২।ইমাম শাফেয়ী (রঃ)
[১৫০– ২০৪ হিঃ মোঃ ৭৬৭– ৮২০]
ইমাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইদ্রীছ শাফেয়ী ১৫০ হিঃ দক্ষিন ফিলিস্তিনের গাজা বা আছকালানে, কাহারো মতে মক্কার মিনায় জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল তিনি মক্কা শরীফেই অতিবাহিত করেন। অতঃপর এলমের সন্ধানে তিনি দেশ–বিদেশ ভ্রমণ করেন। তিনি অসাধারণ মেধাবী ছিলেন। সাত বৎসর বয়সেই তিনি কোরআন পাক হেফজ করিয়া লন। তিনি মক্কার মুফতীয়ে আজমের নিকট ফেকাহ শাস্ত্র শিক্ষা করেন। ১৫ বৎসর বয়সেই তৎকালীন আলেমগণ তাহাকে ফতওয়া দেওয়ার অনুমতি দান করেন। অতঃপর তিনি মদীনা শরীফ যাইয়া ইমাম মালেকের খেদমতে অবস্থান করেন। তাঁহার নিকট শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া তাঁহার অনুমতিক্রমে তিনি বাগদাদ গমন করেন। বাগদাদের আলেমগণ তাঁহার নিকট হাদীছ ও ফেকাহ শিক্ষা করেন। দুইটি বৎসর অবস্থানের পর তথা হইতে তিনি পুনঃ মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। কিছু দিন পর আবার তিনি বাগদাদে আসেন এবং তথা হইতে মিছর গমন করেন। মিছরেই তিনি শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। মিছরেই তাঁহার মাজার।
ফেকাহ শাস্ত্রে তাঁহার যুগে তাঁহার সমকক্ষ কেহই ছিলেন না। তিনি ইমাম আবু হানীফার (রঃ) ফেকাহ হইতেও উপকৃত হইয়াছিলেন। ইমাম মোহাম্মদ বলেনঃ ‘‘একবার শাফেয়ী আমার নিকট হইতে ইমাম আবু হানীফার ‘আওছাত’ নামীয় একটি কিতাব ধার গ্রহণ করেন এবং একদিন ও একরাত্রির মধ্যেই উহা মুখস্ত করিয়া লন। তিনি একজন শা‘এর বা কবিও ছিলেন’’। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলেনঃ ‘‘তিনি দ্বীনের রবি এবং মানুষের পক্ষে শান্তির দূত ছিলেন। বিগত ৩০ বৎসর যাবৎ আমার এমন কোন রাত্র কাটে নাই যাহাতে আমি ইমাম শাফেয়ীর জন্য দোআ করি নাই’’। ইমাম আহমদ (রঃ) ইমাম শাফেয়ীর শাগরিদ ছিলেন।
ইমাম শাফেয়ী প্রায় ১১৪টি গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন। ইহার মধ্যে তাঁহার ফেকাহর ‘কিতাবুল উম্ম’ই প্রসিদ্ধ। ইহাতে বহু হাদিছ রহিয়াছে। ‘মোছনাদ’ তাঁহার একটি স্বতন্ত্র হাদীছের কিতাব। কিতাব রচনায় তিনি কিরূপ সাধনা ও কষ্ট স্বীকার করিয়াছেন তাহা ইহাতেই অনুমান করা যাইতে পারে যে, রাত্রে যখনই তাঁহার কোন কথা মনে পডিত তখনই তিনি আলো জ্বালাইয়া উহা লিকিয়া লইতেন এবং এজন্য তাঁহার রাত্রে বারবারই আলো জ্বালিতে হইত, অথচ তখনকার জমানায় পাথর ঠুকিয়া আলো জ্বালানো সহজ ব্যাপার ছিল না।
৩। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ)
[১৬৭-২৪১ হিঃ মোঃ ৭৮০-৮৫৭ ইং]
ইমাম আবু আবদুল্লাহ আহমদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে হাম্বল বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন এবং বাগদাদেই এন্তেকাল করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করিয়া হাদীছ অন্বেষণে কুফা, বছরা, মক্কা, মদীনা, শাম, ইরাক ও তাবরেজ ছফর করেন। ইমাম শাফেয়ীর বাগদাদ অবস্থানকালে তিনি তাঁহার খেদমতে প্রায় লাগিয়া থাকিতেন। ইমাম শাফেয়ী বলেনঃ ‘বাগদাদ ত্যাগকালে আমি আমার শাগরিদদের মধ্যে আহমদ ইবনে হাম্বলের ন্যায় উচ্চ জ্ঞানী আলেম ও দরবেশ ব্যক্তি আর কাহাকেও দেখিয়া আসি নাই’। ইমাম আবু দাউদ বলেনঃ ‘আমি দুই শত মনীষী মাশায়েখকে দেখিয়াছি, কিন্তু আহমদ ইবনে হাম্বলের ন্যায় কাহাকেও দেখি নাই’। ইমাম দারেমী বলেনঃ ‘রছুলের হাদীছ সংরক্ষণ ব্যাপারে আহমদ ইবনে হাম্বল অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন’। তিনি কখনো কাহারো নিকট কিছু গ্রহণ করেন নাই। ৭৭ বৎসরকাল তিনি এভাবেই অতিবাহিত করেন এবং অতি দীন বেশে দুনিয়া হইতে বিদায় গ্রহণ করেন। তাঁহাকে দেখিলে কাহারো আখেরাত ইয়াদ না হইয়া পারিত না। মু’তাজিলাদের কতক ভ্রান্ত মতবাদ অস্বীকার করায় তিনি খলীফা মো’তাছেম বিল্লাহ কর্তৃক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং বেত্রাঘাত ও ইত্যাকার বহু নির্যাতন ভোগ করেন।
তিনি ৭ লক্ষ ৫০ হাজার হাদীছ সংগ্রহ করিয়া তাঁহার ‘মোছনাদ’ লিখিতে বসেন এবং ৩০ হাজারের কিছু অধিক হাদীছ তাঁহার কিতাবে স্থান দেন। মোছনাদসমূহের মধ্যে তাঁহার কিতাবই সর্ববৃহৎ ও সর্বাপেক্ষা ছহীহ।
দ্বিতীয় যুগের দুইটি প্রসিদ্ধ কিতাব
১। ‘মোআত্তা’
এ যুগের কিতাবসমূহের মধ্যে ইমাম মালেকের ‘মোআত্তা’ হইতেছে প্রসিদ্ধতর ও ছহীহতর কিতাব। মোহাদ্দেছীনদের বিচার উহার সমস্ত হাদীছই ছহীহ বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছে। ইমাম শাফেয়ী (র) বলেনঃ ‘আছমানের নীচে কিতাবুল্লাহর পর ইমাম মালেকের ‘মোআত্তা’ই হইল বিশ্বস্ততর কিতাব’। -হুজ্জাতুল্লাহ-১৩৩ পৃঃ। অবশ্য এ সময় ইমাম বোখারীর ‘আল জামেউছ ছহীহ’ লেখা হয় নাই। কিন্তু ইমাম শাহ ওলী উল্লাহ দেহলবী (মৃঃ ১১৭৬ হিঃ) ও তাঁহার পুত্র শাহ আবদুল আজীজ দেহলবী (মৃঃ ১২৩৯ হিঃ) ইমাম মালেকের ‘মোআত্তা’র দশ গুণ হইলেও ইমাম বোখারী ও মোছলেম হাদীছ বর্ণনার পদ্ধতি, ছনদ বিচারের নিয়ম এবং হাদীছ হইতে ফেকাহ বাহির করার তরীকা ‘মোআত্তা’ হইতেই শিক্ষা করিয়াছেন। হাদীছের পরবর্তী কিতাবসমূহ ‘মোআত্তা’র বর্ধিত সংস্করণস্বরূপই। -হুজ্জাতুল্লাহ, মোছাওয়া, উজালা
ইমাম মালেক (রঃ) ‘মোআত্তা’ লিখিয়া মদীনার ৭০ জন বিশিষ্ট ফকীহ ও মোহাদ্দেছের নিকট পেশ করেন এবং তাঁহারা সকলেই ইহার সমর্থন করেন। এ কারণে তিনি ইহার নাম দেন ‘মোআত্তা’ বা সমর্থিত। ‘মোআত্তা’র আদর মোআত্তা লেখার যুগেই এত অধিক হইয়াছিল যে, সহস্রাধিক বিশিষ্ট আলেম ইমাম মালেকের নিকট তাঁহার এই ‘মোআত্তা’ শিক্ষা করেন। তাঁহাদের মধ্যে ইমাম মোহাম্মদ, ইমাম শাফেয়ী, ইবনে ওহাব ও ইবনে কাছেমের ন্যায় মুজতাহিদ ও ফকীহ, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে ছাঈদ কাত্তান, আবদুর রহমান ইবনে মাহদী ও আব্দুর রাজ্জাকের ন্যায় বিখ্যাত মোহাদ্দেছ এবং খলীফা হারূনুর রশীদ, আমীন ও মামুনের ন্যায় আমীর-ওমারাও রহিয়াছেন। পরবর্তী যুগের আলেমগণও ‘মোআত্তা’র প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। কেহ ইহার সনদ বিচার করিয়াছেন, কেহ ইহার মতনের গুণাগুণ আলোচনা করিয়াছেন, আর কেহ বা ইহার শরাহ করিয়াছেন। এক কথায় বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন আলেম ‘মোআত্তা’র বিভিন্ন দিক লইয়া আলোচনা করিয়াছেন।
‘মোআত্তা’র শরাহঃ
বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন মোহাদ্দেছ ‘মোআত্তা’র শরাহ করিয়াছেন, যথাঃ-
১। শরহে মোআত্তা –ইবনে হাবীব মালেকী (মৃঃ ২৩৯ হিঃ)। সম্ভবতঃ ইহাই ‘মোআত্তা’র প্রথম শরাহ।
২। শরহে মোআত্তা –ইবনে আবদুল বার (মৃঃ ৪৩৬ হিঃ)। ‘তাকাচ্ছী’ ও ‘তামহীদ’ নামে তাঁহার দুইটি শরাহ রহিয়াছে।
৩। শরহে মোআত্তা –আব্দুল্লাহ ইবনে বাতলায়উছী আন্দালুছী (মৃঃ ৫২১ হিঃ)।
৪। শরহে মোআত্তা –ইবনুল আরবী –আবু বকর মোহাম্মদ মাগরেবী (মৃঃ ৫৪৬ হিঃ)। ইহার নাম ‘আল কাবছ’।
৫। শরহে মোআত্তা –জালালুদ্দীন ছুয়ুতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ)। ইহার নাম ‘কাশফুল মোআত্তা’। ইহার সংক্ষেপ করিয়া তিনি নাম দিয়াছেন ‘তানবীরুল হাওয়ালেক’। ইহা প্রকাশিত হইয়াছে।
৬। শরহে মোআত্তা –জুরকানী –মোহাম্মদ ইবনে আবদুল বাকী মিছরী (মৃঃ ১০১৪হিঃ)। ইহা মোআত্তার একটি বিস্তৃত শরাহ; ৪ খন্ডে প্রকাশিত হইয়াছে।
৭। শরহে মোআত্তা –মোল্লা আলী ক্বারী (মৃঃ ১১২২ হিঃ)
৮। শরহে মোআত্তা –শাহ ওলীউল্লাহ মোহাদ্দেছ দেহলবী (মৃঃ ১১৭৬ হিঃ)। তাঁহার আরবী শরাহর নাম ‘আল-মোছাওয়া’ এবং ফরছী শরাহর নাম ‘আল মুছাফফা’। তাঁহার এই শরাহদ্বয় সম্মুখে রাখিয়া মোআত্তা আলোচনা করিলে এ যুগেও মানুষ ইজতেহাদের ক্ষমতা লাভ করিতে পারে বলিয়া তিনি মন্তব্য করিয়াছেন। উভয় শরাহ প্রকাশিত হইয়াছে।
৯। শরহে মোআত্তা –মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলবী। ইহার নাম ‘আওজাজুল মাছালেক’। ইহা একটি উত্তম শরাহ।
এছাড়া অনেকে ‘মোআত্তা’র সংক্ষেপ করিয়াছেন। যথা –খাত্তাবী আবু ছোলাইমান (মৃঃ ৩৮৮ হিঃ) ও আবুল ওয়ালীদ বাজী (মৃঃ ৪৭৪ হিঃ)। আবার কেহ ইহার গরীব (দুর্বোধ্য) শব্দের অভিধান রচনা করিয়াছেন। যথা –বারকী। এছাড়া কাজী আবু আবদুল্লাহ ও জালালুদ্দীন ছুয়ুতী ইহার ছনদ বিচার করিয়াছেন।
২।মোছনাদে আহমদ
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃঃ ২৪০ হিঃ)সাড়ে সাত লক্ষ হাদীছ হইতে বাছাই করিয়া তাঁহার এই কিতাব লিখিয়াছেন। ইহাতে সাত শত ছাহাবী কর্তৃত বর্ণিত ‘তাকরার’ বাদ মোট ৩০ (ত্রিশ) হাজারের মত হাদীছ রহিয়াছে। মোছনাদসমূহের মধ্যে ইহা একটি বৃহত্তর ও বিশ্বস্ততর মোছনাদ। ইহাতে কিছু ‘জঈফ’ হাদীছ সংযোজন করিয়াছেন বলিয়া মোহাদ্দেছগণ মনে করেন। ইমাম ইবনে জাওজী প্রমুখ সমালোচকগণ ইহার কতিপয় হাদীছের বিরূপ সমালোচনা করিয়াছেন। কিন্তু হাফেজ ইবনে হাজর ও জালালুদ্দীন ছুয়ুতী ইহার খণ্ডন করিয়াছেন। হযরত শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবী এ পর্যন্ত বলিয়াছেন যে, ‘ইহার জঈফ হাদীছ পরবর্তী লোকদের ছহীহ হাদীছ অপেক্ষাও উত্তম’।
মোছনাদ পদ্ধতিতে লেখা কিতাবের শরাহ করার রীতি মোহাদ্দেছগণের মধ্যে প্রচলিত নহে। তথাপি শেখ আবুল হাছান সিন্দী ইহার এক শরাহ করিয়াছেন বলিয়া জানা যায়। এছাড়া মিছরের বিখ্যাত মোহদ্দেছ আহমদ আবদুর রহমান ছাআতী ইহাকে ছুনানের নিয়মে বিষয় অনুসারে সাজাইয়া ইহার এক সংক্ষিপ্ত শরাহ করিয়াছেন এবং নামকরণ করিয়াছেন ‘আল ফাতহুররব্বানী’। ইহা হালে মিছর হইতে ২২ খণ্ডে প্রকাশিত হইয়াছে।