তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ মুসলমান আইনবিদদের সিদ্ধান্ত
বাংলায় ওয়াহাবীদের রাজদ্রোহমূলক সংগঠন গড়ে তোলার সময় নিজ দেশবাসীদের কাছ থেকে তাদেরকে কিছুটা বিরোধীতার সম্মুখীন হতে হয়। মুসলমান সমাজের বিভিন্ন ফেরকার মধ্যে যে পারস্পরিক বিদ্বেষ রয়েছে তা এত তীব্র যে, এক ফেরকা অন্যে ফেরকার লোকদের খ্রিষ্টানের মত বিধর্মী বলে মনে করে; এ ছাড়াও বিষয় সম্পত্তি ও কায়েমি স্বার্থের মালিক মুসলমান ও হিন্দু নির্বিশেষে সবাই যেকোনো জেলায় ওয়াহাবীদের উপস্থিতিকে একটা উৎপাত বলে মনে করে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিপ্লবীদের কার্যকলাপ একই রকম হয়ে থাকে এবং ওয়াহাবীরাও তদনুসারে লুথার বা ক্রমওয়েলের মত সংস্কারবাদীর ভূমিকায় না গিয়ে বরং রবসপিয়ের বা তাষ্ণলিনের (তার অনুসারীরাই ছিল খাটি খ্রিস্টান। তিন হাজার দেহরক্ষীর এক বিরাট বাহিনী দ্বারা তিনি সব সময় পরিবৃত থাকতেন। জনসাধারণ তাকে দেবতা বা তার চেয়েও বড় কিছু মনে করে পূজা করত। তার গোছল করা পানি তারা পান করত। মিলম্যান প্রণীত লাতিন খ্রিষ্ট ধমের ইতিহাস; ৫ম খন্ড, পৃঃ ৩৮৯; সঃ ১৮৬৭)মত ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় অবতীর্ণ হয়। উতরেত সম্প্রদায়ের যাজকরা যেমন প্রতিবার কশাঘাতের সম্মুখীন হয়ে ভয়ে চীৎকার দিয়ে ওঠতো, তেমনি মসজিদ বা ধর্মস্থান (সাধারণত: মাজার সংলগ্ন যৎসামান্য জমি বা আম বাগান)সংলগ্ন বারো একর জমির মালিক প্রতিটি মুসলমান যাজক গত অর্ধশতক যাবত ওয়াহাবীদের বিরুদ্ধে ভয়ার্ত কন্ঠে চীৎকার করে আসছে। ১৮১৩ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত মক্কায় ওয়াহাবীরা জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে রাস্তায় বের হতে পারেনি। এমনকি আজও অসম্মান ও মারপিটের আশংকা ছাড়া তারা পথে চলাফেরা করতে পারে না।
অন্য দেশে যেমন, ভারতেও তেমনি, ভূস্বামী ও যাজকরা যে কোন পরিবর্তনকে ভয়ের চোখে দেখে থাকে। মুসলমান ভূস্বামীরা মসজিদের স্বার্থ দেখাশোনা করে,যেমন ইংরেজ ভূস্বামীরা প্রতিষ্ঠিত গির্জার স্বার্থ রক্ষা করে। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক যে কোন ধরনের বিল্পব কায়েমি স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। ভারতীয় ওয়াহাবীরা উভয় দিক থেকেই চরম বিল্পবীঃ ধর্মীয় বিষয়ে তারা মানুষের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসে নাড়া দিয়েছে; আর রাজনৈতিক বিষয়ে তাদের কার্যকলাপ ঠিক কম্যুনিস্ট ও রেড রিপাবলিকানদের মত। গুরু থেকেই তারা স্বমতের বিরোধী যে কোন মুসলমানের উপর উৎপীড়কের মত আর্বিভূত হয়েছে। তাদের ধর্মগুরু হিন্দু-শিখদের বিরুদ্ধে যে অস্ত্র ধারণ করেছেন ঠিক তেমনি ১৮২৭-৩০ সালে পেশোয়ারের জনৈক একগুঁয়ে মুসলিম গভর্নরের বিরুদ্ধেও তিনি অসি চালনা করেন। ১৮৩১ সালে কলকাতার চারপাশে যে কৃষক বিদ্রোহ হয় তখনও তারা মুসলমান ও হিন্দু জমিদারদের গৃহ সমান তছনছ করে। এমনকি তাদের হাতে মুসলমান ভূস্বামীরাই সর্বাধিক নির্যাতিত হয়েছে বলা চলে, কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে দস্যুরা কোন মুসলিম ভূস্বামীরা কন্যাকে বলপূর্বক অপহরণ করে তাদের দলপতির সাথে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। এদেরে সম্পর্কে পনের বছর পর যে সরকারী তথ্য বিবরণী প্রকাশিত হয় তা পড়লে পৃথিবীর যেকোনো ভূস্বামী সক্রোধে অস্থিরতা প্রকাশ করবে। ঐ বিবরণীতে বলা হয়েছে: এরা ছিল আশি হাজার লোকের এক বিরাট জনতা, যারা নিজেদের মধ্যে পূর্ণ সমতা দাবি করে, এবং এরা নিম্ন শ্রেণীর পরিবার থেকে উদ্ভূত।
এমনকি এ ধরনের কোন ধর্মীয় উপদ্রব জমিদার বা সুবিধাভোগী শ্রেণীর কেউ সুনজরে দেখতে পারে না। অবশ্য বাংলায় একটা গোটা বাণিজ্যিক গোষ্ঠী (এরা খুবই বিত্তশালী ও শক্তিমান) তাদের পক্ষভুক্ত ছিল। চমকার হচ্ছে হিন্দু সমাজের নিম্নতম শ্রেণীর লোক। হিন্দুদের পবিত্র গরু মারা গেলে চমকার তার অপবিত্র হাতে সেই গরুর চামড়া খুলে নিয়ে ব্যবসা করে লাভবান হয়। এরা এমন একটা জাতের লোক যারা আজন্ম অপবিত্র, ভদ্র সমাজের কাছে অস্পৃশ্য, এবং কোন সম্পদ বা সাফল্যই তাদেরকে সম্মানজনক স্তরে উঠাতে পারে না। কোন অবস্থাতেই সে আর সমাজের উপর স্তরে উঠতে পারে না, সুতরাং এজন্য কোন চেষ্টাও সে করে না। সে যতই সৎ ও বিনয়ী হোক না কেন, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সে কখনও সম্মানজনক ব্যবহার পাবে না; কাজেই সম্মান ছাড়াই তাকে সন্তুষ্ট থোকতে হয়। গ্রামে অধিকসংখ্যক গরু মারা গেলে সে খুশী হয়, কারণ তাহলে অনেক বেশী চামড়া তার হাতে আসবে। আর গরুর মৃত্যুর হার খুব বেশী কমে গেলে সে বিষ প্রয়োগ করে মৃত্যুর হার কিছুটা বাড়িয়ে নিতে পারে। এ ধরনের হতভাগ্য লোকেরা কখনও খুচরো ব্যবসায়ের চেয়ে বেশি কিছু আশা করতে পারে না; ফলে চামড়ার অতি লাভজনক পাইকারী ব্যবসাটা মুসলমান ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। কিন্তু পবিত্র গরুর চামড়া নিয়ে ব্যবসা করাকে হিন্দুরা যে কত অপরাধজনক কাজ মনে করে, মুসলমানদের তা নিয়ে মাথা ঘামাবার কোনই প্রয়োজন নেই। একারণে এটা মুসলমান চম ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া কারবারে পরিণত হয়েছে এবং এ থেকে তারা দেশের অন্যতম প্রধান ধনাঢ্য শ্রেণীতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু হিন্দুরা তাদেরকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে এবং হিন্দুদের এই মানসিকতার প্রতিদানও তারা দিয়ে থাকে। তারা ভাল করেই জানে যে, ব্রাক্ষণরা কোন সময় কর্তৃত্ব পেয়ে গেলে তারাই হবে পৌত্তলিকদের হামলার প্রথম শিকার। কাজেই তারা পৌত্তলিক হিন্দুদেরকে পহেলা নম্বর দুশমন বলে মনে করে এবং এই অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাবার জন্যই তারা ওয়াহাবীদের সবচেয়ে বেশী অর্থ সাহায্য করে।
কিন্তু যতই শক্তি ও বিত্তের অধিকারী হোক না কেন, টই ওয়াহাবীদের শক্তির একমাত্র উৎস নয়। ওয়াহাবীরা জোরালো ভাষায় জনসাধারণের মধ্যে প্রচার চালায় এবং ধম ও রাজনীতি যে কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই তারা আবেদন করেছে সেটাই অশান্ত জনগণের আশা আকাংখার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে এমন হাজার হাজার কর্মী আছে যাদের সম্বন্ধে আমি আগেই বলেছি এবং আবারও আনন্দের সাথে বলছি যে, তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন দেয়াকেই জীবনে প্রাথমিক কর্তব্য বলে মনে করে। এটা এমনই একটা বৈশিষ্ট্য যার জন্য পার্থিব লাভ লোকসান নিয়ে ব্যাপৃত জনসাধারণ তাদেরকে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও ভক্তির দৃষ্টিতে দেখে। আদর্শ ওয়াহাবীরা নিজের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ভীতিমুক্ত এবং অন্যের সম্পর্কে ক্ষমাহীন। তার চলার পথ খুবই স্পষ্ট এবং কোন কিছুই তাকে দমন করতে পারে না। বাংলার কোন এক কারাগারে বর্তমানে এমন একজন বৃদ্ধ আলেম আটক আছেন যিনি সব দিক দিয়েই নিষ্কলঙ্ক জীবনের অধিকারী তবে তিনি ভয়ঙ্কর রাজদ্রোহী। গত ত্রিশ বছর যাবত তার রাজদ্রোহমূলক কার্যকলাপ সম্পর্কে সরকার অবগত আছেন এবং তিনিও জানতেন যে, সরকার তার মতলব সম্পর্কে ওয়াকিফহাল।১৮৪৯ সালে তাকে সরকারীভাবে সর্তক করে দেয়া হয়। তারপর ১৮৫৩ ও ১৮৫৭ সালে তাকে উপর্যুপরি সর্তক করা হয় এবং ১৮৬৪ সালে তাকে প্রকাশ্যে আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তলব করে শেষবারের মত হুশিয়ার করা হয়। কিন্তু এত সতর্কবাণীর প্রতি কর্ণপাত না করায় ১৮৬৯ সালে তাকে নজরবন্দী করা হয়। এ জাতীয় তৎপরতা দমন করা খুবই অসুবিধাজনক।নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী নিষ্ঠার সাথে নিজ পথ অনুসরণকারী এই ধরনের লোকদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা কোন সরকারই গ্রহণ করতে চায় না এবং এ ক্ষেত্রে কেবল অন্যের ক্ষতি করা থেকে বিরত করার উদ্দেশ্যে তাকে নজরবন্দী রাখা ছাড়া আর কোন বিকল্প সম্ভবত নেই।
ওয়াহাবীদের মতবাদ প্রচার করা মোটেই সহজ কাজ নয়। প্রথমত: এ মতের অনুসারীদের বার্ষিক একটা নিদিষ্ট পরিমাণ অর্থ ওয়াহাবী তহবিলে দান করা অবশ্য কর্তব্য। আর যারা সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করে এবং সীমান্তের প্রশিক্ষণ শিবিরে যারা অংশগ্রহণ করে তাদেরকে তো অত্যন্ত কঠিন ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিচারের এই জাতীয় কর্মীরা যে সকর জবানবন্দী দিয়েছে তার চেয়ে দুঃখজনক আর কোন বিবরণ আমি পাঠ করিনি। বিচারকদের অভিমতের সারাংশ থেকে এ তথ্য জানা গেছে যে, ওয়াহাবী প্রচারকরা অত্যুৎসাহী যুবকদের যাদের বয়স সাধারণত বিশ বছরের নিচে, রিক্রুট করে তাদের মধ্যে থেকে হত্যাকার্যের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিভিন্ন গ্রুপ গঠন করে এসব যুবকদের পূর্ব বাংলার প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে রিক্রুট করা হয়। এভাবে তারা হাজার হাজার কৃষক পরিবারের মাঝে দুঃখ দুর্দশার সঞ্চার এবং উদীয়মান তরুণ বংশধরদের পরিণাম সম্পর্কে সমগ্র পল্লীবাসীদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। কোন ওয়াহাবী পিতার পক্ষে তার তরুণ বয়সের ছেলে কোন মুহূর্তে যে অদৃশ্য হয়ে যাবে না, তা বলা সম্ভবপর নয়। এভাবে গড়ে উঠা যুবকদের একটা বড় অংশ মহামারী, দুর্ভিক্ষ অথবা যুদ্ধের শিকার হয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। শিবির থেকে মুষ্টিমেয় যে কয়টি যুবক ফিরে আসতে পেরেছে তাদের মনে এই ধারনা বদ্ধমূল হয়েছে যে, তাদেরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে প্রয়োজন শেষ হওয়া মাত্রা দূরে হটিয়ে দেয়া হয়েছে। এ জাতীয় যুবকদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম কষ্ট ভোগ করেছে এমন একজনের কথা এখানে তুলে দেওয়া হচ্ছে: আমি পাটনার খলিফার একজন সাগরেদ। দশ কি বারো বছর বয়সে খলিফার কাছে লেখাপড়া শিখার জন্য আমি রামপুরা বোয়ালিয়ায় যাই (শাফীর গ্রামের অনতিদূরে দক্ষিণ বঙ্গের একটা শহর)। শিক্ষকরা একটা ধর্মযুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে এ কাজে অর্থ ও লোক লস্কর পাঠাবার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। আমার বয়স যখন প্রায় পনের বছর সেই সময় আমাকেও জিহাদের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। আবার পাটনা ও দিল্লী হয়ে (সীমান্তের শিবির থেকে প্রায় দুহাজার মাইল দূরবর্তী স্থান) অকুস্থলে গমন করি। পাটনার এক রাত আমি খলিফার কাছে অস্থান করি। দিল্লী পৌছার পর আমার অন্যান্য সঙ্গীরা অকুস্থলে গমন করে কিন্তু আমি সেখানে থেকে যাই এবং একজন ধর্মগুরুর কাছে শিক্ষা লাভের জন্য দেড় বছর অবস্থান করি। অতঃপর সীমান্ত শিবিরে গমনকারী একটা দলের সাথে আমি গুজরাট পর্যন্ত গমন করি। কিছু দিন পর সেখানে আগত আরেকটা দলের সহযাত্রী হয়ে আমি পার্বত্য অঞ্চলে উপস্থিত হই এবং সেখানে আমাকে আশ্বস্ত করে বলা হয় যে, ইমাম সৈয়দ আহমদ পুনরাভির্ভূত হয়েছেন। সেখানে আমি আট থেকে নয় হাজার লোক জমায়েত দেখতে পেলাম এবং তাদের নেতা হিসেবে যাকে দেখলাম তিনিই হচ্ছেন আমার সেই ওস্তাদ যার কাছে বারো বছর বয়সে আমি শিক্ষা লাভ করেছি (এবং এখন তিনি পাটনার খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন) এখানে আমি বুঝতে পারলাম যে, কোন ঐশ্বরিক নেতার আবির্ভাব ঘটেনি এবং সকল ব্যাপারটাই একটা ছলনা। আমি এবং অন্যান্যরা রাগান্বিত হয়ে দিল্লী ফিরে আসি। এরপর আরবের একজন ধর্মগুরু দিল্লী আসেন। তিনি আমাদের আশ্বাস দেন যে, ঐশ্বরিক নেতার পুনরাবির্ভাব ঘটেছে এবং তিনি এখন সিত্তানায় অবস্থান করছেন। তার কথায় বিশ্বাস করে পুনরায় জেহাদে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে আমি দিল্লী থেকে যাত্রা করি। সিত্তানায় উপস্থিত হয়ে আমি ঐশ্বরিক নেতাকে দেখার উচ্ছা প্রকাশ করি, কিন্তু কোন সদুত্তর পেলাম না। আমি সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম যে, আমরা আবার প্রতারিত হয়েছি। অতঃপর হামলার উদ্দেশ্যে একটি ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর আগমনের সময় আমি সেখান থেকে পালিয়ে দিল্লী চলে যাই। কিছু দিনের মধ্যে আমি আমার নিজের বাড়িতে ফিরে আসি। (১৮৭০ সালের ১৫ই আগস্ট দিনাজপুরের জজ সাহেবের এজলাসে প্রদত্ত মোহাম্মাদ আব্বাস আলীর জবানবন্দীর সংক্ষিপ্তসার। আমি যতদূর সম্ভব স্বগতোক্তি পরিহারের চেষ্টা করেছি।)
এটা হচ্ছে একজন বিশিষ্ট কর্মীর বিবরণ, যে শেষ পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসতে পেরেছে। কিন্তু যেসব কর্মী ব্যাধি, ঠাণ্ডা ও দারিদ্র্যের শিকার হয়ে অধিকতর দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় ফিরে আসে তাদের বিবরণ আরো করুণ: তবে এ বিষয়ে আমি আর কিছু উল্লেখ করব না। সরকার কর্তৃক আনিত মোকদ্দমার চেয়ে বরং একজন হতাশাগ্রস্ত মুজাহিদের সীমান্ত থেকে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের ঘটনার দ্বারাই একটা জেলায় ওয়াহাবী মতবাদের ধ্বংসের পথ সুগম হয়েছে। যেসব ধর্মান্ধ যুবক ধর্মযুদ্ধে নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, একজন হতাশাগ্রস্ত মুজাহিদের প্রত্যাবর্তন তাদের মোহমুক্তি ঘটায় এবং এসব ঘটনার ফলে বহু নিষ্ঠাবান ওয়াহাবী বিদ্রোহ অবশ্য প্রয়োজন নয় এই মর্মে প্রদত্ত ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা শোনার আগ্রহ প্রকাশ করে।
এই ব্যাখ্যা বাংলার মুসলমানদের উপর গত কয়েক বছরে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। ওয়াহাবীরা সকল শ্রেণীর লোকের উপর জিহাদে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক বলে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এখন অপেক্ষাকৃত শান্ত পরিবেশে কোন লোককে গুরুতর ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে বাধ্য করা অথবা যোগ না দিলে ধর্মত্যাগী বলে দোষারোপ করা খুব কঠিন কাজ। আগে ওয়াহাবীদের কাজে সাহায্য করা বড় একটা ব্যক্তি ক্ষিতির কারণ ছিল না; কিন্তু শাসন কর্তৃপক্ষ গ্রেফতারের ক্ষমতা লাভের পর থেকে বিদ্রোহাত্মক কাজে সাহায্য করাও খুব মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং কেবল মাত্র অতিরিক্ত ধর্মান্ধ ব্যক্তিই এই ঝুঁকি নিতে রাজী হবে। বিধবাদের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য বেশী এসেছে এবং যারা ধর্মযুদ্ধে আত্মবিসর্জনের আকাংখা পোষণ করে তারাও মসজিদে গিয়ে জিহাদের কাজে চাঁদা দিয়েছে। পক্ষান্তরে বিধর্মী সরকারের ভয়ে যারা ধর্মের স্বার্থ পরিহার করেছে, গোঁড়া ধর্মান্ধরা তাদেরকে নিন্দা করেছে; দলত্যাগীদেরকে তারা শুধুমাত্র কাপুরুষ ও স্বার্থপর বলে নিন্দা করে পরীক্ষণেই আবার জিহাদে উসকানি প্রদানের বিরুদ্ধে ক্রোধ প্রকাশ করেছে এবং এভাবেই সুবিধাভোগী শ্রেণীর লোকেরা ইহকাল ও পরকাল দুইকুল রক্ষার চেষ্টায় আছে:
অতীতে বিত্তশালী মুসলমানরা এই জাতীয় অপবাদ নীরবে সহ্য করেছে। কিন্তু এখন গোটা মুসলমান যাজক সম্প্রদায়ের কায়েমি স্বার্থ তাদের সমর্থনে এসে যাওয়ায় তারা এখন আত্মপক্ষ সমর্থনের শক্ত যুক্তি খুঁজে পেয়েছে। তারা এখন নীতিগতভাবে ওয়াহাবীদের জিহাদি মতবাদের বিরোধিতা করে রাণীর বিরুদ্ধ ধর্মযুদ্ধে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক নয় বলে দাবি করছে। গত কয়েক বছরে এদের যুক্তির সমর্থনে এক গাদা ফতোয়া হাজির করা হয়েছে। এমনকি ইংল্যান্ডের রাণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মত একটা বিপদজনক দায়িত্ব থেকে ভারতীয় মুসলমানদের বিরত করার উদ্দেশ্যে মক্কার তিনজন শীর্ষস্থানীয় মুফতির (হানাফী, শাফী ও মালেকী সম্প্রদায়ের তিনজন মুফতি। চতুর্থ হচ্ছে হাম্বলী সম্প্রদায়, কিন্তু মক্কায় তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য বলে সেকালে এই সম্প্রদায়ের কোন মুফতি নেই) ফতোয়া পর্যন্ত হাজির করা হয়েছে।
এই সন্তোষজনক ফলশ্রুতিতে লাভের জন্য আইনজীবীরা তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা বড় একটা দেখা দেয়নি। কোরআনের সোজা অর্থ হচ্ছে এই যে, ইসলামের অনুসারীরা গোটা দুনিয়াকে স্বমতে আনবে; বিজিতদের হয় স্বধর্মে দীক্ষিত করবে নতুবা এমনভাবে অধীনস্থ করবে যেটা ঠিক গোলামীর অথবা মৃত্যুর সমতুল্য। অবশ্য, কোন আধুনিক জাতির প্রয়োজন মেটাবার জন্য কোরআন লিখিত হয়নি; আত্মকলহে ক্ষতবিক্ষত আরবীয় উপজাতির উপর যুদ্ধংদেহী বিজয়ী সম্প্রদায়ের কর্তৃত্ব কায়েমের স্থানীয় প্রয়োজনের দৃষ্টিকোণ থেকেই কোরআন লেখা হয়েছে। বহু যুগের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি পরবর্তীকালের বিদ্বান ব্যক্তিদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দ্বারা কোরআনের যুদ্ধংদেহী ধর্মান্ধ ভাবধারা অনেকটা পরিমার্জিত হয়েছে; এবং এর একচোখা ধর্মান্ধ ভাবোচ্ছ্বাস থেকে কোনরূপ একক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রদর্শনও গড়ে উঠতে পারেনি। অবশ্য, পবিত্র যুদ্ধের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মহামান্য পয়গম্বর যেসব কথা বলে গিয়েছেন, মুসলমানদের ন্যায়শাস্ত্রে তা অবিকৃতভাবে সংকলিত হয়েছে। হিদায়া নামক বিখ্যাত ভারতীয় গ্রন্থের একটা গোটা অধ্যায় পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং ইসলামী আইনশাস্ত্রের বিশিষ্ট ভারতীয় পণ্ডিতরা এই প্রয়োজনীয়তাকে জোরালো সমর্থন দান করেছেন। কিন্তু এই সব আলোচনায়, যা ভারতীয় মুসলমানদের মনে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, কোরআনের অনুশাসন সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলা হয়নি এবং সব মতের প্রবক্তারা বিষয়টাকে পবিত্র গ্রন্থের আওতাবহির্ভূত করে আইনবিদদের ফতোয়ার বিষয়ভূক্ত করে ফেলেছেন।
মুসলমান ও আমাদের জন্য এটা আনন্দের বিষয় যে, উপরোক্ত সিদ্ধান্তসমূহ শান্তি ও আনুগত্যের পাল্লা ভারী করেছে। বলা বাহুল্য , ঐ ফতোয়াগুলো যদি বিদ্রোহের পক্ষ জোরদার করত তবে তার পরিণাম হত অত্যন্ত বিপদজনক। কিরূপ বিপদজনক ভিত্তির উপর ভারতে আমাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার প্রমাণ এই যে, উপরোক্ত প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এবং এটা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, সরকারের বিরোধিতার জন্য উত্থাপিত ঐ সিদ্ধান্তগুলোর ফলশ্রুতি হিসেবে এমন রক্ষণশীল রক্তাক্ত বিদ্রোহের সূত্রপাত হয় যা বিশ্ববাসী বিস্ময়ের সাথে অবলোকন করেছে। এমনকি জৌনপুরের মুসলিম আইনশাস্ত্রবিদদের সিদ্ধান্তের ফলে আকবরও প্রায় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার উপক্রম করেছিলেন; তারা ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, আকবরের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান শাস্ত্রসম্মত। এর ফলে বাংলায় রড় রকমের সামরিক বিদ্রোহ সংঘটিত হয় এবং সে সময় কতিপয় দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশের ভূস্বামীদের প্রজার পরিবর্তে জায়গীরদার খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময় একটি শহর থেকে দিল্লীর শাসন ঘোষণাকালে একজন মুসলমান বিদ্রোহী প্রথম যে কাজটি করেন সেটা হল ইংরেজদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণার জন্য স্থানীয় মুসলিম ধর্মগুরুর কাছে ফতোয়া চেয়ে পাঠানো। ইউরোপেও দেখা গেছে, তুর্কীর সুলতান যখনই অস্ট্রীয় সীমান্তের খ্রিস্টান প্রদেশগুলোর বা বুলগেরিয়ার উপর স্বীয় দলবলকে লেলিয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন তখনই তিনি বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার সুফল ও পুরস্কার সম্পর্কে ইসলামী আইনবিদদের ফতোয়া কাজে লাগিয়ে সৈন্যদের ধর্মান্ধতায় উসকানি প্রদান করেছেন। খ্রিস্টানরাও ঠিক একই কায়দায় কাজ করেছে এবং ধর্মযুদ্ধের শেষ পর্বে একই পদ্ধতি অনুসরণ করে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার সঞ্চার করা হয়। মুসলমান দেশসমূহে বিধর্মীদের বিতাড়নের জন্য ধর্মীয় ফতোয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে শীর্ষস্থানীয় শাস্ত্রকারদের সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার এবং ১৮৬৭ সালে কনস্টান্টিনোপলে অবস্থানকালে আমি দেখেছি যে,সেখানে শাস্ত্রকারদের সিদ্ধান্ত খুব সহজে পাওয়া গেছে। অতি সম্প্রতি মিশরের পাশা এবং তুর্কীর সুলতান সেইসব ধর্মান্ধ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন, যারা বিশ্বাস করে যে, আমিরুল মুমিনীন পবিত্র শা স্ত্রী বিধি লঙ্ঘন করেছেন এবং তার ফলে তাকে এবং তার অনুগত সেনাবাহিনীকে বিনাশ করাই তাদের পবিত্র কর্তব্য। সুতরাং এটা অতীব আনন্দের বিষয় যে, ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলমান বাদশাহর বিরুদ্ধ বিদ্রোহ করার ফতোয়াটি যে জেলা (জৌনপুর) থেকে ঘোষিত হয়েছিল সেই জেলাতেই এমন আর একজন মুসলিম আইনশাস্ত্রবিদ (১৮৭০ সালের ২৩শে নভেম্বর কলকাতার মোহামেডান লিটারারী সোসাইটিতে প্রদত্ত মৌলভী কেরামত আলীর বক্তৃতা) জন্মগ্রহণ করেছেন যিনি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধ যুদ্ধ করার বিরুদ্ধে জোরালো সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন।
মুসলমানদের দুটি প্রধান মাজহাব শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায় প্রশ্নটির সমাধানের জন্য বিগত কয়েক মাসে যেসব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, আমি এখানে তার সংক্ষিপ্ত বিরবণ পেশ করতে চাই।
শিয়ারা অন্যান্য সব বিষয়ের মত রাণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ব্যাপারেও বিশ্বাসীদের কর্তব্য সম্পর্কে নিজস্ব পৃথক মতামত গ্রহণ করেছে। এটা এমন একটা মাজহাবের অভিমত যাদের সংখ্যা ভারতে খুব নগণ্য। এবং যারা অতীতের সকল ধর্মান্ধ মুসলমান সরকারের আমলে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, এমন নির্যাতন যা কোন ব্রিটিশ শাসক কখনও অনুমোদন করবে না। ধর্মযুদ্ধের প্রশ্নে কিছুদিন আগে তারা যে ক্ষুদ্র ফার্সী প্রচারপত্রটি (মুন্সী আমীর আলী খানবাহাদুর প্রণীত (কলকাতা ১৮৭১) জিহাদ সম্পর্কে শিয়া সম্প্রদায়ের ধারণা ও বিশ্বাস) বিলি করে তা সুন্নিদের মতামতের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করবে না। সুন্নিরা হচ্ছে ভারতীয় মুসলমান জনসমষ্টির দশ ভাগের নয় ভাগ। কিন্তু অযোধ্যার সাবেক নওয়াবের অন্যতম প্রধান ধর্মগুরুসহ শিয়া সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট শাস্ত্রকারদের সাথে পরামর্শক্রমে শিয়া মাজহাবের উপরোক্ত বিশিষ্ট আইনশাস্ত্রবিদ যে ফতোয়া প্রণয়ন করেছেন তা দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। সংখ্যায় অল্প হলেও শিয়াদের মধ্যে থেকে ভারতীয় ইতিহাসের বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা পুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন; এবং গত চার বছর যাবত প্রতিটি জেলায় ধর্মযুদ্ধে মুসলমানদের কর্তব্য সম্পর্কে যে সকল আলোচনা চলেছে সে সম্পর্কেও শিয়ারা নিজস্ব স্পষ্ট বক্তব্য উপস্থিত করেছে।
শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীদের ১২জন ইমামের উপর বিশ্বাস আনতে হয়, আল্লাহর রাসূলের বংশ থেকেই যার প্রধান ইমামের উৎপত্তি এটাই হচ্ছে শিয়াদের মৌলিক নীতি। পবিত্র দায়িত্ব সম্পূর্ণ করার জন্য উক্ত ইমামের একজন এখনও জীবিত আছেন কিন্তু পাপাচারপূর্ণ লৌকিক জগতের অগোচরেই তিনি বর্তমানে অবস্থান করেছেন। এ জগতে তাঁর আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্ব পাপ তাপে দগ্ধ হেতে থাকবে এবং বিশ্বাসীদের উপর ঘৃণ্য সুন্নি, খ্রিষ্টান ও অন্যান্যদের নিপীড়ন চলতে থাকে। কিন্তু প্রত্যাশিত ইমামের আশীর্বাদবাহী এমন একজন মহান ধর্মগুরু আবির্ভাব হবেন যাঁর আগমনের পর সকল অন্যায়ের অবসান হবে। এবং সকল মানুষ আল্লাহর ধর্মে দীক্ষিত হবে। কিন্তু এটা না ঘটা পর্যন্ত বিশুদ্ধ জগত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পার্থিব প্রচেষ্টায় লিপ্ত হওয়া কিংবা বিদ্রোহ বা যুদ্ধ করে কোন লাভ হবে না। এই মতের বিরুদ্ধবাদীদের শিয়ারা ধর্মদ্রোহী বলে নিন্দা করেন। শিয়া সম্প্রদায়ের আলোচ্য ফতোয়াটিতে বলা হয়েছে: বর্তমানে মুহম্মদের (দঃ) অনুশাসন (সূরা ) সম্পর্কে অজ্ঞ ও সত্য উদঘাটনে অক্ষম একদল অবিবেচক লোক রাজদ্রোহের উসকানি দিয়ে পবিত্র ধর্মযুদ্ধে সম্বন্ধে মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রচার করে বেড়াচ্ছে। এদেশে হিন্দুস্থানে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যে মাত্র দুটি মাজহাব রক্ষণশীল বলে প্রমাণিত হয়েছে এরা হচ্ছে শিয়া ও সুন্নি। মুসলমানদের অবশিষ্ট মাজহাবগুলো তা তারা ওয়াহাবী বা ফারায়েজী যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তাদেরকে বিশ্বাস করা যায় না। জিহাদ (জিহাদি-ফি-লিল্লাহ আল্লাহর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় যত্নবান হওয়া। জিহাদ-বা নফস-ই-আমরা রিপু দমন করা, যাতে করে অন্যায় কার্যাবলী থেকে বিরত হয়ে সত্য কাজে সময় নিয়োজিত করা অভ্যাস আয়ত্ব হয়, জিহাদ-ফি-দীন অর্থাৎ মুসলিম শাস্ত্র মোতাবেক বিধর্মীদের বিরুদ্ধে পবিত্র ধর্মযুদ্ধ।)শব্দের তিনটি অর্থ বিশ্লেষণের পর আলোচ্য পুস্তিকায় বিধর্মীদের বিরুদ্ধ পবিত্র ধর্মযুদ্ধকে অর্থবহ ও আইনসিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে সাতটি শর্ত পূরণ করা জিহাদের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় বলে ফতোয়া দেয়া হয়েছে। প্রথমত, যদি সত্যিকার ইমাম উপস্থিত হয়ে জিহাদের অনুমতি প্রদান করেন। দ্বিতীয়ত, যখন যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী প্রস্তুত করা হয়েছে। তৃতীয়ত, যখন খোদাদ্রোহী এবং আল্লাহর দুশমনদের (হার্ব-ই-কাফের) বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালিত হবে। চতুর্থত, ধর্মযুদ্ধের প্রতিটি যোদ্ধা যখন জিহাদের মর্ম সম্পর্কে সম্যক যুক্তির অধিকারী হবেন, এবং তিনি অপ্রকৃতিস্থ বা অস্থিরমতিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি হবেন না; এবং যদি তিনি অসুস্থ বা অন্ধ অথবা খোঁড়া না হন। পঞ্চমত, যখন তিনি জিহাদে যোগদানের জন্য পিতা-মাতার অনুমতি নেবেন। ষষ্ঠত, যখন তিনি ঋণমুক্ত হবেন। সপ্তমত, নিজ পরিবারের ভরণপোষণ চালানো এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাওয়া আসা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহের মত পর্যাপ্ত অর্থ যদি তার থাকে।
রাণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার যৌক্তিকতা এবং তার সাফল্য বা ব্যর্থতার প্রশ্ন বাদ দিলেও ধর্মযুদ্ধের জন্য শিয়াদের প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে ইমামের উপস্থিতি। কিন্তু শিয়া মতবাদ অনুযায়ী ঐ ঐশ্বরিক নেতা এতদিন যাবত দুনিয়ার লোক সমাজের দৃষ্টির অগোচরে অবস্থান করেছেন। তিনি এখনও পর্যন্ত লোকসমাজে আবির্ভূত হয়ে বিশ্বাসীদের সৈনাপত্য গ্রহণের কোন ইচ্ছা প্রকাশ করেন নি। তার আগমন না ঘটা পর্যন্ত ধর্মযুদ্ধ আরম্ভের যে কোন উদ্যোগ অযৌক্তিক ও গোনাহর কাজ বলে বিবেচিত হবে। শিয়াদের পুস্তিকাটিতে বলা হয়েছে: সেই পুণ্যবান ইমামের আবির্ভাব কখন ঘটবে তা শুধু সর্বজ্ঞ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। কিন্তু ইমামের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছাড়া রক্তপাত ঘটানো শিয়াশাস্ত্র অনুযায়ী কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইমামের ঐশ্বরিক নির্দেশ ব্যতীত যারা বিদ্রোহ করবে তারাই বিদ্রোহী এবং গোনাহগার বলে সাব্যস্ত হবে।
সর্বশেষ বাক্যটি সুন্নিদের উপর একটি আঘাত বিশেষ। পবিত্র ইমামের উপস্থিতি ছাড়াই সুন্নিরা বারবার ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং তাদের সাথে শিয়াদের ধর্মীয় নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত দীর্ঘদিনের পুরনো বিবাদ রয়েছে। অবশ্য শিয়াদের পুস্তিকায় অত্যন্ত সরলভাবে গোটা দুনিয়াকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার শেষ আকাংখা ব্যক্ত করা হয়েছে, কিন্তু এ বক্তব্য তাদের বিরোধী মাজহাবের অন্তর্দাহ সৃষ্টি না করে পারে না। শেষ অবধি সত্য ধর্ম ইসলামই যে বিজয়ী হবে এটা ভারতীয় সুন্নি ও শিয়ারা সমভাবে বিশ্বাস করে। তবে উভয়ের বিশ্বাসের মাঝে কিছুটা পার্থক্য আছে। সুন্নিদের মত অনুসারে শেষ জামানায় পয়গম্বরের নির্দেশাবলী পূর্নাঙ্গভাবে অনুসরণ করে তারা গোটা দুনিয়াকে ইসলামে দীক্ষিত করবে। পক্ষান্তরে শিয়াদের মত দুইটি প্রধান ধর্ম খ্রিস্টান ধর্ম ও ইসলামের সম্মিলনীর (যদিও একদেশদর্শীভাবে) মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় আসবে। শেষ জামানায় স্বধর্ম বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করবে এটা প্রায় সবকটি মহান ধর্মের অনুসারীদের স্বপ্ন। হিন্দুদের একটা শাস্ত্র গ্রন্থ (ভবিষ্যৎ পুরাণ) আছে এবং এতে ভবিষ্যৎবাণী করে বলা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে একদিন আসবে যখন মানুষ এক ধর্মের অনুসারী হবে এবং বর্ণভেদ বলে কিছু থাকবে না, এমনকি বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্মান্ধদের বিজয়ের সময় সংকলিত (Cric. AD 1050) বিষ্ণু পুরাণও স্বীকার করে যে, শেষ লৌহ যুগে যেখান থেকে আমরা এসেছে) মানুষের আত্মার মুক্তি আসবে তবে ধর্ম বা জাতিগত কারণে নয়। বরং নিষ্পাপ জীবনযাপন এবং নিষ্কলঙ্ক কার্যকলাপের ফলশ্রুতি হিসাবে আত্মার মুক্তি আসবে। শিয়ারাও যে শেষ বিজয়ের কথা বলে, তবে সেটা ঘটবে খৃষ্টানদের সাথে একত্রিত হয়ে অর্থাৎ খৃষ্টানরা সব শিয়া হয়ে যাবে, সম্ভবত শেষ ইমামের নেতৃত্ব অস্বীকারকারী সুন্নিদের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়েই সেটা ঘটবে। শিয়াদের পুস্তিকায় বলা হয়েছে: আমাদের মুসলমানি আইন শাস্ত্রে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, উপরোল্লিখিত ইমামের আবির্ভাবের সময় ঈসা (আঃ) চতুর্থ আসমান থেকে দুনিয়ায় নেমে আসবেন এবং দুই মহানায়কের মধ্যে শত্রুতার পরিবর্তে মৈত্রীই গড়ে উঠবে।
এটা আনন্দের বিষয় যে, আমাদের মুসলমানে প্রজাদের মধ্যে এমন একটা ছোট সম্প্রদায় আছে যাদের প্রাথমিক ধর্মীয় অনুশাসন মোতাবেক রাণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কোন বাধ্য বাধকতা নেই। অন্যান্য মুসলমানরা যাই করুক না কেন, মুষ্টিমেয় ভারতীয় শিয়ারা ঘোষণা করেছে যে, তারা অস্ত্রবল প্রয়োগ করে আমাদের লিঙ্গাগ্রছেদন করতে অথবা দাসত্ব বরণ এই দুটি অপমানকর বিকল্পের যে কোন একটি বেছে নিতে বাধ্য করবে না। এই আশ্বাস অভিনন্দন যোগ্য হলেও আমি এটা বিস্মৃত হতে পারি না যে, শিয়ারা এমন একটি ধর্মীয় সমঝোতার (তাকিয়াহ: অর্থাৎ আত্মরক্ষা; সাধুতার ছলনা) নীতিতে বিশ্বাসী বলে দাবি করে। যার ফলে আমাদের মত বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রচেষ্টা দুর্বল না হয়ে পারে না। এক পারস্য ছাড়া দুনিয়ার সর্বত্রই এই সম্প্রদায়টি নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এবং তার ফলে তার আত্মরক্ষার এমন একটা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে যেটা বিদেশীদের চোখে নিজের ধর্মবিশ্বাস পরিত্যাগের সমতুল্য বলেই মনে হয়। এভাবে একজন শিয়া নিজেকে সুন্নি বলে পরিচয় দিয়ে মক্কা অতিক্রম করলেও এতে তার ধর্মাত্মা অপবিত্র হয় না। সুন্নি নিগ্রহকারীরা জেরার সম্মুখীন হলে তারা নিজেদের আলাদা বিশ্বাসের কথা অস্বীকার করতে দ্বিধা করে না। চরম নিপীড়নের শিকার হলে (যেমন সম্প্রতি সিরিয়ায় হয়েছে এবং মাঝে মাঝে ভারতে হয়ে থাকে)এই সাধুতার ছলনা নীতি অনুসরণ করে তারা নিজেদের পরম প্রিয় নীতিসমূহ এমনকি বারো ইমামের প্রতি বিশ্বাসের কথাও অস্বীকার করে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনে তাদেরকে নির্যাতন থেকে রক্ষা করা হয়েছে এবং নির্যাতনের ফলে নিজের বিশ্বাসের প্রতি ছলনা করার দুর্ভাগ্য থেকেও তারা রেহাই পেয়েছে। বিদ্রোহের বাধ্যবাধকতা অস্বীকার করে তারা বর্তমানে যে ঘোষণা প্রচার করেছে সেটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করা হয়েছে এবং সে ঘোষণাটা যে মুদ্রাক্ষরে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সেটাও আনন্দের বিষয়। এ ঘোষণাটা শিয়াদের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এসেছে, কাজেই এটা তাদের গোটা সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্য পালনীয় বলেই আমরা মনে করি। এমনকি এ ধরনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রচারিত না হলেও শিয়ারা সব সময় রাজানুগত্য প্রকাশ করে এসেছে, কারণ তারা জানে যে, হিন্দু অথবা সুন্নি মুসলমানরা ভারতে বিশেষ কর্তৃত্বসম্পন্ন হয়ে উঠলে শিয়াদের ধ্বংসের পথ প্রশস্ত হবে। তাছাড়া চূড়ান্ত বিজয়ের সময় সুন্নিরা ভুলে যাচে না যে, ইসলামের চরম বিজয় মুসলমান ও খ্রিস্টানরা সমভাবে ভাগাভাগি করে নেবে এবং মর্মে গৃহীত শিয়াদের আইনগত সিদ্ধান্তটি অযোধ্যার নওয়াবের প্রাসাদ থেকেই ঘোষিত হয়েছে। শিয়াদের এ পুস্তিকাটি ওয়াহাবী ও সুন্নিদের মনে যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে সে কথা স্মরণ করে সাবেক নওয়াব এবং তাঁর মতাবলম্বী আনুগত্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে।
এবার আমি সংখ্যাগুরু মাজহাবের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করব। সুন্নিরা ভারতীয় মুসলমানদের সর্বাধিক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বলেই তারা সর্বাধিক স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে যে, রাণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে তাদের কোন ধর্মীয় বাধ্য বাধকতা নেই। এ ব্যাপারে তারা দুটো স্পষ্ট আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং এ বিষয়ে সুন্নিদের সকল মতামত একত্রিত করে পুস্তকাকারে জোরালো ভাষায় সারাংশ রচনা করেছে কোলকাতার মোহামেডান লিটারারী সোসাইটি। যারা বাঙালী মুসলমানদের বুদ্ধিমত্তাকে খাটো করে দেখে এবং যারা মনে করে যে, সরকারের অধীনে বিচার বিভাগে চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা বাঙালী মুসলমানদের নেই। তাদেরকে আমি আলোচ্য পুস্তিকাটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করেছি। এই পুস্তিকাটিতে আইনের সূক্ষ্ম বিচার বুদ্ধির পরিচায়ক এবং এতে একই সূত্রের বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ কে একত্রিত করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাঞ্ছিত একক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। উত্তর ভারতীয় আইন শাস্ত্রবিদরা অব্যক্তভাবে বুঝাতে চেয়েছেন যে, ভারত শত্রুদেশ (দারুল হারব অর্থাৎ শত্রু দেশ) এবং তারপর সিদ্ধান্ত করেছেন যে, এখানে ধর্মযুদ্ধ অপ্রয়োজনীয়। কলকাতার আইন শাস্ত্রবিদরা ঘোষণা করেছেন যে, ভারত ইসলামী দেশ (দারুল ইসলাম) এবং যে কারণে এখানে ধর্ম যুদ্ধ বেআইনি বলে তারা ঘোষণা করেছেন। উভয় সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিকে অবশ্যই বিত্তশালী মুসলমানদের জন্য সন্তোষজনক বলে মেনে নিতে হবে। কারণ, এটা একদিকে তাদের সীমান্তের ধর্মান্ধ শিবিরে সাহায্য দানের ধ্বংসাত্মক পরিণতি ও আমাদের সন্তুষ্টি বিধানের দ্বৈত সমস্যা থেকে রক্ষা করেছে, এবং এতে করে এটা প্রমাণিত হয় যে, আইন ও শাস্ত্রকারদের যেমন রাজানুগত্য প্রদর্শনের কাজে তেমনি রাজদ্রোহের প্রয়োজনে সমানে ব্যবহার করা যায়। (পুস্তিকার শিরোনাম হচ্ছে কলকাতার মোহামেডান ল, সোসাইটির অধিবেশনের সারাংশ ২৩ শে নভেম্বর ১৮৭০ ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের দায়িত্ব সম্পর্কে মুসলিম আইন শাস্ত্রের উপর জৌনপুরের মৌলবি কেরামত আলীর বক্তৃতা কলকাতা ১৮৭১ অবলম্বনে সংকলিত।)
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে এই যে, উপরোক্ত সিদ্ধান্তগুলো অবস্থাপন্ন মুসলমানদের চেয়ে ধর্মোন্মত্ত জনসাধারণের স্বার্থেই বেশী প্রয়োজন।
১৮১৮সালের ৩নং রেগুলেশনে শাসন বিভাগকে গ্রেফতারের যে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাতে বিদ্রোহের চেষ্টা ভয়াবহ পরিণতিকে আনতে বাধ্য। উক্ত ক্ষমতা বলে ব্যাপক এলাকায় বিস্তৃত রাজদ্রোহমূলক তৎপরতা দমনে শাসন বিভাগ এখনো পর্যাপ্ত ক্ষমতার অধিকারী। গত বিশ বছরে বাংলার এবং মাঝে মাঝে পাঞ্জাবের সীমান্তে বিদ্রোহের যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা উক্ত রেগুলেশনের ক্ষমতা বলে এখন দমন করা সহজসাধ্য হবে। তাই সুবিধাভোগী শ্রেণীগুলো এমনকি রাজদ্রোহীদের মধ্যে যারা বিত্তবান তারাও এখন নিজেদের হাত মুছে ফেলার একটা উপায় খুঁজে পাওয়ায় আনন্দিত হয়েছে। এসব লোক গুরুতর অসুবিধাজনক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ হিসেবে উপরোল্লিখিত আইনগত সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবে। তারা এ সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামাতে যাবে না। বরং দুরূহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের উপায় হিসেবে একে সানন্দে গ্রহণ করবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, কলকাতার মোহামেডান সোসাইটি স্বদেশবাসী এবং আমাদের স্বার্থ সমভাবে রক্ষা করেছে। এবং এজন্য সোসাইটির সেক্রেটারি মৌলবি আবদুর লতীফ খান বাহাদুর বিশেষ প্রশংসার পাত্র। সুন্নিদের দৃষ্টিতে আমাদের শাসনে ভারতের ধর্মীয় মর্যাদা যে রকমই প্রতিভাত হয় না কেন তারা এখন উপলব্ধি করবে যে উক্ত সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কোন বাদ্য বাধকতা তাদের আর নেই। সুন্নিরা কি মনে করে যে, ভারত এখনো ইসলামী দেশ? পুস্তিকায় ৬ষ্ট পৃষ্ঠা টা পড়লে দেখতে পাবে যে, উপরোক্ত কারণে রানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আইন বহির্ভূত কাজ। তারা কি মনে করে যে, ভারত শত্রু দেশে পরিণত হয়েছে? একাদশ পৃষ্ঠায় দীর্ঘ পাদটীকা পড়লে তারা দেখতে পাবে যে, একই কারণে বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে অবাঞ্ছিত কাজ। (আলোচ্য পরিচ্ছেদের বর্তমান অংশে এবং অন্যান্য স্থানে আমি যেসব নিবন্ধ ব্যবহার করেছি সেগুলো কলকাতার ইংলিশম্যান পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছে। উপর্যুপরি আমার এ মতামতগুলো প্রকাশের জন্য আমি পত্রিকার সম্পাদকের সহৃদয়তার কাছে ঋণী থাকব। মুসলমান সম্প্রদায়ের অন্যায় কার্যাবলী এবং তাদের অসুবিধাগুলো দূরীকরণ সম্পর্কে আমার মতামত এসব নিবন্ধে আলোচিত হয়েছে)
সুতরাং আলোচ্য পত্রিকাটি প্রকাশ করে মৌলবি আবদুল লতিফ যে বিরাট উপকার করেছেন তাকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা থেকে আমি বিরত থকবো। কিন্তু কলকাতার মোহামেডান লিটারারী সোসাইটির অভিমতকে যদি আমরা ভারতীয় মুসলমানদের অভিমত বলে নির্ধ্বিদায় গ্রহণ করি তবে সেটা একটা গুরুতর রাজনৈতিক ভ্রান্তি হবে। চরম মতবাদের ওয়াহাবীরা কোন যুক্তি মেনে নেবে বলে আশা করা যায় না। তথাপি ধর্মভীরু মুসলমানদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের পবিত্র শরীয়তের সত্যিকার প্রামাণিক ব্যাখ্যা অনুসারেই নিয়ন্ত্রিত হবেন।
কোন লোকের বিশ্বাস এবং বাস্তব কাজের মধ্যে সব সময় একটা ফাঁক থেকে যায়। বিশেষ করে বিশ্বাসকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে গেলে সে যদি রাজদ্রোহের ভয়াবহ পরিণামের সম্মুখীন হয় তখন এ ফাঁকটা অনিবার্য হয়ে উঠে। তবে ভালো লোকেরা সব সময় বিশ্বাস ও কাজের মধ্যকার ফাঁকটা দূরীকরণের চেষ্টা করে। এই শ্রেণীর লোকেরা এতদিন ধর্মান্ধ ওয়াহাবীতে পরিণত না হয়ে বরং সরল মনের ধর্মযুদ্ধকে একটা বিরক্তিকর কর্তব্য হিসাবে গ্রহণ করেছে। এরাই সীমান্তের বিদ্রোহী শিবিরকে এতদিন অর্থ সাহায্য করে এসেছে এবং এদেরকে শান্তি ও রাজানুগত্যের পক্ষে টেনে আনা বিশেষভাবে প্রয়োজন। সুতরাং আমি প্রস্তাব করছি যে, যে সব ধর্মান্ধ মুসলমানদের মতামতের উপর যারা ধর্মীয় দায়িত্ব পালন কে জীবনের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করে এবং ভয়-ভীতি ও আরাম-আয়েস কোনটাই যাদের মনে দাগ কাটতে না পারে সুন্নিদের আলোচ্য সিদ্ধান্তগুলো কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে তা ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ এটা অস্বীকার করে লাভ নেই যে, আমাদের মুসলমান প্রজাদের একটা বড় অংশ উপরোক্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এক শতাব্দীর এক তৃতীয়াংশ কাল ধরে তারা বিদ্রোহী সেনাবাহিনী হিসেবে কাজ করছে। প্রথমে রনজিৎ সিংহের বিরুদ্ধে এবং পরে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে আমাদের বিরুদ্ধে। সুদূর বঙ্গ প্রদেশেও তারা সীমান্ত শিবিরের জন্য দলে দলে যোদ্ধা সংগ্রহ করেছে। প্রতিটি গ্রাম, এমনকি প্রায় প্রত্যেক পরিবার তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে যুদ্ধের কাজে সাহায্য করেছে। অসন্তুষ্ট পথভ্রান্ত রাজদ্রোহীরা দলে দলে আমাদের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে; আদালতগুলো একের পর এক নতুন নতুন দল নায়কদের দ্বীপান্তরে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে; কিন্তু এ সত্ত্বেও সীমান্তের ইসলামী শিবিরে যুদ্ধ করার জন্য সারাদেশ জুড়ে লোকেরা অর্থ ও জনবল দিয়ে সাহায্য করেছে এবং এভাবেই খ্রিস্টান শাসনের বিরুদ্ধে তাদের রক্তক্ষয়ী উদ্যম অব্যাহত থেকেছে।
আমি দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এইসব অগণিত বিপদজনক লোকের উপর কলকাতা সোসাইটির সিদ্ধান্ত আদৌ কোন প্রভাব বিস্তার করবে না। অবশ্য ধর্মযুদ্ধের বিরুদ্ধে পুস্তিকাটি দুটি স্পষ্ট সীমারেখা আরোপ করেছে। প্রথমত সোসাইটির নিজস্ব সিদ্ধান্ত এবং দ্বিতীয়ত উত্তর ভারতের আইনশাস্ত্রবিদদের সিদ্ধান্ত। শেষোক্তটি প্রতিক্রিয়ামূলক বক্তব্য হিসাবে সংযোজিত হলেও ইতিপূর্বে তা পৃথকভাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং এখানে আমি দেখাবে যে, এটা বিদ্রোহের মুসলমান শাস্ত্রের সত্যিকার প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কাজ করেছে।
প্রথমত পুস্তিকাটি বিজ্ঞ মুসলমান প্রণেতারাই শুধু দেখাতে পারেন যে, তাঁদের যুক্তি কোন খানে ব্যর্থ হয়েছে। ভারত একটা ইসলামী দেশ (দারুল ইসলাম) এটা প্রমাণ করাই পুস্তিকার উদ্দেশ্যে এবং সে কারণে মুসলমান প্রজাদের জন্য বিদ্রোহ করা বেআইনি। উল্লেখ্য যে, পুস্তিকার প্রথম পাতার আলোচ্য মূলাংশে সে কারণে শব্দটা বাদ পড়ে গেছে। আরো উল্লেখ্য, মক্কার আইন শাস্ত্রবিদ এবং মৌলবি আবদুল হক, এই দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে শুধু এটাই বলা হয়েছে যে, ভারত ইসলামী দেশ; কিন্তু সে কারণে বিদ্রোহী বেআইনি একথাটা তারা সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। বাস্তব সত্য হচ্ছে এই যে, মুসলমান শাস্ত্রের কঠোর বিধানুসারে বিপরীত সিদ্ধান্তই সঠিক বলে বিবেচিত হবে। এবং মক্কার আইন শাস্ত্রবিদরা তাঁদের মতামত প্রদানের সময় এটা ভাল করেই জানতেন। তাঁরা স্বীকার করেছেন যে, ভারত ইসলামী দেশ; কিন্তু সে কারণে সরকারী ক্ষমতা জবর-দখলকারী বিধর্মীদের যারা সাবেক মুসলমান শাসকদের ধর্মীয় ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বিনষ্ট করার জন্য শত প্রকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তাদেরকে বিতাড়নের জন্য যুদ্ধ বা অন্য কোন উপায় অবলম্বন করা প্রয়োজন কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব তাঁরা সাধারণ মুসলমানদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন (পরিশিষ্ট-১ মক্কা সিদ্ধান্ত দেখুন)
পুস্তিকায় এই যুক্তি প্রদর্শিত হয়েছে যে, ভারত এখনো একটি ইসলামী দেশ (দারুল ইসলাম) কারণ মুসলমান শাসনামলে তাই ছিলো এবং বর্তমানে বিধর্মীদের সাথে বিজিত হলেও যে তিনটি কারণে এটা শত্রুদেশে (দারুল হার্ব) পরিণত হতে পারত তা অনুপস্থিত রয়েছে। মুসলমান আইনশাস্ত্রের সর্বপ্রধান শাস্ত্রকার আবু হানিফা উক্ত তিনটি কারণ উল্লেখ করে গেছেন। কিন্তু পুস্তিকায় এ প্রাচীন ও সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত শাস্ত্রকারের কিতাব থেকে কারণ তিনটি গ্রহণ না করে আওরঙ্গজেবের আমলের ফতোয়া-য়ে-আলমগীরী থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রথমোক্তটির সাথে শেষোক্তটির মৌলিক পার্থক্য আছে এবং এটা নিঃসন্দেহে তর্কাতীত বিষয় এই যে, আবু হানীফা ও অন্যান্য প্রাচীন শাস্ত্রকারদের বর্ণিত শর্তগুলো ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং রক্ষণশীল মতানুসারে ভারত একটি শত্রুদেশ। নিম্নে এতদসংক্রান্ত ইসলামী শা স্ত্রীয় আইনের দুটি সিদ্ধান্তই আমি তুলে ধরছি যাতে পাঠকরা স্বাধীনভাবে তার অর্থ বিচার করে দেখতে পারেন।