১৮
ব্যাধি ও তার প্রতিকার
[প্রবন্ধটি সর্বপ্রথম ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বরে তরজমানুল কুরআন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। – সম্পাদক]
ইসলাম নিছক একটি বিশ্বাস মাত্র নয়, কিংবা কতিপয় ‘ধর্মীয়’ অনুষ্ঠান এবং রসমেরও সমষ্টি নয়, বরং তা হচ্ছে মানুষের গোটা জীবনের জন্যে এক বিস্তৃত পরিকল্পনা (Scheme)। এতে ধর্ম বিশ্বাস, ইবাদত বন্দেগী আর বাস্তব জীবনের নিয়ম নীতি আলাদা আলাদা নয়, বরং এ সবকিছু মিলে এমন এক অখন্ড ও অবিভাজ্য সমষ্টি গড়ে তোলে যার অংশগুলোর পারস্পারিক সম্পর্ক হচ্ছে ঠিক তেমনি, একটি জীবন্ত দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর সম্পর্ক যেমন হয়ে থাকে।
আপনি কোনো জীবন্ত মানুষের হাত পা কেটে দিন। চোখ, কান ও জিহ্বা বিচ্ছিন্ন করে ফেলুন। পাকস্থলী ও কলিজা বেড় করে ফেলুন। ফুসফুস ও মূত্রাশয় পৃথক করে দিন। মগজেরও কম বেশি কিছু অংশ বের করে দিন এবং তার বুকের মধ্যে নিছক হৃদয় রেখে দিন। এ জিনিসটি কি দেহের বাকি অংশকে জিন্দা রাখতে পারবে?আর জিন্দা রাখলেও তা কি কোন কাজের উপযোগী থাকবে?
ইসলামের অবস্থাও ঠিক এমনই। প্রত্যয় বা বিশ্বাস হচ্ছে তার অন্তকরণ। আর ঐ প্রত্যয় থেকে উদ্ভুত মনোভঙ্গি, জীবনাদর্শ, জীবন লক্ষ্য ও মূল্যমান হচ্ছে তার মস্তিষ্ক। ইবাদত বন্দেগী হচ্ছে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। এগুলোর উপর নির্ভর করেই সে দাঁড়িয়ে থাকে এবং আপন কর্তব্যকর্ম পালন করে যায়। অর্থনীতি, সামাজিকতা, রাষ্ট্রনীতি ও সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ইসলাম যেসব মূলনীতি দিয়েছে, তা হচ্ছে তার পাকস্থলী, কলিজা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের শামিল। তার সুস্থ ও স্বচ্ছ চোখ এবং নির্দোষ কানের প্রয়োজন, যাতে করে সে যুগের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে মগজকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করতে পারে এবং মগজ সেগুলো সম্পর্কে নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। তার নিজের আয়ত্তাধীন ভাষার প্রয়োজন, যাতে করে সে সুষ্ঠুভাবে নিজের ব্যক্তিসত্তাকে প্রকাশ করতে পারে। তার শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণের জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আবহাওয়ার প্রয়োজন। তার পবিত্র ও বিশুদ্ধ খাদ্যের প্রয়োজন, যা তার পাকস্থলীর সাথে সঙ্গতি রেখে উত্তম রক্ত উৎপাদন করতে সক্ষম।
এই গোটা ব্যবস্থাপনায় অন্তকরণটা (অর্থাৎ প্রত্যয়) যদিও গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তার গুরুত্বটা এ জন্যেই যে, সে তামাম অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে জীবনীশক্তি দান করে। যখন বেশির ভাগ অঙ্গ প্রত্যঙ্গই কেটে যায়, দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়, অথবা বিনষ্ট হয়ে যায় তখন একা অন্তকরণ বাকী সামান্য পঙ্গু ও রুগ্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে কিভাবে জিন্দা থাকতে পারে?আর জিন্দা থাকলেও সে জীবনের কী মূল্য হতে পারে?
এবার এই ভারতবর্ষে (বাংলা পাক ভারত) [মনে রাখতে হবে যে, প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে ১৯৩৭ সালে গোলামী যুগকে সামনে রেখে;কিন্তু এর বক্তব্য বর্তমান স্বাধীন পরিবেশেও সম্পূর্ণ প্রযোজ্য। – সম্পাদক] ইসলামের কি দশা পরিলক্ষিত হচ্ছে, একবার ভেবে দেখুন। এখানে ইসলামী আইন কানুন প্রায় সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয়। নৈতিকতা, সামাজিকতা, অর্থনীতি এবং জীবনের অন্যান্য সব ব্যাপারে ইসলামী নীতি শতকরা পাঁচ ভাগের বেশি কার্যকরী নয়। অনিসলামী শিক্ষা, ট্রেনিং ও পরিবেশ লোকদের মন মগজকে কোথাও সম্পূর্ণ এবং কোথাও একটু কমবেশি অমুসলিম বানিয়ে দিয়েছে। তাদের চোখ দেখতে পায়, কিন্তু দৃষ্টিকোণ বদলে গিয়েছে। কান শুনতে পায় কিন্তু পর্দা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। মুখ থেকে কথা বেরোয়, কিন্তু বোলচালে পার্থক্য দেখা দিয়েছে। চারদিকে এক বিষাক্ত পরিবেশ বিরাজ করার দরুন তার ফুসফুস নির্মল বাতাস গ্রহণ করতে পারছেনা। গোটা খাদ্য ভান্ডার বিষদুষ্ট হবার ফলে পাকস্থলী পবিত্র ও বিশুদ্ধ খাদ্য পাচ্ছেনা। ইসলামী দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যে ইবাদত, তার শতকরা ৬০ ভাগই পক্ষাঘাতগ্রস্ত। বাকি ৪০ ভাগই সুস্থ থাকলেও তার কোন প্রভাবই পরিলক্ষিত নয়। কারণ অন্যান্য অঙ্গগুলোর সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। এ জন্যেই তাদের মধ্যে পক্ষাঘাতের ব্যাধি ক্রমশ বিস্তার লাভ করেছে। এমতাবস্থায় আমাদের সামনের এই জিনিসটাকে কি পূর্ণাঙ্গ ইসলাম বলা যায়?এর কতগুলো অঙ্গ কেটে গিয়েছে, কতক বর্জন করা হয়েছে, কতক বর্তমান থাকলেও রুগ্ন এবং সঠিক কাজ করতে অক্ষম। এগুলোর সঙ্গে নিছক একটি অন্তকরণ বাকি রয়েছে এবং তাও পীড়িত হচ্ছে। কারণ তা ঐ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকে যেমন জীবনী শক্তি দান করতো তেমনি নিজেও সেগুলো থেকে শক্তি আহরণ করতো। কাজেই মগজ, ফুসফুস, পাকস্থলী, কলিজা ইত্যাদির ক্রিয়াকর্মই যখন বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে, তখন একা অন্তকরণ কি করে সুস্থ ও সবল থাকতে পারে?তবু সেই অন্তরের মধ্যে যে প্রচন্ড শক্তি নিহিত রয়েছে, তার ফলে সে শুধু জীবিত নয়;বরং বাকি অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকেও কোন প্রকারে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেশবাসীর জীবনে নিজস্ব প্রভাব প্রতিষ্ঠার মতো শক্তি কি তার ভিতরে আছে?বরং আল্লাহ্ না করুক, আমি তো এ প্রশ্নই করতে চাই যে, দুর্যোগের বন্যাবেগ দিন দিন যেভাবে তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছে, তার মোকাবিলায় এমনি অবস্থা নিয়ে সে কি বাকি অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকে অধিকতর কাটাছেঁড়া এবং নিজেকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারবে?বস্তুত এরই ফলে আজ মুসলিম সমাজের (আরবী) (তারা দলে দলে আল্লাহ্র দীনের মধ্যে প্রবেশ করছে) সম্পূর্ণ বিপরীত ইসলামের প্রতি বিদ্রোহ ও বিমুখিতার ব্যাধি দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। সমগ্র ভারতে এবং তার আশে পাশে কোথাও ইসলামী জীবন পদ্ধতিকে তার পূর্ণ মেশিনারীসহ ক্রিয়াশীল দেখা যায় না। তাই লোকেরাও তার সৌন্দর্য ও পূর্ণত্বকে অবলোকন এবং ফুলের সাহায্যে বৃক্ষের পরিচিতি লাভ করতে পারছে না। তারা শুধু এই অঙ্গবিহীন ইসলামকে দেখেই ভাবছে ব্যাস, এটুকুই ইসলাম। এটুকু দেখে কেউ তো প্রকাশ্যেই ঘোষণা করছে যে, আমরা ‘মুসলমান নই’। অনেকে আবার মুসলমানিত্বকে অস্বীকার করেনা বটে, তবে কথাবার্তা যা বলে তাতে তাদের এবং ইসলামের প্রতি অবিশ্বাসীদের মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়না। অনেকের মন তো ফিরে গিয়েছে কিন্তু এখনো প্রকাশ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়নি বলে মুনাফিকীর সঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে শামিল রয়েছে। অবশ্য ব্যাপক গোলযোগ শুরু হলে নিজেরাও যাতে ঝান্ডা নিয়ে দাঁড়াতে পারে, সে জন্যে গোপনে গোপনে এরা বিদ্রোহের বীজ ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লোকেরা স্পষ্টভাবে না বললেও অনুচ্চস্বরে বলছে, ‘নতুন জাতীয়তাবাদ ও নতুনতর সভ্যতায় বিলীন হবার জন্যে তৈরি হও। কারণ তোমরা যে মৃতদেহ নিয়ে বসে আছ, তা নিজে তো তোমাদের কোনো কল্যাণ সাধন করতে পারছেই না;বরং অন্যের মধ্যে বিলীন হবার ফলে যে কল্যাণ লাভের সম্ভাবনা আছে, তার থেকেও তোমাদের সমৃদ্ধ হতে দিচ্ছেনা।’ কারো কারো মতে, এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে ইসলামকে খন্ড খন্ড করে ফেলা। তারা বলেন, শুধু ধর্মীয় ক্রিয়াকান্ড পর্যন্তই মুসলমান থাকা উচিত। জীবনের আর বাকি অংশে অমুসলিমদের শেখানো এবং তাদের অনুসৃত কর্মসূচী আমাদের গ্রহণ করা উচিত। এই লোকগুলো নিজেরা ধোঁকার মধ্যে রয়েছে কি অপরকে ধোঁকা দিতে চাচ্ছে, জানিনা। তবে এরা এই সত্যটি ভুলে গিয়েছে কিংবা ভোলাতে চাচ্ছে যে, জীবনের তাবৎ বিষয়ে অনিসলামী মতাদর্শ গ্রহণ করা এবং অনিসলামী নিয়মনীতিতে অভ্যস্ত হবার পর ধর্মীয় প্রত্যয় ও ধর্মীয় ক্রিয়াকান্ড সম্পূর্ণ দুর্বল হয়ে পড়তে বাধ্য। কারণ প্রত্যয় ও ইবাদতগুলোই হচ্ছে আসল ভিত্তি জীবনের গোটা ইমারতকে গড়ে তুলবার জন্যেই এগুলোকে স্থাপন করা হয়েছে। এই ইমারত যদি ভিন্ন বুনিয়াদের ওপর গড়ে ওঠে তো এই প্রাচীন নিদর্শনগুলোর অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় আকর্ষণ কতোদিন বজায় থাকবে?যে শিশু নতুন জীবনধারায় প্রতিপালিত হয়ে যৌবনে উপনীত হবে, সে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবে;কতিপয় অহেতুক বিশ্বাস ও কতিপয় প্রথার শিকল কেন আমার গলায় পরিয়ে রেখেছে?যে কুরআনের সমস্ত বিধি বিধানই আজ অকেজো হয়ে গিয়েছে তা কেন আমি পড়বো এবং কেনই বা তার প্রতি ঈমান পোষণ করবো?যে লোকটি সাড়ে তেরশ বছর আগে চলে গিয়েছেন, তাঁকে কেন আমি আল্লাহ্র রসূল বলে মানবো?আমার জীবনেই যখন তিনি কোন পথনির্দেশ করতে পারেননা তখন শুধু তাঁর নবুয়তের প্রতি মৌখিক স্বীকৃতিতেই কি লাভ আর অস্বীকৃতিতেই বা কি ক্ষতি?আমি যে জীবনধারা পালন করে চলছি, তাতে নামায পড়া বা না পড়ায়, রোযা রাখা বা না রাখায় কী পার্থক্য সূচিত হয়?কী সম্পর্ক রয়েছে এই জীবনধারা ও এই ক্রিয়াকান্ডগুলোর মধ্যে?কেন আমার জীবনে এমনি বেখাপ্পা জোড়া লাগিয়ে রাখা হবে?এই হচ্ছে দীন ও দুনিয়াকে বিভক্ত করার অতি স্বাভাবিক পরিণাম। এই বিভক্তি নীতিগত ও কার্যত যখন পরিপূর্ণ হবে, তখন এমনি ফলাফল প্রকাশ পাবেই। দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর যেমন অন্তকরনটা সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায়, তেমনি বাস্তব জীবন থেকে সম্পর্কহীন হবার পর প্রত্যয় ও ইবাদতগুলোরও কোন গুরুত্ব বাকি থাকেনা। প্রত্যয় ও ইবাদতগুলো ইসলামী জিন্দেগীকে জীবনী শক্তি দান করে আবার ইসলামী জিন্দেগী প্রত্যয় ও ইবাদতগুলোকে শক্তি সরবরাহ করে থাকে। উপরে যেমন বলেছি, এই দুটি জিনিসের মধ্যে আসলে জীবন্ত দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ন্যায় সম্পর্ক বর্তমান। এই সম্পর্ক ছিন্ন করলে উভয়েরই মৃত্যু অনিবার্য। পরন্তু অনিসলামী জীবনধারার সাথে ইসলামী প্রত্যয় ও ইবাদতকে জুড়ে দিলে তা হবে গরিলার দেহে মানুষের মগজ বা হাত পা জুড়ে দেয়ার মতোই উদ্ভট ব্যাপার।
একথা কেউ মনে করবেন না যে, আধুনিক শিক্ষিতদের একটি ক্ষুদ্র দলই শুধু ইসলামের বর্তমান দুরাবস্থায় প্রভাবিত হচ্ছে, তা মোটেই নয়। আজকে যারা সাচ্চাদিল মুসলমান, যাদের হৃদয়ে এই ধর্মের প্রতি ভালোবাসা ও সম্ভ্রমবোধ বর্তমান নতুন প্রাচীন নির্বিশেষে সবাই কম বেশী এই অবস্থার দ্বারা প্রভাবান্বিত হচ্ছে। ইসলামী জীবনধারার বিপর্যয় হচ্ছে এক সাধারণ দুর্যোগ – এর স্বাভাবিক পরিণাম থেকে কোন মুসলমানই নিরাপদ নয়, আর নিরাপদ থাকা সম্ভবও নয়। আপন আপন যোগ্যতা অনুযায়ী সবাই আমরা তার থেকে অংশ লাভ করছি। এতে আমাদের আলিম ও পীর সাহেবান স্কুল কলেজে শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকদের মতোই সমান অংশীদার।
কিন্তু সবচাইতে বেশি দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে ১৬ লক্ষ বর্গ মাইলব্যাপী এ বিস্তীর্ণ এলাকার বসবাসকারী আমাদের কোটি কোটি জনসাধারণ। এদের কাছে শুধু ইসলামের নামটাই বাকী রয়ে গেছে এবং এর প্রতি তারা অসাধারণ ভালবাসাও পোষণ করে। কিন্তু যে বস্তুটির জন্যে তারা এভাবে প্রাণপাত করছে, জ্ঞানগত দিক থেকে সে সম্পর্কে তারা মোটেই অবহিত নয় বলা চলে। আর বাস্তব ক্ষেত্রেও তাদেরকে অনিসলামী প্রভাব থেকে রক্ষা করার উপযোগী কোন জীবন পদ্ধতি বর্তমান নেই। তাদের এই অজ্ঞতার সুযোগ যে কোনো বিভ্রান্তকারী শক্তি তাদের ঈমান আকীদা ও বাস্তব জীবনকে ইসলামের সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত করতে পারে। তাদেরকে এইটুকু প্রবোধ দেয়াই যথেষ্ট যে, তাদের সামনে পেশকৃত এই গোমরাহী ও ভ্রষ্টতাই হচ্ছে প্রকৃত সুপথ কিংবা অন্তত এটি ইসলামের বিরোধী কিছু নয়। তারপর কাদিয়ানীবাদ, কম্যুনিজম, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি যে কোনো পথে খুশী তাদেরকে ঠেলে নেয়া যেতে পারে। কেননা তাদের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র ও ভয়াবহ দুর্গতি থেকে যে সমস্যাগুলোর উদ্ভব হয়েছে, বর্তমান বিশৃংখল ও বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে সেগুলোকে ইসলামী নীতির আলোকে সমাধান করবার কোন প্রচেষ্টা হচ্ছেনা।
আজকের কম্যুনিজমের মোকাবিলায় ইসলামের অর্থনৈতিক ও তামাদ্দুনিক আদর্শ নিয়ে সামনে এগোবার এবং সাধারণ লোকদের পক্ষে অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলীর সমাধান পেশ করবার মতো কোন সংঘবদ্ধ দল মুসলমানদের মধ্যে নেই। এর ফলে এই কোটি কোটি দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত মুসলিম জনতা কম্যুনিস্ট প্রচারকদের পক্ষে সহজ লভ্য শিকারে পরিণত হয়েছে। বুর্জোয়া শ্রেনীর মধ্যে যারা একটু মাত্রাতিরিক্ত সাহসী ও ক্ষমতালিপ্সু, তারা রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করার জন্যে হামেশাই নতুন নতুন ফন্দি ফিকির তালাশ করে থাকে। রুশ বিপ্লবের পর এই শ্রেণীর লোকেরা একটি নতুন কৌশলের সন্ধান পেয়েছে। আর তা হলো কিষাণ মজুরদের দরদী সেজে গরিব জন সাধারণকে নিজেদের হাতের মুঠোয় পুরে নেয়া। তাদের ভেতর স্বার্থপরতা, লালসা ও প্রতিহিংসার আগুন প্রজ্বলিত করা। তাদেরকে সঙ্গত অধিকারের চাইতে বেশি সম্পদ দেবার প্রলোভন দেখানো। বিত্তবান সম্প্রদায়ের সঙ্গত সম্পদ পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়ে তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়া। এইভাবে দেশের অধিকাংশ লোককে আপন মুঠোয় পুরে এরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সম্রাট, ডিরেক্টর ও ক্রোড়পতিদের হাত থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে কেড়ে নিতে চায়। এরা অমুসলিম জনগণের চাইতে মুসলিম জনগণ সম্পর্কে বেশি আশাবাদী। কেননা আর্থিক দিক থেকে মুসলমানরাই বেশি দুর্দশাগ্রস্ত! এরা তাদের হৃদয় জয় করার জন্যে পেটের দিক থেক পথ তৈরি করছে। কারণ ক্ষুধার্ত মানুষের গোটা দেহের মধ্যে এটি হচ্ছে সবচাইতে নাজুক অংশ! এরা তাদেরকে বলে; ‘এসো, ধনী ও দরিদ্র্যের বৈষম্য মুছে ফেলে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আনবার পথ তোমাদের বাতলে দেই’। একথা শুনে বেচারা ক্ষুধার্ত মুসলমান দু’টুকরো রুটি আর এক মুঠো ভাতের আশায় এদের পেছনে ছুটে যায়। এরা তখন তাকে খোদা পরস্তির পরিবর্তে উদরপূজার ধর্ম গ্রহণের উপদেশ দেয়। তার মানে এই ভাবধারা সৃষ্টির প্রয়াস পায় যে, দীন ও ঈমান কোন কাজের জিনিস নয়, আসল জিনিস হচ্ছে উদরান্ন। যে পন্থায় সেটি সংস্থান করা যায়, তাই হচ্ছে তার ধর্ম এবং তাতেই নিহিত রয়েছে তার মুক্তি ও কল্যাণঃ
“নিঃস্ব, দরিদ্র ও গোলামদের কোন ধর্ম বা তমদ্দুন নেই। তাদের সবচাইতে বড় ধর্ম হচ্ছে এক টুকরো রুটি। তাদের সবচাইতে বড় তমদ্দুন হচ্ছে এক প্রস্থ পুরানো কাপড়। তার সবচাইতে বড় ঈমান হচ্ছে দারিদ্র ও লাঞ্জনা থেকে নিস্কৃতি লাভ। কারণ এই রুটি ও কাপড়ের জন্যে সে চুরি করতে বাধ্য হয়। আজকের দারিদ্র ও গোলামীর দুনিয়ায় তার আর কোন ধর্ম নেই”।
এই হচ্ছে সাম্যবাদী ধর্মের (Communism) প্রথম পাঠ। এই পাঠ দানকালে বেচারা অজ্ঞ ও দরিদ্র মুসলমানকে এই বলে ভুয়া প্রবোধও দেয়া হয় যে, আমরা তোমাদের ধর্মের প্রতি কোনো হস্তক্ষেপ করিনা। তোমরা নিশ্চিন্ত থাকোঃ
এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসের ভয়ের কি কারণ রয়েছে?এগুলোর সাথে তার সম্পর্কই বা কি?ধর্ম তো তার নিজস্ব নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির বলে হামেশাই জীবন্ত ও দীপ্তিমান রয়েছে। [এ অংশ দুটি জনৈক মুসলমান লেখকের একটি প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। প্রবন্ধটি এক বহুল প্রচারিত মুসলিম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।]
বিশ বছরে রাশিয়ার মুসলিম যুব সম্প্রদায়ের ওপর কম্যুনিজম যে প্রভাব বিস্তার করেছে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রই তা জানেন। উপমহাদেশীয় মুসলমানদের সামনেও এমন দুর্যোগময় ভবিষ্যৎ প্রচন্ড হুমকির সাথে এগিয়ে আসছে। উদরাগ্নি তাদের ঈমানের সম্পদকে ভস্ম করে দেয়ার জন্যে লেলিহান শিক্ষা বিস্তার করেছে। এখনো তার ছিদ্রপথ ক্ষুদ্র এবং একটিমাত্র সেলাই দ্বারাই বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু গাফলতির মধ্যে আর কয়েকটি বছর এমনি অতিক্রান্ত হলে তা এতো বড় বন্যাবেগ নিয়ে আসবে যে, তার মোকাবিলায় প্রকান্ড বাঁধাও খড় কুটোর ন্যায় ভেসে যাবে।
এই পরিস্থিতিতে শুধু খ্রিস্টান মিশনারির কায়দায় ইসলামের তাবলীগ করে বেড়ানো একেবারেই অর্থহীন। আকীদা বিশ্বাসের পরিশুদ্ধির জন্যে একটি নয়; বরং লক্ষ লক্ষ পুস্তিকা প্রকাশ করলেও এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবেনা। নিছক মুখে মুখে বা লেখনির সাহায্যে ইসলামের মাহাত্ম কীর্তন করেই বা কি লাভ?আজকে তো প্রয়োজন ইসলামের সৌন্দর্যকে বাস্তব দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করে দেখানো। ইসলামী আদর্শের ভেতরেই আমাদের জীবন সমস্যার সমাধান নিহিত কেবল এটুকু কথা বলে দিলেই আমাদের সমস্যাবলীর আপনা আপনি সমাধান হয়ে যাবেনা। ইসলামের মধ্যে যা কিছু শক্তি ও সৌন্দর্য রয়েছে, তা কার্যকরী করা প্রয়োজন। এ দুনিয়াটা সঙ্ঘাত ও সংগ্রামের দুনিয়া। নিছক বুলির সাহায্যে এর গতি বদলানো যেতে পারেনা। একে বদলাতে হলে এক বিপ্লবাত্মক জিহাদের প্রয়োজন। কম্যুনিস্টরা তাদের ভ্রান্ত আদর্শ দিয়ে যদি অর্ধ শতকের মধ্যে দুনিয়ার এক বিশাল অংশে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি কায়েম করতে পারে; ফ্যাসিস্টরা যদি একটি অসামঞ্জস্য পদ্ধতি নিয়ে দুনিয়ার বুকে নিজেদের খ্যাতি-যশ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, গান্ধীর অহিংস নীতি একটি অস্বাভাবিক বস্তু সত্ত্বেও নিছক চেষ্টা সাধনার বলে প্রকাশ লাভ করতে পারে, তাহলে সততা ও সুবিচারের সনাতন আদর্শবাহী মুসলমানদের পক্ষে দুনিয়ায় আবার প্রতিষ্ঠা লাভ না করার কোনই কারণ নেই। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠা শুধু ওয়াজ নসিহত আর সদুপদেশ দ্বারা লাভ করা যাবেনা। এর জন্যে বাস্তব প্রয়াস প্রচেষ্টা আবশ্যক এবং আল্লাহর মনোনীত পন্থায় কাজ করা প্রয়োজন।
‘বিপ্লবাত্মক সংগ্রাম’ একটি অস্পষ্ট কথা। বাস্তবক্ষেত্রে এর অনেক প্রক্রিয়া রয়েছে এবং আরও অনেক প্রক্রিয়া হতে পারে। তবে যে ধরণের বিপ্লব সৃষ্টিই কাম্য হোক, তার জন্যে বিপ্লবের প্রকৃতির সাথে সুসামঞ্জস্য প্রক্রিয়াই অবলম্বন করতে হবে। আমরা যে বিপ্লব সৃষ্টি করতে চাই,তার জন্যে নতুন কোন প্রক্রিয়া খোঁজার প্রয়োজন নেই। কারণ এর আগেও দুনিয়ায় এ বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। যে মহাপুরুষ এই বিপ্লব প্রথম সৃষ্টি করেন, এর প্রকৃতি সম্পর্কেও তিনি ছিলেন সম্যকরূপে অবহিত। তাঁর অনুসৃত পথে আজো এ বিপ্লব সৃষ্টি করা যেতে পারে। সে মহাপুরুষের জীবন চরিত্র একটি বিস্ময়কর বস্তু। কিন্তু অন্যদিক থেকে তা একটি নির্ভুল আদর্শও বটে। অমন উন্নত চরিত্র পরহেযগারী, বিচার বুদ্ধি, ন্যায়পরায়ণতা, শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ও মহাপুরুষোচিত গুণাবলীর বিপুল দৃষ্টান্ত আজ কে পেশ করতে পারে? কার পক্ষেই বা অতো উন্নতমানের বিপ্লব সৃষ্টি সম্ভবপর? এদিক থেকে তাঁর জীবন চরিত্র বাস্তবিকই এক বিস্ময়কর বস্তু এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ বিস্ময় মানুষকে মুগ্ধ করবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু সে মহাপুরুষ যে আদর্শ রেখে গিয়েছেন, তার মেজাজ ও প্রকৃতি সাড়ে তেরশ বছর পূর্বেকার মতোই বিপ্লবাত্মক। সে আদর্শ যতো বেশি অনুসরণ করা হবে এবং যত বেশি তার অনুকরণ করা হবে, ততো বেশি বিপ্লবাত্মক ফলাফলই প্রতিভাত হবে। পরন্তু যে বিপ্লব মূল আদর্শের বলে সাধিত হয়েছিল এ ফলাফল ততো বেশি তার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবে। এদিক থেকে তা একটি নির্ভুল আদর্শ, সন্দেহ নেই। এ আদর্শ কিয়ামত অবধি মানুষের পক্ষে অনুকরণযোগ্য। এই মহান আদর্শ অনুসরণ করে বিংশ শতকে কি চতুর্বিংশ শতকে, এ উপমহাদেশে কি আমেরিকায় কি রাশিয়ায়- যে কোন দেশে, যে কোন সময় এ ধরণের বিপ্লব সৃষ্টি করা যেতে পারে।
রাসুলে কারীম (সা) যে প্রক্রিয়ায় সাড়ে তেরশ বছর পূর্বে দুনিয়ায় বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন, তা সবিস্তারে বিবৃত করার অবকাশ এখানে নেই। এখানে শুধু এটুকু আভাস দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য যে, দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠান [এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। অতঃপর ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে ‘জামায়াতে ইসলামী’ গঠিত হলে তার সঙ্গেই এই প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করে দেয়া হয়। ] – এর পরিকল্পনা সেই মহান আদর্শের গভীরতর অধ্যয়ন থেকেই উদ্ভূত।
মহানবী সা. যখন আবির্ভূত হন, তখন দুনিয়ার একটি লোকও মুসলমান ছিলনা। এমনি অবস্থায় তিনি দুনিয়ার সামনে তাঁর দাওয়াত পেশ করেন। ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্নভাবে দু একজন করে লোক মুসলমান হতে লাগলো। এই লোকগুলো পাহাড়ের চাইতেও সুদৃঢ় ঈমান পোষণ করতেন। এঁরা ইসলামের জন্য এমনি উৎসর্গপ্রাণ ছিলেন যে, দুনিয়ায় তার কোন নজীর নেই। কিন্তু এঁরা বিচ্ছিন্নভাবে কাফেরদের মধ্যে বেষ্টিত থাকার ফলে স্বভাবতই অসহায় ও দুর্বল ছিলেন। এই কারণেই আপন পরিবেশের বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়াই করে তাদের শক্তি শুধু ক্ষয়ই হচ্ছিল; কিন্তু যে অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে তাঁরা এবং তাঁদের মহান নেতা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, তার কোন পরিবর্তন সাধন করতে পারছিলেননা। এভাবেই রাসুলে কারীম সা. ১৩ বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালালেন। এ সময়ে তিনি উৎসর্গপ্রাণ ঈমানদার লোকদের ক্ষুদ্র দল মাত্র সংগঠিত করতে সমর্থ হলেন। অতঃপর আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকে ভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করার নির্দেশ দিলেন। আর তাহলো সেই উৎসর্গপ্রাণ লোকদের নিয়ে কুফরি পরিবেশ ত্যাগ করা, তাদেরকে এক জায়গায় জমায়েত করে ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টি করা, ইসলামী জীবনধারায় গোটা কর্মসূচি কার্যকরী করার উপযোগী একটি গৃহনির্মাণ করা, মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক ও সামগ্রিক শক্তি পয়দা করার জন্যে একটি কেন্দ্র তৈরি করা, তামাম বিদ্যুৎ শক্তিকে এক জায়গায় জমায়েত করে একটি সুনিয়ন্ত্রিত পন্থায় বিকীর্ণ করা ও দুনিয়ার প্রতিটি ভূ-খণ্ডকে তার দ্বারা উজ্জ্বল উদ্ভাসিত করে তোলার জন্যে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র (Power House) নির্মাণ করা। এই উদ্দেশ্যে তিনি ‘ মদিনায়ে তাইয়েবা’ এ হিজরত করলেন। যেসব মুসলমান আরবের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে ছিলেন, তাঁদের সবাইকে এই কেন্দ্রস্থলে জমায়েত হবার নির্দেশ দেওয়া হল।এখানে বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে ইসলামকে কার্যকরী করে দেখানো হল।এই পুত-পবিত্র আবহাওয়ায় গোটা দলকে ইসলামী জীবনধারা সম্পর্কে এমনই ট্রেনিং দেয়া হল যে তার প্রতিটি ব্যক্তিই এক চলমান ইসলামে পরিনত হলো। ইসলাম কি জিনিস আর কেনোই বা তা এসেছে, যেকোন লোককে দেখেই তা উপলব্ধি করা যেত। তাঁদেরকে আল্লাহর রঙে এমনি প্রগাঢ় ভাবে রাঙিয়ে তোলা হলো:
(আরবী)
যেন তারা অন্যের রং কবুল না করে নিজেদের রঙেই অপরকে রাঙিয়ে তোলে। তাদের মধ্যে এমনি চরিত্রবল সৃষ্টি করা হলো, যেন তারা অন্যের দ্বারা কখনো প্রভাবান্বিত না হন; বরং অপর কেউ তাদের সংস্পর্শে এলে প্রভাবিত হয়ে যায়। তাঁদের শিরা উপশিরায় ইসলামি জীবনধারার লক্ষ্যকে এমনিভাবে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়া হল, যেন জীবনের প্রতিটি কাজেই তাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় এবং বাকি সব দুনিয়াবি লক্ষ্য দ্বিতীয় শ্রেনীর গুরুত্ব পায়। তাদেরকে শিক্ষা ও ট্রেনিং এর সাহায্যে এমনি যোগ্য করে তোলা হল, যেন কুরআন ও সুন্নাহ প্রদত্ত জীবনধারাকে যে কোন মুল্যে কার্যকর করেন এবং সর্ববিধ বিকৃত অবস্থাকে চুরমার করে তারই আলোকে পুনর্গঠিত করেন।
এই বিস্ময়কর সংগঠনের প্রতিটি অংশই গভীরভাবে অধ্যয়ন ও প্রণিধানযোগ্য। এই সংগঠনের গোটা কর্যক্রমকে চারটি বড় বড় ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল:
১। দীন ইসলামে বুৎপত্তি লাভ এবং লোকদেরকে ইসলামের বিধি ব্যবস্থা উত্তম রুপে বোঝানোর উদ্দেশ্যে একদল লোক গঠন করা :
(আরবী)
২। ইসলামের আচরন বিধিকে রূপায়িত করা এবং তার প্রচার ও প্রসার কাজে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার জন্যে কিছু লোককে তৈরী করতে হবে। এই লোকগুলোকে অর্থোপার্জনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া সংগঠনের কর্তব্য। কিন্তু এ ব্যাপারে তারা নিজেরা কোন পরোয়া করবে না। অর্থ সংস্থানের কোন ব্যবস্থা হোক বা না হোক নিজেদের ঐকান্তিক আগ্রহের বশবর্তী হয়ে এবং সর্ববিধ দু:খ ক্লেশ অগ্রাহ্য করেই তারা তাদের জীবনের পরম লক্ষকে বাস্তবায়িত করার কাজে লিপ্ত থাকবে :
(আরবী)
৩। দলের প্রতিটি ব্যাক্তি যাতে আল্লাহর কালেমা প্রচারকেই জীবনের লক্ষ্য বলে মনে করে, তাদের মধ্যে এমনই ভাব ধারা উজ্জীবিত করা হবে। তারা দুনিয়ার কাজকারবার চালাতে থাকবে বটে কিন্তু প্রত্যেক কাজেই এই লক্ষ্য তাদের সামনে থাকবে। ব্যবসায়ী তার ব্যবসা বানিজ্যে, কৃষাণ তার কৃষি কাজে, শিল্পপতি তার শিল্প কর্মে, চাকুরে তার চাকুরিতে এই লক্ষ্য কখনো বিস্মৃত হবে না। তারা হামশোই মনে রাখবে যে, এইকাজ গুলো হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্যে আর বেঁচে থাকাটা এই কাজের জন্যে। তারা জীবনের যেকোন ক্ষেত্রেই কাজ করুক না কেন, নিজেদের কথায় ও কাজে, চরিত্র ও ব্যবহারে ইসলামের নীতি ও আদর্শ পালন করবে – কোথাও দুনিয়ার স্বার্থ ও ইসলামী আদর্শের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে স্বার্থের মাথায় পদাঘাত হানবে, কিন্তু নীতিচ্যুত হয়ে ইসলামের অমর্যাদা করবে না। পরন্তু নিজেদের ব্যাক্তিগত প্রয়োজন থেকে যতটা সময় ও ধন মাল তারা বাঁচাতে পারবে তাকে ইসলামের সেবায় নিয়োজিত করবে এবং এই কাজের জন্যে যারা নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করছেন, তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করবে: (আরবী)
৪। বাইরের লোকদেরকে দারুল ইসলামে আসবার এবং তাদেরকে কালামুল্লাহর বাস্তব জীবনধারা ও ইসলামী পরিবেশে কোরআনকে অধিকতর সুষ্ঠুভাবে বুঝতে পারবে এবং অপেক্ষাকৃত গভীর প্রভাব নিয়ে ফিরে যেতে পারবেঃ
(আরবী)
এমনিভাবে মাত্র আট বছরের স্বল্প সময়ে দুনিয়ার সবচাইতে বড় দিশারী ও পথিকৃৎ মদীনার বিদ্যুত কেন্দ্র (Power House) এক প্রচন্ড শক্তির সঞ্চার করলো, সে শক্তি দেখতে না দেখতে গোটা আরব ভুমিকে আলোকজ্জল করে দিল। অতপর সে আলোক রশ্মি আরব থেকে বেরিয়ে দুনিয়ার দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। এমন কি দীর্ঘ সাড়ে তের’শ বছর অতিক্রান্ত হবার পর আজও সে বিদ্যুৎ কেন্দ্র শক্তি সম্পদে পরিপূর্ন।
খিলাফতে রাশেদার পরই ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় নানা রূপ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলে আমাদের সূফী সম্প্রদায়ও এই প্রক্রিয়ার অনুকরনে বিভিন্ন যায়গায় খানকাহ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আজ খানকাহ কথাটির এমনই অর্থ বিকৃতি ঘটেছে যে, শব্দটি শোনা মাত্রই লোকদের মনে আলো হাওয়া বর্জিত এক বিদঘুটে জায়গার চিত্রই ভেসে ওঠে। কিন্তু আসলে এই খানকাহ ছিল মদীনায় বিশ্বনবী স. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আদর্শেরই একটি অনুকরন মাত্র। যেসব লোকের মধ্যে কিছুটা প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যেত, শ্রদ্ধেয় সূফী সম্প্রদায় তাদেরকে বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে কিছুদিনের জন্য খানকায় রেখে দিতেন এবং মহানবী স. ও সাহাবায়ে কিরামের অনুকরনে সেখানে তাদেরকে উন্নত মানের ট্রেনিং দান করতেন।
আজকে যারা ইসলামী ধরনের বিল্পব সৃষ্টি করতে চান, তাদেরও এমনি প্রক্রিয়া অবলম্বন করা উচিত। যদি এই উপমহাদেশের বাইরে কোথাও মদীনার ন্যায় ‘দারুল ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার উপযোগী স্বাধীন পরিবেশ না পাওয়া যায়, তাহলে অন্তত এ দেশেই এমনি ট্রেনিং কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত যেখানে খালেস ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। যেখানে ইসলামী চরিত্র ও সামাজিকতা প্রতিফলিত হবে, মুসলমানের ন্যায় বাস্তব চিন্তাধার গড়ে উঠবে এবং চারিদিকে ইসলামী ভাবধারা ও আকৃতি সমুদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। যেখানে শুধু আল্লাহ ও রসূলের অনুমতি বা নির্দেশই কোন জিনিসকে অভ্রান্ত ঘোষনার পক্ষে যথেষ্ট হবে এবং আল্লাহ ও রসূলের বারণ বা অপছন্দই কোন জিনিসকে ভ্রান্ত বিবেচনার জন্যে একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে স্বীকৃত হবে। যেখানে এই সর্বগ্রাসী অবাধ্যতা ও বিদ্রোহাত্তক পরিবেশ, এ অনিসলামী পারিপার্শ্বিকতার কোন অস্তিত্ত থাকবে না; যেখানে অন্তত ইসলামী ভাবধারার অনুকূল বহিপ্রভাবকে গ্রহন করবার এবং প্রতিকূল প্রভাব থেকে নিজেদের জীবনধারা ও মন মগজকে রক্ষা করার মত ক্ষমতা থাকবে। যেখানে আমরা মুসলমানের মত ভাবা, মুসলমানী অন্তর্দৃষ্টি পয়দা করা এবং দারুল কুফরের বিশাক্ত আবহাওয়ায় বিলুপ্ত প্রায় গুনরাজিকে বিকাশ দান করার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারব। সর্বোপরি, অনিসলামী পরিবেশে ভুমিষ্ঠ ও লালিত হবার ফলে আমাদের ধ্যান ধারনা ও ক্রিয়া কর্মে অনুপ্রবিষ্ট নোংরামী ও মলিনতা যা কখনো কখনো আমাদের অনুভূত হয় না, আর অনূভুত হলেও শক্তি এমনি প্রচন্ড মূর্তি নিয়ে দাড়ায় যে, শত চেষ্টা করেও আমরা তার থেকে আত্মরক্ষা করতে পারি না – যেখানে গিয়ে আমরা নিজেদের জীবনকে পবিত্র করতে পারবো। এইধরনের ট্রেনিং কেন্দ্রে শুধু সাচ্চা দিলে ইসলামের খেদমত করতে ইচ্ছুক লোকদেরই জমায়েত করা হবে এবং সেখানে তাদের যথার্থ শিক্ষা ও ট্রেনিং দিয়ে এই খেদমতের জন্য তৈরী করা হবে। সেখানে নবী করীম স. – এর অনুসৃত পরিকল্পনাই গ্রহন করতে হবে। তেমনিভাবে গোটা কাজকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে দিতে হবে এবং প্রত্যেক বিভাগেই মনুষ্যত্বকে ইসলামিয়াতের ছাঁচে ফেলে পুনর্গঠিত করতে হবে।
১. এর একটি বিভাগে উন্নত মানের যোগ্যতা সম্পন্ন লোকদের অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। এদের মধ্যে যারা ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানে পারদর্শী তাদেরকে পাশ্চাত্য ভাষা ও আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত করাতে হবে। আর যারা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা লাভ করেছেন তাদেরকে আরবি ভাষা ও ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে হবে। সেই সঙ্গে তাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করে দীন ইসলাম সম্পর্কে ব্যুৎপত্তি ও বিচক্ষণতা লাভ করতে হবে। এরপর তাদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দিতে হবে। প্রত্যেক দলেই জ্ঞানের এক একটি শাখা নিয়ে তাতে ইসলামী নীতি ও মতাদর্শকে আধুনিক পদ্ধতিতে সন্নিবিষ্ট করবেন এবং জীবনের আধুনিক সমস্যাবলী উপলব্ধি করে ইসলামী নীতির আলোকে সেগুলোর সমাধান তালাশ করবেন। পরন্তু জ্ঞান বিজ্ঞানের ভিত্তিমূলে যে পাশ্চাত্য দৃষ্টি ভঙ্গি অনুপ্রবেশ করেছে, তাকে বহিস্কৃত করে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞান বিজ্ঞানকে নতুন করে বিন্যস্ত করবেন এবং নিজস্ব গবেষণা ও অনুসন্ধানের সাহায্যে ইসলামের সপক্ষে মানসিক বিপ্লব সৃষ্টির ক্ষমতাসম্পন্ন সৎ সাহিত্য সৃষ্টি করবেন।
২। দ্বিতীয় বিভাগে ইসলামের খেদমতের জন্যে সুযোগ কর্মী তৈরীর চেষ্টা করতে হবে। সৎ স্বভাব, দৃঢ় চরিত্র, কৃতসংকল্প এবং আপন লক্ষ্যের খাতিরে সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত, এমন লোকদেরই এতে গ্রহণ করতে হবে। এরা একটা প্রচণ্ড বিপ্লবী দলের আকারে সংঘবদ্ধ হবে। এদের জীবনযাত্রা হবে সরল ও সাদাসিধে। এদের মধ্যে কষ্ট সহিঞ্চুতা ও পূর্ণ নিয়ম শৃংখলা বর্তমান থাকবে। এদের বাস্তব জীবন হবে খাঁটি মুসলমানের মতো। এই দলটি ইসলামী নীতির ভিত্তিতে একটি নয়া সমাজ ব্যবস্থা এবং একটি নতুন সভ্যতা গড়ে তুলবার প্রোগ্রাম নিয়ে অগ্রসর হবে এবং জনসাধারণের সামনে সে প্রোগ্রাম পেশ করে সর্বাধিক পরিমাণে রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয় করবে এবং প্রচলিত জুলুমকে শাসন ব্যবস্থাকে সুবিচারমূলক শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করার জন্যে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র যন্ত্র করায়ত্ত করবে।
৩। তৃতীয় বিভাগে এমন লোকদের গ্রহণ করতে হবে, যারা কিছুকাল ট্রেনিং কেন্দ্রে থেকে ফিরে চলে যাবে। তাদেরকে সঠিক জ্ঞান ও নৈতিক ট্রেনিং দিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে। তারা যেখানেই বাস করুক না কেন, মুসলমান হিসেবে বাস করবে। তারা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হবার পরিবর্তে তাদের ওপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করবে। তারা নীতিতে অটল এবং নিজস্ব মত বিশ্বাসে সুদৃঢ় হবে। তারা কখনো উদ্দেশ্যহীন জীবন যাপন করবেনা। একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য সর্বাবস্থায় তাদের সামনে থাকবে। তারা হালাল পন্থায় অর্থোপার্জন করবে এবং দ্বিতীয় বিভাগে কর্মরত লোকদেরকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে সাহায্য করার জন্যে প্রস্তুত থাকবে। এরা তাদেরকে আর্থিক সাহায্যও করবে আর তাদের বাস্তব কাজেও অংশগ্রহণ করবে। পরুন্ত এরা আপন পরিবেশকে বিপ্লবী দলের পক্ষে অনুকূল করে তুলবার জন্যেও চেষ্টা করবে।
৪। চতুর্থ বিভাগটি থাকবে এমন মুসলমান ও অমুসল্মানের জন্যে, যারা সাময়িকভাবে ট্রেনিং কেন্দ্রে এসে কিছু শিক্ষাগত ফায়দা হাসিল করতে কিংবা সেখানকার জীবনধারা পর্যবেক্ষণ করতে ইচ্ছুক। তারা যাতে ইসলাম ও তার শিক্ষার প্রগাঢ় ছাপ নিয়ে ফিরে যেতে পারে, সেজন্যে তাদেরকে সর্বাধিক সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে।
এ হচ্ছে একটি মোটামুটি পরিকল্পনা। ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টির জন্যে আমরা যে ব্যবস্থাটি একটি অপরিহার্য ভূমিকা বলে মনে করি, এটি হচ্ছে তারই খসড়া মাত্র। এই ব্যবস্থাটির সাফল্য নির্ভর করে সর্বতোভাবে এর প্রানবস্তু ও গুণাবলীর ওপর। এই ঈস্পত সাফল্য লাভ করতে হলে মদিনায় নবী করীম সা এর প্রতিষ্টিত আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার সাথে এর অধিকতর সাদৃশ্য স্থাপন করতে হবে।
মদীনায়ে তাইয়্যেবার সঙ্গে সাদৃশ্য স্থাপনের অর্থ এই নয় যে, আমরা বহিরাকৃতিতে সাদৃশ্য স্থাপনের পক্ষপাতী এবং বর্তমান তামদ্দুনিক স্তর থেকে পিছু হটে আরবের সাড়ে তের’শ বছর পূর্বেকার তামদ্দুনিক স্তরে ফিরে যেতে আগ্রহশীল। রসূলে করীম সা ও সাহাবায়ে কিরামের আনুগত্য সম্পর্কে এই ধারনা একবারেই ভ্রান্ত। দুর্ভাগ্য বশত আমাদের অধিকাংশ ধার্মিক লোক এই ভ্রান্ত ধারণাই পোষণ করেন। তাদের মতে, প্রাচীন বুজুর্গ ও মনীষীদের ন্যায় পোষাক পরা ও খাবার খাওয়াকেই বলা হয় তাদের পায়রবী। তেমনিভাবে তাদের পারিবারিক রীতিনীতি, তমদ্দুন ও নাগরিকতাকে হুবহু সেকেলে (Foscilised )রুপ কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষন করা, নিজেদের পরিবেশের বাইরের পরিবর্তন সম্পর্কে চোখ বন্ধ করে নিজস্ব মন মগজ ও জীবনধারার চারিদেকে একটি প্রাচীর তুলে নেয়া এবং তার মধ্যে কালের গতি ও যুগের পরিবর্তনকে প্রবেশ করার অনুমতি না দেয়াই হচ্ছে তাঁদের অনুগতদের কর্তব্য। বস্তুত পতন যুগের কয়েক শতক ধরে ধার্মিক মুসলমানদের মন মগজে প্রভাবশীল এই ধারণাটি ইসলামী ভাবধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কারণ জীবিত অবস্থায়ই প্রাচীন নিদর্শন হয়ে থাকা এবং জীবনটাকে প্রাচীন তমদ্দুনের একটি ঐতিহাসিক নাটকে পরিণত করা মোটেই ইসলামের শিক্ষা নয়। সে কখনো বৈরাগ্যবাদ বা প্রতিক্রিয়াশীলতা শিক্ষা দেয়না। দুনিয়ায় এমন কোন জাতি সৃষ্টি করা ইসলামের উদ্দেশ্য নয়, যারা শুধু পরিবর্তন ও ক্রমবিকাশকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করবে; বরং সে এমন একটি জাতি সৃষ্টি করতে চায়, যে পরিবর্তন ও ক্রমবিকাশকে ভ্রান্ত পথ থেকে ফিরিয়ে সঠিক পথে পরিচালিত করবার প্রয়াস পাবে। ইসলাম আমাদেরকে খোলস নয়, প্রানবস্তু দান করে। সে চায়, স্থান ও কালের পরিবর্তনের ফলে কিয়ামত পর্যন্ত জীবনের যতো বিভিন্ন খোলসই সৃষ্টি হোক, আমরা যেন তাতে এই প্রানবস্তুই সঞ্চার করতে থাকি। মুসলমান হিসেবে এই হচ্ছে দুনিয়ায় আমাদের উদ্দেশ্য। আমাদেরকে শ্রেষ্ট উম্মত বানাবার উদ্দেশ্য এই নয় যে, আমরা ক্রমবিকাশের পথে অগ্রসর লোকদের পশ্চাৎ প্রহরী (Rear Guard) হিসেবে লেগে থাকবো; বরং আমাদের কাজ হচ্ছে ইমামত ও নেতৃত্ব দান করা। আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে অগ্রনায়ক হবার জন্যে এবং আমাদের শ্রেষ্ট উম্মত হবার রহস্য প্রচ্ছন্ন রয়েছে (আরবী) কথাটির ভেতরে।
রসূলে করীম সা এবং তাঁর সাহাবায়ে কিরামের প্রকৃত আদর্শ যা আমাদের অনুসরন করা কর্তব্য হচ্ছে এই যে, তারা প্রাকৃতিক বিধানকে নৈতিক বিধানের আলোকে ব্যবহার করে দুনিয়ার খোদায়ী খিলাফতের পরিপূর্ণ হক আদায় করেছেন। তাঁদের আমলের যে তামদ্দুনিক অবস্থা বর্তমান ছিল, তার খোলসের ভেতরে তারা ইসলামী সভ্যতার প্রানবস্তু ফুঁকে দিয়েছিলেন। তখন যেসব প্রাকৃতিক শক্তির উপর মানুষের কর্তৃত্ব ছিল সেগুলোকে তারা এই সভ্যতার খাদেম বানিয়েছিলেন। তখনকার তমদ্দুন উন্নতি ও প্রতিপত্তির যত উপায় উপকরণই সংগ্রহ করেছিলো সেগুলোকে কাজে লাগাবার ব্যাপারে তারা কাফের ও মুশরিকদের চাইতেও অগ্রবর্তী ছিলেন, যাতে করে খোদাদ্রোহিদের মোকাবেলায় খোদানুগতদের সভ্যতা অর্জন করতে পারে। আল্লাহ পাক তার কিতাবে এই জিনিস টিরই শিক্ষা দিয়েছেন (আরবী) তাদেরকে এই শিক্ষা দেয়া হয়েছিলো যে, আল্লাহর সৃষ্টি শক্তিগুলোকে কাজে লাগাবার ব্যাপারে কাফিরদের চাইতে মুসলমানদেরই অধিকার বেশি; বরং মুসলমানরাই হচ্ছে এর আসল হকধার। কাজেই নবী করীম সা ও তাঁর সাহাবাদের সঠিক আনুগত্য হলো এই যে, তামদ্দুনিক ক্রমবিকাশ ও প্রাকৃতিক শক্তি গুলোর আবিষ্কারের ফলে আজকে যেসব উপায় উপকরণ সংগৃহীত হয়েছে, সেগুলোকে প্রথম যুগের মতোই ইসলামী সভ্যতার খাদেম বানাবার চেষ্টা করতে হবে। এই উপকরণগুলোর মধ্যে কোন নোংরামী ও অপবিত্রতা নেই, তা রয়েছে এগুলোর দ্বারা কুফরী সভ্যতার মধ্যে। রেডিও কোন নাপাক জিনিস নয়; বরং নাপাক হচ্ছে সেই সভ্যতা, যা রেডিও ডিরেক্টর কে নাচ গানের ব্যবস্থাপক কিংবা মিথ্যা ও অসত্যের প্রচারকে পরিণত করেছে। বিমানপোত কোন নাপাক বস্তু নয়; বরং নাপাক হচ্ছে সেই সভ্যতা, যা বাতাসের ফেরেশতা থেকে খোদায়ী বিধানের পরিবর্তে শয়তানি চক্রান্তনুযায়ী এর সেবা গ্রহন করেছে। তেমনিভাবে সিনেমা বা ছায়াছবিও কোন অপবিত্র জিনিস নয়, অপবিত্র হচ্ছে আসলে সেই সভ্যতা যা খোদার সৃষ্টি এই শক্তিটিকে অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার প্রচারে নিয়োগ করছে।[বর্তমান কালের টেলিভিশনের বেলায়ও সমানভাবে প্রযোজ্য- সম্পাদক] আজকে নাপাক সভ্যতার বিকাশ বৃদ্ধি লাভের কারণ এই যে, আজ এর বিকাশ বৃদ্ধির জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। আজকে খোদায়ী সভ্যতার বিকাশ বৃদ্ধি লাভের জন্যে আমাদের ওপর আরোপিত কর্তব্য সুষ্ঠূভাবে পালন করতে হলে ঐ শক্তি গুলোকেই ব্যবহার করতে হবে। বস্তুত এ শক্তি গুলো হচ্ছে তরবারির মতো, যে ব্যক্তি তাকে ব্যবহার করবে তা নাপাক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করুক আর পাক উদ্দেশ্যে, সেই সফলকাম হবে। পাক উদ্দেশ্য পোষণকারী যদি তার উদ্দেশ্যের পবিত্রতা নিয়ে শুধু বসেই থাকে আর তরবারি ব্যবহার না করে, তবে তা হবে গুরুতর অপরাধ এবং সে অপরাধের শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে। কারণ, এই কার্যকারণের জগতে আল্লাহর প্রবর্তিত বিধানকে কারো মুখ চেয়েই বদলানো যেতে পারেনা।
এই ব্যাখা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, আমি যে আন্দোলনটি পেশ করতে যাচ্ছি, তা কোন প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন নয়, কিংবা এমন কোন প্রগতিশীল আন্দোলনও নয়, যার লক্ষ্য শুধু বৈষয়িক উন্নতি লাভ করা। আমার সামনে যে ট্রেনিং কেন্দ্র রয়েছে তার জন্য গ্রোকল কাংড়ী, সত্যাগ্রহ আশ্রম, শান্তিনিকেতন কিংবা দয়াল বাগে [এগুলো হিন্দুদের আশ্রম জাতীয় প্রতিষ্ঠান। – সম্পাদক] কোন আদর্শ নেই। এমনিভাবে যে বিপ্লবী দলের ধারণা আমি পোষণ করি, তার জন্যে ইটালির ফ্যাসিস্ট ও জার্মানির ন্যাশনাল সোশ্যালিষ্ট পার্টিতেও কোন আদর্শ নেই। তার জন্য আদর্শ রয়েছে শুধুমাত্র মদিনাতুর রাসূলও নবী সা কর্তৃক গঠিত হিজবুল্লাহ’র (আল্লাহর দল) এর মধ্যে।
— সমাপ্ত —