অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান
অধ্যাপক গোলাম আযম
রচনা
অধ্যাপক গোলাম আযম (রাহি)
অনুবাদ
মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন মোল্লা
পরিবেশনায়
ক্রিসেন্ট পাবলিকেশন
অনুবাদকের কথা
আলহামদুলিল্লাহ। “অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান” পুস্তিকাটি মূলত অধ্যাপক গোলাম আযম (রাহি.) লিখিত বই Jamaate Islami Ideology and Movemant এর একটি Topic “Solution to economic problems” এর বংগানুবাদ। এই টপিকটি পাঠ করে আমি তীব্রভাবে অনুভব করলাম তা পাঠক সমাজের বেশ কাজে আসবে। তাই অনুবাদ করে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করলাম ।
ইসলামী অর্থনীতি হলো কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় রাজনৈতিক স্বাধীনতার উপর জোর দেয়া হলেও সেখানে অর্থনৈতিক মুক্তি অবর্তমান। আবার সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলা হলেও সেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা নেই। কিন্তু ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সমান সুযোগ রয়েছে।
আলোচ্য নিবন্ধে লেখক অতি সংক্ষেপে, অত্যন্ত চমৎকারভাবে ইসলামী অর্থনীতি এবং বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পার্থক্য তুলে ধরেছেন। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন পুঁজিবাদে জাতীয় সম্পদের মালিকানা একচেটিয়া কয়েকজনের হাতে থাকে আর সমাজতন্ত্রে এই মালিকানা থাকে সরকার কিংবা দলের হাতে। কিন্তু ইসলামে সম্পদের মালিকানা জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিতরণ করা হয়। ইসলামে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি পুঞ্জীভূত করা একেবারে নিষিদ্ধ । অত্র নিবন্ধে স্বল্প পরিসরের আলোচনায় লেখক একথা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, পুঁজিবাদী কিংবা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কোনটার দ্বারাই মানবজাতির কল্যাণ সম্ভব নয়। এর একমাত্র সমাধান হলো জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী অর্থনীতি চালু করা। অর্থনৈতিক সমস্যার চমৎকার সমাধান যে ইসলামে রয়েছে এই লেখনীর মাধ্যমে আশা করি পাঠকমাত্রই সহজে অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রচেষ্টা কবুল করুন। আমীন
মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন মোল্লা, ঢাকা।
তারিখ : ১১ জুলাই ২০২১
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান
বৃটিশ শাসনামলে বর্তমান বাংলাদেশ কলকাতার অন্তর্গত ছিলো। সেজন্য এ অঞ্চলটি ছিল অর্থনৈতিক দিক থেকে তুচ্ছ, শিল্পে পশ্চাৎপদ এবং বাণিজ্যিকভাবে বিশৃংখল। পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭-১৯৭১), ভারতে মুসলিম অভিবাসীরা অনেক শিল্প স্থাপন করে এবং বাণিজ্যের বিকাশ ঘটায়। ১৯৭১ সালে নিরাপত্তাহীনতার কারণে তারা পালিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব সরকার এদেশে শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ করেন। শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করলেও সেগুলো পরিচালনা করার মতো তাঁর কোন অভিজ্ঞ জনবল ছিলো না। তাছাড়া যাদেরকে এসমস্ত শিল্পকারখানা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাদের অদক্ষতা ও অসততা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে লুজিং কনসার্ন (লোকসান হচ্ছে এমন প্রতিষ্ঠান) এ পরিণত করে। ১৯৭৬ সাল থেকে ক্রমাগতভাবে বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান আবার বেসরকারিকরণ করা হয়। কিন্তু দুর্নীতির কারণে বেসরকারিকরণকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ন্যায্য দামও সরকার পায়নি। যাই হোক বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুঁজিবাদী ধরনের। এক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র কোন সমাধান নয় এছাড়া পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া একেবারেই কোন সমাধান নয় ।
ক) সমস্যার মূলে
অর্থনৈতিক সমস্যার সবচেয়ে কঠিন দিক হলো উৎপাদন ও বিতরনের ক্ষেত্রে শোষণ ও ‘মনোপলি (Monopoly) নির্মূল করা এবং একই সাথে প্রত্যেককে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের গ্যারান্টি দেওয়া। মূলধন যদি পুঁজিবাদের মতো রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে তবে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। যদি সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মতো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলো একক কর্তৃত্বে চলে আসে তবে সবচেয়ে খারাপ ধরনের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের সুপ্রীমশাসনে ব্যক্তি স্বাধীনতা পিষ্ট হয়। সুতরাং আসল সমস্যাটি হচ্ছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিনষ্ট না করে কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে ন্যায়বিচারের সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়। [টিকা: মনোপলি (Monopoly) অর্থ একচেটিয়া। অর্থনীতিতে কোন দ্রব্যের বাজারে কেবলমাত্র একজন বিক্রেতা থাকলে তাকে একচেটিয়া বাজার বলে। অর্থাৎ মনোপলিতে উৎপাদন তথা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে একটি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। মনোপলিতে ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অর্থনৈতিক কল্যাণ হ্রাস পায় এবং সমাজে ধনবৈষম্য সৃষ্টি হয়। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ Milton Friedman বলেন A monopoly exists when a specific person or enterprise is the only supplier of a particular commodity. This contrasts with a monopsony which relates to a single entity’s control of a market to purchase a good or service, and with oligopoly and duopoly which consists of a few sellers dominating a market. (অনুবাদক)]
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো, সামাজিক সুরক্ষার সন্তোষজনক ব্যবস্থা। একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হলেও এই সম্ভাবনা থেকে যাবে যেখানে কিছু লোক তাদের কেবল প্রয়োজনীয় দিকগুলোও পূরণ করতে সক্ষম হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র নাগরিকদের অভাব পূরণের দায়িত্ব না নিবে ততক্ষন পর্যন্ত নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান হবে না, আর তা ব্যতীত একটা সমাজকে সভ্য সমাজ বলা যাবে না। কেবল নামেই একটি সমাজকে সভ্য সমাজ বলা যাবে না, এজন্য অবশ্যই সামাজিক সুরক্ষার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
খ) ইসলামী সমাধানের মূলনীতি
অর্থনৈতিক সমস্যার ইসলামী সমাধান নিম্নলিখিত মূলনীতি দ্বারা পরিচালিত
১। সকল সম্পদ মহান আল্লাহ তা’য়ালার, মানুষ কেবল এর রক্ষণাবেক্ষণকারী। তারা মহান আল্লাহ তা’য়ালার কুরআন এবং হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী এ সম্পদের ব্যয় ব্যবহার করবেন। এ নীতি ভোগের মানসিকতাকে দমিয়ে দেয় এবং সম্পদ জমানোর তৃষ্ণা নিবারণ করে।
২। সকল প্রকারের শোষণ, যেমন- সুদ, ঘুস, স্বজনপ্রীতি, চোরাচালান, জুয়া ইত্যাদি যা সমাজে নানারূপে দেখা যায়, এগুলো নির্মূল করতে হবে।
৩। রাষ্ট্রকে অবশ্যই মানুষের মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান,
চিকিৎসা ও শিক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে ।
৪। ৪। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা নিশ্চিহ্ন করার জন্য সকল প্রকারের সুদ তা যে ফরমেটেই হোক না কেন বন্ধ করতে হবে। সুদ পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূল ভিত্তি। সকল প্রকারের গবেষণায় দেখা গেছে যুক্তির পরীক্ষায় সুদ খুবই দুর্বল [ টিকা: Dr. A.I. Quraishi (Economic Advisor to the Government of Pakistan), Islam and the Theory of Interest.] এবং এটি জনগণকে শোষণ করার এবং অর্থনীতিকে একচেটিয়াকরণের সবচেয়ে ধূর্ত হাতিয়ার। [টিকা: Maudoodi, Sood (Interest), in Urdu and Bangla.]
৫। কোন সুবিধাভোগী শ্রেণি গড়ে উঠার সুযোগ থাকবে না। সকল নাগরিকদেরই মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উপার্জনের সুযোগ থাকবে। এ উদ্দেশ্যে পেশাদার ও পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণের জন্য সকলের সমান সুযোগ থাকবে।
৬। ব্যক্তিগত মালিকানা ইসলাম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, অর্থ্যাৎ মালিকানায় একচেটিয়া অধিকার অনুমোদিত হবে না। আয় এবং ব্যয়ের উপায় অবশ্যই মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.) প্রদর্শিত হালাল ও হারাম এর নীতিমালা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে। ইসলাম সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার স্বীকৃতি দেয় কারণ এটি নাগরিক স্বাধীনতার প্রয়োজনীয় অন্যতম উপাদন। মালিকানার অধিকার মহান আল্লাহর দান এই অধিকার ছাঁটাই করার কারও কোন আইনগত অধিকার নেই-যদিনা মালিক নিজে তার অপব্যবহার করেন ।
৭। কিছু ধনী ব্যক্তির হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়াকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে করে উৎপাদন ও বিতরণের ক্ষেত্রে মনোপলি বিকাশের সুযোগ না থাকে ।
৮। শ্রমের মর্যাদা দিতে হবে এবং শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে জনগণের সামাজিক মর্যাদা পেশা বা বৃত্তির দ্বারা নয় বরং সততা, অখণ্ডতা এবং নৈতিকতার মানদণ্ড দ্বারা নির্ধারিত হয়।
৯। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাকাত আদায় করে এটিকে একটি সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মানব সমাজে বিরাজমান সামাজিক সুরক্ষায় সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো
যাকাত । [টিকা: Maudoodi, Significance of Zakat, in Urdu and Bangla.]
গ) বাস্তবায়নে সমস্যা
এ পর্যায়ে অবশ্য প্রতিটি বুদ্ধিমান পাঠক খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারেন, তা হলো উপরোক্ত পরামর্শগুলো নিঃসন্দেহে যথার্থ কিন্তু এগুলো কে বাস্তবায়ন করবে এবং কীভাবে সম্ভব ? এটা অত্যন্ত যৌক্তিক যে ইসলামকে যারা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে অনুসরণ করে না তাদের দ্বারা ইসলামী অর্থনীতি চালু হতে পারে না । যেহেতু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কেবল সমাজবাদীদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশা করা যায় পুঁজিবাদীদের দ্বারা নয়। তেমনি ইসলামী অর্থনীতি কেবল ইসলামের আন্তরিক অসুসারীদের দ্বারাই বাস্তবায়ন সম্ভব। আসুন বাস্তবায়নের কিছু সমস্যা এবং সেগুলোর সঠিক সমাধান নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১। আজ আমাদের অর্থনীতিতে নানা প্রকারের শোষণ ও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে কিছু বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সন্দেহ নেই বিভিন্ন ধরনের শোষণের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু কে জানেনা যে এই আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত না আইন প্রয়োগকারীরা নিজেরা দুর্নীতি ও শোষণ থেকে মুক্ত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে না। আইন প্রয়োগকারীরা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে প্রতিটি নতুন আইন তাদের জন্য শোষণের নতুন দ্বার খুলে দেয়। সুতরাং বেশিরভাগ দুর্নীতি ও শোষণ চলছে এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে মূলত তাদের কারণে যারা এগুলো নির্মূল করার জন্য দায়বদ্ধ। দুর্নীতিপরায়ন লোকদের স্থলে সৎ লোকদের না বসিয়ে কেবল ভালো আইনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা যাবে না। অধিকন্তু উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া কেবল বিপ্লবী আইন এক্ষেত্রে সম্ভব নয়। এ ধরনের নেতৃত্ব এবং কর্মী শ্রমিকদের একটি সৎ ব্যাচ নিয়মতান্ত্রিক আদর্শিক আন্দোলন ব্যতীত তৈরি করা সম্ভব নয়। জামায়াতে ইসলামী এ লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে এবং এ ধরনের আন্দোলনের গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য সকলকে আহ্বান জানায় ৷
২। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই এবং স্বৈরশাসন বংশানুক্রমিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের রূপে গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যহীনভাবে দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। তবে একনায়কতন্ত্র কেবল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী শ্রেণির সহযোগিতায়ই বেচে থাকে এবং একনায়কদের ছত্রছায়ায়ই সুবিধাভোগীরা বেড়ে উঠে।গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সুবিধাভোগী শ্রেণি বেড়ে উঠার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা। রাজনৈতিক ময়দানে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা অর্থনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে এবং সুবিধাভোগী শ্রেণির গড়ে উঠা কমিয়ে দেয়। এজন্য মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলন উন্মুক্ত অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার সাথে সম্পৃক্ত। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা মানে ব্যবসা, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের জন্য লোকদের কেবল মেধার ভিত্তিতেই নির্বাচন করা হবে অন্য কোনভাবে নয় ।
৩। রাষ্ট্র যদি প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষাসহ নুন্যতম চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব গ্রহণ করে, তাহলে রাষ্ট্র অবশ্যই দেখতে পাবে যে নাগরিকরা উৎপাদন কাজে নিয়োজিত আছে এবং সেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্বও কমে আসবে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশের সরকার এখনোও এই প্রাথমিক দায়িত্বটুকুও গ্রহণ করেনি। এ ধরনের রাষ্ট্রের গরীব জনসাধারন এখনো তাদের আত্মীয়স্বজন এবং অন্য কোন দরিদ্র মানুষের করুনার উপর নির্ভর করছে। যখনি রাষ্ট্র এ দায়িত্ব নিতে তৈরি হবে তখনি অর্থনৈতিক সমাধানের পথ তৈরি হবে।
৪। নৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত উপাদান উপভোগ অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারে ব্যাপক অবদান রাখে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি কতটা উপভোগ করা যায় ? যদি লোকেরা ইসলামের আন্তরিক অনুগামী হন এবং তারা নিজেরা অনৈতিক অভ্যাসে আসক্ত না হন, তবে তারা বৈষয়িক উপভোগের অনৈতিক উপায় নির্মূল করতে সক্ষম হবে। মদ, ব্যাভিচার, সঙ্গীত, নৃত্য, পেশাদার মেয়ে, উভয় লিঙ্গের বিলাসবহুল আয়োজন এসকল অনৈতিক উপায়গুলোর জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। এসব অশুভ উপায়-উপকরণগুলো জীবনকে উপভোগের বস্তু বানিয়ে দেয়। ফলে মানুষ সম্পদ উপার্জনে প্রলুব্ধ হয়ে অনৈতিক উপার্জনে ধাবিত হয় যা অর্থনৈতিক অবিচারের দিকে নিয়ে যায়।
৫। জীবন সম্পর্কে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সমাজে একজন মানুষের অবস্থান প্রধানত তার সম্পদ দ্বারা নির্ধারিত হয়, তার চরিত্রের মান দ্বারা নয়। যার ফলে ধনীরা সহজেই নেতৃত্বের দিকে আরোহন করে এবং সর্বস্তরে প্রভাব বিস্তার করে। ইসলামী আন্দোলনের মাধ্যমে নেতৃত্বের পরিবর্তন অবশ্যই সম্পদের এই অবস্থানকে হ্রাস করবে এবং মহৎ মানবিক গুণাবলী এটি প্রতিস্থাপন করবে। উচ্চ নৈতিক চরিত্রটি সেই সমাজে নেতৃত্বের মৌলিক গুণ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং আজকের অনেক নেতাকে সবচেয়ে খারাপ অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
৬। বর্তমানে শ্রমিকরা প্রায় দাসের মতোই, এমনকি ফার্মের তরুন কর্মকর্তাও তাদের বয়স্ক শ্রমিকদের সাধারণ শ্রদ্ধা দেখানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। দরিদ্র শ্রমিকরাও তাদের কর্তা ব্যক্তিদের কাছ থেকে সম্মানের দাবি করার সাহস করেন না। এই দৃষ্টিভংগী পরিবর্তন করতে হবে। শুধু বেতনবৃদ্ধিই এটিকে সরাতে পারে না। এর জন্য সামাজিক সংস্কার (Social reform) প্রয়োজন । যারা কায়িক শ্রমের মাধ্যমে জীবীকা নির্বাহ করেন তাদের সমাজ থেকে পৃথক শ্রেণি বিবেচনা করা উচিত নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা চোখে কোন ভাল কাজই ছোট নয়। এক্ষেত্রে একটি মনোভাবের ব্যবহারিক পরিবর্তন মূলত নেতাদের উপর নির্ভর করে। যদি তারা শ্রমজীবীদের যথাযথ সম্মান দেখায় তবে তাদের অবস্থান সহজেই পুনরুদ্ধার করা যায় । আধুনিক বস্তুবাদী ধারণার কারণে বর্তমান বিকৃত মানসিকতার জন্ম। আজ সম্মান সম্পদশালীর জন্য সংরক্ষিত। এমনকি একজন কৃপন ব্যক্তিকেও সম্মান করা হয় যদি তিনি ধনী হয়ে ওঠেন এবং উচ্চতর নৈতিক গুণাবলীর লোককেও অসম্মান করা হয় কেবল তার দারিদ্রতার কারণে। ইসলামী সমাজে সামাজিক অবস্থান অবশ্যই নৈতিক চরিত্রের মান দ্বারা নির্ধারিত হয়, পেশা বা অর্থনৈতিক অবস্থানের দ্বারা নয় ।
৭। মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে বিশাল সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়া আজ একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি কেবল অবাঞ্চিতই নয়, ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক বিপদ। এটি আধুনিক পুঁজিবাদ সৃষ্ট। এটা অর্থনীতিতে মনোপলি (Monopoly) এবং রাজনীতিতে দুর্নীতির প্রসার ঘটাচ্ছে।
পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে সম্পদ এমনভাবে বন্টন করতে হবে যাতে মাত্র কয়েকজনের হাতে এটা পুঞ্জীভূত না হয় ৷ মহান আল্লাহ বলেন, “যাতে করে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তশালী, কেবল তাদের মাঝেই অর্থ-সম্পদ আবর্তিত না হয়।” (সূরা আল হাশর : ০৭ )
ঘ) মালিকানা বিস্তৃতির জন্য কিছু ব্যবস্থা
ইসলাম যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাতিল করে না তেমনি সম্পদের মালিককেও তা তার খেয়াল খুশি মতো ব্যয় করতে দেয় না। ইসলাম জাতীয় সম্পদের মালিকানা সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ন্যায়পরায়নতার ভিত্তিতে জনগণের মাঝে বন্টন করতে চায়। পুঁজিবাদে ব্যক্তিগত মালিকানা অবশ্যই বড় পাপ তবে সমাজতান্ত্রিক ধরনের রাষ্ট্রীয় মালিকানা নিঃসন্দেহে আরও বড় পাপ। এক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিকার হলো মালিকানার ব্যাপক বিতরণ। এ পর্যায়ে আসুন কয়েকটি প্রতিকার বিবেচনায় আনা যাক :
১) শ্রম বান্ধব শিল্প
আমাদের খুব সীমিত মূলধনের বিপরীতে উদ্ধৃত জনবল রয়েছে। আমাদের সমস্যা উদ্বৃত্ত মূলধনকে কাজে লাগানো নয়, বরং বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থান। অনেক ক্ষেত্রে ভারী ও বড় শিল্পগুলি আমাদের পক্ষে মোটেই উপযুক্ত নয়। আমাদের সমস্যাগুলো অনেকটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান যে সমস্ত সমস্যাগুলো মোকাবিলা করেছিলো তার মতো। যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর জাপান পুঁজির স্বল্পতায় ভোগলেও পুঁজিবাদী দেশগুলোকে অনুসরণ করেনি। জাপান তার শ্রমশক্তির দিকে মনোযোগ দেয় এবং তারা প্রায় প্রতিটি ঘরেই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠা করে এবং পুরো জনসংখ্যাকে উৎপাদন কাজে লাগায়। প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কাজ করতো, তাতে করে তাদের উৎপাদন ব্যয় অনেক কমে যায়। ফলে ১০-১৫ বছরের মধ্যে জাপান বিশ্ব বাজার দখল করতে সক্ষম হয়। আর এ উৎপাদনগুলোর মুনাফা সরাসরি কর্মীদের হাতে যেতো যারা নিজেরা ঐ শিল্পকারখানাগুলোর মালিকও ছিল। এ ধরনের শ্রম-বান্ধব শিল্প প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে খুবই উপযোগী যেখানে প্রতিটি হাত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে কাজে লাগবে এবং যেখানে বড় ধরনের মূলধনেরও কোন প্রয়োজন হবে না। আমাদের বড় বড় টেক্সটাইল এবং চিনি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল পুঁজিই শেষ করছে না বরং বিশাল সংখ্যক জনগণের কর্মসংস্থানও নষ্ট করছে যারা কুটির শিল্পের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের জীবন যাপন করছিল। তারা এখন সেইসব কারখানার শ্রমিকে পরিণত হয়েছে যার লাভ শুধুমাত্র শিল্পপতিদের পকেটে যায়। সে সকল ক্ষেত্রেই কেবল ভারী শিল্প কারখানা স্থাপন করা উচিত যেখানে ক্ষুদ্র শিল্পের মাধ্যমে উৎপাদন সম্ভব নয়। যেমন : লৌহজাত শিল্প, যন্ত্রাংশ উৎপাদন ফ্যাক্টরী ইত্যাদি যেগুলো ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে ব্যাঘাত না ঘটাতে পারে।
২) শিল্প শ্রমিকের মাঝে মালিকানার প্রসার
সকল বড় শিল্পকারখানাগুলোতে শ্রমিকরা যে যেখানে কাজ করছেন ধীরে ধীরে তাদের মাঝে শেয়ার এর একটা অংশ স্থানান্তর করা উচিত।
যাকাত এবং বোনাস এর মাধ্যমে তাদের কাছে শেয়ার বিক্রী করা যেতে পারে। এর ফলে শিল্প প্রতিষ্ঠানটি ধর্মঘট ও লকআউট, শ্রমিকদের অযৌক্তিক দাবি এবং পুঁজিপতিদের দ্বারা শোষণ থেকে রক্ষা পাবে। এই পদ্ধতিটি কম খরচে উচ্চ হারে উৎপাদনের কারণ ঘটাবে। কারণ তারা কেবল মজুরীর জন্যই নয় লভ্যাংশের আশায়ও কাজ করবে।
৩) রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাবলিক লিমিটেড ইন্ডাষ্ট্রীজ
রাষ্ট্র কখনো শিল্পপতি হয় না। কিন্তু রাষ্ট্রকেই শিল্পের সূচনা করতে হবে এবং তা যখন উৎপাদনে যাবে তখন তা ক্ষুদ্র আয়ের গোষ্ঠীর জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত। এভাবে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক লোককে জাতীয় সম্পদ শেয়ার করা যেতে পারে।
৪) শোষণ থেকে মুক্তি
যদি কোন শিল্পের পুঁজিপতিরা সংশ্লিষ্ট আইন অনুসারে শোষণের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয় তবে মালিকরা আইনগুলো মানতে বাধ্য হতে পারেন। মালিকানা শোষণের জন্য দায়ী নয়। পুঁজিবাদী কেবলমাত্র সরকারের সহায়তায়ই শোষণ করতে পারে। পুঞ্জীভূত সম্পদ সম্পর্কে এখানে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্থাপন হতে পারে। উপরের ব্যবস্থা এবং অনুরূপ অন্যান্য পদ্ধতিগুলো শোষণ অপসারণ করতে পারে, তবে বিপুল সম্পদের মালিকরা তাদের ভাগ্যের জোড়ে আরো শোষণ চালাতে পারে। এই প্রশ্নের উত্তর হলো, যদি শোষণের উপায়গুলো বন্ধ হয়ে যায় তবে সম্পদের মালিকরা এগুলো খেয়ে ফেলতে পারবেন না। আইন অনুযায়ী তাদেরকে তাদের সম্পদ ব্যবহার করতে হবে।
৫) সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প
যাকাত ও উশর সরকারের কর (Tax) নয় এবং সরকার এগুলো প্রশাসনিক কাজে ব্যয় করতে পারেন না। যাকাত সংস্থার অর্থ তাদের সুরক্ষা প্রদানের জন্য যারা তাদের প্রয়োজনের চেয়ে কম উপার্জন করে। ২.৫% সম্পদ অলস বা উৎপাদনের জন্য রেখে দেয়া হয় এবং অসেচকৃত জমির ১/১০ (এক দশমাংশ) এবং সেচ জমির ১/২০ (এক বিশমাংশ) ভিক্ষুক, প্রতিবন্দী ও বেকার সমস্যা সমাধানে বিশাল ভূমিকা রাখবে। কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দাবি করতে পারে না যে, উপার্জনের মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিক তার অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। এটি অনিবার্য যে, নানা কারণে বেশিরভাগ নাগরিক তাদের প্রয়োজনের কম উপার্জন করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি সমৃদ্ধ সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাদের উদ্ধার করবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন সভ্য সমাজ গড়ে উঠবে
না। মানব রচিত মতবাদে এ ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় বল প্রয়োগ হয়তো চাপিয়ে দেয়া যেতে পারে। তবে ইসলাম যাকাত ও উশরকে একটি অনন্য সুরক্ষা প্রকল্প হিসাবে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি স্তম্ভ বলে ঘোষণা করেছে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক নয়, বরং স্বয়ং মহান আল্লাহ প্রদত্ত একটি বাধ্যতামূলক ধর্মীয় কর (Tax) বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং এ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে এখানে যে সুপ্ত শক্তি রয়েছে অন্য কোন পদ্ধতি এর সমান হতে পারে না।
৬) দু’টি প্রশ্ন
আমি আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে দু’টি প্রশ্ন রাখতে চাই, যাতে তারা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে জাতিকে নির্দেশনা প্রদান করতে পারেন:
i) পুঁজিবাদ কি সামঞ্জস্যপূর্ণ ?
কিছু কমিউনিস্ট বিরোধীরা ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিতে পারেন। কিন্তু এটা তাদের বোধগম্য নয় যে বাংলাদেশ তা গ্রহণ করার অবস্থানে নেই । এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ইংল্যান্ড বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শোষণ করেছে এবং তাদেরকে দুর্দান্ত শিল্পোন্নত দেশ হিসাবে গড়ে তুলেছে। আর গত দুই বিশ্ব যুদ্ধে আমেরিকা অগাধ সম্পদ নিজেদের করতলগত করেছে। বাংলাদেশ কি সেই অর্থনৈতিক স্তর অধিকার করার মতো অবস্থানে আছে? যদি না হয় পুঁজিবাদের মতো করে আমাদের অর্থনৈতিক সমাধান খুঁজা বোকামী বৈ আর কিছু নয়।
ii) সমাজতন্ত্র কি একমাত্র বিকল্প ?
আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি এতটাই তীব্র যে, যারা সাম্যবাদকে অপছন্দ করেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ সমাজতান্ত্রিক সমাধানের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে হয়। এটি প্রমাণ করে যে প্রচুর পরিমানে বুদ্ধিজীবী সমাজতন্ত্রকেই একমাত্র সমাধান বলে বিবেচনা করেছিলো। সোভিয়েত রাশিয়া পতনের পর সমাজতন্ত্র আস্থা হারিয়েছে। তবে মনস্তাত্ত্বিকভাবে কিছু লোকের কাছে এটি এখনও আবেদন করতে পারে।
ঙ) একটি নিবিড় তুলনামূলক পর্যালোচনা
পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অধ্যয়নের পরে আমরা বাধ্য হয়েছি এমন একটি বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান করতে যা রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য অর্জনে আমাদের সহায়তা করতে পারে। আমরা দেখেছি যে পুঁজিবাদ প্রথমত মানুষকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছে আর সমাজতন্ত্র মানুষকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছে। তবে মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এ উভয় স্বাধীনতারই প্রয়োজন আছে। আমরা একটার জন্য অন্যটা ত্যাগ করতে পারি না। সুতরাং না পুঁজিবাদ, না সমাজতন্ত্র কোনটাই আমাদের মুক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও ইসলামের মধ্যে প্রধান পার্থক্য নিম্নরূপ:
পুঁজিবাদের অধীনে শোষণ ও বেসরকারিকরণ বৃদ্ধির এত সুযোগ রয়েছে যে, জাতীয় সম্পদ বিপজ্জনকভাবে কয়েকজনের কাছে কেন্দ্রীভূত হতে পারে। সমাজতন্ত্র সম্পদ সরকারের হাতে পুঞ্জীভূত করে এবং জনগণের কোন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকে না। পুঁজিবাদে জনগণ ব্যক্তি পুঁজিবাদীর করুনায় এবং সমাজতন্ত্রে জনগণ রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদীর করুনায় বেঁচে থাকে। ইসলাম ব্যক্তি ও গোষ্ঠিকে শর্ত সাপেক্ষে সম্পদের মালিকানা প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। পুঁজিবাদে জাতীয় সম্পদের মালিকানা থাকে একচেটিয়া কয়েকজনের হাতে আর সমাজতন্ত্রে থাকে সরকার অথবা দলের হাতে। তবে ইসলামে কোন ধরনের অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ব্যবস্থা একচেটিয়া সম্ভব নয়। সম্পদের মালিকানা জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিতরণ করা হয় এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি পুঁঞ্জিভূত করা ইসলামে একেবারে নিষিদ্ধ।
আমরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, বুদ্ধিজীবী ও সর্বশ্রেণির মানুষের কাছে এ বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করার এবং ইসলামী অর্থনীতি ও বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য বোঝার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা নিশ্চিত যে, তাঁরা যদি নিরপেক্ষ মন নিয়ে পরিপূর্ণ সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে ইসলামকে অধ্যয়ন করে তবে তাঁরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে, মানবজাতির উদ্ধার কেবল ইসলামী জীবন ব্যবস্থাতেই রয়েছে।
সমাপ্ত