ইমাম আবু হানীফা (রহ) –এর হাদীসের জ্ঞান ও সুন্নাতের অনুসরণ
অতপর বিজ্ঞ বিচারপতি ইমাম আবু হানীফা (রহ) –এর দৃষ্টিভংগীকে প্রমাণ
“কিন্তু আবু হানীফা, যিনি ৮০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৭০ বছর পরে মারা যান, মাত্র ১৭ কি ১৮ টি হাদীস তার সামনে পেশকৃত বিষয়ের সমাধানের জন্য ব্যবহার করেন। খুব সম্ভব এর কারণ এই ছিল যে, তিনি চার খলীফার অনুরূপ রসূলুল্লাহর যুগের নিকটবর্তী ছিলেন না। তিনি তার সমস্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তি কুরআনের লিপিবদ্ধ নির্দেশনামার উপর রাখেন এবং কুরআনের মূল পাঠের শব্দসমষ্টির পেছনে সেইসব ক্রিয়াশীল উপাদান অনুসন্ধানের চেষ্টা করেন যা সেই নির্দেশের কারণ ছিল। তিনি যুক্তি প্রদান ও সমাধান বের করার পর্যাপ্ত শক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি বাস্তব অবস্থার আলোকে কিয়াসের ভিত্তিতে আইনের মূলনীতি ও নিয়ম-প্রণালী প্রণয়ন করেন। হাদীসের সাহায্য ব্যতিরেকে সমসাময়িক পরিস্থিতির আলোকে কুরআনের ব্যাখ্যা প্রদানের অধিকার যদি ইমাম আবু হানীফার থেকে থাকে, তবে অপর মুসলমানদের এই অধিকার প্রদানের বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না”।–(প্যারা ২৪)।
উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণতো ভুল বিবরণ ও কল্পনা প্রসূত বিষয়ের উপর ভিত্তিশীল। ইমমা আবু হানীফা (রহ) সম্পর্কে ইবনে খালদুন না জানি কোন সনদের ভিত্তিতে এ কথা লিখে দিয়েছেন যে, “হাদীস গ্রহণ করার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা এতো বেশী কঠোর ছিলেন যে, তাঁর মতে ১৭-এর অধিক হাদীস সহীহ ছিল না”।
উপরোক্ত কথা প্রচলিত হতে হতে লোকদের মধ্যে এভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে যে, ইমাম আবু হানীফার মাত্র ১৭ টি হাদীসের জ্ঞান ছিল, অথবা বলা হয় তিনি ১৭টি হাদীস থেকে সমাধান বের করেছেন। অথচ এটা সম্পূর্ণরূপে বাস্তব ঘটনার পরিপন্থী কল্পকাহিনী। আজ ইমাম আবু হানীফার সর্বশ্রেষ্ঠ ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ (রহ)-এর প্রণীত ‘কিতাবুল আছার’ শীর্ষক গ্রন্থ মুদ্রিত আকারে বিদ্যমান রয়েছে, যার মধ্যে তিনি নিজ উস্তাদের বর্ণনাকৃত এক হাজার হাদীস একত্র করেছেন। তাছাড়া ইমাম সাহেবের অপরাপর প্রসিদ্ধ ছাত্রবৃন্দ ইমাম মুহাম্মদ (রহ) ও ইমাম হাসান ইবনে যিয়াদ আল-লুলুঈ (রহ) এবং ইমামের পুত্র হাম্মাদ ইবনে আবু হানীফাও তাঁর বর্ণনাকৃত হাদীসসমূহের কংকলন তৈরী করেছিলেন। অতপর অব্যাহতভাবে কয়েক শতাব্দী যাবত অসংখ্য আলেম তাঁর বর্ণনাকৃত হাদীসসমূহ ‘মুসনাদে আবী হানীফা’ [হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষায় –একক ব্যক্তির রিওয়ায়াতকৃত হাদীসসমূহ যে গ্রন্থে সংকলনাবদ্ধ করা হয় তাকে “মুসনাদ” বলা হয়।] শীর্ষক নামে জমা করতে থাকেন। তার মদ্যে ১৫ খানা মুসনাদের একটি ব্যাপক সংকলন কাযীল কুযাত (প্রধান বিচারপতি) মুহাম্মদ ইবনে মাহমুদ আল-খাওয়ারাযমী “জামি মাসানিদিল ইমাম আল-আজম” শিরোনামে সংকলন করেছেন যা হায়দরাবাদের ‘দাইরাতুল মাআরিফ’ শীর্ষক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দুই খণ্ডে প্রকাশ করেছে। এসব কিতাব এই দাবী চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করে যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ) মাত্র ১৭টি হাদীস জানতেন অথবা তিনি ফিকহী মাসআলা প্রণয়নে মাত্র ১৭টি হাদীস ব্যবহার করেছেন। হাদীস শাস্ত্রে ইমাম সাহেবের উস্তাদের সংখ্যা (যাদের রিওয়ায়াত তিনি গ্রহণ করেছেন) চার হাজার পর্যন্ত পৌঁছেছে। তাঁকে হাদীসের প্রবীণ হাফেজদের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। তাঁর সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহ একত্রকারীদের মধ্যে ইমাম দারু কুতনী, ইবনে শাহীন এবং ইবনে উকদার মত নামকরা হাদীসবেত্তাগণ শামিল রয়েছেন। কোন ব্যক্তি হানাফী ফিকহ-এর নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্য থেকে শুধুমাত্র ইমাম তাহাবী (রহ)-এর “শারহু মাআনিল আছার”, আবু বাকর আল-জাসসাস (রহ)-এর “আহকামুল কুরআন” এবং ইমমা সারাখসীর “আল-মাবসূত” দেখে নিলে সে কখনও এই ভুল ধারণার শিকার হবে না যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ) হাদীসকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র কিয়াস ও কুরআনের উপর নিজের ফিকহ এর ভিত্তি স্থাপন করেছেন।
আবার হাদীস থেকে যুক্তিপ্রমাণ গ্রহণ করার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর যে দৃষ্টিভংগী ছিল তা তিনি নিজেই নিম্নোক্ত বাক্যে বর্ণনা করেনঃ
“আমি যখনই কোন হুকুম আল্লাহর কিতাবে পেয়ে যাই তখনই তা দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরি। যদি তাতে না পাই তবে রসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাত এবং তাঁর সেইসব হাদীস গ্রহণ করি যা নির্ভরযোগ্য লোকদের কাছে নির্ভরযোগ্য লোকদের মাধ্যমে প্রসিদ্ধ। অতপর যখন আল্লাহর কিতাবেও নির্দেশ পাওয়া যায় না এবং রসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাতেও না, তখন আমি রসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীগণের বক্তব্যের (অর্থাৎ তাদের ইজমার অনুসরণ করি এবং তাদের মদ্যে মতভেদের ক্ষেত্রে যে সাহাবীর বক্তব্য ত্যাগ করে অপর কারো কথা গ্রহণ করি না। অন্যদের ব্যঅপারে আমার বক্তব্য হচ্ছে, ইজতিহাদের অধিকার যেমন তাদের আছে, তেমন আমারও আছে” –(তারীখে বাগদাদ, আল খাতীব রচিত, ১৩ খৃ., পৃ. ৩৬৮; আল-মুওয়াফফাক আল-মাক্কী, মানাকিব ইমাম আজম, ১খ., পৃ. ৭৯; আয-যাহাবী, মানাকিব ইমাম আবু হানীফা ওয়া সাহিবাইন, পৃ. ২০)।
ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর সামনেই একবার তাঁকে অপবাদ দেয়া হল যে, তিনি কিয়াসকে কুরআনের উপর অগ্রাধিকার দেন। এর জবাবে তিনি বলেন, “আল্লাহর শপথ! ঐ ব্যক্তি মিথ্যা বলেছে এবং আমাদের উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে যে বলেছে –আমি কিয়াসকে কুরআনের উপর অগ্রাধিকার দেই। আল্লাহর কিতাবে দলীল বর্তমান থাকতে কিয়াসের কি আর প্রয়োজন থাকে”-(শারানী, কিতাবুল মীযান, ১খ, পৃ. ৬১)।
আব্বাসী খলীফা মানসূর একবার ইমাম সাহেবকে লিখে পাঠান, আমার কানে এসেছে আপনি কিয়াসকে হাদীসের উপর অগ্রাধিকার দেন। উত্তরে তিনি লিখে পাঠান, “আমীরুল মুমিনীন! যে কথা আপনার কানে পৌঁছেছে তা ঠিক নয়। আমি সর্বপ্রথম আল্লাহর কিতাবের উপর আমল করি, অতপর রসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাতের উপর, অতপর আবু বকর, উমার, উসমান ও আলী (রা)-এর সিদ্ধান্তের উপর, এরপর অবশিষ্ট সাহাবীদের সিদ্ধান্তের উপর। অবশ্য সাহাবীদের মধ্যে মতভেদ থাকলে আমি কিয়াসের আশ্রয় নেই”।–(শারানী, কিতাবুল মীযান, ১খ, ৬২)।
আল্লামা ইবনে হাযম (রহ) তো এ পর্যন্ত লিখেচেন, “আবু হানীফা (রহ) এর সকল সংগী একমত যে, আবু হানীফা (রহ)-এর মাযহাব ছিলঃ যঈফ হাদীসও পাওয়া গেলে তা গ্রহণপূর্বক কিয়অস ও রায় পরিত্যাগ করতে হবে” –(যাহাবী, মানাকিব ইমাম আবু হানীফা ওয়া সাহিবাইন, পৃ. ২১)। প্রকাশ থাকে যে যঈফ হাদীসের অর্থ জাল হাদীস নয়। এখানে যঈফ হাদীস বলতে এমন হাদীস বুঝানো হয়েছে যার সনদসূত্র শক্তিশালী নয়, কিন্তু যা থেকে প্রবল ধারণা জন্মে যে, এটা মহানবী (সা)-এর কথাই হবে।
বিচারপতির মতে হাদীসের উপর বিশ্বাস স্থাপন না করার কারণ
এরপর বিজ্ঞ বিচারকের মতে যেসব কারণে হাদীস নির্ভারযোগ্য নয় এবং দলীল-প্রমাণও নয়, ২৫ প্যারায় তিনি বর্ণনা দিয়েছেন। এ প্রসংগে তার আলোচনার বিষয়গুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
“ইসলামের সকল ফকীহ একবাক্যে স্বীকার করেন যে, যুগের পরিক্রমায় জাল হাদীসের একটি বিরাট স্তূপকে ইসলামী আইনের এক বৈধ ও স্বীকৃত উৎস হিসাবে মেনে নেয়া হয়েছে। মিথ্যা হাদীস স্বয়ং মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স)-এর যুগে প্রকাশ পাওয়া শুরু করে। মিথ্যা ও ভ্রান্ত হাদীসের সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, হযরত উমার (রা) তার খিলাফতকালে হাদীস বর্ণনার উপর বিধিনিষেধ আরোপ কারেন, বরং তার বর্ণনা নিষিদ্ধ করে দেন। ইমাম বুখারী ছয় লক্ষ হাদীসের মধ্য থেকে মাত্র নয় হাজার সহীহ হিসাবে নির্বাচন করেন।“ ২. “আমি বুঝতে পারছি না কোন লোক কি একথা অস্বীকার করতে পারে যে, কুরআনকে যেভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে তদ্রপ প্রচেষ্টা রসূলুল্লাহ (স)-এর নিজের যুগে হাদীসসমূহের সংরক্ষণের জন্য নেয় হয়নি। পক্ষান্তরে যে সাক্ষ্য বর্তমান রয়েছে তা এই যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স) লোকদেরকে তাঁর কথা ও কাজ লিপিবদ্ধ করতে চরমভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন। তিনি নির্দেশ দেন, কোন ব্যক্তি তাঁর হাদীসসমূহ সংরক্ষণ করে থাকলে সে যেন তা অবিলম্বে নষ্ট করে দেয়।
(আরবি*****************************)
এ হাদীস অথবা এ ধরনেরই একটি হাদীসের তরজমা মাওলানা মুহাম্মদ আলী
হতে তার উপর তা লিখে নেয়া হত এবং এই উদ্দেশ্যে রসূলে করীম (স) কতিপয় সুশিক্ষিত সাহাবীকে নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু হাদীস সম্পর্কে বলা যায় যে, তা না মখস্ত করা হয়েছিল, আর না সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তা এমন লোকদের মগজে লুক্কায়িত ছিল যারা ঘটনাক্রমে কখনও অন্যদের সামনে তা বর্ণনা করার পরপরই মরে গেছে। এমনকি রসূলের ওফাতের কয়েক শত বছর পর তা সংগ্রহ ও সংকলনাবদ্ধ করা হয়।“
৫. “একথা স্বীকার করা হয় যে, পরবর্তী কালে প্রথম বারের মত রসূলু্ল্লাহ (স)-এর প্রায় একশত বছর পর হাদীসসমূহ সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু তার রেকর্ড আজ দুষ্প্রাপ্য। এরপর তা নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ সংগ্রহ করেনঃ
ইমাম বুখারী ( মৃ. ২৫৬ হি.) ইমাম মুসলিম ( মৃ. ২৬১ হি.), আবু দাউদ ( মৃ. ২৭৫ হি.), জামে তিরমিযী বিজ্ঞ বিচারক নামটা এভাবে লিখেছেন, অথচ জামে তিরমিযী সংকলকের নাম নয়, বরং সংকলনের নাম। সংকলক ইমাম তিরমিযী নামে পরিচিত। ( মৃ. ২৭৯ হি.), সুনানে নাসাঈ ( মৃ. ৩০৩ হি.), সুনানে ইবনে মাজা এও সংকলকদের নাম নয়, সংকলনের নাম। সুনানে নাসাঈ ও সুনানে ইবনে মাজার তো একনও মৃত্যু হয়নি (কারণ উভয়ই দুটি গ্রন্থ)। ( মৃ. ৩৮৩ হি.), সুনানে দরীবী আমাদের জানমতেও এ নামের কোন সংকলক নেই , না এই কোন কিতাব আছে। ( মৃ. ১৮১ হি.), বায়হাকী ( জ. ১৬৪ হি.)।“ বিজ্ঞ বিচারপতি এরপর শীঅ সম্প্রদায়ের মুহাদ্দিসদের উল্লেখ করেছেন। এদের উল্লেখ আমরা এজন্য করলাম না যে, তাদের সম্পর্কে কিছু বলা শীআ আলেমগণের দায়িত্ব।
৬. “এমন হাদীস খব কমই আছে যে সম্পর্কে হাদীসের এই সংকলকগণ একমত হতে পেরেছেন। এই জিনিস (মতানৈক্য) কি হাদীসসমূহের উপর আস্থা স্থাপনের ব্যাপারটি চরমভাবে সন্দেহপূর্ণ বানিয়ে দেয় না?
৭. “যাদের উপর তথ্যানুসন্ধানের কাজ অর্পন করা হবে তারা অবশ্যই এদিকে দৃষ্টি রাখবে যে, হাজার হাজার জাল হাদীস ছড়ানো হয়েছে যাতে ইসলাম ও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর দুর্নাম গাওয়া যেতে পারে।“
৮. “ তাদেরকে এদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে যে, আরবদের স্মৃতিশক্তি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, শধুমাত্র স্মৃতি থেকে নকলকৃত বিবরণ কি নির্ভরযোগ্য মনে করা যেতে পারে, অবশেষে বর্তমান আরবদের স্মৃতিশক্তি তদ্রূপই রয়ে গেছে যেরূপ স্মৃতিশক্তি তেরশত বছর পূর্বে তাদের পুর্বপুরুষদের থেকে থাকবে। আজকাল আরবদের যা কিছু স্মরণশক্তি আছে তা আমাদের এই সিদ্ধান্ত পৌছতে এক গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশিকা হিসাব আমাদের কাজে আসতে পারে যে, যেসব রিওয়ায়াত আমাদের পযর্ন্ত পৌছেছে তা সঠিক ও যথার্থ হওয়ার ব্যাপারে কি আস্থা স্থাপন করা যায়?”
৯. “আমাদের বাড়াবাড়ি এবং যেসব বর্ণনাকারীর মাধ্যমে এসব রিওয়ায়াত আমাদের পযর্ন্ত পৌছেছে তাদের নিজস্ব ধ্যানধারণা ও গোঁড়ামিও অবশ্যই ব্যাপক আকারে রিওয়ায়াত নকল করতে গিয়ে তাকে কদাকার করে থাকবে। শব্দসমষ্টি যখন এক মস্তক থেকে অন্য মস্তকে স্থানান্তরিত হয়, সেই মস্তক চাই আরবদের হোক বা অপর কারো, মোটকথা এই শব্দভান্ডারে এমন পরিবর্তন মূচীত হয় যা প্রতিটি মস্তিষ্কের নিজস্ব ছাঁচের ফলশ্রুতি হয়ে থাকে। প্রতিটি মস্তিষ্ক অতিক্রম করে আসে তখন যে কোন ব্যক্তি ধারণা করতে পারে যে, তার মধ্যে কত ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।
উল্লেখিত কারণসমূহের সমলোচনা
এই নয়টি দফা আমরা বিজ্ঞ বিচারপতির নিজের বাক্যে তার নিজস্ব ধারাবাহিকতা অনুযায়ী উধৃত করলাম। এখন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যায়ন করে দেখব, এগুলো কতটা সঠিক এবং এগুলোকে হাদীসসমূহের উপর আস্থা স্থাপন না করার এবং সুন্নাতকে দলীল-প্রমাণ হিসাবে না মানার ব্যাপারে যুক্তি হিসাবে কতটা গ্রহণ করা যায়?
জাল হাদীস কি ইসলামী আইনের উৎস পরিণত হয়েছে?
সর্বপ্রথম তার ১নং ও ৭নং দফার উপর আলোকপাত করব। জাল হাদীসসমূহের একটি বিরাট স্তুপ ইসলামী আইনের উৎসের মধ্যে প্রবেশ করার বিষয়টি ইসলামের সকল ফকীহ ঐক্যবদ্ধভাবে মেনে নিয়েছেন-তার দাবী বাস্তব ঘটনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইসলামের ফকীহগণ নিসন্দেহে একথা স্বীকার করেন যে প্রচুর জাল হাদীস ইসলামী আইনের উৎসে পরিণত হয়েছে, তবে এ ধরনের মাত্র একজন ফকীহ অথবা মুহাদ্দিস অথবা নির্ভরযোগ্য আলেম দীনের নাম আমাদের বলা হোক। ঘটনা এই যে, জাল হাদীস যখন থেকে প্রকাশ পেতে শুরু করে তখন থেকেই মুহাদ্দিসগণ, মুজতাহিদ ইমামগণ এবং ফকীহগণ নিজেদের সার্বিক প্রচেষ্টা এদিক নিয়োজিত করেন যে, এই দুর্গন্ধময় নর্দমা যেন ইসলামী আইনের সূত্রসমূহের মধ্যে প্রবাহিত হতে না পারে। যেসব হাদীসের সাহায্যে শরীআতের কোন বিধান প্রমাণিত হত, সে সব হাদীসের পর্যলোচনা ও তথ্যানুসন্ধানেই বেশীরভাগ তাদের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যয় করা হয়। ইসলামী বিচারালয়ের বিচারকগণও সদা সতর্ক ছিলেন যে, কেবলমাত্র
(রসূলুল্লাহ বলেন)” শুনেই যেন তারা কোন ফৌজদারী অথবা দেওয়ানী মামলার রায় না দেন, বরং তার পূর্ণ যাচাই-বাছাই করতেন, যার আলোকে কোন অপরাধী নিস্কৃতি পেতে পারে অথবা তা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। ইসলামের প্রাথমিক কালের আদালতের হাকীমগণ ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে আমাদের বিজ্ঞ বিচারপতি এবং তাদের সহকর্মীদের তুলনায় কিছু কম সতর্ক ছিলেন না। শেষ পযর্ন্ত তাদের জন্য এটি কি কের সম্ভব ছিল যে, প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান ব্যতীত কোন জিনিসকে অইনগত নির্দেশ মেনে নিয়ে তারা রায় প্রদান করে বসেছেন? আর মামলার পক্ষদ্বয়ই বা কিভাবে ঠাণ্ডা মাথায় ছাড়াই কোন কাচাপাকা রিওয়ায়াতের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে রায় প্রদান করা হবে? অতএব একথাও বাস্তবিকই সত্য নয় যে, ইসলামী আইনের উৎসের মধ্যে জাল হাদীসের অনুপ্রবশ ঘটেছে এবং ইসলামের ফকীহগণও এই অনুপ্রবেশকে একমত হয়ে স্বীকার করে নিয়েছেন।
মহানবী (স) এর যুগেই কি জাল হাদীসের প্রচলন শুরু হয়েছিল?
বিজ্ঞ বিচারপতি একথাও চরম বিভ্রান্তিকর যে, জাল হাদীস স্বয়ং রসূলুল্লাহ (স) এর যুগে প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। মূলত এর রহস্য এই যে, জাহিলী যুগে এক ব্যক্তি মদীনাস্থ কোন এক গোত্রের কন্যাকে বিবাহ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু কন্যাপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। হিজরতের পর প্রথমদিকেই ঐ ব্যক্তি একটি জুব্বা পরিধান করে সেই গোত্রে গিয়ে পৌছে এবং কন্যাপক্ষের নিকট গিয়ে বলে যে, রসূলুল্লাহ (স) নিজে আমাকে এই জুব্বা পরিধান করিয়েছেন এবং আমাকে অত্র গোত্রের প্রশাসক নিয়োগ করেছেন। গোত্রের লোকেরা তাকে বাহন থেকে নামিয়ে নিল এবং গোপনে ব্যাপারটি মহানবী (স) কে অবহিত করে। মহানবী (স) বলেন, “মিথ্যা বলেছে আল্লাহর এই দুশমন। ” অতপর তিনি এক ব্যক্তিকে নির্দেশ দিলেন, যাও-তাকে যদি জীবন্ত পাও হত্যা কর, আর যদি মৃত পাও, তার লাশ আগুণে জ্বালিয়ে দাও। এই ব্যক্তি সেখানে পৌছে দেখে যে, তাকে সাপে কামড় দিয়েছে, ফলে সে মারা গেছে। অতএব নির্দেশ অনুযায়ী তার লাশ আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এরপর মহানবী (স) সাধারণ্যে ঘোষণা দিতে থাকেন, যে ব্যক্তি আমার নাম নিয়ে মিথ্যা কথা বলে সে দোযখে যাওয়ার জন্য যেন প্রস্তুত হয়ে যায়।১ উপরোক্ত কঠোর সর্ততামূলক কার্যক্রমের ফল এই হয়েছিল যে, প্রায় ৩০-৪০ বছরের মধ্যে মনগড়া হাদীস ছড়ানোর কোন ঘটনা আর ঘটেনি।
হযরত উমার (রা) অধিক হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন কেন?
বিচারপতি সাহেবের একথাও একটি প্রমাণহীন দাবী যে, হযরত উমার (রা) যুগ পর্যন্ত পৌছতে পৌছতে জাল হাদীসের সংখ্যা এত বেড়ে গেল যে হযরত উমারকে হাদীস বর্ণনার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হল, বরং তা সম্পুর্ণ বন্ধ করে দিতে হল।
উপরোক্ত বক্তব্যের সমর্থনে যদি কোন ঐতিহাসিক প্রমান বিদ্যামান থাকে তবে অনুগ্রহপূর্বক তার বরাত উল্লেখ করা হোক। সে যুগে বাস্তবিকই মনগড়া হাদীসের কোন ফেতনাই উত্থিত হয়নি। ইতিহাসে এর কোন প্রকার উল্লেখ নেই। হযরত উমার (রা) যে কারণে অধিক হাদীস বর্ণনা পছন্দ করতেন না তা মূলত এই যে, দক্ষিণ আরবের সমান্য এলাকা ব্যতীত ঐ সময় পর্যন্ত আরব দেশে কুরআন মজীদের ব্যাপক প্রচার হয়নি। আরবের বেশীর ভাগ এলাকা মহানবী (স) এর পবিত্র জিন্দেগীর শেষাংশে ইসলামের প্রভাবাধীনে এসেছিল এবং আরবেই সাধারণ নাগরিকদের শিক্ষার ব্যবস্থা তখানও পূর্ণভাবে শুরু হতে পারেনি। এই অবস্থায় মহানবী (স) এর ইন্তেকাল এবং তারপরে হযরত আবু বাকর (রা) -র খেলাফতকালে ধর্মতক্যাগীদের বিশৃংখলার প্রাদুর্ভাবহওয়ার একাজ এলোমেলো হয়ে যায়। হযরত উমার (রা) যুগেই মুসলমানগণ নিশ্চিন্তে সর্বসধারণের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পান। এসময় গোটা জাতিকে সর্বপ্রথম কুরআনের জ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া অধিক জরুরী ছিল এবং কুরআনের সাথে অন্য কোন জিনিসের বিভ্রাট সৃষ্টির আশংকা হওয়ার মত কাজ তখন বন্ধ রাখা দরকার ছিল। যেসব সাহাবী মহানবী (স) এর পক্ষ থেকে লোকদের নিকট কুরআন পৌছিয়ে দিচ্ছিলেন তারাই যদি সাথে সাথে মহানবী (স) এর বর্ণনা করতে থাকতেন তবে বেদুঈনদের এক বিরাট অংশের হাদীসের সাথে কুরআনের আয়াতের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে মুখস্ত করে নেয়ার আশংকা ছিল। এই সার্বিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থার কথা হযরত উমার (রা) এক স্থানে নিজেই বর্ণনা করেছেন।
উরওয়া ইবনুয যুবাইর (রহ) বলেন, “হযরত উমার (রা) একবার রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতসমূহ লিপিবদ্ধ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এ সম্পর্কে তিনি সাহাবীদের পরামর্শ নিলেন। সকলে মত ব্যক্ত করেন যে, একাজ অবশ্যই করা উচিৎ। কিন্তু হযরত উমার (রা) লেখার কাজ শুরু করার ব্যাপারে একমাস পর্যন্ত দ্বিধাদ্বদেন্দ্ব অতিবাহত করেন এবং আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে থাকেন যে, যে জিনিসের মধ্যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে সেদিকে যেন তিনি তাকে পথ প্রদর্শন করেন। অবশেষে একমাস পর তিনি একদিন বলেন, “আমি সুন্নাতসমূহ লিপিবদ্ধ করার সংকল্প করেছিলাম কিন্তু আমার ধারণা হল যে, তোমাদের পূর্বে একদল লোক অতিবাহিত হয়ছে, যারা অন্যান্য গ্রন্থ লিখেছিল কিন্তু আল্লাহর কিতাব ত্যাগ করেছিল। অতএব আল্লাহর শপথ! আমি আল্লাহর কিতাবের সাথে অন্য জিনিস শামিল হতে দেব না-” (তাদরীবুর –বারী, পৃ. ১৫১, বায়হাকীর আল-মাদখাল-এর বরাতে)।
১.সুপ্রসিদ্ধ মহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনে আদী তার “আল-কামিল ফী মারিফাতিদ- দুআফা ওয়াল- মাতরুকীন” শীর্ষক গ্রন্থে এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী (রহ)-এর ছয় লক্ষ হাদীসের কল্পকাহিনী
বিজ্ঞা বিচারপতির আরও একটি বক্তব্য যা মারাত্বক ভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে তা এই যে, “ইমাম বুখারী (রহ) ছয় লক্ষ হাদীসের মধ্যে নয় হাজার হাদীসকে সহীহ হিসাবে বাছাই করেছেন।”
উপরোক্ত বক্তব্যে কোন ব্যক্তি প্রভাবিত হয়ে বলতে পারে যে, ছয় লক্ষ হাদীসের মধ্যে তো মাত্র নয় হাজার সহীহ হাদীস ছিল যা ইমাম বুখারী (রহ) গ্রহণ করেছেন এবং অবশিষ্ট ৫,৯১,০০০ জাল হাদিস উম্মাতের মধ্যে ছড়িয়েছিল। অথবা বাস্তব অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায়য় মূলত একটি ঘটনা যদি ধারাবাহিক সনদসূত্রে বর্নিত হয়, তবে তা একটি হাদীস এবং ঐএকটি হাদীস যদি উদহরণস্বরূপ ১০,২০ অথবা ৫০ টি হাদিস বলা হয়। ইমাম বুখারী (রহ) এর যুগ পর্যন্ত পৌছতে পৌছতে মহানবী (স) এর এক একটি হাদসি এবং তার জীবনের এক একটি ঘটনা অসংখ্য রাবী বহু সনদসূত্রে বর্ণনা করতেন এবং এভাবে কয়েক হাজার হাদীস কয়েক লক্ষ হাদীসের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ইমাম বুখারী (রহ) এর নীতি এই ছিল যে, তিনি কোন ঘটনা যতগুলো সনদসূত্রে জ্ঞাত হতেন- সেগুলোকে যথার্থতা যাচাই করার নিজস্ব শর্তাবলী (অর্থাৎ বর্ণনা সূত্রের যথার্থতা, আসল ঘটনার যথার্থতা নয়) মোতাবেক যাচাই-বাছাই করতেন এবং তার মধ্যে সনদ (বর্ণনা সূত্র) অথবা যেসব সনদ সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য মনে করতেন তা বেছে নিতেন। কিন্তু তিনি কখনও এই দাবি করেননি যে, যেসব হাদীস তিনি বেছে নিয়েছেন এ পর্যন্তই সহীহ এবং অবশিষ্ট সমস্ত রিওয়ায়াত সহীহ নয়।১ তার নিজের বক্তব্য এই যে, “আমি আমার গ্রন্থে এমন কোন হদীস স্থান দেইনি যা সহীহ নয়, কিন্তু গ্রন্থের কলেবর বিরাট হয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেক সহীহ হাদীসও বাদ দিয়েছি ” [তারীখ বাগদাদ , ২খ.পৃ. ৮-৯ তাহযীবুন-নববী, ১খ.পৃ.৭৪ তাবাকাতুস-সুবকী, ২খ, ৭১]। বরং আরও এক স্থানে তিনি এর ব্যাখ্যাদান প্রসংগে বলেন, “আমি যেসব সহীহ হাদীস বাদ দিয়েছি তা সংখ্যায় আমার বেছে নেয়া হাদীসের চেয়ে অধিক”। আরও এই যে, “আমার এক লক্ষ সহীহ হাদীস মুখস্ত আছে-” (শুরূতুল-আইম্মাতিস-সিত্তা, পৃ.৪৯। প্রায় এই একই কথা ইমাম মুসলিম (রহ) ও বলেছেন। তার বক্তব্য এই যে, “আমি আমার গ্রন্থে যেসব হাদীস একত্র করেছি তাকে আমি সঠিক বলে দাবী করি। কিন্তু আমি কখনও একথা বলি না যে, আমি যেসব হাদীস নেইনি তা যঈফ বা দুর্বল”-(তাওজীহুন-নযর,পৃ.৯১)।
জাল হাদীস কেন রচনা করা হয়েছিল?
বিজ্ঞ বিচারপতি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে জোর দিয়ে বলেছেন, হাজার হাজার জাল হাদীস রচনা করা হয়েছিল এবং তিনি একথার উপরও জোর দিয়েছেন যে, তথ্যানুসন্ধানী পর্যালোচকগণ যেন এ সম্পর্কে বিশেষভাবে চিন্তাভাবনা করেন।
কিন্তু আমাদের নিবেদন এই যে, তথ্যানুসন্ধানী পর্যালোচকগণকে সাথে সাথে এই প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীর চিন্তাভাবনা করতে হবে যে, এই হাজার হাজার জাল হাদীস শেষ পর্যন্ত ঐ যুগে কেন রচনা করা হয়েছিল? তা রচনার কারণ তো এটাই ছিল যে, মহানবী (স)-এর কথা ও কাজ হুজ্জাত (দলীল-প্রমাণ) ছিল এবং একটি মনগড়া কথা তাঁর সাথে সম্পর্কযুক্ত করে মিথ্যুক লোকেরা কোন না কোন স্বার্থ সিদ্ধি করতে চেয়েছিল। মহানবী (স)-এর কথা ও কাজ যদি হুজ্জাত না হত এবং কোন ব্যক্তির জন্য নিজের কোন দাবীর পক্ষে কথা রচনার কষ্ট স্বীকার করার কি প্রয়োজন ছিল? দুনিয়াতে কোন জাল বস্তু রচনাকারী তো এমন জাল মুদ্রা তৈরী করে যা বাজারে চালানো যেতে পারে। যে মুদ্রার কোন মর্যাদা ও মূল্যই নাই তার নকল শেষ পর্যন্ত কোন নির্বোধ তৈরী করে? যদি ধরে নেয়া হয় যে, কোন সময় জালিয়াতদের কোন গ্যাং দেশে প্রচলিত মুদ্রার হাজার হাজার নকল তৈরী করে ফেলেছে তবে এর উপর ভিত্তি করে কারো এরূপ যুক্তি প্রদান কি সঠিক হবে যে, দেশে প্রচলিত সমস্ত মুদ্রা তুলে নিয়ে ফেলে দেয়া উচিৎ, কারণ জাল মুদ্রার বর্তমানে কোনো মুদ্রা সম্পর্কেই আস্থা স্থাপন করা যায় না? দেশের প্রত্যেক কল্যাণকামী নাগরিক তো সাথে সাথে এসব জালিয়াতকে গ্রেপ্তার করার এবং দেশের মুদ্রাকে এই বিপদ থেকে রক্ষার চিন্তায় লেগে যাবে।
ইসলামের প্রাথমিক কালে জাল হাদীসের ফেতনার প্রাদুর্ভাব হওয়ার সাথে সাথে ইসলামের কল্যাণকামী লোকেরা ঠিক একই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁরা তৎক্ষনাৎ কর্মতৎপর হন এবং প্রতিটি জাল হাদীস রচনাকারীর সন্ধানপূর্বক তার নাম “আসমাউর রিজাল” শিরোনামের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন, এক একটি জাল হাদীসের অনুসন্ধানপূর্বক –এজাতীয় মাওদ (মনগড়া) হাদীসের সংকলন তৈরী করেছেন, হাদীসসমূহের যথার্থতা ও দোষত্রুটি যাচাইয়ের জন্য অত্যন্ত কঠোর নীতিমালা প্রণয়নপূর্বক লোকদেরকে সহীহ ও জাল হাদীসের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের যোগ্য করে তোলেন এবং কোন সময়েও যেন জাল হাদীস ইসলামী আইনের উৎসে অনুপ্রবেশ না করতে পারে সে পথ রুদ্ধ করে দেন। অবশ্য সেই যুগেও হাদীস অস্বীকারকারীদের চিন্তা পদ্ধতি এইরূপ ছিল যে, আইনের উৎসে গলদ হাদীস অনুপ্রবেশ করার ফলে গোটা হাদীস ভাণ্ডার সন্দেহযুক্ত হয়ে গেছে, অতএব সমস্ত হাদীস তুলে নিয়ে ফেলে দিতে হবে। তারা এতটুকুও গ্রাহ্য করেনি যে, রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতসমূহ পরিত্যাগ করলে ইসলামী আইনের উপর কি পরিমাণ ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে এবং স্বয়ং ইসলামের কাঠামো কত মারাত্মকভাবে বিকৃত হয়ে পড়ে থাকবে।
যুক্তির তিনটি ভ্রান্ত ভিত্তি
এখন আমরা বিজ্ঞ বিচারপতির ২, ৩ ও ৪ নম্বর পয়েন্টের উপর আলোকপাত করব। উক্ত তিনটি বিষয়ে তার যুক্তির গোটা ভিত্তি তিনটি জিনিসের উপর স্থাপিত যা স্বয়ং ভ্রান্ত অথবা সত্য থেকে অনেক ভিন্নতর। (এক) রসূলুল্লাহ (স) হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করেছেন। (দুই) মহানবী (স)-এর যুগে এবং তাঁর পরে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও কুরআন মজীদ সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা তো হয়েছিল, কিন্তু হাদীসসমূহের সংরক্ষণের প্রতি কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। (তিন) হাদীসসমূহ সাহাবী ও তাবিঈগণের মনমানসে লুক্কায়িত পড়ে থাকে, তারা কখনও কখনও ঘটনাক্রমে তা অন্যদের সামনে উল্লেখ করতেন এবং এসব রিওয়ায়াত একত্র করার কাজ মহানবী (স)-এর কয়েক শত বচর পর করা হয়েছিল।
বাস্তব ঘটনার বিপরীত এই তিনটি ভিত্তির উপর বিজ্ঞ বিচারপতি প্রশ্নের ভংগিতে এই সিদ্ধান্তের দিকে আমাদের পথনির্দেশ করেন যে, হাদীসের সাথে এই আচরণ এজন্য করা হয়েছে যে, তা মূলত সাময়িক গুরুত্বের অধিকারী ছিল, গোটা পৃথিবীবাসীর জন্য অথবা সর্বকালের জন্য তাকে আইনের উৎস বানানোর উদ্দেশ্য ছিল না। যে তিনটি কথার উপর এই সিদ্ধান্তের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে তার মধ্যে সত্যের কতটুকু উপাদান আছে এবং তা থেকে গৃহীত সিদ্ধান্ত স্বয়ং কতটা সঠিক, সম্মুখের আলোচনায় তা আমরা মূল্যায়ন করে দেখব।
হাদীস লিপিবদ্ধ করার প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞা ও তার কারণসমূহ
বিজ্ঞ বিচারপতি রসূলুল্লাহ (স)-এর যে দুটি হাদীসের বরাত দিয়েছেন তাতে শুধুমাত্র হাদীস লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করা হয়েছিল, তা মৌখিকভাবে বর্ণনা করতে নিষেধ করা হয়নি, বরং এর মধ্যে একটি হাদীসে তো মহানবী (স) পরিস্কার বাক্যে বলেছেনঃ (আরবী**************************)
“আমার বাণী মৌখিকভাবে বর্ণণা কর, এতে কোন আপত্তি নেই”।
কিন্তু শুধুমাত্র এই দুটি হাদীস গ্রহণপূর্বক তা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং একই প্রসংগে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী উপেক্ষা করা মূলতই ভ্রান্ত পদ্ধতি। এ প্রসংগে প্রথমে যে কথা অবগত হওয়া জরুরী তা এই যে, মহানবী (স) যে যুগে প্রেরিত হয়েছিলেন তখন গোটা আরব জাতিই ছিল অশিক্ষিত এবং নিজেদের যাবতীয় বিষয় মুখস্ত ও বাচনিকভাবে আঞ্জাম দিত। কুরাইশের মত উন্নত গোত্রের অবস্থা ঐতিহাসিক বালাযুরীর বর্ণনা অনুযায়ী এই ছিল যে, তাদের মধ্যে মাত্র ১৭ ব্যক্তি পড়ালেখা জানত। বালাযুরীরই বক্তব্য অনুসারে মদীনায় ১১ ব্যক্তির অধিক লেখাপড়া জানা লোক ছিল না। লেখার জন্য কাগজ ছিল দুষ্প্রাপ্য। পাতলা চামড়া, হাড় ও খেজুর পাতার উপর বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা হত। এই অবস্থায় মহানবী (স) যখন প্রেরিত হন তখন তাঁর সামনে সর্বপ্রথম কাজ এই ছিল যে, কুরআন শরীফ এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে এর মধ্যে অন্য কোন জিনিসের সংমিশ্রণ ঘটতে না পারে। লেখক ছিল মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন, তাই তাঁর আশংকা ছিল যে, যেসব লোক ওহীর শব্দভাণ্ডার ও আয়াতসমূহ লিপিবদ্ধ করছে, তারাই যদি আবার তাঁর নিকট থেকে শুনে তাঁর বরাতে অন্য জিনিসও লিখে নেয় তবে কুরআন মিশ্রণ থেকে নিরাপদ থাকবে না। সংমিশ্রণ না ঘটলেও অন্তত সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে যে, একটি বক্তব্য তা কুরআনের আয়াত না মহানবী (স)-এর হাদীস। এ কারণে মহানবী (স) প্রাথমিক যুগে হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন।
হাদীস লিপিবদ্ধ করার সাধারণ অনুমতি
কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। মদীনা তায়্যিবায় পৌঁছার সামান্য কাল পরেই নিজের সাহাবীদের এবং তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা তিনি নিজেই করেন এবং যখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক লেখাপড়া শিখে ফেলল তখন তিনি হাদীস লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দিলেন। এ প্রসংগে নির্ভরযোগ্য রিওয়ায়াতসমূহ নিম্নে উলেঊলখ করা হল।
১. আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সা) –এর নিকট যা কিছু শুনতাম তা লিপিবদ্ধ করে নিতাম। লোকেরা আমাকে নিখতে নিষেধ করল এবং বলল, রসূলুল্লাহ (স) একজন মানুষ, কখনও শান্ত অবস্থায় কথা বলেন, আবার কখনও রাগান্বিত অবস্থায় কথা বলেন। তুমি সবকিছুই লিখে নিচ্ছ? এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, মহানবী (স) –এর নিকট জিজ্ঞাসা না করা পর্যন্ত তাঁর কোন কথাই লিখব না। অতপর আমি মহানবী (সা)-এর নিকট জিজ্ঞেস করলে তিনি নিজের ঠোঁটের দিকে ইশারা করে বলেনঃ (আরবী**********************************************)
২. আবু হুরায়রা (রা) বলেন, আনসারদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি আবেদন করেন, “আমি আপনার নিকট অনেক কথাই শুনি, কিন্তু মনে রাখতে পারি না”।
মহানবী (স) বলেনঃ (আরবী****************************)
“তোমার যান হাতের সাহায্য লও”। অতপর তিনি নিজের ডান হাতের ইশারায় বলেন, লিখে নাও –(তিরমিযী)।
৩. আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। মহানবী (স) একটি ভাষণ দিলেন। পরে (ইয়ামনের অধিবাসী) আবু শাহ আরজ করেনঃ আমাকে ভাষণটি লিখে দিন। মহানবী (স) নির্দেশ দেনঃ (আরবী****************) আবু শাহকে লিখে দাও –(বুখারী, মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী)। হযরত আবু হুরায়রা (রা)-র অপর বর্ণনায় এই ঘটনা বিস্তারিতভাবে উল্লেখিত হয়েছে। মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (স) একটি ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি মক্কার হেরেম শরীফ ও নরহত্যার ব্যাপারে কতিপয় বিধান বর্ণনা করেন। ইয়ামনের এক ব্যক্তি (আবু শাহ) উঠে দাঁড়িয়ে আবেদন করল, আমাকে ভাষণটি লিখিয়ে দিন। মহানবী (স) নির্দেশ দেনঃ ভাষণটি তাকে লিখে দাও –(বুখারী)।
৪. আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাহাবীদের মধ্যে আমার চেয়ে অধিক হাদীস আর কারো কাছে ছিল না। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) এর ব্যতিক্রম ছিলেন। কারণ তিনি হাদীস লিখে রাখতেন, কিন্তু আমি লিখে রাখতাম না –(বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ)।
৫. বিভিন্ন ব্যক্তি হযরত আলী (রা)-কে জিজ্ঞাসা করে এবং একবার তিনি মিম্বরের উপর থাকা অবস্থায় তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার নিকট কোন জ্ঞান আছে কি যা মহানবী (স) বিশেষভাবে আপনাকে দান করেছেন? তিনি উত্তর দেনঃ না, আমার নিকট শুধু আল্লাহর কিতাব রয়েছে এবং এই কয়েকটি বিধান আছে যা আমি মহানবী (স) –এর নিকট শুনে লিখে নিয়েছি। অতপর তিনি লিখিত বিষয় বের করে দেখান। এর মধ্যে যাকাতের বিধান, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান (আরবী**********) মদীনার হেরেম, এবং অনুরূপ আরো কতিপয় বিষয় সম্পর্কে বিধান লিপিবদ্ধ ছিল –(বুখারী, মুসলিম, আহমাদ ও নাসাঈ এ বিষয় সম্পর্কিত বিভিন্ন রিওয়ায়াত বিভিন্ন সনদসূত্রে বর্ণনা করেছেন)।
এছাড়া মহানবী (স) তাঁর প্রশাসকবৃন্দের নিকট বিভিন্ন এলাকায় ফৌজদারী ও দেওয়ানী বিধান, যাকাত ও মীরাস সম্পর্কিত বিধান বিভিন্ন সময় লিখিতভাবে পাঠাতেন। এসব সম্পর্কে আবু দাউদ, নাসাঈ, দারু কুতনী, দারিমী, তাবাকাতে ইবনে সাদ, আবু উবাদের কিতাবুল আমওয়াল, আবু ইয়ূসুফের কিতাবুল খারাজ এবংইবনে হাযমের আল-মুহাল্লা ইত্যাদি গ্রন্থাবলী দেখা যেতে পারে।
হাদীসসমূহ মৌখিকভাবে বর্ণনা করার প্রতি উৎসাহ প্রদান, বরং গুরুত্ব আরোপ
এ হলো হাদীস লিপিবদ্ধ করার প্রকৃত অবস্থা। কিন্তু আমরা যেমন ইতিপূর্বে বলে এসেছি যে, আরবজাতি হাজারো বছর ধরে নিজেদের কাজ লিখিতভাবে করার পরিবর্তে স্মৃতিশক্তি, ধারাবাহিক বর্ণনা ও মৌখিক কথনের মাধ্যমে পারিচালিত করতে অভ্যস্ত ছিল এবং ইসলামের প্রাথমিক কালেও কয়েক বছর পর্যন্ত তাদের এই অভ্যাস অপরিবর্তিত থাকে। এই অবস্থায় কুরআন মজীদ সংরক্ষণের জন্য তো লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা হয়েছিল, কারণ তার প্রতিটি শব্দ, আয়াত ও সূরা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত ধারাবাহিকতা অনুযায়ী সংরক্ষণ করা উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু হাদীসের ব্যাপারে এ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়নি। কারণ তাতে সুনির্দিষ্ট শব্দাবী এবং তার বিশেষ ধারাবাহিক ওহী হওয়ার দাবী ছিল না এবং এরূপ ধারণাও ছিল না, বরং শুধুমাত্র তাতে উল্লেখিত বিধান, শিক্ষা ও হেদায়াতসমূহ স্মরণ রাখা ও অন্যদের নিকট পৌছে দেয়াই ছিল উদ্দেশ্য যা সাহাবীগণ মহানবী (স)-এর নিকট থেকে লাভ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে মৌখিকভাবে বর্ণনা করার শুধু খোলা অনুমতিই ছিল না, বরং অসংখ্য হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, মহানবী (স) লোকদেরকে তা মৌখিকভাবে বর্ণনা করার পুনপুন এবং অসংখ্য বার তাকিদ দিয়েছেণ। উদাহরণ স্বরূপ এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হল।
১. যায়েদ ইবনে সাবেত, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, জুবাইর ইবনে মুতঈম এবং আবুদ-দারদা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) মহানবী (স)-এর নিন্মোক্ত বাণী উদ্ধৃত করেছেনঃ
(আরবি**********************)
“আল্লাহ সেই ব্যাক্তকে সজীব ও আলোকোজ্জ্বল করে রাখুন- যে আমার কোন হাদীস শুনেছে এবং অন্যদের নিকট পৌছে দিয়েছে। কখনও এমনও হয়ে থাকে যে, কোন ব্যক্তি জ্ঞানের কথা এমন কোন ব্যক্তির নিকট পোছিয়ে দেয়-যে তার চেয়ে অধিক জ্ঞানবান। আর কখনও হয় যে, কোন ব্যক্তি স্বয়ং ফকীহ না হলেও ফকহ বহনকারী হয়ে থাকে, অথবা জ্ঞানী না হলেও জ্ঞানের বাহক হয়ে থাকে”- ( আবু দাউদ, তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজা দারিমী)
২. আবু বাকরাহ (রা) বলেন, মহানবী (স) বলেছেনঃ
(আরবি*******************************************)
“উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিত লোকদের পযর্ন্ত পৌছিয়ে দেয়। হয়ত সে এমন কোন ব্যক্তির নিকট পৌছে দেয়, যে তার চেয়ে অধিক স্মরণ রাখতে পারে”-( বুখারী, মুসলিম)
৩. আবু শুরায়হ (রা) বলেন, মক্কা বিজয়ের দ্বিতীয় দিন মহনবী (স) ভাষণ দেন যা আমি নিজ কানে শুনেছি ও উত্তরমরূপে স্মরণ রেখেছি এবং সেই দৃশ্য এখনো আমার চোখে বন্দী হয়ে আছে। ভাষণ শেষে মহানবী (স) বলেনঃ
(আরবি***************************)
“উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিতদের নিকট পৌছে দেয়” (বুখারী)।
৪. বিদায় হজ্জের সময়ও মহানবী (স) ভাষণ প্রায় উত্তমরূপে কথা বলেছেন যা উপরের দুটি হাদীসে উল্লেখ হয়েছে-(বুখারী)।
৫. আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধিদল বাহরাইন থেকে এস মহানবী (স)-এর সাথে সাক্ষাত করে। তারা বিদায়ের প্রক্কালে আবেদন করেনঃ আমরা অনেক দূরের অধিবাসী, আমাদেরও আপনার মাঝখানে কাফেদের বসতি রয়েছি। আমরা কেবল হারাম মাসসমূহেই আপনাদের নিকট আসার সুযোগ পাই। অতএব আপনি আমাদের এমন কিছু উপদেশ দান করুন যা আমরা প্রত্যাবর্তন করে নিজেদের গোত্রের লোকদের পৌছিয়ে দেব এবং জান্নাতের হকদার হতে পাবে। মহানবী (স) তাদেরকে দীন ইসলামের কতিপয় বিধান শিখিয়ে দিয়ে বলেনঃ
(আরবি***************************)
‘এগুলো স্মরণ রাখ এবং তোমাদের ওখানকার লোকদের পযর্ন্ত পৌছে দাও”-(বুখারী মুসলিম)।
উপরের এসব নির্দেশবাণী এবং তাকিদ থেকে কি একথা প্রমাণ হয়ে যে, মহানবী (স) হাদীস বর্ণনা করার জন্য উৎসাহ প্রদান করতে চাইতেন না? অথবা তিনি এগুলোকে সাময়িক বিধান মনে করতেন এবং চাইতেন না যে, তা লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক এবং সাধারণ অবস্থার উপর তার প্রয়োগ হতে থাকুক?
জাল হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারী
কথা শুধু এতটুকুই নয় যে, মহানবী (স) তাঁর হাদীসের প্রচার ও প্রসারের জন্য তাকিদ দিতেন, বরং সাথে সাথে তিনি এসব হাদীসের পূর্ণ সংরক্ষণের জন্য এবং তার সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ থেকে দূরে থাকার কঠোর তাকিদ দেন। এই প্রসংগে কয়েকটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
আবদুল্লাহ ইবনে আমর, আবু হুরায়রা, যুবায়ের ইবনুল আওয়াম ও আনাস (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) বলেন, মহানবী (স) বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************)
“যে ব্যক্তি উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার নামে মিথ্যা কথা রচনা করে সে যেন নিজের বাসস্থান জাহান্নামে বানিয়ে নিল”-(বুখারী, তিরমিযী)।
আবু সাঈদ আল-খুদরী (রা) বর্ণনা করেন যে, মহানবী (স) বলেনঃ
(আরবী***********************************************************)
“আমার হাদীস বর্ণনা কর তাতে কোন আপত্তি নাই। কিন্তু যে ব্যক্তি উদ্দেশ্যমূলকবাবে আমার নামে মিথ্যা কথা রচনা করে সে যেন জাহান্নামে নিজের আবাস বানিয়ে নিল”-(মুসলিম)।
ইবনে আব্বাস, ইবনে মাসউদ ও জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন, মহানবী (স) বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************************)
“আমার পক্ষ থেকে কোন কোন কথা বর্ণনা করা থেকে বিরত থাক –যতক্ষণ না জানতে পার যে, তা আমি বলেছি। কারণ যে ব্যক্তি কোন মিথ্যা কথা আমার সাথে সংশ্লিষ্ট করে যে যেন জাহান্নামকে তার বাসস্থান বানিয়ে নিল” (তিরমিযী, ইবনে মাজা)।
হযরত আলী (রা) বলেন, মহানবী (স) বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************)
”আমার নাম নিয়ে মিথ্যা কথা বল না। কারণ যে ব্যক্তি আমার নাম নিয়ে মিথ্যা কথা বলবে সে দোযখে প্রবেশ করবে” –(বুখারী)।
হযরত সালামা ইবনুল আকওয়া (রা) বলেনঃ
(আরবী****************************************************************)
“আমি মহানবী (সা) –কে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তি আমার নাম নিয়ে এমন কথা বলে যা আমি বলিনি, সে জাহান্নামে নিজের বাসস্থান করে নিল”-(বুখারী)।
বারংবার এই ভীতি প্রদর্শন থেকে কি প্রমাণিত হয় যে, দীন ইসলামে মহানবী (স)-এর বাণীসমূহের কোনই গুরুত্ব ছিল না? দীন ইসলামে যদি তাঁর বাণীসমূহের কোন আইনগত মর্যাদা না থাকত এবং তার দ্বারা দীনের বিধানসমূহ প্রভাবিত হওয়ার আশংকা না থাকত তবে জাহান্নামের ভয় দেখিয়ে লোকদের মিথ্যা হাদীস রচনা থেকে বিরত রাখার কি প্রয়োজন ছিল? রাজা-বাদশাহ ও নেতাদের সাথে ইতিহাসে অনেক ভ্রান্ত কথা যুক্ত হয়ে যায়। তার দ্বারা অবশেষে দীনের উপর কি প্রভাব পড়ে। মহানবী (স)-এর সুন্নাতেরও যদি এইরূপ মর্যাদা হয়ে থাকে তবে তাঁর ইতিহাস বিকৃত করার অপরাধে কোন ব্যক্তির দোযখের শাস্তি কেন হবে?
মহানবী (স) –এর সুন্নাত আইনের উৎস হওয়ার অকাট্য প্রমাণ
এ প্রসংগে সবচেয়ে বড় কথা হলঃ কোন বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সুস্পষ্ট বক্তব্য বর্তমান থাকলে সে সম্পর্কে অপ্রাসংগিক জিনিসসমূহ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনই অবশিষ্ট থাকে না। আল্লাহ তাআলা পরিস্কার বাক্যে তাঁর রসূলকে আল্লাহর কিতাবের ভাষ্যকারের এখতিয়ারও প্রদান করেছেন এবং আইন প্রণয়নের এখতিয়ারও প্রদান করেছেন। ইতিপূর্বে উল্লেখিত সূরা নাহল-এর ৪৪ নং আয়াত, সূরা আরাফের ১৫৭ নং আয়াত এবং সূরা হাশর –এর ৭ নং আয়াত এ প্রসংগে সম্পূর্ণ পরিস্কার বক্তব্য প্রদান করেছে। তাছাড়া মহানবী (স) –ও স্পষ্ট বাক্যে নিজের এসব এখতিয়ারের বর্ণনা দিয়েছেন। আবু রাফে (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************************)
”না, আমি অবশ্যই তোমাদের মধ্যে এমন লোক পাব যে নিজের আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে থাকবে এবং তার নিকট আমার নির্দেশাবলীর মধ্যে কোন নির্দেশ পৌঁছানো হবে, যার মাধ্যমে আমি কোন কাজ করার বা না করার নির্দেশ দিয়েছি, আর সে তা শুনে বলবে, আমি জানি না; যা কিছু আল্লাহর কিতাবে পাব কেবল তার অনুসরণ করব” –(মুসনাদে আহমাদ, শাফিঈ, তিরমিযী, আবু দাঊদ, ইবনে মাজা, বায়হাকীর দালাইলুন-নুবূওয়াহ)।
মিকদাম ইবনে মাদীকারাব (রা) থেকে বর্ণিত। মহানবী (স) বলেনঃ
(আরবী**************************************************************)
”সাবধান! আমাকে কুরআন দেয়া হয়েছে এবং এর সাথে এর অনুরূপ আরও একটি জিনিস। সাবধান! এমন যেন না হয় যে, প্রাচুর্যের গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসমান কোন ব্যক্তি নিজের আরাম কেদারায় বসে বলবে যে, তোমরা কেবল কুরআনের অনুসরণ কর, তাতে যা কিছু হালাল পাবে তা হালাল মানবে এবং যা কিছু হারাম পাবে তা হারাম মানবে। অথচ আল্লাহর রসূল যা কিছু হারাম সাব্যস্ত করেছেন তা মূলত আল্লাহর হারামকৃত বস্তুর সমান। সাবধান! তোমাদের জন্য গৃহপালিত গাধা হালাল হয় এবং নখরযুক্ত হিংস্র জন্তুও তোমাদের ন্য হালাল নয়-[এই শেষের বাক্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কতিপয় লোক গাধা, কুকুর ও অন্যান্য হিংস্র প্রাণী এই যুক্তিতে হালাল প্রমাণের চেষ্টা করে থাকবে যে, কুরআনে এগুলো হারাম হওয়ার কোন বিধানের উল্লেখ নাই। এই কারণে মহানবী (স) উপরোক্ত বক্তব্য পেশ করে থাকবেন।] –(আবু দাউদ, ইবনে মাজা, দারিমী, হাকেম)।
ইরবাদ ইবনে সারিয়া (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, মহানবী (স) ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে বলেনঃ
(আরবী************************************************************)
“তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি কি নিজের আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে একথা মনে করে বসেছে নাকি যে, কুরআনে যা কিছু হারাম করা হয়েছে তা ছাড়া আল্লাহ অন্য কোন জিনিস হারাম করেননি? সাবধান! আল্লাহর শপথ! আমি যেসব নির্দেশ দিয়েছি, উপদেশ দিয়েছি এবং যা কিছু করতে নিষেধ করেছি তাও কুরআনেরই অনুরূপ, অথবা তার অধিক। আহলে কিতাবদের বাড়িতে তাদের অনুমতি ছাড়া প্রবেশ, তাদের স্ত্রীলোকদের মারধর করা এবং তারা তাদের উপর আরোপিত কর আদায় করার পরও তাদের গাছের ফল খাওয়া আল্লাহ তোমাদের জন্য হারাম করেছেন-[হাদীসের এই শেষাংশ পরিস্কার বলে দিচ্ছে যে ,কতিপয় মোনাফিক যিম্মীদের উপর হস্তক্ষেপ করে থাকবে এবং কুরআনের আশ্রয় নিয়ে বলে থাকবে যে ,দেখাও তো কুরআনের কোথাও লেখা আছে যে, আহলে কিতাবদের বাড়িতে প্রবেশ করতে হলে অনুমতির প্রয়োজন আছে? আর কুরআনের কোথায় তাদের নারীদের নির্যাতন করা এবং তাদের বাগানের ফল খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে? এই প্রেক্ষিতে মহানবী (স) উপরোক্ত ভাষণ দিয়ে থাকবেন।] –(আবু দাউদ)।
(আরবী*******************************************************************************)
“যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত থেকে বিমুখ হবে, আমার সাথে তার কোন সম্পর্ক নাই”-(বুখারী, মুসলিম)।
আল্লাহ ও তাঁর রসূলের এরূপ সুস্পষ্ট বক্তব্যের পর অবশেষে এই যুক্তির কি ওজন অবশিষ্ট থাকতে পারে যে, হাদীসসমূহ যেহেতু লিপিবদ্ধ করানো হয়নি তা ই তা সাধারণ প্রয়োগের জন্য ছিল না?
লিপিবদ্ধ জিনিসই কি শুধু নির্ভরযোগ্য হয়ে থাকে?
বিজ্ঞ বিচারপটতি বারবার লেখার বিষয়টির উপর খুবই গুরুত্বপূর্ণ আরোপ করছেন। মনে হয় যেন তার মতে লিপিবদ্ধ করা ও সংরক্ষণ করা সমার্থবোধক নয়। তার যুক্তির সবচেয়ে বড় ভিত্তি এই ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত যে, কুরআন লিপিবদ্ধ করে নেয়ার কারণেই তা নির্ভরযোগ্য এবং প্রমাণ হিসাবে গ্রহণযোগ্য, আর হাদীসসমূহ মহানবী (স)-এর যুগে এবং খেলাফতে রাশেদার যুগে লিপিবদ্ধ না করার কারণে অনির্ভরযোগ্য ও প্রমাণ হিসাবে গ্রহণের অযোগ্য।
এ প্রসংগে প্রথমত একথা বুঝে নেয়া দরকার যে, কুরআন মজীদ লিপিবদ্ধ করিয়ে নেয়ার কারণ এই ছিল যে, তার শব্দভাণ্ডার এবং অর্থ উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিল। তার শব্দসমষ্টির ক্রমবিন্যাসই নয়, এর আয়াতসমূহের ক্রমবিন্যাস এবং সূরাগুলোর ক্রমবিন্যাসও ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে। তার কোন শব্দ অন্য কোন শব্দের দ্বারা পরিবর্তন করাও জায়েয ছিল না। আর তা এজন্য নাযিল হয়েছিল যে, লোকেরা নাযিলকৃত শব্দযোগে তার ক্রমবিন্যাস রক্ষা করে তা তিলাওয়াত করবে।
পক্ষান্তরে সুন্নাতের ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নতর। তা শুধু আক্ষরিক ছিল না, বরং ব্যবহারিকও ছিল। এর শব্দসমষ্টি কুরআনের শব্দসমষ্টির ন্যায় ওহীর মাধ্যমে নাযিল হয়নি, বরং মহানবী (স) তা নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন। তাছাড়া এর এক বিরাট অংশ এমন ছিল যা মহানবী (স) –এর সমসাময়িক কালের লোকেরা নিজেদের ভাষায় বর্ণনা করেছিলেন। যেমন, মহানবী (স) –এর চরিত্র-নৈতিকতা এরূপ ছিল, তাঁর জীবন যাপন পদ্ধতি এরূপ ছিল এবং অমুক স্থানে তিনি অমুক কাজ করেছেন ইত্যাদি। রসূলুল্লাহ (স) –এর বাণী ও বক্তুতামালা নকল করার ক্ষেত্রেও এমন কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না যে, শ্রোতাগণকে তা অক্ষরে অক্ষরে নকল করতে হবে। বরং একই ভাষাভাষী শ্রোতাদের জন্য তাঁর কোন কথা শুনে তার অর্থের পরিবর্তন না করে নিজেদের ভাষায় তা ব্যক্ত করার অনুমতি ছিল এবং এ ব্যাপারে তারা সক্ষমও ছিল। মহানবী (স) –এর বাণীর তিলাওয়াত উদ্দেশ্যে ছিল না, বরং তাঁর দেয়া শিক্ষার অনুসরণই ছিল উদ্দেশ্য। কুরআনের আয়াতসমূহ ও সূরাসমূহের ক্রমবিন্যাসের মত কোন হাদীস আগে এবং কোন হাদীস পরে হবে এরূপ সংরক্ষণও অত্যাবশ্যকীয় ছিল না। এ কারণে হাদীসসমূহের ক্ষেত্রে এতটুকুই যথেষ্ট ছিল যে, লোকেরা তা স্মরণ রাখতবে এবং বিশ্বস্ততার সাথে অন্যদের নিকট পৌঁছিয়ে দেবে। এ ব্যাপারে লিপিবদ্ধ করার গুরুত্ব ততটা ছিল না –যতটা কুরআনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
দ্বিতীয় কথা যা খুব ভাল করে বুঝে নেয়া প্রয়োজন তা এই যে, কোন জিনিসের দলীল-প্রমাণ হওয়ার জন্য তার লিপিবদ্ধ হওয়াটা একান্তই জরুরী নয়। বিশ্বস্ততার মূল ভিত্তি হচ্ছে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের “নির্ভরযোগ্য হওয়া” যার বা যাদের মাধ্যমে কোন কথা অন্যের নিকট পৌঁছে থাকে –চাই তা লিপিবদ্ধ হোক অথবা অলিখিত আকারে পাঠাননি, বরং মহানবী (স) –এর জবানীতে তা বান্দাদের নিকট পৌঁছিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা সমপূর্ণরূপে একথার উপর নির্ভর করেছেন যে, যে ব্যক্তি তাঁর নবীকে সত্য বলে মেনে নিবে সে তাঁর নবীর বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে কুরআনকেও আমার বাণী হিসাবে মেনে নিবে। মহানবী (স)-ও কুরআনের যাবতীয় প্রচার ও প্রসার মৌখিকভাবেই করেছেন। তাঁর যেসব সাহাবী বিভিন্ন জনপদে গিয়ে দীনের প্রচার করতেন তাঁরাও কুরআনের সূরাসমূহ লিখে নিয়ে যেতেন না। লিপিবদ্ধ আয়াত ও সূরাসমূহ তো সেই থলের ভেতর পড়ে থাকত যার মধ্যে তিনি ওহী লেখক সাহাবীদের মাধ্যমে তা লিপিবদ্ধ করে ঢেলে দিতেন। অবশিষ্ট তাবলীগ ও প্রচারের কাজ মৌখিকভাবে করা হত এবং ঈমান আনয়নকারী ব্যক্তি ঐ এক সাহাবীর বিশ্বস্ততার উপর নির্ভর করে একতা মেনে নিত যে, সে যা কিছু শুনছে তা আল্লাহর কালাম, অথবা সাহাবী রসূলুল্লাহ (স) –এর যে নির্দেশ পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন তা তাঁরই নির্দেশ।
এ প্রসংগে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে –লিপিবদ্ধ জিনিস স্বয়ং নির্ভরযোগ্য হতে পারে না যতক্ষন না জীবিত ও বিশ্বস্ত লোকেরা তার সপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে। শুধু লিপিবদ্ধ কোন জিনিস যদি আমাদের হস্তগত হয় এবং আমরা মূল লেখকের হাতের লেখার সাথে পরিচিত না হয়ে থাকি অথবা লিপিবদ্ধকারী নিজে না বলে যে, তা তারই হাতের লেখা, অথবা এমন কোন সাক্ষী না পাওয়া যায়, যে এটাকে ঐ ব্যক্তির হাতের লেখা বলে সাক্ষ্য দেবে, তবে ঐ লিপিবদ্ধ জিনিস আমাদের জন্য নিশ্চিত প্রমান হওয়া তো দূরের কথা, অনুমানসর্বস্ব প্রমাণও হতে পারে না। এটা এমন এক নীতিগত সত্য যার প্রতি বর্তমান কালের সাক্ষ্য আইনেরও সমর্থন রয়েছে এবং বিজ্ঞ বিচারপতি নিজেও আদালতে এই নীতি অনুযায়ী কাজ করেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কুরআন মজীদ সংরক্ষিত হওয়ার বিষয়ে আমাদের যে নিশ্চিত বিশ্বাস রয়েছে তার ভিত্তি কি এই যে, তা লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল? ওহী লেখকদের স্বহস্তে লিখিত কুরআন যার বক্তব্য মহানবী (স) তাদের বলে দিতেন, আজ দুনিয়ার কোথাও বিদ্যমান নাই। তা যদি বিদ্যমান থাকতও তবে আজ কে তার সত্যতার পক্ষে সাক্ষ্য দিত যে, এটা কুরআনের সেই পাণ্ডুলিপি যা মহানবী (স) স্বয়ং লিপিবদ্ধ করিয়েছেন এবং স্বয়ং একথাও যে, মহানবী (স) ওহী নাযিল হওয়ার পরপরই এই কুরআন লিপিবদ্ধ করাতেন? একথা আমরা কেবল মৌখিক বর্ণনার মাধ্যমেই জানতে পারি, অন্যথায় এ সম্পর্কে জানার দ্বিতীয় কোন মাধ্যম ছিল না।
অতএব কুরআনের সুসংরক্ষিত হওয়ার উপর আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাসের আসল কারণ তার লিপিবদ্ধ হওয়া নয়, বরং এর আসল কারণ হচ্ছে –জীবিত লোকেরা অব্যাহতভাবে জীবিত লেকাদের নিকট তা শুনে আসছে এবং এরা তাদের পরবর্তীদের নিকট তা হুবহু পৌঁছে দিয়ে আসছে। অতএব কোন জিনিসের সংরক্ষিত হওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে তাঁর লিপিবদ্ধ আকারে অবশিষ্ট থাকা, এই ভ্রান্ত ধারণা মনমগজ থেকে বের করে দিতে হবে।
এসব বিষয়ের উপর যদি সম্মানিত বিচারক ও তার মত চিন্তাভাবনাকারী লোকেরা গভীরভাবে চিন্তা করেন তবে তাদের একতা স্বীকার করতে ইনশাআল্লাহ কোন কষ্টই অনুভূত হবে না যে, কোন জিনিস যদি নির্ভরযোগ্য মাধ্যমসমূহের সাহায্যে প্রাপ্ত হওয়া যায় তবে তা দলীল-প্রমাণ হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা রাখে, তা লিপিবদ্ধ আকারে না রাখা হলেও।
হাদীসসমূহ কি আড়াইশো বছর ধরে অজ্ঞাত প্রকোষ্ঠে পড়ে রয়েছিল?
পুনরায় চার নম্বর দফার শেষদিকে সম্মানিত বিচারপতির বক্তব্য যে, “হাদীসসমূহ না মুখস্ত করা হয়েছিল আর না সংরক্ষণ করা হয়েছিল, বরং তা এমন সব লোকের মনমস্তিষ্কে লুক্কায়িত অবস্থায় ছিল যারা ঘটনাক্রমে কখনও অন্যদের নিকট তা বর্ণনা করে মারা যায়। এমনকি তাদের মৃত্যুর কয়েক শত বছর পর তা সংগ্রহ ও সংকলনাবদ্ধ করা হয়”-এটা শুধু বাস্তব ঘটনারই পরিপন্থী নয়, বরং এটা মূলত মহানবী (স)-এর ব্যক্তিত্বের এবং তাঁর প্রতি প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের বিশ্বাসের চরম অবমূল্যায়ন। বাস্তব ঘটনা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েও কোন ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি প্রয়োগ করেও যদি সঠিক অবস্থা অনুধাবনের চেষ্টা করে তবে সে কখনও বিশ্বাস করতে পারে না যে, যে সুমহান ব্যক্তিত্ব আরব জাতির লোকদেরকে চরিত্র-নৈতিকতা, সভ্যতা-সংস্কৃতি, আকীদা-বিশ্বাস ও কার্যকলাপের চরম পশ্চাৎপদতা থেকে তুলে নিয়ে উচ্চতর স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন, তাঁর বক্তব্য ও কাজকর্মকে সেই লোকেরা এতটা দৃষ্টি দানের অনুপযুক্ত মনে করবে যে, তারা তাঁর কোন কথা স্মরণ রাখার চেষ্টা করেনি, অন্যদের কাছে ঘটনাক্রমে বর্ণনা করা ছাড়া আরেকটু অগ্রসর হয়ে তার চর্চা করেনি এবং পরবর্তী কালের লোকেরাও তাঁর সাক্ষাত লাভকারী লোকদের নিকট তাঁর বিষয়ে জানার জন্য সামান্য চেষ্টাও করেনি। কোন একজন সাধারণ নেতার সাথেও যদি কেউ ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভে সক্ষম হয় তবে সে তার সাথে নিজের সাক্ষাত লাভের প্রতিটি ঘটনা স্মরণ রাখে এবং অন্যদের নিকট গিয়ে ভবিষ্যৎ বংশধররা তার অবদান সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার চেষ্টা করে। বিচারপতি মুহাম্মাদ শফী সাহেব শেষ পর্যন্ত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা)-কে কোন পর্যায়ের লোক মনে করে নিয়েছেন যে, তাঁর সমসাময়িক কালের এবং এর পরের যুগের লোকেরা তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করার যোগ্যও তাঁকে মনে করেননি?
এখন প্রকৃত অবস্থা কিছুটা খতিয়ে দেখা যাক। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামদের জন্য এমন এক মহান নেতা ছিলেন যাঁর নিকট তাঁরা প্রতিটি মুহুর্তে আকীদা-বিশ্বাস, ঈমান-আমল, ইবাদত-বন্দেগী, নীতি-নৈতিকতা, তাহযীব-তমদ্দুন, আচার-ব্যবহার এবং ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের শিক্ষা গ্রহণ করতেন। তাঁর জীবনের এক একটি দিকের অনুসরণ করে তাঁরা নিষ্কলুষ লোকদের মত জীবন যাপনের শিক্ষা গ্রহণ করতেন। তাঁরা জ্ঞান ছিলেন যে, তাঁর নবী হয়ে আগমনের পূর্বে তাঁরা কি ছিলেন এবং তিনি তাদের কোন পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। তাদের সামনে আগত প্রতিটি বিষয়ে ফতোয়া দানকারী ছিলেন তিনি ই এবং বিচারপতিও ছিলেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই তাঁরা যুদ্ধ করতেন এবং সন্ধিও করতেন। তাদের অভিজ্ঞতা ছিল যে, তাঁর নেতৃত্বের অনুসরণ করে তাঁরা কোথা থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছেছেন। এ কারণে তাঁরা তাঁর প্রতিটি কথা স্মরণ রাখতেন। যাঁরা তাঁর নিকটে থাকতেন তাঁরা অপরিহার্যরূপে তাঁর সাহচর্যে বসে থাকতেন। যাঁদেরকে কখনও তাঁর দরবার থেকে অনুপস্থিত থাকতে হত তাঁরা অন্যদের নিকট জিজ্ঞেস করে জেনে নিতেন যে আজ তিনি কি কি কাজ করেছেন এবং কি কথা বলেছেন?
দূরদূরান্ত থেকে আগত লোকেরা মহানবী (স)-এর সাহচর্যে যতটুকু সময় অতিবাহিত করার সুযোগ পেতেন তাকে তারা নিজেদের গোটা জীবনের মূলধন করে করতেন এবং জীবনভর তা স্মরণ করতেন। তাঁর সাহচর্যে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ যাদের হত না তারা এমন প্রত্যেক ব্যক্তির চারপাশে সমবেত হত যিনি তাঁর সাহচর্য লাভ করে আসতেন এবং তন্নতন্ন করে প্রতিটি কথা তার কাছ থেকে জেনে নিতেন। যারা তাঁকে কখনও দূর থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন অথবা কোন বৃহৎ জনসমাবেশে শুধু তাঁর বক্তৃতা শুনেছিলেন সেই স্মৃতি জীবন ভর ভুলতেন না এবং গৌরবের সাথে নিজের এই সৌভাগ্যের কথা বর্ণনা করতেন যে, আমাদের এই চোখ মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (স) –এর দর্শন লাভ করেছে এবং আমাদের কান তাঁর ভাষণ শুনেছে। অতপর রসূলুল্লাহ (স)-এর পরবর্তী যুগে যারা জন্মগ্রহণ করেন তাদের জন্য দুনিয়াতে যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থেকে থাকত তবে তা ছিল মহানবী (স)-এর ‘সীরাত’ যাঁর নেতৃত্বের মুজিযাসুলভ কৃতিত্ব আরবের উটচালকদের জাগরিত করে সিন্ধু থেকে স্পেন পর্যন্ত ভূখন্ডের শাসকের মর্যাদায় উন্নীত করেছিল। তারা এমন এক একজনের নিকট পৌঁছে যেত যিনি মহানবী (স) –এর সাহচর্য লাভ করেছিলেন, অথবা কখনও তাঁকে দেখেছিলেন, অথবা তাঁর কোন ভাষণ শুনেছিলেন। সাহাবীগণের একে একে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সাথে সাথে তাদের সাহচর্য লাভেল আকাংখাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এমনকি তাবিঈগণ সাহাবাদের নিকট থেকে সীরাতে পাক সম্পর্কে যে জ্ঞানেরই সন্ধান পেতেন তা-ই নিংড়ে নিতেন।
সাহাবীদের হাদীস বর্ণনা
বুদ্ধিবৃত্তি সাক্ষ্য দেয় যে, অবশ্যই এরূপ হয়ে থাকবে এবং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বাস্তবিকই এরূপ হয়েছিল। আজ পৃথিবীতে হাদীসের যে জ্ঞানভাণ্ডার বর্তমান রয়েছে তা প্রায় দশ হাজার সাহাবীদের সূত্রে লাভ করা গেছে। তাবিঈগণ কেবলমাত্র তাঁদের বর্ণিত হাদীসই গ্রহণ করেননি, বরং এসব সাহাবীর জীবনীও লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁরা এও বর্ণনা করেছেন যে, কোন সাহাবী কত কাল মহানবী (স)-এর সাহচর্য লাভ করেছেন অথবা কোথায় এবং কখন তাঁকে দেখেছেন এবং কোন কোন স্থানে তাঁর দরবারে উপস্থিত হয়েছেন। বিজ্ঞ বিচারক তো বলেছিলেন যে, হাদীসসমূহ প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের মনমগজে সমাহিত অবস্থায় পড়েছিল এবং দুইমো আড়াইশো বছর পরে ইমাম বুখারী (রহ) ও তাঁর সমসাময়িক মনীষীগণ এসব হাদীস খননকার্য চালিয়ে উদ্ধার করেছেন। কিন্তু ইতিহাস আমাদের সামনে যে চিত্র তুলে ধরে তা তার বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের মধ্যে যাঁরা সর্বাধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন তাদের নাম ও তাদের বর্ণিত হাদীসসমূহের তালিকা নিম্নে প্রদত্ত হল।
আবু হুরায়রা (রা) (মৃ. ৫৭ হি.), বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫,৩৭৪ (এবং তাঁর ছাত্রবৃন্দের সংখ্যা ৮০০-এর অধিক। তাঁর অধিকাংশ ছাত্র তাঁর বর্ণিত হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করে নিয়েছিলেন)।
আবু সাঈদ আল-খুদরী (মৃ. ৪৬ হি.), হাদীসের সংখ্যা ১১৭০।
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (মৃ. ৭৪ হি.), হাদীস ১,৫৪০।
আনাস ইবনে মালেক (মৃ. ৯৩ হি.), হাদীস ১,২৮৬।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা (মৃ. ৫৯ হি.), হাদীস ২,২১০।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (মৃ. ৬৭ হি.), হাদীস ১,৬৬০।
আবদুল্লাহ ইবনে উমার (মৃ. ৭০ হি.), হাদীস ১,৬৩০।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (মৃ. ৬৩ হি.), হাদীস ৭০০।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (মৃ. ৩২ হি.), হাদীস ৮৪৮।
উপরোক্ত তথ্য কি একথা প্রমাণ করে যে, সাহাবায়ে কিরাম (রা) মহানবী (স)-এর সার্বিক অবস্থায় বর্ণনাসমূহ নিজেদের বক্ষ পিঞ্জরে সমাহিত করে তা এভাবে পৃথিবী থেকে পরজগতে নিয়ে চলে গেছেন?
সাহাবীদের যুগ থেকে ইমাম বুখারীর যুগ পর্যন্ত ইলমে হাদীসের ধারাবাহিক ইতিহাস
এরপর সেইসব তাবিঈগণের দিকে লক্ষ্য করুন যাঁরা সাহাবায়ে কিরামগণের নিকট মহানবী (স) –এর জীবনাচার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং পরবর্তী বংশধরগণ পর্যন্ত তা পৌঁছিয়েছেন। কেবল ইবনে তাবাকাত গ্রন্থে কয়েকটি কেন্দ্রীয় শহরের তাবিঈনের যে জীবনী দেয়া হয়েছে, তা থেকে তাদের সংখ্যা অনুমান করা যেতে পারে। যেমন –মদীনায় ৪৮৪ জন, মক্কায় ১৩১ জন, কূফায় ৪১৩ জন, বসরায় ১৬৪ জন।
তাদের মধ্যে যেসব প্রবীণ সাহাবী হাদীসের জ্ঞান অর্জনে, তা সংরক্ষণ করতে এবং পরবর্তীদের নিকট তা পৌঁছে দিতে সর্বাধিক অবদান রেখেছেন তাদের তালিকা নিম্নে প্রদত্ত হল।
সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব (জন্ম ৪১ জি. মৃত্যু ৯৩ হি.), হাসান বসরী (২১-১১০), ইবনে সীরীন (৩৩-১১০), উরওয়া ইবনুয যুবাইর (২২-৯৪), ইনি সর্বপ্রথম মহানবী (স)-এর জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন, আলী ইবনুল হুসাইন (ইমাম যয়নুল আবেদীন ৩৮-৯৪), মুজাহিদ (২১-১০৪), কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবু বাকর (৩৭-১০৬), শুরায়হ যিনি মুহাম্মদ উমার (রা)-এর খিলাফতকালে বিচারপতি ছিলেন (মৃ. ৭৮ হি.), মাসরূক যিনি হযরত আবু বাকর (রা)-র যুগে মদীনায় আসেন (মৃ. ৬৩ হি.), আসওয়াদ ইবনে হায়ওয়াত (মৃ. ৭৫ হি.) মাকহুল (মৃ. ৬৩ হি.), রাজাআ ইবনে হায়ওয়াত (মৃ. ১০৩ হি.) হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ (৪০-১৩১), তিনি হাদীসের একটি সংকলন প্রণয়ন করেছিলেন যা সাহীফায়ৈ ইবনে হাম্মাম নামে বর্তমান কালেও বিদ্যমান আছে এবং প্রকাশিত হয়েছে। সালেম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমার (মৃ. ১০৬ হি.) নাফে মাওলা ইবনে উমার (মৃ. ১১৭ হি.), সাঈদ ইবনে জুবাইর (৪৫-৯৫), সুলাইমান আল-আমাশ (৬১-১৪৮), আইউব আস-সুখতিয়ানী (৬৬-১৩১), মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির (৫৪-১৩০), ইবনে শিহাব আয-যুহরী (৫৮-১২৪), তিনি লিখিত আকারে হাদীসের বিরাট পাণ্ডুলিপি রেখে যান, সুলাইমান ইবনে ইয়াসার (৩৪-১০৭), ইকরামা ইবনে আব্বাস (রা)-র মুক্তদাস (২২-১০৫), আতা ইবনে আবী রাবাহ (২৭-১১৫), কাতাদা ইবনে দিআমা (৬১-১১৭), আমের আশ-শাবী (১৭-১০৪), আলকামা (মৃ. ৬২ হি.), তিনি রসূলুল্লাহ (স)-এর যুগে যুবক ছিলেন, কিন্তু তাঁর সাক্ষাত লাভ করতে পারেননি। ইবরাহীম নাখঈ (৪৬-৯৬), ইয়াযীদ ইবনে আবী হাবীব (৫৩-১২৮)।
এসকল মহামনীষীর জন্ম ও মৃত্যু তারিখের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই জানা যায় যে, তাঁরা সাহাবীগণের সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই সাহাবীদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এবং মহিলা সাহাবীগণের কোলে লালিত-পালিত হন। আর তাদের কতেক তো কোন না কোন সাহাবীর সাহচর্যে গোটা জীবন কাটিয়ে দেন। তাদের জীবনেতিহাস পাঠে জানা যায় যে, তাদের প্রত্যেকে অসংখ্য সাহাবীর সাথে সাক্ষাত লাভ করে মহানবী (সা)-এর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং তাঁর বাণীসমূহ ও সিদ্ধান্তসমূহ সম্পর্কে যুগপৎভাবে হাদীসসমূহ তাদের পরবর্তীদের নিকট পৌঁছে যায়। যদি না কোন ব্যক্তি মনে করে বসে যে, ১ম হিজরী শতকের সকল ব্যক্তি নিজেদের বাড়িতে বসে মনগড়াভাবে হাদীস রচনা করে থাকবেন এবং এরপরও গোটা উম্মাত তাদেরকে নিজেদের শিরোমনি বানিয়ে নিয়ে থাকবে এবং তাদেরকে নিজেদের প্রবীণ আলেমগণের মধ্যে গণ্য করে থাকবেন।
এরপর আমাদের সামনে আসে, বয়সে যুবক তাবিঈ ও তাবউ তাবিঈনের ইতহাস, যাঁরা ছিলেন সংখ্যায় হাজার হাজার এবং গোটা জাহানে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা ব্যাপকভাবে তাবিঈগণের নিকট থেকে হাদীসের শিক্ষা লাভ করে এবং দূরদূরান্ত পর্যন্ত সফর করে এক এক এলাকায় সাহাবা ও তাবিঈদের জ্ঞানভাণ্ডার একত্রিক করেন। তাদের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের নাম নিম্নে প্রদত্ত হল।
জাফর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী (জন্ম ৮০ হিজরী, মৃত্যু ১৪৮ হিজরী), তিনি ইমাম জাফর সাদেক নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। ইমাম আজম আবু হানীফা আন-নোমান (৮০-১৫০), শোবা ইবনুল হাজ্জাজ (৮৩-১৬০), লাইস (রহ)-এর উসতাদ ছিলেন। সাঈদ ইবনে আরূবা (মৃ. ১৫৬), মিসআর ইবনে কিদাম (মৃ. ১৫২), আবদুর রহমান ইবনুল কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবু বাকর (মৃ. ১২৬), সুফিয়ান আস-সাওরী (৯৭-১৬১), হাম্মাদ ইবনে যায়েদ (৯৭-১৭৯)।