ইকামাতে দ্বীন
অধ্যাপক গোলাম আযম
বইটির অডিও শুনুন
প্রাথমিক কথা
১৯৭৮ সালে ‘বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন’ নামে প্রথম প্রকাশিত এবং ১৯৮১ সালের তৃতীয় সংস্করণ থেকে “ইসলামী ঐক্য ইসলামী আন্দোলন” নামে আমার লেখা পুস্তিকাটিতে চিন্তা-প্রবাহের যে সিরিজ প্রকাশিত হয় তারই দ্বিতীয় সিরিজ হিসেবে ‘ইকামাতে দ্বীন’ লিখছি। প্রথম সিরিজে দেখান হয়েছে যে, আল্লাহ পাকের মেহেরবানীতে বাংলাদেশে ইসলামের খেদমত বিভিন্নভাবে যথেষ্ট হচ্ছে। মাদ্রাসা, মসজিদ, খানকাহ, ওয়াজ, তাবলীগ, ইসলামী সাহিত্য ইত্যাদির মাধ্যমে দ্বীন-ইসলামের যে, বিরাট খেদমত হচ্ছে তার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করে প্রমাণ করা হয়েছে যে, প্রত্যেক প্রকার খেদমতই অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ;সকলের খেদমত মিলেই ইসলামের মর্যাদা বৃদ্ধি করছে এবং এ খেদমতগুলোকে পরস্পর পরিপূরক মনে করা প্রত্যেক মুসলিম খাদেমে দ্বীনের কর্তব্য।
যারা নিজেদের দ্বীনি খেদমতকেই শুধু মূল্যবান মনে করে এবং অন্যদের খেদমতের কদর করে না, তাদের দ্বারা উম্মাতের মধ্যে বিভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হবার আশংকা রয়েছে। সবারই এ ধারণা করা উচিত যে, আমরা সবাই বিভিন্ন আকারে ও পদ্ধতিতে একই মহান দ্বীনের খেদমত করছি। একথাও ইখলাসের সাথে সবারই মনে রাখা উচিত যে, উপরোক্ত সব ক’টি খেদমতই নিজ জি ক্ষেত্রে মূল্যবান ও যরুরী। যদি সবাই সবার খেদমতকে মূল্যবান বলে স্বীকার করে তাহলে দেশের ইসলামী শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য ও মহব্বত সৃষ্টি হবে এবং দ্বীনের মর্যাদা আরও বাড়বে।
ফোরকানিয়া মাদ্রাসা ও মক্তবগুলো দ্বারা যে খেদমত হচ্ছে তা বড় বড় মাদ্রাসা দ্বারা সম্ভব নয়। আলীয়া ও কাওমী মাদ্রামায় যে উলামা তৈরী হচ্ছে তা তাবলীগ জামায়াতের দ্বারা হওয়া অসম্ভব। আবার তাবলীগ দ্বারা অগণিত জনসাধারণ দ্বীনের যেটুকু আলো পাচ্ছে তা মাদ্রাসার মারফতে পাওয়া অবাস্তব। শিক্ষিত সমাজ ইসলামী সাহিত্য দ্বারা ইসলামের জ্ঞান অর্জন করছে। কিন্তু ওয়ায়েযদের দ্বারা অশিক্ষিত লোকেরা ও ইসলামের জ্ঞান ও জযবা হাসিল করছে। মাদ্রাসা, ওয়ায ও তাবলীগ আছে বলেই মসজিদগুলো আবাদ আছে। এসব দিক খেয়াল করলে সব রকম খেদমতকেই মূল্যবান মনে হবে।
‘ইসলামী ঐক্য ইসলামী আন্দোলন’ বইতে প্রধানত খেদমতে দ্বীন সম্পর্কেই আলোচনা করা হয়েছে এবং দ্বীনের খাদেমদের ঐক্যের উপরই বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। ইসলামী ঐক্যের রূপ কী হতে পারে সে বিষয়ে একটি বাস্তব প্রস্তাবও পেশ করা হয়েছে। কিন্তু ইকামাতে দ্বীন সম্পর্কে ঐ পুস্তিকায়বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব সম্পর্কে শুধু কিছুটা ইংগিত সেখানে দেয়া হয়েছে। ইকামাতে দ্বীন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজনেই আর একটি বই লেখা দরকার হয়ে পড়েছে। তাই এ বইটি ঐ বই -এরই পরিপূরক এবং ঐ বইটি যারা পড়েছেন তাদের নিকট এ বইটির আবেদন বেশী স্পষ্ট হবে বলে আমার আশা।
‘ইকামাতে দ্বীন’ পুস্তকটিতে এমন একটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে যার চর্চা দ্বীনের খাদেমগণের মধ্যেও খুব কম। তাই বিষয়টিকে সহজভাবে পেশ করার প্রয়োজনে বিভিন্ন দ্বীনি খেদমাতের উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি যে, খেদমতে দ্বীন ও ইকামাতে দ্বীনে পার্থক্য রয়েছে। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি যাতে আমার কোন কথায় আল্লার দ্বীনের খাদেমগণের অসন্তুষ্ট হবার কারণ না ঘটে। যদি এমন কোন কথা তবু রয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আমাকে জানালে পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করবো ইনশাআল্লাহ।
এ বইয়ের আলোচ্য বিষয়
‘দ্বীন’ শব্দের ব্যাখ্যা
প্রথম অর্থ প্রতিদান বা বদলা
দ্বিতীয় অর্থ আনুগত্য
তৃতীয় অর্থ আনুগত্যের বিধান বা পদ্ধতি
চতুর্থ অর্থ আইন, রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা
দ্বীনের ব্যাপকতা
রাসূলূল্লাহ (সঃ) এর জীবনই দ্বীন ইসলামের বাস্তব নমুনা
‘ইকামাতে দ্বীনের’ মর্ম
বাংলাদেশে দ্বীনে হকের অবস্থা
দ্বীনে হক কায়েম হলে বাতিলের অবস্থা কী হয়
ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব
রাসূল (সঃ) কি দায়িত্বের অতিরিক্ত কাজ করেছেন?
ইসলামী আন্দোলনের চিরন্তন কর্মপদ্ধতি
ইসলামী আন্দোলন ও ক্যাডার পদ্ধতি
হক ও বাতিলের সংঘর্ষ অনিবার্য কেন?
দ্বীনি খেদমতের সাথে এ সংঘর্ষ হয় না কেন?
ওলামায়ে কেরাম সবাই “ইকামাতে দ্বীনে” সক্রিয় নন কেন?
দ্বীনের মাপকাঠি একমাত্র রাসূল (সঃ)
উপমহাদেশের বড় বড় ওলামা ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলন করেননি কেন?
জামায়াত-বদ্ধ প্রচেষ্টার গুরুত্ব
ইকামাতে দ্বীনের উদ্দেশ্যে গঠিত জামায়াতের বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশে এ জাতীয় জামায়াত আছে কি?
জামায়াতে ইসলামী ও মাওলানা মওদূদী (রঃ)
জামায়াত বিরোধী ফতোয়া
মাওলানা মওদূদী (রঃ) বিরোধী ফতোয়া
ওলামা ও মাশায়েখে কেরামের খেদমতে
এ পুস্তকে ব্যবহৃত কুরআনী পরিভাষা
আধুনিক শিক্ষিত লোকেদের নিকট যেসব পরিভাষার অর্থ জানা না থাকার ফলে বইটির বক্তব্য অস্পষ্ট থাকার আশংকা রয়েছে সে সবের সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দেয়া হলো:
১। দ্বীন-আনুগত্য-আল্লাহর আনুগত্যের উদ্দেশ্যে রাসূলের মাধ্যমে প্রেরিত জীবন বিধান।
২। ইকামাত-প্রতিষ্ঠা, কায়েম, স্থাপন।
৩। ইকামাতে দ্বীন-আল্লার প্রেরিত বিধানকে বাস্তবায়িত করা বা প্রতিষ্ঠিত করা।
৪। হক-সত্য, যুক্তিপূর্ণ, অখণ্ডনীয়।
৫। দ্বীনে হক-সত্য দ্বীন–অর্থাৎ ঐ দ্বীন যার সত্যতা অখণ্ডনীয় ও যুক্তিপূর্ণ।
৬। বাতিল-মিথ্যা, অসত্য, খন্ডনীয়, অযৌক্তিক বিধান, অসত্য জীবন ব্যবস্থা।
৭। দ্বীনে বাতিল-মিথ্যা দ্বীন বা আনুগত্যের অযৌক্তিক ।
৮। খেদমত-সেবা, সহায়তা, কাজ।
৯। খেদমতে দ্বীন-দ্বীন ইসলামের সেবা বা দ্বীনের উন্নতির জন্য কাজ।
১০। খাদেমে দ্বীন-ইসলামের সেবক ও সাহয্যকারী।
১১। ইলম-জ্ঞান, আল্লার পক্ষ থেকে নবীর নিকট প্রেরিত জ্ঞান যা কুরআন ও হাদীসে আছে।
১২। উলামা-জ্ঞানী, কুরআন ও হাদীসে যারা জ্ঞানী, এর একবচন হলো আলেম।
১৩। ফিতনা-বাধা, পরীক্ষা, সন্দেহে আটকে পড়া-আল্লার পথে চলতে গেলে যত বাধা, পরীক্ষা ও সন্দেহ দেখা দেয় সবই ফিতনা।
১৪। ওহী-ইংগিত, জানান, প্রকাশ করা, প্রেরণা দান ইত্যাদি। আল্লার নিকট থেকে মানুষের নিকট বাণী পাঠাবার উপায়।
১৫। হেদায়াত-পথ প্রদর্শন, সঠিক পথে চালনা।
১৬। উসওয়া-আদর্শ, অনুকরণযোগ্য, অনুসরণযোগ্য।
১৭। উসওয়াতুন হাসানা-সুন্দরতম আদর্শ, উৎকৃষ্টতম আদর্শ।
১৮। মেইয়ার-মাপকাঠি, মানদণ্ড।
১৯। জামায়াত-দল, সংগঠন।
২০। ফতোয়া-সিদ্ধান্ত, ঘোষণা, মতামত প্রকাশ, মন্তব্য প্রচার।