৮
নবপর্যায়ে ইসলামী আন্দোলন
হিজরতের আগে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হচ্ছিল মক্কার মুশরিকদের কাছে। তাদের কাছে এটা ছিল একটি অভিনব জিনিস। কিন্তু হিজরতের পর সমস্যা দেখা দিল মদিনার ইহুদীদের নিয়ে। এরা তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত, ফেরেশতা, ওহী ইত্যাদি বিশ্বাস করতো এবং একজন পয়গম্বরের (হযরত মূসার ) উম্মত হিসাবে খোদার তরফ থেকে আগত একটি শরীয়াতের অনুগামী হবারও দাবিদার ছিল। নীতিগত ভাবে হযরত মুহাম্মদ (সা:) যে দ্বীন-ইসলামের দিকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন, তাদেরও প্রকৃত দ্বীন ছিল তা-ই। কিন্তু শতাব্দী কালের অনাচার ও বেপরোয়া আচরণের ফলে তাদের ভেতর নানারকমের দোষ-ত্রুটি দেখা দিয়েছিল।তাদের জীবন প্রকৃত খোদায়ী শরীয়ত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল এবং তাদের ভেতর অসংখ্য কুসংস্কার, বিদয়াত,ও কুপ্রথার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।তাদের কাছে তওরাত কিতাব ছিল বটে, কিন্তু তার মধ্যে তারা বহু মানবীয় কালাম শামিল করে নিয়েছিল। তবুও তার মধ্যে খোদায়ী বিধি-বিধান যা কিছু বাকী ছিল, তাও মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ছাঁচে ফেলে তারা ওলট-পালট করে দিয়েছিল। এভাবে খোদার দ্বীনের সাথে তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সামাজিক দিক দিয়ে তাদের ভেতর মারাত্মক সব দোষ-ত্রুটি শিকড় গেড়ে বসেছিল। আল্লাহর কোন বান্দাহ যদি তাদেরকে সঠিক পথ দেখাতে চাইতো, তার কোন কথা পর্যন্ত তারা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। বরং তাকে তারা ঘোরতর দুশমন বলে মনে করতো এবং তার কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্যে সর্বোতভাবে চেষ্টা চালাতো। যদিও তারা মিলগতভাবে মুসলিমই ছিল, তবুও তাদের এতখানি পতন ঘটেছিল যে, তাদের আসল দ্বীন কি ছিল, তা তাদের নিজেদেরই স্মরণ ছিল না।
এদিক দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের সামনে শুধু দ্বীন-ইসলামের মূলনীতি সংক্রান্ত বুনিয়াদী প্রচারের কাজই ছিলনা, বরং ঐসব বিভ্রান্ত মুসলমানের ভেতর পুনরায় দ্বীনি ভাবাদর্শ জাগ্রত করার দায়িত্বও বর্তমান ছিল। তাছাড়া হযরত (সা:) এর আগমনের পর মুসলমানেরা ক্রমান্বয়ে চারদিক থেকে এসে মদিনায় জমায়েত হচ্ছিল এবং এই সব মুহাজির ও মদিনার আনসার গণ মিলে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির ইসলামী রাষ্ট্রেরও ভিত্তি পত্তন করেছিল।
(টীকাঃ ৩৭-৩৭. মদীনায় আসার পর রাসূলে করীম (স) সর্বপ্রথম আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে এক অটুট ভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপন করলেন। এরপর তিনি মদীনায় বসবাসকারী মুসলিম, ইহুদী ও খৃষ্টান এই তিন জাতির মধ্যে ঐক্য, সংহতি, সম্প্ৰীতি ও একাত্ববোধ প্ৰতিষ্ঠা করে একটি মহাজাতি গঠনের উদ্দেশ্যে এদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শক্রমে রচনা করলেন একটি মহাসনদ। তিন জাতির নেতৃবৃন্দের যৌথভাবে স্বাক্ষরিত এই আন্তর্জাতিক সনদটিই ঐতিহাসিক মদীনা সনদ’ নামে খ্যাত এবং এটিই দুনিয়ার প্রথম লিখিত সংবিধান। এর মাধ্যমেই জন্ম নিলো মদীনার ক্ষুদ্রাকার ইসলামী রাষ্ট্র। পরম দয়াময় ও মেহেরবান আল্লাহ্র নামে সম্পাদিত এই সনদের পূর্ণ বিবরণ সুরক্ষিত রয়েছে ইবনে হিশামের পৃষ্ঠায়। এতে মদীনায় বসবাসকারী বিভিন্ন জাতির লোকদের যে অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করা হয়, তার সারমর্ম নিম্নরূপ ৪
‘রাসূল মুহাম্মদ কর্তৃক প্রদত্ত বিশ্ববাসীর জন্যে-হোক তারা কুরাইশ অথবা মদীনার অধিবাসী এবং—যে কোন জন্ম-গোত্রের সকল মানুষের জন্যে যাদের মধ্যে রয়েছে অভিন্ন স্বাৰ্থ, তারা সকলেই গঠন করেছে এক মহাজাতি। “শান্তিও যুদ্ধের অবস্থা হবে সকল মুসলমানের জন্যে অভিন্ন তাদের মধ্যে এককভাবে কারো অধিকার থাকবে না তার স্বাধ্যমী শক্রির সঙ্গে শান্তিপত্র সম্পন্ন করতে অথবা সে শক্রির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে।‘
“যে সব ইহুদী আমাদের সাধারণতন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত, তারা রক্ষিত হবে সকল প্রকার অপমান ও উপদ্রব থেকে, আমাদের সাহায্য ও কর্তব্যের ওপর আমাদের লোকের সঙ্গে তাদেরও থাকবে সমান অধিকার ।”
‘মদীনায় বসতি স্থাপনকারী অন্য সকলেই মুসলমানদের সঙ্গে গঠন করবে একটি মহাজাতি। মুসলমানদের মতোই তারা মুক্তভাবে পালন করবে। নিজ নিজ ধর্ম। ইহুদীদের আশ্রিত ও মিত্ৰগণ ভোগ করবে। একই রকম নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা। অপরাধীগণকে সন্ধান করা হবে এবং শান্তি দেয়া হবে। সকল শত্রুর বিরুদ্ধে মদীনার প্রতিরক্ষায় ইহুদীরা মুসলমানদের সঙ্গে যোগদান করবে।”
‘যারা এই সনদ গ্ৰহণ করবে, তাদের সবার জন্যে মদীনার অভ্যন্তর হবে একটি পবিত্র স্থান। সকল মুসলমানই অপরাধে দোষী সাব্যন্ত প্রতিটি লোককে, অবিচারকে অথবা বিশৃংখলাকে করবে। তীব্র ঘূণা। কেউ সমর্থন করবে না নিন্দনীয় ব্যক্তিকে যদিও সে হয় তার আত্মীয়।”
‘এই সনদ যারা গ্ৰহণ করেছে তাদের মধ্যকার সকল ভবিষ্যত বিবাদ মীমাংসার জন্যে প্রেরিত হবে। আল্লাহ্র অধীন রাসূলের কাছে।’-সম্পাদক)
এ কারণে আন্দোলনকে এ যাবত শুধু আদর্শ প্রচার, আকীদা-বিশ্বাসের সংস্কারে এবং কিছু নৈতিক শিক্ষা সংক্রান্ত নির্দেশ প্রদান করতে হলেও, এখন সামাজিক জবিনধারার সংস্কার, প্রশাসনিক আইন-কানুন প্রণয়ন এবং পারস্পরিক সম্পর্ক-সম্বন্ধ বিষয়ক বিধি-ব্যবস্থা জারির প্রয়োজন দেখা দিলো। সুতরাং এবার এদিকে পুরোপুরি মনোযোগ দেয়া হলো।
এ সময় আরো একটি বিরাট পরিবর্তন সাধিত হলো। এই পর্যন্ত কুফরী পরিবেশেই ইসলামী দাওয়াত পেশ করা হচ্ছিলো এবং এরই ভেতর থেকে মুসলমানরা কাফিরদের জুলুম-পীড়ন বরদাশত করছিলো । কিন্তু এবার তারা ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করলো যা চারদিকে দিয়েই ছিলো কাফিরদের দুর্গ দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাই ব্যাপারটি এখন আর শুধু উৎপীড়ন আর হয়রানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইলো না, বরং গোটা আরব উপদ্বীপই এবার সংকল্পগ্রহণ করলো যে, এই নগন্য দলটিকে যতো শীঘ্র সম্ভব খতম করে দিতে হবে; নচেৎ ইসলামের এই কেন্দ্রটি শক্তি অর্জন করতে শুরু করলে তাদের জন্যে দাঁড়াবার স্থান পর্যন্ত থাকবে না। তাই নিজেদের এবং আন্দোলনের নিরাপত্তার তাগিদে এই নয়া ইসলামী দলের সামনে জরুরী কর্তব্য হয়ে দেখা দিলো:
১. পূর্ণ উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে জিহাদের আদর্শ প্রচার করা, দলিল প্রমাণ দ্বারা তার সত্যতা প্রতিপন্ন করা এবং যতো বেশি সম্ভব লোকদেরকে এর সমর্থক বানানোর চেষ্টা করা;
২. বিরুদ্ধবাদীগণ যে সব আকীদা-বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেছিলো, যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে তার অসারতা প্রমাণ করা, যেনো বিবেকের আলোয় কেউ কিছু বুঝতে চাইলে প্রকৃত সত্য পর্যন্ত পৌঁছতে তাকে কোনো বেগ পেতে না হয়:
৩. ঘরবাড়ি ও ব্যবসায়-বাণিজ্য নষ্ট করে যারা এই নতুন রাষ্ট্রে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তাদের জন্যে শুধু বসবাসের ব্যবস্থাই নয়, বরং তাদেরকে উন্নত মানের নৈতিক ও ঈমানী শিক্ষা দান করা, যেনো চরম দুঃখ-দারিদ্র্য এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা পূর্ণ ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতির মুকাবিলা করতে পারে এবং কোনো কঠিনতর অবস্থায়ও তাদের পা কেঁপে না ওঠে;
৪. মুসলমানদেরকে চরম প্রতিকূল অবস্থার মুকাবিলার জন্যে প্রস্তুত করা, যাতে করে তাদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে বিরুদ্ধবাদীগণ কোনো সশস্ত্র হামলা চালালে নিজেদের দুর্বলতা ও অস্ত্রপাতির দৈন্য সত্ত্বেও তারা পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে শত্রুর মুকাবিলা করতে পারে এবং আপন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সত্যতা সম্পর্কে গভীরতর প্রায় ও খোদার প্রতি ঐকান্তিক নির্ভরতার কারণে ময়দান থেকে কখনো পশ্চাদপসারণ না করে;
৫. যে সব লোক নানাভাবে বুঝানো সত্ত্বেও ইসলামের কাংখিত জীবন পদ্ধতির প্রতিষ্ঠার পথে বাদ সাধবে, তাদেরকে প্রয়োজন হলে শক্তি প্রয়োগ করে ময়দান থেকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্যে আন্দোলনের অনুবর্র্তীদের মধ্যে পূর্ণ হিম্মত ও সৎ সাহস পয়দা করা।
ইহুদীদের সঙ্গে চুক্তি
মদীনার প্রায় চারদিকেই ইহুদীদের বসতি ছিলো।
( টীকাঃ ৩৮– .প্রসঙ্গত তৎকালীন আরব উপদ্বীপে বসবাসরত ইহুদী জনগোষ্ঠীর ওপর কিছুটা বিস্তৃত আলোকপাত করা দরকার। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নববী যুগের সূচনা-পর্বে আরবের প্ৰায় সর্বত্রই কম-বেশি ইহুদী বসতি ছিলো। কোথাও কোথাও তারা ঘন বসতি আকারে বাস করতো, আবার কোথাও কোথাও তাদের দু-একটি বিচ্ছিন্ন ও পরিবার দেখা যেতো। বিশেষত ঈলা (আকাবা) মাকনা, খাইবার, আল-কুরা, ইয়াতামা, ফিদাক, মদীনা (ইয়াসরিব) তায়েফ ও জরাশ থেকে শুরু করে ইয়েমে ওমান ও বাহরাইন পর্যন্ত বিস্তৃত।আরব উপদ্বীপের উত্তর-দক্ষিণ বরাবর ইহুদী বসতির এক সুদীর্ঘ শিকল গড়ে উঠেছিলো। মক্কা ও তার সন্নিহিত এলাকায় ইহুদী বসতি ছিলো খুবই কম। তবে মক্কার আশপাশে (যেমন ওকাজ, মিনা, জুল মিজাজ ইত্যাদি স্থানে) যেসব মেলা বসতো, সেখানে তারা অর্থোপিার্জনের লক্ষ্যে নানারূপ কৌশলের আশ্রয় নিত। ভবিষ্যদ্বক্তা, ভাগ্য গণনাকারী ইত্যাদির ভেক ধারণ করা ছাড়াও তারা সাধারণ মানুষের জন্যে নানাবিধ খেল-তামাসার আয়োজন করতো। তাছাড়া অশিক্ষিত বেদুঈনদের কাছে তারা শিক্ষিত (কিতাবধারী) জনগোষ্ঠী হিসেবে খুব সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলো।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে এটা সৰ্বজনবিদিত যে, নববী যুগের অব্যবহিত পূর্বে কিতাবধারী জনগোষ্ঠীসমূহ এক মহামানব এবং এক সর্বশেষ ত্ৰাণকর্তার জন্যে অপেক্ষমান ছিলো। কিন্তু এই ব্যাপারে কয়েকটি অদ্ভুত, জটিল ও সাংঘর্ষিক তথ্য অবলোকন করে নবী চরিতের কৌতুহলী শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত হতবাক হয়ে যেতে হয়। নবুয়্যাতের আগে মদীনার ইহুদীরা প্রতিবেশী আরবদের এই বলে শাসাতো যে, ‘প্ৰতিশ্রুত নবীর আগমন মুহূর্ত সমাসন্ন। আমরা তাঁর সহযোগী হয়ে শক্ৰদের মস্তক চুৰ্ণ করে দেবো। অথচ ইতিহাসে এমন ঘটনাও প্রচুর দেখা যায়, যাতে প্ৰতিশ্রুত নবীকে হত্যা করার ব্যাপারে ইহুদীদেরই বেশি উদ্যোগী মনে হয় ।
একদা শিশু নবীকে কোলে নিয়ে তাঁর ধাত্রী মা হালীমা এক মেলায় যাচ্ছিলেন। এক ইহুদী গণক তাঁকে দেখামাত্র চীৎকার জুড়ে দিলো ঃ “ওহে ইহুদীরা। তোমরা শীঘ ছুটে এস এবং এই শিশুটিকে মেরে ফেল। এ শিশু তোমাদের উৎখাত করে ছাড়বে।” অনুরূপভাবে কিশোর বয়সে নবীজী একবার তার চাচার সাথে বাণিজ্যিক কাফেলায় শামিল হয়ে ফিলিস্তিন যাচ্ছিলেন। সেখানে এক খ্রিস্টান ধর্মবেত্তা তার চাচাকে পরামর্শ দিলেন, “সামনে আর অগ্রসর হয়োনা। ইহুদীরা এই শিশুর ঘোরতর শক্ৰ । এঁকে দেখতে পেলে এবং চিনতে পারলে প্ৰাণে মেরে ফেলবো। (রাসূল আকরাম (স) কী সিয়াসী জিন্দেগী, অধ্যাপক মুহাম্মদ
হামীদুল্লাহ-সম্পাদক )
এদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে একটা রাজনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণেরও প্রয়োজন ছিলো। কারণ মুসলমানদের মক্কা ত্যাগের কথা জানতে পেরে কাফির কুরাইশগণ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকেনি, বরং মুসলমানদের একটি সংঘবদ্ধ দলকে মদীনায় একত্রিত হতে দেখেই তারা ইসলামের এই নয়া কেন্দ্রকে আপন শক্তি ও প্রভাবে মিটিয়ে দেবার পন্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিয়েছিলো। এ কারণেই মদীনার চার দিককার ইহুদী বাসিন্দাদের সথে একটা স্পষ্টতর রাজনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণের প্রয়োজন দেখা দিলো, যেনো মক্কার মুশরিকগণ কোনো হামলা চালালে ইহুদীদের ভূমিকাটা অনুমান করা যেতে পারে। তাই মদীনা ও লোহিত সাগরের মধ্যবর্তী এলাকায় বসবাসকারী ইহুদী গোত্রগুলোর সঙ্গে হযরত মুহাম্মদ (স) নিরপেক্ষতার চুক্তি সম্পাদন করলেন। অর্থাৎ কুরাইশ বা অন্য কেউ যদি মদীনার মুসলমানদের ওপর হামলা করে, তাহলে এরা না মুসলমানদের পক্ষে লড়াই করবে আর না তাদের শত্রুপক্ষকে সমর্থন করবে; আর কারো সঙ্গে এই মর্মে চুক্তি করা হলো যে, যদি মুসলমানদের ওপর কেউ হামলা করে, তাহলে তারা মুসলমানদেরকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করবে।
মুনাফিক
এ সময় মদীনায় ইসলামী আন্দোলনকে কতকগুলো নতুন সমস্যার মুকাবিলা করতে হলো। এর মধ্যে মুনাফিকদের সমস্যাটি ছিলো অতীব গুরুত্ব্পূর্ণ। মক্কায় শেষ পর্যায়ে এমন কিছু লোক ইসলামী সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো, যারা ইসলামী দাওয়াতকে সম্পূর্ণ সত্য বলে জানতো বটে, কিন্তু ঈমানের দুর্বলতাবশত ইসলামের খাতিরে পার্থিব স্বার্থত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলো না। চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আত্নীয়তা ইত্যাদি প্রায়শ ইসলামের দাবি পূরণের পথে তাদের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতো। কিন্তু মদীনায় আসার পর এমন কিছু লোকও ইসলামী সংগঠনে অনুপ্রবেশ করলো, যারা আদতেই ইসলামে বিশ্বাসী ছিলো না। এরা নিছক ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ইসলামী সংগঠনে শামিল হয়েছিল। আবার কিছু লোক অক্ষমতা হেতু নিজেদেরকে মুসলমান বলে জাহির করতো। এদের হৃদয় যদিও ইসলাম সম্পর্কে নিশ্চিন্ত ছিল না। কিন্তু নিজ গোত্র বা খান্দানের বহু লোক মুসলমান হবার ফলে এরা বাধ্য হয়ে মুসলমানের দলে শামিল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে আরো কিছু সুযোগ সন্ধানী লোকও ইসলামী সংগঠনে ঢুকে পড়েছিল। এরা একদিকে মুসলমানদের সঙ্গী হয়ে পার্থিব ফায়াদা হাসিলের চিন্তা করতো, অন্যদিকে কাফিরদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। এদের চেষ্টা ছিল ইসলাম ও কুফরের সংঘর্ষে যদি ইসলামী বিজয়ী হয়, তাহলে এরা যেন ইসলামের মধ্যে আশ্রয় পেতে পারে আর যদি কুফর জয়লাভ করে, তবুও যেন এদের স্বার্থ নিরাপদ থাকে।
ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে এই মিত্রবেশী শত্রুরাই ছিল সবচেয়ে বেশি অসুবিধার কারণ। এদের সঙ্গে কাজ-কারবার করা মোটেই সহজতর ছিল না। মদিনার গোটা জীবনে এই শ্রেণীর লোকদের সৃষ্ট ফিতনার কিভাবে মুকাবেলা করা হয়, যথাস্থানে তা আলোচিত হবে। এখানে শুধু ঐ শ্রেণীর মুনাফিক আর সাচ্চা মুমিনদের তুলনামূলক পরিচয়টা জেনে রাখারই প্রয়োজন বেশি। কারণ এইসময় ইসলামী আন্দোলন কে এক সংকটজনক পরিস্থিতির মুকাবেলা করতে হয় এবং এ কারণেই যেসব লোক পুরানো বিদ্বেষ এবং ইসলাম বিমুখ চিন্তাধারা আঁকড়ে ধরে ছিল অথবা যাদের ঈমান কোন দিক দিয়ে দুর্বল ছিল, আন্দোলন থেকে তাদের সরে পড়বার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল।
কিবলা পরিবর্তন
এ যাবত ইসলামের কিবলা ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। এদ্দিন ঐদিকে মুখ করেই মুসলমানরা নামায পড়তো। বায়তুল মুকাদ্দাসের সাথে ইহুদীদের সম্পর্ক ছিল খুব ঘনিষ্ঠতর। এরাও ঐদিকে মুখ করে উপাসনা করতো। দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে একদিন ঠিক নামাজের মধ্যে কিবলা পরিবর্তন করার নির্দেশ এলো এবং তখন থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসের বদলে কা’বাকে মুসলমানদের কিবলা বলে ঘোষণা করা হলো। তাই হযরত (সা:) নামাজের মধ্যেই তার মুখ বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে কা’বার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। খোদ আল্লাহ তাআলা এর গুরুত্ব নিম্নোক্ত ভাষায় বর্ণনা করেছেনঃ
وَمَا جَعَلْنَا الْقِبْلَةَ الَّتِي كُنتَ عَلَيْهَا إِلَّا لِنَعْلَمَ مَن يَتَّبِعُ الرَّسُولَ مِمَّن يَنقَلِبُ عَلَىٰ عَقِبَيْهِ
“আমরা কা’বাকে তোমাদের কিবলা নির্ধারণ করে দিয়েছি। এর কারণ হচ্ছে, কে পয়গম্বরের অনুবর্তী আর কে পশ্চাদপসরণকারী, তা যাচাই করে নেয়া”।( সূরা বাকারাঃ১৪৩)
এর দ্বারা এ সত্য ঘোষিত হলো যে, এ যাবত দুনিয়ার নৈতিক এবং ঈমানী নেতৃত্বের যে দায়িত্ব ইহুদীদের ওপর ন্যস্ত ছিল, তা থেকে তাদেরকে অপসারণ করা হয়েছে। কারণ তারা এ দায়িত্ব পালন করেনি এবং এ নিয়ামতটির কদরও বুঝতে পারেনি। তাই তাদের বদলে এ খেদমতের দায়িত্ব এখন উম্মতে মুসলিমার ওপর ন্যস্ত করা হলো। তারা এই কর্তব্য পালন করে যাবে।
এই ঘটনার প্রভাবে বহু কপট মুসলমানেরই -যাদের হৃদয়ে ঈমানের আসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি – মুখোশ খসে পড়লো। তারা রাসূলুল্লাহ (সা:) এর এই কার্যের তীব্র সমালোচনা করলো। এর ফলে ইসলামী আন্দোলনে এইসব লোকের ভূমিকা কি, তাও অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো। এভাবে বহু দো-দিল বান্দাহ ইসলামী সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং এই শ্রেণীর মিত্ররুপী শত্রুদের দুষ্ট প্রভাব থেকে আন্দোলনও বহুলাংশে মুক্ত হলো।
৯.
ইসলামী আন্দোলনের প্রতিরক্ষা
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, মক্কার অদূরবর্তী আকাবা নামক স্থানে মদিনার কিছু লোক হযরত (সা:) এর কাছে আনুগত্যে শপথ গ্রহণ করেছিল। তারা হযরত মুহাম্মদ (সা:) এবং তার সঙ্গী-সাথীদের মদিনায় চলে আসবার জন্যে তার খেদমতে একটি প্রস্থাবও পেশ করেছিল। তখনই এ আশংকা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছিল যে, এইশপথও প্রস্তাব প্রকৃতপক্ষে তামাম আরব উপদ্বীপের প্রতি মদিনাবাসীদের একটি চ্যালেঞ্জ স্বরুপ।এ ব্যাপারে শপথ গ্রহণকারীদের অন্যতম পুরোধা হযরত আব্বাস বিন উবাদাহ (রা:) তার সাথীদের উদ্দেশ্য করে যা বলেছিলেন, আজো তা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেঃ ‘তোমরা কি জানো, এই ব্যক্তির কাছে তোমরা কি জিনিসের শপথ গ্রহণ করছো? তোমরা এর কাছে শপথ গ্রহণ করে প্রকৃতপক্ষে সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছো।
(টীকাঃ ৩৯- এখানে এরূপ সন্দেহ করা সমীচীন নয় যে, ইসলাম শুধু প্রতিরক্ষার জন্যেই যুদ্ধ করে থাকে, বরং দ্বীন-ইসলামের যখন প্রয়োজন হয়, তখন সত্যকে অগ্রসর হয়েই মিথ্যার জারি-জুরি ভেঙে দিতে হয়। ইসলামী আন্দোলনকে এ ধরনের যে সব যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল, তার পর্যালোচনা সামনে II )
সুতরাং তোমরা যদি ধারণা করে থাকো যে, তোমাদের জান-মাল ও সম্ভ্রান- ব্যক্তিগণ বিপন্ন হয়ে পড়লে একে একে দুশমনদের হাতে সোপর্দ করে দিবে, তাহলে আজই একে পরিত্যাগ করা তোমাদের পক্ষে উত্তম। কেননা খোদার কসম,দুনিয়া এবং আখিরাত উভয়ের পক্ষেই এটা চরম অবমাননাকর। পক্ষান্তরে তোমাদের উদ্দেশ্য যদি এ-ই হয় যে, তোমাদের জান-মাল ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ বিপন্ন হলেও তোমরা তাকে রক্ষা করবে,তাহলে নিসন্দেহ এর হাত তোমরা আঁকড়ে ধরো। খোদার কসম,এটা দুনিয়া এবং আখিরাত উভয়ের পক্ষেই কল্যাণকর।’ এ সময় গোটা প্রতিনিধিদলই সম্মিলিতভাবে বলেছিলেন: ‘আমরা একে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের জান-মাল ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতেও প্রস্তুত আছি। ’ এবার মদিনাবাসীদের সেই প্রতিশ্রুতিরই সত্যতা যাচাইয়ের সময় এলো।
কুরাইশদের বিপদ
মদিনায় মুসলমান এবং হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর স্থানান্তরিত হবার অর্থ ছিল এই যে, এবার ইসলাম অন্তত দাঁড়াবার মতো একটি জায়গা পেলো এবং মুসলমানরাও বারবার ধৈর্যের পরীক্ষা দেবার পরিবর্তে একটি সুসংহত সমাজ সংগঠনে পরিণত হলো। কুরাইশদের পক্ষে এ ছিল একটি কঠিন বিপদের ইঙ্গিত। তারা স্পষ্টভাবে দেখতে পেলো, এভাবে ইসলামী সংগঠনের শক্তি সঞ্চয় প্রকৃতপক্ষে তাদের জাহিলী ব্যবস্থারই মৃত্যু ঘটার শামিল। এ ছাড়া আরও একটি কঠিন আশংকা তাদেরকে অস্থির করে তুলেছিল। তাহলো এই যে, মক্কাবাসীদের জীবিকার একটি বড় উপায় ছিল ইয়েমেন ও সিরিয়ার বাণিজ্য। আর লোহিত সাগরের তীর দিয়ে সিরিয়া পর্যন্ত যে বানিজ্য-পথ ছিলো, মদিনা ঠিক তারই ওপর অবস্থিত। সুতরাং মদিনায় মুসলমানদের শক্তি অর্জনের অর্থ ছিলোঃ মুসলমানদের সঙ্গে সুষ্ঠু সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে কুরাইশদেরকে সিরিয়ায় বানিজ্যিক সুবিধা ভোগ করতে হবে। নতুবা মুসলিম শক্তিকে চিরতরে খতম করে দিয়ে ঐ পথে তাদের ব্যবসায়ের পণ্য চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ কারণেই হিজরতের আগে মুসলমানরা যাতে মদিনায় গিয়ে জমায়েত হতে না পারে, সেজন্যে কুরাইশরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ায় তারা এই ক্রমবর্ধমান বিপদকে যেভাবে হোক, চিরতরে মিটিয়ে ফেলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
কুরাইশদের চক্রান্ত
আবদুল্লাহ বিন উবাই ছিলো মদীনার একজন প্রভাবশালী ইয়াহূদী সর্দার। হিজরতের আগে মদীনাবাসীগণ তাকে নিজেদের বাদশা নিযুক্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। কিন্তু বিপুল সংখ্যক মদিনাবাসীর ইসলাম গ্রহণ এবং মক্কা থেকে হযরত (সা:) এর মদিনায় আগমনের ফলে এই পরিকল্পনাটি বানচাল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে আব্দুল্লাহ বিন উবাইর আশা আকাঙ্ক্ষাও পণ্ড হয়ে যায়। এমনি সময় মক্কাবাসীগণ তাকে এই মর্মে একটি চিঠি লিখলোঃ‘তোমরা আমাদের লোকদেরকে আশ্রয় দান করেছো। আমরা খোদার কসম করে বলছি, হয় তোমরা নিজেরা লড়াই করে ওখান থেকে তাদের তাড়িয়ে দাও, নচেত আমরা সবাই মিলে তোমাদের ওপর হামলা চালাবো; তোমাদের পুরুষদের কে হত্যা করবো এবং মেয়েদেরকে বাঁদি বানিয়ে রাখবো।’ এই চিঠিখানি আবদুল্লাহ বিন উবাইর হতাশ মনে কিছুটা আশার সঞ্চার করলো। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা:) যথাসময়ে তার নষ্টামি প্রতিরোধ করার জন্যে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলেন। তিনি তাকে এই বলে বুঝালেন যে, ‘তুমি কি আপন পুত্র এবং ভাইদের সঙ্গে লড়াই করতে চাও? যেহেতু মদিনাবাসীদের (আনসার) অধিকাংশই ইতোমধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, এজন্যে আব্দুল্লাহ বিন উবাইর শেষ পর্যন্ত তার উচ্চাভিলাস থেকে বিরত হলো।
এসময়েই একবার মদিনার নেতা সা’দ বিন মা’আজ উমরা উপলক্ষে মক্কা গমন করলেন। কা’বার দরজায় আবু জেহেলের সঙ্গে তার সাক্ষাত হলো। আবু জেহেল তাকে বললোঃ ‘তোমরা আমাদের ধর্মত্যাগীদের(মুসলমানদের) আশ্রয় দান করেছো আর তোমাদেরকে নিশ্চিন্তে – কা’বা তাওয়াফ করতে দিবো? তুমি যদি উমাইয়া বিন খালাফের মেহমানই না হতে তাহলে এখান থেকে জিন্দা যেতে পারতে না। একথা শুনে সা’দ বললেনঃ খোদার কসম, তোমরা যদি আমায় এতে বাধা দান করো, তাহলে তোমাদের পক্ষে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে (অর্থাৎ মদিনার ওপর দিয়ে বাণিজ্য যাত্রায় ) আমি তোমাদেরকে বাধা দিবো। বস্তুত কুরাইশরা কোনরূপ নষ্টামি করলে মদিনার ওপর দিয়ে তাদের বাণিজ্য পথ বন্ধ হয়ে যাবে, এ ছিল তারই সুস্পষ্ট ঘোষণা।
কুরাইশদের ওপর চাপ প্রদান
বস্তত এ সময় কুরাইশরা মুসলমান এবং ইসলামী আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে যে পরিকল্পনা আঁটছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে তাদেরকে জব্দ করতে হলে তাদের ঐ বাণিজ্য পথটি দখল করে সিরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য পথ বন্ধ করে দেওয়ার চেয়ে উত্তম পন্থা মুসলমানদের কাছে আর কিছুই ছিল না। একমাত্র এহেন চাপের দ্বারাই মক্কাবাসী কুরাইশদের জব্দ করা সম্ভব ছিল। তাই হযরত (সা:) এ বাণিজ্য পথটির নিকটবর্তী ইহুদী বাসিন্দাদের সঙ্গে বিভিন্নরুপ চুক্তি সম্পাদন করে যেমন নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন, তেমনি কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাকে শাঁসানোর জন্যে মাঝে মাঝে মুসলমানদের ছোট ছোট প্রহরী দল ও পাঠানো শুরু করলেন। অবশ্য এইসব প্রহরী দলের দ্বারা না কখনো কোন খুন-খারাবী হয়েছে আর না কোন কাফেলার ওপর লুটতরাজ চলেছে। এদের প্রেরণ করে শুধু কুরাইশদের জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, তারা যে পদক্ষেপই গ্রহণ করুক না কেন, হাওয়ার গতি কোন দিকে তা বুঝে শুনেই যেনো গ্রহণ করে। তারা যদি এখনো মুসলমানদের উত্তক্ত করতে চায়, তাহলে তাদেরকেও আপন ব্যবসায় থেকে হাত গুটাতে হবে।
হাযরামীর হত্যা
এরই মধ্যে কুরাইশগণ কখন কি পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তা জানবার জন্যে হযরত মুহাম্মদ (সা:) সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যথারীতি অবহিত থাকার চেষ্টা করতে লাগলেন। দ্বিতীয় হিজরীর রজব মাসে তিনি বারোজন লোক দিয়ে আব্দুল্লাহ বিন হাজারকে নাখলার দিকে পাঠালেন। জায়গাটি মক্কা ও তায়েফের মাঝখানে অবস্থিত। হযরত মুহাম্মদ (সা:) আব্দুল্লাহর হাতে একটি দিয়ে বললেনঃ এটি দু’দিন পরে খুলবে। ’আব্দুল্লাহ যথাসময়ে চিঠিখানা খুলে দেখলেন,‘নাখলা নামক স্থানে অবস্থান করো কুরাইশদের অবস্থান জেনে নিয়ে খবর দাও।’ ঘটনাক্রমে কুরাইশদের কতিপয় লোক সিরিয়া থেকে ব্যবসায়ের পণ্য নিয়ে ঐ পথ দিয়ে আসছিল। হযরত আব্দুল্লাহ তাদের মুকাবেলা করলেন। ফলে আমর বিন হাযরামী নামক এক ব্যক্তি নিহত হলো।এছাড়া আরো দুই ব্যক্তি কে বন্ধী করা হলো এবং গনীমতের মাল ও যুদ্ধের পরিত্যক্ত সম্পদ সংগ্রহ করা হলো। হযরত আবদুল্লাহ মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে এই ঘটনার কথা বিবৃত করে হযরত মুহাম্মদ (স) এর খেদমতে গণীমতের মাল উপস্থাপন করলেন। কিন্তু হযরত (স) এতে বেজায় অসন্তুষ্ট হয়ে বললেনঃ আমি তো তোমাকে এর অনুমতি দেয়নি। তিনি গণীমতের মাল গ্রহণেও অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।
এই দুর্ঘটনায় নিহত ও ধৃত ব্যক্তিগণ অত্যন্ত উত্তেজিত হলো তারা মুসলমাদের কাছ থেকে রক্তের বদলা নেবারও একটি অজুহাত খুঁজে পেলো।
বদর যুদ্ধের পটভূমি
এমনি অবস্থায় দ্বিতীয় হিজরীর শা’বান মাসে (৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রূয়ারী কিংবা মার্চ কুরাইশদের এক বিরাট কাফেলা সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মুসলিম অধিকৃত এলাকার কাছাকাছি এসে পৌঁছলো। কাফেলার সঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার আশরাফী মূল্যের ধন-মাল এবং ৩০/৪০জনের মতো তত্ত্বাবধায়ক (মুহাফেজ ) ছিল। তাদের ভয় ছিল, মদিনার নিকটে পৌঁছলে মুসলমানরা হয়ত তাদের ওপর হামলা করে বসতে পারে। কাফেলার নেতা ছিল আবু সুফিয়ান। সে এই বিপদাশংকা উপলব্ধি করেই এক ব্যক্তিকে সাহায্যের জন্যে মক্কায় পাঠিয়ে দিল। ঐ লোকটি মক্কায় পৌঁছেই এই বলে শোরগোল শুরু করলো যে, ‘তাদের কাফেলার ওপর মুসলমানরা লুটতরাজ চালাচ্ছে। সুতরাং সাহায্যের জন্যে সবাই ছুটে চলো।’
কাফেলার সঙ্গে যে ধন-মাল ছিল, তার সাথে বহু লোকের স্বার্থ জড়িত ছিল। ফলে এ একটা জাতীয় সমস্যায় পরিণত হলো। তাই সাহায্যের ডাকে সাড়া দিয়ে কুরাইশদের সমস্ত বড় বড় সর্দারই যুদ্ধের জন্যে বেরিয়ে পড়লো। এভাবে প্রায় এক হাজার যোদ্ধার এক বিরাট বাহিনী তৈরি হয়ে গেল।এই বাহিনী অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা ও শান-শওকতের সঙ্গে মক্কা থেকে যাত্রা করলো। এদের হৃদয়ে একমাত্র সংকল্প:মুসলমানদের অস্তিত্ব এবার নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে, যেন নিত্যকার এই ঝঞ্ঝাট চিরতরে মিটে যায়। বস্তত,একদিকে তাদের ধন-মাল রক্ষার আগ্রহ, অন্যদিকে পুরনো দুশমনি ও বিদ্বেষের তাড়না – এই দ্বিবিধ ক্রোধ ও উন্মাদনার সঙ্গে কুরাইশ বাহিনী মদিনা আক্রমনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো।
কুরাইশদের হামলা
এদিকে রাসূলুল্লাহ (সা:) এর কাছেও এই পরিস্থিতি সম্পর্কে যথারীতি খবর পৌঁছতে লাগলো। তিনি বুঝতে পারলেন, এবার সত্যসত্যই মুসলমানদের সামনে এক কঠিন সংকটকাল উপস্থিত হয়েছে। এবার যদি কুরাইশরা তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফলকাম হয় এবং মুসলমানদের এই নয়া সমাজ-সংগঠনটিকে পরাজিত করতে পারে, তাহলে ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে সামনে এগোনো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। এমনকি, এর ফলে ইসলামের আওয়াজও হয়তো চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। মদিনায় হিজরতের এ যাবত দুটি বছর ও অতিক্রান্ত হয়নি। মুহাজিরগণ তাদের সবকিছুই মক্কায় ফেলে এসেছে এবং এখনো তারা রিক্তহস্ত। আনসার গণ যুদ্ধ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। অন্যদিকে ইহুদীদেরও অনেকগুলো গোত্র বিরুদ্ধতার জন্যে প্রস্তত। খোদ মদিনায় মুনাফিক এবং মুশরিকদের অবস্থিতি এক বিরাট সমস্যার রুপ পরিগ্রহ করেছে। এমনি অবস্থায় কুরাইশরা যদি মদিনা আক্রমণ করে,তাহলে মুসলমানদের এই মুষ্টিমেয় দলটি হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়েও যেতে পারে। আর হামলা যদি নাও করে বরং আপন শক্তি বলে,শুধু কাফেলাকে মুক্ত করে নিয়ে যায়,তবুও মুসলমানরা নিবীর্য হয়ে পড়বে। অতঃপর তাদেরকে জব্দ করতে আশ-পাশের গোত্রগুলোকে আর কোন বেগ পেতে হবে না। কুরাইশদের ইঙ্গিতে তারা মুসলমানদের কে নানাভাবে উত্যক্ত করতে শুরু করবে। এদিকে মদিনার ইহুদী,মুনাফিক এবং মুশরিকগণও মাথা তুলে দাঁড়াবে। ফলে মুসলমানদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। এসব কারণেই হযরত মুহাম্মদ (সা:) সিদ্ধান্ত নিলেন যে, বর্তমানে যতটুকু শক্তিই সঞ্চয় করা সম্ভব,তা নিয়েই ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং মুসলমানদের কে আপন বাহুবল দ্বারা টিকে থাকার অধিকার প্রমাণ করতে হবে।
মুসলমানদের প্রস্তুতি
এই সিদ্ধান্তের পর নবী করীম (সা:) মহাজির ও আনসার গণকে জমায়েত করে তাদের সামনে সমগ্র পরিস্থিতি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরলেনঃ‘একদিকে মদিনার উত্তর প্রান্তে রয়েছে ব্যবসায়ী কাফেলা আর অন্য দিকে দক্ষিণ দিক থেকে আসছে কুরাইশদের সৈন্য-সামন্ত। আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, এর যেকোন একটি তোমরা লাভ করবে। বলো,তোমরা এর কোনটি মুকাবেলা করতে চাও? জবাবে বহু সাহাবী কাফেলার ওপর আক্রমণ চালানোর আগ্রহ প্রকাশ করলেন। কিন্তু নবী করীম (সা:) এর দৃষ্টি ছিল সুদূরপ্রসারী। তাই তিনি তার প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করলেন। এরপর মুহাজির দের ভেতর থেকে মিকদাদ বিন আমর(রা:) নামক জনৈক্য সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেনঃ‘হে আল্লাহর রাসূল! প্রভু আপনাকে যেদিকে আদেশ করেছেন সেদিকেই চলুন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আমরা বনী ইসরাঈলের মতো বলতে চাইনা – যাও তুমি এবং তোমার খোদা গিয়ে লড়াই করো, আমরা এখানে বসে থাকবো। ৪০
কিন্তু এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আনসারদের থেকেও মতামত গ্রহণের প্রয়োজন ছিল। এজন্যে হযরত (সা:) তাদেরকে সরাসরি সম্বোধন করে উল্লিখিত প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করলেন। এরপর হযরত সা’দ বিন মা’আজ (রা:) দাঁড়িয়ে বললেন। হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি। আপনাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছি এবং আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা সবই সত্য বলে সাক্ষ্য দিয়েছি। সর্বোপরি আমরা আপনার আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছি। অতএব হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা-ই কার্যে পরিণত করুন। যে মহান সত্ত্বা আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, তার কসম, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সমুদ্রে গিয়ে ও ঝাঁপ দেন, তবুও আমরা আপনার সাথে থাকবো এবং এ ব্যাপারে আমাদের একটি লোকও পিছু হঠবে না। আমরা যে শপথ নিয়েছি, যুদ্ধকালে তা হরফে হরফে পালন করবো। সাচ্চা আত্মোৎসর্গীর ন্যায় আমরা শত্রুদের মুকাবেলা করবো। কাজেই আল্লাহ খুবই শিগগিরই আমাদের দ্বারা আপনাকে এমন জিনিস দেখাবেন, যা দেখে আপনার চক্ষু শীতল হয়ে যাবে। অতএব, আল্লাহর রহমত ও বরকতের ওপর ভরসা করে আপনি আমাদের নিয়ে এগিয়ে চলুন।
এই বক্তৃতার পর স্থির করা হলো যে, কাফেলার পরিবর্তে সৈন্যদেরই মুকাবেলা করা হবে। কিন্তু এটা কোনো মামুলি সিদ্ধান্ত ছিল না। কারণ কুরাইশদের তুলনায় মুসলমানদের সংগঠন ছিল নেহাত দুর্বল। এর মধ্যে যুদ্ধ করার মত যোগ্য লোকের সংখ্যা ছিল তিনশোর চেয়ে কিছু বেশি। এর মধ্যে ঘোড়া ছিল মাত্র দু’-তিন জনের কাছে। উট ছিল মাত্র সত্তরটির মতো। যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম ও ছিল অপ্রতুল। মাত্র ষাট ব্যক্তির কাছে ছিল লৌহবর্ম। এ কারণে মাত্র কতিপয় মুসলমান ছাড়া বাদবাকী সবারই মনে ভীতির সঞ্চার হলো। তাদের অবস্থা দেখে মনে হতে লাগলো, যেনো জেনে-শুনে তারা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। সূরা আনফালের নিম্নোক্ত আয়াতে এই দৃশ্যই ফুটে উঠেছেঃ
كَمَا أَخْرَجَكَ رَبُّكَ مِن بَيْتِكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ فَرِيقًا مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ لَكَارِهُونَ ﴿٥﴾ يُجَادِلُونَكَ فِي الْحَقِّ بَعْدَ مَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُونَ إِلَى الْمَوْتِ وَهُمْ يَنظُرُونَ ﴿٦﴾ وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللَّـهُ إِحْدَى الطَّائِفَتَيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّونَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُونُ لَكُمْ وَيُرِيدُ اللَّـهُ أَن يُحِقَّ الْحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِينَ ﴿٧﴾ لِيُحِقَّ الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُونَ ﴿٨﴾
“ (হে নবী!) এই লোকগুলো তো আপন বাড়ি ঘর থেকে তেমনি বের হওয়া উচিত ছিল,তোমার প্রভু যেমন তোমায় সত্য সহকারে তোমার গৃহ থেকে বের করে এনেছেন; কিন্তু মুসলমানদের একটি দলের কাছে এ ছিল অত্যন্ত অপছন্দনীয়। তারা সত্য সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হওয়ার পরও সে সম্পর্কে তোমার সঙ্গে তর্ক করছিল; তাদেরকে যেন দৃশমান মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। (সেই সময়ের কথা) স্মরণ করো,যখন আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে ওয়াদা করেছিলেন,(আবু সুফিয়ান ও আবু জেহেলের ) দুই দলের মধ্যে থেকে যেকোন একটি তোমাদের করায়ত্ত হবে। আর তোমরা চেয়েছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল(অর্থাৎ নিরস্ত্র)দলটিকে বশীভূত করতে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল তিনি আপন বিধানের দ্বারা সত্যকে অজেয় করে রাখবেন এবং কাফিরদের মূলোচ্ছেদ করে দিবেন, যেন সত্য সত্য হয়েই থাকে এবং মিথ্যা মিথ্যাই থেকে যায় -অপরাধীদের কাছে এটা যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন।”
মদিনা থেকে মুসলমানদের যাত্রা
যুদ্ধ সম্ভার ও রসদ পত্রের এই দৈন্য সত্ত্বেও দ্বিতীয় হিজরীর ১২ রমজান নবী করীম (সা:) আল্লাহর ওপর ভরসা করে মাত্র তিনশ’র মতো মুসলমান নিয়ে মদিনা থেকে যাত্রা করেন। তারা সোজা দক্ষিণ কোণে পা বাড়ালেন; কারণ কুরাইশদের বাহিনীটি ঐ দিক থেকে আসছিল। ১৬ রমজান তারা বদরের নিকটে পৌঁছলেন। এটি মদিনা থেকে কিঞ্চিত দিক ৮০মাইল দক্ষিন -পশ্চিম অবস্থিত একটি প্রান্তর। এখানে পৌঁছার পর জানা গেল যে, কুরাইশ বাহিনী প্রান্তরের অপর সীমান্তে এসে পৌঁছেছে। তাই হযরত(সা:) এর নির্দেশে এখানে ছাউনি ফেলা হলো।
কুরাইশদের বাহিনীটি অত্যন্ত জাঁকালো সাজ-সজ্জা সহকারে বের হয়েছিল। এদের দলে এক সহস্রাধিক সৈন্য ছিলো,সর্দার ছিলো প্রায় একশোর মতো। সৈন্যদের জন্যে রসদ-পত্রেরও খুব উত্তম আয়োজন ছিল। উতবা বিন রাবিয়া ছিল সিপাহসালার।
বদরের কাছে কাছে পৌঁছে কুরাইশ সৈন্যরা জানতে পারলো যে, তাদের বাণিজ্য কাফেলা মুসলমানদের আয়ত্ত্বের বাইরে রয়েছে।এতে জাররাহ ও আদী গোত্রের প্রধানগণ বললো যে, এখন আর আমাদের যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আবু জেহেল তাতে সায় দিলেন না। ফলে জাররাহ ও আদী গোত্রের লোকেরা মক্কায় ফিরে গেল এবং বাকী সৈন্যরা সামনে অগ্রসর হলো।
যুদ্ধক্ষেত্রের যে অংশটি কুরাইশদের দখলে ছিল, উপযোগিতার দিক দিয়ে তা ছিল খুবই উত্তম তাদের জমিন ছিল অত্যন্ত মজবুত। পক্ষান্তরে মুসলমানরা যেখানে ছাউনি ফেলেছিল,তা ছিল লবণাক্ত ভূমি। সৈন্যদের পা তাতে দেবে যাচ্ছিল। অন্যান্য দিক দিয়েও তাদের অসুবিধা ছিল প্রচুর। এই পরিস্থিতিতে রাতভর সমস্ত সৈন্য বিশ্রাম গ্রহণ করলো; কিন্তু নবী করীম (সা:)সারারাত ইবাদাত -বন্দেগীতে মশগুল রইলেন। ১৭রমজান ফজরের পর তিনি মুসলিম সৈন্যদের সামনে জিহাদ সম্পর্কে এক উদ্দীপনাময় ভাষণ দিলেন। অতঃপর যুদ্ধের নিয়ম অনুসারে সৈন্যদের শ্রেণী বিন্যাস করা হলো। এ বছরই মুসলমানদের প্রতি রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয়,এই পয়লা রোজার মধ্যেই মুসলমানদের তিনগুন বেশি সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্যে প্রস্তুত হতে হলো। কি কঠোর পরীক্ষা!
সে রাতে আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমত স্বরুপ দুটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো। প্রথমত,মুসলিম সৈন্যগণ অত্যন্ত প্রশান্তি ও সুনিদ্রার ভেতর দিয়ে রাত যাপন করলো। প্রত্যুষে তারা সতেজ বল-বীর্য নিয়ে ঘুম থেকে জাগলো দ্বিতীয়ত, রাতে খুব বৃষ্টিপাত হলো। তার ফলে লবণাক্ত জমি শক্ত হয়ে গেলো। এবং মুসলমানদের পক্ষে ময়দান খুব উপযোগী হলো। পক্ষান্তরে এই বৃষ্টির ফলে কুরাইশদের অধিকৃত অংশ কর্দমাক্ত হয়ে গেল এবং তাতে সৈন্যদের পা দেবে যেতে লাগলো।পরন্ত মুসলমানদের অধিকৃত অংশের নীচু ভূমিতে পানি জমে গেল এবং তাতে তাদের ওযু-গোসল ইত্যাদির প্রচুর সুযোগ হলো। এসব কারণে মুসলমানদের অন্তর থেকে ভয়-ভীতি ও শংকাবোধ দূর হয়ে গেল সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত মনে তারা শত্রু সৈন্যদের মুকাবেলার জন্যে প্রস্তত হলো।
ময়দানে যখন উভয় পক্ষের সৈন্যদল মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো, তখন এক অদ্ভূত দৃশ্যের অবতারণা হলো। একদিকে ছিল আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণকারী তার বন্দেগী ও আনুগত্য স্বীকারকারী মাত্র ৩১৩ জন মুসলমান, যাদের কাছে সাধারুণ যুদ্ধ সরঞ্জাম পর্যন্ত ছিল না। অন্যদিকে ছিল অস্ত্র-শস্ত্র ও রসদ-পত্রে সুসজ্জিত এক সহস্রাধিক কাফির সৈন্য,যারা এসেছে তওহীদের আওয়াজকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে নবী কারীম(সা:) খোদার দরবারে হাত তুললেন এবং অতীব বিনয় নম্রতার সাথে বললেনঃ‘হে খোদা এই কুরাইশরা চরম ঔদ্ধত্য ও অহমিকা নিয়ে এসেছে তোমার রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে। অতএব আমায় যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি তুমি দিয়েছিলে,এখন সে সাহায্য প্রেরণ করো। হে খোদা! আজ এই মুষ্টিমেয় দলটি যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে দুনিয়ায় তোমার বন্দেগী করার আর কেউ থাকবে না। ’
এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল মুহাজিরদেরকে। এদের প্রতিপক্ষ ছিল আপন ভাই,পুত্র এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজন। কারো বাপ, কারো চাচা, কারো মামা আর কারো ভাই ছিল তার তলোয়ারের লক্ষ্যবস্তু এবং নিজ হাতে তাদের হত্যা করতে হয়েছিল এইসব কলিজার টুকরা কে। এই কঠিন পরীক্ষায় কেবল তারাই টিকে থাকতে পেরেছিল, যারা সাচ্চা দিলে আল্লাহর সঙ্গে ওয়াদা করেছিলঃ যে সব সম্বন্ধকে তিনি বজায় রাখতে বলেছেন,তারা শুধু তাই বজায় রাখবে আর যেগুলোকে তিনি ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন – তা যতোই প্রিয় হোক না কেন – তারা ছিন্ন করে ফেলবে।
কিন্তু সেই সঙ্গে আনসারদের পরীক্ষাও কোনো দিক দিয়ে সহজ ছিল না। এ যাবত আরবের কাফির এবং মক্কার মুশরিকদের চোখে তাদের ‘অপরাধ’ ছিল এটুকু যে, তারা তাদের দুশমন অর্থাৎ মুসলমানদের কে আশ্রয় দান করেছে। কিন্তু এবার তারা প্রকাশ্যভাবেই ইসলামের সমর্থনে কাফির মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, তারা তাদের জনপদটির (মদিনা) বিরুদ্ধে গোটা আরবদেরকেই দুশমন বানিয়ে নিয়েছে। অথচ মদিনার জনসংখ্যা তখন সাকুল্যে এক হাজারের বেশি ছিল না। এতো বড় দুঃসাহস তারা এজন্যেই করতে পেরেছিল যে, তাদের হৃদয় আল্লাহর ও রাসূলের মুহাব্বত এবং আখিরাতের প্রতি অবিচল ঈমানে পরিপূর্ণ হয়েছিল। নতুবা আপন ধন-দৌলত স্ত্রী-পুত্র-পরিবারকে এভাবে সমগ্র আরব ভূমির শত্রুতার ন্যায় কঠিন বিপদের মুখে কে নিক্ষেপ করতে পারে?
কুরাইশদের পরাজয়
বস্তুত ঈমানের এই স্তরে উন্নীত হবার পরই বান্দার জন্যে আল্লাহর সাহায্য অবতীর্ণ হয়ে থাকে। বদর যুদ্ধেও তাই আল্লাহ তাআলা এই সহায়-সম্বলহীন ৩১৩ জন মুসলমানকে সাহায্য দান করেন। এর ফলে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এক সহস্রাধিক সুসজ্জিত সৈন্য অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো এবং তাদের সমস্ত শক্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেল। এই যুদ্ধে কুরাইশ পক্ষের প্রায় ৭০ ব্যক্তি নিহত হলো এবং সম সংখ্যক লোক বন্দী হলো।নিহতদের মধ্যে তাদের বড় বড় নামজাদা সর্দারগণ প্রায় সবাই ছিল। এদের মধ্যে শায়বা, উতবা, আবু জেহেল, জামআহ, আস, উমাইয়া প্রমুখ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব নামজাদা সর্দারের মৃত্যুর ফলে কুরাইশদের মেরুদণ্ড একেবারে ভেঙ্গে পড়লো। মুসলমানদের পক্ষে প্রায় ৬ জন মুহাজির এবং ৮ জন আনসার শহীদ হলেন।
যুদ্ধে যারা বন্দী হলো, তাদের কে দু’-দু’ চার জন করে সাহাবীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হলো এবং নবী করীম (সা:) তাদের কে সদাচরণ করার নির্দেশ দান করলেন। ফলে সাহাবীগণ তাদের কে এমনি আরামে রাখলেন যে, বহুতর ক্ষেত্রে তারা নিজেরা কষ্ট স্বীকার করলেও বন্দীদের কষ্ট দেন নি। এই সদাচরণের ফলে তাদের হৃদয়ে ইসলামের জন্যে অনেক নম্রতার সৃষ্টি হলো। আর এটাই ছিল আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। পরে এইসব বন্দীর অনেকেই ফিদয়ার(মুক্তিপণ) বিনিময়ে মুক্তি লাভ করে। যারা গরীব অথচ শিক্ষিত ছিল, তাদেরকে দশ-দশটি শিশুকে লেখাপড়া শেখানোর বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয়।
বদর যুদ্ধের ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া
ফলাফল ও প্রতিক্রিয়ার দিক দিয়ে বদর যুদ্ধ ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের দাওয়াত অগ্রাহ্য করার দরুন মক্কার কাফের দের জন্যে যে খোদায়ী আযাব নির্ধারিত হয়েছিল, এ যুদ্ধ ছিল তারই প্রথম নিদর্শন। তাছাড়া ইসলাম ও কুফরের মধ্যে মূলত কার টিকে থাকবার অধিকার রয়েছে এবং ভবিষ্যতের হাওয়ার গতিই বা কোন দিকে মোড় নেবে, এ যুদ্ধ তা স্পষ্টত জানিয়ে দিল। এ কারণেই একে ইসলামী ইতিহাসের পয়লা যুদ্ধ বলা হয়। কুরআন পাকের সূরা আনফালে এই যুদ্ধ সম্পর্কে অনেক বিস্তৃত পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে দুনিয়ার রাজা- বাদশাহ বা জেনারেলগণ কোন যুদ্ধ জয়ের পর যে ধরণের পর্যালোচনা করে থাকে, এ পর্যালোচনা তা থেকে সম্পুর্ণ স্বতন্ত্র।
এ পর্যালোচনার একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এর ওপর একটু বিস্তৃত ভাবে দৃষ্টিপাত করলে ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃতি এবং মুসলমানদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।
বদর যুদ্ধের পর্যালোচনা এবং মুসলমানদের প্রশিক্ষণ
১. পূবেই বলা হয়েছে যে, ইসলামের আগে যুদ্ধ ছিল আরবদের একটি প্রিয় ‘হবি’। যুদ্ধে যে মাল-পত্র (গনিমত) হস্তগত হতো, তার প্রতি ছিল তাদের দুর্নিবার মোহ। এমনকি কখনো কখনো ঐ মাল-পত্রের আকর্ষণই তাদের যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াতো। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল ধন-সম্পদের চেয়ে অনেক উন্নত সে উদ্দেশ্যকে মুসলমানদের হৃদয়-মূলে বদ্ধমূল করে নেয়া অতীব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এ দিক দিয়ে বদর যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্যে একটি পরীক্ষামূলক যুদ্ধ। মুসলমানদের হৃদয়-মূলে ইসলামী যুদ্ধের নিয়ম-নীতি ও নৈতিক আদর্শ পুরোপুরি বদ্ধমূল হয়েছে, না অনৈসলামী যুদ্ধের ধ্যান-ধারণা তাদের হৃদয়ে এখনো প্রভাব বিস্তার করে আছে, এই যুদ্ধ ছিল তারই পরীক্ষামাত্র।
বদর যুদ্ধে কাফিরদের মালমাত্তা যাদের হস্তগত হয়েছিল, তারা পুরনো রীতি অনুযায়ী তাকে তাদের আপন সম্পত্তি বলেই মনে করে বসলো। ফলে যারা কাফিরদের পেছনে ধাওয়া করা কিংবা হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর নিরাপত্তার কাজে ব্যস্ত ছিল,তারা কিছুই পেল না। এভাবে তাদের পরস্পরের মধ্যে কিছুটা তিক্ততার সৃষ্টি হলো। ইসলামী আন্দোলনের ধারক ও বাহকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার এটাই ছিল উপযুক্ত সময়। তাই সর্ব প্রথম তাদেরকে স্পষ্টভাবে বলা হলো যে, গনীমতের মাল প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের কোন পারিশ্রমিক নয়। এ হচ্ছে আপন পারিশ্রমিকের বাইরে মালিকের তরফ থেকে দেয়া একটি বাড়তি অবদান বা পুরস্কার বিশেষ(আনফাল)। আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার যথার্থ প্রতিদান তো তিনি আখেরাতেই দান করবেন। এখানে যা কিছু পাওয়া যায়, তা কারো ব্যক্তিগত স্বত্ত্ব (হক) নয়, তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার একটি বাড়তি অবদান মাত্র। কাজেই এই অবদান সম্পর্কে কারোর স্বত্ত্বাধিকার দাবির প্রশ্নই উঠে না। এর স্বত্ত্বাধিকার হচ্ছে আল্লাহ এবং তার রাসূলের। তারা যেভাবে চান, সেভাবেই এর বিলি-বণ্টন করা হবে। এর পর সামনে অগ্রসর হয়ে এই বিলি-বণ্টনের নীতিমালাও বাতলে দেয়া হলো। এভাবে যুদ্ধ সংক্রান্ত এক বিরাট প্রশ্নের নিষ্পত্তি করা হলো। মুসলমানদের কে চূড়ান্ত ভাবে বলে দেয়া হলো যে, তারা দুনিয়ার ফায়দা হাসিলের জন্যে কখনো অস্ত্র ধারণ করতে পারে না,বরং দুনিয়ার নৈতিক বিকৃতিকে সংশোধন করা এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে গায়রুল্লাহর গোলামী থেকে মুক্ত করার অপরিহার্য প্রয়োজনেই তাদের শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। তারা যখন দেখবে যে, বিরুদ্ধ শক্তি তাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে শক্তি প্রয়োগ করতে উদ্যত হয়েছে এবং দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে সংশোধন প্রচেষ্টাকে অসম্ভব করে তুলেছে,ঠিক তখনি এরুপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে কাজেই তারা যে সংস্কার সংকল্প নিয়েছে, তাদের দৃষ্টি শুধু সেদিকেই নিবদ্ধ থাকা উচিত এবং এই লক্ষ্য অর্জনের পথে কোনরুপ অন্তরায় হতে পারে, এমন কোন পার্থিব স্বার্থের দিকেই তাদের ফিরে তাকানো উচিত নয়।
২. ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় আমীর বা নেতার আনুগত্য হচ্ছে দেহের ভেতর রুহের সমতুল্য। তাই নেতৃ আদর্শের পরিপূর্ণ ও নির্ভেজাল আনুগত্যের জন্যে মনকে প্রস্তুত করার নিমিত্ত বারবার মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো।
(টীকাঃ ৪১– ইসলামে নেতৃ আদেশের আনুগত্য হচ্ছে যে কোনা সামষ্টিক কাজে সাফল্যের পূর্বশর্ত। তাই নেতৃ-আদেশ লংঘন একটি গুরুতর অপরাধ। অবশ্য আদেশটি যদি আল্লাহ ও রাসূলের নাফরমানি হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। – সম্পাদক)
আলোচ্য যুদ্ধের গনীমতের মাল সম্পর্কেও তাই সর্বপ্রথম লোকদের কাছে পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যের দাবি জানানো হলো এবং তাদেরকে বলে দেয়া হলো যে,এসব কিছুই আল্লাহ এবং তার রাসূলের স্বত্ত্বা। এ ব্যাপারে তারা যা ফয়সালা করেন, তাতেই সবার রাযী থাকতে হবে।
৩. সাধারণ আন্দোলনগুলোর প্রকৃতি এই যে, সেগুলো আপন কর্মী ও অনুবর্তীদের মনে উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্যে তাদের কৃতিত্বের কথা নানাভাবে উল্লেখ করে থাকে। এভাবে খ্যাতি-যশ লাভের আকাঙ্ক্ষাকে উস্কিয়ে দিয়ে লোকদের কে ত্যাগ তিতিক্ষার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয়। বস্তত এ কারণেই বড় বড় যুদ্ধ বা বিজয় অভিযানের পর এইসব আন্দোলন তার আত্মোৎসর্গী কর্মীদের মধ্যে বড়ো বড়ো খেতাব পদক ইনাম ইত্যাদি বিতরণ এবং নানাভাবে তাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করে থাকে। ফলে একদিকে তারা আপন কৃতিত্বের বদলা পেয়ে সন্তোষ লাভ করে এবং ভবিষ্যতে আরো অধিক ত্যাগ স্বীকারের জন্যে উদ্বুদ্ধ হয়, অন্যদিকে অপর লোকদের মনেও তাদেরই মতো উন্নত মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃতি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। মাত্র ৩১৩ জন মুসলিম সৈন্য কতৃক এক সহস্রাধিক কাফের সৈন্যকে পরাজিত করা এবং এক প্রকার বিনা সাজ-সরঞ্জামে কয়েকগুণ বেশি প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে নির্মূল করা সত্ত্বেও তাদের কে বলে দেয়া হলোঃতারা যেন এ ঘটনাকে নিজেদের বাহাদুরি বা কৃতিত্ব বলে মনে না করে। কারণ তাদের এ বিজয় শুধু আল্লাহর করুণা ও অনুগ্রহ মাত্র। কেবল তারই দয়া এবং করুণার ফলে এতো বড়ো শত্রু বাহিনীকে তারা পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছে। কাজেই তাদের কখনো আপন শক্তি -সামর্থের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়; বরং সর্বদা আল্লাহর ওপর ভরসা করা এবং তারই করুণা ও অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করে ময়দানে অবতরণ করার ভেতরে নিহিত রয়েছে তাদের আসল শক্তি। যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে হযরত (সা:) এক মুঠো বালু হাতে নিয়ে ‘শাহাদাতুল ওজুহ’ (চেহারা আচ্ছন্ন হয়ে যাক) বলে কাফিরদের দিকে ছুঁড়ে মারেন। এরপরই মুসলমান সেনারা একযোগে কাফিরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাদের কে ধরাশয়ী করে। অন্য লোক হলে এই ঘটনাকে নিজের ‘কেরামত ’ বা অলৌকিক কীর্তি বলে ইচ্ছামত গর্ব করতে পারতো এবং একে ভিত্তি করে তার অনুগামীরা ও নানারুপ কিস্সা-কাহিনীর সৃষ্টি করতো। কিন্তু কুরআন পাকে খোদ আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে বলে দিলেনঃ ‘তাদেরকে (কাফিরদেরকে ) তোমরা হত্যা করো নি, বরং তাদের হত্যা করেছেন আল্লাহ। ’ এমনকি তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা:) কে পর্যন্ত বলে দিলেন যে, ‘(বালু) তুমি ছুঁড়োনি,বরং ছুঁড়েছেন আল্লাহ এবং মুমিনদের কে একটি উত্তম পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ করা হয়েছে।’(সূরা আনফাল,আয়াতঃ১৮)। এভাবে মুসলমানদেরকে বলে দেয়া হলো যে,প্রকৃত পক্ষে সমস্ত কাজের চাবিকাঠি রয়েছে আল্লাহর হাতে এবং যা কিছু ঘটে তার নির্দেশ ও ইচ্ছানুক্রমেই ঘটে থাকে। মুমিনদের কাজ হচ্ছে আল্লাহর ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহ ও রাসূলের পূর্ণ আনুগত্য করা এর ভেতরই নিহিত রয়েছে তাদের জন্যে সাফল্য।
৪. ইসলামী আন্দোলনে জিহাদ হচ্ছে চূড়ান্ত পরীক্ষা, যার মাধ্যমে আন্দোলনের অনুবর্তীদের পূর্ণ যাচাই হয়ে যায়। যখন কুফর ও ইসলামের দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয় এবং মুমিনদের পক্ষে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ অব্যাহত রাখার জন্যে ময়দানে অবতরণ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না, তখন সেখান থেকে তাদের পশ্চাদপসরণ করা কিছুতেই সম্ভবপর নয়। আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে নেমে ময়দান থেকে পলায়ন করার অর্থ এ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না যে,
ক. মুমিন যে উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধ করতে নেমেছে, তার চেয়ে তার নিজের প্রাণ অধিকতর প্রিয় কিংবা
খ. জীবন ও মৃত্যু যে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ এবং তার হুকুম না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যু আসতেই পারে না আর হুকুম যখন এসে যায়,তখন মৃত্যু এক মুহূর্ত ও বিলম্বিত হতে পারে না – তার এই ঈমানই অত্যন্ত দুর্বল অথবা
গ. তার হৃদয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং আখিরাতের সাফল্যে ছাড়াও অন্য কোন আকাঙ্ক্ষা লালিত হচ্ছে এবং প্রকৃত পক্ষে সে খোদার দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে নিজেকে পুরোপুরি উৎসর্গ করতে পারেনি। যে, ঈমানের ভেতর এর কোনো একটি জিনিসও ঠাঁই নিয়েছে, তাকে কিছুতেই পূর্ণাঙ্গ ঈমান বলা যায় না। এ কারণেই ইসলামের এই প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধোপলক্ষে মুসলমানদের কে সুস্পষ্ট ভাবে বলে দেয়া হলো যে, যুদ্ধ থেকে পশ্চাদপসরণ করা মুমিনদের কাজ নয়। এ প্রসঙ্গে হযরত (সা:) ইরশাদ করেন, তিনটি গুনাহের মুকাবেলায় মানুষের কোন নেকীই ফলপ্রসূ হতে পারে নাঃ এক,খোদার সাথে শিরক,দুই,পিতামাতার অধিকার হরণ এবং তিন,আল্লাহর পথে চালিত যুদ্ধ থেকে পলায়ন করা।
৫. যখন পার্থিব সম্পর্ক -সম্বন্ধের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সঙ্গত সীমা অতিক্রম করে যায়,তখন আল্লাহর পথে অগ্রসর হতেও তার শৈথিল্য এসে যায়। ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিই হচ্ছে এ পথের প্রধান প্রতিবন্ধক। তাই এই উপলক্ষে আল্লাহ তাআলা ধন-সম্পদ ও সন্তান -সন্ততির সঠিক মর্যাদা সম্পর্কে ও মুসলমানদের অবহিত করলেন। তিনি বললেনঃ
وَاعْلَمُوا أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَأَنَّ اللَّـهَ عِندَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ ﴿٢٨﴾
“জেনে রাখো,তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের পরীক্ষায় উপকরণ মাত্র; আল্লাহর কাছে প্রতিফল দেবার জন্যে অনেক কিছুই রয়েছে।”
(সূরা আনফাল,আয়াতঃ২৮)
বস্তত,মুমিন তার ধন-সম্পদের সদ্ব্যবহার করে কিনা এবং সম্পদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ হেতু আল্লাহর পথে জীবন পণ করতে তার হৃদয়ে কিছুমাত্র সংকীর্ণতা আসে কিনা অথবা সম্পদের মোহে সত্যের জিহাদে সে শৈথিল্য দেখায় কিনা, ধন-সম্পদ দিয়ে আল্লাহ শুধু তা-ই পরীক্ষা করে থাকেন। অনুরুপ ভাবে সন্তান-সন্ততি হচ্ছে মানুষের পরীক্ষার দ্বিতীয় পত্র। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে -প্রথমত সন্তান-সন্ততিকে আল্লাহর বন্দেগী এবং তার আনুগত্যের পথে নিয়োজিত করার পূর্ণ প্রচেষ্টার মাধ্যমে মুমিনকে তাদের প্রতি সঠিক কর্তব্য পালন করতে হবে। দ্বিতীয়ত,মানুষের হৃদয়ে আল্লাহ যে স্বাভাবিক মমত্ববোধ জাগিয়ে দিয়েছেন, তার আধিক্যহেতু আল্লাহর পথে পা বাড়াতে গিয়ে যাতে বাধার সৃষ্টি না হয়, তার প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে। ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির ব্যাপারে এই মহা পরীক্ষার জন্যে প্রতিটি মুমিনের তৈরি থাকা উচিত।
৬. ধৈর্য যে কোন আন্দোলনেরই প্রাণবস্তু। দেহের জন্যে আত্মা যতোখানি প্রয়োজনীয়,ইসলামী আন্দোলনের জন্যে এই গুণটি ততোখানিই আবশ্যক। মক্কার মুসলমানরা যে দুরবস্থার মধ্যে কালাতিপাত করছিল,সেখানেও এই গুণটি বেশি করে অর্জন করার জন্যে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে শুধু একতরফা জুলুম-পীড়ন সহ্য করা ছাড়া মুসলমানদের আর কিছুই করণীয় ছিল না। কিন্তু এখন আন্দোলন দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করার দরুণ খোদ মুসলমানদের দ্বারাই অন্যের প্রতি অন্যায় আচরণ হবার আশংকা দেখা দিল। কাজেই এই পরিবর্তিত অবস্থায়ও এ গুণটি বেশি পরিমাণে অর্জন করার জন্যে তাগিদ দেয়া হলো। বলা হলোঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّـهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ﴿٤٥ وَأَطِيعُوا اللَّـهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ۖ وَاصْبِرُوا ۚ إِنَّ اللَّـهَ مَعَ الصَّابِرِينَ ﴿٤٦﴾ ﴾
“হে ঈমানদারগণ! যখন কোন দলের সঙ্গে তোমাদের মুকাবেলা হয়,তখন তোমরা সঠিক পথে থেকো এবং আল্লাহ কে বেশি পরিমাণে স্মরণ করো। আশা করা যায় তোমরা সাফল্য অর্জন করতে পারবে। আল্লাহ এবং তার রাসূলের আনুগত্য করো এবং পরস্পর বিবাদ করো না। (বিবাদ করলে)তাহলে তোমাদের মধ্যে দুর্বলতার সৃষ্টি হবে এবং তোমাদের অবস্থার অবনতি ঘটবে। সবর বা ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করো; নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্য অবলম্বনকারীদের সাথে রয়েছেন। (সূরা আনফাল,আয়াত ঃ৪৫ও৪৬)
এখানে ধৈর্যের (সবরের)তাৎপর্য হচ্ছে এইঃ ১.আপন প্রবৃত্তি ও ভাবাবেগকে সংযত রাখতে হবে।
২.তাড়াহুড়া,ভয়-ভীতি ও উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত হতে হবে।
৩.কোন প্রলোভন বা অসঙ্গত উৎসাহকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না।
৪.শান্ত মন সুচিন্তিত ফয়সালার ভিত্তিতে সকল কাজ সম্পাদন করতে হবে।
৫.বিপদ-মুসিবত সামনে এলে দৃঢ় পদে তার মুকাবেলা করতে হবে।
৬.উত্তেজনা ও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কোন অন্যায় কাজ করা যাবে না।
৭.বিপদ-মুসিবতের কারণে অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে আতঙ্ক বা অস্থিরতার কারণে মনোবল হারানো যাবে না।
৮.লক্ষ্য অর্জনের আগ্রহাতিশয্যে কোনো অসঙ্গত পন্থা অবলম্বন করা যাবে না।
৯.পার্থিব স্বার্থ ও প্রবৃত্তির তাড়নায় নিজের কামনা-বাসনাকে আচ্ছন্ন করা এবং সে সবের মুকাবেলায় দুর্বলতা প্রকাশ করে কোনো স্বার্থের হাতছানিতে আকৃষ্ট হওয়া যাবে না।
এখন এই পরিবর্তিত অবস্থায় মুমিনদের আপন ধৈর্যের পরীক্ষা অন্যভাবেও দেয়ার প্রয়োজন ছিল। মানুষের ওপর উদ্দেশ্য-প্রীতির প্রাধান্য কখনো কখনো এতোটা চেপে বসে যে, তার মুকাবেলায় সে হক ও ইনসাফের প্রতি পুরোপুরি লক্ষ্য রাখতে পারে না। সে মনে করে যে, উদ্দেশ্যের খাতিরে এরুপ করায় কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু ইসলামী আন্দোলন সর্বতো ভাবে একটি সত্য ভিত্তিক আন্দোলন বিধায় স্বীয় অনুগামীকে সে কখনো হক ও ইনসাফের সীমা অতিক্রম করতে অনুমতি দেয় না। তাই কুফর ও ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ দ্বন্দ্বের সময় অন্যান্য নৈতিক ও শিক্ষামূলক নির্দেশাবলীর সঙ্গে বিরুদ্ধবাদীদের সাথে রাজনৈতিক চুক্তির ব্যাপারেও মুসলমানদেরকে সম্পূর্ণ হক ইনসাফভিত্তিক নির্দেশাবলী প্রদান করা হলো। এইসব নির্দেশাবলীর সারমর্ম এই যে, মুসলমান যেন কখনো জয়-পরাজয় কিংবা পার্থিব স্বার্থের হাতছানিতে চুক্তিভঙ্গ না করে, বরং আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বস্ততার সঙ্গে যেনো চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করে। এর ফলে তার আপন মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য থেকেও যদি বঞ্চিত হতে হয়,তবুও যেনো সে পিছপা না হয়।
বদর যুদ্ধের পর কুরআন পাকে এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে যে পর্যালোচনা করা হয়, এ হচ্ছে তার কয়েকটি উল্লেখ বৈশিষ্ট্য। দুনিয়ার অন্যান্য আন্দোলনের তুলনায় ইসলামী আন্দোলন যে কতোখানি উন্নত ও শ্রেষ্ট এবং অনুবর্তীদের কে সে কি ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে,এ থেকে তা সহজেই অনুমান করা চলে।
ওহুদ যুদ্ধ
পটভূমি
বদর যুদ্ধে মুসলমানরা জয়লাভ করলো বটে, কিন্তু যুদ্ধের মাধ্যমে তারা যেনো ভীমরুলের চাকে ঢিল ছুঁড়লো। এই প্রথম যুদ্ধেই তারা দৃঢ়তার সঙ্গে কাফিরদের মুকাবেলা করেছিল এবং কাফিরদেরকেও শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়ে পিছু হটতে হয়েছিল। এ ঘটনা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সমগ্র আরব জনগোষ্ঠীকে প্রচণ্ড ভাবে উত্তেজিত করে দিলো। যারা এই নয়া আন্দোলনের দুশমন ছিল, তারা এ ঘটনার পর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তদুপরি মক্কার যে সব কুরাইশ সর্দার এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিল, তাদের রক্তের বদলা নেবার জন্যে অসংখ্য চিত্ত অস্থির হয়ে উঠলো। আরবে যেকোন এক ব্যক্তির রক্তই পুরুষানুক্রমে যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াতো। আর এখানে তো এমন অনেক ব্যক্তিই নিহত হয়েছিল,যাদের রক্তমূল্য অসংখ্য যুদ্ধে ও আদায় হতে পারতো না। তাই চারদিকে ঝড়ের আলামত দেখা যেতে লাগলো। ইহুদীদের যে সব গোত্র ইতঃপূর্বে মুসলমানদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেছিলো, তারা চুক্তির কোন মর্যাদা রক্ষা করলো না। এমন কি তারা খোদা,নবুয়্যাত আখিরাত এবং কিতাবের প্রতি ঈমান পোষণের দাবি করার ফলে যেখানে মুসলমানদের সাথে অধিকতর নৈকট্য থাকা উচিত ছিলো,সেখানে মুশরিক কুরাইশদের প্রতিই তাদের সমস্ত সহানুভূতি উপচে পড়তে লাগলো। তারা খোলাখুলিভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে কুরাইশদে কে উত্তেজিত করতে শুরু করলো।বিশেষত কাব বিন আশরাফ নামক বনী নাযির গোত্রের জনৈক্য সরদার এ ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ও অন্ধ শত্রুতায় লিপ্ত হলো। এ থেকে স্পষ্টত অনুমিত হলো যে, ইহুদীরা না পড়োশী হিসেবে কোন কর্তব্য পালন করবে আর না হযরত (সা:) এর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করবে।
এর ফলে মদিনার এই ক্ষুদ্র জনপদটি চারদিক দিয়েই বিপদ পরিবেষ্টিত হয়ে পড়লো। অভ্যন্তরীন দিক দিয়ে মুসলমানদের অবস্থা ছিল এমনিতেই দুর্বল,তদুপরি যুদ্ধের ফলে তাদেরকে আরো বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হলো।
মক্কার মুশরিকদের অন্তরে এমনিতেই মুসলমানদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল। তাদের বড়ো বড়ো সর্দারগণ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে ইতোমধ্যে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছিল। প্রত্যেক গোত্রের মনেই ক্রোধ ও উত্তেজনা কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছিল। এমনি অবস্থায় ইহুদীগণ কর্তৃক মক্কাবাসীকে যুদ্ধের জন্যে উদ্বুদ্ধ করারচেষ্টা আগুনে তেল ছিটানোর কাজ করলো। ফলে বদর যুদ্ধের পর একটি বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই মদিনায় এই মর্মে খবর পোঁছলো যে, মক্কার মুশরিকগণ এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মদিনা আক্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কুরাইশদের অগ্রগতি
এই প্রেক্ষাপটে তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের প্রথম সপ্তাহে হযরত মুহাম্মদ (সা:) কয়েকজন লোককে সঠিক খবর খবর সংগ্রহের জন্যে মদিনার বাইরে প্রেরণ করলেন। তারা ফিরে এসে খবর দিল যে, কুরাইশ বাহিনী মদিনার প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছে। এমনকি তাদের ঘোড়াগুলো মদিনার একটি চারণ ভূমি পর্যন্ত সাফ করে ফেলেছে। এবার নবী করীস (সা:) সাহাবীদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। কুরাইশ বাহিনীর মুকাবেলা কি মদিনায় বসে করা হবে, না বাইরে গিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হবে? কোন কোন সাহাবী এই অভিমত ব্যক্ত করলেন যে, মুকাবেলা মদিনায় বসেই করতে হবে। কিন্তু বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পান নি অথচ শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত এমন কতিপয় যুবক দৃঢ়তার সাথে বললেনঃ ‘না, বাইরের ময়দানে গিয়েই তাদের মুকাবেলা করতে হবে। ’ অবশেষে তাদের এই দৃঢ়তা দেখে নবী করীম (সা:) মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
মুনাফিকদের ধোকাবাজি
কুরাইশগণ মদিনার একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাদের ছাউনি ফেললো। তার একদিন পর হযরত (সা:) জুম’আর নামাজ বাদ এক হাজার সাহাবী নিয়ে মদিনা থেকে রওয়ানা করলেন। এদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতক আবদুল্লাহ বিন উবাইও ছিল। এ লোকটি দৃশ্যত মুসলমান হলেও কার্যত ছিল মুনাফিক।এর প্রভাবাধীন আরো বহু মুনাফিক মুসলমানদের সঙ্গে যাত্রা করেছিল। কিছুদূর গিয়ে আবদুল্লাহ বিন উবাই তিন’শ লোক নিয়ে হঠাৎ ‘যুদ্ধ হবে না’ বলে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। এখন শুধু সাত শ সাহাবী বাকী রইলেন। এমনি নাজুক অবস্থায় মুনাফিকদের এই আচরণ ছিল গুরুতর মনস্তাত্ত্বিক আঘাতের শামিল। কিন্তু যে সব মুসলমানের হৃদয় আল্লাহর প্রতি ঈমান, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং সত্যের পথে শহীদ হবার আকাঙ্ক্ষায় পরিপূর্ণ ছিল, এ ঘটনায় তাদের ওপর কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়ারই সৃষ্টি হলো না। তাই তারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে সামনে অগ্রসর হলেন।
যুব সমাজের উদ্দীপনা
এ সময় হযরত মুহাম্মদ (সা:) তার সঙ্গী- সাথীদের অবস্থা একবার যাচাই করে নিলেন এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক তরুণদের ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। এদের মধ্যে রাফে ’ ও সামারাহ নামক দুটি কিশোর বালকও ছিল। কিশোরদের কে যখন সেনাবাহিনী থেকে আলাদা করে দেয়া হচ্ছিল, তখন রাফে তার পায়ের অগ্রভাগের ওপর ভর করে দাঁড়ালো। যেনো লম্বায় তাকে কিছু উঁচু দেখায়, এবং তাকে সঙ্গে নেয়া হয়। তার এই কৌশল ফলপ্রসূও প্রমাণিত হলো। কিন্তু সামারাহ সেনাবাহিনীতে থাকবার অনুমতি না পেয়ে বললোঃ ‘রাফেকে যখন রেখে দেয়া হয়েছে, তখন আমাকেও থাকবার অনুমতি দেয়া উচিত। কারণ আমি তাকে কুস্তি প্রতিযোগিতায় পরাজিত করতে পারি। ’ তার এ দাবির যথার্থতা প্রমাণের জন্যে উভয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হলো। অবশেষে সে রাফেকে পরাজিত করলো এবং তাকেও সেনাবাহিনীতে নিয়ে নেয়া হলো। এ একটি সামান্য ঘটনামাত্র। কিন্তু এতেই আন্দাজ করা চলে যে, মুসলমানদের মধ্যে আল্লাহর পথে জিহাদ করার কতখানি অদম্য আগ্রহ ছিল।
সৈন্যদের প্রশিক্ষণ
ওহুদ পাহাড় মদীনা থেকে প্রায় চার মাইল দূরে অবস্থিত। হযরত (স) এমনভাবে তার সৈন্যদের মোতায়েন করলেন যে, পাহাড় পিছন দিকে থাকলো আর কুরাইশ সৈন্যরা রইলো সামনের দিকে। পিছন দিকে পাহাড়ের মাঝ বরাবর একটি সুড়ঙ্গ পথ ছিলো এবং সে দিক থেকেও হামলার কিছুটা আশাংকা ছিলো। হযরত (স) সেখানে আবদুল্লাহ বিন জুবাইরকে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজসহ মোতায়েন করলেন। তাকে এই র্মমে নির্দেশ দিলেন যে, এই সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে কাঊকে আসতে দেয়া যাবে না এবং তুমিও এখান থেকে কোন অবস্থায় নড়বে না। এমন কি যদি দেখো যে, পাখিরা আমাদের গোশ্ত ছিঁড়ে নিয়ে খাচ্ছে, তবুও তুমি নিজের স্থান ত্যাগ করবে না।
কুরাইদের সাজ-সজ্জা
এবার কুরাইশরা অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ সাজ-সজ্জা করে এসেছিলো। প্রায় তিন হাজার সৈন্য ও প্রচুর সামান্তপত্র তাদের সঙ্গে ছিলো। তখনকার দিনে যে যুদ্ধে মেয়েরা যোগ দান করতো, তাতে আরবরা জীবনপণ করে লড়াই করতো। তারা মনে করতো, যুদ্ধে যদি পরাজয় হয় তো মেয়েদের বেইজ্জত হবে। এ যুদ্ধেও কুরাইশ বাহিনীর সঙ্গে অনেক মহিলা এসেছিল। এদের মধ্যে আপন পুত্র ও প্রিয়জন মারা গেছে, এমন অনেকেই ছিলো। এতে কেউ কেউ প্রিয়জনদের হত্যাকারীদের রক্তপান করে তবেই নিঃশ্বাস ফেলবে-এমন প্রতিজ্ঞা পর্যন্ত করেছিলো।
যুদ্ধের সূচনা
কুরাইশরা তাদের সৈন্যদেরকে খুব ভালোমতো প্রশিক্ষণ দিয়েছিলো। যুদ্ধের সূচনা-পর্বে কুরাইশ মহিলারা দফ বাজিয়ে আবেগ ও উদ্দীপনাময় কবিতা আবৃতি করতে লাগলো। তারা যোদ্ধদেরকে বদর যুদ্ধে নিহতদের রক্তের বদলা নেবার জন্যে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় উৎসাহ যোগালো। এরপর শুরু হলো যুদ্ধ। প্রথম পর্যায়ে মুসলমানদের দিকেই পাল্লা ভারী রইলো এবং কুরাইশ পক্ষের বহু সৈন্য নিহত হলো।তাদের সৈন্য দের মধ্যে হতাশা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। এদিকে সুড়ঙ্গ পথের প্রহরায় নিযুক্ত সৈন্যরা যখন দেখলো যে, মুসলমানরা মাল সংগ্রহে লিপ্ত হয়েছে এবং দুশমনরাও ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে.তখন তারাও গনীমতের মাল সংগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাদের নেতা হযরত আবদুল্লাহ বিন জুবাইর বারবার তাদেরকে বিরত রাখতে চাইলেনএবং হযরত (সা:) এর কথাও স্মরণ করিয়ে দিলেন।কিন্তু কতিপয় লোক ছাড়া কেউ তার কথা শুনলো না।
পশ্চাদিক থেকে কুরাইশদের হামলা
খালিদ বিন অলীদ তখন কাফির সৈন্যদের একজন অধিনায়ক। সে এই সুবর্ণ সুযোগ কে পুরোপুরি কাজে লাগানো এবং পাহাড়ের পেছন দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে সুড়ঙ্গ -পথে মুসলমানদের ওপর হামলা করলো।হযরত আবদুল্লাহ এবং তার ক’জন সঙ্গী শেষ পর্যন্ত সুড়ঙ্গ পথের প্রহরায় ছিলেন,তাদের অধিকাংশই এই হামলার মুকাবেলা করলেন।কিন্তু কাফের দের এই প্রচণ্ড হামলাকে তারা প্রতিহত করতে পারলেন না। তারা শহীদ হয়ে গেলেন। অতঃপর দুশমনরা একে একে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওদিকে যে সব পলায়নপর কাফির দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিল, তারাও আবার ফিরে এলো।এবার দুদিক দিয়ে মুসলমানদের ওপর হামলা শুরু হলো।এই অভাবিত পরিস্থিতিতে মুসলমানদের মধ্যে এমন আতঙ্কের সঞ্চার হলো যে, যুদ্ধের মোড়ই সম্পূর্ণ ঘুরে গেলো। মুসলমানেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক পালাতে লাগলো। এমনকি আতঙ্কের মধ্যেই গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে, নবী করীম(সা:) শহীদ হয়ে গেছেন। এই খবরে সাহাবীদের মধ্যে বাকী উদ্যমটুকুও নষ্ট হয়ে গেলো এবং অনেকে সাহস পর্যন্ত হারিয়ে ফেললো।
আল্লাহর সাহায্য এবং বিজয়
এ সময় দশ-বারো জন সাহাবী নবী করীম(সা:) কে ঘিরে রেখেছিলেন। তিনি অবশ্য আহত হয়েছিলেন। সাহাবীরা তাকে একটি পাহাড়ের ওপর নিয়ে এলেন। অতঃপর অন্য মুসলমানরা ও জানতে পারলেন যে, নবী করীম (সা:) সুস্থ ও নিরাপদ আছেন।তাই তারা আবার দলে দলে তার কাছে একত্রিত হতে লাগলেন। কিন্তু এ সময় কি কারণে যেন কাফিরদের মনোযোগ হঠাৎ অন্যদিকে নিবদ্ধ হলো এবং নিজেদের বিজয়কে পূর্ণ পরিণতি পর্যন্ত না পৌঁছিয়েই তারা ময়দান ছেড়ে চলে গেল।
তারা যখন কিছু্টা দূরে চলে গেল, তখন তাদের সম্বিত ফিরে এলো। তারা পরস্পরকে বললোঃ এ আমরা কি ভুল করলাম! মুসলমানদের সম্পূর্ণ খতম করে দেবার দুর্লভ সুযোগটিকে নষ্ট করে এমনিই চলে এলাম! এরপর তারা এক জায়গায় থেকে পরস্পর বলাবলি করলোঃ এবার তাহলে মদিনার ওপর আর একবার হামলা করা উচিত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত – আর তাদের সাহস হলো না। তারা মক্কায় ফিরে গেলো।
এদিকে নবী করীম (সা:) চিন্তিত ছিলেন যে,শত্রুরা না জানি আবার ফিরে এসে আবার হামলা করে বসে। তাই তিনি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে মুসলমানদের কে দুশমনদের পশ্চাদ্ধাবন করার নির্দেশ দিলেন। এটা ছিল অত্যন্ত নাজুক সময়। কিন্তু যারা সাচ্চা মুমিন ছিল, তারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে পুনরায় জান কুরবান করার জন্যে তৈরি হয়ে গেল। নবী করীম(সা:) হামরা-উল-আসাদ নামক স্থান পর্যন্ত দুশমনদের পশ্চাদ্ধাবন করলেন। এ জায়গাটি মদিনা থেকে ৮ মাইল দূরে অবস্থিত। এখানে পৌঁছে জানা গেল যে, কুরাইশরা মক্কায় ফিরে গেছে। তাই তিনিও মুসলমানদের নিয়ে মদিনায় ফিরে এলেন।
এ যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবী শহীদ হলেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন আনসার। তাই মদিনায় ঘরে ঘরে শোকের বন্যা নেমে এলো। এ সময় হযরত (সা:) মুসলমানদের শোক প্রকাশের নিয়মাবলী সম্পর্কে অবহিত করলেন।তিনি বললেনঃ ‘মাতম করা এবং ছাতি পিটিয়ে কান্না-কাটি করা মুসলমানদের পক্ষে মর্যাদা হানিকর।’
বিপর্যয়ের কারণ এবং মুসলমানদের প্রশিক্ষণ
ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের যে বিপর্যয় ঘটে, তার পেছনে মুনাফিকদের চালবাজি ও কলা কৌশলের প্রভাব ছিল সন্দেহ নেই; কিন্তু সেই সঙ্গে মুসলমানদের নিজস্ব দুর্বলতাও কম দায়ী ছিল না। অবশ্য ইসলামী আন্দোলন যে ধরণের মেজাজ তৈরি করে এবং তার কর্মীদের যে রুপ প্রশিক্ষণ দিতে ইচ্ছুক, তার জন্যে তখনও পুরোপুরি সুযোগ পাওয়া যায় নি। আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গ করার এ ছিল দ্বিতীয় সুযোগ মাত্র। তাই এ ক্ষেত্রে স্বভাবতই কিছু কিছু দুর্বলতা প্রকাশ পেলো। যেমনঃ সম্পদের মোহে কর্তব্য অবহেলা করা, নেতার হুকুম অমান্য করা,দুশমনকে পুরোপুরি খতম করার আগে গনীমতের মালের দিকে মনোযোগ দেয়া ইত্যাদি। এ কারণেই যুদ্ধ শেষ হবার পর আল্লাহ তাআলা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি অত্যন্ত বিস্তৃত ভাবে পর্যালোচনা করলেন। এ পর্যালোচনা ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলমানদের মধ্যে যা কিছু দোষ-ত্রুটি বাকী ছিল, তার প্রতিটি দিককেই তিনি স্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন এবং সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলীও প্রদান করলেন।সূরা আল ইমরানের শেষাংশে এই নির্দেশাবলীর কথা বিবৃত হয়েছে। এখানে তার কতিপয় অংশ উদ্ধৃত করা যাচ্ছে। এ থেকে ইসলামী আন্দোলনে যুদ্ধের স্থান কোথায় এবং ইসলামের দৃষ্টিতে যুদ্ধ সংক্রান্ত ঘটনাবলীর ওপর কিভাবে আলোকপাত করতে হয়, তা আর একবার উপলব্ধি করা যাবে।
খোদা-নির্ভরতা
মুসলমানরা যখন যুদ্ধের জন্যে যাত্রা করেছিল,তখন তাদের সংখ্যা ছিল এক হাজারের মতো। পক্ষান্তরে দুশমনদের সংখ্যা ছিল তিন হাজার। এরপরও কিছুদূর গিয়ে তিন শ’ মুনাফিক আলাদা হয়ে গেল। এবার বাকী থাকলো শুধু সাত শ’ মুসলমান। তদুপরি যুদ্ধের সামান্তপত্র ছিল কম এবং এক তৃতীয়াংশ সৈন্যও গেল বিচ্ছিন্ন হয়ে। এই নাজুক পরিস্থিতিতে কিছু লোকের মনোবল ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। এ সময় শুধু আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তার সাহায্যের ওপর ভরসাই মুসলমানদেরকে দুশমনদের মুকাবেলায় এগিয়ে নিয়ে চললো। এ উপলক্ষে হযরত মুহাম্মদ (সা:) মুসলমানদের কে যে সান্ত্বনা প্রদান করেন, আল্লাহ তা নিম্নোক্ত ভাষায় উল্লেখ করেছেনঃ
إِذْ هَمَّت طَّائِفَتَانِ مِنكُمْ أَن تَفْشَلَا وَاللَّـهُ وَلِيُّهُمَا ۗ وَعَلَى اللَّـهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ ﴿١٢٢﴾ وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللَّـهُ بِبَدْرٍ وَأَنتُمْ أَذِلَّةٌ ۖ فَاتَّقُوا اللَّـهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ﴿١٢٣﴾ إِذْ تَقُولُ لِلْمُؤْمِنِينَ أَلَن يَكْفِيَكُمْ أَن يُمِدَّكُمْ رَبُّكُم بِثَلَاثَةِ آلَافٍ مِّنَ الْمَلَائِكَةِ مُنزَلِينَ ﴿١٢٤﴾ بَلَىٰ ۚ إِن تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا وَيَأْتُوكُم مِّن فَوْرِهِمْ هَـٰذَا يُمْدِدْكُمْ رَبُّكُم بِخَمْسَةِ آلَافٍ مِّنَ الْمَلَائِكَةِ مُسَوِّمِينَ ﴿١٢٥﴾ وَمَا جَعَلَهُ اللَّـهُ إِلَّا بُشْرَىٰ لَكُمْ وَلِتَطْمَئِنَّ قُلُوبُكُم بِهِ ۗ وَمَا النَّصْرُ إِلَّا مِنْ عِندِ اللَّـهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ ﴿١٢٦﴾
“স্মরণ করো, যখ,তোমাদের মধ্যকার দুটি দল নির্বুদ্ধিতা প্রদর্শনের জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল, অথচ আল্লাহ তাদের সাহায্যের জন্যে বর্তমান ছিলেন। আর মুমিনদের তো আল্লাহর ওপরই ভরসা করা উচিত। এর আগে বদরের যুদ্ধে আল্লাহ তোমাদের শোকরী থেকে তোমাদের বেঁচে থাকা উচিত। আশা করা যায়, এবার তোমরা কৃতজ্ঞ হবে। স্মরণ করো, যখন তুমি (হে নবী) মুমিনদের কে বলেছিলঃ তোমাদের জন্যে এটা কি যথেষ্ট নয় যে, আল্লাহ তিন হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করে তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমরা যাতে খুশি হও এবং তোমাদের হৃদয় নিশ্চিন্ত হয়, সে জন্যেই আল্লাহ তোমাদের কাছে একথা প্রকাশ করলেন। বিজয় বা সাহায্য যা কিছুই হোক, আল্লাহর কাছ থেকেই আসে। তিনি অত্যন্ত শক্তিমান, বিচক্ষণ। (আলে ইমরান আয়াতঃ১২২-১২৬)
এখানে মুসলমানদের কে শেষ বারের মতো বুঝিয়ে দেয়া হলো যে, প্রকৃতপক্ষে বস্তগত শক্তির ওপর ভরসা করা মুসলমানদের কাজ নয়। তাদের শক্তির আসল উৎস হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তার সাহায্যের ওপর ভরসা।
ধন-সম্পদের মোহ
ওহুদে মুসলমানদের বিপর্যয়ের আর একটি বড় কারণ হলো এই যে, মুসলমানরা যুদ্ধের ঠিক মাঝখানেই সম্পদের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল এবং দুশমনকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আগেই সম্পদের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল। এমনকি, যারা সুড়ঙ্গ-পথের প্রহরায় নিযুক্ত ছিল,তাদের মধ্যে পযর্ন্ত দুর্বলতা প্রকাশ পেল। এভাবে যুদ্ধের মোড় সম্পূর্ণ ঘুরে গেল। তাই আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের হৃদয় থেকে ধনের মোহ দূরীভূত করার জন্যে এসময়ই মোহ সৃষ্টির একটি বড় কারণকে নিশ্চিহ্ন করে দিলেন। অর্থাৎ এ সময় সূদকে হারাম ঘোষণা করা হলো। যারা সূদী কারবার করে, তাদের হৃদয়ে ধনের মোহ এমনি বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, তা আর কোন মহৎ কাজের উপযোগী থাকে না।সূদের ফলেই এক শ্রেণীর মনে লালসা, কার্পণ্য, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং ধনের মোহ সৃষ্টি হয়। আর এক শ্রেণীর মধ্যে জাগ্রত হয় হিংসা দ্বেষ ও ক্রোধ-বিক্ষোভ।
সাফল্যের চাবিকাঠি
যদি মনোবলকে সমুন্নত রাখার জন্যে কোন ক্রিয়াশীল শক্তি বর্তমান না থাকে, তাহলে পরাজয়ের পর তা হ্রাস পেতে থাকবেই। ওহুদে মুসলমানদের যে পরাজয় ঘটেছিল, তাতে কিছু লোকের মনোবল ভেঙ্গে পড়ার আশংকা ছিল। কিন্তু এ সময় মুসলমানদের কে এই বলে আশ্বাস দেয়া হলো যে,
وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ ﴿١٣٩﴾ إِن يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهُ ۚ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّـهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنكُمْ شُهَدَاءَ ۗ وَاللَّـهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ ﴿١٤٠ وَلِيُمَحِّصَ اللَّـهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَيَمْحَقَ الْكَافِرِينَ ﴿١٤١﴾ أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّـهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ ﴿١٤٢﴾ ﴾
“ তোমাদের না নিরুৎসাহ হওয়া উচিত আর না দুঃখ প্রকাশ করা উচিত। তোমাদেরই হবে, যদি তোমরা খাঁটি মুমিন হও, ঈমানের ওপর অবিচল থাকো এবং তার দাবি সমূহ পূর্ণ করতে থাকো। তোমাদের কাজ শুধু এটুকুই; এরপর তোমাদের সমুন্নত করা এবং দুঃখ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব আল্লাহর। এরপর রইলো তোমাদের এই সাময়িক দুঃখ- ক্লেশ ও পরাজয়ের প্রশ্ন। এটা শুধু তোমাদেরই ব্যাপার নয়, তোমাদের বিরুদ্ধ দলের ওপরও এরকম দুঃখ-মুসিবত এসে থাকে। তারা যখন মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়েও নিরুৎসাহিত হয়না, তখন তোমরা কেন সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে চিন্তা-ভাবনা করো?তোমরা তো জান্নাতের প্রত্যাশী। তোমরা কি মনে করো, এমনিই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের ভেতর কে আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গ করেছে আর কে তার জন্যে প্রতিকূল অবস্থায়ও ধৈর্য অবলম্বন করতে ইচ্ছুক, আল্লাহ তা এখন পর্যন্ত যাচাই-ই করেননি।(আল -ইমরানঃআয়াত১৩৯-১৪২)
ইসলামী আন্দোলনের প্রাণবস্ত
পৃথিবীর যেকোন আন্দোলনেই তার প্রাণবস্ত কিংবা চালিকা-শক্তিরুপে একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব বর্তমান থাকে। কিন্তু আদর্শবাদী আন্দোলনের উন্নতি বা স্থায়িত্ব কোন ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং যে নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে এ আন্দোলন উত্থিত হয়, তার দৃঢ়তা ও সত্যতার ওপরই এর সবকিছু নির্ভর করে। ইসলামী আন্দোলনের জন্যে নবীদের ব্যক্তিত্ব কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও এটি একটি আদর্শবাদী আন্দোলন এবং এর উন্নতি ও স্থায়িত্ব সম্পূর্ণত ইসলামের উপস্থাপিত নীতিমালার ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে মুসলমানদের এ কথা জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন হলো যে, নবীর মহান ব্যক্তিত্ব তাদের ভেতর বর্তমান থাকলেই কেবল তারা আল্লাহর দ্বীনের ঝাণ্ডা সমুন্নত করবে এবং নবীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হলে অমনি তারা এ পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন পথ অবলম্বন করবে, এরুপ ধারণা যেনো তাদের মনের কোণেও ঠাঁই পায়। ইতঃপূর্বে ওহুদের ময়দানে যখন এই মর্মে গুজব প্রচারিত হলো যে, হযরত (সা:) শহীদ হয়ে গেছেন, তখন কিছু মুসলমানের মনোবল একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল। তারা ভেবেছিল: হযরতের ছায়াই যখন চলে গেল, তখন আর যুদ্ধ করে কি হবে! এই ভুল ধারণা দূর করার জন্যেই এই সময় মুসলমানদের বুঝিয়ে দেয়া হলোঃ “দেখো,মুহাম্মদ (সা:) একজন রাসূল বৈ কিছুই নন। তার আগেও অনেক রাসূল চলে গেছেন। এখন তিনি যদি মরে যান কিংবা নিহত হন, তাহলে তোমরা কি পশ্চাদপসরণ করবে? মনে রেখো, যে ব্যক্তি পশ্চাদপসরণ করবে সে আল্লাহর কোনই ক্ষতি করবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দাহ হিসেবে জীবন যাপন করবে, তাকে তিনি পুরস্কৃত করবেন।”(আল ইমরানঃ আয়াত১৪৪)
আরো বলা হলোঃ ‘তোমরা যে দ্বীনকে বুঝে-শুনে গ্রহণ করেছো, তার ওপর অবিচল থাকার এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে তোমাদের মধ্যে হামেশা নবীর উপস্থিত মাত্র।এর ওপর অবিচল থাকলে তোমরা নিজেরাই সুফল পাবে। এ দ্বীনের আসল শক্তি হচ্ছে এর উপস্থাপিত সত্যতা। এর সমুন্নতি না তোমাদের শক্তি -সামর্থের ওপর আর না কোনো বিশেষ ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল।’
দুর্বলতার উৎস-১
মানুষের সমস্ত দুর্বলতার উৎস হচ্ছে মৃত্যু-ভয়।তাই এ সময় মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হলো যে, তোমাদের মৃত্যু-ভয়ে পলায়ন করা নিতান্তই অর্থহীন। কারণ মৃত্যুর জন্যে নির্ধারিত সময় না আসা পর্যন্ত কোন প্রাণীরই মৃত্যু হতে পারে না। অন্য কথায়, আল্লাহর নির্ধারিত সময়ের আগে না কেউ মরতে পারে আর না তারপর এক মুহূর্তও কেউ বেঁচে থাকতে পারে। অতএব, তোমাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচবার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই; বরং জীবনের যেটুকু অবকাশ পাওয়া গেছে, তা কি দুনিয়াদারিতে ব্যয়িত হচ্ছে না আখিরাতের কাজে,তা-ই শুধু চিন্তা করা উচিত। কারণ যে ব্যক্তি শুধু দুনিয়াদারির জন্যে তার শ্রম-মেহনত নিয়োজিত করে, তার যা কিছু প্রাপ্য তা দুনিয়ায়ই পেয়ে থাকে।আর যে ব্যক্তি আখিরাতের কল্যাণের জন্যে কাজ করে,আল্লাহ তাকে আখিরাতেই প্রতিফল দান করবেন।কাজেই যারা আল্লাহর দ্বীন কবুল করার,এর ওপর কায়েম থাকার এবং একে হারাম করবার চেষ্টা-সাধনার সুযোগ পেয়েছে, তাদের পক্ষে এই মহা মূল্যবান নিয়ামতটিরই কদর করা এবং এর জন্যেই নিজেদের সবকিছু নিয়োজিত করা উচিত। এর ফলাফল অবশ্যই তাদের পক্ষে কল্যাণপ্রদ হবে; আখিরাতের স্থায়ী সাফল্য তারা অর্জন করবে। আর এই নিয়ামতের যারা শোকর আদায় করবে, আল্লাহ তাদেরকে সর্বোত্তম নিয়ামত দ্বারা কৃতার্থ করবেন। তারা আপন মালিকের কাছ থেকে সর্বোত্তম পুরস্কারে ভূষিত হবে।