ইয়ামানের জনৈক দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যোগাযোগ
১৩৪৮ হিজরীতে কায়রোস্থ আঞ্জুমানে শুব্বানুল মুসলেমীন রাসূলুল্লাহর হিজরত স্মরণে এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে। এতে বিপুল সংখ্যক জ্ঞাণীগুণী ব্যক্তি বক্তৃতা করেন। সমাবেশে আমি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করি। আমার বক্তৃতার বিষয় ছিল নবীজীর হিজরত ও ইসলামী দাওয়াত। আঞ্জুমানের পক্ষ থেকে বক্তৃতার বাছাই করা যে সংকলন প্রচার করা হয়, তাতে আমার বক্তৃতাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সমাবেশে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ইয়ামানের সাইয়্যেদ মুহাম্মদ যাব্বারা আল-হাসানও ছিলেন। তিনি তখন ছানআর কাছরুস সাঈদ অঞ্চলের গভর্ণর ছিলেন। বক্তৃতার পর তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং মিশর আর ইয়ামানের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা দীর্ঘক্ষণ কথা বলি। উভয় দেশে যে হারে নাস্তিক্যবাদ আর দর্শদ্রোহিতার বিষ ছড়াচ্ছে, তা রোধের উপায় নিয়েও আমরা দীর্ঘ আলাপ আলোচনা করি। এ আলোচনার পর আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বেরও সম্পর্ক গভীর হয। তিনি ইয়ামানে শিক্ষক হিসাবে কাজ করার জন্য আমার নিকট প্রস্তাব করেন। এ বিষয়ে তিনি ইয়ামানের ইমাম এবং সাইফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগও স্থাপন করেছিলেন (তখন ইয়ামানের ইমাম ছিলেন হামীদুদ্দীন ইয়াহইয়া। ইয়াহইয়া ছিল তাঁর আসল না এবং হামীদুদ্দীন আল মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ তাঁর উপাধী। ১৩৩৬ হিজরী থেকে ১৩৬৭ হিজরী পর্যন্ত তিনি ইয়ামান শাসন করেন। স্বৈরা শাসন আর কঠোরতার জন্য তিনি খ্যাত ছিলেন। তাঁর পুত্র সাইফুল ইসলাম মুহাম্মদ ছিলেন অত্যন্ত দ্বীদার। মানসিক দিক থেকে ভারসাম্যপুর্ণ ধারার অধিকারী এবং ইসলাম দারদী। ইমাম ইয়াহইয়ার ইনতিকালের পর সাইফুল ইসলাম মুহাম্মদের স্থলে সাইফুল ইসলাম আহমদ ইয়ামানের ইমাম নিযুক্ত হন- খলীল হামীদী)
শেষোক্ত ব্যক্তি ছিলেন নিতান্ত সংস্কারবাদী। সংস্কার কর্মের প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন। যত শীঘ্র সম্ভব ইয়ামানে সংস্কার সাধনে তিনি প্রয়াসী ছিলেন। আমার এবং সাইফুল ইসলাম মুহাম্মদের মধ্যেও উক্ত বিষয়ে সরাসরী পত্র বিমিনয় হয়। আমরা দূর থেকে একে অপরকে জানতাম। কিন্তু মধ্যস্থলে সরকারী প্রতিবন্ধকতার কারণে ইয়ামান গমনের ইচ্ছা সফল হতে পারেনি। কারণ, তখন মিশরে ইংরেজদের যে রাজনীতি চলছিল, তাতে কোন আরব দেশের সঙ্গে মিশরের গভীল সম্পর্ক গড়ে তোলার উপায় ছিল না।
সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আযযাবারাহ ইসমাঈলিয়া আগমন করেন এবং আমাদের সঙ্গে তিনদিন অবস্থঅন করেন। তিনি ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠান এবং পরিকল্পনা প্রত্যক্ষ করেন। আলহেরা ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও দেখেন। উম্মাহাতুল মুমিনীন মহিলা মাদ্রাসাও দেখেন। স্কাউটস-এর কর্মকাণ্ডগুলো প্রত্যক্ষ করেন। দারস আর বক্তৃতায়ও ইখওয়ানকে প্রত্যক্ষ করেন। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব এবং ইসলামী প্রেরণায় ইখওয়ানের অন্তর কতটা উজ্জীবিত, তাও প্রত্যক্ষ করেন এবং সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। এসব দেখে তিনি বেশ পুলকিত বোধ করন। শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বহাল ছিল। আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে কাজ করা হয়, তা স্থায়িত্ব লাভ করে।
সম্পদ আর পদ-মর্যদার ফেতনা
এ দু;টি বস্তুই সবসময় বিরোধের কারণ হয়। পৃথিবীতে এ দু’টি বস্তুই সবময় বিরোধের উৎস ছিল। ইসমাঈলিয়ার ইখওনরা পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, আন্তরিক সম্পর্ক এবং অন্তরের স্বচ্ছতার উত্তম নমুনা ছিল, যা কোন কিছুই কলুষিত করতে পারেনি। আল্লাহর বাস্তায় ব্যয় করা, কর্ম প্রেরণা, ইসলাম প্রচারের কাজে কষ্ট, ক্লেশ বরদাশত করায় একে অন্যের চেয়ে অগ্রসর হওয়ার প্রতিযোগিতায় অবর্তীর্ণ হওয়া- এগুলো ইখওয়ানের সাধারণ কাজ। দাওয়াতের কাজে যেসব প্রতিবন্ধকতা অন্তরায় হতো, তাকে তারা তুচ্ছ জ্ঞান করতো। কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতের বাস্তব প্রতিচ্ছবি ছিল তারাঃ
**********************************
তারা মুহাজিদেরকে ভালোবাসে, মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে, তাজ্জন্য তারা ঈর্ষা পোষণ করেনা এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হয়েও তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। আর মনের কার্পণ্য থেকে যারা মুক্ত, তারাই সফলকাম হয়েছে (সূরা হাশরঃ ৯)
যখন এসব বিদ্যালয় খোলা হয এবং নানা পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়, তখন এমন লোকদেরকে কাজে নিয়োজিত করা হয়, যাদের উচ্চ ডিগ্রী ছিল, প্রয়োজনীয় প্রথাগত যোগ্যতাও ছিল, কিন্তু অন্তরের শুভ্রতা এবং দাওয়াতের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ তাদের ছিল না। ইখওয়ানের সমাজ আর পরিবেশ ছিল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, দর্শন আর উপায়-উপকরণের দিক থেকে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ এবং এক সূত্রে গাঁথা একটা সমাজ। নতূন লোকদেরকে শিক্ষকতার কাজে নিয়োগ করার ফলে খাপছাড়া গোছের কিছু অংশ যোগ করা হয়। উপরন্তু এসব র্কজীবীরা ইখওয়ানী পরিমন্ডলের জন্য ছিল কিন্তুত কিম্বাকার গোছের। মন-মানসিকতা আর চিন্তাধারায় তারা ইখওয়ানী পরিবেশের উপযোগী ছিল না। এরা আন্দোলনের পদ-মর্যাদার লোভে পড়ে এবং সম্পদের প্রতিও তাদের দৃষ্টি পড়ে। ইখওয়ানের আন্দোলন কখনো বিত্তশালী ছিল না। তার দাবী আর চাহিদা সব সময়ই সীমাবদ্ধ উপকরণের মধ্যে সীমিত ছিল।
ইখওয়ানের বায়তুল মাল ছিল সব সময়ই নিঃস্বের নিবু নিবু বাতি। এত সবের পরেও কর্মীদের অর্থে আন্দোলনের সমস্ত প্রতিষ্ঠান আর পরিকল্পনা অব্যাহত ভাবে চলে আসছে। কর্মীদের পকেটের পয়সাই ইখওয়ানের আসল মূলধন। ইখওয়ান যখন এবং যেভাবে ইচ্ছা কর্মীদের পকেটের উপর হস্ত প্রসারিত করে। আর এতেই ইখওয়ান সাফল্য অর্জন করে। এসব নব নিযুক্ত কর্মচারীরা ছিল বাইরে থেকে আগত এবং সংগঠন সম্পর্কে অপরিচিত। ইখওয়ানের অভ্যন্তরে চোগলখুরী, কুৎসা রচনা আর গোপন কর্মকান্ড ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর সেবা ও কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানেই নয়, বরং আন্দোলনের মূল কাঠামো আর বড় বড় পদ অধিকার করতে চায় আর এ সুবাদে আয়ের উৎসও তারা হস্তগত করতে চায়। এ ষড়যন্ত্রের হোতা ছিলেন একজন আলিম, ফকীহ, সাহিত্যিক এবং সুবক্তা। আলহেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাকে শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। তাঁর যোগ্যতার মূল্যায়ন করা হয়, কোন কোন কমিটির সভাপতি তাক বানানো হয় এবং ইখওয়ান মসজিদে দারস দেওয়ার দায়িত্বও তার উপর অর্পন করা হয়। প্রত্যেকেই তাকে সম্মানের চোখে দেখতো। তার মনে আকাংখা জাগে, তিনি ইসমাঈলিয়ায় সংগঠনের প্রধান হবেন।
তিনি জানতেন, আমি সরকারী কর্মচারী। অন্য কোথাও আমাকে বদলী করা হবে। ইসমাঈলিয়ায় আমার চার বছর কেটেছে। কাজেই যেকোন সময় বদলীর হুকুম হতে পারে। কিন্তু ভুলে যান যে, তিনি নিজেও একজন শিক্ষক। বদলী বা চাকুরীচ্যুতির সম্ভাবনা আমার চেয়েও তার বেশী। নিজের আকাংখ্যা চরিতার্থ করার জন্য তিনি স্বাভাবিক পন্হা অবলম্বন করেননি। এজন্য স্বাভাবিক পন্হা ছিল নিষ্ঠা-আন্তরিকতা প্রমাণ করা আর সংগঠনের জন্য নিজেকে বিলীন করে দেয়া। এজন্য তিনি বাঁকা পথ অবলম্বন করেন। চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র আর দলাদলী ও চোগলখুরীর ঘৃণ্য পথ ধরেন তিনি। তিনি ইখওয়ান কর্ম পরিষদের কোন কোন সদস্যের সঙ্গে ভালোবাসা স্থাপনের চেষ্টা করেন। তাঁর মতে ইখওয়ানের অভ্যন্তরে সেসব সদস্যদের বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে। তিনি উপরোক্ত সদস্যদের সঙ্গে গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক সুদৃঢ় করে তোলেন, সব সময় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা চলেন। আর তাদেরকেও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য নিমন্ত্রণ জানাতেন। আমরা তার এসব কর্মতৎপরতাকে অনাবিল কাজ বলেই মনে করি। আর ইখওয়ানের বাণীও ছিল অনাবিল এবং নিস্কলুষ। সংশ্লিষ্ট ইখওয়ান কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর করা ছিল ইখওয়ানের অন্যতম কাজ।
ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানের কর্মকর্তা নিয়োগ
ইখওয়ানের আশংকা ছিল তাদের মধ্যে কাউকে স্থলাভিষিক্ত না করে আমি যেন ইসমাঈলিয়া ত্যাগ না করি। এমন একজন ব্যক্তির উপর এ দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে, যিনি সংগঠন পরিচালনা করতে সক্ষম। বিষয়টি নিয়ে সুস্থভাবে চিন্তা করার জন্য তারা আমার প্রতি আহবান জানায়, যাতে হঠাৎ করে আমার বদলীর নির্দেশে তারা কোন আকস্মিক বিপদে না পড়ে। কথাটা আমার কাছে বেশ মূল্যবান মনে হয়। দীর্ঘদিন আমার মন-মগজে কথাটা জেঁকে বসে। অবশেষে এ দায়িত্ব পালনের জন্য আমি শায়খ আলী আল-জাদাদীর নাম প্রস্তাব করি। ধর্মীয় এবং নৈতিক বিচেনায় তিনি ছিলেন ইখওয়ানের উত্তম ব্যক্তি। জ্ঞান আর প্রজ্ঞায়ও তাঁর ছিল বিপুল খ্যাতি। সুললিত কণ্ঠে তিনি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করতেন। আলোচনা আর বিতর্কে অংশ গ্রহণ করতেন অতি সুস্থ-সুন্দর ভঙ্গিতে।
তাঁর বিপুল অধ্যয়ন ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, যারা প্রথম দিকে ইখওয়ানের ডাকে সাড়া দেয়, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। এ কারণে তিনি ছিলেন ইখওয়ানের আত্মার কাছের লোক এবং সকলের প্রিয়পাত্র। আমি ইখওয়ানের সাধারণ সভা আহ্বান করি এবং তাদের সম্মুখে কোন কোন বন্ধুর এ ধারণা পেশ করি যে, ইখওয়ানের একজন কর্মকর্তা নিয়োগ করা উচিৎ, যিনি হবেন মুরশিদে আম-এর সহকারী। আমার আকস্মিক বদলী বা অন্য কোন আকস্মিক দুর্বিপাকের পূর্বেই তাঁকে দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। সকলেই আমার এ ধারণা সমর্থন করলে আমি তাদের সম্মুখে শায়খ আলী-আল-জাদাদীর নাম প্রস্তাব করি। তারা এ মনোনয়নে সন্তোষ প্রকাশ করে এবং সকলে সর্ব সম্মতভাবে এ মত সমর্থন করে। বরং কেউ কেউতো উদ্দীপ্ত হয়ে এমন প্রস্তাবও করে বসে যে, শায়খ আলী তাঁর কর্মকান্ড ত্যাগ করুন এবং তাঁকে ইখওয়ান মসজিদের ইমাম নিযুক্ত করা হোক। এবং আন্দোলনের বায়তুল মাল থেকে তাঁর ভাতা নির্ধারণ করা হোক, যাতে তিনি ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তখন তিনি সূত্রদরের কাজ করতেন। তাঁর নিজের দোকানও ছিল। উপস্থিত সকলে এ ব্যাপারেও একমত হয়।
আর আমি নিজেও ছিলাম এ মতের সমর্থক। কারণ, আন্দোলনের জন্য সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়োগ বেশ ফলপ্রশু। তাঁর জন্য নাম মাত্র ভাতা নির্ধারণ করা হয়। আর তাতেই তিনি রাযী হন। কারণ, ত্যাগের আদর্শেই তিনি আমাদের কাফেলায় শরীক হয়েছেন, ভোগের আশায় নয়। আলহামদু লিল্লাহ, ইসমাঈলিয়ার সকল ইখওয়ান কর্মীরাই এ নীতি। একটা অনুভূতি আমাদের আনন্দের স্বচ্ছ ফোয়ারাকে ঘোলা করে তুলেছিল। আর তা ছিল এই যে, এ পরিস্থিতি আমার বিচ্ছেদের পূর্বাভাষ। আমার বিচ্ছেদ যে নিকটবর্তী, এ ছিল তারই আলামত।
আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রথম আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র
উপরোক্ত শায়খ, যিনি ইখওয়ানের নেতা হওয়ার খায়েশ পোষণ করতেন, তিনি যখন স্বচক্ষে দেখতে পেলেন যে, ইখওয়ানের নেতা হওয়ার স্বপ্ন থেকে তাকে বঞ্চিত হতে হয়েছে, এবং এখন কার্যতঃ ইখওয়ানের নায়েবে মুরশেদ ঠিক হয়েই গেছে, তখন তাঁর চুপ থাকা উচিৎ ছিল। অথচ তিনি নিজেকে এ পদের জন্য সবচেয়ে যোগ্য মনে করেন। তিনি একজন বড় আলিম। কোথায় একজন আলিম আর কোথায় একজন কাঠমিস্ত্রী। একদিকে তাঁর কাছে রয়েছে আল-আযহারের উচ্চতর ডিগ্রি এম এর সনদ। অন্য দিকে তিনি একজন উঁচু মানের কবি। তিনি জানেন, কি ভাবে আন্দোলনকে সম্প্রসারিত করা যায়, কি ভাবে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। সুতরাং এ পদ লাভের জন্য তাকে চেষ্টা করতে হবে। কাজেই পূর্ব থে যাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল, আগে তিনি সেসব বন্ধুদেরকে হাত করার চেষ্টা করলেন। তিনি তাদের বুঝাবার চেষ্টা করলেন যে, একজন সুত্রধর থেকে তিনি যোগ্য এবং এ পদের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি। ওস্তাদ হাসানুল বান্না তাঁর হক নষ্ট করেছেন এবং তাঁর ত্যাগ আর কুরবানীর মূল্যায়ণ করেননি।
তিনি মনে করলেন যে, আমি আন্দোলনের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। অনেক অর্থ ব্যয় করেছি। আমার সংগ্রামের দীর্ঘ ফিরিস্তি রয়েছে। ওস্তাদের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ভালো। আমি আমার পুঁজি, জীবন, পরিবার- পরিজন এবং আমার ভবিষ্যৎ- সব কিছুই ওস্তাদ আর আন্দোলনের জন্য উৎসর্গ করেছি। কিন্তু শায়খ আলী এ সবের কোনটি করেছেন? কিছুইতো করেননি। অর্থ ব্যয় করেননি। ত্যাগ স্বীকার করেননি। আমার চেয়ে কম যোগ্য লোককে বাছাই করেছেন। এটাতো স্পষ্ট যুলুম। এছাড়া জেনারেল কাউন্সিলের বৈঠকও ছিল বেআইনী। হঠাৎ করে এ বৈঠক ডাকা হয়েছে। সকল সদস্য জানতেও পারেনি। সকলে উপস্তিত হতে পালে তাদের মতামত অন্য রকম হতো। এভাবে সকলকে মতামত ব্যক্ত করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
শায়খ আলীর জন্য মসজিদের ইমামতি বাবদ মাসিক তিন পাউন্ড ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছে। সংগঠনের যেখানে ঋণ রয়েছে, সেখানে তিনি কেমন করে এ ভাতা গ্রহণ করতে পারেন? এছাড়া মসজিদ, মাদ্রসা এবং অন্যান্য ইমারত বাবতও অনেক ঋণ রয়েছে। সেসব ঋণের পরিমাণ ৩৫০ পাউন্ডেরও বেশী দাঁড়ায়। অন্যদিকে আকাংখী শায়খ স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে ইমামতির দায়িত্ব পালন করতে প্রস্তুত। কেবল মাদ্রাসা থেকে ভাতা নিয়েই তিনি তুষ্ট থাকবেন। অথবা ভাগা গ্রহণ করলেও তা হবে খুবই নগণ্য-মাসিক ৫০ ক্রোশ এর বেশী হবেনা।
মওলবী সাহেব এমন সব চিকন চিকন কথা বলা শুরু করলেন, কুরআনের ভাষায় যাকে বলা হয়েছেঃ
**********************************
তার বাইরে রহমত আর ভেতরে আযাব তার এসব কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধান্তে ফাটল ধরানো, যাতে সিদ্ধান্ত অকার্যকর হয়ে যায়। তাঁল আসল উদ্দেশ্য ছিল যে কোন উপায়ে পদ দখল করা। আরো কয়েকজন সরলমনা সদস্যও তাঁর ফাঁদে পড়ে এবং তাকে সমর্থন করে।
আমি এ ষড়যন্ত্র সমূলে উৎপাটিত করতে দৃঢ় সংকল্প হই। তবে ষড়যন্ত্রে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা বা তাদেরকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে তাদের এবং সংগঠের মধ্যে আমি দূরত্ব সৃষ্টি করতে চাইনা। আমি তাদেরকে আমার বাসায় সমবেত করে জানতে চাই যে, তারা কি চান? তারা বললেন, আমরা চাইনা যে, আপনি শায়খ আলীকে সহকারী মুরশিদে আম নিযুক্ত করেন। আমি বললাম, কিন্তু আপনাদের অন্যান্য ভাইয়েরাতো অন্য কিছু চাইছেন। তারা তো শায়খ আলীকে মনোনয়ন দিয়েছেন। আমি আপনাদের ইচ্ছা পূরণ করলে তাদের ইচ্ছা পূরণ করা হয়না। তারা বললেন, না, ঠিক নয়। সকলে বৈঠকে উপস্তিত থাকলে ফলাফল অন্য রকম হতো। আমি বললাম, পুনরায় বৈঠক ডাকলে আপনারা কি বৈঠকের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন? তারা ইতিবাচক জবাব দেন।
এদিকে বৈঠক ডাকার আগে শায়খ আলীকে ইঙ্গিতে বলে দেই যে, আপনার পক্ষে সিদ্ধান্ত হলে আপনি ঘোষণা দেবেনে যে, মসজিদ মাদ্রাসা কোন খাত থেকেই আমি ভাতা গ্রহণ করবোনা। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন বৈঠক ডাকা হলো। ফলাফলে দেখা গেল, সে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাদে বাকী সকলেই শায়খ আলীর পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। ফলাফল প্রকাশের পর শায়খ আলী ভাতা গ্রহণ না করার ঘোষণা দিলে সকলেই অবাক হন। লক্ষণীয় যে, মাত্র চার পাঁচজন লোক চর পাঁচশ লোকের উপর নিজেদেরকে চাপাতে চেয়েছিল। তাদের মত গ্রহণ না করা হলে সকলেই অন্যায়কারী সাব্যস্ত হয়। কারণ, তারা নিজেদেরকে সবচেয়ে যোগ্য এবং হকপন্হী বলে মনে করে। দলের অভ্যন্তরে এহেন পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। এ কারণে ইসলামের নির্দেশ এই যে, যারা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহর নবী বলেনঃ
**********************************
-যে ব্যক্তি তোমাদের নিকট আগমন করতঃ তোমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ আর ফাটল ধরাবার চেষ্টা করে, অথচ তোমরা ঐক্যবদ্ধ, তবে সে ব্যক্তি যে কেউ হোকনা কেন, তরবারী দ্বারা তার গর্দান উড়িয়ে দেবে।
আরো একটি ষড়যন্ত্র
কিন্তু অন্তরের জগৎ এমন যে, একবার অন্তরে কোন খাহেশ পেষে বসলে তা মানুষকে অন্ধ ও বধির করে ছাড়ে। তখন মানুষ আর কল্যাণ দেখতে পায় না এবং ভালো কথা শুনতে পায় না। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমরা সবেমাত্র বৈঠক শেষ করেছি। এমন সময় প্রতিপক্ষের লোকজন তাদের শায়খের নিকট গমন করে যা কিছু ঘটেছে, সে সম্পর্কে তাকে অবহিত করে এখন কি করা যায় ভাবতে লাগলেন। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে তারা ঠিক করলেন যে, আন্দোলনের দুর্নাম রটনার কাজে তারা নিয়োজিত হবেন এবং তারা এ মিশনের নাম দেবেন কল্যাণ কামনা আর সহানুভূতি প্রকাশ। বর্তমান সময়ে অন্য কারো হাতে ইখওয়ানের দায়িত্ব ন্যাস্ত করা আন্দোলনের জন্য বিপজ্জনক। আন্দোলন বর্তমানে ব্যবসায়ীদের নিকট ঋণী। মসজিদ আর কেন্দ্রের নির্মাণ কাজে যা ব্যয় হয়েছে তাতে এখনো ৫০ পাউন্ড ঋণ রয়েছে। ঋণদাতারা জানতে পারলে তারা তৎক্ষণাৎ ঋণের টাকা ফেরৎ চাইবে। আর অনেকেই আন্দোলনকে সহায়তা করা বন্ধ করে দেবে। ফলে আন্দোলনের কলংক হবে। কারণ, আন্দোলনের তহবিলে বর্তমানে কানাকড়িও নেই। নূতন দায়িত্বশীল কি এসব বোঝা ঘাড়ে নিতে পারবে? বিশেষ করে এমন একটা পরিস্থিতিতে আন্দোলনের ঘাড়ে ঋণ চাপিয়ে ওস্তাদ হাসানুল বান্না যখন এখান থেকে বদলি হয়ে যাবেন। এহেন পরিস্থিতিতে একজন সাহসী এবং বিত্তবান ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়, যিনি আন্দোলনকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারবেন?
আমার কাছেও এ খবর পৌঁছেছে। কেবল ইখওয়ানের অভ্যন্তরে নয়, বরং সাধারণ মানুষের কানেও তা প্রবেশ করেছে। সকলের মুখে মুখে একই কথা। শুভ ধারণার বর্শবর্তী হয়ে আমি চিত্রের ভালো দিককে প্রাধান্য দেই এবং মিথ্যা অভিযোগে কলংকিত হওয়া থেকে বিরত থেকে প্রতিপক্ষের বক্তব্যকে সত্যি সত্যিই শুভ কামনা আর সহানুভূতি হিসাবে গ্রহণ করি। আর এ বিপর্যয়কেও আমি আমার নিজস্ব পদ্ধতিতে সমাধান করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি পাওনাদার ব্যবসায়ীদেরকে ডাকি। তারা ছিলেন ৩/৪ জন। তাদের নিকট আবেদন জানাই। এ ঋণগুলো কোন একজনের নামে নিয়ে নিন। তারা আমার আবেদন মেনে নেন। বর্তমানে যার নামে ঋণ, তাঁর নিকট আরয করি যে, আমার পক্ষ থেকে দীর্ঘমেয়াদী কিস্তিতে ঋণ শোধ করা হবে। অর্থাৎ মাসে আট পাউন্ড পারিশোধ করা হবে।
তিনি আমার এ প্রস্তাবও মেনে নেন। আর আমি সমস্ত ঋণের জন্য আমার পক্ষ থেকে মুচলেকা লিখে দেই। আর তাঁর নিকট থেকেও অঙ্গীকার পত্র লেখাই নেই যে, আন্দোলনের কাছে তার কোন পাওনা নেই। অন্যান্য পাওনাদারদের নিকট থেকেও অনুরূপ অঙ্গীকারপত্র আদায় করি, যাতে সংগঠন কারো কাছে এক পাই ঋণীও না থাকে। এ কাজ করার পর আমি সমস্ত ইখওয়ান সদস্যকে ডাকি। তাদের মধ্যে বিরুদ্ধবাদী এ চারজনও ছিল। আমি তাদের নিকট গোটা বিবরণ প্রকাশ করি। আমার বক্তব্য শ্রবণ করে তারা হতাশ হয়ে পড়ে এবং নানা ছলচাতুরীরর আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে। কখনো বলে, আপনি কেন নিজেকে এত কষ্টে ফেলবেন। কখনো বলে, এ কেমন কথা, আমরা আপনার একার উপর এ বোঝা চাপাবো? কখনো বলে, ভালো কাজের এ প্রতিদানই কি আপনার পাওনা ছিল? কখনো বলে, ধরে নিন, আপনার উপর এমন কোন আপদ আপতিত হলো যে, আপনি এ ঋণ শোধ করতে পারলেন না, তখন কি হবে? আমি তাদেরকে বললাম, আপনারা আমাকে আমার অবস্থার উপর ছেড়ে দিন। ঋণ পরিশোধের কিস্তি আমি এমনভাবে নির্ধারণ করেছি, যাতে ইনশাআল্লাহ আমার পক্ষে তা পরিশোধ করা সম্ভব হবে। আর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীও তা মেনে নিয়েছেন। আর এ ব্যাপারে আমিও একজন সাধারণ মুসলমান হিসাবে অংশগ্রহণ করবো। দ্বীন ও মিল্লাতের পথে ব্যয় করাও আমার কর্তব্য। সুতরাং আমার জন্য আপনাদেরকে চিন্তিত হতে হবে না। আমি ঋণ পরিশোধ করবো না- এমন কথা না বলা হলেই আমি বাঁচি। আমাদের ঐক্য অটুট থাকুক, এটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।
আমার এ বক্তব্যের পর তাদের কিছু বলার বা করার অবকাশ ছিল না। তারা কেবল এতটুকুই করতে পরেছেন যে, তাদের মধ্যে একজন, যিনি ছিলেন অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল, তিনি এ দায়িত্ব অন্য কারো ওপর ন্যস্ত করার আগ্রহ প্রকাশ করলে তা গ্রহণ করা হয় এবং অন্য একজন সঙ্গীকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়। আমার মনে পড়ে, তিনি দায়িত্ব হস্তান্তরকালে বলেছিলেন, এই নিন চাবি। এখন থেকে বায়তুলমাল শূণ্যই থাকবে। আমি গভীর আবেগে আপ্লুত হয়ে তাকে বলেছিলাম- না ভাই, এমনটি হবে না। ইনশাআল্লাহ বায়তুলমাল জমজমাট থাকবে। এরপর থেকে আল্লাহর মেহেরবাণীতে বায়তুলমাল জমজমাটাই ছিল।
ইসমাঈলিয়ার বিত্তবান ব্যক্তিরা এ বিষয়টা জানতে পেরে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে শায়খ মুহাম্মদ হোসাইন যামলূতের বাসভবনে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। তাঁরা সকলে এ ঋণ নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে চারশ পাউন্ড চাঁদা সংগ্রহ করেন। ফলে সমস্ত ঋণ পরিশোধ করে অবশিষ্ট টাকা বায়তুল মালে জমা করা হয়। ইখওয়ানের পক্ষ থেকেও অব্যাহত ধারায় টাকা আসতে শুরু করে, যার ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তহবিল সংগৃহীত হয়।
**********************************
আসমান-যমীনের সমস্ত ধনভান্ডার আল্লাহরই, কিন্তু মুনাফিকরা বুঝতে পরে না। (সূরা মূনাফিকুনঃ ৭)।
প্রসিকিউটিং-এর নিকট ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যাবর্তন
ষড়যন্ত্রকারীরা দেখতে পেয়েছে যে, তাদের সঙ্গী ইখওয়ানরা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার কাজে কতো অগ্রসর। আল্লাহর দ্বীনের জন্য সম্পদতো দূরের কথা, জীবন উৎসর্গ করতেও তারা দ্বিধা করে না। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, এহেন উত্তম প্রদর্শণী দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার পরিবর্তে তারা উল্টা শক্রতা আর বিরোধিতায় এগিয়ে যায়। এ উত্তম মানবীয় দৃষ্টান্ত তাদের প্রতিহিংসার আগুন আরো তীব্র করার কারণ হয়। একথা প্রমাণ কারার অপেক্ষা রাখেনা যে, মানুষ যখন কেবল বিজয়ী হওয়াকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে নেয়, চাই তা অসত্যের জন্যই হোক না কেন, তখন সে এ ছাড়া অন্য কিছু চিন্তাও করতে পারে না। তেড়াবাঁকা কৌশল তাকে বারবার পরাভূত করলেও সে ফিরে আসবে না কখনো, যতক্ষণ সে সম্পূর্ণ পরাভূত না হয়। আল্লাহর সৃষ্টি কতো রকমারী। এখন তাদের সম্মুখে কেবল একটা উপায়ই ছিল। তাদের মধ্যে যে ব্যক্তিকে অর্থ বিভাগের দায়িত্ব থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, তিনি প্রসটিউটারের নিকট গমন করে নিজের হাতে স্বাক্ষর করে একটা আরজী পেশ করনে। আমার দৃষ্টিতে তার এ কাজ প্রশংসনীয়। এ স্মৃতি ভুলবার মতো নয়। তিনি যখনই বিরোধিতা করছেন, তা করেছেন প্রকাশে এবং খোলাখুলিভাবে। এটা তার নৈতিক বীরত্ব এবং পৌরুষের একটা প্রমাণ। বরং এটা আন্দোলনেরই সৃষ্টি করা একটা চরিত্র। যদিও এখন তার অপব্যবহার হচ্ছে। তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট পেশ করা আর্জিতে লিখেনঃ
হাসান আফেন্দী আল বান্না- ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ান প্রধান এবং প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক দলের পুঁজি উজাড় করছে। সমস্ত পুঁজি কায়রোয় তার ভাইয়ের কাছে পাচার করছে আর সে সম্পর্কে তার ভাই বলছে যে, সে কায়রোয় দলের প্রধান। পোর্ট সাঈদ এবং আবু ছাবীরেও এ পুঁজি পাচার করা হচ্ছে। অথ এ সব পুঁজি ইসমাঈলিয়ার অধিবাসীদের নিকট থেকে সংগৃহীত। সুতরাং তা ইসমাঈলিয়াতেই ব্যয় করা উচিৎ ছিল। মানুষের জান-মাল আর ইজ্জত হেফাযত করার অধিকার পাবলিক প্রসিকিউটরের রয়েছে। এ কারণে আবেদনকারী এ ব্যপারে পাবলিক প্রসিকিউটরের হস্তক্ষেপ কামনা করছে এবং এসব খাতে অর্থ উজাড় রোধ করার দাবী জানাচ্ছে।
প্রসিকিউটিং অফিসার ছিলেন বেশ বিচক্ষণ এবং সূক্ষ্মদর্শী। যতদূর আমার মনে পড়ে, তিনি ছিলেন ওস্তাদ মাহমুদ মুজাহিদ, যিনি পরবর্তীকালে জজ হয়েছিলেন। তিনি আবেদনকারীকে ডেকে বিষয়টা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। তিনি আবেদনকারীকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি ইখওয়ানের নির্বাহী কমিটির সদস্য?
তিনি বললেন: আমি ইখওয়ানের সদস্য এবং অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল ছিলাম। পরে আমি পদত্যাগ করি এবং আমার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে।
তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করেন: আবেদনপত্রে উল্লিখিত যেসব শাখার নামে অর্থ প্রেরণ করা হয, নির্বাহী কমিটি কি তা অনুমোদন করে?
তিনি জবাব দেন, জি, অনুমোদন করে।
প্রসিকিউটর প্রশ্ন করলেন, আপনি কি জেনারেল কাউন্সিলের সদস্য?
তিনি বললেন: আমি সবগুলো কমিটি আর প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিলাম। কিন্তু এখন আমি তাদেরকে দেখতে চাই না। এখন আর আমি নিজেকে তাদের কোন বিভাগের সদস্য মনে করি না।
প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন যে, এসব ব্যয় জেনারেল কাউন্সিলে উত্থাপন করা হলে কাউন্সিল তা অনুমোদন করবে? হাসান আফেন্দীর সিদ্ধান্ত কাউন্সিল কি একমত হবে?
কি অবাককাণ্ড! হাসান আফেন্দী যদি তাদেরকে বলে যে, এ অর্থ আমি নিজের জন্য ব্যয় করেছি, তাহলেও তারা সানন্দে তা অনুমোদন করবে। হাসান আফেন্দী তাদের উপর যাদু করেছে।
এ জেরার পর প্রসিকিউটর বলেনঃ
নির্বাহী কমিটি যদি হাসান আফেন্দীর সমর্থক হয়, জেনারেল কাউন্সিলও যদি তাকে সমর্থন, করে, আপনি তো কোনটারই সদস্য নন, তবে কেন আপনি তাতে নাক গলান? এর সঙ্গে পাবলিক প্রসিকিউটিং-এর কি সম্পর্ক? ইখওয়ানের লোকেরা একটা সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তারা টাকা সংগ্রহ করেছে, যা ব্যয় করার জন্য এক বা একাধিক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিয়েছে। আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যেভাবে টাকা ব্যয় করে, নির্বাহী কমিটি তা অনুমোদন করে। প্রসিকিউটিং অফিস কিসের ভিত্তিতে তাতে হস্তক্ষেপ করবে? তারা স্বাধীন, যেভাবে ইচ্ছা নিজেদের অর্থ নিজেরা ব্যয় করতে পারে। দেখ নওজোয়ান, তোমাকে ভালো মানুষ মনে হয়। কিন্তু তুমি বড় ভুল করছ। আমি তোমাকে বলবো, তুমি সংগঠনে ফিরে যাও। এদিক-সেদিক চিন্তা না করে তাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ কর। আর তারা তোমাকে সহ্য করতে না পারলে গৃহে গিয়ে বসে থাক। নিজের অন্য কোন ধান্দা কর। তারা যা করে, করতে দাও। তুমি নিজের মঙ্গল চাইলে এটাই তোমার জন্য উত্তম।
এসব কথা শুনে নওজোয়ান ফিরে যায়।
শায়খ হামেদ আসকারিয়া এসব ঘটনার খবর পেয়ে শাবরাখীত থেকে ইসমাঈলিয়া আগমন করে বিদ্রোহী ব্যক্তিদেরকে সংগঠনে ফিরায়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা বাঁকা পথ ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। এসব ব্যাপারে শায়খ হামেদ ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ তাদের সঙ্গে কথা বলে ফিরে এসে আমাকে বললেনঃ
তাদের মধ্যে কোন কল্যাণই আর অবশিষ্ট নেই। এরা আন্দোলনের গুরুত্ব-বৈশিষ্ট্য অনুধাবনত করতে অক্ষম। নেতার আনুগত্যের প্রতিও তাদের কোন আস্থা নেই। যারা এ দ্বিবিধ গুণ থেকে বঞ্চিত, আমাদের সারীতে তারা কোন ভালো কাজ করতে পারে না। সুতরাং আপনি তাদের বিরোধিতাকেও কল্যাণকর মনে করুন এবং নিজের কাজ করে যান। আল্লাহ সহায়।
শায়খ হামেদ আসকারিয়া নিজের ব্যক্তিগত অভিমত সম্পর্কে বিদ্রোহীদেরকে নির্ভীকভাবে সতর্ক করে দেন। নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডেকে আমি তাদেরকে সংগঠন থেকে বের কিরে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা নিজেরাই এগিয়ে এসে পদত্যাগকরে। নির্বাহী কমিটি তাদের পদত্যাগপত্র অনুমোদন করে। বিরোধের এখানেই অবসান হয়।
নিজেদেরকে ইখওয়ানের পরিমণ্ডল থেকে অনেক দূরে দেখতে পেয়ে এবং ইখওয়ানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে তারা মনে মনে ক্ষব্ধ হয়। অবশেসে তারা ইখওয়ানের বিরুদ্ধে গুজবের বাজার গরম করে তোলে। সরকারি কর্মকর্তাদের নামে বেনামী দরখাস্ত প্রেরণ করা শক্র করে। কখনো শিক্ষা বিভাগে, কখনো পুলিশ আর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট। অবশেষে শহরের সেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে, যাদেরকে তারা ইখওয়ানের আন্দোলনের স্তম্ভ মনে করতো এবং আন্দালন সম্পর্কে তাদেরকে বীতশ্রব্ধ করে তোলার মতলবে অলীক আর কাল্পনিক কাহিনী তাদেরকে শুনাতো। শায়খ মুহাম্মদ হোসাইন যামলূতকে দিয়ে তাদের এ অভিযান শুরু হয়। তাঁর কাছে গিয়ে এরা বলে- ইখওয়ান একটা ভয়ংকর সংগঠন। তাদের গোপন তৎপরতা এমন যে, আপনার কাছে তা প্রকাশ পেলে আপনি প্রাণ বাঁচাবার জন্য তাদের থেকে দূরে পালাবেন। তাদের এসব গোপন তৎপরতা সম্পর্কে আমরা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদেরকে অবহিত করতে চাই। যাতে আপনি পূর্বাহ্নে সকর্ত হয়ে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক চিহ্ন করেন। নিজে থেকে ইস্তাফা দিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করেন। আপনি আমাদেরকে আশ্বস্ত করলে সরকারি কর্মকর্তাদের নিকট আমরা তাদের রহস্য উন্মোচিত করবো। ফলে আপনার ঘাড়ে কোন আপদ চাপবে না।
শায়খ যামলূত তাদেরকে বললেনঃ আপনারা যা বলছেন, তা যে সত্য, সে বিষয়ে আপনারা কি নিশ্চিত? তারা বললেন: আলবত। বরং সেসব গোপন কাজে আমরাও কার্যতঃ তাদের সঙ্গে ছিলাম। তাঁর হৃদয় ছিল ঈমানের দওলতে ভরপুর। স্পষ্ট উক্তি আর সৎসাহসও ছিল তাঁর। তিনি তাদেরকে বললেন, তোমাদের কথা সত্য হলে তোমরা গাদ্দার আর খিয়ানতকারী। আর মিথ্যা হলে তো তোমরা মিথ্যাবাদী। এহেন পরিস্থিতিতে তোমরা কেমন করে আশা করতে পার যে, আমি তোমাদের সত্যায়ন আর সম্মান করবো? অথচ তোমরা হয় মিথ্যাবাদী, নতুবা খিয়ানতকরী। আমার সম্মুখ থেকে চলে যাও। আর কোনদিন যেন তোমাদেরকে এখানে না দেখি।
স্মরণীয় মুহূর্ত
সে মুহূর্তের কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না, যখন শায়খ মুহাম্মদ হোসাইন যামলূত আমার স্কুলে উপস্থিত হন। তাঁর চেহারা বিবর্ণ। উম্মা আর অস্থিরতার লক্ষণ চেহারায় পরিস্ফূট। তিনি প্রিন্সিপালের অনুমতিক্রমে ক্লাশ থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে ধীরে ধীরে শহর দূরে গমন করেন। আলোচনাকালে ষড়যন্ত্রকারীদের নিকট তিনি যা কিছু শুনতে পেয়েছেন, সে সম্পর্কে খুঁড়ে খুঁড়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন। বললেন, মিয়া এক্ষুণই শহরে ফিরে যাও। এরা যেসব কথা বলছে, তা সত্য হলে এখনই নিজের ব্যবস্থা কর। তোমার এসব গোপন কর্মের কোন একটা দিক- যদি সত্যি সত্যি গোপন কিছু থেকে থাকে- যাতে প্রকাশ না পায়, সে চেষ্টা কর। কোন রহস্য প্রকাশ হয়ে ড়লে বা তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে স্পষ্ট বলবে যে, সে দলের সাথে আমার আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। সে দলের সভাপতি মুহাম্মদ আবু হোসাইন যামলূত। মিয়া, তুমি এখনো যৌবনের পর্যায়ে। তোমার ভবিষ্যৎ আছে। তদুপরি তুমি সরকারি চাকুরীজীব। সরকার তোমাকে উত্যক্ত করতে পারে। তুমি আমাদের শরে একজন মেহরান। আন্দোলনের এ কাজ তুমি করছো আল্লাহর জন্য। যেকোন বিবেচনায় তুমি শুকরিয়া আর অনুগ্রহ পাওয়ার যোগ্য।
আমি শুনে যাচ্ছিলাম আর মর্দে মু’মিনের সাহসিকতা ও বীরত্বে স্তম্ভিত হচ্ছিলাম। আমি তাঁর সমীপে আরয করলামঃ গুরুজন! আপনি নিশ্চিত থাকুন, আমরা যা কিছু করছি, তা করছি দিনের আলোতে। সে দলটি সত্যবাদী হয়ে থাকলে অনেক পূর্ব থেকেই তারা আমাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করতো। তাদের আর আন্দোলনৈর মধ্যে যে বিরোধ, তা নতুন কিছু নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে, তারা দেখতে পায় যে, আপনি নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর অর্থের উপরকণ দ্বারা আন্দোলনের সহায়তা করছেন। আপনি একজন শরীফ ও সম্মানী ব্যক্তি। তারা আন্দোলনকে আপনার স্নেহের পরশ থেকে মুক্ত করতে চায়। চায় আপনাকে আন্দালন থেকে দূরে রাখতে। গণমানুষের সম্মুখে আন্দোলনকে একটা ভয়ঙ্কর রূপে উপস্থাপন করতে চায়। আপনি সহানুভূতির মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এ জন্য আমি আপনার নিকট অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আল্লাহ এ জন্য আপনাকে নেক প্রতিদান দিন।
এরপর সে আল্লাহর বান্দা যা কিছু বলেন, তাও আমার মনে গেঁথে রয়েছে। তিনি বললেনঃ প্রিয় ভাই, আল্লাহর কসম করে বলছি, আমার চাচা শায়খ ঈদকে বহুবার আমি বলতে শুনেছি, ইসলামের বিজয়, মুসলিম মিল্লাতের সাফল্য এবং ইসলামী বিধিবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব না দেখে আমার যেন মৃত্যু না হয়, আল্লাহর নিকট এটাই আমার আবেদন। তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। ইসলামের বিজয় প্রত্যক্ষ করা তাঁর ভাগ্যে জুটেনি। ইসলামের বিজয় আর তাঁর ভাগ্যে জুটেনি। ইসলামের বিজয় আর অগ্রগতি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা ছাড়া আমার জীবনে অন্য কোন আকাঙ্ক্ষা নেই। সর্বদা আল্লাহর নিকট আমি এ দোয়াই করি, যেন ইসলঅমের বিজয় দেখার পরই আমার চক্ষু বন্ধ হয়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, সে মনযিল এখনো অনেক দূরে। কারণ রক্তের ফোটা মুসলমানদের নিকট এখনো অনেক মূল্যবান। যতদিন তারা রক্তের ফোটাকে মূল্যবান মনে করবে, ততদিন কিছুই হাসিল হবে না। মর্যাদা আর স্বাধীনতার দাম কেবল রক্তের ফোটাই হতে পারে। কুরআন মজীদএ তত্ত্বই বিবৃত করে। নবীজীর সীরাত আর সাহাবায়ে কিরামের জেন্দিগী এ কথারই সাক্ষ্য দেয়, তাই নয় কি?
আমি বললামঃ নিঃসন্দেহে আপনি যথার্থই বলেছেন। কিন্তু আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, সত্যিকার ঈমানই কেবল মানুষের রক্তকে গরম করতে পারে। কারণ, ঈমানের রাস্তায় প্রবাহিত রক্তের মূল্য আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশি। একদল আল্লা প্রেমিকের অন্তরে ঈমানের স্ফুলিঙ্গ ছলছল করচে বলে আমি প্রত্যক্ষ করছি। এ দলের হাতে মঙ্গল-কল্যাণ আর মুক্তি-সাফল্যের মহান কীর্তি সাধিত হবে ইনশাল্লাহ। ইখওয়ানের এ নওজোয়ানদেরকে যেকোন মঙ্গলের কাজে অগ্রসর প্রেমিক হিসাবে দেখত পাবেন। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীববী করুন এবং আপনি ইসলামের বিজয় দেখার সুযোগ লাভ করুন।
শায়খ যামূলত বললেনঃ কিন্তু সে দলটিতো সংখ্যায় অতি অল্প।
আমি আরয করলামঃ ভবিষ্যতে এ অল্প অনেকে পরিণত হবে। আর বরকততো এ অল্পে নিহিত রয়েছে।
**********************************
কতো ক্ষুদ্র দল বৃহৎ দলের উপর বিজয়ী হয়েছে আল্লাহর হুকুমে। যারা ধৈর্যশীল, আল্লাহ তাদের সঙ্গে রয়েছেন (সূরা বাকারাঃ ২৪৯)।
এতে উক্ত শায়খ বললেনঃ আল্লাহ তোমাদেরকে সুসংবাদে ধন্য করুন। আল্লাহর কাছে আমরা এ কামনা আর সওয়ালই করি।
পরে তিনি আমাকে জানান যে, প্রসিকিউটিং অফিসার আবেদনকারীদের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি তাঁকে বলি যে, এসব নামধামহীন আবেদনপত্রগুলো ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করুন। তাদের আবেদন সত্য হলে নাম-ধাম কেন গোপন করবে? আল্লাহ শায়খ যামলূতের প্রতি রহম করুন এবং তাকে নেক প্রতিদান দিন।
বিরোধী প্রচারপত্র ও পুস্তিকা
এ ৪/৫ জন বিরুদ্ধবাদী দলের ক্ষতিসাধনের আর কোন উপায় না দেখে অবশেষে মিথ্যা প্রচারপত্র, পুস্তিকা এবং অলীক কাহিনী ছেপে বিতরণ করার উপায় অবলম্বন করে। এসব প্রচারপত্র আর পুস্তিকায় তারা মিছেমিছি প্রচার চালায়। এ দলের মধ্যে ব্যক্তি স্বাধীনতার কোন মূল্য নেই এবং সুরাভিত্তিক বিধানও তারা মেনে চলে না ইত্যাদি ইত্যাদি। মজার ব্যাপার এই যে, তারা নিজেদের বক্তব্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এই বলে যে, তাদের কর্মপরিষদ আর জেনারেল পরিষদ উভয়ই হাসানুল বান্নার কোন কথার বিরোধিতা করে না, বরং অন্ধভাবেই তাকে অণুসরণ করে। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, কর্মপরিষদ আর জেনারেল কাউন্সিলের পরামর্শই যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে শূরার অস্তিত্বহীনতা কিভাবে প্রমাণ হয়? শূরা আর মতামতের স্বাধীনতার এ অর্থ কেমন করে হতে পারে যে, বিরোধিতা আর বিদ্রোহের পথই ধরতে হবে।
তারা বলতোঃ ইসমাঈলিয়ার অর্থ কায়রোয় ব্যয় করা হচ্ছে এবং ওস্তাদ এ অর্থ কায়রোয় তার ভাইয়ের কাছে প্রেরণ করছে। তেমনিভাবে ইসমাঈলিয়ার টাকাকড়ি পোর্ট সাঈদ আর আবূ ছবীরেও ব্যয় করা হচ্ছে। এর অর্থ যেন এ দাঁড়া যে, ইসলামী আন্দোলনের পতাকাবাদীর জন্য কোন আত্মীয়ের সহায়তা গ্রহণ করা নাজায়েয হবে- সে আত্মীয় ঈমান আর যোগ্যতায় যতই বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী হোক না কেন। বরং তাদের কর্তব্য হ হচ্ছে অপবদা থেকেমুক্ত থাকতে হলে আত্মীয়স্বজনকে নিজের বৃত্ত থেকে বের করে দিতে হবে, সে আত্মীয়ের অস্তিত্ব আন্দোলনের জন্য যতই উপকারী ও কল্যাণকর হোন না কেন। কিন্তু আন্দোলনের নেতাদের ভাই-বন্ধু হওয়া কি সামান্য অপরাধ? আর এ আত্মীয়তা তাদের উপর এ বিপদও নিয়ে আসে যে, জীবনের প্রতিযোগিতায় তাদেরকে পেছনে ঠেলে দেয়া হয়। আমাদেরকে করা হয় অগ্রসর। বিরুদ্ধবাসীরা কখনো বলতোঃ মসজিদের হিসাব একনো সকলকে জানানো হয়নি। মসজিদের আমদানী সম্পর্কে আমরা জানি না কতো আমদানী হয়েছে টেন্ডার ছাড়াই। তা ক্রয় করা হয়েছে বেআইনিভাবে। এ সম্পর্কে জানার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে।
এরা যে মনগড়া রিপোর্ট ছাপছে, তা জানতে পেরে আমি সে দলের মুল্য হোতার ঘরে গমন করি। তিনি বুদ্ধিমান লোক। বয়স আর আন্দোলনের কাজে প্রবীন বিধায় আমি তাকে শ্রদ্ধা করতাম। আমিতাকে জিজ্হেস করলাম, তোমরা নাকি এসব কিছু করছো? তিনি জবাব দানে বিরত থাকেন। আমি যন্ত্রস্থ রিপোর্টের অংশবিশেষ বের করে তাঁকে দেখালে বাধ্য হয়ে তাকে স্বীকার করতে হয় যে, বিপোর্টটা ছাপ হচ্ছে।
আমি বললাম, জনাব, কোন দোষ নেই, আপনারা যা ইচ্ছা, করতে পারেন। রিপোর্ট প্রকাশ না করার জন্য মিনতি জানাতে বা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অভিযান চালনা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ জানাতে আমি আপনার কাছে আসিনি। আপনার মতামতের মালিক আপনিক, যা ইচ্ছা করতে পারেন। কিন্তু আমি জানি এবং এখনো মনে করি যে, আপনি একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি। শুভাশুভ বিচার করা হয় সমস্ত কাজের পরিণতি দিয়েই। প্রতিহিংসা কোন ফল বয়ে আনে না। এ রিপোর্ট প্রকাশ করে আপনারা কি আশা করতে পারেন?
তিনি বললেনঃ আমরা জনমত সৃষ্টি এবং প্রকৃত সত্য সম্পর্কে জনগণকে অবগত করাতে চাই।
বললামঃ আপনারা যাতে সত্য মনে করেন, আমি তাকে সরাসরি মিথ্যা মনে করি। কাজেই তা নিয়ে আমি বিতর্কে প্রবৃত্ত হতে চাই না। কিন্তু আমি জানতে চাই যে, আপনারা কি মনে করেন আমরা এ রিপোর্টের জবাব দিতে অক্ষম? অথবা আপনারা কি জনগণকে বুঝাতে পারবেন যে, আপনারা সত্য আর আমরা মিথ্যা? তোমাদের হাতে আছে কেবল অন্তসারশূণ্য দাবী আর আমাদের হাতে আছে আইনগত দলীল প্রমাণ। আসল ব্যাপার আপনিইতো সকলের চেয়ে ভালো জানেনঃ মসজিদের হিসাবপত্র আপনার হাতেই ছিল। মাদ্রাসার জন্য যেসব সরঞ্জাম ক্রয় করা হয়েছে, তাতে আপনিও জড়িত ছিলেন। মসজিদও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশির ভাগ জিনিসপত্র আপনার মাধ্যমেই কেনা হয়েছে। সুতরাং আপনরা জনগণক অবহিত করলে তাতে আপনাদের নয়, বরং আমাদেরই লাভ হবে। তাছাড়া প্রচার-প্রসারের উপকরণও আমাদের রয়েছে। জনগণের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ। আমরা বিষয়টি জুম্মার ভাষণে প্রচার করতে পারি, লিখিতভাবে ছড়াতে পারি, জনগণের সঙ্গে কথাবার্তা প্রকাশ করতে পারি, সভা-সমাবেশ করতে পারি, দারস আর ওয়অজে এ সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারি, মসজিদ, বাজার, চা দোকান এবং রাস্তাঘাটে ছড়াতে পারি। আসল কথা প্রকাশ করার জন্য আমাদের অনেক ভাষা আর অনেক কলম আছে। আর সত্য তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
আমার কাছে এতে কেবল একটা বিষয়ই কষ্টদায়ক, আর তা হচ্ছে এই যে, গতকাল পর্যন্ত আমি আপনাকে পিতার মতো শ্রদ্ধা করতাম। আর এ যুবকদেরকে আমি পরিচয় করাতাম ইসলামের সূর্য সন্তান হিসাবে। আর এখন আপনারা যে ভূমিকা অবলম্বন করছেন, তাতে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনাদেরকে মন্দছন্দ বলতে বাধ্য হবো। ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে আপনাদের প্রলাপোক্তি, অপবাদ আরোপ, গাদ্দারী-খেয়ানত আর নিমকহারামী ইত্যাদি শব্দ এখন আমাকে ব্যবহার করতে হবে আপনাদের বিরুদ্ধে। এ দৃশ্যটা কল্পনা করতেও আমার কষ্ট হয়, আমার অন্তর কেঁপে উঠে। যদিএ মূলনীতি সাধারণ্যে প্রচলিত রয়েছে যে সূচনাকারী বড় যালিম। (************) জনৈক আরব কবি বলেনঃ
**********************************
যারা আমাদের নিকট অতীব প্রীয়, আমরা তাদেরও মাথার খুলী উড়িয়ে দেই। কারণ, তারা বড়ই নাফরমান ও যালিম হয়ে বসেছে।
এ শোক-দুঃখে আরো সংযোজন হয় একথা ভেবে যে, এসব প্রতিশোধমূলক চেষ্টার কোন ফল হবে না। কোন লাভ হবে না এত গলদঘর্ম হয়ে। এ সংঘাতে একে অপরের সম্ভ্রমহানীর কোন ফলই পাওয়া যাবে না। সবই হবে পণ্ডুশ্রম। এ সংঘাত থেকে আপনার দূরে থাকার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আপনার জন্য এর পরিণতি কি হতে পারে, তা আপনার অজানা নয়। যদি নিছক প্রতিশোধ গ্রহণই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে এতে কোন কল্যাণ নেই। আর যদি উপদেশ ও কল্যাণ কামনা লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে তাতো আপনারা করেছেন। লোকেরা জানতে পরেছে যে, আপনারা কি বলতে চান। বরং এটাই তোমাদের জন্য যথেষ্ট যে, আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং সব খবর রাখেন। মোটকথা তোমাদের চেষ্টা- চরিত্র আর বিরোধিতা ও শক্রতা যদি আল্লাহর সম্তুষ্টি কামনায় হয়ে থাকে তবে জেনে রাখবে যে, আল্লাহ অন্তর্যামী।
আমার কথাগুলো দ্বারা তিনি প্রভাতি হন। আমাকে তিনি কথা দেন যে, রিপোর্টটি তিনি প্রকাশ করতে দেবেন না এবং এর খসড়া পাণ্ডুলিপি তিনি প্রেস থেকে ফেরৎ আনাবেন। তাঁর কাছ থেকে এ প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমি ফিরে আসি।
একটা দারস এবং তার প্রভাব
আমার মনে আছে, এসব ঘটনাকালে আমি সাধারণ শ্রোতাদের সম্মুখে একটা দারস পেশ করি। এর বিষয়বস্তু ছিল: অন্তর পবিত্র করার ফযীলত, সকল মানুষের কল্যাণ কামনা এবং বিবাদমান পক্ষদ্বয়ের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন। দারস দান শেষে আমি নিভৃত কক্ষে গিয়ে বসি এবং অন্তরের সঙ্গে আমার তিক্ত কথাবার্তা হয। আমি অন্তরকে লক্ষ্য করে বলি: হাসান! তুমিতো অন্যদেরকে ভালো কাজের নির্দেশ দাও কিন্তু নিজেকে ভুলে যাও। এটা কি মোনাফেকী আচরণ নয়? যে ব্যক্তী কথা আর কাজে এক, এমন লোককে আল্লাহ পসন্দ করেন। আর হঠকারী এবং ঝগড়াটে ব্যক্তি তার নিকট সবচেয়ে বেশি ঘৃণ্য। আল্লাহর নবী বলেছেনঃ
**********************************
আমি কি তোমাদেরকে সে কাজের কথা বলে দেবো না, যা নামায-রোযা এবং ছদকার চেয়েও কয়েকগুণ উত্তম। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অবশ্যই বলবেন। আল্লাহর নবী বললেনঃ মানুষের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন করা। মানুষকে সংঘাতে জড়ানো এমন একটা ফেৎনা, যা মুন্ডন করে ছাড়ে। আমি বলছি না যে কেশ মুন্ডন করে, বরং দ্বীনকেই মুন্ডন করে ছাড়ে। (দ্বীনেরই বিনাশ সাধন করে)।
আর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
**********************************
তবে তাদের উভয়ের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করায় কোন পাপ নেই। আর সন্ধি-সমঝোতা উত্তম (সূরা নিসাঃ ১২৮)।
নিঃসন্দেহে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সত্য বলেছেনঃ কিন্তু আমি অন্যদেরকে উপদেশ দেই আর নিজেকে ভুলে যাই। এ রীতি কিছুতেই ঠিক নয়। অন্তরের পরিচ্ছন্নতা আর নাফসের পরিশুদ্ধি অপরিহার্য। ক্রোধ আর উম্মা দমন করতে হবে এবং নিজের স্বার্থে প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা ভস্ম করে দিতে হবে। সুতরাং সর্বপ্রথম এ সংশোধনমূলক কাজ আমাকে নিজের উপর পরীক্ষা করতে হবে। যদিও আমি কোন গুনাহের কাজ করিনি এবং বাড়াবাড়ির সূচনাও আমার পক্ষ থেকে হয়নি; কিন্তু তার পরও আমাকে এ পরীক্ষা চালাতে হবে। আমি কলম তুলে নেই এবং প্রতিপক্ষের হোতার নিকট একখানা পত্র লিখি। তাতে আমি লিখিঃ
অতীতকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হতে আমি পুরাপুরী প্রস্তুত। প্রতিপক্ষের লোকেরা চাইলে ইখওয়ানের সারীতে তাদেরকে ফিরায়ে নেয়া যায়। তারা উদারতার ভিত্তিতে আমার এ প্রস্তাব মেনে নিলে আল্লাহ তাদের আমল কবুল করবেন। আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। তাদেরকেও ভুলে যেতে হবে, ক্ষমা করতে হবে। সত্যকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করার মূলনীতি অনুযায়ীও তারা যদি পারস্পরিক শুভ্রতা- পরিশুদ্ধি চায়, সেজন্যও আমি প্রস্তুত আছি। সালিস নিযুক্তির অধিকারও তাদেরকে দিচ্ছি। তারা যাকে খুশী সালিশ নিযুক্ত করতে পারে। আমি তাদের সামনে বিষয়টা উত্থাপন করবো। এবং সালিশের রায় শিরোধার্য করে নেবো। এমন ঘোষণা পূর্বাহ্নেই দিয়ে রাখছি।
এ ভূমিকার পর আমি পতে আমার এ মতের কারণও স্পষ্ট উল্লেখ করেছি যে, একটি দারস দেয়ার পর আমার মনের এ অবস্থা হয়েছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, যেন আমি সেসব লোকের অন্তর্ভুক্ত না হই, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেনঃ
**********************************
ঈমানদারগণ! তোমরা যা কর না, তা কেন বল। তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর নিকট অত্যন্ত অসন্তোষজনক (সূরা ছাফঃ ২-৩)।
কিন্তু পত্রের এ একটি ছত্র থেকে আবেগ উৎসারিত হলেও তাদের উপর তা কোন ক্রিয়া করেনি। আমি নিজে গিয়ে এ পত্র দিয়ে আসতে চেয়েছিলাম প্রতিপক্ষের ক্রীড়নকের বাসায়। কিন্তু ইখওয়ানরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং পত্র প্রেরণ থেকে আমাকে বারণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকি এবং নিজে গিয়ে তার হাতে পত্র হস্তান্তর করতে পীড়াপীড়ি করি। ব্যাপারটা ইখওয়ানের কাছে ব্মিয়কর মনে হয়। কিন্তু সত্যকথা এই যে, আমি আমার এ দুর্বলতার মধ্যে- যাকে আমি সবলতা মনে করি এবং এখনো তাই মনে করছি- বিরাট স্বাদ অনুভব করছিলাম। কারণ, এ দুবর্লতা ছিল আল্লাহর নির্দেশের অধীনে।
সত্যবাণী
সে পত্রের আন্তরিকতা মাখা কথাগুলো পাষাণপ্রাণ ব্যক্তিদের অন্তরে স্থান পায়নি। আর রিপোর্ট প্রকাশ না করার প্রতিশ্রুতিও সে ‘বুদ্ধিমান’ ব্যক্তি রক্ষা করেননি। কারণ, তাদের একজন অন্যান্যদের বিরোধিতার মুখে রিপোর্ট নিজের নামে প্রকাশ করতে উদ্যত হয়। কার্যতঃ রিপোর্ট ছাপা আর বিলিও করা হয়। পোর্ট সাঈদ এবং আবু ছাবীর ইসমাঈলিয়া থেকে খুব একটা দূরে নয়। সেখানে তা বিলি করা হলে স্থানীয় ইখওয়ানের পক্ষ থেকে ‘সত্যের বাণী’ বা ‘কালেমাতুল হক’ নাম রিপোর্টেল প্রতিবাদ লেখা হয়। রিপোর্ট আর তার প্রতিবাদ সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আন্দোলনের দিকে আকৃষ্ট করে। আন্দোলনের সকল কর্মকাণ্ডে জনগণ আগ্রহী হয়ে উঠে। ফলে বিরোধী প্রোপাগান্ডা আন্দোলনের প্রসারে বিরাট সহায়কের ভূমিকা পালন করে।
আসল আদালতে
ইখওয়ানের বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা অভিযোগের প্রসঙ্গটি আদালতে উত্থাপন করবো না বলে কর্মপরিষদকে আমিকথা দিয়েছিলাম। একদিন এশার নামাযের পর মসজিদের ভিতরের বারান্দায় আমরা একত্র হই। আমি অধিবেশন উদ্বোধন করি। আমি আলোচ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করবো, এমন সময় নামায শেষে বসে থাকা মুসল্লীদের একজন উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত শুরু করেঃ
**********************************
এমনিভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য শক্র করেছি মানব এবং জিন শয়তানকে। তারা ধোঁকা দেয়ার জন্য একে অপরকে কারুকার্যময় কথাবার্তা শিক্ষা দেয়। তোমার পালনকর্তা চাইলে তারা এ কাজ করতো না। অতএব তুমি তাদেরকে এবং তাদের মিথ্যা অপবাদকে মুক্ত ছেড়ে দাও, যাতে কারুকার্যখচিত বাক্যের প্রতি তাদের মন আকৃষ্ট হয়, আর পরকালে বিশ্বাস করে না তারা একেও পসন্দ করে নেয় এবং যাতে তারা ঐসব কাজ করে, যা তারা করছে। তবে কি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকোন বিচারক অনুসন্ধান করবো, অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি বিস্তারিত গ্রন্হ নাযিল করেছেন। আমরা যাদেরকে গ্রন্হ প্রদান করেছি, তারা নিশ্চিত জানে যে, এটি হবে না। তোমার পালনকর্তার বাক্য পূর্ণ সত্য ও সুক্ষ্ম। তাঁর বাক্যের কোন রদবদলকারী নেই। আর তিনিই মহাশ্রবণকারী, মহাজ্ঞাণী (সূরা আল-আনআমঃ ১১২-১১৫)।
উক্ত মুসল্লী নিজে থেকে তিলাওয়াত করছিলেন। তাহলেও তার আওয়াজ ছিল বেশ বুলূন্দ। আমরা সকলে কান পেতে তার তিলাওয়াত শুনছিলাম। লোকটি তিলাওয়াত শেষ করে চুপ। এদিকে আমিও বোবা সেজে বসে আছি। ইখওয়ানরা বললেনঃ আমরা কেন এখানে বসেছি? আমি বললাম, আয়াতটি আমাদের সিদ্ধান করে দিয়েছে। আমি একত্র হওয়ার উদ্দেশ্যে সবিস্তারে আলোচনা করি এবং সব শেসে বলি, এখন আমি এজেন্ডা থেকে আদালতে মামলা দায়ের করার প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করছি। বিচারক হিসাবে আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তাঁর ফয়সালা সুবিচারভিত্তিক এবং তিনি সবচেয়ে বড় ন্যায়বিচারক।
ষড়যন্ত্রের হোতা মওলবী সাহেবের পরিণতি
এসব ঘটনা ঘটছিল আর সে মওলবী সাহেব, যিনি ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ান কর্মকর্তা হওয়ার খাহেশ পোষণ করছিলেন, তিনি তখনো ইখওয়ানের একটা মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসাবে কাজ করছিলেন। তিনি দূরে থেকে এ ষড়যন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন। তিনি বেশ সূক্ষ্ম চাল চালছিলেন। কিন্তু তিনি এমনই সতর্ক ছিলেন যে, কোন অভিযোগ উঠলে তা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিতেন। আর আমিও অনুমানের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাইছিলাম না। কারণ, এর ফলে আসল ব্যাপারে কোন পার্থক্য দেখা দেবে না। তাঁর সমর্থক ইখওয়ানরা এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন এবং তাদের কাজ শেষ হয়েছে। আমি সবসময় এ আশা পোষণ করতাম যে, তার মতো একজন বিচক্ষণ আলিম এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাহিত্যিক সত্যপথে ফিরে আসবেন এবং অন্যদেরকেও ফিরায়ে আনার ব্যাপারে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন।
কিন্তু আমার এ আকাঙ্খা ছাইয়ে পর্যবসিত হয়েছে। তিনি ষড়যন্ত্রে ইন্ধন যোগাচ্ছিলেন। তবে এমনভাবে যে, সে জন্য তাদে দায়ী করা যায় না। শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্র তীব্র হয়ে উঠে এবং বিষয়টা সীমাতিক্রম করে যায়। ঘটনাচক্রে একবার তিনি হাতেনাতে ধরা পড়ে যান। আর তা এভাবে যে, একবার সারা রাত আমার ঘুম হয়নি। ফজরের ঘন্টা দেড়ঘন্টা আগে নামাজের জন্য আমি আব্বাসী মসজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। পথে ছিল বিরোধীদের একজনের বাসা। দেখলাম বাসায় বেশ আলো জ্বলছে। জানালা খোলঅ। ভেতরে বেশ আলঅপ আলোচনা চলছে। জোরে জোরে কথা শোনা যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে দেখি, মওলবী সাহেব বসা। তার চারদিকে বিরোধীরা। আর মওলবী সাহেব তাদেরকে চক্রান্ত আর শক্রতার তত্ত্ব বুঝাচ্ছেন। এ অবস্থা দেখে আমি আমার পথে এগিয়ে যাই। সকালে আমি তাকে তলব করি। বেশ নম্রতার সঙ্গে নানাকথার ফাঁকে জানতে চাই, রাত কোথায় কাটালেন? জবাবে তিনি আমাকে এক দীর্ঘ কাহিনী শুনালেন, যার সমাপ্তি এরকম, তিনি নিজের বাসায় রাত কাটিয়েছেন।
এরপর আমি শুরু করা ফেৎনা আর তার প্রভাব-পরিণতির দিকে আলোচনার মোড় ঘুরাই। এদিকেও ইঙ্গিত করি যে, লোকে বলে এবং নানা বর্ণনাও পাওয়া যায় যে, এ ফেৎনায় আপনারও অংশ আছে। তিনি তৎক্ষণাৎ নিজেকে মুক্ত জাহির করেন এবং এ ‘অপবাদ’ মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এবং এভাবে জাহির করতে লাগলেন যেন তিনি ধোয়া তুলসি পাতা। বরং তিনি যে নির্দোষ, তার স্বপক্ষে তিনি নানা রকম প্রমাণ উপস্থাপন করা শুরু করলেন। আমি শুনে আঙ্গুলে কামড় দেই যে, হেরফের করার কতো ক্ষমতা আর যোগ্যতা তার। শেষ পর্যন্ত নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য তিনি বিবি তালাকের কসম খেতেও উদ্যত হন।
এবার আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। তার মুখ চেপে ধরে চিৎকার দিয়ে বললাম, আল্লাহ ভয় কর। মিথ্যা কসম করবে না। এরপর জিজ্ঞেস করলাম, রাত্রে এতক্ষণ সময় তুমি কোথায় ছিলে? এবার তার বীরত্ব শেষ। সে হতভম্ব। কোন জবাব বানাবার চেষ্টা করে; কিন্তু তার মুখ রুদ্ধ হয়ে যায়। আমি তাকে আর সুযোগ না দিয়ে আসল তত্ত্ব তার কাছে ফাঁস করি। এবং তার অনস্বীকার্য প্রমাণও দেই। আমি তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেই যে, কেউ আমাকে বলেনি, বরং আমি নিজেই তোমার চালবাজী প্রত্যক্ষ করেছি। এখন তাকে বাধ্য হয়ে অপরাধ স্বীকার করতে হয়েছে। বলতে লাগে, আমি নিতান্ত লজ্জিত এবং কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। আপনি আমার প্রতি দয়া করুন।
আমি বললাম, ভয়ের কোন কারণ নেই। তুমি নিশ্চিত থাকতে পার যে, তোমার কোন ক্ষীত করার কথা আমি ভাবতেও পরি না। কারণ, আমার পক্সে এমন ধারণা করাও অসম্ভব। কাল পর্যন্ত তোমার প্রশংসায় আমি ছিলাম পঞ্চমুখ। তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আমি তোমার পেছনে নামায পড়তাম। আমি নিজে তোমার দারসে হাযির হতাম এবং অন্যদেরকে হাযির হওয়ার জন্য বলতাম। আর আজ আমি তোমার বদনাম করবো, হাটে হাঁড়ি ভাঙবো, তোমার অপরাধের কথা প্রচার করবো। এমন অবস্থার কথা আমি ভাবতেও পারি না। তবে আমি এটা বরদাশত করতে পারি না যে, তুমি দাওয়াত আর বাস্তব জীবনে আমার সঙ্গী হবে। তোমার সম্মুখে দুটা রাস্তা আছে, এর যেকোন একটা অবলম্বন করবে। হয় তুমি ইসমাইলিয়ায় থাকবে, আমি আল্লাহ চাহেন তো তোমার জন্য কোন কাজের ব্যবস্থা করে দেবো। কিন্তু তা হবে ইখওয়ানের পরিমণ্ডলের বাইরে। এ অবস্থায় বর্তমান চাকুরী থেকে সরে দাঁড়াবার কোন যুক্তি সঙ্গত এবং গ্রহণযোগ্য কারণ উল্লেখ করতে হবে। আর দ্বিতীয় রাস্তা এই যে, তুমি নিজ শহরে ফিরে যাবে। আমি তোমাকে সেখান পর্যন্ত পৌঁছাবো। তুমি নিরাপদ স্থানে না পৌছা পর্যন্ত আমি তোমার সকল আরাম-আয়েশের দায়িত্ব নেবো। আল্লাহ আমাদের সকলের কর্মবিধায়ক। তিনি আমাদের সাক্ষী। তিনি দ্বিতীয়টি গ্রহণ করেন, তবে শর্ত দেন যে, তাঁর ঋণ আমাকে শোধ করতে হবে। আমি তার ঋণ শোধ করি। এরপর তিনি যথারীতি ইস্তফা দেন এবং একই সঙ্গে কেন্দ্র আর মাদ্রাসার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
মওলবী সাহেব দেওয়ানী আদালতে
কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি নিজ শহরে ফিরে যাননি। একদিন আমি একটা ঘোষণা শুনতে পেলাম যে, ইসমাঈলিয়ায় তার পরিচালনায় একটা নতুন স্কুল খোলা হয়েছে। যে পাঁচজনের সঙ্গে তার গাঁটছাড়া ছিল, তাদের সমন্বয়ে একটা তত্ত্বাবধায়ক কমিটিও গঠিত হয়েছে। ঘোষণায় ইখওয়ানের চেষ্টা-সাধনা আর মাদ্রাসারও তীব্র সমালোচনা করা হয। আমি মনে মনে বলি: ভালই হলো। আমাদের থেকে তার দূরে থাকাই ছিল আসল দরকার। এরপর যা ইচ্ছা, তা করুন।
কিন্তু একদিন আমি স্থানীয় আদালত থেকে একটা নোটিশ পাই যে, মওলবী সাহেব ইখওয়ানের সঙ্গে যে সময়টা অতিবাহিত করেছেন, তার জন্য পারিশ্রমিক দাবী করছেন। তাঁর এ পারিশ্রমিক ছিল অতি নগণ্য পরিমাণ। কিন্তু এ সামান্য পরিমাণও আদালতের মাধ্যমে দাবী করতেই তাঁর আগ্রহ হয়েছে। অতচ আমার কাছে এমন কাগজ পত্র আছে, যা তার প্রাপ্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী ঋণ প্রমাণ করে। যাই হোক, আমি নিজে আদালতে উপস্থিত হই। মওলবী সাহেব তার দাবী পেশ করেন। আমি তার দাবী মেনে নেই। তবে আমি জজের সামনে সেসব কাগজপত্রও উপস্থিত করি, যা আমার কাছে ছিল। জজ সেসব কাগজপত্র আইনতঃ গ্রাহ্য বলে রায় দেন এবং তার মামলা খারিজ করে দেন। মামলার খরচও তার উপর চাপান। যে মাদ্রসার জন্য ঢাকাঢোল পিটায়ে ঘোষণা প্রচার করা হয়, টিকে থাকার তার ভাগ্যে জুটেনি। বরং খোলার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। মওলবী সাহেবও ইসমাঈলিয়ায় টিকতে পারেননি। তাকে সেখান থেকে চলে যেতে হয়।
এ দীর্ঘ কাহিনী ডাইরিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমি সে মওলবী সাহেবের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। আজ তিনি আমাদের দেশের উত্তম আলিমদের মধ্যে একজন। এবং আমাদেরও অন্যতম উত্তম বন্ধু। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তা অতীত হয়ে গেছে আর তাঁর স্মৃতিও অতীত কাহিনী। হতে পারে তখনো তার কোন ওযর ছিল আর আমরা শুধু শুধু তাকে তিরস্কার করেছি। অন্তরের গোপন রহস্য আল্লাহই ভালো জানেন।
বিবাহ ও বদলী
দাওয়াতী জেন্দেগীর শুরু থেকে যেসব পরীক্ষা আর ফেৎনা আমার জন্য আস্মিক বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছিল, হয়তো তার আঘাত হালকা করাই ছিল মহান আল্লাহর ইচ্ছা। এসব ফেৎনা আর পরীক্ষা ছিল আমার জন্য বিস্ময়কর সবক, বিস্ময়ের জগতে অবগাহন করে একের পর এক আমি যা হাসিল করেছি। আল্লাহর অনুগ্রহ সেসব ফেৎনার ক্ষতিকর প্রভাব দূর করে দিতো এবং তার মধ্য থেকে আমাদের জন্য এমন কল্যাণ উদগত করতো, যাতে আমরা চিৎকার করে উঠতাম: দুশমন যে অনিষ্ঠ ঘটায়, তাতেই আমাদের মঙ্গল নিহিত।
ইসলামী আন্দোলনকে চতুর্মুখী লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হয়। অজ্ঞ দুশনও তার বিরোধিতা করে, আন্দোলনৈর সঙ্গে যাদের কোন সম্পর্ক নেই। তারাও যুদ্ধে লিপ্ত হয়, যারা আন্দোলনকে জানে-বুঝে, তারাও তার বিরুদ্ধে মাঠে নামে। এমন কিছু বিরোধীও আছে, যারা কর্মী হিসাবে আন্দোলনে যোগ দেয়, কিন্তু তা করে স্বার্থবিদ্ধির জন্য। এ চতুর্মুখী লড়াইয়ের জন্য আমি অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে আসছি। আমার সে অস্ত্র হচ্ছে ছবর, আত্মসংযম এবং উত্তম চরিত্র। যে সব নিষ্ঠাবান ব্যক্তির উপর আমাদের পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে, আর তাদেরকে ইন্ধন যোগানোর জন্য এমনকিছু লোক রয়েছে, যারা আন্দোলনের ছায়াতলে আন্দোলনের সংস্থাগুলোতেই প্রতিপালিত হচ্ছে। তারাও বিরোধিতার পতাকা তুলতে পারে আর এ বিরোধিতার কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকে না। এসব কিছুই হয় নিষ্ফল প্রয়াস, তখন এ পরিস্থিতিটা হয় বিস্ময়কর। আর আল্লাহর সৃষ্টি কতো বিচিত্র রঙ্গের।
আল্লাহ আমার জন্য বিবাহের সুযোগ করে দেন। নিতান্ত সহজ অনাড়ম্বরভাবে আমার বিবাহ সম্পন্ন হয়। প্রথম রমযান বিবাহ ঠিক হয় এবং ২৭ রমযান রাত্রে মসজিদে বিবাহ সম্পন্ন হয়। যিলকদের ১০ তারিখ ঘরে তুলে আনি। আর এভাবে আল্লাহর ইচ্ছা পুর্ণ হয়। আলহামদুলিল্লাহ।
বিবাহের পর আমি মনে করি যে, ইসমাঈলিয়ার অভ্যন্তরে এখন আমার মিশন পুর্ণ হয়েছে। আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে। আন্দোলনের অনেক প্রতিষ্ঠান আর সংস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। ইসমাঈলিয়ার সমস্ত অধিবাসী ইখওয়ান- ভাই ভাই হয়েছে। সুতরাং এখন আর কেন আমাকে এখানে বসে থাকতে হবে? কী তার প্রয়োজন? আমার অনুভূতি জাগলো, এবার এখান থেকে আমাকে বদলি করা হবে। ১৯৩২ সালের গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়। আমি মহান ওস্তাদ শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব নাজ্জার-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। আমরা দুজন দীর্ঘক্ষণ আলাপচারিতায় নিরত থাকি। ইসমাঈলিয়ায় আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি নিয়েও আলোচনা হয়। আমি তাঁকে একথাও বলে দেই যে, আমার মন বলছে, অবিলম্বে ইসমাঈলিয়া ত্যাগ করবো আমি তাঁর কাছে আবেদন জানাই যে, ওস্তাদ বাতরাবীর সঙ্গে আলোচনা করবেন যে, আমি কায়রোয় বদলী হতে আগ্রহী। ওস্তাদ নাজ্জার ওস্তাদ বাতরাবীর সঙ্গে কথা বলে আমাকে জানান যে, বদলীর জন্য আমাকে দরখাস্ত করতে হবে। আমি তখনই একটা দরখাস্ত লিখে দেই। আল্লাহ তা’আলা আমার খাহেশ পুর্ণ করের। ১৯৩২ সালের অক্টোবর মাসে আমাকে কায়রোয় বদলি করা হয়।
**********************************
ডাইরীর উর্দু অনুবাদক মরহুম খলীল হামেদী লিখেন।
মরহুম হাসানুল বান্নার ডাইরীর প্রথম অংশ এখানে শেষ। কায়রোর জীবন সম্পর্কে তিনি ব্যক্তিগত ডাইরী লিপিবদ্ধ করেননি। অক্টোবর ১৯৩২ সাল থেকে ফ্রেরুয়ারি ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি কায়রোয় অবস্থান করেন। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে অবশেষে শাহাদাতের পেয়ালঅ পান করেন। ডায়রীর দ্বিতীয় অংশ ব্যক্তিগত ডায়রীর পরিবর্তে দলের রিপোর্ট, প্রোগ্রাম এবং অন্যঅন্য তৎপরতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ইনশাআল্লাহ দ্বিতীয় অংশও অদূর ভবিষ্যতে পাঠকদের সম্মুখে উপস্থাপন করা হবে।
লাহোরস্থ ইসলামিক পাবলিকেশন্স-এর বর্তমান ম্যানেজার জনাব আফযাল মুনীর এক পত্রে আমাকে জানান যে, ডাইরীর দ্বিতীয় খন্ড এখনো প্রকাশিত হয়নি। মূল আরবী ডাইরী কোন সহৃদয় পাঠক সরবরাহ করতে পারলে পাঠকদের আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে তা যথাসময়ে অনুবাদ করে প্রকাশ করা হবে ইনশাআল্লাহ-অনুবাদক।
–০–