শ্রমিক সংকলন
কল্যাণ প্রকাশনী
শ্রমিক সংকলন
সম্পাদনায়
এডভোকেট আতিকুর রহমান
প্রকাশনায়
কল্যাণ প্রকাশনী
সম্পাদকের কথা
পৃথিবীর উত্থান-পতন ভাঙা-গড়ায় মানুষের চেষ্টা এবং শ্রম জড়িত। শ্রমজীবী মানুষের রক্ত আর ঘামের সাথে মিশে আছে পৃথিবীর তাবৎ উন্নয়ন আর অগ্রগতি। যারা রাষ্ট্র ও সমাজ শাসন করছে আর যারা শ্রম দিচ্ছে তাদের সকলকে নিয়েই মানুষের জীবন আবর্তিত। শ্রমজীবী মানুষের অবদানকে অস্বীকার করা, তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা কিংবা যথার্থ মর্যাদা না দেওয়ার কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রে সৃষ্টি হচ্ছে নানা অসঙ্গতি, সমস্যা আর সংকট। এই সমস্যা সংকট নিরসনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মত ও মতবাদের আবিষ্কার হয়েছে কিন্তু এর কোনোটিই শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত সমস্যা সমাধান করতে পারেনি। মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তিনিই মানুষের জন্য দিয়েছেন পরিপূর্ণ জীবন বিধান ইসলাম। ইসলামই কেবলমাত্র মানুষের সকল সমস্যা সমাধান করতে পারে।
শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্র, আইএলও এবং বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ আছে। কিন্তু এ সকল আইনের যথাযথ প্রয়োগ যেমন নেই, তেমনি এ সকল আইন সকল সমস্যার সমাধানও দিতে পারছে না। ইসলাম শ্রমজীবী মানুষের জন্য সবচেয়ে সুন্দর ও সর্বোত্তম বিধান বাতলে দিয়েছে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা যারা পোষণ করেন, তাদের কারো কারো মধ্যে শ্রমিক আন্দোলন বিশেষ করে শ্রমিক সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন সম্পর্কে এক ধরনের নিস্পৃহতা কাজ করে। এর মূল কারণ শ্রমিক আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়ন সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না থাকা।
বাংলা ভাষায় ইসলামে শ্রমিকের অধিকার ও শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে গবেষণা এবং বই পুস্তক প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এতো সব সংকট সত্বেও বেশ কিছু পুস্তক রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে। সেই পুস্তকগুলোর মধ্য হতে বেশ কয়েকটি বই বাছাই করে ‘শ্রমিক সংকলন’ বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই সংকলন বিশেষ করে তাদের জন্যই যারা ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। শ্রমিক শ্রেণির অংশগ্রহণ ব্যতীত পৃথিবীর কোনো আন্দোলন সফলতা লাভ করেনি। বাংলাদেশে একটি ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চলছে তাতে শ্রমিক শ্রেণির অংশগ্রহণ বাঞ্ছনীয়। শ্রমজীবী মানুষকে এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে সকলের সম্যক ধারণা থাকা অতি আবশ্যক। সেই চিন্তা ও আগ্রহ থেকে এই বইটি সংকলিত করা হয়েছে।
এতে যে পুস্তিকাগুলো সংকলন করা হয়েছে, তা হচ্ছে ইসলামি শ্রমনীতি, মাওলানা মওদূদীর চিন্তাধারায় শ্রমিক আন্দোলন, ইসলামি সমাজে শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা, ইসলামি আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষের গুরুত্ব, ইসলাম ও শ্রমিক আন্দোলন, শ্রমিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান। অত্র সংকলনে পুস্তিকাগুলো হুবহু রাখা হয়নি, বিভিন্ন লেখকের বই হওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংযোজন বিয়োজনের নীতি গ্রহণ করতে হয়েছে।
দীর্ঘদিন পরে এমন একটি সংকলন প্রকাশ করতে পেরে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শুকরিয়া আদায় করছি। তাঁর একান্ত অশেষ মেহেরবাণীতে কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। অযাচিত ভুল-ত্রুটি এড়িয়ে এ মহৎ কাজ আল্লামের যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে। এরপরেও মুদ্রণ জনিত ত্রুটি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সম্মানিত পাঠকদের কাছে এর ভুল-ত্রুটি ধরা পড়লে আমাদেরকে জানানোর জন্য একান্তভাবে অনুরোধ করছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সকল প্রচেষ্টা কবুল করুন। একই সাথে যাদের লেখা এতে সংকলন করা হয়েছে তাদের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে উত্তম জাজাহ কামনা করছি।
এডভোকেট আতিকুর রহমান
সেপ্টেম্বর ২০২৩
প্রকাশকের কথা
আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে ‘শ্রমিক সংকলন’ নামক বহুল প্রত্যাশিত বইটি পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পেরেছি। শ্রমিকরা সমাজ ও রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের চেষ্টা, শ্রম আর ঘামের ওপরই একটি সমাজ সভ্যতার ভীত নির্মিত হয়। শ্রমিকের যথাযথ অধিকার ও মর্যাদাকে অস্বীকার করে একটি সমাজ কিংবা রাষ্ট্র সামনে অগ্রসর হতে পারে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার প্রাপ্য মজুরি দিয়ে দাও। হাদিসের এ আপ্ত বাক্য আমরা যত সহজে উচ্চারণ করি, অনেক ক্ষেত্রেই ততো সহজে তাদের অধিকার আদায় হয় না। যারা একটি শান্তি, কল্যাণ ও মানতার সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন, তাদের জন্য এ বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি আদর্শবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কথা আর শ্লোগানের মাধ্যমে আদায় হতে পারে না। সমাজের সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস এবং সমন্বিত প্রচেষ্টায় সে বিপ্লব কাঙ্ক্ষিত রূপ লাভ করতে পারে। এ জন্য সমাজ নিয়ন্ত্রণের বাগডোরকে করায়ত্ব করতে হলে একটি আদর্শবাদী আন্দোলনের জন্য শিক্ষক, আলিম, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, গবেষক, চিকিৎসকসহ শ্রমিক শ্রেণিরও সমান অংশগ্রহণ অতি আবশ্যক। পৃথিবীর বড়ো বড়ো বিপ্লব এবং পরিবর্তনের ইতিহাস এ কথাই সাক্ষ্য দেয় যে, শ্রমিকরাই সে সকল বিপ্লব ও আন্দোলনে প্রথম সাড়িতে থেকে ভূমিকা পালন করেছে।
একটি আদর্শবাদী দলের গতানুগতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি তাই শ্রমিক সংগঠনকে মজবুত করা অপরিহার্য। বিশ্বব্যাপী শ্রমিক অধিকার ও শ্রমিকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আইএলও কনভেনশন এবং সেই আলোকে প্রতিটি দেশে শ্রম আইনে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন বা সংঘ প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ সকল বিষয়কে এক মলাটে যুথবদ্ধ করার প্রয়াস এই সংকলন। বেশ কয়েকজন লেখকের লেখা বইকে একত্র করে এই সংকলন প্রকাশ করা হয়েছে। যারা এই সংকলন প্রকাশে মেধা, শ্রম ও সময় দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি জানাচ্ছি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এবং মহান মনিবের দরবারে তাদের জন্য যথাযথ ও পুরস্কারের জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি। অত্র সংকলনকে যথাসাধ্য নির্ভুল করার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে, তারপরও মুদ্রণ প্রমাদ থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সম্মানিত পাঠকদের কাছে কোনো ভুল পরিলক্ষিত হলে আমাদেরকে জানানোর জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
জামিল মাহমুদ
সেপ্টেম্বর ২০২৩
প্রথম অধ্যায় : ইসলামি শ্রমনীতি
ভূমিকা
মহান আল্লাহ বিশ্বের সর্বত্র জীবিকার উপাদান ছড়িয়ে রেখে দিয়েছেন। বান্দা পরিশ্রম করে আল্লাহর দেওয়া রিযিক হতে জীবিকা সংগ্রহ করবে, এটাই তার চিরন্তন বিধান। প্রত্যেক মুহূর্তে ব্যক্তিকে আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুসারে দুনিয়ার কল্যাণ ও পরকালের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য। একজন পরিশ্রম করবে আর অন্যজন শক্তির বলে কৌশল খাটিয়ে তাকে বঞ্চিত করে তার শ্রমের ফল ভোগ করবে- এরূপ ব্যবস্থা জুলুম ও শোষণ। যারা এরূপ জীবন ব্যবস্থা সমর্থন করে বা কায়েম করতে চায়, সে সব যালেমদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা বা জেহাদ করা ঈমানদার ব্যক্তিদের কর্তব্য।
ইসলামের বিপরীতে জাহেলি সমাজে শ্রমিকের শ্রমকে পণ্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক F.W Taylor নিজেও শ্রমিককে অর্থনৈতিক মানুষ (Ecomomic Man) হিসেবে দেখিয়েছেন। ফলে বস্তুবাদী সমাজে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাকে অস্বীকার করে মানুষকে নিছক ক্রয়-বিক্রয় যোগ্য পণ্য, যন্ত্র অথবা একটি জন্তু মনে করে তালের সাথে সেভাবে আচরণ করে যাচ্ছে। মানব জাতিকে শক্তিমান ও দুর্বল এ দু’শ্রেণিতে বিভক্ত করে Might is Right (শক্তিই সত্য) ফরমূলা আবিষ্কার করে দুর্বল লোকদের অধিকার অস্বীকার করা হচ্ছে।
মহানবি (সা.) এর আবির্ভাবের পূর্বে যেসব সভ্যতার কথা আজকের যুগেও সকলের কাছে পরিচিত এবং যাদেরকে নিয়ে আজকের যুগেও ইউরোপিয়ান দেশগুলো গর্ববোধ করে থাকে, সে সমাজেও খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার স্বীকার করা হয়নি। রোম সাম্রাজ্যে দাস প্রথা প্রচলিত ছিল। সেখানে শ্রমজীবী মানুষকে পণ্য হিসেবে গণ্য করা হতো। হাটে বাজারে গরু-ছাগলের মত দাসদের ক্রয়-বিক্রয় করা হতো, যাতে পালিয়ে যেতে না পারে। মেহনতি মানুষের জন্যে শুধু ততটুকুই খাবার দেওয়া হতো, যতটুকু তাদেরকে জীবিত ও পরিশ্রমের উপযোগী রাখার জন্যে প্রয়োজন হতো। তাদের সামান্য ভুলের জন্য পশুর মত চাবুক মারা হতো।
মিসরে ফেরাউনের কুফুর শাসনকালে প্রায় ৩০ বছর ধরে দেড়শ মিটার উঁচু পিরামিড তৈয়ারকালে দাস শ্রমিকগণ চাবুকের নির্মম কষাঘাতে প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হত। খৃষ্টপূর্ব ৩৭০ অব্দে গ্রীস দাসরা মালিকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ফলে প্রায় ১২০০ দাস-মালিক নিহত হয়। রোমে খৃষ্টপূর্ব ৮ অব্দে গ্রেডিয়েটরের দাসরা বিদ্রোহ করে।
মহানবি (সা.) তাঁর আগমনের পূর্বে মেহনতি মানুষের করুণ চিত্র তুলে ধরে বলেছেন, “আমি জানি ইসলামের পূর্বে খেটে খাওয়া মানুষের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না, তাদেরকে পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট মনে করা হতো। সে সমাজে ধনী ও নেতারা নিজেদেরকে সকল মান-সম্মানের মালিক মনে করত। আল্লাহর বান্দারা ভুলে গিয়েছিল যে, সকল মানুষ সমান এবং সকল মানুষ ন্যায় বিচার লাভের অধিকারী। তারা ভাবতো যে, অধিনস্থদের জীবনের একমাত্র ব্রত হচ্ছে মালিকদের সেবা করা এবং তাদের কৃত সকল জুলুম-অত্যাচার সহ্য করে নেওয়া। মালিকদের কাছে খেটে খাওয়া মানুষের উঠাবসা ও কথা বলা নিষেধ ছিল এবং মালিকদের কথা ও কাজের প্রতিবাদ করা মৃত্যু যোগ্য অপরাধ ছিল।” (কানযুল উম্মাল)
আধুনিক যুগের তথাকথিত সৌভাগ্যবান শাসক ও বিত্তবান লোকেরা অসহায় ও দরিদ্র লোকদের শ্রম ও সম্পদ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শোষণ করে নিজেদের সৌভাগ্য রচনা করছে এবং শোষণের নতুন নতুন পদ্ধতি ও কৌশল আবিষ্কার করছে। আধুনিক যুগে শ্রমজীবী মানুষের বঞ্চনার জন্যে দায়ী দু’টি মতাদর্শ, একটি হচ্ছে পুঁজিবাদ আর অপরটি হচ্ছে সমাজতন্ত্র।
মানব রচিত আইন ভ্রান্ত ও পক্ষপাতদুষ্ট। মানব রচিত আইনের মাধ্যমে দুর্বল লোকদের গোলামে পরিণত করে প্রভুদের খায়েশ পূর্ণ করতে চায়। তাই মহানবি (সা.) এর আগমনের পূর্বে এবং আজকের বিজ্ঞানের যুগের অসহায় মেহনতি মানুষের ওপরে শাসক ও মালিকদের শোষণ ও প্রভুত্ব সমানে চলছে। নবি কারিম (সা.) বিশ্বের ইতিহাসে যে শ্রেষ্ঠতম বিপ্লব সাধন করলেন যার মধ্যে অসহায় শ্রমজীবী মানুষের সকল অধিকার নিশ্চিত হয়। সে জন্য একজন শ্রমিককেও জীবন দিতে হয়নি।
ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত পরিপূর্ণ জীবন বিধান। প্রতিটি মানুষের সকল সমস্যার সমাধান ও অধিকারের গ্যারান্টি দিতে পারে একমাত্র ইসলাম। তাই ইসলামি সমাজ রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, মালিক-শ্রমিক ও সাদা-কালো সকল মানুষের মর্যাদা এবং অধিকার অক্ষুন্ন রাখার নিশ্চয়তা দিয়েছে। কারও অধিকারের প্রতি সামান্যতম অবহেলা প্রদর্শন করা বা অধিকার খর্ব করার প্রয়াস অমার্জনীয় অপরাধ বলে ইসলাম ঘোষণা করেছে। ইসলামি সমাজে শুধু অসহায় মানুষই নয়, বরং পশুর অধিকার আদায় করার প্রতিও তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। জাহেলি সমাজ পরিচালিত হচ্ছে মানব রচিত আইন দ্বারা, আর মানব রচিত আইন শ্রান্ত ও পক্ষপাতদুষ্ট। তাই জাহেলি সমাজে চলছে মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব, শাসনের নামে চলছে শোষণ এবং অসহায় দুর্বল শ্রেণির লোকদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে তাদের অধিকার থেকে।
ইসলাম শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের যে গ্যারান্টি দিয়েছে, তা যেকোন যুগের মানব রচিত আইনে মেহনতি মানুষের অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম। খেটে খাওয়া (শ্রমজীবী) মানুষের অধিকার ইসলাম প্রদত্ত শ্রমনীতির মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।
শ্রমনীতি কী?
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সর্ব প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে মানুষের শ্রম। অধ্যাপক পিটার ড্রকার বলেন যে, মানুষ ব্যতীত মূলধন অর্থহীন; কিন্তু মানুষ মূলধন ছাড়াই অনেক কিছু করতে সক্ষম। অতএব শ্রম ব্যতীত উৎপাদনের সকল উপাদান অর্থহীন। প্রত্যেক দেশেই সরকার কর্মী ব্যবস্থাপনা, যাবতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োজিত শ্রমিক ও কর্মচারীদের সহিত তাদের মালিকদের চুক্তিবদ্ধ নিয়োগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যে ব্যবস্থাপনা, যাবতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োজিত শ্রমিক ও কর্মচারীদের সহিত তাদের মালিকদের চুক্তিবদ্ধ নিয়োগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যে আইন, যে সব নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়ে থাকে তাকে শ্রমিক আইন বলে। সরকারের শ্রম আইন যে সব নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে রচিত হয় তাকে শ্রমনীতি বলে। সমাজের সার্বিক কল্যাণ, সামাজিক ন্যায় বিচার, অধিক উৎপাদন, মুনাফার সুষ্ঠু বণ্টন, মালিক ও শ্রমিকদের অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তা, কর্মী নির্বাচন, নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা বিধান, অভিযোগ নিরসন, নিরাপত্তা বিধান, শ্রমিক সংঘ গঠন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধাসমূহ শ্রমনীতির অন্তর্ভুক্ত। প্রচলিত শ্রমনীতি মাত্র দুই শতাব্দ পূর্বে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়েছে।
ইসলামি শ্রমনীতি কী?
উল্লেখিত বিষয় ও সমস্যা সমূহের সমাধান করার জন্যে কুরআন ও হাদিসের আলোকে যে মূলনীতি রচনা করা হয়, তাকে ইসলামি শ্রমনীতি বলে। ইসলামি শ্রমনীতির ইতিহাস মানবতার ইতিহাসের মতই সুদীর্ঘ। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সময় তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। খলিফাদের যুগে তা পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত হয়।
ইসলামি শ্রমনীতির মূল উৎস
ইসলামি শ্রমনীতির নতুনভাবে প্রণয়ন করার অপেক্ষা রাখে না। মহান আল্লাহ ইসলামি শ্রমনীতির রচয়িতা এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলামি শ্রমনীতির প্রবর্তক। কুরআন ও হাদিসে ইসলামি শ্রমনীতির মৌলিক বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে বর্ণিত রয়েছে, যেসব নীতিমালা আজকের আধুনিক বিশ্বের মেহনতি মানুষের সকল সমস্যার সমাধান দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কুরআন-হাদিস গভীরভাবে অধ্যয়ন ও গবেষণার মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে ইসলামি শ্রমনীতির বিভিন্ন দিক ও বিভাগগুলো।
আল্লাহ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, মানব জীবনের যেকোন সমস্যার সঠিক পথ নির্দেশনা কি? আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ :
“তোমাদের মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় তা আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশ মোতাবেক মীমাংসা করে লও।” (সুরা নিসা: ৫৯)
অর্থাৎ তোমাদের মধ্যকার সকল সমস্যা ও মতবিরোধ কুরআন ও হাদিসের আলোকে ফয়সালা করে লও।
عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ أَنْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا بَعَثَهُ إلَى الْيَمَنِ قَالَ كَيْفَ تَقْضَى إِذا عُرِضَ لَكَ قَضَاء قَالَ أَقْضَى بكِتَابِ اللهِ فَإِنْ لَمْ تَجِدُ فِي كِتَابِ اللَّهِ قَالَ فَبِسُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اجْتَهِدُ بِرَأْنِي وَلَا الُوْ قَالَ فَضَرَبَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى صَدْرِهِ وَقَالَ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وفق رسولَ رَسُولِهِ بِمَا يَرْضَى بِهِ رَسُولُه – (ترمذی ، ابوداود)
হযরত মুয়াজ ইবনে যাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবি কারিম (সা.) যখন তাকে ইয়ামেনে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করছিলেন তখন নবি কারিম (সা.) তাকে প্রশ্ন করলেন, যখন তোমার সামনে কোনো সমস্যা দেখা দিবে, তখন তুমি কীভাবে তার সমাধান করবে? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর কিতাব অনুসারে সকল সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করব। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, যদি আল্লাহর কিতাবের মধ্যে কোনো বিষয়ের ফয়সালা খুঁজে না পাও? তিনি বললেন রাসুলের সুন্নত অনুসারে ফয়সালা করব। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে আবারও প্রশ্ন করলেন, যদি তুমি রাসুলের সুন্নতের মধ্যেও কোনো বিষয়ের সমাধান খুঁজে না পাও? তিনি বললেন যে, আমি নিজেই ইজতিহাদ করে সে কাজের ফায়সালা করার চেষ্টা করব। এ ব্যাপারে কোনো প্রকার অলসতা করব না। নবি কারিম (সা.) তার জবাব শুনে তার ছিনার ওপর হাত রেখে বললেন যে, আল্লাহ তার রাসুলের প্রতিনিধিকে রাসুলের মনঃপুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার তাওফিক দিয়েছেন। (তিরমিযি, আবু দাউদ)
উল্লেখিত হাদিসটি যে কোনো সমস্যার সমাধানের জন্যে একটি আলোক বর্তিকা। নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করার জন্যে ইসলামি মনীষীদেরকে অধিকার দেওয়া হয়েছে। তাই আজকের বিশ্বের সকল সমস্যার সমাধান কুরআন ও হাদিসের আলোকে পেশ করার দায়িত্ব আধুনিক যুগের মুসলিম মনীষীদের। কুরআন, হাদিস, সাহাবায়ে কিরামদের মতামত ও কার্যাবলী এবং ইমামদের অভিমতসমূহের আলোকে গবেষণা করে ইসলামি শ্রম আইন প্রণয়ন করে আধুনিক শিল্পায়িত বিশ্বের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা মোটেই অসম্ভব বা কষ্টকর নয়।
ইসলামি শ্রমনীতির বৈশিষ্ট্য
ইসলামি শ্রমনীতির কতিপয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে:
১. ইসলামি শ্রমনীতির রচয়িতা মানুষের সৃষ্টিকর্তা প্রতিপালক মহান আল্লাহ।
২. ইসলামি শ্রমনীতির প্রতিষ্ঠাতা আল্লাহর নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)।
৩. এ নীতির মূল উৎস কুরআন ও হাদিস।
৪. এ নীতি সর্বকালের দেশের এবং সকল যুগের মানুষের জন্যে প্রযোজ্য ও কল্যাণকর।
৫. এ নীতি সকল মানুষকে আল্লাহর বান্দা ও আশরাফুল মাখলুকাত বলে স্বীকার করে। তাই অধীনদেরকে ঘৃণা করা মহাপাপ বলে ঘোষণা করেছে।
৬. এ নীতি মানুষের মধ্যে আল্লাহভীতি ও পরকালের জবাবদিহির অনুভূতি জাগ্রত করে মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ করে গড়ে তুলতে চায়।
৭. এ নীতি অপরাধীকে দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের আযাবের ভয় দেখায়।
৮. এ নীতি দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের মুক্তির লক্ষ্যে প্রণীত।
৯. এ নীতি মানুষের ওপর থেকে মানুষের প্রভুত্ব খতম করে দিয়ে মানুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
১০. ইসলামি শ্রমনীতি ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ গড়ে তুলে।
১১. এ নীতি মালিক ও শ্রমিকের ন্যায়সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
১২. এ নীতি মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।
১৩. এ শ্রমনীতি শ্রমজীবী মানুষের ওপর যেকোন ধরনের শোষণ, নির্যাতন ও অসদাচরণ মালিকের জন্যে হারাম ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করছে।
১৪. এ নীতি কাজকে ইবাদত বলে ঘোষণা করেছে আর কাজে অবহেলা ও ফাঁকি দেওয়া জঘন্য অপরাধ বলে ঘোষণা করে।
১৫. এ নীতি উপার্জনের সকল অবৈধ পন্থাকে হারাম বলে ঘোষণা করেছে এবং বৈধ পন্থায় উপার্জনকে ফরজ করে দিয়েছে।
১৬. এ নীতিতে বেকারত্ব দূর করে সকল কর্মক্ষম ব্যক্তির জন্য কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া সামাজিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব সরকারকে অবশ্যই পালন করতে হবে।
১৭. এ নীতিতে অসহায় ও অক্ষম মানুষের সর্বপ্রকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব।
১৮. এ নীতি মালিক-শ্রমিকের সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা সমান বলে ঘোষণা করেছে।
১৯. এ নীতি বৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদে ব্যক্তি মালিকানা স্বীকার করে। তবে ধনীদের সম্পদে গরিবদের অধিকার স্বীকার করে নিয়েছে।
২০. এ নীতি মানুষের মৌলিক প্রয়োজনকে সামনে রেখে মজুরি নির্ধারণ করে।
২১. এ নীতি মানুষের যোগ্যতার ভিত্তিতে বেতনে ন্যূনতম পার্থক্য স্বীকার করে।
২২. এ নীতিতে পক্ষপাতিত্ব নয় বরং যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগের নির্দেশ দেয়।
২৩. এ নীতি উৎপাদিত পণ্যে ও কারবারে মেহনতি মানুষের অংশ স্বীকার করে।
২৪. এ নীতি ব্যবস্থাপনায় মেহনতি মানুষের অংশ গ্রহণ স্বীকার করে নিয়েছে।
২৫. এ নীতি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করে।
২৬. এ নীতি বাস্তবায়িত হলে আজকের বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগে অশান্ত বিশ্বে শান্তি ফিরে আসতে পারে। আর অসহায় বঞ্চিত মেহনতি মানুষ ফিরে পেতে পারে তাদের সকল হৃত অধিকার।
২৭. এ নীতি চালু করার জন্যে একটি সরকার প্রয়োজন, আর সেজন্যে প্রয়োজন একটি ইসলামি রাষ্ট্রের। ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থা ব্যতীত ইসলামি শ্রমনীতি অনৈসলামি রাষ্ট্রে চালু হতে পারে না।
২৮. ইসলামি শ্রমনীতি যে রাষ্ট্রের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে, সে ধরনের একটি ইসলামি রাষ্ট্র অলৌকিকভাবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করবে না। সেজন্যে প্রয়োজন একদল মর্দে মুজাহিদ, যারা জান ও মাল কুরবান করে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। যেমন আল্লাহর নবি (সা.) করেছিলেন তার সাহাবাগণকে নিয়ে। এমনকি সে জন্যে তাদেরকে বাড়িঘর ত্যাগ করতে হয়েছে। কাফেরদের অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। আর যুদ্ধ করে অনেককে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে। আজকেও নবির নীতি অনুসরণ করে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দ্বীনের বিজয় ঘোষণা করতে হবে। আর সে সমাজের শ্রমজীবী মানুষের জন্য প্রনীত হবে ইসলামি শ্রমনীতি।
মানুষের রিযিক
রিযিকদানের দায়িত্ব আল্লাহর। সারা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তিনি প্রতিটি বস্তু পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং সকলের জন্যে জীবিকার ব্যবস্থা করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন:
وَ مَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا
“পৃথীবীতে বিচরণশীল এমন কোনো জীব নেই, যার রিযিক দানের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর নয়।” (সুরা হুদ: ৬)
نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُمْ مَعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيُوةِ الدُّنْيَاه
“আমরাই মানুষের জীবিকা ও জীবিনোপকরণ পৃথিবীর জীবনে তাদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছি।” (সুরা যুখরুফ: ৩২)
আল্লাহ প্রাকৃতিকভাবে জীবিকার আয়োজন করেছেন
মানুষ হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টির সেরা। আর মানুষের কল্যাণের জন্যে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর সবকিছু। মানুষ বুদ্ধির দ্বারা পৃথিবীর সবকিছুই তার কল্যাণের জন্যে ব্যবহার করতে পারে। মানুষ সৃষ্টির মধ্যে মর্যাদাসম্পন্ন তাই তার খাদ্য উত্তম ও পবিত্র হতে হবে।
মহান আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْتُهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْتُهُمْ مِّنَ الطَّيِّبَتِ وَفَضَّلْتُهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا.
“বনি আদমকে আমরা শ্রেষ্ঠত্ব-বৈশিষ্ট্য দান করেছি, তাদেরকে স্কুল ও পানি পথে যানবাহন দান করেছি, তাদেরকে উত্তম ও পবিত্র রিযিক দিয়েছি এবং আমার অনেক সৃষ্টির ওপর তাদের খুব বেশি মর্যাদাসম্পন্ন বানিয়েছি।” (সুরা ইসরাইল: ৭০)
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاتِ وَالْأَرْضَ وَاَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْفُلْكَ لِتَجْرِيَ فِي الْبَحْرِ بِأَمْرِهِ ۚ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْأَنْهُرَ ٣٣ وَسَخَّرَ لَكُمُ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ دَائِبَيْنِ وَسَخَّرَ لَكُمُ الَّيْلَ وَ النَّهَارَة ٣٣ وَاتْكُمْ مِنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا
“আল্লাহ তিনিই, যিনি আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষিয়েছেন। পানির সাহায্যে তোমাদের রিজিকের জন্যে বিভিন্ন প্রকার ফল উৎপাদন করেছেন। আর নৌকা-জাহাজকে তোমাদের নিয়ন্ত্রিত বানিয়ে দিয়েছেন, যেন তার নির্দেশ ও বিধান অনুযায়ী নদী ও সমুদ্রপথে চলাচল করে। খাল, ঝরনাগুলোকেও তোমাদের কল্যাণ কর্মে নিয়োজিত করেছেন। সর্বক্ষণ আবর্তনশীল সূর্য ও চন্দ্রকে তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত রেখেছেন। তোমাদের জন্যে রাত্র ও দিবাকে নিয়ন্ত্রিত এবং নিয়োজিত করে রেখেছেন। আর (এ সবকিছুর পরিপূর্ণ সহযোগিতার মাধ্যমে) তোমাদেরকে সে সবকিছু দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, যা তোমরা স্বভাবতই চাইতে পার। এভাবে আল্লাহর দেওয়া নেওয়ামতসমূহ (এত বেশি যে, তা) গুণে তোমরা কখনই শেষ করতে পারবে না।” (সুরা ইবরাহিম: ৩২-৩৪)
আল্লাহর দেওয়া রিযিক অনুসন্ধান করা ফরজ
বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে আল্লাহর দেওয়া রিযিক। মানুষ চেষ্টার মাধ্যমে সংগ্রহ করবে তার নিজস্ব অংশ। তার অংশ পাওয়া থেকে কেউ বঞ্চিত থাকতে পারে না। প্রত্যেক মানুষকে আল্লাহ একটি মুখ ও একটি পেট দিয়েছেন। আর তার রিষিক সন্ধানের জন্য দিয়েছেন দুটি হাত, দুটি পা, দুটি চোখ এবং সর্বোপরি জ্ঞান-বুদ্ধি। এগুলো পরিচালনা করে হালাল রোজগারের জন্যে প্রতিটি মানুষকে পরিশ্রম করতে হয়। এমনকি আল্লাহর প্রিয় বান্দা নবিরাও কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন।
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلوةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“যখন তোমাদের নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (আল্লাহ দয়া করে যে রিজিকের ব্যবস্থা করেছেন তা) সন্ধান কর। আল্লাকে বেশি বেশি স্মরণ করতে থাক। সম্ভবত, তোমরা সফলতা লাভকরতে পারবে।” (সুরা জুমআ: ১০)
যখন নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে বের হও, তখন রাসুল (সা.) নিম্নোক্ত দোয়া পড়তে বলেছেন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ.
“আল্লাহ, তোমার নিকট তোমার অনুগ্রহ চাই।”
অর্থাৎ তুমি নামাজ আদায় করার পর মসজিদের বাহিরে গিয়ে তোমার অনুগ্রহ (রিযিক) অনুসন্ধান করতে নির্দেশ দিয়েছো, তা যেন সঠিকভাবে পালন করতে পারি।
عَنْ عَبْدِ الله بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ طَلَبُ كَسْبِ الْحَلَالِ فَرِيضَةُ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ –
“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন: অন্যান্য ফরজের সহিত হালাল উপার্জনও একটি ফরজ।” (বায়হাকি)
عَنِ الْمِقْدَادِ بْنِ مَعْدِ يُكَرِبَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِّنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ وَإِنْ نَبِيُّ اللَّهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلَامُ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ –
“মিকদাদ ইবনে মাদিকারাব থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিজের পরিশ্রমের ফলে উপার্জিত খাবারের চেয়ে উত্তম খাবার তোমাদের কেউ খায়নি। আল্লাহর নবি দাউদ (আ.) নিজের পরিশ্রমের দ্বারা উপার্জিত খাবার খেতেন। (বুখারি)
হযরত ওমর ফারুক (রা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি যেন শ্রম-মেহনত করে অর্থোপার্জনের কাজ বন্ধ করে না দেয় এবং এ বলে যেন বেকার হয়ে বসে না থাকে যে, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে খাবার দাও। কারণ তোমরা ভালো করে জান যে, আকাশ হতে স্বর্ণ রৌপ্য ঝরে পড়ে না।
শ্রম
একজন মানুষ কিংবা একটি সংগঠিত সংস্থা, ফ্যাক্টরি অথবা কারখানা অন্য লোকের দৈহিক অথবা চিন্তামূলক কর্মশক্তি দ্বারা লাভবান হয়। তাই শ্রমও একটি সম্পদ বিশেষ। কুরআন শরিফেও এর প্রমাণ মজুদ আছে। মাল-সম্পদ এবং নগদ অর্থের মত ‘মহর’ও সেবার (শ্রমের) বিনিময় হিসেবে ধার্য হতে পারে। হযরত মুসা (আ.) মুহরের বিনিময়ে তার স্ত্রীর বকরী চরিয়েছিলেন বলে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে।
قَالَ إِنِّي أُرِيدُ أَنْ أَنْكِحَكَ إِحْدَى ابْنَتَى هُتَيْنِ عَلَى أَنْ تَأْجُرَنِي ثَمْنِي حِجَجٍ فَإِنْ أَتْمَمْتَ عَشْرًا فَمِنْ عِنْدِكَ .
“আমার একান্ত ইচ্ছা, আমার এই কন্যা দুটির একটিকে বিবাহ দেব তোমার সাথে এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করে দেবে, আর যদি দশ বছর পূর্ণ করে দাও, তবে সেটা হবে তোমার অনুগ্রহ।” (সুরা কাসাস: ২৭)
শ্রম বা মেহনত দু’রকমের হতে পারে যেমন: (ক) দৈহিক ও (খ) বুদ্ধি বৃত্তিক।
(ক) দৈহিক শ্রম: সম্পদ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে শ্রম। কুরআন শরিফেও এ মাধ্যমটির উল্লেখ করা হয়েছে। এটাকে অবলম্বন করে মানুষ কোনো রকম পুঁজি ছাড়াই নিজের জীবিকা অর্জন করতে পারে। কুরআন শরিফে দু’জন নবিকে শ্রমিক-মালিক হিসেবে পেশ করা হয়েছে। হযরত শুআ’ইব (আ.) বলেছেন:
أَنْ تَأْجُرَنِي ثَمْنِي حِجَجٍ فَإِنْ أَتْمَمْتَ عَشْرًا فَمِنْ عِنْدِكَ .
“তুমি আট বছর আমার কাজ করে দেবে, আর যদি দশ বছর পূর্ণ করে দাও, তবে সেটা তোমার অনুগ্রহ।” (সুরা কাসাস: ২৭)
হযরত খিজিরকে একজন রাজমিস্ত্রী হিসেবে দেখানো হয়েছে:
فَوَجَدَا فِيهَا جِدَارًا يُرِيدُ أَنْ يَنْقَضَ فَأَقَامَهُ قَالَ لَوْ شِئْتَ لَتَّخَذْتَ عَلَيْهِ أَجْرًاه
“সেই পল্লীতে তারা একটা প্রাচীর দেখতে পেল, একেবারে পতনোন্মুখ, সেই ব্যক্তি (খিজির) প্রাচীরটাকে পুনরায় গেঁথে দিল। মূসা বলে উঠলেন, আপনি ইচ্ছা করলে এদের নিকট থেকে পারিশ্রমিক নিশ্চয়ই নিতে পারতেন।” (সুরা কাহাফ: ৭৭)
(খ) বুদ্ধি বৃত্তিক শ্রম: ঐ সমস্ত পুঁজিহীন পেশা, যেগুলোর মধ্যে দেহের চাইতে মস্তিষ্ককে বেশি খাটানো হয় (যেমন তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা), কুরআন মজিদে সেগুলোরও উল্লেখ করা হয়েছে। ইউসুফ (আ.) এর কাহিনীতে বলা হয়েছে যে, মিসরের বাদশাহ তার সাথে আলাপ-আলোচনা করার পর যখন তাকে চাকরিতে নিয়োগের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, তখন তিনি বললেন,
إِنَّكَ الْيَوْمَ لَدَيْنَا مَكِينْ آمِينٌ
“আজ তুমি আমাদের দৃষ্টিতে বিশেষ মর্যাদাশালী ও বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত হলে।” (সুরা ইউসুফ: ৫৪)
তখন ইউসুফ তার প্রস্তাবিত চাকরিকে গ্রহণ করে নিজের সম্পর্কে বললেন,
قَالَ اجْعَلْنِي عَلَى خَزَائِنِ الْأَرْضِ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيمٌ
“আমাকে দেশের ধনভাণ্ডারের কর্তাপদে নিযুক্ত করুন। আমি ঐগুলোর রক্ষাণাবেক্ষণ করব এবং সে সম্বন্ধে আমার জ্ঞানও আছে।” (সুরা ইউসুফ: ৫৫)
এ আয়াত থেকে জানা জানা যাচ্ছে যে, মানুষ তার যোগ্যতা অনুযায়ী যেকোনো চাকরির জন্যে সরকারের কাছে আবেদন করতে পারে। আর সে আবেদনের মধ্যে নিজের যোগ্যতার উল্লেখ করা পয়গম্বরের সুন্নাত (রীতি) বিশেষ। কেননা হযরত ইউসুফ (আ.) এ সুযোগে নিজেকে রক্ষণাবেক্ষণকারী ও জ্ঞানী বলে দাবি করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)ও শ্রম, চাকরি এবং অন্যান্য পেশার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
قَالَ مَا بَعَثَ اللَّهُ نَبِيًّا إِلَّا رَعَى الْغَنَمَ فَقَالَ أَصْحَابُهُ وَأَنْتَ فَقَالَ نَعَمْ كُنْتُ أَرْعَى عَلَى قِيرَاطَ الأَهْلِ مَكَّةَ –
“আল্লাহর প্রত্যেক নবিই বকরী চরিয়েছিলেন। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, আর আপনি? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন “হ্যাঁ, আমি এক কিরাতের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল-ভেড়া চরাতাম। (বুখারি)
ইসলামের দৃষ্টিতে সকল মানুষই শ্রমিক। একজন রাষ্ট্রপতিও একজন শ্রমিক। বাতিল সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের মধ্যে উঁচু-নিচু পার্থক্যের জন্যে রাজা-প্রজা, সাহেব-কর্মচারী বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসলামের মূল দর্শন হচ্ছে প্রত্যেকটি মানুষই আল্লাহর বান্দাহ এবং আদম ও হাওয়া থেকে তারা বিস্তার লাভকরেছে। অতএব সকল মানুষ ভাই ভাই। ইসলামের সকল নবিই শ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, “হযরত দাউদ (আ.) সুতার ছিলেন, হযরত ইদ্রিস (আ.) দর্জি এবং মূসা (আ.) ছাগল চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আমাদের নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) মেষ চরাতেন। খাদিজা (রা.) এর ব্যবসা পরিচালনা করতেন। কূপ থেকে পানি তোলার বিনিময়ে একটি খেজুর নিতেন, অন্যের ক্ষেতে পানি ঢালতেন। মদিনার শাসক হওয়ার পরও একজন সাধারণ মানুষের মত জীবন যাপন করতেন। অন্ধকার রজনীতে তিনি তার গৃহে তেলের অভাবে প্রদীপ জ্বালাতে পারেননি। শেষ নবি সারাজীবন শ্রমজীবী মানুষের কাতারে থেকে গেছেন। আল্লাহর নবি জানতেন তার উম্মতের মধ্যে অসহায়, অভাবী, শ্রমজীবী মানুষই হবে অধিক, তারা যেন অসহায় অবস্থায়ও নবির আদর্শকে অনুসরণ করতে পারে। শ্রমজীবী মানুষের সুমহান মর্যাদা ঘোষণা করে আল্লাহর নবি বলেছেন,
الْكَاسِبُ حَبِيبُ اللهِ.
“পরিশ্রমি আল্লাহর বন্ধু।” (আল হাদিস)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও ঘোষণা করেছেন:
إِنَّ اللَّهَ يَكَهَ يَكْرَهُ اشْتَرَى عَنْهُ فَارِغًا مِنْ عَمَلِ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ
“আল্লাহ তার ঐ বান্দাকে দেখতে অপছন্দ করেন, যে ইহকালের ও পরকালের কর্ম থেকে বিমুখ।” (মিশকাত)
ইসলামের সুমহান আদর্শ গ্রহণ করে আরবের গোলামেরাও উচ্চ মর্যাদা লাভকরেছিলেন। যেমন হযরত বেলাল (রা.) মদিনার মসজিদের মুয়াজ্জিন হয়েছিলেন। হযরত যায়েদ (রা.) রাসুলুল্লাহর পোষ্যপুত্র হয়েছিলেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) কুরাইশ বংশের সম্মানিত পরিবারের মেয়ে আপন ফুফাত বোন হযরত যয়নব (রা.) কে তাঁর কাছে বিয়ে দিয়ে উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ চিরতরে খতম করে দিলেন। হযরত উমর (রা.) বলেছিলেন, আবু হুযাইফার গোলাম হযরত সালেম (রা.) বেঁচে থাকলে আমি তাকে মুসলমানদের রাষ্ট্র প্রধান নিযুক্ত করে যেতাম।
ইসলাম খেটে খাওয়া, অসহায় মানুষের অবস্থার উন্নয়নে শুধু মায়া-কান্না করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং নবি কারিম (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম তাদের বাস্তব আদর্শ দ্বারা এমন সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, যা রীতিমতো বিস্ময়কর এবং নজীরবিহীন।
আজকের শ্রমিক সমাজ যদি পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের মিথ্যা স্লোগানে বিভ্রান্ত না হয়ে ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে একত্রিত হয়ে ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতো, তাহলে মুসলমানদের সোনালী যুগের ইতিহাস পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠত এবং শ্রমজীবী মানুষের প্রতিটি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতো।
কর্মসংস্থান
প্রত্যেক ব্যক্তিরই জীবিকার জন্যে কর্মের প্রয়োজন। প্রতিটি মানুষই তার ক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করে। সকল মানুষেরই কম-বেশি কর্মদক্ষতা আছে, জন্মগত যোগ্যতা ও প্রতিভা আছে। আল্লাহ প্রদত্ত এ মহাদানকে অকর্মণ্য, নিষ্ক্রিয় ও অকেজো করে রাখার অধিকার কারো নেই। প্রত্যেক মানুষকে আল্লাহ তার চেষ্টা-সাধনা অনুসারে প্রতিফল দান করে থাকেন। এমনকি নবি রাসুলগণকেও কঠোর পরিশ্রম করে খেতে হয়েছে। তাদের জন্যে আকাশ থেকে খাদ্য পাঠানো হতো না। এ ব্যাপারে আল কুরআনে সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে,
وَأَن لَّيْسَ لِلْإِنسَانِ إِلَّا مَا سَعَى ، وَأَنَّ سَعْيَهُ سَوْفَ يُرَى
“মানুষের ভাগ্যে কিছুই আসে না শুধু যতটুকু সে চেষ্টা করে থাকে। তার চেষ্টা সাধনা অচিরেই মূল্যায়ন করা হবে।” (সুরা নাজম: ৩৯-৪০)
لِتُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا تَسْعُى
“প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার চেষ্টা অনুসারে প্রতিফল দেওয়া হবে।” (সুরা ত্ব-হা: ১৫)
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিকের দায়িত্ব
১. শ্রমিক যে কাজে দক্ষ, তা মালিকের নিকট সুস্পষ্ট করে তোলা।
২. কাজের সময় সম্পূর্ণ হক আদায় করে কাজ করা।
৩. অধিক উৎপাদনের জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
৪. সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করা।
৫. দায়িত্ব পালনকে আমানত ও ইবাদত হিসেবে গ্রহণ করা।
৬. কাজে ফাঁকি দেওয়া, গাফলতি দেখান ও আখেরাতের ক্ষতির কারণ হিসেবে বিশ্বাস করা।
৭. নিয়ম-শৃঙ্খলা বিরোধী কাজ না করা।
৮. চুক্তি ভঙ্গ না করা, চুক্তির সকল শর্ত পূরণ করতে হবে।
৯. মালিকের কল্যাণ কামনা করে প্রতিটি কাজ আঞ্জাম দেওয়া।
১০. অলসতা, গাফলতি, কাজে ফাঁকি ও অনুপস্থিতি এড়িয়ে চলা।
১১. মালিকের নির্দেশের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং অসদাচরণ সম্পূর্ণ ত্যাগ করা।
১২. ছুটির সময় ছুটি ভোগ করা।
১৩. কোনো মিথ্যা ডাক্তারী সার্টিফিকেট ও ভুল বর্ণনা প্রদান না করা।
১৪. সদাচরণ নীতি মেনে চলা ও উচ্চ পদস্থদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।
১৫. নির্ধারিত ইবাদতের সময় ব্যতীত মালিকের কাজের সময় কোনো অজুহাত না দেখান।
১৬. কাজে বাধা সৃষ্টি করার জন্য কাউকে উত্তেজিত না করা।
১৭. ইউনিয়নের কার্যক্রম নির্ধারিত কাজের সময় ও ক্ষেত্রে না করা।
১৮. ইউনিয়নের কার্যক্রমের মাধ্যমে শ্রমিক, মালিক ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ নিশ্চিত করা।
১৯. প্রতিষ্ঠানের কোনোরকম ক্ষতি সাধন না করা।
২০. সৎ, আমানতদার ও যোগ্য লোককে শ্রমিক প্রতিনিধি নির্বাচন করা।
২১. দাবি-দাওয়া আদায়ের ব্যাপারে নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করা।
২২. মালিকের সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো দাবির জন্য চাপ প্রয়োগ না করা।
২৩. কোম্পানির দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নিজের স্বার্থ, মালিকের স্বার্থ, দেশের স্বার্থ ও পরকালের মুক্তির আশা পোষণ করা।
২৪. কোনো ক্ষতিকারক ও শরিয়ত বিরোধী কাজ না করা।
ইসলামি শ্রমনীতির সুফল
ইসলামি শ্রমনীতি বাস্তবায়িত হলে মালিক শ্রমিকের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না। কেউ কাউকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে না, সবাই ভাই হিসেবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে দুনিয়ার জীবনে শান্তি ও আখেরাতে মুক্তির প্রত্যাশা করবে। সকল বিষয়ে আল্লাহর নিকট জবাবদিহির চেতনা জাগ্রত হবে। নিম্নে ইসলামি শ্রমনীতির কতিপয় সুফল আলোচনা করা হল:
শ্রমিকের উপযুক্ত পারিশ্রমিক নির্ধারণের তাগিদ
শ্রমের বিনিময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাওয়া একজন শ্রমিকের অধিকার। আর তার এ অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ইসলাম কোনো শ্রমিককে কাজে নিযুক্ত করার আগেই তার পারিশ্রমিক নির্ধারণ করার ব্যাপারে তাগিদ দেয়।
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنِ اسْتِنْجَارِ الْأَجِيرِ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَهُ أَجْرُهُ.
আবু সাঈদ আল-খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে নিযুক্ত করতে নিষেধ করেছেন।” (বায়হাকি)
নিজের পারিশ্রমিক সম্পর্কে অজ্ঞাত রেখে শ্রমিককে কাজে খাটানো যাবে না। সম্ভব হলে কাজে নিযুক্তির আগে অথবা কাজ চলাকালীন তাকে তার পারিশ্রমিক জানিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ এমন যেন না হয় যে, তার কাজ শেষ হয়ে গেছে অথচ সে তার পারিশ্রমিক কত তা জানে না।
অন্যত্র ইমাম বায়হাকি বর্ণনা করেছেন যে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : وَمَنِ اسْتَأْجَرَ أَجِيرًا فَلْيُعْلِمُهُ أَجْرَهُ .
আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবি কারিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, আর যে ব্যক্তি কাউকে শ্রমিক নিযুক্ত করতে চায় সে যেন তাকে তার পারিশ্রমিক জানিয়ে দেয়। (বায়হাকি)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আমাদের সমাজের অনেকেই রিকশা শ্রমিকদের সাথে ভাড়া ঠিক না করেই তাদেরকে নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে গমন করে। এরপর ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। আর তখন পরিস্থিতির শিকার হয়ে রিকশাওয়ালা ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে কম নিতে বাধ্য হয়; কিংবা যাত্রী অতিরিক্ত ভাড়া দিতে বাধ্য হয়। অথচ কোনো পক্ষই হয়ত বিষয়টি অনুধাবন করার চেষ্টা করে না যে, এটি বান্দাহর হকের সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং তা বান্দাহর সাথে মিটিয়ে না গেলে মহান আল্লাহও তা ক্ষমা করবেন না। সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে আমাদের দেশে উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পাওয়ায় শ্রমিকরা আন্দোলন করে, দাবি দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে সংগ্রাম করতে হয়। যার ফলে অর্থনীতিতে একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে, যা আমাদের কারো কাম্য নয়। এমন পরিস্থিতি হতে উত্তরণের উপায় হচ্ছে শ্রমিকদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা। যা একমাত্র ইসলামি শ্রমনীতি বাস্তবায়ন হলে সম্ভব।
যথাসময়ে শ্রমিকের প্রাপ্য প্রদানের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ
উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাওয়া যেহেতু শ্রমিকের অধিকার, তাই যার জন্য সে শ্রম দিবে, তার তথা মালিকের দায়িত্ব হলো যথাসময়ে তার পারিশ্রমিক তাকে দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। হাদিসে কুদসিতে এসেছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : قَالَ اللهُ تَعَالَى : ثَلَاثَةٌ أَنَا خَصْمُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ كُنْتُ خَصْمَهُخَصَمْتُهُ: رَجُلٌ أَعْطَى بِي ثُمَّ غَدَرَ, وَرَجُلٌ بَاعَ حُرًّا فَأَكَلَ ثَمَنَهُ، وَرَجُلٌاسْتَأْجَرَ أَجِيرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ, وَلَمْ يُوَفِّهِ أَجْرَهُ.
আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেছেন, কেয়ামাতের দিন আমি তিন ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হবো। আর আমি যাদের প্রতিপক্ষ হবো, তাদেরকে পরাজিত করেই ছাড়ব। (তারা হলো), এমন ব্যক্তি যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে, এমন ব্যক্তি যে আযাদ মানুষকে ধরে এনে তাকে বিক্রয় করে এবং এমন ব্যক্তি যে কাউকে মজুর নিয়োগ করে পুরোপুরি কাজ আদায় করে নেয়, কিন্তু তাকে তার পারিশ্রমিক পরিপূর্ণরূপে আদায় করে দেয় না। (বুখারি)
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ . قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَعْطُوا الْأَجِيرَ أَجْرَهُ، قَبْلَ أَنْ يَجِفَّ عَرَقُهُ .
আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকাবার আগেই তাকে তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও। (সুনানে ইবনে মাজাহ)
যদি চুক্তির মধ্যে মালিক সাপ্তাহিক, দৈনন্দিন মজুরি প্রদান করে তাহলে বৈধ, কিন্তু তা না দিয়ে টাল বাহানা সম্পূর্ণ অন্যায়। ইসলামি শ্রমনীতি সমাজে বাস্তবায়িত হলে প্রত্যেক শ্রমিক যথাযথ মজুরি যথাসময়ে লাভের নিশ্চয়তা লাভ করবে।
শ্রমিকের কষ্ট লাঘবের ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান
আল্লাহ পাকের নির্দেশ: لَا تُكَلِّفُ نَفْسٌ إِلَّا وُسْعَهَا
“কারো সামর্থ্যের অতিরিক্ত কাজ চাপানো যাবে না”। (সুরা বাকারা: ২৩৩)
একজন শ্রমিক যে শর্তে মালিকের সাথে কোনো কাজের ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়, যদিও সে সেই কাজ আঞ্জাম দিতে বাধ্য থাকে তথাপিও মালিকের প্রতি ইসলামের নির্দেশ হলো, তার প্রতি মানবিক আচরণ করা। তার কষ্টের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে মানবিক বিবেচনায় তা লাঘবের চেষ্টা করা। সে বাধ্য হয়ে জীবিকার প্রয়োজনে যে বিশাল বোঝাটি বহন করতে রাজি হয়েছে, সম্ভব হলে তা হালকা করে দেওয়া। অথবা তা বহনের ব্যাপারে তাকে সহযোগিতা করা। বিশেষ করে সে অসুস্থ হলে কিংবা সিয়াম পালনরত থাকলে তার বোঝা হালকা করে দেওয়ার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তিনি বলেন-
عَنْ حُذَيْفَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : تَلَقَّتِ المَلائِكَةُ رُوحَ رَجُلٍ مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، قَالُوا: أَعَمِلْتَ مِنَ الخَيْرِ شَيْئًا؟ قَالَ: كُنْتُ آمُرُ فِتْيَانِي أَنْ يُنْفِرُوا وَيَتَجَاوَزُوا عَنِ الْمُوسِرِ، قَالَ: قَالَ: فَتَجَاوَزُوا عَنْهُ .
হুযাইফাহ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবি কারিম (সা.) বলেছেন, তোমাদের পূর্বেকার এক লোকের জান কবজ করার জন্য ফেরেশতা আসলো। তারা (লোকেরা) বলল, তুমি কি কোনো (উল্লেখযোগ্য) নেক আমল করেছো? সে বলল, আমি আমার শ্রমিক ও কর্মচারীদেরকে আদেশ করতাম যেন তারা অভাবীকে অবকাশ দেয় ও ক্ষমা করে। তিনি (বর্ণনাকারী) বলেন, তিনি (নবি কারিম সা.) বলেছেন, তখন তারাও (ফেরেস্তা) তাকে ক্ষমা করে দিল।
সুতরাং ইসলামি শ্রমনীতি কোনো মানুষকে বিশেষ করে কোনো অধীন শ্রমিককে কষ্ট দেওয়ার সম্পূর্ণ বিপক্ষে।
অতএব দায়িত্ব প্রদানের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন তা তার সাধ্যের অধিক না হয়ে যায়। আর দায়িত্ব প্রদানের পর তা তাদের জন্য কষ্টকর হবে মনে করলে সে কাজে তাদেরকে সহযোগিতা করতে হবে। প্রসঙ্গত শিশু শ্রমের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। আজকাল যে বয়সে একজন শিশুর শিক্ষালয়ে কিংবা মাতৃস্নেহে থেকে জ্ঞানার্জন করার কথা, সে সময় তাকে গাড়ির হেলপার হয়ে কিংবা কারখানার শ্রমিক হয়ে নিগ্রহের শিকার হতে দেখা যায়। যা নিঃসন্দেহে মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী এবং ইসলামের বিধানের সম্পূর্ণ বিপরীত।
পুরুষ ও নারী শ্রমিকের মধ্যে সমতা বিধান করা
শ্রমিকদের মধ্যে যারা নারী তারা একই পেশায় নিয়োজিত হলে একই রকম সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত হবে। নারী হওয়ার অজুহাতে তাদেরকে কম সুবিধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং তাকে তার মাতৃত্বজনিত ছুটিসহ কিছু অতিরিক্ত সুবিধা দিতে হবে যা পুরুষের ক্ষেত্রে দিতে হয় না। নিয়োগকর্তা কর্তৃক সরকারের সহযোগিতায় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেন নারী শ্রমিকদের কোনো প্রকার যৌন হয়রানি কিংবা অন্য কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হতে হয়।
মহান আল্লাহ কাজের প্রতিদানের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মাঝে কোনো পার্থক্য করেন না। এ ব্যাপারে তাঁর পরিষ্কার ঘোষণা হলো:
وَ مَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصُّلِحَتِ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَ هُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا
“পুরুষ অথবা নারীর মধ্যে কেউ সৎ কাজ করলে ও মুমিন হলে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণুপরিমাণও জুলুম করা হবে হবে না।” (সুরা নিসা: ১২৪)
অন্যত্র মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-
لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِّمَّا اكْتَسَبُوا وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا اكْتَسَبْنَ .
“পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে সেটা তার অংশ।” (সুরা নিসা: ৩২)
পুরুষের (স্বামীর) উপার্জনে স্ত্রীর অধিকার আছে কিন্তু স্ত্রীর উপার্জনে স্বামীর অধিকার নেই। যদি স্ত্রী স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু দেয় তাহলে স্বামী তা গ্রহণ করতে পারে। আর ইসলামি শ্রমনীতি বাস্তবায়িত হলে কাজের বিনিময়ে নারী পুরুষ ইনসাফপূর্ণ অধিকার লাভ করবে।
মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক
ইসলামের দৃষ্টিতে মালিক আর শ্রমিকের সম্পর্ক মনিব আর দাসের মতো নয় বরং তাদের সম্পর্ক ভাই ভাইয়ের। তারা একজন আরেকজনের অধীনে শ্রম দিতে আইনানুগভাবে বাধ্য ছিল না। যেমনভাবে একজন দাস তার মনিবের প্রতি আনুগত্যের শ্রম দিতে বাধ্য থাকে। বরং একজন শ্রমিক নিজের আর্থিক প্রয়োজন আর অপর ভাইয়ের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব- এ দুইয়ের সংমিশ্রণ হয়েছে বলেই তার আরেক ভাইয়ের অধীনে কাজ করতে এসেছে। একইভাবে ধনী লোকটিও নিজের পণ্য উৎপাদনের প্রয়োজন এবং গরিব ভাইটির প্রতি সহযোগিতার মনোভাব- এ দুইয়ের সংমিশ্রণ হয়েছে বলেই তার আরেক ভাইকে নিজের অধীনে কাজে খাটিয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
“নিশ্চয়ই মুমিনরা ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে (কোনো বিরোধ হলে) সংশোধন করে নাও। আর আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় যে, তোমাদের প্রতি রহম করা হবে।” (সুরা হুজুরাত: ১০)
শ্রমিকের প্রতি সদাচরণের ব্যাপারে মহান আল্লাহর সাধারণ ঘোষণা আল কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ ٢١٥ ۲۱۵
“আর মুমিনদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে, তুমি তাদের প্রতি স্নেহ-মমতার ডানা অবনমিত করো।” (সুরা শুআরা: ২১৫)
ইসলামের বিধান মোতাবেক সকলেই আদমের সন্তান তাই শ্রমিক-মালিক ভাই ভাই। একজন শ্রমিককে যেমন হীন মনে করা যাবে না তেমনি তাকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। ইসলামের বিধান কায়েম হলে শ্রমিক-মালিক কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। সকলেই মানুষ ও আল্লাহর বান্দা হিসেবে জীবন যাপন করবে।
অমুসলিম শ্রমিকদের অধিকার
ইসলামি শ্রমনীতিতে একজন অমুসলিম শ্রমিক একজন মুসলিম শ্রমিকের মতই সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে। সকলেই আল্লাহর বান্দাহ। তাই কারো প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা ইসলাম অবৈধ ঘোষণা করেছে। ইসলামি বিধানের ইনসাফপূর্ণ সুফল জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলের জন্যে উন্মুক্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন-
وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ
“তোমরা সেই সব লোকদেরকে গালি দিও না, মন্দ বলোনা, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে ডাকে।” (সুরা আনআম: ১০৮)
হুজুর (সা.) ইরশাদ করেছেন- সতর্ক থাক, সেই ব্যক্তি সম্পর্কে যে ব্যক্তি অমুসলিমদের ওপর জুলুম করে অথবা তাদের হক নষ্ট করে অথবা তাদের শক্তির চাইতে বেশি কাজ চাপাতে চেষ্টা করে অথবা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের থেকে কিছু জোরপূর্বক নেয়, আমি কেয়ামতের দিন সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়ব।” (আবু দাউদ)
উল্লেখিত হাদিসে অমুসলিমদের অধিকার সম্পর্কে মহানবির (সা.) সুস্পষ্ট নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। যারা এ সব অধিকার খর্ব করার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। পুঁজিবাদী দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী গরীবের মধ্যে সকল ব্যাপারে পার্থক্য সৃষ্টি করে মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ইসলামি শ্রমনীতি কায়েম হলে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার সকল শ্রমিক ও নাগরিক সমানভাবে লাভ করবে। সুতরাং ইসলামি শ্রমনীতির সমাজে কোনো ব্যক্তি মুসলিম হোক, আর অমুসলিম হোক এর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না।
সুবিধা বঞ্চিতদের প্রতি সদয় হওয়ার নির্দেশ
সাধারণত দরিদ্র শ্রেণির লোকেরাই শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। আর বিত্তশালীরাই তাদেরকে অর্থের বিনিময়ে কাজে খাটায়। ইসলাম এ সকল সুবিধাবঞ্চিতদের ব্যাপারে ধনবান ও বিত্তশালীদেরকে দয়ার্দ্র হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেছে। মহান আল্লাহ তাদেরকে যে সম্পদ দান করেছেন তা থেকে এদেরকে নিঃশর্তভাবে দেওয়ার আদেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَاتُوهُمْ مِّنْ مَّالِ اللَّهِ الَّذِي الكُمْ
“আর তাদেরকে মহান আল্লাহর ঐ মাল থেকে দাও, যা তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন।” (সুরা আন নূর: ৩৩)
অর্থাৎ মহান আল্লাহ তাআলা বিত্তবানদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, যে মালের মালিক হয়ে আজ তোমরা তাদের উপর কর্তৃত্ব করছো, তা আমিই তোমাদেরকে দিয়েছি। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আল্লাহ চাইলে তুমি তার মতো সুবিধাবঞ্চিত হতে পারতে; আর সে তোমার মতো বিত্তশালী হতে পারতো। অতএব মহান আল্লাহর দেওয়া ঐ সম্পদ একা একা ভোগ করো না। তাতে তোমার ঐসব সুবিধাবঞ্চিত ভাই-বোনদের অধিকারের কথা স্মরণ রেখো। অন্যত্র মহান আল্লাহ তাআলা আরও সুস্পষ্ট করে ঘোষণা করেন যে,
وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ
“আর তাদের সম্পদে সাহায্যপ্রার্থী ও সুবিধা বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।” (সুরা যারিয়াত: ১৯)
সুতরাং একজন শ্রমিককে কেবল তার শ্রমের বিনিময়ে পারিশ্রমিক দিলেই চলবে না; বরং তার প্রয়োজন ও অসুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে তাকে এর বাইরেও আর্থিক সহযোগিতা করতে হবে, তার প্রতি অনুগ্রহের হাত বাড়াতে হবে। অতএব যাকে এমনিতেই সাহায্য ও সহযোগিতা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে তার থেকে কোনোরূপ সেবা নেওয়ার পর তাকে ঠকাবার তো প্রশ্নই আসে না।
কোনো শ্রেণি বা পেশার গুরুত্বই ইসলামের দৃষ্টিতে কম নয়। বরং প্রতিটি পেশার শ্রমিকের উপর অন্য পেশার লোকেরা নির্ভরশীল। সুনির্দিষ্ট কোনো পেশার লোকেরা কিছু সময় বা কিছু দিনের জন্য তাদের শ্রম বন্ধ রাখলে সত্যিকার অর্থেই আমরা সকলে হাড়ে হাড়ে টের পাই যে, আমাদের সকলের জন্যই তাদের ঐ পেশার কত গুরুত্ব। তাই ইসলাম সমাজে পেশাগত কারণে কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করাকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না।
কাজের সময় ও প্রকৃতি
মালিক একজন শ্রমিকের দ্বারা কি ধরনের কাজ নেবে এবং কত ঘণ্টা কাজ করতে হবে, তা উভয়পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। শ্রমিকের মর্জির বাইরে কোনো কাজ তার ওপর চাপানো যাবে না। যে কাজ শ্রমিকের স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর, এমন কাজও তার ওপর চাপানো অবৈধ। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কাজের প্রকৃতি অনুসারে সহজভাবে যে কয় ঘণ্টা কাজ করলে একজন শ্রমিক স্বাভাবিক থাকবে এবং স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হবে না, ততটুকু সময়ের কাজের বিনিময়ে তাকে পূর্ণ একদিনের বেতন দিতে হবে, যা দ্বারা তার মৌলিক প্রয়োজন পূরন করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক শ্রমনীতি অনুসারে কাজের সময় আট ঘণ্টা নির্ধারিত করা হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের বিধান ন্যায়নীতি বিরোধী। কারণ সকল দেশের এবং সব ধরনের কাজের জন্যেই আট ঘণ্টা নির্ধারিত করা হয়েছে। অথচ সহজ, হালকা ও ভারী কাজের মধ্যে পার্থক্য হওয়া ইনসাফের দাবি এবং শীত ও গ্রীষ্ম প্রধান দেশের মধ্যেও কাজের সময়ের পার্থক্য হওয়া উচিত।
একজন লোক রৌদ্র তাপের মধ্যে আট ঘণ্টা মাটি কাটার কাজ করবে আর একজন লোক এয়ারকন্ডিশনে বসেও আট ঘণ্টা কাজ করবে, এটা কোনো দিন ইনসাফ হতে পারে না। তাই কাজের প্রকৃতি ও কাজের পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে কাজের সময় নির্ধারিত হওয়া উচিত।
عن ابي هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ولا يكلفهمن العمل ما يغلبه فأن كلفه ما يغلبه فليعنه عليه .
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শক্তি সামর্থ্যের অতিরিক্ত কাজ শ্রমিকের ওপর চাপাবে না। যদি তার সামর্থ্যের অতিরিক্ত কোনো কাজ তাকে দাও তাহলে সে কাজে তাকে সাহায্য কর। (বুখারি, মুসলিম) “কাজের প্রকৃতি ও পরিমাণ না জানিয়ে কাউকে কাজে নিয়োগ করা যাবে না। (হাদিস)
পোষ্যদের ভরণপোষণ ব্যবস্থা
প্রত্যেক শ্রমিক কর্মচারীর ওপর তার পরিবারের দায়িত্ব আছে। সে কেবল নিজে বেঁচে থাকার জন্য কাজ করে না। বরং তার উপার্জন দ্বারা স্ত্রী-সন্তান ও পিতা-মাতার ভরণপোষণের চেষ্টা করে। তাই বেতন এমনিভাবে নির্ধারিত করতে হবে, যাতে নিজের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের পরে তার পোষ্যদের প্রতিও দায়িত্ব পালন করতে পারে। বিশ্বের অন্যতম ইসলামি চিন্তাবিদ সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) বলেন, “সাধারণ নিয়োগকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পরিবারের লোকসংখ্যা অনুপাতে বেতন নির্ধারণ সহজ নয়। তবে এ দায়িত্ব গ্রহণ করা সরকারের উচিত। আর বড়ো বড়ো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সমূহকে এ জন্যে বাধ্য করা যেতে পারে।” (রাসায়েল ও মাসায়েল)
একটি হাদিস থেকে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হওয়া যায়।
عن عبد الله قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم كفى بالمرءاثماً ان يصيع من يقوت.
“হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, নবি কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, যার ওপর যার লালন পালন করার দায়িত্ব রয়েছে, তা উপেক্ষা করাই একজন ব্যক্তির গুনাহগার হওয়ার জন্যে যথেষ্ট।” (মিশকাত)
বর্তমান বিশ্বে মজুরির ক্ষেত্রে পোষ্যদের বিষয়টি বিবেচনাই আনা হয় না। অথচ মানবিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইসলাম বিষয়টিকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছে।
অতিরিক্ত কাজে ওভার টাইম প্রদান
কোনো শ্রমিকের দ্বারা অতিরিক্ত কাজ করানো হলে তাকে অতিরিক্ত মজুরি দেওয়া যাতে সে খুশি হয়ে অতিরিক্ত কাজ সম্পন্ন করে।
فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُهُ
“যে লোক এক বিন্দু পরিমাণ উত্তম কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে।” (সুরা যিলযাল: ৭)
নবি কারিম (সা.) বলেছেন-
ولا تكلفوهم ما يغلبهم وان كلفتموهم فأعينوهم .
“তাদের উপর সাধ্যের অধিক কাজ চাপাবে না। যদি অতিরিক্ত কাজ চাপান হয় তাহলে সাহায্য কর।” (বুখারি)
মুনাফায় শ্রমিকের অধিকার
একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লাভ তখনি আসে যখন পুঁজি বিনিয়োগ করে তাতে শ্রম যোগ করা হয়। মালিকের পুঁজি হল অর্থ আর শ্রমিকের পুঁজি হল শ্রম। দু’টো মিলিত শক্তি লাভের জন্যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। তাই লাভের অংশটা শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে বণ্টন হবে। এটাই হচ্ছে ইসলামের চূড়ান্ত মত। যে শ্রমিক কঠোর পরিশ্রম করে মালিকদের জন্যে রাজকীয় বালাখানা তৈরি করে, অথচ সে শ্রমিকের মাথা গুঁজাবার ঠাঁই পর্যন্ত নেই। যে শ্রমিক মালিককে লক্ষ লক্ষ গজ কাপড় তৈরি করে দেয় অথচ তার পরনে ছেঁড়া কাপড় পরিলক্ষিত হয়। মালিক তার কুকুরের খাদ্য ও বাসস্থানের জন্যে হাজার হাজার টাকার বাজেট করে কিন্তু একজন শ্রমিক তার সন্তানদের আনন্দের জন্যে কোনো বাজেট করতে পারে না। এমনকি তার মৌলিক অধিকার পূরণ করতে পারে না।
শ্রমিকদের রক্ত নিঃসৃত পরিশ্রম দ্বারা উপার্জিত অর্থে মালিক গাড়িতে করে কুকুর নিয়ে ভ্রমণ করে অথচ একজন শ্রমিক মালিকের গাড়িতে ভ্রমণ করার কথা কল্পনাও করতে পারে না। ইসলাম এই রকম অসাম্য, অবিচার, অমানবিকতা কখনো বরদাশত করে না। বরং ইসলাম এমন সমাজের মূলোৎপাটন করে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
كَيْ لَا يَكُوْنَ دُوْلَةٌ بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ هُ
“সম্পদ এমনভাবে বণ্টন কর, যেন তা শুধু ধনী লোকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে।” (সুরা হাশর: ৭)
وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ
“বিত্তবানদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।” (সুরা যারিয়াত: ১৯)
নবি কারিম (সা.) বলেছেন:
أَعْطُوا الْعَامِلَ مِنْ عَمِلِهِ فَإِنَّ عَامِلَ اللَّهِ لَا يُخَبُّ.
“মজুরকে তার কাজ হতে অংশ দান কর। কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যেতে পারে না।” (মুসনাদে আহমদ)
আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে মালিকরা শ্রমিকদেরকে বঞ্চিত করে সবটুকু লাভের অংশ নিজেদের পকেটস্থ করে। আর বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে অপচয় করে থাকে। সমাজতান্ত্রিক দেশে লাভের সবটুকু অংশ রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়। তা দ্বারা শাসকগোষ্ঠী ও তার পেটোয়া বাহিনী নিজেদের জন্যে স্বর্গ রচনা করে। আর শ্রমিক সমাজকে পশুর মত খাটিয়ে মারে। অধিকারের কথা কোনো শ্রমিক বলতে গেলেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সমাজতন্ত্রের বেদীতে আত্মহুতি দিতে হয়।
মালিক তার প্রয়োজনীয় খরচ ও রাজকীয় ব্যয় ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়ে আর সামান্য বেতন শ্রমিকদেরকে দেয়। যদি মালিক লভ্যাংশ পায় তাহলে কঠোর পরিশ্রমকারী শ্রমিক লাভের অংশ না পাওয়া ন্যায় নীতির বিপরীত। তাই ইসলাম ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করতে চায়।
ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকের অংশ গ্রহণ
ইসলামে শ্রমিক মালিক ভাই ভাই। তাই সকলেই পরস্পরের সুখ, দুঃখের অংশীদার এবং অধিকারের সংরক্ষক। কেউ কাউকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করে না। উভয়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই হবে নিজেদের কল্যাণ ও সমাজের কল্যাণের মূল লক্ষ্য। মালিক পুঁজি বিনিয়োগ করে আর শ্রমিক শ্রম বিনিয়োগ করে। তাই ইসলাম তাদের অধিকার ও মর্যাদার ব্যাপারে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করে না। শ্রমিকেরা বাস্তব ময়দানে কাজ করে, অতএব প্রতিষ্ঠানের সমস্যাদি সম্পর্কে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকাটাই স্বাভাবিক। শ্রমিক ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করতে পারলে তাদের সুচিন্তিত মতামত প্রদান করে প্রতিষ্ঠানকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নেবে। এ ব্যাপারে আল-কুরআনের ইরশাদ হচ্ছে:
وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِة
“তুমি লোকদের সাথে প্রত্যেক বিষয় পরামর্শ কর।” (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَ أَمَرَاءكُمْ خِيَارُكُمْ وَأَغْنِيَاءَكُمْ سَمْحَاءَكُمْ وَأُمُوكُمْ شُورَى بَيْنَكُمْ فَظَهْرُ الْأَرْضِ خَيْرٌ لَكُمْ مِنْ بَطْنِهَا –
“হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন তোমাদের শাসকরা চরিত্রবান হবে, সম্পদশালী লোকেরা দানশীল হবে এবং পারস্পরিক বিষয় পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তখন অবশ্যই পৃথিবীর নীচের অংশের চাইতে ওপরের অংশ তোমাদের জন্যে উত্তম হবে।” (তিরমিযি)
চাকরির নিরাপত্তা
প্রতিটি নাগরিকের চাকুরির নিরাপত্তার দায়িত্ব ইসলামি রাষ্ট্রের সরকারের। কেউ কোনো অপরাধে চাকুরিচ্যুত হলে সরকার তার চাকুরির ব্যবস্থা করতে বাধ্য। তাই বিনা কারণে মালিক যদি কোনো শ্রমিককে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করে, তাহলে সে মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকার বাধ্য থাকবে। শ্রমিকদের কোনো অপরাধ হলে তার বিচার করার অধিকার সরকারের, তা কোনো ব্যক্তি মালিকের খেয়াল খুশির ওপর ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
“ঈমানদার লোকদের মধ্যে যারা তোমাদের অধীন, তাদের সাথে নম্র ব্যবহার কর।” (সুরা শুআরা: ২১৫)
একজন শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করে তাকে এবং তার পরিবারকে জীবিকা থেকে বঞ্চিত করে মানবেতর জীবন যাপনের পথে ঠেলে দেওয়া সত্যিই নিষ্ঠুর ও অমানবিক কাজ, তাকে সংশোধনের মাধ্যমে কাজে বহাল রাখা ইসলামের সৎ আচরণেরও মহৎ শিক্ষা।
একবার এক সাহাবি এসে নবিজিকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন আল্লাহর রাসুল! আমি খাদেমকে (কাজের লোক বা গোলামকে) কতবার ক্ষমা করব? নবিজি (সা.) চুপ থাকলেন। সাহাবিরা আবার জিজ্ঞাসা করলেন। এবার নবিজি (সা.) বললেন, প্রতিদিন সত্তরবার। (তিরমিযি)
পুঁজিবাদী সমাজে চাকুরির নিরাপত্তা নির্ভর করে মালিকের খেয়াল-খুশির ওপর। শুধু মালিকের স্বার্থ রক্ষার জন্যেই মেহনতি মানুষকে ব্যবহার করা হয় এবং যখন প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তাকে তাড়িয়ে দেয়। সমাজতান্ত্রিক দেশে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত মিল ম্যানেজারের ওপরে একজন শ্রমিকের চাকুরি নির্ভর করে। মিল ম্যানেজারকে খুশি রাখাই চাকুরির পদোন্নতির প্রধান সোপান। ইসলাম প্রত্যেক শ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।
সংগঠন ও ইউনিয়ন করার অধিকার
সংগঠন হচ্ছে এক প্রকার বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম। যোগ্য ও উপযুক্ত সংগঠন ব্যতীত কোনো দেশেই ব্যাপকভাবে সম্পদ উৎপাদন করা সম্ভব নয়। এ কারণেই অর্থনীতিবিদরা সংগঠনকে উৎপাদনের একটি পৃথক উৎস বলে মনে করে। সংগঠন বিষয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে, ইসলাম আগাগোড়া একটি সংগঠন ছাড়া কিছুই নয়। নামাজের মধ্যে ইমামত, রাষ্ট্রের মধ্যে খিলাফত ও হজের মধ্যে ইমারত (নেতৃত্ব) এসব কিছুতেই ইসলামি সংগঠনের পরিচয় মিলে।
হযরত উমর (রা.) বলেছেন- لَا إِسْلَامَ إِلا بِالْجَمَاعَةٍ
“জামায়াত ব্যতীত ইসলাম হয় না।”
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তিনজন লোক সফরে বের হলে তারা যেন তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়।” (সুনানে আবু দাউদ)
ইসলামি শ্রমনীতি ব্যবস্থায় প্রত্যেক শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার পাবে।
যৌথ দরকষাকষি ও চুক্তি
ট্রেড ইউনিয়নের একটি মৌলিক দায়িত্ব দরকষাকষি ও আলোচনা করে সমস্যা সমাধানে পৌঁছা। মানুষের জীবনে প্রতিটি ব্যাপারেই দরকষাকষি একটি স্বভাবজাত প্রক্রিয়া। দরকষাকষির মাধ্যমেই প্রতিটি জিনিসের মূল্য নিরুপিত হয়ে থাকে। আধুনিক যুগে দরকষাকষি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের একটি শক্ত হাতিয়ার। যা পবিত্র কুরআনে দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করেছেন।
অসহায় শ্রমিক ও চাকরি থেকে অবসরকালীন ভাতা
বৃদ্ধ হয়ে পড়া, অসুস্থ ও বিকলাঙ্গ হওয়া এবং চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ আজকের সমাজে এক প্রকার অপরাধ। এদের জীবনে নেমে আসে অসহায়তা। কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। শ্রমিক ও মালিক উভয়ের অধিকার রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। উভয়ের মধ্যে উমর (রা.) মজদুরুদের মজুরি নিজে নির্ধারণ করে দিতেন। শ্রমিক হচ্ছে মালিকের অধীন। শ্রমিকের রক্ষণাবেক্ষণ মালিকের দায়িত্ব এবং এ দায়িক্ত পালনে অবহেলা করলে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। শ্রমিকদের প্রতি মালিকের দায়িত্ব শুধু চাকুরির সময়ই নয় বরং চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পরও শ্রমিকের দায়িত্ব মালিককে সাধ্য অনুসারে অবশ্যই নিতে হবে। যদি মালিক অসহায় শ্রমিকের প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে, তাহলে রাষ্ট্রীয় আইনে মালিকের শান্তির ব্যবস্থা থাকবে। কারণ অসহায় শ্রমজীবী মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন মালিকদের খেয়াল খুশির ওপর ছেড়ে দেওয়া যায়না। এ ব্যাপারে সরকারের আইনও কার্যকর থাকতে হবে।
مَا أَفَاءَ اللهُ عَلَى رَسُوْلِهِ مِنْ أَهْلِ الْقُرَى فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبي وَ الْيَتَى وَ الْمَسْكِينِ وَ ابْنِ السَّبِيلِ كَيْ لَا يَكُونَ دُوْلَةٌ بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ
“আল্লাহ তাআলা যা কিছু (ধন সম্পদ) জনগণের কাছ থেকে নিয়ে তাঁর রাসুলের নিকট ফিরিয়ে দিয়েছেন, তা হচ্ছে আল্লাহর জন্য, রাসুলের জন্য, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন ও পথচারীর জন্য। যেন তা (সম্পদ) কেবল বিত্তশালীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।” (সুরা হাশর: ৭)
ইসলামি সমাজে সকল শ্রমিক ও নাগরিক অবসরকালীন ভাতা পাবে এবং সকল অসহায় মানুষ বয়স্ক ভাতা পাবে।
শিশু শ্রম
ইসলাম ছোটদের প্রতি দয়া দেখানোর নির্দেশ দিয়েছে। ছোটদেরকে যত্নসহকারে লালন-পালন করে আগামী দিনের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা একটি জাতীয় ও ঈমানী দায়িত্ব। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের দ্বারা কঠোর পরিশ্রম করানো মানবতা বিরোধী কাজ।
পবিত্র আল-কুরআনের ঘোষণা:
لا تُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا :
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কাউকে তার শক্তির অতিরিক্ত কষ্ট দেন না (অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেন না)।” (সুরা বাকারা: ২৮৬)
অতএব কোনো মানুষ কোনো মানুষকে কাজের মাধ্যমে অতিরিক্ত কষ্ট দেওয়া কুরআনের নির্দেশের বিরোধী কাজ। বরং ছোটদের প্রতি সহানুভূতি দেখাবার তাগিদ দিয়ে মহানবি (সা.) ঘোষণা করেছেন-
“অধীনদের খাওয়া ও পরার ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের উপর অধিক কাজের ভার চাপানো যাবে না।” (মুসলিম, আবু দাউদ)
আজকের বিশ্বে মানুষ তাদের স্বার্থের অনুকূল কাজ করাবার জন্যে এবং অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় সফলতা লাভের লোভে অধিক অর্থ উপার্জনের নেশায় অসহায় মানুষগুলোকে পশুর মত খাটিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, বরং অল্প বয়স্ক শিশুদেরকেও পশুর মত কাজে লাগিয়ে তাদের আগামী দিনের কর্মক্ষমতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ জন্যে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক মানসিকতা সমানভাবে দায়ী। মাসিক চেরাগেরাহ সোশ্যালিজম সংখ্যায় দেখানো হয়েছে যে, “রাশিয়ায় চৌদ্দ বছরের কিশোর বার থেকে ষোল ঘণ্টা ক্ষেতে খামারে, কল-কারখনায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বার বছরের বালকেরা পরপর তিন দিন কাজ করার পর অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। তবুও কর্তাদের অন্তরে সামান্যতম দয়ার উদ্রেক হয় না।”
সকল ধরনের ভয়ভীতি থেকে নিরাপত্তা
মালিকের শক্তির তুলনায় একজন শ্রমিক ব্যক্তিগতভাবে খুবই অসহায়। সব সময় সে মালিকের শক্তির কাছে নিজেকে অসহায় মনে করে, মালিককে ভয় পাচ্ছে, যে কোনো সময় তার চাকরি হারাতে পারে, তার মান মর্যাদার প্রতি আঘাত আসতে পারে। তাই মালিকের জুলুম-অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে ট্রেড ইউনিয়ন করে ঐক্যবদ্ধ হতে হচ্ছে, যাতে করে মহান আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার কোনো শক্তি ক্ষুন্ন করতে না পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَلْيَعْبُدُوا رَبَّ هَذَا الْبَيْتِ الَّذِي أَطْعَمَهُمْ مِنْ جُمْعٍ، وَ أَمَنَهُمْمِنْ خَوْفٍ
“এ ঘরের রবের ইবাদত কর। যিনি তোমাদেরকে ক্ষুধা হতে রক্ষা করে খেতে দিয়েছেন এবং ভয় ভীতি হতে বাঁচিয়ে নিরাপত্তা দান করেছেন।” (সুরা কুরাইশ: ৩-৪)
পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার থাকলেও পুঁজিবাদীদের অর্থের লোভের মুখে শ্রমিক নেতারা বিক্রি হচ্ছে এবং সাধারণ শ্রমিকদের স্বার্থ ব্যাহত হচ্ছে। এটা হচ্ছে পুঁজিবাদীদের ষড়যন্ত্র। ইউনিয়ন করার অধিকার দিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। রাশিয়ায় ১৯২০ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির নবম কংগ্রেস অধিবেশনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সরকারের বিরোধিতা প্রকৃত পক্ষে রাষ্ট্রীয় দর্শনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ও বন্ধুয়া মনোভাব প্রকাশ করা। তাই সেখানে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে মিছিল করা, বিক্ষোভ প্রদর্শন, হ্যান্ডবিল-পোস্টার লাগালো আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ মানুষকে ভয় পাবে না। ভয় থাকবে শুধু আল্লাহর।
চাকরিতে পদোন্নতি
চাকরিতে পদোন্নতি অবশ্যই প্রয়োজন। এতে লোকেরা কাজে উৎসাহ পায় এবং নিজেদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাবার চেষ্টা করে। পদোন্নাতি যোগ্যতার ভিত্তিতে হওয়াই ইনসাফের দাবি। যোগ্যতার সাথে সাথে চাকুরির সিনিয়রিটি ও অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা প্রয়োজন। স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা ও পক্ষপাতিত্ব পরিহার করা প্রয়োজন। সার্বিক উপযুক্ততার বিচারে চাকুরিতে পদোন্নতি পাওয়া একটি অধিকার। এ অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা অপরাধ। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلَا تُؤْتُوا السُّفَهَاءَ أَمْوَالَكُمُ الَّتِي جَعَلَ اللَّهُ لَكُمْ قِيمًا وَارْزُقُوهُمْ فِيهَا وَاكْسُوهُمْ وَقُوْلُوا لَهُمْ قَوْلًا مَّعْرُوْفًا
“ধন সম্পদকে আল্লাহ তোমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে নির্ধারিত করেছেন, তোমরা তা নির্বোধ লোকদের হাতে ছেড়ে দিও না। অবশ্য তাদের খাওয়া ও পরার ব্যবস্থা কর এবং তাদেরকে সদুপদেশ দাও।” (সুরা নিসা: ৫)
যোগ্য লোকদের পদোন্নতি ইসলামের দাবি। তবে চাকরি হতে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। ইসলামি সমাজে যোগ্য লোকেরাই কেবল চাকরিতে পদোন্নতি পাবে। ক্ষমতা, রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বজনপ্রীতি বিবেচ্য বিষয় হবে না।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
শিক্ষার সুযোগ লাভ প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার থেকে শ্রমিক সমাজ ও তাদের উত্তরসূরিদেরকে কেউ বঞ্চিত করতে পারে না। মালিক যদি শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে সরকারকে সকল শ্রেণির নাগরিকের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সাধারণ শিক্ষা ছাড়াও বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেকার শ্রমিকদেরকে কর্মক্ষম করে তুলতে হবে এবং শ্রমিকদের ছেলে-সন্তানদের লেখা পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ট্রেনিং এর মাধ্যমে শ্রমিকগণ দক্ষতা অর্জন করে পদোন্নতি লাভ ও অধিক মজুরি পেতে পারে এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিক অধিক উৎপাদনে সাহায্য করতে পারে। ইসলামি সমাজে সকলের জন্যে শিক্ষা বাধ্যতামূলক। শিক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেকটি মানুষ তার দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করবে এবং পৃথিবীতে জীবন ধারণের জন্যে বাস্তব জ্ঞানও লাভকরবে। মানুষ এমন জীব যে, জ্ঞানার্জন ব্যতীত সে পৃথিবীতে একেবারে অসহায়। তাই ইসলামের প্রথম বাণী ‘জ্ঞান শিখ’-
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ
“পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা আলাক্ব: ১)
هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ .
“বলে দিন, যাদের জ্ঞান আছে এবং যাদের জ্ঞান নেই, তারা কী সমান হতে পারে?” (সুরা যুমার: ৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
طلب العلم فريضة على كل مسلم
“প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে জ্ঞানার্জন করা ফরজ। (বুখারি)
ছুটির ব্যবস্থা
শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের জন্য বিশ্রাম, আপনজনদের সাথে একত্রে থাকা, পারিবারিক ও সামাজিক কাজকর্মে উদ্দীপনা ইত্যাদির জন্য সাপ্তাহিক ও বাৎসরিক ছুটি প্রয়োজন। একজন মানুষ হিসেবে সব দায়িত্ব পালন করার সুযোগ প্রদান করতে হবে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও এসব দায়িত্ব পালন করার তাগিদ ইসলামে রয়েছে। ইসলাম পূর্ব যুগে দাস প্রথা ছিল। মালিকের মর্জির বাহিরে স্বাধীনভাবে কোনো কাজ করতে পারত না। ইসলাম এসে তাদেরকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يُرِيدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَه
“আল্লাহ তোমাদের প্রতি সহজতা ও নম্রতা আরোপ করতে চান, কঠোরতা ও কঠিনতা আরোপ করতে ইচ্ছুক নন।” (সুরা বাকারা: ১৮৫)
নবি করিম (সা.) বলেছেন, তোমরা তোমাদের কর্মচারীদের থেকে যতটা হালকা কাজ নেবে, তোমাদের আমলনামায় ততটা পুরস্কার ও পুণ্য লেখা থাকবে। (তারগীব ও তারহীব) সুতরাং ইসলামি শ্রমনীতিতে মাতৃকালীন ছুটিসহ সকল ধরনের ছুটির ব্যবস্থা থাকবে।
ন্যায় বিচার লাভের অধিকার
ইসলাম এর ন্যায় বিচার জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী, নির্বিশেষে সকলের জন্যে উন্মুক্ত এবং সকলের জন্যে সমান। রাষ্ট্রের একজন নগণ্য নাগরিক থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্র প্রধান পর্যন্ত সকলের জন্যেই বিচারের রায় সমান এবং সবাইকে অপরাধের জন্যে সমান শান্তি ভোগ করতে হবে। রাষ্ট্র প্রধানের কাছ থেকে ন্যায় বিচার লাভ করা প্রত্যেকটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আল কুরআনে ন্যায় বিচারের কঠোর নির্দেশ রয়েছে:
وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ .
“তোমরা যখন লোকদের মধ্যে বিচার ফয়সালা করবে, তখন অবশ্যই ন্যায় বিচার করবে।” (সুরা নিসা: ৫৮)
وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَانُ قَوْمٍ عَلَى إِلَّا تَعْدِلُوا .
“কোনো বিশেষ শ্রেণির লোকদের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের কোনো রকম অবিচার করতে উদ্বুদ্ধ না করে।” (সুরা মায়েদা: ৮)
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُوْنُوا قَوْمِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَ لَوْ عَلَى انْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَ الْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا .
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা সকলে ন্যায় নীতি নিয়ে শক্তভাবে দাঁড়াও। আল্লাহর জন্যে স্বাক্ষী হও। তোমাদের সুবিচার যদি তোমাদের নিজেদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে হয়। আর পক্ষদ্বয় ধনী কিংবা গরিব যাই হোক না কেন তাদের সকলের অপেক্ষা আল্লাহ উত্তম। তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে গিয়ে ন্যায় বিচার হতে বিরত থেকো না।” (সুরা নিসা: ১৩৫)
হযরত উবাদা ইবনে সামেত (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা নিকটবর্তী ও দূরবর্তী সকলের ওপরে আল্লাহর দণ্ডবিধি কার্যকর কর। আল্লাহর ব্যাপারে যেন কোনো অত্যাচারী তোমাদেরকে বাধা দিয়ে রাখতে না পারে। (ইবনে মাজাহ)
আজকের বিশ্বে বিচার ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন সরকার, পুঁজিপতি ও প্রভাবশালী লোকদের হাতে বন্দি, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রভাব খাটিয়ে বিচারের রায় উল্টে দেওয়া হচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে বিচারের রায় বেচা কেনা হচ্ছে। তাই গরিব ও শ্রমিক সমাজ ন্যায় বিচার লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত।
সরকারের ভূমিকা
সরকার হবেন মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে অধিকার প্রতিষ্ঠাকারী প্রতিষ্ঠান। ইসলামি শ্রমনীতিগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে পূর্ণ বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না তা তদারকি করার দায়িত্ব সরকারের। কুরআন ও হাদিসে শ্রমিকদের যেসব অধিকার ঘোষণা করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা মালিকের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপরে ছেড়ে দেওয়া যায় না, বরং সরকার প্রশাসনের মাধ্যমে প্রত্যেক মালিককে তা মেনে চলতে বাধ্য করবে। শ্রমিকদের চাকরির নিশ্চয়তা বিধান করবে, যাতে শ্রমিকরা প্রশান্তির সাথে কাজ করতে পারে। মালিকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সহজভাবে অল্প সময়ে আদালতে ইনসাফ ভিত্তিক রায় লাভ করতে পারে। শ্রমিকদের বেতন, কাজের সময়, কাজের কঠোরতা, অবসরকালীন ভাতা, ক্ষতিপূরণ, বোনাস ও লভ্যাংশ ইত্যাদির ব্যাপারে মালিক যেন ইনসাফ বিরোধী কোনো রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে, সে জন্যে সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
অন্যদিকে শ্রমিক যাতে অন্যায় আচরনের মাধ্যমে মালিকের সম্পদের ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি না করতে পারে, সে জন্যে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারের ইনসাফপূর্ণ ব্যবস্থার নিকট সবাই সমান। কারো প্রতি কোনো প্রকার দুর্বলতা থাকবেনা। কারণ সবাই দেশের নাগরিক, সবাই দেশের কল্যাণের জন্যে কাজ করে যাচ্ছে। অর্থাৎ সরকারের দায়িত্ব হবে নিরপেক্ষ থাকা, ভালো কাজে সহযোগিতা যোগানো, অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করা। এ ব্যাপারে শাসকদের দায়িত্ব সম্পর্কে আল-কুরআনের পরিষ্কার ঘোষণা রয়েছে-
الَّذِينَ إِنْ مَكَّتُهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلوةَ وَآتَوُا الزَّکٰوةَ وَ أَمَرُوا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِه
“তাদের যখন আমরা পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করি, তখন নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎ কাজের নির্দেশ দেবে এবং মন্দ কাজে বাধা দেবে। আর প্রতিটি কাজের চূড়ান্ত পরিণতি আল্লাহর হাতে।” (সুরা হজ্জ: ৪১)
এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফেও বলা হয়েছে:
عَنْ مَعْقَلِ بْنِ يَسَارٍ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ أَيُّمَا وَال وَلِي مِنْ أَمْرِ الْمُسْلِمِينَ شَيْئًا فَلَمْ يَنْصَحْ لَهُمْ وَلَمْ يَجْهَدْ لَهُمْ لِنُصْحِهِ وَجَهْدِهِ لِنَفْسِهِ كَبُّهُ اللَّهُ عَلَى وَجْهِهِ في النضار –
“মা’কাল ইবনে ইয়াসার (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কোনো বিষয়ে মুসলমানদের দায়িত্ব গ্রহণ করে অতঃপর সে যদি তাদের কল্যাণ ও স্বার্থের জন্যে এমনভাবে চেষ্টা না করে, যেমন সে নিজের জন্য চেষ্টা করে, তাহলে আল্লাহ তাকে উল্টোভাবে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” (তিরমিযি)
সরকারের দায়িত্বসমূহ সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নরূপ:
১. কুরআন-হাদিস মোতাবেক শ্রম আইন ও শিল্প সম্পর্কিত বিধিবিধান তৈরি করা।
২. মালিক ও শ্রমিক উভয়কেই আইন মেনে চলতে বাধ্য করা।
৩. যে কোনো পক্ষ থেকে বাড়াবাড়ি ও আইনের সীমালঙ্ঘন করলে তা নিয়ন্ত্রণ করার ত্বরিৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৪. সরকারের সম্পূর্ণ ন্যায়ভিত্তিক ভূমিকা পালন করা ও পক্ষপাতমূলক আচরণ সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা।
৫. শ্রমিকদের জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা প্রদান করা।
৬. শ্রমিক ও তার পরিবারের জন্যে ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
৭. বৃদ্ধদের জন্যে ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা।
৮. বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
৯. ইনসাফ, ভ্রাতৃত্ব এবং পারস্পরিক সম্মান বজায় রাখার জন্যে সুস্থ পরিবেশের নিশ্চয়তার বিধান করা।
১০. মালিক ও শ্রমিকের বিরোধ মীমাংসার জন্যে সালিসি বোর্ড গঠন করা।
১১. ফ্রি, সহজ ও দ্রুত ইনসাফভিত্তিক বিচার লাভের সহজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
পুঁজিবাদী দেশে মালিকের প্রতি সরকারের পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। কারণ পুঁজিবাদীদের টাকায় সরকার পরিচালিত হচ্ছে, ফলে শ্রমিকরা সেখানে ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদের অধিকার আদায় করতে পারছে না। সেখানে আছে শ্রমিকদের মারমুখী প্রোগ্রাম, ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রের ও মালিকের কোটি কোটি টাকার মূল্যবান সম্পদ। মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়েছে অনেক মূল্যবান জীবন। কারণ যেখানে ইনসাফ নেই, ন্যায়নীতি নেই, সুবিচার নেই, সেখানে এসব বিপর্যয়মুলক অবস্থা সৃষ্টি হতে বাধ্য। সমাজতান্ত্রিক সরকার শ্রমিকদের প্রতি যে অশোভন আচরণ করেছে, তা কোনো সভ্য মানুষ কোনোদিন ধারনাও করতে পারে না। তাই আজ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর শ্রমজীবী মানুষ যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে বিদ্রোহ ঘোষণা করে শ্রমিকরাজকে চূর্ণবিচূর্ণ করে মুক্তি পেতে চাচ্ছে।
শ্রমজীবী মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ইসলাম মালিক ও শ্রমিকের মর্যাদা ও গুরুত্ব সমানভাবে দেখে। ইসলামে শ্রেণি সংগ্রাম নেই, রয়েছে শ্রেণি সমঝোতা। মালিক-শ্রমিকের সুষ্ঠু সম্পর্ক সঠিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে একটি সমাজ গড়ে উঠতে পারে। তাই নবি কারিম (সা.) মালিকদেরকে অধিকার আদায় করার প্রতি তাগিদ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং শ্রমিকদের উপর দায়িত্ব আরোপ করেছেন এবং মালিকের দেওয়া দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং মালিকের দেওয়া আমানতও ইবাদত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْآمِينُ
“সর্বোত্তম শ্রমিক সে, যে শক্তিশালী ও আমানতদার।” (সুরা কাসাস: ২৬)
মালিকের দেওয়া কাজ শ্রমিকের নিকট আমানত। শ্রমিক সকল শক্তি, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা দিয়ে মালিকের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে মালিক পক্ষের দায়িত্ব
১. উপযুক্ত ও উন্নতমানের মেশিন ও যন্ত্রপাতি যোগান দেওয়া।
২. শ্রমিক দ্বারা এমন কাজ করাবে না যা শরিয়ত বিরোধী।
৩. সৎ ও আমানতদার দক্ষ প্রশাসন ও পরিচালকের নিয়োগ নিশ্চিত করা।
8. সৎ, দক্ষ ও আমানতদার, স্বাস্থ্যবান শ্রমিক-কর্মচারী নির্বাচন করা।
৫. সুষ্ঠু কর্মবণ্টন নিশ্চিত করা অর্থাৎ যে শ্রমিক যে কাজে দক্ষ ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারে, তাকে সে কাজে নিয়োগ করা।
৬. পরিচালক, শ্রমিক ও কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত মান-মর্যাদা সম্পন্ন বেতন ভাতা প্রদান করা।
৭. যথাসময় বেতন ও মজুরি পরিশোধ করা।
৮. শ্রমিক কর্মচারীদেরকে ধোঁকা ও ঠকাবার মনোভাব সম্পূর্ণ পরিহার করা।
৯. লভ্যাংশে শ্রমিক-কর্মচারীদের অংশ নিশ্চিত করা।
১০. শ্রমিকের মান মর্যাদা নিশ্চিত করা।
১১. কাজের সময়ের নিরাপত্তার জন্য সর্বপ্রকার নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১২. উপযুক্ত, দক্ষ, সৎ ও আমানতদার লোকদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করা।
১৩. শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
১৪. শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা করা।
১৫. শ্রমিকদের জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যে-
ক) বসবাসের জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাসস্থান নিশ্চিত
খ) স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিচ্ছন্ন খাদ্য সরবরাহ করা।
গ) পরিচ্ছন্ন পায়খানা পেশাবখানার ব্যবস্থা করা।
ঘ) বিশ্রাম ও খেলাধুলার ব্যবস্থা করা।
ঙ) শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা করা।
চ) অভিযোগ দায়ের করার পদ্ধতি সহজতর করা।
১৬. মিল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের পরামর্শ গ্রহণ নিশ্চিত করা।
১৭. নিজ পরিবারের সদস্যদের মত শ্রমিকদের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া।
১৮. শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কোনো শান্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা।
১৯. অধীন শ্রমিকদের প্রতি যত্নবান হলে শুধু দুনিয়ায় উন্নতিই নিশ্চিত হয় না সাথে সাথে মালিকের আখেরাতের কল্যাণও নিশ্চিত হয়।
২০. শ্রমিকদের তাদের অধিকার, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন করার অনুমতি প্রদান।
২১. অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি ও ক্ষতির কারণে ক্ষতিপুরণ আদায় না করা।
২২. মালিক বে-আইনিভাবে কারখানা তালাবদ্ধ করবে না।
২৩. শ্রমিক কোনো অপরাধ করলে মালিক আইনগতভাবে শান্তি দিতে পারে কিন্তু শ্রমিকের রিযিক বন্ধ করতে পারে না।
ইসলামি শ্রমনীতি বাস্তবায়নের পদ্ধতি
ইসলামে মজুরদের যে অধিকারের কথা বলা হয়েছে, তাতে ইসলামি সমাজে মজুরদের কোনো সমস্যাই অসমাপ্ত থেকে যাবে না। ইসলাম শ্রমিকের শুধু অধিকার নিশ্চিত করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদাও সমুন্নত করেছে। ইসলামি শ্রমনীতি ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মিল কারখানায় বাস্তবায়িত করা অসম্ভব।
ইসলামি শ্রমনীতি প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন করা সরকারের দায়িত্ব। আসলে দেশের সরকার যে চরিত্রের হবে বা যে নীতিতে বিশ্বাসী হবে, সে দেশে সেই নীতি বাস্তবায়িত হবে। যেমন- সমাজতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী ও অনৈসলামিক দেশে ইসলামি শ্রমনীতি বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ অসম্ভব। তাই হযরত মুহাম্মদ (সা.) আবু জাহেল ও আবু লাহাবের প্রভাবাধীন সমাজ থেকে হিজরত করে মদিনায় গিয়ে একটি ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রে ইসলামি বিধানের বাস্তবায়ন হয়েছিল সমাজের সর্বক্ষেত্রে। আজকের যুগেও যদি কেউ ইসলামি আইনের বাস্তবায়ন দেখতে চায় তাহলে সর্বপ্রথম একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) একটি ইসলামি সমাজ গঠনের জন্য যে সমন্ত কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন, আজকের যুগেও তারই অনুসৃত পন্থায় একটি ইসলামি সমাজ কায়েমের চেষ্টা করতে হবে। তাহলে সে সমাজে ইসলামি শ্রমনীতি বাস্তবায়িত হবে। বাংলাদেশ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র, তাই এ রাষ্ট্রে ইসলামি শ্রমনীতি কল্পনা করা কঠিন। বাংলাদেশে শতকরা নব্বইজন মুসলমান শ্রমিক, তারা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুললে মানব রচিত বিধান ও অসৎ নেতৃত্ব সবকিছুর মূলোৎপাটন হয়ে অতি সহজেই সারা দেশে আল কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এবং প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইসলামি শ্রমনীতি বাস্তবায়িত হতে পারে। তাই সকল শ্রমিক কর্মচারী ভাইদেরকে দুনিয়ায় তাদের অধিকার, মান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং আখেরাতের শান্তি লাভের লক্ষ্যে আল-কুরআনের বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য আল-কুরআনের সৈনিক হওয়ার আহবান জানাই।
দ্বিতীয় অধ্যায় : মাওলানা মওদূদীর চিন্তাধারায় শ্রমিক আন্দোলন
শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা
জামায়াতে ইসলামি ইকামাতে দ্বীনের সংগঠন। আল্লাহর দ্বীন কায়েমই এই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আর এই উদ্দেশ্যে নবি মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত পথে জামায়াত স্থায়ী ৪ (চার) দফা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তন্মধ্যে তৃতীয় দফা কর্মসূচি সমাজ সংস্কার। মাওলানা মওদূদী (রহ.) ১৯৫১ সালে এক বক্তৃতায় জামায়াতের ৪ দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করেছেন, যা “মুসলমানদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের কর্মসূচি” নামক পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত পুস্তকে জামায়াতের তৃতীয় দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাওলানা বলেন, “সমাজের সকল শ্রেণির তাদের অবস্থার দিক দিয়ে সংস্কার করা এ অংশের অন্তর্ভুক্ত।” এ কাজ যারা করবে তাদের উপায় উপকরণ যতো বেশি হবে এ কাজের পরিধি ততো বিস্তৃত হবে। এ উদ্দেশ্যে কর্মীবৃন্দকে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া উচিত। তাদের মধ্যে কেউ শহরবাসীর মধ্যে কাজ করবে, কেউ গ্রামবাসীর মধ্যে, কারো কাজ হবে কৃষকদের মধ্যে। কারো কাজ হবে শ্রমিকদের মধ্যে। মাওলানার উপরিউক্ত বক্তব্যের মধ্যে “এ উদ্দেশ্যে কর্মীদেরকে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া উচিত।” এ কথা কয়টি ইসলামি সংগঠনের নেতৃবৃন্দের প্রতি মাওলানার হেদায়েত বা নির্দেশ।
ইসলামি সংগঠনের পক্ষ থেকে যাদেরকে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে কাজ করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হবে তাদেরকে পরামর্শ দিয়ে মাওলানা মওদূদী (রহ.) বলেন, “যারা শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করবে, তারা তাদেরকে সমাজতন্ত্রের হলাহল থেকে রক্ষা করার জন্য শুধু প্রচার প্রচারণাতেই সন্তুষ্ট থাকবে না। বরং কার্যত; তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টাও করবে।”
তাদের এমন শ্রমিক সংগঠন কায়েম করাও উচিত যাদের উদ্দেশ্য হবে সুবিচার কায়েম করা- উৎপাদনের উপায় উপকরণ জাতীয় মালিকানাভুক্ত করা নয়। শ্রেণি সংগ্রামের পরিবর্তে তাদের কাজ হবে বৈধ ও ন্যায় সংগত অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করা। ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া কলাপের পরিবর্তে তাদের কর্মপন্থা হবে নৈতিকতার ভিত্তিতে এবং আইনসম্মত। তাদের লক্ষ্য শুধু আপন অধিকার আদায় নয়, দায়িত্ব পালনও। যে সব শ্রমিক অথবা কর্মী তাদের মধ্যে শামিল হবে, তাদের ওপর এ শর্ত আরোপিত হওয়া উচিত যে, তারা ঈমানদারী সহকারে নিজের অংশের করণীয় কাজ অবশ্যই করবে। তারপর তাদের কর্মের পরিধি শুধু আপন শ্রেণির স্বার্থেই সীমিত থাকা উচিত হবে না, বরং যে শ্রেণির সাথেই এ সংগঠন সংশ্লিষ্ট থাকবে তার নৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্যেও চেষ্টা করতে হবে।
জামায়াতের তৃতীয় দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মী বাহিনীকে ক্রমাগত সংগঠিত হয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে মাওলানা মওদূদী (রহ.) আরও বলেন, “যে ব্যক্তি যে মহলে ও শ্রেণির মধ্যে কাজ করবে সেখানে ক্রমাগত এবং সংগঠিত উপায়ে করবে এবং আপন চেষ্টা চরিত্র ফলবতী না হওয়া পর্যন্ত কাজ ছেড়ে দেবে না। আমাদের কর্মপন্থা এ হওয়া উচিত নয় যে আকাশের পাখি এবং ঝড় তুফানের মতো বীজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে থাকবে। পক্ষান্তরে আমাদেরকে ঐ কৃষকের মতো কাজ করতে হবে যে কিছু ভূমিখণ্ড নির্দিষ্ট করে নেয়। তারপর জমি তৈরি করা থেকে শুরু করে ফসল কাটা পর্যন্ত ক্রমাগত কাজের দ্বারা নিজের শ্রমকে সাফল্যমন্ডিত করে ক্ষান্ত হয়। প্রথম পন্থা অবলম্বন করলে জমিতে জঙ্গল ও আগাছা জন্মায় এবং দ্বিতীয় পন্থায় রীতিমত ফসল তৈরি হয়।”
মাওলানা মওদূদী (রহ.) উপরিউক্ত বক্তব্যে শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে কাজের জন্য শ্রমিক সংগঠন কায়েম করার কথাই শুধু বলেননি পাশাপাশি শ্রমিক সংগঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি কেমন হবে তাও বলে দিয়েছেন।
ইসলামি রাষ্ট্রে শ্রমিক আন্দোলন থাকবে কী?
ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক আন্দোলনের কোনো প্রয়োজন থাকবে কি না- এটা একটা বড়ো প্রশ্ন। কেননা ইসলামি বিধান অনুযায়ী সব কিছুইতো সঠিকভাবে পরিচালিত হবে। এই প্রশ্নের জবাবে মওলানা মওদূদী (রহ.) বলেন, “ইসলামি রাষ্ট্রে শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রম আদালত থাকবে।” মাওলানা মওদূদীর যুগ জিজ্ঞাসার জবাব পুস্তকে এই প্রশ্নের আরও যে উত্তর পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ:
ইসলামি রাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে এটাই তো পার্থক্য। সমাজতন্ত্রের বক্তব্য হলো, যখন তা কোনো দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে, সেখানে শ্রমিক আন্দোলনের প্রক্রিয়া বিলুপ্ত হয়ে যায়। শুধু নামে মাত্র ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক সংগঠনের অস্তিত্ব থাকবে। প্রকৃতপক্ষে তা হবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মুখপাত্র। শ্রমিকদের কল্যাণের সাথে তার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র যে বেতন-ভাতা ও কাজের সময় শ্রমিকদের জন্য নির্ধারণ করে, তা যথার্থভাবে মেনে চলার দায়িত্ব এই শ্রমিক সংগঠনগুলোর ওপর ন্যস্ত হয়। শ্রমিকদের নির্ধারিত ভাতা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের কোনো অধিকার থাকবে না, তা সে ভাতার পরিমাণ ন্যায়সঙ্গত হোক বা না হোক। ইসলাম এ ধরনের বল প্রয়োগ নীতির পরিপন্থী। ইসলামি রাষ্ট্রে শ্রমিক আন্দোলনের অস্তিত্ব থাকবে। এখানে শ্রমিকদেরকে ইসলামি নীতিমালা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংগঠিত করা হবে। সেভাবেই শ্রম আদালত তার কার্য পরিচালনা করবে। শ্রমিকরা তাদের সংগঠনের মাধ্যমে তাদের দাবি-দাওয়া এ আদালত থেকে আদায় করে নিতে পারবে।
পুঁজিবাদে জুলুম, ইসলামে শ্রমিকদের কল্যাণ
সমাজতন্ত্রের বিপরীত পুঁজিবাদে শ্রমিকদের ব্যক্তি স্বাধীনতা রয়েছে এবং তারা তাদের কল্যাণ কামনায় স্বাধীনভাবে দর কষাকষি করে নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায় করতে পারে বলে পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন। বস্তুত: সমাজতন্ত্রে যেমন শ্রমিক কর্মচারীদের ওপর জুলুম নির্যাতন চলে তেমনি পুঁজিবাদেও শ্রমিকরা শোষণ-নিপীড়নের শিকার হয়। শ্রমিকদের মুক্তির একমাত্র পথ ইসলামি সমাজ। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার স্থলে ইসলামের অর্থনৈতিক বিধান চালু হলে তাতে শ্রমিকদের কি অর্থনৈতিক কল্যাণ হবে? এরূপ এক প্রশ্নের জবাবে মাওলানা মওদূদী (রহ.) বলেন-
অর্থনৈতিক কল্যাণের চেয়ে মানবিক কল্যাণ অধিক গুরুত্বের দাবি রাখে। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো জুলুম হচ্ছে, তা শ্রমিক শ্রেণিকে কলুর বলদ বানিয়ে তাদের কাছ থেকে মানবতা ছিনিয়ে নেয়। বর্তমানে যেখানেই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা চালু আছে, মানুষের ওপর এ রকম উৎপীড়ন চালানো হচ্ছে। ইসলামি বিধান প্রতিষ্ঠিত হলে তা শুধু যে শ্রমজীবী মানুষকে অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী করতে সচেষ্ট হবে তাই নয়, বরং এ রাষ্ট্র ব্যবস্থা চায়, সমাজের সচ্ছল মানুষদের মত তারাও সুখী জীবন যাপন করুক। ইসলামি রাষ্ট্র বৈধ শ্রম এবং ইনসাফভিত্তিক পারিশ্রমিকের নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করবে এবং শ্রমিকদেরকে এ পরিমাণ সময় দেওয়া হবে যে, তারা তাদের ডিউটি শেষ করার পর নিজ পরিবার ও সন্তান-সন্ততিদের প্রতি মনোযোগী হতে পারবে। নিজের ও পরিবারের নৈতিক মানোন্নয়নের কাজও করতে পারবে।
ইসলামি রাষ্ট্রে মালিকরা স্বেচ্ছাচার হতে পারবে না
ইসলামি রাষ্ট্রে কারখানার মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার অধিকার থাকবে কী? এই প্রশ্নের জবাবে মাওলানা বলেন- অবৈধ অধিকার থেকে তাদেরকে নিশ্চিতরূপে বঞ্চিত করা হবে। কিন্তু কারখানার মালিক হিসেবে তাদের কিছু বৈধ অধিকার রয়েছে, যা প্রয়োগে তাদের বাধা দেওয়া হবে না। যেমন ধরে নিন, কোনো ব্যক্তি একটি কারখানার কর্মচারী হয়ে সঠিকভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করে না, কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়ায়, তাদেরকে ভাঙচুর ও সন্ত্রাসের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে এবং অযৌক্তিক কোনো কারণে গোটা কারখানায় গোলমাল বাধায়। এক্ষেত্রে কারখানার মালিক সেই কর্মচারীকে ছাঁটাই অথবা সাময়িকভাবে বরখাস্তের নির্দেশ জারী করার অধিকার অর্জন করবেন। তবে কারখানার মালিকদের জুলুম করার অধিকার দেওয়া হবে না এবং বিশ্বস্ত ও কর্তব্যপরায়ণ কর্মচারীদের যখন খুশি চাকরিচ্যুত করার অধিকারও তাদের থাকবে না।
কারখানার মালিকদেরও অনর্থক ক্ষতি করা যাবে না এবং শ্রমিক শ্রেণিকেও মালিকদের অত্যাচার ও শোষণের শিকারে পরিণত হতে দেওয়া যাবে না। একথা মনে রাখবেন, আমরা সমাজকে শ্রেণি সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে চাই না। আমরা চাই শ্রমিক ও মালিকদের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হোক এবং তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করুক।
কাজের সময় ও কারখানার অংশীদারিত্ব
কল-কারখানায় অনেক সময় শ্রমিকদের নিকট থেকে অধিক শ্রম আদায় করা হয়। তাদের অতিরিক্ত শ্রমের সকল ফায়দা মালিকরা গ্রহণ করে। এতে জামায়াত কী পদ্ধতি অবলম্বন করবে? এই প্রশ্নের জবাবে মাওলানা মওদূদী (রহ.) বলেন, “জামায়াতে ইসলামির দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ইনসাফভিত্তিক পারিশ্রমিকের পাশাপাশি শ্রমিকদের কাজের সময়ও নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। কখনো যেন তাদের নিকট থেকে অতিরিক্ত কাজ আদায় করা না হয়। পক্ষান্তরে কারখানার উৎপাদনের সঙ্গে শ্রমিকদের মুনাফার এমন একটা সম্পর্ক থাকা দরকার, যা তাদেরকে অতিরিক্ত শ্রমের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। এজন্য তাদেরকে বোনাসের শেয়ারও দেওয়া হবে। অর্থাৎ শ্রমিকদেরকে কারখানার অংশীদার বানাতে বোনাসের অংশ ব্যয় করা হবে। তারা যেন উপলব্ধি করে, তাদের শ্রমের সম্পূর্ণ লাভ শুধু মালিকই পাচ্ছে না, বরং এতে তাদেরও অংশ রয়েছে। শ্রম আইন পুনর্বিবেচনার অর্থ হচ্ছে শ্রম শোষণ করার সকল দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং শ্রমজীবী শ্রেণিকে অধিকতর সুখী ও সচ্ছল করা হবে।
শ্রমিক আন্দোলন ও সমাজতন্ত্রী চক্র
শ্রমিক আন্দোলনের নামে সমাজতন্ত্রীরা শ্রমিকদেরকে ভাঙচুর এবং সন্ত্রাসের পথে নামিয়ে দিয়ে এ আশ্বাস দেয় যে, তাদের সমাধানের এটাই উত্তম পথ। এর বিপরীতে ইসলামি শ্রমিক আন্দোলনের করণীয় কী? এইরূপ প্রশ্নের জবাবে মাওলানা মওদূদী (রহ.) বলেন, একথা বুঝে নিন যে, সমাজতন্ত্রীদের উদ্দেশ্য শ্রমিকদের অধিকার আদায় করে দেওয়া নয়। তারা চায়, শ্রমিকদের মধ্যে একটা অরাজকতা ও অস্থির পরিবেশ বিরাজ করুক। এরা যদি কোনো দাবি পূরণ হতে দেখে, যেনতেন নতুন আরেকটা দাবি দাঁড় করিয়ে দেয়। শ্রমিকদেরকে তারা ক্রমাগত এই বলে প্ররোচিত করতে থাকে যে, নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসের মাধ্যমেই তারা স্বীয় অধিকার অর্জন করতে পারে। তাদের উদ্দেশ্য হলো, এ ধরনের নৈরাজ্য এবং বিশৃঙ্খলার ফলে যেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ পরিষ্কার হয়, আর তারা কোনো উপযুক্ত সময়ে দেশ ও জাতিকে সমাজতান্ত্রিক শাসনের কোলে ঠেলে দিতে পারে। এ উদ্দেশ্য পূরণে তারা পুঁজিবাদ এবং শ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতা করে উভয়কেই স্বস্থানে বোকা বানিয়ে রাখে। আমরা সারাদেশে এমন শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করতে চাই, যা নৈতিক রীতিনীতির সীমায় থেকে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের সংগ্রাম করবে। যদি এ ধরনের শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হয়, তবে পুঁজিপতিদের নত করা এবং শ্রমিকদের বৈধ অধিকার অর্জনে সফল না হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। ভাঙচুরের ফলে শুধু পুঁজিপতিদেরই ক্ষতি হবে, শ্রমিকদের নিজেদের কোনো ক্ষতি হবে না- তাদের মধ্যে এ প্রবণতা প্রতিপালিত হওয়া ঠিক নয়। কারণ এতে জাতির সামগ্রিক সম্পদ নষ্ট হয়, যার ক্ষতিকর পরিণতি শেষ পর্যন্ত তাদের ওপরও বর্তাবে।
ডিউটিও ইবাদত
সমাজতন্ত্রীদের যখন আমাদের দেশে খুব প্রভাব ছিল তখন একটা প্রশ্ন তারা তুলেছিল মিল-কারখানায় শ্রমিক আট ঘণ্টা কাজের সময়ের মধ্যে নামাজের সময় ব্যয় করা কি শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েজ হবে? কারণ নামাজের জন্য যে সময় ব্যয় করা হবে তাও তো ঐ আট ঘণ্টার মধ্যে। এইরূপ এক প্রশ্নের জবাবে মাওলানা মওদূদী (রহ.) বলেন- যারা শরীয়তের দোহাই দিয়ে মুসলমানদেরকে নামাজ থেকে বিরত রাখে, তারা প্রকৃতপক্ষে শরিয়ত নিয়ে খেলা করে। তাদের এ কাজ মূলতই নাজায়েজ ও হারাম। মুসলমানদের এদের প্রভাবে প্রভাবিত হওয়া উচিত নয় এবং নামাজ যথারীতি আদায় করা প্রয়োজন। যেভাবে খাওয়া, পান করা এবং প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ মানুষের অপরিহার্য কাজের অন্তর্ভুক্ত এবং এ প্রয়োজন পূরণের জন্য তাদেরকে কারখানায় কাজের মাঝেও অনুমতি দেওয়া হয়; তেমনিভাবে মুসলমানদের জন্য আপন রবের স্মরণ করাও এক অতি জরুরি কাজ। কোনো মহাজনের এ অধিকার নেই যে, সে এই অতি প্রয়োজনীয় কাজের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কোনো মহাজন মুসলমান হয়ে ফরজ নামাজ আদায়ে বাধা দেবে, এটা আরও দুঃখজনক।
শ্রমিক কর্মচারীদের অধিকার
শ্রমিক কর্মচারীদের অধিকার সংক্রান্ত এক একটা প্রশ্ন ও তার উত্তরে মাওলানা মওদূদী (রহ.) এর বক্তব্য নিম্নে তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: এখানকার একটি প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের বেতন ও চাকরি সম্পর্কিত অন্যান্য নিয়মাবলী সম্পর্কে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করেছিল। কুরআন হাদিস ও ফিকাহর কিতাবসমূহ সম্পর্কে আমার যতদূর পড়াশুনা আছে তা থেকে এ ব্যাপারে কোনো সমাধান বের করতে পারলাম না। তাই আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি, আপনি এ সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের নির্দেশ এবং খিলাফতে রাশিদার জামানা ও পরবর্তীকালে সৎ সুলতানগণের কার্যাবলী সুস্পষ্টভাবে পেশ করবেন। নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলোর জবাব চাচ্ছি;
১. প্রত্যেক কর্মচারীর বছরে কতদিন সবেতনে ছুটি নেওয়ার অধিকার আছে?
২. বছরে কতদিন আকস্মিক ছুটি নেওয়ার অধিকার আছে?
৩. অসুস্থকালে বেতন পাবে কি না?
৪. কর্মচারীদের বেতন নির্ধারণের ব্যাপারে কোনো নীতি অবলম্বিত হবে?
৫. কর্মচারীদের পরিবারে লোক সংখ্যা বাড়লে বেতন বেড়ে যাবে কি না?
৬. ছুটি লাভের জন্যে লিখিত অনুমতির প্রয়োজন কি না?
৭. উচ্চ পদস্থ ও নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের অধিকার সমান হবে, নাকি তাদের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য থাকবে?
জবাব: আপনার প্রশ্নগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করা ও বিস্তারিত জবাব দেওয়ার প্রয়োজন। কিন্তু আমি বাধ্য হয়ে সংক্ষিপ্ত জবাবের ওপরই নির্ভর করছি। শরীয়তে শ্রমিক ও কর্মচারীদের অধিকার সম্পর্কে লিখিত বিস্তারিত বিধান আকারে কিছু না থাকলেও আমাদেরকে এমন সব নীতি দান করা হয়েছে যার আলোকে আমরা বিস্তারিত বিধান রচনা করতে পারি। খিলাফতের রাশিদার আমলে এই নীতিগুলোর ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীদের সাথে যে ব্যবহার করা হতো হাদিস ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে তার বিস্তারিত বিবরণ কোথাও একত্রিত নেই বরং বিভিন্ন অধ্যায়ে ও খণ্ডে তা ছড়িয়ে আছে। এই বিস্তারিত অধ্যায়সমূহেও সম্ভবত খুব কমই আপনার প্রশ্নাবলীর জবাব পাওয়া যাবে। আমি বর্তমানে প্রচলিত রীতি ও ইসলামের সর্বজনবিদিত ন্যায়-নীতির ওপর নির্ভর করে আপনার প্রশ্নাবলীর সংক্ষিপ্ত জবাব দিচ্ছি।
ছুটির ব্যাপারে এই পরিচিত পদ্ধতিটিই সংগত মনে হচ্ছে যে, সারা বছরে নিয়মিত এক মাসের ছুটি পাওয়া উচিত এবং বছরে সবেতনে ১৫ দিন আকস্মিক ছুটি পাওয়া উচিত। এর বেশি ছুটি নিতে হলে একটি বিশেষ সীমার মধ্যে বিনা বেতনে তা দেওয়া যেতে পারে। যত দীর্ঘদিনের অসুস্থতা হোকনা কেন অসুস্থকালে প্রত্যেক কর্মচারীর পূর্ণ বেতন পাওয়া উচিত। কোনো নিয়োগকর্তা যদি এটা মঞ্জুর না করে, তাহলে তাকে অসুস্থ কর্মচারীদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা উচিত অথবা তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত এবং অসুস্থ কর্মচারী ও তার পরিবারের ভরণ-পোষনের দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত। কর্মচারীর বেতন নির্ধারণের ব্যাপারে কতিপয় বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন, তার কাজের ধরণ, তার নিজের যোগ্যতা, যে ধরনের কাজে নিযুক্ত সে ধরনের যোগ্যতা সম্পন্ন লোকের জীবন যাপনের জন্যে অপরিহার্য প্রয়োজনীয় বস্তুসমূহ ও তার পারিবারিক দায়িত্বসমূহ।
সাধারণত নিয়োগকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কর্মচারীর পরিবারের লোকদের সংখ্যা বৃদ্ধির আনুপাতিক হারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতন বৃদ্ধি করা সহজসাধ্য নয়। তবে সরকারকে এ দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত অথবা বড়ো বড়ো ব্যবসায় ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহকেও এজন্যে বাধ্য করা যেতে পারে। ছুটির জন্য অনুমতির ব্যাপারটিও একদিক দিয়ে লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়াবলীর সাথে সামঞ্জস্যশীল। তাই নীতিগতভাবে লিখিত আবেদন ও লিখিত অনুমতির বাধ্যবাধকতা বাঞ্ছনীয়। তবে প্রাইভেট চাকরির ক্ষেত্রে একজন কর্মচারীর সম্পর্ক ব্যক্তিগতভাবে একজন মালিকের সাথে স্থাপিত হয়। তাই সেখানে মৌখিক অনুমতির অবকাশ থাকতে পারে। বেতনের ক্ষেত্রে নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠিত থাকা উচিত। (তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারী ১৯৫৩)
ইসলামি রাষ্ট্র এবং দারিত্বহীন কর্মচারী
এ ব্যাপারে একটা প্রশ্ন ও মাওলানা মওদূদী (রহ.) এর জবাব রাসায়েল ও মাসায়েল থেকে এখানে তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে উন্নত নৈতিক চরিত্র এবং দায়িত্ববোধের অনুভূতিই কম। একটি ইসলামি রাষ্ট্র তাদের দ্বারা কিভাবে কাজ আদায় করবে?
জবাব: এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, রাষ্ট্রের কর্মচারীবৃন্দ এবং জাতির অন্যান্য কিছু লোকের নৈতিক চরিত্রের অবস্থা পুরো জাতিকে একেবারে অথর্ব করে দিয়েছে। এটা নাজুক এবং জটিল সমস্যা। সংক্ষেপে বলতে গেলে, সর্বপ্রথম এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, চারিত্রিক দোষত্রুটিগুলো অনিবার্যভাবে আল্লাহ তা’আলার প্রতি ভয় না থাকা ও আখেরাতের প্রতি উদাসীনতার বিষফল। এটা সকল অন্যায়ের মৌলিক কারণ। তাছাড়া আরও অনেক কারণ আমাদের সামাজিক জীবনে পাওয়া যায়, যার দরুন এ মন্দ বিষয়গুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। যেমন, আমাদের সমাজের উচ্চ ভরের লোকেরা অত্যন্ত বিলাসী ও অপচয়ক জীবন যাপন করে থাকে। এই শ্রেণির প্রয়োজনীয়তা শুধু খাওয়া পরা বিলাসিতাপূর্ণ বাসস্থান ও বাচ্চাদের শিক্ষা দান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নেই বরং আরও বহু প্রকার কাজের জন্য তাদের হাজার হাজার টাকার প্রয়োজন হয়। দেশ পরিচালকরা এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত নিয়ম এই যে, ওপরতলার লোকদের আচার আচরণ নিম্নস্তরের লোকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি উঁচু শ্রেণির প্রভাব গ্রহণ করে এবং নিম্নশ্রেণিও আরও নীচের লোকেরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং একেবারে নিম্নশ্রেণির লোকেরা কার্যত; নিজেদের জীবনের মান ঠিক রাখার জন্য ন্যায় অন্যায় সব রকমের উপায় উপকরণ গ্রহণ করতে এক প্রকার বাধ্য হয়ে যায়।
এখন আপনি যদি এসব যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতে চান, তাহলে কোনো এক শ্রেণির সংশোধন দ্বারা সবার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তাও আবার আইনের জোরে, এটা কিছুতেই আশা করতে পারেন না। এ রোগের জীবাণু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। ইসলামের নীতি হল, সামাজিক খারাবী দূর করার উদ্দেশ্যে সে শুধু আইনের ওপর নির্ভর করে না, ইসলাম বরং জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ থেকে সামাজিক অনাসৃষ্টির উপর আক্রমন চালায়।
আইনের শাসন ও প্রভাবসহ শিক্ষা দীক্ষার মাধ্যমে, তাবলীগ ও উপদেশ দ্বারা, সংশোধনী প্রচেষ্টা ও প্রতিরোধমূলক যাবতীয় তত্ত্বীরের মাধ্যমে অন্যায়কে দূর করে। সমাজ সংস্কারের জন্য একটি ইসলামি রাষ্ট্রকে এ কাজগুলোর সবই করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাপাখানা, সংবাদপত্র ও প্রচারযন্ত্রের সকল শক্তিগুলোকেই এ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে হবে। এরপর সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো ওপরের শ্রেণির লোকদের চরিত্র থেকে অপচয়ের কারণগুলো বাস্তবে দূর করতে হবে। এ শ্রেণির মধ্য থেকে যারা উচ্চপদে বহাল আছে তাদের বেতন বৃদ্ধি করার পরিবর্তে কমাতে হবে। কারণ অধিক হারের বেতনই তাদেরকে অতিরিক্ত খরচের দিকে উদ্বুদ্ধ করে। পক্ষান্তরে নিম্নশ্রেণির কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে, কারণ কোনো কোনো সময় প্রকৃত প্রয়োজনের তাগিদেই তারা অন্যায় কাজ করতে বাধ্য হয়। আমার অনুমান নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশ লোক সাধারণভাবে ঘুষ ও অন্যান্য অসৎ কাজে লিপ্ত হতে চায় না, কিন্তু কোনো কোনো সময় অবস্থার চাপে তারা অন্যায় পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়। যাই হোক, এ সকল পদক্ষেপই অবস্থার সংশোধনের জন্য অপরিহার্য। এ সব ব্যবস্থার সবগুলো গ্রহণ করার পরও যদি কেউ ঘুষ ও আমানতের খেয়ানত করা থেকে বিরত না হয়, তাহলে সেই সব অপরাধীদের জন্য এমন সব আইন প্রয়োজন, যার মাধ্যমে তাদেরকে শহরের চৌরাস্তায় দাঁড় করিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শান্তি দেওয়া যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে কোনো ব্যক্তি এ প্রশ্নও তোলে যে, এ কাজ করতে গেলে হঠাৎ করে বাজেট বেড়ে যাবে। এর জবাবে আমি বলব, যদি আমাদের সরকারি ও আধা সরকারি কর্মচারীরা সবাই ঈমানদার হয়ে যায় এবং তাদের দারিদ্র্যতাও না থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের আয় কমপক্ষে দ্বিগুণ বেড়ে যেতে পারে। কারণ ঘুষ, প্রতারণা ও খেয়ানতের কারণে সরকারের আয়ের অনেকাংশ কোষাগার পর্যন্ত পৌঁছতেই পারে না। সরকার এগুলো থেকে বঞ্চিত না হলে সহজেই বেতন বৃদ্ধির চাপ সহ্য করতে পারবে। অবশ্য এ কাজের সূচনা করতে গিয়ে জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি নির্ভরতা এবং আস্থা বর্তমান থাকলে, একটি সংস্কারমূলক স্কীমের উদ্দেশ্যে বিনা সুদে ঋণ হাসিল খুব কঠিন নয়। সরকার, কর্মচারী এবং জনসাধারণ এ অভিযানে বিশ্বস্ততার সাথে পরস্পরকে সহায়তা করলে হয়ত কয়েক বছরের মধ্যে ঘুষ ও খেয়ানতের নাম নিশানাও মিটে যাবে এবং বৈধ উপায়ে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ প্রয়োজনসমূহ সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে।
ইসলামি গণতন্ত্র এবং সরকারি কর্মচারীদের অবস্থা
এ ব্যাপারে একটা প্রশ্নও মাওলানা মওদূদী (রহ.) এর জবাব রাসায়েল ও মাসায়েল থেকে তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: ১৯৫৫ সালের আগষ্ট মাসের তরজমানুল কুরআনে ‘ইশারাত’ শিরোনামের অধীনে আপনি যে মত পেশ করেছেন তার অংশ বিশেষ সম্পর্কে আমি ভিন্নমত পোষণ করি। আমার সন্দেহগুলো নিম্নে বর্ণিত হলো:
১. গণতন্ত্রকে আপনি কুরআন ও সুন্নাহর লক্ষ্য হিসেবে পেশ করেছেন। আপনি ভাল করেই জানেন যে, আমাদের যুগে গণতন্ত্র এক বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে যার ভিত্তি রচিত হয়েছে জনগণের নিরংকুশ সার্বভৌমত্বের ধারণার ওপর, আর এটাকে আমরা কুরআন ও হাদিসের লক্ষ্য হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আপনি গণতন্ত্র শব্দটিকে তার সাধারণ প্রচলিত অর্থ থেকে সরিয়ে অন্য অর্থে ব্যবহার করেছেন। আপনি নিজেই ইসলামি শাসন পদ্ধতি বুঝাতে গিয়ে ‘দি ডেমোক্রেসি’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। এখন সে পরিভাষা পরিত্যাগ করে পুনরায় ডেমোক্রেসির দিকে ফিরে এলেন কেন?
২. আপনার ধারণা অনুসারে সরকারি কর্মচারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত নয়- কথাটা মূলত: অস্পষ্ট এবং সংক্ষিপ্ত। আপনিও কি রাজনীতি ও ধর্মের কৃত্রিম বিভক্তি স্বীকার করেন?
৩. ইসলামি শিক্ষা অনুসারে আপনার এ কথাও সঠিক নয় যে, সরকারি কর্মচারীরা অধিকাংশ জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত যে কোনো সরকারের আনুগত্য করবে, জনগণ আইনত; যাদের হাতে ক্ষমতা অর্পন করেছে। সরকারি কর্মচারী বা সাধারণ নাগরিক যেই হোক না কেন একজন মুসলমানের পক্ষে তারই আনুগত্য করা জরুরি, যে ব্যক্তি কুরআন ও হাদিসের অনুসারী। মুসলমানদের আনুগত্য লাভ করার জন্য আইনত: ক্ষমতার মসনদে বসে যাওয়াই যথেষ্ট হতে পারে না।
জবাব: আমার লেখনী ও বক্তৃতাসমূহে বারবার আমি ভালভাবে এটা স্পষ্ট করে দিয়েছি যে, ইসলামে গণতন্ত্রের মূল প্রাণশক্তি অবশ্যই আছে। কিন্তু ইসলামি গণতন্ত্রের ধ্যান ধারণা এবং পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের ধ্যান ধারণার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ইসলাম জনগণের নিরংকুশ সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে না, বরং একমাত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীন খেলাফত স্বীকার করে। জনগণের এই প্রতিনিধিত্ব যেহেতু কোনো ব্যক্তি, বংশ অথবা দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সামগ্রিকভাবে গোটা জাতির হাতে আবর্তিত হয় এবং তারাই যাকে ইচ্ছা এ ক্ষমতা ব্যবহারের পাত্র হিসেবে নির্বাচন করে। এজন্য স্বৈরতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্র থেকে পৃথক করার জন্য ইসলামের শাসন পদ্ধতিকে গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি বলা যেতে পারে। এটাই ইসলামের বিশেষ গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা। সারা দুনিয়ায় যে একই ধরনের গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা পরিচিত এবং চালু আছে এ দাবিও ঠিক নয়। পাশ্চাত্য জগতেও গণতন্ত্রের বিভিন্ন ধরনের ধারণা চালু আছে। যেমন পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র ইত্যাদি। এগুলোর মোকাবেলায় ইসলামের শাসন পদ্ধতিকে ইসলামি গণতন্ত্র আখ্যা দেওয়া যায়। এহেন ইসলামি গণতন্ত্রেরই আমি ‘দি ডেমোক্রেসি’ আখ্যা দিয়েছি। এ পরিভাষা দ্বারা গণতন্ত্রেরই একটি ধরনকে বুঝানো হয়েছে যার ভিত্তি ইসলামের মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
সরকারি কর্মচারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের যে বিরোধিতা আমি করেছি তার কারণ এবং যুক্তিগুলোও আমি তুলে ধরেছি। আপনি সে যুক্তিগুলো পরখ করার কষ্ট স্বীকার করেননি এবং এমন দিকগুলো সম্পর্কে আপত্তি তুলতে শুরু করেছেন মূল বিষয়ের সাথে যার সম্পর্ক নেই। সরকারি কর্মচারীদের একজন নাগরিক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতি থেকে পৃথক থাকবে একথা কেউ বলে না। এ কারণেই যে কোনো সাধারণ নাগরিকের ন্যায় তারাও ভোট প্রয়োগের আইনসিদ্ধ অধিকারী। কিন্তু সরকারি কর্মচারী হিসেবে তাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হস্তক্ষেপ করা, সরকারি ব্যবস্থাপনার যে দায়িত্ব ও ক্ষমতা তাদের উপর ন্যস্ত রয়েছে সেটাকে দেশে বিরাজিত রাজনৈতিক নানা মতবাদ এবং বিভিন্ন দলের মধ্যে থেকে কারো পক্ষে আবার কারো বিপক্ষে ব্যবহার করা নীতিগতভাবে সিদ্ধ হতে পারে না। এটা কার্যত দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারও। পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং সিভিল সেক্রেটারিয়েটের লোকেরা দলবদ্ধভাবে কোনো মতবাদ গড়ে তুলুক এবং তারাই দেশের ওপর অধিকার বিস্তার করে নিজ মতবাদ জবরদস্তি চালু করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিক এবং তাদের মতবিরোধী কোনো দল ক্ষমতাসীন হলে তাদের শাসন ক্ষমতাকে বিকল করে দিক, এটাকে আপনি সঠিক মনে করতে সম্মত হবেন কী?
এটা ঠিক যে, একজন সাধারণ নাগরিকের ন্যায় একজন সরকারি কর্মচারীর সেই সরকারের আনুগত্য করাই কর্তব্য, যে সরকার কুরআন ও সুন্নাহর পাবন্দ নয় তার অধীনে চাকরি তো করা যাবে, কিন্তু আনুগত্য করা হবে না, এটাও কি যুক্তিসঙ্গত? আমি যে পূর্বাপর অবস্থাকে সামনে রেখে একথা বলেছিলাম তা হচ্ছে এই যে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক যে শাসন কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা প্রদান করবে কর্মচারীদের উচিত তার আনুগত্য করা। সে সময়ে গণতান্ত্রিক মূলনীতি বলে দেওয়ার সাথে সাথে আমি ইসলামের মূলনীতিসমূহও তুলে ধরেছিলাম। আমার কথাগুলোকে উক্ত অবস্থার সাথে সম্পর্কিত রেখেই বুঝা দরকার ছিল। কিন্তু আপনি সে অবস্থা বাদ দিয়ে চিন্তা করলেও আমার কথা হল, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা যদি এমন লোকদের হাতে ক্ষমতা অর্পন করে দেয়, যারা কিতাব ও সুন্নাহ থেকে দূরে সরে আছে, এমতাবস্থায় একজন দ্বীনদার সরকারি কর্মচারীকে আমি পরামর্শ দেব এ পরিস্থিতিতে তার চাকরি ছেড়ে দেওয়া উচিত। চাকরি করবে অথচ কর্তৃপক্ষের আনুগত্য এড়িয়ে যাবে, এহেন দ্বৈত নীতি সমর্থনযোগ্য এবং যুক্তিসংগত হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
ইসলামে শ্রমিকদের সমস্যা ও তার সমাধান
এ ব্যাপারে মাওলানা মওদূদী (রহ.) ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান শ্রমিক কল্যাণ সমিতির এক বার্ষিক সম্মেলনে যে ভাষণ দেন তা এখানে তুলে ধরা হলো-বর্তমানে শিল্পকারখানার শ্রমিকগণ এবং ক্ষেত-খামারের কৃষকগণ যে সব দুঃখ-দৈন্য ও বিপদ আপদ এবং যেসব জটিল সমস্যার সম্মুখীন তার মূল কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ও ত্রুটি। আর এর জন্য দায়ী হচ্ছে সেই প্রতারণা ও প্রবঞ্চনাময় জীবন বিধানটি, যার অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। যে পর্যন্ত না অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভাল ও সুন্দর না হবে সে পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণির বর্তমান দুঃখ-দৈন্য ও বিপদ-আপদ পূর্ণরূপে দূরীভূত হবে বলে আশা করা যায় না।
প্রতারণার কারণ
বর্তমানে আমাদের দেশে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা প্রচলিত রয়েছে তা শুধু যে বৃটিশ শাসনামলের অধীনতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় তাই নয় বরং বৃটিশ শাসনামলের পূর্ব হতেই এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অনিষ্টতা প্রকাশ্যরূপে বর্তমান ছিল। যেমন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মোহাদ্দেসে দেহলবী (রহ.) এর লেখনী দ্বারা প্রকাশ পেয়েছে, তৎকালীন যুগেও মানুষ অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত ছিল এবং একটি জালেমি অর্থব্যবস্থার দলনে কঠোর রূপে নিষ্পেষিত হয়ে মর্মজ্জ্বালার মধ্যে নিপতিত ছিল। বৃটিশের আগমনের পর তারা তৎকালীন অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার সাথে আরও বহু দমন ও দমনমূলক অর্থনীতি সংযোজিত করে পূর্বের তুলনায় আরও কঠোর শোষণ, দমন ও নিষ্পেষণের দুষ্ট অর্থনীতি দেশের মানুষের মাথায় চাপিয়ে দিয়েছিল। বৃটিশ আমলে অর্থনীতির ক্ষেত্রে এসব ত্রুটি বিচ্যুতি ও অনিষ্টতার কারণ হলো এই যে, প্রথমত: সেটা সেই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার উন্নতির যুগে ছিল যে যুগে পুঁজিবাদের ছিল অবাধ ও নিরংকুশ স্বাধীনতা, সেখানে বাধা-নিষেধ বলতে কোনো কিছুই ছিল না। দ্বিতীয়ত: ইংরেজগণ এদেশে তাদের সাম্রাজ্যবাদী হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আগমন করেছিল এবং তৃতীয়ত: এদেশের জনসাধারণকে লুটপাট করে স্বীয় জাতীয় স্বার্থ উদ্ধার করাই ছিল তাদের অভিষ্ট লক্ষ্য। এই তিনটি কারণেই ইংরেজদের চাপিয়ে দেওয়া অর্থ ব্যবস্থা দমন, দলন ও জুলুম শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল।
বর্তমানে আমরা ইংরেজদের গোলামীর নাগপাশ হতে মুক্তিলাভ করে স্বাধীন হয়েছি বটে কিন্তু খুবই পরিতাপের কথা যে, ইংরেজদের এদেশ পরিত্যাগ করে চলে যাবার পর এখানে তাদের ফেলে যাওয়া অর্থনীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন সূচিত হয়নি। এর কারণ হচ্ছে যে, রাজনৈতিক বিপ্লব ও পটপরিবর্তন কোনো নৈতিক ও চিন্তাধারাগত বৈপ্লবিক আন্দোলনের ফলে হিসেবে রূপলাভ করেনি। বরং এটা ছিল এমন একটি কৃত্রিম বিপ্লব যা নিছক একটি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও টানাটানির ফল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। স্বাধীনতা অর্জনের একদিন পূর্বেও ভবিষ্যত কর্মসূচির কোনো নকশা ও রূপরেখা কারো নিকট ছিল না কিংবা কোনো জীবন বিধানের উজ্জ্বল ধ্যান ধারণাও বর্তমান ছিল না। জাতির সামনে এমন কোনো প্ল্যান প্রোগ্রাম ছিল না, যাকে উদ্দেশ্য করে পথ চলা যায়। স্বাধীনতা লাভকরার পর হতে আজ পর্যন্ত সমাজের কোনো অনাচার দূরাচার দূরীভূত হওয়া বা তার পরিণাম কিছুটা কম হওয়াতো দূরের কথা বরং ক্রমান্বয়ে আরও বহু অনাচার দূরাচার সংযোজিত হয়েই চলছে। ইংরেজগণ পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও বস্তুবাদের ভিত্তির উপর জীবন বিধানের যে সৌধমালা রচনা করেছিল বর্তমানে তা পূর্ববতই রয়ে গেছে। সেটা বদলিয়ে ফেলার পরিবর্তে উল্টো আরও তার উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি করা হচ্ছে। এই জীবন বিধানের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা বিধানের খাতিরে যেসব আইন-কানুন প্রণয়ন করা হয়েছিল, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হবার পর তাতে কোনো পরিবর্তন আনয়নের প্রয়োজনই অনুভব করা হয়নি। ইংরেজগণ তাদের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে দৃঢ় ও সুসংহত করার জন্য যে সব নিয়মকানুন বানিয়েছিল, তদ্রুপই রয়ে গেছে। তাদের অনুসৃত ব্যবস্থা ও কর্মপদ্ধতিই কার্যকরি রয়েছে, তাদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থাই এখনো প্রচলিত রয়েছে।
আমাদের স্বাধীনতা যদি কোনো নৈতিক ও আদর্শিক সংগ্রামের স্বাভাবিক ফল হতো, তাহলে সংগ্রামের প্রথম দিন হতেই দেশকে গঠন করার নকশা ও রূপরেখাটি সামনে হাজির করা হতো- এ নকশাটি বহু পূর্বেই তৈরি করে রেখে দেওয়া হতো এবং স্বাধীনতা লাভের পরপরই একটি দিনও অপচয় না করে আমরা একটি নির্দিষ্ট পথে অগ্রসর হতে থাকতাম। কিন্তু সেটা করা হয়নি। আজ গোলামী যুগের অনিষ্টতা বন্ধ হবার পরিবর্তে বেড়েই চলছে। শুধু বেড়েই নয় বরং বৃটিশ আমলের অনিষ্টতাগুলোর মধ্যে আরও বহু অনিষ্টতার সংযোজন হয়ে উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
আসল প্রয়োজন
এই সময় আমাদের আসল প্রয়োজন হচ্ছে সমগ্র জীবন বিধানকে পরিবর্তন করে ফেলা। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত কোনো দুঃখ-কষ্ট, অভাব অভিযোগ এবং কোনো অন্যায় দুরাচারই সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হওয়া সম্ভব নয়। অন্যায় ও দূরাচারের আসল চিকিৎসা হচ্ছে সমগ্র জীবন বিধানটি তার দর্শনে এবং নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা যা সামাজিক ইনসাফ ও সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধানে পূর্ণরূপে সক্ষম হয়। সুতরাং জীবন বিধান পরিবর্তন হবার সাথে সাথে ইনসাফ ও সুবিচারও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে এবং শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অভিযোগও স্বতঃস্ফূর্তভাবে দূরীভূত হবে।
আমাদের মতে জীবন বিধানের জন্য যে মৌলিক ভিত্তিসমূহ বাস্তবক্ষেত্রে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দিতে পারে, তার একমাত্র যোগানদার হতে পারে ইসলাম। আর তাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আমরা সংগ্রাম করে যাচ্ছি। যদিও বর্তমান যুগে বহুলোক ইসলামি সুবিচারের বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা পেশ করে চলেছেন, কারো নিকট এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ একরূপ আবার কারো নিকট অন্যরূপ। কিন্তু ইসলামের আসল উৎসমূল অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহ তার সঠিক রূপাকৃতি নিয়ে বর্তমান রয়েছে সেটাই সঠিক ব্যাখ্যা হবে। আর কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ গ্রহণ করা হবে এবং কোনোটি গ্রহণীয় হবে না, তা শেষ পর্যন্ত মুসলিম সমাজের জনসাধারণের রায় ও মতামত দ্বারাই চূড়ান্তরূপে মিমাংসিত হবে। এ জন্যই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিভিন্নতার দরুন অস্থির হবার কোনোই প্রয়োজন নেই। কুরআন সুন্নাহর ভিত্তির ওপর যে গণতান্ত্রিক জীবন বিধান প্রতিষ্ঠিত হবে, ইনশাআল্লাহ সেটা ন্যায় ও সুবিচারের নিশ্চয়তা দিবে।
বিপদ আপদের সমাধান
প্রথমত: সামগ্রিক জীবনায়নে যতক্ষণ পর্যন্ত এই মৌলিক পরিবর্তন আনয়ন করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত যতদূর সম্ভব ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সর্ববিধ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত্ব: শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ দৈন্য ও অভাব অভিযোগ দূরীকরণের জন্য সম্ভাব্য যা কিছু করা যেতে পারে তা করতে কোনোরূপ কুণ্ঠিত হওয়া উচিত নয়। আর তৃতীয়ত: কোনো শ্রেণি যাতে করে শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ দৈন্য বিপদ আপদ থেকে স্বার্থ উদ্ধার করে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো জীবন বিধানের জন্য তাদেরকে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করতে না করে পারে সেদিকেও আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
উপরিউক্ত তিনটি উদ্দেশ্যের মধ্যে শেষোক্ত উদ্দেশ্যটির কিছুটা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এ জগতে বিভিন্ন লোকের মনোভাব ও গতিচরিত্র বিভিন্নরূপ হয়ে থাকে। যেমন একটি লোক দুঃখ কষ্ট ও বিপদ আপদের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে, আর অপর একটি লোক এই করুণ দৃশ্য অবলোকন করছে আর চিন্তা করছে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির ধন-সম্পদ ও মালামাল লুটপাট করে নেওয়ার, তার বিপদকে স্বীয় স্বার্থের জন্য ব্যবহার করার এই একটি মোক্ষম সুযোগ। অপরদিকে অন্য এক লোক যদি ভাবতে থাকে যে, এ ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার বন্দোবস্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে সর্ববিধ সাহায্য করতে হবে এবং তার দুঃখ খষ্ট যতটুকু পরিমাণ লাঘব করা সম্ভব হয়, ততটুকু করতে হবে। শ্রমিক শ্রেণির বেলায় বর্তমানে এই দু’ধরনের মনোভাব ও গতি চরিত্র নিজ নিজ কাজে বিরাজিত রয়েছে। এ শ্রেণিটি এ সময় কঠোর বিপদের মধ্যে গ্রেফতার রয়েছে। আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা তাদেরকে অগণিত দুঃখ-দুর্দশা ও বিপদকে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবহার করতে চাচ্ছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা অভাব অভিযোগ দূরীভূত করা নয়; বরং দুঃখ-দুর্দশা যাতে আরও বৃদ্ধি পায় সে জন্য তারা চেষ্টার ত্রুটি করে না। কোনো অভাব অভিযোগ বিদূরিত হতে থাকলেও সেটাকে দূর হতে দেয় না। কোনো ক্ষতস্থান আরোগ্যের মুখ দর্শন করলেও সেটা যাতে আরোগ্য লাভ করতে না পারে বরং তার অস্থিরতা আরও বৃদ্ধি পায় সেজন্য খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার ঘা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাদেরকে সমাজের শাসন শৃঙ্খলা ধ্বংস করার মানসে পরিশেষে একটি চরম রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের দ্বারা সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহার করে থাকে। যেই জীবন বিধান ও শাসন ব্যবস্থাকে এরা শ্রমিকদের সম্মুখে পরকালের স্বর্গরূপে উত্থাপন করে থাকে মূলত; তা শ্রমিকদের জন্য নরক সদৃশ। আসল ঘটনা হলো এই যে, শ্রমজীবী শ্রেণিটির ভাগ্য বিপর্যয় সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে যেদিন থেকে এ দুনিয়ায় সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিস্তার লাভ করেছে। বর্তমানে শ্রমিকদের অবস্থা নিঃসন্দেহে খুবই দুর্গতিপূর্ণ এবং বর্ণনাতীত দূরবস্থার মধ্যে তারা জীবনযাপন করছে। কিন্তু একটি সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় তাদের যে কি করুণ ও মর্মবিদারী অবস্থা হবে, তা ধারণাও করা যায় না। এখন আপনারা দাবি-দাওয়া পেশ করতে পারছেন, দাবি-দাওয়া না মানা হলে আপনারা ধর্মঘট করতে পারছেন, সভা-শোভাযাত্রা করতে পারছেন এবং আন্দোলন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সমগ্র দুনিয়া সজাগ করতে পারছেন। এমনকি ভাগ্য পরীক্ষার জন্য এক স্থান ছেড়ে অন্যস্থানে গিয়ে নিযুক্ত হতে পারছেন। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক স্বর্গে এসব কিছুর পথ চিরতরে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেননা সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা, সকল জায়গা জমি, সহায়-সম্পদ, সমুদয় প্রেস ও পত্র পত্রিকা এবং জীবনের সমুদয় উপায় উপকরণ ও মতামত প্রকাশের মাধ্যমসমূহ সেই শক্তির হাতের মুঠোয় যে শক্তির হাতের মুঠোয় রয়েছে দেশের পুলিশবাহিনী, সেনাবাহিনী, সিআইডি, আদালত ও দেশের জেলখানাগুলো। সেখানে কোনো দুঃখ-দুর্দশার দরুন শ্রমিকদের জন্য সভা শোভাযাত্রা ও ধর্মঘটতো দূরের কথা একটু আহ উহ বা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলারও অবকাশ নেই।
আর সেখানে তাদের জন্য একদর ও একমূল্য ব্যতীত এমন দ্বিতীয় কোনোরূপ মূল্য যাচাই করার সুযোগ নেই, যাতে করে মানুষ তাদের ভাগ্য পরীক্ষার জন্য গিয়ে দণ্ডায়মান হতে পারে। সমগ্র দেশে একজন জমিদার হবে, প্রত্যেক কৃষককেই ইচ্ছায় অনিচ্ছায় তার হুকুম তামিল করে জমিজমা চাষাবাদ করার জন্য বাধ্য থাকতে হবে। সমগ্র দেশের কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক হবে মাত্র একজন। তার দেওয়া বেতন ভাতা দ্বারা আপনার পরিবার পরিজনের খোরপোষ সংকুলান হোক বা না হোক তার অধীনে মজদুরী করা ব্যতীত অন্য কোনো উপায় নেই। ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সেখানেই মজদুরী করতে বাধ্য থাকতে হবে। তারা যা কিছু দানাপানি আপনাকে দান করবে সেটাই আপনাকে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় গ্রহণ করতে হবে এবং পেট না ভরলেও মহান নেতার লাখ লাখ শোকর আদায় করতে হবে। এমন শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তথাকথিত প্রগতিবাদী সমাজতান্ত্রিকেরা শ্রমিক শ্রেণিকে তাদের হাতিয়ারে পরিণত করতে চায়। আর এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তারা গরিব ও সর্বহার। লোকদের সমস্যাবলীর কোনো সুষ্ঠু সমাধান যাতে না হতে পারে এবং তাদেরকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানোর জন্য ব্যবহার করতে পারে, সেজন্য তারা সেটাকে নিজেদের হাতে নিয়ে থাকে। এরা কৃষক শ্রমিকদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য এই আশা দিয়ে থাকে যে, দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আনতে পারলে সমন্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা ও জায়গা জমি পুঁজিপতি ও জোতদারদের নিকট থেকে নিয়ে সমাজতান্ত্রিক সরকারের মালিকানাধীন করে দেওয়া হবে। আর দেশের সকল মানুষ ঐ সরকারের মজদূর ও কৃষকে পরিণত হয়ে জীবন যাপন করতে থাকবে। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারা সমগ্র দুনিয়ার শ্রমিকদের জন্য ধর্মঘটের অধিকার দাবি করে থাকে। কিন্তু এ দুনিয়ায় যেখানেই তারা শ্রমিকগণকে এই কথা বলে ধোঁকা দিয়ে থাকে যে, সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় অধিকার দেয় এবং সেটি এমন একটি ভূস্বর্গে পরিণত হয়, যেখানে কৃষক-শ্রমিকদের আদৌ কোনোরূপ অভাব অভিযোগই থাকে না এবং তাদের ধর্মঘট করারও কোনো প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই ছেলে ভুলানো কথাগুলো সম্পূর্ণ অসম্ভব ও অবাস্তব কথা ছাড়া কিছুই নয়। যেখানে কোটি কোটি জনতা মাত্র কয়েকজন শাসকের অধীনে কাজ করতে থাকে, সেখানে কর্মকর্তাদেরও কোনো অভাব অভিযোগ সৃষ্টি হয় না এটি একটি পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কি হতে পারে?
প্রশ্ন হচ্ছে যে, যদি কোনো অভিযোগ সৃষ্টি হয় তবে কি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রমিকগণ কোনো সংঘ বা দলগত প্রতিষ্ঠান কায়েম করতে পারে? এমন কোনো স্বাধীন প্লাটফরম কি তারা পায় যেখানে তারা তাদের ফরিয়াদী কণ্ঠকে বুলন্দ করতে পারে? সেখানে কি তাদের স্বাধীন কোনো প্রেস বা পত্র-পত্রিকা থাকে যার মাধ্যমে তারা তাদের দুঃখ দুর্দশা তুলে ধরতে পারে? বরং অভিযোগের শব্দটি মুখে আনার পরও কি তারা জেলে আবদ্ধ বায়ুতে নিঃশ্বাস না ফেলে বাঁচতে পারে?
এসব কারণেই আমরা মনে করি যে, শিল্পপতি, পুঁজিপতি, জমিদার, জোতদার ও বড়ো বড়ো কল-কারখানার মালিকগণ কৃষক শ্রমিকদের সাথে যে অন্যায়-অবিচার ও জুলুম শোষণ করে যাচ্ছে তার চেয়ে অধিক কঠোর অন্যায়-অবিচার ও জুলুম শোষণের আয়োজন করছে ঐ সকল সমাজবাদী লোক যারা তাদেরকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অগ্নির ইন্ধনে পরিণত করতে চায়।
সংশোধনের নীতিমালা
পক্ষান্তরে যতক্ষণ পর্যন্ত সামাজিক সুবিচারের ইসলামি বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা চাই এই বিপদগ্রন্ত শ্রেণিটির দুঃখ দুর্দশা যথাসম্ভব দূরকরণের চেষ্টা করা। আর আমরা নিজেরা যেমন তাদেরকে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য হাতিয়ারে পরিণত করবো না, তেমনি অপর কাউকেও তা বানাতে সুযোগ দেব না।
আমরা শ্রেণি সংগ্রামের প্রবক্তা নই বরং আমরা শ্রেণিগত অনুভূতি এবং শ্রেণিগত পার্থক্যকে চিরতরে খতম করে দিতে চাই। মূলতঃ ভুল ও অপ্রাকৃতিক শাসন ব্যবস্থার ফলেই সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি সৃষ্টি হয়ে থাকে। নৈতিক দূরাচার ও ত্রুটিই তাদের মধ্যে শ্রেণিগত বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্যকে উদ্বেলিত করে এবং অন্যায় অবিচারই তাদের মধ্যে অনুভূতি সৃষ্টি করে থাকে। সমাজতন্ত্রের প্রোগ্রাম হচ্ছে শ্রেণিগত অনুভূতিকে প্রচন্ড বেগে জাগিয়ে তোলা এবং একই সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া। আর জায়গীরদারী ও পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে তদস্থলে তার চেয়ে আরও অধিক নিকৃষ্ট জালেমী সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা। আমরা এর বিপরীত মানব সমাজকে একটি দেহের বিভিন্ন অঙ্গরূপে মনে করে থাকি। একটি দেহে যেমন বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে এবং তার কাজও বিভিন্ন হয়। কিন্তু হাতের সাথে পদযুগলের, মস্তিষ্কের সাথে হৃৎপিন্ডের কোনো দ্বন্দ্ব সংঘাত থাকে না। বরং এদের সকলের নিজ নিজ স্থানে নিজ নিজ কাজ করে যাওয়া এবং একে অপরের সাহায্যকারী হয়ে থাকার মধ্যেই যেমন দেহের সঞ্জীবিত থাকা নির্ভর করে ঠিক অনুরূপভাবে আমরাও চাই যে মানব সমাজের বিভিন্ন অংশ তাদের নিজ নিজ স্থানে নিজ নিজ প্রকৃতিগত ও অভিজ্ঞতালব্ধ যোগ্যতা ও ক্ষমতা দ্বারা কাজ করে একে অপরের সাহায্যকারী, দরদী ও বন্ধু হয়ে থাকবে। আর তাদের মধ্যে শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব ও বাদবিসম্বাদতো দূরের কথা শ্রেণিগত অনুভূতি ও শ্রেণিগত পার্থক্য সৃষ্টি হতে পারবে না।
আমরা চাই যে, মালিক শ্রমিক নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষই নিজ নিজ অধিকারের কথা বলার পূর্বে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হোক এবং যথাযথরূপে তা সম্পাদন করার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করুক। সমাজের মানুষের মধ্যে দায়িত্ব কর্তব্যের অনুভূতি যতটা বেশি পরিমাণে জাগ্রত থাকবে, সমাজ থেকে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, শ্রেণিগত সংগ্রাম প্রভৃতি ততোটাই বিলুপ্ত হবে এবং বিপদ আপদ দুঃখ দৈন্য কম হতে থাকবে। আর আমরা এটাই চাই যে, মানুষের মধ্যে নৈতিক অনুভূতিকে জাগ্রত করা হোক এবং চরিত্রবান মানুষগুলোর উপর যে জালেম পাষণ্ডদের প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে তা থেকে তাদেরকে পরিত্রাণ দেওয়া হোক। মানুষের ভেতরগত এই নৈতিক মানুষটি যদি জালেম পাষণ্ডদের প্রভাবমুক্ত হয়ে সঠিকভাবে কাজে লেগে যায়, তবে সমাজ দেহ হতে অন্যায় দূরাচারই কেবল দূর হবে তাই নয় বরং তার মূল প্রবাহমান উৎসটিও ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে যেতে থাকবে। আমাদের মধ্যে সমাজ সংস্কারকদেরকে যুগপৎ সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সংস্কারের জন্যও কাজ করতে হবে এবং সাথে সাথে শ্রম গ্রহণকারী ও শ্রম বিনিয়োগকারী উভয়কেই পথ প্রদর্শন করতে হবে।
শ্রম গ্রহণকারীদেরকে আমরা বলতে চাই যে, আপনারা যদি নিজেদের কল্যাণ চান এবং নিজেদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে না চান, তবে সহায় সম্পদ ও ধন-দৌলত লাভের জন্য অন্ধ হয়ে যাবেন না। হারাম ও অবৈধ পথে মানুফা অর্জন করাকে বর্জন করুন। যাদের থেকে আপনারা শ্রম নিয়ে থাকেন তাদের বৈধ অধিকারকে আপনারা উপলব্ধি করুন এবং সেটা আলায় করার জন্য সচেষ্ট হোন। আর দেশের উন্নতির সমন্ত লভ্যাংশ নিজেদের জন্য আঁকড়িয়ে না রেখে, সেই জাতির সাধারণ জনগণ পর্যন্ত তা পৌঁছে দিন, যাদের সামগ্রিক চেষ্টা তদবীর এবং সামগ্রিক উপায় উপকরণ দ্বারা এই উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ সম্ভব হয়েছে। ধন-সম্পদ কেবল পুঁজির দ্বারাই সৃষ্টি হয় না বরং এর সাথে যখন সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা, বিষয়াগত ক্ষমতা, দক্ষতা এবং দৈহিক শ্রম সম্মিলিত হয়ে কাজ করে কেবল তখনই মুনাফা লাভ হয়, যাকে আমরা ধনসম্পদ নামে আখ্যায়িত করে থাকি। আর এই ধনসম্পদ লাভের বেলায় সমাজের সেই পূর্ণ সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনাটিও সাহায্যকারী ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে যাকে আমরা রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা বলে থাকি। এই মুনাফার সম্পদকে বদি ইনসাফ ও সুবিচারের সাথে সমন্ত উৎপাদনীয় উপায় উপকরণসমূহের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয় এবং ইসলাম কর্তৃক নিষিদ্ধকৃত পন্থাগুলো বর্জন করে চলা হয়, তবে সেই সকল ধ্বংসাত্মক আন্দোলন সৃষ্টি হবার সুযোগ কখনো হবে না, পরিশেষে যা নিজেদের ধ্বংসের কারণ হয়ে থাকে। আর শ্রমজীবী ভাইদেরকে আমরা বলতে চাই যে ইনসাফ ও সুবিচারের দৃষ্টিতে আপনাদের বৈধ অধিকার ও দাবি কতটুকু হতে পারে তা আপনারা নিজেরাই বিচার বিবেচনা করুন। আর পুঁজি বিনিয়োগকারীগণের সাংগঠনিক ও কারবারী যোগ্যতা ব্যয়কারীগণের এবং বিষয়গত কর্মদক্ষতা ব্যবহারকারীগণের সেই মুনাফার সম্পদে কতটুকু বৈধ অংশ থাকতে পারে যা আপনাদের সাথে মিলিত ও সংযোজিত হবার ফলে সৃষ্টি হয় তাহাও বিচার বিবেচনা করুন। আপনাদের কখনোই নিজেদের অত্যধিক অধিকার ও দাবি-দাওয়ার এমন ধ্যান-ধারণা গ্রহণ করা উচিত নয় যা শ্রেণি সংগ্রাম সৃষ্টিকারী লোকেরা আপনাদের কাছে পেশ করে থাকে। আর আপনাদের বৈধ অধিকার ও দাবি-দাওয়ার জন্য যে কোনো আন্দোলন প্রচেষ্টা হোক না কেন সেটাও বৈধ উপকরণ দ্বারা হওয়া উচিত। এমতাবস্থায় প্রত্যেকটি ন্যায়বাদী লোকের দায়িত্ব হলো আপনাদের আন্দোলনকে সর্ববিধ সহায়তা দান করা। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্গঠনে আমাদের প্রভাবিত পরিকল্পনাগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ;
এক. সম্পদ উপার্জনের যে সব পথকে ইসলামি শরিয়ত নিষিদ্ধ করে দিয়েছে যেমন সুদ, ঘুষ, জুয়া ইত্যাদি সবই আইনত: নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। আর শরিয়ত অনুমোদিত আয় উপার্জনের সকল পথ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। শুধু এই কর্মপন্থায়ই পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার মূলোৎপাটন সম্ভব এবং জনগণের জন্য অপরিহার্য স্বাধীন অর্থ ব্যবস্থা বেঁচে থাকতে পারে।
দুই. এখন পর্যন্ত অবৈধ ও হারাম পন্থায় এবং একটি সমাজ বিধ্বংসী অর্থ ব্যবস্থার ভুল কর্মপন্থার ফলে ধন-সম্পদ অগাধ পরিমাণে যে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে, তার মূলোচ্ছেদের জন্য ইসলামি নীতিমালা মাফিক সেই সকল লোকদের থেকে কঠোরভাবে হিসেব নিকেশ হওয়া, আর এরা যা কিছু অবৈধ উপায়ে অর্জন করেছে তা তাদের থেকে ছিনিয়ে আনা।
তিন. দীর্ঘদিন যাবত কৃষিজ সহায়-সম্পত্তির ক্ষেত্রে অব্যবস্থা প্রচলিত থাকার ফলে সমাজে যে ভারসাম্যহীনতা, অসমতা ও বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, তা চিরতরে খতম করার জন্য শরীয়তের এই নীতিটিকে অনুসরণ করতে হবে যে, “অসাধারণ অবস্থায় এমন অসাধারণ সংস্কারী কর্মপন্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, যা ইসলামি নীতিমালার সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে না।” এ নীতিটিরও প্রতি লক্ষ্য রেখে-
ক) সেই সকল নতুন পুরাতন জায়গীরদারীকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করতে হবে যা কোনো এক শাসনামলে অধিকারের অবৈধ ব্যবহার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। কেননা এই সম্পদের উপর তাদের আঁালিকানা স্বত্ব শরিয়ত অনুযায়ী হয়নি।
খ) পুরানো সহায় সম্পদের ক্ষেত্রে ভূমির মালিকানাকে বিশেষ একটি সীমারেখা পর্যন্ত সীমায়িত করে দিতে হবে। এই সীমিতকরণ ব্যবস্থা শুধু পূর্বেকার বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণের জন্য একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা রূপে করতে হবে। এটাকে কোনোক্রমেই স্থায়ী নীতির মর্যাদা দেওয়া যাবে না। কেননা এই সীমিতকরণ নীতিকে স্থায়ী রূপ দান করা হলে শুধু ইসলামের উত্তরাধিকারী আইনের সাথেই নয় বরং বিভিন্ন অপরাপর শরিয়তী আইনের সাথেও সংঘর্ষশীল হয়ে পড়বে।
গ) সকল শ্রেণির জমি চাই তা সরকারি মালিকানায় হোক বা উল্লেখিত উভয় পন্থায় প্রাপ্ত হোক অথবা নামপত্তন দ্বারা চাষাবাদের যোগ্য হোক না কেন, তার বেলায় এই নীতি নির্ধারণ করতে হবে যে, তা ভূমিহীন কৃষক বা অর্থনৈতিক সীমারেখার চেয়ে কম জমির মালিক কৃষকগণের নিকট সহজ কিস্তিতে বিক্রয় করে দিতে হবে। সরকারি চাকরিজীবী বা নেতৃবৃন্দকে সন্তাদামে দেওয়া বা দান করে দেওয়ার তরীকাকে বন্ধ করে দিতে হবে। আর যাদেরকে এইভাবে জমি দেওয়া হয়েছে তাদের থেকে তা ফেরত আনতে হবে। এছাড়া নিলামের সাহায্যে বিক্রয় করার প্রথাকেও বর্জন করতে হবে।
ঘ) বর্গাভাগে বা যৌথ অংশীদারের ভিত্তিতে চাষাবাদ করার ইসলামি আইনগুলোকে কঠোরতার সাথে অনুসরণ করতে হবে। আর ভূমির মালিকানা যাতে করে জোর জুলুম ও শোষণের রূপাকৃতি গ্রহণ করতে না পারে সেজন্য আইনগতরূপে সমস্ত অনৈসলামিক প্রথা ও কর্মপন্থা বন্ধ করে দিতে হবে।
চার. বেতন ও মজুরির ক্ষেত্রে বর্তমানে যে এক হতে একশত অংকের চেয়েও বেশি পার্থক্য বিরাজমান রয়েছে, তা কম করে আপাতত; এক হতে বিশেষ পার্থক্যের মধ্যে আনতে হবে এবং পরে ক্রমিক পর্যায়ে এক হতে উদ্ধে দশের অংকে নিয়ে আসতে হবে। এছাড়া বর্তমান যুগের দ্রব্যমূল্যের অনুপাতে একটি পরিবারের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্য যে বেতন ভাতা একান্ত অপরিহার্য, সেই সীমারেখার চেয়ে কম বেতন ভাতা হতে পারবে না বলে নির্ধারণ করে দিতে হবে। আর বাজার দরের সর্বনিম্ন গতির পরিপ্রেক্ষিতে এই সর্বনিম্ন সীমারেখা মাঝে মাঝে পরিবর্তন পরিবর্ধন করতে হবে।
পাঁচ. কম বেতনভুক্ত কর্মচারীদেরকে বাসস্থান, চিকিৎসা ও তাদের শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে যথোপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
ছয়. সমস্ত শিল্প কারখানার শ্রমিকগণকে বেতনের উপরিউক্ত সর্বনিম্ন সীমা ছাড়াও বাৎসরিক বোনাস দিতে হবে। আর যে সম্পদ সৃষ্টির পেছনে শ্রমিকদের মেহনত কার্যকরি রয়েছে, শ্রমিকগণ যাতে করে উক্ত শিল্প কারখানার উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য আন্তরিকভাবে আগ্রহান্বিত ও অনুরিত হয় সেজন্য বোনাস শেয়ার দ্বারা ঐ সকল শিল্প কারখানার মুনাফায় তাদেরকে অংশীদার বানাতে হবে।
সাত, বর্তমান প্রচলিত শ্রম আইনকে পরিবর্তন করে এমন সুবিচারমূলক আইনে পরিণত করতে হবে যার দ্বারা পুঁজি ও শ্রমের সংঘর্ষকে সত্যিকার রূপে সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল করে তোলে এবং শ্রমজীবী শ্রেণিটিকে তাদের যুক্তিযুক্ত বৈধ অধিকার আদায় করে দিতে সক্ষম হয়। আর তা ঝগড়া ফাসাদ ও দ্বন্দ্ব অবস্থায় এমন সন্তোষজনক কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে যা সঠিকরূপে ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়।
আট. দেশের আইন-কানুন এবং সংগঠন ও ব্যবস্থাপনামূলক কর্মপদ্ধতিতে এমন সংশোধন ও পরিবর্তন আনতে হবে যাতে, শিল্পকারখানা ও ব্যবসা বাণিজ্যের উপর থেকে গুটিকয়েক লোকের প্রভাব খতম হয়ে যায় এবং সমাজের সর্বাধিক সংখ্যক লোকেরা তার মালিকানায় ও মুনাফায় অংশীদার হতে পারে। এ ছাড়া আইন-কানুন ও কর্মপদ্ধতিগুলোর সেই সব দোষত্রুটি বিদূরিত করতে হবে যার সাহায্যে অবৈধ মুনাফা অর্জন করা হয় এবং যা কৃত্রিমরূপে অর্থনৈতিক মন্দা ও দুষ্প্রাপ্যতা সৃষ্টি ও সমৃদ্ধির ফল সাধারণ মানুষের দ্বারে পৌঁছতে দেয় না।
নয়. যে সব শিল্প কারখানা খুব বিরাট ও মৌলিক গুরুত্বের অধিকারী এবং বেগুলো ব্যক্তি ম্যালিকানায় বা গোষ্ঠী মালিকানায় পরিচালিত হওয়া সামাজিক স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকারক সেগুলো জাতীয় ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই পরিচালিত হতে হবে। আর কোনো কোনো শিল্পকারখানা জাতীয় ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে তা এমন একটি প্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় সংসদ নির্ধারণ করবে, যে সংসদ নির্বাচিত হয়েছে জনগণের সাধারণ রায় দ্বারা। আর এইসব শিল্পকারখানা যাতে করে আমলাতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক দোষত্রুটির শিকারে পরিণত হয়ে জাতীয় ব্যবস্থাধীনে পরিচালিত হবার উপকারিতা লাভের পরিবর্তে উল্টো ক্ষতির কারণে পরিণত না হয় সে বিষয়েও মীমাংসিত হয়ে পূর্ণরূপে নিশ্চিত হতে হবে।
দশ. ইহুদি সম্প্রদায়ের মন মস্তিষ্ক নিংড়ানো যেই ব্যাংক ও জীবন বীমা ব্যবস্থাটির অন্ধ অনুকরণ আমাদের দেশে চলছে পূর্ণ ব্যবস্থাপনাটি সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে ইসলামের অংশীদারী (শেরকত ও মোজারেবাত) ও পারস্পরিক সাহায্য সহানুভূতির নীতি মাফিক ঢালাই করে আপাদমস্তক নতুনভাবে সংস্কার ও পুনর্গঠন করতে হবে। তা যদি জাতীয় মালিকানাধীনেও নিয়ে যাওয়া হয়, তথাপিও এই মৌলিক সংস্কার ব্যতিরেকে এর মানবতাবিধ্বংসী দোষত্রুটি ও অনিষ্টতা কোনোক্রমেই বিদূরীত হবে না।
এগার. যাকাতকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আদায় ও বণ্টন করার ব্যবস্থা করে জনসাধারণকে প্রতিপালনের সেই ইসলামি পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে হবে যার চেয়ে সামাজিক নিরাপত্তার উত্তম কোনো পরিকল্পনা আজ পর্যন্ত কোনো জীবন বিধান ও রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা পেশ করতে সক্ষম হয়নি। আর এই একটিই মাত্র নিশ্চিত উপায় আছে যার দ্বারা দেশের কোনো একটি লোকও খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ হতে বঞ্চিত থাকতে পারে না।
বার. আমাদের একথা সম্যক উপলব্ধি করতে হবে যে, অর্থনৈতিক সমস্যাই মানব জীবনের আসল ও একমাত্র নয়। বরং এ সমস্যা জীবনের অপরাপর সমস্যার সাথে সুগভীরভাবে সম্পর্কশীল। ইসলামি আদর্শ ও বিধান মাফিক যখন পর্যন্ত চরিত্র, নৈতিকতা, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি, রাজনীতি, আইন-কানুন ও শাসন ব্যবস্থার সমগ্র শাখা-প্রশাখার সর্বাঙ্গীন সংস্কার না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত শুধু অর্থনৈতিক সংস্কারের কোনো পরিকল্পনাই সফলতার সোপানে আরোহণ করতে পারে না এবং তার দ্বারা উপকারও সাধিত হতে পারে না।
শ্রেণি ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব
আজকাল শ্রেণি ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের একটা চমকপ্রদ রাজনৈতিক শ্লোগান উঠেছে যে সংসদে শ্রেণি ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। তা হলে সকল শ্রেণি তাদের অধিকার পাবে। কিন্তু এটা শ্রমিকদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য সমাজতন্ত্রীদের “শ্রমিকরাজ” কায়েমের শ্লোগানের মত চমকপ্রদ শ্লোগান কি না তা বুঝা যাবে এ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে মাওলানা মওদূদী (রহ.) এর নিম্নোক্ত অনুধাবন করে।
মাওলানা মওদূদী (রহ.) বলেন, এটা সেই শ্রেণি বিভাজনের ধারণা, যার ধ্বনি সমাজতন্ত্রীরা তুলে থাকে। সত্যিকার অর্থে যদি শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বের দাবি সমর্থন করা হয়, তাহলে সকল স্তরের মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিনিধিত্ব না দেওয়া পর্যন্ত ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। একথার কি নিশ্চয়তা আছে যে, শ্রেণিভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে লোক নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসবে এবং তারা শ্রেণি সুবিধার উর্ধ্বে থেকে জাতির সামগ্রিক কল্যাণে কাজ করবে? একথারও কোনো নিশ্চয়তা নেই যে, তারা নিজ পক্ষের সঙ্গে বিশ্বস্ততার হক আদায় করবে এবং সংসর্গে এসে কোনো বিকি-কিনির অভিযোগে অভিযুক্ত হবে না। সুতরাং শ্রেণিভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধন করবে না। শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বের দ্বারা যদি সংসদে শ্রমিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া এবং সংসদে তাদের বক্তব্য পেশ করার অধিকার বুঝানো হয়ে থাকে, তবে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে এটা যথার্থভাবেই অর্জিত হবে। প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে যে সাধারণ নির্বাচন হয় সেখানে তো দরিদ্র শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব এসে যায়। আমাদের জনগণ এমন বিবেক বিক্রেতা নয় যে, গুটিকয়েক মুদ্রার বিনিময়ে স্বীয় মতামত বিক্রির পথ বেছে নেবে। প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে যদি এর আগে সাধারণ নির্বাচন হতো, তবে আপনি বুঝতে পারতেন যে, জনগণ কাদের নির্বাচিত করতো। প্রথমবার জনগণ প্রতারণার শিকার হলে, দ্বিতীয়বার অবশ্যই তারা যোগ্য ব্যক্তিকেই নির্বাচিত করবে। তৃতীয়বার আরও অধিক যোগ্য ব্যক্তির আশা করা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এমনটি হয়নি। এখন আমরা নতুন করে এ অভিজ্ঞতা অর্জন করবো।
অজ্ঞতাবশত যদি আমরা সমাজকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করে ফেলি তবে আমাদের মাঝে প্রচণ্ড সংঘাতের সৃষ্টি হবে এবং একক জাতিসত্ত্বার অনুভূতি সম্পূর্ণরূপে বিদূরিত হবে। যারা শ্রেণিভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন উত্থাপন করে, তারা প্রকৃতপক্ষে এরকম সংঘাতেরই সৃষ্টি করতে চায়। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, ঈমানদার এবং আল্লাহভীরু লোক নির্বাচিত হয়ে আসুন। তাদের দ্বারা কোনো শ্রেণির শঙ্কিত হওয়ার কারণ থাকবে না। তারা সকল স্তরের মানুষের কল্যাণ এবং জাতির সামগ্রিক স্বার্থেই কাজ করবে।
শ্রমিক কর্মচারীদের প্রতি মাওলানা মওদূদীর (রহ.) উপদেশ
পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের মাঝে যে নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি করেছে, সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, মানুষ নিজের অধিকারের কথা মনে রাখে কিন্তু কর্তব্যের কথা ভুলে যায়। আমি আপনাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, আপনারা আপনাদের অধিকারের পাশাপাশি নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ থাকবেন এবং যে কাজের বিনিময়ে আপনারা পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন, তা যথাযথভাবে সম্পন্ন করবেন। একইভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনাদের উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, তাও পূরণ করবেন। আমাদের দেশে যে শ্রমিক আন্দোলন চলছে, তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, তারা শ্রমিকদের নৈতিক চরিত্র গঠনের প্রতি কোনো গুরুত্ব দেয় না। আপনারা সেই শ্রমিক আন্দোলনগুলোকেই সফল করে তুলবেন, যারা নৈতিক চরিত্র গঠনেরও উদ্যোগ নেয়।
শ্রমিকদের মধ্যে সিনেমা দেখা এবং মাদকদ্রব্য ব্যবহারের প্রবণতাও দেখা দিয়েছে। এসব তাদের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। যদি তাদের বেতন বৃদ্ধিও পায় কিন্তু স্বভাব ঠিক না হয়, তবে অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।
তৃতীয় অধ্যায় : ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা
ইসলামের পূর্বে দাস শ্রমিকদের অবস্থা
ইসলামের পূর্বে রোমান সভ্যতা ছিল সকলের কাছে পরিচিত। আজকের ইউরোপিয়ান দেশগুলো রোমান সভ্যতার উত্তরসূরি বলে দাবি করছে। তখন রোমে দাস শ্রমিকদের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। রোম সাম্রাজ্যে দাসকে নিছক পণ্য রূপে গণ্য করা হতো, মানুষ রূপে নয়। হাটে-বাজারে গরু-ছাগলের মত দাসদেরকে ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। মনিবের দাসত্ব করাই ছিল তাদের জীবনের একমাত্র ব্রত, কিন্তু সেখানে দাসদের সামান্যতম অধিকারও স্বীকার করা হয়নি।
মাঠে কাজ করার সময় তাদের পায়ে ভারি শিকল বেঁধে দেওয়া হতো যাতে পালিয়ে যেতে না পারে। তাদেরকে কখনও পর্যাপ্ত খানা দেওয়া হতো না। যতটুকু তাদের জীবিত ও পরিশ্রমের উপযোগী রাখার জন্য প্রয়োজন, শুধু ততটুকু খাবারই তাদের দেওয়া হতো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শুধুমাত্র বন্য আনন্দ লাভের জন্যই তাদের পিঠে চাবুক মারা হতো আর তা দেখে প্রভু ও তার সঙ্গীরা আনন্দ উপভোগ করতো। দিনের শেষে দশ থেকে পঞ্চাশ জনের এক একটি দলকে শেকল লাগানো অবস্থায় অন্ধকার ঘরে ঘুমানোর জন্য রাখা হতো। আর দাস রাখার ঘরের অবস্থা ছিল ক্ষুদ্র, দুর্গন্ধময়, ইঁদুর ও পোকা মাকড়ের উৎপাতে ভরা। অন্যদিকে ছিল পেশাব পায়খানায় ভরপুর। গরু বাছুর তাদের গোয়ালে যতটুকু প্রশন্ত জায়গা ও নিম্নতম আরাম পেত দাসদেরকে সেটুকুও দেওয়া হতো না।
দাসদের প্রতি রোমান মনোভাবের সব চেয়ে কদর্য ও লোমহর্ষক দিক তাদের অতিপ্রিয় অবসর বিনোদনের মধ্যে ধরা পড়ে। তলোয়ার ও বর্শা হাতে ‘দাসদেরকে প্রভুদের আঙ্গিনায় নিয়ে যাওয়া হতো এবং একজনকে অপরজনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লাগিয়ে দেওয়া হতো। প্রভুরা সুউচ্চ আসনে বসে এ অমানবিক খেলা উপভোগ করতো। স্বয়ং সম্রাট তার অবসর বিনোদন হিসেবে এ মারাত্মক অমানবিক খেলা উপভোগ করতো। খেলা চরম আকার ধারণ করলে যোদ্ধাদের কেউ কোনো দাস ভাইকে হত্যা করে রক্ত প্রবাহিত করে দিত এবং ঠান্ডা ও নির্জীব করে মাটিতে নিক্ষেপ করে দিত। তখন প্রচণ্ড হাততালি ও উচ্চ হাকডাক, অট্টহাসি ও আনন্দ উৎফুল্লতা দ্বারা হত্যাকারীকে বাহবা জানানো হতো।
প্রভুরা দাসদেরকে নির্দয় ভাবে হত্যা, দণ্ডদান ও শোষণ শাসন করার একক অধিকার লাভ করেছিল। অথচ এ ব্যাপারে দাসদের কোনো মহল থেকে নৈতিক সম্মান আশা করতে পারত না। পারস্য, ভারত ও অন্যান্য দেশেও দাসদের অবস্থা এর চেয়ে ভালো ছিল না। ছোটখাটো পার্থক্যের কথা বাদ দিলে সব দেশেই দাসদের অবস্থা একইরূপ ছিল। দাসদের জীবনের না ছিল কোনো মূল্য এবং না ছিল তাদের কোনো সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা। দাসদের প্রতি তাদের নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা সর্বত্রই সমানভাবে দেখা যেত।
ভারতবর্ষে মনে করা হতো সর্বপ্রকার অবমাননা সহ্য করার জন্যই দাসদের জন্ম। এ কারণেই তাদেরকে হত্যা, দণ্ডাদেশ, খোজা করে দেওয়া বা তাদের প্রতি অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ চাপিয়ে দেওয়া কখনও প্রভুদের বিবেক দংশন করতো না। ভারতের হিন্দুরা বিশ্বাস করতো যে, দাসেরা (শুদ্ররা) ভগবানের পা থেকে উদ্ভুত। সুতরাং তারা জন্মগত ভাবেই নিচ, ঘৃণ্য এবং তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনের চেষ্টা করার অধিকার নেই। তাদের জন্য একটি পথই খোলা আছে যে, ধৈর্য সহকারে তারা এ অবমাননার, লাঞ্ছনার জীবন সহ্য করবে, যাতে মৃত্যুর পর তাদের আত্মা কোনো শ্রেষ্ঠতর জীবের মধ্যে প্রবেশ করে পুনঃজন্ম লাভ করবে। সুতরাং তাদের ওপর অত্যাচারীরা চরম নির্যাতন চালানোর পরেও তারা অসন্তুষ্ট হতে পারে না। যে অন্যায় সমাজ ব্যবস্থার ফলে দাসদের এ করুণ অবস্থা ও অমর্যাদা দেখা দিয়েছে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কোনো অধিকার তাদের ছিল না।
পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা
পুঁজিবাদী সমাজে ধনীক শ্রেণির লোকেরাই হচ্ছে গোটা দেশের ও জনগণের মালিক। আর শ্রমিক সমাজ সেখানে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মেশিন চালানোর জন্য যতটুকু তেল দেওয়া প্রয়োজন, ঠিক মেহনতি মানুষকে বাঁচিয়ে রেখে তাদের দাসত্ব নেওয়ার জন্য যতটুকু খাদ্য দেওয়া প্রয়োজন তাই দিচ্ছে। সে সমাজে এমন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে যে, একজন শ্রমিক মৃত্যু পর্যন্ত মেহনত করেও যেন সমাজে ধনী হবার সুযোগ লাভকরতে না পারে। বরং ধনী ও মালিকদের খেদমত করার জন্য যেন শ্রমিকদের উত্তরসূরিরাও প্রস্তুত থাকে। তাই এমনভাবে বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে শ্রমিকের অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানকে লেখাপড়া ত্যাগ করে পিতার সাথে একই মালিকের কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হতে হয়। একজন শ্রমিক তার যৌবনের সব শক্তি নিয়োগ করে মালিকের কাজ করে একটি মিলের পরিবর্তে দশটি মিলের মালিক বানিয়ে দিয়ে যখন যৌবন হারিয়ে বার্ধক্যে পৌঁছে, তখন সে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে রাস্তায় বের হয় আর খাদ্যের অভাবে শৃগাল-কুকুরের সাথে রাস্তায় মৃত্যু বরণ করে। শ্রমিকদের শ্রমে অর্জিত মুনাফার উপর পুঁজিবাদী সমাজ বেঁচে আছে, অথচ তাদেরকে সে সমাজে ঘৃণা করা হচ্ছে। পুঁজিবাদের সমর্থক ম্যানডেভিল তার বই ‘ফিবল অব দি বিজ’ এ লিখেছেন, গরিব ও অসহায় লোকদের থেকে কাজ নেওয়ার একমাত্র উপায় হলো তাদেরকে গরিব থাকতে দাও এবং সব সময় তাদেরকে পরনির্ভরশীল করে তোল। এদের যা প্রয়োজন তা কিঞ্চিত পূরণ কর। শ্রমজীবী মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলা আত্মঘাতী পদক্ষেপ বৈ কিছুই নয়। বিখ্যাত পুঁজিবাদী রবার্ট ওয়ান তার নিউলানার্ক কারখানার শ্রমিকদের অবস্থা দেখে মন্তব্য করেছিলেন, এরা আমার দাস। এদের জীবনের সব কিছু আমার উপর নির্ভরশীল।
উল্লেখিত দৃষ্টান্ত থেকে পুঁজিবাদী সমাজের কুৎসিত চেহারা প্রকাশ পায়। সেখানে অসহায় মানুষ ধনীদের দাসে পরিণত হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষ তাদের নিকট এক চরম ঘৃণিত জীব।
সমাজতান্ত্রিক সমাজে মেহনতি মানুষের অবস্থা
সমাজতান্ত্রিক দেশে শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার পর শ্রমিক নেতা ও সমাজতান্ত্রিক ক্ষমতাশীন নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলা, মিছিল করা, সংগঠন করা, মিটিং করা, পোস্টার লিখা, হরতাল করা সম্পূর্ণ বেআইনি ঘোষণা করা হল। কোনো শ্রমিক যদি এসব কাজে অংশগ্রহণ করে তাহলে তার জন্য মৃত্যুর সংবাদ শুনানো হয়। পুঁজিবাদী দেশে ব্যক্তি মালিকানা ছিল। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা ও আন্দোলন করার অধিকার ছিল। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশে সব কিছুর মালিক হল রাষ্ট্র। তাই, রাষ্ট্র শ্রমিকদেরকে যেভাবে পরিচালিত করে তারা সেভাবে চলতে বাধ্য, অন্যথায় মৃত্যুই তাদের একমাত্র পথ। সেখানে সমাজতান্ত্রিক নেতারা পুঁজিবাদী দেশের ধনীদের চেয়ে লক্ষগুণ বেশি আরাম আয়েশে বসবাস করেছে। কারণ, দেশের সকলের সম্পদ লুন্ঠন করে মাত্র মুষ্টিমেয় লোক তার মালিক হয়ে বসেছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানা।
সমাজতান্ত্রিক দেশে শ্রমিকদের মর্যাদার বর্ণনা দিতে গিয়ে ভারতের ওয়ারকার্স ডেলিগেশনের সদস্য বজ্র কিশোর তার চীন সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, চীনে আমরা হালের সঙ্গে গরুর পরিবর্তে মেয়ে লোক বাধা দেখেছি। (ইসলামি সমাজে মজুরের অধিকার-মাওলানা আবদুর রহীম)।
সমাজতন্ত্রের সমর্থক প্রখ্যাত রুশ লেখক ড. একনড বলেন- “আমাদের দেশের মিল-কারখানার উৎপাদন এক বিরাট কয়েদি বাহিনীর উপর নির্ভরশীল।” (ইশতাবাকিয়া রুশ কি তাজরাবানাহ)।
উল্লেখিত দৃষ্টান্তের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যায়, সমাজতান্ত্রিক দেশে মেহনতি মানুষের মর্যাদা পশুর চেয়ে বেশি কিছু নয়। আর তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা একজন জেলখানার কয়েদির চেয়ে বেশি নয়। মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য রাশিয়ায় যে বিপ্লব হয়েছিল সে সম্পর্কে রাশিয়ার সাহিত্যিক নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী সোলঝিনিৎসিন বলেন- “১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে লেনিনের নেতৃত্বে যে বিপ্লব হয়েছিল তা আসলে বিপ্লব নয়, নিছক স্বশস্ত্র অভ্যুত্থান।”
তিনি লেনিন সম্পর্কে বলেন- “লেনিনের হৃদয়ে দয়া মায়ার নাম গন্ধ ছিল না, জনগণের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ অমানবিক। তিনি তার বিরোধী দলের লোকদেরকে ঘৃণা করতেন। মন্দ বলতে দৈনন্দিন জীবনে যা বুঝায় লেলিন ছিল তাই।”
লেলিন সম্পর্কে প্রখ্যাত দার্শনিক বার্টান্ড রাসেল বলেন- “আমার জীবনে যত লোকের সাথে দেখা হয়েছে তাদের মধ্যে লেলিন সব চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।”
এমন একজন নিষ্ঠুর হৃদয়হীন, নীতি বিবর্জিত নেতা কী কোনো দিন মানব জাতির কল্যাণ করতে পারেন? এমন একজন নেতা থেকে যিনি কল্যাণের আশা করেন তিনি বিবেকহীন ও ভ্রান্ত। তাই, রাশিয়ায় মেহনতি মানুষের বিপ্লবের নামে লেলিন শ্রমজীবী মানুষের সবটুকু স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ করে দেশটাকে একটা জেলখানায় পরিণত করে গেছেন।
বার্টান্ড রাসেল বলেছেন- “পাশ্চাত্য দেশ শাসিত হচ্ছে পুঁজিপতি শাসক দ্বারা আর সমাজতান্ত্রিক দেশের জনগণ শাসিত হচ্ছে সামরিক জান্তা দ্বারা।”
সমাজতান্ত্রিক দেশের সাধারণ মানুষ ও শ্রমজীবী মানুষ সমাজতন্ত্রের অভিশাপ থেকে বাঁচতে চায়। তাই সারা বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র উৎখাতের আন্দোলন চলছে। যে শ্রমজীবী মানুষ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ছিল, তারাই সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিয়ে জাতিকে মুক্ত করতে চায়। তাই সমাজতন্ত্রের জন্ম ভূমি রাশিয়া থেকে সমাজতন্ত্রকে চির বিদায় করে দিয়েছে। সমাজতন্ত্রের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে সাধারণ মানুষ ও মেহনতি মানুষ।
আধুনিক যুগে শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদার স্বীকৃতি আছে কি?
আমরা বিংশ শতাব্দর চরম উন্নতির যুগে বসবাস করছি। মানুষ যখন রকেটের সাহায্যে মহাশূন্যে ভ্রমণ করছে, মঙ্গল গ্রহে ও চাঁদে বসবাস করার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে- তখন একজন শ্রমজীবী মানুষ আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক যুগ থেকে কী পেয়েছে? বৈজ্ঞানিকের দূর পাল্লার অনুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা মহাশূন্যের হাজারো রহস্য উৎঘাটন করছে, মহাশূন্যের সূক্ষ্মতম বস্তু আবিষ্কার করছে। কিন্তু তাদের অনুবীক্ষণ যন্ত্রে মাটির পৃথিবীর অসহায় শ্রমজীবী মানুষের করুণ অবস্থা ধরা পড়েনি। মানুষ যখন মহাশূন্য যানের সাহায্যে চন্দ্রে অবতরণ করে বিজয় পতাকা উড্ডীন করছে, তখন পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। মানুষ যখন রেডিও টিভির মাধ্যমে তাদের বাণী মুহূর্তের মধ্যে সারা দুনিয়ায় পৌঁছে দিচ্ছে তখন অসহায় শ্রমজীবী মানুষের আর্তনাদ শাসক ও মালিকদের কানে পৌঁছে না। আধুনিক যুগে কুকুরের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে অথচ শ্রমজীবী মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। যে শ্রমিক দেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য বস্ত্র তৈরি করছে তার স্ত্রী ও সন্তানেরাই বস্ত্রের অভাবে লজ্জা নিবারণ করতে পারছে না। যে শ্রমিক কোটি কোটি মানুষের জন্যে ঔষধ তৈরি করছে, তার মৃত্যুর সময় মুখে দেওয়ার মত ঔষধ সে পাচ্ছে না। যে শ্রমিকের কঠোর সাধনায় মালিক একটি কারখানার পরিবর্তে দশটি কারখানা গড়ে তুলছে, খাদ্যের অভাবে সেই শ্রমিকের হাড় এবং মাংস একাকার হয়ে যাচ্ছে।
তাহলে বিংশ শতাব্দর চরম উন্নতি কি শুধু বিত্তবান শাসক এবং শোষকদের জন্য? আর অসহায় শ্রমজীবী মানুষের জন্য বরাদ্দ অভিশাপ, অবহেলা, ঘৃণা, উপহাস, শোষণ ও নির্যাতন। বিংশ শতাব্দর বৈজ্ঞানিক উন্নতি যদি মানুষের জন্য হয়ে থাকে তাহলে শ্রমজীবী কি মানুষ নয়?
শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের কথা তুললেই সম্পদের অভাবের কথা বলা হয়, তাহলে সম্পদের অভাবটা কী, শুধু শ্রমজীবী মানুষের জন্য- যাদের শ্রম ও সাধনায় আধুনিক বিশ্ব চরম উন্নতি লাভ করেছে। আধুনিক সভ্যতা ও উন্নতির প্রতিটি ধাপে রয়েছে শ্রমজীবী মানুষের অক্লান্ত শ্রম ও সাধনা। অথচ বিজ্ঞানের এ চরম উন্নতির যুগে সর্বত্রই অধীন ও মেহনতি মানুষ লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত- শোষিত ও অবহেলিত।
আধুনিক যুগের তথাকথিত সৌভাগ্যবান শাসক ও বিত্তবান লোকেরা অসহায় ও দরিদ্র লোকদের শ্রম ও সম্পদ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শোষণ করে নিজেদের সৌভাগ্য রচনা করছে। আর অধীন ও মেহনতি মানুষকে শোষণ করার নতুন নতুন পদ্ধতি ও কৌশল আবিষ্কার করছে।
শ্রমজীবী মানুষকে শোষণের জন্য কারা দায়ী?
যেসব শাসক, নেতা ও বিত্তবানদের অন্তরে আল্লাহর ভয় নেই, মৃত্যুর পরে জবাবদিহি ও শান্তির ভয় নেই, নবিদের হেদায়াত গ্রহণ করেনি এবং আল্লাহর বিধান মেনে চলে না তারাই যুগে যুগে সাধারণ মানুষ ও মেহনতি মানুষকে শাসনের নামে শোষণ করেছে। অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়েছে, অবহেলা ও ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছে। আল্লাহর আইনকে অস্বীকার করে নিজেরাই দেশের মানুষের প্রভু হয়ে বসেছে। সর্বদাই অধীনদের দুর্বল করে রাখার চেষ্টা করছে, যাতে করে তারা কোনো দিন সৌভাগ্যের অধিকারী হতে না পারে। যে সমাজ আল্লাহর আইন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না বরং দেশের কতিপয় স্বার্থান্বেষী লোক নিজেদের ইচ্ছামত আইন রচনা করে দেশ পরিচালনা করছে সে সমাজে সাধারণ মানুষ ও শ্রমজীবীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করা হচ্ছে শাসক ও নেতাদের আরাম-আয়েশের রসদ যোগানের জন্য। সে সমাজে কতিপয় লোক হচ্ছে নেতা আর সাধারণ মানুষ হচ্ছে তাদের চক্রান্তের শিকার। কতিপয় লোক হচ্ছে মালিক আর সাধারণ লোক হচ্ছে তাদের চাকর ও খাদেম। এমনিভাবে তারা সাধারণ মানুষের উপর প্রভু হয়ে বসেছে। আল্লাহর আইনকে অস্বীকার করে জুলুম ও শোষণের আইন জারী করে মানুষকে তাদের অধীনন্ত করে রেখেছে। যে খোদাদ্রোহী সমাজের নেতা ছিল ফেরাউন, নমরুদ, আবু জেহেল, আবু লাহাব ও তাদের উত্তর সূরীরা। আল্লাহ তাদের শাসনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন আল কুরআনে-
إِنَّ فِرْعَوْنَ عَلَا فِي الْأَرْضِ وَ جَعَلَ أَهْلَهَا شِيَعًا يَسْتَضْعِفُ طَائِفَةٌ مِّنْهُمْ يُذَبِّحُ أَبْنَاءَهُمْ وَيَسْتَحْيِ نِسَاءَهُمْ إِنَّهُ كَانَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ
“ফেরাউন পৃথিবীতে সীমালংঘন ও বিদ্রোহ এবং তার রাজ্যে প্রজা সাধারণকে দলে উপদলে বিভক্ত করে দিয়েছে। তাদের মধ্যে একদলকে সে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেছে। তাদের পুত্র সন্তানদেরকে সে হত্যা করতো এবং কন্যা সন্তানদেরকে জীবিত রাখত। আসলে সে শাসনের নামে রাষ্ট্রের মধ্যে বিপর্যয় ও অশান্তি সৃষ্টিকারীর ভূমিকা পালন করতো।” (সুরা কাসাস: ৪)
ফেরাউন মিশরের বাদশা ছিলো। সে নিজেই আইন তৈরি করে দেশ চালাতো তার ইচ্ছামত ও তার স্বার্থে। সে প্রজা সাধারণকে দলে উপদলে বিভক্ত করে একদলকে অন্য দলের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়েছিল। নিজের দলকে সর্বপ্রকার সুযোগ দিয়ে বিরোধী দলকে দুর্বল করার কৌশল অবলম্বন করেছিল। বিরোধী দলে যাতে লোক বৃদ্ধি না পায় সে জন্য তাদের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা করে ফেলতো। এমনভাবে শাসনের নামে দেশের মধ্যে অশান্তি, শোষণ, নির্যাতন ও হত্যার রাজনীতি প্রচলন করে নিজের দল স্থায়ী করার জন্য ব্যবস্থা করেছিল।
একটু চিন্তা করে দেখুন, আজকের সমাজ আর ফেরাউনের সমাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি? জাহেলি সমাজে শ্রমজীবী ও গোলামের সাথে আচরণের একটি করুণ অবস্থা তুলে ধরে অসহায় মানুষের নেতা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- “আমি দেখতে পাচ্ছি, নেতারা তাদেরকে (অধীনস্তদেরকে) হীন মনে করে এবং তাদের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখায় না। এটা কি করে হতে পারে? এটা কি জাহিলিয়াত যুগের হিংসা-বিদ্বেষ নয়? নিশ্চয়ই এসব আচরণ জুলুম ও অপরাধ। আমি জানি, ইসলামের পূর্বে তাদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না, পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট মনে করা হতো। এখনকার সমাজে ধনী ও নেতারা নিজদেরকে তাদের মান ও সম্মানের মালিক মনে করতো। আল্লাহর বান্দারা ভুলে গিয়েছিল যে, সকল মানুষ সমান এবং ন্যায় বিচার লাভ করার অধিকারী। সে যুগের কথাও আমার মনে আছে, যখন ধনী ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা নিজেদেরকে দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে মনে করতো এবং তাদেরকে নিষ্পাপ বলে প্রচার করতো। তারা ভাবতো যে, অধীনস্তদের জীবনের একমাত্র ব্রত হচ্ছে মালিকদের খেদমত করা এবং তাদের কৃত সকল জুলুম অত্যাচার নিরবে সহ্য করে নেওয়া। মালিকদের কাছে শ্রমজীবী মানুষের ওঠা-বসা নিষেধ ছিল। তাদের সামনে কথা বলা এবং তাদের কোনো কথা ও কাজের প্রতিবাদ করা মৃত্যুযোগ্য অপরাধ ছিল। কিন্তু ইসলাম এসে এ সকল জুলুম ও অন্যায় আচরণের মূলোৎপাটন করেছে এবং জাহিলিয়াতের সকল দাম্ভিকতার উপর কুঠার আঘাত হেনে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। (কানজুল উম্মাল)
উল্লেখিত হাদিসে বিশ্ব নেতা, শান্তির দূত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) জাহেলি যুগের অধীনন্ত ও শ্রমজীবী মানুষের সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। যে সমস্যা দেশের শাসক, নেতা ও বিত্তবান লোকেরা সৃষ্টি করেছে। যা ইসলাম বিরোধী সমাজ ব্যবস্থার অতীতে ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। নবি কারিম (সা.) মুসলিম জাতিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন- “তারা যেন অধীনস্তদের সাথে অন্যায় আচরণ করে জাহেলি যুগের পাপে লিপ্ত না হয়।” সবশেষে রাসুলে খোদা (সা.) বলেন যে, একমাত্র ইসলামি আদর্শই অধীনন্ত ও মেহনতি মানুষকে তাদের স্বাধীনতা ও অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে এবং শাসক ও মালিকদের শোষণ ও নির্যাতন থেকে মুক্ত করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে।
ইসলামের সাম্য
সকল দেশের শাসক, নেতা, ধনীরা অধীনন্ত লোকদেরকে স্বার্থের জন্য ব্যবহার করছে। কিন্তু অধীনস্ত লোকদেরকে কোনো অধিকার ও মানবিক মর্যাদা দিতে রাজী হয়নি। সবাই অধীনস্তদেরকে অসহায় অবস্থায় ত্যাগ করলেও যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তো তাদেরকে ঘৃণা করতে পারেন না। আল্লাহর আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান মর্যাদার অধিকারী। চিন্তার বিষয়, একজন ধনী ব্যক্তির দু’টো চোখ, দু’টো কান, দু’টো হাত, দু’টো পা, একটি মাথা ও এটি পেট আবার একজন অসহায় গরিব মানুষেরও তাই। ধনীও মারা যায় আবার গরিবও মারা যায়। একজন ধনী ব্যক্তির মাতার দু’টো স্তন আবার অসহায় গরীবের মাতারও দু’টো স্তন। আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের মধ্যে কত সাম্য। তাই, ইসলামের আইনে রাজা, প্রজা, ধনী, গরিব ও মালিক, শ্রমিকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আল কুরআনের ঘোষণা-
يَأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْتُكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْتُكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌه
“হে মানুষ, আমরাই তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে সৃষ্টি করেছি। অতপর তোমাদেরকে জাতি ও ভ্রাতৃগোষ্ঠী বানিয়ে দিয়েছি। যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। মূলত আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সে সর্বাধিক সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ। অবশ্যই আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সব বিষয় অবহিত।” (সুরা হুজুরাত: ১৩)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তিনটি নির্দেশ দিয়েছেন:
১. সকল মানুষের মূল এক অর্থাৎ সকল মানুষ আদমের সন্তান এবং এক আল্লাহর বান্দা।
২. বিভিন্ন জাতি ও বংশের পার্থক্য শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নয় শুধুমাত্র পরিচয়ের জন্য।
৩. শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র পথ নৈতিকতা, চরিত্র ও ন্যায়পরায়ণতা।
ইসলামের সাম্যনীতি ঘোষণা করতে গিয়ে নবি (সা.) বিদায় হজ্জে বলেন-
فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَضَكُمْ حَرَامٌ كَحُرُمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا.
“তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন সম্পদ ও মান-সম্মান সব কিছুই পরস্পরের প্রতি আজকের দিনের মত সম্মানিত ও হারাম।”
বিশেষ শ্রেণির মানুষের জন্মগত কোনো অধিকার ও বৈশিষ্ট্য ইসলাম স্বীকার করে না। একজন শ্রমজীবী মানুষ ও গোলাম তার সততা ও যোগ্যতার দ্বারা সমাজে রাষ্ট্র নায়কের পদমর্যাদা লাভ করতে পারে। এ জন্যই মানবতার ও অসহায় মানুষের শ্রেষ্ঠতম বন্ধু মুহাম্মদ (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন-
اسْمَعُوا وَأَطِيعُوا وَإِنْ اسْتُعْمِلَ حَبَشِيٌّ كَانَ رَأْسَهُ زَبِيبَةٌ (صحيح البخاري)
‘বিদঘুটে বিশ্রী চেহারার কোনো হাবশী (কালো জাত) গোলামকেও যদি তোমাদের শাসক বা নেতা নিযুক্ত করা হয়, তবুও তার কথা তোমরা মেনে চল। (বুখারি)
মানুষের আইন ভ্রান্ত ও পক্ষপাত দুষ্ট। আল্লাহর আইন সকল মানুষকে একত্রিত করতে চায় ঈমানের ভিত্তিতে আর মানুষের আইন মানুষকে সর্বদা বিভক্তি করে রাখতে চায়। মানব রচিত আইনের মধ্যেই রয়েছে বড়ো-ছোট, উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, শাসক-শাসিত, রাজা-প্রজা ও সাদা-কালো পার্থক্য। ইসলামি সমাজে কারো মর্যাদা বেশি নেই। নবি কারিম (সা.) ঘোষণা করেছেন- “কেউ যদি তার দাসকে হত্যা করে আমরা তাকে ত্যাগ করবো। কেউ তার নাক কেটে দিলে আমরাও তার নাক কেটে নিব। কেউ তাকে খোজা করে দিলে আমরাও তাকে খোজা করে দিব। (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি)
بَابُ هَلْ يَقُولُ : سَيِّدِي؟ حَدَّثَنَا حَجَّاجُ بْنُ مِنْهَالٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ، عَنْ أَيُّوبَ، وَحَبِيبٍ، وَهِشَامٍ، عَنْ مُحَمَّدٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ. عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ: لَا يَقُولَنَّ أَحَدُكُمْ : عَبْدِي وَأَمَتِي. وَلا يَقُولَنَّ الْمَمْلُوكُ : رَبِّي وَرَبَّتِي، وَلْيَقُلْ: فَتَايَ وَفَتَاتِي، وَسَيِّدِي وَسَيِّدَتِي، كُلُّكُمْ مَمْلُوكُونَ، وَالرَّبُّ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ.
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে ফরমাইয়াছেন: তোমাদিগকে কেউ যেন “আমার দাস”, “আমার দাসী” না বলে, কেননা, তোমরা সকলেই আল্লাহর দাস এবং তোমাদের মহিলারাও আল্লাহর দাসী, বরং বলিবে “আমার গোলাম”, “আমার বাদী”, আমার বালক”, “আমার বালিকা”। (আল-আদাবুল মুফরাদ-২০৯)
عَنْ أَنَسٍ وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْخَلْقُ عَيَالُ اللَّهِ فَأَحَبُّ الْخَلْقِ إِلَى اللهِ مَنْ أَحْسَنَ إِلَى عَيَالِهِ (بيهقي)
হযরত আনাস ও আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, গোটা সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম সৃষ্টি হচ্ছে সে, যে তার পরিবারের সাথে সদাচরণ করে। (বায়হাকি)
পৃথিবীর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি ও এক আদমের সন্তান।
يَأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً
“হে মানব জাতি। তোমরা সকলে তোমাদের প্রতিপালকের দাসত্ব গ্রহণ কর। তোমাদের প্রভু তো তিনিই যিনি তোমাদেরকে একজন মানব হতে সৃষ্টি করেছেন। তারই থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন এবং এ দু’জন থেকেই দুনিয়ার পুরুষ ও নারী ছড়িয়ে পড়েছে।” (সুরা নিসা: ৬)
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَذْهَبَ مِنْكُمْ عَصَبِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ وَفَخْرُكُمْ بِالْآبَاءِ الأَكْلُكُمْ بَنُوْادَمَ وَادَمَ مِنْ تُرَابٍ (سيرة ابن هشام )
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- “আল্লাহর তোমাদের থেকে জাহিলিয়াতের যুগের অন্ধ আত্মম্ভরিতাজনিত বিদ্বেষ ও পূর্ব বংশ নিয়ে গৌরব-অহংকার দূর করে দিয়েছেন। জেনে রাখ, তোমরা সকলেই এক আদমের (আ:) এর বংশধর। আর আদমকে (আ:) কে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে।” (সিরাত ইবনে হিশাম)
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ النَّاسَ مِنْ عَهْدِ آدَمَ إِلَى يَوْمِنَا هَذَا مِثْلُ أَسْنَانِ الْمُشْطِ لَا فَضْلُ لِعَرَبِي عَلَى عَجَمِيٌّ وَلَا لَأَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ الا بِالتَّقْوَى (سيرة ابن هشام )
“রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- “মানুষ আদমের সময় থেকে আজকের (বিদায় হজের দিন) দিনটি পর্যন্ত চিরুনীর দাঁতগুলোর ন্যায় সম্পূর্ণ সমান। যেমন আরব অনারবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম নয়, কালো জাতের ওপর সাদা জাতের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব বা আভিজাত্য নেই। যা কিছু শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য, তা কেবল মাত্র
তাকওয়ার কারণে। (সিরাত ইবনে হিশাম)
ইসলামের সাম্যবাদী ব্যবস্থায় সকল ধর্মীয় মানুষ ধনী-গরিব, মালিক-শ্রমিক, রাজা-বাদশা ও পীর-মুরশীদ সকলেই সমান। কেউ অন্যকে হীন মনে করে নিজের জন্য বিশেষ সম্মান দাবি করা অমার্জনীয় অপরাধ। আল্লাহর রাসুল (সা.) দুনিয়ায় উচ্চ ন্তরের লোকদের সে শিক্ষা দিয়ে গেলেন।
ব্যক্তি পূজার অবসান
ব্যক্তির প্রতি অন্ধ-সম্মানবোধ মানুষের খেলাফতের মর্যাদা ক্ষন্ন করে।
عَنْ أَبِي مَسْعُودٍ الأَنْصَارِي رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ نَهَى رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَقُوْمَ الإِمَامُ فَوْقَ شَيْءٍ وَالنَّاسُ خَلْفَهُ يَعْنِي أَسْفَلَ مِنْهُ (الدار قطني)
“হযরত আবু মাসুদ আনসারী (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) নিষেধ করেছেন যে, ইমাম উচ্চ স্থানে দাঁড়াবে এবং লোকেরা তার পিছনে অর্থাৎ তার থেকে নীচে দাঁড়াবে। উঁচু ও নীচু স্থানে দাঁড়িয়েও বৈষম্য সৃষ্টি করতে নিষেধ করা হয়েছে।” (দারে কুতনী)
عَنْ أَنَسٍ قَالَ لَمْ يَكُنْ شَخْصُ أَحَبُّ إِلَيْهِمْ مِنْ رَسُوْلِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ وَكَانُوا إِذَا رَاوَهُ لَمْ يَقُومُوا لِمَا يَعْلَمُونَ مِنْ كَرَاهِيَتِهِ كَذَالِكَ(ترمذي)
“হযরত আনাস (রা.) বলেন, নবি কারিম (সা.) সকলের নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বলেন, লোকেরা যখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেখতেন তারা (সম্মান দেখানোর জন্য) দাঁড়াতেন না। কেননা, তারা জানতেন যে, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) উহা পছন্দ করেন না।” (তিরমিযি)
عَنْ أَبِي أَمَامَةً قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُتَوَكِّيًّا عَلَى عَمَّا فَقُمْنَا إِلَيْهِ فَقَالَ لَا تَقُوْمُوا كَمَا تَقُوْمُ الْأَعَاجِمُ يُعَلِّمُ بَعْضُهَا بَعْضًا (ابو داود)
“হযরত আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এক সময় লাঠি ভর করে আমাদের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন। আমরা তাকে দেখে দাঁড়ালাম। হুজুর (সা.) বললেন, তোমরা দাঁড়াবে না যেমন লোকেরা পরস্পরের প্রতি সম্মান দেখনোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। (আবু দাউদ)
আল কুরআনে মেহনতি মানুষের মর্যাদার স্বীকৃতি
ইসলাম পৃথিবীতে আসে শান্তির অমৃত বাণী নিয়ে। কোনো জুলুম নয়, অন্যায় অত্যাচার নয়, মানুষ ন্যায়, সত্য এবং শান্তির অনুসরণ করে বসবাস করবে দুনিয়ায়। দুনিয়াতে বেহেস্তের শান্তি বিরাজ করবে। কিন্তু সব মানুষ তো আর শাস্তি চায় না। এমন কিছু মানুষ আছে, যারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, দুর্বল ও অধীনস্ত লোকদেরকে শোষণ অত্যাচার ও নির্যাতন করে। যারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে, মানুষের ওপর জুলুম করে এবং আল্লাহর আইন অমান্য করে নিজেদের স্বার্থে আইন রচনা করে মানুষকে শোষণ করে তাদের মোকাবেলার জন্য আল্লাহ যুগে যুগে নবি-রাসুল পাঠিয়েছেন। তারা অত্যাচারী মানুষ ও শাসকদের শোষণ ও নির্যাতন থেকে সাধারণ ও অধীনন্ত লোকদেরকে মুক্ত করে একমাত্র আল্লাহর বান্দা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। আল কুরআনের ঘোষণা-
فَأُتِيَهُ فَقُوْلَا إِنَّا رَسُوْلًا رَبِّكَ فَأَرْسِلْ مَعَنَا بَنِي إِسْرَاعِيلَ وَلَا تُعَذِّبُهُمْ قَدْ جِئْتُكَ بِأَيَةٍ مِّنْ رَّبِّكَ
“যাও উহার (ফেরাউনের) নিকট, আর বল যে, আমরা তোমার প্রভুর নিকট থেকে রাসুল। বনি ইসরাইল কে আমাদের সাথে যাবার জন্য মুক্ত করে দাও। তাদের ওপর অত্যাচার করোনা। আমরা তোমার নিকট রবের নির্দেশ নিয়ে এসেছি।” (সুরা ত্বো-হা: ৪৭)
ফেরাউন ছিল মিশরের শাসক। সে শাসন ক্ষমতার অপব্যবহার করছিল এবং প্রজা সাধারণকে অত্যাচার নির্যাতন করতো। ফেরাউনের অত্যাচারের মূল টার্গেট ছিল কাওমে বনি ইসরাইল। তাদের উপর ফেরাউনের অত্যাচারের মাত্রা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, তাদের ছেলে সন্তানদেরকে হত্যা করা হতো। কিন্তু বনি ইসরাইল সম্প্রদায় এত অসহায় ছিল যে, ফেরাউনের অত্যাচারের প্রতিবাদও তারা করতে পারত না। ফেরাউনের মোকাবেলা করার জন্য আল্লাহ হযরত মুসা (আ.) কে পাঠালেন। তিনি ফেরাউনকে, আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিলেন এবং সাথে সাথে বনি ইসরাইল কাওমকে স্বাধীন ও মুক্ত করে দিতে বললেন। তাদের উপর সকল অত্যাচার বন্ধ করার কথাও ঘোষণা করলেন।
এমনিভাবে সর্ব যুগের ফেরাউনের অত্যাচার ও জুলুম থেকে অধীনন্ত লোকদেরকে মুক্ত করে তাদের মর্যাদা সমাজে প্রতিষ্ঠা করা সকল নবিদের দায়িত্ব ছিল।
আল্লাহ তায়ালা অসহায়, অধীনন্ত ও দুর্বল লোকদের মর্যাদা সমুন্নত করার কথা আল কুরআনে ঘোষণা করলেন-
وَنُرِيدُ أَنْ نَمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الْأَرْضِ وَ نَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَرِثِينَ له وَ تُمَكِّنَ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ )
“আর আমরা চেয়েছিলাম দুর্বল করে রাখা লোকদের প্রতি অনুগ্রহ দান করতে। তাদেরকে নেতা বানাতে ও উত্তরাধিকারী বানাতে। পৃথিবীতে তাদেরকে ক্ষমতাসীন করতে। (সুরা কুসাস: ৫-৬)
পৃথিবীর জালেম ও শোষক শ্রেণির লোকেরা ক্ষমতা, অর্থ লাভ করে অধীনন্ত প্রজা সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষকে দুর্বল করে রাখতে চায়। কারণ, অধীনস্ত লোকেরা সুযোগ পেলে তাদের মত স্বাবলম্বী হয়ে যাবে। ফলে, তাদের রাজত্ব আর চলবেনা। চলবেনা তাদের বাহাদুরী ও মানুষের ওপর প্রভুত্ব। অন্য দিকে বিশ্বের সৃষ্টি কর্তা আল্লাহ এ অসহায় অত্যাচারিত মজলুম লোকদের মর্যাদা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। অধীনস্ত অসহায় মানুষগুলোকে তিন রকম সাহায্য দিতে চান-
১. অসহায়, দুর্বল লোকদেরকে সমাজে নেতা বানাতে।
২. সমাজের ও সম্পদের উত্তরাধিকারী বানাতে।
৩. রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দান করতে।
তাই আমরা দেখি, আল্লাহর রাসুলগণকে সমাজপতিরা, ক্ষমতাশীনরা সবদিক থেকে অত্যাচার নির্যাতনের দ্বারা সমাজে দুর্বল করে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে কিন্তু আল্লাহর সাহায্যে গরিবরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও লাভ করেছে।
আজকের যুগের অসহায় অধীনন্ত ও শ্রমজীবী মানুষ যদি আল্লাহর দ্বীনকে সঠিকভাবে গ্রহণ করে এবং সংঘবদ্ধ ভাবে ইসলাম বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাহলে আল্লাহর দুর্বল লোকদেরকে বিজয় দান করবেন। ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে সকল মানুষ সমান অধিকার ও ন্যায় বিচার লাভ করবে।
আল হাদিসে শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদার স্বীকৃতি
নবি কারিম (সা.) তার কথা ও কাজের মাধ্যমে অধীনন্ত ও শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদাকে সমুন্নত করার যে বাস্তব দৃষ্টান্ত পৃথিবীর মানুষের কাছে রেখে গেছেন তাই আদর্শ এবং তাই পৃথিবীর অসহায় ও অধীনস্ত মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
الْكَاسِبُ حَبِيبُ اللهِ
“শ্রমজীবী মানুষ হচ্ছে আল্লাহর বন্ধু।” (হাদিস)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِخْوَانُكُمْ جَعَلَهُمُ اللَّهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ فَمَنْ جَعَلَ اللَّهُ أَخَاهُ تَحْتَ يَدَيْهِ فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ وَلْيَلْبِسُهُ مِمَّا يَلْبِسُ وَلَا يُكَلِّفُهُ مِنَ الْعَمَلِ مَا يَغْلِبُهُ فَإِنْ كَلَّفَهُ مَا يَغْلِبُهُ فَلْيُعِنْهُ عَلَيْهِ
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের অধীনন্ত ব্যক্তিরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ এক ভাইকে অন্য ভাই-এর অধীন করে দিয়েছেন। যে ভাইকে যে ভাই-এর অধীন করে দেওয়া হয়েছে তাকে খেতে দিতে হবে যা সে নিজে খায় এবং তাকে তাই পরিধান করতে দিতে হবে যা সে নিজে পরিধান করে। শক্তি সামর্থ্যের বেশি তার উপর কোনো কাজ চাপাবেনা। যদি তার সামর্থ্যের অতিরিক্ত কোনো কাজ তাকে দাও তাহলে সে কাজে তাকে সাহায্য করবে। (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলাম মালিক শ্রমিক স্বীকার করেনা। সকলের মধ্যে ভাই ভাই সম্পর্ক। ভাই হিসেবেই অধীনস্তদের অধিকার দিতে হবে। সকলেই অতিরিক্ত মর্যাদার অধিকারী। একজনে রাষ্ট্র নায়ক হওয়ার কারণে তার কোনো অতিরিক্ত মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা থাকবে না। মর্যাদা শুধু আল্লাহর কাছে লাভ করবে তাকওয়ার ভিত্তিতে। পৃথিবীতে আল্লাহর বান্দাদের ওপর কেউ প্রভু হওয়ার অতিরিক্ত মর্যাদা লাভ করা, কাউকে হীন মনে করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
নবি কারিম (সা.) বলেছেন- “তোমরা তোমাদের আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে যেমন ব্যবহার করে থাক তাদের (অধীনন্ত) সাথেও অনুরূপ ব্যবহার করবে। আর মানুষ হিসেবে তারা তোমাদের চেয়ে কোনো দিক থেকে কম নয়। তোমাদের যেমন অন্তর আছে, তাদেরও তেমন অন্তর আছে। (বুখারি)
হুজুর (সা.) আরও বলেন, অধীনস্তদের সম্পর্কে সতর্ক থাকবে। এদের সঙ্গে নরমভাবে কথা বলবে। অন্যায় মূলক আচরণকারী মালিক কখনও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (কানজুল উন্মাত)
وَعَنْ أَبِي بَكْرَنِ الصِّدِّيقِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ سَيِّءُ الْمَلَكِ (ترمذي)
“হযরত আবুবকর (রা.) হতে বর্ণিত, নবি কারিম (সা.) বলেছেন, দাস-দাসীদের সাথে দুর্ব্যবহারকারী বেহেশতে যাবে না।” (তিরমিযি)
وَعَنْ رَافِعِ بْنِ مَكِيْثٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ حَسْنُ الْمَلَكَةِ يُمْنٌ وَسُوْءُ الْخَلْقِ سُؤُم (ابو داود)
“হযরত রাফে বিন মাকীদ (রা.) হতে বর্ণিত নবি কারিম (সা.) বলেছেন, দাস দাসীদের সাথে ভালো ব্যবহার সৌভাগ্য, আর তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার দুর্ভাগ্য।” (আবু দাউদ)
নবিদের জীবনে শ্রমের মর্যাদা
আল্লাহর নবি ও রাসুলগণ অসহায় ও শ্রমজীবী ছিলেন। নিজেরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেও নবুয়তের মহান মর্যাদা লাভ করেছেন।
পৃথিবীর সকল মানুষের পিতা হযরত আদম (আ.) নিজ হাতে সকল কাজ করতেন। তিনি একজন কৃষকও ছিলেন। হযরত নূহ (আ.) একজন কাঠ মিস্ত্রী ছিলেন। হযরত দাউদ (আ.) ছিলেন একজন কর্মকার। হযরত ইদ্রিস (আ.) ছিলেন একজন দর্জি এবং হযরত মুসা (আ.) ছাগল চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। (মুস্তাদরাক হাদিস)
শ্রমিক হিসেবে আল্লাহর নবিগণ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَا بَعَثَ اللهُ نَبِيًّا إِلَّا رَعَى الْغَنَمَ فَقَالَ أَصْحَابُهُ وَأَنْتَ فَقَالَ نَعَمْ كُنْتُ أَرْعَاهَا عَلَى قَرَارِيطَ لِأَهْلِ مَكَّةَ (بخاري)
“হযরত আবু হুরায়রা (রা.) নবি কারিম (সা.) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আল্লাহর কোনো নবি পাঠাননি যিনি ছাগল চরাননি। সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনিও কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি কয়েক কীরাতের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল-ভেড়া চরাতাম।” (বুখারি)
আম্বিয়ামে কেরাম (আ.) নিজেরা শ্রম করে এবং শ্রম অন্যের কাছে বিক্রি করায় আল্লাহ তাদেরকে অপছন্দ করেননি। বরং তাদের কঠোর পরিশ্রমের জন্য আল্লাহ তাদের প্রতি খুশি হয়ে নবুয়তের দায়িত্ব অর্পন করেছেন। নবিগণ আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করে অসহায় মেহনতি মানুষের অধিকার ও মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন। আজকের যুগে নবিদের আদর্শের অনুসরণের মাধ্যমেই অসহায় মানুষের মুক্তি রয়েছে।
নবিদেরকে শ্রমিক হিসেবে চিহ্নিত করে আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা.) শ্রম ও শ্রমিকদের মর্যাদা সমুন্নত করেছেন।
শেষ নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে শ্রমের মর্যাদা
শ্রমজীবী অসহায় মজলুম মানুষের বন্ধু মদিনার রাষ্ট্রপতি আমাদের নবি মুহাম্মদ (সা.) ছাগল চরাতেন। হযরত খাদীজা (রা.)-এর ব্যবসা পরিচালনা করতেন, কূপ থেকে পানি তোলার বিনিময়ে একটি করে খেজুর মজুরি নিতেন। অন্যের ক্ষেতে পানি টেনে দিতেন। তার শত্রুরা তাকে রাজা বানাতে চেয়েছেন কিন্তু তিনি শ্রমজীবী হিসেবে জীবন যাপন করে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। পরে মদিনায় গিয়ে রাষ্ট্রনায়ক হয়েও একজন সাধারণ শ্রমিকের ন্যায় জীবন যাপন করতেন। অন্তিম রজনীতে মদিনার রাষ্ট্রপতির গৃহে তেলের অভাবে প্রদীপ জ্বালাতে পারেনি।
عَنْ عُتْبَةَ بْنَ النُّدَرِ قَالَ كُنَّا عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَرَا طس حَتَّى إِذَا بَلَغَ قِصَّةَ مُوسَى قَالَ إِنَّ مُوسَى عَلَيْهِ السَّلَامُ أَجَرَ نَفْسَهُ ثَمَانِيَ سِنِينَ أَوْ عَشْرًا عَلَى عِلَّةٍ فَرْجِهِ وَطَعَامِ بَطْنِهِ.
“হযরত উতবা বিন নুদ্দার (রা.) বলেন, একদা আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট গিয়েছিলাম। তিনি (সুরা কাসাসের) তা-ছীন-মীম হতে পড়তে আরম্ভ করে হযরত মুসার (আ.) কাহিনী পর্যন্ত পৌঁছে বললেন, মুসা (সা.) নিজের লজ্জার স্থানকে হারাম হতে বাঁচানো এবং পেটের ভাতের জন্য আট কি দশ বছর নিজেকে মজুরিতে খাটিয়ে ছিলেন। (আহমদ ও ইবনু মাজাহ)
বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মানুষ নিজেকে একজন শ্রমিক হিসেবে পরিচয় দিতে মাত্রও লজ্জাবোধ করেননি বরং নিজকে শ্রমজীবী মানুষের কাতারে দাঁড় করিয়ে গৌরব বোধ করেছেন। অসহায় শ্রমজীবী মানুষ ধনীদের দয়ার পাত্র, ধনীরা শ্রমজীবী মানুষকে হীন মনে করে আর নিজদেরকে অভিজাত ও সম্মানিত মনে করে। আল্লাহর নবি নিজেকে শ্রমিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে আভিজাত্যের সকল বাঁধন ছিন্ন করে দিলেন এবং শ্রমিকদের মর্যাদা কেয়ামত পর্যন্ত সমুন্নত করে গেলেন।
আমাদের পেয়ারা নবি মুহাম্মদ (সা.) সাধারণ মানুষের সাথে মিলেমিশে কাজ করতেন। মদিনার মসজিদ নির্মাণের সময় হুজুর (সা.) একজন সাধারণ মজুরের মতই কাজ করেছেন। খন্দকের যুদ্ধের সময় পরিখা খননের জন্য রাত্র দিন তিনি কোদাল হাতে মাটি কেটে গেছেন। তার পবিত্র দেহ মোবারক মাটি ও ধূলায় এমনভাবে মলিন হয়ে যেত কেউ কেউ তাকে চিনতেই পারত না যে, ইনি মদিনার রাষ্ট্রপতি ও আল্লাহর প্রিয় নবি মুহাম্মদ (রা.)।
عَنْ عُمْرَةً قِيْلَ لِعَائِشَةَ مَاذَا كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى الَهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْمَلُ فِي بَيْتِهِ قَالَتْ كَانَ بَشَرًا مِنْ الْبَشَرِ يَفْلِي ثَوْبَهُ وَيَخْلُبُ شَاتَهُادب المفرد)
“হযরত আয়শা (রা.) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘরে কি কাজ করতেন? জবাবে তিনি বললেন, তিনি সকল মানুষের মতই একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কাপড়ে লেগে থাকা ঘুই বের করতেন এবং ছাগল দুহন করতেন।” (আদাবুল মুফরাদ)
নবি কারিম (সা.) শুধু নিজেই শ্রমিক ছিলেন না বরং তিনি অসহায়, গোলাম, শ্রমিক ও অধীনস্তদের মর্যাদার প্রতি সম্মান দেখাতে কোনো সময় ভুল করতেন না। তার সামনে কেউ গোলাম ও অধীনস্তদের প্রতি অসদাচরণ করলে তিনি তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করতেন।
মেহনতি অসহায় মানুষের অকৃতিম বন্ধু মুহাম্মদ (সা.)-এর শেষ বাণী-
عَنْ عَلِي رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ آخِرُ كَلَامِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصَّلاةَ الصَّلاةَ اتَّقُوا اللهَ فِيمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ (ادب المفرد)
“হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি কারিম (সা.)-এর অন্তিম কথা ছিল নামাজ নামাজ এবং তোমাদের মালিকাধীন দাসদাসীদের সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় করবে।” (আদাবুল মুফরাদ-১৫৮)
অর্থাৎ নামাজ আদায়ের প্রতি যত্নবান হবে এবং গোলাম, চাকর-চাকরাণী ও মেহনতি মানুষের প্রতি সদাচারী হবে। তাদের প্রতি জুলুম, অত্যাচার ও বাড়াবাড়ি করো না।
আল্লাহর রাসুল (সা.) মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও অসহায় মেহনতি মানুষ ও গোলামদের অধিকারের কথা ভুলেননি। অবশেষে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য উম্মতকে দায়িত্ব প্রদান করেছেন।
অভিজাত ও গোলামের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন
নবি কারিম (সা.) গোলাম ও অভিজাত লোকদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেছিলেন, তা ছিল রক্তের সম্পর্কের চেয়েও অনেক মজবুত। গোলাম যায়েদ (রা.)-এর সাথে ভ্রাতৃত্ব ছিল হুজুর (সা.)-এর চাচা হামজা (রা.)-এর, হযরত আবুবকর (রা.)-এর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল হযরত খারেজা ইবনে যায়েদ (রা.)-এর। খালেদ ইবনে রুবাইয়া খাশযাবীর (রা.) ও হযরত বিলাল (রা.) মাঝে ভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হয়। আল্লাহর নবি উঁচু ও নীচু শ্রেণির মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করে দিয়ে সাম্যবাদের যে মহান দৃষ্টান্ত সারা দুনিয়ায় মানুষের সামনে তুলে ধরলেন তা আজকের দুনিয়ায় আবার প্রতিষ্ঠা করার জন্য শ্রমজীবী মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
নবি কারিম (সা.) ঘোষণা করলেন- “অধীনন্তরা তোমাদের ভাই।”
হযরত ওমর (রা.) ঘোষণা করেন-
النَّاسُ شَرِيْفُهُمْ وَوَضِيعُهُمْ فِي دِينِ اللَّهِ سَوَاءٌ.
“আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে আশরাফ ও আতরাফ সবাই সমান।”
অভিজাত ও গোলামদের মধ্যে বিবাহ বন্ধন
অভিজাত ও গোলামদের মধ্যে বিবাহ বন্ধন ছিল সারা পৃথিবীতে অকল্পনীয়। নবি কারিম (সা.) সর্ব যুগের আভিজাত্য বোধের উপর কুঠারাঘাত হেনে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলেন। মানুষের মিথ্যা আভিজাত্য বোধ, মানুষকে হীন মনে করা ও আল্লাহর বান্দাদেরকে ঘৃণা করার অভিশাপ থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করে সাম্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য অভিজাত ও গোলামদের মধ্যে বিবাহ প্রথা চালু করার পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। এটা ছিল খুবই কঠিন পদক্ষেপ। মুসলমান হয়েও তা গ্রহণ করা ছিল প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে এক চরম লড়াই।
আল কুরআন ঘোষণা করল-
وَ اللَّهُ أَعْلَمُ بِأَيْمَانِكُمْ بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ ۚ فَانْكِحُوهُنَّ بِإِذْنِ أَهْلِهِنَّ وَ اتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ .
“তোমাদের ঈমান সম্পর্কে আল্লাহ ভালো জানেন, তোমরা সবাই একই দলের অন্তর্ভূক্ত। কাজেই তাদের অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে তাদের (দাসী) বিয়ে করতে পার। প্রচলিত পন্থায় তাদের মোহরানা আদায় করে দাও।”(সুরা আন নিসা: ২৫)
নবি কারিম (সা.) নিজের জীবন থেকেই আল কুরআনের বাস্তবায়ন শুরু করলেন। ইয়াহুদী মেয়ে হযরত সফিয়াকে (রা.) গোলামী থেকে মুক্ত করে নিজেই তাঁকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলেন। সারা পৃথিবীর মানুষের নিকট দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন যে, একজন দাসীও নবির স্ত্রী হওয়ার অধিকার রাখে। আল্লাহর বান্দা হিসেবে কাউকে ঘৃণা করা যায় না।
নিজের গোলামকে তিনি পুত্র হিসেবে পরিচয় দিতেন এবং মানুষের কাছে প্রচার করতেন যে, যায়েদ আমার গোলাম নয়, সে হচ্ছে আমার পুত্র সমতুল্য। যায়েদের (রা.) যখন বিবাহের সময় হল তখন নবি কারিম (সা.) আরবের সম্মানিত পরিবারের মেয়ে হুজুর (সা.)-এর ফুফাত বোন জয়নাব (রা.)-কে তার
সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম নেতা আল্লাহর নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.)-এর যখন বিবাহের সময় হল তখন মক্কার অভিজাত সম্পদশালী লোকেরা তাঁর জন্য বিয়ের পয়গাম পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু নবি কারিম (সা.) মক্কার একজন শ্রমিক যিনি মানুষের কাছে শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তাঁর কাছে ফাতেমা (রা.) কে বিয়ে দিলেন। অর্থাৎ আলী (রা.)-এর কাছে ফাতেমা (রা.)-কে বিবাহ দিলেন। সারা জীবন ফাতেমা (রা.) হযরত আলী (রা.)-এর ঘরে অনাহারে অর্ধাহারে জীবন কাটিয়েছেন। নবি কারিম (সা.) যখন মদিনার রাষ্ট্রপতি তখনও ফাতেমা (রা.)-এর অভাব ঘুচেনি।
একজন আরবী অভিজাত ইবনে আবুবকর এসে নবি কারিম (সা.)-এর নিকট আবেদন করলেন যে, আমার মেয়েকে আরবী কোনো অভিজাত বংশের ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে দিন। নবি কারিম (সা.) তাঁকে বললেন, বিলাল (রা.)-এর সাথে তাঁর বিয়ে দিয়ে দাও। কিন্তু সে রাজি না হয়ে চলে গেল। এমনিভাবে দ্বিতীয় দিন এসেও নবি কারিম (সা.)-এর নিকট আবেদন করলেন। হুজুর (সা.) একই জবাব দিলেন। তৃতীয় দিন এসেও আবেদন করলেন তখন নবি কারিম (সা.) বললেন, একজন জান্নাতী লোকের নিকট তোমার মেয়েকে কেন বিয়ে দিচ্ছ না? নবি কারিম (সা.)-এর সাথে একমত হয়ে ইবনে আবুবকর বললেন, আপনার মতই আমার মত। (বুখারি)
নবি কারিম (সা.) আরবের অভিজাত লোকদেরকে উৎসাহিত করতেন তাদের কন্যাদেরকে শ্রমজীবী লোকদের নিকট বিয়ে দিতে।
নবি কারিম (সা.)-এর বংশের লোকেরাই ছিল সর্ব যুগের অভিজাত ও শ্রেষ্ঠ কিন্তু তারা তা দাবি করতো না এবং তা নিয়ে গৌরববোধ করে লোকদেরকে ঘৃণা করতোনা। নবির বংশের লোকেরাও গোলাম, শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা দিয়ে সর্ব যুগেই আল্লাহর বিধানকে সমুন্নত রেখেছেন। নবি কারিম (সা.)-এর বংশের ইমাম হযরত জয়নাল আবেদীন একজন দাসীকে মুক্ত করে নিজের স্ত্রী হিসেবে তাকে মর্যাদা দান করেছেন। নিজের কন্যাকেও একজন দাস শ্রমিকের নিকট বিয়ে দিয়েছিলেন।
অভিজাত ও গোলাম শ্রমজীবীদের মধ্যে বিবাহ-শাদী হওয়া ছিল এক অসাধারণ কাজ। কারণ, বিবাহ শাদী হচ্ছে উভয় পক্ষের ক্ষমতা ও মান সম্মানের মাপকাঠি। আল্লাহর নবি ও ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো মতবাদের পক্ষে এ কাজ করা আদৌ সম্ভব নয়, যতই তারা সাম্যবাদের শ্লোগান দিক না কেন। পশ্চিমা দেশগুলোতে দাস প্রথা বেআইনি করা হয়েছে। কিন্তু কোনো নিগ্রো কালোজাতের লোকের পক্ষে শ্বেতাংগ কোনো রমনীকে বিবাহ করা আইনত নিষিদ্ধ। শুধু কি তাই, একজন নিগ্রো বাসে, ট্রেনে, রেস্তোরায়, সেনেটারি অথবা যে কোনো স্থানে শ্বেতাংগের পাশাপাশি বসাও নিষিদ্ধ।
মক্কা বিজয়ের পর নবি কারিম (সা.) আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করলেন। নবির সাথে যে দু’জন লোক আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন তার দু’জনই ছিলেন গোলাম। একজন হচ্ছেন হযরত বিলাল (রা.) অন্যজন হচ্ছেন ওসামা ইবনে যায়েদ (রা.)।
ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, “হুজুর (রা.) মক্কা বিজয়ের পর প্রথম কাবা ঘরে প্রবেশ করেন তাঁর সাথে ছিলেন বিলাল (রা.), ওসামা ইবনে যায়েদ (রা.) এবং চাবি রক্ষক ওসমান ইবনে তালহা (রা.) তাঁরা প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। (বুখারি)
আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রথম কা’বা ঘরে প্রবেশের সময় শ্রমজীবী গোলামদেরকে ভুলে যাননি। এর চেয়ে বড়ো পাওনা আর সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কি থাকতে পারে?
মসজিদে নববীর প্রথম মুয়াজ্জিন ছিলেন হাবশী গোলাম
মসজিদে নববীতে ইমামতি করতেন আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা.)। আর তিনি তাঁর মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করলেন হাবশী গোলাম হযরত বিলাল (রা.)-কে। তিনি মসজিদে নববীর শুধু মুয়াজ্জিনই ছিলেন না নবি কারিম (সা.) মদিনার রাষ্ট্রে প্রথম অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন হযরত বিলাল (রা.)-কে।
হযরত বিলাল আরবী উচ্চারণ ভালো ভাবে করতে পারতেন না। তিনি আশহাদু উচ্চারণ না করে আসাদু বলতেন। মদিনা যখন ইসলামি রাষ্ট্রের রাজধানী হল তখন দুনিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে বড়ো বড়ো পণ্ডিত বুদ্ধিজীবি মদিনায় আসতে আরম্ভ করল। কেউ কেউ নবি কারিম (সা.)-কে পরামর্শ দিলেন যে, বিলাল (রা.) সঠিকভাবে আরবী উচ্চারণ করতে পারেন না তাই আজানে বিজ্ঞ মুয়াজ্জিন মদিনার মসজিদের জন্য নিযুক্ত করা হোক। হুজুর (সা.) রাজী হলেন এবং নতুন মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করা হলো। নতুন মুয়াজ্জিন নিযুক্তির একদিন পর জিরাঈল (আ.) এসে হুজুর (সা.)-কে প্রশ্ন করলেন যে, মদিনার মসজিদে কি আজান হয়নি? হুজুর (সা.) জবাব দিলেন যে, নতুন অভিজ্ঞ মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করা হয়েছে এবং সে তো সুন্দর আজান দিয়েছে। জিবরাঈল (আ.) বললেন, বিলালের (রা.) আজান আমরা চতুর্থ আসমানে বসে শুনতাম আর জামায়াত করতাম কিন্তু এ ক’দিন আমরা কোনো আজানই শুনতে পাইনি। তাই আপনি বিলাল (রা.)-কে মদিনার মসজিদের মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করুন।
বিলাল (রা.) হলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কর্তৃক নিযুক্ত মুয়াজ্জিন। এ সৌভাগ্য একজন শ্রমজীবী গোলামের পক্ষেই লাভ করা সম্ভব হয়েছে।
ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা
নবি কারিম (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে আল্লাহর নির্দেশে মদিনায় যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করলেন, সে রাষ্ট্রে রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, মালিক-শ্রমিক, গোলাম-অভিজাত ও নীচ জাতের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। আল্লাহর বান্দা হিসেবে সকলের অধিকার ও মর্যাদা সমান ছিল।
ইসলামি সমাজে একজন শ্রমজীবী মানুষ এবং গোলামও তার সততা ও যোগ্যতা দ্বারা দেশের রাষ্ট্রনায়ক হতে পারে।
إِنْ أُمِرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللَّهِ تَعَالَى فَاسْمَعُوا لَهُوَأَطِيعُوا (مسلم)
বিশ্বাসীদের প্রতি নবি কারিম (সা.) নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, একজন নাক কাটা ক্রীতদাসকেও যদি তোমাদের নেতা নির্বাচন করা হয় সে যতক্ষণ তোমাদের মধ্যে খোদার বিধান কার্যকরি করে ততক্ষণ তোমাদের তাঁর কথা শুনতে ও মান্য করতে হবে। (মুসলিম)
নবি কারিম (সা.)-এর ইন্তেকালের পরে যিনি খলিফা হলেন তিনি ছিলেন একজন শ্রমজীবী গরিব। নিজেই কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কাপড়ের অভাবে একদিন তিনি খেজুর পাতা দ্বারা চাটাই তৈরি করে তা পরিধান করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে এসেছিলেন। মদিনার রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরেও তিনি একজন দরিদ্র হিসেবেই জীবন যাপন করতেন।
হযরত আবুবকর (রা.) খলিফা হওয়ার পূর্বে এক অসহায় প্রতিবেশীর ছাগলের দুধ দুইয়ে দিতেন। যখন তিনি মদিনার রাষ্ট্রপতি হলেন তখন প্রতিবেশীর একটি শিশু মেয়ে হযরত আবুবকরকে লক্ষ্য করে বলল যে, আপনি তো মদিনার রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, এখন তো আর আমাদের ছাগল দুইয়ে দিবেন না? হযরত আবুবকর (রা.) উত্তরে বললেন, “নিশ্চয়ই পূর্বের মতই ছাগল দুইয়ে দিব এবং তুমি মাখন খেতে চাইলে আমি তোমাকে মাখনও তৈরি করে দিব।”
মদিনার রাষ্ট্রপতি হয়েও প্রতিবেশীর সামান্য খেদমতকেও হযরত আবুবকর (রা.) অবহেলা করেননি বরং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রতিবেশীর ছাগল দুইয়ে তার মাখন নিয়ে দেওয়াকেও দায়িত্ব মনে করেছেন।
হযরত আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতকালে হযরত ওমর (রা.) মদিনায় একজন অন্ধ মহিলার কাজকর্ম করে দিতেন। কিছু দিন পর দেখতে পেলেন তিনি কাজে যাওয়ার পূর্বেই কে যেন এসে সব কাজ করে দিয়ে যান। হযরত ওমর (রা.) রহস্য উদঘাটন করার জন্য গোপনে লুকিয়ে থাকেন। তিনি দেখতে পেলেন মদিনার রাষ্ট্রপতি গভীর রাতে এসে অন্ধ মহিলার সব কাজ করে দিয়ে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় গুরু দায়িত্ব আবুবকর (রা.)-কে এসব খেদমত থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
মদিনার রাষ্ট্রপতি ওমর (রা.) এমন দরিদ্র অবস্থায় জীবন যাপন করতেন যে, তার জামায় ১৪টি তালি ছিল। এক সময় রাষ্ট্রীয় বায়তুল মালের একটি উট হারিয়ে যায়। হযরত ওমর (রা.) নিজেই তার তালাশ করতে বের হলেন। মদিনার রাষ্ট্রপতি উট তালাশ করছে দেখে একজন সরদার বললেন- খলিফা, আপনি নিজে উট তালাশ না করে কোনো একজন গোলাম পাঠিয়ে দিন। হযরত ওমর (রা.) উত্তরে বললেন যে, আমার চেয়ে বড়ো গোলাম আর কে? (আল ফারুক)।
এক রাত্রে হযরত ওমর (রা.) ছদ্মবেশে মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখার জন্য ঘুরে বেড়োাচ্ছেন। একজন মহিলা রাতের আঁধারে তার মেয়েকে বলছে, “আমাদের যে দুধ হয় তা বিক্রি করে তো আমাদের প্রয়োজন মিটে না। যদি আমরা কিছু পানি মিশ্রিত করে নেই তাহলে আমাদের প্রয়োজন মিটান সম্ভব হবে। মেয়ে মায়ের কথার উত্তরে বলল? “মা, খলিফা ওমর শুনতে পেলে শান্তি দিবে। মা বলল: খলিফা কিভাবে জানবে আমরা পানি দিয়েছি। সে বলল: খলিফা না জানলেও আল্লাহ অবশ্যই জানবেন এবং তাঁর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।”
খলিফা ওমর (রা.) মেয়ে এবং মায়ের সব কথা শুনে চলে গেলেন। তিনি সকাল বেলা মেয়েকে ডেকে নিলেন এবং বললেন: তোমাদের সব কথা আমি রাতের বেলা শুনেছি। তোমার মত একজন নেক চরিত্রের মেয়েকে আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাই। খলিফার ছেলেকে বিয়ে করলেন এক গোয়ালের মেয়ে। সততাই ছিল তাদের কাছে আভিজাত্যের বড়ো মাপকাঠি।
হযরত ওমর (রা.) সিরিয়া সফরে যাচ্ছেন। সাথে ছিল তার গোলাম আসলাম। কিছু পথ চলে গোলামকে উটের পিঠে বিশ্রাম করতে বসিয়ে নিজেই উটের রশি ধরে গোলামের দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন। এমনভাবে পালা বদল করে একবার খলিফা বিশ্রাম করছেন আবার খলিফা রশি ধরে উট চালাচ্ছেন আর গোলাম বিশ্রাম করছেন। যখন সিরিয়া পৌছলেন খলিফার আগমনের কথা শুনে চারদিক থেকে দলে দলে লোক আসল দেখতে। মদিনার রাষ্ট্রপতি, মুসলিম বিশ্বের খলিফা হযরত ওমর (রা.) স্বভাবতই হবেন উটের পিঠে আর ভৃত্য হবেন উটের রশি হাতে। কিন্তু সে সময় রশি ধরার পালা ছিল খলিফার আর উটের পিঠে ছিলেন ভৃত্য আসলাম। সবাই ভৃত্য আসলামকেই খলিফা মনে করল কিন্তু আসলাম দেখিয়ে দিলেন উটের রশি হাতে মদিনার খলিফা। এটাই হচ্ছে ইসলামের সাম্য ও ইসলামের শিক্ষা।
হযরত ওমর (রা.) বলেছেন- “আমার রাষ্ট্রের মধ্যে শুধু মানুষ নয়, সুদূর ফোরাতের প্রান্তে একটি ছাগল ছানা না খেয়ে থাকলেও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।”
হযরত আম্মার একজন দাস শ্রমিক ছিলেন। হযরত ওমর (রা.) তাকে কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন।
এক সময় খলিফা ওমর (রা.)-এর সাথে মোলাকাত করার জন্য আবু সুফিয়ান সোহায়েল ও আরও কিছু অভিজাত লোক অপেক্ষা করছিল। হযরত ওমর (রা.) অভিজাত লোকদের পূর্বে গোলাম হযরত বিলাল (রা.)-কে ভিতরে ডেকে নিলেন। আবু সুফিয়ান রাগান্বিত হয়ে বললেন, “এমনটি কখনও দেখিনি, আমরা দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি আর উনি গোলামদেরকে ডেকে নিলেন।”
হযরত ওমর (রা.) আহত অবস্থায় পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করার জন্য ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিষদ গঠন করে দিলেন। তারা হচ্ছেন হযরত ওসমান (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত তালহা (রা.), হযরত জোবায়ের (রা.), হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), হযরত সা’দ ইবনে আবি আক্কাস (রা.) এবং আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)।
হযরত ওমর (রা.) পরিষদের সদস্যদেরকে উপদেশ প্রদান করার সময় বললেন-“হোজাইফার গোলাম সালেহ জীবিত থাকলে আমি তাকে খলিফা নিয়োগ করে যেতাম।” এ থেকে বুঝা যায়, উক্ত ছয়জন ব্যক্তি যখন ছিলেন তখন খলিফা হওয়ার উপযুক্ত কিন্তু তাদের চেয়ে অধিক উপযুক্ত ছিলেন হযরত ওমরের (রা.) নিকট গোলাম শ্রমিক সালেহ (রা.)।
খলিফা নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত হযরত ওমর (রা.) রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন গোলাম সুহাইব (রা.)-কে এবং নিজের নামাজে জানাজা পড়াতেও সুহাইব (রা.)-কে অছিয়ত করেছিলেন। (তরিখ ইবনে আসীর)
রাতের বেলা হযরত ওমর (রা.) সাধারণ মানুষের অবস্থা ও তাদের দুঃখ দুর্দশা জানার জন্য ছদ্মবেশে রাজ্যের মধ্যে ঘুরে বেড়্যোতেন। এক রাতে তিনি দেখতে পেলেন মরুভূমির মধ্যে মিটমটি করে বাতি জ্বলছে। খলিফা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং দেখতে পেলেন একজন গ্রাম্য গরিব কৃষক তাবুর বাইরে বসে আছে আর তাবুর মধ্যে থেকে ক্রন্দনের শব্দ শুনা যাচ্ছে। খলিফা ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে গ্রাম্য কৃষক জবাব দেন যে, তার স্ত্রী প্রসব বেদনায় অস্থির। তাকে সাহায্য করার মত কোনো স্ত্রী লোক নেই। খলিফা হযরত ওমর (রা.) কালবিলম্ব না করে বাসায় এসে তার স্ত্রী উম্মে কুলসুমকে ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে করে তাবুতে উপস্থিত হলেন। হযরত ওমর (রা.) তার স্ত্রীকে তাবুর ভিতর পাঠিয়ে দিয়ে নিজে রুটি বানাতে আরম্ভ করলেন। ইত্যবসরে প্রসব হয়ে গেল। হযরত উম্মে কুলসুম তাবুর ভিতর হতে ডেকে বললেন- “ওগো আমীরুল মোমিনীন, আপনার বন্ধুর ছেলে হয়েছে, তাকে সুসংবাদ দিন।”
লোকটি আমীরুল মোমিনীনের কথা শুনে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়লেন। হযরত ওমর (রা.) তাকে সান্ত্বনা দিলেন। বললেন- “ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
রুটি তৈরি করে খলিফা তা প্রসূতি মাতার জন্য তাবুর ভিতর পাঠিয়ে দিলেন। আর হযরত ওমর (রা.) লোকটিকে নিজ হাতে রুটি খাওয়ালেন আর বললেন, “সমন্ত রাত তুমি জেগে রয়েছ। এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পড়, কাল সকালে আমার কাছে এস, তোমার জন্য একটা ব্যবস্থা করে দিব।”
ইসলামের শিক্ষা যারা গ্রহণ করলেন তারা হলেন খাঁটি মানুষ। ভালো বাসলেন সকল মাটির মানুষকে। রাষ্ট্রনায়ক হয়েও গরীবের খেদমত করলেন।
চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) সারা জীবন পরিশ্রম করে জীবন যাপন করেছেন। অন্যের ক্ষেত-খামারে শ্রম দিয়ে যা উপার্জন করতেন তা দ্বারাই সংসার চালাতেন। অর্ধাহার ও অনাহারই ছিল তাঁর সংসারের বড়ো সাথী।
হযরত আলী (রা.) একদিন তার শ্রমের বর্ণনা দিয়ে বলেন, একবার ক্ষুধার তাড়নায় কাজের অনুসন্ধানে মদিনার শহরতলীতে বের হয়ে দেখি, একটি মেয়ে মাটি জমা করছে, যা ভিজানোর পানি প্রয়োজন। আমি একটি খেজুরের বিনিময়ে এক বালতি পানি তুলতে রাজী হলাম। অবশেষে ১৬ বালতি পানি তুলে ১৬টি খেজুর বিনিময় গ্রহণ করলাম। নবি কারিম (সা.) কে পুরো ঘটনা বললাম আর তিনি আমার সাথে খেজুর খেলেন। (আহমদ)
খলিফা হওয়ার পরেও হযরত আলী (রা.) দীনহীনভাবে জীবন যাপন করতেন।
মুসলমানদের বিজয় যখন সারা বিশ্বব্যাপী তখন মুসলিম সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হওয়া এক দিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ পদ অন্য দিকে সম্মানের আসন। নবি কারিম (সা.) শেষ মুহূর্তে রোম সাম্রাজ্যের বিরদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বিরাট সৈন্য বাহিনীর সেনাপতি নিযগুক্ত করেছিলেন হয়রত উসামা (রা.)-কে। বড়ো বড়ো সাহাবা হযরত আবু বকর (রা.), হযরত ওমর (রা.), হযরত উসমান (রা.) ও হযরত আলী (রা.) হযরত উসামার নেতৃত্বে সাধারণ সৈনিক ছিলেন। যুদ্ধে যাওয়ার মুহূর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.) অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে খবর শুনে উসামা (রা.) যুদ্ধ যাত্রা বন্ধ করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেখতে আসলেন। যখন উসামা (রা.) হুজুর এর হুজরায় প্রবেশ করলেন, তখন তাঁর জবান মুবারক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নবি কারিম (সা.) উসামা (রা.) কে দেখে বড়ো বড়ো সাহাবাগণকে ইশারায় হুজরা থেকে বের হয়ে যেতে বললেন এবং হাত তুলে উসামা (রা.) এর জন্য দোয়া করলেন এবং হাতখানা উসামার উপর রাখলেন।
হুজুর (সা.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আবুবকর (রা.) হযরত ওসামা (রা.)-কে সেনাপতি পদে বহাল রাখেন। খলিফা সেনাপতিকে বিদায় জানাবার জন্য মদিনার থেকে দূরে এলেন। ওসামা (রা.) ঘোড়ায় সওয়ার আর মদিনার রাষ্ট্রপতি আবুবকর পায়ে হেঁটে চলছেন। হযরত ওসামা (রা.) লজ্জাবোধ করছিলেন এবং খলিফাকে বার বার ঘোড়ায় সওয়ার হওয়ার আবেদন করলেও খলিফা পায়ে হেঁটেই সেনাপতিকে বিদায় দিলেন এবং সেনাপতিকেও ঘোড়া থেকে নামতে দিলেন না। অবশেষে খলিফা ওসামাকে অনুরোধ করলেন যে, হযরত ওমর (রা.)-কে আমার প্রয়োজন হতে পারে। যদি আপনি ভালো মনে করেন তবে তাকে অনুগ্রহপূর্বক আমার সাহায্যের জন্য রেখে যান।
মুসলিম বিশ্বের খলিফা তার একজন গোলাম সেনাপতিকে কত শ্রেষ্ঠ মর্যাদার আসন দিয়েছেন। ইসলামি ভ্রাতৃত্ব বোধ ব্যতীত এমন সাম্যের নজির কে স্থাপন করতে পারে।
নবি কারিম (সা.) থেকে যিনি সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনা করেন তিনি হচ্ছেন হযরত আবু হুরাইরা (রা.)। আর তিনি ছিলেন একজন শ্রমজীবী। তিনি মদিনার গভর্নরও ছিলেন। মদিনার গভর্নর থাকা অবস্থায় তিনি অতীত স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, এতীম হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি, অসহায় দরিদ্র অবস্থায় হিজরত করেছি এবং আমি একজন বেতন ভুক্ত মজুর ছিলাম। সকল প্রশংসা ঐ আল্লাহর জন্য যিনি ইসলামকে বিজয়ী করেছেন। আর আবু হুরাইরাকে কর্তৃত্বের আসনে বসার সুযোগ করে দিয়েছেন। (তবকাতে ইবনে মাআদ)
একদিন আবু হুরাইরা (রা.) দেখতে পেলেন, একজন লোক ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে আর তার দাস সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। আবু হুরাইরা (রা.) লোকটিকে বললেন- ‘ওকে তোমার পিছনে ঘোড়ায় তুলে নাও। সেও তোমার ভাই এবং তারও তোমার মত আত্মা আছে।”
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘরের সাথে মসজিদে নববীতে একদল দরিদ্র লোক ছিলেন তাদেরকে আসহাবে সুফফা বলা হতো যাদের সংখ্যা ছিল ৭০জন। যারা সব সময় অপেক্ষায় থাকতেন যে, মহান আল্লাহ ও রাসুলের পক্ষ থেকে কি নির্দেশ আসে এবং কিভাবে তারা সবার আগে সে নির্দেশ পালন করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম তাদের জন্য খাবার পাঠালে খেতেন অন্যথায় উপবাস কাটাতেন। নবি কারিম (সা.) তাদের না দিয়ে কিছু খেতেন না। সর্বদা তাদের দুঃখ-সুখের খোঁজ-খবর নিতেন।
একজন শ্রমজীবী মানুষ নবি কারিম (সা.) নিকট আসেন, আল্লাহর নবি তার হাত দেখে বললেন, তোমার হাত এত শক্ত ও কালো কেন। সে জবাব দিল, হে আল্লাহর রাসুল, আমি যে জমি চাষাবাদ করি তা পাথুরে জমি। হাতুরি দিয়ে পাথর ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে হাত কালো ও শক্ত হয়ে গেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) শ্রমিকের হাতখানা টেনে নিয়ে চুমু খেলেন। এভাবেই আল্লাহর রাসুল খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি তাঁর দরদ ও ভালোবাসা ব্যক্ত করেছেন।
ইসলামি সমাজ গোলাম ও শ্রমিকদেরকে আত্মবিকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে এবং সর্বপ্রকার সুযোগ প্রদান করেছে। ফলে শ্রমজীবী ও গোলাম শ্রেণির মানুষ সমাজের ও রাষ্ট্রের সকল সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান লাভ করেছেন। অন্য দিকে মালিক ও শ্রমিকদের মর্যাদা সমমানে রাখার নৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। অভিজাত ও সম্মানিত লোকেরা আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজেদেরকে আল্লাহর গোলামে পরিণত করে সমাজের উঁচু-নিচু মালিক-শ্রমিক সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়েছে।
অসহায় মানুষের অধিকার আদায়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অধীনস্ত শ্রমজীবী ও গোলামের যে অধিকার নির্ধারিত করে দিয়েছেন, নবি কারিম (সা.) মদিনায় একটি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করে তাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। ইসলামি সমাজ যতদিন পর্যন্ত বিশ্বে সগৌরবে অবস্থান করেছে ততদিন অধীনন্ত মানুষগুলো তাদের প্রভুর দেওয়া অধিকার ভোগ করেছে।
একজন অসহায় ইয়াতিম রাসুলুল্লাহ (সা.) নিকট এসে আবেদন করলো যে, আবু জাহেলের নিকট আমি টাকা পাব কিন্তু সে আমাকে টাকা দিচ্ছেনা এবং কেহ তার থেকে টাকা আদায় করে দিতেও রাজী নয়। নবি কারিম (সা.) অসহায় ইয়াতিম ছেলেটির করুন আবেদন শ্রবণ করে তাকে নিয়েই আবু জাহেলের নিকট উপস্থিত হলেন। তিনি আবু জাহেলকে বললেন, চাচা এই ইয়াতিম ছেলেটি কি আপনার নিকট টাকা পাবে? আবু জাহেল সাথে সাথে বলেছিল হ্যাঁ। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন আমি ইয়াতিমের টাকা আদায় করার জন্য এসেছি। তার টাকা না দেওয়া পর্যন্ত আমি ফিরে যাবনা। আবু জাহেল সাথে সাথে টাকা দিয়ে দিলেন। মক্কার সরদারেরা আবু জাহেলকে বলল, তুমি আমাদের সুপারিশ রক্ষা করনা অথচ তোমার দুশমন মুহাম্মদের কথায় তুমি ইয়াতিমের টাকা পরিশোধ করলে। তখন আবু জাহেল বলল, মুহাম্মদ (সা.)-এর কথায় আমার মধ্যে এমন প্রভাব ও ভয় সৃষ্টি হয়েছিল যে, তার টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত আমি স্থির থাকতে পারিনি।
আল্লাহর রাসুল অসহায় মানুষের অধিকার আদায় করার ব্যাপারে সকলের চেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতেন। ইসলামি আন্দোলনের কর্মীদেরকে এ যুগের অসহায় মানুষের অধিকার আদায় করে নবির আদর্শকে সারাবিশ্বে সমুন্নত করতে হবে।
আল্লাহর রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বললেন আমি কি তোমাদেরকে এমন একটা ইবাদতের কথা বলব না, যা নামাজ, রোজা ও সদকার চেয়ে উত্তম। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসুল অবশ্যই আমাদেরকে সে উত্তম ইবাদতের কথা বলুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন বললেন যে, দুটি বিবাদমান ব্যক্তি, গ্রুপ ও জাতির মধ্যে সমস্যার মিমাংসা করে দেওয়া।
এক ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর কাছে এসে বললেন, আমার কাছে এক ব্যক্তি টাকা পাবে। কিন্তু সে তার টাকার জন্য আমাকে খুবই উক্তত্ব করছে। তার কথাশুনে আবদুল্লাহ (রা.) বললেন। চল আমি তাকে অনুরোধ করে তোমার জন্য সময় নিয়ে দেই। একথা বলেই তিনি উক্ত ব্যক্তির সাথে চললেন। তখন আবদুল্লাহ (রা.) মসজিদে এতেকাফে ছিলেন। সে ব্যক্তি তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, আবদুল্লাহ আপনিতো এতেকাফে আছেন, কিভাবে মসজিদ থেকে বের হবেন। তখন জবাবে তিনি বললেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, আমি নিজ কানে শুনেছি যেন কোনো ব্যক্তি যদি কারো সমস্যার সমাধান করে দেয় তাহলে তার আমল নামায় দশ বছরের এ’তেকাফের সাওয়াব লিখা হয়ে যায়। আমিত দশটি এ’তেকাফের সাওয়াবের চেষ্টা করছি কেন একটি নিয়ে বসে থাকব।
আজকের দুনিয়ায় যে সব অসহায় ও মজলুম শ্রমজীবী মানুষ রয়েছে তাদের অধিকার আদায় করার জন্য চেষ্টা করা, সংগ্রাম করা মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং একটি ইবাদত। মুসলিম জাতি যদি তাদের এ দায়িত্ব পালন করতে না পারে তাহলে আল্লাহর কাছে জবাব দিহি করতে হবে।
চতুর্থ অধ্যায় : ইসলামি আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষের গুরুত্ব
ইসলামি আন্দোলন কী?
ইসলামি আন্দোলন অর্থ ইসলাম বিরোধী সকল মতাদর্শ, রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিধি-বিধান বাতিল করে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও আল্লাহর নাফিলকৃত আইন সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা সাধনা করা। সকল নবিরাই এ দায়িত্ব পালন করার জন্যে দুনিয়ায় প্রেরিত হয়েছেন। মহান আল্লাহ কুরআনে ঘোষণা করেছেন:
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُوْلًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ .
“আমি আল্লাহ! প্রত্যেক জাতির মধ্যে নবি প্রেরণ করেছি (তাঁদের দাওয়াত ছিল) একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর, আল্লাহর নির্দেশ ও বিধান মেনে চল এবং তাগুতি শক্তি (ইসলাম বিরোধী শক্তি) পরিহার কর।” (সুরা নাহল: ৩৬)
ইসলাম বিরোধী শক্তির সাথে মোকাবেলা করে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে, ইবাদতে পূর্ণত্য লাভ করবে না।
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُوْلَهُ بِالْهُدى وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
“তিনি আল্লাহ যিনি তাঁর রাসুলকে হেদায়াতের বিধান ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন যেন উহাকে সর্বপ্রকার দ্বীনের ওপর (মানব রচিত মতবাদ, আইন ও ব্যবস্থার উপর) বিজয়ী করে দেয়। মুশরেকদের পক্ষে তা যতই অসহ্য ব্যাপার হোক না কেন।” (সুরা তাওবা: ৩৩, সুরা ফাতাহ: ২৮ সুরা সাফ: ৯)
যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে তাদেরকে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব পালন করতে হবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআনে ইরশাদ করেন-
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنُ بِاللهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىلا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
“যারা তাগুত; ইসলাম বিরোধী শক্তিকে (যে শক্তি নিজের মত ও রচিত আইন অন্য মানুষকে মানতে বাধ্য করে, তাকেই তাগুতি শক্তি বলে) অস্বীকার করে আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে। (আল্লাহর নাজিলকৃত বিধি-বিধান মেনে নেবে।) তারা ইসলামের সুদৃঢ় রশি ধারণ করল যা কখনও ছিঁড়ে যাবে না। আর আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন।” (সুরা বাকারা: ২৫৬)
ইসলাম বিরোধী শক্তির রাজত্ব, শাসন, আইন-কানুন অস্বীকার না করা পর্যন্ত ঈমানের দাবি মিথ্যা। কোনো নবিই সমকালীন শাসকদের রাজত্ব ও তাদের আইন মেনে নেয়নি।
অসহায় মানুষের অধিকার আদায়ে ইসলামি আন্দোলন
শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, গরিব অসহায়, শোষিত বঞ্চিত মানুষকে জালেম অত্যাচারী ও শোষকের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মহান আল্লাহ ঈমানদার লোকদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তাই আল্লাহ তা’আলা কুরআন মাজিদে ঘোষণা করে বলেন:
وَ مَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَ الْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ و النِّسَاءِ وَ الْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَ اجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا ۚ وَ اجْعَلْ لَنَا مِن لَّدُنْكَ نَصِيرًا
“তোমাদের কি হলো যে, তোমরা দুর্বল নারী-পুরুষ ও শিশুদের পক্ষে আল্লাহর রাহে লড়াই করছ না, অথচ তারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদিগকে এই জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দান কর; এখানকার অধিবাসিরা যে অত্যাচারী! আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পক্ষাবলম্বনকারী নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্বাচন করে দাও।” (সুরা নিসা: ৭৫)
মহান আল্লাহ ঈমানদারগণকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, যাতে তারা জিহাদ ও আন্দোলনের মাধ্যমে অত্যাচারিত নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত লোকদেরকে মুক্ত করে এবং তাদের অধিকার রক্ষা করে। এদের মধ্যে অধিকার হারা বঞ্চিত শ্রমিক সমাজও শামিল রয়েছে।
আল-কুরআনে ইসলামি আন্দোলনের জনশক্তি কারা
মানবজাতির মধ্যে ইসলামি আন্দোলনের জন্যে এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার করার লক্ষ্যে নবিদের সাথী হিসেবে যোগ্যতাসম্পন্ন সাহসী জনশক্তি, যারা বাতিলের সাথে মোকাবেলা করতে সক্ষম সে জনশক্তি কোথায় পাওয়া যাবে তা আল-কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ইংগিত করেছে,
মহান আল্লাহ শক্তিমান ও অসহায় মানুষের পার্থক্য ঘোষণা করে বলেন-
إِنَّ فِرْعَوْنَ عَلَا فِي الْأَرْضِ وَجَعَلَ أَهْلَهَا شِيَعًا يَسْتَضْعِفُ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ يُذَبِّحُ أَبْنَاءَهُمْ وَ يَسْتَعْيِ نِسَاءَهُمْ إِنَّهُ كَانَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ وَنُرِيدُ أَنْ نَمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَرِثِينَ
“ফেরাউন তার দেশে উদ্ধত হয়েছিল এবং দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের একটি দলকে দুর্বল করে দিয়েছিল। সে তাদের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা করত এবং নারীদের জীবিত রাখত। নিশ্চয় সে ছিল ফাছাদ সৃষ্টিকারী। (ফেরাউন রাজ্য শাসনের নামে মানুষের মধ্যে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে রেখেছিল।) যাদেরকে পৃথিবীতে দুর্বল করে রাখা হয়েছে আমার ইচ্ছা হলো তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা, তাদেরকে নেতা করার এবং তাদেরকে দেশের উত্তরাধীকারী করার ও তাদেরকে দেশের ক্ষমতায় আসীন করার।” (সুরা কাসাস: ৪-৫)
উল্লেখিত আয়াতে মহান আল্লাহ ফেরাউনের শক্তি, অসহায় মানুষের উপর তার জুলুম ও শোষণের কথা বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে ফেরাউনের রাজ্যের নিষ্পেষিত, নির্যাতিত, অসহায় লোকদের কথা বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে, সমাজে নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্যে অসহায় লোকদেরকে বেছে নিয়েছেন এবং তাদের মাধ্যমে ফেরাউনকে ও তার সৈন্য বাহিনীকে ধ্বংস করেছেন।
সর্বযুগেই অধীন গোলাম ও শ্রমজীবী মানুষকে রাজা-বাদশা ও সমাজের সম্পদশালী লোকেরা দুর্বল, গরিব ও হীন করে রাখার চেষ্টা করেছে। মহান আল্লাহ ঐসব অসহায় মানুষকে সাহায্য করে মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত করে আল্লাহর গোলামে পরিণত করতে চান। তাই অসহায় মানুষ যেভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য, স্বাধীনতার জন্য, অধিকার লাভের জন্য ইসলামি আন্দোলনে ত্যাগ স্বীকার করবে, যারা সমাজে কায়েমী স্বার্থ ভোগ করছে তাদের পক্ষে এত বড়ো ত্যাগ স্বীকার করা সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ তাআলা উল্লেখিত আয়াতে ইসলামি আন্দোলনের শক্তির জন্যে অসহায় মেহনতি লোকদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
অন্যদিকে আল্লাহর শক্তিই বিজয়ের জন্য যথেষ্ট, তাই তিনি চান একদল মোখলেস কর্মী। দুর্বল লোকদের দ্বারা যদি দ্বীন কায়েম হয় তাহলে সবাই আল্লাহর শক্তির প্রশংসা করবে। আর বাদশাহদের দ্বারা দ্বীন কায়েম হলে তাদের শক্তির প্রশংসা করবে। মহান আল্লাহ নিজের শক্তির প্রশংসা চান তাঁর সৃষ্টির কোনো শক্তির তিনি মুখাপেক্ষী নন। সৃষ্টির সকল শক্তির উৎস মহান আল্লাহ নিজেই।
মহান আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার জন্য যেসব বস্তু প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে তা কুরআন মাজিদে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে-
قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَ اَبْنَاؤُكُمْ وَ إِخْوَانُكُمْ وَ أَزْوَاجُكُمْ وَ عَشِيْرَتُكُمْ وَ اَمْوَالُ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَ تِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَ مَسْكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُوْلِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيْلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفُسِقِينَ
“বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা ক্ষতি হওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ কর, আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর ফায়সালা আসা পর্যন্ত আর ফাসেক সম্প্রদায়কে আল্লাহ হেদায়েত করেন না।” (সুরা তাওবা: ২৪)
উল্লেখিত আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষের সবচেয়ে প্রিয় ও প্রয়োজনীয় ব্যক্তি এবং বস্তুর কথা উল্লেখ করে বলেছেন এসব কিছুর চেয়ে যারা আল্লাহ, আল্লাহর রাসুল ও আল্লাহর পথে জিহাদকে ভালোবাসে তারাই আল্লাহর পথের সৈনিক হতে পারে। যারা উল্লেখিত ব্যক্তি ও বস্তুকে আল্লাহ, আল্লাহর রাসুল ও আল্লাহর পথে জিহাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসে তাদেরকে পরকালের চূড়ান্ত ফায়সালার ভয় দেখানো হয়েছে এবং তাদেরকে ফাসেক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
যাদের পৃথিবীর জীবনে সম্পদের প্রাচুর্য আছে, ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, সুন্দর-সুন্দর বাড়ি-ঘর আছে এবং পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে তাদের পক্ষে এসব কিছুর মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর পথে চলা, জিহাদের ময়দানে জীবন উৎসর্গ করা খুবই কঠিন। তাই নবিদের আহ্বানে এসব লোক খুব কমই সাড়া দিয়েছে। কিন্তু গরিব, অসহায়, গোলাম ও শ্রমজীবী মানুষ যাদের সম্পদের প্রাচুর্য নেই, বসবাসের জন্যে সুন্দর-সুন্দর ঘর নেই এবং অর্থের অভাবে পিতা মাতা, স্ত্রী-সন্তানদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না তারাই দুনিয়ার জীবনের চেয়ে আখেরাতের জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে আল্লাহর পথে চলতে পারে এবং তাদের জীবনকে জিহাদের পথে উৎসর্গ করা খুবই সহজ। তাই ইসলামি আন্দোলনের কর্মীবাহিনী হিসেবে দরিদ্র, অসহায় ও শ্রমজীবী মানুষকে সহজেই লাভ করা সম্ভব। নবি কারিম (সা.) এর প্রথম যুগে অত্যাচার ও নির্যাতনের মধ্যে কাফেরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যে ৪০ জন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাদের মধ্যে ৩৫ জনই হচ্ছেন ক্রীত দাস-দাসী, গরিব শ্রমজীবী মানুষ।
আজকের বিশ্বে বিপ্লব
আজকের আধুনিক বিশ্বের যেখানে যতটুকু সুন্দর তার পিছনে শ্রমজীবী মানুষের হাতের ছোঁয়া রয়েছে ও খেটে খাওয়া মানুষের রয়েছে হাঁড় ভাঙা পরিশ্রম। আধুনিক সভ্যতা শ্রমজীবী মানুষ ধরে রেখেছে। তারা কাজ বন্ধ করে দিলে গোটা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই বিশ্বের সকল দেশ ও জাতি শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের প্রতি নির্ভরশীল। আজকের বিশ্বে যতগুলো বিপ্লব হয়েছে সেসব বিপ্লবে শ্রমজীবী মানুষের বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। কম্যুনিস্ট বিপ্লব যেসব দেশে হয়েছে তাদের মূল শক্তি ছিল শ্রমজীবী মানুষ। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পিছনে শ্রমজীবী মানুষের সমর্থন ছিল বলিষ্ঠ। তারা আমেরিকার জাহাজে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে আমেরিকার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমেরিকার আগ্রাসন বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিল। আলজেরিয়ায় ইসলামি দল শতকরা ৮৫ ভাগ ভোট পেয়েও সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেনি কারণ তাদের হাতে দেশের শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন ছিল না। যদিও সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন ছিলো। যদি শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক সমর্থন থাকত তাহলে সকল সেক্টরে শ্রমজীবী মানুষ কাজ বন্ধ করে দিয়ে দেশে হরতাল কর্মসূচির ডাক দিয়ে দেশকে অচল করে দিয়ে যে কোনো সরকারের পতন ঘটানো সহজ হতো। আধুনিক বিশ্বে যে কোনো রাষ্ট্রে বিপ্লব, আন্দোলন ও পরিবর্তনের জন্য শ্রমজীবী মানুষের বলিষ্ঠ ভূমিকা অপরিহার্য।
বিপ্লব ও আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষের গুরুত্ব কেন?
১. শ্রমজীবী মানুষ একই মিল-কারখানা, অফিস ও প্রতিষ্ঠানে একই সময় ও পারস্পরিক সহযোগিতায় এক সাথে অনেকে কাজ করে। যাদের সংখ্যা হাজার ও লাখের কোটায় দাঁড়াতে পারে, তাই তারা নিজদের মধ্যে সব সময় একটি শক্তি অনুভব করে।
২. শ্রমিকদের স্বার্থ অভিন্ন তাই তারা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে পারে।
৩. শ্রমজীবী মানুষ রাজনৈতিক সচেতন কারণ তাদের স্বার্থ সরকারের সাথে জড়িত, তাই দেশের সরকারের উত্থান পতনের আন্দোলনে তারা স্বক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে থাকে।
৪. মেহনতি মানুষ স্বাভাবিকভাবে কঠোর পরিশ্রমী হয়ে থাকে, অলস নয় ও বিলাসীতার প্রতি কোনো মোহ নেই যা হচ্ছে একজন সৈনিকের জীবন। তাই তারা আন্দোলনকে ভয় পায় না।
৫. শ্রমিক অল্পে তুষ্টি লাভ করে, মোটা ভাত-কাপড় ও সামান্য বেতন-ভাতা পেলেই তারা খুশি হয়ে যায়। তাই আন্দোলন করতে বেশি চিন্তা ভাবনা করতে হয় না।
৬. মেহনতি মানুষ একা চলতে অভ্যন্ত নয়, কারো নেতৃত্বে দলবদ্ধভাবে চলতে অভ্যন্ত যা বিপ্লবের পূর্ব শর্ত।
৭. প্রত্যেক শ্রমিক কঠোর শৃঙ্খলা ও কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে চলতে অভ্যন্ত যা বিপ্লবের চাবিকাঠি।
৮. আন্দোলন শুরু হয় শহর থেকে আর শ্রমিক শহর ও শহরতলীতে বসবাস করে। ফলে শহরে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সহজেই তাদের সহযেগিতা পাওয়া যায়।
৯. মেহনতি মানুষের কর্মতৎপরতাই পৃথিবীটাকে সচল রেখেছে। তারা কাজ বন্ধ করে দিলে মানুষের সমাজ সম্পূর্ণ অচল হতে বাধ্য। তাই সকলেই তাদের প্রতি মুখাপেক্ষী আন্দোলনের সফলতার জন্য।
১০. শ্রমজীবী মানুষ আন্দোলন পছন্দ করে। কারণ তারা বিশ্বাস করে জুলুম শোষণ নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য ও ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনই হচ্ছে একমাত্র পথ ও পন্থা।
১১. আজকের বিশ্বে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষের শক্তির প্রভাব লক্ষ্য করে জাতিসংঘ শ্রমিকদের অধিকারের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন আইএলও (ILO) গঠন করেছে। অর্থাৎ শ্রমিক আন্দোলন আন্তর্জাতিক ভাবে গুরুত্ব লাভকরেছে। ইসলামি আন্দোলন আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ব লাভ করতে হলে শ্রমিক সংগঠন জোরদার করতে হবে এবং শ্রমিকদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শ্রমিক আন্দোলন
১. স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তি যুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষ মিল-কারখানা, অফিস দোকানপাট, পরিবহন, বিদ্যুৎ, টিএন্ডটি প্রভৃতি সেক্টরে কাজ বন্ধ করে দিয়ে দেশকে অচল করে দিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
২. বাংলাদেশে অশিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেশি, তাই বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলনের গুরুত্ব সাধারণ লোকদের কাছে খুবই কম, এদেশের মানুষ আন্দোলন বলতে বুঝে মারামারি করে বিজয় লাভ করা, মিল কারখানা, দোকানপাট, অফিস আদালত বন্ধ করা, বাস-ট্রাক, ট্রেন, রিকশা-ভ্যান বন্ধ না করলে হরতাল হয় না, আর হরতাল না হলে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়া যায় না এবং সরকার উৎখাত করা যায় না। এসব কিছুই নির্ভর করছে শ্রমিক আন্দোলনের উপর।
৩. বাংলাদেশের বড়ো বড়ো সকল রাজনৈতিক দলের শ্রমিক সংগঠন আছে এবং সকল রাজনৈতিক দলই দাবি করছে আমরা রাজপথে আছি। অথচ রাজপথের সৈনিক হচ্ছে দোকান কর্মচারী, হোটেল শ্রমিক, রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, বাস-ট্রাক ড্রাইভার। যে দলের শ্রমিক সংগঠন যত মজবুত তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনও তত তীব্র।
৪. এদেশে যে কোনো সরকার ক্ষমতায় এসেই বামপন্থী সংগঠনগুলোর সাথে বৈঠক করে তাদের সাথে একটি সমঝোতায় এসে দেশ পরিচালনা করেন। কারণ জনগণের মধ্যে বামপন্থীদের কোনো সাংগঠনিক প্রভাব না থাকলেও এবং ভোটের বেলায় জিরো হলেও শ্রমিক ময়দানে তাদের মজবুত সংগঠন থাকায় যে কোনো সরকার তাদেরকে কাউন্ট করতে বাধ্য।
গণতন্ত্র ও শ্রমিক আন্দোলন
আজকের বিশ্বে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সকলের নিকট স্বীকৃত। গণতন্ত্রে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার সমান। সকল মানুষের স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকারে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করার অবকাশ নেই। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশের সরকার পরিবর্তন হয়, জনগণের মতামত প্রয়োগ করা হয় ভোটের মাধ্যমে। অধিকাংশ জনগণ যাকে বা যাদেরকে ভোট প্রদান করবে তারাই বিজয় লাভ করে দেশ শাসন করে। ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে গরিব-ধনী, মালিক-শ্রমিক, রাজা-প্রজার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। একজন প্রধানমন্ত্রীর বা রাষ্ট্র প্রধানের ভোটের যে মূল্য, একজন বস্তিবাসীর ভোটেরও সে মূল্য। একজন মালিকের ভোটের যে মূল্য, একজন শ্রমিকের ভোর্টেরও সে মূল্য। যারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে চায় তারা বস্তিবাসী, গরিব, শ্রমজীবী মানুষকে অবহেলা করতে পারে না কারণ এদের সংখ্যাই সমাজে বেশি। গ্রামে গরিব লোকদের সংখ্যা বেশি এবং শহরে শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি। এদের সমর্থন ব্যতীত কেহই সরকার গঠন করতে পারে না।
এ সত্যই ইসলামি আন্দোলনের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কুরআনের বিধান কায়েম করতে হলে গরিব, বস্তিবাসী ও শ্রমজীবী মানুষকে ইসলামি আদর্শ মোতাবেক গড়ে তুলতে হবে। যারা মানব রচিত মতবাদ নিয়ে রাজনীতি করে, তারা গরিব ও মেহনতি মানুষকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে, কিন্তু গরিব মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। ক্ষমতা যাওয়ার পর গরিবদেরকে উচ্ছিষ্ট মনে করে। ইসলামি আন্দোলন শ্রমজীবী মানুষের দুনিয়ার শাস্তি ও আখেরাতের মুক্তির জন্য কাজ করবে দ্বীনি ভাই হিসেবে। যেমন নবি কারিম (সা.) আল কুরআনের বিধান কায়েম করার জন্য আল্লাহর সৈনিক হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন গোলাম যায়েদ (রা.), উম্মে আয়মান, উসামা (রা.), বিলাল (রা.), খাব্বাব (রা.), সালেম (রা.), আম্মার (রা.) প্রমুখকে। যেমনিভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি গরিব, ধনী, শ্রমিক-মালিক, রাজা-প্রজাকে অধিকার ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একই কাতারে দাঁড় করিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে ইসলাম ধনী-গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে। সকল ভেদাভেদ মুছে দিয়েছে।
তাই ইসলামি আন্দোলনের সকল কর্মী ও দায়িত্বশীলদেরকে গরিব ও মেহনতি মানুষকে ইসলামি আদর্শে গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। তাদের ঘরে ঘরে আল-কুরআনের আলো পৌঁছাতে হবে। তাদেরকে ইসলামি আন্দোলনের সৈনিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই তাদের সমর্থন ও ভোটে আল-কুরআনের বিধান সমাজে সহজেই কায়েম হতে পারে।
শ্রমিক আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলন
ছাত্ররা স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করে, তারা ঐক্যবদ্ধ, আন্দোলনের জন্য তারা জনশক্তি সরবরাহ করতে পারে এটা তাদের মূল কাজ। স্কুল, কলেজ ইউনিভার্সিটি বন্ধ করে দিয়ে জনগণের ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না, যেমন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছয়মাস বন্ধ করে রাখার পরেও জনগণের ওপর সরাসরি কোনো প্রভাব পড়ে না কিন্তু শ্রমজীবী মানুষ দেশের বাস্তব কাজের সাথে জড়িত, তাদের হাতেই উন্নয়নের চাবী কাঠি, শ্রমিকরা যদি বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চ, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, দোকান-পাট, মিল-কারখানা, টেলিগ্রাম, টেলিফোন, বিদ্যুৎ, ওয়াসা একদিনের জন্যও যদি বন্ধ রাখে তাহলে গোটা দেশ অচল হয়ে যায়, জনগণের ওপর আঘাত পড়ে এবং সরকার উৎখাত হয়ে যায়। তাই শ্রমিক আন্দোলনের গুরুত্ব অনেক বেশি।
শ্রমিকদের প্রতি ইসলামি আন্দোলনের কর্মীদের দায়িত্ব
১. ইসলামি আন্দোলনের সকল পর্যায়ের নেতা কর্মীদেরকে আধুনিক শ্রমিক আন্দোলন, ট্রেড ইউনিয়ন তৎপরতা ও ইসলামি শ্রমনীতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
২. বাংলাদেশের ইসলামি আন্দোলনের বিজয়ের জন্য শ্রমিক আন্দোলনের কাজকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে এদেশে সকল পর্যায়ের শ্রমিকদের মধ্যে শ্রমিক সংগঠনকে মজবুত করার জন্য ইসলামি আন্দোলনের সকল পর্যায়ের নেতা কর্মী ও জনশক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে।
৩. ইসলামি আন্দোলনের সমর্থক, কর্মী ও দায়িত্বশীলদের পাশে শ্রমজীবী মানুষ বসবাস করছে, তাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে তাই প্রত্যেক ইসলামি আন্দোলনের কর্মী শ্রমজীবী মানুষকে টার্গেট নিয়ে তাদেরকে ভালোবাসতে হবে, তাদের অভাব, অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট ও সমস্যা সমাধানে আন্তরিক চেষ্টার মাধ্যমে আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাদেরকে হীন মনে করা যাবে না, ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে আন্তরিকতার সাথে। যদি আমরা তাদেরকে হীন মনে করি, যেমন আজকের সমাজে করছে তাহলে আল্লাহ তাদেরকে আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিবেন এবং তারা ইসলামি আন্দোলনের বিরুদ্ধে কাজ করবে। তাদেরকে ইসলামি আন্দোলনের দাওয়াত দিতে হবে ও সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে, তাহলে দেশের সকল জায়গায় শ্রমিকদের মধ্যে ইসলামি আন্দোলনের সংগঠন গড়ে উঠবে এবং তারা হবে ইসলামি আন্দোলনের নিষ্ঠাবান সৈনিক।
৪. যেসব ছাত্র ইসলামি আন্দোলন করছেন এবং ইসলামি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের ছাত্র জীবন শেষ হওয়ার পর তাদের নেতৃত্ব শ্রমিক ময়দানে বিভিন্ন সেক্টরে প্রয়োজন। তাই ইসলামি আন্দোলনের খাতিরে শ্রমিক কর্মচারী হিসেবে বিভিন্ন সেক্টরে চাকুরি নিতে হবে। তাদের নেতৃত্বে শ্রমজীবী মানুষকে ইসলামি আন্দোলনের জন্য গড়ে তুলতে হবে এবং তাদেরকে সুসংগঠিত করতে হবে, তাহলে সহজে শ্রমিক ময়দান দখল করা যাবে।
৫. কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ যেখানেই সফর করবেন শ্রমিকদের কাজের অগ্রগতি তদারকি করবেন এবং এ ময়দানে কাজ জোরদার করার জন্যে কর্মী ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে উৎসাহিত করবেন।
৬. জেলা, মহানগরী, উপজেলা ও থানা পর্যায় পর্যন্ত শ্রমিক আন্দোলনের নেতা-কর্মী রয়েছে। তাদেরকে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা ও দরদ দিয়ে শ্রমিক ময়দানে কাজ করাতে হবে এবং অফিস মিল কারখানা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইসলামি আন্দোলনের জনশক্তিদের কাজ করার জন্য দায়িত্ব প্রদান করতে হবে।
৭. সকল স্তরের নেতৃবৃন্দের মধ্যে শ্রমিকদের কাজের শুরুত্ব বুঝার ব্যবস্থা করতে হবে, এ ব্যাপারে সকল পর্যায়ের প্রশিক্ষণ কোর্সে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে কাজের পদ্ধতি ও গুরুত্বের উপর বিষয় রাখতে হবে।
৮. শ্রমিকেরা যেহেতু গরিব অশিক্ষিত, অধিকার হারা বঞ্চিত, সমাজের কাছে অবহেলিত, অতএব তাদেরকে ইসলামি আন্দোলনের কর্মীরা যদি ভাই হিসেবে গ্রহণ করেন বিপদে তাদের পাশে থাকেন, তাদের সেবা করেন এবং তাদের অধিকারের কথা বলেন, সর্বদা তাদের খোঁজ-খবর রাখেন তাহলে সহজেই তাদের আপনার সাথী হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে পেতে পারেন। এত সহজে সমাজের অন্য কাউকে পাওয়া যাবে না। তাই নবিগণ অসহায় খেটে খাওয়া মানুষকে তাদের আপন করে নিয়ে ছিলেন এবং তারাও নবিগণকে তাদের জীবন উৎসর্গ করে সহযোগিতা করেছেন।
যতদিন পর্যন্ত ইসলামি আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করা যাবে এবং দলে দলে যোগদান না করবে ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলামি আন্দোলনের সফলতা অনিশ্চিত থেকে যাবে।
পঞ্চম অধ্যায় : ইসলাম ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন
শ্রমিক আন্দোলন কী?
অষ্টাদশ শতাব্দর মাঝামাঝি সময়ে বিশেষ করে বৃটেনে এক বিপ্লব সূচিত হয়। গোটা মানবজীবনে যার প্রভাব ছিল সূদুরপ্রসারী। আর তা ছিল শিল্প বিপ্লব। যার সূচনা হয় নতুন নতুন যন্ত্র উদ্ভাবন দ্বারা। এই সব নতুন যন্ত্রপাতি হস্তশিল্পের উপর প্রভাব বিস্তার করে। আর এই সব যান্ত্রিক শক্তি মানুষের পেশি শক্তিকে অবদমিত করে তোলে এবং তার মধ্যে যান্ত্রিক যুগের বীজ রোপণ করে, যে যান্ত্রিক যুগে বর্তমানে মানুষ বসবাস করছে।
এই শিল্প বিপ্লবের গুরুত্ব আমরা খাটো করে দেখছি না। কারণ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব কেবল শিল্প ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হয়েছে। ইতঃপূর্বে সমাজ ছিল অর্গলবন্ধ। আর সমাজ কাঠামো ছিল ছবির। শিল্প বিপ্লবের ফলে সামাজিক সংস্থা-সংগঠনের দ্বার উন্মোচিত হয় এবং সমাজ কাঠামো হয়ে ওঠে উন্নয়নশীল ও অগ্রগামী। ইতঃপূর্বে অর্থনীতি ছিল নিছক প্রাকৃতিক বিষয়, যার লক্ষ্য ছিল অভাব পূরণ করা। পরবর্তীকালে তা সম্প্রসারিত হয়ে মুনাফা অর্জন করাকে লক্ষ্য স্থির করে। ইতঃপূর্বে কাজ করা হতো হন্ত দ্বারা। ব্যক্তির দক্ষতা আর আগ্রহের উপর তা নির্ভর করত। আর শ্রমিক পালন করত কর্তার ভূমিকা। শিল্প বিপ্লবের ফলে হাতের কাজ যন্ত্র দ্বারা সাধিত হয় এবং পুঁজিপতি কর্তৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। পূর্বে সমাজ জীবন কিছু বিশ্বাস আর ধারণার নিগড়ে আবদ্ধ ছিল। সেখানে লক্ষ্য ছিল শান্তি ও স্থিতি। পরবর্তীকালে তার স্থান দখল করে ব্যবসা। যার লক্ষ্য দাঁড়ায় মুনাফা অর্জন করা। ফলে একদিকে শ্রমিক-মালিক সংঘাত শুরু হয়। অপর পক্ষে, কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। সংক্ষেপে বলা চলে, যে সমাজে বর্তমানে আমরা বসবাস করছি এবং যে সমাজ দ্বারা আমরা প্রভাবিত হচ্ছি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব সূদুরপ্রসারী। আমাদের বর্তমান জীবনধারা শিল্প বিপ্লবের অনিবার্য পরিণতি। অনাগত কালেও তা অব্যাহত থাকবে।
যেহেতু আধুনিক শিল্প বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল মুনাফা অর্জন করা। আর যে দর্শনের অধীন শ্রমিকরা শ্রম দান করে তা ছিল স্বাধীনতা। এর ফলে পুঁজিপতিরা চরম সুবিধা লাভের সুযোগ পায়। তারা শ্রমিক শ্রেণিকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে বর্বরভাবে ব্যবহার করে। এ প্রসঙ্গে শিল্প কারখানার শিশু এবং নারী শ্রমিকদেরকে ব্যবহারের উদাহরণ পেশ করা যায়। গার্মেন্ট শিল্প এবং কয়লা খনিতে নারী এবং শিশু শ্রমিকদেরকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করা হয়। এদেরকে দীর্ঘ সময় খাটানো হয় আর মজুরি দেওয়া হয় সর্বনিম্ন। এর দ্বারা তারা ন্যূনতম চাহিদাও পূরণ করতে পারে না। তারা কোনো রকমে জীবন ধারণ করে। দুর্যোগকালের জন্য কিছু সঞ্চয় করার সুযোগ তারা পায় না। ফলে সুষ্ঠুভাবে কাজ করা সম্ভব হয় না। চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত থাকে। এমনিভাবে শ্রমিক শ্রেণি মানবিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। কষ্ট-ক্লেশ, অব্যাহত দুর্ভোগ আর দুর্দিনের একটা অংশে পরিণত হয় তাদের জীবন। এমনি অমানবিক পরিবেশে তাদেরকে জীবন নির্বাহ করতে হয়। এভাবে কলঙ্কিত হয় পুঁজিবাদ। অবশেষে এক পর্যায়ে তারা এই দুর্ভোগ আর দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের জন্য আকুতি জানায়; কিন্তু মুক্তি লাভের পরিবর্তে তারা এক নতুন শোষণের যাঁতাকলে আটকা পড়ে।
শ্রমিক শ্রেণি এই দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের আশায় শাসকগোষ্ঠী এবং গির্জার অধিপতিদের নিকট ধরনা দেয়। কিন্তু, এই উভয় শ্রেণি তাদেরকে দান করে এমন শর্ত, যা শ্রবণ শক্তি রহিত। কারণ শ্রমিক শ্রেণির অধিপতিরা ছিল পুঁজিপতি। সরকার পরিচালনায় তাদের রয়েছে বিরাট ক্ষমতা। শ্রমিক শ্রেণি যখন জোটবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায় তখন ১৭৯৯ সালে বৃটেন সরকার শ্রমিকদের সংগঠন গড়ে তোলাকে বেআইনি ঘোষণা করে আইন জারি করে। অথচ এই জোটবদ্ধ জীবন যাপনের মধ্যে নিহিত ছিল তাদের ঐক্য, সংহতি ও শক্তি-সামর্থ্য। এই নতুন আইনকে শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য এবং কর্মের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও প্রতিবন্ধকতা বলে আখ্যায়িত করা হয়। অথচ এই আইনের দাবি ছিল শ্রমিক শ্রেণির জোটবদ্ধ হওয়ার অধিকার স্বীকার করে নেওয়া, তাদের সম্পদ রক্ষা করা এবং এ ক্ষেত্রে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ১৮২৪ সাল পর্যন্ত এই আইন বলবৎ থাকে। ইউরোপের অন্যান্য সরকার ও রাষ্ট্র বৃটেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশে উনবিংশ শতাব্দর মধ্যভাগ পর্যন্ত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন নিষিদ্ধ ছিল। এ সময়ে শ্রমিক শ্রেণি নানাবিধ উপায়ে বিভিন্ন দেশে সরকারি স্বীকৃতি লাভের জন্য চেষ্টা চালায়। ফলে, শ্রমিক আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং বহুবিধ সংগঠন-সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ছাড়া কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। কেবল ঐক্য সংহতি আর সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক শ্রমজীবী মানুষ শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হতে পারে।
এমনিভাবে শ্রমিক আন্দোলন দাবি-দাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষের নিকট অগ্রসর হয়। মজুরি এবং কর্ম-ঘণ্টা সম্পর্কে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার দাবি জানায়, তারা সুবিচার কামনা করে, যাতে সহজে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে পারে। যেহেতু শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিকরা জড়িত, আর আলাপ-আলোচনা এবং চুক্তিতেও শ্রমিকের নাম উল্লেখ আছে, ফলে শ্রমিক শ্রেণি উপর থেকে নিচে এসে পথের মধ্যস্থলে ট্রেড ইউনিয়নের মুখোমুখি হতে বাধ্য হয় এবং তারা উভয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করে, যাকে বলা যায় যৌথ দরকষাকষি বা যৌথ আলোচনা। একটা মতৈক্য চুক্তি বা যৌথ কর্ম সম্পাদন চুক্তিতে গিয়ে তা সমাপ্ত হয়। আর এই সরল কৌশল অর্থাৎ ব্যক্তিগত উপায়ের চুক্তিতে পরিবর্তন করা, যেখানে শ্রমিক শ্রেণি হয় পরাজিত। সামষ্টিক পদ্ধতি মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এখানে শ্রমিক আন্দোলন ‘কর্ম সমর্পণ’ করতে বাধ্য হয় এবং এমন গুণ-বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, যা একচেটিয়া সুবিধা ভোগকারীর জন্য অপরিহার্য। আর এটাই হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে প্রবেশ করার পথ এবং এই কাজের মূল সারবস্তু। উদার নৈতিক সমাজে অদ্যাবধি এই অবস্থা অব্যাহত আছে। এর ফলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন মজুরি বৃদ্ধি নিশ্চিতকরণ এবং কাজের পরিবেশ উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া রোগ-ব্যাধিকালে সহায়তা নিশ্চিতকরণ এবং অক্ষমতা, কর্মহীনতা এবং বার্ধক্যের বীমার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে।
কোনো রকম অতিরঞ্জন ছাড়াই এ কথা বলা যায় যে, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনই হচ্ছে দায়িত্বশীল সংগঠন। অপর যে কোনো সংস্থা বা সংগঠন থেকে এর দায়িত্ব অনেক বেশি। এর মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির মান উন্নত করা যায়। সামাজিক সুবিচার এবং শিল্প কারখানার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গণতান্ত্রিক অঙ্গনে প্রবেশ করলে গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিকাশ লাভকরে। এর ফলে একাধিক দল গঠনের ভিত্তি স্থাপিত হয়, যা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের জন্য অপরিহার্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মধ্যম শ্রেণির সহানুভূতিশীল অংশ, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক গভীর পরিবর্তন সাধন করে, যেমনটি করেছিল বৃটেনে ১৯৪৫ সালে লেবার মন্ত্রীসভা। এ সময় সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম এবং সামষ্টিক নীতি গ্রহণ করে। ফলে বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় বাজেট গৃহীত হয়, যা ছিল মানবিক, কেবল আক্ষরিক নয়।
এই সব সাফল্য বড়ো বড়ো চিন্তাশীলদেরকে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন যে আধুনিক যুগে সবচেয়ে বড়ো মানবিক আন্দোলন, এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য করে। কারণ এ আন্দোলন বিপুল জনগোষ্ঠীকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা এবং অভাব-অনটন থেকে মুক্তি দিয়ে সত্যিকার গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। আর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সমাজতন্ত্রের চেয়ে উত্তম। সমাজতন্ত্রে রয়েছে গালভরা বুলি আর অন্তঃসারশূন্য কথা-বার্তা এবং সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব-নিকাশ। সেখানে আছে প্রতারণামূলক বাঁকা পদ্ধতি। আর এ আন্দোলন গণতান্ত্রিক রাজনীতির চেয়ে উত্তম। কারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন নির্বাচনের দিনে গালভরা বুলি ছাড়া আর কিছুই দেয় না। দু’জন বৃটিশ লেখক মি. সিডনি এবং মি. বিয়ারটেস ডব্লিউ বি স্বীকার করেন যে, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গণতান্ত্রিক নাগরিক সৃষ্টির ক্ষেত্রে বৃটেনের সংবিধানের চেয়ে বেশি দায়িত্বশীল। কারণ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শ্রমকে গণতান্ত্রিক পরিবেশে পরিণত করে। যেখানে শ্রমিকের জন্য মতামত প্রকাশ করা এবং পরামর্শ দেওয়ার স্বাধীনতা আছে।
এতসব কিছু সত্ত্বেও গোটা বিষয়টা স্বচ্ছ নয় এবং ত্রুটিমুক্তও নয়। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শ্রমিক শ্রেণিকে অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত করার ভিত্তি হিসেবে। অর্থাৎ তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিছক বৈষয়িক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, চাই সে উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক হোক যার সম্পর্ক মজুরির সঙ্গে, অথবা শ্রমের সঙ্গে সম্পর্ক হোক, যেমন-শ্রম ঘণ্টা হ্রাস করা অথবা কাজের পরিবেশ সুন্দর করা। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এ ক্ষেত্রে তার ভূমিকা পালন করে। আর এই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সূচনা হয়েছে ইউরোপীয় সমাজে, যেখানে ধর্মের সঙ্গে সমাজের কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ ধর্ম সমাজ জীবনের নিয়ন্ত্রক নয়। সেখানে ধর্ম থেকে সমাজ দূরে অবস্থান করে অথবা ধর্ম সম্পর্কে নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে। আর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় ইহা তার ভূমিকা পালন করে। এমনকি কম্পন ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। যেমন- এই আন্দোলন মুক্ত হয়েছে মৌলিক প্রাথমিক চিন্তা অর্থাৎ ঈমান থেকে। অর্থাৎ সূচনাতে ঈমানের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। এর সম্পর্ক কেবল উপার্জন এবং ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার সঙ্গে। আর সূচনাকালে এই মৌলিক লক্ষ্য ধর্ম ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। মূল্যবোধ, দৃষ্টান্ত এবং মৌলিক লক্ষ্যের ক্ষেত্রে ধর্মই হচ্ছে সর্বোচ্চ মানদণ্ড। আর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন নিছক একটা সুদৃঢ় কৌশল বা শক্তিশালী পদ্ধতি হিসেবে জন্ম লাভ করেছে। আর এ সব কিছু জনগণের অনুভূতিতে শূন্যের কোঠায় গিয়ে পৌঁছেছে। আর এই সুযোগে এক শ্রেণির সুবিধাবাদী চক্র নেতৃত্বের আসন দখল করে বসেছে। কর্তৃত্বের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া অথবা তাকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা ধর্মের নেই। যেমন- পুঁজিবাদী দেশগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সামনে দুর্বল করে রাখা হয়েছে। সেখানে কম্যুনিস্ট আন্দোলন দ্রুত প্রসার লাভ করছে আর এই আন্দোলনের প্রবক্তারা তাদের এ আন্দোলনকে পূর্ণাঙ্গ দর্শন বলে দাবি করছে এবং তারা মনে করছে যে, শ্রমিক রাজ প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য। এভাবে পুঁজিবাদী শোষণের অবসান ঘটাতে চায় তারা। আর পুঁজিবাদী সমাজে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন তাদের গতানুগতিক উপায়-উপকরণ দ্বারা বেশি দূর অগ্রসর হতে সক্ষম নয়। এতে করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হয় না। এমনিভাবে কম্যুনিস্ট আন্দোলন স্বভাব সুলভ চাতুর্য দ্বারা অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। ফলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে জনগণের আস্থায় নাড়া দিতে থাকে এবং নেতৃত্বের পদে ক্রমাগত স্থান করে নিতে সক্ষম হয় এবং এই আন্দোলনকে কার্যকর সংগঠনে পরিণত করে যা দেশের অভ্যন্তরে কম্যুনিজমের রূপরেখা বাস্তবায়নে নানাভাবে কাজ করে যায়।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে আর একটা ত্রুটি হলো বস্তুনিষ্ঠ মানদণ্ডের অভাব। যা শ্রমিক এবং মালিকের মধ্যে সম্পর্কের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়। মালিক পক্ষকে শূন্যতা নিরসনে এগিয়ে আসতে হবে। এখানে বস্তুনিষ্ঠ এমন কোনো মানদণ্ড নেই, যা উভয়ের মধ্যে ভেদরেখা টানতে পারে। আর উভয়ের মধ্যে সংঘাত নিরসন হতে পারে কাজে যোগদান না করা, কারখানা বন্ধ করে দেওয়া, অথবা কোনো এক পক্ষ সমতার ভিত্তিতে দুঃখকে স্বীকার করে নেওয়া দ্বারা। আর এটা করতে হবে পুনরায় আলোচনার আশায়। আর সেখানে প্রতারণার অনুভূতি সব সময় থাকে। কারণ ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির উপর বিধান প্রণীত হয়।
কিন্তু, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এই জন্য দায়ী নয়। কারণ পুঁজিবাদী বা উদার নৈতিক সমাজের প্রকৃতি হচ্ছে এই যে, তা ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত যাইহোক না কেন- সূচনায় পরিণত করে। পাঠক দেখতে পান যে, এ সব ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিক্রিয়া এবং একের সঙ্গে অপরের সম্পর্ক এটাই হচ্ছে সমাধান বা সমতা বিধানে উপনীত হওয়ার সর্বোত্তম পন্থা। অবশ্য কম্যুনিস্ট সমাজে দলের কঠোর নীতি সকলকে শিকলে আবদ্ধ করে নেয় যা ছিন্ন করা সম্ভব নয়।
আর এখন বাকি থাকল ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। এই আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণির জন্য বেঁচে থাকার নিমিত্ত ন্যূনতম আহার্যের নিশ্চয়তা দেয়। শ্রমিক শ্রেণির গৃহহীন হওয়া এবং অভুক্ত থাকার মধ্যস্থলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর তাদের জন্য উপযুক্ত সম্মানজনক জীবন যাপনের ন্যূনতম চাহিদা ধীরে ধীরে নিশ্চিত করে।
সংঘবদ্ধ ও সংগঠিত হওয়া বর্তমান যুগে সবচেয়ে বড়ো চিন্তা। এ কাজ কেমন করে সম্পন্ন হবে? বাস্তবতা সব কথা আর সব রেখাকে ছিন্ন করে। কারণ শিল্প-কারখানা আর খনি ইত্যাদি স্থানে শ্রমিকের সমাবেশ শ্রমিক শ্রেণির জোট সৃষ্টি করেছে। আর ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য চিন্তা ও অনুভূতির ঐক্য অপরিহার্য। এটাই প্রয়োজনে সংগ্রাম করাকে অপরিহার্য করেছে এবং এক্ষেত্রে সাফল্য লাভের জন্য প্রয়োজনীয় উপায় উপকরণ উদ্ভাবন করেছে। আর এখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে কর্ম বিরতি বা ধর্মঘট। সকল বৈধ উপায়ে জুলুম প্রতিরোধ করার অধিকার মানুষের রয়েছে। এভাবেই গড়ে উঠেছে শ্রমিক শ্রেণির জোট। আর অভিজ্ঞতার আলোকে সৃষ্টি হয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। শ্রমের কারণেই গড়ে উঠেছে জোট এবং শ্রমের যোগাযোগ। ফলে সৃষ্টি হয়েছে শ্রমিক শ্রেণি আর মালিক পক্ষের মধ্যে সংঘাত। এখান থেকেই সূচনা হয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের। যেখানে বিশ্বাস প্রবেশ করেছে বাস্তবতার গভীরে আর পেশা বা বৃত্তির প্রাণসত্ত্বা রূপান্তরিত হয়েছে বৈপ্লবিক প্রাণসত্ত্বায়। ফলে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে পরিবেশ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, মার্কসবাদীদের চিন্তাধারা অনুযায়ী অপরিহার্য ভিত্তি হিসেবে নয়।
আসল কথা এই যে, সৃষ্টি হচ্ছে পেশা বা বৃত্তির প্রাণসত্ত্বা। আর এটাই হচ্ছে বিতণ্ডার মূল বিষয়। যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে ওঠেছে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে শ্রমিক মালিকের মধ্যে রেষারেষি। এটা এমন বিষয়, যা থেকে বাঁচার উপায় নেই। কিন্তু দীর্ঘদিনের বিরোধ অব্যাহত থাকবে, এটা কী অপরিহার্য? আমরা বিশ্বাস করি, যৌথ স্বার্থ উভয় পক্ষকে একদিন কাছাকাছি নিয়ে আসবে। কাছাকাছি নিয়ে আসবে সকল উৎপাদনকারীকে, উৎপাদনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা যেমনই হোক না কেন। কিন্তু, এহেন সুস্থ-সবল সহযোগিতা ভিত্তিক সংগঠন গড়ে তুলতে অতীতে আমরা সক্ষম হইনি, তাই বলে সামাজিক সংকট থেকে পলায়ন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর এই সহযোগিতা ভিত্তিক সংগঠন আমাদের দৃষ্টিতে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য সুদূর লক্ষ্য।
শ্রমিক শ্রেণিকে সংগঠিত করা, তাদের মানসিক প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে তাদেরকে সচেতন করে তোলা এটাই হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। এমনকি সমস্ত অধিকার ভোগ করার পরও এই লক্ষ্য অপরিবর্তিত থাকবে। কারণ অধিকার ভোগ করার জন্য অপরিহার্য হচ্ছে সংগ্রামের মূল ধারা অব্যাহত রাখা। তবে আমরা এমন কথা কখনো বিশ্বাস করি না যে, বিপ্লবের পথ ধরে সংগঠনের হৃদয়ে কঠোর আঘাত হেনে লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে।
শ্রমিক শ্রেণিকে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে যে সব উপায়-উপকরণ-ব্যবহার করতে হবে তা এক জায়গায় সন্নিবেশ করতে হবে, এমন নির্দেশ দেওয়ার অধিকারও আমাদের নেই। কারণ আমাদের দৃষ্টিতে শিল্প কারখানা আর সরকারি বিবেচনা অনুযায়ী এটা বিকশিত হবে। শ্রমিক শ্রেণির অধিকার হচ্ছে আলাপ আলোচনা, কর্মবিরতি, ধর্মঘট এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার সংরক্ষণ করা। আর এ কাজ তখন করবে যখন রাষ্ট্র সহজে দাবি মেনে না নেয় অথবা প্রচলিত বিধান বাস্তবায়ন করা সরকার প্রত্যাখ্যান করে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে সংগ্রামের অভিজ্ঞতার দাবি অনুযায়ী শেষ উপায়টিই বিকশিত হতে পারে। এমনিভাবে আমরা এখানে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে একটা স্থায়ী আন্দোলন হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে কাজের মূল শক্তি এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অব্যাহত রাখা।
সুতরাং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের প্রভুত্ব কল্যাণ সাধন করতে পারে। আবার সামাজিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে; কারণ এ আন্দোলন উদার মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে দেশে দেশে এ আন্দোলন তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ঈমানের সঙ্গে এর সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। ফলে আজ তা এক ধরনের জড়তার শিকার হয়ে পড়েছে। নেতৃত্বের নিম্নন্তর থেকে উচ্চন্তর পর্যন্ত সর্বত্র এ জড়তা বিরাজ করছে। সততার ভিত্তিতে এ আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে না। ফলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন নীতি ভ্রষ্ট হচ্ছে এবং সুবিধাবাদী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের জন্য পথ উন্মুক্ত করে দিচ্ছে।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সত্যিকার ঈমান বর্জিত হওয়ার ফলে তার প্রকৃত মান রক্ষা পায়নি। মালিক পক্ষ এবং সরকারের নিকট যে মানে উন্নীত হওয়ার দাবি করা হয়, তা হল ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক সুবিচার। যে সব দেশে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন চালু আছে সেখানেও এমন প্রাথমিক স্বীকৃতি লাভ করেনি, যার ফলে শ্রমিক শ্রেণির জন্য ইনসাফ ভিত্তিক নীতিমালা কার্যকর করা যায়। অন্যান্য দেশে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের লেবেল লাগিয়ে মতলব হাসিল করার অভিযোগ উঠেছে। জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সুযোগ-সুবিধার প্রতি দৃষ্টি দানের অভিযোগ আছে।
আরব দেশগুলোর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সত্যিকার ঈমান থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে প্রলোভনের মুখে নিষ্পাপ নিঃষ্কলুশ থাকা এবং উপহাসের মুখে শক্তি সঞ্চয় করা থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। যার ফলে কম্যুনিস্ট এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের সম্মুখে পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বিপর্যয় সৃষ্টি করা এবং ভিতর থেকে গোলযোগ বাধানোই যাদের কাজ।
এ কারণেই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে স্বাধীন সত্তা অক্ষত রেখে সম্মুখে অগ্রসর হতে অক্ষম হয়েছে। আর বিভিন্ন সরকার তাদের সঙ্গে হাত মিলাতে এগিয়ে এসেছে এবং ভিতরে বাহিরে সরকার তাদেরকে কব্জা করার জন্য জাল বিছিয়েছে। এরা সরকারের ভাষায় কথা বলে এবং তাদের হাতই শক্তভাবে পাকড়াও করে।
শ্রমিক শ্রেণি যে দৃষ্টিভঙ্গি সম্মুখে রেখে এগিয়ে যেতে পারত তা থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে। ইসলামের বিভিন্ন দিক স্পষ্ট করে তুলে ধরা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল, যার ফলে ইসলামের যৌবন নতুনভাবে প্রকাশ করা যেতো এবং এর ফলে ফিকহের অনেক জটিল এবং সূক্ষ্ম তাত্ত্বিক গ্রন্থি উম্মোচন করা সম্ভব হতো।
উপরে যে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে তা আমাদের সম্মুখে আধুনিক যুগে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের গুরুত্ব ও শঙ্কা স্পষ্ট করে তুলে ধরে। আর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের প্রতি ইসলামি চিন্তাবিদদের অজ্ঞতা সুলভ আচরণ ইসলামের দুশমনদের জন্য বিরাট সহায়ক ভূমিকা পালন করে। চাই ইসলামের দুশমনরা কম্যুনিস্ট হোক বা খ্রিষ্টান ক্রুশেদ। ফলে জনগণের বৃহৎ সংগঠনের সঙ্গে তাদের মিশে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব প্রতিফলিত হয় অপর সংগঠনগুলোর উপর। এই সংগঠনগুলো কম্যুনিস্ট এবং খ্রিষ্টান ক্রুশেদদের হস্তগত হয়। আর যুগের স্রোত যখন তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তখন আরব দেশগুলোর সম্পদের প্রাচুর্য আর দারিদ্র তাদের কোনো কাজে আসেনি। রক্ষা করতে পারেনি তাদের সরকার এবং মহান ব্যক্তিদেরকে কোনো কিছুই। অগ্নি আর দহন যন্ত্রণা ছাড়া তাদের আর কিছু পাওয়ার ছিল না অর্থাৎ পুঁজিবাদের লাঞ্ছনা আর কম্যুনিজমের নির্মূল অভিযান। আল্লাহ সম্পর্কে তারা কিছু না জানলেও নিজেদের সম্পর্কে তাদের কিছু জানা উচিত। তাদের একথাও জানা উচিত ছিল যে, তাদের জাতি তাদের ব্যাপারে দয়াশীল ও সহানুভূতি প্রবণ। কেমন করে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে সে বিষয়ে তারা উদগ্রীব। হায়! যদি অজ্ঞতা আর শত্রুতার রজনীর অবসান ঘটত।
ইসলাম ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ডাক দেয়
আধুনিক কালের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং উপায়-উপকরণের সাথে ইসলাম একমত প্রকাশ করে। কারণ হিজরি তৃতীয় শতাব্দ থেকে হিজরি ত্রয়োদশ শতাব্দ পর্যন্ত যে সব কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক সংস্থা দেখা যায় সাম্প্রতিককালের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন থেকে তা ভিন্ন। আর এ কারণে তার উপর অনুমান করে কিছু বলা গ্রহণযোগ্য নয়।
আর এ কথাও বলা যায় যে, এ হচ্ছে স্বেচ্ছাচারী প্রতিরোধ। কারণ সন্দেহ নেই যে, প্রাচীন বৃত্তিমূলক সংস্থা-সংগঠন কারিগরদেরকে পেশার ভিত্তিতে একত্র করত, যেমন করে থাকে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। উপরন্তু, কারিগর শ্রেণি এবং পেশাজীবীদের অধিকার সংরক্ষণেই সেসব সংগঠন সীমাবদ্ধ না থাকলেও তাদের অধিকার সংরক্ষণ করা ছিল সে সব সংস্থা-সংগঠনের অন্যতম লক্ষ্য। যা তাকে আধুনিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি উপাদানে অন্তর্ভুক্ত করে। আর তার উপর অনুমান করে কিছু বলা প্রত্যাখান করা যায় না। এতদ্বসত্ত্বেও আমরা বলি, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের জন্য আমরা কিছু মূলনীতি উপস্থাপন করছি এবং আমরা স্পষ্ট করে একথা বলছি যে, ইসলাম কেবল ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই এবং উপায়-উপকরণ স্বীকার করে নিয়েই শেষ করে না, বরং ইসলাম এ জন্য আহ্বান জানায়।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য
তাহলে শুরুতেই আমরা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা করি। সে সব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী?
সকলেই জানে যে, শ্রমিক শ্রেণির শোষণ রোধ করার জন্যই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের জন্ম হয়েছে, শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায় এবং সুবিচার নিশ্চিত করা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে সর্বপ্রথম ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শুরু হয়, ইতিপূর্বে এ বিষয়টি আমরা অত্যন্ত স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছি। আর অদ্যাবধি এই জন্যই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন কাজ করছে। যদিও বর্তমানে পুঁজিবাদী শোষণের তীব্রতা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। কারণ অধিকার সব সময় অব্যাহত সহায়তা প্রত্যাশি। আর এ কথাও সত্য যে, সুবিচার আপেক্ষিক বিষয়- কারণ মার্কিন দেশের একজন শ্রমিক আফ্রিকার একজন শ্রমিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মজুরি পায়। কিন্তু এরপরও সে শোষণের শিকারে পরিণত হতে পারে। কারণ তার দক্ষতা এক জিনিস আর আইনানুগ উপায়ে বেতন বৃদ্ধি ভিন্ন জিনিস। আবার, মূল্য বৃদ্ধি এ দু’টির চেয়ে ভিন্ন কিছু। এর প্রত্যেকটি বিষয় মজুরিতে সুনির্দিষ্ট বৃদ্ধির দাবি করে। যদি এই বৃদ্ধি পরিপূর্ণ না হয় তাহলে শ্রমিক তার প্রয়োজন পূরণ করতে অক্ষম হবে। বর্তমান সময় শ্রমিক সমাজ তাদের অভাব কখনো পূরণ করতে পারছে আবার কখনো পারছে না। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে এই যে, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে উঠেছে অভাব পূরণের জন্য। তাছাড়া অন্য কিছুর আলোচ্য বিষয় হতে পারে না। আর এক কথায় এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে হলে তা হবে ‘সুবিচার’। কারণ শ্রমিক শ্রেণি বাহ্যত দয়া-অনুকম্পা বা ভালোবাসা দাবি করে না। তারা শক্তি-সামর্থ্য আর দাপটও অর্জন করতে চায় না। আর তাদের সাধিত কর্মের উপর তারা কর্তৃত্বও করতে চায় না। তারা চায় না শিল্প-কারখানার মালিক বা নিয়ন্ত্রক হতে। তারা যে জিনিসটি কামনা করে তা হলো সুবিচার। আর সে কারণে সুবিচার হলো ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। আর এটাই হচ্ছে ইসলামেরও মূল লক্ষ্য। আর নিশ্চিত করে বলতে গেলে বলতে হয় যে, সুবিচারই হচ্ছে ইসলামি জীবন বিধানের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য। জ্ঞান, সাধ-আহলাদ, বীরত্ব, ভালোবাসা, প্রজ্ঞা, দয়া, অনুগ্রহ, স্বাধীনতা বা সৌন্দর্য এ সব উৎসের মধ্যে কেবল সুবিচারই হতে পারে ইসলামি দাওয়াতের বৈশিষ্ট্য। আর যেহেতু ইসলাম হল পরিপূর্ণ জীবন বিধান তাই অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সমাজনীতি সবকিছুই ইসলামে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ইসলাম কেবল ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আর ইসলামের দৃষ্টিতে ইবাদত মানে কেবল আত্মার পরিশুদ্ধি নয়। আর এ কারণে ইসলামে সুবিচারই কাম্য। আর এ সুবিচার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে অন্য কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নয়। কারণ সুবিচার হল সামাজিক শ্রেষ্ঠত্ব। আর কেবল এই সুবিচারই হতে পারে এমন খুঁটি, যাকে কেন্দ্র করে সকল সম্পর্ক আবর্তিত হয় এবং এখান থেকেই নির্গত হয় সকল সিদ্ধান্ত, সকল শান্তি। আমরা যখন সুবিচার দাবি করি, তখন আমরা কারো প্রতি অবিচার করি না। কারণ সুবিচার অর্থ কাউকে সাধ্যের অতিরিক্ত কষ্ট না দেওয়া, আর কেউ সুবিচার না করতে পারলে অবশ্যই সে জুলুম অবিচার করবে, অন্যের ক্ষতি করবে এবং তাকে ক্ষতির মধ্যে নিক্ষেপ করবে। কিন্তু, আমরা যখন কারো কাছে দাবি করি দয়ালু বীর বা সুন্দর ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য ধারণ করার, যে জন্য সে প্রস্তুত নয় অথবা যে গুণ অথবা যোগ্যতা তার মধ্যে নেই তখন আমরা তার প্রতি জুলুম অবিচার করি। আর কোনো ব্যক্তির ইনসাফ না করা অনিবার্য ভাবে অপরের ক্ষতি করার দিকে তাকে নিয়ে যায় না।
উপরন্তু ইসলামের প্রকৃতি সব কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে। ইসলামের আরও দু’টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার ফল দাবি করে অর্থাৎ সুবিচারই হবে ইসলামের বৈশিষ্ট্য। প্রথমটি হচ্ছে ইসলামের বিশ্বজনীন পরিচিতি আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে এই যে, ইসলাম সর্বশেষ ধর্ম অর্থাৎ সকল দেশের এবং সকল মানুষের ধর্ম ইসলাম, যুগ পরিক্রমায় ইসলামই হবে সর্বশেষ ধর্ম। আর এ দুইটি গুণ দাবি করে যে, সুবিচার টিকে থাকে, অন্য কোনো গুণ বৈশিষ্ট্য ইসলামের সঙ্গে খাপ খেতে পারে না। কারণ সুবিচার হচ্ছে এমন জিনিস, যার দ্বারা সমস্ত মানুষের সমুদয় বিষয় সরুল পথে চালিতে হতে পারে, পৃথিবীর সকল দেশে যে কোনো প্রান্তে। কুরআন মজিদে অনেক স্থানে সুবিচারকে আল হক তথা একমাত্র সত্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, কুরআন মজিদে বলা হয়েছে,
ادْعُوهُمْ لِآبَائِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِنْدَ اللَّهِ
“তাদেরকে তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাকবে, আর এটাই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ইনসাফপূর্ণ। (সুরা আহযাব: ৫)
এখানে ‘কিসত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। মূলত যা আল আদল তথা ইনসাফের সমর্থকবোধক শব্দ।
ইসলামে সুবিচারের একক স্থান আর সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হওয়াতে এটাকে এমন এক অংশে পরিণত করেছে যাকে আর ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা যায় না। এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করাই এখানে বড়ো কথা। আর এক অর্থে সুবিচার হচ্ছে ইসলামের মূল ভিত্তি। আর তা এভাবে যে, সুবিচারের প্রতি ঈমান আনা ছাড়া ইসলামকে হৃদয়ঙ্গম করা অথবা পরিপূর্ণ ঈমান আনা সম্ভব নয়।
মানব রচিত সংবিধান ও নীতিমালা যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে, তা থেকে ইসলামের সুবিচারের গুণগত পার্থক্য রয়েছে তৎ প্রতি সতর্ক ইঙ্গিত করা অপরিহার্য। কুরআন মজিদে যে সুবিচারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল করা বিধান। আর মানব রচিত সংবিধান ও নীতিমালা যে সুবিচার করে তা কখনো কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছতে পারে না, তা হতে পারে না নির্মল ও নির্ভুল। দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ, শাসক শ্রেণি এবং তাদের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া সুদূর পরাহত। আর সর্বাবস্থায় মানব রচিত আইন অক্ষম, সীমাবদ্ধ এবং যোগ্যতা ও মর্যাদার মানে পৌঁছতেও অক্ষম। আর মানব রচিত আইন নিঃসঙ্গ অবস্থায় ব্যক্তি বিশেষকে অনুসরণ করতে সক্ষম নয়। ব্যক্তির মনে কী আগুন জ্বলছে সে কী চিন্তা করছে বা মনের কোণে কী রেখা অঙ্কন করছে তা উঁকি মেরে দেখা মানব রচিত আইনের কাজ নয়। পক্ষান্তরে, একজন নিম্নস্তরের অপরাধী মৃত্যুকালে শান্তি থেকে পালাবার চেষ্টা করতে পারে, যদি তার অপরাধ প্রকাশ না পায় অথবা কোনো কারণে তাকে পাকড়াও করতে অক্ষম হয় অথবা মৃত্যুর পূর্বে তার উপর দণ্ড প্রয়োগ করতে সক্ষম না হয়, তাহলে তার নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে আইন সক্ষম হবে না। কিন্তু ইসলামের সুবিচার নীতি এসব কিছু পরিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম। মহান আল্লাহ মানুষের সকল গতিবিধি, ছোট-বড়ো সকল কর্ম জ্ঞাত আছেন, মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে লুকায়িত বিষয় এবং চক্ষুর পলকে যা ঘটে তাও আল্লাহ জানেন। আর পরকালের জীবনে একটা বিধান আছে, যা তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ও ছাড়ে না। আর যে সব অপরাধীর অপরাধ প্রকাশ পায় না এবং যেসব ঔদ্ধত্যপরায়ণ বিদ্রোহী যারা দুনিয়ার জীবনে আইনের ঊর্ধ্বে ছিল এবং হিসাব-নিকাশ থেকে নিজেদেরকে দূরে ভাবত, পরকালের বিচারে তারাও রক্ষা পাবে না। ইসলামি জীবন ধারায় একটা কথা প্রচলিত আছে-সুবিচারের উপর ভিত্তি করে আসমান-জমিন টিকে আছে।
আর এটাই হচ্ছে সুবিচার, আর তা-ই হচ্ছে ইসলামের বীজ। আর তিনটি প্রধান মূলনীতি অর্থাৎ কুরআন মজিদ, রাসুলে কারিমের সুন্নাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের আদর্শ শাসন ইসলামি নীতিমালার মূল ভিত্তি। অর্থনৈতিক সুবিচার যা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সমার্থক সে সম্পর্কে কথা সংক্ষিপ্ত করলেও ইসলাম বিভিন্ন উপায়ে এই সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। আর সেকারণেই ইসলাম যাকাত ফরজ করেছে এবং সুদকে হারাম করেছে। আর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দায়িত্বকে ইসলামি সমাজের নিয়ামক করেছে। আর অধিক মাত্রায় সম্পদ অর্জন এবং পুঞ্জিভূত করার জন্য সতর্ক করা হয়েছে। ইসলামি সমাজে ক্ষুধার্ত এবং উলঙ্গ ব্যক্তি পাওয়া যাবে এমন কাজকে লজ্জার বিষয় সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর একজন আরব বেদুইনকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে পেয়ে নবি কারিম (সা.) এর চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করে। যেন তাঁর চেহারায় আঙুরের দানা ফুটে উঠেছে। অতঃপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং ভাষণ দিলেন, লোকটিকে বস্ত্রাবৃত করার আগে তার গোস্যা প্রশমিত হয়নি। এ ধরনের ঘটনা মুসলিম সমাজের চেহারাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করা উচিত। কারণ মান সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য প্রত্যেকেই প্রত্যাশা করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র একাই ধনীদের নিকট থেকে সম্পদ আহরণ করে গরিবদেরকে দান করতে পারে। আর যেহেতু ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে সুবিচার এবং ইতিবাচক। আর নেতিবাচক উপায়ে সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে। অর্থাৎ হারামকে হারাম এবং হালালকে হালাল বলে স্বীকার করে এবং মানুষের মন-মানসিকতা গড়ে তুলছে এবং আইন-শৃঙ্খলার বিধান করছে এবং বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করছে। সুতরাং ইসলামের পক্ষে এটা স্বাভাবিক যে, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে স্বীকার করে নেবে, যার লক্ষ্য হচ্ছে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। বরং এজন্য সে সহায়কের ভূমিকা পালন করবে এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের দিকে আহ্বান জানাবে।
কিন্তু যে বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া যায় তা হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সুবিচারের মাত্রাকে ইসলামের সুবিচারের মানের সঙ্গে সমতা বিধান করা। কিন্তু এই ধরনের প্রশ্ন জাগতে পারে কেবল ইসলামের সুবিচারের অনুপস্থিতিতে, অর্থাৎ ইসলামি সমাজের অবর্তমানে। আর এখান থেকে বিষয়টি আলোচ্য বিষয়ের বহির্ভূত হতে পারে। কারণ যতক্ষণ ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠিত না হয় ততক্ষণ ইসলামের মানদণ্ডে উন্নীত, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ভিত্তির সুবিচার প্রতিষ্ঠার কোনো যৌক্তিক নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে না। আর নিয়ম হচ্ছে এই যে, কোনো কাজের প্রতিদান হবে একই ধরনের। যখন ইসলামের সুবিচার অবর্তমান থাকবে, যেমনটি পুঁজিবাদী এবং কম্যুনিস্ট সমাজে সমভাবে বিরাজমান। কারণ সেখানে সবচেয়ে বড়ো বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত অর্থাৎ বিপুল জনগোষ্ঠীর অভিমত এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রস্তাব গ্রহণ করাই হবে সর্বোত্তম মানদণ্ড, সঠিক মানদণ্ডের অনুপস্থিতিতে যদি একক মানদণ্ড নাও হয়।
অবশ্য ইসলামি সুবিচার পাওয়া গেলে তা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সুবিচারে পরিণত হবে। আর যখন ভুল বোঝা হবে তখন বিচার ব্যবস্থা এটাকে ধ্বংস করার দায়িত্ব নেবে এবং মূল বিষয় তুলে ধরবে। আর যখন ইসলাম সে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে যে জন্য ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা, তাহলে অপরাপর অধিকার, স্বাধীনতা এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের চর্চা ও অনুশীলন সম্পর্কে ইসলামের কী ভূমিকা হবে?
আর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মুক্তিকামী কমিটি আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগের উপর অবিরাম চাপ সৃষ্টি করে আসছে ১৯৪৮ সালে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ৮৭ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী নিম্নোক্ত ধারা শ্রমিকদের অধিকার সুবিন্যস্ত করার জন্য:
ক. জোট গঠনের অধিকার;
খ. দলগত দরকষাকষির অধিকার;
গ. ধর্মঘট বা কর্মবিরতির অধিকার;
ঘ. জুলুম-নির্যাতন প্রতিরোধ বা প্রাতিষ্ঠানিক সমাধান;
ঙ. ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়ন এবং নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কাজের স্বাধীনতা।
ক. জোট গঠনের অধিকার
অর্থাৎ ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং এ বিষয়ে শ্রমিক শ্রেণির জোট গঠনের অধিকার। এটাকে ইসলামি ব্যাখ্যার সাথে সামঞ্জস্যশীল বলা যেতে পারে আর তা হচ্ছে ইসলামের পরিচিতি, ইসলামের সংহতি এবং শান্তি-সুস্থিতির প্রসার এবং ব্যক্তিগত অনুশীলনের উপর সামষ্টিক অনুশীলনকে অগ্রাধিকার দান করা। আর ইসলাম জামায়াতে নামাজ আদায় করাকে একাকী নামাজ আদায় করা থেকে সত্তর গুণ বেশি সাওয়াবের কাজ ঘোষণা করে। সুতরাং অন্যান্য গুণের উপর জামায়াতের সাথে নামাজ আদায়ে সর্বোত্তম গুণ একাকী বা গৃহে ব্যক্তির নামাজ আদায় সে পর্যন্ত পৌঁছেতে পারে না। আর নামাজের ক্ষেত্রে যখন ইসলামের এই বিধান, আর তা হচ্ছে মানুষ এবং তার রবের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট কর্ম, সুতরাং পার্থিব বিষয়ে দলগত ভাবে তা আদায় করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এখান থেকে আমরা দেখতে পাই জামায়াত ত্যাগ করে একাকী জীবন যাপন বিষয়ে কঠোর সতর্কবাণী আর জামায়াত ত্যাগকারী ব্যক্তিকে আমরা শয়তান বলে বিবেচনা করি।
তাই ইসলাম কর্মের দু’টি ধায়ার মধ্যে পার্থক্য সূচিত করে; একটি হচ্ছে দলগত ধারা আর অপরটি হচ্ছে একক বা বিচ্ছিন্ন ধারা। আর ইসলাম প্রথম ধারাকে ঊর্ধ্বে স্থান দেয় এবং সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ঘোষণা করে। আর এ ব্যাপারে ইসলামের যুক্তি হচ্ছে এই যে, যখন মানুষ একত্র হয় তখন গণস্বার্থ বা দলীয় স্বার্থের দাবি ব্যক্তি স্বার্থের দাবির উর্ধ্বে স্থান পায়। এই দলীয় স্বার্থ হয় পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে অথবা প্রতিষ্ঠিত হবে ব্যক্তি বিশেষের একক স্বার্থের উপর। এটা জানা কথা যে, ব্যক্তি স্বার্থের কোনো প্রাথমিক বা বস্তুনিষ্ঠ ভিত্তি নেই। অবশ্য ব্যক্তি বিশেষ এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অর্থাৎ ব্যক্তি স্বার্থ সর্বদা ব্যক্তিগত। আর ব্যক্তির ইচ্ছা অভিপ্রায়ের জন্য যখন লাগাম খুলে দেওয়া হয় তখন তা আমাদের পুঁজিবাদী লক্ষ্যপানে চালিত করে, যার শ্লোগান ছিল এবং থাকবে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের জন্য আর সর্বশেষ ব্যক্তিকে শয়তান কব্জা করবে। আর নবি করিম (সা.) যখন একক ব্যক্তিকে শয়তান বলে অভিহিত করেন, তখন তিনি কুরআন মজিদের প্রাণসত্তার প্রতিনিধিত্ব করেন, যাতে একক ব্যক্তিকে শয়তানের প্রতিভূ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইবলিশের বক্তব্য:
أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَ خَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ
“আমি তার চেয়ে উত্তম, তুমি আমাকে অগ্নি দ্বারা সৃষ্টি করেছো আর তাঁকে সৃষ্টি করেছো মাটি দ্বারা। ইবলিশের এ কথা থেকে তার অহংবোধ প্রকাশ পায়।” (সুরা ছোয়াদ: ৭৬)
আর কুরআন মজিদের নিম্নোক্ত আয়াত প্রণিধানযোগ্য:
يَأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْتُكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَ جَعَلْنَكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَكُمْ
“হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ আর এক নারী থেকে এবং তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি নানা দল এবং গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। আর তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে খোদাভীরু ব্যক্তি আল্লাহর নিকট সবচেয়ে সম্মানযোগ্য।” (সুরা হুজরাত: ১৩)
উপরিউক্ত আয়াতে কুরআন মজিদ আদম সৃষ্টি এবং তাকে বিভিন্ন শ্রেণি এবং গোত্রে বিভক্ত করার যৌক্তিকতা উপস্থাপন করেছে। আর তা হচ্ছে পারস্পরিক পরিচয়। এরপর আসে দলের কর্মকাণ্ড বা শাসন বিধি অথবা আবেগ-অনুভূতি এবং চেতনা। আর এই বলে তাদের প্রশংসা করেছেন- তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, আল্লাহর নিকট যে সবচেয়ে বেশি মুত্তাকি। ফলে কুরআন মজিদ দলগত কর্ম এবং পরিচিতির আওতার বাহিরে তাকওয়াকে মর্যাদার ভিত্তি করেছে। আর তা হচ্ছে ব্যক্তিগত কর্মে দলীয় পরিধির বাহিরে ইসলামের রীতি। উপরিউক্ত আয়াতে সে চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে।
আর পারস্পরিক পরিচিতি হচ্ছে সহযোগিতা এবং দলগত কাজের উপায়, যাতে শুরা তথা পরামর্শ সভার আলোচনা বৈঠকে মিলিত হবে এবং সাধারণ মানুষের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলোচনা করবে। আর যখন শ্রমিক শ্রেণি পরস্পরের পরিচয় লাভ করবে এবং সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নের ভিত্তি স্থাপন করবে এই পরিচিতিকে সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার জন্য এবং এর ভিত্তিতে গণমানুষের কল্যাণ করার ফল লাভ করার জন্য এবং দুঃখ-দুর্দশা দূর করা আর সমস্যা সমাধানের জন্য, তখন তারা ইসলামের কল্যাণ ধারা সমাজ জীবনে বাস্তবায়নের নিমিত্ত জন-সমষ্টিকে উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হবে।
আর সাংগঠনিক জীবন পরিহার করে চলা জোট গঠনের চিন্তাধারার পরিপন্থী। ফলে জোট গঠনের সকল রূপ-রেখার জন্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে বৈচিত্র্যগত পদ্ধতিতে ফিরে আসায় প্রভাব বিস্তার করবে। আর এতে ইসলামি জোট গঠনও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। কারণ এই শান্তিপূর্ণ কর্তৃত্বের স্বাভাবিক লক্ষ্য যা, তা হচ্ছে পরিবেশ-পরিস্থিতি যেমন আছে তেমন থাকতে দেওয়া। আর সকল বিষয়ে সংকীর্ণতা পরিবর্তনের দিকে চালিত করে। যে কোনো জোট গঠনকালে এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত।
খ. দলগত চুক্তি (দলীয় দরকষাকষির অধিকার)
আর এই দলগত চুক্তি, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের পরিভাষায় যাকে দলগত দরকষাকষি বা দলীয় চুক্তি বলা যেতে পারে। আর সমাজে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। কারণ শ্রমিক শ্রেণি বা তাদের কোনো সদস্য নিয়োগ কর্তার নিকট একা থাকতে পারে না। অথবা কাজের চুক্তি কার্যকর করার ক্ষেত্রে মালিকের প্রতিপক্ষ হয়ে থাকতে পারে না। আর দাবি-দাওয়া বা আবেদন নিবেদনের রীতি-নীতি সাধারণত শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের বিপরীতে যায়। আর এর পরিণতি হিসেবে কর্তৃপক্ষ বা নিয়োগ কর্তা শ্রমিকের মজুরি হ্রাস করার সুযোগ পায়, যার ফলে শ্রমিক শ্রেণির জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় বস্তুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিম্নস্তরে নেমে যায় অথবা সে চুক্তির শর্তাবলী এমন ভাৰে সীমিত করেন, যা তার ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। অথচ মালিক পক্ষের লাভে শ্রমিকের আনুপাতিক অংশ আছে। আর এ পর্যায়ে এসে একজন কর্মপ্রার্থী অর্থাৎ শ্রমিক কোনো রকম পরিবর্তন ছাড়াই কর্তৃপক্ষের শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়। এ ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণির মজুরি কর্তনের শিকার হবে এবং জীবন ধারণের ন্যূনতম মান থেকেও তা নিচে নেমে যাবে।
আর এই অবস্থার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। আর ইসলাম শক্তিশালী ব্যক্তিকে এ অধিকার দেয় না যে, সে অসহায় ব্যক্তিকে গিলে খাবে, আবার এই অধিকারও দেয় না যাতে লাভ করার লালসা শ্রমিক শ্রেণিকে গিলে খাবে। কারণ যদিও সাধারণ নীতিমালা এ কথা স্বীকার করে যে, চুক্তি হচ্ছে উভয়পক্ষের মধ্যে আইনসিদ্ধ ভিত্তি, তা স্বত্ত্বেও ইসলাম সবদিক থেকে কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের নিরাপত্তা বিধান করে। চুক্তির মূল বিষয়বস্তু, উভয়পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং চুক্তির অপরিহার্য বিষয়গুলো এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আর ইসলামি শরিয়ত নির্ধারিত যে কোনো দিকের বিরুদ্ধাচরণ এই চুক্তিকে বেআইনি এবং বাতিল ঘোষণা করে। এর ফলে চুক্তির বিষয়বস্তু গৃহ পরিচালনা, দোকান পরিচালনা বা জুয়া খেলায় পর্যবসিত হবে অথবা প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী এবং মানুষের জন্য অপরিহার্য দ্রব্যাদি গুদামজাত করা হবে অথবা চুক্তির কোনো একপক্ষ হবে অসম। যেমন একপক্ষ হবে শক্তিশালী অপরপক্ষ হবে দুর্বল অথবা চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে ধোঁকা, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা এবং শোষণ আর নির্যাতনের কোনো উপকরণ। আর এই সব অবস্থার যে কোনো একটিতে চুক্তি ফাসিদ বলে গণ্য হবে।
যখন কোনো সংস্থা-সংগঠন, কোনো কোম্পানি অথবা কোনো যৌথ সংস্থা সংগঠন বা কোম্পানি পরিবহন, বিদ্যুৎ, পানি বা টেলিফোনের মতো কোনো একটি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কুক্ষিগত করে এবং লিখিত চুক্তিতে এই সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করবে। আর তাকে দেবে সমস্ত সুযোগ সুবিধা এবং দায়িত্ব থেকে তাকে করবে মুক্ত। আর শরীকদার সকল দায়িত্ব বহন করবে। কারণ আইনের ভাষায় এই চুক্তি আত্মসমর্পণের চুক্তি বলে পর্যবসিত হবে। আর চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী শর্তের সর্বনিম্নস্তরে নেমে আসতে বাধ্য হবে, তার প্রয়োজন পূরণের জন্য এটা যতই ক্ষতিকর হোক না কেন। আর মূলত এই চুক্তি কোনো চুক্তিই নয়। কারণ এতে উভয় পক্ষের মধ্যে সমতা বিধান করে না। অবশ্য এই চুক্তি কতকগুলো শর্তের নামান্তর যা নির্ধারিত করেছে পণ্য বা সেবা নিয়ন্ত্রণকারী। আর অভাবী ব্যক্তি, কৃত্রিমভাবে যাকে দ্বিতীয় পক্ষ বলে আখ্যায়িত করা যায়, তার পক্ষে এই চুক্তিতে সই করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। আর ইসলামি শরিয়ত এই ধরনের চুক্তিকে ফাসিদ অর্থাৎ আইনের দৃষ্টিতে অগ্রাহ্য বিবেচনা করে এবং কোনো অবস্থায়ই এমন চুক্তি মেনে নেয় না। কারণ এই চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অংশীদারের প্রতি অর্থনৈতিক শোষণ-নির্যাতন।
আর শ্রমিক পক্ষ এবং মালিক পক্ষের মধ্যে কাজের যে চুক্তি সম্পন্ন হয় তা আত্মসম্পণের চুক্তির চেয়েও নিকৃষ্ট। কারণ এ সময় অর্থনৈতিক শোষণ এবং পণ্য গুদামজাত করার আত্মসম্পণের চুক্তিতে সেও অংশগ্রহণ করে। কারণ আত্মসম্পণের চুক্তি সেবার সঙ্গে সম্পর্কিত, এই চুক্তি যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন। কারণ জীবন যাত্রার মান তথা আহার করা, পান করা, পরিধান করা এবং বসবাস করার উন্নত মানে তা পৌঁছতে পারে না। আর এই কারণে ইসলাম এই ধরনের চুক্তিকে মেনে নেয় না। আর শ্রমিকের রক্ত শোষার কাজে ইসলাম এই ধরনের চুক্তিকে প্রতারণার অন্যতম উপায় বলে মনে করে।
যেহেতু ইসলাম এই ধরনের ব্যক্তিগত শোষণমূলক চুক্তি প্রত্যাখান করে, সুতরাং এই ধরনের চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় উদ্ভাবন করাকে প্রয়োজনীয় মনে করে এবং ন্যায় ও সমতা নিশ্চিত করে এই ধরনের চুক্তিতে উপনীত হওয়ার উপায় উদ্ভাবন করা অত্যাবশ্যক বিবেচনা করে। কেবল এ ধরনের ন্যায়ভিত্তিক চুক্তিই হারাম শোষণের পথে অন্তরায় হতে পারে।
বলা যেতে পারে যে, এ ধরনের শ্রমিকের সহায়তা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এটা হচ্ছে এমন কথা, যার চেয়ে সহজ এবং মিথ্যা আর কোনো কথা হতে পারে না। আর এড়িয়ে চলা এবং উক্তি ছুঁড়ে মারা ছাড়া এ ধরনের কথা মেনে নেওয়া যায় না। কারণ সকল দেশের অভিজ্ঞতা এ কথা প্রমাণ করে যে, সরকারের কর্তৃত্ব সকল জটিলতাকে পরিবেষ্টন করে এবং সকল দিক থেকে সমন্ত উৎসকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে, যাতে শ্রমিক অকর্মণ্য হতে বাধ্য হয়। তাই বিশাল দেহের অধিকারী হস্তি যাকে বলা হয় সরকারি পরিবহন বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিবহন, তা কখনো দ্রুতগতির অথবা কাজের নমনীয়তার অধিকারী হবে না, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতেও সক্ষম হবে না। আর বিধানের পেছনে যে ভাবধারা লুকায়িত রয়েছে তা অনুধাবন করতেও সক্ষম হবে না এবং নানাবিধ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সঙ্গে সাহসিফতা দিয়ে মোকাবেলা করতেও সক্ষম হবে না। গোটা বিশ্বে সরকারি কর্তৃত্বের অব্যাহত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় যে, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ন্যায়নিষ্ঠ বলে মেনে নেওয়া যায় না। আর এটা কিছুতেই সম্ভব নয়, এহেন কর্মকাণ্ডের কাঙ্ক্ষিত পরিণতি অনিবার্য হয়ে দেখা দেবে।
যখন এই একমাত্র সমাধানের পথ রুদ্ধ হবে তখন অপর সমাধানের পথ বের করার জন্য আলোচনা করা অনিবার্য হয়ে দেখা দিবে। আর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ছাড়া সমাধানের অন্য কোনো উপায় নেই। ফলে, ইতিবাচক বা নেতিবাচক ভাবে ইসলামি শরীয়তের বিধি-বিধান বাস্তবায়ন অপরিহার্য হয়ে দেখা দেয়। নেতিবাচকভাবে অর্থাৎ জুলুম-নির্যাতন এবং অর্থনৈতিক শোষণের পথ রোধ করা এবং ইতিবাচকভাবে অর্থাৎ সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা।
আর তাড়াহুড়া করা অথবা স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে আমরা অভিযুক্ত হবো না। কারণ আমরা এখানে সে শর্ত উপস্থাপন করছি কুরআন মজিদ যাকে সবচেয়ে নিকটবর্তী অবস্থার জন্য জামানাত বলে উল্লেখ করেছে, আর তা করা হয়েছে সুরা বাকারার ২৮২ নম্বর আয়াতে। কুরআন মজিদ কাজের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে, যদি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজের চুক্তি না থাকে তবে নির্ধারিত সময়ের জন্য বাধ্যতামূলক কাজ করার উপায় বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا تَدَايَنْتُمْ بِدَيْنٍ إِلَى أَجَلٍ مُّسَمًّى فَاكْتُبُوهُ * وَلْيَكْتُبُ بَيْنَكُمْ كَاتِبٌ بِالْعَدْلِ وَلَا يَأْبَ كَاتِبٌ أَنْ يَكْتُبَ كَمَا عَلَمَهُ اللَّهُ فَلْيَكْتُبْ وَلْيُمْلِلِ الَّذِي عَلَيْهِ الْحَقُّ وَلْيَتَّقِ اللَّهَ رَبَّهُ وَ لَا يَبْخَسُ مِنْهُ شَيْئًا فَإِنْ كَانَ الَّذِي عَلَيْهِ الْحَقُّ سَفِيهَا أَوْ ضَعِيفًا أَوْ لَا يَسْتَطِيعُ أَنْ يُمِلَ هُوَ فَلْيُمْلِلْ وَلِيُّهُ بِالْعَدْلِ وَ اسْتَشْهِدُوا شَهِيدَيْنِ مِنْ رِجَالِكُمْ ۚ فَإِن لَّمْ
يَكُونَا رَجُلَيْنِ فَرَجُلٌ وَامْرَأَتْنِ مِمَّنْ تَرْضَوْنَ مِنَ الشُّهَدَاءِ أَنْ تَضِلَّ
احْدُ بِهُمَا فَتُذَكَّرَ إِحْدُهُمَا الْأُخْرَى وَلَا يَأْبَ الشُّهَدَاءُ إِذَا مَا دُعُوا وَلَا تَسْتَمُوا أَنْ تَكْتُبُوهُ صَغِيرًا أَوْ كَبِيرًا إِلَى أَجَلِهِ ذَلِكُمْ أَقْسَطُ عِنْدَ اللَّهِ وَ أَقْوَمُ لِلشَّهَادَةِ وَأَدْنَى إِلَّا تَرْتَابُوا إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً حَاضِرَةً تُدِيرُوْنَهَا بَيْنَكُمْ فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ إِلَّا تَكْتُبُوهَا وَأَشْهِدُوا إِذَا تَبَايَعْتُمْ وَلَا يُضَارَ كَاتِبٌ وَلَا شَهِيدٌ ، وَ إِنْ تَفْعَلُوا فَإِنَّهُ فُسُوقٌ بِكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَيُعَلِّمُكُمُ اللَّهُ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
“হে ঈমানদারগণ। তোমরা যখন একে অন্যের সাথে নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋণের কারবার করো তখন তা লিখে রাখবে; তোমাদের মধ্যে কোনো লেখক যেন ন্যায্যভাবে লিখে দেয়, লেখক লিখতে অস্বীকার করবে না, যেমন আল্লাহ তাকে শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং সে যেন লিখে আর ঋণ গ্রহীতা যেন লিখার বিষয়বস্তু বলে দেয় এবং তার প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করে আর তার কিছু যেন না কমায়। কিন্তু ঋণ গ্রহীতা যদি নির্বোধ অথবা দুর্বল হয় অথবা লিখার বিষয়বস্তু বলে দিতে না পারে তবে যেন তার অভিভাবক ন্যায্যভাবে লিখার বিষয় বস্তু বলে দেয়, সাক্ষীদের মধ্যে যাদের উপর তোমরা রাজি তাদের মধ্যে দু’জন পুরুষ সাক্ষী থাকবে, যদি দু’জন পুরুষ না থাকে তবে একজন পুরুষ ও দু’জন স্ত্রীলোক; স্ত্রীলোকদের মধ্যে একজন ভুল করলে তাদের একজন অপরজনকে স্মরণ করাবে। সাক্ষীদেরকে যখন ডাকা হবে তখন তারা যেন অস্বীকার না করে। এটা ছোট হোক অথবা বড়ো হোক মেয়াদ সহ লিখতে তোমরা কোনোরূপ বিরক্ত হবে না। আল্লাহর নিকট এটা ন্যায্যতর ও প্রমাণের জন্য দৃঢ়তর এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক না হওয়ার নিকটতর। কিন্তু তোমরা যে ব্যবসায় নগদ আদান-প্রদান করো তা তোমরা না লিখলে কোনো দোষ নেই। তোমরা যখন পরস্পরের মধ্যে বেচাকেনা করো তখন সাক্ষী রাখবে, লেখক এবং সাক্ষী যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আর যদি তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত করো তবে তা তোমাদের জন্য পাপ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত।” (সুরূ বাকারা: ২৮২)
কেউ কেউ ধারণা করতে পারে যে, ‘তাদাইয়ানতুম’ শব্দ দ্বারা ব্যক্তিগত ঋণ বুঝানো হয়েছে, কিন্তু এর স্বপক্ষে কোনো যুক্তি-প্রমাণ নেই, কারণ শব্দটি অনির্দিষ্ট। আর কুরআন মজিদ এর বিপরীতে নির্ধারিত সময়ের জন্য আর্থিক লেনদেন এবং উপস্থিত বাণিজ্যের কথা উল্লেখ করেছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, পারস্পরিক নির্ধারিত সময়ের জন্য আর্থিক লেনদেন দ্বারা নির্ধারিত সময়ের কাজ-কারবার উদ্দেশ্য। আর পক্ষান্তরে, শ্রমের চুক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, কারণ এর দাবি হচ্ছে নির্ধারিত সময়ের জন্য আর্থিক লেনদেন করা, যেমন শ্রম আইনকে বিশেষ ঋণ বলে গণ্য করা হয়।
আর এই ধরনের কর্মকাণ্ডে শ্রমিক হবে সেই পক্ষ, যার উপর অধিকার বর্তায় আর নিয়োগকর্তা হবে অর্থের মালিক অথবা পুঁজিপতি। এর বিপরীত দাবি করা সম্ভব নয় অর্থাৎ নিয়োগকর্তা হবে এমন ব্যক্তি, যে ঋণ গ্রহীতা, মানে যার উপর ঋণ বর্তায়। কারণ এটা হচ্ছে সত্যিকার চিত্র, যা আগের রূপ পরিবর্তন করতে পারে না, যা শ্রমিককে এমন ব্যক্তি বানাতে পারে না যার উপর অধিকার বর্তায়। আর উভয় পক্ষ এমন হতে পারে যার উপর অধিকার বর্তায়। শ্রমিকের কর্তব্য হচ্ছে ঠিকমত কাজ করা আর নিয়োগ কর্তার কর্তব্য হচ্ছে মজুরি প্রদান করা। আর এটা স্পষ্ট যে, এ আয়াত দ্বারা তাকে বুঝানো হয়েছে যে চুক্তি লিখা, আর দুর্বল পক্ষ শক্তিশালী পক্ষের সহায়তা পাওয়ার যোগ্য। আর যদি যার উপর অধিকার বর্তায় এ কথার সংজ্ঞা দ্বারা দুর্বল পক্ষ বুঝায় তাহলে শ্রমিক পক্ষ নিঃসন্দেহে দূর্বল পক্ষ হবে। আর সর্বাবস্থায় যার উপর অধিকার বর্তায় এ কথা প্রয়োগ করায় যে বিতর্ক করে, তা হল শ্রমিক। আধুনিক যুগে শ্রমিক নিয়োগের ব্যাপারে মালিক পক্ষ এমন বিতণ্ডা করে না, যাতে ঋণ গ্রহীতাকে সম্পূর্ণ রূপে সমান করতে পারে এবং আয়াতের লক্ষ্য সহায়তা প্রতিপন্ন করতে পারে। অর্থাৎ এক ব্যক্তি তার উপর চাপানো হবে অনেক দায়িত্ব যাতে তার উপর এমন কিছু চাপানো হয় যা দায়িত্বের সীমা অতিক্রম করে। অন্য পক্ষে যার উপর অধিকার বর্তায় তারা শ্রমিক অর্থ নেওয়া যেতে পারে, নিয়োগকর্তা নয়।
বিচারপতি আব্দুল কাদের আওদা শহীদ এই মত গ্রহণ করেছেন। তার রচিত গ্রন্থ ‘ইসলামের দণ্ড বিধি ও মানব রচিত আইন’ তুলনামূলক আলোচনা গ্রন্থে তিনি চুক্তির সঙ্গে আয়াতের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম গবেষকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছেন। উক্ত গ্রন্থে তিনি বলেন, “ইসলামি শরিয়ত এমন এক সাধারণ বিষয় দ্বারা আলোচনা শুরু করেছে, যাতে চুক্তি লিপিবদ্ধ করাকে ওয়াজিব বা অত্যাবশ্যক ঘোষণা করেছে। আর তা হচ্ছে এই যে, যার উপর অধিকার বর্তায় সে লিখে নেবে, অন্য কথায় দু’পক্ষের মধ্যে দুর্বলতম পক্ষ সবল পক্ষের নিকট থেকে লিখায়ে নেবে। অধিকন্তু, শক্তিশালী ব্যক্তি শোষণকে তার কেন্দ্রে বর্ণনা করতে পারে, ফলে দুর্বলের উপর অন্যায় শর্ত আরোপ করে অবিচার করবে। আর যদি নিয়োগকর্তা হয় তাহলে শ্রমিকের সমস্ত অধিকার ছিনিয়ে নেবে এবং নিজের সমস্ত অধিকার সংরক্ষণ করবে। আর ঋণ গ্রহীতা বা শ্রমিক নিজের জন্য কোনো শর্ত আরোপ করতে পারবে না বা নিজের অধিকার সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে না। কারণ সে দুর্বল। ফলে ইসলামি শরিয়ত আগমন করে দুর্বল পক্ষের জন্য চুক্তি লিপিবদ্ধ করা বাধ্যতামূলক করেছে। যাতে তার অধিকার সংরক্ষণ করা যায় এবং জটিলতা থেকে তাকে রক্ষা করতে পারে। চুক্তির শর্ত তার কাছে জ্ঞাত হতে হবে পুরোপুরি ভাবে এবং তার উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা যেন সে পুরোপুরি পালন করতে পারে।”
আর ইসলামি শরিয়ত তার অবতরণের সূচনালগ্নেই এ পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছে। আর এ বিষয়টি বর্তমান যুগে অতীব গুরুত্বপূর্ণ আইনি জটিলতা। বিগত শতাব্দর শিল্প বিপ্লব, বহুবিধ কোম্পানি এবং শ্রমিক ও মালিকের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ইউরোপে এ সংকট দেখা দিয়েছে। আর উক্ত সংকটের সবচেয়ে স্পষ্ট চিত্র এই যে, নিয়োগকর্তা শ্রমিকের প্রয়োজন হরণ করে অথবা উৎপন্ন দ্রব্যে জনগণের অধিকার হরণ করে, ফলে শ্রমিকরা হয় নিষ্পেষিত আর তার উপর অন্যায় শর্ত আরোপ করা হয় এবং শ্রমিক বা নিঃশেষিত ব্যক্তি লাঞ্ছিত অবস্থায় সেই শর্ত মেনে নেয়। কারণ তার নিকট কাজের চুক্তি অথবা ধ্বংসের চুক্তি লিখিত এবং মুদ্রিত আকারে উপস্থাপন করা হয়। আর কাজের প্রয়োজন বা পণ্যের অভাবের কারণে সে চুক্তিতে সই করে বাধ্য হয়ে। এই চুক্তি নিয়োগ কর্তাকে সমস্ত অধিকার দেয় আর শ্রমিক বা নিঃশেষিত ব্যক্তি সবকিছু মেনে নিতে বাধ্য হয়। আর আইনের পরিভাষায় এই চুক্তিকেই আমরা ‘আত্মসমপর্ণের চুক্তি’ বলে অভিহিত করি।
আর মানব রচিত আইন এইসব জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ফলে উৎপাদনকারী এবং নিঃশেষিত ব্যক্তির মধ্যে এমন সব শর্ত আরোপের মাধ্যমে জটিলতা নিরসনের প্রয়াস চালিয়েছে যা নিঃশেষিত ব্যক্তিকে উৎপাদন থেকে রক্ষা করে এবং উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু শ্রমিক এবং মালিকের মধ্যে জটিলতার কোনো কোনো দিক নিরসন করা ছাড়া সে আর কিছু করতে সক্ষম হয়নি, যেমন শ্রমিক বা কর্মচারী চাকরিচ্যুত হলে তা ফিরে পাওয়া বা ক্ষতিপূরণ লাভ করা। কারণ নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিকের মধ্যে চুক্তির ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ কাজের পতি এবং উৎপাদনের ধারা ব্যাহত করে। অবশিষ্ট থাকে সংকটের গুরুত্বপূর্ণ দিক। যেমন শ্রমিকের মজুরি, কর্মঘণ্টা এবং জুটি ছাটার মেয়াদ ইত্যাদি। আর শ্রমিক শ্রেণি সংকট নিরসনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, ঐক্যজোট গঠন এবং ধর্মঘট আর কর্ম বিরতি ইত্যাদির মাধ্যমে। আর শ্রমিক শ্রেণি মনে করে যে, চুক্তির শর্ত যতক্ষণ তাদের নিজেদের হাতে না আসবে ততক্ষণ তাদের সংকট নিরসন হতে পারে না। ফলে পৃথিবীর দিকে দিকে শ্রমিক শ্রেণি এই অধিকারের দাবি জানায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এইসব দাবি বাস্তবায়নের জন্য শ্রমিক শ্রেণি যে ধর্মঘট বা কর্ম বিরতির ডাক দেয় এবং শান্তি-শৃঙ্খলার পথে হুমকি সৃষ্টি করে এ হচ্ছে সে অধিকার, মানব রচিত আইন যার কিছুটা আদায় করতে পেরেছে এবং অনেকাংশ আদায় করতে সক্ষম হয়নি।
শ্রমিক শ্রেণি যে আশা পোষণ করে যে, অদূর ভবিষ্যতে বা নিকটবর্তী কালে তাদের অধিকার পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে তা হলো এমন অধিকার ইসলামি শরিয়ত সবলদের উপর দুর্বলদের যে অধিকার পুরোপুরি স্বীকার করে নেয়, যে অধিকার ইসলামি শরিয়ত স্বীকার করে নেয় চুক্তিবদ্ধ শ্রেণির জন্য কর্তৃপক্ষের উপর। আর কুরআন মজিদের পূর্বোক্ত আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে। আর এটা স্পষ্ট যে, পূর্বোক্ত আয়াতের মর্ম ব্যাপকতা ও কোমলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
উপরিউক্ত আয়াতের মূল বক্তব্যের দিকে ফিরে গেলে আমরা জানতে পারি যে, তাতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে-
১. নির্ধারিত সময়ের জন্য কোনো আর্থিক লেন-দেন করলে তা লিখে রাখতে হবে। অথবা আমরা এভাবে বলতে পারি যে, সময় নির্ণয় করে কোনো আর্থিক লেনদেন করার অঙ্গীকার করলে তা পূর্ণ করা অপরিহার্য।
২. একজন লেখক যথাযথভাবে বিষয়টা লিখে রাখার দায়িত্ব পালন করবে।
৩. আল্লাহ যাকে লিখা শিখিয়েছে, সে ব্যক্তি লিখতে অস্বীকার করবে না।
৪. হকদার ব্যক্তি যথাযথভাবে লিখাবে (কোনো কিছু কম করবে না)।
৫. হকদার ব্যক্তি যদি নির্বোধ বা দুর্বল হয় অথবা লিখাতে সক্ষম না হয় তখন তার অভিভাবক যথাযথভাবে লিখাবে।
৬. দু’জন ব্যক্তিকে সাক্ষী নিযুক্ত করবে, যারা স্বেচ্ছায় সাক্ষী হবে। যদি দু’জন পুরুষ না পাওয়া যায় তবে একজন পুরুষ এবং দু’জন নারীকে সাক্ষী করতে হবে।
৭. সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সাক্ষীদেরকে ডাকা হলে তারা সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করতে পারে না।
৮. লিখতে না পারার অজুহাতে কোনো ছোট বিষয় বাদ দেওয়া যাবে না।
৯. নগদ কাজ কারবার বা লেনদেন করার ক্ষেত্রে লিখে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই।
১০. লেখক বা সাক্ষী কারো ক্ষতি করা যাবে না। এজন্য কাউকে বাধ্য করা বা পীড়াপীড়ি করা যাবে না।
ব্যক্তি বিশেষের কর্মকাণ্ডের যে সব ঘটনা ঘটে তার সঙ্গে উপরিউক্ত বিষয়গুলো তুলনা করলে নিচের বিষয়গুলো প্রকাশ পায়-
১. অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনোভাবে লিখে রাখা হয় না।
২. আবার লিখে রাখার ব্যবস্থা থাকলেও বিশেষ কোনো লেখক থাকে না। অবশ্য উভয় পক্ষের কোনো এক পক্ষ এ দায়িত্ব পালন করে।
৩. এবং ঋণ গ্রহীতা যেন লিখার বিষয়বস্তু বলে দেয়- এ বাক্যের অর্থ এই যে, দুর্বল পক্ষ বা অঙ্গীকারাবদ্ধ ব্যক্তি লেখার বিষয়বস্তু অর্থাৎ যে সব বিষয়ে একমত তা লিখাবে। আর এ বাক্য থেকে স্বভাবত এ কথা বুঝা যায় যে, এ অবস্থায় সে নিজের প্রতি জুলুম করবে না অথবা এমন কোনো শর্ত আরোপ করবে না যাতে জুলুম হয়। আয়াতের মর্ম হচ্ছে, অপর পক্ষকে (ঋণ গ্রহীতা বা কর্মচারী) সহায়তা করা। আর এটা করতে হবে ইসলামের পরিপূর্ণ সুবিচার নীতি অনুযায়ী। আর এটাই হচ্ছে মূল বিষয়। আর এক পক্ষের হিসেবের ক্ষেত্রে অপর পক্ষকে জড়ানো যাবে না। আয়াতের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে কোনো কিছু কম করা যাবে না। কিন্তু কার্যত যা ঘটে তা হচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত। ফলে হকদার ব্যক্তি চুক্তি লিপিবদ্ধ করার কালে একক ও বিচ্ছিন্ন থাকে এবং যত ইচ্ছা শর্ত আরোপ করে থাকে।
৪. আর উপরিউক্ত আয়াতে এ কথা অপরিহার্য করা হয়েছে যে, ঋণ গ্রহীতা ব্যক্তি যদি নির্বোধ বা অসুস্থ হয় অথবা লিখে নিতে সক্ষম না হয় তবে তার অভিভাবক যেন ন্যায্যভাবে লিখে নেয়। আর এটা এমন এক বিষয় শ্রমিকের ক্ষেত্রে যা ঘটে না বললেই চলে, যার ক্ষেত্রে দুর্বল বা অক্ষমতা প্রযুক্ত হয়। সুতরাং মালিকের সম্মুখে শ্রমিক দুর্বল, যেমন ইতঃপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে সব পরিভাষা এবং টেকনিক্যাল শব্দ দ্বারা চুক্তিপত্র লিপিবদ্ধ করা হয়, শ্রমিক তা বুঝতেও অক্ষম হয়। উপরন্তু কখনো শ্রমিক, তাৎক্ষণিকভাবে নিরক্ষর থাকে অথবা যে ভাষায় চুক্তি লিখা হয়েছে তা সে বুঝতে পারে না, যখন নিয়োগকর্তা হয় বিদেশী বা অপরিচিত ব্যক্তি। আর এই সব অবস্থায় চুক্তি সম্পাদনকালে তার প্রতিনিধিত্ব করার মতো কেউ থাকে না, চুক্তিতে ধোঁকা, প্রতারণা এবং শোষণ বা কর্তৃত্বের যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে সে ক্ষেত্রে তার সহায়তা করার কেউ থাকে না।
৫. এবং কোনো রকম সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। উপরিউক্ত তুলনামূলক আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কুরআন মজিদের আয়াতে কোনো বিষয়কে অপরিহার্য করা হয়েছে। আর কার্যত কি কাজ করা হচ্ছে। প্রচলিত আইন দ্বারা কাজের যে সব চুক্তি ব্যক্তি বিশেষের কাজের চুক্তি নামে সাধন করা হয়, তাতে আয়াতের অনেক বিরুদ্ধাচরণ অন্তর্ভুক্ত থাকে। বরং আয়াতে যে সব বিষয়কে ফরয, তথা অপরিহার্য কর্তব্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত দৃশ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে।
আর বর্তমান সময়ে আমরা যদি আয়াতে বর্ণিত বিষয়ের সঙ্গে তুলনা করি এবং সামষ্টিক কাজের ক্ষেত্রে বাস্তবে যে সব চুক্তি করা হয়, ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের নামে যে চুক্তি সম্পাদন করে তাতে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো দেখতে পাই-
ক. এই সব চুক্তি লিপিবদ্ধ করা হয়।
খ. আর চুক্তি লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করে ন্যায়পরায়ণ লেখক অথবা এই সব চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিতে পারে এমন ব্যক্তি চুক্তির দায়িত্ব গ্রহণ করে।
গ. সরকারি পর্যায়ে এ চুক্তি অনুমোদন করা হয়, আয়াতের দাবি অনুযায়ী যার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
ঘ. শ্রমিক শ্রেণির নামে এবং প্রতিনিধি হিসেবে যে এই চুক্তি সম্পাদন করে সে হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন, যে শ্রমিক শ্রেণির অভিভাবক হিসেবে গণ্য, যারা নিজেরা অক্ষম অর্থাৎ তাদের কোনো একজন ব্যক্তি চুক্তির মূল পাঠ বলে দিতে অক্ষম।
আর উপরিউক্ত তথ্য ছাড়াও ট্রেড ইউনিয়ন কর্তৃক দলীয় চুক্তি সম্পাদনের কাজে ইসলামের অন্যান্য গুণ-বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আর তা হচ্ছে দলীয় গুণ। আর দল ব্যক্তির চেয়ে উত্তম, আর দলের লক্ষ হচ্ছে দলীয় স্বার্থ। আর দলীয় স্বার্থ ব্যক্তির স্বার্থের চেয়ে উত্তম। ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠাকালে এই শুরা বা পরামর্শের অনুশীলন করা হয়, চাই তা শ্রমিক শ্রেণির একে অপরের মধ্যে হোক না কেন, অথবা শ্রমিক এবং মালিক পক্ষের মধ্যে হোক না কেন। আর এ হচ্ছে এমন এক অনুশীলন, সামষ্টিক কর্মকাণ্ডে ইসলাম যা দাবি করে।
আর এভাবে আমরা এমন এক চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হই, মুসলিম বিশ্বে মালিক পক্ষ, আইন প্রণেতা এবং লেখক শ্রেণি তাদের কারো মনে এই চিন্তা জাগে নি বলে আমাদের সবচেয়ে বেশি ধারণা। আর তা এই যে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে সব চুক্তি কর্তৃত্ব করে তা ইসলামি শরীয়তের নীতিমালার বিরোধী। আর যে সব দলীয় চুক্তি ট্রেড ইউনিয়ন সম্পাদন করে তা হচ্ছে একক চুক্তি যার ভাষা ও বক্তব্য ইসলামের সঙ্গে সংগতিশীল এবং কুরআনুল করীমের স্পষ্ট আয়াতের অনুকূল।
গ. ধর্মঘট বা কর্মবিরতির অধিকার
ধর্মঘট একটা ভয়ংকর এবং কুৎসিত শব্দ। আর মূলত এই শব্দের পিছনে লুক্কায়িত আছে ঘৃণা এবং শত্রুতা। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অধিকাংশের নিকট এটা স্পষ্ট। এ আন্দোলনের বড়ো বড়ো নেতারা ধর্মঘটের ফলাফল বস্তুনিষ্ঠভাবে এবং শান্তচিত্তে বিবেচনা করার সুযোগ পান না, ফলে ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে এই ধর্মঘটের বিরোধ দেখা দেয়। কুরআন মজিদ কী আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেনি?
وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَأْنُ قَوْمٍ عَلَى إِلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ
للتَّقوى .
“কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, তোমরা সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার নিকটতর।” (সুরা মায়িদা: ৮)
আর ধর্মঘটের যে কোনো চূড়ান্ত ও বস্তুনিষ্ঠ অধ্যয়ন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বিবেচনায় আনে এবং যে সব উপকরণ তা প্রতিরোধ করে তাও বিবেচনায় রাখে। আর এর ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মঘটের পরিণতি এবং ক্ষয়-ক্ষতি থেকে শ্রমিক শ্রেণিকে বিরত রাখে।
আর পুঁজিবাদী সমাজে ধর্মঘট দেখা দেয় যেখানে মালিক পক্ষ নিজেদের বিশেষ স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রভাব গ্রহণ করে শ্রমিক শ্রেণির বিরুদ্ধে একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করে। আর মালিক পক্ষ যেহেতু ধনী এবং প্রভাবশালী শ্রেণি, তাই সমাজ তাদের এই অধিকারকে স্বীকার করে নেয়। সুতরাং শ্রমিক শ্রেণি যারা সবচেয়ে দুর্বল এবং অভাবী পক্ষ, তাই ধর্মঘট তাদের জন্য কেন নিষিদ্ধ হবে? অথচ এই শ্রমিক শ্রেণিই তাদের নিত্যদিনের মজুরি থেকে যুদ্ধের মূল্য পরিশোধ করে এবং মালিকপক্ষের ক্ষয়-ক্ষতির তুলনায় তাদের সীমিত আয়ের বেশি ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করে নেয়। অতঃপর এই শ্রমিক শ্রেণিই সমাজের আক্রোশ বহন করে এবং মালিক পক্ষের বোঝাও তাদের ঘাড়ে চাপায়।
আসল কথা এই যে, শ্রমিক শ্রেণি নিজেরা ধর্মঘটের ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে এজন্য ডাক দেয় না, বরং অন্যসব উপায়-উপকরণ নিঃশেষ হওয়ার পর একমাত্র উপায় হিসেবে তারা ধর্মঘটের ডাক দেয়। আর এই ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকা একজন প্রাচীন আরব কবির কবিতায় ফুটে উঠেছে
إِذَا لَمْ يَكُنْ إِلَّا اللآسِنَةُ مَرْكَبًا فَمَا حِيْلَةَ الْمَرْأَ الأَرَكُوْبُهَا.
যখন বৃদ্ধ উষ্ট্র ছাড়া আর কোনো বাহন থাকে না, তখন তার পিঠে আরোহণ করা ছাড়া নিরুপায় ব্যক্তির আর কি উপায় থাকতে পারে?
আর এসব কিছুর পর ধর্মঘট হচ্ছে একটা নেতিবাচক পদ্ধতি, শ্রমিক শ্রেণির দাবি-দাওয়ার প্রতি মালিক পক্ষের সাড়া না দেওয়ার প্রতিবাদ হিসেবে প্রতীকীরূপে তারা কর্ম থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। আইন অনুযায়ী দীর্ঘ আবেদন-নিবেদন আর দাবি-দাওয়ার ধারাবাহিকতার প্রেক্ষাপটে তারা এই সর্বশেষ হাতিয়ার প্রয়োগ করে। আর শ্রমিক শ্রেণির হাতে এটা হচ্ছে একমাত্র হাতিয়ার। এ ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হলে তাদের অবস্থা হবে তুচ্ছ শ্রেণির, খাবার টেবিলের অসহায় এতিমদের মতো, অথবা ভিক্ষাপ্রার্থী অসহায় ভিক্ষুকদের মতো। আর এ কারণে ধর্মঘটের পথ অবলম্বন করা এমন একটা অনিবার্য উপায়, যার কোনো বিকল্প নাই। সমাজ জীবনের এই কর্ম কৌশল কাজের স্বাধীনতার উপর এর ভিত্তি স্থাপিত।
আমরা এ কথা স্বীকার করি যে, ধর্মঘট একটা খারাপ জিনিস। কিন্তু ধর্মঘট সম্পর্কে এ মত প্রকাশ করার আগে ব্যাপারটা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। আর এটা খারাপ উপায়, তার কারণ সমাজটাও তো খারাপ। সমাজ জীবনে যে সব পাপাচার আর অপকর্ম সংঘটিত হয় সে সবের অনিবার্য পরিণতি হিসেবেই ধর্মঘট দেখা দেয়। আর বর্তমান সমাজ কোনো উন্নত মান স্বীকার করছে না বরং তা প্রত্যেক দলকে নিজেদের মান নির্ধারণ করে নিজেদের জন্য কাজ করার সুযোগ দেয়।
অনুরূপভাবে আমরা এ কথাও স্বীকার করি যে, ধর্মঘট হচ্ছে এমন একটা হাতিয়ার, যার অপপ্রয়োগ হতে পারে। আর ট্রেড ইউনিয়নের এক শ্রেণির নেতৃত্ব তাকে ভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে পারে। যে কোনো শিল্প কারিগরী বিরোধ নিরসনের ক্ষেত্রে এই একমাত্র উপায় থেকে বের হয়ে আসতে পারে, যেমন এটা হতে পারে খ্যাতি অর্জন অথবা বিশেষ কোনো লক্ষ্য অর্জনের উপায় অথবা রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার। আর এসব কিছুই প্রবেশ করতে পারে অধিকার আদায়ের জন্য বাঁকা পথ অবলম্বনের মধ্যে। আর যে কোনো বৈধ হাতিয়ারের ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটতে পারে।
বর্তমানে পৃথিবীর কোথাও ইসলামি সমাজ বিদ্যমান নেই- এমন অজুহাত তুলে ধর্মঘটের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করা চরম অন্যায় হবে। পারস্পরিক সহযোগিতা আর সহমর্মিতার ভিত্তিতে সমাজ জীবন পরিচালিত হলে এবং ইসলামের মহান মানদণ্ড তথা সুবিচারের নীতিমালা দ্বারা সমাজ জীবন পরিচালিত হলে তখন ধর্মঘটের দোষ দেওয়া যায় এবং তার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করা যায়।
ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আর প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভ্রান্তির আশংকাকালে এই সব প্রস্তাবাদি গ্রহণ করার জন্য নতুন পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। এমন সমাজ যখন পাওয়া যাবে না তখন ইসলামি সমাজের উপর অনুমান করে ধর্মঘটের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করা চরম বিভ্রান্তি।
আর সমাজতান্ত্রিক সমাজ আমাদের সম্মুখে এমন অবস্থা উপস্থাপন করে যেখানে ধর্মঘট ছাড়া ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন পাওয়া যায়, যা থেকে বুঝা যায় যে, ধর্মঘট ট্রেড ইউনিয়ন কর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ মোটেই নয়। অবশ্য পুঁজিবাদী সমাজে তা ট্রেড ইউনিয়ন কর্মের অপরিহার্য অংশ। এ সমাজ পরিবর্তিত হলে সেখানে ধর্মঘট করা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন পাওয়া যেতে পারে, তবে সেখানে চূড়ান্ত আঘাত অথবা এমন প্রয়োজন হবে যা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আর কম্যুনিস্ট সমাজে দমন, নিপীড়ন, ভয়-ভীতি, ধর্মীয় বিভ্রান্তি অব্যাহত প্রচার প্রপাগাণ্ডা এবং দলের জন্য কড়া নিরীক্ষণ আর ধর্মঘটের মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা হয়। আর যে সমাজে কাজের পরিবেশ এবং শর্ত আইন সিদ্ধ সেখানে ধর্মঘট পাওয়া যায় না তার কোনো অর্থ হয় না, সেখানে ধর্মঘট কোনো আলোচ্য বিষয় নয় (সাধারণ ধর্মঘট এর ব্যতিক্রম)।
কারণ মজুরি এবং কর্মঘণ্টা ইত্যাদি যখন আইন অনুযায়ী পাওয়া যায় তখন শিল্প কারখানার মান উন্নয়নের জন্য ধর্মঘটের কোনো অর্থ হয় না, আর যতক্ষণ এইসব শিল্প-কারখানার পরিচালকরা শ্রমিকদের ধর্মঘটের প্রতি লক্ষ্য রাখে তখন আইনানুগ শর্ত পরিবর্তন করার কোনো ক্ষমতা তাদের থাকে না। আর এ ধরনের সমাজে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ড আংশিক ধর্মঘট থেকে শরীয়তের সুবিচারের প্রতি পরিবর্তিত হয়। আর ইসলামি সমাজে এই অবস্থাই পাওয়া যায় যেখানে কাজের শর্তাবলী আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় অথবা ন্যূনতমপক্ষে এ জন্য প্রয়োজনীয় ধারা বর্ণিত হয়। এতদসঙ্গে এবং বিষয়বস্তুর সকল দিক ভালোভাবে আলোচনার পর সত্যিই কী ইসলাম ধর্মঘটকে নিষিদ্ধ করে?
ধর্মঘটের নীতিগত সংজ্ঞা হচ্ছে এই যে, শ্রমিক শ্রেণি তাদের মজুরি, কাজের পরিবেশ, নিরাপত্তা ইত্যাদি যা তারা অধিকার বলে মনে করে, সে সব আদায় করার জন্য দলগতভাবে কাজ থেকে বিরত থাকা অর্থাৎ তাদের ইতিগত দিকে পৌঁছার ক্ষেত্রে এই ধর্মঘট একটা প্রতিবাদ।
বৈধ অধিকার আদায় করার জন্য এই ধর্মঘটের আশ্রয় নেওয়াকে ইসলাম কী নিষিদ্ধ করে?
শ্রমিক শ্রেণি এবং পুঁজিপতি শ্রেণি স্বার্থ রক্ষার ইনসাফ ভিত্তিক দাবি হারাম করে আল্লাহ তাআলা কোনো কঠোর আয়াত নাজিল করেননি এবং এজন্য কোনো রাসুলও প্রেরণ করেননি।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মজিদ নাজিল করেছেন এবং মানবতার মুক্তি, হেদায়াত এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে সুষ্ঠু সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তার মহান রাসুলকে প্রেরণ করেছেন। সেই সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক সুবিচারের উপর আবর্তিত হবে এবং সেখানে ব্যক্তি তার নিজের মান-মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে এবং বঞ্চনা, লাঞ্ছনা এবং হুমকি-ধমকি থেকে সে সমাজের মানুষ দূরে থাকবে।
আর ইসলাম প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সম্মানজনক জীবন যাপনের অধিকার স্বীকার করে। আর ইতিবাচকভাবে সম্মানজনক জীবন যাপনের জন্য যাকাত, পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, সমাজের প্রয়োজনে অর্থ ব্যয় করা এবং সম্পদ ও পণ্য পুঞ্জিভূত করা, নির্বোধের মত অর্থ ব্যয় করা অপচয় করা এবং শোষণ করা ইত্যাদি উপায়কে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। অন্যথায় কোনো সমাজ ইসলামি সমাজ পদবাচ্য হতে পারে না।
যেহেতু সম্মানজনক জীবন যাপন করার অধিকার রয়েছে প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির তাই কোনো ব্যক্তিকে বা শ্রমিককে তার প্রাপ্য মজুরি কম দেওয়া অথবা শ্রমিকের শক্তি অযথা ক্ষয় করা, অথবা তার স্বাস্থ্য এবং দেহকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া অথবা তাদেরকে বাড়ি ঘর থেকে বহিষ্কার করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড যা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে ইসলাম এই সবকে অন্যায় অপকর্ম হিসেবে গণ্য করে এবং এই সব ত্রুটির প্রতিবিধান হওয়া উচিত।
ইসলাম একজন মুসলমানকে এই অধিকার দান করে এবং নানাবিধ উপায়ে তার অধিকার রক্ষা করাকে তার জন্য বৈধ করেছে। এইসব উপায়ের মধ্য রয়েছে মুখে স্পষ্ট করে ব্যক্ত করা অথবা হস্তদ্বারা প্রতিরোধ করা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিহত হলে সে শহিদ বলে গণ্য হবে। বরং ইতিবাচকভাবে এই প্রতিরোধকে ইসলাম ওয়াজিব তথা কর্তব্য ঘোষণা করে।
এই ক্ষেত্রে ইসলামের যুক্তি এই যে, প্রতিটি ব্যক্তি যদি তার অধিকার রক্ষা না করে এবং জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে না তোলে তাহলে একদিন সে নিজেই জুলুম-নির্যাতন আর বাড়াবাড়ির শিকার হবে। অবশেষে এই সবই তার ওপর কর্তৃত্ব করবে।
এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদে বলা হয়েছে-
أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقْتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرُ ٣٩الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍ إِلَّا أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ وَلَوْلَا دَفْعُاللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَ صَلَاتٌ وَ مَسْجِدُ
يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا .
“যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদের জন্য যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করতে সম্যক সক্ষম, যাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলে আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ। আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে বিধ্বস্ত হয়ে যেত খ্রিষ্টান সংসার বিরাগীদের উপাসনা স্থান, গির্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ, যাতে অধিক স্মরণ করা হয় আল্লাহর নাম।” (সূরা হজ্ব: ৩৯-৪০)
প্রথম আয়াত থেকে একথা ভালোভাবে ফুটে উঠে, যাতে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং যুদ্ধকে আইনসিদ্ধ করা হয়েছে। আর জুলুম নির্যাতনের কাছে আত্মসমর্পণ করাকে ইসলাম অনুমোদন করে না। মুমিনদের সম্পর্কে কুরআন মজিদে বলা হয়েছে-
وَالَّذِينَ إِذَا أَصَابَهُمُ الْبَغْنُ هُمْ يَنْتَصِرُونَ
“এবং যারা অত্যাচারিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।” (সূরা শুরা ৩৯)
আর একজন মুসলিম ব্যক্তি যখন অত্যাচার প্রতিরোধে সক্ষম না হয় তখন হিজরত করা তার কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদে বলা হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ تَوَفَّهُمُ الْمَلْئِكَةُ ظَالِمِي أَنْفُسِهِمْ قَالُوا فِيْمَ كُنْتُمْ قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِي الْأَرْضِ قَالُوا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا فَأُولَئِكَ مَأْوَلَهُمْ جَهَنَّمُ وَسَاءَتْ مَصِيرًاهُ
“যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করে, তাদের প্রাণ হরণকালে ফেরেশতারা বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম; তারা বলে, আল্লাহর জমিন কী এমন প্রশন্ত ছিল না যেখানে তোমরা হিজরত করতে? এদের আবাসস্থল জাহান্নাম আর তা কত মন্দ আবাস।” (সুরা নিসা: ৯৭)
এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, ইসলাম মানুষকে ইতিবাচক প্রতিরোধের অধিকার দেয়, বরং ইতিবাচক প্রতিরোধ ইসলাম তার জন্য ওয়াজিব করে এবং সন্ত্রাস ও নির্যাতনের সম্মুখে বৈশ্যতা আর আত্মসমর্পণকে ইসলাম প্রত্যাখান করে।
আর যেহেতু ধর্মঘট হচ্ছে একটা নেতিবাচক পদক্ষেপ, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং আইনসংগত অধিকার আদায়ের পদক্ষেপ হিসেবে শ্রমিক শ্রেণি ধর্মঘটে আশ্রয় নেয়, তখন এটাকে হারাম করা থেকে ইসলাম অনেক দূরে থাকে বরং প্রতিরোধ গড়ে তোলাকে অবশ্য কর্তব্য গণ্য করে। আর এ ব্যাপারে যে পিছিয়ে থাকে তাকে নিজের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে লাঞ্ছনা গঞ্জনার শিকার করা এবং নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞানকারী বলে গণ্য করে।
আমরা যদি ইসলামি জীবন বিধানের নীতিমালা থেকে দূরে অবস্থান করি এবং বস্তুবাদের অনুশীলনে অবগাহন করি এবং ইউরোপীয় সভ্যতার দ্বারা প্রভাব গ্রহণ করি, যা নীতি-নৈতিকতা আর অর্থনীতির মধ্যে ভেদ রেখা টেনে দেয় এবং অর্থনৈতিক অনুশীলন এবং অপমানজনক উৎপাদনের সঙ্গে উদারতা প্রদর্শন করে তখন আমরা এ কথা ভুলে যেতে বাধ্য হবো যে, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা আর রাজনীতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে নীতি নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত, জড়িত আছে ইসলামের প্রাণসত্তা, আমরা এ কথাও বলে যাবো যে, ইসলাম এহেন আনন্দ-ফুর্তির কাছে বিনয় প্রকাশ করে। এ কথাও আমরা ভুলে যাবো যে, ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল আর হারামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমরা এ কথাও ভুলে যাবো যে, ইসলামের হালাল-হারাম গণ্ডি বহির্ভূত অনুশীলন কখনো আইনসিদ্ধ হতে পারে না, যদি তাতেই মুক্তি ও কল্যাণ নিহিত থাকে এবং লক্ষ লক্ষ লোক হালাল-হারামের চিন্তা বাদ দিয়ে কোট কোটি টাকা উপার্জন করে। যে বস্তুবাদের দৃষ্টিতে টাকা-পয়সার কোনো গন্ধ নেই, টাকা-কড়ি বেশ্যাবৃত্তির পথ ধরে আসে, না পাদ্রি-সাধু ব্যক্তির মাধ্যমে, তাতে কোনো পার্থক্য নেই।
আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে লাভ করাই হচ্ছে মূল লক্ষ্য, এহেন বস্তুবাদের সাথে ইসলাম দ্বিমত পোষণ করে। ইসলাম এমন বস্তুবাদকে প্রত্যাখান করে এবং ঘৃণার সাথে প্রত্যাহার করে। একজন মানুষ যা উপার্জন করবে তা হারাম কি হালাল সে চিন্তা করবে না, এ অবস্থাকে ইসলাম কিয়ামতের আলামত বলে বিবেচনা করে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইসলাম কিছু নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা পাক-পবিত্র এবং হালালের উপর কর্তৃত্ব করে এবং হারাম থেকে দূরে থাকতে বলে, যেমন ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজে নিষেধ করা। আর কোনো ব্যক্তি মন্দ কাজ দেখলে শক্তি দ্বারা তা পরিবর্তন করা সম্ভব হলে প্রত্যেকের জন্য তা করা ইসলাম অবশ্য কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। অন্যায়ের অনুশীলন করে এমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে উদারতা প্রদর্শন না করা একজন মুমিনের জন্য সর্বোত্তম কাজ। কর্তা ব্যক্তিদের আনুগত্য করার ক্ষেত্রে ইসলাম কোনো অজুহাত গ্রহণ করে না। ইসলাম স্বীকার করে না পাপাচারীর নির্দেশ মেনে নেওয়া, কারণ স্রষ্টার নাফরমানী করে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না।
আর এ থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কর্মক্ষেত্র আর উৎপাদন কর্মকাণ্ডে শ্রমিকের কোনো অধিকার নেই, এমন ধারণা পোষণ করা মারাত্মক অন্যায়। আর এমন ধারণাও পোষণ করা অন্যায় যে, শ্রমিকের ভূমিকা হচ্ছে তার কাছে যা চাওয়া হবে তাই সে কার্যকর করবে এবং কেবল নির্দেশ মেনে চলবে। আর কেবল এটাই তার মজুরিকে হালাল করতে পারে এবং দিতে পারে তাকে অধিকার। কারণ এই মুসলিম শ্রমিকের অধিকার রয়েছে উৎপাদনে, যা তার উপর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আরোপ করে। অনুরূপভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করাও ইসলাম তার জন্য ফরয করে। আর ইসলাম প্রকাশ্যত তার উপর এটা ফরয করে যে, তার কাজ হবে হালাল এবং পবিত্র, তার সাথে হারামের লেশমাত্র থাকবে না। আর কোনো হারাম কর্মকাণ্ড তাকে পরিবেষ্টন করবে না। আর যখন ধর্মঘটের উদ্দেশ্য হবে অন্যায় ও মন্দ কাজ প্রতিরোধ করা এবং ভালো ও কল্যাণকর কাজ প্রতিষ্ঠা করা তখন তা হয়ে যাবে ইসলামি পদক্ষেপ, ইসলাম যা অপরিহার্য করে।
ঘ. শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রশাসনিক সমাধান
এটা এমন এক মূলনীতি, যে সম্পর্কে ইসলামে বাদানুবাদের কোনো অবকাশ নেই। আর এ বিষয়ে সাধারণ মূলনীতি এই যে, যতক্ষণ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আইন সিদ্ধ থাকবে এবং যতক্ষণ উপায়-উপকরণ থাকবে বিধিসম্মত সেখানে কোনো শোষণের সুযোগ নেই। ইতঃপূর্বে আমরা এ কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছি যে, ট্রেড ইউনিয়নের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং তার সকল উপায়-উপকরণ আইনসম্মত, অনুরূপভাবে ইসলাম এমন প্রশাসনিক সমাধান স্বীকার করে না, যা প্রতিরোধের নিরাপত্তা হ্রাস করে। সকল ক্ষেত্রে সকল ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অবস্থা অন্যান্য সংগঠনের অবস্থার মতো।
অবশ্য কোনো কোনো ব্যবস্থা ইসলাম বা ইজতিহাদের নামে যে সব নীতি প্রণয়ন করে এবং যেসব মতামত ব্যক্ত করে কোনো কোনো ফকিহ যাকে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা এবং প্রশাসনের সাথে আঁতাত বলে অভিহিত করেন, ইসলামের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই, বরং দায়-দায়িত্ব এসব নিয়ম-বিধি প্রণয়নকারীদের।
৬. ট্রেড ইউনিয়নের চার্ট প্রণয়ন এবং নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে সদস্যদের অধিকার
আর এটাও ইসলামের অন্যতম মূলনীতি, কারণ আমির নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলের অধিকার একটা স্বীকৃত অধিকার। নবি কারিম (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন:
إِذَا كُنْتُمْ ثَلَاثَةٌ فَأَمِرُوا أَمِيرًا.
“তোমরা যখন তিনজন থাকবে তখন একজনকে আমির বানাবে, এমনকি নামাজের মধ্যেও।” (বুখারি ও মুসলিম)
কারণ ইমামকে প্রথমত সকলের আস্থা এবং সম্মতি অর্জন করতে হবে। ইমামের জন্য এটা সর্বপ্রথম ওয়াজিব। রাসুল করিম (সা.)-এর আচরিত নীতি আর কর্মধারা থেকে এর অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। আর খোলাফায়ে রাশেদিনের জীবন ধারায় এমন অনেক সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় যা বেশুমার। আর ইসলামি জীবন ধারায় বায়আত গ্রহণের নীতি স্বীকৃত ও পরিচিত।
আর নীতিগত দিক থেকে ইসলাম ট্রেড ইউনিয়ন সদস্যদের দায়িত্ব গ্রহণ করে, যারা সরকারের কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়া ট্রেড ইউনিয়নের নেতা নির্বাচন এবং নেতৃত্বের কর্মধারা নির্ধারণ করে। যতক্ষণ তা ইসলামি নীতিমালার গণ্ডির মধ্যে থাকে ততক্ষণ বাইরে কোনো সংস্থার হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। ইসলামি নীতিমালার মধ্যে থাকার অর্থ এতে কোনো হারামকে হালাল এবং কোনো হালালকে হারাম করা হয় না। এই অধিকার প্রয়োগের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করা বা এই অধিকারকে পদদলিত করা ইসলামি নীতিমালার অধীনে সম্ভব নয়। কিন্তু এটা সম্ভব হতে পারে প্রশাসনের কর্তৃত্বের ভিত্তিতে অথবা হতে পারে সংকীর্ণ সীমারেখার মধ্যে।
উপরের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ট্রেড ইউনিয়নের সাথে ইসলামের কোনো বিরোধ নেই, নেই কোনো সংঘাত; বরং ইসলাম এর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত এবং এজন্যই ইসলাম আহ্বান জানায়।
ইসলামি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
গতানুগতিক ট্রেড ইউনিয়ন থেকে ইসলামি ট্রেড ইউনিয়ন তিনটি বিষয়ে স্বতন্ত্র: প্রথম বৈশিষ্ট্য (ইসলামের সাথে গভীর সম্পর্ক): ইসলামি ট্রেড ইউনিয়ন ইসলামের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত এবং ইসলামের মহান মানবিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটা অংশ বলে নিজেকে গণ্য করে। কিছু দৃষ্টান্ত আর উন্নত
মূল্যবোধের উপর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত এবং যে গ্রন্থ যুগ যুগ ধরে তার অনন্য বৈশিষ্ট্য স্থাপন করেছে তা থেকে এ আন্দোলন অনুপ্রেরণা লাভ করে এবং এমনসব ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এর সম্পর্ক স্থাপন করে, মানবতার জন্য যাঁরা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। রাসুলে কারিম (সা.) থেকে শুরু করেছে, যিনি ছিলেন মানুষের জন্য সর্বোত্তম নমুনা তথা মহান নেতা। অতঃপর তাঁর হেদায়েত প্রাপ্ত সাহাবি এবং খোলাফায়ে রাশিদিন। এসব অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব, যারা রাসুলে পাক (সা.) কে পরিবেষ্টন করে রেখেছিলেন, যেমন নক্ষত্র পরিবেষ্টন করে রাখে সূর্যকে, তাঁরা এমনসব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সক্রেটিস, এ্যারিস্টটল, আলেকজান্ডার, কাইজার, মার্কস, ওলিয়ুস নাবলিউন, কাল্ট, হেগেল, কভেন্ট, রুশো, ইত্যাদি গণতান্ত্রিক এবং গ্রেট ব্রিটেনের মহান নেতারা যাদের সম্পর্কে কল্পনাও করতে সক্ষম হয়নি। মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর খলিফাদের জীবনকাল সম্পর্কে মানবতা এমন কিছু প্রত্যক্ষ করেছে, অন্যরা যার ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেনি, সুবিচার-ন্যায়নীতি আর মানবতার যে দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করেছেন তা রীতিমত অনন্য। এটা মুসলমানের কোনো তোষামোদ নয়, বরং ইতিহাসে প্রমাণিত চরম সত্য। আধুনিক ইউরোপীয় চিন্তাধারার সবচেয়ে বড়ো ত্রুটি এই যে, তারা এই বাস্তবতা স্বীকার করে না, অথবা তা থেকে কল্যাণ লাভ করতে প্রস্তুত নয়। ক্রসেড যুদ্ধকালে ইসলামি চিন্তাধারার বিরুদ্ধে গির্জা যে ষড়যন্ত্র করে এ
সম্পর্কে তারা মোটেই সতর্ক নয়। ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে পরিচয় লাভ করতে ব্যর্থ হয়ে খ্রিষ্টানদের ভালবাসা আর রোমানদের পৌত্তলিকতায় তারা উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়োতে থাকে, এর কোনোটির মধ্যে তারা সন্তোষজনক জবাব পায় না।
ইসলামি ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে ইসলামের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাকে গর্ব এবং গৌরবে ধন্য করে এবং এমন মৌলিকতার দ্বারা তাকে পরিবেষ্টন করে, যার দ্বারা প্রথাগত ট্রেড ইউনিয়ন থেকে তাকে পৃথক করা যায় এবং তাকে সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করে যেখানে ইসলাম হয় মূলভিত্তি।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য (বস্তুনিষ্ঠ মান উন্নয়ন): ইসলামি ট্রেড ইউনিয়নের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, সমাজের মানচিত্রে নিজের স্থান নির্ণয় করতে তা সক্ষম এবং সে বস্তুনিষ্ঠ মান অর্জন করতে পারে, যা তার লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হতে পারে, কোনো ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়াই এবং কোনো দলীয় চেষ্টা ছাড়া এবং একই সময়ে কাজের লোক সৃষ্টি এবং সে জন্য রাষ্ট্রীয় সংগঠন প্রয়োগ করার সুযোগ করে দিতে পারে। আর এ উপায়ে মুক্তি লাভ করতে পারে সংকট থেকে, যে সংকটে পতিত হয়েছে সমকালীন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। পুঁজিবাদী সমাজে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের যে কাঠামো গড়ে ওঠে তা কেবল নিজের সদস্যদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে এবং কেবল তাদের জন্যই কাজ করে। অবশ্য সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্র অথবা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিবেচ্য বিষয় এসবের ক্ষেত্রে কোনো মাথা ব্যথা নেই এবং এসব ক্ষেত্র আর বিবেচ্য বিষয়ে নিজের পথ নিজেই বের করে নিতে হবে এবং বিশেষ উপায় উপকরণ কাজে লাগাতে হবে। আর এভাবে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সমাজের উত্তেজনাকে প্রশমিত করতে পারে।
অবশ্য সমাজতান্ত্রিক বা কম্যুনিস্ট সমাজে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন স্বেচ্ছায় বা বাধ্যতামূলকভাবে বিশাল শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে একক শাসক দলের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে বাধ্য। আর যে কাঠামো সরকারের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে এবং শ্রমিক শ্রেণিকে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন মেনে নিয়ে সমাজে তা প্রয়োগ করতে বাধ্য করে। কম্যুনিস্ট দেশগুলোতে নিম্নমানের মজুরি, কাজের দুঃসহ পরিবেশ এবং স্বাধীনতা হারিয়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক সর্ববিবেচনায় সৌভাগ্যের জীবন যাপন করছে, আমাদের জন্য এমন ধারণা করা চরম বোকামি হবে। এর অর্থ হবে দুঃখ-দুর্দশা আর শোষণ-বঞ্চনা নিয়েই তারা পরম আনন্দিত। আর এমনটা হবে অযৌক্তিক। আর যৌক্তিক হচ্ছে এই যে, সূক্ষ্ম সংগঠন, ধর্মীয় বিভ্রান্তি এবং প্রচারণার মাধ্যমে রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়ে বিশাল শ্রমিক শ্রেণীকে তাদের ফাঁদে ফেলে এবং তাদেরকে করে তোলে অক্ষম এবং বিভ্রান্ত। আর এ কাজ করে দলটি নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার এবং তাদের হাতের সমস্ত উপায়-উপকরণ দ্বারা প্রভাব বিস্তার করার পর, সেখানে ভয়-ভীতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ধর্ম ও তরবারি কোনো কাজে আসে না, অবশ্য কাজে আসে তুলনামূলক হিসেবে প্রাথমিক উপায়-উপকরণ।
অনুরূপভাবে আমরা দেখতে পাই যে, পরিবেশ-পরিস্থিতি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈয়ার করে। পক্ষান্তরে পুঁজিবাদী সমাজে তা হচ্ছে উত্তেজনার হাতিয়ার। আর কম্যুনিস্ট সমাজে তা হচ্ছে মানুষকে দাসানুদাসে পরিণত করার উপায়।
অবশ্য এ আন্দোলন চরম সংকটে নিপতিত হয়েছে; কারণ এ জন্য যে কাঙ্ক্ষিত মান প্রয়োজন ছিল সে তা হারিয়ে বসেছে। আর অন্যান্য দিক তা প্রত্যাখান করতে সক্ষম নয়। কারণ পুঁজিবাদী সমাজে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মাপকাঠি হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির ইচ্ছা-অভিপ্রায়। পরিবেশ পরিস্থিতি এবং অন্যান্য ঘনিষ্ঠ বিষয় লক্ষ্যণীয় নয়। আর কম্যুনিস্ট সমাজে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে দলের ইচ্ছা-অভিপ্রায়, শ্রমিক শ্রেণি কি চায় তা লক্ষ্যণীয় বিষয় নয়। আর পুঁজিবাদী সমাজে ট্রেড ইউনিয়ন যা চায় তা পায় না অথবা শ্রমিক শ্রেণি যা চায় এর চেয়ে বড়ো কিছু নির্ভর করার থাকে না। যেমন কম্যুনিস্ট সমাজে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন যা দাবি করে তা পায় না অথবা দল যা চায় তার চেয়ে বড়ো কিছু নির্ভর করার মতো পায় না। আর এইসব কিছু কাঙ্ক্ষিত মানদণ্ড নয়, আর রাষ্ট্র বা মালিক পক্ষ সূচনালগ্নে এর চেয়ে বড়ো কিছুর উপর নির্ভর করে না; পক্ষান্তরে ভয়-ভীতি আর প্রতারণা-প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। অবশ্য ইসলামি ট্রেড ইউনিয়ন কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করে, যে মানে আন্দোলন সন্তুষ্ট এবং যা আন্দোলনকে রক্ষা করে, রাষ্ট্র বা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রত্যাখান করতে সক্ষম নয়। এই মানদণ্ড হচ্ছে ইসলামের সুবিচার। আর যখন ইসলামি ট্রেড ইউনিয়ন সুবিচারকে তার আবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে তখন তা খোদায়ী বিধানের আঙ্গিকে তার কাঙ্ক্ষিত বিষয় প্রণয়ন করে এবং কাঙ্ক্ষিত কেন্দ্র থেকে গমন শুরু করে, ইউরোপ আমেরিকা বা সোভিয়েত রাশিয়ার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মতো জুয়া বা প্রতারণার আশ্রয় নেয় না।
যেমন ইতঃপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, ইসলামি সুবিচারের মূল, সারবস্তু এবং তার দীর্ঘ রেখা অংকন করেছে কুরআন মজিদের দ্ব্যর্থহীন আয়াত, নবি কারিম (সা.)-এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের প্রদর্শিত নীতিমালা।
এইসব রেখাচিত্র থেকে বিস্তারিত বিবরণ লাভ করা কঠিন নয়। এজন্য ফকীহদের উক্তি এবং ইমামদের বচন দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এভাবে ইসলামি ট্রেড ইউনিয়ন শরিয়ত বাস্তবায়নের মাধ্যম এবং সুবিচারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠার উপায়, আর এই ইসলামি সুবিচার দলীয় সুবিধাবাদী সংকট থেকে মুক্তি দেয় এবং পুঁজিবাদী সমাজ বা দলীয় লেজুড়বৃত্তি এবং দলীয় বিতণ্ডা আর টেনশন থেকে মুক্তি দেয় এবং কম্যুনিস্ট সমাজের বিভ্রান্তি আর দমননীতি থেকে উদ্ধার করে।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য (শ্রমের নৈতিক মান): তৃতীয় যে বৈশিষ্ট্য ইসলামি ট্রেড ইউনিয়নকে তথাকথিত ট্রেড ইউনিয়ন থেকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তা হচ্ছে শ্রম সম্পর্কে ইসলামি ট্রেড ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি। তথাকথিত ট্রেড ইউনিয়নে শ্রম হচ্ছে নিছক অনুশীলন অথবা পুঁজির বিপরীতে কার্য সম্পাদন। সুতরাং এই ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমের নৈতিক মান খর্ব করে না। যেমন কার্য সম্পাদনের দায়িত্বের ভিত্তি সর্বোচ্চ ক্ষমতার উপর স্থাপিত নয়, এমনকি পেশাগত বিবেক যখন ব্যাপক আকারে জাগ্রত হয় তখনো নয়। আর যে সব উপায়-উপকরণ শ্রমিকের আচরণে কর্তৃত্ব করে এবং তাকে শ্রমের দিকে চালিত করে তা হচ্ছে মজুরি, প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা এবং দলগত চুক্তির শর্তাবলী। আর এ সবকিছু হচ্ছে ব্যক্তিগত এবং বস্তুগত ছাপ। পক্ষান্তরে কম্যুনিস্ট সমাজে শ্রমের নৈতিক মান হচ্ছে কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯১৭ সালের অক্টোবরে বিপ্লবের দিনগুলোতে এই দাবি জাদুর মতো কাজ করে।
অতঃপর প্রকাশ পায় যে, এই রাষ্ট্রের ভিত্তি অবশ্যই সুবিচার, মানুষের মর্যাদা এবং এই মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য কাঙ্ক্ষিত ভিত্তির উপর এ রাষ্ট্রের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত নয়।
কিন্তু ইসলামি ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, শ্রমকে ইসলাম প্রায় ইবাদত বলে গণ্য করে এবং তাকে নির্ধারিত মূল্য দেয় এবং এজন্য কিছু নীতিমালা নির্ধারণ করে দেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রম এমন এক নৈতিকতার বন্ধনে আবদ্ধ, যা মানুষকে কার্য সম্পাদনে উদ্বুদ্ধ করে আর এই শ্রমের সঙ্গে জড়িত আছে অধিকার ও কর্তব্য, সমাজ এবং মানবজীবনে শ্রমের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। আর এই দায়িত্বানুভূতি শ্রমকে একটা মিশনে পরিণত করে। পৃথিবীকে আবাদ করার ক্ষেত্রে মানুষের শ্রম হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছায় সাড়া দেওয়া, আর এই শ্রমের ফলে পৃথিবী সুন্দর বাসস্থানে পরিণত হয়। পৃথিবীকে সুন্দর নিবাসে পরিণত করার ক্ষেত্রে সুবিচার ও ন্যায়নীতি কর্তৃত্ব করে, এর ফলে সমস্ত মানুষের জন্য পৃথিবী মনোরম নিবাসে পরিণত হয়। মানুষ সুখী সুন্দর জীবন যাপন করার সুযোগ পায়। পৃথিবী থেকে ক্ষুধা-দারিদ্র, অভাব-অনটন এবং শোষণ-নির্যাতন দূরীভূত হয় এবং সাম্য, শান্তি ও সামাজিক দায়িত্বানুভূতির ভিত্তিতে এক নতুন সমাজ অস্তিত্ব লাভ করে।
যেমন আমরা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি, ইসলামি ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমকে যে দৃষ্টিতে দেখে গতানুগতিক ট্রেড ইউনিয়নের দৃষ্টি তা থেকে ভিন্ন, আর এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে শ্রমের অর্থে ব্যাপ্তি এবং কার্যকারিতায় ভিন্নতা দৃশ্যমান হয়। এর ফলে আধুনিক সমাজে শ্রমের ভূমিকা এবং দায়িত্ব কর্তব্য ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করে।
শ্রমের অর্থের বিবেচনায় ইসলাম এ অর্থকে ব্যাপকতা দান করে এবং গতানুগতিক অর্থনীতি এবং ট্রেড ইউনিয়ন ভিত্তিক অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে না। অর্থাৎ শ্রম হচ্ছে বস্তুগত মজুরি লাভের অপর নাম, আর ‘শ্রম’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করে কাজের সকল ক্ষেত্র বা পরিধি।
শ্রম বিষয় সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনায় বলা যেতে পারে যে, ইসলাম পবিত্র শ্রম ভিন্ন অন্য কিছু গ্রহণ করেনা এবং পবিত্র ও হালাল ছাড়া অন্য কিছুকে শ্রম বলে গণ্য করেনা। আর এই গুণে ভূষিত নয় এমন কোনো কর্ম ইসলামি শ্রম বলে গণ্য ও স্বীকৃত নয়। নবি কারিম (সা.) বলেছেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لا يَقْبَلُ الأَطَيِّبًا
“লোক সকল, আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ তাআলা নবি-রাসুলদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, সে নির্দেশই দিয়েছেন মু’মিনদেরকে।” তিনি বলেছেন-
يَأَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ
عَلِيمٌه
“হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর ও সৎকর্ম কর; তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।” (সুরা মু’মিনুন: ৫১)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন-
كُلُوا مِن طَيِّبَاتٍ مَا رَزَقْنَاكُمْ.
“তোমাদেরকে যা দান করেছি তা থেকে ভাল ভাল বস্তু আহার কর।” (সুরা ত্বোয়া-হা: ৮১)
নবি কারিম (সা.) হাদিসে এক ব্যক্তির উল্লেখ করেছেন,
ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلُ يُطِيلُ السَفَرَ أَشْعَثُ أَغْبَرُ ثُمَّ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ وَيَا رَبِّ وَيَا رَبِّ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ وَأُغْذِيَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لَهُ.
“যে দীর্ঘ সফর করে, তার পোশাক ধূলামলিন, মাথার চুল উসুকখুসকু। অতঃপর আসমানের দিকে দু’হাত প্রসারিত করে সে দোয়া করে হে পরওয়ারদিগার… অথচ তার আহার হারাম তার পানীয়বস্তু হারাম, তার পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং হারাম দ্বারা দেহ বর্ধিত হয়েছে, তবে কেমন করে তার দোয়া কবুল করা হবে।”
হযরত ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে-
لَا يَكْسِبُ عَبْدٌ مَالاً مِنْ حَرَامٍ فَيُنْفِقُ عَنْهُ فَيُبَارَكُ فِيهِ.
কোনো বান্দা হারাম মাল উপার্জন করে তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবে এবং আল্লাহ তাতে বরকত দেবেন- এমন হতে পারে না।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে- রাসুল (সা.) বলেছেন-
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَيَأْتِيَنَّ عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لا يُبَانِي الْمَرْءُ بِمَا أَخَذَ مِنَ الْمَالِ بِحَلالٍ أَمْ حَرَامٍ .
“লোকদের উপর এমন এক সময় আসবে যখন মানুষ কোনো পরোয়া করবে না, সে হারাম মাল উপার্জন করেছে না হালাল।”
শ্রম বিষয়ে নৈতিকতা প্রসঙ্গে বলা যায় যে, সব ধরনের কেনাবেচা, লেনদেন এবং বিকৃত অনুশীলন যেমন মদ প্রস্তুত করা, পরিবেশন করা অথবা মূর্তি প্রস্তুত করা অথবা শূকরের মাংস ক্রয়-বিক্রয় করা অথবা মৃত জন্তুর মাংস কেনাবেচা করা অথবা সুদি কাজ কারবার করা অথবা এমন কাজ কারবার যাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ধোঁকা, প্রতারণা, প্রবঞ্চনার কোনো উপাদান অথবা এমন কাজ যাতে দুর্বলকে শোষণ করা হয় অথবা প্রয়োজনীয় বস্তু ছিনতাই করা- ইসলাম এ সকল কাজকে হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং এ সমস্ত কর্মকাণ্ড থেকে মানুষের দূরে থাকা আবশ্যক বিবেচনা করে। বরং অপচয়, কঠোরতা এবং সব ধরনের অন্যায় আচরণ ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কেবল মানুষ নয়, জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদির ক্ষেত্রেও এই সব আচরণ নিষিদ্ধ। ইবনু আব্দুল হাকাম ওমর ইবন আব্দুল আযীয (রা.)-এর জীবন চরিতে উল্লেখ করেন যে, বিনা প্রয়োজনে অশ্ব পালন করতে তিনি নিষেধ করেছেন। তিনি সাকাক অঞ্চলের শাসনকর্তার নিকট লিখে পাঠান যে, কেউ যেন পশুর মুখে ভারি লাগাম পরিধান না করায়। আর কেউ যেন এমন চাবুক দ্বারা পশুকে খোঁচা না মারে, যার নিম্নভাগে লোহা জড়ানো রয়েছে।
যেহেতু ইসলামে শ্রম সংক্রান্ত নীতিমালা আগাগোড়া মৌলিক বিষয় তা যেমন জড় পদার্থকে অন্তর্ভুক্ত করে তেমনি অন্তর্ভুক্ত করে প্রাণীকূলকেও। তাই আমরা দেখতে পাই যে, নবি কারিম (সা.) বৃক্ষের চারা উপড়ে ফেলতে অথবা তার ডালপালা কর্তন করতে নিষেধ করেছেন। অনুরূপভাবে, অজু করার সময় পানির অপচয় করতে নিষেধ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, وَلَوْ كُنْتَ عَلَى نَهْرٍ جَارٍ
“যদি বহতা নদীর কিনারে বসে অজু কর তা হলেও পানির অপচয় করবে না।”
পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করাকে ঈমানের অঙ্গ বলে গণ্য করা হয়েছে। এমনকি পরিবেশ দূষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ অপব্যবহার ইসলামে নিষিদ্ধ। বর্তমান সময়ে মানবতা যেখানে গিয়ে পৌঁছতে পেরেছে, ইসলামি দিকনির্দেশনা এক হাজার বছর আগে যেখানে পৌঁছেছিল। সেখানে পৌছতে পারলে বর্তমানের বিকৃতি, পরিবেশ দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদের পরিচ্ছন্নকরণ এবং সুপেয় পানি দূষিতকরণ ইত্যাদি ঘটনা বর্তমানে ঘটত না।
যেহেতু ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রম হচ্ছে বিশ্বকে আবাদ করার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর ইচ্ছা-অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করা এবং জীবনকে আরামদায়ক করতে এবং নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অবদান রাখা। কারণ একজন মুসলিম শ্রমিকের শ্রম উৎসারিত হয় তার ঈমান থেকে, আর সেই ঈমান জাগ্রত হয় নিয়তের নিষ্ঠা, একাগ্রতা, আন্তরিকতা, সংকল্পের বিশুদ্ধতা এবং চিত্তের পরিশুদ্ধি থেকে একজন মুসলিম শ্রমিকের শ্রমের সূচনা হয়। আর এই অবস্থা তার মনে জাগরুক থাকে ইবাদত তথা কার্যসম্পাদন কালে। আর এই সময় সুষ্ঠুভাবে অতীব যত্ন সহকারে সর্বোত্তম উপায়ে কার্যসম্পাদনে সে ব্রতী হয়। ফলে যথেষ্ট পরিমাণ উৎপাদন এবং সময় ও উপকরণের উত্তম ব্যবহার ইত্যাদির জন্য সে যত্নবান হয়। আর এসব গভীর অনুভূতি এবং ঈমানী ও মানসিক বৃদ্ধি বা শান্তির হুমকি এবং পর্যবেক্ষণের কড়াকড়ি ইত্যাদি ইতিবাচক এবং নেতিবাচক অনেক পরিণতি প্রকাশ পায়। কারণ নগদ মজুরি হচ্ছে একজন মুসলিম শ্রমিকের দৃষ্টিকোণ থেকে সাফল্যের একটা অংশ।
পক্ষান্তরে তার অপর অংশ হচ্ছে অন্তরের সন্তুষ্টি, ব্যক্তিত্বের পরিপুষ্টি ও শ্রমের সৌভাগ্য লাভের জন্য তার প্রশংসা ও শুকরিয়া জ্ঞাপন এবং সমাজ বিনির্মাণে সুযোগ লাভে অংশগ্রহণ এবং জীবন সম্পর্কে ভ্রাতৃত্বের সহযোগিতা লাভ এবং এর দ্বারা মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ এবং যে দিন সন্তান আর সম্পদ কোনো কাজে আসবে না সে দিনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ ইত্যাদির জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা।
আর এই শ্রমিক এমন শক্তি অর্জন করে এমনভাবে যে, মালিক পক্ষ নিষ্ঠাবান শ্রমিকদেরকে অন্যদের উপর প্রাধান্য দেয়। কারণ মালিক পক্ষ এই সব নিষ্ঠাবান শ্রমিকদের নিকট সূচাররূপে কার্য সম্পাদন এবং বিশ্বস্ততা দেখতে পান। আর এদের মধ্যে কেউ কেউ স্পর্শকাতর পদে ঈমানের উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত অফিসার ছাড়া অন্য কাউকে নিয়োগ করেন না। কারণ তারা জানে যে, এই ঈমান তাদেরকে অনেক পদস্খলন থেকে রক্ষা করবে।
পক্ষান্তরে এহেন শ্রম যে সম্পর্ক সৃষ্টি করে এবং যে অধিকার জাগ্রত করে এবং যে দায়িত্বানুভূতি জন্ম দেয় আর তা হচ্ছে সূক্ষ্ম অনুভূতি সম্মত এবং কণ্টকযুক্ত কেন্দ্রবিন্দু, যে বিষয়ে সমস্ত সৃষ্টিকূল বিস্ময়াভিভূত এবং পুঁজিবাদী এবং কম্যুনিস্ট অর্থব্যবস্থা যা উদঘাটন করতে অক্ষম। কারণ ইসলাম তা এমন উপায়ে সমাধান করে, যা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। ইসলাম অধিকার দাবির ক্ষেত্রে শ্রমিকের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত প্রতিবন্ধকতা স্বীকার করে নেয়, যেমন অবস্থা বিরাজ করছে পুঁজিবাদী সমাজে। আর একই সময়ে ইসলাম রাষ্ট্রীয় শক্তি নিয়ে অভিযান চালায় আদালতের সীমারেখা নির্ধারণের জন্য, যা অতিক্রম করা বৈধ নয়। সবচেয়ে বড়ো কথা ইসলাম মানব মনে এমন এক বিবেকের উন্মেষ ঘটায় অথবা বলা চলে, এমন এক ঈমান জাগ্রত করে, যা এমন ক্ষেত্র সৃষ্টি করে যেখানে কোনো রকম বিদ্বেষের উন্মেষ ছাড়া উভয় পক্ষ মিলিত হয়। সুতরাং ইসলামি ট্রেড
ইউনিয়ন শ্রমিকের পবিত্র অধিকার স্বীকার করে নেয় এমনভাবে যে, সে তার শ্রমের পূর্ণ ফল ভোগ করবে, তা থেকে কিছুমাত্র হ্রাস করা যাবে না। আর এই অধিকার লাভ করার জন্য ইসলামি ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিককে কর্মের স্বাধীনতা দেয়, যাতে সে মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। অবশ্য ইসলামি ট্রেড ইউনিয়ন বিশ্বাস করে যে, শ্রমিকের অধিকার অর্থ মন যা চায় তা লাভ করা নয়, বরং এর অর্থ হচ্ছে ইসলামি সুবিচার যে অধিকার স্বীকার করে। আর এখান থেকে উদ্ভব ঘটে এমন বিধির যা কাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডকে যথাস্থানে স্থাপন করে এবং আপন সীমায় নিয়ে তাকে পৌঁছায় এবং সেখানে পৌঁছা শ্রমিক-মালিক উভয়ের ক্ষেত্রে লাভজনক কর্ম নির্ধারণ করতে পারে। কারণ স্বভাবতই শ্রমিক শ্রেণি হচ্ছে মজলুম পক্ষ আর ইসলাম সর্বদা শ্রমিক শ্রেণির সুযোগ-সুবিধা স্বীকার করে নেয়। আর এমন কতৃত্বের অধিকার স্বীকার করে নেয় যা মেনে চলা মালিক পক্ষের জন্যেও বাধ্যতামূলক। কারণ সত্যিকার অর্থে সেই হচ্ছে উপার্জনকারী, এমন কি তার আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং তার মন যা চায় তা হচ্ছে ইসলামি সুবিচার তার জন্য যা বাস্তবায়িত করে তার চেয়েও বড়ো। কারণ ইসলামি সুবিচারের ভিত্তিতে তার জন্য আজ যা অর্জন করা অসম্ভব আগামীকাল তা অর্জন করা সম্ভব হতে পারে। কেননা ইসলামি সুবিচার হচ্ছে নমনীয়, কারণ অতিরিক্ত অভাব এবং মান উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি সে স্বীকার করে। আর এইমূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে হচ্ছে মালিক পক্ষ। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তারা ব্যবসা করে, আবার ব্যবসা করে শান্ত পরিবেশ আর শ্রমিক শ্রেণির আস্থা অর্জনের মাধ্যমে। আর এরপরও ত্রিশ হাজারের পরিবর্তে বিশ হাজার উপার্জন করতে পারে না। কারণ ‘মন যা চায়’ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ইসলামি সুবিচারের নীতিতে সেই অনুগত শ্রমিক নয়। কারণ মানব মনে যে দুর্বলতা নিহিত আছে এবং তাতে স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষ উচ্চাভিলাষী হতে পারে এজন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষার বীজ মানুষের মনে অঙ্কুরিত আছে।
কোনো রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সুষ্ঠু বিধান এখান পর্যন্ত পৌঁছতে পারে, এবং পুঁজিবাদ ও কম্যুনিজমের মধ্যস্থলে সঙ্গোপনে পথ চলতে পারে- এটাও সম্ভব। এরপরও ইসলামের একক বৈশিষ্ট্য বা কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করতে পারে না। কারণ ইসলাম এর তুলনায় অনেক অগ্রগণ্য। কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিধান সেখানে পৌঁছতে পারে না, যেখানে ইসলাম নিয়ে যেতে চায়। আর এটা এজন্য যে, ইসলাম তার মধ্যে পার্থক্যের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে, এটা করে শক্তি-সামর্থ্য, যোগ্যতা-প্রতিতা, চেষ্টা-সাধনা এবং সুযোগ-সুবিধা ও প্রাপ্য অংশের পরিবর্তনে পরিণতি হিসেবে। কিন্তু এতসব পার্থক্য আর ব্যতিক্রম সত্ত্বেও ইসলাম অধিকার ও কর্তব্য এবং মানবীয় মর্যাদার মধ্যে সমতা বিধান করে, প্রতিটি ব্যক্তি যা উপার্জন করে তা থেকে সে সম্মানজনক অংশ পাবে, এর বিনিময়ে সে অনাহারে বা অর্ধাহারে কাটাবে না। অবসাদ বা জড়তায় সে ভুগবে না। কারণ-
الْمُؤْمِنُونَ كَأَسْنَانِ الْمُشْطِ وَهُمْ كَأَعْضَاءِ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تُدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْأَعْضَاءِ بِالْحِمَى وَالشَّهْرِ ، وَهُمْ عُدُولٌ يَسْعَى بِذِلَّتِهِمْ أَدْنَاهُمْ ، وَرُبَّ أَشْعَثَ أَغْبَرَ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لَابَرَّهُ وَهُمْ سَوَاءٌ أَمَامَ الْقَضَاءِ ، سَوَاءٌ فِي الْفُرَضِ وَالْحُقُوقِ وَالْوَاجِبَاتِ.
সমস্ত মুমিন চিরুনির দাঁতের মত (এক সমান) এবং তারা হচ্ছে এক দেহের বিভিন্ন অঙ্গের অনুরূপ। দেহের কোনো অঙ্গে অসুবিধা দেখা দিলে সমস্ত অঙ্গ সাড়া দেয়, বিনিদ্র রজনী যাপন করে এবং জ্বর বোধ করে, আর মুমিনরা হচ্ছে ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি, তাদের একজন নগণ্য ব্যক্তিও নিজ দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পাদন করে। আর এমন অনেক উসকুখুসকু চুলওয়ালা এবং ধূলামলিন বস্ত্র পরিহিত ব্যক্তি আছে, যে আল্লাহর নামে শপথ করে কোনো কথা বললে আল্লাহ্ তা পূরণ করেন এবং বিচারের সম্মুখে তারা সকলে এক সমান, সমান দায়িত্ব-কর্তব্যের ক্ষেত্রে।(আল হাদিস)
অনুরূপভাবে ইসলাম সকলের সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত করে, প্রত্যেকে অগ্রসর হবে তার শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী। কারণ আল্লাহর দান নিষিদ্ধ নয়, সীমাবদ্ধও নয়। কেননা ইসলাম পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করাকে হারাম করেছে, কারও সুখ-শান্তি ধ্বংস হোক, এমন কামনা করাকে নিষিদ্ধ করেছে। অন্য কথায় মালিক পক্ষ মালিক বলে তাদের প্রতি শ্রমিক শ্রেণি অন্তরে ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করতে পারবে না। সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারলে শ্রমিকও একদিন মালিকে পরিণত হতে পারে এবং এমন এক সময় আসতে পারে যখন মালিকের ধ্বংসাত্মক অনুভূতি পোষণ করা অর্থহীন বলে গণ্য হবে। আজকের লায়-লক্ষর চিরকাল থাকবে না, আর আজকের শ্রমিক শ্রেণি চিরকাল শ্রমিক থাকবে না এবং সকল মানুষ কোনো দিন নেতা হবে না। আর সুযোগ-সুবিধা পাওয়া গেলে শ্রমিক শ্রেণি তাদের সম্মুখে এমন কর্মকর্তা দেখতে পাবে, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সজ্জিত, যা একদিন বিশেষ রাষ্ট্রীয় অস্ত্রের চেয়েও জঘন্য রূপ ধারণ করবে। আর কমিউনিজম যখন যুদ্ধের ঘোষণা দেয় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এবং শ্রেণি সংগ্রামকে নিন্দা করে তা করে কেবল এজন্য যে, বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করে তদস্থলে তারা নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চায়, আর এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তারা শ্রমিক শ্রেণিকে কাজে লাগায়। আর রাষ্ট্রের দাসানুদাসে পরিণত হওয়া ছাড়া তাদের এ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না।
সুতরাং কাঙ্ক্ষিত বস্তু অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে মানুষ নিজের জীবন ধ্বংস করবে এর কোনো কারণ নেই। নবি-রসূলগণ ছিলেন সৃষ্টির সেরা। কুরআন মজিদে তাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো বিশেষ কাফেরকে ঈমানের পথে আনতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে নিজেদের জীবন নাশ করতে তাদেরকে বারণ করা হয়েছে। অথচ এই হেদায়েত লাভ করা মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওনা, সর্বোচ্চ লক্ষ্য। আর যে সমাজে মানুষে মানুষে পার্থক্য এবং বিভিন্ন শ্রেণির অস্তিত্ব বিদ্যমান, সে সমাজের রীতিনীতি পরিবর্তন করার চেয়ে বড়ো কোনো পুরস্কার হতে পারে না। স্বয়ং নবি-রাসুলদের মধ্যেও পার্থক্যের বিভিন্ন স্তরের অস্তিত্ব ছিল, তাদের মধ্যে কাউকে আল্লাহ কারও উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর তাদের প্রত্যেকের কর্তব্য ছিল একগুঁয়েমীর লাগাম টেনে ধরা এবং লোভাতুর মনষ্কামনাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সর্বদা মধ্যপন্থা অবলম্বন করে চলা ও আল্লাহ যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তাতে সদা তুষ্ট থাকা, যাতে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার না হতে হয় এবং নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন না দিতে হয়। এমন সন্তুষ্টি এক বিরাট নেওয়ামত।
মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে এই যে, শক্তি-সামর্থ্য, যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা ইত্যাকার বিষয়ে যারা অগ্রগণ্য তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাফল্য অর্জন করতে চায় অথবা শ্রেষ্ঠত্ব ও কৃতিত্ব লাভ করতে চায় এবং অপর পক্ষের এইসব সুযোগ-সুবিধা ধ্বংস হোক তা কামনা করে আর এমন আহ্বান জানানো সাম্যের পরিপন্থী বলে দাবি করা সঙ্গ প্রতারণা, এর লক্ষ্য হচ্ছে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া। আর শ্রমিক শ্রেণি যখন শয়তানের প্ররোচনায় হিংসা-বিদ্বেষের শিকার হয় এবং মনষ্কামনা আর উৎসাহ-উদ্দীপনার কাছে দুর্বল হয়ে পড়ে তখন যারা তাদের চেয়ে শক্তিশালী এবং কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে যারা তাদের চেয়ে বড়ো প্রতারক তাদের জন্য কুরবানির পশুতে পরিণত হয় অথবা মনষ্কামনার ঢেউ এমনভাবে অপবাদে তাদেরকে আড়ষ্ট করবে পুঁজিবাদী সমাজে যা মোটেই হ্রাস পাবে না।
সবচেয়ে বড়ো কথা এই যে, ইসলাম কেবল শ্রমিক শ্রেণিরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে না, বরং ইসলাম দৃষ্টি আকর্ষণ করে ধনিক শ্রেণি এবং মালিক পক্ষের সীমাহীন মুনাফার নিকট আত্মসমর্পণ না করার জন্য এবং তাদেরকে সতর্ক করে অধিক সম্পদ অর্জন, কার্পণ্য, লোভ-লালসা, অপরের হক আত্মসাৎ এবং শোষণ সম্পর্কে এবং তাদেরকে আহ্বান করে বলে তারা যে মাল অর্জন করে ধন্য হয়েছে তা হচ্ছে আল্লাহর মাল, এই সম্পদে তাদেরকে প্রতিনিধি করা হয়েছে, এজন্য তারা জিজ্ঞাসিত হবে এবং হিসেবের সম্মুখীন হতে হবে। এতদসত্ত্বেও ইসলাম প্রাচুর্যের অস্তিত্ব উদারতার সঙ্গে গ্রহণ করে এবং বাহ্যত ইসলাম সম্পদকে অন্যতম প্রয়োজনীয় বস্তু বলে স্বীকার করে। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদ শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়, যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার জন্য লোভের শিকার হতে হবে এবং যে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তাই যদি হত তবে সাহাবায়ে কিরাম সম্পদ অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, নবি কারিম (সা.) এবং তাঁর প্রধান প্রধান সাহাবিরা ছিলেন সংযমশীল, নিঃস্ব ব্যক্তি। আর সাহাবিদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি সম্পর্কে কথিত আছে যে, তিনি হামাগুড়ি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। অথচ ইসলাম প্রচারের কাজে তিনি অকাতরে সম্পদ ব্যয় করেছেন, আর তিনি ছিলেন জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজনের অন্যতম। খিলাফতের জন্য খলিফা উমর ইবন খাত্তাব যে ছয় ব্যক্তিকে মনোনীত করেছিলেন তিনি ছিলেন তাদের একজন। সুতরাং সম্পদের জন্য জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে। সম্পদ যতবেশি হবে পরীক্ষাও তত তীব্র হবে। সম্পদ যত ভারী হবে হিসাব-নিকাশ এবং জিজ্ঞাবাদ তত তীব্র হবে। এসব বিপরীতমুখী পথনির্দেশনার পরিণতি অর্থাৎ ধনীক শ্রেণির প্রতি সতর্কবাণী এবং কার্পণ্য, শোষণ আর সম্পদ পুঞ্জিভূত না করার জন্য মালিক পক্ষের প্রতি সতর্কবাণী আর লোভ-লালসার নিকট আত্মসমর্পণ এবং অপরের হাতে যা আছে তা হস্তগত করার জন্য ব্যাকুলতা, এসব বিষয়েও নিঃস্ব ব্যক্তিবর্গ এবং শ্রমিক শ্রেণিকে সতর্ক করা হয়েছে। আর যৌথ উদ্যোগে সম্পদ উপার্জনের লাগামহীন চেষ্টায় প্রবৃত্ত হওয়ার জন্যও সতর্ক করা হয়েছে। অবশ্য কোনো প্রকার বিদ্বেষ এবং হিংসা প্রবণতা ছাড়া দু’পক্ষের যৌথ কারবারের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। আর এটা তখন সম্ভব, যখন উভয় পক্ষের মন-মানসিকতা ঐসব নির্দেশনা পুরোপুরি মেনে চলবে এবং সম্পূর্ণ বুঝেশুনে বাস্তবায়ন করবে। কারণ এক পক্ষের অধিকার অপর পক্ষের কর্তব্যে পরিণত হবে, এমনভাবে অপরপক্ষ প্রথম পক্ষের কোনো প্রয়োজন ছাড়াই সে নির্দেশনা মেনে চলবে। আর এটা করবে কারবারে সাফল্য অর্জন করার লক্ষ্যে অথবা জোরপূর্বক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করবে। ফলে মালিক পক্ষের যা অধিকার তাই হচ্ছে শ্রমিক পক্ষের কর্তব্য। আর উভয় পক্ষ ঈমানের দাবি অনুযায়ী শ্রমের লক্ষ্যে নিজ নিজ কর্তব্য পালন করবে। এমনকি মালিক পক্ষ এ দায়িত্ব পালন না করলে ট্রেড ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ এবং সম্ভ্রান্ত শ্রেণি ইত্যাদি এ দায়িত্ব পালন করবে। আর শ্রমিক শ্রেণির যা অধিকার, তাই হবে মালিক পক্ষের কর্তব্য এবং তারা ঈমানদারির সাথে শ্রমিকের জন্য এ দায়িত্ব পালন করবে এবং এটাকে তাদের অবশ্য কর্তব্য বলে মেনে চলবে। এমনকি শ্রমিক শ্রেণি যদি ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত নাও হয় এবং হরতাল বা ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন নাও করে তথাপি মালিক পক্ষকে এ কাজ করতে হবে।
কিন্তু মানবতার দুর্ভাগ্য যে, এ ভরে বোধশক্তি উন্নীত হওয়া খুব কম সংঘটিত হয়। আর এখান থেকেই সূচনা হয় কর্মক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন আর বিধি-বিধানের। কিন্তু এই ভরে উন্নীত হতে না পারা একথা বুঝায় না যে, মালিক পক্ষ এবং শ্রমিক পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি রোধ করার ক্ষেত্রে এসব দিকনির্দেশনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আর যদি এক পক্ষের অধিকারকে অপর পক্ষের কর্তব্যে পরিণত নাও করতে পারে তথাপিও মন্দ অনুভূতি ও মন্দ চিন্তা দূর করতে সক্ষম হবে। বৃহত্তর বিরোধের ক্ষেত্রে সাধারণ বিদ্বেষের বীজ বপন করা থাকে। এভাবে সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে। এটাই হচ্ছে ইসলামি ট্রেড ইউনিয়ন।
আর তা হতে পারে এ যুগের সবচেয়ে বড়ো ঘটনা এবং সবচেয়ে বড়ো বিষয় যেখানে ইসলামের গৌরব প্রতিবিম্বিত হতে পারে। কেন? কারণ ইসলাম এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মধ্যে যোগসূত্র কেবল এটাই নয়, যাতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের উৎসের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে, বরং তা ইসলাম এবং মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি মূল্যবান কিছু আরোপ করতে পারে। আর এ সময় ট্রেড ইউনিয়ন দুরারোগ্যে ব্যাধি এবং গভীর সংকট থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে পারে, কারণ এতে করেই ইসলামের বোধ-বুদ্ধি এবং ইসলামি দর্শন মধ্যম শ্রেণির হস্তক্ষেপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
ইসলাম গণমানুষ সম্পর্কে চিন্তা করে, আর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন চিন্তা করে ট্রেড ইউনিয়নের ইসলামিকরণ নিয়ে, আর এই দু’টির সম্মিলনের ফলে এমন এক জাগরণ সৃষ্টি হবে, যাতে ইসলাম কল্যাণ লাভ করবে, যে পরিমাণ কল্যাণ লাভকরবে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। কারণ এক পক্ষের কল্যাণ অপর পক্ষের কল্যাণ হিসেবে প্রতিবিম্বিত হবে। সুতরাং শ্রমের চেয়ে বড়ো এমন কিছু আছে কি, যা মানব মনকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, মানুষকে এবং মানুষের সাহসকে জাগ্রত করতে পারে এবং বড়ো বড়ো কাজের জন্য মানুষকে চালিত করতে পারে। কাঙ্ক্ষিত এই মিলনের ফলেই এটা সম্ভব হতে পারে আর এটা হতে পারে মহা জাগরণের পক্ষে সূচনা বিন্দুর নমুনা।
উদাহরণ জগৎ এবং বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা এমন কিছু দেখতে পাই না, যা সমভাবে এই দৃষ্টান্ত হতে পারে বা হতে পারে তার সমকক্ষ। আমরা দেখতে পাই জনগণের বিপরীতে চিন্তাধারা, যেমন অবস্থা বিরাজ করছে দর্শনের ক্ষেত্রে, আবার আমরা দেখতে পাই চিন্তাধারার বিপরীতে জনগণকে, যেমন অবস্থা বিরাজ করছে ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রে। আবার কখনও জনগণ এবং চিন্তাবিদরা দেখতে পান এমন পরিস্থিতি, যেখানে এই মিলন কোনো প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হতে পারে, যেমন অবস্থা বিরাজ করছে দ্বীন এবং কল্যাণকামীদের ক্ষেত্রে।
কিন্তু আমাদের বর্তমান অবস্থায় আমরা এমন চিন্তাধারার সন্ধান পাই যেখানে মৌলিকতা এবং সমকালীনতায় যুগপৎ পার্থক্য সূচিত হয় এবং আমরা এমন জনতা দেখতে পাই, যারা সমাজের চালিকা শক্তি, যারা উৎপাদন এবং শিল্পকে আন্দোলিত করে, আর উভয়ের ক্ষেত্রে আমরা গভীর সম্পর্ক দেখতে পাই সুবিচার আর ন্যায়নীতির মধ্যে।
ষষ্ঠ অধ্যায় : শ্রমিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান
শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে কেন সমস্যা সৃষ্টি হয়?
যেখানেই দুটো পক্ষ থাকে সেখানেই পারস্পরিক সম্পর্কে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর চেয়ে ঘনিষ্ঠ অন্য কোনো সম্পর্ক নেই। ভালোবাসা ও আবেগ এ সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া সত্ত্বেও দাম্পত্য জীবনে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই আল্লাহ তাআলা পারিবারিক জীবনকে সুখ ও শান্তিময় করার উদ্দেশ্যে স্বামী ও স্ত্রীকে দু’টো পক্ষ গণ্য করে উভয়ের কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। লক্ষ্য করার বিষয় যে, স্বামী ও স্ত্রীর অধিকারের তালিকা না দিয়ে তিনি কর্তব্য পালনের তাগিদ দিয়েছেন। কারণ, স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য পালন করে তাহলে স্ত্রী তার অধিকার ঠিকমতোই পেয়ে যাবে, তেমনি স্ত্রী যদি স্বামীর প্রতি কর্তব্য পালন করে তাহলে স্বামী তার অধিকার ভোগ করতে পারবে।
মহাজ্ঞানী ও মহাকৌশলী আল্লাহ তাআলা স্বামী বা স্ত্রীকে নিজ নিজ অধিকার পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা বা ছল-চাতুরির পরামর্শ দেননি। কারণ, উভয়েই যদি অধিকার হাসিলের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাহলে কেউ তার অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে না।
একই নীতিতে আল্লাহ তাআলা পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য ও সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য কী তাও জানিয়ে দিয়েছেন, যাতে উভয় পক্ষ নিজ নিজ কর্তব্য পালনের মাধ্যমে নিজ নিজ অধিকার ভোগ করার সুযোগ পায়। আল্লাহ তাআলা সন্তানদেরকে তাদের অধিকার হাসিলের জন্য পিতামাতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার হুকুম দেননি।
বাস্তব জীবনে সর্বক্ষেত্রেই দুটো পক্ষ থাকে সরকার বনাম জনগণ, কারখানার মালিক ও শ্রমিক, ক্রেতা ও বিক্রেতা, পরিবহনের মালিক ও যাত্রী, বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটে ইত্যাদি। উভয়পক্ষেরই স্বার্থ বা অধিকার রয়েছে। স্বার্থে আঘাত লাগলেই সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তাই উভয়পক্ষের অধিকার চিহ্নিত, নির্ধারিত ও সুস্পষ্ট থাকা প্রয়োজন। অধিকার অস্পষ্ট থাকলেই সমস্যা দেখা দেয়। এ কারণেই দরদাম ঠিক না করে কেনা-বেচা করা ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে; তেমনি মজুরি ঠিক না করে শ্রমিককে কাজে লাগানো নিষেধ করা হয়েছে।
শ্রমিক সমস্যা সৃষ্টির কারণ
যারা শ্রমিক নিয়োগ করে তারা যদি বেশি মুনাফা অর্জনকেই জীবনের মূল লক্ষ্য বানায় তাহলেই শ্রমিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। তারা মানুষকে কম মজুরির বিনিময়ে শ্রম দিতে বাধ্য করার অপচেষ্টাই চালায়। যারা শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য, জীবন বাঁচানোর জন্য শ্রম বিক্রি করা ছাড়া যাদের কোনো উপায় নেই, তাদের এ অসহায়ত্বকে শোষণের সুযোগ মনে করে যারা সম্পদের পাহাড় গড়তে চায় তারাই শ্রমিক সমস্যা সৃষ্টি করে। তারা শ্রমিককে গৃহপালিত পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট মনে করে। কৃষক তার হালের বলদ থেকে উপযুক্ত কাজ পাওয়ার উদ্দেশ্যে ভালো করে খাইয়ে সবল করে রাখে। কারখানার লোভী মালিকের নিকট শ্রমিকরা হালের বলদের মর্যাদাও পায় না; শ্রমিককে সারাদিন খাটিয়ে মানুষ হিসেবে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার মতো প্রয়োজনীয় মজুরিও দিতে চায় না।
মানুষ সম্পর্কে মর্যাদাবোধ
সব মানুষের আদি পিতামাতা আদম ও হাওয়া (আ.)। আর মানুষই সৃষ্টির সেরা এবং আল্লাহর প্রিয়তম সৃষ্টি। তাদের মধ্যে আকৃতি, রং, ভাষা ইত্যাদির পার্থক্য কৃত্রিম। একই পিতামাতার সব সন্তানের আকার ও রং একই রকম হয় না বিধায় কী তারা সবাইকে আপন ভাই-বোন মনে করে না?
কুরআন গুরুত্বসহকারে ঘোষণা করেছে যে, “বিভিন্ন বংশ, গোত্র ও দেশে যত মানুষ রয়েছে তা কোনো পার্থক্য নয়- এ সবই শুধু পরিচয় প্রকাশের জন্য। সব মানুষই মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদার অধিকারী; এমনকি ধর্মীয় পার্থক্যও মূল পার্থক্য নয়।”
অসৎ চরিত্রের মানুষ যে ধর্মের নামেই পরিচিত হোক, এরা এক জাত। আল্লাহর দৃষ্টিতে উন্নত নৈতিক মানের মানুষই শুধু সম্মানিত। আর তারাই ঐসব লোক, যারা আল্লাহর বিধান মেনে চলার কারণেই নৈতিক মানে উন্নত হতে পেরেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী “যারা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে উন্নত মানবিয় গুণের অধিকারী তারাই ইসলাম গ্রহণের পর উন্নত হয়। মানবসমাজ সোনা-রূপার খনির মতো। খনিতে যা সোনা, খনি থেকে তুলে আনার পর তা-ই সোনা। রূপা খনি থেকে তুলে আনলেও সোনা হয়ে যায় না।”
এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, মূলত সবাই মানুষ। যারা মানবিয় গুণে উন্নত তারা তো ইসলাম গ্রহণ করলে উন্নতই থাকে এবং আরও উন্নত হয়; কিন্তু যারা পূর্বে উন্নত নয়, তারাও ইসলাম গ্রহণ করলে উন্নত হতে পারে।
মর্যাদাবোধের অভাবই সমস্যার মূল
মানুষের প্রতি মানুষের যে মর্যাদাবোধ আল্লাহ ও রাসুল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন, এ শিক্ষার অভাবেই বিশ্বে মানবসমাজে অগণিত সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
বাড়ির কাজের ছেলে বা মেয়ে বাসন-পেয়ালা ধৌত করার সময় অসাবধানতার কারণে ভেঙে ফেললে নির্যাতিত হয়। নিজের ছেলে-মেয়ে কোনো মূল্যবান জিনিস নষ্ট করলেও তাকে শান্তির যোগ্য মনে করা হয় না। গরিবের সন্তান হওয়ায় যে ছেলে ও মেয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে কারো বাসায় কাজ করতে বাধ্য হয় তার জন্য মায়া লাগা উচিত। বাড়িওয়ালার ছেলে-মেয়ে স্কুলে পড়ে। কাজের ছেলেটাও তো গরিব না হলে স্কুলেই যেত। কাজের ছেলে-মেয়েরা সারা দিন যত কাজ করে তাতে গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী কত আরাম ভোগ করে। বাড়িওয়ালার ছেলের ব্যাগটা কাজের ছেলে কাঁধে করে নিয়ে মনিবের ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসে, আবার যথাসময়ে নিয়ে আসে। ঘটনাচক্রে বা ভাগ্যচক্রে আমি সচ্ছল, আর কাজের ছেলেটা গরিব। আল্লাহ আমাকে পরীক্ষা করছেন যে, আমি এ গরিবের আদরের সন্তানটির সাথে কেমন আচরণ করছি। আমি যদি আমার ছেলে-মেয়ের মতো কাজের ছেলে-মেয়েকে মানবসন্তান হিসেবে আদর-যত্ন করি তাতে কী আমি গরিব হয়ে যাব? বরং মনে প্রশান্তি ও তৃপ্তিবোধ হবে। কারণ, মন্দ কাজ করলে যেমন বিবেক দংশন করে, ভালো কাজ করলে তেমনি বিবেক সুখবোধ করে।
ভাগ্যক্রমে আজ আপনি কারখানার মালিক, আর গরিবরা আপনার কারখানায় শ্রমিক। এমন তো হতে পারত যে, আপনিও তাদের মতো শ্রমিক। শ্রমিকদের মেহনত ছাড়া আপনার কারখানায় উৎপাদন সম্ভব নয়। তাদেরকে আপনার মতোই মানুষ মনে করলে আর সমস্যা থাকে না। মানুষের প্রতি মর্যাদাবোধের অভাবেই সমস্যা সৃষ্টি হয়।
গণতান্ত্রিক বিশ্বে শ্রমিক সমস্যা সমাধানের ফর্মুলা
বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো শ্রমিক সমস্যা সমাধানের জন্য যে ফর্মুলা উদ্ভাবন করেছে তা মোটামুটি সন্তোষজনক। শ্রমিকদেরকে সংগঠিত হয়ে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার স্বীকার করে আইন রচনা করা হয়েছে। আইনে CBA (Collective Bargaining Agent)-এর মাধ্যমে মালিকপক্ষের সাথে দর কষাকষির সুযোগও দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি শ্রমিক, মালিক ও সরকার মিলে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (TCC-Tripartite Consultative Committee) ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে আপস-মীমাংসায় সরকার নিরপেক্ষ ভাবে সহযোগিতা করতে পারে।
দেশের সব রাজনৈতিক মহল যদি দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালায় এবং কোনো রাজনৈতিক মহল যদি সন্ত্রাস ও নাশকতাকে প্রশ্রয় না দেয় তাহলে শ্রমিক আন্দোলন গঠনমূলক হবে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়েই শ্রমিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।
শ্রমিক সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উপায়
দেশ পরিচালকরা নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি, মেধা, ইতিহাসের অভিজ্ঞতা ও পাশ্চাত্য সভ্যতার শিক্ষাকেই যথেষ্ট মনে করেন। তারা আল্লাহর দেওয়া বিধানের কোনো প্রয়োজন বোধ করেন না। গোটা প্রাকৃতিক জগৎ তাঁর বিধান মেনে চলছে বিধায় সেখানে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, তিনি কুরআন ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে মানবজাতির সুখ-শান্তির জন্য যে বিধান দিয়েছেন তা পালন করা ছাড়া জীবনের কোনো সমস্যারই স্থায়ী ও সন্তোষজনক সমাধান হতে পারে না।
আল্লাহ তাআলা মানবদেহের জন্য যে বিধান দান করেছেন, চিকিৎসাবিজ্ঞান সে বিধানই জানার চেষ্টা করে। মানুষ যদি স্রষ্টার দেওয়া ঐ বিধান মেনে চলে তাহলে স্বাস্থ্য ভালো থাকাই স্বাভাবিক। ঐ বিধান লঙ্ঘন করার কারণেই অসুস্থ হতে হয়। অসুখ হলে চিকিৎসার মাধ্যমে ঐ বিধান পুর্নবহাল করা হলেই সুস্থতা ফিরে আসে।
তেমনিভাবে পারিবারিক জীবনের জন্য কুরআনে যে বিধান রয়েছে যদি তা পালন করা হয় তাহলে পরিবারে পূর্ণ শান্তি বিরাজ করে। ঐ বিধান অমান্য করার ফলেই পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক জীবনের জন্যও ঐ একই কথা।
রাসুলুল্লাহ (সা.) সেকালের সবচেয়ে অসভ্য, বর্বর ও অশিক্ষিত মানবসমাজে জন্মগ্রহণ করেন। আরবের দুপাশে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য নামে বিশাল দু’টো সভ্যতা তখন বিরাজ করছিল। এ উভয় সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অনুর্বর মরুভূমির দেশ আরবে সভ্যতার কোনো আঁচ লাগেনি। গোটা আরবের কোথাও কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল না। ছোট্ট মক্কা শহরে কাবা শরিফকে কেন্দ্র করে যে সমাজ ছিল সেখানেও লেখাপড়ার চর্চা তেমন ছিল না। তারাই একমাত্র ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ছিল। এর বাইরে আরবরা বহু গোত্রে বিভক্ত ও যাযাবর ছিল; কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাস করত না। উট, ভেড়া, ছাগল, দুম্বা চড়িয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করত। কোথাও কোথাও খেজুর বাগানকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো গোত্র বসবাস করত। ডাকাতি, রাহাজানি ও লুটতরাজ একশ্রেণির লোকের পেশা ছিল। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে গোত্রে গোত্রে লড়াই চলত। পরাজিত গোত্রের নারী-পুরুষকে দাস-দাসী বানিয়ে বাজারে বিক্রি করা হতো। সেয়ানা সেয়ানায় লড়াই শুরু হলে যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ চলত।
এমনই একটি বিশৃঙ্খল মানবসমাজে কোনো জাদুবলে মুহাম্মদ (সা.) মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে এমন বিস্ময়কর বিপ্লব ঘটালেন, যার ফলে সকল গোত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি চমৎকার রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলো? মুহাম্মদ (সা.)-এর উন্নত মহান চরিত্রের পরশমণির সংস্পর্শে অসভ্য মানুষগুলো সভ্যতার উচ্ছ্বাদে পরিণত হলেন। এ নতুন সভ্যতার উত্থানকে ঠেকাতে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য ক্ষুদ্র আরব রাষ্ট্রটিকে ধ্বংসের চেষ্টা করে নিজেরাই পরাজিত ও পদানত হতে বাধ্য হয়।
ইতিহাসের ঐ অলৌকিক ঘটনার পেছনে কোনো জাদুবিদ্যা ছিল না। কুরআনের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, সংস্কৃতি গড়ার বিধান মানবজাতির স্রষ্টাই পাঠালেন। মানবদরদি ও মানবজাতির পরম বন্ধু হিসেবে মুহাম্মদ (সা.) ঐ বিধানকে প্রয়োগ করেই এ অভাবনিয় বিপ্লব সাধন করতে সক্ষম হলেন।
মুহাম্মদ (সা.)-কে বিশ্বের বর্বরতম সমাজে পাঠিয়ে প্রমাণ করা হলো যে, আল্লাহর বিধান প্রয়োগ করে অসভ্যতম মানুষকেও সভ্যতার উচ্ছ্বাদে পরিণত করা যায়। উপযুক্ত ওষুধ প্রয়োগ করে যেমন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিকেও সম্পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব, তেমনি একমাত্র আল্লাহর বিধানই মানবসমাজের সকল ব্যাধি দূর করে পরম শান্তিময় সমাজ কায়েম করতে সক্ষম।
বর্তমানে গণতান্ত্রিক দেশসমূহে ত্রিপক্ষীয় (TCC) পদ্ধতি প্রয়োগ করে যে সমাধান করা হয় তা সাময়িক। এর দ্বারা স্থায়ী সমাধান হয় না। যখন সমস্যা সৃষ্টি হয় তখনই ঐ পদ্ধতি প্রয়োগ করে সাময়িকভাবে মীমাংসা করা হয়; কিন্তু বারবারই সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে।
ইসলামে এর যে স্থায়ী সমাধান রয়েছে তা প্রয়োগ করা না হলে এ সমস্যা বারবার অর্থনৈতিক অগ্রগতি রোধ করতেই থাকবে। শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক পরস্পরবিরোধী দু’টো পক্ষ হিসেবে বহাল থাকবেই। ইসলামি বিধান যদি মালিক ও শ্রমিকপক্ষ আন্তরিকতার সাথে মেনে নেয়। তবেই স্থায়ী সমাধান সহজ হতে পারে। এ মেনে নেওয়াটা তখন ইবাদতে পরিণত হবে, যার পুরস্কার আখেরাতে পাওয়া যাবে। আর দুনিয়ার জীবনেও সবাই সুখ-শান্তি ভোগ করবে।
শ্রমিক সমাজের ভাবনার বিষয়
বর্তমানে দেশে যে নীতি, আদর্শ ও আইন চালু রয়েছে তাতে আল্লাহ ও রাসুল (সা.) মানুষের প্রতি যে মমত্ববোধ করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং শ্রমের প্রতি যে মর্যাদাবোধ করার তাগিদ দিয়েছেন তা বাস্তবে প্রচলন করা অসম্ভব। কারণ, দেশ গড়ার রাজনীতির বদলে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিই দেশে চালু রয়েছে। রাজনীতিই দেশের সকল নীতি নির্ধারণ করে। যা করলে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়, সে রাজনীতিই চলছে।
শ্রমিকদেরকে যারা সংগঠিত করে নেতৃত্ব দেয় তারা ঐ রাজনীতিরই প্রতিনিধি। তারা শ্রমিকসমাজকে নিজ নিজ দলীয় রাজনীতির পক্ষে কাজে লাগায় এবং ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে।
এ পরিস্থিতিতে যে দলই ক্ষমতায় যাক, শ্রমিকদের ভাগ্যের সত্যিকার পরিবর্তন কিছুতেই সম্ভব হবে না। মানুষ হিসেবে শ্রমিকদের যে মর্যাদা এবং জাতীয় উন্নয়নে শ্রমের যে মূল্য তা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীগণ উপলব্ধি না করা পর্যন্ত শ্রমিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। ফলে আন্দোলন করে দাবি আদায়ের যে পদ্ধতি চালু আছে, এর দ্বারা সাময়িকভাবে যতটুকু আদায় করা যায় তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
আদর্শিক রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা
কুরআন মাজিদে ইতিহাসের বহু জাতির পতনের উদাহরণ দিয়ে এ কথাই প্রমাণ করা হয়েছে যে, যুগে যুগে মানবজাতি যে অশান্তি, বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা ভোগ করেছে এর মূল কারণই হলো মানুষের মনগড়া আইন ও অসৎ লোকের শাসন।
যত নবি-রাসুল এসেছেন তাঁরা মানবজাতিকে আল্লাহর দাসত্ব ও নবির নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার জন্যই ডাক দিয়েছেন। তাঁরা মানুষকে আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েমের দাওয়াতই দিয়েছেন। মানুষ যখনই এ ডাকে সাড়া দিয়েছে তখনই আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে এবং জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার পেয়েছে। যে জাতি নবির ডাকে সাড়া দেয়নি সে জাতিকে আল্লাহ শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করেছেন।
তাই আমাদের দেশে আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েমের উদ্দেশ্যে আদর্শিক রাজনীতি বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিক সমস্যাসহ কোনো সমস্যারই বাস্তব ও স্থায়ী সমাধান হবে না।
আদর্শিক রাষ্ট্র ও সরকারের অত্যাবশ্যকতা
রাসুলুল্লাহ (সা.) তেরো বছর পর্যন্ত একদল সৎ লোক তৈরি করে মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করেন এবং তাঁরই নেতৃত্বে ঐ তৈরি করা লোকদেরকে নিয়ে ইসলামি সরকার গঠন করেন। সরকার গঠনের মাত্র দশ বছরের মধ্যে গোটা আরবে তিনি এমন এক আদর্শ মানবসমাজ গড়ে তুললেন, যা চিরকাল, মানবজাতির জন্য উজ্জ্বল নমুনা হয়ে থাকবে।
তিনি প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ ছিলেন না। তিনি যা করেছেন, তা পৌরাণিক বা কাল্পনিক কাহিনী নয়; তাঁর জন্ম, শৈশব, যৌবন, নবুওয়াত লাভ, একদল ব্যক্তি গঠনের যুগ, মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম ও সরকার গঠনের যুগ ইত্যাদির বিস্তারিত বিশ্বস্ত বিবরণ ইতিহাসে রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা রাসুল (সা.)-এর নিকট যেমন কুরআন নাজিল করেছেন। তেমনি কুরআনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও সরকার কায়েমের নিয়ম-পদ্ধতিও শিক্ষা দিয়েছেন। সে পদ্ধতি প্রয়োগ করেই তিনি একটি বর্বর সমাজকে ইতিহাসের সেরা শান্তিময় সমাজে পরিণত করেছেন।
পৃথিবীর বহু দেশে ঐ পদ্ধতি অনুযায়ী ইসলামি আন্দোলন চলছে। বাংলাদেশেও আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েমের মহান উদ্দেশ্যে ঐ পদ্ধতিতেই কাজ করা হচ্ছে। এ পদ্ধতি বিজয়ী হওয়ার মধ্যে দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের জন্য ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক শ্রমনীতি প্রণয়নের মাধ্যমে শ্রমিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে।
গ্রন্থ সহায়িকা
১. ইসলামী শ্রমনীতি- অধ্যাপক মাওলানা হারুনুর রশিদ খান
২. মাওলানা মওদূদীর চিন্তাধারায় শ্রমিক আন্দোলন – এডভোকেট শেখ আনছার আলী
৩. ইসলামী সমাজে শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা – অধ্যাপক মাওলানা হারুনুর রশিদ খান
৪. ইসলামী আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষের গুরুত্ব – অধ্যাপক মাওলানা হারুনুর রশিদ খান
৫. ইসলাম ও শ্রমিক আন্দোলন – ড. জামাল আল বান্না
৬. শ্রমিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান – অধ্যাপক গোলাম আযম।