প্রথম অধ্যায়
স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরের কাহিনী
এক
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হলো। সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি যেমন সর্বাঙ্গ সুন্তর হতে পারতো তা হয়নি, বিশেষ করে পূর্ব পকিস্তানে। ভাসানী ন্যাপ শুধু নির্বাচন থেকে সরেই দাঁড়ায়নি, নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোড় বিরোধিতাও করেছে। নির্বাচনের প্রায় পূর্ব মুহূর্তে এসে মুসলিম লীগ, আতাউর রহমান খানের ন্যাশনাল লীগও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াল। নির্বাচনে যে ফল হলো তা পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে আগেই আঁচ করা গিয়াছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে বরাদ্দ জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ পেল ১৬৭টি। আওয়ামলী লীগের বাইরে নুরূল আমীন নির্বাচিত হলেন তাঁর পাটি পি.ডি.পি. থেকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উপজাতীয় রাজা ত্রিদিবরায় নির্বাচিত হলেন স্বতন্ত্র্য সদস্য হিসেবে। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি পেল ৮৮টি আসন। সেখানে অন্যন্য দলের মধ্যে কাউন্সিল মুসলিম লীগ ৭, মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) ৯, ন্যাপ (মস্কো) ৭, জমিয়তে উলামা ৭, জামায়াতে ইসলামী ৪, মুসলিম লীগ (কনভেনশন) ২, মারকারযী উলামা ৭ এবং স্বতন্ত্র সদস্যরা ১৪টি আসন লাভ করলো।
নির্বাচনের ফল প্রমাণ করলো, পাকিস্তানের দু অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ দুটি আঞ্চলিক দলের উপর তাদের আস্থা স্থাপন করেছে। পূর্ব পাকিস্তানেসর জন্যে বলা যায় এটা বাঞ্ছিত ছিল। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের বাস ছিল এই পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ তারাই অর্থনৈতিক এবং নানাদিক থেকে ছিল বঞ্চিত। এ বঞ্চনার অনুভূতি ছিল তাদের মধ্যে অত্যন্ত তীব্র। আর আওয়া লীগ যেহেতু আঞ্চলিক স্বার্থের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাই বিজয়কে এ দৃষ্টিতে দেখা যায়নি। তাই সেখানে পিপলস পার্টির বিজয় আঞ্চলিকতাবাদের পাল্টা উত্থান বলে বিবেচিত হলো। পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন বিজয়ী শেখ মুজিবুর রহমান স্বাভাবিকভাবেই এ অঞ্চলের স্বার্থের প্রতীক অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব হয়ে দাঁড়ালেন। অনুরূপভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণীর মানুষ, যাদের অবস্থান ছিল ক্ষমতার আশে-পাশে, পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ‘জাতীয় বীর’ –এর মর্যাদায় বরিত করলো। তাদের কাছে ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের প্রতীক হয়ে দাঁড়াল। তারা বলে উঠলো, কিভাবে একটি প্রদেশ সারা দেশকে শাসন করতে পারে? [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল- সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-৪৫] নির্বাচনের প্রচারণা চলাকালে নানা কথা, নানা উক্তি, নানা আচরণ দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যকার বিশ্বসের বুনিয়াদকে অনেকখানিই দুর্বল করেছিল, তখন পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এ মনোভাবের উত্থান পরিস্থিতিকে সংকট শুধু নয়, সংঘাতের দিকে ঠেলে দিল। এ সংঘাতে ভুট্টো এলেন ‘ভিলেন’ –এর ভূমিকায়। এ ভিলেন-এর ভূমিকা কি হতে যাচ্ছে, তার উপর একটা সুন্দর মন্তব্য করেছিল ঢাকার একটি দৈনিক। নির্বাচনের পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৭০, পত্রিকাটি তার সংবাদ ভাষ্যে লিখে:
“জনসংখ্য ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের দাবী অনেক ঘাটে পানি খেয়ে যান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দ্বারা স্বীকৃতি হলো, তখন থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক বিরাট মোড় নিলো। মনে হলো, রাতারাতি যেনো পুবের হাওয়া পশ্চিমে বইতে শুরু করলো। পশ্চিমের যে শোষক মহল এতোদিন আওয়ামী লীগ সরকার প্রবর্তিত সংখ্যা সাম্যের বদৌলতে পূর্ব পাকিস্তানকে শ্মশানে পরিণত করেছিল, হঠাৎ তাদের টনক নড়ে গেল। পশ্চিমের এ শোষক মহলটি হঠাৎ প্রমাদ গুণল। তারা বুঝতে শুরু করলো আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব জনসংখ্যা ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব তার হাতে কেন্দ্রের একচেটিয়া ক্ষমতা অর্পণ করলো। ফলে দীর্ঘ ২৩ বছরের লুট তরাজের হিসাব-নিকাশ দিতে হবে। স্বভাবতই সে মহলের দুর্ভাবনা দেখা দিল। কেন্দ্রীয় ক্ষমতা পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানীরা এতোদিনের পাওনা কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নেবে। এ মহল আরো মনে করলো, পূর্ব পাকিস্তান থেকে নেবার মত এখন আর কিছুই নেই। এখন কেবল দেবার পালাই চলবে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে উপর্যুপরি যে হারে ঝড়-বন্যা হচ্ছে তাতে এটাকে তারা বোঝা বই আর কিছুই ভাছে না।
এ দুর্ভাবনা থেকেই উক্ত মহল যে কোনো অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে রেহাই পাবার পথ খুঁজছিল। তাদের ধারণা দীর্ঘ শোষণে রিক্ত পূর্ব পাকিস্তানকে যদি তারা নিজেরা আলাদা করতে যায়, তাহলে তাদের অভিসন্ধি ধরা পড়ে যাবে। উক্ত মহল তাই পূর্ব পাকিস্তানীদের বিভিন্ন কৌশলে বাধ্য করেছিল বিচ্ছিন্নতার কথা ভাবতে। সাধারণ নির্বাচনই এ মহলের আশার গুড়ে বালি ঢেলেছে। এ মহলের ধারণা ছিলো, কোনো দলই একচেটিয়া আসন পাবে না। শেখ সাহেবও বড়জোর শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ আসন পাবেন। তখন শেখ সাহেবকে ক্ষমতায় বসিয়েও পূর্বপাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার আদায়ের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতার পথে ঢেলে দিবে। সাধারণ নির্বাচন উক্ত মহলের এ চক্রান্ত নস্যাত করে দিয়েছে। সাধারণ নির্বাচনে একটি মাত্র দলের নিরংকুশভাবে জয়ী হবার পর পূর্ব পাকিস্তানীরা এককভাবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হবে।” [****২]
কিন্তু পত্রিকাটির এ আশাবাদ সফল হয়নি। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জনকারী পূর্ব পাকিস্তানের দল আওয়ামী লীগের হাতে অবশেষে শাসন ক্ষমতা দেয়া হলো না। পশ্চিম পাকিস্তান অঞ্চলের নেতা হিসেবে আবির্ভূত ভুট্টোর ভূমিকা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ সংঘাত ও বিচ্ছিন্নতার দিকেই নিয়ে গেল।
দুই
নির্বাচন হলো সাতই ডিসেম্বর। আট তার্যিখ সকালের মধ্যেই নির্বাচনের সবটা ফল মানুষের জানা হয়ে গেল। মানুষের প্রতিক্রিয়ার খবর জানাতে গিয়ে ৯ ডিসেম্বর সকালে ঢাকার একটি দৈনিক বললো, দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবিস্মরণীয় বিজয়ে গণমনের প্রতিক্রিয়া লিখিতভাবে প্রকাশের অবকাশ রাখে না। সংক্ষেপে এতোটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পরক্ষণ হতেই শহরের সকল মহলেই পারস্পরিক সাক্ষাত লগ্নে প্রথম সম্বোধনসূচক কথাটি হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘জয় বাংলা’। [****৩] পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দী জামায়াতে ইসলামীর নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম যদিও বললেন যে, নির্বাচনে পাকিস্তানের রাজনীতি যুক্তির চেয়ে ভাবাবেগ দ্বারাই অধিক পরিচালিত হয়েছে এবং নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শতকরা ২৫ ভাগ নির্বাচনী আইন সঠিকভাবে পালিত হয়নি, তবু তিনি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলের বিজযে তাঁকে অভিনন্দন জানালেন এবং নিশ্চয়তা দিলেন, আওয়ামী লীগ যাতে জনতাকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি মতে দেশের শাসনতন্ত্র রচনা করতে পারে এবং তার সম্ভাব্য সরকার যাতে আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে সে জন্যে আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন। [দৈনিক সংগ্রাম এবং দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ই ডিসেম্বর, ১৯৭০]
কিন্তু নির্বাচন বিজয়ী আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়াই ধীরে প্রকাশ পেল। এমন ঐতিহাসিক বিজয়ের পর বড় ধরনের কোনো সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রধান কথা বলবেন, এটাই স্বাভাবিক। একজন বিদেশী সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্নও করেছিলেন, নির্বাচনে আপনি চূড়ান্তভাবে জয়ী হয়েছেন, তবু আপনি আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করছেন না কেন? জবাবে শেষ সাহেব বলেছিলেন, আমি ১৭ই ডিসেম্বরের প্রতীক্ষা করছি। [দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ই ডিসেম্বর, ১৯৭০।] অর্থাৎ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ধীরে চলতে চাইছিলেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাড়াহুড়া করে কিছু করা বা বলার পক্ষে তিনি ছিলেন না। সম্ভবত পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের নির্বাচনের ফলাফলই এর কারণ ছিল। তিনি নিজের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের চাইতে ওপারের প্রতিক্রিয়াই হয়তো আগে চানতে চাইছিলেন।
কিন্তু মুখ বন্ধ করে থাকতে তিনি পারলেন না। ৯ডিসেম্বর তারিখে দেশী ও বিদেশী সাংবাদিকরা দলে দলে গিয়ে হাজির হলো আওয়াম লীগ অফিসে। সাংবাদিকদের কাছে কথা বলতে বাধ্য হলেন আওয়ামী লীগ প্রধান। এ অনানুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বললেন:
জনগণের সংগ্রামকে বিজয় মুকুটে ধন্য করার জন্যে আমরা আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। জনগণের যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, তাকে অভিনিন্দিত করার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে কায়েমী স্বার্থবাদীদের শোষণ এবং প্রকৃতির করালগ্রাস হতে জনগণকে রক্থার জন্যে আমাদের সকল সম্পদ ও শক্তি প্রয়োগের শপথ গ্রহণ করা। পশ্চিম পাকিস্তানে গণজাগরণের যে শুভ সূচনা হয়েছে আমরা তাকে অভিনন্দন জানাই। বাংলার জনগণের বহু বাঞ্ছিত আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে সাহায্য করার জন্যে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের জাগ্রত জনশক্তির প্রতি আহ্বান জানাই। আমাদের পক্ষ হতে আমরা আশ্বাস দিচ্ছি, সামন্ত প্রভু ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের নিষ্পেষণ হতে মুক্তির সংগ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইদের আমরা সমর্থন জানাব।
আমাদের সামনে যে বিরাট চ্যালেঞ্চ সমুপস্থিত, একমাত্র জনগণের ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই তার মুকাবিলা করা সম্ভব হবে বলে আমরা বিশ্বাস ও আশা করি। আমাদের জনগণ ভবিষ্যত বংশধরদের প্রতি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন-এ সত্যই আমাদের শক্তি ও আশারউৎস। মঞ্চিল এখনও দূরে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম আমাদের চলতেই থাকবে। ৬ দফঅ কর্মসূচীর ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসনের বিধান সহ শাসনতন্ত্র এবং তা সার্বিকভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে। [দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৭০]
এ কথাগুলো আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ লিখিত বক্তব্যের একটা অংশ। বক্তব্যের অন্যান্য অংশে তিনি জনগণের এবং আওয়ামী লীগের যারা আন্দোলন ত্যাগ-তিতিক্ষার পরিচয় দিয়েছে, জেল-জুলুম স্বীকার করেছে, জীবন দিয়েছে, তাদের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছেন। প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসাবে গোটা বক্তব্যটাই সুচিন্তিত এবং জাতীয় নেতাসুলভ। তিনি এখানে পাকিস্তানের সকল মানুষের কথাই চিন্তা করছেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান অঞ্চলের জনগণের তিনি সাহায্য চেয়েছেন এবং তাদের তিনি সহযোগিতা করতে চেয়েছেন। অবশ্য এ বক্তব্যের এক জায়গায় নির্বাচনকে ৬ দফা ও ১১ দফার রেফারেণ্ডাম বলে তিনি অীভহিত করেছেন এবং তিনি বলেছেন যে, ৬ দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণীত হবে যা নির্বাচনের ভিত্তি লিগাল ফ্রেম ওয়ার্কের বিপরীতার্থক মনে হতে পারে। লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্কটি জারি হয় ১৯৭০ সালের ৩০শে মার্চ। ৪৮টি ধারা এবং বহু উপধারা সম্বলিত এ ‘আইন কাঠামো’র মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রশ্নে প্রধান দিক-নির্দেশনাগুলো নিম্নরূপ ছিল: [বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ-দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫০২]
(এক) পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল প্রজাতন্ত্র যার নাম হবে ‘পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র’। ফেডারেশনের সাথে প্রদেশগুলো এমনভাবে অন্বিত থাকবে যাতে আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং জাতীয় সংহতি রক্ষিত হয়।
(দুই) পাকিস্তান সৃষ্টির বুনিয়াদ ইসলামী আদর্শ সংরক্ষিত থাকবে এ রাষ্ট্রে। রাষ্ট্র প্রধান হবেন একজন মুসলমান।
(তিন) গণতন্ত্রের মৌল নীতি অনুসারে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ফেডারেল ও প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নাগরকদের মৌলিক অধিকার সুনির্দিষ্ট ও সুনিশ্চিত করা হবে।
(চার) আইনগত, প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা ফেডারেল সরকার এবং প্রদেশগুলোর মধ্যে এমনভাবে বন্টিত হবে যাতে প্রদেশগুলো সর্বাধিক আইনগত, প্রশাসনিক ও আর্থিক ভোগ করতে পারেো আবার অন্যদিকে ফেডারেল সরকার যাতে আইন, প্রশাসন ও আর্থিক ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীন ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় যথেষ্ট শক্তিশালী হন তার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
(পাঁচ) পাকিস্তানের সকল অঞ্চলের মানুষ জাতীয সকল কর্মকাণ্ডে পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং একটি নির্দিষস্ট সময়ের মধ্যে প্রদেশ-গুলো এবং প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলসমূহের মধ্যকার অর্থনৈতিক সহ সকল বৈষম্য দূর হবে- এর নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
‘আইন কাঠামো’র আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের এখানে উল্লেখ করতে হয়। একটি হলো, নির্বাচনের পরে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের প্রথম দিন থেকে ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে না পারলে জাতীয় পরিষদ বাতিল বলে গণ্য হবে। অপরটি হলো, জাতীয় পরিষদের প্রণীত শাসনতন্ত্র যদি প্রেসিডেন্টের মঞ্জুরী লাভে ব্যর্থ হয় তাহলেও জাতীয় পরিষদ বাতিল হয়ে যাবে।
মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ‘আইন কাঠামো’ শুধু নয়, নির্বাচনকেই প্রত্যাখ্যান করে। মস্কোপন্থী ন্যাপ গ্রহণ-বর্জনের কোনো কথা না বলে ‘আইন কাঠামো’র ২০ ধারাভুক্ত উপরোল্লিখিত পাঁচটি বিষয়ের বাতিল দাবী করে। আওয়ামী লীগ সহ বাদ-বাকী দল ‘আইন কাঠাসো’ মেনে নেয়।[স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতপর, কামরুদ্দিন আ্হমদ, পৃষ্ঠা-৯৯ এবং জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭ থেকে ৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৪৮] কিন্তু এ সময় কথা ওঠে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের লোভেই তার ৬ দফার বিপরীত এ ‘আইন কাঠামো’ গ্রহণ করে। অভিযোগে বলা হয়, মুজিব-ইয়াহিয়া আঁতাতের কারণেই সরকার নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের ‘আইন কাঠামো’ বিরোধী তৎপরতা নীরবে মেনে চলে। [জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭ থেকে ৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৪৮।] জেনারেল ইয়াহিয়ার ‘আইন কাঠামো’ এবং আওয়ামী লীগের ৬ দফার মধ্যকার ঝগড়া পাকিস্তানের শেষ দিন পর্যন্ত টিকে ছিল। সেই ঐতিহাসিক ৬ দফায় নিম্নলিখিত ৬টি ধারা ছিল। [Bangladesh-Birth of a nation, Yatintranath Bhatnagar, pp-69, 69 এবং জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭ থেকে ৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৩৫৯]
(এক) পাকিস্তান সত্যিকার অর্থে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র হবে। সরকার পদ্ধতি হবে পার্লামেন্টারী ধরনের এবং ফেডারেল ও ফেডারেশনের ইউনিটসমূহের আইন সভা জনসংখ্যা ভিত্তিক প্রত্যক্ষ ও সার্বজনীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হবে।
(দুই) ফেডারেল সরকারে হাতে দেশ রক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় থাকবে। অন্যান্য বিষয় ন্যস্ত থাকবে ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে।
(তিন) পাকিস্তানের দুই অংশের জন্যে পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে অথবা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যবস্থাসহ দুই অঞ্চলের জন্যে একই মূদ্রা থাকবে। এতে আঞ্চলিক ফেডারেলর ব্যাংক থাকবে। এ ব্যাংকগুলো এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সম্পদ হস্তান্তর করবে এবং মূলধন পাচার বন্ধের ব্যবস্থা করবে।
(চার) ট্যাক্স ধার্য এবং আদায়ের ক্ষমতা ন্যস্ত হবে ফেডারেশনের অংগ রাষ্ট্রগুলোর উপর। অংগ রাষ্ট্রগুলোর ট্যাক্সের একটি অংশ ফেডারেল সরকারকে দেয়া হবে তার আর্থিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে। কর নীতির উপর অংগ রাষ্ট্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অভিলক্ষ্যের সাথে সংগতি রেখে ফেডারেল সরকারের রাজস্বের প্রয়োজন মিটাবার নিশ্চয়তা বিধানের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে।
(পাঁচ) ফেডারেশনের অন্তর্গত অংগ রাষ্ট্রগুলোর নিয়ন্ত্রণে প্রত্যেকটি ইউনিটের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পৃথক হিসাব রাখার শাসনতান্ত্রিক বিধান থাকবে। শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত পদ্ধতি অনুযায়ী ধার্য হারের ভিত্তিতে অংগ রাষ্ট্রগুলো ফেডারেল সরকারের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মিটাবে। ফেডারেল সরকার কর্তৃক নির্ধারিত পররাষ্ট্র নীতির কাঠামোর মধ্য থেকে আঞ্চলিক সরকারগুলোকে বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে আলোচনা ও চুক্তির ক্ষমতা শাসনতন্ত্রে দেয়া হবে।
(ছয়) জাতীয় নিরাপত্তায় কার্যকরভাবে অংশগ্রহণেল জন্যে ফেডারেশনের অংগ রাষ্ট্রগুলোকে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিশিয়া রাখার ক্ষমতা দেয়া হবে।
জেনারেল ইয়াহিয়া ‘আইন কাঠামো’ এবং আওয়ামী লীগের এই ৬ দফা উভয়ের মধ্যেই ফেডারেল সরকারের কথা আছে এবং আছে ফেডারেল সরকার ও ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের ছয় দফায় এ ভাগাভাগির ব্যাপারটা স্পষ্ট। ফেডারেল সরকার কি পাবে, ফেডারেল ইউনিটগুলোর কি কি ক্ষমতা থাকবে তা সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। জেনারেল ইয়াহিয়ার আইন কাঠামোতে তা নেই। সেখানে শক্তিশালী ও কার্যকর ফেডারেল সরকারের কথা আবেং এবং সেই সাথে আছে ইউনিটগুলোকে ‘সর্বাধিক’ ক্ষমতা দেবার কথা। সুতরাং আইন-কাঠামোতে ব্যাখ্যা এবং দর কষাকষির ফঅঁকে রয়ে গেছে। এ ফঅঁক অবলম্বন করেই ২৫শে মার্চ, ৭১, পর্যন্ত বিতর্ক চলেছৈ এবং চেষ্টা হয়েছে আইন কাঠামো এবং ৬ দফার উপর এনে সেট করতে। আর সরকার চেয়েছে আইন কাঠামো সম্পর্কে তার নিজের যে ব্যাখ্যা রয়েছে, সেই অনুসারে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন-সমস্যার সমাধান করতে। বস্তুত আওয়ামী লীগ নির্বাচনের স্বার্থে ‘আইন কাঠামো’ মেনে নিয়েছে বটে, কিন্তু ৬ দফার দাবী থেকে সে এক ইঞ্চিও সরে আসেনি। আওয়ামী লীগ তার গোটা নির্বাচনী প্রচারণা ৬ দফার ভিত্তিতেই চালিয়েছে। [জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭ থেকে ৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৪৮।] সুতরাং নির্বাচনের পরে যদি আওয়ামী লীগ প্রধান নির্বাচনকে ৬ দফার রেফারণ্ডাম বলেন এবং ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে চান তাহলে তাঁর জন্যে এটা অন্যায় নয়।
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান তার কথা রাখলেন। ১৭ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের আগে কিছুই বললেন না আর তিনি। মাঝখানে ১১ই ডিসেম্বর অবশ্য নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পশ্চিম পাকিস্তান সহ-সভাপতি বি. এ. সলিমী নির্বাচনোত্তর এক সাংবাদিক সম্মেলনে লাহোরে বললেন, দেশের সকল অঞ্চলের স্বার্থে ৬ দফা প্রণীত হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলের দাবী-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তার দল ৬ দফা কর্মসূচীতে সামান্য সংশোধনের কথা বিবেচনা করতে পারে। [পি পি আই, ১১ই ডিসেম্বর, ১৯৭০ এবং দৈনিক সংগ্রাম, ১২ই ডিসেম্বর, ১৯৭০।] নির্বাচনোত্তর কালে ৬ দফা আওয়াম লীগের প্রথম নমনীয় মনোভাবের প্রকাশ এ বক্তব্যে পাওয়া গেল। কিন্তু এ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের প্রতি আওয়ামী লীগ হেড কোয়ার্টারের তখন স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির কোনোটাই পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ হেড কোয়ার্টারের মতোই এ সময় ভুট্টোর পিপলস পার্টি নীরব ছিল। সরকারও এ সময় কিছু বলেনি। মনে হয়েছে সবাই বিবেচনা করেই কথা বলতে চায়। পার্শ্ব রাজনীতি কিন্তু এ সময় নীরব ছিল না। ৮ই ডিসেম্বর মাওলানা ভাসানী ভোলার এক জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার সর্বশেষ সংগ্রামে সকলকে শামিল হবার জন্যে আহ্বান জানালেন। [সংবাদ, ৯ই ডিসেম্বর, ১৯৭০] পরের দিন ঢাকায় তিনি একটি সাংবাদিক সম্মেলনে ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ আন্দোলনে ঘোষণা দিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের বিজয়কে স্বাধীনতার জন্যে গণভোট বলে অভিহিত করলেন। [সংবাদ, ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৭০] ১২ই ডিসেম্বরের দিকে মাওলানা ভাসানীর সাথে কণ্ঠমেলালেন কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা এ. এস. এম. সুলায়মান এবং জনাব আতাউর রহমান খানের মতো আরও কিছু নেতা। [Bangladesh-Birth of a Nation, Yatintranath Bhatnagar, p-333.] বৃটিশ প্রচার মাধ্যমও এ সময় আওয়ামী লীগ প্রধানের সাথে সাক্ষাতকারের বরাত দিয়ে এ ধরনের প্রচারণা চালায়। বৃটেনের পত্র-পত্রিকাগুলো পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলাফলকে বিচ্ছিন্নতার পক্ষে রায় বলে প্রচার করে। এমনকি বৃটেনের একটি টেলিভিশনে একথাও বলা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার দাবী যদি বিষ্ফোরণোন্মুখ অবস্থা সৃষ্টি করে, তাহলে রিলিফ কাজে নিয়োজিত মার্কিন ও বৃটিশ সৈন্য অবিলম্বে দুর্গত এলাকা ত্যাগ করবে। [দৈনিক সংগ্রাম, ১১ই ডিসেম্বর, ১৯৭০।]
এ পার্শ্ব রাজনীতি পূর্ব পাকিস্তানের মূল রাজণৈতিক ধারার কোনো ক্ষতি করতে পারলো না। মাওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, এ. এস. এম. সুলায়মান প্রমুখ নেতারা নির্বাচন বিজয়ী আওয়ামী লীগের তখনকার প্রয়াসকে বিপদগ্রস্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু লক্ষণীয় যে, নির্বাচনে (পূর্ব পাকিস্তান) দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে আবির্ভূত জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। ১৯শে ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম প্রাদেশিক নির্বাচনের রায় মেনে নিয়ে সত্যিকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাথে ষহযোগিতার কথা ঘোষণা করে বলেন, “নির্বাচনে সকল প্রকার অীনয়ম ও অসদুপায় সত্ত্বেও জনগণের রায় স্পষ্ট। জনগণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শেখ সাহেবের প্রতি তাদের যে আস্থা প্রকাশ করেছে, তাকে আমরা শ্রদ্ধা করি।[দৈনিক পাকিস্তান (পরিবর্তে দৈনিক বাংলা), ২০শে ডিসেম্বর, ১৯৭০।] তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে দেশের সংঘবদ্ধ এক বিদেশী চক্রের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এরা যে কোনো মুহূর্তে অগণতান্ত্রিক পন্থার আশ্রয় নিয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াসে লিপ্ত হতে পারে।[দৈনিক সংগ্রাম, ২০শে ডিসেম্বর, ১৯৭০]
পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক মূলধারাটি বিজ্ঞতার সাথেই সামনে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু ভুট্টোর একটি বিবৃতি নাজুক এক বিতর্কের সূত্রপাত ঘটাল। জনব ভুট্টো ২০শে ডিসেম্বর লাহোরে বললেন, ‘আমার দলের সহযোগিতা ছাড়া কোনো শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কিংবা কেন্দ্রে কোনো সরকার পরিচালনা করা যাবে না। পাঞ্চাব ও সিন্ধু ক্ষমতার দুর্গ বিশেষ। যেহেতু পিপিপি এ প্রদেশ দুটিতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লঅভ করেছে, সে কারণে যে কোনো কেন্দ্রীয় সরকারের জন্যে তার দলের সহযোগিতা অনিবার্য প্রয়োজন। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-৪৫]
জনাব ভুট্টো এ উক্তির মাধ্যমে স্পষ্টতই হুমকি দিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগকে। পশ্চিম পাকিস্তানের, যাকে তিনি ক্ষমতার দুর্গ বলেছেন, প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে শাসন ক্ষমতায় স্থান পাওয়া তাঁর যেন অধিকার। পরে এ মনোভাবটা তাঁর আরও স্পষ্টভাবে জানা গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে একমাত্র তার দলই পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষে কথা বলতে পারে। [পিপিআই পরিবেশিত খবর, দৈনিক সংগ্রাম, ২৮শে ডিসেম্বর, ১৯৭০।] অর্থাৎ জনাব ভুট্টো গণতান্ত্রিক পথ পরিহার করে পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের সামনে দাঁড় করালেন এবং নিজেকে উপস্থিত করলেন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে। এ মনোভাব পশ্চিম পাকিস্তানের যারা ভুট্টোকে তাদের স্বার্থের সর্বজয়ী বীর মনে করেছিল, তাদের খুশিই করলো। তবে সেখানকারও অনেকে এতে বিরক্ত হলো, উদ্বিগ্ন হলো। তারা বললো, তেইশ বছর ধরে আমরা তাদের (বাঙ্গালাদেশীদের) উপর আধিপত্য করেছি, এখন তাদের সময়, সবসময় তাদের সাথে প্রতারণা করা উচিত নয়। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-৪৫] আর ভুট্টোর বক্তব্য তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো পূর্ব পাকিস্তানে। আওয়ামী লীগ শাসনতন্ত্র প্রণয়নে এবং কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে একাই যোগ্য। কেউ সাহায্য করলে ভালো, সাহায্য না করলেও আওয়ামী লীগ এককভাবেই সেটা করবে। পাঞ্জাব এবং সিন্ধু কোনোভাবেই ‘ক্ষমতার দুর্গ’ হবার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতে পারে না। [***২২] অত্যন্ত কঠোর ভাষায় প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাক নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম। তিনি বলেন, জনাব ভুট্টো আগে জনৈক ডিক্টেটর কর্তৃক ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বের পরিবর্তনশীল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এখন তিনি একজন রাজনীতিবিদে পৌঁছেছেন। জনাব গোলাম আযম ভুট্টোকে গণতান্ত্রিক মনোভাব গ্রহণ করে একজন দায়িত্বশীল রাজনীতিকের মতো কথাবার্তা বলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নির্বাচনের পূর্বে জনাব ভুট্টোর ভাবধারা যাই হোক না কেন, যেহেতু তিনি এখন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়েছেন, সুতরাং এক্ষণে তাঁর গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভংগি গ্রহণ করা উচিত। [***২৩] শীঘ্রই জনাব ভুট্টোকে কিছুটা নরম দেখা গেল। ২৭শে ডিসেম্বরের করাচী সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি নরমে-গরমে মিশিয়ে বক্তব্য রাখলেন। তিনি একদিকে জানালেন, জাতীয পরিষদে তাঁর দলকে বিরোধী দলে রাখার যে কোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করবেন, অন্যদিকে তিনি বললেন, আমরা সরকারে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্টতাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং তাদের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করছি।’ এই সাথে কেন্দ্রকে দুর্বল না করে শাসনতন্ত্রে সমস্ত প্রদেশকে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন দানে জনাব ভুট্টোর সম্মত হবার কথাও জানা যায়। [দৈনিক সংগ্রাম ২৮শে ডিসেম্বর, ১৯৭০, নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৪৬ এবং দৈনিক পাকিস্তান, ২৯শে ডিসেম্বর, ১৯৭০।] ২৮শে ডিসেম্বর সংবাদ সংস্থা এপিপি আরেকটি সুসংবাদ পরিবেশন করে। খবরটিতে বলা হয়, আগামী মাসের প্রথম দিকে জনাব ভুট্টোর ঢাকা সফরের পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকায় তিনি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাত করবেন এবং তাঁর সাথে দেশের পাঁচটি প্রদেশের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলনকারী একটি শাসনতন্ত্র তৈরির সম্ভাব্যতা সম্পর্কে আলোচনা করবেন। [দৈনিক সংগ্রাম ২৮শে ডিসেম্বর, ১৯৭০]
জনাব ভুট্টোর এই এগিয়ে আসা পূর্ব পাকিস্তানের শুভ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো। ঢাকায় আওয়ামী লীগ প্রধান শেষ মুজিবুর রহমান বললেন, আইন সভায় নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়া সত্ত্বেও আমি বলতে পছন্দ করি না যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য প্রতিনিধিদের স হযোগিতা চাই না। অবশ্যই আমরা এটা চাই। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-৪৬।]
মুজিব-ভুট্টোর মধ্যে এ বাক্য বিনিময়ের পর মনে হলো, শাসনতন্ত্র প্রশ্নে ৬ দফা এবং ‘আইন কাঠামো’ কাছাকাছি হওয়ার বোধহয় একটা সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ ভুট্টো রাজি হলে ইয়াহিয়া বা সরকার গররাজি থাকবে না সবাই তা জানে। তাই সকলেই আশা করলো, ঢাকায় মুজিব-ভুট্টো সাক্ষাত পরিস্থিতির জটিলতা সহজ করবে, সমাধানকে ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু শীঘ্রই এ আশাবাদে বিরাট ছেদ নামলো। ৩রা জানুয়ারী আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান করলো। লক্ষ লক্ষ লোকের এ সমাবেশে শেখ মুজিব দীর্ঘ ভাষণ দেন। ভাষণে শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘৬ দ ফা আজ জনগণের ম্যাণ্ডেট লাভ করেছে। ভবিষ্যতে শাসনতন্ত্র তাই ৬ দফা ভিত্তিতেই রচিত হবে। আওয়ামী লীগ আজ শুধু বাংলাই প্রতিনিধিত্ব করছে না। সমগ্র পাকিস্তানেসর সংখ্যা গুরু দল। তাই সমগ্র দেশ শাসনের অধিকার আমাদেরই। নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আমরা যে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো, তাই পাকিস্তানের জনগণ গ্রহণ করবে। শাসনতন্ত্রের পথে কউ বাধা সৃষ্টি করলে চরম সংগ্রাম শুরু হবে।’ এ বক্তৃতাই শুধু নয়, এ বিষয়ের উপর শপথ গ্রহণ করা হয়। এ শপথ গ্রহণের ভাষা ছিল এ রকম:
“আমরা জাতীয ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় নবনির্বাচিত সদস্যবৃন্দ শপথ গ্রহণ করিতেছি পরম করুণাময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার নামে ছয় দফা ও এগার দফা কর্মসূচীর উপর প্রদত্ত সুস্পষ্ট গণরায়ের প্রতি আমরা একনিষ্ঠরূপে বিশ্বস্ত থাকিব এবং শাসনতন্ত্রে ও বাস্তব প্রয়োগে ছয় দফা কর্মসূচী ভিত্তিক স্বায়ত্বশাসন ও এগার দফা কর্মসূচীর প্রতিফলন ঘটাইতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করিব।” [দৈনিক সংগ্রাম, ৪ঠা জানুয়ারী, ১৯৭১।]
ছয় দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আওয়ামী লীগের এ ঘোষণা নতুন নয়। একথা সে নির্বাচনের আগেও বলেছে, পরেও বলেছে। তবে সকলে মিলে আল্লাহর নামে শপথ গ্রহণ এই প্রথম। আল্লাহর শপথ যেহেতু, তাই একে স্বাভাবিকভাবেই আলাদা দৃষ্টি দেখার কথা। সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে এ ব্যাপারটা কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকাস্থ পাক সেনাবাহিনীর একজন অফিসারর কথায়। তিনি বলেছেন, ‘মনে হলো আমরা আবার চতুষ্কোণ পরিসরে এসে দাঁড়িয়েছি। আওয়ামী লীগ এবং তার নির্বাচিত সদস্যরা ছয় দফার ব্যাপারে শপথ নিয়ে প্রকাশে নিজেদের বেঁধে ফেললেন। দেয়া-নেয়ার যাবতীয আশার সুতো যেন ছিন্ন হয়ে গেল।’ [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৪৬] লক্ষণীয় একটা ব্যাপার হলো, শেখ মুজিবের এ কঠোর সিদ্ধান্ত ঘোষণার কোনো প্রতিক্রিয়া ভুট্টোর কাছ থেকে এলো না। ভুট্টো ২৮শে জানুয়ারীর আগে মুখ খুললেন না। সরকারকেরও নীরব দেখা গেল। কছু বলার চেয়ে এ না বলাটাই বেশী মারাত্মক মনে হলো। শেখ মুজি তাঁর ৩রা জানুয়ারীর শপথ-সমাবেশেই নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ইয়াহিয়ার কর্মচারীদের একাংশ নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।’ সন্দেহ নেই এ ধরনের ষড়যন্ত্র তখন থাকলে শেখ মুজিবের ৩রা জানুয়ারীর সিদ্ধান্ত তাকে আরও জোরদার হবারই সুযোগ করে দিল। ৪ঠা জানুয়ারী ছিল তার ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ছাত্র লীগের সম্মেলনে শেখ মুজিবকে কথা বলতে হয়। ৩রা জানুয়ারী তিনি যা বলেছিলেন, তাঁর চেয়েও বেশী কিছু বলার প্রচণ্ড চাপ এলো তার উপর। কিন্তু ছাত্রদের এ চাপ এড়িয়ে গিয়ে তিনি তাদের বুঝালেন, যদি প্রয়োজন পড়ে আমি ডাক দেব, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৪৭।] আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের এ বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্ট কোনো কথা নেই, কিন্তু নিজেদের সিদ্ধান্তের উপর অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কথা এখানে পুর্ণব্যক্ত হয়েছে। আর ‘আমি ডাক দেব’ কথার মধ্যে কেউ নতুন হুমকির সন্ধান পেতে পারেন।
এ পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণের ঠিক এক সপ্তাহ পর ১১ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা এলেন। বিমান বন্দরেই সাংবাদিকরা তাঁকে ছেঁকে ধরলো। তিনি অনেক প্রশ্নের জবাব দিলেন। প্রশ্নগুলোর সবই ছিল পরিস্থিতির বিভিন্ন দিকের উপর। তিনি যা বললেন, তার সারাংশ হলো: ‘আইনগত কাঠামো অনুযায়ী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্যে ১২০ দিনের প্রয়োজন এবং তিনি আশা করছেন এটা দশ দিনের ভেতরও হতে পারে। তা নির্ভর করছে নির্বাচিত সংসদের উপর। আইনগত কাঠামো নির্দেশ ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা স্কীম। ক্ষমতা হস্তান্তরের সব পদ্ধতি এর উপরই নির্ভর করছে।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ১২ই জানুয়ারী, ১৯৭১।] ইয়াহিয়া খানের কথাগুলোর মধ্য দিয়ে বুঝা গেল শাসনতন্ত্র আইনগত কাঠামোর ভিত্তিতে হতে হবে এবং তা হতে হবে ১২০ দিনের মধ্যেই। তার পরেই হতে পারে ক্ষমতা হস্তান্তর। অর্থাৎ আইন কাঠামোর মূল কথা। প্রেসিডেন্তট ইয়াহিয়ার এ সংক্রান্ত আরও কঠোর মনোভাবের প্রমাণ পাওয়া গেল তাঁর আর একটি কথায়। জনৈক সাংবাদিক প্রেসিডেন্ট এখনো আইনগত কাঠামো নির্দেশের উপর দৃঢ় কিনা জিজ্ঞেস করলে জেনারেল ইয়াহিয়া বলেন, যদি আমি ক্ষমতা হস্তান্তর করবো না বলে আমার মনোভাব পরিবর্তন কর থাকি, তাহলে আইনগত কাটামো নির্দেশ থাকবে না। [দৈনিক সংগ্রাম, ১২ই জানুয়ারী, ১৯৭১।] প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়ার একথার পরিষ্কার অর্থ হলো, আইনগত কাঠামো না মানলে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। এদিন আরেকটা মজার কথা বলেন জেনারেল ইয়াহিয়া। শাসনতন্ত্র তৈরির ব্যাপারে শেখ মুজিব, ভুট্টো এবং প্রেসিডেন্টের মধ্যে কোনো ত্রিদলীয় সম্মেলন হবে কিনা জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন, তাদের নিজেদের মধ্যেই আলোচনা হতে পারে। আমি কেউ না, আমি কোনো আলাদা শক্তি নই।[দৈনিক সংগ্রাম, ১২ই জানুয়ারী, ১৯৭১।] এখানে জেনারেল ইয়াহিয়া ‘আমি কোনো আলাদ শক্তি নই’ বলে নিজেকে সম্ভবত তিনি জনাব ভুট্টোর সাথে সম্পৃক্ত করেছন। ভুট্টো রাজী হলে তিনিও রাজী। তাই তিনি তাদের দুজনের আলোচনার কথা বলেছেন। একথা যদি সত্য হয়, তাহলে ‘আইনগত কাঠামো’ বড় কথা নয়, বড় কথা হলো ভুট্টোর একমত হওয়া।
শেখ মুজিব এবং জেনারেল ইয়াহিয়া ১২ই জানুয়ারী সকালে প্রেসিডেন্ট৬ ভবনে আলোচনা শুরু করলেন দুজন দুই প্রান্তিক মনোভাব নিয়ে। দু ঘন্টা আলোচনা হলো। শেখ মুজিবের সাথে কেউ ছিলেন না। ইয়াহিয়ার সাথে ছিলেন প্রেসিডেন্টের মুখ্য স্টাফ অফিসার জেনারেল পীরজাদা এবং গভর্ণর আহসান। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব সাংবাদিকদের জানালেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও জাতীয় সমস্যা নিয়ে তিনি প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা করেছেন। তাঁদের আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে। [দৈনিক সংগ্রাম, ১৩ই জানুয়ারী, ১৯৭১।] পরদিন ১৩ই জানুয়ারী দ্বিতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হলো। এ দিন শেখ মুজিবের সাথে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহমদ, জনাব মনসুর আলী, জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং জনাব কামারুজ্জামান। এদিনও শেখ মুজিব বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। তিনি জানালেন, পরিষদের অধিবেশনের সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে প্রেসিডেন্টের সাথে তাঁর আলোচনা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কেও তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে এবং আলোচনায় তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন।[দৈনিক সংগ্রাম, ১৪ই জানুয়ারী, ১৯৭১।] উল্লেখ্য, এ বৈঠকেই ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠানেও রাজী হন। ১৪ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। বিমান বন্দরে জেনারেল ইয়াহিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের উভয়ের মধ্যকার বৈঠক সম্পর্কে যা বলেছেন, তা সম্পূর্ণ ঠিক। আলোচনা করে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমান শীঘ্রই তাঁর সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। তিনি পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী।’[দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ই জানুয়ারী, ১৯৭১।] করাচী পৌঁছেও ইয়াহিয়া খান অনুরূপ কথাই বলেন। সেখানে সাংবাদিকদের তিনি জানান, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের সাথে তাঁর আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে, শেখ সাহেবও আলোচনায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আলোচনা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে এবং ইনশাআল্লাহ আমরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারবো। [[দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ই জানুয়ারী, ১৯৭১।]]
মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার উপরোক্ত বিবরণে মূল সমস্যা অর্থাৎ আইন-কাঠামো এবং ৬ দ ফার মধ্যকার সমন্বয় সংক্রান্ত কোনো কথা না থাকলেও শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার কথাবার্তা থেকে বুঝা যায়, তাদের সন্তোষজনক আলোচনা হয়েছে এবং পরিস্থিতিরও উন্নতি ঘটেছে। বিশেষ করে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলা এবং জাতীয় পরিষদের বৈঠক ঢাকায় অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে আলোচনায় কোনো সংকট সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় প্রচারিত এটাই প্রকৃত চিত্র নয়। এ সুন্দর বহিরাংগের আড়ালে আরেকটা দৃশ্য আছে যা নয়ন সুখকর নয়। মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনায় উপস্থিত পূর্ব পাক গভর্ণর এডমিরাল আহসানের বরাত দিয়ে পাক সেনাবাহিনীর একজন অফিসার আলোচনার যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা এই : ইয়াহিয়া, পীরজাদা এবং আহসান আলোচনার এক পাশে বসলেন। অন্য পাশে বসলেন মুজিব, খন্দকার মোশতাক, তাজউদ্দীন এবং অন্যান্য সহকর্মী। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মুজিবই কথা বললেন বেশী। তাঁর ৬ দফাকে তিনি এক এক করে তুলে ধরলেন। প্রত্যেকটা দফা ব্যাখ্যার পর তিনি বললেন, ‘দেখুন এর মধ্যে আপত্তিজনক কিছু নেই। এখানে খারাপ কি আছে? এটা অত্যন্ত সরল।’ ইয়াহিয়া এবং তাঁর সাহায্যকারীরা শুধু শুনলেন। জেনারেল ইয়াহিয় মাঝে-মধ্যে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। কিন্তু মুজিব অত্যন্ত চমৎকারভাবে তাঁকে হটিয়ে দিলেন। সবশেষে ইয়াহিয়া বললেন, ‘আমি আপনার ছয় দফা গ্রহণ করছি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এর বিরুদ্ধবাদী মতামত দারুণ প্রবল। পশ্চিম পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে আপনার এগুতে হবে।’ মুজিব সাথে সাথে বললেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানকে আমাদের সাথে নিয়েই এগুবো। আমরা তাদের সাথে পরামর্শ করবো। আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করবো। আমরা ছয় দফার ভিত্তিতেই সেটা তৈরি করবো। এর মধ্যে কোনো গলদ থাকবে না।’ ইয়াহিয়া খান তাঁর পুরু ভ্রূ জোড়া নাচিয়ে বিদেশী সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলেন এবং চুপচাপ রইলেন। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-৪৭।]
মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার আরেকটা চিত্র পাওয়া যায় তদানীন্তন কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব জি. ডব্লিউ. চৌধুরীর কাছ থেকে। তিনি প্রেসিডেন্টের সফর সঙ্গী ছিলেন। তিনি জানান, ‘যে মুহূর্তে (মুজিব ইয়াহিয়া মিটিং শেষ হলো, সেই মুহূর্তে) প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে ডাক এলো ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করার জন্যে। আমি তাকে হতাশাব্যঞ্জক অবস্থায় দেখলাম। তাঁর মন ছিল বিতৃষ্ণ। তিনি আমাকে বললেন, ‘মুজিব আমাকে ডুবিয়ে দিয়েছে। যারা তার ব্যাপারে আমাকে হুঁমিয়ার করে দিয়েছিল, দেখছি তারাই ঠিক। আমি এ লোকটিকে বিশ্বাস করে ভুল করেছি।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি মুজিবকে নির্বাচনের আগে দেয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন?’ ইয়াহিয়া জবাব ছিল মনস্তাপমূলক। বললেন, ‘আপনি এবং আমি কেউ রাজনীতিক নই। তাঁদের মন ও চিন্তাধারা আমার পক্ষে বুঝা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবু আসুন আমরা ভালোর জন্যে আশা পোষণ করতে পারি এবং প্রার্থনা করতে পারি। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-৪৮।]
মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার উপরোক্ত অন্তর-চিত্র সন্তোষজনক আলোচনার বহিদৃশ্যকে মিথ্যা প্রমাণ করলো। ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের ছয় দফা গ্রহণ করেননি, বরং তাঁকে প্রতিশ্রুতি ভংগকারী হিসেবে ধরে নিয়েছেন। নির্বাচনের আগে শেখ মুজিব তাঁকে কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বলা মুশকিল। হয়তো শেখ মুজিব আইন কাঠামো (L.F.O). মেনে নিয়ে নির্বাচনের পর ৬ দফা থেকে সরে আসতে চেয়েছিলেন। এখন শেখ মুজিব ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে চাওয়ায় তিনি রুষ্ট হয়েছেন। গভর্ণর আহসানের দেয়া তথ্য থেকে আরেকটা জিনিসও পরিষ্কার হচ্ছে, ইয়াহিয়া আসলে কোনো ফ্যাক্টর নয়। পশ্চিম পাকিস্তান অর্থাৎ ভুট্টোর ইচ্ছা-অনিচ্ছাই হলো আসল ব্যাপার। প্রশ্ন হলো, ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের ৬ দফা গ্রহণ করার কথা বলেছিলেন কেন? হয়তো তিনি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবকে বোকা বানাতে অথবা তাঁকে এক মিথ্যা সন্তোষ্টিতে ভরে রাখতে চেয়েছিলেন।
ইয়াহিয়াকে শেখ মুজিব কি সে দিন বুঝেছিলেন? মনে হয় না। ইয়াহিয়া তার ৬ দফা গ্রহণ করায় তিনি খুশীই হয়েছিলেন। ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের সম্মতিও তাঁকে আনন্দিত করেছিল। তবে একথা তিনি নিশ্চয় বুঝেছিলেন, ৬ দফা গ্রহণ করা বা না করার আসল সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে ভুট্টোর উপর। সুতরাং গ্রহণ করা বা না করার আসল সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে ভুট্টোর উপর। সুতরাং সমস্যা যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে। এরপরও ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা শেষে তিনি সরল সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন এ জন্য যে, তিনি ইয়াহিজয়ার মনের কথাটা জানতেন না, দ্বিতীয়ত তিনি হয়তো মনে করেছিলেন ইয়াহিয়াকে তিনি তাঁর কথা বুঝাতে পেরেছেন এবং তৃতীয়ত তিনি আন্তরিকভাবে সমস্যার সমাধান চাইছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা থেকে করাচী গিয়ে সেখানে একদিন থাকলেন। তারপর চলে গেলেন লারকানায় ভুট্টোর বাড়ীতে। ঢাকাতেই সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, তিনি ঢাকা থেকে ফিরে লারকানা অঞ্চলে যাবেন পাখি শিকারে, সেখানে ভুট্টোর সাথেও দেখা হবে। আসলে পাখি শিকারের ব্যাপারটা ছিল একটা বাহানা। প্রেসিডেন্টের প্রোগ্রাম এভাবেই ঠিক হয়েছিল যে, তিনি ঢাকায় মুজিবের সাথে আলোচনা করেই দেখা করবেন ভুট্টোর সাথে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, আলোচনার ফলাফল ভুট্টোকে অবহিত করা।
ইয়াহিয়া ১৭ই জানুয়ারী ভুট্টোর সাথে তাঁর লারকানার বাড়ীতে আলোচনা করলেন। কি আলোচনা হয়েছিল তা কোনো দিনই জানা যাবে না। তবে এ ব্যাপারে ভুট্টো তাঁর বইতে একটা বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ঢাকা থেকে ফিরে এসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর কয়েকজন উপদেষ্ট সহ ১৭ই জানুয়ারী লারকানা শঞরে আমার বাড়ীতে আসেন। ঢাকা আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেন। ঐ আলোচনায় তিনি মুজিবুর রহমানকে বলেন যে, ‘আওয়ামী লীগের জন্যে তিনটি বিকল্প পথ খোলা আছে, যথা, এককভাবে চলার চেষ্টা করা, পিপলস পার্টির সাথে সহযোগিতা করা অথবা পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ও পরাজিত পার্টিসমূহের সহযোগিতা নেয়া এবং তাঁর মতে উত্তম হচ্ছে দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়া। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা ছয় দফার ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এতদসত্ত্বেও আমরা তাঁকে আশ্বাস দিয়েছি যে, অবস্থার উন্নতির জন্যে আমরা যে কোনো ধরনের প্রচেষ্টা নিতে স্থির প্রতিজ্ঞ। [The great Tragedy : Z. A. Butto]
লারকানায় ভুট্টো-ইয়াহিয়া যে সলাপরামর্শ হয়েছিল, তার মাত্র দু একটা কথাই এখানে ভুট্টোর কথার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তবু এ থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার যে, ভুট্টোর সাথে শেখ মুজিবের আপোস করার মধ্যেই সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে। অবশ্য ইয়াহিয়ার কথায় পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ও পরাজিত দলগুলোর সাথে শেখ মুজিবের সহযোগিতাকেও একটা বিকল্প হিসেবে পেশ করা হয়েছে। কিন্তু এটা ছিল কথার কথা। ভুট্টো যেখানে নিজেকে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্থাপন করেছে, সেখানে এ বিকল্পের অবকাশ কোথায়! মনে পড়ে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের পাঁচ দিন পর ১৩ই ডিসেম্বর ঢাকার একটি পত্রিকা তার এক ভাষ্যে এ বিকল্পের কথাই লিখেছিল। বলেছি, ‘দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের প্রশ্নে শেখ সাহেবকে পশ্চিম পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য একটি অংশের সমর্থন পেতে হবে। সে ক্ষেত্রে হয় জনাব ভুট্টো সাহেবের সাথে, নয় তো তাঁর বিরোধী দলগুলোর সাথে তাঁকে হাত মেলাতে হবে। ভুট্টো সাহেবকে যেহেতু উক্ত স্বার্থান্বেষী (যারা ২৩ বছর ধরে পূর্বে পাকিস্তানকে শোষণ করার জন্য দায়ী) চক্রের সমর্থনে পশ্চিম পাকিস্তানর নেতৃত্ব পেতে হয়েছে তাই তিনি তাদের স্বার্থের প্রশ্নে কোনোরূপ আপোষ করতে রাজী হবেন না। এ অবস্থায় কেবল ভুট্টো বিরোধী দলগুলোই শেখের কাছে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য হবে। [দৈনিক সংগ্রাম, ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭০।] আসলে এ বিকল্পটিই ছিল সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে সহজ উপায়। কিন্তু ভুট্টো সাহেব তা হতে দেননি। যাই হোক, ইয়াহিয়া-ভুট্টো বৈঠককে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভালো চোখে দেখা হয়নি। অনেকই একে ‘লারকানা ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৪৯।] বিশেষ করে এ আলোচনার সময় হঠাৎ করে সেখানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদের উপস্থিত হওয়াকে সবাই অর্থপূর্ণ দৃস্টিতে দেখেছেন। এছাড়া সংখ্যালঘু দলের নেতার বাড়ীতে গিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সংখ্যাগুরুদলের নেতাকে বঙ্গভবনে ডেকে পাঠিয়ে আলোচনাকে সংখ্যাগুরু দলের নেতার প্রতি অপমান বলেও মনে করা হয়েছে। প্রকৃতই বিষয়টি একেবারে এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়।
২৭শে জানুয়ারী ভুট্টো এলেন ঢাকায়। ইয়াহিয়ার সাথে লারকানা বৈঠকেই প্রকাশ পেয়েছিল ভুট্টোর এ ঢাকা আগমনের কথা। সন্দেহ নেই তিনি ঢাকা এসেছিলেন তাঁর মত ও এবং ইয়াহিয়ার মতের সমন্বিত একটা যোগফল নিয়ে। ঢাকা বিমান বন্দরে ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেলেন, শাসনতন্ত্র রচনা করতে হলে দেশের সকল অংশের নেতৃবৃন্দের একটি বিশেষ ঐকমত্যে পৌঁছা একান্ত কর্বত্য। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মতামত সম্পর্কে তাদের সাথে বসে খোলাখুঠি আলাপ করার মন নিয়েই তিনি এখানে এসেছেন। সাম্প্রতিক নির্বাচনে দেশের দু অংশের বিজয়ী প্রতিনিধিরা জনগণের কাছ থেকে ম্যাণ্ডেট লাভ করেছে। ফলে তাদের কাঁদে অপরিসীম দায়িত্বের বোঝা চেপেছে। জনগণের আস্থার তারা অশ্রদ্ধা করতে পারেন না। [দৈনিক সংগ্রাম, ২৮শে জানুয়ারী, ১৯৭১।]
ভুট্টোর বিমান বন্দরের কথার দ্বারা বুঝা গেল নিজের জন্যে নির্দিষ্ট একটা অবস্থান স্থির করেই ভুট্টো ঢাকা এসেছেন। জনগণের ম্যাণ্ডেট লাভ করার কারণে শেখ মুজিব যদি ৬ দফা থেকে কিছু ছাড় দিতে না পারেন তাহলে তিনিও পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের ম্যাণ্ডেট থেকে এক ইঞ্চিও সরে আসবেন না।
২৭শে জানুয়ারী তারিখেই শেখ মুজিবের ধানমণ্ডীস্থ বাসভবনে শেখ মুজিবের সাথে ভুট্টোর প্রথম দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হলো। ৭৫ মিনিট আলোচনা শেষে দুই নেতা বেরিয়ে সাংবাদিকদের জানালেন, আমরা সবে আলোচনা শুরু করেছি। আমরা তা চালিয়ে যাবো। [দৈনিক সংগ্রাম, ২৮শে জানুয়ারী, ১৯৭১।] পরের দিন আলোচনা হলো হোটেল ইন্টর কন্টিনেন্টালস্থ ভুট্টোর স্যুটে। এদিন দুই নেতা অপেক্ষামান সাংবাদিকের কোনো সুখবর দিতে পারলেন না। ৭০ মিনিট ব্যাপী আলোচনা শেষে দু নেতা বেরিয়ে এলেন। শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বললেন আমাদের আলোচনা চলছে এবং আগামীকালও চলবে। আমরা দেশের সকল সমস্যা নিয়েই আলাপ করছি।’ শেখ মুজিবের সাথে ভুট্টোও বললেন, তাদের আলোচনার ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। অনেক আলোচনাই শেষ হয়েছে। আলোচনায় যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এ দিনই সাংবাদিকদের কাছে ভুট্টো ইংগিত দিলেন যে, তিনি পর দিন অর্থাৎ ২৯শে জানুয়ারী ঢাকা ত্যাগ করছেন। তিনি সাংবাদিকদের আরও জানান, এ সময়ের মধ্যে আলোচনা সমাপ্ত করার সম্ভব না হলে তিনি আবার ঢাকায় আসবেন। [দৈনিক সংগ্রাম, ২৯শে জানুয়ারী, ১৯৭১।] ভুট্টোর এ কথায় বুঝঅ গেল আলোচনার অবস্থা ভালো নয়। অগ্রগতির কথা ভুয়া। পরদিনই এ ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। সময়টা ২৯শে জানুয়ারীর বিকেল। প্রায় ১ ঘন্টাকাল স্থায়ী রুদ্ধদ্বার আলোচনা শেষে দুই নেতা বেরিয়ে এলেন। এই ছিল শেষ দফার বৈঠক। আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে দুই নেতার কাছ থেকে কোনো যৌথ ঘোষণা এলো না। পৃথকভাবে তারা কথা বললেন সাংবাদিকদের সাথে। শেখ মুজিব জানালেন, ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার ব্যাপারে জনতার কাছে আওয়ামী লীগ যে প্রতিজ্ঞা করেছে, সে কথা তিনি ভুট্টোকে বুঝিয়েছেন। আর ভুট্টো বললেন, শেখ সাহেবের ভূমিকা ও ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার ব্যাপারে তাঁর দৃঢ়তাকে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে তাঁর দলের সাথে আলাপ করবেন। [দৈনিক সংগ্রাম, ৩০শে জানুয়ারী, ১৯৭১।]
নেতাদ্বয়ের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হলো, তাদের আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি তারা জাতীয পরিষদ বৈঠকের তারিখের ব্যাপারেও একমত হতে পারেননি। সাংবাদিকদের কাছে শেখ মুজিব যখন বললেন যে, তিনি ১৫ই ফেব্রুয়ারী জাতীয় পরিষদ ডাকার জন্যে প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেছেন। এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ভুট্টো সাথে সাথেই বললেন, শীগগিরই জাতীয় পরিষদ ডাকার ব্যাপারে তাঁর দল আগ্রহান্বিত, কিন্তু তা ১৫ তারিখেই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আবার ভুট্টো ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তাড়াহুড়ো করে ডাকা সাংবাদিক সম্মেলনে এমন কথা বললেন যা সাময়িকভাবে আলোচনার পথও যেন বন্ধ করে দিল। তিনি বললেন, আওয়ামী লীগের ৬ দফার দুই দফা এবং তিনটি ছাত্র দলের ১১ দফার ১০ দফা তিনি মানেন। [দৈনিক সংগ্রাম, ৩০শে জানুয়ারী, ১৯৭১।]
২৭শে জানুয়ারী থেকে ২৯শে জানুয়ারী পর্যন্ত ভুট্টো-মুজিবের মধ্যে তিন দফায় মোট ২০৫ মিনিট আলোচনা হয়। আলোচনায় কি কথোপকথন হয়েছিল, আলোচনা কোন্ কথায় কিভাবে ব্যর্থ হলো, তা জানার কোনোই উপায় নেই। তবে ছিটেফোঁটা কিছু জানা যায় সংশ্লিষদের দু একজনের কথা থেকে। আলোচনা সম্পর্কে পরবর্তীকালে ভুট্টো বলেছেন: ‘১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসের ২৭ তারিখে পিপল্স পার্টির নেতারা ঢাকায় এলেন। আমাদের আলোচনায় আমরা লক্ষ্য করলাম, শেখমুজিবুর রহমান তার ছয় দফার ব্যাপারে অনমনীয়। আমাদের সোজাসুজি বললেন, তিনি ছয় দফার প্রশ্নে জনগণের কাছ থেকে ম্যাণ্ডেট লাভ করেছেন। সুতরাং এর থেকে এক ইঞ্চিও তাঁর সরে আসা সম্ভব নয়। আমাদের অবস্থা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আমরা আওয়ামী লীগ সভাপতিকে বললাম, আমরা ছয় দফার প্রশ্নে কোনো ম্যাণ্ডেট লাভ করিনি। আমরা কিছু শাসনতান্ত্রিক বিষয়াবলী উপস্থাপন করলাম। কিন্তু অখণ্ডভাবে যতক্ষণ ছয় দফাকে গ্রহণ না করা হচ্ছে, ততক্ষণ আওয়ামী লীগ নেতারা পরবর্তী কোনো আলোচনায় যেতে অস্বীকৃতি জানালেন। আমরা মুজিবুর রহমানকে জানালাম যে, দেশের পশ্চিমাংশের জনগণ ছয় দফা বিরোধী। বললাম, ছয় দফার নিশ্চিত ফল হচ্ছে পাকিস্তান শেষ হয়ে যাওয়া। এবং আমাদের মতামত হচ্ছে, জনগণের ধারণাও আমাদের থেকে দূরে নয়। আওয়ামী লীগ নেতা আমাদের অসুবিধাগুলো উপলব্ধি করলেন, কিন্তু এগুলো গ্রহণে রাজী হলেন না।’[The Great Tragedy, Z. A. Butto] মুজিব-ভুট্টো আলোচনা সম্পর্কে অন্য একটি চিত্র পাওয়া যায়। শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মিঃ রেহমান সোবহানের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, মিঃ ভুট্টো জানুয়ারীমাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা এসেছিলেন। মুজিবের সাথে তাঁর সরাসরি বৈঠক হয়। এরপর তাঁর দলের ‘শাসনতন্ত্র’ বিষয়ক টীম আওয়ামী লীগের ‘শাসনতন্ত্র’ বিষয়ক টীমের সাথে বসেন। আলোচনা চলতে থাকাকালে সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, পিপিপি কোনো শানতান্ত্রিক খসড়া তৈরি করেনি। শুধু ইয়াহিয়া আগে যেমন করেছিলেন, তেমনি ৬ দফাকে পরিপূর্ণভাবে বুঝার চেষ্টা করেছেন। এ অবস্থা আনুষ্ঠানিক সমঝোতার বিষয়কে অসম্ভব করে তুললো। কেননা, দূরত্ব কমিয়ে বিকল্প অবস্থান সন্নিবেশ অপরিহার্য।’ [Negotiontion for Bangladesh Rahman Sobhan, A participants, Vies, The south East Asia Revies, London, July, 1971.] অধ্যাপক জি ডব্লিউ চৌধুরীর বরাত দিয়ে পরিবেশিত আকেরটি বিবরণে আমরা পাই: ‘ভুট্টো ও তাঁর দল ঢাকা এলেন ২৭শে জানুয়ারী। এ দুজন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা হিসেবে যাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে, তাঁদের আলোচনা পর্যবেক্ষণের জন্য ছিলাম। সংলাপ বিনিময় হয়েছিল তিন দিন। কিন্তু পারস্পরিক আপোসহীনতার কারণে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি। আমি বিভিন্ন উৎস থেকে জেনেছিলাম যে, মুজিব ভুট্টোকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, তিনি ৬ দফার কেনোই অদল-বদল করতে প্রস্তুত নন। অন্যদিকে ভুট্টোও জানিয়ে দেন যে, তিনি এ পরিকল্পনার ছদ্মাবরণে বিচ্ছিন্নতাবাদি সমর্থন করবেন না।’ [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৫০।]
উপরোক্ত তিনটি বিবরণের মধ্যে ভুট্টো ও জি ডব্লিউ চৌধুরীর বক্তব্য একই রকম, নতুন কোনো তথ্য এগুলোতে নেই। কিন্তু মিঃ রেহমান সোবহান নতুন তথ্য দিয়েছেন। ভুট্টো শুধু ৬ দফা বুঝতে এসেছিলেন, কোনো বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে আসেননি যা সমঝোতা আলোচনার জন্য প্রয়োজন। এ থেকে বুঝা যায়, ইয়াহিয়ার মতো ভুট্টো চেয়েছেন শেখ মুজিবকে ৬ দফা থেকে সরাতে, কিন্তু তাঁর বিবেচনার জন্য কোনো বিকল্প পরিকল্পনা আনেননি। এর অর্থ কি এই যে, মুজিব সম্পর্কে তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এবং তাঁদের সফরগুলো ছিল নিছকই শেখ মুজিবকে বেশী বেশী পরখ করার জন্যে?
ইয়াহিয়ার সফরের মতো ভুট্টোর সফল পাকিস্তানের সামরিক সরকার ও ভুট্টোর সাথে শেখ মুজিবের সম্পর্কের অবনতিই ঘটাল। শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা ব্যর্থ হবার পর আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতার আশা সুদূর পরাহত হয়ে দাঁড়াল। এ অবস্থায় সমঝোতায় আসতে বাধ্য করার লক্ষ্যে অধিকতর হার্ড লাইনের দিকে ঝুঁকে পড়া আওয়ামী লীগের জন্যে অবধারিত হয়ে পড়লো। এ সময়ই ঘটল একটি ভারতীয যাত্রীবাহী বিমান হাইজ্যাক করে লাহোরে নিয়ে যাবার ঘটনা। ৩০শে জানুয়ারী, ’৭১, মোঃ হাশেম কোরেশী এবং মোঃ আশরাফ নামক জম্মু ও কাশ্মীর ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্য বলে পরিচয় দানকারী দুজন কাশ্মীরী যুবক ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে লাহোর ইয়ারপোর্টে নিয়ে যায় এবং তাদের ছত্রিশজন আটক সহকর্মীর মুক্তি দাবী করে। ২রা ফেব্রুয়ারী বিমানটি তারা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। এ ঘটনা পাকিস্তানে তুমুল বিতর্ক এবং নতুন সংকটের সৃষ্টি করে। ভুট্টো বিমান ছিন্তাই-এর ঘটনা সমর্থন করেন, অন্যদিকে শেখ মুজিব একে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেন। কিন্তু ঘটনার ফল দাঁড়ায় এই যে, ভারত সরকার তার দেশের উপর দিয়ে সকল প্রকার পাকিস্তানী বিমান চলাচল বন্ধ করে দিল।
অনেকেই বিমান ছিনতাই এবং তা ধ্বংসের ঘটনাকে পুরোপুরি একটা ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করলো। ভারতীয় কাশ্মীর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ সাদিক ছিনতাইকারীদের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে জানালেন, মোহাম্মদ হাশেম কোরেশী একজন ডবল এজেণ্ট এবং ভারতীয় কাশ্মীর সরকার কয়েক মাস আগেই ছিনতাই পরিকল্পনা কোরেশীর কাছ থেকে জেনেছিলেন। কিন্তু ভারতরে কেন্দ্রীয় সরকারের এক এজেন্সীর আশ্রয়ে থাকায় কাশ্মীর সরকারের পক্ষে ছিনতাইকারী কোরেশীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। [জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৬২।] কাশ্মীরের ভারতীয় মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য যেহেতু আমরা অবিশ্বাস করতে পারি না, তাই ধরে নিতে পারি ছিনতাই ষড়যন্ত্রের সাথে ভারত যুক্ত ছিলো। ভুট্টো যেভাবে ছিনতাইকারীদের সাথে কথা বলেন, তাতে তাদের প্রশ্রয় দেয়া বুঝায় এবং যেভাতে তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা হয়, তাতে ভুট্টোকেও ষড়যন্ত্রের সাথে শামিল করা হয়। ষড়যন্ত্রের ফল এ দাঁড়ালো যে, মুজিব ও ভুট্টোর মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়লো এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগের পথে একটা বাধার প্রাচীর খাড়া হলো। এক্ষেত্রে ভারতের সাথে কোনো যোগাযোগ কি ভুট্টোর ছিলো? তিনি কি যুক্ত পাকিস্তানে ক্ষমতা লাভের প্রশ্নে হতাশ হয়ে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সবকিছু ভণ্ডুল করে দিতে চাচ্ছিলেন? প্রশ্নগুলোর জবাব তখন কেউই পায়নি। আরেকটা জিনিস লক্ষণীয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের সকল দায়িত্বশীল মহলই বিমান ছিনতাইকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে অশুভ দৃষ্টিতে দেখেছে, এর মধ্যে ষড়যন্ত্রে একটা আলামত তারা লক্ষ্য করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দল জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম বিমান ছিনতাই-উদ্ভূত পরিস্থিতির উপর প্রদত্ত তাঁর দীর্ঘ বিবৃতির উপসংহারে বলেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, একমাত্র জনগণের সরকারই দেশের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমস্যাবলীর সুষ্ঠু মুকাবিলা রতে পারে। এমনকি ‘ফিল্ড মার্শালও’ ফারাক্কা ও কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সুতরাং বর্তমান সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত যেন কোনো কিছুই শাসনতন্ত্র তৈরি ও জনগণের সরকার গঠনের পথে বিলম্বের সৃষ্টি করতে না পারে। [দৈনিক সংগ্রাম, ৬ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১।] বিমান ছিনতাই-এর ঘটনা ক্ষমতা হস্তান্তরকে বিলম্বিত করার ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রেখেছিলো কিনা তা সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ সাদিকের তথ্য ফাঁস এবং ভারতের উপর দিয়ে পাকিস্তানের সকল প্রকার বিমান চলাচল বন্ধের ঘটনাকে পাকিস্তানের শাসক মহল শেখ মুজিবের ব্যাপারে অধিকতর সাবধান হওয়ার একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে নিতে পারে যা ক্ষমতা হস্তান্তর প্রয়াসকে বিলম্বিত বা সংকটাপন্ন করা স্বাভাবিক। বিমান ছিনতাই ষড়যন্ত্রের সার্থকতা এখানেই।
মুজিব-ভুট্টো আলোচনার ব্যর্থতা পূর্ব পাকিস্তানের চিন্তাশীল মহলকে হতাশ করে দিলো। পাকিস্তানের অস্তিত্ব সম্পর্কেই তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। একথা তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ধরা পড়লো যে, উভয় অঞ্চলের মধ্যে অবিশ্বাসের এক বিরাট ফাটল। এ ফাটলই মুজিব ও ভুট্টোকে কাছে আসতে দিচ্ছে না। সংখ্যা গরিষ্ঠ, অথচ বঞ্চিত পূর্ব পাকিস্তানীদের অবিশ্বাস ছিলো বাস্তব। কিন্তু ভুট্টোদের অবিশ্বাস ছিলো তাদের অন্যায় স্বার্থভিত্তিক। এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রবীন সাহিত্যিক ও রাজনীতিক এবং আওয়ামী লীগ সরকারের এককালীন মন্ত্রী জনাব আবুল মনসুর আহমদ ভুট্টোর ঢাকা ত্যাগের ১ দিন পরই এক দীর্ঘ বিবৃতিতে সমস্যা সমাধানের একটা পথ বাতলালেন। তিনি দেশের দু অংশে দুটি রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রস্থাপনের প্রস্তাব পেশ করে বললেন, ‘নিজ নিজ এলাকায় থেকে দেশের দু অংশের জনসাধারণ যাতে সমভাবে তাদের সার্বভৌমত্ব ভোগ করতে পারে সেজন্যে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা উচিত। পাকিস্তান শুধুমাত্র একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থাতেই টিকে থাকতে পারে। এতে থাকতে হবে ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন আসনসহ আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমতা বিধানের ভিত্তিতে ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে একটি নয়া ক্ষমতা সাম্য। এ মৌলিক নীতির ভিত্তিতেই শেখ মুজিবুর রহমান ও জনাব ভুট্টোর শাসনতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করা উচিত। দেশের শোষণকারী অংশের প্রতিনিধিত্বকারী জনাব ভুট্টোর প্রতি আমি আবেদন জানাচ্ছি, পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতারা কেন পূর্ব-পশ্চিম সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁকে তা বুঝতে হবে।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১।]
কিন্তু ভুট্টো ও ভুট্টোর দল এসব আবেদন-নিবেদন কিছুই বুঝতে চাননি। গঠনমূলক কোনো পরিকল্পনা প্রস্তাব নিয়ে এগুবার পরিবর্তে তারা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে, এমন বিবৃতি-বক্তব্য অব্যাহত রাখলেন। লাহোরে জনাব ভুট্টোর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পাঞ্জাবের নবনির্বাচিত জাতীয ও প্রাদেশিক সদস্যদের যুক্ত বৈঠক শেষে পিপলস পার্টির মুখপাত্র মিয়া আরিফ ইফতিখার বললেন, ‘আওয়ামী লীগের ছয় দফা শাসনতন্ত্র রচনার পথে বাধা স্বরূপ। আওয়ামী লীগ যদি ৬ দফার ব্যাপারে অটল থাকে, তাহলে শাসনতন্ত্র তৈরি কঠিন হয়ে পড়বে।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ৩রা ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১।] এ বিবৃতি প্রকাশের ৮ দিন পর এর চেয়ে গুরুতর কথার বোমা ফাটালেন জনাব ভুট্টো। তিনি ১০ই ফেব্রুয়ারী মুলতানে নবনির্বাচিত সদস্যদের সম্মেলন ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার ব্যাপারে শেখ মুজিব ও সরকারের মধ্যে একটি ‘পরিকল্পনা’র অস্তিত্ব সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করে বললেন, দেশের শাসনতন্ত্র ৬ দফার ভিত্তিতে রচিত হলে তিনি সেই শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করবেন।’ [***৫৪] জনাব ভুট্টোর এ বক্তব্য যে ইয়াহিয়া সরকারকে আরো বাগে আনার জন্যে একটা চাপ ও হুমকি তা বলাই বাহুল্য।
জনাব ভুট্টোরা যখন পশ্চিম পাকিস্তানে এ রকম তর্জন-গর্জন করেছিলেন, তখন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নীরব ভূমিকা পালন করছিলো। ভুট্টোর সাথে আলোচনা শেষ হওয়ার সময় থেকে ১৪ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত শেখ মজিব অথবা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে কোনো বিতর্কমূলক বক্তব্যই রাখা হয়নি। এটা নিশ্চয় এজন্যে যে, শেখ মুজিব পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে চায়নি। জনাব ভুট্টোর ১৪ তারিখের আক্রমণাত্মক ও উস্কানিমূলক বক্তব্যের পরেও শেখ মুজিব তার কোনো জবাব দেননি। আওয়ামী লীগ এ সময় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বানের জন্যে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। শেখ মুজিব জাতীয পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত তারিখ নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন ১৫ই ফেব্রুয়ারী। এ লক্ষ্যেই তিনি চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন।
কিন্তু ১৫ তারিখেই বৈঠক ডাকা হলো না। ১০ ফেব্রুয়ারী ভুট্টো ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে এবং ৬ দফার বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেবার পর ১১ তারিখেই ইসলামাবাদে ইয়াহিয়ার সাথে তাঁর দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠকে কি আলোচনা হয়, তা কোনো দিনই হয়তো দিনের আলো দেখবে না। তবে এ আলোচনার দুদিন পর প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে একটা বড় ধরনের ঘোষণা পাওয়া গেলো। ৩ মার্চ তিনি জাতীয পরিষদের বৈঠক আহ্বান করলেন ঢাকায়। এটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়লো সব মহলে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে। অগ্রগতির একটা ধাপ তো রাখা হলো!
১৫ ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগের জাতীয ও প্রাদেশিক নির্বাহী কমিটির সদস্যসহ নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের একটি যুক্ত অধিবেশন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হলো। প্রায় দু সপ্তাহের নীরবতার পর শেখ মুজিব এ অধিবেশনে দীর্ঘ ভাষণ দিলেন। পত্র-পত্রিকা তাঁর এ ভাষণকে নীতি নির্ধারণী ভাষণ হিসেবে অভিহিত করলো। তিনি অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় বললেন, আমরা জাতির সাথে ওয়াদাবদ্ধ আছি ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র তৈরি করার জন্যে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের নয়, সারা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ৬ দফার পক্ষে রায় দিয়েছে। পরিষদের অধিবেশনে অন্যান্য দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও যদি শাসনতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে ৬ দফা কর্মসূচী গ্রহণ করেন তবেই পাকিস্তানের জনগণ ভাই ভাই হিসেবে বসবাস করতে পারবে। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলে সংখ্যাগুরু প্রতিনিধিদের মতামতই মানতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতাই গণতন্ত্রের চূড়ান্ত কথা। আর যারা তা মানতে চায় না, তাদের থেকে ফ্যাসিবাদের গন্ধ পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ ৬ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং একে কোনো শক্তিই রোধ করতে পারবে না।’ এ বক্তৃতায় শেখ মুজিব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর সাবধানবানী উচ্চারণ করেন তিনি বরেন, ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্ত এখনও শেষ হয়নি। তাদের এতো সাহস নির্বাচনের ঐতিহাসিক ফলাফলের পরও ষড়যন্ত্র করছে। যারা ষড়যন্ত্র করছে, তারা জানে না যে, তারা আগুন নিয়ে খেলা করছে। [দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আওয়ামী লীগের এ যুক্ত বৈঠক যখন চলছিলো, তখন পশ্চিম পাকিস্তানে পেশওয়ারে ভুট্টো এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি সেখানে বলছিলেন, ৬ দফা প্রশ্নে আপোসের নিশ্চয়তা না পেলে তার দলের সদস্যরা আগামী ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের বৈঠকে যোগ দেবে না। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের বদলে শাসনতন্ত্র গ্রহণের জন্যে তার দল ঢাকা যাবে না। কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্র সকল প্রদেশের মতামত গ্রহণ অপরিহার্য। আপোস ও সমঝোতার ব্যাপারে তাঁকে নিশ্চয়তা দেয়া হলে তিনি আজই ঢাকা যেতে প্রস্তুত। [দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১] এর একনি পর করাচীর সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে পিপলস পার্টির সদস্যদের কোনো অংশ বা বক্তব্য লাগবে না, সে শাসনতন্ত্র অনুমোদন করার জন্য পিপলস পার্টির সদস্যরা ঢাকা সফর করতে পারেন না। এই সাথে তিনি নতুন এবং মজার যুক্তির অবতারণা করে বললেন, ‘পাকিস্তানের প্রতি ভারতের যুদ্ধাংদেহী মনোভাব পশ্চিম পাকিস্তানে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। লাহোর সীমান্ত ও নিকটবর্তী এলাকাসমূহে ভারতীয় বাহিনীর তৎপরাত শুরু হয়েছে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরও মারাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্যে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। এসব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পিপলস পার্টির ৮৫ জন সদস্যের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকা সফর করা মোটেই সাধারণ ব্যাপার নয়, বরং বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের জনগণের সাথে থাকাই সর্বপ্রথম দায়িত্ব। পশ্চিম পাকিস্তানের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এবং স্বার্থান্বেষী মহলের ভয়ে শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর আলাপ-আলোচনার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তান আসতে পারবেন না বলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জানিয়েছেন। স্বার্থান্বেষী মহল থেকে কোনো ভয়ের আশংকা থাকলে পিপলস পার্টির উপরও তা সমভাবে প্রযোজ্য। আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতায় আসার ব্যাপারে তাঁর দল সাধ্যমত চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগের সাথে পুনরায় আলাপ-আলোচনার অবকাশ এখন আর নেই।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১] জনাব ভুট্টোর জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ না দেয়া এবং অন্যান্য বক্তব্য আওয়ামী লীগকে অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ করলো এবং পাকিস্তানের উভয় অংশে তীব্র প্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি করলো। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী বললেন, ‘পরিষদের বাইরে শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধান করতে চাওয়া এবং পরিষদের অধিবেশনে যোগদানে অস্বীকৃতির মাধ্যমে এ সন্ধিক্ষণে এক শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার সৃষ্টির উদ্যোগ ভুল পদক্ষেপ। সঠিক পন্থা হচ্ছে, নির্বাচিত গণপ্রনিধিরা পরিষদের অধিবেশনে অংশ গ্রহণ করবেন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সব দলই পরিষদে তাঁদের নিজস্ব শাসনতান্ত্রিক খসড়া উপস্থাপন করবেন এবং শাসনতান্ত্রিক খসড়ার যেসব অংশ রাষ্ট্রের ইসলামী চরিত্র দেশকে ঐক্য ও সংগতি গণতান্ত্রিক মূলনীতি, মৌলিক অধিকার এবং প্রতিটি অঞ্চলে সমানাধিকার ও অর্থনৈতিক সুবিচারের মূলনীতির অনুকূল, তা গ্রহণ করা হবে এবং যেসব অংশ এসব মূলনীতির অনুকূল নয়, তার অবশ্যই বিরোধিতা করতে হবে। এরপরেও যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল শুধু তার সংখ্যাধিক্যের জোরেই তা গ্রহণ করার জন্য চাপ প্রদান করে, তাহলে এ ধরনের শাসনতন্ত্র গৃহীত হলেও এটা সাফল্যজনক কিছু হবে না এবং পরিণতি সম্পর্কে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সম্পূর্ণ দায়ী থাকবে। [দৈনিক সংগ্রাম, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১] অনুরূপ ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন পশ্চিম পাকিস্তানের মুফতী মাহমুদ, চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মাওলানা সিদ্দিক আহমদ, নূরুল আমীন, অধ্যাপক গোলাম আযম প্রমুখ নেতাগণ।
৩ মার্চের জাতীয় পরিষদে যোগদান সম্পর্কি ভুট্টোর বক্তব্য প্রকাশ হবার পর ১৯ ফেব্রুয়ারী প্রেসিডেণ্টর সাথে ইসলামাবাদে তাঁর বৈঠক হয়্ বৈঠক পাঁচ ঘন্টা চলে। বৈঠক শেষে ভুট্টো বললেন, ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে আওয়ামী লীগের সাথে সহযোগিতা করতে তাঁর দল রাজী আছে, তবে মুদ্রা, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং কর-এর ব্যাপারে ‘কিছু আপোস মীমাংসা’ করতে হবে। তিনি আবার শেখ মুজিবের সাথে বৈঠকে মিলিত হতে রাজী আছেন। জাতীয় পরিষদে যোগদান করা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করা সংক্রান্ত পূর্ব সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয়।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ২০ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১] পরদিন ২০ ফেব্রুয়ারী করাচীতে ওয়েস্ট পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেণ্ট প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত পিপলস পার্টির জাতীয ও প্রাদেশিক পরিষদের সভায় পরিষদ সদস্যরা ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে দলীয় মনোভাবে অটল থেকে স্বেচ্ছায় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের পদত্যাগপত্র পার্টির চেয়ারম্যানের কাছে পেশ করার ঘোষণা দেয়। সম্মেলনে পিপলস পার্টির মুখপাত্র জনাব আবদুল হাফিজ পীরজাদা বলেন, পরিষদের সদস্যপদ থেকে সম্ভাব্য পদত্যাগের বিষয়ে সদস্যরা পার্টির চেয়ারম্যানকে পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়ে দিয়েছে। [দৈনিক সংগ্রাম, ২১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১] এখানে উল্লেখ্য যে, পিপলস পার্টির এ সিদ্ধান্ত ঘোষণার দিনই সরনকার ‘আইন কাঠামো’ সংশোধন করে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রথম অধিবেশনের পূর্বে সদস্যদের পদত্যাগের অধিকারের প্রতি আইনগত স্বীকৃতি দেয়া হয়। এ সংশোধনের ব্যাপারটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা, না ভুট্টো-ইয়াহিয়ার কোনো যোগ-সাজশের ফল তা বলা মুশকিল। তবে সংশোধনটি সংকটকে আরও জটিল করারই পথ খুলে দিলো।
জনাব ভুট্টোর দল আট ঘাট বেঁধে যখন ৩ ফেব্রুয়ারীর জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বয়কট করা এমনকি অধিবেশনের আগে সবাই মিলে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলে পশ্চিম, পাকিস্তানের ছোট ছোট দলগুলো ভুট্টোর দলের তীব্র বিরোধিতা করলো। কাউন্সিল মুসলিম লীগ, মারকাযী জমিয়তে উলামায়ে পাকিস্তান, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি), জামায়াতে ইসলামী, কনভেনশন মুসলিম লীগ, কাইয়ুম মুসলিম লীগ এবং স্বতন্ত্র সদস্য মিলে সদস্যদের মোট সংখ্যা ছিলো ৫৭ জন। এর মধ্যে কাইয়ুম মুসলিম লীগের ৯জন সদস্য ছাড়া অবশিষ্ট সকলেই ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের কথা ঘোষণা করলো। সংকট সম্পর্কে কথা প্রায় একই রকম, যা মাওলানা মওদূদীর বক্তব্য থেকে আগেই জানা গেছে (শাসনতন্ত্র ব্যাপারে ভিন্মত থাকলে তা আলোচনার উপযুক্ত জায়গা পরিষদ কক্ষই)। এছাড়া খান ওয়ালি খান বললেন, ‘নির্বাচন নিজেই শাসনতন্ত্রের ব্যাপারে একটি রায় এবং বর্তমান অবস্থায় অতি ব্যাখ্যার বাড়াবাড়ি এ রায়কেই বানচাল করে দেবে।’ কাউন্সিল মুসলিম লীগের মিয়া মমতাজ দৌলতানা বললেন, ‘ছয় দফা এবং সব ব্যাপারেই আলোচনার জায়গা জাতীয় পরিষদ।’ আর কনভেনশন মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী বললেন, ‘ভোটদাতাদের রায়কে আমাদের সম্মান করতে হবে।’ মারকাযী জমিয়তে উলামায়ে পাকিস্তান-এর মাওলানা সিদ্দিক আহমদের কথা ছিলো, ‘ভুট্টোর কোনো শর্ত আরোপ চলবে না।’ [Bangladesh-birth of a nation, yatindra Bhatnagar, Page- 101-102.]
পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট দলগুলো জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের প্রতি সমর্থন ঘোষণার পর ভুট্টোর সাথে থাকলো মাত্র কাইয়ুম মুসলিম লীগ। দুই দলের মোট সদস্য সংখ্যা ৯৭ যা মোট সদস্য সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও কম। কিন্তু এরপরেও অবস্থা উন্নতির দিকে না এসে অবনতির দিকেই গড়াল।
৩ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ না দেয়া সংক্রান্ত ভুট্টোর ঘোষণার দিন দুয়েক পর, সম্ভবত ১৯ ফেব্রুয়ারী তারিখে জেনারেল ইয়াহিয়া তাঁর বেসামরিক মন্ত্রিসভা ভেংগে দিলেন। দেশ পুরোপুরি সামরিক নিয়ন্ত্রণেই আবার ফিরে এলো। এরও দুদিন পর ২২ ফেব্রুয়ারী ইসলামাবাদে জেনারেল ইয়াহিয়া সামরিক ও সামরিক আইন প্রশাসকদের এক সম্মেলন আহ্বান করলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে গভর্ণর ভাইস এডমিরাল আহসান এবং পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি জেনারেল ইয়াকুবের ডাক পড়লো ইসলামাবাদে। এমন সম্মেলন আহ্বান তাঁদেরকেও উদ্বিগ্ন করেছিলো। তাঁরা ইসলামাবাদে যাবার আগে সহকর্মীদের নিয়ে সলা-পরার্শে ব সলেন। জেনারেল ইয়াকুব বললেন, মিঃ ভুট্টো তাঁর বক্তব্য নমনীয় করেছেন। যদি মুজিব কিংবা প্রেসিডেন্ট তাঁর মতামত গ্রহণ করার আশ্বাস দেগন, তাহলে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে তিনি যোগদান করবেন। জেনারেল ইয়াহিয়া তাঁর নিজের কথাকে কার্যকর করার জন্যে লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক দ্বারা নিজেকে সজ্জিত রেখেছেন। আর যদি অচলাবস্থা অব্যাহত থাকে, তাহলে এ অনিবার্যভাবে সামরিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাবে এবং সেটা হবে বিপর্যকর। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণ দলিল, সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-৫২]
এ গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যাবার আগে জেনারেল ইয়াকুব ও এ্যাডমিরাল আহসান শেখ মুজিবের সাথে দেখা করলেন। তাঁদের আলোচনায় বর্তমান সংকটের কথা উঠলো। শেখ মুজিবও পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধবান করছিলেন। তিনি তাঁদের আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘ছয় দফা আপোসমূরক।’ [নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিল, সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-৫২] শেখ মুজিবের এ বক্তব্য আন্তরিক ছিলো না তা নয়, কিন্তু জেনারেল ইয়াকুম কিংবা এডমিরাল আহসান কেউ-ই তাঁর একথার উপর আস্থা রাখতে পারেননি। কারণ শেখ মুজিবের প্রকাশ্য ঘোষণা ছিলো তাঁর এ বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত।
১৫ ফেব্রুয়ারীর বক্তব্যের পর শেখ মুজিব পরিস্থিতির উপর উল্লেখযোগ্য আর কোনো কথা বলেননি। ২০ তারিখ মধ্যরাতে শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত সমাবেশে তিনি দেশবাসীকে ঘরে ঘরে প্রস্তুত থাকার জন্যে আহ্বান জানালেন। বললেন, ৫২তে যে ষড়যন্ত্রের শুরু সেই ষড়যন্ত্র আজও অব্যাহত রয়েছে। [দৈনিক সংগ্রাম, ২১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১] পরদিনও শেখ মুজিব তাঁর বাসভবনের সামনে শ্লোগানমুখর, বিক্ষুব্ধ অনেক খণ্ড মিছিলের সমাবেশে বললেন, ‘৭ কোটি বাঙালীর দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অপ্রতিহতগতিতে চালিয়ে যেতে হবে। আন্দোলনের চরম মুহূর্তে কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা বা অনিয়মতান্ত্রিক পদক্ষেপ নেয়া যাবে না।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ২২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১।] লক্ষণীয়, শেখ মুজিবের এ উক্তিগুলোতে আন্দোলনের কথা আছে, কিন্তু ৬ দফা সম্পর্কে এমন কথা নেই যা পরিস্থিতি উন্নয়নের প্রতিকূল হয়।
ইসলামাবাদে আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক ও সামরিক গভর্ণরদের নিয়ে ইয়াহিয়া কি সলাপরামর্শ করলেন, তার পুরো চিত্রটা কোনো দিনই দিনের আলোর মুখ দেখবে না। জেনারেল ইয়াকুব এবং এডমিরাল আহসান ফিরে এলেন। তাঁরা ফিরে আসার পর ঊর্ধতন সামরিক অফিসারদের মধ্যে যে কথাটা ছড়িয়ে পড়লো, তার সারাংশ হলো এই: মুজিবকে আরেকটি সুযোগ দেয়া হবে তার উদ্দেশ্যের সততা প্রমাণের জন্যে। অন্যথায় সারিক আইনের পুনঃ প্রত্যাবর্তন ঘটবে এবং চিরাচরিত ধারা অনুযায়ী। [নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিল, সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-৫২] সরকারের এ মূলনীতি অনুসারে দু ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য ছিলো। এক, শেখ মুজিবের সাথে রাজনৈতিক সংলাপের নতুন উদ্যোগ নেয়া, দুই, সামরিক নিয়ন্ত্রণের জন্যে সারিক পরিকল্পনা গ্রহণ।
কিন্তু দেখা গেল শেখ মুজিবের সাথে কেন্দ্রীয়ভাবে রাজনৈতিক সংলাপের কোনো উদ্যোগ নেয়া হলো না। অবশ্য স্থানীয়ভাবে গভর্ণর আহসান শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা শুরু করলেন। শেখ মুজিবের সাথে গভর্ণর আহসানের কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। গভর্ণর আহসান তাঁকে বুঝালেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে গ্রহণযোগ্যতার জন্যে আপনাকে ছয় দফার অবস্থঅন থেকে নেমে আসা উচিত। আপনি ছয় দফা প্রচারকালে বলেছেন, এটা পূর্ব পাকিস্তানের কাছে যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের কাছেও তেমনি। কিন্তু পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ এর চরম বিরুদ্ধে। অতএব আপনার এমন পদক্ষেপ নেয়া উচিত যা উপরোক্ত মনোভাবকে ধুয়ে-মুছে দিতে পারে।’ এ্যাডমিরাল আহসানের কথানুযায়ী মুজিব তেমন পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৫২] কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দলীয় কার্যালয়ে আহূত সাংবাদিক সম্মেলনে ৬ দফা সম্পর্কে যা বললেন, তা এ আশ্বাসের কথা প্রমাণ করে না। তিনি বললেন, ‘৬ দ ফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার জন্য জনগণ তাঁর দলকে ম্যাণ্ডেট দিয়েছে এবং সে ম্যাণ্ডেট বাস্তবায়নের তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর উপর ছয় দফা চাপিয়ে দেয়া হবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলো যদি বাংলাদেশের সমপরিমাণ স্বায়ত্বশাসন না চায় অথবা কেন্দ্রের হাতে কতিপয় অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকার ব্যাপারে স্বীকৃতি জানায় কিংবা কতিপয় আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করে, তবে ৬ দফা কর্মসূচী আদৌ অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না। ছয় দফা সতর্কভাবে পরীক্ষা করার পর তাতে কোনো ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। ….. কেন্দ্র কর্তৃক কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থে বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদশিক সাহায্য এবং বৈদেখিম কুদ্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের উপর উপনিবেশবাদী শোষণ চালান হয়েছে এবং সকল সম্পদ দেশের অন্য অঞ্চলে পাচার করা হয়েছে। এ পটভূমিকায় কেন্দ্রের হাতে বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক ঋণের ক্ষমতা থাকলে তাতে শুধু জাতীয় সংহতি বিপন্ন হবে তা নয়, বরং কেন্দ্র কর্তৃক বাংলাদেশকে শোষণের পথ নিশ্চিত করবে। প্রদেশ থেকে সমান প্রতিনিধিত্ব সম্পন্টন একটি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পরিষদের প্রস্তাব একটি প্রকৃত ফেডারেশনের জন্য কার্যকরী মডেলতো নয়ই। বরং বাংলাদেশে উপনিবেশবাদী শোষণ জিইয়ে রাখার একটি অনিষ্টকর প্রয়াস মাত্র। [দৈনিক সংগ্রাম, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
শেখ মুজিব ছয় দফার ব্যাপারে কোনো আপোস না করা এবং এর উপর অটল থাকার কথা আবার এভাবে পুনর্ব্যক্ত করলেন। সেই সাথে তিনি ভুট্টোর পিপলস পার্টির সর্বশেষ সুপারিশকেও প্রত্যাখ্যান করলেন। ভুট্টোর পিপলস পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ২২ ফেব্রুয়ারী তাদের করাচী বৈঠকে সংবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত নিম্নলিখিত সুপারিশ পেশ করেছিলো: ‘(১) ফেডারেল সরকার এবং কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় সংস্থা প্রত্যেকটি ফেডারেটিং ইউনিটের সমান প্রতিনিধিত্ব পাবে। (২) আন্তঃপ্রদেশ ও আন্তঃআঞ্চলিক শোষণ বন্ধ করার নিমিত্ব সুষম মুদ্রা ও কর ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হবে। (৩) ভায়াবল (Viable) কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার প্রয়োজনে ফেডারেল সরকার কর আরোপ ও আদায় করবে। (৪) বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য ফেডারেল সরকারাধীন থাকবে এবং (৫) প্রদেশগুলোর মধ্যে পণ্যদ্রব্য ও চলাচলের অবাধ অধিকার থাকবে।’ [জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫ অলি আহাদ পৃষ্ঠা-৪৬৫।] শেখ মুজিব তাঁর ২৪শে ফেব্রুয়ারীর সাংবাদিক সম্মেলনে ৬ দফার প্রশ্নে অটল থাকার ঘোষণা সহ ভুট্টোর দলের এ সুপারিশগুলোরই জবাব দেন এবং তাদের কয়েকটি সুপারিশ ও প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
শেখ মুজিবের এ সাংবাদিক সম্মেলনের বিবরণ প্রকাশিত হলো ২৫ ফেব্রুয়ারীর কাগজে। ২৬ তারিখেই ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে করাচীর প্রেসিডেন্ট ভবনে আলোচনায় বসলেন। বৈঠক চললো চার ঘন্টা। যা আলোচনা হলো তার কিছুই জানা গেলো না। তবে বৈঠকের একদিন পর ২৮ ফেব্রুয়ারী ভুট্টো লাহোরের জনসভায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে স্থগিত রাখা অথবা একশ’ শি দিনের মধ্যে সংবিধান রচনার সময়সীমা প্রত্যাহার করার দাবী জানালেন। তিনি হুমকি দিলেন, নারী সদস্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টা চালালে [নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের ১৩জন নারী সদস্যের জন্য সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ২রা মার্চ ধার্য করা ছিলো এবং ১লা মার্চ ঢাকায় রিটানিং অফিসার সমীপে নমিনেশন পেপার জমা দেয়ার জন্য প্রার্থীদের বলা হয়েছিলো।] খাইবার থেকে করাচী পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালন করা হবে এবং পিপলস পার্টির কোনো সদস্য পরিষদ অধিবেশনে যোগ দিলে তাকে নিশ্চিহ্ন করা হবে। [জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫ অলি আহাদ পৃষ্ঠা-৪৬৬।] মনে করা হয়, ভুট্টোর এসব জ্বালাময়ী কথা, দাবী ও হুমকি সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট দলগুলোর ৩৫জন সদস্য ৩ রা মার্চের জাতীয় পরিষদের বৈঠকে যোগ দেয়ার জন্যে ঢাকায় এলেন।
পরিস্থিতির স্রোত তখন কিন্তু অন্যদিকে বইতে শুরু করেছে। শেখ মুজিবের ২৪ ফেব্রুয়ারীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গবর্ণর আহসানের সাথে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সংলাব ব্যর্থ হবার পর জেনারেল ইয়াকুব তাঁর স্টাফদের সামরিক প্রস্তুত গ্রহণের নির্দেশ দেন। সবুজ সংকেত পাওয়া মাত্রই যাতে দ্বিতীয বিকল্প সামরিক পদক্ষেপ নিতে সেনাবাহিনী এগিয়ে যেতে পারে গোপনে তার প্রস্তুতি চললো। ২৭ ফেব্রুয়ারী থেকে পিআইএ বিমানে ২৭ বালুচ এবং ১৩ ফ্রণ্টিয়ার্স ফোর্সের সৈন্যরা ঢাকায় আসতে শুরু করলো। ১লা মার্চ পর্যন্ত এ সৈন্য আমদানির কাজ চলে। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৫৩] যদিও বাঙালী সামরিক অফিসারদেরকে এ আয়োজন ও ব্যবস্থার সবকিছু থেকে দূরে রাখা হয়েছিলো, কিন্তু কিছুই গোপন থাকলো না। বিমান বন্দরের অধিকাংশ কর্মচারীই বাঙালী। তাদের চোখের সামনে দিয়েই শত শত সৈন্য প্রতিদিন আসছে। তাদের মারফতে সব খবর ছড়িয়ে পড়লো।
স্বাভাবগতই এ খবর আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো। তারা উদ্বিগ্ন হলো। আওয়ামী লীগ চাপ দিচ্ছিলো ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্রের জন্যে, অন্য কোনো পরিস্থিতি সে চায়নি যা জনগণের রায়কে বানচাল করে দিতে পারে। কিন্তু সেই আশংকাই তার সামনে প্রকট হয়ে উঠলো। এ সময় রাজনৈতিক মহলের একটি ধারণা হিসেবে সংবাদপত্রে খবর বেরুলো যে, ৩ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আবার পিছিয়ে যেতে পারে। [দৈনিক সংগ্রাম ২৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১] অন্যদিকে কাউন্সিল মুসলিম লীগের ৭জন সদস্য এবং কাইয়ূম মুসলিম লীগের ৯জন সদস্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের ব্যাপারে ভুট্টোকে সমর্থন করায় ভুট্টোর হাত আরও মযবুত হলো, তার জেদ আরও বেড়ে গেল। সবকিছু মিলে চারদিক থেকে উদ্বেগজনক অনিশ্চয়তার এক অন্ধকার যেন নেমে আসছিলো। এ সময় পাকিস্তানের একজন প্রবীণ রাজনৈতিক মাওলানা মওদূদী এক তারবার্তায় শেখ মুজিবের কাছে আবেদন জানালেন এভাবে: ‘গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনা জাতিকে সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে এবং সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান মর্মান্তিক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে চরম সতর্কতা গ্রহণ করা প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশত যদি পরিষদের অধিবেশন মুলতবি হয়ে যায় অথবা অন্য কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তবে আল্লাহর ওয়াস্তে পুনঃ অবনতি থেকে পরিস্থিতিকে রক্ষা করুন।’ [দৈনিক সংগ্রাম ২৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১] অর্থাৎ সংকটজনক অবস্থার অনুভূতি সবখানে সব চিন্তাশীলের মধ্যেই সমানভাবে অনুভূত হচ্ছিল। এ অবস্থায় শেখ মুজিব সুবিবেচনারই পরিচয় দিলেন। তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। [নিয়াজীর আত্মসর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৫৩] এ চেষ্টার গোটাই চলেছে পর্দার অন্তরালে যার কোনো কিছুই পত্রিকায় প্রকাশ হয়নি। এ পর্দার অন্তরালের কিছু বিবরণ মেলে সে সময় সেনাবাহিনীর গণসংযোগের জন্যে দায়িত্বশীল একজন সেনা-অফিসারের জবানবন্দীতে। তিনি বলছেন, “২৫ ফেব্রুয়ারী একটি প্রভাবশালী বাংলা দৈনিকের সম্পাদক আমাকে টেলিফোন করলেন। তাঁর সাথে একটি জরুরী বৈঠকে বসার জন্যে জোরাজুরি করতে থাকলেন। আমি জানতাম যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের উচ্চ পর্যায়ে তিনি খুব ঘনিষ্ট। সুতরাং ভাবলা, বিষয়টি সর্বশেষ পরিস্থিতি সংক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আমি সকাল এগারটায় তাঁর অফিসে গেলাম। সেখানে তিনি দুজন ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আওয়ামী লীগ নির্বাহী পরিষদের সদ্য ছিলেন ঐ দুই ব্যক্তি। এ খবর অবশ্য আমি পরে জেনেছি। তাঁরা বললেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে দ্রুত ঢাকায় আসতে বলতে হবে। আমি বললাম, ‘দুঃখিত, আমি প্রেসিডেন্টের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করি না।’ তাঁরা বললেন, ‘কিন্তু সর্বোচ্চ পর্যায়ে আপনি আমাদের বক্তব্য পৌঁছে দিতে পারেন। বিষয়টি অতীব জরুরী।’ এরপর তাঁরা জানালেন, যদি প্রেসিডেন্ট আসেন, তাহলে আওয়ামী লীগ তার সফরকে সম্মানিত করবে পর্যাপ্ত পরিমাণ সুবিধা দান করে।’ তাঁরা বললেন, ‘প্রকাশে আমরা ছয় দফার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবো। আসলে ভেতরে কিছু সংশোধনী আনবো যা আপনাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।; তাঁরা তাদের কথার বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য জানান, মুজিবের অনুমোদন নিয়েই তাঁরা কথা বলেছেন।’ যেসব সংশোধনীর কথা তাঁরা বলেন, সেগুলো হলো:
১. বৈদেশিক বাণিজ্য প্রাদেশিক বিষয় হিসেবে থাকবে। প্রদেশসমূহ বাণিজ্য প্রতিনিধি দল পাঠাবে। এরাই বৈদেশিক বাণিজ্যের বাজার অনুসন্ধান এবং বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত করবে। কিন্তু কোনো বাণিজ্য চুক্তিই চূড়ান্ত হবে না যতক্ষণ না কেন্দ্র কর্তৃক অনুমোদিত হচ্ছে।
২. প্রদেশের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সূত্র থেকে আয়কৃত অর্থ প্রাদেশিক রিজার্ভ ব্যাংকে জমা থাকবে। কিন্তু এ অর্থ কোনো প্রকল্পেই ব্যয়িত হবে না যতক্ষণ না কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হচ্ছে। এ সমন্বয় কমিটিতে প্রতিটি ফেডারেটিং ইউনিটের সমান সংখ্যক প্রতিনিধি থাকবে।
৩. খাজনা এবং অন্যান্য অর্থ আদায়ের বিষয়টি প্রাদেশিক বিষয় হিসেবেই থাকবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার খাজনা আদায়ের ব্যাপারটি নিজেই যদি করতে চায়, করতে দেয়া হবে।
৪. আলাদা মুদ্রার জন্যে আমরা চাপ দেবো না। এ সংশোধনী দেয়ার পর তাঁরা জানান, এ ব্যাপারে তাঁরা লিখিত দিতে প্রস্তুত। যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁদের মতামত পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলাম। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৫৩-৫৪] সেদিনই ঢাকার সামরিক সদর দফতর থেকে প্রেসিডেন্টকে সবকিছু জানিয়ে জরুরী ভিত্তিতে ঢাকা আসার অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাফ করা হলো।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, এমনকি এখানকার সেনা কর্মকর্তারা যখন আশাবাদী যে, আওয়ামী লীগের নতুন নমনীয়তার দিকটাকে প্রেসিডেন্ট বিবেচনা করবেন এবং আরও আলোচনার জন্যে তিনি ঢাকা আসবেন, ঠিক তখন ঘটালো অন্য ঘটনা। ২৮ ফেব্রুয়ারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার জেনারেল পীরজাদা এক অশুভ টেলিফোন করলেন ঢাকার এডমিরাল আহসানের কাছে। বললেন, প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরিষদের বাইরে খসড়া শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলসমূহ যাতে ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পারে, সে ব্যাপারে সময়দানের উদ্দেশ্যে তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৫৬]
পিণ্ডির কাছে সিদ্ধান্তটা হয়তো খুবই সহজ ছিলো। কিন্তু ঢাকার কাছে ছিলো খুবই ভারী। ঢাকা প্রশাসনের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাঁরা জানতেন, এ খবর এখানে কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। প্রেসিডেন্টের ঘোষণা যাতে প্রতিক্রিয়ার কোনো ভয়াবহ বিষ্ফোরণ না ঘটায়, সেজন্যে বিষয়টা শেখ মুজিবকে জানিয়ে আগে থেকেই তাঁকে তৈরি রাখা দারকার ঘোষণা গ্রহণের জন্যে। এসব চিন্তা করে গবর্নর আহসান শেখ মুজিবকে গবর্নর হাউজে নিয়ে এলেন। তারপর নানা কথার পর আসল কথাটা পাড়লেন। এতবড় খবর শোনার পরেও ‘আশ্চর্যজনকভাবে মুজিব শান্ত থাকলেন এবং বললেন, ‘এ নিয়ে আমি কোনো ঘটনা সৃষ্টি করবো না যদি আমাকে নতুন কোনো তরিখ দেয়া হয়। যদি নতুন তারিখটি সামনের মাসে (মার্চে) হয়, আমি পরিস্থিতি সামলাতে পারবো। এপ্রিলে হলে আমার পক্ষে কষ্টকর হবে। কিন্তু স্থগিতকরণটি যদি অনির্দিষ্ট কালের জন্যে হয়, তাহলে পরিস্থিতি সামলানো আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে।’[নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৫৬] গবর্নর হাউজ থেকে বের হয়ে আসার সময় শেখ মুজিব মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে আরেকটা কথা বলেছিলেন যার মধ্যে দিয়ে তাঁর তখনকার অবস্থার একটা সুন্দর প্রকাশ ঘটে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার অবস্থা-দুপাশে আগুন, মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে। হয় সেনাবাহিনী আমাকে মেরে ফেলবে, না হয় আমার দলের ভেতরকার চরমপন্তীরা আমাকে হত্যা করবে। কেন আপনারা আমাকে গ্রেফতার করছেন না? টেলিফোন করলেই আমি চলে আসবো।’ [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৫৬]
গবর্নর আহসান এবং তাঁর সংগীরা শেখ মুজিবের অবস্থা মনে হয় অনুধাবন করেছিলেন এবং তাঁর প্রস্তাব খুবই সংগত মনে করেডছিলেন। ২৮ তারিখ সন্ধ্যাতেই শেখ মুজিবের প্রতিক্রিয়া তাঁরা পিণ্ডিকে টেলিফোনে জানালেন এবং অনুরোধ করলেন, জাতীয় পরিষদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুল তবি ঘোষণার সাথে সাথে যেন বৈঠকের নতুন তারিখও ঘোষণা করা হয়।
ভেতরে যখন এ অবস্থা, বাইরে তখন একদিকে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের জন্যে জোরদার প্রস্তুতি, অন্যদিকে এর বিরোধী প্রতিক্রিয়া। ২৮ তারিখের কাগজে দেখা গেল আওয়ামী লীগের খসড়া শাসনতন্ত্র বিবেচনার খবর। আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী কমিটি দীর্ঘ ৫ ঘন্টা ব্যাপী বসে খসড়া শাসনতন্ত্র বিবেচনা করেছে। ২৮ তারিখেও তারা বসছে। ৩ মার্চের আগে তাঁরা খসড়া শাসনতন্ত্র বিবেচনা চূড়ান্ করবে। এই ২৮ তারিখেই লাহোরের এক জনসভায় ভুট্টো বললেন, ‘পিপলস পার্টির নির্বাচিত সদস্যদের অংশগ্রহণ ছাড়াই জাতীয পরিষদের অধিবেশন শুরু হলে পশ্চিম পাকিস্তানে গণআন্দোলন শুরু করা হবে।’ আওয়ামী লীগের ৬ দফা সম্পর্কে জনাব ভুট্টো ঐ জনসভায় বলেন, ‘৬ দফা কর্মসূচী তিনি পসন্দ না করলেও তিনি কখনো তা প্রত্যাখ্যান করেননি।’ তিনি মত প্রকাশ করেন, ‘দেশের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের ব্যাপারে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই ব্যাপক সমঝোতায় আসা প্রয়োজন এবং এ উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির মধ্যকার মতভেদ দূর করার জন্যে আরো কিছু সময়ের আবশ্যকতা রয়েছে। [দৈনিক সংগ্রাম, ১লা মার্চ, ১৯৭১] এ ২৮ তারিখেই পূর্ব পাকিস্তানের একটি ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ সব ষড়যন্ত্র বানচাল করে ৩রা মার্চ তারিখেই জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্যে দাবী জানাল। সংগঠনটির সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী বললেন, ‘নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দলের কর্মসূচীর সাথে আমাদের মতবিরোধ রয়েছে। কিন্তু অগণতান্ত্রিক পথে বা শক্তি প্রয়োগে সে কর্মসূচীকে নস্যাত করার রাজনীতিতে ইসলামী ছাত্রসংঘ শুধু অবিশ্বাসই করে এমন নয়, বরং ছাত্রসংঘ এ কলংকজনক পদ্ধতিকে সর্বান্তঃকরণে ঘৃণা করে। ছাত্র সংঘ মনে করে যে, প্রতিটি গণতন্ত্রকামী মানুষের উচিত বর্তমান জটিলতা ও চক্রান্টেতর বেড়াজাল থেকে জাতিকে মুক্ত করে যে কোনো মূল্যে আগামী ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানকে সংশয়মুক্ত করে তোলা।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ২৮ মার্চ, ১৯৭১।] ২৮ তারিখ সন্ধায় গবর্ণর হাউজে যাওয়ার আগে জনাব মুজিবুর রহমান ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতির সম্বর্ধনা সভায় বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, ‘৬ দফা কর্মসূচী কেবল বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্যেই নয়, বরং আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোকেও বাংলাদেশের সমপরিমাণ প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন দেয়ার পক্ষপাতী। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই জাতীয পরিষদে সমাধান খুঁজে বের করা যেতে পারে। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সম্পর্কে অগ্রিম আশ্বাস কেউই দিতে পারে না। তবে কেউ কোনো ভালো পরামর্শ দিলে অন্যরা তা শুনবে না কেন? তিনি ঘোষণা করেন, পাকিস্তান যেমন টিকে থাকবে, তেমনি টিকে থাকবে বাংলাদেশ, সিন্ধু সীমান্ত, পাঞ্জাপ ও বেলুচিস্তান। আর যা থাকবে না তা হচ্ছে মানুষে মানুষে শোষণ।….. আমরা মরতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু কিছুতেই নতি স্বীকার করবো না। [দৈনিক সংগ্রাম, ১লা মার্চ, ১৯৭১।]
তিন
৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেবার জন্যে কনভেনশন মুসলিম লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে পাকিস্তান, মস্কোপন্থী ন্যাপের সদস্যরা যখন ঢাকা আসছেন, অধিবেশন পর্যবেক্ষণের জন্য বিদেশী কূটনীতিকরা যখন ঢাকার পথে, পূর্ব পাকিস্তানের সকল মানুষ ৩রা মার্চের অধিবেশনের দিকে যখন তাকিয়ে, সেই সময় ১লা মার্চের ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্টের ঘোষণা রেডিওতে পাঠ করে বল হলো, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অর্থাৎ পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এছাড়া ভারত কর্তৃক সৃষ্ট সাধারণ উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সার্বিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে। অতএব আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান পরবর্তী কোনো তারিখের জন্যে স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। [দৈনিক সংগ্রাম, ২রা মার্চ, ১৯৭১।] প্রেসিডেন্ট তাঁর এ ঘোষণা উপলক্ষ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন এবং তার পুরোটা রেডিওতে প্রচার হয়েছিলো। কিন্তু এ বক্তব্য কেউ শুনেনি। অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার কথা কানে যাবার পরে আর কিছু শোনার ধৈর্য কারো ছিলো না। মানুষের বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মতোই হঠাৎ লাফিয়ে উঠলো।
মনে পড়ে এ লেখক সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে বি সি সি পি একাদশ এবং আন্তর্জাতিক একাদশের ক্রিকেট খেলা দেখছিলেন। সময় দেড়টা কিংবা তার কিছু বেশী হতে পারে। দেখলা, পশ্চিম গ্যালারীর এক জায়গায় আগুন জ্বলে উঠলো। সেই সাথে গোটা স্টেডিয়াম গ্যালারীতে ছুটোছুটি ও হৈচৈ। শোনা গেল, প্রেসিডেন্ট ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বাতিল করেছেন। স্টেডিয়ামের বাইরে থেকে তখন মাইকে শব্দ ভেসে আসছিলো। ব্যাপার কি জানার জন্যে গ্যালারী দিয়ে উপরে গিয়ে নীচে আউটার স্টেডিয়ামের দিকে তাকালাম। দেখলাম, মাইক ফিট করা একটা চলন্ত বেবিট্যাক্সি। মাইক থেকে একটা ঘোষণা ভেসে আসছে। যতদূর মনে পড়ে গলাটা ছিলো আ. স. ম. আবদুর রবের। বলা হচ্ছিলো, যতটা এখন স্মরণ আছে, ‘ভাইসব, স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আসুন, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করুন।’ খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। বেরিয়ে এলাম স্টেডিয়াম থেকে। বেরিয়ে এসে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণের চত্তর দিয়ে সামনে এগুলাম। চারদিকে অশান্ত অবস্থা। জি পি ও’-এর বিপরীত দিকে যেখানে আজ কসকর দোকান, সেখানে ছিলো গ্রীনিজ নামের একটা ডিপার্টমেণ্টাল স্টোর। তার সামনে জটলা। ওটার দরজা ভাঙ্গা হয়েছে। কে যেন পাশ থেকে বললো, বায়তুল মোকাররমের বন্দুকের দোকানও ভাঙ্গা হয়েছে। আমি তখন একটি দৈনিকে কর্মরত সাংবাদিক। তাড়াতাড়ি আমি আমার পত্রিকা অফিসে ফিরে এলাম।
বায়তুল মোকাররম এলাকায় যা দেখা গেছে, সে অবস্থা ছিলো সবখানেই। সে সময়ের দৃশ্য সম্পর্কে প্রবীন রাজনীতিক অলি আহাদ সাহেবের বর্ণনা: ‘জাতীয় পরিষদ মুলতবি ঘোষণার হতচকিত ঢাকাবাসী স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে ফাটিয়া পড়ে। ঢাকা স্টেডিয়ামের ক্রিকেট ম্যাচ বন্ধ হইয়া যায়। ঢাকা হাইকোর্ট বার এসোসিয়েশন এবং ঢাকা জেলা এসোসিয়েশনের প্রতিবাদ মিছিল রাস্তায় নামে। ছাত্র সম্প্রদায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হইতে রাজপথে নামিয়া আসে। বিভিন্ন শিল্প এলাকা হইতে শ্রমিকরা দলে দলে মিছিল সহকারে রাজধানী ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে। সকল সিনেমা হল বন্ধ হইয়া যায়। এইসব বিক্ষোভ মিছিলের স্রোত হোটেল পূর্বাণীর দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। হোটেল পূর্বাণীতে তখন আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পার্লামেণ্টরী পার্টির সভা চলিতেছিল। মিছিলকারীরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ উঠায়, পাকিস্তানের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন কর, বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা কর।’ [জাতীয় রাজনীতি, ‘১৯৪৫ থেকে ৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৬৮]
এ চরম বিক্ষুব্ধ পরিবেশ হোটেল পূর্বাণী থেকে শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন, ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ গণতান্ত্রিক মূলনীতি লংঘন করেছেন। আমরা পরিষদ অধিবেশন মুলতবি ঘোষণাকে বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেব না। আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলবো। তবে আমাদের প্রতিরোধ হবে গণতান্ত্রিক অহিংস-অসহযোগ। এ মুহূর্তে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা এক সুদীর্ঘ ষড়যন্ত্রেরই ফলশ্রুতি এবং আমরা এম. এন. এ.এখন ঢাকায় এবং ভুট্টো ও কাইয়ুম খানের দল ছাড়া আর বাকী সকল পশ্চিম পাকিস্তানী এম. এন. এ. অধিবেশনে যোগ দান করে শাসনতন্ত্রের রচনায় সহায়তা করতে প্রস্তুত এমতাবস্থায় একটি সংখ্যালঘু দলের একগুয়েমি দাবীর ফলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের মুলতবি ঘোষিত হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এটা সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। এর প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকায় এবং আগামীকাল বুধবার সারাদেশে সাধারণ হরতাল পালিত হবে এবং আগামী রোববার রেসকোর্সে এক গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ২রা মার্চ, ১৯৭১।]
জনাব মুরুল আমীন, আতাউর রহমান খান, গোলাম আযম প্রমুখ জাতীয় নেতৃবৃন্দও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণার তীব্র নিন্দা করে তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। জনাব গোলাম আযম বললেন, ‘এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, দেশ যখন একটি গণ-সরকারের জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, ঠিক তখনই গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পদ্ধতিতে বাধা সৃষ্টি করা হয়ে উঠেছে যে, ভুট্টোর যোগসাজশে পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় বিশেষ শক্তিশালী মহল দেশের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করার অপচেষ্টা করেছে।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ২রা মার্চ, ১৯৭১।] অনুরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করনে ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি জনাব মতিউর রহমান নিজামী। তিনি এক প্রতিবাদ সভায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘোষণাকে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মুহূর্তে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের বিরুদ্ধে একটি পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের বলে অভিহিত করে বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি অধিকার সচেতন জনগণ এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।’[দৈনিক সংগ্রাম, ২রা মার্চ, ১৯৭১।]
এ বিক্ষুব্ধ গণ-প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি সামরিক শাসনের শক্তিকেন্দ্র ঢাকা সেনানিবাসও শান্ত ছিলো না। সেখানকার অনেকেই প্রেসিডেন্টের এ ঘোষণাকে সন্তুষ্টিচিত্তে গ্রহণ করতে পারেনি। সেখানকার আভ্যন্তরীণ চিত্র সম্পর্কে একটা সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন সে সময় সেনাবাহিনীর গণসংযোগের দায়িত্বশীল সেনা-অফিসার মেজর সিদ্দিক সালিক। তাঁর বিবরণীতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ঘিরে কাল-ষড়যন্ত্রের একটা জাল যে দানা বেঁধে উঠেছিলো তারও কিঞ্চিত স্বীকৃতি ও পরিচয় মেলে। তিনি বলেন,
‘ঘোষণাটি প্রচারিত হলো ১লা মার্চ ১টা ৫মিনিটে। প্রচণ্ড আশা আর আবেগ আমাদেরকে রেডিওর সাথে একাকার করে দিলো। আমরা শুধু বিস্মিতই হলাম না, ভীতও হলাম। ঘোষণার নতুন তারিখ সম্পর্কে কিছুই বলা হলো না। অগুণতি ভয়াবহ দৃশ্যাবলী আমার মানসপটে ভেসে উঠলো। তারিখ বাদ পড়ার বিষয়টি ছাড়াও আমাকে আরেকটি বিষয় দারুণভাবে বিস্মিত করলো। সেটা ছিলো প্রেসিডেণ্টের কণ্ঠের অনুপস্থিতি। এর অর্থ কি এই, তিনি ঘোষণা সংক্রান্ত বিষয়ে কেউ নন।’ এটাই আমাদের বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন অধ্যাপক জি. ডব্লিউ. চোধুরী। তিনি বলেছেন, এ ঘোষণায় ইয়াহিয়া শুধু সই করেছিলেন মাত্র। এ গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সন্ধান নিতে গিয়ে আমি কথা বললাম মেজর জেনারেল ‘আই’-এর সাথে। তিনি ইয়াহিয়ার ব্যক্তিগত স্টাফ ছিলেন। বললেন, ‘ওই সময় প্রেসিডেন্ট করাচীতে ছিলেন। আমরা সবাই নীচের তলায় ছিলাম। মেজর জেনারেল ‘এইচ’ এবং মেজর জেনারেল ‘ও’ বার বার উপর নীচ করছিলেন। তাঁরা প্রেসিডেন্টের কাছে এমন একটি ছবি তুলে ধরেন যে, তাঁকে খসড়া ঘোষণার সম্মতি দিতেই হয়। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৫৬-৫৭] শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ পার্লামেণ্টারী পার্টির বৈঠক শেষ করে বিক্ষুব্ধ জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার পর সোজা চলে এলেন গবর্নর হাউজে। তিনি গবর্নর আহসানকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের নতুন তারিখ নির্ধারণের অনুরোধ করলেন এবং বললেন, ‘আমি আপনাদের আশাবাদ দিচ্ছি এবং বলছি এখনও সময় আছে। এখনও যদি আমাকে একটা নতুন তারিখ দেন, তাহলে আগামীকালই জনগণের ক্রোধ প্রশমিত করতে পারবো। এর পরে হলে অনেক দেরী হয়ে যাবে।’ [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৫৭]
এ দিনই সন্ধায় গবর্নর আহসান শেখ মুজিবের অনুরোধ এবং পরামর্শ পিণ্ডিকে অবহিত করলেন। কিন্তু প্রেসিডেণ্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার জেনারেল পীরজাদা এসব কথায় কান দিতেই চাইলেন না। পরে গবর্নর আহসান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝিয়ে প্রেসিডেন্টকে রাজি করাবার জন্যে তাঁকে অনুরোধ করলেন। কিন্তু ফল কিছুই হলো না। উপরন্তু ঐ রাতের গবর্নর আহসানকে তাঁর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হলো এবং জেনারেল ইয়াকুবকে ঐ দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হলো। গবর্নর আহসান তাঁর সংবেদনশীল মানসিকতার জন্যে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। তাঁর পরিবর্তন সরকারের উদ্দেশ্যের ব্যাপার আওয়ামী লীগকে আরও সন্দিগ্ধ করে তুললো।
এরপরও শেখ মুজিব ২রা মার্চ জনগণের উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য রাখলেন, তা শান্ত এবং খুবই সুবিবেচনাপূর্ণ। তিনি এ বিবৃতিতে লুটরতরা ও অগ্নিসংযোগ থেকে বিরত থাকার জন্য ঢাকায় ও দেশের অন্যান্য স্থানে অগ্নি সংযোগ, লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অবাংগালীরাই এর শিকার হন। এ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেখ মুজিব বলেন, ‘জনসাধারণকে বিশেষ করে উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে এবং মনে রাখতে হবে যে, ভাষা ও জন্মস্থান নির্বিশেষে বাংলাদেশে বসবাসকারী সবাই আমাদের কাছে বাঙালী। তাদের জান, মাল ও সম্মান আমাদের কাছে পবিত্র আমানত। শেখ মুজিব তাঁর এ বিবৃতিতে অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবী জানিয়ে বলেন, একদিনের জন্যেও আর সামরিক আইন অব্যাহত রাখার যুক্তি নেই।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ৩রা মার্চ, ১৯৭১।] লক্ষণীয় যে, নির্বাচনোত্তরকালে সামরিক আইন প্রত্যাহারের কথা শেখ মুজিব এ প্রথমবারের মতো বললেন। এর দ্বারা প্রমাণ হলো, আন্দোলন নতুন দাবী দাওয়া সমৃদ্ধ হয়ে নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। ২রা মার্চের বিবৃতিতে জনাব শেখ মুজিব ৭ মার্চ পর্যন্ত আন্দোলনের কর্মসূচী বর্ধিত করলেন। ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে বিকেল ২টা পর্যন্ত হরতাল চলবে। কর্মসূচীতে আরও ঘোষণা করা হলো, ৩রা মার্চ জাতীয় শোক দিবস। ঐ দিন ছাত্র জনসভা শেষে অপরাহ্ন চার ঘটিকায় পল্টন ময়দান থেকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মিছিল। ৭ই মার্চ রেসকোর্স থেকে শেখ মুজিব জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে ভবিষ্যত কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন।
২রা মার্চ আরও কিছু ঘটনা ঘটলো। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যে বেসরকারী প্রশাসন সৈন্য মোতায়েন দাবী করে। গণ-রোষের শিকার গবর্নর হাউজ পাহারার জন্যে হেলিকপ্টারে সৈন্য এনে সেখানে মোতায়েন করা হলো। সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হলো। উত্তেজনা এখানে তুংগে উঠলো। গুলী বর্ষণের ঘটনাও ঘটলো। জনতার মধ্য থেকে ৬জন মারা গেল। তার তিনজন গবর্নর হাউজের কাছে। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ এলো শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে। তিনি চার পৃষ্ঠায় একটি প্রেস বিজ্ঞাপ্তি পত্রিকা অফিসে পাঠালেন। যাতে জনপ্রতিনিধিদেরকে একমাত্র বৈধ ক্ষমতার উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বেআইনী সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্যে সরকারী কর্মচারীসহ সকলের প্রতি আহ্বান জানানো হলো।
৩রা মার্চ ছিলো শোক দিবস। ছাত্র লীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ শোক সভার আয়োজন করে। শেখ মুজিব এ সভায় বললেন, “আমরা চাই পশ্চিম পাকিস্তানের দরিদ্র জনসাধারণের অর্থনৈতিক উন্নতি। আমরা চাই তাদের সাথে ভাই ভাই হয়ে থাকতে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদের পথ রোধ করে আছে। তারা চায় না যে, আমরা একত্র থাকি। তারা আমাদের এতোদিন শোষণ করেছে। এখন যখন আমরা সম্পদ ও উৎপাদনে পশ্চাৎপদ, আমরা রক্তহীন ছোবড়া, তখন তারা আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়। [স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর, কামরুদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা-১০৮।] ৭কোটি মানুষকে কেউ হত্যা করতে পারবে না। আমরা মারা গেলেও বাংলার মানুষের স্বাধিকার অর্জিত হবে। তারা আর কায়েমী স্বার্থবাদীদের দ্বারা শোষিত হতে রাজী নয়। আমাদের সমগ্র আন্দোলন সুশৃঙ্খলভাবে চালাতে হবে। তা না হলে জীবন যাবে, কিন্তু দাবী আদায় হবে না। ৭ মার্চের মধ্যে সরকারের দায়িত্বভার ভেড়ে না দেয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চলবে। [দৈনিক সংগ্রাম, ৪ঠা মার্চ, ১৯৭১।]
এ বক্তৃতাতেও শেখ মুজিব গুণ্ডামি ও লুটতরাজের কঠোর নিন্দা করে বলেন, ‘বাঙালী, অবাঙালী, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই দেশ-মাতৃকার সন্তান। তাদের সবার জানমাল রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। [দৈনিক সংগ্রাম, ৪ঠা মার্চ, ১৯৭১]
গোটা দেশ এবং ঢাকার তখন উত্তপ্ত অবস্থা এবং পল্টন এলাকার জনসমুদ্রে বিক্ষোভের যে উত্তাল ঢেউ, সে তুলনায় শেখ মুজিবের ভাষণ ছিলো খুবই ঠাণ্ডা। পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে যতদূর গড়ায়, তার চেয়ে বেশী যেন তিনি আনতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু তিনি সৃষ্টি করতে চাচ্ছিলেন প্রচণ্ড চাপ। আর কর্মসূচীগুলো ছিলো শুধু তাঁর দাবী আদায়ের হাতিয়ার নয়, আত্মরক্ষারও বর্ম।
তাঁর এ চাপ কাজ করছিলো। ৩রা মার্চ সকালেই জেনারেল ইয়াকুব রাওয়ালপিণ্ডিতে প্রেসিডেণ্টকে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে ধাবিত হবার কথা জানালেন। এভাবে পরিস্থিতির সার্বক্ষণিক অবস্থা সম্পর্কে প্রেসিডেন্টকে জানানো হচ্ছিলো। কিন্তু ওপরের পাথরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিলো সব কথা। কোনো ফলই হচ্ছিলো না। অবশেষে বরফ গললো। সংশ্লিষ্ট একজন সামরিক অফিসারের ভাষায়, ‘যখন প্রেসিডেণ্ট নিশ্চিত হলেন যে, ফিরে আসার কোনো পথ নেই, তখন তিনি তাঁর উদ্দেশ্য জানালেন।’ [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬০-৬১] জেনারেল ইয়াহিয়া ১০ মার্চ ঢাকায় রাজ নীতিবিদদের সাথে মিলিত হতে চাইলেন। প্রেসিডণ্টের এ ইচ্ছার কথা ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষা মুজিবকে জানালেন। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬১] শেখ মুজিব বৈঠকে সম্মত হলেন। শেখ মুজিবের সম্মতি রাওয়ালপিণ্ডি পাবার পরই প্রেসিডেণ্টের পক্ষথেকে ১০ ম ার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের সকল পার্লামেণ্টারী গ্রুপের নির্বাচিত নেতাদের সম্মেলন আহ্বান করা হলো। সাথে সাথেই পিপলস পারিটর তরফ থেকে সম্মেলনে যোগদানের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হলো। কিন্তু শেখ মুজিব প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘এখনও যখন বিভিন্ন সড়কে শহীদের রক্ত শুকিয়ে যায়নি এবং এখনও যখন কিছু কিছু লাশ কবর না দেয়া অবস্থায় পড়ে রয়েছে এবং শত শত ব্যক্তি হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে, সে সময় নিষ্ঠুর পরিহাসের মত এ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আর এমন কিছু ব্যক্তিদের সাথে মিলিত হবার জন্যে এ আমন্ত্রণ জাননো হয়েছে, যাদের দূরভিসন্ধই নিরপরাধ ও নিরস্ত্র কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্রদের মৃত্যুর জন্যে দায়ী।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ৪ঠা মার্চ, ১৯৭১]
শেখ মুজিবের এভাবে সম্মেলন প্রত্যাখ্যান করা ঢাকার সমরকর্তাদের বিস্মত করলো। কারণ শেখ সাহেবের সম্মতি নিয়েই সম্মেলন ডাকা হয়েছিলো। শেখ মুজিবকে তাঁরা এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় তিনি পরিষ্কারই বললেন, ‘রাজনীতিবিদদের সাথে একক ভিত্তিক আলোচনার প্রশ্নে আমি চাইনি কিংবা বসতেও চাই না ভুট্টোর মতো লোকের সাথে বসতে যে বাঙালীর রক্তপাতের জন্যে দায়ী।’ [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬১] এ তিন (মার্চ) তারিখে আরও একটা উল্লেখযোগ্য বিবৃতি এলো পূর্ব জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমর কাছ থেকে। বিবৃতিটি উল্লেখযোগ্য এ কারণে যে, এ বিবৃতিতেই সর্বপ্রথম একটা বিকল্প পন্থা হিসেবে শাসনতন্ত্র রচনার আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে দেশের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানানো হলো। বিবৃতিতে সুস্পষ্টভাবে পরামর্শ রাখা হলো যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের পর দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে শাসনতন্ত্র রচনার কাজে হাত দেয়া হোক। বিবৃতিটির বিবরণ এই: ‘নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার সাথে আলোচনা না করে জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত রাখার মতো চরম দায়িত্বহীন সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে দেশে যে বিপজ্জনক পরিস্থিরি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের হৃদয়েই গভীর বেদনার ছায়াপাত হয়েছে। এ অবিবেচনাপ্রসূত কাজের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে যে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছে, তাতে প্রমাণিত হয়েছে যে, স্বাধীনতাকামী জনগণ এ ধরনের ষড়যন্ত্র আর বেশী দিন বরদাশ্ত করতে রাজী নয়। বিগত ২৩ বছর যাবত জনগণের শাসনের বিরুদ্ধে যে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র পরিচালিত হয়ে এসেছে, এ সিদ্ধান্ত নিসন্দেহে তারই অন্যতম পদক্ষেপ মাত্র। জনগণ তাদের নিজেদের শাসনই কামনা করে এবং শক্তির মাধ্যমে তাদেরকে প্রতিহত করা হলে তারা তাদের জীবন বিলিয়ে দিতেও ইতস্তত করবে না। এমতাবস্থায় নির্বাচনে জনগণের পরিষ্কার রায় ঘোষণা হওয়ার পর সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের আর মোটেই ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার অধিকার নেই।’ জনাব গোলাম আযম সামরিক আইন প্রত্যাহার করে অবিলম্বে এ ভুল পদক্ষেপ বন্ধ করা এবং নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়ে বললেন, ‘প্রিয় মাতৃভূমিকে অধিকতর দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে হলে শাসনতন্ত্র রচনার পূর্বে অবশ্যই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। গণ-প্রতিনিধিদেরকে দেশ শাসনের সুযোগ দেয়া হোক এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে শাসনতন্ত্র রচনা করা হোক।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ৪ঠা মার্চ, ১৯৭১।] এই ৩রা মার্চের ডেট লাইনে জনাব অলি আহাদের বাংলা জাতীয় লীগের পক্ষ থেকে আরেকটা প্রস্তাব শেখ সাহেবের কাছে পেশ করার কথা জানা যায়। ৩রা মার্চ বেলা ১০টায় শেখ মুজিবের কাছে পেশকৃত এ প্রস্তাবটিতে বলা হয়: (১) জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত সংক্রান্ত প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ঘোষণাকে উপেক্ষা করেই আওয়ামী লীগ দলীয় একশত সাতষট্টি জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সদস্যবর্গের আজই ঢাকায় সংবিধান প্রণয়নকল্পে যথারীতি অধিবেশনে মিলিত হওয়া উচিত এবং যথা শীঘ্র সংবিধান প্রণয়ন করে তার মুতাবেক জন প্রতিনিধিগণের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যে সামরিক আিইন শাসনকর্তা প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানানো উচিত। (২) প্রেসিডেণ্ট এ আহ্বান অস্বীকার করলে অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করা এবং জাতি সংঘের সাহায্য প্রার্থনা করা প্রয়োজন। (৩) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে কনফেডারেশন গঠন। এবং (৪) উপরে বর্ণিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনতার ঐক্য সুদৃঢ় করার জন্যে সংগ্রামী জনতার মোর্চা গঠন।’ [জাতীয় রাজনীতি, ১৯৪৫ থেকে ৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৭০] কিন্তু বাংলা জাতীয় লীগের এ প্রস্তাবকে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও জনাব মনসুর আলী তাৎক্ষণিকভাবেই অবাস্তব বলে অভিহিত কররেন। [জাতীয় রাজনীতি, ১৯৪৫ থেকে ৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৭০]
৩রা মার্চের কর্মসূচীর মধ্যে বিকেল ৪টার ছাত্র জনসভা শেষে শেখ মুজিবের নেতৃত্বের মিছিলের কথা ছিলো। কিন্তু সভা শেষে শেখ মুজিব মিছিলে যোগ দেননি। ছাত্র লীগের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলে তিনি বললেন, ৭ই মার্চ তারিখে তিনি রেসকোর্স ময়দানে জনসভা ডেকেছেন, ঐ জনসভায় তিনি তাঁর পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করবেন, তাঁর আগে তাঁর পক্ষ থেকে ৩রা মার্চের মিছিলে যোগ দেয়া সম্ভব নয়। এর দ্বারা শেখ মুজিব সম্ভবত বাড়তি আবেগকে সংযত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি হয়তো জানতেন না, চরমপন্থী ছাত্র যুবনেতারা অনেক দূর এগিয়ে গেছেন, যখন এ ধরনের সংযম সম্বরণের উপদেশ যুক্তিগ্রাহ্য হয় না। ছাত্র ও যুব নেতারা শেখ মুজিবের ভূমিকাকে তাঁর দুর্বলতা হিসেবে গণ্য করলো। এরপর ছাত্র ও যুব নেতারা ভিন্ন ধারায় চলা শুরু করলো। তাদের বক্তব্য আলা হয়ে গেল। তাদের আন্দোলনের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলে। তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক লড়াই। আর শেখ মুজিব তাঁর দাবী আদায়ের জন্য নিজের বাড়ী ৩২নং কে কেন্দ্র করে অহিংসা ও অসহযোগ নীতির ভিত্তিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে লাগলেন। এ বিষয়টিকে জনাব কামরুদ্দিন আহমদ তাঁর গ্রন্থে সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। লিখেছেন: ‘অসহযোগ আন্দোলনের নির্দেশ দেয়া হতো শেখ সাহেবের ধানমণ্ডীর বাড়ী থেকে, কিন্তু স্বেচ্ছাসেবকগণ কাজের নির্দেশ পেত জহুরুল হক হল থেকে। শেখ মুজিবকে ছাত্ররা যদিও বিপ্লবের প্রতীক বলে মনে করতো, কিন্তু তারা তাদের নিজস্ব কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করতো। ভারতের স্বাধীনতার জন্য বৃটিশ শাসিত উপমহাদেশে যেমন মাহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন এবং নেতাজী সুভাষ বোসের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের দুটি ধারা পরিচালিত হয়েছিলো, ঠিক তেমনি দুটি ধারায় বিভক্ত হলো দেশের সংগ্রামী চেতনা ও নেতৃবৃন্দ। ……. নেতাজী অহিংসায় বিশ্বাস করতেন না। তাই তিনি ভারত ভূখণ্ডে বাইরে স্বাধীন ভারত সরকার ও আযাদ হিন্দু ফৌজ গঠনের মাধ্যমে বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জাপান ও জার্মানের সমর্থনে ভারত-ব্রহ্মদেশ সীমান্তে ব্যাপাক আক্রমণ করেছিলেন। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বেও চাচ্ছিল ঐ একই পন্থায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করে পশ্চিমা শক্তির সাথে যুদ্ধ করতে এবং স্বাধীনতার অর্জন করতে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিই ছিলো স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন।’ [স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর, কামরুদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা-১০৯।] এ পতাকা সর্বপ্রথম উত্তোলিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২রা মর্চ তারিখে। উত্তোলন করেন ছাত্র নেতৃবৃন্দ। এরও অনেক আগে ১৯৬৭ সালের দিকে সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতা সংগ্রামের গোপন তৎপরতা শুরু করেন। এ সময়ে এ তৎপরতার বিবরণ দিতে গিয়ে জনাব কামরুদ্দিন আহমদ লিখেছেন: ‘১৯৬৭ সনের এপ্রিল মাসে “Socio political history of Bangladesh” প্রকাশিত হয়। বইটি হঠাৎ এতো জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, ছয় মাসের মধ্যেই প্রথমং সংস্করণ করা হয়। ঐ পুস্তকখানি প্রকাশিত হবার পর পরই সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাকের সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর রূপ নেয়। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ওরা দুজন আমার অফিসে যেত আমার সাথে বাঙালী জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্যে। সিরাজুল আলম খান তখন মুখে বাংলার স্বাধীনতার কথা না বললেও স্বাধীনতা লাভের জন্যে শেখ মুজিবের অজ্ঞাতে আওয়ামী লীগের কিছু কর্মী নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় গুপ্ত সংস্থা গঠন করেছিলেন। ঐ সংগঠনসমূহের জন্যে প্রচারপত্র লিখা হতো ও তাদের মধ্যে বিতরণ করা হতো। এ সংগঠনের কথা আওয়ামী লীগ নির্বাহী কমিটির কেউ এমনকি শেখ সাহেবও জানতেন না।’ [স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর কামরুদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা-১০৪] ছাত্র ও যুব আন্দোলনের এ স্বতন্ত্র পটভূমির কারণেই অবশেষে তাদের আন্দোলনের কেন্দ্র, কর্মসূচী এবং বক্তব্য আলাদা হয়ে গেল। ৩রা মার্চ তারিখে শেখ মুজিব যে বক্তব্য রাখলেন এবং যে নির্দেশাবলী দিলেন, যে ভাষায় দিলেন, তার সাথে ছাত্র ও যুব নেতাদের কথা মেলে না। তারা পল্টনের জনসভায় যে ৫টি প্রস্তাব গ্রহণ করে, তার শেষ তিনটি প্রস্তাব এই:
(১) এ সভা পাকিস্তান উপনিবেশবাদের কবল হইতে মুক্ত হইয়া স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্যে সমাজ তান্ত্রিক অর্থনীতি ও নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিয়া স্বাধীন বাংলাদেশে কৃষম শ্রমিক রাজ কায়েমের শপথ গ্রহণ করিতেছে।
(২) এই সভা স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা রাখিয়া তাহার সকল সংগ্রাম চালাইয়া যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছে।
(৩) এই সভা দলমত নির্বিশেষে বাংলার প্রতিটি নর-নারীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাইয়া যাওয়ার আবেদন জানাইতেছে। [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৬৬]
এ প্রস্তাব গ্রহণের সাথে সাথে এই ৩রা মার্চ তারিখেই ছাত্র ও যুব নেতাদের তরফ থেকে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর নামে ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা ও কর্মসূচী’ সম্বলিত ‘এক নম্বর ইশতিহার’ প্রকাশ করা হয়। শেখ মুজিব ২রা মার্চ তিনটি দাবী তুলে ধরেন। দাবীগুলো হলো: অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার, অবিলম্বে সংঘাতের নিরসন এবং জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা গ্রহণের পথ থেকে সকল বাধা দূরীকরণ। [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৭০] এ দাবী উত্থাপন করে তিনি ৭ তারিখ পর্যন্ত কর্মসূচী দিলেন এবং বললেন, এ দাবিগুলো আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। কিন্তু ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঐ ইশতিহারে শেখ মুজিবের এ দাবী ও কর্মসূচীর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর আহ্বান এবং পৃথক কর্মসূচী ঘোষণা করা হলো। ইশতিহারের পূর্ণ বিবরণ:
“জয় বাংলা
ইশতিহার নং/এক
(স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা ও কর্মসূচী)
স্বাধীন ও স্বার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে:
গত তেইশ বছরের শোষণ, কুশাসন ও নির্যাতন একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত করেছে যে, সাত কোটি বাঙালীকে গোলামে পরিণত করার জন্য বিদেশী পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র তা বাঙালীর মুক্তির একমাত্র পথ স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকা। গত নির্বাচনের গণনায়কে বানচাল করে শেষ বারের মতো বিদেশী পশ্চিমা শোষকের সে কথার প্রয়োজনীয়তা হাড়ে হাড়ে প্রমাণ করেছে।
৫৪ হাজার ৫শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগলিক এলাকার ৭কোটি মানুষের জন্য আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাঙলাদেশ’। স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাঙলাদেশ’ গঠনের মাধ্যমে নিম্নলিখিত তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
(১) স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাঙলাদেশ’ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালী সৃষ্টি ও বাঙালীর ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
(২) স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাঙলাদেশ’ গঠন করে অঞ্চলে অঞ্চলে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসনকল্পে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক, শ্রমিক রাজ কায়েম করতে হবে।
(৩) স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাঙালাদেশ’ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে।
বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য নিম্নলিখিত কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে:
(ক) বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহাকুমা, শহর ও জেলায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করতে হবে।
(খ) সকল শ্রেণীর জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা ও তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
(গ) শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক ও গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সুসংগঠিত করে, গ্রামে, গ্রামে, এলাকায় এলাকায় মুক্তিবাহিনী গঠন করতে হবে।
(ঘ) হিন্দু-মুসলমান ও বাঙালী-অবাঙালী সাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিহার করতে হবে এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।
(ঙ) স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুশৃঙ্খলারসাথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে এবং লুটতরাজ সহ সকল প্রকার সমাজবিরোধী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারা নিম্নরূপ হবে:
(অ) বর্তমান সরকারকে বিদেশী উপনিবেশবাদী গণ্য করে বিদেশী সরকারের ঘোষিত সকল আইনকে বেআইনী বিবেচনা করতে হবে।
(আ) তথাকথিত পাকিস্তানের স্বার্থের তল্পিবাহী পশ্চিমা অবাঙালী মিলিটারীকে বিদেশী ও হামলাকারী শত্রু সৈন্য হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং এ হামলাকারী শত্রু সৈন্যকে খতম করতে হবে।
(ই) বর্তমান বিদেশী উপনিবেশবাদী শোষক সরকারকে সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা দেয়া বন্ধ করতে হবে।
(ঈ) স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণরত যে কোনো শক্তিকে প্রতিরোধ, প্রতিহত, পাল্টা আক্রমণ ও খতম করার জন্য সকল প্রকার সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে হবে।
(উ) বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী দৃষ্টিভংগি নিয়ে সকল প্রকার সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
(ঊ) বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী দৃষ্টিভংগি নিয়ে সকল প্রকার সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
(ঊ) স্বাধীনত সার্বভৌম বাঙলাদেশের জাতীয সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি……’ সংগীতটি ব্যবহৃত হবে।
(ঋ) শোষক রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানী দ্রব্য বর্জন করতে হবে এবং সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
(এ) উপনিবেশবাদী পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহার করতে হবে।
(ঐ) স্বাধীনতা সংগ্রামে রত বীর সেনানীদের সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করে বাঙলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনাযক:
স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ গঠন আন্দোলনের এ পর্যায়ে নিম্নলিখিত জয়ধ্বনি ব্যবহৃত হবে-
স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাগেশ — দীর্ঘজীবী হোক
স্বাধীন কর স্বাধীন কর — বাংলাদেশ স্বাধীন কর
স্বাধীন বাংলার মহান নেতা —- শেখ মুজিব
গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড় …… মুক্তবাহিনী গঠন কর
বীর বাংগালী অস্ত্র ধর….. বাংলাদেশ স্বাধীন কর
মুক্তি যদি পেতে চাও….. বাংগালীরা এক হও
বাংলা ও বাংগালীর জয় হোক
জয় বাংলা।
স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, ৬৬৬-৬৬৮]
স্বাধীনতার এ ঘোষণা দেয়ার জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছঅত্র লীগের একক উদ্যোগের ফলে এগার দফা দাবী আদায়ের জন্য গঠিত সর্বদলীয় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ বিলুপ্ত করে ১লা মার্চ সার্জেন্ট জহরুল হক হলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আ. স. ম. আবদুর রব ও সাধারণ সম্পদক আবদুল কুদ্দুস মাখন সমবায়ে চার সদস্য বিশিষ্ট ‘স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। [জাতীয় রাজনীতি, ১৯৪৫ থেকে ৭৫, অীল আহাদ, পৃষ্ঠা- ৪৭৩-৪৭৪।] এ ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গটিত হবার পর দিন ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্র সভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। [জাতীয় রাজনীতি, ১৯৪৫ থেকে ৭৫, অীল আহাদ, পৃষ্ঠা- ৪৬৮।] ৮ মার্চ তারিখ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ কেন্দ্রীয় সংসদ ছাত্র লীগের নাম থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম বাদ দেয়া এবং ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’-এর উপর স্বাধীনতা সংগ্রামের দায়িত্বার্পণসহ নিম্নলিখিত প্রস্তাব গৃহীত হয়:
“অদ্যকার এ সভা আগামী কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘ছাত্র লীগ’ নাম ব্যবহৃত হইবে।
প্রত্যেক জেলা শহর হতে প্রাথমিক শাখা পর্যন্ত শাখার সভাপতিকে আহ্বায়ক, সাধারণ সম্পাদক করিয়া এবং ৯জন সদস্য সর্বমোট ১১জনকে নিয়া ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করার প্রস্তাব গ্রহণ করিতেছে। সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ব্যাপারে কলেজ ছাত্র সংসদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করার নির্দেশ প্রদান করেতেছে।
প্রত্যেক শাখাকে তাহার আওয়তাভুক্ত এলাকার আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছে। বটতলা ও পল্টনের জনসভার প্রস্তাবাবলী এক নম্বর ইশতেহার এই সভার প্রস্তাব হিসেবে গ্রহণ করা হইল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্যে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের’ সদস্যদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করিতেছে।
দেশের সকল প্রেক্ষাগৃহে পাকিস্তানী পতাকা প্রদর্শন, পাকিস্তানী সংগীত বাজানো এবং উর্দু বই প্রদর্শন বন্ধ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছে এবং বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত সিনেমা করও প্রদান করার সিদ্ধঅন্ত গ্রহণ করিতেছে।” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭০৮]
এসব ঘোষণা ও বক্তব্য প্রকাশের সাথে সাথে ছাত্র ও যুব নেতারা তাদের কর্মসূচী এগিয়ে নেয়ার জন্যে শিক্ষা প্রশিক্ষণের কাজও শুরু করে দেয়। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে লণ্ডন-এর ‘Tiems’ পত্রিকার Paul Martin তাঁর এক রিপোর্ট লিখেন: ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে চরমপন্থী গ্রুপগুলো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং নিচ্ছিল। বহু জায়গায় স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগেট গঠন করা হয়েছিলো পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে লড়াই করার জন্যে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পেট্রোল ও অন্যান্য বোমা তৈরি হচ্ছিল দেদার।[Times, London, 25th march, 1971] ২৩ মার্চ ছিলো পাকিস্তান দিবস। ছাত্র নেতারা সকলের কাছে আহ্বান জানাল সেদিন পাকিস্তানী পতাকার বদলে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের জন্যে। সামরিক ছাউনিগুলো ছাড়া সর্বত্রই সেদিন বাংলাদেশের পতাকা উড়লো। ছাত্রদের আহ্বানক্রমে ঢাকাস্থ বৃটিশ হাই কমিশন ও সোভিয়েত কনসুলেট বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলো। কিন্তু ঢাকাস্থ চীনা, ইরানী, ইন্দোনেশিয়া ও নেপালী দূতাবাস পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলন করে। কিন্তু ছাত্ররা এসব দূতাবাসে গিয়ে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।’ [দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ মার্চ, ১৯৭১] ছাত্র ও যুব নেতাদের এই যে স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি হলো, স্বাধীনতা যুদ্ধকালেও তা অব্যাহত থাকে। কেউ কেউ স্বাধীনতা যুদ্ধকে চারটি [মূলধারা, ৭১, মঈদুর হাসান, পৃষ্ঠা-৬] ধারায় বিভক্ত করেছেন। চারটি ধারার একটি ছিলো এই ছাত্র ও যুব নেতাদের নিযে গঠিত। এ ধারার নেতৃত্বে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ ছাত্র যুব নেতাগণ। মূলধারা-৭১‘-এর লেখক মঈদুল হাসানের ভাষায় ‘ভারতে প্রবেশের পর থেকে তারা তাকে (এই নেতারা) স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্যাপারে এক স্বতন্ত্র গোষ্ঠীগত ভূমিকা গ্রহণ করেন। এদের নেতৃত্বে এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘Research and Analysis Wing’ (RAW)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মুজিব বাহিনী’ নামে প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এমন এক সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম হয়, এক সময় যার কার্যকলাপ স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিভক্ত করে ফেলতে উদ্যত করে।’ [মূলধারা, ৭১, মঈদুর হাসান, পৃষ্ঠা-৭] এ যুবনেতাগণ সীমান্ত অতিক্রম করার পর প্রকাশ্যেই দাবী করতে থাকেন যে, সশস্ত্র বাহিনী ট্রেনিং এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনার দায়িত্ব শেখ মুজিব কেবলমাত্র তাদের চারজনের (মণি, তোফায়েল, সিরাজুল আলম ও রাজ্জাক) উপরই ন্যস্ত করেছেন, অপর কারো উপর নয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ অবধি তাদের এ দাবী ও ভূমিকা অপরিবর্তিত থাকে। [মূলধারা, ৭১, মঈদুর হাসান, পৃষ্ঠা-৮] এরা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য করেনি, নিয়ন্ত্রণও মানেনি। ভারত সরকারের সাথে এ ছাত্র ও যুব নেতাদের গোপন ও দুর্বোধ্য সম্পর্কের কারণেই তারা কিছুই পরোয়া করতো না। RAW –এর এক বিশেষ ব্রবস্থার অধীনে দেরাদুনের চাকরাতায় মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এদের প্রথম দল বেরিয়ে আসার পর তাদের ভূমিকা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এবং সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী উভয়কেই উদ্বিগ্ন করে তোলে। ‘মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা মুজিব বাহিনীর’ লক্ষ্য বলে প্রচার করা হলেও এ সংগ্রামে তাদের নির্দিষ্ট ভূমিকা, কার্যক্রম ও কোশল কি, কোন্ এলাকায় এরা নিযুক্ত হবে, মুক্তিবাহিনীর অপরাপর ইউনিটের সাথে তৎপরতার কিভাবে সমন্বয় ঘটবে,কি পরিমাণ বা কোন্ শর্তে এদের অস্ত্র ও রসদের যোগান ঘটছে, কোন্ প্রশাসনের এরা নিয়ন্ত্রণাধীন, কার শক্তিতে বা কোন্ উদ্দেশ্যে এরা অস্থায়ী সরকারেরবিশেষত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধাচরণ করে চলেছে, এ সমদুয় তথ্যই বাংলাদেশের কাছে রহস্যাবৃত থেকে যায়। ক্রমে -বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ পায়, মুজিব বাহিনীর কেবল প্রশিক্ষণ নয়, অস্ত্রশস্ত্র ও যাবতীয রসদের যোগান আসে RAW –এর এক বিশেষ উপসংস্থা থেকে এবং এ উপসংস্থার প্রধান মেজর জেনারেল উবান গেরিলা প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ হিসেবে ‘মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার দায়িত্বে নিযুক্ত রয়েছে।’ [মূলধারা, ৭১, মঈদুর হাসান, পৃষ্ঠা-৮] ছাত্র ও যুব নেতাদের অধীন মুজিব বাহিনী শুধু স্বাধীন ও বেপরোয়া চলেই ক্ষান্ত হয়নি, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র কেড়ে নেয়া, তাদের আনুগত্য পরিবর্তনের জন্যে চাপ দেয়া ও মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহের প্ররোচনা দিয়ে চলে। [মূলধারা, ৭১, মঈদুর হাসান, পৃষ্ঠা-৭৯] এ অবস্থার নিরসনের জন্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আগস্ট, ’৭১-এর মাঝামাঝি সময়ে কোলকাতা থেকে দিল্লী যান। দিল্লী প্রশাসনের কাছে ‘মুজিব বাহিনীকে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে ন্যস্ত করা এবং তাদের অন্তর্ঘাতী তৎপরতা বন্ধ করার দাবী জানান। ভারত-প্রশাসনের একজন শীর্ষ ব্যক্তি পি. এন. হাকসার ও RAW প্রধান কাও তাজউদ্দীনের কথা শোনেন। কিন্তু নীরব থাকেন। মুজিব বাহিনীকে তার কমাণ্ডের অধীনে না দিলে জেনারেল ওসমানি পদত্যাগ করবেন, এ হুমকিতেও কোনো কাজ হয়নি। [মূলধারা, ৭১, মঈদুর হাসান, পৃষ্ঠা-৮০] কিন্তু পরবর্তীকালে ছাত্র ও যুব নেতাদের স্বতন্ত্র ধারার অধীন ‘মুজিব বাহিনীর’ সাথে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটলে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিশৃংখলা ও ত্রাস সৃষ্টি থেকে তাদের বিরত করার বিভিন্ন চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর ডি. পি. ধরের পরামর্শে তাজউদ্দীন প্রতিকারের জন্যে আবার দিল্লী সরকারের শরণাপন্ন হন। এবারতিনি নিজে না গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যীক্তত্ব মঈদুল হাসানকে ১২ সেপ্টেম্বর দিল্লী পাঠান। মঈদুল হাসান দিল্লী গিয়ে কি করেছিলেন তার বিবরণ এই: ‘ডি. পি. ধর পরদিন বিকেল চারটায় নয়া দিল্লীর প্রধান সচিবালয় ‘সাউথ ব্লকে’ RAW –এর প্রধান রামনাথ কাও-এর সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। সাম্প্রতিক কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনার আলোকে যথাশীগ্র ‘মুজিব বাহিনীকে’ বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার পক্ষে আমার বক্তব্য কাও ভাবলেশহীন মৌনতার সাথে শ্রবণ করেন এবং আমার বক্তব্য শেষ হবার পর বিদায় জ্ঞাপনের জন্যে ক্ষণিকের জন্যে সে মৌনতা ছিন্ন করেন। চার সপ্তাহ আগে কাও তাজউদ্দীনের বক্তব্যের জবাবে যে নীরবতা প্রদর্শন করেন, তদপেক্ষা কোনো উন্নত সৌজন্য আমার প্রাপ্য ছিলো না। পরদিন সকালে ডি. পি. ধরকে আমি জানাই যে, পূর্ববর্তী অপরাহ্নের সাক্ষাতকারের ফলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতির সম্ভাবনা যেহেতু দৃষ্টিগোচর নয়, সেহেতু প্রতিশ্রুত ‘সর্বোচ্চ মহলের’ হস্তক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধের এ দ্বৈত কমাণ্ডের অবসান একান্ত অপরিহার্য। উত্তরে তিনি আমাকে অধ্যাপক পি. নে. ধরের(তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সচিব) সাথে অপরাহ্নে সাক্ষাত করে সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতি অবহিত করার পরামর্শ দেন। যথাসময়ে আমি তা সম্পন্ন করি বটে, কিন্তু ক্রমশ একটি ধারণা আমার মনে প্রবল হয়ে উঠতে থাকে- ‘মুজিব বাহিনীর’ স্বতন্ত্র কমাণ্ড বজায় রাখার পক্ষে ভারত সরকারের পূর্বেকার সিদ্ধান্ত এমনই জোরাল যে, এর পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্র প্রস্তুতের কাজে আমি হয়তো ব্যবহৃত হয়ে চলেছি। সন্ধায় ডি. পি. ধরের সাথে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ বৈঠকে প্রসংগটি পুনরায় উত্থাপিত হয়, কিন্তু সিদ্ধান্তের আভাস তার বক্তব্যে ছিলো না।’ [মূলধারা, ৭১, মঈদুর হাসান, পৃষ্ঠা-১০৪-১০৫] এ ঘটনার আরো মাস দেড়েক পর অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটা সাক্ষাতকার ঘটে দিল্লীতে। মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর ইউরোপ সফল শুরুরআগে তিনিই তাজউদ্দীনকে দিল্লি ডেকে নেন। এ সুযোগে তাজউদ্দীন মুজিব বাহিনীর প্রশ্নটি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তোলেন। RAW-এর সাথে সম্পর্ক ও সমর্থনের ফলে মুজিব বাহিনী যে বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে চলেছে তার বিবরণ তাজউদ্দীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে দেন। ‘ইন্দিরা এ অবস্থার ত্বরিত প্রতিবিধানের জন্য সভায় উপস্থিত ডি. পি. ধরকে নির্দেশ দেন। ডি. পি.ধর মুজিব বাহিনীকে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা করার জন্য মেজর জেনারেল বি. এন. সরকারকে নিয়োগ করেন। এ উদ্দেশ্যে যথাশীগ্র কোলকাতায এক বৈঠকেরও আযোজন করা হয়। এ বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তাজউদ্দীন ও জেনারেল ওসমানি, মুজিব বাহিনীর পক্ষে তোফায়েল আহমদ, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক (আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও শেখ মণি অনুপস্থিত থাকেন) এবং ভারতের সামরিক বাহিনীর পক্ষে মেজর জেনারেল সরকার ও ব্রিগেযিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত উপস্থিত ছিলেন। আলোচনার এক পর্বে একজন যুব নেতা দাবী করেন, আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলার অধিকার একমাত্র তাঁরই আছে। এরপর আলোচনা আর এগুতে পারেনি। পরে বি. এন. সরকার কেবল যুব নেতাদের নিয়ে আলোচনার জন্য ‘ফোর্ট উইলিয়াম’ এ মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করেন। কিন্তু সেখানে আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলার ‘একমাত্র অধিকারী’ সেই যুব নেতা ছাড়া আর কেউই হাজির হয়নি। কয়েকদিন বাদে যেহেতু যুব নেতাদেরসকলে আগরতলায় উপস্থিত থাকবেন, সেহেতু সেখানেই তাদের সাথে বি. এন. সরকারের পরবর্তী বৈঠকের সময় স্থির করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে ‘মুজিব বাহিনী’র সকল নেতা একযোগে অনুপস্থিত থাকেন। মেজর জেনারেল নারেলবি. এন.সরকারও এ পণ্ডশ্রম বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য জরুরী কাজে মনোনিবেশ করেন।’ [মেজর জেনারেল বি. এন. সরকারের একান্ত সাক্ষাতকারের (১০ই এপ্রিল, ’৭৩) বিবরণ।মূলধারা ’৭১, মঈদুল হাসান, পৃষ্ঠা-১৫২)] অর্থাৎ ভারতের খোদ প্রধানমন্ত্রীকে বলে ছাত্র ও যুব নেতাদের স্বতন্ত্র ধারাকে বাংলাদেশ সরকার তার সাথে আনতে পারলেন না। শক্তির প্রতিযোগিতায় ছাত্র ও যুব নেতাদেরধারাটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের চেয়ে ভারতের অধিকতর প্রমাণিত হলো।
চার
শেখ মুজিব ৩রা মার্চ তারিখে ৬ই মার্চ পর্যন্ত হরতাল কর্মসূচী ঘোষণা করেছিলেন। তিনি ৪ঠা মার্চ এক বিবৃতি মারফত তাঁর আহ্বানে সর্বাত্মকভাবে সাড়া দেয়ার জন্যে জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে কয়েকটি কনসেশনের কথা ঘোষণা করলেন। যেসব সরকারী ও বেসরকারী অফিসের কর্মচারীদের এখনও বেতন দেয়া হয়নি, সেসব অফিসে ৫ ও ৬ই মার্চ বিকেল আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত কাজ চালানোর নির্দেশ দিলেন। অনুরূপভাবে ব্যাংকসমূহকে এ দুদিন পূর্বোল্লিখিত সময়ে বেতনের চেকের অর্থ শুধু মাত্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরে লেন-দেনের নির্দেশ দিলেন। এছাড়া জনজীবনের জন্যে জরুরী বিভাগকে হরতালের বাইরে রাখার কথা ঘোষণা করলেন। পরদিন ৫ই মার্চ শেখ মুজিব ভারতীয় রেডিওর একটা অপপ্রচারের প্রতিবাদ করলেন। ভারতীয় রেডিওতে বলা হয়েছিলো, পূর্ব পাকিস্তানে ‘দমন নীতি’ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির জন্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব আমেরিকা বা অন্য কোনো দেশের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। ভারতীয় রেডিও আরও বলেছিলো শেখ মুজিব ভুট্টোর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। শেখমুজিবুর রহমান এ প্রচারকে কল্পনাপ্রসূত ও অনিষ্টকর বলে অভিহিত করলেন। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে এ দিন বেশকিছু উল্লেখযোগ্য বিবৃতি প্রকাশ পায়। জনাব আবুল মনসুর আহমদ এক বিবৃতিতে হত্যাকাণ্ড ও অবিচারের প্রতিবাদে সম্মানসূচক পাকিস্তানী তঘমাধারী সকলকে তঘমা বর্জন করার আহ্বান জানালেন। [দৈনিক সংগ্রাম, ৬ মার্চ, ১৯৭১] পুর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম নিরপরাধ জনসাধারণকে হত্যা করার তীব্র নিন্দা করেযেসব ব্যক্তি অধিকার আদায়েল মহান সংগ্রামে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের মাগফিরাত কামনা করে এবং অবিলম্বে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানিযে জামায়াত কর্মীদেরকে তাদের নিজ নিজ এলাকায় শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রেখে জনসাধারণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের শাসন কায়েমের সংগ্রাম চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। [দৈনিক সংগ্রাম, ৬ মার্চ, ১৯৭১]
২রা মার্চ সৈন্য মোতায়েনের পর সৈন্যদের গুলী বর্ষণে ৫ মার্চ পর্যন্ত দেড় শতাধিক মৃত্যুর খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। আহদের সংখ্যা বহু-শত শত। সেনাবাহিনী কারফিউ দিয়ে এবং গুলী বর্ষণ করে বিক্ষোভ ও জনতার রোশ মুকাবিলার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির আরও অবনতিই ঘটছিলো। প্রকৃতপক্ষে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিলো না কোথাও। শেখ মুজিব ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে দাবী করলেন সৈন্যদের সব স্থান থেকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে। তাদের তরফ থেকে প্রশ্ন এলো, আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করবে কে? শেখ সাহেব জানালেন, ‘আমার উপর ছেড়ে দিন। আমি আমার স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে লাগাতে পারবো। প্রয়োজন পড়লে আনসারদের ডাকবো এবং পুলিশদের সাহায্য নেব।’ [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬১] ঢাকার সামরিক কর্মকর্তারা শেখ মুজিবের এ প্রস্তাব গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করলো এবং পিণ্ডির নির্দেশ নিয়ে ৫ মার্চ সকল সৈনিককে ব্যারাকে ফিরিয়ে আনা হলো।
সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার ফলে শেখ মুজিবের একটা দাবী মানা হলো মাত্র। অবস্থার এতে কোনোই পরিবর্তন ঘটলো না। গোটা দেশই কার্যত বন্ধ। বারুদের মতো উত্তপ্ত গোটা দেশ। সরকারের কিছুমাত্র নিয়ন্ত্রণও কোথাও নেই। সিদ্দিক সিালিকের’ [পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তখন একজন মেজর এবং নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল গ্রন্থের লেখক।] ভাষার ‘মানুষের দুঃখ-কষ্টের ব্যাপারে জেনারেল ইয়াকুব দারুণ সংবেদনশীল মনের মানুষ।’ ৪ঠা মার্চ জেনারেল ইয়াকুবের রাওয়ালপিণ্ডিতে জেনারেল পীরজাদাকে টেলিফোনে বললেন, প্রেসিডেন্ট কালবিলম্ব না করে ঢাকা অবশ্যই যেন আসেন। একেকটা ঘন্টা পার হয়ে যাওয়া মানে সম্ভাব্য সমাধানের পথ থেকে দূরে সরে যাওয়া।’ [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬২] জেনারেল পীরজাদা অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রেসিডেণ্টের সাথে আলাপ করে ঢাকায় টেলিফোন করে জেনারেল ইয়াকুবকে জানালেন, প্রেসিডেণ্ট খুব শিগগিরই ঢাকা সফরে যাচ্ছেন। কিন্তু এ মুহূর্তে কোনো নতুন তারিখ দেয়া রীতিমতো অসুবিধাজনক ব্যাপার। প্রেসিডেণ্ট ‘এক্ষুণি’ মুজিবের সাথে কথা বলবেন এবং ‘অবস্থা ঘোরাণো না করার জন্য’ তাঁকে বলবেন।’ [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬২] কিন্তু রাত ৯টা ১০ মিনিটে ঢাকা সেনাসদরে জেনারেলদের একটা বৈঠখকালীন সময়ে জেনারেল ইয়াকুব আবার টেলিফোন পেলেন পিণ্ডি থেকে। খোদ প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বললেন, ‘আমি মত বদলেছি, আমি ঢাকা আসছি না।’ জেনারেল ইয়াকুব তাঁকে বুঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া বললেন, না আমি আসতে পারি না, কেননা আমি বুঝে ফেলেছি এ সফর সমস্যা সমাধানের কাছাকাছিও যেতে পারে না। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬২] জেনারেলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রেসিডেণট টেলিফোন রেখে দিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া টেলিফোন রেখে দেবা পর কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার বর্ণনা সেখানে উপস্থিত সেনা অফিসার মেজর সিদ্দিক সালিক এভাবে দিয়েছেন: ‘তাৎক্ষণিকভাবে তিনি জেনারেলদের (জেনরেল ইয়াকুব, জেনারেল খাদিম রাজা, জেনারেল ফরমান) মধ্যে নিদারুণভাবে হতাশাব্যঞ্জক প্রতিক্রিয়ার জন্ম হলো। এখন কি করা যেতে পারে? প্রেসিডেণ্ট আশার আলো নির্বাপিত করে দিলেন। এবার জেনারেল ইয়াকুব জেনারেল পীরজাদাকে টেলিফোন করলেন। তাঁকে সাথে সাথে পাওয়া গেল। তিনি বললেন, পীর, যদি প্রেসিডেণ্টকে (ঢাকায়) আসতে রাজী করানো না যায়, তাহলে আমার দায়িত্ব থেকে আমাকে অব্যহতি দেয়া হোক। কাল সকালেই আমি আমার ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেব।’ টেলিফোনে কথা শেষ হতেই খাদিম ও ফরমান দুজনেই ইস্তিফা দিতে চাইলেন। তাতে জেনারেল ইয়াকুব বললেন, ‘এই সমর্থনের জন্য তোমাদের ধন্যবাদ। এটা ট্রেড ইউনিয়ন নয়, সেনাবাহিনী। তোমরা কাজ চালিয়ে যাও।’ বৈঠক শেষ হবার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, জেনারেল ফরমানকে আজ মধ্যরাতের ফ্লাইটে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দফতরে (রাওয়ালপিণ্ডি) যেতে হবে পীরজাদা ও প্রেসিডেণ্টকে পরিস্থিরি গুরুত্ব জ্ঞঅত করাবার জন্যে প্লেনে উঠে তিনি আটটি ঘন্টা সময় পাবেন এ সংবেদনশীল মিশনের উপর চিন্তা-ভবনা করার। পরের দিন (৫ মার্চ) জেনারেল ইাকুব সিগনালের (টেলিগ্রাম) মাধ্যমে রাওয়ালপিণ্ডিতে ইস্তিফাপত্র পাঠিয়ে দিলেন। ……. জেনারেল ইয়াকুবের ইস্তিফাপত্র রাওয়ালপিণ্ডিতে পৌঁছাবার আগেই প্রেসিডন্টে পাবর্তী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। তিনি একজন সামরিক আইন প্রশাসক (পাঞ্জাব) ও কোর কমাণ্ডার লেফটেন্যাণ্ট জেনারেল টিক্কা খানকে রাওয়ালপিণ্ডিতে ডেকে পাঠালেন জেনারেল ইয়াকুবের দায়িত্বভার তার হাতে তুলে দেয়ার জন্যে। জেনারেল ফরমান ও জেনারেল টিক্কা দুই জায়গা থেকে এবং ভিন্ন ধরনের মিশন নিয়ে এ সময়ে রাওয়ালপিণ্ডিতে পৌঁছলেন। প্রেসিডেণ্ট দুজনের সাথে আলাদা আলাদাভাবে সাক্ষাত দিলেন। জেনারেল ফরমান প্রেসিডেণ্টের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করলেন এবং পরিস্থিতির মোড় পরিবর্তনের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আবেদন জানালেন। তাঁর আবেদনের প্রেক্ষিতে জেনারেল ইয়াহিয়া বললেন, ‘আমার ঘাঁটি সম্পর্কে আমাকে ভাবতে হয় বাচ্চু। পশ্চিম পাকিস্তান সম্পর্কে আমাকে ভাবতে হবে। আমি তো আমার নিজের ঘাঁটিকে ধ্বংস করতে পারি না।’ [নিয়াজীর আত্মসর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬২-৬৩]
পর্দার অন্তরালে এসব ঘটনা যখন ঘটে গেল, তারপরই ভুট্টোর সাথে ৫ ঘন্টাব্যাপী বৈঠক হলো প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার। এ বৈঠকের পরই ঘোষণা এলো প্রেসিডেণ্ট ৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। ৬ মার্চ প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া সাড়ে ১২ মিনিটের একটা ভাষণ দিলেন। ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বললেন, ‘আপনারা দেখবেন যে, নির্বাচন সম্পন্ন করার পর প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরের যতগুলো পদক্ষেপ আমি নিয়েছি, আমাদেরই কিছু নেতা এভাবে কিংবা সেভাবে তা বানচাল করে দিয়েছে। আমি উল্লেখ করতে চাই, নির্বাচন শেষ হবার পর ১৭ই জানুয়ারী এবং তার পরে আমি ঢাকায় দুই বড় দলের নেতাদের সাথে দেখা করেছি এবং নেতারাও পরস্পর দেখা করেছেন। আমি তাঁদেরকে একাধিকবার সামনে এগুবার পথ বের করার জন্যে আমার সাথে আলোচনায় আসার জন্যে আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু দুঃখের সাথেই বলতে হয়, আওয়ামী লীগ প্রধান আমার আমন্ত্রণকে সাড়া দেবার যোগ্য মনে করেননি। এভাবে আলোচনার মাধ্যমে ভুল বুঝাবুঝ দূর করার সুযোগ আমরা নষ্ট করেছি। পশ্চিম পাকিস্তনের বিপুল সংখ্যক সদস্য ৩রা মার্চের অধিবেশনে যোগদান করতে অস্বীকার করার ফলে পরিবেশ শাসনতন্ত্র তৈরির মতো কাজের অনুকুল না থাকায় আমি সিদ্ধান্ত পৌঁছেছি যে, এ অবস্থায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে অর্থহীন, এমনকি জাতীয় পরিষদ এর ফলে বাতিলও হয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমি অধিবেশন বাতিল করে অবস্থার অবনতি রোধ করতে চেয়েছি। আমি এর দ্বারা চেয়েছি একদিকে জাতীয় পরিষদ রক্ষা করতে, অন্যদিকে অর্থপূর্ণ আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে। কিন্তু আমার পদক্ষেপকে এ দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। আমাদের পূর্ব পাকিস্তনী নেতৃত্ব এর বিরুদ্ধে এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন যার ফলে অনিষ্টকারী শক্তিরা রাস্তায় নামা এবং জীবন ও সম্পদ ধ্বংস করার সুযোগ পেল। [****১২৬]
৩রা মার্চের পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করে দেয়াকে সম্পূর্ণভাবে ভুল বোঝা হয়েছে। খোদ পরিষদকে রক্ষার স্বার্থে এ স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোটি কোটি মানুষের প্রতি তাঁর কর্তব্য এ দেশকে রক্ষা করা। জনগণ আমার থেকে এটা আশা করে এবং আমি তাদেরকে নিরাশ করবো না। আমি মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে কোটি কোটি নিরপরাধ পাকিস্তানীর আবাসভূমিকে ধ্বংস করতে দেবো না। শাসনতন্ত্র তৈরির ব্যাপারে নেতাদের একটি ব্যাপক সমঝোতায় নিয়ে আসার জন্য আমি যা চেষ্টা করেছি তা সফল হয়নি। পাকিস্তানের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের স্থায়িত্ব সম্পর্কে যাদের সন্দেহ রয়েছে, সেসব রাজনৈতিক দলের প্রতি আমি বলতে চাই যে, আইন কাঠামো আদেশের বিভিন্ন ধারার চেয়ে কোনো উত্তম নিশ্চয়তার প্রয়োজন নেই।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ৭ মার্চ, ১৯৭১] প্রেসিডেণ্টের ভাষণের পরপরই ভুট্টোর প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল। রাওয়ালপিণ্ডির এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ’২৫ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে তাঁর দল যোগ দেবে।’ তিনি আরও বললেন, ‘৬ দফার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের আলোচনার জন্য তাঁর দল এখন প্রস্তুত। রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসার পূর্বে পিপলস পার্টির শাসনতন্ত্রের ব্যাপারে মতৈক্যের চেষ্টা করছে। পশ্চিম পাকিস্তানে জনমত গঠন করে ৬ দফার কাছাকাছি আসতে আমরা চেষ্টা করবো এবং সমস্ত প্রদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি শাসনতন্ত্র রচনার ব্যাপারে পরিষদ যাতে সাফল্যমণ্ডিত হয় আমাদেরকে তার প্রতিও নজর রাখতে হবে।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ৭ মার্চ, ১৯৭১] দেখা যাচ্ছে, প্রেসিডেণ্ট তাঁর ভাষণে শাসনতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে আইন কাঠামোর (L. F. O) উপর দাঁড়িয়ে রাখতে চাইছেন। অন্যদিকে যদিও ভুট্টো বলছেন, তারা ছয় দফার কাছাকাছি আসতে চেষ্টা করবেন, কিন্তু তিনি সেই সাথে ‘সমস্ত প্রদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি শাসনতন্ত্র রচনা’র কথা বলে রাখছেন। অর্থাৎ ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর পূর্ব অবস্থানের কোনোই মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি।
প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণের ২ ঘন্টা পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটির একটি জরুরী বৈঠক রুদ্ধ কক্ষেশুরু হলো। রাতে তাদের আরেক দফা বৈঠক হয়, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া গেলো না। ৬ মার্চ ছিলো ২রা মার্চ ঘোষিত কর্মসূচীর শেষ দিন। এদিনও গোটা দেশে ২টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হলো। খুলনায় গুলী বর্ষণের ঘটনা ঘটলো। ১০৪ জন হতাহত হওয়ার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো। ঢাকাতেও পুলিশের গুলীতে ৩৭জন হতাহত হলো। ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে গেট ভেংগে ৩২৫জন কয়েদী পালিয়ে গেলো। বিষ্ফোরণোন্মুখ অবস্থা। ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের তারিখ বাহ্যিকভাবে অবস্থার কোনোই পরিবর্তন ঘটাল না। উপরন্তু এদিন (৬ মার্চ) জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক ও গবর্নর হিসেবে ঘোষণা অবস্থার আরও অবনতিই ঘটালো। শ্লোগান উঠলো ‘আপোসের বাণী আগুনে জ্বালিয়ে দাও।’ [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৯৩] জনাব কামরুদ্দিন আহমদ তখনকার অবস্থার চিত্র একেছেন এভাবে: ‘শেখ সাহেব তাঁর ৭ মার্চের ভাষণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অন্যদিকে ছাত্রদের প্রধান কার্যালয় জহুরুল হক হল থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ বাহিনী আনসারদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা হচ্ছিল। ছাত্ররা এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলো যার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ সাহেব তাঁর ৭ মার্চের বক্তৃতায় স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বাধ্য হন।’ [স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর, কামরুদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা-১০৯] এ অবস্থার মধ্যেই ৭ মার্চের সূর্যোদয় ঘটলো।
৭ মার্চের সূর্যোদয়ের আগে রাতের কালো আবরণের অন্তরালে আরো কয়েকটা ঘটনা ঘটে। একটির বিবরণ মেলে ঢাকায় পাকিসআন আর্মির জনসংযোগ অফিসার মেজর সিদ্দিক সালিকের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া টেলিফোনে মুজিবের সাথে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেন এবং তাঁকে রাজী করানোর চেষ্টা করে বলেন, এমন পদক্ষেপ যেন তিনি না নেন, যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় থাকবে না। এরপর তিনি মুজিবের উদ্দেশ্যে টেলিপ্রিণ্টারে একটি বার্তা প্রেরণ করেন। মধ্যরাত আমার উপস্থিতিতে এ বার্তাটি ঢাকার সামরিক আইন সদর দফতরে পৌঁছে। পাঠাবার আগে আমি তাড়াতাড়ি পড়ে নিলাম। পরবর্তীতে আমার স্মরণের উপর নির্ভর করে আমি সেটা ডাইরীতে লিপিবদ্ধ করে ফেললাম। বারতা আমার ডাইরিতে এভাবে লিপিবদ্ধ আছে: ‘অনুগ্রহ করে কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি শিগগিরই ঢাকায় আসছি এবং আপনার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি আপনার আকাঙ্ক্ষা এবং জনগণের প্রতি দেয়া আপনার প্রতিশ্রুতির পুরোপুরি মর্যাদা দেবো। আমার কাছে একটি পরিকল্পনা আছে যা আপনাকে আপনার ছয় দফা থেকেও বেশী খুশি করবে। আমি সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না।’ একজন ব্রিগেডিয়ার নিজে ধানমণ্ডির বাড়ীতে গিয়ে মুজিবের হাতে বার্তাটি পৌঁছে দিয়ে এলেন।…… ওই রাতে জিওসি’র বাড়ীতে রাত দুটায় তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার। আওয়ামী লীগের দুজন প্রতিনিধি ছিলো তাঁর সাথে। মুজিবের দূতরা জিওসিস কে বললেন, ‘শেখ সাহেব চরমপন্থীদের তরফ থেকে চাপের মধ্যে রয়েছেন। তারা তাঁকে একপক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণার জন্যে চাপ দিচ্ছে। তাদেরকে উপেক্ষা করার মতো শক্তিও তাঁর নেই। তাই তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে, তাঁকে সামরিক বাহিনীর হেফাজতে নিয়ে আসা হোক।’ জিওসি জবাবে বললেন, ‘আমি নিশ্চিত, কিভাবে চাপ প্রতিহত করতে হয়, মুজিবের মতো একজন জনপ্রিয় নেতা তা ভালোভাবেই জানেন তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে দিয়ে কিছুই করানোযাবে না। তাঁকে বলবেন, আমি সেখানেই (রমনা রেসকোর্সে) থাকবো চরমপন্থীদের আক্রোশ থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্যে। কিন্তু এও বলে দেবেন, যদি তিনি পাকিস্তানেরসংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেন, তাহলে আমি সম্ভাব্য সবকিছুই করবো। বিশ্বাঘাতকদের হত্যার জন্যে ট্যাংক, কামান, মিশিনগান-সবই। প্রয়োজন যদি হয় ঢাকাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবো। শাসন করার জন্যে কেউ থাকবে না, শাসিত হবার জন্যেও কেউ থাকবে না।’ [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬৪-৬৫] আরেকটা ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন কামরুদ্দিন আহমদ। লিখেছেন তিনি, ‘৬ মার্চ রাতে মার্শাল-ল’ এডিমিনিস্ট্রেটর সাহেবজাদা ইয়াকুব ও গবর্নর এডমিরাল আহসান শেখ সাহেবের সাথে সাক্ষাত করে জানিয়ে দিলেন যে, তাদের দুজনকেই পরের দিন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতে হবে। এবং দুজনের স্থলে জেনারেল টিক্কা খান মার্শালল’ এডমিনিস্ট্রেটর ও গবর্নর দুটো পদই নিযুক্ত হয়েছেন। টিক্কা খান সম্পর্কে জেনারেল ইয়াকুব শেখ মুজিবকে বললেন, টিক্কা খান একজন সাধারণ সৈনিক থেকে পদোন্নতি পেয়ে লেঃ জেনারেল হয়েছেন। এ পুরষ্কার তিনি পেয়েছেন বিশেষ করেতার নিষ্ঠুরতার জন্যে এবং সাথে সাথে নামকরা একজন ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে। বেলুচিস্তানে টিক্কা খান কিভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন, তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণও শেখ সাহেবের সামনে তুলে ধরলেন। তিনি আরও বললেন, টিক্কা খানের পক্ষে রেসকোর্সের জনসভায় বোমা বর্ষণ করাও সম্ভব যদি তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’[স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর, পৃষ্ঠা-১১০] এ দুটি ঘটনার সময় নির্ঘণ্ট দেয়া নেই। তবে প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে মধ্য রাতে। সুতররাং এ শেষের ঘটনাটি আগে ঘটেছে, এটাই স্বাভাবিক। এ দুই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় ঢাকা ও রাওয়ালপিণ্ডির সামরিক কর্তৃপক্ষ ধরেই নিয়েছিলেন যে, ৭ মার্চ তারিখে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। বাইরে থেকে এ উপলব্ধিটাই স্বাভাবিক ছিলো। শ্লোগান, ত ৎপরতা এবং কথাবার্তায় এমন পরিবেশই সৃষ্টি করা হয়েছিলো। রাত দুটোই জিওসির কাছে মুজিবের বার্তাও তাই প্রমাণ করে।
৭ মার্চ। রেসকোর্সে লাখো বিক্ষুব্ধ জনতার উত্তাল ঢেউ। চারদিকটা রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় কাঁপছে। এ পরিবেশে বেলা ২টা ৩০ মিনিটে শেখ মুজিব তার বক্তৃতা শুরু করলেন:
“আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বুঝেন আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলী বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশের ইতিহাসকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃকি মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলছি বাংলাদেশের করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খাঁ মার্শাল-লদ জারি করে ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৪ সালে ৬ দফা আন্দোলনের সময় আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আয়ুইব খাঁর পতনের পরে ইয়াহিয়া এলেন। ইয়াহিয়া খান সাহেব বললেন দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন- আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সাথে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম ১৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে আমাদের জাতীয পরিষদের অধিবেশন দিতে। তিনি আমার কথা রাখলেন না, রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, মার্চ মাসে প্রথম সপ্তাহে সভা হবে। আমি বললাম ঠিক আছে, আমরা এসেমব্লিতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো-এমনকি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশী হলেও একজনের মতেও যদি তা ন্যায্য কথা হয়, আমরা মেনে নেব।
ভুট্টো সাহেব এখানে ঢাকায় এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন আলোচনার দরজা বন্ধ নয়, আরো আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতাদের সাথে আমরা আলোচনা করলাম- আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো- সবাই আসুন বসুন। আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বর যদি আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যে যাবে তাদের মেরে ফেলে দেয়া হবে, যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত জোর করে বন্ধ করে দেয়া হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। আর হঠাৎ ১তারিখ এসেম্বলি বন্ধ করে দেয়া হলো।
ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেণ্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম, আমি যাবো। ভুট্টো বললেন, যাবো না। ৩৫জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এলেন। তারপর হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়া হলো, দোষ দেয়া হলো বাংলার মানুষের, দোষ দেয়া হলো আমাকে। দেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলো।
আমি বললাম, আপনারা শান্তিপুর্ণভাবে হরতাল পালন করুন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সবকিছু বন্ধ করেদেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। আমি বললাম, আমরা জামা কেনার পয়সা দিয়ে অস্ত্র পেয়েছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্থা করার জন্য, আজ সেই আমার দেশের গরীব-দুঃখী মানুষের বিরুদ্ধে-তার বুকের উপর হচ্ছে গুলী। আমরা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু, আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেণ্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের উপর, আমার বাংলার মানুষের উপর গুলী করা হয়েছে। কিভাবে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, আপনি দেখুন। তিনি বললেন, আমি ১০ তারিখে রাউণ্ট টেবিলে কনফারেন্স ডাকবো।
আমি বলেছি, কিসের এসেম্বলি বসবে। কার সাথে কথা বলবো। আপনারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছেন, তাদের সাথে কথা বলবো? পাঁচ ঘন্টার গোপন বৈঠকে সমস্ত দোষ তারা আমার উপর, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন। দায়ী আমরা!
২৫ তারিখে এসেম্বলি ডেকেছে। রক্তের দাগ শুকায়নি। ১০ তারিখে বলেছি, রক্তে পাড়া দিয়ে, শহীদের উপর পাড়া দিয়ে এসেম্বলি খোলা চলবে না। সামরিক আইন মার্শাল-ল’ Withdraw করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকের ভেতরে ঢুকতে হবে। যে ভাইদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে আমরা বসতে পারি না।
আমরা প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজথেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাদে আমার মানুষ কষ্ট না করে সে জন্যে যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ী, রেল চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট সেমি গভর্নমেণ্ট দপ্তর, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন না দেয়া হয়, এর যদি ১টি গুলী চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেকের ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, পানিতে মারবো। সৈন্যরা, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক, তোমাদের কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আর তোমরা গুলী করবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।
আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি সাহায্য করার চেষ্টা করবো। যারা পারেন আওয়ামী লীগ অফিসে সামান্য টাকা পৌঁছে দেবেন। আর ৭দিন হরতালে শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেক শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন। সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এ দেশের মুক্তি না হচ্ছে, ততদিন ওয়াপদা ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলো- কেউ দেবে না। শুনুন, মনে রাখুন, শত্রু পেছনে ঢুকছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান যারা আছে আমাদের ভাই, বাঙালী-অবাঙালী-তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন কর্মচারীরা, রেডিও যদি আমাদের কথা না শুনে তাহলে কোনো বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, তাহলে টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘন্টা ব্যাংক খোলা থাকবে যাতে মানুষ তাদের মাইনেপত্র নিতে পারবে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাঙলায় চলবে এবং বাংলাদেশের নিউজ বাইরে পাঠানো চলবৈ।
এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা চলছে- বাঙালীরা বুঝে-সুজে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লাহয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন। এবং আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। যখন রক্ত দিয়েছি আরও দেবো। এদেশর মানুষকে মুক্ত করে তুলবো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ [শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের টেপরেকর্ড থেকে লিপিবদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭০০-৭০২।]
ক্ষোভ, উত্তেজনা ও আবেগের উত্তাল রেসকোর্সের জনসমুদ্রকে শেখ মুজিবের এ ভাষণ উত্তেজনায় আরও উদ্দীপ্ত করেনি, তাদের শান্ত করতে চেয়েছে। বিদ্রোহের আগুন তখন চারদিকে। কিন্তু শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছেন দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের বেদনার ভাষা দিয়ে। অর্ধেকেরও বেশী তিনি বলেছেন তাঁর বেদনার কথা। আর বক্তৃতার শেষাংশে ছিলো চাপ প্রয়োগের কর্মসূচী এবং হুশিয়ারি উচ্চারণ ও যা দুর্বিনীত এক পক্ষের কাছে জনগণের দাবী আদায়ের জন্যে ছিলো অপরিহার্য। তিনি সেদিন আবেগের কাছে নয়, বুদ্ধিবৃত্তির কাছে আবেদন রেখেছিলেন যা সমস্যা সমাধানে সহায়ক। জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের জন্যে তিনি চারটি[চারটি শর্ত: (১) মার্শালল’ তুলে নিতে হবে, (২) জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, (৩) সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং (৪) হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।] শর্ত দিয়েছিলেন যার কোনোটিই নতুন ছিলো না। এ দাবীগুলো তিনি আগেও করেছিলেন, অন্যান্য নেতৃবৃন্দও করেছিলেন। সুতরাং শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ কোনো নতুন সংকট সৃষ্টি করেনি, সংকট সমাধানের পথ আরও সুনির্দিষ্ট করেছে, উন্মুক্ত করেছে।
৭ মার্চ তারিখেই আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত অহিংস অসহযোগের সপ্তাহব্যাপী নিম্নলিখিত কর্মসূচী ঘোষণা করেন:
(ক) কর না দেয়ার আন্দোলন চলবে।
(২) সেক্রেটারিয়েট, সরকারী ও আধা সরারী অফিস, হাইকোর্ট এবং বালাদেশের অন্যান্য আদালত হরতাল পালন করবে। এ ব্যাপারে কি কি শিথিল করা হবে, তা সময়ে সময়ে জানান হবে।
(৩) রেলওয়ে ও বন্দরসমূহ কাজ চালিয়ে যাবে। তবে জনগণের উপর অত্যাচারের উদ্দেশ্যে রেলওয়ে বন্দরকে সৈন্য সমাবেশের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চাইলে রেল ও বন্দর কর্মচারীরা তাতে সহযোগিতা করবে না।
(৪) বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রকে আমাদের বক্তব্যের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করতে হবে এবং তারা জনতার আন্দোলনের সংবাদ চেপে যেতে পারবে না।
(৫) কেবলমাত্র স্থানীয় ও আন্তঃজেলা ট্রাংক-টেলিফোন যোগাযোগ চলবে।
(৬) সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
(৭) স্টেট ব্যাংক বা অন্য কোনো উপায়ে দেশের পশ্চিম অঞ্চলে টাকা পাঠাতে পারবে না।
(৮) প্রতিদিন সমস্ত ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়।
(৯) অন্যান্য ক্ষেত্রে হরতাল প্রত্যাহার হলো। তবে অবস্থার প্রেক্ষিতে যে কোনো মুহূর্তে পূর্ণ অথবা আংশিক হরতাল ঘোষণা করা যেতে পারে।
(১০) স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রত্যেক ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা এবং জেলায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হবে।
এ কর্মসূচী ঘোষণা কর তিনি বলেন, রেলওয়ে, রিকশা ও সড়ক পরিবহন ক্ষেত্রে পূর্ণভাবে কাজ চলবে। বেতন সংক্রান্ত টাকা, চেক ইত্যাদির জন্যে ব্যাংকসমূহ দু ঘন্টা খোলা থাকবে। কল-কারখানার মালিকরা কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন দেবে। রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে আমাদের নিউজ না দিতে পারলে বাঙালীরা সেখানে কাজ করবে না। [বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ : দ লিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭০৩-৭০৪, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে’ ৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৭৪-৪৭৫]
৭ মার্চ ঢাকার সামরিক সরকার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি মারফত ৬ মার্চ পর্যন্ত ঘটনা ও হরতালের একটা বিবরণ দিলেন। ১লা মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত ১৭২ জন নিহত ও ৩৫৮ জন আহত হবার খবর দিয়ে বললো, এ আহত নিহতের বেতর নিজেদের মধ্যে দাংগাকালে চট্টগ্রামের পাহাড়তলা, ফিরোজবাগ কলোনী ও ওয়ারলেস কলোনীতে মারা গেছে ৭৮ জন এবং আহত হয়েছে ২০৫ জন। সেনাবাহিনীর গুলীতে নিহত হয় ৫ জন এবং আহত হয় ১জন। অন্যদিকে ইপিআর-এর বুলেট বিদ্ধ হয়ে মারা গেছে দুজন। খুলনায় ৩রা মার্চ ও ৪ঠা মার্চে স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে দাংগা দমনকালে পুলিশের গুলীতে মারা গেছে ৪১জন। স্থানীয় গোলযোগ প্রশমনে পুলিশের বুলেট বিদ্ধ হয়ে মারা গেছে ৩জন এবং জখম হয়েছে ১১জন। একটি ট্রেন লাইনচ্যুত করাকালে ৪ঠা মার্চ খুলনায় পুলিশের গুলীতে মারা গেছে চারজন এবং আহত হয়েছে ১জন। ৩৪১জন আসামী ও বিচারাধীন অভিযুক্ত ব্যক্তি ৬ মার্চ ঢাকা কন্দ্রীয় জেলখানা ভেংগে পালাবার চেষ্টা করেছিলো। ফলে পুলিশকে গুলী করতে হয়। এতে প্রাণ হারায় ৭জন এবং আহত হয় ৩০জন। একদল হিংসাত্মক জনতা ৩রা ও ৪ঠা মার্চ যশোর, খুলনা ও রাজশাহীর টেলিফোন কেন্দ্রে আক্রমণ চালায়। এ সময় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা যশোর থেকে খুলনা যাচ্ছিল। পথের জধ্যে জনতা কর্তৃক তারা আক্রান্ত হয়। ফলে তাদের গুলী ছুঁড়তে হয়। এতে ৩ব্যক্তি মারা যায় এবং কয়েকজন আহত হয়। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালনকালে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। মারা গেছে একজন অফিসার ও আহত হয়েছে একজন। ২রা ও ৩রা মার্চ রাতে নওয়াবপুর-তাঁতীবাজার দুর্ঘটনায় ইপিআর-এর গুলীতে মারা গেছে ৬জন এবং আহত হয় ৫৩জন। আত্মরক্ষার জন্যে একজন ইপিআর সদস্য গুলি ছোঁড়ে। তাতে নিহত হয়েছে চারজন এবং আহত হয়েছে তিনজন। সারা প্রদেশে সেনাবাহিনীর গুলীতে মৃতের সংখ্যা হচ্ছে ২৩জন এবং আহতের সংখ্যা ২৬জন। ২রা মার্চ ৩রা মার্চ যখন সদরঘাটে সেনাবাহিনীর উপর জনতা আক্রমণ করে, তখন নিহত ৬জন এবং তরা মার্চ স্থানীয় টেলিভিশন কেন্দ্রে জনতা চড়া হলে নিহত ১জন এ সংখ্যার মধ্যে শামিল রয়েছে। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬৮]
মানুষ সরকারী এ বক্তব্য বিশ্বাস করেনি। বিশ্বাস যে করেনি একথাও ঐ বিবরণের সাথে পাওয়া গেছে। বলা হয়েছে, “বাঙ্গালীরা হতাহতের সংখ্যা বিশ্বাস করলো না। তারা ভাবলো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আসল ঘটনা খাটো কর দেখানো হয়েছে। বরং তারা খবরের কাগজের উচ্চকণ্ঠ চিৎকৃত হেডলাইনগুলোকেই বিশ্বাস করলো। খবরের কাগজগুলো হেডলাইন করলো, ‘কয়েকশত বুলেটবিদ্ধ ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে’, সেনাবাহিনীর গুলীতে হাজার হাজার লোক নিহত’, ‘নিরপরাধ নারী-শিশুরাই আক্রমণের শিকার’ ইত্যাদি’।’[নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬৯] তখন এ বাস্তব অবস্থার বিবরণ দেয়ার সাথে সাথে সংবাদপত্র ও সরকারী প্রেস বিজ্ঞপ্তির একটা ব্যর্থতা সম্পর্কেও একটা বড় ক্ষোভের প্রকাশ এখানে দেখতে পাওয়া যায়। ঐ ক্ষোভে বলা হয়েছে, “প্রেস বিজ্ঞপ্তি ও সংবাদপত্র যা রিপোর্ট করতে ব্যর্থ হলো, তাহলে অবাঙ্গালীদের যাতনা। আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসবাদীদের হাতে যারা সর্বক্ষণ যাতনার শিকার হচ্ছিল। কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, আওয়ামী লীগের এ ডিফ্যাক্ট শাসনামলে তাদের নৃশংসতার বিবরণ প্রকাশ করা হোক। কিন্তু পিণ্ডি কর্তৃপক্ষ এ প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করেন। তারা এ ব্যাপারে দুটো কারণ দর্শান। প্রথমত কর্তৃপক্ষ বলেন, এ প্রস্বাবের পক্ষে গেলে দ্বি জাতিতত্ত্বকে (মুসলমান মুসলমানকে হত্যা করেছে) অস্বীকার করা হয়। দ্বিতীয়ত এটা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিশোধস্পৃহা জাগিয়ে তুলতে পারে। সেখানে এক বিরাট সংখ্যক বাঙ্গালী শান্তিতে বসবাস করছে। [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬৯]
৬ মার্চ তারিখে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকলেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে, যে যে কারণে ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন মুলতবি করা হয়েছিলো, সেসব কারণ কিন্তু ৬ মার্চ তারিখে দূর হয়নি। বরং দু পারের নেতা মুজিব ও ভুট্টোর ফারাক আরও বহু যোজন বেড়ে গিয়েছিলো, অবিশ্বাসের ভিত আরও মযবুত হয়েছিলো। উপরন্তু শেখ মুজিব আগের চেয়ে আরও কঠোরতর অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এ পরিস্থিতিতেই ইয়াহিয়া স্থগিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আবার ডাকলেন। অর্থাৎ ইয়াহিয়া খান সেই পানিই খেলেন, কিন্তু আরও ঘোলা করে খেলেন, সেই পথেই তিনি ফিরে আসলেন,কিন্তু আরও অনেক ক্ষতি করে এলেন। পূর্ব পাকিস্তানের একজন রাজনীতিক এ বিষয়টির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি পূর্ব-পাক জামায়াতের আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম। তিনি ৭ মার্চ তারিখে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বললেন, “অধিবেশন স্থগিতের কারণসমূহ দূরীভূত হয়েছে কি? যদি না হয়ে থাকে, তাহলে পরিষদের অধিবেশন পুনরায় ডাকা হলো কিভাবে? সেসব কারণে বর্তমান থাকা সত্ত্বেও যদি অধিবেশন ডাকা যেতে পারে, তাহলে আগে তা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছিলো কেন? কেন নির্বাচনের পর উদ্বোধনী অধিবেশন বিলম্বিত হলো? নব ঘোষিত তারিখ এতো পিছিয়ে দেয়ার কারণ কি? প্রেসিডেণ্ট জনাব ভুট্টোর কোনো দোষই খুঁজে পাননি। অথচ ভুট্টো সাহেব অধিবেশন স্থগিত করা না হলে খাইবার থেকে করাচী পর্যন্ত তুমুল আন্দোলন শুরু করার হুমকি দেন এবং বার বার ৩রা মার্চের অধিবেশনে যোগ দেবেন না বলে ঘোষণা করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষাক্ত করে তোলেন। আমি জি জনাব ভুট্টোকে প্রশ্ন করতে পারি যে, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পূর্বাহ্নিক সমঝোতা ছাড়া ২৫শে মার্চের অধিবেশনে যোগদান করার ব্যাপারে কিভাবে রাজী হলেন? কোনো চুক্তি ব্যতিরেকেই যদি তিনি এখন অধিবেশনে যোগ দিতে প্রস্তুত হয়ে থাকেন, তবে আগে তিনি অচলাবস্থা সৃষ্টি করলেন কেন?” [দৈনিকস সংগ্রাম, ৮ মার্চ, ১৯৭১] প্রশানগুলোর জবাব কেউ কখনও দেননি।
শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের কোনো সরকারী প্রতিক্রিয়া তৎক্ষণিকভাবে পাওয়া গেলো না। তবে ঢাকা সামরিক প্রধানের উক্তি নাকি এ রকম ছিলো যে, “বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই সবচেয়ে উত্তম ভাষণ।” [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬৬] ভুট্টোও কিছু প্রকাশ করলেন না। ৮ মার্চ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, শেখ মুজিবের বক্তৃতা বিবেচনা করে দেখার পর তিনি মত প্রকাশ করবেন। [দৈনিস সংগ্রাম, ৯ মার্চ, ১৯৭১] তবে পশ্চিম পাকিস্তানের নসরুল্লাহ খান, মিয়া নিজামুদ্দীন এবং পূর্ব পাকিস্তানের খাজা খয়ের উদ্দীন, আতাউর রহমান খান, খান ও সবুর এবং নূরুল আমীন এক বিবৃতিতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছে আবেদন রাখলেন। ‘দেশকে রক্ষা করুন’ শিরোনামে তাদের বিবৃতি প্রত্রিকায় প্রকাশিত হলো। [দৈনিস সংগ্রাম, ৮ মার্চ, ১৯৭১] এ দিন এ বিষয়ে একটি ছাত্র সংগঠনের [আওয়ামী লীগপন্থী ও বামপন্থী সকল ছাত্র সংগঠন ৩রা মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতা ঘোষণার অনুকুলে স্বাধীনতার পক্ষে এবং মুজিবের আপোস প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে করজ করেছিলো।] বিবৃতিও সংবাদে প্রকাশিত হয়। ইসলামী ছাত্র সংঘের ঐ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন মুলতবি সংক্রান্ত ঘোষণার পর থেকে দেশে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে যে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, বর্তমানের সামরিক সরকার তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন যার ফলশ্রুতিতে দেশ এক মারাত্মক পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে। সামরিক সরকার যদি আন্তরিকভাবেই দেশের কোটি কোটি মানুষের কল্যাণ কামনা করে থাকেন, তাহলে তাদের উচিত এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে সামরিক শাসন তুলে নেয়া এবং জনপ্রনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এছাড়া সংকট উত্তরণেল আর কোনো বিকল্প নেই।’ [দৈনিস সংগ্রাম, ৯ মার্চ, ১৯৭১]
৮ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে হরতাল কর্মসূচীর ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা ও শিথিলতা ঘোষণা করলেন:
(১) সকল ব্যাংক বেলা ৮টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ব্যাংকিং কাজের জন্যে খোলা থাকবে এবং বেলা ৩টা পর্যন্ত প্রশাসনিক কাজের জন্যে খোলা থাকবে। শুধুমাত্র জমা, বাংলাদেশের মধ্যে আন্তঃব্যাংক ক্লিয়ারেন্স এবং নিম্নলিখিত কারণে লেনদেনের জন্যে ব্যাংক খোলা থাকবে।
(ক) বেতন এবং গত সপ্তাহের বেতন দান।
(খ) ১ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যক্তিগত তোলা।
(গ) মিল ফ্যাক্টরী চালাবার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় শিল্প কাঁচামাল যেমন পাট ও আখ কেনার জন্যে টাকা তোলা।
২. স্টেট ব্যাংক বা অন্য কোনোভাবে বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাচার করা চলবে না।
৩. উপরোক্ত ব্যাংকিং কাজ চালানোর জন্যে শুধুমাত্র স্টেট ব্যাংক খোলা থাকবে। অন্য কোনো উদ্দেশ্য নয়।
৪. ইপি ওয়াপদা বিদ্যুত সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় বিভাগ শুধুমাত্র খোলা রাখবে।
৫. পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন সংস্থা শুধুমাত্র সার সরবরাহ ও পাওয়ার পাম্পের জন্য ডিজেল সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে চালূ থাকবে।
৬. ইটখোলার জন্যে কয়লা সরবরাহ চালু থাকবে এবং পাটবীজ ও বীজ ধান সরবরাহ কার্যকরী থাকবে।
৭. খাদ্যশস্য সরবরাহ চলাচল অব্যাহত থাকবে।
৮. উপরোল্লিখিত যে কোনো উদ্দেশ্য শুধুমাত্র চালান পাস করার জন্যে ট্রেজারী ও এ. জি অফিস খোলা থাকবে।
৯. ঘুর্নিদুর্গত এলাকাসমূহে রিলিফ ও পুনর্বাসন কাজ অব্যাহত থাকবে।
১০. পোস্ট ও টেলিগ্রাম অফিস শুধুমাত্র বাংলাদেশের ভেতরে চিঠিপত্রে, টেলিগ্রাম ও মনি অর্ডার প্রেরণের উদ্দেশ্যে চালু থাকবে। তবে প্রেস টেলিগ্রাম বাইরেও প্রেরণ করা যাবে। পোস্ট অফিস সেভিংস ব্যাংক খোলা থাকবে।
১১. পূর্ব পাকিস্তান সড়ক পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশের সর্বত্র কাজ চালিয়ে যাবে।
১২. পানি ও গ্যাস সরবরাহ চালু থাকবে।
১৩. স্বাস্থ্য রক্ষা ও স্যানিটেশন সার্ভিস কার্যকরী থাকবে।
১৪. পুলিশ শান্তি-শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করে যাবে। প্রয়োজন সাপেক্ষে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবীরা তাদেরকে সহায়তা করবে।
১৫. যাদেরকে হরতাল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, সেগুলো ছাড়া বাকি সব আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠান হরতাল পালন করতে থাকবে।
১৬. গত সপ্তাহে যেগুলোকে হরতালের আওতামুক্ত করা হয়েছিলো, সেগুলো বলবৎ থাকবে। [দৈনিক সংগ্রাম, ৯ মার্চ, ১৯৭১।]
৯মার্চের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করাতে ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি. এ. সিদ্দিকীর অস্বীকৃতি। এ তারিখেই জেনারেল টিক্কা খান ‘খ’ অঞ্চল অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের মার্শাল-ল’ এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ তারিখ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর হিসেবেও তার দায়িত্ব গ্রহণের কথা। কিন্তু সংবাদগপত্রের খবরে বলা হয়, ঢাকা হাইকোর্টে হরতাল দরুন কোনো বিচারপতি পূর্ব পাকিস্তানের নবনিযুক্ত সামরিক গবর্নরের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে সম্মত হচ্ছেন ন। [দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ মার্চ, ১৯৭১।] মার্চের ৯ তারিখে পল্টন ময়দানে মাওলানা ভাসানীর জনসভা অনুস্ঠিত হলো। এ জনসভায় আতাউর রহমান খানও বক্তৃতা করলেন। ন্যাপ প্রধান মাওলানা ভাসানী তাঁর বক্তৃতায় বললেন, “সাত কোটি বাঙ্গালীর মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। পূর্ব বাংলাকে এটি পৃথক রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমেই দেশের দু অঞ্চলের তিক্ততার অবসান হতে পারে। সংহতি এখন অতীতের স্মৃতি এবং কোনো শক্তিই এখন বাংলার পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে বাঁচার অধিকারকে নস্যাত করতে পারবে না। দুই পাকিস্তান হলে সৌহার্দ বৃদ্ধি পাবে, ব্যবসায় ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের উন্নতি হবে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামেরসাথে কেউ আপোস করতে পারে না। আপোসের দিন শেষ হয়ে গেছে। ইয়াহিয়া ঢাকায় এলে মুজিব তাঁর সাথে বাঙ্গালীর দাবী নিয়ে আপোস করতে যেতে পারে না। শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু বা যে বন্ধুই হোক না কেন আপোস করতে গেলে পিঠের চামড়া খুলে ফেলবো। ….. আমি ৩১টি সমিতির সভাপতি ছিলাম, তার একটি সমিতির সেক্রেটারী ছিলো শেখ মুজিব। শেখ আমার ছেলের মতো। আমি তাকে হাতে খড়ি দিয়ে রাজনীতি শিখিয়েছি। তাকে আপনারা অবিশ্বাস করবেন না। ……. জনাব ভুট্টোর পরিষদ বর্জনের হুমকি নজীরবিহীন ঘটনা। আযাদী পূর্বকালে ভারতীয পার্লামেণ্টে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও পার্লামেণ্টে যোগ দেবে না এরূপ কথা বলেনি। আইন পাসের ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ গলের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘিষ্ট দল পরিষদে বাধাদান করেছে, যুক্তিতর্ক, ন্যায়বিচার ও ইনসাফের দোহাই দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে বুঝাবার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত ওয়াক আউট করেছে। ভুট্টোর উচিত ছিলো সেই গণতন্ত্রের পথ অনুসরণ করা।” [দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক সংগ্রাম, ১০ মার্চ, ১৯৭১।] জনাব আতাউর রহমান খান তাঁর বক্তৃতায় কালবিলম্ব না করে জাতীয সরকার ঘোষণা করার জন্যে শেখ মুজিবের কাছে দাবী জানান। তিনি বলেন, ‘ভানুমতির খেলা শুরু হয়েছে। চারদিকে ষড়যন্ত্রের জাল ফেলা হয়েছে। এ ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করতে হবে। কাজেই আপনি পরিষদের কথা ভুলে যান এবং জাতীয় সরকার ঘোষণ করুন।’ [দৈনিক পাকিস্তান, ১০ মার্চ, ১৯৭১] মাওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান প্রমুখের এ চাপ নির্বাচনের আগে থেকে শুরু হয়েছিলো। কিন্তু আওয়ামী লীগের ছাত্র ও যুব অংশের সাথে এদের কথাবার্তার লক্ষ্যণীয় পার্থক্য বর্তমান। ৯ মার্চ আরেকটা বিবৃতি প্রকাশ পায় তা অধ্যাপক গোলাম আযমের। তিনি তাঁর আগের দাবীর পুনরাবৃত্তি করে বলেন, “অধিবেশনের পুনঃ আহ্বান স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা মোটেই শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অনুকুল নয়। যদি ২৩ বছর যাবত শাসনতন্ত্র ছাড়াই দেশকে পরিচালনা করা সম্ভব হয়ে থাকে, তবে আমাদেরকে আরও কিছুকাল অপেক্ষা করা উচিত। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অজুহাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করার কোনো যুক্তি নেই। ….. বর্তমানেশেখ মুজিবুর রহমানই কার্যত দেশের প্রশাসক এবং সরকারী কর্মচারী সহ সকলেই একমাত্র তাঁর নির্দেশই পালন করছে। আমি অতিসত্বর সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্যে আমার পূর্ব দাবীর পুনরুল্লেখ করছি।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ১০ মার্চ, ১৯৭১] জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এসব বক্তৃতা-বিবৃতির পাশাপাশি জাতীয় পত্র-পত্রিকাও এদিন তাদের মত প্রকাশ করে। আওয়ামীলীগপন্থী ইংরেজী দৈনিক ‘দি পিপল’ লিখলো: ‘In vies of the Latest offer of Shaikh Mujib, however, a solution of the unfortunate crisis may be possible, if this is considered with an unbiased mind’ [‘ The People’ ১০ মার্চ, ১৯৭১, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭২৭] অর্থাৎ শেখ মুজিবের সর্বশেষ প্রস্তাবের আলোকে উদ্ভূত দুর্ভাগ্যজনক সংকটের সমাধান সম্ভব যদি তা পক্ষপাতহীন মন নিয়ে বিবেচনা করা হয়। দৈনিক পাকিস্তান (আজকের দৈনিক বাংলা) বললো, “লঘিষ্ট দলের নেতা ভুট্টো সাহেবের জেদাজেদিতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার ফলে পরিস্থিতি কতদূর গড়াইয়াছে, সে সম্পর্কে সরকার নিশ্চয়ই অবহিত। সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেই প্রকশ, সারা পূর্ব বাংলায় সপ্তাহব্যাপী গোলযোগে ১৭২ ব্যক্তি প্রাণ হারাইয়াছেন, আহত হইয়াছেন ৩৫৮ জন। যথাসময়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইলে এতগুলি অমুল্য প্রাণ বিনষ্ট হইত না। কাজেই আমরা আশা করি, সরকার স্পষ্ট এবং পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নিয়া জনপ্রতিনিধিদের নিকট অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তারের ব্যবস্থা করিবে।” [দৈনিক পাকিস্তান, ১০ মার্চ, ১৯৭১, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭২৮] দৈনিক সংগ্রাম লিখলো: “দেশের এই চরম অনিশ্চয়তা ও সঙকটের মুখে দাঁড়িয়ে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষই দাবী করছে, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত। শেখ সাহেবকে জাতীয় নেতা হিসেবে মেনে নিতে আর কোনো গড়িমসিই হওয়া উচিত নয়। যদি তা না হয় এবং এ অনিশ্চয়তার দ্রুত অবসান না ঘটে, তবে তা আর এক অনিশ্চয়তা আর এক সংকটই ডেকে আনবে।” [দৈনিক সংগ্রাম, ১০ মার্চ, ১৯৭১]
দশই মার্চ শেখ মজিব পরিস্থিতি সম্পর্কে সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দিলেন। বিবৃতিটি ছিলো সংকটের সমাধানের দিকে না গিয়ে সামরিক সরকার কর্তৃক পূর্বপাকিস্তানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং পূর্ব পাকিস্তানস্থ জাতিসংঘ দফতর থেকে লোক সরিয়ে নেয়া বিষয়ে। তিনি বললেন, ‘জনগণের ইচ্ছাই বাংলাদেশের প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। সেক্রেটারিয়েট, সরকারী ও আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠান, কোর্ট, রেলওয়, বন্দসহ সরকারের প্রতিটি শাখাই বাংলাদেশের জনগণের নামে আমাদের জারিকৃত নির্দেশাবলীই মেনে চলছে। যারা মনে করছে শক্তির বলে আমাদের উপর তাদের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দেবে তাদের স্বরূপ বিশ্বের সামনে উদঘাটিত হয়ে গেছে। বিশ্বের জনমত ও পশ্চিম পাকিস্তানের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকেও তারা নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের উপর শক্তির নৃশংস প্রয়োগের যৌক্তিকতা বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। তা সত্ত্বেও হঠকারী গণবিরোধী শক্তি তাদের বেপরোয়া কর্মপদ্ধতিতেই জিদ ধরে রয়েছেন। সমরসজ্হা অব্যাহত রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রতিদিনেই অস্ত্র শস্ত্র ও সৈন্য আনা হচ্ছে।…. আজ কাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথাল্ট এখানে অবস্থানরত জাতিসংঘ কর্মচারীদের অপসারণের অনুমতি দিয়ে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি জানমালের প্রতি যে হুমকির সৃষ্টি করেছে তার স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে তাঁর অনুভব করা উচিত যে, শুধু জাতিসংঘের কর্মচারীদের অপসারণ করেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।….. বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি অর্জন ও স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য শেষ অবধি সংগ্রাম এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ১১ মার্চ, ১৯৭১]’ এ ১১ মার্চ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জনাব তাজউদ্দীন ব্যাংক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার জন্য অনেকগুলো নির্দেশ জারি করেন। লোকজনকে ব্যাংক থেকে প্রতি সপ্তাহে ব্যক্তিগতভাবে ১ হাজার এবং প্রতিষ্ঠানগতভাবে ১০ হাজার টাকা তোলার অধিকার দেয়া হয় [বাংলাশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৩৩-৭৩৪] মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয় এই তাখে ‘পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর, পৃথক রাষ্ট্র গঠন কর’ শ্লোগানসর্বস্ব একটা প্রচারপত্র বিলি করে। প্রচার পত্রটিতে স্বাধীন পূর্ব বাংলা গঠনের আহ্বান জানিয়ে পরিশেষে বলা হয়, ‘বর্তমান গণ সংগ্রামের পটভূমিতে ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আহূত জাতীয পরিষদে অংশগ্রহণের প্রশ্ন বিবেচনার পূর্বশর্ত হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান বর্তমানে ৪টি দাবী উত্থাপন করিতেছেন। এই দাবী হইল, সামরিক শাসন প্রত্যাহর কর, শাসন ক্ষমতা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে অর্পণ কর, সেনাবাহিনী ব্যাপরাকে লও, গণহ ত্যার তদন্ত চাই। বর্তমান গণ অভ্যুত্থানকে অগ্রসর করিয়া লওয়ার স্বার্থেই ২৫ মার্চের মধ্যে এই সকল দাবী পূরণের জন্যে সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন, সরকারের প্রতি অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখুন, ইয়াহিয়া সরকারকে দাবী মানিতে বাধ্য করুন।’ [বাংলাশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৩০-৭৩১] পূর্ব পাকিস্তানের অনেকগুলো ছোট ছোট সংস্থা সংগঠনের বিবৃতি এই দিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো। তারা সকলেই শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর দাবী করলো। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ইয়ার মার্শাল (অবঃ) আসগর খান সুস্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘প্রেসিডেণ্টের একমাত্র উপায় শেখ মুজিবের দাবী পূরণ করা।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ১১ মার্চ, ১৯৭১]
১১ মার্চ পিপলস পার্টি প্রধান ভুট্টো করাচী থেকে শেখ মুজিবের কাছে একটি দীর্ঘ টেলিগ্রাম পাঠালেন। টেলিগ্রামে ভুট্টো বললেন, “দেশের ঘটনাবলী সম্প্রতি যে মোড় নিয়েছে সেজন্যে আমি দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছি। দেশের এ সংকটে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের জন্যে আমি ব্যথিত। তাদের শোকে বিহ্বল পরিবারবর্গের প্রতি আমি সমবেদনা জানাচ্ছি। আমরা পাকিস্তানের জন্যে একটি নয়া সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। সে সমাজ এমন হবে যেখানে মানুষের উপর মানুষের শোষণ এবং অঞ্চলের উপর অঞ্চলের শোষণ থাকবে না। শুধুমাত্র শাসনতন্ত্রের মাধ্যমেই আসুন সকল পাকিস্তানীই এজন্যে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাই। আমরা সকলেই বিরাট সংকটের মুখে নিক্ষিপ্ত হয়েছি। দেশের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আমাদের উভয়েরই বিরাট দায়িত্ব রয়েছে এবং যে সংকট আমাদের সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছি, যখন পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য পাকিস্তানের দুই অংশকে অনতিবিলম্বে একটি সাধারণ সমঝোতায় অবশ্যই পৗঁছাতে হবে। দেশকে রক্ষা করতেই হবে এবং যে কোনো মূল্যেই রক্ষা করতে হবে। ….. আমি শীঘ্রই ঢাকা গিয়ে আপনার সাথে দেখা করে জাতীয় পরিষদ শাসনতন্ত্র রচনার জন্য কাজ চালিয়ে যেতে পারে। আমরা এসব সমস্যা নিরসনে ব্যর্থ হয়েছি জনগণ যেন এমন কথা বলতে না পারে এবং ভবিষ্যতেও ইহিাসযেনো এমন কথা লিখতে না পারে।” [দৈনিক সংগ্রাম, ১২ মার্চ, ১৯৭১] কিন্তু সংবাদ সংস্থা পিপিআই-এর খবরে বলা হলো, ১১ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্তও শেখ মুজিব ভুট্টোর কোনো টেলিগ্রাম পাননি।
১২ মার্চ ঢাকার দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা বৃটেরে ‘লণ্ডন টাইমস’-এ প্রকাশিত পিপলস পার্টি প্রদত্ত একটি বিজ্ঞাপনের ফটোকপি ছাপে। ফটো কপির সাথে প্রকাশিত রিপোর্টে দৈনিক সংগ্রাম লিখে, ‘সমগ্র দেশ এক চরম অনিশ্চয়তায় নিক্ষিপ্ত হলেও ভুট্টো সাহেবদের ষড়যন্ত্রের শেষ হয়নি। বাংলাদেশে, শুধু বাংলাদেশে কেন, সমগ্র দেশের অবিসংবাদিত ও বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতায় নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে অহেতুক ঘৃণা বিদ্বেষ প্রচার করেই এরা ক্ষান্ত হয়নি, বরং এরা বিদেশেও এ কুৎসা প্রচটারণার জাল বিস্তার করেছে। এজন্যে অত্যন্ত ব্যয়বহুল মাধ্যম বেছে নিয়েছে। লণ্ডনের বহুল প্রচারিত ও ঐতিহ্যবাহী সংবাদ ‘টাইমস’ –এর চতুর্থ পৃষ্ঠায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির একটি ডাবল কলাম বিজ্ঞাপনে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে যে কুৎসা প্রচার করা হয়েছে, তা অত্যন্ত গর্হিত। উক্ত বিজ্ঞাপনে বলা হয় : “আওয়ামী লীগের এমন অনেক যোগ্য ব্যক্তি রয়েছে যারা পাকিস্তান পিপলস পার্টির সাথে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের অধিকাংশের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি সম্মানজনক শাসনতান্ত্রিক সমঝোতার পক্ষপাতী। আওয়ামী লীগের উচিত নয় তাদের পথ রোধ করা এবং বৈপ্লবিক, অর্থনৈতিক ও সামাজি সংস্কার সাধিত হতে দেয়া উচিত যা একমাত্র ঐক্যবদ্ধ জনগণই অর্জন করতে পার।” [বিরাট বিজ্ঞাপনের অনূদিত অংশের মূল ইংরজী টেক্সটি এই: There are many capable person in Awami Leageue who desire an honourable constitutional settement with the pakistan People’s Party acceptable to the majority of the people on both the East and west, Pakistan. Awami league leader should not stand in their way and let through the radical social and economic refarms-which only a united people can achieve. দৈনিক সংগ্রাম, ১২ মার্চ, ১৯৭১] লণ্ডন টাইমস-এ প্রকাশিত পিপলস পার্টির এ ব্যয়বহু বিজ্ঞাপনটি দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জেগেছে, বিদেশী সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয়ার মতো বিদেশী মুদ্রা পিপলস পার্টি পাচ্ছে কোথা থেকে? এ অর্থ কি তাহলে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে কোনো অদৃশ্য হস্ত পিপলস পার্টিকে যুগিয়ে যাচ্ছে?” [দৈনিক সংগ্রাম, ১২ মার্চ, ১৯৭১]
আওয়ামী লীগ নেতা কামারুজ্জামানেরও একটা বিবৃতি ১২ মার্চ তারিখে প্রকাশিত হয়। ঐ বিবৃতিতে তিনি আন্দোলনের বিবরণ ও ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন যে, ‘বাংলাদেশকে শোষণমুক্ত করাই সংগ্রামের লক্ষ্য।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ১২ মার্চ, ১৯৭১]
জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, কিন্তু কোনোও পরিবর্তন আনতে পারলেন না। বোধহয় কিছু করার তাকিদেই তিনি ১৩ মার্চ এক সামরিক আদেশ বলে সামরিক বিভাগের কর্মরত বেসামরিক কর্মচারীদের ১৫ মার্চ যথারীতি কাজে যোগ দিতে নির্দেশ দেন। নির্দেশে এও বলা হয় যে, এর অন্যথা হলে অর্থাৎ কাজে যোগ না দিলে কেবল চাকুরী হতেই বরখাস্ত করা হবে না, উপরন্তু সামরিক আদালতের বিচারে সর্বোচ্চ দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হবে। [জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে’ ৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৭৭] কিন্তু সরকারী এ ঘোষণা মাটি পেল না, বরং আরও প্রতিক্রিয়ারই সৃষ্টি করলো। শেখ মুজিবুর রহমান ১৪ মার্চ আন্দোলনের কর্মসূচীর ৩৫টি নতুন বিধি ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন, ‘এ বড় দুঃখজনক যে, এমন পর্যায়েও কিছু অবিবেচক মানুষ সামরিক আইন বলে নির্দেশ জারি করে বেসামরিক কর্মচারীদের একাংশকে ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ এদেশের মানুষ সামরিক আইনের কাছে মাথা নত না করার দৃঢ়তায় একাট্টা। আমি তাই, সর্বশেষ নির্দেশ যাদের প্রতি জারি করা হয়েছে, তাদেরকে হুমকির কাছে মাথানত না করার আবেদন জানাই। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের ও তাদের পরিবারের পেছনে রয়েছে। তাদের ত্রাসিত করার উদ্দেশ্যে এই যে চেষ্টা তা বাংলাদেশের মানুষকে রক্তচক্ষু দেখাবার অন্যান্য সাম্প্রতিক চেষ্টার মতো নস্যাত হতে বাধ্য।’ [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিল পত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৩৮] তাই হলো। ১৫ মার্চ থেকে পরবর্তী দিবসগুলো বেসামরিক প্রশাসনতন্ত্র শেখ মুজিবের নির্দেশিত বিধি মুতাবেক দেশের প্রশাসন কার্য পরিচালনা করতে থাকে। [জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৭৭] পূর্ব পাক জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আযমের একটি বিবৃতি ১৩ তারিখে প্রকাশিত হলো। এ বিবৃতিতে তিনি বললেন, “সামরিক সরকারের একথা বুঝা উচিত যে, বুলেট ও বেয়নেট দ্বারা দেশের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষা করা যায় না। সামরিক সরকার দুষ্কৃতকারীদের কবল থেকে নিরীহ জনগণের জানমাল হেফাজত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। শেখমুজিবুর রহমানের আহ্বানে এবং জাগ্রত জনতার সাড়া প্রদানের ফলে প্রদেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা মোটামুটি বহাল হয়েছে এবং এটা অকাট্যরূপে প্রমাণিত করছে যে, জনগণের প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরই সমস্যা-সমাধানের একমাত্র পন্থা।” অধ্যাপক গোলাম আযমন প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘ইতিমধ্যেই যে দুঃখজনক রক্তপাত হয়ে গেল, স্থায়ীভাবে এর অবসান করুন। শক্তি প্রয়োগ ও রক্তপাতের পথ পরিহার করার একমাত্র উপায়ই হলো অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও ক্ষমতা হস্তান্তর।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ১৩ মার্চ, ১৯৭১] ১৩ মার্চ তারিখেই লাহোরে পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি ছাড়া অন্যান্য রজনৈতিক দলগুলোর, যাদের জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্ব আছে, একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠকে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ মুজিবের জাতীয় পরিষদে যোগদানের চার দফা শর্ত মেনে নেন এবং তাঁরা দাবী জানান যে, ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের বৈঠকের আগেই কেন্দ্র এবং প্রদেশগুলোতে অন্তর্ববর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হোক। এ মিটিং-এ হাজির ছিলেন জামায়াতে ইসলামী পার্লামেণ্টরী পার্টির নেতা অধ্যাপক গফুর আহমদ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পার্লামেণ্টরী পার্টির নেতা মুফতি মাহমুদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ পার্লামেণ্টরী পার্টির মিয়া মমতাজ দোলতানা ও সরদার শওকত হায়াত খান, জমিয়তে উলামায়ে পাকিস্তান- এর পার্লামেণ্টরী পার্টির নেতা মাওলানা শাহ আমদ নূরানী, কনভেনশন মুসলিম লীগ পার্লামেণ্টারী পার্টির জামাল মুহাম্মাদ কারেজা এবং মাওলানা জাফর আহমদ আনসারী ওসরদার মওলা বক্স সামরু সহ জাতীয় পরিষদের স্বতন্ত্র সদস্যগণ ন্যাপের ওয়ালী খান বৈঠকে হাজির থাকতে পারেননি; কিন্তু সিদ্ধান্তের প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল। পিপলস পার্টির বাইরে একমাত্র কাউয়ুম মুসলিম লীগই এ সিদ্ধান্তের সাথে ছিলো না। ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যে একটি প্রতিনিধি দল প্রেসিডেণ্টের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত বৈঠকে হলো। বৈঠক শেখমুজিবের সাথে দেখা করারও সিদ্ধান্ত নিলো। বলা হলো, ভুট্টোর সাথেও প্রতিনিধি দল দেখা করতে পারে। [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৩৬ : বৈঠকের পর সংবাদপত্রের জন্যে যে বিবৃতি দেয়াহয়, তার একাংশ বলা হয়: “So that we can effectively convey the soliedrity oof the people of West Pakistan with their brothers and fellow citizens in East Pakistan, as well as express our depest concern abpout the urgency of immediately resolving the present crisis and discuss our views with respect the ways and means of doing so, we request the president of Pakistan to grrant and immediate interview to a delegation of the parties and MNA`s represnted in this meeting, For the same purpose wi propose that a similar delegation should, proceed to Dacca and meet Shaikh Mujibar Rahman.
We call upon the people of west Pakistan to express, by all demcratic means their commitment to the integral soliderity of Pakistan and their consecrated sense of comradeship and identity with their blood brothers in faith and dwstiny, namely the people of East Pakistan.”]
১১ মার্চ ভুট্টো শেখ মুজিবের কাছে টেলিগ্রাম পাঠান। তাতে তিনি শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার কথা বলেন, সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনার কথা বলেন এবং তাঁর ঢাকা আসার আগ্রহের কথা জানান। কিন্তু ১৪ মার্চ তারিখেই তিনি করাচীর এক জনসভায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দিলেন। [দৈনিক পাকিস্তান (আজকের দৈনিক বাংলা) ১৫ মার্চ, ১৯৭১] পরদিন করাচীতে একসাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর এ বক্তব্য আরও পরিষ্কার করতে গিয়ে বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রতিনিধিত্বকারী পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পিপলস পার্টিকে উপেক্ষা করে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন বর্তমান সংকটের সমাধান হতে পারে না। তাঁর দল চায়, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর, তাহলে সে ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে হতে হবে। আমাদের মত এই যে, গণতান্ত্রিক বিধি মতে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মিলিতভাবেই শুধু দেশের প্রনিধিত্ব করতে পারবে। সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ যদি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘিষ্ঠ দলগুলোকে কেন্দ্রে প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে নেয়, তাহলে তাঁর প্রতিক্রিয়া কি হব। উত্তরে ভুট্টো বলেন, তাঁর দল পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সুতরাং তাঁর দলকে বাইরে রাখার অর্থ হলো পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করা। এ সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো আরও ঘোষণা করলেন, পাকিস্তানের দু অংশের ভৌগলিক দূরত্বের কারণে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসন তত্ত্ব’ এখানে চলতে পারে না। আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ইচ্ছার কথা বিবেচনা করতে হবে।’ [ The dawn, 16th march, 1971 এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৪৭-৭৪৮।]
ভুট্টো এখানে তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ভিত্তিক সংখ্যা গরিষ্ঠতা তত্ত্বকে বাতিল করলেন যা একক একটি দেশের জন্য অপরিহার্য। কার্যত ভুট্টো এখানে দেশকে দুই ভাগে ভাগ করে দুই প্রধানমন্ত্রী ও দুই পার্লামেণ্টের কথাই বললেন। ভুট্টো যে কথা পরিষ্কারভাবে বলতে চাইলেন তাহলো, শেখ মুজিবের দল আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে কি হবে সে সংখ্যাগরিষ্ঠতা যেহেতু পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছে তাই তাদের হাতে ক্ষমতা দেয়া যাবে না। জনাব ভুট্টোর এ বক্তব্য, এ মানসিকতা শুধু পূর্ব পাকিস্তানে নয়, পশ্চিম পাকিস্তানেও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো। পশ্চিম পাকিস্তানের বাহওয়ালপুর থেকে নির্বাচিত এম. এন. এ মিয়া নিজামুদ্দিন হায়দার ভুট্টোর ‘দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল’ ঘোষণাকে পাকিস্তানের জন্য দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভাবন বলে অভিহিত করেন। তিনি বললেন, দায়িত্বহীন ভুট্টো দুই শাসনতন্ত্র দুই সরকার এবং দুই দেশ চায়।’ রাওয়ালপিণ্ডি কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রেসিডেণ্ট খাজা মাহমুদ মাণ্টু বললেন, ভুট্টো জাতীয় সংহতির বিনিময়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চান।’ রাওয়ালপিণ্ডি কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রেসিডেণ্ট আসগর শাহ অনুরূপ উক্তি করে বললেন, ‘ভুট্টো ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া অন্য কিছু চিন্তাই করতে পারছেন না।’ করাচীর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সেখানে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে ভুট্টোর ‘দুই পাকিস্তান তত্ত্বকে’ দূরভিসন্ধিমূলক বলে অভিহিত করলেন। ভুট্টোর পিপলস পার্টির এম. পি. ও এম. এসন. ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য দলের সব এম. পি. ও এম. এন. এ’রা ভুট্টোর বক্তব্যকে শত্রুতা ও প্ররোচনামূলক বলে অভিহিত করেন। জামায়াতে ইসলামী পার্লামেণ্টরী পার্টির নেতা অধ্যাপক গফুর আহমদ বললেন, ভুট্টো শুধুমাত্র তাঁর ক্ষমতায় যাওয়ার স্বার্থে দেশকে দুই ভাগে ভাগ করতে চান।’ পাঞ্জাব জোনের কাউন্সিল মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারী খাজা মুহাম্মাদ সফদার ভুট্টোকে দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি এবং দেশকে ধ্বংসের মুখোমুখি এনে দাঁড় করাবার দায়ে অভিযুক্ত করলেন। রাওয়ালপিণ্ডি বিভাগের জামায়াত প্রধান মাওলান ফতেহ মুহাম্মদ খান ভুট্টোর কথাবার্তাকে স্ববিরোধীর ঝুলি বলে আখ্যায়িত করেন। ইয়ার মার্শাল আসগর খান বলেন, পাকিস্তানের দুই অংশে দুই মেজরিটি পার্টির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ভুট্টোর দাবী অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তিনি বললেন, রাজনৈতিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তান বলে কোনো জিনিস নেই। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ কয়েকটি প্রদেশের সমাহার। আসগর খান মন্তব্য করেন, শেখ মুজিবই প্রকৃতপক্ষে দেশকে এক রাখার চেষ্টা করছেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির নওয়াবজাদা নারসরুল্লাহ খান ভুট্টোর প্রস্তাবকে গণতান্ত্রিক আচরণের সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন। পূর্ব পাক জামায়াতের আমীর গোলাম আযম বললেন, ‘ভুট্টো তাঁর দূরভিসন্ধি চরিতার্থের জন্যে নির্বাচনের পর থেকেই দেশকে ভাগ করার ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন। দেশকে এ সংকট থেকে মুক্ত করার জন্যে প্রেসিডেণ্টের উচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।’ নেজামে ইসলাম ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম-এর জেনারেল সেক্রেটারী মাওলানা সিদ্দিক আহমদ বলেন, ‘ভুট্টোর ভয়ংকন ভূমিকা দেশে আজ একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। দেশকে দ্বিখণ্ডিত করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ভুট্টোর বিচার হওয়া উচিত।’ নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জনাব মুহাম্মাদ মাহমুদ বললেন, পাঞ্জাবের মানুষকে ঠিক করতে হবে তারা এক পাকিস্তান, না দুই পাকিস্তান চায়, যখন তাদের নেতা দুই পাকিস্তানের শ্লোগান তুলেছে। পাঞ্জাবের লোকরাই তাকে নেতা বানিয়েছে, সুতরাং তাদের দায়িত্ব নেতৃত্ব তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া। ভুট্টো এবং কাইয়ুম খানই আজ জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বাধা।’ আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেণ্ট করাচীতে বললেন, ভুট্টোর কথাগুলো সত্য-মিথ্যার এক বিরাট স্তুপ।’ পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব সাইয়েদ খলিল আহমাদ তিরমিযি এবং করাচী সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি জনগণকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বললেন, ভুট্টো দেশকে দুই ভাগে ভাগ করতে চান। ভুট্টোর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত উদ্ধৃতিগুলো জনাব মওদুদ আহমদের ‘Bangladesh cnstitutional Quest For Autonomy Page-235-237’ এবং ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৪৯-৭৫২ এবং ৭৫৩ গ্রন্থদ্বয় থেকে গৃহীত।]
ভুট্টোর পিপলস পার্টির এবং কাইয়ুম খানের মুসলিম লীগ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক নেতা এবং নির্বাচিত এম. পি ও এম. এন. এ রা এক বাক্যে ভুট্টোর বিরোধিতা করলেন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বললেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে এ বিষয়টি বুঝিয়ে তাদেরকে সোচ্চার করার ক্ষেত্রে তাঁরা ব্যর্থ হলেন। বেলচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ভুট্টোর অবস্থানটা কিছু দুর্বল হলেও পাঞ্চাব ও সিন্ধুতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আর এ পাঞ্জাব ও সিন্ধুই ছিলো ইয়াহিয়ার ভাষায় ‘ক্ষমতার দুর্গ’। সুতরাং ভুট্টোর বিরুদ্ধে উত্থিত প্রতিবাদ প্রতিক্রিয়া কোনো ফল দিতে সেখানে ব্যর্থ হলো। যেন ইয়হিয়ার কান পর্যন্তও তা পৌঁছাল না।
১৪ মার্চ ঢাকায় আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটল। ঢাকার দৈনিক সংবাদগুলো তাদের প্রথম পাতায় একযোগে একই সম্পাদকীয় প্রকাশ করলো। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব যখন জাতীয় পরিষদে যোগদানের জন্যে চারটি শর্ত আরোপ করেছে, ভুট্টো যখন পাকিস্তানের দুই অংশে দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বলছে, ইয়াহিয়া যখন তাঁর ‘আইন কাঠামো’র কংকাল নিয়ে বসে আছেন এবং জাতীয় পরিদের অধিবেশন ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ভবিষ্যত যখন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত, তখন জাতীয় সংবাদপত্রগুলো একযোগে একটা অভিমত প্রকাশ করা নিঃসন্দেহে একটা ঐতিহাসিক মূল্য বহন কর। ‘আর সময় নেই’ শীর্ষক সম্পাকীয়তে পত্রিকাগুলো বললো: “আমরা ঢাকার সংবাদপত্রসমূহ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আজ সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিন এসেছে এবং এ মুহূর্তে এক বাক্যে এক সুরে কয়েকটি কথা বলা আমাদের অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেইশ বছরের ইতিহাসে জাতি আজ চরমভাবে সংকটে নিপতিত। দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক জীবন পদ্ধতি কায়েমের আশায় সমগ্র দেশ জীবনের সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচনে শরীক হওয়ার পর দেশের আজ এ অবস্থা। জনগণই দেশের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী; দেশের প্রশাসনিক কাঠামো কি হবে, কি ধরনের সরকারই বা কায়েম হবে, তা নির্ধারণের ক্ষমতার অধিকারী বেল তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই। গণতন্ত্রের যদি বিশ্বাস থাকে, তাহলে দেশের আইন কানুন প্রণয়ন বা রাষ্ট্র পরিচালার ব্যাপারে জনগণের প্রতিনিধিদের এ অধিকার কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এটি একটি মৌলিক রাজনৈতিক প্রতিবাদ্যও বটে। ক্ষমতায় আজ যারা সমাসীন আর ক্ষমতাসীনদের সাথে কানাকানি করার সুযোগ যাদের আছে, তাদের ব্যর্থতাই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির এ অবনতির কারণ। বহিরাক্রমণ থেকে দেশের সীমান্ত রক্ষাই হলো সামরিক বাহিনীর কাজ। রাজনৈতিক বিতর্কে হস্তক্ষেপ বা পক্ষ সমর্থন করা তাদের কোনো দায়িত্বের আওতায় আসে না।
জনগণের সংগ্রাম যাতে অহিংস পথেই পরিচালিত হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের হস্ত শক্তিশালী করাই আজ প্রয়োজন। দেশের দু অংশের মধ্যে ভবিষ্যত সম্পর্ক কি হবে, তা নির্ধারণের দায়িত্ব দেশবাসী জনসাধারণ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। আমরা মনে করি, আজ সময় এসেছে যখন প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খানকে রাজনৈতিক জীবনের এ বাস্তব সত্যগুলো স্বীকার করে নিতে হবে। আমাদের বিচারে প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার উচিত দেশের বুক থেকে সামরিক আইন তুলে নিয়ে অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে একটি মীমাংসায় উপনীত হওয়া যার ফলশ্রুতিতে জনগণের প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। [দৈনিক সংগ্রাম, ১৪ মার্চ, ১৯৭১]
জাতীয় সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে জাতির অভিমত প্রতিফলিত হয়। বিভিন্ন মতের পত্রিকাগুলো সম্মিলিত এ অভিমতকে তাই জাতীয় ঐকমত্য বলে অভিহিত করা যায়। দৈনিক পত্রিকাগুলো একক ও সম্পাদকীয় সম্পর্কে সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ‘দয়া করে অপেক্ষা করুন ও দেখতে থাকুন। আমি একটি সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছি। যতক্ষণ পর্যন্ত না জনগণের অধিকার আদায় করতে পারি, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাস করতে না পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলার জনগণ মুক্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ১ ৫ মার্চ, ১৯৭১]
এ সময় পর্দার অন্তরালে প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমনের প্রস্তুত চলছিল। ঢাকার পথে তিনি ১২ মার্চ করাচী এসে পৌঁছেছিলেন। তিনি আসছেন একথা সম্ভবত শেখ মুজিবকে জানানোও হয়েছিলো। ১৪ মার্চ তিনি সাংবাদিকদের জানালেন, ‘প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা এলে তিনি তাঁর সাথে আলোচনা করতে প্রস্তুত রয়েছেন।. [দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ মার্চ, ১৯৭১]
পাঁচ
প্রেসিডেণ্ট ১৫ মার্চ ঢাকা এলেন। ১৬ মার্চ বেলা ১১টায় প্রেসিডেণ্ট ভবনে মুজিব-ইয়াহিয়ার মধ্যে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠক চললো আড়াই ঘণ্টা। মুজিব প্রেসিডেণ্ট ভবনে প্রবেশ করেন বেলা ১১টায়, বেরিয়ে এলেন দেড়টায়। দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরা তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো প্রেসিডেণ্ট ভবনের গেটে। শেখ মুজিবের গাড়ী গেটে আসতেই সাংবাদিকরা তাঁর গাড়ি ঘিরে ধরলেন। মুজিব বেরিয়ে এলেন গাড়ী থেকে স্মিত হাস্যে। প্রেসিডেণ্টের সাথে আলোচনা সম্পর্কে একজন সাংবাদিকের এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বললেন, ‘দেশের রাজনৈতিক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে প্রেসিডেণ্টের সাথে তাঁর আলোচনা হয়েছে।’ আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন, আলোচনা এখনো শেষ হয়নি। মেহেরবানী কর এর বেশী কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। এটা দু এক মিনিটের ব্যাপার নয়। এজন্য পর্যাপ্ত আলোচনার প্রয়োজন আছে। [দৈনিক সংগ্রাম, ১৭ মার্চ, ১৯৭১]
প্রথম দিনের আড়াই ঘণ্টার এ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে কোনো সহকারী ছাড়াই একান্তে অনুষ্ঠিত হয়। [The People, ১৪ মার্চ, ১৯৭১] সম্ভবত আলোচনার সুপারিশ সৃষ্টির জন্যে সেনাবাহিনীকেও ব্যারাকে ফিরিয়ে আনা হয়্ এছাড়া সামরিক বাহিনী তলব সম্পর্কে তদন্তের জন্যে যে শর্ত আরোপ করা হয় শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে, তাও পূরণের জন্যে ১৭ মার্চ ঢাকার সামরিক আইন প্রশাসক একটি তদন্ত কমিটির নিয়োগের কথা ঘোষণা করেন। আর ১৭ মার্চ বিবিসি তার এক সাংবাদিক বুলেটিনে প্রচার করলো, ক্ষমতা হস্তান্তরের শাসনতান্ত্রিক ও আইনগত দিক সম্পর্কে পরামর্শ দেবার জন্যে বিচারপতি কর্নেলিয়াস ঢাকা এসেছেন। [দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ মার্চ, ১৯৭১] এ দিনই সকালে মাওলানা ভাসানী চট্টগ্রামে বললেন, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এ ধরনের ঘোষণা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে কোনোরূপ মতানৈক্য থাকতে পারে না। ……. প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া এবং শেখ মুজিবের মধ্যে আপোসের কোনা প্রশ্নই উঠতে পারে না। [দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ মার্চ, ১৯৭১]
১৭ মার্চ বেলা ১০টা ৫ মিনিট থেকে ১১টা ৭ মিনিট পর্যন্ত ইয়াহিয়া-শেখ মুজিব দ্বিতীয় দফা বৈটক অনুষ্ঠিত হয়। এ দিনও বৈঠক উভয়ের মধ্যে একাই অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে শেখ মুজিব অপেক্ষামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আলোচনা এখনো অব্যাহ রয়েছে এবং আমাদের মধ্যে আরও আলোচনা হতে পারে। তবে সময় নির্ধারিত হয়নি।’ আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে দেশী-বিদেশী সাংবাদিক অনেক প্রশ্ন করেন। উত্তরে শেখ মুজিব বিমর্ষ চিত্তে বলেন, ‘আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে, আমার কিছু বলার নেই।’ পরে বাড়ীতে পৌঁছে সাংবাদিকদের তিনি ঘরোয়াভাবে সাক্ষাত দান করেন। সেখানে আলোচনা ভেংগে গেছে কিনা এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ মার্চ, ১৯৭১] ১৬ মার্চ বিকেলে শেখ মুজিব তাঁর বাসভবনের সামনে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘জনগণ সত্য ও ইনসাফের জন্যে সংগ্রাম করছে এবং তাদের দাবীর প্রশ্নে কোনো আপোস হতে পারে না।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ মার্চ, ১৯৭১]
এ দাবীর জনপ্রিয়তা পশ্চিম পাকিস্তানেও বাড়ছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কিছু সংস্থা-সংগটন কর্তৃক শেখ মুজিবের ৪ দফা শর্তের প্রতি সমর্থন দানের কথা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ওয়ালী খান এদিন প্রেসিডেণ্টের সাথে ৭৫ মিনিট ধরে আলোচনা করেন। ১৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের একজন রাজনীকি পূর্ব পাক জামায়াতে ইসলামীর প্রধান অধ্যাপক গোলাম আযম এক বিবৃতিতে বললেন, ‘আমি পরিস্থিতি অনুধাবন করা এবং যে দলের প্রতি জনগণ পূর্ণ আস্থা স্থাপন করেছে, সে দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় কাজ সমাপ্ত করার জন্যে প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। কোনো শাসনতান্ত্রিক সমস্যাই ক্ষমতা হস্তান্তরকে বিলম্বিত করতে পারবে না। জনগণের সরকারের চেয়ে কেউই জাতির উত্তম সেবা করতে পারে না।…….. জনাব ভুট্টোর অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রয়াসের প্রতি প্রেসিডেণ্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ মার্চ, ১৯৭১]
১৮ মার্চ প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। এদিন শেখ মুজিবের একটি বিবৃতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। তিনি ঐ বিবৃতিতে সামরিক বাহিনী তলব করা সংক্রান্ত বিষয় তদন্তের জন্যে সামরিক সরকার কর্তৃক গঠিত কমিশন প্রত্যাখান কর এ কমিশনকে কোনো প্রকার সহযোগিতা না করার জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বিবৃতিতে বললেন, তথাকথিত কমিশন নিয়োগের যে ঘোষণা করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের তরফ থেকে উত্থাপিত দাবীকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হয়নি। সামরিক আইন আদেশের মাধ্যমে এর গঠন এবং সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের কাছে এর রিপোর্ট পেশের বিধানও অত্যন্ত আপত্তিকর। তাছাড়া কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়াবলীতেও সর্বপেক্ষা মৌলিক প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।’[দৈনিক সংগ্রাম, ১৯ মার্চ, ১৯৭১] এই সাথে শেখ মুজিব কি পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী কর্তৃক গুলী বর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল তা সরেজমিনে তদন্ত করে রিপোর্ট করার জন্যে খন্দকার মুশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং মিঃ আবিদুর রেজা খানকে চট্টগ্রামে পাঠালেন।’ [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৬৪] ১৮ মার্চ করাচীতে মিঃ ভুট্টো উচ্চপর্যায়ের দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার পর সাংবাদিকদের জানালেন, ‘প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে আলোচনার জন্যে ঢাকা সফরের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তা তিনি রক্ষা করতে পারছেন না। তিনি কতিপয় বিষয়ের ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। কিন্তু এ পর্যন্ত ঢাকা থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় আগামীকাল তিনি যদি ঢাকা যান, তবে তাতে কোনো লাভ হবে বলে তিনি মনে করেন না।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ১৯ মার্চ, ১৯৭১]
১৯ মার্চ সকাল দশটায় ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে তৃতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠকটি প্রেসিডেণ্ট ভবনে রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্টিত হয়। দেড় ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠকে ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের সাথে এদিনও কোনো সহকারী ছিলো না। আলোচনার পর বাসভবনে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে শেখ মুজিব বলেন, ‘প্রেসিডেণ্টের সাথে তিনি রাজনৈকি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।’ আলোচনার সাফল্য সম্পর্কে একজন বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন, ‘এটা খুব সাধারণ ব্যাপার নয়, এর জন্যে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন।’ প্রেসিডেণ্টের সাথে আলোচনায় কোনো লিখিত দলিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে কিনা প্রশ্ন করা হলে শেখ সাহেব ব লেন, এ ‘ধরনের কিছুই হয়নি তবে তাঁর উপদেষ্টগণ আজ (২০ মার্চ) বিকেলে আলোচনার পর ফর্মুলা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এবং তাঁরা কিভাবে অগ্রসর হবেন তাও ঠিক করা হবে।’ এ বৈঠকে দলীয় উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মুশতাক আহমদ, জনাব মনসুর আলী এবং ডঃ কামাল হোসেন শেখ সাহেবের সাথে থাকবেন বলে তিনি জানান।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ২০ মার্চ, ১৯৭১] ইতিমধ্যে ঊনিশে মার্চ সন্ধ্যাতেই শেখ মুজিবের তিনজন উপদেষ্টার সাথে প্রেসিডেণ্ট ভবনে ইয়াহিয়ার তিনজন উপদেষ্টার দু ঘণ্টা ব্যাপী এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠকে শেখ সাহেবের পক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং ডঃ কামাল হোসেন, আর প্রেসিডেণ্টের পক্ষে ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী, এ. আর. কর্নেলিয়াস, প্রেসিডেণ্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার জেনারেল পীরজাদা এবং সামরিরক বাহিনীর জজ এডভোকেট জেনারেল পীরজাদা এবং সামরিক বাহিনীর জজ এডভোকেট জেনারেল কর্নেল হাসান। [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৬৫] এদনি সন্ধ্যায় ভয়েস অব আমেরিকা তার সংবাদ ভাষ্যে জানালো, অন্তর্ববর্তীকালীন সরকার গঠন সম্পর্কে প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে আলোচনা চলছে। ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে উভয়ে আলোচনা করেছেন।’ [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৬৫] সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে ঊনিশে মার্চ শেখ সাহেব আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন। তিনি জানালেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে কোনো রাজনৈতিক নেতা তাঁর সাথে আলাপ করতে এলে তিনি তাঁদের সবসময় স্বাগত জানাবেন। …. আমি আমার দরজা কখনো বন্ধ করিনি, আমার ঘরের জরদা সদা উন্মুক্ত। [দৈনিক সংগ্রাম, ২০ মার্চ, ১৯৭১] শেখ মুজিবুর রহমান মিঃ ভুট্টোর দিকে ইংগিত করেই একথা বলেছেন যাতে মিঃ ভুট্টো ঢাকা আসতে রাজী হন।
২০ মার্চ প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে প্রথমবারের মতো তাঁদের উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। এদিন বৈঠক ২ ঘণ্টা ১০ মিনিটের মতো চলে। শেখ মুজিবের সাথে তাঁর উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজুদ্দিন আহমদ, খন্দকার মুশতাক আহমদ, জনাব মনসুর আলী, জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান ও ডক্টর কামাল হোসেন। আর প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার সাথে ছিলেন বিচারপতি এ. আর কর্নেলিয়াস, লেঃ জেনারেল পীরজাদা এবং জজ এটর্নি জেনারেল কর্নেল হাসান। আলোচনা শেষে প্রেসিডেণ্ট ভবন থেকে বাসায় ফিরে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনার কিছু অগ্রগতি হয়েছে। রাজনৈতিক সংকট সমাধানের পথে তারা এগুচ্ছেন। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘প্রেসিডেণ্ট পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন নেতাদের সাথে পৃথকভাবে আলাপ-আলোচনা করবেন। প্রয়োজনবোধে আমরাও যৌথভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সাথে আলোচনা করতে পারি। [দৈনিক পাকিস্তান, ২১ মার্চ, ১৯৭১]এদিন বিবিসি’র সংবাদ ভাষ্যে মন্তব্য করা হলো, পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সংকট দূরীভূত হচ্ছে।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ২১ মার্চ, ১৯৭১] সাংবাদিকদের কাছে শেখ মুজিব এদিন জানালেন, তাঁর উপদেষ্টারা প্রেসিডেণ্টের উপদেষ্টাদের সাথে পুনরায় পরিস্থিতি ও সমস্যাবলী সম্পর্কে আলোচনা করবেন। উপদেষ্টা পর্যায়ে পরবর্তী বৈঠক কখন অনুষ্ঠিত হবে এ প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন পর্যায়ে পরবর্তী বৈঠক কখন অনুষ্ঠিত হবে এ প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন বললেন যে, কয়েকটি খুঁটিনাটি বিষয় জানার অপেক্ষায় তাঁরা রয়েছেন। [দৈনিক পাকিস্তান, ২১ মার্চ, ১৯৭১]
২০ মার্চ করাচীতে তাড়াহুড়া কর আহূত সাংবাদিক সম্মেলনে মিঃ ভুট্টো বললেন, ‘গতকাল গভীর রাতে অবিলম্বে ঢাকা যাওয়ার জন্যে তিনি প্রেসিডেণ্টের নিকট থেকে অপর একটি আমন্ত্রণ পেয়েছেন এবং এ আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে আগামীকাল ঢাকা রওয়ানা হবার মনস্থ করেছেন।’ এদিন পাকিস্তান রেডিও’র খবরে বলা হয়, জনাব ভুট্টো ২০ সদস্যের একটি উপদেষ্টা দল নিয়ে ঢাকা যাচেনছন। [দৈনিক সংগ্রাম, ২১ মার্চ, ১৯৭১] শেখ মুজিবুর রহমান এদিন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিকর উত্তেজনা সৃষ্টির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এবং সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানালেন। [দৈনিক সংগ্রাম, ২১ মার্চ, ১৯৭১]
মিঃ ভুট্টো ২১ মার্চ বিকেলে ঢাকা এলেন। ঢাকা আসার পরপরই তিনি প্রেসিডেণ্ট ভবনে প্রেসিডেণ্টের সাথে এক আলোচনায় মিলিত হলেন। দুই ঘণ্টা ব্যাপী বৈঠকে কি আলোচনা হয়েছে সংবাদপত্রে তার কিছুই প্রকাশিত হয়নি। সাংবাদিকরা ভুট্টোর সাক্ষাত পায়নি। এ তারিখে প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবেরও একটা অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠক ৭০ মিনিট চলে। এ বৈটকের বিবরণও ঠিক আগের মতোই কিছুই জানা গেল না। তবে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের জানালেন, ‘আজকের বৈঠক আশ্চর্যজনক বা আকস্মিক এমন কিছুই নয়। প্রেসিডেণ্ট ও আমি যতক্ষণ এখানে আছি, ততক্ষণ প্রয়োজনের স্বার্থে যে কোনো সময় যে কোনো ব্যাখ্যার প্রশ্নে আমরা আলোচনায় মিলিত হতে পারি।’ উভয়ের মধ্যে আলোচনাকৃত ব্যাখ্যাসমূহের বিস্তারিত বিবরণ জানতে চাওয়া হলে শেখ মুজিব নীরব থাকেন। পরে বললেন, ইতিপূর্বের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কতিপয় প্রশ্নের ব্যাখ্যাসমূহের বিস্তারিত বিবরণ জানতে চাওয়া হলে শেখ মুজিব নীরব থাকেন। পরে বললেন, ইতিপূর্বের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কতিপয় প্রশ্নের ব্যাখ্যার ভিত্তিতেই এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয। আমরা নানাবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি।[দৈনিক আজাদ, ২২ মার্চ, ১৯৭১] এদিন দৈনিক আজাদ তার এক রাজনৈতিক রিপোর্টে লিখলো, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের চার দফা শর্তের ব্যাপারে একটা গ্রহণযোগ্য ফর্মূলা প্রণয়নের পরই মুজিবের চার দফা শর্তের ব্যাপারে একটা গ্রহণযোগ্য ফর্মূলা প্রণয়নের পরই মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছতে পারে এবং এ ফর্মূলা প্রণয়নের সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন ‘পাঞ্জাব প্রেসার গ্রুপ’-এর উপর নির্ভরশীল বলিয়া ওয়াকিফহাল মহল সূত্রে আভাস পাওয়া গিয়াছে।…… বঙ্গবন্ধুর প্রথম শর্ত অর্থাৎ সামরক শাসন প্রত্যাহারের প্রশ্ন একটি মহল যে বিরূপ চাপ অব্যাহত রখিয়াছে, তাহাতে কার্যতঃ মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনায় জটিলতা সৃষ্টি হইয়াছে।’ [দৈনিক আজাদ, ২২ মার্চ, ১৯৭১]
২২ মার্চ বেলা ১১টার দিকে প্রেসিডেণ্ট ভবনে মুজিব, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠক চলাকালেই প্রেসিডেণ্টের জনসংযোগ অফিসার বাইরে অপেক্ষামান সাংবাদিকদের এসে জানালেন, ‘প্রেসিডেণ্ট ২৫ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত ঘোষণা করেছেন। দেশের উভয় অংশের নেতাদের সাথে পরামর্শ করে এবং রাজনৈতক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমঝোতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের সুবিধার জন্যে প্রেসিডেণ্ট জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৭৫]
বৈঠক ৭৫ মিনিট পর্যন্ত চলে। বৈঠক শেষে বাসভবনে ফিরে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের জানালেন, এর আগে প্রেসিডেণ্টের সাথে তিনি যেসব আলোচনা করেছেন, তা প্রেসিডেণ্ট জনাব ভুট্টোকে অবহিত করেছেন। আলোচনা সম্পর্কে কিছু বলতে শেখ মুজিব অস্বীকার করেন। আলোচনায় অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চেয়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলে তিনি জানালেন, ‘যদি কোনো অগ্রগতি না হতো, তাহলে আমি কেন আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি?’ ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা সম্পর্কে শেখ সাহেবের প্রতিক্রিয়া একজন সাংবাদিক জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘একথা আমাদের জানা আছে যে, আমি বলেছিলাম আমাদের দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা অধিবেশনে যোগদান করবো না। ….. আমাদের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতেই অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে।’ শেখ মুজিব সাংবাদিকদের জানালেন, তিনি পুনরায় আজ )২৩ মার্চ) প্রেসিডেণ্টের সাথে দেখা করবেন এবং তাঁদের উভয় পক্ষের উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকও অনুষ্ঠিত হবে। [দৈনিক সংগ্রাম, ২০ মার্চ, ১৯৭১, দৈনিক পূর্বদেশ, ২৩ মার্চ, ১৯৭১ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, দ্বিতীয খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৭৫-৭৭৬] ২২ মার্চ সন্ধায় ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে পিপলস পার্টির প্রধান মিঃ জুলফিকার আলী ভুট্টো বললেন, ‘দেশের বর্তমান দুর্ভাগ্যজনক রাজনৈতিক সংকট নিরসনের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবুর রহমান ব্যাপক সমঝোতা এবং মতৈক্যে পৌঁছুতে সক্ষম হয়েছেন। সমঝোতার শর্তগুলো তাঁর দল পরীক্ষা করে দেখছে।….. ব্যাপক সমঝোতা এবং সমঝোতার বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রেসিডেণ্ট তাঁকে ইতিপূর্বে অবহিত করেন।’ [দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ মার্চ, ১৯৭১]
কিন্তু সমঝোতার বিষয়, শর্তাবলী, প্রকৃতি ইত্যাদি কোনো বিষয়েই কোনো পক্ষ থেকে কিছু জানা যাচ্ছিল না। সরকার তার মুখ একেবারেই বন্ধ রেখেছিলেন, আর শেখ মুজিবও কিছু বলতে রাজী হচ্ছিলেন না। তবে ২৩ মার্চ ঢাকার ইংরেজী দৈনিক ‘The People’-এর আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পাকিস্তানী আইনবিদ জনাব এ. কে. ব্রোহী এক বিবৃতিতে বললেন, “I have been asked to answer the question viz, whether there are any legal impediments in the way of lifting Martial law and transferring power to the people despite the fact that at present the constitution to be framed by the elected representatives of the people in not existence. The answer to this question purly from juristic point of vies is that there are no legal inprediments whatever. President yahaya who represents the sovereign power in terms of which existing constitutional dispensation is providing for the adminestration of public affires in the country is qualified to declarc that he shall no loonger exercise that will.
There is for us that historic precedent available for providing constitutional arrangemants for the admnestration of public affairs in the country. On the eve of the Independence the departing British power enacted the Indian Independence Act were contained the provisions in terms of which future governance of the country was to carried on by the two governor general and the Dominion legeslatures.
Provision were also made for the continuance of existing laws till itme as new constitution in the two dominious was enacted. If we look at that Act and substitute British power for martial Law power we would have complete analogy for understanding the situation which has arisen in the country, If political decision to transfer power is taken, then Martial law can be brought to an end by enacting a sort of self-efficacious decrce tto be signed by president Yahya where by power can be transferred to the electe representations of the people …..”[বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৭৭]
ব্রোহীর এ বক্তব্য থেকে বুঝা গেল, সমঝোতার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় নিয়ে সংকট চলছে, তার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের পন্থা-পদ্ধতিও একটি। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ব্রোহীর কাছ থেকে প্রকাশ্য বক্তব্য আসা বা নেয়ার কারণ বোধহয় এটাই।
প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিব উপলক্ষে প্রদত্ত তাঁর বাণীতে বললেন, ‘নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যাতে একটি সহজ ও কার্যকরী ব্যবস্থার মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অঞ্চলের উপযোগী সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে নির্বিঘ্নে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যেতে পারেন সেজন্য বর্তমানে সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট অবশ্যই দূর হয়ে যাবে। [দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ মার্চ, ১৯৭১]
তেইশে মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। এদনি সরকারী ও বেসরকারী ভবনগুলোতে পাকিস্তানের পতাকা উড়ার কথা, নানা অনুষ্ঠান হবার কথা। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। একমাত্র সামরিক সদর দফতর ও প্রেসিডেণ্ট ভবন ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উড়েনি। তার বদলে উঠেছে নতুন পতাকা-বাংলাদেশের পতাকা। ইংরেজী দৈনিক ‘দি পিপল’ লিখলো, A New flag is born today-a flag with a golden map of Bangladesh implemanted on a red circle Placed in the midle of deep green rectangle base. This is the flag for Independent’ Bangladesh. [The People, 23rd march, 1971] এ পতাকা ‘স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ, সরবরাহ করে এবং ২৩ মার্চ তা দেশব্যাপী উত্তোলনের জন্য তারা আহ্বান জানায়। [দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ মার্চ, ১৯৭১] শেখ মুজিবের ভবন শীর্ষেও সেদিন কালো পতাকার সাথে উড়ছিলো বাংলাদেশের পতাকা। ভোরে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় শ্রমিক পরিষদের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে (ছাত্রদের দ্বারা) শেখ মুজিবের বাসভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলো। পতাকা উত্তোলনের সময় গাওয়া হলো, ‘জয় বাংলা জয় বাংলা মাতৃভূমি বাংলার জয়।’ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে ঐ পতাকা নামায়। [দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ মার্চ, ১৯৭১] তেইশ তারিখে সকাল থেকেই শেখ সাহেবের বাড়ীর সামনে আসতে লাগলো শত শত মিছিল। তাদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্যেই শেখ মুজিব সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেন। সকালে তিনি বাড়ীর সামনে জয় বাংলা বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং তাদের এ উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। বিকেলে আওয়ামী লীগ মহিলা শাখার এক জংগী মিছিল কুচকাওয়াজ করে তাঁর বাসভবনে এলে তিনি তাদের উদ্দেশ্যেও কথা বলেন। শেখ মুজিব তাঁর এ দিনের বক্তৃতাসমূহে দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কথা পুনরায় ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন, আমরা শান্তিপূর্ণ শৃঙ্খলার সাথে আন্দোলন চালিয়ে যাবো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, নীতির প্রশ্নে আপোস হবে এবং দাবীকে দাবিয়ে রাখতে চাইলে আমরা চুপ থাকবো। [দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ মার্চ, ১৯৭১] উল্লেখ্য, ২৩ মার্চকে শেখ মুজিবুর রহমান ‘লাহোর প্রস্তাব দিবস’ আর স্বাধীন বাংরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলো। প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে ছাত্র শ্রমিক সভা অনুষ্ঠিত হলো। সভায় ছাত্র-শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ‘স্বাধীনতা’ রক্ষার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে সকলের প্রতি আহ্বান জানান। সভায় গৃহীত অন্য এক প্রস্তাবে সকল পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য বর্জনের আহ্বান জানানো হলো এবং এজন্যে ২৪ থেকে ৩৯ মার্চ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য বর্জন সপ্তাহ পালরে আহবান জানানো হয়। আরেকটি প্রস্তাবে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ভারত, সিংহল, বার্মা ইরান প্রভৃতি দেশের প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিকট কোনো প্রকার অস্ত্র সাহায্য, বিক্রয় অথবা সেনাবাহিনীর জন্যে স্থল পথ, জল পথ ও আকাশ পথ ব্যবহারের অনুমতি না দেয়ার জন্যে আবেদন জানানো হলো। [দৈনিক সংগ্রাম, ২৫ মার্চ, ১৯৭১]
শেখ মুজিবের সাথে কোনো বৈঠক এদিন জেনারেল ইয়াহিয়ার হলো না তাঁদের উপদেষ্টাদের মধ্যেও নয়। তবে এদিন মিঃ ভুট্টোর সাথে প্রেসিডেণ্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার জেঃ পীরজাদার একটি বৈঠক প্রেসিডেণ্ট ভবনে ৭৫ মিনিট ব্যাপী চলে। বৈঠক থেকে ফেরার পর মিঃ ভুট্টো সাংবাদিকদের বললেন, প্রেসিডেণ্টের সাথে দেনি তাঁর বৈঠকের কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি আরো জানালেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ফর্মুলা সম্পর্কে তাঁর দলীয় নেতাদের সাথে আলোচনায় তিনি সারাদিন কাটিয়েছেন। গত সোমবার সারা রাতও এ ফর্মূলা নিয়েই আলোচনা করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে ভুট্টো জানালেন, যতদিন ঢাকায় তাঁর থাকা প্রয়োজন, ততদিন তিনি থাকবেন। [দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ মার্চ, ১৯৭১] ভুট্টোর পিপলস পার্টির ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য দলের নেতারা এদিন শেখ মুজিব এবং প্রেসিডেণ্টের সাথে সাক্ষাত করেন এবং সংকট নিরসনে তাঁদের ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। উল্লেখ্য, পশ্চিম পাকিস্তানের এসব নেতা আগেই শেখ মুজিবের চার দফা দাবীর প্রতি সমর্থন দান করেন। তেইশে মার্চ করাচীতে জাতীয পরিষদে প্রতিনিধিত্বকারী পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট দলগুলোর একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পিপলস পার্টির পশ্চিম পাকিস্তানের একমাত্র মুখপাত্র বলে উক্ত দলটি যে দাবী করছে সর্বসম্মতিক্রমে তা প্রত্যাখ্যান করা হলো। বলা হলো, সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই বর্তমান রাজনৈ তিক উত্তরণের একমাত্র উপায়। সভায় প্রেসিডেণ্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব এম এম আহমদকে অবিলম্বে বরখাস্ত করার দাবী জানানো হলো। বলা হলো এম এম আহমদই বর্তমান অচলাবস্থার জন্য দায়ী। [দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ মার্চ, ১৯৭১]
২৪ মার্চ তারিখেও শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে কোনো বৈঠক হবার খবর সংবাদপত্র এলো না। তবে তাঁদের উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক হয়্ প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবুর রহমান যেসব বিষয়ে নীতিগতভাবে মতৈক্যে পৌঁছেছেনস, সে সম্পর্কেই আওয়ামী লীগের তিনজন নেতা এদিন প্রেসিডেণ্ট ভবনে প্রেসিডেণ্টের উপদেষ্টাদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। আওয়ামী লীগের সে তিনজন নেতা ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং ডঃ কামাল হোসেন। বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে তাজউদ্দীন সাংবাদিকদের জানালেন, উপরোক্ত বৈঠকে তাঁরা তাঁদের সকল মতামত ব্যক্ত করেছেন। সে জন্যে তাঁদের দিক থেকে আর কোনো বৈঠকের প্রয়োজন নেই। তিনি বললেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের বক্তব্য ও ‘সম্পূর্ণ পরিকল্পনা’র ব্যাখ্যা দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। জনাব তাজউদ্দীন সাংবাদিকদের কাছে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে আরও বললেন, সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে আর কালবিলম্ব করলে আভ্যন্তরীন পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। [দৈনিক সংগ্রাম, ২৫ মার্চ, ১৯৭১] এদিন ২৪ মার্চ শেখ মুজিবের বাসভবনে পুরুষ-মহিলা-শিশুদের কমপক্ষে ৪০টির মতো মিছিল আসে। বাসভবনের সামনে এক সমাবেশে শেখ মুজিব বললেন, আমাদের দাবী ন্যায়সংগত এবং স্পষ্ট এবং সেগুলো গ্রহণ করতে হবেই। জনগণ জেগে উঠেছে এবং তারা ঐক্যবদ্ধ। পৃথিবীর কোনো শক্তিই তাদের দাবী দাবিয়ে রাখতে পারবে না।….. আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই, কিন্তু কেউ যদি তা না চায়, তাহলে তুমি আমাদের দমিয়ে দিতে পারবে না। আমি আশা করি, কেউ সে চেষ্টা করবেন না। লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে-বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’ [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৮২]
প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার সাথে এদিন মিঃ ভুট্টোর একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা হলো। আলোচনার পর প্রেসিডেণ্ট হাউজ থেকে হোটেলে ফিরে মিঃ ভুট্টো সাংবাদিকদের বললেন, আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে। আলোচনা চলছে, আমরা সামনে এগুতে পারছি। তিনি জানালেন, প্রেসিডেণ্ট, আওয়ামী লীগ এবং তাঁর উপদেষ্টাদের যুক্ত বৈঠক ব্যাপারটিকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারতো, কিন্তু তা এ মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরও বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের ব্যাপারে আমি আন্তরিক এবং আমি স্বীকার করি, পূর্ব পাকিস্তান বঞ্চনার শিকার হয়েছে। তিনি জানালেন, আলোচনার প্রয়োজনীয় নয়, তাঁর টীমের এমন কিছু লোক আজ ঢাকা থেকে চলে যাচ্ছে। যতদিন প্রয়োজন তিনি ঢাকা থাকবেন।’ এর আগে আলোচনার জন্যে প্রেসিডেণ্ট ভবনে যাবার সময় মিঃ ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেণ্ট ভবনে যাবার সময় মিঃ ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান যার উপর ঐকমত্য ও সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন, সে বিষয়ে আমি আমাদের উপদেষ্টাদের সাথে গত সারারাত ধরে আলোচনা করেছি। আমি চাই সংকটের শেষ হোক।’ [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৮১] জনাব তাজউদ্দীন এদিন তাঁর এক বিবৃতিতে রাজনৈতি সমাধান বানচালের চক্রান্ত সফল হতে না দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। অন্যদিকে লাহোর থেকে একজন পিপিপি নেতা পিপলস পার্টির সাথে পরামর্শ না করে কেন্দ্রে সরকার গঠনের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। [দৈনিক সংগ্রাম, ২৫ মার্চ, ১৯৭১]
পিপিআই-এর ২৪ মার্চের এক খবরে জানা গেল ২৫ তারিখে মিঃ ভুট্টোর উপদেষ্টারা প্রেসিডেণ্টের উপদেষ্টাদের সাথে বসছেন। মিঃ ভুট্টোও তার হেটেলে সাংবাদিকদের কাছে একথা বলেছিলেন। কিন্তু বৈঠক হয়েছিলো কিনা সে খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। তবে মিঃ তাজ উদ্দীনসহ আওয়ামী লীগের তিনজন নেতা ২৪ তারিখে প্রেসিডেণ্টের উপদেষ্টাদের সাথে বসার পর আর কোনো বৈঠক তাঁদের মধ্যে হয়নি। শেখ মুজিব ও প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া যে ফর্মুলার ব্যাপারে ঐকমত্য পৌঁছেছিলেন, তার সাথে মিঃ ভুট্টোকে একমত করানই ছিলো এ পর্যায়ের আলোচনার মুখ্য বিষয়। সম্ভবত এ কারণেই মিঃ তাজউদ্দীন ২৪ তারিখে তাঁদের আর বৈঠকে বসার প্রয়োজন নেই বলে উল্লেখ করেছিলেন। বুঝা যায়, শেখ মুজিব ও প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া যে ফর্মূলার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন, তা মিঃ ভুট্টোকে অবহিত করা এবং সম্মতি নেয়ার জন্য তাকে ঢাকা আনা হয়। এবং মিঃ ভুট্টো ঢাকা এসে এ বিষয় নিয়েই তাঁর পার্টি এবং প্রেসিডেণ্টের সাথে বৈঠক করেছেন। কিন্তু সমঝোতার বিষয়টা কি ছিলো, ত্রিপক্ষীয় এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ফল কি দাঁড়াল, তার কিছুই সংবাদপত্র এবং জাতি কেউই জানতে পারল না। পর্দার অন্তরালের এ বিষয়গুলো জানার জন্য আলোচনার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ওয়াকিফহালদের পরবর্তীদের বিবরণীর উপরই আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে। পঁচিশে মার্চের কালরাতের আগে শেখ মুজিবের আর মাত্র দুটো বিবৃতির সন্ধান এ সময় আমরা পাই। একটি ছিল পাট ব্যবসায় শুরু করা এবং আমদানি-রফতানি সম্পর্কিত তার নির্দেশ, অপরটি সৈয়দপুর, রংপুর ও জয়দেবপুরে জনতার উপর সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলী বর্ষণের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ গোটা দেশ ব্যাপী হরতাল আহ্বানের ঘোষণা সংক্রান্ত। [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৮৭]
১৫ মার্চ প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া ঢাকা আসার পর ২৫ মার্চে কালরাত পর্যন্ত প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া, শেখ মুজিব এবং ভুট্টোর মধ্যে কি নিয়ে কি ধরনের আলোচনা হয়েছিল, তাতে কার কি ভূমিকা ছিল, তা পরবর্তীকালে অনেকের কাছ থেকেই জানা গেছে। সেসব আলোচনা সামনে আসলে সে ঐতিহাসিক সময়ের একটা চিত্র সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রথমে সেই সময়ের ঘটনার একজন ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক জনাব মওদূদ আহমদ যে বিবরণ দিয়েছেন সেটা দেখা যাক। ‘Bangladesh Constitutional Quest for Autonomy’ গ্রন্থে লিখেছেন:
“রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া তাঁর কতিপয় জেনারেলকে সাথে নিয়ে ১৫ মার্চ ঢাকা এলেন। ১৬ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে কথাবার্তা চললো। পরে এর সাথে ভুট্টো এসেও যুক্ত হলেন। ইয়াহিয়া আগেরমতোই মুজিবের প্রতি আপোসমূলক আচরণ প্রদর্শন করলেন। এ পর্যন্ত যা ঘটেছে তার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং রাজনৈতিক সমাধানের তাঁর আন্তরিক আকাঙ্ক্ষার কথা জানালেন। এবার আলোচনার বিষয়বস্তু ১লা মার্চের আগের আলোচনা থেকে আলাদা হলো। এবারের আলোচনা পূর্ণ একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দিকে না গিয়ে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রকতি কেমন হবে তার উপরই কেন্দ্রভূত থাকলো। এটা ছিল জন-প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুযোগ সৃষ্টির জন্যে একটা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা ঠিক করার প্রশ্ন। শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের ও ফেডারেল সরকারের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণের প্রশ্নও এর সাথে জড়িত ছিলো। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যে মুজিব ও ইয়াহিয়া নিম্নলিখিত বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেনঃ
(১) সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং একটি প্রেসিডেন্সিয়াল প্রোক্লামেশনের মাধ্রমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।
(২) প্রাদেশিক ক্ষমতা সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের হাতে অর্পণ।
(৩) ইয়াহিয়ার হাতে প্রেসিডেণ্ট এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব থাকবে।
(৪) পূর্ব পাকিস্তান জাতীয পরিষদ সদস্যদের প্রথম প্রস্তুতিমূলক বৈঠক এবং তারপর শাসনতন্ত্রের চূড়ান্ত প্রণয়নের জন্যে জাতীয় পরিষদে যুক্ত অধিবেশন।
চতুর্থ প্রস্তাবটি শেখ মুজিব নিজেই দিয়েছিলেন এবং প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া তা অনুমোদন করেছিলেন। তাজউদ্দীন তাঁর ১৭ এপ্রিল, ’৭১ তারিখের বিবৃতিতে উল্লেখ করেছিলেন যে, ভুট্টোকে এ্যাকোমোডেট করা এ সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোকে এবংফেডারেল গভর্নমেন্টকে তাদের অবস্থান নিরূপণে সুযোগ দেয়ার জন্যে ইয়াহিয়া নিজেই এর প্রস্তাব করেছিলেন। কারণ ৬ ফা পুরোপুরি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর জন্যে প্রযোজ্য ছিলো না। পিপলস পার্টি প্রস্তাব করেছিলো, জাতীয় পরিষদ প্রথমে একক বডি হিসেবে অধিবেশনে মিলি হবে, তারপর দুটি কমিটি গঠন করবে। মুজিব এ প্রস্তাব ভুট্টোকে এ্যাকোমোডেট করার জন্যে গ্রহণ করেছিলেন।
মুজিবের এ-ই লক্ষ্য ছিলো। কিন্তু আন্দোলনের প্রকৃতি দেখে তিনি তাঁর কৌশল পরিবর্তন করেছিলেন। মুজিব আগে যা জাতীয পরিষদের মাধ্যমে চেয়েছিলেন, এখন তিনি তা পেতে চাইলেন ইয়াহিয়ার দ্বারা ঘোষিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে। যেহেতু শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্যে জাতীয় পরিষদ বসতে পারছিলো না এবং যেহেতু ভুট্টো এবং সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগ কর্তৃক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের বিরোধী ছিলো, তাই মুজিবের এ দৃষ্টিভংগীর পরিবর্তন। তিনি এখন প্রথমেই প্রদেশগুলো বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের হাতে ৬ দফার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয আইন প্রণয়নের এখতিয়ার সহ ক্ষমতা হস্তান্তর চাইলেন। এর দ্বারা তিনি জনগণকে শান্ত করতে পারবেন এবং একবার পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে গেলেই জাতীয় পরিষদে তিনি পাকিস্তানের জন্যে শানতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারবেন।
১৬ মার্চ মুজিব যখন ইয়াহিয়ার কাছে তাঁর চার দফা দাবী পেশ করলেন, তখন ইয়াহিয়া মুজিবকে কেন্দ্রে ভুট্টোর সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে বললেন। প্রস্তাবটি খুব মন্দ ছিলো না এবং মুজিব নীতিগতভাবে কেন্দ্রে এ ধরনের সরকার গঠনের বিরোধিতা করলেন না। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে বললেন, গণতান্ত্রিক বিধি অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবেতাঁকে মন্ত্রী পসন্দ করার ক্ষেত্রে চাপ দেয়া যাবে না মুজিবের প্রতিক্রিয়া দেখার পর ইয়াহিয়া বোধগম্য কারণেই এ পথে আর অগ্রসর হননি।
মুজিবের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য ছিলো প্রদেশগুলো বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে বিধিগত ও প্রশাসনিক ক্ষমতা নিরূপণ করা তিনি সেই ১৯৬৯ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন যখন ইয়াহিয়া এবং আইয়ুব তাঁকে এর অফার দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা ও মর্যাদা নির্দিষ্ট না করে তাঁর কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া অর্থহীন এবং বাঙ্গালীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার শমিল হবে। সুতরাং তিনি প্রথমেই প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর পসন্দ করলেন এবং প্রস্তাব করলেন যে, অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন। তখন ইয়াহিয়াও বুঝলেন যে, ১৯৬২ সালের মতো শাসনতন্ত্রে অধীনে মুজিব ও ভুট্টোকে এক কেবিনেটে পাওয়া সম্ভব নয়, তখন প্রদেশগুলোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে মুজিবের সাথে তিনি একমত হলেন।
মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যকার ১৭ ও ১৮ মার্চের আলোচনা ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের তৃতীয় সিডিউল ঘিরেই কেন্দ্রীভূত ছিলো। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের আইনগত ক্ষমতা নির্ধারণ নিয়েই তাঁদের আলোচনা চলছিল। ইয়াহিয়ার উপদেষ্টারা মত প্রকাশ করছিলেন যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের অধীনেই প্রদেশগুলো পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ এ প্রস্তাব সরাসরি বাতিল করে দিলো। ইয়হিয়ার উপদেষ্টা আরও বলেন, সামরিক বিধির অধীনে ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়া উচিত। কিন্তু যেহেতু আওয়ামী লীগের দাবীর প্রথমটিই ছিলো সামরিক আইন প্রত্যাহার, তাই এ প্রস্তাবের আওয়ামী লীগ বিরোধিতা করলা। ১৯ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া আবার বৈঠক হলো। বৈঠকে ইয়াহিয়া স্বীকার করলেন, প্রেসিডেন্সিয়াল অধ্যাদেশের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজী আছেন। তাঁরা আরও একমত হলেন, ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের যথেস্ট আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকা দরকার। ১৯ মার্চের বৈঠকের পর মুজিব খুবই আশান্বিত হলেন এবং তিনি আমাকে বললেন যে, ইয়াহিয়া ৬ দফা এমনকি এরও বেশী কনফেডারেশন পর্যন্ত মানতে রাজী আছেন। আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যার অবশেষে সমাধান হতে যাচ্ছে।’ সংবাপত্র এবং অন্যান্য মাধ্যমও আশাবাদ প্রকাশ করলো এবং জনগণও পুনরায় আশান্বিত হয়ে উঠলো। ঐদিন সন্ধায় আমি শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ করে সেনাবাহিনীর এ বোধদয় হলো কেমন করে? মুজিব উত্তরে বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনমতের মুকাবিলায় তাদের আর কোনো বিকল্প ছিলো না। তারা জানে, এ না হলে তারা পূর্ব পাকিস্তান হারাবে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অস্তিত্ব থাকবে না।’
ইয়াহিয়া ও মুজিবের মধ্যকার সমঝোতা অনুসারে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টারা একটা খসড়া প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণা তৈরি করলেন। মার্শাল-ল’ রেগুলেশনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে বিরোধিতা আওয়ামী লীগ করছিলো তা এর দ্বারা পূরণের ব্যবস্থা করা হলো। এ খসড়া ঘোষণা তৈরির লক্ষ্য ছিল জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বাস্তব সমস্যাসমূহ আলোচনার ভিত্তি তৈরি করা। খসড়া ঘোষণাটি কমবেশী ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রকে বিবেচনায় রেখেই প্রণীত হয়েছিলো। এতে প্রেসিডেণ্ট এবং কেন্দ্র ও প্রদেশিক সরকারের ক্ষমতা এ দায়িত্ব ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের মতোই রইলো। অবশ্য খসড়া দলিলটির ৭নং আইটেম পূর্ব পাকিস্তানের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হলো: ‘কেন্দ্রীয় আইনসভা পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সম্মত ব্যতিক্রমগুলো ছাড়া থার্ড সিডিউল অনুসারে আইন প্রণয়নের নিরংকশ ক্ষমতা ভোগ করবে।’
শেখ মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এ খসড়া ঘোষণাপত্রে খুবই হতাশ হলেন। আইন প্রণয়নের দিক দিয়ে তাঁদেরকে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের পর্যায়ে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। তাঁরা একে সামরিক জান্তার কালক্ষেপণকারী কৌশল বলে মনে করলেন। মুজিব খুবই ক্রুদ্ধ হলেন এবং তাঁদের প্রকৃত মতলবটা জানতে চাইলেন। তিনি এবং তাজউদ্দীন পরদিন (২১ মার্চ) সকালে ইয়াহিয়ার সাথে এক অনির্ধারত সাক্ষাতকারে মিলিত হলেন এবং জানতে চাইলেন তিনি (ইয়াহিয়া) সত্যিই কোনো রাজনৈতিক সমাধান চান কি না। বাইরের বিষ্ফোরণোন্মুখ অবস্থার কথা, যেখানে মানুষ স্বাধীনতার দাবী তুলেছে, তারা ইয়াহিয়াকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, তাঁরা অনির্দিষ্টকাল এ আলোচনা চালিয়ে যেতে পারবেন না। ইয়াহিয়া তাড়াতাড়ি মুজিবকে শান্ত করলেন এবং বললেন, তিনি মুজিবের শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলার সাথে একমত। ইয়াহিয়া মুজিবকে জানালেন যে, ঘোষণা চূড়ান্ত করার আগে আমাদের ঐকমত্যের ব্যাপারটা ভুট্টোকে অবহিত করার জন্যে তাকে আমি ঢাকা আসতে বলেছি।
ঐকমত্য অনুসারে ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা (Legislative powers) সুনির্দিষ্ট করে একটি প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণা আওয়ামী লীগ তৈরি করে দখিল করলো। ঘোষণার প্রস্তাবনায় বলা হলো। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্যে উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনেই এটা প্রণীত। আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত এ খসড়ায় প্রদেশ ও কেন্দ্রীয় সরকারে মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারটা ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেণ্ট আইয়ুবের কাছে পেশকৃত Onstitution Amendment Bill –এর অনুরূপ ছিলো। এ খসড়া ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানের ‘স্টেট অব বাংলাদেশ’ নাম সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছিল। এটা নতুন কোনো বিষয় ছিলো না। ১৯৬৯ সালের শাসনতন্ত্র সংশোধন বিলো ২(৫) ধারায় প্রদেশগুলোকে শাসনতান্ত্রিকভাবে এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিলো যে, যে নামে সে পরিচিত তা গ্রহণ করতে পারে।
আওয়ামী লীগের খসড়া ঘোষণায় রাষ্ট্রের নাম ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’ অক্ষুণ্ণ রাখা হলো এবং বলা হলো ঘোষণায় (Proclamation) গৃহীত সংযোজন, বিয়োজন ও সংশোধন সাপেক্ষে পাকিস্তান ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের বিধান অনুসারে পরিচালিত হবে। ইয়াহিয়া পাকিস্তানর প্রেসিডেণ্ট, সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং সেনাবাহিনীর কমাণ্ডার-ইন-চীফ হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবেন সে সুযোগ ঘোষণাটিতে রাখা হলো। ঘোষণার বিধান সাপেক্ষে প্রেসিডেণ্ট প্রশাসনিক হেড হিসেবে সাবেক শাসনতন্ত্রের সব ক্ষমতা ভোগ করবেন। তিনি প্রয়োজন অনুসারে উপদেষ্টা, ইত্যাদি ধরনের স্টাফ নিয়োগ করতে পারবেন। তবে তিনি জাতীয় পরিষদ কিংবা স্টেট এসেম্বলী বাতিল বা স্থগিত করতে পারবেন না। কেনদ্র ও প্রদেশগুলোর মধ্যে বিষয় বন্টনের মতো মৌল বিষয়ে বলা হলো, ফেডারেল আইন পরিষদ পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) ব্যাপারে ১২টি বিষয়ে আইন প্রণয়ন একক ক্ষমতা ভোগ করবে। বিষয়গুলো হলো:
(ক) Defense of Pakistan
(খ) Foreign Affairs, Excluding Froeign Trade and aid.
(গ) Citizenship, naturalization and aliens, including admission of persons into and departure of persons from Pakistan.
(ঘ) Currency, coinage, legal tender and the state Bank of Pakistan subject to paragraph 16 of the proclamation.
(ঙ) Public Debt of the Centre.
(চ) Standards and weight and measures.
(ছ) Property of the Centre, Wherever situated and the revenue from such property.
(জ) Cordination of international and inter-wing Communiction.
(ঝ) Elections to the office of the President, to the national Assembly and to the Provincial Assemblies, the Chief Election Commissioner and Election Commissioners, remuneration of the Speaker, Deputy Speaker, and other members of the National Assembly, powers, privilages and immnuities of the National Assembly.
(ঞ) Supreme Court of Pakistan.
The Service and Excution outside a province or a state of Proseses and judgements,
(ট) Offences against laws with respect to any of the matters enumerated above.
১৯৭১ সালে আগস্টে প্রকাশিত শ্বেতপত্রে পাকিস্তান সরকার অভিযোগ করলো যে, মুজিবের খসড়া ঘোষণাটি পাকিস্তানকে কনফেডারেশনে পরিণত করতে চাচ্ছিল। কারণ এতে ছিলো দুই শাসনতান্ত্রিক কনভেনশনের কথা- একটি পূর্ব পাকিস্তান, অপরটি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। যা ছিল একই সাথে ‘লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক’ এবং আওয়ামী লীগের ছয় দফার বিরোধী। এ কারণেই সামরক জান্তার কাছে তা ছিলো অগ্রহণযোগ্য।’ যদিও ঐ পরামর্শটা এসেছিলো ভুট্টোকে স্থান করে দেয়ার চিন্তা থেকে, তবু বিরাজমান অবস্থার আলোকে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা চলতে পারতো। কেউ একে ‘ফেডারেশন’ বলুক কিংবা ‘কনফেডারেশন’ মুজিব এর দ্বারা চেয়েছিলেন রাজনৈতিক সমাধানের একটা পথ খুঁজতে। একটি কনফেডারেশনের রূপ যদি হয় ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশসমূহের একটি ইউনিয়ন’, তাহলে আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত খসড়া ঘোষণায় রাষ্ট্রের যে রূপ তুলে ধরা হয়েছিলো তাকে সত্যিকার অর্থে কনফেডারেশন বলা যাবে না। যদিও সময়টা এমনই উত্তপ্ত ছিলো যে, পূর্ব পাকিস্তানের তরফ থেকে কনফেডারেশন, যার কথা জান্তা বলেছে, এর দাবী ওঠা অসম্ভব কিছু ছিলো না, তবু আওয়ামী লীগ কেন্দ্রের হাতে সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষমতা রেখে এক সার্বভৌম পাকিস্তানের প্রস্তাব তার খসড়া ঘোষণায় রেখেছিলো। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের এক বিবৃতিতে তাজউদ্দীন বলছিলেন, আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত খসড়া ঘোষণায় এম. এম. আহমদ তিনটি সংশোধনী এনেছিলেন যা আওয়ামী লীগ ভাষার সামান্য পরিবর্তন সাপেক্ষে গ্রহণ করেছিলো। এ ঐকমত্যের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ আশা করছিলো যে, খসড়া ঘোষণাটির ভিত্তিতে তাদেরকে অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
ইয়াহিয়া মুজিবের ঐকমত্য যা বলেছে তাহলো সামরিক শাসন তুলে নেয়া হবে, জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তান পর্যাপ্ত স্বায়ত্বশাসন ভোগ করবে। ভুট্টো ঢাকা এলেন মার্চের ২১ তারিখে। সেই দিনই প্রেসিডেণ্টের সাথে তিনি দেখা করলেন। প্রেসিডেণ্ট তাঁকে মুজিব-ইয়াহিয়া ঐকমত্যের বিষয়টা পূর্ণভাবে অবহিত করলেন। পরদিন একটি যৌথ বৈঠক ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করবে- ইয়াহিয়া এ আশ্বাসের ভিত্তিতে মুজিব একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে উপস্থিত হলেন যেখানে ইয়াহিয়া, মুজিব ও ভুট্টোই শুধু ছিলেন। এ বৈঠকে ভুট্টো কেন্দ্রে দুই মেজরিটি পার্টির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে আগ্রহ প্রকাশ করলেন, তিনি বললেন, কোনো শাসনতন্ত্রই জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের মেজরিটি অর্থাৎ পিপলস পার্টির অনুমোদন ছাড়া গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ভুট্টো দাবী করলেন যে, ক্ষমতা হস্তান্তর এবং শাসনতন্ত্র তৈরী উভয় ক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তানকে এক ইউনিট হিসেবে ধরতে হবে। ভুট্টোর এ দাবূগুলোর কোনোটিই মুজিবের জন্যে গ্রহণযোগ্য ছিল না। মুজিব কেন্দ্রে সরকার গঠনের আশা ত্যাগই করে বসেছিলেন। কিন্তু ভুট্টোকে একটা স্থান করে দেয়ার জন্যই তিনি অবশেষে এ আপোস ব্যবস্থায় রাজী হলেন যে, অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে জাতীয পরিষদ পূর্ব ও পশ্চিম দুই ভাগে বিভক্ত হবে যাতে করে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর ভুট্টোর কর্তৃত্ব থাকে।
ভুট্টো খুশী হলেন যে, মুজিব অন্তত জাতীয় পরিষদকে দুই ভাগে ভাগ করতে রাজী হয়েছেন। এটা পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা হিসেবে ভুট্টোর প্রতি স্বীকৃতিই শুধু নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যদের সমর্থন নিয়ে ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অবস্থান থেকেও মুজিবকে এটা সরিয়ে আনলো। জাতীয় পরিষদ এক হিসেবে বসবে না দুই, না কমিটিসমূহের আকারে বসবে, মুজিবের জন্যে এটা কোনো ব্যাপারই ছিলো না। তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠ। জাতীয় পরিষদ যখনই একক অধিবেশনে বসবে তিনি গোটা দেশের জন্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকারী। কিন্তু ভুট্টোকে এ স্বীকৃতি দেয়ার বিনিময়ে মুজিব যেটা চেয়েছিলেন তাহলো, পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পূর্ব পাকিস্তানের পর্যাপ্ত স্বায়ত্বশাসনের শাসনতান্ত্রিক নিশ্চয়তা। এ ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর ভুট্টো একে ‘ফলপ্রসু ও সন্তোষজনক’ বলে অভিহিত করলেন এবং জনগণকে এ ধারণা দেয়া হলো যে, সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে। এ বৈঠকে ২৫ মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি করার সিদ্ধাত গৃহীত হয়।
২৩ ও ২৪ মার্চ যখন ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত খসড়া ঘোষণা, অনুসারে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিস্তারিত আলোচনা চলছিলো, তখন ভুট্টো অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানকে বাড়তি কোনো অধিকার দেয়ার বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন এবং ফেডারেল তালিকা থেকে ‘ফরেন এইড ও ফরেন ট্রেড’ বাদ রাখার বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি উত্থাপন করেন। তিনি আরও মত প্রকাশ করলেন, সামরিক শাসনের উপস্থিতি ছাড়া প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর আইন বিরুদ্ধ হবে। এরূপ ঘোষণার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হলে কেন্দ্রীয় সরকার বলতে কিছু থাকবে না।
জেনারেল পীরজাদা এবং অন্যান্য সহ প্রেসিডেণ্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মিঃ এম. এম. আহমদ বৈঠকগুলোতে হাজির ছিলেন এবং খসড়া ঘোষণার বিস্তারিত আলোচনা করেন। ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের মধ্যে শেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৪ মার্চ বিকেলে। সেই পুরাতন বিষয় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের পরিমাণ প্রশ্নেই এ বৈঠক মুলতবি হয়ে যায়। শেখ মুজিবের উপদেষ্টারা যখন প্রেসিডেণ্ট হাউজ থেকে ফিরলেন তাঁদের খুব মলিন মনে হলো এবং তাজউদ্দীন আমাকে বললেন, “তারা তাদের সিদ্ধান্ত আমাদের আগামীকাল (২৫ মার্চ( জানাবে।” যা হোক, গোটা বিষয়টাকে অর্থহীন প্রয়াস মনে হলো।
২৪ মার্চ বিকেল পর্যন্, সরকারীভাবে আলোচনা চলছিলই, পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলো। ভুট্টো বাদে পিপলস পার্টির সব নেতাসহ পশ্চিম পাকিস্তানের সকল নেতাই ঢাকা ত্যাগ করলেন। কোনো একটা পরিকল্পনা যেন কার্যকর হতে যাচ্ছে এবং এ নেতৃবৃন্দ যেন সেনাবাহিনীর সে পরিকল্পনা জানতে পেরেছেন, তাঁদের ঢাকা ত্যাগকে তারই লক্ষণ বলে মনে হলো।
২৫ মার্চ বেলা ৯টায় ভুট্টো ইয়াহিয়অর সাথে দেখা করলেন এবং ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টারা যে শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছিরেন তার প্রতি চূড়ান্তভাবে তাঁর ‘না’ টা জানিয়ে দিলেন। যদিও প্রেসিডেণ্টের সাথে আলোচনার পর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় তিনি দাবী করলেন, ‘আমরা কোনো সমস্যা সৃষ্টি করছি না, তবু ভুট্টো বললেন, পূর্ব পাকিস্তান যে স্বায়ত্বশাসন চাচ্ছে তা স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞার বিচারে সত্যিই স্বায়ত্বশাসন নয়।’
ঐদিন (২৫ মার্চ) সকালেই ১০টার দিকে আমি ক্ষমতাসীন জেনারেলদের শেভ্রুলেট কারের একটি কনভয়কে প্রেসিডেণ্ট ভবনে ঢুকতে দেখলাম। জেনারেল হামিদ, ওমার, মিঠা, পীরজাদা এবং টিক্কা ইয়াহিয়ার সাথে একটি ভাগ্য নির্ধারণী বৈঠকে বসলেন যা চললো মাত্র ৩০ মিনিট। ফল হলো এই, ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শাসনতান্ত্রিক আলোচনার যে রেজাল্ট আওয়ামী লীগকে জানানোর কথা ছিলো, তা আর কোনো দিনই জানানো হলো না। ২৫ মার্চ বিকেলে মুজিব ক্যাণ্টনমেণ্ট সোর্সে জানতে পারলেন যে, রাজনৈতিক সমাধানের কোনো সম্ভাবনা নেই এবং সেনাবাহিনী তার অভিযানের জন্যে তৈরি হচ্ছে। বিকেলে ঐ একই উৎস থেকে মুজিবকে বলা হলো, ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেছেন। সেনাবাহিনীর আসন্ন অভিযানের রকম প্রকৃতি শেখ মুজিব অনুমান করতে পারলেন না। তিনি তাঁর চারদিকের সহকর্মীদের তৎক্ষণাৎ ঢাকা শহর থেকে সরে যাবার নির্দেশ দিলেন এবং তোফায়েল, রাজ্জাক প্রমুখ যুব নেতাদের বুড়িগঙ্গার ওপরে গ্রামাঞ্চলে সরে যেতে বললেন।
রাত সাড়ে দশটার দিকে একটা সেনা ইউনিট রেডিও ও টিভি স্টেশনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলো এবং সাড়ে এগারটা থেকে ব্যাপক আকারে গোলাগুলি শুরু হলো। মুজিব বাড়ীতে থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাজউদ্দীন ও আমি কয়েকজন বন্ধু সমেত হোটেল ইন্টারকন্টালে আটকা পড়েছিলাম। বাঙ্গালীদের প্রতি সহানুভূতিশীল সব বিদেশী সংবাদদাতারাও সেখানে অবস্থান করছিলেন। তাঁরাও আটকা পড়লেন। ভুট্টো ১১০০ নং স্যুটে অবস্থান করছিলেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে সেনাবাহিনীর ৫৮ থেকে ৬০টি গাড়ীর একটা বহর প্রেসিডেণ্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে আমাদের হোটেল অতিক্রম করে বাঁ দিকে ঘুরে শাহবাগের দিকে চলে গেল। সাথে সাথেই আমি হোটেল থেকে মুজিবের কাছে টেলিফোন করলাম। ফোনটা ধরলেন হাজী মোরশেদ। আমি তাকে জানাতে বললাম যে, আমার আশংকা আর্মি মুজিবের বাড়ী আক্রমণ করতে পারে। তাঁকে নিরাপদ স্থানে সরে পড়া দরকার। বারটা পঞ্চাশ মিনিটে মুজিবের বাড়ীতে পুনরায় টেলিফোন করলাম। এ সময়ও টেলিফোনের অপর পারে হাজী মোরশেদকে পেলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, মুজিব নিরাপদ জায়গায় সরেছেন কিনা। হাজী মোরশেদ কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘আমরা তাঁর পা ধরেছি এবং বার বার তাঁকে অনুরোধ করেছি বাড়ী থেকে সরে যাবার জন্যে। কিন্তু তিনি রাজী নন। তিনি দেখতে চান তাঁরা তাকে কি করে।’ রাত ১টা ১০ মিনিটের সময় যখন আমি পুনরায় মুজিবের বাড়ীতে টেলিফোন করার চেষ্টা করলাম। টেলিফোনের লাইন কাটা। মুজিব রাত ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে গ্রেফতার হন।” [Bangladesh : Constitutional Quest for Autonomy, Page 237-249 (Maudud Ahmad]
মার্চের ১৫ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত পর্দার অন্তরালে যা ঘটেছিলো, যার বিবরণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি, তার যে বিবরণ জনাব মওদূদের কাছ থেকে পাওয়া গেলো, তা থেকে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার। এক. জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত বিষয়ের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ ছিলো, দুই. প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণার মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে এবং বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই একমত হয়েছিলো, তিন, আওয়ামী লীগ তৈরি প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণার খসড়া প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু ভুট্টো এর সাথে একমত হননি, চার, ২৫ মার্চ সামরিক অভিযানের পূর্ব পর্যন্তও শেখ মুজিব আলোচনার ইতিবাচক ফল আশা করেছেন, পাঁচ, মুজিব-ইয়াহিয়া সম্মত ফর্মূলা গ্রহণ না করে পাপ করলো ভুট্টো, কিন্তু সামরিক হামলার শিকার হলো শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবের অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা রেহমান সোবহানও জনাব মওদুদের কথারই প্রতিধ্বনি করছেন। তিনি বলছেন:
“ইয়াহিয়া প্রকৃতপক্ষে মুজিবের সব দাবী শুরুতেই মেনে নিয়েছিলেন। এই মেনে নেয়াটা ভুট্টোকে বিক্ষুব্ধ করেছিলো, যার ফলে তিনি পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানে পৃথকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর দাবীর করলেন। এর দ্বারা তিনি দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভব ঘটালেন এবং গোটা পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলার শেখ মুজিবের অধিকার তিনি কেড়ে নিতে চাইলেন। পাঠান ও বেলুচরা ভুট্টোর এ মতের তীব্র বিরোধিতা করলো এবং বললো, যেহেতু এক ইউনিট হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো অস্তিত্ব নেই, তাই ভুট্টো বললে শুধু পাঞ্জাব ও সিন্ধুর পক্ষেই কথা বলতে পারেন।
এই পরস্পর বিরোধী দাবীর মুখে মুজিব কেন্দ্রের কোয়ালিশন সরকারের সম্ভাবনার সম্মুখীন হলেন। কিন্তু কোয়ালিশন গ্রহণ করলেও তিনি ১৬৭জন সদস্য ৮৭জন সদস্যের কাছে সংখ্যা সাম্য মানতে পারেন না। সংকট উত্তরণের জন্যে একটা সমঝোতা এভাবে হলো যে, প্রদেশগুলোর ক্ষমতা সংখ্যাগুরু দলের হাতে হস্তান্তর হবে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ইয়াহিয়াই কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকবেন। কিছু পরামর্শ এমন এলো যে, দলগুলো কেন্দ্রে উপদেষ্টা পাঠাবে।…. উল্লেখ্য যে, অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের আন্তঃপ্রাদেশিক বিষয়গুলো কেন্দ্রের হাতে থাকবে। এটা সহ অন্যান্য সব প্রস্তাবই অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়ের জন্যে। ভিন্ন ভিন্ন বৈঠকে নিজের কাজ সমাধা করার পর দুই অংশ, জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম একত্রে মিলিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্যে যুক্ত অধিবেশনে বসবে।
সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, আলোচনা ভেংগে পড়েনি। প্রকৃতপক্ষে মৌল সব বিষয়েই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। …… প্রকৃতপক্ষে ২৩ মার্চের বৈঠকটাই ছিলো শেষ বৈঠক এবং একটি চূড়ান্ত বৈঠকের আহ্বান কোনোই জবাব পায়নি। গোটা সময়ে ইয়াহিয়ার তরফ থেকে কোনোই প্রস্তাব উত্থাপিত হয়নি এবং বলেননি যে, ফায়সালার জন্যে তাঁর শর্তটা কি। সব আলোচনাই চলছিলো প্রেসডেন্সিয়াল ঘোষণায় আওয়ামী লীগের তৈরি খসড়া নিয়ে। এভাবে আওয়ামী লীগের কথা সবই প্রকাশ পেল, কিন্তু ইয়াহিয়া এবং তাঁর জান্তার মনোভাবটা বিশ্ববাসীর অজানাই থেকে যাচ্ছিল।
ভুট্টো তাঁর টিম নিয়ে ঢাকা এসেছিলেন এবং আলাদাভাবে প্রেসিডেণ্টের সাথে আলোচনা চালাচ্ছিলেন। আওয়ামী লীগ মনে করছিল তাদের আলোচনার ফল ইতিবাচক সিদ্ধান্তকারীই হবে। যেহেতু প্রেসিডেণ্টের কাছে ভুট্টোর ব্রিফিং পুরোপুরিই ছিলো, সুতরাং এ ভয় জাগেনি যে, ভুট্টো মুজিব-ইয়াহিয়া ঐকমত্যের বিরোধিতা করেন।
২৫ মার্চের রাত ১১টায় সেনা অভিযান শুরু হলো। এর কিছু আগে ইয়াহিয়া করাচী চলে গেলেন। যুদ্ধ এসে গ্রাস করলো আলোচনাকে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত একটি সমাধান, যা সেদিন পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারতো। সেনাতিদের হাতের মুঠোর মধ্যে ছিলো, কিন্তু তারা তা উপেক্ষা করলো।” [South Asian Revies, volume 4, Number 4, July, 1971 (Negotiating for Bangladesh : A participants’s view-Rehman Sobhan]
পাকিস্তান সরকার শেখে মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলো যে, তিনি কনফেডারেশনের প্রস্তাব দিয়ে প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানকেই ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। শেখ মুজিব নাকি এ লক্ষ্যেই জাতীয় পরিষদকে দুই ভাগ করে দুই শাসনতান্ত্রিক কনভেনশনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সামরিক সরকারের এ অভিযোগ যে মিথ্যা, তা উপরের আলোচনায় দেখা গেছে। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদও একথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। মুজিব নগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত নীতি নির্ধারণী ভাষণে তিনি এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে সবার কাছে তুলে ধরেন। তিনি বলেন:
“প্রতারণার কৌশল হিসেবেই ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে আলোচনায় আপোসমূলক মনোভাব প্রদর্শন করলেন। ১৬ মার্চ থেকে যে আলোচনা শুরু হলো তাতে ইতিমধ্যে যা ঘটে গেছে তার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং রাজনেতিক সমাধানের পক্ষে তাঁর আন্তরিক মনোভাব ব্যক্ত করলেন। বৈঠকে শেখ মুজিবের চার দফা শর্ত সম্পর্কে সামরিক সরকারের সুস্পষ্ট মনোভাব জানতে চাওযা হয়েছিলো। তিনি জানলেন যে, বড় ধরনের কোনো আপত্তি তাদের নেই। এবং তিনি বললেন, উভয় পক্ষের উপদেষ্টারা নীচের চারটি পয়েণ্টের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারে। উভয় পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারে। উভয় পক্ষে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত সেই চারটি পয়েন্ট হলো:
(ক) সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং প্রেসিডেণ্টের ঘোষণার (Presidential Proclamation) মাধ্যমে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।
(খ) প্রদেশগুলোর ক্ষমতা প্রদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের হাতে হস্তান্তর।
(গ) ইয়াহিযা প্রেসিডেণ্ট থাকবেন এবঙ কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করবেন
(ঘ) শাসনতন্ত্র চূড়ান্তকরণের আগে জাতীয় পরিষদের একক বৈঠকের আগে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যরা শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের জন্যে পৃথক ভাবে বৈটকে মিলিত হবে।
ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো যে কথাটা বলছেন, সত্য তার বিপরীত। ভুট্টোর দাবী পূরণের জন্যে জাতীয পরিষদের পৃথক বৈঠক প্রস্তাব ইয়াহিয়া করেছিলেন। তিনি তাঁর প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দেখান যে, ৬ দফা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে কেন্দ্রের সম্পর্ক নির্ধারণের একটা পরিকল্পনা, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে কেন্দ্রের সম্পর্ক নির্ধারণের একটা পরিকল্পনা, পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ দারুণ অসুবিধার সৃষ্টি করবে। এ কারণেই পশ্চিম পাকিস্তান ও কেন্দ্রের মধ্যে এক ইউনিট বাতিল হওয়া এবং ৬ দফার আলোকে একটা নতুন সম্পর্ক নির্মাণের সুযোগ পশ্চিম পাকিস্তানের এম. পি. দের দিতে হবে।
শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে একবার এ নীতিগত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবার পর বাকি ছিলো অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে কেন্দ্রের ক্ষমতা নির্ধারণের বিষয়টাই শুধু। আরও একটা বিষয়েও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। সেটা হলো, ক্ষমতার বণ্টনটা ছয় দফার ভিত্তিতে হবে। আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, আলোচনার কোনো পর্যায়েই আলোচনা ভেংগে পড়েনি কিংবা ইয়াহিয়া বা তার টিমের তরফ থেকেও এমন ইংগিত কখনও আসেনি যে, আলোচনা অচলাবস্থায় পৌঁছেছে যা অতিক্রম করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই যে নীতিগতভাবে একমত হয়েছিলো, তা ভুট্টোর ২৫ মার্চের সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্য থেকেও পরিষ্কার।
২৪ মার্চ ইয়াহিয়া ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাদের মধ্যকার শেষ বৈঠকের পর আওয়ামী লীগ খসড়া ঘোষণা চূড়ান্ত করার জন্যে জেনারেল পীরজাদার তরফ থেকে একটা ফাইনাল বৈঠকে যোগ দেবার আহ্বানের অপেক্ষা করছিলে। কিন্তু সে আহ্বান আর এলো না। তার বদলে ইয়াহিয়ার প্রধান আলোচক এম. এম.আহমদ আওয়ামী লীগকে কিছু না জানিয়েই হঠাৎ করাচীর পথে পাড়ি জমালেন।
২৫ মার্চ রাত ১১টার মধ্যে সেনাবাহিনীর লোকেরা নগরীর বিভিন্ন স্থানে তাদের অবস্থান নিতে শুরু করলো। সমসাময়িক ইতিহাসের এক নজিরবিহীন বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ঢাকার শান্তিপূর্ণ ও নিশ্চিত জনগণের উপর গণহত্যার এক সুপরিকল্পিত কর্মসূচী চাপানো হলো। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে কিছুই জানালেন না, তাঁর কোনো চূড়ান্ত প্রস্তাবও আওয়ামী লীগের কাছে পেশ করলেন না।” [Press statement issued by Mr. Tajuddin Ahmad, Prime Minister of Bangladesh, on 17th April, 1971-বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৯-৩১]
ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার শেষ মুহূর্তগুলোর আরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে মুজিবের আলোচনা টিমের অন্যতম সদস্য, পরবর্তীকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব ডঃ কামাল হোসেন এক দীর্ঘ সাক্ষাতকারের একটি অংশে তিনি বলেন:
“২৩ মার্চ ছিলো অস্বাভাবিক একটি দিন। এ দিনটি পাকিস্তান দিবস হিসেবে পালিত হয়ে এসেছে। কিন্তু আজকের দিনটি এমন ছিল যখন হাজার হাজার বাংলাদেশী পতাকা বিক্রি হচ্ছে। মনে পড়ে, সকাল ৬টার সময় আমার অফিস থেকে খসড়া ঘোষণার সংশোধিত কপি সহ শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে যাবার পথে নওয়াবপুর রেল-ক্রসিং থেকে একটা বাংলাদেশী পতাকা কিনলাম। ৭টার দিকে আমি শেখ মুজিবের বাসায় পৌঁছলাম। বহু মিছিল এলো এবং তার বাড়ীতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলো।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আওয়ামী লীগ টিম একটি গাড়ীতে প্রেসিডেণ্ট হাউজে প্রবেশ করলো। গাড়ীতে ছিলো বাংলাদেশের পতাকা। গাড়ীর এ পতাকা প্রেসিডেণ্ট হাউজে মোতায়েন সৈনিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো।
আলোচনা শুরু হলে এম. এম. আহমদ বললেন, তাঁর মতে ছয় দফা কর্মসূচী ক্ষুদ্র কয়েকটা বাস্তবমুখী পরিবর্তনসহ বাস্তবায়িত করা যাবে। জেনারেল পীরজাদা প্রস্তাব করলেন, এম. এম. আহমদ এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের অর্থ বিশেষজ্ঞদের সাথে বৈঠকে বসতে পারেন এবং তিনি নূরুল ইসলামের নাম করলেন। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ বিশেষজ্ঞ জনাব নূরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, রেহমান সোবহান এবং অন্যরা জনাব নূরুল ইসলামের বাসভবনে নিয়মিত বৈঠক করেই আসছিলেন এবং আওয়ামী লীগের সংশোধিত খসড়া ঘোষণার মুদ্রা ও অর্থ বিষয়ক ধারাগুলো তাদেরই সমর্থনে তৈরি। আওয়ামী লীগ টিম ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাগণ উত্থাপিত অর্থ বিশেষজ্ঞদের পৃথক মিটিং এর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁদের মতে এটা ছিলো সময় ক্ষেপণকারী একটা কৌশল।
২৩ মার্চ বিকেলের বৈঠকে এম. এম. আহমদ খসড়া ঘোষণার কিছু সংশোধন ও সংযোজন সম্বলিত চিরকুট হাজির করেন।
আওয়ামী লীগ টিমকে তাদের অর্থ বিশেষজ্ঞদের সাথে বসার জন্যে ছাড়া হলো। আওয়ামী লীগ অর্থ বিশেষজ্ঞদের বৈঠক অব্যাহতভাবে চলছিলো প্রফেসর নূরুল ইসলাম সাহেবের বাসভবনে। এম.এম. আহমদ উত্থাপিত সংশোধনীগুলো বৈঠকে আলোচনা করা হরো এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা, বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনা, ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়ে এক এক করে নীতিমালা তৈরি হলো সরকারী পক্ষের কাছে পেশ করার জন্যে।
এ অর্থনৈতিক নীতিমালা বিষয়ে আলোচনার জন্যে আওয়ামী লীগ টিম ২৩ তারিখ বিকেলে আবার আলোচনায় ফিরে গেলো। সেখানে তারা শুনলেন, প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া সারাদিন প্রেসিডেণ্ট হাউজ থেকে অনুপস্থিত আছেন। নানা ঘটনা থেকে প্রমাণ হলো, ২৩ মার্চ গোটা দিনই জেনারেলরা মিটিং এ কাটিয়েছেন। …… পরিস্থিতির এ অবস্থা থেকে প্রতীয়মান হলো যে, মুদ্রা ও অর্থনীতি বিষয়ে এম.এম. আহমদ আওয়ামী লীগ টিমের সাথে যে আলোচনা চালাচ্ছেন তা সময় ক্ষেপণ করে সামরিক সমাধানের পথ প্রশস্ত করার জন্যেই। ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত খসড়া ঘোষণার অর্থনৈতিক ধারাগুলো এক এক করে ক্লজ বাই ক্লজ পাঠ ও পর্যালোচনা সমাপ্ত হলো। অতপর আওয়ামী লগি টিম যখন ২৪ মার্চ বিকেলের আলোচনা বৈঠকে যোগদানের জন্যে প্রেসিডেণ্ট হাউজে যাত্রা করছিলেন, তখন শেখ মুজিব ইংগিত দিলেন যে, রাষ্ট্রের নাম আমাদের ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ প্রস্তাব করা উচিত। তিনি বললেন, তাঁদের আমাদের বুঝানো উচিত জনগণের যে সেণ্টিমেণ্ট তার কারণেই এটা প্রয়োজন। এ প্রস্তাব অংশত স্বাধীনতার জনপ্রিয় দাবীর প্রতিফলন যা বিশেষ করে গণ আন্দোলনের অগ্রবাহিনী মিলিট্যাণ্ট যুবকরা চাইছিলো। এ প্রস্তাব যখন সরকারী পক্ষের কাছে পেশ করা হলো, তারা এর তীব্র বিরোধিতা করলো এই বলে যে, আমাদের অবস্থানের এটা মৌলিক পরিবর্তন। আমরা যুক্তি দিলাম যে, সব বিষয় ও নীতিমালা যখন ঠিক থাকছে নিছক নামের একটা পরিবর্তনে মৌলিক পরিবর্তন হয় না। মনে হলো বিচারপতি কর্নেলিয়াস আমাদের যুক্তি বুঝালেন। কিন্তু তিনি আমাদের প্রস্তাবের পাল্টা বললেন, ‘কনফেডারেশন’-এর বদলে ‘ইউনিয়ন’ শব্দ গ্রহণ করা যেতে পারে। এরপর আওয়ামী লীগ টিম মত প্রকাশ করলো যে, মতপার্থক্যটা একটা শব্দ নিয়ে, এ মতপার্থক্যটা যদি আমরা দূর করতে না পারি, তাহলে বিষয়টার সমাধান শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার বৈঠকে হবে, যখন খসড়া ঘোষণার চূড়ান্তকরণ করা হবে।
এটা মনে হয়েছিলো, ২৪ মার্চের বিকেলের বৈঠক তাঁদের শেষ বৈঠক হবে, যেখানে আলোচনা উপসংহারে পৌঁছবে। কারণ আলোচনা চালিয়ে যাবার মতো পয়েণ্ট আর কমই আছে।
২৪ মার্চ বিকেলের আলোচনা বৈঠকে খসড়া ঘোষণার সব ক্লজ ও সিডিউল এক সাথে পড়া সম্পূর্ণ হলো। আমি তখন জরুরী বিষয় হিসেবে পীরজাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, খসড়া কখন চূড়ান্ত করা হবে? আওয়ামী লীগ পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হলো, আমি ও কর্নেলিয়াসকে আজ রাতেই খসড়া ঘোষণা চূড়ান্ত করার জন্যে বসা দরকার যাতে পরের দিন সকালেই এটা ইয়াহিয়া ও মুজিবের কাছে পেশ করা যায়। কর্নেলিয়াস এ প্রস্তাবের সাথে একমত হলেন। কিন্তু পীরজাদা বললেন, ‘না, আজ আমাদের আরও কাজ আছে, আপনারা আগামী কাল সকালে বসতে পারেন।’ আমি আবার পরামর্শ দিলাম, কাল ক’টায় বৈঠক হবে তা ঠিক করা হোক।’ কিন্তু জেনারেল পীরজাদা পুনরায় বাধা দিয়ে বললেন, ‘এটা টেলিফোনেই ঠিক করা যাবে এবং তার সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হবে।’ তারপর পীরজাদা আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘কখন ঘোষণাটা চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন?’ উত্তরে আমি বললাম, ‘আগামী পরশুর আগেই এটা হয়ে যাওয়া উচিত।’ এ সময় তাজউদ্দীন বললেন, ‘আওয়ামী লীগ টিম মনে করে তারা প্রত্যেকটি বিষয়ই বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, আর আলোচনার কোনো বিষয়ই অবশিষ্ট নেই। যা এখন বাকি তাহলো, খসড়া ঘোষণা শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার কাছে অনুমোদনের জন্যে পেশ করা। অনুমোদন হয়ে গেলেই প্রেসিডেণ্টের ঘোষণা জারি হতে পারে।’ তাজউদ্দীন-এর একথাটিকেই পরে এভাবে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ আলোচনা ভেংগে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এর মধ্যে’ সত্যের কোনো নাম-গন্ধ নেই। যখন বিস্তারিত আলোচনা হয়ে গেছে, তখন তো বাকি ছিলো শুধু শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার কাছে অনুমোদনের জন্যে পেশ করণার্থে খসড়া ঘোষণার চূড়ান্তকরণ করার কাজটিই।
দুর্ভাগ্রজনক ২৫ মার্চের গোটা দিন আমি পীরজাদা টেলিফোনের অপেক্ষা করেছি। কিন্তু সে টেলিফোনটি কখনই এলো না। অবশেষে ২৫ মার্চের রাত ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে আমি উঠে বাড়ী ফেরার জন্যে শেখ মুজিবের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলাম, তখন শেখ মুজিব টেলিফোনটি পেলাম কিনা জিজ্ঞেস করলেন। পাইনি তা আমি তাঁকে জানালাম। [The Daily News, March, 25, 1987]
দেখা যাচ্ছে, ২৫ মার্চে এসে ইয়াহিয়ার আলোচক দল ও শেখ মুজিবের আলোচক দলের মধ্যে দৃশ্যত পার্থক্যটা ছিলো মাত্র পাকিস্তানের নাম নিয়ে। আওয়ামী লীগ টিম প্রস্তাব করেছিলো পাকিস্তানের নাম হবে ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান।’ প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার টিম থেকে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয়েছিলো। এ মতপার্থক্যটা ছিলো খুবই ছোট। সন্দেহ নেই, শেখ মুজিব মিলিট্যাণ্ট ছাত্র-যুবক যারা স্বাধীনতার দাবী তুলেছিলো তাদের শান্ত করার জন্যেই এ প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। কোনোক্রমেই ছোট্ট এ বিরোধটা অনতিক্রম্য ছিলো না। আওয়ামী লীগ একথা বলেও ছিলো যে, বিষয়টার সমাধান উপদেষ্টা লেবেলে না হলে ইয়াহিয়া-মুজিবের শীর্ষ বৈঠকের জন্যে রেখে দেয়া যেতে পারে। যা হোক, সব বিবরণ থেকেই একথা পরিষ্কার যে, শেখ মুজিব দুই কূল রক্ষা হতে পারে এমন একটা রাজনৈতিক সমাধান আশা করছিলেন এবং এ কারণেই আমরা দেখি তিনি ২৫ মার্চ রাত সাড়ে দশটাতেও ডঃ কামাল হোসেনকে জেনারেল পীরজাদার টেলিফোন এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করছেন। কিন্তু তিনি টেলিফোনটা পেলেন না কেন? কেন জেনারেল পীরজাদা আওয়ামী টিমের কাছে মিথ্যা কথা বললেন? ইয়াহিয়া কেন অপেক্ষামান শেখ মুজিবকে কোনো কথা জানালেন না? কেন ইয়াহিয়া জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত রাজনৈতিক সমাধানের ফর্মূলায় উভয় পক্ষ একমত হওয়ার পর তার বাস্তবায়ন না করে এবং শেখ মুজিবের কাছে চূড়ান্ত কোনো বিকল্প প্রস্তাব না দিয়ে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাবে কিছুটা পাওয়া গেছে সেই সময়ে ঢাকায় কর্মরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার জনাব সিদ্দিক সালিকের কাছ থেকে। তিনি তাঁর ‘উইটনেস টু সারেণ্ডার’ (যার বাংলা অনুবাদক ‘নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল’) গ্রন্থে সেদিন পর্দার অন্তরালে যা ঘটেছিলো তার একটা ঘনিষ্ঠ বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন:
“ প্রেসিডেণ্ট বেলা ৩টায় (১৫ মার্চ) পৌঁছুলেন। পি এ এপ-এর স্কোয়াডন লিডার কাজী অবতরণ সেতুটি টেনে নিয়ে গেলেন। প্রেসিডেণ্ট বিমান থেকে নামলেন। তাঁর ফোলা চেহারা ও সুস্বাস্থ্য সতেজদীপ্ত জীবনীশক্তির পরিচয় বহন করছিলো। তিনি রীতি অনুযায়ী কথা বলছিলেন না। তবে তাঁর কথার ধনের আস্থা পরিষ্ফুট হয়ে ওঠে। যে বিমান চালকরা তাঁকে শ্রীলংকা ঘুরিয়ে উড়িয়ে নিয়ে এসেছিলো, তাদের প্রসংগ তুলে বলেন, ‘ওরা দারুণ সাহসী ছেলে। চমৎকার কাজ দেখিয়েছে।’ তারপর তিনি সবার সাথে হাত মেলালেন এমনকি আমার সাথেও। মনে হলো তাঁর বিবেক কিবা মনের উপর কোনো বোঝা নেই। রুটিন অনুযায়ী সেনা ইউনিট পরিদর্শন কালে তাঁকে যেমন ফাঁকা মনে হয় তেমনি মনে হলো। প্রতিটি মিনিটে, প্রতিটি ঘন্টায় এবং দিনের পর দিন ধরে আমরা যে বেদনাদায়ক পরিস্থিতির মধ্যে জীবন যাপন করেছি, সে সম্পর্কে তাঁর ভেতর কোনো প্রতিক্রিয়ার চিহ্ন পরিলক্ষিত হলো না।”
ইতিমধ্যে চার তারকা প্লেট লাগানো একটি গাড়ী ভি আই পি-দের সামনে এসে দাঁড়ালো। জেনারেল টিক্কা খান হেলিকপ্টারেরদিকে তাকিয়ে প্রেসিডেণ্টকে বললেন, আপনি কি করে যেতে চান?
‘তোমার কি সন্দেহ আছে তাতে?’ প্রেসিডেণ্ট বললেন। ‘না তা নয়। আমি বলছিলাম, হেলিকপ্টারও তৈরি।’ ‘না আমি সড়ক পথেই যাব’, প্রেসিডেণ্ট বললেন। প্রেসিডেণ্টের গাড়ীতে টিক্কা খানও উঠলেন। অন্যরাও তাঁদের গাড়ীকে অনুসরণ করলো। ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের একটা কোম্পানী পাহারা দিয়ে এগিয়ে চললো। বেতারে প্রেসিডেণ্টের যাত্রার অগ্রগতি সম্পর্কে রিপোর্ট হতে থাকলো….. ‘তিনি নিরাপদে ফার্মগেট অতিক্রম করলেন…. তিনি এখন ভি আই পি ভবনের দিকে এগুচ্ছেন মোটর গাড়ীর বহর এবার প্রেসিডেণ্ট নিরাপদে তাঁর নিবাসে পৌঁছে গেছেন।’ সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। একটা মস্তবড় বাধা শান্তিপূর্ণভাবে অতিক্রম করা গেল। একই দিন সন্ধায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান স্থানীয় সিনিয়র সামরিক অফিসারদের ডেকে পাঠালেন পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্ট করার জন্যে। জেনারেল-টিক্কা খান, খাদিম, ফরমান এবং এয়ার কমোডর মাসুদও উপস্থিত ছিলেন ঐ বৈঠকে। সেনাবাহিনীর নিজস্ব ধারায় ব্রিফিং শুরু হলো। আলোচনা এগিয়ে চললো নির্ধারিত রীতিতে। যেমন, মিশনের ব্যাখ্যা, সমস্যার গুরুত্ব (আইন-শৃঙ্খলার নিরিখে), সেনাশক্তির প্রাপ্যতা এবং বিভিন্ন এলাকায় তাদের বাটোয়ারা, ইত্যাদি বিষয়ক। সর্বশেষে আস্থাসূচক মন্তব্যের মধ্য দিয়ে ব্রিফিং শেষ হলো।
ব্রিফিং এ রাজনৈতিক জটিলতা ও গভীরতার বিষয়টি প্রেসিডেণ্টের সামনে তুলে ধরা হলো না। কোনো সুপারিশও করা হলো না। এ বিষয়টি কেন বাদ পড়লো, তা জানতে চেয়েছিলাম একজন সিনিয়র অফিসারের কাছে। তিনি বলেন, প্রেসিডেণ্ট এ নিয়ে কিছুই জানতে চাননি। এ ব্যাপারে তাঁর উপদেশকরা রয়েছেন। তাঁদের বিশ্লেষণের উপরই নির্ভর করছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজনের মতামতের জন্য তিনি থোড়াই কেয়ার করেন।
ব্রিফিং শেষে প্রেসিডেণ্ট বলেন, ভাবনার কিছুই নেই। মুজিবের ব্যবস্থা কালকেই করছি আমি। তাঁকে আমার মনের ইচ্ছা একটুখানি জানিয়ে দেব। শীতল চেহারা দেখাব এবং তাঁকে দ্বিপ্রাহরিক ভোজেও আমন্ত্রণ জানাবো না। এরপর পরের দিন আমি তাঁর সাথে দেখা করবো এবং এতে তাঁর মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, সেটা দেখবো। যদি সে ভালো ব্যবহার না করে,তাহলে এর জবাব কি দিতে হবে- তা আমি জানি।
প্রেসিডেণ্টের কথা শেষ হতেই নীরবতা নেমে এলো। একটি অস্বস্তিজনক মুহূর্ত। এ সময় দীর্ধকায় ঋজু দেহের পেশীবহুল এক ব্যক্তি ঘাড় উঁচু করে দাঁড়ালেন এবং কিছু বলার জন্যে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। মাথা নেড়ে তাঁকে অনুমতি দেয়া হলো। তিনি মুখ খুললেন, “স্যার অবস্থা খুবই নাজুক। মুখ্যত এটা একটি রাজনৈতিক ব্যাপার এবং রাজনেতিক ভাবেই এর সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। নইলে হাজার হাজার নিরপরাধ নারী, পুরুষ এবং শিশু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।….. ইয়াহিয়া গভীর মনোযোগের সাথে শুনছিলেন এবং অন্যরা শুনছিলেন দুরু দুরু বক্ষে। প্রেসিডেণ্ট মাথা নাড়লেন। যেন চাবুক দিয়ে আঘাত করলেন, এমনি স্বরে বললেন, ‘মিঠঠি, আমি সেটা জানি আমি জানি।’ মেঠঠি (মেজর জেনারেল মিঠা খান) বসে পড়লেন। কয়েকদিন পর তাঁর দায়িত্ব থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেয়া হলো। পরবর্তীতে তিনি শুধু নিজ মনোবলের উপরই টিকে ছিলেন। সভা ভেংগে গেলো। এটাই ছিলো ঢাকাতে ইয়াহিয়া খানের সর্বশেষ সামরিক সম্মেলন। এরপর তিনি তাঁর রাজনৈতিক কার্যক্রমের দিকে মুখ ফেরালেন।
পরের দিন প্রেসিডেণ্ট হাউজে মুজিবের সাথে তিনি দেখা করলেন। দুজনের কোনো সাহায্যকারী ছিলো না। মনে করা হলে, ভাঙ্গা সম্পর্ক জোড়া লাগানোর জন্যে এটা একটা ঘরোয়া পদক্ষেপ। মুজিব যে তাঁর হাতার ভাঁজে কিছু রেখেছেন, এ আবিষ্কার করতে তাঁর বেশী সময় লাগলো না। কেননা, নির্বাচন পূর্বকালে তিনি প্রেসিডেণ্টের প্রস্তাবাবলীতে যেভাবে খোলা মন নিয়ে সাড়া দিয়েছিলেন, এবার সে রকম হলেন না। প্রেসিডেণ্ট নিরুৎসাহিত হয়ে পড়লেন।…..
মূলত মাসের প্রথম পনের দিনেই সমঝোতামূলক সমাধানের সাধারণ ভিত্তি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। এ সময়টিতে মুজিব শক্ত হাতে প্রদেশটি শাসন করলেন। বেসামরিক প্রশাসন ও জনগণের উপর তাঁর নিরংকুশ আধিপত্য ছিলো। তাঁর এ ক্ষমতার পিছনে সমর্থন যুগিয়েছিলো গত নির্বাচনে জনগণের দেয়া শক্তিশালী ম্যাণ্ডেট। কেন তাহলে মুজিব স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ভাগাভাগি করবেন? তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত একজন অতিথির জন্যে কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিতে পারেন- যদি ঐ অতিথি তাঁর খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদনে পাল্টা সাড়া দেন।
অন্যদিকে জেনারেল ইয়াহিয়া তখনো এ বিশ্বাসে অনড় যে, তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কেননা, তিনি একধারে প্রেসিডেণ্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং সেনাবাহিনীর কমাণ্ডার ইন-চীফ। কেন তিনি একজন আঞ্চলিক নেতাকে স্থান করে দেবেন যতক্ষণ তিনি তাঁর কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে সুবিধা লাভ না করছেন? মৌলিক বিরোধ ছিলো এখানেই। দুজনেই ভিন্নমুখী অবস্থান থেকে কথা বলছিলেন। প্রত্যেকে নিজ নিজ সম্পর্কে ভাবছিলেন যে, তাঁকেই সুবিধাদানের জন্যে বলা হচ্ছে।
১৭ মার্চ ইয়াহিয়া ও মুজিব পূর্ণ প্রস্তুতি সহকারে আলোচনায় বসলেন। সে এক কঠিন বৈঠক। আপোস রফার ক্ষেত্রে দু পক্ষই লক্ষণীয় কোনো মতামত তুলে ধরলেন না।
বৈঠক শেষ হবার পর মুজিব প্রেসিডেণ্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর গাড়ীতে কালো পতাকা উড়ছিলো। অপেক্ষামান সাংবাদিকরা তাঁকে গেটে থামাল। আমিও উপস্থিত ছিলাম সেখানে। কিন্তু আমার ইউনিফর্মের প্রতি মুজিব লক্ষ্য করলেন না। মনে হলো, তিনি ভারাক্রান্ত এবং উদ্বিগ্ন। আমি তাঁর বাঁ কাঁধের কাছে দাঁড়িয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। চেহারা মলিন ও বিমর্ষ। তাঁর দেহে কম্পন ছিলো। উত্তেজনায় কাঁপছিলো ঠোঁট।
ক্যাণ্টনমেণ্টে এসে জানতে পারলাম জিওসি জেনারেল খানের কাছে গেছেন দিনের ফলাফল জানতে। জেনারেল টিক্কা খান তাঁকে বলেন, ‘খাদিম (জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম রাজা), তুমি যতটুকু জান, আমিও ততটুকুই জানি।’ ‘কিন্তু স্যার’, খাদিম রাজা বললেন, ‘কোনো রকম অসতর্কতা যাতে আপনাকে গ্রাস করতে না পারে সে জন্যে অকুস্থলের ব্যক্তি হিসেবে ঘটনার গতিধারার সাথে সংযোগ রাখার অধিকারী ব্যক্তি একমাত্র আপনিই।’ এর কিছুক্ষণ পর জেনারেল টিক্কা খানের স্টাফ কার প্রেসিডেণ্ট হাউজে প্রবেশ করলো। ইয়াহিয়া খান আলোচনার বিবরণী দানকালে বললেন, ‘হারামজাদাটা ভালো ব্যবহার করলো না।তুমি তৈরি হয়ে যাও।’ রাত দশটায় টিক্কা খান জিওসিকে টেলিফোন করলেন। বললেন, ‘খাদিম তুমি এগিয়ে যেতে পারো।’ এরঅর্থ এভাবে ধরে নেয়া হলো, সামরিক কার্যক্রম শুরু করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কাগজপত্র তৈরি করা যেতে পারে। কেননা সেনাবাহিনী সবসময় তৈরি থাকে। কিন্তু ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি রাজনৈতিক আলোচনা ধারার উপর নির্ভরশীল। ঢাকার সেনা কর্তৃপক্ষ সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে প্রেসিডেণ্টের উপর চাপ সৃষ্টি করেনি। এরা তখনো রাজনেতিক সমাধানের আশায় ছিলো। সে প্রচেষ্টা প্রেসিডেণ্ট হাউজে নেয়া হয়। জোরের সাথে উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রস্তুতি কখনো নিশ্চিত করে ইচ্ছাকে ব্যক্ত করে না। ….. কয়েকজন বিদেশী লেখক বলেছেন, ঢাকা আলোচনাকে দীর্ঘায়িত করা হয় সামরিক শক্তি সংগঠন ও পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত করার জন্যে। আসলে এ হচ্ছে সবচেয়ে বাজে, বিদ্বেষপরায়ণ এবং ভিত্তিহীন সংবাদ সূত্রের যুক্তি। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি যে, মুজিবের ডি-ফ্যাক্টো শাসনকালে কোনো অতিরিক্ত সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আসেনি কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরেও এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়নি। উপরন্তু, সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা প্রণয়নের ব্যাপারটি দশ দিনের বেশী (১৫ মার্চে ইয়াহিয়ার আগমন থেকে ২৫ মার্চের হামলা পর্যন্ত) লাগেনি। মূলত দশ ঘণ্টার বেশী সময় লাগেনি।….
২০ মার্চ বিকেলে ফ্লাগ স্টাফ হাউজে জেনারেল হামিদ ও লেফটেন্যাণ্ট জেনারেল টিক্কা খানের সামনে হাতে লেখা পরিকল্পনাটি পড়া হলো। দুজনেই পরিকল্পনাটির প্রধান প্রধান বিষয়গুলো অনুমোদন করলেন। কিন্তু হামিদ বাঙালী সৈনিকদের নিরস্ত্রীকরণের ধারাটি বাতিল করে দেন। কেননা, তাঁর মতে ‘এ ধারাটি বিশ্বের একটি অন্যতম চমৎকার সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করবে।…… পরে প্রেসিডেণ্ট পরিকল্পনার একটি মৌলিক ধারা বাতিল করে দেন। নির্ধারিত তারিখে প্রেসিডেণ্টের সাথে বৈঠকরত আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার করতে হবে- এ বিষয়টি তিনি মেনে নেন না। প্রেসিডেণ্ট বলেন, ‘রাজনৈতিক সমঝোতার উপর জনগণের আস্থাকে আমি নির্মূল করতে পারি না, গণতন্ত্রের প্রতি একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আমি ইতিহাসে চিহ্নিত হতে চাই না।’ তাঁর হুবহু এ কথাগুলো ওই বৈঠকে উপস্থিত এক ব্যক্তি আমাকে বলেন।
অন্যদিকে মুজিবের ডি-ফ্যাক্টো কমাণ্ডার-ইন-চীপ কর্নেল (অবসর প্রাপ্ত) এম. এ. জি. ওসমানিও ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে সামরিক পরিকল্পনা তৈরি করেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালী সৈনিকদের সাথে গোপনে যোগাযোগ করলেন- যাতে তারা মুজিবের ডাকে সাথে সাথে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে বেরিয়ে আতে পারে। মেজর জেনারেল ডি. কে. পালিতের বর্ণনা অনুসারে ( The Lighting Campaign’ by D. K. Palit-১৯৭১ সালের যুদ্ধের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভরত সরকার কর্তৃক বেসরকারীভাবে প্রকাশিত) নিম্নলিখিত ব্যবস্থাবলী গ্রহণের কার্যক্রম কর্নেল ওসমানির পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত ছিলো:
(ক) পূর্ব পাকিস্তান অবরোধের জন্যে ঢাকা বিমান বন্দর ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দখল করতে হবে।
(খ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘাঁটি করে ঢাকা নগরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করবে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ বাহিনী। সশস্ত্র ছাত্ররা তাদেরকে সাহায্য করবে।
(গ) পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট পরিত্যাগকারী ব্যক্তিরা প্রচণ্ড আঘাত হানবে ক্যাণ্টনমেণ্ট দখলের জন্য।
১৮ মার্চ পর্যন্ত প্রেসিডেণ্ট এবং তাঁর উপদেষ্টাদের সাথে আওয়ামী লীগের আলোচনা সমাধানের কাছাকাছি আনতে যখন পারলো না, তখনই নতুন অগ্রগতির সংবাদ এলো। মুজিব এ সংবাদের সত্যতাকে নিশ্চিত করলেন প্রত্যক্ষভাবে। তিনি বললেন, যদি ফল না পাওয়া যায়, তাহলে তিনি আর আলোচনা চালাচ্ছেন কেন। জেনারেল টিক্কা খানকে এ ইতিবাচক অগ্রগতির সংবাদ জানানো হলো। এবং তার মাধ্যমে জানলেন মেজর জেনারেল খাদিম রাজা। ক্যাণ্টনমেণ্ট নামক অন্ধকারময় সুড়ঙ্গের মধ্যে বসবাসকারী আমাদের মতো কয়েক জনের কাছে খবরটি ছিটেফোটা এসে পড়লো। সুড়ঙ্গের ভেতরকার মানুষদের কাছে যা তখন পৗঁছেছে সম্ভবত তা অতিরঞ্জিত হয়েই আসছে। তবু ভবিষ্যত সম্পর্কে আমরা আশান্বিত হলাম। এবং আনন্দিত হলাম। কয়েকজন তাদের পরিবারবর্গকে পশ্চিম পাকিস্তান পাঠানোর পরিকল্পনা বাতিল করলো। অবশ্য আমাদের মধ্যে যারা অতিমাত্রায় বাস্তববাদী তারা পাঠিয়ে দিলো।
আওয়ামী লীগের প্রস্তাবাবলীর উপরই ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকের আলোচ্য বিষয় কেন্দ্রীভূত ছিলো। প্রস্তাবগুলো ছিলো-অনতিবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে কোনো রকমের পরিবর্তন ছাড়াই পাঁচটি প্রদেশের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং আপাতত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীয় সরকার বহাল রাখা। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রস্তাব করলে া,যে গোড়াতেই জাতীয় পরিষদকে দুটি কমিটিতে ভাগ করতে হবে। দুটি কমিটি গঠিত হবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের এম. এন. এ.-দের সমন্বয়ে কমিটি দুটি ইসলামাবাদ ও ঢাকাতে বৈঠক করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৃথক পৃথক রিপোর্ট তৈরি করবে। এরপর দুটো রিপোর্ট নিয়ে জাতীয় পরিষদ বৈঠকে বসবে এবং দুটোর মধ্যে একটা আপোস ফর্মূলা বের করে আনার চেষ্টা করবে। ইতিমধ্যে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র সংশোধন করে ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করে সেটা জারি করা যেতে পারে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমূহ তাদের স্বায়ত্বশাসনের পরিধি নির্ধারণের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনাটি প্রেসিডেণেটর এক ঘোষণার মাধ্যমে জারি করতে হবে। এর মধ্যে প্রেসিডেণ্ট একটা ভালো বিষয় দেখলেন। এ পরিকল্পনাটি তার অবস্থানের নড়চড় করছে না। তিনি তখনো প্রেসিডেণ্ট থাকছেন এবং সাহায্যের জন্যে নিজের ইচ্ছামতো প্রেসিডেণ্ট উপদেষ্টা নিতে পারছেন। এর ভিত্তিতে খবরের কাগজে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির খবর বেরুলো।
কিন্তু এ পরিকল্পনা মারাত্মক পরিণতির সম্ভাবনা বহন করছিলো। যদি সামরিক আইন তুলে নেয়া হয়, তাহলে ইয়াহিয়া সরকার আইনগত বৈধতা হারাবে এবং প্রদেশগুলো স্বাধীনত সত্তা দাবী করার ব্যাপারে অবাধ অধিকার লাভ করবে। তবু প্রেসিডেণ্ট মুজিবকে প্রতিশ্রুতি দিলেন এই বলে যে, এ পরিকল্পনায় ভুট্টো যদি কোনো আপত্তি না তুলেন তাহলে তিনি এটা গ্রহণ করবেন। সুতরাং ভুট্টোকে আবার ঢাকায় আসতে বলা হলো। তখনো তিনি করাচীতে ছিলেন এবং পরিস্থিতির প্রতি নজর রাখছিলেন।…. ভুট্টো ঢাকায় আসতে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি বললেন, কেননা ইতিমধ্যেই তিনি তাঁর বক্তব্য প্রেসিডেণ্টের কাছে পরিষ্কাভাবে উত্থাপন করেছেন। অন্যদিকে সম্মেলন টেবিলে ভুট্টোর উপস্থিতির বিষয়ে মুজিব বিরুদ্ধ মনোভাবাপন্ন ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো যে, পূর্ব পাকিস্তানের রক্তপাতের ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা রয়েছে। মুজিব যাতে তাঁর সাথে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত হন, সে বিষয়ে ভুট্টো আশ্বাস লাভের জন্যে চাপ সৃষ্টি করলেন।……. ভুট্টো এবং তাঁর মুখ্য সহচররা ২১ মার্চ ঢাকায় এলেন। প্রেসিডেণ্ট অত্যন্ত সততার সাথে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত আওয়ামী লীগের পরিকল্পনার মুখ্য বিষয়গুলো ভুট্টোকে অবহিত করলেন এবং জানালেন যে, বাস্তবায়নের জন্যে তাঁর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এর প্রতিক্রিয়া ভুট্টো নিজের ভাষায় এভাবে প্রকাশ করেছেন: ‘দুই কমিটির প্রস্তাব সম্পর্কে আমার সহকর্মীদের আমি জানালাম। তারা এ ব্যাপারে তাদের আশাংকা প্রকাশ করে পরামর্শদিলেন যে, এ প্রস্তাব আমার গ্রহণ করা উচিত হবে না। কেননা, এর ভেতরে দুই পাকিস্তানের বীজ রোপিত আছে। আমরা আরো ঐকমত্যে পৌঁছলা যে, এটাকে পুরোপুরিভাবে জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করতে হবে তাদের অনুমোদনের জন্যে। যে আইন সভার উপর শাসনতন্ত্র ও আইন সভার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারেন না।” (The Great Tragedy Z. A. Bhutto) অপেক্ষামাণ অনুমোদন আর এলো না। সেই মারাত্মক ত্রিভুজ অনড় রইলো।
২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ একটি নতুন প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এলো। আগের শাসনতান্ত্রিক কমিটির প্রস্তাব পরিত্যাগ করে শাসনতান্ত্রিক কনভেশনের প্রস্তাব দিলো। এ কনভেনশন পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যে পৃথক পৃথক দুটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। জাতীয পরিষদ এ দুটি শাসনতন্ত্র নিয়ে বৈঠকে বসবে। দুটোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে পাকিস্তানকে একটি কনফেডারেশনে পরিণত করবে। একই দিনে ভুট্টো প্রেসিডেণ্টের সাথে দেখা করলেন। দুজনেই এ ঐকমত্যে পৌঁছেন যে, সম্ভবত প্রথমবারের মতো নয় যে, আওয়ামী লীগ তার বাজির চাল ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন থেকে পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ভাঙ্গনের পদক্ষেপ নিয়েছে। জাতীয সংহতি রক্ষার জন্যে তারা যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করার চিন্তা করুন না কেন কিংবা যা-ই সিদ্ধান্ত নিন না কেন- ঘোষণা করা হলো যে, আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী তাজউদ্দীন আহমদ সন্ধ্যায় ষোঘণা করলেন, তাঁর দল চূড়ান্ত প্রস্তাব পেশ করেছে এবং তাতে নতুন কিছু সংযোজন কিংবা সমঝোতামূলক কিছু করার নেই।
ভুট্টোর সহচররা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং উপদেষ্টারা করাচীর পথে ‘ফেরা’ শুরু করলেন।…..
সর্বশেষ প্রবণতা নির্ধারণে আওয়ামী লীগের নিজস্ব পদ্ধতি ছিলো। কিন্তু পরে এ দলের প্রতি সহানুভূতিশীল এক ব্যক্তি আমার কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা এখনও আশা করছি যে, সমঝোতার চেষ্টা চলছে। বৈঠক ভেঙ্গে গেছে বলে কেউ এখনও বলেননি। অথবা এমন সতর্কবাণীও কেউ উচ্চারণ করেননি যে, আমরা সীমা অতিক্রম করছি- যেখানে আছে শুধু মৃত্যু আর ধ্বংস।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কনফেডারেশনের প্রস্তাবের পরও আপনি কি এখনও মনে করেন আশা আছে?’
জবাবে তিনি বললেন, ‘এখানেই আমরা ভুল হিসাব করেছি। আমরা ভেবেছিলাম এবং সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেয়া হয় যে, সেনাবাহিনী নতি স্বীকার করেছে। সুতরাং আমরা চাপ দেয়া শুরু করলাম। কিন্তু পুরোপুরি ভুলে গেলাম যে, ভুট্টো ইতিমধ্যেই দৃশ্যপটে হাজির হয়েছেন।’
২৫ মার্চ সন্ধায় প্রেসিডেণ্ট ঢাকা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন।” [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৭১-৮১। এ গ্রন্থের লেখক জনাব সিদ্দিক সালিক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর ছিলেন। সেই সময় তিনি ঢাকায় সেনাবাহিনীর ‘গণ সংযোগ অফিসার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।]
সিদ্দিক সালিকের এ বিবরণ থেকে পরিষ্কার, প্রেসিডেণ্ট একটা বদ্ধমূল ধারণা নিয়েই পূর্ব পাকিস্তানে পা দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব দাবী আদায়ের জন্যে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন, একথা সত্য। কিন্তু জাতীয় পরিষদকে দুই কমিটিতে ভাগ করা এবং প্রদেশগুলোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার যে অভিযোগ তা মুজিবের উপর বর্তায় না। এ দুটি বিষয়ই এসেছে পাকিস্তানের নাম ‘কনফেডারশন অব পাকিস্তান’ রাখার প্রস্তাব করেছিলেন। মুজিব এটা করেছিলেন অবস্থার পাচে যার ইংগিত ডঃ কামাল হোসেনের লেখায় পাওয়া যায। কিন্তু মুজিবের এ প্রস্তাবটাও কোনো ফাইনাল ব্যাপার ছিলো না। আওয়ামী লীগ পরিষ্কারই বলেছিলো যে, বিষয়টা ইয়াহিয়া-মুজিবের শীর্ষ বৈঠকের জন্যে রেখে দেয়া যেতে পারে। এ প্রস্তাবের পর এক ‘Nonnegotiable’ বলা যেতে পারে না। তাজউদ্দীনের যে উক্তিকে আলোচনা ক্লোজ করার দলিল হিসেবে উপস্থিত করা হচ্ছে, তা হাস্যকর বৈ কিছু নয়। যে বৈঠকে তাজউদ্দীন ঐ কথা বলেছিলেন, সেই বৈঠকেই আওয়ামী লীগের তৈরি খসড়া ঘোষণা চূড়ান্ত করার জন্যে ডঃ কামাল হোসেন ও প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার পক্ষের এম. এম. আহমদের বেঠকে বসার সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। তাছাড়া মুজিব ও ইয়াহিয়ার শীর্ষ বৈঠকের কর্মসূচী তো ছিলোই। সুতরাং আওয়ামী লীগ আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছে একথা সবৈর্ব মিথ্যা। বরং প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকেই আলোচনার দরজা বন্ধ করে দিয়ে সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েচিলো। এর কারণ কি ছিলো? কারণ এই ছিলো যে, প্রেসিডেণ্ট একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন। ইয়াহিয়া ক্যাণ্টনমেণ্টে সেনা অফিসারদরে ব্রিফিং বৈঠকে যে কথা বলেছিলেন তা একথাই প্রমাণ করে। মনে হয় তিনি কিছুটা নমনীয় ও সমঝোতামূলক মনোভাব গ্রহণ করে মুজিবকে সামনে বাড়ার সুযোগ দিয়েছিলেন, কতদূর মুজিব যেতে পারে তা দেখতে চেয়েছিলেন। শেষটা দেখার পর আলোচনা বিনা নোটিশে বন্ধ করে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের উপর সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে ইয়াহিয়ার যে দর্শন ছিলো তাহলো ভুট্টোকে খুশী করা। মার্চের ৫ তারিখে রাওয়ালপিণ্ডিতে জেনারেল ইয়াহিয়া রাও ফরমানকে যে কথা (‘আমার ঘাঁটি সম্পর্কে আমাকে ভাবতে হয় বাচ্চু, পশ্চিম পাকিস্তান সম্পর্কে আমাকে ভাবতে হবে, আমি তো আমার নিজের ঘাঁটি ধ্বংস করতে পারি না) বলেছিলেন তাই হলে এ দর্শনের ভিত্তি। ইয়াহিয়ার সামরিক পদক্ষেপের পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়, শেখ মুজিবও সামরিক পদক্ষেপের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে ভারতের মেজর জেনারেল ডি. কে. পালিতের বিবরণকে সাক্ষ্য হিসেবে দাঁড় করান হয়। প্রকৃতপক্ষে ডি. কে. পালিতের বিবরণ অস্বাভাবিক কিছু প্রমাণ করে না। ইয়াহিয়া যদি রাজনৈতিক সমাধানে না আসেন, যদি সামরিক শক্তিই প্রয়োগ করেন, তাহলে সেই পরিবেশের আত্মরক্ষার ঐ ধরনের চিন্তা অসঙগত কিছু নয়। তবে ডি. কে. পালিতের বিষয়টাকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, ঘটনা তেমন ছিলো না। বাস্তব অবস্থাই তা প্রমাণ করেছে। কর্নে ওসমানির নেতৃত্বে শেখ মুজিবের নির্দেশ নিয়ে যদি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, বিডিআর, পুলিশ সশস্ত্র প্রতিরোধের চরম সিদ্ধান্ত নিতো, তাহলে ২৫ মার্চ রাতে অপরেশন শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার পতন ঘটা স্বাভাবিক নয়। আমাদের বাঙালী সৈনিক, বিডিআর এবং পুলিশের দৃঢ়তা ও প্রতিরোধ শক্তি যে এমন ছোট করে দেখার মতো নয় তা পরবর্তীকালে প্রমাণ হয়। পঁচিশে মার্চের সেই কালো রাতে নিরস্ত্র জনগণ কার্যত কোনো প্রতিরোধই দাঁড় করাতে পারেনি। ২৫ মার্চের রাতের অন্ধকার নেমে আসার মতো সেদিন যখন সামরিক সরকারের সামরিক অভিযান আসন্ন হয়ে উঠেছিলো, তখন প্রতিবাদী জনগণ ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় গাছের গুঁড়ি, ভাঙা গাড়ি, ইত্যাদি দিয়ে ব্ররিকেট রচনা করেছিলো। কিনতু এ প্রতিরোধ বেশীক্ষণ টেকেনি। ফার্মগেট এলাকার এ ধরনের একটা চিত্র পাওয়া গেছে: রাইফেলের গুলীর কিছু শব্দ ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেলো। একটু পরেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বিষ্ফোরণ বাতাসে তীক্ষ্ণ শব্দ তুললো। গগণবিদারী শ্লোগান ও গুলীর শব্দের সাথে হালকা মেশিনগানের হালকা কিচির-মিচির আওয়াজ বাতাসে ভেসে আসতে থাকলো। পনের মিনিট পর গোলমালের শব্দ কমে এলো- এবং শ্লোগন ক্ষীণতর হতে হতে এক সময় থেমে গেলো। স্পষ্টতই অস্ত্র বিজয়ী হলো।’ [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল : সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-৮৫] এ ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছিলো সেদিন ঢাকার সবখানে। এটাই প্রমাণ করে ঐ ধরনের প্রতিরোধমূরক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তুতি এবং ইচ্ছা কোনোটাই ছিলো না। কর্মী ও নেতৃবৃন্দের প্রতি শেখ মুজিবের নির্দেশও একথাই প্রমাণ করে। মুজিব ২৫ মার্চ বিকেলেই জানতে পেরেছিলেন আপোস হচ্ছে না, একটা আর্মি অপরেশন আসছে। তিনি তাঁর সহকর্মীদের তৎক্ষণাৎ ঢাকা ত্যাগ করার নির্দেশ দিলেন। তিনি তোফায়েল, রাজ্জাক এবং অন্যান্য তরুণ নেতাদের বুড়িগঙ্গা পার হয়ে গ্রামাঞ্চলে চলে যাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। [Bangladesh : Constitutional quest for Autonomy- Maudus Ahmed, Page-248] জনাব মওদুদ আহমদের ভাষায় শেখ মুজিবের ঐ নির্দেশের একাংশ ছিলো এ রকম: “I was present when Mujib directed Tofail and othes to leave Dacca. Mujib said, `I am known to all, if I am arrested international powers will take up my case, but uou are not known, So you must leave.” [Bangladesh : Constitutional quest for Autonomy- Maudus Ahmed, Page-253] শেখ মুজিবের একজন উপদেষ্টা, পরবর্তীকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন ২৫ মার্চ রাত সাড়ে দশটায় শেখ মুজিবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় আসেন। সাড়ে দশটা পর্যন্ত শেখ মুজিবের বাসায় বসে বসে তিনি জেনারেল পীরজাদার কাছ থেকে আলোচনার নতুন সময় নির্ধারণের অপেক্ষা করছেন। বাসায় ফেরার সময় মুজিব তাঁর কাছে জেনারেল পীরজাদার টেলিফোন তিনি পেয়েছেন কিনা জিজ্ঞেস করেছেন, আসন্ন পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো নির্দেশ তিনি দেননি। বরং মনে হয়েছে, তাদের করণীয় কিছু নেই, অবস্থার উপর তারা নিজেদের ছেড়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জেনারেল তাজউদ্দীন আহমদকেও ঢাকা শহর থেকে সরে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। তাজউদ্দীনকে ঢাকার শহরতলিতে আত্মগোপন করতে বলা হয় যাতে করে শীঘ্রই তারা আবার একত্রিত হতে পরেন। [মূলধারা ’৭১-মঈদুল হাসান, পৃষ্ঠা-৯. তাজউদ্দীনের একান্ত সাক্ষাতকার, সেপ্টেম্বর, ১৯৭২] প্রতিরোধ কিংবা মুক্তি আন্দোলনের কোনো প্রস্তুতি, এমনকি কোনো পরিকল্পনাও ছিলো না আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জেনারেল তাজউদ্দীন আহমদের তৎপরতা থেকেও তা পরিষ্কার। তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবের নির্দেশ অনুসারে ঢাকার শহরতলি এলাকাতেই আত্মগোপন করেছিলেন। কিন্তু এভাবে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হলো না। অবস্থার পরপ্রেক্ষিতে কারও সাথে আলোচনা পরামর্শ ছাড়াই তখনকার করণীয় কাজ তার নিজেকেই নির্ধারণ করতে হলো। তাজউদ্দীনের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী, মুজিব নগর সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি মঈদুল হাসান তাঁর মূরধারা’ ৭১ গ্রন্থে তখনকার চিত্র এভাবে এঁকেছেন: “এক নাগাড়ে প্রায় তেত্রিশ ঘণ্টা গোলাগুলীর বিরামহীন শব্দে তাজউদ্দীনের বুজে নিতে অসুবিধা হয়নি- যে অনুমানের ভিত্তিতেই তাঁকে শহরতলিতে আত্মগোপন করতে বলা হয়ে থাকুক, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তরুণ সহকর্মী আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে ২৭ মার্চ ঢাকা ত্যাগের আগে দলের কোনো নেতৃস্থানীয় সদস্যের সাথে আলাপ পরামর্শের কোনো সুযোগ তাজউদ্দীনের ছিলো না। [তাজউদ্দীনের সাক্ষাতকার, সেপ্টেম্বর, ১৯৭২] তা সত্ত্বেও পরবর্তী লক্ষ্য ও পন্থা সম্পর্কে দুটি সিদ্ধান্ত নিতে তা৭দের কোনো বিলম্ব ঘটেনি: (১) পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক আঘাতের মাধ্যমে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় হলো শসস্ত্র প্রতিরোধ তথা মুক্তির লড়াই; (২) এ সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামকে সংগঠিত করার প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ হিসেবে ভারত ও অন্যান্য সহানুভূতিশীল দেশের সাহায্য-সহযোগিতা লাভের জন্য অবিলম্বৈ সচেষ্ট হওয়া। …… লক্ষ্য স্থির করে সসঙ্গী তাজউদ্দীন ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে গিয়ে হাজির হলেন ৩০ মার্চের সন্ধায়।” [মূলধারা ’৭১-মঈনুল হাসান, পৃষ্ঠা-৯] তাজউদ্দীন ভারতে গিয়ে দেখতে পেলেন মুজিব মুক্তিযুদ্ধের কোনো পরিকল্পনা প্রস্তুতি ভরতের সাথেও করে যাননি। মূরধারা ’৭১-এর মঈদুল হাসান লিখেছেন:
“সীমান্ত অতিক্রম করার আগে কয়েকবারই তাজউদ্দীন মনে করেছিলেন হয়ত বা এ আপদকালীন পরিস্থিতি মুকাবিলার জন্যে উচ্চতর পর্যায়ে কোনো ব্যবস্থা ভারত সরকারের সাথে কথা হয়েছে। তাঁর একথা মনে করার বিশেষ একটি কারণ ছিলো। ৫ অথবা ৬ মার্চে শেখ মুজিবের নির্দেশে তাজউদ্দীন গোপনে সাক্ষাত করেন ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশনার কে. সি. সেন গুপ্তের সাথে। উদ্দেশ্য ছিলো, পাকিস্তানের শাসকেরা যদি সত্য সত্যই পূর্ব বাংলা ধ্বংস তাণ্ডব শুরু করে, তবে সে অবস্থায় ভারত সরকার আক্রান্ত কর্মীদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান বা সম্ভাব্য প্রতিরোধ সংগ্রামে কোনো সাহায্য করবে কিনা জানতে চাওয়া। উত্তরের অন্বেষনে সেন গুপ্ত দিল্লী যান। সারা ভারত তখন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে মত্ত। সেখানে সরকারী মনোভাব সংগ্রহ করে উঠতে উঠতে তাঁর বেশ কদিন কেটে যায় এবং ঢাকা ফেরার পর সেনগুপ্ত ১৭ মার্চ ভাসাভাসাভাবে তাজউদ্দীনকে জানান যে, …… আঘাত যদি নিতান্তই আসে, তবে ভারত আক্রান্ত মানুষের জন্যে ‘সম্ভাব্য সকল সহযোগিতা’ প্রদান করবে। এ বৈঠকে স্থির হয়, তাজউদ্দীন শেখ মুজিবের সাথে পরামর্শের পর সেনগুপ্তের সাথে আবার মিলিত হবেন এবং সম্ভবত তখন তাজউদ্দীন সর্বশেষ পরিস্থিতির আলোকে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতার প্রকার ও ধরন সম্পর্কে নির্দিষ্ট আলোচনা চালাতে সক্ষম হবেন। ২৪ মার্চ বৈঠকের কথা ছিলো। কিন্তু শেখ মুজিব এ বিষয়ে কোনো আলোকপাত করতে না পারায় এবং নির্ধারিত সময়ে তাজউদ্দীনকে অন্য জরুরী কাজে ব্যস্ত রাখায়, সেনগুপ্তের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। সীমান্ত অতিক্রমের আগে তাজউদ্দীন ভেবেছিলেন, হয়তোবা ২৪ মার্চের আলাপ অন্য কারো মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে এবং সম্ভবত এ আপদকালনি পরিস্থিতি মুকাবিলার কোনো ব্যবস্থা ইতিমধ্যে করা হয়েছে।
সীমান্তে পৌঁছুবার পর তাঁর আশাভঙ্গ ঘটে। তিনি দেখতে পান, বেঙ্গল রেজিমেণ্টের বিদ্রোহী সেনাদের পক্ষে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের কোনো ইচ্ছা তো নেই-ই, এমনকি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অস্ত্র গোলা-বারুদ সরবরাহের কোনো এক্তিয়ারও ভারতীয সীমান্ত রক্ষীদের নেই।
এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকার একমাত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং তাজউদ্দীন চাইলে তাঁকে দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন মাত্র। তাজউদ্দীন বুঝলেন, ভারতের সাথে কোনো ব্যবস্থা নেই, কাজেই শুরু করতে হবে একদম প্রথম থেকে।” [মূলধারা ’৭১-মঈদুল হাসান, পৃষ্ঠা-৯-১১। মূলধারার লেখক মঈদুল হাসান এ বিবরণ তাজউদ্দীনের সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ এবং ৮ মে, ১৯৭৩-এর একান্ত সাক্ষাতকার থেকে উদ্ধৃত করেন।]
সুতরাং কোনো প্রকার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিহীন অবস্থায় ঢাকার জনগণ তথা দেশের মানুষ একটি সুসংবদ্ধ সশস্ত্র বাহিনীর পরিকল্পিত হামলার মুখোমুখি হয়। এর ফলে ঢাকার শুধু সহজ পতন ঘটেছিলো তা-ই নয়, খোদ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দও করণীয় সম্পর্কে কিংবকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছিলো। এমনকি আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জেনারেল তাজউদ্দীনও নিজ বুদ্ধিতেই করণীয় ঠিক করে নিয়েছিলেন। তাঁর ভারত গমন এবং স্বাধীন সরকার গঠনের কাজও অবস্থার দাবী হিসেবে নিজ বুদ্ধিতেই করেছিলেন [“৩রা এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দলের নেতৃস্থানীয় অপরাপর সহকর্মী সাক্ষাত পাননি। তারা জীবিত কি মৃত, পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী কি সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টায় রত-এমন কোনো তথ্যই তখন অবধি তাঁর কাছে পৌঁছায়নি। এ অবস্থায় তাঁকে স্থির করতে হয় ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনাকালে তাঁর নিজের ভূমিকা কি হবে? তিনি কি শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের একজন উর্ধতন নেতা হিসেবে আলাপ করবেন? তাতে বিস্তর সহানুভূতি ও সমবেদনা লাভের সম্ভাবনা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার উপযোগী পর্যাপ্ত অস্ত্র লাভের আশা ছিলো অনিশ্চিত। বস্তুত তাজউদ্দীনের মনে কোনো সন্দেহ ছিলো না যে, একটি স্বাধীন সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে সেই সরকারের দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত হওয়ার আগে,বারত বা যে কোনো বিদেশী সরকারের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট সাহায্য ও সহযোগিতা আশা করা নিরর্থক। কাজেই ‘সামরিক বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের সাথে সাথে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যে সরকার গঠন করেন সেই সরকারের সদস্য হিসেবে তাজউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্যে প্রয়োজনীয় সাহায্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দিল্লী এসেছেন’- এমনতর ভূমিকায় সাহায্য সংগ্রহ অপক্ষাকৃত সহজ হবে বলে তাজউদ্দীন মনে করেন। অন্তত পক্ষে ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি অনিবর্তনীয় বিষয় হিসেবে গণ্য হবে বলে তার ধারণা জন্মেছিলো। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের আগর দিন দিল্লীতে তাঁরই এক উর্ধতন পরামর্শদাতা তাজউদ্দীনের সাথে আলোচনাকালে জানতে চান, আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে কোনো সরকার গঠন করেছে কিনা। এ জিজ্ঞাসা ও সংশ্লিষ্ট আলোচনা থেকে তাজউদ্দীন বুঝতে পারেন, স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠন হয়েছে কি হয়নি সে সম্পর্কে কোনো প্রকৃত সংবাদ ভারত কর্তৃপক্ষের জানা নেই এবং সরকার গঠনের সংবাদ তাদের বিস্মিত বা বিব্রত হওয়ারও কোনো আশংকা নেই। বরং সরকার গঠিত হয়েঝে জানতে পারলে ‘পূর্ব বাংলার জনগণকে সাহায্য করার’ জন্যে ভারতীয পার্লামেণ্ট ৩১ মার্চ যে প্রস্তাব গ্রহণ করে তা এ নির্দিষ্ট কার্যকর রূপ গ্রহণ করত পারে বলে তাজউদ্দীনের ধারণা জন্মায়। (তাজউদ্দীনের একান্ত সাক্ষাতকার, সেপ্টেম্বর, ১৯৭২)
এসব বিচার বিবেচনা থেকে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দীন জানান যে, পাকিস্তানী আক্রমণ শুরুর সাথে সাথে ২৫ ও ২৬ মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে একটি সরকার ঘোষণা করা হয়েছে। শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংরাদেশ সরকারের প্রেসিডেণ্ট এবং মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীন সহকর্মীরাই মন্ত্রী সভার সদস্য। শেখ মুজিবের গ্রেফতারের খবর ছাড়া অন্যান্য সদস্যের ভালোমন্দ সংবাদ তখনও যেহেতু সম্পূর্ণ অজানা, সেজন্যে দিল্লীতে সমবেত দলীয় প্রতিনিধিদের পরামর্শক্রমে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থিত করা যুক্তিযুক্ত মনে করেন। তাজউদ্দীনের এ উপস্থিত সিদ্ধান্তের ফলে বাংরাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অসামান্যভাবে শক্তি সঞ্চারিত হয়। ইন্দিরা গান্ধী ‘বাংলাদেশ সরকারের’ আবেদন অনুাসারে বাংলাদেশের সংগ্রামকে সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করেন, ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অত্রন্ত সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে।” মূলধারা, ’৭১ মঈদুল হাসান, পৃষ্ঠা-১১-১২, ] আওয়ামী লীগের আশ্রয় সন্ধানী নেতা তাজউদ্দীনের মতোই যে যেমনভাবে, যেদিক দিয়ে পারেন দেশ ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগ নেতা মনসুর আলী, কামারুজ্জামান এবং শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, আ. স. ম. আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ বিভিন্নভাবে বুড়িঙ্গার ওপরে কলাতিয়ায় গিয়ে জমা হন। তারপর ৪ঠা এপ্রিল মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমদ ভারতের সারিয়াকান্দিতে পৌঁছান। মনসুর আলী সিরাজগঞ্জ যান পরিবার পরিজনের সন্ধানে। কামারুজ্জামন ও শেখ ফজলুল হক মণি, প্রমুখ যুবনেতা ৬ এপ্রিল কোলকাতা পৌঁছান। [জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৮৫-৪৮৬] সৈয়দ নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহ হয়ে গাড়ো পাহাড়ের পথে ভারতে যান। খন্দকার মুশতাক অনেক পর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ঘোষিত হবার পরে ধানমণ্ডির এক নার্সিং হোম থেকে ছদ্মবেশে ভারতের আগরতলা গিয়ে পৌঁছান। অর্থাৎ দেশের ভেতরে কোনো কাজ নয়, আশ্রয়ের সন্ধানে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সবারই একমাত্র লক্ষ্য ছিলো ভারত পৌঁছা। জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া পাকিস্তানের অগ্রাসী বাহিনীকে মুকাবিলার কোনো প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা শেখ মুজিবের ছিলো না। প্রবীণ লেখক ও আওয়ামী লীগের একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি জনাব কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর ‘স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতপর গ্রন্থে লিখেন, “আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এমনিভাবে দেশ ত্যাগ করায় এটাই পরিষ্কার হয়েছিলো যে, এ ধরনের পরিস্থিতি মুকাবিলা করার জন্যে শেখ সাহেব বা আওয়ামী লীগের কোনো প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছিলো না। তাঁরা যদি তৎক্ষণাৎ স্বাধীনতার জন্যে প্রস্তুত থাকতেন, তাহলে শেখ সাহেবও পাক সেনার হাতে বন্দী হতেন না।” [স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর, কামরুদ্দীন আহমদ পৃষ্ঠা-১২১]
পঁচিশ ও পঁচিশ-পূর্ব এ সকল ঘটনার বাস্তবতা সামনে রেখে শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পরবর্তীকালের দাবীকেও অস্বীকার করা হয়। পঁচিশ পরবর্তী আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাজ ও আচরণ এবঙ ভারতের ভূীমকা প্রমাণ করে, তাঁরা এ ধরনের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানতেন না। জিয়াউর রহমান অর্থাৎ ‘মেজর জিয়া’র স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া অন্য কারও কথা জনগণও জানে না। সকলের কাছে মেজর জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব জানালেন, স্বাধীনতার নির্দেশনামা তিনি জহুর আহমদ চৌধুরীকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। [জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৫০১] আরেকটা বিবরণ পওয়া যায় ডেভিড লোসাকের লেখা লণ্ডনে প্রকাশিত ‘Pakistan Crisis’ গ্রন্থ থেকে। ঐ বর্ণনা অনুসারে ‘(২৫ মার্চ রাতে) যখন প্রথম গুলীটি বর্ষিত হলো, টিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিও’র সরকার তরঙ্গের (ওয়েভ লেংনথ) কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হয় আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিলো। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রিক বাংলাদেশে হিসেবে ঘোষণা করেন।’ [নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-৮৫] শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার অন্য একটি বিবরণ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহির্বিশ্ব প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা ‘বংগবন্ধু স্পীকস’। স্বাধীনতার এ ঘোষণাটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রচারিত হয়। [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১] স্বাধীনতা সংক্রান্ত এ তিনটি ঘোষণার মধ্যে স্থানকাল-পাত্র ও বক্তব্যের দিক দিয়ে অসংগতি প্রকট। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তাঁর যে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করেছেন তা জহুর আহমদ চৌধুরীর মাধ্যমে চট্টগ্রামের কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে নোঙর করা জাহাজ হতে টেকনাফ থেকে দিনাজপুর দেশের সর্বত্র এবং বন্ধুদেশগুলোতে প্রচার করা হয়। [Tis message was communicated from Teknaf to Dinajpur and to friendly countries through some vessel which was anchored at Bay of bengal near chittagong by Mr. Zahur Ahmed Choudhury.“জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৫০২”] ডেভিড লোসাক তাঁর ‘পাকিস্তান ক্রাইসিস’ গ্রন্থে পূর্ব বাণীবদ্ধ স্বাধীনতা ঘোষণায় সে সময়ের কথা (যা সিদ্দিক সালিকের ‘নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল’ বইতে উদ্ধৃত হয়েছে) বলেছেন, সেটা হলো ২৫ মার্চের মধ্যরাত। প্রচারের মাধ্যম ছিলো বেনামী ওয়েভলেংনথ, কারণ তখন স্বাধীন বাংলা বেতান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আর বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহির্বিশ্ব প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বংগবন্ধু স্পীকস’ পুস্তিকায় শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতার যে ঘোষণাটির কথা বলা হয়েছে, তা চিটাগাং থেকে সাবেক ইপিআর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। আবার পুস্তিকাটির শিরোনামায় এ ঘোষণাটি ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে’ প্রচার হয় বলে উল্লেখ ককরা হয়েছে। [Message enbodying declaration of independence sent by Bangabandhu Shaik Mujibur Rahman to Chittagong Shortly after miidnight of 26th March, 1971 for transmission through out Bangladesh over the ex-EPR Transmitter.” বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১] শিলোনাম : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণা।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, তৃতীয খণ্ড, পৃষ্ঠা-১]] কিন্তু সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হয়নি। স্থান-কাল-পাত্রের এ পার্থক্য ছাড়াও ঘোষণার বক্তব্যের বিরাট পার্থক্য লক্ষণীয়। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব তাঁর যে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করেন, তাহলো:
“A historic massage from Bangabandhu Sk. Mujibur Rahman conveyed to Mr. Zahur Ahmad Choudhury on the 25th Mach. 1971 at 11-30 hours immedately aftar crackdown of Pak Army:
Pak Army suddenly Sttacked EPR base at Pilkhana, Rajarbagh Police line and killing citizens. Streets, battles are going of in every street of Dhaka, Chittagong. I appeal to the nations of the world for help our freedom fighters are gallantly fighting with the enimeis to free the motherland. I apeal and order you all in the name of almighty Allah to fight to the last drop of blood to liberate the country. Ask Police, EPR, Bengal Reginemt and Ansars to stand by you and to fight. No Compromise, Victory is ours. Convey this massage to all Awami leagye leaders, workers and other patriots and lovers of freedom. May Allah bless you.”[জাতীয রাজনীতি, ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ পৃষ্ঠা-৫০১-৫০২]
২৫ মার্চ মধ্য রাতের পর শেখ মুজিব প্রেরিত স্বাধীনতার যে ঘোষণাটি চট্টগ্রাম থেকে সাবেক ই পি আর ট্রান্স মিটারের মাধ্যমে প্রচারিত হয়, তার বক্তব্য ছিলো:
“This may be last message from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of the Bangladesh and final victory is achived.”[বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১
উপরে উদ্ধৃত দুটি ঘোষণার মধ্যে পার্থক্য যে আকাশ-পাতাল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তৃতীয আরেকটি যে ঘোষণার কথা ডেভিড লোসাকের লেখা ‘পাকিস্তান ক্রাইসিস’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, তার পূর্ব বিবরণ আমাদের হাতে নেই। তবে যেহেতু সেটা পূর্বে রেকড করা, তাই উপরোক্ত দুটির কোনোটিই সেটা নয় বলা যায়। অবশ্য যদি ধরে নেয়া হয় যে, ইপিআর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রেরিত ঘোষণা এবং ডেভিড লোসাকের উল্লিখিত ঘোষণা এক জিনিস, তবু একে শেখ মুজিবের ঘোষণা হিসেবে মেনে নেয়া কঠিন হয়। কারণ ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব যে ঘোষণাটি তাঁর বলে চিহ্নিত করেছেন, তার সাথে এটা মেলে না। তারপর প্রশ্ন দাঁড়ায়, আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে উল্লিখিত ঘোষণাই যদি শেখ মুজিবের প্রকৃত স্বাধীনতা ঘোষণা হয়, ইপিআর ট্রান্সমিটরের মাধ্যমে প্রচারিত ঘোষণাটি এলো কোত্থেকে এবং তা ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ’-এর মতো সরকারী দলিলে স্থান পেল কেমন করে? আর শেখ মুজিব যাকে তাঁর ঘোষণা বললেন, সেটা এ দলিলে স্থান পেল না কেন?
এসব প্রশ্নের জবাবে বলা হচ্ছে, আসলে শেখ মুজিব স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা দেননি। তাঁর সে রকম কোনো পরিকল্পনা-প্রস্তুতিই ছিলো না। তাঁর পক্ষ থেকে কথিত স্বাধীনতার ঘোষণার যে মাধ্যমগুলো আমরা পাচ্ছি, তার কোনোটিই আওয়ামী লীগের নেতা বা দায়িত্বশীল কেউ নন। তাজউদ্দীনসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যাদেরকে তিনি সেই রাতে সরে থাকতে বললেন, তাঁদের কাউকেই তিনি এ ধরনের ইংগিত দেননি। যে সিদ্ধান্ত তখনও হয়নি, তা তাহলে কখন হলো? যা হোক, এ ব্যাপারে একটা সুন্দর তথ্য দিয়েছেন জনাব অলি আহাদ। তিনি লিখেছেন, “…… বাংলা জাতীয লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এম এম আনোয়ারের উদ্যোগে আগরতলা (ভরত) এসেম্বলি মেম্বার রেস্ট হাউজে আমার ও আওয়ামী লীগ নেতা এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মালেক উকিলের মধ্যে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর এক দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়্ আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্ত অবধি কোনো নির্দেশ দান করেন নাই।” অলি আহাদ আরও লিখেন, “ইতিমধ্যে আমি সর্বজনাব আবদুল মালেক উকিল, জহুর আতমদ চৌধুরী, আবদুল হান্নান চৌধুরী, আলী আজম, খালেদ মোহাম্মদ আলী, লুৎফুল হাই প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতার সহিত বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে আলোচনাকালে নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ভবিষ্যত কর্মপন্থা বা লক্ষ্য সম্পর্কে কোনো নির্দেশ দিয়াছিলেন কিনা, জানিতে চাহিয়াছিলাম। তাহারা সবাই স্পষ্ট ভাষায় ও নিঃসঙ্কোচে জবাব দিলেন যে, ২৫ মার্চ পাক বাহিনীর আকস্মিক অতর্কিত হামলার ফলে কোনো নির্দেশ দান কিংবা পরামর্শ দান করা নেতার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। অথচ স্বাধীনতা উত্তরকাল বানোয়াটভাবে বলা হয় যে, তিনি পূর্বাহ্নেই নির্দেশ প্রদান করিয়াছিলেন। শুধু তাহাই নয়, শেখ মুজিবুর রহমানও ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে ঘোষণা কনে যে, তিনি নির্দেশনামা জনাব জহুর আহমদ চৌধুরীকে পাঠাইয়াছিলেন।…. আওয়ামী লীগ নেতাদের সাক্ষ্য অনুসারেই শেখ মুজিবুর রহমানের এ দাবী যে বিতর্কের ঊর্ধে নয় তাহা বলাই বাহুল্য। অবশ্য একথা সত যে, সেদিন আমার মতো কোটি কোটি উৎকণ্ঠিত বাঙালী প্রাণ উল্লিখিত অনুরূপ একটি নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল। পক্ষান্তরে সেই অন্ধকার ও চরম সংকটময় মুহূর্তে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র হইতে ভাসিয়া আসিয়াছিলো একটি নির্ভয় বীরদর্পী বিদ্রোহী কণ্ঠ। এ কণ্ঠই সেদিন লক্ষ কোটি বাঙালীকে দিয়াছিলো অভয়বাণী, ডাক দিয়াছিলো মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষার প্রয়োজনে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করিতে। কণ্ঠটি বেংগল আর্মীর মেজর জিয়াউর রহমানের। সময়োপযোগী নেতৃত্বদানের ব্যর্থতা ঢাকিবার জন্যই পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমান অসত্যের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া নির্দেশ প্রদানের একটি ঘোষণাপত্র ছাপাইয়া সাধারণ্যে বিলি করিয়াছিলেন।” [জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, পৃষ্ঠা-৫০০-৫-২]
স্বাধীনতার ঘোষণা শেখ মুজিব দিয়েছিলেন কিনা, কিংবা কে দিয়েছিলো এ সংক্রান্ত বিতর্ক এটুকু কথার মধ্যে শেষ করা যায় না। এ নিয়ে লম্বা বিতর্ক চলে আসছে এবং তা এখনও শেষ হয়েছে বলা যাবে না। এ বিতর্কের প্রথম সূত্রপাত ঘটে জাতীয় সংসদে। প্রেসিডেণ্ট জিয়ার আমলে জাতীয সংসদে বিরোধী দলের নেতা আওয়ামী লীগের জনাব আসাদুজ্জামান মেজর রফিকুল ইসলাম লিখিত ‘এ টেল অব মিলিয়নস’ গ্রন্থের বরাত দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বলেন এবং জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার দাবীকে মিথ্যাচার বলে উল্লেখ করেন। [বিচিত্রা, ১৭ জুলাই, ১৯৮১] বিতর্কে অংশ নিয়ে সরকার দলীয় সদস্য লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল আকবর হোসেন বললেন, ‘স্বাধীনতার বিষয়ে আমরা ২৭ মার্চেই প্রথম চট্টগ্রাম বেতার থেকে তদানীন্তন মেজর জিয়ার সুস্পস্ট ঘোষণা শুনতে পাই। শেখ সাহেব ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বলে যে দাবী করা হয় তা সর্বৈব মিথ্যা। [বিচিত্রা, ১৭ জুলাই, ১৯৮১] এভাবেই বিতর্ক শুরু হয়ে গেলো। ছড়িয়ে পড়লো সংসদের বাইরেও। আসাদুজ্জামানকে সমর্থন করে এবং কর্নেল আকবর হোসেনের বক্তব্যের বিরোধিতা করে প্রথম বিবৃতি দিলেন- এ টেল অব মিলিয়নস-এর লেখক মেজর রফিক। তিনি বললেন, তাঁর বইতে যা বলা হয়েছে তা পুরোপুরি সত্য। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খোলা হয়ে আওয়ামী লীগের নেতা মরহুম আবদুল হান্নান ২৬ মার্চ দুপুর আড়াইটায় স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন।’ এ সময় জনাব আসাদুজ্জামান ও মেজর রফিকের সমর্থনে এগিয়ে এলেন আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ও মন্ত্রী জনাব এম আর সিদ্দিকী। তিনি এক বিবৃতিতে বললেন, “২৬ মার্চের সকালে চট্টগ্রামে তিনি ‘বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রেরিত বলে কথিত’ একটি ওয়ারলেস মেসেজ পান। তক্ষুণি সংগ্রাম কমিটির বৈঠক ডাকা হয়। মরহুম ডঃ জাফর ঘোষণাটি বাংলায় মুসাবিদা করেন এবং কমিটি তা অনুমোদন করেন। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম এম এ হান্নানের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ঘোষণাটি তদানীন্তন রেডিও পাকিস্তানের কালুঘাট সাব-স্টেশন থেকে পাঠের ব্যবস্থা হয়। ২৬ মার্চ বিকেল ৩টায় ঘোষণাটি বেতারে প্রচার করা হয় এবং সেটা অসময় ও অপ্রত্যাশিত বলে তা অনেকেই শুনতে পাননি।” [বিচিত্রা, ১৭ জুলাই, ১৯৮১]
স্বাধীনতার দশ বছর পর এসে এ বিতর্ক শুরু হলো। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস এবং তারপরও কয়েক মাস পর্যন্ত স্বাধীনতা ঘোষণা কে করেছিলেন তা নিয়ে কোনো বিতর্ক দেখা দেয়নি। তখন সবাই মেনে নিয়েছিলেন, সবাই জানতেন যে, মেজর জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক। এ ব্যাপারে কারো মনে কোনো সংশয় ছিলো না। পরে ধীরে ধীরে নতুন কথা বলা শুরু হলো। প্রথম কথা বললেন জনৈক নূরুল আলম মণ্টু। ১৯৭২ সালের ৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় লিখিত একটা ফিচারে নিবন্ধে তিনি কালুরঘাট সাব স্টেশন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে একটা নতুন কথা সামনে নিয়ে এলেন। ঐ নিবন্ধে কিভাবে কালুরঘাট সাব স্টেশনকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিলো এবং কারা কোন্ অবস্থায় কোন্ উদ্দেশ্যে তা করেছিলেন এসব কথা বলার পর জনাব নূরুল আলম মণ্টু লিখেন: “ডঃ সৈয়দ আনোয়ার আলী, ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার দিলীপ দাশ ও আশিকুল ইসলামকে নিয়ে ওয়াপদার একটা গাড়ীতে করে মেজর জিয়ার কাছে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তারা কয়েকজন ছাত্রের কাছে দেশবাসীর ও বিশ্ববাসীর কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি আবেদনের কপি লাভ করেন। ডঃ আনোয়ার ও তাঁর বন্ধুরা এবং আরো অনেকে মিলে তখন অমানুষিক পরিশ্রমের পর প্রথমে কালুরঘাট বেতারকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেন এবং সেখান থেকেই স্বাধীনতার বাণীটি প্রচার করা হয় ২৬ মার্চের দুপুরে।” [দৈনিক বাংলা, ৬ মার্চ, ১৯৭২] জনাব নূরুল আলম মণ্টুর ও নিবন্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠকদের নাম থাকলেও স্বাধীনতার ঘোষকের নাম উল্লেখ নেই।
এ সম্পর্কিত আরেকটা মজার প্রবন্ধ পাওয়া গেল ১৯৮১ দসালের দৈনিক বাংলার ২৬ মার্চ স্বাধীনতা সংখ্যায়। প্রবন্ধের লেখক ছিলেন জনাব নূরুল আলম মণ্টু উল্লিখিত জনাব ডঃ সৈয়দ আনোয়ার আলী। এ প্রবন্ধেও জানা গেল একটি স্বাধীনতার ঘোষণার বাণী পাঠক করার তাকিদেই তারা কালুরঘাট সাব স্টেশনকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। আরও জানা গেল, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা শেখ মুজিবের নির্দেশে মরহুম হান্নানও দেননি, মেজর জিয়াও নন, দিয়েছিলেন যিনি তার নাম আবুল কাশেম সন্দীপ। তিনি তার নিবন্ধে এ কাহিনী সবিস্তারে এভাবে লিখেছেন:
“আগ্রাবাদ রোডে একজন লোক টেলিগ্রাম টেলিগ্রাম বলে চেঁচাচ্ছিলো। আর একটা ছোট কাগজ বিলি করছিলো। গাড়ী থামিয়ে আমি একটি কাগজ সংগ্রহ করি। কাগজটা ছিলো শেখ মুজিবের নামে প্রচারিত একটা বাণী। তিনি তাতে ২৫ মার্চের ঘটনাবী উল্লেখ করে বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের ও দেশবাসীর প্রতি প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়েছেন।
টেলিগ্রামের কাগজটা আমার স্ত্রী মিসেস মঞ্জুলা আনোয়ারের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। দেখে নি প্রথমে উল্লসিত হয়েছিলেন। কিন্তু একটু পরেই নিরাশ হয়ে বললেন: এ রকম একটা বাণী আমাদেরকে কতটা অনুপ্রাণিত করবে সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। কেননা এতে স্বাধীনতার উল্লেখ নেই। যাই হোক তিনি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক প্রচারের জন্যে সেটা বাংলায় অনুবাদ করে পাড়ারর কিছু ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কার্বন কপি করাতে শুরু করেন। বাংলা অনুবাদে তিনি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কয়েকটা পরিবর্তন সাধন করেছিলেন আমার সাথে আলাপ করে। আমার স্ত্রী এতে একটি ছোট্ট অথচ আকাঙ্ক্ষিত শব্দ যোগ করেছিলেন। সেটা হলো ‘স্বাধীনতা’। ঘোষণাটা শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছিলো এ রকম : ‘বাঙ্গালী ভাই বোনদের কাছে এবং বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের আবেদন। রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প ও পিলখানা ইপিআর ক্যাম্পে রাত ১২টায় পাকিস্তানী সৈন্যরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে হাজার হাজার লোককে হত্যা করেছে। হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে আমরা লড়ে যাচ্ছি। আমাদের সাহায্য প্রয়োজন এবং তা পৃথিবীর যে কোনো সূত্র থেকেই হোক। এমতাবস্থায় আমি বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করছি…..শেখ মুজিবুর রহমান।’ ……. কুরআন তেলাওয়াতের পরই আমার স্ত্রী মঞ্জুলার অনুবাদ (ও পরিবর্তিত) বার্তাটি পাঠ করেন ইঞ্জিনিয়ার আশিকুল ইসলাম। ফেরার পথে….. শুধু দেখেছিলাম আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান ছোট একটা কামরায় নীরবে কি যেন লিখছেন। আমি তাকে বললাম, ‘আমার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করেছি। শীঘ্রই কিছু বলুন, দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করুন।’ উনি বললেন, ‘আমি তাই লিখছি।’ আমি তাকে বলেছিলাম, এখন লেখার সময় নয় যা মুখে আসে তাই বলুন।” [বিচিত্রা, ১৭ই জুলাই, ১৯৮১]
স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে পত্র পত্রিকায় নুতন চিন্তার পরিবেশন শুরু হলো ১৯৭২ সালের মার্চ থেকে। এরপর আওয়ামী লীগও আলোচনার আসরে অবতীর্ণ হলো। ১৯৭২ সালের এপ্রিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণাবাণী টেলিগ্রাম যোগে পাঠিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করলেন। এই ১৯৭২ সালেই সরকারের বহির্বিভাগ প্রচার দফতর শেখ মুজিবের ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রকাশ করে। ইতিপূর্বে আলোচনায় দেখিয়েছি, এ দুটি ঘোষণার মধ্যে স্থান, কাল, পাত্র, বক্তব্য, ইত্যাদি কিছুরই মিল নেই। যাই হোক, এসব থেকেই আওয়ামী লীগ মহল বলা শুরু করলো যে, ২৫ মার্চ রাতেই শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু তখনও তারা বলতে পারলো নে, শেখ মুজিবের স্বাধীনতার সেই ঘোষণাটি কে কবে কখন চট্টগ্রাম বেতার থেকে পাঠ করেছিলেন, অথবা আদৌ পাঠ করেছিলেন কিনা। জিয়াউর রহমানের আমলে জাতীয সংসদে আওয়ামী লগি নেতা আসাদুজ্জামান চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার থেকে ২৬ মার্চ শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা এম এ হান্নান কর্তৃক পাঠ করার যে দাবী করলেন, তা মাত্র রফিকের ‘এ টেল অব মিলিয়নস’ এর উপর ভরসা করে।
‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের দাবী, ‘এ টেল অব মিলিয়নস’-এর মেজর রফিকের এ সম্পর্কিত তথ্য এম. আর. সিদ্দিকীর বিবৃতি, নূরুল আলম মণ্টু ও ডঃ সৈয়দ আনোয়ার আলীর নিবন্ধের এ সম্পর্কিত বক্তব্য, ইত্যাদি সম্পর্কে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত সংগত প্রশ্ন তুলেছেন জনাব খন্দকার আলী আশরাফ বিচিত্রায় প্রকাশিত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে। প্রশ্নগুলো এই:
(১) ডঃ আনোয়ার ‘টেলিগ্রাম’ বলে কথিত স্বাধীনতার ঘোষণাবিহীন ও আবেদন সমৃদ্ধ যে চিরকুটটি পেয়েছিলেন সেটা আদৌ কোনো টেলিগ্রামের কপি ছিলো কিনা আর হলেই বা তার উৎস কি? কে কোত্থেকে সেটা পাঠিয়েছিলেন? তাতে শেখ মুজিবের নামথাকলেই তিনিই যে পাঠিয়েছিলেন তার প্রমাণ কি? সেই তথাকথিত টেলিগ্রামও যে ডঃ আনোয়ার আলী ও তার পত্নী মিসেস মঞ্জুলার মতো চট্টগ্রামের কোনো দেশপ্রেমিক বা দেশপ্রেমিকদের কীর্তি নয় একথা কে বলতে পারে? জনগণকে স্বাধীনতার লড়াই-এর উদ্বুদ্ধ করার জন্যেই হয়তো তাঁরা সেটা করেছিলেন আর ঐ আবেদনটা শেখ সাহেবের নাম ছাড়া অন্য কারো নামে করলে তা যে মূল্যহীন হবে কে তা না জানতো?
(২) ঢাকা থেকে আদৌ যদি কোনো ঘোষণা পাঠানো হয়ে থাকে, তাহলে সেটা জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে টেলিগ্রাম আকারে গিয়েছিলো, না ওয়ারলেস মেসেজ আকারে এম আর সিদ্দিকীর কাছে গিয়েছিলো?
(৩) সেই তথাকথিত টেলিগ্রাম বা ওয়ারলেসে কি সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিলো?
(৪) মরহুম হান্নান যে ঘোষণাটি কালুরঘাট বেতার থেকে পাঠ করেছিলেন বলে বলা হচ্ছে সেটা কি এম আর সিদ্দিকী বর্ণিত সেইওয়ারলেস মেসেজ, নাকি নিজেই কোনো স্বাধীনতার বাণী তিনি রচনা করেছিলেন, আর তিনি কি শেখ মুজিবের নির্দেশেই তা পাঠ করেছিলেন, না অন্য কারো অনুরোধে অথবা নিজের দেশপ্রেমের আবেগে?
(৫) শেখ মুজিবুর রহমান আদৌ চট্টগ্রামে কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন কিনা কিংবা বিরাজমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে টেলিগ্রাম বা ওয়ারলেস কিংবা অন্য কোনো উপায়ে কোনো বক্তব্য পাঠানো তার পক্ষে সম্ভব ছিলো কিনা?” [‘স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন?’ বিচিত্রা, ১৭ জুলাই, ১৯৮১]
এ প্রশ্নগুলো উত্থানের পর গ্রেফতারের আগে পর্যন্ত শেখ মুজিবের পাশে ছিলেন তার এমন ঘনিষ্ঠজনদের বক্তব্য এবং বেগম মুজিবের একটি সাক্ষাতকারের দিকে ইংগিত করে জনাব খন্দকার আলী আশরাফ ঐ নিবন্ধে উপসংহার টানলেন এভাবে:
“তাঁর (শেখ মুজিবের) বাসভবনে কোনো ওয়ারলেস সেটের উপস্থিতি বা তাতে কোনো মেসেজ প্রেরণের…… প্রশ্নই অবান্তর। অথচ শেখ সাহেব যদি রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে কোনো ওয়ারলেস মেসেজ চট্টগ্রামে পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে সময়ের সীমাবদ্ধতা, পরিবেশের জটিলতা ও বিশৃঙ্খলা অর্থাৎ হানাদার বাহিনীর হামলাজনিত বিভীষিকাময় পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেটা শুধু তার বাসভবনে ওয়ারলেসস সেট থাকলেই সম্ভব হতো। সুতরাং ওয়ারলেসে কোনো মেসেজ তিনি পাঠাতে পারেননি। একই কারণে কোনো লোক মারফত সেই অবস্থায় বাইরে কোথাও সেটা পাঠানো সম্ভব ছিলো না।…… বস্তুত রাত এগারটার পর থেকেই রাজধানীর সাথে দেশের অন্য সকল অংশের তার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। শুধু সরকারী চ্যানেলগুলো খোলা থাকে। কিন্তু তা তো ছিলো হানাদারদের হাতে। এ অবস্থায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা বা অন্য কোনো মেসেজ শুধু টেলিপ্যাথির মাধ্যমেই সম্ভব ছিলো।
আরো একটা বিষয় লক্ষণীয়। ডঃ আনোয়অর যে টেলিগ্রামের কপিটি আগ্রাবাদে পেয়েচিলেন তাতে রাজারবাগ ও ইপিআর বাহিনীর উপর হানাদারদের হামলার উল্লেখ ছিলো। সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন ওঠে, শেখ সাহেব যদি তার স্বাধীনতার ঘোষণা আগেই তৈরি রাখতেন, তাঁহলে হানাদার বাহিনীর হামলার ফলে সৃষ্ট উত্তেজনা ও সন্ত্রাসের মুখে এক কথায় সেই চরম বিভীষিকাময় মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণায় রাজারবাগ ও ইপিআর-এর ওপর হামলার উল্লেখ সংযোজন আদৌ সম্ভব ছিলো কি? ছিলো না।
তাহলে ঘুরে ফিরে সেই প্রশ্নটাই আবার করতে হয়: জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে শেখ সাহেবের কোনো টেলিগ্রাম বা এম আর সিদ্দিকীর কাছে কোনো ওয়ারলেস মেসেজ পৌঁছানো সম্ভব হয়েছিলো কি? সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে এর জবাবটা ইতিবাচক হতে পারে না।
সে ক্ষেত্রে চট্টগ্রামে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা আবুল কাশেম সন্দীপ কিংবা মরহুম হান্নান কিংবা মেজর জিয়া যেই থাকুন না কেন, সেই ঘোষণার উৎসস্থল ধানমণ্ডীর ৩২ নম্বর রোড নয়। এ ব্যাপরে মেজর রফিকের বইতেও নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে। তিনি তার বইতে লিখেছেন: মরহুম হান্নানই প্রথমে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন।’ কিন্তু সেই ঘোষণাটি ঢাকা থেকে গিয়েছিলো কিনা সে প্রশ্নে তিনি উচ্চবাচ্য করেননি। এমনকি মরহুম হান্নান যে তা বংগবন্ধুর নির্দেশে পাঠ করেছিলেন এমন ধারণাও তার বইয়ের কোথাও নেই। যদিও প্রত্রিকান্তরে তার সাক্ষাতকারের বিবরণে তার উদ্ধৃতি দিয়েই বলা হয়েছে যে, বংগবন্ধুর নির্দেশেই মরহুম হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। মেজর রফিক সাক্ষাতকারে এ ধরনের কোনো উক্তি করেছেন কিনা সে সম্পর্কে আমাদের মনে গভীর সংশয় আছে। বরং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার মতে, কতিপয় মুক্তিযোদ্ধার সনির্বন্ধ অনুরোধেই মরহুম হান্নান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। সেখানে তার উপস্থিতির ঘটনাটি ডঃ সৈয়দ আনোয়ার আলীর লেখা থেকেও সমর্থিত হয়। পরে তিনি যদি স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা দিয়েও থাকেন তাহলে সেটা তার নিজেরই রচনা- এম আর সিদ্দিকীর বর্ণিত ও ডঃ জাফর কর্তৃক অনূদিত, শেখ সাহেব প্রেরিত ওয়ারলেস মেসেজ নয়।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, শেখ সাহেব ওয়ারেস স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, এমন দাবী শেখ সাহেব নিজেও কখনো করেননি, আওয়ামী লীগ মহল থেকেও করা হয়নি।…
আর একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। শেখ সাহেব যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে থাকবেন, তাহলে তা চট্টগ্রাম কেন্দ্রে প্রচারিত হোক বা না হোক, কেন তা মুজিব নগরস্থ স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে আট মাসে একবারও প্রচারিত হলো না? আমাদেরতো মনে হয়, তেমন কোনো ঘোষণা থাকলে তা প্রতিদিন প্রতিটি অধিবেশনে প্রচারিত হতো (উত্তর কালের ‘বজ্রকণ্ঠ’ স্মরণীয়) এবং হওয়া উচিত ছিলো।
কেননা সেই চরম দুর্যোগের দিনে জাতিকে অনুপ্রাণিত করতে তার বাণীর চেয়ে শক্তিশালী আর কোনো অস্ত্র ছিলো না। মুজিব নগরে তো সবাই চিলেন। ২৫ মার্চের রাতে শেখ মুজিবের বাড়ীতে উপস্থিত নেতা ও কর্মী সবাই তো মুজিব নগর আলো করে রেখেছিলেন। এরা কেউই দুগ্ধপোষ্য অপোগণ্ড শিশু ছিলো না, বরং অনেকেই ছিলো অভিজ্ঞ, দূরদর্শী রাজনৈতিক কর্মী। তা সত্ত্বেও এদের কারো কাছেই শেখ সাহেবের দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণার কোনো কপি ছিলো না, কারোরই কি তার ভাষা ও বক্তব্য স্মরণ ছিলো না? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এ নীরবতা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণার অস্তিত্ব সম্পর্ক কি সংশয় সৃষ্টি হয় না?
তার চেয়েও বড় কথা মুজিব নগর সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন তাতেও শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এমনকি কোনোও উল্লেখও তাতে নেই। কেন?
শেষ করার আগে মেজর রফিকের কথায় ফিরে আসা যাক। তিনি তার সাম্প্রতিক বিবৃতিতে বলেছেন, মরহুম হান্নান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন বলে তিনি তার বইতে যে কথা বলেছেন, শেখ সাহেব বা জেনারেল জি য়া তার প্রতিবাদ করেননি।
এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য এই যে, এ ধরনের প্রতিবাদ আশা করা ঠিক নয়। কেননা, মরহুম হান্নান ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। স্বভাবতই প্রতিবাদ জানিয়ে শেখ সাহেব তাকে হেয় প্রতিপন্ন করবেন না। আর জিয়াউর রহমান তখন দেশ রক্ষা বাহিনীতে কর্মরত। চাকরির শর্ত অনুযায়ী তার কোনো প্রকার বিবৃতি দেয়ার অধিকার ছিলো না।” [‘স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন?’ খোন্দকার আলী আশরাফ, বিচিত্রা, ১৭ জুলাই, ১৯৮১]
বস্তুত ২৫ মার্চের সেই রাতে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, বাস্তব পরিস্থিতির যুক্তিসংগত উপসংহার বোধ হয় এটাই। এনকি মুকাবিলার কোনো প্রস্তুতি বা ইচ্ছাও তাঁর ছিলো না, তাঁর সে সময়ের কথা ও কাজ এটাই প্রমাণ করে। যদি কোনো প্রস্তুতি থাকতো তাহলে, নেতৃবৃন্দকে ঢাকার বাইরে ঠেলে দিতেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীদের মধ্যে সেদিন প্রতিরোধের ব্যাপারে যে দৃঢ়তা ছিলো, তা নেতৃত্বের মধ্যে ছিলো না। একটা স্থির সিদ্ধান্তের অভাব এবং ইচ্ছার অনুপস্থিতিরই এটা প্রমাণ। এ চরম অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যেই ২৫ মার্চের কালো রাতে টিক্কা খানের কালো থাবা নিরীহ জনগণের উপর বিস্তৃত হলো। যুক্তি ও বুদ্ধির গলা টিপে ধরলো অস্ত্র। অপ্রস্তুত ও অসংগঠিত জনশক্তির উপর অস্ত্র সাময়িকভাবে বিজয় লাভ করলো।
পঁচিশের কালো রাতে টিক্কা খানের বাহিনী আওয়ামী লীগকে টার্গেট করে রাস্তায় নেমে এলো সংগীন উঁচিয়ে। কিন্তু তাদের উঁচানো এ সংগীন আওয়ামী নেতা কর্মীদের উপর নয়, আপতিত হলো জনগণের উপর। তাদের হত্যা, অত্যাচার, সন্ত্রাস এবং ভারতীয প্রচার মাধ্যমের প্রচারণায় আতংকিত মানুষ নিরাপত্তার তাকিদে আশ্রয়ের সন্ধানে বিপুল সংখ্যায় দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করলো। [একজন ভারত ফেরত রিফুজি তার অভিজ্ঞতা এভাবে লিখেছেন: “The propaganda work by the Indian press and radio was grossly exaggerated and mostly misleading. But it was dressed out in such a pluasible way the it was difficult not to believe it. Its real worth was however discovered only after we returned to our homeland. Blood curdling stories of ‘happening’ in district X made people in other districts run for safety in India. Similar stories of districts Y led the people of districts X to dash towards India.”] প্রথম এক সপ্তাহে যারা ভারতে আশ্রয় নেয় তাদের সংখ্যা কয়েক হাজারের বেশী হবে না। এঁরা মূলতহ আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী এবং বিদ্রোহী সশস্ত্র বাহিনীর লোকজন। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ভারতে আশ্রয় নেয়া লক্ষাধিক মানুষ। এপ্রিলের দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে পাকবাহিনী তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যায়। ছড়িয়ে পড়ে হত্যা এবং সন্ত্রাসও তার সাথে। এপ্রিলের দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে পাকবাহিনী তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যায়। ছড়িয়ে পড়ে হত্যা এবং সন্ত্রাসও তার সাথে। এপ্রিলের দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই দেশ ত্যাগের সংখ্যা অবিশ্বাস্য হারে বেড়ে যায়। এক এপ্রিলের দ্বিতীয়ার্ধেই ১১ লাখ মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অভাব ছিলো এ বিপুল হারে দেশ ত্যাগের আরেকটি বড় কারণ। [‘’ Washington post-এর সংবাদদাতা গোটা অঞ্চল সরেজমিনে দেখার পর জানান: “As the special Targets of the army all most all (Hindus) have fled to India, gone into hiding in rural villages or been killed. The army attack on Hinus have been so widespread that few ave doubt that theyw ordered by Pakistan govt, an order that many west Pakistan officers and rolders appear to have obeyed with enthusiasm……..” U. S. cogressional Record, 1971, P. 25850 মূলধারা ’৭২, পৃষ্ঠা-১৯] মে মাসে আরও ৩১ লাখ মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে ভারত যায়। [মূলধারা, ’৭১, মঈদুল হাসান, পৃষ্ঠা-১৯] অর্থাৎ মে পর্যন্ত ভারতে রিফুজিদের সংখ্যা ৪৩ লাখের মতো। ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা গিয়ে আশি লাখে দাঁড়ায়।
পঁচিশের পর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ভারত গমনের পরই সেখানে স্বাধীন বাংলা সরকার গঠন হলো। অন্যদিকে কারো নির্দেশের অপেক্ষা না করে অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বিদ্রোহী বীর বাঙালী সৈনিকরা বাঁচার একমাত্র পথ হিসেবে যে যেখানে ছিলো, সেখান থেকেই তারা স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে দিলো। ২৭ মার্চ চট্টগ্রামে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা এ সিদ্ধান্তেরই ফল।
তাজউদ্দীন দিল্লী যাওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের আগে ৩রা এপ্রিল কিভাবে একক সিদ্ধান্তে স্বাধীন বাংলা সরকার গঠন করে নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে সরকার গঠন অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিশেষ করে যুব নেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো। ৮ এপ্রিল কোলকাতার বৈঠকে তাঁর এ সিদ্ধান্ত তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হলো। ভারতীয় RAW-এর বিশেষ আশ্রয় ও অনুগ্রহপুষ্ট শেখ মণি সহ যুব নেতারা তাজউদ্দীনের সরকার গঠনের বিরোধিতা করলেন এবং প্রস্তাবিত তাঁর বেতার ভাষণ বন্ধ করার দাবী জানালেন। এই সাথে শেখ মণি উপস্থিত ৪২জন আওয়ামী নেতা ও যুব নেতার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তাজউদ্দীনের বেতার ভাষণ বন্ধ করার জন্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক আবেদন পাঠালেন। কিন্তু তাদের আবেদন গ্রাহ্য হয়নি। [শেখ মণি ও যুব নেতাদের পেছনে ভারত সরকার এবং ভারতীয় গোয়েন্ত সংস্থা RAW- এর বিশেষ সম্পর্ক ও আনুকুল্য থাকলেও দিল্লীর একটা রাজনৈতিক মহল (বামপন্থ) তাজউদ্দীনকে সমর্থন দিচ্ছিল। তাছাড়া এ ধরনের একটা স্বাধীন বাংলা সরকারের অস্তিত্ব তখন ভারত সরকারের জন্যে খুবই প্রয়োজন ছিল।]
তাজউদ্দীনের সরকার এভাবে টিকে গেল। তবে এ সরকার অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে কোনো সময়ই মুক্ত থাকেনি। খন্দকার মুশতকের নেতৃত্বাধীন একটা বড় গ্রুপ তো তাজউদ্দীনের অজান্তে পকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন ও আপোসের আলোচনা চালাচ্ছিল। [মূলধারা ’৭২, পৃষ্ঠা-৯৬-৯৭, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৫০১] তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে আওয়ামী নেতা কামারুজ্জামানও একটা গ্রুপ পোষণ করতেন। আর শেখ মণি, রাজ্জাক, তোফায়েল, প্রমুখ যুব নেতাদের গ্রুপ কোনো দিনেই তাজউদ্দীনের সরকার মেনে নেয়নি। ভারত সরকারের বিশেষ ব্যবস্থাধীনে এবং ভারতীয় গোয়েন্দা RAW-এর তত্ত্বাবধানে তারা মুজিব বাহিনী গঠন করে- যে বাহিনী তাজউদ্দীন সরকারকে বৃদ্ধাংগুলি দেখাতে পারতো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র কেড়ে নিতে পারতো।[মূলধারা ’৭২, পৃষ্ঠা-৮০]
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের স্বাধীন বাংলা সরকার ন্যাপ, সিপিবি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী অন্য কাউকেই সরকারে নিতে রাজী হয়নি। এমনকি ফ্রন্ট গঠনেও নয়। আওয়ামী লীগের এ ভূমিকা ভারতের বামপন্থী মহল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নর সাহায্য লাভে সমস্যা সৃষ্টি করছিলো। অবশেষে দিল্লী থেকে ডিপি ধর ২৯ আগস্ট কোলকাতা আসেন। চারদিনের চেষ্টা সত্ত্বেও কার্যকর কিছু করতে তিনি ব্যর্থ হন। এ ব্যাপারে মঈদুল হাসান তার গ্রন্থে লিখেন:
“ডিপি ধরের সফরের দ্বিতীয় মূল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিলো বাংলাদেশের বামপন্থী দলসমূহকে স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলশক্তি আওয়ামী লীগের সাথে এমনভাবে গ্রথিত করা যাতে এ সংগ্রাম জাতীয় মুক্তি আন্দোলন রূপ লাভ করে এবং যার ফলে ভারত সোভিয়েট মৈত্রী চুক্তিকে কেবলমাত্র নিরাপত্তার বর্ম হিসেবে ব্যবহার না করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানী দখল বিলুপ্তির অন্যতম মূল সহায়ক উপাদাদন হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। এ রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে বৃহত্তর ঐক্য সাধনের জন্যে ডি পি ধর অত্যন্ত স্বল্প সময়-সীমার মাঝে (অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের শেষে ইন্দ্রিরা গান্ধীর মস্কো সফল শুরু হবার আগে) মন্ত্রিসভার অনিচ্ছুক অংশকে ঐক্যজোট প্রস্তাবে যেভাবে সম্মত করান, তা সংশ্লিষ্ট নেতাদের বিরাগ উৎপাদন করে।…… তাঁর (ডিপি ধরের) দিল্লী প্রত্যাবর্তনের পর পরই বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা প্রস্তাবিত জাতীয় মোর্চার নির্দিষ্ট কাঠামো ও ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু এঁদেরই কোনো সদস্যের অভিমতকে প্রতিধ্বনিত করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিভিন্ন স্তরে জাতীয় ঐক্যফ্রণ্ট গঠনের জন্যে ভারত সরকারের ‘চাপ’ এবং ‘হস্তক্ষেপের’ বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ গুঞ্জন শরু হয়। এ পরিস্থিতিতে মন্ত্রিসভা জাতীয় ঐক্যজোট গঠন করেন ঠিকই, তবে এ জোটকে কোনো কার্যকরী সংগঠনের রূপ না দিয়ে নিছক এক উপদেষ্টা সংস্থার মর্যাদা দান করেন এবং এর অধিকার সীমিত করেন এবং মুক্তি সংগ্রামের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে ‘পরামর্শ, দানের মধ্যে। কিন্তু এ পরামর্শ দান প্রক্রিয়া কিভাবে বা কত নিয়মিত সংঘটিত হবে, সে বিষয়টিও সর্বাংশে অস্পষ্ট থাকে। অন্য কথায়, বৃহত্তর রণনৈতিক বিবেচনা করে মন্ত্রিসভা ‘জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি’ গঠনে সম্মত হলেও সাংগঠনিক অর্থে এ একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানের রূপ লাভ করে।” [মূলধারা, ’৭১, পৃষ্ঠা-৮৮-৯০]
স্বাধীন বাংলা সরকারকে আওয়ামী লীগ মনোপলি করে রাখলেও মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু আওয়ামী লীগের দ্বারা শুরু হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতারা যখন ভারতে যেতে ব্যস্ত এবং ভারতে গিয়ে সরকার গঠনের কোন্দলে ব্যাবৃত, তখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বিদ্রোহী বাঙালী সৈনিক, ইপিআর জোয়ান, পুলিশ ও আনসাররা অস্তিত্ব রক্ষার জন্যেই প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে দেয়। শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ ‘In Side RAW : The Story of Indias Secret Serveice’ গ্রন্থে Asoka Raina মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চারটি শ্রেণীর কথা উল্লেখ করেছেন। তারা হলো: এক, সর্বস্তর থেকে আসা ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সী যুবক, দুই, আওয়ামী লীগের যুব শাখার চরমপন্থী যুবকরা, তিন, ফ্রন্টিয়ার গার্ড, পুলিশ, মুজাহিদ, আনসার প্রবৃতি প্যারা মিলিশিয়ার লোক এবং চার, ইস্ট বেংগল রেজিমেণ্টের নিয়মিত সৈনিক। [In Side RAW : The Story of Indias Secret Serveice’ -Asoka Raina, Page-55] এদের মধ্যে চতুর্থ ও তৃতীয় সশস্ত্র গ্রুপই প্রথমে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় এগিয়ে আসে। অবশিষ্ট দুটি গ্রুপ রণাংগনে আসে অনেক পরে- মে মাসের শেষ দিকে ট্রেনিং লাভ করার পর। প্রথম গ্রুপ, যাদের মধ্যে আওয়ামী লগি ও ছাত্র লীগের সাধারণ কর্মীরা শামিল ছিলো, তাদের ট্রেনিং হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে। কিন্তু দ্বিতীয় গ্রুপ অর্থাৎ আওয়ামী লগের যুব শাখার চরমপন্থী যুবকরা ছিলো বিশেষ সুবিধাভোগী গ্রুপ। এদের ট্রেনিং, অস্ত্র সরবরাহ প্রভৃতি সবকিছু ছিলো, RAW –এর জেনারেল উবানের হাতে। RAW –এর তত্ত্বাবধানে দেরাদুনে এদের ট্রেনিং হয়। [মূলধারা, ’৭১, পৃষ্ঠা-৭৮-৭৯] এসব থেকে একটা বিষয় সুস্পষ্ট যে, প্রকার ও প্রকৃতির দিক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা একমুখী ছিলো না। বিভিন্ন ধারায় তারা বিভক্ত ছিলো। জনাব মঈদুল হাসান তাঁর মূলধারা-‘৭১’ গ্রন্থে ধারাকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন:
“২৬ মার্চের পর থেকে প্রথম দশ দিনের মধ্যেই এ প্রতিতেরাধ সংগ্রামে তিনটি স্বতন্ত্র ধারা পরিস্ফুট হয়।
প্রথম ধারা ছিলো আক্রান্ত বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ইপিআর-এর সেনা ও অফিসারদের সমবায়ে গঠিত। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সকল বাঙালী সৈন্য ও অফিসারই যে এতে যোগ দিয়েছিলো তা নয়। অনেকে নিরস্ত্রীকৃত হয়েছে, অনেকে বন্দী হয়ে থেকেছে, আবার অনেকে শেষ অবধি পাকিস্তানীদের পক্ষে সক্রিয় থেকেছে। মেজর জিয়াকে ঘোষণা এবং বিদ্রোহী ইউনিটগুলোর মধ্যে বেতার যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হবার ফলে এসব স্থানীয় ও খণ্ড বিদ্রোহ দ্রুত সংহত হতে শুরু করে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িত হবার বিষয়টি এদের জন্যে মূলত ছিলো অপরিকল্পিত, স্বতঃস্ফূর্ত এবং উপস্থিত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এ যুদ্ধের রাজনৈতিক উপাদান সম্পর্কে এদের অধিকাংশের জ্ঞানও ছিলো সীমিত। তবু বিদ্রোহ ঘোষণার সাথে সাথে পাকিস্তানী বাহিনী সীমান্ত পর্যন্ত এমনভাবে এদের তাড়া করে নিয়ে যায় যে, এদের পাকিস্তানে ফিরে আসার পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ হয়। হয় ‘কোট মার্শাল’ নতুবা ‘স্বাধীনতা’ –এ দুটি ছাড়া অপর সকল পথই তাদের জন্য রুদ্ধ হয়ে পড়ে। এমনিভাবে পাকিস্তানী আক্রমণের এক সপ্তাহের মধ্যে স্বাধীনতার লড়াই-এ শামিল হয় প্রায় এগার হাজার বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ইপিআর এর অভিজ্ঞ সশস্ত্র যোদ্ধা। কখনও কোনো রাজনৈতিক আপোস-মীমাংসা ঘটলেও দেশে ফেরার পথ তাদের জন্যে ছিলো বন্ধ যতদিন না বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানীরা সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামে দ্বিতীয ধারার সমাবেশ ও গঠন প্রথম ধারার মতো আকস্মিক, অপরিকল্পিত বা অরাজনৈতিক ছিলো না। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী যুব সংগঠনের চার নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খকান, তোফায়েল আহমদ আবদুর রাজ্জাক সরাসরি কোলকাতায় এসে পড়েন। শেখ মুজিবের বিশেষ আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত এ চার যুব নেতারই আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মীদের উপর বিশেষ প্রভাব ছিলো। বিশেষ করে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে এ তরুন নেতাদের ক্ষমতা অসামান্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ভারতে প্রবেশের পর থেকে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্যাপারে এক স্বতন্ত্র গোষ্ঠীগত ভূমিকা গ্রহণ করে। এদের নেতৃত্বে এবং ভারতীয় বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘Researh and Analysis Wing (RAW)’-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মুজিব বাহিনী’ নামে প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণে বাইরে এমন এক সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম হয়, এক সময় যার কার্যকলাপ স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিভক্ত করে ফেলতে উদ্যত করে।….
প্রতিরোধ যুদ্ধে তৃতীয় ধারা যদিও ক্রমে ক্রমে স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলধারায় পরিণত হয়, তবু সূচনায় তা না ছিলো বাঙালী সশস্ত্র বাহিনীর মতো অভাবিত, না ছিলো যুব ধারার মতো ‘অধিকারপ্রাপ্ত’। পাকিস্তানী আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে ক কার্যত সমগ্র আওয়ামী সংগঠন দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেয়। আক্রমণের অবাবনীয় ভয়াবহতা, সর্বময় নেতার কারাবরণ, পরবর্তী কর্মপন্থা ও নেতৃত্ব সম্পর্কে সম্যক অনিশ্চয়তা ইত্যাকার বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও মূলত মধ্যবিত্ত নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লগি এক দুর্লভ বৈপ্লবিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কাজে প্রয়াসী হয়।” [মূলধারা, ’৭১, পৃষ্ঠা-৬-৮]
এ তিনটি ধারার মধ্যে প্রথম ও তৃতীয় ধারাটি পঁচিশে মার্চের সৃষ্টি। পঁচিশের রাত আমাদের বাঙালী সৈনিক ও জোয়ানদের এমন এক অবস্থানে নিক্ষেপ করে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো বিকল্প তাদের ছিলো না। স্বাভাবিকভাবেই ‘ডু অর ডাই’ তাদের মন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। অনুরূপভাবে রজনীতি এবং নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের প্রশ্নে আওয়ামী লগি এমন এক অবস্থানে নিক্ষিপ্ত হলো পঁচিশের রাতে যখন ভারতে আশ্রয় নেয়া এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করা ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্প ছিলো না। তবে প্রথম ও তৃতীয ধারার মধ্যে পার্থক্য এই যে, প্রথম ধারার কাছে মুক্তিযুদ্ধই ছিল শেষ কথা, কিন্তু তৃতীয় ধারার কাছে রাজনৈতিক সমাধারে একটা সম্ভাবনা ছিলো। [স্বাধীন সরকার গঠনের ভাষণেও তাজউদ্দীন যুদ্ধের বিকল্প হিসেবে রাজনৈতিক সমাধানের একটা শর্ত পেশ করেছিলেন। স্বাধীন বাংলা সরকারের অনেকে প্রকাশে এবং গোপনে রাজনৈতিক আপোসের একটা চেষ্টাও করে গেছেন। আনন্দ বাজার পত্রিকার রিপোর্টার এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত মিঃ সুখরঞ্জন দাস গুপ্ত লিখেছেন:
“এবার ধীরে ধীরে ধরা পড়তে লাগলো চক্রান্তটা। মুক্তিযুদ্ধ যখন তুঙ্গে ঠিক সেই সময়ই একটি বিদেশী সংস্থার যোগসাজশে এ ষড়যন্ত্রের সূচনা। খোন্দকার এবং মেহবুব চাষী ছাড়াও এ চক্রান্তে ছিলেন কর্নেল ওসমানি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাহের উদ্দীন ঠাকুর, ফরিদপুরের ওবায়েদুর রহমান আর শাহ মোয়াজ্জেম, মুন্সিগঞ্জের ডাঃ টি. হোসেন, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত একটি খবরের কাগজের সম্পাদক মহম্মদ খালেদ প্রমুখ চাঁই। শত্রুর কবল থেকে দেশ উদ্ধারের জন্য একদিকে যখন বুকের রক্ত ঢেলে লড়াই করছে মুক্তিফৌজ, অপরদিকে তখন ওই বেইমানের দল কলকাতায় হোসেন আলির ডেরায় ঘনঘন গোপন বৈঠকে মিলিত হচ্ছে, শলাপরামর্শ করছে মুক্তিফৌজের পিছনে চাকু মারতে, খতম করতে মুক্তিযুদ্ধ।
রাতের অন্ধকারে চক্রান্তকারীরা মিলিত হতো। ওরা একটা মতলব আঁটে। বিদেশ দফতর একটা পশ্চিমীচক্রের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার সামরিক জুন্টার সাথে যোগযোগ করবে। জুন্টাকে বোঝাবে- ‘একটা ঢিলেঢালা পাক কনফেডারেশনের মধ্যেই তারা যদি বাংলাদেশকে ‘পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য’ দেয় তাহলে এখনও পকিস্তানকে অটুট রাখা সম্ভব। এতে রাজি হলে এক্ষুণি যুদ্ধ বন্ধ করে আলোচনা বৈঠকের ব্যবস্থা করা যায়।’ বিদেশ দফতরের সচিব মেহবুব আলম চাষী এ প্রস্তাবটাই পাক জুন্টার কাছে পাঠায়। ওই বয়ানের সঙ্গে সে আরও জানিয়ে দেয়, জেনারেল ইয়াহিয়া এ প্রস্তাবে রাজি হলে জনাব খোন্দকার এক প্রতিনিধিদল নিয়ে যাবেন। করনেল ওসমানিও থাকবে তাঁর সঙ্গে।….
রিলিফ দেওয়ার নাম করে ওই সব বিদেশী সংসথা বিদেশ মন্ত্রকের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঢুকে পড়লো। অনেকে আসে সাংবাদিক হিসেবে সংবাদ সংগ্রহের অছিলায়। কিন্তু নানা যুক্তি প্রমাণে এটা বিশ্বাস করায় অসুবিধা নেই যে, ওরা যেভাবে মেজর জিয়ার সাথে যোগাযোগ করে। ফলে বিদেশী পৃষ্ঠপোষকতায় একটা দক্ষিণপন্থী চক্র মুজিব নগরে বেশ জাঁকিয়ে বসতে পারে। এবার শুরু হ’ল তাজউদ্দীন সম্পর্কে নানা মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিব্রত করার কাজ। এমনকি, তাজউদ্দীন আর নজরুলের মধ্যে ব্যক্তিগত স্তরে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করা হ’ল কুৎসিত উপায়ে। অল্পদিনেই দলাদলিতে ভরে গেল মুজিব নগর। খোন্দকারের নির্দেশে মতলব বাজরা মিলিত হ’ত শলাপরামর্শের জন্য হোসেন আলির ডেরায়। তাহের উদ্দীন ঠাকুর আর মেহবুব চাষী করতে লাগল নানা স্থানে ছড়ানো দক্ষিণপন্থী নেতা আর সমর্থকদের সাথে সংযোগ রক্ষা। আরও একটা জবর খুশির খবর অপেক্ষা করছিলো তাদের জন্য। মুক্তি বাহিনীর নাম কা ওয়াস্তে প্রধান কর্নেল ওশমানির কাছে হাজির হয়েই তারা বুঝতে পারল সেটা। বুঝল ওই কর্নেলও সুযোগের পথ চেয়ে আছে পাশা উল্টেদেয়ার জন্য।” –(মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র, সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত, পৃষ্ঠা-১১-১৬)] এদিক দিয়ে প্রথম ধারাটি ছিলো নিখাদ এবং তাদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও দলীয় স্বার্থ ছিলো না বলে এরাই ছিলো প্রকৃতপক্ষে জাতীয় স্বার্থের প্রতীক। যা হওয়া তৃতীয় ধারাটির পক্ষে অসম্ভব ছিলো।
আর দ্বিতীয় ধারাটির জন্ম পঁচিশে মার্চ নয়, তার অনেক আগে। কমপক্ষে ১৯৬৭ সাল [‘স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর’, কামরুদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা-১০৪] থেকে এঁরা আওয়ামী লীগের অজ্ঞাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ করেছেন। [‘১৯৬৪ সালে আমরা কয়েকজন যুবক দেশের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। তখন আমি, সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ আহমদ ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গড়ে তুলি। এ পরিষদকে ইংরেজীতে বলা হতো বিএলএফ।…. আমাদের বিএলএফ-ই পরে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মে মাসে মুজিব বাহিনীতে পরিণত হয়।….. মুজিব বাহিনী ছিলো একটি রাজনৈতিক বাহিনী। এ বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিলো দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সমাজতন্ত্রি বাংলাদেশ কায়েমের জন্যে।” (বাংলাদেশের যুদ্ধঃ যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে বাকশাল প্রধান আবদুর রাজ্জাকের উক্তি, দৈনিক দেশ, ১২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৯০)] ৩রা মার্চ এঁরাই পল্টন ময়দানে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ ছাত্র তরুণরাই আওয়ামী লীগের আপোস আলোচনা উপেক্ষা করে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনা করেন।[“চরমপন্থী ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দ তাঁর শেখ (শেখ মুজিবের) সিদ্ধান্তকে দুর্বল মনে করলো। ছাত্ররা তখন ছাত্র সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু সার্জেরন্ট জহুরুল হক হলে তাদের প্রধান কার্যালয় স্থানান্তরিত করলো। ঐ তারিখ (৩রা মার্চ) থেকেই আন্দোলন দুটো ধারায় বইতে শুরু করলো। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে সার্জেণ্ট জহুরুল হক হলের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রধান কার্যলয় স্বাধীনতার জন্যে সর্বাত্মক লড়াই-এর প্রস্তাব গ্রহণ করলো। অন্যদিকে শেখ সাহেবের বাড়ীতে অহিংসা ও অসহযোগ নীতির ভিত্তিতে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হলো।” –স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর, পৃষ্ঠা-১০৮] এদিক থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি এঁদের দাবীই ছিলো অগ্রগণ্য। সম্ভবত এ কারণেই তারা সীমান্ত অতিক্রম করার পর দাবী করতে থাকেন যে, ‘সশস্ত্র বাহিনী ট্রেনিং এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনার জন্যে শেখ মুজিব কেবলমাত্র তাদের চারজনের (শেখ মণি, সিরাজুল আলম, তোফায়েল, আবদুর রাজ্জাক) উপরেই দায়িত্ব অর্পণ করেছেন (শেখ মুজিবের এ কথিত নির্দেশের সত্যাসত্য নিরূপণের কোনো উপায় না থাকলেও) অপর কারোর উপরে নয়।’ [মূলধারা, ’৭১, পৃষ্ঠা-৮] তবে তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে হয়নি। কারণ তাদের বাহিনী ট্রেনিং নিয়ে তৈরি হতে হতে স্বাধীনতা যুদ্ধই শেষ হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে এ ধারা বিশেষ একটা চেতনা নিয়েই সবার অজান্তে এবং সন্তর্পণে বহু আগে থেকে মুক্তি সংগ্রাম শুরু করেছিলো। সেটাকে তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলা যায়। কিন্তু এ ধরনের কোনো বিশেষ চেততনা প্রথম ও তৃতীয় ধারায় ছিলো না। কারণ পঁচিশের রাতে তাদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ায় এ ধরনের কোনো চিন্তা-ভাবনার সময় তাদের হবার কথা নয়। দেশ এবং দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খা-আদর্শ যেমন তেমনিভবে তাদের ভালবেসেই তারা তাদের জন্যে যুদ্ধ শুরু করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জনগণের যে লক্ষ্য-ই ছিলো তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। [“আজ জোর করেই বলা হচ্ছে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র ভালো কি মন্দ সে নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু সেদিনের মুক্তিযোদ্ধারা এসব আদর্শের কথা ভেবে জীবন মরণ লড়াইয়ের ঝুঁকি নিতে আসেন্নি আমাদের যেসব বুদ্ধিজীবি ১৯৭১-এর যুদ্ধকে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত যুদ্ধ হিসাবে ভাষ্য করতে চাচ্ছেন, তারা আসলে কেউই মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বাজি রেখে লড়াই করতে এগোননি। এদের অনেকেই সে সময় ছিলেন ভারত সরকারের নিরাপদ আশ্রয়ে। এঁরা পেয়েছিলেন থাকার জন্যে সুন্দর বাড়ী। অন্নের কোনো চিন্তা ছিলো না এঁদের।” (মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত’-ডঃ এবনে গোলাম সামাদ, বিক্রম, জানুয়ারী, ১৯৭৯)]
পঁচিশে মার্চের পর সৈনিক (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট), ইপিআর, পুলিশ ও আনসাররা কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, নির্দেশ ও সমন্বয় ছাড়াই যে যার মতো লড়াই করছিলেন। যোগাযোগ ও সমন্বয়ের প্রয়োজন তারা অনুভব করলেন। তাজউদ্দীন যখন দিল্লীতে স্বাধীন বাংলা সরকার গঠন নিয়ে ব্যস্ত, তখন ৪ঠা এপ্রিল আপন তাকিদেই সেনা অফিসাররা একত্রিত হলেন সিলেট জেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। এ বৈঠকে ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত (অবঃ) ওসমানি, লেঃ কর্নেল আবদুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান, কেমর খালেদগ মোশাররফ, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর কাজী নূরুজ্জামান, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর মমিন চৌধুরী এবং আরো কয়েকজন। আলাপ-আলোচনার পর পরিস্থিতির দাবী অনুসারে তারা সমস্ত্র বিদ্রোহী ইউনিটের সমবায়ে সম্মিলিত মুক্তি ফৌজ গঠন করলেন এবং কর্নেল ওসমানিকে তা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলো। [চার মাস পরে অর্থাৎ জুলাই মাসের শেষে ‘মুক্তি ফৌজ’ নাম বদলিয়ে ‘মুক্তি বহিনী’ করা হয়।] ভারী অস্ত্রশস্ত্র আর গোলঅ-বারুদের অভাব মেটাবার জন্যে অবিলম্বে ভারতের শরণাপনন হবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো এবং বিদেশ থেকে সমর সম্ভার সংগ্রহ করার জন্যে রাজনীতিকদের সমবায়ে যথাশীঘ্র স্বাধীন সরকার গঠনের আবশ্যকতাও তারা অনুভব করলেন।
এভাবে তাঁরা জাতির স্বার্থকেই বড় করে দেখায় কে কিভাবে সরকার গঠন করলো সেদিকে তাঁরা নজর দেননি। তাজউদ্দীনের সরকার গঠন নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে কোন্দল চললেও, আওয়ামী যুব নেতারা কোন্দল চালালেও তাজউদ্দীনের সরকার মেনে নিতে কিন্তু মমাণ্ডাররা দ্বিধা করেনি। [যেখানে স্বার্থ ও সুখ ভোগের প্রশ্ন থাকে, সেখানেই ভাগাভাগির দ্বন্দ্বটা তীব্র হয়ে ওঠে। ক্ষমতা ও অধিকার কুক্ষিগত করতে গিয়ে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ ও যুব নেতারা এ নিকৃষ্ট দ্বন্দ্বেরই পরিচয় দিয়েছেন। তারা সুখে থেকে আরও সুবিধা লাভেরই সংগ্রাম করেছেন। এ সম্পর্ক মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের কমাণ্ডার জনাব মেজর এম এ জলিল লিখেন:
“মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শিবিরগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করা বাঙ্গালী তরুণ ক্যাপ্টেন, মেজর পদে অফিসার দিয়েই শুরু হয়। কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শিবির স্থাপনের ব্যাপারে কোনো ধরনেরই অবদান রাখতে পারেনি।
এমনকি পশ্চিম বাংলার নিরাপদ এলাকায় ট্রেনিং শিবির গড়ে ওঠার পরও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে ট্রেনিং শিবিরের আশে-পাশেও দেখা যায়নি। তবে এর ব্যতিক্রম যারা ছিলেন তাদের সংখ্যা সীমিত। ….. আওয়ামী নেতৃত্বের এ ব্যর্থতার কারণ হিসেবে অনেকে বলে থাকেন যে, ‘বেচারারা’ বিচ্ছিন্নভাবে যে যেভাবে পেরেছে বর্ডার অতিক্রম করার ফলে পশ্চিম বাংলায় গিয়ে এক রকম কক্ষচ্যুত নকএত্রর ন্যায়ই এখানে-সেখানে ছুটাছুটি করেছেন। তাদের নাকি নিজেদেরই কোনোরূপ অবস্থান ছিলো না। কি করেই বা যুদ্ধের খবর নিব? কথাগুলো বেশ যুক্তি আছে, তবে অতটা জোরালো নয়। …… ভুরি ভুরি প্রমাণ পেয়েছি যখন তাদের দেখেছি কোলকাতার অভিজাত এলাকার হোস্টেল-রেস্টুরেণ্টগুলোতে জমজমাট আড্ডায় ব্যস্ত। একাত্তরের সেই গভীর বর্ষণরত দিন-রাতে কোলকাতার অভিজাত রেস্টুরেণ্টগুলোতে বসে গরম কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়ে হাঁটুতক কাদাজলে ডুবন্ত মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শিবিরগুলোতে অবস্থানরত হাজার হাজার তরুণের বেদনাহত চেহারাগুলোকে তারা একবারও দেখেছে কিনা আমার জানতে ইচ্ছা করে। আমার জানতে ইচ্ছা করে কোলকাতার পার্ক স্ট্রিটের অভিজাত নাইট ক্লাবগুলো ‘বিয়ার হুইস্কি’ পানরত আওময়ামী লীগ নেতৃত্বের মনোমুকুরে একবারও ভেসে উঠেছে কিনা সেই গুলিবিদ্ধ কি শোর কাজলের কথা যে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত চীৎকার করে ঘোষণা কছে ‘জয় বাংলা’। আমার জানতে ইচ্ছে করে কোলকাতায় বিশেষ এলাকায় যুবতী নারী সম্ভোগে অধীর কামাতুর ঐ সকল আওয়াম লীগ নেতাদের মনোসরোবরে একবারও ভেসে উঠেছে কি যুদ্ধরত পূর্ব বাংলার পশু পাঞ্জাবী কর্তৃক ধর্ষিত মা বোনের বীভৎস চেহারা?
ভারতে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অনেক কিচুই জানতে চেয়েছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক এবং চিত্র নির্মাতা কাজী জহির রায়হান। তিনি জেনেছিলেন অনেক কিছু, চিত্রায়িতও করেছিলেন অনেক দুর্লভ দৃশ্যের। কিন্তু অতসব জানতে বুঝতে গিয়ে তিনি বেজায় অপরাধ করে ফেলেচিলেন। স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই সেই অনেক কিছু জানার অপরাধেই প্রাণ দিতে হয়েছে বলে ধারণা। ভারতের মাটিতে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের চুরি, দুর্নীতি, অবৈধ ব্যবসায়, যৌন কেলেংকারী, বিভিন্নরূপ ভোগবিলাস সহ তাদের বিভিন্নমুখী অপকর্মের প্রচুর প্রামাণ্য দলিল ছিলো-ছিলো সচিত্র দৃশ্য। আওয়ামী লীগের অতি সাধের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজী জহির রায়হানের এতোবড় অপরাধকে স্বার্থান্বেষী মহল কোন্ যুক্তিতে ক্ষমা করতে পারে?…. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৩নং আসামী স্টুয়ার্ড মুজিবেরও ঘটেছিলো একই পরিণতি। এ দায়িত্বশীল, নিষ্ঠাবান, তেজোদীপ্ত যুবক স্টুয়ার্ড মুজিব আমার ৯নং সেক্টরের অধীনে এবং পরে ৮নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছে। তার মতো নির্ভেজাল ত্বরিতকর্মা একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধা সত্যিই বিরল। প্রচণ্ড সাহস ও বীরত্বের অধিকারী স্টুয়ার্ড মুজিব ছিলো শেখ মুজিবের অত্যন্ত প্রিয় ও অন্ধ ভক্ত। স্টুয়ার্ড মুজিব ভারতে অবস্থিত আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেক কুকীর্তি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। এতোবড় স্পর্ধা কি করে সইবে স্বার্থান্বেষী মহল? তাই স্বাধীনতার মাত্র সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ঢাকা নগরীর গুলিস্তান চত্বর থেকে হাইজ্যাক হয়ে যায় স্টুয়ার্ট মুজিব। এভাবে হারিয়ে যায় বাংলার আর একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র।” অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা- মেজর (অবঃ) এম এ জলিল, পৃষ্ঠা-২৬-২৭)] তাজউদ্দীনের সরকার ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এদিন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে থেকে নীতি নির্ধারণী বিবৃতি দিলেন এবং পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। যুদ্ধের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সংসদ সদস্য জেনারেল ওসমানিকে সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হলো এবং বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে প্রত্যেক সেক্টরের জন্য একজন করে সেক্টর কমাণ্ডার নিয়োগ করা হলো। মেজর রফিক-উল-ইসলাম, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর সফীউল্লাহ, মেজর সি আর দত্ত, মেজর শওকত আলী, বিমান বাহিনীর এম কে বাশার, মেজর কাজী নূরজ্জামান, মেজর এম এ মঞ্জুর, মেজর এম এ জলিল, মেজর এম এ তাহের এবং মেজর জিয়াউর রহমান- এ এগারজনকে এগারটি সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হলো। এভাবে মুক্তিযুদ্ধ একটা সুসংবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করলো।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কার্যকরী রূপ পরিগ্রহ করতে সময় লাগলো। ২৬ মার্চ থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম যে পর্যায় এ সময় ভারত কার্যত কোনো সাহায্য করেনি। আমাদের সৈনিক, ইপিআর, পুলিশরা এবং তাদের হাতে তৈরি মুক্তিযোদ্ধারা তাদের হাতে যা ছিলেো তাই নিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালায়। কিন্তু প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় সর্বাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে শহর-বন্দরে তাদের অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন ছিলো। সুতরাং বাধ্য হয়ে তাদের পিছু হটতে হয়। ….মে মাস ছিল নিদারুণ হতাশার মাস। পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম অভিযানের মুখে মার্চ-এপ্রিলের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ সংগ্রাম ক্রমশ থেমে যাওয়া দেশের ভেতরে ও বাইরে সর্বত্রই নিরুৎসাহের ভাব। মধুপুর, গোপালগঞ্জ এবং আরও দু একটা ছোট-খাটো অঞ্চল বাদে গোটা বাংলাদেশ পাকিস্তানী সেনাদের ক রতলগত।’ [মূলধারা, ’৭১, পৃষ্ঠা-২২] এ হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয পর্যায় শুরু হলো। ৩০ এপ্রিল ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার দায়িত্ব ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর হাতে অর্পন করলো। আর মে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদর সশস্ত্র ট্রেনিং দেয়ার দায়িত্ব তাদের হাতেই অর্পিত হলো। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ নতুন প্রাণ পেল। আগের চেয়ে অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটলো। কিন্তু বাংলাদেশ দিল্লীর কাছে যে সর্বাত্মক সাহায্য চাচ্ছিল তা পেল না। ভারত বাংলাদেশ সরকারকে তখনও স্বীকৃতি দেয়নি। একটা রাজনৈতিক সমাধান হয়ে যায় কিনা, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে ভারত একা পড়ে যায় কিনা ইত্যাদি চিন্তা ভারতকে দ্বিধাগ্রস্ত করছিলো। ভারতের এ দ্বিধাগ্রস্ততার কারণে মুক্তিবাহিনীর প্রয়োজনীয় শক্তিবৃদ্ধি ব্যাহত হয়। অন্যদিকে রাজাকার রিক্রুটের কারণে পাক বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি হয়। জুলাই মাসে দেশে সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা যখন মাত্র চার হাজার, তখন সশস্ত্র রাজাকারদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো বাইশ হাজারে।[এ বিপুল সংখ্যায় ‘রাজাকার রিক্রুট হওয়ার পিছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করেছিলো। বাংলাদেশের সবগুলো ইসলামপন্থী দলের কোনোটিই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে তাদের সমর্থকদের মধ্য থেকে একটা সংখ্যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজাকার বাহিনীতে শামিল হয়। তবে এ ধরনের আদর্শবাদী লোকদের সংখ্যা খুবই নগণ্য ছিলো। প্রকৃতপক্ষে ‘নিয়মিত ভাতা, রেশমন, স্থানীয় ক্ষমতার ব্যবহার এবং সর্বোপরি হিন্দু সম্প্রদায় সদস্যদের ঘরবাড়ী ও বিষয়-সম্পত্তি অবাধে লুটপাট ও ভোগ দখল করার’ লোভে সমাজের সুযোগ সন্ধানী এক শ্রেণীর লোক ব্যাপকহারে রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করে।–(মূলধারা, ’৭১, পৃষ্ঠা-৭১)। জনাব কামরুদ্দিন আহমদ তাঁর স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় গ্রন্থে এ বিষয়ে একটা প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন:
“বাঙ্গালীদের রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি হবার কতকগুলো কারণ ছিলো। তাহলো:
(ক) দেশে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিলো। সরকার সে দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়ে ঘোষণা করলো, যারা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেবে, তাদের দৈনিক নগদ তিন টাকা ও তিন সের চাউল দেয়া হবে। এর ফলে বেশ কিছু সংখ্যক লোক, যারা এতোদিন পশ্চিমা সোনার ভয়ে ভীত হয়ে সন্ত্রস্ত দিন কাটাচ্ছিল, তাদের এক অংশ ঐ বাহিনীতে যোগ দান করলো।
(খ) এতোদিন পাক সেনার ভয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, আত্মরক্ষার একটি মোক্ষম উপায় হিসেবে তারা রাজাকারদের দলে যোগ দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
(গ) এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী জোর করে মানুষের সম্পত্তি দখল করা এবং পৈতৃক আমলের শত্রুতার প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ গ্রহণের জন্যেও এ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো।…… রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি হবার পর তাদের বুঝানো হলো যে, যুদ্ধে পাক সেনারা হারলে, পাক সেনাদের সাথে সহযোগিতা করার অপরাধে মুক্তিবাহিনী তাদের সকলকে হত্যা করবে। সুতরাং জীবন রক্ষা করার জন্য মুক্তি বাহিনীর গুপ্ত আশ্রয়স্থলের সংবাদ তারা পাক সেনাদের জানিয়ে দিতে শুরু করে। ১৯৭১-এর এপ্রিল মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ইপিআর ও পুলিশ অবাঙ্গালীদের মধ্য থেকে ভর্তি করা হতো। কারণ বাঙ্গালীদের পাক-সেনারা বিশ্বাস করতো না।” –(স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর-কামরুদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা-১২৬-১২৭)] “রাজকার বাহিনীর তুলনামূলক সংখ্যাধিক্য, অস্ত্রশস্ত্রের সুবিধা এবং দ্রুত চলাচল ক্ষমতার দরুন এদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সীমিত অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমশ বেকায়দায় পড়ে। পাকিস্তানী বাহিনীর নির্বিচার প্রতি আক্রমণের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের চকমপ্রদ তৎপরতা মাত্র ৫/৬ সপ্তাহের মধ্যেই হ্রাস পেতে শুরু করে। [মূলধারা, ’৭১, পৃষ্ঠা-৭১] এ অবস্থায় স্বাধীনতা যুদ্ধকে তীব্রতর করার জন্যে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করা হলো। এ সময় আগস্ট মাসে ভারত-সোভিয়েতের মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো এবং ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মস্কো সফরের প্রোগ্রাম স্থির হলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সোভিয়েত সাহায্য নিশ্চিত করার জন্যে ইন্দিরার মস্কো সফরের আগে বামপন্থীদেরকে একটা ‘উপদেষ্টা কমিটি’র নামে মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাথে শামিল হবার সুযোগ দেয়া হলো। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীতে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কর্মী ছাড়া অন্য কোনো দলের লোক নেয়া হতো না। ন্যাপ, সিপিবি’র লোকদেরকেও নয়। সেপ্টেম্বরের ১৮ তারিখ থেকে ন্যাপ, সিপিবি’র উপর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিধি-নিষেধ উঠে যায়। এ উদ্দেশ্যে দিল্লী থেকে ডিপি ধর (D. P. Dhar) আওয়ামী লীগের স্বাধীন বাংলা সরকারকে রাজী করার জন্যে কলকাতা আসেন। [কোলকাতায় ডি পি ধরের বহুমুখী ব্যস্ততা ও আলাপ-আলোচনার মাঝে যে সীমিত বিষয় নিয়ে আমার (মঈনুল হাসান) সাথে তার আলোচনা হয়, সে বিষয়ে রক্ষিত নোটের উদ্ধৃতি সে সময়ের অবস্থা উপলব্ধির পক্ষে সহায়ক হ তে পারে:
১৭ সেপ্টেম্বর
Met D p at 8-30 am. Now that a consultative committee has been formed, restrictions against recruiting N A P-C P B workers as FF can be waived, if the pm (Bangladesh) gives the clearnce, said DP, As I mentioned that such cleaarrance would be readily available, DP, wanted to know hou many of left worders could be mobilised for recuitment and how fast. Secondly, he wanted could be mobilised for recuitment andhow fast. Secondly, he wanted that the clearance should be communicated to him by Tajuddin himself and if possible by tomorrow before he left Calcutta, so that necessary orders could be issued speedily.
Met Tajuddin at 3-30 at P. M. and told him about the clearance required by Dp….. He asked for Group captain khondkars opinion, since the C-in-c was out of station, khondkar supported the move. He offered his transport for its use for contacting NAP camps on western sectors. On my way back to DP, I went to NAP and CPB offices, handed over the Jeep and gave necessary advice. Met DP at 5 P.M. as scheduled …. DP said that recuitment and training would begin immediately…
১৮ সেপ্টেম্বর
Met Tajuddin at 8 am. and briefedhim about the development since previous afternoon. He wanted me to keep the pressure on nDP about bringing Mujib Bahini under BD command …. Met DP at 5 PM. He showed, anxiety at the dicline of FF activity ….. I explained the difficulty of repoliticising the occupied areas and its consequence on FF activity. He emphasised the need for better co-ordination in selecting the targets for FF operationsand wanted to know if there wase any insurmountable difficulty in inucing base worders in a few pre-selected areas for operations. On Mujib Bahini, he felt that his PM (Indira Gandhi) intervetion would be required as it seemmed to be a ticky matter “মূলধারা, ’৭১-মঈদুল হাসান, পৃষ্ঠা-১০৬-১০৮] তবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে মুক্তিবাহিনীতে NAP-CPB কর্মীদের রিক্রুট যথাসম্ভব সন্তর্পণে চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর মস্কো সফর করেন। তিন সোভিয়েত নেতা-ব্রেজনেভ, পোদগর্নি ও কোসিগিনের সাথে তাঁর ছ ঘণ্টা ব্যাপী দীর্ঘ বৈঠক হলো। এ বৈঠক সোভিয়েত ইউনিয়নকে সর্বাত্মকভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড় করাল। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তাঁর মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে প্রবেশ করলো। পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে একটা হওয়ার যে ভয় ভারত এতোদিন করছিলো,তা এবার উবে গেল। [“বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ২৮-২৯ সেপ্টেম্বর এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। কেননা এ প্রথম বাংলাদেশের পরিস্থিতির মাঝে ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের উপাদান বর্তমান –এ স্বীকৃতির ভিত্তিতে এবং ‘এ পরিস্থিতি ভারতকে বৃহত্তর সংঘর্ষে জড়িত করে ফেলতে পারে’- এ আশাংকায একমত হয়ে ভারতের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পক্ষে বিশ্বের অন্যতম শক্তির সম্মতি বাংলাদেশের মুক্তির জন্যে ভারতের সর্বাত্মক সাহায্যের পথ উন্মুক্ত করে।” –(মূলধারা, ’৭১, পৃষ্ঠা-১১২]
মুক্তিযুদ্ধকে সবদিক থেকে শক্তিশালী ও ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ নেয়া হলো। ভারত ও সোভিয়েত ব্লকের মিলিত উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থনের একটা ভিত্তি রচনা করলো। সোভিয়েত ভেটো এবং সমর্থনের কারণেই যুদ্ধ বিরতি করে শেষ রক্ষার পাকিস্তান-মার্কিন উদ্যোগ সফল হয়নি। আভ্যন্তরীণভাবেও মুক্তিযুদ্ধকে জোরদার করে তোলা হলো। সেপ্টেম্বর থেকেই মাসে ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হয়। নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা মুক্তিযুদ্ধকে তীব্রতর করে তোলে। “পরবর্তী সাত সপ্তাহ ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরবচ্ছিন্ন তৎপরতা এবং ভারত ও বাংলাদেশের মিলিত বাহিনীর তীব্রতর সীমান্ত চাপের ফলে সর্বাত্মক যুদ্ধ হওয়ার পূর্বেই পাকিস্তানী বাহিনী বিরামহীন তৎপরতার ভারে পরিশ্রান্ত, বৈরী পরিবেশ ও অতর্কিত গোপন আক্রমণের ভয়ে শঙ্কিত,দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে বিস্তৃত হওয়ার ফলে দুর্বল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটে বিভক্ত এবং স্বচ্ছ রাজনৈতিক লক্ষ্য ও সামরিক সাফল্যের অভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলো।” [মূলধারা, ’৭১, পৃষ্ঠা-১৯৭] অবশেষে এলো ৩রা ডিসেম্বর। অতিষ্ট, অধৈর্য পাকিস্তান ৩রা ডিসেম্বর ভারতকে আক্রমন করে বসলো। বাংলাদেশের দীর্ঘ প্রতীক্ষা পূরণ করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলঅদেশের যুদ্ধকে ভারত ভারতের যুদ্ধ বলে ঘোষণা করলো। শুরু হয়ে গেলো যুদ্ধ। ভারত এটাই কামনা করছিলো। ভারতয়ি গোয়েন্দা সংস্থা RAW- এর মূল্যায়ন ছিলো, সময় ক্ষেপণ কৌশলের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীকে আরও ভালো অবস্থায় আনা যাবে, কিন্তু পাক বাহিনীকে তাদের দ্বারা কাবু করা যাবে না। ভারতের সামরিক পদক্ষেপ তাই যৌক্তিক দাবী। [These delay tacties only gave the growing Mukti Bahini more time to reoganise. RAW estimate clery indicated that in spite of the Mukti Bahini’s growing Strength. It would be unable to take on the pakistan army over a long period, Military action was the only logical solution. Yahya provided the answer on December 3rd at 5-30 PM.” Inside RAW the story of India’s secret service.” Asoka Raina, Pae-58] ইয়াহিয়া ভারতের এ যৌক্তিক দাবী পূরণর ব্যবস্থা করলেন ভারত আক্রমণ করে। ভারতের এ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলো। এভাবে যে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলো, তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের হাতে তুলে দিলো, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কমাণ্ডারগণ একান্তভাবেই কামনা করেননি। [“একাত্তরের রণাঙ্গন” বইতে প্রকাশিত এক সাক্ষাতকারে তৎকালীন মেজর শওকত বলেন, যে কোনো যুদ্ধে গেরিলা রণ-কৌশল চালিয়ে একটি সৈন্য দলকে যদি আপনি দুর্বল করে ফেলেন, তাহলে জয় আপনার অবশ্যম্ভাবী। ধরুন, পাকিস্তানীরা যুদ্ধ করেছিলো বাংলাদেশে, প্রত্যেক বাঙালী তাদের শত্রু ছিলো। এ অবস্থায় আর কয়েক মাস পর পাকিস্তান বাহিনী এমনিতেই আত্মসমর্পণ করতো। ভারতীয় সেনাবাহিনী সাহয্য করলো কি না করলো তাতে কিছুই যেতো-আসতো না। এটাই আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক যে, ডিসেম্বর, ’৭১-এ আমরা চাইনি ভারতীয় বাহিনী আমাদের পক্ষে পাকিস্তানীদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করুক। আমরা চেয়েছি,ম আমরা আরো কিছু দিন লাগতো না হয় যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করবো। ভারতীয় বাহিনী এলো কে ন? “-একাত্তরের রণাঙ্গন, পৃষ্ঠা-১৯৩] ভারতীয জেনারেলের নেতৃত্বে যৌথ কমাণ্ড গঠন ভারতীয় উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথকে আরও খোলাসা করে দিলো। [অথচ জেনারেল অরোরা যিনি ইস্টার্ণ কমাণ্ডের সি. ইন. সি ছিলেন, তাঁর চেয়ে জেনারেল ওসমানী সিনিয়র ছিলেন।” –মেজর শওকতের সাক্ষাতকার, একাত্তরের রণাঙ্গন, পৃ্ঠা-১৯৫] তারপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। মুক্তিবাহিনী এবং আমাদের জানবাজ কমাণ্ডাররা মাসের পর মাস ধরে যে ফসলের বীজ পবন করেছিরো, তা হাত করার জন্যে ভারতীয় বাহিনী ছুটে এলো ঢাকার দিকে। Asoka Raina তাঁর গ্রন্থে এই শেষ অংশটাকে এভাবে তুলে ধরেছেন:
“ঘটনা দ্রুত গড়িয়ে চললো। পাকিস্তানী প্রতিরোধের দীপগুলো এড়িয়ে ভারতীয় বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হলো ঢাকার দিকে। ভারতীয় RAW এজেণ্টদের পরিবেশিত তথ্যের ভিত্তিতেই পাকিস্তানী প্রতিরোধ বাহিনীর চোখে ধুলা দিয়ে এভাবে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়েছিলো। পাকিস্তানীরা অনেক জায়গায় তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর দ্বারা নাজেহাল হয়ে এবং ভারতীয় বাহিনী অব্যাহত সাফল্যে তারা হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলো। ঢাকা ও তার আশেপাশের উপর ক্রমাগত আক্রমন পাকিস্তানী ইস্টার্ণ কমাণ্ডকে স্থবির করে দিয়েছিলো এবং এখান থেকে সৈন্যরা কোনো নির্দেশনাই পাচ্ছিল না।
জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধিরা যখন যুদ্ধ বিরতির চেষ্টা করেছিলো, ভারত তখন ১২ ডিসেম্বর ঢাকার উপর চূড়ান্ত আঘাতের জন্যে তৈরি হচ্ছিল। এ সময় ভারতীয় গোয়েন্দারা একটা বেতার বার্তা ধরে ফেলে, যা ঢাকার উপর চূড়ান্ত আঘাত এবং পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পণের নিমিত্ত হয়ে দাঁড়ায়। সেই বেতার বার্তাটি ছিলো এই: ‘আমরা দুপুর ১২টায় গবর্নর হাউজে বৈঠকে বসছি।’ এ বার্তা থেকে এটা ধরে নেয়া হলো, একটা উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক সেখানে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বৈঠকটি বানচাল করার পরিকল্পনা নেয়া হলো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো ভারতীয় বিমান বাহিনীর ইস্টার্ণ কমাণ্ড বোমা বর্ষণের লক্ষ্যস্থল গবর্নর হাউজের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারছিলো না। বিমান ও সেনাবাহিনী হেড কোয়ার্টারে সকল দৌড়াদৌড়ি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। বয়ে যাচ্ছিলো সময়। বিষয়টা অন্য সংস্থার কাছে পাঠানো হলে। RAW-এর যেসব এজেণ্ট ঢাকায় কাজ করছিলো দ্রুত তাদের একটি মিটিং ডাকা হলো। এ এজেণ্টরা ২৫ মার্চ রাতে সেনা অভিযানের পূর্বক্ষণে ঢাকা ত্যাগ করেছিলো। এজেণ্টদের মধ্যে একজন তার কাছে অবশ্টি ঢাকা ত্যাগ করেছিলো। এ এজেণ্টদের মধ্যে একজন তার কাছে অবশিষ্ট ঢকার একটা পর্যটন ম্যাপ মাত দিতে পারলো। ম্যাপটার অবস্থা ছিলো খুব খারাপ। তবু কোনো রকমে তাকে ভিত্তি হিসেবে নিয়ে আকাশ থেকে দেখা যায়, এমন একটা ভূমি চিহ্ন নির্দিষ্ট কর গবর্নর হাউজকে চিহ্নিত করা হলো। RAW-এর তৈরি এ নির্দেশনা ম্যাপটি বিমান বাহিনীর পাইলটের হাতে পৌঁছানো হলো। ভারতীয় বিমান বাহিনীর হাণ্টার বিমান বোমা বোঝাই করে বেলা ১২টার দিকে কোলকাতা থেকে আকাশে উড়লো। বোমা ফেলা হলো।
পরে পাওয়অ তথ্যে জানা গিয়েছিলো, গবর্নর মালিক দৌড়ে নেমে গিয়েছিলেন ভূ-গর্ভস্থ বাংকারে। নামায পড়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে তাঁর মন্ত্রিসভার সহযোগীদের সমেত তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। [“Mr. A. M. Malik, the governor wrote the draft ofhis cabinet resignation letter to the president Yahya with shaking ball point on a scrap of office paper as theIndian MIG-21s destroyed his official residence….. All morning Mr. Malik and his cabinet had been unable to decide wheather to resign or hang on. The Indian air raids finally decided him. The resignation effectively throws all responsibility for a last-ditch stand on the East Pakistan Army Commander Lt. gen A. A. K. Niazi, who yesterday vowedto fight to the last man. “The Times, Dec. 15. 1971.] তারপর রেডক্রসের নিয়ন্ত্রণাধীন হোটেল ইণ্টার কণ্টিনেণ্টালে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন পাকিস্তান সরকারের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সামরিক প্রশাসক জেনারেল নিয়াজীর উপর যুদ্ধ পরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব গিয়ে পড়লো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তখন প্রায় শেষ। এর দুদিন পর নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলেন। আর বাংলাদেশের জন্ম হলো।” [‘Inside RAW : The story of India’s secret service’, Page-60-61]
১৬ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটায় জেনারেল নিয়াজী রেসকোর্স ময়দানে আনুষ্ঠানিভাবে তাঁর আত্মসমর্পণের দলিল ভারতীয় জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার হাতে তুলে দিলেন। আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর করলেন জেনারেল নিয়াজী এবং জেনারেল অরোরা। এ ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানি হাজির ছিলেন না। চারটে দিকে জগজিৎ সিং অরোরা এবং অন্যান্য জেনারেলরা এ অনুস্থান সম্পাদনের জন্যে ঢাকা অবতরণ করতে পারলেন। কিন্তু জেনারেল ওসমানির আসা হয়নি। বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানি বিভিন্ন সমরাঙ্গান সফর করার উদ্দেশ্যে ১১ ডিসেম্বর থেকে কোলাতায় অনুপস্থিত থাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। [মূলধারা, ’৭১, পৃষ্ঠা-২৩৬] একথা সর্বৈব মিথ্যা ও বানোয়াট। জেনারেল ওসমানির বক্তব্যই জলজ্যান্ত প্রমাণ। তিনি বলেন, ঐদিন ও এর আগের দিন আমি ময়নামতির রণাঙ্গনে, ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিংহের সাথে মধ্যাহ্ন ভোজন করি। ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে তদানীন্তন লেঃ কর্নেল সফিউল্লাহর ‘এস’ ফোর্স রণাঙ্গণ পরিদর্শন করার জন্য আমার যাবার কথা ছিলো। জেনারেল জগজিৎ সিংহ সেদিন না যেতে অনুরোধ করে বলেন, সেদিন ‘এস’ ফোর্স পরিদর্শনে অসুবিধা হতে পারে, যেহেতু তারা অগ্রসর হচ্ছেন। আমি তখন আমার সফরসূচী পরিবর্তন করে সিলেটে ‘জেড’ ফোর্স পরিদর্শনে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। ….. বাংলাদেশ সরকার বিশেষ করে অস্থায়ী প্রেসিডেণ্ট এবং তথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানতেন আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে। তাছাড়া মিত্র বাহিনীর উচ্চতম কর্মকর্তারাও জানতেন আমি কোথায়” [সাপ্তাহিক ‘বিক্রম, ১২ ডিসেম্বর, ১৯৮৮]
দেখা যাচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে জেনারেল ওসমানি ও জেনারেল অরোরা এক সাথেই ছিলেন। বিকেল ৪টার সময় জেনারেল অরোরা ঢাকা আসেন। যে সংবাদ পেয়ে জেনারেল অরোরা ঢাকা এলেন, সেই সংবাদ পেলে জেনারেল ওসমানি ঢাকা আসতে পারবেন না কেন? আসলে তাঁকে জানানো হয়নি। জানানো হয়নি তাঁকে ঢাকা আসা থেকে বিরত রাখার জন্যেই। জেনারেল ওসমানির মতো করে উল্লেখযোগ্য অন্যান্য ব্রিগেট কমাণ্ডারদেরকেও ঢাকা আসতে বাধা দেয়া হয়েছে। জনাব এম. আর. আখতার মুকুল লিখেছেন, “আমাদের যেসব ব্রিগেট কমাণ্ডার যুদ্ধ করে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিলেন, তাঁদেরকে ভারতীয় বাহিনী ঢাকায় আসতে না দিয়ে অন্যদিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।….. সাবরুম সেক্টর থেকে ঢাকার কে অগ্রসরমান তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানকে তাঁর ‘জেড ফোর্স’ নিয়ে সিলেটের দিকে যাবার নির্দেশ দেয়া হলে। ‘কে ফোর্স-এর অধিনায়ক খালে মোশাররফ কসবা আখাউড়া থেকে দুর্বার গতিতে ঢাকার পথে দাউদকান্দি পর্যন্ত এসে হাজির হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় বাহিনী কর্তৃপক্ষ তাঁকে পথ পরিবর্তন করে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়। অথচ খালেদ মোশাররফের দুই নম্বর সেক্টরের ‘ক্র্যাক প্ল্যাটুনের’ প্রধান ক্যাপটেন হায়দার তাঁর দলবল নিয়ে ঢাকার আশে পাশে পরবর্তী নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।” [আমি বিজয় দেখেছি, পৃষ্ঠা-২১৭-২১৮] ‘একাত্তরের রণাঙ্গন’ শীর্ষক গ্রন্থে ‘এসব ফোর্স’-এর অধিনায়ক সফিউল্লাহর এক সাক্ষাতকার থেকে জানা যায়, ভারতীয় কমাণ্ডার তাঁর ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া পসন্দ করেননি। আখাউড়া দখলের পর ভারতীয বাহিনীর অধিনায়ক তাঁকে বললেন আখাউড়া প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকার জন্যে এবং তার বাহিনী ভৈরবের দিকে যাবে বলে জানালেন। তখন ‘এসব ফোর্স’-এর অধিনায়ক সামনে এগিয়ে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক তাঁকে বললেন, ‘তাহলে তো আপনাকে নিজস্ব প্রবেশ পথ নিতে হবে।’ ‘এস ফোর্স’-এর অধিনাযক বললেন, তাই হবে। ভৈরবে পৌঁছে ভারতীয় কমাণ্ডার বললেন, আপনি ফরটিন্থ ডিভিশনকে ঘিরে রাখুন। তিনি বললেন, ফরটিন্থ ডিভিশন ঘিরে রাখার জন্যে কিছু ফোর্স রেখে আমিও ঢাকা যাব।’ ভারতীয় কমাণ্ডার বললেন, আমাদের ফোর্স তো হেলিকপ্টারে নরসিংদী যাচ্ছে, আপনি কিভাবে যাবেন? ‘এসব ফোর্স-এর কমাণ্ডার বললেন, ঠিক আছে, আমি হেডে চলে যাব।’ আপনি নরসিংদী থাকুন, আমরা ঢাকা যাচ্ছি। ‘এসব ফোর্স-এর কমাণ্ডার মেজর শফিউল্লাহ বললেন, ‘নরসিংদীতে আমার থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। আমিও ঢাকা যাব।’ অতপর নরসিংদীর সব যানবাহন ভারতীয় বাহিনী নিজেরা নিয়ে ডেমরা পৌঁছেন। আমাদের কমাণ্ডার তাঁর বাহিনী সহ পায়ে হেঁটে ভোলতা পুলের কাছে আসেকন। সেখান থেকে কোণাকুণি পথে রূপগঞ্জ দিয়ে শীতলক্ষা ও বালু নদী অতিক্রম করে ডেমরার পেছনে গিয়ে উছেন।’[‘একাত্তরের রণাঙ্গন’, পৃষ্ঠা-১৫২] আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমাণ্ডারদের এ দুর্দশার কাহিনী প্রমাণ করে, ভারতীয় বাহিনী আমাদের সেক্টর কমাণ্ডারদের শুধু ঢাকা আসতেই বাধা দেয়নি, মুক্তিবাহিনীকে তারা অনুগত অনুল্লেখযোগ্য বাহিনীর মর্যাদা দিতে চায়নি। যার কারণে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমাণ্ডাররা পর্যন্ত অত্যন্ত অপমানকর আচরণের সম্মুখীন হয়েছেন। এমনকি বাংলাদেশ সরকারও তাদের তাচ্ছিল্য ও অপমানকর আচরণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এ সম্পর্কে একটা সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন নবম সেক্টরের কমাণ্ডার জনাব মেজর এম এ জলিল। তিনি লিখেছেন:
“বরিশাল সদর থেকে নির্বাচিত জনপ্রিয় সংসদ সদস্য (প্রাদেশিক) জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ইতিপূর্বেই পশ্চিম বংগ ঘুরে বরিশালে ফেরত এসে আমাকে জানালেন যে, লেঃ জেনারেল অরোরা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সর্বাধিনায়ক এবং তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাঙ্গালী সামরিক অফিসারদের কাছে অস্ত্র সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন। এ তথ্য লাভের মাত্র ১ দিন পরেই আমি কিছু মুক্তিযোদ্ধা সহকারে ভারত অভিমুকে রওয়ানা হয়ে প্রথমে পৌঁছে পশ্চিম বাংলার বারাসাত জেলার হাছনাবাদ বর্ডার টাউনে। ঐ অঞ্চলের বি এস এফ-এর কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল শ্রী মুখার্জীর সংগে হয় প্রথম আলোচনা। কমাণ্ডার মুখার্জী অত্যন্ত সুহৃদ বাঙালী অফিসার। তিনি সর্বান্তঃকরণেই আমাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে সরাসরি লেঃ জেনারেল অরোরার কাছে নিয়ে গেলেন। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে তার হেডকোয়ার্টার। তিনি আমাকে প্রথম সাক্ষাতেই বিশ্বাসী করতে পারলেন না। সাক্ষী-প্রমাণ দাবী করলেন আমার। তখনই আমাদে সদ্য ঘোষিত স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানি সাহেবের নাম নিতে হয়েছে। উত্তরে জেনারেল অরোরা সাহেব আমাদের নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করলেন তা, কেবল ‘ইয়াস্কী’দের মুখেই সদা উচ্চারিত হয়ে থাকে। সোজা ভাষায় তার উত্তর ছিলো ‘ঐ দুটো ব্লাডি ইঁদুরে কথা আমি জানি না। ওদরে কোনো মূল্য নেই আমার কাছে। অন্য কোনো সাক্ষী থাকলো বলো।’
মহা মুশকিল দেখছি। ব্যাটা বলে কি? আমার স্বাধীন বাংলার পধানমন্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের সম্পর্কেই যে ব্যক্তি এরূপ কদর্য উক্তি করতে ছাড়েননি, তিনি আমার মতো চুনোটুঁটিদের যে কি চোখে দেখবেন তা অনুধাবন করতেই একটা অজানা আতংকে আমার সর্বাংগ শিহরিত হয়ে উঠলো।” [অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, পৃষ্ঠা-২২]
অন্যান্য অনেক ভারতীয়, দায়িত্বশীলদের মধ্যেও এ মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। মুক্তিবাহিনীর ভূমিকাকে তারা সব সময় তুচ্ছ ও অনুল্লেখযোগ্য করে দেখবার চেষ্টা করেছেন। ভারতীয় ইস্টার্ণ কমাণ্ডের মেজর জেনারেল সখওয়অন্ত সিং তাঁর ‘দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতাকে সারা সীমান্ত জুড়ে ‘ঠোকরানো অভিযান’ বলে অভিহিত করেন এবং ‘ঘুমন্ত সিংহের উপর পিপড়ার আক্রমণ’-এর সাথে তুলনা করেন। [The Liberation of Bangladesh, Page, 123] তিনি লিখেন, ‘সকল পর্যায়ে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ খেলা থেকে যে স্ট্যাটেজী অবশেষে উদ্ভাবিত হলো তা হচ্ছে মুক্তিবাহিনী অপরাশেনের নাম ক্রমাগত অভিযান চালিয়ে সীমান্ত সজীব রেখে পাকিস্তানী বাহিনীকে বের করে নিয়ে আসা।’ [The Liberation of Bangladesh, Page, 92] মুক্তিবাহিনীর যোগ্যতার উপর কটাক্ষ করে তিনি বলেন, ‘মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার দ্বারা সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা কমে যায়। কারণ, এটা পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা যায় যে, এ ধরনের তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর থেকে (পাকিস্তানী) সামরিক আধিপত্য শিথিল করতে সময় লাগবে। [The Liberation of Bangladesh, Page, 106] ভারতে ২০ মাউণ্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল লছমন সিংও এ একই সুরে কথা বলেন। তিনি তাঁর ‘Indian Sword Strikes in East Pakistan’ গ্রন্থে উত্তর-পশ্চিম সেক্টরের যুদ্ধ-পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আমি একমত যে, গেরিলাদের একার পক্ষে পাকিস্তান বাহিনীকে ধ্বংস করা অসম্ভব ছিলো, তবে তারা পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিশৃংখলা গোলযোগ ও সংগা অব্যাহতভাবে টিকিয়ে রাখতে পারতো।’ [Indian Sword strikes in East Pakistan, Page-20] মিঃ লছমন সিংহ আরও অগ্রসরহয়ে মুক্তিবানিীকে ফায়ফরমাশ খাটা সহকারীর ভূমিকায় স্থানীয় বিষয়াদির ব্যাখ্যা দানকারী, তথ্য ও কাজের লোক সংগ্রহকারী হিসেবে অত্যন্ত উপকারী ছিলো।’ [Indian Sword strikes in East Pakistan, Page-181]
যারা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এ দৃষ্টিতে দেখতো, তারা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ককে কোন্ দৃষ্টিতে দেখবে তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং মুক্তিাবাহিনীর সর্বাধিনায়ককে ঢাকা আসতে দিয়ে তাঁকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হতে দেবে কেন? তারা হয়তো মনেও করেছে যে, যুদ্ধটা পাক-ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক অবান্তর। সম্ভব এ কারণেই নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল ভারত সরকারই গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়নের ভারত দায়িত্ব সরকার তাদের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মানেক শ’র হাতে অর্পণ করে।[“At 6-30 P.M. on Deember 14, General Niazi…… Appeared at the Amereican consulate in Daca seeking help. He wanted the Indians for ceasfire…. V.S. Consul General Herbert Spivak followed protocol to the letter and sent Niazi’s plea to washington for rebroadcasting. It was received in the state department at 7-45 P.M. Dacca time. The State Department, despite its public pleas for peace, did not expedite General Niazi’s ceasfire message, The cable was forwarded to Ambassador Farland in Inlamabak, to havehim seek with yahya It was 3-30 A. M. in Dacca before washington received sufficient confirmation from Islamabad The message was finally sent to Ambassadore keating in New Delhi, where it was received at 12-56 P.M. It took another hour and a half to decode the message, locate Indian officeals and deliver it to them” The anderson paper, pp,-267-268(মূলধারা, ’৭১, পৃষ্ঠা-২৩৩)] জেনারেল মানেকশ’ই আত্মসমর্পনের শর্ত-শরায়েত নিয়ে দরকষাকষি করেন। তিনি নিছক যুদ্ধ বিরতির নিয়াজীর ‘প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দাবী করেন, ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাক বাহিনীর শর্তহীন আত্মসমর্পণই যুদ্ধ বিরতির একমাত্র ভিত্তি হতে পারে।’[মূলধারা, ’৭১-২৩৪-২৩৫
“Since you (Niazi) have indicated your desire to stop fighting, I (General Manekhsaw expecto you to issue orders to all forces under your command in Bangladesh to ceasfire immediately to my advancing forces whever they are located….. Immediately I receive a positive response from you I Shall direct Gen, Aurora…., to refrain from all ari and ground action against your force.” Daily Telegraph, Dec. 16. 1971.”] যুদ্ধ বিরতির এ প্রস্তাব এবং যুদ্ধ বিরতির এসব শর্ত-শরায়েত সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার এবং সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানি কিছুই জানতেন না, তাঁদের অবহিত করা হয়নি। সব যখন শেষ, তখন ১৬ ডিসেম্বর বেলা ১২টার দিকে ভেসে আসা একটা খবরের মতো বাংলাদেশ সরকার জানতে পারলেন যে, আজ আত্মসমর্পণ হচ্ছে। [“১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রায় বারোটা নাগাদ কোলকাতাস্থ থিয়েটার রোডে মুজিব নগর সরকারের অস্থায়ী সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে খবর এসে পৌঁছলো যে, ঢাকার হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণে সম্মত হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদ প্রতি মুহূর্তের খবরের জন্যে উদগ্রীব ছিলেন। এমন সময় খবর এলো, আজ বিকেলেই আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় আত্মসমর্পণ হবে।” –আমি বিজয় দেখেছি’-এম আর আখতার মুকুল, পৃষ্ঠা-৩০৮] এ থেকে প্রমাণ হয়, ভারত যুদ্ধ পরিচালনা, যুদ্ধ বন্ধ, ইত্যাদি নীতিগত ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিাবহিনীর ভূমিকাকে অবান্তর মনে করতো। অর্থাৎ তাদেরক কাছে ওটা ছিলো পাক-ভারত যুদ্ধ। [লক্ষণীয়, ভারতের ইস্টার্ণ নেভাল কমাণ্ডের ফ্ল্যাগ অফিসার কমাণ্ডার ইন-চীফ ভাইস এডমিরাল এস. কৃষ্ণাণ-এর বাংলাদেশ যুদ্ধের উপর লিখিত ‘নো ওয়ে বাট সারেণ্ডার’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ শিরোনম ছিলো: ‘An account of the Indo-Pakistan war in the Bay of Bengal?’ আমাদেরমুক্তিযুদ্ধের উপর ভারতের মিঃ প্রাণ চোপরার লিখিত একটা বইয়ের নাম: The Secound Revoliution of India.’] যৌথ কমাণ্ডটা যেন ছিলো কৌশলতগত ও কূটনৈতিক একটা বর্ম মাত্র। [“আসলে শুধু সামরিক দিক বিবেচনা করলে ভারী অস্ত্রশস্ত্র বিবর্জিত বাংরাদেশ বাহনীর জন্য এ ধরনের পৃথক মোতায়েন ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে এটা দেখানো দরকার ছিলো যে, বৃহৎ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ বাহিনী ভিন্নভাবে যুদ্ধ করছে।” ‘দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ-মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং, পৃষ্ঠা-৩৬
তাছাড়া “তাঁর (সুখওয়ান্ত সিং) গ্রন্থে যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়নের ব্যাপারে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক এবং প্রবাসী সরকারের নেতৃবর্গের কোনো ভূমিকাই স্বীকার করা হয়নি। তাঁর বর্ণনা মতে যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে লেঃ জেনারেল কে কে সিং এর নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনীর কয়েকজনসদস্য নিয়ে গঠিত একটা টিম।’ –(মাসিক ডাইজেক্ট, জানুয়ারী, ১৯৮৬)]
মুক্তিবাহিনীর প্রতি তাচ্ছিল্য ও অমর্যাদাকর ব্যবহার দেখে এটাই মনে হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর প্রতি তারা এ মানসিকতা পোষণ করলেও মুক্তিবহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানির ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা ও মর্যাদাবোধকে তারা ভয় করতো। জেনারেল ওসমানি তাঁর দেশ, তাঁর বাহিনীর মর্যাদার ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। ভারতীয় বাহিনীর মিলিটারী অপারেশনের ডিপুটি ডিরেক্টর মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং বলেছেন, “তিনি (ওসমানি) মুক্তিযুদ্ধকালে যেখানেই গিয়েছেন, একটা স্বাধীন দেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মর্যাদা ও সম্মান প্রাপ্তির দিকে তাঁর তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছিলো। আমাদের মনে আছে, একবার একজন ভারতীয় আর্মি কমাণ্ডার তাঁকে অভ্যর্থনার জন্যে রানওয়েতে তৈরি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি বিমান অবতরণ করাতে অস্বীকার করেন, যদিও তাঁর বিমান আগেই এয়ারফিল্ডে এসে পড়ে। বেচারী পাইলটকে প্রায় দশ মিনিট আকাশে চক্কর দিতে হয়্ সাথের বিমানে আরোহী ভারতীয় কমাণ্ডার আগে নেমে তাকে অভ্যর্থনার জন্যে প্রস্তুত হবার পরই তার বিমান অবতরণ করে। ওসমানির মনোভাব ছিলো যে, তিনি দেশ থেকে নির্বাসিত হলেও দেশের উপর তাঁর পূর্ণ অধিকার আছে। তাঁর দেশের জন্যে সাহায্য প্রয়োজন, ভিক্ষা নয়। প্রাথমিকভাবে তাঁর সৈন্যরা ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু পরাজিত হয়নি। যদিও তিনি জুনিয়র র্যাংকের ছিলেন, তবু মর্যাদা ও অন্যান্য যে কোনো দিক দিয়েই ভারতীয প্রতিপক্ষের কোনো অংশেই কম ছিলেন বলে মনে করতেন না।” [দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৩৪ (মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং)] জেনারেল ওসমানি সাহায্য ছাড়া অন্য কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ও মুরুব্বিয়ানা সহ্য করতে চাইতেন না। সুখওয়ান্ত সিং-ই বলেছেন, “নিজ দেশের স্বাধীন সত্তা সম্পর্কে তাঁর যে ভয়ংকর অহংকার ছিলো তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি এটা চেয়েছিলেন। তাঁর বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সাথে সংযুক্ত বলে বিবেচিত হোক, এটা তিনি কিছুতেই চাইতেন না।” [দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৩৪ (মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং)] জেনারেল অরোরার একক নেতৃত্বে যৌথ কমাণ্ড গঠন করাকেও তিনি সহজভাবে নিতে পারেননি, কিন্তু সম্পূর্ণ অস্বীকার করার ক্ষমতাও তাঁর ছিলো না। “তাই দেখা যায়, যৌথ কমাণ্ড গঠনের পরও তিনি মুক্তিবাহিনীকে সরাসরি কমাণ্ড করতেন। কিন্তু কোনো বেতার যন্ত্র না থাকার সবসময় যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব ছিলো না।” [“একাত্তরের রণাঙ্গন,” পৃষ্ঠা-১৮৫] মেজর জেনারেল লছমন সিং-এর অভিযোগ থেকেও এ বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হয়। তিনি লিখেন, “মুক্তিবাহিনী তাঁর কমাণ্ডে আসলেও তারা অনেক সময় তাদের ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মতো কাজ করতো এবং এর ফলে দ্বৈত নিয়ন্ত্রণের সমস্যা দেখা দিতো। এ ব্যাপারে ঊর্ধতন কর্তপক্ষের কাছ থেকে কোনো পরিষ্কার নির্দেশ পাননি।” [Indian sword strikes in East Pakistan, Page-181] কথাটাকে আরও পরিষ্কার করে তিনি লিখেন, “শেষ দিন পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী সরাসরি জেনারেল ওসমানির কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে এসেছে, যা তাদেরকে দেয়া আমাদের পরিকল্পনা ও নির্দেশের সাথে সবসময় সংগতিপূর্ণ হতো না।” [Indian sword strikes in East Pakistan, Page-181]
এ ধরনের স্বাধীনচেতা এবং দেশ ও জাতির মর্যাদার ব্যাপারে আপোসহীন মুক্তিযুদ্ধের যে সর্বাধিনায়ক ওসমানি, তাঁকে ঢাকায় নিয়াজীর আত্মসর্পণ অনুষ্ঠানে ডাকা হবে কেন? ভারতীয়রা ভয় করছে যে, নিজ দেশে ভারতীয় জেনারেলের কাছে পরাজিত শত্রু পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য বসে বসে দেখতে জেনারেল ওসমানি কিছুতেই রাজী হবেন না, এ অসংগত ব্যবস্থা তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না। এ জন্যেই আত্মসমর্পণের গোটা ঘটনা তাঁর কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছে এবং কৌশলে তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। [জেনারেল ওসমানি ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যনের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটিতে কেন হাজির থাকেননি তার আর একটা বিবরণ পাওয়া গেছে সাংবাদিক (বর্তমান দৈনিক মানব জমীন’ সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর কাছ থেকে। তিনি বলছেন:
নয় মাস আমরা যুদ্ধ করেছি পাক হানাদার বাহিনীর সাথে। ….. পাক বাহিনী শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর। মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো প্রায এক লাখ পাকিস্তানী আধুনিক সৈন্য। মুজিবনগর সরকারের একজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন মাত্র। এ নিয়ে বিতর্ক ১৯৭২ সাল থেকেই। জেনারেল ওসমানি জীবিত থাকা অবস্থায বলে যাননি কেন তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসেননি। তৎকালীন সরকারও কোনো সময় ব লেননি। …..১৯৭১ সালের অক্টোবর। প্রবাসীমুজিবনগর সরকার ও ভারত সরকার একটি সমঝোতায় এলেন। সাতটি বিষয়ে সমঝোতা। এ দিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন ভারতের একজন কর্মকর্তা ও বাংরাদেশের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম। চুক্তি স্বাক্ষরের ভয়াবহতা ভেবে অনুষ্ঠানেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি এ চুক্তি। মুজিবনগর সরকারের অনেকেই জানতেন না। মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন মরহুম তাজউদ্দীন…… প্রশাসনিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক বিষয়ই ছিলো চুক্তির প্রধান লক্ষ্য। প্রশাসনকে গতিশীল করার জন্যে সিদ্ধান্ত হলো মুক্তিযুদ্ধ করেনি এমন কর্মকর্তাদেরকে চাকরি থেকে অবসর দেয়া হবে। অভিজ্ঞ কর্মচারীর শূন্যতা পূরণ করবে ভারতীয কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা। লক্ষ্য করে দেখবেন স্বাধীনতার পর বেশ কিছু ভারতীয় সিভিল সার্ভিস অফিসার ঢাকা এসেছিলেন। বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনবাহিনী থাকবে না। আভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য একটি প্যারা মিলিশিয়া বাহিনী থাকবে। যা পরে রক্ষবিাহিনী হিসেবে গঠিত হয়েছিলো। প্রশিক্ষণে ছিলেন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা। সামরিক সমঝোতার মধ্যে আরো ছিলেঅ-বাংরাদেশে ভারতের সেনাবাহিনী থাকবে। প্রতি বছর নভেম্বর মাসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ হবে। ৭২ সনের নভেম্বর থেকে এর কাজ শুরু হবে।
বাণিজ্যিক সমঝোতা ছিলো খোলাবাজার প্রতিষ্ঠা। সীমান্তের তিন মাইল জুড়ে চালু হবে খোলা বাজার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। শুধু বছর শেষে হিসেবে-নিকেশ হবে। প্রাপ্য মেটানো হবে পাউণ্ড-স্টার্লিং এর মাধ্যমে। বিদেশ বিষয়ে ভারত যা বলতে তাই মেনে চলতে হবে। সাউথ ব্লকের এ্যানেকস হবে সেগুন বাগিচা। এক কথায় বলা চলে উল্লিখিত চুক্ত বলে ভারত বাংরাদেশের সামরিক ও পররাষ্ট্র বিষয়ের কর্তৃত্ব পেয়ে যায়।
পাকিস্তানের সাথে চূড়ান্ত লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিবেন ভারতীয সেনাবাহিনী প্রধান। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক সহ প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পবেন না। এ কারণেই জেনারেল ওসমানি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে দর্শকের ভূমিকা পালন করতে রাজী হননি।’ –(শেখ মুজিব চুক্তিটি অগ্রাহ্য করলেন’ –মতিউর রহমান চৌধুরী, নাঈমুল ইসলাম খান সম্মপাদিত, বাড়ি ৫০ সড়ক ২ এ ধানমণ্ডি থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘কাগজ’, ৯ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ১১ জানুয়ারী, ১৯৯০)] এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে শত অনুরোধ সত্ত্বেও জেনারেল ওসমানি কোনো দিনই মুখ খোলেননি, বলা হয়, “যুদ্ধ বিধ্বস্ত নবীন দেশের কর্মবীর হিসেবে হাজারো জটিল সমস্যার সমাধান চিন্তায় ব্যাপৃত…… শেখ মুজিবুর রহমান পুরনো দিনের কোনো কথা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হোক এটা হয়তো অভিপ্রেত মনে করেননি। আর তাই হয়তো জেনারেল ওসমানিকে কিছু কিছু কথা প্রকাশ না করতে তিনি অনুরোধ করেছেন। একদিকে বঙ্গোপসাগর আর অপর তিন দিকে বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত বাংরাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে হয়তো ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সব সত্য কথা সবসময় প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর যেহেতু জেনারেল ওসমানি বঙ্গবন্ধুকে কথা দিয়েছিলেন, কিছু কিছু কথা প্রকাশ করবেন না, তাই তিনি নীরব রইলেন। ‘হাফ ট্রুথ’ প্রকাশ করার লোক তিনি ছিলেন না।” [জেনারেল ওসমানি নীরব রইলেন কেন? এম. মমিন উল্লাহ, মাসিক ডাইজেক্ট, জানুয়ারী, ১৯৮৬] কিন্তু অনেক পরে অবশেষে তিনি মুখ খুলতে চাইলেন। তিনি প্রকাশ করতে চাইলেন অন্ধকারের ঘটনাগুলো। ১৯৮৩ সালের ২৪ নভেম্বর বিচিত্রা এক সাক্ষাতকার নেয়ার সময় তাঁকে প্রশ্ন করে, ‘পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পণ আপনার কাছে হলো না কেন?’ জেনারেল ওসমানি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের এমন অনেক ঘটনা আমি জানি, [ অনেক ঘটনার মধ্য দিল্লীর সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের গোপন চুক্তিও একটা। সাংবাদিক জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী গোপন চুক্তির যে বিবরণ উপরে দিয়েছেন, তার চেয়েও সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দিল্লী মিশন প্রধান, স্বাধীনতার পর দিল্লীতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার, পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং শেখ হাছিনা সরকারের সময়ে (১৯৯৬-২০০১) জাতীয় সংসদের স্পীকার জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। তিনি একটি সাক্ষাতকারে বলেন,
“১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকারের সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এক লিখিত চুক্তিতে, প্যাক্ট নয়, এগ্রিমেণ্টে আসেন। ওই চুক্তি বা এগ্রিমেণ্ট অনুসারে দুপক্ষ কিছু প্রশাসনিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক সমঝোতায় আসেন। প্রশাসনিক বিষয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ভারতের যে প্রস্তাবে রাজি হন, তাহলো যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, শুধু তারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োজিত থাকতে পাবে। বাকীদের চাকুরিচ্যুত করা হবে এবং সেই শূন্য জায়গা পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। স্বাধীনতার পর বেশ কিছু ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু (শেখ মুজিব) এসে তাদেরকে বের করে দেন।
সামরিক সমঝোতা হলো-বাংরাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে (কতদিন অবস্থান করবে তার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়না)। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাস থেকে আরম্ভ করে প্রতি বছর এ সম্পর্কে পুননীরিক্ষণের জন্য দু দেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না।
অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুক্তি বাহিনীকে কেন্দ্র করে একটি প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হবে।
ওই লিখিত সমঝোতাই হচ্ছে বাংলাদেশ রক্ষী বাহিনীর উৎস। আর ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ বিষয়ক সমঝোতাটি হলো-সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান, মুক্তিবাহিনী সর্বাধিদনায়ক নন। যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে থাকবে।
চুক্তির এ অনুচ্ছেদটির কথা মুক্তি বাহিনী সর্বাধিনাযক জেনারেল ওসমানীকে জানান হলে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এর প্রতিবাদে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানত তিনি উপস্থিত থাকেন না।”] যাতের অনেকেরই অসুবিধা হবে। আমি একটা বই লিখছি। তাতে সব ঘটনাই পাবেন।” চিকিৎসার জন্যে লণ্ডন যাওয়ার প্রাক্কালে সি এম এইচ হাসপাতালে দেয়া জীবনের এ সর্বশেষ সাক্ষাতকারে অসুস্থ জেনারেল জানান:
“আমার একটা দুঃখ আছে- আমি বাংলা ভাষা দিয়ে লিখতে পারি না। ইংরেজী স্কুলে লেখাপড়া করেছি তাই। আমি বসে নেই- আমি অনেক ঘটনা নোট টুকে রেখেছি। ইংরেজীতে। একটা আত্মজীবনী লিখবো। অনেক অজানা ইতিহাস থাকবে তাতে। জেনারেল ওসমানির জীবনী গ্রন্থ হবে না সেটা- সেটা হবে বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস। দেশবাসীর কাছে আমি ঋণী। অনেক আগের পাওনা তাদের। বইটা শেষ করে প্রকাশ না করতে পারলে আমার মৃত্যুর সাথে সাথে আমার লাশের মতো অনেক অজানা কথা, অনেক অপ্রকাশিত ইতিহাস কবরের মাটিতে চাপা পড়বে। এটা হওয়া উচিত না। ভাবছি, ভালো হয়ে ফিরে এসে অবশ্যই বইটি লিখবো- আর কিসের ভয়। কারে ভয়? এক বঙ্গবন্ধুকে ভয় করতাম। [এ ভয় কিন্তু তাঁকে নীতিচ্যুত করতে পারেনি। শেখ মুজিব যখন ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করলেন, তখন তিনি এর প্রতিবাদে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।] সেই লোকটারে কথা দিছিলাম, কিছু কিছু কথা লিখবো না, বলবো না। তিনিও নাই, আমার দেওয়া কথাও নাই। এই সব কথা বর্তমান ও আগামী দিনের নাগরিকদের জানা দরকার। হ্যাঁ আমি লণ্ডন থেকে ফিরেই লিখবো নিয়মিত।”[বিচিত্রা, নভেম্বর, ২৪, ১৯৮৩।]
কিন্তু জেনারেল ওসমানি আর ফিরে আসেননি। ফিরে এলো তাঁর লাশ। তিনি জাতিকে যা জানাতে চেয়েছিলেন, তা অজানাই থেকে গেল। যা বলা তিনি বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন, তা তাঁর না বলাই রয়ে গেলো। অজানা রয়ে গেল, কি ছিলো সে ষড়যন্ত্র যার শিকার হয়েছিলো দেশ, দেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তিনি! বলার অনেক কথা অনেক ইতিহসা জমেছিলো তাঁর বুকে। ১১ নং সেক্টরের অধীনস্থ মুক্তিযুদ্ধের ইনটেলিজেন্স গ্রুপের সৈয়দ আবুল হোসেন রাজার একটি উক্তি: “সেপ্টেম্বরের শেষেরদিকে দিল্লীতে বাংলাদেশের অস্থায়ী কেবিনেটের যে সভা হয়, [২৮ সেপ্টেম্বর ইন্দরা গান্ধী মস্কোতে রাশিয়ার সাথে বাংরাদেশ ব্যাপারে চূড়ান্ত বুঝাপড়ার সময় আগে অনুষ্টিত এ বৈঠকে সম্ভবত ভারত বাংলাদেশ সরকারের সাথে চূড়ান্ত বুঝাপড়া করে। ] তাতে যোগদান শেষে দেশে ফিরে (জেনারেল ওসমানি) রণাঙ্গনে দেয়া তাঁর ভাষণে আমাদের বলতেন: ‘আজ থেকে আমাদের তিনটি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। এর একটি হচ্ছে পাক হানাদার বহিনী, আরেকটি হলো আমাদের যুদ্ধকালীন সরকারের বিভক্ত শিবির। কিন্তু তৃতীয় শত্রুর কথা তিনি মোটেই বললেন না। উনি ব্যথিত সুরে বলতেন, প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে আজাদ করার জন্যে আমাদের নেতৃত্বে আজ যারা যুদ্ধ করছেন, তাদের নিকট আমার সতর্কবাণী : আমরা কারো করুণার পাত্র রূপে যুদ্ধ করছি না।” [‘আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানি না থাকার নেপথ্য কথা’- গোলাম ফারূক, বিক্রম ডিসেম্বর, ১২, ১৯৮৮।]
তৃতীয় শত্রুটির নাম সেদিন জেনারেল ওসমানি ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে না বলতে পারলেও সে শত্রুকে আমরা চিনি। কিন্তু কি জেনে, কি দেখে, কি বুঝে, কোন্ কারণে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনাযক জেনারেল ওসমানি সেদিন হানাদার পাক-বাহিনীর স্বাধীন বাংলা সরকার ও ভারতেক একই শত্রুর কাতারে শামিল করলেন, তা আর কোনো দিনই জানা যাবে না। জানা যাবে না, কি তিনি বলতে চেয়েছিলেন আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে লণ্ডন যাবার প্রাক্কালে! এ জানাটা বাদ দিয়ে বর্তমানে প্রচলিত ইতিহাস নামের ‘মুক্তিযুদ্ধের রূপকথা’ শুনে কি জাতির যে প্রয়োজন তা মিটাতে পারে! [“এই যে এতো স্বাধীনতা যুদ্ধের বই বাজারে- আমি তার অনেকগুলিই দেখেছি। পাবলিক লাইব্রেরীরে গেছি-দেখেছি সব মুক্তিযুদ্ধের রূপকথা।…… “-জেনারেল ওসমানি, সাক্ষাতকার, বিচিত্রা, ২৪ নভেম্বর, ১৯৮৩]