মুক্তির পয়গাম
ইবনে মাসুম
বইটির অডিও শুনুন
মুক্তির পয়গাম
কি সুন্দর এই পৃথিবী! চোখ জুড়ানো বিস্তীর্ণ শ্যামল শস্য ক্ষেত। গাছের ডালে ডালে রঙ-বেরঙের ফল ফুল, তারই মাঝে রঙ-বেরঙের পাখ-পাখালি প্রজাপতির মনভোলানো খেলা। মন জুড়িয়ে যায় বিরাট আকাশটার দিকে তাকিয়ে থেকে। মেঘের কোলে ভেসে বেড়াচ্ছে স্বাধীন ডানা মেলা পাখিরা, রোদ হাসছে ঝিকমিক।কি সুন্দর! কি সুন্দর এই সৃষ্টি! কি বিরাট বিষ্ময়কর এই সৃষ্টি! সৃষ্টির এই সৌন্দর্য উপভোগ করে শেষ করা যায় না। এর সীমা-সংখ্যা গুণে শেষ করা যায় না। বিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণু মেনে চলছে আল্লাহর আইন। এই শৃংখলার কোন ব্যতিক্রম নেই।
আর এ জন্যই এই বিশ্বজগত এতো সুন্দর। বিরাট ও বিশ্বজগতে বিরাজ করছে অনাবিল শান্তি,ঐক্য আর শৃংখলা।
মানুষ এই দুনিয়ার সুন্দরতম সৃষ্টি। আশরাফুল মাখলুকাত বলা হয় তাকে। অন্যান্য সৃষ্টি থেকে আলাদা তার মর্যাদা । বিশেষ তার স্থান। মানুষ এই দুনিয়ায় আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি, আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন জ্ঞান-বিবেক, দিয়েছেন ভাল-মন্দ বুঝবার ক্ষমতা। সে যেমন এই জ্ঞানের আলোকে ভাল কাজ করতে পারে তেমনি খারাপ কাজ করার রয়েছে তার ক্ষমতা ও স্বাধীনতা। কিন্তু কেন আল্লাহ মানুষকে এই বিশেষ মর্যাদা দিলেন? কেন দিলেন এমন স্বাধীনতা? এর পিছনে রয়েছে আল্লাহর এক মহান উদ্দেশ্য। তা হলো, বিশ্বে প্রকৃতির অন্যান্য সৃষ্টি যেমন আল্লাহর নিয়ম মেনে তৈরি করছে অনাবিল শান্তির জগত তেমনি মানুষ তার স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও যেনো আল্লাহর পথকে বেছে নিতে পারে। খারাপ কাজ করার ক্ষমতা ও স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও যাতে নিজের ইচ্ছায় আল্লাহর আইনের গোলামীকে বরণ করে নিতে পারে। আর তারই ফলে তাদের জীবনে নেমে আসবে শান্তি। পৃথিবীতে গড়ে উঠবে এক সুন্দর শান্তিপূর্ণ সমাজ।
অশান্তির কারণ
কিন্তু এই দুনিয়ার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই মানুষে মানুষে আজ সৃষ্টি হয়েছে,ভেদাভেদ,হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ। অমানুষের সমাজে সে ঐক্য কোথায়? কোথায় সে শান্তি? এর কারণ কি? আগেই বলা হয়েছে, ভাল ও মন্দ কাজ করার ইচ্ছাটা পুরোপুরি মানুষের। আল্লাহ মানুষের উপর জোর করে তার বিধান চাপিয়ে দিতে চান না। বরং আল্লাহ দেখতে চান মানুষ তার নিজের ইচ্ছায় তাঁর বিধান বা এই শান্তির পথকে বেছে নেয় কিনা। যখন মানুষ এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে আল্লাহর পথ থেকে সরে গেছে, তখনই নেমে এসেছে মানুষের জীবনে বিপর্যয় ও অশান্তি।
মুক্তির পথ
তাহলে কি মানুষকে এই অশান্তি সৃষ্টির জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন? বিভেদ ও বিশৃংখলার জন্য সৃষ্টি করেছেন? কঠিন ও জটিল এই পৃথিবীতে মানুষকে পথের সন্ধান না দিয়েই ছেড়ে দিয়েছেন? না, কখনই তা হতে পারে না। আল্লাহ তো দয়াময় ও মেহেরবান। যে আল্লাহ্ বিশাল এই পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টি করেছেন আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য যে আল্লাহ্ সব মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছেন আলো, বাতাস আর খাবার দিয়ে সেই আল্লাহ্ মানুষকে বাতলে দিয়েছেন সরল, শান্তির পথ-সিরাতুল মুস্তাকিম । কোন পথে চললে মানুষ পাবে শান্তি, কোন পথে আসবে মানুষের মর্যাদা, কোন পথে চললে মানুষ তার দায়িত্ব পাবে তা তিনি সৃষ্টির সাথে সাথেই জানিয়ে দিয়েছেন মানুষকে। শিখিয়ে দিয়েছেন প্রথম মানুষ হযরত আদম (আঃ) কে। হযরত আদম (আঃ) তাঁর গোটা জীবন সেইভাবে চালিয়েছেন।
তাঁর পুত্র পরিজনকেও সেইভাবে পরিচালনা করেছেন। তার পর দিন দিন মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। ছড়িয়ে পড়লো মানুষ পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। আস্তে আস্তে আল্লাহর পথও ভুলে গেল তারা। রাহমানুর রাহীম আল্লাহ আবার মানুষকে মুক্তির পথ বাতলিয়ে দিতে চাইলেন। তিনি মানুষের মধ্যে থেকে বিশেষ কিছু মানুষকে মনোনিত করলেন। এই মনোনীত বান্দারা হলেন নবী ও মানুষ। এবং সেই বাতলিয়ে দেয়া পথের নাম-ইসলাম। আল্লাহর এই মনোনীত বান্দারা তাঁর হুকুম নিজেরা মেনে চলেছেন আর তাদের যুগের সাধারণ মানুষদেরকে দেখিয়ে দিয়েছেন-দেখো, এইভাবে চলো, এইভাবে নিজেদের জীবনকে গড়ে তোল, সমাজকে গড়ে তোল। শুধু মুখে মুখে নয়, কাজের মাধ্যমে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন আল্লাহর পথ কোনটি। তাই ইসলাম শুধু মাত্র একটি ধর্মের নাম নয়। ইসলাম আল্লাহর মনোনীত শান্তির পথ। এই দুনিয়ায় মানুষের জীবন-যাপনের পথ নির্দেশ।
সর্বশেষ নবী হলেন আমাদের প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (স)। তিনি সকল নবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ নবী। আল্লাহ তাঁর কাছে যে বাণী পাঠিয়েছেন তা হলোআল-কুরআন। কুরআন আজও হুবহু আমাদের মাঝে আছে অথচ অন্যান্য নবীদের শিক্ষা আজ আর অক্ষত অবস্থায় নেই। তাই আল্লাহর দেখানো পথ আমরা এখন একমাত্র হযরত মুহাম্মদ (স) এর কাছ থেকে পেতে পারি। ইসলাম বলতে আমরা এখন যা বুঝি তা হলো-হযরত মুহাম্মদ (স) এর কাছ থেকে দেয়া শিক্ষা-দীক্ষা।
মানুষের গড়া মতবাদ
আল্লাহর দেখানো এই মুক্তির পথকে বাদ দিয়ে মানুষ নিজে তার চলার পথ রচনার চেষ্টা করেছে বহুবার। কেউ বলেছে, এ পৃথিবীর কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। এ দুনিয়াটাই সব-দুনিয়ার সুখ শান্তিই সব। অতএব খাও দাও ফুর্তি কর। আর এ জন্যে অন্যকে ঠকিয়ে বড়লোক হওয়া অন্যায় নয়। শ্রমিককে খাটিয়ে তোমার টাকাকে আরো বাড়াও। কিন্তু তাদেরকে ঠাকানো কোন ক্ষতি নেই। কে তোমাকে আটকাবে? পরকাল? তা তো নেই। এই ধরণের চিন্তা বা মতবাদের নাম হলো পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ সমাজে এক দলের ঘাম আর রক্তের বদলে বড়লোক হলো অন্য একদল। বড়লোকেরা আরও বড়লোক হলো গরীবরা হলো আরও গরীব। সমাজের সমস্ত কর্তৃত্ব চলে গেল এই সব লোকের হাতে। পুঁজিবাদ তাই কোন শান্তির দিশা দেখাতে পারলো না মানুষকে। এই অন্যায় ও বেইনসাফীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ক্ষেপে উঠলো। ক্ষেপে উঠলো শ্রমিকরা, ক্ষেপলো সাধারণ কৃষকরা। ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো আরও একটা মতবাদ। তার নাম কম্যুনিজম। এই মতবাদের হোতারা বললো-দেখো, মানুষ ধনের জন্য অন্যর উপর জুলুম করে। অতএব সকলের নিজস্ব সব সম্পদ কেড়ে নাও। সকলের সম্পদ কেড়ে নিয়ে গড়ে তোলা গরীবদের সমাজ। সব সম্পদের মালিক হবে রাষ্ট্র। সকলেই খাটবে। সকলে সমান মজুরী পাবে। সকলেই হবে সমান। কথাগুলো সত্যি খুব সুন্দর। গরীবরা যারা এতদিন ছিল নির্যাচিত তারা আশার আলো দেখলো তাতে। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা ঘটলো অন্য রকম। গরীবরা শাসক হবে কিভাবে? সব গরীবতো একসাথে দেশ শাসন করতে পারে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই গুটিকতক লোকের হাতে চলে গেল দেশ শাসনের সর্বময় ক্ষমতা। আর সেই সাথে তারা হলো সারাদেশের সম্পদের হর্তাকর্তা। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে সম্পদের মালিক ছিল গুটিকতক লোক। তাদের হাতে তেমন ক্ষমতা ছিল না। এখন এই নতুন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন পথের সন্ধান করলো। তারা বুঝলো দেশ এখন সবার। সরকার সকলের। অতএব বিরোধিতা করা যাবে না। সামলোচনা করা যাবে না। যারা বিরোধিতা করবে, সমালোচনা করবে তারা সরকারের শত্রু অতএব জনগণের শত্রু। আর তাই লাগাম আঁটা হলো সকলের মুখে। একমুঠো খাবারের জন্যে হারাতে হলো সবকিছু। এই নতুন মতবাদও মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে পারলো না। সময়ের ব্যবধানে এই মতবাদও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।
মুক্তির পথ ইসলাম
এইভাবে দুনিয়ার সব দেশের সব মানুষ চেষ্টা করেছে তাদের নিজেদের বুদ্ধি ও ক্ষমতা খাটিয়ে চলার পথ রচনা করতে। কিন্তু বার বার ব্যর্থ হয়েছে। এর প্রকৃত কারণ কি? এর একটি মাত্র কারণ মানুষ এই মহাসত্যকে বুঝতে পারেনি, যে মানুষের পক্ষে মানুষের জন্যে জীবন পথ রচনা করা সম্ভব নয়। মানুষের সীমিত জ্ঞান, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দ্বারা এমন কোন পথ রচনা করা সম্ভব নয় যা সব যুগের, সব দেশের, সকল মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের পথ দেখাতে পারে। কারণ তার আগের লোকদের সে দেখেনি, পরের লোকদের দেখবে না। দুনিয়ার সবগুলো দেশ আর সমাজ সম্পর্কে তার পুরাপুরি ধারণা থাকা সম্ভব নয়, তাহলে তার পক্ষে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ রচনা করা কি করে সম্ভব হতে পারে? মানুষের কল্যাণের পথতো একমাত্র আল্লাহই দিতে পারেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে তাঁর রহমত দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। যার কাছে মানুষের স্বাভাবিক দুর্বলতা, ভুল-ত্রুটি সবকিছু পরিষ্কার এবং যিনি দুনিয়ার সব সমাজের সকল মানুষকে সম্পূর্ণরূপে জানেন। পৃথিবীর মানুষ মানুষের গড়া সব মতবাদকে পরীক্ষা করে দেখেছে। সাম্যের নামে মানুষ খেয়েছে ধোঁকা। যারা বিশ্ব মানবতার বুলি আওড়াতো তাদের কাছে আজ শুধু নিজের জাতির উপকার করাই আদর্শে পরিণত হয়েছে। তথাকথিত গণতন্ত্র এনেছে নৈতিক-উচ্ছৃংখলতা, সৃষ্টি করেছে পুঁজিবাদী সমাজ, আধুনিক সভ্যতার চরম শিখরে ওঠে মানুষ ভুলতে পারেনি সাদাকালোর ভেদাভেদ। ইহুদীবাদ আজ চরমভাবে হুমকি দিচ্ছে মানবতাকে। নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার মোহে গড়ে তোলা হয়েছে মারণাস্ত্রের পাহাড়। বৃহৎ শক্তিগুলোর হুমকির দাপটে-যুদ্ধের ভয়ে মানবতা আজ সদা কম্পমান। একদিকে উপচে পড়ছে ভোগের পেয়ালা, অন্যদিকে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ না খেয়ে গুণছে মৃত্যুর প্রহর। সারা বিশ্বের অগণিত মানুষের আজ একটি মাত্র জিজ্ঞাসা। এই নিরাশা, এই হিংসা-বিদ্বেষ এই লাঞ্ছনার কি শেষ নেই? মুক্তির আশায়, শান্তির আশায় মানুষ এক পথ ছেড়ে চলতে চেয়েছে অন্যপথে। কিন্তু বার বার হয়েছে ব্যর্থ। পুরাতন শিকলের বদলে নতুন আর এক শিকল মানুষের গলায় জড়িয়ে পড়েছে। তাই মানুষের সামনে আজ একটি মাত্র পথ। তার স্রষ্টার দেয়া সহজ সরল পথ ইসলাম। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্যে মুক্তির পথ হলো হযরত মুহাম্মদ (স) এর প্রদর্শিত পথ ইসলাম। একথা শুধু মুসলমানরা নয়, অমুসলিম গবেষকরাও স্বীকার করেছেন যে, হযরত মুহাম্মদ (স) মানুষের জন্যে যে শিক্ষা রেখে গেছেন তা আজও অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। তাঁর ওফাতের চৌদ্দশত বছর পরও তাঁর শিক্ষা অটুট রয়েছে কুরআন এবং হাদীসের মধ্যে। আজকাল তো মানুষের উন্নতিও হয়েছে অনেক। পৃথিবী এখন মানুষের কাছে ছোট। খুব সহজেই রাসূলের (স) এই শিক্ষাকে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব। তাই একথা খুব স্বাভাবিকভাবে দাবী করা যায় যে, মানুষের জন্যে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ মুক্তি পেতে পারে একমাত্র ইসলামের পথেই। ইসলাম সাধারণ অর্থে একটি ধর্মের নাম নয়। ইসলামের প্রকৃত অর্থ তাই আমাদেরকে ভালভাবে বুঝতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে, আমরা যারা মুখে মুখে ইসলাম মেনে নিয়েছি কিংবা মুসলমান বলে নিজেদেরকে পরিচয় দেই-তাদের প্রকৃত দায়িত্ব কি?
২. মুসলমান কাকে বলে
মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেই মুসলমান হওয়া যায় না। মুসলমানের মত নাম রাখলেই তাকে মুসলমান বলা যায় না। ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হতে হয়। ইসলাম গ্রহণ করলেই কেবল মুসলমান হওয়া যায়। আর এই ইসলাম গ্রহণ অর্থ আমি মুসলমান হয়েছি কিংবা আমি মুসলমান এই কথা বলা নয়।
ইসলাম গ্রহণ করার অর্থ:
(ক) হযরত মুহাম্মদ (স) এর শিক্ষা-দীক্ষাকে অন্তরের সাথে সত্য বলে গ্রহণ করা;
(খ) নিজের জীবনে এই শিক্ষাকেই একমাত্র পথ হিসেবে মেনে নেয়া, এবং
(গ) এই ব্যবস্থা অনুযায়ী গোটা জীবনকে গড়ে তোলা।
আল্লাহ তাঁর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের মাধ্যমে আমাদেরকে যে সমস্ত জিনিস বিশ্বাস করতে বলেছেন তা বিশ্বাস করার অর্থ হলো-ঈমান। আর এই বিশ্বাসের আলোকে দুনিয়ার প্রতিটি কাজ করার নাম ‘ইবাদাত’ বা দাসত্ব করা।
ঈমান
মুসলমান হতে হলে কতকগুলো জিনিসের উপর বিশ্বাস আনতে হয়। ইসলামী পরিভাষায় একে বলা হয় ঈমান বা আকীদা। যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান ঠিক না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের কোন প্রশ্নই আসে না। সাধারণভাবে ঈমানকে বলা যেতে পারে কতকগুলো বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান বা ইলম। আমরা সবাই জানি যে কোন কাজ করতে হলে সেই কাজ সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা থাকতে হয়। এই ধারণাটুকু না থাকলে সে কাজও ভালভাবে করা যায় না। তেমনি ইসলামকে গ্রহণ করে মুসলমান হতে হলে জানতে হবে ইসলামী ধ্যান-ধারণার ভিত্তি কি। আর এ জন্য জ্ঞান বা ইসলামকে ইসলামে এতো গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
যে সমস্ত বিষয়ের উপর ইসলামের মূল ভিত্তি বলা হয়, তা হলোঃ
- আল্লাহর উপর বিশ্বাস,
- ফেরেশতাদের উপর বিশ্বাস,
- আল্লাহর কিতাবের উপর বিশ্বাস,
- রাসুলের উপর বিশ্বাস ,
- আখেরাত বা পরকালের উপর বিশ্বাস,
- তাকদীরের উপর বিশ্বাস,
- পুনরুত্থান দিবসের প্রতি বিশ্বাস।
তাওহীদ
আমাদের চারপাশে বিরাট জগত-আকাশ, পৃথিবী, গাছপালা, কীট পতঙ্গ, পশু-পাখি, মানুষ-এসব কি আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়েছে? এসব কিছু যে একটা সুন্দর নিয়ম মেনে চলেছে, তা কি কোন পরিচালক ছাড়াই হচ্ছে? না, তা কখনো হতে পারে না। কেননা আমরা সবাই এটা জানি যে সামান্য একটা বলও কেউ ধাক্কা না দিলে নড়তে পারে না। ছোট্ট একটা খেলনা একজন কারিগর ছাড়া আপনা-আপনি তৈরি হতে পারে না। তাই এই বিশ্ব জগতের একজন কারিগর আছেন-মালিক আছেন-পরিচালক আছেন। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর দয়ায় আমরা বেঁচে আছি। তিনি আমদাদের রিজিক দেন। যা কিছু হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে-সবই তাঁর জানা আছে। কিন্তু এ কথাটি মুখে স্বীকার করলেই আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা সম্পূর্ণ হয় না। প্রয়োজন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহকে প্রভু বা মালিক হিসেবে মেনে নেয়া। চাকর বা গোলাম যেমনভাবে তার প্রভুকে মেনে চলে, তার হুকুম অনুযায়ী চলে।
প্রভুর অনুপস্থিতিতেও নিজের খেয়ালখুশী মত চলে না। মালিকের নিয়ম মত সব কাজ করে। তেমনি ভাবে আল্লাহকে প্রভু হিসেবে মেনে নিয়ে জীবনের কাজ তাঁর আইন অনুযায়ী করতে হবে। এটা অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে হবে যে, আমাদের জীবনে একমাত্র তাঁরই আইন চলবে। এই দুনিয়ায় একমাত্র তাঁরই হুকুম চলতে হবে। মানুষের বানানো আইনের সামনে মাথা নত করা যাবে না। কিন্তু আমরা কি দেখি? আল্লাহর উপর ঈমান এনেও আমরা জীবনের এক এক সমস্যার জন্যে একটা একটা শক্তির দ্বারস্থ হচ্ছি। এইভাবে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার বানানোকে শিরক বলা হয়। শিরক মহাপাপ-সবচেয়ে বড় গোনাহ। তাই আমাদেকে জেনে নিতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে এই দুনিয়ার কিভাবে জীবন-যাপন করতে বলেছেন। এসব কিছু জেনে নিয়ে পুরোপুরিভাবে মেনে চলতে পারলেই তাঁকে প্রভু হিসেবে মেনে নেয়া সার্থক হবে। আল্লাহর প্রকৃত গোলাম আমরা তখনি হতে পারব যখন জীবন চলার পথ হিসেবে একমাত্র তাঁর দেয়া পথ সিরাতুল মুস্তাকিমকে আমরা বেছে নেবো। কোন কাজ করলে একমাত্র তাঁর জন্যেই করবো। কাউকে ভালবাসলে একমাত্র তাঁর জন্যেই ভালবাসবো। কাউকে ত্যাগ করলে একমাত্র তাঁর জন্যেই ত্যাগ করবো। তবেই তো হবে আল্লাহর প্রতি সত্যিকারের ঈমান আনা।
রিসালাত
এমনিভাবে ঈমান আনতে হয় নবী-রাসূলের প্রতি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জীবনটা সহজ নয়। জীবনে হাজারো সমস্যার সামনে তাকে পড়তে হয়। আর তখনই প্রশ্ন আসে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল।কোন কাজ করতে হবে আর কোনটা থেকে দূরে থাকতে হবে। দুনিয়ার এসব ব্যাপারে সকলে সমান বুঝে না। তাই এমন একজনের নিকট থেকে তা জেনে নিতে হবে যিনি সব কিছু ভালভাবে জানেন। মানুষের জীবনের সব সমস্যার সমাধান একমাত্র আল্লাহ দিতে পারেন। তাই তিনি মানুষের মাঝে যাদেরকে দুনিয়া জাহানের এসব রহস্য জানিয়ে দিয়ছেন তাঁদের নিকট থেকে আমাদেরকে তা জেনে নিতে হবে। জীবনের পথে তারাই আমাদের নেতা। আর এই নেতারাই হলেন নবী-রাসূল। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সমাজে আল্লাহ তাঁর নবী-রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন তাঁর বাণী দিয়ে। শেষ বারের মত যিনি আল্লাহর কাছ থেকে শান্তির পথ-নির্দেশ নিয়ে এসেছিলেন তিনি নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স)। আমরা তাঁর উম্মত বা অনুসারী। কিন্তু এতটুকু বিশ্বাস করার মধ্যে কোন কল্যাণ নিহিত নেই। রাসূলের (সা) প্রতি বিশ্বাস আনার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে নিজের জীবনকে পথের দিশারী বা নেতা হিসেবে তাঁকে মেনে নেয়া। রাসূলের শিক্ষা-দীক্ষার উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস এনে তাঁর দেখানো পথে দৃঢ় পদে এগিয়ে যাওয়া। হযরত মুহাম্মদ (সা) কে শেষ এবং শ্রেষ্ঠ রাসূল হিসেবে মেনে নেয়ার অর্থই হলো একথা মেনে নেয়া যে, কিয়ামত পর্যন্ত তিনিই আমাদের নেতা। তিনিই আমাদের মুক্তির দিশারী। মানবতার মুক্তি একমাত্র তাঁর দেখানো পথেই আসতে পারে।
আখিরাত
আল্লাহ ও রাসূলের (সা) উপর ঈমান আনার পর আমাদেরকে আর একটি বিষয়ের প্রতিও ঈমান আনতে হয়। তা হলো এই যে, দুনিয়ার এই জীবনই শেষ নয়। মানুষ এই দুনিয়ায় ভাল বা মন্দ কাজ করলে তার ফল দুনিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি কাজের জন্যে মৃত্যুর পর পরকালেও তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এবং তখনই তাকে চূড়ান্ত ফলাফল দেয়া হবে। ভাল কাজের জন্য পাবে বেহেশত আর খারাপ কাজের জন্য পাবে দোজখ। এই সবের উপর বিশ্বাস আনার অর্থ হলো আখেরাতের প্রতি ঈমান। এই ঈমানও সত্যিকারভাবে সম্পূর্ণ হবে তখন যখন জীবনের সব কিছুতে সব সময়ে পরকালের প্রতি ঈমানকে কাজে লাগানো হবে। আখিরাতের প্রতি ঈমান না থাকলে, আল্লাহর কাছে জবাব দেয়ার ভয় না থাকলে, মানুষ কখনো ভাল মানুষ হতে পারে না। যে কাজই সে করবে নিজের খেয়াল খুশীমত করবে। খারাপ কাজ করতে, মানুষ ঠকাতে, মানুষের উপর জুলুম করতে, দেশের ক্ষতি করতে সে কোন পরোয়াই করবে না। ধীরে ধীরে সব মানুষ শঠ, অসৎ-চরিত্র ও খারাপ প্রকৃতির হয়ে গড়ে উঠবে। দুনিয়ায় নেমে আসবে সীমাহীন অশান্তি। যখন মানুষ ঈমান আনে আখিরাতের প্রতি, তখন আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে এই ভয়ে নিয়ে সে কাজ করে। তখন তার দ্বারা কোন খারাপ কাজ হতে পারে না। সে হয়ে উঠে এক সুন্দর আর আদর্শ মানুষ।
কিতাব ও ফিরিশতা
আল্লাহ নবীদের কাছে যে বাণী পাঠিয়েছেন তাকে অহী বলা হয়। অহীর মাধ্যমে আল্লাহ অনেক নবীর কাছে কিতাব পাঠিয়েছেন। যেমন হযরত মূসা (আ) এর কাছে এসেছে তাওরাত হযরত দাউদ (আ) এর কাছে জাবুর আর হযরত ঈসা (আ) এর কাছে ইঞ্জিল। এমনিভাবে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর কাছে যে কিতাব এসেছে তার নাম আল কুরআন। কুরআনে রয়েছে মানুষের জন্যে আল্লাহর হুকুম-আহকাম। আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্যে-দুনিয়ায় একসুখী-সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার জন্যে মৌলিক নিয়ম নীতি এসেছে এই কুরআনে। আর আল্লাহর নবী কুরআনের আলোকেই নিজের জীবনকে গড়ে তুলেছিলেন। এই কুরআনের দেখানো পথে কায়েম করেছিলেন এক সুন্দর ইসলামী সমাজ। সেই কুরআনকে কি আমরা তেমনিভাবে আমাদের জীবনে গ্রহণ করেছি? না, বরং অতি ভক্তির সাথে কুরআনকে তাকের উপর তুলে রেখেছি। কুরআনে আমাদের রব আমাদের জন্যে কি কি নির্দেশ দিলেন তা জানার এবং তো মেনে চলার আগ্রহ আমাদের মধ্যে নেই। শুধু কুরআন তিলাওয়াতের মধ্যে সওয়াব দেখেছি। একদিকে কোরআন তিলাওয়াত করছি অন্যদিকে কুরআনের বিধি বিধানের উল্টো কাজ করছি। প্রতি মুসলিম ঘরে আজ সুন্দর কাপড়ে মুড়ানো, সুন্দরভাবে সাজানো আছে কুরআন। কিন্তু আমাদের চারপাশের সমাজে বিরাজ করছে ঠিক কুরআনের উল্টো আইন-কানুন। এই অবস্থায় কিভাবে আমরা দাবী করতে পারি যে, কুরআনের উপর রয়েছে আমাদের অবিচল বিশ্বাস? কুরআনের প্রতি আমাদের ঈমানের দাবী তখনই পূর্ণ হতে পারে যখন কুরআনকে জীবনপথের চলার দিশা হিসেবে মেনে নেবো। যখন কুরআনকে আমাদের নিজেদের এবং সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় আমরা তৎপর হবো। তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত ও কিতাবের উপর ঈমান আনার সাথে সাথে তকদির ও ফিরিশতাদের প্রতিও আমাদের ঈমান আনা দরকার। ফিরিশতারা নূরের তৈরি। আল্লাহর হুকুমেই তারা প্রত্যেকেই এক একটি দায়িত্ব পালন করেন।