২
উপমহাদেশে ইসলামী সভ্যতার বিপর্যয়
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বর্তমান মুসলিম জাহানের অধিকাংশ দেশই সোনালী যুগের মুজাহিদদের প্রচেষ্টায় বিজিত হয়েছে। যারা এই দেশগুলো জয় করেছেন, তাঁরা রাজ্য বিস্তার কিংবা ধনার্জনের নেশায় নয়, বরং দুনিয়ার বুকে আল্লাহ্র কালেমা বুলন্দ করার উদ্দেশ্যেই জীবন পণ করে নিজেদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করেছিলেন। তাঁরা দুনিয়াবী ভোগাসক্তির বদলে পরকালীন সুখাভিলাষের নেশায়ই বিভোর ছিলেন। এ জন্যেই তাঁরা বিজিতদের শুধু নিজেদের অনুগত ও করদাতা বানিয়েই ক্ষান্ত হননি, তাদেরকে ইসলামের রঙে রাঙিয়ে তুলবারও ব্যবস্থা করেন। তাদের গোটা জনসংখ্যা কিংবা তার অধিকাংশকেই তাঁরা মিল্লাতে ইসলামিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেন। পরন্তু জ্ঞানচর্চা ও কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের ভেতর ইসলামী চিন্তাধারা ও সভ্যতাকে এমনিভাবে দৃঢ়মূল করে দেন যে, পরবর্তীকালে তাঁরা নিজেরাই ইসলামী কৃষ্টি-সভ্যতার নিশানবরদার এবং ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষকে পরিণত হন। এগুলো ছাড়া বাকি দেশগুলো বিজিত হয় সোনালী যুগের বহু পরে। তখন ইসলামী প্রাণ-চেতনা নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল এবং বিজেতাদের হৃদয়ে খালেস আল্লাহ্র পথে জিহাদের চেয়ে রাজ্যবিস্তারের আকাঙ্খাই অধিক প্রবলভাবে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঐসব দেশে ইসলামের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার কাজ বহুলাংশে সফল হয়। এমনকি ঐ দেশগুলোতে ইসলাম নিরঙ্কুশ জাতীয় সভ্যতার সংস্কৃতির মর্যাদা লাভ করে।
দুর্ভাগ্যবশত এই উপমহাদেশের ব্যাপারটি উপরোক্ত দুই শ্রেণীর দেশ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সোনালী যুগে এ দেশের খুব সামান্য অংশই বিজিত হয়। আর ঐ সামান্য অংশেও ইসলামী শিক্ষা ও সভ্যতার যেটুকু প্রভাব পড়েছিল, তথাকথিত মা’রেফাতের বন্যাপ্রবাহে তাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এরপরেই এখানে শুরু হয় মুসলমানদের বিজয় অভিযানের আসল ধারাক্রম। কিন্তু তখন বিজেতাদের মধ্যে সোনালী যুগের মুসলমানদের বৈশিষ্ট ও বিশেষত্ব বর্তমান ছিলোনা। তাঁরা এখানে ইসলাম প্রচারের পরিবর্তে রাজ্য বিস্তারের কাজেই নিজেদের সমগ্র শক্তি ব্যয় করেন। তারা লোকদের কাছে আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্যের বদলে নিজেদের আনুগত্য ও রাজস্ব দাবি করেন। এরই অনিবার্য ফলে কয়েকশ বছর রাজ্য শাসনের পরও উপমহাদেশের বেশির ভাগ অধিবাসীই অমুসলিম রয়ে যায় এবং ইসলামী কৃষ্টি ও সভ্যতা এখানে বদ্ধমূল হতে পারেনি। পরন্তু এখানকার যেসব অধিবাসী ইসলাম গ্রহণ করে, তাদের জন্যে ইসলামী শিক্ষা ও ট্রেনিংয়েরও কোন বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে নও মুসলিমদের ভেতরে প্রাচীন হিন্দুয়ানী চিন্তাধারা, ধর্ম-বিশ্বাস ও রসম-রেওয়াজ কম-বেশি অবশিষ্ট থেকে যায়। এমনকি খোদ বহিরাগত প্রাচীন মুসলমানরা পর্যন্ত এদেশের অধিবাসীদের সাথে মেলামেশার ফলে মুশরিকী রাজনীতির সঙ্গে উদার ব্যবহার এবং বহুতরো জাহিলী প্রথার অনুবর্তন শুরু করে।
মুসলিম ভারতের ইতিহাস এবং তার বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করলে একথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এদেশে যখন মুসলমানদের রাষ্ট্রশক্তি পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান ছিলো তখনও ইসলামের প্রভাব ছিলো অত্যন্ত দুর্বল। এখানকার পরিবেশ যথার্থ ইসলামী পরিবেশ ছিলোনা। অবশ্য হিন্দুদের ধর্ম ও তমদ্দুনও ছিলো অত্যন্ত নিস্তেজ। তদুপরি পরাভূত ও পদানত জাতির ধর্ম ও তমদ্দুন হিসেবে তা হয়ে পড়েছিল আরো নিষ্প্রভ। কিন্তু তবু মুসলিম শাসকদের উদারতা ও গাফলতির পরিবেশে তা অপ্রতিদ্বন্দ্বী থাকায় এবং মুসলমানরা পুরোপুরি ইসলামী শিক্ষা ও ট্রেনিং লাভ না করায় এখানকার মুসলমানদেরও একটি বিরাট অংশ নিজেদের ধর্ম বিশ্বাস ও কৃষ্টি-সভ্যতার দিক দিয়ে ততোটা পরিপক্ক ও পূর্নাঙ্গ মুসলমান হতে পারেনি, যতোটা হতে পারতো খালেস ইসলামী পরিবেশ।
অবশেষে ঈসায়ী আঠার শতকে ভারতে ইসলামী সভ্যতার সবচেয়ে বড় সহায়ক সেই রাষ্ট্রক্ষমতাও মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে গেলো। প্রথমে মুসলমানদের সাম্রাজ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে ছোটখাটো রাষ্ট্রে বিভক্ত হলো। তারপর একে একে মারাঠা, শিখ ও ইংরেজদের বন্যাপ্রবাহ এসে বেশির ভাগ রাষ্ট্রের অস্তিত্বই নিশ্চিহ্ন করে দিলো। এরপর স্বাভাবিকভাবেই এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে গেলো। যে দেশে কয়েক শতাব্দীকাল ধরে মুসলমানরা শাসন চালিয়েছিল, মাত্র একশ বছরেই পুরো দেশ থেকে উৎখাত হয়ে তারা পরাভূত ও পদানত হলো। আর যেসব শক্তির সহায়তায় ভারতে ইসলামী কৃষ্টি ও সভ্যতা কিছু কায়েম ছিলো, ইংরেজদের রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গেই তা মুসলমানদের হাতছাড়া হতে লাগলো। তারা ফারসী ও আরবীর পরিবর্তে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যমে পরিণত করলো। সেই সাথে ইসলামী আইন ব্যবস্থা বাতিল করলো, শরয়ী আদালত ভেঙ্গে দিলো এবং দেওয়ানী ও ফৌজদারী ব্যাপারে নিজস্ব আইন প্রবর্তন করলো। এমনকি তারা ইসলামী আইনের প্রয়োগকে খোদ মুসলমানদের জন্যেও শুধু বিবাহ তালাক ইত্যাদির মধ্যে সীমিত করে দিলো আর এই সীমিত প্রয়োগ ক্ষমতাও কাজীদের পরিবর্তে সাধারণ দেওয়ানী আদালতের ওপর ন্যস্ত করা হলো। এইসব আদালতের বিচারকরা সাধারণত অমুসলিম বিধায় তাদের হাতে তথাকথিত ‘মুহামেডান ল’ দিন দিনই বিকৃত হতে লাগলো। অধিকন্তু শুরু থেকেই ইংরেজ শাসকদের এই নীতি ছিলো যে, একটি শাসক জাতি হিসেবে মুসলমানদের হৃদয়ে শতাব্দীকাল ধরে যে গৌরব ও মর্যাদাবোধ লালিত ও পরিপুষ্ট হয়ে আসছে আর্থিক বঞ্চনা ও নিষ্পেষণের সাহায্যে সেটিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে। তাই একটি শতাব্দীর মধ্যেই এই জাতিকে তারা দরিদ্র, মূর্খ, নীচুমনা, চরিত্রহীন এবং অপমানিত ও লাঞ্ছিত করতে সমর্থ হলো।
এই পতনশীল জাতিটির ওপর শেষ আঘাতটি আসে ১৮৫৭ সালের গোলযোগের সময়। সে আঘাত শুধু মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতারই অবসান ঘটায়নি; বরং তাদের মনোবল একেবারে ভেঙ্গে দিলো। তাদের হৃদয়ে নৈরাশ্য ও হীনমন্যতাবোধের অমানিশা নেমে এলো। তারা ইংরেজদের শাসনক্ষমতার দাপটে এতোখানি সম্মোহিত হলো যে, তাদের ভেতরে স্বজাত্যবোধের চিহ্নমাত্র বাকি রইলোনা। এমনকি অপমান ও লাঞ্ছনার চরম প্রান্তে পৌঁছে গিয়ে তারা এ পর্যন্ত ভাবতে বাধ্য হলো যে, শান্তি ও নিরাপত্তার উপায় হচ্ছে ইংরেজদের আনুগত্য করা; মান ইজ্জত লাভের পন্থা হচ্ছে ইংরেজদের সেবা করা এবং উন্নতি ও প্রগতির উপায় হচ্ছে ইংরেজদের অনুসরণ ও অনুকরণ করা- এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। পক্ষান্তরে তাদের নিজেদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কৃষ্টি-সভ্যতার যা কিছু সম্পদ রয়েছে, তা হচ্ছে দীনতা ও হীনতার প্রধানতম কারণ।
ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মুসলমানরা যখন আবার মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো, তখন তাদের মধ্যে দু’রকম দুর্বলতা বর্তমান ছিলো। প্রথম এই যে, চিন্তা ও কর্মের দিক থেকে আগে থেকেই তারা ইসলামী প্রত্যয় ও কৃষ্টি-সভ্যতায় পরিপক্ক ছিলোনা। পরন্তু এক অনৈসলামী পরিবেশ তার জাহিলী ধ্যান-ধারণা ও তমদ্দুনসহ তাদেরকে ঘিরে রেখেছিল। দ্বিতীয় হলো, গোলামি তার সমস্ত দোষত্রুটি সমেত কেবল তাদের দেহের ওপরই নয়; বরং তাদের হৃদয় ও আত্মার ওপরও চেপে বসেছিল। ফলে যেসব শক্তির সাহায্যে একটি জাতি তার তাহযীব ও তমদ্দুনকে বহাল রাখতে পারে, সেগুলো থেকে তারা বঞ্চিত হয়ে পড়ে।
এই দ্বিবিধ কমজোরীর মধ্যেই মুসলমানরা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো, ইংরেজ শাসকরা অতি সুকৌশলে আর্থিক উন্নতির সমস্ত দরজা তাদের জন্যে বন্ধ করে দিয়েছে এবং তার চাবি রেখে দিয়েছে ইংরেজি স্কুল ও কলেজের মধ্যে। এবার ইংরেজি শিক্ষা লাভ করা ছাড়া মুসলমানদের আর কোনোই গতি রইলোনা। তাই স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে এক প্রচণ্ড আন্দোলন গড়ে উঠলো। তার প্রভাবে গোটা উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনবোধ জাগ্রত হলো। এ ব্যাপারে প্রাচীন পন্থীদের বিরোধিতা সম্পূর্ণ নিষ্ফল প্রতিপন্ন হয়। কারণ ধন দৌলত, মান ইজ্জত ও প্রভাব প্রতিপত্তির দিক থেকে জাতির আসল শক্তি যাদের করায়ত্তে ছিলো, তারা এই নয়া আন্দোলনকে অভিনন্দন জানালো এবং এর প্রত্যক্ষ সহায়তায় এগিয়ে এলো। ফলে ভারতের মুসলমানরা অতি দ্রুত ইংরেজি শিক্ষার দিকে এগিয়ে চললো। জাতির অকেজো ও অপদার্থ অংশটিকে পুরানো ধর্মীয় মাদ্রাসার জন্যে রেখে দেয়া হলো যাতে করে তারা মসজিদের ইমামতি ও মক্তব-মাদ্রাসায় শিক্ষকতার কাজ আঞ্জাম দিতে পারে। আর স্বচ্ছল ও স্বচ্ছন্দ শ্রেণীর উত্তম শিশুদেরকে ইংরেজি স্কুল-কলেজে পাঠানো হলো, যেনো তাদের নিষ্কলুষ মন-মগজে ফিরিঙ্গি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-কলার ছাপ অঙ্কিত হতে পারে।
এটা ছিলো ঊনিশ শতকের শেষ চতুর্থাংশের অবস্থা। ইউরোপে তখন বস্তুবাদের চরম উন্নতি ঘটে। ইতিপূর্বে আঠার শতকে বিজ্ঞান পুরোপুরি ধর্মকে পরাজিত করে।আধুনিক দর্শন ও নতুন বিজ্ঞানের নেতৃত্বে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের তাবত পুরনো মতবাদ বাতিল হয়ে নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। মোটকথা এইসব আধুনিক মতবাদের ভিত্তিতে ইউরোপে এক বিশেষ ধরনের কৃষ্টি ও সভ্যতার জন্ম হয়। এই বিরাট বিপ্লব জীবনের বাস্তব ক্রিয়াকাণ্ড থেকে ধর্ম এবং ধর্ম নির্দেশিত রীতিনীতিকে নির্বাসিত করে বটে, তবে চিন্তা ও কল্পনার জগতে ধর্মীয় প্রত্যয়ের কিছুটা প্রভাব তখনো বাকি ছিল। তাই তার বিরুদ্ধে এবার প্রচন্ড লড়াই শুরু হয়ে গেল। যদিও জ্ঞান বিজ্ঞানের কোনো একটি সূত্রও বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কিত খোদায়ী মতবাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ (যাকে প্রকৃতই প্রমাণ বলা যায়) পেশ করতে পারেনি কিন্তু তবুও বিজ্ঞানীরা কোনরূপ দলীল প্রমাণ ছাড়াই নিছক ভাবাবেগের কারণেই খোদার প্রতি অপ্রসন্ন ও খোদায়ী মতবাদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করতে থাকে। আর যেহেতু তখন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে তারাই ছিল দুনিয়ার নেতৃত্বের আসনে সমাসীন, তাই তাদের প্রভাবে খোদাবিমুখতার (Theophobia) ব্যাধি এক ব্যাপক মহামারীর ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে খোদার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা বিশ্বপ্রকৃতিকে স্বাভাবিকভাবে সৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী চলমান বস্তু বলে মনে করা, খোদাপরস্তিকে কুসংস্কার আখ্যা দেয়া, ধর্মকে অনর্থক এবং ধার্মিকতাকে সংকীর্ণতা ও অন্ধত্ব বলে অভিহিত করা, প্রকৃতিবাদকে ঔদার্য ও স্বচ্ছ দৃষ্টির সমার্থক জ্ঞান করা তখন একটা ফ্যাশনে পরিনত হয়। এমনকি দর্শন ও বিজ্ঞানে যার এতটুকু জ্ঞান নেই এবং এই সকল জটিল প্রশ্ন গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধানের যে অনুপরিমাণ চেষ্টাও করেনি, এমন ব্যক্তিও শুধু সমাজে একজন আলোকপ্রাপ্ত লোক হিসেবে বিবেচিত হবার আকাঙ্খায় এই ধরনের মতবাদ জাহির করতো। ফলে আধ্যাত্মবাদ বা অতি প্রকৃতিবাদের সপক্ষে কিছু বলা বা লেখা তখনকার দিনে কুফরতুল্য অপরাধ ছিলো। এমনকি কোনো প্রখ্যাত বিজ্ঞানীও এ ধরনের কোনো মত প্রকাশ করলে বিজ্ঞানীদের মহলে তাঁর আর কোনো মর্যাদাই থাকতোনা, তাঁর তামাম কৃতিত্বই একেবারে ম্লান হয়ে যেত এবং তিনি বিদগ্ধ সমাজে আসন লাভেরই অনুপযুক্ত হয়ে পরতেন।
১৮৫৯ সালে ডারউইনের বিখ্যাত ‘প্রজাতির উত্স’ (Origin of Species) গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি প্রকৃতিবাদ ও নাস্তিকতাবাদের আগুনে তেল সংযোগের কাজ করে। অবশ্য ডারউইন তাঁর উদ্ভাবিত বিবর্তনবাদের সপক্ষে যে দলিল প্রমাণ পেশ করেন, তা ছিল নিতান্তই দুর্বল এবং প্রমাণ সাপেক্ষ। তাঁর মনগড়া বিবর্তন ধারায় কেবল একটি স্তরই নয়; বরং প্রতিটি বর্তমান স্তরের সামনে ও পেছনে অনেকগুলো স্তরই ছিলো অনুপস্থিত। ফলে বিজ্ঞানীরা এই মতবাদ সম্পর্কে তখন নিশ্চিত হতে পারেননি। এমনকি এর সবচেয়ে বড় প্রবক্তা হাক্সলে (Huxley) পর্যন্ত এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি। কিন্তু তা সত্বেও নিছক খোদাদ্রোহিতার কারণেই ডারউইনবাদকে গ্রহণ করা হলো। শুধু তাই নয়, তার সপক্ষে মাত্রাতিরিক্ত রকমের প্রচার চালানো হলো এবং সেটাকে ধর্মের বিরোধিতার, একটি প্রকান্ড অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হলো। কেননা, এই মতবাদটি বিজ্ঞানীদের ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে একটি বিরাট দাবিকে সপ্রমাণ করেছিল (অথচ ডারউইনবাদের আসল দাবিটিও ছিল প্রমাণ সাপেক্ষ)। তা হলো এই যে, গোটা বিশ্বপ্রকৃতি কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তির সহায়তা ছাড়াই স্বাভাবিক নৈসর্গিক নিয়মে চালিত হচ্ছে। ধর্মবাদিগন এই মতবাদের ঘোর বিরোধিতা করলো। বৃটিশ এসোসিয়েশনের সভায় অক্সফোর্ড ও গ্লাডস্টোনের বিসপগন এর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে ভাষণ দান করেন, কিন্তু তা সত্বেও তাঁরা পরাজিত হন। অবশেষে ইউরোপীয় ধর্মবাদিগন বৈজ্ঞানিক নাস্তিকতার সামনে এতখানি পরাভূত হলো যে, ১৮৮২ সালে ডারউইন মৃত্যুবরণ করলে ইংল্যান্ডের চার্চ তাকে সর্বশ্রেষ্ট সম্মানে ভুষিত করেন। অর্থাৎ তাঁকে ওয়েস্ট মিনিস্টার এবিতে সমাহিত করার অনুমতি দেয়া হলো। অথচ ইউরোপে ধর্মের কবর রচয়িতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন শিরোমণি। তিনিই চিন্তাধারাকে বস্তুতন্ত্র, নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহিতার পথে চালিত করার ব্যাপারে প্রধাণ ভুমিকা গ্রহণ করেন। তিনি যে মানসিকতার গোড়াপত্তন করেন, তার ফলেই ইউরোপে বলশেকিভবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিকাশ ও বৃদ্ধির সুযোগ লাভ করে।
বস্তুত এই সময়ই আমাদের যুবসমাজকে ইংরেজি শিক্ষা ও ফিরিঙ্গী সংস্কৃতির দ্বারা অনুগৃহীত হবার জন্যে ইংরেজি স্কুল ও কলেজে প্রেরণ করা হলো। তারা আগে থেকেই ইসলামী শিক্ষায় আনকোরা এবং ইসলামী সংস্কৃতিতে অপরিপক্ক ছিলো। পক্ষান্তরে ইংরেজ শাসন শক্তির সামনে পরাভূত এবং ফিরিঙ্গী সভ্যতার জাঁকজমকে ছিল মোহমুদ্গ্ধ। এর ফলে ইংরেজি স্কুলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মানসিক কাঠামো বদলে গেলো। তাদের ঝোঁক প্রবনতা ধর্মের দিক থেকে ফিরে গেলো। কারন, ইউরোপের কোনো লেখক গবেষকের নাম কিছু পেশ করা হলে তাকে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়া এবং কুরআন, হাদিস ও ইসলামী মনিষীদের তরফ থেকে কিছু বলা হলে তার সপক্ষে প্রমাণ দাবি করা ছিলো ওই আবহাওয়ার সবচেয়ে প্রথম প্রভাব। এই পরিবর্তিত মানসিকতা নিয়ে তারা যে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা করলো, তার মূলনীতি ও শাখা প্রশাখার অধিকাংশই ছিল ইসলামের মূলনীতি ও শাখা প্রশাখার পরিপন্থী।
ইসলামে ধর্মের ধারণা হলো, তা হচ্ছে মানুষের জীবন বিধান। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য ধর্মের ধারণা হচ্ছে তা একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস মাত্র, বাস্তব জীবনের সঙ্গে তার কোনই সম্পর্ক নেই। ইসলামে প্রথম জিনিস হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ইমান, আর পাশ্চাত্যে আদপেই আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকৃত নয়। ইসলামের গোটা কৃষ্টি ও সভ্যতাই ওহী ও রিসালাত সংক্রান্ত প্রত্যয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর পাশ্চাত্যে ওহীর সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ এবং রিসালাতের যথার্থতা সম্পর্কে সংশয় রয়েছে। ইসলামে আখিরাত বিশ্বাস হচ্ছে গোটা জীবন পদ্ধতি ও আচরণবিধির ভিত্তি, আর পাশ্চাত্যে এ ভিত্তিটাই ভিত্তিহীন বলে বিবেচিত। ইসলামে যেসব ইবাদত বন্দেগী ও ক্রিয়াকাণ্ড ফরয বলে গণ্য, পাশ্চাত্যে তা শুধু জাহিলি যুগের অর্থহীন প্রথার মাত্র। এইভাবে ইসলামের গত তাহযীব ও তমদ্দুন পাশ্চাত্যের কৃষ্টি সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। আইনের ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি হলো, আল্লাহই হচ্ছেন আইন প্রনেতা; রসুল আইনের ব্যাখ্যাদাতা, আর মানুষ শুধু আইনের অনুগত মাত্র। কিন্তু পাশ্চাত্যে আইন প্রণয়নে খোদার কোনো অধিকারই স্বীকৃত নয়। সেখানে আইন পরিষদ হচ্ছে আইন প্রনেতা আর জনগণ হচ্ছে পরিষদের নির্বাচক। রাষ্ট্রনীতিতে ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে খোদায়ী হুকুম কায়েম করা, আর পাশ্চাত্যের লক্ষ্য জাতীয় রাষ্ট্র। ইসলামের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে আন্তর্জাতিকতাবাদ আর পাশ্চাত্যের লক্ষ্যস্থল হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। অর্থনীতিতে ইসলাম হালাল উপার্জন এবং যাকাত ও সদকা প্রদান ও সুদ বর্জনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে, আর পাশ্চাত্যের গোটা অর্থ ব্যবস্থাই সুদ ও মুনাফার ভিত্তিতে চালিত। নীতিশাস্ত্রে ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে আখিরাতের সাফল্য আর পাশ্চাত্যের লক্ষ্য হচ্ছে দুনিয়ার মঙ্গল।
অনুরূপভাবে সামাজিক বিষয়াদিতেও ইসলামের পথ প্রায় প্রতিটি ব্যাপারেই পাশ্চাত্যের পথ থেকে ভিন্নতর। পর্দা ও পোশাক, নারী পুরুষের সম্পর্ক, একাধিক বিবাহ, বিবাহ তালাক সংক্রান্ত আইন, জন্মনিয়ন্ত্রণ, পিতামাতার অধিকার, স্বামী স্ত্রীর অধিকার এবং এ ধরনের আরো বহুতরো বিষয়ে এ দু’ সভ্যতার পার্থক্য অনেক এবং এত প্রকট যে, তা বিস্তৃতভাবে বিবৃত করা নিষ্প্রয়োজন। এ পার্থক্যের কারণ এই যে, উভয় সভ্যতার মূলনীতিই পৃথক। আমাদের যুবসমাজ পরাভূত ও গোলামিসুলভ মানসিকতা এবং অসম্পূর্ণ ইসলামী শিক্ষা ও ট্রেনিংয়ের সঙ্গে যখন ওই পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবাধিনে ট্রেনিং লাভ করলো, তখন তার পরিনাম ফল যা হবার তা-ই হলো। তাদের মধ্যে ভালো মন্দ বিচারের কোনো যোগ্যতা সৃষ্টি হলো না। পাশ্চাত্য থেকে তারা যা কিছু শিখছিলো, তাকেই যথার্থ ও বিশুদ্ধতার মাপকাঠিরূপে গ্রহণ করলো। অতপর অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিযুক্ত জ্ঞান নিয়ে ইসলামের নীতি ও আইন কানুনকে তারা উক্ত মানদন্ডে যাচাই করতে লাগলো এবং কোনো বিষয়ে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য দেখতে পেলে কখনো পাশ্চাত্যের ভ্রান্তি উপলব্ধি করতে পারেনি; বরং ইসলামকেই ত্রুটিপূর্ণ মনে করে তার নীতিও আইন কানুনের সংশোধন ও পরিবর্তন করতে প্রস্তুত হলো।
ফলকথা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে আধুনিক শিক্ষা হিমালিয়ান উপমহাদেশের মুসলমানদের যতই কল্যাণ সাধন করুক না কেন, তাদের ধর্ম ও সভ্যতার যে বিরাট ক্ষতিসাধন করেছে, কোনো কল্যানের দ্বারাই তা পূর্ণ হতে পারেনা। (তর্জমানুল কুরআন: অক্টোবর ১৯৩৪ইং)