দ্বিতীয় অধ্যায়
আনুগত্যের শপথ
যেমন আগে বলেছি, ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সাথে আমার সম্পর্ক যেমনি গভীর তেমনি পুরনো। অথচ সরকারী কর্মকর্তারা ভেবেছিল, ইখাওয়ানের সাথে আমার সম্পর্ক হতে যাচ্ছে সবেমাত্র। বস্ততঃ১৯৩৭ থেকেই আমি ইখওয়ানের সাথে সম্পৃক্ত। ইসলামী মহিলা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় তেরশো আটান্ন হিজরীতে। এর মাস ছয়েক পরে একদিন ইমাম হাসানুল বান্নার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ইখওয়ানের সদর দফতরে মহিলাদের জন্যে আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তৃতা দানের পরপরই ইমাম বান্না আমাকে সাক্ষাতের সুযোগ দেন। তিনি তখন ইখওয়ানের মহিলা বিভাগ কায়েম করতে চাচ্ছিলেন। আলোচনাকালে তিনি সার্বিক পর্যায়ে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁরপর প্রায় প্রতিটি প্রস্তাব এবং মতামতের সাথে আমি একমত পোষণ করি। অবশেষে তিনি আমাকে ইখওয়ানের মহিলা বিভাগের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের আহবান জানান। বস্তুতঃএই মহিলা দল ছিল ইখওয়ানের একটি শাখা। আমি ইমাম বান্নার প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্যে আমার দলীয় নেত্রীদের সাথে আলোচনা করি। তারা প্রত্যেকেই বৃহত্তর পর্যায়ে উভয় দলের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা এবং সর্বক্ষেত্রে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রস্তাব মেনে নেন; কিন্তু ইখওয়ানের একটি অঙ্গ শাখার সভানেত্রী হিসেবে আমার ইখওয়ানের অন্তর্ভূক্তির প্রস্তাব নাকচ করে দেন। অবশ্য, এরপরেও নিয়মিত আমাদের দেখা সাক্ষাৎ এবং আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। আমাদের প্রত্যেকেই ইমাম হাসানুল বান্নার মতামতকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতো এবং ইমামকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করতো-ভালোবাসতো।
শেষ পর্যন্ত আমরা পৃথক দল হিসেবেই থেকে গেলাম। কিন্ত আমাদের সম্পর্ক দিন দিন মজবুততর হতে থাকলো। আমি সংস্থার কেন্দ্রীয় দফতরে আয়োজিত শেষ বৈঠকে ইমাম বান্নার কাছে এই শপথ করি যে, আমার দল আলাদা অস্তিত্ত বজায় রাখা সত্ত্বেও ইখওয়ানের প্রতিটি ডাকে সাড়া দেবে এবং একই উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাবে।
কিন্তু এতে ইমাম বান্না পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি চেয়েছিলেন, আমি যেন ইখওয়ানের মহিলা শাখার নেতৃত্বের জন্যে আত্মনিয়োগ করি।
যাই হোক, এর পরবর্তী অবস্থা দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৪৮ সালে দুর্ঘটনার পর হটাৎ ইখওয়ানুল মুসলিমুনকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং ইখওয়ানের সব তহবিল বাজেয়াপ্রাপ্ত করা হয়। ইখওয়ানের সব দফতর তালাবদ্ধ করা হয় এবং বেপরোয়াভাবে ইখওয়ান নেতা ও কর্মীদের গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়। এই অপ্রত্যাশিত এবং আকস্মিক সংকটের সময় ইসলামী আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ এবং নির্ভীক ভূমিকা পালন করে। আমি আমার ভাবী এবং চাচাতো বোন তাহিয়া জুবিলির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করি এবং শিগগিরই অনুভব করি যে, আমাকে ইমাম বান্নার প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে মেনে নেয়াই উচিৎ ছিল। ইমামের প্রস্তাব মেনে নেইনি বলে আমি অনুতাপবোধ করলাম।
ইখওয়ানের নিষিদ্ধ ঘোষণার পরবর্তী দিনই আমি দলের কেন্দ্রীয় দফতরে আমার নির্দিষ্ট কক্ষে উপস্থিত হই। এই সেই কক্ষ, যেখানে ইমাম বান্নার সাথে আমার আলাপ হয়েছিল। আমি তখনো কক্ষে শ্রদ্ধেয় বান্নার মহান অস্তিত্ব অনুভব করছি যেন! দুঃখে অনুশোচনায় আমার অন্তর জ্বলছিল তখন। দু’চোখ বেয়ে দরদর করে গড়িয়ে পড়ছিল তপ্ত অশ্রুধারা। আমি স্বগতোক্তি করে বলে যাচ্ছিলাম-
“ইমাম বান্না যথার্থই সত্যনির্ভর ছিলেন। ইমামের অনুসরণ করে সত্যের পথে জিহাদী ঝাণ্ডা উড়িয়ে এগিয়ে চলা প্রতিটি মুসলমানদের কর্তব্য। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে ইমাম যে পথে ডাক দিয়েছেন, তাছাড়া মুক্তি ও শান্তির বিকল্প কোন পথ নেই। হাসানুল বান্নার মতো বিজ্ঞ, দূরদর্শী এবং নির্ভীক নেতৃত্বই মুসলিম মিল্লাতকে তার মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছাতে সক্ষম”।
পরমুহূর্তেই আমি আমার প্রাইভেট সেক্রেটারীকে পাঠাই ভাই আবুদল হাফিজ আসসাইফিকে ডেকে আনতে। এর মাধ্যমেই আমি ইমাম বান্নার সাথে অলিখিত তথ্যাদি আদান-প্রদান করতাম। আমি তাঁর মাধ্যমে ইমামকে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী মোতাবেক আলোচনায় মিলিত হবার কথা স্মরণ করিয়ে দেই। ভাই আব্দুল হাফিজ যখন ইমামকে সংবাদ পাঠিয়ে তাঁর সম্মতি নিয়ে ফিরে এলো, তখন আমি আমার ভাই মুহাম্মাদ আল গাজালী এবং তাঁর স্ত্রীর মাধ্যমে ইমাম বান্নার কাছে নিম্নলিখিত সংক্ষিপ্ত চিঠি পাঠাইঃ
“মুহতারাম ইমাম হাসানুল বান্না!
আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন এবং ইসলামের খেদমতের জন্যে আমি জীবনের অনন্যা সব তৎপরতা বর্জন করে আপনার সম্মুখে উপস্থিত হবার জন্যে উদগ্রীব। আপনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যার পথ-নির্দেশ এবং পৃষ্ঠপোষকতা আমার একান্ত কাম্য। আল্লাহ্র দ্বীনের সেবার জন্যে আপনি আমাকে নির্দেশ দেবেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই হবে আমার জীবনের মহত্তম ব্রত!মুহতারাম ইমাম! আপনার নির্দেশের অধীর অপেক্ষায়-আল্লাহ্র দাসী”। -জয়নব আল-গাজালী।
এরপর ইমাম বান্নার সাথে অবিলম্বে সাক্ষাৎ করার জন্যে উপযুক্ত স্থান হিসেবে মুসলিম যুব সংস্থার কেন্দ্রীয় দফতরে নির্দিষ্ট করা হয়। কিন্তু বৈঠকে মিলিত হওয়ার জন্যে কোন সময় বা তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। সুযোগ মত আকস্মিক সাক্ষাতেরই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
একদিন আমি মুসলিম যুব সংস্থার কেন্দ্রীয় দফতরে আয়োজিত সম্মেলনে বক্তৃতা করার জন্যে যাচ্ছি, হটাৎ সিঁড়ির গোড়াতেই মহামান্য ইমামকেই আমি দেখতে পাই। তার এই সাধারণ ও অনাড়ম্বর উপস্থিতিতে আমি অত্যন্ত বিস্মিত হই এবং ভাবাবেগ ও আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়ি। আমি আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসার আগেই সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে উঠতেই মুহতারাম ইমাম বান্নার সাথে আলাপ শুরু করি।
সর্বপ্রথম আমি তাঁকে বললামঃ
“শ্রদ্ধেয় ইমাম! আমার মুর্শেদ। আমি আল্লাহ্র নামে শপথ করে বলছি যে, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা এবং ইসলামী সরকার কায়েমের উদ্দেশ্যে আপনি যে মহতী প্রয়াস চালাচ্ছেন, আমি তার সাথে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত এবং এ পথে যে কোন ত্যাগ-তিতিক্ষা এমনকি প্রাণ দিতেও দ্বিধা করবো না। আমি সর্বান্তঃকরনে আপনার আদেশ-নিষেধ মেনে চলার প্রতিজ্ঞা করছি”। ইমাম আমার কথায় এবং প্রতিজ্ঞায় অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন “ইসলামী মহিলা সংস্থা আপাততঃ যেভাবে কাজ করছে, সেভাবেই করতে থাকুক”।
আমার এবং ইমাম বান্নার সাথে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ত দেয়া হয় আমার ভাইকে। ইমাম বান্না নুহাস এবং ইখওয়ানের মধ্যে মধ্যস্থতা রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত করেন আমার উপর। তখন রাফয়াত, মুস্তফা পাশা আন-নুহাস দেশের বাইরে ছিলেন। এঁরা মরহুম আমীন খলিলীকে বিভ্রান্তি দূরীকরণ অভিযানের দায়িত্ব অর্পণ করেন। এ ব্যাপারে ইমাম বান্নাও একমত ছিলেন। আমাকেও যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৯৪৯ সালের ফেরুয়ারী মাসে এক রাতে জনাব আমীন খলিলী আমার কাছে আসেন। তাঁর চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ ছিল স্পষ্ট। তিনি বললেন-কর্তৃপক্ষ ইমাম বান্নাকে হত্যার পরিকল্পনা নিচ্ছে। তাঁকে শিগগিরই কায়রো থেকে বের করার ব্যবস্থা করতে হবে।
কিন্ত আমার ভাইকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে বলে ইমামের সাথে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যম কেউ ছিল না। ফলে আমি নিজেই ইমামের সাথে দেখা করার জন্যে রওয়ানা হই। কিন্তু দুর্ভাগ্য! আমার, আমার জাতির এবং গোটা বিশ্বমানবটার দুর্ভাগ্য যে, আমি অর্ধপথেই মুহতারাম ইমামের মর্মান্তিক শাহাদাতের সংবাদ পাই। শতাব্দির মহান বিপ্লবী নায়ককে মানবতার শত্রুরা নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডে গোটা জাতি ক্ষোভে-দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। হন্তাদের প্রতি সর্বত্র তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করা হয়। আমি প্রকাশ্যভাবে সরকারের এই বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও আন্তরিক ক্ষোভ প্রকাশ করি। এরপর দেশে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয় এবং নতুন সরকার অবিলম্বে ইসলামী মহিলা সংস্থাকে বেআইনী ঘোষণা করে।
আমি সরকারের ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা দায়ের করি। ১৯৫০ সালে জনাব হুসাইন সিরয়ী পাশার আমলে আদালত আমাদের পক্ষে রায় দেন এবং ইসলামী মহিলা সংস্থার তৎপরতা আবার পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। এই ঐতিহাসিক মামলায় আমাদের পক্ষের কৌশুলী ছিলেন প্রখ্যাত আইনবিদ জনাব আব্দুল ফাত্তাহ হাসান পাশা।
এরপর ওয়াফদ পার্টির সরকার গঠিত হয় এবং জনাব ইমাম হাসান হুজায়বীর নেতৃত্বে ইখওয়ানুল মুসলিমুন আবার কর্মতৎপরতায় শুরু করে। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কেন্দ্রীয় দফতর উদ্বোধনের প্রথম দিনেই আমি প্রকাশ্যভাবে ইখওয়ানের সাথে আমার সার্বিক সম্পর্কের কথা ঘোষণা করি, এবং মুর্শিদে ‘আম’ জনাব হুজায়বীর ব্যক্তিগত দফতর হিসেবে ব্যবহারের জন্যে আমার বাড়ীর সবচেয়ে বড় এবং সুসজ্জিত হল ঘরটি উৎসর্গ করি।
ইখওয়ানের ভাই আব্দুল কাদের আওদাহ এ জন্যে ব্যক্তিগত ভাবে সাক্ষাৎ করে আমাকে ধন্যবাদ জানান এবং বলেন-
“ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সাথে সরাসরি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত আপনার প্রকাশ্য ঘোষণা সত্যিই প্রশংসনীয় এবং আমাদের জন্যে অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার। বস্তুতঃ এটাকে আমাদের বড় সৌভাগ্যই বলতে হবে”।
আমি বিনয়ের সাথে বললাম- যা হয়েছে তার জন্যে আল্লাহ্কে অশেষ শুকরিয়া। বলা বাহুল্য, ইখওয়ানের সাথে অত্যন্ত সন্তোষজনকভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এর মধ্যেই জেনারেল নজীবের নেতৃত্বে সামরিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। বিপ্লবের কয়েকদিন আগে আমীর আব্দুল্লাহ ফয়সলসহ জেনারেল নজীব আমার সাথে দেখা করেন। এই বিপ্লবের প্রতি ইখওয়ান এবং মহিলা সংস্থার কিছুটা সহানুভূতি ছিল।
কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই বিপ্লবী সরকারের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা এবং কাজকর্মের মধ্যে অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে ইখওয়ান নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় আমি আমার মতামত প্রকাশ করি। পরে যখন নজীব সরকার ইখওয়ানের কয়েকজন সদস্যকে মন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় অংশগ্রহণের প্রস্তাব করেন, তখন আমি আমার পত্রিকার মাধ্যমে এই বলে প্রস্তাবের বিরোধিতা করি – “যেহেতু বিপ্লবী সরকার আন্তরিকতার সাথে ইসলামী জীবনাদর্শে অনুসারী নন বলে প্রকাশ পাচ্ছে-সুতরাং ইখওয়ানের কোন ব্যক্তিই এ ধরনের সরকারের সাথে মৈত্রী স্থাপন বা তার অধীনে দায়িত্ব পালনের কথা ভাবতেও পারে না। যদি কোন ব্যক্তি তা করে তাহলে তাকে ইখওয়ান থেকে বহিস্কার করা উচিৎ। বস্তুতঃবিপ্লবী সরকারের আসল উদ্দেশ্য স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত ইখওয়ানকে তার ভূমিকা ও নীতির উপর অটল থাকতে হবে”।
পত্রিকায় আমার বক্তব্য প্রকাশের পর জনাব আব্দুল কাদের আওদাহ আমার সাথে সাক্ষাৎ করে আপাততঃ এ ধরনের বক্তব্য প্রকাশ মূলতবী রাখার অনুরোধ করেন। এর পরবর্তী দু’সংখ্যায় আমি এ ব্যাপারে কিছুই লিখিনি। কিন্ত পরে আবার লিখতে শুরু করি। এবার জনাব আব্দুল কাদের আওদাহ জনাব হুজায়বীর নির্দেশপত্র নিয়ে আসেন। তাতে তিনি এ ব্যাপারে কিছু লিখতে নিষেধ করেন। বলাবাহুল্য, আমি এই নির্দেশ মেনে নেই। নেতার নির্দেশ অমান্য করা সম্ভব ছিল না। এ সময় সব ব্যাপারেই আমি ইমাম হুজায়বীর আদেশ নিষেধ-মোতাবেকই কাজ করি। এমনকি তাঁর অনুমতিতেই আমি শান্তি সম্মেলনে অংশ গ্রহন করি।
মুখোস উন্মোচিত
সময় তার নির্ধারিত গতিতে কালের প্রেক্ষাপট অতিক্রম করছিল। অবশেষে ১৯৪৫ সালের ভয়াবহ ঘটনাবলী দেশের ভাগ্যাকাশকে মেঘাচ্ছন্ন করে তোলে। জামাল আব্দুন নাসের তার মুখোস খুলে ফেলে তার আসল পৈশাচিক রুপে ধরা দেয়। সে প্রকাশ্যভাবে ইসলামের বিরোধিতা শুরু করে এবং ইসলামী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার অঙ্গীকার করে। এক্ষেত্রে বিদেশী শক্তিবর্গ এবং তাদের দেশীয় চরেরা তাকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। নাসের কাল বিলম্ব না করে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়ার জঘন্য হুকুম জারী করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান বীর জনাব আব্দুল কাদের আওদাহ এবং শেখ মোহাম্মাদ ফরগালীর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নেতাদের শুধু এই জন্যেই ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। কারণ, তারা দেশের সার্বিক উন্নতি এবং জনগণকে মুক্তি ও সমৃদ্ধির জন্যে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের দাবী তুলেছিলেন। নাসের ইমাম হুজায়বীর মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় বৃদ্ধ নেতাকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়ার হুকুম দেয়। কিন্তু আকস্মিক হৃদরোগ আক্রান্ত হওয়ার কারণে ডাক্তাররা তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলানোর অযোগ্য ঘোষণা করে। তারা এও বলে যে, এই বুড়ো এমনিতেই কয়েক ঘণ্টার বেশী বাঁচবেন না। সুতরাং ফাঁসিতে ঝুলানোর দরকার হবে না। একই কথা ভেবে জামাল নাসের জনাব হুজায়বীর ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করে।
কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? ইমাম হুজায়বী অচিরেই সুস্থ হয়ে উঠেন এবং নাসেরের জুলুম নির্যাতন এবং রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দ্বিগুণ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। তাঁর নির্ভীক পদক্ষেপ এবং বলিষ্ট নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠলে সরকার ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে গ্রেফতার করে এবং সামরিক কারাগারে নিক্ষেপ করে। সেখানে তাঁর উপর যে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়, তাতে অতি পাষণ্ডের চোখও অশ্রু ছলছল হতে বাধ্য। কিন্তু ইমাম হুজায়বী অতি ধৈর্য ও সহনশীলতা মূর্ত প্রতীক হয়ে সব অত্যাচার সহ্য করেন।
শেষ পর্যন্ত এই বৃদ্ধ নেতার চোখের সামনেই নাসের এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের মৃত্যু ও পতন ঘটে। প্রেসিডেন্ট নাসেরের স্বৈরাচারী আমলে অবর্ণনীয় অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকেই যখন আপাততঃচুপচাপ নিস্ক্রিয়তা অবলম্বনের অনুমতি চেয়ে ইমাম হুজায়বীর কাছে আসেন, তখন বৃদ্ধ ইমাম হুজায়বী একজন নবীন বিপ্লবীর মত উদ্দীপনা প্রকাশ করে বলেন-
“তোমরা কারা সক্রীয় থাকতে চাও বা কারা নিস্ক্রিয়তা অবলম্বন করতে চাও,তা নিয়ে ভাবার অবকাশ আমার নেই। তবে একটা কথা তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ইতিহাস খুলে দেখ, বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে যারা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বেড়িয়েছে, তারা কোন দিনই ইসলামী আন্দোলনের সেবা করতে পারেনি। ইসলামী আন্দোলনের ভীরু কাপুরুষ এবং সুযোগ সন্ধানীদের কোন স্থান নেই”। এসব কথা বলেছেন, তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করার সময়; তখন তাঁর বয়স আশি বছর। কুখ্যাত নাসেরের মৃত্যুর পর তিনি সবার পরে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।
দায়িত্ব পালনের ডাক
১৯৫৫ সালে স্বৈরাচারী সরকারের অকথ্য নির্যাতনে এবং নির্বিচারে মৃত্যুদণ্ডের শিকার হয়ে ইসলামী আন্দোলনের হাজার হাজার কর্মী শাহাদাত বরণ করেন। আমি শাহাদাতপ্রাপ্ত ভাইদের মাসুম সন্তান এবং বিধবাদের করুন অবস্থা দেখে দারুনভাবে বিচলীত হয়ে পড়ি। এসব এতীম ও বিধবাদের বুকফাটা কান্না, অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা এবং রিক্ত অসহায় অবস্থা আমাকে গভীরভাবে দুঃখ ভরাক্রান্ত করে তোলে এদের যথার্থ পুনর্বাসন এবং শহীদদের রক্তে ভেজা পথে দ্বিগুণ উৎসাহে এগিয়ে চলার জন্যে আমি নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। আমি সরকারের সাথে সরাসরি সংঘাতে অবতীর্ণ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
নতুনভাবে কাজে নেমে দেখি সারাদেশে অভাব অনটন এবং ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ অস্থির। কোন রকমে বেঁচে থাকার জন্যে দু’মুঠো অন্ন এবং লজ্জা ঢাকার মতো এক প্রস্থ কাপড়ের অভাবে লাখ লাখ বনি আদম অবৈধ আয়ের পথে হন্যে হয়ে ঘুরছে। ক্ষুধা মানুষের চরিত্র ও নৈতিকতাকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্র অসন্তোষ এবং কল-কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ জ্যামিতিকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সুযোগ বুঝে কায়েমী স্বার্থবাদী চক্র এবং মালিক ও বণিকরা জনসাধারণকে শোষণ করার নিত্য নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিল।
এদিকে যারা দীর্ঘদিনের কারাবাস থেকে মুক্তি পেয়ে বাইরে আসে, তারা কারাগার থেকেও বেশী ভয়ংকর এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। রোজগারের কোন একটি পথও তাদের জন্যে খোলা ছিল না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সাধারণ লোক তাদের অধিকার নিয়ে আওয়াজ তোলার সাহস করছিল না। এই ভয়ে প্রত্যেকেই সন্ত্রস্ত ছিল যে, টু-শব্দ করা মাত্রই সরকার যেকোনো বানোয়াট অভিযোগে মৃত্যুর পরওয়ানা জারি করতে বিলম্ব করবে না। বিশেষ করে ইসলাম এবং মুসলমানিত্ত নিয়ে যারাই কথা বলবে তাদের জন্যে কঠোর শাস্তি ছিল অবধারিত।
এমন ঘন-ঘোর দুর্দিনে আমাদের সব প্রচেষ্টা অত্যন্ত তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। কি যে করবো, তা ভাবে পাচ্ছিলাম না। সমস্যার যেন এক অশেষ তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ মহাসাগরে আমাদের পথরোধ করে প্রবাহিত হচ্ছিল। মুক্তির কোন পথই যখন দেখা যাচ্ছিল না, তখন পথনির্দেশ পাওয়ার আশায় আল-আহজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামান্য অধ্যাপক জনাব শেখ মোহাম্মাদ আল উদনের স্মরণাপন্ন হই। তাঁর প্রজ্ঞা চিন্তাধারা এবং ইমাম বান্নার সাথে আমার সম্পর্কের ব্যাপারে আন্দোলনের প্রতি তাঁর পূর্ণ সহানুভূতি ছিল। ইমাম বান্নার শাহাদাতের আগে এবং পরে প্রায় আমি তার সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে মত বিনিময় করি।
আমি অধ্যাপক আল উদনের সামনে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরি। তিনি ধৈর্য্য সহকারে আমার কথা শোনেন এবং নীরবে চোখের পানি ফেলতে থাকেন।
আমি তাঁকে বললামঃ
“এসব নিরপরাধ শিশু এবং বিধবাদের একমাত্র অপরাধ এই যে তাদের পিতা এবং স্বামীরা আল্লাহ্র দুনিয়াতে আল্লাহ্র দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে”।
আমার কথা শুনে তিনি সশব্দে কেঁদে ওঠেন এবং বাকরুদ্ধ স্বরে আমাকে নির্ভীকভাবে ত্রান তৎপরতা শুরু করতে বলেন। তিনি আরো বলেন-
“তুমি কমপক্ষে শহীদ পরিবারগুলোকে আশু সাহায্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা কর। আল্লাহ্ তোমাকে সাহস এবং মদদ যোগাবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে সহযোগিতা জন্য প্রস্তুত। মনে রেখো বাতিলের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে ইসলামী আন্দোলনের কাজে অবিচল থাকাই হচ্ছে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় দাবী। আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সরকারী নির্যাতনের শিকারে পরিণত ইখওয়ানেরাই হচ্ছে আল্লাহ্র পথের যথার্থ মুজাহিদ। এরাই মানুষকে সত্যিকারের স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে দেবে। তাদের সাফল্য অনিবার্য্য”।
এরপর তিনি আমাকে কতিপয় পরামর্শ দেন। সেসব পরামর্শের আলোকে আমি ত্রান অভিযানের রূপরেখা তৈরী করি। আমি সম্পূর্ণ গোপনীয়তার সাথে শহীদ এবং কারারুদ্ধ মুজাহিদদের পরিবারবর্গকে সাহায্য সামগ্রী পাঠাতে শুরু করি। আমাকে এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন কয়েকজন বিশ্বস্ত এবং দক্ষ কর্মী। তারা পূর্ণ দায়িত্ব ও যোগ্যতার সাথে ত্রান সামগ্রী নির্ধারিত স্থানসমূহে পাঠাতে থাকে।
ত্রান তৎপরতায় নেমে আসার আগেই অনেক মহিলা এই মহান কাজে আত্মনিয়োগ করেন; অবশ্য সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করে। এসব মহীয়সী মহিলাদের মধ্যে ইমাম হুজায়বীর পত্নি, মহিলা নেত্রী আমাল উসমাবী, অধ্যাপিকা মনিরুদ্দৌলা, মুহতারেমা আমীনা কুতুব এবং হামীদা কুতুব, ফাতহিয়া বকর, আমীনা জওহারী, আলীয়া এবং তাহিয়া জুবায়লীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কাজের মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমি নিজে মুহতারেমা খালেদা হুজায়বী এবং আমীনা ও হামীদা কুতুবের সাথে সাক্ষাৎ করে বাস্তব কর্মপন্থা নির্ধারণ করি। “আল্লাহ্র অশেষ শুকর যে, আমরা আমাদের শহীদ ও মুজাহিদ ভাইদের পরিবারবর্গকে প্রয়োজনীয় সাহায্য যোগাতে সক্ষম হই। ছোট-ছোট মাসুম এতীম এবং অসহায় বিধবা বোনদের মুখে হাসির রেখা ফোটাতে আমরা রিজিকদাতা রহমানুর রাহীমের দরবারে সিজদাবনত হই।
আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলের সাথে হজ্জের পথে
১৯৫৭ সালে এক সকালে সুয়েজ বন্দরে জনাব ফাত্তাহর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। আমি মহিলা হজ্ব প্রতিনিধিদের সভানেত্রী হিসাবে ওখানে উপস্থিত ছিলাম। আমাদের বিদায় সম্বর্ধনা জানানোর উদ্দেশ্যে লোকদের মধ্যে আমার ভাই মোহাম্মাদ আল-গাজালীও উপস্থিত ছিলেন। তিনি কিছুক্ষনের জন্যে কোথাও গেলেন যেন। ফিরে এলেন, সৌম্যকান্তির এক বৃদ্ধ মুরুব্বীকে সাথে নিয়ে। এলেন সরাসরি আমারই কাছে। বৃদ্ধের দৃষ্টি ছিল মাটির দিকে। চোখে মুখে এক অস্বাভাবিক শান্তদীপ্তি তাঁর মহৎ ব্যক্তিত্তের আভা বিকিরণ করছিল। আমার ভাই তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন-
“ইনি হচ্ছেন ভাই আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল। যৌবনকালে নবীন ইখওয়ানদের মধ্যে তিনি ইমাম হাসানুল বান্নার অতিপ্রিয় শিষ্য ছিলেন। ইমাম বান্না তাঁকে যেমন অত্যধিক ভালবাসতেন, তেমনি তাঁর উপর অবিচল আস্থাও পোষণ করতেন। ………আপনি একই জাহাজে হজ্বে যাচ্ছেন শুনে তিনি পরিচয়ের জন্যে এক্ষুনি আপনার সাথে দেখা করতে আসেন”। এরপর জনাব ফাত্তাহ সালাম জানিয়ে বলেন-
“ইনশাআল্লাহ জাহাজে আপনার সাথে দেখা করব”। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই এবং তিনি ফিরে যান। কিছুক্ষন পরেই আমাদের জাহাজ জেদ্দার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। দেখতে না দেখতে উপকূল ত্যাগ করে জাহাজ গভীর সমুদ্রে প্রবেশ করে। আমি মহিলা হজ্ব প্রতিনিধি দলের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানোর কাজে লেগে যাই। মধ্যাহ্ন ভোজের পর আমি আমার নির্দিষ্ট কক্ষে একটু আরাম করব বলে শুতে যাব এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে আমি উঠে দাঁড়াই এবং অতিথিকে ভিতরে আসার অনুমতি দেই। কিন্তু ভিতরে কেউই এলোনা। অবশ্য কড়া নাড়ার শব্দ হলো আরেকবার। ভাবলাম আমার আওয়াজ হয়তো আগমকারী শুনতে পাননি। তাই অপেক্ষাকৃত উঁচু শব্দে তাকে ভিতরে আসতে বললাম। এবার নীরবে দরজা খুলে প্রবেশ করলেন সুয়েজ বন্দরে আমার ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচয়দানকারী সেই শ্রদ্ধেয় বৃদ্ধ।তিনি স্বভাবসুলভ ভাবে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমাকে সালাম জানিয়ে বললেন-
“আল্লাহ্র অশেষ শুকরিয়া। শহীদ ইমামের সাথে দীর্ঘদিন পর্যন্ত মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত আপনি আনুগত্যের শপথ নিয়েছেন”।
আমি সাথে সাথেই প্রস্ন করলাম-
“সেকথা আপনি কেমন করে জানলেন?” তিনি সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন,
“স্বয়ং ইমামই জানিয়েছেন”।
আমি তাঁর উদ্দেশ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন-
“আমরা আল্লাহ্র ঘরে আল্লাহ্রই সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ করব। ইমাম হাসানুল বান্না যেসব ব্যাপার নিয়ে আপনার সাথে আলোচনা করতে চাচ্ছিলেন ওসব নিয়েই আমি কথা বলব”।
তিনি মক্কা শরীফের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন-
“এ প্রসঙ্গে ইনশাআল্লাহ্ ওখানেই আলাপ হবে”। তাঁর কথাবার্তা বলার ভঙ্গি ছিল খুবই সাদাসিধে এবং পরিচ্ছন্ন। কিন্তু সততা, দায়িত্বশীলতা ও গাম্ভীর্যের প্রচণ্ড শক্তি সক্রীয় ছিল তাঁর স্বাভাবিক শব্দ উচ্চারণে। এতে চিন্তাভাবনার কোন অবকাশ ছিল না। আমি তাঁকে বললাম-
“আল্লাহ্ চাহেতো, মক্কা শরীফ অথবা জিদ্দায় মুসলিম মহিলা কেন্দ্রে আমাদের আলোচনা হবে”। তিনি আমার ঠিকানা জানতে চাইলে আমি তাঁকে জিদ্দায় অবস্থানরত আমার দুটি ভাই শেখ উসমাবী এবং মুস্তফা আলামের ঠিকানা দিয়ে বলি-
“এরা মক্কা শরীফ এবং জিদ্দায় আপনাকে আমার বাসভবন পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেবে”। তিনি বললেন, এ দু’জনকে তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন। এরপর তিনি সালাম জানিয়ে তখনকার মত বিদায় নেনে। জিলহজ্জ মাসের এক রাতে নির্ধারিত প্রোগ্রাম মোতাবেক এশার নামাজের পরে, আমি সউদী আরবের প্রধান মুফতি মরহুম ইমাম মোহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহীমের সাথে সাক্ষাৎ করি।
দেশে মেয়েদের শিক্ষাদানের যথোপযুক্ত ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করে আমি বাদশাহ সউদের কাছে যে মেমোরেন্ডাম পেশ করি, মরহুম প্রধান মুফতির সাথে সে ব্যাপারে আলোচনা করি। মেমোরেন্ডামে দেশের সুবিধের আলোকে নারী শিক্ষার কার্যক্রম অবিলম্বে বাস্তবায়ন করার দাবী জানানো হয়।এই মেমোরেন্ডামে প্রধান মুফতির বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়েছিল। এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য প্রধান মুফতি আমাকে ডেকে পাঠান। আমি এ ব্যাপারে দুঘণ্টা পর্যন্ত আলোচনা করি। ওখান থেকে ফেরার পথে পবিত্র কা’বা ঘরে তওয়াফের উদ্দেশ্যে আমি হেরেম শরীফের বাবুস সালামের পথ ধরি। এমন সময় পেছন থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকলে ফিরে দেখি জনাব আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইল। আমার তওয়াফের উদ্দেশ্য জানতে পারে তিনিও আমার সাথে গিয়ে খোদার ঘর তওয়াফ করেন। তওয়াফের সুন্নাত আদায় করে আমরা মুলতাজিমের দিকে মুখ করে বসলাম এবং জনাব আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল নির্ধারিত সূচি মোতাবেক আলোচনা শুরু করেন। প্রথমে তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের উপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা আরোপ সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চান। আমি তাকে বললাম-
“শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত”।
তিনি বললেন-
“আসলে এ ব্যাপার নিয়েই আমি আপনার সাথে আলোচনা করতে চাই”। আমি এ বিষয়ে আলোচনার জন্যে তাঁকে “ওফদ ভবনে” মিলিত হতে প্রস্তাব করলে তিনি বলেন-
:ওসব জায়গায় নাসেরের গোয়েন্দা বাহিনীর লোক মোতায়েন থাকা অস্বাভাবিক নয়। ফলে তা আলোচনার জন্যে নিরাপদ জায়গা নয়।
এরপর আমরা হেরেম শরীফের নির্মাণ সংক্রান্ত দফতরে জনাব শেখ সালে কাজাজের কক্ষে বৈঠকে মিলিত হতে একমত হই। কিন্তু ওখানে পৌঁছে তিনি আমাকে চাপা স্বরে বলেন-
:না এখানেও নয়, তার চেয়ে বরং হেরেম শরীফেই গিয়ে আলোচনা করব।
আমরা মাকামে ইব্রাহীমের পেছনে বৈঠকের জন্যে সময় নির্ধারণ করি। তওয়াফ এবং সুন্নাতে তওয়াফ আদায় করে আমরা মাকামে ইব্রাহীমের পাশে জমজম কূপের উপর নির্মিত ইমারতের পেছনে বসে ইখওয়ানের উপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নাকচ করা এবং ইখওয়ানের সংগঠনকে পুনর্গঠিত করে আবার জোর তৎপরতা শুরু করার বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করি। আলোচনায় আমরা এ ব্যাপারে একমত হই যে, হজ্ব থেকে ফিরে গিয়ে আমরা ‘মুর্শেদে ‘আম’ ইমাম হুজায়বীর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর কাছে পুণরায় কাজ শুরু করার অনুমতি চাইব। আমরা যখন হজ্বের পর স্বদেশ রওয়ানা হব তখন তিনি বললেন-
:আমাদের আল্লাহ্র কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া জরুরী যে, আমরা ইখওয়ানের পুনর্গঠন পর্যন্ত আল্লাহ্র পথে জিহাদ করব এবং কোন ক্রমেই চুপচাপ বসে থাকব না। আর যারা এই মহৎ কর্মের বিরোধী, তা শক্তি সামর্থের দিক থেকে তারা যেকোনো পদ বা ক্ষমতার অধিকারী হোননা কেন, আমরা তাদেরকে বর্জন করব। আমরা উভয়েই, আল্লাহ্র দরবারে ইসলামের কাজে শাহাদাত এবং অবিরাম জিহাদের শপথ করি। এরপর মিশর প্রত্যাবর্তন করি।
কাজের অনুমতি
১৯৫৮ সালের গোঁড়ার দিকে ইসলামী মহিলা সংস্থার সদর দফতর এবং আমার বাস ভবনে জনাব আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলের সাথে আমার বারবার দেখা সাক্ষাৎ হয়। আমরা মুসলমানদের সমস্যাবলী নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করি এবং ইসলামের খেদমতে এমন কর্মপন্থা নির্ণয়ের প্রয়াস পাই, যাতে করে জাতি তার আত্মমর্যাদা এবং জীবনাদর্শ সম্পর্কে পুনরায় সচেতন ও সজাগ হতে পারে। আমরা রাসূলে করীমের জীবন চরিত, সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তীকালে মুসলিম মনীষীদের পন্থা অনুকরণে এমন এক কর্মসূচী ও সংবিধান তৈরী করি, যার ভিত্তি হবে কুরআন-সুন্নাহ। পরিকল্পনা মোতাবেক ইসলামের স্বার্থে কাজ করতে ইচ্ছুক প্রতিটি লোককে আমাদের সাথে দেখা করার জন্যে একত্রিত করা প্রয়োজন। কিন্তু এ সবকিছু ছিল কাজ শুরু করার আগে পন্থা নিরুপনের জন্যে আলাপ আলোচনা এবং পরামর্শ মাত্র। অবশ্য যখন আমরা কাজ শুরু করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করি, তখন ইখওয়ানের মুরুব্বী ও মুর্শেদ হিসেবে ইমাম হুজায়বীর মতামত নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করি। কারণ, আমাদের আইন সংক্রান্ত পড়াশোনার পর এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ইখওয়ানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত ছিল অবৈধ। কেননা, জামাল নাসেরের পক্ষে মুসলমানদের উপর নেতৃত্ব করার কোন বৈধ অধিকার নেই। যেহেতু সে ব্যাক্তিগতভাবে ইসলাম বিরোধী তাই তার আনুগত্য করতে কোন মুসলমানই বাধ্য নয়। এ ছাড়া সে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কুরআন ও সুন্নাহর বিধির পরওয়া করে না।
আমি আমার এবং জনাব আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলের নামে সাংগঠনিক কাজ শুরু করার অনুমতি লাভের জন্যেই ইমাম হুজায়বীর সাথে সাক্ষাৎ করি। একাধিকবার আলোচনায় মিলিত হবার পর তিনি আমাদের পরিকল্পনা ও কর্মপন্থার রূপরেখা বিস্তারিতভাবে যাচাই করেন এবং আমাদেরকে কাজ শুরু করার অনুমতি দেন।
এরপর আমাদের প্রথম পদেক্ষেপ হিসেবে তথ্যানুসন্ধান, প্রাথমিকভাবে সংগঠনের জন্যে লোক যোগাড়, কারা আমাদের সাথে কাজ করতে প্রস্তুত এবং কাজের দিয়ে কোন কাজ করানো যাবে ইত্যাদি বিস্তারিত অবগত হওয়ার উদ্দেশ্যে জনাব আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইল জেলা-শহর ও গ্রাম ভিত্তিক সমগ্র মিশর সফরে বের হন। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সাবেক কর্মীদের এ উদ্দেশ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয়, যাতে করে তারাই আন্দোলনের প্রথম কাতার রচনা করতে পারেন।
জনাব আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইল সদ্য কারামুক্ত ইখওয়ান কর্মীদের কর্মোৎসাহ যাঁচাই করার উদ্দেশ্যে প্রথমে তাদের সাথেই যোগাযোগ করেন। যারা আগে কারাভোগ করে এসেছেন তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা, সাহস এবং মনোবল অটুট রয়েছে কিনা, তিনি তাও সরেজমীনে পরিক্ষা করেন। দীর্ঘ কারাভোগ, অত্যাচার, উৎপীড়ন এসব কর্মীদের ইসলামী আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়নি তো? তারা কি আল্লাহ্র দ্বীনের পথে সংগ্রাম করতে গিয়ে এখনো আগের মত কর্মচাঞ্চল্য দেখাতে সক্ষম? এখনো কি তারা যেকোনো ত্যাগ তিতিক্ষার জন্য প্রস্তুত? বিপদ-মুসিবত হাসিমুখে মোকাবিলা করার মতো মনোবল তাদের তাদের অবশিষ্ট আছে তো? এসব প্রশ্নের জবাব হাসিলের জন্যে অপেক্ষাকৃত বেশী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কর্মীদের অবস্থা ও মতামত জানা আবশ্যক। এরই আলোকে নতুন পদক্ষেপ নেয়া হবে।
জনাব আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইলের পাঠানো প্রতিটি রিপোর্টের পর্যালোচনা করে আমি মুর্শিদে আমের সাথে সাক্ষাৎ করি এবং সর্বসম্মত বিষয়াদি ও সমস্যাবলী সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করি। আমি বিভিন্ন অসুবিধে ও সমস্যা সম্পর্কে সংশয় ও শঙ্কা প্রকাশ করলে তিনি বলেন –
“অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চল। পেছনে ফিরে তাকিও না, কে বা কারা কোন পদাধিকারী বা কোন প্রখ্যাত ব্যক্তি কি বলেছে- সেদিকেও ভ্রূক্ষেপ করোনা। মনে রেখো তোমরা সম্পূর্ণ একটি ইমারাত গড়ে তুলতে যাচ্ছ”।
তিনি কোন কোন ব্যাপারে আমাদের সাথে সম্পূর্ণ একমত প্রকাশ করতেন এবং কোন কোন ব্যাপারে নির্দেশ ও পরামর্শ দিতেন। তাঁর অন্যতম একটা পরামর্শ ছিল, আমরা যেন আলাপ-আলোচনায় ইমাম ইবনে হাজম এর আলমুহাল্লা সামনে রাখি।
১৯৪৯ সালে আত্মশুদ্ধিমূলক কর্মসূচী তৈরির জন্যে আমাদের গবেষণা কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যায়। আল্লাহ্ সাক্ষী, আমাদের কর্মসূচীতে মুসলমানদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়া কিছুই ছিল না। আমাদের কর্ম উদ্দেশ্য ছিল আরব হিসেবে তারা যেন ইসলামী সমাজ কায়েমের উদ্দেশ্যে তাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ও সক্রিয় হয়।
১৯৫৪ সালে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার কারণে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কর্মতৎপরতা মুলতবী হয়ে গিয়েছিল; এজন্যে আমাদের নতুন তৎপরতা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
স্বামীর সাথে স্পষ্ট কথাবার্তা
এসব তৎপরতায় অংশ গ্রহণের সাথে সাথে আমি ইসলামী মহিলা সংস্থার কেন্দ্রে নিয়মিত পয়গাম পাঠানো এবং নিজের পারিবারিক দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছিলাম।
ভাই আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইল এবং অন্যান্য কর্মী ভাইয়েরা আমাদের বাসভবনে বারবার যাতায়াত করছিলেন, তা আমার স্বামী মোহাম্মাদ সালেহ লক্ষ্য করেন। তাই তিনি একদিন প্রশ্ন করেন-
:ইখওয়ানের লোকদের যাতায়াত, আলাপ-আলোচনা ইত্যাদি এখানে তাদের তৎপরতারই ইঙ্গিত বহন করে। আসলেই কি ব্যাপারটা তাই?
আমি জবাবে বললাম-
:জী হ্যাঁ!
এরপর তিনি এসব তৎপরতার প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আমি বললাম-
:আমার ইখওয়ানের পুনর্গঠন করতে চাই।
এ সম্পর্কে তিনি আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে আমি আমাদের বৈবাহিক চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললাম-
প্রিয়তম, স্মরণ করুন তো, বিয়ের সম্মতি প্রদানের আগে আমি আপনাকে কি বলেছিলাম?
তিনি জবাব দিলেন-
“ হ্যাঁ, তুমি কিছু শর্ত রেখেছিলে। কিন্তু আজ আমি ভয় পাচ্ছি যে, পাছে জালিম সরকার তোমাকে গ্রেফতার না করে বসে”।–এই বলে তিনি মাথা নিচু করে চুপ রইলেন। আমি পূর্ব স্মৃতিচারণ করে বললাম-
“আমার স্পষ্ট মনে পড়ে আমি আপনাকে বলেছিলাম, আমার জীবনের সাথে সম্পৃক্ত এমন অনেক ব্যস্ততা আছে, যা আপনাকে জানানো দরকার। কারণ, আপনি আমার জীবনসঙ্গী হতে যাচ্ছেন। অতএব, আপনি যদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানার চেষ্টা না করেন তাহলে ওসব ব্যস্ততা সম্পর্কে আপনাকে অবহিত করতে চাই। এছাড়া আমি কয়েকটি শর্তও আপনার কাছে রাখব।
বস্তুত আমি মুসলিম মহিলা সংস্থার সভানেত্রী। কিন্তু অনেকেরই ধারণা, আমি ওফদ পার্টির রাজনৈতিক নীতিমালায় বিশ্বাসী। তা কিন্তু সত্য নয়। আসলে আমি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের নীতিতেই আস্থাবান। মুস্তাফা নুহাসের সাথে আমার যোগাযোগ ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব এবং সমচিন্তার কারণেই হয়েছিল। কিন্তু ইমাম হাসানুল বান্নার কাছে আমি আল্লাহ্র পথে জিহাদ করব বলে আনুগত্যের শপথ গ্রহন করি। এর অন্যথায় আমি এমন কোন পদক্ষেপের কথা ভাবতেও পারিনে, যা আমাকে খোদার নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে। বরং আমি অব্যাহতভাবে এই পথেই এগিয়ে চলব। আমি রাতদিন এই স্বপ্নই দেখি এবং এই আশাই পোষণ করি। কোনদিন যদি অনুভব করি যে, আপনার ব্যক্তিগত স্বার্থ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আমার ইসলামী কাজের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঠেকেছে এবং যদি উপলব্ধি করি যে, আমাদের দাম্পত্য জীবন ইসলামী আন্দোলনের পথে বাধার সৃষ্টি করছে, তখন আমরা পৃথক হয়ে যাব”। সেদিন আমার কথার জবাব দিতে গিয়ে আপনার চক্ষু অস্রুসজল হয়ে পড়েছিল এবং আপনি বলেছিলেন-
“তুমি তোমার বৈষয়িক প্রয়োজন এবং মোহর নির্ধারণ সম্পর্কে কোন দাবী তুলছনা কেন? আর তোমাকে ইসলামের কাজে বাধা না দেয়ার জন্যে তুমি যে শর্ত আরোপ করছ, তা ইমাম হাসানুল বান্নার সাথে তোমার সম্পর্কের ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনে। যতটুকু জানি, তা হচ্ছে, তুমি ইখওয়ানের মহিলা শাখার দায়িত্ব গ্রহণের ব্যাপারে মতবিরোধ করছ”।
আমি বললাম-
“ কিন্তু আল্লাহ্র শোকর, ইমাম বান্নার শাহাদাতের আগে ১৯৪৮ সালের দুর্যোগ কালে এ ব্যাপারে আমি তাঁর সাথে ঐক্যমতে পৌঁছাই এবং আমি পুরোপুরিভাবে ইসলামী আন্দোলনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেই। তা আমি আপনার কাছে এই দাবী তো করতে পারিনি যে, আপনিও এই জিহাদে আমার সাথে শামিল হোন; তবে আপনার কাছে এই অনুরোধ করার অধিকার আমার আছে যে, আপনি আমাকে আল্লাহ্র পথের এই জিহাদে শামিল হতে বাধা দেবেন না। আর যখন আমাকে মুজাহিদদের কাতারে যাবার প্রয়োজন দেখা দেবে, তখন আপনি যেন কোথায় কেন যাচ্ছি তা জিজ্ঞেস না করেন”। পুরুষ এ ব্যাপারে পূর্ণ আস্থাবান থাকা উচিৎ যে, যার সাথে আর বিয়ে হতে যাচ্ছে, সেই মহিলা তার যৌবনের প্রাথমিক পর্যায়েই নিজেকে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের পথে উৎসর্গ করে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও এই বিয়ে যদি ইসলামী আন্দোলনের পথে বাধা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা ভেঙ্গে যাবে এবং আমার অস্তিত্ত কেবল ইসলামী আন্দোলনের জন্যেই অবশিষ্ট থেকে যাবে”।
মুহূর্ত কয়েক চুপ থেকে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম-
:বিয়ের পূর্বেকার এসব কথা আপনার মনে পড়ছে কি?
তিনি বললেন- হ্যাঁ………
তাঁর জবাবে আমি বললাম –
“তাহলে আপনার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আপনি এটা জিজ্ঞেস করবেন না যে, আমি কার সাথে সাক্ষাৎ করছি বা কোথায় যাচ্ছি। ব্যস, শুধু আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করুন যে, তিনি যেন আমার জিহাদের প্রতিদানকে আমাদের উভয়ের মধ্যে বন্ধন করে দেন এবং আমার কাজকে কবুল করেন। আমি এটা ভালো করেন জানি যে, আমার উপর আদেশ-নিষেধ আরোপের পূর্ণ অধিকার আপনার রয়েছে এবং স্ত্রী হিসেবে আপনার হুকুম মানতে আমি বাধ্য। কিন্তু বর্তমানের নাজুক পরিস্থিতিতে ইসলামী আন্দোলনের কাজে আত্মনিয়োগ করা আমাদের পারস্পরিক দায়-দায়িত্ব পালন থেকে অনেক বেশী জরুরী”। আমার কথা শুনে তিনি বললেন-
“প্রিয়তমা! জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আমি তোমার কাছে লজ্জিত। দোয়া করি, এই মহত্তর কাজে অবিচল থাকার জন্যে আল্লাহ্ তোমাকে সৎ সাহস এবং উৎসাহ দান করুন। আমার জিবদ্দশাতে যদি আমি ইখওয়ানের সাফল্য দেখে যেতে পারি তাহলে কতই না সুখী হব। খোদা যেন তোমাদের প্রচেষ্টায় ইসলামী সরকার কায়েম করেন। হায়, নবীন হয়ে যদি আমিও তোমাদের সাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে কাজ করতে পারতাম!”
এরপর আমাদের কর্মতৎপরতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। দিন রাত কর্মীদের যাতায়াত এবং গতিবিধিতে আমাদের বাড়ী সরগরম হয়ে থাকে। এমনকি মধ্যরাতেও যদি কেউ এসে দরজায় কড়া নাড়ে তো আমার স্বামী উঠে গিয়ে আগমনকারীদের জন্যে দরজা খুলে দেন, তাদেরকে সাক্ষাৎকারের কক্ষে নিয়ে যান, এরপর পরিচালিকাকে জাগিয়ে চা-নাস্তা তৈরীর আদেশ দিয়ে অত্যন্ত সাবধানে আমাকে জাগিয়ে বলতেন-
“তোমার ছেলেরা এসেছে। তাদের চোখেমুখে শ্রান্তির ইঙ্গিত স্পষ্ট”।
আমি উঠে গিয়ে তাদের স্বাগত জানাই এবং আমার স্বামী ঘুমোতে যাওয়ার আগে বলে যান যে, আপনারা যদি ফজরের নামাজ জামায়াতের সাথে পড়েন, তাহলে দয়া করে আমাকেও জাগিয়ে দেবেন; জামায়াতে শামিল হতে পারি যেন”।
তাঁর আগ্রহ মোতাবেক যথা সময়ে তাঁকে জাগিয়ে দেই। নামাজের পর তিনি অতিথিদের সাথে এমন আদর-যত্ন সহকারে কথা বলেন, যেন এরা তাঁর প্রিয়তম সন্তান। এরপর সালাম-দোয়া করে তিনি তাঁর কক্ষে চলে যান।
সাইয়েদ কুতুবের সাথে সাক্ষাৎ
১৯৬২ সালে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সভাপতি অধ্যাপক হাসান হুজায়বীর অনুমতি এবং ভাই আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইলের সম্মিতিতে বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও বিপ্লবী নেতা ইমাম সাইয়েদ কুতুবের সাথে কারাগারে দেখা করার উদ্দেশ্যে প্রথমে তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ করি। বিভিন্ন গবেষণামূলক বিষয়াদি সম্পর্কে তাঁর মতামত গ্রহণ এবং তাঁর উপদেশ ও পরামর্শ থেকে উপকৃত হওয়াই ছিল কারাগারে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করার মূল উদ্দেশ্য।
আমি প্রথমে বোন হামীদা কুতুবের কাছে নিজের উদ্দেশ্যে বর্ণনা করে ভাই সাইয়েদ কুতুবকে আমার সালাম পৌঁছাতে বলি এবং বিশেষ করে জানাই যে, ইসলামী পাঠ্যসূচী পর্যালোচনাকারী দল তার মতামত নিতে আগ্রহী।
আমি বোন হামীদা কুতুবকে আমাদের পাঠ্যতালিকা পেশ করি। এতে তাফসীরে ইবনে কাসীর, ইবনে হাজমের’মুহাল্লা, ইমাম শাফেয়ীর কিতাবুল উম্ম, ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের কিতাবুত তাওহীদ এবং সাইয়েদ কুতুবের ফি জিলালিল কুরআন শামিল ছিল। একটু পরে হামীদা ফিরে এসে আমাকে সূরা আনয়ামের দ্বিতীয় সংস্করণ পাঠের পরামর্শ দেন। এছাড়া একটি পাণ্ডুলিপি দেখিয়া বলেন যে, সাইয়েদ কুতুব কারাগারে বসেই এই গ্রন্থ রচনা করেন এবং এর নাম রাখেন মায়লিমু ফিততারীক-মাইল-ষ্টোন- শিগগিরই এটি প্রকাশিত হবে। তুমি এই কয়পাতা পড়ে নিলে আমি তোমাকে অন্যান্য পরিচ্ছদও এনে দেব।
আমাকে জানানো হয়ে যে, মুর্শিদে ‘আম’ এই পাণ্ডুলিপি পুনর্বিবেচনা করে তা অবিলম্বে ছাপানোর নির্দেশ দেন। পরে এ ব্যাপারে আমি মুর্শিদে ‘আম’ কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন-
“আল্লাহ্র রহমত বৈকি! এই গ্রন্থ পড়ে সাইয়েদ কুতুবের প্রতি আমার বিরাট আশা দানা বেঁধে উঠেছে, আমি দু-দু’বার গ্রন্থটি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি”।
নিঃসন্দেহে বর্তমানে সাইয়েদ কুতুবই আমাদের আশা-আকাংখার মধ্যমণি। মুর্শিদে ‘আম’ আমাকে পুরো পাণ্ডুলিপিই পড়তে দেন। আমি পাণ্ডুলিপি নিয়ে একটি রুদ্ধদার কক্ষে বসে পড়ি। ‘মায়ালিমু ফিততারিক’ এর পাণ্ডুলিপিটি পূর্ণাঙ্গ পড়েই আমি কক্ষে থেকে বেরুই। এরপর নবীদের মধ্যে বিতরণের জন্যে ছোট ছোট পুস্তিকা আকারে এর এক একটি পরিচ্ছেদ পৃথক পৃথক ভাবে প্রকাশের ব্যাপারে শলা-পরামর্শ করি। আমরা এ ব্যাপারে সর্ব সম্মতিক্রমে পদক্ষেপ গ্রহন করি। ইমাম সাইয়েদ কুতুব কারাগার থেকে প্রয়োজনীয় বিষয়াবলীর উপর বিভিন্ন পুস্তিকা পাঠাতে থাকেন এবং আমরা তার সামষ্টিক পাঠ এবং ব্যাপকভাবে প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা করি।
নবীনরা কুরআনের শিক্ষা গ্রহনের জন্যে একত্রিত হতে শুরু করে এবং তাদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। কতো যে সুন্দর এবং পবিত্র অনুভূতির উদ্রেক করতো নবীনদের সেসব সামষ্টিক পাঠচক্রের দৃশ্য, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আমাদের সামষ্টিক পাঠের নিয়ম ছিল এরকম যে, প্রথমে কুরআন শরীফের দশটি আয়াত তেলাওয়াত করা হতো, এর শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ বুঝানো হতো, এর উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হতো, এরপর মুসলমানদের ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক জীবনে এ সবের বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে বাস্তবভিত্তিক আলোচনা করা হতো।
এভাবে সাহাবাদের নীতির অনুসরণে দশ আয়াত পাঠ করে বুঝে নিয়ে পরবর্তী দশ আয়াত তেলাওয়াত ও তা বুঝার দিকে মনোনিবেশ করা হতো। আমরা এভাবে আল্লাহ্র রহমতের ছায়াতলে কুরআন পাঠ ও বুঝার জন্যে সমবেত হয়ে নিজেদের ব্যক্তিত্ব গঠনের কাজে তৎপর থাকি এবং অন্যান্যদের কাছে ইসলামী দাওয়াত পৌঁছিয়ে তাদেরকে আন্দোলনের জন্যে তৈরী করি। নবীনরা যথার্থ ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপারে খুবই উৎসাহী ছিল। ভবিষ্যৎ বংশধররা যাতে করে অকৃত্রিম আন্তরিকতার সাথে ইসলামী আন্দোলনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারে, তার ক্ষেত্রে প্রস্তুত করার জন্যে নবীনরা ইসলামী আন্দোলনকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার উপর বিশেষ জোর দেয়।
আমরা ইমাম হুজায়বীর অনুমতি এবং ইমাম সাইয়েদ কুতুবের পরামর্শের আলোকে মুসলমানদের তাওহীদী আকীদায় যুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রশিক্ষণ এবং সংগঠিত করার কাজ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেই। আমরা এটা স্পষ্ট করে দেই যে, যতক্ষণ না ইসলামী আইন অর্থাৎ কুরআন সুন্নাহর আলোকে ফয়সালার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, ততক্ষন কোন ইসলামী সরকার আছে বা ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে হবে না। সুন্নাহর আইনকে মুসলমানদের সামষ্টিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সুতরাং, মক্কায় রাসূলে খোদার তেরো বছরের প্রাথমিক প্রচার কার্যের অনুসরণে আমরাও তেরো বছর মেয়াদী বিশেষ কর্মসূচী হাতে নেই। এ উদ্দেশ্যে প্রথমে ইখওয়ান কর্মীদেরকেই তাদের জীবনে ইসলামের আদর্শকে পুরোপুরি কায়েম করা এবং ইমামের আনুগত্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু ইসলামী বিধান মোতাবেক হুদুদ বা দণ্ডবিধি জারী করা ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত মুলতবী থাকবে। (অবশ্য সম্ভাব্য উপায়ে এর প্রয়োগ এবং প্রতিরক্ষার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। )
আমরা এটাও জানতাম যে, নবী এবং তাঁর সাহাবাদের যুগের মত গুণাবলী সম্পন্ন মুসলমান চরিত্র আজকের পৃথিবীতে বিরল। এ জন্যে যে কোন ইসলামী সংস্থার উপর অবিরাম জিহাদ চালিয়ে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য এবং গোটা মুসলিম মিল্লাত ইসলামী আদর্শের আওতায় না আসা পর্যন্ত এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। কেবল শ্লোগানের মাধ্যমেই নয় বরং কার্যকরী ভাবেই এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
অবস্থার বিস্তারিত বিশ্লেষণ করার পর এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বর্তমান সরকার সম্পূর্ণরূপে অনৈসলামী , যদিও সরকার বেশ কয়েকবার ঘোষণা করেছে যে, তারা আল্লাহ্র আইন প্রবর্তন করেছেন। এই পর্যালোচনার পর যুবক-যুবতী ,নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের প্রশিক্ষণের ১৩ বছরের নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ হবার পর দেশব্যাপী সমীক্ষা চালানো হবে। এরপর যদি শতকরা ৭৫ ভাগ লোককে (যারা এ ব্যাপারে আমাদের সাথে একমত হবে যে, ইসলাম এবং রাজনীতি আলাদা আলাদা বিষয় নয় এবং ইসলামকে বাস্তবায়নের জন্যে রাজনীতি অপরিহার্য) আমাদের সহগামী হিসেবে পাই তাহলে আমরা দেশে সত্যিকারের ইসলামী শাসন কায়েমের দাবী তুলব। কিন্তু প্রথম তেরো বছরেও যদি অধিকাংশ জনসাধারণ ইসলামের আওতা থেকে দূরে সরে থাকে তাহলে পরবর্তী দশকে আমরা জনগণকে ইসলামী শিক্ষার আলোকে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যাপারে পুণরায় মনোনিবেশ করব। আমাদের এই কাজ ইসলাম বিরোধীদের সমূলে উৎখাত, ইসলামী আদর্শকে পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করা পর্যন্ত চলতে থাকবে। আমরা ইসলামী আন্দোলনের এই মিশনে আজীবন তৎপর থাকার শপথ নেই। এভাবে যদি আমাদের মৃত্যুর মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে তাহলে আমরা পরবর্তী বংশধরদের হাতে ইসলামের ঝাণ্ডা তুলে দেব। মুর্শিদে ‘আম’ ইমাম হুজায়বীর ইচ্ছা মোতাবেক ইমাম সাইয়েদ কুতুবের সাথে আমার যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। তিনিও নয়া মিশরে অবস্থিত আমার বাসভবনে নবীনদের বিভিন্ন প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার জবাব ও পরামর্শ দানের জন্যে আসতেন। যুবকরা বিভিন্ন বিষয়ে তাঁকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যেত এবং তিনি ধৈর্য সহকারে এক একটি প্রশ্নের বিস্তারিত এবং সন্তোষজনক জবাব পেশ করতে থাকেন।