হিজরাতের তারিখ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় পৌঁছেন তখন সময় ছিল রৌদ্রতপ্ত দুপুরের প্রাক্কাল। তারিখ ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। এটা নবুওয়াতের ১৩ বছর পরের ঘটনা। অতঃপর রবিউল আউয়াল মাসের বাকী দিনগুলো এবং রবিউস সানী, জামাদিউল আউয়াল, জামাদিউস সানী, রযন, শা’বান, রমাদান, শাওয়াল, যিলকাদ, যিলহাজ্ব ও মুহররমার মাস মদীনাতেই অবস্থান করেন। [অর্থাৎ হিজরত করে মদীনায় যাওয়ার পরে এই সময়ে মদীনার বাইরে কোথাও যাননি: – সম্পাদক]
প্রথম যুদ্ধাভিযান
মদীনা আগমনের ঠিক ১২ মাস পর সফর মাসে তিনি ওয়াদ্দান তথা আবওরা অভিযানে বের হন। কুরাইশ ও বনু দামরা ইবনে বাক্রের সন্ধানে তিনি ওয়াদ্দান পৌঁছেন। সেখানে বনু দামরা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে। অতঃপর তিনি কোন রকম ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন না হয়েই নিরাপদে মদীনায় ফিরে আসেন। সফর মাসের অবশিষ্ট দিনগুলো ও রবিউল আউয়াল মাসের প্রথমাংশ সেখাইেন অতিবাহিত করেন।
উবাইদা ইবনে হারিসের নেতৃত্বে অভিযান
রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে এই যুদ্ধের ঝান্ডা বেঁধেছিলেন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা অবস্থানের এই সময়েই তিনি উবাইদা ইবনে হারিসকে ৬০ অথবা ৮০ জন লোকের একটি অশ্বারোহী বাহিনীসহ পাঠালেন। তাঁরা সবাই ছিলেন মুহাজির। আসারদের কেউই তাঁদের সাথে ছিলেন না। দলটি সানিয়াতুল মুররায় নিম্নভূমিতে একটি জলাশয়ের কাছে পৌঁছিলে কুরাইশদের বিরাট একটি দলের সম্মুখীন হলো। কিন্তু কোন য্দ্ধু হলো না। কেবল সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস একটি তীর নিক্ষেপ করেন। এটাই ছিল ইসলামী বাহিনীর প্রথম তীর নিক্ষেপ। অতঃপর দলটি ফিরে এলো। মুসলমানরা ছিলো তখন বেশ উদ্দীপ্ত।
সমুদ্র উপকূলের দিকে হামযার নেতৃত্বে অভিযান
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সময় হামযার (রা) নেতৃত্বে ৩০ জন ঘোরসওয়ার মুহাজিরের একটি দলকে ঈসের দিক দিয়ে সমুদ্রোপকূলের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। এ অভিযানেও কোন আনসারকে পাঠালেন না। এবার মুসলিম বাহিনী আবু জাহলেন নেতৃত্বাধীন মক্কার ৩০০ অশ্বারোহীর একটি বাহিনীর মুখোমুখি হলো। মাজদী আবনে আমর জুহানীর প্রচেষ্টায় তখনও কোন সংঘর্ষ ঘটলো না। তিনি উভয় পক্ষকে দূরে সরিয়ে দিলেন। ফলে উভয় বাহিনী পরস্পর থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে ফিরে গেল। এবারও কোন যুদ্ধ সংঘটিত হলো ন।
বুয়াত অভিযান
রবিউল আউয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে বেরিয়ে বুয়াত নামক স্থানে পৌঁছলেন। এখানে গেলেন রিদ্ওয়ার দিক দিয়ে। কোন যুদ্ধ ছাড়াই তিনি মদীনায় ফিরে এলেন। সেখানে তিনি রবিউস সানীর অবশিষ্ট দিনগুলো এবং জমাদিউল উলার প্রথম ভাগ অতিবাহিত করলেন। [৫২. এই অভিযানে যাওয়ার সময় সায়েব ইবনে উসমান ইবনে মাযউনকে (রা) মদীনায় দেখাশুনার দায়িত্ব দেয়া হয়। বুয়াত : ইয়াম্বুর নিকটবর্তী জুহাইনা গোত্রের এলাকার একটি পর্বতের নাম। ]
উশাইরা অভিযান
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় কুরইশদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করলেন।[ ৫৩. এই সময় আবু সালামা ইবনে আবুদর আসাদকে (রা) মদীনা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়।]বনু দীনারের গিরিবর্ত দিয়ে অতঃপর হাবারের মরুভূমির মধ্য দিয়ে বাহিনী নিয়ে ইবনে আযহার উপত্যাকায় পৌঁছে একটি গাছের ছায়ায় যাত্রাবিরতি করলেন। সেখানে নামায পড়লেন। এজন্য সেখানে একটি মসজিদ রয়েছে। সেখানে তাঁর জন্য খাবার তৈরী করা হলে তিনি সবাইকে সাথে নিয়ে খাওয়া দাওয়া করলেন। ঐ স্থানে ডেকচি রাখার রাখার জায়াগা এখনো সুস্পষ্ট। তাঁকে সেখানকার ‘মুশতারাব’ নামক ঝর্ণা থেকে পানি পান করানো হলো। অতঃপর তিনি খালায়েক নামক স্থানকে বাম দিকে রেখে যাত্রা শুরু করলেন এবং আবদুল্লাহ গিরিপথ অতিক্রম করলেন। অতঃপর বাম দিকে ঘুরে ইয়ালইয়াল নামক সমভূমিতে পৌঁছে ইয়ালইয়াল ও দাবুয়ার সংযোগস্থলে যাত্রাবিরতি করলেন এবং সেখানকার একটি কুয়া থেকে পানি পান করলেন। অতঃপর ফারশ মিলালের সমভূমির মধ্য দিয়ে চললেন। অবশেষে ইয়ামামের ছোট ছোট পার্বত্য অঞ্চলের পথ পেলেন। অতঃপর সেই পথ ধরে ইয়াম্বুর সমভূমি দিয়ে উশাইরাতে গিয়ে যাত্রাবিরতি করলেন। এখনে জামাদিউল উলা এবং জামাদিউস সানীর কয়েকটা দিন অবস্থান করলেন। এখানে বনু মাদলাজ এবং তার বনু দামরা গোত্রীয় মিত্রদেরকে বশ্যতা স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করলেন। অতঃপর নিরাপদে মদীনায় ফিরে এলেন।
সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে সামরিক অভিযান
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠান। ৮ জন মুহাজিরের এই বাহিনী হিজাযের খাযযার নামক স্থানে গিয়ে উপনীত হলো। অতঃপর নিরাপদে মদীনায় ফিরলো।
সাফওয়ান অভিযান: প্রথম বদর অভিযান
উশাইরা অভিযান থেকে ফেরার দশ দিনের কম সময়ের মধ্যে একদিন কুরয ইবনে জাবের ফেহরী মদীনার আশপাশে ছেড়ে দেয়া উট ও অন্যান্য গৃহপালিত পশু লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে হামলা চালিয়ে বসলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৎক্ষনাৎ তার পিছু ধাওয়া করলেন। [৫৪. এই যুদ্ধে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়িদ ইবনে হারিসাকে মদীনার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন।] তিনি বদর প্রন্তরের একপাশে সাফওয়ান সামক একটি উপত্যকায় পৌঁছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরয ইবনে জাবেরের নাগার পেলেন না। এ ঘটনাকে প্রথম বদর অভিযান বলা হয়। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় ফিরে এলেন এবং জামাদিউস সানী মাসের বাকী দিনগুলো এবং রযব ও শা’বান মাস মদীনাতেই কাটালেন।
আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের নেতৃত্বে সামরিক অভিযান
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রযব মাসে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের নেতৃত্বে প্রথম বদর অভিযান থেকে প্রত্যাগত মুহাজিরদের ৮ জনের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনী পাঠালেন। তাদের মধ্যে কোন আনসারকে অন্তর্ভুক্ত করলেন না। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশকে একটি পত্র দিয়ে বললেন যে, দুইদিন পথ চলার পর এই পত্রখানা খুলে পড়বে, তার আগে নয়। চিঠি পড়ার পর তাতে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সে অনুসারে কাজ করবে এবং সঙ্গীদের কারো উপর কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে দেবে না।
দুইদিন ধরে পথ চলার পর আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ চিঠি খুলে পড়লেন। তাতে লেখা ছিল, “আমার এই চিঠি যখন তুমি পড়বে, তখুনি রওনা হয়ে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাখলা নামক স্থানে গিয়ে যাত্রাবিরতি করবে। সেখানে কুরাইশদের জন্য ওত পেতে থাকবে এবং কোন তথ্য পেলে আমাকে জানাবে।”
আবুদল্লাহ ইবনে জাহাশ চিঠিখানা পড়েই বললেন,“আমি মেনে নিলাম ও অনুগত রইলাম। ” অতঃপর সঙ্গীদেরকে বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নাখলায় গিয়ে কুরাইশদের জন্য ওৎ পেতে থাকতে বলেছেন এবং কোন খবর জানলে তা তাঁকে জানতে বলেছেন। আর এ ব্যাপারে তোমাদের কারো ওপর বাধ্যতামূলক কোন দায়িত্ব চাপাতে নিষেধ করেছেন। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি শাহাদাত লাভে ইচ্ছুক থাকে তবে সে যেন যায়। আর যে তা চায় না, সে যেন ফিরে যায়। তবে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ পালন করবো।” একথা বলার পর আবদুল্লাহ ইবন জাহাশের সঙ্গে সবাই রওয়ানা হয়ে গেল। কেউই ফিরে গেল না। তিনি হিজাযে প্রবেশ করলেন। বাহরান নামক স্থানে সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গায ওয়ান তাদের উট হারিয়ে ফেললেন। তাঁরা দু’জন ঐ উটকে অনুসরন করে চলছিলেন। ফলে ঐ উট খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে তাঁরা আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ থেকে পিছিয়ে পড়লেন। আর আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ও তাঁর সঙ্গীগণ যাত্রা অব্যাহত রাখলেন। চলতে চলতে তাঁরা নাখলাতে পৌঁছে যাত্রাবিরতি করলেন। এই সময় তাঁদের নিকট দিয়ে কুরাইশদের একটি কাফিলা কিসমিস চামড়া বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। আর সেই সাথে কুরাইশদের অন্যান্য পণ্যদ্রব্যও ছিল। এই দলের মধ্যে আমর ইবনে হাদরামী, উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ও তার ভাই নওফেল ইবনে আবদুল্লাহ এবং হাকাম ইবনে কাইসান ছিল। আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের দল তাদেরকে দেখে ঘাবড়ে গেলো কেননা তারা তাদের খুব নিকটে পৌঁছে গিয়েছিলো। উক্কাশা ইবনে মুহসান ওদের কাছে চলে গেলেন। তাঁর মাথা মু-ানো ছিল। তাঁকে দেখে কুরাইশরা আশ্বস্ত হলো। বললো, “এরা স্থানীয় বাসিন্দা। এদের দিক থেকে কোন ভয় নেই।” ওদিকে মুসলমানগণ কুরাইশদের ব্যাপারে পরামর্শে বসলেন। ঐদিন ছির রযব মাসের শেষ দিন। সকলে মত প্রকাশ করলেন যে, আজকে কুরাইশদের এই কাফিলাকে ছেড়ে দিরে এরপরই তারা হারাম শরীফের এলাকায় প্রবেশ করবে এবং আমাদের হাত থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে। পক্ষান্তরে আজ যদি তাদেরকে হত্যা করা হয় তাহলে নিষিদ্ধ মাসের মধ্যে রক্তপাত ঘটানোর দোষে দোষী হতে হবে। তাই তারা দ্বিাধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেলেন এবং কুরাইশ কাফিলার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সংকোচ বোধ করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেললেন এবং দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে একমত হলেন যে, যাকে যাবে পারা যায় হত্যা করতে হবে এবং তাদের যার কাছে যা আছে তা নিয়ে নিতে হবে। ওয়াকিদ ইবনে আবদুল্লাহ তামিমী আমর ইবনে হাদরামীকে বর্শার আঘাতে হত্যা করলেন। আর উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ও হাকাম ইবনে কাইসানকে বন্দী করলেন। নওফেল ইবনে আবদুল্লাহ পালিয়ে আত্মরক্ষা করলো। তাকে কিছুতেই ধরা সম্ভব হলো না। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ কাফিলার অবশিষ্ট লোক ও বন্দী দুজনকে নিয়ে মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি তো তোমাদেরকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করতে বলিনি। ” অতঃপর তিনি কাফিলা ও বন্দীদেরকে আটকে রাখলেন এবং তাদের সম্পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ উক্তিতে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ সবার সামনে খাটো ও লা জওয়াব হয়ে গেলেন। তাঁর দলের লোকেরা ভাবলেন তদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। মুসলমানরা এ কাজের জন্য তাদেরকে তিরস্কার করলেন। ওদিকে কুরাইশরা বলতে লাগলো, “মুহাম্মাদ ও তার সহচররা নিষিদ্ধ মাসের পবিত্রতা লংঘন করেছে। তারা নিষিদ্ধ মাসে রক্তপাত ঘটিয়েছে, অন্যের সম্পদ হস্তগত করেছে এবং লোকজনকে বন্দী করেছে।” মক্কাতে যে কয়জন মুসলমান তখনো ছিলেন তাদের একজন জবাব দিলেন, “মুসলমানরা যা করেছে, শা’বান মাসে করেছে। [একথা বলার পেছনে যুক্তি ছিলো যে, রজব মাসের শেষ তারিখের সূর্যাস্তের পর শা’বান মাস শুরু হয়েছিলো।-সম্পাদক]
এই প্রচারনা অভিযান যখন ব্যাপক আকার ধারণ করলো তখন আল্লাহ তা’য়ালা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এই আয়াত নাযিল করলেন:
[আরবী *************]
“তারা তোমাকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। তুমি বল: এ মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া অন্যায়। তবে আল্লাহর কাছে তার চেয়েও বড় অন্যায় হলো
আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখা,কুফরী করা, মসজিদে হারামে যেতে বাধা দেয় এবং মসজিদে হারামের অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা। বস্তুতঃনির্যাতনের মাধ্যমে মানুষকে বিপথগামী করা হত্যার চেয়েও বড় অপরাধ। তারা অবিরতভাবে তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, যাতে করে সাধ্যে কুলালে তোমাদেরকে ধর্মান্তরিত করতে পারে।” (আল বাকারাহ)
অর্থাৎ তোমরা যদি হারাম মাসে হর্তাকা- করেও থাক, তবে তারা তো আল্লাহর পথে চলতে তোমাদেরকে বাধা দিয়েছে, সেইসাথে কুফরীও করেছে এবং মসজিদে হারামে তোমাদেরকে যেতে দেয়নি। আর তোমরা মসজিদুল হারামের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও তোমাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা আল্লাহর কাছে তোমাদের একজন কাফিরকে হত্যা করার চাইতে মারাত্মক অপরাধ। আর তারা যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে ধর্মত্যাগে বাধ্য করতো এবং কুফরী ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনতো, সেটা হত্যার চেয়েও জঘন্য কাজ। আর এই জঘন্যতম অন্যায় কাজ তারা তোমাদের সাথে অবিরতভাবেই করে চলেছে এবং তা থেকে ফিরছে না বা তাওবাহ করছে না।
কুরআনে যখন এই পথনির্দেশ এলো এবং আল্লাহ মুসলমানদের ভীতি ও দুশ্চিন্তা দূর করে দিলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আটক কাফিলা ও বন্দীদেরকে সরকারীভাবে গ্রহণ করলেন। কুরাইশরা তাঁর কাছে উসমান ও হাকামকে পণ্যের বিনিময়ে মুক্তি দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বার্তা পাঠালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জবাবে এদেরকে জানালেন, “আমাদের দুইজন লোক সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গাযওয়ান ফিরে না আসা পর্যন্ত বন্দীদের মুক্তি দেবো না। কেননা তোমাদের দ্বারা ওদের জীবন বিপন্ন হবার আশংকা রয়েছে।”অচিরেই সা’দ ও উতবা ফিরে এলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পণ্যের বিনিময়ে মুক্তি দিলেন। তবে বন্দীদ্বয়ের মধ্যে হাকাম ইবনে কাইসান ইসলাম গ্রহণ করেন ও সাচ্চা মুসলিমে পরিণত হন। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছেই থেকে যান। পরে বীরে মাউনার ঘটনায় তিনি শহীদ হন। উসমান ইবনে আবদুল্লাহ মক্কা চলে যায় এবং কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।
কিবলা পরিবর্তন
বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনা আগমনের আঠার মাস পর শাবান মাসে কিবলা পরিবর্তন হয়।
বদরের যুদ্ধ
এরপর একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারলেন যে, আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের নেতৃত্বে কুরাইশদের একটি বিরাট কাফিলা সিরিয়ার দিক থেকে এগিয়ে আসছে। সে কাফিলায় কুরাইশদের বহু সম্পদ এবং বাণিজ্যিক সম্ভার রয়েছে। কাফিলায় মাখরামা ইবনে নওফেল ও আমর ইবনুল ‘আসসহ কুরাইশ বংশোদ্ভূত ৩০ অথবা ৪০ জন লোক রয়েছে। তিনি মুসলমানদেরকে তাদের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, “এটা কুরাইশদের কাফিলা। এতে প্রচুর ধন-সম্পদ রয়েছে। তোমরা ওদিকে যাও। হয়তো আল্লাহ ঐসব সম্পদ তোমাদের হস্তগত করে দেবেন।” মুসলমানরা কাফিলাকে ধরার জন্য যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কেউবা ত্বরিৎ প্রস্তুত হয়ে গেলেন। কেউবা একটু শৈথিল্য দেখালেন এবং দেরী করলেন। কারণ তারা ধারণা করতে পারেননি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছেন।
হিজাযের কাছাকাছি এসে আবু সুফিয়ান ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলো। পথচারী যার সাথেই দেখা হলো, তাকে সে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো। কেননা সে মুসলমানদের প্রস্তুতি সম্পর্কে ভীতসন্ত্রন্ত ছিল। শেষ পর্যন্ত কোন কোন পথচারী তাকে স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিল যে, মুহাম্মাদ তাঁর সহচরদেরকে তোমার ও তোমার কাফিলার ওপর আক্রমণ চালাতে চলেছে। সুতরাং আবু সুফিয়ান সাবধান হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলো। সে দামদাম ইবনে আমর গিফারীকে তৎক্ষণাৎ মজুরীর বিনিময়ে মক্কা পাঠিয়ে দিল। তাকে বলে দিল, সে যেন কুরাইশদের কাছে গিয়ে তাদের ধন সম্পদ নিরাপদে নিয়ে আসার জন্য কিছু অস্ত্রসজ্জিত লোক পাঠাতে অনুরোধ করে এবং মুহাম্মাদ যে তার দলবলসহ তাদেরকে আক্রমণ করতে উদ্যত তা তাদেরকে জানায়। দামদাম খুব দ্রুত মক্কার দিকে রওয়ানা হয়ে গেল।
দামদাম মক্কা পৌঁছার তিন দিন আগে আবদুল মুত্তালিব তনয়া আতিকা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি তাঁর ভাই আব্বাসকে ব্যাপারটা জানালেন। বললেন, “ভাই, আজ খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। আমার ভয় হচ্ছে যে, তোমার সম্প্রদায়ের ওপর কোন বিপদ মুসিবত এসে পড়বে। কাজেই আমি তোমাকে যা বলছি কাউকে বলো না।”
আব্বাস বললেন, “তুমি স্বপ্নে কী দেখেছো?”
আতিকা বললেন, “দেখলাম, একজন সওয়ার মক্কার পার্শ্ববর্তী সমতল ভুমিতে এসে নামলো। অতঃপর উচ্চস্বরে চিৎকার করে বললো, ‘হে কুরাইশগণ, তিন দিনের মধ্যে মৃত্যুর জন্য তৈরী হয়ে যাও, হুঁশিয়ার!” অতঃপর তার উট তাকে নিয়ে আবু কুবাইস পর্বত শিখরে আরোহণ করলো। অতঃপর আবার চিৎকার করে একই কথা ঘোষণা করলো। তারপর সেখান থেকে বড় একটা পাথর গড়িয়ে দিল। পাথরটা গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের পাদদেশে পড়তেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল এবং তার কোন না কোন টুকরো মক্কার প্রত্যেক বাড়ীতে গিয়ে পড়লো।”
আব্বাস বললেন, “এটা গুরুতর স্বপ্ন। তুমি কাউকে এটা বলো না। সম্পূর্ণ গোপন রেখো।”
এরপর আব্বাস বাইরে বেরুতেই তার বন্ধু ওয়ালীদ ইবনে রারিয়ার সাথে তার দেখা হলো। তিনি তাকে স্বপ্ন বৃত্তান্ত জানালেন এবং তাকে সাবধান করে দিলেন যেন কাউকে না বলে। ওয়ালীদ ব্যাপারটা তার পিতা উতবাকে জানালো। এভাবে কথাটা সমগ্র মক্কায় রটে গেল। কুরাইশরা সকল মহফিল ও বৈঠকে এ নিয়ে আলাপ করতে লাগলো।
আব্বাস বলেন, আমি পরদিন কা’বা শরীফ তাওয়াফ করতে গেলাম। আবু জাহ্ল সেখানে কুরাইশ একদল লোকের সাথে আতিকার স্বপ্ন নিয়ে আলাপ করছিলো। আবু জাহ্ল আমাকে দেখেই বললো, “আব্বাস, তাওয়াফ শেষ করে এ দিকে এসো।” তাওয়াফ শেষে আমি তাদের কাছে গিয়ে বসলাম। আবু জাহ্ল আমাকে বললো, “হে আবদুল মুত্তালিবের পুত্র, এই মহিলা- নবী কবে তোমাদেরকে এসব কথা বলেছে?”
আমি বললাম, “কিসের কথা?”
আবু জাহ্ল, “আতিকার দেখা সেই স্বপ্নের কথা।”
আমি বললাম, “সে কী স্বপ্ন দেখেছে?”
আবু জাহ্ল, “হে আবদুল মুত্তালিবের পুত্র, তোমাদের পুরুষরা নবুওয়াতী করতে করতে অবশেষে তোমাদের মহিলারাও দেখছি নবুওয়াতী শুরু করে দিল। আতিকা নাকি স্বপ্নে দেখেছে, কে বলেছে, ‘তিন দিনের মধ্যে তৈরী হয়ে যাও।’ আমরা তোমাদের জন্য তিন দিন অপেক্ষা করবো। যদি কথা সত্য হয় তাহলে তো যা হবার হবে। আর যদি তিন দিন অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও কিছু না ঘটে তাহলে আমরা তোমাদের সম্পর্কে লিখিত ঘোষণা জারী করে দেব যে, আরবে তোমাদের মত মিথ্যাবাদী পরিবার আর নেই।”
আব্বাস বলেন, আবু জাহলের উক্তিতে আমি তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। শুধু অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হলাম। বললাম: আতিকা কোন স্বপ্ন দেখেনি। অতঃপর যার যার কাজে চলে গেলাম। বিকালে আবদুল মুত্তালিব পরিবারের প্রত্যেক মহিলা এক এক করে আমার কাছে এসে বললো, “এই পাটিষ্ঠ খবিসটাকে তোমরা কেন এত সহ্য করছো? সে এতদিন আমাদের পুরুষদের যা ইচ্ছে বলেছে। এখন সে আমাদের নারীদেরকেও যা ইচ্ছে বলতে শুরু করেছে। তুমি এসব শুনছো, অথচ তোমার কোন সম্ভ্রমবোধ জাগছে না।” আমি বললাম, “আল্লাহর কসম আমি ভীষণ বিব্রতবোধ করছি। আমি বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া দেখাইনি। তবে ওকে আমি দেখে নেব। আর একবার বলুক, তখন তোমাদের হয়ে যা করা দরকার, তা আমি করবোই।”
আতিকার স্বপ্নের তৃতীয় দিন পর আমি সেখানে গেলাম। আমি তখন রাগে ও ক্ষোভে ফুঁসছি। ভাবছিলাম, বেটার সাথে যে আচরণ করা দরকার ছিল, ত করতে পারিনি। আবার যদি সুযোগ পাই, তবে যা করতে পারিনি তা এবার করে দেখাবো। আমি মসজিদে প্রবেশ করে সেখানে তাকে দেখতে পেলাম। আমি তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম আর অপেক্ষা করতে লাগলাম যে, সেদিন যেসব কথা বলেছে, তার কিছু অংশের পুনরাবৃত্তি করলেই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বো। আবু জাহল ছিল হালকা পাতলা গড়নের, কিন্তু তার চাহনি ছির তীক্ষè, ভাষা ছিল তীব্র ধারালো। সহসা সে দ্রুত মসজিদের দরজায় দিকে এগিয়ে এলো। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর অভিশাপ হোক ওর ওপর! ওর কী হয়েছে? ওর সমগ্র সত্তা এমন ভীতসন্ত্রস্ত কেন? তবে কি আমার ভর্ৎসনার ভয়ে? সহসা বুঝতে পারলাম, সে দামদাম ইবনে আমর গিফারীর হাঁকডাক শুনেছে যা আমি তখনো শুনিনি। দামদাম মক্কার মরুভূমিতে এসে তার উটের ওপর বসেই চিৎকার করে বলছে, “হে কুরাইশগণ, মহাবিপদ! মহাবিপদ! তোমাদের ধন সম্পদ আবু সুফিয়ানের কাছে। মুহাম্মাদ তার সহচরদেরকে ঔ সম্পদের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। মনে হয় তোমরা তো আর রক্ষা করতে পারবে না। সাহায্য করতে অগ্রসর হও! সাহায্য করতে অগ্রসর হও!” গিফারী চিৎকার করে এ কথা বলার আগেই উটের নাক কেটে, হাওদা উল্টিয়ে দিয়ে এবং নিজের জামা ছিঁড়ে একটা তেলেসমাতি কা- করে ফেলেছে।
এই ভয়াবহ ঘটনার কারণে আমরা কেউ কারো প্রতি মনোযোগী হতে পারলাম না। লোকজন অতি দ্রুত প্রস্তুত হয়ে গেলো। তারা বলতে লাগলো, “মুহাম্মাদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কি মনে করেছে যে, আমরা ইবনুল হাদরামীর কাফিলার মত অসহায়? [৫৫. অর্থাৎ আমর ইবনুল হাদরামী, যাকে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের বাহিনী হত্যা করে। ]কক্ষনো না, এবার তারা অবশ্যই অন্য রকম অভিজ্ঞতা লাভ করবে। সেদিন তারা মাত্র দুইজনের মুকাবিলায় এমন ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছে। তাও এমন ধরনের লোক যে, হয় যুদ্ধের ময়দান থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, নতুবা নিজের জায়গায় অন্যকে পাঠাতে চায়। আর আজ গোটা কুরাইশ গোত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে। কুরাইশদের কোন গণ্য মান্য লোক আজ বাদ পড়েনি। কেবলমাত্র আবু লাহাব বাদ পড়েছে এবং তার জায়গায় আসী ইবনে হিশাম ইবনে মুগীরাকে পাঠিয়েছে।” এই ব্যক্তির নিকট আবু লাহাম চার হাজার দিরহামের পাওনাদর ছিল। সে দারিদ্রের জন্য ঐ ঋণ শোধ করতে পারেনি। সেজন্য এ পাওনা টাকার বিনিময়ে সে তাকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেয় তার স্থলাভিষিক্ত করে।
উমাইয়া ইবনে খালাফও যুদ্ধে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে ছিল স্থূলদেহী রাশভারী এক বৃদ্ধ। উকবা ইবনে আবু মুয়াইত তার কাছে এলো। উমাইয়া তখন মসজিদুল হারামে লোকজনের সাথে বসে ছিল। সে তাকে চন্দন কাঠের তৈরী একটা সুগন্ধি দিয়ে বললো, “নাও, তুমি এটি দিয়ে সুবাসিত হও। কারণ তুমি তো মেয়ে মানুষ।” উমাইয়া বললো, “দূর হ’ এখান থেকে! আল্লাহ তোকে কুৎসিত করে দিক।” লজ্জা পেয়ে বুড়ো উমাইয়া অতঃপর যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল।
প্রস্তুতি নেয়া সম্পন্ন হলো এবং রণাঙ্গনে যাওয়ার জন্য সবাই বদ্ধ পরিকর হলো। তখন তাদের সাতে বনু বাক্র ইবনে আবদ্ মানাতে যে যুদ্ধ হয়েছিল তার কথা মনে করে তাঁরা বললো, “আমাদের আশংকা হয় যে, ওরা পেছন দিক থেকে আমাদের ওপর হামলা করতে পারে।” এ আশংকা তাদেরকে যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত করে তুলছিল। তখন ইবলিস সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জাশআম আল মুদলাজীর আকৃতি ধারণ করে তাদে কাছে হাজির হলো। সে বললো, “আমি তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক থাকছি যেন কিনানা গোত্র তোমাদের ওপর পেছন দিক থেকে আক্রমণ করতে না পারে।” এ আশ্বাস লাভ করার পর তারা দ্রুতবেগে মক্কা ত্যাগ করলো।
ওদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদেরকে সঙ্গে নিয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন। তখন রমযান মাসের কয়েকটা দিন অতিবাহিত হয়েছে। তিনি আমর ইবনে উম্মে মাকতুমকে নামায পড়ানোর দায়িত্বে নিয়োজিত করলেন। মুসআব ইবনে উমাইরের হাতে সাদা পতাকা তুলে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে ছিল দুটো কালো পতাকা। তার একটি ছিল আবু তালিব তনয় আলীর নিকট এবং এটির নাম ছিল ঈগল। অপরটি ছিল জনৈক আনসারের নিকট। ঐদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের কাছে সর্বমোট ৭০ টি উট ছিল। তারা পালাক্রমে ঐগুলোতে আরোহণ করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আলী ইবনে আবু তালিব ও মুরসাদ ইবনে আবু মুরসাদ একটি উটের পিঠে পালাক্রমে আরোহণ করতে লাগলেন। আর হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই ভৃত্য যায়িদ ইবনে হারিসা ও আবু কাবশা আরোহণ করতে লাগলেন আরেকটিতে। আরেকটিতে চড়তে লাগলেন আবু বাক্র, উমার ও আবদুর রহমান ইবনে আউফ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা থেকে মক্কার পথ ধরে চলতে লাগলেন এবং মদীনার বাইরের গিরি প্রবেশপথে পৌঁছিলেন। অতঃপর সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে আকীক, যুল হুলায়ফা, আওলাতুল জায়েশ, তুরবাম, মালাল, মারইনের গামীছূর হাম্মাম, ইয়ামামের কংকরময় ভূমিতে সাইয়ালা, ফাজ্জুর রাওহা এবং সেখান থেকে শানুকায় পৌঁছলেন। সেখান থেকে আরকাজ যারিয়াহ নামক স্থানে পৌঁছলে এক বেদুইনের সাথে দেখা হলো। বেদুইনকে জিজ্ঞেস করলেন সে কোন লোকজন দেখেছে কিনা। কিন্তু তার কাছে কোন খবর পাওয়া গেলো না। সাহাবারা ঐ লোকটাকে বললো, ‘আল্লাহর রাসূলকে সালাম দাও।’ সে বললো, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসুল আছে নাকি?’ সবাই বললো, হ্যাঁ।’ অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, “তুমি যদি আল্লাহর রাসূল হয়ে থাকে তাহলে বলতো আমার এই উষ্ট্রীর পেটে কি আছে?” সালামা ইবেন সুলামা ইবনে ওয়াকশ তাকে বললো, “তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করো না। আমার কাছে এসো, আমি বলছি ওর পেটে কি আছে। তুমি ঐ উষ্ট্রীটার সাথে সঙ্গম করেছিলে। তাই ওর পেটে তোমার ঔরসের একটা ছাগলের বাচ্চা রয়েছে।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে সঙ্গে সালামাকে ধমক দিয়ে বললেন, “চুপ কর। লোকটার সাথে তুমি অশ্লীল কথা বলছো?” অতঃপর অন্যদিকে মনোযোগ দিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাওহার ‘সাজসাজ্’ নামক কূপের নিকট গিয়ে যাত্রাবিরতি করলেন। সেখান থেকে আবার রওয়ানা হলেন। কিছুদূর গিয়ে মক্কার পথ ত্যাগ করে ডান দিকের পথ ধরে নাজিয়া অভিমুখে যাত্রা করলেন। তাঁর গন্তব্যন্থল ছিল বদর। বদরের নিকটবর্তী একটি জায়গায় পৌঁছে তিনি রুহকান নামক একটি উপত্যাকা পাড়ি দিলেন। এই উপত্যকাটি নাজিরা ও সাফরা গিরিপথের মধ্যস্থলে অবস্থিত। সেখান থেকে তিনি গিরিপথে গিয়ে উপনীত হলেন। অতঃপর সেখান থেকে নেমে সাফরার নিকট পৌঁছলেন। এখানে পৌঁছে তিনি বাসবাস ইবনে আমর জুহানী ও আদী ইবনে আবু জাগবা জাহানীকে বদর এলাকায় পাঠালেন আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও অন্যদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার জন্য। ঐ দু’জনকে আগে পাঠিয়ে দেয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর অভিমুখে রওয়ানা হলেন।
পথিমধ্যেই তিনি জানতে পারলেন ও, কুরাইশরা তাদের বাণিজ্য কাফিলাকে রক্ষা করার জন্য সদলবলে মক্কা থেকে যাত্রা করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ খবর সাহাবাদের জানালেন এবং এ মুহূর্তে তাদের কি করা উচিত সে সম্পর্কে সকলের সাথে পরামর্শ করলেন। সর্বপ্রথম আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) উঠে দাঁড়ালেন ও তাঁর মতামাত অতি চমৎকারভাকে ব্যক্ত করলেন। এরপর মিকদাদ ইবনে আমর দাঁড়িয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ আপনাকে যেদিকে বলতে বলেছেন সেদিকে এগিয়ে চলুন। আল্লাহর কসম, বনী ইসরাঈল যেমন মুসাকে (আ) বলেছে, ‘তুমি আর তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর, আমরা এখানে বসে রইলাম’Ñ আমরা সে রকম কথা আপনাকে বলবো না। আমরা বলছি, আপনি ও আপনার রব গিয়ে লড়াই করুন, আমরাও আপনার ও আপনার রবের সহযোগী হয়ে লড়াইতে শরীক আছি। সেই মহান সত্তার শপথ যিনি আপনাকে সত্য বিধান দিয়ে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সুদূর ইয়ামানের বারকুল গিমাদেও যান, তাহলেও আমরা আপনার সঙ্গী হয়ে সেখানে যাবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিকদাদকে ধন্যবাদ দিলেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করলেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের সম্বোধন করলেন, “তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও।” আনসারদের এত গুরুত্বদানের কারণ ছিল এই যে, তারা ছিল মুসলমানদের সহায়। তারা যখন আকাবাতে বাইয়াত করেছিলো তখন বলেছিলো, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি যত দিন আমাদের আবাসভূমিতে না যাবেন ততদিন আমরা আপনার দায়িত্ব নিতে অপরাগ। যখন আপনি আমাদের কাছে যাবেন তখন আমাদের দায়িত্বে থাকবেন। আমরা আমাদের ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীদেরকে যেভাবে সব রকমের বিপদ থেকে রক্ষা করি ঠিক সেইভাবে আপনাকে রক্ষা করবো।” এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশংকা করেছিলেন যে, আনসাররা হয়তো মনে করতে পারে যে, মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলেই কেবল তাদের ওপর তাঁর সাহায্য করার ও তাঁকে রক্ষা করার দায়িত্ব বর্তায়। আনসাররা এরূপ ভেবে থাকতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে তাদের আবাসভূমির বাইরে কোন শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে যেতে চাইলে তাঁর সাথে যাওয়া তাদের দায়িত্ব নয়। তাই তিনি যখন আনসারদেরকে সম্বোধান করলেন তখন সা’দ ইবনে মুয়ায বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি বোধ হয় আমাদের মতামত জানতে চাচ্ছেন।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ।” সা’দ বললেন, “আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি যে বিধান নিয়ে এসেছেন তা পরম সত্য। আর এই প্রত্যয়ের ভিতরেই আমরা আপনার কাছে অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে, আমরা আপনার নির্দেশ মানবো ও আনুগত্য করবো। হে আল্লাহর রাসূল, তাই আপনি যা ভাল মনে করেন, করুন। আমরা আপনার সাথে আছি। সেই আল্লাহর শপথ যিনি আপনাকে মহাসত্য দিয়ে পাঠিয়েছেন, সামনের এই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আপনি যদি তার অথৈ পানিতে নামেন, আমরাও আপনার সাথে নামবো। আমাদের একটি লোকও আপনাকে ছেড়ে পেছনে থাকবে না। আগামীকাল যদি আপনি আমাদের সাতে নিয়ে শত্রুর মুখোমুখি হতে চান, ততেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমরা যুদ্ধে ধৈর্যশীল এবং শত্রুর মুকাবিলায় সংকল্পে অবিচল। আশা করি, আল্লাহ আপনাকে আমাদের এমন তৎপরতা দেখবার সুযোগ দেবেন, যাতে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। আল্লাহর রহমতের ওপর নির্ভর করে আমাদের নিয়ে আপনি এগিয়ে চলুন।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দের বক্তব্য শুনে খুশী হলেন এবং খুবই উৎসাহিত বোধ করলেন। অতঃপর বরলেন, “তোমরা বেরিয়ে পড়। আল্লাহ আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, দুই কাফিলার যে কোন একটি আমাদের হাতে পরাভূত হবো।[ ৫৬.একটি হলো আবু সুফিয়ান ও আমর ইবনুর আ’স সহ বাণিজ্যিক কাফিলা, অপরটি আবু জাহলের নেতৃত্বে আগত সমর সজ্জায় সজ্জিত সুবিশাল বাহিনী।] আল্লাহর কসম, আমি যেন এখনই কুরাইশদের শোচনীয় মৃত্যু ঘটতে দেখছি।”
অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর প্রান্তরের কাছাকাছি গিয়ে তাঁবু স্থাপন করলেন। তারপর তিনি নিজে আর একজন সাহাবাকে [৫৭. ইনি আবু বাক্র সিদ্দীক রাদিয়ল্লাহু আনহু।]নিয়ে টহল দিতে বেরুলেন। কিছুদূর গিয়ে জনৈক বৃদ্দ আরবের সাক্ষাত পেলেন। তিনি কুরাইশদের কথা কিছু জানেন কিনা এবং মাহাম্মাদ ও তাঁর সহচরদের সম্পর্কে কোন খবর শুনেছেন কিনা জিজ্ঞেস করলেন। বৃদ্ধ বললেন, “তোমরা কারা বল, তা না হলে বলবো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমরা যা জানতে চেয়েছি, সেটা আগে বল। তারপর আমরা আমাদের পরিচয় দেবো।” বৃদ্ধ বললেন, “শুনেছি, মুহাম্মাদ ও তাঁর সহচরগণ অমুক দিন যাত্র শুরু করেছেন। এটা যদি সত্য হয় তাহলে তার এখন অমুক জায়গায় থাকার কথা। আর কুরাইশদের সম্পর্কে শুনেছি, তারা অমুক দিন রওয়ানা দিয়েছে। এটা যদি সত্য হয় তাহলে তার আজ অমুক জায়গায় এসে পৌঁছার কথা।” উভয় দল সত্যি যেখানে উপস্থিত হয়েছে, বৃদ্ধ সেই স্থানের কথাই বললেন। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কোথা থেকে এসেছো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “পানি থেকে। ”বৃদ্ধ বললেন, “পানি থেকে’ অর্থ কি?” ইরাকের পানি থেকে নাকি?
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের কছে এলেন রাত্রে তিনি আলী ইবনে আবু তালিব, যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস সহ একদল সাহাবীকে কুরাইশদের খোঁজ খবর নিতে বদর প্রান্তরের পার্শ্ববর্তী জলাশয়ে পাঠালেন। সেখানে তাঁরা কুরাইশদের এক পাল পানি পানরত উট দেখতে পেলেন এবং তার মধ্যে বনু হাজ্জাজ গোত্রের ভৃত্য আসলাম ও বনু আস ইবনে সাঈদের ভৃত্য আরীদ আবু ইয়াসারের সাক্ষাত পেলেন। তাঁরা ঐ ভৃত্যদ্বয়কে সাথে নিয়ে এলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়ছিলেন। তাদেরকে জিজ্ঞস করা হলো, “তোমরা কারা?” তারা বললো, “আমরা কুরাইশদের পানি বহনকারী। তাদের জন্য খাবার পানি নিতে আমাদেররকে পাঠিয়েছে।” মুসলমানগণ তাদের কথা বিশ্বাস করলেন না। তাদের ধারণা ছিল, ওরা আবু সুফিয়ানের লোক। অতঃপর তাদেরকে প্রহার করা হলো পিটুনীর চোটে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে, তারা আবু সুফিয়ানের লোক। অতঃপর মুসলমানগণ তাদেরকে ছেড়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষ করে বললেন, “ওরা যখন সত্য বললো তখন তখন ওদের তোমরা প্রহার করলে। আর যখন মিথ্যা বললো তখন ছেড়ে দিলে। এটা তোমাদের কেমন কাজ? ওরা ঠিকই বরেছে। ওরা কুরাইশদের লোক। তোমরা আমাকে কুরাইশদের খবর বল।” তারা বললো,“আল্লাহর কসম, ঐ দূর প্রন্তরে বালুর টিলাটা দেখছেন, ওর অপর পার্শ্বেই তারা রয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, “ওরা সংখ্যায় কত?” আসলাম ও আরীদ বললো, “জানি না।” তিনি বললেন, “প্রতিদিন কয়টা জন্তু জবাই করে?” তারা বললো, “কোন দিন দশটা, কোন দিন নয়টা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাহলে ওদের সংখ্যা নয়শো থেকে হাজারের মধ্যে হবে।”অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, “কুরাইশ নেতাদের মধ্যে কে কে এসেছে?” তারা বললো, ‘উতবা ইবনে রাবীআ, শাইবা ইবনে রাবীআ, আবুল বুখতারী ইবনে হিশাম, হাকিম ইবনে হিযাম, নওফেল ইবনে খুয়াইলিদ, হারেস ইবনে আমের ইবনে নওফেল, তুয়াইমা ইবনে আদী ইবনে নওফেল, নাদার ইবনে হারেস যাম’আ ইবনে আসওয়াদ, আবু জাহেল ইবনে হিশাম, উমাইয়া ইবনে খালাফ, হুজাজের দুই পুত্র নাবীহ ও মুনাব্বিহ, সুহাইল ইবনে আমর এবং আমর ইবনে আব্দ উদ্।” এ বিবরণ নেয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের সামনে গিয়ে বললেন, “মক্কা তোমাদের নিকট তার কলিজার টুকরাগুলোকে পাঠিয়ে দিয়েছে।”
ইতি পূর্বে বাসকাস ইবনে আমর ও আদী ইবনে আবু যাগবা টহল দিতে দিতে বদর প্রান্তরে এসে থামে। তারা জলাশয়ের নিকটবর্তী একটা পাহাড়ের কাছে গিয়ে উট থেকে নামলো এবং একটা মশকে পানি ভরে নিল। মুজদী ইবনে আমর জুহানী তখন জলাশয়োর কিনারে ছিল। জলাশয়ের কাছে আগত লোকদের মধ্যে দুটি বাঁদী ছিল। তাদের একজন অপরজনের কাছে তার প্রাপ্য পরিশোধ করার দাবী জানাতে লাগলো ঋনগ্রস্ত বাঁদীটি বললো,“কাফিলা কাল অথবা পরশুদিনই আসছে। তখন আমি কাফিলার কাজ করে তোমার পাওনা পরিশোধ করে দেবো।” মুজদী বরলো, “তুমি ঠিকই বলেছো।” অতঃপর সে উভয়ের মধ্যে আপোষ করিয়ে দিল। আদী ও বাসবাস একই কথোপকথন শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে গেল এবং যা শুনেছে তা তাঁকে জানালো। আবু সুফিয়ান ইবনে হারব সাবধানতা অবলম্বনের জন্য কাফিলাকে পেছনে রেখে আগে আগে এলো। সে জলাশয়ের কাছে গিয়ে মুজদী ইবনে আমরকে জিজ্ঞেস করলো, “কারো আনাগোনা টের পেয়েছো নাকি?” সে বললো, “সন্দেহজনক কাউকে দেখিনে। কেবল দুজন উট সওয়ারকে দেখলাম এই পাহাড়টার কাছে এসে উট থেকে নামলো। তারপর মশকে পানি ভরে চলে গেল।” আবু সুফিয়ান সেই জায়গায় উপস্থিত হলো যেখানে বাসবাস ও আদী উট থেকে নেমেছিলো। সেখানে তাদের উটদ্বয়ের খানিকটা গোবর পেয়ে তা তুলে নিল এবং সেটা ভেঙে ছিন্ন ভিন্ন করলো। তার ভেতর সে কতকগুলো আঁটি পেল। এ আঁটি দেখে সে বললো, “আল্লাহর কসম, এটা ইয়সরিবের পশুখাদ্য।” সে দ্রুত বেগে তার কাফিলার কাছে ছুটে গেল। কাফিলাকে সে ভিন্ন পথে চালিত করে বদর প্রান্তর বামেরেখে সমুদ্র কিনারে পথ ধরে দ্রুত চলে গেল।
আবু সুফিয়ান যখন নিশ্চিন্ত হলো যে, তার কাফিলাকে সে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে, তখন সে কুরাইশবাহিনীর কাছে এই মর্মে বার্তা পাঠালো, “তোমরা তোমাদের বাণিজ্যিক কাফিলা, তোমাদের লোকজন ও ধন সম্পদকে রক্ষা করার জন্য এসেছো। আল্লাহ ওগুলোকে রক্ষা করেছেন। অতএব তোমরা মক্কায় ফিরে যাও।” জবাবে আবু জাহর বললো, “বদরের মেলা পর্যন্ত না গিয়ে আমরা কিছুতেই ফিরবো না। এখানে তিন দিন থাকবো, পশু জবাই করে ধুমধাম করে খাবারের আয়োজন করবো, মদ খাবো, গায়িাকারা বাদ্য বাজিয়ে গান গাইবে, আরবদেরকে আমাদের অভিযানের কথা ও বাহিনী গড়ে তোলার কাহিনী শোনাবো। এভাবে তাদের মনে আমাদের ভীতি চিরকালের জন্য বদ্দমূল হয়ে যাবে। অতএব মেলায় চলো।” উল্লেখ্য যে, বদরের প্রান্তরে প্রতি বছর একটি মেলা বসতো এবং তা ছিল আরবের নামকরা মেলা।
আতঃপর কুরাইশরা তাদের আয়োজন ও প্রস্তুতি অব্যাহত রাখলো। তারা বদর প্রান্তুরের অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী মরুময় টিলার অপর পার্শ্বে গিয়ে তাঁবু ফেললো। আল্লাহ প্রবল বৃষ্টি লামালেন। প্রান্তরের মাটি তেমন উষর ছিল না, খানিকটা রসালো ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ এতটা বৃষ্টি পেলেন যে,তাঁদের অবস্থানস্তলের মাটি ভিজে গেল। কিন্তু চলাচলে কোন অসুবিধার সৃষ্টি করলোনা। পক্ষান্তুরে কুরাইশদের অবস্থানস্থলের মাটি এত বেশী স্যাঁত সেতে হয়ে গেল যে, তাদের চলাচল অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে আরো বেশী পানি জমা হয়েছে এমন জায়গায় সরিয়ে নিলেন।
হুবাব ইবনে মুনযির বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এই জায়গাটা কি আপনি আল্রাহর নির্দেশক্রমেই বাছাই করেছেন যার থেকে আমরা একটুও এদিক ওদিক করতে পারি না? অথবা এটা কি আপানার নিজের রণকৌশলগত অভিমত?” তিনি বললেন, “এটা নেহায়েত একটা রণকৌশল এবং আমার নিজস্ব অভিমত।” হুবাব বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এ জায়গাটা বাছাই করা ঠিক হয়নি। অতএব সবাইকে নিয়ে এখান থেকে সরে পড়ুন। যেখানে অপেক্ষঅকৃত কম পানি আছে সেখানে তাঁবু ফেলুন। অতঃপর আমরা সেই জায়গার আশে পাশে যে কূপ আছে তা বন্ধ করে দেবো। তার ওপর চৌবাচ্চা তৈরী করে সেটা পানি দিয়ে ভরে রাখবো। অতঃপর শত্রু পক্ষের সাথে লড়াই করবো। ফলে আমরা পর্যাপ্ত খাবার পানি পাবো। কিন্তু ওরা পাবে না। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি ঠিক বলেছো।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে নিয়ে উঠলেন। সামান্য পানি জমা স্থানে এসে তাবু ফেললেন। অতঃপর পানির কূপ বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং তাই করা হলো। অতঃপর কূপের ওপর একটা চৌবাচ্চা তৈরী করে তাতে পানি ভরে রাখা হলো।এবং তাতে পানির পাত্র ফেলে রাখা হলো।
সা’দ ইবনে মু’আয বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদেরকে অনুমতি দিন, আমরা আপনার জন্য একটা সুরক্ষিত মঞ্চ তৈরী করি, আপনি তার ভেতরে থাকবেন এবং আমরা হবো আপনার বহনকারী। অতঃপর শত্রুর মুকাবিলায় যাবো। আল্লাহ যদি আমাদেরকে বিজয়ী করেন তাহলে আমাদের আশা পূর্ণ হবে। আর যদি তা না হয় তাহলে আপনাকে আমরা বহন করে নিয়ে যাবো। আপনি অন্যান্য মুসলমানের সাথে মিলিত হবেন। হে আল্লাহর নবী, বিপুল সংখ্যক মুসলমান আপনার সাথে শুধু এই জন্য আসতে পারেনি যে, আপনি যুদ্ধে যাবেন তা তারা জানে না। তারা আপনাকে আমাদের চেয়ে কম ভালবাসে না। তারা যদি জানতো যে, আপনি যুদ্ধে যাচ্ছেন তাহলে তারা যুদ্ধে না এসে ক্ষান্ত হতো না। তাদের দিয়ে আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করতেন এবং তারা আপনার হিতাকাক্সক্ষী হতো এবং আপনার সহযোগী হয়ে লড়াই করতো।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দের কথা শুনে খুশী হলেন, তাঁর প্রশংসা করলেন এবং তাঁর কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য একটা সুরক্ষিত মঞ্চ তৈরী করা হলো এবং তিনি তার মধ্যে অবস্থান করতে লাগলেন।
সকাল বেলা কুরাইশরা বালুর টিলা দিয়ে বেরিয়ে এলো। তাদেরকে নামতে দেখেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ, এই সেই কুরাইশ যারা গর্ব ও অহংকারের সাথে আপনার সাথে বিদ্রোহ ও আপনার রাসূলকে অস্বীকার করে আজ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। হে আল্লাহ, আপনি যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আমাকে দিয়েছেন তাঁর সময় সমুপস্থিত। হে আল্লাহ, ওদেরকে আজ সকালেই ধ্বংস করে দিন। ”
সবাই যখন ময়দানে নামলো তখন কুরাইশদের একটি দল সামনে অগ্রসর হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তৈরী করা চৌবাচ্চায় এসে উপনীত হলো। এই দলের মধ্যে হাকীম ইবনে হিযামও ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে বললেন, “ওদেরকে বাধা দিও না।” বস্তুতঃ ঐ চৌবাচ্চা থেকে যে যে পানি খেয়েছে, সে ঐ দিন নিহত হয়েছে। একমাত্র হাকীম ইবনে হিযাম এর ব্যতিক্রম সে নিহত হয়নি। পরে সে ইসলাম গ্রহণ করে এবং ভালো মুসলমানে পরিণত হয়। এই ঘটনাকে সে আজীবন স্মরণ রেখেছিল। এমনকি কখনো দৃঢ়ভাবে কসম করতে হলে বলতো, “সেই মহান সত্তার কসম যিনি আমাকে বদর যুদ্ধের দিন রক্ষা করেছেন।”
মুসলমানগণ শান্ত ও স্থির হলে কুরাইশরা ইমাইর ইবনে ওয়াহাব জুমাহীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য পাঠালো। সে যোড়ায় চড়ে বাহিনীর চারপাশ দিয়ে একট চক্কর দিয়ে ফিরে গিয়ে বললো, “তিনশোর সামান্য কিছু বোশী বা কম হতে পারে। তবে আমাকে আর একটু সময় দাও দেখে আসি ওদের কোন গুপ্ত ঘাঁটি বা সাহায্যকারী আছে কিনা।” অতঃপর সে সমস্ত প্রান্তর ঘুরলো, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। অতঃপর ফিরে গিয়ে বললো, “কোন কিছুই সন্ধান পেলাম না। তবে তাদের হাবভাব দেখে মনে হয়, তারা মরণপণ করে এসেছে। ইয়াসরিবের উষ্ট্রীগুলো সুনিশ্চিত মৃত্যু বহন করে এনেছে। ওরা এমন একটা দল তরবারীই যাদের একমাত্র সহায় ও রক্ষক। আল্লাহর কসম, আমি নিশ্চিত যে, ওদের একজন নিহত হলে তার বদলায় তোমাদের একজন নিহত হবে। তারা কুরাইশদের মধ্য থেকে যখন তাদের সমসংখ্যক মানুষ হত্যা করবে, তখন আর তা আমাদের জন্য সুখবর হবে না। অতএব তোমরা এখনো ভেবে দেখো।”
হাকীমইবনে হিযাম এ কথা শুনে কুরাইশ বাহিনীর লোকদের কাছে গেল। প্রথমে সে উতবা ইবনে রাবীআকে গিয়ে বললো, “হে ওয়ালীদের পিতা, আপনি কুরাইশদের একজন প্রবীণ নেতা। আপনার কথা সবাই মানে। আপনি কি এমন একটা কাজ করতে প্রস্তুত যা করলে অনন্তকাল ধরে আপনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন?” সে বললো, “হাকীম, তুমি কি বরতে চাচ্ছো?” হাকীম বললো, “আপনি কুরাইশবাহিনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যান এবং আপনার মিত্র ‘আমর ইবনে হাদরামীর হত্যাকা-ের ব্যাপারটা মিটিয়ে দেবার দায়িত্ব নিন।” উতবা বললো, “তা আমি করতে রাজী। সে ব্যাপারে আমি তোমার কথা রাখবো। হাদরামী আমার মিত্র এবঙ তার রক্তপণ ও আর্থিক ক্ষতি পূরণ করে দিতে আমি প্রস্তুত। তুমি আবু জাহলের কাছে যাও। আমি মনে করি, কুরাইশদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার প্রশ্নে সে ছাড়া আর কেউ বিরোধিতা করবে না।” অতঃপর উতবা ইবনে রাবীআ দাঁড়িয়ে কুরাইশদের উদ্দেশ্যে বললো, “হে কুরাইশগণ, মুহাম্মাদ ও তার সহযোগীদের সাথে লড়াই করে আমাদের কোন লাভ হবে না। বস্তুতঃ আজ যদি আমরা তাকে হত্যা করতে সক্ষম হইম তা হলেও আমাদের ভেতের কখনো সদ্ভাব জন্মাবে না। একজন আর একজনের মুখ দেখা পছন্দ করবে না। কেননা সে তার চাচাতো ভাই, খালাতো ভাই কিংবা কোন আত্মীয়ের হত্যাকারী বল চিহ্নিত হবে অতএব, বলো আমরা ফিরে যাই এবং মুহাম্মাদ ও তার অনুচরদের পথ থেকে সরে দাঁড়াই। তাদের ব্যাপারটা আরববাসীর উপর অর্পণ করি। সমগ্র আরববাসী মিলে যদি তাকে হত্যা করে তাহলে তো আমাদের উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হবে। আর যদি তা না করে তাহলে মুহাম্মাদের কাছে আমরা অন্ততঃ নির্দোষ থাকবো।”
হাকীম বলেন, অতঃপর আমি আবু জাহলের কাছে গেলাম, দেখলাম, সে তার যুদ্ধের সাজ সরঞ্জামে শাণ দিচ্ছে। আমি তাকে বললাম, “হে আবুল হিকাম, উতবা আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছে।” অতঃপর উতবা যা বলেছে তা তাকে জানালাম। সে সঙ্গে বললো, “উতবার মাথা বিগড়ে গেছে। নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ তাকে যাদু করেছে। এটা কখ্খনো সম্ভব নয়। আল্লাহ আমাদের ও মাহাম্মাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত আমরা ফিরবো না। উতবা যা বলেছে তা তার মনের কথা নয়। যেহেতু মাহাম্মাদ ও তার অনুচররা সংখ্যায় খুবই নগন্য এবং তাদের ভেতরে তার ছেলেও রয়েছে, যুদ্ধ হলে তার ছেলের জীবন বিপন্ন হবে তা ভেবে সে একথা বলেছে।” অতঃপর সে নিহত আমর ইবনে হাদরামীর ভাই আমের ইবনে হাদরামীর কাছে এই মর্মে খবর পাঠালো যে, “তোমার মিত্র ইতবা কুরাইশদেরকে ফেরত নিয়ে যেতে চায়। অথচ তুমি তোমার প্রতিশোধের সুযোগ নিজের চোখে নাগালের মধ্যে দেখতে পাচ্ছো। সুতরায় তুমি কুরাইশদের তোমার ভাই- এর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে তাদের প্রতিশ্রুতি পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দাও। ” ‘আমের ইবনে হাদরামী উঠে দাঁড়ালো এবং বুকের কাপড় খুলে ‘হায় আমর! হায় আমর!!’ বলে চিৎকার করে মাতম করতে থাকলো। সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। কুরাইশরা রণোন্মাদ হয়ে উঠলো। উতবা যে শুভ উদ্যোগ নিয়েছিল, আমের তা এক নিমিষে নস্যাৎ করে দিল।
আসওয়াদ ইবনে আবদুল আসাদ মাখযুমী ছিল কুরাইশদের মধ্যে চরম অসৎ ওগুা স্বভাবের লোক। সে তার ঘৃণ্য তৎপরতা শুরু করে দিল। সে ঘোষণা করল। “মুসলমানদের জলাধার থেকে আমি পানি পান করবো। কিংবা তা ভেঙ্গে ফেলবো। এম যদি আমার মৃত্যুও ঘটে, পরোয়া করি না। ” এই বলে সে ময়দানে নামলে হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব তার মুখোমুখি হলেন। দুইজনের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ চলাকালে হামযা আসওয়াদের পায়ে তরবারীর আঘাত করলেন। তার পা কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এ সময় সে চৌবাচ্চার কাছেই ছিল। সে চিৎ হয়ে পড়ে গেল এবং তার পা থেকে ফিনকি দিযে রক্ত ছুটতে লাগলো।সে পুনরায় হামাগুড়ি দিয়ে চৌবাচ্চার দিকে এগুলো এবং নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে চৌবাচ্চার সীমানার ভেতরে ঢুকে পড়লো। হামযা তার পিছু ধেয়ে গেলেন এবং চৌবাচ্চার সীমানার ভেতরেই তাকে হত্যা করলেন।
এরপর ময়দানে অবতীর্ণ হলো উতবা ইবন রাবীআ। তার ভাই শাইবা ও ছেলে ওয়ালীদ তার সঙ্গে এলো। কুরাইশদের ব্যুহ ছেড়ে সামনে গিয়ে সে হুংকার দিয়ে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান জানালে আনসারদের মধ্য হতে তিন যুবক আউফ ও মুয়াওয়েব ইবন হারেস (দুই ভাই) এবং আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা তার মুকাবিলায় এগিয়ে গেলেন। কুরাইশরা বললো “তোমরা কারা?” তাঁরা বললেন, “আমরা আনসার।” তারা বললো, “তোমাদের দিয়ে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই।” অতঃপর একজন চিৎকার করে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে যারা আমাদে সমকক্ষ, তাদেরকে পাঠাও।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উবাইদা ইবনে হারেস হামযা ও আলীকে পাঠালেন। তাঁরা গিয়ে নিজ নিজ পরিচয় দিলে প্রতিপক্ষ খুশী হয়ে বললো, “ঠিক আছে। এবার মর্যদাসম্পন্ন প্রতিপক্ষ পাওয়া গেছে।” মুসলিম বাহিনীর সবকনিষ্ঠ মুজাহিদ উতবা ইবনে রাবীআর বিরুদ্ধে, হামযা শাইবার বিরুদ্ধে এবং আলী ওয়ালীদ ইবনে উতবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। হামযা শাইবাকে এবং আলী ওয়লীদকে পাল্টা আঘাত হানার সুযোগও দিলেন না। প্রথম আঘাতেই সাবাড় করে দিলেন। আর উবাইদা ও উতবা উভয়ে একটি করে আঘাত বিনিময় করলো এবং উভয়ে গুরুতরভাবে আহত হলো। হামযা ও আলী (রা) দ্রুত ছুটে দিয়ে নিজ নিজ তরবারী দিয়ে উতবাকে খতম করে দিলেন। অতঃপর তারা উবাইদাকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে পৌঁছিয়ে দিলেন।
এরপর উভয় পক্ষ একযোগে পরস্পরের দিকে এগিয়ে গেল এবং পরস্পরের কাছাকাছি হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহবাদেরকে বলে দিলেন, তিনি নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তারা যেন হামলা না করে। তিনি বললেন, “কুরাইশরা তোমাদের ঘেরাও করে ফেললে তীর নিক্ষেপ করে তাদেরকে হটিয়ে দিও।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সময় মুসলিম বাহিনীকে সারিবদ্ধ করে আবু বাক্র সিদ্দীকসহ তাঁর মঞ্চসদৃশ স্থানে অবস্থান করতে লাগলেন। সেখানে আর কেউ ছিল না। তিনি আল্লাহর কাছে তাঁর প্রতিশ্রুতি সাহায্য প্রেরণের জন্য দোয়া করতে লাগলেন। তিনি বলতে লাগলেন, “হে আল্লাহ, এই মুষ্টিমেয় মুসলমান যদি আজ ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে আপনার ইবাদত করার জন্য কেউ থাকবে না।” আবু বাক্র(রা) বরতে লাগলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। আল্লাহ আপনাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা অবশ্যই পালন করবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সময় নিজ মঞ্চের ভেতরে কিছুক্ষণের জন্য তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়রেন। অতঃপর সাহায্য এসে গেছে। এই দেখোনা জিবরীল একটি ঘোড়ার লাগাম ধরে হাঁকিয়ে আসছেন। তাঁর পোশাকের ভাঁজে ভাঁজে ধূলোর আস্তরণ জমে গেছে।” পরক্ষণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেরিয়ে রণাঙ্গনে গেলেন এবং মুজাহিদগণকে এই বলে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করলেন, “সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, আজ যে ব্যক্তি কাফিরদের সাতে ধৈর্য ও নিষ্ঠা সহকারে যুদ্ধ করবে এবং শুধু সামনের দিকে এগুতে থাকবে, কোন অবস্থায় পিছু হটবে না, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।” বনু সালামা গোত্রের উমাইর ইবন হুমাম (রা) হাতে কয়েকটি খোরমা নিয়ে খাচ্ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনেই বললেন, “বাহ! আমার তাহলে জান্নাতে যাওয়ার পথে শাহাদাত লাভ করা ছাড়া তো আর কোন বাধাই নেই দেখছি।” একথা বলেই তিনি হাতের খোরমাগুলো ছুড়ে ফেলে দিলেন এবং তরবারী নিয়ে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। কিছুক্ষণ পরেই তিনি শাহাদাত বরণ করলেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুষ্টি ধুলি হাতে নিয়ে কুরাইশদের দিকে এগিয়ে গেলেন। অতঃপর এই বলে ফুঁ দিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দিলেন, “ওদের মুখ বিকৃত হয়ে যাক।” অতঃপর সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেন, “জোর হামলা চালাও।” অল্পক্ষণের মধ্যেই কুরাইশদের চরম পরাজয় ঘটলো। কুরাইশদের বড় বড় নেতাদের অনেকেই নিহত ও বন্দী হলো।
ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন সাহাবীদেরকে বলেছিলেন, “আমি জানতে পেরেছি যে,বনু হাশিমের কিছু সংখ্যক লোককে জোর জবরদস্তি করে যুদ্ধে নিয়ে আসা হয়েছে। আমাদের সাথে যুদ্ধ করার কোন প্রয়োজন তারা অনুভব করে না। কাজেই বনু হাশিমের কেউ তোমাদের সামনে পড়লে তাকে হত্যা করো না। আবুল বুখতারী ইবনে হিশাম কারো সামনে পড়লে তাকে হত্যা করো না। কেননা তাকেও জবরদস্তিমূলকভাবে টেনে আনা হয়েছে।” মুসলিম বাহিনীর জনৈক আবু হুযাইফা বললেন, “আমরা আমাদের বাপ-ভাই-পুত্র ও আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করবো, আর আব্বাসকে কেন ছাড়বো? আমার সামনে পড়লে আমি তাকে তরবারী দিয়ে আঘাত করবোই।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ কথা শুনলেন তখন উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) ডেকে বললেন, “হে উমার, আল্লাহর রাসূলের চাচার মুখে কি তরবারী দিয়ে আঘাত করা যায়।” উমার বললেন “ইয়া রাসূলুল্লাহ, অনুমতি দিন আমি তরবারী দিয়ে ওর ঘাড়টা কেটে ফেলি। আমি নিশ্চিত যে, আবু হুযাইফা মুনাফিক হয়ে গেছে।” পরবর্তীকালে আব হুযাইফা বলতেন, “বদর যুদ্ধের দিন আমার ঐ কথাটা বলা আমাকে শংকিত করে তুলেছে। শাহাদাত লাভের দ্বারা এর কাফফারা না হওয়া পর্যন্ত আমার এ শংকা দূর হবে না।” পরে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
মুসলমানদের অনেক দুর্যোগের দিনে ফেরেশতারা সাহায্য করেছেন। কিন্তু নিহতদের ভেতরে আবু জাহলের লাশ আছে কিনা খুঁজে দেখার নির্দেশ দিলেন। ইবনে মাসউদ বলেন, আমি তার মস্তক ছিন্ন করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে গেলাম। বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, এটা আল্লাহর দুশমন আবু জাহলেন মাথা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সত্যি কি তাই?” আমি বললাম, “আল্লাহর কসম, সত্যি।” ইবনে মাসউদ বলেন, আবু জাহলকে হত্যা করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিজ্ঞা ছিল। আমি অতঃপর তার মাথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে রাখলাম। তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ নেতৃবৃন্দের লাশ কুয়ার মধ্যে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিলেন। উমাইয়া ইবনে খালাফ ছাড়া আর সবার লাশ নিক্ষেপ করা হলো। উমাইয়ার লাশ তার সামরিক পোশাকের মধ্যে ফুলে সেঁটে গিয়েছিল। সাহাবীগণ তাকে পেশাক থেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলে তার গোশত ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে তাঁরা তাকে যেমন ছিল তেমনভাবেই রেখে মাটি ও পাথর চাপা দিলেন। কুয়ার ভিতর নিক্ষেপ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে দাঁড়ালেন। তখন মধ্যরাত। সাহাবীগণ শুনতে পেলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একে একে কুয়ায় নিক্ষিপ্ত সকলের নাম নিয়ে সম্বোধন করে বললেন, “হে কুয়ার অধিবাসী, হে উতবা, শাইবা, উমাইয়া ও আবু জাহল! আল্লাহ তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা যথাযথভাবে পেয়েছো? আমি তো আমার রবের প্রতিশ্রুতি বাস্তবরূপে পেয়েছি।” মুসলমানগণ বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, যারা মরে পচে গিয়েছে তাদেরকে আপনি সম্বোধন করছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমার কথা তোমরা যেমন শুনতে পাও তারাও তেমনি শুনতে পাচ্ছে। সাড়া দিতে পারছে না।”
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীর কাছে যে গণিমতের মার (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) রয়েছে, তা একত্রিত করার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণ তা নিয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হলেন। যারা ঐ সম্পদ সংগ্রহ করেছেন তারা বললেন, “এ সম্পদ আমাদের পাওনা।” যারা শত্রুর সাথে যুদ্ধ করেছিরেন তাঁরা বললেন, “এ সম্পদ আমাদের পাওনা, কেননা আমরা যদি যুদ্ধ না করতাম তাহলে তোমরা এগুলো সংগ্রহ করার সুযোগ পেতে না, কুরাইশদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় আমরা তোমাদের সাথে গণিমত সংগ্রহের কাজে যোগ দিতে পারিনি, ফলে তোমরা এগুলো সংগ্রহ করতে পেরেছো।” শত্রুরা ভিন্ন পথ দিযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আক্রমন চালাতে পারে এই আশংকায় যারা তাঁর পাহারায় নিয়োজিত ছিলেন তাঁরা বললেন, “আল্লাহর কসম, তোমরা আমাদের চেয়ে বেশি হকদার নও, শত্রুকে আমরাও বাগে পেয়েছিলাম এবং আমরা তাদেরকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছিলাম। আর এইসব মালপত্র সংগ্রহ করতেও আমাদের কোন বাধা ছিল না এবং আমরা সংগ্রহ করতেও চেয়েছিলাম। কিন্তু শত্রুরা নতুন করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে এই আশংকায় আমরা তাঁর পাহারায় নিয়োজিত হই। সুতরাং এই সম্পদে তোমাদের অধিকার আমাদের চেয়ে বেশী নয়।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাকে মদীনার উঁচু এলাকায় এবং যায়িদ ইবনে হারিসাকে নিম্ন এলাকায় মুসলমানদের বিজয় সয়বাদ দিয়ে পাঠালেন। অতঃপর তিনি সদলবলে মুশরিক যুদ্ধবন্দীদের সাথে নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করলেন। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে উতবা ইবনে আবু মুরাইত ও নাদার ইবনে হারেসও ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদের কাছ থেকে পাওয়া গণিমতের সম্পদও সাথে নিয়ে চললেন। আবদুল্লাহ ইবনে কা’ব ইবনে আমর ইবনে আউফকে গণিমতের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফরা গিরিপথ থেকে বেরিয়ে যখন গিরিপথ ও নাজিয়ার মধ্যবর্তী বালুর পাহাড়ে উপনীত হলেন তখন সেখানে বসে তিনি মুসলমানদের মধ্যে গণিমতের মাল সমভাবে বণ্টন করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় যাত্রা শুরু করলেন। রাওহাতে পৌঁছলে সাখানকার মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের আল্লাহ যে মহাবিজয় দান করেছেন সেজন্য অভিনন্দন জানাতে লাগলেন। তখন সালামা ইবনে সুলামা (রা) বললেন, “তোমরা কিসের জন্য আমাদেরকে মুবারকবাদ জানাচ্ছ? কতকগুলো ঝানু বৃদ্ধ লোকের সাথেই তো আমরা লড়াই করে এলাম। বন্দী উটের মত তারা হীনবল হয়ে গিয়েছিল। তাই আমরা তাদের জবাই করে দিলাম।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসলেন এবং বললেন, “ভাতিজা ওরাই তো হর্তাকর্তা।”
সাফরা গিরিপথে পৌঁছে যুদ্ধবন্দী নাদার বিন হারেসকে হত্যা করা হলো। আবু তালিব তনয় আলী তাকে হত্যা করলেন। অতঃপরে তাঁরা পুনরায় অগ্রসর হলেন। আরকুয যারীয়াতে পৌঁছে উকবা ইবনে আবু মুয়াইতকেও হত্যা করা হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হত্যার নির্দেশ দিলে উকবা বললো, “শিশুদের দেখাশুনার জন্য কে থাকলো, হে মুহাম্মাদ!” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংক্ষেপে শুধু বললেন, “আগুন!” অতঃপর আসেম ইবনে সাবিত ইবনে আবুল আফলাহ্ আনসারী উকবা ইবনে মুয়াইতাকে হত্যা করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাত্রা করলেন। তিনি যুদ্ধবন্দীদের পৌঁছার একদিন আগেই মদীনায় পৌঁছলেন। যুদ্ধবন্দীরা পৌঁছলে সাহাবাদের মধ্যে তাদেরকে বণ্টন করে রাখা হলো। তারপর তিনি বললেন, “যুদ্ধবন্দীদের প্রতি তোমরা সহানুভূতির মনোভাব রাখবে।”
ওদিকে হাইসমান ইবনে আবদুল্লাহ কুরাইশদের শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানিময় সংবাদ নিয়ে সর্বপ্রথম মক্কায় পৌঁছলো। কুরাইশগণ তাদো নিহতদের জন্য বিলাপ করতে লাগলো। তারপর সংযত হয়ে পরস্পরকে বলতে লাগলো, “এমন বিলাপ করো না। মুহাম্মাদ ও তার অনুচররা জানতে পাররে খুশীতে বগল বাজাবে। আর বন্দীদের খালাস করিয়ে আনতে তাড়াহুড়ো করো না যাতে মুহাম্মাদ ও তার অনুচররা মুক্তিপণ আদায়ের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কড়াকড়ি করার সুযোগ পায়।” আবদুল মুত্তালিব তনয় আসওয়াদ তার তিন ছেলেকে হারিয়েছিল। ছেলে তিনটি হলো: যামআ, আকীল ও হারেস। তার ইচ্ছা হচ্ছিল ছেলেদের জন্য বিলাপ করতে। এই সময় গভীর রাতে সে এক শোকাহত নারী কণ্ঠের কান্না শুনতে পেল। দৃষ্টিশক্তিহীন আসওয়াদ তার এক গোলামকে বললো, “যাও তো খোঁজ নিয়ে এসো, উচ্চস্বরে বিলাপ করা বৈধ করা হয়েছে কিনা। দেখ, কুরাইশগণ তাদের নিহতদের জন্য কাঁদছে কিনা। তাহলে আমি যামআর জন্য কাঁদবো। কেননা আমার কলিজা পুড়ে গেছে।” গোলাম ফিরে এসে জানালো, “এক মহিলা তার উট হারিয়ে বিলাপ করছে। এ কথা শুনে আসওয়াদ নিম্নলিখিত কবিতা আবৃত্তি করলো, “ঐ মহিলা একটা উটের জন্য এমন করে রাত জেগে কাঁদছে, এ কেমন কথা? আসলে কিন্তু সে জওয়ান উটের জন্য নয় বরং এমন এক পূর্ণিমার চাঁদের জন্য কাঁদছে, যার সৌভাগ্য খুবই সীমিত। সেই পূর্ণিমার চাঁদ যার জন্য বনু হুসাইস, মাখযুম ও আবুল ওয়ালীদের গোত্র ক্রন্দনরত। যদি আমি কাঁদি তাহলে আকীরের জন্য ও বীর কেশরী হারেসের জন্য কাঁদার মানুষ অনেক রয়েছে। সেই অসংখ্য কান্নারত লোকের উল্লেখ করা সম্ভব নয়। বস্তুত: যামআর কোন জুড়ি নেই।”
অতঃপর কুরাইশগণ যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ দিযে খালাস করে আনার আয়োজন করলো। প্রথমে তারা সুহাইল ইবনে আমরকে মুক্ত করার জন্য তাদের সম্মতি নেয়ার পর মুসলমানগণ বললেন, “এবার পণের অর্থ দাও।” মিকরায বললো, “তোমরা সুহাইলের পরিবত্যে আমাকে আটক করে রেখে তাকে ছেড়ে দাও যাতে সে গিয়ে তার পণের অর্থ পাঠিয়ে দিতে পারে।” এ কথায় সম্মত হয়ে তাঁরা সুহাইলকে ছেড়ে দিলেন এবং তার বদলে মিকরাযকে বন্দী করে রাখলেন। তার আগে উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে অনুমতি দিন সুহাইলের সামনের দাঁত উপড়ে ফেলি যাতে কথা বলতে তার জিহ্বা বেরিয়ে আসে এবং আপনার বিরুদ্ধে আর কখনো বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে না পারে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি তার চেহারা বিকৃত করবো না। তাহলে নবী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ আমার চেহারা বিকৃত করে দেবেন।”
যুদ্ধবন্দীদের একজন ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামাতা, তাঁর কন্যা যয়নাবের স্বামী আবুল ‘আস ইবনে রাবী ইবনে আবদুল উয্যা। যয়নাবের ইসলাম গ্রহনের ফলে আবুল আসের সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটে, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কার্যতঃ তাদের বিচ্ছেদ ঘটাতে সক্ষম ছিলেন না। তাই যয়নাব মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও মুশরিক স্বামীর ঘর করতে থাকেন। এই অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরাত করেন। পরে কুরাইশরা বদরের যুদ্ধে গেলে আবুল আসও তাদের সাথে যোগ দেয়। এভাবে সে যুদ্ধবন্দীদের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নীত হয়।
অতঃপর মক্কাবাসীরা যুদ্ধবন্দীদেরকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণ পাঠাতে লাগলো। যয়নাবও আবুর আ’স ইবনে রাবী’র মুক্তিপণ বাবদ কিছু টাকা ও বিয়ের সময় খাদীজার দেয়া হার পাঠিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারখানি দেখে আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন। সাহাবীদেরকে তিনি বললেন, “তোমরা যদি ভাল মনে কর তবে যয়নাবের পাঠানো মুক্তিপণ ফেরত দিয়ে তার বন্দীকে মুক্ত করে দিতে পার।” সাহাবীগণ তাকে মুক্তি দিলেন এবং মুক্তিপণ বাবদ পাঠানো টাকা ও হার ফেরত দিলেন।
আবুল ‘আস মক্কায় গিয়ে এবং যয়নাব মদীনায় এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বাস করতে লাগলেন। ইসলাম তাদের বিচ্ছেদ ঘটালো। মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে আবুল ‘আস ব্যবস্ায় উপলক্ষে সিরিয়া গেল। তার কাছে নিজের ও কুরাইশদের ব্যবসার টাকা আমানত হিসেবে ছিল যা তাকে মূলধন হিসেবে দেয়া হয়েছিল। সে কেনাবেচা সম্পন্ন করার পর যখন প্রত্যাবর্তন করছিল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেরিত একটি বাহিনী তার পণ্যদ্রব্য কেড়ে নেয় এবং আবুল ’আস পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। সেনাদল যখন রাসূলের কন্যা যয়নাবের নিকট উপস্থিত হয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করলো। যয়নাব তাকে আশ্রয় দিলেন। সে তার জিনিসপত্র ফেরত চাইতে এসেছিল। সকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়তে গেলেন এবং সাহাবীদের সাথে সামাযে দাঁড়ালেন। তখন যয়নাব নারীদের কক্ষ থেকে চিৎকার করে বললো, “হে জনগণ, শুনে রাখ, আমি আবুল ’আস ইবনে রাবী’কে আশ্রয় দিয়েছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফেরানোর পর সবার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “হে মুসলমানগণ, আমি যে কথা শুনতে পেরেছি, তোমরাও কি তা শুনেছো?” সবাই বললো, “হ্যাঁ শুনেছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহর কসম, এই ঘোষণা শুনবার আগে আমি এ ঘটনার কিছুই জানতাম না। চুক্তি অনুসারে যে কোন ব্যক্তি মুসলমানদের নিকট আশ্রয় নিতে পারে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কন্যার কাছে গিয়ে তাঁকে বললেন, “যয়নাব, আবুল আসকে সযতেœ রাখ। কিন্তু সে যে নির্জনে তোমার কাছে না আসে। কেননা তুমি এখন তার জন্য হালাল নও।”
আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র বলেন, যে সেনাদলটি আবুল আসের জিনিসপত্র ছিনিয়ে এনেছিল তাদের কাছে তিনি বার্তা পাঠালেন, “তার সাথে আমাদের সম্পর্ক কি তা তোমরা জান। তোমরা তার কিছু জিনিস হন্তগত করেছো। তোমরা যদি সদয় হয়ে তার জিনিস ফিরিয়ে দাও, তবে তা হবে আমাদের পছন্দনীয়। আর যদি না দিতে চাও ওটা গণিমতের মাল যা আল্লাহ তোমাদের দিয়েছেন। এসব সম্পদের আইনগত অধিকারী তোমরাই।” তাঁরা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা বরং তার জিনিস তাকে ফিরিয়েই দেব।” এরপর কেউ বালতি নিয়ে এলো। কেউ তার পুরনো মশক, কেউ তার চামড়ার পাত্র এবং কেউবা তার ছোট একটা কাঠের হাতল পর্যন্ত ফিরিয়ে দিল। এভাবে তার সব জিনিস সে হুবহু ফেরত পেলো। একটা জিনিসও বাকি রইলো না। পরে সে ঐসব জিনিস মক্কায় নিয়ে গেল এবং কুরাইশদের যার যে জিনিস তা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমাদের আর কারো কোন জিনিস কি ফেরত পেতে বাকী আছে?” তারা বললো, “আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আমাদের আর কোন প্রাপ্য ইেন। তুমি আমাদের সাথে একজন সত্যিকার আমানতদর ও মহৎ লোকের ন্যায় আচরণ করেছো।” তখন সে বললো, “তাহলে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমি শুধু এ আশংকায় ইসলাম গ্রহণ করিনি যে, তোমরা হযতো ভাবতে আমি তোমাদের সম্পদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যেই এরূপ করেছি। আল্লাহ যখন এগুলো তোমাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যাবস্থা করেছেন এবং আমি দায়মুক্ত হয়েছি, তখনই আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম।” অতঃপর আবুল আস (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে আসেন।
বদরের যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে যাদের অনুকম্পা প্রদর্শন করে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি দেয়া হয়েছির তারা হলেন: আবুল আস ইবনে রাবী, মুত্তালিব ইবনে হানতাব, সাইফী ইবনে আবু রিফায়া এবং আবু আযযা আমর ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উসমান। আবু আযযা ছিল দরিদ্র এবং বহু কন্যাদায়গ্রস্ত। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গিয়ে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমার কি অর্থ সম্পদ আছে তা আপনার জানা। আমি অত্যন্ত অভাবী এবং বহু সন্তানভারে ক্লিষ্ট। অতএব আমাকে অনুকম্পা প্রদর্শন করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মুক্তিপণ মাফ করে দিলেন এবং অঙ্গীকার নিলেন যে, সে আর কখনো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে না। আবু আযযা তার গোত্রের কাছে ফিরে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় নিন্মোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করে
“রাসূল মুহাম্মাদের নিকট আমার এ বার্তাটি কে পৌঁছিয়ে দেবে?
আপনি সত্য এবং বিশ্ব সম্রাট সকল প্রশংসার অধিকারী।
আপনি সেই ব্যক্তি যিনি সত্য ও ন্যায়ের দিকে আহব্বান জানান,
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পরম সম্মানিত ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি,
আপনি আমাদের পক্ষ থেকে পরম সম্মানিত ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি,
আপনি যার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন, সে চরম হতভাগা,
আর যার সাথে আপোষ করেন সে পরম ভাগ্যবান।”
মুশরিকদের থেকে যে মুক্তিপণ আদায় করা হয় তার পরিমাণ ছিল বন্দিপ্রতি এক হাজার দিরহাম থেকে চার হাজার দিরহাম। তবে বিত্তহীন ব্যক্তিকে অনুকম্পা দেখানো হয় এবং বিনা পণে মুক্তি দেয়া হয়। মোট ৮৩ জন মুহাজির, ১৬১ জন আওস গোত্রীয় আনসার এবং ১৭০ জন খাজরাজ গোত্রীয় আনসার বদর যুদ্ধে অংগ্রহণ করেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে গণিমতের অংশ দেন। বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলিম সংখ্যা আনাসার ও মুহাজির মিলে তিনশো চৌদ্দ জন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সবাইকে গণিমতের অংশ ও পারিশ্রমিক প্রদান করেন। বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৭ই রমযান, শুক্রবার সকাল বেলা।