ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী
বইটির অডিও শুনুন
ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী
যারা সত্যিই একটি ইসলামী সমাজ কায়েম করতে চান তাদের-
সর্বপ্রথম ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে, আমাদের জাতির মধ্যে একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খার মোটেই অভাব নেই। আসল অভাব আগ্রহ ও উদ্যোগ গ্রহণের এবং তার চাইতেও বেশী অভাব যোগ্যতার। এ কাজের জন্য যে মৌলিক গুণাবলীর প্রয়োজন অধিকাংশ লোকের মধ্যে তা অনুপস্থিত।
দ্বিতীয় যে বিষটির প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে তা হচ্ছে আমাদের জাতির সমগ্র প্রভাবশালী অংশ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজে বিকৃতি ও ভাঙ্গন সুষ্টিতে মূখর। আর যারা বিকৃতি ও ভাঙ্গনের কাজে লিপ্ত নেই তারাও সৃষ্টি ও বিন্যাসের চিন্তামুক্ত। সমাজ সংস্কার ও গঠনের প্রচেষ্টারত ব্যক্তিদের সংখ্যা মুষ্টিমেয়।
তৃতীয় যে বিষয়টি থেকে গাফেল থাকা উচিৎ নয় সেটি হচ্ছে, বর্তমান যুগে সমাজ জীবন পরিগঠন ও ভাঙ্গার বৃহত্তম শক্তি হচ্ছে সরকার। আর যেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকে সেখানে জনগনের উপযুক্ততা বা অনুপযুক্ততা ব্যক্তিদের হাতে শাসন ক্ষমতা সোপর্দ করার ওপরই সরকারের উপযুক্ত বা অনুপযুক্ত পূর্ণতঃ নির্ভরশীল। ভাঙ্গার কাজে যারা লিপ্ত থাকে তারা জনগণ যাতে কোনদিন নির্ভুল নির্বাচনের যোগ্য না হতে পারে সেজন্যে জনগণকে প্ররোচিত করার কাজে যতো শক্তি ব্যয় করে অন্য কাজে ততো ব্যয় করে না।
এ তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ে একটি ভয়াবহ দৃশ্য সৃষ্টি করে যা প্রথমাবস্থায় মানুষের মনে নিরুৎসাহের সঞ্চার করে এবং চারদিকের নৈরাশ্যের মধ্যে সে চিন্তা করতে থাকে, এখানে কোন কাজে সফলতা কি সম্ভব? কিন্তু এগুলোর বিপরীতে আরো কতিপয় বিষয় রয়েছে যেগুলো সামনে রাখলে নিরাশার মেঘ কেটে যেতে থাকে এবং আশার আলোকচ্ছটায় চতুর্দিক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
প্রথমটি হচ্ছে আমাদের সমাজ কেবল অসৎ লোকের আবাসস্থল নয়, এখানে কিছু সংখ্যক সৎলোকও আছে। তারা কেবল সংশোধন ও চরিত্র গঠনের আকাঙ্খা মনে পোষন করে না, বরং তাদের মধ্যে আগ্রহ ও যোগ্যতা রয়েছে। আর এর মধ্যে কিছুটা অভাব থাকলেও সামান্য যত্ম ও প্রচেষ্টায় তা পরিবর্ধিত করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় হচ্ছে, আমাদের জাতি সামগ্রিকভাবে অসৎপ্রবণ নয়। অশিক্ষা ও অজ্ঞতার দরুন তারা প্রতারিত হতে পারে এবং প্রতারিত হয়ে আসছে, কিন্তু প্রতারণাকারীরা যে বিকৃতির সম্মুখীন করে তার ওপর তারা সন্তুষ্ট নয়। বিচক্ষনতার সাথে সুসংবদ্ধ ও অবিরাম প্রচেষ্টা চালালে দেশের জনমতকে অবশেষে সংশোধন প্রয়াসী শক্তিগুলোর সমর্থকে পরিণত করা যেতে পারে। সমাজে অসৎ শক্তিগুলোর প্রভাবের ফলে যে সমস্ত অনাচারের সৃষ্টি হচ্ছে জাতির বৃহত্তম অংশ খোদ তার পরিপোষক হলে অবশ্যি নিরাশার কথা ছিল। কিন্তু আসল পরিস্থিতি তা নয়।
তৃতীয় কথা হচ্ছে, বিকৃতির জন্য যার কাজ করে যাচ্ছে তারা সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছে কিন্তু দু’টি সুবিধা অর্জন করতে পারেনি। এক.চারিত্রিক শক্তি, দুই- ঐক্যের শক্তি।
সর্বশেষ ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ আল্লাহ তায়ালার নিজের কাজ। এজন্য যারা প্রচেষ্টা চালায় তারা আল্লাহর সমর্থন লাভ করে তবে শর্ত হচ্ছে এই যে, তাদের ছবর ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে এবং বুদ্ধি ও বিচক্ষনতা পরিহার করলে চলবে না। এ ধরণের লোক যতই স্বল্প সংখ্যক হোক না কেন এবং তাদের সাজ-সরঞ্জাম-উপকরণাদি যতই সামান্য হোক না কেন অবশেষে আল্লাহর সাহায্য ও সমর্থন তাদের সকল অভাব পূরণ করে দেয়।
আপাতঃ নৈরাশ্যের পেছনে আশার এ আলোকচ্ছটা একটি আদর্শ ইসলামী সমাজের কেবল সম্ভাবনার উন্মেষ সাধনই নয় বরং তার সফল প্রতিষ্ঠারও দিগন্ত উন্মুক্ত করে। তবে প্রয়োজন হচ্ছে, যারা এ কাজের সত্যিকার আকাঙ্খা পোষন করে তাদের আশা ও আকাঙ্খার মন্জিল অতিক্রম করে কিছু করার জন্য অগ্রসর হতে হবে এবং সাফল্যের জন্য আল্লাহ যে নীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন সেই পদ্ধতিতে এগিয়ে যেতে হবে। আপনি কেবল অসৎ কাজ ও দোষত্রুটির সমালোচনা করে যাবেন এবং সেগুলো নিছক আপনার কথার জোরে শুধরে যাবে, এটা আল্লাহর নীতি নয়। আপনি হাত ও পায়ের শক্তি ব্যবহার না করা পর্যন্ত জংগলের একটি কাঁটা এবং পথের একটি পাথরও সরে না। তাহলে সমাজের দীর্ঘকালের দোষত্রুটিগুলো নিছক আপনার কথার জোরেই বা কেমন করে দূর হতে পারে? কৃষকের পরিশ্রম ছাড়া ধানের একটি শীষও উৎপন্ন হয় না। তাহলে নিছক দোয়া ও আশার মাধ্যমে কেমন করে সমাজে সততা ও সৎপ্রবণতার সবুজ শ্যামল শস্য উৎপাদনের আশা করা যেতে পারে? যখন আমরা ময়দানে নেমে কাজ করি এবং আল্লাহর নিকট সাফল্যের দোয়া চাই তখনই সমালোচনা কার্যকরী হয়। নিঃসন্দেহে ফিরিশ্তাদের আগমন ঘটে। কিন্তু তারা নিজেরা লড়বার জন্য আসে না। বরং যে সকল সত্যপন্থী খোদার পথে প্রাণ উৎসর্গ করার জন্য লড়াই করতে থাকে তাদেরকে সাহায্য করতে আসে। কাজেই যাদের মনে কাজ করার আগ্রহ আছে তাদের মিথ্যা আশা-আকাঙ্খার পথ পরিহার করে সুস্থ মস্তিষ্কে এ কাজের যাবতীয় দাবী ও চাহিদা উপলব্ধি করা উচিৎ। অতঃপর তারা কি সত্যিই এ কাজ করবেন, না নিছক সমাজের বিকৃতি দেখে অশ্রুপাত করবেন এবং সমাজ গঠনের আকাঙ্খা হৃদয়ে পোষন করেই ক্ষান্ত হবেন, এ ব্যাপারে যথার্থ চিন্তাভাবনা করে তাদের সিদ্ধান্ত করা উচিৎ। কাজ করার সিদ্ধান্ত যিনি করবেন তিনি উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে নয় বরং সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে চিন্তেই করবেন। সাময়িক উত্তেজনার বশে মানুষ বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিতে এবং প্রাণ দান করতে পারে কিন্তু সাময়িক উত্তেজনার বশে একটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে পৌছার জন্য সারা জীবন পরিশ্রম করা তো দূরের কথা মাত্র চারদিন কোন অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকা অথবা কোন সৎ কাজের উপর অটল থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যারা সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নিজেদের সমগ্র জীবন গঠনমূলক ভাবে কাজে নিয়োগ করতে প্রস্তুত হয় একমাত্র তারাই এ কাজ করতে পারে।
কাজ করার আগ্রহ ও উদ্দেশ্য গ্রহণের সাথে সাথে মানুষ সাধারণতঃ কর্মসূচীর প্রশ্ন উত্থাপন করে। কিন্তু তারা ভুলে যায়, কর্মের সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচীর মধ্যবর্তী স্থানে কর্মীর নিজের সত্তাই হচ্ছে কাজের আসল ভিত্তি ও নির্ভর। এ বিষয়টিকে বাদ দিয়ে কাজ ও কর্মসূচীর কথা বলা ঠিক নয়। কাজ করার জন্য কেবল সংকল্পই যথেষ্ট এবং এরপর শুধুমাত্র কর্মসূচীর প্রশ্ন থেকে যায়, এ কথা মনে করা ভুল। এ ভুল ধারণার কারণে আমাদের এখানে অনেক বড় বড় কাজ শুরু হয়েছে এবং পরে তা চূড়ান্ত লক্ষে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই কর্মসূচী ও পরিকল্পনা আসল নয়, আসল হচ্ছে এগুলোর বাস্তবায়নে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ ও তাদের চারিত্রিক গুণাবলী এবং প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক গুণাবলী। কর্মসূচী ও পরিকল্পনার সাফল্য ও ব্যর্থতার মূলে এটিই আসল কার্যকর শক্তি। ব্যক্তির প্রতিটি দুর্বলতা কাজের ফলাফলকে প্রভাবিত করে এবং তার প্রতিটি গুণ কাজকে সুষমা-মন্ডিত করে। সে উন্নত ও উত্তম গুণাবলীর অধিকারী হলে একটি ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা ও বাজে কর্মসূচীকেও এমন সফল পরিচালনার মাধ্যমে চূড়ান্ত লক্ষে উন্নীত করে যে মানুষ অবাক হয়ে যায়। বিপরীতপক্ষে তার যোগ্যতার অভাব থাকলে উত্তম কাজও পণ্ড হয়ে যায়। এমনকি অযোগ্য লোক যে কাজ সম্পাদনে ব্রতী হয় তার নির্ভুলতা সম্পর্কেও মানুষের মনে সন্দেহ জাগে। কাজেই সংস্কার ও গঠনমূলক বাস্তব পরিকল্পনা সম্পর্কে চিন্তা করার আগে এ কাজ সাধনের জন্য যে সব লোক এগিয়ে আসবে তাদের কোন্ ধরনের যোগ্যতা থাকতে হবে, কোন্ ধরণের গুণাবলী সমন্বিত হতে হবে এবং কোন্ ধরণের দোষ ত্রুটি থেকে তাদেরকে মুক্ত হতে হবে, উপরন্তু এ ধরণের লোক গঠনের উপায়-পদ্ধতি কি, এ ব্যাপারেও যথাযথ পর্যালোচনা করতে হবে।
পরবর্তী আলোচনায় এ বিষয়টিকে আমরা নিন্মোক্ত ক্রমানুসারে বর্নণা করবো-
১) এ উদ্দেশ্যে যারা কাজ করে তাদের প্রত্যেকের মধ্যে ব্যক্তিগত যেসব গুণ থাকা উচিৎ।
২) তাদের মধ্যে সামষ্টিক পর্যায়ে যেসব গুণ থাকা উচিৎ।
৩) ইসলাম প্রচার, ইসলামী দাওয়াত সম্প্রসারণ ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাফল্য অর্জনের জন্যে যেসব গুণ থাকা উচিৎ।
৪) ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে যেসব বড় বড় দোষ ত্রুটি থেকে তাদের মুক্ত থাকা উচিৎ।
৫) অভিপ্রেত গুণাবলীর বিকাশ সাধনে ও অনভিপ্রেত গুণাবলী থেকে ব্যক্তি ও সমষ্টিকে মুক্ত রাখার জন্যে যেসব উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে।
দুনিয়ায় ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বাস্তবে প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর সাহায্যের পর সাফল্যের দ্বিতীয় চাবিকাঠি হচ্ছে এ কাজ সম্পাদনের জন্যে প্রচেষ্টারত ব্যক্তিবর্গের নিজস্ব গুণাবলী। কতিপয় গুণাবলী ব্যক্তিগতভাবে তাদের প্রত্যেকের মধ্যে থাকতে হবে। কতিপয় গুণাবলী সামষ্টিক পর্যায়ে তাদের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। কতিপয় গুণাবলীর সংস্কার ও গঠনমূলক কার্য সম্প্রসারণের জন্যে তাদের মধ্যে থাকতে হবে। আবার কতিপয় দোষত্রুটি থেকে যদি তারা নিজেদেরকে মুক্ত না রাখে তাহলে তাদের সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। সবার আগে এ বিষয়গুলো অনুধাবন করতে হবে। ফলে যারা এ খেদমতের সত্যিকার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ তারা নিজেদের অনভিপ্রেত গুণাবলীর লালন ও অনভিপ্রেত গুণাবলী থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখার জন্য বিশেষভাবে সচেষ্ট হতে পারবে। সমাজ গঠনের জন্য এভাবে ব্যক্তি গঠন হচ্ছে প্রথম শর্ত। কারণ যে নিজেকে সজ্জিত ও বিন্যস্ত করতে পারে না সে অন্যকে সজ্জিত ও বিন্যস্ত করার ব্যাপারে কিছুই করতে পারে না।
ব্যক্তিগত গুণাবলী
ইসলামের যথার্থ জ্ঞান
ব্যক্তিগত গুণাবলীর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ইসলামের যথার্থ জ্ঞান। যে ব্যক্তি ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাকে সর্বপ্রথম যে জিনিসটি কায়েম করতে চায় তা জানতে ও বুঝতে হবে। এ কাজের জন্য ইসলামের নিছক সংক্ষিপ্ত জ্ঞান যথেষ্ট নয় বরং কমবেশী বিস্তারিত জ্ঞানের প্রয়োজন। আর এর স্বল্পতা ও বিপুলতা মানুষের যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল। এ জন্যে এ পথের প্রত্যেকটি পথিককে এবং আন্দোলনের প্রত্যেকটি কর্মীকে মুফতি বা মুজতাহিদ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই তবে তাদের প্রত্যেককে অবশ্যি ইসলামের আকীদা বিশ্বাসকে জাহেলী চিন্তা কল্পনা ও ইসলামী কর্মপদ্ধতিকে জাহেলিয়াতের নীতি-পদ্ধতি থেকে আলাদা করে জানতে হবে এবং জীবনের বিভিন্ন বিভাগে ইসলাম মানুষকে কি পথ দেখিয়েছে সে সম্পর্কে অবগত হতে হবে। এ জ্ঞান ও অবগতি ছাড়া মানুষ নজে সঠিক পথে চলতে পারে না, অন্যকেও পথ দেখাতে পারে না এবং সমাজ পরিগঠনের জন্যে যথার্থ পথে কোন কাজ করতেও সক্ষম হয় না। সাধারণ কর্মীদের মধ্যে এ জ্ঞান এমন পর্যায়ে থাকতে হবে যার ফলে তারা গ্রাম ও শহরের লোকদেরকে সহজ-সোজাভাবে দ্বীনের কথা বুঝাতে সক্ষম হবে। কিন্তু উন্নত বুদ্ধি-বৃত্তির অধিকারী কর্মীদের মধ্যে এ জ্ঞান অধিক মাত্রায় থাকতে হবে। তাদের বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে হবে। শিতি লোকদের সকল প্রকার সন্দেহ-সংশয় নিরসন করতে হবে। বিরুদ্ধবাদীদের প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ ও সন্তোষজনক জবাব দিতে হবে। ইসলামের আলোকে জীবনের বিভিন্ন সমস্যাবলীর সমাধান করতে হবে। ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে শিক্ষা ও শিল্পকে নতুন ছাঁচে ঢালাই করে বিন্যস্ত করতে হবে। ইসলামের অনাদী ও চিরন্তন ভিত্তির ওপর একটি নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রাসাদ গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক চিন্তা ও কর্মের ত্রুটিপূর্ণ অংশকে ত্রুটিহীন অংশ থেকে আলাদা করার মত সমালোচনার যোগ্যতা তাদের মধ্যে থাকতে হবে। এবং এই সঙ্গে যা কিছু ভাঙ্গার তাকে ভেঙ্গে ফেলে তদস্থলে উন্নততর বস্তু গড়ার এবং যা কিছু রাখার তাকে কায়েম রেখে একটি উত্তম ও উন্নততর ব্যবস্থায় তাকে ব্যবহার করার মত গঠনমূলক যোগ্যতা ও শক্তির অধিকারী তাকে হতে হবে।
ইসলামের প্রতি অবিচল বিশ্বাস
এ উদ্দেশ্য সম্পাদনে ব্রতী ব্যক্তির মধ্যে জ্ঞানের পর দ্বিতীয় যে অপরিহার্য গুণটি থাকতে হবে সেটি হচ্ছে, যে দ্বীনের ভিত্তিতে সে জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় তার ওপর নিজেকে অবিচল ঈমান রাখতে হবে। ঐ জীবন ব্যবস্থার সত্যতা ও নির্ভুলতা সম্পর্কে তার নিজের মন নিঃসংশয় হতে হবে। সন্দেহ, সংশয় ও দোদুল্যমান অবস্থায় মানুষ এ কাজ করতে পারে না। মানসিক সংশয় এবং বিশৃঙ্খলা, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তির মন দোদুল্যমান, যার চিন্তা একাগ্র নয়, চিন্তা ও কর্মের বিভিন্ন পথ যাকে বিভ্রান্ত করে অথবা করতে পারে, সে ধরণের কোন লোক এ কাজের উপযোগী হতে পারে না। যে ব্যক্তি এ কাজ সম্পন্ন করবে তাকে নিঃসংশয় চিত্তে খোদার ওপর বিশ্বাস করতে হবে এবং কুরআনে বর্ণিত খোদার গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারের ওপর অবিচল ঈমান আনতে হবে। তাকে আখেরাতের ওপর অটল বিশ্বাস রাখতে হবে এবং কুরআনে আখেরাতের চিত্র যেভাবে বর্ণিত হয়েছে হুবহু সেভাবে বিশ্বাস করতে হবে। তাকে বিশ্বাস করতে হবে, মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (স) প্রদর্শিত পথই একমাত্র সত্য পথ এবং তার বিরোধী বা তার সাথে সামঞ্জস্যহীন প্রত্যেকটি পথই ভ্রান্ত। তাকে বিশ্বাস করতে হবে, মানুষের যে কোন চিন্তা ও যে কোন পদ্ধতি যাচাই করার একটি মাত্র মানদণ্ড আছে এবং তা হচ্ছে খোদার কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত। এ মানদণ্ডে যে উতরে যাবে সে সত্য ও অভ্রান্ত আর যে উতরে যাবে না সে বাতিল ও ভ্রান্ত। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা পরিগঠনের জন্য এ সত্যগুলোর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং চিন্তার পূর্ণ একাগ্রতা লাভ করতে হবে। যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে সামান্য দোদুল্যমান অবস্থায় বিরাজ করে অথবা এখনো অন্যান্য পথের প্রতি আগ্রহশীল তার এ প্রাসাদের কারিগর হিসেবে অগ্রসর হবার আগে নিজের এ দুর্বলতার চিকিৎসা করা প্রয়োজন।
চরিত্র ও কর্ম
তৃতীয় অপরিহার্য গুণটি হচ্ছে, কাজ কথা অনুযায়ী হতে হবে। যে বস্তুকে সে সত্য মনে করে তার অনুসরন করবে, যাকে বাতিল গণ্য করে তা থেকে দূরে সরে যাবে, যাকে নিজের দ্বীন ঘোষণা করে তাকে নিজের চরিত্র ও কর্মের দ্বীনে পরিণত করবে এবং যে বস্তুর দিকে সে বিশ্বাসীকে আহবান জানায় সর্বপ্রথম সে নিজে তার আনুগত্য করবে। সৎ কাজে আনুগত্য এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য তাকে বাইরে কোন চাপ প্রভাবের মুখাপেক্ষী হওয়া উচিৎ নয়। কোনো কাজ করলে খোদার সন্তুষ্টি লাভ করা যাবে, কেবল এতোটুকু কারণেই তার আন্তরিক আগ্রহ ও ইচ্ছা সহকারে ঐ কাজ সম্পন্ন করা উচিৎ। আবার কোন কাজ নিছক খোদার নিকট অপছন্দ হবার কারণেই সে তা থেকে বিরত থাকবে। তার এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেবল সাধারণ অবস্থায় হওয়া উচিৎ নয় বরং তার চারিত্রিক শক্তি এতই উন্নত পর্যায়ের হতে হবে যে, অস্বাভাবিক বিকৃত পরিবেশে তাকে সকল প্রকার ভয়-ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবেলা করে এবং সবরকম বিরোধিতা ও প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেও সত্য পথে অবিচল থাকতে হবে। যার মধ্যে এ গুণ নেই সে সমাজ সংস্কার ও পরিগঠনের কাজে সাহায্যকারী হতে পারে কিন্তু সে প্রকৃত কর্মী হতে পারে না। ইসলামের জন্য যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে সামান্যতম ভক্তি, শ্রদ্ধা ও দরদ রাখে সে এ কাজে সাহায্যকারী হতে পারে। এমনকি যে ব্যক্তি ইসলামের অস্বীকারকারী ও তার বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে তৎপর নয় সেও অনেকটা এর সহায়ক হতে পারে। কিন্তু এ ধরণের কোটি কোটি সাহায্যকারী থাকলেও কার্যতঃ ইসলামী ব্যবস্থা প্রবর্তিত হতে পারে না এবং জাহেলিয়াতের বিকাশ ও পরিপুষ্টি সাধনের গতি রুদ্ধ হতে পারে না। কার্যতঃ এ কাজ একমাত্র তখনই সম্পাদিত হতে পারে, যখন এর জন্য এমন একদল লোক সামনে অগ্রসর হবে যারা জ্ঞান ও বিশ্বাসের সাথে চরিত্র ও কর্মশক্তি সমন্বিত হবে এবং যাদের ঈমান ও বিবেক এতো বিপুল জীবনী-শক্তির ধারক হবে যার ফলে বাইরের কোন উস্কানী ছাড়াই নিজেদের আভ্যন্তরীণ তাকীদে তার দ্বীনের চাহিদা ও দাবী পূরণ করতে থাকবে। এ ধরণের কর্মীরা যদি ময়দানে নেমে আসে তাহলে মুসলিম সমাজে এমনকি অমুসলিম সমাজেও সর্বত্র যে বিপুল সংখ্যক সমর্থক ও সাহায্যকারী পাওয়া যায় তাদের উপস্থিতিও ফলপ্রসূ হতে পারে।
দ্বীন হচ্ছে জীবনোদ্দেশ্য
সমাজ সংস্কার ও পরিগঠনে ব্রতী কর্মীদের মধ্যে এ তিনটি গুণাবলীর সাথে সাথে আর একটি গুণ থাকতে হবে। তা হলো খোদার বাণী বুলন্দ করা এবং দ্বীনের প্রতিষ্ঠা নিছক তাদের জীবনের একটি আকাঙ্খার পর্যায়ভূক্ত হবে না বরং এটিকে তাদের জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করতে হবে। এক ধরণের লোক দ্বীন সম্পর্কে অবগত হয়, তার উপর ঈমান রাখে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে কিন্তু তার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম তাদের জীবনের লক্ষ্য বিবেচিত হয় না বরং সততা ও সৎকর্ম করে এবং এই সঙ্গে নিজেদের দুনিয়ার কাজ কারবারে লিপ্ত থাকে। নিঃসন্দেহে এরা সৎ লোক। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কার্যতঃ প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকলে তারা ভাল নাগরিকও হতে পারে। কিন্তু যেখানে জাহেলী জীবনব্যবস্থা চর্তুদিক আচ্ছন্ন করে রাখে এবং তাকে সরিয়ে তদস্থলে ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার প্রশ্ন দেখা দেয় সেখানে নিছক এ ধরণের সৎলোকদের উপস্থিতি কোনো কাজে আসে না বরং সেখানে এমন সব লোকের প্রয়োজন হয় যাদের জীবনোদ্দেশ্যরুপে এ কাজ বিবেচিত হয়। দুনিয়ার অন্যান্য কাজ তারা অবশ্যি করবে কিন্তু তাদের জীবন একমাত্র এ উদ্দেশ্যের চারিদিকে আবর্তন করবে। এ উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য তারা হবে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এ জন্যে নিজেদের সময়-সামর্থ, ধন-মাল ও দেহ-প্রাণের সকল শক্তি এবং মন মস্তিষ্কের পরিপূর্ণ যোগ্যতা ব্যয় করতে তারা প্রস্তুত হবে। এমন কি যদি জীবন উৎসর্গ করার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে তাতেও তারা পিছপা হবে না। এ ধরণের লোকেরাই জাহেলিয়াতের আগাছা কেটে ইসলামের পথ পরিস্কার করতে পারে।
দ্বীনের সঠিক নির্ভুল জ্ঞান, তার প্রতি অটল বিশ্বাস, সেই অনুযায়ী চরিত্র গঠন এবং তার প্রতিষ্ঠাকে জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করা এগুলো এমন সব মৌলিক গুণ যেগুলো ব্যক্তিগতভাবে ইসলামী জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টারত প্রত্যেকটি ব্যক্তির মধ্যে থাকা উচিৎ। এগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। অর্থাৎ এ গুনাবলীর অধিকারী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ছাড়া এ কাজ সম্পাদনের কল্পনাই করা যেতে পারে না।
বলাবাহুল্য, এহেন ব্যক্তিরা যদি সত্যিই কিছু করতে চায় তাহলে তাদের একটি দলভুক্ত হয়ে এ কাজ করা অপরিহার্য। তারা যে কোন দল-ভুক্ত হোক এবং যে কোন নামে কাজ করুক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি জানে, নিছক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সমাজব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনা যেতে পারে না। এজন্যে বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা নয়, সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কাজেই একে একটি সর্ববাদী সম্মত সত্য মনে করে এখন আমরা এ ধরণের দলের মধ্যে দলীয় যে সব গুণ থাকা অপরিহার্য সেগুলোর আলোচনায় প্রবৃত্ত হবো।
দলীয় গুণাবলী
ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা
এ ধরণের দলের মধ্যে সর্বপ্রথম যে গুণটি থাকতে হবে তা হচ্ছে, তার অর্ন্তভূক্ত প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরস্পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। প্রাসাদের প্রত্যেকটা ইট মজবুতভাবে একটার সাথে আরেকটা মিশে থাকলে তবে প্রাসাদটি মজবুত হয়। সিমেন্ট এ ইটগুলোকে পরস্পরের সাথে মিশিয়ে রাখে। তেমনিভাবে কোন দলের সদস্যদের দিল পরস্পরের সাথে একসূত্রে গ্রথিত থাকলে তবেই তা ইস্পাত প্রাচীরে পরিণত হয়। আর এ দিলগুলোকে একসূত্রে গ্রথিত করতে পারে আন্তরিক ভালোবাসা, পারস্পারিক কল্যাণাকাঙ্খা, সহানুভূতি ও পরস্পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার। ঘৃণাকারী দিল কখনো পরস্পরে মিলেমিশে থাকতে পারে না। মুনাফেকী ধরণের মেলামেশা কখনো সত্যিকার ঐক্য সৃষ্টি করতে পারে না। স্বার্থবাদী ঐক্য মোনাফেকীর পথ প্রশস্ত করে। আর নিছক একটি শুষ্ক-নিরস ব্যবসায়িক সম্পর্ক কোন সৌহার্দ ও সহযোগিতার ভিত্তিতে পরিণত হতে পারে না। কোন পার্থিব স্বার্থ এ ধরণের সম্পর্কহীন লোকদেরকে একত্রিত করলেও তারা নিছক বিক্ষিপ্ত হবার জন্যই একত্রিত হয় এবং কোন মহৎ কাজ সম্পাদনের পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে হানাহানী করেই শেষ হয়ে যায়। যখন একদল নিঃস্বার্থ চিন্তার অধিকারী ও জীবনোদ্দেশ্যের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগী লোক একত্রিত হয় অতঃপর চিন্তার এই নিঃস্বার্থতা ও উদ্দেশ্যের প্রতি এ অনুরাগ তাদের নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সৃষ্টি করে কেবল মাত্র তখনই একটি মজবুত ও শক্তিশালী দলের সৃষ্টি হতে পারে। এ ধরণের দল আসলে ইস্পাত প্রাচীরের ন্যায় অটুট হয়। শয়তান এর মধ্যে ফাটল ধরাবার কোন পথই পায় না। আর বাহির থেকে বিরোধীতার তুফান এনে এর বিরুদ্ধে দাঁড় করালেও একে স্থানচ্যুত করতে পারে না।
পারস্পারিক পরামর্শ
দ্বিতীয় প্রয়োজনীয় গুণ হচ্ছে, এ দলকে পারস্পারিক পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে এবং পরামর্শের নিয়ম-নীতি পুরোপুরি মেনে চলতে হবে। যে দলের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের ইচ্ছামতো চলে এহেন স্বেচ্ছাচারী দল আসলে কোন দল হয় না বরং নিছক একটি জনমন্ডলী। এহেন জনমন্ডলী কোন কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয় না। অনুরুপভাবে যে দলের এক ব্যক্তি বা কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির একটি গ্রুপ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসে এবং বাদ বাকি সবাই তার ইঙ্গিতে পরিচালিত হয় এহেন দলও বেশী দিন টিকে থাকতে পারে না। একমাত্র পরামর্শের মাধ্যমে প্রতিটি বিষয়ের ভালো-মন্দ দিকগুলো পর্যালোচনা করে একটি ভালো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে বরং এর মাধ্যমে আরো দুটি ফায়দাও হাসিল হয়।
এক. যে কাজের পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমগ্র দলের পরামর্শ কার্যকরী থাকে সমগ্র দল মানসিক নিশ্চিন্ততার সাথে তা সম্পাদন করার চেষ্টা করে সেক্ষেত্রে একথা কেউ চিন্তা করে না যে, ওপর থেকে কোন বস্তু তার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
দুই. এভাবে সমগ্র দল সমস্যা ও ঘটনাবলী অনুধাবন করার শিক্ষা লাভ করে। প্রত্যেক ব্যক্তি দল ও তার কাজের প্রতি আগ্রহ পোষণ করে এবং তার পথেকে গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহকে নিজের সিদ্ধান্ত মনে করে। কিন্তু এজন্যে শর্ত হচ্ছে, পরামর্শের নিয়ম-নীতি পালণ করে চলতে হবে। আর পরামর্শের নিয়মনীতি হচ্ছে ঃ প্রত্যেক ব্যক্তি ঈমানদারীর সাথে নিজের মত পেশ করবে এবং মনে মধ্যে কোন কথা লুকিয়ে রাখবে না। আলোচনায় কোন প্রকার জিদ, হঠধর্মিতা ও বিদ্বেষের আশ্রয় নেবে না। এবং সংখ্যাধিক্যের মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যাওয়ার পর ভিন্ন মতের অধিকারীরা নিজেদের মত পরিবর্তন না করলেও দলীয় সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার জন্যে সানন্দে অগ্রসর হবে। এ তিনটি বিষয়ের প্রতি ল্ক্ষ্য না রাখলে পরামর্শের সমস্ত ফায়দাই নষ্ট হয়ে যায়। বরং এটিই পরিশেষে দলের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে।
সংগঠন ও শৃঙ্খলা
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে, সংগঠন, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, পারস্পারিক সহযোগিতা ও একটি টিমের ন্যায় কাজ করা। একটি দল তার সব রকমের গুণাবলী সত্ত্বেও কেবলমাত্র নিজের সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনাসমূহ কার্যকরী করতে সক্ষম না হওয়ার কারণে ব্যর্থ হয়ে যায়। আর এটি হয় সংগঠন, শৃঙ্খলা ও সহযোগিতার অভাবের ফলশ্রুতি। ধ্বংসমূলক কাজ নিছক হৈ-হাঙ্গামার সাহায্যেও সমাধা হতে পারে। কিন্তু কোন গঠনমূলক কাজ সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া সম্পাদিত হতে পারে না। সমগ্র দলের একযোগে দল কর্তৃক গৃহীত নিয়ম-নীতির অনুসারী হওয়ার নামই হচ্ছে সংঘদ্ধ প্রচেষ্টা। দলের মধ্যে যে ব্যক্তিকে কোন পর্যায়ে কর্তৃত্বশীল করা হয় তার নির্দেশাবলী মেনে চলতে হবে। দলের প্রত্যেক ব্যক্তিকে কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হবে এবং তার ওপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যথাসময়ে নিষ্ঠার সাথে তা সম্পাদন করার চেষ্টা করতে হবে। যে কর্মীদের ওপর সম্মিলিতভাবে কাজ করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তাদের পরস্পরের মধ্যে পূর্ণ সহযোগীতা থাকতে হবে। দলের মেশিন এমন পর্যায়ে সক্রিয় হতে হবে যে, একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার সাথে সাথেই তাকে কার্যকরী করার জন্যে তার সকল কল-কব্জা চালু হয়ে যাবে। দুনিয়ায় এ ধরণের দলই কোন কাজ সম্পন্ন করতে পারে। অন্যথায় যেসব দল কল-কব্জা সংগ্রহ করে কিন্তু সেগুলো যথাস্থানে সংযোজিত করে যথারীতি মেশিনের মত চালাবার ব্যবস্থা করেনি তাদের থাকা না থাকা সমান হয়ে দাঁড়ায়।
সংস্কারের উদ্দেশ্যে সমালোচনা
সর্বশেষ ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে, দলের মধ্যে সংস্কারের উদ্দেশ্যে সমালোচনা করার যোগ্যতাও দলের থাকতে হবে। অন্ধ অনুসারী ও সরলমনা ভক্তবৃন্দ যতই সঠিক স্থান থেকে কাজ শুরু করুক না কেন এবং যতই নির্ভুল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সামনে রেখে অগ্রসর হোক না কেন, অবশেষে তারা সমগ্র কাজ বিকৃত করে যেতে থাকে। কারণ মানবিক কাজে দুর্বলতার প্রকাশ স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যেখানে দুর্বলতার প্রতি নজর রাখার কেউ থাকে না অর্থাৎ তা চিহ্নিত করা দোষরুপে বিবেচিত হয় না, সেখানে গাফলতি বা অক্ষমতা পূর্ণ নিরবতার কারণে সব রকমের দুর্বলতা, নিরুদ্বেগ ও নিশ্চিন্ততার আশ্রয়স্থলে পরিণত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা দ্বিগুণ চর্তুগুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দলের সুস্থ-সবল অবয়ব ও রোগমুক্ত দেহের জন্যে সমালোচনার অভাবের চাইতে ক্ষতিকর আর কিছু নেই। আর সমালোচনামূলক চিন্তাকে দাবিয়ে দেয়ার চাইতে দলের জন্যে বড় অকল্যাণাকাঙ্খা আর কিছুই হতে পারে না। এ সমালোচনার মাধ্যমেই দোষ-ত্রুটি যথাসময়ে প্রকাশিত হয় এবং তার সংশোধনের চেষ্টা চালানো যায়। কিন্তু সমালোচনার অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে এই যে, তা দোষ দেখাবার উদ্দেশ্যে হতে পারবে না বরং পূর্ণ আন্তরিকতা সহকারে সংশোধনের উদ্দেশ্যে হতে হবে। এবং এই সঙ্গে দ্বিতীয় সমান গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে এই যে, সমালোচনাকারীকে যথার্থ সমালোচনার পদ্ধতিতে সমালোচনা করতে হবে। একজন দোষ সন্ধানকারী সদুদ্দেশ্য প্রনোদিত সমালোচকের বেয়াড়া, বেকায়দা, অসময়োচিত ও বাজে সমালোচনাও দলকে ঠিক একই পর্যায়ের ক্ষতির সম্মুখীন করতে পারে।
পূর্ণতাদানকারী গুণাবলী
এ পর্যন্ত আমরা সমাজ সংশোধন ইসলামী জীবনব্যবস্থা পরিগঠনের জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠনের অপরিহার্য গুণাবলী আলোচনা করেছি। এ প্রসঙ্গে যেসকল বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো নিছক প্রারম্ভিক ও মৌলিক গুণাবলীর পর্যায়ভুক্ত। কোন ব্যবসা শুরু করতে হলে যেমন একটা সর্বনিন্ম পুঁজির প্রয়োজন হয়, যা না হলে ঐ ব্যবসা শুরু করাই যেতে পারে না। তেমনি এ গুণাবলী হচ্ছে ব্যক্তির সর্বনিম্ন নৈতিক পুঁজি, এগুলো ছাড়া সমাজ সংশোধন ও ইসলামী জীবনব্যবস্থা পরিগঠনের কাজ শুরু করাই যেতে পারে না। বলাবাহুল্য যেসব লোক নিজেরা ইসলাম সম্পর্কে অবগত নয় বা এ ব্যাপারে মানসিক নিশ্চিন্ততা ও একাগ্রতা লাভ করতে পারেনি অথবা তাকে নিজেদের চরিত্র, কর্ম ও বাস্তব জীবনের ধর্মে পরিণত করতে সক্ষম হয়নি বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে নিজেদের জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করেনি, তাদের দ্বারা কোন ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তাই করা যায় না। অনুরূপভাবে যদি অভিপ্সীত গুণাবলী সমন্বিত ব্যক্তিবর্গের নিছক সমাবেশ হয় কিন্তু তাদের দীল পরস্পরের সাথে সংযুক্ত না হয়, তাদের মধ্যে সহযোগীতা শৃঙ্খলা ও সংগঠন না থাকে, তারা এক সাথে মিলেমিশে কাজ করার রীতিতে অভ্যস্ত না থাকে এবং পারস্পারিক পরামর্শ ও সমালোচনার যথার্থ পদ্ধতি সম্পর্কে যদি তারা অজ্ঞ থাকে, তাহলে তাদের নিছক সমাবেশ কোন প্রকার ফলপ্রসূ হতে পারে না। কাজেই এ কথা ভালোভাবে অনুধাবন করা উচিৎ যে, ইতিপূর্বে আমি যে চারটি ব্যক্তিগত ও চারটি সামষ্টিক গুণাবলীর উল্লেখ করে এসেছি সেগুলোই হচ্ছে এ কাজা শুরু করার প্রাথমিক পুঁজি এবং একমাত্র এ প্রেক্ষিতেই সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ কাজের বিকাশ ও সাফল্যের জন্য নিছক এতটুকু নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পুঁজি যথেষ্ট-এ ধারণা যথার্থ নয়। এখন আমরা অপরিহার্য গুণাবলীর আলোচনা করবো।
খোদার সাথে সম্পর্ক ও আন্তরিকতা
এ গুণাবলীর মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, খোদার সাথে সম্পর্ক ও আন্তরিকতা। দুনিয়ার অন্যান্য কাজ ব্যক্তি, পরিবার, গোত্র, জাতি বা দেশের জন্যে করা যেতে পারে, ব্যক্তিস্বার্থ ও ব্যক্তিগত লাভের যাবতীয় দিক সম্ভাবনা সহকারে সম্পাদন করা যেতে পারে, খোদা বিশ্বাসই নয়, খোদাকে অস্বীকার করেও করা যেতে পারে এবং এর ভেতর সব রকম পার্থিব সাফল্য লাভের সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু ইসলামী জীবনব্যবস্থা কায়েম করা একটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী কাজ। যে পর্যন্ত মানুষের সম্পর্ক খোদার সাথে যথার্থ শক্তিশালী ও গভীর না হয় এবং সে একমাত্র খোদার জন্যে কাজ করতে মনস্থ না করে সে পর্যন্ত এ কাজে কোন প্রকার সাফল্য সম্ভব নয়। কারণ এখানে মানুষ খোদার দ্বীনকে কায়েম করতে চায়। আর এ জন্যে সবকিছু খোদার জন্যে করা প্রয়োজন দেখা দেয়। এ কাজে একমাত্র খোদার সন্তুষ্টিই কাম্য হতে হবে। একমাত্র খোদাপ্রীতিই এ কর্মের মূল প্রেরণা হতে হবে। তাঁর সাহয্য ও সমর্থনের ওপর পূর্ণ আস্থা থাকতে হবে। তাঁরই নিকট থেকে পুরস্কারের আশা থাকতে হবে। এবং তাঁরই নিকট জবাবদিহীর ভয়ে সমগ্র মন আচ্ছন্ন থাকতে হবে। এছাড়া আর কোন ভয়, লোভ-লালসা প্রীতি ও আনুগত্যের মিশ্রণ এবং অন্য যে কোন স্বার্থের অন্তর্ভুক্তি এ কাজকে যথার্থ পথ থেকে বিচ্যুত করবে এবং এর ফলে অন্যকিছু কায়েম হতে পারে কিন্তু খোদার দ্বীন কায়েম হতে পারে না।
আখেরাতের চিন্তা
এ প্রথোমোক্ত গুণটির সাথে নিকট সম্পর্কযুক্ত দ্বিতীয় গুণটি হচ্ছে, আখেরাতের চিন্তা। যদিও দুনিয়াই মু’মিনের কর্মস্থল এবং সবকিছু তাকে এখানেই করতে হয়। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও সে এ দুনিয়ার জন্যে কাজ করে না বরং আখেরাতের জন্যে করে এবং দুনিয়ার ফলাফলের দিকে তার লক্ষ্য থাকে না বরং তার লক্ষ্য থাকে আখেরাতের ফলাফলের প্রতি। যেসব কাজ আখেরাতে লাভজনক সেসব তাকে করতে হবে এবং যেসব কাজের ফলে আখেরাতের কোন লাভ হবে না সেগুলো তাকে বর্জন করতে হবে। আর দুনিয়ার যেসব ক্ষতি আখেরাতে লাভজনক সেগুলো তাকে গ্রহণ করতে হবে আর দুনিয়ার যেসব ক্ষতি আখেরাতে লাভজনক সেগুলো তাকে গ্রহণ করতে হবে। তাকে একমাত্র আখেরাতের শাস্তি ও পুরস্কারের চিন্তা করতে হবে। দুনিয়ার কোন শাস্তি ও পুরস্কারের গুরুত্ব তার চোখে থাকা উচিৎ নয়। এ দুনিয়ায় তার চেষ্টা ফলপ্রসূ হোক বা না হোক, সে সফলতা বা ব্যর্থতা যারই সম্মুখীন হোক, সে পুরুস্কার লাভ করুক বা পরীক্ষার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হোক, সকল অবস্থায় তাকে এ বিশ্বাস নিয়ে কাজ করা উচিৎ যে, যে খোদার জন্যে সে এ পরিশ্রম করছে তাঁর দৃষ্টি থেকে কিছুই প্রচ্ছন্ন নেই এবং তাঁর নিকট আখেরাতের চিরন্তন পুরস্কার পাওয়া থেকে সে কোনক্রমেই বঞ্চিত হবে না এবং সেখানকার সাফল্যই হচ্ছে আসল সাফল্য। এ মানসিকতা ছাড়া এ পথে মানুষের পক্ষে নির্ভুল লক্ষ্য এর দিকে এক পা অগ্রসর হওয়াও সম্ভব নয়। দুনিয়ার স্বার্থের সামান্যতম মিশ্রণ এর মধ্যে থাকলে এখানে পদস্খলন ছাড়া গত্যন্তর নেই। যে ব্যক্তি দুনিয়ার সাফল্যকে চুড়ান্ত লক্ষ্যে পরিণত করে অগ্রসর হয় খোদার পথে একটি না হলেও দু’চারটি আঘাতেই সে হিম্মতহারা হয়ে পড়ে। দুনিয়ার স্বার্থ যার মনে স্থান লাভ করে এ পথের যে কোন সাফল্য কোন না কোন পর্যায়ে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনে।
চরিত্র মাধুর্য
চরিত্র মাধুর্য উপরোক্ত গুণটির প্রভাবকে কার্যতঃ একটি বিরাট বিজয়ী শক্তিতে পরিণত করে। খোদার পথে যারা কাজ করে তাদের উদার হৃদয় ও বিপুল হিম্মতের অধিকারী হতে হবে, সৃষ্টির প্রতি সহানুভুতিশীল ও মানবতার দরদী হতে হবে। তাদের হতে হবে ভদ্র ও কোমল স্বভাবসম্পন্ন, আত্মনির্ভরশীল ও কষ্টসহিষ্ণু, মিষ্টভাষী ও সদালাপী। তাদের দ্বারা কোন ক্ষতি হবে এমন কোন ধারণাও যেন কেউ পোষন করতে না পারে এবং তাদের নিকট থেকে কল্যাণ ও উপকার সবাই কামনা করবে। তারা নিজেদের প্রাপ্যের চাইতে কমের ওপর সন্তুষ্ট থাকবে এবং অন্যকে তার প্রাপ্যের চাইতে বেশী দিতে প্রস্তুত থাকবে। তারা মন্দের জবাব ভালো দিয়ে দেবে অথবা কমপক্ষে মন্দ দিয়ে দেবে না। তারা নিজেদের দোষ-ত্রুটি স্বীকার করবে এবং অন্যের গুণাবলীর কদর করবে। তারা অন্যের দুর্বলতার প্রতি নজর না দেবার মত বিরাট হৃদয়পটের অধিকারী হবে, অন্যের দোষ-ত্রুটি ও বাড়াবাড়ি মাফ করে দেবে এবং নিজের জন্যে কারোর উপর প্রতিশোধ নেবে না। তারা অন্যের সেবা গ্রহণ করে নয় বরং অন্যকে সেবা করে আনন্দিত হবে। তারা নিজের স্বার্থে নয় বরং অন্যের ভালোর জন্য কাজ করবে। কোন প্রকার প্রশংসার অপেক্ষা না করে এবং কোন প্রকার নিন্দাবাদের তোয়াক্কা না করে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাবে। খোদা ছাড়া আর কারো পুরস্কারের প্রতি দৃষ্টি দেবে না। তাদেরকে বল প্রয়োগে দমন করা যাবে না। ধন-সম্পদের বিনিময়ে ক্রয়করা যাবে না কিন্তু সত্য ও ন্যায়ের সামনে তারা নির্দ্বিধায় ঝুঁকে পড়বে। তাদের শত্রুরাও তাদের ওপর এ বিশ্বাস রাখবে যে, কোন অবস্থায় তারা ভদ্রতা ও ন্যায়-নীতি বিরোধী কোন কাজ করবে না। এ চারত্রিক গুণাবলী মানুষের মন জয় করে নেয়। এগুলো তলোয়ারের চাইতে ধারালো এবং হীরা, মণি-মুক্তার চাইতেও মূল্যবান। যে এহেন চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনকারী সে তার চারপাশের জনবসতির ওপর বিজয় লাভ করে। কোন দল পূর্ণাঙ্গরূপে এ গুণাবলীর অধিকারী হয়ে কোন মহান উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যে সুসংবদ্ধ প্রচেষ্টা চালালে দেশের পর দেশ তার করতলগত হতে থাকে এবং দুনিয়ার কোন শক্তিই তাকে পরাজিত করতে সক্ষম হয় না।
ধৈর্য
এই সঙ্গে আর একটি গুণও সংযুক্ত আছে, তাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলা যায়। সেটি হচ্ছে ধৈর্য। ধৈর্যের বহু অর্থ হয় এবং খোদার পথে যারা কাজ করে তাদের এর প্রত্যেকটি অর্থের প্রেক্ষিতেই ধৈর্যশীল হতে হয়।
ধৈর্যের একটি অর্থ হচ্ছে তাড়াহুড়ো না করা, নিজের প্রচেষ্টার ত্বড়িৎ ফল লাভের জন্যে অস্থির না হওয়া এবং বিলম্ব দেখে হিম্মত হারিয়ে না বসা। ধৈর্যশীল ব্যক্তি সারাজীবন একটি উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যে অনবরত পরিশ্রম করতে থাকে এবং একের পর এক ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েও পরিশ্রম থেকে বিরত হয় না। মানুষের সংশোধন ও জীবন পরিগঠনের কাজ অন্তহীন ধৈর্যের মুখাপেক্ষী। বিপুল ধৈর্য ছাড়া কোন ব্যক্তি এ কাজ সম্পাদনে সক্ষম হয় না। এটা নিছক ছেলের হাতের মোয়া নয়।
ধৈর্যের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে তিক্ত স্বভাব, দুর্বল মত ও সংকল্পহীনতার রোগে আক্রান্ত না হওয়া। ধৈর্যশীল ব্যক্তি একবার ভেবেচিন্তে যে পথ অবলম্বন করে তার ওপর অবিচল থাকে এবং একাগ্র ইচ্ছা ও সংকল্পের পূর্ণ শক্তি নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে।
ধৈর্যের আর একটি অর্থ হচ্ছে বাঁধা বিপত্তির বিরোচিত মোকাবেলা করা এবং শান্ত চিত্তে লক্ষ্য অর্জনের পথে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট বরদাশত করা। ধৈর্যশীল ব্যক্তি যে কোন ঝড়-ঝঞ্জার পর্বত প্রমাণ তরঙ্গাঘাতে হিম্মতহারা হয়ে পড়ে না।
দুঃখ-বেদনা, ভরাক্রান্ত ও ক্রোধান্বিত না হওয়া এবং সহিষ্ণু হওয়াও ধৈর্যের একটি অর্থ। যে ব্যক্তিকে সমাজ সংশোধন ও পরিগঠনের খাতিরে কিছু অপরিহার্য ভাঙ্গার কাজও করতে হয়, বিশেষ করে যখন দীর্ঘকালের বিকৃত সমাজে তাকে এ কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়, তখন অবশ্যি তাকে বড়ই নিম্নস্তরের হীন ও বিশ্রী রকমের বিরোধীতার সম্মুখীন হতে হয়। যদি সে গাল খেয়ে হাসবার ও নিন্দাবাদ হজম করার ক্ষমতা না রাখে এবং দোষারোপ ও মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডাকে নির্বিবাদে এড়িয়ে গিয়ে স্থির চিত্তে ও ঠান্ডা মস্তিষ্কে নিজের কাজে ব্যস্ত না থাকতে পারে, তাহলে এ পথে পা না বাড়ানোই তার জন্যে বেহতর কারণ এ পথে কাঁটা বিছানো। এর প্রত্যেকটি কাঁটা এই দৃঢ় মনোবল নিয়ে মুখ উঁচিয়ে আছে যে, মানুষ অন্য যে কোনদিকে নির্বিঘ্নে অগ্রসর হতে পারে কিন্তু এ দিকে তাকে এক ইঞ্চিও এগিয়ে আসতে দেয়া হবে না। এ অবস্থায় যে ব্যক্তি কাপড়ের প্রত্যেকটি কাঁটা ছাড়াতে ব্যস্ত হবে সে কেমন করেই বা অগ্রসর হবে? এ পথে এমন সব লোকের প্রয়োজন যারা নিজেদের কাপড়ে কোন কাঁটা বিধলে কাপড়ের সে অংশটি ছিড়ে কাঁটাগাছের গায়ে রেখে দিয়ে নিজের পথে এগিয়ে যেতে থাকবে। কেবল বিরোধীদের মোকাবেলায় এ ধৈর্যের প্রয়োজন হয় না বরং অনেক সময় এ পথের পথিকের নিজের সহযোগীদের তিক্ত ও বিরক্তিকর বাক্যবাণেও বিদ্ধ হতে হয় এবং তাদের ব্যাপারে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় না দিলে সমগ্র কাফেলা পথভ্রষ্ট হতে পারে।
ধৈর্যের এক অর্থ হচ্ছে, সকল প্রকার ভয়ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবেলায় সঠিক পথে অবিচল থাকা, শয়তানের উৎসাহ প্রদান ও নফসের খায়েশের বিপক্ষে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করা। হারাম থেকে দুরে থাকা ও খোদার নির্দেশিত সীমার মধ্যে অবস্থান করা, গোনাহর পথে যাবতীয় আরাম-আয়েশ, লাভ প্রত্যাখান করা এবং নেকী ও সততার পথে সকল প্রকার ক্ষতি ও বঞ্চনাকে সাদরে বরণ করা। দুনিয়াপুঁজারীদের আরাম-আয়েশ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেও তার প্রতি লোভ না করা এবং এজন্যে সামান্য আপেক্ষা না করা। দুনিয়ার স্বার্থ উদ্ধারের পথ প্রশস্ত দেখে এবং সাফল্যের সুযোগ-সুবিধা নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েও পূর্ণ মানসিক নিশ্চিন্ততার সাথে একমাত্র নিজের লক্ষ্য অর্জনের পথে লব্ধ দানের ওপর সন্তুষ্ট থাকার নাম ধৈর্য।
উপরোক্ত সকল অর্থেই ধৈর্য হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি। কাজেই আমাদের কাজের মধ্যে যে কোন দিক দিয়ে ধৈর্যহীনতা দেখা দিলে অবশ্য আমাদেরকে তার কুফলের সম্মুখীন হতে হবে।
প্রজ্ঞা
এসব গুণের পাশাপাশি আর একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে প্রজ্ঞা। কাজের বেশী সাফল্য এরই ওপর নির্ভরশীল। দুনিয়ায় যেসব জীবনব্যবস্থা কায়েম রয়েছে উন্নত পর্যায়ের বুদ্ধিজীবি ও চিন্তাশীল লোকেরাই সেগুলো চালাচ্ছে। তাদের পেছনে ব্যক্তিগত উপায়-উপকরণের সাথে সাথে বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষমতাও কাজ করছে। এগুলোর মোকাবেলায় আর একটি জীবনব্যবস্থা কায়েম করা এবং সাফল্যের সাথে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নেহায়েত ছেলে খেলা নয়। নিছক বিসমিল্লাহর গম্বুজে যাদের বসবাস এ কাজ তাদের দ্বারা সাধিত হওয়া সম্ভব নয়। সরলমনা, চিন্তা ও তীক্ষবুদ্ধি বিবর্জিত লোকেরা যতই সৎ নেক-দীল হোক না কেন, এ কাজ তাদের দ্বারা সম্পাদিত হবার সম্ভাবনা নেই। এ জন্যে গভীর দৃষ্টি, চিন্তাশক্তি, বুদ্ধি ও বিবেচনা শক্তির প্রয়োজন। এ কাজ একমাত্র তাদের দ্বারাই সম্পাদিত হতে পারে যারা পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল, বিচার-বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে এবং জীবন সমস্যা বুঝার ও সমাধানের যোগ্যতা রাখে। এসব গুণকেই এক কথায় প্রজ্ঞা বলা যায়। বুদ্ধি ও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ও প্রকাশের ওপর এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
প্রজ্ঞার অভিব্যক্তি হচ্ছে মানবিক মনস্তত্ব অনুধাবন করে সেই অনুযায়ী মানুষের সাথে ব্যবহার করা, এবং মানুষের মনের ওপর নিজের দাওয়াতের প্রভাব বিস্তার করে তাকে লক্ষ্য অর্জনে নিয়োজিত করার পদ্ধতি অবগত হওয়া। প্রত্যেক ব্যক্তিকে একই পেটেন্ট ওষুধ না দিয়ে বরং প্রত্যেকের মেজাজ ও রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করা। প্রত্যেককে একই লাঠি দিয়ে হাঁকিয়ে না দিয়ে বরং প্রত্যেক ব্যক্তি, শ্রেণী ও দলের বিশেষ অবস্থা অনধাবন করে সেই অনুযায়ী তাদের সাথে ব্যবহার করা।
নিজের কাজ ও তা সম্পাদন করার পদ্ধতি জানা এবং তার পথে আগত যাবতীয় বাঁধা-বিপত্তি, প্রতিবন্ধকতা-বিরোধীতার মোকাবেলা করাও প্রজ্ঞার অভিব্যক্তি। তাকে নির্ভুলভাবে জানতে হবে যে, যে উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যে সে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তা সফল করার জন্যে তাকে কি করতে হবে, কিভাবে করতে হবে এবং কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতা কিভাবে দূর করতে হবে।
পরিস্থিতির প্রতি নজর রাখা, সময়-সুযোগ অনুধাবন করা এবং কোন সময়ে কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে, এসব জানাও প্রজ্ঞারই পরিচয়। অবস্থা না বুঝেই অন্ধের মত পা বাড়িয়ে দেয়া, অসমায়োচিত কাজ করা, কাজের সময় ভুল করা গাফেল ও বুদ্ধিবিবেচনাহীন ব্যক্তির কাজ। এ ধরণের লোকেরা নিজেদের উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যে যতই সততা ও সৎ সংকল্পের সাথে কাজ করুক না কেন তারা কোন ক্রমেই কামিয়াব হতে পারে না।
দ্বীনের ব্যাপারে সূক্ষ্ম তত্ত্বজ্ঞান ও দুনিয়ার কাজ-কারবারের ক্ষেত্রে তীক্ষ্ম দূরদৃষ্টি রাখাই হচ্ছে সবচাইতে বড় প্রজ্ঞার পরিচয়। নিছক শরীয়তের বিধি-নিষেধ ও মাসায়েল অবগত হয়ে উপস্থিত ঘটনাবলীকে সে দৃষ্টিতে বিচার করা মুফতির জন্যে যথেষ্ঠ হতে পারে। কিন্তু বিকৃত সমাজের সংশোধন ও জীবনব্যবস্থাকে জাহেলিয়াতের ভিত্তি থেকে সমূলে উৎপাটিত করে দ্বীনের ভিত্তিতে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে যথেষ্ঠ হতে পারে না। এ উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যে বিধি-নিষেধের খুঁটিনাটি দিকের সাথে তার মূলগত দিকের (বরং পরিপূর্ণ দ্বীনি ব্যবস্থার) ওপর নজর রাখতে হবে। উপরন্তু বিধি-নিষেধের সাথে সাথে সেগুলোর কারণ, যৌক্তিকতা ও ফলাফল সম্পর্কেও ওয়াকিফহাল হতে হবে এবং যেসব সাময়িক পরিস্থিতি ও সমস্যাকে সে দৃষ্টিতে বিচার করতে হবে সেগুলোও বুঝতে হবে।
অভিপ্সীত গুনাবলীর এ বিরাট ফিরিস্তি দেখে আপাতঃ দৃষ্টিতে মানুষ ভীত হয়ে পড়ে এবং চিন্তা করতে থাকে যে, আল্লাহর কামেল বান্দাহ ছাড়া তো এ কাজ আর কারোর দ্বারা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে এতো বিচিত্র ও বিপুল গুণের সমাবেশ কেমন করে সম্ভব। এ ভুল ধারণা নিরসনের জন্যে অবশ্যই একথা জানা প্রয়োজন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে প্রত্যেকটি গুণ পরিপূর্ণরুপে পাওয়া সম্ভব নয় এবং কোন ব্যক্তির মধ্যে প্রথম পদেক্ষেপই তা পূর্ণ অনুশীলিত আকারে বিদ্যমান থাকাও জরুরী নয়। আমি একথা বলে বুঝাতে চাচ্ছি যে, যারা এ কাজ করতে অগ্রসর হবে তারা নিছক জাতি সেবার একটি কাজ মনে করে গতানুগতিক পদ্ধতিতে অগুসর হবে না বরং নিজের মনোজগত পর্যোলচনা করে কাজ সম্পাদনের জন্যে যে গুনাবলীর প্রয়োজন তার উপাদান তার মধ্যে আছে কি-না তা জানার চেষ্টা করবে। উপাদান থাকলে কাজ শুরু করার জন্যে যথেষ্ঠ। তাকে লালণ করা ও নিজের সামর্থ অনুযায়ী যথাসম্ভব অধিক উন্নত করা পরবর্তী পর্যায়সমূহের সাথে সম্পর্কিত। বীজ থেকে অঙ্কুরিত একটি ছোট্ট চারাগাছ মাটির গভীরে শিকড় পৌঁছিয়ে দেবার পর ধীরে ধীরে খাদ্য সংগ্রহ করে বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়। কিন্তু যদি বীজেরই অস্তিত্ব না থাকে তাহলে সেখানে কিছুই হতে পারে না। অনুরূপ ভাবে অভিপ্সীত গুণাবলীর উপাদান যদি মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকে তাহলে উপযুক্ত প্রচেষ্টা সাধনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে তা পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। কিন্তু যদি আদতে উপাদানই না থাকে তাহলে প্রচেষ্টা সাধনার মাধ্যমে কোন প্রকার গুণাগুণ সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়।
এ পর্যন্ত যা কিছু বলা হলো তার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে, সংশোধন ও পরিগঠনের জন্যে একটি নির্ভুল কর্মসূচীর যতটা প্রয়োজন তার চাইতে কয়েকগুণ বেশী প্রয়োজন এ কাজের উপযোগী নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন কর্মীদের। কারণ, কোন কর্মসূচীর দফাসমূহকে নয় বরং যেসব লোক কর্মেক্ষেত্রে কাজ করার জন্যে অগ্রসর হয় তাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক চরিত্রকেই অবশেষে সমাজ এবং সমষ্টির সাথে সংঘর্ষশীল ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। তাই কোন কর্মসূচী ও প্রোগ্রাম স্থির করার পূর্বে কাজের জন্যে কোন ধরণের কর্মীর প্রয়োজন, তাদের কোন গুণাবলী সমন্বিত হতে হবে ও কোন ত্রুটিমুক্ত হতে হবে এবং এ ধরণের কর্মী তৈরীর উপায় কি, এ সম্পর্কে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এ বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করার পর আমি অভিপ্সীত গুণাবলীকে তিন অংশে আলোচনা করতে চাই। প্রথমতঃ কাজের ভিত্তি হিসেবে এ কাজে অংশ গ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে যে সব গুণ থাকা উচিৎ সেগুলো হচ্ছেঃ
১) দ্বীনের নির্ভুল জ্ঞান;
২) তার প্রতি অটুট বিশ্বাস;
৩) সে অনুযায়ী চরিত্র গঠন ও কর্ম সম্পাদন;
৪) তাকে প্রতিষ্ঠিত করাকে নিজের জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করা।
দ্বিতীয়তঃ যে দল এ কাজ সম্পাদনে অগ্রসর হয় তার মধ্যে যে সব গুণ থাকা উচিৎ সেগুলো হচ্ছেঃ
১) পারস্পারিক ভালোবাসা, পরস্পরের প্রতি সুধারণা, আন্তরিকতা, সহানুভূতি, কল্যাণ কামনা ও পরস্পরের জন্যে ত্যাগ স্বীকার।
২) সংগঠন, শৃঙ্খলা, সুসংবদ্ধতা, নিয়মানুবর্তিতা, সহযোগীতা ও টীম স্প্রীরীট;
৩) সংশোধনের উদ্দেশ্যে সমালোচনা, এ সমালোচনা হতে হবে ভদ্রতার সাথে, যুক্তিসংগত পদ্ধতিতে, যার ফলে দলের মধ্যে সৃষ্ট অসৎ গুণাবলী বৃদ্ধি পাওয়ার পরিবর্তে যথাসময়ে তার অপনোদন সম্ভব হবে।
তৃতীয়তঃ দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে নির্ভুল পথে পরিচালিত করার ও তাকে সাফল্যের মঞ্জিলে পৌঁছাবার জন্যে যে সব গুণ অপরিহার্য সেগুলো হচ্ছেঃ
১) আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন ও তার সন্তুষ্টির জন্যে কাজ করা;
২) আখেরাতের জবাবদিহীকে স্মরণ রাখা এবং আখেরাতের পুরস্কার ভিন্ন অন্য কিছুর প্রতি নজর না দেয়া;
৩) চরিত্র মাধুর্য;
৪) ধৈর্য;
৫) প্রজ্ঞা।
এখন আমি এ মহান উদ্দেশ্য সম্পাদনে ব্রতী ব্যক্তিবর্গকে যেসব অসৎ গুণ থেকে মুক্ত হওয়া উচিৎ সেগুলো আলোচনা করবো।