তৃতীয় অধ্যায়
ষড়যন্ত্র
প্রথমেই উল্লেখ করেছি, ইমাম সাইয়েদ কুতুবের কারাগার থেকে মুক্তির কয়েক মাস আগে আমাকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। আমরা বিশ্বস্ত সুত্রে খবর পাই যে, ইমাম সাইয়েদ কুতুবকে সহজতর উপায়ে হত্যা করার উদ্দেশ্যেই এবার মুক্তি দেয়া হচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ড কার্যকরী করার জন্যে গোয়েন্দা বাহিনী ইতিমধ্যেই তার ষড়যন্ত্রের চূরান্ত রূপরেখা তৈরি করে নিয়েছিল। গোয়েন্দা বাহিনীর হত্যা অভিযান তালিকায় ভাই আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইলের নামও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এসব খবর শুনেও আমরা একান্ত নির্লিপ্তভাবে আল্লাহ্র উপর ভরসা করে কাজ করে যাই। আন্দোলনের কাজে এতটুকু শিথিলতাও আসুক, তা আমরা কেউ কামনা করতে পারিনি। অবশ্য জুলুমশাহীর ভেল্কি-ধমকী এবং তাদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে আলোচনা পর্যালোচনা অবশ্যই করি। বস্তুতঃ ওরা মনে করেছিল আমাদের এটা ভাববাদী আন্দোলন। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন কারারুদ্ধ নেতা জনাব সাইয়েদ কুতুব। আর বাইরে এর বাস্তব অনুশীলন করেছেন আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইল এবং জয়নব আল গাজালী।
এমন সময় আমরা অত্যন্ত বিশ্বস্ত সূত্রে এই তথ্য পাই যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন এবং তার সব তৎপরতাকে অবিলম্বে খতম করার জন্যে মার্কিন ও সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা প্রেসিডেন্ট নাসেরকে একটি রিপোর্ট হস্তান্তর করে। রিপোর্টে তারা শঙ্কা প্রকাশ করে বলে যে, অবিলম্বে যদি ইখওয়ানকে স্তব্ধ করে না দেয়া হয়,তাহলে সামরিক সরকার জনগণকে ইসলামী ধ্যান-ধারণা থেকে দূরে সরিয়া আনার জন্যে এবং ইসলামের মাধ্যমে সংশোধন ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে জনসাধারণকে নৈরাশ্যজনক অবস্থায় আনার ক্ষেত্রে যে সাফল্য অর্জন করেছে- তার সব কিছুই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। সুতরাং ইখওয়ান তার চিন্তাধারা এবং আন্দোলনকে সমূলে উৎখাত করার জন্যে সরকারের উচিৎ সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহন করা। মার্কিন এবং সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে পাওয়া রিপোর্টের আলোকে প্রেসিডেন্ট নাসের এটা অনুভব করেন যে, ইসলামী আন্দোলনের অস্তিত্ব তার স্বৈরাচারী শাসনের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা।
১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসের গোড়ার দিকে আমি খবর পাই যে, অবিলম্বে যাদের গ্রেফতার করা হবে, তাদের তালিকার চূরান্ত রুপ দেয়া হয়ে গেছে। এই তালিকায় বিশেষভাবে কয়টি নাম হচ্ছে- ইমাম সাইয়েদ কুতুব, জয়নব আল গাজালী, আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইল এবং মোহাম্মাদ ইউসুফ হাওয়াস।
১৫ই আগস্ট মাসের গোঁড়ার দিকে আমি খবর পাই। আমি সে সময় কয়েকজন বোনের সাথে আলাপ করছিলাম, এমন সময় টেলিফোন আসে। টেলিফোনে আমাকে জানানো হয় যে, সাইয়েদ কুতুবের খানাতল্লাসী করা হয় এবং তাঁর দেহ তল্লাসীও বাদ পড়েনি। এর কয়েকদিন আগেই তাঁর ভাই মোহাম্মাদ কুতুবকেও আটক করা হয়। আমার স্বামী সে সময় রাস আলবীরে অবস্থান করছিলেন। আমি তাঁকে টেলিফোন করে সাইয়েদ কুতুব সম্পর্কে সন্তোষজনক তথ্য পাঠাতে বলি। ঘণ্টা খানেক পরে টেলিফোনের মাধ্যমে আগে পাওয়া খবর সত্য বলে জানান। আমি তৎক্ষণাৎ বোনদের বৈঠকে স্থগিত করে পরবর্তী পরিস্থিতির দিকে মনোনিবেশ করি। সাইয়েদ কুতুবের গ্রেফতারীর খবর তরুণদের মধ্যে দারুণ চাঞ্চল্য এবং উত্তেজনার সৃষ্টি করে। আমাদের কথাতো বলাই বাহুল্য।
ইমাম হুজায়বীতো আন্দোলনের সব দায়িত্ব সাইয়েদ কুতুবের উপরই ন্যাস্ত করে রেখেছিলেন। আমরা জনাব হুজায়বীর নির্দেশ মোতাবেক তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখি। সাইয়েদ কুতুবের গ্রেফতারীর পর পরবর্তী দায়িত্বশীল কে হচ্ছেন, তা জানার জন্যে আমরা মুর্শিদে ‘আম’ ইমাম হুজায়বীর সাথে সাক্ষাৎ করি।
আমি এবং আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল গ্রেফতারীর পাঁচদিন আগেই এই দুর্ঘটনা হবে আশংকা করছিলেন। যাই হোক, এই দুর্ঘটনার পর আব্দুল ফাত্তাহ আমার সাথে সাক্ষাৎ করে আমাকে আলেকজান্দ্রিয়া গিয়ে মুর্শিদে ‘আমের’ সাথে দেখা করার জন্যে সফরে রওয়ানা হবার নির্দেশ দেন। তিনি একজন যুবকের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেন এবং বলেন-
“আমি যদি গ্রেফতার হয়ে যাই তাহলে এ যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করবে”।
এর কয়েক ঘণ্টা পরে তিনি টেলিফোন করে আমাকে নিজ বাসভবনে থাকার আদেশ দেন এবং আলেকজান্দ্রিয়া সফর মুলতবী করতে বলেন। কিন্তু আমি ইতিমধ্যেই মুর্শিদে ‘আমের’ সাথে যোগাযোগ কায়েম করে নিয়েছিলাম। মুর্শিদে ‘আমের’ স্ত্রীও আলেকজান্দ্রিয়া থেকে এসে গিয়েছিলেন। আমরা নিয়মিতভাবে জনাব হুজায়বীর সাথে যোগাযোগ রাখার সিদ্ধান্ত নেই। এবার আমাদের মধ্যেকার যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব দেয়া হয় ভাই মোস্তফা মুরসীকে।
এরপর আমি মুর্শিদে ‘আমের’ সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে সব ব্যাপারে অবহিত করি এবং আমাদের কর্মসূচী ব্যাখ্যা করি। তিনি এতে সম্মতি দান করেন। তিনি গ্রেফতারীর ঘটনাবলী, বিশেষ করে সাইয়েদ কুতুবের গ্রেফতারীতে গভীর দুঃখ ও দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করেন।
এরপর গ্রেফতারী অভিযান চলতেই থাকে। দেখতে না দেখাতে বেশ কয়েক হাজার ইখওয়ানকে কারারুদ্ধ করে নেয়া হয়। আমাকে গ্রেফতার করার পর শামস বাদরান প্রেসিডেন্ট নাসেরের কাছে শপথ করে বলে যে গত কুড়ি দিনে ইখওয়ানের এক লাখ লোককে গ্রেফতার করে সামরিক কারাগার, দূর্গের জেলখানা, আবুজাওয়াল জেল, আলেকজান্দ্রিয়া এবং তানতাহসহ আরো অনেক কারাগার ভরে দেয়া হয়েছে।
ঊনিশে আগস্ট খবর পাই যে, ৮৫ বছর বয়স্কা ফাজেলা ওরফে উম্মে আহমদকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি ইসলামী আন্দোলনে প্রথম থেকেই আমাদের সহগামীনি ছিলেন। তিনি ইমাম হাসানুল বান্নার যথার্থ অনুসারী ছিলেন এবং কারারুদ্ধ ইখওয়ানদের পরিবার বর্গের দেখাশুনা এবং সাহায্য সহযোগিতা দানে তাঁর বিরাট ভূমিকা ছিল। এহেন মহীয়সী অশীতিপর বৃদ্ধার গ্রেফতারের দুঃসংবাদ আমাকে মর্মাহত করে। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আমি বার্তাবাহক তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে সম্বোধন করে বলি-
“আমাদের সৌভাগ্য যে, পঁচাশি বছরের বৃদ্ধাও আল্লাহ্র পথে জিহাদ করতে গিয়ে কারাগারের দুঃসহ নির্যাতনকে হাসিমুখে বরণ করে নিচ্ছেন, কিন্তু খোদাদ্রোহী বাতিল শাসনের সামনে মাথা নত করেননি। তাঁর উপর আল্লাহ্র রহমত নাজিল হোক এবং আল্লাহ্ তার কাজে সন্তুষ্ট হোন”।
আমি আমার ধর্ম মেয়ে গাদা আম্মারকে ডেকে বলি-
“শিবলার প্রখ্যাত মুজাহেদা ফাজেলা ওরফে উম্মে আহমদকেও গ্রেফতার করা হয়েছে… আমি ইসলামী আন্দোলন এর প্রচার কার্য পরিচালনা এবং গ্রেফতারকৃত লোকদের পরিবারবর্গের খরচ পত্রের জন্যে যে তহবিল তোমার কাছে রাখছি, আমি যদি গ্রেফতার হই তাহলে সব টাকা তুমি মুর্শিদে ‘আম’ অথবা কুতুব পরিবারের কারো কাছে হস্তান্তর করে দেবে। এই বলে আমি গাদার কাছে টাকার থলে সোপর্দ করি। এসব টাকা কর্মীদের চাঁদা থেকে সংগ্রহীত হয়েছিলো। পরে কারাগারে গিয়ে খবর পাই যে, গাদা এসব টাকা আমার আরেক ধর্ম মেয়ে ফাতেমা ইসার কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু সেও যখন গ্রেফতার হয়ে যায়, তখন জালিম শাহীর এজেন্টরাও সেসব টাকাও ছিনিয়ে নেয়। অথচ এসব টাকা ছিল সেসব নিরপরাধ খরচের জন্যে খাদ্য, বাসস্থানের ভাড়া, ঔষধপত্র কেনা এবং লেখাপড়ার খরচের জন্যে নির্দিষ্ট, যাদের পিতাদেরকে শুধু এই জন্যেই গ্রেফতার করা হয় যে, তারা ইসলামী পুনর্জাগরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে নয়া ইতিহাস রচনা করছিল।
গাদা আম্মার এবং আলীয়া হুজায়বীর কারাগারে আমার সাথে দেখা করে এসে সবকিছু বিস্তারিতভাবে জানান। আমি তাদের বললাম-
“দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই; আল্লাহ্ই আমাদের জন্যে যথেষ্ট। তিনিই উত্তম ব্যবস্থাপক। আমাদের প্রকৃত ঠিকানা তো আখেরাতে……। আর এই পৃথিবীতো ক্ষণস্থায়ী……”।
আমার গ্রেফতারীর আগে পর্যন্ত ইখওয়ানদের পাইকারী হারে গ্রেফতারের খবর প্রতিনিয়ত আমার বুকে তীরের মতো এসে বিঁধছিল। এর মধ্যে বার্তাবাহক এসে আমাকে মুর্শিদে আমের সাথে আলেকজান্দ্রিয়ায় গিয়ে সাক্ষাৎ করার পয়গাম দিয়ে যায়। ১৯-শে আগস্টেই আমি যখন রওয়ানার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন দ্বিতীয় বার্তাবাহক এসে রওয়ানা আপাততঃ মূলতবী করতে বলে যায়।
এবার আমার পালা
২০-শে আগস্ট শুক্রবার ভোরে ফজরের নামাজের সময় হটাৎ জালিম-শাহীর সৈন্যরা আমার বাসভবনে চড়াও করে। আমি তাদেরকে খানাতল্লাসীর অনুমতিপত্র দেখাতে বললে তারা বলে-অনুমতিপত্র? কিসের অনুমতিপত্র? কার অনুমতিপত্র? আরে পাগল নাকি! তুমি জাননা যে এটা নাসেরের আমল। জানো আমাদের যা মর্জি তাই করব। তারা হিস্টিরিয়া আক্রান্ত রোগীর মত বিকট হাসির সাথে আবার বলে-
ইখওয়ানরা সত্যিই পাগল। জামাল নাসেরের যুগে তারা আমাদের কাছে ঘরে ঢোকার অনুমত্রিপত্র চাচ্ছে। এরপর তারা যা সামনে পাচ্ছিল, সব আসবাবপত্র এলোপাথাড়ি ভেঙ্গেচুড়ে দুমড়িয়ে যেতে থাকল, একটি জিনিসও তাদের অভিশপ্ত থাবা থেকে রেহাই পেলনা। তাদের এই জঘন্য কর্মকাণ্ড দেখেও আমি একান্ত অসহায় দৃষ্টিতে নীরবে অবলোকন করতে থাকলাম। ঘরের সব কিছু তছনছ করে পরে তারা আমার ভ্রাতুষ্পুত্রকে গ্রেফতার করে নেয়। সে ছিল টিচার্স কলেজের ছাত্র এবং আমাদের বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া করত। এরপর তারা বলল-তুমি বাড়ী ছেড়ে কোথাও যাবেনা। আমি প্রশ্ন করলাম-
:এর মানে কি এটাই বুঝব যে আমি নজরবন্দী? তারা জবাব দিল দ্বিতীয় আদেশ না আসা পর্যন্ত তোমার তদারক আমাদের হাতে থাকবে। যদি তুমি বাড়ীর বাইরে যাবার চেষ্টা কর তাহলে তোমাকে গ্রেফতার করা হবে। আমি ভাবছিলাম, সম্ভবতঃ নজরবন্দী পর্যন্তই আমার ব্যাপার সীমিত থাকবে। তবুও আমি গ্রেফতারের আশংকায় প্রয়োজনীয় জরুরী প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় আমার প্রতিবেশিনীর স্বামী এবং ছেলেমেয়েরা আমার সাথে সাক্ষাতের জন্য চলে আসেন। পাছে ভদ্রলোকেও গ্রেফতার করে নেয় এই ভয়ে আমি তাকে তক্ষুনি বাড়ি ত্যাগ করতে অনুরোধ করি। কারণ ওরা আমার ভ্রাতুস্পুত্রকেও গ্রেফতার করে নিয়েছিল। কিন্তু আমার শত অনুরোধে সত্ত্বেও তারা আমাকে ছেড়ে যেতে রাজী হলেন না।
ঠিক মধ্যাহ্ন ভোজের সময় নাসেরের জালিম সৈন্যরা আমার ঘরে ঢুকে অবশিষ্ট সব সাজ-সরঞ্জাম নষ্ট করতে শুরু করে। তাড়া আমার অফিসে কক্ষের অর্ধেক জিনিসপত্র ধ্বংস করে দেয়। সিন্ধুক দখল করে নেয়। এত শিগগীর আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর অতি গুরুত্বপূর্ণ বই-পুস্তক-বিশেষ করে তাফসীর, হাদীস, ফিকহ এবং ইতিহাস ইত্যাদি সরিয়ে নিতে ব্যর্থ হই। এছাড়া ১৯৫৮ সালে বেআইনী ঘোষিত পত্রিকার ৩টি বিশেষ সংখ্যার খসড়া পাণ্ডুলিপি সরিয়ে নিতে পারিনি। পাষণ্ডরা যাচ্ছেতাই নষ্ট করছিল এবং যা ইচ্ছে বাজেয়াপ্রাপ্ত বা তচনছ করছিল। সিন্ধুকের চাবি নিয়ে তাদের সাথে আমার বচসা হয়। আসলে সিন্ধুকটি আমার স্বামীর তত্ত্বাবধানেই ছিল। ওতে আমার কিছু জিনিসপত্র সংরক্ষিত ছিল। সিপাহীরা যখন আমার কাছে সিন্ধুকের চাবি তলব করে তখন আমি তাদেরকে জানাই যে, চাবি আমার স্বামীর কাছে রয়েছে। তিনি গ্রীষ্মের ছুটিতে সফরে বেরিয়েছেন। এ কথা শুনে তারা হৈ-হল্লা শুরু করে দেয়। তারা তাদের একজনকে তালা খুলতে বলে। সে ব্যক্তি চাবির গোছা নিয়ে একে একে সব চাবি প্রয়োগ করেও তালা খুলতে ব্যর্থ হয়। আমি এবার তাদের কাছে বাজেয়াপ্রাপ্ত জিনিসপত্র ও সাজ-সরঞ্জামের রসিদ তলব করি। আমার কথা শুনে তারা হাসিতে ফেটে পড়ে বলে-
“রশিদ, ওসবের রসিদ চাও তুমি? এস তোমাকে রসিদ দিচ্ছি”- বলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে এনে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। গাড়ীতে আমার ভ্রাতুস্পুত্র সেই সকাল থেকেই আটক হয়ে বসেছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- কেমন আছ মুহাম্মাদ? কিন্তু সে কোন জবাব দিলনা। বুঝলাম তাকে কথা বলতে বারণ করা হয়েছে। একটু আগে তাকে ধরে নেয়া হয়েছিলো শুধু তাদের সুবিধার্থেই। বলাবাহুল্য, এবার যেসব সিপাহী এসেছিল, তারা ভোরবেলার সিপাহীদের দল থেকে আলাদা।
গাড়ী আমাদের নিয়ে চলতে শুরু করে। কারাগারের প্রধান গেটে নামফলক পড়েই আমি জানতে পারি যে, এই হচ্ছে কুখ্যাত জঘন্য সামরিক কারাগার। জেলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আমাকে গাড়ী থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। এরপর এক ভয়ংকর আকৃতির লোক আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। এখানে অপেক্ষমান এক ব্যক্তি আমাকে প্রশ্ন শুরু করে। এরপর আমাকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে অন্য একজন কৃষ্ণকায় ব্যক্তি আমার নাম জানতে চাইলে আমার সাথে আসা সেই ভয়ংকর লোকটি কুৎসিত গালি দিয়ে ওকে আমার নাম জানায়।
এরপর সেই কৃষ্ণকায় ব্যক্তি তীব্র রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে প্রশ্ন করে-
তুই কে? আমি ধীর শান্তভাবে জবাব দিলাম-
:জয়নব আল-গাজালী আল জুবায়লি……। আমার এতটুকু কথা! শুনতে না শুনতেই সে তার বীভৎস বিকৃত মুখে এমন সব অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করে দিল যে, জীবনে এমন কদর্য্য ভাষা আমি কোনদিন শুনিনি। আমার সাথে আসা ভয়ংকর লোকটি অগ্নিশর্মা হয়ে গালি দিতে দিতে বলল-
: হতভাগী, যার সামনে দাড়িয়ে আছিস, তাঁর সাথে ভদ্রতার সাথে জবাব দিস। আমি এবার বললাম-
:তোমরা আমাকে গ্রেফতার করেছ; আমার জিনিসপত্র সাজ-সরঞ্জাম টাকাকড়ি এবং বইপত্র বাজেয়াপ্রাপ্ত করেছে- ওসব কিছুর তালিকা এবং রসিদ আমাকে দেয়া উচিৎ যাতে মুক্তির পর আমি আমার সব জিনিস ফেরত পেতে পারি। আমার একথা শুনে সরকারের তথাকথিত এটর্নি শামস বদরান অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সাথে বলল-
: আমরা তোকে এক ঘণ্টা পরেই হত্যা করব; এর তুই কিনা বইপত্র, টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র এবং সাজ-সরঞ্জামের রসিদ চাচ্চিস! বাহরে আমার কর্ত্রী! সাথে সাথে আরো অশ্রাব্য গালি দিয়ে বলল-
: তোর আগে তোর অসংখ্য সাথীকে যেমনি এখানে দাফন করে দিয়েছি, তেমনি তোকেও এখানেই দাফন করা হবে।
এই বলে উচ্চস্বরে হোঃ হোঃ করে হেসে যা মুখে আসছিল, বকে যাচ্ছিল। এমন নোংরা অসভ্য, অভদ্র পরিবেশের কথা কোন সভ্য মানুষ কল্পনাই করতে পারে না। সুতরাং কোন কথা বলার পরিবর্তে আমি নীরবতা অবলম্বনকেই শ্রেয় মনে করি। এ অবস্থায় এটর্নি শামস বাদরান সেই ভয়ংকর সিপাহীকে আদেশ দিল-
: একে এখান থেকে নিয়ে যাও।
সে জিজ্ঞেস করল-
:কোথায়?
এটর্নি সংকেতে বলল-
:ওরা জানে।
এরপর ভয়ংকর লোকটি আমাকে গালি দিতে দিতে টেনে হেঁচড়ে নির্দয়ভাবে অন্য এক কক্ষে নিয়ে যায়। দেখি, দৈত্যের মতো বিরাটকায় এক লোক ধোঁয়ার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মুখ খিস্তি করে আমার নাম ডাকছে। আমি তার নিষ্ঠুর চেহারা দেখে তার শয়তানী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে আল্লাহ্র সাহায্য কামনা করে বলি-
: হে পাক পরওয়ারদেগার! আমাকে স্বস্তি দান কর এবং চরম পরিক্ষার মুহূর্তেও ধৈরযের শক্তি দাও। আমাকে তোমার পাক নাম উচ্চারণে ব্যস্ত রেখো এবং তোমারই সন্তুষ্টির পথে অবিচল রেখো।
আমার সাথে আসা ভয়ংকর লোকটি দরজায় দাঁড়িয়ে নতুন শয়তানকে বলল-
:নিন জনাব……।
দৈত্যাকারের শয়তান বলল-
“তাকে ২৪ নাম্বার কক্ষে নিয়ে যাও”। এরপর আমাকে নিয়ে একটি কক্ষে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। এটি দেখতে একটি অফিসের মতো মনে হলো। সেখানে দু’জন লোক বসেছিল। তাদের একজনের হাতে ছিল একটি ডাইরী। ডাইরী দেখেই আমি চিনতে পারি যে, এটা জনাব আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলের সেই বিশেষ ডাইরী, যা তিনি দারসে কুরআন দেওয়ার সময় বের করে প্রয়োজনীয় নোট লিখতেন। এতে করে আমি বুঝতে পারলাম যে, তিনি এবং তাঁর সাথীরাও গ্রেফতার হয়েছেন। কারণ তখন তার ওখানে বৈঠকে হবার কথা ছিল। শয়তানরা তাদেরকে বৈঠকেই গ্রেফতার করেছে- এ কথা চিন্তা করে কেঁপে উঠি আমি।
এর মধ্যে আসরের আযান শোনা গেল। আমি নামাযের জন্যে প্রস্তুত হলাম। নামায শেষ করা মাত্রই সেই ভয়ংকর শয়তান হিংস্র জানোয়ারের মত আমার দিকে এগিয়ে এল।
চব্বিস নম্বর কক্ষের পথ
এবারে আমার দু’হাত পিছমোড়া বেঁধে আরো দু’জন কৃষ্ণকায় সহ সামরিক কারাগারের বিভিন্ন অংশ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সামনে নিয়ে চললো। ওদের হাতে ছিল লিকলিকে কালো চাবুক। কারাগারের বিভিন্ন অংশে আমি ইখওয়ানের উপর অত্যাচার-উৎপীড়ন বীভৎস চিত্র দেখে আঁতকে উঠি। তাদেরকে বিবস্ত্র করে খামের সাথে কষে বেঁধে বেপরোয়া চাবুক মারা হচ্ছিল। চাবুকের ঘায়ে তাদের চামড়া চৌচির হয়ে শত ধারায় রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। আবার কোন কোন ইখওয়ানকে হান্টার মেরে তাদের উপর ক্ষুধার্ত শিকারী কুকুর ছেড়ে দেয়া হচ্ছিল। কুকুরের বিষাক্ত দংশনে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছিল তাদের দেহ। অনেক ইখওয়ানকে দৈহিক নির্যাতনের আগে দেয়ালের দিকে মুখ করে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে অনেক যুবক কর্মীকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে জানতাম। তারা নিজ সন্তানের মত প্রিয় ছিল, আমার কাছে। এসব মানবহিতৈষী খোদাভীরু শিক্ষিত নবীনরা ছিল আল্লাহ্র পথে নিবেদিত প্রাণ-মুজাহিদ। দিন কেটে যেত তাদের ইসলামী আন্দোলনের কাজে আর রাতের অন্ধকারে তারা মশগুল থাকতো আল্লাহ্র জিকিরে। জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার এবং জনগণের নয়নের মণি এসব যুবকদের প্রতি এই নির্মম নির্যাতন, এই নিষ্ঠুর বর্বরতা প্রদর্শন কেবল ইসলামের জঘন্যতম শত্রুরাই করতে পারে! কিন্তু এই অকথ্য জুলুম-নিপীড়নের পরেও তাদের চেহারায় স্বাভাবিক দীপ্তি, ধৈর্য ও স্থিরতা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি আমি! তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা এবং অত্যাচারের সামনে আতঙ্কিত না হবার বাস্তব দৃষ্টান্ত দেখে তাদের প্রতি দস্তুর মত ঈর্ষা জাগে আমার। ধৈর্যের প্রতীক অসম সাহসী এসব যুবকের জন্যে গর্ববোধ করি আমি। আমি দেখিছি এসব নির্যতিত-উৎপীড়িতদের মধ্যে একদিকে যেমন যুব, পৌঢ় এবং বৃদ্ধরা রয়েছেন। তেমনি রয়েছেন অল্পবয়স্ক কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে আশি-নব্বই বছরের বৃদ্ধরা পর্যন্ত। প্রত্যেকের একই হাল, একই অবস্থা।
তাদের সারা শরীর রক্তাক্ত, হান্টারের ঘায়ে ক্ষত-বিক্ষত পিঠ, চেহারায় আঁচড়ের রক্তাক্ত চিহ্ন, আর শতচ্ছিন্ন পরনের একপ্রস্থ কাপড়। যে কপাল খোদার দরকার ছাড়া কোনদিন কারো সামনে নত হয়নি, সেই কপাল বেয়ে দরদর করে পড়ছে উষ্ণ রক্তধারা। কিন্তু কি আশ্চর্য্য! অদ্ভুত এক রশ্মিতে ভাস্বর তাদের চোখ-মুখ। শুলিতে চড়েও তারা প্রশান্ত মুখে আল্লাহ্র জয়গান গাইছে। তাদেরকে ছাদ থেকে উল্টো লটকিয়ে রাখা হয়েছে, তাতেও তাদের ধৈর্য ও সত্যবাদিতায় এতটুকু ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু এই মর্মান্তিক দৃশ্য আর দেখার শক্তি ছিল না আমার। অসহ্য…… অসহ্য……অসহ্য!
হটাৎ গুলিতে লটকানো এক যুবক আমাকে দেখে ফেলে। সে গুলি কাঠের উপর থেকেই জোরে চেঁচিয়ে আমাকে বলল-
: ও আম্মা! আমাদের আম্মা! আল্লাহ্ যেন আপনাকে সত্যের পথে অবিচল রাখেন।
: আল্লাহ্ তোমাকেও অবিচল রাখুন; আল্লাহ্ তোমাকে ধৈর্য ও সাহস দান করুন……আমি বললাম।
আমি দেখেছি, তার ক্ষতবিক্ষত দেহের রক্ত এসে এক জায়গায় জমা হচ্ছে। সেই জমাট রক্ত থেকে কেমন যেন এক উজ্জ্বল আলোর আভা ফুটে উঠেছিল। আমি দোয়া করলাম-
“হে রাব্বুল আলামীন, তোমার দ্বীনের মুজাহিদদের ধৈর্য, শক্তি, সাহস এবং প্রশান্তি দাও! তুমি রহমত বর্ষণ কর খোদা……!”
অত্যাচারিত বীর মুজাহিদদের দিকে চেয়ে বললাম-
“আমার প্রিয় সন্তানরা, রাসূলের উত্তরসূরীরা! ধৈর্য ও সাহস হারিও না। আল্লাহ্ তোমাদের সহায় আছেন। – তোমাদের মঞ্জিল বেহেশত”। যে জল্লাদ আমাকে নিয়ে ঘুরে ফিরছিল, সে আমাকে আল্লাহ্র দরবারে দোয়াবাক্য উচ্চারণ করতে শুনে তার প্রকাণ্ড ভারী দু’হাত উপরে তুলে প্রচণ্ড জোরে আমার কানপট্রির উপর মুষ্ঠাঘাত হানে। আঘাতের তীব্রতায় আমি বধির হয়ে পড়ি এবং কিছুক্ষনের জন্যে দৃষ্টিশক্তিও লোপ পেয়ে যায়। মনে হচ্ছিল, যেন আকস্মিক বজ্রপাতে হতভম্ব হয়ে পড়েছি। আরো মনে হচ্ছিল আমার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ছে এবং সারা দেহ থেকে এক অস্বাভাবিক আলোর ছটা ফুটে উঠেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করা সত্ত্বেও আমি বললাম-
“হে খোদা, তোমার সন্তুষ্টির পথে সব সহ্য করবো”। তখন আমার মনে হচ্ছিল,- যেন জান্নাত থেকেই শব্দ কয়টি ভেসে আসছিল- “হে প্রভু! আত্মপ্রত্যয় দান কর; হে খোদা, তুমি ইমানদারদের জালিমের জুলুম থেকে নিরাপদ রাখ”।
“তুমি যদি আমাদের প্রভু না হতে তাহলে আমরা হেদায়াত পেতাম না, আমরা সাদকা এবং নামাজ আদায় করতাম না, বিপদ মুসীবতে তুমি আমাদের আত্মপ্রত্যয় দান কর”।–হাদীস
চাবুক এবং হান্টারের শপাং শপাং শব্দ বৃদ্ধি পেয়ে চলছিল, কিন্তু ঈমানের আওয়াজ ছিল আরো সুস্পষ্ট শক্তিশালী। হটাৎ আরেক আওয়াজ শুনতে পেলাম যে জান্নাত থেকে ভেসে আসছে সেই আওয়াজ।
“আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন প্রভূ নেই, তিনি এক এবং অদ্বিতীয়”। আমি পুনরায় বললাম-
“ধৈর্য ধারণ কর আমার সন্তানরা, ধৈর্য ধারন কর। জান্নাত তোমাদের প্রতিক্ষায় রয়েছে”।
জালিমের জেলারদের কঠিন মুষ্ঠাঘাত আমার পিঠের উপর মুষলধারে বৃষ্টির মত বর্ষিত হচ্ছিল। আমি বললাম –
আল্লাহু আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ- আল্লাহ্ সর্ব শক্তিমান। যাবতীয় প্রশংশা আল্লাহ্রই জন্যে……। হে আল্লাহ্! ধৈর্য এবং সন্তুষ্টির সাথে তোমার সব পুরস্কারের জন্যে শুকর আদায় করছি, যা তুমি আমাদেরকে, ইসলাম, ঈমান এবং জিহাদের রুপে দান করেছ।
এরপর জল্লাদ এক অন্ধকার ঘরের দরজা খুলে আমাকে তাতে রেখে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে চলে গেল।
চব্বিশ নম্বর কক্ষে
আমি বিসমিল্লাহ্ বলে সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করলাম। কক্ষের দ্বার বন্ধের সাথে সাথেই তীব্র বৈদ্যুতিক আলোকে চোখ ধাঁধিয়ে উঠল যেন। বুঝলাম, আমার দ্বিতীয় প্রকার শাস্তি শুরু হয়ে গেছে। দেখলাম, পুরো কক্ষটি কুকুরে ভরা। সংখ্যা ঠিক কত কুকুর ছিল তা আমার মনে পড়ছে না। আমি এত সব হিংস্র কুকুর দেখে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম। আমার সারা শরীর জুড়ে অসংখ্য কুকুরের অসহ্য দংশন চলছিল। মাথা, হাত, ছাতি, পিঠ, পা মোটকথা সর্বত্র কুকুরের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল আমি এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখার জন্যে চোখ খোলা মাত্রই আবার বন্ধ করতে বাধ্য হলাম। অনন্যোপায় অবস্থায় আমি আল্লাহ্র নাম-আসমাউল হুসনা জপতে শুরু করলাম। আমি কুকুরের বিষাক্ত দংশনের কথা ভুলে গিয়ে আল্লাহ্র জিকিরে মশগুল হয়ে পড়লাম। বললাম-
“হে পাক পরওয়ারদেগার! পৃথিবীর সবকিছু থেকে আমার সম্পর্ক ছিনিয়ে নিয়ে কেবল তোমার সাথে আমার সম্পর্ক অটুট রাখছি। তুমি আমার উপর সন্তুষ্ট থাকলেই আমার সাফল্য…… আমি জীবন ও দুনিয়ার সবকিছুর বিনিময়ে কেবল তোমার নৈকট্য চাই। তোমার রহমতের দরবারে আমাকে ঠাঁই দাও…… আমাকে তোমার দ্বীনের পথে ভালবাসা সন্তুষ্টি এবং শাহাদাতের মৃত্যু দান কর এবং তাওহীদবাদী প্রতিটি ব্যক্তিকে বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয় দান কর”।
এভাবে কুকুরের কামড় এবং আমার ইবাদতের মধ্যে বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে যায়। হটাৎ কক্ষের দরজা খুলে যায় এবং আমাকে ঘরে নেয়া হয়।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আমার পরনের সাদা-পরিচ্ছদ রক্তে লালে লাল হয়ে আছে। কিন্তু কি আশ্চার্য! আমার পরিচ্ছদ ঠিক আগের মতই নিখুঁত সাদা রয়েছে এবং শরীরের কোথাও কুকুরের কামড়ের কোন চিহ্নই নেই। এ কি বিস্ময়! আল্লাহ্ পাকের সে-কি গায়েবী রহমত! হে খোদা, আমি কি তোমার এত করুণা পাওয়ার উপযুক্ত!…… সব তোমারই প্রশংসা,প্রভু!…… আমি মনে মনে এসব বলছিলাম। এমন সময় কারাগারের জল্লাদ আমাকে জিজ্ঞেস করল-
:কি ব্যাপার, তোকে কুকুরে কামড়ায়নি? কিন্তু কেন? কি অবাক কাণ্ড এসব…বলে সে তার হান্টারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। তার সাথে আগত দ্বিতীয় ব্যক্তিও হাতের ছড়ি নাড়তে নাড়তে কি যেন ভাবছিল।
পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যার শেষ লালিমা ম্লান হয়ে আসছিল। এটা মাগরিবের নামাজের সময়। তিন ঘণ্টার চেয়ে বেশী সময় পর্যন্ত হিংস্র কুকুরদের মধ্যে কাটিয়ে সম্পূর্ণ অক্ষত শরীরে বের করে আনার জন্যে আমি অশ্রুসজল হয়ে আল্লাহ্র শোকর আদায় করলাম।
নামাজের পর জেলের এক কর্মী আমাকে নিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এক বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড় করাল। দরজা খুললে সামনে দেখলাম ভয়াল এক নির্জন মাঠ। মাঠ পেরিয়ে এক দীর্ঘ অন্ধকার করিডোর হয়ে সামনে যাচ্ছিলাম। করিডোরের উভয় পাশে অসংখ্য বন্ধ দরজা। মাত্র একটি দরজা দিয়ে দেখলাম আলো বেরিয়ে আসছে। দ্রুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলাম, এটা দু’নম্বর কক্ষের দরজা এবং উচ্চ পদস্থ এক অফিসার মোহাম্মাদ রাসাদ মুহনা বসে আছেন। তিনি এক সময় মিশরের যুবরাজ ছিলেন। তাঁর ব্যাপারে সরকারের এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল যে, ইখওয়ানরা সম্ভবতঃতাঁকেই মিশরের প্রেসিডেন্ট পদে বসাবে। সুতরাং তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়।
তিন নম্বর কক্ষে
তিন নম্বর কক্ষের দরজা খুলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঠেলে দেয়া হলো। দরজা বন্ধ হতেই ছাদে লটকানো তীব্র আলোক-সম্পন্ন বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে উঠল। সে আলো এতই প্রখর ছিল যে, তাতে চোখ খোলা রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। বুঝলাম, চোখ ধাঁধানো এই আলোর খেলা আমার শাস্তিরই একটি অংশ বটে!
কিছুক্ষন পরে আমি ভেতর থেকে দরজা খোলার জন্যে দরজায় করাঘাত করলে এক ভয়ংকর হাবশী দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি তাকে ওজুর পানি এনে দিতে বললে সে কর্কশ কণ্ঠে মুখ ভেংচিয়ে বলল-
“তুই জানিসনে, এখানে দরজা নাড়া নিষিদ্ধ, পানি চাওয়া নিষিদ্ধ, ওজু করা নিষিদ্ধ, পানি খাওয়া নিষিদ্ধ……”। এই বলে সে শুন্যে হান্টার ঘুরিয়ে আবার বলল-
“খবরদার! আবার যদি তোর দরজা নাড়ার শব্দ শুনি, তাহলে এই হান্টার দিয়ে তোর গায়ের চামড়া খুলে ফেলব”।
কক্ষে কিছুই ছিল না। এমনিতেও চব্বিশ নম্বর কক্ষে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত কুকুরের সাথে কাটিয়ে দৈহিক ও মানসিক ভাবে শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সুতরাং মাটিতে তায়াম্মুম করে গায়ের চাদর বিছিয়ে এশার নামাজ আদায় করি। এরপর আমি একটু আরাম করার চেষ্টা করি। কিন্তু হাড়ে হাড়ে প্রচণ্ড ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলাম। তবুও জুতো দুটো মাথার নিচে পেতে শোয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মানবতার দুশমনরা এমন কাণ্ড শুরু করে দিল যে, বিশ্রাম করার কথা ভুলেই গেলাম।
আমার কক্ষে ভ্যান্টিলেটার ছিল অনেক বড়। ভ্যান্টিলেটারের পথে কারাগারের প্রাঙ্গন স্পষ্টই দেখা যায়। ওরা ঠিক সেই ভ্যান্টিলেটারের সামনেই একটি গুলিকাষ্ঠ এনে দিল। এরপর ইসলামী আন্দোলনের যুবক কর্মীদের সেই গুলিতেই চড়িয়ে নির্যাতনের নিত্য নতুন কলাকৌশলের অনুশীলন শুরু করলো। হান্টারের আঘাতে তাদের দেহ জর্জরিত করে দেয়া হলো। কিন্তু আল্লাহ্র পথের সেসব বীর তরুণরা পরম ধৈর্যের সাথে সব সহ্য করে। কেবল আল্লাহ্র নাম ছাড়া আর কোন শব্দই তাদের মুখ থেকে শোনা যেত না। চাবুকের প্রতিটি আঘাতের সাথে তাদের মুখ থেকে বের হতো শুধু ইয়া আল্লাহ্! শব্দ, ব্যাস।
এই জঘন্য-অমানুষিক নির্যাতনের সময় খুনী জল্লাদ তাদের অত্যন্ত কদর্য ভাষায় জিজ্ঞেস করতো………
: বল কুত্তার বাচ্চা, এখানে কবে এসেছিস?
ওরা এর জবাব দিলে জিজ্ঞেস করতো-
:জয়নব আল-গাজালীর ওখানে শেষবার কবে গিয়েছিলি?
যদি কোন যুবক এই প্রশ্নের জবাবে বলতো যে, জানিনে বা মনে নেই তখন এই নরাধম বর্বর পশুরা সবাই এক সাথে ওর উপর ঝাঁপিয়া পড়ে হান্টার এবং চাবুক মারতে মারতে তাদেরকে বলতো অশ্লীল ভাষায় আমাকে গালি দেয়ার জন্য। কিন্তু এসব চরিত্রবান শিক্ষিত যুবক যাদের মধ্যে কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ অধ্যাপক, কেউ বুদ্ধিজীবি, আইনজীবী মুসলিম প্রাণ থাকতে তারা গালি দেয়ার কথা ভাবতেও পারেনা। তারা বলত-
“তিনি তো আমাদের মায়ের মত, খোদাভক্ত মহীয়সী মহিলা। যুবকরা যখন অশ্লীল গালাগালি উচ্চারণ করতে অস্বীকার করতো তখন জল্লাদ তাদের উপর ক্ষেপে গিয়ে অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিত। কিন্তু কোনক্রমেই যুবকদেরকে নিতিভ্রষ্ট করা সম্ভব ছিলনা। কোটি কোটি প্রশংসা সেসব বীর যুবকদের, যারা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও মিথ্যা-বাতিলের সাথে আপোষ করেনি, শত বিপদ-মুসীবতের মুখেও সত্যের পথ থেকে এতটুকু বিচ্যুত হয়নি।
এসব উন্নত চরিত্রের অধিকারী বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন যুবকদের উপর অন্যায় অত্যাচারের পাহাড় ভেঙ্গে পড়তে দেখে আমার মনপ্রাণ যে কেমন ছটফট করছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। শুধু আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করছিলাম………
“হে রাহমানুর রহীম আল্লাহ্, তুমি ওসব নিরাপরাধ যুবকদের শাস্তি আমারই কাঁধে চাপিয়ে তাদের মুক্তি দাও”।
আমি চাচ্চিলাম, যুবকরা জালিমদের কথায় সায় দিয়ে মুক্তি লাভ করুক এবং আমি তাদের জায়গায় সব অত্যাচার সহ্য করি। কিন্ত তা হয়নি।
তারা একের পর এক কঠিন নির্যাতন ভোগ করছিল। আল্লাহ্কে ডাকছিল কিন্তু সত্য পথ ত্যাগ করেনি। তাদের এসব দুঃখ কষ্ট দেখে আমি আমার ব্যথা-বেদনার কথা ভুলে যাই। তাদের কষ্টের সামনে আমার উপর কৃত অত্যাচারকে অনেক হালকা বলে মনে হচ্ছিল। এখন তাদের ব্যাথাতেই আমি ব্যথা অনুভব করছিলাম। তাদের জন্যে আল্লাহ্র কাছে শুধু রহমত কামনা করছিলাম।
স্বপ্ন
এই অবস্থায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি তা টেরই পাইনি। সম্ভবতঃ এতে আল্লাহ্রই মেহেরবানী নিহিত ছিল। আমি আমার বিপদের দিনগুলোতে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে ইতিমধ্যেই তিনবার স্বপ্নে দেখেছি; আর আজ চতুর্থবারের মত এই সৌভাগ্য অর্জন করলাম।
আমি স্বপ্নে দেখলাম, বিরাট এক মরুপ্রান্তরে অনেকগুলো উট। সে সব উটের পিঠে আলো ঝমমল আসন পাতা এবং প্রতিটি উটের পিঠে চারজন করে শান্ত সৌম্য-কান্তির যাত্রী বসে আছেন। যতদূর দৃষ্টি যায় সারা মরুপ্রান্তর জুড়ে উট আর উটের দিগন্ত পরিব্যাপ্ত কাফেলা। এর মধ্যে আমি নিজেকে ভাবগম্ভীর অথচ হাসি মুখে দীপ্ত চেহারার এক মহাপুরুষের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় পাই দেখলাম এত অসংখ্য উট যে প্রান্তরময় ঘরে বেড়াচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের গলার রসি তাঁরই হাতের মুঠোয়।
আমি অত্যন্ত বিনয়-নম্রতার সাথে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম-
:প্রিয় নবী কি এখানে আছেন? তিনি আমার প্রতি প্রশান্ত দৃষ্টিপাত করে বললেন-
:জয়নব! তুমি আল্লাহ্র রাসূল এবং তাঁর বান্দা মুহাম্মদের অনুসৃত পথেই রয়েছে।
আমি আনন্দাপ্লুত হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম-
সত্যি সত্যিই কি আমার আল্লাহ্র রাসূল এবং তাঁর বান্দার নির্দেশিত পথে চলছি?
:হ্যাঁ, হে জয়নব, হে গাজালী, আল্লাহ্র বান্দা এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পথেই রয়েছ। আমি পুনরায় একই কথা জিজ্ঞেস করলাম-
:ওগো আমার প্রিয় নবী; ওগো আমার আল্লাহ্র রাসূল! আমি কি আল্লাহ্র বান্দা এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পথের অনূসরণ করছি?
:প্রিয় নবী বললেন-
: হে জয়নব তুমি সত্যের পথে রয়েছ; হে জয়নব! তুমি আল্লাহ্র বান্দা এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের অনুসৃত পথে আছ।
ঘুম থেকে জেগে আমি নিজের মধ্যে অপূর্ব এক শক্তি ও প্রশান্তি অনুভব করলাম। এই স্বপ্ন আমাকে বর্তমানের সব জুলুম নির্যাতনের ভাবনা থেকে নির্লিপ্ত উদাসীন করে দেয়। হান্টারের আঘাত অথবা আমার সামনের প্রাঙ্গণে ইখওয়ানের উপর চালানো বর্বরতার অত্যাচার…… কিছুকেই আর তেমন দুঃখজনক মনে হচ্ছিল না। দেখলাম, সামনে প্রাঙ্গণ থেকে শুলিকাষ্ঠ তুলে নেয়া হয়েছে। এখন বেশ দূর থেকেই মারপিটের শব্দ ভেসে আসছিল।
আমি ভেবে আশ্চর্য হলাম যে স্বপ্নে প্রিয় নবী আমাকে আমার আসল পৈত্রিক নামেই সম্বোধন করেছেন। আমার আসল পৈত্রিক নাম হচ্ছে জয়নব গাজালী। কিন্তু জনসাধারণ আমাকে জয়নব আল-গাজালী হিসেবে জেনেছেন।
এই সৌভাগ্যপূর্ণ স্বপ্ন দেখেছি বলে আল্লাহ্র শোকর আদায় করার জন্যে তক্ষণই তায়াম্মুম করে নামাজে দাঁড়াই। সিজদাবনত হয়ে আমি অশ্রু বিগলিত স্বরে আল্লাহ্কে বললাম-
: আমার প্রভূ! কি বলে আমি তোমার শোকর আদায় করবো? তোমার শোকর আদায় করার মত শক্তিও যে আমার নেই। ……ইয়া রাব্বুল আলামীন! আমি নিজেকে তোমার সন্তুষ্টির পথে শাহাদাতের জন্যে উৎসর্গ করছি। ……হে পারওয়ারদেগার! আমার কারণে যেন কেউ দুঃখ মুসিবতে না পড়ে যায়…… হে প্রভূ!……শুধু তোমার সন্তুষ্টির সরল-সুন্দর পথেই আমাকে অবিচল রাখ………।
আমি নামাজ আদায় করেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত একই প্রার্থনা পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছিলাম। তখন আমি এমন প্রশান্তি ও আনন্দ অনুভব করছিলাম যে, যেন কোন নতুন পৃথিবীতে পৌঁছে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কক্ষের বাইরের পথ ও প্রাঙ্গণে আমি অনেকগুলো গাড়ী এবং লোকদের ত্রস্ত চলাফেরার শব্দ শুনে চকিত হই। পরে জেনেছি যে, তা ছিল জল্লাদদের ডিউটি পরিবর্তনের সময়। পুরানো জল্লাদরা চলে গেছে এবং নতুন জল্লাদরা অত্যাচারের জন্যে নতুন উদ্যম নিয়ে এসেছে।
ফজরের আযান শুনে আমি তায়াম্মুম করে বারবার আজানের শব্দ উচ্চারণ করি এবং নামায আদায় করি। এ অবস্থায় ২০শে আগস্ট থেকে ২৬শে আগস্ট পর্যন্ত বরাবর ৬দিন একই কক্ষে আবদ্ধ থাকি এর মধ্যে একটি বারও কক্ষের দরজা খোলা হয়নি, এক ফোটা পানি কিংবা কোন রকমের খাদ্য দেয়া হয়নি। বাইরের কারো সাথে যোগাযোগ বা কথাবার্তাও হয়নি।পানি নেই, খাদ্য নেই, কথাবার্তা নেই-৬টি দিন বা ৬টি রাত অন্ধকার কক্ষে একাকীত্বের এই জীবন, একটু কল্পনা করে দেখুনতো! পানাহার নাইবা হলো, কিন্তু মানুষের প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণকে কেউ কিভাবে অস্বীকার করতে পারে।
সেসব লোকদের আপনারা কি নামে বিশেষিত করবেন, যারা নিজেদেরকে মানুষ বলে দাবী করে, কিন্ত তাদের কার্য্যকলাপ শয়তানকেও লজ্জিত করে। এসব অত্যাচারী শাসকরা নিজেদের অতিমানবীয় কোন সৃষ্টি বলেই মনে করে নিয়েছে এবং নিজেদেরকে মানবতার সব নীতি থেকে মুক্ত বলে ভেবে নিয়েছে।
আপনারাও হয়তো বিস্মিত হচ্ছেন যে, ৬দিন পর্যন্ত পানাহার না করে, এমনকি প্রাকৃতিক প্রয়োজনও পূরণ না করতে পেরে একজন মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে। সেই একই বিস্ময় জেগেছিল আমার কক্ষের বাইরে প্রহরারত জল্লাদেরও। সে দরজা খুলে আমাকে সুস্থ ও শান্ত ভাবে বসে থাকতে দেখে একটা বিশ্রী গালি দিয়ে জিজ্ঞেস করল-
: কিরে, তুই আজো মরিসনি বুঝি! এখনও বেঁচে আছিস? এমন অস্বাভাবিক এবং অবিশ্বাস্য অবস্থায় এতদিন পর আমি কিভাবে বেঁচে আছি এবং সুস্থ আছি তা বলছি, শুনুন!
প্রথমতঃ আল্লাহ্র উপর অবিচল ঈমান ও আস্থা। কারণ ইসলাম তার সত্যিকারের অনুসারীদের মধ্যে এমন এক শক্তির সঞ্চার করে, যার ফলে ঈমানদার ব্যক্তি সব রকমের দুঃখ-মুসিবত জয় করে নিতে পারে, তা জুলুম- অত্যাচার যত সাংঘাতিকই হোক না কেন। আল্লাহ্র ফজলে মু’মিন ব্যক্তি এমন সহ্য শক্তির অধিকারী হয়ে উঠে যে, কোন কঠিনতর বিপদও তাকে আতঙ্কিত বা বিচলিত করেত পারে না। জালিম অত্যাচারীরা তাদের বাহ্যিক শক্তির অহমিকায় মদমত্ত থাকে কিন্তু ঈমানদারের আধ্যাত্মিক শক্তির কাছে অন্য সব শক্তিই তুচ্ছ প্রমাণিত হয়। মুমিন ব্যক্তি যেকোনো রকমের ভয় ভীতি বা লোভ-লালসা থেকে মুক্ত জীবন-যাপনে সক্ষম। দ্বিতীয়তঃ সেই পবিত্র স্বপ্ন, যা আল্লাহ্র পক্ষে থেকে আমাকে সত্য জীবন এবং সাফল্য দানেরই সমতুল্য। এর ফলে আমি পরিবেশের প্রভাব উপেক্ষা করে বাঁচার শক্তি পাই। এই স্বপ্ন আমাকে যে কোন চরম দুঃখ বিপদ সহ্য করেও সহজ জীবন যাপনের শক্তি সঞ্চার করে।
পানাহার থেকে বঞ্চিত নিঃসঙ্গ বন্দিত্বের সপ্তম দিন সেই জল্লাদ পচা-দুর্গন্ধযুক্ত চারটি ময়লা রুটি এবং এক টুকরো মাখন নিয়ে আমার কক্ষে প্রবেশ করে ওসব আমার সামনে মাটিতে ছুঁড়ে মেরে বলে-
:যতক্ষণ বেঁচে আছিস, এসব খেয়ে নে………।
এর সাথে সাথে তার কুৎসিত মুখের বিশ্রী গালিগালাজ তো ছিলই। আমি রুটি বা মাখন স্পর্শও করিনি। তবে পানির পাত্র তুলে নেই। কিন্তু পানির পাত্র এবং পানিও এত ময়লা এবং দুর্গন্ধযুক্ত ছিল যে, মুখে নেয়ার উপায় নেই। কিন্ত চোখ-নাক বন্ধ করে এই বলে পানিটুকু খেয়ে নিলাম-
“সেই মহান আল্লাহ্র নামে, যার নামের বরকতে আকাশ মাটির কোন কিছুই আমার ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ্ সব কিছু শুনেন এবং জানেন। হে আল্লাহ্, তুমি আমার জন্য এই পানিকে স্বাস্থ্যের জন্যে প্রয়োজনীয় খাদ্যে রুপান্তরিত করে দাও”।
পানি পান করার পর দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর সূর্য্যেস্তের সময় সেই জল্লাদ আবার এসে দরজা খুলে তার স্বভাব-সুলভ ভঙ্গিতে অশ্রাব্য গালি দিতে দিতে বলল-
:বেরিয়ে এসে পেশাব-পায়খানা সেরে আয়।
বেরুতে গিয়ে আমি শারীরিক দুর্বলতায় মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলাম। তা দেখে জল্লাদ আমাকে ধরে পায়খানা পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়। আমি যখন শৌচাগারের দরজা বন্ধ করতে যাই তখন সে বলে-
এর দরজা বন্ধ করা নিষেধ। একথা শুনে বেরিয়ে এসে আমি তাকে বললাম-
:আমাকে আমার কক্ষে পৌঁছিয়ে দিয়ে এস। আমার কোন কিছুর দরকার নেই।
কথাগুলো শুনে সে অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা ও নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়ে বলল-
:আমি তোর প্রতিক্ষার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। তুই গিয়ে সেরে আয়!
ভেবে দেখুন, পশুত্বের এমন নজীর কি আর পাওয়া যাবে? সবচেয়ে নিকৃষ্টতম মানুষও কি এমন নীচ, এমন জঘন্য হতে পারে? কিন্তু নাসেরের হুকুমে এসব জল্লাদ অসভ্যতার-পৈশাচিকতার ক্ষেত্রে পশুকেও হার মানিয়েচে।
আমি কক্ষে ফিরে এসে আফসোস করে বললাম-
এর চেয়ে তো মৃত্যুই ভাল। অন্ততঃ এমন অসভ্য-বর্বরের মুখ থেকে রক্ষা পেতাম। পানির কল পর্যন্ত এই শয়তানের সাথে যাবার জন্যে বাধ্য হতাম না। সেই জল্লাদ কক্ষের দরজা বন্ধ করে চলে গেলে আমি তায়ম্মুম করে মাগরিবের নামাজ আদায় করি। নামাজ শেষ করার সাথে সাথেই দরজা খুলে কয়েক ব্যক্তি কক্ষে ঢুকলো। এর মধ্যে সেই পাষণ্ড শয়তানকেও দেখতে পেলাম, যে আমাকে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত অসংখ্য কুকুরের মধ্যে থাকতে বাধ্য করেছিল। আমি তখন মাটিতে শুয়েছিলাম। সেই শয়তান কাউকে যেন বলল-
এস ডাক্তার, একে দেখ!
আমাকে পরিক্ষা করে ডাক্তার বলল-
: “কিছুই হয়নি। এর হৃৎপিণ্ড এখনো ঠিক আছে”।
কিন্তু অত্যাচারে আমার প্রাণ যে ওষ্ঠাগত, ডাক্তার তার কি জানে! এরপর ওরা দরজা বন্ধ করে সবাই চলে যায়। মিনিট কয়েক পর দরজা খুলে আমাকে অন্য একটা অন্ধকার কক্ষে নিয়ে গিয়ে দেয়ালের সাথে দু’ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁধে রাখা হয়। তারা আমাকে নড়তে পর্যন্ত নিষেধ করে। তারা দরজা বন্ধ করে গালি দিতে দিতে বলল-
: ওরে কুতার বাচ্চা, তোর মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসছে!
আমি তাদের কথাকে উপেক্ষা করে পূর্ণ শক্তির সাথে আল্লাহ্কে বললাম-
“হে খোদা; আমার মৃত্যু যেন ঈমান ও ইসলামের পথে হয়”। এরপর আমি সূরা ফাতেহা এবং সূরা বাকারা তেলাওয়াত শুরু করি। মনে হলো, যেন জীবনে এই প্রথমবার কুরআন তেলাওয়াত করছি। আমি চোখ বন্ধ করে কুরআন পাঠে মগ্ন ছিলাম, হটাৎ প্রচণ্ড জোরে আমার মুখের উপর কে যেন চড় বসিয়ে দেয়। সাথে সাথেই আলো জ্বলে উঠে। দেখি বিরাটকায় এক জল্লাদ হান্টার নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে আমার উপর নির্দয়ভাবে হান্টারের ঘা বসাতে লাগল। এরপর তিন খানা সাদা কাগজ আমার সামনে রেখে বলল-
: আমরা যা যা বলব, এতে তা লিখে দিবি……।
হটাৎ ওদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি এসে আমাকে তার বলিষ্ট হাতে কষে ধরে প্রচণ্ড বেগে দেয়ালের গায়ে ছুঁড়ে মারে। এরপর দ্বিতীয় ব্যক্তি আমাকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে ঝটকা দিতে দিতে দম করে মাটিতে ফেলে দেয় এবং একজন সিপাহীকে হুকুম দিয়ে বলে-।
: বুট দিয়ে যত পার লাথি মার।
অনেক্ষন পর্যন্ত এই নির্মম নির্যাতনের পর আমাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে সে কাগজ ৩ খানা হাতে দিয়ে বলে-
“তুই যত মানুষের নাম জানিস, এতে প্রত্যেকের নাম লিখে যা, তা সেসব ব্যক্তি সউদী আরব, সিরীয়া,সুদান, লেবানন বা দুনিয়ার যেকোনো অংশেই অবস্থান করুক না কেন! যদি আমাদের হুকুম মোতাবেক না লিখিস, তবে তোকে এখানে এক্ষুণি গুলী করা হবে। আর হ্যাঁ, ইখওয়ান সম্পর্কে তোর সব জানা তথ্য এবং এর সাথে তোর সম্পর্কের ব্যাপারেও বিস্তারিত ভাবে লিখবি। নে, এই রইল কলম”।
এরপর দরজা বন্ধ করে ওরা চলে যায়।
আমি অত্যন্ত অবর্ণনীয় ব্যথায় জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও কাগজ কলম নিয়ে বসলাম-
আমি লিখতে শুরু করলাম-
“ইসলামী আন্দোলনের সুত্রে আমাকে চেনে এমন ভাই-বোন অনেক দেশেই ছড়িয়ে আছেন। আমাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ্র দ্বীন কায়েম করা। খোদার শপথ, আমাদের কাছে তারাই আসে, যারা সঠিক পথ নির্বাচন করতে সক্ষম। আর এই সঠিক পথ হচ্ছে প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ(সাঃ) এবং সাহাবাদের অনুসৃত পথ।
আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ্র দ্বীনের প্রচার এবং দ্বীনের বিধান মোতাবেক শাসন পরিচালনার জন্যে লোকদের আহবান জানানো। আর আমি আল্লাহ্র নামে তোমাদেরকেও আহবান করছি যে, তোমরা মূর্খতা ও জুলুমের পথ ছেড়ে দিয়ে ইসলামের পথে এস, তাওহীদ ও রিসালাতের অনুসরণ কর এবং নিজেদেরকে আল্লাহ্র কাছে সমর্পণ কর। বাতিলের পথে চলে তোমাদের মনমগজে যে অসত্য-অন্যায়ের বিষবাষ্প ঢুকেছে আল্লাহ্র পথে তা পরিস্কার হয়ে যাবে এবং আল্লাহ তোমাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে তুলে আনবেন”।
“আমার একথা দেশের প্রেসিডেন্টের কাছেও পৌঁছিয়ে দিও। সম্ভবতঃ তাওবা করে তিনি পুনরায় ইসলামের পথে ফিরে আসবেন। যদি তিনি তোমাদের দাওয়াত অস্বীকার করেন, তাহলে তিনি নিজে তার জবাবদিহি করবেন। আমি সাক্ষ দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই এবং হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহ্র বান্দা এবং রাসূল”।
“হে আল্লাহ্, তুমি সাক্ষ্য থেকো যে, আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি।
এখন এরা যদি তওবা করে তুমি তাদের তাওবা কবুল কর। আর তারা যদি জুলুমাতের অন্ধকারে থাকতে চায়, তাহলে তুমিই সব কিছু জানো, তুমিই উত্তম বিবেচক। আয় আল্লাহ্! আমাদেরকে সত্যের পথে অটল রেখ। আমাদের শহীদী মৃত্যু দান কর”।
আমি আমার দ্বীনি দায়িত্ব মনে করে এসব লিখি এবং লেখা শেষ করে পুনরায় কুরআন শরীফ তেলাওয়াত শুরু করি।
কিছুক্ষণ পর সাফওয়াত রুবী এসে আমার লিখিত কাগজগুলো নিয়ে যায় আর আমাকে সেই নিঃসঙ্গ জায়গায় রেখে যায়। এরপর কয়েক মুহূর্তও কাটেনি, হটাৎ দরজা খুলে সাফওয়াতের চারজন সামরিক ব্যক্তি ভিতরে প্রবেশ করে; তাদের গালিগালাজের অভিধানে যত গালি আছে, সব প্রয়োগ করে বলল।
তুই কাগজে কি সব বাজে কথা লিখেছিস?
এরপর সে দরজার কাছে থেকে চেঁচিয়ে বলল-
: সাবধান!সাবধান! সামরিক কারাগারের ডাইরেক্টর হামজা পাশা বসিউনি আসছেন।
ডাইরেক্টর কক্ষে প্রবেশ করে এমন সব অশ্লীল-বিশ্রী গালি উচ্চারণ করতে থাকল যে, কোন সাধারণ লোক তা ভাবতেও পারে না। আমি অত্যন্ত ঘৃণাভরে তার দিকে চেয়ে রইলাম। সে ওদের হাত থেকে আমার লিখিত কাগজ কয়খানা নিয়ে বলল-
: তুমি যা কিছু লিখেছ, সব মিথ্যে কথা।
এই বলে সে ওসব টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে।
তারা সাফওয়াতের কথা উল্লেখ করে বলে-
: এসব ঠাট্টা মস্করা নাকি! তোমার লিখিত বাজে কথা গুলো তাকে পীড়িত করেছে। বসিউনি বলল-
:একে ধরে রাখ-বলে বাইরে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত পরে একজন সিপাহীকে নিয়ে ফিরে এলো। সিপাহীটি আমাকে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে অনেক উপরে উঠিয়ে ধড়াম করে নিচে ফেলে দেয়। মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই আমি বেহুঁশ হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরে এলে দেখি, আমাকে কাঠের উপর এভাবে উল্টো লটকিয়ে বাঁধা হয়েছে, যেভাবে কসাই জবাইকৃত পশু লটকিয়ে রাখে। এরপর হান্টারের বেদম প্রহার। সেকি জঘন্য পাশবিক মার! আমি তো আমি, কোন মানুষের পক্ষেই তা সহ্য করা সম্ভব নয়! এরই মধ্যে আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করতে করতে আবার সম্বিত হারিয়ে ফেলি।
পুনরায় জ্ঞান ফিরে এলে দেখি আমি হাসপাতালের একটি স্ট্রেচারে শায়িত। তখন আমার কথা বলা বা নড়াচড়ার মত সামান্য শক্তিটুকুও ছিল না। অবশ্য আশেপাশের কথাবার্তা শুনছিলাম।
কিছুক্ষনের মধ্যে আমাকে আবার কারাকক্ষে রেখে আসা হয়। তখনো আমার শরীরের সর্বত্র রক্ত বয়ে পড়ছিল। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি দরজা নেড়ে প্রহরীকে ব্যান্ডেজ এবং ডাক্তার ডেকে পাঠাতে বলি। কিন্তু এর জবাবে বিশ্রী গালিগালাজ ছাড়া আর কিছুই পাইনি। অনন্যোপায় হয়ে আমি আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করি, যেন আমার ব্যথা-বেদনা এবং রক্ত পড়া বন্ধ হয়। আল্লাহ্ আমার দোয়া কবুল করেন। আমার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্ত ব্যথা বেদনা অব্যাহত থাকে। এ থেকে মুক্তির জন্যে আমি আল্লাহ্র নাম জপতে শুরু করি। এতে করে ব্যথা, যন্ত্রণা অনেকটা কম অনুভব করি। এমন সময় প্রিয় নবীর একটি হাদীস মনে পড়ল। প্রিয়নবী বলেছেন-
“অত্যাচারিতের ফরিয়াদ থেকে বেঁচে থেক। কারণ অত্যাচারিত ব্যক্তি এবং আল্লাহ্র মাঝখানে কোন যবনিকা থাকে না”।
এই দুঃসহ অবস্থাতেই বেশ কয়েক রাত কেটে যায়। কোন রকমের ওষুধপত্র বা চিকিৎসার নাম নেই। শুধু সেই কৃষ্ণকায় ভয়ঙ্কর প্রহরী দৈনিক নির্দিষ্ট সময়ে দরজা খুলে একটু মাখন আর বাসি কয়খানা রুটির টুকরো ছুড়ে দিয়ে যেত। কিন্ত খাবার অযোগ্য বলে আমি ওসবে হাতও দিতাম না। ফলে সে যেভাবে রেখে যেত, ঠিক ওভাবেই কুড়িয়ে নিয়ে যেত। ওসব রুটি ও মাখনের দুর্গন্ধ সহ্য করাই ছিল বড্ড কঠিন।
আল্লাহ তাদের সহায়
একদিন দরজার বাইরে কারো পায়ের চাপা শব্দ শুনে আমি এক আজব অনুভূতিতে দরজার কাছে গিয়ে পৌঁছাই। দরজার যে ছিদ্রপথে প্রহরী আমার দেখাশুনা করত,সেই ছিদ্র পথে তাকিয়ে দেখি সামনে মুর্শিদে ‘আম’ ইমাম হুজায়বী। তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়েছে তাহলে! আমি সেই ছিদ্র পথে মুখ লাগিয়ে পবিত্র এই আয়াতটি পাঠ করলাম-
“যদি আপনি আহত হয়ে থাকেন তাহলে জাতিও ওভাবে আহত হয়েছে; দুর্বলতা দেখাবেন না এবং দুঃখ করবেন না। আপনি যদি ঈমানের উপর কায়েম থাকেন তাহলে আপনি সাফল্য মণ্ডিত হবেন”।
আমার দৃষ্টি তাঁর পবিত্র কদম চুম্বন করল এবং বারবার কুরআনের সেই আয়াত পড়তে থাকি। তিনি এর জবাব হাতের ইঙ্গিত এমন ভাবে দিতেন যে, ছায়ার মত দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরী যেন কিছু বুঝতে না পারে। ইমাম হুজায়বীর এই নৈকট্য থেকে আমি আমার দুঃখ বেদনা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যাই।
বস্তুতঃ মুমিন আল্লাহ্র পথে পরস্পরের সাথে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে। ইসলামে ছোট-বড় বলে কোন ভেদাভেদ বা বৈষম্য নেই। ইসলামে প্রত্যেকে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যে কাজ করে। সুতরাং নেতা এবং তার অনুসারী বা সেনাধ্যক্ষ এবং সাধারণ সিপাহীদের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই। সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যেই কাজ করে এবং প্রত্যেকের কাছে আপন ভাইয়ের মত। এসব আদর্শগত চিন্তা আমার মনে প্রশান্তির শীতলতা এনে দেয়।
জুলুম-নির্যাতনের ষ্টীমরোলার
এই প্রশান্তি বেশী দিন থাকেনি। একদিন বিকেলে হটাৎ কক্ষের দরজা খুলে সাফওয়াত এসে উপস্থিত। সে তার হাতের চাবুক দিয়ে দেয়াল পিটাতে পিটাতে আমাকে ধরে টেনে হেঁচড়ে কারাগারের অফিসের কাছে নিয়ে একটি চেয়ারে বসিয়ে চলে যায়। কয়েক মুহূর্ত পরে এক ব্যক্তি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল-
:তুমিই কি জয়নব আল-গাজালী?
ইতিবাচক জবাব পেয়ে সে চলে গেল। এবার এলো বিরাটকায় ভয়ঙ্কর তিনজন সামরিক জওয়ান। মনে হচ্ছিল, তারা যেন এক্ষণি জাহান্নাম থেকে উঠে এসেছে। তাদের চেহারায় নিষ্ঠুরতার স্পষ্ট চিহ্ন। এরপর আরেক ব্যক্তি এসে তাদের জিজ্ঞেস করল-
: তারা কি আমাকে চিনতে পেরেছে?
জবাবে তারা সবাই বলল-
: হ্যাঁ চিনেছে বৈ-কি। এর মৃত্যুর মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে।
এরপর দেখি, তারা বেরিয়ে গিয়ে ভাই ফারুক মনসাবীকে চাবুক মারছে। তাকে উঁচু কাঠের উপর লটকিয়ে রাখা হয়েছে আগ থেকেই। চাবুক মারার সাথে সাথে তারা ভাই ফারুককে জিজ্ঞেস করছিল-
“জয়নব গাজালীর সাথে কয়বার দেখা করেছিস? এর সাথে সাথে তাকে আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়ার জন্যেও বলছিল। কিন্তু সেই আল্লাহ্র বান্দা ওদের কথা মানতে অস্বীকার করলে পিটুনির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাঁর এই অবস্থা দেখে আমার চোখ ফেটে অশ্রুর বদলে যেন রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। অনেক মারধরের পর ভাই ফারুককে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। তাঁর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি তাঁর প্রাণ বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু আল্লাহ্র রহমতে তিনি বেঁচে যান। শেষ পর্যন্ত বিচারের সাথে প্রহসন চালিয়ে তাঁকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। আল্লাহ্র এই সৈনিক জেলে বসেও কয়েদীদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করে তাদেরকে ইসলামী আন্দোলনের উদ্ধুদ্ধ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ইসলামের দুশমনরা তাঁকে লিমানতারা জেলে নিয়ে গিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে (ইন্নালিল্লাহ………) তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহ্র সন্তুষ্টির পথে অবিচল থেকে শাহাদাতের সৌভাগ্য অর্জন করেন।
পাপিষ্ঠরা শুধু ভাই ফারুকের উপরই এমন অত্যাচার করেনি। তারপর, তারা অন্য এক ভাইকে কাষ্টে লটকিয়ে সেই একই ধরনের প্রশ্ন করে এবং আমাকে গালি দিতে বলে। কিন্তু ভাইটি গালি দিতে অস্বীকার করলে তাঁকে এমন নিষ্ঠুরভাবে মারা হয় যে, তিনি বেহুশ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তিনি মরে গেছেন মনে করে স্ট্রেচারে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আসলে পাপিষ্ঠরা মনে করেছিল, এসব দেখে আমি তাদের মর্জিমত মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে রাজী হয়ে যাব। এ উদ্দেশেই তারা আমার কাছে এক ব্যক্তিকে পাঠায়। সেই ব্যক্তি আমার কাছে এসে নিজেকে অত্যন্ত ভদ্র এবং আমার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করে।
সে এসে আমাকে সালাম করে পরিচয় দেয়-
“আমি এটর্নি ওমর ঈসা”।
পরে আমি জানতে পেরেছি, তার কথা মিথ্যে। আসলে সেও ঐ শয়তানদের একজন। সে তার কথা শুরু করতে গিয়ে বলে-
“জয়নব, আমি তোমার সাথে সমঝোতা করতে আগ্রহী। তুমি নিজেই নিজেকে যে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছ, তা থেকে তোমাকে মুক্তি করানোই আমার উদ্দেশ্য……।তুমি একজন সম্মানীতা মহিলা। একটু ভেবে দেখতো! হুজায়বীর মতো লোকেরা পর্যন্ত সব স্বীকার করে নিয়েছে এবং তারা তোমার ব্যাপারে এমন সব কথা প্রকাশ করেছে, যাতে তোমার ফাঁসীর শাস্তিও হতে পারে। তারা নিজেদেরকে তো বাঁচিয়ে নিয়েছে কিন্ত তোমাকে আরো বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমার মতে সময় থাকতে তুমি এখনো নিজের মান-ইজ্জত রক্ষা কর এবং সব কিছু বলে দাও। বল, তাদের উদ্দেশ্য কি ছিল? এবং তোমার নিজের মতামতও বিস্তারিত ভাবে জানাও। আমার ধারণা তোমার মতামতই যথার্থই হবে”।
ওর এসব ভনিতা শুনেও আমি চুপ করে রইলাম। কোন জবাব না পেয়ে সে আবার বলল-
“জয়নব, তুমি খুব ভেবেচিন্তে জবাব দিও। আসলে আমি প্রকৃত ব্যাপার জানতে চাই”।
এবার আমি বললাম-
“আমার যতটুকু ধারণা, ইখওয়ানুল মুসলিমুন এমন কোন কাজ করেনি, যা কোন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তির কাছে ক্রোধের কারণ হতে পারে। আমি নিজেও ইখওয়ানের সাথে রয়েছি। আমরা এমন কিইবা অপরাধ করেছি? আমরা লোকদের ইসলামী শিক্ষা দেই, এটা কি কোন অপরাধের কাজ?”
এই বলে আমি চুপ করে গেলে সে বলল-
কিন্তু এতে করে এটা প্রমাণিত হচ্ছে যে, তারা এমন অনেক ষড়যন্ত্রের লিপ্ত ছিল, যার মধ্যে জামাল আবদুন নাসেরের হত্যা এবং দেশে অরাজকতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রও শামিল ছিল। আর তাতে তুমি তাদের মদদ দিচ্ছিলে। দেখ, আমি এটর্নি, বাস্তব সম্পর্কে অবহিত হওয়াই আমার কাজ। আমি বললাম-
আবদুন নাসেরকে হত্যা করা বা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করা ইখওয়ানের উদ্দেশ্য হতেই পারে না। বরং জামাল নাসেরই দেশকে ধ্বংস করে ছেড়েছে। বস্তুতঃ আমাদের উদ্দেশ্য অনেক উন্নত এবং গঠনমূলক এটা একটা অকাট্য সত্য। আমরা নিখুঁত তাওহীদ, ইবাদাত তথা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আল্লাহ্র মনোনীত জীবনাদর্শ কায়েম করতে চাই। আমরা যখন এই মহৎ উদ্দেশ্য অর্জন করব, তখন মিথ্যে জুলুমাতের তখত-তাউস আপনা থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সব নকল কাহিনীর বিনাশ ঘটবে। মনে রেখো, আমাদের উদ্দেশ্য সংস্কার সাধন ও পুনর্গঠন। ভাঙ্গা নয় নির্মাণ এবং উন্নতিই আমাদের কাম্য।
একথা শুনে সে হেসে বলল-
“প্রকৃতপক্ষে তোমরা জামাল নাসের এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিলে। এটা তোমার কথাতেই বোঝা যায়”।
আমি বললাম-
:দেখ, ইসলামে ষড়যন্ত্র, চক্রান্তের কোন অবকাশ নেই। আমরা ওসব জানিনে। বরং আমরা সব রকমের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। আমরা মানুষের সামনে দুটি পথের স্বরূপ তুলে ধরি। তার একটি হচ্ছে আল্লাহ্র নির্দেশিত পথ এবং অন্যটি শয়তানের পথ। যারা শয়তানের পথে চলে আমরা তাদেরকে বিভ্রান্ত রোগী মনে করি। এসব লোকদের আমরা অত্যন্ত স্নেহের সাথে সত্যের ওষুধ দান করি। আর তা হচ্ছে আল্লাহ্র শরীয়ত-আল্লাহ্র দ্বীন।
“আমরা কুরআন নাযিল করেছি, তা মোমেনদের জন্যে রহমত এবং মুক্তি (স্বরূপ), এবং অত্যাচারীদের জন্যে ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই নেই”।
এবার সেই শয়তানের কথাবার্তা পাল্টে যেতে লাগলো, যে নিজেকে এটর্নি হিসেবে জাহির করছিল। আসলে এ ছিল সাঈদ আবুদল করিম। সে এই বলে বেরিয়ে গেল-
“আমি তোমার উপকার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে, তুমি এখনো ইখওয়ানের ভাব প্রবণতার শিকার হয়ে রয়েছো”।
এরপর সাফওয়াত রুবী এসে আমাকে দেয়ালের দিকে মুখ করিয়ে দেয়। এভাবে বেশ কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত আমাকে নিশ্চলভাবে দাঁড় করিয়ে রাখে এবং আমার সামনে ইখওয়ানদের উপর অকথ্য অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে। এসব দেখে দেখে আমার রক্ত পানি হচ্ছিল শুধু। এঁদের মধ্যে অনেককেই আমি ঘনিষ্টভাবে জানি। যেমন, সারসী মুস্তফা, ফারুক আসসাদী, তাহের আব্দুল আজীজ সালেম। এঁরা আন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী। কিছুক্ষণ পরে সেই তথাকথিত এটর্নি, হামজা বিসিউবি এবং সাফওয়াত রুবি ফিরে আসে। হামজা বলল-
“তুমি এটর্নির সাথে সমঝোতায় আসতে চাচ্ছনা কেন? আমরাতো তোমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে চাচ্ছি। আমি তোমার স্বামীকে যতটুকু জানি, তিনি খুবই ভাল লোক। কিন্তু তুমি প্রতারণার শিকারে পরিণত হয়েছ। হাসান হুজায়বী সব কিছুই বলে দিয়েছে।
আমি শ্লেষের স্বরে জিজ্ঞেস করলাম-
“সত্যিই কি ইখওয়ানরা সব কিছু বলে দিয়েছে? আর এজন্যেই তোমরা ওদের উপর এখনো অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছ? তাদের গুলিকাষ্ঠে ঝুঁলিয়ে চাবুক মারছো!……… জেনে রেখো, আমি কক্ষনো ইখওয়ানের বিরুদ্ধে বা আমার নিজের বিরুদ্ধে মিথ্যে বলতে পারবো না। আমরা মুসলমান। ইসলামের জন্যেই আমাদের সব চেষ্টা সাধনা। এই আমাদের কাজ কর্ম”।
এদের পিছনে চারজন জল্লাদ দাঁড়িয়েছিল। ওদের হাতের হান্টার ও চাবুক এই ক্ষণিক আগে ইখওয়ানদের ঝরাচ্ছিল।
আমি তথাকথিত এটর্নির দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে তিরস্কারের স্বরে বললাম-
মিস্টার এটর্নি! এসব হান্টার আর চাবুক ও বুঝি আপনাদের আইন কলেজের পাঠ্য সূচীর বিষয়বস্তু ছিল? আমরা কথা সম্পন্ন হবার আগেই হামজা বিসিউনি আমার গালে প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিয়ে বলল-
“তুই আমাদের সবাইকে পাগল ঠাউরিয়েছিস, না? আমি তোকে আজ এমন ভাবে দাফন করে দেবো, যেভাবে রোজ দশজন ইখওয়ানকে দাফন করে থাকি”।
আমি দ্বিতীয় বার তথাকথিত এটর্নির দিকে লক্ষ্য করে বললাম-
সত্যি সত্যিই যদি এটর্নি হয়ে থাক, তাহলে তুমি তোমার সার্বক্ষণিক ডায়রীতে এসব অত্যাচারের ঘটনা নোট করছ না কেন?……… তাছাড়া তুমি যে এটর্নি তার প্রমাণ কি……?
একথা শুনে হামজা বিসিউনি বলল-
“ব্যাস, যাও তোমরা নিজ নিজ কাজে যাও। আমি তো এর উপকার করতে চেয়েছিলাম। কিন্ত সে যে তা চায় না”।
এর সাথে সাথে সাফওয়াত এবং তার সাথী জল্লাদরা এলোপাথাড়ী ভাবে আমার উপর হান্টার চালাতে শুরু করে। চোখ রক্ষার জন্যে আমি দু’হাতে চোখ ঢেকে রাখি। বাকী সমগ্র শরীর হান্টারের আঘাতে জর্জরিত হচ্ছিল। আমি এই দুঃসহ উৎপীড়নের অনুভূতি হ্রাসের উদ্দেশ্য আল্লাহ্র দরবারে মোনাজাত করি এবং হান্টারের প্রতি ঘায়ের সাথে “ইয়া রব-ইয়াআল্লাহ” শব্দ উচ্চারণ করতে থাকি।
সাফওয়াত ও তার সঙ্গীরা অনেক হান্টার চালিয়ে প্রায় ক্লান্ত হয়ে গিয়ে আমাকে বেঁধে দেয়ালের গায়ে লটকিয়ে রাখে এবং হাত দু’টোকে যতটুকু সম্ভব উপরে দিকে টেনে বেধে রেখে চলে যায়। এ অবস্থায় আমার শান্তি ও আরাম লাভের একমাত্র সম্বল ছিল আল্লাহ্র নাম জিকির করা। সুতরাং আল্লাহ্র নাম জিকির এবং তাঁরই কাছে মোনাজাত করতে থাকি।
বেশ কয়েক ঘণ্টা এভাবে রাখার পর সাফওয়াত সাম্বো নামক এক কৃষ্ণকায়কে নিয়ে আমার কাছে আসে। আসা মাত্রই তারা উভয়ে আমার উপর দমাদম কিল ঘুষি আর চড় মারতে থাকে। এরপর আমাকে সেলে নিয়ে বন্ধ করে দেয়।
ওরা চলে যাবার পর দূরে কোন মসজিদে মিনার থেকে ফজরের আযান ধ্বনি ভেসে আসে। আমি সব ব্যথা-বেদনা ভুলে গিয়ে প্রথমে নামাজ আদায় করি এরপর দু’হাত তুলে খোদার কাছে বলি-“ ইয়া রাব্বুল আলামীন, তুমি যদি আমার উপর অসন্তুষ্ট না হও তাহলে দুনিয়ার কোন অত্যাচারকেই ভ্রুক্ষেপ করিনে। তোমার দয়া এবং রহমত আমার জন্যে যথেষ্ট। আমি তোমার আলোক কামনা করি যা দুনিয়া ও আখেরাতকে আলোকিত করে এবং তোমার অসন্তুষ্টি ও গজব থেকে মুক্তি চাই। হে খোদা, আমি তোমারই দরবারে হাজির হয়েছি-হে প্রভু! তুমি আমার উপর সন্তুষ্ট থাক; নিঃসন্দেহে তুমিই সব কিছুর মালিক সর্ব শক্তিমান”।
প্রেসিডেন্ট নাসেরের প্রতিনিধি
একাধারে তিন দিন পর্যন্ত সেলে আবদ্ধ রাখার পর আমাকে দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে লম্বা চওড়া এক শ্বেতকায় ব্যক্তি আমারই অপেক্ষায় বসে ছিল। আমি দফতরে পৌঁছান মাত্রই ভদ্রলোক বলল-
“বস, জয়নব! আমরা জানি যে, এরা তোমাকে মেরেপিটে খুব ক্লান্ত করে রেখেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে জানি। ……আমি প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে সরাসরি এসেছি। আমি তোমার সাথে আপোষ মীমাংসায় আসতে চাই। সারা দেশের জনতা তোমাকে ভালোবাসে, আমরাও তোমাকে শ্রদ্ধা করি। ……কিন্তু তুমি আমাদেরকে দূরে ঠেলে রেখেছো এবং আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করে চলেছ। ………জানিনে, তুমি আমাদের সাথে সমঝোতায় আসতে কেন রাজী নও। খোদার শপথ করে বলছি, তুমি যদি আমাদের সাথে সমঝোতা কর তা হলে আজই তোমাকে সামরিক কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হবে। আমরা সবাই জানি যে, কারাগারে থাকার মত ব্যক্তি তুমি নও। আমরা তোমাকে কেবল কারাগার থেকে মুক্তি দেয়ার কথাই বলছিনা বরং তোমাকে হেকমত আবু জায়েদের জায়গায় সমাজ কল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী পদে বরণ করার নিশ্চয়তাও দিচ্ছি”।
ওর কথা শুনে আমি জিজ্ঞেস করলাম-
“তা আপনারা হেকমত আবু জায়েদকে মন্ত্রী বানানোর আগে বুঝি খুব চাবুক লাগিয়েছিলেন, এবং হিংস্র কুকুরের মধ্যে ছেড়ে রেখেছিলেন?”
:তা হবে কেন? তা হবে কেন? সত্যি বলছি, তুমি এখানে কারাভোগ করছ, দুঃখ পাচ্ছ; আসলে আমরা তা চাইনি।
: তাহলে আপনারা আমার কাছে কি চান?- আমি জিজ্ঞেস করি। সে বলল-
“দেখ, ইখওয়ানুল মুসলিমুনের প্রত্যেকেই তোমার উপর অভিযোগ আরোপ করেছে……। হুজায়বী সাহেবও এ ব্যাপারে সবিস্তারে সব জানিয়েছেন। আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল এবং সাইয়েদ কুতুবও সব ব্যাখ্যা করে বলে জানিয়েছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, ওরা সবাই নিজেদের মুক্তি এবং তোমাকে জব্দ করার জন্যেই ওসব বলেছেন। এজন্যে আমি প্রেসিডেন্ট নাসেরের নির্দেশে তোমার সাথে সমঝোতায় আসার জন্যে নিজেই হাজির হয়েছি। তুমি সমঝোতায় এলে এক্ষণি তোমাকে মুক্তি দেয়া হবে এবং আমি নিজেই আপন গাড়ীতে করে তোমাকে বাড়ী পৌঁছিয়ে দেব। তোমাকে প্রসঙ্গত এটা বলে দেয়া প্রয়োজন যে, ইখওয়ানদের দেয়া বিবৃতিতে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা গদী দখলের চেষ্টায় ছিল এবং তুমি প্রেসিডেন্ট নাসের ও তাঁর চারজন মন্ত্রীকে হত্যা করার স্কীম তৈরী করেছিলে। এ ব্যাপারে আমরা তোমার বিবৃতি জনাব হুজায়বী এবং সাইয়েদ কুতুবের ভুমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই। আর যে চারজন মন্ত্রীকে হত্যা করার স্কীম নেয়া হয়, তারাই বা কারা? অনুগ্রহ করে বিস্তারিত বিবৃতি দান করো”।
আমি মুহূর্তে বিলম্ব না করে বললাম-
প্রথম কথা হচ্ছে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন কখনো গদী দখলের কিম্বা তথাকথিত চারজন মন্ত্রীকে অথবা কোন ব্যক্তিকে হত্যা করার কোন স্কীম তৈরী করেনি। আসল ব্যাপার ছিল ইসলাম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন, মুসলমানদের দারিদ্র ও অধঃপতনের কারণ নির্ণয় এবং সামগ্রিক অবস্থার বাস্তব ভিত্তিক পর্যালোচনাই ছিল ইখওয়ানের কাজ এবং এ ব্যাপারে ইখওয়ান সাফল্য অর্জন করে।
ভদ্রলোক আমার কথায় বাধা দিয়ে বলল- “জয়নব; ওরা সব কিছুই বলে দিয়েছে”।
আমি বললাম-
:বলেছে বৈ-কি! জল্লাদরা তাঁদেরকে যা বলার জন্যে বাধ্য করেছে তা তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও হয়তো বলে থাকবেন। যা হয়নি, তা হয়েছে বলে স্বীকার স্বীকার করার জন্য জোর-জুলুম চালিয়ে বাধ্য করা হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের জবরদস্তি স্বীকারোক্তির কোন মানে হয় না। অথচ আসল কথা হচ্ছে, আমরা নিছক ইসলামের শিক্ষাই প্রচার করছিলাম এবং নবীন বংশধরদের এমন প্রশিক্ষন দিচ্ছিলাম, যাতে তারা যথার্থ ভাবে ইসলামকে বুঝতে ও বাস্তবায়ন করতে পারে। আপনাদের দৃষ্টিতে যদি এটা অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে ন্যায় বিচারের জন্যে আল্লাহ্র দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই”।
প্রেসিডেন্ট প্রতিনিধি এবার খোদার শপথ করে সহানুভূতির ভঙ্গিতে বলল-
“আমি তোমার কল্যাণ কামনা করি। তোমাকে মুক্ত করানোর জন্যেই আমি এসেছিলাম”।
“আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম-
“দেখুন, পদস্থ সরকারী অফিসার অথবা মন্ত্রীত্ব লাভের বাসনা আমার মনে কোন দিনই জাগেনি। আমি আমার সারা জীবন দ্বীন-ইসলামের সেবায় কাটিয়ে দিয়েছি। বড় লোক বড়নেতা বা মন্ত্রীত্তের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহও আমার নেই। আমার প্রথম এবং শেষ কাজ হচ্ছে শুধু ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করা”।
এরপর কক্ষ থেকে বেরুতে প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি আক্কেপ করে বলল-
“তোমার সেবায় এসেছিলাম তোমাকে মুক্ত করানোর জন্যেই –কিন্তু তুমি তা অস্বীকার করছ, প্রত্যাখ্যান করছ”।
প্রেসিডেন্ট প্রতিনিধি চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর রিয়াজ এবং সাফওয়াত আমার কাছে আসে। এর আগে রিয়াজ বেশ কয়েকবার আমাকে শাশিয়ে দিয়ে বলেছিল, আমি যদি তাদের কথা মত বিবৃতি না দেই তাহলে আমাকে খুন করা হবে।
এর পরপরই সেই তিন দিন আগের মত আমাকে বেদম প্রহার করা হয়। আমার সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত করে ওরা আবার আমাকে সেলে বন্ধ করে চলে যায়।
আমার সেলে অনেক চেহারা
সেলে দ্বিতীয় দিন বিকেলে আসরের নামাজের সময় কিছু পরিচিত কণ্ঠস্বর আমার কানে বাজে। আমি কোন রকমে উঠে দরজার কাছে গিয়ে প্রহরীর জন্যে নির্দিষ্ট সেই ছিদ্রপথে বাইরের অবস্থা দেখার প্রয়াস পাই। কিন্তু ছিদ্রের কেবল সামনেই হামজা, সাফওয়াত এবং তার সাথীরা দাঁড়িয়েছিল বলে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। আমি কিন্তু অপেক্ষা করতে থাকি। কিছুক্ষণ পর ওরা একটু এদিক-সেদিক হলে আমার সামনে মুহতারেমা আলীয়া হুজায়বী এবং গা’দা আম্মারের দীপ্তিময় প্রশান্ত চেহারা মওজুদ ছিল। আমি জল্লাদদের শ্যেন দৃষ্টি থেকে নিজেকে যথাসম্ভব লুকিয়ে রেখে ওদের পাক-পবিত্র চেহারা দেখে যাচ্ছিলাম। ওদের এত কাছে দেখতে পেয়ে আমি আমার ব্যথা-যন্ত্রণা পর্যন্ত ভুলে যাই। অথচ দাঁড়িয়ে থাকা দুরের কথা, শুয়ে বসেও আমি স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। কিন্তু এখন কোন অজানা যাদুর স্পর্শে যেন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছি……। আমি তাদের দেখছি আর দোয়া করছি, হে-পাক পরওয়ারদেগার! আমার এসব বোন এবং মেয়েদেরকে জালিমের অত্যাচার-উৎপীড়ন থেকে রক্ষা কর।আমি ভাবছিলাম-আলীয়া শিগগিরই হতে যাচ্ছে এবং গা’দা আম্মার তো বলতে গেলে এখনো দুধ খাওয়া মেয়ে। কিন্তু সত্যের দুশমনরা এমন মাসুম বালিকাকেও গ্রেফতার করতে ইতস্ততঃ করেনি। কি নিষ্ঠুর এসব জালিম! শাসন ক্ষমতায় মদমত্ত এসব নির্দয় কাপুরুষরা অসহায় নিরীহ বালিকা ও মহিলাদের উপর এই জঘণ্য নির্যাতন চালিয়ে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে কোন বীরত্বের প্রতিযোগিতায় নেমেছে জানিনে। বস্তুতঃস্বঘোষিত এসব স্বৈরাচারী শাসকরা যখন তাদের আসল পাশবিক চেহারায় ধরা দেয় তখন দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং নিকৃষ্টতম মানসিকতা প্রকাশ করতেও তারা দ্বিধা বোধ করে না। এদের বিবেক এবং সুবুদ্ধি বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। তখন এরা দেশের সাধারণ নাগরিকদের কাছে এক অভিশাপের মত ছেয়ে যায়। এদের জুলুম-অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে দেশের শান্তিকামী মানুষ। নাসের এবং তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা ছিল ঠিক এরকমেরই অভিশপ্ত শাসক।
“হে অত্তাচারি নাসের, তুই ধ্বংস হ’- খোদার কাছে তোর মৃত্যু কামনা করি-জাতিকে প্রতারিত করে কি-ই না ভয়ানক অবস্থার মধ্যে টেনে এনেছিস তুই-! আবেগের আতিশয্যে আমি ঢলে পড়ি। একটু পরেই আমার কক্ষের দরজা খুলে সেই কৃষ্ণকায় প্রহরী একখানা চাদর ও একটি বালিশ ভেতরে রেখে যায়। আমি বিস্মিত হলাম! গত আঠার দিন ধরে আমি মাটিতে পড়ে আছি—আজ হটাৎ এই দয়া কেন?
এরপর প্রহরী এসে আরো দু’খানা চাদর এবং দুটি বালিশ রেখে যায়। এর কিছুক্ষণ পরে আলীয়া হুজায়বী এবং গা’দা আম্মারকে নিয়ে সাফওয়াত এবং হামজা বিসিউনি প্রবেশ করে। ওঁদের দু’জনকে ভেতরে ছেড়ে তারা দরজা বন্ধ করে ফিরে যায়।
আলীয়া কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আমি তখন আমার নিজের অবস্থা এবং সারা দুনিয়ার কথা ভুলে গিয়ে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মুখে কেবল জিজ্ঞেস করছিলাম-
:আলীয়া……আমার আলীয়া……! তুমি সুস্থ আছতো?
এরপর গা’দা আম্মারের দিকে চেয়ে দেখি তার দু’চোখের তপ্ত অশ্রুধারায় নীচে উষর মাটি সিক্ত হয়ে উঠেছে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম-
:গা’দা আমার মেয়ে! আমাকে চিনতে পারছিসনে? সে বলল-
:না,……না হে আলহাজ্বা! তুমি একেবারে বদলে গেছ মা। তোমার শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। আর তোমার চেহারা দেখে তোমার ভাই সা’দ উদ্দিনের কথা মনে পড়ছে……” আমি তাকে সান্তনা দিয়ে বললাম-
:আমরা যে অবস্থায় আছি, তাতে তো এমন হওয়াই স্বাভাবিক। এক ভয়ঙ্কর পরিবেশে শ্বাস নিচ্ছি আমরা। তাছাড়া জানিস, আমি রাতদিনের চব্বিশ ঘণ্টায় খাদ্য হিসেবে পাই শুধু এক চামচ সালাদ। তাও একজন সিপাহী লুকিয়ে দিয়ে যায়। ধরা পড়লে তার আর রক্ষে নাই।
এরপর চাদর আর বালিশ পেতে দিয়ে ওরা আমাকে দারসে কুরআন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। তারা ভেবেছিল অন্ততঃ কুরআন শরীফ রাখা ও পড়ার সুযোগ আমার ছিল। তারা জানতো না যে, আমি যাদের কাছে আছি, তারা কুরআন এবং মানবতার দুশমন। আমি যখন সব ঘটনা খুলে বললাম তখন ক্ষোভে-দুঃখে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়ে তারা। একটু পরে আলীয়া এবং গা’দা আম্মার তাদের নিজ নিজ কুরআন শরীফ আমার কাছে পেশ করলো। এতদিন পরে চোখের সামনে কুরআন দেখে আমার দু’চোখ আনন্দাশ্রু দেখা দেয়।
একটু পরে আমি যখন ব্যথা লাঘবের উদ্দেশ্যে আমার আহত পা বিছিয়ে দেই, তাতে হান্টারের দগদগে ঘা দেখে আঁৎকে উঠে তারা। তাদের উভয়ের চোখের অশ্রু ছলছল করছিল। আমি পবিত্র কুরআনের আসহাবুল উখদুদ’ সংক্রান্ত আয়াত পড়ে শুনাই। গা’দা আম্মার নীরবে কাঁদতে থাকে আর আলীয়া বিস্ময় কণ্ঠে স্বাগত প্রশ্ন করে।
:মহিলাদের সাথেও এমন নির্মম-নিষ্ঠুর ব্যবহার কিভাবে সম্ভব হলো? কোন বন্য নৃশংসতার নিদর্শন এসব……।
কিন্তু আলীয়া হয়তো কল্পনা করতে পারেনি যে, ইসলাম ও মানবতার দুশমন জামাল নাসেররা আল্লাহ্র ও তাঁর রাসূলের শত্রুতায় এর চেয়েও নীচে নামতে পারে।
রাফাত মুস্তফা নুহাসের ইন্তেকাল
আলীয়া আলোচনার ধারা পাল্টিয়ে আমাকে বাইরের জগত সম্পর্কে অবহিত করতে শুরু করে। প্রথমে সে আমাকে মুস্তফা নুহাসের মৃত্যু-সংবাদ জানায়।
“হে রাহমানুর রামীম!তুমি কারো মুখাপেক্ষী নও, সবাই তোমার রহমতের- তোমার দয়ার মুখাপেক্ষী। তুমি তার উপর দয়া কর”। আলীয়া আমাকে জানায় যে, আমার গ্রেফতারীর দু’তিন দিন পরই তার ইন্তেকাল হয়। হাজার হাজার লোক তাঁর জানাজায় অংশ গ্রহন করে। এসময় লোকেরা সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। জনসাধারণ তার লাশ নিয়ে মসজিদে হোসাইন পর্যন্ত মিছিল বের করে। শ্লোগান-শ্লোগানে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠছিল। সরকার এই বিক্ষুব্ধ জনস্রোতের সামনে বেসামাল হয়ে পড়ে মোটকথা; মুস্তফা নুহাসের জানাজার সমাবেশে জনসাধারণ সরকারের জুলুম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সুযোগ গ্রহন করে। …… এ সম্পর্কে দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা এবং অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সম্পর্কে ও আলীয়া আমাকে সবিস্তারে জানায়।
মুস্তফা নুহাসের মৃত্যুতে লোক প্রকাশ্যভাবে সরকারের সমালোচনা শুরু করে। তারা এও বলে যে, নুহাসের পর আর কোন নেতা নেই। দেশবাসী তাদের মতামত প্রকাশ করতে থাকে। তাদের মনের পুঞ্জিভূত ব্যথার বিস্ফোরণ ঘটেছে মিছিলে দেয়া সোচ্চার শ্লোগানে। তাদের শ্লোগানে ছিল “মিথ্যাশাহী মুর্দাবাদ; দিকে দিকে শুনেছি আজ নাসের হলো ধোঁকাবাজ” “খুলে ফেল, খুলে ফেল, মুখোস তাদের খুলে ফেল” নাসের শাহী জালেমশাহী ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক” ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি মুস্তফা নুহাসের স্মৃতির উদ্দেশ্য বললাম-
:হে জনগণের বন্ধু!তুমি যে সব ধোঁকাবাজ মোনাফেকদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলে, তারা ক্ষমতা পেয়ে অন্যায়-দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। আর তুমি তাদের সরকারের স্বীকৃতি দিয়েছ। বর্তমান সরকার টিকে আছে প্রচার প্রোপাগান্ডা আর তাদের খরিদা লেখক এবং লাঠিয়ালদের জোরে।……এসব কাঠের সিংহও একদিন জ্বলে পুড়ে ছাইয়ের গাদায় পরিণত হবে………।
আলীয়া আরো জানায়ঃ জানাজায় শরীক হবার জন্যে আগতদের মধ্যে বিশ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। জনসাধারণ এর বিরুদ্ধেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বস্তুতঃমুস্তফা নুহাসের জানাজায় জনসাধারণের সুপ্ত ক্রোধ ফেটে পড়ে। তারা উদাত্ত কণ্ঠে সত্যের পক্ষে তাদের সমর্থন ঘোষণা করে। আলোচনার মাধ্যমে মুস্তফা নুহাসের স্মৃতি-কথা মনে পড়লো। বড্ড সাদাসিধে এবং নিরহংকার লোক ছিলেন তিনি। একান্ত শত্রুদের বিরুদ্ধেও তিনি মনে কোন বিদ্বেষ পোষণ করতেন না। আর নিজের ভুলকে প্রকাশ্য ভাবে স্বীকার করার মতো সৎসাহস তাঁর ছিল। সকল অর্থেই তিনি ছিলেন মিশরের জাতীয় নেতা।
এরপর আমি আমার ভাই সাইফ আল গাজালীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা তা আলীয়াকে জিজ্ঞেস করি। আলীয়া এর জবাবে হ্যাঁ অথবা না কিছুই না বলে আমার কাঁধে হাত রেখে ইতস্ততঃ করে বলল-
:হে আলহাজ্বা! সব কিছুর জন্যে সময় নির্ধারিত রয়েছে। এতে করে বুঝতে পারলাম, আমার ভাই সম্পর্কে আমি যে শংকায় ছিলাম, তাই ঘটেছে।
আলীয়া জানালো যে, আমার ভাইয়ের জানাজায় লোকদের অংশগ্রহন করতে না দেয়ার জন্যে সরকারের তথ্য বিভাগ আপ্রান চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে সমাগম হয়, তা ছিল ধারণাতীত। আলীয়ার ভাষ্য মোতাবেক, জনগন যাদেরকে তাদের ভাগ্যবিধাতা বলে মনে করতো, এখন তাদের মুখোস খুলে পড়েছে। জনগণকে আর বেশী দিন বোকা বানিয়ে রাখা যাবে না।
সরকার ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তৎপরতার বিনিময়ে বিবেকহীন স্বার্থ সন্ধানী লোকদের মন্ত্রিত্তের আসন বণ্টন করছে। জাতির বিবেক ক্রয়েরও চেষ্টা চলছে। এভাবে নাসের সরকার যা করে চলেছে তা দেশ ও জাতির জন্যে যে তিক্ত পরিণাম বয়ে আনবে, তা ভাবতেও ভয় লাগে।
আলীয়ার পর্যালোচনা শুনে আমি গা’দা আম্মারের দিকে চেয়ে তার স্বামী ছেলে-মেয়ে এবং মা-বাবার কুশল জিজ্ঞাসা করলাম। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল-
“তার স্বামী সরকারী অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে সুদান পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। মা খুবই অসুস্থ, বাচ্চা দু’টো সাথে না থাকলে সে হয়তো জীবন সম্পর্কেই বিতৃষ্ণ হয়ে যেতো।
আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম এবং প্রত্যেকের মঙ্গলের জন্যে আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করলাম।
এরপর আমি জিয়া তুহীর বিয়ে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তারা জানালো, তাদেরকে বিয়ের মাহফিল থেকে বিয়ের পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। দুলহা-দুলহান উভয়ই এখন কারাগারে বন্দী। এ ছাড়া তার বোন মলি এবং তার ডাক্তার ভাইকেও জেলে আটক করা হয়েছে”।
এমনি নির্বিচার গ্রেফতারী, বিশেষ করে নিরীহ মেয়েদের গ্রেফতারীতে আমি ভীষণভাবে মর্মাহত হই।
:কেন, ইখওয়ানের ভাইবোন বা আত্মীয়-স্বজন হওয়াও কি অপরাধ যে, সবাইকে নাহক জেলে ভরা হচ্ছে? আমার প্রশ্নের জবাবে আলীয়া বলল-
:তাতো বটেই; এ ছাড়া সরকার কাউকে নামাজ পড়তে দেখলেও গ্রেফতার করে নিচ্ছে।
এভাবে কত নিরীহ লোককে যে গ্রেফতার করা হয়েছে, গা’দা তার বিবরণ পেশ করে। যাদেরকেই মুসলমান মনে হয়েছে, তাদের ঘরবাড়ি তল্লাসী করা হয়েছে এবং নিছক সন্দেহের বসে অসংখ্য লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব শুনো আমি মন্তব্য করলাম-
“আমার মনে হয়, মোঙ্গল তাততারী দস্যুরাও এমন জঘন্যতার পরিচয় দেয়নি, যা জামাল নাসের করে বেড়াচ্ছে। মিশরে ইসলামী বিপ্লবের আগে রোমানরাও কোনদিন এমন নির্যাতন চালায়নি। বস্তুত জামাল আবদুন নাসের মানবেতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য অপরাধীদেরকেও অপরাধের ক্ষেত্রে হার মানিয়েছে। নাসেরের মত এমন বিবেকহীন অন্ধ পাপিষ্ঠ দুনিয়াতে আর জন্মেছে কিনা সন্দেহ। ইসলাম, সত্য ও ন্যায়ের নাম শুনে সে জ্বলে উঠতো। তার মত নীচ-হীন ব্যক্তির পক্ষে মহিলাদের গ্রেফতার করে তাদের উপর হান্টার চালানো মোটেই আশ্চর্যের কথা নয়। নিরীহ লোকদের হয়রানী করা, মহিলাদের বিধবা করা; খুন করা, এমনকি মানুষকে জীবন্ত দাফন করে দেয়া কেবল নাসেরের মত ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। রাজনৈতিক বিরোধীদের জান, মাল, ইজ্জত এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তাদের জীবন নিয়ে চিনিমিনি খেলা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় অভ্যাস। অত্যন্ত তিক্ত হলেও এই হচ্ছে সত্য কথা”।
এসব তিক্ত ও উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনার পর আলীয়া আমার পায়ের ক্ষত পরিস্কার এবং তাতে পট্রি বাঁধার দিকে মনোযোগ দেয়। সে আশংকা করে বলল-
:এবার মনে হয় আমাদেরকে হান্টারের শিকারে পরিণত হতে হবে, আমি বললাম-
“আল্লাহ্ সবাইকে জালিমের অত্যাচার থেকে নিরাপদ রাখুন”।
গা’দা পট্রি তালাশ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো-
“আপনার কাপড়ের থলে কোথায় আলহাজ্বা”।আমি অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও স্মিত হেসে বললাম-
“গত আঠার দিন থেকে এই রক্তাক্ত পোষাকেই আমি আছি মা”। সে আমার পরণের রক্তাক্ত ছিন্ন বসনের দিকে তাকিয়ে হু-হু করে কেঁদে উঠলো। এরপর ওরা আমার পোশাক পরিবর্তনের জন্য যখন আমার জামা উঠালো তখন গায়ে হান্টারের অসংখ্য আঘাত দেখে উভয়েই চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। কোন মহিলার সাথে এমন নির্দয় নিষ্ঠুরতার কথা তারা ভাবতেই পারেনি।
আমি তাদের অনুভূতিকে শান্ত করার উদ্দেশ্য আল্লাহ্র প্রশংসা এবং ইসলামের পথে ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলতে শুরু করি। আমি বললাম-
:দেখ, কোন পার্থিব স্বার্থের জন্যে নয়, বরং আল্লাহ্র পথে এগিয়ে চলেছি বলেই দুনিয়ার এই শাস্তি এতে দুঃখের কি আছে?……… আল্লাহ্র শোকর যে তিনি আমাদেরকে ইসলাম তাওহীদ ও রিসালাত দান করেছেন এবং কালেমায়ে তাইয়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর ছায়াতলে আশ্রয় দিয়েছেন। আলীয়া কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল-
জানেন মুহতারেমা, খালেদা হুজায়বী বলেছেন, বোন জয়নব যদি আমার সাথে থাকে, তাহলে জেলের কোন দুঃখকেই আমি পরওয়া করব না”।
একথা শুনে আনন্দিত হলাম আমি। কিন্তু খালেদা যদি এখন আমার সেই ক্ষত-বিক্ষত শোণিত সিক্ত শরীর দেখতে পেতো তাহলে জানিনে তার সেই ভাবনা থাকতো কিনা। আমি আল্লাহ্র দরবারে সব মুসলমান ভাই-বোনকে জালিমের অত্যাচার থেকে নিরাপদ রাখার মোনাজাত করি।
খাদ্য গ্রহন ইবাদত তুল্য
এরই মধ্যে হটাৎ দরজা খোলা হয় বলে আমাদের আলাপ বন্ধ হয়ে যায়। কৃষ্ণকায় সেই শয়তান প্রহরী এক হাতে তিনখানা রুটি এবং অপর হাতে সিদ্ধ সেমাইয়ের প্লেট রেখে ফিরে যায়। প্রহরী চলে গেলে আলীয়া দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি এ ধরণের খাবারের বাসী গন্ধ সহ্য করতে অক্ষম; এদিকে ক্ষিধেতে প্রাণও ওষ্ঠাগত প্রায়। আলীয়া আমার ব্যাপারে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিল। সে খাবার আমার কাছে এলে বিনয় করে বলল-
:নিন আলহাজ্বা! খাবার দেখছি মোটামুটি ভালই আছে। এ বলে সে তিনখানা রুটি আমাদের তিনজনের মধ্যে বণ্টন করে দেয়। আমরা তিনজনেই একান্ত অনন্যোপায় হয়ে এসব খেতে বাধ্য হচ্ছিলাম। আলীয়া খেতে খেতে বললো, অন্ততঃ অনাগত অতিথির স্বার্থে কিছু না কিছু খেতে বাধ্য | সম্ভাব্য সন্তানের প্রতিই ছিল তার ইঙ্গিত। কিন্তু আমাকে খাওয়া বন্ধ করে দিতে দেখে সেও তাই করলো। গাদাও খাবার ছেড়ে দিল। এবার আলীয়া আমাকে সম্বোধন করে বললো, দেখুন। আলহাজ্ব, আপনি না খেয়ে না খেয়ে এতটুকু হয়ে গেছেন। এ অবস্থায় তো খাদ্য গ্ৰহণ করা ইবাদতেরই সমতুল্য। যদি এভাবে অনশন চালাতে থাকেন তাহলে এর পরিমাণ সম্পর্কে কিছু ভেবেছেন কি? জলিমরা তো জয়নব আল-গাজালী যে কোনভাবে মরতে দেখলে খুশি হবে। আসলে এটাই তারা চায়। আমি তাকে বললাম, কোন রকমে বেঁচে থাকার জন্য তো আমি কিছু কিছু খাচ্ছিই। এক চামচ সালাতের উপরেই তো আল্লাহু আমাকে বেঁচে থাকার শক্তি দিচ্ছেন। কিন্তু তারা বারবার খাবার প্রতি জোর দিলে শেষ পর্যন্ত খেতে রাজী হই। কিন্তু এত কষ্টে যে সে খাবার খেয়েছি তা কেবল আল্লাহুই জানেন। দ্বিতীয় দিন সকালে, আলীয়া ও গাদা আম্মারের উপস্থিতিতে আমি দরজার ছিদ্রপথে মুর্শিদ আম জনাব হুজায়বীর সাথে রোজাকার মত সাক্ষাৎ করি। আলীয়া এবং গাদাকেও আমি সে সুযোগ করে দেই। মুর্শিদ আমের সাথে সাক্ষাৎ করে অপূর্ব এক প্রশান্তি অনুভব করি। আলীয়াও তার বাবাকে নিয়মিত দেখতে পেত। বলাবাহুল্য, আলীয়া মুর্শিদ আম হুজায়বীর মেয়ে। আমাদের কক্ষের সামনের পথে গোসলখানায় আসা যাওয়ার পথে তারা মুর্শিদে আমাকে দেখে নিতো। গাদা আম্মার তার নিজের গ্রেফতারীর ঘটনা, হামীদা কুতুবের সাথে তার সাক্ষাৎ এবং পুরো কুতুব পরিবারের গ্রেফতারীর ঘটনাবলী একে একে বলে যায়। এতে করে অনেক নতুন তথ্য অর্জন করি। সময় কাটছিল অত্যন্ত ধীর গতিতে। আমরা অস্বন্তি থেকে বাচার জন্যে জামায়াতে নামাজ আদায় এবং দারিসে কুরআনের আয়োজন করি।
দুর্যোগের রাত
এশার নামাজের পর জল্লাদ সাফওয়াত রুবী একজন সিপাহীকে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। তারা আমাকে অফিসে নিয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, একই অফিসে এর আগে আমি আরো দু’বার ঘুরে এসেছি। অফিসকক্ষে এক ব্যক্তি আগে থেকেই বসেছিল। আমি তাকে সালাম জানালাম। কিন্তু সে সালামের জবাব না দিয়ে অত্যন্ত কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
“তুমিই কি জয়নব আল-গাজালী?”
“জী হ্যাঁ”। আমি জবাব দিলাম। সে আমাকে সামনের চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করে বললো –
“আচ্ছা, তাহলে তুমিই হচ্ছ জয়নব গাজালী………! বলতো, তুমি স্বেচ্ছায় এমন ভয়ঙ্কর স্থান বেছে নিয়েছ কেন………..? কেন এসব দুঃখ কষ্ট সহ্য করছ কেবল ইখওয়ানুল মুসলিমুনের জন্যেই?………এরা তো সবাই মুক্তির জন্যে ছটফট করছে এবং প্রত্যেকেই সব দোষ তোমার উপর চাপাচ্ছে। ……আর এদিকে তুমি আমাদেরকে মুশকিলে ফেলে রেখেছ। আমি কিন্তু তোমাকে মুক্ত করানোর এবং কয়েকটি ব্যাপারে তোমার সাথে আপোষ মীমাংসায় আসার প্রতিজ্ঞা করে এসেছি। এরপর তুমি তোমার বাড়ী চলে যাবে। শুধু তাই নয়। তুমি যদি বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ কর তাহলে আমি প্রেসিডেন্ট নাসেরের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, অবিলম্বে ইসলামী মহিলা সংস্থার সদর দপ্তর তোমাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। ………তোমার পত্রিকার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে এবং পত্রিকার জন্যে মাসিক দু’হাজার মিশরীয় পাউন্ড সাহায্য দেয়া হবে। তুমি যদি সমঝোতায় আস তাহলে তোমার সংস্থাকে আরো সম্প্রসারিত করার জন্যে সাহায্য দেয়া হবে। তুমি যদি সমঝোতার জন্যে এক্ষুণি হ্যাঁ বলে দাও, তাহলে আমি তোমার যাবতীয় পোশাক পরিচ্ছদ আনিয়ে দিচ্ছি এবং এক ঘণ্টার মধ্যেই প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠকে বসার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সত্যিই ইখওয়ানরা তোমাকে খুব প্রতারিত করেছে। আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করুন। তুমিও আমাদেরকে ভীষণ বিপদে ফেলে রেখেছ, যাই হোক, আমাদের প্রেসিডেন্ট খুবই উদারমনা লোক”।
সে এক তরফা বলেই যাচ্ছিল আর আমি চুপচাপ শুনছিলাম। আমাকে আগাগোড়া নীরব থাকতে দেখে সে জিজ্ঞেস করলো-
: “কি ব্যাপার তুমি কিছু বলছ না যে! দেখ জয়নব, তুমি আমার কথা বুঝবার চেষ্টা কর। আল্লাহ্র শপথ করে বলছি প্রেসিডেন্ট আবু জায়েদকে বরখাস্ত করে তোমাকে তার স্থলে মন্ত্রী নিয়োগ করবেন। আমরা তোমার সহযোগিতা কামনা করি। দয়া করে তুমি তোমার মনকে বড় কর এবং সত্যি সত্যি সব কথা বলে দাও। কাজে কর্মে তুমি দেখে নেবে যে, আমি তোমার ভাই এবং শুভাকাঙ্ক্ষীই প্রমাণিত হবো। তুমি জান, কারাগারের বাইরে কত লোক তোমাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। তোমার জন্যে ওরা যে কোন কাজ করতে প্রস্তুত। তারা তোমাকে ভালোবাসে, ভক্তি করে, তোমার জন্য তারা সব কিছুই করবে”।
এবার আমি শান্ত স্বরে বললাম-
:মন্ত্রিত্তের পদ গ্রহণ তো দূরের কথা, সে সম্পর্কে কোন ভাবনাকেও স্থান দিতে আমি রাজী নই। আর ইসলামী মহিলা সংস্থা এবং পত্রিকা সম্পর্কে এতটুকুই বলবো যে, আমি ওসবকে আল্লাহ্র কাছে সোপর্দ করে রেখেছি। তাছাড়া, মুসলমানদের জন্যে কোন সংস্থা বা পত্রিকার অনুসরণ জরুরী নয় বরং “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র ঝান্দাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করাই প্রত্যেকের জন্য ফরজ”।সে মাঝখানে প্রশ্ন করলো-
:তাহলে জয়নব, তুমি ইখওয়ানুল মুসলিমুন পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিলে কেন?” আমি বললাম-
“আসলে আমার কাজের ধরণটাই আলাদা। যেমন,আমি মনে করি ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী মহিলা সংস্থা কখনও ভেঙ্গে যায়নি। অথচ জামাল নাসের মনে করেছে সংস্থার সব সম্পত্তি এবং সদর দপ্তর দখল করে সংস্থাকে কার্যকরী ভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। এটা তার ভুল ধারণা। বস্তুতঃআমাদের সাফল্য বা ব্যর্থতা আল্লাহ্র মর্জির উপরই নির্ভরশীল। আর তুমি তো শুনেই থাকবে সে প্রবাদ বাক্য-রাখে খোদা মারে কে? এভাবে ইখওয়ান বা মুসলিম মহিলা সংগঠন ভাঙ্গেনি। আল্লাহ্র দ্বীনের কাজে তার নিজ পথে স্বাভাবিক ভাবেই অব্যাহত রয়েছে। সত্য সদা টিকে থাকবে। জামাল নাসেরদের সরকার এবং ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী কিন্তু আল্লাহ্র দ্বীন, আল্লাহ্র শাসন চিরস্থায়ী। আমারা তো আমাদের পথে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করব। কিন্তু সরকার তার অবৈধ কার্যকলাপের জন্যে শিগগীরই তিক্ত পরিণামের সম্মুখীন হবে”।
“নিঃসন্দেহে আল্লাহ্র দ্বীন প্রতিষ্ঠিত থাকবে আর এর খেদমতে নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদদের গতিরোধ করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয় এবং এরই মধ্যে আল্লাহ্র সিদ্ধান্ত কার্যকরী হবে। আমি আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করি যে, তিনি যেন আমাকে সত্যের স্বপক্ষে এবং মিথ্যের বিপক্ষে রাখেন এবং সত্যপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত করেন। ন্যায় ও সত্যের পক্ষে এবং বাতিল ও মিথ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, তারা হচ্ছে রাসূলের যথার্থ প্রতিনিধি। আর এরাই ইসলামের নবীন কর্ণধার। তোমাদের জানা উচিৎ যে, হাসানুল বান্না বিনা চিন্তা ভাবনাতেই ইখওয়ানের ভিত্তি স্থাপন করেননি। বরং তিনি এর মাধ্যমে দ্বীন প্রতিষ্ঠা তথা আল্লাহ্র শাসন কায়েম করার জন্যে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তাছাড়া এমন এক মহান আন্দোলনের উপর বিধিনিষেধ আরোপের ক্ষমতা জামাল নাসেরকে কে দিয়েছে?
এ-ই বলে আমি চুপ করলাম। সে বলল-
:সত্যিই তুমি চমৎকার বক্তৃতা করতে পার। কিন্তু এখন আমি তোমার কাছে এজন্য আসিনি যে, তুমি আমাকে ইখওয়ান সম্পর্কে বক্তৃতা শোনাবে। আমি তোমার কাছে ইখওয়ান হতে আসিনি, বরং এসেছি তোমাকে কারাগারের আযাব থেকে মুক্ত করানোর জন্যে একটা পারস্পরিক সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা চালাতে। সব ইখওয়ান তোমাকে দোষী করছে। আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল বলছে, তুমিই তাকে উস্কিয়ে সশস্ত্র করেছ; হুজায়বী সাহেবও নিজেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্য সব দোষ তোমার কাঁধে চাপিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তুমিই নতুন সংগঠনের বুনিয়াদ স্থাপন করেছ। সাইয়েদ কুতুবও তোমার উপর দোষ চাপিয়ে রেহাই পেয়েছেন। তা তুমি কি সুস্থ আছ, না পাগল হয়ে গেছ? জামাল নাসের স্বয়ং তোমাকে বাঁচাতে চাচ্ছেন। আজ সারা দেশ জামাল নাসেরের হাতের মুঠোয়। জামাল নাসের তোমার অতীতকে ক্ষমা করে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় রচনা করতে আগ্রহী। তিনি ভাল করেই জানেন যে, তুমিই কত বড় বাগ্মী এবং জনসাধারণ তোমাকে কতো বেশী ভালোবাসে। ………জয়নব, এখন লাভ-ক্ষতির চাবিকাঠি তোমার হাতে। -বলতো আজকের মিশরে এমন কোন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে কি, যার সাথে জামাল নাসের নিজেই ঘনিষ্ঠ হতে চায় সে ব্যক্তি তাতে অস্বীকৃতি জানায়। আমার তো মনে হয়, তুমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছ। -আমি তোমার কল্যাণকামী বলে এ সব কথা খোলাখুলি বলছি। মুক্তি পেয়ে তুমি সারা জীবন এতীম বিধবাদের সেবা এবং অন্যান্য সৎকর্মে লাগতে পারবে।
-বুদ্ধির সাহায্যে কাজ কর জয়নব! নিজের পরিবারবর্গের মর্যাদার কথা খেয়াল রেখ এবং আমার প্রস্তাবে সায় দাও”-
অবশেষে আমি তাকে বললাম-
তোমার সব কথা কি শেষ হয়েছে?” সে বলল-
দেখ,আমাকে শুধু এতটুকু কথা বলে দাও যে, ইখওয়ানেরা কারা কারা তোমার বাড়ীতে যাতায়াত করতো এবং কিভাবে তারা নাসেরকে হত্যা করতে চেয়েছিল? আর হ্যাঁ, প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার জন্যে তুমি হুজায়বী থেকে নির্দেশ কবে নিয়েছিলে? সাইয়েদ কুতুবের অভিমতও আমি জানতে চাই। কিভাবে পরিকল্পনা তৈরি হয় এবং তার বিস্তারিত বিবরণও জানতে চাই। আমি আরেকবার তোমার কাছে জামাল আবুদন নাসেরের মাথায় দিব্যি দিয়ে বলছি যে, আজ রাতেই তোমাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হবে এবং শীগ্রই তোমাকে সমাজ কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী নিয়োগ করা হবে। এই সুযোগ নষ্ট করো না। আমি তোমার কাছে আমার প্রেসিডেন্টের মর্যাদার শপথ করেছি, এতএব বুদ্ধিমানের মত কাজ কর এবং নিজের স্বার্থ চিন্তা কর। সব ইখওয়ান এখন কেবল নিজের স্বার্থেই চিন্তিত” এর মধ্যে লম্বা এক ব্যক্তি এসে বলল-
কর্নেল সাহেব! আমরা জয়নবের নয়া মিশরস্থ বাসভবন থেকে সব ক্যাসেট বাজেয়াপ্ত করে এনেছি। আপনার অনুমতি পেলে ওসব শোনানোর ব্যবস্থা করতে পারি।
“কর্নেল এ ব্যাপারে পরে কথা বলবে বলে লোকটিকে বাইরে যেতে বলে। এরপর আমাকে সম্বোধন করে আবার বলতে লাগল-
দেখ জয়নব, আমি জানি যে তোমার স্বামী একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। তোমার জন্যে আমি তাঁকেও খুব শ্রদ্ধা করি। তাছাড়া তোমার ভাইও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু!…… বিশ্বাস কর, আমি এবং প্রেসিডেন্ট নিজেই তোমার সাথে মৈত্রী সম্পর্ক কায়েমে আগ্রহী……আমি শপথ করে বলছি তোমার সাথে আপোষে আসার পর মুহূর্তে এসব ক্যাসেট আমি নিজ হাতে জালিয়ে দেব। …… ইখওয়ানরা তোমাকে যে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে, আমরা তোমাকে তা থেকে মুক্ত করতে চাই। আল্লাহ্র শপথ, আমরাও ভাল মুসলমান। ইসলাম কি? ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে মানুষ তার ভাইয়ের ক্ষতি করবে না”।
আমি তার কথাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করি-
“তুমি যে খোদাকে সাক্ষ্য মানছ, সে খোদার শপথ করে বলতো তোমাদের অত্যাচারের ফলে তোমাদের ভাইয়েরা এবং অন্যান্য লোকেরা কি ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি?”
সে বিষয়ে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে বললো-
“সত্যি আমরাও ভাল মানুষ! আমাদের সাথে সমঝোতায় এলে তুমি নিজেই সব দেখতে পাবে যে, আমরা কত ভাল”।
আমি বললাম-
“আল্লাহ্র কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তোমাদেরকে তওবা করার তাওফীক দেন এবং তোমরা সত্যিকার অর্থে মুসলমান হয়ে যাও”।
এরপর সে তার ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে জিজ্ঞেস করল-
“জয়নব তুমি এখন আমাকে বলবে কি যে, তোমার কাছে কোন ব্যক্তি যাতায়াত করতো?” আমি বললাম-
:কোন ব্যক্তি বিশেষের নাম আমার মনে নেই। আসলে লোকদের নাম আমার মনে থাকেনা, আর কারও নাম জিজ্ঞেস করাটা আমার স্বভাব নয়।
:ঠিক আছে, তাহলে আপাততঃআমরা এ নিয়ে আলাপ করছিনা। চল,হুজায়বী সাহেব এবং সাইয়েদ কুতুব সম্পর্কে আলোচনা করা যাক, সে বললো-
আমি জিজ্ঞেস করলাম-
:এটা আবার কোন ধরনের ব্যাপার? সে বলল জামাল নাসেরকে হত্যা করে সরকার দখল করার প্রচেষ্টা সংক্রান্ত ব্যাপার।
আমি বললাম-
:দেখুন জনাব! আবদুন নাসেরকে হত্যা করা নিতান্তই একটা বাজে কাজ। কোন মুসলমানই এমন বাজে কাজ করার কথা ভাবতে পারে না। আসলে প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে ইসলাম নিয়ে। আমাদের দেশে ইসলাম কায়েম নেই। তাই আমরা ইসলামী আদর্শের প্রতিষ্ঠা এবং এ উদ্দেশ্য নবীন বংশধরদের প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। অথচ জামাল নাসের এবং তার লোকেরা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছি। সে ইসলামের আলোকে সরকার পরিচালনা করতে অস্বীকার করছে। আর প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছে, ইসলাম নাকি সেকেলে এবং যারা ইসলামের কথা বলে, সে তাদেরকে সাম্প্রদায়িকতা বলে অভিযুক্ত করছে। নাসেরের এসব বাজে কথায় তোমাদেরকে মনে কি কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়না?
একথা শুনে সে বললো-
:তুমি পাগলই বটে! জান, তোমাকে খুন করে যদি এখানে পুঁতে রাখি, তাহলেও কেউ জানতে পারবে না; বরং তুমি এরই উপযুক্ত। আমি যদি তোমাকে এক্ষণি ছেড়ে দেই তাহলে এক ঘণ্টার মধ্যেই তোমাকে খুন করে দেয়া হবে।
আমি শান্তভাবে বললাম-
আল্লাহ্ যা চান, তাই করেন…… আমি এই বাক্যটুকু পুরো করার সাথে সাথেই সে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে আমাকে গালি দিতে শুরু করল এবং এক সিপাহীকে ইঙ্গিত করে রিয়াজ ইব্রাহীমকে ডেকে পাঠালো। রিয়াজ এলে তাকে বলা হয়-
:এসব টেপ ও ক্যাসেট আদালতে পেশ করার জন্যে রেখে দিও।
……এ হচ্ছে আস্ত পাগলি। ……তোমরা এর ব্যাপারে নিজেদের কর্তব্য পালন করে যাবে। এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য সা’দকে ডেকে দাও। কয়েক মুহূর্ত পরে সা’দ এসে তাকে স্যালুট করে দাঁড়াল। সে সা’দকে বলল-
:তুমি একে ঠিক করে দাও সা’দ।
:কি পরিমাণ চাবুক মারব, পাশা? সা’দ তাকে জিজ্ঞেস করল।
:পাঁচশো চাবুক। আমি একটু পরেই ফিরে আসছি।
হুকুম পাওয়ার সাথে সাথেই সা’দ চাবুক লাগাতে শুরু করে দেয়। আমার সারা গায়ে চাবুক মেরে সে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন আমাকে সে অবস্থাতেই দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে ক্ষণিকের জন্যে বাইরে চলে যায়। তারপর আবার নতুন উদ্দীপনায় আমার উপর চাবুক মারতে শুরু করে। এরপর ইখওয়ানের কয়েকজন যুবক কর্মীকে এনে নির্মমভাবে পিটাতে শুরু করে এবং আমাকে বিশ্রী গালি দেয়ার জন্যে তাদের বলতে থাকে। কিন্তু সত্যের সৈনিক ইখওয়ানদের মুখে গালি উচ্চারণ করা যখন সম্ভব হয়নি তখন তাদেরকে আরো বেদম প্রহার করা হয়। এ সব যুবক কর্মীদের মিশরীয় বিমানের পাইলট জিয়া তুয়াইজীও ছিল। তাকে বিয়ের পোশাক পরিহিত অবস্থায় বিয়ের আসর থেকেই গ্রেফতার করে আনা হয়।
এবার হামজার পালা
আমাকে এবং ইখওয়ানের যুবক কর্মীদেরকে খুব মারধর করার পর আমাকে আবার জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। নির্দিষ্ট সেলের কাছে নিয়ে গিয়ে সা’দ আমাকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রাখে। প্রচণ্ড শীত পড়ছিল তখন উন্মুক্ত স্থানে হিমেল বাতাসে আমার সারা শরীর জমে বরফে পরিণত হচ্ছিল যেন। এর উপর চাবুকের ঘায়ে ব্যাথার যন্ত্রণা। ক্ষতস্থান থেকে প্রবাহমান রক্ত জমে শক্ত হয়ে যায়। এমন অসহ্য অবস্থায় রিয়াজকে নিয়ে সেখানে হামজা বিসিউবি এলো। রিয়াজ এসেই বলল-
“এই মেয়ে! বুঝে-সুঝে কাজ কর। নিজের মঙ্গল নিজে ভেবে নে। এতে তোরই ভাল ……। হামজা পাশা, তুমি একে বুঝাও”। এবার হামজা তার বক্তৃতা শুরু করল-
“জয়নব! জ্ঞানবুদ্ধিকে কাজে লাগাও। বোকামির পরিচয় দিওনা। অন্যান্য সব ইখওয়ানের মত তুমিও তোমার ভুল স্বীকার করে নিচ্ছনা কেন?
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
“কি ভুল করেছি যে, তা স্বীকার করবো?দেখ, আমরা নবীন বংশধরদের মধ্যে তওহীদের শিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্য সংগঠিত হয়েছিলাম”
আমার কথা শুনে হামজা সাফওয়াতের দিকে তাকাল। সাফওয়াত ইতিমধ্যেই তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে সাফওয়াতকে বলল-
“আমার জন্যে এবং এর জন্যে দু’খানা চেয়ার আন। এর স্বামী আমার বন্ধু। এ জন্যেই আমি একে বুঝাবার এত কসরৎ করছি”। চেয়ার আনা হলে সে আমাকে বসতে বলল।
কিভাবে আলোচনা শুরু করবে সে ভাবতে লাগল। এবার সে আমার স্বামীর সাথে তার বন্ধুত্তের বানোয়াট কাহিনী এবং সে সুবাদে আমার প্রতি তার সহানুভূতি প্রকাশের চেষ্টা করে। আমি বসতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু চাবুকের আঘাতে শরীরের যা অবস্থা, তাতে বসতেই পারছিলাম না। খুব ব্যাথা পাচ্ছিলাম।
হামজা আমাকে আবার বসতে বলল। আমি তাকে বললাম-
“আমার পক্ষে এখন বসা সম্ভব হচ্ছে না। আমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলতে এবং শুনতে দাও”।
সে কথা শুরু করলো এভাবে-
“তুমি নিজের উপর নিজেই জুলুম করেছে। তোমরা চেহারা ভেঙ্গে ম্লান হয়ে গেছে। পা দু’টো বন মানুষের পায়ের রুপ ধারণ করেছে। তোমার স্বামী তোমাকে এ অবস্থায় দেখলে কি-ই না দুঃখ পাবেন। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি ষাট বছরের বুড়ী। তোমার স্বামী আমার বন্ধু। তোমাকে এ অবস্থায় দেখে আমি খুবই দুঃখ পাচ্ছি। তোমার হাত দুটোর দিকে চেয়ে দেখতো……যেন শ্রমিক মজুরের হাত”।
সাফওয়াত পেছন থেকে টিপ্পনী কেটে বলল বলল-
“পাশা! তুমি বলছ এক ষাট বছরের বুড়ী আর আমার মনে হচ্ছে এক’শ কুড়ি বছরের বুড়ী। দেখ তার চেহারা-সুরত পর্যন্ত বিগড়ে গেছে। তার স্বামী তো আজকাল তার নাম শুনে গালি দেয় এবং শিগগীরই একে ছেড়ে দেবে এবং যেকোনো দিক ডাকযোগে তালাকনামা পাঠিয়ে দিবে।
এসব কথায় কোন মন্তব্য না করে হামজা আমাকে সম্বোধন করে বলল-
“তুমি আমার সামনে এক চ্যালেঞ্জ খাড়া করে রেখেছ। আমি তোমাকে বর্তমান দুরবস্থা থেকে মুক্তি দিতে চাই। বিশ্বাস কর, আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী”।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওর প্রতি ঘৃণা মিশ্রিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। সে আমার নীরব ঘৃণা প্রকাশ বুঝতে পারছিল কিনা জানিনা। তবে আমার মতে সে ছিল এক নম্বর কাপুরুষ।
সে যখন আমাকে ধমক দিয়ে কথা বলতো তখন মনে হতো; আমাকে ভয় দেখিয়ে সে নিজের ভয় লুকানোরই চেষ্টা করছে। বস্তুতঃ আমার অবিচলতায় তারা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।
সে হঠাৎ বন্য জন্তুর মত গর্জন করে আমাকে শায়েস্তা করার আদেশ দিল সাফওয়াকে। আমি তৎক্ষণাৎ দেয়ালের দিকে মুখ করে হাত দু’টো দেয়ালের সাথে উঁচু করে তুলে দেই। এরপর সাফওয়াতের হাতের হান্টার আমার আগের ক্ষত-বিক্ষত পিঠের উপর নাচতে লাগল। সে সা’দ নামক আরো একজন সিপাহীকে ডেকে আমার পাশে দাঁড় করিয়ে দেয়। তার হাতেও হান্টার। আরও একজন সিপাহী জয়তুন তেলে ভেজানো হান্টারের একটি ভাঁড় এনে আমার সামনে রেখে দিল। নিষ্ঠুর সা’দ গরম জয়তুনে সিদ্ধ সেসব হান্টারের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। এরপর আরো ডজন খানেক সিপাহী এসে গরম তেলে সিদ্ধ এক একটি হান্টার হাতে নিয়ে তা বাতাসে দুলিয়ে আমাকে কুৎসিত গালাগালি দিতে লাগল।
কিন্তু আমি ওদের প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে তাদের কোন গুরুত্ত না দিয়ে, আল্লাহ্র জিকিরে মশগুল থাকি। আমি পবিত্র কুরআনের সেই আয়াতই বারবার পাঠ করছিলাম-
(সত্যিকার ঈমানদার তারা) যাদেরকে বলা হয় তোমাদের বিরুদ্ধে লোকেরা সংঘবদ্ধ হয়েছে;সুতরাং তোমার তাদেরকে ভয় করো। একথা শুনে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা বলে উঠে “হাসবুনাল্লাহ ওয়া নে’মাল ওয়াকীল”- আল্লাহ্ই আমাদের জন্যে যথেষ্ট আর তিনিই তো সর্বোত্তম অভিবাবক”।
একটু পরেই পাষণ্ড রুবী এসে আস্ফালন করতে করতে বলল-
“তোমরা সব……বেরিয়ে যাও অপেক্ষা কর……।আমি আজ রাতের জন্য এর হত্যা মুলতবী করছি”।
এরপর আমার হাত ধরে টেনে হেঁচড়ে সেলে দিকে নিয়ে যায়।
সেলে প্রত্যাবর্তন
দরজা খুললে সেলে ঢুকে দেখি আলীয়া ও গা’দ আম্মার ঘুমোচ্ছে। আমার আসার শব্দ পেয়ে উভয়েই জেগে উঠে আমার পা বেয়ে রক্ত গড়াতে দেখে ভীষণভাবে ঘাবড়ে যায়। আমি তাদের ঘুমিয়ে পড়তে বলি এবং নিজে প্রিয় নবীর সেই হাদীস আবৃত্তি করতে থাকি-
আল্লাহ্র নামে শুরু করছি। আল্লাহ্র মহান ইজ্জত ও অসীম কুদরতে আমার সামনে-পেছনের সব কিছুর অনিষ্ট থেকে তাঁর হুকুমে পানাহ চাই”।
এভাবে দু’রাত কেটে যায়। কিন্তু যন্ত্রণার উপশম হয় না। আমি আলীয়া ও গা’দার চোখ থেকে চাবুকের চোট লুকানোর জন্যে সারা শরীর ঢেকে রাখি। ওরা সে রাতের ঘটনা জানার জন্যে পীড়াপীড়ি করছিল। দ্বিতীয় দ্বীন গা’দা সেদিনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে গেলে আলীয়া তাকে চুপ করিয়ে দেয়। গা’দার প্রশ্নে কোন নতুন প্রস্তাবের ইঙ্গিত পেয়ে আমিও চুপ করে থাকি।
দ্বিতীয় রজনী
এশার নামাজের পর সেলের দরজা খুলে সাফওয়াত তার ভয়ঙ্কর রুপ নিয়ে প্রবেশ করে। সে তার স্বভাবগত কঠোরতার স্বরে বলল-
“এই মেয়ে, জয়নব- এই বলে আমার হাত ধরে টানতে টানতে বলল চল-। আমাকে ধাক্কা মেরে-মেরে সে পথ চলছিল। পথে এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হলো’সে বলল-
“সাফওয়াত, খলীল তোমার অপেক্ষায় রয়েছে”। সাফওয়াত আমার প্রতি গালি ছুঁড়ে বলল-
“একে ওর কাছেই তো নিয়ে যাচ্ছি”।
সে ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল-
“এ-ই কি জয়নব আল-গাজালী?”
সাফওয়াত গালি দিয়ে বলল-
“হ্যাঁ এ-ই হচ্ছে জয়নব আল-গাজালী”। একটু পরেই আমাকে এক কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। টেবিলের ওপাশে বীভৎস চেহারার এক ব্যক্তি বসেছিল। আমাকে দেখা মাত্রই সে জীনগ্রস্থ রোগীর মতো প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। এরপর কক্ষময় টহল দিতে দিতে সাফওয়াতকে বলল-
“যাও ওকে ডেকে নিয়ে এস”।
সাফওয়াত এক লোককে নিয়ে প্রবেশ করল। সে এসেই চেয়ারে বসে আমাকে জিজ্ঞেস করল-
এই বুড়ী! তুই কে?
:জয়নব আল গাজালী-জবাব দিলাম।
সে জিজ্ঞেস করল-
:তুমি এখানে কেন?
:আমি তার কি জানি-বললাম……
সে বলল-
: তোমার জানা উচিৎ যে, তুমি হুজায়বী, সাইয়েদ কুতুব এবং আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল মিলে প্রেসিডেন্ট নাসেরকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়েছিলে বলে আজ তুমি এখানে-
আমি দৃঢ়তার সাথে প্রতিবাদ করে বললাম-
:এসব মিথ্যে অপবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়।
সে বলল-
:সাবধানে কথা বল। আজ রাতে আর মারধোর নয় একবারে খুন…তুমি জান না, আমি কে? আমি সামরিক কারাগারের জানোয়ার, কথা বুঝেছ?
আমি বললাম-
:কারাগারে আসা পর্যন্ত জানোয়ার আর কুকুর ছাড়া কোন মানুষের সাক্ষাৎ পাইনি। অবশ্য নির্যাতিত ইখওয়ানদের কথা আলাদা। জনগণের প্রিয় নেতারা এখানে জানোয়ার এবং কুকুরের হাতে নির্মমভাবে লাঞ্চিত-নিপীড়িত হচ্ছে।
সে ব্যক্তি হটাৎ লাফিয়ে উঠে আমাকে জোরে লাথি মারে এবং দু’হাতে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে অবিরাম লাথি মারতে থাকে। এই অতর্কিত হামলায় আমি প্রায় অচেতন হয়ে পড়ি। সে নিজেও হাফাচ্ছিল। সে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল-
:আমি দার্শনিক সুলভ কথা শুনতে চাইনা- ঠিক মতো কথা বলবে। এই বলে সে আমার গালে জোরে এক চড় বসিয়ে দেয়।
সাফওয়াত দু’হাতে আমাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিল। এরপর দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় এক ব্যক্তি এসে বলল-
:হে জয়নব, এসব কি করছ তুমি? তুমি লোকদের অপমানিত করছো, উপহাস করছো? জান, প্রেসিডেন্ট খুব উদারমনা লোক। তিনি তোমার মঙ্গল কামনা করেন। আমরা তোমাকে মামলায় রাজসাক্ষী বানাতে চাই। ইখওয়ানের সাথে মিলে তুমি যে পরিকল্পনা গ্রহন করেছিলে, আমরা তোমার উপর থেকে সে অভিযোগ তুলে নেব।
আমি বললাম-
:অপরাধ ইখওয়ানুল মুসলিমুন বা আমার নয়। বরং তোমরাই অপরাধী। একটি মুসলিম দেশের উপর জবরদস্তী শাসন চালানোর দায়ে অপরাধী।
সে বলল-
:তুমি হয় পাগল- নয়তো হতে পারে তোমার মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। যাই হোক, আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি। তবে এমন এক ব্যক্তিকে পাঠাবো, যে এটা ভালো করেই জানে যে, তোমার সাথে কিভাবে সমঝোতায় পৌঁছানো যাবে।
সে চলে গেলে আমি আল্লাহ্র শোকর আদায় করি। সে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকার জন্যে বাধ্য করে যায়নি।
আমি অত্যন্ত ক্লান্তিবোধ করছিলাম।
একটু পরে এক ব্যক্তি চাবুক হাতে ভেতরে এসে আমাকে দাঁড়াতে বলে, আমার নাম জিজ্ঞেস করল। আমি স্বাভাবিকভাবে বললাম-
:জয়নব আল-গাজালী।
সে বলল
:রে-হতভাগী মেয়ে! আজ তোর জীবনের শেষ রাত। তোর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি এখানেই থাকবো।
এমন সময় আরেক ব্যক্তি এসে প্রথম জনকে বলল-
:তুমি যাও। আমি কিছুক্ষণের জন্যে এর কাছে আছি। এই মেয়ে অনেক সৎকাজ করেছে জীবনে। কিন্তু অবশেষে ইখওয়ানের পাল্লায় পড়ে এতবড় বিপদের সম্মুখীন হয়েছে আজ।
প্রথম জন বিস্ময়ের সাথে বলল-
:সত্যি! এ জীবনে ভালো কাজও করেছে?
কিন্তু যাই হোক, তার জীবনের আর সামান্য সময়ই অবশিষ্ট আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওকে খুন করা হবে।
দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল –
:তুমি যাও তো। আমি দেখি ওর সাথে কোন মীমাংসায় আসতে পারি কিনা! তা তোমরা ওর কাছে থেকে কি আশা কর?
প্রথম জন বলল-
:প্রেসিডেন্ট এবং তার উপদেষ্টা উভয়েরই ইচ্ছে হচ্ছে যে, ও মামলায় রাজসাক্ষী হোক এবং ইখওয়ানের বিরুদ্ধে বিবৃতি দান করুক। ইখওয়ানরা ইতিমধ্যেই তাদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। এই বলে প্রথম জন চলে গেল।
এবার দ্বিতীয় জন আমার প্রতি কৃত্রিম সহানুভূতি প্রকাশ করে বলল-
:জয়নব, তুমি নিজের সাথে অবিচার করছ কেন? তোমার পরিচ্ছদ ছিঁড়ে পেঁজা পেঁজা হয়ে গেছে।
এরপর সে টেবিলের উপর বসে বলল-
:তুমি তোমার সব জ্ঞানবুদ্ধি একত্রিত করে শোন এবং আমার এক একটি প্রশ্নের জবাব দাও।
আমাকে নীরব দেখে সে আবার বলল-
:আমি আজ সকালে তোমার ভাই আবদুল মোমেন ও সাইফ এবং তোমার স্বামীর সাথে সাক্ষাৎ করেছি। তোমার স্বামী সত্যিই খুব ভাল মানুষ। কিন্তু তুমি তার জন্যে অসুবিধার সৃষ্টি করেছ। আমি তোমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে আগ্রহী। আর এর জন্যে তোমাকে শুধু রাজসাক্ষী হতে হবে। এটা খুবই সহজ পথ।
এরপর সাফওয়াতকে ডেকে বলল-
:এর ঘুমানো এবং আরামের প্রয়োজন। একে সেলে রেখে এসো।
আমাকে বলল-
:আর হ্যাঁ! আগামীকাল আবার সাক্ষাৎ হবে; তুমি খুব ভেবে চিন্তে এসো।
সংক্ষিপ্ত বিশ্রাম
আমি যখন সেলে পৌঁছাই তখন আলীয়া ও গা’দা ঘুমুচ্ছিল। আমার আসার শব্দ পেয়ে আলীয়া জেগে উঠল। সে ঘুমে জড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করল-
:আপনি এসে গেছেন আলহাজ্বা!
:আলহামদুলিল্লাহ। -আমি জবাব দিলাম। আমি ঘুমুতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু ঘুম এলো না। এরই মধ্যে ফজরের আযান হলো। আমরা সবাই মিলে জামায়াতে নামাজ আদায় করলাম। নামাজের পর গা’দা রাত্রির দুরবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে আমি তাকে বললাম-
:আল্লাহ্র কাছে দোয়া কর যেন তিনি আমাকে সত্যের পথে প্রতিষ্ঠিত রাখেন। ওরা আমাকে নতুন পরীক্ষার সম্মুখীন করতে চাচ্ছে। তারা আমার কাছে অসম্ভব কাজ আদায় করার দাবী করছে।
:আল্লাহ্ আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করবেন। কিন্তু গা’দা রাতের ব্যাপারে জানার জন্যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলো। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত এবং যন্ত্রণাপীড়িত ছিলাম বলে ওকে কিছু জানাতে পারলাম না। আমি মনে মনে পরবর্তী রাতের অবস্থার মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আলীয়া অবস্থার গুরুত্ব অনুভব করছিল। সে গা’দাকে চুপ করিয়ে রাখলো। এভাবে কোন রকমে সেদিন কেটে গেল।
জুলুমের রাত
শেষ পর্যন্ত যে আশঙ্কায় ছিলাম, সেই রাত এলো। আলীয়া এবং গা’দা আম্মার আমার জন্যে এবং সব ইখওয়ানদের মঙ্গল ও মুক্তির জন্যে আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করলো। দরজা খুলে সাফওয়াতের সাথে এক নতুন লোক এলো। আমাকে নিয়ে এক কক্ষে প্রবেশ করে নতুন লোকটি সাফওয়াতকে চলে যাবার আদেশ নিয়ে আমাকে একটি চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করে বলল-
:জয়নব! যারা তোমাকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্যে এসেছিল তাদের প্রত্যেককে তুমি নিরাশ করে ফিরিয়ে দিয়েছ। আজ আমিও তোমার কাছে উপস্থিত হয়েছি! আমি আশা করি, আমাদের প্রভূ আমাকে সাহায্য করবেন এবং তোমাকেও আল্লাহ্ সঠিক পথের সন্ধান দেবেন। আর তুমি ইখওয়ানের পক্ষে কথা বলার চেয়ে আশা করি এদিকেই মনোযোগ দেবে যে,ওরা তোমাকে বিভ্রান্ত করে এই নাজুক অবস্থায় টেনে এনেছে। তুমি ওদের ব্যাপারে প্রতারিত হয়েছ। ভেবে দেখতো; তারা সত্যি-সত্যিই কি ইসলামী আদর্শের বাস্তবায়ন চায়? নাকি ক্ষমতা লাভের জন্যে ইসলামের নাম ব্যবহার করছে। আমরা চাই, তুমি আমাদের ব্যাপারে উদার দৃষ্টিকোণ গ্রহণ কর। জনাব হুজায়বী, তোমার ব্যাপারে এমন সব কথা বলেছেন, যার ভিত্তিতে তোমার ফাঁসীর শাস্তিও হতে পারে। সাইয়েদ কুতুবও জনাব হুজায়বীর মতের সমর্থন করেছেন আমরা অবশ্য তাঁদের কথা স্বীকার করি না, কারণ আমরা তোমাকে এই বিরোধ থেকে মুক্ত করতে চাই। তোমাকে সরকারের পক্ষে রাজসাক্ষী বানাতে চাই। আমরা চাই, তুমি এখন ঘরে ফিরে যাও এবং যখনই তোমার সাক্ষ্যের প্রয়োজন হবে, কাউকে পাঠিয়ে অথবা আমি নিজে গিয়ে তোমাকে আনবো। তুমি যদি এ ব্যাপারে আমার সাথে একমত হও তাহলে তোমার সাথে প্রেসিডেন্ট এবং তার উপদেষ্টার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে পারি। এছাড়া তোমার সংস্থার সদর দফতর তোমাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে অবিলম্বে প্রেসিডেন্টের আদেশ জারি করা হবে। শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট তোমাকে উচ্চতর মন্ত্রী পদে বহাল সহ দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানের ডিগ্রি ও দান করা হবে। ইখওয়ান তোমার সাথে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। তারা সব দোষের বোঝা তোমার আমার কাঁধে চাপিয়ে নিজেরা মুক্তির পথ খুঁজছে।
লোকটা এভাবে বলে যাচ্ছিল আর আমি নীরবে শুনে যাচ্ছিলাম। সে কথা বলার সাথে সাথে আমার চেহারার প্রতিক্রিয়া পাঠেরও চেষ্টা করছিল। এরপর সে টেবিলের উপর রাখা কলিং বেল টিপে সাফওয়াতকে ডাকল। এরপর আমার দিকে লক্ষ্য করে বলল-
:তুমিতো ‘কাহওয়া’(এক জাতের কফি) খাও তা তোমার জন্যে এক বাটি আনতে বলব?
আমি বললাম-
:অনেক ধন্যবাদ। আমার আপাততঃ কিছুর প্রয়োজন নেই। আমার জবাব পেয়ে সে সাফওয়াতকে তার জন্যে চা আনতে পাঠিয়ে দিয়ে বলল-
:জয়নব, আমি তোমাকে কাগজ কলম দিচ্ছি। যেসব ব্যাপারে আমরা ঐক্যমতে পৌঁছেছি সেসব কথা তুমি এতে লিখে দাও।
আমি তাজ্জব হয়ে বললাম-
:আমিতো কোন বিষয়ে আপনার সাথে একমত হইনি। আমাকে কি লিখতে হবে তাও জানিনা।
সে কাগজ-কলম দিতে গিয়ে বলল –
:তুমি এখনো তোমার স্বার্থ সম্পর্কে যথার্থ অনুমান করতে পারনি।
:তুমি এখনো তোমার স্বার্থ সম্পর্কে যথার্থ অনুমান করতে পারনি। প্রেসিডেন্ট জামাল নাসের তোমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছেন এবং তোমাকে এই মামলা থেকে উদ্ধার করতে ইচ্ছুক।
আমি জিজ্ঞেস করলাম-
:কিসের মামলা? জনসাধারণ যথার্থভাবে দ্বীনকে বোঝবার জন্যে একতাবদ্ধ হচ্ছে তার জন্যে মামলা?আসলে মামলা চালানো উচিৎ প্রেসিডেন্ট, তার উপদেষ্টা এবং সাঙ্গ-পাঙ্গদের বিরুদ্ধেই। কারণ, দেশে নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয়, অশ্লীলতার প্রসারতা এবং নাস্তিক্যবাদী চিন্তা-ধারার আমদানির জন্যে তারাই দায়ী। তারাই দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। আমাকে যদি লিখতেই হয়, তাহলে এই দরিদ্র দেশের সামগ্রিক বাস্তবতা সম্পর্কেই লিখব। যেসব সত্য আমার কাছে স্পষ্ট এবং যা আমার পর্যবেক্ষণে এসেছে, আমি তাই লিখতে পারি।
সে বলল-
:আমি জানি জয়নব, তুমি উচ্চ শিক্ষিতা মহিলা এবং তোমার প্রতিভা অনন্য; তোমার অবস্থা আরো শোচনীয় হোক আশা করি তা কামনা করবে না। এই রইলো কাগজ কলম, ভেবেচিন্তে যা তোমার জন্যে ভাল তা লিখে রেখো, আমি চললাম। আর হ্যাঁ, লিখতে গিয়ে এটা মনে রেখো যে, প্রেসিডেন্ট তোমাকে মামলা থেকে মুক্ত রাখতে চান। মামলার বিষয়বস্তু তোমার কাছে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আবার বলছি, হুজায়বী এবং সাইয়েদ কুতুব উভয়েই জামাল নাসেরের হত্যা এবং সরকার দখলের পরিকল্পনা নেয়। উভয়ের বক্তব্য মোতাবেক জয়নব আল-গাজালীই স্কীম তৈরি করে। তারা সব দোষ তোমার উপর আরোপ করে নিজেরা রেহাই চাচ্ছে। তারা বরং এও বলছে যে, এসব ঘটনাবলীর জন্যে কেবল তুমিই দায়ী এবং তোমারই কারণে তারা আজ বিপদের মুখোমুখি হয়েছে। এবার লিখ। তবে নিজের মতামত এবং তোমার ব্যাপারে ইখওয়ানদের অভিমত সম্পর্কে খুব ভেবে চিন্তে লিখ। ওরা সব কিছুর জন্যে তোমাকেই দায়ী করছে। আমাদের মতে ওরাই তোমাকে বিপথগামী করেছে এবং তোমাকে উস্কিয়ে নিজেরা পিছু হতে গেছে। বলতো এটা কি বাহাদুরী হয়েছে, নাকি কাপুরুষতা?
এরপর সে আমাকে কাগজ কলম সহ একা রেখে চলে যায়। আমি লিখতে শুরু করলাম ঠিকভাবে-
:হতভাগ্য এই কাগজ কলমের উপর শত আফসোস যে, সেলের এক নির্যাতিত কয়েদীর হাতেই তারা পড়েছে। আমরা নবীন ইখওয়ানদের সাথে ইসলামী আইন শাস্ত্র, হাদীস ও রাসূলের সুন্নাত, পবিত্র কুরআনের তাফসীর ইত্যাদিই অধ্যয়নের উদ্দেশ্য সমবেত হয়েছিলাম। ইবনে হাজমের আলমুহাল্লা, ইবনে কাইয়ুমের জাদুল মায়াদ, হাফেজ মোন্তাজারীর আততারগীব ওয়াত তারতীব এবং সাইয়েদ কুতুবের ফী যিলালিল কুরআন এবং ময়ালেমু ফিততারিক গ্রন্থাবলী পড়তাম। আমরা রাসূলে করীমের জীবনী ও সাহবীদের জীবনীগ্রন্থ পাঠ করি, ইসলামী জীবনাদর্শ কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা জানার জন্যে। এসব পাঠক্রম চলতো ইমাম হুজায়বীর অনুমতি এবং তত্ত্বাবধানে। এসব পাঠক্রমের উদ্দেশ্য ছিল নবীন বংশধরদের সৎচিন্তা ও সৎকর্মের দিকে আকৃষ্ট করা এবং সুষ্ঠু নেতৃত্বের ক্ষেত্র তৈরি করা। আমরা দুনিয়ার বুকে পুনরায় ইসলামী আদর্শ কায়েমের আশায় যথার্থ কর্মী সৃষ্টির প্রয়োজন অনুভব করি। বিস্তারিত আলোচনা পর্যালোচনা এবং চিন্তা-ভাবনার পর আমরা তরুণদের সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেই। সমাজের অশিক্ষিত এবং বিভ্রান্ত তরুণদের সুপথে আনাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যে তের সাল মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করি। এরপর আমরা সারাদেশে সমীক্ষা চালিয়ে দেখবো। যদি তাতে ইসলামী আদর্শে বিশ্ববাসীদের অনুপাত শতকরা ২৫ ভাগের কম বের হয় তাহলে আমরা আবার তের বছরের পরিকল্পনা কার্যকরী করব বলে সিদ্ধান্ত নিই। এইভাবে নিয়মতান্ত্রিক পর্যায়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় চতুর্থ বার পর্যন্ত অবস্থা দেখবো। যতদিন না দেশের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ লোক ইসলামী আদর্শের সক্রিয় সমর্থক হচ্ছে, ততদিন এইভাবে প্রশিক্ষণমূলক কাজ চলতে থাকবে। তা এতে জামাল নাসেরের ভয় পাওয়ার কি আছে? আর তোমরা যারা সরকারের সাথে জড়িত রয়েছ তোমাদেরই বা এত ভয় কিসের? আমাদের উদ্দেশ্য অর্জনের আগেই হয়তো বেশ কয়েক যুগ পেরিয়ে যাবে। তাহলে তোমাদের বুক শংকায় দুরদুরু করছে কেন? আমাদের পরিকল্পনা নাসেরকে খুন করার কোন কথাই নেই। তাকে খুন করা কোন সমস্যা নয় বরং ওর মতো অনেককে খুন করার চেয়েও বড় সমসসার সম্মুখীন গোটা জাতি। কাউকে খুন করাতো দুরের কথা কোন প্রাণীকে সামান্য আঘাত দেয়াও আমাদের কল্পনার বাইরের কথা। কিন্তু তোমরা এ ধরনের ভিত্তিহীন মিথ্যা অভিযোগ তুলে অসংখ্য মুমিন মুসলমানকে নাহক খুন করার ফন্দী আটছো। বরং তুমিই আমাকে জবাব দাও যে আমাদেরকে এভাবে নির্বিচারে আটক করে নির্যাতন করার এবং হত্যার পরিকল্পনা কার্যকরী করার হুকুম তোমাদেরকে কে দিয়েছে? তোমরা কি এসব অন্যায় অবৈধ কাজ করছ ইহুদীদের নির্দেশে, না কি সমাজতন্ত্রী শিখদন্তীদের আদেশে? মুসলমানদের ইসলামী পুনর্জাগরণ দেখে আজ নাস্তিক্যবাদী কম্যুনিস্ট সোশ্যালিস্ট এবং পাশ্চাত্যের ধর্মবৈরী খৃস্টান শোষণবাদী পুঁজিপতি এবং ইহুদীবাদীদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ইসলামী বিপ্লবের শ্লোগান তাদের রাতদিনের আরামকে হারাম করে দিয়েছে। জী হ্যাঁ! ইসলামের নাম তাদের অসহ্য। এজন্যে তারা সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ইসলামী আন্দোলনের পেছনে তাদের গোয়েন্দা বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছে এবং তারা তাদের পোষা এজেন্টদের মাধ্যমে ইসলামের মুজাহিদদের হয়রানী এবং হত্যা করার চক্রান্ত কার্যকরী করছে।
কিন্তু জেনে রেখ, আল্লাহ্ তাঁর আলোকে ছড়িয়ে দিবেন এবং অবিশ্বাসীদের অপদস্থ করবেন। আজ তোমরা যদি আমাদের হত্যা কর তাহলে আগামীকাল ইসলামের ঝাণ্ডাকে সমুন্নত রাখার জন্যে এগিয়ে আসবে লাখো মুমীনের অপ্রতিরোধ্য কাফেলা।
মুসলিম মহিলা সংস্থার পত্রিকা, সংস্থার সদর দফতর বা আমাদের চারপাশের এই গোটা পৃথিবী সম্পর্কে এইটুকু বলবো যে, আমরা কোন কিছুরই মুখাপেক্ষী নয়। আমরা শুধু আল্লাহ্র সন্তুষ্টি এবং আল্লাহ্র দুনিয়াতে আল্লাহ্রই দ্বীনের প্রতিষ্ঠা চাই। আমার বক্তব্য লিখে নীচে আমার নাম “জয়নব আল-গাজালী” সাক্ষর করি।
সাফওয়াত রুবী ভিতরে এসে লিখিত কাগজ চাইলে আমি তা তাকে দিয়ে দেই। সে তা নিয়ে বাইরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর সেই ব্যক্তি আমার কাছে এল, যে কাগজ কলম দিয়ে গিয়েছিল। ওর হাতে কয়খানা কাগজ ছিল। অবশ্য এগুলো আমার লিখিত ছিলনা। কিন্তু সে এসব কাগজকে কেটে চিরে এমনভাবে ছুঁড়ে মারলো, যেন আমাকে বুঝাতে চাচ্ছে যে, আমারই লিখিত কাগজগুলো ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে ফেলে দিয়েছে।
সে এবার সাফওয়াতকে ডেকে বলল-
:একে ধর সাফওয়াত……। এ আসলে ফাঁসিতে ঝুলারই উপযুক্ত মেয়ে, লোকেরা তাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঠিকই করেছে। আমি তার সাহায্য করতে এসেছিলাম। সে যখন আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, তাকে এখন ফাঁসিতেই ঝুলতে দাও। -এসব বলে সে ফিরে যায়। এরপর সেই সাফওয়াত আমাকে পশুর মত মারতে শুরু করলো। সে দু’হাতে আমাকে ঘুষি মারছিল আর পা দিয়ে লাথি মেরে চলছিল। ক্লান্ত হয়ে পড়লে, পরে আমাকে সেলে বন্ধ করে চলে যায়।
আমি ভেবে বিস্মিত হচ্ছিলাম যে, আমি যখন নিজের বক্তব্য মৌখিক এবং লিখিত ভাবে বার বার স্পষ্ট করে দিয়েছি তখন তারা আমার বিরুদ্ধে এবং লোভ-লালসা দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত কি আদায় করতে চায়? তাদের তো এখন বিশ্বাস করা উচিৎ যে, কোন কিছুতেই আমাকে নীতি থেকে টলানো যাবে না। নাকি, তারা পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি মোতাবেক আমাকে হত্যা করে স্বস্তি পেতে চাচ্ছে। আমি তো সবকিছু একাধিকবার স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছি, কিছুই তো গোপন নেই, সব স্পষ্ট এবং সব কিছুরই ব্যাখ্যাসহ বর্ণনা করা হয়েছে। তাহলে এরা চায় কি?
স্যুটকেস এবং প্রেসিডেন্ট নাসেরের চিঠি
সেলের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে আমি যেন আরেক দুনিয়ায় গিয়ে পৌঁছুই। সমস্ত শরীর, প্রতিটি জোড়া এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন খসে খসে পড়ে যাচ্ছে। ব্যথা-বেদনা, জ্বালা ও যন্ত্রণায় অস্থির অবস্থা। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না। বসতে পারছি না, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা। জড় সড় হয়ে একটু শুতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ব্যথ্যা। চাবুক-হান্টার, কিল-ঘুষি এবং লাথির আঘাতে অসহ্য যন্ত্রণায় শুধু ছটফট করছিলাম। মেরে মেরে ওরা আমার গোটা শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে আর অকথ্য অশ্রাব্য গালি দিয়ে আমার আত্মাকে বিষণ্ণ করে দিয়েছে। অস্থিরতা ও যন্ত্রণায় এপাশ ওপাশ করতে করতে ফজরের আজান শোনা গেল। আলীয়া এবং গা’দা আম্মার নামাজের জন্যে জেগে উঠল। আমরা তায়াম্মুম করে নামাজ আদায় করি। আমার অবস্থা ছিল তখন সকল প্রশ্নে জবাবের মত। কি হয়েছে, কেন হয়েছে, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। আলীয়া আমাকে বলল-
:ডাক্তার আমাকে ঘুমের বড়ি দিয়েছে। আপনি নেবেন কি একটা……? আমি বললাম –
:দিতে পার। আমি ঘুমোবার উদ্দেশ্য চাইলাম। কিন্তু কোথায় ঘুম; আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ শরীর আর আহত মনের অস্থিরতায় ঘুম আসবে কোত্থেকে? একমাত্র আল্লাহ্র রহমত ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমি আল্লাহ্র নামের মধ্যেই প্রশান্তি খুঁজে পাই। এত নির্যাতনের মধ্যেও নামাজের জন্যে এবং আল্লাহ্র কুরআন পাঠের জন্যে নিজের মধ্যে এক অজানা শক্তির আভাষ পাই।
গা’দা আম্মার সেলে দেয়ালে দাগ কেটে তারিখে লিখে রাখতো। সে বলল-
:আজ আঠারই অক্টোবর। আমি বললাম-
:আল্লাহ্র ফজলে অবশিষ্ট দিনগুলোও পেরিয়ে যাবে। আলীয়া বলল-
:ইনশাআল্লাহ।
বিকেল চারটায় সেলের দরজা খুলে সাফওয়াতের সাথে দু’জন সিপাহী প্রবেশ করল। তাদের হাতে মস্তবড় এক স্যুটকেস। স্যুটকেস দেখেই তা আমি চিনে নিয়েছি। এটা আমার বাড়ী থেকেই আনা হয়েছে। সাফওয়াত স্যুটকেস খুলে একটা জিনিস বের করে দেখাতে দেখাতে বলল-
:জয়নব, এসব কাপড়-চোপড় এবং জিনিসপত্র আমরা তোমার বাড়ী থেকে আনিয়েছি এরপর সব জিনিস আবার স্যুটকেস ভরে তা বন্ধ করে রাখল। দেখে মনে হচ্ছিল, যেন আমাকে কোথাও লম্বা সফরে পাঠানো হবে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
:এসব কে আনিয়েছে এবং কে এনেছে? সাফওয়াত বলল-
:আমারাই আনিয়েছি এবং তোমার বোন হায়াত এসব এখানে পৌঁছিয়ে গেছে। এরপর সে সিপাহীদেরকে চলে যেতে বলে, একটু পরে নিজেও ফিরে যায়। জল্লাদকে আবার ফিরে আসতে দেখ বিরক্তিতে চোখ বন্ধ করে রাখি এবং হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ি। আলীয়া ও গা’দা ত্বরিত আমার হাত পায়ের তালু মালিশ করতে শুরু করল। ওদের চেষ্টায় আমার চেতনা ফিরে এলে ওরা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল-
:কিছু নয়, আলহাজ্বা! ব্যাপারটা তো খুবই সহজ! আপনার পরণের কাপড় নষ্ট হয়ে গেছে তাই হয়তো ওরা ভালো কাপড়-চোপড় আনিয়েছে। আর কোন বিশেষ কারণ নেই।
আলীয়াকে বললাম-
: এটা আসন্ন সংকটের ইঙ্গিত বহন করছে, আলীয়া!
: না আলহাজ্বা! ওরা স্রেফ আপনার প্রয়োজনের তাগিদেই এসব আনিয়ে থাকবে। -আলীয়া বলল।
আমি বললাম-
:না আলীয়া, না! এটা আরেক পরিক্ষা নয়তো! শুধু আমার কাপড়ই আনা হবে কেন? আমি তো আনতে বলিনি- আমার উপর বিরাট বিপদ আসতে যাচ্ছে……আল্লাহ্ আমাকে সত্যের উপর সুদৃঢ় রেখে বিপদমুক্ত করুন।
আমরা আসরের নামাজ আদায় করছিলাম। হটাৎ সাফওয়াত ভেতরে ঢুকে আমাকে নামাজ থেকেই ধাক্কা মেরে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল-
:আমার সাথে চল। এরপর আলীয়া ও গা’দাকে সেলে বন্ধ করে আমাকে নিয়ে চলে যায়। সে আমাকে আলাদা, এক গ্যালারীতে নিয়ে যায়। এরপর এক সংকীর্ণ অন্ধকার এবং দুর্গন্ধময় স্থানে ঠেলে দেয়া হয়। এ স্থানটি ছিল সাপ ইঁদুরের গর্তে ভরা ভীষণ ভয়ংকর স্থান। প্রচণ্ড শীত দুর্গন্ধ এবং ভয়াল নীরবতা আমাকে দারুণভাবে সন্ত্রস্ত করে তোলে। আমি অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়ে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করি এবং সংকট মোকাবিলার জন্যে তাঁর সাহায্য কামনা করি। “জেনে রেখো, আল্লাহ্র নাম জপলে, আত্মায় এক অবর্ণনীয় শক্তি ও প্রশান্তির সঞ্চার হয়।
হঠাৎ আলো দেখা দেয় এবং সাফওয়াত ভেতরে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
: নে এই চিঠি পড়ে নে।
আমি চিঠি খুলে দেখলাম ছাপার অক্ষরে লেখা-
“প্রেসিডেন্ট দফতর। এরপর টাইপের অক্ষরে লিখিত হয়েছে-
“প্রেসিডেন্ট আব্দুন নাসেরের নির্দেশে জয়নব আল-গাজালীকে পুরুষদের চেয়েও বেশী নির্যাতন এবং দুঃখময় শাস্তি দেয়া হোক”।
স্বাক্ষর
জামাল আবদুন নাসের
মিশরের প্রেসিডেন্ট।
চিঠিতে সরকারী মনোগ্রাম এবং বিশেষ প্রেসিডেন্সিয়াল সীলমোহরও অংকিত ছিল। আমি প্রেসিডেন্টের চিঠি পড়ে সাফওয়াতকে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে বলি-
: তোমাদের সবার চেয়ে আল্লাহ্ অনেক বড় এবং শক্তিশালী। আল্লাহ্ই আমাদের জন্যে যথেষ্ট।
সে আমাকে খুনী দৃষ্টিতে দেখে অকথ্য গালি দিতে দিতে সেলের দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
একটু পরেই পুনরায় সাফওয়াতের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠি;সে বলছিল-
: হুঁশিয়ার, সাবধান!
সেলের দরজা খুললে দেখলাম বিসিউনি। ভেতরে’ এসে বলল-
: আরো ভাল করে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে তোমাকে আরো এক ঘণ্টা সময় দেয়া হচ্ছে। নিজের উপকারের ব্যাপারে যথার্থ ধারণা করে নাও। প্রেসিডেন্ট জামাল নাসের এবং তাঁর উপদেষ্টা আবদুল হাকীমের সাথে সাক্ষাতের জন্যে তোমার প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় আনিয়ে রেখেছি। এরপর মামলা সম্পর্কে তোমার অভিমত পাল্টে যাবে। সাফওয়াতের দিকে চেয়ে সে বলল-
: একে প্রেসিডেন্টের চিঠি পড়ে শোনাও। সাফওয়াত চিঠিখানা আবার পড়লো।
“প্রেসিডেন্ট আবদুন নাসেরের নির্দেশে জয়নব আল-গাজালীকে পুরুষদের চেয়েও বেশী নির্যাতন এবং দুঃখময় শাস্তি দেয়া হোক”।
সাক্ষর
জামাল আবদুন নাসের
মিশরের প্রেসিডেন্ট।
হামজা, সাফওয়াতের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে আমাকে দিয়ে বলল-
: ধর পাগলী! চিঠি পড় এবং এর বিষয়বস্তু ভাল করে বুঝে নেয়ার চেষ্টা কর।
আমি বললাম-
: এ চিঠি আমি ইতিমধ্যেই পড়েছি। সে বলল-
: আবার পড়। হান্টার কোথায় সাফওয়াত? আমি চিঠি নিয়ে আবার পড়লাম। এরপর চিঠিখানা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললাম-
: পাপিষ্ঠ কাফেরের বাচ্চারা; বেরিয়ে যাও বলছি। আমার প্রভু অনেক শক্তিমান……। হামজা বিসিউনি সেলের বাইরে গিয়ে সিপাহীদের ডাকল। সিপাহীরা কাপড়ের সেই স্যুটকেস নিয়ে ভেতরে এসে চেঁচিয়ে বলল-
: আমরা তোকে আর এক ঘণ্টার সুযোগ দিচ্ছি। এ হচ্ছে তোর পোশাক-পরিচ্ছদ। নিজের ভালোর জন্যে ভেবে চিন্তে যা হয় কর। সমস্যার সমাধান এখন তোর হাতেই রয়েছে।
এরপর সেলের দ্বার বন্ধ করে ফিরে যায়। আমি আল্লাহর দরবারে দোয়া করছিলাম-
“হে পাক পরওয়ারদিগার! আমাকে শক্তি ও সাহস দাও, যেন বিপদের মোকাবেলা করতে পারি”।
এক ঘণ্টা পরই সাফওয়াতের কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা গেল-
: হুশিয়ার, সাবধান! হামজা বিসিউনি আসছেন। হামজা ভেতরে ঢুকে আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল-
: কি ব্যাপার, তুমি এখনো কাপড় পরনি। তা তুমি মৃত্যুই চাও বুঝি? আমি বললাম-
: কোন পরওয়া নেই। আমি নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছি। হামজা বলল-
: ঠিক আছে সাফওয়াত, এই মেয়ে সাইয়েদ কুতুব এবং হুজায়বীর প্রাণের বিনিময়ে নিজের প্রাণ নিবেদন করছে। ওরাতো এরই কাছ থেকে মুক্তি চায়। ওরা এখন বে-কসুর খালাস পাবে…। সাফওয়াত আমাকে কঠিন হাতে টেনে হিঁচড়ে অজানা পথের দিকে চলল। আমি গ্যালারীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উচ্চ কণ্ঠে ‘আল্লাহ্ আকবর’ ধ্বনি তুললাম। আলীয়া এবং গা’দা আম্মারকে শোনানোই ছিল আমার উদ্দেশ্য। কারণ হামজা বিসিউনির কথা মত আমি ভাবছিলাম এটাই হয়তো আমার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত।