তাইবেরিয়াসে সালাহউদ্দীন
ক্রুসেডের ৯০০ বছর পার হয়ে গেছে। ইউরোপ থেকে তৃতীয় ক্রুসেডারদের নতুন দল এসে ফিলিস্তিনে ক্রুসেডারদের শক্তি বৃদ্ধি করছে। ওদিকে সুলতান সালাহউদ্দীন খন্ড-বিখন্ড মুসলিম শক্তিহকে সংঘবদ্ধ করে তুলেছেন।
১১৮২-৮৩ সন। মিসর সহ সমগ্র এশিয়া-মাইনর ও তুর্কী অঞ্চল প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সুলতান সালাহউদ্দীনের পতাকাতলে আশ্রয়লাভ করল। অতঃপর এদিক থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে সুলতান এবার মনোযোগ দিলেন ক্রুসেডারদের দিকে। সমগ্র ফিলিস্তিন তখনও তাদের করতলগত। ফিলিস্তিনের প্রত্যেকটি শহরে হাজার হাজার মুসলিম বন্দী অকথ্য নির্যাতন ভোগ করছে। প্রায় ৮৪ বছর ধরে বাইতুল মুকাদ্দাসের মিনার শীর্ষ থেকে মুয়াযযিনের উচ্চকণ্ঠ শোনা যায়নি। জেরুসালেমের উমর মসজিদের অভ্যন্তরে খ্রষ্টানরা যে হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছিল, তার রক্তের দাগও হয়তো মুছে ফেলা হয়নি তখনও। সুলতামন সালাহউদ্দীন অধীর হয়ে উঠেছেন। একদিকে তাঁর এই অধীর চিত্ততা, অন্যদিকে খৃষ্টান ক্রুসেডারদের অত্যাচারও তাঁকে অতিষ্ঠ করে তুলল। শান্তির সময়েও মুসলিম বণিকদের কাফিলা বার বার লণ্ঠিত ও মুসলিম বণিকরা নিহত হচ্ছিল তাদের হাতে। ১১৮৬ সনেও খৃষ্টান অধিনায়ক রেজিনাল্ড অতীতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করল। ধৈর্যের বাঁধঘ ভেংগে গেল সুলতান সালাহ উদ্দীনের। ৯০ বছরের পুরাতন খৃষ্টান ক্রুসেডের বিরুদ্ধে সুলতান সালাহউদ্দীন জিহাদ ঘোষণা করলেন। সময়টা ছিল ১১৮৭ সনের মার্চ মাস। জিহাদ ঘোষণার পর সুলতান সালাহউদ্দীন আশতারায় শিবির সন্নিবেশ করলেন। সালাহ উদ্দীনের প্রাথমিক প্রধান লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনের সীমান্ত শহর তাইবেরিয়াস।
তাইবেরিয়াসের রাজা গেডি লূসিগনানানের নেতৃত্বে জেরার্ড, রেজিনাল্ড, হামফ্রে রিমন্ড, বিলিয়ান প্রমুখ বিখ্যাত ক্রুসেড অধিনায়করা সালাহ উদ্দীনের মুকাবিলার জন্য এগিয়ে এল। তাদের অধীনে ১২০০ নাইট সহ অর্থলক্ষ সৈন্য সমবেত হলো। সুলতান সালাহউদ্দীন ১২ হাজার ঘোড় সওয়ার ও অনুরূপ সংখ্যক পদাতিক সৈন্য নিয়ে তাইবেরিয়াস অভিমুখে যাত্র করলেন। সিত্তিনের দু‘মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে ফিলিস্তিনের লুবিয়া গ্রামের সন্নিকটবর্তী প্রান্তরে খৃষ্টান ও মুসলিম সৈন্য মুখোমুখি দাঁড়াল। সুলতান সালাহ উদ্দীন প্রথম বারের মত খৃষ্টান ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হলেণ। লুবিয়া প্রান্তরে ঘোরতর যুদ্ধ সংঘটিত হলো। ক্রুসেডার সেই যুদ্ধেঘ শোচনীয় পরাজয় বরণ করল। জেরার্ড, রেজিনাল্ড, হামফ্রে প্রমুখ অধিনায়ক সহ স্বয়ং রাজা ও তাঁর ভাই বন্দী হলেন। যুদ্ধে ৩০ হাজার খৃষ্টান সৈন্য মৃত্যুবরণ করল। ১১৮৭ সনের জুলাই মাসে সুলতান সালাহ উদ্দীন তাইবেরিয়াস পুনরুদ্ধার করলেন। প্রথম জিহাদ জীয় হয়ে সুলতান সালাহ উদ্দীন তাইবেরিয়অস নগরীতে প্রবেশ করলেন। কিন্তু তাঁর চোখে আজ খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে কোন ঘৃণা নেই। কিংবা নেই কোন প্রতিহিংসার আগুণ। ক্রুসেডাররা ১০৯৬ সনে তাদের প্রথম বড় রকমের সাফল্য অর্থাৎ এন্টিয়ক নগরী দখর করার পর যে মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিল তা থেকে এ মানসিকতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। যুদ্ধ নয়, বরং জনৈক মুসলিম নামধঘারী বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় এন্টিয়ক নগরী দখল করার পর আত্মসমর্পনকারী দশ হাজার মুসলিম নর-নারী ও শিশুকে তার হত্যা করেছিল। আর সুলতান সালাহউদ্দীন তাঁর প্রথম জিহাদে সাফল্য লাভ করার পর কোন খৃষ্টানের গায়ে আঁচড়ও লাগল না। অগণিত লুণ্ঠন ও হত্যাকান্ডের নায় রেজিনাল্ডকেই শুথু তার দু‘শ সাঙ্গ-পাঙ্গসহ প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হলো। আর এন্টিয়ক নগরীতে খৃষ্টানরা যেখানে শহীদ আমীরদের লাশ কবর থেকে তুলে মাথা কেটে বর্শায় গেঁথে এন্টিয়কের রাস্তায় বন্য নৃত্য করে বেড়িয়েছিল, সেখানে সুলতান সালাহ উদ্দীন তাইবেরিয়াসের খৃষ্টান রাজাকে হাতে ধরে নিরেজর কাছে বসিয়ে ঠান্ডা শরবত পান করিয়েছিলেন।
সালাহউদ্দীনের জানাযা
১১৯৩ সন। ২০শে ফেব্রুয়ারী। মক্কা মুয়াজ্জমা থেকে হাজীরা দেশে ফিরছেন। সুলতান সালাহ উদ্দীন হাজদের কাফিলাকে আগ বাড়াতে গেলেন। গরম কাপড় না পরে ভিজা আবহাওয়অয় হাঁটাহাঁটি করে তাঁর জ্বর হলো। জ্বর থেকে আর উঠলেন না তিনি। ১১৯৩ সনের ৪ঠা মার্চ সারা মুসলিম জাহানকে কাঁদিয়ে সুলতান সালাহউদ্দীন ইন্তিকাল করলেন।
ইসলামরে সোনাল ইতিহাসের এক অনন্য নায়ক সুলতান সালাহউদ্দীন। ১১৮৭ সনে খৃষ্টান ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা ও বাইতুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধার করার পর দীর্ঘ পাঁচ বছর রণাঙ্গনেই কাটাতে হয়েছে তাঁকে। জেরুসালেম হাতছাড়া হওয়ার সংবাদে গোটা খৃষ্টান ইউরোপ ক্রোধে ফুলে উঠেছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, ডেনমার্ক, ইতালী প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশ থেকে ১১৯৮ সনে ছয় লক্ষ খৃষ্টান সৈন্য ছুটে এসেছিল ফিলিস্তিনে। তারা সাথে করে নিয়ে এসেছিল গোটা ইউরোপবাসীর আয়ের এক-দশমাংশ। দীর্য় তিন বছর ধরে সুলতান সালাহউদ্দীন যুদ্ধ করলেন উম্মত্ত ক্রুসেডারদের সাথে। কিন্তু সমগ্র ইউরোপের সমবেত শক্তিও সালাহউদ্দীনের সাথে এঁটে উঠতে পারেনি। ব্যর্থ হলো তাদের তৃতীয় ক্রুসেডও। প্রায় ৪ লক্ষ থেকে ৫লক্ষ ইউরোপীয়কে ভূমধ্যসাগরের বালুবেলায় চিরতরে শুইয়ে রেছে ক্রুসেডাররা ফিরে গেল দেশে। ফিলিস্তিনসহ গোটা নিকট প্রাচ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে থাকলেন সুলতান সালাহউদ্দীন। সুলতান সালাহ উদ্দীন সমগ্র ইউরোপে কি অপরিসীম ভীতির সৃষ্টি করেছিলেন, সালাহ উদ্দীনকে পরাভূত করার জন্য গোটা ইউরোপ থেকে তোলা ‘সালাহউদ্দীন কর’ই তার প্রমাণ। ইউরোপের ভীতি ও এক বিশাল রাজ্যের একচ্ছত্র অধিনায়ক সেই সুলতান সালাহউদ্দীন ইন্তিকাল করলেন। আল্লাহর পথে জিহাদের আত্মোৎসর্গিত এই সুলতান যখন মৃত্যুবরণ করলেন, তখন কপর্দকহীন ছিলেন তিনি। তিনি ইউরোপত্রাস প্রবল প্রতাপশালী সুলতান ছিলেন, কিন্তু তাঁর কোন সিংহাসন ছিলনা, ছিল না বিলাস ব্যসনের কোন রাজ প্রাসাদ। রাজ্যের সাধারণ রাজকোষ ছিল, কিন্তু তাঁর নিজস্ব কোন তহবিলের অস্তিত্ব ছিল না। নিজের জীবন, সম্পদ সব কিছুকেই তিনি উজার করে দিয়েছিলেন জিহাদে। তিনি যদি চাইতেন, যে শক্তি তাঁর ছিল তা দিয়ে তিনি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি চাননি। তিনি চেয়েছিলেন িইসলামের বিজয়, নিজের জন্য কোন রাজ্য প্রতিষ্ঠা নয়। এ পথেই তিনি তাঁর সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিলেন। তাঁর যেদিন মৃত্যু হলো, সে দিন জানাযার খরচ সংকুলানের অর্থও তাঁর কাছে পাওয়া যায়নি। ধরা করা অর্থে তাঁর জানাযার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল।
‘ফাঁসিই দিন আর যাই করুন যা সত্য তা বলবই’
সুলতান আলাউদ্দিন খালজী তাঁর প্রধান কাজী (প্রধান বিচারপতি)- কে আহবান করলেন দরবারে। কাজী দরবারে এলেন। সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, “দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের বিকলাংগ করে শাস্তি দেয়া যায় কিনা।” কাজী রায় দিলেন, “এরূপ শাস্তি ইসলাম বিরুদ্ধ।” এই উত্তরে সুলতান মনক্ষুন্ন হলেন। তিনি আবার জানতে চাইলেন, “দেবগিরি থেকে আমি যে ধনসম্পদ লাভ করেছি, তা আমার না জন সাধারণের পাপ্য?” নির্ভীক কাজী উত্তর দিলেন, “ইসলামের সৈন্যবল দিয়ে তা অধিকৃত হয়েছে, সে সম্পদ আপনার হতে পারে না। জনসাধারণের কোষাগারে তা অবিলম্বে জমা দেয়া উচিত।”
সুলতান এবা আর ক্রোধ রাখতে পারলেন না। ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত জণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “জনসাধারণের কোষাগারে আমার ও আমার পুত্র-পরিজনদের অধিকার বা অংশ কতটুকু?”
অবিচল কণ্ঠে কাজী উত্তর দিলেন, “ একজন সৈনিকের যতটুকু ততটুকু অংশ আপনার ও আপনার পুত্রের প্রাপ্য। আপনার খেয়অল খশীমত অর্থ যদি আপনি জনসাধারণের কোষাগার থেকে ব্যয় করেন, তাহলে এর জন্য মহা বিচারের দিন আপনাকে আল্লাহর কাছে জবাব দিহি করতে হবে।”
কাজীর কথায় সুলতহান ভীষণ রেগে গেলেন। চরম শাস্তি দেবেন বলে সুলতাম তাঁকে শাসালেন।
অকম্পিত কণ্ঠে কাজী বললেন, “ফাঁসিই দিন আর যাই করুন, যা সত্য তা বলবই।” উপস্থিত সকলেই কাজীর ভবষ্যত ভেবে শংকিত হয়ে পড়ল।
পরদিন কাজী দরবারে হাজির হলেন। সুলতান কাজীকে সসম্মানে গ্রহণ করলেন দরবারে। বহু মূল্যবান উপঢৌকন দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করলেন। নির্মম হলেও আলাউদ্দিন খালজীর সত্যগ্রহণ করার সাহস ছিল। তাঁর বাহুবলেল সাথে এই সত্য-প্রীতি যুক্ত ছিল বলেই তাঁর একচ্ছত্র প্রভাব সিন্ধু নদ থেকে রামেশ্বরমের সেতু পর্যন্ত ছাড়িয়ে পড়েছিল।
গিয়াসুদ্দীন বলবনের ন্যায়পরায়নতা
গিয়াস উদ্দীন বলবনের বিশাল সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমানা-বাদায়ুন প্রদেশ। পাহাড় আর মালভূমির দেশ বাদায়ুন। পাহাড়ের মাঝে মাঝে সুনীল উপত্যকা। পাহাড় থেকে নেমে আসা সফেদ ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছে সবুজ উপত্যকার বুক চিরে। এই বাদায়ুনের শাসনকর্তা মালিক ফয়েজ। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবরেনর পক্ষ থেকে শাসন করছেন তিনি বাদায়ুন। শান্তি ও সমৃদ্ধি তাকে ঠেলে দিল বিলাসিতার দিকে। মদ্যপ হয়ে উঠলেন তিনি। মদ তাঁকে নিয়ে গেল জঘন্য মানুষের রক্তে লাল হয়ে উঠল। মালিক ফয়েরেজই একজন খেদমতগার দাস, একদিন মাতাল অবস্থায় তাকে খুন করলেন মালিক ফয়েজ। বাদায়ুনের অনেক কণ্ঠই প্রতিবাদে সোচ্চার হতে চাইল, কিন্তু মদ্যপের কাছে কোন সুবিচার আশঅ নেই জেনে সবাই ধৈর্য ধারণ করল। ঠিক এই সময়েই গিয়াস উদ্দিন বলবন এলেন বাদায়নে। সাড়ম্বর সম্বর্ধনার আয়োজন করে মালিক ফয়েক আগু বাড়িয়ে নিয়ে এলেন সুলতানকে। গিয়াস উদ্দিন বলবন তাঁর প্রিয় শাসনকর্তার কুশলবার্তা জেনে এবং তাঁকে খুশহাল দেখে খুবই খুশী হলেন। পরদিন আম দরবারে বসলেন গিয়াসউদ্দিন বলবন। নাগরিকদের সাথে তিনি দেখা করবেন, তাদের কথা বার্তা শুনবেন। দরবারের এক পর্যায়ে এক বোরখাবৃতা মহিলা এসে সুলতানের সামনে দাঁড়াল। সে অভিযোগ করল, “তার নির্দোষ স্বামীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন শাসনকর্তা মালিক ফয়েজ।” মহিলাটির অভিযোগ শেষ হলে গিয়াসউদ্দিন বলবন মুহূর্তকাল চুপ করে থাকলেন। তারপর মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন পাশেই বসা মালিক ফয়েজের দিকে। মুখে সুলতানের কথা নেই। কিন্তু চোখে তাঁর একরাশ প্রশ্ন। সে দৃষ্টির সামনে মালিক ফয়েজ বস থাকতে পারলেন না। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন। সুলতানের অন্তর্ভেদী চোখের একরাশ প্রশ্নের কোন জবাব মালিক ফয়েজের মুখে জোগালোনা। কিন্তু তাঁর চোখে মুখেই ফুটে উঠল পাপের কালিমা রেখা। সুলতান মুখ ঘোরালেন এবার ফরিয়াদী মহিলাটির দিকে। বললেন, “যাও মা, আল্লাহর আইনে কাজীর আদালতেই এর বিচার হবে। আমি তোমার পক্ষে বাদী হয়ে দাঁড়াব।”
কাজীর আদালতে বাদায়ুনের শাসনকর্তা মালিক ফয়েজের বিচার হলো। হলো প্রাণদন্ডাদেশ- কঠিন প্রহারে জর্জরিত করে তাঁকে মেরে ফেলার হুকুম হলো। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সে নির্দেশ কার্যকর করালেন। তারপর অত্যাচারী সেই শাসকের মৃতদেহ টাঙ্গিয়ে রাখলেন শহরের বুলন্দ দরওয়াজায়।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের আর একটি বিচার। অযোধ্যায় শাসনকর্তা হয়বত খান হত্যা করেছেন তাঁর দাসকে। নিহত দাসের বিধবা স্ত্রী ফরিয়াদ জানালো সুলতানের কাছে। সুলতান শাসনকর্তাকে পাঁচশ বেত্রাঘাতের নির্দেশ দিলেন এবং তাঁকে নিহত দাসের বিধবা মহিলার দাসত্বে নিয়োজিত করলেন। পরে হাজার টাকার মুক্তিপণ দিয়ে হয়বত খান সেই বিধবা মহিলার কাছ থেকে বহুকষ্টে মুক্তি ভিক্ষা করে নেন।
নামায যুদ্ধ থামিয়ে দিল
আফগানিস্তানের উত্তর পশ্চিমে এক পর্বতময় মালভূমি। তদানীন্তন বলখ ও বাদাখশান রাজ্যের সীমান্ত সন্নিহিত একটি স্থান। ভীষণ যুদ্ধ চলছে দুই দলে। বহু যুদ্ধের মত এটিও ভাইয়ে ভাইয়ে মুসলমানে মুসলমানে আত্মঘাতী এক লড়াই। যুদ্ধমান দু‘পক্ষের এক পক্ষে রয়েছে মোগল বাহিনী, অন্যপক্ষে রয়েছে বলখের সুলতান আযীয খানের সৈন্যদল। মোগল বাহিনীকে পাঠিয়েছেন দিল্লীর সম্রাট শাহাজান তাঁর পিতৃভূমি বলখ-বুখারা-বাদাখশান পুনুদ্ধার করতে। অপর পক্ষে বলখের সুলতান রক্ষা করতে এসেছেন তাঁর রাজ্য। উভয় পক্ষেই কাজ করছে ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠি স্বার্থ, জাতীয় স্বার্থ চিন্তার কোন চিহ্ন কোথাও নেই।
মোগল বাহিনীর পরিচালনা করছেন শাহজাদা আওরঙ্গজেব। আর বলখের সুলতান স্বয়ং তাঁর বাহিনী পরিচালনা করছেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে।
ভীষণ যুদ্ধ চলছে। ধীরে ধীরে সূর্য তার আকাশ পরিক্রমায় উঠে এল মধ্য গগনে। মধ্য গগন থেকে সূর্য একটু হেলে পড়ল পশ্চিমে। সেনাপতি শাহজাদা আওরঙ্গজেব মাথা তুলে একবার সূর্যে দিকে চাইলেন। তাঁর চেহারায় পরিবর্তন ঘটল। তিনি হাতের বর্শা ছুড়ে দিলেন মাটিতে। ঘোড়া থেকে নামলেন। কমরবন্ধ খুলে রেখে দিলেন মাটিতে। তার পর জায়নামায বিছিয়েঢ পশ্চিমমুখী হয়ে নামায শুরু করলেন। যুদ্ধ তখন অবিরাম চলছে। বৃষ্টির মত ছুটে আসছে তীর বর্শা। যোদ্ধাদের হুংকার, আহতের আহাজারি, অশ্বের হ্রের্ষা রব এক ভয়াবহ পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। কোন দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, জায়নামাযের উপর চোখ দুটি তাঁর যেন আটকে আছে, অখন্ড মনোযোগে নামায আদায় করছেন শাহজাদা। আরঙ্গজেব। শত্রুদের পুরোপুরি দৃষ্টির মধ্যে রয়েছেন তিনি। যে কোন সময় তীর বর্শা ছুটেচ এসে তাঁকে বিদ্ধ করতে পারে কিংবা স্বশরীরে শত্রু তাঁর উপর এসে চড়াও হতে পারে। কিন্তু শাহজাদা আওরঙ্গজেবের সমগ্র চেহারায় এজন্য কোন প্রকার চিত্ত-চাঞ্চল্যের লেশ মাত্র নেই। মনে হচ্ছে তিনি যেন কোন এক বিরল উপত্যকার নীরব নিঝুম পরিবেশে গভীর প্রশান্তিতে নামায আদায় করছেন।
এই অপরূপ অদৃশ্য অশ্বে সমাসীন সুলতান আব্দুল আযীয খান দেখতে পেলেন। তাঁর দৃষ্টি যেন আটকে গেল মহাপ্রভুর সামনে বিনীতভাবে দন্ডয়মান শাহজাদা আওরঙ্গজেবের উপর। হৃদয়টি তাঁর মোচড় দিয়ে উঠলো। শিউরে উঠলো তাঁর গোটাদেহ। কার বিরুদ্ধে, কোন মহান ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন তিনি। সুলতান আবদুল আযীয খান চীৎকার করে উঠলেন, “যুদ্ধ অসম্ভব—-যুদ্ধ থামাও —–থামাও যুদ্ধ।”
যুদ্ধ বন্ধ হলো। ব্যক্তি স্বার্থ পেছনে পড়ে গেল, জয়ী হলো জাতীয় স্বার্থ, ভ্রাতৃ সম্পর্ক। ইসলাম যেন মূর্তিমান রূপ নিয়ে এসে দু‘ভায়ের রক্তপাত বন্ধ করলো। প্রমাণ হলো একমাত্র ইসলামই ভাইয়ে ভাইয়ে আপোষ ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হতে পারে।
তাইমুরের দরবারে হামিদা বানু
১৩৮০ সন। তাইমুর লংয়েল দুর্ধর্ষ তাতার বাহিনী ধ্বংসের বিষান বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে সামনে। তুর্কী সুলতান বায়েজিদ সে তাতার বাহিনীর ঘূর্ণিঝড়কে সিংহ বিক্রমে বাধা দান করলেন। তুরষ্কের রণক্ষেত্রে রক্তের নদী বইল। কিন্তু সুলতান অবশেষে পরাজয় বরণ করলেন। অনেক তুর্কী সৈন্য ও সেনানায়ক বন্দী হল। নিষ্ঠুর তাইমুর তাদের নির্বিচারে প্রাণহন্ড দিতে লাগলেন। একজন তরুন সেনানী রূখে দাঁড়াল এই অবিচারের বিরুদ্ধে। সে তাইমুরের সাক্ষাত প্রার্থনা করল। শিকলে বেঁধে সে বন্দীকে তাইমুর সমীপে আনা হল। বিশ্বজয়ী তাইমুরের সামনে গর্বোন্নত শিরে দাঁড়িয়ে সে তরুন সৈনিক বলল, “সম্রাট তাইমুর, আপনি অন্যায়ভাবে সুলতান বায়েজিদকে আক্রমণ করে হাজার হাজার আল্লাহর বান্দাকে হত্যা করেছেন, মুসলমানা হয়ে আপনি ইসলামের অনুগত সেবকদের হত্যা করছেন। বিশ্ব জয়ের অন্যায় ও গর্বিত দাবির জন্যেই শুধু এসব অন্যায় ও গর্হিত কাজ করছেন। কিন্তু মনে রাখবেন আপনাকেও একদিন সকল রাজার রাজা আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে, তখন এসব কাজের কি জওয়াবদিহি আপনি করবেন?”
তরুণ সৈনিকের এ কথা শুনে বিমূঢ় গোটা দরবার। এভাবে পৃথিবীর কেউ যে তাইমুরের সামনে কথা বলতে পারে, আল্লাহর রাজ্যে যে এমন লোকও আছে, দরবার আজই যেন তা বুঝল, বুঝে সন্ত্রস্ত হলো। ভাবল তারা, না জানি এই তরুণের ভাগ্যে কি উৎপীড়ণ আছে।
তরুণ বন্দী মুহূর্তের জন্য একটু থেমেছিল। তারপর মন্ত্রমুগ্ধ দরবারের সামনে এক ঝটকায় মাথার শিরস্ত্রাণ খুলে ফেলল। একরাশ সুন্দর কেশগুচ্ছ প্রকাশ হয়ে পড়ল- সুন্দর মসৃন একরাশ নারীকেশ। বিশ্ব জয়ী তাইমুরও এবার বিস্মিত। বন্দিনী আবার বলতে লাগল, “চেয়ে দেখুন, আমি একজন অন্তঃপুরবাসিনী নারী। বতু অন্যায়-অবিচারের প্রতিরোধের জন্য অস্ত্র হাতে ধরতে হয়েছে, রক্তের নদীতে সাঁতার কাটতে হয়ে। আপনি আপাততঃ জয়ী হয়েছেন, কিন্তু মনে রাখবেন, যে জাতি এ ধরণের মানসিকতায় উজ্জীবিত, তাকে পদানত রাখা যায় না, ধ্বংস করা যায় না।”
বিশ্বজয়ী তাইমুরের শির নুইয়ে পড়ল। তিনি মুক্তি দিলেন বায়েজিদ তনয়া হামিদা বানুকে। হামিদা বানুর অনলবর্ষী উক্তি এবং তাঁর সাথে তাইমুরের পরিচয় তাইমুরের জীবনে আনল অভূতপূর্ব পরিবর্তন। ধ্বংসের হাত তাঁর জাতি গড়ার কাজে ব্রতী হলো।
উরুজ বার্বারোসার বীরত্ব
১৫১৭ সাল। স্পেনে মুসলমানদের শেষ আশ্রয়স্থল। গ্রানাডার পতনের (১৪৯২) ২৫ বছর পরের ঘটনা। গোটা স্পেন খৃস্টানদের পদানত। সম্রাট পঞ্চম চার্লস এবং তার পুত্র ফিলিপের লোমহর্ষক অত্যাচারে লক্ষ লক্ষ মুসলমান ধর্মান্তরিত অথবা স্পেন থেকে বিতাড়িত। উত্তর আফ্রিকার মুসলিম শক্তিও বিধ্বস্ত। সেখানেও চলছে স্পেন রাজের হুকুম। আলজিয়ার্স সহ উপকূলীয় মুসলিম বন্দরগুলোতে মেরামতের অভাবে মুসলিম রণপতগুলো পচে খসেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্পেনের বিতাড়িত মুর মুসলমানরা বাঁচার প্রাণান্তরকর সংগ্রামে রত। ভূমধ্য সাগরের যাযাবর সেনাতি উরুজ বারবারোসা তাদেরই একজন। ঐতিহাসিক মরণগান তাকেঁ অভিহিত করেছেন সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাধ্যক্ষ হিসাবে। খৃস্টান ইউরোপ তাকেঁ বলেছে ভূমধ্যস সাগরের বোম্টেটে জলদস্যু। আর ঐতিহাসিক লেনপুন বলেছেন আত্মীয় স্বজন ও স্বজাতির পৈশাচিক হত্যালীলার প্রতিশোধ নেবার জন্য খৃস্টানদের বিরুদ্ধে তিনি এক পবিত্র যুদ্ধে রত।
সেই ১৫১৭ সাল। উরুজ বার্বারোসা তখন আলজিরিয়ার তিলিসমানে অবস্থান করছেন। সাথে মাত্র ১৫০০ তুর্কী ও মূর সৈন্য। পার্শ্ববর্তী ওরানের খৃস্টান শাসনকর্তা মার্কোয়েস ডি কোমারেসের আকুল আবেদনে স্পেন সম্রাট পঞ্চম চার্লসের প্রেরিত সৈন্য উরুজের বিরুদ্ধে ছুটে আসছে। চেষ্টা করেও সাহায্যেল কোন উৎস তিনি কোথাও থেকে বের করতে পারলেন না। সামনে রয়েছে ডি কোমারেসের বিরাট বাহিনী। অগ্রসর হওয়া যায়না। সুতরাং পিছু হটে আলজির্য়াস ফেরাই যুক্তিযুক্ত মনে করলেন উরুজ। শত্রুপক্ষের চোখ এড়াবার জন্য একদিন রাত্রিযোগে তিনি আলজির্য়াস যাত্রা করলেন। কিন্তু তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হলো। কোমারেসের নেতৃত্বে সম্মিলিত শত্রু বাহিনী ছুটে এল। উরুজের চলার পথে সামনেই রয়েছে এক নদী। উরুজ নিশ্চিত, একবার নদী পার হতে পারলেই শত্রুপক্ষ আর তাঁদের নাগাল পাবে না। লোভী স্পেনীয়দের যাতে বিলম্ব হয় সেজন্য উরুজ তাঁর স্বর্ণ ও অর্থ সম্পদ রাস্তাময় ছড়িয়ে আসতে লাগলেন। কিন্তু খৃস্টান বাহিনী এবার দুর্জয়, অপ্রতিরোধ্য উরুজকে হাতে পাবার নেশায় পাগল হয়ে উঠেছে। তারা মণিমানিক্য পদদলিত করে ছুটে চলে এল উরুজের পেছনে। উরুজ তাঁর অর্ধেক সৈন্য সহ নদী পার হয়েছেন। ইতোমধ্যে খৃস্টান বহিনী এস পড়ল নদীর তীরে। নদীর ওপারে উরুজের অবশিষ্ট সৈন্য আক্রান্ত হলো। উরুজ ফিরে দাঁড়ালেন। নদীর এপার থেকে নদীর ওপারে নিজ সাথীদের আক্রান্ত হবার দৃশ্য দেখলেন। ইচ্ছা করলে উরুজ তাঁর অর্ধেক সৈন্য নিয়ে নিরাপদে আলজির্য়াস ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। তিনি এপারের হাতে সাথীদের বললেন, আমার একটি মুসলিম ভাইকেও খৃস্টানদের হাতে রেখে আমি ফিরে যেতে পারি না। এই বলে আবার তিনি লাফিয়ে পড়লেন নদীতে। তাঁকে অনুসরণ করল তাঁর প্রতিটি সৈনিকই। ওপারে উঠে তিনি তার ক্ষুদ্র বাহিনী সংগঠিত করে শত্রুসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। উরুজের প্রতিটি সৈনিক শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শত্রু হনন করে শাহাদাত বরণ করলেন। ইতিহাস বলে, একটি মুসলিম সৈনিকও সেদিন যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়নি। সিংহের মত যুদ্ধ করে উরুজ তাঁর ১৫০০ সাথী সমেত যুদ্ধ ক্ষেত্রে শাহাদাত বরণ করলেন। একটি যুদ্ধে একটি গোটা বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর সমগ্র ইতিহাসে আর নেই।
দান কমাতে গিয়ে বাড়ল
বাংলাদেশে তখন সুলতানী শাসন। সুলতান ফিরোজ শাহ বাংলার সিংহাসনে। হযরত বিলালের দেশ আবিসিনিয়ার অধিবাসী তিনি। কৃষ্ণাংগ ফিরোজ শাহ সামান্য অবস্থা থেকে সুলহতান পদে অধিষ্ঠিত হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
সুলতান ফিরোজ শাহ ক্ষমতার উচ্চ শিখরে উঠেও দৃষ্টি তার উর্ধমুখী হলো না, নীচের দিকে জনসাধারণের দিকেই নিবদ্ধ থাকলো। ভুললেন না তিনি জনসাধারণের কথা- গরীবদেরকথা। তিনি অকাতরে রাজকোষ থেকে গরীব জনগণকে অর্থ দান করতে লাগলেন। অভাবীর সংখ্যা বিপুল, প্রয়োজন তাদের বিরাট। তাই রাজকোষ থেকে অর্থ খরচ হতেও লাগল পানির মতো। রাজ দরবারের আমীর-উমরারা মহাবিপদে পড়ল-প্রমাদ গুণল তারা। ভাবল সুলতানের এ কী অমিতাচার! এভাবে দান করতে থাকলে তো রাজকোষ শূন্য হয়ে যাবে। আমীর উমরারা চিন্তা করলো, সুলতান নিজের হাতে অর্থ সাহায্য দেন না, তাই হয়তো অর্থের মায়া তাঁর কাছে বড় হয় না। দিনে যে অর্থ দান করা হয় তা যদি তিনি এক সংগে দেখতে পেতেন, তাহলে এত অর্থ কিছুতেই তিনি দিতে রাজী হতেন না। সামান্য অবস্থা থেকে তিনি এত বড় হয়েছেন, অর্থের মর্যাদা তাঁর চেয়ে আর বেশী কে বুঝবে। সুতরাং মন্ত্রণা পরিষদ পরামর্শ করে ঠিক করল, দানের অর্থ এনে সুলাতেন সামনে হাজির করতে হবে। পরামর্শ অনুসারেই কাজ হলো। পরদিন দানের জন্য নির্দিষ্ট একলক্ষ কাঁচা রোপ্য মুদ্রা এনে স্তূপীকৃত করে একজন মন্ত্রী অতি বিনয় সহকারে বললেন, “এ টাকাগুলোই আজ গরীব ও সাহায্যপ্রার্থীদের মধ্যে বিতরণের জন্য দিয়েছিলেন।” সুলতান ফিরোজ শাহ সে টাকার দিকে চেয়ে বললেন, “ও আচ্ছা, এ চাকাও তো যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। এর সাথে আরও এক লক্ষ টাকা যোগ করে গরীব দুঃখীদের মঝে বিলিয়ে দাও।” হতবাক মন্ত্রী আর কিছু বলতে পারলো না, বলতে সাহস পেলোনা। সুলতানের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হলো। সেদিন দান করা হলো দু‘লক্ষ রৌপৗ মুদ্রা।
ইতিহাসে ব্যক্তিগত ও বংশীয় রাজসিংহাসনে খোদাভীরু শাসকের আগমনে মাঝে মধ্যে এভাবে রাজকোষ জনসাধারণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে।
— সমাপ্ত —