদ বা পরশ্রীকাতরতা বলা যায় না।
দ্বিমুখীপনা
(۲۰۰)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: تَجِدُونَ شَرَّ النَّاسِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عِنْدَ اللَّهِ ذَا الْوَجْهَيْنِ الَّذِي يَأْتِي هَؤُلَاءِ يوَجْهِ وَهَؤُلاءِ يوجه (بخاري – مسلم)
(২০০) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, কিয়ামতের দিন তোমরা দ্বিমুখী লোকটিকেই সবচেয়ে জঘন্য অবস্থায় পাবে। (দুনিয়ায়) সে কারও কাছে একরূপে আবির্ভূত হয়েছে তো অন্যের কাছে অন্যরূপে।” (বুখারী, মুসলিম)
(۲۰۱)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِيَّاكُمْ وَسُوءَ ذَاتِ الْبَيْنِ فَإِنَّهَا الْحَالِقَةُ
(ترمذی)
(২০১) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, তোমরা নিজেদেরকে পরষ্পর দুই ব্যক্তির মধ্যে ঝগড়া ফাসাদ সৃষ্টি করা থেকে বাঁচাও। কেননা এর পরিণামে তোমাদের দ্বীন ধ্বংস হবে।” (তিরমিযী)
(۲۰۲)
وَعَنْ أَبِي بَكْرِ الصِّدِّيقِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَلْعُونٌ مِنْ ضَارَّ مُؤْمِنًا أَوْ مَكَرَ بِهِ (ترمذي)
(২০২) “হযরত আবু বকর (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের ক্ষতি সাধন করে কিংবা তাকে প্রতারণা করে সে অভিশপ্ত।” (তিরমিযী)
অধ্যায়: ৭ নৈতিক গুনাগুন
নৈতিক চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ
“হে নবী, অবশ্যই আপনি নৈতিকতার অতি উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন।” (আল-কলম- ৪)
(۲۰۳) وَعَنْ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّهُ قَدْ بَلَغَهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : بُعِثْتُ لِأُتِمَّ مَكَارِمَ الأخلاق (موطأ إمام مالك)
(২০৩) “ইমাম মালেক (রা:) হতে বর্ণিত, তাঁর কাছে এই মর্মে খবর পৌঁছেছে যে, নবী করীম (সঃ) ইরশাদ করেছেন, আমি মানুষের নৈতিক গুণ মহাত্মাকে পূর্ণতার স্তরে পৌছিয়ে দেয়ার জন্যেই প্রেরিত হয়েছি।” (মুয়াত্তা-ইমাম মালেক)
ব্যাখ্যাঃ কোরআনে রসূলের যেসব দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি প্রধান ও অন্যতম দায়িত্ব হল তাযকীয়াহ।
অর্থাৎ নবী (স:) তার অনুসারীদেরকে অন্যায়, অপবিত্রতা ও চরিত্রহীনতার পংকিলতা হতে উদ্ধার করে চরিত্র মহাত্ম্যের উন্নত স্তরে পৌঁছিয়ে দিবেন। বর্ণিত হাদীসটিতে হুযুর (স:) সে কথার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন যে, নৈতিক চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্যেই আমাকে পাঠান হয়েছে।
(٢٠٤) وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّ الْمُؤْمِنَ لَيُدْرِكُ بِحُسْنِ خُلُقِهِ دَرَجَةً قَائِمِ اللَّيْلِ وَصَّائِمِ النَّهَارِ
(أبو داود)
(২০৪) “হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলকে (স:) বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই একজন মুমিন ব্যক্তি তার উত্তম চরিত্রগুণে সেই সব আবেদ লোকের মর্যাদা লাভ করতে পারে, যারা সারা রাত নামাযে কাটায় এবং সারা বছরই রোযা রাখে।”
(আবু দাউদ)
ব্যাখ্যাঃ একজন চরিত্রবান মুমিন ব্যক্তি তার উপর অর্পিত শরীয়তের বাধ্যতামূলক অপরিহার্য কাজগুলো সমাধা করার পর সে তার চরিত্র গুণে সর্বাধিক নফলের ছওয়াব প্রাপ্ত হবে।
(٢٠٥) وَعَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: آخِرُ مَا أَوْصَانِي بِهِ رَسُولُ اللَّهِ حِينَ وَضَعْتُ رِجْلِي فِي الْغَرْزِ أَنْ قَالَ: أَحْسِنْ خُلُقَكَ لِلنَّاسِ (موطأ إمام مالك)
(২০৫) “হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা:) বলেছেন, আমাকে (শাসক হিসাবে ইয়ামানে পাঠাবার সময়) ঘোড়ার রেকাবে পা রাখা অবস্থায় হুযুর (স:) শেষ উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, “হে মুয়ায লোকের সামনে স্বীয় সর্বোত্তম চরিত্রের নমুনা পেশ করবে।”
(মুয়াত্তা-ইমাম মালেক)
(٢٠٦) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمْ أَحْسَنُكُمْ أَخْلَاقًا (بخاري – مسلم)
(২০৬) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে উত্তম যে চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম।” (বুখারী, মুসলিম)
(۲۰۷)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَيَّ أَحْسَنُكُمْ أَخْلَاقًا (بخاري)
(২০৭) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) ইরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্য হতে সেই লোকটিই আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয়, যে চরিত্রের দিক থেকে উত্তম।” (বুখারী)
(۲۰۸)
وَعَنِ النَّوَّاسِ بْنِ سَمْعَانَ قَالَ: سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الْبَرِّ وَالإِثْمِ، فَقَالَ: الْبِرُّ حُسْنُ الْخُلُقِ وَالإِثْمُ مَا حَاكَ فِي صَدْرِكَ وَكَرِهْتَ أَنْ يَطْلِعَ عَلَيْهِ النَّاسُ (مسلم)
(২০৮) “হযরত নোয়াস ইবনে সাময়ান (রা:) হতে বর্ণিত বলেন, একদা আল্লাহর নবীকে পাপ ও পূণ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম। (যে তা কি?) হুযুর (স:) জওয়াব দিলেন, উত্তম চরিত্রই হল পূণ্য। আর যে কাজ তোমার মনে খটকা সৃষ্টি করে এবং লোকের কাছে তা প্রকাশ হওয়াকে তুমি পছন্দ করোনা তা হলো পাপ।” (মুসলিম)
হায়া (লজ্জাশীলতা)
(۲۰۹) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ عَلَى رَجُلٍ مِنَ الْأَنْصَارِ وَهُوَ يَعِظُ أَخَاهُ فِي الْحَيَاءِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : دَعْهُ فَإِنَّ الْحَيَاءَ مِنَ الْإِيمَانِ
(بخاري – مسلم)
(২০৯) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত, একদা নবী করীম (স:) একজন আনসার সাহাবীর পার্শ্ব দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, যে তার ভাইকে (অতিরিক্ত) লজ্জাশীলতার কারণে ভর্ৎসনা করছিল। হুযুর (স:) বললেন, একে ছেড়ে দাও। কেননা হায়া (লজ্জাশীলতা) হলো ঈমানের একটি অংগ।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ অশালীন, অশোভনীয় ও অন্যায় কাজ দর্শনে মনে সঙ্কোচবোধ করার নাম হল হায়া। হাদীসের ভাষ্য মতে হায়া হলো ঈমানের একটি অন্যতম শাখা। কাজেই ঈমানদার ব্যক্তি মাত্রই সম্ভ্রমশীল অর্থাৎ হায়ার গুণে গুণান্বিত হতে বাধ্য। সুতরাং লজ্জাশীলতার জন্য ভর্ৎসনা করা সঙ্গত নহে।
(۲۱۰) وَعَنْ عِمْرَانَ بْنَ حُصَيْنٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْحَيَاءُ لَا يَأْتِي إِلَّا بِخَيْرٍ، وَفِي رِوَايَةِ الْحَيَاءُ خَيْرٌ كُلُّهُ
(بخاري – مسلم)
(২১০) “হযরত ইমরান ইবনে হোসাইন (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, লজ্জা শুধু কল্যাণ-ই আনায়ন করে। অন্য এক বর্ণনা মতে, লজ্জার সবটুকু-ই কল্যাণকর।” (বুখারী, মুসলিম)
(۲۱۱)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْحَيَاءُ مِنَ الإِيمَانِ، وَالْإِيمَانُ فِي الْجَنَّةِ، وَالْبَذَاءُ مِنَ الْجَفَاءِ، وَالْجَفَاءُ فِي النَّارِ (أحمد – ترمذي)
(২১১) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, লজ্জা হলো ঈমানের একটি অঙ্গ এবং ঈমানদার ব্যক্তি বেহেশতী হবে। আর লজ্জাহীনতা হলো পাপ, আর পাপী ব্যক্তি জাহান্নামী হবে।” (আহমদ, তিরমিযী)
গোস্বার সময় ধৈর্য ধারণ করা
(۲۱۲)
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَا تَجَرَّعَ عَبْدٌ جَرْعَةً
أَفْضَلَ عِنْدَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ جَرْعَةِ غَيْلٍ، يَكْظِمُهَا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ تَعَالَى (أحمد)
(২১২) “ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, মানুষ যেসব বস্তুর ঢোক গ্রহণ করে থাকে, তন্মধ্যে গোস্বার সেই ঢোকটিই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম, যেটি আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখার জন্যে মানুষ গ্রহণ করে থাকে।” (আহমদ)
ব্যাখ্যাঃ আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের নিমিত্তে রাগকে প্রশমিত করা এবং লোককে ক্ষমা করে দেয়া ও ধৈর্য ধারণ করা একটি মহৎ গুণ। আল্লাহ স্বয়ং কোরআনে বলেছেন,
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (آل عمران: (١٣٤)
“যারা রাগকে প্রশমিত করে এবং লোককে ক্ষমা করে দেয়, আল্লাহ এ ধরনের সৎকর্মশীলদেরকে ভালবাসেন।” (আলে ইমরান- ১৩৪)
(۲۱۳)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَجُلًا قَالَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْصِنِي قَالَ: لَا تَغْضَبْ فَرَدَّدَ ذَالِكَ مِرَارًا ، قَالَ : لَا تَغْضَبْ (بخاري)
(২১৩) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি নবী করীমের (স:) কাছে নিবেদন করল যে হুযুর, আপনি আমাকে কোন উপদেশ দান করুন। হুযুর (স:) বললেন, তুমি রাগ করবে না, লোকটি বার বার একই প্রশ্ন করছিল এবং হুযুর (স:) বার বার তাকে জওয়াব দিচ্ছিলেন যে তুমি রাগ করবে না।” (বুখারী)
(٢١٤) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَة رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَيْسَ الشَّدِيدُ بالصَّرْعَةِ إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ
(بخاري – مسلم)
(২১৪) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি লোককে কুস্তিতে হারিয়ে দেয় সে বাহাদুর নয়, বরং প্রকৃতপক্ষে বাহাদুর সেই ব্যক্তি যে রাগের মুহূর্তে নিজেকে সামলাতে পারে।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ একজন মুসলমান ব্যক্তি যে আদৌ রাগ করবে না তা নয়। তবে যে সব ক্ষেত্রে সে রাগ করবে সেখানে সে কান্ড জ্ঞান বিবর্জিত হয়ে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে না। বরং চরম রাগের মুহুর্তেও যেন সে নিজেকে সামলাতে পারে এটাই রসূলের তালীম।
জিহবা ও লজ্জাস্থানের হেফাযত
(٢١٥) وَعَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ شَفَتَيْهِ وَمَا بَيْنَ فَحْذَيْهِ أَصْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ (بخاري)
(২১৫) “হযরত সাহল ইবনে সায়াদ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাকে তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের (পবিত্রতার) নিশ্চয়তা দিতে পারবে, আমি তাকে বেহেশতের নিশ্চয়তা দিতে পারব।” (বুখারী)
ব্যাখ্যাঃ মানব দেহের অভ্যন্তরে উপরোক্ত দুটি অঙ্গ হলো এমন দুর্বল যেখান থেকে শয়তানের হামলার সম্ভাবনা সর্বাধিক। সুতরাং যে ঈমানদার ব্যক্তি শয়তানকে পরাভূত করে এ দুটি অঙ্গের পবিত্রতা রক্ষা করবে, হুযুর (স:) তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দান করেছেন।
শিক্ষার গুরুত্ব (ইলম)
(٢١٦) وَعَنْ مُعَاوِيَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهُهُ في الدِّينِ (بخاري – مسلم)
(২১৬) “হযরত মোয়াবিয়া (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ যার কল্যাণ কামনা করেন, তাকে তিনি দ্বীনের জ্ঞান দান করে থাকেন।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ মানুষের পরকালীন কল্যাণ নির্ভর করে আল্লাহর দ্বীনকে সঠিকরূপে বুঝা, তা উপলব্ধি করা এবং তার উপর যথাযথ আমল করার উপর। যে লোক আল্লাহর দ্বীনকে অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যসহ জানতে ও বুঝতে পারবে, দ্বীনের উপর সে সঠিকভাবে আমল করতে পারবে। কাজেই আল্লাহ যার কল্যাণে ব্রতী হন, তাকেই তিনি দ্বীনের জ্ঞানদান করে থাকেন।
(۲۱۷)
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ
رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ (ابن ماجه)
(২১৭) “হযরত আনাস (র:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, প্রতিটি মুসলিম নর নারীর উপর ইলম শিক্ষা করা ফরয।”
(ইবনে মাযাহ)
(۲۱۸) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ، وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتِ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفْتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيْمَنْ عِنْدَهُ وَمَنْ بَطْأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ
(مسلم – أبو داود – ترمذي)
(২১৮) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্যে পথ চলবে, আল্লাহ তার জন্য বেহেশতের পথ সুগম করে দিবেন। আর যখন কোন একদল লোক আল্লাহর ঘরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে এবং তার উপর শিক্ষামূলক আলাপ আলোচনা করে, তখন তাদের উপর (আল্লাহর তরফ হতে) এক মহাপ্রশান্তি অবতীর্ণ হয় এবং আল্লাহর রহমত তাদেরকে আবৃত করে রাখে। আর ফিরেশতাদের মজলিসে তাদের সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করেন। আর যার আমল তাকে পিছন দিকে টানবে, বংশ গৌরব তাকে আগে বাড়াতে পারবে না।” (অর্থাৎ ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্য হল ইলম অনুসারে আমল করা। সুতরাং যে আমল করবে না তার ইলম কিংবা বংশ মর্যাদা তাকে আল্লাহর নিকট পৌঁছাতে পারবে না।)
(মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি)
(۲۱۹) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ بِمَجْلِسَيْنِ فِي مَسْجِدِهِ فَقَالَ: كِلَاهُمَا عَلَى خَيْرٍ، وَأَحَدُهُمَا أَفْضَلُ مِنْ صَاحِيهِ، أَمَّا هَؤُلَاءِ فَيَدْعُونَ اللَّهَ وَيُرَغْبُونَ إِلَيْهِ فَإِنْ شَاءَ أَعْطَاهُمْ وَإِنْ شَاءَ مَنَعَهُمْ، وَأَمَّا هَؤُلَاءِ فَيَتَعَلَّمُونَ الْعِلْمَ وَيُعَلِّمُونَ الْجَاهِلَ فَهُمْ أَفْضَلُ، وَإِنَّمَا بُعِثْتُ مُعَلِّمًا
ثُمَّ جَلَسَ مَعَهُمْ (مشكوة)
(২১৯) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) হতে বর্ণিত, একদিন আল্লাহর নবী মসজিদে নববীতে এসে দুটি দল দেখতে পেলেন। (তন্মধ্যে একটি দল ইলম চর্চা করতেছিল এবং অন্য দলটি আল্লাহর যিকির ও দোয়ায় মশগুল ছিল)। হুযুর (স:) বললেন, উভয় দলই ভাল কাজে লিপ্ত। একটি দলতো আল্লাহর যিকির ও দোয়ায় মশগুল। আল্লাহ ইচ্ছা করলে এদেরকে (এদের কাংখিত বস্তু) দিতেও পারেন, নাও দিতে পারেন। আর ঐ দ্বিতীয় দলটি ইলম চর্চা করছে এবং অজ্ঞ লোকদেরকে তালীম দিচ্ছে। সুতরাং এই দলটিই উত্তম। কেননা আমাকেও শিক্ষক করে পাঠানো হয়েছে। এই বলে হুযুর (স:) দ্বিতীয় দলটির সঙ্গে বসে গেলেন।” (মেশকাত)
(۲۲۰) وَعَنْ أَبِي أُمَامَةَ الْبَاهِلِيِّ قَالَ ذُكِرَ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلَانِ أَحَدُهُمَا عَابِدٌ وَالْآخَرُ عَالِمٌ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِي عَلَى أَدْنَاكُمْ، ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ حَتَّى النَّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ
(ترمذي – دارمي)
(২২০) “হযরত আবু উমামা (রা:) হতে বর্ণিত, একদা নবী করীমের (স:) কাছে এমন দুই ব্যক্তির বিষয় আলোচনা করা হলো, যার মধ্যে একজন ছিলেন আবেদ এবং অন্যজন ছিলেন আলেম। (অর্থাৎ এই মর্মে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে এদের উভয়ের মধ্যে মর্যাদার দিকে দিয়ে কে উত্তম।) হুযুর (স:) বললেন, তোমাদের একজন সাধারণ মুসলমানের তুলনায় আমি যে মর্যাদার অধিকারী, উক্ত আলেম ব্যক্তিও উক্ত আবেদ ব্যক্তির তুলনায় অনুরূপ মর্যাদার অধিকারী। অত:পর হুযুর (স:) বললেন, স্বয়ং আল্লাহ, ফিরেশতাগণ ও আসমান জমীনের অধিবাসীরা এমন কি ভূগর্ভস্থ পিপীলিকা ও পানির ভিতরের মাছ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির জন্য দোয়া করে, যে লোককে কল্যাণকর ইলম শিক্ষা দিয়ে থাকে।” (তিরমিযী, দারমী)
আমরু বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকার
(সৎকার্যের আদেশ দান ও অসৎকার্য হতে বিরত রাখা)
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
آل عمران: (١٠٤)
“তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক থাকতেই হবে, যারা মানুষকে নেকী ও মঙ্গলের দিকে ডাকবে, ভাল ও সৎ কাজ করার জন্যে আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ করতে নিষেধ করবে। তারাই হবে সফলকাম।” (আল ইমরান: ১০৪)
(۲۲۱)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَمَّا وَقَعَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ فِي الْمَعَاصِي نَهَتْهُمْ عُلَمَاؤُهُمْ فَلَمْ يَنْتَهُوا ، فَجَالَسُوهُمْ فِي مَجَالِسِهِمْ وَأَكَلُوهُمْ وَشَارَبُوهُمْ، فَضَرَبَ اللَّهُ قُلُوبَ بَعْضِهِمْ عَلَى بَعْضٍ وَلَعَنَهُمْ عَلَى لِسَانِ دَاوُدَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَالِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا
يَعْتَدُونَ، قَالَ: فَجَلَسَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَكَانَ مُتَّكِنًا، فَقَالَ: لَا وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ وَلَتَأْخُذُنَّ عَلَى يَدَيِ الظَّالِمِ وَلَتَأْطِرُنَّهُ عَلَى الْحَقِّ أَطْرًا، أَوْ لَيَضْرِبَنَّ اللَّهُ بِقُلُوبِ بَعْضِكُمْ عَلَى بَعْضٍ ثُمَّ لَيَلْعَنَنَّكُمْ كَمَا لَعَنَهُمْ (بيهقي – مشكوة)
(২২১) “হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সঃ) বলেছেন, যখন ইসরাঈল জাতির লোকেরা পাপকার্যে লিপ্ত হলো, তখন তাদের আলেমগণ তাদেরকে নিষেধ করলেন। কিন্তু তারা তাতে কর্ণপাত করল না। অত:পর তাদের আলেমগণ (তাদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ না করে) তাদের সংগেই খানা-পিনা ও উঠা-বসা করতে থাকল। ফলে আল্লাহ তাদের উভয় দলের অবস্থা এক করে দিলেন। (অর্থাৎ আলেমদের দেলও পাপীদের দেলের ন্যায় পংকিল ও কালিমাময় হয়ে গেল) আর তাদের এ পাপকার্য ও সীমালংঘন হেতু আল্লাহ হযরত দাউদ (আঃ) হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মের (আ:) মাধ্যমে তাদেরকে অভিসম্পাত দিলেন। বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন এ পর্যন্ত হুযুর (স:) হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় (কথাগুলি বলতে ছিলেন।) হঠাৎ তিনি (কথার গুরুত্ব বিবেচনা করে) সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন না, (তোমাদেরকে বনী ইসরাঈলদের ন্যায় হলে চলবে না)। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি যার মুঠোর মধ্যে, আমার জান। নিশ্চই তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে এবং অসৎ কাজ হতে লোককে বিরত রাখবে। যদি তোমরা তা না কর, তাহলে তোমাদের দেলও পাপীদের দেলের অনুরূপ হয়ে যাবে। অতঃপর তোমরাও বনী ইসরাঈল জাতির ন্যায় অভিসপ্ত জাতিতে পরিণত হবে।” (বায়হাকী, মেশকারত)
ব্যাখ্যাঃ বর্ণিত হাদীসটিতে আল্লাহর নবী মুসলমানদের প্রভাবশালী আলেম সমাজ ও ইসলামী রাষ্ট্রের কর্ণধারদেরকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রভাব দ্বারা যালেমদেরকে বাধা দান করতে: সমাজ হতে যুলুম ও অবিচারের মূলোচ্ছেদ করতে এবং ন্যায় ও সুবিচারের প্রচলন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীসের বর্ণনায় পরোক্ষভাবে এ কথার ইঙ্গিত মিলে যে, ক্ষমতাহীন লোকদের পক্ষে প্রকৃত অর্থে “আমরু বিল মারুফ নাহী আনিল মুনকার” সম্ভব নয়। কেননা তারা যালেমকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে না, তারা শুধু মৌখিক তাবলীগ করতে পারে। তাও যেটুকু যালেম সরকার ও প্রভাবশালী নেতা অনুমোদন করবে। প্রকৃত অর্থে আমর বিল মারুফের জন্য যে, রাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতার প্রয়োজন, তা কোরআনে বর্ণিত নিম্নোক্ত আয়াতটি হতে অনুধাবন করা যায়।
الَّذِينَ إِنْ مَكَنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الأُمُورِ (سورة الحج: (٤١)
“যদি আমি তাদেরকে (মুসলমানদেরকে) ভূখন্ডের কোন অংশে শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করি, তাহলে তারা সেখানে নামায কায়েম করবে, যাকাতের ব্যবস্থা চালু করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দান ও অসৎকাজ হতে লোককে বিরত রাখবে। আর প্রতিটি ব্যাপারের পরিণাম আল্লাহর হাতে।” (সূরা হজ্জ: ৪১)
(۲۲۲)
وَعَنِ نُعْمَانَ بْنِ بَشِيرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَثَلُ الْمُدْهِنِ فِي حُدُودِ اللَّهِ وَالْوَاقِعِ فِيهَا مَثَلُ قَوْمٍ اسْتَهَمُوا سَفِينَةً فَصَارَ بَعْضُهُمْ فِي أَسْفَلِهَا بَعْضُهُمْ فِي أَعْلَاهَا فَكَانَ الَّذِي فِي أَسْفَلِهَا يَمُرُّ بِالْمَاءِ عَلَى الَّذِينَ فِي أَعْلَاهَا فَتَأَذَوْا بِهِ فَأَخَذَ فَأْسًا فَجَعَلَ يَنْقُرُ أَسْفَلَ السَّفِينَةِ فَأَتَوْهُ فَقَالُوا مَا لَكَ قَالَ تَأَذَّيْتُمْ بِي، وَلَا بُدَّ لِي مِنَ الْمَاءِ فَإِنْ أَخَذُوا عَلَى يَدَيْهِ أَنْجَوْهُ وَنَجَّوْا أَنْفُسَهُمْ وَإِنْ تَرَكُوهُ أَهْلَكُوهُ، وَأَهْلَكُوا أَنْفُسَهُمْ (بخاري)
(২২২) “হযরত নোমান ইবনে বশীর (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (স:) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানীর কাজে লিপ্ত, আর যে ব্যক্তি তা দেখেও কিছু বলে না। (বরং চোখ ফিরিয়ে থাকে) এ দুই ব্যক্তির অবস্থা হল তদ্রুপ, যেমন একদল লোক কোন একখানা জলযানে আরোহণ করেছে। অত:পর কিছু লোক উপর তলায় অবস্থান করল এবং কিছু লোক নীচের তলায়। (যেমন দ্বিতল স্টীমার কিংবা লঞ্চে লোক অবস্থান করে থাকে।) ফলে নীচের তলার লোকেরা পানির প্রয়োজনে উপরে আসতে থাকল এবং এর ফলে উপরের লোকেরা অস্বস্তি বোধ করতে থাকল। (নিরুপায় হয়ে) শেষ পর্যন্ত নীচের তলার লোকেরা কুঠার নিয়ে জলযানের নীচের তক্তা ছিদ্র করার প্রস্তুতি নিল। (যাতে নদী হতে পানি তুলে প্রয়োজন মিটাতে পারে।) উপরের লোকেরা (টের পেয়ে) নীচে এসে তাদেরকে বলল, কেন তোমরা এ আত্মঘাতী কাজ করছ? তারা জওয়াবে বলল, আমাদের পানির প্রয়োজন, অথচ (পানির প্রয়োজনে) আমাদের উপরে যাওয়াটা তোমরা পছন্দ করছো না। এমতাবস্থায় উপরের লোকেরা যদি তাদের হাত ধরে তাদেরকে এ আত্মঘাতী কাজ হতে বিরত রাখে তবে উভয় দলই বেঁচে যাবে। আর যদি তারা তা না করে, তাহলে উভয় দলই ডুবে মরবে। অর্থাৎ যদিও উপর তলার লোকেরা জলযান ছিদ্র করার ব্যাপারে অংশ গ্রহণ করেনি, তবুও সলিল সমাধির হাত থেকে তারাও রক্ষা পাচ্ছে না, যেমন পাচ্ছে না ছিদ্রকারী নীচ তলার লোকেরা। অনুরূপভাবে সমাজে পাপকার্যে আধিক্যের কারণে যে আযাব নাযিল হয়, তা হতে তারাও বাঁচতে পারে না, যারা পাপকার্যে অংশ গ্রহণ করেনি। অথচ পাপীদেরকে পাপকাজ হতে বিরত রাখারও চেষ্টা করেনি।” (বুখারী)
(۲۲۳) وَعَنِ أَبِي سَعِيدِنِ الْخُدْرِي رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ رَائَ مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ ذَالِكَ أَضْعَفُ الإِيْمَانِ (مسلم)
(২২৩) “হযরত আবু সাইয়েদ খুদরী (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, তোমাদের কেহ যদি কোন অন্যায় কাজ অনুষ্ঠিত হতে দেখে, তাহলে সে যেন তা হস্তদ্বারা ঠেকায়। আর যদি তার সে শক্তি না থাকে তাহলে যেন মৌখিক বারণ করে। যদি সে মৌখিক বারণ করতেও অপারগ হয়, তাহলে যেন মনে মনে তার পরিবর্তন কামনা করে। আর মনে মনে পরিবর্তনের আকাঙ্খা পোষণ করাটা হলো ঈমানের দুর্বলতম লক্ষণ।” (মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ বর্ণিত হাদীসটিতে মানুষকে পাপ ও গর্হিত কাজ হতে বিরত রাখার জন্য অবস্থা ভেদে তিনটি পদ্ধতি গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। যাদের সামনে পাপকার্য সংঘটিত হয়, তারা যদি শক্তিশালী ব্যক্তি হয়, যেমন শাসক, দলপতি, সমাজ বা পরিবারের কর্তা কিংবা প্রভাবশালী কোন নেতা, তাহলে যেন তারা শক্তি প্রয়োগ করে উক্ত পাপ হতে তাকে বিরত রাখে। আর যদি শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষমতা না রাখে, যেমন পাপানুষ্ঠানে যে লিপ্ত সে যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী কিংবা কোন প্রভাবশালী নেতা হয়, তাহলে যেন মৌখিক প্রতিবাদ করে। আর যদি মৌখিক প্রতিবাদ করার মত অবস্থাও না থাকে, তাহলে যেন অন্তরে উক্ত পাপকার্যের অবসান কামনা করে। হুযুর (স:) বলেছেন, সর্বশেষ পন্থাটি অবলম্বন করা হলো দুর্বল ঈমানের লক্ষণ।
(٢٢٤) وَعَنْ حُذَيْفَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ النَبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ أَوْ لَيُوشِكُنَّ اللَّهُ أَنْ يَبْعَثَ . عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِنْ عِنْدِهِ ثُمَّ لَتَدْعُونَهُ فَلَا يُسْتَجَابُ لَكُمْ (ترمذي)
(২২৪) “হযরত হোযায়ফা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) ইরশাদ করেছেন, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যার নিয়ন্ত্রণে আমার জীবন। অবশ্যই তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায় ও পাপ কাজ হতে লোককে বিরত রাখবে। নতুবা তোমাদের উপর শীঘ্রই আল্লাহর আযাব নাযিল হবে। অতঃপর তোমরা (তা হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে) দোয়া করতে থাকবে কিন্তু তোমাদের দোয়া কবুল হবে না। (তিরমিযী)
(٢٢٥) عَنِ جَرِيرٍ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَا مِنْ رَجُلٍ يَكُونُ فِي قَوْمٍ يُعْمَلُ فِيهِمْ بِالْمَعَاصِي يَقْدِرُونَ عَلَى أَنْ يُغَيِّرُوا عَلَيْهِ فَلَا يُغَيِّرُوا إِلَّا أَصَابَهُمُ اللَّهُ بِعَذَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَمُوتُوا
(أبو داؤد)
(২২৫) “হযরত জরীর ইবনে আবদুল্লাহ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর নবীকে একথা বলতে শুনেছি যে, যে জাতির মধ্যে কোন এক ব্যক্তি পাপকার্য্যে লিপ্ত হয়, আর উক্ত জাতির লোকেরা শক্তি রাখা সত্ত্বেও তা হতে তাকে বিরত রাখে না আল্লাহ সে জাতির উপর মৃত্যুর পূর্বেই এক ভয়াবহ আযাব চাপিয়ে দিবেন।” (আবু দাউদ)
ব্যাখ্যাঃ উপরোক্ত হাদীসটিতে আল্লাহর নবী মুসলমানের একটি অন্যতম সামাজিক দায়িত্বের কথা স্মরন করিয়ে দিয়েছেন। মুসলিম সমাজের কোন এক ব্যক্তি যখন প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত হয় তখন গোটা সমাজের দায়িত্ব হলো উক্ত ব্যক্তিকে তা হতে বিরত রাখা, সমাজের যে কোন ব্যক্তিই আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হোক, আর সে যতই প্রভাবশালী হোক। গোটা সমাজের প্রতিরোধের সামনে মাথানত করতে সে বাধ্য। এমন কি সে যদি রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিও হয়। কেননা গোটা জনগণ যখন তার প্রকাশ্য পাপাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠবে, তখন সে জনগণের সামনে মস্তক অবনত করতে বাধ্য হবে। পক্ষান্তরে সমাজ বা জাতি যখন তার এই পবিত্র দায়িত্বের কথা ভুলে যায় এবং পাপী ব্যক্তিকে অবাধে পাপকার্যে লিপ্ত দেখেও মৌনতা অবলম্বন করে তখন পরোক্ষভাবে উক্ত জাতিও ঐ পাপকার্যের অংশীদার হয়ে যায়। অত:পর আল্লাহ তাদের উপর আযাব নাযিল করেন।
(٢٢٦) وَعَنْ حُذَيْفَةَ بْنِ الْيَمَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ، وَلَتَحَاضُنَّ عَلَى الْخَيْرِ أَوْ لَا يَسْتَعَنَّكُمُ اللَّهُ جَمِيعًا بِعَذَابٍ أَوْ لَيُؤْمِرَنَّ عَلَيْكُمْ شِرَارَكُمْ ثُمَّ يَدْعُو خِيَارُكُمْ فَلَا يُسْتَجَابُ لَهُمْ (مسند أحمد)
(২২৬) “হযরত হোযায়ফা ইবনে ইয়ামান (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) ইরশাদ করেছেন, অবশ্যই তোমরা নেক কাজের নির্দেশ দান করবে, পাপকাজ হতে লোককে বিরত রাখবে এবং কল্যাণকর ইসলাম সম্মত কাজের জন্য লোককে উৎসাহ দিবে। অন্যথায় এক সামগ্রিক আযাবের মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদেরকে ধ্বংস করে দিবেন। অথবা তোমাদের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম পাপী লোকগুলোকে তোমাদের শাসক নিযুক্ত করবেন। অত:পর তোমাদের নেককার লোকেরা দোয়া করতে থাকবে, কিন্তু তাদের দোয়া কবুল করা হবে না।” (মুসনাদে ইমাম আহমদ)
ব্যাখ্যাঃ কোন একটি দেশ বা ভূখন্ডের মুসলিম অধিবাসীরা সামগ্রিকভাবে যখন আমরু বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের” দায়িত্ব পালন করা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ এ দুনিয়ায়ই তাদেরকে নিম্নোক্ত দুটি শাস্তির যে কোন একটি দ্বারা শায়েস্তা করে থাকেন।
একটি হলো ব্যাপক ভিত্তিক কোন আসমানী আযাব। যেমন বন্যা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদি। দ্বিতীয় হল অত্যাচারী শাসক, অর্থাৎ সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও পাপী লোকদেরকে তাদের শাসক নিয়োগ করে দেয়া হয়, যাদের যুলুম ও নিষ্পেষণে গোটা জাতিই ধুকে ধুকে মরতে থাকে। আর এই চরম অবস্থাটা যখন দেখা দেয়, তখন সে সমাজের বোযর্গ লোকদের দোয়াও আল্লাহ কবুল করেন না।
আমলবিহীন তাবলীগ
(۲۲۷)
وَعَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: رَأَيْتُ لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِي رِجَالًا تُقْرَضُ شِفَاهُهُمْ بِمَقَارِيضَ مِنْ نَارٍ، فَقُلْتُ: مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيلُ ؟ قَالَ: هَؤُلَاءِ خُطَبَاءُ مِنْ أُمَّتِكَ يَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَيَنْسَوْنَ أَنْفُسَهُمْ (مشكوة)
(২২৭) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, মেরাজের রাতে আমি দেখতে পেয়েছিলাম যে, কতগুলো লোকের ঠোট দুটি আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। আমি জিবরীলকে (আ:) জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, এরা হলো আপনার উম্মতের মোবাল্লেগ, যারা অপরকে নেক কাজ করার নসীহত করেছে, কিন্তু নিজেরা তা আমল করেনি।” (মিশকাত)
জামায়াতের অপরিহার্যতা
(۲۲۸)
وَ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: مَنْ خَرَجَ مِنَ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً
(مسلم)
(২২৮) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রসূলকে (স:) এ কথা বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্যকে অস্বীকার করত জামায়াত পরিত্যাগ করল এবং সেই অবস্থায়ই সে মারা গেল, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল।” (মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ মানব সমষ্টির এমন একটি দলকে “জামায়াত” বলা হয় যারা কোন একটি সুষ্ঠ প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিশেষ কোন একটি লক্ষ্য হাসিলের জন্যে পরষ্পর সংঘবদ্ধ হয়। জামায়াতের জন্য চারটি জিনিস অপরিহার্য্য। উদ্দেশ্য, কর্মসূচী, নেতৃত্ব ও সংগঠন। উপরোক্ত চারটি বস্তুর যে কোন একটির অভাবে জামায়াত হবে না। এ কারণেই হাট বাজারের সংঘবদ্ধ লোকগুলোকে জামায়াত বলা হয় না। কেননা উপরোক্ত শর্তগুলোর একটিও তাতে পাওয়া যায় না। পক্ষান্তরে ঈদগাহ ও জুময়ার মসজিদের দলবদ্ধ লোকগুলোকে জামায়াত বলা হয়। কেননা শর্ত চতুষ্ঠয়ের সবকটিই তাতে বিদ্যমান।
হাদীসে “জামায়াত” অর্থে ইসলামী জামায়াতকে বুঝানো হয়েছে। আর ইসলামী জামায়াত বা দল বলা হয়, এমনই একটি দলকে যে দলটি আল্লাহ রসূলের পছন্দনীয় প্রোগ্রামের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কোন একজন নেতার (ইমামের) নেতৃত্বে পরষ্পর সংঘবদ্ধ হয়। আল্লাহ তায়ালা বাতেলকে মিটিয়ে দ্বীনে হক প্রতিষ্ঠার যে দায়িত্ব উম্মতে মুহাম্মাদীকে দিয়েছেন, তার জন্য সংঘবদ্ধ শক্তি অপরিহার্য। বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন পরষ্পর সংযোগ বিহীন একক প্রচেষ্টা দ্বারা না দ্বীন প্রতিষ্ঠা সম্ভব, না বাতেলকে মিটানো সম্ভব।
আল্লাহ তাঁর পবিত্র কালামে মজীদে ইরশাদ করেছেন,
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ (آل عمران : ١٠٤)
“তোমরাই সর্বোৎকৃষ্ট উম্মত। মানব জাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের আবির্ভাব। তোমরা (তাদেরকে) সৎকাজের নির্দেশ দান করবে এবং অসৎ কাজ হতে বিরত রাখবে।” (আলে ইমরান- ১১০)
প্রকাশ থাকে যে, উপরোক্ত দায়িত্বটি আল্লাহ মুসলমানদের জামায়াতকে দিয়েছেন ব্যক্তিকে নয়। কেননা এত বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজ এক ব্যক্তির চেষ্টায় সম্ভব নয়, তা তিনি যত বড়ই জ্ঞানী, গুণী কিংবা ক্ষমতাশালী লোকই হোক। পয়গম্বরদের মতো পবিত্র চরিত্র, গুণধর ও বিরাট ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোকদের পক্ষেও উম্মতে মুসলেমার জামায়াতের সাহায্য ব্যতিরেকে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। এর জন্যেই হাদীসে জামায়াতের সাথে শামিল থাকার জন্যে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং জামায়াত হতে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে জাহেলিয়াত’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
(۲۲۹)
وَعَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ الشَّيْطَانَ ذِئْبُ ابْنِ آدَمَ كَذِئْبِ الْغَنَمِ، يَأْخُذُ الشَّاةَ الْقَاصِيَةَ النَّاحِيَةَ، وَإِيَّاكُمْ وَالشِّعَابَ، وَعَلَيْكُمْ بِالْجَمَاعَةِ وَالْعَامَّةَ.
(مسند أحمد)
(২২৯) “হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, মেষ পালের (শত্রু) বাঘের ন্যায় মানুষের বাঘ (শত্রু) হলো শয়তান। (মেষ পালের ভেতর হতে) বাঘ সেই মেষটিকেই ধরে নিয়ে যায়, যে একাকী বিচরণ করে। কিংবা (খাদ্যের অন্বেষণে) পাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা হয়ে যায়। সাবধান, তোমরা (দল ছেড়ে) দুর্গম গিরি পথে যাবে না এবং তোমরা অবশ্যই দলবদ্ধভাবে সাধারণের সংগে থাকবে।” (আহমদ)
ব্যাখ্যাঃ আরব এবং তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে কিছু লোক পশু পালন দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে। চারণভূমি এবং পর্বতের পাদদেশে তারা তাদের পশুগুলোকে দলবদ্ধভাবে চরায়। আর বাঘে যাতে কোন পশু ধরে নিয়ে যেতে না পারে, সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে। ফলে রাখালদের অস্ত্রের ও পাল-রক্ষাকারী শিকারী কুকুরের ভয়ে কোন বাঘই পালের পশুকে আক্রমণ করে না। কিন্তু রাখালদের অগোচরে কোন পশু যদি ঘাস খেতে খেতে পাল ছাড়া হয়ে যায়, তখনই নিকটবর্তী পর্বত গুহা কিংবা জংগল হতে বাঘ এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়।
উপরোক্ত দৃষ্টান্তটির মাধ্যমে রসূল (স:) মুসলমানদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন যে, পাল ছাড়া পশু যেমন বাঘের শিকার হয়, তেমনি জামায়াত ত্যাগী বা জামায়াত ছাড়া মুসলমানও শয়তানের শিকার হয়, তা সে যত বড় মুসলমানই হোক না কেন।
সারা বিশ্বে বর্তমানে মুসলমানদের যে দুর্দশা তার একমাত্র কারণ হলো তাদের পরষ্পর বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্য। আরবের মুসলিম দেশগুলোর অনৈক্য ও কোন্দলের ফলেই তারা আজ ক্ষুদ্র ইহুদী জাতি দ্বারা লাঞ্ছিত। এককালে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী তুর্কিস্তান, উজবেকিস্তান ও আজারবাইজানের মুসলমানেরা নিজেদের অনৈক্যের ফলেই কমিউনিষ্ট শাসনে নিষ্পেষিত। আমাদের এ উপমহাদেশের মুসলমানেরাও ঠিক একই চরিত্রের অভিনয় করছে। ফলে সারা বিশ্বে আজ আর মুসলমানদের বিশেষ কোন মর্যাদা নেই।
অধুনা যদিও মুসলমানেরা কোথাও দলবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা করে, তবে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তিতে নয়। বরং ভাষা বর্ণ কিংবা এলাকার ভিত্তিতে। যাকে আল্লাহর নবী পরিষ্কার ভাষায় জাহেলিয়াত বলে আখ্যায়িত করেছেন,
(۲۳۰)
وَعَنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ لَا يَجْمَعُ أُمَّتِي أَوْ قَالَ أُمَّةَ مُحَمَّدِرٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى ضَلَالَةٍ، وَمَنْ شَدَّ شُدَّ فِي النَّارِ (ترمذي)
(২৩০) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা আমার উম্মতকে অথবা মুহাম্মদের (স:) উম্মতকে কখনও ভুল সিদ্ধান্তের উপর সংঘবদ্ধ করবেন না। আর জামায়াতের উপরই আল্লাহর রহমত। সুতরাং যে জামায়াত হতে বিচ্ছিন্ন হবে সে জাহান্নামে পতিত হবে।” (তিরমিযী) ব্যাখ্যাঃ বর্ণিত হাদীসটিতে আল্লাহর নবী সুসংবাদ দান করেছেন যে, মুহাম্মদ (স:) এর প্রকৃত উম্মতেরা কখনও কোন ভুল সিদ্ধান্তের উপর ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। আর এরই কারণে উম্মতের ইজমাকে (সংঘবদ্ধ ফয়সালাকে) শরীয়তের দলীল হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে।
(۲۳۱)
وَعَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ
أحمد – أبو داؤد)
(২৩১) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি জামায়াত ত্যাগ করে এক বিঘাত পরিমান দূরে সরে গেল, সে যেন ইসলামের রজ্জু হতে তার গর্দানকে আলাদা করে নিল।” (আহমদ, আবু দাউদ)
ব্যাখ্যাঃ রসূলের উপরোক্ত ঘোষণা এ কথাই প্রমাণ করে যে, ব্যক্তিগত জীবনে একটি লোক যতই পরহিযগার হোক না কেন, যদি সে আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠাকল্পে সংগঠিত মুসলমানদের কোন জামায়াতে নিজেকে শামিল না করে, তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে সে জীবন হবে মূল্যহীন।
এখানে একটি কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তা এই যে, নবীর জীবদ্দশায় নবীর নেতৃত্ব যে জামায়াত গঠিত হয় তাকে বলা হয় “আল জামায়াত”। অর্থাৎ মুসলমানদের একমাত্র জামায়াত। তখন প্রতিটি লোকের উক্ত জামায়াতে শরীক হওয়া ফরয ছিল এবং বাহিরে থাকা ছিল কুফরী। তবে নবীর তিরোধানের পর তার উম্মতের মধ্যে একাধিক লোকের নেতৃত্বে একাধিক জামায়াত হতে পারে। তবে তাদের লক্ষ্য হবে এক ও অভিন্ন। তাহলো নবীর প্রদর্শিত পন্থায় আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা। ফলে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অভিন্নতা উক্ত একাধিক দলকে পরষ্পর পরষ্পরের সহযোগী করবে, প্রতিদ্বন্দ্বী করবে না।
প্রকৃতপক্ষে নবীর তিরোধানের পর মুসলমানদের বিশেষ কোন একটি জামায়াত নিজেদের জামায়াতকে সমগ্র বিশ্বের জন্য একমাত্র জামায়াত বলে দাবী করতে পারে না, যার বাহিরে থাকা কুফরী। পক্ষান্তরে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা কল্পে সুনির্দিষ্ট কোন প্রোগ্রামের ভিত্তিতে মুসলমানদের কোন একটি দলে শামিল না হয়ে নিজেকে আহলে সুন্নাত আল জামায়াতের একজন সদস্য মনে করে আত্মতৃপ্তি লাভ করাও একটি হাস্যকর প্রবণতা।
(۲۳۲)
وَعَنِ الْحَارِثِ الأَشْعَرِي رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ،
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ: بِالْجَمَاعَةِ، وَالسَّمْعِ، وَالطَّاعَةِ، وَالْهِجْرَةِ، وَالْجِهَادِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، وَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ مِنَ الْجَمَاعَةِ قِيدَ شِبْرٍ فَقَدْ
خَلَعَ رِبْقَةَ الإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ إِلَّا أَنْ تُرَاجِعَ مَنْ دَعَا
بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُتَى جَهَنَّمَ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى
وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ (أحمد – ترمذي)
(২৩২) “হযরত হারিছ আল আশয়ারী (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) ইরশাদ করেছেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি। জামায়াতে শামিল হওয়া, নেতার কথা শুনা ও তার অনুগত্য করা, (প্রয়োজন বোধে) হিজরত করা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা। আর যে ব্যক্তি জামায়াত হতে এক বিঘাত পরিমাণ দূরে সরে যাবে, সে পুনরায় জামায়াতভুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যেন ইসলামের রজ্জু তার গ্রীবাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। আর যদি কোন ব্যক্তি জাহেলিয়াতের নিয়ম-নীতির দিকে লোককে আহ্বান করে, সে যতই নামায রোযা করুক এবং নিজেকে মুসলমান মনে করুক সে জাহান্নামীদের দলভূক্ত হবে।” (আহমদ, তিরমিযী)
আল্লাহর রাহে জিহাদ
(۲۳۳) وَعَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَلَا أَدُلُّكُمْ بِرَأْسِ أَمْرِ وَعَمُودِهِ، وَذُرْوَةِ سَنَامِهِ ۚ قُلْتُ: بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ رَأْسُ الْأَمْرِ الإِسْلَامُ وَعَمُودُهُ الصَّلَاةُ وَذِرْوَةُ سَنَامِهِ
الجهاد (أحمد – ترمذي – ابن ماجة)
(২৩৩) “হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা:) হতে বর্ণিত, একদা নবী করীম (স:) বললেন, আমি কি তোমাকে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের (দ্বীনের) মূল সূত্র, তার স্তম্ভ এবং সর্বোচ্চ চূড়ার সন্ধান দিব না? আমি বললাম হাঁ, হুযুর (স:) বললেন, দ্বীনের মূল হলো ইসলাম, খুটি হলো নামায এবং তার সর্বোচ্চ চূড়া হলো জিহাদ।” (আহমদ, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটিতে অতি সংক্ষেপে দ্বীনের একটি সংক্ষিপ্ত, অথচ পূর্ণাঙ্গরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ দ্বীনের মূল হতে শাখা পর্যন্ত তিনটি প্রধান বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত: একটি লোক আল্লাহর আনুগত্য ও অধীনতার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে ইসলামে প্রবেশ করে। দ্বিতীয়: নামাযের মাধ্যমে তার এ আনুগত্যের বাস্তব প্রকাশ ঘটে। তৃতীয়ত: নামাযের পবিত্র তরবীয়তের ভিতর দিয়ে সে আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য নিজেকে তৈরী করে।
উপরোক্ত তিনটি বিষয়ই পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং এর কোন একটি বাদ দিয়ে ইসলামী জিন্দিগীর কল্পনা করা যায় না।
(٢٣٤) عَنْ أَبِي ذَرِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ الْأَعْمَالِ أَفْضَلُ، قَالَ: الإِيمَانُ بِاللَّهِ وَالجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ (بخاري – مسلم)
(২৩৪) “হযরত আবুযার গিফারী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর নবী, কোন আমলটি (আল্লাহর নিকট) সব চেয়ে উত্তম? হুযুর (স:) বললেন, আল্লাহর উপর ঈমান আনা এবং তার পথে জিহাদ করা।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসে ঈমানের পরই সর্বোত্তম কাজ বলা হয়েছে জিহাদকে। জিহাদ শব্দটি আরবী। অন্য ভাষায় এর সম অর্থবোধক কোন প্রতি শব্দ পাওয়া একেবারেই দুষ্কর।
জিহাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো চরম প্রচেষ্টা। আর পারিভাষিক অর্থ হলো, আল্লাহ প্রদত্ত ব্যবস্থাকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করা ও তার জন্য মরণ পণ সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া এবং যাবতীয় শক্তিকে এ কাজে নিয়োজিত করা।
“জিহাদ” শুধু সশস্ত্র অভিযানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং লিখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষের চিন্তাধারা বদলিয়ে তাকে আল্লাহর দ্বীনের অনুগামী করাও জিহাদ। আবার দ্বীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করাও জিহাদ। চরম অবস্থায় শক্তি প্রয়োগ করে জাহেলী ব্যবস্থা মূলোৎপাটন করে খোদায়ী ব্যবস্থা কায়েম করার নামও জিহাদ।
“জিহাদ” যেহেতু অত্যন্ত কঠিন কাজ এবং দুর্বলচিত্ত লোকের পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয় তাই আল্লাহর রসূল (স:) জিহাদকে ঈমানের পরে সর্বোত্তম কাজ বলে উল্লেখ করেছেন।
(٢٣٥) عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: عَيْنَانِ لَا تَمَسُّهُمَا النَّارُ، عَيْنٌ بَكَتْ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ، وَعَيْنٌ بَاتَتْ تَحْرُسُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ (ترمذي)
(২৩৫) “হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলকে (স:) একথা বলতে শুনেছি যে, দুই ধরণের চক্ষুকে দোযখের আগুন স্পর্শ করবে না। এক হলো ঐ চোখ যে আল্লাহর ভয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে। দ্বিতীয় হলো সেই চোখ যে আল্লাহর পথে পাহারাদারীতে রাত জেগেছে।” (তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ হাদীসে চক্ষু দ্বারা চক্ষুওয়ালা লোকটিকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় ক্রন্দনরত ব্যক্তি, আর ইসলামের শত্রু থেকে রাষ্ট্র ও ইসলামী আদর্শের হেফাযতে নিয়োজিত ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে না।
(٢٣٦) عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ (مسلم)
(২৩৬) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি জিহাদে শরীক হলো না, কিম্বা জিহাদ সম্পর্কে কোন চিন্তা-ভাবনা করলো না। আর এই অবস্থায়ই সে মারা গেলো, সে যেন মোনাফেকের মৃত্যু বরণ করলো।” (মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ যদি কোন ব্যক্তি পূর্ণ অন্তর দিয়ে আল্লাহর দ্বীন কবুল করে, তাহলে সে উক্ত দ্বীনের প্রচার প্রতিষ্ঠা ও তার বাস্তবায়নের জন্যও তার সমস্ত চেষ্টা সাধনাকে নিয়োজিত করবে। আর যদি কোন কারণে তার ভাগ্যে সে সুযোগ না ঘটে তাহলে সে মনে অন্তত: তার কোন পরিকল্পনা পোষণ করবে, আর যে এর কোনটাই করবে না, বুঝতে হবে সে তার সম্পূর্ণ অন্তর দিয়ে আল্লাহর দ্বীন কবুল করেনি। ফলে তার মৃত্যু মোনাফেকের মতই হবে।
জিহাদ গুনাহের কাফ্ফারা
(۲۳۷)
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَامَ فِيهِمْ فَذَكَرَ لَهُمْ: أَنَّ الْجِهَادَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالإِيمَانَ بِاللَّهِ أَفْضَلُ الْأَعْمَالِ، فَقَامَ رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ قُتِلْتُ فِي سَبِيلِ اللهِ تُكَفِّرُ عَنِّى خَطَايَايَ؟ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: نَعَمْ وَأَنْتَ صَابِرٌ مُحْتَسِبٌ مُقْبِلٌ غَيْرُ مُدْبِرٍ، ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: كَيْفَ قُلْتَ؟ قَالَ أَرَأَيْتَ إِنْ قُتِلْتُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَتُكَفْرُ عَنِّى خَطَايَايَ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: نَعَمْ وَأَنْتَ صَابِرٌ مُحْتَسِبٌ مُقْيلٌ غَيْرُ مُدْبِرٍ إِلَّا الدَّيْنَ فَإِنَّ جِبْرِيلَ قَالَ لِي ذَالِكَ (مسلم)
(২৩৭) “হযরত আবু কাতাদাহ্ (রা:) হতে বর্ণিত, একদা নবী করীম (স:) ছাহাবায়ে কেরামদের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের বললেন, অবশ্যই আল্লাহর রাহে জিহাদ করা এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনা সবচেয়ে উত্তম কাজ। এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী, আমি যদি আল্লাহর রাহে জিহাদ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করি, তাহলে কি আমার পূর্বকৃত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে?
হুজুর (স:) বললেন, হ্যাঁ, তুমি যদি আল্লাহর রাহে দৃঢ়তা সহকারে শত্রুর বিরুদ্ধে অগ্রসর হও এবং ময়দান ছেড়ে পালাবার চেষ্টা না করে মৃত্যুবরণ কর, তাহলে অবশ্যই তোমার গুনাহ মাফ করা হবে। কিছুক্ষণ থেমে হুজুর (স:) জিজ্ঞেস করলেন, ওগো হে, তুমি আমাকে কি প্রশ্ন করেছিলে? লোকটি বলল, হুজুর আমি যদি আল্লাহর রাহে জিহাদ করে শাহাদাত বরণ করি, তাহলে কি আমার পূর্বকৃত যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যাবে? হুজুর (স:) বললেন: হ্যাঁ তুমি যদি আল্লাহর দুশমনদের বিরুদ্ধে দৃঢ়তা সহকারে অগ্রসর হও, তাহলে তোমার যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। তবে কারও দেনা থাকলে মাফ হবে না। এইমাত্র জিবরীল (আ:) এ কথাটি আমাকে বলে গেলেন।” (মুসলিম)
(۲۳۸)
وَعَنْ زَيْدِ بْنُ خَالِدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ جَهَزَ غَازِيًا فِي سبِيلِ اللَّهِ فَقَدْ غَزَا ، وَمَنْ خَلَفَ غَازِيًا فِي أَهْلِهِ فَقَدْ غزا (بخاري – مسلم)
(২৩৮) “হযরত যায়েদ ইবনে খালেদ (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন মোজাহিদের সামান সংগ্রহ করে দিবে, সেও জিহাদের ছওয়াবের অধিকারী হবে। আবার যে ব্যক্তি মোজাহিদের পরিবার পরিজনের দেখাশুনা করবে, সেও জিহাদের
ছওয়াব পাবে।” (বুখারী, মুসলিম)
অধ্যায় : ৮ রাষ্ট্র ব্যবস্থা
শাসকমন্ডলীর দায়িত্ব
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ
عَاقِبَةُ الأُمُورِ (سورة الحج: (٤١)
“যদি আমি তাদেরকে ভূমন্ডলের কোথাও রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী করি। তাহলে সেখানে তারা নামায কায়েম করে, যাকাত ব্যবস্থা চালু করে, সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎ কাজ হতে লোকদেরকে বিরত রাখে। আর প্রতিটি কাজের পরিণতি আল্লাহর হাতে।” (সূরা হজ্জ: ৪১)
(۲۳۹)
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : اللَّهُمَّ مَنْ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِي شَيْئًا فَشَقَّ عَلَيْهِمْ فَاسْقُقْ عَلَيْهِ وَمَنْ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِي شَيْئًا فَرَفَقَ بِهِمْ فَارْفُقْ بِهِ (مسلم)
(২৩৯) “হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (স:) এই মর্মে দোয়া করছিলেন, হে আল্লাহ যে ব্যক্তিকে আমার উম্মতের কোন বিষয়ের কর্তৃত্ব দান করা হয়, অত:পর সে তাদের প্রতি কঠোরতা করে, তুমিও তার প্রতি কঠোর হও। আর যে ব্যক্তি আমার উম্মতের কোন বিষয়ে কর্তৃত্ব লাভ করে তাদের প্রতি মেহেরবানী করে, তুমিও তার ওপর মেহেরবান হও।” (মুসলিম)
(٢٤٠) وَعَن مَعْقَلِ بْنِ يَاسَرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: مَا مِنْ وَالٍ وَلِيَ رَعِيَّةً مِنَ الْمُسْلِمِينَ فَيَمُوتُ وَهُوَ غَاسٌ لَهُمْ إِلَّا حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ (بخاري – مسلم)
(২৪০) “হযরত মায়া’কাল ইবনে ইয়াসার (রা:) বলেন, আমি রসূলকে (স:) এ কথা বলতে শুনেছি যে, যে শাসক মুসলমানের উপর শাসন ক্ষমতা লাভ করে যালেম ও খিয়ানতকারী হিসাবে মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য জান্নাত হারাম করবেন।” (বুখারী, মুসলিম)
(٢٤١) وَعَن مَعْقَلِ بْنِ يَاسِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا مِنْ عَبْدِ يَسْتَرْعِيهِ اللَّهُ رَعِيَّةً فَلَمْ يُعْطِهَا بِنَصِيْحَةٍ إِلَّا لَمْ يَجِدْ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ (بخاري – مسلم)
(২৪১) “হযরত মায়াকাল ইবনে ইয়াসার (রা:) বলেন, আমি রসূলকে (স:) বলতে শুনেছি, আল্লাহ তার যে বান্দাকে প্রজা সাধারণের উপরে কর্তৃত্ব দান করেন, অত:পর সে তাদের সাথে কল্যাণমূলক আচরণ করে না, সে জান্নাতের গন্ধও পাবে না।” (অর্থাৎ কিছুতেই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।) (বুখারী, মুসলিম)
(٢٤٢) وَعَن مَعْقَلِ بْنِ يَاسَارٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: أَيُّمَا وَالٍ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ الْمُسْلِمِينَ شَيْئًا، فَلَمْ يَجْهَدْ لَهُمْ كَنُصْحِهِ وَجُهْدِهِ لِنَفْسِهِ كَبَّهُ اللَّهُ عَلَى وَجْهِهِ فِي النَّارِ
(طبراني)
(২৪২) “হযরত মায়া’কাল ইবনে ইয়াসার (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলে করীমকে (স:) এ কথা বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মুসলমানদের কোন বিষয়ে দায়িত্বশীল হলো, অতঃপর সে তাদের কল্যাণ ও স্বার্থের জন্য সে ধরনের চেষ্টা করল না, যে ধরণের চেষ্টা সে নিজের জন্য করে, আল্লাহ তাকে উল্টো করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” (তিবরানী)
(٢٤٣) وَعَنْ عَائِدَ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّ شَرَّ الرِّعَاءِ الْحُطَمَةُ (مسلم)
(২৪৩) “হযরত আয়েয ইবনে আমর (রা:) বলেন, আমি রসূলকে (স:) এ কথা বলতে শুনেছি, শাসকদের মধ্যে নিকৃষ্টতম শাসক হলো সেই ব্যক্তি যে, অত্যাচারী” (অর্থাৎ যে প্রজা সাধারণের ওপর অত্যাচার করে।) (মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ উপরোক্ত হাদীসসমূহে আল্লাহর নবী শাসকদেরকে প্রজাসাধারণের প্রতি সহানুভূতিশীল, সুবিচারক ও তাদের কল্যাণকামী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আর নির্দয়, অত্যাচারী ও যালেম শাসকদের শেষ পরিণাম যে জাহান্নাম সে কথাও হুযুর (স:) পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন। হুযুর (স:) হযরত মুয়াযকে (রা:) ইয়ামানের শাসক হিসাবে প্রেরণ করার সময় তাকে যে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছিলেন, তার শেষ অংশে তিনি বলেছিলেন, “হে মুয়ায তুমি অবশ্যই মযলুমের বদ দোয়াকে ভয় করবে। কেননা মযলুমের ফরিয়াদ ও আল্লাহ তায়ালার মাঝখানে কোন পর্দা থাকে না।”
ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক খলিফা নির্বাচিত হয়ে তিনি যে নীতি নির্ধারক বক্তৃতা করেছিলেন, তার এক অংশে তিনি বলেছিলেন, সাবধান, আজ হতে তোমাদের প্রতিটি দুর্বল লোক আমার কাছে সবল। কেননা আমি রাষ্ট্র শক্তি নিয়ে তার সাহায্যে এগিয়ে আসব। আর তোমাদের শক্তিশালী লোক হবে আমার কাছে দূর্বল। কেননা আমিই তার কাছ থেকে দুর্বলের হক আদায় করে দিব।”
সুতরাং আল্লাহ যাকে শাসন ক্ষমতার অধিকারী করবে তার উচিত আল্লাহ ও রসূলের মর্জি মোতাবেক শাসনকার্য পরিচালনা করা। আর প্রজা সাধারণের উপরে সুবিচার করা। কেননা ইসলামে রাষ্ট্রকে শরীয়তের আওতার বাহিরে রাখা হয়নি।
প্রজা সাধারণের দায়িত্ব
(٢٤٤) وَعَنْ أُمِّ الْحُصَيْنِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنْ أُمْرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللَّهِ تَعَالَى فَاسْمَعُوا لَهُ وأَطِيعُوا (مسلم)
(২৪৪) “হযরত উম্মুল হোসাইন (রা:) বলেন, নবী করীম (স:) ইরশাদ করেছেন, কোন নাক কাটা গোলামকেও যদি তোমাদের আমির নির্বাচিত করা হয় এবং সে আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের উপর শাসনকার্য পরিচালনা করে, তাহলে তোমরা তার কথা শুনবে ও তার আনুগত্য করবে।” (মুসলিম)
(٢٤٥) عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: اسْمَعُوا وَأَطِيعُوا وَإِنِ اسْتُعْمِلَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ حَبَشِيٌّ كَأَنَّ رَأْسَهُ زَبِيبَةٌ (بخاري)
(২৪৫) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল (স:) বলেছেন, আঙ্গুর ফলের ন্যায় (ছোট) মস্তক বিশিষ্ট কোন হাবসী দাসকেও যদি তোমাদের শাসক করা হয়, তাহলেও তোমরা তার কথা শুনবে ও তার আনুগত্য করবে।” (বুখারী)
ব্যাখ্যা: ইসলামে দলীয় শৃঙ্খলা ঐক্য ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। হুজুরের (স:) নির্দেশ হলো, একবার যখন তোমরা কাউকে তোমাদের নেতা নির্বাচন করবে, যখন পর্যন্ত সে তোমাদেরকে কোরআন সুন্নাহ মোতাবেক পরিচালনা করবে, তোমরা তার আনুগত্য করবে ও তার আদেশ মানবে। কেননা দুনিয়ায় আল্লাহর দ্বীনের প্রচার প্রতিষ্ঠা ও উম্মতে মুসলেমার উন্নতি এবং কল্যাণ তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির উপরই নির্ভরশীল।
আনুগত্যের সীমা
(٢٤٦) وَعَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ فِيمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ مَا لَمْ يُؤْمَرُ بِمَعْصِيَةٍ فَإِذَا أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ (بخاري – مسلم)
(২৪৬) “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) বলেন, রসূল (স:) বলেছেন, শাসক যে পর্যন্ত কোন পাপ কার্যের আদেশ না করবে, সে পর্যন্ত তার আদেশ শুনা ও মেনে নেয়া প্রতিটি মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য, তা তার পছন্দ হোক আর নাই হোক। হ্যাঁ সে যদি কোন পাপকার্যের আদেশ করে, তাহলে তার কথা শুনা বা তার আনুগত্য করার কোন প্রয়োজন নেই।” (বুখারী, মুসলিম)
(٢٤٧) وَعَنْ عَلِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لا طَاعَةَ فِي مَعْصِيَةٍ إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوفِ (بخاري – مسلم)
(২৪৭) “হযরত আলী (রা:) বলেন, নবী করীম (স:) বলেছেন, গুনাহের কাজে কোন আনুগত্য নেই, আনুগত্য শুধু নেক কাজের
ব্যাপারে।” (বুখারী, মুসলিম)
(٢٤/٠) وَعَنْ أُمِّ سَلَمَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَكُونُ أُمَرَاءُ تَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ فَمَنْ أَنْكَرَ فَقَدْ بَرِئَ، وَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ سَلِمَ أَيْ مَنْ كَرِهَ بِقَلْبِهِ وَأَنْكَرَ بِقَلْبِهِ، وَلَكِنْ مَنْ رَضِيَ وَتَابَعَ، قَالُوا : أَفَلَا نُقَاتِلُهُمْ، قَالَ: لَا ، مَا صَلَّوْا ، لا،
مَا صَلَّوْا (مسلم)
(২৪৮) “হযরত উম্মে সালমা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী করীম (স:) বলেছেন, (এমন এক সময় আসবে যখন) তোমাদের উপর এমন শাসক চাপান হবে, যারা ভাল কাজও করবে মন্দ কাজও করবে। সুতরাং যে, তার প্রতিবাদ করবে সে নিষ্কৃতি পাবে। আর যে মনে মনে তাকে খারাপ জানবে এবং অন্তরে তার প্রতিবাদ করবে সেও নিরাপদ হবে। কিন্তু যে উক্ত খারাপ কাজকে পছন্দ করে তার অনুসরণ করবে, সে উক্ত পাপকার্যের অংশীদার হবে। সাহাবীরা আরয করলেন, হে আল্লাহর নবী, আমরা কি সে শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবো না? হুজুর (স:) বললেন, না, যতক্ষন পর্যন্ত তারা নামায আদায় করতে থাকবে ততক্ষন পর্যন্ত তোমরা তা করবে না।” (মুসলিম)
পদের লোভ করা অন্যায়
(٢٤٩) وَعَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ سَمُرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تَسْأَلِ الإِمَارَةَ، فَإِنَّكَ إِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وَكَلَتْ إِلَيْهَا ، وَإِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا
(بخاري – مسلم)
(২৪৯) “হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরাহ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (স:) আমাকে বলেছেন তুমি নেতৃত্ব চেয়ে নিবে না। কেননা তুমি যদি চেয়ে নেতৃত্ব লাভ কর, তাহলে তোমাকে উক্ত পদের হাওয়ালা করা হবে। (সে অবস্থায় তুমি আল্লাহর কোন সাহায্য পাবে না।) আর যদি কোন রকম প্রার্থনা করা ব্যতীত তুমি নেতৃত্ব লাভ কর, তাহলে আল্লাহর তরফ হতে তোমাকে দায়িত্ব পালনে সাহায্য করা হবে।” (বুখারী, মুসলিম)
(٢٥٠) عَنْ أَبِي مُوسَى رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: دَخَلْتُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَنَا وَرَجُلَانِ مِنْ بَنِي عَمِّى فَقَالَ أَحَدُهُمَا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَمِّرْنَا عَلَى بَعْضٍ مَا وَلَاكَ اللَّهُ ، وَقَالَ الآخَرُ: مِثْلَ ذَلِكَ، فَقَالَ: إِنَّا وَاللَّهِ لَا نُوَلِّى
عَلَى هَذَا الْعَمَلِ أَحَدًا سَأَلَهُ وَلَا أَحَدًا حَرَصَ عَلَيْهِ، وَفِي رِوَايَةٍ لَا تَسْتَعْمِلُ عَلَى عَمَلِنَا مَنْ أَرَادَهُ
(بخاري – مسلم)
(২৫০) “হযরত আবু মুসা (রা:) বলেন, একদা আমি এবং আমার দুই চাচাত ভাই নবী করীমের (স:) দরবারে হাযির হলাম। ভাইদের মধ্যে হতে একজন হুজুরকে (স:) বলল, হে আল্লাহর নবী, আল্লাহ আপনাকে যে শাসন ক্ষমতার অধিকারী করেছেন, তার অধীনে আমাকেও কোন এলাকার দায়িত্ব দান করুন। দ্বিতীয় ভাইটিও ঠিক অনুরূপ উক্তি করলেন, হুজুর (স:) বললেন, আল্লাহর কসম, আমরা কিছুতেই এ ধরনের কাজের দায়িত্ব এমন কোন লোককে দিব না, যে তা চায় অথবা তার লোভ রাখে। অন্য এক বর্ণনা মতে হুজুর (স:) তাদেরকে বললেন, আমাদের এ সব পদে এমন লোককে নিয়োগ ক্রব না, যারা তা চায়।” (বুখারী, মুসলিম)
(٢٥١) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: تَجِدُونَ مِنْ خَيْرِ النَّاسِ أَشَدُّهُمْ كَرَاهِيَةً لِهَذَا الْأَمْرِ حَتَّى يَقَعَ فِيهِ
(بخاري – مسلم)
(২৫১) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, যারা পদকে ভীষণভাবে অপছন্দ করে, অত:পর যখন তাতে সংশ্লিষ্ট হয়, তখন তোমরা তাদেরকে সর্বোত্তম লোক হিসেবে পাবে।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ শাসন সংক্রান্ত কোন দায়িত্ব বা পদের গুরুত্ব অনুভব করে যারা উক্ত পদ গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক থাকে, তাদের সততা ও দায়িত্ব বোধের কথা বিবেচনা করে যখন তাদের উপর দায়িত্ব চাপান হয়, তখন তারা অতিরিক্ত নিষ্ঠা ও সততার সহিত কাজ করে। ফলে তাদেরকে আল্লাহর তরফ হতে সাহায্য করা হয় এবং তারা তখন সমাজের উৎকৃষ্ট লোকে পরিণত হয়।
বিচারকের দায়িত্ব
وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا
(سورة النساء : ٥٨)
“আর তোমরা মানুষের মাঝে বিচার করার সময় ন্যায় বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে অতি উত্তম উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয়
আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা নিসা- ৫৮)
(٢٥٢) وَعَنْ أَبِي بَكْرَةً رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ
رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: لَا يَقْضِيَنَّ حَكَمٌ بَيْنَ اثْنَيْنِ وَهُوَ غَضَبَانُ (بخاري – مسلم)
(২৫২) “হযরত আবু বাকারাহ (রা:) বলেন, আমি রসূলকে (স:) একথা বলতে শুনেছি যে, কোন বিচারক যেন রাগের অবস্থায় দুই ব্যক্তির মধ্যে কোন ফয়সালা দান না করে।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ বিচারক যদি ক্রোধাবস্থায় বিচার ফয়সালা করে, তাহলে সম্ভাবনা আছে ক্রোধের প্রভাবে উক্ত বিচার ব্যবস্থাকেও প্রভাবান্বিত করবে, ফলে ন্যায় বিচার হবে না। তাই আল্লাহর নবী সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় উভয় পক্ষের কথা-বার্তা শুনে ও প্রমাণাদি পরীক্ষা করে যথাযথ ন্যায় বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন।
(٢٥٣) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ جُعِلَ قَاضِبًا بَيْنَ النَّاسِ فَقَدْ ذُبِحَ بِغَيْرِ سِكِينٍ
أحمد – ترمذي – أبو داؤد – ابن ماجة)
(২৫৩) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) বলেন, রসূলুল্লাহ (স:) ইরশাদ করেছেন, যাকে বিচারক নিয়োগ করা হলো, তাকে যেন বিনা ছুরিতে জবেহ করা হলো।” (আহমদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ)
ব্যাখ্যাঃ বিচারকের গুরুত্বপূর্ণ ও নাযুক দায়িত্বের কথা বুঝাবার উদ্দেশ্যে নবী (স:) উপরোক্ত দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। দুইজন বিবাদমান ব্যক্তির মধ্যে বিবাদীয় বিষয়ের বিচার করাকালে বিচারককে স্বীয় কঠোর দায়িত্ব এতই পেরেশান করে তুলবে, যে সে মনে করতে থাকবে তাকে যেন বিনা ছুরিতে কোন কঠিন বস্তু দ্বারা জবেহ করা হচ্ছে।
(٢٥٤) وَعَنْ بُرَيْدَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْقُضَاةُ ثَلَاثَةٌ وَاحِدٌ فِي الْجَنَّةِ وَاثْنَانِ فِي النَّارِ فَأَمَّا الَّذِي فِي الْجَنَّةِ فَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَقَضَى بِهِ، وَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَجَارَ فِي الْحُكْمِ فَهُوَ فِي النَّارِ وَرَجُلٌ قَضَى لِلنَّاسِ عَلَى جَهْلٍ فَهُوَ فِي
النَّارِ
(أبو داؤد – ابن ماجة)
(২৫৪) “হযরত আবু বোরায়দাহ (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, বিচারক হলো তিন ধরনের। তন্মধ্যে এক ধরনের বিচারক হবে জান্নাতী, আর দুই ধরনের বিচারক হবে জাহান্নামী। জান্নাতী হবে সেই বিচারক, যে সত্যকে অনুধাবন করে তদনুসারে ফয়সালা দান করে। আর জাহান্নামী হবে সেই বিচারক, সে সত্যকে পেয়েও তার বিপরীত ফয়সালা দেয়। অনুরূপ ভাবে যে বিচারক অজ্ঞতার উপর ফয়সালা দান করে সেও জাহান্নামী হবে।” (আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ)
বিচারে কোন পন্থা অবলম্বন করবে
(٢٥٥) وَعَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا بَعَثَهُ إِلَى الْيَمَنِ، قَالَكَ كَيْفَ تَقْضِي إِذَا عَرَضَ لَكَ قَضَاءٌ؟ قَالَ أَقْضِى
بِكِتَابِ اللَّهِ ، قَالَ: فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فِي كِتَابِ اللَّهِ؟ قَالَ: فَبِسُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ قَالَ: أَجْتَهِدُ رَأْيِي وَلَا آلُو، قَالَ: فَضَرَبَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى صَدْرِهُ وَقَالَ: الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَفِّقَ رَسُولَ رَسُولِ اللَّهِ لِمَا يَرْضِي بِهِ رَسُولُ اللَّهِ ترمذي – أبو داؤد – دارمي)
(২৫৫) “হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা:) বলেন, রসূল (স:) যখন তাকে ইয়ামান পাঠাচ্ছিলেন, তখন জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে যখন কোন মুকদ্দমা উত্থাপন করা হবে, তখন তুমি তার ফয়সালা কিসের ভিত্তিতে করবে? হযরত মুয়ায জওয়াব দিলেন, আমি আল্লাহর কিতাব মোতাবেক ফয়সালা করব। হুজুর (স:) বললেন, যদি তুমি আল্লাহর কিতাবে তার কোন ফয়সালা না পাও? তিনি বললেন, তাহলে আমি রসূলের সুন্নাতানুসারে তার ফয়সালা করব। হুজুর (স:) বললেন, যদি তুমি রসূলের সুন্নাতেও তা না পাও? এবারে হযরত মুয়ায বললেন, তাহলে আমি ইজতেহাদ করে (জ্ঞান খাটিয়ে) তার ফয়সালা দিব এবং ইজতেহাদের ব্যাপারে গাফলতী করব না। একথা শুনে হুজুর (স:) মুয়াযের সিনার উপর হস্ত চালনা করলেন এবং বললেন, সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আল্লাহর রসূলের প্রতিনিধিকে রসূলের মনমত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে তৌফিক দিয়েছেন।” (তিরমিযী, আবু দাউদ, দারেমী)
বিচার ব্যবস্থায় সুপারিশ
(٢٥٦) وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا أَنَّ قُرَيْشًا أَهَمَّهُمْ شَأْنُ الْمَرْأَةِ الْمَحْزُومِيَّةِ الَّتِي سَرَقَتْ فَقَالُوا : وَمَنْ يُكَلِّمُ فِيهَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالُوا : وَمَنْ يَجْتَرِئُ عَلَيْهِ إِلَّا أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ حِبُّ رَسُولِ اللَّهِ صلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَكَلَّمَهُ أُسَامَةُ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَتَشْفَعُ فِي حَدٍ مِنْ حُدُودِ اللَّهِ ثُمَّ قَامَ فَاخْتَطَبَ ثُمَّ قَالَ إِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ، وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ وَايْمُ اللَّهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ ابْنَةَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقُطِعَتْ يَدُهَا
(بخاري – مسلم)
(২৫৬) “হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, একদা কোরায়েশগণ মাখজুমী বংশের একটি মেয়ে লোকের ব্যাপারে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিল। কেননা মেয়ে লোকটি কিছু চুরি করেছিল। (আর তার মুকদ্দমা হুজুরের (স:) আদালতে পেশ হয়েছিল) তারা পরস্পর বলাবলি করছিল, কে এর ব্যাপারে রসূল করীমের (স:) সাথে আলাপ করতে পারবে? তারা একে অপরকে বলল, রসূলের (স:) প্রিয় পাত্র উসামা বিন যায়েদ ছাড়া আর কে এ প্রসঙ্গে রসূলের সাথে কথা বলার সাহস রাখে? অতঃপর হযরত উসামা (রা:) হুজুরের (স:) সাথে উক্ত বিষয় কথা বললেন। হুজুর (স:) বললেন, আল্লাহর অনুশাসন কার্যকরি করার বিষয় তুমি আমার কাছে সুপারিশ করছো (যাতে আমি তা কার্যকরি না করি।) অত:পর হুজুর (স:) দাঁড়িয়ে ভাষণে বলেন, তোমাদের আগের কোন কোন জাতি এ জন্য ধ্বংস হয়েছিল যে, তাদের কোন সম্ভ্রান্ত লোক যদি চুরি করত তাকে ছেড়ে দিত। আর দুর্বল লোক চুরি করলে তার উপর বিধি প্রয়োগ করতো। আল্লাহর শপথ যদি মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমা চুরি করে, তাহলে অবশ্যই তারও হাত কাটা হবে।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ ইসলামী আইনে চুরির সর্বোচ্চ শাস্তি হাত কাটা। একদা কোরায়েশ গোত্রের প্রসিদ্ধ মাখজুমী পরিবারের একজন মহিলা ফাতিমা বিনতে আসাদ ঘটনাক্রমে চুরি করেছিল এবং তার মুকদ্দমা হুজুরের (স:) কাছে পেশ হয়েছিল। এই অভিজাত বংশের মেয়েটির চুরির দায়ে হাত কাটা যাবে একথা ভেবে তার স্বগোত্রের লোকেরা খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিল। ফলে তারা তার শাস্তি রহিত করার জন্যে রাসূলের প্রিয় ব্যক্তি হযরত উসামা (রা:) দ্বারা সুপারিশ করালেন। এতে হুজুর (স:) খুবই অসন্তুষ্ট হলেন এবং উপস্থিত সাহাবীদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দিলেন। বললেন, শরীয়তের শাস্তি কার্যকরি করার ব্যাপারে এ ধরনের সুপারিশ বড়ই গর্হিত। ফাতিমা বিনতে আসাদ কেন, যদি ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদও এ কাজটি করত, তাহলে অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দিতাম। হুজুর (স:) আরও বললেন, তোমাদের আগে কতগুলো জাতি বিচার ব্যবস্থায় যখন অবৈধ সুপারিশ ও পক্ষপাতিত্ব শুরু করেছিল, তখনই আল্লাহ তাদের ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।
অধ্যায়: ৯ পরকাল
মৃত্যু ও মৃত্যুর পরবর্তী জিন্দিগি
قُلْ إِنَّ الْمَوْتَ الَّذِي تَفِرُّونَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مُلَاقِيكُمْ ثُمَّ لَا تُرَدُّونَ إِلَى عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ
تَعْمَلُونَ (سورة الجمعة (۸)
“এদেরকে বলুন, যে মৃত্যু থেকে তোমরা পালাচ্ছো তা নিশ্চয়ই তোমাদেরকে পাকড়াও করবে। অতঃপর তোমাদেরকে সে মহান সত্ত্বা আল্লাহর নিকট হাজির করানো হবে যিনি (তোমাদের) প্রকাশ্য ও গোপন সবকিছু জানেন। আর তখন তিনি তোমাদেরকে তোমাদের এ দুনিয়ার আমলসমূহ জানিয়ে দিবেন।” (সূরা জুমআ: ৮)
(٢٥٧) وَعَنْ تَوْبَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : يُوشِكُ الْأُمَمُ أَنْ تَدَاعَى عَلَيْكُمْ كَمَا تَدَاعَى الأَكِلَةُ إِلَى قَصْعَتِهَا ، فَقَالَ قَائِلٌ وَمِنْ قلةٍ نَحْنُ يَوْمَئِذٍ ؟ قَالَ : بَلْ أَنْتُمْ يَوْمَئِذٍ كَثِيرٌ وَلَكِنَّكُمْ غُنَاءٌ كَفَتَاءِ السَّيْلِ وَلَيَنْزِعَنَّ اللَّهُ مِنْ صُدُورِ عَدُوِّكُمُ الْمَهَابَةَ مِنْكُمْ وَلَيَقْذِفَنَّ اللَّهُ فِي قُلُوبِكُمُ الْوَهَنَ، قَالَ
قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا الْوَهَنُ قَالَ: حُبُّ الدُّنْيَا
وَكَرَاهِيَةُ الْمَوْتِ (أبو داؤد)
(২৫৭) “হযরত ছাওবান (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, শীঘ্রই আমার উম্মতের উপরে এমন একটি সময় আসবে, যখন দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি তাদের দিকে এমনভঅবে ধাবিত হবে, যেমন ধাবিত হয় ক্ষুধার্ত খাদ্যের দিকে। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর সেদিন কি আমরা সংখ্যায় খুব নগণ্য থাকব? যে দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি আমাদেরকে মিটিয়ে ফেলার জন্যে অগ্রসর হবে। হুজুর (স:) বললেন, না বরং সেদিন তোমাদের সংখ্যা হবে অনেক। কিন্তু তোমরা হবে বন্যার পানির ফেনা সমতূল্য। অবশ্যই আল্লাহ সেদিন তোমাদের মনে তাদের ভয় সৃষ্টি করে দিবেন। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর আমাদের মনে এ দুর্বলতা ও ভীতি দেখা দেয়ার কি কারণ হবে? হুজুর (স:) বললেন, যেহেতু সেদিন তোমরা দুনিয়াকে ভালবাসবে এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করবে। (আবু দাউদ)
ব্যাখ্যাঃ আল্লাহর দেয়া ইলমের ভিত্তিতে আল্লাহর নবী কখনও কখনও ভবিষ্যদ্বাণীও করেছেন। উপরোক্ত হাদীসটি রসূলের একটি ভবিষ্যদ্বাণী। এতে আল্লাহর নবী মুসলমানদের পরবর্তী কোন এক যুগের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে এমন একটি সময় আসবে, যখন আমার উম্মতেরা দুনিয়ার মোহে এমনভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে যে, তারা আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জিন্দিগিকে অত্যন্ত মঙ্গলময় মনে করবে এবং ইসলাম ও মিল্লাতে ইসলামীয়ার জন্য জান-মাল কোরবানী করাকে আদৌ পছন্দ করবে না। ফলে ইসলামের দুশমনদের অন্তর হতে তাদের ভয় চলে যাবে এবং মুসলমানের সংখ্যা অধিক হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের দুশমনরা দুনিয়া হতে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তিকে মিটিয়ে দিবে।
(٢٥٨) وَعَنْ شَدَّادِ بْنِ أَوْسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ، وَالْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ (ترمذي)
(২৫৮) “হযরত সাদ্দাদ ইবনে আওস (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজ প্রবৃত্তিকে বশ করেছে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের উদ্দেশ্যে কাজ করে। আর বুদ্ধিহীন হলো সেই ব্যক্তি যে আপন নফসকে প্রবৃত্তির খামখেয়ালীর হাতে সুপে দিয়ে আল্লাহর (রহমতের) উপর অহেতুক আশা বেধে বসে আছে।” (অর্থাৎ কাজ কর্ম তো নফসের বাসনা মোতাবেক করে। অথচ আশা করে বসে আছে যে আল্লাহ তাকে মাফ করে দিবেন। (তিরমিযী)
(٢٥٩) وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اسْتَحْيُوا مِنَ اللَّهِ حَقَّ الْحَيَاءِ، قُلْنَا إِنَّا لَنَسْتَحْيِي يَا رَسُولَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، قَالَ: لَيْسَ ذَاكَ وَلَكِنَّ الإِسْتِحْيَاءَ مِنَ اللَّهِ حَقَّ الْحَيَاءِ أَنْ تَحْفَظَ الرَّأْسَ وَمَا وَعَى وَتَحْفَظَ الْبَطْنَ وَمَا
حَوَى وَتَتَذَكَّرَ الْمَوْتَ وَالْبَلَى، وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ تَرَكَ زِينَةَ الدُّنْيَا وَآثَرَ الآخِرَةَ عَلَى الْأُولَى، فَمَنْ فَعَلَ ذَالِكَ فَقَدِ اسْتَحْيَا مِنَ اللَّهِ حَقَّ الْحَيَاء (ترمذي)
(২৫৯) “একদা নবী করীম (স:) ছাহাবায়ে কেরামদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা আল্লাহকে বিশেষভাবে সম্ভ্রম করে চলবে। (বর্ণনাকারী) সাহাবী বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর নবী, আমরা আল্লাহর শোকর আদায় করিতেছি যে, আমরা আল্লাহকে পরিপূর্ণ সম্ভ্রম করে চলি। হুজুর (স:) বললেন, না তোমরা যা বললে সেরূপ নয়। বরং আল্লাহকে পরিপূর্ণরূপে সম্ভ্রম করে চলার অর্থ হল, তুমি তোমার মস্তিস্ক এবং মস্তিস্কে যা কিছু চিন্তা ভাবনা আসে তার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখবে, পেট ও পেটের ভিতরে (খাদ্য হিসাবে) যা কিছু গ্রহণ করছ তার ব্যাপারে দৃষ্টি রাখবে এবং মৃত্যু ও মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থাকে বার বার স্মরণ করবে। আর যে ব্যক্তি পরকালকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করবে সে দুনিয়ার চাকচিক্যকে প্রত্যাখান করবে এবং পরকালকে ইহকালের উপর প্রাধান্য দিবে। উপরোক্ত কাজগুলো যে করে, সেই প্রকৃত পক্ষে আল্লাহকে পুরাপুরি সম্ভ্রম করে চলে।” (তিরমিযী)
ব্যাখ্যাঃ বর্ণিত হাদীসটিতে মহানবী (স:) আল্লাহকে পরিপূর্ণরূপে সম্ভ্রম করে চলার তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনটি বিষয়ের দিকে অঙ্গুলি সংকেত করেছেন। তন্মধ্যে একটি হল মস্তিস্ক। কেননা মস্তিস্ক হল মানুষের চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রস্থল। মস্তিস্কের প্রতি খেয়াল রাখার অর্থ কোনরূপ গর্হিত, অন্যায় ও পাপ কাজের কল্পনাকে মস্তিকে স্থান না দেয়া। গাড়ী যেরূপ ইঞ্জিন দ্বারা পরিচালিত হয়, তেমনি মানুষ মস্তিস্ক দ্বারা পরিচালিত হয়। ভাল বা মন্দ কাজের কল্পনা প্রথমত: মস্তিস্কেই আসে। অত:পর তার হাত-পা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তা কার্যে পরিণত করে। সুতরাং যার মস্তিস্ক ভাল চিন্তা করবে তার হাত-পাও ভাল কাজ করতে বাধ্য হবে। মস্তিস্ক অন্যায় ও অসৎ কাজের চিন্তা করলে তার অঙ্গ-প্রতঙ্গ তাই কার্য্যে পরিণত করবে। এ কারণে আল্লাহর নবী মস্তিস্ক ও তাতে আগত চিন্তা ভাবনার প্রতি লক্ষ্য রাখতে বলেছেন।
দ্বিতীয়টি হলো পেট বা উদর। মানুষ তার উদরে যে খাদ্য গ্রহণ করে সেই খাদ্য দ্বারাই শক্তি সঞ্চিত হয় এবং সেই শক্তিই মস্তিস্কের চিন্তা শক্তিকে সক্রিয় ও সতেজ রাখে। সুতরাং খাদ্য যদি অপবিত্র ও হারাম হয়, তাহলে সেই খাদ্য নিঃসৃত শক্তি দ্বারা মস্তিস্ক কিছুতেই পবিত্র চিন্তা করতে পারবে না। তৃতীয়টি হলো পরকাল। কেননা পরকাল চিন্তাই মানুষকে ইহকালে সঠিক পথে চলতে বাধ্য করে। পরকালে বিশ্বাসহীন মানুষ মনযিল বিহীন যাত্রীর ন্যায়। মনযিল বিহীন মানুষ যেমন ভবঘুরের ন্যায় অলি-গলি ঘুরে বেড়ায় এবং রাস্তার পার্শ্বের প্রতিটি চাকচিক্য তাতে আকৃষ্ট করে, তেমনি পরকাল ভোলা লোককে দুনিয়ার মায়াজালে আকৃষ্ট করে এবং আল্লাহ থেকে গাফেল করে রাখে।
(٢٦٠) وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَجُلاً قَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَتَى السَّاعَةُ؟ قَالَ: وَيْلَكَ وَمَا أَعْدَدْتَ لَهَا؟ قَالَ: مَا أَعْدَدْتُ لَهَا إِلَّا أَنِّي
أُحِبُّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ، قَالَ: أَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ، قَالَ أَنَسٌ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ مَا رَأَيْتُ الْمُسْلِمِينَ فَرِحُوا بِشَيْءٍ
بَعْدَ الإِسْلَامِ فَرَحَهُمْ بِهَا (بخاري – مسلم)
(২৬০) “হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি আল্লাহর নবীকে জিজ্ঞেস করলেন, কিয়ামত কখন হবে? হুজুর (স:) বললেন, আপসোস তোমার জন্যে, তুমি কিয়ামতের জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছ? লোকটি আরয করল, আমি আল্লাহ এবং আল্লাহর রসূলের মহব্বত ব্যতীত কিয়ামতের জন্য অধিক কিছু প্রস্তুত করতে পারিনি। হুজুর (স:) বললেন, দুনিয়ায় যাকে তুমি ভালবাসবে কিয়ামতের দিনে তুমি তার সাথেই অবস্থান করবে। হযরত আনাস (রা:) বলেন, রসূলের উপরোক্ত কথায় (সাহাবীরা) মুসলমানেরা সেদিন এতই খুশী হয়েছিলে যে, ইসলাম গ্রহণ করার পর আর কখনও তাদেরকে এত খুশী হতে দেখা যায়নি।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ ছাহাবায়ে কেরামগণের তাকওয়া পরহেযগারী ও আল্লাহর রাহে তাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার স্বয়ং কোরআনে প্রশংসা করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও ছাহাবায়ে কেরামগণ পরকালের চিন্তায় অবিরাম বিচলিত থাকতেন। ফলে হুজুরের (স:) উপরোক্ত সুসংবাদে তারা গভীর আনন্দিত হয়েছিলেন। কেননা তারা ছিলেন নবীর মহব্বতে আত্মহারা। সুতরাং কিয়ামতের দিন তারা নবীর সঙ্গেই অবস্থান করবে একথা জেনে সর্বাধিক আনন্দিত হয়েছিলেন।
কিয়ামতের বর্ণনা
(٢٦١) وَعَنْ سَهْلِ بْنِ سَعَدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : يُحْشَرُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى أَرْضِ بَيْضَاءَ عَفْرَاءَ كَفُرْصَةِ النَّقِيِّ لَيْسَ فِيهَا عَلَمٌ لأَحَدٍ (بخاري – مسلم)
(২৬১) “হযরত সাহাল ইবনে সায়াদ (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, কিয়ামতের দিন মানবজাতিকে মথিত আটার রুটির ন্যায় লালিমাযুক্ত শ্বেতবর্ণ জমীনে একত্রিত করা হবে, যেখানে কারও কোন ঘর বাড়ীর চিহ্ন থাকবে না।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ এ পার্থিব জগত এবং এর যাবতীয় বস্তু লয় হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা সমগ্র মানব ও জ্বিন জাতিকে পার্থিব জগতে কৃত তাদের যাবতীয় কাজের হিসাব গ্রহণকল্পে এমন একটি প্রশস্ত সমতল ভূমিতে একত্র করবেন, যেখানে কোন ঘরবাড়ী পাহাড় জঙ্গল ইত্যাদি থাকবে না যার আড়ালে কেহ আশ্রয় নিতে পারে। উক্ত বিশাল সমতল ভূমিই হল ময়দানে হাশর, যার তুলনায় আমাদের এ পৃথিবী একটি বিন্দু মাত্র। ময়দানে হাশরের যে মাটি হবে, তার রং হবে সাদা এবং লালিমা যুক্ত।
(٢٦٢) وَعَن عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: يُحْشَرُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلًاً، قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ
النِّسَاءُ وَالرِّجَالُ جَمِيعًا يَنْظُرُ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ، فَقَالَ يَا عَائِشَةُ الْأَمْرُ أَشَدُّ مِنْ أَنْ يَنْظُرَ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ
(بخاري – مسلم)
(২৬২) “হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর নবীকে একথা বলতে শুনেছি যে, কিয়ামতের দিন মানব জাতিকে খালি পায়, উলঙ্গ ও খাতনা বিহীন অবস্থায় একত্রিত করা হবে। আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলুল্লাহ, এমতাবস্থায়তো নারী
পুরুষ পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকাবে। হুজুর (স:) বললেন হে আয়েশা, সেদিনকার অবস্থা এত ভয়াবহ হবে যে, পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকাবার কোন কল্পনাই করবে না।” (বুখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যাঃ রোজ হাশরে সমস্ত মানুষই বস্ত্রহীন, পাদুকাহীন, উলঙ্গ এমন কি খাতনা বিহীন অবস্থায় ময়দানে হাশরে একত্রিত হবে। অর্থাৎ মাতৃগর্ভ হতে মানুষ যে অবস্থায় ভূমিষ্ট হয়েছিল, অনুরূপ: অবস্থায়ই তার পুনরুত্থান ঘটবে। এ ব্যাপারে কোরআনের ভাষ্য হল নিম্নরূপ:
كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُعِيدُهُ وَعْدًا عَلَيْنَا إِنَّا كُنَّا فَاعِلِينَ
“প্রথম সৃষ্টিতে যেভাবে আমি তৈরী করেছিলাম, অনুরূপভাবে তাদের পুনরুত্থান ঘটবে। এ হলো আমার প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি। আর আমি তা
করেই ছাড়বো। (সূরা আল আম্বিয়া- ১৩৪)
কিয়ামতের দিনের ভয়াবহতা, আতংক ও ভীতি মানুষকে এতই ভীত বিহব্বল করে ফেলবে যে, যদিও সমস্ত মানুষ উলঙ্গ উঠবে কিন্তু কেহ কারও দিকে ফিরে পর্যন্ত তাকাবে না। প্রত্যেকেই নিজ নিজ চিন্তায় পেরেশান ও উদ্বিগ্ন থাকবে।
(٢٦٣) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لَيَأْتِي الرَّجُلُ الْعَظِيمُ السَّمِينُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَا يَزِنُ عِنْدَ اللَّهِ جَنَاحَ بَعُوضَةٍ وَقَالَ اقْرَؤُوا : فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا
(بخاري – مسلم)
(২৬৩) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, কিয়ামতের দিন একজন মোটা তাজা বড় লোককে হাযির করা হবে, আল্লাহর কাছে যার মর্যাদা একটি মশার ডানার সমানও হবে না। অত:পর হুজুর (স:) নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করতে বললেন, “কিয়ামতের দিন তাদের জন্যে মিজান কায়েম করব না।” (কারণ তাদের পরিমাণ যোগ্য কোন কাজ থাকবে না।) (বুখারী, মুসলিম)
(٢٦٤) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَرَأَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَذِهِ الْآيَةَ: يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا، قَالَ: أَتَدْرُونَ مَا أَخْبَارُهَا؟ قَالُوا : اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: فَإِنَّ أَخْبَارَهَا أَنْ تَشْهَدَ عَلَى كُلِّ
عَبْرٍ أَوْ أَمَةٍ بِمَا عَمِلَ عَلَى ظَهْرِهَا أَنْ تَقُولَ: عَمِلَ عَلَيَّ كَذَا وَكَذَا يَوْمَ كَذَا وَكَذَا ، قَالَ : فَهَذِهِ أَخْبَارُهَا
أحمد – ترمذي)
(২৬৪) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রসূলুল্লাহ (স:) এই আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন, “যেদিন জমীন তার যাবতীয় খবর বলে দিবে” অত:পর হুজুর (স:) জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা বলতে পার জমীনের সংবাদসমূহ কি কি? ছাহাবারা আরয করলেন, আল্লাহ ও তার রসূলই কেবল মাত্র জানেন (আমরা জানি না)। হুজুর (স:) বললেন, জমীনের সংবাদ হলো জমীনের উপর নারী পুরুষ যা কিছু ভাল মন্দ কাজ করেছে, (কিয়ামতের দিন) জমীন তার সাক্ষ্য দিবে। জমীন বলবে, আমার বুকের পরে অমুক অমুক দিনে অমুক অমুক লোক এই কাজ করেছে। হুজুর (স:) বললেন, এই হল জমীনের সংবাদ দান।” (আহমদ, তিরমিযী)
(٢٦٥) وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا أَنَّهَا ذَكَرَتِ النَّارَ فَبَكَتْ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا يُبْكِيكِ ، قَالَتْ: ذَكَرْتُ النَّارَ فَبَكَيْتُ فَهَلْ تَذْكُرُونَ أهْلِيكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَمَّا فِي ثَلاثَةِ مَوَاطِنَ فَلَا يَذْكُرُ أَحَدٌ أَحَدًا
عِنْدَ الْمِيزَانِ حَتَّى يَعْلَمَ أَيَخِفُ مِيزَانُهُ أَوْ يَثْقُلُ، وَعِنْدَ الْكِتَابِ حِينَ يُقَالُ هَاؤُمُ اقْرَءُوا كِتَابِيَهْ حَتَّى يَعْلَمَ أَيْنَ يَقَعُ كِتَابُهُ أَفِي يَمِينِهِ أَمْ فِي شِمَالِهِ أَمْ مِنْ وَرَاءِ ظَهْرِهِ، وَعِنْدَ الصِّرَاطِ إِذَا وُضِعَ فِي ظَهْرِ جَهَنَّمَ
(أبو داؤد)
(২৬৫) “হযরত আয়েশা (রা:) বলেন, একদা আমি জাহান্নামের কথা স্মরণ করে কেঁদে ফেললাম। রসূলুল্লাহ (স:) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন কাদছো? আমি বললাম, জাহান্নামের কথা স্মরণ করে কাঁদছি। হুজুর আপনি কি কিয়ামতের দিন আপন পরিবার পরিজনের কথা মনে রাখবেন? হুজুর (স:) বললেন, তিনটি জায়গা এমন ভয়াবহ হবে যেখানে কেউ কারও কথা স্মরণ রাখবে না। একটি জায়গা হল মিযানের কাছে, এমন কি সকলেই তখন পেরেশান থাকবে যে, তার আমলের পরিমাণ কম হবে কি বেশী হবে। অপর একটি জায়গা হলো, যেখানে আমলনামা হাতে দেওয়া হবে। কেননা তখন সকলেই পেরেশান থাকবে যে, তার আমলনামা ডান হাতে পাওয়া যাচ্ছে, না পিছন দিক থেকে বাম হাতে। (আল্লাহর নাফরমান বান্দারা তাদের আমলনামা পিছন দিক থেকে বাম হাতে পাবে।) এমনকি বান্দাহ (ডান হাতে আমলনামাধারী) বলবে, এস, আমার আমলনামা পাঠ করে দেখ। তৃতীয় জায়গাটি হবে পুলসিরাতের কাছে, যখন তা জাহান্নামের পৃষ্ঠদেশে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। (আবু দাউদ)
জান্নাতবাসীদের বর্ণনা
إِنَّ اللَّهَ يُدْخِلُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الأَنْهَارُ (سورة الحج)
“যারা ঈমান আনবে ও নেক আমল করবে তাদেরকে আল্লাহ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে।”
(সূরা হজ্জ: ২৩)
(٢٦٦) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ اللَّهُ تَعَالَى: أَعْدَدْتُ لِعِبَادِيَ الصَّالِحِينَ مَالَا عَيْنٌ رَأَتْ، وَلَا أُذُنَ سَمِعَتْ ، وَلَا خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ فَاقْرَؤُوا إِنْ شَئْتُمْ: فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ
(بخاري – مسلم)
(২৬৬) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন যে, আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য (জান্নাতে) এমন সব নিয়ামত তৈরী করে রেখেছি যা কোন চোখ দেখেনি কোন কান (যার সম্পর্কে) শুনেনি এবং কোন অন্ত:করণও তা সম্পর্কে কোন ধারণা রাখে না। আর এর সত্যতার জন্যে তোমরা (নিম্নলিখিত) এ আয়াতটি তেলাওয়াত করতে পার,
فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ
(سورة السجدة : (۱۷)
“আল্লাহ চোখ জুড়ান যেসব নিয়ামত নেক বান্দাদের জন্যে দৃষ্টির অন্তরাল করে রেখেছেন, তা সম্পর্কে কেহই কোন জ্ঞান রাখে না।”
(সূরা সাজদাহ-১৭)
(٢٦٧) وَعَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ أَهْلَ الْجَنَّةِ يَأْكُلُونَ فِيهَا وَيَشْرَبُونَ وَلَا يَتْفُلُونَ وَلَا يَبُولُونَ وَلَا يَتَغَوَّطُونَ وَلَا يَمْتَخِطُونَ، قَالُوا : مَا بَالُ الطَّعَامِ؟ قَالَ: جُشَاءُ وَرَشْحٌ كَرَشْحِ الْمِسْكِ يُلْهَمُونَ التَّسْبِيحَ وَالتَّحْمِيدَ كَمَا يُلْهَمُونَ النَّفْسَ (مسلم)
(২৬৭) “হযরত জাবির (রা:) বলেন, রসূল (স:) বলেছেন, অবশ্যই জান্নাতবাসীরা জান্নাতে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করবে। কিন্তু তাদের থুথু ফেলার, পেশাব পায়খানা করার কিম্বা নাক ঝাড়ার প্রয়োজন হবে না। সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন, তাদের ভক্ষ্যবস্তুর (পেটে) কি দশা হবে? হুজুর (স:) বললেন, ঢেকুর ও পছিনার মাধ্যমে বের হবে। কিন্তু তা থেকে মেশকের সুগন্ধ বের হবে। আর জান্নাতবাসীর অন্তরে আল্লাহর তাসবীহ ও তাহমীদ এমনভাবে বেধে দেয়া হবে যেমন শ্বাস প্রশ্বাস। (অর্থাৎ জান্নাতীরা শ্বাস প্রশ্বাসের ন্যায় সোবহানাল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করতে থাকবে।)” (মুসলিম)
জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের বর্ণনা
وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا (سورة الجن : (۲۳)
“আর যে আল্লাহ ও রসূলের অবাধ্য হবে তার ভাগ্যে জাহান্নামের আগুন। সেখানে সে চিরকাল থাকবে।” (সূরা জিন: ২৩)
(٢٦٨) عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: نَارُكُمْ جُزْءٌ مِنْ سَبْعِينَ جزْءًا مِنْ نَارِ جَهَنَّمَ، قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنْ كَانَتْ لَكَافِيَةٌ، قَالَ: فَضَّلَتْ عَلَيْهِنَّ بِتِسْعَةٍ وَسِتِّينَ جُزْءًا كُلُّهُنَّ مِثْلُ حَرِّهَا (بخاري – مسلم)
(২৬৮) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, তোমাদের এ পৃথিবীস্থ অগ্নি (তাপের দিক দিয়ে) জাহান্নামের অগ্নির সত্তর ভাগের একভাগ। প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর নবী কেন এ আগুনেই কি যথেষ্ট ছিল না? হুজুর (স:) বললেন, দুনিয়ার অগ্নি হতে জাহান্নামের অগ্নিকে (দাহিকা শক্তির দিক দিয়ে) উনসত্তর অংশে বর্ধিত করা হয়েছে। এর প্রতিটি অংশই আলাদাভাবে দুনিয়ার আগুনের সমতূল্য।” (বুখারী, মুসলিম)
(٢٦٩) وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : أُوقِدَ عَلَى النَّارِ أَلْفَ سَنَةٍ حَتَّى احْمَرَّتْ ، ثُمَّ أُوقِدَ عَلَيْهَا أَلْفَ سَنَةٍ حَتَّى ابْيَضَتْ ثُمَّ أُوقِدَ عَلَيْهَا أَلْفَ سَنَةٍ حَتَّى اسْوَدَّتْ فَهِيَ سَوْدَاءُ مُظْلِمَةٌ (ترمذي)
(২৬৯) “হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স:) বলেছেন, জাহান্নামের অগ্নিকে হাজার বছর যাবত তাপ দেয়া হয়েছিল, ফলে তা রক্ত বর্ণ ধারণ করেছিল। অতঃপর তাকে আরও হাজার বছর তাপ দেয়া হয়েছিল, ফলে তা শ্বেত বর্ণ ধারণ করেছিল। পরবর্তী পর্যায় আরও হাজার বছর উত্তপ্ত করার পরে উত্তপ্ত অগ্নি কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছে। ফলে তা নিবিড় কালো অন্ধকারে রূপান্তরিত হয়েছে।” (তিরমিযী)
সমাপ্ত