দ্বিতীয় যুগ
এ যুগ হিজরী দ্বিতীয় শতকের প্রথম হইতে তৃতীয় শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত কিঞ্চিদধিক এক শতাব্দীর যুগ। এ যুগ তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীনদের যুগ। এ যুগে হাদীছ অনুযায়ী আমলকরণ বরাবর অব্যাহত থাকে এবং শিক্ষাকরণ, শিক্ষাদান, হেফজকরণ ও লিখন বহুগুণে বাড়িয়া যায়।
তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীনগণের
হাদীছ শিক্ষাকরণ
তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীনগণের
হাদীছ শিক্ষাকরণ
ছাহাবীগণের উৎসাহদানের ফলে তাবেয়ীনদের মধ্যে এবং তাবেয়ীনগণের উৎসাহদানের ফলে তাবে’-তাবেয়ীনদের মদ্যে এইরূপ উৎসাহউদ্দীপনার সৃষ্টি হয় যে, তাঁহাদের এক এক ব্যক্তি এক একটি হাদীছের নজ্য তৎকালের হাদীছের কেন্দ্র –মদীনা, মক্কা, বছরা, কুফা, শাম ও মিছর ঘুরিয়া বেড়ান। তাবেয়ী বোছর ইবনে উবায়দুল্লাহ বলেনঃ ‘আমি একটি মাত্র হাদীছ লাভের জন্য এ সকল শহরের অনেকটিতে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছি। -[দারেমী-১/১২৬ পৃঃ] প্রসিদ্ধ তাবেয়ী আবুল আলীয়া রেয়াহী (রঃ) বলেনঃ ‘আমি বছরায় (প্রবীণ তাবেয়ীনদের নিকট) হাদীছ শুনিয়া তৃপ্তিলাভ করিতাম না –যে পর্যন্ত না মদীনায় যাইয়া উহা স্বয়ং ছাহাবীদের মুখে শুনিতাম’। ; [দারেমী-১/১২৬ পৃঃ] তাবেয়ী আবু কেলাবা বলেনঃ ‘মদীনা সফরকালে আমি প্রত্যাবর্তনের সমস্ত আয়োজন শেষ করিয়াও শুধুমাত্র একটি হাদীছ শোনার জন্য তিন…. পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়াছিলাম এবং হাদীছটি শুনিয়াই প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলাম’। (তিন অর্থে তিনি সম্ভবতঃ তিন মাসকেই বুঝাইয়াছেন।) [ দারেমী-১/১২৫ পৃঃ] স্বনামখ্যাত তাবেয়ী ইমাম জোহরী হাদীছ লাভ করার জন্য প্রবীণ তাবেয়ী ওরওয়া ইবনে জুবায়রের দরজায় পড়িয়া থাকিতেন। [ দারেমী-১/১২৬ পৃঃ]
তাবেয়ীগণ ছাহাবীদের নির্দেশ অনুসারে হাদীছ হেফজ রাখার জণ্য উহা পুনঃ পুনঃ আলোচনা করিতেন। তাবেয়ী আতা ইবনে আবি রাবাহ (রঃ) বলেনঃ (আরবী********************************)
‘আমরা ছাহাবী হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর নিকট যাইতাম, আর তিনি আমাদের হাদীছ বর্ণনা করিতেন। আমরা যখন তথা হইতে প্রত্যাবর্তন করিতাম, পরস্পর মিলিয়া উহা আলোচনা করিতাম’। -তাদবীনে হাদীছ-৯০ পৃঃ
একদিন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাছউদ তাঁহার শাগরিদদের জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ‘হাদীছ আলোচনা ও ইয়াদ রাখার জন্য তোমরা পরস্পর মিলিত হও কি?’ উত্তরে তাঁহারা বলিলেনঃ ‘কোন দিন আমাদের কোন সংগী হাদীছ আলোচনায় যোগদান না করিলে আমরা বাড়ী যাইয়া তাহার সহিত উহা আলোচনা করি –যদিও তাহার বাড়ী কুফার শেষ প্রান্তে অবস্থিত হয়’। ইহা শুনিয়া হজরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলিলেনঃ ‘যে পর্যন্ত তোমরা এরূপ করিতে থাকিবে, কল্যাণের সহিত থাকিবে’। -দারেমী
তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীন ও পরবর্তী মোহাদ্দেছগণের
হাদীছ হেফজকরণ
ছাহাবীগণের পক্ষে ৫০-৬০ হাজার (অধিক হইতে অধিক লাখখানিক) ছনদবিহীন হাদীছ হেফজ বা রক্ষা করা মোটেই কঠিন ব্যাপার ছিল না, কিন্তু পরবর্তী যুগে ছনদ মুখস্ত করার আবশ্যকতা দেখা দেওয়ায় হাদীছ হেফজকরণের ব্যাপার কিছুটা কঠিন হইয়া উঠিলেও –যে পর্যন্ত না সমস্ত হাদীছ কিতাবে লিপিবদ্ধ হইয়া যায় সে পর্যন্ত মোছলিম জাহানে –আরব ও গায়র আরবে –এমন এমন তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের আবির্ভাব হয়, যাঁহাদের স্মরণশক্তির কথা শুনিলে বিস্ময়ে হতবাক হইতে হয়।
ইমাম শা’বী (মৃঃ ১০৪ হিঃ) বলেনঃ আমি কখনও সাদা কাগজে কালির দাগ দিই নাই। আমি যাহা একবার শুনি তাহা আমার হেফজ হইয়া যায়। আমি কোন দিন কোন হাদীছ পুনঃ বলিতে কাহাকেও অনুরোধ কির নাই। আমি কবিতা মুখস্থ করিয়াছি সর্বাপেক্ষা কম, তথাটি একাধাকে একমাস বলিলেও কোনো পংক্তি পুনঃ বলিতে হইবে না। -[?] মনীষী কাতাদা (মৃঃ ১১৭ হিঃ) সম্পর্কে ইমামা আহমদ ইবনে হাম্বল বলেনঃ কাতাদার কোন কথা শুনিবামাত্রই হেফজ হইয়া যাইন। তিনি একবার মাত্র শুনিয়াই ‘ছহীফায়ে জাবের’ হেফজ করিয়া লইয়াছিলেন। -[তাজকেরা] ইমাম জোহবী (মৃঃ ১২৪ হিঃ) বলেনঃ আমি যখন জান্নাতুল বাকী’র দিকে যাই, তখন আমি আমার কানে আঙ্গুল দিয়া রাখি যাহাতে বাজে কথা আমার কানে প্রবেশ না করে। খোদার কছম, একবার যে কথা আমার কানে প্রবেশ করে, তাহা আমি কখনো ভুলি না। -[জামে’ বয়ানুল এলম] ইমাম ইছহাক ইবনে রাহওয়াইহ (মৃঃ ২৩৮ হিঃ) বলেনঃ আমার কিতাবসমূহে লেখা ১ লক্ষ হাদীছ আমার চোখের সামনে ভাসিতেছে, ৩০ হাজার হাদীছ আমি গড় গড় করিয়া শুনাইতে পারি। দাঊদ ইবনে খাফফাফ বলেনঃ একবার ইমাম ইছহাক আমাদের ১১ হাজার হাদীছ লিখাইয়া দিলেন এবং আমরা লেখা দুরস্ত করিয়া লইবার উদ্দেশ্যে পরে উহা তিনি পুনঃ বলিলেন। কিন্তু কোথাও একটি অক্ষরও বেশ-কম হইল না। -[তাহজীব] ইমাম বোখারীর (মৃঃ ২৫৬ হিঃ) তিন লক্ষ হাদীছ মুখস্থ ছিল। হাশেদ ইবনে ইছমাইল বলেনঃ বোখারী আমাদের সহিত শায়খদের নিকট হাদীছ শুনিতে যাইতেন, আমরা সকলেই লিখিতাম। বোখারী লিখিতেন না। এজন্য আমরা তাঁহাকে তিরস্কার করিলে একদিন তিনি আমাদের সমস্ত হাদীছ মুখস্থ শুনাইয়া দেন, অথচ তখন পর্যন্ত ১৫ হাজার হাদীছ লেখা হইয়াছিল। -[তারীখে খতীব –তারজমান] ইমাম আবু জুরআ রাজী বলেনঃ আমি এক লক্ষ হাদীছ এমনভাবে মুখস্থ বলিতে পারি, যেভাবে এক ব্যক্তি কুলহুয়াল্লা (আরবী*****) বলিতে পারে। আমার ঘরে ৫০ বৎসর আগেরে বহু লেখা রহিয়াছে, যাহা আমি এ সময়ের মধ্যে কখনও দেখি নাই, অথচ আমি বলিতে পারি যে, কোন কথা কোন কিতাবের কোন পৃষ্ঠায় কোন লাইনে রহিয়াছে। ইমাম আহমদ (রঃ) বলেনঃ ছহীহ হাদীছের (অর্থাৎ, ছহীহ ছনদের) কুল সংখ্যা সাত লক্ষ আর এই যুবকটি (আবু জুরআ) ছয় লাখই মুখস্থ করিয়া ফেলিয়াছে। -[তাহজীবুত তাহজীব] ইমাম তিরমিজী (মৃঃ ২৭৯ হিঃ] একবার যাহা শুনিতেন, তাহাই তাঁহার কন্ঠস্থ হইয়া যাইত। একবার তাঁহার এক শায়খ পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁহাকে এক সঙ্গে ৪০টি হাদীছ শুনাইয়া উত্তর চাহিলে তিনি সাথে সাথে উহা শুনাইয়া দেন। -[তাজকেরা ২-১২৮] মোহাদ্দেছ আবু দাউদ তায়ালছী বলেনঃ ৩০ হাজার হাদীছ আমি ফরফর করিয়া শুনাইতে পারি, অথচ ইহাকে আমি গৌরবের বিষয় বলিয়া মনে করি না। -[তাহজীব] ইমাম তকীউদ্দীন বা’লাবাক্কী একই বৈঠকে ৭০টি পর্যন্ত হাদীছ মুখস্থ করিতে পারিতেন। হোমাইদীর ‘আল জামউ বায়নাছ ছহীহাইন’ মোছলেমের ‘ছহীহ মোছলেম’ ও ইমাম আহমদের বিরাটকায় ‘মোছনাদে আহমদ’ কিতাবের বেশীর ভাগ তাঁহার মুখস্থ ছিল।
এইরূপ আর কত জনের উদাহরণ দিব? ইমাম জহরী এইরূপ হাফেজ হাদীছ মনীষীদের সম্পর্কে ‘তাজকেররাতুল হোফফাজ’ নামে চারি খণ্ডে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্হই রচনা করিয়াছেন, যাহাতে ১১ শতের অধিক হাফেজের জীবনী রহিয়াছেন। অথচ ছনদের সম্যক অবস্থাসহ যাহার এক লক্ষ হাদীছ অর্থাৎ, ছনদ মুখস্থ নাই, তাহাকে হাফেজ বলাই যায় না। এছাড়া উহাতে বহু হুজ্জাতের জীবনীও রহিয়াছে যাহাদের এইরূপে অন্ততঃ তিনি লক্ষ করিয়া হাদীছ’-ও কেবল (ছনদ) মুখস্থ ছিল।ইমাম বোখারীও এইরূপ একজন হুজ্জাত। দুনিয়াতে ‘হাকেমুল হাদীছ’ ও কেবল কম জন্মগ্রহণ করেন নাই, অথচ আপন সময় পযর্ন্ত প্রচলিত সমস্ত হাদীছের অবস্থা জানা না থাকিলে কাহাকেও হাকেম নাম অভিহিত করা যায় না।[ওলামায়ে ছলফ-শিরওয়ানী]
এই দ্বিতীয় যুগের কতিপয় বিখ্যাত হাফেজ হাদীছ
১। হজরত আমর ইবনে দীনার (মৃঃ ১১৬ হিঃ)
২। হজরত কাতাদা ইবনে দাআমা ছদুছী (মৃঃ ১১৭ হিঃ)
৩। ইয়াহইয়া ইবনে ইয়ামার (মৃঃ১১৯ হিঃ)
( ইনিই হাজ্জাজের আদেশে কোরআন পাকের অক্ষরে প্রথম নোকতা ব্যবহার করেন বলিয়া অনেকে মনে করেন)
৪। ইমাম জোহরী মোহম্ম ইবনে মুছলিম ইবনে উবায়াদুল্লাহ ইবনে শেহাব (মৃঃ ১২৪ হিঃ)
৫। হজরত আবদুর রহমান ইবনে কাছেম ইবনে মোহাম্মদ (মৃঃ ১২৬ হিঃ মদীনা )
৬। ইমাম আবু ইছহাক ছিবিয়ী (রঃ ১২৭ হিঃ)
তিনি ৪০০ ওস্তাদের নিকট হাদীছ শিক্ষা করিয়াছিলেন-যাঁহাদের মধ্যে ৩৮ জন ছিলেন ছাহাবী।
৭। হজরত মানছুর ইবেন মো’তামের (মৃঃ ১৩৬ হিঃ কুফা)। তিনি হজ্জাত ছিলেন।
৮। হজরত রাবীয়াতুল-রায় (মৃঃ ১৩৬ হিঃ ইমাম মালেকের ওস্তাদ)
৯। হজরত দাউদ ইবনে দীনার (মৃঃ ১৩৯ হিঃ)
১০। হজরত ইউনুছ ইবনে উবায়দ (মৃঃ ১৩৯ হিঃ)।
১১।হজরত ছালমাহ ইবনে দীনার (মৃঃ ১৪০ হিঃ)।
১২। হজরত ছোলাইমান ইবনে দীনার (মৃঃ ১৪৩ হিঃ)।
১৩। হজরত ওকাইল ইবনে খালেদ আইলী ) মৃঃ ১৪৪ হিঃ)।তিনি হুজ্জাত ছিলেন।
১৪। হজরত হেশাম ইবনে ওরওয়াহ (মৃঃ ১৪৬ হিঃ)। তিনি হুজ্জাত ছিলেন এবং হাদীছ লিখিয়াও ছিলেন।
১৫। হজরত ইছমাইল ইবনে আবু খালেদ (মৃঃ ১৪৭ হিঃ)।
১৬। হজরত উবায়দুল্লাহ ইবনে ইছহাক (মৃঃ ১৪৭ হিঃ)।
১৭। হজরত হোছাইন মুয়াল্লিম বছরী (মৃঃ ১৪৯ হিঃ)।
১৮। ইমাম মোহাম্মদ ইবনে ইছহাক (মৃঃ ১৫১ হিঃ)। তিনি মাগাজী সম্পর্কে হাদীছের কিতাবও রচনা করিয়াছেন।
১৯। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আওন (মৃঃ ১৫১ হিঃ)
২০। হজরত মা’মার ইবনে রাশেদ (১৫৩ হিঃ)। তিনি হাদীছের হুজ্জাত ছিলেন ইয়ামানে সর্বপ্রথম তাছনীফ করিয়াছিলেন।
২১। ইমাম ছুফাইয়ান ছওরী (১৬৩ হিঃ)। তাঁহার ৩০ (ত্রিশ) হাজার হাদীছ মুখস্থ ‘জামে’ছওরী’ প্রভৃতি তাহার হাদীছের কিতাব।
২২। ইমাম আবু জোরআ ইবনে আবু শাইবাহ ( হিঃ খোরছান) লক্ষধিক তাঁহার মুখস্থ ছিল।
২৬। হজরত ইমাম ইবনে ইয়াহইয়া বছরী ( ১৬৪ হিঃ) তিনি হুজ্জত ছিলেন।
তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীনদের
হাদীছ শিক্ষাদান
হাদীছেন শিক্ষাকরণ ও হেফজকরণের ন্যায় উহা শিক্ষাদানের ব্যাপারেও তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীনদের আগ্রহ ও তৎপরতার অন্ত ছিল না। তাঁহারদের প্রত্যেকেই হাদীছের একজন মোআল্লেম ছিলেন।রেজালেন কিতাব এইরূপ কয়েক হাজার তাবেয়ীন, তাবে’-তবেয়ীনের জীবনী রহিয়াছে যাঁহারা আজীবন হাদীছ শিক্ষায় ( রেওয়ায়তে) ব্যাপৃত ছিলেন। ইবনে ছাদ তাঁহার ‘তাবকাতে’ এইরূপ…. হাজার লোকের জীবনী আলোচনা করিয়াছন। হাকেম আবু আবদুল্লাহ নিশাপুরী তাঁহার ‘মা’রেফাতে উলুমিল হাদীছ’ গ্রন্হে ইহাদের প্রায় সাড়ে পাঁচ শত (৫৪১) এমন লোকের নামে করিয়াছেন যাঁহাদের নিকট হাদীছ শিক্ষা করাকে বরকতও গৌরবের ব্যাপার বলিয়া মনে করা হইতে। নীচে এইরূপ কতিপয় হাদীছ শিক্ষাদাতার নাম দেওয়া গেলঃ
মদীনায়ঃ
১। হজরত ছাঈদ ইবনে মোছায়্যাব (মৃঃ ৯৪ হিঃ)।
২। হজরত ওরওয়া ইবনে জুবায়র (মৃঃ ৯৪ হিঃ)।
৩। হজরত আবু বোরদা ইবনে আবু মূছা আশআরী (মৃঃ ১০৪ হিঃ)
৪। হজরত ইকরামা মাওলঅ ইবনে আব্বাছ (মৃঃ ১০৭ হিঃ)।
৫। হজরত কাসেম ইবনে মোহাম্ম ইবনে আবু বকর ছিদ্দী (মৃঃ ১০৭ হিঃ)
৬। হজরত নাফে’ মাওলা ইবনে ওমর (মৃঃ ১০৭ হিঃ)
৭। হজরত ইবনে শেহাব জোহরী (মৃঃ ১৪২ হিঃ)।
৮। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে দীনার (মৃঃ ১২৭ হিঃ)
৯। হজরত আবুজ জেনাদ (মৃঃ ১৩১ হিঃ)
১০। হজরত জায়দ ইবনে আছলাম (মৃঃ ১৩৬ হিঃ)
১১। হজরত হেশাম ইবনে ওরওয়াহ (মৃঃ ১৪৬ হিঃ)।
১২। হজরত ইবনে আবি জে’ব_
১৩। হজরত ইমাম মালে (মৃঃ ১৭৯ হিঃ)
মক্কায়ঃ
১। হজরত মুজাহিদ ইবনে জাবার (মৃঃ ১০৪ হিঃ)।
২। হজরত আতা ইবনে আবি রাবাহ (মৃঃ ১১৪ হিঃ)।
৩। হজরত আমরা ইবনে দীনার (মৃঃ ১২৬ হিঃ)
৪। হজরত ইবনে জোরাইজ (মৃঃ ১৬০হি)
কুফায়ঃ
১। হজরত ইব্রাহীম নাখায়ী (মৃঃ ৯৫ হিঃ )
২। হজরত ছাঈদ ইবনে জুবায়র (মৃঃ ৯৫ হিঃ)
৩। হজরত শা’বী (আমের) (মৃঃ ১০৩ হিঃ)
৪। হজরত আবু ইছহাক ছাবিয়ী (মৃঃ ১১৭ হিঃ)
৫। হজরত আ’মাশ (মৃঃ ১৪৮ হিঃ)
৬। হজরত মেছআর ইবনে কেদাম (মৃঃ ১৫৫ হিঃ)
৭। হজরত জয়েদাহ ইবনে কাদামাহ (মৃঃ ১৬১ হিঃ)
৮। হজরত ইমাম ছুফাইয়ান ছাওরী (মৃঃ ১৬১ হিঃ)
৯। হজরত ছুফইয়ান ইবনে উয়ায়নাহ (মৃঃ ১৯৮ হিঃ প্রমুখ
বছরায়
১। হজরত আবু ওছমান নাহদী (মৃঃ ১০০ হিঃ)
২। হজরত কাতাদ ইবনে দাআমা (মৃঃ ১১৫ হিঃ)
৩। হজরত আইয়ুব ছিখতেয়ানী (মৃঃ ১৫৪ হিঃ)
৪। হজরত হেশাম দস্তওয়াইহ (মৃঃ ১৫৪ হিঃ)
৫। হজরত ছাঈদ ইবনে আবি আরূবাহ (মৃঃ ১৫৬ হিঃ)
৬। হজরত ইমাম শো’বা ইবনে হাজ্জাজ (মৃঃ ১৬০ হিঃ)
৭। হজরত ইবনে আওন (মৃঃ ১৫০ হিঃ) প্রমুখ
তাবেয়ীন, তাবে’-তাবেয়ীনদের
হাদীছ লিখন
হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষর দিকেই পঞ্চম খলীফায়ে রাশেদ হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (মৃ ১০১ হিঃ) ব্যাপকভাবে হাদীছ সংগ্রহ করার জন্য মদীনার শাসনকর্তা আবু বকর ইবনে হাজম (মৃঃ ১১৭ হিঃ) এবং ইসলামী রাষ্ট্ররে অন্যান্য প্রধান প্রধান কেন্দ্র ওলামা ও সরকরী কর্মচারী প্রতি এক ফরমান জারি করেন এবং বলেনঃ
{ আরবী********************}
‘আপনাদের রছূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম-এর হাদীছ তালাশ করিয়া সংগ্রহ করুন। আমার আশংকা হইতেছে যে, ওলামাদের (ছাহাবা ও তাবয়ীনদের) মৃত্যুর সংগে সংগে হাদীছও বিলুপ্ত হইয়া যাইবে। কন্তু সাবধান! রছূলুল্লাহর হাদীছ ব্যতীত অপর কাহারো হাদীছ গ্রহণ করবেন না। [খলীফ হজরত ওছমানের আমলেই ছাহাবীদের দ্ধারা হাদীছ জাল করার ষড়যন্ত্র আরম্ভ হইয়া যায় এবং দেশের] এতদ্বতীত আপনার সর্বত্র মজলিস কায়েম করিয়া হাদীছ শিক্ষা দিতে থাকুন, যাহাতে যাহাদের জানা নাই তাহারা জানিতে পারে। কেননা, এলম গোপন করা হয় (অর্থাৎ তার র্চচা করা না হয়) তখন উহা বিলুপ্ত হইয়া যায়। বোখারী কিতাবুল এলম এই আমাদের ফলে দেশে হাদীছ সংগ্রহ করার এক বিরাট সাড়া পড়িয়া যায় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আলেমগণ (তবেয়ীন ও তাবে’ তাবেয়ীনগণ) হাদীছ সংগ্রহ ও লেখার কাজে উঠিয়া-পড়িয়া লাগেন। নীচে ইহাদের লিখিত কতিপয় কিতাবের নাম দেওয়া গেলঃ
দ্বিতীয় যুগে লিখিত
কতিপয় হাদীছের কিতাব
তৃতীয় শতব্দীর বিখ্যাত গ্রন্হ-ঐতিহাসি ইবনে নদীম (মৃঃ ৩২৬ হিঃ) তাঁহার ‘আল ফিহরিন্ত’ নামক গ্রন্হ-পরিচিতি কিতাবে দ্বিতীয় শতব্দীতে রচিত প্রায় অর্ধশত হাদীছের কিতাবের নাম উল্লাখ করিয়াছেন।নীচে উহাদের মধ্যে কতিপয়ের নাম করা গেলঃ
১। কিতাবুছ ছুনান ইমাম মকহুল শামী (মৃ ১১৬ হিঃ)
২। কিতাবুল ফরায়েজ আবু হেশাম মুগীরা (মৃঃ ১৬৩ হিঃ)
৩। কিতাবুছ ছুনান ইমাম আবদুল মালেক ইবনে জোরাইজ (মৃঃ১৫০ হিঃ)
৪। কিতাবুছ ছুনান ছাঈদ ইবনে আবি আরূবা (মৃঃ ১৫৭ হিঃ)
৫। কিতাবুছ ছুনান ইবনে আবি জে’ব (মৃঃ ১৫৯ হিঃ)
৬। কিতাবুছ ছুনান ইমাম আওজাঈ (মৃঃ ১৫৯ হিঃ)
৭। কিতাবুল জামে’উল কবীরইমাম ছুফইয়ান ছওরী (মৃঃ১৬১ হিঃ)
৮। কিতাবুল জামে’উছ ছগীরইমাম ছুফইয়ান ছওরী(মৃঃ ১৬১ হিঃ)
৯। কিতাবুছ ছুনান জায়েদা ইবনে কোদামা ছফকী(মৃঃ ১৬১ হিঃ)
১০। কিতাবুজ জোহদা ঐ
১১। কিতাবুল মানাকিব ঐ
১২। কিতাবুছ ছুনান ইমাম হাম্মাদ ইবনে ছালেমা (মৃঃ ১৬৫ হিঃ)
১৩। কিতাবুল মাগাজীআবদুল মালিক ইবনে মোহাম্মদ
ইবনে আবু বকর ইবনে হাজম(মৃঃ ১৭৬ হিঃ)
১৪। কিতাবুছ ছুনান ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (মৃঃ ১৮১ হিঃ)
১৫। কিতাবুজ জোহদাঐ
১৬। কিতাবুল বিররে ওয়াছছেলাহ ঐ
১৭। কিতাবুছ ছুনান আবু ছাঈদ ইয়াহইয়া (মৃঃ ১৮৩ হিঃ)
ইবনে জাকারিয়া ইবনে জায়েদা।
ইনি মাদায়েন-এর কাজী ছিলেন।
[বিভিন্ন অঞ্চলে ছাড়াইয়া পড়ে। সম্ভঃ ইহা লক্ষ্য করয়াই হজরত ওমর ইবনে আবুদল আজীজ তুরায় এ ব্যবস্থ অবলম্ভন করেন এবং রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর হাদীছকে জাল হাদীছ হইতে বাহিয়া লইতে আদেশ দেন। ছাহাবীদের হাদীছ জালেন বিবিরণ হাদীছ জাল ও তার প্রতিকার অধ্যায়ে দেওয়া হইয়াছে।]
১৮। কিতাবুছ ছুনান হুশাইম ইবনে বশীর (মৃঃ ১৮৩ হিঃ)
১৯। কিতাবুত তাহারাত ইমাম ইছমাইল ইবনে উলাইয়া(মৃঃ ১৯৩ হিঃ)
২০। কিতাবুছ ছালাতঐ
২১। কিতাবুল মানাছিকঐ
২২। কিতাবুছ ছুনান ওয়ালিদ ইবনে মুসলিম(মৃঃ ১৯৪ হিঃ)
২৩। কিতাবুল মাগাজীঐ
২৪। কিতাবুছ ছুনান মোহাম্মদ ইবনে ফোজাইল ইবনে (মৃঃ ১৯৫ হিঃ)
২৫। কিতাবুজ জোহদগোজওয়ান
২৬। কিতাবুছ ছিয়ামঐ
২৭। কিতাবুদ দো’আ ঐ
২৮। কিতাবুছ ছুনান ইমাম ওয়াকী ইবনে জাররাহ (মৃঃ ১৯৭ হিঃ)
২৯। কিতাবুল মানাছিক ইমাম আবু মোহাম্মদ ইছহাক আজরক(মৃঃ ১৯৫ হিঃ)
৩০। কিতাবুছ ছালাতঐ
৩১। কিতাবুল কেরা’আত ঐ
৩২। কিতাবুল খারাজইমাম ইয়াহইয়া ইবনে আদম (মৃঃ ২০৬ হিঃ)
ইহা প্রকাশিত
৩৩। কিতাবুল ফারায়েজ ইমাম এজীদ ইবনে হারূন (মৃঃ ২০৬ হিঃ)
৩৪। কিতাবুছ ছুনান ইমাম আবদুর রাজ্জাক
ইবনে হুমাম ছন’আনী(মৃঃ ২১১ হিঃ)
৩৫। কিতাবুল মাগাজীঐ
-কিতাবুল ফিহরিস্ত-৩১৪-৩২৬ পৃঃ
৩৬। আল জামে ইমাম মা’মার ইবনে রাশেদ (মৃঃ ১৫১ হিঃ)
৩৭। কিতাবুল মাগাজীআবু মা’শার নজীহ সিন্দী (মৃঃ ১৭০ হিঃ)
৩৮। কিতাবু জম্মুল মালাহী ইবনে আবিদ্দুনয়া (মৃঃ ১৮০ হিঃ)
৩৯। মো’আত্তাইমাম মালেক (মৃঃ ১৭৯ হিঃ)
৪০। কিতাবুল খারাজইমাম আবু ইউছুফ (মৃঃ ১৮২ হিঃ)
৪১। মোআত্তা ইমাম মোহাম্মদ(মৃঃ ১৮৯ হিঃ)
৪২। মোআত্তা কবীর আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব(মৃঃ ১৯৭ হিঃ)
৪৩। আহওয়ালুল কিয়ামাহ ঐ
৪৪। আল মুছনাদ ইমাম শাফেয়ী (মৃঃ ২০৪ হিঃ)
৪৫। কিতাবুল উম্ম ঐ
ইহা ফেকাহর কিতাব হইলেও ইহাতে ছনদ সহ বহু হাদীছ রহিয়াছে।
৪৬। আল মুছনাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ)
দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত এ সকল হাদীছ গ্রন্থের অধিকাংশ আজ পাওয়া না গেলেও তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত এ সকল গ্রন্থ বিদ্যমান ছিল। ইবনে নদীম এই সকল গ্রন্থের রচয়িতাদের নিকটতম যুগের লোক ছিলেন বলিয়া তিনি স্বয়ং এইগুলির প্রায় সকলটিই দেখিয়াছিলেন বা এ সম্পর্কে বিশ্বস্ত সূত্রে অবগত হইয়াছিলেন। তৃতীয় শতাব্দীর হাদীছ সংকলক মোহাদ্দেছগণ এ সকল গ্রন্থকার প্রমুখাৎ শুনিয়া সে সকল গ্রন্থের প্রায় সমস্ত হাদীছই তাঁহাদের কিতাবে লিপিবদ্ধ করিয়া লইয়াছেন।
এ যুগের তিন জন বিশিষ্ট হাদীছের ইমাম
১। ইমাম মালেক (রঃ)
[৯৩-১৭৯ হিঃ মোঃ ৭১১-৭৯৫ ইং]
ইমাম আবু আবদুল্লাহ মালেক ইবনে আনাছ আছবাহী মদনী মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং মদীনায়ই জীবন অতিবাহিত করেন। রছূলুল্লাহর মাজার ছাড়িয়া তিনি কখনো মদীনার বাহিরে যান নাই। একবার মাত্র মক্কা শরীফে হজ্জ করিতে গিয়াছিলেন। তিনি ‘তাবে’-তাবেয়ী’ (তাবেয়ীগণের শাগরিদ) ছিলেন। হজরত নাফে’, (আবদুল্লাহ ইবনে ওমরের শাগরিদ) মোহাম্মদ ইবনে মুনকাদির ও ইমাম জোহরী প্রভৃতি বিখ্যাত তাবেয়ী ও বহু তাবে’-তাবেয়ীর নিকট তিনি হাদীছ শিক্ষা করেন। তাকওয়া-পরহেজগারী ও হাদীছ হেফজের ব্যাপারে তৎকালে কেহ তাঁহার সমকক্ষ ছিলেন না। হাদীছের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘মোআত্তা’ তাহারই রচিত। তিনি অতি অসাধারণ মনীষীসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। ইমাম শাফেয়ী বলেনঃ ‘ইমাম মালেক ও ইবনে উ’য়ায়না না থাকিলে হেজাজবাসীদের এলম বিলুপ্ত হইয়া যাইত’। ইমাম মালেকের ওস্তাদগণের মদ্যে এমন ব্যক্তি খুব খমই ছিলেন যিনি ইমাম মালেকের নিকট মাছআলা জিজ্ঞাসা করেন নাই।
ইমাম মালেক হাদীছের অত্যন্ত তা’জীম করিতেন। কোন লোক তাঁহার নিকট কোন মাছআলা দরইয়াফত করিলে তিনি তৎক্ষণাৎ তাহার উত্ত দিতেন; কিন্তু কোন হাদীছ দরইয়াফত করিলে তিনি প্রথমে গোসল করিয়া উত্তম লেবাছ পরিতেন এবং গায়ে খোশবু লাগাইতেন। অতঃপর উচ্চ আসনে বসিয়া অতি ভীত-সন্ত্রস্তভাবে উহা বর্ণনা করিতেন। এভাবে তিনি রছূলূল্লাহর (ছঃ) এত আদব-লেহাজ করিতেন যে, তিনি সম্পূর্ণ অচল হইয়া না পড়া পর্যন্ত কখনো মদীনার পাক মাটিতে পায়খানা-প্রস্রাব করেন নাই। শহর-সীমার বাহিরে যাইয়াই উহা করিয়াছেন।
একবার রছুলুল্লাহর (ছঃ) জেয়ারত উপলক্ষে খলীফা হারূনুর রশীদ কিছুদিন মদীনায় অবস্থান করেন। তখন তিনি ইমাম ছাহেবের নিকট অনুরোধ জানাইলেন যে, ‘আপনি যদি আমার ঘরে বসিয়া আমার ছেলে দুইটিকে কিছু শিক্ষা দেন তা হইলে আমি আনন্দিত হইব’। ইমাম ছাহেব উত্তরে জানাইলেনঃ ‘আল্লাহ এলমকে সম্মানিত করিয়াছেন। আপনি উহাকে অপমানিত করিতে চেষ্টা করিবেন না’। অতঃপর খলীফা তাঁহার পুত্র আমীন ও মামুনকে ইমাম ছাহেবের বাড়ীতে রাখিয়াই শিক্ষা দেন।
ইমাম মালেক (রঃ) ১৭৯ হিজরীতে মদীনায় এন্তেকাল করেন এবং মদীনার প্রসিদ্ধ গোরস্থান ‘জান্নাতুল বাকী’তে সমাধিস্থ হন।