তিনঃ সম্পর্ককে বিকৃতি থেকে রক্ষা করার উপায়
এ বুনিয়াদী নীতি ও গুণরাজির আলোকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ) আমাদেরকে বিস্তৃত হেদায়াত প্রদান করেছেন, যাতে করে সম্পর্ককে অভীষ্ট মানে উন্নীত করা যায়। এর ভেতরে কতিপয় জিনিস হচ্ছে নেতিবাচক, এগুলো সম্পর্ককে অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে। আর কতিপয় বিষয় ইতিবাচক, এগুলো তাকে অধিকতর স্থিতি ও প্রীতির সঞ্চার করে।
সবচেয়ে প্রথম ও প্রধান নিষিদ্ধ জিনিসটি হচ্ছে অধিকারে হস্তক্ষেপ।
১. অধিকারে হস্তক্ষেপ
এ বিশ্ব জাহানে প্রত্যেক মানুষেরই কিছুনা কিছু অধিকার রয়েছে। এ অধিকার যেমন মানুষের ব্যবহৃত জিনিসপত্রে রয়েছে, তেমনি রয়েছে তার সাথে সম্পর্কযুক্ত মানুষের প্রতি। একজন মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে, তার ভাইয়ের এ উভয়বিধ অধিকারের মধ্যে কোন একটি অধিকারও হরণ করার অপরাধে যাতে সে অপরাধী না হয়, তার প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখা। অর্থ-সম্পদ বা বস্তুগত স্বার্থের ভেতর তার ভাইয়ের যে অধিকার রয়েছে, তা যেমন সে হরণ করবে না, তেমনি তার জান-মাল, ইজ্জত-আব্র“ ও দ্বীনের দিক থেকে তার প্রতি যে কর্তব্য ন্যস্ত হয়েছে, তা পালন করতেও সে বিরত থাকবে না। এ সমস্ত অধিকার সম্পর্কেই কুরআন সবিস্তারে আলোচনা করেছে। মীরাস, বিবাহ, তালাক এবং অন্যান্য প্রতিটি বিষয়েই আল্লাহ্ তাঁর সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে সেগুলোতে হস্তক্ষেপ করার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কিত খুঁটিনাটি বিবরণ হাদীসে খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। উপরন্তু যে সকল জায়গায় এ সম্পর্কিত বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে সেখানে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় অধিকার ও খোদাভীতি সম্পর্কে নছিহত এবং নির্ধারিত সীমা লঙঘনের মন্দ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
تلك حدود الله فلا تعتدوها ومن يعتدَّ حدود الله فاولـــئك هم الظالمون –
“এ হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা, অতঃএব একে লংঘন করো না। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমা লংঘন করে, সে-ই জালিম।” (সূরা বাকারা-২২৯)
تلك حدود الله ومن يطع الله ورسوله يدخله جنات تجرى من تحتها الانهار خالدين فيها وذالك الفوز العظيم- ومن يعص الله ورسوله ويعتدَّ حدوده يدخله نارا خالدا فيها وله عذاب مُّهين –
“এ হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা, যে ব্যক্তি আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহ্ তাকে এমন বাগিচায় প্রবেশ করাবেন যার নিম্নদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত এবং সেখানে সে চিরকাল থাকবে। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সাফল্য। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (সঃ) নাফরমানী করে এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘন করে, আল্লাহ তাকে দোযকের আগুনে নিক্ষেপ করবেন, সেখানে সে চিরদিন অবস্থান করবে এবং তার জন্যে রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।” (সূরা নিসা-১৩-১৪)
মহানবী (সঃ) এ কথাটি মুসলমানদের সামনে এভাবে বর্ণনা করেছেন:
من اقتع حق امرء مسلم بيمينه فقد اوجب الله له النار وحرَّم عليه الجنة –
“যে ব্যক্তি কসম খেয়ে কোন মুসলমানের হক নষ্ট করেছে, আল্লাহ নিঃসন্দেহে তার প্রতি জাহান্নামকে অনিবার্য এবং জান্নতকে হারাম করে দিয়েছেন।
সাহাবীদের ভেতর থেকে কেউ জিজ্ঞেস করলেন:
وان كان شيئا يسيرا يا رسول الله ! فقال ان كان قضيبا من اراك –
“তা যদি কোন মামুলি জিনিস হয়? মহানবী (সঃ) বললেন: হ্যাঁ, তা যদি পীলো গাছের একটি অকেজো এবং মামুলি ডালও হয়, তবুও।”
একবার রাসূল (সঃ) অত্যন্ত মনোরম ভঙ্গিতে একথাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করেন:
أتدرون المفلس؟ قالوا المفلس فينا من لا درهم له ولا متاع فقال ان المفلس فى امتى من يأتى يوم القيامة بصلوة وصيام وزكوة وياتى قد شتم هذا وقذف هذا واكل مال هذا وسفك دم هذا وضرب هذا فيعطى هذا من حسناته وهذا من حسناته فان فنيت حسناته قبل ان يقضى ما عليه اخذ من خطاياهم فطرحت عليه ثم طرح فى النار –
“দরিদ্র কে, জানো? সাহাবীগণ (সাধারণ অর্থের দৃষ্টিতে) বললেন: যে ব্যক্তির মাল-মাত্তা নেই, সেই দরিদ্র। রাসূল (সঃ) বললেন: আমার উম্মতের মধ্যে আসল দরিদ্র হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও যাকাতের ন্যায় আমল নিয়ে আসবে এবং সে সঙ্গে গালি দেয়া, কারুর ওপর অপবাদ দেয়া, কারুর মাল খাওয়া, কারুর রক্তপাত করা এবং কাউকে মারধর করার আমলও নিয়ে আসবে। অতঃপর একজন মজলুমকে তার নেকী দিয়ে দেয়া হবে। তারপর দেয়া হবে দ্বিতীয় মজলুমকে তার নেকী। এভাবে চুড়ান্ত ফায়সালার আগে তার নেকী যদি খতম হয়ে যায়, তাহলে হকদারের পাপ এনে তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে এবং তারপর তাকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে।” (মুসলিম- আবু হুরায়রা রাঃ)
দুনিয়ার জীবনে সম্পর্ক-সম্বন্ধকে বিকৃতি থেকে রা করা এবং আখিরাতের শাস্তি থেকে বাঁচবার জন্যে অধিকারের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রয়োজন। এজন্যেই রাসূলে কারীম (সঃ) মৃত্যুর আগে মুসলমান ভাইদের কাছ থেকে নিজের দোষত্র“টি মাফ চেয়ে নেবার জন্যে বিশেষভাবে নছিহত করেছেন।
অধিকারের নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রধান বুনিয়াদী জিনিস হচ্ছে এই যে, মুসলমানদের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্র“ তার ভাইয়ের হাত ও মুখ থেকে নিরাপদ থাকবে। এমন কি এ জিনিসটিকে রাসূলে কারীম (সঃ) একজন আবশ্যকীয় গুণাবলীর মধ্যে শামিল করেছেন। তিনি বলেছেন:
المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده –
“মুসলমান হচ্ছে সে ব্যক্তি, যার মুখ ও হাত থেকে সমস্ত মুসলমান নিরাপদ।” (বুখারী ও মুসলিম- আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ)
২. দেহ ও প্রাণের নিরাপত্তা
প্রত্যেক মুসলমানের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও মূল্যবান হচ্ছে তার দেহ ও প্রাণ। এ ব্যাপারে যে ব্যক্তি অন্যায়াচরণ করবে, তাকে সে কখনো নিজের ভাই বলে মনে করতে পারে না। তাই নাহক রক্তপাত থেকে মুসলমানদেরকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে:
ومن يقتل مؤمنا متعمدا فجزائه جهنم خالدا فيها وغضب الله عليه ولعنه واعدله عذابا عظيما –
“যে ব্যক্তি কোন মু’মিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে, তার পুরস্কার হচ্ছে জাহান্নাম। সেখানে সে চিরদিন থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি গজব ও লা’নত বর্ষণ করেছেন এবং তার জন্যে নির্দিষ্ট করে রেখেছেন কঠোরতম শাস্তি।” (সূরা নিসা-৯৩)
বিদায় হজ্জের কালে রাসূল (সঃ) অত্যন্ত মনোজ্ঞ ভাষায় মুসলমানদের প্রতি পরস্পরের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্র“কে সম্মনার্হ বলে ঘোষণা করেন এবং তারপর বলেন: ‘দেখো, আমার পরে তোমরা কাফের হয়ে যেয়োনা এবং পরস্পরের গলা কাটতে শুরু করো না।’
এভাবে একবার তিনি বলেন:
سباب المسلم فسوق وقتاله كفرً-
‘মুসলমানকে গালি দেয়া ফাসেকী আর তার সঙ্গে লড়াই করা হচ্ছে কুফুরী।’ (বুখারী ও মুসলিম)
হাতের চাইতে মুখের অপব্যবহার পারস্পারিক সম্পর্ককে অত্যন্ত নাজুক করে তোলে। এ জিনিসটি অসংখ্য দিক দিয়ে ফেতনার সৃষ্টি করতে থাকে। আর প্রত্যেকটি ফেতনাই এতো জটিল যে, তার নিরসন করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। এজন্যেই এ শ্রেণীর ফেতনার সামনে অন্তরায় সৃষ্টি করাই সবচাইতে বেশী প্রয়োজন। তাই আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সঃ) মুখের ব্যবহার সম্পর্ক যেমন অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, তেমনি সম্পর্কের চৌহদ্দীর মধ্যে বিকৃতি ও বিপর্যয়ের প্রত্যেকটি কারণকে চিহ্নিত করে সেগুলোকে প্রতিরোধ করার পন্থা বাতলে দিয়েছেন।
আল কুরআন মুসলমানদের বলছেঃ
ما يلفظ من قول الا لديه رقيب عتيد –
“তার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোয় না, কিন্তু তার কাছে হাজির রয়েছেন একজন নিয়ামক।” (সূরা ক্বফ-১৮)
একদা রাসূলে কারীম (সঃ) হযরত মা’য়াজকে (রাঃ) বিভিন্ন নছিহত করার পর নিজের জিহ্বা আঁকড়ে ধরে বলেনঃ كف عليك هذا তোমার কর্তব্য হচ্ছে একে বিরত রাখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা যা কিছু বলা-বলি করি, সে সম্পর্কেও কি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে? তিনি বললেনঃ
هل يكبَّ الناس على وجوههم الا حصائد ألسنتهم –
“জবানের কামাই (অর্থাৎ ভাষা) ছাড়া আর কোন্ জিনিস মানুষকে দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করবে?” (তিরমিযি-মু’য়াজ ইবনে জাবাল)
সুফিয়ান বিন আব্দুল্লাহ্ জিজ্ঞেস করলেন: ‘নিজের ব্যাপারে কোন জিনিসটাকে সবচাইতে বেশী ভয় করবো?’ রাসূল (সঃ) নিজের জিহ্বা ধরে বললেনঃ ‘একে’।
৩. কটু ভাষণ ও গালাগাল
কোন ভাইকে সাক্ষাতে গালাগাল করা, তার সঙ্গে কটু ভাষায় কথা বলা এবং তাকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। অনুরূপভাবে বিকৃত নামে ডাকাও এর আওতায় এসে যায়। এ সম্পর্কে আল কুরআনে বলা হয়েছে:
ولا تنابزوا بالالقاب بئس الاسم الفسوق بعد الايمان –
“আর বদনাম করোনা বিকৃতির উপাধির সঙ্গে, ঈমানের পর বিকৃত নামকরণ হচ্ছে বদকারী।” (সূরা হুজরাত-১১)
অনুরূপভাবে রাসূল (সঃ) বলেছেনঃ
لا يدخل الجنة الجواط الجعظرى –
“কোন কটুভাষী ও বদ-স্বভাব বিশিষ্ট ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (আবু দাউদ, বায়হাকী-হারিস বিন ওয়াহাব)
ان ابغضكم الى وابغضكم منى عبسا يوم القيامة الثارثرون المتشدقون المتفيهقون –
“কিয়ামতের দিন আমার দৃষ্টিতে সবচাইতে অভিশপ্ত এবং আমার থেকে সবচাইতে দূরে থাকবে বাচাল, অশ্লীলভাষী, ইলমের মিথ্যা দাবীদার ও অহংকারী ব্যক্তিগণ।” (তিরমিযি-জাবির রাঃ)
ليس المؤمن بالطّعّان ولا بالَّعان ولا الفاحش ولا البذى –
“মু’মিন না বিদ্রুপকারী হয়, না লা’নত দানকারী, না অশ্লীলভাষী আর না বাচাল হয়।” (তিরমিযি-ইবনে মাসউদ রাঃ)
মোটকথা, মু’মিন তার ভাইয়ের সামনে তার মান-ইজ্জতের ওপর কোনরূপ হামলা করবে না।
৪. গীবত
অপর একটি ফেতনা হচ্ছে গীবত। এটা আগেরটির চেয়েও বেশী গুরুতর। কারণ এতে মানুষ তার ভাইয়ের সামনে নয় বরং তার পেছনে বসে নিন্দাবাদ করে। তাই কুরআন গীবতকে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাবার সঙ্গে তুলনা করেছে:
لا يغتب بعضكم بعضا – أيحب أحدكم أن يأكل لحم اخيه ميتا فكرهتموه –
“কেউ কারো গীবত করো না। তোমরা কি কেউ আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? একে তো তোমরা অবশ্যই ঘৃণা করবে।” (সূরা হুজরাত-১২)
রাসূলে কারীম (সঃ) গীবতের সংজ্ঞা দান প্রসঙ্গে একবার সাহাবীদের কাছে জিজ্ঞাসা করেন: ‘গীবত কি তা তোমরা জানো?’
সাহাবীগণ বলেন: ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন।’ তিনি বললেন:
ذكرك اخاك بما يكره فقيل ارايت ان كان فى اخى ما اقول قال ان كان فيه ما تقول فقد اغتبته وان لم يكن فيه ما تقول فقد بهته –
“গীবত হচ্ছে এই যে, তোমার ভইয়ের পছন্দনীয় নয়, এমনভাবে তার চর্চা করা। বলা হলো, আমার ভাইয়ের মধ্যে যদি উল্লেখিত খারাবী বর্তমান থাকে? রাসূল (সঃ) বললেন: তোমরা যদি এমন খারাবীর কথা উল্লেখ করো, যা তার মধ্যে বর্তমান রয়েছে, তবে তো গীবত করলে। আর তার মধ্যে যদি তা বর্তমান না থাকে তো তার ওপর অপবাদ চাপিয়ে দিলে।” (মুসলিম-আবু হুরায়রা রাঃ)
বস্তুত একজন মুসলিম ভাইয়ের মান-ইজ্জত দাবী করে যে, তার ভাই যেনো পেছনে বসে নিন্দাবাদ না করে।
৫. চোগলখুরী
গীবতের একটি রূপ হচ্ছে চোগলখুরী। আল কুরআন এর নিন্দা করতে গিয়ে বলেছে:
همَّازٍ مَّشّاء بنميم –
‘যারা লোকদের প্রতি বিদ্রুপ প্রদর্শন করে এবং চোগলখুরী করে বেড়ায়।’ (সূরা কালাম-১১)
হযরত হোজায়ফা (রাঃ) বলেন:
‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি চোগলখোর জান্নাতে যাবে না।’
রাসূলে কারীম (সাঃ) সঙ্গীদেরকে বিশেষভাবে নছিহত করে বলেনঃ
لا يبلغنى احد من اصابى شيئا فانى احبَّ ان اخرج اليكم وانا سليم الصدر –
“কোন ব্যক্তি কারো সম্পর্কে কোন খারাপ কথা আমার কাছে পৌঁছাবে না, কারণ আমি যখন তোমাদের কাছে আসি, তখন সবার প্রতিই আমার মন পরিস্কার থাকুকু-এটাই আমি পছন্দ করি।” (আবু দাউদ-ইবনে মাসউদ রাঃ)
গীবত ও চোগলখুরীর মধ্যে জবান ছাড়াও হাত, পা ও চোখের সাহায্যে দুস্কৃতি করাও অন্তর্ভুক্ত।
৬. শরমিন্দা করা
দুস্কৃতিরই একটি গুরুতর সৃষ্টিকারী এবং মানব মনে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী রূপ হচ্ছে- আপন ভাইকে তার সাক্ষাতে বা অন্য লোকের সামনে তার দোষ-ত্র“টির জন্যে লজ্জা দেয়া এবং এভাবে অবমাননা করা। এমন আচরণের ফলে তার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়। কারণ এমনি অবমাননা কোন মানুষই সহ্য করতে পারে না।
আল কুরআনে বলা হয়েছেঃ
ولا تلمزوا انفسكم –
‘আপন ভাইয়ের প্রতি দোষারোপ করো না।’ (সূরা হুজরাত-১১)
একটি হাদীসে রাসূলে কারীম (সঃ) বলেছেন: যে ব্যক্তি তার ভাইকে কোন গুনাহ্র জন্যে লজ্জা দিলো তার দ্বারা সেই গুনাহর কাজ না হওয়া পর্যন্ত সে মৃত্যুবরণ করবে না।
من غيَّر اخاه بذنب لم يمت حتى يعمله –
হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে হযরত (সঃ) মুসলমানদের কতিপয় কর্তব্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তাতে তিনি বলেছেন: ‘তাদেরকে কোন দোষ বা গোনাহর লক্ষ্য বানিয়ে শরমিন্দা ও অপমানিত করো না। (তিরমিযি)
৭. ছিদ্রান্বেষণ
দোষারোপ করে শরমিন্দা করার আগে আর একটি খারাপ কাজ রয়েছে। তা হচ্ছে, আপন ভাইয়ের দোষ খুঁজে বোড়ানো, তার ছিদ্রান্বেষণ করা। কারণ, যার ছিদ্রান্বেণ করা হয় সে যেন অপ্রতিভূত হয়, তার দোষত্রুটি যার গোচুরীভুত হয়, তার মনেও বিরূপ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায়। যেহেতু ছিদ্রান্বেষণ কোন নির্ভরযোগ্য অন্বেষণ উপায়ের ধার ধারে না এজন্যই সাধারনত বাজে অন্বেষণ উপায়ের উপর নির্ভর করে আপন ভাই সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তথা সন্দেহ পোষনের মতো গুরুতর অপরাধে লিপ্ত হবার সম্ভাবনাই থাকে বেশী। এ জন্যে আল কুরআন বিরূপ ধারণার সঙ্গে সঙ্গেই মুসলমানদের বলেছে:
ولا تجسَّسوا
‘আর দোষ খূঁজে বেড়িয়ো না।’ (সূরা হুজরাত-১২)
নবী কারীম (সঃ)ও এ সম্পর্কে বলেছেন:
ولا تتَّبعوا عوراتهم فانه من يتَّبع عورة اخيه المسلم يتَّبع الله عورته ومن يتَّبع الله عورته يفضحه ولو فى جوف رحله –
‘মুসলমানদের দোষ খুঁজে বেড়িয়ো না। কারণ, যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন দোষ ও গুনাহ্ খুঁজতে থাকে, আল্লাহ্ তার গোপন দোষ ফাঁস করতে লেগে যান। আর আল্লাহ যার দোষ প্রকাশ করতে লেগে যান, তাকে তিনি অপমান করেই ছাড়েন-সে তার ঘরের মধ্যেই লুকিয়ে থাকুক না কেন।’ (তিরমিযি- আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাঃ)
৮. উপহাস করা
জবানের দুস্কৃতির মধ্যে আর একটি মারাত্মক দুস্কৃতি-যা এক ভাই থেকে অন্য ভাইকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়-তা হচ্ছে ঠাট্টা বা উপহাস করা। অর্থাৎ আপন ভাইকে এমনিভাবে ঠাট্টা বিদ্রুপ করা, যার মধ্যে হেয় প্রতিপন্নের সূর মিশ্রিত রয়েছে, বরং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠতর মনে করারই ফল হচ্ছে উপহাস। তাই আল কুরআন এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত ভাষায় সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেঃ
يايُّها الذين امنوا لا يسخر قوم من قوم عسى ان يَّكونوا خيرًا منهم ولا نساء من نساءٍ عسى ان يّكنًّ خيرًا منهنَّ-
‘হে ঈমানদারগণ! কোন সম্প্রদায় অপর কোন সম্প্রদায়কে ঠাট্টা করোনা, সম্ভবতঃ সে তার চাইতে শ্রেষ্ঠ হবে। আর কোন নারী অপর কোন নারীকে ঠাট্টা করো না, সম্ভবতঃ সে শ্রেষ্ঠ হবে তার চাইতে।’ (সূরা হুজরাত-১১)
যে ব্যক্তি তার কোন মুসলমান ভাইকে উপহাস করে, আখিরাতে তার ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে রাসূলে কারীম (সঃ) নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছেনঃ
انَّ المستهزئين بالناس يفتح لاحدهم فى الاخرة باب من الجنة فيقال له هلمَّ فيجئُّ بكربه وغمِّه فاذا جاءه اغلق دونه ثم يفتح له باب اخر فيقال له هلمَّ فيجئُّ بكربه وغمِّه فاذا جاءه اغلق دونه فما يزال كذالك حتى انَّ احدهم ليفتح له الباب من ابواب الجنة فيقال له هلمَّ فما يأتيه من الياس-
‘লোকদের প্রতি বিদ্রুপ প্রদর্শনকারী ব্যক্তির জন্যে কিয়ামতের দিন জান্নাতের একটি দরজা খোলা হবে। এবং তাকে বলা হবে, ‘ভেতরে আসুন’। সে কষ্ট করে সেদিকে আসবে এবং দরজা পর্যন্ত পৌঁছতেই তার সামনে দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। অতঃপর দ্বিতীয় দরজা খুলে বলা হবে, ‘আসুন’ ‘বসুন’। সে আবার কষ্ট করে আসবে, যেইমাত্র সে কাছাকাছি পৌঁছবে অমনি দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। এ ঘটনা পরস্পরা এমনিভাবেই অব্যহত থাকবে। এমনকি এক সময়ে তার জন্যে জান্নাতের দরজা খুলে বলা হবে, ‘আসুন’। তখন সে নৈরাশ্যের কারণে সেদিকে যেতে এবং জান্নাতে প্রবেশ করতে সাহসই পাবে না।’ (বায়হাকী)
উপহাসের একপি রূপ হচ্ছে, অন্য লোকের দোষত্রুটি নিয়ে ব্যঙ্গ করা। একবার হযরত আয়েশা (রাঃ) কারো ব্যঙ্গ করলে রাসূল (সঃ) অত্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং বলেন:
ما احب انى حكيت احدا وانَّ لى كذا وكذا –
‘আমি কারুর ব্যঙ্গ করাকে পছন্দ করি না- তার বিনিময়ে আমাকে অমুক অমুক জিনিস দেয়া হোক না কেন (অর্থাৎ যে কোন দুনিয়াবী নিয়ামত)। (তিরমিযি-আয়েশা রাঃ)
৯. তুচ্ছ জ্ঞান করা
যে বস্তুটি মনের ভেতর চাপা থাকে এবং বাহ্যত তা গালি দেয়া, লজ্জা দেয়া, গীবত করা, চোগলখুরী করা ও উপহাস করার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তা হচ্ছে আপন ভাইকে নিজের চাইতে তুচ্ছ জ্ঞান করা। বস্তুত এমনি উচ্চমন্যোতাবোধ সৃষ্টির পরই মানুষ তার ভাই সম্পর্কে এ শ্রেণীর আচরণ করার সাহস পায়। নচেৎ আপন ভাইকে যে ব্যক্তি নিজের চাইতে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করবে, সে কখনো এ ধরণের কাজ করতে পারে না। এজন্যই আল কুরআন উপহাস থেকে বিরত রাখার সময় এ ইংগিত প্রদান করেছে যে, মানুষ যদি চিন্তা করে দেখে যে, তার ভাই তার চাইতে শ্রেষ্ঠ হতে পারে, তবে সে কখনো তাকে বিদ্রুপ করবে না।
عسى ان يَّكونوا خيرًا مِّنهم –
‘হতে পারে সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম।’ (সূরা হুজরাত-১১)
সাহাবীদের ভেতর থেকে কেউ জিজ্ঞেস করলেন – ঈমান ও তাকওয়ার সাথে একজন মু’মিন ও মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান অথবা তার সম্পর্কে নীচ ও নিকৃষ্ট ধারণায় কখনো একত্রিত হতে পারে না। কারণ, প্রত্যেক ব্যক্তির মান-সম্ভ্রমের মানদণ্ড হচ্ছে তাকওয়া এবং এর প্রকৃত মীমাংসা হবে আখিরাতে আল্লাহ্র দরাবারে। সুতরাং দুনিয়ায় আপন মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করার মানেই হচ্ছে সে ব্যক্তি ঈমানের প্রকৃত মূল্যমানকে এখনো বুঝতে পারেনি। একবার রাসূলে কারীম (সাঃ) এক বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ হাদীসে তাকওয়াকে অন্তরের জিনিস আখ্যা দিয়ে বলেন:
يحسب امرء مِّن الَِّشرِّ ان يُّحقر اخاه المسلم –
‘এক ব্যক্তির গুণাহ্গার হবার জন্যে এতোটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে নীচ জ্ঞান করে।’ (মুসলিম-আবু হুরায়রা রাঃ)
অপর একটি বর্ণনায় রাসূল (সঃ) এমনিভাবে বলেনঃ
ولا يخذ له ولا يحقره –
‘কোন মুসলমান অপর মুসলমানকে না অপমান করবে আর না তুচ্ছ জ্ঞান করবে।’
একদা রাসূল (সঃ) বলেন যে, যার দিলে অনুপরিমাণও অহংকার تعد থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। অতঃপর এক ব্যক্তির প্রশ্নের জাবাবে তিনি অহংকারের ব্যাখ্যা দান করে বলেন:
يطر الحقِّ وغمط النَّاس –
‘অহংকার বলতে বুঝায় সত্যকে অস্বীকার এবং লোকদের নীচ জ্ঞান করা।’ (মুসলিম-ইবনে মাসউদ রাঃ)
একটি হাদীসে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) তিনটি নাজাতদানকারী এবং তিনটি ধ্বংসকারী বিষয় উল্লেখ করে বলেন:
اعجاب المرء بنفسه وهى اشدُّ هُنَّ –
‘একটি ধ্বংসকারী জিনিস হচ্ছে নিজেকে নিজে বুজুর্গ ও শ্রেষ্ঠতম মনে করা আর এটা হচ্ছে নিকৃষ্টতম অভ্যাস।’ (বায়হাকী- আবু হুরায়রা রাঃ)
আজকের সমাজ-পরিবেশ শুধু নিজেদের বন্ধু-সহকর্মীদের সঙ্গেই নয়, বরং সাধারণ মুসলমানদের সাথে আচরণের বেলায়ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের এদিক দিয়ে আত্মানুশীলন করা উচিত।
১০. নিকৃষ্ট অনুমান
অনুমানের ব্যাধি এক গুরুতর ব্যাধি। এ ব্যাধি পারস্পরিক সম্পর্কে ঘুণ ধরিয়ে দেয় এবং তাকে অন্তঃসারশূণ্য করে ফেলে। প্রচলিত অর্থে অনুমান বলতে বুঝায় এমনি ধারণাকে, যার পেছনে কোন স্পষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ বা প্রত্যক্ষ জ্ঞান নেই। আর এমনি ধারণা যখন নিকৃষ্ট হয়, তখন তাকেই বলা হয় সন্দেহ। কোন মুসলমান যদি তার ভাই সম্পর্কে কোন প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছাড়াই সন্দেহ করতে শুরু করে, তবে সেখান থেকে প্রেম-ভালোবাসা বিদায় গ্রহণ করতে বাধ্য। তাই আল কুরআন এ সম্পর্কে বলেছে:
يايها الذين امنوا اجتـنبوا كثيرًا من الظَّنِّ انَّ بعض الظَّنِّ اثم –
‘হে ঈমানদারগণ! বহু অনুমান থেকে তোমরা বেঁচে থাকো, নিঃসন্দেহে কোন কোন অনুমান হচ্ছে গুনাহ্।’ (সূরা হুজরাত-১২)
রাসূল (সঃ) তাঁর সঙ্গীদেরকে নিম্নোক্ত ভাষায় বলেছেন:
ايّاكم والظّنِّ فانَّ الظَّنَّ اكذب الحديث –
‘তোমরা অনুমান পরিহার করো, কেননা অনুমান হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যা কথা।’ (বুখারী ও মুসলিম-আবু হুরায়রা রাঃ)
অনুমান সন্দেহ থেকে বাঁচার সবচাইতে বড় উপায় হলো এই যে, মানুষ তার ভাইয়ের নিয়্যাত সম্পর্কে কোন কারাপ ধারণা পোষণ করবে না, কোন খারাপ মন্তব্যও করবে না। কারণ, নিয়্যাত এমনি জিনিস যে, সে সম্পর্কে কোন স্পষ্ট বা প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সর্বদাই অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি কথা সামনে রাখলে সহজেই এ ব্যাধিটির প্রতিকার সম্ভব হবে।
প্রথম কথা এই যে, আপন ভাই সম্পর্কে অনুমান বা সন্দেহ পোষন না করা যেমন প্রত্যেক মুসলমানের অব্যশ্য কর্তব্য, তেমনি নিজের সম্পর্কে অপরকে সন্দেহ পোষণের সুযোগ না দেয়াও তার কর্তব্য। তাই সন্দেহের সুযোগ দানকারী বিষয়কে যতদূর সম্ভব পরিহার করতে হবে। অপরকে কোন অবস্থায়ই ফেতনায় ফেলা উচিত নয়, এ সম্পর্কে স্বয়ং নবী কারীম (সঃ) দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। একবার তিনি ই’তেকাফে বসেছিলেন। রাতে তাঁর জনৈকা স্ত্রী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতে এলেন। ফিরতি পথে তিনি তাঁকে এগিয়ে দিতে চললেন। ঘটনাক্রমে দু’জন আনসারের সঙ্গে তাঁর দেখা হলো। তারা তাঁকে স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেখে নিজেদের আগমনকে ‘অসময়’ মনে করে ফিরে চললেন। অমনি তিনি তাদেরকে ডেকে বললেন: ‘শোনো, এ হচ্ছে আমার অমুক স্ত্রী’। আনসারদ্বয় বললেন: ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! কারো প্রতি যদি আমাদের সন্দেহ পোষণ করতেই হতো তবে কি আপনার প্রতি করতাম?’ তিনি বললেন: ‘শয়তান মানুষের ভেতর রক্তের ন্যায় ছুটে থাকে।’
দ্বিতীয়তঃ যদি এড়াবার চেষ্টা সত্ত্বেও সন্দেহের সৃষ্টি হয়ই, তবে তাকে মনের মধ্যে চেপে রাখবে না। কারণ মনের মধ্যে সন্দেহ চেপে রাখা খিয়ানতের শামিল। বরং অবিলম্বে গিয়ে নিজের ভাইয়ের কাছে তা প্রকাশ করবে, যাতে করে সে তার নিরসন করতে পারে। অপরদিকে যার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করা হবে, সে চুপচাপ বসে না থেকে সঙ্গে সঙ্গেই তার অপনোদন করবে। নচেৎ এ গুনাহর অনেকখানি তার নিজের ঘাড়েও চাপতে পারে।
১১. অপবাদ
জেনে-শুনে নিজের ভাইকে অপরাধী ভাবা অথবা তার প্রতি কোন অকৃত গুনাহ্, আরোপ করাকে বলা হয় অপবাদ। এটা স্পষ্টত এক ধরণের মিথ্যা ও খিয়ানত। এ অপবাদেরই আর একটি নিকৃষ্টতর রূপ হচ্ছে নিজের গুনাহকে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া। এ সম্পর্কে আল কুরআন বলেছে:
ومن يكسب خطيئة او اثما ثمَّ يرم به بريئًا فقد احتمل بهتانا وَّاثمًا مُّبينا –
‘যে ব্যক্তি কোন গুনাহ্ বা নাফরমানী করলো এবং তারপর এক নিরপরাধ ব্যক্তির ওপর তার অপবাদ আরোপ করলো, সে এক মহাক্ষতি এবং স্পষ্ট গুনাহ্কেই নিজের মাথায় চাপিয়ে নিলো।’ (সূরা নিরা-১১২)
এভাবে মুসলমানদের মিথ্যা অপবাদ দেয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে:
والذين يؤذون المؤمنين والمؤمنات بغير ما اكتسبوا فقد احتملوا بهتانا وَّاثما مُّبينا –
‘যারা মুসলমান পুরুষ ও মুসলমান নারীর প্রতি মিথ্যা আপবাদ চাপিয়ে কষ্ট দেয়, তারা আপন মাথায় ‘বুহতান’ ও স্পষ্ট গুনাহ্ চাপিয়ে নিলো।’ (সূরা আহযাব-৫৮)
বস্তুত একটি ভালোবাসার সম্পর্কে এমন আচরণের কতোখানি অবকাশ থাকতে পারে?
১২. ক্ষতি সাধন
তি শব্দটিও অত্যন্ত ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এখানে এর অর্থ হচ্ছে এই যে, কোন মুসলমানের দ্বারা তার ভাইয়ের যাতে কোন ক্ষতি সাধন না হয়, এর প্রতি সে লক্ষ্য রাখবে। এ ক্ষতি দৈহিকও হতে পারে, মানসিকও হতে পারে। এ সম্পর্কে রাসূলে কারীম (সঃ) অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বলেছেন:
ملعون من ضارُّمؤمنا او مكربه-
‘যে ব্যক্তি কোন মু’মিনের ক্ষতি সাধন করে অথবা কারো সঙ্গে ধোকাবাজী করে, সে হচ্ছে অভিশপ্ত।’ (তিরমিযি, আবু বকর সিদ্দিক রাঃ)
“যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের ক্ষতিসাধন করলো, আল্লাহ তার ক্ষতিসাধন করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের কষ্ট দিলো আল্লাহ তাকে কষ্ট দিবেন।(ইবনে মাযাহ, তিরমিযি)
১৩. মনোকষ্ট
কোন মুসলমানের পে তার ভাইয়ের মনে কষ্ট দেয়া নিশ্চিতরূপে এক অবাঞ্চিত কাজ। এমন কাজকে আদৌ প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। এক ভাইয়ের মন অন্য ভাইয়ের দ্বারা কয়েকটি কারণে কষ্ট পেতে পারে। এ সম্পর্কিত বড় বড় কারণগুলো ছাড়াও জীবনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে মানুষের মেজাজ ও প্রকাশভংগীও মনোকষ্টের একটা কারণ হতে পারে। এ ব্যাপারে নীতিগত কথা এই যে, কোন মুসলমানের দ্বারা তার ভাইয়ের মন যাতে কষ্ট না পায় অথবা তার অনুভূতিতে আঘাত না লাগে, তার জন্যে তার চেষ্টা করা উচিত।
গীবতের মতো গুরুতর অপরাধেরও ভিত্তি হচ্ছে এটি। তাই গীবতের সংজ্ঞা হচ্ছে এই যে, কারো সম্পর্কে এমনি আলোচনা করা, যা তার কাছে পছন্দনীয় নয় অথবা তার মনোকষ্টের কারণ হতে পারে।
রাসূলে কারীম (সঃ) বলেছেন: ‘যখন তিন ব্যক্তি একত্রিত হবে, তখন দু’জনে কোন কানালাপ করবে না। অবশ্য অনেক লোক যদি জমায়েত হয়, তবে এমন করা যেতে পারে।’ এই হুকুমের যে কারণ বর্ণিত হয়েছে, তা হচ্ছে এই:
من اجل ان يَّحزنه –
‘এই ভয়ে যে, সে দুশ্চিন্তায় পড়ে।’ (মুসলিম-আবু আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ)
ইমলামের দেয়া এ নিয়ম-কানূনগুলোর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে জানা যাবে যে, কোন মুসলমান ভাইয়ের মনে কষ্ট না দেয়া এর পেছনে একটি বুনিয়াদী নীতি হিসেবে ক্রিয়াশীল রয়েছে। মুসলমানকে কষ্ট দেয়া দ্বীনি দৃষ্টিকোন থেকেও অত্যন্ত অন্যায়। তাই এ সম্পর্কে রাসূলে কারীম (সঃ) বলেছেন:
من اذى مسلما فقد اذى الله –
‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে কষ্ট দিলো, সে আল্লাহকেই কষ্ট দিলো।’ (তিরমিযি- আনাস রাঃ)
পান্তরে কারো মনকে খুশী করার উদ্দেশ্যে কোন কাজ করা হলে সে সম্পর্কে সুসংবাদ দেয়া হয়েছেঃ
من قضى لاحد من امَّتى حاجَّة يُّريد ان يُّسرَّه بها فقد سرَّنى ومن سرَّنى فقد سرَّالله ومن سرّالله ادخله الله الجنة –
‘যে ব্যক্তি আমার কোন উম্মতকে খুশী করার উদ্দেশ্যে তার প্রয়োজন পূর্ণ করলো, সে আমাকে খুশী করলো। যে আমাকে খুশী করলো, সে আল্লাহকেই খুশী করলো। আর যে আল্লাহকে খুশী করলো, আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখিল করে দেবেন।’ (বায়হাকী- আনাস রাঃ)
এখানে রাসূলে কারীম (সঃ) এর এ কথাটিও স্মর্তব্য: ‘মুমিন হচ্ছে প্রেম-ভালোবাসার উজ্জল প্রতীক। যে ব্যক্তি কারো প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে না এবং তার প্রতিও কেউ ভালোবাসা রাখে না, তার ভেতর কল্যাণ নেই।’
মনোকষ্ট সাধারণতঃ হাসি-তামাসার মাধ্যমে উত্যক্ত করার ফলেই হয়ে থাকে। অর্থাৎ এমনভাবে হাসি তামাসা করা, যাতে অপর ব্যক্তি বিব্রত হয় এবং তার মনে কষ্ট লাগে।
একবার সাহাবীগণ রাসূল (সঃ) এর সঙ্গে সফর করছিলেন। পথে এক জায়গায় কাফেলার রাত্রিযাপনকালে এক ব্যক্তি তার অপর এক ঘুমন্ত সঙ্গীর রশি তুলে নিলো এবং এভাবে তাকে বিব্রত করলো। এ কথা জানতে পেরে রাসূলে কারীম (সঃ) বললেন:
لا يحلُّ للمسلم ان يَّروع مسلماً –
‘কোন মুসলমানকে হাসি-তামাসার মাধ্যমে উত্যক্ত করা মুসলমানের পক্ষে হালাল নয়।’ (আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযি-আব্দুর রহমান রাঃ)
অনুরূপভাবে একবার অস্ত্র গোপন করার এক ঘটনা ঘটলে রাসূল (সঃ) এই বলে নিষেধ করলেন:
ان يَّروع المؤمن او ان يُّؤخذ متاعه لا لعبا وَّلا جدَّا –
‘কোন মু’মিনকে ভয় দেখানো এবং হাসি-তামাসা করে অথবা বাস্তবিক পক্ষে কারো কোন জিনিস নিয়ে যাওয়া জায়েজ নয়।’
১৪. ধোঁকা দেয়া
কথাবার্তা বা লেনদেনে আপন ভাইকে ধোঁকা দেয়া বা মিথ্যা কথা বলা সম্পর্কে মুসলমানদেরকে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। কারণ যেখানে এক পক্ষে অন্য পক্ষের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে, সেখানে একজন অপরজনের ওপর নির্ভর করতে পারে না। আর যেখানে এক ব্যক্তির কথা অন্য ব্যক্তির পক্ষে নির্ভরযোগ্য করতে নয় সেখানে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও পারস্পারিক আস্থা কিছুতেই বর্তমান থাকতে পারে না। হাদীস শরীফে এ জিনিসটাকেই ‘নিকৃষ্টতম খিয়ানত’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। রাসূল (সঃ) বলেছেন:
قال كبرت خيانة ان تحدث اخاك حديثا هولك مصدق وانت به كاذبٌ –
‘সব চাইতে বড় খিয়ানত হচ্ছে এই যে, তুমি তোমার ভাইকে কোন কথা বললে সে তোমাকে সত্যবাদী মনে করলো; অথচ তুমি তাকে মিথ্যা কথা বললে।’ (তিরমিযি-সুফিয়ান বিন আসাদ)
১৫. হিংসা
হিংসা বা পরশ্রীকাতরতা এক ঘৃণ্য ব্যাধি। এ ব্যাধিটা যদি মানুষের মনে একবার ঠাঁই পায় তাহলে আন্তরিক সম্পর্কই শুধু ছিন্ন হয় না, লোকদের ঈমানও বিপন্ন হয়ে পড়ে। হিংসার সংজ্ঞা এই যে, কোন মানুষের প্রতি আল্লাহ্ তায়ালার দেয়া কোন নিয়ামত, যেমন ধন-দৌলত, জ্ঞান-বুদ্ধি বা সৌন্দর্য সুষমাকে পছন্দ না করা এবং তার থেকে এ নিয়ামতগুলো ছিনিয়ে নেয়া হউক, মনে প্রাণে এটা কামনা করা। হিংসার ভেতর নিজের জন্যে নিয়ামতের আকাঙ্খার চাইতে অন্যের থেকে ছিনিয়ে নেয়ার আকাঙ্খাটাই প্রবল থাকে।
হিংসার মূলে থাকে কখনো বিদ্বেষ ও শত্রুতা, কখনো ব্যক্তিগত অহমিকা ও অপরের সম্পর্কে হীনমন্যতাবোধ, কখনো অন্যকে অনুগত বানানোর প্রেরণা, কখনো কোন সম্মিলিত কাজে নিজের ব্যর্থতা ও অপরের সাফল্য লাভ, আবার কখনো শুধু মান-ইজ্জত লাভের আকাঙ্খাই এর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হিংসা সম্পর্কে নবী কারীম (সঃ) এ মর্মে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন:
ايَّاكم والحسد فانَّ الحسد يأكل الحسنات كما تأكل النّار الحطب –
“তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কারণ, আগুন যেমন লাকড়িকে (কাঠ) খেয়ে ফেলে, হিংসা তেমনি নেকী ও পুণ্যকে খেয়ে ফেলে।” (আবু দাউদ-আবু হুরায়রা রাঃ)
আর এ জিনিসটি থেকেই আল কুরআন প্রত্যেক মুসলমানকে আশ্রয় প্রার্থনার নির্দেশ দিয়েছে:
من شرِّ حاسدٍ اذا حسد –
“এবং (আমি আশ্রয় চাই) হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে।” (সূরা ফালাক-৫)
একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীসে নবী কারীম (সঃ) ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কের জন্যে অপরিহার্য কতকগুলো বিষয়ের প্রতি অংগুলি নির্দেশ করেছেন। উক্ত হাদীসের এক অংশে নিকৃষ্ট অনুমান প্রসঙ্গে উল্লেখিত হয়েছে। বাকী অংশে রাসূল (সঃ) বলেন:
ولا تجسَّسوا ولا تناجشوا ولا تحاسدوا ولا تباغضوا ولا تدابروا ولا تنافسوا وكونوا عباد الله اخوانا –
“কারো দোষ খুঁজে বেড়িয়ো না, কারো ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষতি করো না, পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পরে শত্রুতা রেখোনা, পরস্পর সম্পর্কহীন থেকো না, পরস্পরে লোভ-লালসা করো না বরং আল্লাহর বান্দাহ্ ও ভাই ভাই হয়ে থাকো।” (বুখারী ও মুসলিম-আবু হুরায়রা রাঃ)
হাদীসের প্রখ্যাত ভাষ্যকার হাফিজ ইবনে হাজ্বার আসকালানী এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন: ‘এর তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, তোমরা যখন এ নিষিদ্ধ কাজগুলো বর্জন করবে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই ভাই ভাই হয়ে যাবে।’ উপরন্তু এ হিংসা ও শত্রুতা সম্পর্কে রাসূল (সঃ) এও বলেছেনঃ
دبَّ اليكم داء الامم قيلكم الحسد والبغضاء هى الحالقة لا اقول تحلق الشَّعر ولكن تحلق الدين-
“পূর্বেকার উম্মতদের ব্যাধি তোমাদের মধ্যে প্রবেশ করেছে। আর এ ব্যাধি হচ্ছে হিংসা ও শত্রুতা-যা মুণ্ডন করে দেয়। অবশ্য চুল মুণ্ডন করে দেয়া একথা আমি বলছি না, বরং দ্বীনকে মুণ্ডন করে দেয়।” (আহমদ, তিরমিযি)