প্রথম স্তর
শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবী
[১১১৪-১১৭৬ হিঃ মোঃ ১৭০৩-১৭৬২ ইং]
শাহ ওলীউল্লাহ ইবনে আবদুর রহিম দেহলবী ওমরী (১১১৪ হিঃ মোঃ ১৭০৩ ইং) দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। ৭ বৎসর বয়সে তিনি কোরআন হেফজ এবং ১৫ বৎসর বয়সে পূর্ণ শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১৭ বৎসর বয়সে (তাঁহার পিতার নিকট হইতে) তাছাওফে খেলাফত লাভ করেন। হাদীছের মেশকাত শরীফ, শামায়িলে তিরমেজী ও বোখারী শরীফের কিয়দংশ তিনি তাহার পিতা শাহ আবদুর রহিম দেহলবী (মৃঃ ১১৩১ হিঃ) এর নিকট এবং পূর্ণ মেশকাত ও হাদীছের অপর কয় কিতাব হাজী আফজাল সিয়ালকোটির নিকট শিক্ষা করেন। ১১৪৩ হিঃ মোঃ ১৭৩০ইং তিনি হারামাইন (মক্কা ও মদীনা) গমন করেন এবং তথায় শেখ আবু তাহের কুরদি মদনী (মৃঃ ১১৪৫ হিঃ), শেখ ওয়াফদুল্লাহ মক্কী ও শেখ ওমর ইবনে আহমদ মক্কী প্রমুখ প্রসিদ্ধ মোহাদ্দেছগণের নিকট হাদীছে উচ্চ জ্ঞান লাভ করেন। ১১৪৬ হিঃ, মোঃ ১৭৩৩ ইং তিনি হারামাইন হইতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং দিল্লীতে তাঁহার পিতার রহীমিয়া মাদ্রাছায় হাদীছ-কোরআন শিক্ষাদানে আত্ননিয়োগ করেন।
পূর্ণ ৩০ বৎসরকাল কোরআন-হাদীছ শিক্ষাদান ও বিভিন্ন সংস্করকার্যসম্পাদনের পর ৬৩ বৎসর বয়সে ১১৭৬ হিঃ মোঃ ১৭৬২ ইং তিনি ইহজগত ত্যাগ করেন।
তাঁহার ন্যায় প্রতিভাশালী ও প্রজ্ঞাবান ব্যাক্তি দুনিয়ায় খুব কমই জন্মলাভ করিয়াছেন। তিনি একাধারে মুজতাহেদ, মুজাদ্দেদ, মুফাছছের, মোহাদ্দেছ, ছুফী, দার্শনিক ও শরীয়াত তত্বজ্ঞানী ছিলেন। এ সকল বিষয়ে তিনি শতের উপর ছোট-বড় মূল্যবান কিতাব প্রণয়ন করিয়াছেন। (ত্রিশ-এর অধিক পাওয়া যায় না।) দর্শন ও তত্বজ্ঞান সম্পর্কে তাঁহার ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ’ বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারে একটি মহামূল্য অবদান। কোরআন বুঝিবার উপায় ও নিয়ম-কানুন সম্বন্ধে তাঁহার ‘আল ফাওজুল কাবীর’ একটি অতুলনীয় কিতাব। ‘ফাতহুর রাহমান’ নামে তাঁহার কোরআন পাকের ফারছী অনুবাদ অনুবাদকদের জন্য পথপ্রদর্শক। ইজতেহাদ সম্পর্কে তাঁহার ‘ইকদুল জীদ’ অন্ধদের পক্ষে চক্ষু দানকারী। এক কথায় তাঁহার রচনাবলী হইতেছে অন্ধকারে আলোকস্তম্ভ। তাঁহার রচনাবলীর আলোচনা ব্যতীত এ যুগে কাহারও পক্ষে আল্লাহ ও রছুল প্রদর্শিত সত্য পথের সন্ধান লাভ করা সুকঠিন।
তিনি তাঁহার রচনায় কোন বিশেষ মাজহাব, তরীকা বা পন্হার প্রতি পক্ষপাত না করিয়া যেখানে যাহা হক মনে করিয়াছেন তাহাই ব্যক্ত করিয়াছেন। হাদীছ শিক্ষায় তাঁহার এ নীতি ছিল সুপ্রকট। তাঁহার হাদীছ শিক্ষার নীতি ওলামাদের নিকট এতই মকবুল (গ্রহনিয়) হইয়াছে যে, আজ পাক-ভারতে হাদীছ শিক্ষার এমন কোন ছিলছিলা নাই যাহা তাঁহাতে আসিয়া বর্তায় না। পাক-ভারত কেন, দুনিয়ার বহু হাদীছ শিক্ষার ছিলছিলাই তাঁহাতে আসিয়া বর্তায়।
হাদীছে তাহার রচনাঃ
১। ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বলেগাহ’। ইহা দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে সৃষ্টি রহস্য, কর্মফলতত্ত্ব, শরীয়ততত্ত্ব এবং সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হইয়াছে। দ্বিতীয় ভাগে তত্ত্বজ্ঞানের ভিত্তিতে হাদীছের ব্যাখ্যা দান করা হইয়াছে।
২। ‘মুছাফফা’, ইহা মোয়াত্তা ইমাম মালেকের ফারছী শারাহ। ইহাতে তিনি মাজহাব চতুষ্টয়ের মধ্যে কোন বিশেষ মাজহাবের প্রতি পক্ষপাত না করিয়া ইজতেহাদের ভিত্তিতে হাদীছসমূহের ব্যাখ্যা করিয়াছেন। তাঁহার এ কিতাব গভীরভাবে আলোচনা করিলে অনুসন্ধানী ব্যক্তিগল আজও ইজতেহাদের পথ পাইতে পারেন বলিয়া তিনি মন্তব্য করিয়াছেন।–প্রকাশিত
৩। ‘মুছাওয়া’, ইহা ইমাম মালেকের ‘মোয়াত্তা’র আরবী শরাহ। ইহাতে তিনি ইমাম মালেকের নিজস্ব অভিমতগুলিকে বাদ দিয়া আসল হাদীছসমূহের ব্যাখ্যা করিয়াছেন।–প্রকাশিত
৪।‘আরবায়ীন’। ইহাতে হজরত আলী (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত চল্লিশ হাদীছ সংগ্রহ করা হইয়াছে; ইহা মাওলানা খোররম আলী বালগুরী ও হাদী আলী লক্ষ্ণৌবীর শরাহসহ দিল্লীর মোস্তাফিয়া প্রেস হইতেপ্রকাশিত হইয়াছে।
৫। ‘ওয়াছীকাতুল আখইয়ার’, ইহাতে তিনি ইমাম নাওয়াবীর ছেহল হাদীছের শরাহ করিয়াছেন।
৬। ‘আদ দুররুছ ছামীন’ (আরবী………………………………….)। ইহাতে তিনি রছুলুল্লাহ (ছঃ) এর স্বপ্ন সম্পর্কীয় হাদীছ সমূহ একত্রিত করিয়াছেন।–প্রকাশিত
৭। ‘আল ফজলুল মুবীন’ (আরবী………………………………….)। ইহাতে কতক ‘মোছালছাল’ হাদীছ জমা করা হইয়াছে।–প্রকাশিত
৮। ‘আল ইরশাদ’ (আরবী………………………..)। ইহাতে তিনি তাহার হাদীছ লাভের ছনদসমূহ বর্ণনা করিয়াছেন।
৯। ‘তারাজিমূল বোখারী’। ইহাতে তিনি ছহীহ বোখারীতে অবলম্বিত নীতিসমূহের আলোচনা করিয়াছেন।
১০। ‘শরহে তারাজিমে আবওয়াবে বোখারী’। ইহাতে ছহীহ বোখারীর ‘তরজুমাতুল বাব’-এর শরাহ করা হইয়াছে।
১১। ‘আছারুল মোহাদ্দেছীন’ (আরবী………………………….)। হায়দরাবাদের আছফিয়া লাইব্রেরীতে ইহার পাণ্ডুলিপি বিদ্যামান আছে।
১২। ‘মাকতুবাত’ (আরবী………………………………)। ইহাতে তিনি ইমাম বোখারী ও ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করিয়াছেন ।
—india’s contribution-174p
তাহার প্রসিদ্ধ শাগরিদগণঃ
হাদীছে শাহ ছাহেবের বহু শাগরিদ রহিয়াছেন। নিম্নে তাঁহাদের কতিপয় প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নাম দেওয়া গেল।
১। কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথী (মৃঃ ১২২৫ হিঃ)। তিনি শায়খ জালালুদ্দীন কবিরুল আওলিয়ার বংশধর এবং হজরত মির্জা জানে জানান দেহলবীর (মৃঃ ১২০৫ হিঃ) খলীফা ছিলেন। হাদীছ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁহার অগাধ জ্ঞানের দরুন শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী তাঁহাকে ‘বায়হাকীউল ওকত’ (যুগের বায়হাকী) উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁহার ন্যায় ইসলামিয়াতে সর্ববিষয়ে পারদর্শী লোক কুত্রাপি দৃষ্ট হইয়া থাকে। তাঁহার ‘তফছীরে মাজহারী’ ইহার সাক্ষ্য।
হাদীছে তাঁহার ‘আল লুবাব’ নামে একটি কিতাব রহিয়াছে। ইহাতে তিনি শামছুদ্দীন ছালেহীর (মৃঃ ৯৪২ হিঃ) ‘ছুবুলুল হুদা’ কিতাবের তৃতীয় খণ্ডকে সংক্ষেপে করিয়াছেন। ‘মানারুল আহকাম’ (আরবী……………………………..)। নামে তাঁহার একটি অতি মূল্যবান কিতাব। (প্রকাশিত হয় নাই। (আরবী…………………..) দ্রষ্টব্য)
২। শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী (মৃঃ ১২৩৯ হিঃ)। শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবীর জেষ্ঠক পুত্র। (তাহার পূর্ণ পরিচয় পরে আসিতেছে।)
৩। মাওলানা মোহাম্মদ আশেক ফুলতী। তিনি শাহ ছাহেবের মামাত ভাই, সুরিদয় ও খলীফা ছিলেন। শাহ ছাহেবকে ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ’ লেখার জন্য তিনিই উদ্ধুদ্ধ করিয়াছিলেন। তিনি শাহ আবদুল আজিজ দেহলবীর ওস্তাদ ছিলেন। —খান্দানে আজীজিয়া-৩০ পৃঃ
৪। মাওলানা রফীউদ্দিন মোরাদাবাদী (মৃঃ ১২১৮ হিঃ)। ‘ছালউল কায়ীব’—(আরবী……………………………..) ও ‘শরহে আরবায়ি নাওয়াবী’ নামে হাদীছে তাঁহার দুইটি কিতাব রহিয়াছে।
৫। মাওলানা খায়রুদ্দীন ছুরতী (মৃঃ ১২০৬ হিঃ)।মাওলানা রফীউদ্দীন মোরাদাবাদী শাহ ওলীউল্লাহর পরে তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করিয়াছিলেন।–খান্দানে আজীজিয়া ৫৯ পৃঃ
৬। খাজা মোহাম্মদ আমীন কাশ্মীরী। শাহ আবদুল আজীজ দেহলবীর প্রাথামিক ওস্তাদ।
৭। মাওলানা মুঈন ইবনে মোহাম্মদ আমীন সিন্কী। ‘দেরাছাতুল লবীব’ (আরবী………………………………….) নামে তাঁহার একটি মূল্যবান কিতাব রহিয়াছেন।
৮।মাওলানা মোহাম্মদ ইবনে পীর মোহাম্মদ বিলগ্রামী এলাহাবাদী।
৯। ফকীহ নুর মোহাম্মদ বুঢানবী। শাহ আবদুল আজীজ দেহলবীর শ্বশুর। শাহ আবদুল আজীজ তাহার নিকট ফেকাহর উচ্চজ্ঞান লাভ করেন।
১০। মাওলানা মাখদুম লক্ষ্ণৌবী।
১১। মাওলানা জামালুদ্দীন রামপুরী।
১২। মাওলানা সৈয়দ মোরতাজা বিলগ্রামী জাবীদী (মৃঃ ১২০৫ হিঃ)। তিনি প্রথমে শাহ ছাহেবের নিকট, পরে ইয়ামানে তথাকার মোহাদ্দেছগণের নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। হাদীছে ১৭টি কিতাবসহ বহু বিষয়ে তাহার বহু কিতাব রহিয়াছে। তিনি মিছরে বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন।
দ্বিতীয় স্তর
শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী
[১১৫৯-১২৩৯ হিঃ মোঃ ১৭৪৬-১৮২৪ ইং]
তিনি ১১৫৯ হিঃ দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁহার পিতার ন্যায় ১৫ বৎসর বয়সেই হাদীছসহ সমস্ত এলমে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন এবং ১৭ বৎসর বয়সে তাছাওফের ছনদ হাছিল করেন। তিনি হাদীছ ও অন্যান্য প্রায় সকল এলমই তাঁহার পিতা ওলীউল্লাহ দেহলবীর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। হাদীছ, তফছীর, ফেকাহ এবং মান্তেক, হিকমত (—গ্রীকবিজ্ঞান)-এর ন্যায় অংক, জ্যামিতি, ভূগোল ও ইসলামের ইতিহাস প্রভৃতি শাস্ত্রে তাঁহার জ্ঞান ছিল অতলস্পর্শী সমুদ্রতুল্য। তিনি তাঁহার পিতার এন্তেকালের পর হাদীছ ও ‘তাছাওফ’ শিক্ষাদানে তাহার স্থলাভিষিক্ত হন এবং ৬০ বৎসরকাল অসংখ্য আল্লাহর বান্দাকে ইহা বিতরণ করেন। অনেকের মতে হাদীছের প্রচার তাঁহার পিতা অপেক্ষা তাঁহার দ্বারাই অধিক হইয়াছে। ৮১ বৎসর বয়সে ১২৩৯ হিঃ তিনি দিল্লীতে এন্তেকাল করেন।
হাদীছে তাহার রচনাঃ
১। ‘উজালায়ে নাফেয়াহ’। ইহা তাঁহার উছুলে হাদীছ সম্পর্কীয় একটি তথ্যপূর্ণ কিতাব। (মাওলানা আবদুল আহাদ কাছেমী ‘আল উলালাতুন নাজেআহ’ (আরবী……………………………………..) নামে ইহার আরবী অনুবাদ প্রকাশ করিয়াছেন।)
২। ‘বুস্তানুল মোহাদ্দেছীন’ । ইহাতে তিনি হাদীছের ৯৫টি প্রসিদ্ধ কিতাব ও উহাদের রচয়িতাগণের পরিচয় দান করিয়াছেন।
৩। ‘তা’লীকাতুন আলাল মুছাওয়া’। ইহাতে তিনি তাঁহার পিতার মুছাওয়া গ্রন্হের পাদটীকা লিখিয়াছেন।
৪। ‘আল মাওজুআত’। ইহা মাওজু হাদীছ সম্পর্কীয় কিতাব। (লক্ষ্ণৌর ‘নুদওয়াতুল ওলামা’র লাইব্রেরীতে ইহার পাণ্ডুলিপি বিদ্যমান আছে।)
৫। ‘মায়াজের হেফজুহু লিন্নাজের’ (আরবী…………………………….), এছাড়া ‘তফছীরে আজীজী’ও ‘ফতওয়ায়ে আজীজী’ তাঁহার আরো দুইটি মূল্যবান কিতাব।
তাহার প্রসিদ্ধ শাগরিদগণঃ
তাঁহার সমস্ত শাগরিদগণের ফিরিস্তি দান করা সম্ভবপর নহে। এখানে শুধু এমন কতক প্রসিদ্ধ লোকের নাম করা হইতেছে যাহারা কোথাও না কোথায় হাদীছ শিক্ষায় আত্ননিয়োগ করিয়াছিলেন।
১। শাহ রফীউদ্দীন ইবনে ওলীউল্লাহ দেহলবী (মৃঃ ১২৪৯ হিঃ)। তিনি শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবীর দ্বিতীয় পুত্র। তিনি একজন গভীর জ্ঞানী লোক ছিলেন। যখন কোন বিষয় আলোচনা করিতেন শ্রোতাগণ মনে করিতেন যে, এ বিষয়ে তাহার অপেক্ষা গভীর জ্ঞানী লোক কেহই নাই। তাঁহার কোরআন পাকের উর্দু তরজমা (শাব্দিক), ‘মোকাদ্দমাতুল এলম’ ও ‘আত তাকমীল’ প্রভৃতি কিতাব সত্যই তাঁহার জ্ঞান গভীরতার পরিচয়ক। তিনি দিল্লীতে হাদীছ শিক্ষা দেন। শাহ আহমদ ছাঈদ মুজাদ্দেদী ও তাঁহার ভাই শাহ আবদুল গনী মুজাদ্দেদী, শাহ ছাহেবের পুত্র শাহ মাখছুছুল্লাহ দেহলবী (মৃঃ ১২৭৩ হিঃ)—ইহারা সকলেই শাহ আবদুল আজীজ দেহলবীর ন্যায় শাহ রফীউদ্দিন দেহলবীর নিকটও হাদীছ শিক্ষা করেণ।
২। শাহ আবদুল কাদের দেহলবী (১২৪১ হিঃ)। শাহ ওলীউল্লাহর তৃতীয় পুত্র। তিনি ১১৬৭ হিঃ দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার কোরআন পাকের উর্দু তরজমা একটি তুলনাহীন তরজমা। বিশেষজ্ঞগনের মতে কোরআন পাকের এরূপ বিশুদ্ধতম ও সফল তরজমা দ্বিতীয়খানী নাই। ‘মুজেহুল কোরআন’ নামে তিনি উক্ত তরজমার যে পাদটীকা লিখিয়াছেন তাহাও অতি মূল্যবান। এ তরজমা ও পাদটীকায় তিনি ১৮ বৎসরকাল ব্যয় করিয়াছেন । শিক্ষাদান অপেক্ষা তিনি এবাদতেই অধিক মশগুল থাকিতেন। তাঁহার শাগরিদগণের মধ্যে ফজলে হক খায়রাবাদী, শাহ মোহাম্মদ দেহলবী, মাওলানা ইমামুদ্দীন বখশী ও মাওলানা আবদুল হাই বুঢানবীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৩। শাহ আবদুল গনী দেহলবী (মৃঃ ১২২৭ হিঃ)। শাহ ওলীউল্লাহর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র ও শাহ ইছমাঈল শহীদের পিতা।
৪। শাহ ইছরাঈল শহীদ (মৃঃ ১২৪৬ হিঃ)। তিনি শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবীর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র শাহ আবদুল গনী দেহলবীর পুত্র। তিনি দিল্লীতে এবং জেহাদের ছফরে অনেককে হাদীছ শিক্ষা দিয়াছেন। মাওলানা বেলায়েত আলী ছাহেব ছফরকালেই বেরেলবীতে তাঁহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।–তারাজিম। তিনি একজন অসাধারণ জ্ঞাণী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহার তাওহীদ সম্পর্কীয় কিতাব ‘তাকবীয়াতুল ঈমান’, তাছাওফ সম্পর্কীয় কিতাব ‘আকাবাত’ ও ‘ছেরাতে মোস্তাকীম’।ইমামত বা খেলাফ সম্পর্কীয় কিতাব ‘মানছাবে ইমামত’ এবং উছুলে ফেকাহ সম্পর্কীয় ‘রিছালাহ’ জ্ঞানভাণ্ডারের অমুল্য সম্পদ। তিনি ১১৯৩ হিঃ দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২৪৬ হিঃ ছৈয়দ সাহেব বেরেলবীর সহিত শিখদের বিরূদ্ধে জেহাদে সীমান্তের বালাকোটে ‘শাহাদাত’ লাভ করেন। হাদীছে তাঁহার দুইটি কিতাব রহিয়াছেঃ
(ক) ‘তানবীরুল আইনাইন’ (আরবী…………….)
–তারাজিম ৯৩ পৃঃ।
১২৫৬ হিঃ ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।–খান্দানে আজীজিয়া
(খ) ‘তানকীদুল জওয়াব’ (আরবী…………………………..)।
৫। শাহ মাখছুছুল্লাহ দেহলবী (মৃঃ ১২৭৩ হিঃ)। তিনি শাহ রফীউদ্দীন দেহলবীর পুত্র। হাদীছ, তফছির প্রভৃতি এলমে তাঁহার অসাধারণ জ্ঞান ছিল। তিনি প্রথমে কিছু দিন এ সকল এলম শিক্ষাদানে রত থাকেনম, পরে শিক্ষাদান ছাড়িয়া কেবল এবাদতে আত্ননিয়োগ করেন। শাহ আবদুল গনী মুজাদ্দেদীর ভাই শাহ আবদুর রশিদ তাঁহার নিকট শিক্ষালাভ কারয়াছিলেন।–তারাজিম
৬।মুফতি ছদরূদ্দীন খাঁ কাশ্মীরী দেহলবী (মৃঃ ১২৫৮ হিঃ)। তিনি দিল্লীতেই হাদীছ শিক্ষা দিয়াছেন। তিনি দিল্লীর ছদরুল ছুদুর ছিলেন। ‘মোন্তাহাল মাকাল’—
(আরবী…………………………………) নামে হাদীছে তাহার একটি কিতাব রহিয়াছে।
৭। মাওলানা আবদুল হাই দেহলবী (মৃঃ ১২৪৩ হিঃ)। শাহ আবদুল আজীজ দেহলবীর জামাতা। তিনি আবদুল কাদের দেহলবীর নিকটও পড়িয়াছেন। তিনি ছৈয়দ শহীদ বেরেলবীর দক্ষিণ হস্ত ছিলেন। মাওলানা আবদুল কায়উম বৃঢানবী, ভূপালী (মৃঃ ১২৯৯ হিঃ) তাঁহারই পুত্র।
৮। মাওলানা হাছান আলী মোহাদ্দেছ লক্ষ্ণৌবী। তিনি লক্ষ্ণৌতে হাদীছ শিক্ষা দিয়াছেন।
৯। মাওলানা হোছাইন আহমদ মলীহাবাদী (মৃঃ ১২৭৫ হিঃ)। তিনি লক্ষ্ণৌর নিকট মলীহাবাদেই হাদীছ শিক্ষা দেন।
১০। শাহ রউফ আহমদ মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৪৯ হিঃ)।তিনি হজরত মুজাদ্দেদে আলফে ছানীর বংশধর ছিলেন। ভূপালে বসতি স্থাপন করেন এবং তথায় হাদীছ শিক্ষা দেন। উর্দু ভাষায় ‘তফছীরে রউফি’ তাহারই রচিত।
১১। মাওলানা আবদুল খালেক দেহলবী।
১২। মাওলানা খোররম আলী বালহুরী (মৃঃ ১২৭১ হিঃ)। তিনি ছাগানীর মাশারিকুল আনওয়ার এবং শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবী আরবায়ীনের উর্দূ তরজমা করেন ও পাদটীকা লিখেন।
১৩। শাহ (খাজা) আবু ছাঈদ মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৫০ হিঃ)। শাহ আবদু গনী মুজাদ্দেদীর পিতা। তিনি ১১৯৬ হিঃ রামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ফনুনাত তিনি মুফতি শরফুদ্দীন দেহলবীর নেকট এবং হাদীছের মোছলেম শরীফ শাহ রফীউদ্দীন নিকট শিক্ষা করেন। অতঃপর শাহ ছাহেব হইতে ছেহাহ ছেত্তার এজাজত লাভ করেন। তিনি দিল্লী ও রামপুরে হাদীছ শিক্ষা দেন এবং টংকে এন্তেকাল করেন।
১৪। মাওলানা মোহাম্মদ শাকুর মাছলী শহরী (মৃঃ ১৩০০ হিঃ)। তিনি আ’জমগড়ের নিকট মাছলী শহরে হাদীছ শিক্ষা দেন।
১৫। মাওলানা জহুরুল হক কলন্দরী। তিনি পাটনায় ফুলবারী শরীফে হাদীছ শিক্ষা দেন।
১৬। মাওলানা ছৈয়দ আওলাদ হাছান কন্নুজী (মৃঃ ১২৫৭ হিঃ)। তিনি কন্নুজে হাদীছ শিক্ষা দেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে বহু কিতাব রচনা করেন। হাদীছে তিনি ‘রাহে জান্নাত’ নামে একটি আরবায়ীনের উর্দু তরজমা করেন। নওয়াব ছিদ্দীক হাছান খাঁ ভূপালী তাহার পুত্র।
১৭। মাওলানা করমুল্লা (করীমুল্লাহ) মোহাদ্দেছ (মৃঃ ১২৫৮ হিঃ)। তিনি দিল্লীতে হাদীছ শিক্ষা দেন। মাওলানা আবদুল আজীজ তাহার ‘তফছীরে আজীজ’ তাহারই জন্য লিখিয়াছিলেন।
১৮। মাওলানা ছালামতুল্লাহ বাদায়উনী। তিনি কানপুরে হাদীছ শিক্ষা দেন। –india’s 180p
১৯। মাওলানা মুফতী রশীদুদ্দীন খাঁ দেহলবী (মৃঃ ১২৪৯ হিঃ)। তিনি দিল্লীতে হাদীছ শিক্ষা দেন। মাওলানা কাছেম নানুতবী ও মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গুহীর ওস্তাদ মাওলানা মামলুক আলী নানুতবী তাঁহার একজন বিশিষ্ট ছাত্র।—-(আরবী……………………………….)
২০। শাহ মোহাম্মদ ইছহাক দেহলবী (মৃঃ ১২৬২ হিঃ)। (তাহার পূর্ণ পরিচয় পরে আসিবে।)
২১। শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুব দেহলবী (মৃঃ ১২৮৩ হিঃ মোঃ ১৮৬৬ ইং)। শাহ ইছহাক দেহলবীর ছোট ভাই। তিনি শাহ আবদুল আজিজ দেহলবীর এন্তেকালের পর স্বীয় ভ্রাতা শাহ ইছহাক ছাহেবের নিকটও হাদীছ শিক্ষা করেন ও ভ্রাতার সহিত দিল্লীতে হাদীছ শিক্ষা দেওয়ার পর সেখানেই এন্তেকাল করেন।
২২। মাওলানা আলে রছুল। তিনি মাওলানা আহমদ রেজা খাঁ বেরেলবীর ওস্তাদ ছিলেন।
২৩। মাওলানা ছৈয়দ কামরুদ্দীন হাছানী। তাহার জন্যই শাহ ছাহেব ‘উজালায়ে নাফেয়া’ কিতাবটি লিখেন।
২৪। শাহ গোলাম আলী দেহলবী। তিনি মির্জা মাজহার জানে জানানের খলীফা ছিলেন।
২৫। মাওলানা ছালামতুল্লাহ মোরাদাবাদী।
২৬। মাওলানা হায়দর আলী টংকী (মৃঃ ১২৭৭ হিঃ)।
২৭। মাওলানা আহমদুদ্দীন বাগাবী (মৃঃ ১২৮২ হিঃ)। তিনি পাঞ্জাবী হাদীছ প্রচার করিয়াছেন।—খান্দানে আজীজিয়া
২৮। মাওলানা গোলাম মুহীউদ্দীন বগবী (মৃঃ ১২৭৩ হিঃ)।
২৯। মুফতি ইলাহী বখশ ইবনে আল্লামা শায়খুল ইছলাম কান্দলবী (মৃঃ ১২০৯-এর পর)। ‘শিয়ামুল হাবীব’ নামে ছীরাতে তাহার একটি কিতাব রহিয়াছে। তিনিই মাওলানা রূমীর মসনবীর শেষ খণ্ড লিখিয়া উহাকে পূর্ণ করিয়াছেন।
তৃতীয় স্তর
শাহ মোহাম্মদ ইছহাক দেহলবী
[১১৭২-১২৬২ হিঃ মোঃ ১৭৫৮-১৮৪৬ ইং]
তাঁহার পিতার নাম মোহাম্মদ আফজাল ফারূকী দেহলবী। তিনি ১১৭২ হিঃ দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং অল্প বয়সেই স্বীয় পিতামহ শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী ও পিতামহের ভ্রাতৃদ্বয় শাহ আবদুর কাদের দেহলবী ও শাহ রফীউদ্দীন দেহলবীর নিকট হাদীছসহ যাবতীয় শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। পিতামহের জমানাতেই তিনি দিল্লীতে হাদীছের দরছ দিতে আরম্ভ করেন এবং পিতামহের এন্তেকালের পর তাহার স্থলাভিষিক্ত হন। দিল্লীতে ২০ বৎসরকাল শিক্ষাদানের পর ১২৫৯ হিঃ তিনি মক্কায় হিজরত করেন এবং তথায় তিনি বৎসর শিক্ষাদানের পর তথায়ই এন্তেকাল করেন।
তাঁহার প্রসিদ্ধ শাগরিদগণঃ
তাহার শাগরিদের সংখ্যা অনেক। এখানে মাত্র বিশিষ্ট কয়েক জনের নাম দেওয়া গেলঃ
১। নওয়াব কুতবুদ্দীন খাঁ দেহলবী (মৃঃ ১২৭৯ হিঃ)।হাদীছ তাহার রচনা ‘মাজাহেরে হক’ ইহা মেশকাত শরীফের উর্দু তরজমা ও সংক্ষিপ্ত শরাহ। শরায় মাওলানা অর্থে তিনি শাহ ছাহেবকেই বুঝাইয়াছেন।
২। মুফতী ইনায়েত আহমদ কাকুররী (মৃঃ ১২৮৩ হিঃ)। ‘আল আহাদীছুল মোতাবারেকাহ’ নামে হাদীছে তাহার একটি কিতাব রহিয়াছে।
৩। মাওলানা শাহ আহমদ ছাঈদ মুজাদ্দেদী ইবনে আবু ছাঈদ মুজাদ্দেদী।
৪। মাওলানা আলম আলী নগীনবী (মৃঃ ১২৯৫ হিঃ)।
৫। মাওলানা আবদুল গণী মুজাদ্দেদী ইবনে আবু ছাঈদ মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৯৬ হিঃ)।
৬। মাওলানা শায়খ মোহাম্মদ থানবী (মৃঃ ১২৯৬ হিঃ)।
হাদীছে তাহার ‘আল কেছতাছ ফী আছারে আব্বাছ’ নামক একটি কিতাব রহিয়াছে।
৭।মাওলানা আহমদ আলী সাহারনপুরী (মৃঃ ১২৯৭ হিঃ)।
৮। মাওলানা আবদুল কায়উম বুঢানবী, ভূপালী (মৃঃ ১২৯৯ হিঃ)।
তিনি শাহ আবদুল হাই বুঢানবীর পুত্র এবং শাহ ইছহাক দেহলবীর খালাত ভাই ও জামাতা। তিনি দীর্ঘদিন ভূপালে হাদীছ শিক্ষা দিয়াছেন। মাওলানা খলীল আহমদ সাহারনপুরী ভূপালে তাহার নিকট হাদীছের ছনদ লাভ করেন।
৯। কারী আবদুর রহমান পানিপথী (মৃঃ ১৩১৪ হিঃ)।
১০। মাওলানা ছৈয়দ নজীর হোছাইন ওরফে মিঞা সাহেব (মৃঃ ১৩২০ হিঃ)।
১১। শায়খ ইব্রাহিম নগর-নহছবী।
১২। মাওলানা ছোবহান বখশ মুজাফফরপুরী।
১৩। মাওলানা আহমদ ঢৌঁকি (টংকী)।
১৪। মাওলানা ফখরুদ্দীন দেহলবী ‘ফখরে জাহাঁ’।
১৫। মাওলানা মোহাম্মদ ওরফে ‘ঝাও’ (রাজশাহী)।
চতুর্থ স্তর
(ক) মাওলানা আলম আলী নগীনবী মোরাবাদী
[মৃঃ ১২৯৫ হিঃ মোঃ ১৮৭৮ ইং]
মাওলানা আলম আলী নগীনবী ইবনে ছৈয়দ কেফায়েত আলী দিল্লীতে মাওলানা শাহ ইছহাক দেহলবীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন এবং রামপুরে হাদীছ শিক্ষা দেন। তিনি হাফেজ, হাকীম ও ক্কারী ছিলেন এবং বহু বিখ্যাত আলেমের নিকট বহু বিষয় শিক্ষা করিয়াছিলেন।
তাঁহার কতিপয় প্রসিদ্ধ শাগরিদঃ
১। মাওলানা আলী আকরাম আরাবী (আরা, বিহার)। ছৈয়দ বরকত আলী শাহ তাহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। ঢাকার জনাব শাহ আবদুছ ছালাম বরকতী—ছৈয়দ বরকত আলী শাহর পুত্র এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাছার হেড মাওলানা মুফতী ছৈয়দ আমীমুল এহছান বরকতী তাহার জামাতা।
২। মাওলানা ছৈয়দ হাছান শাগ রামপুরী। তাহার পুত্র মাওলানা ছৈয়দ মোহাম্মদ শাহ তাহার নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন। মাওলানা মোনাওয়ার আলী রামপুরী মাওলানা মোহাম্মদ শাহর নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন এবং রামপুরে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদীছ শিক্ষা দেন। আলিয়া মাদ্রাছার হেড মাওলানা শামছুল ওলামা ছফীউল্লাহ সেরহদী ওরফে ‘মোল্লা সাহেব’ (মৃঃ ১৩৬৭ হিঃ মোঃ ১৯৪৭ ইং) ও অবসরপ্রাপ্ত হেড মাওলানা শামছুল ওলামা মাওলানা বেলায়েত হোছাইন সাহেব মাওলানা মোনাওয়ার আলী রামপুরী নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন।—তারীখূল হাদীছ