সফল জীবনের পরিচয়
অধ্যাপক এ.কে.এম. নাজির আহমদ
বইটির অডিও শুনুন
লো কোয়ালিটি ডাউনলোড হাই কোয়ালিটি ডাউনলোড
সফল জীবনের পরিচয়
এ.কে.এম. নাজির আহমদ
বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার
ঢাকা
প্রকাশনায়
এ কে এম নাজির আহমদ
পরিচালক,
বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার
প্রারম্ভিক কথা
আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ মানব-সত্তায় বহুবিধ চাহিদা জুড়ে দিয়েছেন। আবার, এই আল্লাহই মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য যা যা প্রয়োজন, সবই সৃষ্টি করেছেন।
তদুপরি আল্লাহ মানুষকে তার চাহিদা পূরণে সম্পদ আহরণ, সম্পদ রূপান্তরিতকরণ এবং সম্পদ ভোগ-ব্যবহারের জন্য জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্ম- ক্ষমতা দান করেছেন।
এই জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্ম-ক্ষমতা প্রয়োগ করেই মানুষ আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব করে থাকে।
মানুষের কোন কোন চাহিদা আপনা-আপনিই পূরণ হয়। কোন কোন চাহিদা মানুষ একক প্রচেষ্টায় পূরণ করতে পারে। কোন কোন চাহিদা পূরণের জন্য মানুষকে অপরাপর মানুষের সহযোগিতা নিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের নানাবিধ চাহিদা পূরণের জন্যই পরিবার, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা, আর্থিক সংস্থা এবং রাষ্ট্র-সংগঠন গড়ে ওঠে।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য চাই বায়ু। পৃথিবীর চারদিকে একটি পুরো বায়ুমণ্ডল জুড়ে দিয়ে আল্লাহ মানুষের এই চাহিদা পূরণ করেছেন।
এই চাহিদা আপনা-আপনিই পূরণ হয়। শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে বায়ু অটোমেটিক মানুষের ফুসফুসে যাতায়াত করে। বায়ুর চাহিদা মেটাবার জন্য মানুষকে কষ্ট করতে হয় না। চেষ্টা চালাতে হয় না।
শীতের দিনে শীত তাড়াবার জন্য তাপের প্রয়োজন । তাপ লাভের অন্যতম উপায় রোদ পোহানো। কেউ শীত তাড়াতে চাইলে রোদে গিয়ে দাঁড়ালে শীত দূর হয়। এইভাবে তাপ লাভের জন্য তাকে কারো সহযোগিতা নিতে হয় না। অর্থাৎ সে একাই তার এই চাহিদা পূরণ করতে পারে।
বেঁচে থাকার জন্য মানুষের খাদ্য চাই। আল্লাহ শস্য, ফল, শাক-সবজি, তরি-তরকারি ইত্যাদি উৎপন্ন করার উপযুক্ত করে মাটি সৃষ্টি করেছেন। এই মাটি কর্ষণ করে, এতে বীজ বহন করে এবং চারাগাছ পরিচর্যা করে এইগুলোর উৎপাদন নিশ্চিত করতে হয়। আবার, চুলোর ওপর পাতিলে সেদ্ধ করে এইগুলো খাওয়ার উপযোগী করতে হয়।
খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এবং খাদ্য প্রস্তুতকরণের বিভিন্ন স্তরে একজন মানুষকে অপরাপর মানুষের সহযোগিতা নিতে হয় এবং আল্লাহ পৃথিবীময় যেই সব উপাদান মওজুদ করে রেখেছেন সেইগুলোর রূপান্তর ঘটিয়ে অপরাপর মানুষ যেইসব উৎকরণ তৈরি করেছে, সেইগুলোর সাহায্য নিতে হয়। অর্থাৎ সে একা এ চাহিদা পূরণ করতে পারে না।
মানুষের চাহিদার তালিকা বেশ দীর্ঘ। মানুষের খাদ্য চাই, পানি চাই, ঘর চাই, পোশাক চাই, ঔষধ চাই, শিক্ষা চাই, ভাব প্রকাশের সুযোগ চাই, বাহন চাই, নিরাপত্তা চাই, ঘুমের প্রতিকার চাই। ইত্যাদি।
মানুষের যাবতীয় প্রয়োজন মেটানো বা চাহিদা পূরণের জন্য, মানুষের জীবনকে স্বচ্ছন্দ করার জন্য, মানুষের জীবনকে সুন্দর করার জন্য এবং মানুষের জীবনকে সমুন্নত করার জন্য আল্লাহ যেইসব নিয়ামাতের ব্যবস্থা করেছেন সেইগুলো সবই মানুষের রিয্ক।
উল্লেখ্য যে অন্যান্য সৃষ্টির রিকের ব্যবস্থাও আল্লাহই করে থাকেন।
রিয্ক তালাশের নির্দেশ
এই পৃথিবীর অংগনে মুমিনদেরকে দুইটি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হয়। একটি হালাল জীবিকা উপার্জনের সংগ্রাম, অপরটি আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্ৰাম।
জীবিকা উপার্জনে উদাসীন হওয়া, সংসার ত্যাগী হওয়া, বৈরাগী হওয়া, সন্ন্যাসী হওয়া এবং আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রাম বিমুখ হওয়া ইসলাম নির্দেশিত জীবন পদ্ধতি নয়।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন, এ لَأَرَهْبَانِيَّةَ فِي الْإِسْلام
“ইসলামে রাহবানিয়াত বা বৈরাগ্যবাদ নেই।” [মুসনাদে আহমাদ]
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন, وَرَهْبَانِيَّةَ فِي ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنُهَا عَلَيْهِمْ
“আর বৈরাগ্যবাদ তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে, আমি ওটা তাদের ওপর চাপিয়ে দিইনি।” [আল হাদীদ- ২৭]
قُل مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللهِ الَّتى أَخْرَجَ لعباده والطيبتُ من الرِّزْقِ قُلْ هى الذينَ آمَنُوا فى الحيوة الدُّنْيَا خَالِصةً يُوْمَ الْقِيَامَة ط
“তাদেরকে বলে দাও : আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেইসব সাজ-শোভা এবং পবিত্র রিষ্ক দান করেছেন, সেইগুলোকে হারাম করলো কে? দুনিয়ার জীবনে এইগুলোতো মুমিনদের জন্যই এবং আখিরাতেও একান্তভাবে তাদের জন্যই হবে।” অর্থাৎ আল্লাহর অনুগত বান্দা হওয়ায় মুমিনরাই এইগুলো ভোগ-ব্যবহারের প্রকৃত হকদার।” [আল আ’রাফ- ৩২]
وَلَقَدْ مَكَّنكُمْ فِي الأَرْضِ وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيهَا مَعَايِشَ قَلِيلاً ما تَشْكُرُونَ
“আমি তোমাদেরকে পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছি এবং এতে তোমাদের জন্য জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করেছি। তোমরা সামান্যই শুকরিয়া আদায় করে থাক।” [আল আ’রাফ -১০]
هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا
“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীর সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন।” [আল বাকারা-২৯]
واتْكُم مِّنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ – وَإِنْ تَعُدُّ نِعمت الله لا تحصوها
“এবং তোমরা যা চাও (অর্থাৎ তোমাদের চাহিদা পূরণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন) সবই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামাতগুলো গণনা করতে চাও তা করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”[ ইবরাহীম-৩৪]
هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضِ ذَلُولاً فَامْشُوا فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُوا مِنْ رِزْقِهِ ، وَإِلَيْهِ النُّشُور
“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে অনুগত বানিয়ে দিয়েছেন। অতএব তোমরা এর বুকে বিচরণ কর এবং আল্লাহর দেওয়া রিয্ক (আহরণ করে) খাও। আবার জীবিত হয়ে তোমাদেরকে তাঁর দিকেই যেতে হবে।” [আল মুলক-১৫]
.يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلوةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إلى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ. فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلُوةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ
وَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ.
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, জুমুআর দিন যখন ছালাতের জন্য ডাকা হয় আল্লাহর স্মরণে দৌড়ে আস, বেচাকেনা ছেড়ে দাও । এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জান। ছালাত আদায় করে যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ কর এবং বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাক। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।” [আলজুমুআ- ৯, ১০]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
أطْلُبُوا الرِّزْقَ فِي خَبَايَا الْأَرْضِ
“তোমরা মাটির গভীর তলদেশে রিয্ক তালাশ কর।” ৃ ৃ[আয়িশা (রা), মুসনাদু আবী ইয়া’লা]
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَاَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرَّبوا
“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন।” [আলবাকারা- ২৭৫]
لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُوا فَضْلاً مِّنْ رَّبِّكُمْ
“(হাজের সময়ে) তোমরা যদি তোমাদের রবের অনুগ্রহ (রি) তালাশ কর এতে কোন দোষ নেই।” [আলবাকারা -১৯৮]
وَجَعَلْنَا أيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةٌ لتَبْتَغُوا فَضْلاً مِّنْ رَّبِّكُمْ
“এবং আমি দিনকে করেছি আলোকোজ্জ্বল যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ (রিক) তালাশ করতে পার।” [বানী ইসরাঈল -১২]
وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشا
“এবং আমি দিনকে জীবিকা উপার্জনের সময় বানিয়েছি।” [আন নাবা- ১১]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
ما أكل أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِّنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ.
“কারো জন্য নিজের হাতের উপার্জনের চেয়ে উত্তম খাবার আর নেই।” [মিকদাম ইবনু মা’দী কারাব (রা), সহীহ আলবুখারী]
আল্লাহর রাসূলকে (সা) জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “কোন্ উপার্জন উত্তম?”
তিনি বললেন,
عمَلُ الرَّجُلِ بِيَدِهِ وَكُلُّ بَيْعٌ مُبْرُورٍ
“ব্যক্তির নিজের হাতের উপার্জন এবং সৎ ব্যবসা।” [রাফে’ ইবনু খাদীজ (রা), মিশকাতুল মাসাবীহ]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
إذَا صَلَّيْتُمُ الْفَجْرَ فَلاَ تَنُومُوا عَنْ طَلْبٍ أَرْزَاقِكُمْ
“তোমরা ছালাতুল ফাজর আদায়ের পর তোমাদের রিয্ক তালাশে নিয়োজিত না হয়ে ঘুমিয়ে থেকো না।” [আনাস ইবনু মালিক (রা), আলকাউলুল মুসাদ্দাদ]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
طَلَبُ كَسْبِ الْحَلَالِ فَرِيْضَةً بَعْدَ الْفَرِيضَةِ
“নির্ধারিত ফারযগুলোর পর হালাল জীবিকা তালাশ করাও ফরয।” [আবদুল্লাহ ইবনু মাস’উদ (রা), সুনানু আলবাইহাকী]
আল্লাহই রিয্ক দিয়ে থাকেন
“সৃষ্টির সূচনা থেকে কিয়ামাত পর্যন্ত যতো প্রকারের যতো মাখলুক আল্লাহ সৃষ্টি করবেন তাদের প্রত্যেকের সঠিক চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে খাদ্যের সব সরঞ্জাম হিসাব করে তিনি পৃথিবীর বুকে রেখে দিয়েছেন। স্থলভাগে ও পানিতে অসংখ্য প্রকারের উদ্ভিদ রয়েছে। যাদের প্রতিটি শ্রেণীর খাদ্য সংক্রান্ত প্রয়োজন অন্য সব শ্রেণী থেকে ভিন্ন। আল্লাহ বায়ুমণ্ডল, স্থল ও পানিতে অসংখ্য প্রজাতির জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিটি প্রজাতির স্বতন্ত্র ধরনের খাদ্য প্রয়োজন। তাছাড়া এই সব প্রজাতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সৃষ্টি মানুষ। মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন শুধু দেহের লালন ও পরিপুষ্টি সাধনের জন্যই নয়, তার রুচির পরিতৃপ্তির জন্যও নানা রকম খাদ্যের প্রয়োজন। আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে কি জানা সম্ভব ছিলো, মাটির তৈরি এই গ্রহটির ওপর জীবনের উৎপত্তি থেকে শুরু করে তার পরিসমাপ্তি পর্যন্ত কোন্ কোন্ শ্রেণীর সৃষ্টিকুল কত সংখ্যক, কোথায় কোথায় এবং কোন্ কোন্ সময় অস্তিত্ব লাভ করবে এবং তাদের প্রতিপালনের জন্য কোন্ প্রকারের খাদ্য কত পরিমাণে দরকার হবে? নিজের সৃষ্টি পরিকল্পনা অনুসারে যেইভাবে তিনি খাদ্যের মুখাপেক্ষী এইসব মাখলুককে সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করেছিলেন, অনুরূপভাবে তাদের চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্য সরবরাহেরও পূর্ণ ব্যবস্থা করেছেন।” [তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, ১৪শ খণ্ড, সূরা হামীমুস সাজদার তাফসীরের ১২ নাম্বার টীকা।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَكَأَيِّنْ مِنْ دَابَّةٍ لا تَحْمِلُ رِزْقَهَا اللَّهُ يَرْزُقُهَا وَأَيَّاكُمْ
“অসংখ্য জীব এমন রয়েছে যারা নিজেদের রিকের ভাণ্ডার বহন করে বেড়ায় না। আল্লাহই তাদেরকে রিয্ক দেন এবং তোমাদের রিও তিনিই দেন। ”[আলআনকাবূত- ৬০]
وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلا عَلَى اللهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا ، كُلُّ فِي كِتَابٍ مُّبِين
“পৃথিবীতে এমন কোন জীব নেই যার রিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর নয়। তিনিই জানেন কার বাস কোথায় এবং তাকে কোথায় রাখা হয়। সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।”
[ হূদ -৬]
إنَّ اللهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ
“নিশ্চয়ই আল্লাহই রিয্কযাতা, অটল ক্ষমতার অধিকারী।” [আযযারিত-৫৮]
وَالْأَرْضَ مَدَدْنَهَا وَالْقَيْنَا فِيهَا رَوَاسِي وَأَنْبَتْنَا فِيهَا مِنْ كُلِّ شَيْءٍ موزون وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيهَا مَعَايِشَ وَمَنْ لَسْتُمْ لَه برزقين، وَإِنْ مِّنْ شَيْءٍ الأعِنْدَنَا خَزَانته ، وَمَا نُنَزِّلُه الا بِقَدَرٍ مَّعْلُومٍ
“আমি পৃথিবীকে ছড়িয়ে দিয়েছি। এর ওপর পাহাড় গেড়ে দিয়েছি। এর মধ্যে পরিমাণ মতো নানা ধরনের গাছপালা জন্মিয়েছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছি এবং তাদের জন্যও যাদের রিয্কদাতা তোমরা নও। এমন কোন জিনিস নেই যার ভাণ্ডার তাঁর হাতে নয়। এবং আমি তা সুনির্দিষ্ট পরিমাণে নাযিল করে থাকি।” [আলহিজর । ১৯-২১]
وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسى مِنْ فَوْقِهَا وَبرَكَ فِيهَا وَقَدْرَ فِيهَا أَقْوَاتَهَا في أربَعَةِ أَيَّامٍ ، سَوَاءٌ للسَّائِلِينَ
“তিনি (পৃথিবীকে অস্তিত্ব দানের পর) ওপর থেকে পাহাড় গেড়ে দিয়েছেন। এতে বারাকাত দান করেছেন। আর এতে সকল প্রার্থীর চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক পরিমাণে রিয্ক নির্দিষ্ট করেছেন, মাত্র চারদিনে।” [হামীমুস সাজদা-১০]
قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا
“আল্লাহ সবকিছুরই একটি পরিমাণ ঠিক করে রেখেছেন।” [আত্ তালাক-৩]
نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُمْ مُعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَوةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَابَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجت لِّيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِيًّاطوَرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ
“আমি দুনিয়ার জীবনে এদের মধ্যে জীবনোপকরণ বণ্টন করেছি, এদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোককে অন্যদের ওপর বেশি মর্যাদা দিয়েছি যাতে
এরা একে অপরের সেবা গ্রহণ করতে পারে। এরা যা জমা করে তার চেয়ে তোমার রবের রাহমাত অনেক বেশি মূল্যবান।” [আয্ যুখরুফ-৩২]
اللهُ لَطِيفٌ بِعِبَادِهِ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ ، وَهُوَ الْقَوِيُّ الْعَزِيزُ
“আল্লাহ সূক্ষ্ম বদান্যতাপ্রবণ। যাকে ইচ্ছা রিক দেন। তিনি শক্তিমান ও মহাপরাক্রমশালী।” [আশ্ শূরা- ১৯]
قُلْ إِنَّ رَبِّي يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يُشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُلَهُ ط وَمَا أَنْفَقْتُم مِّنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ ، وَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ
“তাদেরকে বলে দাও : আমার রব তাঁর বান্দাদের যাকে ইচ্ছা প্রচুর রিয্ক দেন, আর যাকে ইচ্ছা সংকীর্ণ করে দেন। আর তোমরা যা খরচ কর তার পরিবর্তে তিনি তোমাদেরকে আরো রিয্ক দেবেন। তিনিই তো সর্বোত্তম রিয্কদাতা।” [সাবা-৩৯]
لَهُ مَقَالِيْدُ السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ ، يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ ، إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
“আসমান ও যমীনের চাবি তাঁরই হাতে। তিনি যাকে চান অঢেল রিয্ক দেন এবং যাকে চান কম দেন। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছুর জ্ঞান রাখেন।” [আশ্ শূরা -১২]
أَوَ لَمْ يَعْلَمُوا أَنَّ اللهَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ ط إِنَّ في ذَلِكَ لَأَنْتَ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
“তারা কি জানে না, নিশ্চয় আল্লাহ যাকে চান অঢেল রিয্ক দেন এবং যাকে চান তার রিয্ক সংকীর্ণ করে দেন। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা ঈমান পোষণ করে।” [আয যুমার-৫২]
قُلْ إِنَّ رَبِّي يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يُشَاءُ وَيَقْدِرُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاس لا يَعْلَمُونَ
“তাদেরকে বলে দাও : নিশ্চয়ই আমার রব যাকে চান প্রশস্ত রিক দেন এবং যাকে চান সংকীর্ণ রি দেন। কিন্তু বেশির ভাগ লোকই এর তাৎপর্য জানে না।” [সাবা-৩৬]
وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاَقِ ، نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُم ط إِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خطاً كَبِيرًا
“এবং তোমরা অভাবের ভয়ে সন্তান হত্যা করো না। আমি তাদেরকে রিয্ক দেবো, তোমাদেরকেও দিচ্ছি। নিশ্চয়ই তাদেরকে হত্যা করা মস্ত বড়ো গুনাহ।” [বনী ইসরাঈল-৩১]
وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلادَكُمْ مِنْ اخلاق ، نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ
এবং অভাবের ভয়ে সন্তান হত্যা করো না। আমি তোমাদেরকে রিয্ক দিচ্ছি, তাদেরকেও দেবো।” [আল আন’আম- ১৫১]
وَلَوْ بَسَطَ اللَّهُ الرِّزْقَ لِعِبَادِهِ لَبَغَوْا فِي الْأَرْضِ وَلَكِنْ يُنَزِّلُ بِقَدَرٍ مَّا يَشَاءُ ط
“আল্লাহ যদি তাঁর বান্দাদেরকে সীমাহীন রিয্ক দান করতেন, তাহলে তারা পৃথিবীতে বিদ্রোহের তুফান সৃষ্টি করতো। কিন্তু তিনি ইচ্ছা মতো একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে রিয্ক নাযিল করেন।”
[আশ্ শূরা- ২৭]
فَابْتَغُوا عِنْدَ الله الرِّزْقَ وَاعْبُدُوا وَاشْكُرُوا لَهُ
“অতএব আল্লাহর কাছেই রিয্ক অনুসন্ধান কর, তাঁরই ইবাদাত কর এবং তাঁরই শুকরিয়া আদায় কর।” [আলআনকাবূত- ১৭]
রিকের প্রাচুর্য অথবা সংকীর্ণতা দ্বারা আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন দুনিয়ার জীবনে যাকে যা কিছু দিয়েছেন তো পরীক্ষার জন্যই দিয়েছেন।
আল্লাহ অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা-কর্তৃত্ব, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদি পরীক্ষার জন্যই দিয়ে থাকেন। তিনি দেখতে চান, এইগুলো পেয়ে সে তাঁর শুকরিয়া আদায় করে, না অকৃতজ্ঞ হয়।
আবার আল্লাহ অভাব-অনটন, বিপদ-মুসীবাত ইত্যাদিও পরীক্ষার জন্যই দিয়ে থাকেন। তিনি দেখতে চান, অভাব-অনটন ও বিপদ-মুসীবাতে পড়ে মানুষ তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর সন্তুষ্ট থেকে ধৈর্যধারণ করে, না নৈতিকতার বাঁধন ছিন্ন করে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
فَأَمَّا الْإِنْسَانُ إِذَا مَا ابْتَلَهُ رَبُّهُ فَأَكْرَمَهُ وَنَعْمَهُ لَا فَيَقُولُ رَبِّي أكْرَ من وَأَمَّا إِذَا مَا ابْتَلَهُ فَقَدَرَ عَلَيْهِ رِزْقَهُ ، فَيَقُولُ رَبِّي آهَانَنِ
“কিন্তু মানুষের অবস্থা হচ্ছে : যখন তার রব তাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং তাকে সম্মান ও নিয়ামাত দান করেন তখন সে বলে : আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন। আবার তিনি যখন তাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং তার রিয্ক সংকীর্ণ করে দেন, তখন সে বলে : আমার রব আমাকে হেয় করেছেন।” [আলফাজর- ১৫, ১৬]
আরো উল্লেখ্য যে, আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন কাউকে সুদর্শন এবং কাউকে কুৎসিত রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে সবল-সুঠাম দেহের অধিকারী এবং কাউকে দুর্বল দেহের অধিকারী রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে মেধাবী ও কাউকে মেধাহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে অসাধারণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন এবং কাউকে স্মৃতিশক্তিহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে সুষ্ঠু প্রত্যংগসহ এবং কাউকে বিকলাংগ রূপে সৃষ্টি করেন। তিনি কাউকে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন এবং কাউকে দৃষ্টিশক্তিহীন রূপে সৃষ্টি করেন। তিনি কাউকে কর্তৃত্বশীল এবং কাউকে কর্তৃত্বহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে খ্যাতিমান এবং কাউকে খ্যাতিহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
এই সকল অবস্থাই মানুষের জন্য পরীক্ষা। মানুষের কর্তব্য হচ্ছে সদা সচেতন থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য চেষ্টা করা।
আল্লাহর অনুগত ব্যক্তি ও জাতি সহজে রিয্ক লাভ করে থাকে
দুনিয়ার জীবনে এবং আখিরাতের জীবনে মানুষের কল্যাণ কিংবা অকল্যাণ হয় তার কৃত আমলের নিরিখে। কোন ব্যক্তি যদি পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল জীবন যাপন করে আল্লাহ তাকে জীবিকার পেরেশানী দ্বারা পর্যুদস্ত করবেন, এটা স্বাভাবিক নয়।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ. .
“যেই ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে চলে আল্লাহ তাকে কঠিন অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার পথ দেখান এবং এমন উপায়ে তাকে রি দেন যে উপায়ের কথা সে কখনো কল্পনাও করেনি।”
[আত্ তালাক – ২,৩]
[তবে ঈমানী দৃঢ়তা পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন যদি কোন ব্যক্তিকে বা ব্যক্তি-সমষ্টিকে অভাব-অনটন অথবা অন্য কোন বিপদ-মুসীরাতে ফেলেন, সেটা ভিন্ন কথা। এই সম্পর্কে
মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الْأَمْوَالِ
‘এবং আমি অবশ্যই তোমাদেরকে ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি, অনাহার এবং অর্থ-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করবো । আর ছবর অবলম্বনকারীদেরকে সুসংবাদ দাও।”
[আলবাকারা- ১৫৫]
وَ أَنِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُمْ مَّتَاعًا حَسَنًا إِلَى أَجَلٍ مُّسَمًّى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِي فَضْلٍ فَضْلَهُ ، وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنِّى أخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ كَبِير
“এবং তোমরা যদি তোমাদের রবের নিকট ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে আস, তাহলে তিনি তোমাদেরকে একটি মিয়াদ পর্যন্ত উক্ত জীবিকা দান করবেন এবং তাঁর অনুগ্রহ পাওয়ার যোগ্য প্রত্যেককে অনুগ্রহ করবেন। আর তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, আমি তোমাদের জন্য এক ভয়াবহ দিনের আযাবের ভয় করছি।” [হূদ-৩]
و يُقَوْمِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مدْرَارًا وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلى قُوتِكُمْ وَلَا تَتَوَلُّوا مُجْرِمِينَ
“এবং ওহে আমার কাউম, তোমরা তোমাদের রবের নিকট ইসতিগফার কর, তাঁর দিকে ফিরে আস, তাহলে তিনি তোমাদের জন্য আসমানের দরওয়াজা খুলে দেবেন এবং বর্তমান শক্তির সাথে আরো শক্তি যুক্ত করে দেবেন । তোমরা অপরাধী হয়ে মুখ ফিরিয়ে থেকো না।” [হূদ-৫২]
وَلَوْ أَنَّهُمْ أَقَامُوا التَّوْرَةَ وَالْإِنْجِيلَ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِمْ مِّنْ رَّبِّهِمْ لاَ كَلُوا مِنْ فَوْقِهِمْ وَمِنْ تَحْتِ اَرْجُلِهِمْ ط مِنْهُمْ أُمَّةٌ مُقْتَصِدَةٌ م وَكَثِيرٌ مِّنْهُمْ سَاءَ مَا يَعْمَلُونَ
“এবং তারা যদি আত্ তাওরাত, আল ইনজীল এবং তাদের প্রতি তাদের রবের কাছ থেকে যা কিছু নাযিল হয়েছে তা কায়েম করতো, তাহলে তারা ওপর থেকেও রিযৃক পেতো, নীচ থেকেও পেতো। তাদের মধ্যে কিছু লোক অভিপ্রেত পথেই আছে। কিন্তু তাদের বেশির ভাগ লোকই মন্দ কাজ করে চলছে।” [আল-মাইদা-৬৬]
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى امَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكْتٍ مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْتُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
“আর যদি জনপদের লোকেরা ঈমান আনতো এবং আল্লাহকে ভয় করে চলতো, তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান ও যমীনের বারাকাতের দুয়ার খুলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা বলেই উড়িয়ে দিলো। তাই আমি তাদের কামাই অনুযায়ী তাদেরকে পাকড়াও করলাম।” [আল আ’রাফ – ৯৬]
পক্ষান্তরে আল্লাহর অবাধ্য ব্যক্তিকে আল্লাহ পেরেশানীযুক্ত জীবিকা দিয়ে থাকেন।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
ئ فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَ وَمَنْ الْقِيَامَةِ أَعْمَى
“আর যেই ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে, আমার উপদেশনামা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে তার জন্য রয়েছে সংকীর্ণ (পেরেশানীযুক্ত) জীবিকা। আর কিয়ামাতের দিন আমি তাকে উঠাবো অন্ধ করে।”
[তাহা ॥ ১২৪]
আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রাম
ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন কর্তৃক তাঁর সৃষ্টির জন্য নির্ধারিত বিধান।
গোটা বিশ্বময় প্রতিষ্ঠিত, প্রাকৃতিক আইন বলে পরিচিত, বিধানগুলো আসলে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিধান।
বিশেষ অর্থে ইসলাম হচ্ছে মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান। মানুষের জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা রয়েছে এই বিধানে। আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান হওয়ায় ইসলাম নির্ভুল, ভারসাম্যপূর্ণ এবং কল্যাণকর জীবন বিধান।
গোটা বিশ্ব-প্রকৃতিতে স্বীয় বিধান কার্যকর করলেও আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন মানব সমাজে তাঁর বিধান কার্যকর করেননি। তাঁর অভিপ্রায়, মানুষ স্বেচ্ছায় তাঁর দেওয়া জীবন বিধান কবুল করুক এবং তার ভিত্তিতে তার সমাজ ও সভ্যতা গড়ে তুলে পৃথিবীকে শান্তির নীড়ে পরিণত করুক। আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীতে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান কায়েমের জন্যই মানুষের সৃষ্টি। আল্লাহর পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব পালন করার জন্যই মানুষের নিযুক্তি। অর্থাৎ মানুষ এই পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষকে সৃষ্টি করার প্রাক্কালে গোটা বিশ্বের ফেরেশতাদেরকে সম্বোধন করে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
إِنِّي جَاعِلُ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
“আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে যাচ্ছি।” [আলবাকারা- ৩০]
আবার মানুষ পৃথিবীতে আসার পর তিনি মানুষকে তার পজিশন স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,
هُوَ الَّذي جَعَلَكُمْ خَلْيْفَ فِي الْأَرْضِ
“তিনি সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন।” [ফাতির-৩৯]
এই পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। আর মানুষের জীবন মিশন হচ্ছে ইকামাতুদ্ দীন।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
شَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّيْنِ مَا وَصَّى به نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ ط
“তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য দীনের সেই বিধান নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং যা এখন আমি তোমার নিকট ওহীর মাধ্যমে পাঠাচ্ছি এবং যার নির্দেশ আমি দিয়েছিলাম ইবরাহীমকে, মূসাকে এবং ঈসাকে, (আর তা হচ্ছে :) এই দীন কায়েম কর এবং এতে বিভেদ-বিভক্তি-বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করো না।” [আশ্ শূরা-১৩]
উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে নূহ (আ), ইবরাহীম (আ), মূসা (আ) এবং ঈসা (আ)-এর প্রতিও দীন কায়েমের নির্দেশ ছিলো।
এই আয়াতে মানব ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ের কয়েকজন নবীর নাম নেওয়া হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে এই কয়জন নবীকে শুধু দীন কায়েমের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। আসলে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বুঝাতে চাচ্ছেন যে সকল নবীরই জীবন মিশন ছিলো ইকামাতুদ্ দীন। নবীর উম্মাতের জীবন মিশনও ছিলো ইকামাতুদ্ দীন।
এখানে উল্লেখ্য যে দীন অটোমেটিক কায়েম হয় না। আবার, জোর- জবরদস্তি করেও দীন কায়েম করা যায় না।
দীন কায়েমের জন্য বিজ্ঞতাপূর্ণ সংগ্রাম প্রয়োজন। নবী-রাসূলগণ দীন কায়েমের পদ্ধতি শিখিয়ে গেছেন।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন একের পর এক বহু সংখ্যক নবী পাঠিয়েছেন মানব সমাজে। তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তাঁরা আবির্ভূত হয়েছেন বিভিন্ন কালে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, দীন কায়েমের জন্য তাঁরা সকলেই অবলম্বন করেছেন অভিন্ন কৰ্ম-কৌশল।
নবী-রাসূলগণ মানুষকে আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ এবং তাঁর দেওয়া জীবন বিধান অনুসরণের জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন।
যেখানেই মানুষ সেখানেই তাঁরা ছুটে গেছেন। কখনো এক ব্যক্তির কাছে, কখনো ব্যক্তি সমষ্টির কাছে তাঁরা তাঁদের বক্তব্য পেশ করেছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তাঁরা পরিশ্রম করেছেন। জীবন ধারণের প্রকৃত প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যয়িত অংশটুকু ছাড়া তাঁদের সময়, মেধা, শ্রম এবং অর্থ নিয়োজিত হয়েছে এই সুমহান কাজে। তাঁদের প্রতি যাঁরা ঈমান এনেছিলেন তাঁদেরও কর্মধারা ছিলো অনুরূপ।
যদিও সকল মানুষকেই আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি বানিয়ে তাঁর দীন কায়েমের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, নবীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যাঁরা তাঁদের কাফিলায় শামিল হয়েছেন তাঁরা ছাড়া বাকিরা আল্লাহদ্রোহিতাকেই তাদের জীবন মিশন বানিয়ে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এইভাবে তারা পৃথিবীর জীবনে তো অকল্যাণের শিকারে পরিণত হয়েছেই, যেই কর্তব্য সাধনের জন্য তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিলো তা না করার কারণে আখিরাতে তাদেরকে অবশ্যই হতে হবে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন।
সফল জীবনের পরিচয়
পৃথিবীর বেশি সংখ্যক মানুষকেই জীবনের প্রকৃত মিশনের প্রতি উদাসীন থেকে ‘সফলতার’ ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে বেহুঁশের মতো ছুটতে দেখা যায়।
এই জীবনে টাকার পাহাড় গড়তে পারা, বিশাল অট্টালিকার মালিক হওয়া, বহু সংখ্যক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়া, বিলাসী জীবন যাপন করতে পারা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে পারাকেই তারা মনে করে সফলতা।
কিন্তু মহাজ্ঞানী মহাবিজ্ঞ আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের দৃষ্টিতে সফলতার স্বরূপ ভিন্ন। আলকুরআনের বহু সংখ্যক আয়াতে তিনি সফল ব্যক্তিদের পরিচয় তুলে ধরেছেন যাতে মানুষ ‘সফলতার’ ভুল ধারণা থেকে মুক্ত হতে, সঠিক ধারণা লাভ করতে এবং সঠিক কর্মধারা অবলম্বন করতে পারে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
ألا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَاهُمْ يَحْزَنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَياةِ الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ ط
“জেনে রাখ, যারা আল্লাহর বন্ধু, যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে তাদের কোন ভয় ও চিন্তার কারণ নেই। দুনিয়া এবং আখিরাতে- উভয় জীবনেই তাদের জন্য সুসংবাদ। আল্লাহর কথা পরিবর্তিত হবার নয়। এটি বড়োই সফলতা ।” [ইিউনুস ॥ ৬২-৬৪]
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَهَا . وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسها
“অবশ্যই সেই ব্যক্তি সফল যে নিজকে পরিশুদ্ধ করে নিয়েছে । আর সেই ব্যক্তি বিফল যে নিজকে দাবিয়ে দিয়েছে।” [আশ্ শামস – ৯, ১০]
ياَيُّهَا الَّذِينَ امَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رجس مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য নজরানা পেশ করার স্থান এবং ভাগ্য গণনার জন্য শর নিক্ষেপ নাপাক, শাইতানী কাজ। তোমরা এইগুলো পরিহার করে চল। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।” [আল মা-ইদা-৯০]
فَأْتِ ذَالْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنِ السَّبِيلِ ، ذَلِكَ خَيْرٌ للَّذِينَ يُرِيدُونَ وَجْهَ الله ، وأولَنكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“আত্মীয়দেরকে তাদের হক দাও, মিসকীন ও মুসাফিরদেরকেও। যারা আল্লাহর সন্তোষ প্রত্যাশী তাদের জন্য এটি খুবই উত্তম কাজ। তারাই ঐসব লোক যারা সফল।” [আর-রুম-৩৮]
قُلْ لا يَسْتَوى الخبيث والطيب وَلَوْ أَعْجَبَكَ كَثرَةُ الخَبِيثِ . فَاتَّقُوا اللهَ يُأُولِي الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“বলে দাও : অপবিত্রতার আধিক্য তোমাদেরকে চমৎকৃত করলেও পবিত্ৰ ও অপবিত্র জিনিস সমান নয়। ওহে জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চল। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।” [আল মা-ইদা-১০০]
ياَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا الرَّبُوا أَضْعَافًا مُّضْعَفَةً وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না । আল্লাহকে ভয় করে চল। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।” [আল ইমরান-১৩০]
فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّلِحَتِ فَيُدْخِلُهُمْ رَبُّهُمْ فِى رَحْمَتِه ، ذلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْمُبِينُ.
“অতপর যারা ঈমান এনেছে এবং আমালে ছালেহ করেছে তাদের রব তাদেরকে তাঁর রাহমাতের মধ্যে দাখিল করে নেবেন। এটি সুস্পষ্ট সফলতা। [আল জাসীয়া – ৩০]
الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلوةَ وَمِمَّا رَزَقْنَهُمْ يُنْفِقُونَ. وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ ، وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ. ُأولَئِكَ عَلَى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْ ، وَ أولئكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“যারা গাইবে বিশ্বাস করে, ছালাত কায়েম করে, আমি যেই রিক তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে দান করে, যারা তোমার প্রতি ও তোমার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান পোষণ করে, আর আখিরাতের প্রতিও যাদের রয়েছে ইয়াকীন, তারাই রয়েছে তাদের রবের নির্দেশিত পথে । আর তারাই সফল।” [আল বাকারা-৩-৫]
إنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنُوْنَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِ لِيَحْكُم بيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا ط وأولئكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“নিশ্চয়ই মুমিনদেরকে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা মেনে নেওয়ার জন্য ডাকা হয় তখন তারা বলে : আমরা শুনলাম এবং মেনে নিলাম। এবং এরাই সফল।” [আন্ নূর- ৫১]
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَقُولُوا قَوْلاً سَدِيدًا. يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ، وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহকে ভয় করে চল এবং সোজা সঠিক কথা বল। তাহলে আল্লাহ তোমাদের আমলগুলো সংশোধন করে দেবেন এবং তোমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন। আর যেই ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে চলে সে লাভ করেছে বিরাট সফলতা।”
الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلوةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكُوةَ وَهُمْ بِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ أُولَئِكَ عَلَى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“যারা ছালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আখিরাতর প্রতি ইয়াকীন রাখে, তারাই রয়েছে তাদের রবের নির্দেশিত পথে। আর তারাই সফল।” [লোকমান – ৪, ৫]
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِى الْأَمْرِ مِنْكُمْ ، فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ والرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ مَا ذَلِكَ خَيْرٌ و أَحْسَنُ تَأْوِيلاً
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আর আনুগত্য কর উলুল আমরের (আদেশ প্রদানের অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের)। তোমাদের মধ্যে যদি কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরাও। এটাই সঠিক কর্মনীতি এবং শেষ ফলের দিক দিয়ে এটাই ভালো ।” [আন্ নিসা । ৫৯]
به وَ عَزْرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي فَالذِينَ آمَنُوا بِهِ وَ عَزْرُوهُ وَنَم أنْزِلَ مَعَها أولئكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“অতপর যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সহযোগিতা করে, তাকে সাহায্য করে এবং তার প্রতি নাযিলকৃত নূরের (আলকুরআনের) অনুসরণ করে, তারাই সফল”। [আল আ’রাফ – ১৫৭]
وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلوةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكُوةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ، أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ وَ إِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ. وَعَدَ اللهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَتِ جَنَّتِ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهُرُ خُلِدِينَ فِيهَا وَمَسْكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّتِ عَدْنٍ ط وَرِضْوَانٌ مِّنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ، ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
“এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কাজের নির্দেশ দেয়, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে, ছালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। আল্লাহ শিগগিরই তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী মহাবিজ্ঞ। এই মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের সাথে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নীচে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত এবং সেখানে তারা থাকবে চিরদিন। সবুজ বাগানে তাদের জন্য উত্তম বাসস্থান থাকবে। আর সবচে’ বড়ো কথা, তারা আল্লাহর সন্তোষ হাছিল করবে। আর এটাই তো বড়ো সফলতা।” [আত্ তাওবা – ৭১, ৭২]
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَشِعُونَ وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ. وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكوة فَعِلُونَ. وَالَّذِينَ الفُرُوجِهِمْ حَفِظُونَ إِلا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ. فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْعُدُونَ. وَالَّذِينَ هُمْ لِاَمُنْتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوْتِهِمْ يُحَافِظُونَ ُأولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْس طَهُمْ فِيهَا خَالِدُونَ.
“সফলতা লাভ করলো সেইসব মুমিন যারা তাদের ছালাতে খুশু অবলম্বন করে, যারা বেহুদা কাজ থেকে বিরত থাকে, যারা পবিত্রতা বিধান কাজে তৎপর থাকে, যারা লজ্জাস্থানের হিফাজাত করে নিজেদের স্ত্রী ও তাদের দক্ষিণ হস্তের মালিকাধীন স্ত্রীলোকদের ছাড়া, এই ক্ষেত্রে তারা ভর্ৎসনাযোগ্য নয়, তবে এর বাইরে কিছু চাইলে তারা হবে সীমালংঘনকারী, যারা আমানাত ও ওয়াদা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে, যারা ছালাতের পূর্ণ হিফাজাত করে। তারাই সেই উত্তরাধিকারী যারা উত্তরাধিকার হিসেবে ফিরদাউস পাবে, সেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল।” [আল মুমিনূন- ১-১১]
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَشِعُونَ وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكُوةِ فَعِلُونَ وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَفِظُونَ إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْعُدُونَ وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمْنَتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَاتِهِمْ يُحَافِظُوْنَ. أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوسَ مَا هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ.
“মুমিন পুরুষদেরকে বল তারা যেনো তাদের চোখ সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজাত করে। এটাই তাদের জন্য পবিত্রতম পন্থা তারা যা কিছু করে আল্লাহ তার খবর রাখেন ।
মুমিন মহিলাদেরকে বল তারা যেনো তাদের চোখ সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজাত করে। [আন্-নূর-৩০,৩১]
তারা যেনো তাদের সাজ দেখিয়ে না বেড়ায় এটুকু ছাড়া যা আপনাআপনি প্রকাশিত হয়ে পড়ে৷
তারা যেনো তাদের বুকের ওপর ওড়নার আঁচল দিয়ে রাখে।
তারা যেনো তাদের সাজ প্রকাশ না করে, তবে তাদের সামনে ছাড়া : তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজের ছেলে, নিজের স্বামীর ছেলে, আপন ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, ঘনিষ্ঠ চেনা-জানা মহিলা, নিজেদের দাস, অধীনস্থ এমন পুরুষ যাদের অন্য রকম চাহিদা নেই এবং এমন বালক যারা মেয়েদের গোপন বিষয় জানে না।
তারা যেনো তাদের গোপন সাজ সম্পর্কে লোকদেরকে জানাবার উদ্দেশ্যে যমীনে জোরে পা ফেলে না চলে।
হে মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তাওবা কর। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
وَلْتَكُن مِّنْكُمْ أُمَّةً يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ طَ وَأُولَنكَ
‘তোমাদের মধ্য থেকে এমন একদল লোক থাকতে হবে যারা লোকদেরকে কল্যাণের দিকে ডাকবে, মা’রূফ কাজের নির্দেশ দেবে এবং মুনকার থেকে বিরত রাখবে। আর এরাই সফল।” [আলে ইমরান-১০৪]
فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوا وَاطِيْعُوا وَأَنْفِقُوا خَيْرًا لانْفُسِكُمْ ، وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُون
“আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করে চল। শুন, আনুগত্য কর এবং ইনফাক কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম। যারা মনের সংকীর্ণতা থেকে বেঁচে গেছে তারাই সফল।” [আত্ তাগাবুন-১৬]
الفُقَرَاءِ الْمُهْجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلاً مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا وَيَنْصُرُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ط أولَئِكَ هُمُ الصَّدِقُوْنَ وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيْمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مما أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ طَ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“(ঐ মাল) ঐ দরিদ্র মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের বাড়িঘর ও সহায়-সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদকৃত। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তোষ প্রত্যাশী। এরাই সত্যনিষ্ঠ।
(ঐ মাল তাদের জন্যও) যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বেই ঈমান এনে বসবাস করছিলো। তারা ঐসব লোকের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে যারা হিজরাত করে তাদের কাছে এসেছে।
এমনকি মুহাজিরদেরকে যা কিছু দেওয়া হয় সেই বিষয়ে তারা নিজের অন্তরে কোন চাহিদা পর্যন্ত অনুভব করে না।
“নিজেদের যতো অভাবই থাকুক না কেন তারা নিজেদের ওপর অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। যারা মনের সংকীর্ণতা থেকে বেঁচে গেছে তারাই সফল।” [আলহাশর -৮,৯]
ياَيُّهَا الَّذينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الوَسيلَةَ وَجَاهِدُوا في سَبِيْلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহকে ভয় করে চল, তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধানে লেগে থাক এবং তাঁর পথে জিহাদ কর। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।” [আল মা-ইদা- ৩৫]
اِنَّ اللّهَ اسْتَرى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الجنَّةَ ، يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الله فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ قف وعدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَةِ وَالإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ ، وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللهِ فَاسْتَبْشِرُوابِبَيْعِكُمُالَّذِيبَايَعْتُمْبِهِ ط وَذَلِكَ هُوَالْفَوْزُ الْعَظِيمُ
“আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান-মাল কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে, মারে ও মরে। তাদেরকে জান্নাত দেবার মজবুত ওয়াদা আত্ তাওরাত, আল ইনজীল ও আল কুরআনে করা হয়েছে। ওয়াদা পালনে আল্লাহর চেয়ে বেশি যোগ্য আর কে আছে? অতএব তোমরা আল্লাহর সাথে যেই বেচাকেনা করেছো সেই ব্যাপারে খুশি হয়ে যাও। এটা অতি বড়ো সফলতা।” [আত তাওবা- ১১১]
الذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللهِ بِأَمْوَالِهِمْ وأَنْفُسِهِمْ لا أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدَ اللهِ ط وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ.
“আল্লাহর কাছে তো ঐসব লোকের মর্যাদাই বড়ো যারা ঈমান এনেছে, হিজরাত করেছে এবং আল্লাহর পথে তাদের মাল ও জান দিয়ে জিহাদ।” [আত্ তাওবা ॥ ২০ ]
يْأَيُّهَا الَّذِينَ امَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِّنْ عَذَابٍ اليم تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِ، وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ الله بأموالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ، ذلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ يَغْفِرْ
ط لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلُكُمْ جَنَّتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الأَنْهَرُ وَمَسْكِنَ في جَنَّتِ عَدْنٍ ط ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ طَيِّبَةً
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আমি কি তোমাদেরকে এমন ব্যবসার কথা বলবো যা তোমাদেরকে কষ্টদায়ক আযাব থেকে বাঁচাবে? আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং মাল ও জান দিয়ে তাঁর পথে জিহাদ কর। যদি তোমরা জান, এটাই তো তোমাদের জন্য উত্তম। আল্লাহ তোমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন, তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নীচে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত। তোমাদেরকে চিরস্থায়ী জান্নাতে উত্তম ঘর দেবেন। এটি অতি বড়ো সফলতা।” [আছ্ ছাফ ॥ ১০-১২]
يايُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُم فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, কোন বাহিনীর সাথে তোমাদের মুকাবিলা হলে তোমরা দৃঢ়পদ থাক এবং বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ কর । আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
يايُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا قف وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, ছবর অবলম্বন কর, বাতিলপন্থীদের মুকাবিলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর, ঐক্য শক্তি সৃষ্টি কর এবং আল্লাহকে ভয় করে চলে, আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।” [আলে ইমরান-২০০]
لكنالرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ جَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وأَنْفُسِهِمْ ، أُولَيْكَ لَهُمُ الْخَيْراتُ : وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَلكن
“কিন্তু রাসূল এবং ঐসব লোক যারা তাঁর সাথে ঈমান এনেছে তাদের মাল ও জান দিয়ে জিহাদ করেছে। এদের জন্যই তো সব কল্যাণ। আর এরাই তো সফল।”
لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادٌ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا أَبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ ، أُولَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيْمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحِ مِّنْهُ ، وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّتٍ تَجْرِيمِنْ تَحْتِهَاالْأَنْهُرُ خَلِدِينَ فِيهَارَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ، أُولَئِكَ حِزْبُ اللَّهِ ، أَلا إِنَّحِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“তোমরা কখনো এমন দেখতে পাবে না যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে তারা এমন লোকদেরকে ভালোবাসে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করছে, ঐ লোকেরা চাই তাদের পিতা, পুত্র, ভাই কিংবা গোষ্ঠীর কেউ হোক না কেন। আল্লাহ এইসব লোকের অন্তরে ঈমান বদ্ধমূল করে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে একটি রূহ দিয়ে তাদেরকে শক্তি যুগিয়েছেন। তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে ঝর্ণা প্রবাহিত থাকবে। তারা সেখানে থাকবে চিরদিন। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এরাই আল্লাহর বাহিনী । জেনে রাখ, আল্লাহর বাহিনীর লোকেরাই সফল।” [আল মুজাদালা -২২]
এইসব আয়াতে সফল জীবনের যেইসব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে সেইগুলোকে আমরা নিম্নরূপে সাজিয়ে নিতে পারি :
১। আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা-ইখতিয়ার কিংবা অধিকারে শিরকমুক্ত ঈমানের অধিকারী হওয়া।
২। আখিরাতের জওয়াবদিহিতা, শাস্তি ও পুরস্কারের কথা মনে জাগ্ৰত রেখে জীবন যাপন করা।
৩। কোন বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা জানার পর বিনা দ্বিধায় মেনে চলা।
৪। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য করতে থাকা।
৫। ছালাত কায়েম করা ও খুশু সহকারে ছালাত আদায় করা।
৬। যাকাত আদায় করা।
৭ । আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়গুলোর অনুশীলন করতে থাকা।
৮। আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিবেদিত থাকা।
৯। ইনকাফ ফী সাবীলিল্লাহ করতে থাকা।
১০। মারুফের প্রতিষ্ঠা ও মুনকারের উচ্ছেদে চেষ্টিত থাকা।
১১। সর্বাবস্থায় ছবর অবলম্বন করা।
১২। যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়পদ থাকা।
১৩। একে অপরকে শক্তি যোগাতে থাকা।
১৪ । আত্মীয়, মিসকীন ও মুসাফিরের হক আদায় করা।
১৫। সুদ থেকে বেঁচে থাকা।
১৬। মদ থেকে বেঁচে থাকা।
১৭। জুয়া থেকে বেঁচে থাকা।
১৮। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য নজরানা পেশ করা হয় এমন স্থান পরিহার করে চলা ।
১৯। তীর নিক্ষেপ করে ভাগ্য গণনা থেকে বেঁচে থাকা।
২০। নাপাক জিনিস পরিহার করা।
২১। অবৈধ যৌনাচার থেকে বেঁচে থাকা।
২২। পর নারীর সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে বেঁচে থাকা।
২৩। আমানাতের হিফাজাত করা।
২৪। ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন করা।
২৫। বেহুদা কাজ থেকে বেঁচে থাকা।
২৬। কৃপণতা থেকে মুক্ত হওয়া।
২৭। আত্মীয়-স্বজন হলেও যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে তাদেরকে ভালো না বাসা।
লক্ষ্য করার বিষয়, আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন টাকার পাহাড় গড়তে পারা, বিশাল অট্টালিকার মালিক হওয়া, বহু সংখ্যক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়া, বিলাসী জীবন যাপন করতে পারা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়াকে কোথাও সফলতার মাপকাঠি বলে উল্লেখ করেননি।
দুনিয়া-প্রীতি
স্ত্রী, পুত্র, কন্যা এবং আত্মীয়-স্বজনের প্রতি মানুষের অন্তরে থাকে গভীর অনুরাগ। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য সম্পদের প্রতি মানুষ দারুণ আকর্ষণ অনুভব করে। একটি সীমা পর্যন্ত এই অনুরাগ ও আকর্ষণ আপত্তিকর নয়। কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে গেলেই ঘটে বিপত্তি।
দুনিয়া-প্রীতি মানুষের জন্য দারুণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আসলে দুনিয়ার জীবন তো খুবই সংক্ষিপ্ত। এক সময় সকল আপনজন এবং সব সম্পদ পেছনে ফেলে আখিরাতে পাড়ি দিতে হয়। দুনিয়া-প্রীতি মানুষকে আখিরাতমুখী হতে দেয় না। আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে।
সেই জন্যই আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন দুনিয়ার জীবনের প্রকৃত অবস্থা বারবার মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যাতে মানুষ দুনিয়ার জীবনের গোলকধাঁধায় পড়ে প্রতারণার শিকারে পরিণত না হয়।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
زيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ والحارث ، ذلك مناع الحيوة الدُّنْيا ، والله عِنْدَه حُسنُ الْعَاب.
مَتَاعُ
“মানুষের জন্য নারী, সন্তান, সোনা-রূপার স্তূপ, সেরা ঘোড়া, গৃহপালিত পশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আকর্ষণকে খুবই সুশোভিত করা হয়েছে। কিন্তু এইগুলো দুনিয়ার জীবনের সামগ্রী মাত্র। আর আল্লাহর কাছেই তো রয়েছে উত্তম আবাস।” [আলে ইমরান- ১৮ ]
المَالُ وَالبَنُونَ زِينَة الحيوة الدُّنْيَا، والبقيتُ الصلحت خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلاً
‘এই অর্থ-সম্পদ এবং সন্তান-সন্তুতি তোমাদের দুনিয়ার জীবনের সাময়িক সাজ-সজ্জা মাত্র। আসলে তো টিকে থাকার মতো নেক আমলই তোমার রবের নিকট পরিণামের দিক দিয়ে উত্তম। এবং এই বিষয়েই ভালো কিছু আশা করা যায়।” [আল কাহফ ॥ ৪৬]
اِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ. وَاللهُ عِنْدَةٌ أَجْرٌ عَظِيمٌ.
“অবশ্যই তোমাদের অর্থ-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি একটি পরীক্ষা। আর কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই রয়েছে বিরাট প্রতিদান ।” [আত্ তাগাবুন ॥ ১৫]
اعْلَمُوا أَنَّمَا الحيوةُ الدُّنْيَا لَعِب وَلَهُوَ وَزِيْنَهُ وَتَفَاخُرَا بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرُ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلادِ ط
“জেনে নাও, দুনিয়ার জীবন একটি খেলা, তামাশা, বাহ্যিক চাকচিক্য, তোমাদের পারস্পরিক গৌরব-অহংকার এবং অর্থ-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততিতে একে অপরকে অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। ” [ আলহাদীদ ॥ ২০]
وَمَا هَذِهِ الْحَيوةُ الدُّنْيَا إِلا لَهْوٌ وَلَعِبٌ ، وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةِ لهي الحيوان م
“আর দুনিয়ার জীবন তো খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। আসল জীবনের ঘর তো হলো আখিরাতের ঘর।” [আল আনকাবূত ॥ ৬৪ ]
“অর্থাৎ এর (দুনিয়ার জীবনের) বাস্তবতা শুধুমাত্র এতোটুকুই যেমন ছোট ছেলেরা কিছুক্ষণের জন্য নেচে গেয়ে আমোদ করে এবং তারপর যার যার ঘরে চলে যায়। এখানে যে রাজা হয়ে গেছে সে আসলে রাজা হয়ে যায়নি বরং শুধুমাত্র রাজার অভিনয় করছে। এক সময় তার এই খেলা শেষ হয়ে যায়। তখন সে তেমনি দীনহীন অবস্থায় রাজ সিংহাসন থেকে বিদায় নেয় যেইভাবে এই দুনিয়ার বুকে এসেছিলো। অনুরূপভাবে জীবনের কোন একটি আকৃতিও এখানে স্থায়ী ও চিরন্তন নয়। যে যেই অবস্থায়ই আছে সাময়িকভাবে একটি সীমিত সময়ের জন্যই আছে। মাত্র কয়েক দিনের জীবনের সাফল্যের জন্য যারা প্রাণপাত করে এবং এরি জন্য বিবেক ও ঈমান বিকিয়ে দিয়ে সামান্য কিছু আয়েশ আরামের উপকরণ ও শক্তি প্রতিপত্তির জৌলুস করায়ত্ত করে নেয়, তাদের এই সমস্ত কাজ মন ভুলানো ছাড়া আর কিছুই নয়। এইসব খেলনার সাহায্যে তারা যদি দশ বিশ বা ষাট সত্তর বছর মন ভুলানোর কাজ করে থাকে এবং তার পর শূন্য হাতে মৃত্যুর দরোজা অতিক্রম করে এমন জগতে পৌঁছে যায় যেখানকার স্থায়ী ও চিরন্তন জীবনে তাদের এই খেলা এক প্রতিকারহীন রোগে পরিণত হয়, তাহলে এই ছেলে ভুলানোর লাভ কি?” [তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী ১১শ খণ্ড, সূরা আল ‘আনকাবূতের তাফসীরের ১০২ নাম্বার টীকা।]
فَمَا أُوتِيتُمْ مِّنْ شَيْءٍ فَمَتَاعُ الْحَيَوةِ الدُّنْيَا، وَمَا عِنْدَ الله میر و
“তোমাদেরকে যা কিছু দেওয়া হয়েছে তা দুনিয়ার (ক্ষণস্থায়ী) জীবনের সামগ্রী। আর আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা যেমনি উত্তম তেমনি স্থায়ী। তা সেই সব লোকের জন্য যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের রবের ওপর তাওয়াক্কুল করেছে।” [আশ্ শূরা ॥ ৩৬]
وَلَوْلاً أن يكونَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً لَجَعَلْنَا لِمَنْ يَكْفُرُ بِالرَّحْمَنِ لِبُيُوتِهِمْ سُقْفًا مِنْ فِضَّةٍ وَمَعَارِج عَلَيْهَا يَظْهَرُونَ. وَلِبُيُوتِهِمْ أبواباً وسُرُوا عَلَيْهَا يَتَّكِنُونَ وَزُخْرُفًا ، وَإِنْ كُلُّ ذلِكَ لَما أمَتَاعُ الْحَيَوةِ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةُ عِنْدَ رَبِّكَ المُتَّقِينَ.
“সকল মানুষ একই পথ ধরার আশংকা না থাকলে আমি কাফিরদের ঘরের ছাদ, যেই সিঁড়ি দিয়ে তারা ওপরে উঠে সেই সিঁড়ি, তাদের ঘরের দরওয়াজাগুলো এবং যেই উচ্চাসনে তারা হেলান দিয়ে বসে সেইগুলো রূপা ও সোনা দিয়ে বানিয়ে দিতাম। এইগুলো তো পার্থিব জীবনের (সামান্য) উপকরণ। তোমার রবের নিকট আখিরাত তো কেবল মুত্তাকীদের জন্য নির্ধারিত।” [আয্ যুখরুফ ॥ ৩৩-৩৫]
“অর্থাৎ এই সোনা-রূপা যা কারো লাভ করা তোমাদের দৃষ্টিতে চরম নিয়ামাত প্রাপ্তি এবং সম্মান ও মর্যাদার চরম শিখরে আরোহণ, তা আল্লাহর দৃষ্টিতে এতোই নগণ্য যে যদি সকল মানুষের কুফরের দিকে ঝুঁকে পড়ার আশংকা না থাকতো, তাহলে তিনি প্রত্যেক কাফিরের বাড়িঘর সোনা-রূপা দিয়ে তৈরি করে দিতেন। এই নিকৃষ্ট বস্তুটি কখন থেকে মানুষের মর্যাদা ও আত্মার পবিত্রতার প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে? এই সম্পদ তো এমন সব মানুষের কাছেও আছে যাদের ঘৃণ্য কাজ-কর্মের পংকিলতায় গোটা সমাজ পুঁতিগন্ধময় হয়ে যায়। আর একেই তোমরা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড বানিয়ে রেখেছো।” ু[তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, ১৪শ খণ্ড, সূরা আয্ যুখরুফের তাফসীরের ৩৩ নাম্বার টীকা।]
وَالَّذِيْنَ كَفَرُوا يَتَمَتَّعُونَ وَيَأْكُلُونَ كَمَا تَأْكُلُ الْأَنْعَامُ وَالنَّارُ مَثْوًى لَّهُمْ.
“আর কাফিররা দুনিয়ায় ক’ দিনের মজা লুটছে। জন্তু-জানোয়ারের মতো পানাহার করছে। ওদের চূড়ান্ত ঠিকানা জাহান্নাম। ” [মুহাম্মাদ – ১২]
وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِه أَزْوَاجًا مِّنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيوة وَرِزْقٌ رَبللِنَفْتِنَهُمْ الدُّنْيَا یر و
“দুনিয়ার জীবনের এই জাঁকজমক যা আমি তাদের মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়েছি সেই দিকে তুমি চোখ তুলেও তাকাবে না। এইসব তো তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলার জন্য দিয়েছি। আর তোমার রবের রিকই উত্তম ও স্থায়ী।” [তা-হা -১৩১]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
إنَّ لِكُلِّ أُمَّةٍ فِتْنَةً وَفِتْنَةٌ أُمَّتِي الْمَالُ
“অবশ্যই প্রত্যেক উম্মাতের জন্য রয়েছে এক একটি ফিতনা। আমার উম্মাতের ফিতনা হচ্ছে- অর্থ-সম্পদ।” [কা’ব ইবনু ইয়াদ (রা), জামে আত তিরমিযী]
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَا أَمْوَالُكُمْ وَ لَا أَوْلَادُكُمْ بِالَّتِى تُقَرِّبُكُمْ عِنْدَنَا زُلْفَى إِلا مَنْ أمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَأُولَئِكَ لَهُمْ جَزَاءُ الضَّعْفِ بِمَا عَمِلُوا وَهُمْ فِي الْغُرُفت أمنُونَ.
‘তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এমন নয় যে তা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে, তবে যারা ঈমান আনে এবং আমালে ছালেহ করে তারা এমন লোক যাদের জন্য রয়েছে তাদের কর্মের দ্বিগুণ প্রতিদান এবং তারা সুউচ্চ প্রাসাদে নিরাপদে অবস্থান করবে। [সাবা ॥ ৩৭]
وَمَا الْحَيَوةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
“আর দুনিয়ার জীবন তো ছলনার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।” [আলে ইমরান ॥ ১৮৫]
ياَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ : وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَسِرُونَ
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে না রাখে। যারা এমনটি করবে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” [আল মুনাফিকুন- ৯]
“বিশেষভাবে অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির উল্লেখ করা হয়েছে এই জন্য যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ এইসব স্বার্থের কারণে ঈমানের দাবি পূরণ না করে নিফাক অথবা ঈমানের দুর্বলতা অথবা পাপাচার ও না-ফরমানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।” [তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, ১৭শ খণ্ড, সূরা আল মুনাফিকুনের তাফসীরের ১৮ নাম্বার টীকা।]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
لَوْ كَانَت الدُّنْيَا تَعْدِلُ عِنْدَ الله جَنَاحَ بَعُوضَةٍ مَا سَقَى كَافِرًا منْهَا شربة ماء
“আল্লাহর নিকট দুনিয়াটার মূল্য যদি একটি মশার ডানার মূল্যের সমান হতো, তাহলে তিনি কোন কাফিরকে এথেকে এক চুমুক পানি পান করতে দিতেন না।” [সাহল ইবনু সা’দ (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
يايُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيوةُ الدُّنْيَا وقفه وَلَا يَغُرُنَّكُمْ بِاللهِ الْغَرُورُ.
“ওহে মানব জাতি, অবশ্যই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। আল্লাহর ব্যাপারে ধোঁকাবাজ (শাইতান) যেন তোমাদেরকে ধোঁকা দিতে না পারে।” [ফাতির ॥ ৫]
فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيوةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ
“অতএব দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে। আর ধোঁকাবাজ (শাইতান) যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলতে না পারে।” [লোকমান ॥ ৩৩]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
مَنْ أَحَبَّ دُنْيَاهُ أَضَرُّ بِأَخْرَتِهِ وَمَنْ أَحَبُّ أُخِرَتَهُ أَضَرُّ بِدُنْيَاهُ فاثرُوا مَا يُبْقَى عَلى ما يَفْنى
“যেই ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালোবাসে সে তার আখিরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যেই ব্যক্তি আখিরাতকে ভালোবাসে সে তার দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অতএব যা ধ্বংসশীল তার ওপর যা স্থায়ী তাকে অগ্রাধিকার দাও। ” [আবু মূসা আলআশ’আরী (রা)। আহমাদ, ইবনে হাব্বান, বাযযার, আল হাকেম, আলবাইহাকী।]
জাতিগতভাবে দুনিয়া-প্রীতির পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
يُوشِكُ الْأَمَمُ أَنْ تَدَاعَى عَلَيْكُمْ كَمَا تَدَاعَى الْأُكِلَةُ إِلى قَصْعَتِهَا . فَقَالَ قَائِلٌ وَ مِنْ قلة نَحْنُ يَوْمَئِذٍ ؟ قَالَ بَلْ أَنْتُمْ يَوْمَئِذٍ كَثِيرٌ وَلكِنْكُمْ غُثَاءٌ كَفْثَاءِ السَّيْلِ – وَلَيَنْزِعَنَّ اللَّهُ مِنْ صُدُورٍ عَدُوِّكُمْ المَهَابَةَ مِنْكُمْ – وَلِيَقْذِفَنَّ فِي قُلُوبِكُمُ الْوَهْنَ – قَالَ قَائِلٌ يارَسُولَ اللهِ وَمَا الْوَهْنُ؟ قَالَ حُبُّ الدُّنْيَا وَكَرَاهِيَةِ الْمَوْتِ
“অচিরেই তোমাদের ওপর অন্য জাতিগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে যেমন ক্ষুধার্ত মানুষ খাদ্য সামগ্রীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন জিজ্ঞেস করলো : “তখন কি আমরা সংখ্যায় খুব কম থাকবো?’ আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন, “না, তোমরা বরং সংখ্যায় বেশি হবে, কিন্তু তোমরা বন্যা-স্রোতের ওপরে ভাসমান ফেনার মতো হবে। আল্লাহ্ শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের ভয় দূর করে দেবেন। তোমাদের অন্তরে দুর্বলতা সৃষ্টি করে দেবেন। লোকটি জিজ্ঞেস করলো, ‘সেই দুর্বলতা কী?’ আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন, “দুনিয়া-প্রীতি এবং মৃত্যুর প্রতি অনীহা।” [সাওবান (রা), সুনানু আবী দাউদ]
অর্থাৎ তোমরা দুনিয়ার প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়বে এবং জিহাদের কথা শুনলে প্রাণভয়ে পিছটান দেবে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَأَمْوَالِ نِ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسْكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبُّ إِلَيْكُمْ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ ، وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفُسِقِينَ
“তাদেরকে বল: তোমাদের আব্বা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত অর্থ-সম্পদ, তোমাদের ঐ ব্যবসা যার মন্দার আশংকা তোমরা কর, তোমাদের পছন্দের ঘরবাড়ি যদি তোমাদের কাছে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ থেকে বেশি প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর । আর আল্লাহ ফাসিকদেরকে সঠিক পথের দিশা দেন না।” [আত্ তাওবা- ২৮ ]
এই আয়াতের দাবি হচ্ছে,
দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে একজন মুমিনের নিকট আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ প্রিয়তর হতে হবে।
অর্থাৎ আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদকে অগ্রাধিকার দিতে পারার ওপরই নির্ভর করে তার আখিরাতের সফলতা।
অনাড়ম্বর জীবন যাপন
হারাম থেকে বেঁচে, হালালের গণ্ডিতে থেকে, কারো কাছে হাত না পেতে এবং ঋণগ্রস্ত না হয়ে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের মতো অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়াকে ইসলাম উৎসাহিত করে। জীবন ধারণের প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেলেও উত্তরোত্তর অর্থ-সম্পদের পেছনে দৌড়ানোকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করে।
এক শ্রেণীর লোক অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়া, রকমারি বিলাস সামগ্রী সংগ্রহ করা এবং প্রতিপত্তিশালী হওয়ার জন্য অহর্নিশ মেতে থাকে।
বিস্ময়ের ব্যাপার, তাদের এই চাওয়ার কোন শেষ নেই। ‘আরো চাই, আরো চাই’- এই যেন তাদের চিন্তা-চেতনার সারকথা।
এই মনোভংগিকেই আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন “আত্ তাকাসুর” বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন,
الهكُمُ التَّكَاثُرُ. حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ
“আধিক্যের মোহ তোমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে যেই পর্যন্ত না তোমরা কবরে পৌঁছ।” [আত্ তাকাসুর – ১, ২]
এই মনোভংগি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
لَوْ كَانَ لِابْنِ أَدَمَ وَادِيَانِ مِنْ ذَهَب لَأَحَبُّ أَنْ يَكُونَ لَهُ ثَالِثُ وَلَا يمل ، فَاهُ الا التُّرَابُ.
“আদম-সন্তান যদি দুইটি স্বর্ণ ভরা উপত্যকা লাভ করে, তবুও সে তৃতীয় আরেকটি লাভ করতে চাইবে। মাটি ছাড়া আর কিছুই তার মুখ ভর্তি করতে পারে না।” [আনাস ইবনু মালিক (রা), সহীহ মুসলিম, সহীহ আলবুখারী, মুসনাদে আহমাদ।]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
ما ذنْبَان جَائِعَانِ أَرْسُلاً فِي غَنَم بِأَفْسَدَ لَهَا مِنْ حَرْضِ الْمَرْءِ ععلَى الْمَالِ وَالشَّرْفِ لِدِينِهِ
“অর্থ-সম্পদের লোভ এবং অভিজাত হওয়ার লালসা একজন ব্যক্তির দীনদারীর জন এতো বেশি ক্ষতিকর যে বকরীর পালে পতিত দুইটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘও বকরীর পালের এতো ক্ষতি করতে পারে না।” [কা’ব ইবনু মালিক (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
আল্লাহর রাসূল (সা) মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
لَيْسَ ِلابْنِ آدَمَ حَقٌّ فِى سوى هذِهِ الْخِصَالِ بَيْتُ يَسْكُنُهُ وَثَوْبُ يوارى عَوْرَتَهُ وَجلْفُ الخُبز والماء
“আদম-সন্তানের এই কয়টি বস্তু ছাড়া আর কিছুর অধিকার নেই । বসবাসের জন্য একটি ঘর, লজ্জা নিবারণের জন্য কিছু কাপড় এবং কিছু রুটি ও পানি।” অর্থাৎ এইগুলোই মানুষের প্রকৃত মৌলিক প্রয়োজন।” [উসমান ইবনু আফফান (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
অন্যত্র আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
مِنْ سَعَادَةِ الْمَرْءِ المَسكَنُ الْوَاسِعُ وَالْجَارُ الصَّالِحُ وَالْمَرْكَبُ الهَنيئ
‘কোন ব্যক্তির কতক সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে : প্রশস্ত বসত ঘর, নেক প্রতিবেশী এবং আরামপ্রদ বাহন।” [নাফে ইবনু আবদিল হারিস (রা), মুসনাদে আহমাদ ]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ أَسْلَمَ وَكَانَ رِزْقُهُ كَفَافًا وَقَنَّعَهُ اللهُ بِمَا أَتَاهُ
“সেই ব্যক্তি সফল যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, প্রয়োজন মাফিক রি পেয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তার ওপর সন্তুষ্ট থাকার তাওফীক দিয়েছেন।” [আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল আস (রা), সহীহ মুসলিম]
আহওয়াছ (রা) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন,
آتَيْتَ رَسُولَ الله (ص) وَ عَلَيَّ ثَوْبٌ دُونَ – فَقَالَ لِي أَلَكَ مَالُ؟ فَقُلْتُ نَعَمْ – قَالَ مِنْ ُأيُّ الْمَالِ ؟ قُلْتُ مِنْ كُلِّ الْمَالِ – قَدْ أَعْطَانِي اللهُ مِنَ الْإِبِلِ وَالْبَقَرِ وَالْغَنَمِ وَالْخَيْلِ وَالرَّقِيق – قَالَ فَاذَا أتَاكَ مَالاً فَلْبُرَ أَثَر نعمة الله عَلَيْكَ.
“আমি একবার খুবই নিম্নমানের পোশাক পরে আল্লাহর রাসূলের (সা) কাছে আসলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কি ধন-সম্পদ আছে?’ আমি বললাম, “হাঁ, আছে।” তিনি বললেন, “কী কী ধরনের ধন-সম্পদ আছে?” আমি বললাম, “সব রকমের ধন-সম্পদ। উট, গাভী, বকরী, ঘোড়া এবং দাস-দাসী।” তিনি বললেন, “আল্লাহ যখন তোমাকে ধন-সম্পদ দিয়েছেন তোমার অবয়বে তাঁর নিয়ামাতের প্রকাশ পাওয়া উচিত।” [আহওয়াছ (রা), মিশকাতুল মাছাবীহ]
একজন ব্যক্তিকে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন অর্থ-সম্পদ দান করা সত্ত্বেও সে ফকিরের মতো জীবন যাপন করবে, এটাও অভিপ্রেত নয়।
কিন্তু নিজের অবয়বে আল্লাহর নিয়ামাতের প্রকাশ ঘটানোর অর্থ- বিলাসী জীবন যাপন করা নয়। ইসলাম বিলাসী জীবন পছন্দ করে না। বিলাস- ব্যসন পরিহারকরণ এবং অনাড়ম্বর জীবন যাপনের
তাকিদ দিয়ে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেন,
إِيَّاكَ وَالتَّنَعمَ فَإِنَّ عِبَادَ اللَّهِ لَيْسُوا بِالْمُتَنَعَمِينَ
“বিলাসিতা থেকে বেঁচে থেকো। অবশ্যই আল্লাহর বান্দারা বিলাসী হয় না।” [মুয়ায ইবন জাবাল (রা), মুসনাদে আহমাদ, সুনানু আলবাইহাকী]
বাস্তব জীবনে দেখা যায়, বিলাসিতা থেকে জন্ম নেয় আরামপ্রিয়তা, আরামপ্রিয়তা থেকে জন্ম নেয় অলসতা, আর অলসতা থেকে জন্ম নেয় পরিশ্রমবিমুখতা।
বিলাসিতামুক্ত জীবন যাপনের তাকিদ দিতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
الا تَسْمَعُونَ أَلا تَسْمَعُونَ إِنَّ الْبَدَادَةَ مِنَ الْإِيْمَانِ إِنَّ الْبَدَادَةَ منَ الْإِيمَان
“তোমরা কি শুনছো না? তোমরা কি শুনছো না? নিশ্চয়ই অনাড়ম্বর জীবন ঈমানের পরিচায়ক, নিশ্চয়ই অনাড়ম্বর জীবন ঈমানের পরিচায়ক।” [আবু উমামা ইয়াস (রা), সুনানু আবী দাউদ]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) আবদুল্লাহ ইবনু উমারকে (রা) উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন,
كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرٍ سَبِيلِ
“তুমি দুনিয়াতে একজন মুসাফির কিংবা একজন পথচারীর মতো হয়ে থাক।” [আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা), সহীহ আল বুখারী]
আমরা জানি একজন মুসাফির কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্যই সফরে যান। তিনি অল্প ক’দিনের জন্য সফরে যান। তিনি সহজে বহনযোগ্য অত্যাবশ্যক বোঝা সাথে নেন।
এই পৃথিবীতে মানুষের আগমন একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হাছিলের জন্য। এখানে তার অবস্থানও হাতে গোনা ক’টি দিনের জন্য।
ডাক পড়লেই তাকে তৎক্ষণাত এখান থেকে চলে যেতে হয়।
অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান মুসাফিরের মতোই।
অতএব তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের বোঝা বহন করার প্রয়োজন নেই।
সফরটা মোটামুটি স্বচ্ছন্দ হওয়ার মতো পাথেয় থাকাই যথেষ্ট ৷
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
فَوَالله مَا الْفَقْرَ أخْشَى عَلَيْكُمْ وَلكِنِّى أَخْشَى أَنْ تُبْسَطَ الدُّنْيَا عَلَيْكُمْ كَمَا بَسطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوْهَا فَتُلْهِكَكُمْ كَمَا أَهْلَكَتْهُم
“আল্লাহর কসম, তোমাদের জন্য আমি দারিদ্র্যের ভয় করছি না, বরং ভয় করছি যে তোমাদের সামনে পার্থিব প্রাচুর্য প্রসারিত করা হবে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য করা হয়েছিলো। অতপর তোমরা পার্থিব প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতায় লেগে যাবে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীরা লেগেছিলো এবং এটি তোমাদেরকে ধ্বংস করবে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করেছিলো ।” [আমর ইবনু আওফ আলআনছারী (রা), সহীহ মুসলিম, সহীহ আলবুখারী]
উল্লেখ্য যে কম-পাওয়ার বেদনা মানুষকে দারুণভাবে পীড়ন করে। কিন্তু অল্পে তুষ্টি এই বেদনা দূর করে দেয়। মানুষের মাঝে প্রচণ্ড ভোগের আকাংখা বিদ্যমান। এই আকাংখার যেন নিবৃত্তি নেই, শেষ নেই। কিন্তু অল্পে তুষ্টি এই আকাংখা নিয়ন্ত্রণ করে। ভোগবাদ এক মহা আপদ । ভোগবাদের খপ্পরে পড়ে মানুষ উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকে। অল্পে তুষ্টি এই যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়।
অর্থাৎ অল্পে তুষ্টি এক অনন্য সাধারণ গুণ। এই গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিদের পক্ষেই সম্ভব অনাড়ম্বর জীবন যাপন ।
অনাড়ম্বর জীবন যাপনের কয়েকটি উজ্জ্বল উদাহরণ
১। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) :
মানব-শ্রেষ্ঠ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) ছিলেন অনাড়ম্বর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
মাক্কায় অবস্থানকালে নবুওয়াত লাভের পূর্বে ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে তিনি সচ্ছলতার অধিকারী হন। তাঁর উপার্জিত অর্থের বিরাট অংশ ব্যয়িত হতো অভাবী ও দুঃখী মানুষের কল্যাণে। নবুওয়াত লাভের পর তিনি প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এমতাবস্থায় ব্যবসা চালানো ছিলো সুকঠিন । তদুপরি আদ্দা’ওয়াতু ইলাল্লাহ এবং নও মুসলিমদের তা’লীম ও তারবিয়াতে তাঁর বেশির ভাগ সময় ব্যয় হতে থাকে।
ঈসায়ী ৬২২ সনে তিনি ইয়াসরিবে হিজরাত করেন। ইতোমধ্যে সেখানে ইসলামের পক্ষে জনমত গড়ে ওঠেছিলো। তাঁর আগমনের পর ইয়াসরিব একটি নগর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এর নাম হয় আলমাদীনা। এই নব-গঠিত রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্র-প্রধান হন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা)।
রাষ্ট্র-প্রধান হিসেবে তিনি বৈধভাবেই বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
তিনি সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন।
তিনি বসবাস করতেন ছোট্ট ঘরে। তাঁর ঘরটি ছিলো আসবাবপত্রের বাহুল্য মুক্ত। তিনি ব্যবহার করতেন চামড়ার তৈরি একটি বিছানা। এর ভেতরে ছিলো খেজুর গাছের ছোবড়া।
তিনি ভুরি-ভোজ পছন্দ করতেন না।
ঠেসে ঠেসে পেট ভর্তি করে খাবার খেতেন না। তবে দুধ ও মধু খুব পছন্দ করতেন।
তিনি চোখে সুরমা লাগাতেন ৷
আতর ব্যবহার করতেন।
তিনি জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরতেন না।
কোন কোন সময় ভিন্ন রঙের পোশাক পরলেও সাদা রঙের পোশাকই তিনি বেশি পছন্দ করতেন।
তাঁর বহু সংখ্যক কাপড়-চোপড় ছিলো না। ফলে এইগুলো ভাঁজ করে স্তূপ করে রাখার প্রয়োজন পড়তো না।
রাষ্ট্র-প্রধান হয়েও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করে তিনি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
২। আবু বাকর আছছিদ্দিক (রা) :
আবু বাকর আছুছিদ্দিক (রা) ছিলেন মাক্কার সেরা ব্যবসায়ীদের একজন। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাঁর সঞ্চয় ছিলো চল্লিশ হাজার দিরহাম। আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগেকার একজন মানুষের হাতে চল্লিশ হাজার দিরহাম থাকাটা কোন ছোট্ট ব্যাপার ছিলো না।
ইসলাম গ্রহণ করার পর বিরোধীদের সৃষ্ট প্রতিকূলতার কারণে তাঁর ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন হয়ে ওঠে।
অথচ পরিবার থেকে বিতাড়িত নও মুসলিমদের পুনর্বাসন এবং নির্যাতিত দাস-দাসিদের মুক্তির জন্য তিনি অর্থ ব্যয় করতে থাকেন। হিজরাতের সময় দেখা গেলো তাঁর হাতে বাকি আছে আর মাত্র পাঁচ হাজার দিরহাম। আল মাদীনায় এসে তিনি আবার ব্যবসাতে মনোযোগ দেন। তবে ব্যবসা লব্ধ অর্থের বেশির ভাগ তিনি আদ্ দা’ওয়াত ইলাল্লাহ, আলজিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ এবং বহুবিধ জনহিতকর খাতে ব্যয় করতেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সা) ইন্তিকালের পর তিনি আলমাদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্র-প্রধান হন।
রাষ্ট্র-প্রধান হয়েও তিনি নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাবার জন্য ব্যবসা চালিয়ে যেতে চান।
প্রবীন ছাহাবীগণ তাঁকে এথেকে বিরত রাখেন। তাঁরা তাঁর জন্য বাইতুল মাল থেকে একটি ভাতা নির্ধারণের উদ্যোগ নেন।
তিনি বছরে মাত্র আড়াই হাজার দিরহাম ভাতা নিতে রাজি হন।
তিনি খুবই সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন।
সাধারণ খাবার খেতেন।
বাইতুল মাল থেকে তিনি বছরে দুই সেট পোশাক পেতেন। এতেই তিনি পরিতৃপ্ত ছিলেন।
মৃত্যুকালে তিনি একজন দাসী এবং দুইটি উটনি ছাড়া আর কোন সম্পদ রেখে যাননি।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি ওয়াছিয়াত করে যান, মৃত্যুর পর যেন তাঁর পরনের কাপড়টি ধুয়ে তার সাথে আরো দুই টুকরো কাপড় মিলিয়ে তাঁর কাফন দেওয়া হয়।
৩। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) :
উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) ছিলেন মাক্কার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের একজন । আলমাদীনায় হিজরাত করে আসার পর তিনি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করেন। মুনাফার টাকার বিরাট অংশ আদ্ দা’ওয়াত, আলজিহাদ ও খিদমাতে খালকে ব্যয় করতেন।
আবু বাকর আছিদ্দিকের (রা) ইন্তিকালের পর তিনি আলমাদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্র-প্রধান নির্বাচিত হন। যুগপৎ রাষ্ট্র পরিচালনা ও ব্যবসা চালানো খুবই কঠিন ছিলো। তথাপিও তিনি কয়েক বছর পর্যন্ত বাইতুল মাল থেকে ভাতা নিতে রাজি হননি। রাষ্ট্রীয় কাজের চাপে যখন ব্যবসাতে সময় দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন তিনি ভাতা গ্রহণে রাজি হন। তাও বছরে মাত্র আট শত দিরহাম। হিজরী ১৫ সনে বাইতুল মাল বেশ সমৃদ্ধ হয়। তখন সকলকেই ভালো পরিমাণে ভাতা দেওয়া সম্ভব হয়। এই সময় তিনি বার্ষিক পাঁচ হাজার দিরহাম ভাতা নিতে সম্মত হন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) ও আবু বাকর আছ্ছিদ্দিকের (রা) মতোই ছিলো তাঁর জীবনধারা।
তিনি সাধারণ খাবার খেতেন।
কম সংখ্যক পোশাক পরতেন।
৪। উসমান ইবনু আফফান (রা) :
উসমান ইবনু আফফান (রা) ছিলেন মাক্কার সফল ব্যবসায়ীদের একজন । ইসলাম গ্রহণ করার পর বিরুদ্ধবাদীদের সন্ত্রাসের কারণে তাঁর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
আলমাদীনায় হিজরাতের পর তিনি আবার ব্যবসা সংগঠিত করেন। আল্লাহ্ তাঁর ব্যবসাতে বারাকাত দিতেন। তিনি প্রচুর মুনাফা অর্জন করতেন।
তুলনামূলকভাবে তিনি ভালো পোশাক পরতেন এবং ভালো খাবার খেতেন। কিন্তু তিনিও বিলাসী জীবন যাপন করতেন না।
তাঁর উপার্জিত অর্থের বিরাট অংশ আদৃদা’ওয়াত, আলজিহাদ ও জনহিতকর খাতে ব্যয়িত হতো।
মাসজিদে নববী সম্প্রসারণের জন্য পার্শ্ববর্তী জমি কিনে তিনি তা ওয়াক্ফ করে দেন।
তখন আলমাদীনায় পানযোগ্য পানির বড়ো অভাব ছিলো। এক ইয়াহুদীর মালিকানাধীন রুমা কূপের পানি ছিলো পানযোগ্য। সেই ইয়াহুদী বিনা পয়সায় এক গ্লাস পানি কাউকে দিতো না।
উসমান (রা) আঠার হাজার দিরহামের বিনিময়ে সেই কূপ কিনে নেন এবং জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য ওয়াক্ফ করে দেন।
তাবুক যুদ্ধের ত্রিশ হাজার যোদ্ধার মধ্যে দশ হাজার যোদ্ধার যাবতীয় ব্যয় ভার তিনি বহন করেন।
উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) শাহাদাতের পর তিনি আলমাদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্র-প্রধান হন। বাইতুল মাল থেকে নির্ধারিত ভাতা তিনি গ্রহণ করতেন। কিন্তু নিজে ভোগ না করে অভাবী লোকদের মাঝে বিতরণ করে দিতেন।
৫। আলী ইবনু আবী তালিব (রা) :
আলী ইবনু আবী তালিব (রা) ব্যবসায়ী পিতার সন্তান ছিলেন। দশ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করে তিনি আল্লাহর রাসূলের (সা) সান্নিধ্যে থাকা অব্যাহত রাখেন। ব্যবসার দিকে তাঁর মন ছিলো না। অংশ অংশ করে আলকুরআন নাযিল হচ্ছিলো। আল্লাহর রাসূলের (সা) কাছে শুনে শুনে তিনি তা মুখস্থ করে নিতে থাকেন। নবী গৃহেই তিনি অবস্থান করতেন। নবীর (সা) সাথেই তিনি পানাহার করতেন।
আলমাদীনায় হিজরাত করে আসার পরও আল্লাহর রাসূলের (সা) সাথেই তিনি বসবাস করতে থাকেন।
বদর যুদ্ধের পর তিনি আল্লাহর রাসূলের (সা) কন্যা ফাতিমাকে (রা) বিয়ে করেন। এবার তাঁকে আলাদা ঘর নিতে হয়। আয়-রোজগারের কথা ভাবতে হয়। টুকটাক কাজ করে তিনি যা কিছু পেতেন তা দিয়েই সংসার চালাতেন।
কখনো কখনো তিনি যুদ্ধলব্ধ সম্পদের অংশ পেতেন।
উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) শাসনকালে বাইতুল মাল সমৃদ্ধ হলে তাঁর জন্য বার্ষিক পাঁচ হাজার দিরহাম ভাতা নির্ধারিত হয়।
তিনি ছিলেন খুবই দানশীল।
কোন সাহায্যপ্রার্থীকে তিনি খালি হাতে ফেরাতেন না। ফলে কখনো কখনো সপরিবারে অভুক্ত থাকতেন।
উসমান ইবনু আফফানের (রা) শাহাদাতের পর তিনি রাষ্ট্র-প্রধান নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার পরও তাঁর জীবনধারায় কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
তিনি কম সংখ্যক পোশাক পরতেন।
সাধারণ খাবার খেতেন।
কখনো কখনো তাঁর গায়ে তালি দেওয়া পোশাক শোভা পেতো।
শাহাদাতকালে তিনি রেখে যান নগদ মাত্র সাত শত দিরহাম।
৬। আবাইর ইবনুল আওয়াম (রা) :
আবাইর ইবনুল আওয়ামও (রা) মাক্কার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। আলমাদীনায় অস্যার পর নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন।
ব্যবসা থেকে তিনি প্রচুর মুনাফা অর্জন করতেন। মুনাফার একটি অংশ তিনি পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করতেন। বাকি অংশ লোকদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন।
তাঁর মালিকানাধীন দাসের সংখ্যা ছিলো এক হাজার।
এরা প্রতিদিন অর্থ উপার্জন করতো এবং তাদের মালিকের হাতে তুলে দিতো । দাসদের উপার্জিত সমুদয় অর্থ তিনি কম বিত্তবান লোকদের মধ্যে বিলি করে দিতেন।
তিনি অনাড়ম্বর পোশাক পরতেন।
সাধারণ খাবার খেতেন।
৭। তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রা) :
তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রা) ছিলেন মাক্কার সফল ব্যবসায়ীদের একজন। হিজরাত করে আলমাদীনায় এসে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসাতে সফলতাও অর্জন করেন।
ব্যবসালব্ধ অর্থের সামান্য অংশ পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনে ব্যয় করতেন । বাকি অংশ দান করে দিতেন।
একদিন সন্ধ্যা বেলা হাজরামাউত থেকে ব্যবসার মুনাফার সত্তর হাজার দিরহাম তাঁর হাতে আসে। রাতে বিছানায় শুয়ে তিনি ছটফট করতে থাকেন। কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলেন না।
তাঁর স্ত্রী কারণ জানতে চান।
জওয়াবে তিনি বলেন, “সেই সন্ধ্যা থেকে ভাবছি, এতোগুলো দিরহাম ঘরে রেখে ঘুমুলে একজন মানুষের তার রবের প্রতি কি ধারণা পোষণ করা হয়।”
স্ত্রী বলেন, “এতো চিন্তিত হওয়ার কি আছে? এতো রাতে আপনি গরীব-মিসকীন পাবেন কোথায়? সকাল হলেই বণ্টন করে দেবেন।”
স্ত্রীর কথায় তিনি শান্ত হন।
স্বচ্ছন্দে রাত কাটান।
ভোর না হতেই অনেকগুলো থলে এনে দিরহামগুলো ভাগ করে গরীব-মিসকীনদের মধ্যে বিলিয়ে দেন।
তালহা (রা) প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন।
কিন্তু জীবনে বিলাসিতার ছোঁয়া লাগতে দেননি।
৮। সায়ীদ ইবনু আমের আলজুমাহী (রা) :
উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) শাসনকালে সায়ীদ ইবনু আমের আলজুমাহী (রা) হিম্স নামক স্থানে গভর্ণর নিযুক্ত হন। গভর্ণর হয়েও তিনি একটি ছোট্ট ঘরে বসবাস করতেন।
উল্লেখযোগ্য কোন আসবাব ছিলো না তাঁর ঘরে।
তিনি সাধারণ পোশাক পরতেন।
সাধারণ খাবার খেতেন।
একবার হিম্স থেকে একদল লোক আসেন আলমাদীনায়। তাঁরা রাষ্ট্র-প্রধান উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) সাথে দেখা করেন। তিনি তাঁদেরকে হিমুসের গরীব মানুষদের একটি তালিকা তৈরি করে দিতে বলেন। তাঁরা পরস্পর আলাপ করে একটি তালিকা তৈরি করে উমারের (রা) হাতে দেন। তালিকার প্রথম নামটি ছিলো সায়ীদ ইবনু আমের।’ উমার (রা) জানতে চান, “এ কোন সায়ীদ?”হিম্সবাসীগণ জানান যে এই সায়ীদ হচ্ছেন তাঁদের গভর্ণর।
তাঁর জীবন যাত্রার বিশদ বিবরণ শুনে তিনি তাঁর জন্য এক হাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) বরাদ্দ করেন। অন্যদের জন্যও স্বতন্ত্র বরাদ্দ দেন। হিম্সবাসীগণ ফিরে গিয়ে সকলকে তাদের থলে বুঝিয়ে দিয়ে গভর্ণনের কাছে তাঁর জন্য প্রেরিত থলেটি নিয়ে যান। থলে খুলে দীনারগুলো দেখেই তিনি বলে ওঠেন, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।”
তাঁর মুখে এই কথা শুনে স্ত্রী দরওয়াজার কাছে এসে জানতে চান, “আমীরুল মুমিনীন কি মারা গেছেন?” সায়ীদ বললেন, “না, আমার আখিরাত বরবাদ করার জন্য দুনিয়া আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে। আমার ঘরে বিপদ এসে পড়েছে।” স্ত্রী বললেন, “বিপদটা দূর করে দিন।” সায়ীদ বললেন, “এই ব্যাপারে তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?” স্ত্রী বললেন, “অবশ্যই।”
অতপর সায়ীদ দীনারগুলো ভাগ করে কয়েকটি থলেতে ভরে হিট্সের দরিদ্র ব্যক্তিদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
ইসলামের সোনালী যুগে অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বহু সংখ্যক মানুষ। তাঁরা জাঁকজমক পছন্দ করতেন না। বিলাসিতাকে তাঁদের কাছে ঘেঁষতে দিতেন না।
আখিরাতের জীবনের সফলতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো বলেই তাঁরা দুনিয়ার প্রতি এমন নির্মোহ হতে পেরেছিলেন।
আখিরাতের সফলতাই প্রকৃত সফলতা
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
لَتَرْكَبُنُ طَبَقًا عَنْ طَبَقٍ
“তোমরা অবধারিতভাবে একটি পর্যায় থেকে আরেকটি পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছো।” আল ইনশিকাক-১৯]
একজন মানুষ জীবনের সূচনার পর থেকে শুরু করে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত অনেকগুলো স্তর অতিক্রম করে। অবশেষে তাকে দুনিয়ার জীবন শেষ করে কবরে পৌঁছতে হয়। এইভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কবরের বাসিন্দা হতে থাকে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন পৃথিবী ও অসমান ভেংগে দেওয়ার ক্ষণ উপস্থিত হবে। ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়ে পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। মহাকাশের সবকিছু বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়বে। সবকিছু ভেংগে চুরমার হয়ে যাবে।
এরপর আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের নির্দেশে নতুন আকারে, নতুন রূপে, নতুন বিন্যাসে পৃথিবী ও আসমান আবার অস্তিত্ব লাভ করবে।
يَوْمَ تُبَدِّلُ الْأَرْضِ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمَوتُ
“সেই দিন পৃথিবী ও আসমানকে পরিবর্তিত করে নতুন আকার দেওয়া হবে। নতুনভাবে গড়া পৃথিবী হবে আজকের পৃথিবী থেকে অনেক বড়ো। নতুন পৃথিবীতে কোন সাগর-মহাসাগর থাকবে না। পাহাড়-পর্বত থাকবে না ৷ গাছ-গাছালি থাকবে না। কোন ঘরদোর থাকবে না। গোটা পৃথিবী হবে একটি ধূসর সমতল প্রান্তর ।” [ইবরাহীম ॥ ৪৮]
فَيَذَرُهَا قَاعًا صَفْصَفًا. لا تَرى فِيهَا عِوَجًا وَلَا أَمْنًا
“অতপর এই পৃথিবীকে এক সমতল ধূসর প্রান্তরে পরিণত করা হবে । তুমি এতে উঁচু নিচু কিছু ও সংকোচন দেখতে পাবে না।” [তা-হা ॥ ১০৬, ১০৭]
“আলকাউসার” নামে একটি জলাধার হবে একমাত্র ব্যতিক্রম। নতুন পৃথিবী পৃষ্ঠে “আলকাউসার” ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না। এই বিশাল ধূসর প্রান্তরে জীবিত করে ওঠানো হবে সকল মানুষকে।
فَإِذَا هُمْ قِيَامَ يُنْظُرُونَ وَأَشْرَقَتِ الْأَرْضُ بِنُورِ رَبِّهَا وَوُضِعَ الْكِتَابُ.
“অতপর তারা ওঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চোখে দেখতে থাকবে। পৃথিবী তার রবের নূরে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠবে। আমলনামা (প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে মুতায়েন দুইজন ফেরেশতা কর্তৃক তৈরি ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের বিবরণ) সামনে আনা হবে।” [আয্ যুমার ॥ ৬৮, ৬৯]
চারদিকে আল্লাহর নূরের উদ্ভাসন দেখে প্রত্যেকেই বুঝবে, দুনিয়ার জীবনে আখিরাতের যেই আদালতে উপস্থিত হওয়া সম্পর্কে তাদেরকে জ্ঞাত করা হয়েছিলো, তারা সেই আদালতে উপস্থিত হয়ে গেছে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের পক্ষ থেকে ঘোষণা হবে,
اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا
“তোমার আমলনামা পড়। তুমিই আজ তোমার হিসাব নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।” [বানী ইসরাঈল ॥ ১৪]
প্রত্যেক ব্যক্তি তার আমলনামা পড়বে। আর দেখবে তার কৃত কণা পরিমাণ নেক আমলের বিবরণ সেখানে আছে। আবার কণা পরিমাণ বদ আমলের বিবরণও রয়েছে। “কিরামান কাতিবীন” (সম্মানিত লেখকবৃন্দ কোন কিছু বাড়িয়েও লেখেননি, কোন কিছু কমিয়েও লেখেননি। প্রতিটি কাজের বিবরণ নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন।
অতপর শুরু হবে জিজ্ঞাসাবাদ। আল্লাহর প্রতিনিধি (খালীফা) ও আল্লাহর বান্দা (আবদ) হিসেবে দুনিয়ার জীবনে তাদের ওপর যেইসব কর্তব্য অর্পিত ছিলো, সেইগুলো সম্পন্ন করা সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
কোন কোন অপরাধী ব্যক্তি ধৃষ্টতা দেখাবে। তারা তাদের অতো সব পাপের ফিরিস্তির বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করতে চাইবে। তখন আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন দ্বিতীয় প্রকারের সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করবেন।
আল্লাহর নির্দেশ লাভ করে তাদের প্রত্যংগগুলো তাদের কৃত কাজের বিবরণ পেশ করা শুরু করবে।
وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ.
“এবং তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে। তাদের পা সাক্ষ্য দেবে তারা কী কী করেছিলো।” [ইয়া-সীন ॥ ৬৫]
يَوْمَ تشهد عليهم السنتهم وأيديهم وَأَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“সেই দিন তাদের জিহ্বা, তাদের হাত ও তাদের পা সাক্ষ্য দেবে তারা কী কী করেছিলো।” [আন্ নূর ॥ ২৪]
شهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعهم وأبصارهم وجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“তাদের কান, তাদের চোখ ও তাদের ত্বক (চামড়া) সাক্ষ্য দেবে তারা কী কী করেছিলো।” [হামীমুস্ সাজদা ॥ ২০]
ان السمع وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولاً
“নিশ্চয়ই তাদের কান, চোখ ও অন্তরকে জওয়াবদিহি করতে হবে। ” [বানী ইসরাঈল ॥ ৩৬]
وَإِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ الله
“আর তোমাদের মনের কথা তোমরা প্রকাশ কর অথবা গোপন কর, আল্লাহ অবশ্যই সেই সম্পর্কে হিসাব নেবেন। ” [আলবাকারা ॥ ২৮৪]
এই জিজ্ঞাসাবাদ হবে সূক্ষ্ম, দীর্ঘ ও ব্যাপক।
এক পর্যায়ে ব্যক্তির “আমালে ছালেহ” সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে। কোন্ আমল কোন্ অভিপ্রায়ে বা নিয়াতে করা হয়েছিলো তা বিশ্লেষণ করা হবে।
উল্লেখ্য যে “ইখলাছুন্নিয়াত” বা নিয়াতের বিশুদ্ধতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। “ইখলাছুন্নিয়াত” সহকারে করা না হলে কোন আমালে ছালেহকে আল্লাহ স্বীকৃতি দেন না।
একদিন এক ব্যক্তি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (সা) জিজ্ঞেস করলো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা খ্যাতি অর্জনের জন্য অর্থ ব্যয় করে থাকি । এতে কি আমরা পুরস্কৃত হবো?” আল্লাহর রাসূল বললেন, “না”। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো, “আমাদের নিয়াত যদি আল্লাহর পুরস্কার লাভ এবং দুনিয়ায় খ্যাতি অর্জন- দুইটিই হয়?” আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন, “কোন আমল খালিছভাবে তাঁর জন্য করা না হলে আল্লাহ তা কবুল করেন না।” [ইয়াযিদ আর রাকাশী (রা), ইবনু মারদুইয়া]
“ইখলাছুন্নিয়াতের” অভাবে বড়ো বড়ো ত্যাগ-কুরবানীও আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন কবুল করেন না।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
“শেষ বিচারের দিন প্রথম পর্বে এমন এক ব্যক্তির বিচার হবে যে শহীদ হয়েছে। তাকে আল্লাহ প্রদত্ত সকল নিয়ামাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে। সে এইসব নিয়ামাত প্রাপ্তি ও ভোগের কথা স্বীকার করবে। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, “এইসব নিয়ামাত পাওয়ার পর তুমি আমার জন্য কী করেছো?” সে বলবে, “আমি আপনার পথে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি।”
আল্লাহ বলবেন, “তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি বীররূপে আখ্যায়িত হওয়ার জন্য লড়াই করেছো। সেই খ্যাতি তুমি পেয়েছো।” অতপর তার সম্পর্কে ফায়সালা দেওয়া হবে, তাকে উপুড় করে পা ধরে টেনে হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
“অর্থাৎ আমলে ছালেহ গৃহীত হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে ইখলাছুন্নিয়াত।
আদ্দা’ওয়াত, আলজিহাদ, আছ্ছালাত, আছ্ছাওম, আয্যাকাত, আলহাজ, ইনফাক, খিদমাতে খালক তথা সবকিছু একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের সন্তোষ অর্জনের জন্যই নিবেদিত হতে হবে।
আল্লাহর আদালতে বিশ্লেষণে যদি প্রমাণিত হয় মুমিন সকল আমালে ছালেহ একমাত্র আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের জন্যই সম্পন্ন করেছে, তাহলে তার নাজাতের পথ প্রশস্ত হয়ে যাবে।
আল্লাহর আদালতে বিচারপর্ব শেষ হওয়ার পর কিছু মানুষের ঠিকানা হবে জাহান্নাম, আর কিছু মানুষের ঠিকানা হবে জান্নাত।
জাহান্নাম :
জাহান্নাম কঠিন শাস্তির স্থান।
ভয়ংকর আকৃতির ফেরেশতারা সেখানে নিযুক্ত রয়েছেন। আল্লাহর নির্দেশে তাঁরা পাপীদের গলায় বেড়ি লাগিয়ে দেহে লোহার শিকল পেঁচিয়ে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।
জাহান্নামের আগুনের তেজ দুনিয়ার আগুনের তেজের চেয়ে সত্তর গুণ বেশি।
জাহান্নামে ঘন শ্বাসরুদ্ধকর ঝাঁঝালো ধোঁয়া আবর্তিত হচ্ছে।
জাহান্নামের নানাস্থানে বিশাল আকৃতির ভয়ংকর বিষধর সাপ রয়েছে।
জাহান্নামীদের দেহ হবে বিশাল আকৃতির। ফেরেশতারা ভারি গুর্জ দিয়ে আঘাত হেনে জাহান্নামীদের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকবে। জাহান্নামীরা ভীষণ চিৎকার করতে থাকবে।
আগুনের উত্তাপে ও পিপাসায় তারা হাঁপাতে থাকবে।
তাদেরকে ভীষণ গরম পানি ও রক্ত-পুঁজ পান করতে দেওয়া হবে।
কাঁটাযুক্ত, তিক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত যাক্কুম গাছ গিলতে বাধ্য করা হবে।
আরো বহুবিধ শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে জাহান্নামে। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
“জাহান্নামের সবচেয়ে কম শাস্তি হবে তার যাকে আগুনের ফিতাযুক্ত একজোড়া জুতা পরানো হবে। এতেই তার মাথার মগজ জ্বলন্ত চুলার ওপর হাঁড়ির পানির মতো টগবগ করে ফুটতে থাকবে।”
[সহীহ মুসলিম]
জান্নাত:
জান্নাত অনাবিল সুখ-শান্তির স্থান।
ফেরেশতারা জান্নাতীদেরকে খোশ আমদেদ জানিয়ে জান্নাতে নিয়ে যাবেন।
জান্নাতের বাগানগুলো নয়নাভিরাম।
বাগানগুলো পাখ-পাখালিতে পূর্ণ।
চারদিকে ফুলের সমারোহ।
জান্নাতে প্রবাহিত হচ্ছে সুপেয় পানির ঝর্ণা, সুস্বাদু দুধের ঝর্ণা, স্বচ্ছ মধুর ঝর্ণা এবং উন্নতমানের পানীয়র ঝর্ণা।
জান্নাতে রয়েছে সুস্বাদু মাছ, গোশত, রকমারি খাদ্য এবং ফলের প্রাচুর্য।
জান্নাতে রয়েছে অনুপম উপাদানে তৈরি সারি সারি প্রাসাদ।
জান্নাতীদের জন্য আরামদায়ক পোশাক, শয্যা ও সুউচ্চ আসনের ব্যবস্থা রয়েছে।
জান্নাত আলো ঝলমল৷
জান্নাতে রয়েছে অগণিত সৌন্দর্য-শোভার উপকরণ।
জান্নাতের প্রতিটি বস্তুতে রয়েছে তুলনাহীন সুঘ্রাণ।
জান্নাত উত্তাপ ও শীতের প্রকোপযুক্ত।
জান্নাতীদের দৈর্ঘ্য হবে ষাট হাত। সকল জান্নাতী হবেন যুবক ও যুবতী।
তারা লাভ করবেন চিরস্থায়ী যৌবন।
জান্নাতে কারো অসুখ হবে না।
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে অসাধারণ দৈহিক সৌন্দর্য দান করবেন।
তাদের দেহে থাকবে অনন্য সাধারণ সুঘ্রাণ।
জান্নাত মানুষের অনন্ত জীবন লাভ এবং বিশাল সম্পদ-সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার আকাংখা পূরণের স্থান।
প্রত্যেক জান্নাতীকে জান্নাতের সুবিশাল অংশের মালিক বানিয়ে দেওয়া হবে।
আল্লাহ সবচেয়ে কম মর্যাদাবান জান্নাতীকেও বর্তমান পৃথিবীর চেয়ে দশগুণ বেশি স্থান দেবেন।
مُلكًا كَبِيرٌ وَاذَا رَأَيْتَ ثَمَّ رَأَيْتَ نَعِيم
“এবং তুমি যেই দিকেই তাকাবে নিয়ামাত আর নিয়ামাতই দেখতে পাবে। আর দেখতে পাবে এক বিশাল সাম্রাজ্য।” [আদ দাহর ॥ ২০]
আল্লাহর সৃষ্টি ক্ষমতা সীমাহীন।
তিনি নতুন নতুন নিয়ামাত সৃষ্টি করে জান্নাতীদেরকে উপহার দিতে থাকবেন।
لَهُمْ مَّا يَشَانُونَ فِيهَا وَلَدَيْنَ مَزيد
“জান্নাতে তারা যা চাইবে, তা-ই পাবে। আর আমার পক্ষ থেকে আরো অনেক কিছু রয়েছে তাদের জন্য।” [কা-ফ ॥ ৩৫ ]
قُرَّةٍ أَعْيُن: فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ
“তাদের চোখ জুড়াবার জন্য আমি যেইসব জিনিস গোপন করে রেখেছি তা তাদের কারোরই জানা নেই।” [আস্ সাজদা ॥ ১৭]
أعددت لِعِبَادِي الصَّالِحِينَ مَا لَا عَيْنُ رَأَتْ وَلَا أُذُنٌ سَمِعَتْ وَلَا أعْدَدْتُ خَطَرٌ عَلَى قَلْبٍ بَشَرٍ.
“(আল্লাহ বলেন,) আমি আমার ছালেহ বান্দাদের জন্য এমন এমন নিয়ামাত মওজুদ করে রেখেছি যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, যার কথা কোন কান কখনো শুনেনি এবং যার ধারণা কোন হৃদয়ে কখনো উদিত হয়নি।” [সহীহ আলবুখারী]
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে তাঁর দর্শন দান করে ধন্য করবেন।
যাঁর প্রতিনিধি (খালীফা) এবং বান্দা (আব্দ) রূপে পৃথিবীতে কর্তব্য পালন করে তারা জান্নাতে স্থান পেলো, সেই আল্লাহকে দেখে তারা পরিতৃপ্ত হবে । জান্নাতীদের কাছে সবচে’ বেশি আনন্দের বিষয় হবে আল্লাহর দর্শন।
জাহান্নামীরা জাহান্নামে এবং জান্নাতীরা জান্নাতে অবস্থান গ্রহণের পর মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে একজন ফেরেশতা ঘোষণা করবেন, “ওহে জাহান্নামীরা, আর মৃত্যু নেই। ওহে জান্নাতীরা আর মৃত্যু নেই। সামনে তোমাদের অনন্ত জীবন।”
আখিরাতের মৃত্যুহীন জীবন সম্পর্কে আলকুরআনে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
“প্রথম মৃত্যুর পর ওখানে তারা আর মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে না।” [আদ দুখান ॥ ৫৬]
আখিরাতের অনন্ত জীবনের ব্যর্থতাই প্রকৃত ব্যর্থতা। আবার, সেই অনন্ত জীবনের সফলতাই প্রকৃত সফলতা।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
لا يَسْتَوى أَصْحَبُ النَّارِ وَأَصْحَبُ الجَنَّةِ ط أَصْحَبُ الجَنَّة هُمُ الْفَائِزُونَ
“জাহান্নামের অধিবাসীরা এবং জান্নাতের অধিবাসীরা কখনো সমান হতে পারে না। জান্নাতের অধিবাসীরাই সফল।” [ আলহাশর ॥ ২০]
আখিরাতের অনন্ত জীবনের সফলতাকে সামনে রেখে দুনিয়ার জীবনে সঠিক ভূমিকা পালনের তাকিদ দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَسَارِعُوا إِلى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضُ
“এবং তোমরা দ্রুত এগিয়ে চল তোমাদের রবের মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও পৃথিবীর বিস্তৃতির সমান।” [আলে ইমরান – ১৩৩]
سارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ
“তোমরা প্রতিযোগিতা করে দ্রুত এগিয়ে চল তোমাদের রবের মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও পৃথিবীর বিস্তৃতির সমান।” [আলহাদীদ – ২১]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন,
الْكَيْس مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ وَالْعَاجِزُ مَنْ أتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهُ وَتَمَنَّى عَلَى الله
“সেই ব্যক্তি বুদ্ধিমান যে নিজের নাফসকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের দিকে লক্ষ্য রেখে আমল করেছে। সেই ব্যক্তি নির্বোধ যে নিজকে নাফসের হাতে সঁপে দিয়েছে, আবার আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশাও [শাদ্দাদ ইবনু আউস (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
সমাপ্ত