ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন
মতিউর রহমান নিজামী
بسم الله الرحمن الرحيم
বইটির অডিও শুনুন
প্রথম অধ্যায়ঃ ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন
আন্দোলনের অর্থ ও সংজ্ঞা
আন্দোলন, Movementএবং حركة(হারাকাতুন) এখন একটা রাজনৈতিক পরিভাষা হিসেবেই প্রচলিত। যার সাধারণ অর্থ কোন দাবী -দাওয়া প্রতিষ্ঠার জন্যে এবং কোন কিছু রদ বা বাতিল করার জন্যে কিছু লোকের সংঘবদ্ধ নড়াচড়া বা উদ্যোগ গ্রহণ করা। এর ব্যাপক ও সামগ্রিক রূপ হলো প্রতিষ্ঠিত কোন কিছুকে অপসারণ করে সেখানে নতুন কিছু কায়েম বা চালু করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা, প্রাণান্তকর চেষ্টা। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর অর্থ হলো একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তন করে অন্য একটা ব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা করা। নিছক ক্ষমতার হাত বদলের প্রচেষ্টা ও আন্দোলন হিসেবেই পরিচিত হয়ে আসছে। আদর্শিক দৃষ্ঠিকোণ থেকে একটা দেশের প্রতিষ্ঠিত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত সংঘবদ্ধ ও সুসংগঠিত প্রচেষ্টাই সত্যিকার অর্থে আন্দোলন নামে অভিহিত হতে পারে।
এভাবে আমরা এক কথায় বলতে পারি, সুনিদির্ষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে পরিচালিত সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা বা সংগ্রাম সাধনার নামই আন্দোলন।
ইসলামের অর্থ ও সংজ্ঞা
ইসলাম শব্দের অর্থ আনুগত্য করা, কোন কিছু মাথা পেতে নেয়া। ইসলাম শব্দের মূল ধাতু سلم এর অর্থ আবার শান্তি এবং সন্ধি। পারিভাষিক অর্থে একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (সাঃ) প্রদর্শিত জীবন-পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং এর বিপরীত সমস্ত মত ও পথ পরিহার করে চলাকেই বলা হয় ইসলাম। মানুষের ইহকালীন শান্তি এবং পরকালীন মুক্তির এটাই একমাত্র সনদ। মূলত মানুষ ইসলামী আদর্শ কবুলের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে একটা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।
কোরআনের ভাষায়:
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ [التوبة : 111]
সন্দেহ নেই আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের জান ও মাল বেহেশতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন, এখন তাদের একমাত্র কাজ হলো আল্লাহর পথে লড়াই করা, সংগ্রাম করা। পরিণামে জীবন দেয়া বা জীবন নেয়া।(সূরা আত তাওবা১১১)
সিলমুন অর্থ শান্তি। কিন্তু সে শান্তি নিছক নীতিকথার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কিংবা নয় নিছক কিছু শান্তিমূলক উপদেশবাণীর মধ্যেও সীমাবদ্ধ। ইসলfম-শান্তি এই অর্থে যে, মানুষের জীবন ও সমাজের সর্বত্র অশান্তি বিরাজ করছে ইসলাম না থাকার কারণে। অন্য কথায় আল্লাহর দাসত্ব ও গোলামির পরিবর্তে মানুষ মানুষের দাসত্ব ও গোলামিতে নিমজ্জিত আছে বলেই মানুষের সমাজে অশান্তির আগুন জ্বলছে। সর্বশক্তি নিয়োগ করে, সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে মানুষের সমাজকে এই অশান্তির কবল থেকে মুক্ত করার জোর তাকিদ ইসলামে রয়েছে বলেই ইসলাম শান্তির বাহক। এই শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বাভাবিক দাবী অনুসারে ইসলামকে শক্তির অধিকারী হওয়া একান্তই অপরিহার্য। এভাবে ইসলামের নিজস্ব পরিচয়ের মাঝে মানুষের সমাজে একটা আমূল পরিবর্তন ঘটানোর ও উলট পালট করার উপাদান নিহিত রয়েছে।
ইসলাম মানুষের জন্যে একমাত্র র্পূণাঙ্গ জীবন বিধান। মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা লাভই তার অন্তর্নিহিত দাবী। সুতরাং ইসলাম একটা র্পূণাঙ্গ আন্দোলন ও বটে। মানব সমাজকে মানুষের প্রভুত্বের যাঁতাকল থেকে মুক্ত করে আল্লাহর প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে মানুষকে সুখী সুন্দর জীবন যাপনের সুযোগ করে দেয়াই ইসলাম। কাজেই মানুষের প্রকৃত শান্তি, মুক্তি ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনই ইসলাম। এই শাশ্বত সত্যটি বাস্তবে উপলব্ধি করতে পারলে যে কোন ব্যক্তিই বলবে ইসলাম মূলতই একটি আন্দোলন। বরং আন্দোলনের সঠিক সংজ্ঞার আলোকে ইসলামই একমাত্র সার্থক ও সর্বাত্মক আন্দোলন।
ইসলাম ও আন্দোলন
আমরা এই পর্যন্ত ইসলামের অর্থ ও সংজ্ঞা প্রসঙ্গে যে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলাম তার আলোকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আন্দোলন, সংগ্রাম, বিপ্লব প্রভৃতি শব্দ আজ ইসলামের আলোচনায় বা জ্ঞান গবেষণায় নতুন করে আমদানী করা হয়নি। ইসলামের মূল প্রাণসত্তার সাথে এই শব্দ গুলো ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে আছে। আল কোরআন ইসলামকে আদ-দ্বীন হিসেবে (অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান) ঘোষণা করেই শেষ করেনি। বরং সেই সাথে এই ঘোষণা ও দিয়েছে, এই দ্বীন এসেছে তার বিপরীত সমস্ত দ্বীন বা মত ও পথের উপর বিজয়ী হওয়ার জন্যেই। (আত তওবা: ৩৩,আল ফাতহ:২৮,আস সফ:৯)
لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ
কোন বিপরীত শক্তির উপর বিজয়ী হওয়ার স্বাভাবিক দাবীই হলো একটা সর্বাত্মক আন্দোলন, একটা প্রাণান্তর সংগ্রাম, একটা সার্বিক বিপ্লবী পদক্ষেপ। এই কারণেই আল কোরআনে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহকে ঈমানের অনিবার্য দাবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর হাদিসে বলা হয়েছে,
الجهاد ماض الى يوم القيامة
আল্লাহর পথে জিহাদ বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে হবে।
ইসলামী আন্দোলনের পরিধি
আমরা আন্দোলন বলতে যা বুঝে থাকি তার আরবী প্রতিশব্দ الحركة এই জন্যেই আধুনিক আরবী ভাষায় ইসলামী আন্দোলনের প্রতিশব্দ হলো الحركة الاسلامي। কিন্তু আল কোরআনের এক্ষেত্রে একটা নিজস্ব পরিভাষা আছে। সেই পরিভাষাটি হলো الجهاد في سبيل الله বা আল্লাহর পথে জিহাদ। حركةশব্দের মাধ্যমে আন্দোলন, সংগ্রাম বা চেষ্টা সাধনার যে ভাব ফুটে ওঠে, জিহাদ শব্দটা সে তুলনায় আরো অনেক ব্যাপক ও গভীর অর্থ বহন করে। আরবী ভাষায় جهد শব্দটাই জিহাদের মূল ধাতু। جهد অর্থ যথাসাধ্য চেষ্টা-সাধনা, চূড়ান্ত প্রচেষ্টা, প্রাণান্তকর সাধনা প্রভৃতি। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ অর্থ আল্লাহর পথে চূড়ান্ত ও প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো। আল্লাহর পথ কি? দুনিয়ায় মানুষের জীবন যাপনের জন্যে আল্লাহ তায়ালা যে পথ ও পন্থা নবী রাসূলদের মাধ্যমে নির্ধারণ করে দিয়েছেন আল্লাহর পথ বলতে সেটাকেই বুঝায়। এই পথে জিহাদ বা চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালানোর অর্থ এই পন্থা ও পদ্ধতি অনুসরণ করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করা। যেখানে এই পদ্ধতি অনুসরণের সুযোগ নেই, সেখানে এমন সুযোগ সৃষ্টির জন্যে সংগ্রাম করা। জিহাদ শব্দের অর্থের ব্যাপকতার আলোকে আমরা আল কোরআনের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে আন্দোলন, সংগ্রাম বা বিপ্লব প্রভৃতি শব্দের ভাবার্থ বুঝাতে চেষ্টা করলে দেখতে পাই- এর কোন একটির মাধ্যমেও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর পুরো অর্থ প্রাকাশ করা বা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। আল কোরআন দ্বীন প্রতিষ্ঠার গোটা প্রচেষ্টার বিভিন্নমুখী কার্যক্রম এবং প্রতিষ্ঠা লাভের পর তার হেফাযতের উদ্দেশ্যে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ- এই সব কিছুকেই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর মধ্যে শামিল করেছে। দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার সূচনা থেকে সাফল্য লাভ পর্যন্ত এবং সাফল্যের পরবর্তী করণীয় বিষয়ে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয় সে সবের অর্থ এবং তাৎপর্য বুঝলে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা ইসলামী আন্দোলনের পরিধির ব্যাপক রূপ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করা সহজ হয়ে যায়।
আমাদের সমাজে সাধারণত জিহাদকে যুদ্ধ বা যুদ্ধকেই জিহাদ মনে করা হয়ে থাকে। অথচ এটা জিহাদের একটা অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃত ব্যাপার হলো যুদ্ধ জিহাদের একটা অংশ মাত্র। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর সূচনা হয় মানব জাতির প্রতি আল্লাহর দাসত্ব কবুলের আহবান জানানোর মাধ্যমে।
সহজ, সরল ও দরদপূর্ণ ভাষায় মানব জাতিকে আল্লাহর দ্বীন কবুলের আহবান, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব গ্রহণ এবং গায়রুল্লাহর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব বর্জনের আহবানই এক পর্যায়ে কায়েমী স্বার্থের সাথে সংঘাত- সংঘর্ষে নিয়ে যায়। তাই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজে অংশগ্রহণকারীকে বাতিল শক্তির সাথে যুদ্ধেও লিপ্ত হতে হয়। এই যুদ্ধে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর গোটা কার্যক্রমের একটা বিশেষ দিক বৈ আর কিছুই নয়। আল কোরআনের আলোকে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর অর্ন্তভুক্ত কাজগুলোকে মোটামুটি ৫টি ভাগে ভাগ করা যায়। (১) দাওয়াত ইল্লাল্লাহ (২) শাহাদাত আলান্নাস (৩) কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ (৪) ইকামাতে দ্বীন (৫) আমর বিল মা’রুফ ও নেহি আনিল মুনকার। এই পাঁচটি কার্যক্রমের সমষ্টির নামই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা ইসলামী আন্দোলন। সুতরাং ইসলামী আন্দোলনের কোরআনী পরিচয় জানতে হলে উল্লিখিত পাচঁটি বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারলা লাভ করা একান্তই অপরিহার্য।
(১) দাওয়াত ইলাল্লাহ
মানুষের জীবনে ও আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আল্লাহর নির্দেশে নবী রাসূলদের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়েছে। সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) পর্যন্ত সব নবীর আন্দোলনের সূচনা হয়েছে দাওয়াতের মাধ্যমে। আল কোরআন বিভিন্ন নবীর আন্দোলন প্রসঙ্গে ঘোষণা করেছে:
لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ [الأعراف
আমি নূহ (আঃ) কে তার কওমের নিকট পাঠিয়েছিলাম। তিনি তাঁর কওমকে ডাক দিয়ে বললেন, হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর- আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ বা প্রভু নেই। (আল আ’রাফ:৫৯)
وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ أَفَلَا تَتَّقُونَ [الأعراف
এবং আদ জাতির প্রতি আমি তাদের ভাই হুদ (আঃ) কে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বললেন, হে আমার দেশবাসী ! তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই। (আল আ’রাফ: ৬৫)
وَإِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ [الأعراف
এবং সামুদ জাতির প্রতি তাদের ভাই সালেহ (আঃ) কে পাঠিয়েছিলাম। তিনি তাঁর দেশবাসীকে ডাক দিয়ে বললেন, হে আমার কওমের লোকেরা! তোমরা আল্লাহর দসত্ব কবুল কর। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। (আল আ’রাফ:৭৩)
وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ [الأعراف
এবং মাদইয়ানবাসীর প্রতি তাদেরই ভাই শোয়ায়েব আ. কে পাঠিয়েছিলাম। তিনি তার কওমকে ডাক দিয়ে বললেন, হে আমার কওম। তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কবুল কর। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। (আল আ’রাফ:৮৫)
শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর আন্দোলনে ও তাঁকে প্রথম এভাবে মানব জাতিকে আল্লাহর দাসত্ব কবুলের আহবান জানাতে হয়। তাঁর জীবনের প্রথম গণভাষণের প্রধান বক্তব্য ছিল:
يايها الناس قولوا لا اله الا تفلحون
হে মানব জাতি! তোমরা ঘোষণা কর আল্লাহ ছাড়া সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী আর কেউ নেই তাহলে তোমরা সফল হবে। (আল হাদিস) আল্লাহর দাসত্ব কবুল এবং গায়রুল্লাহর দাসত্ব বর্জনের আহবান জানানোর এই কাজটা আল কোরআনে বিভিন্নভাবে ব্যক্ত করা হয়। কোথাও সরাসরি নির্দেশ আকারে এসেছে, যেমন সূরা নাহলের শেষ দুটি আয়াতে দাওয়াতের পদ্ধতি শেখাতে গিয়ে বলা হয়েছ:
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ [النحل : 125]
ডাক, তোমার রবের পথের দিকে হিকমত ও উত্তম নসীহতের সাথে। (আন নাহল:১২৫)কোথাও এসেছে রাসূলের কাজ ও পথের পরিচয় প্রদান হিসেবে। যেমন সূরায়ে ইউসুফের শেষ রুকুতে বলা হয়েছে:
قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ [يوسف : 108]
বলে দিন হে মুহাম্মদ (সা.) এটাই একমাত্র পথ, যে পথে আমি আল্লাহর দিকে আহবান জানাই। (ইউসুফ: ১০৮)
সূরায়ে আহযাবে ৪৫-৪৬ আয়াতে বলা হয়েছে:
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا (45) وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا [الأحزاب : 45 ، 46]
হে নবী! আমরা তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শকরূপে এবং খোদার নির্দেশে তাঁর প্রতি আহবানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে। আবার কোথাও এসেছে এই কাজের প্রশংসা বর্ণনা হিসেবে। যেমন, সূরায়ে হা মীম আসসাজদায় ৩৩ আয়াতে বলা হয়েছে:
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ [فصلت : 33]
আর সে ব্যক্তির কথার চেয়ে উত্তম কথা আর কারও হতে পারে কি যে আল্লাহর দিকে আহবান জানায় এবং ঘোষণা করে যে, আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। কোথাও এসেছে উম্মতে মুহাম্মদীর দায়িত্ব ও কর্তব্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে। যেমন, সূরায়ে আল ইমরানের ১০৪ আয়াতে বলা হয়েছে:
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ [آل عمران : 104]
তোমাদেও মধ্যে এমন একদল লোক অবশ্যই থাকতে হবে যারা ভাল কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করবে, সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দেবে। সমস্ত আম্বিায়অয়ে কেরামের দাওয়াতের মূল সুর, মূল আবেদন এব ও অভিন্ন। সবার দাওয়াতের মধ্যেই আমরা কয়েকটি প্রধান দিক লক্ষ্য করতে পারি। প্রথমতঃ সবাই তাওহীদেও আল্লাহর সার্বভৌমত্বেও দাওয়াত দিয়েছেন এবং গায়রুল্লাহর সার্বভৌমত্ব পরিহার করার আহ্বান রেখেছেন।
দ্বিতীয়তঃতাঁরা সমাজের খুঁটিনাটি সমস্যা সমাধানের প্রসঙ্গ তোলেননি। কিন্তু আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা না থাকার ফলে যে সব বড় বড় সমস্যায় মানুষ জর্জরিত ছির সেগুলোর কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। তৃতীয়তঃ দাওয়াত কবুল না করার পরিণাম ও পরিণতি দুনিয়া ও আখেরাতে কি হবে এই সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে, ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি এই দাওয়াত কবুলের প্রতিদান-প্রতিফল দুনিয়া ও আখেরাতে কি হবে সে সম্পর্কেও শুভ সংবাদ শুনানো হয়েছে। আম্বিয়ায়ে কেরামের এই দাওয়াতের মেজাজ প্রকৃতি গভীরভাবে অনুধাবনের ও অনুশীলনের চেষ্টা করলে যে কেউ বুভে ত সক্ষম হবে, এই দাওয়াত ছিলণ যার যার সময়ের সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের একটা আপোষহীন বিপ্লবী ঘোষনা। এই জন্যেই প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার পষ্ঠপোষক, ধারক, বাহক ও সুবিধাভেগীদেও সাথে তাদেও সংঘাত ছিল অনিবার্য।
(২) শাহাদাত আ’লান্নাস
শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর এক পরিচয় বরং প্রধান পরিচয় যেমন দা’য়ী ইলাল্লাহ বা আল্লাহর দিকে আহবানকারী, তেমনি তাঁর অন্যতম প্রধান পরিচয় হলো দাওয়াতের বাস্তব নমুনা হিসেবে, মূর্ত প্রতীকরূপে শাহেদ এবং শহীদ। কুরআনে বলা হয়েছেঃ
إِنَّا أَرْسَلْنَا إِلَيْكُمْ رَسُولًا شَاهِدًا عَلَيْكُمْ كَمَا أَرْسَلْنَا إِلَى فِرْعَوْنَ رَسُولًا [المزمل : 15]
আমি তোমাদের প্রতি রাসূল পাঠিয়েছি সত্যের সাক্ষীরূপে। যেমন সাক্ষীরূপে রাসূল পাঠিয়েছিলাম ফেরাউনের প্রতি (মুয্যাম্মিল: ১৫)
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا [الأحزاب : 45]
আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে। (আল-আহযাব: ৪৫)
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا [البقرة : 143]
এভাবে আমি তোমাদের একটি উত্তম জাতিরূপে গড়ে তুলেছি- যাতে কওর তোমরা গোটা মানবজাতির জন্যে সত্যের সাক্ষ্যদাতা (বাস্তব নমুনা) হতে পার এবং রাসূল (সা.) যেন তোমাদের জন্যে সাক্ষ্য বা নমুনা হন।
(আল বাকারা: ১৪৩)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ [المائدة : 8]
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর জন্যে সত্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়াও। (আল মায়েদা: ০৮)
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَتَمَ شَهَادَةً عِنْدَهُ مِنَ اللَّهِ [البقرة : 140]
যার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন সাক্ষ্য বর্তমান রয়েছে সে যদি তা গোপন করে তাহলে তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে? (আল বাকারা: ১৪০)এই শাহাদাত মূলত দাওয়াতেরই একটা বাস্তব রূপ। জীবন্ত নমুনা পেশ করার মাধ্যমেই যুগে যুগে নবী রাসূলগণ তাদের দাওয়াতকে মানুষের সামনে বোধগম্য ও অনুসরণযোগ্য বানানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁরা সবাই এই সাক্ষ্য দুই উপায়ে প্রদান করেছেন।
এক: তারা আল্লাহর দ্বীনের পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। এটা মৌখিক সাক্ষ্য।
দুই: তারা যা বলেছেন বাস্তবে তা করে দেখিয়েছেন। মৌখিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাদের আমল আখলাক গড়ে তুলেছেন।
শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) এই ব্যাপারে উত্তম ও পরিপূর্ণ আদর্শ উপস্থাপন করেছেন। রাসূলে করমি (সা.) কে উত্তম আদর্শ বা উসওয়াতুন হাসানা হিসেবে গ্রহণ করে তাঁর আদর্শের সার্থক অনুসারী ও উত্তরসূরী হিসেবে তহাঁর উম্মতকে ও দা’য়ী ইলাল্লাহ হওয়ার সাথে সাথে শুহাদা আ’লান্নাসের ভূমিকা পালন করার তাকিদ স্বয়ং আল্লাহ দিয়েছেন। মক্কী জিন্দেগীর চরম প্রতিকুল পরিবেশে রাসূল (সা.) যে অল্প সংখ্যক সাথী পেয়েছিলেন, তাঁরা আল্লাহর নবীর দাওয়াত কবুল করে নিজেরাও দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং এই দাওয়াতের পক্ষে নিজেদেরকে বাস্তব সাক্ষী বা নমুনারূপে গড়ে তোলেন যার সাক্ষ্য স্বয়ং আল্লাহ দিয়েছেন সূরায়ে ফোরকানের শেষ রুকুতে এবং সূরায়ে মুমিনুনের প্রথম রুকুতে।
এভাবে বাস্তব সাক্ষ্যদানকারী এক দল লোক তৈরি হওয়ার উপরই আল্লাহর সাহায্য এবং জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজের সাফল্য নির্ভর করে বিধায় ইসলামী আন্দোলনে এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী।
(৩) কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ
দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যখন প্রতিকূল পরিবেশে নানা বাধা-বিপত্তি ও ঘাত-প্রতিঘাতের মোকাবিলা করে সামনে এগুতে থাকে, মৌখিক দাওয়াতের পাশে তখন বাস্তব জীবনে আমূল পরিবর্তন আনার মাধ্যমে আমলি শাহাদাত বাস্তব সাক্ষ্যদানে সক্ষম হয়। তাদেরকে এই দাওয়াত থেকে বিরত রাখা, তাদের আওয়াজকে স্তব্ধ করার ক্ষেত্রে জালেমের জুলুম নির্যাতন হার মানে, হার মানে লোভ-প্রলোভনও। তখন সমাজের মানুয়ের মনের উপরে দাওয়াত প্রদানকারীদের নৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। কায়েমী স্বার্থের শ্রেণীভুক্ত লোকেরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনেতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে তখন তারা দা’য়ীদেরকে নিশ্চিহ্ন করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। খোদাদ্রোহী শক্তির বিরোধিতার জবাবে দা’য়ীদেরকে ধৈর্যের চরমপরাকাষ্ঠা দেখানোর নির্দেশ রয়েছে। মক্কী জীবনের শেষ দিকে তাদের জুলুম নির্যাতনের প্রতিশোধ নেয়ার অনুমতি সীমিতভাবে দেয়া হয়েছে সূরায়ে নাহল এবং শূরার’ মাধ্যমে। তাও এমন শর্তসাপেক্ষ যে, সেখানে প্রতিশোধ না নিয়ে বরং ক্ষমা করাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু দা’য়ীগণ উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন পাওয়ার পর, মাদিনায় একটি ইসলামী সমাজ কায়েমের পর খোদাদ্রোহী শক্তির জুলুম নির্যাতনের প্রতিশোধ নেওয়ার অনুমতি তাদেরকে দেয়া হলো সূরায়ে হজ্জের মাধ্যমে এবং প্রত্যক্ষ যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হলো সূরায়ে মুহাম্মদের মাধ্যমে। এই জন্যে এই সূরার আর এক নাম সূরায়ে কিতাল। ইসলামী আন্দোলনে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজে এই সংঘাত ও সংঘর্ষ অনিবার্য।তাই তো আল কুরআনের ঘোষণাঃ
الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ [النساء : 76]
ঈমানদার তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে আর যারা কাফের তারা লড়াই করে তাগুতের পথে।(নিসা: ৭৬)ইসলামী সমাজ পরিচালনার উপযোগী লোক তৈরি হলে, ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে, সেই সাথে আমলি শাহাদাতের মাধ্যমে জনগণের মন জয় করে তাদের সাথে নিতে সক্ষম হলে আন্দোলন এই স্তর (সংঘর্ষের স্তর) অতিক্রম করে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। এই পর্যায়ের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সম্পর্কে আল কোরআনের নির্দেশঃ
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ [البقرة : 193
ফেৎনা দূরীভূত হয়ে দ্বীন কায়েম না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করতে থাক। (আল বাকারা: ১৯৩)
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّه [الأنفال : 39]
ফেৎনা ফাসাদ মূলোৎপাটিত হয়ে দ্বীন পরিপূর্ণরূপে কায়েম না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে লড়াই অব্যাহত রাখ। (আল আনফাল: ৩৯)
قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ [التوبة : 29]
যুদ্ধ কর আহলে কিতাবীদের সেইসব লোকদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে না। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করে দিয়েছেন তাকে হারাম সাব্যস্ত করে না। (তাদের সাথে লড়াই অব্যাহত রাখ) যতক্ষণ না তারা নিজেদের হাতে জিযিয়া দিতে ও ছোট হয়ে থাকতে প্রস্তুত হয়। (আত-তাওবা: ২৯)
আল কোরআনের আলোচনায় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজকে যেমন আমরা ঈমানের অনিবার্য দাবীরূপে দেখতে পাই তেমনি জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর এই অংশবিশেষ অর্থাৎ কিতাল ও ঈমানের দাবী পূরণের উপায় হিসেবে বিবৃত হয়েছে। বলা হয়েছেঃ
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ [التوبة : 111]
যারা ঈমানের ঘোষণা দিয়েছে তাদের জান ও মাল আল্লাহ খরিদ করে নিয়েছেন বেহেশতের বিনিময়ে। (এখন তাদের একমাত্র কাজ হলো) তারা আল্লাহর পথে লড়াই করবে জান ও মাল দিয়ে। এই লড়াইয়ে তারা জীবন দেবে এবং জীবন নেবে। (আত-তাওবা: ১১১)
এই কিতালের নির্দেশ মূলত দ্বীন ইসলামকে পরিপূর্ণরূপে বিজয়ী আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠা করা এবং মানুষের সমাজ থেকে অশান্তির কারণ যাবতীয় ফেতনা ফাসাদের মূলোৎপাটন করার জন্যেই। এই হিসেবেই আমরা আল কোরআনে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কার্যক্রমের মধ্যে ইকামাতে দ্বীনের একটা পরিভাষা ও দেখতে পাই।
(৪) ইকামাতে দ্বীন
ইকামাতে দ্বীন অর্থ দ্বীন কায়েমের প্রচেষ্টা। আর দ্বীন কায়েম বলতে বুঝায় কোন একটা জনপদে দ্বীন ইসলাম বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণ বিধি-বিধান অনুসরণ ও বাস্তবায়নের পথে কোন প্রকারের বাধা ও অন্তরায় না থাকা। কোন দেশে যদি ইসলামী অনুশাসন বা কুরআন সুন্নাহর বিপরীত আইন চালু থাকে তাহলে জীবন যাপনের আন্তরিক নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও ঐ আইনের কারণে তা মানা সম্ভব হয় না। কোন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি ইসলামী আদর্শের বিপরীত কিছু শেখায় এবং ইসলাম না শেখায় তাহলে সেখানেও ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার মত মন মানসিকতাই তৈরি হয় না। যে দেশের সামাজিক ও অর্থনেতিক অবস্থা ও পরিবেশ ইসলামী আদর্শের বিপরীত, সেখানেও ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ইসলামী অনুশাসন মেনে চলা সম্ভব নয়। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজ জীবনের চাবিকাঠি যাদের হাতে, ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সর্বসাধারণ তাদের অনুসরণ করতে বাধ্য হয়। সুতরাং সমাজের এই নেতৃস্থানীয় ও প্রভাবশলী জনগোষ্ঠী যারা দেশ, জাতি ও সমাজ জীবনের স্নায়ুকেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রন করছে তারা যদি ইসলামী আদর্শ বিরোধী হয় তাহলে ও সেই সমাজের মানুষ ইসলাম অনুসরণ করার সুযোগ পায় না।ব্যক্তি জীবনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যতটা দ্বীন মানা হয় তা পরিপূর্ণ দ্বীনের তুলনায় কিছুই নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে সামগ্রিক ও পরিপূর্ন দ্বীন মানা তো দূরের কথা আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলোর ও হক আদায় করা হয় না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে নামাজ আদায় হতে পারে কিন্তু কায়েম হয় না। অথচ নামাজ কায়েমেরই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আদায়ের নয়। এমনিভাবে জাকাত আদায়ও সঠিক অর্থে ব্যক্তিগত উদ্যোগে হতে পারে না। রোযা তো এমন একটা পরিবেশ দাবী করে যা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সম্ভব নয়। হজ্জের ব্যাপারটা আরও জটিল। নামাজ, রোযা এবং জাকাত তো ব্যক্তি ইচ্ছে করলে সঠিকভাবে হোক বা নাই হোক তবুও আদায় করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ছাড়পত্র ছাড়া হজ্জের সুযোগ বর্তমান ব্যবস্থায় না থাকায় ব্যক্তি ইচ্ছে করলেও হজ্জের ফরজ আদায় করতে পারছে না। সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগে আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ-নিষেধের কোন একটিও পালন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। অর্থনৈতিক জীবনে আমরা সুদ বর্জন করতে সক্ষম হচ্ছি না। সমাজ জীবনে বেপর্দেগী ও উলঙ্গপনা-বেহায়াপনা থেকে আমরা বাঁচতে পারছি না। যেনা শরীয়তে নিষিদ্ধ হলেও রাষ্ট্রীয় আইনে এর জন্যে লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন-খারাবী প্রভৃতি সামাজিক অপরাধ ও নৈতিকতা বিরোধী কাজের মূলোৎপাটন করে সৎকাজের প্রসার ঘটানোর সুযোগ এখানে রুদ্ধ। যেখানে দেশে দ্বীনের আনুষ্ঠানিক ও সামগ্রিক দিক ও বিভাগের অনুসরণ ও বাস্তবায়নে উল্লিখিত কোন বাধা নেই বরং দ্বীনের বিপরীত কিছুর পথে অনুরূপ অন্তরায় আছে সেখানেই দ্বীন কায়েম আছে বলতে হবে। এভাবে দ্বীন কায়েম হওয়ার জন্যেই আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। সব নবী রাসূলেরই দায়িত্ব ছিল এভাবে দ্বীনকে বিজয়ী করার চেষ্টা করা।আল্লাহ তায়ালা সূরায়ে শূরায় ঘোষণা করেছেন:
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ [الشورى : 13]
তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের সেই নিয়ম কানুন নির্ধারণ করে দিয়েছেন যার নির্দেশ তিনি নূহ (আ.) কে দিয়েছিলেন। আর যা এখন তোমার প্রতি যে হেদায়াত ওহীর মাধ্যমে প্রদান করেছি, আর সেই হেদায়েত যা আমি ইব্রাহীম (আ.) মূসা (আ.)-এর প্রতি প্রদান করেছিলাম। (সব নির্দেশের সার কথা ছিল) তোমরা দ্বীন কায়েম কর এই ব্যাপারে পরস্পরে দলাদলিতে লিপ্ত হবে না। (আশ শূরা: ১৩) এভাবে দ্বীন কায়েমের চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালানোটাই ইসলামী আন্দোলনের জাগতিক লক্ষ্য। আর এরই মাধ্যমে অর্জিত হয় পারলৌকিক লক্ষ্য অর্থাৎ নাজাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি। শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) কে দুনিয়ায় পাঠানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল কুরআনে যা বলা হয়েছে তার ও সার কথা এটাই। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজের আওতাভুাক্ত অপর কাজটি আমর বিল মা’রূফ ও নেহী আনিল মুনকার সঠিকভাবে দ্বীন কায়েম হওয়ার পরেই হতে পারে। আল কোরআন ঘোষণা করছে:
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَر [الحج : 41]
এরা তো ঐসব লোক যাদেরকে আমি দুনিয়ায় ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব দান করলে তারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত আদায় করে এবং সৎ কাজের আদেশ দেয় ও অসৎ কাজে বাধা দান করে। (আল-হাজ্জ: ৪১)
(৫) আমর বিল মা’রূফ ও নেহী আনিল মুনকার
সৎকাজের আদেশ প্রদান ও অসৎকাজে বাধা দানের কাজটা বিভিন্ন পর্যায়ে আঞ্জাম দেয়া যায়:
এক: সাধারণভাবে গোটা উম্মতে মুহাম্মদীরই এটি দায়িত্ব। একদিকে এই দায়িত্ব তাদের পক্ষ থেকে আঞ্জাম দেবে তাদেরই আস্থার ভিত্তিতে পরিচালিত রাষ্ট্র ও সরকার। অন্যদিকে এই ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে তারা যার যার জায়গায়, এলাকায় এই কাজ আঞ্জাম দিতে বাধ্য।
দুই. সরকারী প্রশাসনের মাধ্যমে এই কাজের আঞ্জাম পাওয়াটাই শরীয়তের আসল স্পিরিট। ইসলামী সরকারের গোটা প্রশাসন যন্ত্রই এই কাজে ব্যবহৃত হবে। আবার এর জন্যে নির্দিষ্ট কোন বিভাগও থাকতে পারে। আমরা উপরে যে পাঁচটি বিষয়ে আলোচনা করলাম অর্থাৎ দাওয়াত ইলাল্লাহ, শাহাদাতে হক, কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ, ইকামাতে দ্বীন এবং আমর বিল মা’রূফ ও নেহী আনিল মুনকার- এই সবটার সমষ্টির নাম ইসলামী আন্দোলন বা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ।