বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন করতে হলে প্রথমেই জাতীয় আদর্শ সম্পর্কে অবহিত থাকা প্রয়োজন। কোন্ ধরনের মানুষ গড়ে তুলবার উদ্দেশ্যে আমরা শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করছি, তা-ই এক্ষেত্রে মৌলিক প্রশ্ন। আমাদের নিজস্ব কোন মত, ব্শ্বিাস, জীবনদর্শন, উদ্দেশ্য এবং জীবনধারা বলতে যদি কিচু থাকে, তাহলে আমাদের শিক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যেন তারা আমাদের তাহযীব তমদ্দুনকে ভিত্তি করে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।
জাতীয় আদর্শকে রক্ষা করার ব্যাপারে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে মৌলিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদের দেশ ইসলামী জীবন বিধান সংরক্ষণের মাধ্যমেই বেঁচে থাকবে।
ইসলামী নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক মূল্যবান এবং দেশের আযাদী, অখণ্ডতা ও দৃঢ়তাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রেরণাদানকারী আদর্শ হতে হবে।
সুতরাং বাংলাদেশে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা দরকার, যার মাধ্যমে ইসলামের আদর্শকে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে রূপদানের জন্য উপযুক্ত নেতৃত্ব ও কর্মী সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। আধুনিক বিশ্বে ইসলামের আদর্শকে মানব জাতির মুক্তিবিধানরূপে পেশ করার যোগ্য লোক তৈরি করতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল দিকের শিক্ষায় এবং সাহিত্যে ইসলামী নৈতিকতা, মূল্যমান ও মূল্যবোধের প্রাধান্য স্থাপন করতে হবে। কাজেই বস্তুগত জ্ঞানের সাথে নৈতিক শক্তির সমন্বয় সাধনই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য হতে হবে। আমরা যদি গন্তব্যস্থল সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ না হই তাহলে দিশেহারার ন্যায় অনিশ্চিত পথে চলে জাতিকে ধ্বংসের পথেই নিয়ে যাবে।
আমাদের শিক্ষ পুনর্গঠনের প্রধান সমস্যা
বর্তমানে আমাদের দেশে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। একটি হল প্রাচীন ধরণের মাদরাসা শিক্ষা অপরটি আধুনিক শিক্ষা নামে পরিচিত। প্রথমটি ‘ইসলামী শিক্ষা’ বলে দাবি করে এবং দ্বিতীয়টি ‘আধুনিক শিক্ষা’ হিসেবে গৌরব বোধ করে। যারা মাদরাসা শিক্ষা লাভ করে, তারা কুরআন, হাদীস, ফিকা ইত্যাদি অধ্যয়ন করে বটে; কিন্তু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরচা করার কোনই সুযোগ পায় না। ফলে মানব জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগের যত প্রকার সমস্যা আছে, এর আধুনিক রূপ ও গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তারা কোন ধারণাই লভ করে না। ফলে মানব সমস্যার যে সুষ্ঠু সমাধান আল্লাহর কুরআন ও রাসূলের হাদীসে দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার কোন দৃষ্টিভঙ্গিই তরা লাভ করতে পারে না। এ কারণে দীর্ঘকাল মাদরাসায় কঠোর সাধনা করেও তারা যে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভ করে তা আধুনিক বিশ্বের প্রয়োজন পূরণ করতে সম্পূর্ণ অক্ষম। এ মাদরাসাসমূহ কাওমী মাদরাসা নামে পরিচিত। অবশ্য আলীয়া মাদরাসায় আলিম ক্লাশ পর্যন্ত আধুনিক বিষয়ও শিক্ষা দেওয়া হয়।
আর যারা আধুনিক শিক্ষা অর্জন করে, তারা প্রচলিত দুনিয়ার ভালোমন্দ জ্ঞান অনেক কিছুই হাসিল করতে সক্ষম হয় বটে; কিন্তু মুসলিম হিসেবে জীবন যাপনের কোন প্রেরণাই তারা লাভ করে না। চিন্তা ও কর্মে তারা প্রায়ই অমুসলিম হিসেবে গড়ে উঠে। এ শিক্ষা পাওয়ার পরও যারা ইসলামের প্রতি পূর্ণ আনুদহ্য প্রকাশ করেন, তারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রচেষ্টায় শিক্ষাব্যবস্থার বাইরের পরিবেশে নিদেরকে খাঁটি মুসিলমরূপে গঠন করেন। তারা নিয়মের ব্যতিক্রম।
এমতাবস্থায় আমাদের দেশে শিক্ষা পুনর্গঠন করা রীতিমতো জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি দেশের নাগরিকদেরকে উপযুক্তরূপে গড়ে তুলবার জন্য একই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা থাকা উচি। দুই ধরনের শিক্ষিত লোক সমাজকে দুই বিপরীত দিকে টানতে থাকলে দেশের বিপর্যয় অনিবার্য। উপরিউক্ত দুই প্রকারের শিক্ষা সম্পূর্ণ বিপরীত চিন্তাধারা সৃষ্টি করে চলেছে। জাতীয় আদর্শ ইসলাম বলে স্বীকার করার পর ইসলামী শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষা বলে দুই প্রকার শিক্ষা চলতে থাকার কোন অর্থই হয় না। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে ইসলামী শিক্ষাকে আধুনিক করে তুলতে হবে এবং আধুনিক শিক্ষাকে ইসলামী শিক্ষার রূপ দিতে হবে। উভয় শ্রেণীর শিক্ষিত লোকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকলে এ কাজ অসম্ভব নয়।
পাকিস্তান আমলে শিক্ষা পুনর্গঠন প্রচেষ্টা
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার সাধনের যে কয়েকটি প্রচেষ্টা হয়েছে, তার কোনটিতেই ইসলামী রাষ্ট্রের উপযোগী নাগরিক গড়ে তুলবার ব্যবস্থ হয়নি। যতগুলো শিক্ষ কমিশন দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ার সুপারিশ করতে পারেনি। সকলেই ইসলামকে একটি ধর্মের মর্যাদা দিয়েছে মাত্র। ইংল্যান্ড ও আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থায় খ্রিষ্টধর্মক যেটুকু স্থান দেওয়া হয়েছে, পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামকে মাত্র ততটুকু স্বীকৃতই দেওয়া হয়েছে।
বস্তুত শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ভিত্তিতে গঠন করে এর সাথে Religious Instruction (ধর্মীয় শিক্ষা)-এর লেজটুকু জুড়ে দিলেই কোন শিক্ষাপদ্ধতি ইসলামী হয়ে যায় না। এ ধরনের অস্বাভাবিক সংযোগ দ্বারা আর যাই হোক, ইসলামী রাষ্ট্রের উপযুক্তে নাগরিক গঠন করা কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না।
বাংলাদেশ আমলে শিক্ষা পুনর্গঠন প্রচেষ্টা
বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কায়েম হওয়ার পর শেষ মুজীব সরকার “ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন” গঠন করেন। ঐ কমিশনের সুপরিশ স্বাভাবিক কারণেই তখনকার রাষ্ট্রীয় আদর্শ “ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্র” অনুযায়ী প্রণীত হয়।
জেনালের জিয়ার আমলে ১৯৭৬ সালে প্রফেসর শামসুল হককে চেয়ারম্যান করে “জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠসূচি প্রণয়ন কমিটি” গঠন করা হয়। ১৯৭৮ সালে শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে শিক্ষা পরিষদ গঠিত।
জেনারেল এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালে শিক্ষামন্ত্রী ড. আ. মজীদ খানের নেতৃত্বে ‘মজীদ খান কমিটি’ গঠন করা হয়। ১৯৮৭ সাল অধ্যাপক মফিজুদ্দীন আহমদকে চেয়ারম্যান করে জাতয়ি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়।
১৯৯১ থেকে ৯৬ পর্যন্ত বেগম জিয়ার আমলে কোন কমিশন গঠন করা হয়নি। তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আইন পাশ করা হয়।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার আমলে ‘ড. কুদরত-ই-খুদা রিপোর্টের’ ভিত্তিতে প্রফেসর মু. শামসুল হকের নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটিকে শিক্ষানীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০০১ সালে ৪ দলীয় জোট সরকার কায়েম হবার পর ড. মুহাম্মদ মুনীরুয্যামান মিঞাকে চেয়ারম্যান করে ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩’ গঠন করা হয়।
শেখ মুজীব ও শেখ হাসিনার আমল শিক্ষা-ব্যবস্থা খাঁটি ধর্মনিরপেক্খ করা এবং ধর্ম শিক্ষা সরকারী ব্যয়ে বনধ করার প্রচেষ্টা চলে। অন্যান্য আমলে এমনকি বর্তমান (২০০৪) চার দলীয় জোট সরকার আমলেও ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩’ যে সুপারিশ মালা পেশ করেছে তাও সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ। অবশ্য এতে মাদরাসা শিক্ষাকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
উপরিউক্ত শিক্ষা কমিশন ও কমিটিসমূহের রিপোর্ট ও সুপারিশমালার কোনটাই যথাযথভাবে বাস্তাবায়িত হতে পারেনি। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথেই পূর্ববর্তী সরকারের আমল প্রণীত শিক্ষা-ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায় এবং নতুন ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়। যা হোক ঐ সব সুপারিশে যারা একমুখী শিক্ষা-ব্যবস্থার চিন্তা করেছেন তা ধর্ম-শিক্ষাকে বলতে গেলে বাদেই দিয়েছেন। আর যারা ধর্ম-শিক্ষাকে বাদ দেননি তারা ধর্মীয় শিক্ষাকে ধর্ম-নিরপেক্ষ শিক্ষা-ব্যবস্থার লেজুড় হিসেবে রেখেছেন।
প্রচলিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক গলদ
ইসলামকে জাতীয় আদর্শ হিসেবে স্বীকৃতির ভিত্তিতে শিক্ষা পুনর্গঠন করতে হলে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক গলদটুকু তালাশ করে বের করতে হবে।
যে কোন শিক্ষাব্যবস্থার মূলে যে প্রশ্নটি বিশেষভাবে সক্রিয় থাকে তা এই যে, তা দ্বারা কোন্ ধরনের মানুষ গড়ে তোলা হবে। এ দেশে প্রচলিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাটি ইংরেজ শাসকদের অবদান। ইসলামী আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত কর্মী তৈরি করার উদ্দেশ্যে ইংরেজগণ নিশ্চয়ই এ দেশের আধুনিক শিক্ষঅর প্রবর্তন করেনি। এমনকি তারা নিজ দেশে যে প্রকার নাগরিক গঠন করার উদ্দেশ্যে শিক্ষার বন্দোবস্ত করেছে, সে ধরনের উদ্দেশ্য এখানে ছিলো না; বরং এমন কতক লোক তৈরি করা তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো, যারা মুষ্টিমেয় ইংরেজ শাসকদের বিশ্বস্ত কর্মচারীরূপে এদেশে ইংরেজ শাসনকে জারি রাখতে সাহায্য করবে। তাদের এমন কতক লোক যোগাড় করার প্রয়োজন দেখা দেয়, যারা ইংরেজদের কথা বুঝতে পারে, তাদের আদব-কায়দা, চালচলন, রীতিনীতি অনুকরণ করতে সক্ষম এবং তাদের আদর্শকে ভালোবাসতে রাজি।
ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত সেই শিক্ষাব্যবস্থাকেই অধিকতর উন্নত করার চেষ্টা চলছে। সেই ব্যবস্থার সাথে Religious Instruction (ধর্মীয় শিক্ষা)-এর নামে দীনিয়াতের সংযোগও ইংরেজদের অনুকরণ মাত্র। পাশ্চাত্য দেশসমূহে দর্শন, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, ভূগোল, অংক ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে যে প্রকারের দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়, জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে যে ধারণা জন্মলাভ করে, বিশ্বাস ও জ্ঞান যে পথে ধাবিত হয়, আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোন কারণ নেই।
বিশাল শিক্ষা-বৃক্ষকে যদি ইসলামের জীবন দর্শন থেকে নিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে সেই শিক্ষাবৃক্ষের কাণ্ডের সাথে দীনিয়াতের আলাদা কলম বেঁধে দিলে যে কি পরিণাম হয়, তার অভিজ্ঞতা আমাদের বহুবার হয়েছে। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনকালে এ পরিকল্পনাই গঠন করা হয়েছিলো। পাশ্চাত্য জীবনদর্শনের ভিত্তিতে সবকিছু শিক্ষা দেবার সঙ্গে দীনিয়াতের অস্বাভাবিক সংযোগ সেখানেও ছিলো। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মানুসারেই এরূপ ব্যবস্থা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এক প্রকারের জীবের শরীরে অন্য জীবের অংশবিশেষ বেঁধে দিলে যে কি অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা বেশি ব্যাখ্যা করার নিষ্প্রয়োজন।
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় পার্থিব সকলশাস্ত্র এমনভাবে শিক্ষঅ দেবার ব্যবস্থা হচ্ছে ও বাস্তব ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করে দেখানো হচ্ছে যে, এ বিশাল বিশ্বের কোন স্রষ্টা নেই। এটা নিজে নিজেই চলছে এবং সাফল্যের সাথে নিয়মিত ও সুষ্ঠভাবেই চলছে। সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক বিধান শিক্ষা দেওয়ার ভিতর দিয়ে ছাত্রদের মগজে এ ধারণাই সৃষ্টি হচ্ছে যে, আল্লাহ, রাসূল, ওহী, কুরআন ইত্যাদি ব্যতীতই জগৎ উন্নতি লাভ করছে। সমগ্র শিক্ষার মাধ্যমে গোটা জীবন ব্যবস্থা সম্বন্ধেই তারা স্রষ্টানিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করছে। এমতাবস্থায় তাদেরকে যখন হঠাৎ দীনিয়াত শিক্ষা দিতে আরম্ভ করা হয়, তখন আল্লাহ, রাসূল, আখিরাত, ওহী ইত্যাদির কথা প্রথম প্রথম তাদেরকে অবাক করে। অতঃপর এ সকল বিষয় তাদের বিদ্রুপের জিনিস হয়ে দাঁড়ায়।
এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মকে হেয় মনে করা, ধর্মকে অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় বলে বিশ্বাস করা অত্যন্ত স্বাভাবিক। এ ধরনের ব্যবস্থায় বড়জোর ধর্মকে শুধু একটি নিষ্ক্রিয় হিসেবে কিছু লোকের পক্ষে স্বীকার করা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু এটা জীবনকে ইসলামের ভিত্তিতে পরিচালিত করার যোগ্যতা কিছুতেই সৃষ্টি করবে না। এ ধরনের শিক্ষার ফলে ভবিষ্যৎ বংশধরদের জীবনে ইসলাম একটি অপ্রয়োজনীয় পরিশিষ্ট হিসেবে স্থান পাবে।
ইসলাম এমন কোন ধর্মের নাম নয় যে, মানুষকে নিজের ইচ্ছানাযায়ী যাবতীয় কাজ করার অনুমতি দেবে, আর সেই সাথে কিছু কর্মহীন বিশ্বাস ও প্রাণহীন অনুষ্ঠানের পরিশিষ্ট জুড়ে দিলেই রাজি হবে। কারো গড বা ভগবান হয়তো বা এতে রাজি হতে পারে যে, গির্জা ও মন্দিরে তাকে ডাকলেই সে সন্তুষ্ট হবে এবং জীবনের অন্যান্য যাবতীয় ক্ষেত্রে বিশ্বাস ও কর্মে তাকে ত্যাগ করলে কোন আপত্তি করবে না; কিন্তু কুরআনের আল্লাহ অত্যন্ত শক্তিশালী। তিনি কারো সাথে আপস করে রাজি নন। এ কারণেই তিনি মুমিনদের ‘সম্পূর্ণরূপে ইসলামে দাখিল হও’ বলে আহবান জানিয়েছেন।
আমরা একে অত্যন্ত অযৌক্তিক মনে করি যে, আল্লাহ আছে বলে মানবো, অথচ তিনি পার্থিব জীবনে আমাদর পথপ্রদর্শক হবেন না। যে আল্লাহ দুনিয়ার চলার পথে আমাকে সঠিক হেদায়াত দেন না, তাকে শুধু মসজিদে মেনেই বা লাভ কি?
সুতরাং ইসলাম সম্বন্ধে যে শিক্ষার মাধ্যমে এরূপ ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয় নিশ্চয় তা বিশুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা। এর সাথে দীনিয়াতের শিক্ষাকে জুড়ে ইসলামকেও একটি অনুষ্ঠানিকসর্বস্ব নির্জীব ধর্মেই পরিণত করা হয়েছে।
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার ধরন
বর্তমান মাদরাসা শিক্ষার মাধ্যমে যে ধরনের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তাতে ইসলামের ধর্মীয় দিকটুকুরই চর্চা হয় মাত্র। ইসলামকে একটি ধর্ম হিসেবে শিক্ষা করার নাম ইসলামী শিক্ষা বলা কিছুতেই উচিত নয়। ইসলাম একটি জীবনদর্শন ও জীবন বিধান। মানব জীবনের সমগ্র দিক ও বিভাগের জন্যই এর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী ও বিধান রয়েছে। ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ মতাদর্শ বলে স্বীকার করলে, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, বিবাহ, তালাক, ফারায়েয ইত্যাদি শিক্ষা দান কজরার দ্বারাই ইসলামী শিক্ষার প্রয়োজন পূর্ণ হতে পারে না।
যে শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামকে একটি পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ হিসেবে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে তাই ইসলামী শিক্ষা। সে শিক্ষা লাভ করার ফলে শিক্ষার্থদের মন, মগজ ও চরিত্র এমনভাবে গড়ে উঠবে, যাতে ইসলামের আদর্শে একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। সে শিক্ষা লাভ করলে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কুরআন যে দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করতে চায়, তাই লাভ করা যাবে। এ শিক্ষা ব্যক্তিজীবন হতে আরম্ভ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র পর্যন্ত সকল দিকেই ইসলামের আদর্শকে মানব রচিত সকল আদর্শ হতে উন্নত ও প্রগতিশীল বলে প্রমাণিত করবে। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা হতে উচ্চতম মান পর্যন্ত শিক্ষার সকল স্তরেই এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখায়ই কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে যাবতীয় শিক্ষা দান করতে হবে। ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থা, অর্থনীতি, যুদ্ধনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কনীতি এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া হবে, যাতে মানব রচিত মতবাদসমূহের সাথে তুলনা করে ইসলামের যৌক্তিকতা ও শ্রেষ্ঠত্ব শিক্ষার্থীদের নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠে।
মোটকথা, যে শিক্ষা মুসলিম দার্শনিক, মুসলিম বৈজ্ঞানিক, মুসিলম শাসক, মুসিলম বিচারক, মুসলিম অর্থনীতিবিদ, মুসলিম সেনাপতি, মুসলিম রাষ্ট্রদূত ইত্যাদি সৃষ্টি করবে তাই ইসলামী শিক্ষ নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য। যদি ইসলামই আমাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শ হয়, তা হলে এ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উপযোগী একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।