দ্বিতীয় হিজরী শতকের হাদীস সংকলকবৃন্দ
এ যুগেই হাদীসের সংকলন প্রণয়নের কাজ যথারীতি শুরু হয়। এ যুগে যেসব মহান মুহাদ্দিসগণ হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন করেন তাদের নাম নিম্নে প্রদত্ত হল।
রবী ইবনে সাবীহ (মৃ. ১৬০ হি.), তিনি প্রতিটি ফিকহী বিষয়ের উপর পৃথক পৃথক পুস্তিকা প্রণয়ন করেন। সাঈদ ইবনে আরূবা (মৃ. ১৫৬ হি.), তিনিও প্রতিটি ফিকহী বিষয়েল উপর স্বতন্ত্র পুস্তিকা রচনা করেন। মূসা ইবনে উকবা (মৃ. ১৪১ হি.), তিনি মহানবী (স) –এর যুদ্ধসমূহের ইতিহাস সংকলন করেন। ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯), তিনি ইসলামী শরীআতের বিধিবিধান সম্পর্কিত হাদীস ও আছারসমূহ সংগ্রহ করেন। ইবনে জুরাইজ (৮০-১৫০), ইমাম আওযাঈ (৮৮-১৮৯), সুফিয়ান সাওরী (৯৭-১৬১), হাম্মাদ ইবনে সালামা ইবনে দীনার (৯৭-১৭৬), ইমাম আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২), ইমাম মুহাম্মাদ (১৩১-১৮৯), এঁরা সকলেই ইমাম আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২), ইমাম মুহাম্মাদ (১৩১-১৮৯), এঁরা সকলেই ইমাম মালেক (রহ)-এর অনুরূপ কাজ করেন। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (মৃ. ১৮১ হি.), তিনি রসূলুল্লাহ (স) –এর জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন। ইবনে সাদ (১৬৮-২২০), তিনি মহানবী (স) –এর সীরাত এবং সাহাবা ও তাবিঈদের জীবনী সংক্রান্ত বর্ণনা একত্র করেন। উবায়দুল্লাহ ইবনে মূসা আল-আবসী (মৃ. ২১৩ হি.), মুসাদ্দাদ ইবনে মুসারহাদ আল বসরী (মৃ. ২১৮ হি.) আসাদ ইবনে মূসা (মৃঃ ২১২ হি.), মুসাদ্দাদ ইবনে মুসারহাদ আল-বসরী (মৃ. ২১৮ হি.) আসাদ ইবনে মূসা (মৃঃ ২১২), নুআইম ইবনে মুহাম্মাদ আল-খুযাঈ (মৃ. ২২৮), ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (১৬৮-২৪১), ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ (১৬১-২৩৮), উসমান ইবনে আবু শাইবা (১৫৬-২৩৯), এঁরা সকলে প্রত্যেক সাহাবীর বর্ণিত হাদীসসমূহ স্বতন্ত্রভাবে সংকলন করেন। আবু বাকর ইবনে আবু শাইবা (১৫৯-২৩৫), তিনি ফিকহ-এর অনুচ্ছেদসমূহের ক্রমানুসারে এবং সাহাবীদের প্রত্যেকের রিওয়ায়াতসমূহ উভয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে হাদীস সংকলন করেন।
তাদের মধ্যে ইমাম মালেক, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ, মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক, ইবনে সাদ, ইমান আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং আবু বাকর ইবনে আবু শাইবার গ্রন্থাবলী বর্তমান কাল পর্যন্ত বিদ্যমান আছে এবং তা প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া মূসা ইবনে উকবার আল-মাগাযী গ্রন্থের একটি অংশও পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া যাদেঁর গ্রন্থাবলীর পাণ্ডুলিপি বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে না তাও মূলত বিলীন হয়ে যায়নি, বরং সেগুলোর পরবর্তীগণ নিজ নিজ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। এজন্য লোকেরা এসব দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপির এখন আর মুখাপেক্ষী নয়।
ইমাম বুখারী (রহ)-এর যুগ পর্যন্ত ইলমে হাদীসের ধারাবাহিক ইতিহাস অধ্যয়নের পর কোন ব্যক্তি বিজ্ঞ বিচারকের নিম্নোক্ত কথার কোনো মূল্য দিতে পারে কিঃ “হাদীসসমূহ মুখস্তও করা হয়নি, সংরক্ষণও করা হয়নি, বরং সেইসব লোকের মনমগজে তা লুক্কায়িত ছিল যারা ঘটনাক্রমে তা অন্যদের সামনে উল্লেখ করার পর মরে গেছে, অতপর তাদের মৃত্যুর কয়েক শত বছর পর তা সংগ্রহ ও সংকলন করা হয়েছিল”? এবং তার এ কথা “পরে প্রথম বারের মত রসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রায় একশত বছর পর হাদীসসমূহ সংগ্রহ করা হয়েছিল, কিন্তু তার দস্তাবেজ সংরক্ষিত নেই”? এ স্থানে আমরা এই নিবেদন বিচারকগণের ইসলাম তথা কুরআন-সুন্নাত ভিত্তিক বিষয়সমূহ সম্পর্কিত মত প্রকাশের জন্য এর চেয়েও অধিক সতর্ক ও সুগভীর পাণ্ডিত্বের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন।
হাদীসসমূহের মধ্যে মতপার্থক্যের তাৎপর্য
সামনে অগ্রসর হয়ে সম্মানিত বিচারপতি তার ষষ্ঠ দফায় হাদীসসমূহের “চরম সংশয়পূর্ণ” ও “অনির্ভরযোগ্য” হওয়ার একটি কারণ এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “এমন হাদীস খুব কমই আছে যে সম্পর্কে হাদীস সংগ্রহকারীগণ একমত হতে পেরেছেন”।
এটা এমন একটি দাবী যা কয়েকটি বিরোধপূর্ণ হাদীসের উপর ভাসাভাসা দৃষ্টি নিক্ষেপের মাধ্যমে করা যেতে পারে বটে, কিন্তু বিস্তারিতভাবে হাদীসের গ্রন্থাবলীল তুলনামূলক অধ্যয়ন করলে জানা যায় যে, সেই হাদীসগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্যই বেশী এবং মতভেদ সামান্যই আছে। অতপর যেসব ক্ষেত্রে মতভেদ পাওয়া যায় তার মূল্যায়ন করা হলে অধিকতর মতভেদ নিম্নোক্ত চার ধরনের যে কোন এক ধরনের আওতায় পড়বেঃ
(এক) বিভিন্ন রাবী একই কথা বা একই ঘটনা শাব্দিক পার্থক্য সহকারে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এর অর্তের মধ্যে তেমন গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য নেই, অথবা বিভিন্ন রাবী একই ঘটনা অথবা ভাষণের এক একটি অংশ বর্ণনা করেছেন।
(দুই) স্বয়ং মহানবী (স) একই বিষয় বিভিন্ন শব্দে বর্ণনা করেছেন।
(তিন) মহানবী (স) বিভিন্ন অবস্থায়, পরিবেশে বা স্থানে বিভিন্ন পন্থায় আমল (কাজ) করেছেন।
(চার) একটি হাদীস পূর্বের ও অপর হাদীস পরের এবং শেষোক্ত হাদীস পূর্বোক্ত হাদীসকে রহিত (মানসূখ) করে দিয়েছে।
এই চার শ্রেণীর আওতাভুক্ত হাদীস ব্যতীত যেসব হাদীসের বর্ণনাকারী পারস্পরিক বৈপরিত্য দূর করা বাস্তবিকই কষ্টসাধ্য গোটা হাদীস শাস্ত্রে এরূপ হাদীসের সংখ্যা শতকরা একটিরও অনেক কম। কয়েকটি মাত্র হাদীসের মধ্যে এরূপ ত্রুটি বিদ্যমান থাকার কারণে গোটা হাদীস ভাণ্ডারকে সংশয়পূর্ণ ও অনির্ভরযোগ্য সাব্যস্ত করার মত সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য যথেষ্ট কি? রিওয়ায়াত (বা হাদীস) শ্রেণীবিভাগের অযোগ্য কোন অখণ্ড একক-এর নাম নয় যার কোন অংশ অকেজ বা বর্জিত হওয়ার কারণে সর্ম্পূর্ণটাই বর্জিত হতে পারে। প্রতিটি রিওয়ায়াত (হাদীস) নিজস্বভাবে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এবং নিজের স্বতন্ত্র সনদ সহকারে বর্ণিত হয়ে থাকে। এর ভিত্তিতে একটি-দুইটি নয়, দুই-চারশত রিওয়ায়াত বর্জিত হলেও অবশিষ্ট রিওয়ায়াতসমূহের বর্জিত হওয়া অপরিহার্য হতে পারে না। ইলমী (বুদ্ধি ও যুক্তিগ্রাহ্য) সমালোচার মানদণ্ডে যে রিওয়ায়াতই পূর্ণরূপে উতরে যাবে তা অবশ্যই মেনে নিতে হবে।
মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতপার্থক্যের আরেকটি দিক এই যে, কোন রিওয়ায়াতের সনদকে একজন মুহাদ্দিস নিজস্ব সমালোচনার নিরিখে সঠিক মনে করেন এবং অপরজন তাকে দুর্বল সাব্যস্ত করেন। এটা রায় ও তথ্যানুসন্ধানের পার্থক্য, যার ফলে অস্থির ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। বিচারালয়সমূহে কি কোন সাক্ষ্য গ্রহণ ও কোন সাক্ষ্য বর্জন করার ব্যাপারে কখনও মতপার্থক্য হয় না?
স্মৃতিশক্তি থেকে নকলকৃত রিওয়ায়াত কি অনির্ভরযোগ্য?
এখন আমরা বিজ্ঞ বিচারপতির সর্বশেষ দফা দুটির উপর আলোকপাত করব। তিনি বলেন, “বর্তমান কালের আবরদের স্মৃতিশক্তি যতটা শক্তিশালী প্রথম হিজরী শতকের আরবদের স্মরণশক্তি ততটাই শক্তিশালী যতটা শক্তিশালী হয়ে থাকবে। তথাপি এটাকে যতই শক্তিশালী বলে স্বীকার করে নেয়া হোক, শুধুমাত্র স্মৃতিশক্তি থেকে নকলকৃত বক্তব্যকে কি নির্ভরযোগ্য মনে করা যেতে পারে? তিনি আরও বলেন, “একজনের স্মৃতিশক্তি থেকে অপরের স্মৃতিশক্তিতে কোন বক্তব্য স্থানান্তরিত হতে হতে তার মধ্যে কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটে থাকে এবং প্রত্যেকটি স্মৃতিশক্তির নিজস্ব ধ্যানধারণা ও দৃষ্টিভংগী তাকে দুমড়াতে মোচড়াতে থাকে”।
এই দুটি অতিরিক্ত কারণের ভিত্তিতে তিনি হাদীসসমূহকে নির্ভরযোগ্য ও দলীল-প্রমাণ হিসাবে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না।
তার প্রথমোক্ত কথা সম্পর্কে বলা যায় যে, তা অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের পরিপন্থী। অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মানুষ তার যে শক্তির সাহায্যে অধিক কাজ করে তা উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করতে থাকে এবং যে শক্তির সাহায্যে কম পরিমাণে গ্রহণ করে তা ক্রমশ দুর্বল হয়ে যায়। একথা যেমন সমস্ত মানবীয় শক্তির ব্যাপারে সত্য তেমন স্মৃতিশক্তির বেলায়ও সত্য। আরব জাতি মহানবী (স) এর পূর্বে হাজারো বছর ধরে নিজেদের কাজ লেখনির পরিবর্তে স্মৃতিশক্তির সাহায্যে চালাতে অভ্যস্ত ছিল। তাদের ব্যবসায়ীরা লাখ লাখ দীনারের আদান প্রদান করত এবং কোন লেখাপড়া জানত না। কড়ায় গন্ডায় হিসাব এবং অগণিত ক্রেতার হিসাব তারা মুখে মুখে রাখত। তাদের গোত্রীয় জীবনে বংশীয় ও রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা ছিল অতীব গুরূত্বপূর্ণ। এসবক কিছুও স্মৃতিশক্তিতে সংরক্ষিত থাকত এবং মৌখিক বর্ণনার মাধ্যমে এক বংশধর থেকে পরবর্তী বংশধরদের নিকট পৌছানো হত। তাদের সমস্ত সাহিত্য সম্পদ কাগজে নয়, বরং অন্তরের পর্দায় মুদ্রিত থাকত। তাদের এই অভ্যাস লেখার প্রচলন হওয়ার পরও প্রায় একশত বছর পর্যন্ত অপরিবর্তিত রয়ে যায়। কারণ জাতীয় অভ্যাসসমূহ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। তারা কাগজে লিপিবদ্ধ করে রাখার পরিবর্তে নিজেদের স্মৃতিশক্তির উপরই অধিক নির্ভর করত। এটা ছিল তিাদের গৌরবের বিষয়। কোন ব্যক্তির নিকট কোন কথা জিজ্ঞেস করা হলে সে যদি তা স্মৃতিশক্তি থেকে না বলে বাড়িতে গিয়ে লিখিত পুস্তক এনে তার জবাব দিত তবে সে তাদের দৃষ্টি থেকে পরিত্যক্ত হয়ে যেত। দীর্ঘকাল যাবত তারা লিপিবদ্ধ করে রাখ সত্ত্বেও মুখস্ত করে রাখত এবং লিখিত বিবরণ পড়ে শুনানোর পরিবর্তে মুখস্ত শুনিয়ে দেয়া কেবল সম্মানের বিষয়ই মনে করত না, বরং তাদের দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তির বিদ্যাবত্তার উপর নির্ভরতা এ পন্থায়ই কায়েম হত।
আজকের আরবদের মধ্যে স্মতিশক্তির এই অবস্থা অটুট থাকার কোন কারণ নেই। শত শত বছর ধরে লেখনিশক্তির উপর নির্ভর করা এবং স্মৃতিশক্তিকে কম কাজে লাগানোর কারণে এখন তাদের স্মৃতিশক্তি প্রাচীন আরবদের মতই প্রখর থাকা কোন প্রকারেই সম্ভব নয়। কিন্তু আরব ও অনারব সকলের মধ্যে আজও পর্যবেক্ষণ শিক্ষিত ও চক্ষুষ্মান লোকদের তুলনায় অধিক প্রখর। মূর্খ ব্যবসায়ীদের মধ্যে এমন অসংখ্য লোক পাওয়া যায়, যারা নিজেদের ক্রেতাদের সাথে সম্পদিত হজার হাজার টাকার লেনদরে পূর্ণাংগরূপে ও বিস্তারিতভাবে মনে রাখতে পারে। এমন অসংখ্য অন্ধ মানুষ আছে যাদের স্মৃতিশক্তি মানুষকে হতবাক করে দেয়। একথা চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে, লেখনির উপর নির্ভর করার পর কোন জাতির স্মৃতিশক্তির সেই অবস্থা অবশিস্ট থাকতে পারে না যা মূর্খতার যুগে তাদের মধ্যে ছিল।
হাদীসসমূহের সুরক্ষিত থাকার আসল কারণ
এটা হল উল্লেখিত বিষয়ের একটি দিক। দ্বিতীয় দিকটি এই যে, সাহাবায়ে কিরামদের জন্য বিশেষভাবে রসূলুল্লাহ (স) এর হাদীসসমূহ স্মরণ রাখা এবং সঠিকভাবে বর্ণনা করার পেছনে আরও কাতিপয় জিনিসও ক্রিয়াশীল ছিল যা কিছুতেই উপেক্ষা করা যেতে পারে না।
প্রথমতঃ তারা সর্বান্তকরণে মহানবী (স) কে আল্লাহর রসূল এবং বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মনে করতনে।তাদের অন্তরের মধ্যে তাঁর সুমহান ব্যক্তিত্বের গভীর প্রভাব বিদ্যমান ছিল।তাদের নিকট মহানবী (স) এর বক্তব্য এবং তার জীবনের ঘটনাবলী ও অবস্থার মর্যাদা সাধারণ মানবীয় ঘটনাবলীর মত ছিল না যে, তা নিজেদের স্মরণশক্তির হাওয়ালা করে দিয়েই ক্ষান্ত হতেন। তাঁরা মহানবী (স) এর সাহচর্যে যে সময় অতিবাহিত করেন তার প্রতিটি মুহূর্তে ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস এবং তাকে নিজেদের স্মৃতিতে ধরে রাখাকে তাঁরা নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ মূলধন মনে করতেন।
দ্বিতীয়তঃ তাঁরা রসূলুল্লাহ (স) এর প্রতিটি ভাষণ, প্রতিটি বক্তব্য এবং তার জীবনের প্রতিটি কার্যক্রম তেকে এমন শিক্ষা লাভ করতেন যে, তারা ইতিপূর্বে কখনও লাভ করতে সক্ষম হননি। তারা নিজেরাও জানতেন যে, তাঁরা ইতিপূর্বে চরম অজ্ঞ, মূর্খ ও পথভ্রষ্ট ছিলো এবং এই পরিবত্রতম মানুষটি তাদেরকে এখন সঠিক জ্ঞান দান করছেন এবং সুসভ্য মানুষের মত জীবন যাপন করতে শিখিয়েছেন। তাই তারা তাঁর প্রতিটি কথা পূর্ণ মনোযোগ সহকারে শুনতেন এবং প্রতিটি কাজ পর্যবেক্ষণ করতেন। কারণ তাদেরকে নিজেদের বাস্তব জীবন তদনুযায়ী গঠন করতে হত,তারই হুবহু অনুস্মরণ করতে হত এবং তারই নির্দেশনারয় কাজ করতে হত। প্রকাশ থাকে যে, এই চেতনা ও অনুভূতি সহকারে মানুষ যা কিছু দেখে ও শুনে থাকে তা স্মরণ রাখার ব্যাপারে তাঁরা এতটা সহজ হতে পারে না যতটা তার কোন মেলায় অথবা কোন বাজারে শ্রুত ও দৃষ্ট কথা স্মরণ রাখার ব্যাপারটি সাধারণ মনে করতে পারে।
তৃতীয়তঃ তাঁরা কুরআনের আলোকেও জানতেন এবং মহানবী (স) বারবার তাকিদ দেয়ার কারণেও তাদের প্রবল অনুভুতি ছিল যে, আল্লাহর নবীর উপর মিথ্যা আরোপ অতীব মারাত্বক অপরাধ, যার শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়া। এ কারণে তারা মহানবী (স) এর সাথে কোন কথা সংযুক্ত করে বর্ণনা করার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে এমন একটি উদাহরণও পাওয়া যায় না যে, কোন একজন সহাবীও নিজের কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে অথবা নিজের কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মহানবী (স) এর নাম অবৈধভাবে ব্যবহার করেছেন। এমনকি তাদের মধ্যে যখন মতবিরোধের সূচনা হয় এবং দুটি রক্তক্ষায়ী মনগড়াভাবে কোন হাদীস রচনা করে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেননি। পরবর্তী কালের অসৎ ও আল্লাহর প্রতি ভয়হীন লোকেরা অবশ্যই এ ধরনের জাল হাদসি রচনা করেছে, কিন্তু সাহাবায়ে কিরামের ঘটনাবলীর মধ্যে এর একটি দৃষ্টান্তও খজে পাওয়া যাবে না।
চতুর্থতঃ পরবর্তী বংশধরদের নিকট মহানবী (স) এর জীবনারচার এবং তার হেদায়াত ও শিক্ষা সম্পূর্ণ যথার্থ আকারে পৌছে দেয়া এবং তার মধ্যে কোন প্রকার বাড়াবাড়ি অথবা মিশ্রণ না ঘটানোকে সাহাবায়ে কিরাম নিজেরদ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব মনে করতেন। কারণ তাদের নিকট এটাই ছিল (আল্লাহর) দীন এবং তার মধ্যে নিজের পক্ষ থেকে পরিবর্তন সাধন করাটা কোন সমান্য অপরাধ নয়, বরং তা ছিল এক মারাত্মক প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা। তাই সাহাবাদের জীবনে এমন অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় যে, তারা হাদীস বর্ণনা করার সময় থরথর করে কেপেঁ যেতেন। তাদের চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যেত। যেখানে সামন্যতম সন্দেহ হত যে, হয়ত রসূলুল্লাহ (স) এর ব্যবহৃত শব্দ অন্য কিছু সেখানে বক্তব্য নকল করার সাথে সাথে “আও কামা কালা” (অথবা তিনি অনুরূপ বলেছেন) ব্যাক্যাংশ বলে দিতেন, যাতে শ্রোতামন্ডলী তাদের ব্যবহৃত শব্দাবলীকে হুবহু মহানবী (স) এর ব্যবহৃত শব্দ মনে না করে বসে।
পঞ্চমতঃ প্রবীণ সাহাবীগণ বিশেষভাবে সাধারণ সাহাবীদের হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সৎর্কতা অবলম্বনের উপদেশ দিতে থাকতেন। এ ব্যাপারে সামান্য অবহেলা প্রদর্শনকেও তারা কঠোরভাবে প্রতিহত করতেন এবং কখনও কখনও তাদের নিকট মহানবী (স) এর কোন হাদীস শুনলে তার সপক্ষে সাক্ষ্য তলব করতেন, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, অন্যরাও সংশ্লিষ্ট হাদীস শুনেছে। এই নিশ্চয়তা লাভের জন্য সাহাবীগণ একে অপরের স্মরণশক্তি পরীক্ষাও নিতেন। যেমন, একবার হজ্জের মৌসুমে হযরত আয়েশা (রা) এর নিকট হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনূল আস (রা) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস পৌছে। পরের বছর হজ্জের সময় উম্মুল মুমিনীন (আয়েশা) পুনরায় একই হাদীস সম্পর্কে জানার জন্য তার নিকট লোক পাঠান। মাঝখানে এক বছরের ব্যবধানের পরও হযরত আবদুল্লাহ (রা) এর দুই বারের বর্ণনার মধ্যে একটি শব্দেরও পার্থক্য ছিল না। এর উপর হযরত আয়েশা (রা) মন্তব্য করেন, বাস্তবিকই আবদুল্লাহর সঠিক কথা স্মরণ আছে (বুখারী, মুসলিম)।
ষষ্ঠতঃ মহানবী (স) এর শিক্ষা ও হেদায়াতের এক উল্লেখযোগ্য বিরাট অংশ যা শুধু মৌখিক বর্ণনাই ছিল না, বরং সাহাবাদের সমাজে, তাদের ব্যক্তিগত জীবনে, তাদের পরিবারে, তাদের অর্থনীতি, সরকারী প্রশাসন ও বিচারালয়সমূহে পরিপূণরূপে কার্যকর ছিল যার প্রভাব ও প্রকাশ লোকেরা দৈনন্দিন জীবনে সর্বত্র দেখতে পেত। এমন এক জিনিস সম্পর্কে কোন ব্যক্তি স্মৃতিশক্তির ভ্রান্তি অথবা নিজের ব্যক্তিগত ধ্যানধারণা ও ঝোক-প্রবণতার ভিত্তিতে কোন বিচ্ছিন্ন কথা নিয়ে এসে পেশ করলে তা কিভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারত? অতএব কখনও কোন অপরিচিত ও বিচ্ছিন্ন হাদীস সামনে এসে পড়লেও তার বর্ণনাকারীকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং মুহাদ্দিসগণ বলে দিয়েছেন যে, ঐ বিশেষ বর্ণনাকারী ছাড়া এই কথা আর কেউ বর্ণনা করেননি অথবা তদনুযায়ী আমল করার কোন নযীর বর্তমান নাই।
হাদীসসমূহের যথার্থতার একটি প্রমাণ
এসব ছাড়াও অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ আরও একটি কথা আছে-যা সেইসব লোকেরাই বুঝতে পারেন যারা আরবী ভাষা জানেন এবং যারা ভাসাভাসাভাবে কখনও কখনও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু হাদীস অধ্যয়ন করেননি, বরং গভীর দৃষ্টিতে হাদীসসের সব গ্রন্থাবলীর অথবা অন্ততপক্ষে কোন একটি গ্রন্থে যেমন বুখারী, অথবা মুসলিম) আদ্যপান্ত পাঠ করেছেন। তাদের নিকট একথা গোপন নয় যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নিজস্ব একটি ভাষা এবং তার নিজস্ব একটি বিশেষ প্রকাশভংগী ও বাচনভংগী রয়েছে যা সমস্ত সহীহ হাদীসসমূহে সম্পূর্ণ একরূপ এবং এক রং-এর দৃষ্টিগোচর হয়। কুরআনের মত তার সাহিত্য ও স্টাইলে এতটা স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান রয়েছে যে, তার অনুকরণ অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এর মধ্যে তার ব্যক্তিত্যই সবাক অনুভূত হয়। তাতে তাঁর উন্নত মর্যাদা ও অবস্থান অত্যুজ্জ্বল দৃষ্ঠিগোচর হয়। তা পড়তে পড়তে মানুষের অন্তর সাক্ষ্য দিতে থাকে যে, একথা মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (স) ব্যতীত অপর কোন ব্যক্তি বলতে পারে না। যেসব লোক অধিক পরিমাণে হাদীসমূহ পাঠ করে এবং মহানবী (স) এর ভাষা ও বচনভংগী উত্তমরূপে অনুধাবন করতে পেরেছে তারা হদীসের সনদসূহের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে শুধু মুল বক্তব্য পাঠ করে বলে দিতে পারে যে, হাদসিটি সহীহ অথবা মনগড়া কি না? মনগড়া হাদীসের ভাষাই বলে দেয় যে, তা রসুলুল্লাহ (স) এর ভাষা নয়। এমনকি সহীহ হাদীসের মধ্যে পর্যন্ত শব্দগত বর্ণনা ও অর্থগত বর্ণনারমধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য অনুভব করা যায়। কারণ বর্ণনাকরী যেখানে মহনবী (স) এর বক্তব্য নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেছেন সেখানে তাঁর ভাষা ও স্টাইল সম্পর্কে অবহিত ব্যক্তি অনুধাবন করতে পারে যে, এই চিন্তধারা ও বর্ণনা তো মহানবীরই (স),কিন্তু ভাষার মধ্যে পার্থক্য আছে। এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হাদীসমূহের মধ্যে কখনও পাওয়া যেত না, যদি অসংখ্য দুর্বল হাফেজগণ এগুলোকে নিজ নিজ ধ্যানধারণা ও ঝোক প্রবণতা অনুযায়ী চুরমার করে থাকত। একথা কি বুদ্ধিতে কুলায় যে, অসংখ্য মস্তিষ্ক একত্র হয়ে একটি একই রূপ বৈশিষ্ট্যের সাহিত্য এবং একটি একক রীতির (Style) সৃষ্টি করতে পারে?
এ ব্যপারটি শুধু ভাষা ও সাহিত্যের গন্ডি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। আরো সামনে অগ্রসর হয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, দেহ ও পোশাকের পরিবত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা থেকে সন্ধি ও যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী পর্যন্ত জীবনের সার্বিক দিক ও বিভাগসমূহে এবং ঈমান-আকীদা ও নীতি-নৈতিকাতা থেকে কিয়ামতের নির্দশনসমূহ সম্পর্কে সহীহ হাদীসসমূহ এমন এক চিন্তা ও কার্যপদ্ধতি পেশ করে যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব একক গঠন প্রকৃতির অধিকারী এবং যার সমস্ত অংশ ও শাখার মধ্যে পুরাপুরিভাবে যুক্তিসংগত মিল রয়েছে। এতটা সুবিন্যস্ত সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধ ব্যবস্থা এবং এতটা পূর্ণাঙ্গ ও অখন্ড ব্যবস্থা অপরিহার্যরূপে একই চিন্তাধারা থেকে গড়ে উঠতে পারে, বিভিন্ন চিন্তার অধিকারী মস্তিষ্ক একতাবদ্ধ হয়ে এরূপ ব্যবস্থা গঠন করতে পারে না। এটা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় যার সাহায্যে শুধু মনগড়া জাল হাদীসইনয়, বরং সন্দেহযুক্ত হাদীস পর্যন্ত চিহ্নিত করা সম্ভব। সনদসূত্র দেখার পূর্বেই গভীর দৃষ্টির অধিকারী কোন মুহাদ্দিস এই প্রকারে কোন হাদীসসমূহ ও কুরআন মজীদ একই হয়ে ইসলামের যে চিন্তাপদ্ধতি ও জীবন ব্যবস্থা গঠন করেছে তার মধ্যে এই বিষয়বস্তু কোন প্রকারেই ঠিকভাবে খাপ খায় না। কারণ এর মেজাজ-প্রকৃতি পুরা জীবন ব্যবস্থার বিপরীত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
উপর্ক্তো তথ্য ও আলোচনার আলোকে সম্মানিত বিচারপতির এই রায় নিতান্তই ভাসাভাসা অধ্যায়ন এবং নেহায়েত চিন্তাভাবনা ও পর্যালোচনার ফলশ্রুতি বলেই দৃষ্টিগোচর হয় যে, হাফেজদের ভুলভ্রান্তি এবং বিভিন্নধর্মী মস্তিষ্কের তৎপরতা হাদীসকে বিকৃত করে দিয়েছে। অর্বাচীনের মুখ দিয়েই কেবল হাদীস সম্পর্কে এরূপ মন্তব্য বের হতে পারে।
কতিপয় হাদীস সম্পর্কে বিজ্ঞ বিচারকের আপত্তি
সামনে অগ্রসর হয়ে সম্মানিত বিচারপতি বলেন যে, হাদীসের ভান্ডারে এমন সব হাদীস বর্তমান আছে যাকে ‘সঠিক মেনে নেয়া খুবই কঠিন। এর সপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ তিনি মিশকাতুল-মাসাবীহ-এর আলহাজ্জ মৌলভী ফজলুল করিম সাহেব এম.এ. বি. এল. কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে ১৩ টি হাদীস নকল করেছেন। এই অনুবাদ কলিকাতা থেকে ১৯৩৮ খৃ. প্রকাশিত হয়। এসব হাদীসের উপর সম্মানিত বিচারপতির অভিযোগসমূহ সম্পর্কে কিছু নিবেদন করার পূর্বে অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমাদের বলতে হচ্ছে যে, মিশকাত শরীফের এই অনুবাদে অনুবাদক সাহেব এত সাংঘাতিক ভুল করেছেন যা শুধু হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কেই নয় আরবী ভাষা সম্পর্কেও তার অজ্ঞতার প্রমান বহন করে। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে সম্মানিত বিচারক সাহেব এই সমস্ত ভুলভ্রান্তিসহ তার মূল পাঠ নকল করে দিয়েছেন। যদিও আলোচ্য বিষয়ের সাথে অনুবাদকের এই ভ্রান্তির কোন সম্পর্ক নেই, কিন্তু আমরা এখানে কেবলমাত্র এই কথার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য উক্ত বিষয়টির উল্লেখ্য করছি যে, বর্তমানে পাকিস্তান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম রাষ্ট, তার উচ্চ আদালতের একটি রায়ে হাদীসের আইনগত মর্যাদার উপরা এতটা সুদূরপ্রসারী আলোচনা ও বিতর্ক তোলা হবে এবং হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কে এতটা ভাসাভাসা বরং চরম ক্রটিপূর্ণ অভিজ্ঞতার সুস্পষ্ট প্রমাণ যুগপৎভাবে উপস্থিত করা হবে, সত্যিই এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাকর ব্যাপার। এই বিষয়টি শেষ পর্যন্ত দুনিয়ার জ্ঞানবান লোকদের উপর কি প্রভাব বিস্তার করবে এবং আমদের বিচারালয়সমুহের সম্মান ও মর্যাদা কতটুকু বৃদ্ধি করবে?
“উদাহরণস্বরূপ তার উধৃত প্রথম হাদীসের দুটি বাক্যাংশ দেখা যাক। …………….. এর অনুবাদ করা হয়েছে “এবং এর চেয়ে অধিক আশ্চর্যজনক কথা আর কি হতে পারে।:” অথচ তার সঠিক অনুবাদ হবেঃ “তার কোন কথাটি আশ্চর্যজনক ছিল না!” …………………. কে ……………….. অনুবাদক পড়েছেন এবং এর অনুবাদ করেছেনঃ “আমাকে ছেড়ে দাও। তুমি কি আমার প্রতিপালকেরে ইবাদত করবে?” অথচ এই অনুবাদই শুধু অস্পষ্ট ও অর্থহীনই নয়, বরং মূল পাঠ পড়তে গিয়ে অনুবাদক এমন ভুল করেছেন যা আরবী ব্যাকরণ সম্পর্কে প্রাথামিক জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিও করতে পারে না। (তাবুদু) হল পুং লিংগের ক্রিয়াপদ, আর বাক্যের পারস্পর্য বলে দিচ্ছে যে, সম্বোধিত ব্যক্তি হচ্ছেন মহিলা। মহিলাকে সম্বোধন করতে হলে … (তাবদীনা) বলতে হয়, (তাবুদু) নয়। উপরোক্ত বাক্যাংশের সঠিক অনুবাদ হলঃ “আমাকে ছেড়ে দাও, আমি আমার প্রতি পালকের ইবাদত করব।” এই প্রকারের ভুলভ্রান্তি দেখে শেষ পর্যন্ত কোন জ্ঞানবান ব্যক্তি বিশ্বাস করবে যে, সম্মানিত বিচারপতির হাদীস শাস্ত্রের উপর অন্তত এতটা বোধশক্তি আছে যতটা কোন বিষয়ের উপর বিজ্ঞতা সুলভ রায় দেয়ার জন্য অত্যাবশ্যক?
কোন কোন হাদীসে অশালীন বিষয়বস্তু আছে কেন?
এখন আমরা মূল আলোচনার দিকে ফিরে যাব। ২৬ নং প্যারায় বিজ্ঞ বিচারপতি একের পর এক ৯টি হাদীস নকল করেছেন এবং কোথাও তিনি বলেননি যে, কোন হাদীসের বিষয়বস্তুর উপর তার কি আপত্তি আছে। অবশ্য ২৭ নং প্যারায় তিনি সংক্ষিপ্ত আকারে মত প্রকাশ করেন যে, উক্ত হাদীসসমূহে যে “উলংগপনা” লক্ষ্য করা যায় তার ভিত্তিতে একথা বিশ্বাস করা যায় না যে, বাস্তবিকই এসব সঠিক হতে পারে। খুব সম্ভব তার ধারণা এই যে, মহানবী (স) ও মহিলাদের মধ্যে এবং মহানবী (স) এর পবিত্র স্ত্রীগণ ও তাদের ছাত্রবৃন্দের মধ্যে এ ধরনের খোলামেলা কথোপকথন শেষ পর্যন্ত কিভাবে সম্ভব ছিল?. এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞ বিচারপতি পেশকৃত হাদীসসমূহ সম্পর্কে পৃথকভাবে আলৈাচনা করার পূর্বে কয়েকটি মৌলিক কথা বলে দেয়া প্রয়োজন। কারণ বর্তমান কালের “শিক্ষিত ব্যক্তিগণ” সাধারণত এসব কথা না বুঝার কারণে উল্লেখিত প্রকারের হাদীসসমূহের সম্পর্কে সংশয় ও জটিলতায় পতিত হয়ে থাকে।
(এক) মানুষের একান্ত (Confidential) ব্যক্তিগত (Privet) জীবনের এমন কতিপয় দিক রয়েছে যে সম্পর্কে তার প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রশিক্ষণ এবং পথনির্দেশ ও উপদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে লজ্জা শরমের অনর্থক অনুভুতি অধিকাংশ সময় প্রতিবন্ধক হয়ে আছে এবং এর কারণে উন্নত দেশসমূহের লোকেরা পর্যন্ত এ সম্পর্কে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা প্রাথমিক নীতিমালা সম্পর্কে পর্যন্ত অনবহিত রয়েগেছে। এটা আল্লাহর দেয়া শরীআতেরই কৃপা যে, তা এসব দিক সম্পর্কেও আমাদের পথনির্দেশ দান করেছে এবং এসব আভ্যন্তরীণ বিষয় সম্পর্কে নিয়ম-কানুন ও নীতিমালা বলে দিয়ে আমাদের ভুলভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেছে। বিজাতির চিন্তাশীল ও প্রতিভাবান লোকেরা এসব জিনিসের মূল্য ও মর্যাদা দিয়ে থাকে, কারণ তাদের জাতির লোকেরা জীবনের এই বিশেষ শাখার শিক্ষা-প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে। কিন্তু মুসলমান যারা ঘরে বসেই এসব নীতিমালা পেয়ে গেছে, আজ তারা এই শিক্ষর অবমূল্যায়ন করছে এবং আশ্চর্যজনক মজার ব্যাপার এই যে, এই অবমূল্যায়নের প্রকাশের ক্ষেত্রে সেইসব লোকেরাও অংশগ্রহণ করেছে যারা পাশ্চাত্য জাতির অনুকরণে যৌন বিজ্ঞানকে (Sex Education) পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে চালু করার পক্ষপাতী।
(দুই) আল্লাহ তাআলা আমাদের শিক্ষার জন্য যে কোন নবীকে প্রেরণ করেছিলেন তার উপর জীবনের এই প্রাইভেট শাখা সম্পর্কেও শিক্ষা- প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্বও ন্যস্ত ছিল। আরব জাতি এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক নিয়ম- কানুন সম্পর্কে পর্যন্ত অনবহিত ছিল না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে তাদের পুরুষদের ও এবং মহিলাদেরও পবিত্রতা, পায়খানা- পেশাব, গোসল ইত্যাদি নিয়ম-কানুন, অনন্তর এ জাতীয় অন্যান্য নিয়ম কানুনও কিবলমাত্র মৌখিকভাবেই বুঝিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হনানি, বরং নিজের স্ত্রীগণকেও অনুমতি দেন যে, তারা যেন মহানবী (স) এর একান্ত পরিবারিক জীবনের এসব দিক ও বিভাগ সম্পর্কে সাধারণ লোকদের সামনে তুলে ধরেন যে, তিনি স্বয়ং কোন নীতিমালার উপর আমল করতেন।
(তিন) আল্লাহ তাআলা এই প্রয়োজনে মহানবী (স) এর পরিবত্র স্ত্রীগণকে মুমিন মুসলমানদের মাতৃস্থানীয় মর্যাদা দান করেছিলেন, যাতে মুসলমানগণ তাদের নিকট উপস্থিত হয়ে জীবনের এই দিক ও বিভাগ সম্পর্কে পথনির্দেশ লাভ করতে পারে এবং উভয় পক্ষের মধ্যে এই প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময় কোন প্রকারের নাপাক আবেগের বহিপ্রকাশের আশংকা না থাকে। এ কারণে হাদীসের গোটা ভান্ডারে এমন কোন একটি নযীর পাওয়া যাবে না যে, মুমিন মুসলমানদের মাতৃস্থানীয় উম্মাহাতুল মুমিনীনের নিকট যে কথা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তা খোলাফায়ে রাশেদীনের বা অপরাপর সাহাবীদের স্ত্রীদের নিকটও জিজ্ঞাসা করা হয়েছে এবং তারা পুরুষদের সাথে এই ধরনের কথোপকথন করে থাকবেন।
(চার) লোকেরা নিজেরদের ধারণায়, অথবা ইহুদী খৃষ্টানদের প্রভাবে যেসব জিনিস হারাম অথবা মাকরুহ বা অপছন্দণীয় মনে করে নিয়েছিল সেসব বিষয় শরীআত তাদের জন্য বৈধ করেছে শুধু এতটুকু শুনেই তারা আশ্বস্ত হতে পারত না। বৈধতার নির্দেশ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তাদের অন্তত মাকরূহ থেকে মুক্ত নয়-তাই তারা নিজদের মনের প্রশান্তি লাভের উদ্দেশ্যে এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) এর নিজস্ব কার্যক্রম কি ছিল তা অবহিত হওয়া প্রয়োজন মনে করত। তারা যখন জানতে পারত যে, মহানবী (স) স্বয়ং অমুক কাজ করেছেন তখন তাদের মন থেকে সংশ্লিষ্ট কাজটির অন্তত অপছন্দীয় হওয়ার ধারণা দূর হয়ে যেত। কারণ তারা মহানবী (স) কে অনুসরণীয় আদর্শ মনে করত এবং তাদের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, তিনি যে কাজ করেছেন তা মাকরুহ অথবা পবিত্রতার স্তরে থেকে নিচু হতে পারে না। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ যার ভিত্তিতে মহানবী (স) এর পবিত্র স্ত্রীগণকে দাম্পত্য ও পরিবারিক জীবনের এমন কাতিপয় বিষয় সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে হয়েছে যা অন্য কোন মহিলা বর্ণনা করতে পারত না এবং বর্ণনা করতেও চাইত না।
(পাঁচ) হাদীসসমূহের এই অংশ মূলত মুহাম্মদ (স) এর মহানত্ব এবং তাঁর নবুয়াতের সপক্ষে অতীব গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যসমূহের অন্তর্ভুক্ত করার যোগ্য। মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (স) ব্যতীত পৃথিবীতে তেইশটি বছরের রাত ও দিনের প্রতিটি মূহূর্তে নিজেকে সর্বসাধারণের দৃষ্টির সামনে রেখে দিতে, নিজের প্রাইভেট জীবনকেও উম্মুক্ত করে দিতে এবং নিজের স্ত্রীদের পর্যন্ত লোকদের সামনে নিজের পারিবারিক জীবনের অবস্থাও পরিষ্কারভাবে বিবৃত করার অনুমতি প্রদানের দুসাহস আর কে করতে পারত এবং গোটা মানব ইতহাসে কে এইরূপ সৎসাহস দেখাতে পেরেছে?
অভিযোগসমূহের বিস্তারিত মূল্যায়ন
উপরোক্ত বিষয়সমূহ দৃষ্টির সামনে রেখে বিজ্ঞ বিচারপতির পেশকৃত প্রতিটি হাদীস স্বতন্ত্রভাবে নিরীক্ষণ করে দেখা যাক।
প্রথমোক্ত হাদীসে হযরত আয়েশা (রা) মূলত বলতে চাচ্ছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যদিও বৈরাগ্যে থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন এবং দুনিয়ার মানুষ নিজ নিজ স্ত্রীর সাথে যেরুপ সম্বন্ধ ও সম্পর্ক বজায় রাখে তিনিও নিজ স্ত্রীদের সাথে তদ্রুপ সম্বন্ধ ও সম্পর্ক বজায় রাখতেন। কিন্তু তথাপি আল্লাহ তাআলার সাথে তার এমন গভীর সম্পর্ক ছিল যে, বিছানায় স্ত্রীর সাথে শুয়ে যাওয়ার পরও কখনও কখনও হঠাৎ তার উপর ইবাদতের আকাংখা প্রবল হয়ে উঠতো এবং তিনি পার্থিব স্বাদ ও ভোগ বিলাস ত্যাগ করে এমনভাবে উঠে যেতেন যে, আল্লাহর বন্দেগী ছাড়া কোন জিনিসের প্রতি যেন তার কোন আকর্ষন নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, নবী করীম (স) এর পবিত্র জীবনের এই নির্জন গন্ডি সম্পর্কে তার স্ত্রীগণ ব্যতীত আর কে বলতে পারত? এই তথ্য যদি আলোতে না আসৎ তবে আল্লাহর প্রতি তার নিষ্ঠার সঠিক অবস্থা বিশ্ব কিভাবে জানতে পারত? ওয়াজ নসীহতের মজলিসে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও ভয়ের প্রদর্শণী কে না করে থাকে? মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গোপন অবস্থা ও কার্যাবলী সম্পর্কে অবগত হওয়া গেলেই তখন আল্লাহর প্রতি গভীর ও সত্যিকার ভালোবাসা ও তাকওয়ার অবস্থা পরিস্ফুটিত হয়ে উঠে।
দ্বিতীয় হাদীসে মূলত একথা বলা উদ্দেশ্য যে, চুমু দেয়া স্বয়ং উযূ নষ্টকারী জিনিস নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না যৌন উত্তেজনা বশত বীর্যরস নির্গত হয়। লোকেরা সাধারণত চুমুকেই স্বয়ং উযু নষ্ট না হলেও অন্তত পবিত্রতার মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য বা ক্রটি এসে যায়। তাদের এই সন্দেহ দূর করার জন্য হযরত আয়েশা (রা) কে বলতে হয়েছে যে, মহানবী (স) স্বয়ং চুমু খাওয়ার পর উযু না করেই নামায পড়েছেন। অন্য লোকের নিকট এই মাসআলাটির গুরুত্ব থাক বা না থাক, কিন্তু যাদের নামায পড়তে হয় তাদের তো অবশ্যি এটা মেনে নেয়া অত্যাবশ্যক যে, কোন অবস্থায় তারা নামায পড়ার উপযোগী থাকে এবং কোন অবস্থায় থাকে না।
তৃতীয় হাদীসে এক মহিলার এই মাসআলা জানার প্রয়োজন হয়ে পড়ে যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মত নারীদের ও যদি স্বপন্নদোষ হয় তবে তাকে কি করতে হবে। মহিলাদের ক্ষেত্রে যেহেতু তা কমই ঘটে থাকে তাই তারা এর শরীআত সম্মত বিধান সম্পর্কে অনবহিত ছিল। ঐ মহিলা রসূলুল্লাহ (স ) এর নিকট উপস্থিাত হয়ে মাসআলা জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে বলেন, পুরূষদের মত তাকেও গোসল করতে হবে, শুধু তাকেই নয়, যে কোন মহিলাকেই (এরূপ ঘটলে) গোসল করতে হবে। এভাবে তিনি একজন মহিলার মাধ্যমে সব স্ত্রীলোককে একটি জরূরী শিক্ষা দান করলেন। এর উপর যদি কারো আপত্তি থেকে থাকে তবে তিনি কি এটাই চাচ্ছেন যে, মহিলারা তাদের জীবনের প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল কারো কাছে জিজ্ঞেস না করুক এবং লজ্জাবনত অবস্থায় নিজের বুদ্ধিতে যা আসে তাই করতে থাকুক? হাদীসের দ্বিতীয় অংশে এক মহিলার আশ্চর্যবোধ করার প্রেক্ষিতে মহানবী (স) দেহ বিজ্ঞান সম্পর্কিত একটি তথ্য বর্ণনা করেন যে, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মত প্রাপ্তবয়স্কা নারীদের দেহ থেকেও পদার্থ (বীর্য) নির্গত হয়। উভয়ের মিলিত হওয়ার ফলে সন্তান পয়দা হয় এবং উভয়ের মধ্যে যার বীর্যের অংশ বেশী থাকে সন্তানের মধ্যে তার বৈশিষ্ট্যের প্রাবল্য অধিক প্রতিয়মান থাকে। বুখারী ও মুসলিমের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে এ হাদীসের যে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে তা মিলিয়ে দেখুন। এক বর্ণনায় মহানবী (স) এর বক্তব্য নিম্নরূপ:
“সন্তানের মধ্যে সাদৃশ্য কি এ ছাড়া অন্য কোন কারণে হয়ে থাকে? যখন স্ত্রীর বীর্য স্বামীর বীর্যের উপর প্রাধান্য লাভ করে তখন সন্তান মাতুল গোষ্ঠীর অনুরূপ হয়ে থাকে। আর যখন স্বামীর বীর্য স্ত্রীর বীর্যের উপর প্রাধান্য লাভ করে তখন সন্তান পিতৃকূলের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়।”
হাদীস অস্বীকারকারীরা অজ্ঞান অথবা ভন্ডামীর আশ্রয় নিয়ে এসব হাদীসের এই অর্থ করেছে যে, সহবাসে যদি নারীর আগে পুরূষের বীর্যপাত হয় তবে বাচ্চা পিতৃকূলের প্রভাব প্রাপ্ত হয়, অন্যথায় মায়ের অনুরূপ হয়। আমরা এদেসের পরিস্থিতি সম্পর্কে অত্যন্ত চিন্তিত যে, জাহেল-মূর্খ ও নিকৃষ্ট স্বভাবের লোকেরা প্রকাশ্যে হাদীসের জ্ঞান নিয়ে এই প্রকারের ধোকাবাজি করছে এবং উচ্চ শিক্ষিত লোকেরা পর্যন্ত অনুসন্ধান ছাড়াই এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই ভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছে যে, হাদীস বিশ্বাসের অযোগ্য কথায় ভরপুর।
চতুর্থ হাদীসে হযরত আয়েশা (রা) বলেছেন যে, স্বামী-স্ত্রী একসাথে গোসল করতে পারে এবং মহানবী (স) স্বয়ং এরূপ করেছেন। যেসব দম্পতি নিয়মিত নামায পড়ত মূলত তাদেরই এ মাসআলাটি সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ফজরের সময় বারংবার তারা এমন অবস্থায় সম্মুখীন হয়েছিল যে, সময়ের সংকীর্ণতার কারণে একজনের পরে অপরজন গোসল করলে একজনের নামাযের জামাআত ছুটে যেত। এরূপ পরিস্থিতিতে তাদেরকে একথা বলে দেয়া আবশ্যক ছিল যে, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের একসাথে গোসল করা শুধু জায়েযই নয়, বরং তাতে দোষেরও কিছু নেই। এ প্রসঙ্গে আরও জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, সে সময় মদীনায় গোসল খানায় বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্তা ছিল না এবং ফজরের জামাআত তার প্রথম ওয়াক্তে অনুষ্ঠিত হত এবং মহিলারাও ফজর ও এশার নামায মসজিদে গিয়ে জামাআতে আদায় করত। এসব তথ্য দৃষ্টির সামনে রেখে আমাদের বলে দেয়া হোক এ হাদীসে কোন জিনিসটি গ্রহণযোগ্য নয়?
পঞ্চম হাদীসে হযরত আয়েশা (রা) বলেছেন যে, খারাপ স্বপ্ন দেখলে কোন অবস্থায় গোসল ফরয হয় এবং কোন অবস্থায় ফরয হয়না। আর ষষ্ঠ হাদীসে তিনি বলেছেন যে, জাগ্রত অবস্থায় কখন গোসল ওয়াজিব হয়। এ দুটি হাদীস কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিকভাবে উপলব্দি করতে পারবে না, যতক্ষণ না সে জানতে পারে যে তৎকালীন সময়ে গোসল ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈদের মধ্যে একটি মতভেদের উদ্ভব হয়েছিল।
কতিপয় সাহাবী ও তাদের ছাত্রবৃন্দ ভুল বুঝাবুঝির শিকার হয়ে পড়েছিলেন যে, সংগমকালে বীর্যপাত হলেই কেবল গোসল ফরয হয়। এই ভুল বুঝাবুঝি দূরীকরণার্থে হযরত আয়েশা (রা) কে একথা বলে দিতে হয়েছে যে, এই হুকুম কেবল স্বপ্নদোষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং সহবাসের ক্ষেত্রে উভয় লিংগ পরস্পর একত্র হলেই গোসল ফরয হয়ে যাবে এবং রসূলুল্লাহ (স) এর স্বীয় আমলও তাই ছিল। একথা সুস্পষ্ট যে, নামাযী লোকদের জন্য এই মাসআলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যেসব ব্যক্তি কেবল বীর্যপাত হলেই গোসল ফরজ হওয়ার পক্ষপাতী ছিল তারা স্ত্রীসহবাসে বীর্যপাত না হওয়ার ক্ষেত্রে গোসল না করেই নামায পড়ার মত ভুল করে বসতে পারত। এ প্রসঙ্গে মহানবী (স) এর নিজস্ব কর্মনীতি বলে দেয়ার মাধ্যমেই এই বিষয়টির চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে গেল।
৭,৮,৯, ১০ ও ১১ নম্বরের এই হাদীস কয়টি সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য জানা প্রয়োজন যে, ফরয গোসল ও হায়েয (মহিলাদের মাসিক ঋতু) অবস্থায় মানুষের নাপাক হওয়ার ধারণা প্রাচীন শরীআতেসমূহেও ছিল এবং শরীআতে মুহাম্মদীতেও পেশ করা হয়েছে। কিন্তু প্রাচীন শরীআতসমূহে ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মযাজকদের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এই ধারণাকে এতটা ভারসাম্যহীন করে দেয় যে. তারা এই অবস্থায় মানুষের অস্তিত্বকেই নাপাক মনে করতে থাকে এবং এদের প্রভাবে হেজাযের এবং বিশেষত হায়েযগ্রস্ত মহিলারা তো সেখানে সম্পূর্ণ সমাজচ্যুত হয়ে পড়ত।
বিজ্ঞ বিচারপতি মেশকাতের যে গ্রন্থ থেকে এসব হাদীস উধৃত করেছেন তার “হায়েয” শীর্ষক অনুচ্ছেদের প্রথম হাদীস এই যে, “নারীরা হায়েযগ্রস্ত হয়ে পড়লে ইহুদীরা তাদের সাথে একত্রে পানাহার, শয়ন ও স্বাভাবিক মেলামেশা পরিত্যাগ করত। মহানবী (স) লোকদের বলেন যে, এ অবস্থায় কেবল সহবাসই নিষিদ্ধ, অবশিষ্ট যাবতীয় মেলামেশা পূর্ববৎ স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকবে।” কিন্তু তা সত্ত্বেও এক উল্লেখযোগ্য সময় যাবত লোকদের মধ্যে প্রাচীন ধ্যানধারণা অবশিষ্ট থাকে এবং তারা মনে করতে থাকে যে, হায়েয অবস্থায় নারীর অস্তিত্ব কিছু না কিছু অপবিত্র তো থাকেই এবং এ অবস্থায় যে যে জিনিসে তার হাত লেগে যায় তাও অন্তত কিছুটা অপবিত্র অবশ্যই হয়ে যায়। এই ধ্যানধারনাকে ভারসাম্যপূর্ণ করার জন্য হযরত আয়েশা (রা) কে বলতে হয়েছেঃ এ অবস্থায় স্বয়ং মহানবী (স) বেছেগুছে চলতেন না। তার মতে না পানি নাপাক হয়ে যেত, না বিছানা, না জায়নামায। অনন্তর তিনি আরও বলে দিয়েছেন যে, হায়েযগ্রস্ত আচার-ব্যবহার ও মেলামেশা তার সাথে করতে পারে। হযরত আয়েশা (রা) এবং মহানবী (স) এর অপরাপর স্ত্রীগণ তাঁর কর্মনীতির বিবরণ দান করে যদি এই কুসংস্কারের মূলোৎপাটন না করতেন তবে আজ আমাদেরকে নিজেদের পারিবারিক কাজকর্মে যেসব সংকীর্ণতা ও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হত তা অনুমান করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের উপর এই অনুগ্রহ প্রদর্শনকারিণীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের পরিবর্তে আমরা এখন বসে বসে চিন্তা করছি যে, আচ্ছা নবী (স) এর স্ত্রীগণ কি এ জাতীয় কথা মুখে আনতে পারেণ।
আরও দুটি হাদীস সম্পর্কে অভিযোগ
অত:পর ২৮ নং প্যারায় বিচারপতি সাহেব আরও দুটি হাদীস উধৃত করেছেন, যাতে মহানবী (স) বলেছেন যে, তিনি জান্নাতসমূহ দেখেছেন এবং তার অধিকাংশ অধিবাসী ছিল দরিদ্র ও ফকির-মিসকীন। তিনি দোযখও দেখেছেন এবং অধিকাংশ বাসিন্দা ছিল স্ত্রীলোক।
এ হাদীস সম্পর্কে তিনি শুধুমাত্র এই মত প্রকাশ করেননি যে, “আমি নিজেকে বিশ্বাসই করাতে পারছি না যে, মহানবী (স) এই রকম কথা বলে থাকবেন বরং তিনি এ হাদীসের প্রথমাংশ সম্পর্কে এই রায় ব্যক্ত করেন যে, “এর অর্থ কি এই যে, মুসলমানদের ধন-সম্পদ উপার্জন করতে নিষেধ করা হয়েছে।”
এ জাতীয় কোন হাদীস যদি কোন ব্যক্তি কখনও হালকা দৃষ্টিতে দেখে তবে সে উপরোক্ত ভ্রান্তির শিকার হবে যা এই বিজ্ঞ বিচারপতি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু যেসব লোক ব্যাপক ও গভীরভাবে হাদীস অধ্যয়ন করেছে এবং যাদের সামনে এ ধরনের প্রচুর হাদীস এসেছে তাদের একথা অজ্ঞাত নয় যে, মহনবী (স) তাঁর এই পর্যবেক্ষণ কেবলমাত্র কাহিনী বলার খাতিরে বর্ণনা করেননি, বরং বিভিন্ন পর্যায়ভুক্ত লোকের সংশোধনের জন্য বর্ণনা করেছেন। তিনি অবশ্যই একথা বলেননি যে, গরীব লোকদের তুলনায় ধনী লোকরা দোযখের অধিক উপযোগী হয়ে থাকে, বরং সম্পদশালীদের এও বলেছেন যে, তাদের কি কি দোষ বা অপরাধ রয়েছে যা আখেরাতে তাদের ভবিষৎ ধ্বংস করে দেয়; এবং তাদের কি কর্মধারা অবলম্বন করা উচিত যার ফলশ্রুতিতে তারা পার্থিব জীবনের মত আখেরাতেও সুখ-স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারবে। অনুরুপভাবে তিনি তাঁর বিভিন্ন ভাষণে মহিলাদেরও বলে দিয়েছেন যে, তাদের কোন ধরনের দোষক্রটি তাদেরকে জাহান্নামের বিপদে নিক্ষেপ করতে পারে, যা থেকে তাদের বেচেঁ থাকা উচিত এবং কি ধরনের ভালো কাজ করে তারা জান্নাত লাভের অধিকারী হতে পারে। যেসব লোকের কোন একটি বিষয়ের সংশ্লিষ্ট সার্বিক দিক অধ্যয়ন ও গবেষণার অবকাশ নেই তাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যৎসামান্য জ্ঞানের উপর ভরসা করে মত প্রকাশের কি প্রয়োজন আছে?
আরও একটি হাদীসের বিরুদ্ধে অভিযোগ
এরপর ২৯ নং প্যারায় বিজ্ঞ বিচারপতি বলেন, “উপরন্তু এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ এমন কথা বলে থাকবেন যা বুখারীর ৮২৫ নং পৃষ্ঠায় রিওয়ায়াত নং ৬০২/৭৪-এ আবদুল্লাহ ইবনে কায়েসের সূত্রে বর্ণিত আছে যে, মুসলমানগণ জান্নাতে একটি তাঁবুর বিভিন্ন অংশে উপবিষ্ট নারীদের সাথে সংগম করবে?”
আমরা অত্যন্ত পেরেশান ছিলাম যে, এই বুখারী নামক হাদীস গ্রন্থে শেষ পর্যন্ত কোন কিতাব যার ৮৫২ নং পৃষ্ঠার বরাত দেয়া হয়েছে? অবশেষে সন্দেহ দূরীভুত হল যে, সম্ভবত এ গ্রন্থটি হচ্ছে তাজরীদুল বুখারীর উর্দূ অনুবাদগ্রন্থে যা মালিক মুহাম্মাদ এন্ড সন্স প্রকাশ করেছেন। অনুবাদগ্রন্থখানি বের করে দেখা গেল সত্যিই উক্ত গ্রন্থের বরাত দেয়া হয়েছে। এখন কিছুটা এই জুলুম ও অবিচারের প্রতি লক্ষ্য করুন যে, বিজ্ঞ বিচারপতি হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কে একটি বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তে বিজ্ঞসুলভ রায় প্রকাশ করেছেন এবং বরাত দিচ্ছেন এমন একটি ভুলভ্রান্তিপূর্ণ অনুবাদগ্রন্থের যার অনুবাদকের নামটা পর্যন্ত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়নি। আরও অধিক জুলুম ও অন্যায় এই যে, তিনি হাদীসের মূল ভাষা পড়ার পরিবর্তে অনুবাদের ভাষা পাঠ করে রায় প্রদান করেছেন এবং এতটুকুও অনুভব করলেন না যে, অনুবাদে কি ভুল রয়েছে। হাদীসের মূল পাঠ ও তার সঠিক অনুবাদ নিম্নেপ্রদত্ত হলঃ
“বেহেশতে একটি তাবু আছে যা কারুকার্য খচিত মণিমুক্তা দ্বারা নির্মিত। তার প্রস্থ ষাট মাইল। এর এক প্রকোষ্ঠের লোকেরা অপর প্রকোষ্ঠে বসবাসকারীদের দেখতে পায় না। মুমিনগণ তাদের নিকট যাতায়াত করবে”
(অর্থাৎ মাঝে প্রতিটি প্রকোষ্ঠের বাসিন্দাদের নিকট যাতায়াত করতে থাকবে)১
রেখাংকিত “ইয়াতূফূনা আলাইহিম” বাক্যাংশের অর্থ অনুবাদক সাহেব করেছেন- “তারা তাদের সাথে সংগম করবে” এবং বিজ্ঞ বিচারপতি এর উপর নিজের রায়ের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। অথচ “তাফা আলাইহে” এর অর্থ “কখন্ কখনো কারো নিকট যাতায়াত করা” “সহবাস করা” এর অর্থ নয়। কুরআন মজীদে জান্নাতের উল্লেখপূর্বক বলা হয়েছেঃ
يَطُوفُ عَلَيْهِمْ وِلْدَانٌ مُّخَلَّدُونَ
“তাদের নিকট এমন সব কিশোরেরা যাতায়াত করবে যারা চিরকালই কিশোর থাকবে” (সূরা ওয়াকিয়াঃ ১৭; আদ-দাহরঃ১৯)। এর অর্থ কি এই যে, এসব কিশোর তাদের সাথে সংগম করবে? সূরা নূর-এ (৫৮ নং আয়াতে) দাস-দাসী ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালকদের সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা তিন সময়ে বাড়ির মালিকের নির্জন কক্ষে অনুমতি ব্যতিরেকে প্রবেশ করবে না। অবশ্য অন্যান্য সময়ে অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করতে পারবে এবং এই নির্দেশের যে কারণ বর্ণনা করা হয়েছে তা এই যে, طوافون عليكم “তাদেরকে তোমাদের নিকট যাতায়াত করতে হয়।” এখানেও কি এই তাওয়াফ শব্দের অর্থ সংগমই হবে? আলোচ্য হাদীসে (আহল) শব্দের অর্থ যদি একজন মুমিন ব্যক্তির স্ত্রীগণই হয়ে থাকে যারা এই ষাট মাইল প্রশস্ত তাবুর বিভিন্ন অংশে বসবাস করবে, তবুও কোন ব্যক্তির নিজের স্ত্রীদের কোঠাসমূহে “যাতায়াত” কি অপরিহার্যরূপে “সংগম” এর সমার্থবোধক? কোন উত্তম ব্যক্তি কি এই একটি উদ্দেশ্য ছাড়া নিজের স্ত্রীর প্রতি কোন আকর্ষণ বোধ করে না? তাওয়াফ শব্দের এই অর্থ তো কেবলমাত্র সেই ব্যক্তিই করতে পারে যার মন মগজের উপর যৌনাবেগ নিকৃষ্টভাবে সওয়ার হয়ে আছে।
বিচারপতির মতে সুন্নাতে নববী আইনের উৎস না হওয়ার ব্যাপারে আরও দুটি প্রমাণ
৩০ নম্বর প্যারায় বিজ্ঞ বিচারক আরও দুটি প্রমাণ পেশ করেছেন। (এক) রাফে ইবনে খাদীজ (রা) থেকে বণিত হাদীসে (যার বরাত তিনি দিয়েছে) মহানবী (স) স্বযং বলেছেন, যেসব বিষয় দীন ইসলামের সাথে সম্পর্কিত নয় সেসব ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্যকে চুড়ান্ত মনে করবে না। (দুই) মহানবী (স) স্বয়ং এই বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন (এখানে তিনি অবশ্য কোন বরাত উল্লেখ্য করেননি) যে, শুধু কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা জীবনের সার্বিক দিক ও বিভাগে মুসলমানদের পথপ্রদর্শক হওয়া উচিত।
এর মধ্যে প্রথম দলীল তাঁর পেশকৃত হাদীসের সাহায্যেই চুরমার হয়ে যায়। উক্ত হাদীসে এই ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে যে, মহানবী (স) খেজুরের উৎপাদন কার্যের ব্যাপারে মদীনাবাসীদের একটি পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করাতে খেজুরের উৎপাদন কমে যায়। এর ভিত্তিতে তিনি বলেন, “আমি তোমাদের দীনের ব্যাপারে যখন তোমাদের কোন নির্দেশ দেই তখন তার অনুসরণ কর এবং যখন নিজের ব্যক্তিগত অভিমত অনুযায়ী কিছু বলি তবে সে ক্ষেত্রে আমি একজন মানুষই।”
উপরোক্ত হাদীস থেকে একথা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ইসলাম যেসব বিষয় নিজের দিক নির্দেশনার আওতাভুক্ত করে নিয়েছে সেসব ক্ষেত্রে তো মহানবী (স) এর বাণীর আনুগত্য অপরিহার্য। অবশ্য যেসব বিষয় দীন ইসলাম নিজের আওতাভুক্ত করেনি সেসব ক্ষেত্রে নবী (স) এর ব্যক্তিগত অভিমতের আনুগত্য অপরিহার্য নয়। এখন স্বয়ং প্রত্যেক ব্যক্তি দেখে নিতে পারে যে, দীন ইসলাম কোন সব বিষয় নিজের আওতাভুক্ত করে নিয়েছে এবং কোনটিকে নয়। একথা সুস্পষ্ট যে, লোকদের উদ্যানচর্চা, অথবা দর্জীর কাজ, অথবা বাবুর্চির কাজ শিখানোর বিষয় দীন ইসলাম নিজের দায়িত্বভুক্ত করেনি। কিন্তু স্বয়ং কুরআন মজীদই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন, পারিবারিক আইন, অর্থনৈতিক বিধান এবং অনুরূপভাবে সামাজিক জীবনের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে আইন-কানূন বলে দেয়ার দায়িত্ব দীন ইসলাম তার কার্যক্ষেত্রে আওতায় নিয়ে নিয়েছে। এসব বিষয় সম্পর্কে মহানবী (স) এর হেদায়াত ও পথনির্দেশ প্রত্যাখ্যান করার জন্য উপরোক্ত হদীসকে কিভাবে প্রমাণ হিসাবে পেশ করা যেতে পারে?
তার দ্বিতীয় দলীল সম্পর্কে আমাদের দাবী এই যে, অনুগ্রহপূর্বক আমাদের বলে দেয়া হোক যে, মহানবী (স) এর কোন হাদীসে এই বক্তব্য এসেছে যে, মুসলমানদের পথনির্দেশ লাভের জন্য শুধুমাত্র কুরআনের দিকে প্রত্যাবর্তন করা উচিৎ।
تركت فيكم امرين لن تضلوا ما تمسكتم بهما كتاب الله وسنة رسوله
“আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম। যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে ধরে থাকবে ততক্ষণ মোটেই পথভ্রষ্ট হবে নাঃ (এক) আল্লাহর কিতাব, (দুই) তার রসূলের সুন্নাত”-(মুওয়াত্তা ইমাম মালেক)।
১. বুখারী বাংলা অনু. ৪খ. হাদীস নং ৪৫২ ইংরেজী অনু. ডক্টর মুহসিন খান, ৬খ. হাদীস নং ৪০২ মুসলিম (জান্নাত) তিরমিযী (জান্নাত) দারিমী, (রিকাক) মুসনাদে আহমাদ. ৩য়., ৪র্থ খন্ড- (অনুবাদ)।
স্বয়ং মুহাদ্দিসগণের কি হদীসসমূহের উপর আস্থা ছিল না?
৩১ নং প্যারায় সম্মানিত বিচারক আরও একটি যুক্তি পেশ করেছেন। তিনি বলেন, “স্বয়ং মুহাদ্দিসগণ নিজেদের সংগৃহীত হাদীসসমূহের যথার্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না শুধু এই একটিমাত্র বিষয় থেকে প্রতীয়মান হয় যে,তারা মুসলমানদের বলেন না যে, তোমরা আমাদের সংগৃহীত হাদীসগুলো যথার্থ বলে গ্রহণ কর। বরং তারা বলেন, এগুলোকে আমাদের নির্ধারিত হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের মানদন্ডে যাচাই করে তোমরা নিশ্চিত হও। এসব হাদীসের যথার্থতা সম্পর্কে তাঁরা যদি নিশ্চিত হতেন তবে যাচাই বাছাইয়ের প্রশ্ন ছিল সম্পূর্ণ নিরর্থক ও নিষ্প্রয়োজন।”
বাস্তবিকই এ এক আজব যুক্তি। দুনিয়ার কোন প্রতিভাবান ও বিচক্ষণ লোক কোন জিনিসকে ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক বলেন না, যতক্ষণ না তিনি স্বয়ং যথার্থতা সম্পর্কে আশ্বস্ত হতে পারেন। কিন্তু আপনি একজন ঈমানদার প্রতিভাবান ব্যক্তি সম্পর্কে এ আশা করতে পারেন না যে, তিনি নিজের তথ্যানুসন্ধান ও গবেষণার উপর ঈমান আনার জন্য দুনিয়া ব্যাপী দাবী করবে এবং প্রতারণার সাথে লোকদের বলবে যে, আমি এটাকে সঠিক মনে করি, অতএব তোমাদেরও তা সঠিক বলে মেনে নেয়া উচিৎ। তিনি তো এটাই বলবেন যে, নিজের তথ্যানুসন্ধান ও গবেষণা চলাকালে যে তথ্যাবলীই তার সামনে আসবে তার সমস্তটাই লোকদের সামনে রেখে দেবেন এবং বলে দেবেন যে,এই তথ্যাবলীর ভিত্তিতে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌছেছি, তোমরা তা যাচাই করে নাও। যদি তোমরা আমার পেশকৃত তথ্য সম্পর্কে আশ্বস্ত হতে পার তবে তা কবুল করে নাও, অন্যথায় এই উপকরণ উপস্থিত আছে তার মাধ্যমে নিজেরাই যাচাই বাছাই করে নাও। মুহাদ্দিসগণ এই কাজ করেছেন। তাদের নিকট মহানবী (স) এর যে কথা ও কাজের বিবরণ পৌছেছে তার পূর্ণ সনদ (সূত্র পরস্পর) তারা বর্ণনা করেছেন। প্রতিটি সনদ সূত্রে যতজন রাবীর (বর্ণনাকারী) নাম এসেছে তাদের প্রত্যেকের অবস্থা স্বতন্ত্রভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। বিভিন্ন সনদসূত্রে প্রাপ্ত রিওয়ায়াতসমূহে যে যে দিক থেকে দুর্বল বা শক্তিশালী হওয়ার কোন কারণ পাওয়া যেত তাও তারা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। প্রতিটি হাদীস সম্পর্কে তাঁরা নিজেদের মত ব্যক্ত করে বলেছেন যে, আমরা অমুক অমুক যুক্তিপ্রমাণের ভিত্তিতে এই হাদীসকে সহীহ অথবা দুর্বলতার দিক থেকে এই মর্যাদা দান করি।
এখন পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, মুহাদ্দিসগণ যেসব হাদীসকে এই যুক্তিপূর্ণ পন্থায় সহীহ বলেন, তা তাদের নিকট সহীহ বলেই বিবেচিত। এগুলো সহীহ ও যথার্থ হওয়া সম্পর্কে তাঁরা যদি নিশ্চিতই না হতে পারতেন এবং তাদের যদি এরুপ বিশ্বাসই না জন্মাত তবে শেষ পর্যন্ত তাঁরা একে সহীহ বলবেনই বা কেন। এর পরও কি তাদের এরূপ আহবান জানানোর প্রয়োজন ছিল যে, হে মুসলমানগণ! তোমরাও এসব হাদীসের সহীহ ও যথার্থ হওয়ার উপর ঈমান আন, কারণ আমরা এগুলোকে সহীহ ও যথার্থ সাব্যস্ত করেছে?
হাদীসের বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ততা ও অসংলগ্নতার অভিযোগ
বিজ্ঞ বিচারপতি ৩৩ নং প্যারায় দুটি কথা বলেছেন, যেখানে পৌছে তার যুক্তিপ্রমাণের সমাপ্তি হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম কথা এই বলেছেন যে, “প্রচুর হাদীসের বক্তব্য খুবই সংক্ষিপ্ত, অসংলগ্ন ও সম্পর্কহীন যা পাঠ করলে পরিষ্কার অনুভব করা যায় যে, এগুলোকে পূর্বাপর সম্পর্ক ও যথাস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করে বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে হৃদয়ংগম করা এবং এর যথার্থ দাবী ও তাৎপর্য নিরুপন করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ না তার পূর্বাপর সম্পর্কের বিষয়টি সামনে রাখা হবে এবং কোন পরিবেশ পরিস্থিতিতে রসূলে পাক সংশ্লিষ্ট বক্তব্য রেখেছেন বা কোন কাজ করেছেন তা জ্ঞাত হওয়া যাবে।”
তার দ্বিতীয় কথা এই যে, “একথা বলা হয়েছে এবং যথার্থভাবেই বলা হয়েছে যে, হাদীস কুরআনের বিধান মানসূখ (রহিত) করতে পারে না। কিন্তু অন্ততপক্ষে একটি ক্ষেত্রে তো হাদীসসমূহ কুরআন পাকে সংশোধন আনয়ন করেছে, আর তা হচ্ছে ওসিয়াত সম্পর্কিত বিষয়।”
উপরোক্ত দুটি কথা সম্পর্কেও কয়েকটি বাক্য নিবেদন করে আমরা এই সমালোচনার পরিসমাপ্তি টানব।
প্রথম কথাটি মূলত এমন একটি প্রতিক্রিয়া যা হদীসের সংক্ষিপ্ত ও ক্ষুদ্র গ্রন্থাবলীর কোন একটি গ্রন্থ সম্পূর্ণ অগভীর দৃষ্টিতে পাঠ করার পর একজন পাঠকের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু হাদীসের বিরাট ও ব্যাপক ভান্ডার সম্পর্কে বিস্তারিত অধ্যয়নের পর তার পাঠক জানতে পারে যে, যেসব হদীস এক স্থানে সংক্ষিপ্ত আকারে ও সম্পর্কহীনভাবে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোই অন্য স্থানে তার পূর্বাপর সম্পর্কের সাথে এবং সংশ্লিষ্ট সমস্ত ঘটনার সাথে সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে। যেসব হাদীসের ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না, সে সম্পর্কেও যদি চিন্তাভাবনা করা হয় তবে তার মূল পাঠ স্বয়ং তার প্রেক্ষাপটের দিকে ইংগীত করে থাকবে। কিন্তু এর প্রেক্ষাপট কেবলমাত্র সেইসব লোকই সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেন, যাঁরা হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাবলী প্রচুর পরিমাণে অধ্যয়নের পর রসূলুল্লাহ (স) এর যুগ এবং তার সমসাময়িক সমাজের অবস্থা ও ধরন প্রকৃতি উত্তমরূপে উপলব্দি করতে পেরেছেন। তারা কোন একটি সংক্ষিপ্ত হাদীসে হঠাৎ কোন কথা বা কোন অবস্থায় এবং কোথায় ও কোনপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছিল; এবং এই ঘটনা কোন ঘটনাবলীর ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয়েছিল। এর কতিপয় উদহারণ আমরা ইতিপূর্বে এই সমালোচনার এক পর্যায়ে কয়েকটি হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসংঙ্গে পেশ করে এসেছি।
হাদীস কি কুরআনের পরিবর্তন ও সংশোধন করে?
দ্বিতীয় কথাটি সম্পর্কে আমাদের নিবেদন এই যে, বিজ্ঞ বিচারক ওসিয়াত সম্পর্কে যেসব হদীসকে কুরআন মজীদে পরিবর্তন বা সংশোধনের সমার্থবোধক সাব্যস্ত করছেন সেগুলোকে যদি সূরা নিসায় বর্ণিত মীরাস সম্পর্কিত বিধানসমূহের সাথে মিলিয়ে পাঠ করা হয় তবে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, ঐসব হাদীসে কুরআন মজীদের নির্দেশের পরিবর্তন বা সংশোধন করা হয়নি, বরং ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। এই সূরার দ্বিতীয় রূক’তে কতিপয় নিকটাত্মীয়ের অংশ নির্দিষ্ট করে দেয়ার পর বলা হয়েছে যে, এই অংশসমূহ মৃত ব্যক্তির ওসিয়াত পূর্ণ করার পর এবং তার ঋণ পরিশোধের পর বের করা হবে। মনে করুন এক ব্যক্তি ওসিয়াত করল যে, তার কোন ওয়ারিশকে কুরআন কর্তৃক নির্দিষ্ট অংশের কম দিতে হবে, কাউকে বেশী দিতে হবে এবং কাউকে কিছুই দেযা যাবে না, তবে সে মূলত এই ওসিয়াতের মাধ্যমে কুরআন মজীদের নির্দেশের পরিবর্তন বা সংশোধনকারী সাব্যস্ত হবে। এজন্য মহানবী (স) বলেছেঃ
لاوصية بوارث
“ওয়ারিশদের জন্য কোন ওসিয়াত করা যাবে না।” অর্থাৎ কুরআন মজীদে তার জন্য যে অংশ নির্দিষ্ট করে দেযf হয়েছে তা ওসিয়াতের সাহায্যে বিলোপ করা যাবে না, হ্রাসও করা যাবে না এবং বৃদ্ধিও করা যাবে না, বরং কুরআন অনুযায়ী মৃতের পরিত্যক্ত সম্পত্তি ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন করতে হবে। অবশ্য যারা ওয়ারিশ নয় তাদের অনুকূলে, অথবা সামাজিক স্বার্থে অথবা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার জন্য যে কোন ব্যক্তি ওসিয়াত করতে পারে। কিন্তু এই সুযোগেও কোন ব্যক্তির কোন কারণে নিজের সমস্ত সম্পত্তি অথবা এর অধিকাংশ যারা ওয়ারিশ নয় তাদের দিয়ে দেয়ার ওসিয়াত করে বসার এবং ওয়ারিশদের বঞ্চিত করার আশংকা ছিল। তাই মহানবী(স) সম্পত্তির মালিকের একতিয়ারসমূহের উপর আরও একটি বিধিনিষেধ আরোপ করেন যে, সে কেবল তার সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ। ওসিয়াত করতে পারবে এবং অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি সেইসব হকদারের জন্য ত্যাগ করতে হবে, যাদেরকে কুরআন নিকটতর আত্মীয় সাব্যস্ত করেছে এবং উপদেশ দিয়েছে যে,
لَا تَدْرُونَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعًا
“তোমাদের জানা নাই যে, তাদের মধ্যে উপকারের দিক থেকে তোমাদের নিকটতর”-(সূরা নিসাঃ১১)।
কুরআনিক বিধান অনুযায়ী কাজ করার জন্য কুরআনের ধারক ও বাহক রসূল(স) যে নীতিমালা ও আইন-কানূন প্রণয়ন করেছেন তা উত্তমরূপে হৃদয়ংগম করার পর আমাদের বলে দেয়া হোক যে, শেষ পর্যন্ত কোন যুক্তিসংগত দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে এটাকে “পরিবর্তন বা সংশোধন”-এর সংজ্ঞাভুক্ত করা যেতে পারে? এই প্রকারের বক্তব্য রাখার পূর্বে কিছু চিন্তাভাবনা তো করা উচিৎ যে, কুরআন পাকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যদি তার ধারক ও বাহকই না করেন তবে আর কে করবে? আর এই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যদি ঐ সময় না করে দেয়া হত তবে ওসিয়াতের অধিকারসমূহ প্রয়োগ করতে গিয়ে লোকেরা কুরআন মজীদের উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আইনের অবয়ব কিভাবে বিকৃত করে ফেলত। আবার এর চেয়েও আশ্চর্যজনক কথা এই যে, এই সঠিক ব্যাখ্যাকে তো বিজ্ঞ বিচারক “পরিবর্তন বা সংশোধন” সাব্যস্ত করেছেন, কিন্তু স্বয়ং নিজের উপরোক্ত সিদ্ধান্তের তিনি নমুনা স্বরূপ কুরআনের তিনটি বিধানের যে মুজতাহিদ সুলভ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন সে সম্পর্কে তিনি মোটেই অনুভব করছেন না যে, মূলত তার নিজের ব্যাখ্যাই “পরিবর্তন ও সংশোধন” এর সংজ্ঞার আওতায় পড়ে।
শেষ নিবেদন
এ হলো সার্বিক যুক্তিপ্রমাণ যা বিজ্ঞ বিচারপতি হাদীস ও সন্নাহ সম্পর্কে নিজের রায়ের পক্ষে পেশ করেছেন। আমরা তার পেশকৃত প্রতিটি যুক্তির বিস্তারিত মূল্যায়নপূর্বক যে আলোচনা পেশ করেছি তা অধ্যয়নপূর্বক প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তি স্বয়ং সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে, এসব যুক্তির কতটুকু ওজন আছে এবং এর প্রতিকূলে সুন্নাহ আইনের উৎস হওয়ার এবং হদীসসমূহের নির্ভরযোগ্য সূত্র হওয়ার সপক্ষে আমরা যেসব দলীল-প্রমাণ পেশ করেছি তা কতটা শক্তিশালী। আমরা বিশেষভাবে স্বয়ং বিজ্ঞ বিচারপতির নিকট এবং তার বন্ধুদের নিকট নিবেদন করছি যে, তারা গভীর চিন্তাভাবনা সহকারে আমাদের এই সমালোচনা অধ্যয়ন করুন এবং তাদের নিরপেক্ষ রায় অনুযায়ী একটি উচ্চ আদালাতের বিজ্ঞ বিচারপতিগণের রায় যেরূপ নিরপেক্ষ হওয়া উচিৎ এই সমালোচনা যদি বাস্তবিকই শক্তিশালী যুক্তিপ্রমাণের উপর ভিত্তিশীল হয়ে থাকে তবে তারা আইন অনুযায়ী এমন কোন কার্যক্রম গ্রহণ করুন যার ফলে উক্ত রায় ভবিষ্যতের জন্য নযীর হতে না পারে। বিচারালয়সমূহের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা প্রতিটি দেশের বিচার ব্যবস্থা ও ন্যায়-ইনসাফের প্রাণস্বরূপ এবং বহুলাংশে তার উপর যে কোন দেশের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল। দেশের উচ্চতর আদালতসমূহের রায় যদি বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে দুর্বল যুক্তিপ্রমাণের ভিত্তিতে দেওয়া হয় এবং অযথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও অযথার্থ তথ্য সম্বলিত হয় তবে তা তার মান-মর্যাদার জন্য যতটা ক্ষতিকর অন্য কোন জিনিস ততটা ক্ষতিকর নয়। অতএব ঈমানদার সুলভ সমালোচনার মাধ্যমে এ ধরনের কোন ভ্রান্তি চিহ্নিত হয়ে গেলে প্রথম অবসরেই স্বয়ং বিচারালয়সমুহের বিচারকগণের এর প্রতিকারের পদক্ষেপ নেয়া একান্ত প্রয়োজন।
(সমাপ্ত)