ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হলে ছয়টি মৌলিক বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
১. শিক্ষাব্যবস্থাকে একই সঙ্গে দীন ও দুনিয়ার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হতে হবে।
২. পার্থিব জীবনের প্রয়োজনে যত প্রকার বিদ্যা শিক্ষা করতে হয় সে সবকেই ইসলামী দৃষ্টিকোণ হতে শিক্ষা দিতে হবে।
৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোটা পরিবেশকেই ইসলামী ছাঁচে ঢালাই করতে হবে।
৪. উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামের সাথে মানব রচিত বিধানের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে ইসলামের যৌক্তিকতা ও শ্রেষ্ঠত্ব শিক্ষার্থদের মনে বদ্ধমূল করতে হবে।
৪. যেহেতু কুরআন, হাদীস ও ফিকহ ইসলামী জ্ঞানের মূল উৎস, যেহেতু শিক্ষাব্যবস্থার উচ্চস্তরে উন্নতমানের মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও ফকীহ সৃষ্টির উপযোগী বিশেষ কোর্স থাকতে হবে।
ইসলামী শিক্ষার বাস্তব রূপ
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহকে লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে যদি শিক্ষাব্যবস্থঅকে গড়ে তোলা হয় তা হলে ইসলামী শিক্ষার বাস্তবরূপ কি দাঁড়াবে সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন।
দীন ও দুনিয়া
প্রথম বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থাকে দীন ও দুনিয়ার প্রয়োজন পূর্ণ করার যোগ্য হতে হবে। দীন ও দুনিয়া কথাটি দ্বারা সাধারণত ধর্মীয় ও পার্থিব বলে কথিত দুটি পৃথ দিক মনে করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসলামের দৃষ্টিতে দীন ও দুনিয়া দুটি সামঞ্জস্যহীন পৃথক সত্তা নয়। অন্যান্য ধর্মে যেহেতু জীবনের সকল দিক ও বিভাগের উপযোগী পূর্ণাঙ্গ বিধান নেই (অন্তত অন্য কোন ধর্মের নেতৃবৃন্দ এরূপ দাবি করেন না), সেহেতু সে সব ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় শিক্ষার সাথে তাদের পার্থিব শিক্ষার যোগাযোগ নেই। তারা দুনিয়ার প্রয়োজন পূরণ করার জন্য যে শিক্ষার ব্যবস্থা করে তা সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মের প্রভাবমুক্ত। তারা ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে বিশ্বাস করে এবং ব্যক্তিগতভাবেক ধর্মীয় প্রয়োজন পূরণ করার উদ্দেশ্যে তারা ঐ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার সাথে ধর্মীয় শিক্ষার পরিশিষ্ট জুড়ে দেয়।
কিন্তু ইসলাম ঐ ধরনের কোন ধর্ম মাত্র নয়; ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। সুতরাং ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহ পালন করার উপযোগী শিক্ষাকে পূর্ণ ইসলামী শিক্ষা মনে করা মারাত্মক ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। পার্থিব প্রয়োজন পূরণ করার জন্য যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য, সে শিক্ষাকে যদি ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবেশন করা হয় তা হলেই তা ইসলামী শিক্ষায় পরিণত হয়।
মানুষকে পার্থিব জীবনে যা কিছু করতে হয় তা আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ অনুযায় করলেই তা ইবাদতে পরিণত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, শাসন ও বিচার, পারিবারিক ও সামাজিক কাজকর্ম সকল মানুষকেই করতে হয়। যারা আল্লাহকে স্বীকারই করেনা তাদেরও এসব কাজ না করলে চলে না। জীবনের সকল কাজকর্মেই তারা নিজেদের মনগড়া নীতি বা অন্য কোন মানুষের রচিত নীতি ও আইন অনুযায়ী সম্পন্ন করা হয় তাহলে এ সবই ইবাদতে পরিণত হয়। ইসলামে কোন বিশেষ অনুষ্ঠাই শুধু ইবাদত নয়; গোটা জীবনটাকে ইবাদতে পরিণত করার উদ্দেশ্যেই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে।
জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার যোগ্যতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন। একথা যদি স্বীকৃত হয় তাহলে ইসলামী শিক্ষা বাস্তব জীবন থেকে পৃথক কোন নিষ্ক্রিয় শিক্ষা হতে পারে না। দুনিয়ায় আল্লাহর পছন্দনীয় জীবন যাপন করার উপযোগী শিক্ষাই ইসলামী শিক্ষা নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য। তাই ইসলামী শিক্ষায় দীন ও দুনিয়ার প্রচলিত ভিন্ন করে দেখাও অসম্ভব।
পার্থিব শিক্ষায় ইসলামী দৃষ্টিকোণ
আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞান পরোক্ষ (Indirect) পরোক্ষ উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। মানুষের মনস্তত্ব গভীরভাবে অধ্যয়ন করে এবং বাস্তব গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষাবিজ্ঞানীগণ এ সিদ্ধান্তে উপনী হয়েছেন যে, শিক্ষার্থীদেরকে নীতিজ্ঞঅন ও তত্ত্বকথা পৃথকভাবে শিক্ষা দিতে গেলে যতটা কার্যকরী হয়, বাস্তব কার্যকলাপের মাধ্যমে সে শিক্ষা দিলে অবচেতনভাবেই তা অধিকতর সুফল ও ফলপ্রসূ হয়। মানুষ স্বাভাবিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেরণায় যা করতে চায় তাকেই শিক্ষঅমূক করে তোলার নামই পরোক্ষ শিক্ষাপদ্ধতি। আধুনিক শিক্ষায় এ নীতির উপর ভিত্তি করেই খেলার মাধ্যমে অক্ষরজ্ঞন, সংখ্যাজ্ঞান, শব্দগঠন ইত্যাদি শিক্ষাকে শিশুদের নিকট আকর্ষনীয় করা সম্ভব হয়েছে।
শিক্ষাপদ্ধতির এই পরোক্ষ নীতিকে অবলম্বন করে পার্থিক জীবনের প্রয়োজনীয় যাবতীয় শিক্ষাক ইসলামী ছাঁচে ঢেলে শিক্ষা দলে বাস্তব দিক দিয়ে আধিক কার্যকরী হবে। সুদ যে এক প্রকার জঘন্য যুলুম তা পৃথকভাবে মুখস্থ না করিয়ে যদি সুদের অংক কষার মাধ্যমেই শিক্ষা দেওয়া যায়, তাহলে অবচেতনভাবেই শিক্ষার্থীর মনে তা সহজে কায়েম হবে। আমরা স্কুল জীবেন গোয়ালা দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রয় করার অংকের মাধ্যমে যা শিখেছি, তাতে এরূপ সমাজবিরোধী কার্যকলাপের প্রতি অন্তরে ঘৃণার সৃষ্টি হয়নি। সেখানে পরোক্ষ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, কিরূপে বেশি দামে কিনে পানি মিশানোর ফলে কম দানে বিক্রয় করেও গোয়ালা লাভবান হতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এ অংকটিতে “গোয়ালা কত লাভ করেছে” জিজ্ঞেস না করে যদি “গোয়ালা মানুষকে পরিমাণ ঠকিয়েছে” জিজ্ঞেস করি তাহলে সহজেই এ কাজের প্রতি ছাত্রদের ঘৃণার উদ্রেক হবে।
স্বাস্থবিজ্ঞান পড়ানোর সাথেই পবিত্রতার ইসলামী ধারণা দান করা হলে পবিত্রতা সম্পর্কে পৃথকভাবে মাসআলা শিক্ষা দেওয়ার অপেক্ষা বেশি উপকারী হবে। সৌরজগৎ সম্পর্কে ভৌগলিক জ্ঞান দান করার সাথেই সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-তারা সম্বন্ধে কুরআনে বর্ণিত আয়াতসমূহকে শিক্ষা দেওয়া হয় তাহলে ভূগোলবিজ্ঞানেও ইসলামী দৃষ্টিকোণ সৃষ্টি করবে।
এভাবে সকল স্তরের শিক্ষাকে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব এবং সকল বিষয়কেই কুরআন হাদীসের জ্ঞান দান করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
শিক্ষার পরিবেশ
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের গোটা পরিবেশে একেবারেই ইসলামবিরোধী। এ পরিবেশ কুর্ন ও হাদীসের শিক্ষা অধিক পরিমাণে পরিবেশন করলেও শিক্ষার্থীদের চরিত্রে ইসলামের কোন প্রথাবই প্রতিষ্ঠিত হবে না। নামায ইসলামী জীবনবিধানের দ্বিতীয় প্রধান ভিত্তি। কিন্তু আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলমান শিক্ষক ও ছাত্রদের নিকট তা ‘ফরয’ বলে গণ্য নয়। সেখানে নামায বাস্তব ক্ষেত্রে একটি মুবাহ (যা করা ও না করায় কোন লাভ-ক্ষতি নেই) কাজ মাত্র। ইসলাম পর্দার নির্দেশ দেয়; কিন্তু সেখানে পর্দা ‘হারাম’। মিথ্যা প্রচার ও মিথ্যা সাক্ষ্য ইসলামে হারাম, কিন্তু সেখানে ছাত্র সংসদের নির্বচানে এ সবই আর্টের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামী নৈতিকতার অধিকাংশ সীমাই সেখানে লঙ্ঘন করা সহজ; নৈতিকতা পালন করা সেখানে অত্যন্ত কঠিন।
বিশেষ করে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ফলে উত্তরাধিকারসূত্রে ইসলামের বিশ্বাস ও মূল্যমান সম্পর্কে যেটুকু শিক্ষা ছোটসময় থেকে শিক্ষার্থীদের মনে বদ্ধমূল হয়ে বসে। কিন্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের বিশ্বাস ও কর্মে প্রথমে দ্বন্দ্ব এবং পরে স্পষ্ট বৈপরীত্বের সৃষ্টি হয়। তাদের নৈতিক শক্তি অত্যন্ত দুর্বল হতে থাকে। গোটা শিক্ষা জীবনেই তারা বিশ্বাসের বিপরীত কাজ করার এক ব্যাপক ট্রেনিং লাভ করে থাকে।
এরই ফলে তাদের বাস্তব জীবন কোন বলিষ্ঠ চরিত্রের পরিচয় বহন কর না। তারা ঘুষ খাওয়াকে অন্যায় বলে বিশ্বাস কররেও এ বিশ্বাসের বিপরীত চলারই শিক্ষা লাভ করেছে। জাতির খিদমত করা কর্তব্য বলে বিশ্বাস করা সত্ত্ওেব বাস্তব ক্ষেত্রে জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নিজের খিদমত করার মহান ট্রেনিংই এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে লাভ করেছে।
জাতির মূল্যমান ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোটা পরিবেশে গড়ে তোলা না হলে শুধু কিতাবী বিদ্যা দ্বারা চরিত্র সৃষ্টি হতে পারে না। দিবেশে যে সমস্ত বই পড়ানো হয় আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও সেসব বই-ই পাঠ্য আছে। কিন্তু ঐসব দেশে সমাজের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে শিক্ষার পরিবেশের বিরোধ সামান্যই আছে। ছাত্র-ছাত্রীদের অবাধ মেলামেশা তাদের বিশ্বাসের বিপরীত নয়। সুতরাং তাদের বিশ্বাস মোতাবেক চরিত্রই সেখানে সৃষ্টি হয়। ফলে সেসব দেশের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে এতোটা নৈতিক অধঃপতন দেখা যায় না।
প্রকৃত কথা এই যে, চরিত্র সৃষ্টির জন্য কিছু মূল্যবোধ প্রয়োজন। যদি মূল্যবোধ ও বাস্তব শিক্ষা একরূপ হয় তবেই চরিত্রের উন্নতি সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে আমাদের সাধরণে মূল্যবোধের বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং হয় আমাদের মূল্যবোধের বিশ্বাসকে বদলে শিক্ষার পরিবেশে মোতাবেক গঠন করতে হবে, না হয় পরিবেশকে ঈমান অনযায়ী সংস্কার করতে হবে। প্রথম অবস্থায় আমরা বিশুদ্ধ অনৈসলামিক চরিত্র সৃষ্টি করবো। আর দ্বিতীয় অবস্থায় সত্যিকার ইসলামী চরিত্র গঠিত হবে।
উচ্চশিক্ষার ইসলামী রূপ
জীবনের সর্বক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিত লোকেরাই নেতৃত্ব দান করে। কারণ চিন্তার ক্ষেত্রে নেতৃত্বেই প্রকৃত নেতৃত্ব। বর্তমানে আমাদের দেশে অনৈসলামী বা ইসলাম নিরপেক্ষ উচ্চশিক্ষিত লোকের নেতৃত্বের ফলেই সমাজে ইসলামের প্রভাব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। তাই উচ্চশিক্ষাকে ‘ইসলামী’ করে গঠন না করলে বাস্তব ক্ষেত্রে সমাজে ইসলামী চিন্তাধারার ব্যাপক প্রসার কিছুতেই সম্ভবপর নয়।
উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে দর্শন, বিক্থঅন,. ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে, যাতে ইসলামী জীবন দর্শন, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা, ইসলামী অর্থনৈতিক বিধান এবং কুরআনের ইতিহাস দর্শনের শ্রেষ্ঠতব ও যৌক্তিকতা শিক্ষার্থীদের মনে বদ্ধমূল হতে পার। ইসলামের দৃষ্টিকোণ ব্যতীত প্রচলিত পন্থায় এসব বিষয় শিক্ষা দিতে থাকলে পৃথকভাবে দিীনিয়াত শিক্ষঅ যতই হোক, তাতে ছাত্র-ছাত্রীদের মন-মগজ কিছুতেই ইসলামের ছাঁচে গঠিত হবে না।
ইতিহাসের জড়বাদী ব্যাখ্যা মন-মগজে প্রতিষ্ঠিত করার পর শুধু কুরআন অনুবাদ ও তাফসীর শিক্ষা দ্বারা কিছুতেই ইসলামের ইতিহাস-দর্শনকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ইতিহাসের উচ্চশিক্ষা কুরআনের ইতিহাস দর্শনের সাথে অন্যান্য দর্শনের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে ইসলামের শ্রেষ্ঠতক্ব প্রতিপন্ন করা দ্বারাই তা সম্ভব। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের যৌক্তিকতা ও শ্রেষ্ঠত্ব শিক্ষা দেবার পর রাসূল (স)-এর শাসনব্যবস্থঅর ভাসাভাসা আলোচনা কিছুতেই মুসলিম রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সৃষ্টি করবে না। তাই শিক্ষার বিষয়সমূহকে এমনভাবে পরিবেশন করতে হবে, যাতে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে প্রতিভাবান শিক্ষার্থীগণ মুসলমান বৈজ্ঞানিক, মুসলিম দার্শনিক, মুসলমা ঐতিহাসিক এবং মুসলমান অর্থনীতিবিদ হিসেবে গড়ে উঠতে সক্ষম হবে।
শিক্ষার বিষয়সমূহকে প্রচলিত নিয়মে শিক্ষা দিতে থাকলে ধর্মীয় শিক্ষা যদি শিক্ষার সকল স্তরে বাধ্যতামূলকও করা হয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের একাংশ মসজিদে মুসলমান, রাজনীতিতে গণতান্ত্রী, অর্থনীতিতে সমাজতনত্রী এবং পারিবারিক জীবনে ফ্রয়েডপন্থি হিসেবে গঠিত হয়ে কিছুসংখ্যক কার্টুনে পরিণত হবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রকৃত মুসলমান হিসেবে গঠন করতে হলে শিক্ষার সকল বিষয়কেই ইসলামের ছাঁচে ঢেলে গঠন করতে হবে।
ইসলামে জ্ঞানের উৎস
কুরআন ও হাদীসই ইসলামী জ্ঞানের মূল উৎস। আরবী ভাষায় মূল কুরআন ও হাদীসকে পূর্ণরূপে বুঝার লোকের অভাব হলে জীবনের সকল দিকেই ইসলামের প্রথাব ক্ষুণ্ণ হবে। তদুপরি বহু শতাব্দীরে কঠোর সাধনার ফলে কুরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে যে ইসলামী আইনশাস্ত্র বা ফিকহ গড়ে উঠেছে তাও আরবী ভাসায়ই রচিত। সুতরাং কুরআন, হাদীস ও ফিক্হ সম্পর্কে গভীর সম্পর্কে গবেষণা করার যোগ্য প্রতিভাবান লোক তৈরি না হলে ইসলামী শিক্ষা তো দূরের কথা, ইসলামী সমাজই টিকতে পারবে না।
মাধ্যমিক শিক্ষার পর বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষার যেমন ব্যবস্থা থাকে, তেমনি কুরআন, হাদীস ও ফিকহ বিষয়ে বুৎপত্তি লাভ করার জন্য শিক্ষার উচ্চস্তরে বিশেষ কোর্সের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এর মাধ্যমে যে সকল মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও ফকীহ তৈরি হবে প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই ইসলামী দৃষ্টিতে সর্বক্ষেত্রে জাতিকে নেতৃত্ব দেবার যোগ্য হবে। কিন্তু তারা যদি মানব সমস্যা, আধুনিক জগৎ ও প্রচলিত চিন্তাধারার সাথে পরিচিত না হয় তাহলে তাদের কুরআন-হাদীস সম্পর্কিত জ্ঞঅন মানুষের কোন উপকারে আসবে না। সুতরাং তাদেরকে ডিগ্রি পর্যায়েও বিভিন্ন বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করতে হবে, যাতে তারা কুরআন ও হাদীসের আলোকে জাতিকে যোগ্য ইসলামী নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়।
শিক্ষকদের আদর্শ
শিক্ষার ব্যাপারে সকল অবস্থায়েই শিক্ষকের গুরুত্ব সর্বাধিক। শিক্ষকের বিদ্যা ও চরিত্রের মানের উপর চিরদিনই শিক্ষার ফল প্রধানত নির্ভরশীল। “কী পড়ানো হচ্ছে” তার চেয়ে “কী ধরনের শিক্ষক পড়াচ্ছেন” এর মূল্য ও গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। তাই ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকগণকে চিন্তা ও কর্মে প্রকৃত মুসলমান হতে হবে। কিতাবী বিদ্যা অপেক্ষা বাস্তব উদাহরণ অনেক বেশি কার্যকর হয়। যদি শিক্ষকগণ ইসলামের দৃষ্টিতে আদর্শস্থানীয় হন তাহলে শিক্ষপদ্ধতির মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার উদ্দেশ্য অনেকখানি সফল হবে।
আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞানের উন্নতি
জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার ন্যায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান আজ বিরাট উন্নতি লাভ করেছে। এ উন্নতিকে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে যাতে ব্যবহার করা যায়, সেদিকেও আমাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। ইসলামের চর্চা করার জন্য আমরা যেমন মাইক্রোফোন ব্যবহার করি, শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণার ফলে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করা হয়েছে তাও ইসলামী শিক্ষার ব্যাপারে অবশ্যই কাজ লাগাতে হবে।
অতীত ও বর্তমানের দার্শনিকদের গবেষণা এবং শিক্ষাবিদদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হতে শিক্ষা সম্পর্কে এতো তত্ত্ব ও তথ্য আমাদের হস্তগত হয়েছে যে, শিক্ষা আজ রীতিমতো এক বিরাট বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। এ বিজ্ঞানকে উপেক্ষা করলে বর্তমান যুগের উপযোগী মানের লোকদেরকে ইসলামী শিক্ষা দান করা অসম্ভব হবে। সুতরাং ইসলামী নৈতিকতার সীমার মধ্যে থেকে আধুনিক সকল উপায়-উপকরণকেই ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে।
উপসংহার
এ কথা মনে রাখতে হবে যে, এই প্রবন্ধে শিক্ষাপদ্ধতির ইসলামী রূপ সম্বন্ধে যা বলা হযেছৈ তা সরকারী পরিকল্পনা ব্যতীত ব্যাপকভাবে প্রচলন করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। আর যে সরকার ইসলামকে একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কোন পরিকল্পনাই গ্রহণ করেনে, সে ধরনের কোন সরকারকে এরূপ কোন কাঠামোর ভিত্তিকে একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে বললেও কোন সুফল পাওয়া যাবে না।
সমাজে ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি করার জন্য সর্বক্ষেত্রে যেমন কিছুসংখ্যক মুজাহিদদের সুসংবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে, তেমনি শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাদেরকে চিন্তা ও গবেষণার সাথে সাথে ক্ষুদ্রাকারে হলৌ এরূপ একটি শিক্ষাব্যবস্থঅ গড়ে তুলবার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এভাবেই যখন কোন সমাজে একটি পূর্ণাঙ্গ আন্দোলন চলতে থাকে, তখন জীবনের সকল দিকেই উপযুক্ত চিন্তানায়ক ও কর্মবীরের দল তৈরি হতে থাকে। কোথাও এরূপ একটি আন্দোলন বিজয়ী হলে অতি সহজেই উপরিউক্তরূপ ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থঅ বাস্তবে পরিণত হবে। সুতরাং যারা ইসলামের পুনর্জাগনের স্বপ্ন দেখেন তাদেরকে একটি ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলবার পরিকল্পনাকেও নিজেদের কর্মসূচির একটি বিশেষ অশ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
(ঢাকায় ১৯৬১ ইসলামী সেমিনারে প্রদত্ব বক্তৃতা)
“ইসলামের ইতিহাস থেকে আমি একটি শিক্ষালাভ করেছি যে, মুসলিমদের ভয়াবহ বিপদের সময় একমাত্র ইসলামই তাদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আজ যদি আপনারা পুনর্বার ইসলামের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং তার জীবনীশক্তি উৎপাদক চিন্তাধারায় প্রভাবিত হন, তাহলেই আপনাদের মহান অস্তিত্ব ধ্বংসের কবল হতে রক্ষা পাবে।”
— সমাপ্ত —