গোপন পুলিশ
আমার স্মরণ আছে যে, এ সফরে দীরব নজম-এর নিকট একটা স্থানে এসে আমরা দাঁড়াই। আমাদের সম্মুখে ছিল কয়েকটা আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তা। কোন পথে যেতে হবে, আমরা বুঝে উঠতে পারছিলামনা। কাউকে জিজ্ঞেস করে নেয়ার জন্য এদিক সেদিক ছুটাছুটি করে আমরা লোক খুঁজছিলাম। কিন্তু রাস্তায় বা ক্ষেত খামারে আমরা কাউকেই পেলামনা। অবশেষে এক বন্ধু কর্পোরাল মুহাম্মদ শালাশ-এর কথা আমাদের মনে পড়লো। তখন তিনি রাওজুল ফারাজ ব্রাঞ্চে কর্মরত ছিলেন। এ সফরে আমাদের সঙ্গী হওয়ার আগ্রহ ছিল তাঁর। আমাদের মনে পড়লো যে, তাঁর কাছে পুলিশের হুইসেল আছে। তিনি হুইসেল বের করে বাজালেন। হুইসেলের আওয়াজ শুনে চতুর্দিক থেকে সিপাহীলা ছুটে আসে! একজন সেপাহী এগিয়ে এসে সেলুট দেয়। তিনি জানতে চান, কে আমরা? মুহাম্মদ শালাশ জবাব দেন, ইন্টেলিজেন্স। এরপর তাঁর কানে কানে কিছু বললেন। পরে তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, পথ কোন দিকে? সিপাহী নিতান্ত সম্মানের সঙ্গে আমাদেরকে পথ বলে দেয়। আমরা সঠিক পথ ধরি। আমি ভাই শালাশকে বললাম, তুমি মিথ্যা বললে কেন? ভাই শালাশ মৃদু হেসে বললেন, আমি মিথ্যা বলিনি। আমরাতো সত্য ও কল্যাণের পথ প্রদর্শক। আমি তাকে অন্য কিছু বললে সে আমাদেরকে থানায় নিয়ে যেতো। এছাড়া অন্য কিছুতে সে মোটেই রাজী হতোনা। আর থানায় নিয়ে গেলে না জানি সেখানে কি আচরণ করা হতো। হয়তো সকাল পর্যন্ত আমাদেরকে থানায় বসে থাকতে হতো। আমাদের হাতে একেবারেই সময় নেই। এ ছিল একটা অবাক কান্ড। আর উদ্ধার পাওয়অর উপায় ছিল আরো বেশী অবাক করার মতো।
সরকারের বিরোধিতার অভিযোগ
মসজিদের নির্মাণ কাজে আমরা সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যাই। ইমারত দাঁড়ায় এবং তা শেষ পর্যায়ে পৌঁছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীব্রতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। চারিদিক থেকে স্বার্থপর লোকেরা উঠে দাঁড়ায় এবং ভালো কাজ সম্পন্ন করায় অন্তরায় সৃষ্টি করতে শুরু করে। আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র করা, চোগলখোরী করা এবং বেনামী দরখাস্ত লিখে ইসমাঈলিয়ার ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এবং অন্যঅন্য ঊর্ধতন সরকারী কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করা ছাড়া অন্য কোন কৌশল অবলম্বন করার ছিলনা তাদের। এ সব চেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণিত হলে তারা একটা স্মরক লিপি প্রস্তুত করে। তাতে ইসমাঈলিয়ার কিছু অধিবাসীর স্বাক্ষর নিয়ে সরাসরি তা প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রেরণ করে। তখন সেদকী পাশা ছিলেন মিশরের প্রধানমন্ত্রী। এ স্মারক লিপিতে অবাক করার মতো কথাবার্তা উল্লেখ করা হয়। যেমন, বলা হয় যে, এ শিক্ষক-হাসানুল বান্না-কমিউনিষ্ট। মস্কোর সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। সেখান থেকে আর্থিক সাহায্য লাভ করে। সাম্প্রতিক কালে তারা একটা মসজিদ এবং কেন্দ্র নির্মাণ করছে। নিজেদের দল আর প্রচার-প্রোপাগান্ডার কাজেও অর্থ ব্যয় করে। এরা মানুষের নিকট থেকে কোন আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করে না। তাহলে এত টাকা তারা পায় কোথা থেকে? সেকালে একটা নতূন ফ্যাশন হিসাবে মিশরে কমিউনিজম প্রবেশ করছিল এবং সেদকী পাশাও কঠোর হস্তে তা দমন করছিলেন। স্মারক লিপিতে একথাও বলা হয় যে, এ শিক্ষক ওয়াফাদ পার্টির সমর্থক এবং বর্তমান সরকার অর্থাৎ সেদকী পাশার সরকারের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা বলে বেড়ায় যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ঠিক হয়নি। ১৯৩০ সালের সংবিধানও ভুল। তাই এ লোকটা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা করার জন্য রাহীরাও গমন করেছে এবং সেখানে লেবার ক্লাবে ১৯৩০ সালের অক্টোবর মাসে একটা বক্তৃতা দিয়েছে। বক্তৃতার বিষয় ছিল আবুবকর। বক্তৃতায় সে বলেছে যে, হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা) এর নির্বাচন ছিল সরাসরী। তা দু’পর্যায়ে বিভক্ত ছিলনা। সুতরাং, দু’পর্যায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বাতেল ও অবৈধ। স্মারক লিপিতে এ কথাও বলা হয় যে, এ ব্যক্তিটি আমাদের মহামান্য বাদশাহ ফুয়াদের নাম এমনভাবে উল্লেখ করে, যা এখানে বলতে আমাদের লজ্জা হচ্ছে। সে লোকটা অক্টোবর মাসে আরো একটা বক্তৃতা করেছে। যার বিষয় ছিল ওমর ইবনে আব্দুল আযীয, বক্তৃতায় সে বলেছেঃ
“হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয কখনো বায়তুল মাল থেকে এক পয়সাও গ্রহণ করেননি। কিন্তু বর্তমান কালের শাসকরা অবৈধভাবে প্রজাদের সম্পদ লুটে নিচ্ছে”।
এ সময় ওস্তাদ মাহমূদ আক্কাদকে কারাগারে আটক করা হয়। কারণ তিনি বাদশাহের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন (আব্বাস মাহমূদ আক্কাদ ছিলেন মিশরের নামকরা সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক। বাদশাহ প্রথম ফুয়াদ তাঁকে গ্রেফতার করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কিছুদিন পরই তাঁকে মুক্তি দেন এই বলে যে, ইতিহাস বাদশাহ ফুয়াদের ব্যাপারে মত প্রকাশ করবে যে, লোকটা একজন সাহিত্যিককে বন্দী করেছিল। ‘আবকারিয়াত’ নামে আক্কাকের একটা সিরিজ ইসলামের ইতিহাসের মহামূল্যবান গ্রন্হ। এতে রাসূলে করীম, খোলাফায়ে রাশেদীন অন্যান্য সাহাবী আর মহিলা সাহাবীদের জীবনী বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা স্থান পেয়েছে)। আর একই অভিযোগে আযযাহের প্রাইমারী স্কুলের চারজন শিক্ষককেও বরখাস্ত করা হয়। স্মারক লিপিতে একথাও বলা হয় যে, এ শিক্ষক শহরের অধিবাসীদের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে। আর এ চাঁদা মসজিদ-মাদ্রাসার প্রকল্পের কাজে ব্যয় করে। কিন্তু এসব সংগৃহীত চাঁদা কোথা ব্যয় করা হয়, তা কেউ জানেনা। একথা লিখার সময় তারা আগের কথা ভুলে যায়। স্মারক লিপিতে তারা উল্লেখ করে যে, সরকারী বিধান অনুযায়ী সরকারী কর্মচারীদের চাঁদা সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ। লোকটা ঠিক সরকারের নাকের ডগার উপরই লংঘন করছে সরকারী আইন।
স্মারক লিপিত এ ধরনের আরো অনেক অভিযোগ করা হয়, যার সংখ্যা ১২ পর্যন্ত পৌঁছে। এ সমস্ত অভিযোগ ছিল সরাসরী মিথ্যা আর মনগড়া। এ স্মারক লিপির বদৌলতেই আমি আল্লাহ তা’আলার এ বানীর তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিঃ
**********************************
“হে কিতাবধারীগণ! কেন তোমরা সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ করছ, আর কেন তোমরা জেনে শুনে সত্যকে গোপন করছ? (সূরা আলে ইমরানঃ ৭১)।
স্মারক লিপিতে যে ভাষণের কথা বলা হয়েছে, আসলে সে ভাষণ আমি ঠিকই দিয়েছি। উল্লেখিত তারিখ আর বিষয়ও ঠিকই আছে। কিন্তু যে বিশেষ অর্থ আর ব্যাখ্যার উল্লেখ করা হয়েছে, তা ঠিক নয়। এটা প্রচারণা আর ফেৎনা সৃষ্টিতে গভীল সিদ্ধহস্ততার একটা নমুনা। সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণে একান্ত পারদর্শী ব্যক্তিই এ কাজ করতে পারে। – আর আল্লাহ কতো রকম মানুষইনা পয়দা করেছেন! *********************
অভিযোগের তদস্ত
একদিন ভোরে আমি ক্লাশে যাচ্ছিলাম, প্রথম বা দ্বিতীয় পিরিয়ডের ক্লাশ। আমি দেখতে পাই, আমাদের প্রিন্সিপাল ওস্তাদ আহমদ হাদী সাহেব তাঁর কক্ষের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমাকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখছেন। আমি কাছে এসে বললামঃ আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ, সুপ্রভাত প্রিন্সিপাল সাহেব।
তাঁর জবাবের ভঙ্গি এমন ছিল, যা থেকে আমি বুঝতে পারলাম যে, পর্দার অন্তরালে একটা কিছু আছে। আমি বললামঃ আল্লাহর মেহেরবানীতে ভালোত? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, ভালোই আছি বটে!
আমি আবার বললামঃ কিছু একটা হয়েছে মনে হয়?
তিনি বললেনঃ ওস্তাদ হাসান, কিচ্ছা ক্রিমিনাল কোর্টের। প্রিয় বন্ধু, ক্রিমিনাল কোর্টের। আমরা সকলেই এতে জড়িয়ে গেছি।
আমি বললাম, কিভাবে এ ক্রিমিনিাল কোর্টে তবল করা হয়েছে?
প্রিন্সিপাল সাহেব বললেনঃ প্রধানমন্ত্রী পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীর নামে একটা পত্র এসেছে। এতে বলা হয়েছে যে, আপনি কমিউনিষ্ট এবং বর্তমান সরকারের বিরোধী। আপিনি শাহেরও বিরোধী এবং তামাম দুনিয়ার বিরুদ্ধে।
আমি বললামঃ কেবল এতুকুই! আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহর কসম করে বলছি, পাশা সাহেব, আমরা নিরপরাধ। আপনি আল্লাহর এ বাণী শুনে রাখুনঃ
**********************************
“আল্লাহ অবশ্যই মুমিনদেরকে হেফাযত করবেন। অকৃতজ্ঞ বিশ্বাস ঘাতকদেরকে আল্লাহ কিছুতেই জালোবাসেননা। (সূরা হজ্বঃ ৩৮)।
আর যদি আমাদের এ জিহাদ, দ্বীনের এ দাওয়াত লোকদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য হয়ে থাকে, তবে আপনি নিশ্চিৎ থাকুন যে, যারা দুনিয়ার ভয়ে দ্বীনের অন্তরালে লোকজনকে ধোঁকা দেয়, ক্রিমিনিাল কোর্ট আর জাহান্নামও তাদের জন্য সামান্য শাস্তি। সুতরাং আপনি কোন পরোওয়া করবেননা। ব্যাপারটা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিনঃ
**********************************
“আর নিপীড়নকারীরা অবিলম্বে জানতে পারবে, কোন গন্তব্য স্থলে তারা প্রত্যবর্তিত হবে (সূরা শু’আরাঃ ২২৭)।
আমি আপনাকে কসম করে বলতে পারি যে, মঙ্গল ভিন্ন এর পরিণাম অন্য কিছুই হবেনা। অনুমতি চাইছি। আমার পিরিয়ডের কিছু সময় কেটে গেছে। এটা নিয়ম-শৃংখলার পরিপন্হী, যা আমি পছন্দ করি না।
আমি প্রিন্সিপাল সাহেবকে সেখানে রেখে ক্লাশরুমে গমন করি। প্রিন্সিপাল সাহেব আমার জবাব শুনে আঙ্গুলে কামড়ান। কিন্তু আমার মনে ছিল পূর্ণ আস্থা। আমি মনে করি যে, এটা শিশু খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। এহেন আচরণের যে ফল হয়ে থাকে, এর ফলও তাই হবে। অর্থাৎ ব্যাপারটাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আবর্জনার স্তুপে নিক্ষেপ করা হবে। প্রিন্সিপাল সাহেবকে নির্দেশ দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর পত্রে যেসব বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, ভালোভাবে তা অনুসন্ধান করে দেকার জন। এ অনুসন্ধান কার্যে সব রকম উপায় অবলম্বন করার জন্যও তাঁকে বলা হয়েছে। যেসব কপিতে আমি পাঠ প্রস্তুত করি, তা-ও খুঁজে দেখতে বলা হয়েছে। ছাত্রদের মুখস্ত করা বা অধ্যয়ন করা এবং রচনা লেখার জন্য যেসব বিষয় আমি নির্ধারণ করে দেই, তারও খোজ-খবর নিতে বলা হয়েছে। সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-কর্মপন্হা এবং গতি-বিধির খোঁজ-খরব নিতেও বলা হয়েছে। এসব বিষয়ে তাঁকে স্পষ্ট রিপোর্ট আর মতামত দিতেও বলা হয়েছৈ। এ অভিযানে তিনি যা ভালো মনে করেন, তা করা ছাড়া তার কোন উপায় ছিল না। তিনি অনুসন্ধনে স্থানীয় আদালতের জজ, প্রসিকিউটিং অফিসার, পুলিশ ইন্সপেক্টর এবং ডেপুটি পুলিশ ইন্সপেক্টরের সহায়তাও গ্রহণ করেন। এসব পদের যেসব অফিসার অন্যত্র বদলী হয়ে গেছেন, চিঠি পত্রের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেও তিনি তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি এসব তথ্য সংগ্রহ করেন এবং সংগঠনের গঠনতন্ত্র, লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং তৎপরতাসহ একটা বিস্তারিত রিপোর্টও তৎসঙ্গে সংযুক্ত করেন। ছাত্রদের কপি ঘাটাঘাপি করে রচনা লিখার প্রথম যে বিষয়টা তিনি উদ্ধার করেন, তা ছিল বাদশাহ ফুয়াদের সুয়েজ খাল অঞ্চলে সফর বিষয়ে। পোর্ট সাঈদ থেকে সুয়েজ খাল পর্যন্ত এলাকায় এ সফর করেন। রচনায় বাদশাহ ফুয়াদের প্রশংসা করা হয় এবং তাঁর ভালো কীর্তির উল্লেখ করা হয়। প্রিন্সিপাল সাহেব তাঁর রিপোর্টে এ রচনাটা অক্ষরে অক্ষরে উল্লেখ করেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, একজন ছাত্রের কপিও এর সঙ্গে যুক্ত করেন। তিনি বিষয়টার প্রতি অস্বাভাবিক গুরুত্ব দেন। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল যে, তিনি ওয়াফাদ পার্টির সমর্থক। আর সরকারী পতে এ বিষয়টাকেই বড় করে দেখা হয়েছে। এ সুযোগে তিনি সত্য উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্রতিরোধও করেন।
একটা সাক্ষ্য
এ সময় একটা অবাক করার মতো ঘটনা ঘটে। তখন ইসমাঈলিয়ায় উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন কাপ্তান হাসান শরীফ নাবায়ূসী। রিপোর্ট প্রণয়ন কালে সরকারী পত্রে যেসব মিথ্যা অভিযোগের উল্লেখ ছিল, তা দেখে তিনি বিস্মিত হন। একদিন সুয়েজ কোম্পানীর অ-মিশরীয় ক্লার্কদের মধ্যে কোন একজন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে। উক্ত ক্লার্ক জিজ্ঞেস করে, আপনার চেহারায় অস্থিরতার ছায়া কেন? তিনি সব কথা খুলে বললেন। শুনে ক্লার্ক বললোঃ
এসব বাজে কথা। আমি নিজেই দেখেছি, যেদিন বাদশাহ ফুয়াদ ইসমাঈলিয়া হয়ে গমন করেন, সেদিন শায়ক হাসানুল বান্না শ্রমিকদেরকে বলেছিলেন, তোমাদেরকে উপস্থিত হয়ে বাদশাহকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করতে হবে যাতে সেখানে অবস্থানুযায়ী বিদেশীলা বুঝতে পারে যে, আমরা বাদশাহকে সম্মান করি এবং তাঁকে পছন্দ করি। এর ফলে তাদের অন্তরে স্বয়ৃং আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। তিনি একথাও বলেন যে, আমার নিজের চক্ষে দেখা সাক্ষ্য ফরাশী ভাষায় লিখে দিতেও আমি প্রস্তুত।
আমার মনে পড়ে যে, তিনি লিখিত সাক্ষ্য দান করেছেন এবং তার সাক্ষ্যও ফাইলে নথিভুক্ত করা হয়েছে। খুব সম্ভব তাঁর নাম মসিও তাওফীক ক্রুজ। আমার শেষ সময় পর্যন্ত ইনি ইসমাঈলিয়ায় ছিলেন।
আরো অবাক করার মতো একটা ঘটনা ঘটে। এ প্রসঙ্গে অপর এক পুলিশ অফিসারের রিপোর্টে বলা হয়ঃ
পুলিশের শাস্তিমূলক কাজ যাদের কোন কাজে আসেনা, অপরাধ সংগঠন থেকে যাদেরকে বিরত রাখতে পারেনা, এমন লোকদের জন্য ইখওয়ানের অনুসৃত রূহানী পরিকল্পনা বেশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ইখওয়ানের রূহানী তরবিয়তের বদৌলতে অনেক অপরাধী সরল পথে এসেছে এবং সরলতা আর দৃঢ়তার আদর্শে পরিণত হয়েছে। সুতরাং, তারা অর্থাৎ পুলিশ অফিসার প্রস্তাব পেশ করছে যে, সরকারের উচিৎ ইখওয়ানের সহায়তা করা এবং সারা দেশে ইখওয়ানের শাখা প্রসারিত করা। কারণ, তাদের দ্বারা জন নিরাপত্তা আর জনগণের সংশোধনের কাজ বেশী পরিমাণে সাধিত হতে পারে।
ইখওয়ানের সদস্য হলেন শিক্ষা পরিদর্শক
তদন্ত রিপোর্ট সম্বলিত বিরাট ফাইল ইসমাঈলিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। যতদূর আমার মনে পড়ে, তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন আলী মাহের। কিছুদিন পর ইসমাঈলিয়ার প্রাথমিক শিক্ষা ইন্সপেক্টর জেনরেল আলী বেক কীলানী আমাদের স্কুলে আগমন করেন। দ্বিতীয় পিরিয়ডে তিনি আমার ক্লাশে আগমন করেন। তাঁর সঙ্গে প্রিন্সিপাল সাহেবও ছিলেন। বেশ মনোযোগের সঙ্গে তিনি আমার পাঠদান শুনেন। এরপর হেসে প্রিন্সিপালকে বললেনঃ ইনি নাকি উস্তাদ হাসান?
প্রিন্সিপাল বললেনঃ জি-হ্যাঁ, ইনিই ওস্তাদ হাসান।
আমার হাসি পায়। বললামঃ জি জনাব, এ লোকটাই রহস্যজনক কাজকারবার করে। এরপর তাঁরা দু’জনেই চলে যান। ক্লাশ শেষে আমি কক্ষ থেকে বের হই। ইন্সপেক্টর জেনারেল প্রিন্সিপালের কক্ষে ছিলেন। আমি কক্ষে গিয়ে তাঁকে সালাম করি। তাঁর কাছে জানতে পেলাম, আজ রাত্রে তিনি ইসমাঈলিয়ায় অবস্থান করবেন। আমাকে বললেন, ওস্তাদজি, তোমার পত্রতো আমাদেরকে ব্যাকুল করে তুলেছে! প্রধানমন্ত্রী চিঠিটা শিক্ষা মন্ত্রীর কাছে প্রেরণ করেছেন আর শিক্ষামন্ত্রী প্রেরণ করেছেন আমার কাছে।
আমি বললামঃ আমিতো কমিউনিষ্ট, সন্ত্রাসী। লাখ লাখ লোক জড়ো করি; আর হাজার হাজার লোক তার অনুসারী। যেমন, স্মারক লিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং আমি পত্রখানা ইন্সপেক্টর জেনারেল আব্দুর রহীম বেক ওসমানীর কাছে পৌঁছাই। তিনি আমার নিকট আগমন করে বললেনঃ এ শিক্ষক যদি এমনই হয়ে থাকে, তবে আমরা তাঁর সঙ্গে কেমন আচরণ করতে পারি? এতো এক বিরাট আশংকার বিষয়। আমাদের তদন্তের বাইরেও গোপন কিছু থাকতে পারে। আমরা স্মারক লিপির বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে দেখছি। এত যেসব বৈপরিত্য রয়েছে, তাতেই বুঝা যায় যে, অভিযোগ মিথ্যা। আমাদের মনে হয়, সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে কাজটা প্রিন্সিপালের উপর ন্যস্ত করা। এটাই সবচেয়ে নিরাপদ। তাঁর নিকট থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট বিস্তারিত এবং সন্তোস জনকও। কিন্তু যে লোকটা এত বিরাট কোলাহল সৃষ্টি করেছে, তাকে দেখার জন্য আমার কৌতুহল জেগেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে দেখতে এসেছি। আমার আগমনকে অনুসন্ধান মূলক বা সরকারী কার্যক্রম মনে করবেননা। আমি আপনাকে কেবল এক নজর দেখতে এসেছি।
ইন্সপেক্টর জেনারেলের এ আচরণের জন্য আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই এবং সুযোগ বুঝে বলিঃ
জনাব, আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনার এই সাক্ষাৎ আর অনুগ্রহের পরিপূর্ণতার জন্য আপনার প্রতি আমার এ অধিকার বর্তায় যে, আপনি মসজিদ আর মাদ্রাসার নির্মাণ কাজও পরিদর্শন করুন, যাতে আপনি স্বচক্ষে আমাদের দাওয়াত আর সংগঠনের কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করতে পারেন।
তিনি বিকালে সেকানে যাওয়ার ওয়াদা করেন। ইখওয়ানরা নিজেদেরকে প্রস্তুত করে এবং ইমারতের অভ্যন্তরে একটা অনাড়ম্বর চায়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ইখওয়ানের বক্তা আর হামদ-না’ত পরিবেশকারীরাও প্রস্তুত হয়। তিনি ওয়াদত পুরা করেন এবং নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হন। তাঁর ধারনা ছিল, এটা হবে একটা নিছক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান। কিন্তু টি পার্টির আয়োজন করা হয়েছে দেখে তিনি অবাক হন। এ সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং বড় বড় সরকারী কর্মকর্তাদেরকেও আমি দাওয়াত দেই। স্বার্থপর মহল আর স্মারক লিপিতে স্বাক্ষর কারীদেরকেও বিশেষভাবে দাওয়াত করি, যাতে তারা উপস্থিত হয়ে নিজেদের প্রোপাগান্ডার ব্যর্থতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারে। মহফিল বেশ জমজমাট, বক্তারা একের পর এক নিজেদের মনোভাব ব্যক্ত করেন। মেহমানতো এসব দেখে রীতিমতো অবাক। বিশেষ করে তিনি আরো বেশী অবাক হন, যখন দেখতে পান যে, অনুক বক্তা ছুতার মিস্ত্রী, অমুক বক্তা মালী, অমুক বক্তা ধোপা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব দেখে তিনি বলে উঠলেনঃ
বেশ চমৎকার। আমি অবাক করার মতো একটা মাদ্রাসা দেখতে পেলাম। বক্তৃতার পালা শেষ হলে িতন আর থাকতে পরলেন না। তিনি উঠে দাঁড়ান এবং ইখওয়ানের ব্যাজ নিয়ে তা নিজের কোটে লাগালেন। তখন ইখওয়ানের ব্যাজ ছিল সবুজ রঙ্গের তমগা। তার উপর লিখা ছিল ইখওয়ানুল মুসলিমুন। এ ব্যাজ দারণ করে তিনি নিজেই ইখওয়ানে যোগদানের কথা ঘোষণা করেন। এরপর অতি সংক্ষেপে উপস্থিত ব্যক্তি বর্গের উদ্দেশ্যে তিনি কিছু কথা বললেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণের এ কয়টা কথা আমার আজও স্মরণ আছেঃ
এ মাদ্রাসা আর এ দলের প্রধানের প্রশংসায় আমি কেবল এটুকুই বলতে পারি যে, এ মাদ্রাসা একটা বিরল প্রতিষ্ঠান আর এ দলের প্রধন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। আমি এ মুহূর্ত থেকেই ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সদস্য হচ্ছি, যদি তোমরা আমাকে সদস্য হিসাবে গ্রহণ কর। শিক্ষক বিভাগে আমার চাকুরীর আর কয়েকটা মাস বাকী আছে। এরপরই আমি অবসর গ্রহণ করবো। আমি আপনাদের সঙ্গে অঙ্গীকার করছি যে, আমি যতো দিন বেঁচে থাকবো, আমার সময় আর শ্রম এ দাওয়াতের জন্য উৎসর্গ করবো।
মনে হয়, সময় যে ঘনিয়ে আসছে, তিনি তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। অবসর গ্রহণের অল্প পরই তিনি দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে আখেরাতের পথে পাড়ি জমান। আমরা তাঁকে বন্ধু সহকর্মী হিসাবে গ্রহণ করি এবং দাওয়াতের কাফেলায় তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করি। জিহাদ বিন নিয়্যত আমার জিহাদের নিয়তের অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহমতের বিপুল বৃষ্টি বর্ষণ করুন।
ধর্মীয় ফের্কাবাজীর অভিযোগ
ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট আমাদের বিরুদ্ধে যেসব আবেদন পত্র প্ররণ করা হয়, তন্মধ্যে একটা ছিল জনৈক খৃষ্টানের স্বাক্ষর করা। এতে অভিযোগ করা হয় যে, এ গোঁড়া শিক্ষক হাসানুল বান্না- যিনি সাম্প্রদায়িক সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমূনের প্রধান- ইনি ক্লাসে মুসলমান আর খৃষ্টান ছাত্রদের মধ্যে পার্থক্য করেন। তিনি জেনেশুনে খৃষ্টান ছাত্রদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। তাদেরকে কোন পাত্তাই দেন না। খৃষ্টান ছাত্রদেরে শিক্ষার প্রতি তিনি আদৌ মনোযোগ দেন না। পক্ষান্তরে মুসলমান ছাত্রদেরকে সব দিক থেকে প্রাধান্য দেন। প্রশ্ন বলে দেয়া, সাধারণ উপদেশ আর দেখাশুনাও মুসলমান ছাত্ররাই তার চোখের পুতুল। শিক্ষা বিভাগ পরিস্থিতির পরিবর্তন সাধন না করলে এবং প্রতিষ্ঠানটা এখান থেকে না সরালে এ লোকটার আচরণ এক বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
তদন্তের জন্য এ আবেদনপত্র যকন প্রিন্সিপালের নিকট প্রেরণ করা হয়, তখন বিষয়টা চতুর্দিকে রাষ্ট্র হয়ে পড়ে। ইসমাঈলিয়ার খৃষ্টান অধিবাসীরা তীব্র ভাষায় নিন্দা জানায়। খৃষ্টানদের একটা প্রতিনিধি দল স্কুলে আগমন করতঃ এহেন আচরণের প্রতিবাদ জানায়। অর্থোডক্স চার্চের প্রধান কর্মকর্তা এ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। চার্চ এসোসিয়েশনের সভাপতি জর্জেস সোরেল আফেন্দী, কিবাতী কল্যাণ সংগঠনের সভাপতি জোযেফ আফেন্দী, ঊর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তা ফাহমী আফেন্দী আতিয়া এবং তাদের সঙ্গে খৃষ্টানদের নানা দলের নারী-পুরুষ সদস্য সকলেই লিখিতভাবে প্রিন্সিপালের নিকট প্রতিবাদ জানান। অনুরূপভাবে গীর্জার পক্ষ থেকেও এর বিরুদ্ধে লিখিত প্রতিবাদ জানানো হয়। অনেকে পত্র দ্বারাও প্রতিবাদ জানায়। প্রিন্সিপাল তাঁর রিপোর্টের সঙ্গে এসব সংযুক্ত করে তাঁর নিজস্ব মন্তব্যসহ রিপোর্ট প্রেরণ করেন। তিনি মন্তব্যে লিখেনঃ
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি আবেদন, তাঁরা যেন এসব বেনামী চিঠির বোঝা আমাদের উপর না চাপান। তাঁরা নিজেরাই এসব অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন। কারণ, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, এসব আবেদনপত্র ষড়যন্ত্রমূলক। এসবের পেছনে কোন সত্যতা নেই এবং কারো কল্যাণ সাধন করা এর উদ্দেশ্য নয়।
ইখওয়ান মসজিদ উদ্বোধন
সমস্ত প্রতিবন্ধকতা স্বত্ত্বেও আল্লাহর ইচ্ছায় মসজিদের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। রমযানের আগমনের পূর্বেই মসজিদ নামায আদায়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আমার স্মরণ শক্তি অনুযায়ী এটা ছিল হিজরী ১৩৪৮ সাল। ১৭ ই রমযান এশার নামায আদায় দ্বারা মসজিদ উদ্বোধন করা হয়। এ তারিখটা ছিল বদর যুদ্ধের সূচনার রজনী। আর এটাই হচ্ছে কুরআন মজীদ নাযিলের রাত্রি। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
**********************************
“তোমরা জেনে রাখবে যে, যে গনীমতের মাল তোমাদের হস্তগত হয়েছে, তার এক পঞ্চমাংম আল্লাহ, তাঁর রাসূল, আত্মীয় স্বজন, এতীম, মিসকীন এবং মুসাফিরে জন্য- যদি তোমরা ঈমান আন আল্লাহ এবং ঐ বস্তুর উপর, যা আমরা নাযিল করেছি আমাদের বান্দার উপর ফুরকানের দিনে এবং দু’টি দলের মুখোমুখী হওয়ার দিনে (আনফালঃ ৪১)
এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ দিনটি হচ্ছে ফুরকান তথা কুরআনের দিন। আর এ দিনটিই বদর যুদ্ধে দু’টি দলের মুখোমুখী হওয়ার দিন। আল্লাহই ভালো জানেন। ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক এ মতই ব্যক্ত করেছেন।
এক আজিমুশশান মাহফিলের মাধ্যমে উদ্বোধনের কাজ সম্পন্ন হয়। এ মাহফিলে ইসমাঈলিয়া ছাড়াও শাবরাখীতের ইখওয়ানদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। ইখওয়ানরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয় যে, মসজিদে প্রথম নামাযের ইমামতি আমি করবো। এ সিদ্ধান্তের প্রতি তারা বেশ জোর দেয়। উদ্বোধনও যেন আমার হাতে হয়, এজন্যও তারা চাপ দেয়-যাতে অযোগ্য লোভাতুর ব্যক্তিদের আকাংখা ধূলিস্যাৎ হয়। কিন্তু ওস্তাদ আহমদ সাকারী, তখন যিনি ছিলেন মাহমুদিয়ায় ইখওয়ানের প্রধান, তিনি উপস্থিত সকলকে বিস্মিত করে ফেলেন। হঠাৎ তিনি সম্মুখে এগিয়ে যান এবং দরজায় লাগানো ফিতা কেটে মসজিদের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। তাঁর এ কাণ্ড ওঁৎ পেতে থাকা ব্যক্তিদের আকাংকা নস্যাৎ করে দেয়। তাদের জন্য এ ঘটনা ছিল একটা কার্যকর আঘাত। আর ওস্তাদ আহমদ সাকারী উদ্বোধন করার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিও ছিলেন। আমিও উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের বিস্ময়ের সংযোজন ঘটাই। আমি ওস্তাদ হামেদ আসকারিয়াকে মেহরাবের দিকে ঠেলে দেই, যেন তিনি এ মসজিদের প্রথম ইমামতি করেন। মসজিদ নির্মাণ আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাঁর বিরাট ভূমিকা ছিল। তাঁকে ইমাম বানিয়ে আমি তাঁর কীর্তির স্বীকৃতি দিয়েছি মাত্র। যাই হোক, উদ্বোধনের পালাও শেষ হয়।
মসজিদের পরিকল্পনা শহরের জন্য কল্যাণ ও বরকতের পয়গাম বহন করে আনে। এরপর শহরে আরো মসজিদ নির্মাণের ধারা শুরু হয়। ইসমাঈলিয়া এবং আরীশার নেককার বাসিন্দাদের মধ্যে আলহা ইউসুফ এবং আলে ফরাজ-এর মধ্যেও মসজিদ নির্মাণের আগ্রহ জাগে এবং তাঁরা শহরের অপর প্রান্তে আরো একটা মসজিদ নির্মাণ করেন। এ অঞ্চলে মসজিদ নিতান্ত জরুরী ছিল। তাঁদের সাহস এতটা বৃদ্দি পায় যে, ইখওয়ান মসজিদের সঙ্গে তাঁরা প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। উভয় মসজিদের নির্মাণ কাজ একই দিনে সমাপ্ত হয়। আলহাজ্ব ইউসুফের মসজিদ উদ্বোধনের জন্যও আমাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয়। এবং তিনি চাপ দেন আমাদের মসজিদের আগে তাঁর মসজিদ উদ্বোধন করার জন্য। সৌভাগ্য বশতঃ উদ্বোধনের দিন ছিল শুক্রবার। আমরা জুমার নামায তাঁর মসজিদে আদায় করি এবং একই দিন এশার নামায মসজিদে ইখওয়ানে আদায় করি। এভাবে একই দিনে দু’টা বিজয় অর্জিত হয়।
ইসমাঈলিয়ার অপর একজন নেককার মানুষ আলহাজ্ব মুহাম্মদ জাদুল্লাহ। তাঁর অন্তরেও আগ্রহ জাগে মসজিদ নির্মাণের। তিনি নিজের নামে তৃতীয় মসজিদ নির্মাণের জন্য প্রস্তুত হন। এ মহল্লায়ও ইবাদাতখানার প্রয়োজন ছিল্। এ মসজিদ নির্মাণের কাজও সুচারু রূপে সম্পন্ন হয়। আলহাজ্ব মুস্তফা সাহেব আরীশায় ইতিপূর্বেই একটা মসজিদ নির্মাণ করেন। এখন তিনি মসজিদটি আরো প্রশস্ত করার উদ্যাগ গ্রহণ করেন। বিরাট আয়তন মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং আরো অনেক দিক থেকে মসজিদের শোভা বর্ধন করেন। যেন ইখওয়ান মসজিদ ইসমাঈলিয়ার অভ্যন্তরে এমন পবিত্র পরিকল্পনার ফিরিস্তির সূচনা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী সেদকী পাশার সিনাই সফর
এ সময় মিশরের প্রদানমন্ত্রী সেদকী পাশা সিনাই সফরে গমন করেন। এ জন্য তাঁকে যেতে হবে ইসমাঈলিয়া হয়ে। এ খবর পেয়ে সরকারের মেশিনারী সক্রিয় হয়। এবং তাঁকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের প্রস্তুতি শুরু হয়। তাঁকে দেখার জন্য বিপুল সংখ্যক লোক স্টেশনে উপস্থিত হয়। ডেপুটি কমিশনার আর মেজিস্ট্রেটও আসেন। অভ্যর্থনা সভায় বক্তৃতার জন্য কাকে বাছাই করবে, সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। জানিনা, কোন খবীস আমার নাম দিয়েছে তাঁদের কাছে। তারা বলছেন, অমুক সরকারী কর্মচারী অভ্যর্থনা সভায় বক্তৃতা করবেন। আমাকে দফতরে ডাকা হয়। মেজিষ্ট্রেট সাবেক বেক তানতাবী এ প্রসঙ্গে আমার সাথে কথা বলেন। পুলিশ অফিসার আর অন্যান্য সরকারী কর্মচারীরাও তা সমর্থন করলো। আমার বেশ রাগ ধরলো। আমি তাঁকে বললাম, এখনি আমি চাকুরীতে ইস্তফা দেবো। আপনি কি মনে করেন যে, সরকারী কর্মচারীরা নিছক কাঠের পুতুল। তাদেরকে যেমন ইচ্ছা নাচানো যায়। আপনাদের জানা উচিৎ যে, আমার মূল্য আমার হাতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে নয়। আমি নিজেকে এমন পজিশনে আনতে কিছুতেই প্রস্তুত নই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমার যে চুক্তি হয়েছে, সে সম্পর্কে আমি ভালোবাবেই অবগত আছি। তা কেবল এতটুকুই যে, শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে আমি উন্নত সেবা করে যাবো। চুক্তিতে এমন কথা কোথাও লিখা নেই যে, প্রধানমন্ত্রী সমীপে প্রশস্তিমূলক কাসীদা পাঠ করতে হবে। এ ধরনের একটা দীর্ঘ আলোচনা হয় তাদের সঙ্গে। আমার প্রচন্ড আপত্তিকর মুখে এ কাজের জন্য অপর কাউকে খোঁজা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় থাকেনা।
সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানীর বদান্যতা
মসজিদের কাজ সম্পন্ন করার কিছুদিন আগে এমন অবস্থা হয় যে, সহ্ছিত অর্থ প্রায় শেষ। অথচ আমাদের পরিকল্পনায় মসজিদের সঙ্গে মাদ্রাসা এবং কেন্দ্রও আছে। এ দু’টো ছিল মসজিদেরই পরিশিষ্ট। আসলে এসব মিলেই ছিল মূল পরিকল্পনা। এ সময় একদিন সুয়েজ কোম্পানীর ডাইরেক্টর ব্যারন ডা বেনো সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর সচিব মসিও ব্লুমও। ব্যারন মসজিদের ইমারত দেখলেন। লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেন। এ সম্পর্কে খোজ খবর দিলেন। আমি স্কুলে ছিলাম। কোম্পানীর জনৈক কর্মচারী আমাকে গিয়ে বললেন, আমি যেন দফতরে গিয়ে মিঃ ব্যারন এর সঙ্গে দেখা করি। আমি তাঁর কাছে গেলাম, তিনি দোভাষীল মাধ্যমে আমার সঙ্গে কথা বললেন। তিনি বললেন, আমি মসজিদের ইমারত দেখেছি। আমি তাই আপনাদের সাহায্য করতে চাই; কিচু চাঁদা দিতে চাই। এজন্য মসজিদের প্রকল্পের নকশা ও অন্যান্য বিষয় তাঁর প্রয়োজন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে ফিরে আসি এবং মসজিদের নকশা ও অন্যান্য বিবরণ তাঁর কাছে প্রেরণ করি। এরপর কয়েকমাস কেটে যায়। মিঃ ব্যারন আর তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা আমি প্রায় ভুলেই বসেছিলাম। আবার একদিন তাঁর পক্ষ থেকে নিমন্ত্রণ আসে। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, আপনাদের প্রকল্পের জন্য কোম্পানী পাঁচশ মিশরীয় পাউন্ড মঞ্জুর করেছে। আমি এজন্য ব্যারনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলি যে, কোম্পানীল পক্ষে এ সাহায্য নিতান্ত অপ্রতুল। আমরা কোম্পানীর নিকট থেকে এত ক্ষুদ্র অংক আশা করিনি। কারণ, কোম্পানীর খরচে একটা চার্চ নির্মাণ করা হচ্ছে, যেখানে ব্যয় হচ্ছে ৫ লক্ষ পাউন্ড। সেখানে মসজিদের জন্য মঞ্জুর করা হয়েছে মাত্র পাঁচশ পাউন্ড। মিঃ ব্যারন আমার যুক্তি আর দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে বললেন, দুঃখের বিষয়, কোম্পানীল পক্ষ থেকে এ সিদ্ধান্তই হয়েছে। এ পরিমাণ গ্রহণ করার জন্য তিনি আমাকে অনুরোধ জানিয়ে ভবিষ্যতে আরো চেষ্টা করার আশ্বাস দেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, এটা গ্রহণ করা না করা আমার কাজ নয়, কোষাধ্যক্ষ শায়খ মুহাম্মদ হোসাইন সমলূত এর কাজ। কোম্পানী যে পরিমাণ অর্থ দান করছে, তিনি নিজের পক্ষ থেকেও তার চেয়ে বেশী অর্থ ব্যয় করেছেন এ প্রকল্পে। আমার অনুরোধে শায়খ সামলূত তা গ্রহণ করেন। এরপর মিঃ ব্যারন কোন চেষ্টা চালাননি, আর আমরাও তাঁর কাছে দাবী করিনি।
বিরুদ্দবাদীদের রটনা
বিরুদ্ধবাদীরা এ খবর শুনে উম্মা প্রকাশ করে। তারা রটনা করে যে, ইখওয়ানরা অমুসলিমদের সাহায্য নিয়ে মসজিদ বানাচ্ছে। চতুর্দিক থেকে ফতুয়াবাজী শুরু হয়। বলা হয়, অমুসলিমদের সাহায্যে নির্মিত মসজিদে কেমন করে নামায জায়েয হবে? আমরা মানুষকে বুঝাবার চেষ্টা করি যে, এসব বাজে কথা। কোম্পানীর পুঁজি আমাদেরই সম্পদ অমুসলিমদের নয়। সুয়েজ আমাদের, সমুদ্র আমাদের, দেশ আমাদের। এসব অমুসলিমরা জবরদখলকারী এবং লুটেরা। আমাদের দুর্বলতার সুযোগে তারা আমাদের উপর জেঁকে বসেছে। আল্লাহর ইচ্ছায় মসজিদের কাজ সম্পন্ন হয় অমুসলিমদের সাহায্য খরচ না করেই। বরং তাদের দেয়া অর্থ ইখওয়ান কেন্দ্রের জন্য ব্যয় করা হয়েছে। আর এর ফলে বিরুদ্দবাদীদের রটনা কোন কাজে লাগেনি। সংকীর্নমনা মওলবীরা এমনই করে থাকে। আল্লাহ কত কিসিমের মানুষ পয়দা করেছেন।
আলহেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
আল্লাহর সাহায্য, সহায়তার বদৌতে মসজিদের ইমরাতের উপর মাদ্রাসার ইমারত স্থাপন করা হয়। সেকালে শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে নানা উপায় অবলম্বন করা হতো, ব্যবহার করা হতো নানা ধরনের ছবি। নানা ধরনের শিক্ষা পদ্ধতিতে এসব পদ্ধতির উদ্ভাবকদের ছবিও ব্যবহার করা হতো। হার্বার্টা আর বেন্সটোর এর দর্শন আর পদ্ধতি অনুযায়ী শিশুদেরকে শিক্ষা দেওয়া হতো। এসব দর্শন আর পদ্ধতিকে আমরা এক নূতন ছাঁচে ঢালাই করি। ইসলামী রীতিতে শিশুদের শিক্ষার নিমিত্ত এসব পদ্ধতিকে পুনর্বিন্যাস করে নব পর্যায়ে ঢালাই করা হয়। বিদ্যালয় ভবনের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে আমরা এজন্য একটা ইসলামী নাম প্রস্তাব করি। আমরা এর নাম করণ করি আলহেরা শিক্ষায়তন। ছাত্রদের জন্য ইউনিফর্মও ঠিক করি- দেশী কাপড়ের তৈরী লম্বা জামা আর কোট। দেশে তৈরী সাদা টুপি এবং জুতা। পাঠ দানের সময়ও ছিল অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন। সকাল থেকে পাঠ দান শুরু হয়ে জোহরের নামায পর্যন্ত চলতো। ছাত্ররা জামায়াতে জোহরের নামায আদায় করতো এবং খাওয়া দাওয়া শেষ করে আসরের পূর্বে ফিরে এসে জামায়াতের সঙ্গে আসরের নামায আদায় করতো। পাঠ্যসূচী ছিল তিন ধরনের। প্রথম ধরন ছিল আল-আযহারের প্রাথমিক শিক্ষার অনুরূপ। এ ধরনের পাঠ্যসূচীতে ছাত্রদেরকে আল-আযহার এবং অন্যান্য দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত করা হতো। দ্বিতীয় ধরনের পাঠ্য সূচীতে দিনের প্রথমভাগে আল-আযহারের পাঠ্যসূচী অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়া হতো, এবং দিনের দ্বিতীয় ভাগে শিল্পকর্ম শিক্ষা দেওয়া হতো। দুপুরের খাবার পর ছাত্ররা শহরে ইখওয়ান কর্মীদের কারখানা আর ওয়ার্কশপে ট্রেনিং এর জন্য গমন করতো। এসব কারখানার মালিক ইখওয়ান কর্মীরা দায়িত্ব নিয়েছিলেন ছাত্রদেরকে কারিগরী শিক্সা দানের জন্য। আল-হেরা শিক্ষায়তনের তত্ত্বাবধানে একটা বিশেষ ব্যবস্থাপনায় এই কারিগরী শিক্ষা দেওয়া হতো। তৃতীয় ধরনের শিক্ষা ছিল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনুরূপ। এ ধরনের শিক্ষায় ছাত্রদেরকে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হতো। ছাত্রদের উপর ধার্যকৃত বেতনও ছিল যৌক্তিক। ছাত্রদের সামর্থ্যের বেশী বোঝা চাপানো হতো না। অভিভাবকদের অবস্থা বিচেনা করে বিনা বেতনের ছাত্রদের হারও বৃদ্ধি করা হয়। উচ্চশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বাছাই করা একদল শিক্ষকও নিয়োগ করা হয়। এ শিক্ষায়তনের প্রতি মানুষের বেশ আগ্রহ দেকা দেয়। এতে নতুন পদ্ধতি অনুসৃত হয়, যা আধুনিক শিক্ষা দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। ইসমাঈলিয়ার সুদর্শন পার্ক আর বাগানে গাছের তলেও ছাত্রদেরকে পাঠ দান হতো। মৃত্তিকা, প্রস্তর খন্ড আর কাগজের টুকরার সাহায্যে বর্ণমালা আর অংকের বুনিয়াদী বিষয় শিক্ষা দেওয়া হতো। ছাত্ররা যা খুশী শিক্ষককের জিজ্ঞাসা করতে পারতো। ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক ছিল সহযোগতিা আর ভালোবাসার। ইসামাঈলিয়ার অনেক নওজোয়ান আজও এ শিক্ষায়তনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এখানে ছাত্র এবং শিক্ষকের মধ্যে যে স্নেহ ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল, অনেকে আজও মনে মনে তার স্বাদ অনুভব করে।
আমি ইসমাঈলিয়া ছেড়ে আসার পর এ শিক্ষায়তন একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রূপ ধারন করেছে। শিক্ষামন্ত্রনালয় থেকে তা বজায় রাখার কোন চেষ্টা করা হয়নি, বরং তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। আর এ বিরোধিতার ফলে এ আদর্শ শিক্ষায়তন একটা সাধারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। আমাদের এই আদর্শ শিক্ষায়তনের সাফল্যের পেচনে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল এমন লোকের অভাব, যারা নিজেদেরকে চাকুরী সন্ধানী মনে না করে একটা মিশনের পতকাবাহী মনে করবেন। আমি শিক্ষকতা জীবনে যখনই কোন ঘন্টা খালি দেখতে পেয়েছি, তখনই ছুটে গেছি আল হেরায়। সেখানে শিক্ষকদের উপস্থিতিতে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে লেকচার দিয়েছি। পাঠ দান কালে বা পাঠ দান শেষে স্বয়ং শিক্ষকদেরকেও দীর্ঘ হেদায়াত আর পরামর্শ দিয়েছি। অধিকন্তু পাঠ প্রস্তুতিতেও শিক্ষকদের সঙ্গে শরীক থাকতাম। ছাত্রদের সঙ্গে বাগানে চলে যেতাম, কখনো একা, আবার কখনো শিক্ষক আর পরিচালকদের সঙ্গে মাগরিব পর্যন্ত প্রায় দু’ঘন্টা ছাত্রদের সঙ্গে কাটাতাম। ভ্রমণ আর বিনোদনের পরিবেশ সৃষ্টি হতো। ছাত্রদের জন্য অনুমতি ছিল, যা খুশী তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারে, যেদিকে ইচ্ছা ঘুরাফেরা করতে পারে। যা কিছু ইচ্ছা খেলাধুলা করতে পারে, যেমন খুশী কৌতুক আর খোশগল্প করতে পারে। এসব বিষয়ে আমি নিজেও তাদের সঙ্গে যোগ দিতাম। ফলে তাদের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক কোন বিষয়ই আমার কাছে গোপন থাকতো না। তারাও মনে করতো আর আমিও এ অনুভূতিতে ডুবে থাকতাব যে, আমি তাদের পিতা বা বড় ভাইয়ের মতো। আমি নিজেই তাদের মধ্যে এ অনুভূতি জাগাবার চেষ্টা করতাম এবং শিক্ষকদেরকেও একথা বলার চেষ্টা করতাম যে, তাদেরকেও এরকম হতে হবে। তাদেরকে অনুভব করতে হবে যে, তারা এটা পয়গামের পতাকাবাহী, একটা বিশেষ মতবাদের আহবায়হক এবং একটা প্রজন্মের প্রতিষ্ঠাতা এবং মুরব্বী। এরফলে তাদের অধিকাংশের মধ্যে এ স্পৃহা জাগ্রত হয়। আবার অনেকে এমনও ছিলেন যাদের কাছে এ সব কিছুই অরণ্যে রোদন বলে পর্যবষিত হয়েছে। আমাদের সমাজে এমন লোকের ভীষণ প্রয়োজন, যারা দেহ আর অবয়ব দিয়ে নয়, বরং মনে-প্রাণে সমাজের সেবা করবে। যারা কাজ করবে বিবেকের তাড়নায়, অন্যের তত্তাবধানের ভয়ে নয়। মানুষের মনতো আল্লাহর হাতে, তিনি যেদিকে ইচছা সেদিকে মনকে ঘুরাতে পারেন।
শায়খ মুহাম্মদ সাঈদ ওরফী
আল হেরা শিক্ষায়তন প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে যে, আমাদের জনৈক আলেম ফাযেল এবং মুজাহিদ ভাই শায়খ মুহাম্মদ ওরফী এ নাম প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি ছিলেন শিরিয়ার দিরযুর অঞ্চলের আলেম এবং পার্লামেন্টে মেম্বার। ফরাশীদের যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রামে লিপ্ত হন। ফরাশীরা তাঁর সহায়-সম্পত্তি এবং লাইব্রেরী বাজেয়াপ্ত করে এবং তাঁকে দেশ থেকে নির্বাসনের নির্দেশ দেয়। এরপর তিনি মিশর আগমন করেন এবং কায়রোয় একটা সাধারণ ভাড়া বাষায় বসবাস করেন। কোনভাবে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমি তাঁর মধ্যে ঈমান-একীনের শক্তি, বীরত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, সৎ সাহস এবং উক্তি আর যুক্তি ভিত্তিক জ্ঞানে তীক্ষ দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করতে পারি। তিনি আলেম এবং তবীবও ছিলেন, সামরিক অফিসার এবং রাত্রি যাপনকারী ইবাদাতগুজার ছিলেন। স্বদেশে বড় বড় মাশায়েখদের নিকট তিনি ইলম হাসিল করেন এবং এরপর তুর্কী সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। প্রমোশন পেয়ে তিনি অফিসার পদে উন্নীত হন। সেনাবাহিনীতে মেডিক্যাল ইউনিটের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও জ্ঞান অর্জন করেন। চাঁদমারীতে তিনি ছিলেন পটু। ১০ রাউন্ডে ১০টা চাঁদমারী করতে পারতেন। উপরন্তু তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যিক এবং ঐতিহাসিক। অনৈক পদ্য আর গদ্য তাঁর মুখস্থ ছিল। মিষ্টভাষী, ফুর্তিবাজ, সূক্ষ্ণতত্ত্ব জ্ঞানী এ মানুষটির উপস্থিত বুদ্ধি ছিল নযীর বিহীন। ইবাদগুজারী আর আরাম আয়েশ বিসর্জনে তিনি পবিত্র আত্মার সূফী। তাঁর চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গী ছিল দার্শনিক সুলভ। তাঁর সংস্পর্শে আমি বেম ধন্য ও উপকৃত হয়েছি। ইসমাঈলিয়া এসে তিনি আমার সঙ্গে কয়েকদিন অতিবাহিত করেছেন। সেদিনগুলো ছিল জীবনের সোনালী দিন। সুখের দিন। তিনি জানতে পারেন যে, আমরা একটা মাদ্রাসা স্থাপন করতে যাচ্ছি এবং এর নাম নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি। তিনি বলেন, ইসমাঈলিয়া হচ্ছে আন্দোলনের কেন্দ্র আর আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই প্রথম মাদ্রাসা স্থাপন করা হচ্ছে। আর আন্দোলনের দাওয়াত হচ্ছে কুরআনেরই দাওয়াত। আর কুরআন সর্ব প্রথম হেরা গুহায়ই নাযিল হয়েছে। সুতরাং তোমরা এ মাদ্রাসার নাম আল-হেরা রাখবে। দরবেশের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এ নামই রাখা হয়েছে। শায়খ ওরফী রাত্রে রড়জোর চার ঘন্টা ঘুমাতেন। ফজরের অনেক আগে জাগতেন এবং আমাদের দরজায় নক করে বলতেনঃ হুঁশে এসো, হুঁশে এসো। এ জীবন শেষে দীর্ষ নিদ্রার সুযোগ ঘটবে। আমাদের উঠা উচিৎ। আল্লাহর হুজুরে সাজদায় নত হওয়া উচিৎ। আমরা তাঁর প্রশংসা করি এবং তাঁর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করি।
শায়খ ওরফী বলতেন, শুভ নাম আর উপাধীতে ধন্য করো।
আমি আরয করতামঃ জনাব, কাকে?
তিনি বলতেনঃ তোমার ভাই-বন্ধু, সঙ্গী এবং প্রতিষ্ঠানকে ভালো নাম আর উপাধীতে ধন্য করবে। অমুক সঙ্গীকে বলবে, তোমার মধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা)-এর বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া যায়। অমুক সঙ্গী হযরত ওমর (রা)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এসব কথা তাদের মধ্যে আত্ম মর্যাদা জাগায়ে তুলবে, আদর্শ চরিত্র আর সৎ নমুনার দিকে তাদেরকে নিয়ে যাবে।
আমি আরয করতামঃ এমন করলে লোকেরা আমাদেরকে সমালোচনা করবে তীব্র ভাষায়।
শায়খ বলতেনঃ লোকের সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক? তুমি আল্লাহর হয়ে জীবন যাপন করবে। যে কাজে মঙ্গল নিহিত, সে কাজ করতে থাকবে। তোমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর এ রকম নাম রাখবে, আল-হেরা বালক মাদ্রাসা, উম্মাহাতুল মুমিনীন বালিকা বিদ্যালয়, ফুন্দক ক্লাব ইত্যাদী। এভাবে ইতিহাসের এ সব মুবারক নাম অন্তরে স্থান করে নেবে।
তিনি সবসময় আমাকে বলতেন, যারা ইবাদাত-আনুগত্যে ক্রটি করে, বা সামান্য গুনাহের দিকে ঝুকে তাদেরকেও আন্দোলনে শরীক করে নিতে কোন দোষ নেই, যদি দেখতে পাও যে, তাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় আছে। দেখতে হবে দলের শৃংখলার প্রতি শ্রদ্ধ আর আনুগত্য পরায়নতা। এমন লোকেরা খুব তাড়াতাড়ি তাওবা করবে। দাওয়াত একটা শেফাখানা, একটা আরোগ্য নিকেতন। এখানে চিকিৎসা করার জন্য ডাক্তার আর চিকিৎসা পাওয়ার জন্য রুগী আসে। এদের জন্য কখনো দরজা বন্দ করবে না। বরং যতোভাবে, যতো উপায়ে তাদেরকে নিজের দিকে টানতে পার, টানবে। আকৃষ্ট করবে। এটাই হচ্ছে আন্দোলনের প্রথম মিশন। অবশ্য দুধরনের লোক এমন আছে, যাদেরকে কঠোরভাবে দূরে রাখার প্রয়োজন রয়েছে। এদেরকে কখনো আন্দোলনের ভিতরে প্রবেশ করার সুযোগ দেওয়া যাবে না।
এক. সেই নাস্তিক, যার কোন কিছুতেই বিশ্বাস নেই, নেই কোন দর্শন। সে নিজেকে সত্যাশ্রয়ী বলে যতই প্রচার করুক না কেন। এমন লোকের সংশোধন লাভ করার কোনই আশা নেই। মূল বিশ্বাসের দিক থেকে সে শত যোজন দূরে। এমন লোকের নিকট থেকে আপনি কি আসা পোষণ করতে পারেন?
দুই. সে যাহিদ দরবেশ লোক, যে নিয়ম-শৃঙ্খলাকে কোনই মর্যাদা দেয় না। আনুগত্যের তাৎপর্য সম্পর্কেই যে ব্যক্তি অবহিত নয়। এমন লোক ব্যক্তিগতভাবে কল্যাণকর হতে পারে, ব্যক্তিগতভাবে তার কাজ ফলপ্রসূ হতে পারে, কিন্তু দলের ভিতরে প্রবেশ করলে লোকদের মনে বিকৃতি সৃষ্টি করবে। নিজের তাকওয়ার মাধ্যমে দলকে নিজের ওক্ত-অনুরক্ করে তুলবে; কিন্তু দলের শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকাণ্ড দ্বারা দলের মধ্যে বিদ্রোহ আর ভাঙ্গন সৃষ্টি করবে। দলের অন্তর্ভুক্ত না করে এমন লোক দ্বারা উপকার লাভ করতে পারলে অবশ্যই করবে। কিন্তু নিজেদের সারীতে তাকে ঢুকালে নিয়ম-শৃঙ্খলা বিকৃতি-বিচ্যুতি আর অস্থিরতার শিকার হবে। মানুষ যখন কাউকে নিয়ম-শৃঙ্খলার বাইরে দেখতে পাবে, তখন তারা একথা বলবে না যে, অমুক ব্যক্তি দল থেকে বেরিয়ে গেছে; বরং তারা একথাই বলবে যে, এ দলই বাঁকা, ওরা বাঁকা পথেই চলে। সুতরাং এমন লোক থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকতে হবে।
তিনি একথাও বলতেন যে, আলেমে দ্বীনরা কাল্পনিক রশিতে বাঁধা থাকেন। কেবল ঈমানই মুমিনদের সম্মুখে আসল তত্ত্ব উদ্ভাসিত করতে পারে। ঈমান মযবুত হলে ঈমানদাররা দুর্বল আর অক্ষম হলেও সফল হবে। আর যাদের ঈমান মযবুত হবে না, তারা পরিপূর্ণ শক্ত-সামর্থ হওয়া স্বত্ত্বেও পরাজিত হবে। যেন জীবনের রণক্ষেত্রে আন্দোলনের কর্মীদের জন্য ঈমানই হচ্ছে সবচেয়ে মযবুত অস্ত্র।
তিনি বলতেনঃ আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, সব ক্ষেত্রে উন্নতিও দেখা দেয়, আবার অবনতিও আসে। যখন উন্নতি দেখা দেয়, তখন সবকিছু পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে। এমনকি একজন ডাকাতও পথ চলতে গিয়ে সামনে পড়লে মাথানত করবে। আর যখন পতন আর দুর্ভাগ্যের ঘনঘটা ছেয়ে যায়, তখন সবকিছুই মুখ ফিরায়ে নেয়, এমনকি নিজের বশীভূত সওযারীও ঔদ্ধত্য- অবাধ্যতায় নেমে আসে। যদিও ঔদ্ধত্য-অবাধ্যতা তার স্বভাব নয়। আমি দু’বার মিশরে আগমন করি। প্রথম দফা আমি যখন মিশরে আসি, তখন আমি ছিলাম দীরযুর- এর বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আর তথাকার নামকরা আলেম মুহাম্মদ সাঈদ ওরফী। তোমাদের শহরের বড় বড় ব্যক্তিবর্গ স্টেশনের প্লাটফর্মে আমাকে এমন বিপুল অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেছেন যে, আমি আমার মনের কাছে লজ্জিত হ্ই। আর দ্বিতীয় দফা যখন আসি, তখনো আমি সেই মুহাম্মদ সাঈদ ওরফীই ছিলাম; কিন্তু এখন মুহাম্মদ সাঈদ ওরফীকে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ থেকে নির্বাসনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ধন-সম্পদ আর পদ-মর্যাদা সবই তার হাতছাড়া হয়েছে। তখন আমি স্টেশনে একজন লোককেও আামার জন্য অপেক্ষারত দেখতে পাইনা। কেউ এগিয়ে এসে আমি কেমন আছি, জানতে চায়নি। তখনো আমি লজ্জায় গলে যাই। অথচ দ্বিতীয়বার সহানুভূতি আর সমবেদনার ভীষণ প্রয়োজন ছিল আমার। আর প্রথম বারের তুলনায় অভ্যর্থনা পাওয়অর বেশী যোগ্য ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা ইখওয়ানুল মুসলিম- এর সঙ্গে আমার পরিচয়ের বদৌলতে আমার জন্য উত্তম কল্যাণ ও পূর্ণ, উত্তম প্রতিদান আর তার চেয়েও উত্তম সহায়তা আর সহানুভূতির ব্যবস্থা করেছেন।
শায়খ মুহাম্মদ সাঈদ ওরফী ছিলেন তীব্র আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন, পরমুখাপেক্ষীহীন, দরিয়াদিল এবং পূত-পবিত্র আত্মার অধিকারী ব্যক্তি। তিনি যতদিন মিশরে অবস্থান করেছেন, নিজ হাতের উপার্জন দ্বারা বীবিকা নির্বাহ করেছেন। গ্রন্হাবলী সম্পাদনা আর সংশোধন দ্বারা তিনি কিছু না কিছু উপার্জনের ব্যবস্থা করতেন। তিনি কখনো কারো নিকট থেকে দান বা সাহায্য গ্রহণ করেননি। নিজের ব্যয় নির্বাহের পর যা কিছু অবশিষ্ট থাকতো, তা তিনি দান করতেন ইখওয়ানুল মুসলিমুন এবং অন্যান্য আগত ব্যক্তিদেরকে। দীর্ঘদিন পর তিনি পুনরায় সিরিয়ায় ফিরে যান এবং নিজের এলাকা থেকে পার্লামেন্টের মেম্বার নির্বাচিত হন। আর এভাবে সিরীয় পার্লামেন্ট সদস্যদের সমন্বয়ে একটা প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে তৃতীয়বার তিনি মিশর আগমন করেন এবং ফিলিস্তীন সমস্যা সংক্রান্ত একটা পার্লামেন্টারী সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেন। আমার মনে পড়ে, তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে মালপত্র রেখে কিছুক্ষণ পর ইখওয়ানের কেন্দ্রে আগমন করেন। সরকারী কাজের সময় তিনি সঙ্গীদের সঙ্গে ব্যস্ত থাকতেন, আর অবশিষ্ট সময় কাটাতেন আমাদের সঙ্গে। আমার মনে পড়ে পরবর্তীকালে তিনি তিনি কাজী বা বিচারপতি পদে বরিত হন। আল্লাহ তাঁকে সর্বাবস্থায় সফল করুন এবং তাঁর দ্বারা মুসলমানদের কল্যাণ সাধন করুন।
আবু ছবীর-এ দাওয়াতের সূচনা
ইসমাঈলিয়ার অদূরে ইংরেজ ছাউনীর পরে আবু ছবীর স্টেশন অবস্থিত। স্থানটা ইসমাঈলিয়া থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। আবু ছবীর শিবির আর এয়ার ট্রেনিং স্কুলে যেসব শ্রমিকরা কাজ করে, তারা এখানে বসবাস করে। এদের সঙ্গে বাস করে ব্যবসায়ী আর কৃষকদের এক বিরাট অংশ। এ উদ্দেশ্যে লোকদের চেহারা আমি নিরীক্ষণ করি। আমি আবু ছবীর সফর করি। কফি হাউস, সড়ক আর দোকানে লোকজনকে তালাশ করি। অবশেষে শায়খ মুহাম্মদ আল-আজরুদী এর দোকানে পৌছি। ইনি ছিলেন নিতান্ত মর্যাদাবান, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এবং উদারমনা ব্যক্তি। তাঁর মধ্যে সততা এবং কথা বলার যোগ্যতাও ছিল। আমি তাঁকে দোকান করতে এবং গ্রাহকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেও দেখেছি। আমি তাঁর মধ্যে ভালো লক্ষণ দেখতে পাই। সালাম জানিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বসি। তাঁর সঙ্গে আরো কিছু লোকও বসা ছিলেন। আমি তাঁদের কাছে আমার পরিচয় দেই এবং যে উদ্দেশ্যে আবু ছাবীর-এ আমার আগমন, তাও ব্যক্ত করি। আামি তাঁকে বলি যে, আপনার মধ্যে শুভ লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি এবং আপনি আমাদের দাওয়াতের বোঝা বহন করতে পারেন। আমি কথাবার্তা বলার সময় তাঁর এবং তাঁর কয়েকজন সঙ্গীর দৃষ্টি আকর্ষণ করি দলের বুনিয়দী বিষয়ের প্রতি। অর্থাৎ ইসলামের উদ্দেশ্য কত মহ আর ইসলামের বিধান কতো পবিত্র, তাঁকে আমি তা বুঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের সমাজে বিকৃতি অন্যায়-আচার কতোটা বিস্তার লাভ করেছে, তাও বুঝাই। এটা প্রমাণ করে যে, আমরা ইসলামের বিধানকে উপেক্ষা করে চলছি। এখন আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এমন আন্দোলন সৃষ্টি করা, যাতে এসবের সংশোধন-পরিবর্তন হতে পারে। অন্যথায় আমরা সকলেই গুনাহগার হবো। কারণ, ভালো কাজের নির্দেশ আর মন্দ কাজের নিষেধ এবং হিদায়াত ও নছিহত করা ফরয। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ ফরয পালন করা যথেষ্ট হতে পারে না। বরং এমন জনমত সৃষ্টি করতে হবে, যা দাওয়াতের পৃষ্ঠপোষকতা করবে। প্রতিটি জনপদ থেকে ভালো লোকদেরকে সংগঠিত করতে হবে, দাওয়াতের প্রতি যাদের ঈমান আছে, দাওয়াতকে কেন্দ্র করে তাদেরকে সংগঠিত হতে হবে। আমরা এ দলটাকে ইখওয়ানুল মুসলিমুন বলতে পারি। দোকানদার আর তাঁর সঙ্গীরা বেশ মনোযোগের সঙ্গে আমার কথা শুনে। শুরুতে তিনি মনে করেছিলেন যে, আমি নিছক কোন সেবামূলক সংগঠনের দাওয়াত দিচ্ছি। অথবা আমি কেবল একটা বক্তৃতাই করতে চাইছি। দোকানদার দয়া করে আমাকে দুপুরে খাবার দাওয়াত দেন এবং আমার জন্য কফিও আনেন। আমি খাবার দাওয়াত গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে উঠে দাঁড়াই। কিন্তু তিনি জোর দিয়ে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন যে, আমাকে মসজিদের ভিতরে বক্তৃতা করতে হবে, অথবা সমুদ্রের তীরবর্তী ক্ষুদ্র মসজিদে ওয়াযের মজলিসে ওয়ায করতে হবে। আমি কফি হাউসেদারস দান করার পসন্দ করি। আমার প্রস্তাব মনযুর করা হয়। লোকজন কফি হাউসে সমবেত হয় এবং মনোযোগের সঙ্গে আমার বক্তৃতা শ্রবণ করে। তারা যা কিছু দেখে এবং শ্রবণ করে, তাতে বিস্ময়বোধ করে। একজন প্রতিশ্রুতিশীল যুবক শিক্ষক এভাবে কফি হাউসে লোকজনকে দ্বীনি দারস দিতে দেখে তারা আঙ্গুলে কামড়ায়। অথচ এ যুবক শিক্ষক কোন মসজিদের ইমামও নয়। সে কোন পীরও নয়, আবার কোন তরীকতের শায়খও নয়। আমার কথাগুলো তাদের উপর বেশ ক্রিয়া করে। পুনরায় এখানে আগমন করার জন্য তারা বেশ জোর দেয়। তাদের দাবী অনুযায়ী আমি পুনরায় সেখানে গমন করি।
পরপর কয়েকবর সফর করার পর পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়। একদিন আমরা আহমদ আফেন্দী দাসুতীর বাসায় সমবেত হয়ে আবু ছবীর-এ ইখওয়ানুল মুসলিমুনের শাখা স্থঅপন করার সিদ্ধান্ত নেই। এ ক্ষুদ্র জনপদটি ক্ষুদ্র হলেও পরস্পর প্রতিযোগিতা- প্রতিদ্বন্দ্বীতা আর হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত ছিল না। আমি এখানে থাকতাম না, আর আহমদ আফেন্দী দাসূতী, যাকে শাখা সভাপতি করা হয়েছে, তিনি কোন শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি সবসময় ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। স্থানীয় বিবাদ-বিসংবাদ আর বাক-বিতণ্ডার মোকাবিলা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি এসবের কোন সমাধা দিতে না পারায় সংগঠন ভেঙ্গে পড়ে বা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। আমি পুনরায় সফরে এলে এসব দূর হয়ে সংগঠন কিছুটা চাঙ্গা হতো। অবশেষে শোধবোধ সম্পন্ন কিছু ইখওয়ান, যাদের অন্তরে দাওয়াত স্থান করে নিয়েছিল, এবং ইসমাঈলিয়ায়ও যাদের যাতায়াত ছিল, তারা বললেন যে, আন্দোলনের বোঝা আর দাওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য সর্বোত্তম ব্যক্তি হতে পারেন ওস্তাদ আবদুল্লাহ বাদবী। তিনি আবু ছবীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। প্রথমত, তিনি একজন শিক্ষিত লোক। সবসময় লোকজনকে ওয়ায ও দারস দান করেন। দ্বিতীয়ত, এখানে তাঁর রয়েছে বিশিষ্ট স্থান ও মর্যাদা। এখানকার সকলেই তাঁকে ভালোবাসে। জনগণের সঙ্গেও তাঁর মেলামেশা আছে। সকেলই তাঁকে শ্রদ্ধা আর সম্মান করে। তাঁর সঙ্গে রয়েছে জনগণের অন্তরের সম্পর্ক। তৃতীয়ত, তাঁর হাতে সময় আছে। স্কুল ছুটির পর তিনি যে সময় পান, ব্যবসায়ী আর কারিগররা তা পায় না।
ইখওয়ানদের এ মত আমার পছন্দ হয়। আমি আবু ছবীর গমনকরতঃ শায়খ আব্দুল্লাহ বদবীর সঙ্গে দেখা করি। লোকজন তাঁর সম্পর্কে যা বলতো, আমি তাঁর মধ্যে সেসব দেখতে পাই। বরং তার চেয়েও বেশি দেখতে পেয়েছি। আল- হামদুলিল্লাহ। আমি এটা দেখেও খুশী হই যে, তিনি বেশ খোঁজ-খবর রাখেন। তাঁর দারসের ধারাও অব্যাহত আছে। তিনি বেশ দৃঢ় ব্যক্তিত্বেরও অধিকারী। তাঁর চিন্তাধারাও সুস্থ এবং ভারসাম্যপূর্ণ। আমি তাঁর সম্মুখে আমার প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করি। তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে বেশ ইতস্ততঃ করেন। অবশ্য আমার চাপের মুখে তিনি রাজি হন; তবে একটা শর্ত দেন। শর্তটা হচ্ছে এই যে, তাঁর সঙ্গে যেসব শিক্ষক কাজ করেন, তাদের দ্বারা শাখাটা গঠন করার স্বাধীনতা তাঁর থাকবে। এসব শিক্ষকরা তাঁকে ভালোবাসেন এবং বেশ শ্রদ্ধা আর সম্মানের চোখে দেখেন। আর এ শাখায় তিনি স্থানীয় শোধবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গকেও অন্তর্ভুক্ত করবেন। আমি তাঁর দাবী মেনে নেই। তিনি বেশ পরিশ্রম সহকারে এ কাজ শুরু করেন এবং এ জন্য বেশ কোমর বেঁধেই নামেন। আল্লাহ তা’আলাও তাঁকে সফলতা দান করেন। তাঁর নেতৃত্বে এ জনপদে আমাদের বেশ শক্তিশালী শাখা গড়ে উঠে।
আবু ছবীর-এ ইখওয়ানের মসজিদ
তখন পর্যন্ত আবু ছবীর-এ কেবল একটা মসজিদ ছিল- মসজিদুল হারুন। নামাযীদের জন্য এ মসজিদটা ছিল সংকীর্ণ। ইসমাঈলিয়া শহরের তীরেও একটা ক্ষুদ্র মসজিদ ছিল। জুমার সমাবেশের জন্য তাও যথেষ্ট ছিল না। তৃতীয় একটা অসম্পূর্ণ মসজিদও ছিল, যা নির্মাণ করেন শায়খ ইবরাহীম আবু হারীশ নামে জনৈক ব্যক্তি। ইনি থাকতেন জনপদ থেকে বেশ দূরে এবং মসজিদের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক ছিল না। এ কারণে মসজিদটা নামায আদায়ের উপযোগী ছিল না। শায়খ আব্দুল্লাহ বদবী এ মসজিদটা হস্তগত করে তাকে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কেন্দ্র বানাবার পরিকল্পনা করেন। সে মতে তিনি শায়খ ইবরাহীমের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাঁর মসজিদ নিয়ে মেরামতের কাজ শুরু করেন। আর আজ তা এক বিরাট মসজিদে পরিণত হয়েছে। মসজিদের সন্নিকটে ইখওয়ানের একটা ক্লাবও নির্মাণ করা হয়। এ মসজিদেই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো। মসজিদের সম্মুখে ছিল একটা প্রশস্ত ময়দান। এখানে ইখওয়ানের স্কাউটসদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। গ্রীষ্মের ছুটিতে এখানে বক্তৃতা আর দারসের পালা শুরু হতো। মসজিদটি একটা কল্যাণকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, যেখান থেকে হিদায়াত আর জ্ঞানের আলো বিচ্ছুরিত হয়।
এই মোবারক অঙ্গনে আমরা আন্দোলনকে মযবুত করার পরিকল্পনা করি। আমরা শায়খ ঈদ আল আযহারীকে কিছুদিনের জন্য এখানে প্রেরণ করি। ইনি ছিলেন আল আযহারের সেসব ছাত্রদের অন্যতম, যারা সেখানে জীবনটা ভালোভাবে কাটিয়েছেন। তিনি সেখানে ভালো রকমে কুরআন মজীদ হিফয করেন। তিনি ইসমাঈলিয়া আগমন করে ইখওয়ানুল মুসলিমুনে অন্তর্ভুক্ত হন এবং ইখওয়অনের কেন্দ্রে ক্লার্ক হিসাবে কাজ শুরু করেন। তিনি ছিলেন কুরআনের কারীও। নামায আর খতীবের দায়িত্ব তিনি ভালোভাবে পালন করতে পারেন। আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, আবু ছবীর কেন্দ্রে ইমামতি, খতীবী, ওয়ায আর দফতরের শৃঙ্খলা- এসব কাজ তাঁর উপর ন্যস্ত করা হবে। তাঁকে বিনিময় দেওয়া হবে ইসমাঈলিয়া থেকে। কারণ ইসমাঈলিয়া হচ্ছে আন্দোলনের মূলকেন্দ্র। আবু ছবীর শাখা এখনো নূতন। নূতন লোকের নিকট শুরুতেই মোটা অংকের আর্থিক সহায়তা দাবী করা হলে তারা আঁতকে উঠবে। দাওয়াত আর আন্দোলনের ক্ষেত্রে আল্লাহর রীতি এই যে, আর্থিক দাবী থেকে দূরে থাকতে হবে। যারা দাওয়াত দেবেন, তারা মানুষের কাছে কোন বিনিময় বা প্রতিদান চাইতে পারবে না। আর চাইলেও মানুষ কার্পণ্য করবে। তখন দাওয়াতের জন্য তাদের বক্ষ হবে সংকীর্ণ। অবশ্য তাদের অন্তরে ঈমান ভালোভাবে বদ্ধমূল হলে তারা কেবল স্বেচ্ছায় নিজেদের অর্থই ব্যয় করবে না, বরং এ জন্য নিজেদের জীবনও উৎসর্গ করবে। আবু ছবীর-এ শায়খ আব্দুল্লাহ বদবীর নেতৃত্বে দাওয়াতের সূচনার জন্য শায়খ ঈদ আল আযহারীর অস্তিত্ব দাওয়াতের শিকড় মযবুত করায় বেশ উপকারী প্রমাণিত হয়েছে। আর এটা আমাদের জন্যও এক ধরনের স্বস্তির কারণ হয়েছে।
পোর্ট সাঈদে দাওয়াতের সূচনা
ইসমাঈলিয়ায় একজন নওজোয়ান ছিলেন আহমদ আফেন্দী মিছরী। বয়স ১৭/১৮ বৎসর। ইনি ছিলেন পোর্ট সাঈদের বাসিন্দা। নিজের কিছু কার্য উপলক্ষে সাময়িকভাবে ইসমাঈলিয়ায় অবস্থান করতেন। তিনি বেশ সময় ইসমাঈলিয়ায় কাটান এবং এ সুবাদে তিনি ইখওয়ানের কেন্দ্রে যাতায়াত করেন। সেখানে যেসব বক্তৃতা করা হতো, বা যেসব হিদায়াত দেওয়া হতো, তাও শ্রবণ করতেন। কিছুদিন পরই তিনি যথারীতি বায়য়াত করে দলে অন্তর্ভুক্ত হন। ইখওয়ানের যে দলটি ছিল দাওয়াতের জন্য নিষ্ঠাবান এবং দাওয়াতের শোধবোধে আগ্রসর, ইনি সে দলে শামিল হন। ইসমাঈলিয়ায় তাঁর আসল মিশন শেষ হলে তিনি স্বদেশ ভূমি পোর্ট সাঈদে প্রত্যাবর্তন করেন। সঙ্গে নিয়ে যান তিনি দাওয়াতের আলোও। দাওয়াতের উদাহরণ হচ্ছে সে পবিত্র ও ভালো বীজের মতো, যা যেখানেই বপন করা হোক না কেন ফল দান করবে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
**********************************
“পবিত্র বাক্যের উদাহরণ হচ্ছে পবিত্র বৃক্ষের মতো। তার শিকড় মযবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত। পালনকর্তার নির্দেমে সে অহরহ ফল দান করে”। (ইবরাহীমঃ ২৪-২৫)
পোর্ট সাঈদে ভাই আহমদ আফেন্দী মিছরীর ভালো বন্ধু-বান্ধব এবং সেখানকার পূণ্যত্মা নওজোয়ানদের একটা দল তার পাশে জড়ো হয় এবং তারা দাওয়াত দ্বারা অস্বাভাবিকভাবে প্রভাতি হয়। ভাই আহমদের অনন্য ব্যক্তিত্ব, গভীর ঈমান, সুন্দর স্বভাব এবং দাওয়াতের পথে মূল্যবান কোরবানীর ফলে তাঁর যেসব বন্ধুরা দাওয়াতকে বুশেুনে তার প্রতি ঈমান এনেছিলেন, তারা তাঁল নেতৃত্বে একমত হয়ে তাঁকেই নিজেদের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে স্বীকার করে নেয়।
পোর্ট সাঈদে ইখওয়ানের শাখা স্থাপিত হয়। পোর্ট সাঈদের স্থানে স্থানে খালী যায়গায় শাখার সমাবেশ হয়। মাগরিব বা এশার নামাযের পর সকলে সমবেত হতো। নূতন দাওয়াতের অবস্থা আর দাবী নিয়ে তারা কথাবার্তা বলতো। ভাই হাসান আফেন্দী আমাকে অনুরোধ জানান পোর্ট সাঈদ আগমন করে এসব নূতন ভাইদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য। এ আহ্বানে আমি যার পর নাই আনন্দিত হই। প্রথম সুযোগেই আমি তথায় গিয়ে তাদের সঙ্গে মিলিত হই। একটা মামুলী স্থানে বসে আমি পোর্ট সাঈদের নওজোয়ানদের প্রথম দলের নিকট থেকে এ মর্মে বায়য়াত গ্রহণ করি যে, তারা দাওয়াতের পথে জিহাদ অব্যাহত রাখবে, যতক্ষণ না দুটি পরিণতির যেকোন একটি দেখা দেয়- হয় আল্লাহ তা’আলা এ দাওয়াতকে বিজয় দান করবেন, অথবা এ পথে আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। পরবর্তীকালে ইখওয়ান চিন্তা করে যে, তারা নিজেদের জন্য একটা বিশেষ স্থানের ব্যবস্থা করবে। তারা আল-মানইয়া সড়কে একটা মামুলী ঘর ভাড়া নেয় এবং সেখানে শাখা স্থাপন করে। এটাই পোর্ট সাঈদে দারুল ইখওয়ান নামে পরিচিত হয়। দলের লোকজনের কাছ থেকে যেসব চাঁদা পাওয় যেতো, একটা স্বতন্ত্র দফতরের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। আর এটা ছিল ইখওয়ানের স্তির সিদ্ধান্ত যে, তারা লোকজনের নিকট আর্থিক সহায়তা চাইবে না। বরং তারা অপেক্ষা করতো যে, দাওয়াত লোকজনের অন্তরে স্থান করে নিক, এবং এ পথে তারা নিজেরা আর্থিক কোরবানীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করুক। ইখওয়ানরা ছিল অন্তরের সন্ধানী, পকেটের নয়। আন্দোলনের কেন্দ্র ইসমাঈলিয়া এখানকার ব্যয়ের একটা অংশ গ্রহণ করে এবং পোর্ট সাঈদের ইখওয়ানেরা নিজেদের দান দ্বারা নিজেদের যে প্রয়োজন পূরণ করতে পারতো না, ইসমাঈলিয়া তা পূরণ করতো।
পোর্ট সাঈদে ইখওয়ানের অব্স্থায় স্থিতি এলে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা দাওয়াতকে খোলাখুলী জনগণের নিকট পৌঁছাবে, পোর্ট সাঈদের গণমানুষের সামনে উপস্থাপন করবে। আমার স্মৃতি শক্তি অনুযায়ী ১৩৪৯ হিজরীর মহররম উপলক্ষে তারা একটা সাধারণ সমাবেশের আয়োজন করে। তারা এ সমাবেশের আয়োজন করে নতুন কেন্দ্রের সামনে শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে। ইসমাঈলিয়া আর পোর্ট সাঈদের ইখওয়ান নেতৃবৃন্দ সমাবেশে বক্তৃতা করেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল নবীজীর হিজরত। পোর্ট সাঈদে ছিল ইলম ও আলেমদের প্রতি ভালোবাসার পরিবেশ। নবীজীর জীবনী আর জীবন চরিত বর্ণনা এবং নবীজীর প্রতি ইশক ও ভালোবাসার জন্য যে মাহফিলের আয়োজন করা হতো, লোকেরা তাতে আগ্রহ-উদ্দীপনা নিয়ে অংশ গ্রহণ করতো। মানুষ ইখওয়ানের দাওয়াত সম্পর্কে সরাসরী অনবহিত ছিল। যারা দাওয়াত দিয়েছে, তাদেরকেও ভালোভাবে জাতে না- চিনতো না। কিন্তু তারপরও এ মহফিলে দলে দলে যোগদান করে। সেখানে এটাই ছিল ইখওয়ানের প্রথম সমাবেশ। সমাবেশটি ছিল আনন্দদায়ক এবং শুভ। উপস্থিতির সংখ্যাও বেড়ে যায় অনেক।
সমাবেশের দিন হঠাৎ আমার শরীর খারাপ হয়ে যায়। আমি গলার ভীষণ ব্যথায় ভোগী। দুর্বলতার কারণে ইসমাঈলিয়া থেকে পোর্ট সাঈদ পর্যন্ত আমি শুয়ে শুয়ে সফল করি। স্কুলে ডাইরেক্টর মাহমুদ বেক সাহেব আমার অবস্থা দেখে বললেনঃ আপনি যদি আজ সফর করেন আর রাত্রে বক্তৃতা করেন, তবে আপনি নিজের প্রতি যুলূম করবেন। আপনি কোন অব্স্থায়ই বক্তৃতা করতে পারেন না। এতদস্বত্ত্বেও আমি সফরের দৃঢ় সংকল্প করি। ট্রেন থেকে নেমে আমি সোজা দারুল ইখওয়ান গমন করি। দুর্বলতার কারণে আমি বসে বসে মাগরিবের নামায আদায় করি। নামাযের পর আমার এক অদ্ভুদ মানসিক অবস্থা সৃষ্টি হয়। আমি ভাবি, পোর্ট সাঈদের ইখওয়ানদেরকে এ মহফিল উপলক্ষ্যে কতই না উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। এ মাহফিল নিয়ে তাদের কতই না আশা-আকাঙ্খা। আর কিভাবে তারা নিজেদের পেট কেটে এ মহফিলের ব্যয়ের আয়োজন করেছে। লোকজনকে অংশগ্রহণের দাওয়াত দেওয়ার জন্য তারা কতই না কষ্ট করেছে। এতসব কিছুর পরও এর পরিণতি কি এই যে, আসল বক্তা বক্তৃতা করতে অক্ষমতা জ্ঞাপন করছে?
এসব দিক চিন্তা করে আমি আবেগে কেঁদে ফেলি। এক বিশেষ অভিপ্রায়ে অভিভূত হয়ে এশার নামায পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলার নিকট কান্নাকাটি করতে থাকি সুস্থতার জন্য। এ সময় আমি নিজের মধ্যে কিছুটা সজীবতা অনুভব করি। এশার নামায দাঁড়িয়ে আদায় করি। সমাবেশের সময় হয়। কুরআন মজীদ তিলাওয়াতের মাধ্যমে সমাবেশের কার্যক্রম শূরু হয়। আমি বক্তৃতা করার জন্য দাঁড়াই। আমি যখন বক্তৃতা শুরু করি, তখন অবস্থা এমন ছিল যে, আমি নিজেই নিজের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু হঠাৎ করে আমার মধ্যে এক বিস্ময়কর শক্তি সংক্রমিত হয়। যেন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছি। আমার আওয়াজ বিস্ময়করভাবে স্বচ্ছ, স্পষ্ট এবং গর্জন করে উঠে। শামিয়ানার নিচে যারা বসা ছিল, তারাও। তখনো মাইক ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়নি। আওয়াজ এমনই সূরেলা হয়ে উঠে যে, স্বয়ংয আমার ঈর্ষা হয় নিজের প্রতি। এভাবে মহফিল ভালোভাবে শেষ হয়। প্রায় দু’ঘন্টার বেশী সময় ধরে আমার বক্তৃতা চলে। এটা ছিল আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী। প্রতি বৎসরই আমার এরকম হতো। কিন্তু এ পবিত্র রজনীর পর সারা জীবনে আমার আর এ রোগ হয়নি। ভীষণ ঠাণ্ডা আর অস্বাভাবিক পরিশ্রম করলে তা ভিন্ন কথা। আমার বিশ্বাস মতে এ সুস্থ পরিবর্তন ছিল পোর্ট সাঈদের ইখওয়ানদের নিষ্ঠা-আন্তরিকতা আর দোয়অর বরকত। দাওয়াতের প্রতি তাদের রয়েছে ঐকান্তিক আগ্রহ। জনগণের নিকট তা পৌঁছাবার জন্য তারা নিজেদেরকে বিলীন করে দিয়েছে।
দাওয়াতের ক্ষেত্রে পোর্ট সাঈদ একের পর এক অগ্রসর হতে থাকে, উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করে। এখন সেখানে ইখওয়ানের চারটা মযবুত শাখা খোলা হয়েছে। তাদের আছে একটা খেলার মাঠ। এই সীমান্ত শহরের বাছাইকরা নওজোয়ানদের মধ্যে ঈমানে সত্যবাদী মুজাহিদ আর সক্রিয় কর্মীদের এক বিপুল সংখ্যা দাওয়াতকে গ্রহণ করে নিয়েছে।
আল-বাহর আল ছগীর-এ দাওয়াতের প্রসার
পোর্ট সাঈদের একটা সমাবেশে বাহরুছ ছগীর-এর জামালিয়া অঞ্চলের অধিবাসীদের একটা প্রতিনিধি দল যোগদান করে। এ প্রতিনিধি দলে জামালিয়া অঞ্চলের ভাই মাহমুদ আফেন্দী আব্দুল লতীফ নামে এক নওজোয়ানও ছিল। ওয়াকহিলার সিঙ্গার কোম্পানীল এজেন্ট ভাই ওমর গানামও ছিল। কোন প্রোগ্রাম অনুযায়ী নয়, বরং নিছক সমাবেশের টানে ইনি অংশ গ্রহণ করেন। সমাবেশের বক্তৃতা তিনি শোনেন। সমাবেশ শেসে তিনি থেকে যান এবং আন্দোলনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং মৌলিক বিষয় সম্পর্কে কথাবার্তা বলেন। নিজ অঞ্চলে এ মহান কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তিনি সমাবেশ থেকে ফিরি যান। খুব বেশীদিন যেতে না যেতেই তাঁর পক্ষ থেকে আমরা পরপর পত্র পাই। অবশেসে বাহরে ছগীর এর আলমানষিলা অ্ঞ্চলে ইখওয়ানের একটা পাখা কোলা হয়। মহান ওস্তাদ শায়খ মুস্তফা তাইর এ শাখা সভাপতি মনোনীত হন। ইনি ছিলেন আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত। বর্তমানে তিনি কায়রোর ইসলামিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষক। এরপর আল-জামালিয়ায় আলে আবদুল লতীফের গৃহে অপর একটা শাখা খোলা হয়। জাদীদা আল মানযিলা নামে তৃতীয় শাখা খোলা হয় আলে তবীলার বাসায়।
মোটকথা, প্রিয় স্বদেশ ভূীমর এ অংশেও দাওয়াতের কাফেলা উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে কাজ শুরু করে। ইসমাঈলিয়ায় আমার শেষ দিনগুলোতে পোর্ট সাঈদের পথে বাহরে ছগীর ইখওয়ানের শাখাগুলোতে আমি সফর করেছি। এসব সফর বেশ বরকত আর কল্যাণের কারণ হয়েছে। এতে লোকদের অন্তরে বিরাট সাফল্যের আশার সঞ্চার হয়। এ সময় একটা মজার ঘটনাও ঘটে। আমি মাতরিয়া গমন করি। সেখানে আল মানযিলার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের একটা দল আমাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করার জন্য উপস্থিত ছিলেন। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের ওষ্ঠে ফুটে ওঠতো তাৎপর্যপূর্ণ হাসির একটা রেখা। যখন আমরা আল মনযিলা পৌঁছি এবং দারুল ইখওয়ানে প্রবেশ করি, তখন দেখতে পাই যে, অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করার জন্য দারুল ইখওয়ানে আগত আলেম-ফাযেল আর সম্মানিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গে অফিস কানায় কানায় পরিপূর্ণ। জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া সাধারণ মানুষও ছিল বিপুল সংখ্যায়। সেখানেও আমাকে দেখে সকলেই একটা তাৎপর্যপূর্ণ হাসি প্রকাশ করে। আমি শায়খ মুস্তফা তাইরকে একান্তে জিজ্ঞেস করি- এরা হাসছে কেন? শায়খ বললেন: আপনি তাদের ধারনার সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা অপেক্ষায় ছিল হাসানুল বান্না নামের একজন প্রতাপশালী, বিশাল দেহধারী, বয়স্ক এবং শানদার একজন মওলানার চেহারা দেখতে পাবে। কিন্তু তারা দেখতে পেয়েছে একটা ছোকরা, যার বয়স বড় জোর ২৫ বৎসর হবে। শায়খ মুস্তফা তাইর একথা বলার পর বললেন, এখন আমাদেরকে জনগণের আস্থা বহাল করতে হবে, তাদের মনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদেরকে মানাবার জন্য যতটা বেশী চেষ্টা করা যায়, তা করতে হবে আজ রাতেই।
আমি বললামঃ তাওফীক আর সাফল্য আল্লাহর হাতে নিহিত। কেবল আল্লাহর স্বত্ত্বার নিকট থেকেই সাহায্য-সহায়তা পাওয়া যেতে পারে। তিনি যদি কোন মঙ্গল আর কল্যাণেল ফয়সালা করেই থাকেন, তা অবশ্যই হবে। দেহের দুটা ক্ষুদ্র অংশের নাম মানুষ: একটা যবান, আর অপরটা অন্তর। আর মুমিনের অন্তর দয়াময়ের দুটি আঙ্গুলির মধ্যে নিহিত। তিনি যেমন ইচ্ছা আর যেদিকে ইচ্ছা হয়; তা পরিবর্তণ করান। এ সফরে আমার সঙ্গে ছিলেন মহান ভাই হামেদ আসকারিয়া রহমতুল্লাহ আলাইহি। আমি বললাম: তিনি একজন বরকতময় মানুষ। তিনি এ অপূর্ণতা পূর্ণ করবেন। আল্লাহর ইচ্ছা হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে।
বিকালে আমি জলাসয় বক্তৃতা করি। শামিয়ানার নীচে জলসা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। তা ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। যতদূর দৃষ্টি যায়, কেবল মানুষ আর মানুষই চোখে পড়ে। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর লোকজন আমার নিকট আগমন করে। তারা উচ্ছাসিত ভাষায় আমার নিকট তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন যে, বক্তৃতার পূর্ব পর্যন্ত তাদের ধারনা ছিল, তারা একজন বাহ্যিক শায়খকে দেখতে পাবে। কিন্তু এখন তারা একজন সত্যিকার শায়খকে দেখতে পেয়েছে। তাদের এ প্রতিক্রিয়া ছিল আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহের ফল।
পরবর্তীকালে এ অঞ্চলে বহুবার আমরা সফল করেছি। স্থানে স্থানে দলের শাখা খোলা হয়েছে আর এসব শাখার তত্ত্বাবধানের জন্য আল্লাহ তা’আলা ভালো মানুষের একটা বিরাট দল সরবরাহ করেছেন। মাতরিয়া, মীতে খামীর, মীত আল-বছরাত, মীতে সালীসাল, বরম্বাল আল-কাদীসা, মীতে আদ্দেস, কাফরে জাদীদ- এসব স্থানে আমাদের শাখা খোলা হয়েছে। এ অঞ্চলের দুটি জনপদের পুরোটাই ছিল ইখওয়ানের। এর একটা হলো আল-মানযিলা, আর অপরটা হচ্ছে মীতে আছেম। যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আর পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে, তাদের মধ্যে ছিলেন ড. হিলযী আল-জিয়ার, বারাম্বার এর আলে সুয়াইলিম পরিবার। মীতে সালীসাল-এর আলে কাদাহ এবং কাফরে জাদীদ-এর আলুল হাওয়ারী পরিবার। এগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা সকলেই আমাদের দাওয়াতকে পসন্দ করেন, সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং অদ্যবধি এর পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন। একথাও উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৩২ সালে খৃষ্টান মিশনারীরদের তৎপরতা দমনে যে অভিযান পরিচালিত হয়, মূলতঃ আল মানযিলায়ই তার প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর পোর্ট সাঈদে আরো দুটি বিস্ফোরণ ঘটে এবং সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ অভিযানের পরিণতি এই দাঁড়াঁ যে, স্বয়ং মুসলমানদের পক্ষ থেকেই কয়েকটা এতীমখানা, চিকিৎসা কেন্দ্র এবং অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। এসব প্রতিষ্ঠান এখনো চালু আছে।
সুয়েজে দাওয়াতের ইতিহাস
আমি সুয়েজে সংক্ষিপ্ত সফরে গমন করি। উদ্দেশ্য ছিল ওস্তাদ সাঈয়্যেদ মুহাম্মদ হাফেয তীজানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা এবং সেখানকার অন্যান্য বন্ধু-বান্ধব আর শিক্ষকদেরকে দেখা। তখন শরীয়ত আদালতের বিচারপতি ওস্তাদ শায়খ মুহাম্মদ আবু সউদও সেখানেই অবস্থান করতেন। তিনি সেখানে একটা চমৎকার জ্ঞান ও আমলের আন্দোলন সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। তাঁর মজলিসে জ্ঞাণী-গুণী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটতো। এরা নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করতেন, যিকির-ফিকিরে নিমগ্ন হতেন, পরস্পরে মতবিনিময় করতেন। মানুষকে ওয়ায-নছিহত করার দায়িত্বও পালন করতেন। আমি তাঁর মহফিলে হাযির হই। এ মহফিল অনুষ্ঠিত হতো আল-গরীব মসজিদে। কোন কোন ইমাম আর আলেমের সঙ্গে আমাদের দাওয়াত নিয়ে আমিও আলোচনা করি। শরীয়ত আদালতের উকীল হাজী আতিয়া এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুহাম্মদ হাসান সৈয়দ (র)-এর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয় পথিমধ্যে। দাওয়াত প্রসঙ্গে তাদের সঙ্গেও সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়। আমার ধারনা জন্মে যে, এদের মধ্যে দাওয়াত সম্পর্কে বর্তমানে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। পুনরায় সুয়েজ সফর কার নিমন্ত্রণ জানানো হয় আমাকে। আমি গমন করি এবং পূর্বোক্ত দুজনের সঙ্গে ওস্তাদ মুহাম্মদ তাহের মুনীর, ভাই শায়খ আব্দুল হাকীম এবং ভাই শায়খ আফীফী আতওয়া শাফেয়ীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। এ সাক্ষাতের ফল এ দাঁড়ায় যে, ‘আরবাঈন’-এর অভ্যন্তরে ইখওয়ানের একটা শাখা খোলা হয়। শায়খ আফীফী শাফেয়ীকে এর সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। এরপর যথারীতি দাওয়াতের অগ্রগতি সাধিত হয়। এমন কি এ অঞ্চলে একাধিক শাখা খোলা হয়। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ইখওয়ানের বিরাট কেন্দ্র আর স্থাপিত হয় বিশাল ইমারত। লোহিত সাগর এর সমস্ত অঞ্চল, যথা গাযুকা, রা’স গারেব, কাছীর, মাফাজা ইত্যাদী স্থানে শাখা খোলা হয়। আর এসব শাখা ছিল সুয়েজ কেন্দ্রের অধীন। এসব অঞ্চলে পূত-পবিত্র ব্যক্তিবর্গের একটা বাছাই করা দল দাওয়াতকে কেন্দ্র করে সমবেত হয়।
সুয়েজে ‘চাটাই-এর রজনী’র কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারবো না। মরহুম হাসান আফেন্দীর প্রতি আল্লাহ রহমতের বৃষ্টি বর্ষন করুন এবং তাঁর জন্য জান্নাতকে প্রশস্ত করুন। তাঁর বাসার সামনে চাটাইয়ের উপর আমরা বসেছিলাম। রজনীর শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে শুরু হয় একটা অনাবীল জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। নানা তত্ত্ব-তথ্যসমৃদ্ধ বিষয়ে অতীব সূক্ষ্ম ও জটিল প্রশ্ন আলোচনায় স্থান পায়। আমার মনে পড়ে ভাই শায়খ আব্দুল হাফীয সূরা ছাদ-এর একটি আয়াতে হযরত সুলায়মান (আ)-এর এ উক্তি সম্পর্কে একটা ভীষণ সমস্যায় পড়েছিলেনঃ
**********************************
“তিনি বললেন: হে মোর পালনকর্তা! আমাকে ক্ষমা কর এবং এমন রাজত্ব দান কর, যার অধিকারী আমি ছাড়া অন্য কেউ না হয়। তুমি তো পরম দাতা” (৩৫)।
শায়খ আব্দুল হাফীয বললেন: আয়াতে ক্ষমা ভিক্ষা করা হয়েছে। যাতে অপরাধের অনুভূতি প্রকাশ পায়; আবার রাজত্বও কামনা করা হয়েছে, যাতে এ অনুভূতি কার্যকর হয় যে, তিনি যেন আল্লাহর সন্তোষ আর পরিতুষ্টি অর্জন করেছেন। একই সঙ্গে এ দ্বিবিধ অনুভূতি কিভাবে জাগ্রত হতে পারে? একই ব্যক্তি থেকে একই অবস্থায় এ দ্বিবিধ অনুভূতি কিভাবে প্রকাশ পেতে পারে?
আমার পক্ষ থেকে এ সংকটের জবাবে বলা হয়: হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম বলেছিলেন যে, আজ রাত্রে আমি সকল স্ত্রীদের নিকট গমন করবো। তাদের প্রত্যেকের গর্ভে এক একজন সন্তান জন্মলাভ করবে, যারা হবে আল্লাহর ইবাদাত গুজার বান্দাহ। রাজত্বের পরিধি প্রশস্ত করায় এবং ইসলামী ক্ষমতা সংযোজনে এরা হবে সহায়ক। তখন যেন কেবল কার্যকরণের উপরই হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, সে রাত্রে কেবল একজন স্ত্রী গর্ভধার করেন। আর তিনিও যে সন্তান প্রসব করেন, তা ছিল অপূর্ণ, অ-পরিণত। জন্মের পর ধাত্রী নবাগত শিশূকে দৈহিক ক্রটিপূর্ণ মনে করে হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে যে, রাজত্বের সম্প্রসারণ আর সুস্থিতির নিমিত্ত সন্তান দ্বারা তিনি সাহায্য লাভ করতে চেয়েছিলেন। অথচ রাজত্ব হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার একটা দান। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম তাঁর আগের অনুভূতির জন্য আল্লাহ তা’আলার নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করেন। অতঃপর কোন উপায়-উপকরণ আর মাধ্যম ছাড়ই সরাসরী আল্লাহর নিকট রাজত্বের জন্য আবেদন করেন এবং বলেন যে, কেবল তুমিই হচ্ছ মহান দাতা। যে অনুভূতি তাঁর জন্য পরীক্ষার কারণ হয়েছিল, এমন রাজত্ব কামনা করা দ্বারা মূলতঃ সেই পূর্ব অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা ব্যক্ত করা হয়েছে। অধমের এ জবাব উপস্থিত সকলেই পছন্দ করেন।
এ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা দীর্ঘক্ষণ অব্যাহত থাকে। অতঃপর এক বিস্ময়কর রূহানী আবহের মধ্য দিয়ে এ আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটে। সূচনা হয় ভোরে মৃদুমন্দ বায়ুর মনমাতানো প্রবাহ। আর প্রত্যেকেই নিয়োজিত হয় আপন আপন পালনকর্তা সমীপে কাতর মিনতিতে। কেউ অঝোরে রোদন করছিল, আবার কেউ আদো্যপান্ত ব্যাকুল-বিহ্বল ছিল তাওবা- অনুশোচনায়, আবার কেউ ডুবে ছিল দোয়া আর ক্ষমা ভিক্ষঅয়। এহেন পরিবেশে ফুটে উঠে উষার আভা। আমরা সকলেই তাওবা নবায়ন করি; অঙ্গীকার আর প্রতিশ্রুতিকে করি আরো শক্তিশালী এবং আনুগত্যের অঙ্গীকারের সাথে বিশ্বস্ততাকে করি আরো সংহত। এরপর আদায় করি সালাতুল ফাজর। আর এটা ছিল আল্লাহর অনুগ্রহ যে, এ রাত্রে যেসব বন্ধুরা বায়য়াতের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন, তাঁর এ পথে অবিচল রয়েছেন:
**********************************
“মু’মিনের মধ্যে কতক এমন আছেন, যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার পূরণে সত্য প্রমাণিত হয়েছেন। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ আপন মৃত্যু পূর্ণ করেছেন, আর কতক প্রতীক্ষার প্রহর গুণছেন। তারা নিজেদের সকল্পে কোনই পরিবর্তন সাধন করেননি”। (সূরা আহযানঃ ২৩)।
মেহেন্দি বৃক্ষের শাখার কথাও আমি বিস্মৃত হতে পারবো না। একবার আমি সুয়েজ খাল অঞ্চলে সফরে গমন করি। সুয়েজের ইখওয়ানদের মধ্যে জনৈক সাথীর গৃহে অবস্থান করি। কক্ষের ভিতরে টেবিলের উপর রাখা ছিল ফিরোজাবাদী প্রণীত ‘সিফরুস সাআদাহ’ গ্রন্হ। আমি তা হাতে তুলে নেই। খোলামাত্রই আমার নযর পড়ে একটা হাদীসের প্রতি, নবীজী মেহেন্দি পাতা পসন্দ করতেন। নবীজীর অনুসরণে আমার অন্তরেও মেহেন্দি পাতার তীব্র আগ্রহ জাগ্রত হয়; কিন্তু এখানে তা পাওয়া যাবে কেমন করে। আমি নিজ শহর আর পরিবার থেকে অনেক দূরে। কিছুক্ষণ পর আমরা ইখওয়ানের কেন্দ্রে গমন করি। সেখানে পৌঁছেই আমি ভাষণ শুরু করি। জানালা ছিল আমার পিছন দিকে। জানালা আর তার আশপাশে কিছু বালক উঁকি মারছিল। হঠাৎ জনৈক বালক শায়খ হাদী আতিয়াকে ডাক দেয়। শায়খ বালকটির নিকট গমন করলে বালকটি তাঁর হাতে মেহেন্দি গাছের একটা বড় শাখা তুলে দিয়ে আমার প্রতি ইঙ্গিত করে (যা আমি নিজেই দেখতে পেয়েছি) বলে, শাখাটা বক্তাকে দেয়া হোক। শায়খ হাদী শাখাটা আমার হাতে দিয়ে বলেন: আপনার জন্য এটা আরবাঈন (এটা স্থানের নাম) শিশুদের উপহার। আমি মৃদু হেসে বলি: এটা শিশুদের উপহার নয়, বরং এটা হচ্ছে রাসূলে খোদার ভালোবাসা আর স্মৃতির একটা সুরভিত ঝংকার। অপ্রত্যাশিত এহেন মোবারক ঘটনায় সারাটা দিন আমি আনন্দের হিল্লোলে ডুবে ছিলাম।
কায়রোয় দাওয়াতের ইতিহাস
আল-ফালকী সড়কে বাণিজ্য বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে একটা দ্বীনী সংস্থা-জমিয়তে দ্বীনিয়্যহ। স্কুলের দুজন ছাত্রই হচ্ছে এ সংগঠনের পুঁজি। এরা হচ্ছে আব্দুর রহমান সায়াতী এবং মাহমুদ সা’দী আল-হাকীম। অবশ্য এদের সঙ্গে কয়েকজন সহপাঠিও রয়েছে। এরা নিয়মিত নামায আদায় করে। ইসলামের বরকত আর কল্যাণ স্বীকার করে এবং ইসলামের শিক্ষার সৌন্দর্য সম্পর্কেও এরা অবহিত। স্কুল ছুটি হলে মসজিদ হয় তাদের সমাবেশের কেন্দ্র। এখানেই প্রকাশ পায় তাদের কর্মতৎপরতা। সহপাঠি ছাত্রদের উপহাসের পাত্র হতে হয়েছে তাদেরকে বহুবার। ছাত্ররা অবাক হয়ে তাদের প্রতি অঙ্গুলী সংকেত করতো। কিছু ছঅত্র এসব দৃশ্যকে কোন পাত্তাই দিতো না। স্কুলের কর্মচারীরাও এদের বিরোধিতা করতো। কিন্তু এরা নিতান্ত ভদ্রতার সঙ্গে ধৈর্য-স্থৈর্য অবলম্বন করে চলে।
এ দুজন সৎ যুবক স্কুল জীবন শেষ করে রেলওয়ের কারিগরী শাখায় একই সঙ্গে চাকুরী গ্রহণ করে। এদের অন্তরে ছিল ইসলামের প্রতি গভীর ভালোবাসা, ছিল ইসলামের অর্পিত দায়িত্বের অনুভূতি এবং ইসলামের জন্য কাজ করার ব্যাকুলতা। সত্য দ্বীনের তরে যেকোন ত্যাগ আর কোরবানীর জন্য তারা প্রস্তুত। সে সময়ে ইসলামের জন্য কাজ করার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিল ইসলামী সংগঠন গড়ে তোলা। সে মতে তাদের মধ্যেও একটা উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় একটা ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার। যে সংগঠন ইসলামী দাওয়াত পেশ করবে। ইসলামকে উর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য চেষ্টা-সাধনার চালাবে। আর এ উৎসাহ-উদ্দীপনার পরিণতিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় জমিয়তে হাদারাতে ইসলামিয়া- ইসলামী সংস্কৃতি সংস্থা। শুরু হয় সংস্থার কার্যক্রম। রোম মহল্লায একটা ভবনের নিচের তলায় ভাড়া নেওয়া হয় একটা কক্ষ। কক্ষের সামনে ছিল একটা প্রশস্ত আঙ্গিনা। এ কক্ষটাই তাদের কর্মতৎপরতার কেন্দ্রে পরিণত হয়। এটাই হয়ত তাদের চেষ্টা-সাধনার আখড়া। আরো কতিপয় জ্ঞাণী-গুণী ব্যক্তিত্ব যোগ দেয় এ সংগঠনে।
এসব গুণী ব্যক্তিরা সেখানে আগমন করে ভাষণ দিতেন। সাধারণ লোকদের সম্মুখে নিয়মিত ওয়ায করতেন। দারস দান করতেন, হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে লোকদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানাতেন। এদের মধ্যে তালিকার শীর্ষে ছিলেন শায়খ মুহাম্মদ আহমদ শরীত, ওস্তাদ হামেদ শরীত (যিনি পরবর্তীকালে শিক্ষা বিভাগে চাকুরীতে যোগদান করেন), ওস্তাদ মাহমুদ বারাবী (যিনি পরবর্তীকালে ইখওয়ানের সংবাদপত্র বিভাগের প্রধান ছিলেন), শায়খ মুহাম্মদ ফারগালী (যিনি পরবর্তীকালে ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানের প্রধান হন। জামাল নাসের ১৯৫২ সালে ইখওয়ানের যেসব নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দান করেন, আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ ফারগালীও ছিলেন তাঁদের অন্যতম) এবং শায়খ জামীল আক্কাদ (সিরিয়ার হলব বা আলেপেপো প্রদেশের অধিবাসী)। তৎকালে এর ছিলেন সেরা ছাত্র এবং বুদ্ধিমান যুবক হিসাবে খ্যাত।
এ সময় ইসলামী সংস্কৃতি সংস্থা ইসমাঈলিয়ার অভ্যন্তরে ইখওয়ানুল মুসলিমুন-এর কর্ম তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে এবং এই বরকতময় শহরের দিকে দিকে ইখওয়ানের শাখা ছড়িয়ে থাকতে দেখে সংস্থার কর্মকর্তাদের মনে বিশ্বাস জন্মে যে, অনৈক্যের চেয়ে ঐক্য ভালো। দাওয়াতী কর্মকান্ডে সহযোগিতা আর একমুখীতা সর্বোত্তম এবং ফলপ্রসু বলেও তারা মনে করেন। তারা ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানের দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ স্তাপন করেন। ঐক্য স্থাপন সম্পর্কে তারা আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। এসব আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে ইসলামী সংস্কৃতি সংস্থাকে ইখওয়ানের সঙ্গে একীভূত করা হয়। ফলে কায়রোস্থ সংস্কৃতি সংস্থার দফতরকে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের শাখায় পরিণত করা হয়। এরপর ইখওয়ান কায়রোয় সালাখ বাজার সড়কে সলীম পাশা হেজাযীর ইমারতে একটা কক্ষ ভাড়া নিয়ে সেখানে দফতর স্থাপন করে। ইখওয়ান কর্মীরা নিজেরাই এর সংস্কার আর শোভা বর্ধনের কাজ করে। তারা এ নূতন দফতরকে এমনভাবে সুসজ্জিত করার চেষ্টা করে, যাতে তা মিশরের রাজধানী কায়রোয় আন্দোলনের উপযুক্ত কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। কায়রোয় ইখওয়ানের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। আধুনিক চাহিদা অনুযায়ী দফতর সাজানোর জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করার সঙ্গতি ইখওয়ানের ছিল না। এ কারণে কায়রোয় ইখওয়ানের আর্থিখ অবস্থা স্বচ্ছল না হওয়া পর্যন্ত ইসমাঈলিয়া আর্থিখ সহায়তার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৯৩২ সালের প্রথম দিকে আমার কায়রোয় বদলী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইখওয়অনের সদর দফতরও কায়রোয় স্থানান্তর হয়।
কায়রোয় ইখওয়ানদের একটা ঘটনা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কায়রোয় সবে মাত্র দাওয়াতের কাজ শুরু হয়েছে। আর্থিক সহায়তার বেশ প্রয়োজন ছিল ইখওয়ানের জন্য। কেবল ইসমাঈলিয়াই নিয়মিত কায়রোয় আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আসছিল। এহেন টানাটানি আর দুর্দিনে ইখওয়ানকে বিপুল আর্থিক সহায়তা দানের প্রস্তাব করা হয়। বিনিময়ে তাদের কাছে দাবী করা হয় সরকারের প্রতি সমর্থন করে তার পক্ষে প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালাবার। সংবিধান রচনা আর নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে উদ্যোগ-আয়োজন সরকার গ্রহণ করেছে, তার স্বপক্ষে কাজ করার জন্যও বলা হয় ইখওয়ানকে। তখন সিদকী পাশা প্রথমবারে মতো মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন। ভাই আব্দুর রহমান সায়াতী বা ঘড়ির মেকার (ইনি ছিলেন ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের ছোট ভাই এবং বয়সে তাঁর চেয়ে দুই বৎসরের ছোট)। তখন ইনি ছিলেন একজন সাধারণ সরকারী কর্মচারী মাত্র। এ প্রস্তাবের জবাবে ভাই আবদুর রহমান বলেন:
“আমাদের হস্ত কর্তন করা যেতে পারে, কিন্তু তা এমন কোন অর্থের দিকে অগ্রসর হতে পারে না, যাতে আমাদের কোন অধিকার নেই এবং যে অর্থের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনকে ব্যক্তিস্বার্থের অধীন করে নেয়া। বর্তমান রাজনৈতিক বিধানে আমরা সন্তুষ্ট থাকলে তার জন্য জান-মাল উৎসর্গ করে জিহাদ করা আমাদের নিজেদেরই কর্তব্য হতো। অর্থের বিনিময়ে সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়”।
মোটকথা সরকারী স্বার্থে ইখওয়ানকে ক্রয় আর ব্যবহারে সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অথচ তখন ইখওয়ান কতিপয় যুবক আর সরকারী কর্মচারী ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এভাবে আল্লাহ তা’আলা শুরু থেকেই ইসলামী আন্দোলনকে পংকীলতা থেকে রক্ষা করেছেন। এহেন পংকীলতা যে আন্দোলনে সংক্রমিত হয়, তার বিনাশ অনিবার্য। কোন ব্যক্তির মধ্যেও এটা প্রবেশ করলে সে ব্যক্তিও আল্লাহ থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য। কায়রোর ইসলামী আন্দোলন আর তার কর্মকর্তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী যে, তারা এ পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন। আলহামদুলিল্লাহ- সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য।
উম্মাহাতুল মু’মেনীন মাদ্রাসা
বালকদের জন্য প্রতিষ্ঠিত আল-হেরা মাদ্রাসা ভালোভাবে নিজের পায় দাঁড়াবার পর ইখওয়ান বালিকাদের জন্য একটা মাদ্রাসা স্থাপন করার কথাও চিন্তা করে। তারা এ মাদ্রাসার নাম ঠিক করে উম্মাহাতুল মু’মেনীন মাদ্রসা। আর এ জন্য এক বিশাল ইমারতও ভাড়া নেওয়া হয়। যুগোপযোগী একটা পাঠ্যসূচিও প্রণয়ন করা হয়, যা একদিকে ইসলামী আদর্শ এবং বালিকা, মাতা আর স্ত্রী হিসাবে নারীদের জন্য ইসলামের শিক্ষার আলোকে প্রণীত হয়েছিল, তেমনিভাবে যুগের দাবী আর চাহিদা অনুযায়ী বিজ্ঞান শিক্ষা দানের ব্যব্স্থাও ছিল এ পাঠ্যসূচিতে। আমার প্রস্তাব ছিল মাদ্রসার পরিবেশ সুস্থ ও নিরাপদ রাখার জন্য ইসমাঈলিয়ার শিক্ষিত আর দক্ষ-অভিজ্ঞ মহিলাদেরকে শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত করা হোক। আমার এ পরামর্শ মেনে নেওয়া হয। মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালনের জন্য ওস্তাদ আহমদ আব্দুল হালীমের নাম প্রস্তাব করা হয়। ইনি ছিলেন একজন দ্বীনদার পরহেজগার ব্যক্তি। আন্দোলনের সঙ্গেও তাঁল ছিল গভীর সম্পর্ক।
আল-আখাওয়াত আল-মুসলিমাত
যে উদ্দেশ্যে উম্মাহাতুল মু’মিনীন মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়, তা ভালোভাবে পূরণ হলে শিক্ষা বিভাগ মাদ্রাসাটির পরিচালনার ভার গ্রহণ করে। এ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কিছুদনি পর ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মহিলা শাখা-আল-আখাওয়াত আল-মুসলিমাত খোলা হয়। ইখওয়ান কর্মীদের স্ত্রী-বোন-কন্যঅ আর আত্মীয়স্বজন দ্বারা এ শাখা খোলা হয়। এ শাখার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন এ মাদ্রাসারই শিক্ষয়িত্রীরা। আমি এ শাখাকে বলতাম ফির্কাতুল আখাওয়াত আল মুসলিমাত- মুসলিম বোনদের গ্রুপ। এদের জন্য বিশেষ নীতিমালা আর কর্মসূচীও প্রণয়ন করা হয়। মুসলিশ নারীদের মধ্যে দাওয়াত প্রসারের কাজে তারা ক কি উপায়-উপকরণ ব্যবহার করবে, তাও চিহ্নিত করে দেওয়া হয়।
স্কাউটস গ্রুপ
উপরন্তু ইখওয়ান চিন্তা করে যে, শারীকির ব্যায়ামের অনুশীলনও শুরু করা উচিৎ। এ ধারণার ভিত্তি ছিল ইসলামী জিহাদের অনুপ্রেরণা। জিহাদের জন্য নিয়মত পরিপক্ক করা এবং জিহাদ সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশ কার্যকর করার আগ্রহে ইখওয়ান ছিল উদগ্রবী। এ ব্যাপারে সে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুঁসিয়ারী থেকেও রক্ষা পেতে চায়ঃ
**********************************
“যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে এ অবস্থায় যে, সে জিহাদ করেনি, জিহাদের নিয়তও পোষণ করেনি, সে ব্যক্তি জাহিলিয়্যাতের মৃত্যুবরণ করে”।
এ কারণে ইখওয়ানুল মুসলিমুন স্কাউটিং-এর নীতিতে একটা গ্রুপ গড়ে তোলে, যার নাম দেওয়া হয় কিরআতুল রিছলাত-বা ট্যুরিস্ট স্কাউটস গ্রুপ। ইসমাঈলিয়ার পর ইখওয়ানের অন্যন্য শাখা এবং কেন্দ্রেও এ ব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়ে। অধুনা ইখওয়ানের অভ্যন্তরে যে স্কাউটস গ্রুপ রয়েছে এটাই হচ্ছে তার পড়ে। অধুনা ইখওয়ানের অভ্যন্তরে যে স্কাউটস গ্রুপ রয়েছে এটাই হচ্ছে তার ভিত্তি (ইখওয়ান নওজোয়ানদেরকে জিহাদের যে দীক্ষা দান করে, তার ফলে ৯৪৭ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে দশ হাজার ইখওয়ান মুজাহিদ জিহাদের জন্য বেরিয়ে পড়ে এবং তরা ইহুদীদেরকে নাকানী-চুবানী খাইয়ে দেয়। এ সময় আন্তর্জাতিক ষড়ন্ত্রে ইখওয়ানের উপর নির্যাতন নেমে না এলে এবং পরবর্তীকালে ইখওয়ানকে বেআইনী ঘোষণা না করা হলে ইসরাইল রাষ্ট্র অংকুরেই মূলোৎপাঠিত হতো- অনুবাদক)।
জাবাসাত আল বালাহ-এ ইখওয়ানের দাওয়াত
জাবাসাত-এর কিছু মজদূর এবং শ্রমজীবী মানুষ ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পায়। এরা জাবাসাত এর শ্রমিক শ্রেণীর নিকট ইখওয়ানের দাওয়াত ও দর্শন পৌছায়। আমাকে নিমন্ত্রণ জানানো হয় জাবাসাত সফর করার। আমি সেখানে গমন করে শ্রমিক ইখওয়ানদের নিকট থেকে দাওয়াত ও আন্দোলনের প্রতি বায়য়াত গ্রহণ করি। দূরাঞ্চলে এ বায়য়াত ছিল চিন্তার রাজ্যে একটা বিপ্লবের পূর্বাবাস। খুব বেশী দিন যেতে না যেতেই শ্রমিকরা সুয়েজ কোম্পানীর নিকট একটা মসজিদ নির্মাণের বাদী উত্থাপন করে। কারণ, সেখানে মুসলমান শ্রমিকের সংখ্যা ছিল তিনশ’রও বেশী। সুতরাং এসব শ্রমিকদের জন্য কোম্পানীকে একটা মসজিদ নির্মাণ করতে হবে। কোম্পানী শ্রমিকদের দাবী মেনে নিয়ে একটা মসজিদ নির্মাণ করে। ইমামতি এবং দারসের দায়িত্ব পালন করতে পারে- এমন একজন আলেমে দ্বীন প্রেরণ করার জন্য কোম্পানী ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানকে লিখে। এ কাজের জন্য বিশিষ্ট আলেম ভাই মুহাম্মদ ফারগালীকে মনোনীত করা হয়। তিনি তখন আল হেরা মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন।
শায়ক ফারগালী জাবাসাত আল বালাহ গিয়ে মসজিদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মসজিদের নিকটেই তাঁর বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। শ্রমিকদের সঙ্গে শায়খের মনের মিল ঘটে। কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই শ্রমিকদের মানসিক এবং সামাজিক মান-মর্যাদার বিস্ময়কর পরিবর্তন সূচিত হয়। তারা জীবনের সত্যকার মূল্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। জীবনের উন্নত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা অবগত হতে পারে। মানবতার মর্যাদা আর গুণাবলী সম্পর্কে তারা সঠিক ধারণা লাভ করতে পার্ তাদের মন থেকে ভয় আর অপমানের অনুভূতি এবং দুর্বলতা আর আক্ষমতার ভাব বিদূরিত হয়। তারা ঈমানের দওলতে ধন্য হতে পেরেছে এবং জীবনের আসল কর্তব্য অর্থাৎ হুকমুতে এলাহী প্রতিষ্ঠা করার কথা তারা বুঝতে পেরেছে এ জন্য তারা গর্ব অনুভব করে। এ কারণে তারা বেশ পরিশ্রম করে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে এবং অত্যন্ত পরিশ্রম দ্বারা রাসূলে খোদার এ বাণী কার্যকর করেঃ
**********************************
তোমাদের মধ্যে কেউ কোন কাজ করলে তা ভালোভাবে সম্পন্ন করাকে আল্লাহ পসন্দ করেন। অন্যদিকে যে বিষয়ে তাদের কোন অধিকার নেই, তা থেকে তারা নিজেদেরকে দুরে রাখতো, কোন নীচ লোভ-লালসা তাদেরকে আকৃষ্ট করতে পারতো না, আর তুচ্ছ বস্তুর প্রতি আকর্ষণও তাদেরকে টানতে পারতো না। একজন কর্মচারী তার অফিসারের সম্মুখে এমনভাবে দাঁড়াতো যে, তার শির উঁচু, কিন্তু তাই বলে সে শিষ্টাচার বিসর্জন দিতো না। সে আত্মমর্যাদায় পরিপূর্ণ, কিন্তু তাই বলে শালীনতার সীমা লংঘন করে না। কথা বলার সময় যে যুক্তি- প্রমাণ উপস্থাপন করে। আগের মতো কোন অসমীচীন শব্দ মুখ থেকে নির্গত করে না, অফিসারের নিকট থেকেও এমন কোন শব্দ শুনতে সে রাজি নয়। তুচ্ছ আর অপমানের কোন রীতি সে নিজের জন্যও পসন্দ করে না, অফিসের জন্যও নয়। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এসব শ্রমিকদেরকে এক স্থানে সমবেত করেছে। পরিশ্রম, ভালোবাসা আর বিশ্বস্ততা ছিল তাদের ঐক্যের ভিত্তি। কিন্তু কোম্পানীর কর্মকর্তারা শ্রমিকদের এ রীতি ভালো নজরে দেখতে পায় না। তারা শংকিত হয়ে উঠে। তারা ভাবে, এ অবস্থা চলতে থাকলে একদিন এ মওলবী শায়খ ফারপালীর হাতে কর্তৃত্ব চলে যাবে। এরপর কোন শক্তিই তাকে আর এ শ্রমিকদেরকে আয়ত্বে আনতে পারবে না।
শায়খ ফারগালী আর বিদেশী কোম্পানীর সংঘাত
সুতরাং কোম্পানীর কর্মকর্তারা এ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে এহেন সাহসী শায়খকে যেকোনভাবে চাকুরীচ্যুত করার কথা চিন্তা করে। একনজ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রেরণ করা হয় শায়খের নিকট। কর্মকর্তা শায়খকে বলে: পরিচালক আমাকে জানিয়েছেন যে, আপনার সেবার আর প্রয়োজন নেই কোম্পানীর। এখন কোম্পানী আপনার পরিবর্তে অন্য কাউকে মসজিদের দায়িত্ব দিতে চায়। এই নিন পরিচালকের নির্দেশ অনুযায়ী আজ পর্যন্ত আপনার পাওনা।
মায়খ ফারগালী অত্যন্ত ধৈয্য আর শান্তভাবে তাকে জবাব দেনঃ
মোসিও ফ্রান্সো! আমি নিজেকে জাবাসাত আলবালাহ –এর কোম্পানীর কর্মচারী বলে মনে করতাম না। এটা জানলে আমি আদৌ কোম্পানীর চাকুরী গ্রহণ করতাম না। আমি তো মনে করতাম যে, ইসমাঈলিয়ার ইখওয়ানুল মুসলিমুনের পক্ষ থেকে আমি এখানে প্রতিনিধিত্ব করছি। আমি বিনিময়ও তাদের নিকট থেকে গ্রহণ করি, যা আপনার মাধ্রমে আমার কাছে পৌঁছে। আমার চুক্তি আপনার সঙ্গে নয়, বরং ইখওয়ানের সঙ্গে। আমি আপনার নিকট থেকে কোন বেতনও নেবো না, হিসাবও চাই না। আমি মসজিদে যে দায়িত্ব পালন করছি, তা কিছুতেই ত্যাগ করবো না। এ জন্য শক্তি প্রয়োগ করা হলেও না। ইখওয়ান প্রধান, যিনি আমাকে এখানে প্রেরণ করেছেন, কেবল তিনিই আমাকে পদচ্যুতির নির্দেশ দিতে পারেন। তিনি ইসমাঈলিয়ায় আছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করে যা কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার আছে, নিতে পারেন।
শায়খ ফারগালীর এ জবাব শুনে কর্মকর্তা শায়খের অনুমতি নিয়ে ফিরে যান। শায়খের এ কঠোর ভূমিকায় কোম্পানীর প্রশাসন বিপাকে পড়ে। কোম্পানী কিছুদিন ধৈর্যধারণ করতঃ অপেক্ষায় থাকে যে, শায়খ হয়তো তাদের কাছে বেতন দাবী করবেন। কিন্তু শায়খ ইসমাঈলিয়ায় আমার নিকট আগমন করেন। আমিও তাঁকে বলি যে, আপনি নিজের ভূমিকায় অটল থাকুন। কোন অবস্থায়ই আপনি স্থান ত্যাগ করবেন না। আপনার যুক্তি ন্যায়সঙ্গত এবং বলিষ্ঠ। আপনার কাছে তাদের কিছুই নেই। এখন কোম্পানী কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আশ্রয় নেয়। আর তার ডাইরেক্টর মোসিও মেনো ময়েজ গভর্নরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আর গভর্নর ইসমাঈলিয়ার পুলিশ পরিদর্শককে নির্দেশ দেন একদল পুলিশসহ জাবাসাত আলবালাহ গমন করে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য।
পুলিশ ইন্সপেক্টর সেপাহী নিয়ে তৎক্ষণাৎ সেখানে পৌঁছে এবং ডাইরেক্টরের দফতরে গিয়ে অবস্থান নেয়। শায়খকে ডেকে আনার জন্য একজনকে প্রেরণ করেন। শায়খ মসজিদে আশ্রয় নেন। শায়খ জবাব দেন, পুলিশ ইন্সপেক্টর বা ডাইরেক্টরের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমার কাজ মসজিদের সঙ্গে যুক্ত। তাদের কারো প্রয়োজন থাকলে এখানে আমার কাছে আসতে পারে। ফলে পুলিশ ইন্সপেক্টর নিজেই শায়খের নিকট গমন করেন। ডাইরেক্টরের নির্দেশ মেনে নেওয়ার জন্য তিনি শায়খকে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। কাজ ছেড়ে ইসমাঈলিয়া গমন করার জন্য তিনি চাপ দিতে থাকেন। শায়খ পূর্বের জবাব পুনরাবৃত্তি করে বলেনঃ
আপনি ইসমাঈলিয়া থেকে আমাকে বরখাস্ত করার লিখিত নির্দেশ এনে দিন, আমি তৎক্ষণাৎ চলে যাবো। কিন্তু আপনি যদি শক্তি প্রয়োগ করতে চান, তবে আপনি যা খুশী করতে পারেন। আমি কিছুতেই বের হবো না। এখান থেকে কেবল আমার লাশই বের হতে পারে।
খবরটা শ্রমিকদের নিকট পৌঁছে। তারা তখনই কাজ বন্ধ করে এবং দল বেঁধে শ্লোগান দিতে দিতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পুলিশ ইন্সপেক্টর বিরোধের পরিণতি সম্পর্কে শংকিত হয়ে সে অবস্থায় ইসমাঈলিয়া গমন করে। সমস্যা সমাধানে সমঝোতার উপায় বের করার জন্য আমার সঙ্গে দেকা করে। আমি অক্ষমতা জ্ঞাপন করে বলি, বিষয়টা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করে আমি কোন মত ব্যক্ত করতে পারি না। আমি দলের কর্মপরিষদের বৈঠক ডাকবো, কর্মপরিষদ বিষয়টা বিবেচনা করে দেখবে। এর পর আমি আপনাকে কিছু বলতে পারবো। আমাকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, এ সময় আমি কায়রো গমন করি এবং সুয়েজ কোম্পানীর প্রশাসনিক পরিষদের জনৈক মিশরীয় সদস্যের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলি। আমি দেখতে পাই যে, তিনি শ্রমিকদের স্বার্থের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাচ্ছেন। কোম্পানী আর তার ডাইরেক্টরের চিন্তা আগাগোড়া সমর্থন করছেন। জাতীয় স্বার্থের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্রও লক্ষ্য নেই। অত্যন্ত দুঃকের সঙ্গে আমাকে একথাগুলো বলতে হচ্ছে।
এরপর আমি নিজে কোম্পানীর ডাইরেক্টরের সঙ্গে দেখা করি এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কেন তিনি শায়খ ফারগালীর পিছনে আদা-নুন খেয়ে লেগেছেন? তাদের প্রয়োজন এমন লোকের, যে তাদের নির্দেশের সামনে মাথানত করবে- এছাড়া অন্য কোন জবাব তার কাছে ছিল না। ডাইরেক্টরের একথাগুলো এখনো আমার ভালোভাবে মনে আছেঃ
“আমি অনেক মুসলমান নেতার বন্ধু। আলজেরিয়াও আমি কুড়ি বৎসর অতিবাহিত করেছি। কিন্তু আমি তাদের মধ্যে শায়খের মতো একজন মুসলমানও দেখতে পাইনি, যে আমাদের উপর হুকম চালাতে পারে। তিন যেন একজন সামরিক কর্মকর্তা আর কি”।
আমি তার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কে প্রবৃত্ত হই এবং তাকে বুঝাবার চেষ্টা করি যে, তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আসলে এসব কোম্পানীরাই শ্রমিকদের প্রতি যুলুম-নির্যাতন চালায়। শ্রমিকদের অধিকার হরণ করে; এমনকি তাদেরকে মানুষই মনে করে না। তাদের সঙ্গে নিতান্ত সংকীর্ণতা এবং কৃপণতা করে। তাদেরকে পূর্ণ পারিশ্রমিক দেয় না। একদিকে হচ্ছে এ অবস্থা; আর অন্যদিকে কোম্পানীর মোনাফায় অঢেল সংযোজন হচ্ছে। এ বিকৃতির সুরাহা নিতান্তই জরুরী। এর প্রতিবিধান এভাতে হতে পারে যে, কোম্পানীর বিধান সংশোধন করতে হবে এবং স্বল্প মোনাফায় কোম্পানীকে তুষ্ট থাকতে হবে। অবশেষে আমি আর ডিরেক্টর এ ব্যাপারে একমত হই যে, শায়খ ফারগালী দু’মাস যথারীতি স্বপদে বহাল থাকবেন। এ মেয়াদ সমাপ্ত হলে ডিরেক্টর এবং তার কোম্পানী তাঁকে সসমআনে বিদায় দেবে। কোম্পানী যথারীতি ইখওয়ানের নিকট আবেদন জানাবে তাঁর পরিবর্তে অন্য কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ করার জন্য। এবং নবনিযুক্ত মওলবী সাহেবকে দ্বিগুণ বেতন দিতে হবে। তাঁর জন্য বাসস্থান এবং অন্যান্য প্রয়োজনের উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। দু’মাস সময় অতিক্রান্ত হলে শায়খ ফারগালী বিদায় নেন। তাঁর স্থান গ্রহণ করেন শায়খ শাফেয়ী আহমদ। এ মরু অঞ্চলে ইসলামী দাওয়াতের কাফেলা ভালোভাবে এগিয়ে চলে।
ঘৃণ্য চক্রান্তের কয়েকটি দৃষ্টান্ত
রমযানুল মুবারকে আমার নিয়ম ছিল আব্বাসী মসজিদে ফজরের পর নামাযের ইসলামী মাসায়েল বিষয়ে দারস দান করতাম। বেশীর ভাগ এসব মাসায়েল ছিল নামায-রোযা এবং রমযানের ফযীলত সম্পর্কিত। রমযানুল মুবারক শেষ হয়ে এলে আমি ঈদের নামাযের বিধান ও মাসায়েল শুরু করি। এসব মাসায়েল প্রসঙ্গে এ আলোচনাও স্থান পায় যে, ঈদের নামায জনপদের বাইর মুক্ত ময়দানে আদায় করতে হয়। নারী-পুরুষ সকলে বের হবে এবং ইসলামের শওকত আর মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি প্রকাশ করবে। ইসলামের সকল ইমাম এ ব্যাপারে একমত যে, বাইরে খোলা যায়গায় ঈদের নামায আদায় করা উত্তম। কেবল ইমাম শাফেয়ী এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁর ফতোওয়া এই যে, ঈদের নামায মসজিদে আদায় করা উত্তম। অবশ্য এ জন্য শর্ত এই যে, শহরের ভিতরে এতবড় মসজিদ থাকতে হবে, যেখানে শহরের সমস্ত মানুষের স্থান সংকুলান হতে পারে।
আমি যখন এসব মাসায়েল বয়ান করছিলাম এবং যুক্তি প্রমাণ দ্বারা তা ব্যাখ্যা করছিলাম, তখন উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে একজন প্রস্তাব করেন যে, এ সুন্নাত জীবন্ত করার আমাদের উচিৎ। বাইরে মাঠে ঈদুল ফিতরের নামায আদায় করা কর্তব্য। তখন ইসমাঈলিয়ায় তেমন বড় কোন মসজিদ ছিল না। সবই ছিল ছোট ছোট মসজিদ। শহরের সমস্ত লোকতো দূরের কথা, কয়েকশ লোকেরও স্থান সংকুলান হতো না সেখানে। শহরের আশপাশে এতোবড় উপযুক্ত প্রান্তর আছে, যেখানে ইংরেজ সৈন্যদের এক বিরাট দলেরও স্থান সংকুলান হতে পারে। উপস্থিত সকলে অতি উৎসাহের সঙ্গে এ প্রস্তাব সমর্থন করে এবং আমাকেও ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাদের প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করতে হয়। কিন্তু আমার ভাল করেই জানা ছিল যে, এ শহরে ধর্মীয় বিষয়ে দ্রুত মত পরিবর্তন ঘটে। নানামত প্রকাশ পায়। কারণ, ধর্মীয় বিষয়ে এরা অতিশয় স্পর্শকাতর এবং আবেগপ্রবণ। উপরন্তু এ শহরে মাত্র কিছুদিন আগে ধর্মীয় বিরোধ নিয়ে তুলকালামকাণ্ড ঘটে যায়। এ কারণে আমি শর্ত আরোপ করি যে, আলেম সমাজের সঙ্গে পরামর্শ না করে এবং এ প্রস্তাব কার্যকর করার ব্যাপারে ঐকম্যতে উপনীত না হয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে না। আলেম সমাজ ঐক্যমত প্রকাশ করলে ভালো কথা, অন্যথায় কোন অনুত্তম বিষয়ে লোকদের একমত হওয়া কোন উত্তম বিষয় কার্যকর করতে গিয়ে অনৈক্যের শিকার হওয়ার চেয়ে উত্তম।
আমি এ বিষয়ে কেবলমাত্র পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি, এমন সময় হঠাৎ করে আন্দোলনের অকল্যাণকামীদের পক্ষ থেকে আমার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন আর অভিযান চালানো হয়। আর আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয় জঘন্য অভিযোগ। যেমন বলা হয় যে, খোলা যায়গায় ঈদের নামায আদায় করা বেদয়াত। এটা মসজিদকে উজাড় করার নামান্তর। এটা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এটা একটা ভুল ফতোওয়া। কে এমন কথা বলে যে, সড়ক মসজিদের চেয়ে উত্তম। বাপদাদার কালে তো আমরা এমন কথা শুনিনি। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শহরে। কফিশপ, চা দোকান, মসজিদ, সাধারণ সমাবেশ, একান্ত বৈঠক- মোটকথা সর্বত্র লোকদের মুখে মুখে এর চর্চা শুরু হয়। এটা ছিল এক ভয়ংকর অভিযান আর সময়টা ছিল রমযানের শেষ দশক। আমি আব্বাসী মসজদে এ’তেকাফে ছিলাম। লোকজন নামায শেষে আমার দিকে ছুটে আসতো আর বলতো- এ কি নূতন বেদয়াত শুরু করেছেন? আমি এহেন ভিত্তিহীন অভিযোগের সামনে বোকা বনে যাই। আমি সরলভাবে দ্বীনের বিধান বয়ান করতাম, ফিকহের কিতাবে যা কিছু উল্লেখ আছে, কেবল তাই বলতাম। বাকবিতন্ডা থেকে বিতর থাকতাম এবং ঐক্য-সংহতি বজায় রাখার উপদেশ দান করতাম আর বিরোধ বিতণ্ডা থেকে বিরত থাকার দীক্ষা দিতাম।
কিন্তু ব্যাপারটা সীমাতিক্রম করে যায় এবং আমার নিজের এবং আলেম সমাজেরও হাতছাড়া হয়ে যায়। জনগণ উত্তেজিত। তারা হক আর সুন্নার অনুসরণ করতে চায়। তারা ঘোষণা করে যে, ঈদের নামায শহরের বাইরে আদায় করা হবে। তারা নামাযের জন্য কার্যতঃ ময়দানও সমতল করেছে। ওদিকে আমি কায়রো গমন করতঃ পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে বাধ্য ছিলাম। ইসমাঈলিয়ায় লোকেরা নিজেরাই সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে। আরাইশা মসজিদের ইমাম শায়খ মুহাম্মদ মাদইয়ান ঈদের নামায পড়ান। এ ইসলামী প্রদর্শণীতে মানুষ নিতান্ত আনন্দিত। তাদের অন্তরে নবীজীর পাক সুন্নাতের বরকত স্থান করে নিয়েছে। ঈদের ছুটি শেষে ফিরে এসে আমি সকলের চেহারায় খুশীর লক্ষণ দেখতে পাই। এভাবে স্বার্থান্বেষী মহলের পরিচালিত অনভিপ্রেত আন্দোলন স্তিমিত হয়। নবীজীর মোবারক সুন্নাহ জারী হয়। ইসমাঈলিয়ায় আজও ঈদের নামায আদায় করা হয় শহরের বাইরে মুক্ত ময়দানে নিতান্ত শানশওকতের সঙ্গে।
কাযীর বাসভবনে বিতর্কের কাহিনী
রমযানুল মুবারকের এক রাত্রে আমি ইসমাঈলিয়ায় শরীয়তী কাযীর বাসভবনে গমন করি। তখন সেখানে পুলিশ ইন্সপেক্টর, সিভিল জজ, প্রাইমারী স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষক, শিক্ষা বিভাগের একজন পরিদর্শক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এবং আইনজীবীসহ শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। আসর বেশ জমে উঠে। কাযী সাহেব চা আনতে বলেন এবং রৌপ্য পাত্রে সকলকে চা পরিবেশন করা হয়। আমার পালা এলে আমি কাঁচের পাত্রে চা আনতে বলি। কাযী সাহেব মৃদু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে আপনি রৌপ্য পাত্রে চা পান করবেন না। আমি আরয করি, আলবত। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা তো এখন শরয়ী কাযী বাসভবনে!
কাযী সাহেব বললেনঃ
বিষয়টি ইখতিলাফী বটে। কিন্তু রৌপ্যপাত্রে পানাহার সম্পর্কে যে বিধান রয়েছে, তাতে কোন দ্বিমত নেই। এ সম্পর্কে যে হাদীস বর্ণিত আছে, তা সর্ববাদী সম্মত। আর তাতে এসব পাত্র ব্যবহার সম্পর্কে কঠোর নিষেধবাণী রয়েছে। নবী করীম (স) তাঁর পবিত্র বাণীতে বলেছেনঃ
**********************************
তোমরা স্বর্ণ ও রৌপ্য পাত্রে খাবে না এবং তাতে পান করবে না। মহানবী (স) আরো বলেছেনঃ
**********************************
যে ব্যক্তি স্বর্ণ-রৌপ্য পাত্রে পানাহার করে, সে পেটে জাহান্নামের আগুন ঢুকায়। স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন নির্দেশ বর্তমান থাকতে কিয়াস ও ইজতিহাদের অবকাশ নেই। আর নবী করীম (স)-এর নির্দেশ পালন করা অপরিহার্য। সকলেই কাঁচের পাত্রে পান করবে- আপনি এ নির্দেশ দান করলে ভালো হতো। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কিছু লোক বলার চেষ্টা করেন যে, যেহেতু বিষয়টা বিরোধপুর্ণ, সুতারাং এসব পাত্রে কফি পান করতে অস্বীকর করা তেমন জরুরী নয়। সিভিল জজ সাহেবও ময়দানে অবতীর্ণ হলেন। তিনি শরীয়তের কাযীকে বললেনঃ শ্রদ্ধেয় কাযী সাহেব! এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ বর্তমান রয়েছে, সুতরাং তাই অবশ্যপালনীয়। এ নিষেধের রহস্য কি এবং সে রহস্য উন্মোচিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা স্পষ্ট নির্দেশ বর্জন করবো- এমনটি করতে আমরা বাধ্য নই। সে রহস্য সন্ধান করা আমাদের কাজ নয়। আগে নির্দেশ শিরোধার্য করে নেয়া আমাদের কর্তব্য। এরপর যদি তাতে নিহিত রহস্য উন্মোচিত হয় তবে ভালো কথা। আর তা জানা না গেলে তা আমাদের অন্তর্দৃষ্টির ক্রটি এবং ব্যর্থতা হবে। দ্ব্যর্থহীন নির্দেশ মেনে চলা সর্বাবস্থায় অপরিহার্য।
সিভিল জজ সাহেবের এ বক্তব্যের পর আমি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যাই এবং তাঁর শুকরিয়া আদা করতঃ তাঁর আঙ্গুলির প্রতি ইঙ্গি করে তাঁর নিকট আরয করি, আপনি তো বিষয়টা ফয়সালা করে দিলেন। এখন আপনি হাতের আংটিটাও খুলে ফেলুন। এটা স্বর্ণের আংটি এবং স্পষ্ট নির্দেশ অনুযায়ী তা পরিধান করা হারাম তিনি হেসে বললেন, ওস্তাদজী! আমার ফয়সালা তো নেপোলিয়ান কোড অনুযায়ী আর কাযী সাহেব ফয়সালা করেন কিতাব এবং সুন্নাহ অনুযায়ী। সুতরাং আমাদের সকলেই নিজ নিজ আইন মেনে চলতে বাধ্য। কাজেই আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। অবশ্য কাযী সাহেবকে পাকড়াও করতে পারেন। আমি বললাম, ইসলামী শরীয়তের নির্দেশ সমস্ত মুসলমানদের জন্যই এসেছে। আর আপনিএ একজন মুসলমান। সুতরাং নির্দেশটি আপনার উপরও প্রয়োজ্য। সিভিল জজ সাহেব আংটি খুলে ফেলেন। বাস্তবিক পক্ষে আসরটি ছিল বেশ আনন্দদায়ক এবং সুখপ্রদ। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ আলোচনার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তারা এহেন সাধারণ উপলক্ষ্যকেও আমর বিল মা’রুফ নাহী আনিল মুনকার এবং লিল্লাহ নছীহতের মহান কীর্তি বলে মনে করেন।
মি’রাজের ঘটনা সম্পর্কে আমার ভাষণ এবং আলিমদের হৈচৈ
একবার শবে মি’রাজ উপলক্ষ্যে আমি ইসরা ও মি’রাজ বিষয়ে বক্তৃতা করি। বক্তৃতায় আমি বলি যে, ইসরা ও মি’রাজের সফর রাসূলুল্লাহ (স)-এর জন্য এক সহা সম্মান। আমরা যদি চিন্তা করি যে, দেহের উপর রূহের বিরাট শক্তি অর্জিত রয়েছে, তাহলে এর ভিত্তিতে বলা যায় যে, এ পবিত্র রজনীতে রাসূলে পাক (স)-এর মুবরাক রূহ শক্তি-ক্ষমতা আর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রশস্ততার এমন এক স্তরে উন্নীত হয়েছিল যে, তা নবীজীর পূরো দেহের উপর বিজয় লাভ করে এবং তা দেহের সমুদয়া বস্তুগত বিধানকে বিকল করে দেয়। এবং তা দেহকে পানাহার, ক্ষুৎ পিপাসা, মানবীয় কামনা-বাসনা, চাওয়া-পাওয়া এবং দূরত্বের প্রভাব থেকে মুক্ত করে দেয়… এমন ধারণা করা অসম্ভব কিছু নয়। বরং এ ধারণা মি’রাজ ও ইসরার মু’জিযাকে সেসব লোকদের জন্য বোধগ্য করে তোলে, যারা মি’রাজের ঘটনা মুনে আঙ্গুলে কামড় দেয়। আমি একথও বলি যে, কবি সম্রাট শাওকী (রহ) এ সূক্ষ্ম তত্ত্বের প্রতি ইঙ্গিত করেই বলেছিলেনঃ
**********************************
-লোকেরা জিজ্ঞেস করে, তিনি তো সকল রাসূলদের সেরা রাসূল। তাঁর ইসরার সফর দেহযোগে হয়েছে, নার রূহযোগে?
সন্দেহ নেই যে, উভয়যোগে তিনি এ সফর করেছেন। উভয়ই হয়েছে অশেষ পাকপবিত্র। উভয়ই ছিল আদ্যোপান্ত রূহ, রূহানিয়্যাত এবং আলো।
মহফিল শেষ হয় এবং উপস্থিত লোকজন আমার ভাষণ শুনে বেশ আনন্দিত হয়। কিন্তু সুযোগ সন্ধানীরা আর একটা সুযোগ পেয়ে যায়। তারা প্রচার করে বেড়ায় যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন ইসরা ও মি’রাজ অস্বীকার করে। তারা বলে যে, এ ঘটনা কোন মু’জিযা নয়। মি’রাজ হয়েছিল কেবল আত্মিক, দৈহিক নয়। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের এ আকীদা উম্মতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বিপরীত। কোন ইমাম থেকে এ ধরনের আকীদা বর্ণিত নেই ইত্যাদী ইত্যাদী।
ইখওয়অন এসব কথার জবাব দিতে চায়, কিন্তু আমি তাদেরকে কঠোরভাবে বারণ করি। আমি তাদেরকে বলি যে, এহেন পরিস্থিতিতে নেতিবাচক কর্মপন্হার চেয়ে ইতিবাচক কর্মপন্হা হাজার গুণ উপকারী আর কার্যকর প্রমাণিত হয়। আপনারা সাধারণ মানুষকে সঠিক চিন্তার দিকে নিয়ে আসুন, তখন তারা নিজেরাই ভুল চিন্তা পরিহার করবে। ইখওয়ানরা জিজ্ঞেস করে, তবে আমরা কি করবো? আমি প্রস্তাব করলাম যে, আপনারা আর একটা বক্তৃতার ঘোষণা দিন। এই বক্তৃতার বিষয়বস্তুত হবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শ্রেষ্ঠত্ব। তারা তাই করলো, প্রোগ্রাম অনুযায়ী লোকেরা সমবেত হয়। আমি তাদের সম্মুখে মহানবী (স)-এর শ্রেষ্ঠত্বের বিভিন্ন দিক তুলে ধরি। যেমন দৈহিক দিক থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, নৈতিক দিক থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, আত্মিক দিক থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, ইবাদাতের দিক থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। উপরন্তু রাসূল হিসাবে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বও বর্ণনা করি। তাঁর এ শ্রেষ্ঠত্ব সর্বব্যাপক, চিরন্তন, সর্বশেষ এবং পূর্ণা!ঙ্গও। আল্লাহ তা’আলার নিকট দুনিয়া এবং আখিয়ারাতে তাঁর যে স্থান ও মর্তবা রয়েছে, তাও বর্ণনা করি। লোকেরা যখন এ বক্তৃতা শ্রবণ করে মহফিল ত্যাগ করে, তখন তাদের সকলের মুখে মুখে ছিল এ বক্তৃতা সম্পর্কে আলোচনা। আল্লাহ তা’আলা সত্যেরা দ্বারা মিথ্যাকে প্রতিহত করলেন, মিথ্যার জারিজুরী ফাঁস করে দিলেন আর দেখতে না দেখতেই মিথ্যা পরাভূত হয়ে গেলো। আল্লাহ তা’আলা কালাম মজীদে বলেনঃ
**********************************
“আমরা সত্যকে মিথ্যার উপর ছুঁড়ে মারি আর সত্য মিথ্যার মস্তক চূর্ণ করে অতঃপর মিথ্যা তৎক্ষণাৎ বিলীন হয়ে যায় (সূরা আম্বিয়াঃ ১৮)।
আল-বাহরুছ ছগীরে দা’ওয়াতের কাজ
শায়খ আহমদ আলমাদানী ১৯৩০ সাল থেকেই মিত মিরজা সালাসিলা’-এ ইখওয়ানের অন্যতম দায়িত্বশীল ছিলেন। তিনি আমার নিকট প্রেরিত এক পত্রে অসন্তোষ প্রকাশ করেন যে, সেখানে ইখওয়ানের বাণী প্রচার এবং ইখওয়ানের দৃঢ়তা সম্পর্কে আমি কোন আলোচনা করিনি (এ ডায়রী সংগঠনের সামরিক পত্রে ধারা্বাহকভাবে প্রকাশিত হয়। এ যাবৎ ডায়রীর যে অংশ প্রকাশ পেয়েছে, তাতে তাদের সম্পর্কে কিছু উল্লেখ না করায় তারা এ অভিযোগ করে- অনুবাদক)। মিত মিরজা’র ইখওয়ানরা প্রথম দিকের ইখওয়ানের অন্তর্ভুক্ত এবং এখনো তারা সে পথে অটল রয়েছে। তাঁর এ অসন্তোষ পছন্দীয় এবং তা শুভ পরিণতি বয়ে আনবে। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা উক্ত অহ্ছলে ইখওয়ানের প্রচারকার্যে যে ত্যাগ তিতীক্ষার পরিচয় দিয়েছেন, তা সংঘাতমুখর মুজাহিদদের স্মৃতির কথা স্মরণ করায়ে দেয়। তারা অদ্যবধি সত্যপথে নিষ্ঠাবান সিপাহী এবং ঈমান—বিশ্বাসে সত্যিকার ইমানদারের মতো অটল-অবিচল রয়েছেন। আল্লাহ তাদেরকে শুভ প্রতিদান দান করুন।
ইখওয়ানের বাণী প্রচার পর্যায়ে আমি এ যাবৎ যা কিছু আলোচনা করেছি, তা ছিল নিতান্ত সংক্ষিপ্ত। আমার উদ্দেশ্য ছিল সংক্ষেপে একথা আলোচনা করা যে, বিগতকালে দাওয়াতের গতি কেমন ছিল এবং সেসব নূতন নূতন পর্যায়ে দাওয়াদের কাফেলা কোন গতিতে এগিয়ে গেছে। সেসব বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ ইখওয়ানের দীর্ঘদিনের। যদিও কেবল নীতিগত আলোচনা করাই আমার মতে যথেষ্ট। কোন নীতি আর বুনিয়াদকে ভিত্তি করে ইখওয়ানের পবিত্র বৃক্ষ গড়ে উঠেছে, সে সম্পর্কে কেবল ইশরা-ইঙ্গিত করাই যথেষ্ট হবে বলে আমার ধারণা। তা সত্ত্বেও শায়খ আমদ আল মাদানী এবং তাঁর বিজ্ঞ সহকর্মীদের হক আদায় করার নিমিত্ত এবং তাদের সবার আগে ইখওয়ানের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার স্বীকৃতি স্বরূপ এখানে তাঁদের উল্লেখ করেছি। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এবং তাদেরকে সত্যের পথে অটল রাখুন এবং আমাদরে সকলকে সোজা পথে চালিত করুন। আমি সসব বিজ্ঞ সহকর্মীদের নিকটও ক্ষমাপ্রার্থী, এ মুবারক দাওয়াতের সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করার এখান সুযোগ নেই। তাদের পক্ষে একটা যথেষ্ট যে, তাঁরা আল্লাহর ইলমে আছেন এবং আল্লাহই তাদেরকে নেক প্রতিদান দেবেন। আল্লাহই উত্তম এবং দীর্ঘস্থায়ী।
একটা অভিযোগঃ হাসানুল বান্নার পূজা করা হয়!
একদিন দুজন নিষ্ঠাবান ইখওয়ানকার্মী নিতান্ত ব্যাথাতুর হয়ে আমার কাছে ছুটে আসে। তারা বলে, শহরে আমাদের বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আমরা এ ধরনের গুজব বরদাশত করতে পারি না। যারা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটনা করছে, তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য আপিনি আমাদেরকে অনুমতি দিন। তাদের কথা শুনে আমি মৃদু হেসে বললাম, এতে কি কোন কল্যাণ আছে? আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
**********************************
ধন-সম্পদ আর জনসম্পদে অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা হবে এবং পূর্ববর্তী আহলি কিতাব আর মুশরিকদের নিকট থেকে তোমাদেরকে শুনতে হবে অনেক অশোভন উক্তি। আর তোমরা যদি ধৈর্য ধারণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে তা হবে একান্ত সৎসাহসের কাজ (সূরা আলে ইমারানঃ ১৮৬)।
সুতরাং ছবর আর তাকওয়া আমাদের কখনো ত্যাগ করা উচিৎ নয়। লোকেরা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করবে আর নানা মনগড়া কথা রটনা করবে- এটাতো দাওয়াতের সত্যতারই প্রমাণ। প্রথম ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিরোধীদের পক্ষ থেকে কি কি বিষয় রটানো হয়েছে এবং স্বয়ং নবীজী সম্পর্কে কেমন ব্যক্তিগত কুৎসা রটানো হয়েছে, তাতো আপনারা ভালো করেই জানেন। মোটকথা, এ সম্পর্কে আমি তাদের সম্মুখে ভালোভাবেই আলোকপাত করি। কিন্তু তারপরও তারা দুজনে নিতান্ত দুঃখ আর বেদনাবোধের সঙ্গে বললেন, যে নূতন অভিযোগ আমরা শুনে এসেছি, তাতে তো আমরা খামুশ থাকতে পারি না। এটা এক ভয়ংকর অভিযোগ আর এ অভিযোগ ছড়াচ্ছে এমনসব লোকেরা যারা বেশ পরিচিত এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তিও রয়েছে।
আমি জানতে চাইলাম, কি সে অভিযোগ? তারা বললেন, বিরুদ্ধবাদীরা বলছে, আপনি দারস আর ওয়াজে আমাদেরকে দীক্ষা দান করছেন, যাতে আমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে আপনার ইবাদাত করি। সুতরাং আপনার কথা মতো ইখওয়ান বিশ্বাস করে যে, হাসানুল বান্না মানুষ নয়, নবী-ওলী বা কোন পীরও নয়; বরং সে হচ্ছে খোদা, পূজা-ইবাদাত পাওয়ার যোগ্য। আপনার নিকট আগমন করার আগে আমরা খোঁজ নিয়ে এসেছি এসব অপপ্রচারের উৎস কোথায়। আমরা জানতে পেরেছি, যিনি এসব অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তিনি একজন আলেমে দ্বীন, একটা ধর্মীয় পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি। আর তিনি যা বলেন, মানুষ তা সত্য বলে মনে করে। আমরা কেবল খোঁজ-খবরই নেইনি, বরং আমরা সে মওলবী সাহেবের নিকট গমন করে তাকে জিজ্ঞাসাও করছি যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন হাসানুল বান্নাকে মা’বুদ মনে করে, এমন কথা কে আপনাকে বললো? তিনি বললেন, তোমাদের ওস্তাদ হাসানুল বান্নার মুখে আনি নিজ কানে শুনেছি। তাঁর জবাব শুনে আমরা আঙ্গুলে কামড় দেই। তাঁকে বারবার একই প্রশ্ন করি। কিন্তু তিনি প্রতিবারই জবাব দেন- আমি নিজ কানে তাকে একথা বলতে শুনেছি। তবে আমরা তো এমন কথা সত্য বলে মেনে নিতে পারি না। আসল তত্ত্ব জানার জন্য আমরা আপনার কাছে এসেছি। সত্য বলতে কি, তাঁর কথায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। এতদত্ত্বেও এ গুজবের উৎস আর তত্ত্ব সম্পর্কে আমরা জানতে চাই।
তাদের এসব কথা ছিল আমার জন্য বজ্রাঘাততুল্য। আমাকে অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, কারো বিরেধিতা করতে গিয়ে মানুষ এতোটা নীচেও নামতে পারে! পারে এমন চক্রান্তের আশ্রয় নিতে। আমি চিন্তা করতে লাগলাম, কবে কোথায় এমন মওলবী সাহেবের সঙ্গে আমি একত্র হলাম। এমন কি ঘটনা ঘটলো, যার ফলে এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ উঠতে পারে। কিন্তু এরকম কোন মজলিস বা ঘটনার কথা আমার মনে পড়লো না। তাই আ তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালাম। উপরোক্ত, সহকর্মীদ্বয় ছাড়াও ইখওয়ানের দুজন শিক্ষককেও সঙ্গে নিলাম। শিক্ষকদ্বয় সম্পর্কে আমি জানতাম যে, মওলবী সাহেবের সাথে তাদের সম্পর্ক গভীর। আমি এদেরকে সবকথা শুনালাম এবং বললাম, এখনই আমাদেকের যেতে হবে তাঁর কাছে। তাঁর নিকট গিয়ে আমাদেকের জানতে হবে, তিনি যেসব কথা ছড়াচ্ছেন, তার ভিত্তি কি? কারণ, ভ্রাতৃদ্বয়ের একথা শোনার পর তত্ত্ব নেওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় থাকে না। হয় মওলবী সাহেব নিজে প্রতারিত হয়েছেন, অথবা তাঁর কথা এরা ভালোভাবে বুঝতেই পারেনি। আর এটা এমন এক অভিযোগ যে, এ বিষয়ে অলসতা করা বা উপেক্ষা করা উচিৎ হবে না। চলূন আমরা এখনই তাঁর কাছে যাই। আমরা পাঁচজনই তাঁর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। আমরা তাঁর বাসায় কড়া নেড়ে ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসি। তিনি বেরিয়ে এসে আমাদেরকে সালাম জানালেন। আমদেরকে দেখে তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। তাঁর কণ্ঠস্বর এবং গতিবিধি অসংলগ্ন হয়ে পড়ে। তিনি যেন বুঝতে পেরেছেন যে, তাঁর কোথায় কোন বিপদ পড়েছে।আমি সরাররি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ওস্তাদজী! আমি এ মাত্র শুনতে পেলাম যে, আপনি আমার সম্পর্কে এমন এমন কথা বলেছেন। আপিনি তাদেরকে অত্যন্ত আস্থার সঙ্গে একথাও বলেছেন যে, আপনি নিজ কানে আমার মুখ থেকে একথাগুলো শুনেছেন। তারা কি ঠিক বলেছে? সত্যি সত্যিই কি আপনি এমন কথা বলেছেন? তিন বললেন, হ্যাঁ, তারা ঠিকই বলেছে।তবে তো তাদের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে গেলো। আমানত আদায়ে তারা কোন ক্রটি করেনি। আমি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললাম, এ আমানতদারীর জন্য আল্লাহ আপনাদেরকে উপযুক্ত প্রতিদান দিন।
এবার আমি মওলবী সাহেবের প্রতি লক্ষ্য করে আরয করলাম ওস্তাদজী! আপনি কবে এমন কথা শুনলেন যে, আমি মা’বূদ আর আমার অনুসারীদের কর্তব্য হচ্ছে আমার পূজা করা? তিনি বললেন, আমার মনে পড়ে, প্রায় এক মাস আগে একদিন আমি মসজিদের আঙ্গিনায় বসা ছিলাম। ইতিমধ্যে মুহাম্মদ লাইসী আফেন্দী নামে একজন শিক্ষক উপস্থিত হলেন। তিনি আমার কাছে এসে বসলেন। এক এক করে ইখওয়ান কর্মীরা উপস্থিত হতে থাকেন। তারা আপনাকে বেশ ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে সালাম করতে থাকে। এ অবস্থা দেখে মুহাম্মদ লাইসী আফেন্দী বললেনঃ ইখওয়ানরা আপনাকে পূজার পর্যায়ে ভালোবাসে। আপনি এর জবাবে বলেছিলেন, এমন ভালোবাসা যদি একান্তভাবে আল্লার জন্য হয়ে থাকে, তবে এ সম্পর্কে কি আর বলা যায়! আমরা আল্লাহর নিকট আবেদন জানাই, তিনি যেন আমাদের মধ্যে এমন ভালোবাসা বেশী বেশী সৃষ্টি করেন। আপনি উদাহরণ হিসাবে ইমাম শাফেয়ীর একটা কবিতাও উল্লেখ করেছেনঃ
**********************************
মুহাম্মদ (সা) এর পরিবার-পরিজনকে ভালোবাসা যদি রাফেয়ী মতাবলম্বী হওয়া বিবেচিত হয়, তবে জিন ও ইনসান সাক্ষী থাকুক যে, আমি একজন রাফেযী।
আমি তাঁকে বললাম, হ্যাঁ, এমন ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। তিনি বললেন, তবে কি এর অর্থ এটা দাঁড়ায় না যে, এরা আপনাকে পূজা করে? তার যবান থেকে একথা উচ্চারিত হওয়া মাত্রই আমার সঙ্গে আগত একজন ইখওয়ান কর্মী, যিনি ছিলেন তাঁর মতই শিক্ষক এবং তাঁর বন্ধুও- ওঠে দাঁড়ালেন আর ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকে গালমন্দ দেয়া শুরু করলেন। বরং তাঁর গৃহেই তাঁকে মারার জন্য উদ্যত হলেন। এবং তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ ওস্তাদ! এটাই আপনি শিখেছেন? আপনার জ্ঞানের দৌড় এ পর্যন্তই? কারো বক্তব্য অনুধাবন করার এই অবস্থা আপনার? মজলিসে কথা বলার ব্যাপারে এটাই আপনার আমানতাদারী? একজনের কথা অপরজনের কাছে পৌঁছাবার ব্যাপারে এটাই সততা বজায় রাখার সীমা? আমরা উভয়ের মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াই এবং তাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করি।
মওলবী সাহেবকে উদ্দেশ্য করে আমি বললামঃ ওস্তাদজী! আপনিতো বচন নকল করেছেন এবং যা ইচ্ছা এর অর্থ করতে পারেন। তবে আপনি নিজের পক্ষ থেকে একথা যোগ করেছেন যে, আমি ইখওয়ানকে গায়রুল্লাহর ইবাদাত করার নির্দেশ দেই (এটা কখনো হতে পারে না। আল্লাহর দ্বীন এহেন প্রলাপোক্তি থেকে অনেক ঊর্ধ্বে)। আপনি একথাও বলেছেন যে, এটাই ইখওয়ানের আকীদা এবং একথা আপনি নিজ কানে আমার মুখ থেকে শুনেছেন। আপনি আমার কথার একটা অংশ বাদ দিয়েছেন যে, এ ধরণের ভাষা ব্যবহার করতে আমি মুহাম্মদ লাইছী আফেন্দীকে কঠোরভাবে বারণ করেছি। এ জন্য তাকে তিরস্কারও করেছি। আমি তাকে একথাও বলেছি যে, এ ধরনের কথাবার্তা ইসলাম অনুমোদন করে না। ইওরোপীয় সাহিত্য আর পাশ্চাত্যের চিন্তার দেউলিয়াপনা থেকে আমাদের মধ্যে এহেন অসংযত বাকধারাও অনুপ্রবেশ ঘটেছ। আর অন্ধ অনুকরণের পথধরে আমাদের ভাষা আর লেখনীতে তা চালূ হয়েছে। এ ধরণের শব্দমালা পরিহার করার প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য।
ওস্তাদজী! আপনি ঘটনাতো ঠিকই স্মরণ রেখেছেন। কিন্তু আমার সমালোচনার কথা ভুলে গেছেন। যাই হোক, আমার প্রতি আপনার এতটুকু দানই যথেষ্ট। এখন আসল ব্যাপার দ্বিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আমার সঙ্গে আগত ব্যক্তিরা সকলেই তাঁর বন্ধু আর সাথী হওয়া সত্ত্বেও এটুকু কড়া কথা শোনানোকে যথেষ্ট মনে করছিল না। তারা ইখওয়ানের কোন গণসমাবেশে বিষয়টা খুলে বলা তাঁর জন্য কর্তব্য বলে স্থির করলেন। অন্যথায় কিভাবে তাকে শায়েস্তা করতে হবে, তা তাদের জানা আছে। তিনি তাদের প্রস্তাব মেনে নিলেন এবং বন্ধুদের নির্দেশের সামনে মাথানত করলেন। ইখওয়ানের পরবর্তী সাপ্তাহিক সমাবেশে দাঁড়িয়ে তিনি গোটা কাহিনী বিবৃত করেন এবং বলেন যে, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ঘটনাটা পুরাপুরী নকল করা। তিনি ইখওয়ানের নিকট কৃতজ্ঞ। ইখওয়ানের বাণী সাধারণ মানস, বিশেষ করে যুব মানসে শুভ প্রভাব ফেলছে। একটা বিপদ উপস্থিত হয়েছিল, যা ভালোয় ভালোয় কেটে গেল।