সংগঠনের সাথে সম্পর্ক
কোন দলের সাংগঠনিক ব্যবস্থা যদি ঢিলে থাকে এবং এ অবস্থায় সে কোন বিরাট অভিযানে অংশগ্রহণ করে তাহলে তার অবস্থা হয় ঠিক এমন একটি মোটর গাড়ীর ন্যায়, যার কলকব্জাগুলো ভালোভাবে আঁটা হয়নি, অথচ ড্রাইভার এ গাড়ী নিয়ে পার্বত্য পথ অতিক্রম করার জন্য বের হয় এবং পদে পদে অসুবিধার সম্মুখীন হয় এমনকি গাড়ীর মেশিন একেবারে অচল হয়ে পড়ে।
সংগঠন প্রত্যেক দলের একটি স্বাভাবিক প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের নিকট তা কেবল একটি স্বাভাবিক প্রয়োজনই নয় বরং আমাদের দ্বীনদারী, নৈতিকতা, আল্লাহর ইবাদত ও রাসূলের আনুগত্যেরই মূর্তপ্রকাশ। সাংগঠনিক দুর্বলতা কাজের পথে নানান অসুবিধার সৃষ্টি করে। তাই বিভিন্ন দল এই দুর্বলতা দূর করার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা মনে করি যে, এটা আমাদের পরকালীন ক্ষতির কারণ হবে। এ উদ্দেশ্যে আমরা একে হামেশা পরিত্যাজ্য মনে করি। তাই সংগঠন শৃংঙ্খলাকে মজবুত করা এবং প্রত্যেক সহযোগীকে এর প্রহরায় নিযুক্ত হওয়া নিজের দায়িত্ব মনে করা অপরিহার্য। সংগঠন সম্পর্কে এখানে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করছিঃ-
১. আদেশ ও আনুগত্যের ভারসাম্য সংগঠনের মেরুদণ্ড। এ ভারসাম্য ছাড়া আদতে সংগঠনের অস্তিত্বই অর্থহীন। এ জন্যই এ আদেশ ও আনুগত্যের ভারসাম্য নষ্ট করা গুনাহ করার শামিল। অর্থাৎ এটা হচ্ছে আল্লাহ ও রাসুলের (স) নাফরমানী। এ অপরাধ অনুষ্ঠানের পর মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতে সাফল্য লাভ করতে পারে না।
কুরআনের দাবী হচ্ছে-
اَطـِعُـوا اَللهَ وَاَطـِعـُوا الـرَسـُولَ وَ اُولِـى الاَمـرِ مَنكَـم-
অর্থাৎ “আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসুলের আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বশীলদের।” (সূরা নিসা, আয়াতঃ৫৮)
মনে রাখবেন এ তিনটি আনুগত্য হচ্ছে ওয়াজিব। এর মধ্য থেকে কোন একটির আনুগত্য পরিহার করলে মুসলমান ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
রাসূলুল্লাহ (সা) নিজেই বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করে, সে আল্লাহর আনুগত্য করে এবং যে আমার নাফরমানী করে, সে আল্লাহর নাফরমানী করে। আর যে আমার (অর্থাৎ রাসূলের নিযুক্ত অথবা তাঁর আনুগত্যকারী) আমীরের আনুগত্য করে, সে আমার আনুগত্য করে এবং যে আমার আমীরের নাফরমানী করে, সে আমার নাফরমানী করে।”
হযরত আবু হুরায়রার (রাঃ) একটি বাণী এ কথাটিকে আরো সুস্পষ্ট করে। তিনি বলেছেনঃ
“এ কথা সন্দেহাতীত সত্য যে নেতৃবৃন্দের আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্য এবং তাদের নাফরমানী আল্লাহর নাফরমানীর নামান্তর।”
এই প্রসঙ্গে হাদীসের পুস্তকসমূহে চূড়ান্ত নির্দেশসম্বলিত অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এই হাদীসগুলোর বক্তব্য হচ্ছে এই যে, ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের জন্য ইসলামী আইন ও সংবিধানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের যে সকল লোককে ইসলামী নেতৃত্বের বিশিষ্ট গুণাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত মানের ইলম ও তাকওয়ার অধিকারী হবার কারণে নেতৃত্বের পদে নির্বাচন করা হয়, সৎকর্মসমূহে তাঁদের আনুগত্য করা শরীয়তের অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ও ওয়াজিবসমূহের অর্ন্তভূক্ত।
এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা) দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষনা করেছেন যে, নাককাটা হাবশীকেও যদি নেতৃত্বের পদে সমাসীন করা হয়, তাহলে তার চেহারা-সুরত, তার বংশ গোত্রগত মর্যাদা, তার আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, তার রুচি, অনুভূতি ও আবেগ যতই পৃথক ও বিশিষ্ট হোক না কেন এবং এজন্য তা কোন ব্যক্তির নিকট চরম অপ্রিয় হলেও তাঁর পূর্ণ আনুগত্য অপরিহার্য।
রাসূলুল্লাহ (সা) একথাও বলেছেন যে,
আমীরের এই আনুগত্যের এই দাবীকে যারা অস্বীকার করবে, তারা বিপুল তাকওয়ার অধিকারী হলেও আখেরাতে তাদের সাফল্যের কোন সম্ভবনা নেই।
তিনি বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে কেয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে, যখন (নিজেকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার জন্য) তার নিকট কোন দলিল প্রমাণ থাকবে না।”
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে এ কথা আন্দাজ করা যেতে পারে যে, ইসলামী দল ও সংগঠনের পরিচালক ও নেতৃবৃন্দ সাধারণ দুনিয়াপরস্ত রাজনৈতিক দলসমূহের সভাপতি, সহ-সভাপতি ও তাঁদের উপদেষ্টাগণের সমপর্যায়ভুক্ত নন। বরং এখানে পরিচালকবৃন্দ ও কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্যগন একটি বিশেষ দ্বীনি শরীয়তভিত্তিক মর্যাদার অধিকারী হন। তাঁদের অধিকার ও কর্তব্যসমূহও সাময়িক সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে নয় বরং দ্বীন ও শরিয়তের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। এ কারনে তাঁদের আনুগত্যের ব্যাপারটি ঠিক সাধারন রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃবৃন্দের আনুগত্যের সমপর্যায়ভুক্ত নয়।
যতক্ষণ নেতৃবৃন্দ কুরআন ও সুন্নাহর পথ থেকে প্রকাশ্যভাবে সরে না দাঁড়ান ততক্ষণ তাঁদের নির্দেশ লংঘন করা অথবা সানন্দে ও সাগ্রহে তাঁদের আনুগত্য করার পরিবর্তে অসন্তুষ্ট চিত্তে আনুগত্য করা, অথবা তাঁদের কল্যাণ কামনা করার পরিবর্তে তাঁদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ করা, তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা, তাঁদের গীবত করা, তাঁদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সৃষ্টি করা, তাঁদেরকে যথার্থ অবস্থা ও ঘটনাবলী সম্পর্কে অবগত না করা, সঠিক পথে চলার জন্য নির্ভুল পরামর্শ দানের ব্যাপারে কার্পণ্য করা এবং তাঁদের গোপন কথাসমূহ প্রকাশ করে বেড়ানো কবীরা গুনাহর অর্ন্তভুক্ত হবে। এগুলো এমন পর্যায়ের কবীরা গুনাহ যে, এগুলোর কারণে ইবাদত-বন্দেগী অনুষ্ঠান ও সাধারণ চরিত্র সংশোধন সত্ত্বেও মানুষের আখেরাত বিনষ্ট হতে পারে। এই ভয়াবহ অবস্থা মানুষকে মুনাফেকীর পর্যায়ে নামিয়ে দিতে পারে। তাই ইসলামী দল ও সংগঠনের মধ্যে অবস্থানকারীদের আনুগত্যের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে।
২. ইসলাম অবশ্য কখনো অন্ধ আনুগত্যের দাবী করে নি। বরং সে কেবল ‘সৎকর্মের’ ক্ষেত্রে আনুগত্য চেয়েছে। ‘সৎকর্মের’ সীমার বাইরে তার নির্দেশ হচ্ছেঃ
وَلاَ تَعـاَوَنـُوا عَـلَـىَ الاِثـمِ وَالـعُـدوَانِ-
“গুনাহ ও আল্লাহ নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘনমূলক কাজে পরস্পরের সহযোগী হয়ো না।” (সূরা মায়েদা, আয়াতঃ ২)
ইসলামী দল ও সংগঠনের আভ্যন্তরীন তাগিদেই তার সদস্যবৃন্দকে দলীয় কার্যাবলীর প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। এবং দলের পরিচালকগণকে সৎকর্মের সীমার বাইরে কদম রাখা থেকে বিরত রাখতে হবে।
এ সম্পর্কে হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেনঃ
“বন্ধুগণ! তোমাদের কেউ যদি আমার নীতি বা কাজে বক্র দেখে তাহলে আমার এই বক্রতাকে সোজা করে দেয়া তার কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে।“
এই প্রসঙ্গে কোন খুঁটিনাটি ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দিলে, তা দূর করার জন্য তাকে পেশ করার, সে সম্পর্কে আলোচনা করার এবং সন্তোষজনক প্রত্যুত্তর না পেলে তার উপর অবিচল থাকার শরীয়তভিত্তিক অধিকারও দলের সদস্যবর্গের আছে। কিন্তু পরিচালকবৃন্দের পক্ষ থেকে যে সিদ্ধান্ত কার্যকরী হয়, একমাত্র তারই আনুগত্য করতে হবে। আমার মতের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো কেন? এবং আমি যে দৃষ্টিতে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি সে দৃষ্টিতে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয় নি, নিছক এতটুকু কারণে আনুগত্য অস্বীকার করা যেতে পারে না। আনুগত্যের শৃঙ্খলা একমাত্র তখনই ছিন্ন করা যেতে পারে যখন রাসূলুল্লাহর (সা) ভাষায় ইসলামের পথ ছেড়ে পরিষ্কারভাবে অন্য পথ অবলম্বিত হয়।
দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরকে হক পথে রাখার জন্য তাঁদের সমালোচনা করাও কর্মীদের একটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু অন্যান্য দলে সন্দেহ ও সংশয়ের ভিত্তিতে সমালোচনা করার নীতি স্বীকৃত হলেও ইসলামী দলের জন্য এ নীতি অনৈসলামিক বলে বিবেচিত হয়। ইসলামী দলে সমালোচনা হয় সু-ধারণার ভিত্তিতে। এখানে আপত্তি ও অভিযোগের পরিবর্তে কল্যাণকামিতা ও সৎপরামর্শের সুর ধ্বণিত হয়। ইসলামী জামায়াতের সাথে সমালোচনায় কেবল এমন পদ্ধতিই খাপ খেতে পারে যেখানে সমালোচকের মনে কোন প্রকার তিক্তভাব থাকে না এবং শ্রোতার মনেও সমালোচনা বিরক্তি উৎপাদন করে না, যেখানে সমালোচনার সাথে কোন প্রতিশোধ স্পৃহা শামিল থাকে না, যেখানে নিজের কথাকে স্বীকার করিয়ে নেবার জিদের প্রভাব থাকে না এবং সমালোচনা গ্রহণ না করার ফলে সমালোচক দুঃখিত বা বিরক্ত হয় না। উপরন্তু ইসলামী দলে সমালোচনা হয় মুখোমুখি, সামনা সামনি; পিছনে গিয়ে বা অন্তরালে থেকে কারুর সমালোচনা হয় না। পেছনে গিয়ে কিছু বললে তা সমালোচনা নয়, গীবত হয়। গীবত ইসলামী দলের প্রতি পয়লা নম্বরের অনিষ্টকারিতার পরিচায়ক। অথচ সমালোচনা তার সর্বোত্তম কল্যাণ কামনার পরিচয় বহন করে। এ দু’য়ের মধ্যে আসমান-জমীন তফাৎ।
আমাদের সংগঠনের প্রকৃতিই হচ্ছে এই যে, এখানে দায়িত্বশীলদের যত অধিক দ্ব্যর্থহীন সমালোচনা হয় ততই তা আন্দোলনের জন্য কল্যাণকর হয়। কিন্তু পরিচালকদের সম্পর্কে বিদ্রুপাত্মক শব্দ উচ্চারণ করা, তাঁদের মর্যাদার পরিপন্থী বাক্য ব্যবহার করে মনের ঝাল ঝাড়া, তাঁদের ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা অথবা তাঁদের দুর্বলতা উল্লেখ করে আনন্দ উপভোগ করা অবশ্যই ইসলামী চরিত্রনীতির পরিপন্থী।
সমালোচনা অধিকারের ওপর কোন আইনের বাঁধন না থাকার কারণে তাকে একটি স্থায়ী কর্মে পরিনত করা, পরিচালকবৃন্দের প্রতিটি নির্দেশ, কর্ম ও সিদ্ধান্তের এবং তাদের প্রতিটি কথার সমালোচনা শুরু করে দেয়া এবং তাঁদের নির্দেশের পক্ষে পূর্ণাঙ্গ যুক্তি প্রমাণ পেশ করার দাবী করাও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাড়ায়। এ অবস্থা সৃষ্টি হবার পর এক ব্যক্তি কোন দায়িত্ব গ্রহণ করে একদিনও চলতে পারে না। অতঃপর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা দলের সাধারণ সদস্যদের সম্মুখে বসে কেবল জবাবদিহিই করতে থাকবে এবং তাদের আস্হা পুণর্বহাল করার জন্য নিজেদের প্রতিটি বাক্য ও কর্মের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে তাদেরকে বুঝাতে থাকবে যে, এর মধ্যে অভিযোগ করার মতো তেমন কোন বিষয় নেই। এ কথাগুলি সম্মুখে রেখে চিন্তা করলে সহজেই উপলব্ধি করা যাবে যে, দায়িত্বশীলদের সমালোচনার ব্যাপারে ন্যায় সংগত পন্থা অবলম্বন করতে হলে যথেষ্ট সতর্ক হতে হবে। আর এ ব্যাপারে সতর্ক না হলে সমালোচনার অধিকারকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে কর্মীরা সংগঠনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিতে পরিণত করতে পারেন এবং এর ফলে তাদের নিজেদের পরিণামও হতে পারে অত্যন্ত ভয়াবহ।
অন্যায় সমালোচনার একটি বড় আলামত হচ্ছে এই যে, তা আনুগত্যের পথে বাঁধা সৃষ্টি করে। কোন ব্যক্তি এ পথে পা বাড়াবার পর প্রকাশ্য অন্যায় আচরণে লিপ্ত হয়। কাজেই আনুগত্য ও সমালোচনার পৃথক পৃথক সীমানা রয়েছে এবং নিজেদের সীমানার মধ্যেই তাদের অবস্থান করা উচিত। আল্লাহর নাফরমানী ছাড়া আর কোন বস্তু আনুগত্যকে খতম করতে পারে না।
৩. ব্যক্তির পরিবর্তনের কারণে আনুগত্য ব্যবস্থাকে মেনে চলার ক্ষেত্রে কোন প্রকার পরিবর্তন আসতে পারে না। হতে পারে, কোন আন্দোলনের ব্যাপকতর অবস্থায় দায়িত্ব গ্রহণকারী একটি বড় দলের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কতক উচ্চমানের, কতক নিম্নমানের, কারুর জ্ঞান অধিক, কারুর তাকওয়া অধিক, কেউ বর্তমান যুগের বিশেষ বিষয়সমূহে অধিক পারদর্শী, কেউ প্রথম যুগের অবস্থা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন, কেউ নির্দেশনাবলীর বাহ্যিক বিষয়সমূহ সম্পর্কে অধিক অবগত, আবার কেউ নির্দেশনাবলীর আভ্যন্তরীণ তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী, কারুর নিকট আন্দোলনের একটি দিক অধিক গুরুত্বপূর্ণ, আবার কারো নিকট অন্য একটি দিক গুরুত্বের অধিকারী। আবার এমনও হতে পারে যে, কারুর মেজাজ একটু কঠোর, কারুর কোমল, কেউ অত্যাধিক নিঃসংকোচ ভাবকে পছন্দ করেন আবার কেউ একটু ভারিক্কি ধরণের গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যবহারে অভ্যস্ত, কেউ অত্যধিক বাকপটুতাকে পছন্দ করেন, আবার কেউ নীরবে কাজ করার পক্ষপাতি।
এছাড়াও পোশাক-পরিচ্ছদ, আহার-বিহার, চলা-ফেরা, উঠা বসা প্রভৃতি জীবনের বিভিন্ন ব্যাপারে বিভিন্ন ব্যক্তির রুচি বিভিন্ন হতে পারে। ব্যক্তিগত রুচি, প্রকৃতি ও প্রবণতা একটি দলীয় ব্যবস্থার সামগ্রিক নীতির ঐক্য সত্ত্বেও একটি বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত নিজের কাজ করে থাকে। এই পার্থক্য ও বিভিন্নতার কারণে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অবস্থার মধ্যে এমন কোন পার্থক্য সূচিত হয় না, যার ফলে তাঁদের আনুগত্যের অধিকারের মধ্যে কম-বেশী করা যেতে পারে এবং তাঁদের মধ্যে কোন রদবদল হলে লোকেরা অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হতে পারে যে, অমুক ব্যক্তির মধ্যে যে রুচি ও মননশীলতা ছিল তা অমুক ব্যক্তির মধ্যে নেই কেন? কোন এক ধরণের ব্যবহার ও কর্মপদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠার পর যদি কোন রদবদল অনুষ্ঠিত হয় তাহলে মনের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয় এবং কর্মের গতি মন্থর হয়ে পড়ে। এই অনাসৃষ্টির দুয়ার বন্ধ করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) হেদায়েত দিয়েছিলেন যে, একজন নাককাটা হাবশীকেও যদি তোমাদের ইমাম করা হয় তাহলে তাঁর নির্দেশ শ্রবণ করো এবং তাঁর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য করো। এক্ষেত্রে তাঁর চেহারা সুরত লেবাস-পোশাক রুচি প্রকৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করো না। দায়িত্বশীলদের ব্যক্তিগত রুচি, প্রকৃতি সকল দিক দিয়ে অনুগতদের চাহিদানুযায়ী হবে, এ বিষয়টির উপর শরিয়ত আনুগত্যকে নির্ভরশীল করেনি।
ইসলামী আন্দোলন ব্যক্তিত্বের চর্তুদিকে আবর্তিত হয় না। বরং এ আন্দোলন এক সময় রাসূলুল্লাহর (সা) নেতৃত্বে চলতে থাকে এবং অন্য সময় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) কুরআনের এ বাণী-
وَمَا مُحَمّدٌ اِلاَ رَسـولٌ مِن قـَـبلـِهِ الـرّسـَلُ اَفَـائـن مـَاتَ اَوقُـتـِلَ انـقـَلَـبـتـُم عَـلـَيَ اَعـقـَاَبِـكُـم-
(অর্থাৎ, “মুহাম্মদ (সা) একজন রাসূল মাত্র ছিলেন। তাঁর পূর্বে আরো বহু রাসূল অতিক্রান্ত হয়েছেন, যদি তিনি মরে যান বা নিহত হন তাহলে কি আবার তোমরা পিছনের দিকে ফিরে যাবে?” – সূরা আলে ইমরান, আয়াতঃ১৪৪) উচ্চারণ করে অগ্রসর হন এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহন করেন। তারপর হযরত উমরের (রা) ন্যায় কঠোর হৃদয়ের ব্যক্তি নেতৃত্ব লাভ করেন। অতঃপর হযরত উসমানের (রাঃ) মত কোমল হৃদয়ের সহনশীল ব্যক্তি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর হযরত আলী (রাঃ) তাঁর বিশেষ গুনাবলীসহ এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন। এই সমস্ত হাত বদলের মধ্যে অবশ্যই আনুগত্য ব্যবস্থার অপরিহার্যতা বহাল থাকে এবং এ ব্যবস্থা ভঙ্গ করা হামেশা কবীরা গোনাহর অর্ন্তভূক্ত থাকে।
মনে রাখবেন, আমাদেরকে ব্যক্তিত্বকে সম্মুখে রেখে শৃঙ্খলার আনুগত্য করার জন্য নয় বরং শরীয়ত বিভিন্ন দায়িত্বকে যে মর্যাদা দান করেছে তাকে সম্মুখে রেখে শৃঙ্খলার আনুগত্য করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কাজেই প্রয়োজন ও পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিদিন ব্যক্তি বদল হতে থাকলেও, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) আমাদের উপর দায়িত্বশীলদের যে সকল অধিকার দান করেছেন পূর্ণ সততার সাথে আমাদের সেগুলি আদায় করা উচিত।
৪. এ পর্যন্ত কেবল কর্মীদের দায়িত্ব বিবৃত করা হয়েছে। এদের তুলনায় কর্তৃত্বশীলদের দায়িত্ব অনেক বেশী নাজুক প্রকৃতির। কর্তৃত্বশীলগণ তাঁদের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন না করা পর্যন্ত কর্তৃত্ব ও আনুগত্য ব্যবস্থার মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকতে পারে না। কর্মীদের মোকাবেলায় নেতাদের পরকালীন জবাবদিহিও অনেক কঠিন হবে। দুনিয়ায় ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যের সিংহভাগও তাঁদের সঠিক ও যথার্থ কর্মের উপর নির্ভর করে। কর্মীরা তখনই যথার্থ আনুগত্য করতে পারে যখন নেতৃবৃন্দ তাঁদের নিজেদের অংশের কর্তব্য অর্থাৎ কর্তৃত্বের ব্যাপারে তাঁদের নিজেদের দায়িত্ব পুরোপুরি আদায় করে।
এ ব্যাপারে নিম্নলিখিত আয়াতটি থেকে চমৎকার নির্দেশ পাওয়া যায়। এখানে আল্লাহতায়ালা রাসূলুল্লাহর (সা) কর্তৃত্বের স্বরূপ নিন্মোক্ত ভাষায় ব্যক্ত করেছেনঃ
فـَـبِمَـا رَحـمـَةٍ مَّنَ اَللهِ لِـنـتَ لـَهـُم وَلـَو كَـنـتَ فـَظـاًّ غَـلـِظَ الـقـَلـبِ لاَنـفتَضـُّوا مِن حَـولِــكَ فـَاعـفُ عَـنـهُـم وَاسـتـَغـفـِرلَـهُـم وَشَـاوِرهُـم فِـى الاَمـرِ فَـاِذاَ عـَزَمـتَ فـَتـَوَكّـل عَـلـَىَ اللهِ اَِنَّ اَللهَ يُـحِـبُّ الـمُـتـَوَكّـِلـِيـنَ-
“এটা একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ যে, আপনি এদের (মুসলমানদের) প্রতি কোমল। যদি আপনি কঠোরভাষী ও তিক্ত মেজাজ সম্পন্ন হতেন, তাহলে এরা আপনার চারপাশ থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতো। কাজেই এদের ত্রুটিকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখুন, এদের জন্য সাফায়াত চান এবং বিভিন্ন বিষয়ে এদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর পরামর্শের পর যখন কোন বিষয়ে দৃঢ় সংকল্প হয়ে যায়, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ (তাঁর উপর) ভরসাকারীদের ভালবাসেন।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াতঃ১৫৯)
এই আয়াতে রাসূলুল্লাহর (সা) আনুগত্যকারী প্রত্যেকটি কর্তৃত্বশীল ব্যক্তির জন্য এমন একটি মৌলিক বিধান দান করা হয়েছে যার অনুপস্থিতিতে কোন দলীয় শৃঙ্খলা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না। সংগঠনের অর্ন্তভুক্ত প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে এই আয়াতের আলোকে যে সমস্ত বিষয়ের অনুগত থাকা উচিত এবং যে বিষয়কে সম্মুখে রেখে নিজের স্বভাব-চরিত্র মেজাজ গড়ে তোলা উচিত তা নিম্নে বর্ণিত হলোঃ
ক. ব্যক্তি যেন কোন প্রকার বড়-ছোট, উঁচু-নীচু ভেদাভেদ অনুভব না করে। এ পরিবেশ যেখানে নেই সেখানে কর্তৃত্বশীল ও অনুগতদের মধ্যে মানসিক, আন্তরিক ও বৈঠকী ব্যবধান সৃষ্টি হয় এবং সহযোগিতার প্রাণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
এ মহা সত্যটিকে আল্লামা ইকবাল তাঁর কবিতায় এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
“কাফেলার সারি হতে
বিচ্ছিন্ন হলো কেউ,
সংশয়িত হলো কেউ
হারেমের প্রতি,
কেননা ব্যবহার প্রীতিপূর্ণ নয়
আমাদের কাফেলা সালারের।“
সংশ্লিষ্ট আয়াতটি এই প্রীতিপূর্ণ ব্যবহারই দাবী করে।
এই প্রীতিপূর্ণ ব্যবহারের অর্থ এই নয় যে, দায়িত্বশীল ব্যক্তি কোন ব্যাপারে কঠোর হবেন না, কোন ভুলত্রুটির জন্য কৈফিয়ত চাইবেন না, কোন অন্যায় কাজে বাঁধা দিতে পারবেন না, উপরন্তু প্রত্যেকটি কর্মীর তোষামোদ করে ফিরবেন। বরং পরিস্থিতি ও পরিবেশ অনুযায়ী কোথাও কঠোর নীতি অবলম্বন করার প্রয়োজন হলে সেখানে তা না করলে আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর হবে। আদর্শ, উদ্দেশ্য ও শৃঙ্খলার খাতিরে দায়িত্বশীলদেরকে কখনো কখনো সহযোগীদের সাথে আদেশের সুরে কথা বলতে হয়, কাজ আদায় করতে হয়। কিন্তু সে আদেশে থাকবে স্নেহ প্রীতির প্রাণ প্রবাহ। তার বাইরের কঠোরতা নেহায়েত একটা খোলস বৈ আর কিছুই নয়।
খ. দায়িত্বশীলগন সকল সহযোগীর উঠা-বসা, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, হাব-ভাব প্রভৃতি গভীরভাবে নিরীক্ষণ করার সুযোগ পান। কাজেই তাদের অনেক দোষ-ত্রুটি, দুর্বলতা, গলদ তাঁদের সম্মুখে থাকে। হয়ত কেউ কর্তব্য পালনে গাফলতি করেছে, কেউ আন্দোলনের বিরোধীদেরকে কোন অপ্রীতিকর কথা বলেছে, কেউ ত্রুটিপূর্ণ আবেগ প্রকাশ করেছে, কেউ সর্বসমক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গোপন কথা প্রকাশ করে দিয়েছে, কেউ নিজের সহযোগী বা অন্যের সাথে অন্যায় আচরণ বরেছে, কেউ গীবত করেছে, কেউ কারুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে।
এ সমস্ত বিষয় সামনে থাকার কারণে মানুষের মনে কুধারণা, তিক্ততা ও বিরক্তি সৃষ্টি না হয়ে পারে না। এ ধরণের দুর্বলতা দেখে ধীরে ধীরে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মন বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের সম্পর্কে এবং নিজেদের সমগ্র দলটি সম্পর্কেও তিক্ত হয়ে ওঠে। তখন কঠোর কিন্তু কর্কশ ব্যবহার ও কথাবার্তার মাধ্যমে এক ধরণের বিরক্তি ফুটে উঠতে থাকে। এর ফলে মন ভেঙ্গে যায়, সন্দেহ-সংশয়ের পরিধি বেড়ে যায় এবং কর্তৃত্ব ও আনুগত্যের বাঁধন ঢিলে হতে থাকে। পূর্বোল্লেখিত আয়াতটি এ ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে। এর মাধ্যমে কর্তৃত্বশীলদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছেঃ নিজের সহযোগীদের দুর্বলতাগুলি দেখো এবং সেগুলি মাফ করে দাও, এজন্য মনকে কলুষিত করো না এবং নিরাশ হয়ো না। কারণ বিভিন্ন মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার দুর্বলতা আছে। অনেক প্রচেষ্টা, মেহনতের পর ধীরে ধীরে এগুলি দূরীভূত হয়। কেবল তাদেরকে মাফ করে দেওয়াই যথেষ্ট নয় বরং স্নেহ প্রীতির তাগিদে *****অনুপস্থিতিতে তাদের জন্য আল্লাহর কাছে মাগফেরাত চাইতে হবে। এটিই হচ্ছে পারস্পরিক প্রীতির সম্পর্ক শক্তিশালী করার সর্বত্তোম উপায়।
গ. “আর বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করো” – নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সময়ে সময়ে এবং প্রয়োজনবশতঃ নিজেদের বিভিন্ন সহযোগীর সাথে তাদের বুদ্ধি-বিচক্ষণতা, জ্ঞান ও তাকওয়া অনুযায়ী পরামর্শ করা উচিত। পরামর্শের মাধ্যমে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি পায়, সন্দেহ-সংশয় দূরীভূত হয় এবং সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করা সহজ হয়।
পরামর্শ করা অবশ্যই ফরজ। যে ব্যাপারে যে সহযোগী সঠিক পরামর্শ দেয়ার যোগ্যতা রাখে সে ব্যাপারে তার সাথে পরামর্শ করাই হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ। প্রত্যেক ব্যাপারে প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করা জরুরী নয় বরং যে ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করা সঙ্গত তার সাথে অবশ্য সে ব্যাপারে পরামর্শ করা উচিত। অনেক সময় বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের সাথে, অনেক সময় কেবল নির্বাচিত ‘কার্যকরী পরিষদ’ – এর সাথে আবার অনেক সময় সাধারণ সদস্য ও সহযোগীদের সাথে পরামর্শ করা, অতঃপর তাদের মতামত সম্পর্কে চিন্তা ও বিচার-বিশ্লেষন করা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা ও সংগ্রামকে শক্তিশালী করে। উপরন্তু এর সাহায্যে দলীয় সংগঠন মজবুত হয়। পরামর্শের মাধ্যমে বিভিন্ন মন মস্তিষ্কের মিলন ঘটে, তাদের মধ্যে ঐক্য সংস্থাপিত হয় এবং তারা বিভিন্ন বিষয়ে গৃহীতব্য সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
ঘ. কর্তৃত্বশীলদের জন্য আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতের মধ্যে যে সর্বশেষ নির্দেশ দিয়েছেন, তা হচ্ছে এই যে, প্রয়োজনীয় পরামর্শের পর যখন কোন বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তখন একাগ্রচিত্তে তার উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকা উচিত। একটি দলের দায়িত্বশীলদের প্রতিদিনকার বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার পরও মতবিরোধের সম্মুখীন হতে হয় এবং অনবরত নতুন নতুন মতামত তাঁদের সম্মুখে আসতে থাকে। কিন্তু স্থিরীকৃত বিষয়ে যদি বারবার রদবদল করা হয় তাহলে সে ব্যাপারে সাফল্যের সাথে কোন একটি দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয় বরং উল্টা দায়িত্বশীলদের মনে ইতস্তত ও চিন্তার নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। এর ফলে দলের সামগ্রিক নীতিও স্থায়ী অস্থিরতার শিকার হয়। এ সমস্ত কারণে যথারীতি একটি পরিণতিতে পৌছে যাবার পর আল্লাহ তায়ালা পরামর্শদানকারী ব্যক্তিদেরকে স্থিরীকৃত বিষয়সমূহ মেনে নিয়ে নিজেদের বাস্তব দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন।
৫. কর্তৃত্ব ও আনুগত্য সম্পর্কে আরো বক্তব্য হচ্ছে এই যেঃ
ক. বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তির পক্ষ থেকে যে সমস্ত সার্কুলার ও নির্দেশনামা জারি করা হয় সাধারণত সেগুলির আনুগত্যের ব্যাপারে শরীয়ত নির্ধারিত অপরিহার্যতার অনুভূতি কিছুটা দুর্বল। এই সার্কুলার ও নির্দেশগুলিকে সম্ভবত অফিস-আদালতের মামুলি সার্কুলার মনে করা হয়। অথচ যখনই কোন সার্কুলার জারি করা হয় তার অবস্থা হয় ঠিক ‘আমর বিল মারুফ’ (সৎকর্মের আদেশ দান) – এর সমতুল্য। এ ব্যাপারে ‘উলিল আমরে’র (কর্তৃত্বশীলদের) আনুগত্যকে অপরিহার্য গণ্য করা হয়েছে। সার্কুলারগুলির প্রতিটি শব্দ সম্পর্কে ভালোভাবে চিন্তা করা উচিত এবং যে বন্দেগীর প্রেরণা নিয়ে শরীয়তের সমস্ত বিধি-নিষেধ পালন করা হয় সেই প্রেরনা সহকারে যথাসময়ে সেগুলিকে কার্যকরী করার জন্য নিজের সমগ্র শক্তি নিয়োগ করা উচিত।
খ. সভায় উপস্থিতির জন্য যে সময় নির্ধারিত করা হয়, কোন ডিউটিতে পৌছাবার জন্য যে সময়-কাল স্থিরীকৃত হয়, অনুরুপভাবে কোন সংবাদ বা রিপোর্ট পৌছাবার বা কোন হুকুম তামিল করার জন্য যে পদ্ধতি বা সময় নির্ধারিত হয়, তা যথাযথভাবে মেনে চলার যোগ্যতা এখনো আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় নি।
লোকেরা এখনো এ দায়িত্ব পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছে না যে, তাদের প্রত্যেকেই একটি ঘূর্ণায়মান মেশিনের কলকব্জা স্বরূপ এবং প্রতিটি কলকব্জা যদি নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে বিলম্ব করে অথবা অনিয়ম করে তাহলে সমগ্র মেশিনটাই যথাসময়ে কাজ করতে ব্যর্থ হবে। এ পঙ্গুত্বসহ আমরা কোন বড় অভিযানে সফল হতে পারবো না। কাজেই আমাদের প্রত্যেকেরই সংগঠন-মেশিনের কলকব্জার ন্যায় যথা নিয়মে কাজ করার জন্য নিজেদেরকে তৈরী করা উচিত।
গ. কর্তৃত্ব ও শৃঙ্খলা ব্যবস্থার আনুগত্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি যে একটি গোনাহর শামিল উপরের আলোচনায় এ কথা সুস্পষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। এজন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে আমাদেরকে জবাবদিহী করতে হবে। কিন্তু মনে হয়, এ ধরণের ত্রুটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করলে সহযোগীরা কিছুটা লজ্জিত হয় ঠিকই, তবে এ জন্য তাদের মধ্যে সাধারণভাবে যে ধরণের গুনাহর অনুভূতি সৃষ্টি হওয়া দরকার তা হয় না। দলীয় শৃঙ্খলার আনুগত্যে ত্রুটি করা-মিথ্যা বলা, কাউকে গালি দেয়া, ওয়াদা ভঙ্গ করা, কারুর অধিকার আত্মসাৎ করা, চুরি করা, গীবত করা, মিথ্যা সাক্ষী দেয়া এবং এ ধরণের অন্যান্য বড় বড় অপরাধের চাইতে কম পর্যায়ের নয়। কিন্তু বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার ব্যক্তিগত চরিত্রের নীতি বিরোধী উপরোল্লেখিত কাজগুলি করার সঙ্গে সঙ্গেই মনে খটকা লাগে এবং আল্লাহর নিকট তওবা ও ইস্তেগফার করার প্রেরণা জাগে, অথচ দলীয় চরিত্রনীতি বিধ্বস্ত হবার পর এমন গোনাহগারীর কোন অনুতাপের ভাব মনের মধ্যে সৃষ্টি হয় না যার ফলে সঙ্গে সঙ্গেই তওবা ও ইস্তেগফার করে নিজের কার্যাবলী সংশোধন ও ক্ষতিপূরণ করা যেতে পারে।
দলীয় চরিত্রের মূল্য ব্যক্তিগত চরিত্রের চাইতে অনেক বেশী। এ জন্যই দলীয় চরিত্রে দুর্বলতার প্রকাশ বৃহত্তর গোনাহ। আমাদের সহযোগীদের এ বিষযটি অনুভব করা উচিত। আরো যদি সংগঠন কর্তৃক অর্পিত কোন দায়িত্ব সম্পাদন করতে, কোন কাজের জন্য সময় বের করতে, কোন নির্দিষ্ট স্থানে যথাসময়ে পৌঁছতে অথবা অন্যদিকে দায়িত্বশীলদের অধিকার আদায় করতে, তাঁদের কল্যাণ কামনার দাবী পূরণ করতে, সঠিক সমালোচনা পদ্ধতি অবলম্বন করতে, পরামর্শ ও তথ্যদান করতে, গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার আদায় করতে বা দায়িত্বশীলদের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করতে কোন প্রকার ত্রুটি করে; তাহলে এমনি ধরণের প্রত্যেকটি ত্রুটির পর আমাদের মনে চরম লজ্জানুভূতি সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন। এমন লজ্জানুভূতি সৃষ্টি হবে যা আমাদের তওবা ইস্তেগফারের দিকে ঝুঁকিয়ে দিবে, রাব্বুল আলামীনের সম্মুখে আমাদের দীনতার শির নত করে দিবে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃত্বশীল বা সহযোগীদের নিকট ওজর পেশ করা ও ক্ষমা চাওয়ার জন্য আমাদের মধ্যে অধিকতর কর্মতৎপরতা সৃষ্টি করবে এবং আমাদের আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করার প্রেরণা জাগাবে।
আমাদের মধ্যে এ গুণ সৃষ্টি না হলে ইসলাম নির্ধারিত পথে নিজেদের সংগঠন ও শৃঙ্খলার বিকাশ সাধনও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
ঘ. কর্তৃত্ব ও আনুগত্যের উপরোল্লেখিত দাবীসমূহ পূরণ করার জন্য নিছক আবেদন বা কতিপয় গণতান্ত্রিক ও শাসনতান্ত্রিক ধারা যথেষ্ট নয়। বরং একমাত্র সহযোগীদের দায়িত্বানুভূতিই এ দাবীগুলির পূর্ণতার ধারক হতে পারে। যদি প্রত্যেক সহযোগী আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক কায়েম করে মু’মনিদেরকে সাক্ষী রেখে আল্লাহর নিকট যে অঙ্গীকার করেছে তা সব সময় মনের মধ্যে জাগরুক রাখে, তাহলে তাদের মাঝে এ দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত থাকতে পারে। এই অনুভূতির তাগিদে প্রত্যেক সহযোগীকে এ কথা মনে রাখা দরকার যে, সংগঠন শৃঙ্খলা হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে একটি আমানত এবং তার এবং তার সাথীদের ন্যায় তাকেও এর প্রহরায় ও রক্ষনাবেক্ষনে নিযুক্ত করা হয়েছে। এটি একটি মহামূল্যবান আমানত। এই আমানতটিকে অস্তিত্ব দান করার জন্য ইতিহাসের বিভিন্ন যুগের হাজার হাজার শক্তি কাজ করেছে এবং এর পিছনে বহু চিন্তা-গবেষণা, শ্রম, অর্থ, নিদ্রাহীনতা, প্রচেষ্টা, সংগ্রাম ও ত্যাগ রয়েছে। কাজেই কোন ব্যক্তি যদি এই শৃঙ্খলায় কোন প্রকার দুর্বলতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে তাহলে তার হস্তক্ষেপ থেকে এ আমানতকে রক্ষা করা প্রত্যেক সহযোগীর প্রাথমিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব সম্পাদনে যারাই ত্রুটি করবে তারাই সেই পাহারাদারের ভূমিকা গ্রহণ করবে যে নিজের কাজে ফাঁকি দেয়।
কাজেই সহযোগীদের উচিত এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং এমন একটি ঐতিহ্য সৃষ্টি করার জন্য অবিশ্রাম প্রচেষ্টা চালানো, যার ফলে শৃঙ্খলার উপর প্রভাব বিস্তারকারী কোন ক্ষতিকর বস্তু মাথা উঁচু করতে না পারে। আর কোন অপ্রীতিকর বস্তু মাথা উঁচু করলেও যেখানে মাথা উঁচু করে সেখানেই যেন তাকে ভালোভাবে দাবিয়ে দেয়া যায়। একমাত্র এ পদ্ধতিতেই কর্তৃত্বশালী ও আনুগত্যকারীরা স্ব স্ব স্থানে অবস্থান করে কুরআন ও সুন্নাহর দাবী অনুযায়ী অগ্রসর হতে পারে।
সহযোগীদের সাথে সম্পর্ক
যে সমষ্টিগত পরিবেশে ব্যক্তিদের পারস্পরিক সম্পর্ক যথার্থ নৈতিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় একমাত্র সেখানেই ইসলামের চাহিদা অনুযায়ী কর্তৃত্ব ও আনুগত্য যথাযথভাবে প্রবর্তিত হতে পারে। এই নৈতিক ভিত্তিগুলিকে আল্লাহ তাঁর রাসূল (সা) দ্বারা যথাযথভাবে নির্ধারণ করেছেন। বিশেষ করে সূরায়ে হুজরাতে এই গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলি সংক্ষেপে বিবৃত করা হয়েছে। ইসলামী সমাজ ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের এগুলি সম্মুখে রাখা প্রয়োজন। এইখানে আমি সংক্ষেপে এর উল্লেখ করছিঃ
১. সমাজ জীবনকে ত্রুটিশূন্য রাখার জন্য প্রথম নির্দেশ হচ্ছেঃ
يــَااَيـهـاَ الـَّذِيـنَ اَمَنـُوا اِن جــاَءَكُـم فــاَسـِقٌ بـِـنَـبـاَءٍ فَـتـَبـيـَنـُوا اَن تَـًصِيـبُوا قـَومـأً بِـجـَهـأَ لَـةٍ فـَتـُصـبـِحـُوا عَـلـىَ مَـا فـَعَـلـتـُم نَـدِمـِيـنَ-
“হে ঈমানদারগণ! যদি কোন ফাসেক ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন খবর নিয়ে আসে, তাহলে (সে সম্পর্কে চিন্তা গ্রহণের পূর্বে) অনুসন্ধান করো, যাতে করে তোমরা অজ্ঞাতে (বিক্ষুদ্ধ হয়ে) কোন দলের ওপর আক্রমন না করো এবং পরে এ জন্য পস্তাতে না হয়।“ (সূরা হুজরাত, আয়াতঃ ৬)
কোন খবর বা বিবরণ শুনার পর সঙ্গে সঙ্গেই সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অনেক সময় মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে। এই ধরণের ভুলের কারণে পরে লজ্জিত হতে হয়। এ নির্দেশটি অত্যন্ত ব্যাপক। ইসলামী সমাজের সদস্যদের এর ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকা উচিত। ফাসেকদের প্রদত্ত খবরে পরস্পরের সম্পর্কে তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত নয়।
২. দ্বিতীয় নির্দেশ হচ্ছেঃ
اِنَّـمـاَ المُـؤمِنـُونَ اِخوأَةٌ فَـاَصـلِحـُوا بَـيـنَ اَخَـوَيـكَـُم-
“ঈমানদারেরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই নিজের ভাইদের মধ্যে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠিত করো।“ (সূরা হুজরাত, আয়াতঃ১০)
এ নির্দেশটির উদ্দেশ্য অত্যন্ত পরিস্কার। মুসলিম সমাজের সদস্যদের মধ্যে মানবিক দুর্বলতার কারণে যদি কখনো মনোমালিন্য, ঝগড়া-বিবাদ দেখা দেয়, তাহলে ফেতনাকে আরো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করা অন্য ভাইদের কাজ নয়। বরং তাদের কাজ হচ্ছে সন্দেহ-সংশয় দূর করা, বিবাদমান পক্ষদ্বয়কে নিকটতর করা এবং উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য চেষ্টা চালানো, যার ফলে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক পুনর্বহাল হতে পারে। কেননা এই ভ্রাতৃত্ব ছাড়া ইসলামী দলের শৃঙ্খলা কোন দিন মজবুত হতে পারে না।
৩. তৃতীয় নির্দেশ হচ্ছেঃ
يـَاَ يـُّهـاَ الـّذِيـنَ اَمَـنـُوا لأَ يَـسـخَـر قـَومٌ مِّـن قـَومٍ عَـسـىَ اَن يـَّكُـونـُوا خَـيـراً مـِّنـهـُم- وَلاَ نـِسـأءٌ مِّـن نـِسـأءٍ عَـسـىَ اَن يـَّكُـنَّ خَـيـراً مـَّنـهـُنَّ- وَلاَ تَـلمِزُوا اَنـفـُسـَكُـم وَلاَ تَـنـاَ بَـزُوا بـِالاَلـقَـَابِ- بـِئـس الاَِ سـمُ الغُـسـُوقُ بـَعـدَ الاِيـمـأَنِ- وَ مَـن لَّـم يَـتـُب فَـاُولــئـكَ هـُمُ الظاَّلِـمـُونَ-
“হে ঈমানদারগন! তোমাদের একদল যেন অন্য দলের প্রতি বিদ্রুপ না করে, কেননা হতে পারে তারা এদের তুলনায় ভালো লোক। আর তোমাদের মেয়েরা যেন অন্য মেয়েদের বিদ্রুপ না করে, কেননা হতে পারে তারা এদের তুলনায় ভালো । আর তোমরা পরস্পরের দোষ খুঁজে বেড়িয়ো না, পরস্পরের জন্য অসম্মান জনক নাম ব্যবহার করো না। কেউ ঈমান আনার পর তাকে মন্দ নামে ডাকা গোনাহ্ । এসব কাজ থেকে যারা তওবা করে না তারা জালেম।“ (সূরা হুজরাত, আয়াতঃ১১)
এ নির্দেশের মাধ্যমে বিদ্রুপ করা, পরস্পরের দোষ খুঁজে বেড়ানো এবং অসম্মানজনক নাম ব্যবহার করা থেকে মুসলমানকে বিরত রাখা হয়েছে এবং এজন্য সতর্কবাণী শুনানো হয়েছে যে, যারা এ অভ্যাস পরিত্যাগ করবে না তারা সৎ মুমিনদের দলভুক্ত হবে না, বরং তারা হবে জালেমদের দলভুক্ত। এ দোষগুলি সমাজদেহে ঘুণ ধরিয়ে দেয়। এই ছোট দোষগুলি মনে ভাঙ্গন ধরায়। যে দলে ঠাট্টা-বিদ্রুপ, কটাক্ষ, মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা, অসম্মান করা প্রভৃতি রোগ সৃষ্টি হয় সে দল কখনো ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের উন্নততর পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না। আমাদের প্রত্যেক কর্মীর এই রোগসমূহ খেকে মুক্ত থাকার জন্য চেষ্টা করা উচিত।
৪. চতুর্থ নির্দেশ হচ্ছেঃ
يـَاَ يـُّهـاَ الـّذِيـنَ اَمَـنـُوا اِجـتَنـِبـُوا كــثـَيـِراً مِّنَ الـظَّـنِّ- اِنَّ بَـعـضَ الـظّـنِّ اِثـمٌ- وَلاَ تـَجَـسّـَسُـوا وَلاَ يـَغـتـَب بـَعـضُـكُـم بـَعـضاـً أيـُبُّ اَحـَدُكُـم اَن يّـَأكُـلُ لَـحـمَ اَخِـيـهِ مـَيـتاً فَـكَـرِهـتـُمُوهُ- وَاتَـقُـوااللهَ- اِنَّ اللهَ تَوَّابٌ رَّحِـيـمٌ-
“হে ঈমানদারগণ! খুব বেশী কু-ধারণা পোষন থেকে বিরত থাক। কেননা অনেক কু-ধারণা গোনাহর নামন্তর। অন্যের অবস্থা জানার জন্য গোয়েন্দাগীরি করো না এবং কারুর গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? (না, করবে না) বরং তোমরা তা ঘৃণা করো। আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী ও দয়াময়।“ (সূরা হুজরাত, আয়াতঃ১২)
এ আয়াতটির প্রথম দাবী হচ্ছে এই যে, মুসলিম দলের সদস্যদের পরস্পরের সম্পর্কে কু-ধারণা করা যাবে না। মনের মাটিতে সন্দেহ-সংশয়ের বীজ বপন করা যাবে না। পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করা এবং এদিক-ওদিক থেকে শুনে শুনে কারুর বিরুদ্ধে দোষের পাহাড় গড়ে তোলা যাবে না, কেননা প্রত্যেকটি ভিত্তিহীন সন্দেহ-সংশয় ও দোষারোপ আসলে একটি গোনাহ।
এর দ্বিতীয় দাবী হচ্ছে এই যে, পরস্পরের গোপনীয়তা জানার জন্য গোয়েন্দাগিরি করা যাবে না। গোয়েন্দাগিরির অর্থ এই যে, পরস্পরের দোষ খুঁজে বেড়ানো বা গোপন কথা জানার জন্য সর্বত্র ঢু-মারা অথবা বিভিন্ন মজলিসের ভেতরের কথা জানার জন্য তৎপর থাকা। এগুলি অত্যন্ত দোষনীয় এবং শৃঙ্খলার জন্য ধ্বংসকর।
এর তৃতীয় দাবী হচ্ছে এই যে, একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যের দোষ বর্ণনা করে আনন্দ উপভোগ করা যাবে না। কেননা এটা মারাত্মক অপরাধ। এটা হচ্ছে যে ব্যক্তির গীবত করা হয় তার গোশত কেঁটে খাওয়ার তুল্য ঘৃণ্য অপরাধমূলক কাজ। এই দাবীগুলোর প্রতি যত অধিক নজর রাখা হবে ততই আন্দোলনের ঐক্য ও সহযোগীদের ভ্রাতৃত্ব শক্তিশালী হবে এবং কর্তৃত্ব ও আনুগত্য ব্যবস্থা যথাযথভাবে কাজ করতে সক্ষম হবে।
দলীয় চরিত্রের সাথে সম্পর্কিত আরো কতিপয় বিষয় সূরায়ে হুজরাতে আছে। আপনারা ইচ্ছা করলে সেগুলি সম্পর্কেও চিন্তা করতে পারেন। এখানে মাত্র কতিপয় সুস্পষ্ট নৈতিক দাবী পেশ করা হলো।
পরিশেষে বলা যায়, যদি আমরা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক কায়েমের যথাযথ ব্যবস্থা করে দলীয় নীতি ও শৃঙ্খলার আনুগত্য করি এবং উল্লেখিত নৈতিক গুনাবলী নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ি, তাহলে ইনশাল্লাহ আমাদের ব্যর্থতার সামান্যতম সম্ভবনাও নেই। আল্লাহ যদি আমাদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার তিনটি সুযোগ দেন তাহলে বিশ্বাস করুন, আমরা ব্যবসায় যে পুঁজি খাটাচ্ছি তা কয়েকগুণ অধিক মুনাফা দানে সক্ষম হবে।
— সমাপ্ত —