৬.
মু’জিযা ও মি’রাজ
মু’জিযা কথাটির সাধারণ অর্থ কোন অলৌকিক বা অস্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু দ্বীন ইসলামের পরিভাষায় মু’জিযা হচ্ছে এক প্রকারের চূড়ান্ত দলীল। কোন পয়গম্বরের নবুয়্যাত প্রমাণ করার জন্যে আল্লাহ তাআলা চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসাবে বিশ্ববাসীর সামনে এই দলিল কে উপস্থাপন করেন। অবশ্য তার জন্যে শর্ত এই যে, দলিলের বিষয়বস্তুকে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম হতে হবে। দৃষ্টান্ত স্বরুপ বলা যায়ঃ আগুনের কাজ হচ্ছে দাহ করা, কিন্তু এ ক্ষেত্রে দাহ করবে না;সমুদ্রের ধর্ম হচ্ছে প্রবাহিত হওয়া, কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রবাহ থেমে যাবে;বৃক্ষের স্বভাব হচ্ছে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা, কিন্তু এক্ষেত্রে সে চলমান হবে। অনুরুপভাবে মৃত জীবিত হয়ে উঠবে, লাঠি সাপে পরিণত হবে ইত্যাদি। যেহেতু দুনিয়ার প্রত্যেকটি কাজের আসল কারন হচ্ছে আল্লাহর মহিমা এবং তার ইচ্ছা মাত্র, সেহেতু কোন কোন কাজ যেমন নির্ধারিত নিয়মে ক্রমাগত সম্পন্ন হতে থাকে, ঠিক তেমনি কোন কোন কাজ আল্লাহ তাআলার মহিমায় এই স্বাভাবিক নিয়ম থেকে বিচ্যুত হয়ে কোন অস্বাভাবিক নিয়মেও হতে পারে। আর যখন আল্লাহর ইচ্ছা হয়,তখন তা হয়েও থাকে।
আল্লাহ তাআলা অধিকাংশ নবীকেই তাদের নবুয়্যাতের সত্যতা প্রমাণের জন্যে মু’জিযার ক্ষমতা দান করেছিলেন। কিন্তু সে মু’জিযা কাফিরদের ঈমান আনা ও বিশ্বাস পোষণের কারণ হিসাবে খুব কমই কাজ করেছে।আগেই বলা হয়েছে মু’জিযা হচ্ছে এক প্রকারের চূড়ান্ত দলিল।এজন্যে লোকেরা যখন মু’জিযা দেখার পরও নবীকে অস্বীকার করেছে, তখন তাদের ওপর আল্লাহ তাআলা গযব নাযিল করেছেন এবং দুনিয়া থেকে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। মক্কার কুরাইশরাও হযরত (সা)-এর কাছে মু’জিযা দাবি করেছিল। তাদের এই দাবিকে বারবার এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কারণ আল্লাহ তাআলার নিয়মানুযায়ী কোন জনগোষ্ঠী কে তাদের দাবি অনুসারে যদি কোন মুজিযা দেখানো হয়,তাহলে তারপর তাদের সামনে শুধু দুটি পথই খোলা থাকেঃঈমান অথবা ধ্বংস। কুরাইশদেরকে এক্ষুনি ধ্বংস কর দেয়ার ইচ্ছা আল্লাহ তাআলা ছিল না। সে জন্য তাদের দাবিকেও বারবার এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু ইসলামের দাওয়াত পেশ করতে যখন দীর্ঘ দশ-এগারটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল এবং অন্যান্য মুমিনদের মনে মাঝে মাঝে আগ্রহ জাগতে লাগলো:হায়!আল্লাহর তরফ থেকে যদি কোন অলৌকিক লোকদের প্রকাশ পেত, যা দেখে অবিশ্বাসী লোকেরা ঈমান আনতো ইসলামের সত্যতা স্বীকার করতো! কিন্তু তাদের এই আগ্রহের জবাবে বলা হচ্ছিলঃ ‘দেখো, অধৈর্য হয়ো না। যে ধারা ও নিয়মে আমি আন্দোলন পরিচালনা করছি, ঠিক সেভাবে ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে তুমি কাজ করতে থাকো। মুজিয়া দ্বারা কাজ হাসিল করতে চাইলে তা অনেক আগেই সম্পন্ন হয়ে যেত। আমি যদি ইচ্ছা করতাম তো এক একটি কাফিরের অন্তর মোমের মত নরম করে দিতাম এবং তাদেরকে জোরপূর্বক সুপথে চালিত করতাম। কিন্তু এ আমার নীতি নয়। এভাবে না মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতার কোন পরীক্ষা হয়ে থাকে আর না তার চিন্তাধারা ও নৈতিক জীবনে আদর্শ সমাজ গড়ার উপযোগী কোন বিপ্লব আসতে পারে। তথাপি লোকদের বেপরোয়া আচরণ এবং তাদের অবিশ্বাসের ফলে যদি তুমি ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মুকাবেলা করতে না পারো তো তোমার যা ইচ্ছা হয় তা-ই করো। জমিনের মধ্যে ঢুকে অথবা আসমানে উঠে কোন মুজিযা নিয়ে এসো।
কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, হযরত (সা:)-কে কোন মু’জিযায় দান করা হয়নি। তার সবচেয়ে বড় মু’জিযা তো খোদ কুরআন মজীদ। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে তার ব্যক্তিসত্ত্বা থেকে অসংখ্য মু’জিযা প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিতকরণ এবং তার মহাকাশ ভ্রমণ (মিরাজ) অত্যন্ত – গুরুত্বপূর্ণ। এতৎভিন্ন বহুতর ভবিষ্যৎ বাণীর সফল হওয়া, তার দু’আর ফলে পানি বর্ষিত হওয়া, লোকদের সুপথপ্রাপ্ত হওয়া, প্রয়োজনের সময় অল্প জিনিস বৃদ্ধি পাওয়া, রুগ্ন ব্যক্তির আরোগ্য লাভ করা, পানি প্রবাহিত হওয়া ইত্যাকার অসংখ্য মু’জিযা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে।
চন্দ্র দ্বিখন্ডিতকরণ
মক্কার কাফিরদের সামনে প্রমাণ পেশ করার জন্যে হযরত(সা:)-কে যে সব মু’জিযা দেখাতে হয়, তন্মধ্যে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত করণের ঘটনাটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা:) এই ঘটনাটি বিবৃত করেছেন এবং সহীহ বুখারী, মুসলিম প্রভৃতি হাদিস গ্রন্থে তা উল্লেখিত হয়েছে। তিনি এ ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন এবং স্বচক্ষে চাঁদকে দু’টুকরা হতে দেখেছেন। তিনি বলেনঃ আমরা হযরত(সা:)- এর সঙ্গে মিনায় ছিলাম, ঠিক এমনি সময় দেখলাম চন্দ্রটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল এবং তার একটি খন্ড পাহাড়ের দিকে চলে গেল। হযরত(সা:) বললেন: ‘সাক্ষী থেকো।’ কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, মু’জিযা দেখার পরই কাফিররা ঈমান আনবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই; বরং কার্যত দেখা যায় যে সব লোকের মন অবিশ্বাস ও হঠকারিতায় পরিপূর্ণ,কেবল তারাই মু’জিযা দাবি করে। এভাবেই তারা নিজেদের অবিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকার জন্যে বাহানা তালাশ করে থাকে। নচেত যাদের অন্তরে ঈমান কবুল করার মত যোগ্যতা থাকে এবং যারা পার্থিব স্বার্থের জালেও জড়িত নয়, তাদের কাছে তো হযরত (সা:) এর মহান চরিত্র এবং তার শিক্ষাগুলোই সবচেয়ে বড়ো মু’জিযা। আর এই শ্রেণীর লোকেরাই যে সত্য ধর্ম গ্রহণে হামেশা অগ্রবর্তী হয়ে থাকে, তা বলাই বাহুল্য। তাই চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হবার পরও কাফিররা বলতে পারলো; ‘ওহো, এটা তো একটা জাদুর সাহায্যে চিরদিনই এরকম হয়ে আসছে।’ এভাবে তারা সুপথ প্রাপ্তির এক দুর্লভ সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হলো। অবশ্য এমনি সুস্পষ্ট নিদর্শনের পরও তারা আল্লাহর রাসূলকে মিথ্যা মনে করায় তাদের ব্যাধির তালিকায় আরো একটি গুরুতর ব্যাধি সংযোজিত হলো।
মি’রাজ
মি’রাজ অর্থ ঊর্ধে আরোহণ করা। যেহেতু হযরত (সা:) তার এক মহাকাশ ভ্রমণ সম্পর্কে এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন, এজন্যে তার এই ভ্রমণ কে মি’রাজ বলা হয়। এর অপর নাম হচ্ছে ইসরা অর্থাৎ রাতের পর রাত ভ্রমণ করা। এ ভ্রমণ যেহেতু রাতের পর রাত অব্যাহত ছিল, সে জন্যে একে ইসরাও বলা হয়। কুরআন পাকে এই শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছে।
আল্লাহর নবীদেরকে দাওয়াত, তাবলীগ, ও ইকামতের দ্বীনের যে বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিতে হয়, সে জন্যে অত্যন্ত উচু দরের ঈমান ও সুদৃঢ় বিশ্বাসের প্রয়োজন। এ কারণেই তারা যে অদৃশ্য সত্যের প্রতি ঈমান আনার জন্যে আহবান জানিয়ে থাকেন, তা অন্তত তাদের নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করা দরকার। কারণ তাদেরকে সারা দুনিয়ার সামনে এ কথা দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করতে হয় যে, তোমরা শুধু আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে একটা জিনিসকে অস্বীকার করছো; অথচ আমরা নিজ চোখে দেখা সত্যকেই বিবৃত করছি। তোমাদের কাছে আছে শুধু আন্দাজ-অনুমান, আমাদের কাছে আছে ইলম ও জ্ঞান।এজন্যে অধিকাংশ নবীর কাছেই ফেরেশতা আত্মপ্রকাশ করেছে, তাদেরকে আসমান ও জমিনের বিশাল রাজত্ব প্রত্যক্ষ করানো হয়েছে, স্বচক্ষে বেহেশত ও দোযখ দেখানো হয়েছে এবং এ জীবনেই মৃত্যুর পরবর্তী অবস্হা সম্পর্কে অবহিত করানো হয়েছে মি’রাজ বা ইসরা এ ধরণেরই একটা ঘটনা মাত্র।এতে একজন মুমিনকে যে সব অদৃশ্য সত্যের প্রতি ঈমান আনতে হয়, হযরত (সা:)-কে তা স্বচক্ষে দেখানো হয়েছে।
মিরাজের ঘটনা কোন তারিখে ঘটেছিল, এ সম্পর্কে হাদিসে বিভিন্ন রুপ বর্ণনা পাওয়া যায়। অবশ্য সমস্ত বর্ণনা সামনে রেখে ঐতিহাসিকগণ এ তথ্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন যে, এ ঘটনা হিজরতের প্রায় বছর দেড়েক আগে ঘটেছিল। এ সম্পর্কে বুখারী এবং মুসলিমের বর্ণনা সামনে রাখলে যে মোটামুটি বিবরণ পাওয়া যায়, তা নিম্নরূপঃ একদিন সকাল বেলা হযরত (সা:) প্রকাশ করেনঃ‘গত রাতে আমার প্রভু আমায় অত্যন্ত সম্মানিত করেন। আমি শুয়ে বিশ্রাম করছিলাম, এমন সময় জিবরাঈল এসে আমাকে জাগিয়ে কা’বা মসজিদে নিয়ে যান। সেখানে তিনি আমার বক্ষ বিদীর্ণ করেন এবং তা জমজমের পানি দ্বারা ধুয়ে ফেলেন অত:পর তাকে ঈমান ও হিকমত দ্বারা পূর্ণ করে বিদীর্ণ স্থান পূর্বের ন্যায় জুড়ে দেন। এরপর তিনি আমার আরোহণের জন্যে খচ্চরের চেয়ে কিছু ছোট একটি সাদা জানোয়ার উপস্থিত করেন। তার নাম ছিল বুরাক। এটি অত্যন্ত দ্রুতগতি সম্পন্ন জানোয়ার ছিল। আমি তার ওপর আরোহণ করতেই বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়ে উপনীত হলাম। এখানে বুরাকটি মসজিদে আকসার দরজার সাথে বেঁধে রেখে আমি মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকায়াত নামাজ পড়লাম। এই সময় জিবরাঈল আমার সামনে দুটি পেয়ালা উপস্থিত করলেন। তার একটিতে শরাব এবং অপরটিতে দুধ ছিল। আমি দুধের পেয়ালাটি গ্রহণ করে শরাবেরটি ফেরত দিলাম। এটা দেখে জিবরাঈল বললেনঃ‘আপনি দুধের পেয়ালাটি গ্রহণ করে স্বভাব ধর্মকেই (দ্বীনে ফিতরাত) অবলম্বন করেছেন। ‘এর পর মহাকাশ ভ্রমণ শুরু হল। আমরা যখন প্রথম আকাশ পর্যন্ত পৌঁছলাম, তখন জিবরাঈল পাহারাদার ফেরেশতা কে দরজা খুলে দিতে বললেন। সে জিজ্ঞেস করলো, তোমার সাথে কে আছেন?’ জিবরাঈল বললেন,‘মুহাম্মদ। ফেরেশতা আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘একে কি ডাকা হয়েছে?’ জিবরাঈল বললেন, ‘হ্যাঁ ডাকা হয়েছে।’ একথা শুনে ফেরেশতা দরজা খুলতে খুলতে বললো, ‘এমন ব্যক্তিত্বের আগমন মুবারক হোক।’ আমরা ভেতরে ঢুকতেই হযরত আদম(আ:)-এর সঙ্গে সাক্ষাত হলো। জিবরাঈল আমায় বললেন, ‘ইনি আপনার পিতা আদম। আপনি একে সালাম করুন। আমি সালাম করলাম। তিনি সালামের জবাবদান প্রসঙ্গে বললেন, ‘ খোশ আমদেদ! হে নেক পুত্র, হে সত্য নবী! এর পর আমরা দ্বিতীয় আকাশে পৌঁছলাম এবং প্রথম আকাশের ন্যায় সওয়াল -জওয়াবের পর দরজা খুলে দেওয়া হলো। আমরা ভেতরে গেলাম হযরত ইয়াহইয়া ও হযরত ঈসা(আ:)- এর সঙ্গে সাক্ষাত হলো। জিবরাঈল তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খোশ আমদেদ, হে নেক ভ্রাতা, হে সত্য নবী! অত:পর আমরা তৃতীয় আকাশে পৌঁছলাম। এখানে হযরত ইউসুফ (আ:) এর সঙ্গে দেখা হলো। আগের মতই তার সঙ্গে সালাম কালাম হলো। অনুরুপভাবে চতুর্থ আকাশে হযরত ইদরীস (আ:) এর সঙ্গে, পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন (আ:) এর সঙ্গে এবং ষষ্ঠ আকাশে হযরত মূসা(আ:) এর সঙ্গে সাক্ষাত হলো। সর্বশেষ সপ্তম আকাশে হযরত ইবরাহীম (আ:) এর সঙ্গে সাক্ষাত হলো এবং তিনিও সালামের জবাব দান প্রসঙ্গে বললেন,‘খোশ আমদেদ! হে নেক পুত্র,হে নেক নবী! এরপর আমাকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ নামক একটি সমুন্নত বরই গাছ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়া হলো। এর ওপর অগনিত ফেরেশতা জোনাকির মতো ঝিকমিক করছিল।
এখানে হযরত (সা:) অনেক গোপন রহস্য প্রত্যক্ষ করলেন। তিনি আল্লাহ তাআলার সঙ্গেও কথাবার্তা বললেন। এ সময় আল্লাহ তাআলা তার উম্মতের জন্যে মোট পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরয করে দিলেন। এ সব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পর তিনি যখন প্রত্যাবর্তন করছিলেন, তখন আবার হযরত মূসা(আ)এর সঙ্গে সাক্ষাত হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ‘বলুন খোদার দরবার থেকে কি উপহার নিয়ে যাচ্ছেন?’ হযরত (সা:) বললেন, ‘দিন-রাত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ?’ মূসা(আ:) বললেন, ‘আপনার উম্মত এত বড় বোঝা বহন করতে পারবে না; কাজেই আপনি ফিরে যান এবং এটা কম করে আনুন।’ হযরত (সা:) আবার ফিরে গেলেন এবং নামাজের ওয়াক্ত কমানোর জন্যে আবেদন জানালেন। ফলে ওয়াক্তের সংখ্যা কিছুটা কমিয়ে দেয়া হলো।কিন্তু মূসা(আ:) হযরত (সা:) কে বারবার পাঠালেন এবং প্রত্যেক বারই সংখ্যা কমতে লাগলো। অবশেষে কমতে কমতে সংখ্যা মাত্র পাঁচটি রয়ে গেল। এতেও হযরত মূসা(আ:) নিশ্চিত হলেন না, বরং তিনি আরো কম করানোর কথা বললেন। কিন্তু হযরত (সা:) বললেন:‘আমার আর কিছু বলতে লজ্জা করছে।’ এ সময় আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে এই মর্মে ঘোষণা এলো:যদিও আমি নামাজের সংখ্যা পঞ্চাশ থেকে পাঁচ করে দিয়েছি তবুও তোমার উম্মতের মধ্যে যারা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে, তাদেরকে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজেরই পুরস্কার দান করা হবে।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়া এই উপলক্ষে আল্লাহর নিকট থেকে আরও দুটি উপহার পাওয়া গেল। একটি হচ্ছে সূরা বাকারার শেষ আয়াত সমষ্টি, যাতে ইসলামের মৌল আকিদাগুলো এবং ঈমানের পূর্ণতার বিষয় বিবৃত করার পর এই মর্মে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, মুসিবতের দিন এখন সমাপ্ত প্রায়। দ্বিতীয় হচ্ছে এই সুসংবাদ যে, উম্মতে মুহাম্মদীর যারা অন্তত শিরক থেকে বেঁচে থাকবে, তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে।’এই ভ্রমণকালে হযরত (সা:) স্বচক্ষে বেহেশত এবং দোযখও পরিদর্শন করেন। মৃত্যুর পর আপন কৃত কর্মের দৃষ্টিতে মানুষকে যে সমস্ত পর্যায় অতিক্রম করতে হয়, তার কয়েকটি দৃশ্যও তার সামনে উপস্থাপন করা হয়।
মহাকাশ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি আবার বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়ে দেখেন যে, অন্যান্য নবীগণ সেখানে সমবেত হয়েছেন। তিনি নামাজ পড়লেন এবং সবাই তার পেছনে নামাজ আদায় করলেন। এরপর তিনি নিজের জায়গায় ফিরে আসেন এবং ভোর বেলা সেখান থেকে সজাগ হন।
মি’রাজের গুরুত্ব ভবিষ্যতের জন্যে ইঙ্গিত
সকাল বেলা হযরত (স) মহাকাশ ভ্রমণের এই ঘটনার কথা জনসমক্ষে বিবৃত করলেন। বিরুদ্ধবাদী কাফের কুরাইশরা তাকে মিথ্যাবাদী (নাউযুবিল্লাহ) বলে অভিহিত করলো। পক্ষান্তরে যাদের হৃদয়ে তার সত্যতা ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে আস্থা ছিল, তারা এর প্রতিটি হরফকেই সত্য বলে মেনে নিল। তারা বললোঃ হযরত যখন নিজেই এ ঘটনার কথা বলেছেন,তখন এর সবটাই সত্য।’ এভাবে মিরাজের ঘটনা একদিকে ছিল ঈমান ও নবুয়্যাত স্বীকারের পরীক্ষাস্বরুপ, অন্যদিকে ছিল খোদ হযরত (সা:) এর পক্ষে অসংখ্য গায়েবী রহস্য প্রত্যক্ষ করার উপায়। সেই সঙ্গে এ ছিল সেই অনাগত বিপ্লবের প্রতিও এক সুস্পষ্ট ইঙ্গিত যা ইসলামী আন্দোলনকে অনতিকালের মধ্যেই সংঘটিত করতে হয়েছিল। এই ইঙ্গিতের বিস্তৃত বিবরণ কুরআন পাকের সূরা বনী ইসরাঈলে (মি’রাজ সম্পর্কিত আলোচনায়) বিবৃত হয়েছে। এই সূরার বিষয়বস্ততে যেসব সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে, তা নিম্নরুপঃ
নেতৃত্ব থেকে ইহুদীদের অপসারণ
বনী ইসরাঈল গণ এই পর্যন্ত আল্লাহর দ্বীনের উত্তরাধিকার আল্লাহর বাণীর সাথে বিশ্ববাসীকে পরিচিত করানোর মহান দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু তারা এ খেদমত আঞ্জাম দেয়া তো দূরের কথা, বরং নিজেরাই অসংখ্য প্রকার পাপাচারে লিপ্ত হয়ে আল্লাহর দ্বীনের খেদমত করার অযোগ্য হয়ে পড়েছিল। সুতরাং এ খেদমতের দায়িত্ব এবার বনী ইসমাঈলের ওপর ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো এবং হযরত (সা:)- কে এই খান্দানের মধ্যেই প্রেরণ করা হলো। ইতঃপূর্বে বনী ইসরাঈলকে সরাসরি উদ্দেশ্য করে কিছু বলা হয় নি; কিন্তু এবার সূরা বনী ইসরাঈলে তাদের কে বলে দেয়া হলো যে, এ পর্যন্ত তোমরা যা ভুলভ্রান্তি করেছো তাতো করেছোই। এর আগে তোমাদেরকে দু’ দুবার যাচাই করা হয়েছে; কিন্তু তোমরা আপন দোষ-ত্রুটি সংশোধন করোনি। এবার বনী ইসমাঈলের এই নবীকে পাঠানোর পর তোমাদেরকে শেষ বারের মতো সুযোগ দেয়া হচ্ছে। যদি তোমরা এর আনুগত্য করো, আবার তোমরা উন্নতির পথে চলতে পারবে।
বস্তত মক্কার চরম উৎপীড়ন ও পেরেশানীময় জীবনে এই ইঙ্গিত ছিল একটি মস্তবড় সুসংবাদ, যা পরবর্তীকালে হুবহু সত্য প্রমাণিত হয়েছিল।
মক্কার কাফিরদের প্রতি সতর্কবাণী
মক্কার কাফিরদের জুলুম-পীড়ন এবং হঠকারিতা ইতোমধ্যে চরমে পৌঁছেছিল। তারা বারবার চ্যালেঞ্জ দিতে লাগলোঃ ‘মুহাম্মদ যদি আল্লাহর রাসূলই হবে তাহলে আমাদের অবিশ্বাসের কারণে আমাদের ওপর কেন আযাব নাযিল হয় না? তাহলে তো সে আমাদেরকে ভয় দেখাতে পারতো।’ এর জবাবে তাদেরকে বলা হলোঃ ‘আল্লাহ তাআলার শাশ্বত নীতি এই যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন জাতির মধ্যে আল্লাহর রাসূল আসেন, ততক্ষণ তার ওপর কোন আযাব নাযিল হয় না। যখন রাসূল আগমন করেন, তখন জাতির বিত্তবান ও প্রভাবশালী লোকেরা তার সত্য প্রচারের পথ রোধ করার জন্যে কোমর বেঁধে লেগে যায়। অন্যদিকে সাধারণ ও নির্যাতিত লোকেরা তার সহযোগিতা করার জন্যে এগিয়ে আসে। অবশ্য প্রথমোক্তদের মধ্যে সত্যকে গ্রহণ করার জন্যে যোগ্যতাসম্পন্ন কিছু লোকও বর্তমান থাকে এবং তারা এগিয়ে এসে সত্যকে গ্রহণও করে। এরপর এই দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায় এবং পরিণামে মজলুমের জন্যে আল্লাহর সাহায্য আসে।এই সাহায্যের একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। কিন্তু মানুষ স্বভাবতই তাড়াহুড়া প্রবণ বলে কখনো কখনো সে অকল্যাণকর জিনিসকেও ভালো মনে করে দাবি করতে থাকে। তার এটা খেয়ালই হয় না যে,আল্লাহ তাআলার প্রত্যেকটি কাজই তার নিজস্ব সময়ের জন্য নির্ধারিত। দিন-রাতের আবর্তনের বিষয়টির প্রতিই লক্ষ করো:এর ভেতর আল্লাহ তা’আলার কতবড় নিদর্শন রয়েছে এবং একটি বাঁধা-ধরা নিয়ম অনুযায়ী কিরুপ একের পর এক দিন-রাত ঘুরে আসছে। অতীত ইতিহাস লক্ষ করে দেখো নূহ(আ:) এর পর থেকে এ পর্যন্ত কত জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।বস্তত আল্লাহ তার বান্দাদের অবস্থা পুরাপুরি অবগত রয়েছেন।তিনি প্রত্যেকের কৃত কর্ম অনুযায়ী প্রতিফল দিয়ে থাকেন। সুতরাং মক্কার কাফিরদেরও জানা উচিত যে, তারা প্রথম আল্লাহর রাসূলের দাওয়াতের মুকাবেলায় যে ভূমিকা গ্রহণ করবে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই তাদের সঙ্গে ব্যবহার করা হবে। আর চূড়ান্ত ফয়সালার সময় এখন খুবই নিকটবর্তী।
ইসলামী সমাজের বুনিয়াদ
এবার মুসলমানদের জীবন থেকে দুঃখ-রজনীর অবসান ঘটার এবং ইসলামী নীতির ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ একটি সমাজ গঠিত হবার সময় ঘনিয়ে এলো। মি’রাজের ঘটনা থেকে এই ইসলামী সমাজের বুনিয়াদী নীতিসমূহও উপহার পাওয়া গেল। যে নীতিসমূহ ভবিষ্যতে ইসলামী জীবন পদ্ধতির জন্যে নির্দেশক নীতিমালা হিসেবে কাজ করবে, তার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে:
১.আল্লাহর সাথে আর কাউকে প্রভু ও মাবুদ বানানো যাবেনা। ইবাদত-বন্দেগী, আনুগত্য ও আজ্ঞানুবর্তিতাও তার সাথে কাউকে শরীক করা চলবে না।
২.পিতামাতা কে সম্মান এবং তাদের আনুগত্য করে চলতে হবে। কোথাও তাদের আনুগত্য খোদার আনুগত্যের প্রতিকূল হলে সেখানে তাদের আনুগত্য বর্জন করতে হবে।
৩.আত্মীয়-কুটুম্ব,মিসকীন ও মুসাফিরদের হক আদায় করতে হবে। সমাজের নাগরিকদের পরস্পরের ওপর যে অধিকার রয়েছে, তার প্রতি উপেক্ষা বা ঔদাসিন্য দেখানো যাবে না। সমস্ত অধিকার সঠিক ভাবে আদায় করতে হবে। নচেত কোন সামাজিক ব্যবস্থা শোধরানো যেতে পারে না।
৪. অপব্যয় ও অপচয় করা যাবে না;কেননা খোদার দেয়া সম্পদকে অনর্থক ব্যয় করা শয়তানের কাজ যে সমাজের লোকেরা নির্বিচারে অর্থ ব্যয় করে অর্থের মায়ায় সম্পূর্ণরুপে হাত গুটিয়ে বসে,তা কখনো সুস্থ বা সমৃদ্ধ হতে পারে না। অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে হবে।
৫.দারিদ্র্য ও অনটনের ভয়ে সন্তান হত্যা করো না; কেননা জীবিকার ব্যবস্থা করা খোদার কাজ এবং তিনি তার ইন্তেজাম করেই থাকেন। কাজেই খাদ্যাভাবের আশংকায় ভবিষ্যত বংশধরদের ধ্বংস করো না। এটা অত্যন্ত গুনাহর কাজ এবং সামাজিক আত্মহত্যার নামান্তর।
৬.ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। এই নোংরা কাজটি থেকে শুধু বেঁচে থাকাই নয়, বরং এই ঘৃন্য কাজে উৎসাহজনক প্রত্যেকটি তৎপরতায় খতম করে দাও। যে সমাজ এই লা’নত থেকে মুক্ত না হবে, সে নিজেই নিজের মূলোচ্ছেদ করবে এবং শীগগীরই ধ্বংসের মুখে নিক্ষিপ্ত হবে।
৭.অন্যায় ভাবে কাউকে হত্যা করো না। যে সমাজে লোকদের জীবন-প্রাণ নিরাপদ নয়, তা কখনো সমৃদ্ধ হতে পারে না। শান্তিপূর্ণ অবস্থা ছাড়া কোন সমাজেরই উন্নতি লাভ করা সম্ভব নয়। কাজেই সর্বপ্রথম জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা আবশ্যক।
৮.ইয়াতিমের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। অক্ষম, দুর্বল, অসহায় লোকদের সাহায্য করো। যে সমাজে দুর্বল ও অক্ষম লোকদের অধিকার সংরক্ষণ না করা হবে, তা কখনো প্রগতি অর্জন করতে পারবে না।
৯.আপন অঙ্গীকার পূর্ণ করো। কারণ অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। অঙ্গীকার বলতে লোকদের পারস্পরিক চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি যেমন বুঝায়, তেমনি ঈমান আনার সময় খোদার সাথে মুমিন বান্দাহর কৃত ওয়াদাকে বুঝায়।
১০. ওজন ও মাপ-জোখের সময় দাঁড়িপাল্লা ও মাপকাঠি ঠিক রেখো। লেন-দেনের ব্যাপারে সততা ও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখা এবং পরের অধিকার সংরক্ষণ করা সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্যে অতীব প্রয়োজন।যেখানে লোকদের পরস্পরের প্রতি আস্থা না থাকবে এবং সাধারণভাবে লোকেরা পরের হক মেরে খাবার ফিকিরে থাকবে, সেখানে কোন সুস্থ সামাজিক পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে না।
১১.যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তার পিছনে ছু্টো না। অজানা ও অজ্ঞাত বিষয়ের পেছনে ছুটা এবং আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলেই লোকদের পারস্পরিক অবনতি ঘটে। কাজেই এই সব দোষ-ত্রুটি থেকে প্রত্যেকটি উত্তম সমাজেরই মুক্ত হওয়া উচিত। লোকদের জেনে রাখা দরকার যে,তাদের কান, চোখ এবং মন সম্পর্কেই সবচেয়ে বেশি জিজ্ঞাসা করা হবে।
১২.জমিনের ওপর অহংকারের সাথে চলো না; কেননা গর্ব ও অহংকার মানুষকে নিকৃষ্ট চরিত্রের দিকে ঠেলে দেয়।এই দোষের ফলেই মানুষ সমাজের পক্ষে অনিষ্ঠের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই নিজের মুকাবেলায় অন্য কাউকে হেয় মনে না করা এবং কারো সঙ্গে অমানুষিক আচরণ না করা পারস্পরিক সম্পর্কের সুস্থতা বিধানের জন্যে একান্ত অপরিহার্য।
হিজরতের জন্য ইঙ্গিত
আল্লাহ তাআলা যখন কোন জাতির মধ্যে তার রাসূল প্রেরণ করেন, তখন সেই জাতির লোকেরা যাতে সেই রাসূলের দাওয়াত শুনতে,বুঝতে এবং গ্রহণ করতে পারে, তজ্জন্যে তিনি কিছুকাল সুযোগ প্রদান করেন। এই সুযোগের ফলে কিছু লোক তো আপনাতেই সেই দাওয়াত কবুল করে নেয়।, কিন্তু বেশির ভাগ লোকই পার্থিব স্বার্থ, বাপ-দাদার অন্ধ অনুসৃতি ও প্রবৃত্তির গোলামীতে লিপ্ত থাকে বলে সেই দাওয়াত কে বর্জন করে এবং তার বিরোধিতায় কোমর বেঁধে লেগে যায়। অবশেষে এমন এক সময় আসে, যখন স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, জাতির মধ্যেকার যোগ্য লোকেরা আন্দোলনকে কবুল করে নিয়েছে; এখন আর এ আন্দোলনের প্রতি কর্ণপাত করতে এ সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করতে আগ্রহী কোন লোক বাকী নেই।
বস্তত এমনই পর্যায়ে এসেই জাতির লোকেরা নবীর কাছে মু’জিযা দাবি করে বসে এবং প্রায়শই সে জাতির সামনে মু’জিযা উপস্থাপন করা হয়। তাই এ পর্যায়ে এসে হযরত(সা:) এর কাছেও মু’জিযা দাবি করা হলো এবং তিনি বিভিন্ন রূপ মু’জিযা প্রদর্শনও করলেন। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও যখন অবিশ্বাসীরা তাদের অবিশ্বাসের ওপর অটল হয়ে রইলো, তখন স্থির করা হলো যে, এখন এ জাতির মধ্যে থেকে এ নবীর চলে যাওয়াই উচিত। কেননা এখন যেকোন মুহূর্তে এদের ওপর আযাব আসতে পারে। এই আযাব কখনো আসমান বা জমিনের কোন প্রাকৃতিক শক্তির মাধ্যমে আসে আবার তা কখনো মুমিনের দ্বারাও সংঘটিত হয়। তাই আল্লাহ তাআলা এই সূরা বনী ঈসরাইলেই তার এ নিয়মের কথা উল্লেখ করে নবীকে সুস্পষ্ট ভাষাই বলেন যে,‘এই লোকগুলো হঠকারিতার চরমে পৌঁছে খুব শিগগিরই তোমাকে এই জনপদ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করবে।যদি তা-ই হয়, তাহলে তোমার বিদায়ের পর এরা এখানে নিশ্চিত থাকতে পারবে না। তোমার পূর্বে আমি যতো রাসূল পাঠিয়েছি, সবার ক্ষেত্রেই এ নিয়ম চলে এসেছে। আর এখনো এতে কোন পরিবর্তন সূচিত হবে না।’
তাহাজ্জদ নামাজের গুরুত্ব
এই সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতি মুকাবেলায় আত্মিক প্রস্ততি গ্রহণের জন্যে ফরজ নামাজ ছাড়াও তাহাজ্জদ নামাজের আয়োজন করার নির্দেশ দেয়া হলো। এ ছাড়াও হিজরতের জন্যে নবীকে নিম্নোক্ত দো’আ শিখিয়ে দেয়া হলোঃ‘হে প্রভু আমাকে ভালো জায়গা চিনে নেবার তওফীক দিও এবং এখান থেকে সহি-সালামতে বের করে নিও আর নিজের তরফ থেকে সাহায্য পাঠিয়ে দুশমনদের ওপর বিজয় দান করো।’ অতঃপর এই সুসংবাদও প্রদান করা হলো যে, সত্যের বিজয় এবং মিথ্যার পতন অবশ্যম্ভাবী; কারণ পতনের জন্যেই মিথ্যার উত্থান। এর জন্যে শুধু শর্ত এই যে, সত্যকে ময়দানে উপস্থিত থাকতে হবে।
এরপর হঠকারিতার বশবর্তী হয়ে মক্কার কাফিররা যে সব প্রশ্ন ও আপত্তি উত্থাপন করেছিল, তারও জবাব দেয়া হলো। এভাবে যুক্তি-প্রমাণ কানায় কানায় পূর্ণ করে দেয়ার পর শিক্ষণীয় বিষয়ে হিসেবে হযরত মূসা(আ:)- এর ঘটনাবলীর উল্লেখ করা হলো।
এ যুগের আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
এ পর্যায়ে কুরআনের যেসব অংশ নাযিল হচ্ছিলো, সমকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপঃ
১. আল্লাহর ওপর নির্ভরতা
মানুষের প্রকৃতি এই যে, যখন সে কোনো কাজের জন্যে চেষ্টা-সাধনা করে এবং তার আশানুরূপ ফলাফল লাভে ব্যর্থ হয়, তখন তার ওপর একটা নৈরাশ্যের অন্ধকার নেমে আসতে থাকে। সত্যের আন্দোলনের নিশানবাহীদের জন্যে এই পর্যায়টিই সবচেয়ে বেশি কঠিন হয়ে থাকে। খোদা না করুন,তারা যদি এরূপ নৈরাশ্যের শিকারে পরিণত হয়,তাহলে তাদের এবং গোটা আন্দোলনের পক্ষে তা এক বিরাট ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই এমনি পর্যায়ে সঠিক পথে থাকা এবং ফলাফলকে সম্পূর্ণ খোদার ওপর ছেড়ে দিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য অত্যন্ত মজবুত ঈমানের প্রয়োজন। তাই এই কঠিন পর্যায়ে আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে এ সম্বন্ধেই পথনির্দেশ নাযিল করেন। দীর্ঘ বারো বছরের নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা সাধনার যে ফলাফল সামনে ছিল, তা একজন সাধারণ লোকের পক্ষে ছিল নিরুৎসাহ ব্যঞ্জক। তাছাড়া এত দীর্ঘদিন পরেও মুমিনদের যে সব উৎপীড়নের সম্মুখীন হতে হচ্ছিল, তাও নেহাত কম তিতিক্ষার ব্যাপার ছিল না। এ জন্যে মুমিনদের হৃদয় কে মজবুত করা এবং তাদেরকে সঠিক পথে চালিত করার জন্যে এ পর্যায়ে বিশেষভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো।
এ ব্যাপারে সূরা আনকাবুতের প্রতিপাদ্য বিষয় একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। এতে মুমিনদের সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দেওয়া হলো যে, তোমরা যে পথে চলবার সিদ্ধান্ত নিয়েছো, যাচাই-পরীক্ষা হচ্ছে সে পথের অপরিহার্য মঞ্জিল। এই নিরিখ দ্বারা যাচাই করেই ঈমানের প্রশ্নে সত্যবাদী আর মিথ্যাবাদীদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা হয়। কিন্তু মুমিনদের এই যাচাই-পরীক্ষা করার অর্থ এই নয় যে, কাফিররা প্রকৃতপক্ষে প্রাধান্য লাভ করেছে, বরং তাদেরও জেনে নেয়া উচিত যে, খোদার মুকাবেলায় তারা কখনোই বিজয়ের গৌরবে গৌরবান্বিত হতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত সত্যের আওয়াজ বুলন্দ হবেই। এ জন্যে শুধু শর্ত এই যে, সত্যের অগ্রসেনাদেরকে ধৈর্য ও সহিঞ্চুতার দ্বারা আল্লাহর সাহায্যের যোগ্য প্রতিপন্ন হতে হবে। এ প্রসঙ্গে মুমিনদেরকে আরো বলা হলো:এ পথে তো স্বভাবতই বাধা-বিপত্তি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা এসে থাকে,কিন্তু তাদের কিছুতেই নিরাশ হওয়া উচিত নয়। এর আগেও আল্লাহর যে সমস্ত বান্দাহ ইসলামের আওয়াজ বুলন্দ করেছেন, তাদেরকেও এমনি অবস্থাই অতিক্রম করতে হয়েছে। হযরত নূহ (আ:)-এর কথা উল্লেখ করে বলা হলো যে, তিনি দীর্ঘ সাড়ে ন’শ বছর পর্যন্ত কতো ধৈর্য ও সহিঞ্চুতার সাথে আপন জাতির বিরোধিতা সহ্য করেছেন। অনুরূপভাবে হযরত ইবরাহীম (আ:), হযরত লূত(আ:), হযরত শুআইব(আ:), হযরত সালেহ(আ:) প্রমুখকেও এমনি পরিস্থিতিরই মুকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যেরই বিজয় হয়েছে এবং মিথ্যাকে ময়দান ছেড়ে পালাতে হয়েছে।
এর আগে বলা হয়েছে যে, কাফিরদের মুজিযা দাবির ফলে হযরত(সা:) এবং অন্যান্য মুমিনদের হৃদয়ে কখনো কখনো এই মর্মে আগ্রহ জাগতোঃ হায়! এমন কোন মুজিযা যদি প্রকাশ পেত, যা দেখে এই লোকগুলো ঈমান আনতো।এই আগ্রহের জবাবে আল্লাহ তাআলা যে পথনির্দেশ পাঠিয়েছেন, তাও ইতঃপূর্বে আলোচিত হয়েছে। এই উপলক্ষে আল্লাহ তাআলা তার সর্বশেষ নবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মু’জিযার প্রতি লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, তোমরা তো মুজিযা দাবি করছো; কিন্তু তার পূর্বে যে মুজিযা দুনিয়ার শেষ পর্যন্ত মানব জাতির জন্যে এক স্থায়ী নিদর্শন রূপে বিরাজ করবে এবং যাতে রয়েছে প্রতিটি জ্ঞানী ও সমঝদার মানুষের জন্যে নির্ভুল পথনির্দেশ,সেই কুরআন মজীদের ওপর সর্বপ্রথম তোমাদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করা উচিত।
এই পর্যায়ে অবতীর্ণ সূরা আনকাবুতে বলা হয়েছেঃ ‘নবুয়্যাতের আগে হযরত(সা:) যে কোন প্রকার পুথিগত জ্ঞান অর্জন করেন নি এবং কোনরুপ লেখাপড়া পর্যন্ত শেখেন নি, তা ঐ বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে কে না জানে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার পেশকৃত কালাম এত উন্নত এবং জ্ঞানগর্ভ যে একজন উম্মী লোক যে এমন অপূর্ব কালাম পেশ করতে পারে, তাদের বড়ো বড়ো আলেমরা পর্যন্ত তার কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে না। এতৎসত্ত্বেও এই লোকগুলো অবিরত মু’জিযা দাবি করে চলেছে। এদেরকে বলে দিন,মু’জিযা প্রকাশ পাওয়া বা না পাওয়া তো আমার প্রভুর ইচ্ছাধীন বিষয়। আমি শুধু তোমাদের পরিণতি সম্পর্কে ভয় প্রদর্শনকারী মাত্র। অবশ্য আমি তোমাদেরকে যে আল্লাহর বাণী শুনাই,তা আমার নবুয়্যাতের দাবি প্রমাণের জন্যে যথেষ্ঠ কিনা তা তোমাদের একটু ভেবে দেখা দরকার। তোমরা একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে যে, যে সব লোকের ভেতর হৃদয়কে ঈমানের সম্পদে সমৃদ্ধ করার মতো প্রয়োজনীয় যোগ্যতা রয়েছে, এ বাণীসমূহ কেবল তাদেরই জন্যে রহমত ও নসিহত স্বরুপ।
২. কুরআন শ্রেষ্ঠ মু’জিযা
বস্তুত হযরত(সা:)- কে যতো মু’জিযাই দান করা হয়েছে তন্মধ্যে করআন নিসন্দেহে শ্রেষ্ঠ মু’জিযা।
হযরত(সা:)- নিজেও কুরআন পাককে তার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মু’জিযা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ ‘প্রত্যেক পয়গম্বরকেই আল্লাহ তাআলা প্রচুর মু’জিযা দান করেছেন তা দেখেই লোকেরা ঈমান এনেছে। কিন্তু আমাকে যে মু’জিযা দান করা হয়েছে, তা হচ্ছে আমার প্রতি অবতীর্ণ ওহী(কুরআন) এজন্যে আমি প্রত্যাশা করি, কিয়ামতের দিন আমার আনুগত্যের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি হবে। বস্তত কুরআন হচ্ছে এক স্থায়ী মু’জিযা এবং অন্যান্য মুজিযা হচ্ছে সাময়িক। সেসব মু’জিযা বিলীন হয়ে গেছে; কিন্তু এ মু’জিযা কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষয় হয়ে থাকবে এবং লোকদেরকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে থাকবে। কুরআন পাকের ছন্দোময় ভাষা,এর মাধুর্য ও লালিত্য এতে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি বহির্ভত অদৃশ্য খবরাখবর ও ভবিষ্যত বাণীর উল্লেখ,এর অপূর্ব প্রভাব বিস্তারকারী ক্ষমতা, এর বিধি-বিধান ও শিক্ষাসমূহের অতুলনীয় কল্যাণকর ভূমিকা,আজ পর্যন্ত কুরআন উপস্থাপিত জীবন পদ্ধতির মতো কার্যকর আর কোন জীবন পদ্ধতি উদ্ভাবনে মানব সমাজের ব্যর্থতা, এর বিষয়বস্ত বৈচিত্র্য ও ব্যাপকতা সত্ত্বেও সকল প্রকার অসংগতি ও বৈপরিত্য থেকে তার মুক্ত থাকা,সর্বোপরি এক নিরক্ষর ব্যক্তির জবান থেকে এইসব বাণী নিসৃত হওয়া – এসব কিছুই কুরআন পাকের মু’জিযা হবার জন্যে অকাট্য প্রমাণ। এই সমস্ত দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে আজো হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর নবুয়্যাত সম্পর্কে মানুষের মন পুরোপরি নিশ্চিন্ত ও নিঃসন্দেহ হতে পারে এবং তা হয়েও থাকে।
৩. চূড়ান্ত কথা
এ পর্যায়ে অবতীর্ণ কালামের আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এবার থেকে কাফিরদের সাথে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও চূড়ান্ত ভাবে কথা বলা শুরু হলো। এর ধরণটা ছিলো এই যে, এবার বুঝানো এবং বাতলানোর পর্যায় শেষ হয়ে গেছে। মানবার যদি ইচ্ছা থাকে তো এখনো সময় আছে, মেনে নাও। নচেত অবিশ্বাস ও হঠকারিতার পরিণাম ভোগ করার জন্যে তৈরি হও।
তাই হযরত(সা:)- তাদেরকে সুস্পষ্টত বলে দিলেন: আমি আমার প্রভুর তরফ থেকে অবতীর্ণ একটি উজ্জ্বল প্রমাণের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। আর তোমরা তাকে এই বলে অস্বীকার করছো যে, এই অবিশ্বাসের ফলে যে আযাব আসার তা আসুক। কিন্তু তোমাদেরকে আমি জানিয়ে দিচ্ছি, যে বস্তুটির জন্যে তোমরা তাড়াহুড়া করছো, তা আমার হাতে নেই। এ সম্পর্কিত ফয়সলা সম্পূর্ণ খোদার হাতে। এটা যদি আমার এখতিয়ারের বিষয় হতো, তাহলে কবে এর মিমাংসা হয়ে যেত! গায়েবের খবর তো শুধু আল্লাহ তাআলাই জানেন। কোন কাজের জন্যে কোন সময় উপযুক্ত, তা তিনিই ভালো বুঝেন। তিনি যখন ইচ্ছা তখন তোমাদের ওপর আযাব নাযিল করতে পারেন। এ আরো কিছুটা অগ্রসর হয়ে নির্দেশ করা হলোঃ ‘যে সব লোক দ্বীনের ব্যাপারটিকে একটি খেল তামাসা মনে করে নিয়েছে এবং দুনিয়ার জীবনেই মোহগ্রস্থ হয়ে আছে, তাদেরকে নিজস্ব অবস্থার ওপরই ছেড়ে দাও। অবশ্য তাদেরকে যথারীতি কুরআন শুনাতে থাকো। এরপরও যদি তারা সত্যকে মেনে নিতে রাজি না হয়, তাহলে তাদেরকে বলে দাওঃ লোক সকল! তোমরা যা করতে চাও তা নিজের জায়গায় করতে থাকো আর আমিও আমার জায়গায় কাজ করতে থাকি। এর পরিণামে কে সঠিক পথে আছে, তা শিগগিরই তোমরা জানতে পারবে।
এই ধরনের কালামের এ একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। এ ছাড়াও এই পর্যায়ে ওহীতে এ ধরণটি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে এবং প্রায় দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করা হয় যে, এবার বিষয়টি সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রত্যাসন্ন হয়ে উঠেছে।
৪. হিজরতের প্রস্তুতি
এতৎভিন্ন এ পর্যায়ের কালামে হিজরতের জন্যেও বারবার ইশারা আসতে লাগলো। এই সূরা আনকাবুতেই নির্দেশ করা হলোঃ ‘হে আমার বান্দাহ গণ!তোমরা শুধু আমারই বন্দেগী করতে থাকো। আমার বন্দেগীর কারণে যদি স্বদেশের জমিন তোমাদের জন্যে সংকীর্ণ হয়ে যায়, তাহলে সে জন্যে কোন পরোয়া করো না। আমার জমিন অত্যন্ত প্রশস্ত; এজন্য যদি ঘরবাড়িও ও ছেড়ে দিতে হয় দাও, কিন্তু আমার বন্দেগীর সম্পর্ক ছিন্ন করো না।কোন জানদারের পক্ষে সবচেয়ে বড় ভয় যা হতে পারে, তাহলো মৃত্যুভয়। নিশ্চয় জেনে রেখ, প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এবং তার পর সবাইকে আবার আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে। কাজেই সেই মৃত্যু যদি আমার পথেই আসে, তাহলে আর চিন্তা কিসের? যে কেউ ঈমান ও সৎকর্মের পুঁজি নিয়ে আসবে, তাকে এমন আরামদায়ক বাগিচায় স্থান দেয়া হবে, যার নিম্নদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত। সেখানে চিরকাল সে অবস্থান করবে। যারা ঈমানদার ও সৎকর্মশীল, যারা কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতিতেও আল্লাহর দ্বীনের পথে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এবং যারা নিজেদের প্রতিটি ক্রিয়াকর্মে শুধু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ওপরই ভরসা রাখে, তাদের জন্যে এ কত উত্তম বিনিময়!এরপর বলা হলো যে, আল্লাহর পথে ঘর-বাড়ি ছাড়বার দ্বিতীয় ভয় হচ্ছে আর্থিক দুর্গতি। এ সম্পর্কে তাদের এই প্রত্যয়কে আরো মজবুত করা হলো যে, প্রকৃতপক্ষে রিযিক দেবার ক্ষমতা সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ।দুনিয়ায় বিচরণশীল কত প্রাণী রয়েছে; তাদের কেউই আপন রিযিক সঙ্গে নিয়ে বেড়ায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ তাদের রিযিক যুগিয়ে থাকেন। কাজেই রিযিক দাতা হিসেবে তার ক্ষমতা সম্পর্কে তোমরা কেন নিরাশ হও এবং তিনি তোমাদের রিযিকের ব্যবস্থা করবেন না বলে কেন ভয় পাও?এছাড়া এ পর্যায়ের অপর সূরা বনী ইসরাঈলে হিজরতের জন্যে দু’আ ও শিক্ষাদান করা হলো। বলা হলোঃ দু’আ প্রার্থনা করোঃ ‘প্রভু হে! আমায় উত্তম জায়গায় পৌঁছিয়ে দাও, মক্কা থেকে ভালভাবে বের করে নাও এবং শত্রুর ওপর বিজয় ও সাহায্য দান করো।’ আর হে নবী!ঘোষণা করে দাওঃ সত্য এসে পড়েছে এবং মিথ্যা অপসৃত হয়েছে। মিথ্যাকে অপসৃত হতেই হয়েছে।’ মোটকথা, এ পর্যায়ের কালামে এগুলো ছাড়াও এ ধরনের আরো বহুতর ইঙ্গিত রয়েছে। এতে একদিকে যেমন সেই প্রত্যাসন্ন বিপ্লবের দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছিল, অন্যদিকে তেমনি এরূপ পরিস্থিতির মুকাবেলায় যে প্রস্তুতির দরকার, তার প্রতিও বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছিল। আখিরাতের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় স্থাপন করা, অন্তর থেকে পার্থিব সম্পদের বাসনা মুছে ফেলা, খালেস তওহীদ এবং তার দাবিগুলোকে মনের ভেতর বদ্ধমূল করে নেয়া, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো অবলম্বনকে মনের মধ্যে স্থান না দেয়া, কেবল তারই সত্ত্বার ওপর পুরোপুরি ভরসা করা, তার কাছ থেকে প্রাপ্ত নির্দেশাবলীকে কিছুমাত্র হ্রাস-বৃদ্ধি না করে যথারীতি পেশ করতে থাকা এবং এসব কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জনের নিমিত্ত নামাজ কায়েম করা ও তার প্রতি পুরোপুরি মনোযোগ দেয়া ইত্যাকার উপায়-উপকরণের মাধ্যমে মুসলমানদের কে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল। সেই সঙ্গে এই কঠিনতর পরিস্থিতিতেও দ্বীনের প্রচার অব্যাহত রাখার জন্যে তাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করা হচ্ছিল।
৭.
হিজরত
হিজরত শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে পরিত্যাগ কিংবা পরিবর্জন। কিন্তু ইসলামী পরিভাষায় হিজরত বলতে বুঝায়: দ্বীন ইসলামের খাতিরে নিজের দেশ ছেড়ে এমন স্থানে গমন করা যেখানে প্রয়োজন সমূহ পূর্ণ হতে পারে। কারণ ইসলামী জীবন যাপন করার এবং আল্লাহর দ্বীনের দিকে আহ্বান জানানোর আজাদী যে দেশে নেই, সে দেশকে শুধু আয়-উপার্জন,ঘর-বাড়ি,ধন-সম্পত্তি কিংবা আত্মীয়-স্বজনের খাতিরে আঁকড়ে থাকা মুসলমানদের পক্ষে আদৌ জায়েয নয়।
প্রসঙ্গত একটি কথা জেনে রাখা দরকার যে,আল্লাহর দ্বীনের প্রতি ঈমান পোষণকারীর পক্ষে কোনো কুফরী রাষ্ট্র (টীকাঃ৩১- কুফরী রাষ্ট্র বলতে শুধু কাফির, মুশরিক ও নাস্তিকদের দ্বারা চালিত রাষ্ট্রকেই বুঝায় না, বরং আল্লাহ্র সার্বভোমত্ব দ্ব্যার্থহীন ভাষায় অস্বীকার করে এবং মানবীয় প্রভুত্বের প্রতি আস্থা রাখে এমন যে কোন রাষ্ট্রকেই কুফরী রাষ্ট্র বলা হয়। সে রাষ্ট্রের অধিবাসী শাসকবৃন্দ ‘মুসলিম’ নামে পরিচিত হলেও কার্যত তাতে কিছু যায় আসেনা ।-সম্পাদক)
ব্যবস্থার অধীনে জীবন যাপন করা কেবল দুটি অবস্থায়ই সঙ্গত হতে পারে। একঃ সংশ্লিষ্ট দেশে ইসলামের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং কুফরী ব্যবস্থাকে ইসলামী ব্যবস্থায় রুপান্তরিত করার জন্যে সে ক্রমাগত চেষ্টা-সাধনা করতে থাকবে – এ যাবত মক্কায় থেকে মুসলমানেরা যেরূপ চেষ্টা-সাধনা করে আসছিল এবং সে জন্যে সর্বপ্রকার দুঃখ-মুসিবত সহ্য করেছিল। দুই:সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে তার বেরোবার কোন পথ যদি সত্যই না থাকে কিংবা ইসলামী ধারায় জীবন যাপন ও ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত চেষ্টা-সাধনা করার উপযোগী কোন জায়গা যদি সে খুঁজে না পায়।(টীকাঃ৩২- মনে রাখতে হবে যে, হিজরতের জন্যে কোনো দারুল ইসলাম বর্তমান থাকা অপরিহার্য নয়। মুসলমান প্রয়োজন হলে যেন কোন জংগল বা পাহড়ে গিয়ে অবাধে জীবন যাপন করতে পারে , তার পক্ষে কুফরী রাষ্ট্র ব্যবস্থার আনুগত্য থেকে বাঁচবার জন্যে এটুকু যথেষ্ট । কারণ , মুসলমানদের দৃষ্টিতে যে কোন জিনিসের চেয়ে তার দ্বীনের মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব বেশী )
কিন্তু দ্বীনের প্রয়োজন পূর্ণ হবার উপযোগী জায়গা যখনি পাওয়া যাবে – এবার মদিনা থেকে যেমন প্রত্যাশা করা গিয়েছিল – তখন অবশ্যই তাদের হিজরত করে সেখানে চলে যেতে হবে। তবে এক্ষেত্রে যারা নিতান্তই অক্ষম ও পঙ্গু এবং যারা অসুস্থতা কিংবা দারিদ্র্যের কারণে কোন প্রকারেই হিজরতের জন্যে সফর করতে সক্ষম নয়, কেবল তারাই ক্ষমা পাবার যোগ্য।
মদিনায় সাধারণ মুসলমানদের হিজরত
মদিনায় ইতোমধ্যেই ইসলাম বেশ কিছুটা প্রচারিত হয়েছিল। এই অবস্থায় মক্কায় যে সব মুসলমান কাফিরদের হাতে উৎপীড়িত হচ্ছিল, হযরত(সা:) তাদেরকে মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। এটা টের পেয়েই কাফিররা মুসলমানদেরকে বিরত রাখার জন্যে জুলুমের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল এবং যাতে মুঠো থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে, সে জন্যে সর্বোত ভাবে চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু মুসলমানেরা তাদের ধন প্রাণ ও সন্তান-সন্ততির জীবন বিপন্ন করেও নিছক দ্বীনের খাতিরে দেশ ত্যাগ করাকেই পছন্দ করলো। কোন প্রলোভন বা ভয়-ভীতিই তাদেরকে এই সংকল্প থেকে বিরত রাখতে পারলো না। ক্রমান্বয়ে বহু সাহাবী মদিনায় চলে গেলেন। এখন হযরত(সা:)এর সঙ্গে থেকে গেলেন শুধু হযরত আবু বকর(রা:) এবং হযরত আলী(রা:)। আর থাকলো দারিদ্র্য ও শারীরিক অক্ষমতা হেতু সফর করতে অসমর্থ এমন কিছূ সংখ্যক মুসলমান।
হযরত (সা:) কে হত্যা করার সলা-পরামর্শ
এভাবে নবুয়্যাতের ত্রয়োদশ বছরের সুচনা পর্যন্ত বহূ সাহাবী মদীনায় হিজরত করলেন। কুরাইশরা দেখতে পেল মুসলমানরা একে একে মদীনায় গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করছে এবং সেখানে ইসলাম ক্রমশ প্রসার লাভ করছে। এর ফলে তারা অত্যন্ত শংকিত হয়ে উঠলো এবং ইসলামকে চিরতরে খতম করে ফেলার পন্থা সর্ম্পকে চিন্তা-ভাবনা করলে লাগলো। সাধারণ জাতীয় সমস্যাবলী সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ও সলা-পরামর্শ করার জন্যে ‘দারুন্নদ্ওয়া’ নামে তাদের একটি জায়গা নির্দিষ্ট ছিলো। সেখানে প্রত্যেক গোত্রের প্রধান ব্যক্তিগণ জমায়েত হলো এবং এই আন্দোলনকে পর্যুদস্ত করার জন্যে কি পন্থা অবলম্বন করা যায়, সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু করলো। কেউ কেউ পরামর্শ দিলো: মুহাম্মদ (সাঃ)-কে শৃংখলিত করে কোন ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখা উচিত। কিন্তু কেউ কেউ মত প্রকাশ করলো যে, মুহাম্মদ (সাঃ) – এর সঙ্গী-সাথীগণ হয়তো আমাদের কাছ থেকে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে এবং তার ফলে আমাদের পরাজয়ও ঘটতে পারে; এজন্যে উক্ত পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করা হলো। কেউ কেউ আবার পরামর্শ দিলো যে, তাঁকে নির্বাসিত করা উচিত। কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) যেখানে যাবেন সেখানেই তাঁর অনুগামী বাড়তে থাকবে এবং তাঁর আন্দোলনও যথারীতি সামনে অগ্রসর হবে; এ আশংকায় উক্ত পরামর্শও নাকচ করা হলো। অবশেষে আবু জেহেল পরামর্শ দিলো: ‘প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে যুবক মনোনীত করা হবে; এরা সবাই এক সঙ্গে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওপর হামলা করবে এবং তাঁকে হত্যা করে ফেলবে। এর ফলে তাঁর রক্ত সকল গোত্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাবে। আর সমস্ত গোত্রের সঙ্গে একাকী লাড়াই করা হাশিমী খান্দানের পক্ষে কিছুতেই সম্ভবপর হবে না।’ এ অভিমতটি সবাই পছন্দ করলো এবং শেষ পর্যন্ত এ কাজের জন্যে একটি রাত ও নির্দিষ্ট করা হলো। সিদ্ধান্ত করা হলো যে নির্দিষ্ট রাতে মনোনীত ব্যক্তিগণ হযরত (সা:) এর বাসভবন ঘেরাও করে থাকবে। ভোরে তিনি যখন বাইরে বেরোবেন,তখন তারা আপন কর্তব্য সমাধা করবে। এরুপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ এই যে, আরবরা রাতের বেলায় অন্য কারো ঘরে প্রবেশ করাকে পছন্দ করতো না।
কিন্তু আল্লাহ তাআলার কৃপায় দুশমনদের ঐসব গোপন অভিসন্ধির কথা হযরত (সা:) এর কাছে যথারীতি পৌঁছতে থাকে। অতঃপর সেই প্রতিক্ষিত সময়টি এলো,যখন তিনি মক্কা ছেড়ে মদিনায় গমন করার জন্যে ওহী যোগে নির্দেশ পেলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে হিজরতের দুদিন আগে থেকেই তিনি আবু বকর সিদ্দিক (রা:) এর সঙ্গে এ সম্পর্কে পরামর্শ করেন এবং এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, তার সাথে হযরত আবু বকর(রা:) ও গমন করবেন। সফরের জন্যে দুটি উষ্ট্রী ঠিক করা হলো এবং কিছু পাথেয়ও তৈরি করা হলো।
মক্কা থেকে রওয়ানা
কাফির কুরাইশগণ হযরত(সা:) কে হত্যা করার জন্যে যে রাতটি নির্দিষ্ট করেছিল, সেই রাতেই তিনি আলী(রা:) কে ডেকে বললেন:‘আমি হিজরতের নির্দেশ পেয়েছি এবং আজ রাতেই মদিনা রওয়ানা হয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে বহু লোকের আমানত জমা রয়েছে। এগুলো তুমি প্রত্যুষে লোকদের কাছে প্রত্যার্পণ করে দিয়ো। আর আজ রাতে তুমি আমার বিছানায় থেকো,যেন আমি ঘরে আছি ভেবে লোকেরা নিশ্চিন্ত থাকে।
কুরাইশরা ইসলাম বৈরিতার কারণে হযরত(সা:) এর রক্তের নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিল; কিন্তু এ অবস্থায়ও তারা হযরত(সা:) কে এতোখানি আমানতদার ও বিশ্বাসভাজন মনে করতো যে, তাদের নিজ নিজ আমানত ও মাল-মাত্তা এনে তার কাছে জমা রাখতো।
নির্দিষ্ট রাতে কাফিররা হযরত(সা:) এর গৃহ ঘেরাও করলো। রাত যখন গভীর হলো, হযরত(সা:) নিরবে ও নিশ্চিন্তে ঘর থেকে বের হলেন। সে সময় তিনি সূরা ইয়াছিনের একটি আয়াত (فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لاَ يُبْصِرُونَ) পাঠ করছিলেন। তিনি এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে ‘শাহাতিল ওজুহ ’(মুখমন্ডল আচ্ছন্ন হয়ে যাক) কথাটি বলে কাফিরদের দিকে ছুঁড়ে মারলেন এবং তাদের ব্যূহ ভেদ করে নিবিঘ্নে বেরিয়ে গেলেন। সে সময় আল্লাহর কুদরতে অবরোধকারি গণ যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো; ফলে তারা হযরত(সা:) কে বেরিয়ে যেতে দেখতে পেলো না।প্রথমে তিনি হযরত আবু বকর (রা:) এর গৃহে গমন করলেনএবং সেখান থেকে তাকে নিয়ে মক্কার বাইরে গিয়ে সওর পর্বত গুহায় আশ্রয় নিলেন।
ভোরবেলা কাফিরগণ দেখতে পেলো, হযরত (স) মক্কা ছেড়ে চলে গেছেন। তারা অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লো এবং তাঁর সন্ধানে চারদিকে ছুটাছুটি শুরু করলো। একবার তারা খুঁজতে খুঁজতে‘ সওর’র্পবত গুহায় (হযরত মুহাম্মদ সাঃ ও সিদ্দিক রাঃ যে গুহায় আত্মগোপন করেছিলেন ) মুখ পর্যন্ত পৌঁছল। তাদের পদধ্বনি শুনে হযরত আবু বকর (রা) কিছুটা বিচলিতও হয়ে উঠলেন। তার কারণ,তার নিজের জীবন সম্পর্কে তার কোন ভয় ছিল না;বরং হযরত(সা:)- এর ওপর না জানি কোন বিপদ এসে যায় এই ছিল তার আশংকা। তার এই অস্থিরতা লক্ষ্য করে হযরত মুহাম্মদ সাঃ অত্যন্ত প্রশান্ত চিত্তে বললেনঃ‘লা তাহযান ইন্নাল্লাহা মাআনা’ – ঘাবড়িও না,আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। কার্যত তা-ই হলো।
আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে গুহামুখে এমন কতকগুলো নিদর্শন ফুটে উঠলে যে, তা দেখে কাফিররা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। তাদের মনে ধারণা জন্মালো যে, এ গুহার ভেতরে কেউ প্রবেশ করে নি।
হযরত আবু বকর(রা:)-এর পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ তখন বয়সে নবীন। তিনি রাতের বেলায় হযরত মুহাম্মদ (সা:) ও সিদ্দিক (রা:)-এর কাছে থাকতেন এবং ভোরে মক্কায় এসে কাফিরদের সলা-পরামর্শ সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে গুহায় ফিরে গিয়ে বুজর্গদ্বয়কে অবহিত করতেন। কয়েক রাত যাবত হযরত আবু বকর(রা:)-এর গোলাম বকরীর দুধ নিয়ে যেত, কখনো বা ঘর থেকে কিছু খাবার নিয়ে পৌঁছতো। এভাবে তিন রাত পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা:) ও সিদ্দিক(রা:) সেখানে অবস্থান করলেন।
চতুর্থ দিন হযরত মুহাম্মদ (সা:) সওর পর্বত গুহা থেকে বেরোলেন এবং পুরো এক রাত এক দিন তারা সমানে পথ চললেন। সফরের জন্যে আবু বকর(রা:) আগে থেকেই দুটি উষ্ট্রী ঠিক করে রেখেছিলেন। পথ বাতলানোর জন্যে একজন জানাশোনা লোকও নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন। পরদিন দুপুর বেলা রোদের তেজ প্রখর হয়ে উঠলে বিশ্রামের জন্যে একটি বৃহদাকার পাথরের ছায়ায় তারা কিছুক্ষণ অবস্থান করলেন। অদূরেই একটি গোয়ালা ছিল; তার বকরী থেকে হযরত(সা:) দুধ পান করলেন।অতঃপর সেখান থেকে তিনি আবার যাত্রা শুরু করলেন। তিনি সামনে পা বাড়াতেই সোরাকা বিন জাশিম নামক জনৈক কুরাইশ হঠাৎ তাকে দেখে ফেললো।এই লোকটি পুরস্কারের লোভে হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর সন্ধানে বেরিয়েছিল। সে হযরত(সা:) কে দেখতে পেয়েই ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। কিন্তু ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। সে আবার নিজেকে সামলে নিল এবং হযরত(সা:) এরওপর হামলাকরার জন্যে তৈরি হলো। কিন্তু এবারও সামনে এগুতেই তার ঘোড়া হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে বসে গেল। এবার সোরাকা শংকিত হয়ে উঠলো এবং বুঝতে পারলো। ব্যাপারটা মোটেই সুবিধাজনক নয়। তার পক্ষে মুহাম্মদ(সা:) এর ওপর হামলা করা কিছুতেই সম্ভবপর নয়। সে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়লো এবং হযরত(সা:) এর কাছে আত্মসমার্পণ করে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলো। হযরত(সা:) তাকে ক্ষমা করে দিলেন। এও ছিল হযরত(সা:) এর একটি মু’জিযা।
মদিনায় শুভাগমন
হযরত(সা:) এর আগমন বার্তা পূর্বেই মদিনায় পৌঁছেছিল গোটা শহরই তার শুভাগমনের জন্যে প্রতিক্ষমান ছিল। ছোট-বড় সবাই প্রতিদিন সকালে শহরের বাইরে গিয়ে জমায়েত হতো এবং দুপুর পর্যন্ত ইন্তেজার করে ফিরে আসতো। অবশেষে একদিন তাদের সেই প্রতিক্ষিত শুভ মুহূর্তটি এসেই পড়লো। দূর থেকে হযরত (সা:) এর আসবার আলামত দেখে গোটা শহরটি তকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো। প্রতিটি প্রতিক্ষাকারী হৃদয় উজার করে তাকে স্বাগত জানালো। মদিনা থেকে তিন মাইল দূরে ‘কুবা’ নামক স্থানে আনসারদের অনেকগুলো খান্দান বসবাস করতো(টীকাঃ৩৪-বর্তমানে কুবা মদিনার শহরতলীর অন্তর্ভুক্ত একটি মহল্লা )। এদের মধ্যে আমর ইবনে আওফের খান্দান টি ছিল সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয়। কুলসুম বিন আল হাদাম ছিলেন এদের প্রধান ব্যক্তি। এর পরম সৌভাগ্য যে, দো-জাহানের নেতা সবার আগে এরই আতিথ্য কবুল করেন এবং কুবাই এর গৃহেই অবস্থান করেন। হযরত (সা:) এর রওয়ানার তিন দিন পর হযরত আলী(রা:) মক্কা থেকে যাত্রা করেছিলেন; তিনিও এখানে এসে হযরত (সা:) এর সঙ্গে মিলিত হলেন।
কুবায় হযরত (সা:) শুভাগমন করেন নবুয়্যাতের ত্রয়োদশ বছরের ৮ রবিউল আওয়াল (মুতাবেক ২০সেপ্টেম্বর, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ)।এখানে অবস্থানকালে তার পয়লা কাজ ছিল একটি মসজিদ নির্মাণ করা। তিনি তার পবিত্র হস্ত দ্বারা এইমসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং অন্যসাহাবীদের সঙ্গে নিয়ে এর নির্মানকাজ সম্পূর্ণ করেন। কয়েকদিন অবস্থান করে তিনি শহরের দিকে রওয়ানা করলেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। পথে বনী সালেমের মহল্লা পর্যন্ত পৌঁছলে জুহর নামাজের সময় হলো। এখানে তিনি সর্বপ্রথম জুম’আর খুতবা প্রদান করেন এবং প্রথম বার জুম’আর নামাজ পড়ালেন।
মদিনায় প্রবেশকালে প্রতিটি আত্মোৎসর্গী মুসলিমের হৃদয়েই তার মেহমানদারীর সৌভাগ্য লাভের আকাঙ্খা জাগলো। তাই প্রত্যেক গোত্রের লোকই তার সামনে এসে আবেদন জানাতে লাগলো:‘হুযুর, এই হচ্ছে আপনার ঘর, অনুগ্রহ করে এখানে আপনি অবস্থান করুন। লোকদের মধ্যে এতখানি আগ্রহ-উদ্দীপনার সঞ্চার হলো যে প্রতিটি হৃদয়ই যেন পথের ফরাশে পরিণত হলো; প্রতিটি হৃদয়ই উৎসর্গীকৃত হবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলো। এমনকি মেয়েরা পর্যন্ত গৃহের ছাদে উঠে গাইতে লাগলোঃ
طلع البدر علينا
من ثنيات الوداع
وجب الشكر علينا
ما دعا لله داع
أيها المبعوث فينا
جئت بالأمر المطاع
جئت شرفت المدينة
مرحبا يا خير داع
অর্থাৎ
চন্দ্র উদিত হয়েছে,
বিদা পর্বতের ঘাঁটি থেকে, খোদার শোকর আমাদের কর্তব্য,,
যতক্ষণ প্রার্থনাকারীরা প্রার্থনা করে।,
কিশোরী বালিকারা দফ বাজিয়ে বাজিয়ে গাইতে লাগলোঃ,
আমরা নাজ্জার খান্দানের বালিকা,
(আর) মুহাম্মদ (সা:) আমাদের কত উত্তম পড়োশী!,
হযরত(সা:) বালিকাদের জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমরা কি আমায় ভালোবাস?তারা বললো,হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ ‘আমিও তোমাদের ভালোবাসি।’
মদিনায় অবস্থান
হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর মেহমানদারীর সৌভাগ্য কে লাভ করবে? এমন একটি প্রশ্ন যে এর মিমাংসা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। হযরত বললেন যে, আমার উষ্ট্রী যার গৃহের সামনে দাঁড়াবে, এ খেদমত সেই আজ্ঞাম দিবে। ’ ঘটনাক্রমে এ সৌভাগ্য টুকু হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা) এর ভাগ্যে পড়লো। বর্তমানে যেখানে মসজিদে নববী অবস্থিত, তার নিকটেই ছিল তার গৃহ। গৃহটি ছিল দ্বিতল বিশিষ্ট। তিনি হযরত (সা:) এর থাকবার জন্যে ওপরের তলাটি পেশ করেন। কিন্তু লোকদের আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে হযরত (সা:) নিচের তলায় থাকা পছন্দ করলেন্ হযরত আবু আইয়ুব এবং তার স্ত্রী নিচের তলা ছেড়ে ওপরের তলায় চলে গেলেন। এখানে হযরত(সা:) সাত মাস কাল অবস্থান করলেন। এরপর তার বসবাসের জন্যে মসজিদে নববীর নিকটে একটি কোঠা নির্মিত হলো এবং সেখানেই তিনি স্থানান-রিত হলেন। কয়েক দিনের মধ্যে তার খান্দানের অন্যান্য লোকও মদিনায় চলে এলো।
মসজিদে নববীর নির্মাণ
মদিনায় আগমনের পর সবচেয়ে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল একটি মসজিদ নির্মাণ করা। হযরত (সা:) যেখানে অবস্থান করছিলেন, তার নিকটেই দুই ইয়াতিমের কিছু অনাবাদী জমি ছিল। নগদ মূল্যে তাদের কাছ থেকে এই জমিটি খরিদ করা হলো। তারই ওপর মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হলো। এবারও হযরত(সা:) সাধারণ মজুরের ন্যায় সবার সাথে মিলে কাজ করলেন। স্বহস্থে তিনি ইট-পাথর বয়ে আনলেন। মসজিদটি অত্যন্ত সাদাসিদেভাবে ভাবে নির্মিত হলো। কাঁচা ইটের দেয়াল, খেজুর গাছের খুঁটি এবং খেজুর পাতার ছাদ – এই ছিল এর উপকরণ। মসজিদের কিবলা হলো বায়তুল মুকাদ্দিসের দিকে। কেননা, তখন পর্যন্ত মুসলমানদের কিবলা ছিল ঐ দিকে। অতঃপর কিবলা কা’বামুখী হলে তদনুযায়ী মসজিদের সংস্কার করা হলো।মসজিদের মেঝেও ছিলো কাঁচা । বৃষ্টিপাত হলে মসজিদের ভেতর কাদা জমে যেতো। তাই কিছুদিন পর পাথর বিছিয়ে মেঝে পাকা করে নেয়া হলো। মসজিদের একপাশে একটি উঁচু চত্বর নির্মিত হলো। এর নাম রাখা হলো ‘ সুফফা’। যে সব নও মুসলিমের কোন বাড়ি-ঘর ছিলো না। এটি ছিল তাদের থাকবার জায়গা।
মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে তার নিকটেই হযরত (সা:) তার স্ত্রীদের জন্যে কয়েকটি কোঠা তৈরি করে নিলেন। এগুলো কাঁচা ইট এবং খেজুর গাছ দ্বারা নির্মিত হলো। এই ঘরগুলো ছয়-সাত হাত করে চওড়া এবং দশ হাত করে লম্বা ছিল। এর ছাদ এতোটা উঁচু ছিল যে, একজন লোক দাঁড়ালে তা স্পর্শ করতে পারতো। দরজায় ঝুলানো ছিল কম্বলের পর্দা।
হযরত(সা:) এর গৃহের নিকটে যে সব আনসার বাস করতো, তাদের ভিতরকার স্বচ্ছল লোকেরা তার খেদমতে কখনো তরকারী, কখনো বা অন্য কিছু পাঠাতো। এর দ্বারাই তার দিন গুজরান হতো; অর্থাৎ সংকটের ভেতর দিয়েই তার জীবন-যাত্রা নির্বাহ হতো।
ভাই ভাই সম্বন্ধ
মক্কা থেকে যে সব মুসলমান ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে মদিনায় চলে এসেছিল, তাদের প্রায় সবাই ছিল সহায় সম্বলহীন। তাদের মধ্যে যারা স্বচ্ছল ছিল, তারাও নিজেদের মাল-পত্র মক্কা থেকে আনতে পারেন নি। তাদের সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে একদম রিক্ত হস্তেই আসতে হয়েছিল। এই সব মুহাজির যদিও মুসলমানদের (আনসার) মেহমান ছিলো, তথাপি এদের স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল। তাছাড়া এরা নিজেরাও স্বহস্থে পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতে ভালবাসতো। তাই মসজিদে নববীর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে একদিন হযরত (সা:) আনসারদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি এবং মুহাজিরদের ভেতর থেকে এক ব্যক্তিকে ডেকে বললেন, ‘আজ থেকে তোমরা পরস্পর ভাই।’ এভাবে সমস্ত – মুহাজিরকে তিনি আনসারদের ভাই বানিয়ে দিলেন। তার ফলেই আল্লাহর এই খাঁটি বান্দাগণ শুধু ভাই-ই নয়, পরস্পরে ভাইয়ের চেয়েও ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হলেন। আনসারগণ মুহাজিরদেরকে নিজ নিজ বাড়িতে নিয়ে গেল এবং তাদের সামনে নিজেদের সমস্ত সম্পত্তি ও সামান-পত্রের হিসাব করে বললো: ‘এর অর্ধেক তোমাদের আর অর্ধেক আমাদের।’ এভাবে বাগানের ফল, ঘরের সামান, বাসগৃহ, সম্পত্তি – মোটকথা, প্রতিটি জিনিসই সহোদর ভাইদের মতো বিভক্ত হলো। ফলে আশ্রয়হীন মুহাজিরগণ সব দিক থেকে নিশ্চিন্ত হলো। তারা যথারীতি ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করলো, দোকান-পাট খুললো এবং অন্যান্য কাজে নিযুক্ত হলো। এভাবে মুহাজির পুনর্বাসনের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হলো এবং এদিক দিয়ে সবাই নিশ্চিন্ত হলো।