ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
খুররম জাহ মুরাদ
বইটির অডিও শুনুন
ভূমিকা
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আম্বিয়ায়ে কিরাম সর্বদাই মানব সমাজের পুনর্বিন্যাস করেছেন। তাঁরা মানব জাতিকে এক বুনিয়াদী আদর্শের দিকে আহবান জানিয়েছেন। এবং সে আহবানে যারা সাড়া দিয়েছে, তাদেরকে এক নতুন ঐক্যসূত্রে গেঁথে দিয়েছেন। যে মানব গোষ্ঠী বিভিন্ন দল-গোত্র-খান্দানে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিলো, ছিলো পরস্পরের রক্ত পিপাসু ও ইজ্জতের দুশমন-এ আহবানর ফলে তারা পরস্পর পরস্পরের ভাই এবং একে অপরের ইজ্জতের সংরক্ষক বনে গেল। এই ঐক্যের ফলে এক নতুন শক্তির উদ্বোধন হলো এবং এই আহবান দুনিয়ার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস সৃষ্টি করলো ও শ্রেষ্ঠতম সংস্কৃতি রূপায়ণের নিয়ামকে পরিণত হলো। এই গূঢ় সত্যের দিকেই আল কুরআন ইংগিত করেছে তার নিজস্ব অনুপম ভঙ্গিতেঃ
واذكروا نعمة الله عليكم اذ كنتم اعداء فالَّف بيت قلوبكم فاصبحتم بنعمته اخوانا وَّ كنتم على شفاء حفرة من النار فانقذكم منها –
“আল্লাহর সেই নিয়ামতের কথা স্মরণ করো, যখন তোমরা ছিলে পরস্পরের ঘোরতর দুশমন, তখন তিনিই তোমাদের হৃদয়কে জুড়ে দিলেন এবং তোমরা তাঁর অনুগ্রহ ও মেহরবানীর ফলে ভাই-ভাই হয়ে গেলে। (নিঃসন্দেহে) তোমরা ছিলে আগুনের গর্তের তীরে দাঁড়িয়ে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে সেখান থেকে নাজাত দিলেন (এবং ধ্বংসের হাত থেকে রা করলেন।)” আলে ইমরানঃ ১০৩
আম্বিয়ায়ে কিরাম মানব জাতিকে আহবান জানিয়েছেন এই বলেঃ
واعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرقوا –
“আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো (ঐকবদ্ধ হও) এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।”
ইসলামের এই একতা শুধু কানুনী বাহ্যিক একতা নয়, বরং এ হচ্ছে হৃদয়ের একত্ব। ইসলাম শুধু কানুনী ঐক্যকে ঐক্য মনে করে না, বরং এই বাহ্যিক ঐক্যের বুনিয়াদকে সে মানুষের হৃদয়ে স্থাপন করতে চায়। এর প্রকৃত উৎস হচ্ছে বিশ্বাস ও মতোবাদের ঐক্য, আশা ও আকাঙ্খার ঐক্য, সংকল্প ও হৃদয়াবেগের ঐক্য। সে বাইরে যেমন সবাইকে এক ঐক্য সূত্রে গেঁথে দেয়, তেমনি ভেতর দিক দিয়েও তাদেরকে এক ‘উখুয়্যাত’ বা ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে জুড়ে দেয়। আর এটাই সত্য যে, এই উভয় লক্ষণ যখন পূর্ণভাবে প্রকাশ পায়, প্রকৃত ঐক্য ঠিক তখনই গড়ে ওঠে। কারণ কৃত্রিম ঐক্য কখনো স্থায়ী হয়না ঘৃনা ও বিদ্বেষপূর্ণ হৃদয় কখনো যুক্ত হতে পারে না। মিথ্যা কখনো কোন ঐক্য গড়ে তুলতে পারে না। স্বার্থপরতামূলক ঐক্য শুধু বিভেদ ও অনৈক্যের উৎস হয়ে থাকে। আর শুধু আইনগত বন্ধনও কোন যথার্থ মিলন বা বন্ধুত্বের ভিত্তি রচনা করতে পারে না। এ কারণেই ইসলাম একতার ভিত্তিকে ঈমান, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের ওপর স্থাপন করেছে। এই ভিত্তিভূমির ওপর গড়ে ওঠা সম্পর্ক এমনি সুদৃঢ় প্রাচীরে পরিণত হয় যে, তার সাথে সংঘর্ষ লাগিয়ে বড় বড় তুফানও শুধু নিজের মস্তকই চূর্ণ করতে পারে, কিন্তু তার কোন তি সাধন করতে পারে না।
উপরন্তু এই ভিত্তির ওপর যে সমাজ সংস্থা গঠিত হয়, সেখানে বিরোধ ও সংঘর্ষের বদলে সহযোগিতা ও পোষকতার ভাবধারা গড়ে ওঠে। সেখানে একজন অপরজনের সহায়ক, পৃষ্টপোষক ও সাহায্যকারী হয়ে থাকে। সেখানে পড়ন্ত ব্যক্তিকে পড়ে যেতে দেয়া হয় না, বরং তার সাহায্যের জন্যে অসংখ্য হাত প্রসারিত হয়। সেখানে পিছে পড়ে থাকা ব্যক্তিকে ফেলে যাওয়া হয় না, বরং তাকে সর্বতো ভাবে সাহায্য করে সামনে এগিয়ে নেয়া হয়। এ সমাজ ব্যক্তিকে তার সমস্যাদির মুকাবেলা করার যোগ্য করে তোলে এবং পতনশীল ব্যক্তিকে আঁকড়ে ধরে রাখার কাজ আঞ্জাম দেয়।
ইসলাম যে ভিত্তিগুলোর ওপর তার সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলে সেগুলোকে খুব ভালোমতো অনুধাবন করা এবং সে লক্ষ্য অর্জনের জন্যে নিজের শক্তি ও সামর্থকে নিয়োজিত করা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পক্ষে অবশ্য কর্তব্য।
আমাদের শ্রদ্ধেয় বন্ধু ও প্রিয় ভাই খুররম জাহ্ মুরাদ ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের এ বুনিয়াদী প্রয়োজনটি পূর্ণ করার জন্যে এই পুস্তকটি রচনা করেছেন। এ দেশের যে ক’জন নগন্য সংখ্যক যুবক পাশ্চাত্য শিক্ষা লাভ করা সত্ত্বেও ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে বিশেষ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন করেছেন, খুররম সাহেব তাঁদের অন্যতম। বস্তুতঃ খোশবু থেকে যদি ফুলের পরিচয় পাওয়া যায় তবে তাঁর এ রচনাটিও তাঁর চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভংগী উপলব্ধি করার পক্ষে সহায়ক হবে। প্রকৃতপক্ষে আলোচ্য বিষয়টির তিনটি দিক রয়েছেঃ
একঃ এক সামাজিক ও সামগ্রিক জীবনধারা গড়ে তোলা এবং একে স্থিতিশীল রাখার জন্যে ইসলাম ব্যক্তি-চরিত্রে কোন্ কোন্ মৌলিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ দেখতে চায়।
দুইঃ কি কি বস্তু এ ভিত্তিগুলোকে ধ্বংস ও দুর্বল করে দেয়, যাতে করে সেগুলো থেকে বেঁচে থাকা যায়।
তিনঃ কি কি গুণাবলী এ ভিত্তিগুলোকে মজবুত ও উন্নত করে তোলে, যাতে করে সেগুলোকে গ্রহণ করা যেতে পারে।
শ্রদ্ধেয় লেখক অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে এ তিনটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণ যদি এই জবাবগুলো অভিনিবেশ সহকারে পড়েন এবং এগুলো অবলম্বন করার প্রয়াস পান, তবে নিজেদের সামগ্রিক জীবনকেই তারা ঈমান, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের পুষ্পে- যা জীবনের ফুল-বাগিচাকে কুসুমিত করে তোলে –পুষ্পিত করতে পারবেন।
এ পুস্তিকা থেকে উপকারীতা লাভের ব্যাপারে কর্মীদের আরো একটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। সমস্ত জিনিস মানুষ রাতারাতি অর্জন করতে পারে না। তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে: চরিত্র গঠনের গোটা পরিকল্পনাটিকে বুঝে নিয়ে এক একটি জিনিসকে মনের মধ্যে খুব ভালো মতো বদ্ধমূল করে নেয়া, তারপর তাকে গ্রহণ ও অনুসরণ করার চেষ্টা করা এবং এভাবে প্রথমটির পর দ্বিতীয়টির পর তৃতীয়টিকে গ্রহণ করা।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি সাত-আট বছরে সূরায়ে বাক্বারাহ পড়েছিলেন। এ সম্পর্কে তাঁর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে তিনি বলেন যে, ‘আমি একটি জিনিস পড়ি, তাকে গ্রহণ করি এবং তারপর সামনে অগ্রসর হই।’ বস্তুতঃ চরিত্র গঠনের জন্যে এমনি ক্রমিক, ধারাবাহিক ও অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টারই প্রয়োজন। নিছক অধ্যায়নই এর জন্যে যথেষ্ট নয়। এ উদ্দেশ্য কেবল ক্রমাগত প্রয়াস-প্রচেষ্টার দ্বারাই হাসিল হতে পারে। এ কথাও খুব ভালোভাবে মনে রাখতে হবে যে, এটা চড়াই-উৎরায়ের পথ। সাহস ও আস্থার সাথে অবিরাম প্রচেষ্টার ভেতরেই এ পথের সাফল্য নিহিত। এ পথে ব্যর্থতা আসবে কিন্তু দৃঢ়ভাবে তার মুকাবেলা করতে হবে। সমস্যা যুদ্ধের আহবান জানাবে, কিন্তু তাকে জয় করতে হবে। সংকট বাধার সৃষ্টি করবে, কিন্তু তাকে পরাভূত করতে হবে। এগুলো হচ্ছে এ পথের অনিবার্য পর্যায়। এসব দেখে কি আমরা ভীত কিংবা লক্ষ্যপথ থেকে পিছিয়ে যাবো|
-অধ্যাপক খুরশীদ আহমাদ।
একঃ পারস্পারিক সম্পর্কের ভিত্তিঃ তার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
১. সম্পর্কের ভিত্তি ও মর্যাদা
ইসলামী আন্দোলন এক সামগ্রিক ও সর্বাত্মক বিপ্লবের আহবান। এ জন্যই এ বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মীদের সাধারণভাবে সমস্ত মানুষের সঙ্গে এবং বিশেষভাবে পরস্পরের সাথে এর সঠিক ভিত্তির ওপর সম্পৃক্ত করে দেয়া এর প্রধানতম বুনিয়াদী কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। এ কর্তব্য সম্পাদনের জন্যে ইসলাম এই সম্পর্কের প্রতিটি দিকের ওপরই আলোকপাত করেছে এবং ভিত্তি থেকে খুঁটিনাটি বিষয় পর্যন্ত প্রতিটি জিনিসকেই নির্ধারিত করে দিয়েছে।
পারস্পারিক সম্পর্ককে বিবৃত করার জন্যে আল-কুরআনে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ মনোজ্ঞ বর্ণনাভংগী ব্যবহার করা হয়েছে, বলা হয়েছেঃ
انما المؤمنون اخواة –
“মু’মিনেরাতো পরস্পরের ভাই”–হুজরাতঃ ১০
দৃশ্যতঃ এটি তিনটি শব্দ বিশিষ্ট একটি ছোট্ট বাক্যাংশ মাত্র। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পারস্পারিক সম্পর্কের ভিত্তি, তার আদর্শিক মর্যাদা এবং ইসলামী আন্দোলনের জন্যে তার গুরুত্ব ও গভীরতা প্রকাশ করার নিমিত্তে এ বাক্যাংশটুকু যথেষ্ট। এ ব্যাপারে একে ইসলামী আন্দোলনের সনদের (ঈযধৎঃবৎ) মর্যাদা দেয়া যেত পারে।
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী আন্দোলনে লোকদের সম্পর্ক হচ্ছে একটি আদর্শিক সম্পর্ক। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের একত্ব এর গোড়া পত্তন করে এবং একই আদর্শের প্রতি ঈমানের ঐক্য এতে রঙ বিন্যাস করে। দ্বিতীয়তঃ আদর্শিক সম্পর্ক হবার কারণে এটা নিছক কোন নিরস বা ঠুনকো সম্পর্ক নয়। বরং এতে যে স্থিতি, গভীরতা ও প্রগাঢ় ভালোবাসার সমন্বয় ঘটে, তাকে শুধু দুই ভাইয়ের পারস্পারিক সম্পর্কের দৃষ্টান্ত দ্বারাই প্রকাশ করা চলে। এমনি সম্পর্ককেই বলা হয় উখুয়্যাত বা ভ্রাতৃত্ব। বস্তুতঃ একটি আদর্শিক সম্পর্কের ভেতর ইসলাম যে স্থিতিশীলতা, প্রশস্ততা ও আবেগের সঞ্চার করে,তার প্রতিধ্বনি করার জন্যে ভ্রাতৃত্বের (উখুয়্যাত) চেয়ে উত্তম শব্দ আর কি হতে পারে?
২. ভ্রাতৃত্ব ঈমানের অনিবার্য দাবী
ইসলামী সভ্যতায় ঈমানের ধারণা শুধু এটুকু নয় যে, কতিপয় অতি প্রাকৃতিক সত্যকে স্বীকার করে নিলেই ব্যস হয়ে গেল। বরং এ একটি ব্যপকতর ধারণা বিশিষ্ট প্রত্যয়-যা মানুষের হৃদয়-মনকে আচ্ছন্ন করে, যা তার শিরা-উপশিরায় রক্তের ন্যায় সঞ্চালিত হয়। এ এমন একটি অনুভূতি, যা তার বক্ষশেকে উদ্বেলিত করে ও আলোড়িত করে রাখে। এ হচ্ছে তার মন-মগজ ও দিল-দিমাগের কাঠামো পরিবর্তনকারী এক চিন্তাশক্তি। সর্বোপরি, এ হচ্ছে এক বাস্তবানুগ ব্যবস্থাপনার কার্যনির্বাহী শক্তি, যা তার সমস্ত অংগ-প্রত্যংগকে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে গোটা ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনেই বিপ্লবের সূচনা করে। যে ঈমান এতোটা ব্যাপক প্রভাবশালী, তার অক্টোপাস থেকে মানুষের পারস্পারিক সম্পর্ক কিভাবে মুক্ত থাকতে পারে! বিশেষতঃ এটা যখন এক অনস্বীকার্য সত্য যে, মানুষের পারস্পারিক সম্পর্কের সাথে তার গোটা জীবন–একটি নগণ্য অংশ ছাড়া- ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। বস্তুতঃ এ কারণেই ঈমান তার অনুসারীদেরকে সমস্ত মানুষের সাথে সাধারণভাবে এবং পরস্পরের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্ক স্থাপন করার নির্দেশ দেয়। উপরন্তু ঐ সম্পর্ককে সুবিচার (আদ্ল) ও সদাচরণের (ইহ্সান) ওপর প্রতিষ্ঠা করার জন্যে সে একটি সামগ্রিক জীবনপদ্ধতি এবং সভ্যতারও রূপদান করে। অন্যদিকে অধিকার ও মর্যাদার ভিত্তিকে সে একটি পূর্ণাঙ্গ বিধি-ব্যবস্থায় পরিণত করে দেয়, যাতে করে নিজ নিজ স্থান থেকে প্রত্যেকেই তাকে মেনে চলতে পারে। এভাবে এক হাতের আঙ্গুলের ভেতর অন্য হাতের আঙ্গুল কিংবা এক ভাইয়ের সঙ্গে অন্য ভাই যেমন যুক্ত ও মিলিত হয়, ঈমানের সম্পর্কে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরাও যেনো পরস্পরে তেমনি যুক্ত হতে পারে। আর এ হচ্ছে ঈমানের আদর্শিক মর্যাদার অনিবার্য দাবী। এমন ঈমানই মানব প্রকৃতি দাবী করে এবং এ সম্পর্কেই তার বিবেক সাক্ষ্যদান করে। যারা সব রঙ বর্জন করে শুধু আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হয়, তামাম আনুগত্য পরিহার করে কেবল আল্লাহর আনুগত্য কবুল করে, সমস্ত বাতিল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু সত্যের সাথে যুক্ত হয় এবং আল্লাহরই জন্যে একনিষ্ঠ ও একমুখী হয়, তারাও যদি পরস্পরে সম্পৃক্ত ও সংশ্লিষ্ট না হয় এবং প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন না করে, তবে আর কে করবে? উদ্দেশ্যের একমুখিনতার চাইতে আর কি বড় শক্তি রয়েছে, যা মানুষকে মানুষের সাথে যুক্ত করতে পারে! এ একমুখিনতার এবং সত্য পথের প্রতিটি মঞ্জিলই এ সম্পর্ককে এক জীবন্ত সত্যে পরিবর্তিত করতে থাকে। যে ব্যক্তি সত্যের খাতিরে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়, সে স্বভাবতই এ পথের প্রতিটি পথিকের ভালোবাসা, সহানুভূতি, সান্তনা ও পোষকতার মুখাপেক্ষী এবং প্রয়োজনশীল হয়ে থাকে। সুতরাং এ পথে এসে এ নিয়ামতটুকুও যদি সে লাভ না করে তো বড় অভাবকে আর কিছুতেই পূর্ণ করা সম্ভব নয়।
৩. বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লবের জন্যে ভ্রাতৃত্ব অপরিহার্য
এ দুনিয়ায় ঈমানের মূল লক্ষ্যে (অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি এবং ইসলামী সভ্যতার প্রতিষ্ঠা) স্বতঃই এক সূদৃঢ়, স্থিতিশীল ও ভ্রাতৃত্বসুলভ সম্পর্কের দাবী করে। এ লক্ষ্য অর্জনটা কোন সহজ কাজ নয়। এ হচ্ছে ‘প্রেমের সমীপে পদার্পণ করার সমতুল্য’। এখানে প্রতি পদক্ষেপে বিপদের ঝড়-ঝান্ডা ওঠে,পরীক্ষার সয়লাব আসে। স্পষ্টত এমনি গুরুদায়িত্ব পালন করার জন্যে প্রতিটি ব্যক্তির বন্ধুত্ব অতীব মূল্যবান। এর অভাব অন্য কোন উপায়েই পূর্ণ করা চলে না। বিশেষত এ পথে সমর্থক-সহায়কের অভাব এক স্বাভাবিক সত্য বিধায় এমনি ধরণের শূণ্যতাকে এক মুহূর্তের জন্যেও বরদাশত করা যায় না।
উপরন্তু একটি সংঘবদ্ধ ও শক্শিালী জামায়াত ছাড়া কোন সামগ্রিক বিপ্লবই সংঘটিত হতে পারে না। আর সংহত ও শক্তিশালী জামায়াত ঠিক তখনই জন্ম লাভ করে, যখন তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিগণ পরস্পরে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। এই উদ্দেশ্যে এমনি সংঘবদ্ধভাবে কাজ করা উচিত, যাতে স্বভাবতই এক ‘সীসার প্রাচীরে’ পরিণত হবে (بنيان مرصوص); তার ভেতরে কোন বিভেদ বা অনৈক পথ খুঁজে পাবে না। বস্তুত এমনি সুসংহত প্রচেষ্টাই সাফল্যের নিশ্চয়তা দিতে পারে।
আল্লাহ তায়ালা সূরায়ে আলে ইমরানে একটি নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের পরিচালকদের এমন সম্পর্ক গড়ে তোলবারই নির্দেশ দিয়েছেন:
يايها الذين امنوا اصبروا وصابروا ورابطوا واتقوا الله لعلكم تفلحون –
“হে ঈমানদারগণ! ধৈর্যধারণ কর এবং মুকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারো।” (আলে ইমরানঃ২০০)
সূরায়ে আনফালের শেষ দিকে ইসলামী বিপ্লবের পূর্ণতার জন্যে মুসলমানদের পারস্পারিক সম্পর্ককে একটি আবশ্যিক শর্ত হিসাবে সামনে রাখা হয়েছে। এবং বলা হয়েছেঃ যারা এই দ্বীনের প্রতি ঈমান আনবে, এর জন্যে সবকিছু ত্যাগ করবে এবং এই আন্দোলনে নিজের ধন-প্রাণ উৎসর্গ করবে, তাদের পারস্পারিক সম্পর্ক হবে নিশ্চিতরূপে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক। এ সম্পর্কের জন্যে এখানে ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
ان الذين امنوا وهاجروا وجاهدوا باموالهم وانفسهم فى سبيل الله والذين اواو ونصروا اولـــئك بعضهم اولــياء بعضٍ –
“যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে, স্বীয় জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় ও সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছে, তারা একে অপরের বন্ধু।” (আনফালঃ৭২)
এখান থেকে আরো কিছুটা সামনে এগিয়ে কাফেরদের সাংগঠনিক ঐক্য এবং তাদের দলীয় শক্তির প্রতি ইশারা দিয়ে বলা হয়েছে যে, মুসলমানরা যদি এমনি বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে না তোলে তবে আদল, ইহসান ও খোদাপরস্তির ভিত্তিতে একটি বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লবের আকাঙ্খা কখনো বাস্তব দুনিয়ায় দৃঢ় মূল হতে পারবে না। ফলে আল্লাহর এই দুনিয়া ফেতনা-ফাসাদে পূর্ণ হয়ে যাবে। কেননা এ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছাড়া বিপ্লবের বিরুদ্ধ শক্তিগুলোর মুকাবেলা করা মুসলমানদের পে সম্ভবপর নয়।
والذين كفروا بعضهم اولـــياء بعضٍ – الا تفعلوه تكن فتنة فى الارض وفساد كبير –
“আর যারা কাফের তারা পরস্পরের বন্ধু, সহযোগী। তোমরা (ঈমানদার লোকেরা) যদি পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে না আস তাহলে জমীনে বড়ই ফেতনা ও কঠিন বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।” (আনফালঃ৭৩)
আর এ কথা সুস্পষ্ট যে, ইসলামী সভ্যতার প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টির জন্যে এমন প্রয়াস-প্রচেষ্টাই হচ্ছে ঈমানের সত্যাসত্য নির্ণয়ের প্রকৃত মানদন্ড।
والذين امنوا وهاجروا وجاهدوا فى سبيل الله والذين اَوَاوْ ونصروا اولـــئك هم المؤمنون حقاً –
“যারা ঈমান এনেছে নিজেদের ঘর-বাড়ী ছেড়েছে এবং আল্লাহর রাহে জিহাদ করেছে এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, সাহায্য-সহায়তা করেছে, তারাই প্রকৃত মু’মিন। (আনফালঃ৭৪)
এরই কিছুটা আগে আল্লাহ তায়ালা বিরুদ্ধবাদীদের মুকাবেলায় আপন সাহায্যের প্রতিশ্র“তির সাথে মু’মিনদের জামায়াত সম্পর্কে নবী করিম (সঃ)কে এই বলে সুসংবাদ দিয়েছেন যে, তাদের দিলকে তিনি নিবিড়ভাবে জুড়ে দিয়েছেন এবং তারাই হচ্ছে ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের চাবিকাঠি।
هو الذى ايدك بنصره وبالمؤمنين – والّف بين قلوبهم-
“তিনিই তো নিজের সাহায্য দ্বারা ও মু’মিনদের দ্বারা তোমার সহায়তা করেছেন এবং মু’মিনদের দিলকে পরস্পরের সাথে জুড়ে দিয়েছেন।” (আনফাল: ৬২-৬৩)
৪. ভ্রাতৃত্বের দাবীঃ তার গুরুত্ব ও ফলাফল
বস্তুত ইসলামী বিপ্লবের আহবায়কদের এ পারস্পারিক সম্পর্ক হচ্ছে ভ্রাতৃত্ব (উখুয়্যাত), বন্ধুত্ব, রহমত ও ভালোবাসার সম্পর্ক। কিন্তু এর ভেতর ‘ভ্রাতৃত্ব’’ শব্দটি এতো ব্যাপক অর্থবহ যে, অন্যান্য গুণরাজিকে সে নিজের ভেতরেই আত্নস্থ করে নেয়। অর্থাৎ দুই সহোদর ভাই যেমন একত্রিত হয় এবং তাদের মধ্যকার কোন মতপার্থক্য, ঝসড়া-ফাসাদ বা বিভেদ-বিসম্বাদকে প্রশ্রয় দেয়া হয় না, ইসলামী আন্দোলনের কর্র্মীদের পরস্পরকে ঠিক তেমনিভাবে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। দুই ভাই যেমন পরস্পরের জন্যে নিজেদের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়, পরস্পর পরস্পরের শুভাকাক্সী হয়, সাহায্য ও সহযোগিতায় নিয়োজিত থাকে এবং একে অপরের সহায়ক ও পৃষ্টপোষকে পরিণত হয়; যেভাবে এক তীব্র প্রেমের আবেগ ও প্রাণ-চেতনার সঞ্চার করে, সত্য পথের পথিকদের (যারা দ্বীন ইসলামের খাতিরে নিজেদের গোটা জীবনকে নিয়োজিত করে দেয়) মধ্যে ঠিক তেমনি সম্পর্কই গড়ে ওঠে। মোটকথা ইসলামী বিপ্লবের প্রতি যে যতোটা গভীরভাবে অনুরক্ত হবে, আপন সাথী ভাইয়ের সংগে ততোটা গভীর সম্পর্কই সে গড়ে তুলবে। তেমনি এ উদ্দেশ্যটা যার কাছে যতোটা প্রিয় হবে, তার কাছে এ সম্পর্কও ততোটা প্রিয় হবে। কারণ এ সম্পর্ক হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর জন্যে এবং আল্লাহর পথে সংগ্রামকারীদের। কাজেই যে ব্যক্তি ইসলামী বিপ্লবের কর্মী ও আহবায়ক হবে, আপন সাথী ভাইয়ের সাথে তার সম্পর্ক যদি পথ চলাকালীন অপরিচিত লোকের মত হয় তবে তার নিজের সম্পর্কে চিন্তা করে দেখা উচিত যে, সে কোন্ পথে এগিয়ে চলেছে। অথবা আপন সংগী-সহকর্মীদের সাথে তার সম্পর্ক যদি গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়া ধুলোর মত ণস্থায়ী হয়, তবে, তার চিন্তা করে দেখতে হবে যে, যে উদ্দেশ্যের প্রতি মে ভালোবাসার দাবী করে, তার দিলে তার কতোটা মূল্য রয়েছে।
ভ্রাতৃত্বের এ সম্পর্কের জন্যেই নবী করিম (সঃ) حب الله (আল্লাহর জন্যে ভালোবাসা)-এর মত পবিত্র, ব্যাপক ও মনোরম পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। ‘ভালোবাসা’ নিজেই এক বিরাট চিত্তাকর্ষক ও শ্র“তিমধুর পরিভাষা। এর সাথে ‘আল্লাহর পথে’ এবং ‘আল্লাহর জন্যে’ বিশ্লেষণদ্বয় একে তামাম স্থুলতা ও অপবিত্রতা থেকে মহত্ত্বের উচ্চতম পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। এমনিভাবে এ পরিভাষাটি দিল ও আকলকে যুগপৎ এমন এক নির্ভুল মানদন্ড দান করে, যা দিয়ে প্রত্যেক মু’মিন তার সম্পর্ককে যাচাই করে দেখতে পারে।
আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তার পথে ভালোবাসা এ দু’টো জিনিসের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। যেখানে এর একটি থাকবে, সেখানে অপরটিও দেখা যাবে। একটি যদি না থাকে তবে অপরটি সন্দেহজনক হয়ে দাঁড়াবে। তাই নবী করিম (সঃ) বলেছেন: لا تؤمنوا حتى تحابوا
“তোমরা ততোণ পর্যন্ত মু’মিন হবে না, যতোণ না পরস্পরকে ভালোবাসবে।” (মুসলিমঃ আবু হুরায়রা)
অতঃপর গোটা সম্পর্ককে এই ভিত্তির ওপর স্থাপন করা এবং ভালোবাসা ও শত্রুতাকে শুধু আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট করে দেয়াকে ঈমানের পূর্ণতার জন্যে অপরিহার্য শর্ত বলে অভিহিত করা হয়েছে:
من احب لله وابغض لله واعطى لله ومنع لله فقد استكمل الايمان –
“যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহর জন্যে ভালোবাসলো, আল্লাহর জন্যে শত্রুতা করলো, আল্লাহর জন্যে কাউকে কিছু দান করলো এবং আল্লাহর জন্যই কাউকে বিরত রাখলো, সে তার ঈমানকেই পূর্ণ করে নিলো।”
মানুষের জীবনে বন্ধুত্ব ও শত্রুতা বাস্তবিকই অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তাই ঈমানের পূর্ণতার জন্যে এ দু’টো জিনিসকেই আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট করে দেয়ার অপরিহার্য শর্ত নিতান্ত স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত হয়েছে। ঈমানের বহুতর শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এর প্রতিটি শাখাই নিজ নিজ জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুসংহত শক্তিকে ক্ষমতাশীন করার জন্যে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা যেরূপ জরুরী তার পরিপ্রেক্ষিতে নবী করিম (সঃ) তাকে সমস্ত কাজের চাইতে শ্রেষ্ঠ কাজ বলে অভিহিত করেছেন। হযরত আবু জার (রাঃ) বর্ণনা করেন:
خرج علينا رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال أتد رون اىُّ الاعمال احب الى الله تعالى قال قائـــل الصلوة والزكوة وقال قائـــل الجهاد قال النبى صلى الله عليه وسلم ان احب الاعمال الى الله تعالى الحب لله والبغض لله –
“একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের কাছে আগমন করলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা কি জান, আল্লাহ তায়ালার কাছে কোন কাজটি বেশী প্রিয়? কেউ বললো নামাজ ও যাকাত। কেউ বললো জিহাদ। মহানবী (সঃ) বললেনঃ কেবল আল্লাহর জন্যে ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্যেই শত্রুতাই হচ্ছে সমস্ত কাজের মধ্যে আল্লাহর কাছে বেশী প্রিয়।”(আহমদ, আবু দাউদ, আবু যাররা)
আর একবার হযরত আবুজার (রাঃ)কে উদ্দেশ্য করে মুহাম্মাদ (সঃ) প্রশ্ন করেন:
يا اباذرٍّ اىُّ عرى الايمان اوثق قال الله ورسوله اعلم قال
الموالاة فى الله والحب لله وابغض لله ‘হে আবুজার! ঈমানের কোন্ কাজটি অধিকতর মজবুত? জবাব দিলেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। মহানবী (সঃ) বললেন: তা হচ্ছে আল্লাহর পথে বন্ধুত্ব এবং তাঁর জন্যে ভালোবাসা ও শত্রুতা।’ (বায়হাকী-ইবনে আব্বাস)
হাদীসে উল্লেখিত عرى বলতে রজ্জু এবং থালা-বাসনের আংটা বা হাতলকেও বুঝায়। তাছাড়া যে গাছের পাতা শীতকালেও ঝরে না, তাকেও عرى বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহর পথে ভালোবাসা হচ্ছে এমন মজবুত ভিত্তি, যার ওপর নির্ভর করে মানুষ নিশ্চিন্তে ঈমানের চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে।এমন ভিত্তিতে না কখনো ফাঁটল ধরে, আর না তা ধসে পড়ে।
মোটকথা, ঈমান মানুষের গোটা জীবনকেই দাবী করে। অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি মুহুর্তই- যতক্ষন দেহে শ্বাস-প্রশ্বাসের আসা যাওয়া অব্যহত থাকবে-ঈমানের চাহিদা অনুযায়ী অতিবাহিত করা উচিত। কিন্তু যতোণ পর্যন্ত মু’মিনের গোটা সম্পর্ক-সম্বন্ধ আল্লাহর জন্যে ভালোবাসার সম্পর্কে পরিণত না হবে ততোক্ষণ জীবনে এতো ব্যাপকভাবে নেক কাজের সূচনা হতে পারে না। এ জন্যে যে, সম্পর্ক-সম্বন্ধ হচ্ছে মানব জীবনের এক বিরাট অংশ। এ জিনিসটি অনিবার্যভাবে তার জীবনকে প্রভাবান্বিত করে এবং এক প্রকারে তার বন্ধুত্ব ও দীনের মানদন্ড হয়ে দাঁড়ায়। তাই যাদের জীবনে খোদার স্মরণ দৃঢ় মূল হয়েছে, তাদের সাথে আপন সত্তাকে যুক্ত করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। এবং তারা যাতে সত্য পথে চালিত হয় এবং দুনিয়ার শান-শওকত ও সাজসজ্জার গোলক-ধাঁধায় পড়ে নিজেদের চুকে বিভ্রান্ত না করে,তার জন্যে ‘সবর’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন:
واصبر نفسك مع الذين يدعون ربهم بالغدوت والعشى يريدون وجهه ولا تعد عيناك عنهم تريد زينة الحيوة الدنيا –
‘তুমি স্বীয় সত্তাকে তাদের সঙ্গে সংযত রাখো, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় আপন প্রভূকে ডাকে এবং তার সন্তুষ্টি তালাশ করে, আর দুনিয়াবী জীবনের চাক্চিক্য কামনায় তোমাদের দৃষ্টি যেন তাদের দিক থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্যদিকে ছুটে না যায়।’ –(সূরা ক্বাহাফ)
অন্যদিকে মানুষকে তার বন্ধুত্ব স্থাপন খুব ভেবে চিন্তে করার জন্যে নবী করিম (সঃ) সাবধান করে দিয়েছেন। কেননা:
المرء على دين خليله فلينظر احدكم من يخالل – (احمد- ترمذى – ابو داود –بيهقى- ابو هريرة)
‘মানুষ তার বন্ধুর (খলীল) দ্বীনের ওপরই কায়েম থাকে। কাজেই তোমরা কাকে বন্ধু বানাও তা প্রত্যেকেই ভেবে চিন্তে নাও।’ (আবু হুরায়রা রাঃ থেকে)
হাদীসে উল্লেখিত خليل শব্দটি থেকে خلت নিষ্পন্ন হয়েছে। এর মানে হচ্ছে এমন ভালোবাসা ও আন্তরিকতা, যা দিলের ভেতর বদ্ধমূল হয়ে যায়। হাদীসে ভালো ও মন্দ লোকের ভালোবাসা ও সহচর্যের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে: ভালো লোকের সহচর্য হচ্ছে কোন আতর বিক্রেতার কাছে বসার মতো, যদি আতর না পাওয়া যায়, তবু তার খুশবুতে দিল-দিমাগ সতেজ হয়ে উঠবে। মতো, যদি আতর না পাওয়া যায়, তবু তার খুশ্বুতে দিল-দিমাগ সতেজ হয়ে উঠবে। আর মন্দ লোকের সংস্পর্শ হচ্ছে লোহার দোকানের তুল্য; তাতে কাপড় না পুড়লেও তার কালি এবং ধোঁয়া মন-মেজাজ খারাপ করে দিবেই।
ঈমানের একটি স্তরে এসে মানুষ নিজেই ঈমান এবং তার বাস্তব দাবী পূরণে এক বিশেষ ধরণের আনন্দ ও মাধুর্য অনুভব করে। এ আনন্দানুভূতির কারণেই মানুষের ভেতর নেক কাজের প্রেরণা জাগে। রাসূলে কারীম (সঃ) এই জিনিসটাকেই حلاوت الايمان বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এর তিনটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে একটা জিনিস হচ্ছে এই:
ان يحب المرء لا يحبه الا لله –
‘সে অন্য লোককে ভালোবাসবে এবং তার এ ভালোবাসা আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্যে হবে না।’ (বুখারী, মুসলিম)
গোলাম ও বান্দাহ্ যদি তার মালিক ও মনিবের ভালোবাসা অর্জন করতে পারে তো এ বিরাট সম্পদের বিনিময়ে সে আর কি জিনিস পেতে পারে! বস্তুত এ ভালোবাসাই হচ্ছে মু’মিনের পক্ষে মি’রাজ স্বরূপ। নবী করিম (সঃ) বলেছেন- ‘যারা আল্লাহর জন্যে পরস্পরের বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে, তারাই এ বিরাট নিয়ামতের উপযুক্ত।’ তাই হযরত মু’য়াজ বিন জাবাল (রাঃ) বলেন:
سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول قال الله تعالى وجبت محبتى للمتحابين فى المسجالسين فى المتزاورين فى والمتباذلين فى-
‘আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: ‘যারা আমার জন্যে পরস্পরকে ভালোবাসে, আমার জন্যে একত্রে উপবেশন করে, আমার জন্যে পরস্পরে সাাত করতে যায় এবং আমার জন্যে পরস্পরে অর্থ ব্যয় করে, তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা অনিবার্য।’ – (মালেক)
৫. আখিরাতে ভ্রাতৃত্বের সুফল
দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর জন্যে ভালোবাসার এ ফলাফল তো আছেই; কিন্তু আখিরাতে যখন মানুষের প্রতিটি নেক কাজই মূল্যবান বিবেচিত হবে এবং একটি মাত্র খেজুরের সাদকা ও একটি ভালো কথাও তার জন্যে গণীমত বলে সাব্যস্ত হবে, তখন এ সম্পর্ক একজন মু’মিনকে অত্যন্ত উচু মর্যাদায় অভিষিক্ত করবে। বস্তুত ইসলামী বিপ্লবের ব্যাপারে এ সম্পর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা যা কিছু জানি, তার পরিপ্রেক্ষিতে এটা খুবই স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার।
সেদিন অন্যের সম্পর্কে কারো কোন হুশ থাকবে না। মানুষ তার মা-বাপ, ভাই-বোন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা সবকিছু ছেড়ে দূরে পালিয়ে যাবে। জাহান্নাম থেকে বাঁচবার জন্যে তাদের সাবাইকে বিনিময় দিতেও সে তৈরী হবে। সেদিন বন্ধুত্বের তামাম রহস্য উদ্ঘাটিত হয়ে যাবে এবং দুনিয়ার জীবনে যাদের ভালোবাসা দিল ও দিমাগে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিলো, সে বন্ধুই সেখানে শত্রুতে পরিণত হবে। কিন্তু প্রকৃত খোদাভীরু লোকদের বন্ধুত্ব সেখানে বজায় থাকবে। এজন্যে যে, সেদিন কাজে লাগবার মতো কি জিনিস সে বন্ধুরা দুনিয়ার জীবনে পরস্পরকে দান করেছে, সেই সংকট মুহুর্তে তা নির্ভুলভাবে জানা যাবে এবং তার গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুভূত হবে:
الا خلاء يومئذ بعضهم لبعض عدو الا المتقين ياعباد لا خوف عليكم اليوم ولا انتم تحزنون –
‘যারা পরস্পরের বন্ধু ছিল, সেদিন পরস্পরের শত্রু হয়ে যাবে, কেবল মুত্তাকি লোক ছাড়া। হে আমার বান্দাহ্গণ! আজকে তোমাদের কোন ভয় নেই, তোমরা ভীত সন্ত্রস্তও হবে না।’ -(সূরা যুখরাদ)
এভাবে যাদের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপিত হবে, তাদের সাথেই তার পরিণাম যুক্ত হবে। এমনকি আল্লাহর জন্যে ভালোবাসা পোষণকারীগণ যদি একজন থাকে প্রাচ্যে এবং অপর জন পাশ্চাত্যে তবুও মহান রব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কিয়ামতের দিন একত্রিত করে বলবেন, যার প্রতি তুমি আমার জন্যে ভালোবাসা পোষণ করতে সে লোকটিই হচ্ছে এই। হাদীসের বর্ণনা এমন:
১) المرء مع من احبَّ
২) لو ان عبد ين تحابَّا فى الله عزَّ وجلَّ واحد فى المشرق واخر ى المغرب لجمع الله بينهما يوم القيامة يقول هذا الذى كنت تحبه فىَّ
১। “মানুষ যে যাকে ভালোবাসে তার সাথেই তার পরিণাম সংযুক্ত।” (বুখারী, মুসলিম; ইবনে মাসউদ রা.)
২। “আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা পোষণকারী দু’ব্যক্তির একজন যদি থাকে প্রাচ্যে এবং অপর জন যদি থাকে পাশ্চাত্যে তবুও আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন তাদের উভয়কে কিয়ামতের দিন একত্রিত করে বলবেন, যার প্রতি তুমি আমার জন্যে ভালোবাসা করতে সে ব্যক্তিটি হচ্ছে এই – (বায়হাকী; আবু হুরায়রা রা.)
সেদিন মানুষের পায়ের নীচে আগুন উৎক্ষিপ্ত হতে থাকবে, মাথার ওপরে থাকবে আগুনের মেঘ এবং তা থেকে বর্ষিত হতে থাকবে আগুনের ফুলকি। ডানে, বামে, সামনে, পেছনে শুধু আগুনই তাকে পরিবেষ্টিত করে রাখবে আর তার আশ্রয় লাভের মতো একটি মাত্র ছায়াই থাকবে। আর তা হচ্ছে আরশে ইলাহীর ছায়া। সেদিন এ ছায়াতে সাত শ্রেণীর লোক স্থান পাবে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সঃ) বলেছেন:
رجلان تحابَّا فى الله اجتمعا عليه وتفرق عليه –
‘তাদের ভেতর এমন দু’জন লোক থাকবে, যারা আল্লাহর জন্যে পরস্পরকে ভালোবেসেছে, তাঁরই জন্যে একত্রিত হয়েছে এবং তাঁরই খাতিরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।’
তাঁর প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক যে, তিনি আমাদের কাছে তাঁর এ ফরমান পৌঁছে দিয়েছেন:
ان الله تعالى يقول يوم القيامة اين المتحابون فىَّ بجلا لى اليوم اظلهم فى ظلى يوم لا ظلَّ الا ظلِّى –
‘আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন বলবেন, যারা আমার শ্রেষ্ঠত্বের জন্যে পরস্পরকে ভালোবাসতো, তারা আজ কোথায়! আজকে আমি নিজের ছায়াতলে আশ্রয় দান করবো। আজকে আমার ছায়া ছাড়া আর কারো ছায়া নেই। -(মুসলিম-আবু হুরায়রা রা.)
আর যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা নিম্নরুপ সংবাদ দিয়েছেন তাদের জন্যে তো কতোই মর্যাদার ব্যাপার হবেঃ
المتحابون بجلالى لهم منابر من نور يغيطهم النبيون والشهداء –
‘যারা আমার শ্রেষ্ঠত্বের খাতিরে পরস্পরকে ভালোবাসে তাদের জন্যে আখিরাতে নূরের মিম্বর তৈরী হবে এবং নবী ও শহীদগণ তাদের প্রতি ঈর্ষা করবেন।’ – (তিরমিযি-মু’য়াজ বিন জাবাল)
৬. পারস্পারিক সম্পর্কের গুরুত্ব
আল্লাহর জন্যে এক ঈমানের ভিত্তিতে পরস্পরের এ গভীর স্থিতিশীল ও প্রেমের আবেগময় সম্পর্ক ইসলামী আন্দোলনের জন্যে এতোখানি গুরুত্বপূর্ণ যে, এর বিকৃতিকে অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে দেখা হয়েছে। পারস্পারিক সম্পর্কচ্ছেদ সম্পর্কে যে কঠোর সতর্কবাণী এসেছে, পরস্পরে আপোষ-মীমাংসা করা ও করানোর ব্যাপারে যে প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছে এবং সম্পর্ক বিকৃতকারীদের সম্বন্ধে যা কিছু বলা হয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পরে আসবে কিন্তু এখানে একথা মনে রাখা দরকার যে, সম্পর্কের বিকৃতি ও বিদ্বেষ পোষণকে নবী করীম (সঃ) এমন এক অস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন যা গোটা দ্বীনকেই একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়:
هى الحالقة لا اقول تحلق الشعر ولكن تحلق الدين – (احمد وترمذى- زبير)
এ সম্পর্কের প্রভাব কতো ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী হয়ে থাকে, তা এ থেকে বোঝা যায়। যারা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে এ দ্বীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে, আপন সঙ্গী-সাথীদের জন্যে তাদের অন্তঃকরণ থেকে ক্রমাগত প্রেমের ঝর্ণাধারা উৎসারিত হবে। তাদের কাছে এ সম্পর্ক এতোটা প্রিয় হবে এবং তাদের এ হৃদয়ে এর জন্যে এতোখানি মূল্যবোধের সৃষ্টি হবে যে অন্য যে কোন তি স্বীকারে তারা প্রস্তুত হবে; কিন্তু এর কোন অনিষ্ট তারা বরদাশ্ত করবে না।
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের এই পারস্পারিক প্রেম-ভালোবাসা তথা প্রীতির সম্পর্ককেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর শ্রেষ্ঠতম নিয়ামতের মধ্যে গণ্য করেছেন। আর যে ইসলামী জামায়াত এই অমূল্য সম্পদ লাভ করবে, তার প্রতি বর্ষিত হবে তার বিশেষ করুণা-আশির্বাদ। কেননা এ সম্পর্কই হচ্ছে ইসলামী জামায়াতের প্রাণবন্তু এবং তার সজীবতার লক্ষণ। এ সম্পর্ক তার লোকদের জন্যে এমন এক পরিবেশ রচনা করে, যাতে তারা একে অপরের পৃষ্ঠপোষক হয়ে সত্য পথের মঞ্জিল নির্ধারণ করতে থাকে; পরস্পর পরস্পরকে পূণ্যের পথে চালিত করার জন্যে হামেশা সচেষ্ট থাকে। প্রথম যুগের ইসলামী জামায়াতকে আল্লাহ তায়ালা পারস্পারিক ঐক্য, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বেও যে বিরাট সম্পদ দান করেছিলেন, সূরা আলে ইমরানে তার উল্লেখ করে তাকে তাঁর বিশেষ নিয়ামত বলে অভিহিত করা হয়েছে:
واذكروا نعمة الله عليكم اذ كنتم اعداء فالف بين قلوبكم فاصبحتم بنعمته اخوانًا –
“আর আল্লাহর সে নিয়ামতকে স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পরে দুশমন ছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়কে জুড়ে দিলেন আর তোমরা তাঁর মেহেরবানীর ফলে ভাই ভাই হয়ে গেলে।” – (আল ইমরানঃ১০৩)
অতঃপর সূরায়ে আনফালে নবী কারীম (সঃ)কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে যে, দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ ব্যয় করলেও মুসলমানদের দিলকে এমন প্রেম, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে জুড়ে দেয়া আপনার পক্ষে সম্ভবপর ছিলো না। এটা কেবল আল্লাহ তায়ালার কুদরতেই সম্ভবপর হয়েছে-একমাত্র তাঁর পক্ষেই এটা সম্ভবপর ছিলো। তিনি মানুষকে একটি দ্বীন দিয়েছেন এবং তাঁর প্রতি ঈমান ও ভালোবাসা পোষণের তাওফিক দিয়েছেন। তারই অনিবার্য ফল হচ্ছে এই প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসা।