চারঃ সম্পর্ক দৃঢ়তর করার পন্থা
সম্পর্কের বিকৃতি ও অনিষ্টসাধনকারী এ জিনিসগুলো থেকে বারণ করার সঙ্গে সঙ্গে যেগুলো গ্রহণ ও অনুসরণ করার ফলে সম্পর্ক দৃঢ়তর ও স্থিতিশীল হয়, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় এবং যার ফলে দুটো হৃদয়ের মধ্যে এক হাতের দু’টি অংগুলির মতোই ঘনিষ্ঠতার সৃষ্টি হয়, আল্লাহ্ ও রাসূল (সঃ) সেগুলোও আমাদেরকে সুনির্দিষ্টরূপে বলে দিয়েছেন। এর ভেতর কতকগুলো জিনিসকে অত্যাবশকীয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অথবা বলা যায়, সেগুলোকে অধিকার (হক) হিসেবে পেশ করা হয়েছে। আবার কতকগুলো জিনিসের জন্যে করা হয়েছে নচিহত। এগুলো হচ্ছে শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের পর্যায়ভূক্ত। ইতিপূর্বে চরিত্রের যে বুনিয়াদী গুণরাজির কথা বিবৃত করা হয়েছে, প্রকৃতপে তাই হচ্ছে অধিকার ও মহত্বের প্রাণবস্তু স্বরূপ, তবে তার প্রতিটি জিনিসকেই আলাদাভাবে সামনে রাখা দরকার। কারণ, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ককে বিকশিত এবং ফুলে-ফলে সুশোভিত করার জন্যে এর প্রতিটি জিনিসই অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
১. মান-ইজ্জতের নিরাপত্তা
একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে তার মান-ইজ্জত। নিজের মান-ইজ্জতকে বরবাদ করতে সে কিছুতেই সম্মত হয় না। তাই একদিকে যেমন মুসলমানকে তার ভাইয়ের ইজ্জতের ওপর হামলা করতে নিষেধ করা হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি আপন ভাইয়ের ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান করার জন্যেও বিশেষভাবে তাকিদ করা হয়েছে এবং একে একটি পরম কর্তব্য বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। যদি ভাইতে কোথাও গালাগাল করা হয়, তার ওপর মিথ্যা অপবাদ চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে তাকে নিজের ইজ্জতের ওপর হামলা মনে করে তার মোকাবেলা করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। নিজের ইজ্জত বরবাদ হলে তার যতোখানি মনোকষ্ট হয়, সেক্ষেত্রে তার ততোটাই হওয়া উচিত। একজন মুসলমানের যদি একথা নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস হয় যে, তার মান-ইজ্জত তার মুসলমান ভাইয়ের হাতে নিরাপদ, তবে তার ভাইয়ের সঙ্গে অবশ্যই এক আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কিন্তু একথাও যদি তার নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস হয় যে, সে তার সামনে অথবা পেছনে নিজের ইজ্জতের মতোই তার ইজ্জতের সংরক্ষণ করে তবে তার দিলে কতোখানি প্রগাঢ় ভালোবাসার সৃষ্টি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এজন্যেই নবী কারীম (সঃ) বেশুমার হাদীসে এ বিষয়টির নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:
ما من امرء مُّسلم يخذل امرأ مسلما فى موضع ينتهك فيه حرمته وينتقص فيه من عرضه الا خذله الله فى موطن يحب فيه نصرته وما من امرى ينصر مسلما فى موضع ينتقص فيه من عرضه وينتهك فيه من حرمته الا نصره الله فى موطن يحب نصرته –
‘যদি কোথাও কোন মুসলমানের অমর্যাদা বা ইজ্জতহানি করা হয় এবং সেখানে তার সাহায্য ও সহায়তা করতে কোন মুসলমান বিরত থাকে, তবে এমনিতরো নাজুক পরিস্থিতিতে আল্লাহও তার সাহায্যকে সংকুচিত করে দেন। অথচ তিনি চান যে, কেউ তার সাহায্য ও সহয়তার জন্যে এগিয়ে আসুক। আর কোথাও কোন মুসলমানের অবমাননা ও মর্যাদাহানি হলে কোন মুসলমান যদি তার সাহায্যের জন্যে দন্ডায়মান হয় তো আল্লাহ্ও এমনি অবস্থায় তার সাহায্য ও সহায়তা করে থাকেন। কেননা তিনি চান যে, কেউ তার সাহায্য করুক। (আবু দাউদ-জাবির রাঃ)
আল্লাহর সবচেয়ে বড় সাহায্য হচ্ছে এই যে, তিনি দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করবেন। তাই রাসূল (সঃ) বলেছেন:
ما من مسلم يردُّ عن عرض اخيه الا كان حقا على الله ان يَّردُّ عنه نار جهنَّم ثمَّ تلا هذه الاية وكان حقا علينا نصر المؤمنين –
“যে মুসলমান তার মুসলিম ভাইয়ের ইজ্জতহানি থেতে কাউকে বিরত রাখবে, আল্লাহর প্রতি তার অধিকার এই যে, তিনি জাহান্নামের আগুনকে তার থেকে বিরত রাখবেন। অতঃপর রাসূল (সঃ) এ আয়াত পড়লেন: ‘মুসলমামদের সাহায্য করা আমাদের প্রতি এক কর্তব্য বিশেষ’।” (শরহুস সুন্নাহ-আবু দারদা)
মর্যাদাহানির একটি সাধারণ রূপ হচ্ছে গীবত। এর পরিচয় ইতিপূর্বেই বর্ণিত হয়েছে।
এ সম্পর্কে রাসূল (সঃ) বলেনঃ
من اغضب عنده اخوه المسلم وهو يقدر على نصره فنصره نصر الله فى الدنيا والاخرة فان لم ينصره وهو يقدر على نصره اخذه الله به فى الدنيا والاخرة –
“যে ব্যক্তির সামনে তার মুসলমান ভাইয়ের গীবত করা হবে, সে যদি তার সাহায্য করার মতো সামর্থবান হয় এবং তার সাহায্য করে, তবে দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ্ তার সাহায্য করবেন। আর যদি সাহায্য করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার সাহায্য না করে, তো দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ্ তাকে পাকড়াও করবেন। (শরহুস সুন্নাহ্-আনাস রাঃ)
আপন ভাইকে অন্যের অনিষ্ট থেকে রা করা সম্পর্কে রাসূল (সঃ) বলেছেন:
من حمى مؤمنا من منافقٍ ازاه قال بعث الله ملكا يحمى لحمه يوم القيامة من نَّار جهنَّم –
‘যে ব্যক্তি কোন মু’মিনকে মুনাফিক (এর অনিষ্ট) থেকে রা করবে, তার জন্যে আল্লাহ্ তায়ালা এমন একজন ফিরিশতা নিযুক্ত করবেন, যে তার গোশতকে কিয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপদ রাখবে।’ (আবু দাউদ)
একজন মুসলমানের প্রতি তার ভাইয়ের সাহায্যের ব্যাপারে বহু রকমের কর্তব্য আরোপিত হয়। যেমন-আর্থিক সাহায্য, অসুবিধা দূর করা, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা, এছাড়াও অসংখ্য প্রকারের দ্বীনি ও দুনিয়াবী প্রয়োজন পূর্ণ করা। এ জিনিসগুলো আইনের চৌহদ্দীর বাইরে ইহ্সানের সাথে সম্পৃক্ত। তবু এগুলো জরুরী জিনিস এবং আখিরাতে এ সম্পর্কে জবাবাদিহিও করতে হবে-যদিও এগুলো সম্পর্কে কোন আইন প্রণয়ন করা সম্ভবপর নয়। একজন মুসলমান যদি অপর মুসলমানের পেট ভরাতে পারে, তার নগ্ন দেহ ঢাকতে পারে, তার বিপদ-মুছিবত দূর করার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে, তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে, তার আর্থিক অনটন দূর করতে পারে-তবে এগুলো করাই হচ্ছে তার প্রতি তার ভাইয়ের অধিকার। নচেৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা এর প্রতিটি জিনিসকেই নিজের হক বলে উল্লেখ করে এ মর্মে জবাব চাইবেন যে, এ হকটি তুমি কেন আদায় করো নি। নবী কারীম (সঃ) এ কথাটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ভাষায় বিবৃত করেছেন: ‘আল্লাহ্ বলবেন, হে বান্দাহ্ আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, তুমি কেন আমাকে আহার করাও নি? আমি উলংগ ছিলাম, তুমি কেন আমাকে কাপড় দাও নি? আমি রুগ্ন ছিলাম, তুমি কেন আমাকে পরিচর্যা (ইয়াদত) করো নি? কিন্তু বান্দাহর কাছে এর কোনই জবাব থাকবে না। (মুসলিম- আবু হুরায়রা রাঃ)
বস্তুত আল্লাহর কোন বান্দাহ্ এবং কোন মুসলমান ভাইয়ের সাহায্য বা প্রয়োজন পূরণ এত বড় পূণ্যের কাজ যে, অন্য কোন নেকীই এর সমকক্ষ হতে পারে না। এর আসল ¯স্পিরিট হচ্ছে এই যে, একজন মুসলমান ভাইকে আরাম দেয়া বা তার হৃদয়কে খুশী করার মতো যে কোন উপায়ই পাওয়া যাক না কেন, তাতে মোটেই বিলম্ব করা উচিত নয়।
একব্যক্তি যতোক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে লিপ্ত থাকে, ততোক্ষণ সে আল্লাহর সাহায্যের উপযোগী থাকে। রাসূলে কারীম (সঃ) বলেছেন:
والله فى عون عبده ما كان العبد فى عون اَخِيْهِ –
‘আল্লাহ্ ততোক্ষণ তার বান্দার সাহায্য করতে থাকেন, যতোক্ষন সেই বান্দাহ্ তার ভাইয়ের সাহায্যে লিপ্ত থাকে।’ (মুসলিম, তিরমিযি- আবু হুরায়রা রাঃ)
এ হাদীসে নবী কারীম (সঃ) সাহায্যের বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করে তার প্রত্যেকটি পুরস্কার সম্পর্কে বলেন:
من نفس عن مؤمن كربة من من كرب الدنيا نفس الله عنه كربة من كرب يوم القيامة من يَّسَّر على معسر يسَّر الله عليه فى الدنيا والاخرة ومن يستر مسلما ستره الله فى الدنيا والاخرة –
‘যে ব্যক্তি কোন মু’মিনের কোন দুনিয়াবী অসুবিধা দূর করলো, আল্লাহ্ তার কিয়ামত- দিবসের একটি অসুবিধা দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবী লোককে সুবিধা দান করলো, আল্লাহ্ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সুবিধা দান করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ গোপন রাখলো, আল্লাহ্ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবের।’ (মুসলিম-আবু হুরায়রা)
এ প্রসঙ্গেই অন্য একটি হাদীসে তিনি বলেন:
المسلم اخو المسلم لا يظلمه ولا يسلمه ومن كان فى حاجة اخيه كان الله فى حاجته ومن فرج عن مسلم كربة فرج الله عنه كربة من كربات يوم القيامة –
‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। না সে তার ওপর জুলুম করবে, আর না আপন সাহায্য থেকে হাত গুটিয়ে তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিবে। যে ব্যক্তি আপন ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করলো, আল্লাহ্ তার প্রয়োজন পূর্ণ করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দুঃখ-মুছিবত দূর করে দিবে, আল্লাহা তার কিয়ামত-দিবসের অসুবিধা দূর করে দিবেন।’ (বুখারী ও মুসলিম-ইবনে ওমর রাঃ)
সাহায্য ও সদাচরণের একটি বিরাট অংশ ধন-মালের ওপর আরোপিত হয়। আল্লাহ্ যাকে এ নিয়ামত দান করেছেন, প্রত্যেক বঞ্চিত ব্যক্তিই তার কাছ থেকে সাহায্য পাবার অধিকারী:
وفى اموالهم حق للسَّائل والمحروم –
রাসূল (সঃ) এ জিনিসিটিকে অত্যন্ত উচ্চাংগের বর্ণনাভংগীর মাধ্যমে পেশ করেছেন:
الخلق عيال الله فاحبُّ الخلق الى الله من احسن الى عياله –
‘মাখলুক হচ্ছে আল্লাহর পরিবার বিশেষ, সুতরাং যে ব্যক্তি তাঁর এ ব্যক্তি পরিবারের সংগে সদাচরণ করলো, আল্লাহর কাছে তাঁর মাখলুকের মধ্যে সেই হচ্ছে সবচেয়ে প্রিয়।’ (বায়হাকী)
ক্ষুধার্তকে আহার করানোর ব্যাপারে কুরআন খুব তাকিদ করেছে। প্রাথমিক মক্কী সূরাগুলোতে এর বহু নজীর রয়েছে। রাসূলে কারীম (সঃ) মদীনায় এসে তাঁর প্রথম খুতবায় মুসলমানদেরকে চারটি বিষয়ের নির্দেশ দান করেন এবং বলেন যে, এরপর তোমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারো। তার ভেতর একটি নির্দেশ ছিলো এই: واطعموا الطعام ‘এবং আহার করাও’
তিনি আরো বলেন:
ليس المؤمن بالذى يشبع وجاره جائع الى جنيه –
‘যে ব্যক্তি নিজে পেট ভরে খেলো এবং তার নিকটস্থ প্রতিবেশী অনাহারে রইলো, সে মু’মিন নয়।’ (বায়হাকী- ইবনে আব্বাস রাঃ)
এক ব্যক্তি রাসূল (সঃ) এর কাছে নিজের নির্দয়তা সম্পর্কে অভিযোগ পেশ করলো। রাসূল (সঃ) তাকে বললেন:
قال امسح رأس اليتيم واطعم المسكين –
‘ইয়াতিমের মাথায় হাত বুলাও এবং মিসকিনকে আহার করাও।’ (আহমদ-আবু হুরায়রা রাঃ)
ফরিয়াদীর প্রতি সুবিচারও এ সাহায্যেরই একটি শাখা বিশেষ। তাই রাসূল (সঃ) বলেছেন:
من اغاث ملهو فا كتب الله ثلاثا وثبعين مغفرة وَّاحدة فيها صلاح امره كله واثنتان وسبعون له درجات يوم القيامة –
‘যে ব্যক্তি কোন ফরিয়াদীর প্রতি সুবিচার করলো, আল্লাহ্ তার জন্যে ৭৩টি পুরস্কার লিপিবদ্ধ করে দেন। এর ভেতর একটি পুরস্কার হচ্ছে তার সমস্ত কাজের কল্যাণকারিতার নিশ্চয়তা। আর বাকি ৭২টি পুরস্কার কিয়ামতের দিন তার মর্যাদাকে উন্নত করবে।’ (বায়হাকী)
কোন প্রয়োজনশীল ব্যক্তির পক্ষে সুপারিশ করাও সাহায্যের একটি অন্যতম পন্থা। কুরআন ন্যায়ানুগ ও কল্যাণকর সুপারিশের প্রশংসা করে বলেছে:
من يشفع شفاعة حسنة يكن لَّه نصيب منها –
‘যে ব্যক্তি নেক কাজের সুপারিশ করবে, সাওয়াবে তারও অংশ থাকবে।’ (সূরা নিসা-৮৫)
রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কাছে কখনো কোন ব্যক্তি প্রয়োজন নিয়ে এলে তিনি সাহাবীদের বলতেন:
قال اشفعوا فلتؤ جروا –
‘এর জন্যে সুপারিশ করো এবং সাওয়াবে অংশগ্রহণ করো।’
একদা হযরত আবু জার গিফারী (রাঃ) এর সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে নবী কারীম (সঃ) সাহায্যের বিভিন্ন পর্যায় ও পন্থাকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট করে তোলেন। তিনি (গিফারী) বললেন: ‘ঈমানের সঙ্গে আমলের কথা বলুন।’ রাসূল (সঃ) বললেন: ‘আল্লাহ যে রুজী দিয়েছেন, তা থেকে অপরকে দান করবে।’ আরজ করলেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল! সেলোকটি যদি নিজেই গরীব হয়?’ বললেন: ‘নিজের জবান দ্বারা নেক কাজ করবে।’ পুণরায় আরজ করলেন: ‘তার জবান যদি অক্ষম হয়?’ বললেন: ‘দুর্বলের সাহায্য করবে।’ আরজ করলেন: ‘যদি সে নিজেই দুর্বল হয় এবং সাহায্য করার শক্তি না থাকে?’ বললেন: ‘যে ব্যক্তি কোন কাজ করতে পারে না তার কাজ করে দিবে।’ পুণরায় আরজ করলেন: ‘যদি সে নিজেই এমনি অকর্মন্য হয়?’ বললেন: ‘লোকদের কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকবে।’
এখানে সেই হাদীসটিরও পুনরুল্লেখ করা আবশ্যক:
‘যে ব্যক্তি আমার কোন উম্মতকে খুশী করার জন্যে উদ্দেশ্যে তার দ্বীনি ও দুনিয়াবী প্রয়োজন পূর্ণ করলো, সে আমাকেই খুশী করলো; যে আমাকে খুশী করলো, সে আল্লাহকেই খুশী করলো এবং যে আল্লাহকে খুশী করলো আল্লাহ্ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’
এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে একটি চমৎকার বর্ণনা উল্রেখিত হয়েছে। বর্ণনাটি হচ্ছে এই: একদা রাসূল (সঃ)-এর কাছে এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞাসা করলো: লোকদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচাইতে প্রিয় কে? রাসূল (সঃ) বললেনঃ
احبَّ الناس الى الله انفعهم للنَّاس- احبَّ الاعمال الى الله عزَّ وجلَّ سرور تدخله تكشف عنه كربة او تقضى عنه دينا او تطرد عنه جوعا وان تمشى مع اخ فى حاجة احبَّ الىَّ من ان اعتكف فى هذا المسجد شهرًا ومن كظم غيظه ولو شاء ان يمضيه امضاه ملائه الله قلبه يوم القيامة رضاه ومن مَّشى مع اخيه فى حاجة حتى يقضيهاله ثبَّت الله قدميه يوم تزول الاقدام –
‘লোকদের ভেতর আল্লাহর কাছে সবচাইতে প্রিয় হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে মানুষের বেশী উপকার করে; আর আমলের মধ্যে আল্লাহর কাছে অধিকতর পছন্দনীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, তুমি কোন মুসলমানের বিপদ-মুছিবত দূর করবে। অথবা তার দেনা পরিশোধ করে দেবে অথবা তার ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করে তাকে খুশি করবে। জেনে রেখো, এই মসজিদে একমাস ইহ’তেকাফ করার চাইতে কোন ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণের খাতিরে তার সঙ্গে চলা আমার কাছে বেশী প্রিয়। যে ব্যক্তি নিজের ক্রোধ সংবরণ করলো অবশ্য সে চাইলে তা পূর্ণ করতেও পারতো-তার দিলকে আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন আপন সন্তুষ্টি দ্বারা পূর্ণ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণার্থে তার সঙ্গে চললো এবং তা পূর্ণ করে দিলো, আল্লাহ্ তার পদযুগলকে সেদিন স্থিরতা দান করবেন, যখন তা থরথর করে কাঁপতে থাকবে (অর্থাৎ কিয়ামতের দিন)।
২. দুঃখ কষ্টে অংশগ্রহণ
আপন ভাইয়ের সাহায্য ও প্রয়োজন পূরণ এবং তার সঙ্গে সদাচরণ করার ভিত্তি হচ্ছে এই যে, একজনের দুঃখ ব্যথা অপরের দুঃখ ব্যাথায় পরিণত হবে। এক ব্যক্তি যদি কষ্ট অনুভব করে তবে অপরেও অতোখানি তীব্রতার সঙ্গেই তা অনুভব করবে। যেমন দেহের একটি অংগ অন্যান্য তাবৎ অংগ-প্রত্যংগের কষ্টে শরীক হয়ে থাকে, তেমনি এক মুসলমান অপর মুসলমানের দুঃখ কষ্টে শরীক থাকবে।
রাসূলে কারীম (সঃ) কয়েকটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে এ বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করে তুলেছেন। তিনি বলেছেনঃ
ترى المؤمنين فى تراحمهم وتوادَّهم وتعاطفهم كمثل الجسد اذا اشتكى عضوا تداعى له سائر الجسد بالسهر والحمَّى –
‘তোমরা মু’মিনদেরকে পারস্পারিক সহৃদতা, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা এবং পারস্পারিক দুঃখ-কষ্টের অনুভুতিতে এমনি দেখতে পাবে, যেমন একটি দেহ। যদি তার একটি অঙ্গ রোগাক্রান্ত হয়, তবে তার সঙ্গে গোটা দেহ জ্বর ও রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে তাতে অংশ গ্রহণ করে থাকে।’ (বুখারী ও মুসলিম-নু’মান বিন বশীর রাঃ)
অনুরূপভাবে একটি বর্ণনায় তিনি এর ব্যাখ্যা দান প্রসঙ্গে বলেছেন যে, সমাজে একজন মু’মিনের অবস্থান হচ্ছে গোটা দেহে মস্তকের সমতুল্য। মাথায় ব্যাথা হলে যেমন গোটা দেহহ কষ্টানুভাব করে, তেমনি একজন মু’মিনের কষ্টে সমস্ত মু’মিনই কষ্টানুভাব করতে থাকে। রাসূল (সঃ) এর একটি সরাসরি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন:
المؤمن للمؤمن كالبنيان يشدُّ بعضه بعضا ثم شبك بين اصابعه –
‘এক মুসলমান অপর মুসলমানের জন্যে ইমারতের মতো হওয়া উচিত এবং তাদের একে অপরের জন্যে এমনি দৃঢ়তা ও শক্তির উৎস হওয়া উচিত, যেমন ইমারতের একখানা ইট অপর ইটের জন্যে হয়ে থাকে।’ এরপর রাসূল (সঃ) এক হাতের আঙ্গুল অন্য হাতের আঙ্গুলের মধ্যে স্থাপন করলেন। (বুখারী ও মুসলিম-আবু মুসা রাঃ)
৩. সমালোচনা ও নছিহত
একজন মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে এই যে, সে তার ভাইয়ের কাজ কর্মের প্রতি দৃষ্টি রাখবে এবং তাকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হতে দেখলে পরামর্শ দিয়ে শোধরানোর চেষ্টা করবে। এ হচ্ছে একজন মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমানের কর্তব্য বিশেষ। অবশ্য এ কর্তব্য পালনটা প্রায়ই অপ্রীতিকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এ সত্ত্বেও অনস্বীকার্য যে, এক ব্যক্তির মনে যদি আখিরাতে আসল কামিয়াবী এবং সে কামিয়াবী অর্জনে পারস্পারিক সহায়তা সম্পর্কে পূর্ণ চেতনা বর্তমান থাকে এবং সে এ সম্পর্কেও সজাগ থাকে যে, আখিরাতের জিজ্ঞাসাবাদের চাইতে দুনিয়ার সমালোচনাই শ্রেয়তর, তবে দুনিয়ার জীবনে এ সংশোধনের সুযোগ দানের জন্যে যে আপন ভাইয়ের প্রতি অবশ্যই কৃতজ্ঞ হবে। উপরন্তু সমালোচক ও জিজ্ঞাসাবাদকারী যদি এ সম্পর্কেত জরুরী শর্তাবলীর প্রতি লক্ষ্য রাখেন এবং ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে এ কাজটি সম্পাদন করেন, তবে এ কৃতজ্ঞতাই আরো সামনে এগিয়ে গিয়ে পারস্পারিক ভালবাসা, বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতাকে আরো সমৃদ্ধ ও দৃঢ়তর করে তুলবে। এ জন্যে যে, এর ফলে সমালোচক একজন সহৃদয় ব্যক্তি বলে প্রতিভাত হবেন। নবী কারীম (সঃ) যে হাদীসে সমালোচনার নছিহত করেছেন, তাতে একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি গোটা জিনিসটাকে স্পষ্ট করেও দিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ
انَّ احدكم مراة اخيه فان راى به اذًى فليمت عنه –
‘তোমরা প্রত্যেকেই আপন ভাইয়ের দর্পণ স্বরূপ। সুতরাং কেউ যদি তার ভাইয়ের মধ্যে কোন খারাপ দেখে তো তা দূর করবে।’ (তিরমিযি- আবু হুরায়রা রাঃ)
এ সম্পর্কে আবু দাউদের বর্ণনাটি হচ্ছে এই:
المؤمن مرأة المؤمن والمؤمن اخوُّ المؤمن يكفُّ ضيعته او يحوطه من وَّرائه –
‘একজন মু’মিন অপর মু’মিনের পক্ষে আয়না স্বরূপ এবং এক মু’মিন হচ্ছে অপর মু’মিনের ভাই, সে তার অধিকারকে তার অনুপস্থিত কালেও সংরক্ষিত রাখে।’
এ দৃষ্টান্তের আলোকে সমালোচনা ও নছিহতের জন্যে নিম্নোক্ত নীতি নির্ধারণ যেতে পারে:
১. ছিদ্রান্বেষণ বা দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ানো উচিত নয়। কেননা আয়না কখনো ছিদ্রান্বেষণ করে না। মানুষ যখন তার সামনে দাঁড়ায়, কেবল তখনই সে তার চেহারা প্রকাশ করে।
২. পেছনে বসে সমালোচনা করা যাবে না। কারণ, সামনা-সামনি না হওয়া আয়না কারো আকৃতি প্রকাশ করে না।
৩. সমালোচনায় কোন বাড়াবাড়ি হওয়া উচিত নয়। কেননা আয়না কোনরূপ কমবেশী না করেই আসল চেহারাটাকে ফুটিয়ে তোলে।
৪. সমালোচনার ক্ষেত্রে নিরপে এবং কোনরূপে স্বার্থসিদ্ধি ও দূরভিসন্ধি থেকে মুক্ত হওয়া উচিত, কারণ আয়না যার চেহারা প্রতিবিম্বিত করে, তার প্রতি কোন বিদ্বেষ পোষণ করে না।
৫. বক্তব্যটুকু দেবার পর তাকে আর মনের মধ্যে লালন করা উচিত নয়, কেননা সামনে থেকে চলে যাবার পর আয়না কারো আকৃতি সংরতি রাখে না। অন্য কথায় অপরের দোষ গেয়ে বেড়ানো উচিত নয়।
৬. সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে এই যে, এর ভেতর পরম নিষ্ঠ, আন্তরিকতা, সহানুভূতি ও ভালোবাসা ক্রিয়াশীল থাকতে হবে, যাতে করে নিজের সমালোচনা শুনে প্রতিটি লোকের মনে স্বভাবতই যে অসন্তোষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, সমালোচকের এ মনোভাব উপলব্ধি করা মাত্রই তা বিলীন হয়ে যায়। এ জন্যই হাদীসে مرأة المسلم এর সঙ্গে اخوُّ المسلم ও বলা হয়েছে। বস্তুত এক ব্যক্তি যখন তার দোষত্রুটিকে তার পে ধ্বংসাত্মক বলে অনুভব করতে পারবে এবং সে সঙ্গে নিজেকে তার চাইতে বড় মনে না করে বরং অধিকতর গুনাহ্গার ও অপরাধী বলে বিবেচনা করবে, কেবল তখনই এমনি সহানুভূতি ও সহৃদয়তা পয়দা হতে পারে।
৪. মুলাকাত
ভালোবাসার অন্যতম প্রধান ও বুনিয়াদী দাবী হচ্ছে এই যে, মানুষ যাকে ভালোবাসবে, তার সঙ্গে বার বার মুলাকাত বা দেখা- সাক্ষাত করবে, তার সহচর্য গ্রহণ করবে এবং তার কাছে বসে কথাবার্তা বলবে। একথা মানবীয় মনস্তত্বের একজন প্রাথমিক ছাত্রও জানেন যে, এ জিনিসগুলো শুধু প্রেম ভালবাসার বুনিয়াদী দাবীই নয়, বরং তার বিকাশ বৃদ্ধি এবং পরস্পরের আন্তরিক বন্ধনকে দৃঢ়তর করার পক্ষে অন্যতম প্রধান কার্যকরী উপায়। প্রেম ভালোবাসা এই দাবী করে যে, মানুষ যখনই সুযোগ পাবে, তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করবে। এমনি মুলাকাতের ফলে পারস্পারিক ভালোবাসা স্বভাবতই বৃদ্ধি পায় এবং এভাবে এর এক অসমাপ্য ধারা শুরু হয়ে যায়। মুলাকাতের বেলায় যদি শরীয়াতের পূর্বোল্লেখিত নীতিসমূহ স্মরণ রাখা হয় এবং সামনের জিনিসগুলোর প্রতিও লক্ষ্য আরোপ করা হয়, তবে দু’জন মুসলমানের দেখা সাক্ষাত তাদের পারস্পারিক সম্পর্কোন্নয়নের সহায়ক হবে না এবং দু’ভাইকে অধিকতর নিকটবর্তী করবে না এটা কিছুতেই হতে পারে না। এ জন্যই আমরা দেখতে পাই যে, নবী কারীম (সঃ) পারস্পারিক ভালোবাসার ক্ষেত্রে এ জিনিসটিকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন, এর জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন, এর বেশুমার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। একটি হাদীসে তিনি বলেন: ‘সৎ সহচর একাকিত্বের চাইতে উত্তম।’ (বায়হাকী-আবু জার রাঃ কর্তৃক বর্ণিত)
একবার তিনি হযরত আবু জারাইনকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ
هل شعرت انَّ الرجل اذا خرج من بيته زئرًا اخيه شيَّعه سبعون الف ملك كلُّهم يصلُّون عليه ويقلون ربَّنا انَّه وصل فيك فصيله فان استطعت ان تعمل جسدك فى ذالك فافعل –
‘তুমি কি জানো, কোন মুসলমান যখন তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়, তখন তার পেছনে সত্তর হাজার ফিরিশতা থাকে! তাঁর জন্যে দোয়া করে এবং বলে হে প্রভু, এ লোকটিকে শুধু তোমার জন্যে মিলিত হতে যাচ্ছে, সুতরাং তুমি একে মিলিত করে দাও। যদি তোমার নিজের শরীর দিয়ে এ কাজটি (মুলাকাত) করা সম্ভবপর হয় তা হলে তা অবশ্যই করো।’ (বায়হাকী-আবু জারাইন রাঃ)
একটি হাদীসে রাসূলাল্লাহ (সঃ) অত্যন্ত চমৎকারভাবে এ মুলাকাতের ওপর আলোকপাত করেছেনঃ
قال انَّ رجلا زار اخالَّه فى قرية اخرى فارصد الله له على مدرجته ملكا فلما اتى عليه قال: اين تريد ؟ قال اريد اخالّى فى هذه القرية – قال هل لَّك عليه من نعمة تربُّها قال لا غير انِّى احببته فى الله قال فانِّى رسول الله اليك بانَّ الله قد احبَّك كما احببته فيه –
‘এক ব্যক্তি ভিন্ন গাঁয়ে অবস্থিত তার এক ভাইয়ের সঙ্গে মুলাকাত করতে চললো। আল্লাহ্ তায়ালা তার চলার পথে একজন ফিরিশতা নিযুক্ত করলেন। ফিরিশতা তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’ সে বললো, ‘অমুক গ্রামে আমার ভাইয়ের সঙ্গে মুলাকাত করতে যাচ্ছি।’ ফিরিশতা আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তার কাছে কি আপনার কিছু পাওনা আছে, যা আদায় করতে যাচ্ছেন?’ সে বললো, ‘না, আমি শুধু আল্লাহর জন্যে তাকে ভালোবাসি; এছাড়া আর কোন কারণ নেই।’ ফিরিশতা বললো, ‘আল্লাহ্ আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন এবং এ সুসংবাদ দিয়েছেন যে, আপনি যেমন তাঁর খাতিরে আপনার বন্ধুকে ভালোবাসেন, তেমনি তিনিও আপনাকে ভালোবাসেন।’ (মুসলিম-আবু হুরায়রা রাঃ)
একব্যক্তি হযরত মা’য়াজ বিন জাবাল (রাঃ) এর প্রতি তার ভালোবাসার কথা প্রকাশ করলো এবং বললো: ‘আমি আল্লাহর জন্যে আপনাকে ভালোবাসি।’ তিনি তাকে রাসূলুল্লাহর (সঃ) এই সুসংবাদটি শুনালেন: ‘আল্লাহ্ তায়ালা বলেন যে, যারা আমার জন্যে একত্রে উপবেশন করে, আমার জন্যে একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যায় এবং আমারই খাতিরে পরস্পরের জন্যে অর্থ ব্যয় করে, তাদের জন্যে আমার ভালোবাসা অনিবার্য।’
আল্লাহর জন্যে পারস্পারিক ভালোবাসা ও দেখা সাক্ষাতের যে পুরস্কার আখিরাতে রয়েছে, নবী কারীম (সঃ) তারও সুসংবাদ দিয়েছেন নিম্নোক্তরূপে:
انَّ فى الجنة لعمدا مِّن ياقوت عليها غرف مِّن زبرجدٍ لَّها ابواب مُّفتَّحة منه تضئ كما يضئ الكوكب الدَّرِّىُّ فقالوا يا رسول الله من يَّسكنها قال المتحابُّون فى الله والمتجالسون فى الله والمتلاقون فى الله –
‘জান্নাতে ‘ইয়ফুতের স্তম্ভ এবং তার ওপর জবরজদের (এক প্রকার সবুজ মূল্যবান পাথর) বালাখানা রয়েছে। তার দরজাগুলো এমনি চমকদার, যেনো তারকারাজি ঝিকমিক করছে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সেখানে কারা থাকবে? তিনি বললেন: যারা আল্লাহর জন্যে পরস্পরকে ভালোবাসে, একত্রে উপবেশন করে এবং পরস্পরে সাক্ষাত করতে যায়।’ (বায়হাকী- আবু হুরায়রা রাঃ)
পারস্পারিক ভালোবাসা ও দেখা সাক্ষাতের এতো তাকিদ এবং তার জন্যে এতো বড় পুরস্কারের সুসংবাদ শুধু এজন্যে নয় যে, এটা ভালোবাসার অনিবার্য দাবী অথবা এর দ্বারা ভালোবাসার বিকাশ বৃদ্ধি হয়ে থাকে। বরং এর এও একটি কারণ যে, মানুষকে সঠিক পথে কায়েম রাখার জন্যে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সহচর্যও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এ সহচর্য দেখা সাাত ও কথাবার্তার মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে। তাছাড়া আরো একটি কারণ এই যে, মানুষ সাধারণভাবে দেখা সাাত তো করতে থাকেই, কিন্তু সে যদি পুরোপুরি সাওয়াব ও পুরস্কারের প্রত্যাশা নিয়ে আপন ভাইয়ের সঙ্গে মুলাকাত করে এবং এ মুলাকাতের মাঝে আল্লাহকে স্মরণ রাখে, তাহলে তার এ মুলাকাত তার জীবন ও চরিত্র গঠন ও বিকাশ সাধনে এক বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
উল্লেখিত হাদীস ও প্রমাণগুলো সামনে রেখে আমরা বলতে পারি যে, একজন মু’মিনের সঙ্গে অপর মু’মিনের যথাসম্ভব বেশী পরিমাণে মুলাকাত ও দেখা সাক্ষাতের চেষ্টা করা উচিত। এতে করে শুধু পারস্পারিক সম্পর্কেরই উন্নতি ঘটবে না, বরং সে সত্তর হাজার ফিরিশতার দোয়ায়ে মাগফিরাত এবং আল্লাহর ভালোবাসার হকদার হবে। তাছাড়া এই মুলাকাতের মাঝে উল্লেখিত হাদীস ও নির্দেশগুলো সামনে রাখলে মন থেকে কখনো আল্লাহর জন্যে মুলাকাতের অনুভূতি বিনষ্ট হবে না।
৫. রুগ্ন ভাইয়ের পরিচর্যা (عيادت )
এ মুলাকাতেরই একটি বিশেষ ধরণ হচ্ছে আপন রুগ্ন ভাইয়ের পরিচর্যা করতে যাওয়া। একে এক মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমান ভাইয়ের বিশেষ কর্তব্য বলে অভিহিত করা হয়েছে। একজন রুগ্ন মানুষ তার দৈহিক ও মনস্তাত্বিক তাকিদেই অপরের সেবা-শুশ্রুষা ও সহানুভূতির মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে। এ সময়ে তার কোন ভাই এ প্রয়োজন দু’টো পূরণ করতে পারলে তা তার হৃদয় মনকে এমন গভীরভাবে প্রভাবান্বিত করে, যা পারস্পারিক সম্পর্কের স্থিতি ও বিকাশ বৃদ্ধিতে বিরাট সহায়ক হতে পারে।
সাধারণ পরিচর্যা বলতে বুঝায় রুগ্ন ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া। কিন্তু প্রকৃতপে এ খোঁজ-খবর নেয়াটা হচ্ছে এর ন্যুনতম ধারণা। নতুবা সহানুভুতি প্রকাশ, সান্ত্বনা প্রদান, সেবা শুশ্রুষা করা, ওষুধ পথ্যের ব্যবস্থা করা ইত্যাদিও এর আওতায় এসে যায়। তবু যদি ধরেও নেয়া যায় যে, পরিচর্যা বলতে শুধু রোগীর খোঁজ-খবর নেয়াই বুঝায়, তাহলে এ খোঁজ-খবরের জন্যে এতো তাকীদ ও এতো বড় পুরস্কার থাকলে সহানুভূতি প্রকাশ, সান্ত্বনা প্রদান, আরোগ্য কামনা ও সেবা- শুশ্রুষার কি মর্যাদা হতে পারে, তা অবশ্যই আমাদের ভেবে দেখা উচিত।
এক মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমানের কর্তব্য সম্পর্কে যে মাশহুর হাদীসগুলো রয়েছে এবং যাতে পাঁচ, ছয় কি সাতটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে, তার প্রত্যেকটি হাদীসেই একটি বিশেষ কর্তব্য হিসেবে রোগীর পরিচর্যার তাকীদ করা হয়েছে।
واذا مرض فعده –
‘যখন সে রোগাক্রান্ত হয়, তার পরিচর্যা করো।’ (মুসলিম-আবু হুরায়রা রাঃ)
আল্লাহর রাসূল (সঃ) অত্যন্ত চমৎকারভাবে বান্দার কর্তব্য ও অধিকারকে বর্ণনা করেছেন। একবার তিনি এর ব্যাখ্যা দান করতে গিয়ে বলেন যে, এ কর্তব্য ও অধিকারগুলো মূলত আল্লাহর তরফ থেকে আরোপিত হয়েছে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ নিজেই ফরিয়াদী হয়ে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তাই রোগীর পরিচর্যা সম্পর্কে নবী কারীম (সঃ) বলেন যে, আল্লাহ্ তায়ালা জিজ্ঞেস করবেন: ‘হে আদম সন্তান, আমি রুগ্ন হয়ে পড়েছিলাম তুমি পরিচর্যা করোনি।’ সে বলবে ‘হে আমার প্রভু, আপনি সারা জাহানেরই রব, আমি আপনার পরিচর্যা কিভাবে করতাম।’ আল্লাহ্ বলবেন: ‘তোমার কি জানা ছিলো না যে আমার বান্দাহ্ রুগ্ন হয়ে পড়েছিলো? কিন্তু তুমি তার পরিচর্যা করোনি। যদি করতে তবে আমাকে তার পাশেই পেতে।’ একজন রোগীকে পরিচর্যা করলে বান্দাহ্ তার প্রভুরও নৈকট্য লাভ করবে-এর চেয়ে বড় সদুপোদেশ আর কি হতে পারে!
রোগীর পরিচর্যার পুরস্কার সম্পর্কে নবী কারীম (সঃ) বলেনঃ
ان المسلم اذا عاد اخاه المسلم لم يزل فى حرفة الجنة حتى يرجع –
‘যখন কোন মুসলমান তার (রুগ্ন) মুসলিম ভাইয়ের পরিচর্যার জন্যে যায় তবে ফিরে আসা পর্যন্ত জান্নাতের মেওয়া বাছাই করতে থাকে।’ (মুসলিম-ছাওবান রাঃ)
ما من مسلم يعود مسلما غد وة الا صلىَّ عليه سبعون الف ملك حتى يمسى وان عاده عشيَّة الا صلىَّ عليه سبعون الف ملك حتى يصبح وكان له حريف فى الجنة –
‘যখন কোন মুসলমান অপর কোন (রুগ্ন) মুসলমানের পরিচর্যা সকাল বেলায় করে, তার জন্যে সত্তর হাজার ফিরিশতা দোয়া করতে থাকে, এমনকি সন্ধ্যা পর্যন্ত। আর যদি সন্ধ্যায় পরিচর্যা করে তো সত্তর হাজার ফিরিশতা তার জন্যে দোয়া করতে থাকে, এমনকি সকাল পর্যন্ত। আর তার জন্যে রয়েছে জান্নাতে মেওয়ার বাগিচা।’ (তিরমিযি, আবু দাউদ-আলী রাঃ)
من عاد مريضا لَّم بزل يخوض الرحمة حتى يجلس واذا جلس اغتمس فيها –
‘যে ব্যক্তি রোগীর পরিচর্যা করতে যায়, সে রহমতের দরিয়ায় প্রবেশ করে। আর যখন সে রোগীর কাছে বসে, তখন রহমতের মধ্যে ডুবে যায়।’
রাসূল (সঃ) আরো বলেছেন:
اتمام عيادت المريض انَّ يضع احدكم يده على جبهته او على يده فيساله كيف هو –
‘রোগীর পরিচর্যার পূর্ণত্ব হচ্ছে এই যে, পরিচর্যাকারী নিজের হাতকে তার হাত কিংবা কপালে রাখবে এবং সে কেমন আছে, এ কথা তাকে জিজ্ঞেস করবে।’ (আহমদ, তিরমিযি-আবু ওসমান রাঃ)
পরিচর্যার কিছু নিয়ম-কানুনও আছে। এর ভেতর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাগেীকে সান্ত্বনা প্রদান, তার আরোগ্য কামনা এবং সেবা শুশ্র“ষা করা। রাসূলে কারীম (সঃ) নিম্নোক্ত ভাষায় এর নির্দেশ দিয়েছেনঃ
اذا دخلتم على مريض فنفسوا له فى اجله فانَّ ذالك لا يردَّ شيئا ويطيب بنفسه –
‘তোমরা যখন কোন রোগীর কাছে যাও তো তাকে সান্ত্বনা প্রদান করো। এটা যদিও খোদায়ী হুকুমকে রদ করতে পারে না, কিন্তু রোগীর দিলকে খুশী করে দেয়।’ (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ্- আবু সাঈদ খুদূরী রাঃ)
খোদ রাসূল (সঃ) যখন কোন রোগীর পরিচর্যার জন্যে যেতেন তখন কার কপালে হাত রেখে সান্ত্বনা প্রদান করতেন এবং বলতেন-لا بأس طهور انشاء الله অতঃপর তার মন কোন্ বিশেষ জিনিসটি চায়, তা জিজ্ঞেস করতেন। সাহাবীদেরকেও তিনি বলতেন যে, তোমরা যখন কোন রোগীর পরিচর্যার জন্যে যাবে, তার হাত কিংবা কপালে নিজের হাত রাখবে, তাকে সান্ত্বনা দেবে এবং আরোগ্যের জন্যে দোয়া করবে। (আবু দাউদ-সারাতুন্নবী (সঃ)
কিন্তু রোগীর কাছে বেশীক্ষণ বসে থাকতে কিংবা শোরগোল করতে তিনি নিষেধ করেছেন।
৬. আবেগের বহিঃপ্রকাশ
মানুষের অন্তরের মাঝে প্রেমের আবেগ থাকলে তা স্বভাবতই আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজে বেড়ায়। আবেগের বহিঃপ্রকাশ থেকে সাধারণত দুটি ফায়দা পাওয়া যায়। প্রথমতঃ যে ব্যক্তি তার আবেগকে আত্মপ্রকাশের সুযোগ দেয়, তার আবেগ সর্বদা সতেজ ও উদ্দীপ্ত থাকে এবং তা ক্রমশ বিকাশ লাভ করতে থাকে। যদি আবেগকে মনের মধ্যে চেপে রাখা হয়, তাহলে তিল-তিল করে তার ওপর মৃত্যুর ছায়া নেমে আসে, তার বিকাশ বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। সজীবতা ও তেজস্বিতা থেকে সে বঞ্চিত হয় এবং এভাবে সে ধীরে ধীরে অধঃপাতের দিকে নেমে যেতে থাকে। আবেগের দ্বিতীয় ফায়দা এই যে, এটা পারস্পারিক সম্পর্কেকে অধিকতর দৃঢ় ও স্থিতিশীল করে তোলে। এক ব্যক্তি যখন তার প্রতি তার ভাইয়ের হৃদয়াবেগ সম্পর্কে অভিহিত হবে এবং তার জন্যে তার ভাইয়ের মন কতো গভীর প্রেম, ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের ভাবধারা পোষণ করে তা জানতে পারবে তখন স্বাভাবিক ভাবেই তার হৃদয়ে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করবে। নিজ ভাইয়ের বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার মূল্য সম্পর্কে তার মনে শ্রদ্ধাবোধ জাগবে। বস্তুত হৃদয়াবেগের প্রকাশ না ঘটলে উত্তম ভাবধারা পোষণ করা সত্ত্বেও দুই ভাইয়ের মধ্যে কখনো বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার দৃঢ় ও স্থিতিশীল সম্পর্ক টিকে থাকতে পারে না।
এক মুসলমানের প্রতি অন্য মুসলমান ভাই যদি ভালোবাসা পোষণ করে তবে ভাইয়ের জন্যে এ মানসিকতা প্রবণতা সম্পর্কে অবহিত হবার তার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এ জন্যে যে, সে যেন ঐ আবেগের জবাবে নিজের মনের ভেতর সমপরিমাণের আবেগ বিকশিত করতে পারে এবং তার জন্যে ভাইয়ের মনে যে প্রেমানুভূতি রয়েছে, অজ্ঞতাবসত তার পরিপন্থী বা প্রতিকূল কোন কর্মপন্থা সে গ্রহণ করে না বসে।
এ কারণেই দুই মুসলমান ভাইয়ের পারস্পারিক ভালোবাসার বিকাশ বৃদ্ধির জন্যে বরং এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্যে আবেগকে গোপন না রাখা এবং তাকে খোলাখুলিভাবে আত্মপ্রকাশ করতে দেয়া একান্ত প্রয়োজন। বিপর্যয় সৃষ্টির মূল কারণ হিসেবে দেখা যায় যে, এক ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে এবং নিজের এ ভালোবাসাকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করে। কিন্তু তার ভাই মনের ভেতর ভালোবাসা পোষণ করা সত্ত্বেও যদি নীরব দর্শকের মতো মুখ বন্ধ করে রাখে, তবে সে এ প্রেমের আবেগ প্রকাশের দ্বারা তার ভাইয়ের মনে অবশ্যই সন্দেহ, অবিশ্বাস ও দূরত্বের সৃষ্টি করবে।
অন্তরের গোপন ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতির প্রবণতা যদি বাইরে প্রকাশ পায় তাহলে তা বহু পন্থা অবলম্বন করে থাকে। এমতাবস্থায় মানুষের প্রতিটি কাজ-কর্ম ও পদেক্ষেপেই তার ভাইয়ের প্রতি তার আবেগের প্রকাশ ঘটে। এ প্রকাশটা কাজের মাধ্যমেও হয়, জবানের দ্বারাও হয়ে থাকে। বস্তুত সদাচরণ, প্রয়োজন পূরণ, আন্তরিক সমালোচনা ও সংশোধনের প্রয়াস, খাবারের দাওয়াত, প্রসন্ন মুখ, মুচকি হাসি, কোলাকুলি, দুঃখ-কষ্টে অংশ গ্রহণ, পরস্পরের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আস্থা স্থাপন ইত্যাদির মাধ্যমে ঐ প্রবণতাকেই আত্মপ্রকাশ করে থাকে। এর ভেতর কতগুলো বিষয় সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি, বাকিগুলো সম্পর্কে সামনে আলোচনা করা হবে।
এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় বড় কার্যকারী শক্তি হচ্ছে জবান। জবান থেকে নিঃসৃত একটি পীড়াদায়ক কথা যেমন তীরের মতো ক্রিয়াশীল হয় এবং তার ত মুছে ফেলা কঠিন হয়ে পড়ে, তেমনি একটি মিষ্টি কথা এমনি সুগভীর প্রভাব বিস্তার করে যে, অন্য মানুষের পে তা আন্দাজ করাও মুশকিল। এ জন্যই আমরা দেখেছি যে, জবান সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সবচেয়ে বেশী সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এর অপব্যবহার যেমন পারস্পারিক সম্পকর্কে বিপর্যয় ও বিকৃতির নিম্নতম পংকে পৌঁছাতে পারে, তেমনি এর সদ্ব্যবহার করলে এ সম্পর্ককে প্রেম-ভালোবাসা ও বন্ধুত্বেও উচ্চতম পর্যায়েও উন্নীত করতে পারে। এটা খুব কম লোকেই অনুধাবন করে থাকে। সাধারণত জবান থেকে নিঃসৃত কয়েকটি কথার সমষ্টি-যা অন্যের কাছে বন্ধুত্ব ও প্রেমাবেগকে তুলে ধরে মানব হৃদয়কে কতোখানি তুষ্ট করে দেয়। এমন কি, কখনো কখনো বড় রকমের সদাচরণও এর সমকক্ষ হতে পারে না। অথচ এমন অনেক লোক রয়েছে, যারা একটি ভালো কথা, একটি উদ্দীপনাময় বাক্য এবং একটি আনন্দদায়ক শব্দ উচ্চারণেও কার্পণ্য করে থাকে। এভাবে সে শুধু আপন ভাইয়ের অন্তরকে অপরিসীম আনন্দদানের সৌভাগ্য থেকেই বঞ্চিত হয় না। (যে সম্পর্কে পূর্বে বিবৃত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি কোন মুসলমান ভাইয়ের হৃদয়কে খুশী করলো সে আল্লাহর রাসূলকে খুশী করলো; যে আল্লাহর রাসূলকে খুশী করলো সে আল্লাহকেই খূশী করলো, আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে খুশী করলো, আল্লাহ্ তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন।) বরং কখনো কখনো প্রীতিকর কথা না বলে তার ভাইয়ের অন্তরকে কষ্টও দিয়ে থাকে। এমন কি কোন কোন সময় বে-ফাঁস ও দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি পর্যন্ত পর্যন্ত করতে কুণ্ঠিত হয় না। অথচ এ সম্পর্কে বলে দেয়া হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের মনে কষ্ট দিলো, সে আল্লাহকেই কষ্ট দিলো।’
জবান থেকে আবেগের প্রকাশ বলতে সাধারণত ভালোবাসার অভিব্যক্তি, সালাম, দোয়া, নম্র ও প্রীতিপূর্ণ কথা, সহানুভূতি প্রকাশ, কুশলবার্তা জিজ্ঞাসা ইত্যাদি জিনিসকে বুঝায়। জবানের এ গুরুত্বকে সামনে রেখেই নবী কারীম (সঃ) সাহাবীদের কাছে হাশর-দিনের নিম্নোক্ত নক্শা পেশ করেন যে, সেদিন মানুষের চারপাশে শুধুই আগুন দাউ-দাউ করতে থাকবে অথবা থাকবে তার আমল ও নেক কাজসমূহ, আর সেদিন আল্লাহ্ তায়ালা নিজেই সরাসরি হিসাব-নিকাশ গ্রহণ করবেন। অতঃপর তিনি এ মর্মে নির্দেশ দান করেন যে, ‘সে ভয়াবহ আগুন থেকে বেঁচে থাকে। তা খেজুরের একটি টুকরো দিয়েই হোক না কেন, আর এটাও সম্ভব না হলে অন্তত ভালো কথা বলো।’
বস্তুত সমস্ত দলীল-প্রমাণ সামনে রেখে এবং সকল দিক বিচার বিবেচনার পর ঐ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল (সঃ) কি নির্দেশ দিয়েছেন এবং কেন দিয়েছেন, আমরা সহজেই তা বুঝতে পারি। ভালোবাসার প্রকাশ সম্পর্কে তিনি বলেছেন:
اذا احبَّ الرَّجل اخاه فليخبره انه يحبه-
‘যখন কোন ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করবে, তখন সে যে তাকে ভালোবাসে, এ খবরটি তাকে পৌঁছানো দরকার।’ (তিরমিযি, আবু দাউদ)
এভাবে একদা মহানবী (সঃ)-এর সামনে দিয়ে একটি লোক যাচ্ছিলো। তখন তাঁর কাছে যারা ছিলো, তাদের ভেতর থেকে একজন বলে উঠলো, ‘আমি ঐ লোকটিকে আল্লাহর জন্যে ভালোবাসি।’ নবী কারীম (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন:
أعلمته قال لا قال قم فاعلمه فقام اليه فاعلمه فقال احبَّك الذى احببتنى له –
‘তুমি কি এ কথা কি তার গোচরীভূত করেছো? সে বললো, ‘না’। তিনি বললেন: ‘যাও তুমি যে তাকে আল্লাহর জন্যে ভালোবাসো, একথা তার গোচরীভূত করো।’ অতঃপর সে উঠে দাঁড়ালো এবং তাকে গিয়ে বললো। লোকটি বললো: ‘তুমি যার সন্তুষ্টির খাতিরে আমাকে ভালোবাসো, তিনি তোমাকে ভালোবাসুন।’ (বায়হাকী, তিরমিযি-আনাস বিন মালিক রাঃ)
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) একটি ঘটনা বর্ণনা করে বললেন যে, রাসূলে কারীম (সঃ) হযরত হাসান বিন আলী (রাঃ)-কে চুম্বন করছিলেন। তখন তাঁর কাছে আফরা বিন জালিস (রাঃ) বসেছিলেন। তিনি মহানবী (সঃ)-কে চুম্বন করতে দেখে বললেন: ‘আমার দশটি পুত্র আছে। তাদের কাউকে কখনো আমি চুম্বন করিনি।’ রাসূলে কারীম (সঃ) তার দিকে তাকিয়ে বললেন: ‘যে ব্যক্তি রহমত থেকে শূণ্য, তার প্রতি রহমত করা হয় না।’
من لا يرحم لا يرحم –
অন্য এক হাদীসে কথাটিকে এভাবে বলা হয়েছে: ‘আল্লাহ্ তোমর দিলকে রহমত থেকে বঞ্চিত করলে আমি কি করবো।’ (বুখারী ও মুসলিম।)
আবেগ প্রকাশের সর্বোত্তম সুযোগ হচ্ছে মুলাকাত। মুলাকাতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। এখন আবেগ প্রকাশের জন্যে মুলাকাতটি কি রকম হওয়া উচিত, তাও দেখা যাক।
৭. প্রীতি ও খোশ-মেজাজের সাথে মুলাকাত
পারস্পারিক সম্পর্কের উন্নয়নে সদ্ব্যবহারের পর মুলাকাতই হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। কিন্তু এর জন্যে শর্ত হচ্ছে এই যে, মুলাকাতের সময় একদিকে যেমন অপ্রিয় ভাষণ, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, উপহাস ইত্যাদির মাধ্যমে কারো মনোকষ্ট দেয়া যাবে না, অন্যদিকে মুলাকাতের ধরণ থেকেই যাতে প্রেমের আবেগটা প্রকাশ পায়, মুলাকাত তেমনিভাবে করতে হবে। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফ থেকে আমরা বহু পথনির্দেশ পাই। এর একটি ধরণ হচ্ছে এই যে, মুলাকাতের সময় রূঢ়তা, কঠোরতা, তাচ্ছিল্য ও নির্লিপ্তিতা ইত্যাদি পীড়াদায়ক ও হৃদয়বিদারক আচরণের পরিবর্তে নম্রতা, শিষ্টতা, সৌজন্য ও প্রিয়ভাষণের পরিচয় দিতে হবে। নম্র ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূলে খোদা (সঃ) বলেছেন:
الا اخبركم بمن يحرم على النَّار وبمن تحرم النّار عليه على كلِّ هيِّن ليِّن قريب سهل –
‘আমি তোমাদেরকে এমন এক ব্যক্তির কথা বলে দিচ্ছি, যার ওপর জাহান্নামের আগুন হারাম এবং সেও জাহান্নামের ওপর হারাম। এ লোকটি নম্র মেজাজ, নম্র প্রকৃতির ও নম্রভাষী।’ (আহমদ, তিরমিযি-ইবনে মাসউদ রাঃ)
আর একটি পন্থা হচ্ছে, হাস্যোজ্বল মুখে সাক্ষাত করা এবং দেখা হওয়া মাত্রই মুচকি হাসি দেয়া। রাসূলে কারীম (সঃ) এ উভয় জিনিসেরই নসিহত করেছেন। একবার তিনি বলেন:
لا تحفرنَّ من المعروف شيئا ولو ان تلقى اخاك بوجه طليقٍ –
‘নেক কাজের ভেতর কোনটাকে তুচ্ছ জ্ঞান করো না, যদি তা আপন ভাইয়ের সাথে তোমরা হাস্যোজ্বল সাক্ষাৎ করার তূল্যও হয়।’ (মুসলিম-আবুযর রাঃ)
অন্যত্র বলা হয়েছে যে, ‘আপন ভাইকে দেখা মাত্র মুচকি হাসি দেয়াও একটি সাদকা।’
তাচ্ছিল্য ও নির্লিপ্তিতার সঙ্গে নয়, বরং আগ্রহ ও মনোযোগ সহকারে সাক্ষাত করতে হবে এবং এ সাক্ষাতকারের যে আন্তরিক খুশীর তাকীদেই করা হচ্ছে একথা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে হবে।
নবী কারীম (সঃ) সম্পর্কে সাহাবীগণ বলেন যে, তিনি কারো প্রতি মনোযোগ প্রদান করলে সমগ্র দেহ-মন দিয়েই করতেন। এমনি ধরণের একটি ঘটনা বায়হাকী উদ্বৃত করেছেন। ঘটনাটি হচ্ছে এই: একদা নবী কারীম (সঃ) মসজিদে এক মজলিসের ভেতর বসেছিলেন। এমনি সময়ে ষেখানে একটি লোক এলো নবী কারীম (সঃ) নড়েচড়ে উঠলেন। লোকটি বললো: ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্, যথেষ্ট জায়গা আছে।’ তিনি বললেন:
انَّ للمسلم لحقاً اذا راه اخوه انْ يَّتزخزح له-
‘মুসলমানের হক হচ্ছে এই যে, তার ভাই যখন তাকে দেখবে তার জন্যে সক্রিয় হয়ে উঠবে।’ (বায়হাকী-ওয়াইলাহু বিন খাত্তাব রাঃ)
হযরত আয়িশা (রাঃ) বলেন যে, জায়িদ বিন হারিস (রাঃ) যখন মদীনায় আসেন এবং রাসূলুল্লাহর সঙ্গে মুলাকাত করার জন্যে বাহির থেকে দরজায় খটখট আওয়াজ দেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) চাদর না বেঁধে শুধু টানতে টানতেই বাইরে বেরিয়ে পড়েন। খোদার কসম, আমি না এর আগে আর না এর পরে তাঁকে এমনি অবস্থায় কখনো দেখেছি। তিনি প্রেমের আবেগে যায়েদর গলা জড়িয়ে ধরেন এবং তাঁকে চুম্বন করেন। অনুরূপভাবে হযরত জা’ফর তাইয়ার (রাঃ) যখন আবিসিনিয়া থেকে ফিরে আসেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে চুম্বন করেন। হযরত আকরামা (রাঃ) বিন আবু জাহেল তাঁর খেদমতে গিয়ে হাজির হলে তিনি বললেন, ‘হিজরতকারী আরোহীকে স্বাগতম।’
৮. সালাম
সালামের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশকে একটি সুনির্দিষ্ট পন্থা বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং একেও এক মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমানের কর্তব্য ও অধিকারের শামিল করে দেয়া হয়েছে। এতে করে একদিকে আবেগের প্রকাশ এবং অন্যদিকে আপন ভাইয়ের জন্যে দোয়া তথা শুভাকাক্ষার অভিব্যক্তি ঘটে। নবী কারীম (সঃ) মদীনায় আসবার পর প্রথম যে খুতবাটি প্রদান করেন, তাতে তিনি চারটি বিষয়ের নির্দেশ দেন। তার একটি ছিলো এই:
وافشوا السَّلام بينكم –
‘নিজেদের মধ্যে সালামকে প্রসারিত করো।’ এর চেয়ে অধিকতর গুরুত্ব নিম্নোক্ত হাদীস থেকে প্রকাশ পায়ঃ
لا تدخلون الجنَّة حتَّى تؤمنوا ولا تؤمنوا حتّى تحابُّوا الا ادلُّكم على شيئ اذا فعلتموه تحاببتم افشوا السلام بينكم –
‘তোমরা কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবেনা, যতোক্ষণ না মু’মিন হবে। আর ততোক্ষন পর্যন্ত মু’মিন হবে না, যতোণ না পরস্পরকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন কিছুর সন্ধান দেব না, যা গ্রহণ করে তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে? তা হচ্ছে এই যে, তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামকে প্রসারিত করো।’ (মুসলিম-আবু হুরায়রা রাঃ)
আর একবার মুসলমানের প্রতি মুসলমানের ছয়টি কর্তব্য ও অধিকার নির্দেশিত করে তিনি বলেন:
يسلِّم اذا لقيه –
‘তার সঙ্গে যখনই মিলিত হবে, তাকে সালাম করবে।’ (নিসায়-আবু হুরায়রা রাঃ)
এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে সালামের সূত্রপাতকারী ও অগ্রাধিকার লাভকারীকে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। রাসূলে কারীম (সঃ) বলেছেন:
‘সালামের সূচনাকারী অহংকার থেকে বেঁচে থাকে।’
তিনি আরো বলেন:
انَّ اولى النّاس بالله من بدء السلام –
‘সালামের সূত্রপাতকারী হচ্ছে আল্লাহর রহমত থেকে অধিকতর নিকটবর্তী লোকদের অন্যতম।’ (আহমদ, আবু দাউদ-আবু উসমান রাঃ)
স্পষ্টত প্রেমের দাবীই হচ্ছে এই যে, মানুষ সামনে এগিয়ে তার ভাইয়ের জন্যে দোয়া করবে এবং এভাবে তার হৃদয়াবেগ প্রকাশ করবে। রসূলুল্লাহ (সঃ) পথ দিয়ে চলবার কালে সর্বদাই নিজে সালামের সূচনা করতেন। পথে যার সঙ্গেই দেখা হোক-নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সবাইকে তিনি সালাম করতেন। বরং শিশুকে সালাম করার ব্যাপারে তিনি বিশেষভাবে অগ্রসর থাকতেন। সালাম সম্পর্কে তিনি বলেন:
اذا لقى احدكم اخاه فليسلِّم عليه فان حالت بينهما شجَّرةٌ او جدارٌ او حجر ثمَّ لقييه فليسلِّم عليه –
‘যখন তোমাদের ভেতরকার কেউ তার ভাইয়ের সঙ্গে মিলিত হবে তখন তাকে সালাম করবে। অতঃপর এ দু’জনের মধ্যে কোন গাছ, প্রচীর, পাথর বা অন্য কোন জিনিস যদি আড়াল সৃষ্টি করে এবং তারপর আবার সাক্ষাত হয়, তখনও সালাম করবে। (আবু দাউদ-আবু হুরায়রা রাঃ)
বিশেষভাবে তিনি পরিবারের লোকদেরকে সালাম করার জন্যে পরামর্শ দিয়েছেন এবং হযরত আনাস (রাঃ)-কে বলেছেন:
يا بنىَّ اذا دخلت على اهلك فسلِّم يكون بركة عليك وعلى اهل بيتك –
‘হে বৎস! যখন তুমি নিজ ঘরে প্রবেশ করো, সবাইকে সালাম করো। এটা তোমার এবং তোমার পরিবারের লোকদের জন্যে কল্যাণকর হবে।’ (তিরমিযি-আনাস রাঃ)
সালামের আদান-প্রদান যখন সঠিক অনুভূতি নিয়ে করা হবে, এক ভাই অপর ভাইকে শান্তির জন্যে দোয়া করবে এবং এর মাধ্যমে তার হৃদয়ের ভালোবাসা ও শুভাকাঙ্খার গভীরতা প্রকাশ পাবে, কেবল তখনই সালামের দ্বারা ভালোবাসা বৃদ্ধি পেতে পারে। নচেৎ প্রচলিত ইসলামের মতো অভ্যাস বশত মুখ থেকে গোটা দুয়েক শব্দ নিঃসৃত হলেই তা দিয়ে পারস্পারিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পেতে পারে না, এতে সন্দেহ নেই।
৯. মুছাফাহা
মুলাকাতের সময় আপন ভালোবাসা ও হৃদয়াবেগ প্রকাশের জন্যে রাসূলে কারীম (সঃ) সালামের পর দ্বিতীয় যে জিনিসটি নির্দেশ করেছেন তা হচ্ছে মুছাফাহা বা করমর্দন। হযরত আনাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীদের মধ্যে কি মুছাফাহার প্রচলন ছিলো? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
প্রকৃত পক্ষে মুছাফাহা হচ্ছে সালামের সমাপ্তি বা পূর্ণত্ব। অর্থাৎ সালামের গোটা ভাবধারাই এদ্বারা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। রাসূলে কারীম (সঃ) নিজেই এ বর্ণনা করেছেন:
تمام تحيّاتكم بينكم المصافحة –
‘মুছাফাহার দ্বারা তোমাদের পারস্পারিক সালামের পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটে।’ (আহমদ, তিরমিযি-আবু উমালাহু রাঃ)
এুছাফাহা সম্পর্কে নবী কারীম (সঃ) আরো বলেছেন: ‘তোমরা মুছাফাহা করতে থাকো, কারন এর দ্বারা শত্রুতা দূরীভূত হয়।
(تصافحوايذهب الغلَّ) এছাড়া মুছাফাহার পুরস্কার সম্পর্কে রাসূলে কারীম (সঃ) নিম্নোক্ত সুসংবাদও দিয়েছেন:
ما من مسلمين يلتقيان فيصا فحان الاَّ غفرلهما قبل ان يَّتفرَّقا وفى رواية اخرى اذا التقى المسلمان فتصافحا وحمدا الله واستغفرا الله غفرلهما –
‘যখন দু’জন মুসলমান মিলিত হয় এবং পরস্পর মুছাফাহা করে তখন তাদের পৃথক হবার পূর্বে তাদের (যাবতীয় দোষত্রুটি) মার্জনা করে দেয়া হয়। অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, যখন দুজন মুসলমান মুছাফাহা করে, আল্লাহর প্রশংসা করে এবং তার কাছে মার্জনা চায় তখন তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। – (আহমদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্-বায়া বিন গারিব রাঃ)
১০. উৎকৃষ্ট নামে ডাকা
মানব-প্রকৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রই চান যে, নিজেকে উৎকৃষ্ট নামে সম্বোধন করুক। এটা মানুষের এক স্বাভাবিক আকাঙ্খা। আর যতো প্রীতিপূর্ণ ভাষা ও আবেগময় ভঙ্গীতে তাকে সম্বোধন করা হবে, সম্বোধনকারীর আন্তরিকতা ও ভলোবাসায় তার দিল ততোই প্রভাবিত হবে। কাজেই এ ব্যাপারে কোন কার্পণ্য করা উচিত নয়। বরং আপন ভাইয়ের প্রতি নিজের প্রেমের আবেগ যাতে পুরোপুরি প্রকাশ পায়, এমন ভাষা ও ভঙ্গীতেই তাকে ডাকবার চেষ্টা করা উচিত। সাইয়্যেদ আহমাদ শহীদ (রহ)-এর আন্দোলনে প্রত্যেক ব্যক্তি তার সমপর্যায়ের ও বয়োজ্যেষ্ঠ লোকদেরকে তাদের নামের সঙ্গে ‘ভাই’ শব্দ যোগ করে সম্বোধন করতেন, আর ছোটদের শুধু নাম উচ্চারণ করতেন। মোটকথা, নিজের ভালোবাসা যাতে পূর্ণরূপে প্রকাশ পায় এবং অপরের দিলও খুশী হয়, সম্বোধনটা এমনিতরো হতে হবে। এক ব্যক্তি তার ভাইকে তার অপছন্দনীয় ভাষায় সম্বোধন করবে, একটা প্রীতি ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্কের ভেতর এর কোনই অবকাশ নেই। এ ব্যাপারে প্রিয় ভাষণ সম্পর্কিত সম্পূর্ণ হাদীসই প্রযোজ্য। হযরত উমর (রাঃ)-কে ‘বন্ধুত্ব কিসের দ্বারা দৃঢ়তার হয়’-এ মর্মে প্রশ্ন করা হলে তিনি তার কত চমৎকার জবাবই না দিয়েছেন। বলেছেন-‘বন্ধুকে উৎকৃষ্ট নামে সম্বোধন করো।’
১১. ব্যক্তিগত ব্যাপারে ঔৎসুক্য
আন্তরিক ভালোবাসার একটি অন্যতম তাকিদ হচ্ছে, নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারের ন্যায় আপন ভাইয়ের ব্যক্তিগত ব্যাপারেও ঔৎসুক্য পোষণ করা। ভাইয়ের সঙ্গে যখন মিলিত হবে, তার ব্যক্তিগত অবস্থাদি জিজ্ঞেস করবে এবং সে সম্পর্কে পুরোপুরি ঔৎসুক্য প্রকাশ করবে। এভাবে এক ভাইয়ের মনে অপরের আন্তরিকতা ও শুভাকাঙ্খা সম্পর্কে প্রত্যয়ের সৃষ্টি হবে, এক ভাইয়ের হৃদয়াবেগ অন্যের কাছে প্রকাশ পাবে। ফলে এ জিনিসগুলো তাদের সম্পর্ককে অধিকতর স্থিতিশীল করে তুলবে। নবী কারীম (সঃ) তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে ব্যক্তিগতভাবে পারস্পারিক পরিচয় লাভের নির্দেশ দান প্রসঙ্গে এ জিনিসটির প্রতিও আলোকপাত করেছেন। তিনি বলেছেন:
اذا اخى الرَّجلُ الرَّجلَ فليسأله عن اسمه واسم ابيه وممَّن هو فانَّه او صل للمودَّة –
‘এক ব্যক্তি যখন অন্য ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, তখন তার কাছ থেকে তার নাম, তার পিতার নাম এবং তার গোত্র-পরিচয় জিজ্ঞেস করে নেবে। কারণ এর দ্বারা পারস্পারিক ভালোবাসার শিকড় অধিকতর মজবুত হয়।’ (তিরমিযি-ইয়াজিদ বিন নাআমাহ্ রাঃ)
নিজের নাম ইত্যাদি মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপারেরই একটা অংশ। এভাবে আলোচ্য হাদীস আমার পেশকৃত নীতির দিকেই ইঙ্গিত করছে। ‘এছাড়া প্রেমের শিকড় মজবুত হয়’ একথাটি এর প্রকৃত তাৎপর্যের ওপরও আলোকপাত করছে।
১২. হাদিয়া
আপন ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতা প্রকাশার্থে হাদিয়া দেয়া সম্পর্কের স্থিতিশীলতার জন্যে অতীব ফলপ্রসূ জিনিস। প্রকৃতপক্ষে ভালো কথা বলা, উৎকৃষ্ট নামে ডাকা, ভালোবাসা প্রকাশ করা ইত্যাদি হচ্ছে জবানের হাদিয়া। এ গুলোর মাধ্যমে এক ভাই অন্য ভাইয়ের প্রতি নিজের ভালোবাসা ও হৃদয়াবেগ প্রকাশ করে তাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার প্রয়াস পায়। জবানের এ হাদিয়াগুলো যেমন দিলকে খুশী করে, বিভিন্ন দিলের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করে এবং একে অপরকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে সহায়তা করে, তেমনি বস্তুগত হাদিয়াও একের দিলকে অন্যের দিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেয় এবং এভাবে পারস্পারিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। নবী কারীম (সঃ) হাদিয়ার উপদেশ দান প্রসঙ্গে তার এ ফায়দাও বাতলে দিয়েছেন যে, এরদ্বারা দিলের মলিনতা ধুয়ে সাফ হয়ে যায়। তিনি বলেছেন:
تهادوا تحابُّوا وتذهب شحناؤكم – (او كما قال عليه السلام)
‘একে অপরকে হাদিয়া পাঠাও, এর দ্বারা পারস্পারিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে এবং হৃদয়ের দূরত্ব ও শত্রুতা বিলীন হয়ে যাবে।’ (মুয়াত্তা মালিক, আত্বা)
খোদ নবী কারীম (সঃ) তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে পুনঃ পুনঃ হাদিয়া দিতেন এবং তাঁর সাহাবীগণ তাঁর খেদমতে ও পরস্পর পরস্পরের কাছে হাদিয়া পাঠাতেন। এ ব্যাপারে আমাদের যে, কথাগুলো মনে রাখা দরকার এবং নবী (সঃ)-এর জীবন থেকে যে পথনির্দেশ পাই, তা হচ্ছে এই:
১. হাদিয়া সর্বদা আপন সামর্থ অনুযায়ী দেয়া উচিত এবং কোন মুল্যবান বা বিশিষ্ট জিনিস দিতে পারি না বলে এ থেকে বিরত থাকা উচিত নয়; আসলে যে, জিনিসটি হৃদয়ে যোগসূত্র রচনা করে, তা হাদিয়ার মূল্য বা মর্যাদা নয়, তা হচ্ছে দাতার আন্তরিকতা ও ভালোবাসা।
২. হাদিয়া যা কিছুই না কেন, তা সর্বদা কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ করা উচিত।
৩. হাদিয়ার বিনিময়ে সর্বদা হাদিয়া দেয়ার চেষ্টা করা উচিত। এজন্যে সমপরিমাণের হাদিয়া হতে হবে, এমন কোন কথা নেই, বরং প্রত্যেকেই নিজ নিজ সঙ্গতি অনুযায়ী দেবে। নবী কারীম (সঃ)-এর নীতি ছিলো যে, তিনি সর্বদা হাদিয়ার বিনিময় দেবার চেষ্টা করতেন। একবার এক ব্যক্তি বিনিময় নিতে অস্বীকার জানালে তিনি অত্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
৪. হাদিয়ার মধ্যে রাসূলে কারীম (সঃ)-এর কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় জিনিস ছিলো খুশবু। আজকের দিনে এ পর্যায়ে বই পত্রকেও রাখা যেতে পারে।
১৩. শোকর গোজারী
নিজের প্রেমের আবেগের অভিব্যক্তি এবং অপরের ভালোবাসা উপলব্ধিকে প্রকাশ করার জন্যে শোকর-গোজারী হচ্ছে একটি উত্তম পন্থা। এক ব্যক্তি যখন উপলব্দি করেন যে, তার ভাই তার প্রেমের আবেগ ও প্রেমের তাকিদে কৃত কার্যাবলীর গুরুত্ব ও তার মূল্য যথাযথ উপলব্ধি করছে, তখন ভাইয়ের প্রতি তার আন্তরিক ভালোবাসা বেড়ে যাবে। পাক্ষান্তরে ভালোবাসা পোষণকারী ব্যক্তি যদি উপলব্ধি করে যে, তার আন্তরিকতা ও ভালোবাসার কোন মূল্য নেই, তবে তার হৃদয়াবেগ স্ববাবতই নিষ্পভ হতে থাকবে। এজন্যেই এক মুসলমান যখন অন্য মুসলমান ভাইয়ের সাহায্য করতে তার সঙ্গে সদাচরণ করবে, তাকে কোন ভালো কথা বলবে, আথবা তাকে কোন হাদিয়া দান করবে, তখন তার প্রতি সানন্দচিত্তে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সে মুসলমান ভাইয়ের অবশ্য কর্তব্য। এভাবে সে যে তার আন্তরিকতা ও ভালোবাসার মূল্য পুরোপুরি উপলব্ধি করছে, একথা তাকে জানিয়ে দেবে। নবী কারীম (সঃ) সম্পর্কে সাহাবাগণ বলেন যে, কেউ যখন তাঁর খেদমতে কিছু পেশ করতো তিনি শুকরিয়ার সাথে তা গ্রহণ করতেন এবং কেউ তাঁর কোন কাজ করে দিলে সেজন্যে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন।
১৪. একত্রে বসে আহার
আহারাদিতে একে অপরের সঙ্গে অংশগ্রহণ এবং অপরকে নিজ গৃহে খাবারের দাওয়াত দেয়াওেআন্তরিকতা ও ভালোবাসা প্রকাশের একটি চমৎকার পন্থা। এর মাধ্যমে শুধু নিঃসংকোচ আলাপ-আলোচনার সুযোগ পাওয়া যায় তাই নয়, বরং এক মুসলমান তার ভাইকে নিজ গৃহে খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানালে নিমন্ত্রিত ব্যক্তির মনে এই অনুভূতির সৃষ্টি হয় যে, তার ভাই তার প্রতি গভীর ভালোবাসা পোষণ করে। আর এমনি অনুভূতির সৃষ্টি হলে পারস্পারিক সম্পর্ক নিশ্চিতরূপে দৃঢ়তর হবে। সাহাবাগণ পরস্পর পরস্পরকে এবং নবী কারীম (সঃ)-কে প্রায়ই দাওয়াত করতেন। খোদ নবী কারীম (সঃ)-এর কাছে কোন খাবার জিনিস থাকলে অথবা কোথাও থেকে কোন কিছু আসলে তিনি গোটা মজলিসকে তাতে শরীক করাতেন। ইতিপূর্বে হাদিয়া প্রসঙ্গে যে জিনিসগুলো বর্ণিত হয়েছে, দাওয়াত ও একত্রে বসে আহার করার ব্যাপাওে সেগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা দরকার। বিশেষ করে দাওয়াতের ব্যাপারে কোনরূপ সংকোচের প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়, বরং প্রত্যেকেই আপন সামর্থানুযায়ী খাওয়াবেন, তা প্রাত্যাহিক খাবারই হোক না কেন। তবে এ ব্যাপারে কিছু ব্যবস্থা করা সম্ভব হলে নিমন্ত্রিতের মনে তা শুভ প্রভাব বিস্তার করে বৈ কি। তবে সামনে যা-ই পেশ করা হোক না কেন, নিমন্ত্রিতের কর্তব্য হচ্ছে তাকে সন্তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতার সাথে কবুল করা। এ ব্যাপারে শেষ কথা হচ্ছে এই যে, হাদিয়ার ন্যায় দাওয়াতেরও বিনিময় করার চেষ্টা করা উচিত।
এ প্রসঙ্গে একথাও জেনে রাখা দরকার যে, শুরুর দিকে আপন প্রিয়জন ও আত্মীয়-স্বজনের গৃহে আহার করার ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিধাসংকোচ দেখা যেতো। এ ব্যাপারে খোদ কুরআনের সূরা আন্ নূরে আয়াত নাযিল করে আল্লাহ্ তায়ালা এ দ্বিধা-সংকোচের নিরসন করে দিয়েছেন।
১৫. দোয়া
দোয়া এমন একটা জিনিস, যা এক বিশেষ দিক থেকে আমাদের আলোচিত বহুতরো কর্তব্য ও অধিকারকে নিজের ভেতরে আত্মস্থ করে নেয় এবং অন্য দিক দিয়ে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা বৃদ্ধি করে। দোয়ার মাধ্যমে এক মুসলমান তার ভাইয়ের জন্যে আপন প্রভুর কাছে রহমত ও মাগফিরাত কামনা করে, তার ভালাই ও কল্যাণের জন্যে প্রার্থনা করে এবং তার অবস্থার উন্নতির জন্যে আবেদন জানায়। স্পষ্টতঃ মুসলমানই এ প্রত্যয় পোষণ করে যে, কার্যকারণের আসল চাবিকাঠি আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ। এমতাবস্থায় যখন সে দেখে যে তার ভাই তার জন্যে আপন প্রভুর সামনে প্রার্থনার হাত তুলে ধরেছে, তখন সে যারপরনাই মুগ্ধ ও প্রভাবিত হয়।
দোয়া আড়ালে বসে বা সামনা সামনি উভয় প্রকারেই হতে পারে। এর একটি পন্থা হচ্ছে সালাম, যার পূর্ণাঙ্গ রূপের মাধ্যমে মুসলমান তার ভাইয়ের জন্যে শান্তি, রহমত ও বরকত কামনা করে। এক মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমানের আর একটি কর্তব্য হচ্ছে এই যে, সে যখন হাঁচি দেবে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বলবে তার জন্যে রহমতের দোয়া করবে। আপন মুসলমান ভাইয়ের জানাযার নামাজ পড়াও একটা বিশেষ কর্তব্য এবং এও দোয়ার একটি পন্থা। রুগ্ন ভাইয়ের পরিচর্যার (যা ইতিপূর্বে বিবৃত হয়েছে) মধ্যেও দোয়া রয়েছে।
দোয়া সামনা সামনি হলে কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জ্ঞাতসারে হলে তার প্রথম সুফল এই হয় যে, সে তার ভাইয়ের আন্তরিক শুভাকাঙ্খা ও ভালোবাসার প্রতি মনে প্রাণে বিশ্বাসী হয়। যেহেতু উভয়েরই অভীষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর রহমত, তাই সে দেখতে পায় যে, তার ভাই তার মঙ্গলের জন্যে শুধু বাস্তব প্রচেষ্টাই চালায় না বরং নিজের আশা-আকাঙ্খার মতো তার আশা-আকাঙ্খাকেও আল্লাহর দরবারে পেশ করে। নিজের দুঃখ ক্লেশে অস্থির হয়েও আপন মালিকের সামনে হাত বাড়িয়ে দেয়, নিজের দোষত্রুটির মতো তার দোষত্রুটি ও গোনাহ্ খাতার জন্যেও মাগফিরাত কামনা করে এবং নিজের ন্যায় তার জন্যেও খোদার সন্তুষ্টি ও রহমতের প্রত্যাশা করে। সে আরো দেখতে পায় যে, তার ভাই তার প্রতি এতোটা লক্ষ্য রাখে যে, যখন নির্জনে শুধু ভাই এবং তার আল্লাহই বর্তমান থাকে, তখনো ভাই তার কথা স্মরন রাখেন। এমতাবস্থায় তার অন্তরে তার জন্যে দোয়া প্রার্থনাকারী ভাইয়ের প্রতি স্বাভাবিক ভাবেই ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। এভাবে হৃদয়াবেগ প্রকাশের সমস্ত ফায়দাই দোয়ার মাধ্যমে লাভ করা যায়।
দ্বিতীয়তঃ দোয়া প্রার্থনাকারী যখন চেষ্টা করে অন্যকে নিজের দোয়ার মধ্যে শামিল রাখে, তখন উভয়ের আন্তরিক সম্পর্ক অধিকতর বৃদ্ধি পায় এবং সে সঙ্গে সম্পর্কের ভেতর পবিত্রতারও সঞ্চার হয়।
উপরন্তু রহমত, মাগফিরাত, প্রয়োজন পূরণ ও অসুবিধা দূরীকরণের দোয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপন ভাইয়ের জন্যে সত্যপথে অবিচল থাকা এবং পারস্পারিক বন্ধুত্বের জন্যেও দোয়া করতে উপদেশ দেয়া হয়েছে।
اللّهمَّ الِّف بين قلوبنا واصلح ذات بيننا –
‘হে আল্লাহ্! আমাদের অন্তরসমূহকে সংযুক্ত করে দাও, আমাদের পারস্পারিক মনোমালিন্য দূর কর।’
এভাবে অন্তর থেকে মলিনতা, বিদ্বেষ ইত্যাদি দূরীভূত হবার জন্যেও দোয়া করার উপদেশ দেয়া হয়েছে। কারণ, হৃদয়ে পরস্পরের প্রতি তিক্ততা, মনোমালিন্য বা অভিযোগ লালন করা এক মারাত্মক রকমের ব্যাধি। এর নিরাময়ের জন্যে তাই বিনীতভাবে দোয়া করা উচিত।
ربَّنا اغفرلنا ولاخواننا الَّذ ين سبقونا بالايمان ولا تجعل فى قلوبنا غلاًّ لّلَّذين امنوا ربَّنا انَّك رؤف الرَّحيم –
‘হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে এবং আমাদের সেই সব ভাইকে ক্ষমাদান করো যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে এবং আমাদের দিলে ঈমানদার লোকদের জন্যে কোন হিংসা ও শত্রুতাভাব রেখো না। হে আমাদের প্রভূ! তুমি বড়ই অনুগ্রহ সম্পন্ন এবং করুনাময়।’ (সূরা হাশর- ১০)
দোয়ার ভেতর আপন ভাইয়ের নামোচ্চারণ বা তার স্মরণ করলে তা দ্বারা অধিকতর সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। নিজে স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে আপন ভাইয়ের জন্যে রহমতের দোয়া করা, আল্লাহর কাছে তার বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা কামনা করা এবং সম্পর্ককে বিকৃতি ও অনিষ্টকরিতা থেকে রক্ষা করার জন্যে আবেদন জানানো তো এক মুসলমানের প্রতি অন্য মুসলমানেরই কর্তব্যই; কিন্তু পরস্পর পরস্পরকে নিজের দোয়ার জন্যে অনুরোধ করা এবং দোয়ার ভেতর শরীক থাকার আকাঙ্খা প্রকাশ করাও পারস্পারিক সম্পর্কোন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ নবী করীম (সঃ) বলেছেন: ‘যখন আপন রুগ্ন ভাইয়ের পরিচর্যার জন্যে যাও তখন তার দ্বারাও নিজের জন্যে দোয়া করিয়ে নাও। কারণ, তার দোয়া বেশী কবুল হয়ে থাকে।’
একবার হযরত উমর (রাঃ) হজ্জে রওয়ানা করলে নবী কারীম (সঃ) তাঁকে কয়েকটি কথা বলেন, কথা কয়টি সম্পর্কে খোদ উমর (রাঃ)-এর বক্তব্য হচ্ছে এই যে, ‘এটা আমার গোটা জীবনের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস।’ সে কথা কয়টি হচ্ছে এই: ‘হে আমাদের ভাই, নিজের দোয়ার মধ্যে আমাদেরকে স্মরণ করো।’
১৬. সুন্দরভাবে জবাব দেয়া
আপন মুসলমান ভাইয়ের আন্তরিকতা ও ভালোবাসার জবাব তাঁর চেয়েও অধিকতর আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সঙ্গে দেয়ার জন্যে প্রত্যেক মুসলমানেরই চেষ্টা করা উচিত। এ জন্যে যে, কোন সম্পর্কই একতরফা ভালোবাসার দ্বারা বিকাশ লাভ করত পারে না। পরন্তু এর দ্বারা অন্য ভাইয়ের মনও এই ভেবে নিশ্চিত থাকে যে, তার ভালোবাসার না অপচয় হচ্ছে আর না তাকে অসমাদর করা হচ্ছে। সালামের জবাবে সালাম দেয়া, হাদিয়ার বিনিময়ে হাদিয়া দেয়া, ভালো কথার জবাবে ভালো কথা বলা এবং এ সবকিছুই সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার নির্দেশ উল্লেখিত নীতির ওপরই আলোকপাত করে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে কারীম (সঃ) এর নিম্নোক্ত বাণীও স্মরণ রাখা উচিত:
‘দুইজন প্রেমিকের মধ্যে সেই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ, যে তার ভাইয়ের প্রতি অধিক ভালোবাসা পোষন করে।’
যদি আপন ভাইয়ের ভালোবাসার জবাবে অধিকতর উত্তম জবাব দেয়া সম্ভবপর না হয় তাহলে অন্তত সমপর্যায়ের জবাব দেয়া উচিত এবং সেই সঙ্গে নিজের অক্ষমতা জ্ঞাপন করলে তা অন্যের হৃদয়কে প্রভাবিত করবেই।
১৭. আপোষ রফা এবং অভিযোগ খণ্ডন
সম্পর্কের ভিত্তিকে মনে রাখার পর তাতে বন্ধুত্ব ভালোবাসার আবেগ সৃষ্টি এবং বিকৃতি ও অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা করার উপযোগী উপায় অবলম্বনের ব্যাপারে স্বভাবতই নানারূপ দোষত্রুটি ও অক্ষমতা প্রকাশ পেয়ে থাকে। কখনো কোন কাজে ভুলত্রুটি হবে না, এটা কোন মানুষের পক্ষে বলা সম্ভবপর নয়। বিশেষতঃ এ সম্পর্ক যেহেতু ইসলামী বিপ্লবের জন্যে গড়ে ওঠে, তাই শয়তানও এ ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর থাকে এবং পারস্পারিক সম্পর্ককে বিকৃত করা ও তাতে ফাটল সৃষ্টির জন্যে সর্বদা ছিদ্রপথ খুঁজতে থাকে। পারস্পারিক সম্পর্ক সম্বন্ধে ইতিপূর্বে যা কিছু আলোচিত হয়েছে, তা সঠিকভাবে সামনে রাখা হলে এবং নিজের জবান ও আমল দ্বারা আপন ভাইকে কোনরূপ দৈহিক বা মানসিক কষ্ট না দেয়া, ভাইয়ের দ্বীনি ও দুনিয়াবী সাহায্যের জন্যে সম্ভাব্য সর্বোতভাবে চেষ্টা করা, নিজের আন্তরিকতা ও ভালোবাসাকে পুরোপুরি প্রকাশ করা, অন্যের আন্তরিকতা ও ভালোবাসার মূল্য উপলব্ধিস্বরূপ অধিকতর অন্তরিকতা ও ভালোবাসা কিংবা অন্তত সমপর্যায়ের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা প্রকাশ করা ইত্যাকার নীতি অনুসরন করলে এবং এরই মানদণ্ডে নিজের আচরণকে যাচাই করতে থাকলে এর ভেতর শয়তানের অনুপ্রবেশ খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। তারপরেও যদি সম্পর্কের ভেতর বিকৃতি ও খারাবী পরিলক্ষিত হয়, তবে প্রত্যেক মুসলমান ভাইয়ের সামনে কয়েকটি জিনিস অবশ্যই রাখতে হবে। এ জিনিসগুলো সামনে রাখা হলে বিকৃতি দেখা দিলেও তা সহজেই দূর করা যাবে। সম্পর্কের বিকৃতির সাধারণ ভিত্তি হচ্ছে, এক মুসলমান ভাইয়ের প্রতি অপর ভাইয়ের মনে অভিযোগ সৃষ্টি। অভিযোগ সৃষ্টির বহু কারণ থাকতে পারে। তবে এ অধ্যায়ে যে জিনিসগুলো আলোচিত হচ্ছে, তা সবগুলো কারণকেই দূরীভূত করে দেয়। প্রতিটি অভিযোগের ভেতরই একটি সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় যে, কোন মুসলমান তার ভাইয়ের কোন কথা বা কাজের দ্বারা মনোকষ্ট পেলে তা থেকেই অভিযোগের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি যদি গুরুতর হয় তাহলে এ অভিযোগই সম্পর্কের বিকৃতির জন্যে যথেষ্ট। আর যদি ছোটখাট ব্যাপার হয় তবে অনুরূপ আরো কয়েকটি বিষয় মিলে এক প্রচন্ড অনুভুতির সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে আলোচিত বিষয়গুলো সবার সামনে রাখা জরুরী।
প্রথমতঃ এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে কোন অভিযোগের সুযোগই দেবেন না। তার দ্বারা অন্য ভাইয়ের মনে যাতে কোন কষ্ট না লাগে, এজন্যে তার সর্বদা চেষ্টা করা উচিত।
দ্বিতীয়তঃ আপন ভাইয়ের ব্যাপারে প্রত্যেক মুসলমানেরই দারাজদিল হওয়া উচিত। রাসূলে কারীম (সঃ)-এর উন্নত নৈতিক শিক্ষার প্রতি তার লক্ষ্য রাখা উচিত এবং কারো বিরুদ্ধে যাতে অভিযোগ সৃষ্টি না হয় আর হলেও তা অবিলম্বে অন্তর থেকে দূর করার জন্যে তার যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত।
তৃতীয়তঃ উক্ত প্রচেষ্টার পরও যদি অভিযোগ সৃষ্টি হয় এবং তাকে বিস্মৃত হওয়া সম্ভবপর না হয়, তবে তাকে মনের ভেতর লালন করা উচিত নয়। বিষয়টি ছোট হোক বা বড় হোক, অবিলম্বে তা আপন ভাইয়ের কাছে প্রকাশ করা উচিত। আপন ভাই সম্পর্কে মনের ভেতর অনমান ও মালিন্য রাখা এবং সে মালিন্যের সাথে তার সঙ্গে মিলিত হওয়া নিকৃষ্টতম চরিত্রের পরিচায়ক। কাজেই এ ব্যাপারে কোনরূপ বিলম্ব না করে অন্তরের এ মলিনতা দূর করার জন্যে অনতিবিলম্বে চেষ্টা করা উচিত।
চতুর্থতঃ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে, তিনি অসন্তুষ্ট হবেন না এবং এজন্যে নাসিকাও কঞ্চিত করবেন না। বরং যে দরদী ভাই পেছনে বলাবলি করে খেয়ানত করার পরবর্তে সামনে এসে অভিযোগ পেশ করলো এবং সম্পর্ককে অতীব মূল্যবান জিনিস মনে করে সামান্য অভিযোগেরও নিরসন করতে এগিয়ে এলা এবং সংশোধনের সুযোগ দান করলো তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত।
পঞ্চমতঃ আপন ভাইয়ের মনে কোন অভিযোগ রয়েছে, একথা জানবার সঙ্গে সঙ্গেই আত্মসংশোধনের চেষ্টা করবে। কারণ, সময় যতো অতিক্রান্ত হয় বিকৃতিও ততোই দৃঢ়মূল হয়। তাছাড়া যতো তাড়াতাড়ি ফেতনার মূলোৎপাটন করা যায়, ততোই মঙ্গল। যদি সত্যি সত্যি তার দ্বারা ত্রুটি হয়ে থাকে তাহলে খোলা মনে তার স্বীকৃতি জানাবে এবং সেজন্যে অনুশোচনা প্রকাশ করবে। সে ত্রুটির জন্যে কোন ওজর থাকলে তাও পেশ করবে। আর কোন ত্রুটি না হলে বরং কোন ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হলে অথবা কোন যুক্তি সংগত ওজর থাকলে সে ভুল বুঝাবুঝি দূর করবার প্রয়াস পাবে। এ ব্যাপারে ইঞ্জিলে হযরত ঈসা (আঃ)-এর নিম্নোক্ত উক্তি একজন মুসলমানের এ কর্তব্য পালনের প্রতি সুন্দরভাবে আলোকপাত করে:
“তুমি যদি কুরবান গাহে আপন নজর পেশ করতে যাও এবং সেখানে গিয়ে তোমার মনে আসে যে, আমার বিরুদ্ধে আমার ভাইয়ের অভিযোগ রয়েছে, তাহলে কুরবান গাহের সামনে তোমার নজর রেখে দাও এবং ফিরে গিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে আপোষরফা কর; কেবল এরপরই আপন নজর পেশ করতে পারো।”
এখানে অত্যন্ত চমৎকার কথা বলা হয়েছে। তোমার ভাই যদি তোমার প্রতি বিরূপ হয় তাহলে তোমার পক্ষে একজন ভালো লোক হওয়া এবং ভাইয়ের সঙ্গে তোমার সম্পর্ককে সম্প্রীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন ব্যাপার। বস্তুতঃ ইবাদতের আসল উদ্দেশ্য কেবল তখনই পূর্ণ হবে, যখন আমরা আল্লাহকে খুশী করতে পারবো। তাই নজর পেশ করার আগে ভাইয়ের অভিযোগ দূর করে আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করা এবং এ ব্যাপারে আদৌ বিলম্ব না করার উপদেশ দেয়া হয়েছে।
ষষ্টতঃ এক মুসলমান ভাই ত্রুটি স্বীকার করলে তাকে ক্ষমা করে দেয়াই কর্তব্য, এ ব্যাপারে কোনরূপ কার্পণ্য করা উচিত নয়। সে কোন অক্ষমতা পেশ করলে তাকে অক্ষম বলে বিবেচনা করা এবং তার অক্ষমতাটি কবুল করাও কর্তব্য। পরন্তু সে যদি ভুল বুঝাবুঝি দূরীকরণের উদ্দেশ্যে কোন বক্তব্য পেশ করে তাহলে তার কথা সত্য বলে বিশ্বাস করাও কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে নবী কারীম (সঃ)-এর নিম্নোক্ত বাণীটি স্মরণ রাখা উচিত:
‘যে ব্যক্তি তার কোন মুসলমান ভাইয়ের কাছে নিজের ত্রুটির জন্যে অক্ষমতা (ওজর) পেশ করলো, অথচ সে তাকে অক্ষম মনে করলো না এবং তার অক্ষমতাও কবুল করলো না, তার এতোটা গুনাহ্ হলো, যতোটা অবৈধ শুল্ক প্রহণজনিত জুলুমের ফলে একজন শুল্কগ্রহণকারীর হয়ে থাকে।’
এ নির্দেশগুলো যথাযথ অনুসরন করতে হলে লোকদের পারস্পারিক সম্পর্কের মূল্যটা খুব ভালোমতো উপলব্ধি করতে হবে, নিজের অন্তরে ভাই এবং ভাইয়ের প্রেমের আবেগের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা থাকতে হবে এবং সেই সঙ্গে সম্পর্কের বিকৃতি কত বড় গুনাহর ব্যাপার সে সম্পর্কেও পুরোপুরি উপলব্ধি থাকতে হবে। এর প্রথম জিনিসটি প্রথম অধ্যায়ের আলোচনা এবং বর্তমান অধ্যায়ের দ্বিতীয় অংশের আলোচনা থেকে খুব ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়। দ্বিতীয় জিনিসটি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, নবী কারীম (সঃ)-এ সম্পর্কের বিকৃতির ব্যাখ্যা দান করতে গিয়ে বলেছেন: ‘এ হচ্ছে একটা মুণ্ডনকারী ক্ষুর, যা গোটা দ্বীন ইসলামকেই পরিষ্কার করে দেয়।’ কাজেই যে ব্যক্তি আখিরাতের কামিয়াবীকেই আসল কামিয়াবী বলে বিশ্বাস করে, সে অবশ্যই নিজের দ্বীনকে যে কোন মূল্যে সংরক্ষিত রাখবে, আর যে দ্বীনকে সুরক্ষিত রাখতে ইচ্ছুক হবে, সে আপন সাধ্যানুযায়ী ঐ সম্পর্ককে কখনোই বিকৃত হতে দেবে না। নবী কারীম (সঃ) পারস্পারিক অসন্তুষ্টি ও সম্পর্কচ্ছেদ সম্পর্কে যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, তা যেমন মনোরম তেমনি কঠোরও। তিনি বলেছেন:
لا يحلُّ للرَّجل ان يَّهجر اخاه فوق ثلاث ليالٍ يلتقيان فيعرض هذا ويعرض هذا وخيرهما الَّذى يبدأ بالسلام-
‘আপন ভাইকে অসন্তুষ্টি বশত তিন দিনের বেশী ত্যাগ করা এবং উভয়ের সাক্ষাত হলে পরস্পর বিপরীত দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া কোন মুসলমানের পক্ষে জায়েয নয়। এই দু’জনের মধ্যে যে ব্যক্তি সালামের সূচনা করবে (অর্থাৎ, অসন্তোষ বর্জন করে আপোষের সূত্রপাত করবে) সেই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ।’ (বুখারী ও মুসলিম-আবু আইউব আনসারী রাঃ)
এ থেকে আপোষ-রফার সূত্রপাতকারীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হয়। এ ধরনের দু’জন মুসলমানের সাথে আল্লাহর দরবারে কিরূপ আচরণ করা হয়, নবী কারীম (সঃ) তাও বলেছেন:
تعرض اعمال النَّاس فى كلِّ جمعة مرَّتين يوم الاثنين ويوم الخميس فيغفر لكلِّ عبدٍ مُّؤمن الاَّ عبدأً بينه وبين اخيه شحناء فيقال اتركوا او اركوا هذين حتى يفيئا –
‘সপ্তাহের দু’দিন সোম ও বুহস্পতিবার লোকদের কীর্তি-কলাপ (আল্লাহর দরবারে) পেশ হয়ে থাকে এবং প্রত্যেক মু’মিন বান্দহকেই ক্ষমা করে দেয়া হয়, কেবল আপন মুসলমান ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া। বলা হয়, তাকে কিছু দিনের জন্যে ছেড়ে দাও, যেন পরস্পরে আপোষ করে নিতে পারে।’ (মুসলিম আবু হুরায়রা রাঃ)
যে ব্যক্তি তিন দিন পর্যন্ত আপন ভাইকে পরিত্যাগ করে, তার সম্পর্কে রাসূল (সঃ) আরো বলেছেন:
لا يحلُّ لمسلم ان يَّهجر اخاه فوق ثلاث فمن هجر فوق ثلاث فمات دخل النَّار-
‘আপন ভাইকে তিন দিনের বেশী পরিত্যাগ করা কোন মুসলমানের জন্যে জায়েয নয়। যে ব্যক্তি তিন দিনের বেশী বিচ্ছিন্ন থাকলো এবং এই সময়ের মধ্যে মারা গেল, সে জাহান্নামী হবে।’ (আহমদ, আবু দাউদ-আবু হুরায়রা রাঃ)
তিনি আরো বলেছেন:
فمن هجر اخاه سنة فهو كسفك دمه –
‘যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইকে এক বছরের জন্যে ত্যাগ করলো, সে যেন তার রক্তপাত করলো (অর্থাৎ সে এতোটা গুনাহ্ করলো)।’ (আবু দাউদ- আবু হুরায়রা রাঃ)
অবশ্য এ ব্যাপারে এমনি অবস্থাও দাঁড়াতে পারে যে, এক পক্ষ আপোষ মীমাংসার চেষ্টা করার পর সম্পর্কচ্ছেদ করছে কিংবা বিরোধের ক্ষেত্রে সে সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমতাবস্থায় বিচার-বুদ্ধি ও শরীয়াতের দৃষ্টিতে তার কোনই গুনাহ্ হবে না। তবে এমনি পরিস্থিতিতেও দারাজদিল হয়ে কাজ করা, নিজের ভাইকে ক্ষমা করে দেয়া এবং সত্যের ওপর থেকেও বিরোধ মিটিয়ে ফেলার সদুপদেশই তাকে দেয়া হয়েছে। একটি হাদীসে নবী কারীম (সঃ)-এ বিরোধ প্রত্যাহারের উপদেশ দান প্রসঙ্গে বলেছেন:
من ترك المراء وهو على حقٍّ بنى له بيت فى وسط الجنة ومن حسن خلقه بنى له فى اعلاها-
‘যে ব্যক্তি বিরোধ প্রত্যাহার করলো, তার জন্যে জান্নাতের মাঝখানে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। আর যে ব্যক্তি তার চরিত্রকে উন্নত করে নিলো, তার জন্যে জান্নাতের উচ্চতর স্থানে প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়।’ (তিরমিযি-আনাস রাঃ)
স্পষ্টতঃ সুন্দরতম চরিত্রের উচ্চতম স্তরই হচ্ছে ক্ষমা বা মার্জনা। এর বিনিময়েই মানুষ জান্নাতের উচ্চতম স্তরে স্থান পাবার যোগ্য হয়।
আপোষ-রফার সঙ্গে সঙ্গে দুই-ভাইয়ের মধ্যকার সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টি রাখা এবং কোথাও বিকৃতির চিহ্ন দেখলে তাকে সংশোধন করা অন্যান্য মুসলিম ভাই ও সাধারণভাবে মুসলিম সমাজের কর্তব্য। কারণ এ সংশোধনের উপরই পারস্পারিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতা নির্ভর করে। আর এ সম্পর্কই হচ্ছে সমাজের প্রাণ ও আত্মা। আল কুরআন নিম্নোক্ত ভাষায় এ সংশোধনের হুকুম দিয়েছে:
انَّما المؤمنون اخوة فاصلحوا بين اخويكم –
“মু’মিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতঃএব তোমরা তোমাদের দু’ভাইয়ের মধ্যে ঝসড়া-বিবাদ মীমাংসা করে ফেলে।” (সূরা হুজরাত-১০)
এমন কি, এ ব্যাপারে সীমাতিক্রমকারীর বিরুদ্ধে লড়াই করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রাসূলে কারীম (সঃ) একবার সাহাবীদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি আমলের কথা বলবো মাহাত্মের দিক দিয়ে যার সওয়াব নামাজ, রোজা, সাদকার চাইতেও বেশী?’ সাহাবীগণ বললেন: হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অবশ্যই বলুন।’ তিনি বললেন:
اصلاح ذات البين – وفساد ذات البين الحالقة –
‘লোকদের মধ্যকার (সম্পর্কের) সংশোধন করা আর লোকদের মধ্যকার সম্পর্কের বিপর্যয় সৃষ্টি করা হচ্ছে দ্বীনকেই মুণ্ডিয়ে ফেলা।’ (আবু দাউদ, তিরমিযি)
এ সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন (যদিও মিথ্যার ব্যাপারে ইসলামের ভূমিকা অত্যন্ত কঠোর):
ليس الكذَّاب الَّذى يصلح بين النَّاس ويقول خيرًا فيمنى خيرًا او يقول خيرًا –
‘যে ব্যক্তি লোকদের মধ্যে আপোষ মীমাংসা করায়, ভালো কথা বলে এবং ভালো কথা পৌঁছিয়ে দেয় সে মিথ্যাবাদী নয়।’ (বুখারী ও মুসলিম-উম্মে কুলসুম রাঃ)
অর্থাৎ এক প থেকে অন্য পরে কাছে এমনি সৎপ্রবণতা পৌঁছিয়ে দেয়, যা প্রকৃত পে প্রকাশ করা হয়নি। অবশ্য এমন মধ্যস্থতা যেখানে সংশোধনের জন্যে প্রয়োজন হবে, সেখানে মিথ্যা কথা বলা এবং এক প অন্য পরে ভালোবাসা ও শুভাকাঙ্খার প্রতি আস্থাবান হতে পারে, এমন ভঙ্গীতে কথা বলাই উচিত।
এ নির্দেশগুলোর আলোকে মুসলমান যদি নিজেও অভিযোগের সুযোগ না দেয় এবং সেই সঙ্গে সংশোধনের প্রচেষ্টা চালাতে থাকে আর সমাজ সচেতন থাকে, তাহলে শয়তানের পক্ষে নাক গলানো খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।
১৮. প্রভুর কাছে তাওফিক কামনা
বন্ধুত্ব, ভ্রাতুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক হচ্ছে একটি বুনিয়াদী শর্ত এবং তার অনিবার্য দাবী। নিজের লক্ষ্য যতোটা প্রিয় হবে, এক ভাইয়ের সঙ্গে অন্য ভাইয়ের ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কও ততোটাই গভীর হবে। যখন একজনের দুঃখ-ক্লেশ অপরের দুঃখ-ক্লেশে, একজনের পেরেশানী অপরের পেরেশানীতে এবং একজনের আনন্দ অপরের আনন্দে পরিণত হয়, তখন সম্পর্ক একদিক দিয়ে তার অভীষ্ট মানে উন্নীত হয়ে যায়। আর সেই সঙ্গে যখন রহমত ও শুভাকাঙ্খায় সমন্বয় ঘটে তখন সবদিক থেকেই সম্পর্ক উচ্চতম স্থান লাব করে। বস্তুতঃ এমনি সম্পর্কই একটি জামায়াত ও আন্দোলনের ভেতর সাফল্যের নিশ্চয়তা দান কারী জীবন ও কর্মচেতনার সঞ্চার করতে পারে। এ বিরাট নিয়ামত যেখানে আল্লাহ্ ও রাসূলের (সঃ) নির্দেশিত সকল শর্ত ও প্রক্রিয়া অবলম্বনে অর্জিত হয়, সেখানে আল্লাহর তাওফিকও এর জন্যে প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কারণ, এই হচ্ছে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। কাজেই রাব্বুল আলামীন যাতে এই পবিত্র সম্পর্ককে বিকৃতি ও বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন এবং এর ভেতর বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা উত্তরোত্তর বাড়িয়ে দেন, তার জন্যে বিনীতভাবে তাঁর কাছে মুনাজাত করা উচিত।
ربَّنا اغفرلنا ولاخواننا الَّذ ين سبقون بالايمان ولاتجعل فى قلوبنا غلاًّ للَّذ ين امنوا ربَّنا انَّك رؤف الرَّحيم –
‘হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে এবং আমাদের সেই সব ভাইকে ক্ষমা দান কর, যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে এবং আমাদের দিলে ঈমানদার লোকদের জন্যে কোন হিংসা ও শত্রুতাভাব রেখো না। হে আমাদের প্রভু! তুমি বড়ই অনুগ্রহ সম্পন্ন এবং করুণাময়।’ (সূরা হাশর- ১০)
— সমাপ্ত —