পরিচিতি
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
পরিচিতি
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
প্রকাশনা বিভাগ
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
প্রকাশক
মাওলানা আবুতাহের মুহাম্মদ মা’ছুম
চেয়ারম্যান, প্রকাশনা বিভাগ
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
প্রথম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর ১৯৮১
৫৪তম মুদ্রণ – এপ্রিল ২০২৫, বৈশাখ ১৪৩২, শাওয়াল ১৪৪৬
এক নজরে
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
– ইসলামী জ্ঞান চর্চার এক নিখুঁত পরিকল্পনা।
– উন্নত চরিত্র গঠনের এক মজবুত সংগঠন।
– জনসেবা ও সমাজ সংস্কারের এক বাস্তব কর্মসূচি।
– জনকল্যাণমুখী আদর্শ রাষ্ট্র ও সরকার গঠনের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন।
প্রকাশকের কথা
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এ দেশের মানুষের কাছে একটি পরিচিত নাম। দীর্ঘদিন ধরে জনগণের পাশে থেকে মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, আমাদের কর্মসূচি, আমাদের কাজের ধারা যাদের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে তাদের মধ্যে অনেকেই জামায়াতের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছেন। অনেকে সরাসরি জামায়াতে যোগ দিতে না পারলেও জামায়াতকে পছন্দ করছেন। এভাবে জামায়াত ক্রমেই এ দেশের গণমানুষের সংগঠনে পরিণত হচ্ছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কুরআন ও হাদিসের আলোকে মানুষকে রাঙিয়ে তুলে সমাজ থেকে অসততা, বেইনসাফী, প্রতারণা, ঘৃণা ও প্রতিহিংসার মূল উৎপাটন করে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে চায়। এ কাজ করতে গেলে অতীতের ন্যায় বিরোধিতা আসবে। নানা মিথ্যা প্রচারণা করে, জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে, ভয়-ভীতি দেখিয়ে এ কাজ থেকে জনগণকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জুলুম, নির্যাতন, মিথ্যাচার, ষড়যন্ত্র জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে কখনোই ধ্বংস করতে পারেনি। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা এবং এদেশের মানুষের হাজার বছরের ইতিহাস।
আমাদের পূর্ব পুরুষগণ পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সবশেষে পাকিস্তানী শাসকচক্রের শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভকরেছে, শোষণহীন এক সমাজ গড়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে। কিন্তু অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হলেও জনগণ আজও খুঁজে পায়নি সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি, শোষণহীন সেই সমাজ। অথচ এ মুক্তির পথনির্দেশ লুকিয়ে আছে আমাদের ঘরে রাখা পবিত্রতম গ্রন্থ আল কুরআনে। জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ চাইলে এ কুরআনকেই আঁকড়ে ধরতে হবে সর্বোতভাবে। এ লক্ষ্যেই জামায়াতের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এ পুস্তিকায় তুলে ধরা হলো।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
এক: ঈমান ও আক্বীদা
কুরআন এবং সহীহ হাদিসে নির্দেশিত ঈমান ও আক্বীদাই জামায়াতে ইসলামীর অনুসারীগণ পোষণ করে থাকেন। যার সার কথা হলো-
– আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনই মানব জাতির একমাত্র ইলাহ, বিধানদাতা ও হুকুমকর্তা।
– কুরআন ও সুন্নাহই মানুষের জন্য একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।
– হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য একমাত্র আদর্শ নেতা।
– ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনই মুমিন জীবনের লক্ষ্য।
– আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের মুক্তিই মুমিন জীবনের কাম্য।
দুই: জামায়াতের আদর্শ
কুরআন ও হাদিসে ইসলামের যে পূর্ণরূপ রয়েছে এর সবটুকুই জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের যে বাস্তব রূপ দিয়ে গেছেন তার সবটুকুর নামই হলো দীন ইসলাম। নবুয়তের ২৩ বছরের জীবনে তাঁর কথা, কাজ ও অনুমোদন ইসলামের যে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছে তার কোন দিক, বিভাগ ও অংশই ইসলামের বাইরে নয়। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের প্রেরিত সেই শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই সুন্দরতম আদর্শ হিসাবে অনুসরণ করার জন্য কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুধু ধর্মীয় ব্যাপারে অনুসরণ করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য দিকে তাঁর ‘আদর্শ না মানা মুনাফিকীর পরিচায়ক। জীবনের সর্বক্ষেত্রে যেমন আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা মানতে হবে, তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে আদর্শ নেতা হিসেবে মানতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ ও আনুগত্যের ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) যে মহান আদর্শ স্থাপন করেছেন তা-ই জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ।
তিন: এ জামায়াত কোন্ ধরনের দল
জামায়াতে ইসলামী প্রচলিত অর্থে শুধুমাত্র ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক দল নয়। ইসলাম যেমন ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে ব্যাপ্ত, জামায়াতে ইসলামীও তেমনি ব্যাপক। ইসলামে ধর্মীয় জীবনের গুরুত্ব আছে বলেই জামায়াত ধর্মীয় দলের দায়িত্ব পালন করে। রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া ইসলামী আইন চালু হতে পারে না বলেই জামায়াত রাজনৈতিক ময়দানে কাজ করে। সমাজ সেবা ও সামাজিক সংশোধনের জোর তাকিদ ইসলান দিয়েছে বলেই জামায়াত সমাজ সেবা ও সমাজ সংস্কারে মনযোগ দেয়। এ অর্থেই জামায়াতে ইসলামী পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলন।
চার: ইসলামের তাৎপর্য
ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য। আসমান-যমীনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করেছে। বিশালাকার সূর্যও আল্লাহর দেয়া বিধান মেনে চলে। মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একমাত্র স্রষ্টার রচিত আইনই মেনে চলতে বাধ্য। মানবদেহসহ সৃষ্টিলোকের কেউ নিজের প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুন তৈরি করতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা সৌরলোক থেকে অণু-পরমাণু পর্যন্ত সবার জন্য যে বিধান তৈরি করেছেন, তা তাদেরকে মানতে বাধ্য করেছেন। এর বিপরীত চলার কোন ক্ষমতাই কারো নেই।
মানুষের জৈবিক নিয়ম-কানুন, তার দেহযন্ত্রের বিকাশ এবং কার্যাবলীর বিধি-বিধানও ঐ আল্লাহরই সৃষ্টি। মানুষ সে বিধান মেনে চলতে বাধ্য। কিন্তু মানুষের নৈতিক জীবনে আল্লাহর বিধানকে মানতে বাধ্য করা হয়নি, ইচ্ছা ও চেষ্টার ক্ষেত্রে মানুষকে ভাল বা মন্দ গ্রহণ করার স্বাধীনতা বা ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে। মানব জীবনের এ ঐচ্ছিক দিকের জন্য আল্লাহ তা’আলা নবীর মাধ্যমে বিধান পাঠিয়েছেন। সে বিধানের নামই ইসলাম। এ বিধান মানা বা না মানা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এ বিধান মানলে দুনিয়া ও আখিরাতে সীমাহীন কল্যাণ রয়েছে, আর না মানলে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ইসলামের সহজ সংজ্ঞা হলো “সৃষ্টির জন্য স্রষ্টার আনুগত্যের বিধান”। তাই প্রত্যেক সৃষ্টির জন্যই তার উপযোগী বিধান বা ইসলাম দেয়া হয়েছে এবং সেই ইসলাম মেনে চলতে বাধ্য করা হয়েছে। মানুষের দেহের বেলায়ও এ কথা সত্য। কিন্তু মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও চেষ্টাশক্তিকে ব্যবহার করার জন্য স্রষ্টা যে বিধান দিয়েছেন, তা পালন করতে বাধ্য করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে মানুষের আচরণের নিরিখেই আখিরাতে পুরস্কার ও শাস্তি দেয়া হবে।
পাঁচ: ইসলামের ব্যাপকতা
১। ইসলামের উপরিউক্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী দ্বীন ইসলাম মানুষের ইচ্ছা ও চেষ্টার সর্বক্ষেত্রে পালনযোগ্য বিধান।
২। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুয়তের ২৩ বছরের সবটুকু জীবনই ইসলামের বাস্তব রূপ। ধর্মীয় বিষয়ে যেমন তিনি আল্লাহর রাসূল, তেমনি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য দিকেও তিনি যা কিছু করেছেন, তা রাসূল হিসেবেই করেছেন। তাই শুধু ধর্মীয় বিষয়ে তাঁকে অনুসরণ করলে ইসলামের একাংশ মানা হবে মাত্র। প্রকৃত মুসলিম হতে হলে তাঁর গোটা জীবনকেই শ্রেষ্ঠতম আদর্শ হিসেবে মানতে হবে।
৩। আল্লাহর দেয়া বিধানকে মানুষের জীবনে চালু করার জন্য তিনি দীর্ঘ তেইশ বছর যে কঠিন সংগ্রাম করে গেছেন তা-ই হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রকৃত সুন্নাত। এ সুন্নাতকে অবহেলা করে শুধু ধর্মীয় জীবনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করা দুর্বলের ইসলাম।
৪। ইসলাম অন্য কোন বিধানের অধীনে কোন প্রকারে বেঁচে থাকার জন্য আসেনি। মানব রচিত বিধি-ব্যবস্থা ইসলামের যতটুকু বিধানকে বেঁচে থাকার অনুমতি দেয় ততটুকুতে যারা সন্তুষ্ট তারা ইসলামের সঠিক ধারণা রাখেন না। বর্তমানে আমাদের দেশে এবং প্রায় সব দেশেই ইসলাম বাস্তবে ততটুকুই টিকে আছে যতটুকু
সরকারী কর্তৃপক্ষ ও সমাজব্যবস্থা অনুমতি দিয়েছে। ইসলাম তার আসল রূপ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ অবয়বে বাস্তবে চালু নেই। যেটুকু আছে ত. পূর্ণ রূপের সামান্য অংশ মাত্র। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সুস্পষ্ট নির্দেশ হলো-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً مِن وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوتِ الشيطان ، إِنَّهُ لَكُم عدو مبين (سورة البقرة : ۲۰۸)
“হে ঈমানদারগণ তোমরা পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করো এবং জীবনের কোন ক্ষেত্রে শয়তানের অনুসারী হয়োনা কেননা সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন।” (সূরা আল বাকারা: ২০৮)
ছয়: ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা শুধু প্রচার করার দায়িত্ব দেননি। বরং অন্য সব রকমের প্রচলিত ব্যবস্থার উপর ইসলামকে বিজয়ী করার দায়িত্বও দিয়েছেন। যেমন-
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كله (سُورَةُ التَّوْبَة : ٣٣ – سورة الفتح – ۲۸ – سورة الصف : (۹)
“তিনিই সেই সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও একমাত্র সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন যেন সেই দ্বীনকে আর সব দীনের উপর বিজয়ী করা হয়।” (সূরা আত্ তাওবা: ৩৩, আল ফাত্হঃ ২৮, আস্ সাফঃ ৯ আয়াত)
শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পূর্বে যত নবী-রাসূল এসেছেন তাঁদের প্রতি এ একই দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন-
هَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تتفرقوا فيه ما (سورة الشورى : (۱۳)
“তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই নিয়ম-বিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যার হুকুম তিনি নূহকে দিয়েছিলেন। আর যা (হে মুহাম্মাদ!) এখন তোমার প্রতি আমরা ওহীর সাহায্যে পাঠিয়েছি। আর যার হিদায়াত আমরা ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে দিয়েছিলাম-এই তাকীদ সহকারে যে, কায়েম কর এই দ্বীনকে এবং এতে বিভেদ-বিভক্তি-বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করো না।” (সূরা আশ শূরাঃ ১৩)
ইসলাম রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত না হলে, রাষ্ট্র শক্তি ইসলাম পালনে আনুকূল্য দান না করলে কোন মুমিনের পক্ষেই পরিপূর্ণ ভাবে ইসলাম মানা সম্ভব নয়, এ জন্যেই নবী-রাসূলগণ সমাজে দ্বীন ইসলামের বিজয়ের জন্য আদিষ্ট ছিলেন।
মানব সমাজে কোন না কোন ব্যবস্থা চালু থাকেই। তাই আরবে যে সমাজ ব্যবস্থা চালু ছিল সেখানে আল্লাহর দাসত্ব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্যের ভিত্তিতে সমাজকে নতুনভাবে গঠনের দাওয়াত কায়েমী স্বার্থবাদীরা স্বাভাবিকভাবেই সহ্য করতে পারেনি। সমাজে যে ব্যবস্থা চালু থাকে তা যাদের স্বার্থ কায়েম রাখে তারা যে কোন পরিবর্তনকে সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দেয়।
আমাদের দেশেও ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টাকে এ দেশের কায়েমী স্বার্থবাদীরা সহ্য করবে না। তাই ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলনকে কায়েমী স্বার্থবাদীরা বাধা দিচ্ছে। এ দেশের ইসলাম বিরোধী শক্তি ও সকল প্রকার কায়েমী স্বার্থবাদীরা এ কারণেই জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতা করে।
সাত: জামায়াতবদ্ধ জীবনের গুরুত্ব
ইকামাতে দ্বীনের মহান দায়িত্ব একা একা পালন করা নবীদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। তাই নবীগণ দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পর যারা ঈমান এনেছেন তাদেরকেই সংঘবদ্ধ করে তাঁরা ইসলামী আন্দোলন চালিয়েছেন। যে সমাজে ইসলাম কায়েম নেই, সেখানে তো একাকী মুসলিম হিসেবে জীবন-যাপন করাই অসম্ভব। আর আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজ জামায়াতবদ্ধভাবে ছাড়া একার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন-
واعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا – (سُورَةُ آل عِمْرَانَ : ۱۰۳)
“সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জু শক্ত করে ধারণ কর এবং দলাদলিতে লিপ্ত হয়োনা।” (সূরা আলে-ইমরান: ১০৩)
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, মেষের পাল থেকে আলাদা একটি মেষকে যেমন নেকড়ে বাঘ ধরে খায়, তেমনি জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে শয়তানের খপ্পরে পড়তে হয়।
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজকে ইসলাম মুতাবিক গঠন করতে হলে সংঘবদ্ধ চেষ্টা ছাড়া উপায় নেই। ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব পালনের জন্য জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি সংগঠন আল্লাহর বিশেষ রহমত। বাতিলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দীনে হককে কায়েমের জন্য যদি জামায়াতে ইসলামীর চেয়ে ভাল কোন জামায়াত দেশে থেকে থাকে, তাহলে আলাদা কথা। নইলে এ উদ্দেশ্যে এ জামায়াতেই যোগদান করা দ্বীনের দাবি, আর যদি কেউ নতুন কোন জামায়াত গঠন করা সম্ভব মনে করেন, তাহলে তাই করা উচিত। কিন্তু জামায়াতবিহীন জীবন-যাপন করা কোন মুসলিমের জন্য কিছুতেই উচিত নয়।
আট: জামায়াতের ৩ দফা দাও’য়াত
শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীন ইসলামের যে বাস্তব নমুনা কায়েম করে দেখিয়ে গেছেন সে আদর্শেই জামায়াত এ দেশকে গড়ে তুলতে চায়। তাই জামায়াতে ইসলামী দেশবাসীকে সে দাওয়াতই দেয়। জামায়াত কোন নতুন দাওয়াত দিচ্ছে না। যুগে যুগে নবীগণ যে কালেমার দাওয়াত দিয়েছেন জামায়াত সেই কালেমায়ে তাইয়্যেবার গাওয়াতই দিচ্ছে।
সেই পবিত্র কালেমা এইঃ
لا إلهَ إِلَّا اللهُ مُحَمَّدٌ رَّسُولُ اللهِ
এর সরল অর্থ “আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁরই রাসূল বা বাণীবাহক।” এ কালেমা দাবি করে যে, অন্য সকল প্রকার দাসত্ব ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালাকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে মনিব মানতে হবে এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে আল্লাহর দাসত্ব করার নমুনা দেখিয়ে গেছেন, সেভাবেই দাসত্ব করতে হবে। অর্থাৎ পূর্ণরূপে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য ও অনুসরণ করতে হবে।
কালেমার এ দাও’য়াতকেই জামায়াত নিম্নরূপ ৩টি দফায়
প্রকাশ করে:
১। সাধারণভাবে সকল মানুষ ও বিশেষভাবে মুসলিমদের প্রতি জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তা’য়ালার দাসত্ব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য করিবার আহ্বান।
২। ইসলাম গ্রহণকারী ও ঈমানের দাবিদার সকল মানুষের প্রতি বাস্তব জীবনে কথা ও কাজের গরমিল পরিহার করিয়া খাঁটি ও পূর্ণ মুসলিম হওয়ার আহ্বান।
৩। সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম করিয়া সমাজ হইতে সকল প্রকার জুলুম, শোষণ, দুর্নীতি ও অবিচারের অবসান ঘটানোর আহ্বান।
নয়: জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন
জামায়াতে ইসলামী এ দেশে দীনকে কায়েম করতে চায় বলেই এর সংগঠনের মাধ্যমে দীন কায়েমের যোগ্য নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী সৃষ্টি করছে। যারা ইসলামকে ভালভাবে জানে না এবং যেটুকু জানে তাও নিজেদের জীবনে বাস্তবে মেনে চলে না, তারা যতই ইসলামের দোহাই দিক তাদের দ্বারা ইসলামী সমাজ কায়েম হতে পারে না।
ইসলামী রাষ্ট্র, সমাজ ও সরকার কায়েম করতে হলে এ বিরাট কাজের উপযোগী লোক যোগাড় করতেই হবে। এ লোক আসমান থেকে নাযিল হবে না বা বিদেশ থেকেও আমদানী করা যাবে না। আরবের অধঃপতিত সমাজ থেকে বিশ্বনবী যেমন সংগঠনের মাধ্যমে লোক তৈরি করেছিলেন, তেমনি এ দেশের মানুষ থেকেই উপযোগী লোক তৈরি করতে হবে। এ কাজই জামায়াতে ইসলামী করছে। জামায়াত এ কাজকে সন্তোষজনকভাবে সমাধা করার উদ্দেশ্যেই এর উপযোগী একটা বিজ্ঞানসম্মত কর্মসূচি অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে।
দশ: জামায়াতের ৪ দফা কর্মসূচি
আল্লাহ তা’য়ালার আনুগত্য ও রাসূলের (সা.) আদর্শের ভিত্তিতে এদেশে ইসলামী সমাজ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে, তা সফল করার উদ্দেশ্যে জামায়াত ৪ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এগুলো হলোঃ
১। চিন্তার পরিশুদ্ধি ও পুনর্গঠনের কাজ: জামায়াত কুরআন ও হাদিসের সঠিক শিক্ষাকে বলিষ্ঠ যুক্তির সাহায্যে তুলে ধরে জনগণের চিন্তার বিকাশ সাধন করছে। তাদের মধ্যে ইসলামকে অনুসরণ ও কায়েম করার উৎসাহ ও মনোভাব জাগ্রত করছে।
২। সংগঠন ও প্রশিক্ষণের কাজ: জামায়াত ইসলাম কায়েমের সংগ্রামে আগ্রহী ব্যক্তিদেরকে সুসংগঠিত করে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার যোগ্য করে গড়ে তুলছে।
৩। সমাজ সংস্কার ও সেবার কাজ: জামায়াত ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাজের সংশোধন, নৈতিক পুনর্গঠন ও সমাজসেবামূলক কাজের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধন করছে।
৪। সরকার সংশোধনের কাজ: জামায়াত গ্রাম ও ইউনিয়ন থেকে শুরু করে শাসন ব্যবস্থার সকল স্তরে আল্লাহদ্রোহী জালিম ও অসৎ নেতৃত্বের বদলে আল্লাহভীরু, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব কায়েমের জন্য গণতান্ত্রিক পন্থায় চেষ্টা চালাচ্ছে।
এগার: ইসলামের বিজয়ের জন্য শর্ত
আল্লাহ তা’য়ালা ইসলামের বিজয়ের জন্য দুটো শর্ত রেখেছেন। প্রথমত, এমন একদল লোক তৈরি হতে হবে যারা ইসলামকে কায়েম করার যোগ্য। এমন নেতৃত্ব ও কর্মীদল সৃষ্টি হতে হবে যাদের হাতে সরকারী ক্ষমতা দিলে তারা ইসলামী আদর্শকে সমাজে চালু করতে সক্ষম হবে। দ্বিতীয়ত, যে দেশে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করা হয়, সে দেশের জনগণ ইসলামের সক্রিয় বিরোধী যেন না হয়। ইসলামের সমর্থক হলে তো কোন কথাই নেই।
এ দুটো শর্তের মধ্যে দ্বিতীয় শর্তটি এ দেশে অবশ্যই আছে। এ দেশের জনগণ ইসলাম চায়। তাই ইসলাম বিরোধীরাও প্রকাশ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পায় না। জনগণ ইসলাম চায় বটে, কিন্তু তারা কিভাবে ইসলাম পাবে? প্রথম শর্ত পূরণ হলেই ইসলাম কায়েম করার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে। জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন এ শর্তটি পূরণেই তৎপর। জামায়াতের আসল কাজই হলো সমাজকে ইসলাম মুতাবিক গড়ে তুলবার যোগ্য নেতৃত্ব ও কর্মীদল তৈরি করা।
বার: জামায়াতের লোক তৈরির পদ্ধতি
প্রথমত: যখন কেউ জামায়াতের ‘সহযোগী সদস্য’ ফরম পূরণ করেন, তখন থেকেই ইসলামী আন্দোলনের বীজ তার মন-মগজে রোপিত হয়।
দ্বিতীয়তঃ জামায়াতের কোন কর্মী এ সহযোগী সদস্যের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। আলাপ-আলোচনা, ভাব-বিনিময় ও বই-পুস্তক পড়ানোর মাধ্যমে তাকে সাপ্তাহিক বৈঠকে হাযির করার চেষ্টা চলে। এ সাপ্তাহিক বৈঠকই লোক তৈরির মেশিন।
তৃতীয়ত: সাপ্তাহিক বৈঠকে নিয়মিত হাযির হলে কর্মী হিসাবে তিনি গণ্য হন। তাকে মূলত দু’রকমের কাজ করতে হয়। একটা কাজ হলো নিজকে খাঁটি মুসলিমরূপে গঠন করা। আর একটা হলো অন্যান্য মানুষকে এ পথে আনার চেষ্টা করা। এ দু’ধরনের কাজের বিবরণ সাপ্তাহিক রিপোর্ট ফরমে রয়েছে।
কর্মী রিপোর্ট বই থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। রোজ কুরআন থেকে কিছু অংশ বুঝে পড়া, কমপক্ষে দশ পৃষ্ঠা ইসলামী সাহিত্য পড়া, আত্মসমালোচনা করা, জামায়াতে নামায আদায় করা ইত্যাদির হিসাব এ ফরমে দিতে হয়। কতজন লোককে দীনের দাওয়াত দেয়া হয়েছে এবং কতজনকে কর্মী বানানোর চেষ্টা হচ্ছে তারও রিপোর্ট দিতে হয়। যারা এ নিয়মে কাজ করেন, তারাই জামায়াতের পূর্ণাঙ্গ সদস্য হওয়ার পথে দ্রুত এগিয়ে যান।
চতুর্থতঃ একজন কর্মী যখন খাঁটি মুসলিম জীবনের কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছেন, তখন তাঁকে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অবলম্বনে জামায়াতের সদস্য (রুকন) হতে হয়।
জামায়াতের কর্মী ও সদস্যদের (রুকনদের) মান বৃদ্ধির জন্য উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে শিক্ষা শিবির করা হয়। এসব প্রশিক্ষণ-এর মাধ্যমে তাদের মন-মগজ-চরিত্র ইসলাম মুতাবিক গড়ে ওঠে। এতে বহু রকমের বাস্তব শিক্ষাও দেয়া হয় যাতে তারা আন্দোলন ও সংগঠনের যাবতীয় দায়িত্ব পালনের যোগ্য হতে পারে।
এসব হলো জামায়াতের লোক তৈরির ইতিবাচক দিক। কিন্তু সংগ্রামী, সাহসী, নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী হিসেবে গড়ে তুলবার উদ্দেশ্যে ইসলাম বিরোধী শক্তি ও কায়েমী স্বার্থের পক্ষ থেকে ছোট-বড় যত প্রকার বাধা, জুলুম ও নির্যাতন আসে সে সবকে পরওয়া না করে সাহস-হিম্মত, ধৈর্য ও অধ্যাবসায় সহকারে আন্দোলনের পথে কর্মীদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
এটা হলো লোক তৈরির নেতিবাচক দিক। এদিক দিয়ে যারা এগুতে পারে না, তারা কখনও নেতৃত্ব পায় না। জামায়াতের জনশক্তির স্তর বিন্যাসের ফলে দুর্বলমনা লোক আপনিই ছাঁটাই হয়ে যায় এবং ত্যাগী নেতৃত্ব গড়ে ওঠা সম্ভব হয়।
তের: জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামো
জাতীয় কাউন্সিল নামে জামায়াতে ইসলামীর একটি ফোরাম রয়েছে। আমীরে জামায়াত কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সকল সদস্য (পুরুষ ও মহিলা), জেলা/মহানগরী আমীর, জেলা/মহানগরী মজলিসে শূরার সকল সদস্যগণের (পুরুষ ও মহিলা) সমন্বয়ে জাতীয় কাউন্সিল গঠিত হয়। কোন বিষয়ে মজলিসে শূরার সাথে আমীরে জামায়াতের মতানৈক্য হলে উক্ত বিষয় জাতীয় কাউন্সিলর সম্মেলনে মীমাংসা করা জাতীয় কাউন্সিলের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য।
নীতিনির্ধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জামায়াতে ইসলামীর “কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা” রয়েছে। সাধারণত নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্যদের (রুকনদের) মধ্য থেকে একজন প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য নির্বাচিত হন। অবশ্য প্রতি জেলা/মহানগরী থেকে কমপক্ষে একজন প্রতিনিধি শূরায় থাকতেই হবে। জেলা/মহানগরী থেকে নির্বাচিত সদস্যদের ভোটে সারা দেশের সদস্যদের মধ্য থেকে আরও ৩০ জন (গঠনতন্ত্র, ধারা ২০/৪/গ) সদস্য নির্বাচিত হয়। আমীরে জামায়াত যে কোন সময় কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন। বছরে কমপক্ষে ০২ (দুই) বার কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সাধারণ অধিবেশন বসে।
কেন্দ্রীয় মহিলা মজলিসে শূরার সকল সদস্য কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য হন। কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার প্রত্যেক নির্বাচনের পর মজলিসে শূরার সদস্যগণ কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ নির্বাচিত করেন। কেন্দ্রীয় মহিলা কর্মপরিষদ সদস্যগণ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য হন। আমীরে জামায়াতের সভাপতিত্বে প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বৈঠক বসে।
কর্মপরিষদের সদস্যগণ বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। আমীরে জামায়াতের নেতৃত্বে তারা বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কর্মপরিষদেরই হাতে ন্যস্ত।
কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত সমূহ বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা অনধিক ২১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ নির্বাচিত করেন। আমীরে জামায়াতের আহ্বানে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
চৌদ্দ: জামায়াতের নির্বাচন ব্যবস্থা
জামায়াতে ইসলামী এমন একটি সংগঠন যার সকল স্তরে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়। কিন্তু এ নির্বাচন এমন কতক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যার তুলনা অন্য কোন সংগঠনে নেই। যেমন-
ক. কোন পর্যায়েই কেউ পদপ্রার্থী হতে পারে না। ইসলামী নীতি অনুযায়ী পদপ্রার্থী হওয়া অযোগ্যতার প্রমাণ, প্রার্থী না থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতারও সুযোগ নেই।
খ. নির্বাচনে কোন ব্যক্তির পক্ষে ক্যানভাস করাও নিষিদ্ধ। প্রার্থী নেই বলে এর দরকারও হয় না।
গ. নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন দায়িত্বের জন্য ভোটারদের নিকট থেকে গোপন ব্যালটে ভোট সংগ্রহ ও গণনার ব্যবস্থা করেন।
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী জামায়াতের কেন্দ্রীয়, জেলা/মহানগরী পর্যায়ের নির্বাচন পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে। নির্বাচনের ব্যাপারে এ কমিশনের পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে।
অধঃস্তন পর্যায়ের নির্বাচন পরিচালনার জন্য জেলা/মহানগরী মজলিসে শূরা কর্তৃক জেলা/মহানগরী নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়।
পনের: আমীরে জামায়াতের নির্বাচন
মজলিসে শূরা ভোটের মাধ্যমে আমীর পদের জন্য তিন জনের একটি প্যানেল তৈরি করেন। সারাদেশের সদস্যগণ (রুকনগণ) উক্ত প্যানেলের মধ্য থেকে আমীর নির্বাচনের জন্য নিজকে ব্যতীত যে কোন একজনকে ভোট দেন। অবশ্য কেউ চাইলে এর বাইরেও কোন সদস্যকে (রুকনকে) ভোট দিতে পারেন। নির্বাচন কমিশন উক্ত ভোটের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আমীরে জামায়াত নির্বাচিত হয়েছেন বলে ঘোষণা দেন।
ষোল: সমস্যার সমাধানে জামায়াত
দেশের ও জনগণের সমস্যা সমাধানই সরকারের প্রধান দায়িত্ব।
রাজনৈতিক দল সরকারী দায়িত্ব নেয়ার উদ্দেশ্যেই গঠিত বলে স্বাভাবিকভাবেই তাদেরকে ঐসব সমস্যার সমাধান জনগণের নিকট পেশ করতে হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে সমস্যাবলীর বিজ্ঞানসম্মত সমাধানের জন্য বলিষ্ঠ চিন্তা ও বাস্তব কর্মসূচি পেশ না করে রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এমন সব সস্তা শ্লোগান দেয়া হয় যাতে ভাবপ্রবণতার বন্যায় জনগণকে ভাসিয়ে ক্ষমতা দখল করা যায়। এতে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী উপকৃত হলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বা দেশের কোন কল্যাণ সাধিত হয় না।
জামায়াতে ইসলামী নিম্নরূপ দৃষ্টিভঙ্গিতে যাবতীয় সমস্যার সমাধান তালাশ করে:
১ । জামায়াতে ইসলামী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, মানব জাতির মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন কুরআনের মারফতে ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে
জনগণকে সুখী ও উন্নত করার যে পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন সে পথ ছাড়া দুনিয়ায় শান্তি ও আখিরাতের মুক্তির কোন উপায় নেই। কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে জামায়াত যে ম্যানিফেস্টো দিয়েছে তাই
এ দেশের সব সমস্যার সমাধানের দিশারী।
২। আদর্শহীন রাজনীতি ও গদিলোভী নেতৃত্বের পরিবর্তে আদর্শভিত্তিক রাজনীতি চালু করে জ্ঞানী ও চরিত্রবান নেতৃত্ব কায়েম করতে হবে। কারণ সবচেয়ে বড় সমস্যাই হলো অসৎ ও নীতিহীন নেতৃত্ব।
৩। আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সৎ ও যোগ্য কর্মী বাহিনী তৈরি করে রাজনৈতিক ময়দান থেকে নীতিহীনতা, সন্ত্রাস ও উচ্ছৃঙ্খলতা দূর করতে হবে। আদর্শহীন রাজনৈতিক দল ও কর্মীদের দ্বারা মানুষের সমস্যা যে বাড়ে তা এ দেশে কে অস্বীকার করতে পারে?
৪। কোন দল দেশের সমস্যার কি সমাধান পেশ করছে তা দলের ম্যানিফেস্টো থেকেই জানা যায়। অবশ্য ম্যানিফেস্টোই চূড়ান্ত কথা নয়, ক্ষমতায় গিয়ে দলের নেতৃবৃন্দের ভূমিকা ও কার্যাবলীই বিচার্য বিষয়। এ পর্যন্ত এ দেশে বহু দলই ক্ষমতায় গিয়েছেন। ভোটের সময় সে সব দল সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন, চমৎকার ম্যানিফেস্টো দিয়েছেন, বহু দফার ওয়াদা পেশ করেছেন। কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণ করে তারা সে সব ওয়াদা ভুলে গেছেন, বিপরীত ভূমিকা পালন করেছেন, জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তাদের হাতে ধ্বংস হয়েছে জাতির নৈতিক কাঠামো, চারিত্রিক ভিত্তি, রাজনৈতিক সততা, অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ও শিক্ষার মান, দ্রুততর হয়েছে নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক অধঃপতন।
তাই কোন দল কি ওয়াদা করেছে তা দেখাই যথেষ্ট নয়। যারা ওয়াদা করছে তাদের চরিত্র ও সততাই পয়লা বিচার করে দেখার বিষয়।
নিম্নে জাতীয় জীবনে সমস্যা কবলিত কতিপয় মৌলিক বিষয়ের সমাধানে আমাদের প্রচেষ্টার উল্লেখ করা হলো-
(ক) রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে জামায়াতে ইসলামী
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের দাওয়াত দান, দাওয়াত প্রাপ্তদের সংগঠিত করা এবং সেই সংগঠিত জনশক্তিকে যোগ্যতা-দক্ষতায় স করে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে রাজনীতি করেছেন জামায়াত সেই রাজনীতিই করতে চায়। যেহেতু আমরা মনেপ্রাণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একমাত্র অনুসরণযোগ্য আদর্শ নেতা বলে গ্রহণ করেছি, সেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করেছেন, যা করতে বলেছেন এবং যা তিনি অনুমোদন করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সেই সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনের প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব। আমরা ঠিক ততটুকু রাজনীতিই করতে চাই যতটুকু আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন। এর কমও নয়, বেশিও নয়।
ইসলামকে খণ্ডিতভাবে যারা মানতে চায় তাদের সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,
افَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَبِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاء مَنْ يَفْعَلُ ذَلِكَ مِنكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الحَيَوةِ الدُّنْيَا ، وَيَوْمَ الْقِيمَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَمَدٌ العَذَابِ ، وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوا الحيوةَ الدُّنْيَا بِالْآخِرَةِ وَ فَلَا يُخَفِّفُ
عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ ينصرون (سورة البقرة : ۸۵-۸۶)
“তবে কি তোমরা কুরআনের কিছু অংশ বিশ্বাস কর আর কিছু অংশ অবিশ্বাস কর? যারা এমনটি করে পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া তারা আর কিছুই পাবে না। কিয়ামাতের দিন তাদেরকে কঠিনতম শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের খোঁজখবর রাখেন না, এমন নয়। এরাই পরকালের বিনিময়ে ইহকালকে খরিদ করে নিয়েছে। অতএব, এদের শাস্তি কিছুমাত্র লঘু করা হবে না এবং (আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচার মত) এরা কোন সাহায্যও পাবে না।” (সূরা আল বাকারা: ৮৫-৮৬)
দ্বীনকে খণ্ডিত করলে বিনিময়ে যে দুনিয়া-আখিরাতে দুর্গতির শিকারে পরিণত হতে হবে সে কথা এখানে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম হওয়ার পরও জাতিগতভাবে এখনো জীবনের সর্বস্তরে ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে মেনে চলতে পারছি না। এটাই আমাদের ইহকালীন দুর্গতি ডেকে আনছে এবং আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী পরকালেও এই আংশিক অনুসরণ আমাদের মুক্তির অন্তরায় হবে। যে জীবনাচরণ আমাদের ইহকাল ও পরকাল দুটোই বরবাদ করবে কোন মুসলিম সেই আচরণ করতে পারে না।.
আমবা জেনেশুনে এই আত্মধ্বংসী পথে পা বাড়াতে চাই না বলেই ইসলামী রাজনীতি না করে আমাদের উপায় নেই।
(খ) অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে জামায়াতে ইসলামী
আল্লাহ দুনিয়ায় যত মানুষ সৃষ্টি করেছেন, সম্পদ সৃষ্টি করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। যমিনের ওপর সম্পদ, ভূগর্ভে সম্পদ, পানিতে সম্পদ, পাহাড়ে সম্পদ। এত বেশি সম্পদ পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে যে, আল্লাহর বিধান মত চললে মানুষের কোন অভাব থাকার কথা ছিল না। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানুষকে এমনভাবে বিভাজন করেছে যে, একদল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে, অন্যদল সম্পদের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে তাকে করে তুলেছে যন্ত্রমানব। সম্পদের সুষম বণ্টন হলে মানবজাতি এরকম কঠিন সংকটে পড়তো না। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামী অর্থব্যবস্থা গড়ে তুলে সমাজ থেকে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নির্মূল করেছিলেন। যে আরবে ইসলাম আসার আগে মানুষ দারিদ্র্যের ভয়ে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত, ইসলাম এসে সেই আরবে এমন অবস্থার সৃষ্টি করল যে, যাকাত নেয়ার মত কোন লোক আরবে পাওয়া যেত না বলে তা বিদেশের গরীবদের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হত। যাকাত মূলত ধনীর সম্পদে গরীবের হক নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এ দেশে যে সম্পদ আছে, যদি পরিপূর্ণভাবে ইসলামী অর্থনীতি এখানে চালু করা যায় এবং সুষ্ঠ ভারে যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টন করা যায় তাহলে অচিরেই এ দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করে দেয়া সম্ভব। জামায়াতে ইসলামী এদেশে ইসলামী অর্থনীতি চালু করে সমাজ থেকে দারিদ্র্য নির্মূল করতে চায়।
(গ) শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারে জামায়াতে ইসলামী
আমরা বলি, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু এই শিক্ষা যদি সুশিক্ষা না হয় তাহলে তার পরিণতি হয় ভয়াবহ ও মারাত্মক। শিক্ষা যদি যোগ্যতা অর্জনের পাশাপাশি সততা অর্জন করতে না শেখায় তাহলে মানবতা বিপর্যস্ত হয়। তাই নৈতিকতা বিবর্জিত ধর্মহীন শিক্ষার বদলে চাই নৈতিকতা সমৃদ্ধ সুশিক্ষা। যে শিক্ষায় থাকবে নীতি ও নৈতিকতার বাঁধন। থাকবে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার বোধ ও বিশ্বাস। ইংরেজ প্রবর্তিত গোলামী যুগের শিক্ষার পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী ইসলামী শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য জামায়াতের রয়েছে নিজস্ব শিক্ষানীতি। এ শিক্ষা একজন ইঞ্জিনিয়ারকে বানাবে নীতিবান ইঞ্জিনিয়ার, একজন ডাক্তারকে বানাবে দরদী সেবক। একজন বিচারককে বানাবে পক্ষপাতমুক্ত ন্যায়বান বিচারক। এটাই ইসলামী শিক্ষানীতির বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এর পরিপূর্ণ সুফল পেতে হলে রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতিকে ঢেলে সাজাতে হবে এর আলোকে। আর এ জন্য চাই সর্বস্তরের জনসাধারণের সচেতনতা, সম্পৃক্ততা ও ব্যাপক গণআন্দোলন।
(ঘ) সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুকাবিলায় জামায়াতে ইসলামী
অপসংস্কৃতি আজকে দুনিয়াব্যাপী মুসলিমদের ঈমান আকিদা ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। নগ্নতা ও অশ্লীলতার প্রসার ঘটিয়ে বিষিয়ে তুলছে সমাজ। এ সয়লাব রুখতে না পারলে তা কেবল আমাদের ঈমান আকিদাই ধ্বংস করবে না, আমাদের পরবর্তী বংশধরদেরকে ইসলামের পথ থেকে দূরে সরিয়ে নেবে। তাই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেখানো পথে এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখা সময়ের দাবি।
আমরা জানি, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধঃপতিত একটি সমাজে আগমন করেছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদর্শ গ্রহণ করার পর সেই সমাজের মানুষগুলোই হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। পাশবিকতার স্থান দখল করেছিল মানবিকতা, অসভ্যতা পরিবর্তিত হয়েছিল পবিত্রতায়। যে মানুষ একদিন অন্যের জীবন নিত সেই মানুষ অন্যের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। আর এই পরিবর্তন এসেছিল ইসলামের অনুপম সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে। অপসংস্কৃতির ধারকরা বাগান বানান মার্জিত রুচির, সম্প্রীতি ও সদাচরণের। জামায়াত সংস্কৃতির ইসলামী ধারার পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
(ঙ) নারী অধিকার রক্ষায় জামায়াতে ইসলামী
ইতিহাস সাক্ষী, ইসলাম ছাড়া আর কোন ধর্ম ও সমাজ নারীকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। নারী ও পুরুষকে মর্যাদা দিয়ে আল্লাহতা’য়ালা ঘোষণা করেন,
من لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ، (سُورَةُ الْبَقَرَةِ : (۱۸۷)
“তারা তোমাদের আবরণ আর তোমরা তাদের আবরণ।” (আল বাকারা: ১৮৭)
নারী অধিকার আদায়ের জন্য আজ দেশে দেশে আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু ইসলাম নারীর প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছে তখন, যখন নারীকে মানুষ বলেই গণ্য করা হতো না। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ নারীদের মিরাসী অধিকার নিয়ে তাদের নামেই আলাদা সূরা অবতীর্ণ করেই ক্ষান্ত হননি, কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় নারীর ন্যায়সংগত অধিকার নিয়ে বহু আয়াত নাযিল করেছেন। নারী পুরুষের ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছেন,
وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ مَن وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ . وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيرٌ (سُورَةُ الْبَقَرَةِ : ۲۲۸)
“নারীদের জন্যও ঠিক তেমনি ন্যায় সংগত অধিকার আছে যেমন পুরুষদের অধিকার আছে তাদের ওপর তবে পুরুষদের তাদের উপর একটি মর্যাদা আছে আর সবার উপরে আছেন আল্লাহ সর্বাধিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী বিচক্ষণ ও জ্ঞানী।” (সূরা আল বাকারা: ২২৮)
ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ নারী-পুরুষ সবার জন্যই ফরজ। রাসূলের যুগের নারীগণ এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। তাঁরা সর্বশক্তি দিয়ে দ্বীনের প্রচার করেছেন, যুদ্ধ তৎপরতায় অংশগ্রহণ করেছেন, প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীর মর্যাদা লাভ করেছেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বাণীর মাধ্যমে নারীকে দিয়েছেন অনন্য মর্যাদা। মহান আল্লাহ ও আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরেই মায়ের মর্যাদা নির্দিষ্ট করেছে ইসলাম। নারীর সম্ভ্রম ও সতীত্ব রক্ষা করা, নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে ইসলামের চাইতে কার্যকর ব্যবস্থা আর কোথাও নেই। কিন্তু অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে আমাদের সমাজে নারীরা ইসলাম প্রদত্ত অধিকার থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত।
শুধু বঞ্চিত নয়, আমাদের দেশে নারীরা আজ ব্যাপকভাবে নির্যাতনেরও শিকার। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন স্তরে। এমনকি উচ্চবিত্ত শিক্ষিত সমাজেও নারীরা বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার। এর প্রধান কারণ ইসলাম প্রদত্ত নারীর অধিকার দেয়ার ব্যাপারে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সর্বোতভাবে সচেতন ও সচেষ্ট নয়।
যৌতুক সমাজের জন্য এক অভিশাপ। নারীরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর শিকার হয়ে থাকে। এর কারণ ইসলামী বিধান সম্পর্কে জানা ও মানার ব্যাপারে অজ্ঞতা ও অবহেলা। যৌতুক দেয়া-নেয়া ইসলামে হারাম। এই হারাম কাজ থেকে বিরত রাখার জন্যই জামায়াত যৌতুকবিহীন বিয়ের ব্যাপারে জনগণকে নিরলসভাবে সচেতন করে যাচ্ছে।
নারী অধিকারের নামে নারীকে পণ্যে পরিণত করা, পুরুষের প্রতিপক্ষ করে তোলা বা একঘরে ও অসহায় করে তোলা ইসলামের কাম্য নয়। এ জন্যই অর্থনৈতিকভাবে নারীকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য ইসলামের যে উদার নীতি রয়েছে তার বাস্তবায়নে জামায়াত আন্তরিক। নারীর নিজস্ব সম্পদ, মোহরানা বাবদ আয়, পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে তার অধিকার নিশ্চিত করা গেলে নারীর সামাজিক মর্যাদাকে আমরা সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবো। জামায়াত নারীর এসব অধিকার আদায়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মোট কথা, কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত নারীর মর্যাদা ও সমুদয় অধিকার প্রতিষ্ঠায় জামায়াতে ইসলামী সর্বোতভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
পাশ্চাত্য সমাজে ভোগবাদ নারীকে আজ পণ্যে পরিণত করেছে। সেখানে পরিবার প্রথা ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। তথাকথিত প্রগতিশীলতা নারীকে পরিণত করছে ভোগের সামগ্রীতে। নারীর সামাজিক নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। নারী হয়ে পড়ছে অসহায় ও একঘরে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও আজ এগিয়ে আসতে হবে। ইসলাম প্রদত্ত নারী অধিকার আদায়ের দাবিতে তাদের সংঘবদ্ধ হতে হবে। নারী ও পুরুষ পরস্পরের শত্রু নয়, বরং পরিপূরক ও সহায়ক, এই বোধ সকলের মধ্যে জাগরিত করা এবং নারী-পুরুষের মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই একটি কল্যাণময় সমাজ ও সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব বলে জামায়াত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।
(চ) অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় জামায়াতে ইসলামী
ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র হলে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে কেমন আচরণ করা হবে এ নিয়ে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ভাইদের প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু তারা যদি ইসলামের ইতিহাস পড়েন তাহলে এমন এক চিত্র দেখতে পাবেন, যা তাদের চোখকে শীতল ও হৃদয়কে শান্তিতে ভরে দেবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পথে কাঁটা দিত যে অমুসলিম বুড়ি তাকেই সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জামায়াত তাঁরই আদর্শ অনুসরণ করার পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের বিপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো জামায়াতের ধর্মীয় দায়িত্ব।
ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ ধর্ম অবাধে পালন করার পূর্ণ অধিকার পাবে, যেমন পেয়েছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জামানায়। ঠিক তেমনিভাবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের। স্বাধীনভাবে তারা ধর্মকর্ম ও ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবে। প্রাত্যহিক জীবনের সকল কাজ তারা তাদের মতই করতে পারবে। বাংলাদেশে যত হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় আছে তাদের সবাই যাতে নিজ নিজ ধর্ম যথাযথভাবে পালন করতে পারে সেই পরিবেশ রক্ষা করা জামায়াতের অন্যতম নীতি। কুরআন ও হাদিসে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার যত বিধান আছে জামায়াতে ইসলামী তা পরিপূর্ণভাবে পালন করতে চায়। জামায়াতে ইসলামী সেই লক্ষ্যেই দেশের সকল নাগরিককে সুসংগঠিত করতে চায়, যাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই ন্যায়সংগতভাবে কল্যাণের অধিকারী হতে পারে।
আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে পড়শিকে অভুক্ত রেখে পেট পুরে খায় সে আমার উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ এ প্রতিবেশী মুসলিম বা অন্য ধর্মাবলম্বী যেই হোক সে মুসলিমের সেবা ও সাহায্য পাওয়ার হকদার। এটাই আমাদের ধর্মীয় নীতি এবং জামায়াতের আদর্শ। আর এ নীতি আদর্শ প্রতিষ্ঠার কাজে শামিল হবার জন্য জামায়াতের রয়েছে নিজস্ব ‘সহযোগী সদস্য’ ফরম- যা পূরণ করে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও জামায়াতে যোগ দিতে পারেন। সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করার কাজে ধর্ম-বর্ণের বিভেদ ভুলে সবাই এগিয়ে এলে বাংলাদেশকে একটি আদর্শ কল্যাণরাষ্ট্র বানানো সময়ের ব্যাপার মাত্র।
সতের: ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের সুফল
ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেই কেবল সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। এ ধরনের রাষ্ট্রই তার সকল নাগরিকের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে। আল্লাহ তা’য়ালার সৃষ্ট সূর্যের আলো, বাতাস, আগুন, পানি থেকে যেমনি ধর্ম-বর্ণ-গোত্র সকল মানুষ কল্যাণ লাভ করে তেমনি আল্লাহ তা’য়ালার দেয়া ইসলামী জীবন বিধান থেকে ও সকল মানুষ কল্যাণ লাভকরবে। এটাই ইসলামের বৈশিষ্ট্য। কুরআন কেবল মুসলিমের কল্যাণের জন্য আসেনি, এসেছে বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্য। মুসলিমরা রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মাত হলেও তাঁকে কেবল মুসলিমদের কল্যাণের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়নি, বরং তাঁকে বলা হয় রাহমাতুল্লিল আলামীন, মানে বিশ্ব জাহানের জন্য তিনি রহমত স্বরূপ। আল্লাহর দ্বীনের আলো সবার জন্যই কল্যাণের বার্তাবহ। যিনি বা যারা এর যতটুকু পালন করবেন তার সুফলও ততটুকুই পাবেন। ইসলামী আইন যেখানে যতটা কার্যকর হবে সেখানে তার ততটা কল্যাণধারা প্রকাশ পাবেই। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সবার জন্যই এ নীতি সমভাবে প্রযোজ্য। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান পূর্ণঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা পূর্ণভাবে নিশ্চিত হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّلِحَتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا. (سُورَةَ النَّوْرِ : ۵۵)
“আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি অবশ্যই পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত (নেক) লোকদেরকে দান করেছিলেন এবং অবশ্যই তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে মজবুত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন যাকে আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং নিশ্চিতই তাদের (বর্তমান) ভয় ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন।” (সূরা আন্ নুর: ৫৫)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরও বলেন-
٩٦- وَلَوْ أَنْ أَهْلَ الْقُرَى أَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَتٍ مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ ، (سُورَةُ الْأَعْرَافِ : ٩٦)
“যদি জনপদের লোকেরা ঈমান আনতো এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করতো, তাহলে আমি তাদের জন্য অবশ্যই আকাশ ও পৃথিবীর বরকত সমূহের দুয়ার খুলে দিতাম।” (আল আরাফঃ ৯৬)
জামায়াতে ইসলামী কল্যাণের এ ধারাকে সমাজ ও রাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চায়। প্রতিটি নাগরিকের দোর গোড়ায় পৌঁছে দিতে চায়।
আঠার: জামায়াতে ইসলামীর বৈশিষ্ট্য
যেহেতু:
* মানব জীবনের সব সমস্যা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমাধান করাই জামায়াতের লক্ষ্য।
* ব্যক্তিজীবনে যাদের মন-মগজ ও চরিত্র ইসলাম অনুযায়ী গঠিত একমাত্র তাদের নেতৃত্বেই এ কাজ সম্ভব বলে জামায়াতের বিশ্বাস।
সেহেতুঃ
* সত্যিকার মুসলিমের কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন না করা পর্যন্ত জামায়াত কাউকে সদস্য (রুকন) বানায় না।
* জামায়াতে নেতৃত্ব ইসলামী চরিত্র ও আন্দোলনের প্রতি নিষ্ঠা দ্বারা নির্ধারিত হয়। এখানে ডিগ্রী, ধন-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি দ্বারা নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রিত নয়।
* জামায়াতে নেতৃত্বের কোন কোন্দল বা প্রতিযোগিতা কখনো ছিল না, এখনও নেই। নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টা করা জামায়াতে ঘৃণ্য অপরাধ বলে গণ্য।
জামায়াতে কোন ব্যক্তিকে রেডিমেড নেতা হিসেবে গণ্য করা হয় না। সদস্য (রুকন) হওয়ার পর যোগ্যতা থাকলে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই নেতৃত্বের দায়িত্ব আসবে। তখন শরয়ী ওযর ব্যতীত নেতৃত্ব কবুল করতে অস্বীকার করাও জামায়াতে নীতি বিরোধী কাজ।
উনিশ: জামায়াতে ইসলামীর অবদান
* বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্যের বিপুল সমাহার ও ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে।
* রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্তিশালী ইসলামী ধারা সৃষ্টি ও জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
* মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের যোগ্যতা বৃদ্ধি করে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ ও জনগণের খেদমত করার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
* একদল নিষ্ঠাবান, সৎ ও যোগ্য লোক তৈরি করেছে এবং সততা ও স্বচ্ছতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে।
বিশ: আপনি কোন্ দলে যোগ দেবেন?
আপনি নিশ্চয়ই নিজের ও সন্তান-সন্ততির কল্যাণ চান। দেশ ও জাতির কল্যাণ ছাড়া কি সে কল্যাণ সম্ভব? তাহলে দেশে কী ঘটছে, কারা দেশকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে এ বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকা কি উচিত? নিজের স্বার্থেই আপনাকে দেশ সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
দেশে যেসব রাজনৈতিক দল আছে আপনার ভবিষ্যত ভাল-মন্দ এদের কার্যাবলীর উপরই নির্ভরশীল। কি করে আপনি নিরপেক্ষ থাকতে পারেন? সরাসরি রাজনীতির ময়দানে না এলেও কোন্টা ভাল আর কোন্টা মন্দ তুলনা করে দেখতে হবেই। নির্বাচনের সময় শেষ পর্যন্ত কোন একটি দলকে অবশ্যই সমর্থন করবেন। আপনি রাজনীতি করতে না চাইলেও রাজনীতির ফলাফল আপনাকে পেতেই হবে। তাই সবাইকে জানুন এবং কোন্টা ভাল আর কোন্টা মন্দ তা তুলনা করে বাছাই করে নিন। এ বিষয়ে চুপ থাকা আত্মহত্যার শামিল। রাজনৈতিক ময়দানে নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব নয়।
একুশ: কোন্ পথ আপনার পছন্দ?
ময়দানে যারা রাজনীতি করছেন তাদের মত ও পথ এক নয়। দেশের ক্ষমতা তাদের মধ্যেই কারো হাতে যাবে। তাই কারা কিভাবে ক্ষমতায় যেতে চায় তা বুঝতে হবে। কোন্ পথে দেশের কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি তা চিন্তা করতে হবে। হাঙ্গামা ও শক্তির মহড়া দেখে এমন কোন দলকে ক্ষমতায় যেতে দেবেন না যারা সরকার গঠনের জন্য ক্ষমতা জোর করে কেড়ে নিতে চায়। রাজনৈতিক ময়দানকে এরাই যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে রেখেছে। হিংসা, বিদ্বেষ ও গালির ভাষায় এরা কথা বলে। শ্রেণীবিদ্বেষ এদের রাজনৈতিক আদর্শ হওয়ায় রাজনীতিতে তাদের হিংস্র মেজাজ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। এ ধরনের মনোভাবসম্পন্ন লোকদের জন্য যদি আপনি এ ময়দান ছেড়ে দেন, তাহলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ কোন দিনই ফিরে আসবে না।
নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সমর্থন নিয়ে যারা ক্ষমতায় আসতে চান, তারা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। জনগণের উপরও তাদের আস্থা আছে। তাদের আদর্শ জনসমর্থন পাওয়ার যোগ্য বলে তারা বিশ্বাস করে। কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লবের যারা হুমকি দেয়, যারা সন্ত্রাসের ভাষায় কথা বলে, রাজনীতির ময়দানে বুদ্ধি ও যুক্তির বদলে দৈহিক শক্তি ব্যবহার করে, তারা জনগণকে বিশ্বাস করে না। তারা ক্ষমতা পেলে মানুষের অধিকার হরণ করবেই। জনসমর্থন না নিয়ে বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করা একটি জাতির উপর চরম ডাকাতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
আপনি কোন্ পথ পছন্দ করছেন? গণতন্ত্রের পথ পছন্দ হলে চুপ করে থাকবেন না। জনগণের হাতে ক্ষমতা বহাল রাখতে ময়দানে নেমে আসুন।
একমাত্র এ উপায়েই রাজনৈতিক ডাকাতি থেকে দেশকে বাঁচাতে পারবেন, নিজেও বাঁচবেন।
বাইশ: আপনি কি জামায়াতকে সঠিকভাবে জানেন?
– ভালভাবে না জেনে সমর্থন করা বা বিরোধিতা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
– জানতে হলে জামায়াতের দায়িত্বশীলদের সাথে কথা বলুন, জামায়াতের সাহিত্য পড়ুন, জামায়াতের সমাবেশে যোগ দিন এবং জামায়াতের কার্যাবলী দেখুন।
– যারা ইসলামী জীবন বিধানে বিশ্বাসী নয় তাদের প্রোপাগান্ডা ও বিরোধিতা শুনে জামায়াত সম্পর্কে কোন নেতিবাচক ধারণা করলে জামায়াতের প্রতি চরম অবিচার হবে।
– জামায়াতকে অন্যের কাছ থেকে জানবার চেষ্টা না করে সরাসরি জামায়াতের সাহিত্য ও কর্মীদের কাছ থেকেই জানুন এবং আল্লাহর দেয়া বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন।
তেইশ: মুসলিম হিসেবে আপনার কর্তব্য
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন যদি আপনার একমাত্র আদর্শ হয়ে থাকে, তাহলে জীবনের সব ব্যাপারেই কি তাঁকে পূর্ণরূপে অনুসরণ করা কর্তব্য নয়? তাঁকে শুধু মসজিদে মানলেই কি চলবে? তিনি আল্লাহর আইন মুতাবিক দেশ শাসন করে যে আদর্শ শেখালেন তা অনুসরণ না করলে মুসলিম জীবনের দায়িত্ব কি পালন করা হয়? এ দায়িত্ব পালন সকল মুসলিম নর-নারীর উপর ইসলাম ফরজ করে দিয়েছে। এ কর্তব্য পালনের প্রয়োজনেই জামায়াতে ইসলামী গঠিত। একজন মুসলিম যেহেতু একা এ দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম নয়, জামায়াতবদ্ধ প্রচেষ্টা তাই মুসলিম জীবনের প্রধান কর্তব্য। এ কর্তব্য অবহেলা করে ধর্ম পালন যদি যথেষ্ট হতো, তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এত ঝামেলা পোহালেন কেন? ইসলামকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেয়ে বেশি কে বুঝতে পারে? তিনি যা করে গেছেন এর টকুই ইসলাম। নামায, রোযা, যিকর, তিলাওয়াত ইত্যাদি ঐ আসল দায়িত্ব পালনের প্রাথমিক প্রস্তুতি মাত্র। দ্বীনের যথার্থ দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো ইকামাতে দীন বা ইসলামের প্রতিষ্ঠা। সকল নবী রাসূল এ জন্যেই তাঁদের যাবতীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছেন। শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কাজের পরিপূর্ণতা বিধান করেছেন এবং পরবর্তীদের জন্য নমুনা রেখে গেছেন।
চব্বিশ: দেশবাসীর প্রতি আমাদের আহ্বান
সাধারণভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি প্রতিহিংসাপরায়ণ, প্রতারণাপূর্ণ ও চটকদার শ্লোগান সর্বস্ব। মানুষকে যুক্তি-বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত করার পরিবর্তে তাদের মনে স্বার্থপরতা, লোভ ও ভয় সৃষ্টি করে ছলে-বলে-কৌশলে তারা জনগণের সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করে। একশ্রেণীর রাজনীতিবিদের দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন, জনস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে বেপরোয়া আচরণ, শোষণ, নির্যাতনে এ দেশের গণমানুষ আজ অতিষ্ঠ। সাধারণ মানুষ এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায়। কিন্তু কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের ভয়ে এ কথা অনেকেই মুখ ফুটে বলতে সাহস পায় না। অথচ পৃথিবীর ইতিহাস এ সাক্ষ্যই দেয়, প্রতিটি সমাজ বিপ্লবে প্রভাবশালী ও স্বার্থবাদী মহল নয়, সাধারণ মানুষের আর্তি ও আকাঙ্ক্ষারই বিজয় হয়।
সভ্যতা যখন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে তখন আল্লাহই বিপন্ন মানুষের মুক্তির জন্য নতুন শক্তির জন্ম দেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তেমনি এক আশার আলোকবর্তিকা। আমরা আমাদের ঈমান আকিদার হিফাযত করতে চাই। যে ইসলামী অর্থনীতি চালু করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গরীব, দুঃখী, অভাবী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেই অর্থনীতি চালু করে এ দেশের গরীব ও অভাবী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। আরবের পঙ্কিল সমাজের অপসংস্কৃতির বেড়াজাল ছিন্ন করে যেই পবিত্র সংস্কৃতির ফল্গুধারা প্রবাহিত করেছিলেন রাসূল মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমরা সেই পবিত্র সংস্কৃতি দিয়ে এ দেশের মানুষের দুঃখ ঘুচিয়ে দিতে চাই। যে রাজনীতি প্রতিহিংসার বদলে রক্তপাতহীনভাবে মক্কা বিজয় ও শত্রুকে নিরাপত্তা দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরার শিক্ষা দেয় সে রাজনীতি দিয়ে কল্যাণকর ইসলামী রাষ্ট্র এ দেশের জনগণকে উপহার দিতে চাই।
বিগত নির্বাচনগুলোতে ক্রমবর্ধমান হারে জামায়াতের সমর্থন বৃদ্ধি এবং প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোকের জামায়াতে যোগদান, জামায়াত কর্মীদের আত্মত্যাগ ও জনগণের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান আমাদের আশান্বিত করেছে। জামায়াতকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন কল্পনাই করা যায় না।
সচেতন দেশবাসীর কাছে তাই আমাদের আবেদন, আসুন, ইসলামের আলোয় রাঙিয়ে তুলি নিজেদের জীবন। আমাদের সমাজ, সংসার, রাষ্ট্রকে গড়ে তুলি ইসলামের আলোয়। প্রতারক, ধর্মবিমুখ ও সুবিধাবাদী রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতের মুক্তির জন্য সাধ্যানুযায়ী সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাই। এমন একটি কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে তুলি যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই জানমালের নিরাপত্তাসহ সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারি। আর এই কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য নিজে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করি এবং অন্যকেও জামায়াতে যোগদান করার জন্য উদ্বুদ্ধ করি। আল্লাহ আমাদের সকল নেক মাকসাদ পূর্ণ করুন। আমীন।
পঁচিশ: জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিতে হলে
– জামায়াতের সাথে যোগাযোগ করুন।
– জামায়াত অফিসে দেখা করুন। অথবা
– নিকটবর্তী কোন জামায়াত কর্মীর সাথে যোগাযোগ করুন। অথবা অফিসের ঠিকানায় চিঠি লিখুন।
– সহযোগী সদস্য ফরম পূরণ এবং সে অনুযায়ী যথাসাধ্য কাজ করুন।
– জামায়াতের বৈঠকে নিয়মিত যোগ দিন। কর্মীরূপে গড়ে উঠুন।
– যোগ্যতার সাথে দীনের দায়িত্ব পালন করতে হলে সদস্য (রুকন) হওয়ার চেষ্টা করুন।
– সত্যিকার মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠবার জন্য জামায় তর সংগঠন আপনাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও আনুকূল্য দানে প্রস্তুত।
সমাপ্ত