মৌলিক ও অসৎ গুনাবলী
গর্ব ও অহংকার
সমস্ত সৎগুণের মুলোৎপাটনকারী প্রধানতম ও সবচাইতে মারাত্মক অসৎ গুণ হচ্ছে গর্ব অহংকার, আত্মাভিমান ও নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ। এটি একটি শয়তানী প্রেরণা এবং শয়তানী কাজেরই উপযোগী হতে পারে। শ্রেষ্ঠত্ব একমাত্র আল্লাহর সাথে সংযুক্ত। (তাই এ অসৎ গুণ সহকারে কোন সৎকাজ করা যেতে পারে না।) বান্দাহর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও অহংকার একটি নির্জলা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে ব্যক্তি বা দল এ মিথ্যা গর্ব-অহংকারে লিপ্ত থাকে সে খোদার সব রকমের সমর্থন থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ খোদা নিজের বান্দাহর মধ্যে এ বস্তুটিই সবচাইতে বেশী অপছন্দ করেন। ফলে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কোন ক্রমেই সঠিক পথ লাভ করতে পারে না। সে অনাবরত মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতে থাকে। এভাবে অবশেষে ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়। ফলে মানুষের সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সে যতই গর্ব ও অহংকারের প্রকাশ করে ততই তার বিরুদ্ধে ঘৃণার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এমনকি অবশেষে সে মানুষের চোখে ঘৃণিত হয়ে এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যার ফলে মানুষের ওপর তার কোন নৈতিক প্রভাব কায়েম থাকে না।
সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে যারা কাজ করে তাদের মধ্যে বিভিন্ন পথে এ রোগটি অনুপ্রবেশ করে। সংকীর্ণমনা লোকদের মনে এ রোগটি একটি বিশেষ পথে অনুপ্রবেশ করে। যখন আশেপাশের দ্বীনি ও নৈতিক অবস্থার তুলনায় তাদের অবস্থা অনেকটা ভালো হয়ে ওঠে এবং তারা কিছু উল্লেখযোগ্য জনসেবামূলক কার্যাবলী সম্পাদন করে, ফলে অন্যের মুখেও তার স্বীকৃতি শুনা যায়, তখন শয়তান তাদের দিলে ওয়াস্-ওয়াসা পয়দা করতে থাকে যে, সত্যিই তোমরা মহাবুজর্গ হয়ে গেছো। শয়তানের প্ররোচনায়ই তার স্বমুখে ও স্বকীয় কার্যের মাধ্যমে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে থাকে। এভাবে সৎকাজের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে কাজের সূচনা হয়েছিল তা ধীরে ধীরে ভুল পথে অগ্রসর হয়। এ রোগের অনুপ্রবেশের দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে যারা সদিচ্ছা সহকারে নিজের ও মানুষের সংশোধনের প্রচেষ্টা চালায় তাদের মধ্যে অবশ্য কিছু না কিছু সদগুণাবলী সৃষ্টি হয়, কোন না কোন পর্যায়ে তারা নিজেদের সমাজের সাধারণ অবস্থার মধ্যে বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয় এবং তাদের কিছু না কিছু জনসেবামূলক কাজ উল্লেখ হয়। এগুলো সমাজের প্রশস্ত অঙ্গণে প্রকাশ্য দিবালোকে অনুষ্ঠিত হবার কারণে অবশ্য মানুষের দৃষ্টি এড়াতে পারে না। এগুলো দৃষ্টিগোচর হওয়াই স্বাভাবিক ও অনিবার্য। কিন্তু মনের লাগাম সামান্য ঢিলে হয়ে গেলেই শয়তানের সফল প্ররোচনায় তা অহংকার, আত্মপ্রীতি ও আত্মম্ভরিতায় পরিণত হয়। আবার অনেক সময় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যার ফলে তাদের বিরোধীরা যখন তাদের কাজের মধ্যে বাঁধা সৃষ্টি করে এবং তাদের ব্যক্তিসত্তার গলদ আবিষ্কারের চেষ্টা করে তখন বাধ্য হয়েই আত্মরক্ষার তাগিদে তাদের কিছু না কিছু বলতে হয়। তাদরে বলা ঘটনা ভিত্তিক ও বাস্তব সত্য হতে পারে কিন্তু তার মধ্যে নিজের গুণাবলীর প্রকাশ অবশ্যই থাকে। একটু সামান্য ভারসাম্যহীনতা এ বস্তুটিকে বৈধ সীমা ডিঙিয়ে গর্বের সীমান্তে পৌঁছে দেয়। এটি একটি মারাত্মক বস্তু। প্রত্যেক ব্যক্তি ও দলকে এ সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে।
বাঁচার উপায়
বন্দেগীর অনুভূতি
যারা আন্তরিকতার সাথে সংস্কার ও সংশোধনের উদ্দেশ্য নিয়ে অগ্রসর হয় তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে অবশ্য বন্দেগীর অনুভূতি নিছক বিদ্যমান নয় বরং জীবিত ও তাজা থাকা উচিৎ। তাদেও কখনো এ নির্জলা সত্য বিস্মৃত হওয়া উচিৎ নয় যে, অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ একমাত্র আল্লাহর সাথে বিশেষিত। খোদার তুলনায় অসহায়তা ও দীনতা, অক্ষমতা ছাড়া বান্দাহর দ্বিতীয় কোন পরিচয় নেই। কোন বান্দাহর মধ্যে যদি সত্যিই সদগুণের সৃষ্টি হয়, তাহলে তা খোদার মেহেরবানী, তা গর্বের ও অহংকারের নয় বরং কৃতজ্ঞতার বিষয়। এজন্যে খোদার কাছে আরো বেশী করে দীনতা প্রকাশ করা উচিৎ এবং এ সামান্য মূলধনকে সৎকর্মশীলতার সেবায় নিযুক্ত করা উচিৎ। এর ফলে খোদা আরো মেহেরবানী করবেন এবং এ মূলধন ফুলে ফেঁপে উঠবে। সদগুণ সৃষ্টি হবার পর অহংকারে মত্ত হওয়া আসলে তাকে অসদগুণে পরিবর্তিত করার নামান্তর। এটি উন্নতি নয়, অবনতির পথ।
আত্মবিচার
বন্দেগীর অনুভূতির পর দ্বিতীয় যে বস্তুটি মানুষকে অহংকার প্রবণতা থেকে রক্ষা করতে পারে সেটি হচ্ছে আত্মবিচার। যে ব্যক্তি নিজের সদগুণালী অনুভব করার সাথে সাথে নিজের দুর্বলতা, দোষ ও ত্রুটি বিচ্যুতিগুলোও দেখে সে কখনো আত্মপ্রীতি ও আত্মম্ভরিতার শিকার হতে পারে না। নিজের গোনাহ্ ও দোষ ত্রুটির প্রতি যার নজর থাকে, এস্তেগফার করতে করতে অহংকার করার চিন্তা করার মতো অবকাশ তার থাকে না।
মহৎ ব্যক্তিদের প্রতি দৃষ্টি
আর একটি বস্তু এই ক্ষতিকর প্রবণতা রোধ করতে পারে। তাহলো কেবল নিজের নীচের তলার দিকে দৃষ্টিপাত করা উচিৎ নয়, যাদের চাইতে সে নিজেকে বুলন্দ ও উন্নত প্রত্য করে আসছে। বরং তাকে দ্বীন ও নৈতিকতার উন্নত ও মূর্ত প্রতীকদের প্রতি দৃষ্টিপাত করা উচিৎ যাদের চাইতে সে এখনো অনেক নিম্ন পর্যায়ে অবস্থান করছে। নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার উন্নতির ন্যায় অবনতিও সীমাহীন। সবচাইতে দুষ্ট প্রকৃতির লোকও যদি নীচের দিকে তাকায় তাহলে কাউকে নিজের চাইতেও দুষ্ট ও অসৎ দেখে নিজের উন্নত অবস্থার জন্যে গর্ব করতে পারে। এ গর্বের ফলে সে নিজের বর্তমান অবস্থার ওপর নিশ্চিত থাকে এবং নিজেকে উন্নত করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত হয়। বরং এর চাইতেও আরো আগে অগ্রসর হয়ে মনে শয়তানী প্রবৃত্তি তাকে আশ্বাস দেয় যে, এখনো আরো কিছুটা নীচে নামার অবকাশ আছে। এ দৃষ্টিভঙ্গী একমাত্র তারাই অবলম্বন করতে পারে যারা নিজেদের উন্নতির দুশমন। যারা উন্নতির সত্যিকার আকাঙ্খা পোষন করে তারা নীচে তাকাবার পরিবর্তে হামেশা ওপরের দিকে তাকায়। উন্নতির প্রতিটি পর্যায়ে উপনীত হয়ে তাদের সামনে আরো উন্নতির পর্যায় দেখা দেয়। সেগুলো প্রত্য করে গর্বের পরিবর্তে নিজের অবনতির অনুভূতি তাদের দিলে কাঁটার মতো বিঁধে। এ কাঁটার ব্যাথা তাদেরকে উন্নতির আরো উচ্চমার্গে আরোহন করতে উদ্বুদ্ধ করে।
দলগত প্রচেষ্টা
এই সঙ্গে দলকে হরহামেশা এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে ও নিজের সমগ্র পরিসরে সকল প্রকার গর্ব, অহংকার ও আত্মম্ভরিতার প্রকাশ সম্পর্কে অবগত হয়ে যথাসময়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। কিন্তু এ ব্যবস্থা গুহণের জন্যে যেন এমন পদ্ধতি অবলম্বন না করা হয় যার ফলে মানুষের মধ্যে কৃত্রিম দীনতা ও নগণ্যতার প্রদর্শনী করার মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টি হয়। আত্মম্ভরিতার গায়ে কৃত্রিম দীনতা-হীনতার পর্দা ছড়িয়ে রাখার মতো মারাত্মক অহংকার আর নেই।
প্রদর্শনেচ্ছা
আর একটি অসৎগুণ অহংকারের চাইতেও মারাত্মকভাবে সৎকাজকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলে। তা হলো প্রদর্শনেচ্ছা। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি বা দল লোক দেখানোর জন্যে, মানুষের প্রশংসা কুড়াবার উদ্দেশ্যে কোন সৎকাজ করলে তা এ পর্যায়ে উপনীত হয়। এ বস্তুটি কেবল আন্তরিকতারই নয় আসলে ঈমানেরও পরিপন্থী এবং এ জন্যেই একে প্রচ্ছন্ন শিরক গণ্য করা হয়েছে। খোদা ও আখেরাতের ওপর ঈমান আনার অপরিহার্য দাবী হচ্ছে এই যে, মানুষ একমাত্র খোদার সন্তুষ্টির জন্যে কাজ করবে, একমাত্র তাঁর নিকট থেকে পুরস্কার লাভের আশা পোষণ করবে এবং দুনিয়ার পরিবর্তে আখেরাতের ফলাফলের প্রতি দৃষ্টি রাখবে। কিন্তু প্রদর্শনেচ্ছু ব্যক্তি মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনকে লক্ষ্যে পরিণত করে, মানুষের নিকট থেকে পুরস্কার লাভ করতে চায়। এর অর্থ দাড়ায়ঃ সে মানুষকে খোদার শরীক ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়েছে। বলাবাহুল্য, এ অবস্থায় মানুষ খোদার দ্বীনের যে পরিমান ও পর্যায়ের খেদমত করুক না কেন, তা কোন ক্রমেই খোদার জন্যে ও দ্বীনের জন্যে হবে না এবং খোদার নিকট তা কখনোই সৎকাজ রুপেও গৃহীত হবে না।
এ ক্ষতিকর প্রবণতাটি যে কেবল ফলাফলের দিক থেকেই কর্মকে নষ্ট করে তা নয় বরং এ প্রবণতা সহকারে কোন যথার্থ কাজ করাও সম্ভব নয়। এ প্রবণতার একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট হচ্ছে এই যে, মানুষ কাজের চাইতে কাজের বিজ্ঞাপনের চিন্তা করে বেশী। দুনিয়ায় যে কাজের ঢাকঢোল পিটানো হয় এবং যেটি মানুষের প্রশংসা অর্জন করে সেটিকেই সে কাজ মনে করে। যে নীরব কাজের খবর খোদা ছাড়া আর কেউ রাখে না সেটি তার কাছে কোন কাজ বলে মনে হয় না। এভাবে মানুষের কাজের পরিমন্ডল কেবল প্রচারযোগ্য কাজ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে এবং প্রচারের উদ্দেশ্য সাধিত হবার পর ঐ কাজগুলোর প্রতি আর কোন প্রকার আকর্ষণ থাকে না। যতই আন্তরিকতার সাথে বাস্তব কার্যারম্ভ করা হোক না কেন এ রোগে আক্রান্ত হবার সাথে সাথেই যক্ষ্মারোগে জীবনীশক্তি ক্ষয় হওয়ার ন্যায় মানুষের আন্তরিকতা অন্তর্হিত হতে থাকে। অতঃপর লোকচুর বাইরেও সৎভাবে অবস্থান করা এবং নিজের কর্তব্য মনে করে কোন কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। সে প্রত্যেক বস্তুকে লোক দেখানো মর্যাদা ও মৌখিক প্রশংসার মূল হিসেবে বিচার করে। প্রতিটি কাজে সে দেখে মানুষ কোনটা পছন্দ করে। ঈমানদারীর সাথে তার বিবেক কোন কাজে সায় দিলেও যদি সে দেখে যে, এ কাজটি দুনিয়ায় তার জনপ্রিয়তা নষ্ট করে দেবে তাহলে তার পে এমন কোন কাজ করার কথা চিন্তা করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ঘরের কোণে বসে যারা আল্লাহ আল্লাহ করে তাদের জন্যে এ ফেৎনা থেকে মুক্ত থাকা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ। কিন্তু যারা বৃহত্তর সমাজক্ষেত্রে প্রবেশ করে এবং সংশোধন, জনসেবা ও সমাজ গঠনমূলক কাজ করে তারা হরহামেশা এই বিপদের মুখোমুখী দাড়িয়ে থাকে। যে কোন সময় এ নৈতিক যক্ষ্মার জীবাণু তাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে পারে। জনসম্মুখে প্রকাশিত হয় এমন বহু কাজ তাদের জনগণকে নিজেদের পাবলম্বী ও তাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করতে হয়। যেগুলোর কারণে মানুষ তাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং তাদের প্রশংসায় উচ্চকন্ঠ হয়। তাদের বিরোধীতারও সম্মুখীন হতে হয় এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও আত্মরার খাতিরে বাধ্য হয়ে নিজেদের ভালো কাজগুলোকে জনসমে তুলে ধরতে হয়। এ অবস্থায় খ্যাতির সাথে খ্যাতির মোহ না থাকা, কাজের প্রদর্শনী সত্ত্বেও প্রদর্শনেচ্ছা না থাকা, জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও সেটি লক্ষ্যে পরিণত না হওয়া, সানুষের প্রশংসাবাণী পাওয়া সত্ত্বেও তা অর্জনের চিন্তা বা আকাঙ্খা না করা চাট্টিখানি কথা নয়। এ জন্যে কঠোর পরিশ্রম, প্রচেষ্টা ও সাধনা প্রয়োজন। সামান্যতম গাফলতিও এ ব্যাপারে প্রদর্শনেচ্ছার রোগ-জীবাণুর অনুপ্রবেশের পথ করতে পারে।
এ রোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উভয় ধরণের প্রচেষ্টা থাকতে হবে।
ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা
ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে প্রচেষ্টা চালাতে হবে তার পদ্ধতি হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তিকে অত্যন্ত সংগোপনে চুপে চুপে কিছু না কিছু সৎকাজ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিজের মনোজগত বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে যে, সে ঐ গোপন সৎকাজগুলোর ও জনসমক্ষে প্রকাশিত সৎকাজগুলোর মধ্যে কোন্ গুলোর ব্যাপারে অধিক আকর্ষণ অনুভব করে। যদি দ্বিতীয়টির সাথে অধিক আকর্ষণ অনুভূত হয়ে থাকে, তাহলে তাকে সঙ্গে সঙ্গেই সাবধান হওয়া দরকার যে, প্রদর্শনেচ্ছা তার মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। এবং এজন্যে খোদার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে দৃঢ় সংকল্প হয়ে মনের এ অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হবে।
সামষ্টিক প্রচেষ্টা
সামষ্টিক প্রচেষ্টার পদ্ধতি হচ্ছে দল নিজের সীমানার মধ্যে প্রদর্শনেচ্ছাকে কোন প্রকারে ঠাঁই দেবে না। কাজের প্রকাশ ও প্রচারকে যথার্থ প্রয়োজন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখবে। প্রদর্শনেচ্ছার সামান্যতম প্রভাবও যেখানে অনুভূত হবে সেখানে তৎণাৎ তার পথ রোধ করবে। দলীয় পরামর্শ ও আলোচনা কখনো এমন খাতে প্রবাহিত হবে না যে, অমুক কাজ করলে জনপ্রিয়তা অর্জন করা যাবে কাজেই কাজটি করা উচিৎ বা অমুক কাজ লোকেরা পছন্দ করে কাজেই ঐ কাজটি করা প্রয়োজন। দলের আভ্যন্তরিণ পরিবেশ এমন হতে হবে যার ফলে মানুষের প্রশংসা ও নিন্দবাদের পরোয়া না করে কাজ করার মতো মানসিকতা সেখানে সৃষ্টি হয় এবং নিন্দাবাদের ফলে ভেঙে পড়ার ও প্রশংসা শুনে নবোদ্যমে অগ্রসর হওয়ার মানসিকতা লালিত না হয়। এ সত্ত্বেও যদি দলের মধ্যে প্রদর্শনী করার মনোবৃত্তি সম্পন্ন কিছু লোক পাওয়া যায় তাহলে তাদেরকে উৎসাহিত করার পরিবর্তে তাদের রোগের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিৎ।
ত্রুটিপূর্ণ নিয়ত
তৃতীয় মৌলিক দোষ হচ্ছে নিয়তের গলদ। এর ওপর কোন সৎকাজের ভিত্তি স্থাপন করা যায় না। সৎকাজের প্রসার ও সেজন্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে খোদার নিকট সফলকাম হওয়ার আন্তরিক ও পার্থিব স্বার্থ বিবর্জিত নিয়তের মাধ্যমেই কেবল মাত্র দুনিয়ায় কোন সৎকাজ অনুষ্ঠিত হতে পারে। এ নিয়তের সাথে নিজের কোন ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট থাকা উচিৎ নয়। কোন পার্থিব স্বার্থ এর সাথে মিশ্রিত থাকতে পারবে না। এমনকি কোন প্রকার ব্যাখ্যা সাপেক্ষে সৎকাজের এ উদ্দেশ্যের সাথে নিজের জন্যে কোন লাভের আশা জড়িত থাকতে পারবে না। এ ধরণের স্বার্থপ্রীতি কেবল খোদার নিকট মানুষের প্রাপ্য নষ্ট করে দেবে না বরং এ মনেবৃত্তি নিয়ে দুনিয়াতেও কোন যথার্থ কাজ করা যাবে না। নিয়তের ত্রুটির প্রভাব অবশ্যই কাজের ওপর পড়ে এবং ত্রুটিপূর্ণ কাজ নিয়ে এমন কোন প্রচেষ্টায় সাফল্য লাভ করা সম্ভব নয়, যার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে মন্দকে খতম করে ভালোকে প্রতিষ্ঠিত করা।
ইতিপূর্বে যে অসুবিধার কথা বলেছি এখানেও আবার তার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন আংশিক সৎকাজ করার সময় নিয়তকে ত্রুটিমুক্ত রাখা বেশী কঠিন নয়। সামান্য পরিমাণ খোদার সাথে সম্পর্ক ও সাচ্চা প্রেরণা এজন্যে যথেষ্ট হতে পারে। কিন্তু যারা সমগ্র দেশের জীবনব্যবস্থা সংশোধন করার এবং সামগ্রিকভাবে তাকে ইসলাম নির্দেশিত ভিত্তিসমূহের ওপর প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে তারা নিজেদের উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যে কেবলমাত্র চিন্তা পরিগঠন বা প্রচার-প্রপাগান্ডা অথবা চরিত্র সংশোধনের প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করতে পারে না। বরং এই সঙ্গে তাদেরকে অবশ্য নিজেদের উদ্দেশ্যের দিকে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মোড় পরিবর্তনের জন্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হয়। এভাবে ক্ষমতা সরাসরি তাদের হাতে আসে অথবা এমন কোন দলের হাতে স্থানান্তরিত হয় যে তাদের সমর্থন ও পৃষ্টপোষকতা লাভ করে। এ দু’টি অবস্থার যে কোন একটিতেও রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বাদ দিয়ে ক্ষমতার কথা চিন্তা করা যেতে পারে না। ব্যাপারটি এখন সমুদ্র গর্ভে অবস্থান করে গায়ে পানি লাগাতে না দেয়ার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কোনো দল পরিপূর্ণ শক্তি নিয়োগ করে এ কাজ করবে এবং এরপরও তার সদস্যদের ব্যক্তিগত নিয়ত ও সমগ্র দলের সামষ্টিক নিয়ত ক্ষমতার লোভ বিমুক্ত থাকবে, এজন্যে কঠিন আত্মিক পরিশ্রম ও আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে নির্ভুল দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করার জন্যে দু’টি আপাতঃ সামঞ্জস্যশীল বস্তুর সূক্ষ্ম পার্থক্য হৃদয়ঙ্গম করা উচিৎ। বলাবাহুল্য, অন্যান্য পরিবর্তনের সাথে সাথে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে যারা এই পরিবর্তন চায় ক্ষমতা স্বতঃস্ফুর্তভাবে সেইসব সমগ্র জীবনব্যবস্থার পরিবর্তনের প্রয়াসী ব্যক্তির দিকে বা তাদের পছন্দসই লোকদের দিকে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু যারা নিজেদের জন্যে ক্ষমতা চায় আর যারা নিজেদের আদর্শ ও লক্ষের জন্যে ক্ষমতা চায় তাদের উভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। নীতি ও আদর্শের কর্তৃত্ব কার্যত নীতি ও আদর্শের বাহকদের কর্তৃত্ব হলেও নীতি ও আদর্শের কর্তৃত্ব চাওয়া এবং তার বাহকদের নিজেদের জন্যে কর্তৃত্ব চাওয়া আসলে দু’টি আলাদা বস্তু। এ উভয়ের মধ্যে প্রেরণা ও প্রাণ বস্তুর দিক দিয়ে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। নিয়তের ত্রুটি দ্বিতীয়টির মধ্যে আছে, প্রথমটির মধ্যে নেই। আর প্রথম বস্তুটির জন্যে মরণপণ প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও দ্বিতীয় বস্তুটির সামান্যতম গন্ধও মনের মধ্যে প্রবেশ করবে না, এজন্যে কঠোর আত্মিক পরিশ্রম করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে। তাঁরা সমগ্র জীবনব্যবস্থা পরিবর্তন করে ইসমলামী নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালান। এ জন্যে রাজনৈতিক বিজয় ও কর্তৃত্বের প্রয়োজন ছিল। কারণ এ ছাড়া দ্বীনকে পুরোপুরি বিজয়ী করা সম্ভব ছিল না। আর কার্যতঃ এ প্রচেষ্টার ফলে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা তাদের হাতে আসলেও কোন ঈমানদার ব্যক্তি এ সন্দেহ পোষন করতে পারে না যে, ক্ষমতা হস্তগত করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল। অন্যদিকে যারা নিজেদের কর্তৃত্ব চেয়েছিল তাদের দৃষ্টান্তও ইতিহাসের পাতায় রয়েছে। এ দৃষ্টান্ত তালাশ করার জন্যে ইতিহাসের পাতা ওল্টাবারই বা কি প্রয়োজন, আমাদের চোখের সামনেই তাদের অনেকেই ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। বাস্তবে কর্তৃত্ব লাভ করাকে যদি নিছক একটি ঘটনা হিসেবে বিচার করা হয় তাহলে উভয় দলের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখা যাবে না। কিন্তু নিয়তের দিক দিয়ে উভয়ের কাজ, প্রচেষ্টা এবং সংগ্রামী যুগের কাজ ও সাফল্য যুগের কাজও দ্যার্থহীন সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে।
যারা সাচ্চা দীলে ইসলামী নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী জীবনব্যবস্থায় সার্বিক কর্তৃত্ব চায় তাদের ব্যক্তিগতভাবেও এ পার্থক্যকে যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করে নিজেদের নিয়ত ঠিক রাখা উচিৎ। এবং তাদের দলেরও সামগ্রিকভাবে পূর্ণ প্রচেষ্টা চালানো উচিৎ যেন নিজের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রত্যাশা কোন অবস্থায়ও এর ত্রিসীমানায় প্রবেশ করতে না পারে।