১২
বিদ্রোহের আত্মপ্রকাশ
[প্রবন্ধটি সর্বপ্রথম ১৯৩৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তরমানুল কুরআন প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়।– সম্পাদক]
জাতি দু’শ্রেণীর লোক নিয়ে গঠিত হয়, এক শ্রেণী সাধারণ মানুষ, অপর শ্রেণী বিশিষ্ট লোক। সাধারণ শ্রেণীর লোকেরা সংখ্যায় বিপুল, আর জাতির সংখ্যাশক্তিও এদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু চিন্তা ভাবনা ও নেতৃত্ব করার মতো মস্তিষ্ক এই শ্রেণীর থাকে না। এই শ্রেণীর লোকেরা না জ্ঞান সম্পদে সমৃদ্ধ হয় আর না এদের কাছে আর্থিক শক্তি থাকে। তেমনি এরা যেমন পদমর্যাদাশীল হয় না, তেমনি রাষ্ট্রশক্তিও এদের হাতে থাকে না। এ কারণেই জাতিকে পরিচালিত করা এদের কাজ নয়, বরং চালকদের পেছনে চলাই হচ্ছে এদের কাজ। এরা নিজেরা কোন পথ রচনা বা আবিষ্কার করে না, বরং যে পথ তৈরি করে দেয়া হয়, সে পথেই এরা চলতে থাকে। পথ রচনা এবং তাতে গোটা জাতিকে পরিচালিত করা আসলে বিশিষ্ট লোকদেরই কাজ। কারণ এদের প্রতিটি কথা ও কাজের পেছনে থাকে বুদ্ধি, জ্ঞান, ধন-দৌলত, মান-ইজ্জত ও রাষ্ট্রশক্তির সমর্থন। আর জনসাধারণকে ইচ্ছায় হোক কি অনিচ্ছায়, এদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হয়। কাজেই এ কথা বললে অসঙ্গত হবে না যে, জাতির চালিকা শক্তি তার জনগণ নয়, বরং তার বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ। এদের ওপরই জাতির উত্থান-পতন ও গঠন-ভাঙ্গন নির্ভর করে। এদের সদাচরণ গোটা জাতির সদাচরণের এবং এদের পাপাচার গোটা জাতির পাপাচারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যখন কোন জাতির জীবনে সুদিন আসে, তখন তার মধ্যে এমনি অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা নিজেরা যেমন সৎপথে চলেন, গোটা জাতিকেও তেমনি সৎপথে চালিত করেনঃ
(আরবী)
অর্থঃ “আমি তাদের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করি, আর তারা আমার নির্দেশমতো পথ প্রদর্শন করে। তাদের আমি নির্দেশ প্রদান করি মঙ্গলময় কাজ করার।” (সূরা-আল আম্বিয়া, আয়াত-৭৩)
আবার যখন কোনো জাতির ধ্বংসের সময় ঘনিয়ে আসে, তখন তার বিকৃতির সূচনা হয় ঐ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা। তাদের ভ্রষ্টতা ও অনৈতিকতার ফলে অবশেষে গোটা জাতিই কদাচার ও পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েঃ
অর্থঃ “ আমরা যখন কোনো জনপদকে ধ্বংস করে দিতে চাই তখন সেখানকার দুস্কৃতকারী লোকদেরকে সীমা লংঘনের কাজে লিপ্ত করে দিই। ফলে সে জনপদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। তখন আমি তাকে সমূলে ধ্বংস করে দিই। (সূরা-ইসরা, আয়াত- ১৬)
কুরআনের ভাষায় এই বিশিষ্ট লোকদেরকে ————– বলে অভিহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা এমন লোক, যাদেরকে আল্লাহ প্রচুর অনুগ্রহ দানে ধন্য করেছেন। আল্লাহ তায়ালার সাক্ষ্য অনুযায়ী চিরদিন এমনি ঘটে আসছে যে, প্রথমে এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরাই (———) সমাজে পাপাচার, খোদাদ্রোহীতা, অত্যাচার ও অবিচার শুরু করে। অতপর গোটা জনপদই দুষ্কৃতি ও কদাচারে জড়িয়ে পড়ে।
এই সাক্ষ্যের সত্যতা সম্পর্কে কি কোনো প্রশ্নের অবকাশ আছে? খোদ আমাদের এই জাতির অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করুন; এর বিকৃতিও কি আমাদের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারাই শুরু হয়নি? এই শ্রেণীর লোকেরাই তো খোদায়ী বিধানের অনুগত পথিকৃৎদের পন্থা ছেড়ে শয়তানী পন্থার অনুসরণ শুরু করেছে। এরাই প্রবৃত্তি-পূজার খাতিরে শরীয়তের বন্ধনকে শিথিল করতে লেগেছে। এরাই ফেরাউন ও কাইজারের ন্যায় খোদার বান্দাহদের দ্বারা নিজেদের গোলামী করাতে শুরু করেছে এবং নিজ জাতিকে আল্লাহপরস্তির পরিবর্তে শাসকপরস্তির ও আমলাপরস্তিতে অভ্যস্ত করে তুলেছে। এরাই মানুষকে আল্লাহর পরিবর্তে বান্দাহর সামনে নত স্বীকার করতে শিখিয়েছে। এরাই চটকদার পোশাক ও শানদার মহলে বসে পাপাচার ও দুষ্কর্মকে চমকপ্রদ বানিয়েছে। এরাই হারাম মাল খেয়ে নিজ জাতির মধ্যে হারাম খাওয়া ও খাওয়ানোর অভ্যাস সৃষ্টি করেছে। এরাই জ্ঞান বিজ্ঞানকে ভ্রষ্টতার জন্যে, বুদ্ধিকে দুষ্কৃতির জন্যে, ধী-শক্তিকে প্রতারণা ও চক্রান্তের জন্যে, ধন-দৌলতকে ঈমান ক্রয়ের জন্যে, রাষ্ট্রশক্তিকে জুলুম নিপীড়নের জন্যে এবং শক্তিমত্তাকে দাম্ভিকতার জন্যে ব্যবহার করেছে। পরন্তু, এরাই লোকদের অধিকার, উপকার এবং উন্নতি লাভ করবার অধিকাংশ সঙ্গত পন্থা বন্ধ করে দিয়েছে এবং লোকদেরকে তোষামোদ, উৎকোচ, মিথ্যা চক্রান্ত ইত্যাকার ঘৃণ্য পথে আপন লক্ষ্য অর্জনে বাধ্য করেছে। ফলকথা, নৈতিক চরিত্র ও আচার ব্যবহারের এমন কোনো বিকৃতি নেই, যার সূচনা এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা হয়নি। তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা যে অনুগ্রহ সম্পদ দান করেছিলেন, তাকে তারা ভ্রান্তপথে ব্যবহার করেছে। তারা নিজেরা যেমন বিগড়েছে, সেই সঙ্গে গোটা জাতিকেও বিগড়ে দিয়েছে।
এই সবকিছু কয়েক শতক ধরেই ঘটে আসছিলো এবং নৈতিক বিকৃতির গুণ মুসলামানদের জাতীয় শক্তিকে ভেতরে ভেতরে খেয়ে ফেলছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও লোকদের হৃদয়ে অন্তত ঈমানের রৌশনী বর্তমান ছিল। আল্লাহ ও রসুলের নির্দেশ প্রতিপালিত না হলেও লোকদের মনে খোদা ও রসূলের শ্রেষ্ঠত্ববোধ বজায় ছিলো। ইসলামী আইনের বিরুদ্ধাচরণ যতোই করা হোক না কেন, কিন্তু সে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ লোকদের মন থেকে একেবারে তিরোহিত হয়ে যায় নি; ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি লোকদের মন যতোই অপ্রসন্ন হোক না কেনো, কিন্তু তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা মতো দুঃসাহস কখনো হয়নি; বরং ইসলাম যাকে সত্য বলেছে, তাকে সত্য বলেই স্বীকার করা হতো। তাকে বর্জন করে মিথ্যার পায়রবীতে যতোই আতিশয্য দেখানো হোক না কেনো- ইসলামের নির্দেশিত সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য, ফরয বা অবশ্য করণীয়কে বাহুল্য ও অবান্তর, বৈধকে অবৈধ, হারামকে হালাল, সৎকাজকে গুণাহ্ এবং গুণাহ্কে পুণ্যকাজ বলা বা ভাবার মতো ধৃষ্টতা কারুর মধ্যেই ছিল না। পাপাচার নিঃসন্দেহে অনুষ্ঠিত হতো। অপরাধ ও দুষ্কৃতিতে লোকেরা অবশ্যই লিপ্ত হতো। শরীয়তের সীমারেখা বহু ক্ষেত্রেই লংঘন করা হতো। কিন্তু সেই সঙ্গে লোকদের মন লজ্জাবোধও করতো। অনুশোচনায় তাদের মস্তক নুইয়ে আসতো। অন্তত হৃদয় তাদের স্বীকার করতো যে, তারা আল্লাহ ও রসূলের অবাধ্যতা করছে।
এর কারণ হলো, ঈমানের দুর্বলতা ও আচরণের বিকৃতি সত্ত্বেও মুসলামানদের সভ্যতার প্রাসাদ ইসলামের গড়া ভিত্তি-স্তম্ভের ওপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলো। গ্রীক ও ইরানী চিন্তাধারার আমদানির ফলে যদিও অনেক গোমরাহী বিস্তার লাভ করেছিলো; কিন্তু তা মুসলমানদের দৃষ্টিকোণকে একেবারে বদলে দেবার এবং তাদের মানসিক গড়নকে ইসলামের প্রতি অপ্রসন্ন করে তুলবার মতো সাফল্য কোনো দিনই লাভ করেনি। তারা মুসলমানের দৃষ্টিতে দেখা এবং মুসলমানদের মগজ দিয়ে চিন্তা করা একেবারে ছেড়ে দেবে- তাদের বুদ্ধিমত্তা, চিন্তাধারা ও বিচার শক্তিকে তা কখনোই এতোটা প্রভাবান্বিত করতে পারে নি। অনুরূপভাবে তাহযীব ও তমদ্দুনের ক্রমবিকাশ যদিও বহিরাগত প্রভাবের দরুন ইসলামের নির্ধারিত পথ থেকে অনেকটা ভিন্ন পথে হয়েছে; কিন্তু যে মূলনীতির ওপর তাহযীব ও তমদ্দুনের গোড়াপত্তন করা হয়েছিলৌ, তা যথারীতিই তার ভিত্তিমূলে বর্তমান ছিলো এবং অপর কোনো তাহযীব ও তমদ্দুনের মূলনীতি এসে তার জায়গা দখল করে নেয়নি। মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকখানি বিগড়ে গিয়েছিলো, কিন্তু তবু তার মধ্যে ধর্মতত্ত্বের বিশিষ্ট স্থান ছিলো। কোনো শিক্ষিত মুসলমান ইসলামী আকাইদ, শরয়ী বিধি-নিষেধ ও জাতীয় রীতি-নীতির অন্তত প্রাথমিক জ্ঞান সম্পর্কে অনভিজ্ঞ থাকতো না। মুসলমানদের বাস্তব জীবনে ইসলামী আইনের বন্ধন অনেকখানি শিথিল হয়ে পড়েছিলো, কিন্তু তবু তাদের গোটা বিষয়কর্মে একটিমাত্র আইন চালু ছিলো আর তা ছিলো ইসলামী আইন। ফলকথা, তামাম বিকৃতি সত্ত্বেও মুসলমানদের ধ্যান-ধারণা, স্বভাব-চরিত্র ও আচার-ব্যবহারে ইসলামের গভীর প্রভাব বর্তমান ছিলো। তার মূলনীতির প্রতি তারা একনিষ্ঠভাবে ঈমান পোষণ করতো- অন্তত তাদের ঈমানের চৌহদ্দীতে ইসলাম-বিরোধী নীতি অনুপ্রবেশ করবার সুযোগ পায় নি। তাছাড়া, স্বভাব-চরিত্র ও আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলাম যে মূল্যমান নির্ধারণ করে দিয়েছিলো, তা একবারে বিপর্যস্ত হয়ে যায় নি এবং তার বিরোধী অন্য কোন মূল্যমান কর্তৃক তার স্থান দখল করবার মতো পরিবর্তন তাতে ঘটেনি।
কিন্তু উনিশ শতকে রাষ্ট্রক্ষমতা হাতছাড়া হবার পর আমাদের জাতির বিশিষ্ট ব্যক্তিরা দেখলেন যে, রাষ্ট্রক্ষমতার সংগে পদমর্যাদা, মান সম্ভ্রম, ধন-দৌলত, সবকিছুই হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে এবং পরাধীন অবস্থায় এগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে এবং সমূহ ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে হলে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শিতা লাভ ছাড়া অন্য কোন পন্থা নেই। এ সময়ে তাদের কর্মনীতিতে আর একটি পরিবর্তন সূচিত হলো; প্রকৃত প্রস্তাবে যা শুধু পরিবর্তনই নয়; বরং একটি ‘বিপ্লব’ ছিলো। কারণ পরিবর্তনের মানে হচ্ছে বদলে যাওয়া আর বিপ্লবের অর্থ হচ্ছে ওলট-পালট হওয়া। আর প্রকৃতপক্ষে তারা এমনি ডিগবাজি খেলো যে, তাদের লক্ষ্যস্থল, মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছুই পাল্টে গেলো- যা ইসলামের ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত।
ইসলামী আইনের বিরুদ্ধাচরণকালে প্রথমদিকে যে লজ্জা ও অনুশোচনা বোধ করা হতো, এই বিপ্লবের সূচনা হবার পর তা ধীরে ধীরে বিদায় হতে লাগলো; বরং শরয়ী বিধি-ব্যবস্থা লংঘন করা তারা আদৌ কোনো গুনাহ্ ও অপরাধ করছে, এই অনুভূতিই লোপ পেতে লাগলো। তারপর ধীরে ধীরে লজ্জা ও অনুশোচনার পরিবর্তে সাহসিকতা ও নির্লজ্জতা দেখা দিলো। প্রকাশ্যে সর্ববিধ আইনের বিরুদ্ধাচরণ হতে লাগলো এবং এ ব্যাপারে লজ্জার পরিবর্তে গর্ব প্রকাশ পেতে লাগলো। কিন্তু বিপ্লবের তরঙ্গ এ পর্যন্ত এসেও ক্ষান্ত হয়নি। অধুনা পাশ্চাত্য ঘেষা মহলে যা কিছু শোনা ও দেখা যাচ্ছে, তা নির্লজ্জতাকে অতিক্রম করে ইসলামের বিরুদ্ধে স্পষ্ট বিদ্রোহের লক্ষণই প্রকাশ করছে। এক্ষণে পরিস্থিতি এই দাড়িয়েছে যে, এক ব্যক্তি ইসলামী আইনের প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ করা সত্ত্বেও নিজের অপরাধের জন্যে অনুতপ্ত হওয়া তো দুরের কথা, যে ব্যক্তি আজো ঐ পুরনো আইনটি অনুসরণ করে চলেছে, উল্টো তাকেই শরমিন্দা করার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে, ইসলামী আইন ভঙ্গকারী যেনো আজ আর অপরাধী বা গুনাকারী নয়; বরং অপরাধী হচ্ছে ইসলামের অনুসরণকারীরাই। আজকে নামাজ-রোযা শুধু পরিহারই করা হচ্ছে না, বরং এ ব্যাপারে গর্বও প্রকাশ করা হচ্ছে। সাধারণ্যে নামাজ-রোযা ত্যাগের স্বপক্ষে প্রচার চালানো হচ্ছে। যারা নামায পড়ে, কুরআন পাঠ করে ও রোযা পালন করে, তাদেরকে প্রকাশ্যে উপহাস করা হচ্ছে। পরন্তু নামায রোযা পালনকারীরা (বিশেষত তারা যদি শিক্ষিত হয়) নিজেদের কৃতকর্মের জন্য উল্টো নিজেরাই শরমিন্দা হবে- এই আশাবাদ পোষণ করা হচ্ছে। একজন লোকের পক্ষে নামায রোযা ত্যাগ করা নয়; বরং তা পালন করাকেই একটা দোষাবহ ও লজ্জাজনক কাজ বলে গণ্য করা হচ্ছে। এমনকি কোনো নামাযী যদি কোনো দূষণীয় কাজ করে বসে, তাহলে অত্যন্ত বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে বলা হয় যে, ‘লোকটা না নামাযী?’ অর্থাৎ লোকটির দোষী হবার প্রকৃত কারণ হচ্ছে এমন একটি কাজ, যাকে আল্লাহ তায়ালা পাপাচার ও অশ্লীলতার প্রতিরোধকারী বলে ঘোষণা করেছেন এবং তাঁর রসূল যাকে সবচাইতে শ্রেষ্ঠ কাজ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এই বিদ্রোহ শুধু নামায-রোযা পর্যন্তই সীমিত নয়; বরং জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এটি বিস্তার লাভ করেছে। আজকে ইসলামী বিধানের আনুগত্যকে ‘মোল্লাপানা’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। আর মোল্লাপানা’ হচ্ছে আমাদের নব্যযুগের ভাষায় সঙ্কীর্ণদৃষ্টি, অন্ধতা, মূর্খতা, সেকেলেপনা ও নির্বুদ্ধিতার এক নিকৃষ্ট মিশ্রণের নামান্তর। অর্থাৎ মতলবটা হলো এই যে, দৃঢ়প্রত্যয়ী ও শরীয়তনিষ্ঠ মুসলমানের নামই হচ্ছে ‘মোল্লা’ আর ‘মোল্লা’ হচ্ছে এমন ব্যক্তি, সভ্যতা ও আলোকপ্রাপ্তির সঙ্গে যার কোনো দূরতম সম্পর্কও থাকবে না- সভ্য সমাজেও যে ব্যক্তি কোনো মতে খাপ খাইয়ে চরতে পারবে না। এ হচ্ছে অসংখ্য গালির মধ্যে একটি মাত্র গালি। আর ঘৃণা ও অবজ্ঞা প্রকাশের জন্যে আমাদের ‘কালো ফিরিঙ্গীরা’ দেশি কতকগুলো শব্দ ব্যবহারের পরিবর্তে সকল দোষের আধার এই ‘মোল্লা’ শব্দের মধ্যেই তাদের সমস্ত ভাবালুতাকে একত্রে পুরে দিয়ে থাকে। [এই লেখা ১৯৩৪ সালের। বর্তমানে ২০০২ সাল। এরি মধ্যে খাঁটি মুসলিমদের ঘায়েল করার জন্যে আরো অনেক উপাধি তাদের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। যেমন, সন্ত্রাসী, উগ্রবাদী, মৌলবাদী, তালেবান, আল-কায়েদা ইত্যাদি।– সম্পাদক।]
আজকে কোনো কথা বা কাজের সপক্ষে এটা কোনো দলিল হিসেবেই গ্রাহ্য নয় যে, তা কুরআন ও হাদিস সম্মত। কোনো অমুসলিম নয়; বরং দূর্ভাগ্যক্রমে ‘শিক্ষিত ও আলোকপ্রাপ্ত’ বলে পরিচিত মুসলমান পর্যন্ত কুরআন ও হাদিসের প্রামাণিতাকে নিঃসঙ্কোচে উড়িয়ে দেয়। এ ব্যাপারে সে এতোটুকু লজ্জা অনুভব তো করেই না; বরং আশা করে যে ইসলামী আইনের সনদ পেশকারী উল্টো শরমিন্দা হবে। কুরআন ও হাদিসকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করা তো দূরের কথা; বরং আমাদের তো এমন অবস্থা দেখবারও সুযোগ ঘটেছে যে, কোনো বিষয়কে ইসলামের নামে পেশ করলে সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরুদ্ধে একটা বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে যায়। অথচ সেই একই বিষয়কে যুক্তি প্রমাণসহ পেশ করা হলে অথবা কোনো পাশ্চাত্য লেখকের উদ্ধৃতির সাহায্যে বর্ণনা করলে তা একেবারে নির্ভূল বনে যায়। মোটকথা ইসলামের প্রসঙ্গ উঠলেই আমাদের পাশ্চাত্য ঘেষা মুসলামানদের মনে নানারূপে শোবা সন্দেহের সৃষ্টি হতে থাকে। তাদের মনে এই সংশয় চেপে বসে যে, এর মধ্যে অবশ্যই কোনো দুর্বলতা রয়েছে। ভাবখানা এই যে, তাদের দৃষ্টিতে আজ কুরআন ও হাদিসের প্রামাণিকতা কোনো বিষয়কে শক্তিশালী করে না; বরং উল্টো তাকে আরো দুর্বল ও প্রমাণ সাপেক্ষ করে তোলে।
কয়েক বছর আগে এই ব্যাধি শুধু আমাদের পুরুষ মহলেই সীমিত ছিলো এবং মহিলা সমাজ ছিলো এর থেকে নিরাপদ। অন্তত ইসলামী সভ্যতার ব্যাপারে আমরা বলতে পারি যে, ‘অন্তপুর’ হচ্ছে তার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। এখানেই ইসলাম তার তাহযীব ও তমদ্দুনের পরিচর্যা ও নিরাপত্তা বিধান করে। ইসলাম নারীকে যেসব কারণে শরয়ী পর্দার মধ্যে রাখতে ইচ্ছুক, তার একটি বড় কারণ এই যে, যে বক্ষদেশ থেকে মুসলিম শিশু দুগ্ধ পান করে, অন্তত সে বক্ষদেশটি ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত থাকা প্রয়োজন। যে ক্রোড়ে মুসলিম শিশু প্রতিপালিত হয়, সে ক্রোড়টি অন্তত কুফর ও ভ্রষ্টতা, অনৈতিকতা ও কদাচার থেকে নিরাপদ থাকা দরকার। যে দোলনায় মুসলিম সন্তানের জীবনের প্রারম্ভিক স্তরগুলো অতিক্রান্ত হয়,তার চার পার্শ্বে অন্তত খালেস ইসলামী পরিবেশ বিরাজ করা প্রয়োজন। যে চার দেয়ালের মধ্যে মুসলিম শিশুর সরল মন-মগজে শিক্ষা-দীক্ষা ও অভিজ্ঞতা র প্রাথমিক চিত্র অঙ্কিত হয়, সেটি বহিঃপ্রভাব থেকে নিরাপদ থাকা আবশ্যক। কাজেই অন্তপুর হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে ইসলামী সভ্যতার সবচাইতে সুদৃঢ় দূর্গ। এ দূর্গটি ও বিধ্বস্ত হতে চলেছে। ফিরিঙ্গীপনার মহামারী আজ আমাদের অন্দর মহলেও দ্রুত প্রবেশ করছে। আমাদের পাশ্চাত্য ঘেষা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা আজ তাদের স্ত্রী কন্যাদের ও টেনে হিচড়ে বাইরে নিয়ে আসছে, যাতে করে তাদের ন্যায় এরাও বিষাক্ত প্রভাবে প্রভাবিত হতে পারে। আমাদের জাতির মেয়েদেরকে আজ গুমরাহী, অবিশ্বাস, অনৈতিকতা ও ফিরিঙ্গী সভ্যতা শিক্ষা গ্রহনের জন্যে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হচ্ছে, যা ইতোপূর্বেই আমাদের ছেলেদেরকে এসবকিছু শিখিয়ে ইসলামের প্রতি বিদ্রোহী করে তুলেছে।
আমাদের মতে, এই সর্বশেষ পদক্ষেপটি উপরে উল্লেখিত বিপ্লবকে পূর্ন পরিনতিতে নিয়ে পৌছাবে। এটা শুধু আমাদের অনুমানই নয়; বরং বিপ্লবের এই পূর্নতার লক্ষণ আমাদের দেখাবার ও শুনাবার মতো দুর্ভাগ্যও হয়েছে। আজকে অবস্থা এই দাড়িয়েছে যে, একজন মুসলমান নারী কুরআন ও হাদিসের স্পষ্ট বিধান অমান্য করে নির্বিবাদে আপন দেহ সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করে বেড়াচ্ছে;ইংরেজি হোটেল রেস্তোঁরায় গিয়ে ‘লাঞ্চ ও ডিনার’ খাচ্ছে, সিনেমা হলে গিয়ে পুরুষদের মাঝে উপবেশন করছে,বাজারে ঘূরে অসঙ্কোচে কেনাকাটা করছে। অধিকতর আক্ষেপের বিষয় এই যে, ইসলামী আইন ভঙ্গ করে এসকল কাজ করার দরুন লজ্জিত ও অনুতপ্ত অবার পরিবর্তে তারা আপন কার্যকলাপকে আরো গর্বের সঙ্গে বর্ণনা করছে। উপরন্তু যে বেচারী ইসলামী আইন অনুসারে প্রথমত শরীয় পর্দা বর্জনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং তারপর স্বামী কতৃক বলপূর্বক বাইরে টেনে নিয়ে আসার পর পুরুষদের মধ্যে নির্লজ্জভাবে দেহ প্রদর্শনী করতে লজ্জানুভাব করছে এবং সর্বোপরি যারা বাজারের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো, নৈশক্লাবের আনন্দ ভোগ, পর্যটন কেন্দ্রের বায়ু সেবন ইত্যাদিকে আল্লাহ ও রসুলের নির্দেশত চৌহদ্দীর মধ্যবর্তী নিরানন্দের চাইতে পছন্দনীয় হয়নি-তাকে তারা নিন্দার যোগ্য বলে মনে করছে। এর মানে হচ্ছে এই যে,ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্নক মনোবৃত্তি পুরুষদের সীমা ডিঙ্গিয়ে মেয়েদের মধ্যেও দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। পুরুষদের ন্যায় তারাও ইসলামী আইনের বিরুদ্ধাচরণকে নয়; বরং তার অনুবর্তনকেই একজন মুসলিম নারীর পক্ষে লজ্জা ও অনুতাপজনক বলে মনে করে।
আল্লাহর ওয়াস্তে কেউ আমায় বলুন, প্রাচীন ধর্ম পরায়ন মহিলাদের ক্রোড়ে প্রতিপালিত হওয়া সত্ত্বেও এদের অবস্থা যখন এই, তখন এদেরই ঘরের মেয়েরা ঈমানী সম্ভ্রমের সঙ্গে অপরিচিত হলে এবং আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্যসীমা থেকে বেরিয়ে গেলে নব্য পাশ্চাত্যঘেষা মহিলাদের ক্রোড়ে প্রতিপালিত সন্তানদের ভবিষ্যত কি দাড়াবে? যে শিশু চোখ খুলেই তার চারপাশে শুধু ফিরিঙ্গিপনারই নিদর্শন দেখতে পাবে, যার নিষ্পাপ দৃষ্টি ইসলামী তাহযীব ও তমুদ্দুনের কোনো লক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করবেনা, যার কানে কখনো আল্লাহ ও রসূলের কথা প্রবেশ করবেনা, যার মন মগজে নির্মল পটে শুরু থেকেই ফিরিঙ্গীপনার চিত্র অঙ্কিত হয়ে যাবে, সে তার আবেগ অনুভূতি, ধ্যান ধারনা, নৈতিক চরিত্র, কার্যকলাপ, এক কথায় কোনো একটি দিক দিয়েও মুসলমান হয়ে গড়ে উঠবে –এ প্রত্যাশা কি করা চলে?
অপরাধের প্রথম পর্যায় হলো, মানুষ অপরাধ করে, কিন্তু তাকে অপরাধই মনে করে এবং তার জন্য শরমিন্দা হয়। এই ধরনের অপরাধ শুধু নিজস্ব গুরুত্বের প্রেক্ষিতেই শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হয়; বরং তওবা বা অনুশোচনা করলে ক্ষমা করে দেয়া যেতে পারে। কারণ এই ধরনের দায়িত্ব শুধু মানুষের দূর্বলতার ওপরই চাপানো হবে।
অপরাধের দ্বিতীয় পর্যায় হলো, মানুষ অপরাধ করে এবং তাকে দোষের পরিবর্তে গুন মনে করে-পরন্তু তা গর্বের সঙ্গে সাধারণ্যে জাহির করে। এর অর্থ হচ্ছে এই যে,সংশ্লিষ্ট লোকটির অন্তরে এই আইনের প্রতি কিছুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই; যা তার আচরণকে অপরাধ বলে ঘোষনা করছে।
অপরাধের শেষ পর্যায় হলো এই যে, মানুষ একটি আইনের বিরুদ্ধে শুধু অপরাধই করেনা; বরং তার মোকাবিলায় অপর একটি আইন অনুযায়ী নিজের অপরাধকে সঙ্গত ও পুণ্য বলে মনে করে। পরন্তু যে আইনটি এহেন আচরনকে অপরাধ বল ঘোষনা করছে, তাকে উপহাস করে এবং তার অনুবর্তীদেরকে অন্যায়চারী ভাবে। এহেন ব্যক্তি শুধু আইনের বিরুদ্ধাচরণই করেনা; বরং তাকে রীতিমতো তাচ্ছিল্য করে এবং তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহে লিপ্ত হয়।
যে কোনো সামান্য কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন লোক স্বীকার করবে যে, মানুষ যখন এই সর্বশেষ পর্যায়ে উপনীত হয়, তখন যে আইনে বিরুদ্ধে সে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষনা করছে, তার সীমার মধ্যে সে আর থাকতে পারেনা। কিন্তু তবু পাপাত্না শয়তান লোকদেরকে এই ভুয়া নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে, তোমরা ইসলামী আইনকে উপহাস ও তাচ্ছিল্য করো এবং তার অনুবর্তঙ্কে দূষনীয়, বিরুদ্ধাচরণকে পুন্যের কাজ ঘোষনা করেও মুসলমান থাকতে পারো। তাই একদিকে তারা আল্লাহ ও রসূলের ভালোকে মন্দ ও মন্দকে ভালো বলছে, তাদের গুনাহকে সওয়াব ও সওয়াবকে গুনাহ মনে করছে, তাদের নির্দেশাবলীকে উপহাস করছে, তাদের নির্ধারিত আইনের বিরুদ্ধাচরণে লজ্জা করার পরিবর্তে উলটো তার অনুবর্তীদেরকেই লজ্জিত করার চেষ্টা করছে- অন্যদিকে তারা আল্লাহ ও রসূলের প্রতি ঈমান পোষনকারী, তাদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব হৃদয়ঙ্গমকারী এবং তাদের মনোনীত দীন ইসলামের অনুবর্তী বলে নিজেদেরকে দাবি করছে। এহেন আচরনের সঙ্গে এই ধরনের দাবিকে কোনো বুদ্ধিমান মানুষই কি যথার্থ বলে স্বীকার করতে পারে? যদি ঈমানের সঙ্গে অবিশ্বাস ও শ্রদ্ধার সঙ্গে তাচ্ছিল্য একত্র হতে পারে, যদি অন্তরে কাউকে সম্মান আর মুখে তাকে উপহাস করা সম্ভব হতে পারে, যদি বিরুদ্ধাচরণে গর্ব প্রকাশকারী এবং অনুবর্ত্নে অপমানবোধকারী ব্যক্তিকে বাধ্য ও অনুগত বলে ধারনা করা চলে, তাহলে বিদ্রোহকে আনুগত্য, তাচ্ছিল্যকে শ্রদ্ধা ও অবিশ্বাসকেই ঈমান বলে মানতে হবে। এমনিভাবে যে ব্যক্তি আঘাত হানে, সে-ই ভালোবাসে; যে উপহাস করে, সে-ই আসলে শ্রদ্ধা করে; যে মিথ্যা বলে, সে-ই সত্যবাদী প্রতিপন্ন হয়- এই উলটো যুক্তি স্বীকার করতে হবে!
বস্তুত ইসলাম আনুগত্য ছাড়া আর কিছুই নয়, আর প্রকৃত আনুগত্য ঈমান ছাড়া কিছুতেই যথার্থ হতে পারেন। ঈমানের সর্বপ্রথম দাবি এই যে, মানুষের কাছে আল্লাহ ও রসুলের নির্দেশ পৌছামাত্রই মাথা নতো করে দেবে এবং তা অগ্রাহ্য করে কখনো মাথা তুলতে পারবেনাঃ
(আরবী)
অর্থঃ মুমিনদের কাজ হচ্ছে এই যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ডাকা হবে- যাতে করে তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেয়া যায় – তখন আরা বলবেঃ ’আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম’। প্রকৃতপক্ষে এরাই হচ্ছে কল্যানপ্রাপ্ত।(সুরা নুরঃ৫১)
পরন্তু এই নতি স্বীকারও অনিচ্ছা ও বিরক্তির সঙ্গে নয়; বরং স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে করতে হবে। এমনকি আল্লাহ ও রসূলের নির্দেশের বিরুদ্ধে মনে কোনো প্রচ্ছন্ন বিরক্তি কিংবা অসন্তোষও রাখা যাবেনা। যে ব্যক্তি মাথা কেবল দৃশ্যত নতো হবে আর মনে বিরক্তি অনুভব করবে, সে মুমিন নয়; বরং মুনাফিকঃ
(আরবী)
অর্থঃ ‘যখনি তাদেরকে বলা হয়েছে, আল্লাহর অবতীর্ন বিধান ও রসূলের দিকে এসো, তখন তুমি দেখেছো যে, মুনাফিকরা তোমাদের দিকে আসতে ইতস্তত করে। …তোমার প্রভূর শপথ! তারা কখনোই মুমিন হতে পারবেনা, যতোক্ষন না তারা নিজেদের মতানৈক্যের ব্যাপারে তোমাকে ফয়সালাকারী বলে স্বীকার করবে এবং তুমি যা কিছু ফয়সালা করে দেবে, সে সম্পর্কে মনে কোনো বিরক্তি বোধ না করে তার সামনে মাথা নতো করে দেবে’।(সুরা নিসাঃ৬১-৬৫)
কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে আল্লাহর বিধানকে অমান্য করবে, আল্লাহ ও রসূলের বিধান পরিহার করে অন্যবিধ কানুনের অনুবর্তন করবে এবং তাকেই সত্য-যথার্থ মনে করবে, ভিন্ন আইনের অনুবর্তনকালে আল্লাহ ও রসূলের কানুনকে উপহাস করবে এবং তার আনুগত্যকে দূষনীয় কাজ মনে করবে, সে কিছুতেই মুমিন হতে পারেনা। এমন ব্যক্তি নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করুক আর মুসলমানের ন্যায় নাম ধারন করুক, কিংবা আদমশুমারী খাতায় সে মুসলমান হিসেবে স্বীকৃত হোক-তাতে কিছুই আসে যায় না। মানুষ গুনাহ করেও মুমিন থাকতে পারে; কিন্তু তার জন্যে শর্ত এই যে, গুনাহকে গুনাহ ভাবতে হবে এবং তার জন্যে অনুতপ্ত হতে হবে। পরন্তু যে আইনের বিরুদ্ধে নিছক চারিত্রিক দুর্বলতার কারণেই একটি অপরাধ করে বসেছে, তাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। কিন্তু গুনাহর সঙ্গে যখন নির্লজ্জতা ও দুসাহসিকতার মিশ্রন ঘটে, তার জন্যে গর্ব ও অহঙ্কার প্রকাশ করা হয় এবং তাকে পুন্যকাজ বিবেচনা করে তাতে লিপ্ত না হওয়ার দরুন কাউকে নিন্দা ও ভৎসনা করা হয়- তখন আল্লাহর শপথ! এমন দুষ্কৃতির সঙ্গে কখনো ঈমান টিকে থাকতে পারেনা। এই পর্যায়ে কারো প্রবেশ করতে হলে পূর্বাহ্নেই তাকে সিদ্ধান্ত করতে হবে যে, সে কি মুসলমান থাকতে ইচ্ছুক, না ইসলামকে পরিহার করে যে আইনের অনুবর্তন করে মর্যাদাবোধ করছে, তার আনুগত্য সীমায় প্রবেশ করতে উৎসুক?
আল্লাহর ফযলে মুসলিম জনসাধারন এখনো পর্যন্ত ফিরিঙ্গীপনা ও কুফরীসূলভ বিদ্রোহের এই বন্যা প্রবাহ থেকে নিরাপদ রয়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের অন্তরে আল্লাহ ও রসূলের বিধানের প্রতি শ্রদ্ধা বাকি রয়েছে। তাদের মধ্যেই ইসলামী আইনের অনুসৃতি কম বেশি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সম্ভ্রান্ত শ্রেনীর চালচলন পূর্বে যেমন তাদের স্বভাব চরিত্র ও আচার ব্যবহারের ওপর প্রভাবশালী হয়েছে, তেমনি তাদের ঈমানের ওপর নব্য রীতিনীতরও ধীরে ধীরে ধ্বংসাত্নক প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কা রয়েছে। সাধারন মুসলমানদের মধ্যে যে হারে নামায রোযা পরিত্যাগ, দুষ্কৃতি ও পাপানুষ্ঠান, ফিরিঙ্গী রীতিনীতির অনুকৃতি এবং ফিরিঙ্গী সভ্যতার খোলস্বরুপ চোখঝলসানো খেল তামাশার প্রতি আগ্রহ বেড়ে চলছে, তা এই প্রত্যাসন্ন বিপদেরই ঘন্টাধ্বনি মাত্র। আমাদের সম্ভ্রান্ত শ্রেনীর চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি যদি পরিশুদ্ধ না হয় এবং ইসলামের সিরাতুল মুস্তাকিমের প্রতি তাদের বিরূপতা এভাবেই অব্যাহত থাকে,তবে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন সমগ্র জাতিই এই পাপ সমুদ্রে ডুবে যাবে এবং আল্লাহর এই সুন্নতও পূর্ণতা লাভ করবেঃ
(আরবী)
অর্থঃ আমরা যখন কোনো জনপদকে ধ্বংস করে দিতে চাই তখন সেখানকার দুস্কৃতকারী লোকদেরকে সীমা লংঘনের কাজে লিপ্ত করে দিই। ফলে সে জনপদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। তখন আমি তাকে সমূলে ধ্বংস করে দিই।(সুরা ইসরাঃআয়াত ১৬)