দ্বিতীয় অধ্যায়
স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভেদের পটভূমি ও পরিণতি
এক
শতকরা ৮৬জন মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের মানুষ বড় বড় সব জাতীয় ইস্যুতেই ঐকমত্যের পরিচয় দিয়েছে। বৃষ্টিস্নাত, নদী বিধৌত নরম মাটির সবুজ বাংলাদেশের অনুভূতিপ্রবণ মানুষ যেন এক সাথে বসেই সব সময় তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। হিন্দুদের বর্ণাশ্রম পীড়িত এ গাঙ্গের ব-দ্বীপের নিষ্পিষ্ট মানুষ, যাদের পরিচয় ছিলো ম্লেচ্ছ এবং যাদের মুখের ভাষাকে বলা হতো পক্ষির ভাষা, আত্মরক্ষার জন্যই দল বেঁধে একদিন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলো। কিন্তু আশ্রয় ও বৌদ্ধ ধর্মই যখন হিন্দু ধর্মের গ্রাসে পরিণত হলো, তখন এ দেশের সংগ্রামী মানুষ শান্তি ও স্বস্তির সন্ধানে মুক্ত মানুষ হবার পথ হিসেবে দল বেঁধে আবার ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিলো। এ রকমটা ভারতের আর কোথাও হয়নি। তাইতো দেখা যায় দিল্লী এবং তার আশপাশ ৮শ বছরের মুসরিম শাসনের কেন্দ্র হলেও সে অঞ্চলের মুসলমানরা সংখ্যালঘু। অথচ বাংরাদেশ মুসলিম শাসন কেন্দ্রের সবচেয়ে দূরে অবস্থান করার পরেও সেখানে মুসলমানরা সংখ্যা গুরু। হিন্দুদের নিপীড়ন ও বর্ণাশ্রম বিরোধী বাংলাদেশের মানস-প্রকৃতিই নিঃসন্দেহে এ বৈশিষ্ট্যের কারণ। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের উদার ও সংগ্রামী হৃদয় ভারতের মুসলমানদের দুর্দিনগুলোতে ইসলাম ও মুসলমানদের আশ্রয় হিসেবেও কাজ করেছে। ১২০৪ খৃস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর শাসন শুরুর সময় থেকে শুরু করে বাংলায় মুসরিম শাসনের শেষ পর্যন্ত মোট ৫৬২ বছরে ৭৬জন মুসরিম গভর্নর, রাজা এবং শাসনকর্তা বাংলাদেশে শাসন কাজ পরিচালনা করেন। এ ৭৬ জনের মধ্যে ১৬জন ছিলেন দিল্লীর ঘোরী ও খিলজী সম্রাটদের নিয়োগকৃত গভর্নর, ২৬ জন ছিলেন স্বাধীন শাসক এবং অবশিষ্ট ৩৪জন ছিলেন মুখল সম্রাটদের প্রতিনিধি বা সুবাদার। এঁদের গোটা শাসনকালেই বাংলাদেশ সারা ভারতের দুর্গত, বিপদগ্রস্ত, বিতাড়িত মুসলিম পরিবার ও ব্যক্তিত্বের জন্যে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে কাজ করেছে। [The origin of the Musalmans of Bengal, Page 17-31 (Khandakar Fazli Rabbi, first Pub, 19=895] এ কারণে বাংলাদেশকে অনেকেই ভারতবর্ষের ‘মদীনা’ বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত বর্ণাশ্রয়ী ধর্মের প্রতিভু প্রচণ্ড জাত-বিদ্বেষী আর্যদের ব্যাপারে বাংলাদেশী জনগণের প্রবল মানসিক বৈরীতা এবং আরবের সেমেটিক জনগোষ্ঠী ও তাদের একত্ববাদী ধর্মের সাথে তাদের যেন সহজাত একাত্মতা লক্ষ্য করা যায়। সমাজ বিজ্ঞানীরা এর কারণ সন্ধান করেছেন। তারা বলছেন, হরপ্পা ও মহেনজোদাড়ো সভ্যতার জনক বাংলাদেশী জনগণ মূলত সেমিটিক দ্রাবিড়। সেমিটিকদের আদি নিবাস আরব ভূখণ্ড থেকেই তারা এসেছেন। [Encyclopedia Britanica জানাচ্ছে “At a still pre historic stage, it is believed that an inflow of what are losely called Draividian races made its way through Baluchistan from western Asia and slowly penetrated to far south.” জনাব H. J. Flwure “The Dravidian Element in Indian culture” গ্রন্থে বলেছেন, “That in so far as the Draividian ncivilizationn was derved from outside sources, its origin is to be traced to Egypt and Mesopotamia, linked up with India by sea commerce.” প্রখ্যাত ঐতিহাসিক Mr Nichalson তার Literary History of the Arabs’ গ্রন্থে লিখেছেন, “The term (semetic) includes the Babylonians, the assyriars, the Hebrews, the phoemecians, the Armenians, the Abyssinians, the Sabians, the Arabs.” সুতরাং বাঙ্গালী যদি নৃতান্ত্বিক পণ্ডিতদের মতেই দ্রাবির হয় আর দ্রাবির যদি আরব হয়, তদুপরি আরব যদি সেমিটিক হয় তবে বাঙ্গালী যে সেমেটিক আরব গোষ্ঠীরই অধঃস্তন পুরুষ হইতেছে তাহাতে আর সন্দেহ থাকেকি –(বাংলার মূল আরবী, অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী, পৃষ্ঠা-১৬] অনেক সমাজ বিজ্ঞানী বাংলাদেশী জনগণের সাথে সেমিটিক আরবদের নাড়ির সম্পর্ক সন্ধান করতে গিয়ে বলছেন, খোদ ‘বাংলা’ শব্দটি আরবী শব্দমালার পরিবর্তিত রূপ।’ [“বাংলাদেশের প্রাচীন ভৌগলিক ও স্থানীয় বিবরণ পাঠে জানা যায় যে, উজানের গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চল ছিলো এক সুগভীর ও দুর্ভেদ্য জঙ্গলময় স্থান। উজানের গঙ্গার জঙ্গলময় স্থান বা জঙ্গলের আরবী হইতেছে ‘বাদিয়াতুল কানকেল আলিয়াহ’ বাদিয়া অর্থাৎ জঙ্গলময় স্থান বা জঙ্গল। কানক অর্থ গঙ্গানদী। আলিা অর্থ উজান। উক্ত ‘বাদিয়া কানক আলিয়াহ’ হচ্ছে বাদিয়া+কানক+আলিয়া>বাদ্দা কানকাল্লাহ> (প্রকৃত উচ্চারণ মতে শব্দ-মধ্যে দুই স্বরবর্ণের মধ্যস্থিত ক. গ. চ. ত. দ. প. য়. লোপ পায়,- এ সম্পর্কে ডক্টর শহীদুল্লাহ বিরচিত ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ পথম খণ্ড, পূন দ্রষ্টব্য)> বাঙ্কালাহ> বাঙ্কালা (১৮৯০ খ্রীস্টাব্দে Gourunal Asiatique-এর ২০৫ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত কান্দাহার শিলালিপিতে দেখতে পাওয়া যায় ঘোরাঘাট, গৌড়, বাঙ্কালা নামগুলো লেখা হয়েছে কোড়াকাট, কেরিড় এবং বাঙ্গালা রূপে’- বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর : স্বাধীন সুলতানদের আমল-১৩৩৮-১৫৩৮ খৃস্টাব্দ, ২য় খণ্ড, শ্রী সুখময় মুখোপাধ্যায়, এম এ অধ্যাপক বিশ্ব ভারতী পৃষ্ঠা-৩ এবং Gourunal Asiatic-Fevrier-Man, 1990)>বাঙ্গালা>বাংলা (বর্তমান রূপ)” (বাংলার মূল আরবী, অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী, পৃষ্ঠা-১৮)] ‘বাংলা’ শব্দের মতো বাংলাদেশের অনেক স্থান-স্থানের নামের উৎস ও বলা হয় আরবী। যেমন বিক্রমপুর। বিক্রমপুরের উৎস বলা হচ্ছে আরবী শব্দ থেকে। [“Map of Gerard Mercator, 1612> (Bancala), Bianpur, Bicanpur (Bancala>Baeanur>Bacala+UR UR অর্থাৎ লোকালয়, বন্দর, নগর যাহা মেসোপটেমিয়ার UR নামক একটি বন্দর বা নগরের নাম হইতেছে হইয়াছে….>Bacalaur>Bicanapu8r>Bicanpor>Bikrampur বা vikrampur”, (বাংলার মূল আরবী, অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী, পৃষ্ঠা-১৮-১৯)] আরবী মূল থেকে নামগুলো বিকৃত হয়ে পরিবর্তি রূপ ধারণ করেছে। অনেকগুলোর আবার সুপরিকল্পিতভাবে সংস্তৃত রূপ দেয়া হয়েছে। এ ষড়যন্ত্রের কথা ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও উদারভাবে স্বীকার করেছেন এবং সেই সাথে বলেছেন, নামগুলো দ্রাবিড়ীয়। [“But it is pity that generally there was an attempt to give these names a Sankrit look …… In the formation of these we find some word which are distinctively Dravidian. An investigation of place names of Bengal, as inn other parts of Aryan Indiam, is sure to reveal the presence of non-Aryan Speaker, mostly Dravidian, all over the land before the establishment of the Aryantongue.” (ডক্টর নীহার রঞ্জনের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ পৃষ্ঠা-৬২)] বলা যায়, বর্ণাশ্রয়ী আর্য হিন্দুদের জুলুম-নিপীড়নে জর্জরিত। [আর্য হিন্দুরা বাংলার দ্রাবিড় লোককূলের উপর যে বর্বর জুলুম-নিপীড়ন চলায় তার হাজারো মর্মস্পর্শী গাথা ইতিহাস ও লোক কাহিনীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গোবিন্দ চন্দ্রের ময়নামতি প্লেটে স্বামীহারা ম্লেচ্ছ নারী (দ্রাবিড় নারী)দের বিলাপের একটা চিত্র আছে। উক্ত প্লেটের সপ্তম শ্লোকের বিবরণ এভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে: “7th verse-refers to kalyaqn candra’s fight against redoubled by the tears droping from the eyes of the Mleccha Ladies, Who were agitated owing to k illing of their husbands.” (Dynastic History of Bangal, Page-170)] বাংলার মুক্ত ও মানুষ হবার পথ [“…..পূর্ব বাংলার চাষী-বাসিন্দাদের অধিকাংশই হচ্ছে মুসলমান। এ অঞ্চলের জলাভূমি ও নদী বহুল জেলাগুলোর আদি বাসিন্দাদেরকে কখনো ভদ্র হিন্দু সমাজে স্থান দেয়া হয়নি। দক্ষিণ দিকে আকর্ষণ ও এ রকম উপযুক্ত সংখ্যায় উপনিবেশ স্থাপন করেনি যার দ্বারা সাগর-উপকূলের এবং বদ্বীপের বাসিন্দাগণকে পুরাকালীন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের গণ্ডীভূত করা যেতে পারতো। এজন্যে তারা হিন্দু উচ্চবর্ণের গণ্ডীর বাইরেই থেকে যায়। এ চণ্ডালেরা দূরবর্তী সাগরের খাড়িতে মাছ ধরে খেতো এবং বন্যা উপদ্রুত ক্ষেত্র থেকে অতিকষ্টে ধান জন্মিয়ে ঘরে তুলতো। তাদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিলো না। অথবা তারা কোনো ধর্মের বিধি নিষেধেরও ধার ধারতো না। তারা এতোদূর অচ্ছুত সে, উচ্চ কোনো ব্রাহ্মণ সে অঞ্চলে গিয়ে তাদের ছোয়া বাঁচিয়ে বাস করতে পারে না, ফলে কয়েক পুরুষের মধ্যে সেস উত্তর ভারতের বাসিন্দা তার আপন বংশের সকল রক্তগত সম্বন্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। (তার কারণ এই যে, বহু বছর তারা এসব অস্পৃশ্য চণ্ডালের সাথে বাস করেছে ও তাদের পৌরহিত্য করেছে)। মুসলমানদের এস বর্ণবৈষম্যের বালাই ছিলো না। তারা কখনো বিজয়ীর বেশে বসতি স্থাপন করতো, আবার কখনো ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এ বদ্বীপে আগমন করতো।…….. মুসলমানরা দক্ষিণ অঞ্চলে এ রকম বহু পতিত ভূমি আবাদ করে বসতি স্থাপন করেছিলো এবং এজন্যে তারা পূর্ব বাঙলার নাম রেখে গেছে প্রথম পানি ও মাটির পৃথককারী হিসেবে। আজও শিকারীরা তাদের কতো বাঁধ ডিঙ্গিয়ে, পাকা সড়ক বেয়ে, কতো মসজিদ, মাযার, দীঘি পার হয়ে জংগলের নিভৃততম অঞ্চলে প্রবেশ করে। কারণ মুসলমানরা যেখানেই গেছে, সেখানেই ধর্ম প্রচার করেছে। কতকটা তলোয়ারের জোরে, কিন্তু বেশীর ভাগ মানুষেরই হৃদয়ের কোমলতম দুটো তন্ত্রীতে সজোরে আঘাত করে। হিন্দুারা এ বদ্বীপের বাসিন্দাদেরকে কখনো তাদের সমাজে স্থান দেয়নি। মুসলমানরা ব্রাহ্মণ ও নীচ জাতি নির্বিশেষে ইসলামের পূর্ণ অধিকার সবাইকে সমানভাবে দান করেছিলো। তাদের উৎসাহী ধর্ম প্রচারকরা এ শিক্ষা দিয়েছিলো- তোমরা সকলেই তোমাদের আল্লাহর কাছে নতজানু হও, তার দৃষ্টিতে সব মানুষই সমান, সব সৃষ্টিজীব ধরার ধুলার মতোই….. এক আল্লাহ ছাড়া আর প্রভু নেই এবং মুহাম্মদ তার রাসূল।” –(The Indian Musalmans, W. W. Hunter, Page-149-150.)] হিসেবেই ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে এবং বাংলাদেশ হয়ে দাঁড়ায় উপমহাদেশের মুসলমানদের এক আশ্রয় কেন্দ্র-এক মদীনা।
ঐতিহ্যবাহী ও সংগ্রামী মানুষরা তাদের ভাগ্যের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে কখনই ভুল করেনি। ১৭৫৭ সালে পলাশীর রণাঙ্গনে এদেশের স্বাধীনতা যখন বিজাতীয় শক্তির হাতে চলে গেল, তখন জনগণ সে সময়ের রাজণৈতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে কিছুই জানতে পারেনি। তাই তারা কোনো সম্মিলিত সিদ্ধান্তও নিতে পারেনি। কিন্তু যখনই জানতে পারলো, তখনই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ঝাণ্ডা তারা উড্ডীন করলো। বৃটিশ শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত এ ঝাণ্ডা তাদের অবনমিত হয়নি। ফকির বিদ্রোহ, ওয়াহী আন্দোলন, ফরায়েজী আন্দোলন, তিতুমীরের আন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ এবং সর্বশেষে পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে বৃটিশদের হটিয়ে স্বাধীন আবাসভূমি লাভ করে তবেই তারা ক্ষান্ত হয়। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান ইস্যুর উপর গৃহীত রেফারেণ্ডামে বাংলাদেশের মানুষ একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন আবাসভূমির পক্ষে রায় দেয়ার ক্ষেত্রে যে ঐক্যের পরিচয় দিয়েছিলো, তার দৃষ্টান্ত ভারতের আর কোথাও পাওয়া যায়নি। এখানে তারা ব্যক্তির চেয়ে লক্ষ্যকেই বড় করে দেখেছিল। তাই তো তেখা গেছে, জনগণের যে লক্ষ্য ছিলো, তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বড় বড় ব্যক্তিত্ব ধরাশয়ী হয়েছেন। এ চিত্র আমরা দেখি ১৯৫৪ সালে আবার। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ সরকারকে সরিয়ে দেবার জন্যে। জনগণ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। এখানেও মানুষ লক্ষ্যকেই বড় করে দেখে-ব্যক্তিকে নয়। এ কারণেই দেখা গেল, লক্ষ্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে কলা গাছও নির্বাচিত হয়ে এলো। ১৯৭০ সালে এরই পুনরাবৃত্তি ঘটলো। এখানে মানুষই লক্ষ্যকেই বড় করে দেখলো। অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার বাংলাদেশী জনগণ তাদের শোষণ মুক্তির প্রোগ্রাম মনে করে ৬ দফার পক্ষে একযোগে ভোট দিলো। লক্ষ্যের পক্ষে যাকে পেয়েছে, নির্বিচারে ভোট দিয়ে তাকেই তারা জিতিয়ে দিয়েছে। এ নির্ভেজাল ঐক্য তাদের ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। এদিন পর্যন্ত দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে তাঁর পেছনে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক-বাহিনী আওয়ামী লীগ বিরোধী অভিযানের নামে বাংলাদেশী জনগণের উপর নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যখন ভারত চলে গেল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হলো এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো, তখন ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতির অতি গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক ইস্যুতে জাতির মধ্যে বড় ধনের বিভেদ দেখা দিলো। ঐতিহ্যবাহী এক জাতি হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রশ্নে বিভক্ত মতের উত্থান ঘটলো। এ ধরনের কথা শ্রবণ যন্ত্রের জন্যে বড় কষ্টদায়ক হলেও বেদনাদায়ক এ সত্যকে আমরা অস্বীকার করতে পারবো না, এড়িয়ে যেতে পারবো না। ইতিহাস ইতিহাসই। ইতিহাস বলছে, ২৫ মার্চের সেনা-অভিযান উদ্ভূত অশান্তি ও অনিশ্চয়তার শিকার হওয়ার পরও এক শ্রেণীর মানুষ ভারতে যায়নি, এক শ্রেণীর দল ও গোষ্ঠী স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়নি। যাদের সংখ্যা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মতোই বিপুল। দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে যদি আমরা এ বিভক্তির বিচার করি, তাহলে দেখবো, আওয়ামী লীগ, মস্কোপন্থী ন্যাপ ও কম্যুনিষ্ট পার্টি এবং এদের অংগদল ও সমমনা গ্রুপ ও দলই তখন স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলো, অন্যদিকে মুসলিম লগি, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও এদের অংগ দল এবং ইসলামপন্থী বলে পরিচিত সকল দল, গ্রুপ ও ব্যক্তিত্বই স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলো। এই সাথে চীনপন্থী বাম দলগুলোও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়নি। দেখা গেল, হাজার হাজার সংখ্যায় বাঙালী যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলো, সেই হাজার হাজার সংখ্যায় তারা আবার যোগ দিলো রাজাকার বাহিনীতেও।
একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জনমতের এ ধরনের বিভক্তি অভূতপূর্ব। ১৯৪৭ সালে সমাপ্ত হওয়া বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে এ বিভক্তি আমরা দেখিনি। বৃটিশকে তখন সমর্থন করা দূরে থাক, শক্তিশালী প্রচারণা সত্ত্বেও কংগ্রেসও বাংলাদেশ থেকে কোনো জনশক্তি তার পক্ষে পায়নি। দল-মত নির্বিশেষে সবাই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন আবাস ভূমির জন্যে বৃটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। এ একই দৃশ্য আমরা দেখি আমাদের অতি কাছের ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়া সহ এশিয়া-আফ্রিকার সব দেশের সব জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে। কোথাও কখনও এক বা একাধিক ব্যক্তিকে বৈরী শক্তির কাছে আত্মবিক্রয় করতে হয়তো আমরা দেখি, কিন্তু কোথাও কোনো জাতিকে এভাবে জাতির অস্তিত্বের ইস্যুতে বিভক্ত হতে আমরা দেখি না। ইতিহাস তাই এ প্রশ্ন অতি বড়ো করেই আমাদের সামনে তুলে ধরছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে এ অভূতপূর্ব বিভক্তি আমাদের তাহলে কেন?
অতি বড় এ প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের আগে সেই সময় কার্যত প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, যারা ছিলো এ জাতীয় বিভক্তির প্রধান নিমিত্ত, তাদের পরিচয় সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোচনা প্রয়োজন।
আওয়ামী লীগ
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নাম নিয়ে আওয়ামী লগি প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সৃষ্টি মূলত মুসলিম লীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলেরই ফল। মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসা কিংবা মুসলিম লীগ থেকে বের করে দেয়া নেতা ও কর্মীদের নিয়েই এ দল গঠিত হয়। যারা আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করলেন, তাদের অনুভূতি তখন এ রকম ছিলো যে, সরকারী মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে তারা জনগণের মুসলিম লীগ গঠন করেছেন। [“দেখা গেলো, আমরা কতিপয় ছাত্র ব্যতীত আর সকলেই আওয়ামী মুসলিম লীগ নামকরণের ঘোর পক্ষপাতি। তাহাদের যুক্ত, আমরা সকলেই মুসলিম লীগ। আকরস খাঁ, নূরুল আমীন, চৌধুরী খালিকুজ্জামান ও লিয়াকত আলী পরিচালিত মুসলিম লীগ হইল সরকারী মুসলিম লীগ এবং আমাদেরই হইবে আওয়ামের অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ।”-(জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-১০০] ঢাকার ‘রোজ গার্ডেন’-এর হল কামরায় অনুষ্ঠিত প্রায় শ’ তিনেক ডেলিগেটের উপস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলো। সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের সাবেক সভাপতি এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসললিম লীগের সদস্য পদ বঞ্চিত মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মূল সম্মেলনে সভাপতিত্ব করলেন জনাব আতাউর রহমান খান। সম্মেলনে মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি এবং টাঙ্গাইলের শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট একটি নির্বাহী কমিটি গঠন করলো। [সভাপতি : মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ সভাপতি : আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহাম্মাদ খান, সাধারণ সম্পাদক : শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক : শেখ মুজিবুর রহমান, সহ সম্পাদক, খন্দকার মুশতাক আহদ, এ. কে. এম. রফিকুল হোসেন, কোষাধ্যক্ষ : ইয়ার মোহাম্মদ খান।]
পূর্ব পাকিস্তানে এতোদিন কোনো কার্যকরী বিরোধী দল ছিলো না। আওয়ামী মুসলিম লগিই প্রথম সত্যিকার বিরোধী দল হিসেবে মাঠে এলো। দলে স্বাভাবিকভাবেই সংগ্রামী ও তরুণদের আধিক্য ছিলো। মুসলিম লীগের কর্মসূচীহীন ও প্রাসাদ-রাজনীতির মুকাবিলায় আওয়ামী মুসলিম লগি জনগণকে আকৃষ্ট করার মতো দলীয় নীতিও গ্রহণ করে। তাদের প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণায় পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন, বিনা ক্ষতি পূরণে জমিদার প্রথার উচ্ছেদ, কৃষকদের মধ্যে কৃষি জমি বন্টন, তেভাগা নীতির বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে মবায় ও যৌথ কৃষি ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, কমনওয়েলথ থেকে সদস্য পদ প্রত্যাহার এবং জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির দাবী জানানো হয়। মৌলিক শিল্পের রাষ্ট্রয়ত্তকরণের দাবীও ঘোষণায় ছিলো। শুরু থেকেই এ দলের ঘোষণায় একটা র্যাডিক্যাল প্রবণতা লক্ষণীয়। এর কারণ কিছু তরুণ কর্মী ও প্রবীন নেতৃত্বের উপর বামপন্থী চিন্তার প্রভাব। ভাসানীর নেতৃত্বে এ প্রভাব পরবর্তীকালে আরও বাড়ে।
১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলো। এ অধিবেশনে ভাসানীকে সভাপতি এবং শেখ মুজিবকে সাধাণ সম্পাদক করে নতুন ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়। এ কাউন্সিলের পূর্বের নীতিগত ঘোষণা বহাল রাখা হয় এবং রাজনৈতিক একটি প্রস্তাবে দেশরক্ষা, মুদ্রা ও পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া সকল বিষয়ের কর্তৃত্বসহ পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন দাবী করা হলো। সোহরাওয়ার্দী এ সময় পুরোপুরি আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করলেন। ‘পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে তাঁর একটি দল ছিলো। ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল তারিখে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে দুই দলকে একীভূত করা হয় এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’কে পাকিস্তান ভিত্তিক করার জন্য ‘পাকিস্তান আওয়ামী লগি’ গঠনের উদ্দেশ্যে সোহরাওয়ার্দীকে এর আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয়।
সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী মুসলিম লীগে প্রবেশকে মাওলানা ভাসানী ভালো চোখে দেখেননি। বামচিন্তা ও বামপন্থীদের প্রভাবে ভাসানী দলের বৈদেশিক নীতিকে জোট নিরপেক্ষ করণের নামে কম্যুনিষ্ট ব্লক-মুখী করতে চাচ্ছিলেন। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে দাবী-দাওয়ার প্রশ্নেও বিপ্লবাত্মক নীতি অনুসরণ করেছিলেন। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কম্যুনিষ্ট ব্লকের প্রতিদ্বন্দ্বী পূজিবাদী পশ্চিমের একনিষ্ঠ ভক্ত। এ দুই বিপরীতমুখী মানসিকতা আওয়ামী লীগে ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে ওঠে। ৫৪ সালে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ সহ বিরোধী দলগুলো যুক্তফ্রন্ট [১৯৫৪ সালের ১০ মার্চের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হহক (পাকিস্তান কৃষক পার্টি), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাষানী (আওয়ামী মুসলিম লীগ) নেজামে পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও খেলাফতে রব্বানী পার্টির সমন্বয়ে ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই যুক্তফ্রণ্ট মোট ২২৩টি আসন লাভ করে এবং মুসলিম লীগ পায় ১০। অবশিষ্ট ৭২টি সংখ্যালঘু আসনের ২৫টি পাকিস্তান কংগ্রেস, সিডিউল কাস্ট ফেডারশন ২৭, কম্যুনিষ্ট পার্টি ৪ এবং গণতন্ত্রী দল ৩টি আসন লাভ করে।] গঠনের মাধ্যমে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে। নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের মধ্যকার আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্য আরও স্পষ্ট ও তীব্র হয়ে ওঠে। যুক্তফ্রণ্টের ২১ দফাকে [যুক্তফ্রণ্টের বহুল আলোচিত ২১ দফা ছিলো নিম্নরূপ:
“নীতি : কুরআন ও সুন্নাহত মৌলিক নীতির খেলাফ কোনো আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।
(১) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে।
মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লগি ক্ষমতা ভোগ দখলেল পথে অগ্রসর হয়। অন্যদিকে ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি গ্রুপ প্রতিবাদের পথ নেয়।
(২) বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদার ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করিয়া ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জ মি বিতরণ করা হইবে।
(৩) পাট ব্যবসায় জাতীয়করণ, পাট চাষীদের পাটের ন্যায্য মূল্য দান, মুসলিম লীগ আমলের পাট কেলেংকারির তদন্ত।
(৪) সবায় কৃষি ব্রবস্থার প্রবর্তন, সকল কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন।
(৫) পূর্ব পাকিস্তানের লবণ শিল্পকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, লবণ কেলেংকারির জন্য দায়ী মুসলিম লীগ মন্ত্র সভার সদস্যদের শাস্তি বিধান।
(৬) খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা ও খরার হাত হইতে রক্ষা।
(৭) পূর্ব পাকিস্তানকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত, কৃষিকে যুযোপযোগী করিয়া দেশকে শিল্প ও খাদ্যে স্বাবলম্বী করা এবং I. L. O. এর বিধান অনুসারে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা।
(৮) শিল্পী ও কারিগর মোহাজেরদের কাজের আশু ব্যবস্থা।
(৯) প্রাথমিক, অবৈতনিক ও বাধ্যামূলক শিক্ষা প্রবর্তন এবং শিক্ষকদের ন্যায়সংগত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা।
(১০) শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, সরকারী ও বেসরকারী স্কুলের মধ্যকার পার্থক্য দূর করা, শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন, ভাতার ব্যবস্থা।
(১১) ‘ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ বাতিল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্বশাসন দান, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সহজ লভ্য এবং ছাত্রাবাসকে অল্প ব্যয় সাধ্য করা।
(১২) শাসন ব্যয় হ্রাস, উচ্চ বেতন কমিয়ে, নিম্ন বেত বাড়িয়ে সামঞ্জস্য বিধান, যুক্তফ্রণ্টের মন্ত্রীরা ১ হাজার টাকার বেশী বেতন না নেয়া।
(১৩) দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ঘুস রিসাওয়াত বন্ধ করা, ১৯৪০ সালের পরবর্তী পিরিয়ডের জন্যে সরকারী ও বেসরকারী পদাধিকারী ও ব্যবসায়ীদের সম্পত্তির হিসাব গ্রহণ এবং অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা।
(১৪) ‘জন নিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স’ প্রভৃতি কালাকানুন বাতিল, বিনা বিচারে আটকদের মুক্তি দেয়া এবং সংবাদপত্র ও সভা সমিতির অধিকার নিরংকুশ করা।
(১৫) বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগকে পৃথক করা।
(১৬) যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের বদলে কম বিলাসের বাড়ীতে বাস করবেন।
(১৭) ভাষা শহীদদের শাহাদাতের স্থানে শহীদ মিনার স্থাপন ও শহীদ পরিবারের ক্ষতিপূরণ।
(১৮) ২১ ফেব্রুয়ারীকে শহীদ দিবস ও সরকারী ছুটি ঘোষণা।
(১৯) ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বশাসিত ও সভরিন করা হইবে, দেশ রক্ষা, পররাষ্ট্র নীতি ও মুদ্রা ছাড়া সব বিষয় পূর্ব পাকিস্তানের হাতে থাকবে, নৌবাহিনীর হেড কোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে থাকবে, অস্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপনসহ পূর্ব পাকিস্তান আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা।
(২০) যুক্তফ্রন্ট কোনো অজুহাতেই আইন পরিষদের মেয়াদ বাড়াইবে না, মেয়াদ শেষ হবার ছ মাস আগে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা।
(২১) যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার আমলে পরিষদের কোনো সদস্য পদ খালি হাতে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা, পর পর ৩টি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী পরাজিত হইলে মন্ত্রিসভার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ। (অলি আহাদের ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ কে ’৭৫ গ্রন্থ থেকে(পৃষ্ঠা-২০১-২০৫) সংক্ষিপ্ত।]পদদলিত করে সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়াম মুসলিম লীগ ক্ষমতা ভোগ দখলের পথে অগ্রসর হয়। অন্যদিকে ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি গ্রুপ প্রতিবাদের পথ অনুসরণ করে। পাকিস্তানর কেন্দ্রীয় সরকার যখন যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপরয যুলূম-নিপীড়ন চালাচ্ছিলো, যখন ইউরোপ সফররত ভাসানীকে দেশে ফিরতে দিচ্ছিলো না, তখন সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দান করলেন এবং শেখ মুজিব ও আওয়ামী মুসলিম লীগ তাকে সমর্থন করলো। কনভেননের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র তৈরির কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণাকে কৃষক শ্রমিক পার্টি থেকে শুরু করে মুসলিম লগি পর্যন্ত সকলে বিরোধিতা করেছিলো, কিন্তু সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লগি তার বিরোধিতা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু কোলকাতা থেকে স্বেচ্ছা নির্বাচিত মাওলানা ভাসানী, যিনি পূর্ব পকিস্তানের মধ্যকার সংখ্যা সাম্য নীতি মেনে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাধিক্যের ন্যায্য দাবীকে বিসর্জন দিলেন। এটাও ভাসানী পক্ষ এবং অন্যান্যরা মেনে নেয়নি। অবশেষে যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে যায় এবং বিদেশ নীতি ও আভ্যন্তরীণ নীতির প্রশ্নে আওয়ামী মুসলিম লগি ভাঙনের দিকে ছুটে যায়। ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের সরকার গঠন হয় এবং কেন্দ্রেও সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী। এরপর ভাসানী গ্রুপের সাথে তাদের বিরোধ আরও বেড়ে চলে। বিরোধ সংঘাত-সংঘর্ষে রূপ নেয়। এর মধ্যেও ১৯৫৬ সালে ভাসানীর প্রচল চাপে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব পাক আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সরকারীভাবে পূর্ব পাক পার্লামেণ্টে স্বায়ত্ত শাসনের বিল উত্থাপনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। অনেক গড়িমসির পর বিলটি পার্লামেণ্টে আনা হয় এবং তা পাস হয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করলেন সোহরাওয়ার্দী। তিনি বললেন, “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে প্রাদেশিকতার বীজ উস্কে দিয়ে কিছু লোক সেখানে নায়ক হতে চাচ্ছেন এবং এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তানীদের মনে এমন ধারণার সৃষ্টি হয়েযে, পূর্ব পাকিস্তানীরা তাদের সাথে এক সাথে থাকতে চান না।” [বিচিত্রা, নবেম্বর, ১৯৮৬ (আওয়ামী লীগের ৩৭ বছর)] এছাড়া প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারী কাগমারীতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লগের কাউন্সিল অধিবেশনে মাওলানা ভাসানী যখন ২১ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্ব শাসনের কথা বললেন, তখন প্রধামন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী তাঁর ভাষণে বলেন, শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে ৯৮ ভাগ স্বায়ত্ব শাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। [বিচিত্রা, নবেম্বর, ১৯৮৬ (আওয়ামী লীগের ৩৭ বছর) আওয়ামী লীগের ভাসানী গ্রুপের সাথে আওয়ামী লীগের সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের সম্পর্ক এতোটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে, “প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী মাওলানা ভাসানীকে ‘ভারতের অর্থপ্রাপ্ত অনুচর’ হিসেবে চিহ্নিত করে একাধিক ভাষণে বলেন যে, তিনি ভাসানীর মতো ‘পাকিস্তান ভাঙ্গনের নৃত্যে অংশ নিতে’ বা ‘ভাতের অংগ রাজ্যে পরণত হতে’ রাজী নন, কেননা আমার এ হাত পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার জন্যে। [বিচিত্রা, নবেম্বর, ১৯৮৬ (আওয়ামী লীগের ৩৭ বছর)] সোহরাওয়ার্দী ঐ বিবৃতির পর আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘাত তীব্রতর হয়ে ওঠে এবং ভাঙন চূড়ান্ত রূপ নেয়। ১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই ভাসানী ঢাকায় গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। আওয়ামী লগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব বিজ্ঞপ্তি মারফত এ সম্মেলনে যোগ না দেয়ার জন্যে আওয়ামী লীগ কর্মীদের নির্দেশ দেন। অবশেষে ভাসানী পন্থীরা সম্মেলনে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ভাঙন সম্পূর্ণ রূপ দিলেন।
ভাসানী ও তাঁর গ্রুপ চলে গেলেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে কোন্দল হয়নি। সংঘাত শুরু হয় এবার মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবের মধ্যে যার নিরসন সোহরাওয়ার্দীও করতে পারেননি। এ সংঘাতের পরিণতি ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাক সংসদে ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলীর হত্যা।
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর গোটা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হবার পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে। ১৯৬২ সালের ৮ জুন জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন প্রত্যাহার করলেন। সামরিক শাসন জারির ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারায়, সুতরাং এ দলই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বোধহয় সে কারণেই মার্শাল-ল’ প্রত্যাহার হবার পর আওয়ামী লীগ পুনর্জীবিত না করে সোহরাওয়ার্দী চাইলেন সম্মিলিতভাবে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। সুতরাং ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট গঠিত হলো। অন্যদিকে মুসলি লগিররা (কনভেনশন পন্থী) আইয়ুবের পিছনে সবমেত হয়ে মুসলিম লগি পুনর্গঠিত করলেন। এন ডি এফ এর আন্দোলন তেমন ভালো এগুলো না। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী মারা গেলেন। অতপর আতাউর রহমান খান আবুল মনসুরআহমদ প্রমুখ প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাদের বাধা উপেক্ষা করে শেখ মুজিব ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারী আওয়ামী লীগ পুনর্জীবিত করলেন। ১৯৬৪ সালের ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এ সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হলো। তাদের আন্দোলনের প্রধান টার্গেট হলো : এক. প্রাপ্ত-বয়স্কদের ভোটাধিকারের [****১৪] ভিত্তিতে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, দুই, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠন। কিন্তু তাদের একক আন্দোলন বেশী দূর এগুলো না। ১৯৬৫ সালের ২রা জানুয়ারী ছিলো প্রেসিডেণ্ট নির্বাচনের তারিখ। এ নির্বাচনে সম্মিলিতভাবে সরকারী দলকে মুকাবিলার জন্যে আওয়ামী লগি সহ বিরোধী দলগুলো ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে ‘Combined opposition party’ (cop) গঠন করলো।[cop –এর অংগ দলগুলো: মুসলিম লগি (কাউন্সিল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং নেজামে ইসলাম পার্টি।]
১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারী প্রেসিডেণ্ট নির্বাচনের [প্রেসিডেণ্ট নির্বাচনে কনভেনশন মুসলিম লীগ প্রার্থী আইয়ুব খান পূর্ব পকিস্তানে ২১০১২ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ২৮৯১২ মোট ৪৯৯৩৩ ভোট পান। আর cop এরপ্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে ১৮৪২৪ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ১-২৪৪ মোট ২৮৬৬৮ ভোট পান।] পরপরই মার্চে জাতীয পরিষদ [“জাতীয় পরিষদে সম্মিলিতভাবে কাজ করিবার নিমিত্ত বিরোধী দল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান ন্যাশনাল পার্টি, পাকিস্তান মুসলিম লীগ, পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রণ্ট (NDF) সম্মিলিত বিরোধী (combined opposition party) গঠন করে এবং নুরুল আমীন, শাহ আজিজুর রহমান ও কামারুজ্জামান যথাক্রমে নেতা, উপনেতা ও সম্পাদক নির্বাচিত হন” –(জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৩৪৬] এবং এপ্রিলে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শুরু হয় পাক ভারত যুদ্ধ। সুতরাং আওয়ামী লগের পক্ষে ব্যাপকভাবে দলীয় ভিত্তিতে কাজ করার সুযোগ গোটা ১৯৬৫ সালেই তেমন একটা হয়নি। অবশ্য পাক-ভারত যুদ্ধ অবসানের পর বছরের শেষ প্রান্ত থেকে এ সুযোগ এ দলই পেয়ে গেল।
আওয়ামী লগি ছিলো প্রকৃতই দলীয় মেজাজ সম্পন্ন একটি গণসংগঠন। জনপ্রিয় কিংবা জনপ্রিয় হতে পারে এমন দাবী নিয়ে মাঠে নামা এবং জনমত জয় করে ক্ষমতায় যাবার অভিজ্ঞতা তার ছিলো। [১৯৫৪ সালে এ ঘটনাই ঘটে। অবশ্য ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের দাবী মনে না থাকাও তার একটা অভ্যাস, যার দৃষ্টান্ত ৫৬ থেকে ৫৮, ’৭২ থেকে ’৭৪ এবং ’৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তার শাসনকালগুলো।] তারা পাকিস্তানের যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বুঝলো আন্দোলনের জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বুঝলো আন্দোলনের জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি খুবই উর্বর। যুদ্ধকালীন অবস্থা দেখে পূর্ব পাকিস্তান যে একেবারেই বঞ্চিত, অরক্ষিত ও অনুভূতি সকলের মনে তীব্র হয়ে উঠছিলো। [“পাক-ভারত যুদ্ধকাল পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় রাজধানী হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিলো। এখানকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিলো অত্যন্ত দুর্বল। ফলে এদেশ রক্ষার দায়িত্বভার পড়িয়াছিলো গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উপর। ইত্যাকার তথ্য ও বক্তব্য মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, চাকরীজীবী সম্প্রদায়কে বিশেষভাবে আলোড়িত করে।” –(জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৩৪৯] এ অবস্থায় শেখ মুজিব ১৯৪৯ ও ১৯৫৪ সালের অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে আন্দোলনের সূচনা হিসেবে লাহোরে আয়োজিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয সম্মেলনে (৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৬) ৬ দফা কর্মসূচী পেশ করলেন। শেখ মুজিহবের এ ৬ দফার প্রথম দফায় ফেডারেল ও পার্লামেণ্টরী ধরনের সরকারের কথা বলা হলো। দু নম্বর দফায় বলা হলো, ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতি এবং শর্তাধীন মুদ্রা। এ শর্তের কথা বলা হয়েছে তৃতীয় দফায়। বলা হলো, দেশের দুটি অংশের পাচার বন্ধের গ্যারান্টি সহ দুই অঞ্চলের জন্যে একই মুদ্রা থাকবে। চতুর্থ দফায় রাজস্ব সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণ ও ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা দেয়া হলো প্রদেশ বা অংগরাষ্ট্রগুলোর হাতে। প্রদেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার পৃথক হিসাব ও ব্যবস্থাপনার বিধান ছিলো পঞ্চম দফায়। ষষ্ঠ দফায় ফেডারেল রাষ্ট্রের অংগরাষ্ট্রগুলোকে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিশিয়া রাখার ক্ষমতা দেয়া হলো। শেখ মুজিবের এ ৬ দফাগুলো মূলত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার বক্তব্য থেকে খুব নতুন কিছু নয়। ৬ দফায় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের কথা আছে, কিন্তু ২১ দফায় আছে আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে রূপান্তরে কথা। স্বায়ত্বশাসনের প্রকৃতি প্রশ্নে ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের কথা ৬ দফায় আছে, কিন্তু ২১ দফায় নেই। কিন্তু ২১ দফায় এর চেয়েও বড় কথা আছে। ২১ দফায় ১৯তম দফায় ‘পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেয়ার’ পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানকে এমনকি ‘সভরেন’ (সার্বভৌম) করার কথা বলা হয়েছিলো।
অথচ এ ৬ দফাই চারদিকে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো। পাকিস্তানের প্রেসিডেণ্ট এবং সরকারী দল একে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ পদক্ষেপ বলে অভহিত করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রপাগাণ্ডা শুরু করলো। যারা আওয়ামী লীগের সাথে এক সাথে গণতান্ত্রিক ও বিরোধী দলীয় আন্দোলন করে আসছিলো, সেই নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রভৃতি রাজনৈতিক দলগুলো ৬ দফা কর্মসূচীকে পাকিস্তানের ‘সংহতি বিরোধী ‘ভারতের ষড়যন্ত্র’ ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা কর্মসূচী’ হিসেবে অভিহিত করলো। এমনকি পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুস সালম খানও ৬ দফার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। [বিচিত্রা, নবেম্বর, ১৯৮৬ (আওয়ামী লীগের ৩৭ বছর)] ২১ দফার বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া না হওয়া এবং ৬ দফার ক্ষেত্রে হওয়ার পেছনে কয়েকটি পরিস্থিতিগত কারণ কাজ করেছে: এক, “এমন একটি সময়ে মুজিব ৬ দফা উপস্থাপিত করলেন, যখন যুদ্ধে পরাজয় এবং তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে ‘জাতীয স্বার্থ ও সম্মান’ ভারতের হাতে তুলে দেয়ার অভিযোগে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকরা একদিকে আইয়ুব বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন, অন্যদিকে ক্ষমতার, ‘প্রসাদ নিয়ন্ত্রকরা’ ও তাঁকে অপসারণের জন্যে তৎপর হয়ে উঠচিলো। [বিচিত্রা, নবেম্বর, ১৯৮৬ (আওয়ামী লীগের ৩৭ বছর)] দুই, পাক-ভারত যুদ্ধোত্তর সেই সময়ে জনগণের মধ্যে ভারতের ম তলব সম্পর্কে উদ্বেগ, আশাংকা এবং সেন্টিমেন্ট তীব্র হয়ে উঠেছিলো। তিন, পাক ভারত যুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিলো দ্ব্যর্থবোধক। ভারতের বিরুদ্ধে তার কোনো স্পষ্ট ও শক্ত বক্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রথমোক্ত কারণে সরকার তার নিজ স্বার্থে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সুযোগ গ্রহণ করে। আর শেষোক্ত দুটি কারণে আওয়ামী লগি সহযোগী বিভিন্ন দলের সন্দেহ ও সমালোচনার শিকার হয়। মাওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও ৬ দফাকে পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ পুঁজির সাথে মুকাবিলায় পরাস্ত এবং অবদমিত বাঙালী ধনিক শ্রেণীর অবাধ বিকাশের কর্মসূচী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো। [বিচিত্রা, নবেম্বর, ১৯৮৬ (আওয়ামী লীগের ৩৭ বছর)]
আওয়ামী লীগ ৬ দফার প্রচার শুরু করার সাথে সাথেই সরকারী তরফ থেকে তার উপর জুলুম-নির্যাতন নেমে এলো। এপ্রিলের মধ্যেই শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হলো। মে মাসের শুরুর দিকে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ শীর্ষ নেতা কারান্তারালে চলে গেলেন। প্রচণ্ড সরকারী দমন এবং সাধারণ মানুষের সমর্থনহীন আওয়ামী লীগের একক আন্দোলনের ব্যর্থতা সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বিপর্যয় ঘটিয়াছিলো।[বিচিত্রা, নবেম্বর, ১৯৮৬ (আওয়ামী লীগের ৩৭ বছর)] ১৯৬৬ সালের জুন মাসের মধ্যেই আওয়ামী লগি নির্জীব হয়ে পড়লো। এর উপর আওয়ামী লীগে দেখা দিলো ভাঙন। রাজনৈতিক আন্দোলনের বিপর্যস্ত অবস্থায় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ৮ দফা কর্মসূচীতে ১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল ‘পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেণ্ট’ (পিডিএম) [পিডিএম পন্থী আওয়ামী লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি এবং এন ডি এফ সমন্বয়ে গঠিত হয়। আতাউর রহমান খানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নিম্ন ব্যক্তিদের নিয়ে PDM- প্রথম জাতীয় কমিটি গটিত হয়:
জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) থেকে জনাব রুরুল আমিীন, জনাব হামিদুল হক চৌধুরী, জনাব আতাউর রহমান খান। কাউন্সিল মুসলিম লগি থেকে জনাব মমতাজ দওলাতানা, জনাব তোফঅজ্জল আলী, সৈয়দ খাজা খয়েরদ্দীন। জামায়াতে ইসলামী থেকে তোফায়েল আহমদ, মাওলানা আবদুর রহীম এবং অধ্যাপক গোলাম আযম। আওয়ামী লীগ থেকে নসরুল্লাহ খান, আবদুর সালাম খান, গোলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোর। নেজামে ইসলাম পার্টি থেকে চৌধুরী মুহাম্মদ আলী, ফরিদ আহমদ এবং এম. আর. খান।] গঠিত হয়। মাওলানা তর্কবগিশ, রাজশাহীর মুজিবর রহমান ও আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিরাট অংশ এ আন্দোলনে যোগদান করে। [১৯৬৭ সালের ২৩ আগস্ট মাওলানা তর্কবাগিশকে সভাপতি ও রাজশাহীর মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত দলটি PDM পন্থী আওয়ামী লীগ নামে পরিচিত হয়।] ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারী শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী হিসেবে অভিযুক্ত করা হলো। [১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারী সরকার এক প্রেসনোটে ঢাকাস্থ ভারতীয ডেপুটি হাই কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারীর যোগসাজশে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকবার অপরাধে আঠার জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কথা বলা হয়। তারপর ১৮ জানুয়ারী আরেক প্রেস নোটে এ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অপরাধে শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের কথা ঘোষণা করা হয়্ অতপর ১৯ জুন সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপ্রতি এস. এ রহমান এবং পূর্ব পাকিস্তান হাই কোর্টের বিচারপতি মুজিবুর রহমান ও বিচারপতি মকসুদুল হাকিমের সময়বায়ে গঠিত আদালতে ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত সাইত্রিশ জনের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়।] বলা হলো, শেখ মুজিব ভারতের যোগসাজশে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। গোটা দেশে এ অভিযোগের কথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলো। আওয়ামী লগি এবং শেখ মুজিব ভারতের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগের কথা অস্বীকার করলেন। [আদালতে শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর উপর আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে যে জবানবন্দী দেন তা এই: “স্বাধীনতা পূর্ব ভারতীয় ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে আমার বিদ্যালয় জীবনের সূচনা হইতেই আমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্যে নিরলসভাবে সংগ্রাম করিয়াছি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাকে আমার লেখাপড়া পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হইয়াছে। স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ক রে, এর ফলে ১৯৪৯ সালে আমরা মরহুম জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠন করি। আওয়ামী লীগ পূর্বেও ছিলো এবং এখনও সেইরূপ একটি নিয়মতান্ত্রিকতার পথানুসারে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদ্যমান। …….. সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর হইতেই সরকার আমার উপর নির্যাতন চালাইতে থাকে। ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর তাহারা পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে আমাকে গ্রেফতার করে এবং দেড় বছর কাল বিনা বিচারে আটক রাখে। আমাকে এই ভাবে আটক রাখাকালে তারা আমার বিরুদ্ধে ছয়টি ফৌজদারী মামলা দায়ের করে। কিন্তু ঐ সকল অভিযোগ হইতে সসম্মানে অব্যহতি লাভ করি। ১৯৫৯ এর ডিসেম্বরে কিংবা ১৯৬০ এর জানুয়ারীতে আমাকে উক্ত আটকাবস্থা হইতে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি লাভের পর আমার উপর কিছু কিছু বিধি-নিষেরদ জারি করা হয়- যেমন ঢাকা ত্যাগ করিলে আমাকে গন্তব্যস্থল সম্পর্কে লিখিতভাবে স্পেশাল ব্যাঞ্চকে জানাইতে হইবে।….. অতঃপর ১৯৬২ সালে বর্তমান শাসনতন্ত্র জারি প্রাক্কালে যখন আমা নেতা মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হলো, তখন আমাকেও জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স বলে কারান্তরারে নিক্ষেপ করা হয় এবং ৬ মাস বিনা বিচারে আট রাখা হয়। জনাব সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে দেশের উভয় অংশে আওয়ামী লীগকে একটি রাজতিক প্রতিষ্ঠান পুনর্জীবিত করা হয় এবং সম্মিলিত বিরোধী দলের অংগদল হিসাবে প্রেসিডেণ্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। …… ১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মিলনীর বিষয় নির্বাচনী কমিটির নিকট আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলীর নিয়মতান্ত্রিক সমাধান ছয় দফা কর্মসূচী উপস্থিত করি। ছয় দফা কর্মসূচীতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অংশের জন্যিই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী করা হইয়াছে। অতপর আমার প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লগি ছয় দফা কর্মসূচী গ্রহণ করে এবং দেশের উভয় অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্য দূরীকরণের অনুকূলে জনমত যাচাই ও গঠনের জন্য ছয় দফার পক্ষে জনসভা অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়। ইহাতে প্রেসিডেণ্টসহ অন্যান্য সরকারী ও নেতৃবৃন্দ ও সরকারী প্রশাসনযন্ত্র আমাকে “অস্ত্রের ভাষা’ ‘গৃহযুদ্ধ’ ইত্যাদি হুমকি প্রদান করে এবং একযোগে এক ডজনেরও অধিক মামলা দায়ের করিয়া আমাকে হয়রানি করিতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে আমি যখন খুলনায় একটি জনসভা করিয়া যশোর হইতে ঢাকা ফিরিতেছিলাম, তখন তাহারা এক গ্রেফতারী পরোয়া বলে এই বারের মতো আমাকে গ্রেফতার করে। ……. কেবলমাত্র আমার উপর নির্যাতন চালাইবার জন্য এবং আমার দলকে লাঞ্চিত, অপমানিত ও আমাদিগকে কুখ্যাত করিবার জঘন্য মনোবৃত্তি লইয়া আমাকে এ তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলায় মিথ্যা জড়িত করা হইয়াছে।….. আমি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। ইহা একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, দেশের অর্থনৈতক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাহার একটি সুনির্দিষ্ট, সুসংগঠিত নীতি ও কর্মসূচী রহিয়াছে। আমি অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে কদাপি আস্থাশীল নহি। বর্তমান মামলা উল্লিখিত নিষ্পেষণ ও নির্যাতন-নীতির পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নহে।….. আকি কখনও পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে কোনো কিছু করি নাই কিংবা কোনো দিনও এ উদ্দেশ্যে কোনো স্থল, নৌ বা বিমান বাহিনীর কোনো কর্মচারীর সংস্পর্শে কোনো ষড়যন্ত্রমূলক কার্যে আত্মনিয়োগ করি নাই।…. আমি নির্দোষ এবং এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ অজ্ঞ। তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।” –(আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানের লিখিত বিবৃতি, বিচিত্রা, ২৫ অক্টোবর, ১৯৮৭)
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয় শেখ মুজিব নাও জানতে পারেন। আওয়ামী লীগেরই একটা গোপন লবী পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো তা নানাভাবেই পরে প্রকাশ পেয়েছে। যা হোক, আগরতলা ষড়যন্ত্র ঠিকই হয়েছিলো তা পরে সুস্পষ্টভাবেই জানা গেছে: ভারত থেকে প্রকাশিত ‘In Side Raw’ বইতে বলা হয়েছে,
“In order to present a clear synopsis of the evens that finally brought RAW into the Bangladesh ops (operation), one must reies the intelligence activitis that started soon after its formation in 1968. But by then indian operatives had already been in contact with the pro-Mujib faction. A meeting concerned in Agartala during 1962-63, between the IB foreign desk operativesand the Mujib faction, gave some clear iundication of what was to follow.
The meeting in Agortala had incicated to colonel Mennon (which in fact Sankaran Nair), the main liaison man between the Mujib faction and the Indian intelligence, that the `group’ was eager to excalate their movement. They raided the armoury of the East Bangala Rifles in Dacca but this initial movements failed, In fact it was total disaster.
A few month later on January 6, 1968, the Pakistan government annoinced that 28 persons would be prosecuted for conspiring to bring about the scessodon of East Pakistan, with Indians helf. thd high court judgment published. Mentioned that conspiratiors had links with Indian agents, whom they had was far from complete. They had mixed up the ranks of the two officers, who were in fact colonel Menon and Major Tripathi…” (Inside RAW the story of India’s secret service, by Asoka Raian. Page-49-50] প্রকাশ্য আদালতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরু হলো ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন। পত্র-পত্রিকাকে বিচারের যাবতীয় বিষয় প্রকাশ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হলো।
আওয়ামী লীগ আর কার্যত মাঠে থাকলো না। কিন্তু পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আন্দোলন এমন একটা রূপ নিলো যার কারণে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রায় পর্যন্ত আর গড়াতে পারেনি। পিডিএম-এর আন্দোলনের সাথে ডিসেম্বর ৬৮ থেকে যুক্ত হয় মাওলানা ভাসানীর ঘেরাও আন্দোলন। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ হয়ে উঠলো উত্তপ্ত। ছাত্ররাও সম্মিলিতভাবে এগিয়ে এলো আন্দোলনে। ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারী ১১ দফা [ছাত্র ইউনিয়ন (মস্কোপন্থী), ছাত্র ইউনিয়ন (পিকিংপন্থী) ছাত্র লীগ, জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন ও ডাকসু সমবায়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গটিত হয়। ১১ দফার তৃতীয় দফা ছাড়া অন্য সবগুলো শিক্ষা ও সামরিয়ক রাজনৈতিক সংক্রান্ত তৃতীয় দফা ৬ দফার অনুরূপ।] দাবীর ভিত্তিতে কেন্দ্রীয ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। স্বৈরাচার বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন জোরদার করার জন্যে পিডিএম কে এরপর পুনর্গটিত করা হলো। ছয় দফাপন্থী আওয়ামী লীগ ইতিপূর্বে পিডিএম এর বাইরে ছিলো। তাকেও আন্দোলনে আনা হলো। মুফতি মাহমুদের জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও ফ্রন্টে শামিল হলো। ৮টি [আওয়ামী লীগ (ছয় দফা), আওয়ামী লীগ (পিডিএম পন্থী), জামায়াতে ইসলামী, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, এন ডি এফ এবং জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম।] রাজনৈতিক দল ৮ দফার [৮ দফা দাবী : (১) ফেডারেল পার্লামেণ্টারী সরকার, (২) প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন, (৩) অবিলম্বে জরুরী আইন প্রত্যাহার, (৪) নাগরিক স্বাধীনতার পুনর্বহাল ও সকল কলাকানুন বাতিল, (৫) শেখ মুজিব, খান ওয়ালী খান প্রমুখ সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি এবং সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার, (৬) ১৪৪ ধারা সংক্রান্ত সকল আদেশ প্রত্যাহার, (৭) শ্রমিকতদের ধর্মঘট করার অধিকার বহাল, (৮) নতুন ডিক্লারেশন দান এবং ইত্তেফাক, টাট্টান সহ সকল বন্ধ পত্র-পত্রিকা ফেরত দান।] ভিত্তিতে ‘ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি’ (DAC) গঠন করলো ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারী। রাজনৈতিক আন্দোলন প্রচণ্ড আকার ধারণ করলো। ১লা ফেব্রুয়ারী প্রেসিডেণ্ট আইয়ুব রাজনীতিকদের গোল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাব করলেন। মাওলানা ভাসানী এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষ গোল টেবিল বৈঠকের বিরোধতা করলো। আর ডাক (DAC) গোল টেবিল বৈঠকের আগে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবী করলো। ২১ ফেব্রুয়ারী আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও মুজিব সহ অন্যান্য বন্দীদের মুক্তি দেয়া হলো। ২৬ ফেব্রুয়ারী রাওয়ালপিণ্ডিতে গোল টেবিল বৈঠক [শেখ মুজিব সহ DAC এর ষোলজন প্রতিনিধি গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন।] অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠক কোনোই ফল দিলো না। আইয়ুব খান ২৫ মার্চ ইয়াহিয়ার হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে গেলেন।
গণ আন্দোলনের মাধ্যমে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তি শেখ মুজিবকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলে দিলো। কিন্তু কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে এ জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তিনি আন্দোলনকারী সকল শক্তিকে অস্বীকার করলেন। অকৃতজ্ঞ ও চরম স্বার্থপর আবার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করলো। গোল টেবিল বৈঠকের সময়ই তিনি ডাক-এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছিলেন। [গোল টেবিল বৈঠকের পর DAC ভেঙ্গে দেয়া হয়।] ছাত্রদের ১১ দফাকেও তিনি অস্বীকার করলেন। “অত্যন্ত কৌশলের সাথে মুজিব তাঁর বিস্মৃতপ্রায় ৬ দফাকে পুনর্বাসিত করেছিলেন: কিছুকাল পর্যন্ত ১১ দফা ও ৬ দফা বঃলার পর তিনি ৬ দফা ও ১১ দফা বলতে শুরুকরেন এবং শেষ দিকে এসে সমগ্র সাফল্যই তিনি ৬ দফার উপর আরোপ করতে থাকলেন।” [‘আওয়ামী লীগের ৩৭ বছর’,বিচিত্রা, নবেম্বর, ১৯৮৬] নিসন্দেহে শেখ মুজিবের চোখ তখন ক্ষমতার দিকে। আর প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা ছাড়া আওয়ামী আর কিছুই চোখে দেখে না। স্বার্থসিদ্ধির পথে বাধা হলে নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ, মানবিকতা, কিছুরই মূল্য তার কাছে নেই।
পয়লা আগস্ট (১৯৬৯) আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলো। এ সম্মেলন নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ কাউন্সিলে ৬ দফাকে শাসনতন্ত্রের মূলনীতি এবং অর্থনৈতিক নীতি হিসাবে ‘স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা তথা সামাজিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা’ কে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে ঘোষণা করা হলো। এ সময় থেকে শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে ‘জয় বাংলা শ্লোগান দিতে শুরু করেন এবং তা অবশেষে দলীয় শ্লোগানে পরিণত হয়। [‘আওয়ামী লীগের ৩৭ বছর’, বিচিত্রা, নবেম্বর, ১৯৮৬]
১৯৭০ সালের ৩১ মার্চ ইয়াহিয়া নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসাবে ৫ দফা লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক ঘোষণা করলেন। লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্কের মোদ্দাকথা ছিলো- পাকিস্তানের সংহতি ও ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদকে ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র তৈরি করতে হবে এবং প্রণীত শাসনতন্ত্রটিকে প্রয়োজনে বাতিল করার প্রশ্নাতীত ক্ষমতা প্রেসিডেণ্টের থাকবে। অনেক মহল থেকে এ ধরনের শর্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠলো, আন্দোলনের ডাক এলো। কিন্তু শেখ মুজিব কোনো আন্দলনে গেলেন না। “প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত আঁতাতের ফলে ৩০ মার্চ ঘোষিত আইনগত কাঠামো আদেশের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার সক্রিয় আন্দোলন সম্ভব হয়নি। পক্ষান্তরে এ আঁতাতের দরুন সরকারও ছয় দফা ভিত্তিক নির্বাচনী প্রচারনায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন না করিয়া স্বীয় ঘোষিত আইনগত কাঠামো আদেশের পরিপন্থী কাজ করতে দ্বিধা করেন নাই। বস্তুত এ ব্যাপারে স্কার স্পষ্টত দ্বিমুখী নীতিই অনুসরণ করিয়াছিলেন। হয়তো এভাবেই প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান উক্ত ছক কাটা রাজপথে শেখ সাহেবের সহিত ক্ষমতা ভাগাভাগি করার ও ভোগ করার চিন্তা করিয়াছিলেন। কেনন ইহা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও ‘আইন কাঠামো আদেশ’ ছিলো পরস্পর পরিপন্থী।” –(জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৪৮)] গেলেন নির্বাচনে।
বস্তুত আওয়ামী লীগের লক্ষ্যই ছিলো ক্ষমতা। অতীতের দৃষ্টান্ত বলে, ওয়াদা পূরণ, জনগণের দাবী আদায় ইত্যাদিকে আওয়ামী লীগ থোরাই তোয়াক্কা করে। সুতরাং লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক বা ৬ দফা কিছুই তার কাছে কোনো বড় বিষয় ছিলো না। লক্ষ্য অর্জনের জন্যে শেখ মুজিব প্রথম থেকেই যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন সেটা হলো, জনপ্রিয় দাবী-দাওয়া সামনে নিয়ে আসা। যুক্তফ্রণ্ট এটাই করেছিলো। শেখ মুজিবও ৬ দফার আকারে তাই করলো। দ্বিতীয় যে নীতি তার সামনে বড় হয়ে উঠেছিলো তাহলো, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে ভারতের সাহায্য ও সমর্থন প্রয়োজন ও মূল্যবান হতে পারে। বিশেষ করে সামরিক শাসন এবং তার পরবর্তী সরকারের অব্যাহত নির্যাতন নিপীড়ন থেকেই সম্ভবত এটা তিনি মনে করেছিলেন। সুতরাং তাঁর কণ্ঠে জয় বাংলা শ্লোগান এলো এবং পররাষ্ট্র নীতিও তিনি নিলেন ভারতকে খুশী করার মতো আর আদর্ষিক ক্ষেত্রে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি তো আগে থেকেই ভারতের আনন্দের বিষয় ছিলো। আওয়ামী লীগের এ নীতিগত অবস্থানই তাকে মানুষের কাছে একটি Por-Indian দলেপরিণত করে। যার ফলে আদর্শবাদী ইসলামপন্থী দলগুলো আওয়ামী লগিকে প্রবল সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে।
মস্কোপন্থী ন্যাপ
মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ থেকে মস্কোপন্থী অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে মস্কোপন্থী ন্যাপ গঠিত হয়। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে কম্যুনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীরা ভাসানীকে ঘিরে আওয়ামী লীগে সমবেত হয়। আওয়ামী লীগের নীতি প্রথম দিকে এদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব সামনে এগিয়ে এলে এবং বাধার সৃষ্টি করলে আওয়ামী লীগ ভেঙে যায়। ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই কম্যুনিস্ট, সমাজতান্ত্রিক সমচিন্তার লোকরা মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠন করে। ১৯৬৭ সালে ন্যাপ দ্বিখণ্ডিত হয়ে মস্কোপন্থী ন্যাপ পিকিংপন্থী ন্যাপ গঠিত হয়। ’৬৭ সালের ১৬—১৭ ডিসেম্বর মস্কোপন্থীরা এক তলবী কাউন্সিল অধিবেশনে অধ্যাপক মুজাফফর আহমদকে সভাপতি ও সৈয়দ আলতাফ হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে মস্কোপন্থী ন্যাপের পূর্ব পাক কমিটি গঠন করে।
ন্যাপের এ বিভক্তির মূল কারণ ছিলো আন্তর্জাতিক কম্যুনিজমের বিভক্তি। আন্তর্জাতিক কম্যুনিজমের এক ভাগের নেতৃত্বে এলো চীন, অন্য ভাগে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৬৪ সালে এ ভাঙন সম্পূর্ণ হয়। এ ভাঙনের পথ ধরে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন প্রথম বিভক্ত হয়। ১৯৬৫ সালে রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে গঠিত হয় পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন। অন্যদিকে মতিয়া চৌধুরী নেতৃত্ব দেন মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নকে। এরপর বিভক্ত হয় ন্যাপ।
আদর্শগত কারণ ছাড়াও ন্যাপের বিভক্তির মূলে আরও কিছু রাজনৈতিক কারণও ছিলো। ১৯৬২ সালে চীন ভারত যুদ্ধের পর এবং ভাসানী ১৯৬৪ সালে চীন সফরের পর ন্যাপ নেতা মাওলানা ভাসানী চীনমুখী ও ভারত বিরোধী হয়ে পড়েন। অন্যদিকে চীনের বৈরী মস্কো এবং চীনের বৈরী ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক আরো গভীর হলো। এ সুবাদে ন্যাপের মস্কোপন্থীরা ভাসানী বিরোধী হবার সাথে সাথে ভারতমুখী হয়ে পড়লো এবং ন্যাপের ১৪ দফা কর্মসূচী বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের ৬ দফা সমর্থন করে বসলো।’ মস্কোপন্থীরা ৬ দফাকে ‘জাতির মুক্তির সনদ’ বলে অভিহিত করলো। এভাবে মস্কোপন্থীরা শেখ মুজিবের প্রতি ঝুঁকে পড়লো। এর বোধ হয় এও একটা কারণ যে, একদিন ভাসানীকে কেন্দ্র করে কম্যুনিস্টরা আওয়ামী লীগে এসে জুটেছিলো, তারপর ভাসানীর আশ্রয়ে তারা জাতীয়তাবাদী প্লাটফরম ‘ন্যাপ’ গঠন করেছিলেন, পরে যখন ভাসানীকে ছাড়তে হলো, তখন জনপ্রিয় এবং জাতীয়তাবাদী একটা অবলম্বন তাদের প্রয়োজন ছিলো। শেখ মুজিবকে তারা তাই অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করলো।
তবে আওয়ামী লীগের দুর্দিনে মস্কোপন্থীরা তাদের কোনো কাজে আসেনি। ৬ দফা ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের উপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিলো, তার গোটাটাই তাদেরকে একাই বহন করতে হয়েছে। তবে DAC গঠিত হলে মস্কোপন্থী ন্যাপও আওয়ামী লীগের সাথে ‘ডাক’ এ যোগদান করে।
জেনারেল ইয়াহিয়া যখন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলো, আওয়ামী লীগের সাথে মস্কোপন্থী ন্যাপও নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলো। লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক-এর বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানী যতটুকু কথা বলেছিলেন, মস্কোপন্থীরা তাও বললো না। তবে মস্কোপন্থীরা ৬ দফা সমর্থনের কথা বললেও তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টো ৬ দফার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিলো না। স্বায়ত্বশাসন প্রশ্নে মস্কোপন্থী ন্যাপ কেন্দ্রের হাতে দেশ রক্ষা, পররাষ্ট্র নীতি ও মুদ্রা রাখার কথা বললো। আর বৈষম্যের প্রতিবিধানের জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে ‘পৃথক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা’র কথা বললো।
নির্বাচনের পর মস্কোপন্থী ন্যাপ যথা নিয়মে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করলো। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও তারা শেখ মুজিবের সাথে ছিলো। তবে তারা আওয়ামী লীগের ছাত্র ও যুব শাখার স্বাধীনতা দাবীকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেনি। বরং তাদের মুরব্বী সংগঠন কম্যুনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ ’৭১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী প্রকাশিত তাদের রাজনৈতি মূল্যায়নে বললো: “অন্যদিকে কিছু উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী তথাকথিত স্বাধীন পূর্ব বাংলার নামে অবাঙালী বিরোধী জিগির তুলিয়া এবং মাওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়াজ তুলিয়া জনগণের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিরোধী মনোভাব গড়িয়া তুলিয়া অবস্থাকে আরও জটিল ও ঘোরালেঅ তুলিতেছে।….. সারা পাকিস্তানে এ (গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের) সংগ্রামের ফলে পাকিস্তানের জন্য একটা গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের দাবী অর্জিত হইতে পারে- এরূপ সম্ভাবনা আছে।….. এ সংগ্রামের সফলতার জন্য উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদের অবাঙালী জনগণ বিরোধী জিগির এবং মাওলানা ভাসানীর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিরোধী বিরোধী জিগিরেও মুখোশও আমাদের খুলিয়া দিতে হইবে।” [‘ন্যাপের ৩০ বছর’, শাহ আমদ রেজা, বিচিত্রা।] ‘এ দৃষ্টিকোণ থেকে মস্কোপন্থীরা গোটা মার্চ মাস ব্যাপী স্বায়ত্তশাসন এবং পাকিস্তানের জন্য একটা গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র রচনার দাবী অব্যাহত রেখেছিলেন। প্রস্তাবিত সংগ্রামের অংশ হিসেবে তারা ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে শেখ মুজিবের আলোচনাকে স্বাগত জানান এবং সমঝোতার সর্বশেষ প্রচেষ্টাকে সফল করার উদ্দেশ্যে অগ্রণী ভূমিকা নেন ন্যাপ সভাপতি ওয়ালী খান। শুধু তাই নয়, ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করার পর ২৯ মার্চেও কম্যুনিস্ট পার্টির প্রচারপত্রে বলা হয়: নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, সামরিক শাসন প্রত্যাহার, প্রভৃডিত যে দাবীগুলো আওয়ামী লীগ প্রধান উত্থাপন করিয়াছেন, ……. ঐ দাবীগুলো পূরণে ইয়াহিয়া সরকারকে বাধ্য করা, ইহা হইলে এই মুহূর্তের জরুরী কর্তব্য।’ [‘ন্যাপের ৩০ বছর’, শাহ আমদ রেজা, বিচিত্রা।
‘সেপ্টেম্বর পর্যন্তও এ পার্টি (বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি-সিপিবি) নিজেকে পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি নামে পরিচয় দিয়েছিলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি সোভিয়েত সমর্থন ঘোষিত হবার (২৯ সেপ্টেম্বর, ’৭১) পর পার্টি নামের আগে বাংলাদেশের শব্দটি যোগ করে।’ ‘ন্যাপের ৩০ বছর’, বিচিত্রা।] মস্কোপন্থীদের এ ভূমিকার কারণ সম্ভবত এই যে, তাদের তৎপরতা যাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সেখান থেকে তারা কোনো সুনির্দিষ্ট সিগন্যাল পাননি।
সেই সময় মস্কোপন্থীদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রিত করছিলো মস্কোর নীতি ও দৃষ্টিভংগি, ভারতের মনোভাব এবং আওয়ামী লীগের চিন্তা। এ তিনের সমন্বয় নিঃসন্দেহেই সময় সাপেক্ষ ছিলো। তবে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের পিছনে তাদের থাকার বিষয়টা নতুন কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ছিলো না।
ভাসানী ন্যাপ
আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি এবং সেখানকার কংগ্রেস-তাড়িত মজলূম মানুষের সংগ্রামী নেতা মাওলানা ভাসানী দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে এসে মুসলিম লীগের সাধারণ মেম্বারশীপও পেলেন না। কিন্তু রাজনীতিকদের রাজনীতি এভাবে বন্ধ করা যায় না। বন্ধ হলো না। তদানীন্তন মুসলিম লগি রাজনীতিকদের আচরণের প্রতিক্রিয়া এবং ব্যক্তি দ্বন্দ্বের পটভূমিতে ভাসানীর নেতৃত্বে সৃষ্টি হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ। এভাবে বিক্ষুব্ধ মনের প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটলো একটা সংগঠনের আকারে। ক্ষমতাসীনদের প্রবল বিরোধিতা হলো এ সংগঠনের প্রধান লক্ষ্য। মাওলানা ভাসানী এ বিরোধিতার ঝাণ্ডা উত্তোলন রেখেছেন তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ভাসানী চরিত্রের এ বৈশিষ্ট্য কম্যুনিষ্ট ও বামপন্থী কর্মীদের তাঁর চারদিকে সমবেত করে। একদিকে তাঁর চারদিকে বামপন্থীদের এ সম্মেলন, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের নীতি পশ্চিমাঘেঁষা হওয়ার কারণে আওয়ামী মুসলিম লীগ পররাষ্ট্রনীতি ক্ষেত্রে বামঘেঁষা হয়ে উঠলো। আর অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা অর্জন ও ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে বিপদে ফেলার জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক দাবী উত্থাপন করলো। কিন্তু ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের শরিকদল হিসাবে আওয়ামী মুসলিম লগি নির্বাচন জিতে কেন্দ্রে ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন হবার পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে শেখ মুজিবের পরিচালনায় আওয়ামী লীগের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দাবী থেকে সরে দাঁড়ালো। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও তারা পশ্চিমা জোট ঘেঁষা হয়ে উঠলো। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই আওয়ামী লগি দ্বিধাবিভক্ত হলো এবং গঠিত হলো মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ। […….in East Pakistan, the Awami league led by Suhrawardy, having abandoned the cause of Bengalis, was split. The leftist led by Maulana who could prevail upon Awami league till 1953 could no more find any common ground to remain together the underground communists were successful earlier through maulana and their worders to make it adopt the path of secularism by droping the word ‘Muslim’ from its name in 1955.” –Bangladesh, constitutional quest for Autonomy-Maudud Ahmed, Page-57.] মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের পশ্চিমা জোট ঘেঁষানীতির তীব্র সমালোচনা করলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ বিরোধী হবার অভিযোগ আনলেন। এর আগে ১৯৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারী কাগমারী সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে সামনে রেখে সুস্পষ্ট কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি আপনারা পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার নীতি অনুসরণ করেই চলেন, যদি পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবী মেনে না নেন, তাহলে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী শুনে রাখুন আপনাদের প্রতি আমাদের ‘আস সালামু আলাইকুম’। আপনাদের পথে আপনারা চলুন, আমাদের পথে আমরা চলি। [Bangladesh, constitutional quest for Autonomy- Maudud Ahmed, Page-58] মাওলানা ভাসানী ‘ন্যাপ’ গঠনের পর তাঁর প্রথম ঘোষণায় পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জন্যে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠার অংগীকার করে বলা হলো, দেশ রক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও মুদ্রা ছাড়া অন্য সব বিষয় প্রদেশের কর্তৃত্বে আনা হবে। [‘ন্যাপের ৩০ বছর’ বিচিত্রা।] প্রতিষ্ঠাকালে ভাসানী বিভিন্ন দাবী সম্বলিত ৬৩ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন।
১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারি হলে সব দলের সাথে ন্যাপেরও কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী আহূত সম্মেলনের মাধ্যমে ন্যাপ পুনরুজ্জীবিত হয়। এর আগে ন্যাপ এনডিএফ [১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নূরুল আমীন, সোহরাওয়ার্দী, প্রমুখের নেতৃত্বে এন ডি এফ গঠিত হয়।] –এর প্লাটফরমে থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেয়। পরে ন্যাপ পুনরুজ্জীবনের পরই ১৯৬৪ সালে ‘ন্যাপ’ সম্মিলিত বিরোধী দলীয় জোট ‘কপ’-এ যোগদান করে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয পরিষদ নির্বাচন ও প্রেসিডেণ্ট নির্বাচনে অংশ নেয়। এদিকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর মাওলানা ভাসানী ভারত বিরোধী এবং বন্ধু চীনের মিত্র আইয়ুব সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধকালে আওয়ামী লগি যখন ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা থেকে বিরত থাকে, তখন মাওলানা ভাসানী আইয়ুব সরকারকে বলিষ্ঠ সমর্থন দেন। পাক-ভারত যুদ্ধের ৪ মাস পর ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগের ৬ দফা ঘোষিত হলে মাওলানা ভাসানী এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং জুন (১৯৬৬) মাসে ১৪ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে পাল্টা আন্দোলনের ডাক দেন। ন্যাপের মস্কোপন্থী অংশ কিন্তু আওয়ামী লীগকে এবং সেই হেতু ৬ দফা ছাড়তে রাজী ছিলো না। এ মতবিরোধ ন্যাপকে ভাসানী ন্যাপ (চীনপন্থী) ও মস্কোপন্থী ন্যাপ-এ দুই অংশে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে আশু কারণ হিসেবে আজ করলো। এরপর মাওলানা ভাসানীর ন্যাপকে একই সাথে আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থী ন্যাপের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হতে হলো। ১৯৬৯ সালে এসে পিডিএম [….. এক ব্যক্তি শাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি হইতে সমগ্র দেশকে মুক্ত করিবার উদ্দেশ্যে ও জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার ঐকান্তিক বাসনার পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (পিডিএম পন্থী), মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), গঠন নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ঐক্য সংস্থা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত ৩০ এপ্রিলের (১৯৬৭) সভায় ‘পাকিস্তান ডেমোক্রাটিক মুভমেণ্ট’ (পি পি এম) গঠিত হয়।” –(জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৩৭৯-৩৮০)] –এর নেতৃত্বে চলে আসা গণতান্ত্রিক আন্দোলন ‘ডাক’ [১৯৬৯ সালের ৭ জানুয়ারী ডাক গঠিত হয় ৮টি দলের সমন্বয়ে। পি ডি এম-এর ৫টি দলের সাথে যুক্ত হয় আওয়ামী লীগ (ছয় দফা পন্থী), ন্যাপ (মস্কোপন্থী) এবং পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম।] গঠনের মাধ্যমে যখন তীব্র হয়ে উঠলো, তখন মাওলানা ভাসানী ইসলামী সমাজতন্ত্রের শ্লোগান তুলে ঘেরাও এবং জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন শুরু করলেন। ছাত্রদের ১১ দফা ভিত্তিক আন্দোলনও গণতান্ত্রিক আন্দলনকে নতুন গতি দান করে। সব মিলিয়ে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে উঠলো তার চাপে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহৃত হলো, শেখ মুজিব ছাড়া পেলেন, আইয়ুব খান পদত্যাগ করলেন, জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতায় এলেন এবং ক্ষমতায় এসে তিনি তাঁর ঘোষিত লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্কের আওতায় ১৯৭০ সালের শেষ দিকে সাধারণ নির্বাচনের কর্মসূচী ঘোষণা করলেন। অন্যান্য দলের মতো ভাসানী ন্যাপও আইন কাঠঅমো আদেশের (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক) অধীনে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলো। মশিয়ুর রহমান (যাদু মিয়া) ছিলেন এ সময় ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক।
নির্বাচনের বাতাস আওয়ামী লীগের জন্যে সৌভাগ্যের বার্তা নিয়ে এলো। পিডিএম-এর আন্দোলন, ডাক-এর আন্দোলন, ১১ দফার আন্দোলন –সব আন্দোলনের ফল গিয়ে জমা হলো ৬ দফার জন্যে নির্যাতিত আওয়ামী লীগের পকেটে। তার উপর ১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর লাখো লোক বিনাশী ভয়াবহ জলোচ্ছাস-উদ্ভূত আবেগও আওয়ামী লীগের পক্ষেই গেল। আওয়ামী লগি হয়ে উঠলো অপ্রতিরোধ্য। এ অবস্থায় বহুদর্শী নেতা মাওলানা ভাসানীকে হঠাৎ জ্বলে উঠতে দেখা গেল। বিরাট একটা উল্লষ্ফন ঘটলো তাঁর। তিনি ৩০ নবেম্বর পাকিস্তানী অবহেলার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন, ৪ ডিসেম্বরের পল্টনের জনসভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামে সকলকে যোগদান করার আহ্বান জানালেন [‘ন্যাপের ৩০ বছর’, বিচিত্রা।] এবং নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বললেন, ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। মাওলানা ভাসানীর এ আকস্মিক উল্টা গতিকে সেই সময় আওয়ামী লীগের হাতে পরাজয় এড়াবার জন্যে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবার একটা কৌশল হিসেবে সবাই মনে করেছিলো। কিন্তু নিছক দলীয় পরাজয় এড়ানো নয়, বিষটার শিকড় যে আরো অনেক গভীরে ছিলো, মশিয়ুর রহমানের এক বক্তব্যের পরবর্তীকালে তা পরিষ্কার হয়। জনাব মশিয়ুর রহমান [জনাব মশিয়ুর রহমান তখন ছিলেন ভ াসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক পরে প্রেসিডেণ্ট জিয়াউর রহমানের ক্যাবিনেটে ইনি চীফ মিনিস্টার হন।] ‘মাওলানা আমাদের ঐতিহ্য’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেন:
“’৭০ সালে আমরা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতাম এবং নির্বাচন করতাম তবে ২৫টা আসন অন্তত নিশ্চয়ই পেতাম। পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের চারজন ভুট্টোর সাথে যোগ দিয়ে জিতেছিলো, এটা অনেকেই হয়তো জানেন। সেদিন নির্বাচন বিরোধিতার ডামাডোলের মধ্যে কিন্তু এমন কয়েকজন ছিলেন-আনোয়ার জাহিদ, নূরুল হুদা, কাদের বক্স, মোহাম্মদ সুলতান এবং শ্রদ্ধেয় হাজী দানেশ- যারা ন্যাপের নির্বাচন করার সপক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ আমি মনে করি,যদি প্রথম থেকেই নির্বাচনের ব্যাপারে পার্টি পজেটিভ হ তো এবং ২৫টা আসন নিতে পারতো, তাহলে পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরই আঞ্চলিক প্রশ্নের সমাধাদেনর ব্যাপারে আমরা কার্যকরী পদক্ষেপ এবং ভূমিকা রাখতে পারতাম। অন্যদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামেও ভারত পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একচেটিয়া কর্তৃত্ব করতে পারতো না। কারণ আমরা থাকতাম বাধা।
এখানে কিছু পূর্বকথা বলে রাখা প্রয়োজন। ’৬৯-এর মাঝামাঝির দিকে ইন্টেলিজেন্সের এক অফিসার মেজর কমল (বর্তমান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান) দেখা করেছিলেন মাওলানার সাথে। তখন ইন্টেলিজেন্সের চীফ ছিলেন জেনারেল আকবর। মেজর কমল মাওলানার সাথে স্বাধীনতার প্রশ্নে আলোচনা করেছিলেন। পূর্বাপর বিচার করে মাওলানা ভীষণভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং এ সময় আমার সাথে তাঁর বহু আলাপ হয়, যা আমার জন্যে এক বিরাট অভিজ্ঞতা। আমাদের নিজেদের পার্টি তখন ক্ষত-বিক্ষত। সাধারণ নেতা ও কর্মীরা বিভ্রান্ত। বামপন্থী বন্ধুরা নৈরাজ্যের ঘোরে আচ্ছন্ন প্রায় সবাই। এমনি এক অবস্থায় রাজনীতির ঘোর-প্যাঁচ বেড়ে চললো নেপথ্যে। এ সময় ঘোষিত হলো, ইয়াহিয়া চীন যাচ্ছেন সেপ্টেম্বর মাসে। মাওলানা আমাকে বললেন, ‘প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনীতি বাঁচাতে হলে ইলেকশন বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ, ইলেকশন হলেই ৬ দফার আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে রূপ নেবে।সুতরাং ইলেকশন আপাতত স্থগিত রাখার জন্যে যদি কিছু করা যায় তাই কর।’ তিনি বললেন, ‘আগে শাসনতান্ত্রিক এবং কাঠামোগত প্রশ্নগুলো মীমাংসা করে তারপর নির্বাচন হোক। যেমন ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট ভেংগে দিয়েছে, তেমনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কাঠামোও ঘোষণা করুক। তারপর যদি নির্বাচন হয়, তাহলেই কেমলমাত্র অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলো সামনে আসবে, না হলে আঞ্চলিক ভিত্তিতেই নির্বাচন চলে যাবে। অতএব আমি বলছি, তুমি নির্বাচন মুলতবি রাখার জন্যে কাজ করো।’ এ যেন এক ভবিষ্যত দ্রস্টার অমরবাণী।
আমি পাকিস্তানে চীনা রাষ্ট্রদূত যিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার সাথে পিকিং যাচ্ছিলেন তাকে বললাম, ‘আপনি প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-কে আমার এ ছোট চিরকুটটি পৌঁছে দেবেন।’ চীন থেকে ফিরে এলেন ইয়াহিয়া। সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখে ঢাকায় প্রেসিডেণ্ট হাউজে আমি তাঁর সাথে দেখা করলাম। তাঁর সাথে হুজুরের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করলাম। তিনি আমাকে জানালেন,
“প্রধানমন্ত্রী চৌ, সেই জ্ঞানী বৃদ্ধও এমনি আশংকার কথা আমাকে বলেছেন। কিন্তু আমি বলছি, বেশী খারাপ অবস্থা দেখলে আমি ক্ষমতা হস্তান্তর করবো না।’ তাঁকে আমি বুঝাতেই পারলাম না, কোন পথে এর সমাধান নিহিত। তিনিও বুঝতে চাইলেন না, সেতুর কোন্ পারে সংকট থেকে মুক্তি।” [‘মাওলানা ভাসানী : রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রাম’, সম্পদনা-শাহরিয়ার কবির, পৃষ্ঠা-২১-২৩]
জনাব মশিয়ুর রহমানের উপরোক্ত বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, মাওলানা ভাসানী নির্বাচন বর্জন ও ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ আন্দোলনর লক্ষ্য ছিলো আওয়ামী লীগের বিভিন্নতাবাদী প্রয়াসকে রোধ করা এবং এ আন্দোলন তিনি করেছিলেন পাকিস্তানী মিলিটারী ইনটেলিজেন্সের সাথে পরামর্শ করেই। এবং তিনি জানতেন যে, নির্বাচনের পর শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার কথা মতো না চললে তার হাতে ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না।
মাওলানা ভাসানীর ন্যাপ শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেয়নি। জাতীয পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন ৪ ডিসেম্বর। ৩০ নবেম্বর তিনি একথা প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন। তারপর অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও তিনি তাঁর এ কথার পুনরাবৃত্তি করে গেছেন এবং ইয়াহিয়া-মুজিবের মধ্যে যে কোনো সমঝোতার তিনি বিরোধিতা করেছেন। অথচ তাঁর আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিলো আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা রোধ করা। ভাসানীর এ দুই অবস্থান পরিষ্কারভাবে পরস্পর বিপরীত। কিন্তু আসলেই কোনো বৈপরীত্য নেই। মাওলানা ভাসানী আন্দোলনের নেতৃত্ব শেখ মুজিবের কাছ থেকে নিজের হাতে আনতে চেয়েছিলেন। এজন্যেই প্রয়োজন ছিলো শেখ মুজিব যা বলেছিলেন তার চেয়ে আগে বেড়ে কথা বলা। কিন্তু মাওলানা ভাসানী সফল হলেন না। নির্বাচনোত্তর দীর্ঘ টানাপোড়েনার পর ইয়াহিয়া যখন ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজী হলেন না এবং নৃশংস দমন অভিযান শুরু করলেন, তখন স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে অদ্ভূত এক দ্বন্দ্বে পড়লো মাওলানা ভাসানীর ন্যাপ। বহুদর্শী মাওলানা ভাসানী বুঝলেন, যুদ্ধ যেটা শুরু হয়ে গেছে তার পরিণতি বিচ্ছিন্নতা-স্বাধীনতা। এ উপলব্ধির পরও তিনি আওয়ামী লীগের সাথে একাত্ম হলেন না এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণও করতে পারলেন না। ভাসানী ন্যাপ স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রকৃতই কোনো ভূমিকা পালন করেনি। [ন্যাপের ৩০ বছর’, বিচিত্রা।] মাওলানা ভাসানী ভারতে গিয়েছিলেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের গোটা সময়ই তিনি সেখানে বন্দী জীবন কাটান। ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মশিয়ুর রহমান মাওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করার জন্যে ভারতে গিয়ে ছিলেন। কিন্তু গ্রেফতারী পরওয়ানার সম্মুখীন হয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন এবং তারপর তিনি তাঁর হোম-টাউন রংপুরেই বসবাস করেন। [মাওলানা ভাসানী : রাজনৈতি জীবন ও সংগ্রাম, সম্পাদনা-শাহরিয়ার কবির, পৃষ্ঠা-২৫] এ অবস্থায় ভাসানী ন্যাপের কোনো কর্মীর পক্ষে ভারত থেকে পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা সম্ভবপর ছিলো না। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা প্রশ্নে পিকিংপন্থী কম্যুনিস্ট গ্রুপগুলোর অধিকাংশের ভূমিকা ছিলো নেতিবাচক। [’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির ভূমিকা’ বিচিত্রা।] এমনকি মোহাম্মদ তোয়াহা ও আবদুল হকের নেতৃত্বাধীন ‘পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি’ (এম এল) স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘প্রতিবিপ্লবী’ আখ্যা দিয়ে একে ‘সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতা প্রত্যাশী দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ি’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলো। [’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির ভূমিকা’ বিচিত্রা।] পিকিংপন্থী গ্রুপ গুলোর মধ্যে শুদু সিরাজ সিকদারের গ্রুপকেই কেউ কেউ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু এ মতও ঠিক নয়। সিরাজ সিকদারের যুদ্ধ ছিলো প্রকৃতপক্ষে আদর্শিক একটা মুক্তি সংগ্রাম যা স্বাধীনতা যুদ্ধকে একটা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছিলো। ভারত কেন্দ্রিক চলমান স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে তার কোনোই সম্পর্ক ছিলো না। ২০ এপ্রিলের (১৯৭১) একটা ইশতেহারে ‘শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ভারতে গঠিত সরকারকে সমর্থন বা সহযোগিতা দিতে সিরাজ সিকদার অস্বীকার করেছিলেন’ এবং ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সহায়তার নামে ভারত, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বা অন্য কোনো দেশের সৈন্য বা সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ব বাংলার ভূমিতে প্রবেশ করতে দেয়ার সম্ভাব্য সিদ্ধান্তের সম্পর্কে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।’ [’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির ভূমিকা’ বিচিত্রা।] সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে সিরাজ সিকদারের এ ভূমিকা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের জন্যে সর্বনাশের এবং মুক্তিযুদ্ধ বিনাশী শক্তি পাকিস্তান বাহিনীর যুদ্ধ-কৌশলের একান্ত সহায়ক। [“তার (সিরাজ সিকদার) মতে ক্ষমতালিপ্সু আওয়ামী লীগ নেতারা বারতে গিয়ে ‘ছয় পাহাড়’ তথা ভারতীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সমানতবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের দালালে পরিণত হয়েছেন। এদের প্রদত্ত আশ্রয়, অস্ত্র, অর্থ ও সমর্থনের বিনিময়ে তারা নিজেদের স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়েছেন, পূর্ব বাংলাকে ভারত ও সাম্রাজ্যবাদের কাছে বন্ধক দিয়েছেন।” –([’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির ভূমিকা’ বিচিত্রা। ] ’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্ত হওয়ার মাধ্যমে যে স্বাধীনতা লাভ হয়, তাকে মেনে নিতে অস্বীকার করে সিরাজ সিকদার একে ‘ভারতের উপনিবেশ’ এবং ‘ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদীদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করেন। [ঐ] সিরাজ সিকদারের মৌল অবস্থান ভাসানী ন্যাপের মৌলনীতি ও অবস্থানের সাথে সংগতিপূর্ণ। মাওলানা ভাসানী সেই ১৯৬৬ সালে নে নীতিগত [“মাওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ৬ দফাকে পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ পুঁজির সাথে মুকাবিলায় পরাস্ত এবং অবদমিত বাঙালী ধনিক শ্রেণীর অবাধ বিকাশের কর্মসূচী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো।” –‘আওয়ামী লীগের ৩৭ বছর’, বিচিত্রা, নবেম্বর, ১৯৮৬।] দৃষ্টিকোণ থেকে ৬ দফার সমালোচনা করেছিলেন, যে কারণে চৌ এন লাই ৭০-এর নির্বাচন সম্পর্কে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিলেন, সে একই নীতিগত কারণে ভাসানী ন্যাপ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি। ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবসকে মাওলানা ভাসানী ‘বিজয় দিবস’ মনে করতেন না। এ তারিখে পাকিস্তান বাহিনীকে ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করানোর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে ‘ভারতীয় উপনিবেশ’ বানিয়েছে এ যুক্তিতেই ভাসানী ১৬ই ডিসেম্বর ‘বিজয়দিবস’ এর বদলে একে ‘কালো দিবস’ হিসাবে পালন করেছেন।
মুসলিম লীগ
১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই মুসলিম লীগ সমগ্র ভারতে মুসলিম স্বার্থের প্রতীক হয়ে উঠলো। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু স্বার্থের প্রতীক ভারতীয জাতীয় কংগ্রেসের মোকাবিলায় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা ছিলো মুসলিম লীগের রাজনৈতিক দর্শন। জাতীয় স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন মাওলানা আবুল কালাম আযাদের মতো গুটিকয়েক মুসলমান ছাড়া কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ থেকে শুরু করে সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব পর্যন্ত সকলেই ছিলেন মুসলিম লীগের নেতা ও কর্মী। সংখ্যা গুরু হিন্দুদের গ্রাস থেকে মুসলমানদের রক্ষার জন্যেই সৃষ্টি হয়েছিলো মুসলিম লীগের।
১৯০৫ সালে বংগ-ভংগের মাধ্যমে ঢাকা কেন্দ্রিক পূর্ব বংগ প্রদেশ গঠন পূর্ব বংগের অনুন্নত, অবহেলিত মুসলিম সংখ্যা গুরু জনগণের উপকারে এসেছিলো। কিন্তু হিন্দু-পুঁজি ও হিন্দু জমিদার শোষিত পূর্ব বংগের মজলুম মানুষের উপকারকে হিন্দুরা ভালো চোখে দেখেনি। “তাঁদের মতে বিভাগ প্রস্তাবের অরথ বঙ্গ-মাতাকে দ্বি-খণ্ডিত করার প্রচেষ্টা। তাই এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন গড়ে তোলে। সে সংগঠিত আন্দোলনের শ্লোগান ছিলো ‘বন্দে মাতরম’। মাতৃ-বন্দনার এ শ্লোগান পরে সাম্প্রদায়িক অর্থ পেয়েছিলো। এক পক্ষের বিভাগ সমর্থন এবং অন্য পক্ষের প্রবল বিরোধিতার ভেতর দিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের স্বাতন্ত্র্যটাই নতুন করে উদঘাটিত হলো।” [ঊনিশ শ ছয় থেকে ছত্রিশ- অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (শতাব্দী পরিক্রমা’ শীর্ষক বিএনআর প্রকাশিত সংকলন থেকে নিবন্ধটি ‘আমাদের সাহিত্যে ও ভাবনায় কায়েদে আযম’ শীর্ষক সংকলনের নতুন করে ছাপা হয়েছে পৃষ্ঠা-৮৪)] হিন্দুদের এ বাড়াবাড়ি এবং তাঁর ঈর্ষার কথা অমুসলিম লেখক, চিন্তাবিদদেরও নজর এড়ায়নি। ভারতের সংখ্যাগুরু দলিতদের নেতা ভারতীয সংবিধানের অন্যতম জনক ডঃ আম্বেদকর লিখেছেন, “সারা বাংলা, উড়িষ্যা ও আসাম এমনকি উত্তর প্রদেশও ছিলো বাংলার হিন্দুদের চারণ ভূমি। তারা এসব প্রদেশের সিভিল সার্ভিস দখল করে রেখেছিলো। বংগ বিভাগের অর্থ ছিলো এ চারণ ভূমির হ্রাস।
বং বিভাগের প্রতি হিন্দুদের বিরোধিতার পশ্চাতে বাংরার মুসলমানদেরকে তাদের ন্যায়সংগত অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার ইচ্ছাই প্রধান ছিলো।” [‘পাকিস্তান এন্ড দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া’ –বি, আর, আম্বেদকর, পৃষ্ঠা-১১১] ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী নিরদ চন্দ্র চৌধুরী (এন. সি. চৌধুরী) বলছেন, “বং বিভাগ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে শত্রুতার একটি স্থায়ী আবেদন রেখে যায় এবং মুসলমানদের প্রতি একটা তীব্র ঘৃণা আমাদের অন্তরে আসন লাভ করে বন্ধুত্বের যাবতীয় অন্তরঙ্গতার অবসান ঘটায়। রাস্তা-ঘাট, বিদ্যালয় এবং হাট-বাজার সর্বত্রই এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং সর্বোপরি এটা মানুষের মনের মধ্যে বাসা বাঁধে। [‘এ্যান অটোবায়োগ্রাফি অব এ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ –এন সি চৌধুরী, পৃষ্ঠা-৩৯] বস্তুত ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের প্লাটফরমে হিন্দু-মুসলিম মিলন শ্লোগানের মুখোশ হিন্দুদের রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠাকামী ও মুসলিম স্বার্থ বিনাশী যে চেহারা গান্ধী, নেহেরু, প্রমুখ হিন্দু নেতৃবৃন্দ সযতনে গোপন করে রেখেছিলেন, বংগভংগের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে তার নগ্ন প্রকাশ ঘটে। নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়ার উদ্যোগ হিসেবে নওয়াব সলিমুল্লাহ ১৯০৬ সালে ঢাকার শাহবাগ উদ্যানে মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের আয়োজন করলেন। এ সম্মেলনেই গঠিত হলো ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম নেতৃবৃন্দ একে একে মুসলিম লীগে চলে এলেন। ১৯১৩ সালে কায়েদে আযম মুসলিম লীগে যোগদানের পর মুসলিম লগি নতুন প্রাণ পেল। এ মুসলিম লীগই মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাস ভূমি ও আযাদী ছিনিয়ে আনলো ১৯৪৭ সালে।
কিন্তু মুসলমানদের এ ঐতিহ্যবাহী সংগঠন অন্তঃসংঘাত থেকে মুক্ত ছিলো না। দেশ বিভাগ ও কায়েদে আযমের মৃত্যুর পর যা আরও উৎকটভাবে দেখা দেয়। সাংগঠনিক দুর্বলতা, বিশৃঙ্খলা ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে বিরোধী দলের সংখ্যা দাঁড়াল উনিশটিতে। ’৫১ পর্যন্ত খোদ মুসলিম লীগ নামের সংগঠনের সংখ্যাই দাঁড়াল পাঁচটি। [মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’, মামদোতের নবাবের নেতৃত্বে ‘জিন্নাহ মুসলিম লীগ’, মানকি শরিফের পীরের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগ’, সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ‘জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এবং সরকারী ‘মুসলিম লীগ’।] সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলো পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সংগঠন। বাংলার মুসলিম নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, খাজা নাজিমউদ্দীন, আবুল হাশিম, আকরাম খান প্রমুখ। এঁদের মধ্যে ফজলুল হক আগেই মুসলিম লগি চত্বর থেকে ছিটকে পড়েন। স্বাধীনতার প্রাক্কালে সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিমও ঝড়ে পড়লেন মুসলিম লীগ থেকে। কংগ্রেস নেতা শরৎ বসুর সাথে মিলে যুক্ত বাংলার আন্দোলন করা, দেশ বিভাগের পর তাঁরা ঢাকায় চলে না আসা এবং আরও কিছু কারণে তারা লীগে তাদের অবস্থান হারান। সুতরাং ’৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মুসলিম লগি পুরোপুরি খাজা নাজিমউদ্দীন গ্রুপের কুক্ষিগত হয়ে পড়লো। আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা ভাসানী আসাম থেকে যখন ফিরলেন মুসলিম লীগের সাধারণ সদস্য পদও পেলেন না। সোহরাওয়ার্দী এবং তাঁর অনুগত কর্মীদের ক্ষেত্রেও এটাই ঘটলো। এ অবস্থায় মুসলিম লীগ যেমন দুর্বল হয়ে পড়লো, তেমনি শক্তিশালী বিরোধী দল গঠিত হবার সুযোগ হলো। ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবের মতো মুসলিম লীগ পরিত্যক্তদের নিয়ে গঠিত হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ। দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলো ১৯৫২ সালে। অগণতান্ত্রিকতা এবং স্বেচ্ছাচারিতা অন্তত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লগিকে ভেতর থেকে একেবারেই অন্তঃসারশূন্য করে তুললো। বিভাগোত্তরকালে পূর্ব পাক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন মাওলানা আকরাম খান। ১৯৫২ সালের আগস্টে কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতি করা হলো জনাব নূরুল আমীনকে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতার আসন থেকে মুসলিম লীগ নির্মূল হয়ে যায়। ২৩৭টি আসনের মধ্যে মাত্র দশটি আসনে মুসলিম লীগ জয় লাভ করে। মুসলিম লীগ থেকে যাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী ও ভারতের অনুচর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো, সেই হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীরাই ক্ষমতায় এলেন। পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতা হারালেও মুসলিম লগি পশ্চিম পাকিস্তানে ক্ষমতায় থাকলো এবং কেন্দ্রে ক্ষমতার অংশীদার রইলো। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মুসলিম লীগে যোগদান করে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করায় ’৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতন পর্যন্ত মুসলিম লীগ ক্ষমতায় টিক থাকলো। আইয়ুব খান কর্তৃক মুসলিম লীগের কনভেনশন আহ্বানকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগের একটা অংশ আলাদা হয়ে যায়। কাউন্সিল মুসলিম লগি নামে গ্রুপ বিরোধী দলীয় ভূমিকা পালন করে যায়। ’৬৯ সালে কনভেনশন মুসলিম লগি আবার দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানে এক ভাগের নেতৃত্বে ছিলেন খান এ সবুর, অন্য ভাগকে নেতৃত্ব দেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের সব গ্রুপই অংশগ্রহণ করে। কাউন্সিল মুসলিম লীগ ৭টি, কনভেনশন মুসিলম লগি (ফজলুল কাদের) ২টি এবং কাইয়ুম মুসলিম লগি (সবুর) ৯টি আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু সবগুলো আসনই পশ্চিম পাকিস্তানে।
মুসলিম লীগের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের জন্ম। মুসলিম লীগ শুরু থেকেই আওয়ামী লীগকে মনে করতো ভারতীয় স্বার্থের প্রতিভু, আর আওয়ামী লগি মুসলিম লগিকে মনে করতা পাঞ্জাবী স্বার্থের ক্রীড়ানক। জাতীয় রাজনীতির দুই প্রান্তে ছিলো দু দলের অবস্থান। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কাউন্সিল মুসলিম লীগ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান ও শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে তৎপরতা দেখিয়েছে। কিন্তু কাইয়ুম মুসলিম লগি সব সময় ভুট্টো পক্ষকেই সমর্থন করে গেছে। অন্যদিকে কনভেনশন মুসলিম লীগ অনেকটা নীরবতা পালন করেছে।
সুতরাং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো, মুসলিম লগি তাকে সমর্থন করেনি। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে দাঁড়ালে মুসলিম লগি তার বিপরীত পক্ষে অবস্থান নিলো।
জামায়াতে ইসলামী
জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতা উত্তরকালে হয়ে পড়ে সবচেয়ে বেশী বিতর্কের শিকার। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: স্বাধীনতা সংগ্রামের তারা বিরোধিতা করেছে এবং পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতিকে সমর্থন করেছে। ১৯৭১ সালে এ ভূমিকা পালন করেছে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী পার্টি, পিডিপি, কেইসপি, জমিয়তে ওলামায়ে পাকিস্তান সহ ইসলামপন্থী সকল সংস্থা ও সংগঠনও। এদেরকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী বলে গালি দেয়া হয়, কিন্তু অভিযোগ ও আক্রমণের প্রবল ঝড় জামায়াতে ইসলামীকেই আহত করেছে সবচেয়ে বেশী। প্রেসিডেণ্ট জিয়াউর রহমানের বি. এন. পি. সরকারও এক সময় জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধী হবার অভিযোগ এনে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে প্রবল এক আন্দোলন শুরু করেছিল। অথব বি. এন. পি.-র ক্যাবিনেটে তখন শাহ আজিজ, আবদুল আলিম, মাওলানা আবদুল মান্নানের মতো স্বাধীনতা যুদ্ধ বিরোধীদের শক্তিশালী অবস্থান। এরশাদ সরকারের আমলেও এ ঘটনাই ঘটলো। তাঁর ক্যাবিনেটেও স্বাধীনতা যুদ্ধ বিরোধীদের শক্ত অবস্থান আমরা দেখি। অথচ তিনি জামায়াতে ইসলামীকে স্বাধীনতা বিরোধী আখ্যায়িত করে তাঁদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের লাগান। আর আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দলগুলো তো পারলে জামায়াতে ইসলামীকে উৎখাত করেই ছাড়ে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, যারা তখন রজাকার সেজে পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগিতা করেছে, তাদের মধ্যে এমনকি আওয়ামী লগিসহ সব দলের লোকই ছিলো, তাদের কথা চেপে যাওয়া হচ্ছে। [খন্দকার আবুল খায়ের, যার বাড়ীতে মুক্তিযুদ্ধকালে শেখমুজিবের ভাই শেখ নাসের ৩৫ দিন লুকিয়ে ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালে যার বাড়ী ছিলো অনেক ন্যাপ ও আওয়ামী লীগ নেতার আশ্রয়, ‘সওয়াল জওয়াব’ নামক পুস্তিকায় লিখেন:
“আমি যে জেলার লোক সেই জেলায় ৩৭টি ইউনিয়ন থেকে জামায়াত আর মুসলিম লীগ মিলে ৭০-এর নির্বাচনে ভোট পেয়েছিলো দেড় শতের কাছাকাছি আর সেখানে রাজাকারের সংখ্যা ১১ হাজার। যার মাত্র ৩৫টি ছেলে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগারদের। …… যারা ছিলো সুযোগ সন্ধানী, তারা সুযোগ পেয়েছে, ব্যস রাজাকার হয়ে পড়েছে। এরপর এগার হাজার রাজাকার যারা নৌকা (আওয়ামী লীগ) থেকে নেমে এসেছিলো, তাদের সব দোষ গিয়ে আমাদের (ইসলামপন্থীদের) ঘাড়ে চাপল।” –সওয়াল-জওয়াব, খন্দকার আবুল খায়ের, পৃষ্ঠা-৪৪, ৪৫, ৬২)] পত্র-পত্রিকারও আক্রমণের টার্গেট জামায়াতে ইসলামী। সাপ্তাহিক বিচিত্রার মতো মানী পত্রিকাও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে অর্ধ ডজনেরও বেশী কভার স্টোরি করে। এর কারণ সম্ভবত এটাই যে, স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান না করা দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীই সবচেয়ে সংগঠিত ও শক্তিশালী দল হি সেবে আজ আবির্ভূত হয়েছে। সুতরাং আমাদের আলোচনায় রাজনৈতিক অংগনের এ দলটির একটু গভীরেই আমাদের দৃষ্টিপাত করা উচিত।
জামায়াতে ইসলামী ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ভারতের আওরঙ্গবাদে জন্মগ্রহণ করেন। আল্লামা ইকবালের আমন্ত্রণে তিনি লাহোরে এসে বসতিস্থাপন করেন। [আল্লামা ইকবারের পুত্র বিচারপতি ডঃ জাবিদ ইকবালের সাক্ষাতকার, বিশ্বের মনীষীদের দৃষ্টিতে মাওলানা মওদূদী, পৃষ্ঠা-৩২৩] জামায়াতে ইসলামী একটি ক্যাডারভিত্তিক দল হিসেবে পরিচিত। দলটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে: “বাংলাদেশে তথা সারা বিশ্বে সার্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানব জাতির কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (স) প্রদর্শিত দীন (ইসলাম জীবন বিধান) কায়েমের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন সাফল্য অর্জন করাই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।” [গঠনতন্ত্র, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৮] জামায়াতে ইসলামীর সদস্য হতে হলে প্রত্যেকেই একটা শপথ বাক্য পাঠ করতে হয়। শপথে বলতে হয়: “আমি অমুক পিতা বা স্বামী অমুক জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর গঠনতন্ত্র বর্ণিত আকীদা [কালেমায়ে তাইয়্যেবা (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) এবং এর ব্যাখ্যা।] উহার ব্যাখ্যা সহকারে ভালোভাবে বুঝিয়া লওয়ার পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে সাক্ষী রাখিয়া ঘোষণা করিতেছি যে-(১) এক ও লা-শরীক আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁহার বান্দাহ ও রাসূল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ), (২) আমি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য উহার ব্যাখ্যা সহকারে ভালোভাবে বুঝিয়া লওয়ার পর অংগীকার করিতেছি যে, দুনিয়ায় সামগ্রিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানব জাতির কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (স) প্রদর্শিত দীন কায়েমের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন সাফল্য অর্জন করাই আমার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং এই লক্ষ্য হাসিলের প্রচেষ্টা চালাইবার জন্যে আমি খালিসভাবে জামায়াতে ইসলামীতে শামিল হইতেছি, (৩) আমি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর গঠনতন্ত্র বুঝিয়া লওয়ার পর ওয়াদা করিতেছি যে, আমি (ক) এই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জামায়াতের নিয়ম শৃঙ্খলা পূর্ণরূপে মানিয়া চলিব, (খ) সর্বদা শরীয়ত নির্ধারিত ফরয-ওয়াজিবসমূহ রীতিমতো আদায় করিব এবং কবীরাহ গুনাহসমূহ হইতে বিরত থাকিব, (গ) আল্লাহর নাফরমানীর পর্যায়ে পড়ে উপার্জনের এমন কোনো উপায় গ্রহণ করিবো না, (ঘ) এমন কোনো পার্টি বা প্রতিষ্ঠানের সহিত সম্পর্ক রাখিব না, যাহার মূলনীতি এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য জামায়াতে ইসলামীর আকীদা, যাহার মূলনীতি এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য জামায়াতে ইসলামীর আকীদা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং কর্মনীতির পরিপন্থী। ইন্না সালাতী ও নুসুকী ও মাহ্ইয়া-ই ওয়া মামাতী লিল্লাহে রাব্বিল আলামীন। আল্লাহ আমাকে এই ওয়াদা পালনের তওফিক দান করুন। আমীন।” [গঠনতন্ত্র, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৩৬-৩৭]
জামায়াতে শামিল হবার পর লোকদেরকে দলের তিন দফা দাওয়াত ও চার দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে কাজ করে যেতে হয়। তিন দফা দাওয়াতের কথাগুলো এই: (১) সাধারণভাবে সকল মানুষ ও বিশেষভাবে মুসলিমদের প্রতি আল্লাহর দাসত্ব ও রাসূলের (স) আনুগত্য করিবার আহ্বান, (২) ইসলাম গ্রহণকারী ও ঈমানের দাবীদার সকল মানুষের প্রতি বাস্তব জীবনের সকল কাজে মুনাফিকী ও কর্ম-বৈষম্য পরিহার করিয়া খাঁটি ও পূর্ণ মুসলিম হওয়ার আহ্বান, (৩) সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমাজের সকল ক্ষেত্র হইতে অসৎ, খোদাদ্রোহী যালিম ও ফাসিক নেতৃত্ব অপসারিত করিয়া সৎ, খোদাভরু, ন্যায়পরায়ণ ও আল্লাহর নেক বান্দাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আহ্বান।”
আর চার দফা স্থায়ী কর্মসূচীতে বলা হয়েছে: (১) “সর্ব শ্রেণীর মানুষের নিকট ইসলামের প্রকৃত রূপ বিশ্লেষণ করিয়া চিন্তার বিশুদ্ধীকরণ ও বিকাশ সাধনের মাধ্যমে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামের অনুসরণ ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অনুভূতি জাগ্রত করা, (২) ইসলামকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করিবার সংগ্রামে আগ্রহী সৎ ব্যক্তিদিগকে সংগঠিত করা এবং তাহাদিগকে জাহিলিয়াতের যাবতীয় চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ ও ইসলাম কায়েম করিবার যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মীরূপে গড়িয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ দান করা, (৩) ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে সামাজিক সংশোধন, নৈতিক পুনর্গঠন ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সাধন এবং দুঃস্থ মানবতার সেবা করা, এবং (৪) ইসলামের পূর্ণাংগ প্রতিষ্ঠাকাল্পে গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বাঞ্ছিত সংশোধন আনয়নের উদ্দেশ্যে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন এবং সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও খোদাভীরু নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করা।” [গঠনতন্ত্র, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৯-১০]
জামায়াতে ইসলামীর এ উদ্দেশ্য লক্ষ্য, দাওয়াত কর্মসূচী এবং ক্যাডারভিত্তিক পার্টি গঠনের মূলে জামায়াত প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদূদীর নিজস্ব একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগি কাজ করেছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মৌল সমস্যাগুলোকে মওদূদী এক বিশেষ দৃষ্টিভংগিতে অবলোকন করেছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো: “দুনিয়ায় ফেতনা ফাসাদের মূল উৎস হলো মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্ব কর্তৃত্ব (খোদায়ী)। এর থেকেই অনাচার অকল্যাণের সূচনা হয় এবং এর থেকেই আজ হলাহলের বিষাক্ত প্রস্রবণ প্রবাহিত হচ্ছে।…… কোথাও একটি জাতি আরেকটি জাতির খোদা হয়ে বসেছে, কোথাও এক শ্রেণী আরেক শ্রেণীর খোদা, কোথাও গ্রুপ একটি প্রভুত্ব কর্তৃত্বের আসন অধিকার করে আছে, কোথাও জাতীয রাষ্ট্র খোদার আসনে বিরাজমান, কোথাও কোনো ডিক্টেটর উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করছে, আমি ছাড়া তোমাদের আর কোনো খোদা আছে বলে আমার জানা নেই (সূরা কাসাস, ৮৩)।….. এটাই হলো সেই অশুভ শক্তি যা মানুষের সকল বিপদ-মুসিবত, সকল বিপর্যয় ও ধ্বংস এবং সকল বঞ্চনার মূল কারণ। তার উন্নতি-অগ্রগতির পথে এটাই বড় বাধা।….. এর প্রতিকার এছাড়া আর কিছু হতে পারে না যে, মানুষ সকল খোদায়ীর দাবীদার শক্তিগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে একমাত্র আল্লাহকে নিজের ‘ইলাহ’ এবং একমাত্র রাব্বুল আলামীনকে নিজের ‘রব’ বলে মেনে নেবে….. এটাই সেই বুনিয়াদী সংস্কার সংশোধনের কাজ যা আল্লাহর মহান নবীগণ মানুষের জীবনে করেছেন।” [ইসলামী রাষ্ট্র, ইসলামের রাজণেতিক মতবাদ (দ্রষ্টব্য, ‘জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, পৃষ্ঠা-৮২] এই মৌল সমস্যার পটভূমিতে মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে মাওলানা মওদূদীর মত হলো, “মুসলমানদের বাঁচার উপায় থাকলে শুধু এর মধ্যেই আছে যে, তাদেরকে আবার নতুন করে জাতির মুবাল্লিগের ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধুমাত্র এ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমেই তারা সেসব জটিলতা থেকে মুক্ত হতে পারে যার মধ্যে তারা এখন নিমজ্জিত আছে।…… একথা তাদের মনে বদ্ধমূল করে দিতে হবে যে, ইসলামের নিজস্ব একটা জীবন বিধান আছে। তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা আছে, নিজস্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আছে, তার নিজস্ব চিন্তাধারা আছে, নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা আছে- যা সব দিক দিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো থেকে অনেক ভালো ও উচ্চমানের। সভ্যতা-সংস্কৃতির ব্যাপারে কারো কাছে হাত পাততে হবে, এ ধারণা তাদের মন থেকে মুঝে ফেলতে হবে।” [জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা-৮০]
এ দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে নতুন করে মুবাল্লিগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার জন্যেই মাওলানা মওদূদী মুসলিম লীগ থেকে ভিন্নতর একটা দল গঠনের কথা চিন্তা করেন। তিনি এ সম্পর্কে বলেছেন, “তারপর ১৯৩৯ সসসসাল এবং তার পরের কথা। মুসলিম লীগের আন্দোলন জোরদার হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রস্তুতি হতে থাকে। অবশেষে ১৯৪০ সালে আন্দোলন পাকিস্তান প্রস্তাবের রূপ লাভ করে।….. সে সময়ে আমার মনের মধ্যে যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তাহলো এই যে, মুসলমানদের মধ্যে এ অনুভূতির সঞ্চার করা হোক যে, তারা নিছক একটা জাতি নয়, বরঞ্চ একটা মুবাল্লিগ জাতি, একটা মিশনারী জাতি। তাদের এমন এক রাষ্ট্র কায়েম করা উচিত যা হবে একটা মিশনারী রাষ্ট্র।
এ উদ্দেশ্যে আমি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লেখা শুরু করি….। যখন আমি দেখলাম যে, আমার সবকিছু অরণ্যে রোদন হয়ে পড়ছে, তখন আমি দ্বিতীয় পদক্ষেপ যা আমি সমীচীন মনে করলাম তা এই যে, নিজের পক্ষ থেকে একটি জামায়াত গঠন করা উচিত- যা চরিত্রবান লোক নিয়ে গঠিত হবে এবং ঐসব ফেতনার মোকাবিলা করবে যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সে সময় যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমার মনে ছিলো তা এই যে, অবস্থা যেদিকে চলছে তাতে একটা সংকট এটা হতে পারে যে, পাকিস্তান সংগ্রামে মুসলিম লগি বিফল মনোরথ ….. হবে এবং ইংরেজ ভারতে এক ভারতীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে তা হিন্দুদের হাতে তুলে দিয়ে চলে যাবে। তখন কি করতে হবে? দ্বিতীয় অবস্থা এ যে, মুসলিম লীগের উদ্দেশ্য সফল হবে এবং দেশ বিভক্ত হয়ে যাবে, এ অবস্থায় কয়েক কোটি মুসলমান যে ভারতে রয়ে যাবে তাদের কি দশা হবে এবং স্বয়ং পাকিস্তানে ইসলামের দশাটাই বা কি হবে?…..। এ ছিলো এমন এক পরিস্থিতি যখন আমি এ দৃঢ় সিদ্ধান্ত করলাম যে, জামায়াতে ইসলামী নামে একটি জামায়াত গঠন করা হোক।” [জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা-৮৩-৮৪]
জামায়াতে ইসলামীর মৌল দৃষ্টিভংগি সম্পর্কি উপরোক্ত আলোচনা থেকে জামায়াতের যে প্রকৃতিটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে তাহলো: (১) জামায়াতে ইসলামী ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং জামায়াত সদস্যরা মুবাল্লিগ বা মিশনারী চরিত্রের, (২) আদর্শের প্রতিষ্ঠা তাদের মূল লক্ষ্য, এ মূল লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থেই তারা চায় নেতৃত্বের পরিবর্তন যা তাদের ভাষায় সৎ নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা, (৩) আদর্শ বা ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার যারা বিরোধী, তারা মানুষের ইহকালীণ সুখ-শান্তি ও পরকালীণ সাফল্যের পথে বাধা সৃষ্টিকারী এবং এরাই অসৎ নেতৃত্ব, এদের বিরোধিতা করতে জামায়াত আদর্শিকভাবে বাধ্য এবং (৪) জামায়াত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী এবং জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। [“জামায়াত উহার, বাঞ্ছিত সংশোধন ও বিপ্লব কার্যকর করিবার জন্য নিয়মতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করিবে। অর্থাৎ দাওয়াত সম্প্রসারণ এবং সংগঠন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লোকদের মনমগজ ও চরিত্রের সংশোধন এবং অনুকুলে জনমত গঠন করিবে।” (গঠনতন্ত্র, পৃষ্ঠা-৯)]
জামায়াতে ইসলামীর এ বৈশিষ্ট্যগুলো তাকে একদমই একটা ভিন্ন প্রকৃতির দলে পরিণত করেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হলো, আওয়ামী লীগ গঠিত হলো, তারপর আরও অনেক দল সামনে এলো, কিন্তু কারও সাথেই জামায়াতে ইসলামীর সাদৃশ্য, খুঁজে পাওয়া যায় না। কম্যুনিস্ট পার্টিও ক্যাডারভিত্তিক, তারও একটা আদর্শিক লক্ষ্য আছে। কিন্তু এ দিক দিয়ে কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে জামায়াতে ইসলামীর তুলনা করা হয়। কিন্তু আসলেই তাদের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। কম্যুনিস্ট পার্টির একটা আদর্শ আছে, কিন্তু তা মানবীয়, যার পরিবর্তন মানবীয় ইচ্ছারই অধীন। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ খোদায়ী- যার পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কোনো ক্ষমতা জামায়াতে ইসলামীর নেই। কম্যুনিস্ট পার্টি লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিতে পারে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্যের মতোই লক্ষ্য পৌঁছার পথও তার সুনির্দিষ্ট, যার নির্মাতা মহানবী (স)। এখানে কোনো স্বেচ্ছাচারিতার অবকাশ নেই। [“কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিংবা কোনো কর্মপন্থা গ্রহণের সময় জামায়াত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের (স) নির্দেশ ও বিধানের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করিবে। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিলের জন্যে জামায়অতে ইসলামী এমন কোনো উপায় ও পন্থা অবলম্বন করিবে না যাহা সততা ও বিশ্বাসপরায়ণতার পরিপন্থী কিংবা যাহার ফলে দুনিয়ায় ফিতনা ও ফাসাদ (বিপর্যয়) সৃষ্টি হয়।” –(গঠনতন্ত্র জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৯)] জামায়াতে ইসলামীর এ অনড় নীতিষ্ঠ প্রকৃতির জন্যেই তাকে মৌলবাদ বা ফাণ্ডামেণ্টালিস্ট বলা হয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু ইসলাম এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো না। সকল মুসলমানের সংগ্রামের ফসল পাকিস্তানকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দলীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করলো এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনামূলক আদর্শিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও এর চরম স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়ে চললো। জামায়াতে ইসলামী এর তীব্র বিরোধিতায় এগিয়ে এলো। উত্থাপন করলো চার দফা দাবী: [১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে লাহোরে আইন কলেজে প্রদত্ত ভাষণে মাওলানা মওদূদী এর চার দফা দাবী উত্থাপন করেন। ‘মাওলানা মওদূদী, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা-৯৮] প্রথম, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সার্বভৌম মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা এবং এ রাষ্ট্রে একমাত্র তাঁরই ইচ্ছা পূরণ হবে। দ্বিতীযত, এ যাবত যত প্রকার ইসলাম বিরোধী আইন বলবত আছে, তার সবই রহিত করতে হবে। তৃতীয়ত, একমাত্র ইসলামী শরীয়তই হবে পাকিস্তানের যাবতীয় আইন-কানুনের উৎস। চতুর্থত, শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যেই পাকিস্তান তার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতে পারে। এ আন্দোলন দমনের জন্য মুসলিম লগি সরকার ‘জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল করছে’, ‘জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করে না’ ইত্যাদি অভিযোগ তুলে মাওলানা মওদূদীসহ জামায়াদের ঊর্ধতন নেতৃবৃন্দকে ১৯৪৮ সালের ৪ অক্টোবর গ্রেফতার করলো। দীর্ঘ ঊনিশ মাস বিনা বিচারে কারাভোগের পর ১৯৫০ সালের ২৮ মে তাঁরা ছাড়া পান। এ আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৫১ সালে জামায়াতে ইসলামী ৯ দফা [“উক্ত ৯ দফা দাবী ছিলো- ইসলামী শরীয়তই হবে দেশের শাসনতন্ত্রের প্রকৃত উৎস, শরীয়তের খেলাফ কোনো ‘আইন প্রণয়ন করা চলবে না, সকল শরীয়ত বিরোধী আইন বাতিল করতে হবে, সরকারের কর্তব্য হবে ভালো কাজে আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেদ করা, আদালতে বিচার ব্যতিরেকে নাগরিক অধিকার হরণ করা চলবে না। শাসন বিভাগ ও সরকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দেশের আদালতে বিচার প্রার্থনা করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে, বিচার বিভাগে শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপ চলবে না। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন যথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা- এ পাঁচটি বিষয়ের পূর্ণ দায়িত্ব সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।” –(মাওলানা মওদূদী, পৃষ্ঠা-১০৪] দাবীর ভিত্তিতে গোটা দেশ ব্যাপী প্রবল স্বাক্ষর অভিযান শুরু করলো। স্বাক্ষর অভিযান ৫২ সালের শেষ পর্যন্ত চললো। পাঞ্জাব ডিস্টারব্যান্স [পাঞ্জাব ডিস্টারব্যান্স বা কাদিয়ানী দাংগা ১৯৫৩ সালের ৪ঠা মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত চলে। এ দাংগা যে ডারেকট এ্যাকশন এর ফল তাতে জামায়াত ছিলো না। জামায়াত এর বিরোধিতা করেছে এবং জামায়াতের শূরা ৪ঠা ও ৫ই মার্চ এর তীব্র নিন্দা করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। -(মাওলানা মওদূদী, পৃষ্ঠা-১০৬-১০৭)] যাতে ১১ জন নিহত ও ৪৯ জন আহত হয়, এর অজুহাতে ১৯৫৩ সালের ২৮ মার্চ মুসলিম লগি সরকার মাওলানা মওদূদী ও অন্যান্য জামায়ত নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। সামরিক আদালত মাওলানা মওদূদীকে প্রাণদণ্ড দেয়। কিন্তু দেশের ভেতর ও বাইরে তীব্র প্রতিক্রিয়ার দরুন তাঁকে অবশেষে মুক্তি দেয়া হয়। দীর্ঘ দু বছর ন মাস পরে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
জামায়তে ইসলামীর রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও সংশোধনের এ আন্দোলন ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়া পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চললো। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন প্রত্যাহার হলে জামায়াত তার আন্দোলন পুনরায় শুরু করলো। ১৯৬৩ সালের ২৫ অক্টোবর লাহোরে জামায়াতে ইসলামীর ৬ শত শামিয়ানার এক বিশাল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। কনবেনশন মুসলিম লগি সরকার একে ভালো চোখে দেখেনি। তারা সম্মেলনে মাইক ব্যবহারের অনুমতি দিলো না। এরপরও সম্মেলন চ ললে তা সরকার লেলিয়ে দেয়া হামলার সম্মুখীন হয়। প্যান্ডেলে আগুন লাগানো হয়। একজন জামায়াত কর্মী আল্লাহ বখশকে গুলী করে হত্যা করা হয়। এরপরও জামায়াতের আন্দোলন অব্যাহত গতিতেই সামনে এগুলো। ১৯৬৪ সালের ৬ জানুয়ারী কনভেনশন মুসলি লীগের সরকার জামায়াতকে বেআইনী ঘোষণা করে প্রথম সারির ষাটজন জামায়াত নেতাকে জেলে পুরলো। বলপ্রয়োগে ক্ষমতা দখল, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা, সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়ানো, সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি ইত্যাদি অভিযোগ জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে আনা হয়। জেল থেকে সরকারের কাছে পেশকৃত দীর্ঘ বক্তব্যে জামায়াত প্রধান মাওলানা মওদূদী জামায়াতের বিরুদ্ধে আনীত সমস্ত অভিযোগ যুক্তি প্রমাণ সহকারে অস্বীকার করে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার তিনটি কারণ চিহ্নিত করেন। তিনি লিখেন, “প্রথম কারণ হলো এই যে, ১৯৬৩ সালের রাওয়ালপিণ্ডির এক জনসভায় বক্তৃতাদান কালে আমি দাবী করেছিলাম যে, কালাত, খারান, মাকরান, বাহওয়ালপুর এবং অন্যান্য সীমান্ত রাষ্ট্রগুলোকে যেভাবে পাকিস্তারে সাথে সংযুক্ত কর হয়েছে, ঠিক একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ সোয়াত, দীর প্রভৃতি রাজ্যকেও পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত করা উচিত। এবং পাকিস্তানের অন্যান্য নাগরিকরা যেসব সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার ভোগ করছে, এসব এলাকার অধিবাসীদেরকেও সেসব সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার দান করা উচিত। আমার দাবী পূর্ণ আইনানুগ ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিলো যে, যখন প্রাক্তন বৃটিশ ভারতের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারতের সাথে সংযুক্ত হলো, তখন গোলামীর যুগের এ শেষ চিহ্নটিকেই বা কেন অপসারিত করা হবে না? এমনি পরিষ্কারভাবে একটি নির্ভুল মত ব্যক্ত করার দরুন সরকারের কতিপয় ঊর্ধতন ব্যক্তি অস্বস্তি অনুভব করেন ও ক্রোধে ফেটে পড়েন। দ্বিতীযত, জামায়াতে ইসলামীর প্রচেষ্টায় ক্ষমতাসীন দল রাওয়ালপিণ্ডি ও হায়দারাবাদে দুটি উপনির্বাচনে পরাজয় বরণ করে। এটি ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের ক্রোধকে উস্কিয়ে দেয়। এ নির্বাচন দুটি অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে। তৃতীযত, ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ জামায়াতে ইসলামীর সুসংগঠিত আন্দোলনকে নিজেদের কনভেনশন মুসলিম লগের পথে বিরাট বাধা স্বরূপ মনে করতেন। এবং আগামী নির্বাচনের পূর্বে বিরোধী দলের এ সবচেয়ে সুসংবদ্ধ দলকে খতম করে দেয়া এবং তার নেতৃবৃন্দকে ময়দান থেকে সরিয়ে দেয়া জরুরী মনে করতেন। কেননা উপনির্বাচনের ফলাফ প্রত্যক্ষ করে তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী সরকারী দলের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রমাণিত হবে।” [১৯৬৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী লাহোর ডিস্টিক্ট জেল থেকে হোম সেক্রেটারীর কাছে প্রেরিত মাওলানা মওদূদী লিখিত সুদীর্ঘ চিঠির একটা অংশ, ‘মাওলানা মওদূদী’, পৃষ্ঠা-১৫৯-১৬০]
জামায়াতে ইসলামী সরাকরের এ নিষিদ্ধাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করে। মামলাটি সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সুপ্রীম কোর্টের রায়ে সরকারের নিষিদ্ধাদেশ বেআইনী ঘোষিত হয়। নয় মাস কারাভোগের পর জামায়াত নেতাগণ মুক্তি লাভ করেন।
এ ধরনের জুলুম নির্যাতনের মধ্যেই জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানে ইসলামের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যায়। তারা যে যে ইস্যুকে সামনে রেখে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তার মধ্যেও এ কর্মসূচী প্রধান বিষয় ছিলো।
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এ আন্দোলন চালিয়ে যাবার সাথে সাথে জামায়াতে ইসলামী জনগণের আশু প্রয়োজন পূরণ ও সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও অংশ নেয়। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার ও দাবী দাওয়ার ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য ছিলো খুবই সুস্পষ্ট। জামায়াত প্রধান মাওলানা মওদূদীর বক্তব্য এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯৫৬ সালের ২৪ জানুয়ারী থেকে দেড় মাস পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। সফরকালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মৌল সমস্যা বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনা সম্পর্কে তিনি বলেন, “যারা এখানে সরকারী কর্মচারী হিসেবে এসেছেন, তাদের একটা বিরাট অংশ বিশেষ কোনো প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেননি। ইংরেজদের চেয়ারে বসে তারা নিজেদেরকে ইংরেজ মনে করে নিয়েছেন। অপর জাতির উপর শাসন চালাতে ইংরেজরা যে নীতি অনুসরণ করতো, তারাও সেই নীতি অবলম্বন করেছেন। তারা একথা চিন্তা করেননি যে, নিজ দেশের নিজ জাতির শাসন তথা খেদমতের ভারেই তারা গ্রহণ করেছেন। ইংরেজদের অনুকরণ করা্ যদি তাদের লক্ষ্য ছিলো তবে ইংল্যাণ্টে প্রচলিত নীতি অনুসরণ করাই তাদের কর্তব্য ছিলো। বস্তুত যেসব কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ এ ধারণা পোষণ করতে আরম্ভ করেছে যে, তাদেরকে একটি কলোনীতে পরিণত করা হয়েছে, এই হচ্ছে তার প্রধান কারণ। …… বহিরাগত ব্যবসায়ী ও কারখানা মালিকগণ এসে এখানকার শিল্প ও বাণিজ্য সামলে নিয়েছেন। সে জন্যে আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাদের উচিত ছিলো এ দেশকে নিজেদের দেশ এবং জাতিকে নিজেদের জাতি মনে করে অনুন্নত ভাইদেরস সাহায্য করে উন্নত করবার চেষ্টা করা, তাদের দূরবস্থা দূর করার নিমিত্ত এখানের উপার্জিত অর্থ এখানেই ব্যয় করা তাদের মঙ্গল ও উন্নতির জন্যে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান কায়েম করা এবং তাদের বিপদ-আপদের সময় যথোপযুক্ত সাহায্য করা। বড়ই দুঃখের বিষয়, তাদের মধ্যে অনেকেই এ কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন না।” [পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা ও তার সমাধান, পৃষ্ঠা-৫, ৭, ৮ (মাওলানা মওদূদী-আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা-১২৪-১২৫)। ১৯৫৬ সালের মার্চ মাওলানা মওদূদী ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট বোর্ট হলে যে দীর্ঘ নীতি নির্ধারণী ভাষণ দেন, তা-ই ‘পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা ও তার সমাধান’ পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়।]
সরকারী চাকরি ও দেশ-রক্ষা ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের প্রতি কৃত অবহেলা ও বঞ্চনা প্রশ্নে মাওলানা মওদূদী বলেন, “ইংরেজ আমলে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানগণ চাকরির ক্ষেত্রে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ ছিলো। উচ্চ পদগুলোতে তাদের আনুপাতিক স্থান শূন্যের কোঠায় ছিলো। অবশ্য ইংরেজ ও হিন্দুদের দু শত বছর যাবত কৃত এ ত্রুটি সংশোধন করা সহজ সাধ্যও ছিলো না। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর পূর্বাঞ্চলের মুসলমানগণ ন্যায়তই এ আশা করে আসছিলো যে, তাদের উন্নতি লাভের সুযোগ দেয়া হবে। দুঃখের বিষয় তাদের এ আশা পূর্ণ করা হয়নি। কর্তব্য ছিলো বাংলাদেশের অবহেলিত ও অনুন্নত মুসলমান ভ্রাতাগণকে উন্নত করার চেষ্টা করা যাতে তারা দেশের সেবায় সমান অংশগ্রহণ করার সুযোগও লাভ করতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ ব্যাপারে অত্যন্ত অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে। এটা অপেক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো সৈন্য বিভাগের চাকরি, এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি আপত্তিজনক। আজ পর্যন্ত এখানে ইংরেজ আমলের নীতিই প্রচলিত রয়েছে যে, সৈন্য বিভাগের জন্যে কেবল ‘সামরিক জাতিই’ উপযুক্ত। এ পরিণাম এ হয়েছে, সৈনিক বৃত্তি একটা বিশেষ এলাকার লোকদের জন্যে একচেটিয়া হয়ে রয়েছে।…… জানি না আমাদের ক্ষমতাসীন লোকদের নিকট সিংহল, বার্মা, সিরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ইত্যাদি দেশগুলোর বাসিন্দাগণ সামরিক জাতি বলে গণ্য হয় কিনা। যদি না হয়ে থাকে, তবে হয় তাদের দেশ রক্ষার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিত, নতুবা অন্য স্থান থেকে সামরিক লোক আহ্বান করে সৈন্য বাহিনী গঠন করা উচিত। আর যদি এ দেশগুলো নিজেদের দেশ নিজেরাই রক্ষা করতে সক্ষম হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা তাদের চেয়ে কোন্ অংশে নিকৃষ্ট যে, তাদেরকে সৈন্য বিভাগের চাকরির অযোগ্য বলা হবে? এ ব্যাপারটির গুরুত্ব এখানেই শেষ নয়। বরং এ পাকিস্তানের একটা জীবন-মরণ সমস্যা। এ দেশের অর্ধেকেরও বেশী লোক এমন ক্ষুদ্র এলাকায় বাস করে যার তিনটি দিকই হিন্দুস্থানের আওয়তার মধ্যে রয়েছে। তার প্রায় চৌদ্দশত মাইলের সীমান্ত রক্ষা করতে হয়। যুদ্ধের সময় একে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোনো সাহায্য করা সম্ভব বলে মনে হয় না। এখানকার বাসিন্দাগণ যদি নিজেদের দেশ নিজেরা রক্ষা করতে সক্ষম না হয়, তবে কখনও তাদের মনে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা আসবে না। তাদেরকে আপনারা এ বিশ্বাস দিয়ে কখনও নিশ্চিত করতে পারবেন না যে, যুদ্ধের সময় পূর্বাঞ্চলকে পশ্চিমাঞ্চল রক্ষা করবে। এ একটি ভ্রান্ত দৃষ্টিভংগি ছাড়া আর কিছুই নয়।” [পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা ও তার সমাধান, পৃষ্ঠা-১৪-১৬ (মাওলানা মওদূদী-আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা-১২৭-১২৯)] বাংলাদেশের ভাষা সমস্যার ব্যাপারে মাওলানা মওদূদীর বক্তব্য খুবই সুস্পষ্ট ছিলো। তিনি বলেন, “বাংলাভাষিগণ উর্দুর সাথে বাংলাকেও সরকারী ভাষা করার দাবী জানিয়েছিলেন। …. প্রথম দিনই এ দাবী মেনে নিলে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়া হতো। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বিপরীত কাজ করা হয়েছে। একদিকে দমন নীতির সাহায্যে নিষ্পেষিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, আর অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বার বার এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা হয়েছে।” [পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা ও তার সমাধান, পৃষ্ঠা-১২-১৩ (মাওলানা মওদূদী-আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা-১২৬)]
পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর কাজ শুরু হয়। বাংলা ভাষায় তাদের আন্দোলনের সাহিত্যও তখন খুব সীমিত ছিলো। তাই পঞ্চাশের শেষ পর্যন্তও জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তানে কোনো শক্তিশালী সংগঠন হয়ে দাঁড়ায়নি। ষাটের দশকে এসে তা ক্রমশ বিস্তৃত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই সাথে স্বৈরাচার বিরোধী ও গণতান্ত্রিক সকল আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীকে সক্রিয় দেখা যায়। মৌলিক গণতন্ত্রের নামে আইয়ুব খানের একনায়কতন্ত্র প্রতিরোধের জন্যে ১৯৬৪ সালের ২০ জুলাই যে সম্মিলিত বিরোধী দল (Combined Opposition Party COP) [“মুসলিম লীগ (কাউন্সিল). ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আওয়ামী লীগ, নেজামে ইসলাম এবং নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অবতীর্ণ হবার সংকল্পে ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে ২০ জুলাই (১৯৬৪) চার দিবস ব্যাপী বৈঠকে নয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে সম্মিলিত বিরোধী দল (Combined Opposition Party COP) গঠন করেন।”-(জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫-অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৩৪৫)] গঠিত হয়, জামায়াতে ইসলামী তার শক্তিশালী শরিক দল ছিলো, যদিও জামায়াতে ইসলামী তখন নিষিদ্ধ ঘোষিত। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ছয় দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মাঠ থেকে আওয়ামী লগি যখন উৎখাত প্রায়, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঝাণ্ডা যখন ভুলুণ্ঠিত, তখন ১৯৬৭ সালে গঠিত হলো ‘পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পি ডি এম)। [“এক ব্যক্তি শাসনে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি হইতে সমগ্র দেশকে মুক্ত করিবার উদ্দেশ্যে ও জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার ঐকান্তিক বাসনায় পাকিস্তান আওয়ামী (পিডিএম পন্থী), পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয গণতান্ত্রিক ফ্রণ্ট ঐক্য সংস্থা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। জনাব আতাউর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত ৩০ এপ্রিলের (১৯৬৭) সভায় ‘পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেণ্ট’ গটিত হয়।” –(জাতীয রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৩৭৯-৩৮০)] জামায়াতে ইসলামী এ আন্দোলনের সক্রিয় অংশীদার ছিলো। পিডিএম-এর পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লগি নেতা স্বনামধন্য আইনজীবি জনাব আবদুস সালাম খান এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর অধ্যাপক গোলাম আযম। তারপর গণতান্ত্রিক আন্দোলন যখন ১৯৬৯ সালের শুরুতে গণ-আন্দোলনে পরিণত হওয়ার মতো ক্রান্তিলগ্নে পৌঁছল, তখন সমগ্র দেশ ব্যাপী গণ-আন্দোলন পরিচালনার তাকিদে ৭ ও ৮ জানুয়ারী ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দিন ব্যাপী বৈঠকে পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (ছয় দফঅ), নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রণ্ট, জামায়াতে ইসলামী পকিস্তান, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (পিডিএম পন্থী) এর সমন্বয়ে গঠিত হলো ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি (DAC)। জামায়াতে ইসলামী এ আন্দোলনেও অত্যন্ত সক্রিয় ছিলো।
কিন্তু যে আন্দোলন আওয়ামী লীগকে ঘর থেকে এবং জেলখানা থেকে বের করে আনলো, আওয়ামী লীগ বের হয়ে আসার পর সেই আন্দোলনের এবং আন্দোলনকারীদের পিঠে ছুরিকাঘাত করলো। প্রথম ঘটনা ঘটলো পল্টনে ১৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯ তারিখে। এদিন ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির জনসভায় আওয়ামী লগি ও ন্যাপ ছাড়া আর কোনো দলকে বক্তৃতা করতে দেয়া হলো না। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকলো নানা স্থানে। ‘পার হলে পাটনি পাটনি শালা’ বলে একটা প্রবাদ আছে, আওয়ামী লীগ এ আচরণই করলো। শেখ মুজিব জেল ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হবার পর এবং ইসলামাবাদের রাউণ্ড টেবিল কনফারেন্স থেকে ফিরে আসার পর শুধু ‘ডেমোক্রাটিক এ্যাকশন কমিটি’র সাথেই সম্পর্কচ্ছেদ করলেন না, নিজে হিরো সাজার জন্যে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে অত্যন্ত কদর্যভাবে চিত্রিত করলেন। [“শেখ মুজিবুর রহমান রাওয়ালপিণ্ডি গোল টেবিল বৈঠকে অংশ গ্রহণের পর ১৪ মার্চ ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করিলে জনতা তাঁহাকে বিরোচিত সম্বর্ধনা দান করে। বিমান বন্দরে তিনি ঘোষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ সমর্থন করিলে প্রেসিডেণ্ট আইয়ুব আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ পূর্ব পাকিস্তানের দাবী মানিতে বাধ্য হইতেন। শেখ সাহেব আরো মন্তব্য করেন যে, ‘সর্ব জনাব হামিদুল হক চৌধুরী, মাহমুদ আলী, ফরিদ আহমদ ও আসদুস সালাম খান অদ্যাবধি বিগত ২২ বৎসর যাবত একই খেলায় মাতিয়া আছেন।
মাওলানা ভাসানীর রাজনীতি রাজনীতি হইতে অবসর গ্রহণ করা বিধেয় বলিয়াও তিনি মন্তব্য করেন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে সমর্থন করিত এবং তাহাদেরই প্রত্যক্ষ প্রয়াসের ফলে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে একচ্ছত্র নেতার মর্যাদা পান। প্রসঙ্গত ইহাও অনস্বীকার্য যে, ঘটনায় আবর্তনের সমগ্র বাঙ্গালী জনতাই শেখ সাহেবকে বিনা প্রশ্নে নেতারূপে বরণ করিয়াছিলো। অতএব ব্যক্তি-আক্রোশ মিটাইবার কঠিন প্রয়াসে বিমান বন্দরে লাখো জনতার সামনে উপরোক্ত নেতাদের নাম প্রকাশ তাঁহার আদৌ নেতাসূলভ কাজ হয় নাই। ইহা প্রকারন্তরের উপরোক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে জনতাকে উস্কাইয়া দেয়া ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।” -(জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫ –অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৭)
“Mujib decided to dissociate from DAC. It was done in the afternoon of march 13 when mujib read out a written statement in the midst of a few hundred local and international media reporters…. The decision to disassociate from the DAC scored two points for Mujib, one, he manintained his leadership in East Pakistan by nullifying the criticism of the radical forces that he went to the Round Table Conference to compromise the cause of the people….. two, he now secured a position to bargain and degotiate with the leaders of the government on his won strength.” Bangladesh: Constitutional quest for Autonomy, Maudud Ahmed, Page-159-160] আওয়ামী লগি এবং তার ছাত্র ফ্রন্টের অগণতান্ত্রিক ও সহিংস আচরণের ফলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যান্য দলের মতো জামায়াতে ইসলামীর পক্ষেও মাঠে থাকা কঠিন হয়ে পড়লো।
১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ প্রেসিডেণ্ট আইয়ুব পদত্যাগ করলেন। এলেন ইয়াহিয়া খান। তিনি ৫ দফা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের ভিত্তিতে নির্বাচন দিলেন। সব দল লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক মেনে নেয়ার পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন মহলের ষড়যন্ত্র এবং লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক ও ছয় দফার মধ্যে সংঘাতের কারণে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হলো না। জামায়াতে ইসলামী সর্বাবস্থায় আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে কথা বলেছে। অসহযোগ আন্দোলনের গোটা সময়ে জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন বক্তব্য থেকে তাদের যে নীতি পরিষ্কার হয়ে যায় তাহলো: (ক) তারা পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও সংহতির পক্ষে, (খ) জনগণের রায় আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে, সুতরাং সরকার গঠন করা তার অধিকার। বিনা শর্তে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়া উচিত।
জামায়াতে ইসলামীর এ নীতি তার আদর্শ ও দলের নীতিমালার সাথে সংগতিশীল। আওয়ামী লীগের ভারত নীতি, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শ এবং একনায়কসুলভ তার স্বার্থপরতা সম্পর্কে প্রবল বিরোধী মনোবাব পোষণ করা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক বিধির কারণেই জামায়াত আওয়ামী লীগের হাতে বিনা শর্তে ক্ষমতা হস্তান্তর সমর্থন করেছে। কিন্তু ২৫ মার্চের (১৯৭১) পর আওয়ামী লীগ যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করলো, জামায়াতে ইসলামী তাকে সমর্থন করলো না।
নেজামে ইসলাম পার্টি ও অন্যান্য
মাওলানা সিদ্দকী আহমদের নেতৃত্বাধীন নেজামে ইসলাম পার্টি পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে এসেছে। বলা যঅয় এটি একটি পুরানো দল। ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রণ্ট ১৯৬২ সালে গঠিত হয় সোহরাওয়ার্দী, নুরুল আমীন, আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান খান প্রমুখের দ্বারা। পরে এখান থেকেই জনাম হয় নূরুল আমীনের নেতৃত্বে পাকিস্তান ডেমোক্রাটিক পার্টি (পিডিপি)। কৃষক-শ্রমিক পার্টিও পুরানো। এর প্রতিষ্ঠাতা প্রকৃতপক্ষে শেরে বাংলা। পরবর্তীকালে এর নেতৃত্বে আসেন এ. এস. এম সোলায়মন। জমিয়ত ওলামায়ে ইসলাম আলেমদের একটি সংগঠন। বৃটিশ আমল থেকেই আছে এবং পাকিস্তান আন্দোলন অংশগ্রহণ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে এ সবগুলো দলেরই নেতিবাচক ভূমিকা ছিলো। এছাড়া আরও অনেক ধর্মীয় বিশিস্ট ব্যক্তিত্ব এবং গ্রুপও স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তাদের নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন পীর জাফর মোহাম্মদ সালেহ এবং তাঁর গ্রুপ। এছাড়া রয়েছেন মাওলানা আতাহার আলী, মোস্তফা আল-মাদানী, মালানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী সহ দেশের সকল স্বনামখ্যাত আলেম। এ সমস্ত দল, গ্রুপ, ব্যক্তি সকলের মধ্যেই পাকিস্তানপ্রীতি এবং আওয়ামী লীগ ভীতি প্রবল ছিলো। আওয়ামী লীগ গঠনের পর থেকেই আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের এ মনোভাবের শুরু এবং তা ক্রমশ বেড়েছেই। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভূমিকা এবং আগরতলা ষড়যন্ত্রের বিষয়বস্তু এবং ১৯৬৯ সালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে আওয়ামী লীগের চরম স্বার্থপর আচরণ তার প্রতি সকলকে আরও সন্দেহপ্রবণ ও ভীত করে তোলে। উল্লেখ্য, আলেম ওলামা, পীর-মাশায়েখ এবং ইসলামী দল ও গ্রুপগুলো মুসলিম স্বার্থ এবং পাকিস্তানকে এক করে দেখত। আওয়ামী লীগকে তারা দেখত তাদের এ চিন্তার প্রতিকূল শক্তি হিসেবে। [ঊনিশ শত একাত্তর সালের ৩ জুন মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর, মাওলানা মুফতী দীন মোহাম্মদ খান, সেক্রেটারী জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া ঢাকা, মাওলানা সিদ্দীক আহমদ, প্রেসিডেণ্ট জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম, পূর্ব পাকিস্তান, মাওলানা মোহাম্মদ ইউনুস, প্রিসিন্পিাল, কাসেমুল উলুম, পটিয়া, চট্টগ্রাম, মাওলানা মোস্তফা আল-মাদানী, ভাই সেক্রেটারী, হিজবুল্লাহ, শর্ষিণা, আলহাজ্জ আবদুল ওহাব, কোষাধ্যক্ষ জামিয়া কুরআনিয়া, ঢাকা, মাওলানা আশরাফ আলী, সেক্রেটারী জেনারেল জমিয়াতে ওলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম, মাওলানা আজীজুল হক, মোহাদ্দেস, লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া, মাওলানা নূর আহমদ, সেক্রেটারী দাওয়াতুল হক প্রমুখ নিম্নলিখিত বিবৃতি দান করেন:
“লক্ষ্য প্রাণ, অমানুষিক কষ্ট ও বিরাট আত্মত্যাগের বিনিময়ে এবং মুসলমানদের অক্লান্ত ও অতুলনীয় প্রচেষ্টার ফলে পাকিস্তান একটা সুস্পষ্ট রাজনৈতিক সত্তা হিসাবে মাথা উঁচু করতে পেরেছে। কিন্তু মুসলিম বিরোধী শক্তিগুলো তাদের ষড়যন্ত্র ত্যাগ করেনি।….. গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ছদ্মাবরণে পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বিচ্ছিন্নতাবাদী অভ্যুত্থান ছিলো পাকিস্তানকে ধ্বংস করার অপর একটি ভারতীয চক্রান্ত। …….. যাতে ভারতীয় হামলা মোকাবিলা করা যায়, সে জন্যে সরকারের উচিত তার অনুগত নাগরিকদের মুজাহিদ হিসেবে গড়ে তোলা।” –দৈনিক পাকিস্তান, ৪ জুন, ১৯৭১)] অসহযোগ আন্দোলনকালে তাঁদের এ মনোভাব আরও তীব্র হয়ে দাঁড়ায়। তাঁদের অধিকাংশ বিনা শর্তে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরকেও সমর্থন করেনি।
রাজনৈতিক দলগুলোর উপর এই আলোচনার পর আরেকটি বেদনাদায়ক দিকের এখানে উল্লেখ প্রয়োজন। রাজনৈতিক অঙ্গনের মতো বুদ্ধিঝীবি অঙ্গনেও স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রশ্নে অত্যন্ত দুঃখজনক বিভক্তি দেখা দেয়। দেশের স্বনামধন্য সম্মানিত বুদ্ধিজীবি ব্যক্তিত্বগণ জাতীয় জীবনের এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আবু সাইদ চৌধুরী, সৈয়দ আলী আহসান, ডাঃ মাজহারুল ইসলাম, ডঃ এ আর মল্লিক, রণেশ দাস গুপ্ত, ডঃ এবনে গোলাম সামাদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, শওকত ওসমান, আসাদ চৌধুরী, সরোয়অর মুর্শেদ প্রমুখের মতো সম্মানিত বুদ্ধিজীবিগণ দেশ ত্যাগ করেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। অন্যদিকে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, ডঃ কাজী দীন মোহাম্মদ, ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, কবীর চৌধুরী, কবি শামসুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, ডঃ হাসান জামান, ডঃ মোহর আলী, হাসান হাফিজুর রহমান প্রমুখ বুদ্ধিজীবিগণ দেশ ত্যাগ করেননি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধেও অংশ নেননি। বরং তাঁদের অনেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত করার গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে এমন বিবৃতি দেন এবং এমন ভূমিকা পালন করেন যা ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধের অত্যন্ত নগ্ন বিরোধিতা। ১৯৭১ সালের ১৭ মে এক বিবৃতিতে এ বুদ্ধিজীবিগণ বলেন:
“নিউইয়র্কের ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব ইউনিভার্সিটি ইমারজেন্সি বলে পরিচিত একটি সংস্থা তাদের ভাষায় ‘ঢাকায় বিপজ্জনক ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে’ উদ্বেগ প্রকাশ করে যে বিবৃতি দিয়েছেন আমরা তা পাঠ করে হতবাক হয়ে গিয়েছি। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের অধ্যাপক, কলেজ শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক ও শিল্পীবৃন্দ আমাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও ভবিষ্যতের জন্যে আইসিইউ-র উদ্বেগ প্রকাশকে গভীরভাবে অনুধাবন করছি। যাই হোক, ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই না করে, যা কিনা পণ্ডিত ব্যক্তিদের প্রথম গুণ বলে বিবেচিত, এরূপ সম্মানিত, বিদ্বান ও সুধী ব্যক্তিরা এমন একটা বিবৃতি প্রকাশ করায় আমরা মর্মাহত হয়েছি। সত্যানুসন্ধানই যাদের জীবনের লক্ষ্য তেমনি একটি পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাই অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে আমাদের মহান সঙ্গীরা পণ্ডিত ও জ্ঞানান্বেষীর এ মৌল নীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির অভিযোগকে সম্বল করে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এবং অভিমত প্রকাশ করেছেন। আমাদের অনেকেই গুলীবিদ্ধ ও নিহতের তালিকায় তাদের নাম দেখতে পেয়ে হতবাক হয়েছেন। নেহাত নাচার হয়েই আমাদের জানাতে হচ্ছে আমরা মৃত নই।…….. আমাদের পেশাগত কাজের স্বাভাবিক রীতি অনুসারেই আমরা ঢাকা টেলিভিশনের পর্দায় আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ নিয়েছি।
আমাদের মৃত্যুর খবর যে অতিরঞ্জিত এটা জানিয়ে দিয়ে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং ছাত্রদের আশ্বস্ত করেছি।
ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে গোলযোগ চলাকালে আমাদের অধিকাংশই মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে নিজ নিজ গ্রামে চলে গিয়েছিলাম, এ কারণেই হয়তো ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়ে থাকবে। সময় নির্দিষ্ট করে বলার কারণ আছে। কেননা এ সময়টাতেই দেশের প্রতিষ্ঠিত বৈধ সরকারকে অমান্য করার কাজ পুরাদমে চলছিলো। নির্বাচনে জনগণের কাছ থেকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ম্যাণ্ডেট পেয়ে চরমপন্থীরা স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার দাবীতে সম্প্রসারিত ও রূপায়িত করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গিয়েছিলো, যারাই জনতার অর্পিত আস্থার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতায় অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে, তাদের উপর দুর্দিন নেমে এসেছিলো।
এ সময়েই ব্যাপকভাবে শিক্ষার অঙ্গনকে রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির কাজে অপব্যবহার করা হতে থাকে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ছাত্ররা লেখাপড়া বা খেলাধুলায় ব্যস্ত ছিলো না। তা ছিলো বাংলাদেশ মুক্তি ফৌজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তা ছিলো মেশিনগান, মর্টার ইত্যাকার সমরাস্ত্রের গোপন ঘাঁটি। ফ্যাসিবাদি সন্ত্রাসবাদ ও রাজনৈতিক দলের অসহিষ্ণুতার এ শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ এড়ানোর জন্য আমাদের অধিকাংশই আমাদর গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিয়েচিলেন। পাকিস্তানকে খণ্ড-বিখণ্ড করার সশস্ত্র প্রয়াস নস্যাৎ এবং প্রদেশে আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আগে কেউ শহরে ফিরে আসতে পারেনি।
অবশ্য আমাদের কিছু সহকর্মী বাড়ীতে না ফিরে সীমান্ত পার হয়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। ভারতীয় দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকার ২৫ এপ্রিলের খবরে দেখা যাচ্ছে যে, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পনেরজনকে তাদের স্টাফ হিসেবে নেয়ার পরিকল্পনা এবং পূর্ব পাকিস্তানী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আরো শিক্ষকদের তাদের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য ভারত সরকারের কাছে বিপুল অংকের বরাদ্দ দাবী করেছে।
পাকিস্তানী শাসন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের নিজস্ব অভাব-অভিযোগ রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের যেটা প্রাপ্য সেটা না পেয়ে আমরা অসুখী। আমাদের এ অসন্তোষ আমরা প্রকাশ করেছি একই রাষ্ট্র কাঠামোর আওতায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যাপক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভোট দিয়ে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ চরমপন্থীরা এ সহজ সরল আইন সঙ্গত দাবীকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার দাবীতে রূপান্তরিত করায় আমরা মর্মাহত হয়েছি। আমরা কখনও এটা চাইনি, ফলে যা ঘটেছে তাতে আমরা হতাশ ও দুঃখিত হয়েছি। বাঙালী হিন্দু বিশেষ করে কোলকাতার মারোয়াড়ীদের আধিপত্য ও শোষণ এড়ানোর জন্যেই আমরা বাংলার মুসলমানেরা প্রথমে ১৯০৫ সালে বৃটিশ রাজত্বকালে আমাদের পৃথক পূর্ব বাংলা প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত নেই এবং আবার ১৯৪৭ সালের ভোটের মাধ্যমেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রদেশের মুসলিম ভাইদের সাথে যুক্ত হওয়ার সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। উক্ত সিদ্ধান্তে অনুতপ্ত হওয়ার আমাদের কোনো কারণ নেই। পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু প্রদেশ হিসেবে সারা পাকিস্তানকে শাসন করার অধিকার আমাদের আছে। আর সেটা আমাদের আয়ত্তের মধ্যেই এসে গিয়েছিলো। ঠিক তখনই চরমপন্থীদের দুরাশায় পেয়ে বসলো এবং তারা জাতীয় অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুললো। প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন দিলেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া আলোচনাকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে সংখ্যাগুরু দল হিসেবে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু উল্টোটাই ঘটে গেলো এবং নেমে এলো জাতীয় দুর্যোগ।
কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদী হওয়ার সঙ্গত কারণ রয়েছে। আমরা পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত এবং বর্তমান সরকার অবস্থা অনুকূলে হওয়ার সাথে সাথে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার ইচ্ছা আবার ঘোষণা করেছেন। এমতাবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য স্থানের আমাদের বন্ধু একাডেমিশিয়ানরা আমাদের কল্যাণের জন্যে উদ্বেগ প্রকাশ করায় আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা তাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনো বড় ধরনের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা ও ন্দিান করছি।” [দৈনিক পাকিস্তান (আজকের দৈনিক বাংলা), ১৭ মে, ১৯৭১]
এ বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে রয়েছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, লেখক নাট্যকার শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান এম. কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের প্রধান এবং এফ. এইচ. মুসলিম হলের প্রভোস্ট ডঃ মীর ফখরুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রিডার ডঃ কাজী দীন মোহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার, নাট্যকার নূরুল মোমেন, কবি আহসান হাবিব, অভিনেতা চিত্র পরিচালক ও সঙ্গীত পারিচালক খান আতাউর রহমান, গায়িকা শাহনাজ বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার, নাট্যকার আশকার ইবনে শাইখ, গায়িকা ফরিদা ইয়াসমিন, পল্লী গীতির স্বনাম ধন্য গায়ক আবদুল আলিম, লেখক প্রযোজক চিত্র পরিচালক আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম, লেখক প্রযোজক পরিচালক ও এ এইচ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ডঃ মোহর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান মুনির চৌধুরী, বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী, গায়ক খোন্দকার ফারূক আহমদ, গায়ক এম এ হাদি, গায়িকা নীনা হামিদ, গায়িকা লায়লা আর্জুমান্দ বানু, শামসুল হুদা চৌধুরী (জিয়া ক্যাবিনেটের মন্ত্রী এবং এরশাদ সরকারের পার্লামেণ্ট স্পীকার), শিল্পী বেদার উদ্দিন আহম. গায়িকা ষাবিনা ইয়াসমীন, গায়িকা ফেরদৌসী রহমান, গায়ক মোস্তফা জামান আব্বাসী, ছোট গল্পকার সরদার জয়েন উদ্দীন, লেখক ও সমালোচক সৈয়দ মুর্তজা আলী, কবি তালিম হোসেন, ছোট গল্পকার শাহেদ আলী, মাহেন ও সম্পাকদ কবি আবদুস সাত্তার, নাট্যকার ফররূখ শীয়র, কবি ফররূখ আহমদ, পাকিস্তান আবজারভার (আজকের বাংলাদেশ অবজারভার) সম্পাদক আবদুস সালাম, মর্নিং নিউজ সম্পাদক এস. জি. এম. বদরুদ্দীন, দৈনিক পাকিস্তান (আজকের বাংলা) সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, অভিনেতা, চিত্র পরিচালক ফতেহ লোহানী, কবি হেমায়েদ হোসেন, লেখক আকবর উদ্দীন, লেখক আকবর হোসেন, শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ এ কিউ এম আদম উদ্দিন, নাট্য শিল্পী আলী মনসুর, লেখ কাজী আফসার উদ্দীন আহমদ, লেখক সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী, কবি ও লেখক শামসুল হক, লেখক সরদার ফজলুল করিম, গায়িকা ফওজিয়া খান প্রমুখ ৫৫জন নেতৃস্থানীয় কবি, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী। [দৈনিক পাকিস্তান, ২৭ জুন, ১৯৭১]
দেশের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের আরও একটা উল্লেখযোগ্য বিবৃতি প্রকাশিত হয় জুনের ২৭ তহারিখে। এ বিবৃতিদাতারা বলেন: “আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনায় গভীর বেদনা বোধ করছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, ভারতীয যুদ্ধবাজ যারা মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টিকে কখনো গ্রহণ করেনি প্রধানত তাদের চক্রান্তের ফলেই এটা হয়েছে। আমরা আমাদের প্রিয় স্বদেশ ভূমির সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্যে আমাদের সেনাবাহিনীর সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশংসা করছি। আমরা দেশের সংহতি ও অখণ্ডতা বিপন্ন করার জন্য চরমপন্থীদের অপপ্রয়াসের নিন্দা করছি। বহিবিশ্বের চোখে পাকিস্তানের মর্যাদা হ্রাস ও পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার অপচেষ্টা এবং সীমান্তে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে আমাদের ঘরোয়া ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের আমরা নিন্দা করছি। ভারতীয় বেতারে প্রচারিত একটি খবরের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। উক্ত খবরে অভিযোগ করা হয়েছে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি, এটা নির্লজ্জ মিথ্যা প্রচারণা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনের সকল ভবন অক্ষত অবস্থায় রয়েছে এবং কোনো ভবনের কোনোরূপ ক্ষতিসাধন করা হয়নি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বা করি, বর্তমান মুহূর্তে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন আমাদের সকলের মধ্যে ঐক্য ও শৃঙ্খলা। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে আমরা বর্তমান সংকট হতে মুক্ত হতে পারবো।” [দৈনিক পাকিস্তান (আজকের দৈনিক বাংলা), ১৭ মে, ১৯৭১]
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ভাইস চ্যান্সেলর এবং আইন ফ্যাকাল্টির ডীন ইউ. এন. সিদ্দিকী, ইতিহাস বিভাগের প্রধান ও সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ আবদুল করিম, সমাজ বিজ্ঞানের ডিন ডঃ এম বদরুদ্দোজা, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের লেকচারার মোহাম্মদ ইনামুল হক, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রধান ডঃ রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের রিডার মোঃ আনিসুজ্জামান, ইংরেজী বিভাগের সিনিয়র লেকচারার খোন্দকার রেজাউর রহমান, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের লেকচারার সৈয়দ কামাল মোস্তফা, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের লেকচারার এম এ জিন্নাহ, ইতিহাসের সিনিয়র লেকচারার রফিউদ্দীন, রসায়ন বিভাগের প্রধান এ কে এম আহমদ, সমাজ বিজ্ঞানের সিনিয়র লেকচারার রুহুল আমীন, বাণিজ্য বিভাগের প্রধান মোঃ আলী ইমদাদ খান, ইতিহাসের সিনিয়র লেকচারার মোঃ দিলওয়ার হোসেন, সংখ্যা তত্ত্বের সিনিয়র লেকচারার আবদুর রশিদ, ইতিহাস বিভাগের রিডার মুকাদ্দাসুর রহমান, ইতিহাসের লেকচারার আহসানুল কবীর, অর্থনীতি বিভাগের লেকচারার শাহ মোঃ হুজ্জাতুল ইসলাম, ইংরেজী বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ আলী, পদার্থ বিভাগের রিডার এজাজ আহমদ, গণিতের লেকচারার এস এম হোসেন, গণিত বিভাগের রিডার জেড, এইচ. চৌধুরী, সংখ্যা তত্ত্বের লেকচারার জনাব হাতিম আলী হাওলাদার, বাংলা বিভাগের রিডার ডঃ মোঃ আবদুল আওয়াল, বাংলার সিনিয়র লেকচারার মোঃ মনিরুজ্জামন বাংরা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মোঃ মনিুজ্জামান হায়াত (হায়াত মাহমুদ), ইতিহাসের গবেষণা সহকারী আবদুস সায়ীদ, অর্থনীতির লেকচারার মোহাম্মদ মোস্তফা, ইতিহাসের লেকচারার সুলতানা নিজাম, ইতিহাসের রিডার ডঃ জাকিউদ্দীন আহমদ এবং ফাইন আর্টসের লেকচারার আবদুর রশীদ হায়দার। [দৈনিক পাকিস্তান, ২৭ জুন, ১৯৭১]
জাতির দিক দিশারী বলে পরিচিত রাজনীতিক ও রাজনৈতিক দল সমূহের পরিচয় ও অবস্থান এবং জাতির বিবেক বলে কথিত বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষ প্রশ্নে তাদের সুস্পষ্ট দ্বিধা বিভক্তির প্রাথমিক রূপও আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। এ মতবিরোধ পরবর্তীতে ভয়ংকর রূপ পরিগ্রহ করে এবং পরস্পর জীবন দেয়া-নেয়ার সর্বনাশা খেলায় তারা মেতে ওঠে। স্ব স্ব নীতি নিয়ম, ইত্যাদি প্রশ্নে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, দলে দলে মতবিরোধ, মতভেদ এবং সংঘাত সংঘর্ষ অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাধীনতার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তর্কাতীত জাতীয প্রশ্নে এক ঐতিহ্যবাহী জাতির এমন বিভক্ত মত, যা দেশের জনগণকেও বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করেছিলো, মোটেই স্বাভাবিক ছিলো না। স্বাধীনতার পর আজ এ মৌল প্রশ্নে আবার জাতি এক ও অখণ্ড। কিন্তু সে সময়ে ঐ বিভক্তি, পরস্পরের ঐ বৈরিতা ইতিহাসের এক যন্ত্রণাদায়ক বিষয় হিসেবে জাতিতে পীড়া দিয়েই চলবে। জাতির জন্যে এ পীড়াদায়ক বিষয় হিসেবে জাতিকে পীড়া দিয়েই চলবে। জাতির জন্যে এ পীড়াদায়ক পরিস্থিতি সেদিন সৃষ্টি হলো কেন? কে কিংবা কারা ছিলো এ বিভক্তির জন্যে দায়ী? অথবা কি সেই ঘটনাবলী যা সৃষ্টি করেছিলো এ জাতীয দুর্ঘটনার? উভয় পক্ষের সেদিনের কাজ ও মানবিকতার মধ্যেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে নিসন্দেহে।
দুই
প্রথমে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিচালনা পক্ষের কথাই ধরা যাক। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লগি। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের গোটা সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বিরাজ করেছে। তারপর স্বাধীনতা যুদ্ধকালেও তারই একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিলো। কিন্তু যা জাতীয মত বিভক্তি রোধ করতে পারতো, পদক্ষেপের ক্ষেত্রে সে ধরনের সুস্পষ্টতা আওয়ামী লগের ছিলো না এবং দল মত নির্বিশেষে সবাইকে কাছে টানার ও জাতীয় সমঝোতা সৃষ্টির সে ধরনে উদ্যোগ আওয়ামী লীগের তরফ থেকে নেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের এ ব্যর্থতাকে নিম্নলিখিতভাবে তুলে ধরা যায়:
(ক) ১৯৭১-এর ১লা মার্চের পর আন্দোলনের নতুন মোড় নিলো। এর আগে আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসেবে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলো। কিন্তু ১লা মার্চে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি করলে আওয়ামী লগি তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠলো। প্রবল চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে এর মুকাবিলার জন্যে আওয়ামী লীগ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলো। এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছাত্র আন্দোলন স্বাধীনতার শ্লোগান তুললো। অসহযোগ আন্দোলন ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠলো। প্রেসিডণ্ট হাউজ এবং ক্যান্টনমেন্টগুলো ছ াড়া গোটা দেশ আওয়ামী লীগের হাতে এলো। এভাবেই এলো পঁচিশে মার্চ। গোটা অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে আন্দোলনের নেতা আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে অনেকেই দেখা করতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে তাঁর আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করেছেন, কিন্তু শেখ মুজিব সব দলকে ডেকে কোনো আলোচনা করেননি এবং তাদের আস্থায় নেননি এবং তাদের আন্দোলনে শামিল করেননি। [১৯৭১ সালের ১লা মার্চজ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি হবার পর হোহটেল পূর্ববাণীতে তাড়াহুড়া করে আহূত সাংবাদিক সম্মেলনে “এক প্রশ্নের জবাবে শেখ সাহেব বলেন যে, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি মাওলানা ভাসানী, জনাব নুরুল আমীন, জনাব আতাুর রহমান সহ প্রদেশের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনা করা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।” –(দৈনিক সংগ্রাম, ২রা মার্চ, ১৯৭১) কিন্তু জনাব শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর এ মহৎ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত করেছেন তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।] বরং দেখা গেছে শেখ মুজিব সবদিক থেকে বেতোয়াক্কা হয়ে ক্ষমতার যে পিরামিড, তার শীর্ষে উঠে গেছেন। ছাত্র ফ্রন্টের আন্দোলনে প্রথম ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ কাজ করেছে। কিন্তু আন্দোলনের এক পর্যায়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাতিল করে দিয়ে শুধুমাত্র ছাত্র লীগ কর্মীদের নিয়ে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের মাধ্যমে ছাত্র লীগ আন্দোলনকে এককভাবে হস্তগত করলো। [‘জাতীয রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪৭৩-৪৭৪, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতু যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭০৮] ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ফল একা কুক্ষিগত করে সবকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ যেমন একাই এগিয়ে গিয়েছিলো, ঠিক তেমনিভাবে অসহযোগ আন্দোলনের ফল ভোগে সে কাউকেই শরিক করতে চাইলো না। যেন সে নিশ্চিত ছিলো ক্ষমতা হস্তান্তর হচ্ছে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাচ্ছে। এ না হয়ে স্বাধীনতা স্বাধীনতা যুদ্ধের চিন্তু যদি তাদের মাথায় থাকতো, তাহলে আসন্ন স্বাধীনতা সংগ্রাম বা স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে আওয়ামী লীগের এ মানসিকতা ছিলো অযৌক্তিক, অনুপুযুক্ত এবং ক্ষতিকর। কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধ হয় সকলের। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের উচিত ছিলো সব দলকে কাছে ডাকা এবং তাদের আস্থায় নেয়া ও তাদের আস্থা অর্জন করা যাতে করে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কোনো ভুল বুঝাবুঝি থাকলে তা দূল হয় এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদেরও পওয়া যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ এটা করেনি। আন্দোলনের নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগের এটা একটা বড় ব্যর্থতা। যার ফলে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি, মুসলিম লীগ, প্রভৃতি ইসলামপন্থী ও ইসলাম মনা দলগুলোর সাথে আওয়ামী লীরেগ আলোচনা ও আরও জানাজানির মাধ্যমে ভুল বুঝাবুঝি ও দূরত্ব দূর করার কোনো পথ হয়নি। এভাবে আওয়ামী লগি বলয়ের বাইরে ঐ দলগুলো সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকা অবস্থায় এবং শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে হঠাৎ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো তাকে এ দলগুলো আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের যোগসাজশপূর্ণ ষড়যন্ত্র বলে মনে করলো সে সময়ের তাদের বক্ততা, বিবৃতি, শ্লোগানের মুখ্য কথাই ছিলো। এটা শান্তি কমিটির মিছিলগুলোর প্রধান শ্লোগান ছিলো: “পাক্তিানের উৎস কি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, হাতে লও মেশিনগান-দখল করো হিন্দুস্তান, বীর মুজাহিদ অস্ত্র ধরো-আসাম বাংলা দখল করো, ভারতের দালালদের-খতম করো খতম করো, ভারতের দালালী-চলবে না চলবে না, ইত্যাদি।” [‘একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়’, পৃষ্ঠা-৪৬] আন্হর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজ্ঞ, পাকিস্তানের সাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অবজারভার গ্রুপ অব পাবলিশেন্স-এর মালিক জনাব হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, “ভারতীয় প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিনন করা এবং তার দ্বারা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এ দেশের অস্তিত্ব বিলোপ করে নিজস্ব সম্প্রসারণবাদী মনোভাব চরিতার্থ করা। এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে এবং বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্যে তারা তাদের সকল প্রচার মাধ্যমের দ্বারা বিশ্ববাসীর নিকট হাজার হাজার নত হত্যা ও বোমা বর্ষণের ফলে শহর ধ্বংসের ভিত্তিহীন অভিযোগ প্রচার করছে।” [‘একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়’, পৃষ্ঠা-৪৮ (বিবৃতিটি ৬ এপ্রিল দেয়)] পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাওলানা আবদুল মান্নান ৭ এপ্রিল (১৯৭১) এক বিবৃতিতে বলেন, “সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমূলে উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক জনগণ আজ ‘জেহাদের জোশে’ আগাইয়া আসিয়াছে।” [‘একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়’, পৃষ্ঠা-৮৮] শাহ আজিজুর রহমান বলেন, “প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া প্রবল উৎকণ্ঠার সাথে রাজনৈতিক দলসমূহকে অধিকতর স্বাধীনতা প্রদান পূর্বক দেশে পূর্ণ ও বাধাবিহীন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল অধুনালুপ্ত আওয়ামী লগি এ সুযোগ ভুল অর্থ করে বলপ্রয়োগের….. মাধ্যমে নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসেবে জয়লাভ করে নিজেদের খেয়াল খুশীতে দেশ শাসন করার দাবী করে এবং এভাবেই অহমিকা, অধৈর্য এবং ঔদ্ধত্যের ফলে নিজেদের ভাসিয়ে দেয়। আমি সাম্রাজ্যবাদী ভারতের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।” [‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’, পৃষ্ঠা-৯১ (৪ঠা মে, ১৯৭১ তারিখের বিবৃতি)] পূর্ব পাক জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ৮ এপ্রিল (১৯৭১) এক বিবৃতিতে বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানীরা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ভারতকে ছিনিমিনি খেলতে দেবে না।….. ভারতীয় পার্লামেন্ট সম্প্রতি সর্বসম্মাতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং প্রস্তাবটির ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ……… পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি ভারতের তথাকথিত সহানুভূতির মধ্যে ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যবাদের দূরভিসন্ধির গন্ধ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের শত্রুর কাছ থেকে সহানুভূতি কামনা করে না। জনগণ তাদের অধিকার চায় এবং কিভাবে তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে সেটা হলো সম্পূর্ণরূপে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
অসৎ লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রতিটি পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণের ব্যাপারে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের দুরভিসন্ধি বর্তমানে ফাঁস হয়ে গেছে।….. পূর্ব পাকিস্তানীরা কখনো হিন্দু ভারতের দ্বারা প্রভাবিত হবে না। ভারতীয়রা কি মনে করেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের এতদূর অধঃপতন হয়েছে, তারা ভারতকে তাঁদের বন্ধু ভাববে?” [দৈনিক সংগ্রাম, এপ্রিল, ১৯৭১] পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা জনাব নূরুল আমীন বলেন, “পাকিস্তান সৃষ্টির জন্যে আমরা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি এবং সে সংগ্রামে জয়ী হয়েছি।…… আজও পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য আমাদের বিরুদ্ধ-শক্তির মুকাবিলা করতে হবে।” [দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ আগস্ট, ১৯৭১ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭১৮-৭১৯] জনাব মৌলবী ফরিদ আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানকে খণ্ডিত করা এবং মুসলমানদের হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য ফ্যাসিবাদীদের ক্রীতদাসে পরিণত করার ভারতীয চক্রান্ত বর্তমানে নিরপেক্ষ বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।……. দেশদ্রোহী ও পাকিস্তানীদের মধ্য থেকে হিন্দু ভারতের সংগৃহীত ক্রীড়নকদের রক্ষা করার জন্যে হিন্দুস্তান পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক অত্যাচারের মনগড়া ও ভিত্তিহীন কাহিনী প্রচার করছে। হিন্দু ভারতের সাথে যে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের এজেণ্টরা ষড়যন্ত্র করছে, তারাই আগ্রহভরে এ মিথ্যা সংবাদ গোপন সূত্র থেকে প্রাপ্ত বলে প্রচার করছে।…… একমাত্র ইসলামের নামেই এ দেশের সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস ভারতীয় এজেণ্টরা তথাকথিত সাংস্কৃতিক বাঙালী জাতীয়তাবাদের নামে এমন জঘন্য কাজ সম্পাদনে সক্ষম হয়েছে যা করতে হিটলারের ঘাতকদের বর্বরতাও লজ্জা পাবে।” [দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১ (বাংলাদেশো স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৭১-৬৭২)] কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রেসিডেণ্ট জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “জাতি আজ তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের সবচেয়ে ‘মারাত্মক সংকটের’ মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে।……. পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নিজের ভুলের জন্যে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। …….. পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৯৬জন লোক পাকিস্তানের জন্যে ভোট দিয়েছিলো। কিন্তু গত ২৩ বছর ধরে তরুণদের অপরিপক্ক মনে যে কারণেই হোক বঞ্চনার ধারণা বদ্ধ মূল হয়েছে এবং এ বঞ্চনা ও অবহেলা মুকাবিলার জন্য সংগ্রামের মাত্রা তাদের জানা ছিলো না। ভারতীয় এজেণ্টদের দ্বারা পরিচালিত তথাকথিত বাংলাদেশ বেতার থেকে দিন রাত তাঁর ও অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতার মৃত্যুদণ্ডের কথা তার স্বরে ঘোষণা করা হচ্ছে। পাকিস্তানের জন্যে সংগ্রাম করেযাব। কারণ যদি পাকিস্তানিই না থাকে, তাহলে অধিকারের জন্যে সংগ্রামের অবকাশ কোথায়।” [দৈনিক পাকিস্তান, জুলাই, ’৭১ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিরপত্র, পৃষ্ঠা-৬৮২-৬৮৩)] অনুরূপভাবে খান এ সবুর সহ মুসলিম লীগ নেতাগণ এবং নেজামে ইসলাম পার্টিসহ ইসলাম মনা বিভিন্ন দল ও গ্রুপের নেতাগণ ভারতীয ষড়যন্ত্র ও আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের বিরোধিতা করে ১৬ ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত বক্তৃতা, বিবৃতি ও তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। [বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের মানসিকতা সম্পর্কে তাদের এসব অভিযোগ যে অমুলক ছিলো না, স্বাধীনতা উত্তরকালে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। The Tide এক সংবাদ নিবন্ধে বলছে: “Almost all the beneficiaries of the 1975 massacres are always very vocal about the India Bangladesh Friendship Treaty signed by the Awami League government, but no one ever talks about the october, 1971, agreement the implement of which would have great by compromised the irdprendence and sovereignty of Bangladesh. According to usually infromed quarter important clauses of that agreement, signed of behalf of the Provisisonal government by its Action President, included, (1) replacing the Bangladesh Army with a para military force under Supervision of Indian Army, (2) Alloing Senior Indian civil servants to run the adminestration in Bangladesh, (3) Stationing Indian troops indefinitely on the soil of Bangladesh, (4) Declaring a three-mile area all along the border as a free trade area…… But everything changed after shaikh Mujib’s return…….. one must accapt honestly that towards the end of 1971, after India had committed its troops, it did look that if Bangladesh at all emerged victorious she would wind up as an Indian protecrate only the international prestige of Shaik Mujib stophed that from becoming the reality.” (The Tide, January, 28, 1990)]
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে উপরোক্ত দল ও ব্যক্তিসমূহের পূর্ব অভিজ্ঞতাই তাদের এ ভূমিকার জন্যে প্রধানত দায়ী। নির্বাচন বিজয়ী বৃহত্তর দল হিসেবে তাদের এ বিভেদের দেয়াল উপড়ে ফেলার দায়িত্ব ছিলো আয়ামী লীগের এবং তাদের উৎকৃষ্ট সময় ছিলো নির্বাচনোত্তর কাল বিশেষ করে অসহযোগ আন্দোলনের সবচেয়ে অনুকূল সময়টি। কিন্তু আওয়ামী লীগের একক ক্ষমতা দললের পুরানো মনোভাবই তার ব্যর্থতার জন্যে দায়ী। দুঃখের বিষয়, যে স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিলো সকলের, সেই স্বাধীনতা যুদ্ধকে আওয়ামী লগি তার দলীয় যুদ্ধে পরিণত করেছিলো। রাশিয়ার চাপ সত্ত্বেও এবং মস্কোপন্থী ন্যাপ ও কম্যুনিস্ট পার্টি তার সহযোগী হওয়ার পরেও তাদেরকেই যেখানে সে সাথে নেয়নি, পিকিংপন্থীদের যেখানে ভারতের মাটিতে তিষ্টাতে দেয়া হয়নি, সেখানে সে মুসলিম লীগ ও জামায়াতের মতো ইসলাম পন্থী দল ও ব্যক্তিত্বকে তারা পাশে স্বাগত জানাবে কেমন করে এবং এরাই বা তার উপর আস্থা স্থাপন করবে কি করে? আন্দোলনের নেতাহিসেবে আওয়ামী লীগের এ দুর্ভাগ্যজনক আচরণই স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা যুদ্ধ বিষয়ে সেদিন জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির পথ তৈরির কোনো সুযোগ দেয়নি। যার ফলে জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ মুসলিম লগি, জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দল ও ব্যক্তিত্বের চোখে হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ভারতের যোগ-সাজশে পরিচালিত এবং বাম ষড়যন্ত্রের শিকার আওয়ামী লীগের একটি চরমপন্থী মহলের স্বাধীনতা যুদ্ধ। স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের উপরে উল্লিখিত বিবৃতিগুলো একথারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
(খ) জনগণের করণীয় সম্পর্কে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের কিছু না বলা বা অস্পষ্টতা রাখা মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে জাতির মত-বিভক্তির সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ অসহযোগ আন্দোলন তাঁর নেতৃত্বেই করেছে। গোটা দেশ ছিলো তাঁর হাতের মুঠোয়। জনগণ তাঁর কথায় উঠেছে বসেছে। [সেই সময় এমন কোনো দল ছিলো না, যে তার নেতৃত্ব মেনে নেয়নি।] এ অবস্থায় ২৫ মার্চ রাতে তিনি গ্রেফতার বরণ করলেন জাতিকে কোনো কথা না বলেই। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন একথা যেমন যুক্তি নিরপেক্ষ বিচারে টেকে না, তেমনি শেখ মুজিব কোনো ঘোষণা দেয়ার সুযোগ করে উঠতে পারেননি, একথাও ঠিক নয়। শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব রেহমান সোবহান ২৫ তারিখ সন্ধা ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন। সে সময় শেখ মুজিব তাঁকে পরিষ্কার ভাষায় বলেন, সেনাবাহিনী সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। [রেহমান সোবহানের সাক্ষাতকার, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৯০ (Bangabandhu told us that the army had decided for go in a crack down)] বিষয়টা তিনি সুনির্দিষ্টভাবে জানার পরও কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। তিনি শেষ পর্যন্ত আপোসেরই অপেক্ষা করেছেন। তিনি মনে করেছেন, জেনারেল ইয়াহিয়া প্রধান আলোচক জেনারেল পীরজাদা অবশেষে টেলিফোনে একটা আপোস করার কথা জানাবেন। শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ডঃ কামাল হোসেন লিখেছেন, “I waited for a telephone call throughout the fateful 25th. This telephone call never came, Inded, when I finally took leave of Shaikh Mujib at about 10.30 P.M. on 25 March, Shaikh Mujib asked me whether I had received such a telephone call. I confirmed to him that I hadnot.”[ডঃ কামাল হোসেনর সাক্ষাতকার (১৯৭৪), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৭৮] আসলে শেখ মুজিব সেই কালো রা্রির সন্ধাতেও স্বাধীনতার কথা ভাবেননি। ২৫ তারিখ সন্ধায় শেখ মুজিব সাংবাদিকদের কাছে পরবর্তী কর্মসূচী হিসেবে ২৭ মার্চ হরতালের কথা বলেছিলেন। [“Shaikh Mujibur Rahman today (25, March) gave a call for a general stike throughout `Bangladesh’ on March 27th as a mark of protest against `heavy firing upon the civilian population in Saidpur, Rangpur and joydevpur. ……. He said all this had happend while the president is at Dacca for the declared purpose of resolving politically the grave crisis facing the country ….” Pakistan Times, 25th March, 1971. (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৮৭) ব্যবসায়-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার আরেকটা নির্দেশও শেখ মুজিব ২৫ মার্চ রাতে জনগণের উদ্দেশ্যে প্রচার করেন। এ সংক্রান্ত প্রকাশিত খবরে বলা হয়: “Sheikh Mujibur Rahman, the Awami League Chief, directed tonight (25th March) that export of jute and jute goods from Bangladesh should be resumed forth with, …… He also announced tele communication links with foreign countries will function via Manila and London……” The Dawn, 26th March, 1971 (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৮৬)
ঢাকা ও চট্টগ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী আঘাত করার জন্যে যখন পজিশন নিচ্ছিলো, এ সময় আওয়ামী লগের সংবাদবাহক সাংবাদিকদের নিকট শেখ মুজিবের স্বাক্ষরিত এ ইশতিহার বিলি করছিলো : প্রেসিডেণ্টের সহিত আমাদের আলোচনা শেষ হয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যাপারে আমরা ঐকম্যে পৌঁছেছি। আশা করি, প্রেসিডেণ্ট এবার তাঁর ঘোষণা করবেন। [বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত, মাহবুবুল আলম, পৃষ্ঠা-৪০] শেখ মুজিবের স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরণকেও স্বাধীনতা ঘোষণার চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক মনে হয়। বলা হয় সশস্ত্র স্বাধীনতা তিনি চাননি। [“সশস্ত্র সংগ্রামে তাঁর (শেখ মুজিবের) তেমন বিশ্বাস ছিলো না। তাঁর বাসায় গেরিলাযুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা হলে তাঁকে কখনো খুব উৎসাহিত হতে দেখিনি। তাঁর গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবেরে ন্যায় নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন।” –(ঢাকা আগরতলা মুজিব নগর, এম এ মোহাইমেন, পৃষ্ঠা-৬৭)] এ কারণেই “২৫ মার্চ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী যখন বাংলাদেশের মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং গোটা অসহযোগ সংগ্রাম ছত্রখান হয়ে যায, তখন অপ্রস্তুত জাতিকে প্লাবনে ডুবিয়ে শেখ মুজিব ‘মধ্য যুগীয় নাইটের মতো বীরত্ব সহকারে’ আত্মসমর্পণ করলেন। এর চেয়ে ব্যতিক্রমী কোনো ভূমিকা রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। যে মানুষটি অবশ্যম্ভাবী ভয়াবহ যুদ্ধের কথা জানেন, কিন্তু গোটা জাতিকে সে জন্যে প্রস্তুত করেননি এবং সেই ভয়াবহ লড়াইয়ের ভবিষ্যত কেবল আপন শ্রেণী স্বার্থের বিপরীতকেই দেখতে পান। তিনি কি কের সেই যুদ্ধে অংশ নেবেন।” [***৯৪] শেখ মুজিবের গ্রেফতার বরণ নিয়ে খোদ ভারতীয প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে প্রশ্ন তেলেন। খন্দকার মোশতাক বলেন, “ইন্দিরা গান্ধী আমাদের যখন জিজ্ঞেস করলেন আপনাদের যুদ্ধের স্টাটিজিটা আমাকে বুঝিয়ে বলুন- যুদ্ধ আরম্ভ করে সেনাপতি ধরা দিয়েছেন আর আপনাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বলেছেন, এটা কোন ধরনের রণকৌশল!’ আমরা একথার কোনো জবাব দিতে পারিনি। ২৫ তারিখ রাতে শেখ সাহেবের পাক সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের সমর্থনে আমরা কোনো যুক্তিই দেখাতে পারিনি। ইন্দিরা গান্ধি যখন বারে বারে বলছিলেন, ভু-ভারতে কে কোথায় শুনেছে যে, যুদ্ধ আরম্ভ করে সেনাপাতি শত্রু পক্ষের হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দেয়? আপনরা প্রথম প্রথম বলেছিলেন তিনি ২৫ মার্চ রাতেই গৃহত্যাগ করেছেন এবং সহসাই আপনাদের সাথে মিলিত হবেন। পরে দেখা গেল, আপনাদের সে কথা ঠিক নয়। তিনি স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন, এটা যুদ্ধের কোন ধরনের কৌশল আমাকে বুঝিয়ে বলুন।” [ঢাকা আগরতলা মুজিব নগর, এম এ মোহাইমেন, পৃষ্টা-৬৪] খন্দকার মোশতাক ও তাজউদ্দীন সাহেবরা ইন্দিরা গান্ধীর এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন সময়ের আওয়ামী লগি এম. পি জনাব মোহাইমেন তার ‘ঢাকা আগরতলা মুজিব নগর’ গ্রন্থে ইন্দিরা গান্ধির এ বক্তব্য উদ্ধৃত করে নিজেই এর জবাবটা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “শেখ সাহেবের এভাবে সেদিন রাতে ধরা দেয়াকে আমি কোনো দিন মনের সাথে যুক্তি দিয়ে খাপ খাওয়াতে পারিনি। অন্যেরা যে যাই বলুক আমার নিজের ধারণা, আওয়ামী লীগর নেতারা তাজউদ্দীন সাহবের নেতৃত্বে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করে এভাবে দেশ স্বাধীন করবে এটা ভাবতে পারেননি। তাঁর ধারণা ছিলো, পাকবাহিনী অল্প কিছু দিনের মধ্যেই অবস্থা আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারবে। বেশ কিছু নেতা ও উপনেতাকে হত্যা করবে। দশ-বিশ হাজার কর্মীকেও হত্যা করে সাময়িকভাবে দেশের আন্দোলন স্তব্ধ করেদিলেও শেষ পর্যন্ত রাখতে পারবে না। আগরতলা কেসেরসময তাঁকে যেভাবে দেশের মানুষ আন্দোলন করে জেল থেকে বের করে এনেছিলো, সেভাবে দু তিন বছর পরে তুমুল আন্দোলনের ফলে পাকিস্তান সরকার তাঁকে মুক্তি দিয়ে ক্ষমতা তার হাতে অর্পণ করতে বাধ্য হবে।’ [ঢাকা আগরতলা মুজিব নগর, এম এ মোহাইমেন, পৃষ্টা-৬৫] অর্থাৎ শেখ মুজিব ২৫ মার্চের রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত জেনারেল পীরজাদার টেলিফোনের অপেক্ষা করেছেন শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে এ আশায়। আবার তিনি স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরণ করলেন জনগণকে অসহায় রেখে তাও একদিন তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে এ দৃঢ় আশাতেই। সুতরাং তাঁর মাথায় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধের কোনো চিন্তা ছিলো না। ছিলো না বলেই তিনি কোনো প্রস্তুতি [“আওয়ামী লীগের আইন অমান্য অভিযান দর্শনীয় হলেও ওতে সাফল্যৈর অপরিহার্য উপাদানের অভাব ছিলো। সর্বাধিক চাপ সৃষ্টি, কিন্তু সর্বনিম্ন প্রস্তুতি এমন একটা ভুল ছিলো যার মাশুল অনেক।” –(বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের উতিহাস, মাহবুবুল আলম, পৃষ্ঠা-৪০)] নেননি। ভারতের সাথে যোগাযোগ করতে গিয়েও করেননি [মূলধারা, ’৭১, -মঈদুল হাসান, পৃষ্ঠা-১০] এবং নেতৃবৃন্দকে ঢাকার আশেপাশেই আত্মগোপন করতে বলেছেন, [তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সাক্ষাতকার, সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ এবং মূলধারা, ’৭১, মঈদুল হাসান, পৃষ্ঠা-৮-৯)Bangladesh Constitutional quest for Autonomy Maudud Ahmed, Page-248] ভারত যাবার নির্দেশ কাউকেই তিনি দেননি। হতে পারে ভারতের প্রতি এটা তাঁর আস্থার অভাব। [লক্ষণীয়, স্বাধীনতার পর দেশে ফিরেও শেখ মুজিব ভারতকে আমল দেননি, ভারতের বড় ভাই গিরীকে বরদাশত করতে চাননি। মুজিবনগর সরকার ভারতের সাথে যে গোপন অপমানকর চ ুক্তি করে, মুজিবই দেশে ফিরে তা অগ্রাহ্য করেন। এজন্যে কেউ কেউ ১৬ ডিসেম্বরের বদলে শেখ মুজিবের দেশে ফেরার দিন ১০ জানুয়ারীকে বিজয় দিবস বলতে চান। সাংবাদিক (বর্তমানে ‘মানব জমীন’ সম্পাদক) মতিউর রহমান চৌধুরী লিখছেন:
“ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন ১৬ ডিসেম্বর ইস্টার্ণ কমাণ্ড দিবস হিসেবে পালন করে, তখনই বুঝতে কষ্ট হয় না তারা কি চেয়েছিলো? আমরা ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসেবেই পালন করে আসছি। আমরা মনে করি এ দিনই আমরা হানাদারমুক্ত করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। বাস্তব অবস্থাও তাই। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় আসলেই কি আমরা পুরোপুরি মুক্ত হয়েছিলাম? ….. ইতিহাস নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখা যায় ভারতের সাথে সাত দফা ভিত্তিক যে চুক্তি হয়েছিলো, তাতে বাংলাদেশকে স্বাধীন ভাবা দুস্কর হতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশে ফিরে না এলে কি হতো তারই আলোকপাত করছি এ প্রতিবেদনে।…… বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সবকিছু উড়িয়ে দিলেন। বললেন, এ চুক্তি আমি মানি না। কার্যত অগ্রাহ্য করলেন চুক্তিটি। একে একে সব সিদ্ধান্ত বাতিল করতে লাগলেন। ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চলে যেতে বললেন। ভারত তাদের অফিসারদের প্রত্যাহার করে নিলো। তিন মাইলের মধ্যে অবাধ বাণিজ্যের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিলেন। রক্ষী বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত মানলেন। তবে সেনাবাহিনী রাখার পক্ষে মত দিলেন। এ নিয়ে মন্ত্রী পরিষদে এক বৈঠকে তুমুল বিতণ্ডা হয়েছিলো। এক পক্ষ বলেছিলেন অতীত অভিজ্ঞতার কারণে সেনাবাহিনী রাখার দরকার নেই। শেখ সাহেব এ যুক্তি খণ্ডন করে বললেন, তোমরা কি বলতে চাও বুঝি না। একটি স্বাধীন দেশে লেফট-রাইট শুনবো না তা হয় না। সেনাবাহিনী থাকবে। পাকিস্তান থেকে আমাদের অফিসারদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছি। তাজউদ্দীন আহমদসহ আরও কয়েকজন বিরক্ত হলেন। দিল্লী নাখোশ হলো। ভারতীয় জেনারেলরা অনেকটা প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।
ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার নিয়ে শেখ সাহেব মিসেস গান্ধীকে এক বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলেছিলেন কলকাতার গবর্নর হাউসে। মিসেস গান্ধীর সাথে কথা হচ্ছে নানা বিষয়ে। পাশে ভারতের সমরনায়করা উপস্থিত। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিনটিতে শেখ সাহেব হঠাৎ বললেন, আমি একটি কথা বলতে চাই, …… আপনি কবে আপনার সৈন্য আমার দেশ থেকে ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আমাকে অনেক কথা শুনতে হচ্ছে এজন্যে। মিসেস গান্ধী জেনারেল মানেকশ’র দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন, আপনি যেদিন বলেন সেদিনই।……. ভারতের সাবেক প্রেসিডেণ্ট জৈল সিং সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা ঠিক হয়নি। মিসেস গান্ধী শেখ সাহেবের অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তার কারণে চটজলদি সম্মতি দিয়েছিলেন।…… পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও শেখ সাহেব ভারতের চাপিয়ে দেয়া নীতি মেনে নেননি। ইসলামী সম্মেলন সংস্থার লাহোর শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। ভারত চায়নি শেখ সাহেব লাহোর যান। মন্ত্রী পরিষদ বৈঠকে ভিন্নমতও ছিলো। শেখ বলেছিলেন, আমি লাহোর যাব এবং ও আই সি’র সদস্য পদ লাভ করবো। কে কি বললো তাতে কিছু যায়-আসে না। (দিল্লীর) সাউথ ব্লকের একজন কর্মকর্তা মন্তব্য করেছিলেন, শেখ মুজিব বড় বেশী বাড়াবাড়ি করছেন। শেখ সাহেবকে যখন এ মন্তব্য অবহিত করা হলো তখন শেখ বলেছিলেন, সবে তো শুরু, ওরা কি পেয়েছে?
১০ জানুয়ারী থেকেই ভারত বিরক্ত হতে থাকে। শেখ সাহেব যেদিন নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকা এলেন সেদিন পাকিস্তান থেকে শেখ সাহেব প্রথমে গেলেন লণ্ডন। তারপর দিল্লী হয়ে ঢাকা। দিল্লী যখন এলেন, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী খবর পাঠালেন, শেখ সাহেব যেন বৃটিশ এয়ার ফোর্সের বিমানে ঢাকা না যান। তিনি যেন ভারতীয় বিমানে যান এই ছিলো অনুরোধ। ভারত বললো, বৃটিশ সরকার যেখানে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, সেখানে শেখ সাহেব কি করে তাদের বিমানে ঢাকা যান। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদ শেখ সাহেবকে ভাতের এ ইচ্ছার কথা যখন জানালেন, তখন শেখ সাহেব কোনো চিন্তা-ভাবনা না করেই বললেন, আমি বৃটিশ বিমানেই যাব। ওদের বলে দিন আমার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। এতে কোনো হেরফের হবে না।
১০ জানুয়ারী প্রতি বছরই আসে। আওয়ামী লগি দিবসটি পালন করে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে জনসভা করে, নেতারা নরম-গরম বক্তৃতা দেন। কিন্তু একবারও বলেন না বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না হলে কি হতো বাংলাদেশের অবস্থা। আমার মতে ১০ জানুয়ারী হওয়া উচিত বিজয় দিবস।…… ২৫ বছরের চুক্তি নিয়ে কথা হয় যখন-তখন। আসলে এ চুক্তিতে তেমন কিছু নেই। চুক্তি ছিলো ১৯৭১ সালের অক্টোবরে। যা কার্যকর হলে বাংলাদেশ হতো আরেক সিকিম। এ চেষ্টাও যে হয়নি তা বলা যায় না। ১৯৭১ সনের ২৮ ডিসেম্বর তিনজন সংখ্যালঘু নেতা মিসেস গান্ধীর সাথে দেখা করে বাংলাদেশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনজন হলেন মনোরঞ্জন ধর, প্রয়াত ফনিভুষন মজুমদার ও বর্তমান ভারত প্রবাসী চিত্তরঞ্জন সুতার।” –(শেখ মুজিব চুক্তিটি অগ্রাহ্য করলেন’ –মতিউর রহমান চৌধুরী : নঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত, বাড়ী ৫০ সড়ক ২ এ ধামণ্ডি থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘কাগজ’ ৯ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ১১ জানুয়ারী, ১৯৯০) অতএব যে স্বাধীনতার চিন্তা শেখ মুজিব করেননি, সে স্বাধীনতার ডাক তিনি দেবেন কেমন করে? তাই স্বাধীনতার ডাক শেখ মুজিব তরফ থেকে আসেনি। তাঁর তরফ থেকে ডাক না আসা জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে, বিভক্ত করেছে। পাকিস্তান সরকার এর সুযোগ গ্রহণ করেছে এবং ভারত সরকার দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে থেকেছে। শেখ মুজিব পাকিস্তান সরকারের হাতে থাকায় সম্ভবত শেখ মুজিবের মনোভাব দেশের জনগণ জানার ফলে পাকিস্তান সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভারতের ষড়যন্ত্র বলে চালানোর সুযোগ পেয়েছে বেশী যা ব্যাপকভাবে বিভ্রান্ত করেছে দেশের মানুষকে। শেখ মুজিব স্বাধীনতার প্রস্তুতি নিলে, সবাইকে আস্থায় আনার চেষ্টা করলে এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করলে, স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপ ভিন্নতর হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের তখন দলীয় রূপ থাকতো না, সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি হতে কম পারতো এবং জাতীয় মত-বিভক্তি এভাবে ঘটতো না।
(গ) স্বাধীনতা ঘোষণায় কম্যুনিস্টট ও সমাজতান্ত্রীদের অগ্রণী ভূমিকা ইসলামপন্থী মহলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের পরিচাণা করে।
এ অসহযোগ আন্দোলনের টার্গেট ছিলো নিঃশর্তভাবে নির্বাচন বিজয়ী সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর যাতে আওয়ামী লগি ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে দেশ শাসন করতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা করছিলো, তখন কিছু দল ও গ্রুপ স্বাধীনতার ডাক দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে দিয়েছিলো। কয়েকটা দৃষ্টান্ত:
১৯৭১ সালের ২ মার্চ ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিপ্লবী পরিষদ’ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যে একটা খোলা চিঠি প্রচার করে। তাতে বলা হয়: “পূর্ব বাংলার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। পূর্ব বাংলার কৃষক শ্রমিক প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সম্বলিত স্বাধীন গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলা অস্থায়ী সরকার কায়েম করুন। প্রয়োজন বোধে এ সরকারের কেন্দ্রীয় দফতর নিরপেক্ষ দেশে স্থানান্তর করুন। ….. পূর্ব বাংরার জাতীয় মুক্তি বাহিনী গঠন এবং শহর ও গ্রামে জাতীয শত্রু খতমের ও তাদের প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের আহ্বান জানান।” তাদের শ্লোগান ছিলো: “পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা-জিন্দাবাদ, পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী ও তার দালালদের খতম করুন, গ্রাম শহরে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করুন।” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৬৩-৬৬৫] ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ তার পল্টনের জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ প্রস্তাবে বলা হয়: “এ সভা পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকদের কবল হইতে মুক্ত হইয়া স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিয়া স্বাধীন বাংলাদেশে কৃষক শ্রমিক রাজ কায়েমেরশপথ গ্রহণ করিতেছে।” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৬৬] এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ’ এর যে ঘোষণা ও কর্মসূচী প্রচার করে তার অংশবিশেষ এই:
“৫৪ হাজার ৫ শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের জন্যে আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম হবে ‘বাঙলাদেশ’। স্বাধী ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে নিম্নলিখিত তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
“(১) স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাঙলাদেশ’ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালী জাতি সৃষ্টি ও বাঙালীর ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
(২) স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাঙলাদেশ’ গঠন করে অঞ্চলে অঞ্চলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসনকল্পে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক, শ্রমিক রাজ কায়েম করতে হবে।
(৩) বাঙলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালিনার জন্যে নিম্নলিখিত কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে।
(ক) বাঙলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা, শহর ও জেলায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করতে হবে।
(খ) স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলাদেশের জাতীয সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাঙলা আমি তোমায় ভালোবাসি….’ সংগীতটি ব্যবহৃত হবে।” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৬৭-৬৬৮]
ইশতিহারটি প্রচারিত হয় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর নামে।
স্বাধীন সার্বভৌম শোষণমুক্ত বাংরাদেশের জাগ্রত লেখক শিল্পীদের মুখপাত্র বলে কথিত ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ প্রকাশিত ‘প্রতিরোধ’ (দ্বিতীয সংখ্যা) এ বলা হয়: “আমরা বাংলাদেশের জাগ্রত শিল্পী-সাহিত্যিকদের জাগ্রত বিবেক থেকে আজ এ ঘোষণাই করছি, বাঙালী আর মোহাচ্ছন্ন থাকবেন না। শোষণহীন, রোদনহীন, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ কায়েম করে বাঙালী আজ নিজের অধিকার পতিষ্ঠিত করবেই করবে। সাথে সাথে আমরা বাঙলাদেশের সকল রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি এ হুশিয়ারী উচ্চারণ করছি যে, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আমরা আপনাদের রূপ দেখতে চাইনে। বাঙলার স্বাধীনতার বিপক্ষে যে কোনোরূপ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে জনগণের হাত থেকে আপনাদের নিস্তার থাকবে না।…… স্বাধীন সার্বভৌম শোষণমুক্ত বাঙলাদেশ জিন্দাবাদ। পরিষদ বৈঠক বর্জন করো, বাঙলাদেশ ‘স্বাধীন করো।” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৯৩-৬৯৪]
‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংরা সমন্বয় কমিটি’ কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপনের উদ্দেশ্যে গেরিলা যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে তাদের ইশতিহারে বলা হয়: “পূর্ব বাংলার মাটি আজ রক্ত চায়। পূর্ব বাংলার কোটি কোটি মানুষ আজ স্বাধীনতার জন্য উন্মাদ হইয়া উঠিয়াছে। আমরা পূর্বেই বার বার বলিয়াছি যে, নির্বাচনের মাধ্যমে আপোসে বাংলার স্বাধীনতা আসিবে না- আসিবে না পূর্ব বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত তথা সমগ্র জনতার মুক্তি। মুক্তির একমাত্র পথ সশস্ত্র বিপ্লব। তাই আজ এক মুহূর্তও দেরী করার সময় নাই। পূর্ব বাঙলার মাটি আজ রক্ত চায়। তাই পূর্ব বাঙলার কৃষক গ্রামে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করো। শাসক গোষ্ঠীর হাত হইতে ক্ষমতা ছিনাইয়া লও। গ্রামে বাংলার স্বাধীনতার পতাকা উড়াইয়া দাও। মুক্ত এলাকা গঠণ করো।
আস, আমরা ঘোষণা করি, হুশিয়ার! পূর্ব বাংরার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে যাহারা বাধা প্রদান করিবে কিংবা যাহারা তাহাকে মাঝ পথে থামাইয়অ দিতে চাহিবে তাহাদের আমরা কিছুতেই ক্ষমা করিব না বরদাশত করিব না।” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৯৬]
ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে ৮ মার্চ (১৯৭১) তাদের এক প্রচার পত্রে বলে: “সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে- ঘরে ঘরে আজ উড়ছে স্বাধীন বাঙলার পতাকা। ….. বাঙলার সাড়ে সাত কোটি জাগ্রত স্বাধীনতাকামী ভাইবোনদের নিকট আমাদের আকুল আবেদন, টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত বাঙলার প্রতিটি ঘরে ঘরে মাতৃভূমি বাঙলাকে স্বাধীন করার যে দুর্জয় প্রতিজ্ঞা গর্জে উঠেছে তাকে যে কোনো মূল্যে বাঁচিয়ে রেখে ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাঙলদেশ’ গঠন করতে হবেই। এরই প্রেক্ষিতে সর্বস্তরে ‘বাঙলা মুক্তিফ্রন্ট’ (Bengal Liberation Front) গঠন করুন, গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে মুক্তিফৌজ গড়ে তুলূন আর স্বাধীনতা সংগ্রামকে সঠিক গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলুন। [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭০৫-৭০৬
পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। তাদের প্রচারপত্রে বলা হয়: “বাংলাদেশের জনগণ আজ গণতন্ত্র ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে এখানে পৃথক ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েম করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছেন।
পূর্ব বাংলা কম্যুনিস্টরা দীর্ঘকাল হইতেই বাঙালীসহ পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষী জাতির বিচ্ছিন্ন হইয়া পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার তথা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার দাবী করিয়া আসিতেছে। ঐক্যবদ্ধ গণশক্তি ও জনতার সংগ্রামের জোরে গণ দুশমনদের ও উহাদের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করিয়া এখানে জনগণের দাবী মতে ‘স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলা’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অগ্রসর করিয়া লইতে হইবে।…… এজন্য পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে, কল-কারখানা সর্বত্র দলমত নির্বিশেষে সমস্ত শক্তি নিয়া গড়িয়া তুলুন স্থানীয় সংগ্রাম কমিটি ও গণবাহিনী।…….” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭০৯-৭১১]
ছাত্র ইউনিয়ন স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েমের আহ্বান জানায় ১৯৭১ সালের ১১ মার্চ। ছাত্র ইউনিয়ন প্রচারিত ‘শোষণমুক্ত স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েমের সংগ্রাম আরও দুর্বার করিয়া তুলুন’ শীর্ষক প্রচারপত্রে বলা হয়: “অনেক ঘটনার ঘাত ও প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাত কোটি জনতা আজ পূর্ব বাংরায় তাহাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার কায়েম করিতে চাহিতেছেন, চাহিতেছেন একটি স্বাধীন-স্বার্বভৌম স্বতন্ত্র রাষ্ট্র কায়েম করিতে। এই চন্য জনগণ আজ অকুতোভয় জীবন মরণ সংগ্রামে লিপ্ত হইয়াছেন।……. আমাদের দেশ মাতকার উপর হইতে বৃটিশ, আমেরিকা প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের যে কোনো শোষণ ও প্রভাব লুপ্ত হইবে, কৃষকদের উপর হইতে জোতদার মহাজনদের সামন্তবাদী শোষণ উচ্ছেদ হইবে, দেশের জনগণকে পুনরায় পুঁজিবাদী শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হইতে হইবে না। সকল প্রকার শোষণমুক্ত বাংলাদেশের জনগণের জাতীয গণতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলা কায়েমের লক্ষ্য সামনে রাখিয়া বর্তমান সংগ্রামকে অগ্রসর করিয়া লইবার আহ্বান আমরা জানাইতেছি।….. [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৩৩-৭৩৪]
উপরোক্ত দৃষ্টান্তসমূহের গ্রুপ ও দলগুলো যারা আওয়ামী লগের অসহযোগ আন্দোলনের সমান্তরালে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্যে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলো, তারা কম্যুনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, বামপন্থী বলে পরিচিত ছিলো। এদের মধ্যে ছাত্র লীগই একমাত্র গ্রুপ যার বামপন্থী পরিচয় ছিলো না। কিন্তু তারাও তাদের স্বাধীনতা ঘোষণার ইশতিহারে সমাজন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দেয়। সুতরাং অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে স্বাধীনতা ঘোষণাকারী সকলেই ছিলো বাম শিবিরের। এরা ছিলো দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনতার চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার পরিপন্থী শক্তি। আর ইসলামপন্থী দল ও গ্রুপগুলোর সাথে ছিলো এদের চরম বৈরিতা। ইসলামপন্থী দল ও গ্রুপগুলোর কাছে এরা ছিলো বিজাতীয আদর্শ ও বিদেশী শক্তির এজেণ্ট। সুতরাং এদের উদ্দেশ্যকে সন্দেহের চোখে দেখা এবং তার বিপরীত অবস্থানে গিয়ে দাঁড়ানো ইসলামপন্থী দল ও জনতার জন্যে ছিলো স্বাভাবিক। তার উপর আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনের সাথে বামপন্থীদের আন্দোলন ছিলো সুস্পষ্ট পার্থক্য। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লগি চাচ্ছিল তাদের হাতে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতার হস্তান্তর যাতে ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা ও দেশ শাসন করা যায়। আর ওরা চাচ্ছিলো স্বাধীনতা যার আদর্শিক ভিত্তি ওরা দাবী করছিলো সমাজতন্ত্র হবে। এমনকি স্বাধীনতা ঘোষণা প্রশ্নে “ছাত্র লীগের সমাজতন্ত্র প্রভাবিত ছাত্র তরুণদের আন্দোলনের সাথে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের আন্দোলনের সুস্পষ্ট পার্থক্য সূচিত হয় ৩রা মার্চ থেকে। জনাব কামরুদ্দীন আহমদ এ দৃশ্যটি তার গ্রন্থে সুন্দর করে ধরে রেখেছেন। তিনি লিখেছেন:
“শেখ সাহেবের ৩ মার্চের বক্তৃতার পর ছাত্র নেতৃবৃন্দ তাঁকে তাদের মিছিলে শরিক হবার জন্যে অনুরোধ করলো। শেখ সাহেব সবাইকে জানিয়ে দিলেন যে, ৭ মার্চ তারিখ তিনি রেসকোর্স ময়দানে জনসভা ডেকেছেন। ঐ জনসভায় তিনি তাঁর পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করবেন। তার আগে তাঁর পক্ষে ৩ মার্চের মিছিলে যোগ দেয়া সম্ভব হবে না। চরমপন্থী ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দ তাঁর এ সিদ্ধান্তকে দুর্বলতা বলে মনে করলো। ছাত্ররা তখন ছাত্র সংগ্রামের কেন্দৃবিন্দু সার্জেণ্ট জহুরুল হক হলে তাদের প্রধান কার্যলয় স্থানান্তরিত করলো। ফলে ঐ তারিক থেকেই আন্দোলন দুটোর ধারায় বইতে শুরু হলো। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে সার্জেণ্ট জহুরুল হক হলের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয় স্বাধীনতার জন্যে সর্বাত্মক লড়াই এর প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। অন্যদিকে শেখ সাহেবের নিজের বাড়ীতে অহিংস ও অসহযোগ নীতির ভিত্তিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। অসহযোগ নীতির ভিত্তিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়অর সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। অসহযোগ নীতির ভিত্তিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। অসহযোগ আন্দোলনের নির্দেশ দেয়া হতো শেখ সাহেবের ধানমণ্ডীর বাড়ী থেকে, কিন্তু স্বেচ্ছাসেবগণ কাজের নির্দেশ পেতো জহুরুল হক হল থেকে। শেখ মুজিবকে যদিও ছাত্ররা বিপ্লবের প্রতীক বলে মনে করতো, কিন্তু তারা তাদের নিজস্ব কর্মপদ্ধতিই অনুসরণ করতো।” [স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর, কামরুদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা-১০৮]
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সেই সময়ের আন্দোলণ বামপন্থী ও চরমপন্থীদের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন এ দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে এই দুই ধারার মধ্যে দল-মত নির্বিশেষে সকলে অসহযোগ আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলো। তারা শেখ মুজিবকেই চিনতো, শেখ মুজিবকেই মানতো এবং নির্দেশের জন্যে তাঁরই মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। বিশেষ করে বামপন্থীদের বৈরী ইসলামপন্থী দল, গ্রুপ ও জনতার জন্যে একথা ছিলো আরও বেশী সত্য। নিঃশর্ত ক্ষমতা হস্তান্তর ভিত্তিক অসহযোগ আন্দোলনের মোকাবিলায় বাম ও চরমপন্থীদের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণাকে তারা বিদেশ ও বিজাতীয় ষড়যন্ত্র বলেই ধরে নিয়েছিলো। [তাদের ঐ সময়ের এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরের বিবৃতি-বক্তব্য দ্রষ্টব্য, যাতে স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিদেশী ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।] আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিব এ ধারণা ভাঙার কোনো চেষ্টা করেননি এবং পৃথক দুই ধারাকে এক করে গেলেন না তিনি শেষ পর্যন্তও। স্বাধীনতা ঘোষণা না করে এবং অবশেষে ক্ষমতা তাঁর হাত হস্তান্তর হবেই- এ আশা নিয়ে তিনি স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরণ করলেন। সেই সময়ের জন্যে নেতৃত্বের এটা ছিলো সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। [“জাতির জন্যে স্বাধীনতা অর্জনই যদি শেখ মুজিবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে ৭ মার্চের অমন জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রদানের পরে তিনি কি করে শত্রু পক্ষের সাথে বৈঠকের আশা পোষণ করেছিলেন? পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল সামরিক সরকার প্রধান ইয়াহিয়া খানের সাথে স্বাধীনতা ঘোষণার পরে পুনরায় শেখ মুজিব কেন বৈঠকে বসতে চেয়েছিলেন? স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণাকারী শেখ মুজিবের কি ধরনের প্রত্যাশা ছিলো জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে? ‘যার যা আছে তাই নিয়ে জাতিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ প্রদান করার পরে কোন্ ভরসায় জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে আপোস রফার আলোচনার টেবিলে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন? তাহলে কি শেখ মুজিব স্বাধীনতা চাননি? তিনি কি চেয়েছিলেন পাকিস্তানী প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদে পৌঁছতে? জাতিকে চূড়ান্ত ত্যাগের জন্য নির্দেশ দিয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোনো ত্যাগের প্রস্তুতি না নিয়ে ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত কেনইবা শত্রু পক্ষের সাথে বৈঠকের চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। এখানেই খুজঁজতে হবে শেখ মুজিবের নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণ। ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ‘মুক্তির সংগ্রাম’ এ ধরনের মন্তব্য করতে যেমন তাঁর বাধেনি, তেমনি বাধেনি মুক্তির সংগ্রাম ঘোষণা করার পরেও শত্রু পক্ষের সাথে আলোচনার টেবিলে বসার জন্যে অপেক্ষা করতে।……, তখনকার ছাত্র নেতৃত্বের চাপেই শেখ মুজিব ৭ মার্চ ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এ ধরনের ঘোষণা তিতেও বাধ্য হয়েছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে এক বৈঠকে তিনি প্রকাশ্যে বলেও ফেলেছিলেন, ‘আমি যদি আপনার কথামতো কাজ করি, তাহলে ছাত্র নেতারা আমাকে গুলী করবে, আর যদি আমি ছাত্র নেতাদের কথামতো চলি, তাহলে আপনি আমাকে গুলী করবেন, বলুন তো এখন আমি কি করি।’ শেখ মুজিব তাঁর নেতৃত্বের অসহায় ও করুণ অবস্থায়ই ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর উপরোক্ত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে।….. শেখ মুজিব একদিকে ছাত্র নেতৃত্বের কাছে নতি স্বীকার করে স্বাধীনতার পক্ষে যেমন কাজ করেছেন, ঠিক তেমনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন, পাকিস্তানকে রক্ষা করতে।” –(অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, মেজর (অব) এম এ জলিল, ১১-১২)] এ ব্যর্থতাই বিভ্রান্তির কুয়াশাকে ঘনীভূত করে। দেখা গেলো, শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার পর যে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো তাকে ইসলামপন্থী দল ও গ্রপরা বিদেশ ও বিজাতীয় আদর্শের ষড়যন্ত্র হিসেবেই চিহ্নিত করছে। [“১৯৭০-এর নির্বাচনের দীর্ঘ অভিযানে শেখ মুজিব প্রায় প্রতিটি নির্বাচনী জনসভায় জনগণকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ‘আমরা ইসলাম বিরোধী নই’ এবং ‘আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চাই না।’ জনগল তাকে ভোট দিয়েছিলেন তাদের অধিকার আদায়ের জন্যে। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কোনো ম্যাণ্ডেট তিনি নেননি। নির্বাচনের পরেও এ জাতীয় সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা তিনি দেননি। তাই ১৯৭১ এ যারা বাংলাদেশের আন্দোলনে শরিক হয়নি তারা দেশের স্বাধীনতার বিরোধী ছিলো না। ভারতের অধীন হবার ভয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের খপ্পরে পড়ার আশংকাই তাদেরকে ঐ আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করেছিলো।…… নিজ দেশের কল্যাণ চিন্তাই তাদেরকে এ ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছিলো।” পলাশী থেকে বাংলাদেশ, অধ্যাপক গোলাম আযম, পৃষ্ঠা-২৬]
“ভারতের সাহায্যে দেশ স্বাধীন হোক এটা এদেশের অনেকেরই কাম্য ছিলো না।….. এদেশের অধিকাংশ লোকের ধারণা ছিলো যে, ভারত মনে-প্রাণে পাকিস্তান ও পাকিস্তানের মুসলমানদের মঙ্গল কোনো দিন চায়নি। শুধু পাকিস্তানকে ভাঙ্গার লক্ষ্যেই তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে এতো সাহায্য করেছিলো, এ দেশের লোকের সত্যিকার মুক্তির জন্যে সাহায্য করেনি।…… যখন বাংলাদেশ হয়, তখন দেশের অধিকাংশ লোরে মনোভাবই এরূপ ছিলো” স্বাধীনতা উত্তর জাতীয সংসদে আওয়ামী লীগ সদস্য জনাব মোঃ আবদুল মোহাইমেন লিখিত ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ’, পৃষ্ঠা-২৭[ ২৫ মার্চ পর্যন্ত একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি এভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়লো জাতির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক ইস্যুতে।
যারা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়নি তাদেরও এ সিদ্ধান্তের মূলে আওয়ামী লীগের আচরণ সম্পর্কে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা, বামপন্থীদের মতলব সম্পর্কে সন্দেহ ও ভয়, শেখ মুজিব কিছু না বলা ও তার অনুপস্থিতিসহ শুরু হওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে বিভ্রান্তি এবং অন্যদের মতো স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে ভারত গমনে তাদের অসুবিধা প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে যার ফলে জাতির ঐতিহাসিক এবং বেদনাদায়ক বিভক্তি আরও স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। কারণগুলোর বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নিম্ন বিষয়সমূহ সামনে আসতে পারে:
(খ) প্রথমেই তাদের আওয়ামী লীগ ও ভারতভীতি এবং পাকিস্তান প্রীতির কথা ধরা যাক। মুসলিম লগি থেকে শুরু করে সবগুলো ইসলামপন্থী দল, গ্রুপ এবং উল্লেখযোগ্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব রাজনৈতিক ও আদর্শিক মতপার্থক্যের কারণে আওয়ামী লীগকে সবসময় ভয় ও সন্দেহের চোখে দেখে আসছে। জন্মের সময় থেকেই আওয়ামী লীগের সাথে মুসরিম লীগের বিরোধ। এ বিরোদের কারণ কিছুটা রাজনৈতিক, কিছুটা আদর্শিকও। আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগের ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বি হওয়া ছাড়াও কিছুটা বামঘেষা, স্বায়ত্ব শাসনের পক্ষপাতি ধর্মনিরপেক্ষ এবং কিছুটা ভারতমুখী। অন্যদিকে মুসলিম লীগ শক্ত কেন্দ্রের নামে স্বায়ত্তশাসনের বিরোধী এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পক্ষপাতী। আর জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি প্রভৃতি ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দী ছিলো না। তাদের বিরোধ ছিলো মূলতই আদর্শিক। পঞ্চাদশের দশকে জামায়াতে ইসলামী যুক্ত নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। আর আওয়ামী লগি করেছে যুক্ত নির্বাচনকে সমর্থন। এখানে জামায়অতে ইসলামীর বিবেচ্য ছিলো মুসলিম স্বার্থ, আর আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক স্বার্থের দিকটাই বিবেচনা করেছে। জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি প্রভৃতি ইসলামী দল পঞ্চাশের দশকে ইসলামী শাসনতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছে। আর আওয়ামী লীগ তার উপর বাম প্রভাব এবং ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভংগির কারণে এ আন্দোলনে তীব্র বিরোধিতা করেছে। এভাবে ষাটের দশকে আওয়ামী লগি ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতর বিরুদ্ধে কথা না বলা, ছয় দফা দাবী উত্থাপন এবং সর্বশেষে ’৬৯ সালের সর্বদলীয় আন্দোলনের ফলকে একা কুক্ষিগত এবং অন্যদল বিশেষ করে ইসলামপন্থী দরসমূহকে মাঠ থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা আওয়অমী লীগ সম্পর্কে ইসলামপন্থী দলসমূহের সাথে আওয়ামী লীগের অদৃশ্য যোগসাজশ রয়েছে। আর তাদের কাছে ভারতের রাজনীতি মানেই হলো ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের গলা টিপে মারা। একদিকে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তাদের এ সহজাত ভয় ও সন্দেহ, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তাদেরকে বাঙালীর শত্রু মনে করার ফলে এ দুই শক্তির পক্ষে মনের দিক দিয়ে কাছাকাছি আসা সম্ভব হয়নি। এ কারণেই ইসলামপন্থী দলগুলো অসহযোগ আন্দোলন সমর্থন করলেও ২৫ মার্চের পর আওয়ামী লগি এবং অরাজনৈতিক অন্যদের মতো করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি। তারা একে জাতির বা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধই মনে করেনি, পশ্চিমবংগ ও ভারতের মুসলমানরাও সাধারণভাবে এ আন্দোলনকে মুসলিম স্বার্থ বিরোধী পাকিস্তান ভাঙ্গার আন্দোলন মনে করেছে। [ যে নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা কোলকাতায় ছিলাম, বরাবরই আমরা লক্ষ্য করেছি কোলকাতার বাঙালী মুসলমানরাও আমাদেরকে এ আন্দোলনকে খুব প্রীতির চোখেদেখেনি। এ আন্দোলনকে পকিস্তান ভাঙ্গার আন্দোলন বলেই তারা মনে করতো। তাদের ধারণা ছিলো কোলকাতায় বা পশ্চিম বংগে সাম্প্রতিক দাংগা আরম্ভ হলে কিছু দিনের জন্যে হলেও তারা হয়তো পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে। কিন্তু পাকিস্তান ধ্বংসে হয়ে গেলে তারা যে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে…….। কোলকাতার অবাঙ্গালী মুসলমানরাও মনে প্রাণে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধী ছিলো। আমাদের তারা রীতিমতো শত্রু স্থানীয় মনে করতো, বাড়ী ভাড়া করতে গিয়ে দেখেছি, যে মুহূর্তে তারা জানতে পারতো আমরা পূর্ব পাকিস্তানের লোক, তখনি বাড়ী ভাড়া দিতে অস্বীকার করতো।….. আমরা যারা সীমান্তে অপর পারে গিয়ে বাড়ী ভাড়া করে থাকবার সুযোগ পেয়েছিলাম, সেসব বাড়ী হিন্দুদেরই ছিলো।” -(ঢাকা আগরতলা মুজিব নগর’, এম এ মোহাইমেন, পৃষ্ঠা-৫৭)] অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও অন্যরা স্বাধীনতা যুদ্ধকে বাঙালী স্বার্থের জন্যে অপরিহার্য মনে করেছে। বস্তুত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অদুরদর্শিতা ও অর্বাচিনতা থেকে সৃষ্ট মুসলিম স্বার্থ ও বাঙ্গালী স্বার্থের যে একই স্বার্থ-একথা সেদিন দুই পক্ষের কেউ কাউকে বুঝাতে পারেনি। পারলে সব ইসলামপন্থী দল, গ্রুপ ও ব্যক্তিত্ব একদিকে এবং সব বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ দল ও গ্রুপ অন্যদিকে-এভাবে জাতি বিভক্ত হয়ে পড়তে পারতো না।
ইসলামপন্থী দল ও গ্রুপের পাকিস্তান প্রীতিও তাদের উপরোক্ত মানসিকতার একটি কারণ। বৃটিশ আমলে পাকিস্তান দাবী ছিলো মুসলিম স্বার্থ সুরক্ষার প্রতীক। তখন হিন্দু কংগ্রেস পাকিস্তান দাবীর বিরোধিতা করেছে, কারণ তারা মুসলিম স্বার্থের সুরক্ষা চায়নি। তাদের বিরোধিতার মধ্য দিয়েই ভারত বিভক্ত হয়েছিলো ১৯৪৭ সালে, সৃষ্টি হয়েছিলো পাকিস্তান মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসেবে। মুসলমানদের এ স্বতন্ত্র আবাস ভূমিটিকে হিন্দু কংগ্রেস সাময়িকভাবে মেনে নিয়েছিলো এ আশাতেই যে, পাকিস্তান টিকবে না।…… আবার জোড়া লাগবে বিভক্ত ভারত। হিন্দু কংগ্রেসের এ উচ্চাশার বিজয়েল মধ্যে ইসলামপন্থী দল, গ্রুপ ও জনতা অবলেকন করেছিলো তাদের আদর্শের পরাজয় এবং মুসলিম স্বার্থের বিপন্ন অস্তিত্ব। এ কারণেই তারা পাকিস্তানের অস্তিত্বকে অত্যন্ত মুল্যবান মনে করছিলো এবং পাকিস্তানের অস্তিত্বের সাথে ইসলামকে এক করে ফেলেছিলো তারা। অথচ ইসলাম ও পাকিস্তান এক জিনিস ছিলো না। ভূখণ্ডের নাম ও তার বিভাগ-বিভক্তির সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। যাই হোক, তাদের মনোভাব তাদের দৃষ্টির স্বচ্ছতা দুরদর্শিতাকে অনেকখানিই আচ্ছন্ন করেছিলো। যার ফলে তারা পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা বা পাকিস্তান বিভক্তির কথা চিন্তাই করতে পারেনি-পাকিস্তানের ঐক্যবদ্ধ কাঠামোর অধীনেই তাঁরা বিরাজিত সমস্যার সমাধান খুঁজছেন। আওয়ামী লীগের কিছু বাহ্যিক আচরণও তাঁদের এ মনোভাবকে আরও পাকাপোক্ত করে দেয়। আওয়ামী লীগের ভারত-প্রীতির সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে এক সময় এসে যুক্ত হয় ‘জিন্দাবাদ’ এর স্থলে তাঁদের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান, যা ছিলো ‘জয় হিন্দ’ এর অনুকরণ। তাছাড়া ২৫ মার্চের আগে এবং পরে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের পক্ষে এবং পাকিস্তাতেনর বিপক্ষে ভারতীয সরকারী ও বেসরকারী প্রচার মাধ্যমের ‘নগ্ন ও আপত্তিকর’ তৎপরতা আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইসলামপন্থীদের ভুল বুঝাবুঝির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আওয়ামী লগি ভীতি, ভারত ভীতি এবং পাকিস্তান প্রীতি তাঁদের মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে। এসব মিলিয়েই জাতি-বিভক্তির অবাঞ্চিত ও বেদনাদায়ক ঘটনা সংঘটিত হবার পথ প্রসারিত হয়।
(খ) ইসলামপন্থী দল ও গ্রুপের প্রতি ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী ও ক্ষমতাসীন হিন্দু কংগ্রেসের ঐতিহাসিক বৈরিতার কারণে ইসলামপন্থীদের ভারত গমন সম্ভব ছিলো না। এ কারণের শিকার হয়ে তাঁদের অনেককে মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের অভ্যন্তরে উভয় সংকটের মুকাবিলায় এক বিদঘুটে ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। [“ভারত বিরোধী ও ইসলামপন্থীরা উভয় সংকটে পড়ে গেলো। যদিও তারা ইয়াহিয়া সরকারের সন্ত্রাসবাদী দমন নীতিকে দেশের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর মনে করেন, তবু এর প্রকাশ্য বিরোধিতা করার কোনো সাধ্য তাদের ছিলো না। বিরোধিতা করতে হলে তাদের নেতৃস্থানীয়দেরকেও অন্যদের মতো ভারতে চলে যেতে হতো যা তাদের পক্ষে চিন্তা করাও অসম্ভব ছিলো।……. তারা একদিকে দেখতে পেল যে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ করে ইয়াহিয়অ সরকারকে বিব্রত করার জন্যে কোনো গ্রামে আশ্রয় নিয়ে কোনো পুল বা থানায় বোমা ফেলেছে, আর সকালে পাক বাহিনী যেয়ে ঐ গ্রামটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা রাতে কোনো বাড়িতে উঠলে পরদিন ঐ বাড়িতেই সেনাবাহিনীর হামলা হয়ে যায়। এভাবে জনগণ এক চরম অসহায় অবস্থায় পড়ে গেলো।………… ভারত বিরোধী ও ইসলামপন্থীরা শান্তি কমিটি কায়েম করে সামরিক সরকার ও অসহায় জনগণের মধ্যে যোগসূত্র কায়েম করার চেষ্টা করলেন যাতে জনগণকে রক্ষা করা যায় এবং সামরিক সরকারকে যুলূম করা থেকে যথাসাধ্য ফিরিয়ে রাখা যায়।………… একথা টিক যে, শান্তি কমিটিতে যারা ছিলেন, তাদের সবার চারিত্রিক মান এক ছিলো না। তাদের মধ্যে এমন লোকও ছিলো যারা সুযোগ মতো অন্যায়ভাবে বিভিন্ন স্বার্থ আদায় করেছে।” -(পলাশী থেকে বাংলাদেশ, অধ্যাপক গোলাম আযম, পৃষ্ঠা-১৮)] ইসলামপন্থী দল ও গ্রুপের জন্যে তখন ভারতের মাটি কেমন বিপজ্জনক ছিলো তা আওয়ামী লীগের মিত্র রাজনীতিদের অবস্থা থেকেই পরিষ্কার। ছয় দফার আন্দোলন থেকে শুরু করে অসহযোগ আন্দোলন পর্যন্ত মস্কোপন্থী ন্যাপ ও সিপিবি ছিলো আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র। এরপরও তারা ভারতে গিয়ে আওয়ামী লীগের কাছে বিমাতাসুলভ আচরণ পায় এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের মধ্যে ছয় মাসই তারা যুদ্ধে অংশ নিতে ব্যর্থ হয়। সে সময়ের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গিয়ে এক আলোচনায় বলা হয়েছে:
“পাকিস্তানী আক্রমণের মুখে ‘মস্কোপন্থী’ নেতারা প্রথম সুযোগেই কোলকাতা মুজিব নগরে সমবেত হয়েছিলেন। ১৭ এপ্রিল গঠিত অস্থায়ী সরকারের প্রতি সমর্থন ঘোষণার মধ্যে দিয়ে তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের দলীয় সংকীর্ণতার কারণে মস্কোপন্থীদের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়, তারা ‘বিস্তর দেন-দরবার’ চালাতে থাকেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিষ্ফল দেন-দরবার অব্যাহত থাকে। পরে সে পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণ ঘটিয়েছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরিস্থিতির চাপে ভারত শেষ পর্যন্ত ’৭১ সালের ৯ আগস্ট ২৫ বছর মেয়াদী ‘ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি’ স্বাক্ষর করার পর ক্রেমলিনের নায়করা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পরিস্থিতির মধ্যে ‘জাতীয মুক্তিযুদ্ধের উপাদান’ খুঁজে পান এবং ২৮-২৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মস্কো সফরকালে ব্রেজনেভ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। সোভিয়েত মনোভবের এ পরিবর্তন সার্বিকভাবে ভারত সরকারের অভ্যন্তরেও তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলেছিলো। ক্ষমতায় ডানপন্থীরা এর ফলে কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেন এবং মস্কোপন্থী কুটনীতিক ডিপি ধর বাংলাদেশ সরকারের উপর ‘মস্কোপন্থী’দের সুযোগ দানের জন্যে প্রবল চাপ সৃষ্টি করেন এবং সে কারণেই মূলত ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা অক্টোবর থেকে অস্ত্র এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলো। (এ সময়ই সিপিবি ‘পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি’ নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি’ নাম গ্রহণ করে।)। [‘ন্যাপের ৩০ বছর’, বিচিত্রা।]
মস্কেপন্থী ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের মুরব্বী মস্কো ছিলো বলেই তারা ভারত যেতে পেরেছে এবং অবশেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পেরেছে, কিন্তু অন্য রাজনৈতি দলের ভাগ্যে তা ঘটেনি। পিকিংপন্থী ন্যাপ ও কম্যুনিস্ট পার্টির দু একটি গ্রুপের দু একজন নেতাকে ভারত গিয়ে আবার ফিরে আসতে হয়েছে। কাজী জাফর আহমদ তাঁর এক সাক্ষাতকারে বলেছেন,
“সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ জুন জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণার কপি সহ আমি, রাশেদ খান মেনন এবং হায়দার আকবর খান রনো কোলকাতায় অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে সাক্ষাত করে স্বাধীনতা যুদ্ধে বামপন্থীদের অংশগ্রহণের প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করি। ধৈর্য ও সহানুভূতির সাথে বক্তব্য শুনলেও তিনি আমাদের উপর বিশ্বাস রাখতে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের মুক্তি বাহিনীতে আমাদের কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকার করন। আমরা বলি যে,
আপনি কেবল আওয়ামী লীগের সম্পাদকই নন, দেশেরও প্রধানমন্ত্রী এবং এজন্যেই জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে যে কেউকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া আপনার কর্তব্য। এ প্রসংগে জনাব তাজউদ্দীন জানান যে, তাকে সিদ্ধান্তের আগে গোয়েন্দা রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে এবং আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার অনুপস্থিতিতে নির্ভর করতে হবে ভারত সরকারের গোয়েন্দা রিপোর্টের উপর।…. আমরা মর্মাহত হয়ে ফিরে আসি। দেশে ফেরার পথে জুনের মাঝামাঝি আগরতলায় আমাকে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ আটক করে নিয়ে যায় শিলং এর ডাক বাংলায়। সেখানে আমাকে সাত দিন রাখা হয়। ……. সাত দিন ব্যাপী অবিরাম প্রশ্নের মাধ্যমে আমাকে ব্যতিব্যস্ত রাখা হয়।” [কাজী জাফর আহমদের সাক্ষাতকার, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২০১-২০২]
পিকিংপন্থী ন্যাপেরই যখন এ অবস্থা, মস্কোপন্থীদের যখন ঐ হেনস্থা এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা যেখানে মুক্তিযোদ্ধা বাছাই-এর অধিকারপ্রাপ্ত, সেখানে ইসলামপন্থী দল ও গ্রুপের লোকরা ভারত গেলে তারা কি করতে পারতো, তাদের কি অবস্থা দাঁড়াতো, তা সহজেই অনুমান করা যায়। আর এ ধরনের রাজণৈতি পরিচয়ের লোকদের জন্যে ভারত সীমান্ত অতিক্রমটাই কঠিন ছিলো। মাওলানা ভাসানীর সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনা থেকে এর একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে। মাওলানা ভাসানী আসাম সীমান্ত পার হলেন অবস্থা যাচাইয়ের জন্যে। মাওলানার মুরিদ একজন অসমীয় মুসলমান তাদেরকে একজন পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে নিয়ে গেলো। তার পরের ঘটনা এ রকম:
“বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে পঞ্চায়েত প্রধান বললেন, আপনারা কি আওয়ামী লীগের লোক?
– না
– আওয়ামী লীগের লোক ছাড়া বর্ডার পার হবার অর্ডার নাই।
– যারা রাজনীতি করেন না, তাদেরও?
– তারা বর্ডার পেরুবেন কেন?
– জান বাঁচানোর দায়ে।
পঞ্চায়েত প্রধান কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, ভোট দিয়েছেন কোন দলকে?
– আমরা ‘ন্যাপের’ লোক।
আবার কিছুক্ষণ দম ধরে থেকে তিনি বললেন, আপনারা বরং ফিরে যান। জানাজানি হলে অসুবিধা হতে পারে।
অবস্থা আঁচ করে মাওলানা সাহেবের কথা পঞ্চায়েত প্রধানের কানে তুললাম না। নানা দ্বিধাদ্বন্দ নিয়েই সামাদ সাহেবের (মাওলানার অসমীয় মুরিদ) বাড়ীতে বসলাম। মন জুড়ে একটা প্রশ্ন চেপে বসলো, পাকিস্তান দল মত নির্বিশেষে সব বাঙ্গালীকে মারছে। এমনকি সেমসাইড করে দু চারজন পাকিস্তানপন্থীও মেরেছে। অথচ ভারত কেবল আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগপন্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে। তাহলে বাকি বাঙ্গালীরা যাবে কোথায়?” [‘স্বাধীনতা ভাসানী ভারত’, সাইফুল ইসলাম, পৃষ্ঠা-৮]
অবশেষে মাওলানা ভাসানী ভারতে প্রবেশ করতে সমর্থ হন। কিন্তু প্রবেশের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী গান্ধীর বিশেষ অনুমতি গ্রহণ করতে হয়। মাওলানা ভাসানীর শিষ্য ভারতের তদানীন্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মঈনুল ইসলামের সুপারিশ ও বিশেষ অনুরোধেই ইন্দিরা গান্ধী ভাসানীর ব্যাপারে রাজী হন। [‘স্বাধীনতা ভাসানী ভারত’, সাইফুল ইসলাম, পৃষ্ঠা-১০-১১] এরপরও মাওলানা ভাসানীকে স্বাধীনতা যুদ্ধের গোটা সময়টা ভারতে বন্দী দশায় কাটাতে হয়। মাওলানা ভাসানী ভারত প্রবেশের যে বিশেষ সুযোগটা পেয়েছিলেন, ভাসানী ন্যাপের আর কোনো নেতা কিন্তু তা পাননি। বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের অভিজ্ঞতাও এখানে তুলে ধরা যায়। তিনি তার ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহীর ট্রিলজী- তারপর’ কলামে ‘শেষতক পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’ শিরোনামে লিখেন, “মে মাসে (১৯৭১) আগরতলায় যাওয়অর পরও আমি জানতাম না কোথায় যাব, কোথায় প্রকৃত আশ্রয় আর কোথায় খাব। ১১মে দুপুরে একটা ২১ জনের জীব থেকে আমাকে কম্যুনিস্ট পার্টির অফিসে নামিয়ে দেয়া হয়। পার্টি আমার শহরের উপকণ্ঠে থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করলো। এক্সরে ওখানেই। আমি ২৫শে (মার্চ) রাতে প্রেস ক্লাবে ট্যাংকের গোলায় আহত হয়েছিলাম। ……. আগরতলা থেকে ভারতীয় বিমানে গৌহটি হয়ে কলকাতায় পৌঁছাই। মিথিক্যাল মুজিব নগর শহর কলকাতা যেন আমার জন্যে ছিল না। আগরতলায় যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, তারা আমাকে (মুক্তি) বাহিনীতে নিতে অনিচ্ছুক।……. আগরতলায় অনেক অভিযোগ পেয়ে এলাম, সেখানে সবাইকে মুক্তি বাহিনীতে নেয়া হচ্ছে না। ক’জন যুবক হতাশ ও আশ্চর্য হয়ে বলছিল, তারা দেশের জন্যে জীবন দিতে এসেছে। কিন্তু কোনো অভ্যন্তরীণ কারণে অনেককে বাহিনীতে নেয়া হচ্ছে না। কেন? ব্যাপারটা রাজনৈতিক বিধায় সহজেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। একদিন সকালের দিকে আগরতলায় বন্ধুরা একদল বন্ধুকে বললো, যারা সবাই যুবক ও শিক্ষারথী, চলো, তোমাদের মুক্তিবাহিনীতে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটা স্থানীয় অস্থায়ী ক্যাম্পে থাকে এরা, সবাই প্রগতিশীল ও কম্যুনিস্ট মনোভাবাপন্ন। সেই যে তারা গাড়িতেগেল আর ফিরেনি। একটা গভীর জংগলে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এমন গুপ্ত হত্যার বিচার করার কোনো পন্থা নেই। একটা দলকেই কেবল অস্ত্র দেয়া হবে, তারাই ট্রেনিং পাবে। গোড়াতেই ষড়যন্ত্র ও বিভেদ সৃষ্টি করে রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের উপায় কি? প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের কাছে একটা স্মারকলিপি প্রদানের সিদ্ধান্ত হলো। সেই স্মারকলিপিতে প্রগতিশীল ও কম্যুনিস্টদেরম মুক্তিযুদ্ধে অবাধে যোগদানের সুযোগদানের দাবী জানানো হয়। কাজী জাফর আহমদ, রাশেধ খান মেনন প্রমুখ এ স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীকে দেন। কিন্তু তিনি প্রতিনিধিদের নানা কথার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এভাবে তিনি কোনো নির্দেশ দিতে সক্ষম নন।…… মুজিবনগর সরকারের প্রপাগাণ্ডা দফতরের সন্ধান করি। জনাব আবদুল মান্নান ছিলেন মেম্বার ইনচার্জ প্রচার দফতরের। পার্ক সার্কাসের এক গলিতে এঁদের তখন অফিস, বালূ হককক লেনে, অনেক খুঁজে বের করলাম সেই গলিটা। ২৪শে মে আমি এ বাড়িতেই উপস্থিত হই। সবাই আমাকে চিন্ল, কিন্তু কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে যেন সাহস পেল না। ব্যাপারটা রহস্যজনক মনে হচ্ছিল। মিনিট পাঁচেক পরে মান্নান সাহেব সবাইকে বললেন, চলূন যাই সময় হয়েছে। বন্ধু মুকুলসহ আরও অনেকে সেখানে ছিল, যারা আমাকে ফয়েজ ভাই বলে। কিন্তু সবাই আমাকে ত্যাগ করে বংশীবাদকের পেছনে কোথায় যেন ছুটল। আমি আমার সামান্য আস্তানায় গিয়ে ভাবলাম, মুক্তিযুদ্ধে যেতে হলে আওয়ামী লীগার হতে হবে। পরের দিন মুজিবনগর সরকারের সচিবালয়ে গিয়ে বন্ধুদের খুঁজলাম। সে সময় চারজন সেক্রেটারীর সবাই আমার পরিচিত। তাদের একজন বন্ধু নূরুল কাদেরকে বললাম সব কথা।…… ক’দিন পর আমি নূরুল কাদেরের অফিসে পুনরায় গেলাম। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, জে. ওসমানীর সাথে দেখা করবো, আমি তাঁকে চিনি। তিনি হেসে বললেন, তিনি তো নেই। তবে বসো, একজন তার অফিসার আছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলো। এই বলে তিনি অন্য কক্ষে গেলেন। একটু পরে একজন এলেন কাদেরের কক্ষে সামরিক ড্রেস পরা। কাদের বললেন, এর সাথে কথা বলো যুদ্ধে কিভাবে যাবে সে সম্পর্কে। সামান্য পরিচয়ে আমাদের হাসিমুখে কথা শুরু হলো। আমি বললাম, পথগুলো বন্ধ মনে হচ্ছে। তবু আমি অস্ত্র হাতেই মুক্তিযুদ্ধে যেতে চাই।
: ‘আপনার বয়স বাধা নয়তো?’
: ‘মুক্তিযুদ্ধে কোনো বয়সের বাধা নেই।’
: ‘আপনি কোন্ পার্টি করেন?’
: ‘কোনো পার্টি আমি করি না। পার্টির কথা উঠছে কেন? এ যুদ্ধ জনযুদ্ধ নয় কি?’
: ‘আপনি আওয়ামী লীগ করেন না কেন?’
: ‘আমি কোনোদিন বুর্জোয়া-বর্ণবাদী পার্টির সদস্য হইনি।’
: ‘ছাত্রলীগে ছিলেন না কোনো দিন?’
: ‘তাও ছিলাম না।’
: আপনি আপনার পথে যান। আমরা বিশেষ কারণে আপনাকে রিকমেন্ড করতে পারবো না।” [***১৬]
আমার মত অনুরূপ কারণেই ন্যাপ-সেক্রেটারী জেনারেল মশিয়ুর রহমান (যাদু মিয়া) কেও ভারত গিয়ে ওয়ারেন্ট –এর তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসতে হয়।[‘মাওলানা ভাসানী : রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রাম’, সম্পাদনা শাহরিয়ার কবির, পৃষ্ঠা-২৪, ২৫ অলি আহাদের মত আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ নেতারাও নিরাপত্তাহীনতার কারণ ভারত থেকে দেশে পালিয়ে আসেন। দ্রষ্টব্য : জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৫০৭]
পিকিংপন্থীরা ভারতের কাছে ইসলামপন্থী দল ও গ্রুপের চেয়ে অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য ছিলো। পিকিংপন্থীদের সাথে ভারত সরকারের বিরোধটা ছিলো রাজনৈতিক, কিন্তু ইসলামপন্থীদের সাথে তাদের বিরোধ ছিলো রাজনৈতিক ও আদর্শিক দুই-ই। এ বিরোধের জন্ম ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের আগে এবং দেশ বিভাগের পরে এ বিরোধ আরও বৃদ্ধি পায় ইসলামপন্থীদের আওযামী লীগ বিরোধিতা ও ভারত বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। সুতরাং বর্ডার পার হওয়া কিংবা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ক্লিয়ারেন্স ইসলামপন্থীদের ভাগ্যে কিছুতেই জুটতো না। যার ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিদের জন্যে করেনি। দু চারজন ইসলামপন্থী যারা এভাবে কিংবা সেভাবে ওপারে গিয়েছিলো তারা সেখানে শুধু তেষ্ঠাতে পারেনি নয়, জীবন তাদের বিপন্ন হয়েছে। [“আগরতলায় বাস ধরার জন্য মোস্তফাসহ বেরিয়ে পড়লাম। বাসে উঠে খানিকটা আসতেই হঠাৎ রাস্তার পাশে এক জায়গায় বেশ কিছু লোকের একটা জটলা চোখে পড়লো, দেখলাম কিছু লোক লম্বা একটি দাড়িওয়ালা লোককে মারধর করছে এবং লোকটি দু হাতে মার ঠেকিয়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করছে। লোকটিকে দেখে আমি চমকে উঠলাম, এ যে শেখ নুরুল্লাহ একজন মুসলিম লীগ নেতা। একে আমি বহুদিন ধরে চিনতাম।
ঘটনাটি দেখে আমি দারুণ বিচলিত হয়ে পড়লাম। একবার ভাবলাম বাস থেকে নেমে গিয়ে তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করি, কিন্তু কি করবো ভাবতে ভাবতে বাস অনেকটা পথ এসেগিয়েছে, বাস থেকে এখন নেমে পিছন দিকে ঘটনার স্থান পর্যন্ত যেতে যেতেই যা হবার হয়ে গেছে ভেবে ভারাক্রান্ত মনে গাড়ীতে চুপ করে বসে রইলাম। এ প্রভাবশালী লোকটি ফেনী কোর্টের বিখ্যাত আইনজীবী এডভোকেট শেখ অহিদুল্লাহর বড় ভাই অর্থাৎ বর্তমান এরশাদ সরকারের মন্ত্রী কর্নেল জাফর ইমামের জ্যেঠা।” –(ঢাকা-আগরতলা-মুজিবনগর’, এম. এ. মোহাইমেন, পৃষ্ঠা-৪২)]
(গ) আগেই বলেছি, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বরূপ ইসলামপন্থীদের বিভ্রান্ত করে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় প্রজাতন্ত্রী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী চরমপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে তারা ধরে নিয়েছিলো, ২৬ মার্চ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ ভারতের যোগসাজসে তারাই শুরু করেছে। এ ধারণা তাদের ঠিক ছিলো না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তা ছিলো আমাদের দেশপ্রেমিক বিদ্রোহী বাঙালী সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ, আনসারদের প্রতিরোধের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, এর পেছনে কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছিলো না। মূলত নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর আকস্মিক হামলা ও নির্বিচার হত্যার প্রতিক্রিয়া হিসাবে স্বাধীনতার দাবী রাতারাতি সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।’ [‘মূলধারা ‘৭১’, মঈদুল হাসান, পৃষ্ঠা-২৫] এ অবস্থায় একটি নিরুপায় পরিস্থিতি এবং স্বতঃস্ফূর্ত দায়িত্বানুভূতি থেকেই স্বাধীনতা ঘোষিত হয় এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। ’২৭ মার্চ সন্ধায় ৮-ইবি’র বিদ্রোহী নেতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া তাঁর প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজেকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন। এসব ঘোষণায় বিদ্যুতের মতো লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে শেখ মুজিবের নির্দেশে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালীরা স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই শুরু করেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বেতারের এসব ঘোষণার পিছনে না ছিলো রাজনৈতিক অনুমোদন, না ছিলো কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি।’ [‘মূলধারা ‘৭২’, মঈদুল হাসান, পৃষ্ঠা-৫]
এ পরিকল্পনাহীন অপ্রস্তুত অবস্থায় আমাদের বাঙালী সৈনিক পুলিশ, ইপিআর ও আনসাররা স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে। এছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্পই ছিলো না। কি নিরুপায় পরিস্থিতিতে এঁদের দ্বারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়, তা ‘মূলধারা ‘৭১’-এ এভাবে বলা হয়েছে:
“সামরিক আক্রমণের অবর্ণনীয় ভয়াবহতার ফলে সাধারণ মানুষের চোখে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও আদর্শগত অস্তিত্বের অবশিষ্ট যুক্তি রাতারাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। …… যারা আক্রান্ত অথবা বিশেষ আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়, তারা অচিরে জড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধ লড়াইয়ে।
মেজর জিয়ার ঘোষণা এবং বিদ্রোহী ইউনিটগুলোর মধ্যে বেতার যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হবার ফলে এ স্থানীয় ও খণ্ড-বিখণ্ড বিদ্রোহ দ্রুত সংহত হতে শুরু করে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িত হবার বিষয়টি এদের জন্য মূলত ছিলো অপরিকল্পিত, স্বতঃস্ফূর্ত এবং উপস্থিত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে।
বিদ্রোহ ঘোষণার সাথে সাথে পাকিস্তানী বাহিনী সীমান্ত পর্যন্ত এমনভাবে এদের তাড়া করে নিয়ে যায় যে, এদের জন্যে পাকিস্তানে ফিরে আসার পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ হয়। হয় ‘কোর্ট মার্শাল’ নতুবা স্বাধীনতা-এ দুটি ছাড়া অপর সকল পথই তাদের জন্য বন্ধ হয়ে পড়ে।” [“মূলধারা, ’৭১, মঈদুল হাসান, পৃষ্ঠা-৬-৭]
এভাবেই এক নিরুপায় পরিস্থিতে আমাদের অরাজনৈতিক ও দেশপ্রেকিম সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের দ্বারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। এঁদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিলো না, এঁদের সাথে ভারতের সাথে কোনো যোগসাজশও ছিলো না। এছাড়া দেশের হাজার হাজার অরাজনৈতিক নিরুপায় তরুণ ও যুবক নানাভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। এদেরও কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিলো না, [“ এর (ছাত্র লীগের ক্ষুদ্র অংশ ও কম্যুনিস্টদের) বাইরে যে ছাত্র সমাজ বা রাজনৈতিক সংগঠন ছিলো তাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ছিলো গতানুগতিক দেশ প্রেমিকদের দায়িত্ব স্বরূপ, ……….. নির্দিষ্ট চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, অন্যান্য চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী ইত্যাদি মহলের ক্ষেত্রেও একথাই প্রযোজ্য। এদের মধ্যে আবার অনেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে নিতান্তই বাধ্য হয়ে- প্রাণ বাঁচানোর তাকিদে, কেউ কেউ করেছে সুবিধা অর্জনের লোভ-লালসায়, কেউ করেছে পদ-যশ অর্জনের সুযোগ হিসেবে, কেউ করেছে তারুণ্যের অন্ধ আবেগ এবং উচ্ছাসে এবং কতিপয় লোক অংশগ্রহণ করেছে ‘এডভ্যানচারইজম’-এর বশে। এ সকল ক্ষেত্রে দেশ প্রেম, নিষ্ঠা এবং সততার তীব্র তারতম্য ছিলো।” –(অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, মেজর (অব) এম এ জলিল, পৃষ্ঠা-১৫] ছিলো না ভারতের সাথে কোনো যোগসাজশও। সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা এবং এ যুবকরাই ছিলো স্বাধীনতার মৌলশক্তি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় সমাজন্ত্রী, কম্যুনিস্ট যারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে বড় বড় বুলি কপচিয়েছিলো, ইকবাল হলকে কেন্দ্র করে যারা ৩রা মার্চ থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছিলো, যারা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যে [“মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নির্দিষ্ট রূপ যে ছিলো না তা নয়, তবে সে চেতনা সীমাবদ্ধ ছিলো একটা মহল বিশেষের মধ্যে এবং তারা হচ্ছে তৎকালীন ছাত্র সমাজের সর্বাধিক সচেতন মহলেরও একটা ক্ষুদ্র অংশ বিশেষ-বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাত্র লীগের সেই অংশটি যার নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল ইসলাম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরিফ প্রমুখ। এ অংশটির চিন্তা-চেতনার সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানী চক্র থেকে মুক্ত করে এ অঞ্চলকে বাঙালীর জন্য একটি স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলাই ছিলো তাদের লক্ষ্য। এর বাইরে যারা এ অঞ্চলকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্ত করে স্বাধীন, সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন তারা হচ্ছেন ‘কম্যুনিস্ট পার্টি (মণি সিং), ন্যাপ (মোজাফফর) ন্যাপ ভাসানীর একটা অংশ, মরহুম সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম সহ অন্যান্য ব্যক্তিবরগ।” –(অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, মেজর (অব) এম এ জলিল, পৃষ্ঠা-১৫)] স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলছিলো, স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রকৃতই তাদের কোনো ভূমিকা ছিলো না। ইকবাল হল-গ্রুপের মুজিব বাহিনী তৈরী হয়ে মাঠে নামার আগেই মুক্তিযুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের এ রূপ তখন ইসলামপন্থী দলগুলো সামনে আসেনি, আসা সম্ভবও ছিল না। তাদের নজর ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধকে রাজনৈতিক নেতৃত্বদানকারী ভারতপন্থী আওয়ামী লীগের ‘বাংলাদেশ সরকার’ এবং ভারতের প্রতি। ভারতভিত্তিক বাংলাদেশ সরকার ও ভারতীয় আচরণের মানদণ্ডেই তারা গোটা স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিচার করে। এভাবে তাদের কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হাজার হাজার নিবেদিতপ্রাণ যুবকের (যাদের সামনে দেশের মুক্তি বিধান ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিলো না) ত্যাগ ও কুরবানী এবং অত্যুজ্জ্বল দেশপ্রেম তাদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়। এ পরিস্থিতিতেই তারা হয় সবচেয়ে বড় ভুলের শিকার। যার ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধকে তারা বাম ও আওয়ামী লীগের চরমপন্থীদের সাথে ভারতের এক যোগ-সাজশপূর্ণ ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি।
সব কারণ মিলিয়ে স্বাধীনতা প্রশ্নে সেদিন যে বেদনাদায়ক মত-বিভক্তি ঘটলো, তার জন্যে আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিব এবং তাঁর দল আওয়ামী লগিই মূলত দায়ী। দলীয় স্বার্থেই তারা জাতীয় ঐক্য চাননি, কিংবা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ তারা নেননি। মার্চের পয়লা তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত জামায়াত, মুসলিম লীগসহ সব দলই শেখ মুজিবের পাশে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু শেখ মুজিব পাশে ডাকেননি কাউকে। এক থেকে পঁচিশ তারিখ সংকটকালীন এ দীর্ঘ সময়ে তিনি কোনো নেতাকে ‘হ্যালো’ পর্যন্ত বলেননি। তিনি কি করছেন, কি করবেন তা কাউকে না জানিয়েই পাকিস্তানীদের হাতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। অন্যদিকে ভারত ও ভারতে যাওয়া আওয়ামী লগি ছিল ইসলামপন্থী দলগুলোর জন্যে যমদূত সমতুল্য। যার ফলে ইসলামপন্থী দল ও ব্যক্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ বলে মনে করার সুযোগ পায়নি এবং আওয়ামী লীগ এ মতপার্থক্য দূর করার জন্যে ভারত গমনকে বিপজ্জনক করে তুলে সন্দেহ-সংশয়কে আরও বাড়িয়ে তোলে। এ অবস্থায় জাতীয মত-বিভক্তি ছিল অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং জাতির মত-বিভক্তি একটা যন্ত্রণাদায়ক বাস্তবতা এবং এর কড়া মাসুল জাতিকে দিতে হয়েছে। সব ভুল ও অন্যায়ের দুর্বহ বোঝা জাতিকেই বহন করতে হয়েছে তার সহস্র, লাখো সোনালী সন্তানকে কুরবানী দেয়ার মাধ্যমে, তাদের বুকের তাজা-তপ্ত রক্ত মাটিতে ঢেলে।
তিন
এ কুরবানীর শুরু ১৯৭১ সালের মার্চ থেকেই। এ মার্চ থেকে নির্যাতিত-নিষ্পেষিত জাতির বুকে শুরু হয় রক্তশোষণকারী এক মহা ঘুর্ণিঝড়। এ ঘুর্ণিঝড়কে উস্কে দিবার জন্য ছিলো ভুট্টো নিয়ন্ত্রিত এক সামরিক কোটারী-কুক্ষিগত পাকিস্তান সরকার এবং সুযোগ-সন্ধানী ও প্রতিশোধকামী ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত সরকার। তাদের কারসাজি ও কুমন্ত্রণায় এক ভাই আরেক ভাইয়ের বুকে ছুরি মারার যে আত্মবিনাশী কাজ ’৭১ এর মার্চ থেকে শুরু হয় তা চলে স্বাধীনতার পরও অনেকদিন পর্যন্ত। আত্মবিনাশী এ ঘুর্ণিঝড়েরর চক্রে পড়ে বিহারী মুসলমান মেরেছে তার বাঙালী মুসলমান ভাইকে, বাঙালী মুসলমান মেরেছে তার বিহারী মুসলমান ভাইকে, রাজাকার মেরেছে মুক্তিযোদ্ধ ভাইকে, মুক্তিযোদ্ধা মেরেছে রাজাকার ভাইকে। তারপর সরকার বিরোধী বামপন্থী মেরেছে ক্ষমতাসীন ভাইদের, আর ক্ষমতাসীনরা মেরেছে তাদের বিরোধী বামপন্থী ভাইদের। যে যেখানেই মরুক, যেভাবেই মরুক, বুক খালি হয়েছে জাতির, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ। লাভবান হয়েছে জাতির দেশের শত্রুরা।
প্রথমেই আসে মার্চের অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীণ এবং ২৫ মার্চ রাত থেকে পাক বাহিনী হামলা-অভিযান শুরু হবার পর তারা বিভিন্ন বন্দরে পৌঁছার সময় পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের কথা। এ সময়ের হত্যাকাণ্ড প্রধানত ছিলো ১লা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা এবং ২৫ মার্চ পাক-সেনাবাহিনীর হামলা-অভিযান শুরুর প্রতিক্রিয়া। অবাঙালীরাই এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো। পহেলা মার্চ যেন ছিলো নিঃসীম এক কাল দেয়াল। এ দেয়াল ভাগ করে দিলো বাংলাদেশের বাঙালী-অবাঙালীদের। ক্ষুদ্র বাঙালীদের সমস্ত রোগ যেন মূর্তি মান আজরাঈলের মতো গিয়ে আপতিত হলো অবাঙালীদৈর উপর। আন্দোলনের নেতা এ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। ২রা মার্চ (’৭১) রাতেই শেখ মুজিব দেশবাসীর উদ্দেশে বললেন, “জনসাধারণকে বিশেষ করে উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে এবং মনে রাখতে হবে, ভাষা ও জন্মস্থান নির্বিশেষে বাংলাদেশে বসবাসকারী সকলেই আমাদের কাছে বাংগালী। তাদের জান, মাল ও সম্মান আমাদের কাছে পবিত্র আমানত এবং আমারকে তা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।” [দৈনিক সংগ্রাম, ৩রা মার্চ, ১৯৭১] একথার তিনি পুনরাবৃত্তি করেন ৩রা মার্চ। পল্টনের শোক সভায় তিনি গুণ্ডামি ও লুটরাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, “বাঙালী অবাঙালী, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই দেশ মাতৃকার সন্তান। তারে সবাইর জানমাল রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবাইর।” [দৈনিক সংগ্রাম, ৩রা মার্চ, ১৯৭১] কিন্তু ন্দোলনের নেতার এ উদাত্ত আহ্বান সেদিন কোনো কাজে আসেনি। অবাঙালী হত্যার এক পশলা কাল ঝড় যেন বয়ে যায় দেশের উপর দিয়ে।
এ হত্যার কাল ঝড় কত জীবনকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে তার সত্যিকার হিসেব কোনো দিনই পাওয়া যায়নি, কোনো দিনই পাওয়া যাবে না। সে সংখ্যাতত্ত্বের দিকে না গিয়ে সে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতার কিছু দৃশ্য এখানে তুলে ধরছি, যা থেকে অবস্থার কিছুটা আঁচ করা যাবে। একটি পাকিস্তানী দ লিল সে সময়ের হত্যাকাণ্ডের একটা সাধারণ বিবরণ দিয়েছে। তার একটা অংশ এই : “আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অশুভ ইচ্ছার যারা বিরোধিতা করেছে, তারাই তাদের হত্যার শিকারে পরিণত হয়। অবর্ণনীয় বর্বরোচিত কাজ সংঘটিত হয়। বগুড়া জেলার শান্তাহারের একটি এলাকায় ১৫ হাজারেরও বেশী লোককে ঘেরাও করা হয় এবং তাদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। মহিলাদের রক্তপান করতে বাধ্য করা হয়। চট্টগ্রামে ১০ হাজারেরও বেশী লোককে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ছোট একটা এলাকাতেই আড়াইশো মহিলা ও শিশুকে বেয়নেট দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সিরাজ গঞ্জে সাড়ে তিনশো মহিলা ও শিশুকে একটি হল ঘরে তালাবদ্ধ করে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়, ফলে তারা জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যায়। ময়মনসিংহে সানকিপাড়া এলাকায় দু হাজার পরিবারের একটি কলোনীকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা হয়। পুরুষদেরকে ঘর থেকে টেনে বেরক রে গুলী করে মারা হয়। এবং মহিলাদের দিয়ে কবর খোঁড়ানো হয় ও তাদের ধর্ষণ করা হয়। তারপর বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাদেরকে হত্যা করাহয়। ……. ১৯৭১ সালের ৩রা ও ৪ঠা মার্চ রাতে….. চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অতর্কিত আক্রমণকারীদের দ্বারা পরিচালিত বিক্ষুব্ধ জনতা Wirless Colony এবং শহরের অন্যান্র এলাকা আক্রমণ করে যথেচ্ছা লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, হত্যা এবং ধর্ষণ করেছিলো। ফিরোজশাহ কলোনীতে ৭০০ ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সেখানকার অধিবাসী পুরুষ, মেয়ে ও শিশুদের পুড়িয়ে মারা হয়। যারা পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলো তাদের হত্যা কিংবা গুরুত্বর রূপে আহত করা হয়। ৩ ও ৪ মার্চে যারা জীবন্ত দগ্ধ হয়েছিলো এবং যাদের ভস্মীভূত দেহ পরে পাওয়া যায়, তারা ছাড়াও, ৩শর বেশী লোক হত্যা ও আহত হয়।” [ ‘East Pakistan Doocumentation Sereis’, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪২০, ৪৩০, ৪৩১।]
পাকিস্তানী দলিলে হত্যাকাণ্ডের জন্যে আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করা হয়েছে, কিন্তু যারা নিহত হয়েছে তাদের পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। মনে হবে বাঙালী বাঙালীদের মেরেছে।কিন্তু তা নয়। এ নিহতরা সবাই [অসহযোগ আন্দোলনকালে সংঘর্ষে পাক সৈন্যদের গুলী বর্ষণে নিহত বাঙালীরা এর মধ্যে শামিল নয়। ২৫ মার্চ পর্যন্ত এদের সংখ্যা কয়েকশ’ হবে।] অবাঙালী। বিদেশী পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট থেকে এ বিষয়টা পরিষ্কারভাবে জানা যায়।
নয়া দিল্লীর ‘স্টেটম্যা’ পত্রিকা ৪ এপ্রিল (’৭১) বললো, “পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে আটকা পড়া অবাঙালী মুসলমান সবসময় পূর্ব-পশ্চিম উত্তেজনার শিকারে পরিণত হয়েছে। এখন ভয় করা হচ্ছে বাঙালীরা সেখানে প্রতিরোধস্পৃহায় সংখ্যালঘুদের উপর অপতিত হয়েছে।” [ ‘East Pakistan Doocumentation Sereis’, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১৯, ৩২১, ৩২২।] আর ৬ এপ্রিল লণ্ডনের ‘দি টাইমস’ জানাল, “দেশ বিভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে বসতি স্থাপনকারী হাজার হাজার অসহায় মুসলমান ক্রুদ্ধ বাঙালীর গণ হত্যার শিকার হয়েছে।” [ ‘East Pakistan Doocumentation Sereis’, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১৯, ৩২১, ৩২২।] আটাশে এপ্রিল (৭১) তারিখে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ লিখলো, “৩৫ হাজার বিহারী একং কয়েক সহস্র পাঠান ও অন্যান্য অবাঙালী (পূর্ব পাকিস্তাতনে) নিহত হয়েছে।” [ ‘East Pakistan Doocumentation Sereis’, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১৯, ৩২১, ৩২২।] কানাডার ‘অটোয়া জার্নাল’ এবং ‘টরেণ্টো ডেইলি স্টার’ মে মাসের ৮ তারিখে বললো, “দায়িত্বশীল সরকারী ও অন্যান্য সূত্র হিসেবে দিয়েছে পহেলা মার্চ থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘাতে পূর্ব পাকিস্তানে ৩০ হাজার লোক মারা গেছে।” [ ‘East Pakistan Doocumentation Sereis’, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১৯, ৩২১, ৩২২।] আত্মনিবাশী সেই সংঘাতের দৃশ্য এভাবে পত্র-পত্রিকা এভাবে এঁকেছিলো:
“সে এক মহা আতংকের খবর শোনা। হত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংস, ব্যাপক লুটতরাজ- এসব ঘটনা এতো বেশী যে আতংকে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। অসহায় বিহারীরাই এর প্রধান শিকার।…… কিন্তু কত সংখ্যায় বিহারীরা নিহত হয়েছে সেটা প্রকৃত দুর্ভাগ্যের ব্যাপার নয়, তাদেরকে কত বিচিত্র কায়দায় মারা হয়েছে সেটাই আসল। ……. বিহারীদের হত্যাখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়। মহিলাটি বেঁচে আছে, কিন্তু বাঁচার কোনো ইচ্ছা তার নেই।…… একজন মহিলাকে মেরে ফেলা হয়।, কিন্তু তার ৩ মাসের শিশুকে একটা হাত কেটে ফেলেবাঁচিয়ে রাখা হয়। একজন ডাক্তার সিরিঞ্জ দিয়ে লোকদের দেহ থেকে সব রক্ত শুষে নিয়ে তাদের মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়।
ময়মনসিংহের অবশিষ্ট বিহারীদের আশ্রয় দেয়া একটি ক্যাম্পে একজন লোক তার কাহিনী বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সেখানে উপস্থিত সেই ক্যাম্পে দায়িত্বশীল একজন সেনা অফিসার দেখলাম তার কান্না ঢাকার জন্যে তার মুখ ঘরিয়ে নিলো।” [গার্ডিয়ান, লন্ডন, ১০ মে ১৯৭১ : ‘East Pakistan Doocumentation Sereis’, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩২৩-৩২৪]
“যখন পাক-বাহিনী ময়মনসিংহে পৌঁছলো, তারা এক মসজিদে ১৫০০ বিধবা ও ইতমকে পেল।…… এ্যাসিস্টেন্ট পোস্ট মাস্টার বলে পরিচয়দানকারী তার সাক্ষাতকারে বললো, সে ‘শান্তি’ নামের এক কলোনীতে বাস করতো। সেখানকার হাজার অবাঙালীর মধ্যে মাত্র ২৫জন জীবিত আছে। সাক্ষাতকার বন্ধ হয়ে গেলো। তার পরিবারের হত্যাকাহিনী বলতে গিয়ে কান্নায় ভেংগে পড়লো-তার বাকষ্ফূরণ হলো না।” [সান, সিংগাপুর, ৯ মে, ১৯৭১ : ‘East Pakistan Doocumentation Sereis’, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩২৩।]
“নির্যাতন করার পর হাজার হাজার অবাঙালীকে খুলনায় হত্যা ক রা হয়। বিহারীদের রাখা বন্দীখানাসাংবাদিকদের দেখানো হয়। রক্ত মাখা কাপড়-চোপড়, মেয়ের চুল ইতস্তত ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।” [‘নিউইয়র্ক টাইমস, ১০মে ১৯৭১ : ‘East Pakistan Doocumentation Sereis’, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৩২২।]
“চট্টগ্রামে পাক-সৈন্য পৌঁছার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লগি এবং তাদের হযোগী বাঙালী শ্রমিকরা, যারা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল বিহারীদের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ছিলো, বিহারীদের বিপুল পরিমাণে হত্যা করে।…… একটি স্থানীয় ব্যাংকের ইউরোপীয় ম্যানেজার বললেন, প্রত্যেক ইউরোপীয়র এটা সৌভাগ্য, সৈন্যরা ঠিক সময় এসে গিয়েছিলো, তা না হলে এ কাহিনী বলার জন্যে আমি জীবিত থাকতাম না। (New York Times, May 11, 1971)…… বন্দর নগরী চট্টগ্রাম সফরকারী সাংবাদিকরা ব্যাপক বেসামরিক লোক হত্যার চিহ্ন দেখতে পায়। ইস্পাহনী জুট মিলের বিনোদন ক্লাবে ১৫২জন অবাঙালী নারী-শিশুকে হত্যা করা হয়। বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত করে রক্তমাখা কাপড়ের স্তুপ, শিশুদের খেলা তখনও পড়ে থাকতে দেখা যায়।…… অধিবাসীরা একটা পোড়া বাড়ি দেখিয়ে বলে ৩শ পাঠানকে সেখানে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। (Washington Post, May 12, 1971)……. প্রত্যক্ষদর্শীর ৮০টি সাক্ষাতকার থেকে ধর্ষণ, নির্যাতন, চক্ষু উৎপটন, মেয়ের স্তন কেটে ফেলা, হত্যার আগে হাত-পা কাটার মত লোমহর্ষক কাহিনী পাওয়া গেছে।…… পাঞ্জাবী সৈনিক ও বেসামরিক অফিসার এবং পরিবারদের বিশেষ নৃশংসতা চালানোর জন্যে আলাদা করে নেয়া হয়। চট্টগ্রাম মিলিটারী একাডেমীর কর্নেল কমাণ্ডিং অফিসারের স্ত্রী ধর্ষিতা ও নিহত হন এবং তাকেও হত্যা করা হয়। চিটাগাং এর অন্য অংশে একজন ইপিআর অফিসারের শরীরে চামড়া জীবন্ত তুলে ফেলা হয়। তার দুই ছেলের শিরচ্ছেদ করা হয় এবং স্ত্রীর পেটে বেয়নেট চালানো হয়। এরপর দুই ছেলের মাথা নগ্নদেহ তুলে দিয়ে মৃত্যুর চন্যে ছেড়ে দেয় হয়।….. অনেক তরুণীর মৃতদেহ পাওয়া যায় যাদের পেটে বাংলাদেশের পতাকা দণ্ড পোঁতা ছিলো।
সরকারী হিসেব অনুসারে টট্টগ্রামে ৯ হাজার মারা যায়। খুলনার সংখ্যুর অনুরূপ। হত্যাকাণ্ড অন্যান্য জায়গাতেও ঘটেছে। ঠাকুরগাঁওয়ে ৩ হাজার নারী-শিশু নিহত হয়। এভাবে নিহত হয় ইশ্বরদিতে ২ হাজার, বৈরব বাজারে ৫শ, কালুরঘাট জুটমিল শেডে ২৫৩ জন।……. ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গুলী করে হত্যা করা ৮২টি শিশুর একটা লাই দেখি। আর ৩শ’টি লাশ দেখি জেলের আশেপাশে, যাদের বাঙালী বন্দীরা মুক্ত হবার পর জেলে আটকে রাখা হয়েছিলো। পাক-সৈন্যরা ব্রাহ্মণবড়িয়া আসার আগে এদের হত্যা করা হয়। (Anthony Mascarenhas’এর রিপোর্ট, The Sunday Times, London, May 2, 1971 [ ‘East Pakistan Doocumentation Sereis’, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১৯, ৩২১-৩২৪ এবং ৩২৮।]
বাঙালী ভাইয়ের হাতে অবাঙালী ভাই হত্যার আত্মবিনাশী কয়েকটা দৃষ্টান্ত উপরে তুলে ধরা হলো। এ থেকে সেদিন আমরা কি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলাম তার কিছুটা আঁচ করা যাবে। নেতার আহ্বান-আবেদনও আমাদের তখন শান্ত করতে পারেনি।
দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে গোটা একাত্তর মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ, হিন্দু এবং নিরীহ জনগণের উপর যে ব্যাপক হত্যা কাণ্ড চালানো হয়, সেই কাহিনী। এ হত্যাকাণ্ড চালায় পাক সৈন্য এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত লোকজন। শহর-নগরে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনগণকে নির্যাতন ও অসুবিধা থেকে বাঁচানোর জন্যেই তাদেরমতে, শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিলো। [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭১০] কিন্তু সংঘাতময় পরিবেশে তৃতীয় পক্ষের কোনো ভূমিকা পালন তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তারা পাকিস্তান সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবেই কাজ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে পাক সৈন্যরা হত্যা নির্যাতনের কাজে তাদেরকে ব্যবহার করেছে যেমন ব্যবহৃত হয়েছে বাঙালী পুলিশ, বাঙালী কর্মচারী, এমনকি কিছু বাঙালী সৈন্যও। আর রাজাকাররা তো পাক-প্রশাসন ও পাক-সেনাবাহিনীরই রিক্রুট। তারাই তাদের ট্রেনিং বেতনের ব্যবস্থা করতো। [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৩৬-৭৩৭-এর নিম্ন লিখিত দলিলগুলো উদ্ধৃত করা হয়েছে:
“To deputy commissoner, jesore….
sub : pay of Rajakars
Please confirm that the Pay of Razakars are being regularly Paid.
Sd/Mohammad Amin
Major, ASMLAS
“Tp HQ 18 Punjan, oc. ‘B’ Coy
Sub : Fresh Trg, Razakars
Copy of HQ 9 Div. Itr no G/15242/Tr, of 23 Oct 71 and copy of HQ Eastern Command Itr No 418/48Gs (T) of 19 Oct. 71 Alongwith Gen. Instr block syllabus and Trq. Programme (Am ‘A’ ‘B’ & ‘C’) for the Sec Comds. Cadre Razakars are Fwd Herewith For you info and nec action please.
Sd/Major Asmal
(Zain-ul-Malook)”] রাজাকাররা মজুরীর বিনিময়ে সংগৃহীত জনগোষ্ঠী। সাধারণভাবে সব দল, (যাতে আওয়ামী লগিও শামিল ছিলো) সব মতের লোক, যারা ভারত যায়নি, প্রয়োজন ও অবস্থার চাপে এর মধ্যে শামিল হয়েছিলো। [“বাঙালীদের রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি হবার কতকগুলো কারণ ছিলো। তাহলো: (ক) দেশে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিলো। সরকার সে দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়ে ঘোষণা করলো, যারা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেবে, তাদের দৈনিক নগদ তিন টাকা ও তিন সের চাউল দেয়া হবে। এর ফলে বেশ কিছু সংখ্যক লোক, যারা এতোদিন পশ্চিমা সেনার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত দিন কাটাচ্ছিল, তাদের এক অংশ এ বাহিনীতে যোগদান করলো। (খ) এতদিন পাক সেনার ভয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, আত্মরক্ষার একটি মোক্ষম উপায় হিসেবে তারা রাজাকারের দলে যোগ দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। (গ) এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী জোর করে মানুষের সম্পত্তি দখল করা এবং পৈতৃক আমলের শত্রুতার প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ গ্রহণের জন্যেও এ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো।
রাজাকরদের দায়িত্ব ছিলো মুক্তিবাহিনীর লোক খোঁজ করা এবং লোকের দেহ ও মালামাল অনুসন্ধান বা সার্চ করে দেখা যে কেউ আগ্নেয়াস্ত্র বহন করছে কিনা? তারা মেয়ে-পুরুষ সবাইকে সার্চ করার নামে তাদের টাকা-পয়সা, অলংকার ছিনিয়ে নেয়ার সুযোগ পেল।
কিন্তু রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি হবার পরে তাদের বুঝানো হলো যে, যুদ্ধে পাক সেনারা হারলে, পাক সেনাদের সাথে সহযোগিতা করার অপরাধে মুক্তিবাহিনী তাদের সকলকে হত্যা করবে। সুতরাং জীবন রক্ষা করার জন্য মুক্তিবাহিনীর গুপ্ত আশ্রয় স্থলের সংবাদ তারা পাক সেনাদের জানিয়ে দিতে শুরু করলো।” –(স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয়’, কামরুদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা-১২৫
“আমার কিছু গ্রামের খবর জানা আছে, যেখানে ‘৭১০-এর ত্রিমুখী বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্যে গ্রামের মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আমাদের কিছু ছেলে রাজাকার আর কিছু ছেলে মুক্তিফৌজ দিতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি, আমাদের ইউনিয়নের বড়গলই ও কলাইভাঙ্গা (যশোর জিল) গ্রামের গ্রাম্য প্রধানগণ মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেন যে, দু দিকেই ছেলেদের ভাগ করে দিয়ে বাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে। এ সিদ্ধান্ত মুতাবিক যে গ্রামের শতকরা ১০০জন লোকই ছিলেন নৌকার ভোটার, তাদেরই বেশ কিছু সংখ্যক ছেলেদের দেয় রাজাকারে। যেমন কলাইভাঙ্গা গ্রামের একই মায়ের দুই চেলের সাদেক আহম যায় রাজাকারে, আর তার ছোট ভাই ইজহার যায় মুক্তিফৌজে।….. এটাই ছিলো অধিকাংশ গ্রামের অবস্থা।” –(‘সওয়াল জওয়াব’ খন্দকার আবুল খায়ের, পৃষ্ঠা-৪৫] অনেক হিন্দু রাজাকার বাহিনীতে শামিল হয়। তারা পাক বাহিনীর অধীনে তাদেরসব কাজেই সহায়কের ভূমিকা পালন করতো। হত্যা-নির্যাতনের কাজেও তারা ব্যবহৃত হয়েছে।
পঁচিশে মার্চের পর এই যে হত্যাকাণ্ডের ঝড় শুরু হয় তাতে ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতাকামী মানুষ এবং নিরীহ অরাজনৈতিক এমনকি পাকিস্তান সমর্থন লোকরাও। [“মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের খবর পেয়ে মিলিটারীরা ভবানীগঞ্জ অভিমুকে যাত্রা করে।…… সমস্ত ভবানীগঞ্জ ‘বাজার লুটপাট করে আগুন করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ভবানীগঞ্জ গ্রামের বেশ কিছু মহিলার উপর নির্যাতন চালায়। বলা প্রয়োজন উক্ত গ্রাম খান সেনারা তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে।” –বাগমারা উপজিলার বাজে গোয়ালকান্দীর মোঃ আনিসুর রহমনের দেয়া বিবরণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৫] সেই সাথে মারা যায় রাজাকার এবং শান্তি কমিটির অনেক লোকও। সবচেয়ে দুঃখ জনক হলো, এ হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ চিত্র আমাদের কাছে নেই। এক হিসেবে নিহত রাজাকারের সংখ্যা বলা হয়েছে ৫ হাজারের মতো। [‘স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয়’, কামরুদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা-১২৬] আর মুক্তিযুদ্ধের মোট সংখ্যা বলা হয়েছে ৩০ লাখ। কিন্তু কোনোটাই তথ্য নির্ভর নয়। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ’ পঞ্চদশ খণ্ডে গণহত্যার একটা বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। কিন্তু তথ্যাবলীর অধিকাংশই অস্পষ্ট, অগোছালো এবং বহু ক্ষেত্রে অনুমান ভিত্তিক। এসব তথ্যের ভিত্তিতে দেশ ব্যাপী অনুসন্ধান চালিয়ে একটি সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়নি। বিনা পরিশ্রমেই সরকার তার কাজটা সারতে চেয়েছেন। ৩০ লাখের একটা কথা কোন মহল থেকে উঠলো, আর তাকেই অবলম্বন করা হলো সরকারীভাবেও। [দৈনিক জনপগের সম্পাদক প্রক্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট জনাব আবদুল গফফার চৌধুরী নিজস্ব কলামে লিখেন, “আমরা এখন বলছি মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ বাঙালী শহীদ হয়েছে। কোনো পরিসংখ্যান ছাড়াই বলছি। আমরা বলছি ৩০ লাক বাঙ্গালী মরেছে। কিন্তু যে ১ কোটি বাঙ্গালী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো তাদের ৪ লাখ শিশু, দেড় লাখ নারী এবং দু লাখের মতো বৃদ্ধের মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য দায়ী আমরা যারা মুজিব নগরে গিয়ে প্রশাসনের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলাম।” –(দৈনক জনপদ, ২০ মে, ১৯৭৩)] ১৯৭৮ সালে একটি সাপ্তাহিক সরকারী এ মনোভাবের উপর কটাক্ষ করতে গিয়ে ’৩০ লাখ’ সংখ্যাটির ইতিবৃত্ত এভাবে লিখেছে:
“দৈনিক পূর্ব দেশের জনাব এরশাদ মজুমদারের একটি প্রতিবেদন ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর তারিখে পূর্ব দেশেই প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি তথ্য ভিত্তিক কোনো আলোচনা বা সমালোচনা ছিলো না। বরং তা ছিলো সংগ্রামকালীন সময়ে যারা প্রাণ হারিয়েছিলো তাদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন এবং হত্যাযজ্ঞের জন্য যারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলো তাদের তীব্র সমালোচনা। প্রসঙ্গত জনাব এরশাদ মজুমদার সংগ্রামের ন’ মাসে কত লোক নিহত হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা নরূপণের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন মহলের এমন ব্যক্তির অনুমান ভিত্তিক সংখ্যা প্রকাশের তীব্র সমালোচনাও করেছিলেন। জনাব মজুমদার তাঁর রিপোর্টে ন’ মাসে আহত, নিহত, সতিত্বহানি, ঘরবাড়ী ভস্ম এবং অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিসংখ্যানের জন্য সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু ২১ বা ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো স্থায়ী বা অস্থায়ী সরকার ছিলো না। বাংলাদেশের মন্ত্রি সভার সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও জনাব কামরুজ্জামান সহ অন্যান্য নেতৃবর্গ ২২ ডিসেম্বর বুধবার ভারত থেকে ঢাকা আগমন করেন। সুতরাং কোনো ইতস্তত না করেই আমরা বলতে পারি যে, ২২ ডিসেম্বর বুধবার পর্যন্ত বাংরাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠিত সরকার হয়নি। শুধু তাই নয়, সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পরিসংখ্যান সংগ্রহের কাজটা হাত দেয়া খুব সহজ ছিলো না। গোটা দেশে তখন চরম অরাজকতা চলছিলো। যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ছিলো না বললেই চলে। তাছাড়া এ পথে আরো বহু বাধা ছিলো যা তৎক্ষণাৎ দূর করা সম্ভব ছিলো না। এ অবস্থার মধ্যে নিহতদের সঠিক সংখ্যা নিরূপন করা কোনো পক্ষে তো সম্ভব ছিলোই না, এমনকি কোনো সংস্থা বা সরকারের বেলায় একই কথা বলা চলে। কিন্তু তেলেসমতি কাণ্ড দেখালেন পূর্বদেশের সম্পাদক জনাব এহতেশাম হায়দার চৌধুরী। ভারত থেকে আগত বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার সদস্যদের খেদমতে ২২ ডিসেম্বর তিনি ‘ইয়াহিয়া জান্তার ফঅঁসি দাও’ শীর্ষক সম্পাদকীয নিবন্ধ পেশ করেন। এ নিবন্ধে তিনি কোনো ইতস্তত না করেই পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেন যে, ন’ মাসের মুক্তির সংগ্রামে ৩০ লক্ষ্য লোক নিহত হয়েছে।
জানি না কোন্ বৈদ বলে তিনি এ তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। হাতী ঘোড়ার যেখানে ঠাঁই নেই, বকের নাকি সেখানে হাঁটু পানি হয়ে থাকে।কিন্তু সত্যিই কি তাই? বকের হাঁটুই যদি পানির গভীরতার মাপকাঠি হয়ে থাকে, তাহলে ওয়াপদার পানি জরিপ বিভাগের কোনো প্রয়োজন বাংলাদেশে আছে বলে মনে হয় না।
পূর্বদেশের সম্পাদকের এ যদি দৈব জ্ঞান হয়ে থাকে, তাহলে তা ভিন্ন কথা। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ দেখলাম, গোটা ব্যাপারটা যেন একটা ভোজবাজির খেলা মাত্র। রাশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ‘প্রাভদার’ ঢাকাস্থ সংবাদদাতা পূর্ব দেশ সম্পাদকের প্রাপ্ত দৈব জ্ঞানের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন। প্রাভদা ৩০ লক্ষ নিহতের সংবাদ ফলাও করে প্রচার করে। এ সংবাদ দ্রুত ঢাকায় এসে পৗঁছে। ৫ জানুয়ারী (১৯৭২) ঢাকার সকল কাগজে প্রাভদার বরাত দিয়ে ৩০ লক্ষ নিহত হওয়ার সংবাদ প্রচার করা হয়। এ যেন বাংলার ডালের বস্তা বিলেত ঘরে এসে ‘বিলেত ফেরত’ মর্যাদা পায়।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো এবং বিদেশী সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা তাদের স্ব স্ব সংস্থা বা কাগজে পূর্বদেশের আবিষ্কারকে রাশিয়ার প্রাভদা দ্বারা সত্যায়িত করে প্রেরণ করেন। এমনিভাবে বিশ্বময় সংবাদটি প্রচার হয়ে পড়ে।
পূর্বদেশ সম্পাদকের কাল্পনিক আবিষ্কারের পাশাপাশি কতকগুলো বিপরীত চিত্র আমরা পাই। তদানীন্তন যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব শেখ আবদুল আজিজ ৭ জানুয়ারী (১৯৭২) কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে নিহতের সংখ্যা ১০ লক্ষের বেশী হবে বলে মত প্রকাশ করেন। (১০ লক্ষের বেশীর অর্থ ৩০ লক্ষকে বুঝায় না তা অবশ্য সবাই স্বীকার করবেন)। মন্ত্রী মহোদয় তাঁর নিজ গ্রামে ১০৭জনের প্রাণহানির কথাও উল্লেখ করেন। নিজ গ্রামের নিহতের হিসাবের সাথে ৬৪,৪৯৯টি গ্রামের গড়পড়তা হিসাব করেই গোটা দেশে ১০ লক্ষাধিক লোক নিহত হওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন।
এ ব্যাপারে আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অলক্ষ্যে জনাব এহতেশাম হায়দার চৌধুরীর দৈব জ্ঞানকেই সত্যায়িত করেন। প্রধানমন্ত্রী (শেখ মুজিবুর রহমান) পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন ৭ জানুয়ারী (১৯৭২) বাংলাদেশ সময় বিকেবল ৪ ঘটিকায়। অতপর তিনি বিলেতে যান, বিলেত থেকে ১০ জানুয়ারী দিল্লী হয়ে ঢাকা আসেন এবং ঐ দিনই তিনি রমনা ময়দানে যে ভাষণ দেন তাতে নিহতের সংখ্যা ৩০ লক্ষই উল্লেখ করেছিলেন। এ তথ্যের মূল সূত্র যে কোথায় তা বোধ হয় আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। ১০ জানুয়ারীতে তিনি ৩০ লক্ষের উল্লেখ করলেও ১০ জানুয়ারীতে দলীয় কর্মী ও এম সি’দের সমাবেশে অন্য কথা বলেন। ঐদিন তিনি তাদেরকে হত্যা, লুটতরাজ এবং অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ১৫ দিনের মধ্যে আওয়ামী লগি অফিসে পেশ করার নির্দেশ দেন। এছাড়াও মুক্তি সংগ্রাম কালে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের জন্য ১২ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি নিয়োগের কথা ২৯ জানুয়ারী (১৯৭২) শনিবারেই ঘোষণা করা হয়। ১৯৭২ সালের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে কমিটিকে সরকারের নিকট রিপোর্ট পেশের অনুরোধ জানানো হয়।
সুতরাং ১৯৭১ সনের সেই ন’ মাসের সংগ্রামে কত লোক যে নিহত হয়েছিলো তার সঠিক সংখ্যা আজও নিরূপিত হয়নি। মৃতের সংখ্যা নিয়ে ভেজাল রাজনীতি….. সংক্রমিত হয়ে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিলো। সত্য আজও উদঘাটিত হলো না, মিথ্যা এখনো সত্যের স্থান দখল করে আছে। কবি যথার্থই বলেছেন, ‘দ্বারা বন্ধ করে ভ্রম করে রাখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি।” [সাপ্তাহিক বাংলার ডাক, ৬ আগস্ট, ১৯৭৮।]
স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন। একথাগুলো যতই সামনে আনা যায়, বিভ্রান্তির পরিধি ততই বাড়ে। বাংলাদেশ যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ভারতীয় জেনারেল বলেন, “পাকিস্তান আর্মি ৩০ লাখ বাঙালীকে হত্যা করেছে, এটা একেবারেই অসম্ভব।” তার মতে পাকিস্তান আর্মি দশ লাখ বাঙালীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। [‘তিরিশ লাখের তেলসমত,’ সালেহ উদ্দিন আহমদ, জহুরী, পৃষ্ঠা-২৭ (‘আশা প্রকাশন, মগবাজার, ১৯৯৩)।] অন্যদিকে আওয়ামী নেতা, মুজিব নগর সরকারের এম.পি. স্বাধীনতা উত্তর জাতীয় সংসদের পার্লামেণ্ট সদস্য এ সম্পর্কি বক্তব্য খুবই মজার। তিনি ১৯৯০ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী জাতীয গ্রন্থ কেন্দ্রে এক বক্তৃতায় কিছু কথা বলেন। একথাগুলোই আবার বলেন এ সালেরই ২৩শে ফেব্রুয়ারী সাপ্তাহিক তারকালোককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে। তিনি বলেন, “আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১০ই ডিসেম্বর পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দশ লাখ বলে ঘোষণা দিয়েছি। এ হিসাবটি আমরা তখন কলকাতায় বসে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে খবরাখবর নিয়ে একটা আনুমানিক সংখ্যা দাঁড় করিয়েছিলাম। পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে নিহতের সঠিক সংখ্যা নিরুপণ করতে প্রয়াস পাই। তখন বৃহত্তর নোয়াখালীর মৃতদের সংখ্যা বের করার দায়িত্ব গণপরিষদের সদস্য হিসাবে আমাকে দেয়া হয়েছিল। আমি বিভিন্ন থানা ও ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগ করে যে সখ্যা পেয়েছিলাম, সেটা সাত হাজারের কম। নিহত রাজাকারদের সংখ্যা ধরেও সাড়ে সাত হাজারের বেশী দাঁড়ায়নি। তখন বাংলাদেশে ১৯টি জেলা ছিল। সব কয়টি জেলাতেই যুদ্ধ সমভাবে হয়নি। যেসব জেলায় যুদ্ধের প্রকোপ বেশী হয়েছিল, তার মধ্যে নোয়াখালী একটি। তাই নোয়াখালী জেলার মৃতের সংখ্যা যা দাঁড়িয়েছিল, গড়ে ঐ সংখ্যাও যদি সব জেলাতে ধরা যায়, তাতেও লাখ সোয়া লাখের বেশী মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় না।” জনাম মোহাইমেন ঐ সাক্ষাতকারেই আরও বলেন, “৩০ লাখ যে মরেনি, তার আর একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯৭২ সালের সরকারের তরফ থেকে প্রতি নিহতের জন্য দু‘ হাজার টাকা করে ঘোষণা করা হয়েছিল। মাত্র ৭২ হাজার দরখাস্ত পড়েছিল। তার মধ্যে (বাছাই এর পর) ৫০ হাজার নিহতের আত্মীয়দের ঘোষিত অর্থ দেয়া হয়। ঐ ৭২ হাজারের মধ্যে বহু ভূয়া দরখাস্তও ছিল। এমনকি অনেক রাজাকারও ছিল।” মুক্তিযুদ্ধে নিহত হওয়ার সংখ্যা সম্পর্কিত ‘ভুলটি শোধরালেন না কেন’-এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাইমেন সাহেব বলেন, ‘কেউ শোয়দরায়নি কিংবা প্রতিবাদ করেননি মুজিব বাহিনী ও রক্ষী বাহিনীর ভয়ে। শেখ মুজিব ভুলটি নিজে জেনেও সংশোধন করতে এগিয়ে আসেননি।” [***১৩৭ খ]
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে কেউ কোথাও কোনো দেশে এ ধরনের দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে বলে জানা নেই। তবু ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ’ শিরোনামে ১৬ খণ্ডে স্বাধীনতা যুদ্ধের যে বিপুল দলিলপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে, তার জন্যে সংশ্লিষ্ট ধন্যবাদ পাবেন জাতির কাছে। এ দলিল-দস্তাবেজ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে যে বর্বোরোচিত গণহত্যা ও নির্যাতনের মর্মস্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিলো, তার কিছু নজীর এখানে উদ্ধৃত করছি যা আমাদের বিভেদও আত্মবিনাশী ভূমিকার আরও কিছুটা পরিচয় তুলে ধরবে:
কারাকাসের SUMMA MAGAZINE ১৯৭১ সালের অক্টোবরে তার একটি রিপোর্টে বললো: “নাজীদের হাতে ইহুদী নিধনযজ্ঞ, হিরোশিমা ও নাগাসাকির আণবিক অপরাধ, বাইফ্রায় হত্যালীলা, ভিয়েতনামের নাপাম ধ্বংসলীলা প্রভৃতি বড় বড় গণহত্যা আজ তাদের এক সাথী খুঁজে পেল পূর্ব পাকিস্তানে একটি মাত্র রাতেই হানাদার বাহিনী ঢাকা শহরে ৫০ হাজার লোক হত্যা করেছে।” ‘A Country full of corpses, Summa Magazine, caracas, oct, 1971.’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৬৩] সেপ্টেম্বর মাসে ইক্যুয়েডরের ‘EL Commercio’ লিখলো, “বাংলাদেশে লাখ মানুষের হত্যালীলাকে শুধু এক নামেই ডাকা যায়, সেটা হলো : গণহত্যা। টিক্কা খানের নির্দেশে পাক-আর্মিরা এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। এ হত্যার সংখ্যাটা, যা ইউ এস এইডের ডাইরেক্টর লিওন এফ হেসার দিয়েছেন, বৃটিশ হিসেবে ৩ লাখে উত্তীর্ণ হয়েছে।” [[বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিল পত্র, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৬১] আর ঢাকা শহরেই ৭ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে। ……. জ্বলন্ত শহর পরিদর্শন থেকে একথা পরিষ্কার হয়েছে, কোনো প্রকার হুশিয়ারী ছাড়াই ঢাকার উপর অভিযান চালানো হয়। প্রজ্জ্বলিত বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছাত্রের লাশ এখনও তাদের ঘরে পড়ে আছে। জগন্নাথ হলে তাড়াহুড়া করে একটা গণ কবর তৈরি করা হয় এবং দুশ ছাত্রকে হত্যা করা হয় ইকবাল হলে।” [[বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিল পত্র, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৪৭]
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশলের অধ্যাপক ডঃ নূরুল উল্লাহ, যিনি যগন্নাথ হলের ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ডের মর্মান্তিক দৃশ্য তার মুখি ক্যামেরায় ধরে রাকেন, এক সাক্ষাতকারে বলেন, “যাদেরকে আমার চোখের সামনে মারা হয়েছে ও যাদের মারার ছবি আমার ক্যামেরায় রয়েছে তাদের দিয়ে প্রথমে হলের ভেতর থেকে মৃতদেহ বের করে আনা হচ্ছিল। মৃতদেহগুলো এনে সব এক জায়গায় জমা হচ্ছিল। এবং ওদেরকে দিয়ে লেবারের কাজ করাবার পর আবার ওদেরকেই লাইনে দাঁড় করিয়ে এক সারিতে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। মনে হচ্ছিল একটা একটা করে পড়ে যাচ্ছিল্ …….. আমার মনে হয় প্রায় ৭০/৮০ জনের মৃত দেহ এক জায়গায় জমা করা হয়েছিলো। …… আমার মনে হয় ছাত্র ছাড়াও হলের মালি, দারোয়ান, বাবুর্চি এদেরকেও একই সাথে গুলী করা হয়েছে। তবে অনেক ভালো কাপড়-চোপড় পরা বয়সী লোকদেরও ওখানে লাইনে দাঁড় করিয়ে মারা হচ্ছিল। এদের দেখে আমার মনে হয় তারা ছাত্রদের গেস্ট হিসাবে হলে থাকছিলো।” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিল পত্র, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪২৫] পঁচিশের মার্চ পরবর্তী কালো দিনে ঢাকা নগরীর একটা জীবন চিত্র পাওয়া যায় ১৮নং তাঁতী বাজার লেনের শ্রীয় পূরণচন্দ্র বসাক বাবুর বিবরণীতে। তিনি বলেন:
“আমি ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চ রাতে আমার ১৮, তাঁতী বাজারস্থিত বাসায় ছিলাম। রাত ১২টায় উত্তর দিক থেকে অকস্মাৎ কামানের আকাশ ফাটা গর্জন শুনে আমি তেতলার ছাদের উপর উঠে দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসমূহে আগুনের ফুলকি ও লক্ষ লক্ষ গুলীর আগুনের ফুলকি আকাশ ভরে গেছে। অনবরত কামানের ভয়াল ও ভয়ংকর আওয়াজ আসছে। ………. কিছুক্ষণ পরই সরদঘাট খৃস্টানদের গীর্জার সম্মুখে সামরিক গাড়ী ও ট্যাংকের ঘরঘর আওয়াজ শুনলাম। এ সময় শত কণ্ঠের ‘মাগো, বাবাগো, বাঁচাও বাঁচাও, আর্তনাদ শুনলাম। শাঁখারী বাজারের সকল হিন্দু জনতা যার যার ছাদে দাঁড়িয়ে এ বীভৎস কাণ্ড দেখছিলো। ২৭ মার্চ সন্ধ্য আইন তুলে নেয়ার পর শুনলাম শাঁখারী বাজারের কোর্টে প্রবেশ পথের একটি বাড়ীতে দশজন হিন্দুকে একই ঘরে গুলীবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে এবং ডঃ শৈলেন সেনকে গ্রেফতার করে জগন্নাথ কলেজের পাক সেনাদের ছাউনিতে আটক রাখা হয়েছে। ইংলিশ রোড দিয়ে অগ্রসর হয়ে দেখলাম ইংলিশ রোড, ফ্রেঞ্চ রোডের দুই পাশের কোটি কোটি টাকার কাঠের কারখানা ও মেশিনপত্র ভস্ম হয়ে পাক সেনাদের বীভৎসতার স্বাক্ষর হয়ে পড়ে আছে- দুই পাশের বাণিজ্য এলাকার সকল দোকান ও বাণিজ্য কেন্দ্র নিশ্চিহ্ন হয়ে আছে। রাস্তাঘাট শূন্য, কোথাও কোনো মানুষ নেই। আমি কাজী আলাউদ্দীন রোড হয়ে বাবুপুরা ফাঁড়ির বারান্দায় ও রাস্তায় বিকৃতভাবে পড়ে আছে। রেল লাইনের দুই পাশের বস্তি এলাকার ভস্ম ছাই হয়ে পড়ে আছে,দেখলাম চারদিক জনমানবশূন্য। আমি দ্রুত আমার বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক জি কে নাথ, সংস্কৃতের অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ঠাকুর, সংস্কৃতের অধ্যাপক শ্রী পরেশচন্দ্র মণ্ডলে খোঁজে জগন্নাথ হলে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক দিয়ে প্রবেশ করে দেখলাম, জগন্নাথ হলের চারদিকে দেয়াল লক্ষ লক্ষ গুলীর আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে আছে। হলের কাঁচের জানালাসমূহ ভেঙ্গে খান হয়ে পড়ে আছে। হলের পুকুর পাড় দিয়ে আমি অগ্রসর হওয়ার সময় দেখলাম হঠাৎ পুকুরের মধ্য হতে একজন মানুষের মাথা উপরের দিকে উঠার চেষ্টা করছে। ভীত-সন্ত্রস্ত, দিশেহার উন্মাদে মতো হয়ে পানি থেকে মাথা তুলে ক্রন্দন ও বুকে চপেটাঘাত করতে করতে বলতে লাগলেন, ‘দাদা ওদিকে যাবেন না, ওরা আমাদের সব মেরে ফেলেছে।’ আমি লোকটিকে উন্মাদ মনে করে তার কথায় কান দেইনি। আমি আরও অগ্রসর হয়ে হলের কেন্টিনের দিকে এগিয়ে দেখলাম একটি প্রাণীও নাই। নীরব, নিস্তব্ধ, জনমানবশূন্য। কেন্টিনের মধ্য দিয়ে হলের নর্থ হাউসে প্রবেশ করে সিঁড়ির নিকটে দেখলাম একজন হিন্দু যুবকের লাশ পড়ে আছে- মাথার চুল আগুনে পোড়া, সারা দেহ গুলীতে ঝাঁঝরা। আমি দোতলায় না উঠে সোজা রাস্তায় নেমে পড়ে হলের শহীদ মিনারেরর সামনে এসে দেখলাম- শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়ে আছে। শহীদ মিনারের পেছনেই সদ্য মাটি তোলা এতশত ফুট লম্বা এক বিরাট গর্ত দেখলাম- গর্তটি কিছুক্ষণ পূর্বেই মাটি দিয়ে ভরাট করে রাখা হয়েছে। আমি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে…… শামসুন্নাহার হলের দিকে অগ্রসর হয়ে জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর মিঃ জি কে নাথ, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ঠাকুর এবং পরেশ মণ্ডলের কোয়ার্টারের প্রবেশ পথে গিয়ে দেখলাম- কোয়ার্টারের দরজা-জানালা সব খোলা, জনমানবশূন্য। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে দেখলাম- তোতলা থেকে পঁচা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে, সিঁড়ির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রক্তের চিহ্ন জমাট হয়ে আছে। ……. আমার উপরে উঠতে সাহস হলো না…….. ভীত-সন্ত্রস্তভাবে যে পথ দিয়ে এসেছিলাম সেই পথ দিয়ে দ্রুত ফিরে গেলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা ধরে দ্রুত ঢাকা মেটিকেল কলেজের ভেতরে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ পথে জগন্নাথ হলের একজন চাপরাশির সাক্ষাত পেলাম। সে বললো, আমাদের হলের প্রভোষ্ট ডঃ জ্যোতির্ময় গূহ ঠাকুরতা গুলীবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালের দোতালায় ৯নং কক্ষে আছেন।
……… আমি হাসপাতালের দোতালার ৯নং কামরায় প্রবেশ করতেই হাতে ব্যাণ্ডেজ বাধা আহত (জগন্নাথ) হলের একজন যুবক ছাত্র আমাকে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দর করতে করতে বলতে থাকলেন, দাদা আমি কি বেঁচে আছি।….
আহত গুলীবিদ্ধ ছাত্রটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি করে বাঁচলে?’ সে বলতে লাগলো, ‘খান সেনারা ভারী অস্ত্র নিয়ে রাত ১২টার দিকেআমাদের হলের গেট ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে প্রত্যেক কামরা ও কক্ষে ব্যাপক তল্লাশি চালায়। হল বন্ধ থাকলেও কতিপয় অনার্স পরীক্ষার্থ ও এম এ পরীক্ষার্থী প্রতিভাবান বিশ-পঁচিশজন ছাত্র হলে অবস্থান করছিলো। প্রত্যেক কক্ষে প্রবেশ করে যাকে যেখানে পেয়েছে তাকে সেখানেই গুলীবিদ্ধ করে হত্যা করেছে, আমি সে সময় হলের বাথরুমে পালিয়েছিলাম। তারা আমাকে বাথরুমেই ধরে ফেলে। আমাকে ওরা ধরে বললো, ‘তুমকো কুচ নেহি বলেগা, এবং দোতলা থেকে আরও তিনজন ছাত্রকে নামিয়ে নিয়ে এসে আবার বললো, ‘ইয়ে দেখ তোমলোগ কো কুচ নাহি করেগা। উপরে যেতনা লাল হায়, সবকো নীচে লে আও।’ আমরা চারজন তাদের নির্দেশ মতো উপর থেকে সদ্য গুলীবিদ্ধ ক্ষত-বিক্ষত শহীদদের লাশ নীচে নিয়ে আসলাম। বীর শহীদদের সব লাশ আমরা শহীদ মিনারের গর্তের সামনে নিয়ে এসে দেখলাম-পাক সেনারা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। লাশগুলো ওরা গর্তের ভেতরে ফেলে মাটি চাপা দিলো। হত্যাযজ্ঞ শেষে আরেকদল সৈন্য উপরে গিয়ে আবার তল্লাশি চালিয়ে ফিরে আসলো আমাদের চারজনকে লাইন করে দাঁড়াবার নির্দেশ দিলো। আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম লাইন করে, এরপর আমাদের উপর গুলীবর্ষণ করতে লাগলো। আমাদের উপর গুলীর শব্দ হওয়া মাত্র আমি মৃত ভান করে পড়ে গেলাম। বীর শহীদদের সেই লাশের মধ্যে পড়ে থেকে দেখলাম-পাক সৈন্যরা আর্মি ট্রাক নিয়ে চলে গেল লাশের মধ্য থেকে উঠে এক দৌড়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে এসেছি।’
আমি বাড়ীতে চলে এসে দেখলাম, চারদিকে শাঁখারী বাজারে থমথমে ভাব-শাঁখঝারী বাজারের হিন্দু অধিবাসিগণ মনে করেছিলো আর কোনো হত্যাকাণ্ড হবে না- আমরা আমাদের এলাকায় ২৭ ও ২৮ মার্চ দিনের বেলায় রাস্তায় কোনো পাক সেনা দেখনি। কিন্তু কার্ফু আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে পাক সেনারা ঘরে ঘরে প্রবেশ করে হত্যাকাণ্ড চালায় এবং বাড়ী ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। আমরা কয়েকদিন ছাদের উপর বসে থেকে ঢাকার চারদিকে শুধু গুলীবর্ষণের শব্দ শুনেছি এবং অগ্নি সংযোগ দেখেছি।
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ গুজব ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিহারী জনতা হিন্দু মহল্লাহ হামলা করার জন্য এগিয়ে আসছে। এ সংবাদ পাওয়া মাত্র আমরা তাঁতিবাজার থেকে সকল হিন্দু পরিবার আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে পল্লী এলাকায় চলে যাই।”[ [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিল পত্র, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯-২২]
ঘোড়াশালের মোহাম্মদ মাহমুদুল আশরাফ এক জবানবন্দীতে বলেন, “নবেম্বর মাসের ১৭ তারিখ ঘোড়াশাল স্টেশন মিলিটারী ক্যাম্প থেকে ৫০/৫৫ জনের একটি দল ভোর ৬টায় স্টেশনের দক্ষিণ দিকের দু তিনটা পথ দিয়ে খিলপাড়া ও আটিয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়।…… খিলপাড়া গ্রামের জনৈক দোকানদার ইসলামের সাথে পাক বাহিনী সাক্ষাত করে। …….. পাক বাহিনী ইসলামকে সাহায্য করতে বলে। উপান্তুর না দেখে ইসলাম বাধ্য হলো পাক বাহিনীর সাহায্য করতে। এরপর শুরু হয় পাক বাহিনীর ধ্বংসলীলা। একের পর এক বাড়ী ধ্বংস করতে থাকে এবং লোকজনকেও এক এক করে গুলী করে হত্যা করে। প্রকাশ, ইসলাম ধর্মভীরু লোক। তিনি কুরআন শরীফ পাঠ করেছিলেন। ……. এমনকি শিশু, নারী, পুরুষ কেউই তাদের নৃশংস হত্যা হতে নিস্তার পায়নি। দু গ্রামের প্রায় ২০০ নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। পাক বাহিনীর সাহায্যকারী ইসলাম তাদের এ অপকার্যে সাহায্য করেছিলো। যখন পাক বাহিনী দেখলো তাদের সাহায্যের আর প্রয়োজন নেই, পাক দস্যুরা ইসলামকেও হত্যা করে।….. দৈনন্দিন খাওয়ার যাবতীয় জিনিসপত্র গ্রামের নিরীহ লোকদের নিকট থেকে জোর করে নিয়ে যেত। পাক পশুরা গ্রামের যুবতী মেয়েদের উপর মাঝে মাঝে পাশবিক অত্যাচার চালাত। হঠাৎ একদিন পাক বাহিনী আমাকে এবং আরও অনেককে ধরে ফেলে। মুসলমান ছিলাম বলে বেঁচে যাই।” [[বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিল পত্র, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬২] ঘোড়াশাল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলী নূর চৌধুরী তাঁর দেয়া জবানবন্দীতে বলেন, “১লা ডিসেম্বর। ১৯৭১। সকাল ৫টায় রেলগাড়ীতে করে প্রায় ৫০/৬০ জন সৈনিক সাথে একজন মেজর সহ ন্যাশনাল জুটমিল ঘিরে ফেলে। ……. ঘোড়াশাল সেতুর পশ্চিম পাশে গাড়ী থামিয়ে মিছিল সহকারে প্রথমত গুলী করতে করতে পাক বাহিনী প্রবেশ করে। গুলীর শব্দ শুনে মিলের আশেপাশের লোকজন দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। কিন্তু পাক বাহিনী ওদিকে কোনো দৃষ্টিপাত করেনি। রাস্তার পাশে যেসব বাড়ীঘর ছিলো সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে মাত্র।
অনুমান (মিলের) স্টাফের সংখ্যা দেড় শত জন ছিলো এবং তাদের পরিবার পরিজন সহ ৫০০ লোক। মেজর সবাইকে ডেকে শীলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ে নিয়ে যায়। চক্ষু লাল করে ম্যানেজার সাহেবকে জিজ্ঞেসবাদ করে এখানে মুক্তিবাহিনী আছে কিনা? এবং স্টাফের সবাইকে মুক্তিবাহিনী বলে মেজর আখ্যায়িত করে। সহকারী ম্যানেজার সাহেব মেজরকে নানাভাবে তার স্টাফ মুক্তিবাহিনী নয় তা বুঝাতে চেষ্টা করেন এবং তার প্রমাণ দেন। ভোর ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে এসব কথা কাটাকাটি হয়। শেষ পর্যন্ত মেজর ব্যাপারটা বুঝতে সক্ষম হন। সহকারী ম্যানেজার সবাইকে তাদের স্ব স্ব কাজে লিপ্ত হতে আদেশ দেন। স্টাফেল সবাই নিজ নিজ কাজে চলে যায়। মেজর ও তার সৈন্যরা মিল প্রদক্ষিণ করতে থাকে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো মুক্তিবাহিনীর অনুসন্ধান করা। অবশেষে আবার তারা গাড়ী করে রওয়ানা হয়। যখন তারা গাড়ীর দিকে ধাবমান ঠিক সেই মুহূর্তে কোথা হতে কে যেন দুটি গুলী করে। গুলীর শব্দ শুনে মেজর ও অন্যান্য সৈনিকরা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে এবং পুনরায় মিলের দিকে রওয়ানা হয। আর কালবিলম্ব না করে অফিসার-স্টাফের প্রত্যেকের বাসায় উঠে যাকে যেভাবে দেখেছে সেভাবেই নৃশংসভাবে হত্যা করে। গেটকিপার সহ অফিসার স্টাফের দু একজন ছাড়া সবাইকে হত্যা করে।” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিল পত্র, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬০] রাজশাহী চারঘাটের আনসার কমাণ্ডার মোঃ আবদুর রাজ্জাক তার বক্তব্যে বলেন, “১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল পাক সৈন্যরা ৬০/৭০ খানা গাড়ী যোগে সারদা আসে। এবং অবশেষে সারদার পতন ঘটে। তারা এসেছে এ খবরে এবং তাদের দেখে সারদা এলাকার লোকজন আবাল বৃদ্ধ-বনিতা প্রাণের ভয়ে আত্মরক্ষার্থে চরে আশ্রয় নেয়।…. তারা চরে আশ্রয় নেয়া লোকদের একত্রিত করে। এক একটা দলকেধরে এনে তারা গুলী করে হত্যা করে। ইতিমধ্যে আর একটি দল জমা হয়্ তাদেরকে দিয়ে মৃত লাশগুলো জমা করে। অতপর তাদেরকে গুলী করে হত্যা করে।……. শেষাবধি দেহগুলোকে পেট্রলদিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
তের দিন বন্দী অবস্থায় ছিলাম। এবং সে সময় আমি লক্ষ্য করেছি যে, সারাদিন ধরে লোক জমা হতো এবং রাতে অস্ত্রশস্ত্র সহকারে একজন হাবিলদার এবং তিনজন সেপাই আসতো। তাদের সাথে মোটা দড়ি থাকতো। কাগজে নাম লিখা থাকতো। নাম ধরে ডাকতো এবং বলতো ‘তোম খাড়া হো যাও’। খাড়া হয়ে গেলে পেছনে এ দড়ি দিয়ে কষে হাত বাঁধত এবং টেনে মাঠের মধ্যে নিয়ে যেত। …… তারপর শোনা যেত গুলীর আওয়াজ। যতগুলো লোক ধরে নিয়ে যেত ঠিক ততটি গুলী হতো।
বেত পেটানো তো নিয়মিতই ছিলো। প্রত্যেক দিন বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ১৬২ জন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, মাস্টার সহ বিভিন্ন ধরনের লোককে অত্যাচার করতো। …… নামায পড়তে চাইলে তারা বলতো ‘তোম লোগ কাফের হ্যায়, নামায কিউ পড়তা হ্যায়’?….. ৫ই সেপ্টেম্বরের সপ্তাহ খানে আগে সামরিক আইনের ১৮ ধারা মতে চার্জশিট দাখিল করে। বিচার শুরু হওয়ার আগেই ইয়াহিয়ার সাধারণ ক্ষমা পেয়ে যাই।” [[বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিল পত্র, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০০-১০২] বাগেরহাট বৈতপুর গ্রামের ‘তাহমীনা বেগম (দিপালী) এর সাক্ষ্য : “২৪শে এপ্রিল পাক সেনারা কাড়াপাড়া হয়ে বাগেরহাট আসে। এসেই কাড়াপাড়া এলাকাতেই ১শতের উপর লোককে হত্যা করে। ………. শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে বাগেরহাট শহর এলাকাতে যত হিন্দু ছিলো কিছু হত্যা বাদে সবাইকে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করে। এরপর গ্রামের দিকে হাত বাড়ায়। গ্রামকে গ্রাম ধরে সবাইকে মুসলমান করতে থাকে। আমি আমার স্বামী, ছেলেমেয়ে, মা-বাবা, কাকা, কাকীমা তাদের ছেলেমেয়ে সবাই ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেই। কিন্তু রাজাকাররা এরপরেও অত্যাচার করতে ছাড়েনি। এরপরও অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে। ২২শে আশ্বিন রাত তিনটার দিকে ৫০/৬০ জন রাজাকার আমাদের বাড়ী ঘিরে ফেলে। প্রথমে তারা মুক্তি বাহিনী পরিচয় দিয়ে থাকতে চায় রাতের মত। ….. প্রথমে আমার ভাই প্রদীপ গুহ দেখেই চিনেছিল তারা রাজাকার। তাই সে ছাদ গিয়ে গাছ বেয়ে পেছনে নামার চেষ্টা করেছে। উপর থেতে নিচে নামলে রাজাকাররা ধরে ফেলে। ওকে কিছুদূর নিয়ে গিয়ে বেয়নেট গিয়ে গলা কেট হত্যা করে। তারপর বাবা, কাকা এবং পাশের তিনজনকে কিছুদূর নিয়ে গুলী করে মাথা উড়িয়ে দেয। হত্যা করে বাড়ীঘর লুট করে চলে যায়। আমরা যারা বেঁচে ছিলাম বাগের হাটশহরে চলে আসি। বাড়ীতে কেবল একজন কৃষাণ এবং আমার ৭০ বছরের বৃদ্ধা দিদিমাকে রেখে আসি। …….. “[বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিল পত্র, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ২৪০।] যশোর জেলার কচুয়াবিল গ্রামের আইনুল হক বলেন, “কচুয়াবিলে পাক মিলিটারী ক্যাম্প ছিল। সেখানে প্রায় ১০০জন লোককে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়। যে ১০০জন লোককে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়, প্রথমে তাদেরকে দুপা এবং দুহাত রশি বা দড়ি দিয়ে বেঁধে একটা আম গাছের ডালে পা উপর দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে লাঠি দিয়ে ও বন্দুকের বাঁট দিয়ে শুধু শরীরের বিভিন্ন জোড়ায় মারতে থাকে। তাদের উপর দৈহিক পীড়ন করার পর একটা গর্তের মধ্যে নিয়ে ফেলে রেখে শাটি চাপা দিয়ে চলে আসতো। …… এভাবে ১৫/২০টা গর্তে ১০০ জনকে জ্যান্ত কবর দিয়েছে।” [[বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিল পত্র, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬৬] ঝালকাঠির ছাচলেপুর গ্রামের সুধারাণী বসু বলেছেন, “১৩৭৮ সালের ৭ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে ঝালকাঠি থানার ১৪জন বাঙালী পুলিশ স্থানীয় শান্তি কমিটির দালালসহ ছাচলেপুর গ্রামে অপরেশনে যায়। সকাল বেলা পুলিশগণ আমার পিতার বাড়ী আক্রমণ করে এবং জ্বালিয়ে দেয়। আমরা সবাই নিকটস্থা জংগলে পালিয়ে যাই। আমি আমার বড় মেয়ে রমাবতি বসুকে নিয়ে নিরাপত্তার জন্যে মোতাহের গোমস্তার বাড়ীতে রেখে দিই। পুলিশরা পরে উক্ত বাড়ীতে গিয়ে মোতাহেরের সাহায্যে আমার মেয়ে এবং অপর দুজনমেয়ে কমলা রাণী দাস (১৭) ও কল্পনা রাণী দাস (১৮)-কে ধরে নিয়ে যায়। পরে মেয়েদের খুঁজতে গিয়ে দেখি কমলা ও কল্পনাকে গুলী করে বিষখালী নদীর পাড়ে হত্যা করেছে এবং রমাকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করেছে। এছাড়া আমার আত্মীয় দুর্গা শংকর দাসকেও গুলী করে হত্যা করে। উক্ত মেয়েদের নৃশংসভাবে হত্যা করে এই পুলিশ বাহিনী। থানা হতে পুলিশরা বিভিন্ন গ্রামে অপারেশন চালিয়ে নিরীহ লোকদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে।………… আমি থানা হতে বহু মানুষের চিৎকার ও করুণ আর্তনাদ শুনেছি। কাউকেই রক্ষা করেনি। …….একদিন প্রায় ৯৫ জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে এসে হত্যা করে। প্রত্যেক দিন ধৃত ব্যীক্তদের নাম জিজ্ঞেস করতো, কিন্তু সেই দিন তাদের সবাইকে নিয়ে গিয়ে লাইন করে হত্যা করেছে। সকালে একজন পুলিশ এসে তৎকালীন সি. আই (পুলিশ)-কে জানায় যে, ৯৫জনের মধ্যে একজন জীবিত আছে। তখন উক্ত সিআই উক্ত ব্যক্তিকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়।….. [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিল পত্র, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১৮-৩১৯।] এ পর্যায়ে সর্বশেষ যে কাহিনীর উল্লেখ করবো, সেটা ফটিকছড়ির কাঞ্চন নগর গ্রামের। এ গ্রামের মোঃ সফিকুর রহমান বলেছেন:
“২১/১১/’৭১ তারিখে প্রায় ২০০জন পাক বাহিনী আমাদের এলাকায় প্রবেশ করে। তার ভেতর ১০/১৫জন পাক বাহিনী এসে আমাকে সহ আরো ৪০০ লোককে ডেকে জমায়েত করে। প্রথম অবস্থায় তারা আরো কয়েকবার আমাদের এলাকায় আসে, তখন তারা কাউকে কিছু বলেনি। সেই জন্যে তাদের ডাকে সবাই জমায়েত করে। তারপর সেখান হতে বেছে বেছে প্রায় ২০০ জোয়ানকে লাইন করে। তারপর আমাদের কালেমা পড়ার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়। তারা আমাদের একথাই বার বার জিজ্ঞেস করেছে যে, তোমাদের ভিতর কোনো মুক্তি বাহিনী বা হিন্দু আছে কিনা। এ সময় আমাদের লাইন হতে একটি ছেলে হিন্দু বলে স্বীকার করে। তখন তাকে বেয়নেট দিয়ে নানা জায়গায় কেটে হত্যা করা হয়। এমন সময় উত্তর দিক হতে পাক বাহিনী আরো নয়জনকে ধরে আনে। তাদেরকে আমাদের পাশে ২০ গজ দূরে গুলী করে হত্যা করে। তারপর আমাদের গুলী করার জন্যে প্রস্তুত হতে বলে। এমন সময় ৭নং ইউনিয়নের রাজাকার কমাণ্ডার আমাদের ভাল প্রমাণ করাতে পাক বাহিনী আমাদের গুলী না করে চলে যায়।” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিল পত্র, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩৮]
তৃতীয় পর্যায়ে আসছে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের কথা। এ হত্যা কাণ্ড ব্যাপকভাবে ও বেচিত্রের দিক দিয়ে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ছিল। আত্মবিনাশী এ হত্যাকাণ্ডে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা মেরেছে পরাজিত বিহারী, রাজাকারা ও শান্তি কমিটি এবং ক্ষেত্র বিশেষে নিরপরাধ ইসলামপন্থীদের। এরপর আওয়ামী লীগ বিরোধী বামপন্থীদের মেরেছে আওয়ামী লীগপন্থী মুক্তি যোদ্ধাদের এবং সরকার মেরেছে বিরোধী বামপন্থীদের। বিহারী, রাজাকারা ও শান্তি কমিটির লোক হত্যার কোনো প্রকাশিত বিবরণ কোথাও পাওয়া যায় না। তাদের হত্যা তখন কোনো নিউজ ছিল না, তাই সেগুলো কোনো সংবাদপত্রে আসেনি। কোনোভাবে কোনো লেখায় এগুলো কেউ সংরক্ষণও করেনি, অন্তত তা এখনও প্রকাশিত হয়নি। সুতরাং জাতীয় ইতিহাসের এ হত্যাকাণ্ডের অংশটা ভাবী প্রজন্মের কাছে অনুদৃঘাতি, অজানাই থেকে যাবে। জাতীয় ইতিহাসের ধারাবাহিকতার স্বার্থেই এ অন্ধকার অধ্যায় দিনের আলোতে আসা প্রয়োজন। জাতির জানা প্রয়োজন, স্বাধীনতা যুদ্ধের হত্যা, ধ্বংস ও লুটে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত জাতি কিভাবে স্বাধীনতা পরবর্তী দিনগুলোতে আরেক হত্যা, ধ্বংস ও লুটের মুখোমুখি হলো। এ ইতিহাস উদ্ঘাটিত হলে দেখা যেত এ হত্যাকাণ্ডেও দেশপ্রেম খুব অল্প ক্ষেত্রেই আছে, ব্যক্তিগত ঈর্ষা, বিদ্বেষ, শত্রুতা, লোভ ইত্যাদিই এ ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে কাজ করেছে। [“১৯৭২ সন হতে ১৯৭৪ সনের শেষ পর্যন্ত সারাদেশ ব্যাপী যুবকদের মধ্যে যে হানাহানি, গুপ্ত হত্যা প্রভৃতি চলেছিল তার অধিকাংশই হলো লুটলব্ধ অর্থের ভাগাভাগি ও ঘরের দখল নিয়ে।” – বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ, মোঃ আবদুল মোহাইমেন, পৃষ্ঠা-২২] আওয়ামী লীগ বিরোধী বামপন্থী ও মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর যে হত্যাকাণ্ড চালায়, তার খবর সে সময়ের পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে। [এই ব্যাপক রাজনৈতিক হত্যার কাহিনীও সংগৃহীত আকারে জাতির সামনে আসেনি।] এ হত্যাকাণ্ড যে উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের বক্তব্য থেকেও সুস্পষ্ট হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারীতে জাতীয সংসদে শাসনতন্ত্রের চতুর্থ সংশোধনী উত্থাপন সম্পর্কিত বক্তৃতায় শেখ মুজিব বলেন:
“মাননীয় স্পীকার………….. দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আপনর এ এসেম্বলি বা সংসদের চারজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের আগে হত্যা করা হয়েছে- যাঁরা কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলির মেম্বার ছিলেন। হত্যা করা হয়েছে গাজী ফজলুর রহমানকে, হত্যা করা হয়েছে নূরুল হককে, হত্যা করা হয়েছে মোতাহের মাস্টারকে। এমনকি নামাযে-ঈদের জামাতে নামায পড়তে গেলে সেই নামাযের সময়ে একজনকে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। যা কোনো দিন আমাদের দেশে শুনিনি। হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের হত্যা করা হয়েছে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁদের হত্যা করা হয়েছে যাঁরা স্বাধীনতার জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁদের হত্যা করা হয়েছে যাঁরা ২৫ বছর এ বাংলাদেশে পাকিস্তানী শোষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। অত্যাচার সহ্য করেছেন। ……. গোপনে গোপনে তারা অস্ত্র জোগাড় করেছেন এসব অস্ত্রদিয়ে- যাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়েছি আমরা, যারা অস্ত্র দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করেছে, তাদের হত্যা করেছেন ঘরের মধ্যে যেয়ে।” [গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ভাষ্য, গাজী শামসুর রহমান, পৃষ্ঠা-৬২২-৬২৩।]
আওয়ামী লীগের সাথে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণেই এ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর বীজ বপিত হয় স্বাধীনতা যুদ্ধকালে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতমুখী আওয়ামী লীগের নীতি অবস্থানকে সিরাজ সিকদার, তোয়াহা-হক প্রভৃতি গ্রুপরা সহ পিকিংপন্থী ন্যাপ সাধারণভাবেই গ্রহণ করতে পারেনি এবং আওয়ামী নেতৃত্বে আনা স্বাধীনতাকেও তারা স্বাধীনতা মনে করেনি। এ মনোভাবেরই ফল ছিল স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের সাথে তাদের সংঘাত। তারই এক রূপ ছিল প্রতিপক্ষ ও শ্রেণী শত্রু নির্মূলের মত রাজনৈতিক হত্যা।
স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মতপার্থক্যজনিত বিরোধের উত্তর ফল হিসেবেই আওয়ামী লীগ বিরোধী মুক্তিযোদ্ধা ও বামপন্থীরা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক হত্যার শিকারে পরিণত হয়। এ হত্যা কাণ্ড রাষ্ট্রশক্তি এবং আওয়ামী লীগের দলীয় শক্তি ব্যবহার হয়। “আওয়ামী লীগ শাসনামলে যেসব প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার ও তার নীতির বিরোধিতা করেছে, সেসব দলের মতে সে আমলে ২৫ হাজার ভিন্ন মতাবলম্বীকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ। এ হতভাগাদের হত্যা করা হয়েছে চরম নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার মধ্য দিয়ে- যে নৃশংসতার অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানী সৈন্যদেরও ছড়িয়ে গেছে। খুন, সন্ত্রাস, নির্যাতন, হয়রানি, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন কোনো কিছুই বাদ রাখা হয়নি।” [ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, পৃষ্ঠা-৫, আহমদ মূসা।] এ হত্যা কাণ্ডের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মাওলানা ভাসানীর পত্রিকা ‘হক কথা’ লিখে : “একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা বিশেষ প্রোগ্রামে এ দেশে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের হিসেব হলো, বাংলাদেশের সোয়া লক্ষ বামপন্থী কর্মীকে হত্যা করতে হবে। তা না হলে শোষণের হাতিয়ার মজবুত করা যাবে না।” [হক কথা, ২৬শেমে, ১৯৭২ (ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, পৃষ্ঠা-৩৭।)] সেই সময়ের পরিস্থিতির কয়েকটা দৃষ্টান্ত:
“পুরো কিশোরগঞ্জ জেলায়ই ব্যাপক হত্যা কাণ্ড ও সন্ত্রাস হয়েছে, এরমধ্যে সবচেয়ে বেশী হয়েছে বাজিতপুরে। বাজিতপুরে ১২৬ জনকে রক্ষীবাহিনী ও মুজিববাদীরা হত্যা করেছে।…… চুয়াত্তরের প্রথম থেকে পঁচাত্তরের আগস্ট পর্যন্ত ছয়চিড়া, দীঘির গাঁও, বালিয়ার গাঁও, দুলালপুর, গুরুই প্রভৃতি এলাকা ছিল বিরান ভূমি। দল বেঁধে রক্ষীবাহিনী ও মুজিববাদীরা গ্রামে আসতো। লোকজনকে দাঁড় করিয়ে অকথ্য নির্যাতন করতো। হাত পা বেঁধে উল্টো করে নাকে গরম পানি ঢেলেছে বহু লোককে। মহিলাদেরও রেহাই দেয়নি।
পিরোজপুরের আমিনার সারা গায়ে কম্বল জড়িয়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। বালিগাঁয়ে আকবরকে ধরতে না পেরে তার মা’র উপর নরকীয় অত্যাচার করেছে। রাজনীতি করতো না এমন বহু লোককেও তারা হত্যা এবং অত্যাচার করেছে। সবারচরে ‘টাইগার হোল’ নামক একটি নির্যাতন ক্যাম্প করেছিল তারা। আলো-বাতাসহীন সেই গর্তে দিনের পর দিন লোকজনকে আটক রেখে নির্যাতন করতো।
ইকোরাটিয়অর রশিদকে তার বাপের সামনে গুলী করে হত্যা করে। তার বাবা আবদুল আলীর হাতে কুঠার দিয়ে বলেছে তার ছেলের মাথা কেটে দিতে। নির্যাতনের এক পর্যায়ে আবদুল আলী বাধ্য হয়েছে ছেলের মাথা কেটে দিতে। সেই মাথা দিয়ে ফুটবল খেলেছে মুজিববাদীরা। ইউসুফকে হত্যা করার পর তার লাশ গাছে তিন দিন টানিয়ে রেখেছে। ফারূক ধরা পড়েছিল খাগড়ায়। সেখানকার মুজিববাদীরা তাকে বাজিতপুর মুজিববাদীতের হাতে তুলে দেয়। আওয়ামী লীগ অফিসে তাকে নির্মমভাবে পিটাতে পিটাতে হত্যা করেছে। …… মাহবুবকে হত্যা করা হয় থানা থেকে নিয়ে। মাহবুবের এক একটি করে অংশ কেটে লবণ-মরিচ মাখিয়ে ধীরে ধীরে হত্যা করেছে। তার কাটা হাত পা ও মাথা তার আত্মীয়স্বজনকে দেখিয়ে বলেছে মুজিববাদের বিরুদ্ধে রাজনীতি করলে এ অবস্থা হবে। হেমায়েদপুরের নূরুল ইসলামকে ধরে বুকে মইদিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে নারকীয়ভাবে হত্যা করেছে মুজিববাদীরা।” [‘বাজিতপুর বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাম্যবাদী’ দলের নেতা সাইফুল ইসলামের জবানবন্দী, ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ’, আহমেদ মুসা, পৃষ্ঠা-৫৬, ৬৫, ৬৬।]
“১৯৭৩ সালের আগস্ট মাস হবে। উত্তর রামভদ্রপুর (শরিয়তপুর জেলা) গ্রাম রক্ষীবাহিনী এলো। মুক্তিবাহিনীর ফজলু ও আমাদের দলের সমর্থক কৃষ্ণ ধরা পড়লো তাদের হাতে। প্রথমে খুব মারলো তাদের। কৃষ্ণ ছিল স্কুল শিক্ষক। রক্ষী বাহিনীর কাছে পানি খেতে চেয়েছিল কৃষ্ণ, রক্ষীরা তাকে প্রস্রাব খেতে দিয়েছে। কাহিল ও বিধ্বস্ত কৃষ্ণ উঠে দাঁড়াতে পারছিল না। একজন রক্ষীবাহিনী বললো, ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে জান? কৃষ্ণ বললো, হ্যাঁ জানি। ‘গাও তাহলে’। কৃষ্ণ কাঁদতে কাঁদতে গাইল।….. ধরে নিয়ে গেল তাদের। আর ফিরে আসেনি তারা। পরে আমি যখন রক্ষী বাহিনীর হাতে ধ রা পড়লাম, তখন তাদের মুখেই শুনলাম, ধরে আনার সময়ই তাদের এমন মার দিয়েছে যে, পথেই মরে গেছে। ৬ই ফেব্রুয়ারী (’৭৪) রাত্রি ভোর না হতেই রক্ষীবাহিনী আমাকেঘুম থেকে তুললো। আমাকে বাড়ীর বাইরে নিয়ে এলে দেখলাম রীণাও রয়েছে। আমাদের নিয়ে তারা রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে রওনা হলো। রাস্তায় রীণার প্রতি তারা অশ্লীল উক্তি করছিল। আমরা ক্যাম্পে আসতেই অনেক রক্ষীবাহিনী এসে আমাদের ঘিরে দাঁড়ালো। কেউ অশ্লীল মন্তব্য করে, কেউ চুল ধরে টানে, কেউ চড় মারে। কেউ খোঁচা দেয়, এমনি সব বর্বরতা। কিছুক্ষণ পর আমাদের রৌদ্রের মধ্যে বসিয়ে রেখে তারা চলে গেল। সন্ধ্যায় আমাদের একটি কামরায় ঢুকালো। অনেক রাত রীণাকে তারা উপরে দোতলায় নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরই শুনলাম রীণার হৃদয়বিদারী চিৎকার। প্রায় আধ ঘন্টা পর আর্তনাদ স্তিমিত হয়ে গেল। নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকার ভেদ করে ভেসে আসছিল শুধু বেতের ক্ষীণ সপাং সপাং শব্দ আর পাশবিক গর্জন। আমাকে ও রীণাকে এক সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে রীণার অস্ত্র খুলে নেয়। তারপর পড়ে আছি। রীণার সর্বাঙ্গ দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমার গায়ে কাপড় থাকায় অপেক্ষাকৃত কম আহত হয়েছি।
নয় তারিখ দুপুরের অল্প পরে তারা হনুফা, রীণা ও আমাকে নিয়ে গেল পুকুরের ধারে। সেখানে আমাদের এক দফা বেত দিয়ে পিটিয়ে চুবানোর জন্যে পানিতে নামাল। প্রথম আমাদেরকে ওরাই সাঁতরাতে বাধ্য করলো। আমরা শ্রান্ত হয়ে কিনারায় উঠতে চেষ্টা করি, ওরা আমাদের বাঁশ দিয়ে ঢেলে দূরে সরিয়ে দেয়। পরিশ্রান্ত হয়ে যখন আমরা আর সাঁতরাতে পারছিলাম না, তখন পানি থেকে তুলে আবার বেত মারতে থাকে। শেষের দিকেআমরা আর সাঁতরাতে পারছিলাম না। তখন তারা আমাদের পানিতে ডুবিয়ে আমাদের দেহের উপর দুপা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। এভাবে তিন দফা আমাদের চুপানো ও পেটানো হয়। কিছুক্ষণ আগেই করিম মারের চোটে মরে গেছে। আমাদের সাথে আর একটি অল্প বয়স্ক যুবককে চুবিয়ে অচেতন করে ফেলেছিল। তাকে ঘাটলার উপর ফেলে রাখে। আমার আঁচল দিয়ে গা মুছাবার সময় ছেলেটি চোখ মেলে তাকায়। ‘মা, আমি কে’ বলে করুণ কণ্ঠে ডেকে ওঠে। আমি চোখের জল রাখতে পারলাম না। রক্ষীরা তাকে সরিয়ে নিয়ে যায়, পরে শুনেছি, ছেলেটিকে নাকি মেরে ফেলেছে।………..” [প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা শান্তি সেনের স্ত্রী অরুণা সেনের বিবৃতি, ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, আহমেদ মূসা, পৃষ্ঠা-৭০, ৭৩, ৭৪, ৭৫, ৭৬, ৭৭।]
“……….কেদারপুরে ঘটে আরো মর্মন্তুদ ঘটনা।………
…….রক্ষী বাহিনী এসে বিপ্লবকে প্রথম খুব মারধোর করলো।……. খুব মেরে বিপ্লবের মা ও বাবাকে ডাকিয়ে আনলো। তারপর বিপ্লবকে বললো, ‘কলেমা পড়’। বাধ্য হয়ে বিপ্লব হিন্দু হয়েও কালেমা পড়লো। যখন সেজদা দিল, পেছন থেকে বেয়োনেট চার্জ করে বাবা-মা ও অনেক লোকের সামনে হত্যা করলো তাকে। বেয়োনেট চার্জ করার সময় রক্ষীদের একজন বললো, মুসলমান হয়েছো, এবার বেহেশতে চলে যাও।’ ………. আমার সাথে যে ৪০ জনের মতো ছেলে রাজনীতি করতো তারা সবাই ছিল ব্রিলিয়াণ্ট, ফাস্টক্লাশ পাবার মতো ছেলে। শুধুবেঁচে আছিআমি ও আরেকজন। বাকি সবাই রক্ষী বাহিনী, মুজিব বাহিনী ও মুজিবের অন্যান্য বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে গৌতম দত্তকে গ্রেফতার করা হয় ঢাকায় এবং হত্যা করা হয় কাটুবুলিতে তার নিজের বাড়ীতে নিয়ে। …….. রশীদকে হত্যা করা হয় রামভদ্রপুরে নিয়ে। ডামুড্যার আতিক হালদার, ধনুই গ্রামের তোতালেব এদরকেও তাদের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে আত্মীয়স্বজনের সামনে হত্যা করা হয়। পঁচাত্তরের প্রথম দিকে মোহর আলীকে ধরেছিল পুলিশে। শিবচর থেকে তাকে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তার শরীরের চামড়া খুলে লবণ মাখিয়ে তাকে হত্যা করা হয় এবং তার লাশ ডামুড্যা বাজারে টানিয়ে রাখা হয় কয়েকদিন। ……… আঘাত এলো সিরাজ সরদারের উপর। তিনি পালিয়ে গিয়ে সিরাজ সিকদারের বাহিনীতে আশ্রয় নিলেন। সিরাজ সিকদার তাকে চারজন গার্ড দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। একদিন শওকত আলীর বাহিনী বিনোদপুরে (শরিয়তপুর) এক বৈঠকের নামকরে তাকে ডেকে নিয়ে এলো। এরপর ঘেরাও করে প্রথমে তারা সিরাজ সিকদারের দেয়া চারজন গার্ডকে হত্যা করলো। আর সিরাজ সরদারকে নিয়ে এলো নদীতে। নৌকার মাঝির বর্ণনা মতে, প্রথমে তারা সিরাজ সরদারের হাতের কবজি কাটল, তারপর পা ও অন্যান্য অংগ প্রত্যংগ কেটে এবং শরীরের মাংস কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ফেলে দিলো।” [বামপন্থী নেতা শান্তি সেনের বরণনা, ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, আহমেদ মূসা, পৃষ্ঠা-৮৩, ৮৫, ৯১।]
“কালিগঞ্জ থেকে সাত মাইল দূরে কালা বাজারের কাছে রক্ষীবাহিনীর যে ক্যাম্প ছিল সেখানে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর গণ কবর আবিষ্কৃত হয়েছে। বহু ছেলেকে ধরে এনে এখানে হত্যা করা হয়েছে। বামপন্থীদের হত্যা করার জন্যে রক্ষী বাহিনী এখানে চাতুরীয় আশ্রয় নিতো। তারা লোক মারফত বামপন্থী ছেলেদের বল খেলার জন্যে আহ্বান জানাত। খেলা শেষে চায়ের নিমন্ত্রণ করতো। এরপর চোখ বেঁধে যেত বধ্যভূমিতে।……….” [কালিগঞ্জের কম্যুনিস্ট নেতা ওয়াজেদ আলীর ছোট ভাই মনিরুল হকের বর্ণনা, ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, পৃষ্ঠা-৯৩।] “সিরাজগঞ্জ শহরেই মুজিববাদীদের নির্যাতন ক্যাম্প ছিল ৪টি। লোক হত্যার জন্য মুজিববাদীদের বাঁধা জল্লাদ ছিল সমর ও শংকর। ……….. মুজিববাদীরা প্রথম ধাক্কায় হত্যা করে শ্রমিক নেতা মোকাদ্দেস, তোয়াহা গ্রুপের মনিরুজ্জামান এবং জাসদের নজরুলও বদরুলকে।……….. মুক্তিযোদ্ধা সেলিম ও সালামকে পাবনায় নিয়ে গিয়ে এসিড দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। শাহজাদপুরে হেলাল, কুরবান, ছগির, দীলিপ, প্রভৃতিকে হত্যা করা হয় গুলী করে। ছলিম ও মতিনকে একইভাবে………। কারো কারো মাথা ইট দিয়ে ছেঁচে গুড়িয়ে দিয়েছে।…….. সিরাজগঞ্জে ১৯৭৩ সালেই শ’ পাঁচেক বামপন্থী ও জাসদ কর্মী মুজিব বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল। পুরো মুজিব আমলে এখানে নিহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে।……… এলাকার মানুষ এক ভয়ানক দুঃস্বপ্নময় সময় অতিবাহিত করেছেন তখন। প্রভাবশালী আওয়ামী নেতার ভাই নিজে ক্যাম্প চালাত। সেখানে মানুষ হত্যা ছাড়াও যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে স্ফূর্তি করতো। কোনো সুন্দরী মেয়ে তাদের চোখে পড়লে তার বাপকে নির্দেশ দেয়া হতো মেয়েকে রাতে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিতে। নির্দেশ অমান্য করলে মৃত্যু ছিল অবধারিত।……… যুবকরা ছিল তাদের বন্দুকের খোরাক ও যুবতরীরা লালসার।” [বামপন্থী ছাত্র নেতা মোহন রায়হানের বর্ণনা, ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, আহমেদ মূসা, পৃষ্ঠা-১০৭-১০৮] ঈশ্বরগঞ্জ ময়মনসিংহ জেলার মধ্যখানে অবস্থিত। ……… আওয়ামী লীগ আমলে থানা সদরে একটি মাত্র কলেজ ছিল। …… এ কলেজের শতকরা ৩৩জন শিক্ষার্থী আওয়অমী লীগ আমলে নিহত হয়। এ আমলে এ থানার একটি মাত্র বালিকা বিদ্যালয়, ১টি উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অভাবে প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল। ………… ছেলেরা স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। অভিভাবকরা জানান, ভয়ে তাদের ছেলেদের বইপত্র মাটির নীচে গর্ত করে লুকিয়ে রেখে ছাত্র পরিচয় গোপন করা হতো।…….. বৃদ্ধ বাপ খুব ভোরে উঠে চোখ কচলে তার উঠানে দেখলেন, কয়েকদিন আগে রক্ষী বাহিনী কর্তৃক ধৃত ছেলের বিকৃত লাশ। অথবা একটা গাঁয়ের মানুষ অবাক হয়ে দেখল, তাদের চৌরাস্তার মোড়ে পাঁচটা বীভৎস অপরিচিত লঅশ পড়ে আছে। অথবা তারা দেখলো, স্কুলের সামনে জাম গাছে পা বাঁধা অবস্থায় উল্টাভাবে ঝুলছে এক তরুণের লাশ। তৎকালে এটা ঈশ্বরগঞ্জ থানার জনবহুল এলাকাগুলোর একটা প্রাত্যহিক দৃশ্য। ……… চলতি ট্রাকের পেছনে বেঁধে টেনে-হিঁচরে হত্যা করার মতো মারাত্মক ঘটনাও ঘটেছে। অনেক জায়গায় রক্ষীবাহিনী লঅশ ফেলেসাদা কাগজে ‘স্বাক্ষর বিহীন আদেশনামা লাশের পাশে রেখে আসতো। ইসলামপুর মাদ্রাসার কাছে এক জায়গায় তিনটা লাশের পাশে এ রকম স্বাক্ষর বিহীন আদেশনামা পাওয়া যায়। এ আদেশে স্থানীয় জনগণের উদ্দেশ্যে লাশগুলো পুঁতে ফেলার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছিল। রাজীবপুরের হাশেমকে মারার দিন মধুপুর বাজারের আশেপাশের গ্রামের প্রতিটি বাড়ীতে তাকে ঘুরিয়েছে। প্রতিটি বাড়ীর সামনে হাশেমকে দিয়ে বলিয়েছে, “আমাকে মধুপুর স্কুলের মাঠে আজ বিকেল পাঁচটায় গুলী করে মারা হবে- আপনারা সবাই আসবেন।” নিজের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে হতভাগ্য হাশেম। তবুও সে রক্ষী বাহিনীর বেয়োনেটের খোঁচা সহ্য করতে না পেরে তাদের শেখানো বুলি তোতা পাখির মতো আউড়ে গেছে। এ দিন পাঁচটায় হাশেমকে মধুপুর স্কুলের মাঠে গুলী করে হত্যা করা হয়েছিল। রক্ষী বাহিনীরা ছাড়াও সন্ত্রাস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের সদস্যরা অনেককে প্রকাশ্যে হত্যা করেছে। …….. সন্ত্রাস তারা সৃষ্টি করতে পেরেছিলও। মানুষ কথা বলতে ভুলে গিয়েছিল। সন্ধ্যার সাথে সাথে জনপদ হয়ে যেতো মৃতপুরীর মতো নীরব। সবাই আতংকে থাকতো কে কখন লাশ হয়ে যায়।” [ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, আহমেদ মূসা, পৃষ্ঠা-১১১. ১১৪. ১১৫. ১১৬।]
সেই সময়ের ভয়াবহ অবস্থার চিত্র বিদেশী পত্র-পত্রিকাতেও প্রতিফলিত হয়। কোলকাতার ‘ফ্রন্টিঢার (Vol-B No-2) লিখে: “বাংলাদেশের রাজনীতি এতটা একদলীয় হয়ে গেছে যে, বিরোধী রাজণৈতিক দলগুলো আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রেসিডেণ্টের অভিযানের অস্ত্র হচ্ছে তার গুপ্ত পুলিশ ও আধা সামরিক মিলিশিয়া রক্ষীবাহিনী। তারা গ্রাম বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে। …….. ময়মনসিংহ জেলার একটি থানাতেই (নান্দাইল) শত শত তরুণ চাষী ও ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে।…….. প্রত্যক্ষদর্শীর হিসাব মতে, রক্ষীবাহিনী গত জানুয়ারীতে এক ময়মনসিংহ জেলাতেই অন্তত এক হাজার ৫শ’ কিশোরকে হত্যা করে।…………. এমনকি, অনেক বাঙালী যুবক যারা রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় ছিল না, তারাও এ সন্ত্রাসের অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে।” ‘শিকাগো ডেইলি নিউজে’ জো গ্যাণ্ডেম্যান পাঠানো রিপোর্ট : ‘জাতির পিতা’র নামে রক্ষীবাহিনী ব্যাপক উৎপীড়ন ও হত্যা কাণ্ড চালিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয।…….. বাঙালীরা বলেন, গোপনে সংবাদ সংগ্রহের ব্যাপক অভিযান চালানো হচ্ছে। পাকিস্তানী আমলে যা করা হতো তা এ থে আদৌ অফাৎ নয়। একমাত্র রুদ্ধদ্বারের অন্তরালে লোকজন মুখ খুলে কথা বলে। ঢাকায় অবস্থারত জনৈক ভারতীয় সাংবাদিক যেমন বলেছেন, ‘ঢাকার বিখ্যাত প্রেস ক্লাবে যারা সব রকম বিষয়ে কথা বলতেন এখন তারা শুধু আবহাওয়া, কানাডা এ ধরনের বিষয়ে কথা বলেন।” [শিকাগো ডেইলি নিউজ, ২৩শে জুন, ১৯৭৫] নিউজ উউক বরে, “রক্ষী বাহিনী নামক একটি আধা সামরিক বাহিনী পুনরায় নির্যাতন এবং হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে। বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে দেশের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বলতে যেয়ে আজো পাকিস্তানী আমলের মতই জনগণ ভয়ে কেঁপে ওঠে।………. [নিউজ উউক, ১৫ই জুলাই, ১৯৭৫] দৃষ্টান্তের এখানেই শেষ নয়। এ রকম শত শত দৃষ্টান্ত , বর্ণনা, বিবরণ, কাহিনী সেই সময়ের দেশীয় সংবাদপত্রেও ছড়িয়ে আছে। সে সবের একটা অংশকেও এখানের স্বল্প পরিসরে সামনে আনা সম্ভব নয়। কি ঘটেছিল তার স্বরূপ উপলব্ধির জন্য যা এখানে তুলে ধরা হলো তা-ই যথেষ্ট।
চার
স্বাধীনতা উত্তরকালের এ বিভিন্নমুখী হত্যা কাণ্ড, স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ন’ মাসের গণ হত্যা এবং পঁচিশে মার্চ পূর্ববর্তী হত্যা কাণ্ডের সূচনা পর্বে আমাদের আত্মবিনাশী যে রূপ আমরা দেখি তার চরিত্র একই। সংকীর্ণ স্বার্থ, প্রচণ্ড রাজনৈতিক ঈর্ষা ও বিদ্বেষই এসব ঘটনার পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। বিহারীরা বাঙালীদের উপর চড়াও হওয়া এবং বাঙালীরা বিহারীদের উপর হত্যা কাণ্ড চালানো, জনগণের রায় উপেক্ষা করে বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে উল্টো তাদের উপরই গণ হত্যা চালানো, যুদ্ধোত্তরকালে যুদ্ধ বিজয়ী ক্ষমতাসীন শক্তি পরাজিত ও প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির উপর হত্যা সন্ত্রাসের স্টীমরোলার চালানো, ক্ষমতাসীন বিজয়ী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী বামশক্তির অসম-অসমীচীন যুদ্ধ ঘোষণা এবং আওয়ামী লীগ দুঃশাসনের প্রতিবাদকারী জাসদ ও বামশক্তির উপর দেশ ব্যাপি হত্যাযজ্ঞ চালালো- এসব কিছুর মূলে ঐ সংকীর্ণ স্বার্থ চিন্তা এবং রাজনৈতিক ঈর্ষা বিদ্বেষই সক্রিয় ছিল, কোনো জাতি প্রেম নয়, দেশ প্রেম নয়। এই চরিত্র সেদিন এমনভাবে এমন সব ঘটনার জন্ম দেয় যা জাতিকে বিভ্রান্তি, বিতর্ক, পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতা এবং দেশ ত্রাগ ও শত্রুর উপর নির্ভরশীলতার এমন এক অন্ধকার গলিতে ঠেলে দিল, যখন জাতির স্বাধীনতার মত প্রশ্নেও জাতির মত-বিভক্তি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। এ মত-বিভক্তি স্বাধীনতার পরেও রক্ত ঝরায়, হাজার হাজার মানুষ মর্মান্তিক হত্যা কাণ্ডের শিকার হয় বিদেশী হানাদারমুক্ত স্বাধীন পরিবেশেও। যদিও সেই প্রবল বিভ্রান্তি-বিতর্কের এখন অবসান ঘটেছে। তবু কিন্তু ঐ মত-বিভক্তির একটা বিকৃত প্রচ্ছায়া জাতিকে এখনও তাড়া করে ফিরছে, যন্ত্রণা দিচ্ছে। এ বিকৃত প্রচ্ছায়াকে যে চেতনার নামে যারাই বয়ে বেড়ান না কেন, এর মূলেও জাতি-প্রেমহীন, দেশ-প্রেমহীন এবং সংকীর্ণ স্বার্থ ও রাজনৈতিক ঈর্ষা বিদ্বেষ জাত সেই আত্মবিনাশী প্রবণতাই শক্তি হিসেবে সক্রিয় রয়েছে। যার বিনাশের মধ্যে জাতির ঐক্য, সমাজের শান্তি ও স্বস্তি এবং এমনকি দেশের স্বাধীনতাও নির্ভর করছে।
পরিশিষ্ট
১. আইন কাঠামো আদেশ, ১৯৭০
২. ইয়াহিয়ার পয়লা মার্চের বিবৃতি
৩. জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত সম্পর্কে শেখ মুজিবের পয়লা মার্চের প্রেস স্টেটমেন্ট
৪. পল্টনে শেখ মুজিবের ৩রা মার্চের ভাষণ
৫. ইয়াহিয়ার উপদেষ্টা কমিটির নিকট পেশকৃত আওয়ামী লীগের খসড়া শাসনতন্ত্র
৭. ইয়াহিয়ার ২৬শে মার্চের বেতার ভাষণ
৮. ভারতীয় পার্লামেণ্টে ২৭ মার্চ বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বিবৃতি
৯. ৩১শে মার্চ বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতীয় পার্লামেণ্টের সর্বসম্মত প্রস্তাব
১০. ১০ই এপ্রিলের স্বাধীনতা ঘোষণা অধ্যাদেশ
১১. স্বাধীন সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ
১২. ইয়াহিয়অ-মুজিব আলোচনার উপর ডঃ কামাল হোসেনের সাক্ষাতকার