বিপদের বেষ্টনিতে বিশ্বাসের সঞ্জীবনী
খন্দক যুদ্ধের মুহূর্ত। মক্কার কুরাইশদের নেতৃত্বে দশ হাজার মুশরিক সৈন্য মদীনার প্রায় উপকণ্ঠে এসে পৌঁছেছে।
একদিকে বাইরে এই বিপদ, অন্যদিকে রয়েছে মদীনার ষড়যন্ত্রকারী ইহুদী এবং মুনাফিকদের ভেতর থেকে অভ্যুত্থানের আশংকা।
বাইরের আক্রমণকে বাধা দেয়ার জন্য পরিখা খনন করা হয়েছে।
ভেতরের ইহুদী মুনাফিকদের অভ্যুত্থান রোধের জন্যে মহানবী (সা) ছালমা ইবনে আছলাম ও যায়েদ ইবনে হারেসার নেতৃত্বে দুটি নগর রক্ষা বাহিনী গঠন করলেন। ছালমার বাহিনীতে দু‘শ’ আর যায়েদের বাহিনীতে থাকল তিনশ’ লোক। ভেতরের যে কোন ষড়যন্ত্র প্রতিরোধের দায়িত্ব দেয়া হলো এই দু’টি দলের উপর।
দশ হাজার মুশরিক সৈন্য যখন মদীনার উপকণ্ঠে পৌঁছল, তাদের রণহুংকার, তাদের নানারকম আস্ফালন আর চিৎকারে ছোট শহর মদীনায় এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করলো।
মুসলিম সেনা দলে পনের বছরের বালকদের শামিল করার পরেও মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র তিন হাজার। নারী ও শিশুদের নগরীর এক প্রান্তে এক সুরক্ষিত বাড়ীতে আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
মহানবী (সা) সর্বসাকুল্যে আড়াই হাজার সৈন্য নিয়োগ করতে পারলেন পরিখা রক্ষা ও পরিখা অতিক্রমে শত্রুদের বাধা দেয়ার জন্য।
মদীনার আকাশ বাতাস তখন কাঁপছে মহা বিপদেও ঘনঘটায়।
মহানবী (সা) প্রতিরক্ষার আশু ব্যবস্থাগুলো সম্পন্ন করার পর অন্যদিকে মনোযোগ দিতে যাচ্ছেন, এমন সময় খবর এল, মদীনার ইহুদি গোত্র বনি কোরাইজাও বিদ্রোহ করেছে।
সমগ্র মদীনায় মুসলমানরা ছাড়া এই একমাত্র বনি কোরাইজা সন্ধিসূত্রে মুসলমানদের মিত্র ছিল। অন্য দুই ইহুদি গোত্র আগেই মুশরিক পক্ষে যোগ দিয়েছে। বনি কোরাইজ বিদ্রোহ করার পর মদীনায় মুসলমানদের মিত্র বলতে কেউ আর থাকলো না।
এই খবর মুসলমানদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক হল। সর্বশেষ একটি বড় আঘাত হিসেবে খবরটি মুসলমানদের অন্তরকে যেন ক্ষত-বিক্ষত কওে দিল।
যেন তারা ভেতর ও বাইরে থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল।
সকলের মুখেই তখন মহাবিপদের এক কাল ছায়া। কিন্তু মহানবী (সা)-এর মুখে কোনই ভাবন্তর নেই। বার্তা-বাহকের মুখ থেকে খবর শোনার পরেই শান্ত, অথচ অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করলেন, ভয় কি, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। তিনি সর্বশক্তিমান, তিনি একাই সকলের পক্ষে যথেষ্ট। মহানবীর (সা) এই একটি বাক্য যেন সকলের দেহে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের কাজ করল।
সমবেত কণ্ঠে আল্লাহু আকবার ধ্বনি মুহূর্তের জড়তা-উদ্বেগ কোথায় যেন দূর করে দিল।
‘সে আমর, আমিও আলী’
খন্দকের যুদ্ধ।
পরিখার ওপারে দশ হাজার মুশরিক সৈন্য। আর এপাড়ে প্রতিরোধের জন্য দাঁড়ানো আড়াই হাজার মুসলিম।
মদীনায় প্রবেশের মুখে পরিখা দেখে মুশরিক বাহিনী বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। কারণ পরিখা খনন করে প্রতিরোধের কৌশলের সাথে আরবরা পরিচিত নয়। বিমূঢ় ভাব তাদের কেটে যাবার পর তার অস্থির হয়ে পড়ল। পরিখা অতিক্রমের জন্যে অগভীর ও প্রশস্ত কোন জায়গা তার তালাশ করতে লাগল। পাহাড়ের কিনারে যেখানে পরিখা শেষ হয়েছে, সেখানে এমন একটি সুবিধামত জায়গা তার পেয়ে গেল।
তার পরিকল্পনা করল এই পথে তারা দুর্ধর্ষ ও অজেয় একটি ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করবে। তার ওপাড়ে গিয়ে পরিখার এই অংশকে শত্রুমুক্ত রাখবে এবং সেই সুযোগে অবশিষ্ট সৈন্য ঐ পথে নগরে প্রবেশ করবে। তার ক্ষুদ্র বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ নির্বাচন করল আরবের সর্বজনবিদিত শ্রেষ্ঠ বীর আমর ইবনে আব্দে ওদ্দ এবং অমিত সাহসী তরুণ সেনাধ্যক্ষ আকরামা ইবনে আবু জেহেলকে। আরবের মানুষের সাধারণ ধারণা, আমর একাই এক হাজার যোদ্ধার সাথে লাড়াই করে জিততে পারবে। আমর প্রথমে তার ঘোড়া নিয়ে লাফিয়ে পরিখা অতিক্রম করল। তারপর অন্যান্যরা। আমর ওপাড়ে পার হয়েই ভয়াল আকারে তর্জন-গর্জন শুরু করে দিল, কে আছ যোদ্ধা, সাহস থাকলে এগিয়ে এসো আমরের সামনে ।
একেতো শত্রুর একটি দল পরিখা অতিক্রমে সমর্থ হয়েছে! তার উপর পরিখা অতিক্রম করেছে আমর-এর মত পালোয়ান। প্রথমটায় মুসলমানরা চমকে গিয়ে কিছুটা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। সে কারণেই আমর প্রথম দিকে তার আস্ফালনের কোন জবাব পেল না। আমরের তর্জন-গর্জন অব্যাহত। আহবান জানাচ্ছে কাউকে সে যুদ্ধের। ‘এই যে আমি আছি’ বলে শেরে খোদা হযরত আলী বেরিয়ে এলেন। আমরের তুলনায় হযরত আলী বালক-সদৃশ। আমর মহাবীর ও বহুদর্শী এক বিশাল পালোয়ান। আর হযরত আলী মাত্র এক নব্য তরুণ। মহানবী (সা) হযরত আলীকে লক্ষ্য করে ত্বরিত কণ্ঠে বললেন, ‘জানো তো, সে আমর।’ হযরত আলী ঘুরে দাঁড়িয়ে সসম্ভ্রমে বললেন, ‘সে আমর, আমিও আলী।’ বলেই হযরত আলী মহানবীর অনুমতি নিয়ে উলংগ তরবারী হাতে ছুটলেন আমরের দিকে। শুরু হলো যুদ্ধ। মুহূর্তেই ধুলায় অন্ধকার হয়ে গেল স্থানটা। অস্ত্রের ঝনঝনানি ছাড়া কিছুই দৃষ্টিগোচর হলো না কারও। ভয়াবহ এই যুদ্ধের একদিকে শক্তি, অন্যদিকে ঈমানের তেজ। শক্তির সাথে ঈমানের তেজের লড়াই। মহানবীর (সা) কণ্ঠে তখন করুণ প্রার্থনা, হে আল্লাহ, বদর যুদ্ধে ওবায়দাকে গ্রহণ করেছে, ওহোদের অনল পরীক্ষায় হামজাকে তুমি নিয়েছ, আর এই আলী তোমার সন্নিধানে উপস্থিত। সে আমার পরমাত্মীয়। আমাকে একদম স্বজন-বর্জিত করো না। মুসলমানরা বাক্হীন রুদ্ধশ্বাসে ধুলায় অন্ধকার যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে। তাদের উদ্বিগ্ন, অচঞ্চল চোখ অপেক্ষা করছে ফলাফলের। এক সময় ধুলায় অন্ধকার যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে আল্লাহু আকবার নিনাদ ধ্বনিত হলো হযরত আলীর কণ্ঠে। সংগে সংগে সহস্র কণ্ঠে আবেগ আনন্দ-আপ্লুত প্রতিধ্বনি উঠল, আল্লাহু আকবার।
এই বিজয় আনন্দের বন্যাবেগ সৃষ্টি করল মুসলমানদে মধ্যে।
খালিদের দুর্ধর্ষ বাহিনীও অবসন্ন
খন্দকের যুদ্ধ চলছে। আরব-খ্যাত বীর আমর হযরত আলীর হাতে নিহত এবং ইকরামা ইবনে আবু জেহেল ব্যর্থ হবার পর এবার মক্কায় মুশরিক সৈন্যের শেষ বড় ভরসা খালিদ ইবনে ওয়ালিদ এগিয়ে এলন।
খালিদ বাছাই করা সৈন্য নিয়ে একটা অজেয় বাহিনী গঠন করলেন। দীর্ঘ পরিখা পর্যবেক্ষণ করার পর খালিদ আক্রমণের জন্যে সে স্থানটিই বেছে নিলেন যেখানে মহানবী অপেক্ষা করছেন।
তার কৌশল হলো, মহানবীর (সা অবস্থান স্থলে যদি আস্কিক সর্বাত্মক আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করা যায়, যদি কোনভাবে মহানবীর অবস্থান এলাকায় বিপর্যয় ঘটানো যায়, তাহলে মুসলমানদের ভীত-সন্ত্রস্ত ও দুর্বল করা যাবে এবং সেই সুযোগে অরক্ষিত এ স্থান দিয়ে পরিখা অতিক্রম করা সম্ভব হবে। এই পরিকল্পনা অনুসারে দুর্ধর্ষ সেনাপতি খালিদ তার কথিত ‘অজেয়’ বাহিনী নিয়ে আস্মিকভাবে প্রচ- আক্রমণ পরিচালনা করলেন মহানবীর অবস্থান স্থলের উপর। ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। খালিদের লক্ষ্য হলো পরিখার তীর থেকে মহানবীর বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে তাদের পরিখা পাড় নিরাপদ করা, আর মুসলিম বাহিনীর চেষ্টা মুশরিক বাহিনিকে পরিখার তীর থেকে দূরে রাখা। আক্রমণের বিরতি নেই। আক্রমণের ঢেউ একের পর এক এসে আঁছড়ে পড়ছে। এ যেন সাগরে অফুরন্ত ঢেউ-এর অব্যাহত আঘাত। যুদ্ধ এমন এক ভয়াবহ পর্যয়ে পৌঁছল যে, মহানবী (সা) এবং তার সাথীরা নামায পড়ার সময় পর্যন্ত কেউ বের করতে পারলেন না। খালিদ এভাবে তাঁর আক্রমণ কয়েকদিন পর্যন্ত অব্যাহত রাখলেন। কিন্তু শেষে তাঁর ‘নির্বাচিত দুর্ধর্ষৎ‘ সৈন্যরা ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ল। কিন্তু পরিখার ওপারে মুসলমানরা তখনও অস্ত্র উচিয়ে শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ সেদিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে ভাবতে বাধ্য হলেন, পরিখা রক্ষাকারী মুসলিম সেনা-প্রাচীন ভেদ করা বা ভাঙ্গ তাদের পক্ষে সম্ভব নয় এবং পরিখা পার হবারও তাদের কোন সুযোগ নেই।
যেমন ছেলে তেমনি মা
খন্দক যদ্ধের একটি মুহূর্ত।
মদীনার আনসার প্রধান সা’আদ ইবনে মা’আজ বিশেষ এক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মনে তাঁর আনন্দ। পরিখা মুশরিক বাহিনীকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে। ওদের তর্জন-গর্জন এখন সবই ওপাড়ে। সংখ্যার জোরে মুহূর্তে মুসলমানদের পিষে ফেলার পর্বতপ্রমাণ অহংকার নিয়ে ওরা ছুটে এসেছিল। দশহাত গভীর ৬ হাজার হাত দীর্ঘ পরিখায় ওদের অহংকার এসে থুবড়ে পড়েছে। নিশ্চিন্ত মনে কাজ করছিলেন সা’আদ ইবনে মা’আজ। হঠাৎ আগুনের মত ছড়িয়ে পড়া খবর সা’আদ ইবনে মা’আজও শুনলেন। মুশরিক বাহিনী সর্বাত্মক এক আক্রমণ পরিচালনা করেছে। ওরা পরিখা পার হওয়ার চেষ্টা করছে। খবর শোনার সাথে সাথে সা’আদ উঠে দাঁড়ালেন। পাশ থেকে বর্শা তুলে নিয়ে ছুটলেন তিনি পরিখার পাড়ে। তিনি ছুটছেন আর আবৃত্তি করছেন একটা কবিতার অংশ : একটু অপেক্ষা কর , মানুষ আসিতেছে,
সময় পূর্ণ হইলে মরণ তো আসিবেই, সুতরাং মরণে আর ভয় কি?
পাশেই সা’আদ ইবনে মা’আজের বাড়ি। মা’আজের উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনে তার মা বেরিয়ে এলেন। দেখলেন সা’আদকে এবং শুনলেন খবরও। শুনেই উত্তেজিত ও আবেগময় কণ্ঠে সা’আদের মা সা’আদকে লক্ষ্য কওে চিৎকার করে বললেন, ‘বৎস পিছিয়ে পড়েছো, দ্রুত অগ্রসর হও।’ মায়ের উৎসাহ ও আশীর্বাদে দ্রুততর হলো সা’আদ ইবনে মা’আজের গতি। তিনি পরিখা তীরে পৌঁছতেই শত্রুপক্ষের একটা তীর এসে বিদ্ধ করল তাঁকে। গুরতর আহত হলেন তিনি। এই আঘাত তাকে শাহাদাতের দিকে নিয়ে গেল। অচিরেই শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করলেন তিনি।
যে যুদ্ধ অস্ত্রের নয় ধৈর্যের
মক্কা বিজয়ের অনেক আগের ঘটনা। হোদাবিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধটা অস্ত্রের নয়, ধৈর্যের। দুর্বলরা অপমান, অবমাননা বাধ্য হয়ে সহ্য করে। কিন্তু শক্তিমান, সামর্থবানরা অপমান, অবমাননা সহ্য করে সংযত থাকা অস্ত্রের যুদ্ধে জেতার চেয়ে কঠিন। এই কঠিন যুদ্ধেরই মুখোমুখি হলো মুসলমানরা হোদায়বিয়ায়। হজ্বেও জন্যে মক্কার দ্বার শত্রু-মিত্র সকলের জন্যে উন্মুক্ত, এটাই আরবের প্রচলিত প্রথা। কিন্তু মুসলিম হজ্বযাত্রীর মক্কায় প্রবেশ করতে দেয়া হলো না। কুরাইশ ছাড়া মক্কার আশেপাশের অন্যান্য গোত্র কুরাইশদের এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হয়নি তবুও। উপরন্তু, নিরস্ত্র প্রায় মুসলমানদের উপর চড়াও হবার জন্যে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ ও ইকরামা ইবনে আবু জেহেলের নেতৃত্বে কয়েকশ’ কোরাইশ সৈন্য ঝড়ের বেগে অগ্রসর হলো মুসলমানদের উদ্দেশ্য। মহানবী (সা) যুদ্ধ এড়াবার জন্যে ভিন্ন পথ দিয়ে মক্কায় সন্নিকটে হোদায়বিয় প্রান্তরে গিয়ে উপনীত হলেন। এই বৈরিতার উত্তরে মহানবী (সা) কুরাইশ সর্দারদের কাছে শান্তির প্রস্তাব পাঠালেন এবং তাদের পক্ষ থেকে একজন আলোচনাকারীকে আহবান করলেন। কোরাইশদের পক্ষ থেকে একজন আলোচনাকারীকে আহবান করলেন। কোরাইশদের পক্ষ থেকে একজন আলোচনাকারী এলেন। এলেন বটে, কিন্তু শান্তির জন্যে নয়, গণ্ডগোল পাকানোর লক্ষ্যে। কুরাইশ সর্দার উরওয়া এমন আচরণ করলেন এবং এমন সব কথা বললেন যে, সেই অপমান ও অবমাননা হযরত আবু বকরের পক্ষেও হজম করা সম্ভব হলো না। কঠোর ভাষায় তিনি উরওয়াকে আক্রমণ করলেন। উরওয়া চলে গেলেন। পরে মহানবী (সা.) তাঁর শান্তি ও শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে নিজের প্রিয় উটে চড়িয়ে খেরাশ নামক সাহাবীকে পাঠালেন মক্কায় শান্তির প্রস্তাব নিয়ে। মক্কার লোকেরা মহানবীর এই শুভেচ্ছার জবাব দিলেন হযরতের উটকে হত্যা করে। খেরাশকেও তারা হত্যা করতে যাচ্ছিলো। মক্কার পাশের এক গোত্র সর্দার তাকে বাঁচিয়ে নিরাপদে ফেরত পাঠালেন হোদায়বিয়ায়। ঠিক এই সময়েই মক্কার একটি গুপ্ত ঘাতক দল মুসলমানদের একটা অংশের উপর চড়াও হতে এলো। তার সবাই প্রেফতার হলো কিন্তু মহানবী (সা.) তাদের সঙ্গে সঙ্গেই মক্কায় ফেরত পাঠালে। পরে মহানবী (সা) হযরত ওসমানকে শান্তির বার্তা নিয়ে পাঠালেন মক্কায় । মক্কার লোকেরা তাকে বন্দী করল। মহানবী সাঃ এর কাছে খবর এল হযরত উসমান হত্যা করা হয়েছে। গর্জে উঠলো দেড় হাজার মুসলমানের ক্ষুদ্র বাহিনী। তার মহানবীর হাতে হাত রেখে শপথ নিলো ‘মৃত্যুর জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যুদ্ধ করবো, কোন অবস্থায়ই একপদ পশ্চাৎবর্তী হবো না, আল্লাহর নামে আমাদের এই প্রতিজ্ঞা।’ কোরাইশরা মুসলমানদের চেনে। এই শপথের খবর মক্কায় পৌঁছার সাথে সাথে তাদের বীরত্বের আগুনে পানি পড়লো। উসমান (রা)-কে ছেড়ে দিয়ে তাঁর সাথেই সন্ধির বার্তা নিয়ে লোক পাঠালো মহানবীর কাছে। হোদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদিত হলো। সন্ধির শর্ত অনুসারে মুসলমানদের এবার হজ্ব না করে ফিরে যেতে হবে। এছাড়া সন্ধির অন্যসব শর্তও সম্পূর্ণভাবে কোরাইশদের পক্ষে গেলো। এই সন্ধি সকল মুসলমানের মানে অপমানের অসহ্য জ্বালা ধরিয়ে দিলো। হযরত উমরের মত মহানবীর অতি ঘনিষ্ঠ সাথীর কণ্ঠেও উত্তেজিত প্রতিবাদ উঠলো। কিন্তু এরপরও মহানবীর নির্দেশ সবাই ভগ্ন হৃদয়ে মেনে নিলো। অসহ্য অপমান, অবমাননার বিরুদ্ধে ধৈর্যের জয় হলো। যে পরীক্ষা মুসলমানদের মক্কার ১৩ বছরে দিতে হয়নি, যে পরীক্ষা তাদের বদর, ওহোদ ও খন্দক যুদ্ধেও দিতে হয়নি, সেই পরীক্ষা তাদের দিতে হলো হোদায়বিয়ায়। পরীক্ষা যেন তাদের সম্পূর্ণ হলো। তাই বোধহয় হোদায়বিয়ায় সন্ধির পর মুসলমানদের ‘মহাবিজয়’ (ফতহুম্ মুবিন)-এর খোশ খবর এলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের তরফ থেকে।
‘…….. শুকনো রুটি সম্বল করে’
এক বিপদ যায়, আরেক বিপদ আসে।
হোদায়বিয়ার সন্ধির পর কোরাইশদের দিক থেকে মহানবী (সা) নিশ্চিত হলেন। কিন্তু বিপদ ছুটে এল ইহুদীদের দিক থেকে। যড়যন্ত্রকারী ও চির মুসলিম-বিদ্বয়ী ইহুদীরা যখন বুঝলো মক্কার কুরাইশদের আর শক্তি নেই মুসলমানদের ধ্বংস করার, তখন খায়বরের ইহুদী গোত্রগুলো পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী গাতফান ও অন্যান্য পৌত্তলিক গোত্রকে নানা প্রকার আশা ও প্রলোভন দেখিয়ে তাদের মদীনা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত করলো। তারা মুসলমানদের উত্যক্ত ও দুর্বল করার জন্য মুসলমানদের একটা বাণিজ্য কাফেলা আক্রমণ করে অনেককে হতাহত করল এবং সবকিছু লুণ্ঠন করে নিয়ে গেল। এর কিছুদিন পর আরও দুঃসাহসী হয়ে তারা মাদীনার উপকণ্ঠে জ-ফারাদ প্রান্তরে মহানবী (সা) ও তাঁর সাহাবাদের পশুপালে আক্রমণ চালিয়ে প্রহরী এক মুসলমানকে হত্যা করে লোকটির স্ত্রীসহ গোটা পশুপালকে লুট করে নিয়ে গেল। মহানবী (সা) গুপ্তচর পাঠিয়ে খবর নিয়ে জানলেন, ইহুদী ও গাতফানীরা মদীনা আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত। যে কোন সময় তারা মদীনার উপর আপতিত হতে পারে।
মহানবী সাঃ আর মুহূর্ত দেরী করলেন না । ওরা মাদিনা আক্রমণের আগেই ওদের গাঁটি খায়বর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
মহানবী (সা) ১৪শ’ পদাতিক ও দু’শ সওয়ারী নিয়ে খায়বর যাত্রা করলেন। তিনি এমনভাবে তাঁর বাহিনী পরিচালনা করলেন যাতে গাতফানীদের থেকে খায়বরের ইহুদীদের বিচ্ছিন্ন করা যায়। তাই হলো। গাতফানীরা মনে করল মুসলমানরা তাদের ফাঁদে আটকাবার চেষ্টা করছে। তারা ভয়ে দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে তাদের এলাকায় দুর্গে আশ্রয় নিল। ইহুদীরাও সম্মুখ যুদ্ধ এড়িয়ে খায়বরে তাদের সুরক্ষিত দুর্গে গিয়ে প্রবেশ করল এবং মিত্র গাতফানীদের আগমনের অপেক্ষা করতে লাগল। তারা আরও ভাবল, দুর্গ অবরোধ করে মুসলমানরা তাদের কাবু করতে পারবে না। বেশীদিন দুর্গ অবরোধ করে বসে থাকার মত রসদ মুসলমানদের নেই। ইহুদীদের এই হিসাব সত্য। মুসলমানদের তখন খুবই আর্থিক দুর্দিন। মুসলমানরা মাত্র কিছু ছাতু সম্বল করে খায়বর অভিযানে এসেছিল। সে ছাতু ক’দিনেই নিঃশেষ হয়ে গেল। অনাহার-অর্ধাহারের কালছায়া নেমে এল মুসলিম শিবিরে। অবরোধের সময় যত বাড়ল, মুসলমানদের দুঃখ দুর্দশা ততই বৃদ্ধি পেতে লাগল। তার উপর দুর্গ প্রকার থেকে ইহুদীরা মাঝে মাঝেই তীর, বর্ষা, পাথর ইত্যাদি নিক্ষেপ করে মুসলমানদের হতাহত করতে লাগল। ইহুদীদের ধারণা হলো, অনাহার-অর্ধাহারে মুসলমানরা বিপর্যস্ত হয়ে অচিরেই অবরোধ উঠিয়ে পালিয়ে বাঁচবে। এদিকে মহানবী (সা) যখন দেখলেন যে, ইহুদীরা কোন মতেই আত্মসমর্পণ বা সন্ধি করবে না, তখন একদিন তিনি সাথীদেরকে দুর্গ দখলের নির্দেশ দিলেন। এই নির্দেশ অমৃত হয়ে দেখা দিল মুসলমানদের জন্য। ক্ষুধা-তৃষ্ণার জ্বালা তারা ভুলে গেল। মুহূর্তেই দুর্বল শরীর তাদের সবল হয়ে উঠল। শুরু হলো ঘোরতর যুদ্ধ। একের পর এক ইহুদী দুর্গে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হতে লাগল। ইহুদীদের সর্ব বৃহৎ দুর্গ কা’মুছ। তিনদিন যুদ্ধ চালাবার পর মুসলমানরা এ দুর্গ দখল করে নিল। কা’মুছ দুর্গের পতনের পর এক সপ্তাহের মধ্যে খায়বরের সকল ইহুদী দুর্গের পতন ঘটল। যুদ্ধে মুসলমানরা যে কতটা দক্ষতা ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, যুদ্ধের ফলাফল থেকেই তা আঁচ করা যায়। ৪ সপ্তাহের যুদ্ধে শহীদ হয়েছেলেন ১৫ জন মুসলিম, আর অন্যপক্ষ মার গিয়েছিলেন ৯৩ জন ইহুদী। অনাহার, অর্ধাহার আর সংখ্যা স্বল্পতা মুসলমানদের বিজয় ঠেকাতে পারেনি। আর প্রাচুর্য, সংখ্যাধিক্য এবং সুরক্ষিত দুর্গ পারেনি ইহুদীদের বিজয় দিতে।
সীমাহীন বৈরিতার সীমিত শাস্তি
মদীনায় হিজরতের পর মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদীরা বার বার বিশ্বাসঘাতকতা করছে। নানরকম ষড়যন্ত্র তারা অবিরাম করে গেছে। খন্দক যুদ্ধের আয়োজন প্রকৃতপক্ষে তারাই করেছিল। আরবের দশ হাজার সৈন্য তার ডেকে এনেছিল মুসলমানদের ধ্বংসের জন্যেই। সে আয়োজন যখন ব্যর্থ হলো, তখন খায়বরকে কেন্দ্র করে অন্যান্য গোত্রের সাহায্য নিয়ে নিজেরাই মদীনা থেকে মুসলমানদের মুছে ফেলার আয়োজন করেছিল। কিন্তু খায়বর যুদ্ধেও তার পরাজিত হলো। জাগতিক নিয়মে এবং তদানীন্তন আরবের প্রচলিত নিয়মে উচিত ছিল ইহুদীদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, তাদের সক্ষম পুরুষদের হত্যা করা এবং অন্যান্যদের দাসে পরিণত করা। কিন্তু মহানবী (সা) ইহুদীদের সাথে যে ব্যবহার করলেন তখন পর্যন্ত জগতের ইতিহাসে তার কোন তুলনা ছিল না। যুদ্ধ শেষে মহানবী (সা) ঘোষণা করলেন:
(ক) ইহুদীরা আগের মতই স্বাধীনভাবেই ধর্ম-কর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কোন প্রকার বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারবে না।
(খ) তাদেরকে কোন যাকাত, ওশর দিতে হবে না, যা মুসলমানরা দিয়ে থাকে।
(গ) তাদেরকে মুসলমানদের পক্ষে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করা হবে না।
(ঘ) তাদের কতকগুলো দুর্গের স্বর্ণ ও রৌপ্য স্পর্শ কর হবে না।
(ঙ) তাদের কতকগুলো দুর্গের স্বর্ণ ও রৌপ্য স্পর্শ করা হবে না।
(চ) তবে দেশের সমস্ত জমির মালিকানা মদীনা রাষ্ট্রের অধীন থাকবে। জনগণ জমির শস্যের একটা ভাগ মদীনার সরকারকে দেবে এবং তাদেরে বাড়ি-ঘর জমি-জামা পূর্বের ন্যায় তাদেরচধিকারে থাকবে ।
(ছ) ভাগ আগের মতই অর্ধাংশ হবে।
এই ঘোষণা যখন হলো, তখন ইহুদীদেরই চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হল। তাদের সীমাহীন বৈরিতার বিনিময়ে এই বদন্যতা পাবে, কল্পনাও করতে পারেনি তারা।
বিষের পরাজয় বিশ্বাসের জয়
খায়বর যুদ্ধ তখন শেষ।
মহানবী (সা) তখনও খায়বরে।
ভেতরে ভেতরে ইহুদীরা পাগল হয়ে গেছে কিছু করার জন্যে। ইহুদীদের একটা গ্রুপ সিদ্ধান্ত নিল মহানবী (সা)-কে হত্যা করার। ঠিক হলো বিষ খাওয়ানোই সবচেয়ে নিরাপদ। পরিকল্পনা অনুসারে ছাগল জবাই করে রান্না করা গোশতে তীব্র বিষ মেশানো হলো, যার ফোঁটা পরিমাণ গলাধঃকরণ করলে সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মৃত্যু ঘটবে। মহানবী (সা) ছাগলের রানের গোশত বেশী পছন্দ করতেন। সেই রানের গোশতে অধিক পরিমাণে বিষ মেশানো হলো। যয়নাব নামে সম্ভ্রান্ত বংশীয় ইহুদী মেয়ে আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে মহানবী (সা)-এর কাছে এসে বলল, ‘আপনার জন্যে এই সামান্য হাদিয়া এনেছি। আপনি অনুগ্রহ করে গ্রহণ করবেন কি?’
মহানবী (সা) ধন্যবাদের সাথে হাদিয়া গ্রহণ করলেন এবং উপস্থিত সাহাবাদের সাথে নিয়ে খেতে বসলেন।
তিনি এক টুকরো গোশত খেয়েই সাহাবাদের উদ্দেশ্য দ্রুত বললেন, ‘গোশতে বিষ মোশানো আছে, খেওনা কেউ।’
কিন্তু বিশর নামের একজন সাহাবী তখন এক টুকরার কিছু অংশ গিলে ফেলেছিলেন।
সংগে সংগেই তাঁর দেহে বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। দেহ তার বিবর্ণ হয়ে যেতে লাগল। বিষের যন্ত্রণায় তিনি কাতর হয়ে পড়লেন।
মহানবী (সা) যয়নাব ও তার সাথীদের ডেকে তাদের কৃত অপরাধের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।
যয়নাব উদ্যত কণ্ঠেই বলল, ‘আপনাকে হত্যা করার জন্যে এটা করেছি।’ আর তার সাথী ইহুদীরা ধূর্ততার সাথে বলল, ‘আমরা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম, তুমি যদি ভ- হও, তাহলে বিষ তোমার জিহ্বা স্পর্শ করার সাথে সাথে তোমার মৃত্যু ঘটবে। আর যদি সত্যিই নবি হও, তাহলে বিষ তোমার কিছু করতে পারবে না।’
চারদিকে দাঁড়ানো সাহাবীরা ইহুদীদের এই ষড়যন্ত্রে ক্রোধে তখন আগুন। তারা বলল, ‘এদের হত্যা করা অনুমতি কি আমরা পাব না?’
মহানবী (সা) তাদেরকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিলেন। তাঁর নিজের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ কখনও তিনি নেন না, এ জন্যে কাউকে কোন দ-ও কখনও তিনি দেন না।
যয়নাব উদ্যত কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু শীঘ্রই তার ভাবান্তর ঘটতে লাগল। সে মনে করেছিণ তখনই তাদের গর্দান চলে যাবে, হত্যা করা হবে তাদের সংগে সংগেই। সাহাবাদের প্রতি ধৈর্য ধারণের উপদেশ, প্রতিশোধ না নেবার মহানবীর কথায় সে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়ল। দ্বিতীয়ত, সাহাবী বিশরের চেয়ে অনেক বেশী গোশত মহানবী (সা) খেয়েছেন। কিন্তু বিশষর যেখানে মুমূর্ষু, সেখানে মহানবী সুস্থ। তাঁর ঠেঁট দু’টি বিবর্ণ হওয়া ছাড়া বিষের আর কোন প্রতিক্রিয়া তাঁর দেহে নেই। এই চিন্তা যয়নাবের মনকে ওলট-পালট করে দিল। সর্বোপরি যয়নাব যখন দেখল, তাদের হত্যা তো দূরে গ্রেফতারও করা হলো না, তখন যয়নাব আর স্থির থাকতে পারলো না। মুহূর্তে তার তার হৃদয় খেকে সব বিদ্বেষ কোথায় যেন দূর হয়ে গেল। তার জায়গায় তার হৃদয়ে থেকে সব বিদ্বেষ কোথায় যেন দূর হয়ে গেল। তার জায়গায় তার হৃদয়ে নামল মহানবীর প্রতি ভক্তি, মমতার অঢেল প্রস্রবণ। সে লুটিয়ে পড়ল মহানবীর পায়ে এবং কালেমায়ে তাইয়্যেরা পাঠ করে ইসলামে দাখিল হয়ে গেল। হত্যা করতে এসে নতুন জীবন স্থায়ী হলো না। বিষক্রিয়ার ফলে তিনদিন পরে সাহাবী বিশর-এর মৃত্যু ঘটলে হত্যার অপরাধে যয়নাবে প্রাণদন্ডে দন্ডিত হলেন।
মদীনার পথে ত্রি-রত্ন
আমর ইবনে ‘আস ছুটছেন মরু পথ ধরে মদীনার দিকে। আমর মক্কার একজন প্রথিতযশা যোদ্ধা এবং দূরদর্শী একজন রাজনীতিবিশারদ পণ্ডিত। আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসীর দরবার থেকে হিজরতকারী মুসলমানদের ধরে আনার কঠিন কূটনৈতিক কর্মে কুরাইশরা তাকেই পাঠিয়েছিল আবিসিনিয়ায়। এই আমর আজ তাঁর বাড়ী-ঘর, সহায়-সম্পত্তি, আত্মীয়-স্বজন সব মক্কায় ফেলে দেহের পোশাকটুকু মাত্র সম্বল করে ছুটছেন মদীনায়। অনেকটা পথ এগুবার পর এক জায়গায় হঠাৎ তাঁর সাক্ষাত ঘটলো খালিদ ইবনে ওয়ালিদ ও ওসমান ইবনে তালহার সাথে। চমকে উঠলেন আমর, চমকে উঠলেন খালিদ এবং ওসমানও। উভয়পক্ষের কাছে তাদের এই সাক্ষাত যেন অকল্পনীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ এবং ওসমান ইবনে তালহা দু’জনেই আমরের মতই মক্কার বিখ্যাত ব্যক্তি। খালিদ অদ্বিতীয় বীর এবং অজেয় সেনাপতি হিসেবে আরবে পরিচিত। আর ওসমান ইবনে তালহা মক্কার মহাসম্মানিত ব্যক্তি। তিনি কা’বার প্রধান মুহাফেজ এবং বায়তুল্লাহর সকল চাবি তাঁরই জিম্মায় থাকে। এঁদের মুখোমুখি হয়ে আমর নিজের বিস্ময় কিছুটা সামলে নেবার পর খালিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘খালিদ! কতদূর?’ খালিদ একজন নির্ভীক যোদ্ধা। কিন্তু তিনিও চমকে উঠেছিলেন আমরের অপ্রত্যাশিত দর্শনে। খালিদ জানেন না, সত্য গোপন করতে। খালিদ অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘যাচ্ছি মদীনায়। জেদের বশবর্তী হয়ে অসত্যের পূজা করতে করতে মন হাঁপিয়ে উঠেছে। আর সহ্য করতে পারছি না। তাই মদীনায় চলেছি প্রকাশ্যে সত্যকে স্বীকার করতে, আগের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে।’ বলে একটু দম নিলেন খালিদ। তারপর আমরকে লক্ষ্য করে উদাও কণ্ঠে বললেন, ‘আমর, আর কতদিন, নিশ্চয় জেনো এই ব্যক্তি (মহানবী) সত্যবাদী। তিনি নিশ্চিয় আল্লাহর নবী। আমি ও আমার সঙ্গী ওসমান এই উদ্দেশ্যেই মদীনা যাত্রা করেছি। আমরের মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। উৎসাহ-উদ্দীপনায় নেচে উঠলো মুখম-ল। বললেন আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে, আমিও তো একই উদ্দেশ্যে মদীনা যাত্রা করেছি। দুই কাফেলা এক হয়ে এক মহানন্দে ছুটলো মদীনার দিকে। ফাতহুম্ মুবিন-এর জ্বলন্ত চিত্র যেন এটা।
নববী এক মোজেজা
রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস, আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসীর কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর পর পারস্যের সম্রাট খসরু পারভেজের দরবারে চিঠি দিয়ে দূত প্রেরণ করলেন মহানবী (সা)। মহানবীর চিঠি কোন সম্রাটের দরবারে যে অমর্যাদার শিকার হয়নি, সেটাই ঘটল পারস্যে। সম্রাট খসরু চিঠি পেয়ে ক্রোদে জ্বলে উঠলেন এবং চিঠি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। শুধু তাই নয়, ইয়ামেনে তাঁর শাসনকর্তাকে লিখে পাঠালেন,চিঠি পাওয়া মাত্র মদীনায় গিয়ে মুহাম্মাদকে গ্রেফতার করে পারস্য সম্রাটের দরবারে পাঠানো হোক। চিঠি পেয়ে ইয়ামেনের শাসনকর্তা ‘বাজান’ প্রেফতারী পরওয়ানা ও উপযুক্ত সৈন্যসহ দু’জন রাজ-কর্মচারীকে মদীনা পাঠালেন। রাজকর্মচারীদ্বয় যথাসময়ে মদীনায় মহানবীকে বললেন, স্বেচ্ছায় ত্বরিত হাজির হলে গভর্নর সাহেব তার পক্ষে ভাল সুপরিশ করতে পারেন। মহানবী (সা) তাদের সাথে কিছু কথাবার্তা বলে তাদেরকে পরদিন সকালে আসতে বললেন। পরদিন সকালে ওঁরা এলেন। মহানবী ওদের বললেন, ‘খসরু পারভেজ নিহত। তাঁর ছেলে শেরওয়াহ তাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছে। যাও, তোমরা ফিরে গিয়ে ‘বাজান’-কে এই সংবাদ দাও। নিশ্চয় জেন, ইসলাম শীঘ্রই খসরু পারভেজের সিংহাসনের উপর অধিকার বিস্তার করবে। আর ‘বাজান’-কে বলো, সে ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে তার পদে বহাল রাখব। রাজকর্মচারীদ্বেয় এই অবিশ্বাস্য সংবাদ শুনে স্তম্ভিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ছুটল ইয়ামেনে তাদের শাসনকর্তা ‘বাজার’-এর কাছে। ইয়ামেনের শাসনকর্তা ‘বাজান’ তাঁর কর্মচারীর কাছে সবশুনে উদ্বেগ ও বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলল, এমন স্পষ্ট অনাবিল ভবিষ্যদ্বাণী তো বাইবেলে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ভবিষ্যদ্বাণী যদি সত্য হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে বুবং যে, মুহাম্মদ যথার্থই আল্লাহর নবী। ঠিক আছে কয়দিন অপেক্ষা করা যাক, পারস্য থেকে কোন খবর আসে কিনা। খুব শীঘ্রই ‘বাজান’-এর উন্মুখ অপেক্ষার অবসান ঘটল। ‘বাজান‘-এর কাছে পারস্যের নতুন সম্রাট শেরওয়াহের ফরমান এল। যাতে বলা হলো- ‘খসরুকে তার অন্যায় আচরণের জন্যে হত্যা করে আমি সিংহাসনে অধিপতি হয়েছি। ইয়ামেনবাসীকে আমার আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করবো। আর মক্কার সেই ব্যক্তি সম্পর্কে আমার দ্বিতীয় আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত কিছু করবে না।’ ফরমান পড়ার পর আর কালবিলম্ব না করে ইয়ামেনের শাসনকর্তা ‘বাজান’ ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং অল্পকাল পরেই ছুটলেন মদীনায় মহানবীর মহাদর্শন লাভের আকূল বাসনায়। কিন্তু তাঁর বাসনা অতৃপ্তই রয়ে গেল। পথিমধ্যে তিনি শহীদ হলেন গুপ্ত ঘাতকের হাতে।
প্রথম দিগি¦জয়ী বাহিনীর প্রতি মহানবী
বাসরার রাজার কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে দূত উমাইর ইবনে হারেসকে প্রেরণ করেন মহানবী (সা)। পথে ‘মুতা’ নামক স্থানে একজন খৃস্টান আঞ্চলিক শাসনকর্তা শুরাহবিল উমাইরকে বন্দী করে তাকে হাত-পা কেটে অশেষ কষ্ট দিয়ে হত্যা করল। শুধু ‘দূত’ হত্যাই নয়, সে লক্ষাধিক সৈন্য যোগাড় করে মদীনা আক্রমণের দুরভিসন্ধি আাঁটতে লাগল। রোম সম্রাটের কাছে কাছেও আশু সাহায্যের ঘোষণা সে পেয়ে গেল। ‘দূত’ হত্যার খবর এবং খৃস্টানদের সমরায়োজনের কথা মহানবীর কাছে পৌঁছলে মহানবী (সা) সঙ্গে সঙ্গেই তিন হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী মুতায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। এই বাহিনীর সেনাপতির দায়িত্ব দিলেন যায়েদ ইবনে হারেসকে। তিনি বলে দিলেন, যায়েদ নিহত হলে আলীর ভাই বীরবর জাফর সেনাপতি হবেন। আর জাফর নিহত হলে সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। মহানবীর আশংকা শুধু আশংকা নয়, এক দেদীপ্যমান সত্য। সুতরাং বাহিনীটি যে কি ভয়াবহ এক যুদ্ধের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে তা আঁচ করা বাকী রইল না মহানবীর কথা থেকে। তাই বোধ হয় মদীনার অধিবাসীরা মদীনার বাইরে ‘বিদা উপত্যকা’ পর্যন্ত বাহিনীটির সাথে হেঁটে এল। বিদায়ের প্রাক্কালে মহানবী (সা) মুসলিম বাহিনী যাতে কোন অবস্থাতেই নীতিভ্রষ্ট না হয়, কোন বাড়াবাড়ির আশ্রয় যাতে না নেয়, আল্লাহর উপর ভয় ও ভরসাকেই যাতে সর্বাবস্থায় পাথেয় মনে করে, সে জন্যে বিদায়ী উপদেশ হিসেবে বললেন :
‘আমি তোমাদেরকে সর্বদা সদ্ব্যবহার করার উপদেশ দান করছি। আল্লাহর নামে যুদ্ধযাত্রা কর এবং সিরিয়ায় তোমাদের ও আল্লাহর শত্রুদের মুকাবিলা কর। তোমরা যে দেশে যাচ্ছ সেখানকার মাঠে সাধু-সন্ন্যাসীদেরকে নিভৃত সাধনায় মগ্ন থাকতে দেখবে। সাবধান! তাদের কাজে কোন প্রকার বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না। সাবধান! একটি স্ত্রীলোক, একটি বালক বা বালিকা, একজন বৃদ্ধও যেন কোনক্রমে তোমাদের হাতে নিহত না হয়। সাবধান! শত্রুপক্ষের একটি বৃক্ষও ছেদন করবে না, একটি বাড়ীও নষ্ট করবে না।’
এই প্রথমবারের মত মুসলিমরা আরব ভূখণ্ডের বাইবে যুদ্ধযাত্রা করছে। যাদের বিরুদ্ধে তাদের এই যুদ্ধযাত্রা তারা সংখ্যা ও সজ্জায় অনেক অনেক বড়। কিন্তু তবু সৈনিকরা বুঝলে, যথেচ্ছা চলার এক ইঞ্চি সুযোগও তাদের থাকল না। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সাহায্য লাভের এই তো উপায়।
সিরিয়ার আকাশে প্রথম ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি
মুতা যুদ্ধ-যাত্রার একটি মুহূর্ত।
তিন হাজার সৈন্যের মুসলিম বাহিনী আরব সীমান্ত অতিক্রম করে সিরিয়া প্রদেশে প্রবেশের পর জানতে পারলো, খৃস্টান শাসনকর্তা শুরাহবিল এক লাখ সৈন্যের এক সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার মা’আব স্থানে অপেক্ষা করছেন। মুসলিম বাহিনী আরও জানতে পারলো, রোম সম্রাট স্বয়ং ২ লাখ সৈন্যের একটা বাহিনী তৈরী করছেন শুরাহবিলের সাহায্যের জন্যে। অর্থাৎ গোটা খৃস্টান সাম্রাজ্যই যেন এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এ খবর পাওয়ার পর মুসলিম বাহিনীর অনেকেই পরিস্থিতি সম্পর্কে পরামর্শ করার প্রয়োজন অনুভব করল। পরামর্শ সভায় দিলেন, ‘এই নতুন পরিস্থিতি সম্পর্কে মদীনায় খবর পাঠানো হোক। এ ব্যাপারে মহানবী (সা)-এর পরামর্শ আসার পর অনুসারে কাজ করা উচিত।’ যারা এই মত প্রকাশ করলেন, তারা যুক্তি হিসেবে বললেন, ‘তিন হাজার সৈন্য নিয়ে লাখ অথবা তারও বেশী সুসজ্জিত সৈন্যের সাথে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া সঙ্গত হবে না।’ যুক্তি খুবই শক্তিশালী। বিশেষ করে মহানবী (সা)-এর পরামর্শ নেয়ার প্রস্তাব অনেকের কাছে সঙ্গত বলে মনে হলো। কিন্তু অনেকেই এই দ্বিধাগ্রস্তকে মেনে নিতে পারলেন না। তাদেরই একজন মহামতি আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, উঠে দাঁড়িয়ে গুরুগম্ভীর আওয়াজে তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘মুসলিম সৈনিকবৃন্দ, তোমরা যে সাফল্য অর্জনের জন্যে বের হয়েছিলে, আল্লাহর কসম এখন সে সাফল্যই যেন তোমাদের কাছে অবাঞ্ছিত বলে মনে হচ্ছে। তোমরা তো বের হয়েছিলে শাহাদাত হাসিলের উদ্দেশ্যে, সত্যের নামে আত্মোৎসর্গ করার জন্যে। সংখ্যার গণনা মুসলমানরা কখনই করে না, পার্থিব শক্তির তুলনা করার কাজে কখনই তারা প্রবৃত্ত হয় না, তাদের একমাত্র শক্তি আল্লাহ। সেই আল্লাহর প্রেরিত মহাসত্যকে বক্ষে ধারণ করে, সত্যের তেজে উদ্দীপ্ত হয়ে কর্তব্যের কোরবান গাহে আল্লাহর নামে হৃৎপিন্ড শোণিত ঢেলে দেয়াই তো আমাদের সাফল্য। বিজয়ী হতে পারি ভাল, আর শাহাদাত যদি হয় আরও ভাল। সুতরাং এ সময় এত আলোচনা আর এই যুক্তি-পরামর্শ কিসের জন্যে?
খালিদ হলেন সেনাপতি
মুতার যুদ্ধ চলছে। এক লাখ সুসজ্জিত সৈন্যের বিরুদ্ধে তিন হাজার সৈন্যের লড়াই। সেনাপতি যায়েদ ইবনে হারেসার শাহাদাতের পর সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন জাফর ইবনে আবু তালিব। ভয়াবহ যুদ্ধের তীব্রতার মধ্যে সেনাপতি জাফর শহীদ হলেন। তাঁর শাহাদাতের পর পতাকা তুলে ধরলেন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। তিনিও শহীদ হলেন। মুসলিম পতাকা ভূলুণ্ঠিত হলো রণাঙ্গনে। পতাকা ভূলুণ্ঠিত হওয়ায় মুসলিম বাহিনীর কেন্দ্র ভেঙ্গে পড়লো। মুসলিম বাহিনী তখন মহাবিপর্যয়কর অবস্থা। একদিকে শত্রুপক্ষের প্রবল চাপ, অন্যদিকে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতিহীন বিশৃংখল অবস্থা। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে, গোটা যুদ্ধক্ষেত্রে দু’জন মুসলিম সৈনিকও একসাথে ছিলো না। যুদ্ধের এই অবস্থা দেখে কেউ কেউ মদীনা অভিমুখে পালানো শুরু করেছিলেন। ভয়াবহ এই দুঃসময়ে উকবা ইবনে আমের নামক একজন সাহাবী উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘পলাতক অবস্থায় নিহত হওয়া অপেক্ষা সামনে অগ্রসর হয়ে জীবন দেয়া শ্রেয়তর।’ উকবার এই চিৎকারে অনেকের চেতনা হলো, কেন্দ্রও একটা খুঁজে পেলো তারা। কিছু মুসলিম যোদ্ধা ছুটে এলো তাঁর দিকে। সামনেই তাদের মুসলিম বাহিনীর ভূলুণ্ঠিত, পদদলিত পতাকা এবং সবেগে তা বাতাসে উড়াতে উড়াতে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘কে কোথায় আছ মুসলিম বীর, এদিকে ছুটে এসো’। একজন সেনাপতি নির্বাচন করতে হবে। ছুটে এলো আরও কিছু মুসলিম সৈনিক। সাবেত এবং উপস্থিত অন্যান্য সৈনিকরা সেনাপতি হিসেবে খালিদ ইবনে। ওয়ালিদ-এর নাম প্রস্তাব করলেন। খালিদ বিনীতভাবে বললেন, ‘সাবেত, তুমি আমাদের সকলের ভক্তিভাজন, তুমিই এর উপযুক্ত পাত্র। তুমিই আমাদের সেনাপতি।’ কিন্তু দূরদর্শী সাবেত তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘খালিদ, ভাবপ্রবণতা মনোনীত করেছি। মহানবী (সা)-এর পতাকা তুমি গ্রহণ করো এবং বলো আমাদের কি করতে হবে।’ খালিদ আর অপেক্ষা করলেন না। ভক্তিভরে মহানবীর যুদ্ধ-পতাকা হাতে তুলে নিলেন। ..
যে যুদ্ধে ৮টি তরবারী ভাঙে সেনাপতির
মুতার যুদ্ধ নিয়ে উদ্বিগ্ন মহানবী (সা)।
মুতার সৈন্যদল পাঠাবার কয়েকদিন পর যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্যে আবু আমের আশআরী নামক একজন সাহাবীকে তিনি পাঠালেন মুতা অঞ্চলে। তিন সেনাপতি শহীদ হওয়ার মর্মান্তিক খবর পেয়ে আবু আমের ছুটে এলেন মদীনায়। বললেন মহানবীকে, তিন সেনাপতি শহীদ হওয়ার পর খালিদ ইবনে ওয়ালিদ এখন সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। শহীদ তিন সেনাপতির মধ্যে জাফর ছিলেন মহানবী (সা)-এর চাচাতো ভাই। শহীদের আত্মীয়-স্বজনকে সান্তনা দিয়ে মহানবী (সা) জনসমক্ষে এসে দাঁড়ালেন। বললেন সকলকে উদ্দেশ্য করে, ‘সকলে যুদ্ধ যাত্রা কর, ভাইদের সাহায্য কর। একজন সমর্থ ব্যক্তিও যেন বাদ না পড়ে।’ যে যুদ্ধে যায়েদ, জাফর, আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার মত বীর সেনাপতি পর পর শহীদ হন সে যুদ্ধ যে কতটা ভয়বহ তা বুঝতে মদীনার কারোরই বাকী রইল না। তার উপর মহানবীর আহবান পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। অভূতপূর্ব এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো মদীনায়। সাহাবীরা যে যে অবস্থায় ছিল, যে যা পেল তা নিয়ে ছুটলো মুতার দিকে। কেউ হেঁটে কেউ ঘোড়ায় বা উটে চড়ে। এই যুদ্ধ-যাত্রার ক্ষেত্রে কেউ কারও অপেক্ষা করেনি। কে কার আগে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা। মহানবী (সা), হযরত আবু বকর (রা) এবং হযরত ওমর (রা)-একইভাবে মুতা যাত্রা করলেন। মদীনা থেকে প্রেরিত এই সাহায্যেও কি পরিমাণ যথাসময়ে মুতা যুদ্ধে খালিদ ইবনে ওয়ালিদের মুসলিম সেনাদলে শামিল হতে পেরেছিলেন, এটা বড়া কথা নয়। বড় কথা হলো মদীনা থেকে সাহায্যা পৌঁছেছিল। খৃস্টান শুরাহবিলের বাহিনীর জন্যে এটা ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক ধরলেন বড় খবর। সেদিন রাত শেষে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ মুতা প্রান্তরে মুসলিম বাহিনীকে এমন কৌশল ছকে ছকে দাঁড় করালেন যাতে মনে হতে লাগল মদীনা থেকে অসংখ্য সৈন্য মুতায় পুরাতন সেনাদলের সাথে যোগ দিয়েছে। খৃস্টান বাহিনীকে স্তম্ভিত করল এই ঘটনা। আর সেদিন মুসলিম বাহিনীও এমনভাবে যুদ্ধ শুরু করল যেন তারা শতগুণ শক্তিতে আজ উদ্দীপ্ত। ভয়াবহ এক যুদ্ধ সংঘটিত হলো সেদিনও। অবশেষে খৃস্টান বাহিনী পিছু হটল। সেদিন প্রথমে তাদের মানসিক পরাজয় সূচিত হয়েছিল। সেই মানসিক পরাজয় ডেকে আনল যুদ্ধে তাদের এক শোচনীয় পরাজয় । মুতার যুদ্ধ চলেছিল প্রায় ৭ দিন ধরে। এক খালিদ ইবনে ওয়ালিদের হাতেই ৮টি তরবারি টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধেও শেষ মুহূর্তে তিনি ব্যবহার করেছিলেন নবম তরবারী। মুতা ছিল তদানীন্তন আরব এলাকার বাইরে মুসলমানদের প্রথম যুদ্ধ এবং প্রথম বিজয়।
স্বজনের চেয়ে ওয়াদা বড়
হুদায়বিয়া সন্ধির পর দেশের ভেতরে-বাইরে ইসলামের দ্রুত বিস্তারে দিশেহারা হয়ে পড়ল কুরাইশ এবং আরবের প্রধান পৌত্তলিক গোত্রগুলো। মক্কায় কুরাইশ, তায়েফের সাকিফ এবং হোনায়েনের হাওয়াজেন ছিল আরবের প্রধান পৌত্তলিক গোত্র। তারা একযোগে চেষ্টা করে সমগ্র দক্ষিণ আরবের সব পৌত্তলিক গোত্রকে সংঘবদ্ধ করল মহানবীর মদীনার উপর শেষ আঘাত হানার জন্যে। অসুবিধাটা হয়ে দাঁড়াল মক্কায় পার্শ্ববর্তী খোজাআ গোত্র। গোত্রটি মুসলমানদের মিত্র এবং আশ্রিত। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে একটা শর্ত ছিল যে আরবের অন্যান্য গোত্র তাদের ইচ্ছা অনুসারে কুরাইশ অথবা মুসলমান যে কোন পক্ষের মিত্র হতে পারে। সেই অনুসারে খোজআর চিরশত্রু বনি বকর কুরাইশদের সাথে যোগ দিলে বনি খোজাআ মুসলমানদের সাথে সন্ধি করে। তাছাড়া এই খোজাআ পূর্ব থেকে বরাবরই মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। কুরাইশ, হাওয়াজেন ও সাকিফ গোত্রত্রয় পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিল, মুখের সামনে থেকে খোজাআদের সরাতে হবে, নির্মূল করতে হবে। এতে হবে দুইটা কাজ। এক, গোটা দক্ষিণ আরব একমুখী হবে এবং হুদায়বিয়া সন্ধি ভঙ্গ হওয়ার ফলে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধের সুযোগ পাওয়া যাবে। বনি খোজাআদের প্রতিবেশী এবং চিরশত্রু বনি বকর গোত্রকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করল কুরাইশরা এবং উত্তেজিত করে তুলল তাদেরকে খোজাআদের বিরুদ্ধে। একদিন রাতে ঘুমন্ত খোজাআ গোত্রের উপর আপতিত হলো বনি বকরের লোকরা। তাদের সাহায্য করতে এল কুরাইশদেরও কিছু লোক। সেদিন রাতে অমানুষিক হত্যাক- অনুষ্ঠিত হলো খোজাআ পল্লীতে। বাঁচার জন্যে কিছু পুরুষ-নারী-শিশু আশ্রয় নিয়েছিল কা’বা ঘরে, যেখানে সকল মানুষ অবধ্য। কিন্তু কা’বায় আশ্রয় নিয়েও বাঁচল না তারা। আক্রমণকারীদের একজন চিৎকার করে বলল, আজ আর ঈশ্বর বলে কেউ নেই, আজ মনের সাধ মিটিয়ে শত্রু বিনাশ কর।
বনি খোজআর এই মর্মান্তিক খবর মদীনায় গিয়ে পৌঁছল। শোকাভিভূত হয়ে পড়লেন মহানবী। একদিকে খোজাআদের হত্যাকাণ্ড, অন্যদিকে কুরাইশদের জঘন্য অপরাধ দুই-ই তাকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করল। খোজাআরা তার মিত্র, আশ্রিত আর কুরাইশরা তার স্বজন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন মহানবী (সা)। কুরাইশদেরকে তাদের সন্ধি ভঙ্গ ও হত্যাকাণ্ডের শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে। তিনি কুরাইশদেরকে একটা সুযোগ দেয়ার জন্য দূত পাঠালেন মক্কায়। তিনি বলে পাঠালেন, অর্থ দ্বারা অন্যায় হত্যাকাণ্ডের ক্ষতিপূরণ করতে হবে, অথবা বনি বকর গোত্রের সাথে মিত্রতা পরিত্যাগ করতে হবে। কোন একটিকে তাঁদের গ্রহণ করতে হবে। কুরাইশরা সন্ধি ভঙ্গই চাচ্ছিলো। সুতরাং মহানবীর শর্ত পাবার সাথে সাথেই তারা হুদায়বিয়ার সন্ধি ভেঙ্গে গেছে বলে ঘোষণা দিলো। কুরাইশদের আচরণ মহানবী (সা)-কে খুবই ব্যথিত করলো। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মক্কা অভিযানের সিদ্ধান্ত নিলেন। সন্ধি বাতিল করার পর কুরাইশরা বুঝতে পারলো ঝোঁকের মাথায় তারা যে কাজ করেছে, তা ঠিক হয়নি। স্বয়ং আবু সুফিয়ান ছুটলেন মদীনায় বুঝিয়ে মহানবীকে নিবৃত্ত করার জন্যে। আবু সুফিয়ান আবু বকর (রা), উমর (রা), আলী (রা) সহ সকলের দ্বারস্থ হলেন সুপারিশ করার জন্য যে, হুদায়বিয়ার সন্ধি ঠিক আছে, ভেঙ্গে যায়নি। কিন্তু মহানবী কোন কথার প্রতিই কর্ণপাত করলেন না। স্বজনের চেয়ে চুক্তি বড়, ওয়াদা বড়, খোজাআদের প্রতি কৃত অন্যায়ের অবশ্যই প্রতিবিধান করতে হবে। ৮ম হিজরী ১৮ই রমযান দশ হাজার মুসলিম মুজাহিদ নিয়ে মক্কার পথে যাত্রা করলেন মহানবী (সা)।
‘ফাতহুম মুবিনে’র প্রথম বন্দী
‘ফাতহুম মুবিন’ বা মক্কা বিজয়ের মহামুহূর্হটি সমাগত। দশ হাজার মুসলিম সৈন্যে বাহিনী সেদিন গভীর রাতে মক্কার উপকণ্ঠ মাররুজ-জাহরান উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছল এবং সেখানেই রাত যাপনের সিদ্ধান্ত নিলো। মক্কার কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ও আরও কয়েকজন রাতে মক্কার উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে। মাররুজ্-জাহরান উপত্যকায় হাজার আলোর সারি দেখে স্তম্ভিত হলো আবু সুফিয়ান। রহস্য উদ্ধারের জন্যে আবু সুফিয়ানকে অতি সন্তর্পণে এগুলো ঐ উপত্যকার দিকে। হঠাৎ আবু সুফিয়ান বন্দী হয়ে গেলো হযরত উমর (রা)-এর হাতে। হযরত উমর (রা) আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন মুসলিম বাহিনীর অগ্রবর্তী দিকটা। হযরত উমর (রা) আবু সুফিয়ানকে মহানবীর সামনে হাজির করে বললেন, সত্যের শত্রুদের সমূলে উৎপাটিত করার শুভমুহূর্ত সমাগত। আবু সুফিয়ান বন্দী। প্রতিশোধ গ্রহণ ও প্রতিফল দানের সময় উপস্থিত। মহানবী (সা) এ প্রসঙ্গে না গিয়ে আবু সুফিয়ানকে সন্বোধন করে বললেন, আবু সুফিয়ান, এখনও তুমি সেই করুণা-নিধান ‘ওয়াহদাহু লা-শারিকালাহু’ কে চিনতে পারোনি? আবু সুফিয়ানের বিমর্ষভাবে আমতা করে বললো, ‘তা, এখন পারছি বৈ কি। আমাদের ঠাকুর কেউ থাকলে আমাদের পানে তাকাতো।’ আবু সুফিয়ানের উত্তরে উৎসাহিত হয়ে মহানবী (সা) আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা আবু সুফিয়ান, আমি যে আল্লাহর প্রেরিত সত্য নবী, এ ব্যাপারে এখনও কি তোমার সন্দেহ আছে?’ আবু সুফিয়ান বললো, ‘এখনও কিছু কিছু সন্দেহ আছে?’ মহানবী (সা) বন্দী আবু সুফিয়ানের কথায় বিন্দুমাত্রও ক্রুদ্ধ হলেন না এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করলেন না। শুধুমাত্র মহানবী (সা) আবু সুফিয়ান যখন ফিরে যাবার জন্যে উত্যত হলেন, তখন তাকে আদেশ করলেন সকাল পর্যন্ত থেকে যেতে। মহানবী (সা) বোধ হয় চেয়েছিলেন আবু সুফিয়ান ফিরে গিয়ে গোঁট পাকাবার কোন সুযোগ না পায়।
সেনাপতি সা’আদ পদচ্যুত হলেন
মক্কার উপকণ্ঠে মাররুজ জাহরান উপত্যাকায় ফজরের নামায পড়ে দশ হাজার সৈন্যের মুসলিম বাহিনী মক্কা প্রবেশের জন্যে যাত্রা শুরু করলেন। বিভিন্ন সেনাপতির অধীনে দলে দলে বিভক্ত হয়ে মুসলিম বাহিনী মক্কা প্রবেশের জন্যে অগ্রসর হচ্ছে। প্রত্যেক সেনাপতি বহন করছেন তাঁর দলের পতাকা। তখনও সকাল হয়নি। আবু সুফিয়ান মহানবী (সা)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রা)-এর সাথে এক টিলায় বসে তাদের সম্মুখ দিয়ে মক্কার দিকে অগ্রসরমান মুসলিম সেনাদলের শান-শওকত ও শৃংখলা দেখছিলেন বিস্মিত চোখে। মদীনার আনসার রেজিমেন্ট তখন অগ্রসর হচ্ছিল আবু সুফিয়ানের সম্মুখ দিয়ে। আবু সুফিয়ান চিনতে পারলো না ওদের। জিজ্ঞাসা করল হযরত আব্বাস (রা)-কে, এরা কারা? আব্বাস (রা) বললেন, এটা মদীনার আনাসারদের রেজিমেন্ট। সা’আদ ইবনে উবাদা এদের সেনাপতি। তখন সেনাপতি সা’আদ ইবনে উবাদা একদম সামনে এসে পড়েছিলেন। তিনি আবু সুফিয়ানকে দেখে বললেন, ‘আজ ভীষণ সংঘর্ষের দিন, আজ কা’বার সম্ভ্রম বিনষ্ট হবে।’ শুনে তাঁর জাতির কথা ভেবে আবু সুফিয়ান আর্তনাদ করে উঠলেন। অনুরোধ করতে লাগলেন তিনি হযরত আব্বাসকে কুরইশদের সাহায্য করার জন্যে। আনসারদের পরেই ছিল মুহাজির রেজিমেন্ট। আবু সুফিয়ান দেখলেন, মুহাজির দল যাচ্ছে তার সামনে দিয়ে এবং মহানবী (সা) তাদের সাথে রয়েছেন। দেখেই আবু সুফিয়ান ছুটলেন মহানবীর কাছে। আর্তনাদ করে বললেন, “মুহাম্মাদ, তুমি কি তোমার স্বজনদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছো?” মহনাবী (সা) বললেন, ‘না, কখনই না।’ তখন আবু সুফিয়ান সা’আদ ইবনে উবাদার কাছে যা শুনেছিল, বলল মহানবীকে। শুনে মহানবী বললেন, ‘না, সা’আদের কথা সত্য নয়, আজ প্রেম ও করুণার দিন। আজ কা’বার সম্ভ্রম চির প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিন।’ বলে একজন অশ্বারেহীকে কিছু নির্দেশ দিলেন মহানবী (সা)। সঙ্গে সঙ্গেই অশ্বারোহীটি ছুটল আনসার রেজিমেন্টের দিকে। সে সেনাপতি সা’আদ ইবনে উবাদার সামনে হাজির হয়ে জানাল যে, আবু সুফিয়ানকে উপরোক্ত উক্তি করার জন্যে তাকে পদচ্যুত করা হয়েছে। সেনাপতি সা’আদ সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর হাতের পতাকা নব নিয়োজিত সেনাপতির হাতে তুলে দিয়ে পেছনে সাধারণ সৈনিকদের কাতারে এসে দাঁড়ালেন। কোন প্রশ্ন বা অসন্তুষ্টির সামান্য চিহ্নও তাঁর চোখে-মুখে ফুটে উঠল না। অশ্বারোহীকে আনসার রেজিমেন্টের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে মহানবী সাঃ আবু সুফিয়ানকে বললেন, ‘আবু সুফিয়ান, গিয়ে মক্কাবাসীকে অভয় দাও, আজ তাদের প্রতি কোনই কঠোরতা দেখানো হবে না। তুমি আমর পক্ষ থেকে ঘোষণা করে দা :
(ক) যে ব্যক্তি অস্ত্র ত্যাগ করবে তাকে অভয় দেয়া হলো।
(খ) যে ব্যক্তি কা’বায় প্রবেশ করবে, তারা নিরাপদ।
(গ) যারা দরজা বন্ধ করে বাড়ীর ভেতরে অবস্থান করবে তাদের কোন ভয় নেই এবং
(ঘ) যারা আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে, তারাও নিরাপদ। মক্কাবাসীকে অভয়দানের এই চারটি শর্তের ঘোষণা মুসলিম বাহিনীর সব সৈন্য, সব সেনাপতিকে জানিয়ে দেয়া হলো। সেই সাথে মুসলিম বাহিনীকে আদেশ দেয়া হলো, মক্কায় প্রবেশের সময় বা পরে কেউই অস্র ব্যবহার করতে পারবে না। যারা বার বার মদীনার অভিযান পরিচালনা করেছে মুসলমানদের অস্তিত্ব দুনিয়া থেকে মুছে ফেলার জন্যে, মদীনাকেও ধ্বংস করার জন্যে, তাদের জন্যেই মহানবীর এই ক্ষমা, এই মহানুভবতা। কারণ তিনি রাহমাতুল্লিল আলামীন।