Magic : জাদু, ইন্দ্রজাল
জাদু বা ইন্দ্রজাল বলতে প্রাচীনকালের কতকগুলি আচার অনুষ্ঠানকে বুঝায়। আদিম মানুষ বিশ্বাস করতো, এ সকল আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ, পশু, প্রেত ইত্যাদি শক্তিকে ইচ্ছানুযায়ী বশ করা যায়। জাদুর মূলে মানুষের মনে এই ধারণা কাজ করত যে, প্রাকৃতিক জগতের সঙ্গে মানুষ একটা অলৌকিক বন্ধনে আবদ্ধ। আদিম মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজন, যেমন কোনো শ্রমের নির্দিষ্ট ফল লাভ, অপরের ক্ষতিসাধন, রোগ হতে আরোগ্য লাভ প্রভৃতির জন্য ভিন্ন ভিন্ন জাদুমন্ত্র ছিল। জাদুমন্ত্রে বিশ্বাস ইউরোপের মধ্যযুগ পর্য্যন্ত প্রবল ছিল। খ্রিষ্টধর্ম, হিন্দুধর্ম ও অন্যান্যধর্মসমূহের প্রার্থনা, পূজা ইত্যাদির মধ্যে জাদুর রেশ এখনো বিদ্যমান।
Mahabharat, Ramayan : মহাভারত এবং রামায়ান
প্রাচীন ভারতের সুবিখ্যাত দুটি মহাকাব্য-রামায়ণ এবং মহাভারত। শ্লোক হিসেবে এ কাহিনী লিখিত হয়েছিল। এ দুটি মহাকাব্যের শ্লোকসংখ্যা দুই লক্ষের উপর ছিল। যেমন গ্রীসের হোমারের ইলিয়াড, তেমনি রামায়ন, মহাভারত উভয় কাহিনী প্রেম বিষয়ক। রামায়ণের প্রধান চরিত্র ছিল রাজা রাম এবং তার স্ত্রী সীতা। ভারতের দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা নামে যে দ্বীপ ছিল সে দ্বীপের রাজা নাকি সীতার রূপে মুগ্ধ হয়ে সীতার বনবাসকালে তাকে অপহরণ করেছিল।
এ নিয়ে রামের সঙ্গে তার যুদ্ধ বাধে। এ যুদ্ধে যে কেবল মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল তা নয়। বানরও এ কাহিনীর অন্যতম চরিত্র রাম ও সীতার পক্ষে দীর্ঘ সময় লড়াই করে সীতাকে লঙ্কা হতে উদ্ধার করেছিল। বাংলা সাহিত্যের অমর কবি মেঘনাদ রাম রাবণের যুদ্ধের উপর দীর্ঘ এবং তাৎপর্য্যপূর্ণ শ্লোক রচনা করেন। মাইকেল মধুসূদনের রচনা ছন্দকে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বলা হয়।
Malthusianism : মালথুসবাদ
ইংল্যান্ডের ধর্মজাযক মালথুস(১৭৬৬-১৮৩৪ খ্রি.) জনসংখ্যা ও খাদ্য উৎপাদন সমস্যার উপর একটি তত্ত্বের প্রবর্তন করেন। এই তত্ত্ব মালথুসবাদ নামে পরিচিত। মালথুসের মতে, কোনো দেশের খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির হারের সঙ্গে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের তুলনা করলে দেখা যাবে যে, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার যদি আঙ্কিক হয়, তা হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি হচ্ছে জ্যামিতিক। অর্থাৎ মানুষের খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধি পায় ১,২,৩,৪ এরূপ ক্রমিক ভিত্তিতে। বিপরীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ১, ৩, ৯, ২৭ এরূপ গুণনের হারে। ফলে কালক্রমে জনসংখ্যা ও খাদ্যের মধ্যে ব্যবধান বিরাট হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের জীবন ধারণের জন্য জনসংখ্যা ও খাদ্যের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করা আবশ্যক। মালথুসের মতে এই ভারসাম্য মানুষ সাধারণত বজায় রাখে না। জনসংখ্যা খাদ্যের পরিমাণকে সংকটজনকভাবে অতিক্রম করে যায়। এমন অবস্থায় প্রকৃতি নিজে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ঝড়, যুদ্ধ ইত্যাকার দূর্বিপাক সৃষ্টি করে জনসংখ্যা হ্রাস করে খাদ্যের পোষন ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে আসে। মালথুসের পরবর্তী অনুসারীগণ মনে করেন, আধুনিককালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির মূলে আছে জনস্বাস্থ্যের উন্নতির ফলে মৃত্যুর হারের হ্রাসপ্রাপ্তি। জনসংখ্যা ও খাদ্যের মধ্যকার ব্যবধান দূর করার জন্য মালথুস যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদিকে প্রকৃতিদত্ত সমাধান এবং অনিবার্য্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণ এবং তার ফলে যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করেছেন। মার্কসবাদ এ কারণে তীব্রভাবে মালথুসবাদের বিরোধিতা করে। মার্কসবাদের মতে বিজ্ঞানের যে বিরাট উন্নতি সাধিত হয়েছে তাতে খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে অধিক করা সম্ভব। কাজেই জনসম্পদ জনসংখ্যাকে বহন করতে পারে না, একথা সত্য নয়। সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থায় জনসংখ্যার বৃদ্ধি কোনো অলঙ্ঘ সমস্যা বলে প্রতীয়মান হয় নি। জনসংখ্যার বৃদ্ধিকেও পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রিত করা চলে। আসলে পুঁজিবাদী সমাজে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে কৃত্রিমভাবে অর্থনীতিক সঙ্কটের মূল হিসাবে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করা হয়। সমস্যার মূল জনসংখ্যার বৃদ্ধি নয়, উৎপাদন ও বন্টনে পুঁজিবাদী শোষণ এবং অরাজকতার অস্তিত্ব।
Mao-Tse-Tung : মাও সে তুং(১৮৯৩-১৯৭৬ খ্রি.)
চীনের কমিউনিষ্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং চীন ভূখন্ডের প্রায় শতাব্দীকালের সামাজিক রাজনীতিক মুক্তি ও বিপ্লবের নায়ক। জাপানি দখলদার শক্তি এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার কুওমিনটাং নেতা চিয়াংকাইশেকের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সামাজিক বিপ্লবের জন্য চীনের অগণিত এবং অনুন্নত কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার কৌশলী হিসেবে মাও সে তুং এক সময় সমগ্র পৃথিবীতে সংগ্রামী মানুষের অনুপ্রেরণাদায়ক উপকথায় পরিণত হয়েছিলেন। চীনের একাংশে শিল্পের বেশ কিছুটা বিকাশ ঊনবিংশ শতাব্দীতে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম পঁচিশ বছরের মধ্যেই ঘটেছিল। কিন্তু চীনের সামাজিক বিপ্লব শিল্পের কেন্দ্র শহরসমূহ এবং তার শিল্পশ্রমিকদের শক্তির ভিত্তিতে ঘটে নি। শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লবী শ্রেণী হিসেবে সংঘটিত হয়েছে এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু মাও সে তুং বিপ্লবের প্রতিষ্ঠিত পরিক্রমার পরিবর্তে গ্রামাঞ্চলে গরীব কৃষকদের সংগঠিত করে জাপানি ও কুওমিনটাং বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা কৌশলে লড়াই এর মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে এক শক্তিশালী সৈন্যদল গঠন করেন। প্রধানত এই সশস্ত্র কৃষক বাহিনীকে নেতৃত্বদান করে মাও সে তুং এবং চীনের কমউনিস্ট পার্টি কুওমিনটাং এর সামাজিক ও সামরিক শক্তিকে সুদীর্ঘ সংগ্রামে পরাজিত করে ১৯৪৯ সনে সমগ্র চীন দখল করেন। কুওমিনটাং দলের নেতা এবং চীন সরকারের প্রধান চিয়াংকাইশেক তাঁর পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে ফরমোজা দ্বীপে আশ্রয় নিতে সক্ষম হন। ১৯২৭ সালের হুনান বিদ্রোহ থেকে চীনে সশস্ত্র সংগ্রামের শুরু। সংগ্রামের প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯৩৪ সালে কুওমিনটাং বাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য মাও সে তুং তার কৃষক বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে দুর্গম পথে তিন হাজার মাইল অতিক্রম করে চীনের পশ্চিমাঞ্চল ইয়েনানে গিয়ে উপস্থিত হন। চীনের ইতিহাসে এই যাত্রা ‘লং মার্চ’ বা ‘দীর্ঘ যাত্রা’ নামে খ্যাতিলাভ করে। মাও সে তুং এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় ত্রিশ বছরের সংগ্রাম শেষে চীনে কমিউনিষ্ট সরকারের প্রতিষ্ঠা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিধি ও শক্তি বিরাটভাবে বৃদ্ধি করে। সোভিয়েত রাশিয়ার সক্রিয় সাহায্যে চীনের শিল্প ও কৃষিতে বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়। পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক মিত্রসুলভ ছিল। কিন্তু ষাটের দশক থেকে বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে চীন ও সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতবিরোধ প্রকাশ পেতে থাকে। এই মতবিরোধের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন অভিযোগ তোলে যে মাও সে তুং চীনকে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের পথে নিয়ে যাচ্ছেন। অপর দিকে চীনের নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ পরিত্যাগ করে সংশোধনবাদী নীতি অনুসরণ করছে। চীন ও সোভিয়েতের মতবিরোধের প্রভাব আন্তর্জাতিক কমি উনিস্ট আন্দোলনেও বিস্তারিত হয়েছে। ফলে অনেক দেশের কমিউনিস্ট পার্টির পূর্বেকার ঐক্য ভেঙ্গে গেছে। একাধিক কমিউনিস্ট পার্টির উদ্ভব ঘটেছে।
Marcus Aurelius : মার্কাস অরেলিয়াস(১২১-১৮০ খ্রি.)
মার্কাস অরেলিয়াস ছিলেন স্টয়েক বা নিস্পৃহবাদী দার্শনিক এবং রোমের সম্রাট। তাঁর একমাত্র রচনা ‘মেডিটেশনস’ বা অনুধ্যান উপদেশ বাক্যাকারে লিখিত। মার্কাস অরেলিয়াসের দর্শনে রোম সাম্রাজ্যের সংকটের আভাস পাওয়া যায়। স্টয়েক দর্শনের যে নতুন ব্যাখ্যা অরেলিয়াস পেশ করেন তাতে স্টয়েক দর্শনের বস্তবাদী বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে উক্ত দর্শন ধর্মীয় রহস্যবাদের রূপ ধারণ করে। মার্কাস অরেলিয়াসের ব্যাখ্যায় ঈশ্বরই সার্বিক বিবেক হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র সর্বপ্রাণে বিস্তারিত হয়ে আছে। ব্যক্তির দেহের মৃত্যুর পরে মৃত্যুর চেতনা বিশ্ববিবেকের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। ব্যক্তির জীবন ধারণের নীতির ক্ষেত্রে মার্কাস অরেলিয়াসের অভিমত অদৃষ্টবাদের রূপ গ্রহণ করে। তিনি ব্যক্তিকে বাস্তব জীবনের ঘটনার অপরিহার্য্য নিয়তিকে মেনে নিয়ে নিজের আত্মোশুদ্ধি ও আত্মোন্নয়নের মাধ্যমে সান্ত্বনা প্রাপ্তির উপদেশ দেন। মার্কাস অরেলিয়াস সম্রাট হিসেবে সদ্য প্রতিষ্ঠিত খৃষ্টধর্মের অনুসারীদের প্রতি নির্দয় নীতি অনুসরণ করলেও পরবর্তীকালে খ্রিষ্টীয় ধর্মের উপর তাঁর দর্শনের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
Marx, Carl : কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩ খ্রি.)
কার্ল মার্কস বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদ এবং দ্বন্ধমূলক ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা এবং ঊনবিংশ শতকের শ্রমিক শ্রেণীর সাম্যবাদী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে ইতিহাসে বিখ্যাত। ছাত্রাবস্থাতে মার্কস হেগেলের দর্শনের প্রভাবে এলেও হেগেলের দর্শনের বামপন্থী ও প্রগতিশীল ভাবসমূহই মার্কসকে অধিকতর আকৃষ্ট করে। হেগেলের অনুসারীদের মধ্যে তিনি বামপন্থী হেগেলবাদী নামে পরিচিত। পরবর্তীতে মার্কস ক্রমান্বয়ে যত প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবী আন্দোলনে নিজেকে লিপ্ত করে তোলেন ততবেশী তিনি হেগেলের ভাববাদী প্রভাব কাটিয়ে উঠতে থাকেন। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে জার্মানীর অর্থনীতির অবস্থা সম্পূর্ণরূপে তার প্রত্যক্ষ জ্ঞান এবং ফয়েরবাদের বস্তুবাদী দর্শনের সঙ্গে তার পরিচয় মার্কসকে পরিপূর্ণভাবে হেগেলের দর্শনের আওতার বাইরে টেনে আনে। তিনি এই সময় থেকে তীব্রভাবে হেগেলের দর্শনের বৈপরীত্য, তার আভ্যন্তরীণ অসঙ্গতি, বাস্তব অবস্থার সঙ্গে তার ভাব-ব্যাখ্যার বিরোধ ইত্যাদি সম্পর্কে মার্কস তার বিরোধী অভিমত ব্যাখ্যা করতে থাকেন। ১৮৪৮ সালেরা জার্মানিতে কৃষক এবং শ্রমিকের যে বিপ্লবাত্মক অভ্যুত্থান ঘটে তাতে এবং পরবর্তীকালে প্যারিস শহরের শ্রেণী সংগ্রামে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মার্কস পরিপূর্ণরূপে সাম্যবাদী নেতায় পরিণত হন। এই সময়ে মার্কসবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং মার্কসের কর্মজীবনের একনিষ্ঠ সাথী ফ্রেডারিক এঙ্গেলস মার্কস এর সঙ্গে এসে মিলিত হন। মার্কস এবং এঙ্গেলস উভয়ই মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের উপর গভীর গবেষণার মাধ্যমে এক নতুন বিশ্বদর্শন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৪৭ সালে মার্কস এবং এঙ্গেলস ব্রুসেলস শহরে সাম্যবাদী দল নামে একটি গোপন শ্রমিক সংস্থা সংগঠিত করেন। এই সংগঠনের দ্বিতীয় কংগ্রেসে দুই বন্ধু ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ বা ‘সাম্যবাদের ইশতেহার’ (১৮৪৮ সালে) রচনা করেন। ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ মার্কসবাদের অন্যতম মৌলিক দলিলবিশেষ। এই ইশতেহারের মধ্যে অত্যন্ত জোরালো ভাষায় তীক্ষ্মভাবে ইতিহাসের দ্বন্ধমূলক বিকাশের তত্ত্ব বিবৃত করে ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণীকে পুঁজিবাদের গর্ভে নতুন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অনিবার্য্য শক্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মার্কসের দর্শনের ঐতিহাসিক প্রকাশ ঘটেছে ঊনবিংশ শতকের ইউরোপীয় সমাজের অর্থনীতিক ও সামাজিক অবস্থার উপর রচিত তাঁর গভীর গবেষণামূলক ‘দি ক্যাপিটাল’ বা পুঁজি নামক গ্রন্থে। এই গ্রন্থের প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় ১৮৬৭ সালে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খন্ড প্রকাশ করেন এঙ্গেলস মার্কসের মৃত্যুর পরে যথাক্রমে ১৮৮৫ এবং ১৮৯৪ সালে। ভারতবর্ষের সামাজিক বিকাশ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভারত শোষণের স্বরূপ এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী যুদ্ধের তাৎপর্য্ ব্যাখ্যা করে মার্কস আমেরিকার একটি সাময়িক পত্রে যে প্রবন্ধরাজি প্রকাশ করেন মার্কসের গভীর জ্ঞান এবং অন্তর্দৃষ্টির স্মারক হিসেবে তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য্যও অপরিসীম। বিপ্লবী কার্যক্রমের অভিযোগে জার্মানি এবং পরবর্তীকালে বেলজিয়াম সরকার কর্তৃক নির্বাসিত হয়ে ১৮৪৮ সালের পর থেকে মার্কস সপরিবারে লন্ডন শহরে বসবাস করতে থাকেন। ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ মার্কস লন্ডন শহরে মারা যান।
Materialism : বস্তুবাদ
বিশ্ব ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে দুটি অভিমত মৌলিক এবং প্রধান। একটি বস্তুবাদ অপরটি ভাববাদ। মানুষের চেতনার বিকাশের আদিকাল থেকে এই দুই মতবাদের দ্বন্ধ চলে আসছে।
বস্তুবাদকে দুইভাগে ভাগ করে বিবেচনা করা যায়। সাধারণ বস্তুবাদ, দার্শনিক বস্তুবাদ। সাধারণ বস্তুবাদ বলতে জগত সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মতবাদ বুঝায়। চারিপাশের জগৎ সত্য না মিথ্যা, মায়া না যথার্থ, এ সম্পর্কে মানুষের মনে আদিকাল থেকেই প্রশ্ন জেগেছে। সাধারণ মানুষ গভীর যুক্তি-তর্ক ব্যতিরিকেই জীবন যাপনের বাস্তব প্রয়োজনে জগৎ এবং বাস্তবকে সত্য বলে মনে করেছে। কিন্তু জগতের বৈচিত্র্য এবং প্রতিমুহুর্তের পরিবর্তনের ব্যাখ্যার জন্য সাধারণ বস্তুবাদ যথেষ্ট নয়। এই সাধারণ বা স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক এবং পূর্ণতার বিশ্লেষণ ঘটেছে দার্শনিক বস্তুবাদে। জগৎ সম্পর্কে দার্শনিক বস্তুবাদের অভিমত হচ্ছে: বস্তু এবং মন বা ভাবের মধ্যে বস্তু হচ্চে প্রধান। মন, চেতনা এবং ভাব অপ্রধান। এরই অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছেঃ বিশ্বজগত অবিনশ্বর এবং শাশ্বত। ঈশ্বর বা অপর কোনো বহিঃশক্তি বিশ্বের স্রষ্টা নয়। স্থান এবং কাল উভয়তই বিশ্ব অসীম। কোনো বিশেষ সময় বা কালে যেমন বিশ্বকে অপর কেউ সৃষ্টি করে নি, তেমনি স্থানিক সীমা বলেও বিশ্বের কোনো সীমা নেই। বিশ্ব হচ্ছে বস্তু। চেতনা বিশ্বের বিবর্তনের সৃষ্টি। চেতনা বিশ্বের প্রতিচ্ছায়া। চেতনা যখন বিশ্বের সৃষ্টি তখন বিশ্ব চেতনার অজ্ঞেয় নয়।
দর্শনের ইতিহাসে দেখা যায় যে, বস্তুবাদ প্রত্যেক যুগের প্রগতিশীল ব্যক্তি এবং শ্রেণীর দর্শন হিসেবে অনুসৃত হয়েছে। যে ব্যক্তি বা শ্রেণী জগতকে সঠিকভাবে জানতে চেয়েছে এবং সেই জ্ঞানের সাহায্যে প্রকৃতির উপর মানুষের শক্তিকে বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করেছে তারাই বস্তুবাদকে তাদের দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছে। বস্তুবাদ কোনো কাল্পনিক অভিমত নয়। যে-কোনো যুগের বৈজ্ঞানিক বিকাশের সূত্রকার বিবরণই বস্তুবাদ। বিজ্ঞানের বিবরণ যেমন বস্তুবাদ, তেমনি বস্তুবাদ আবার বিজ্ঞানের অগ্রগতিরও হাতিয়ার। বিজ্ঞান ও বস্তুবাদ তাই পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে সম্পর্কিত। এই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও বস্তুবাদ উভয়ই নিরন্তর বিকাশ লাভ করেছে। বস্তুবাদের জন্ম এবং বিকাশ কোনো বিশেষ দেশে সীমাবদ্ধ থাকে নি। প্রাচীন ভারত, চীন এবং গ্রিসের দাসভিত্তিক সমাজে জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত এবং মানুষের অভিজ্ঞতাভিত্তিক অন্যান্য জ্ঞানসূত্র বিকাশলাভ করার ফলে বস্তুবাদ প্রথম জন্মলাভ করে। প্রাচীনকালের এই বস্তুবাদ জগৎ সংসারের সমস্যাদির ব্যাখ্যায় স্বাভাবিকভাবেই অতি সহজ বা প্রাথমিক চরিত্রের ছিল। বস্তুজগৎ মন নিরপেক্ষভাবেই অস্তিত্বসম্পন্ন, এই ছিল প্রাচীন বস্তুবাদের ধারণা। জগতের বৈচিত্র্যের মূলে কোনো একক নিশ্চয়ই আছে। এবং সে একক অবশ্যই বস্তু। প্রাচীন বস্তুবাদীদের মধ্যে চীনের লাওজু, ওয়াং চু, ভারতের চার্বাকমত, গ্রিসের হিরাক্লিটাস, এ্যানাক্সাগোরাস, এমপিডোকলিস, এপিক্যুরাস নামক দার্শনিকের নাম সুপরিচিত। লউসিপাস, ডিমোক্রিটাস প্রমুখ প্রাচীন বস্তুবাদী দার্শনিকগণ বিচিত্র বস্তুর মূল হিসেবে একক কিংবা একাধিক অণুর অস্তিত্বের কথাও কল্পনা করেছিলেন। প্রাচীন বস্তুবাদের একটি অসম্পূর্ণতা এই ছিল যে, প্রাচীন বস্তুবাদের পক্ষে বস্তু এবং মনের পার্থক্য এবং সম্পর্কের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হয় নি। মন বা চেতনার সকল বৈশিষ্ট্যকেই প্রাচীন বস্তুবাদ বস্তুর প্রকারভেদ বলে ব্যাখ্যা করতে চাইত। কিন্তু মন এবং চেতনা একটি জটিল সত্তা। তাকে কেবল বস্তুর প্রকারভেদ বললে তার সম্যক জ্ঞান লাভ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া প্রাচীন বস্তুবাদের মধ্যে প্রাচীন ধর্মীয় অলীক বিশ্বাসেরও আভাস পাওয়া যায়। ইউরোপের মধ্যযুগে বস্তুবাদ ধর্মীয় প্রকৃতিবাদের রূপ গ্রহণ করে। সর্ববস্তুতে ঈশ্বর প্রকাশিত এবং প্রকৃতি ও ঈশ্বর উভয়ই নিত্যসত্য, এই অভিমতের মাধ্যমে বস্তুবাদ এই যুগে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করেছে। ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশের যুগে বস্তুবাদের পরবর্তী পর্যায়ের বিকাশ ঘটে। আর্থনীতিক উৎপাদন, বিজ্ঞান এবং কারিগরি কৌশলের নতুনতর উন্নতির পরিবেশে সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে বস্তুবাদ মধ্যযুগের চেয়ে অধিকতর সুস্পষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করে। এই পর্যায়ের বস্তুবাদী দার্শনিকদের মধ্যে বেকন, গেলিলিও, হবস, গাসেন্দী, স্পিনোজা এবং লকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই পর্যায়ে বস্তুবাদী দার্শনিকগণ অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানের উৎস এবং প্রকৃতিকে মূল সত্তা ধরে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা এবং যাজক প্রাধান্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেন। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই সময়ের প্রধান বিকাশ ঘটে গণিত এবং বলবিদ্যায়। বিজ্ঞানের এই দুই শাখার উপর নির্ভর করাতে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের বস্তুবাদী দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দেয় যান্ত্রিকতা। চেতনাসহ বস্তুর বিভিন্ন প্রকাশের মধ্যকার অন্তর্নিহিত সংযোগ সূত্র প্রকাশে এই বস্তুবাদ ব্যর্থ হয়। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বস্তুবাদী দার্শনিক ডিডেরট, হেলভিটিয়াস, হলবাক এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার প্রয়াস পান। এর পরবর্তী পর্যায়ে জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাকের মধ্যে আমরা নৃতাত্ত্বিক বস্তুবাদের বিকাশ দেখি। বস্তুবাদের পূর্ণতর বৈজ্ঞানিক বিকাশ ঘটেছে ঊনবিংশ শতকের কার্ল মার্কস, ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এবং লেনিনের দার্শনিক চিন্তাধারায়। প্রাচীন বস্তুবাদের প্রকৃতিগত স্বাধীনতা, হেগেলের দ্বন্দ্বের তত্ত্ব এবং মনুষ্য সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের বাস্তব বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কার্ল মার্কস এবং এঙ্গেলস দ্বন্ধমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রতিষ্ঠা করেন। মার্কসীয় বস্তুবাদ কেবল বিশ্বসংসারের বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। মার্কসীয় বস্তুবাদ বর্তমান বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের হাতে নতুনতর সঙ্গতিপূর্ণ মনুষ্য সমাজ তৈরির প্রধান হাতিয়ার। বস্তুত, দর্শনের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত যেখানে ভাববাদের প্রাধান্য ছিল, সেখানে ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বন্ধমূলক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে।
Materialism and Empirio-Criticism : লেনিনের দার্শনিক গ্রন্থ : ‘বস্তুবাদ এবং নব-অভিজ্ঞতাবাদ’
১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের ব্যর্থতার পরবর্তী পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বুদ্ধিজীবিদের একাংশের মধ্যে নানা দার্শনিক বিভ্রান্তির প্রকাশ দেখা যায়। ম্যাক, অ্যাভানারিয়াস প্রমুখ চিন্তাবিদগণ ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে ‘এ্যামপিরিও ক্রিটিসিজম’ নামক এক তত্ত্ব দাঁড় করান। রুশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে এই তত্ত্বের অনুসারীদের লেনিন ‘ম্যাকিসটস’ বলে আখ্যায়িত করেন। এই তত্ত্বের মূল বিভ্রান্তির দিক উন্মোচন করে তার যে বিশ্লেষণ লেনিন রচনা করেন তাঁর সেই রচনা ‘ম্যাটেরিয়ালিজম এন্ড এমপিরিওক্রিটিসিজম’ নামে ১৯০৯ সনে প্রকাশিত হয়। লেনিন এই তাত্ত্বিকদের আলোচনা করে বলেন, আন্দোলনের বিপর্যয়কালে যেখানে প্রয়োজন দ্বান্ধিক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল সত্যকে সংশোধনবাদের আঘাত হতে রক্ষা করা, রুশ ‘ম্যাকিটস’গণ সেখানে ‘সংশোধনবাদী নব অভিজ্ঞতাবাদের’ ‘অন্তর্বাদী’ বা ‘সাবজেকটিভ’ ভাববাদ এবং জ্ঞানের প্রশ্নে ‘অজ্ঞানবাদ’কে প্রচার করার চেষ্টা করেছেন। বাজারভ, বোগদানভ, লুনাচারস্কি প্রমুখ সমাজতন্ত্রী বুদ্ধিজীবিগণ সংগ্রামের পথ পরিত্যাগ করে গ্রহণ করেছেন রহস্যবাদ এবং হতাশাবাদকে। অভিজ্ঞতাবাদ, উপলব্ধিবাদ, প্রতীকবাদ প্রভৃতি নতুন নতুন শব্দের আড়াল দিয়ে তাঁরা বিকৃত করার চেষ্টা করেছেন দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদ তথা মার্কসবাদকে। লেনিনের এ গ্রন্থ ভাবধারার ক্ষেত্রে সংগ্রামের প্রশ্নে তাঁর আপসহীনতারও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাজারভ, বোগদানভ, লুনাচারস্কি এরাও সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, কাজেই তাদের আক্রমণ করে রুষ্ট না করে তাঁদের সঙ্গে আপসের প্রস্তাব করলে লেনিন গোর্কীকে বলেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই একদিন স্বীকার করবেন যে, আদর্শের ক্ষেত্রে কোনো মতকে যদি দলের কর্মী স্বপ্রত্যয়ে ভ্রান্ত এবং ক্ষতিকর বলে জানে, তবে সে ভ্রান্ত এবং ক্ষতিকর মতের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম করাই তার অনিবার্য্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়; তার সঙ্গে আপস করা নয়।’ লেনিন তাঁর এই গ্রন্থে বার্কলে, কান্ট, হউম প্রভৃতি আধুনিক মুখ্য ভাববাদীদের দর্শনসহ সমগ্র ভাববাদের, দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদের ভিত্তিতে, তাঁর বিশিষ্ট রচনাশৈলীতে তীক্ষ্ম সমালোচনা উপস্থিত করেন। লেনিনের ‘ম্যাটেরিয়ালিজম এন্ড এমপিরিও-ক্রিটিসিজম’ সংগ্রামী দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক সংযোজন।
Materialism, Historical : ঐতিহাসিক বস্তুবাদ
মার্কসবাদকে দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদ বলা হয়। মানব সমাজের ইতিহাসের ব্যাখ্যায় এই দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদকে ঐতিহাসিক দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদ বা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে অভিহিত করা হয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যায়, মানুষের সামাজিক জীবনের ইতিহাসের মূল শক্তি হচ্ছে মানুষের জীবন ধারণের জন্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম। মানুষ তার জীবন ধারণ করে জীবন রক্ষার উপাদানসমূহ সংগ্রহ ও সৃষ্টি দ্বারা। এজন্য তার হাতিয়ার আবশ্যক। এই হাতিয়ার বা উপায়কে মার্কসবাদে উৎপাদনের শক্তি বা ‘ফোর্সেস অব প্রোডাকশন’ বলা হয়। উৎপাদনের উপায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে সম্পর্ক তৈরি হয়। এটা হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্ক বা ‘প্রোডাকশন রিলেশনস’। আদিতে মানুষের অস্তিত্ব একেবারে প্রকৃতি ও পরিবেশ নির্ভর হওয়ার কারণে জীবিকার উপায়সমূহ যৌথভাবে ব্যবহার বা প্রয়োগ এবং তার ফলকে যৌথভাবে ভোগ করা ব্যতীত উপায়ান্তর ছিল না। মানুষের আদিকালের এই যৌথজীবন ও সমাজব্যবস্থাকে আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা বা পর্যায় বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু এমন অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে না। অধিকতর স্বচ্ছন্দ্য জীবন যাপনের জন্য মানুষ জীবনধারণের উপায়সমূহকে ক্রমান্বয়ে উন্নত করে তোলে। উন্নততর উপায়সমূহ সকলের হাতে সমানভাবে না থাকার কারণে এরূপ উপায় বা শক্তির মালিকগণ এরূপ উপায় বা শক্তির অমালিকগণের চাইতে অধিকতর শক্তিমান হয়ে পড়ে। শক্তিমানরা শক্তিহীনদের তুলনায় উন্নততর উৎপাদনী উপায় প্রয়োগের মাধ্যমে সম্পদ সংগ্রহে সমর্থ হন। সংগৃহীত সম্পদকে তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ বলে গণ্য করতে থাকেন। এভাবে আদিম যৌথ বা সাম্যবাদী সমাজ ভেঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও তার মালিক এবং অ-মালিক তথা পরস্পরবিরোধী অর্থনৈতিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। মার্কসবাদী তত্ত্বে সমাজ বিকাশের এই পর্যায়কে দ্বিতীয় বা দাস পর্যায় বলে উল্লেখ করা হয়। এই দাসপর্যায়ের মূল বৈশিষ্ট্য এই যে, এই পর্যায়ে শক্তিমান শ্রেণী শক্তিহীন দাসদের মাধ্যমে জীবনধারণের দ্রব্যসামগ্রী, সম্পদ ইত্যাদি সংগ্রহ করত। অর্থাৎ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ছিল দাসভিত্তিক বা দাসদের শ্রমের শোষণভিত্তিক। এই দাস পর্যায় পৃথিবীর সর্বত্র সমানভাবে একই সময়ে ছিল কি না এবং তার আয়ুষ্কালের পরিধি কোথায় কি পরিমাণ ছিল তা এখনো গবেষণা এবং তর্কসাপেক্ষ। তথাপি মার্কসবাদ দাসপর্যায়কে মানবসমাজের অতিক্রান্ত ইতিহাসের একটি সাধারণ পর্যায় বলে গণ্য করে। শস্য উৎপাদনের নতুনতর হাতিয়ারাদির উদ্ভাবন, দাসদের বিদ্রোহ এবং নতুন উৎপাদনে দাসব্যবস্থা ক্রমান্বয় প্রতিবন্ধক বলে বোধ হতে থাকা প্রভৃতির মাধ্যমে দাসব্যবস্থার স্থানে নতুন অপর একটি অর্থনৈতিক পর্যায়ের উদ্ভব ঘটে। এটি সমাজ বিকাশের ইতিহাসে তৃতীয় বা সামন্ততান্ত্রিক পর্যায়। এই পর্যায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে জমির শস্য এবং জমির উপর দখল সামাজিক জীবনের শক্তির আঁধার হয়ে দাঁড়ায়। জমির জবরদস্তি বা শক্তিমান মালিকরা সামন্তপ্রভু এবং গোড়াতে কৃষিতে বাধ্যতামূলকভাবে নিযুক্ত কৃষকদের ভূমিদাস এবং পরবর্তীতে কৃষক বলে অভিহিত করা হয়। এই পর্যায়ও কোনো দেশে কিরূপ ছিল এবং এর কালপরিধি কি ছিল সে সম্পর্কে এখনো গবেষণা চলছে। কিন্তু ইতোমধ্যে বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার সংঘটিত হয়। মাটির অভ্যন্তরে শক্তির আধার কয়লা উদঘাটিত হয়। দ্রব্যের উৎপাদন অধিকতরভাবে পণ্য উৎপাদন ও পণ্য বিনিময় তথা পণ্য বিক্রয়ের রূপ লাভ করতে থাকে। শহরকেন্দ্রিক এবং উন্নততর যন্ত্রভিত্তিক উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এই প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ প্রথমে ইউরোপে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে পুঁজিভিত্তিক যন্ত্রশিল্প তথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক থেকে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে ঊনবিংশ শতকে প্রধান এবং প্রবল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপ গ্রহণ করে। মানব সভ্যতার বিকাশের এই স্তরকে চতুর্থ তথা ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী পর্যায় বলে অভিহিত করা হয়। মার্কসবাদের মতে এর পরবর্তী বা পঞ্চম পর্যায় হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
Matriarchy : মাতৃতন্ত্র
আদিম সমাজের বিকাশে একটি বিশেষ পর্যায় ছিল মাতৃতন্ত্র। এই পর্যায়ের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে নারীর ভূমিকা ছিল প্রধান। সমাজের বিকাশের একেবারে গোড়ার দিকে মানুষের জীবন এবং জীবিকার প্রাথমিক পর্যায়ে নারী-পুরুষের সম্পর্ক ব্যক্তির ভিত্তিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। যৌথ বিবাহ তখন প্রচলিত ছিল। যৌথ বিবাহের ফলে সন্তান এবং বংশধারার জন্য বর্তমানের ন্যায় পিতাকে নির্দিষ্ট করা সম্ভব হতো না। মাতাই ছিল সন্তানের পরিচয় সূত্র। মাতৃপক্ষ হতেই সন্তানের বংশধারা নির্দিষ্ট হতো। অমুক মায়ের সন্তান-এই ছিল সন্তানের পরিচয়। গোত্র জীবনের অর্থনীতিরও পরিচারিকা ছিল নারী। পুরুষ পশুশিকার করত, কিন্তু পশুশিকার জীবিকা নির্বাহের কোনো নিশ্চিত বা নির্ভরশীল উপায় ছিল না। শস্যক্ষেত্রে বীজবপন, সন্তানপালান, গৃহরক্ষা প্রভৃতি কাজের দায়িত্ব ছিল নারীর। পশুপালন জীবিকার অন্যতম উপায় হওয়ার পরে সামাজিক জীবনেও পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। এই সময় থেকে জীবিকা নির্বাহে পুরুষ প্রধান ভূমিকা পালন করতে থাকে। উৎপাদনশক্তি হিসেবে পশুর বহর পালন করার এবং দাসদের খাটানোর দায়িত্ব পুরুষ গ্রহণ করতে থাকে। পিতা এখন থেকে পরিবারের প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের গোড়াপত্তন এই সময়েই ঘটে।
Matter : বস্তু
চেতনায় প্রতিফলিত বটে, কিন্তু চেতনা নিরপেক্ষ বাস্তব অস্তিত্বকে বস্তু বলা হয়। বস্তুর অসংখ্য প্রকাশ। সর্বপ্রকার প্রকাশ, বিভিন্ন প্রকাশের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক, গতি সব কিছুর ধারক হচ্ছে বস্তু। গতি আর বস্তু ভিন্ন সত্তা নয়। গতিময়তা হচ্ছে বস্তুর অচ্ছেদ্য চরিত্র। কাজেই বিশেষ প্রকাশের বাইরে গতিহীন অনড় কোনো নির্বিশেষে বস্তুকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে না। বিভিন্ন প্রকাশকে তাদের গতি এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে জানাই বস্তুকে জানা। বস্তু নিয়ত বিবর্তিত হচ্ছে। বস্তুর বিবর্তনে যেমন চেতনার উদ্ভব ঘটছে, তেমনি চেতনার শক্তি বস্তুর বিবর্তনে এবং বস্তুর বৈচিত্রের বৃদ্ধিতে এক মাধ্যমের ভূমিকা পালন করে। বস্তুর বিকাশের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তুলনামুলকভাবে সহজ থেকে জটিলতা প্রাপ্তি। বস্তুর বিকাশ যত জটিল, তত বিচিত্র তার প্রকাশ এবং তাদের মধ্যকার আভ্যন্তরীণ সম্পর্ক। বস্তুর বিকাশের চরম পর্যায়ে চেতনাসম্পন্ন মানুষের উদ্ভব ঘটেছে। চেতনা বস্তুর বিকাশের ফল হলেও চেতনা ও বস্তুর চরিত্র এত পরস্পরবিরোধী বলে মনে হয় যে, এই বিরোধিতার ভিত্তিতে ভাববাদী দার্শনিকগণ চেতনাকে বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং বস্তুর চেয়েও আদি ও মূলসত্তা বলে দাবি করেন। ভাববাদী দার্শনিকদের অনেকের মতে চেতনা যে কেবল অ-বস্তু তাই নয়। চেতনাই বস্তুর মূল। বস্তু চেতনারই প্রকাশ কিংবা বস্তু চেতনার কল্পনা মাত্র। দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদের মতে বস্তু এবং চেতনার মধ্যকার বিরোধিতা আপেক্ষিক। বস্তু এবং চেতনার মধ্যে চরম কোনো বিরোধিতা থাকতে পারে না। বস্তুর সঙ্গে চেতনাসম্পন্ন মানুষের যে সম্পর্ক তাতে মানুষ তার পরিবেশকে নিয়ত পরিবর্তিত করে বস্তুর নতুনতর প্রকাশের এবং তাদের নতুনতর সাংগঠনিক সম্বন্ধের উদ্ভব ঘটাতে সক্ষম এবং তা ঘটাচ্ছে। উৎপাদনের নতুনতর উপায়, দালানকোঠা, ঘর-বাড়ি তৈরি, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার বিধানসমূহের প্রয়োগে নতুনতর দ্রব্যসামগ্রীর সৃষ্টি-এসবই প্রকৃতি এবং পরিবেশের উপর মানুষের চেতনার হস্তক্ষেপের পরিফল। বিজ্ঞান ও কারিগরী কৌশলকে মানুষ যত আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছে, বস্তুর প্রকাশের সংখ্যা এবং বৈচিত্র্য তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই মানুষ কেবল বস্তুর বিবর্তনের ফল নয়; মানুষ বস্তুর বিবর্তনের অন্যতম মাধ্যমও বটে। অর্থাৎ বস্তুর ক্ষেত্রে মানুষ কেবল সৃষ্টি নয়, মানুষ স্রষ্টাও। এই অভিমত ব্যক্ত করে দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদের অন্যতম ব্যাখ্যাতা লেনিন বলেছিলেন, ‘মানুষের চেতনায় কেবল বাস্তব জগতের প্রতিফলন ঘটে না। মানুষের চেতনা বাস্তব জগতকে সৃষ্টিও করে।’
Matubbar, Araz Ali : আরজ আলী মাতুব্বর (১৯০০-১৯৮৬)
বাংলাদেশের বরিশাল শহরের ৭-৮ কি.মি. দূরের একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে আরজ আলী মাতুব্বরের জন্ম। তাঁর নিজের কথায় ‘লামচারী গ্রামের বাড়িতে বাংলা ১৩০৭ সনের ৩ পৌষ আমার জন্ম হয়।’
আরজ আলী মাতুব্ববর ছিলেন বাংলার এক অসামান্য লোক দার্শনিক এবং জ্ঞানী ব্যক্তি। শ্রমজীবি কৃষকের জমিতে জাত, আত্মপ্রচার বিমুখ, ঋষিপ্রতিম চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। ‘কৃষকের সারল্যে এবং স্মিতমুখে অনুচ্চ শব্দে এবং মিতবাক্যে তিনি কথা বলতেন। চলাচলে, বসনে ভূষণে এবং আলাপচারিতায় আরজ আলী মাতুব্বর ছিলেন অতুলনীয় এবং অনুপ্রেরণাদায়ক এক ব্যক্তিত্ব।” সাধারণ অর্থে কোনো বিদ্যাপীঠে তার পড়ালেখা করার সুযোগ হয় নি। কিন্তু জ্ঞান আহরণ, গ্রন্থপাঠ এবং শিক্ষায় তিনি ছিলেন একটি আদর্শ চরিত্র। ‘স্বশিক্ষিত’ কথাটির একটি অসাধারণ বাস্তব দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। যৌবনে মায়ের মৃত্যুর পর আরজ আলী মাতুব্বর সমাজের অনুশাসনের কারণে মায়ের কোনো আলোকচিত্র গ্রহণ এবং তাঁকে রক্ষা করতে না পারার কারণে তিনি মর্মাহত হন এবং সমাজের এমন অনুশাসনকে অবৈজ্ঞানিক এবং অমানবিক বলে অভিহিত করেন। তাঁর মন সমাজের প্রচলিত ধর্মীয় আচার আচরণ ও বিধি নিষেধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। আরজ আলী মাতুব্বর নিজের হাতে জমি কর্ষণ এবং অন্যান্য কাজ সম্পাদন করতেন। জীবিকার জন্য তিনি পরবর্তীতে জমি জমার মাপজোঁকের কঠিন বিষয়ও নিজের চেষ্টায় আয়ত্ত করে একজন ‘আমিনের’ বৃত্তি গ্রহণ করেন। তিনি প্রতিবেশিীদের নিকট একজন প্রাজ্ঞ এবং নির্ভরযোগ্য জমিজমা জরিপকারী হিসেবে পরিচিত হন এবং এই বৃত্তি থেকে অল্পপরিমাণ যে অর্থ তিনি উপার্জন করেন তার ভিত্তিতেই তাঁর নিজের বাড়িতে স্কুল ও লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন।
জীবন, জগৎ, সৃষ্টিকর্তা, ন্যায়, অন্যায়, সত্য মিথ্যা, বস্তু ও জীবনের সংজ্ঞা, জীব-অজীবে পার্থক্য প্রভৃতি মৌলিক বিষয় নিয়ে আরজ আলী মাতুব্বর কৈশোরেই তার মনে জিজ্ঞাসা তুলেছেন এবং চিন্তা করেছেন। অপরের সঙ্গে কোনো উচ্চকন্ঠ তর্ক-বিতর্ক কিংবা কলহে প্রবৃত্ত না হয়ে তিনি নিজের চিন্তা নিজের ভাষায় লিপিবদ্ধ করে তাকে পুস্তকাকারে প্রকাশের চেষ্টা করেছেন। সে প্রকাশ বই এর জগতে বাহ্যিকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণকারী না হলেও, তাঁর সকল প্রকাশিত গ্রন্থই তাঁর মৌলিক চিন্তা ও জ্ঞানের পরিচয়বাহী। প্রতিকূল পরিবেশ এবং বৈরী রাজপুরুষরা নানাভাবে তাঁর চিন্তার জগতকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে। তাঁকে বিধর্মী, ধর্মহীন ইত্যাদি নিন্দনীয় অপবাদে আখ্যায়িত করে তাঁর সামাজিক জীবনকে বিপন্ন করার চেষ্টা করেছে। জনৈক ম্যাজিস্ট্রেট কেন তাঁকে তাঁর চিন্তার জন্য দন্ড দিয়ে কারাগারে আটক করা হবে না, তার কারণ দর্শানোর জন্য কৈফিয়ত তলব করে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। এতদসত্ত্বেও চিন্তার ক্ষেত্রে আরজ আলী মাতুব্বর কখনো দমিত হয় নি। তার চিন্তার কোনো আড়ম্বরপূর্ণ প্রকাশে আরজ আলীর আগ্রহ ছিল না। কিন্তু অনুসন্ধিৎসু মানুষ যেন তার চিন্তার সাক্ষাৎ লাভ করতে পারে সেজন্য সে নিজব্যয়ে ও পরিশ্রমে একাধিক গ্রন্থ রচনা করে মুদ্রিত করেছে। তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে-‘সত্যের সন্ধান’, ‘অনুমান’, ‘সৃষ্টি রহস্য’ ও ‘স্মরণিকা’।
তাঁর সত্যের সন্ধান গ্রন্থে আরজ আলী মাতুব্বর যে মৌলিক প্রশ্নগুলি উল্লেখ করে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন তার মধ্যে রয়েছে : ‘১. আমি কে? ২. প্রাণ কি অরূপ না স্বরূপ? ৩. মন ও প্রাণ কি এক? ৪. প্রাণের সহিত দেহের সম্পর্ক কি? ৫. প্রাণ চেনা যায় কি? ৬. আমি কি স্বাধীন? ৭. অশরীরী আত্মার কি জ্ঞান থাকিবে? ৮. প্রাণ কিভাবে দেহে আসা যাওয়া করে?’…………ঈশ্বর সম্পর্কিত প্রশ্নে আরজ আলী মাতুব্বর জিজ্ঞেস করেছেন ‘স্রষ্টা কি সৃষ্টি হইতে ভিন্ন?’ ঈশ্বর কি স্বেচ্ছাচারী না নিয়মতান্ত্রিক?’
কেবল দার্শনিক চিন্তায় নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ বোধের আর এক প্রকাশ ঘটেছে তার এরূপ কর্মে যে, তিনি জীবিত অবস্থাতেই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মানুষের হিতার্থে তাঁর দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে উইলের মাধ্যমে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজকে দান করে গেছেন।
বাংলাদেশের লোকঐতিহ্যের স্মারক আরজ আলী মাতুব্বর ১৯৮৬ সনে তাঁর পূর্ণ কর্মজীবন সায়াহ্নে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
Means of Production : উৎপাদনের উপায়
মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী তৈরির জন্য মানুষের শ্রম এবং মাল-মসলা ও যন্ত্রপাতির সমাহারকে উৎপাদনের উপায় বলা যায়। ‘উৎপাদনের উপায়’ বলতে তাই মানুষের শ্রমশক্তি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ উভয়কে বুঝায়। মানুষের শ্রম যার উপর প্রয়োগ করা হয় তাকে বলা যায় শ্রমের মাধ্যম বা শ্রমের উপায়। এই অর্থে শ্রমের উপায় বলতে যে সমস্ত বস্তু এবং যন্ত্রপাতির দ্বারা মানুষ তার প্রয়োজনীয় কোনো কিছু উৎপাদন করে সে সমস্ত বস্তু এবং যন্ত্রপাতিকে বুঝায়। প্রাচীনকালে মানুষ প্রধানত লাঠি এবং ঘর্ষিত পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করে তার জীবনের প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ এবং তৈরি করত। তাই প্রাচীনকালের মানুষের কাছে তার শ্রমের উপায় বা মাধ্যম ছিল লাঠি এবং পাথরের অস্ত্র। আধুনিক মানুষের কাছে তার শ্রম প্রয়োগের হাতিয়ার হচ্ছে বিবিধ রকম যন্ত্রপাতি। শ্রমের মাধ্যমের মধ্যে জমি, শ্রমের স্থান বা ঘর, রাস্তা ঘাট, খাল, নদী, পরিবহনের গাড়ি, জাহাজ প্রভৃতিকেও অন্তুর্ভুক্ত করতে হয়। অর্থাৎ উৎপাদনের জন্য শ্রমের কার্য্কর প্রয়োগের যাবতীয় উপকরণই শ্রমের উপায় বা মাধ্যম। প্রাচীনকাল হতে শুরু করে মানুষের শ্রমের প্রয়োগে উৎপাদনের উপকরণ ক্রমান্বয়ে উন্নত এবং পরিবর্তিত হয়েছে। মানুষের শ্রমই যে কেবল উৎপাদনের উপকরণ পরিবর্তন করেছে তাই নয়। উৎপাদনের উপকরণও আবার শ্রমের ক্ষেত্রে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্দিষ্ট করেছে। এক জোড়া গরু এবং একখানি লাঙ্গল যখন উৎপাদন বা শ্রমের উপকরণ ছিল তখন শ্রমের ক্ষেত্রে মানুষের সম্পর্ক ছিল প্রধানত ব্যক্তিগত এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন। কিন্তু আধুনিককালে জটিল এবং বৃহৎ যন্ত্রপাতি যেখানে উৎপাদনের প্রধান উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে শ্রমের ক্ষেত্রে মানুষের সম্পর্ক অপরিহার্যরূপে যৌথ এবং সম্মিলিত সম্পর্কের রূপ গ্রহণ করেছে।
Medieval Philosophy : মধ্যযুগীয় দর্শন
খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে রোম সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। চতূর্দশ পঞ্চদশ শতকের দিকে ইউরোপে পুঁজিবাদী অর্থনীতিক ব্যবস্থার প্রাথমিক রূপ আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। এই দুই পর্যায়ের মধ্যবর্তী এক হাজার বছর ইউরোপের দেশসমূহের দর্শনের যে বিকাশ ঘটে, তাকে ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে মধ্যযুগীয় দর্শন বলে সাধারণ আখ্যায়িত করা হয়। প্রাচীন গ্রিস ও রোমের দাসভিত্তিক সমাজে প্রাচীন ইউরোপীয় দর্শনের বিকাশ ঘটেছিল। প্রাচীন এই দাস সমাজের ধ্বংসের ফলে প্রাচীন দর্শনেরও অবক্ষয় ঘটে। রোম সাম্রাজ্যের পতনের পরে ইউরোপে জমিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির পরিপোষক ভাবধারারূপে খ্রিষ্টীয় ধর্ম সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির সহযোগী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে একদিকে খ্রিষ্টীয় যাজকতন্ত্র সুসংগঠিত রূপ নিতে থাকে, অপরদিকে সামন্ততান্ত্রিক ভূম্যাধিকারীদের বশীভূত করে রাষ্ট্রপতি বা রাজতন্ত্র সুদৃঢ় হতে থাকে। সামাজিক ও রাষ্ট্র্রীয় ক্ষেত্রে পরিণামে খ্রিষ্টধর্মের যাজকতন্ত্র এবং রাজতন্ত্রের মধ্যে শক্তির দ্বন্ধ শুরু হয়। এই দ্বন্ধে যাজকতন্ত্র যেমন নিজেদের ঐশ্বরিক শক্তির একমাত্র প্রতিভূ বলে দাবি করে এবং রাজাকে যাজকতন্ত্রের অধীনস্থ বলে মনে করে, তেমনি অপরদিকে রাজা নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করে রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীয় উভয় ক্ষেত্রে তার শাসনাধিকার প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পায়। এই দ্বন্ধের প্রতিফলন দর্শনের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। দর্শনের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ধর্মীয় প্রশ্নের ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যার দ্বারা দর্শন হয় ধর্মীয় পোপ নয়তো রাষ্ট্রীয় রাজার দাবিকে সমর্থন করে। প্রাচীন দর্শনের মধ্যে বাস্তবমুখীনতা এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার যে পরিচয় ছিল, মধ্যযুগে তা হারিয়ে যায়। দ্বাদশ শতাব্দীতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে জেহাদের উপলক্ষে পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের যোগাযোগ ঘটে এবং গ্রিক দর্শনের আরবীয় অনুবাদের সঙ্গে ইউরোপীয় দার্শনিকদের পরিচয় ঘটে। এর পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপের কাছে প্রাচীন গ্রিক দর্শন একরকম অজ্ঞাত থাকে।
মধ্যযুগের ধর্মীয় পরিমন্ডলের দার্শনিকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন চতূর্থ পঞ্চম শতকের আফ্রিকার অধিবাসী ধর্মযাজক সেন্ট অগাস্টিন, দ্বাদশ শতকের আবেলার্ড. ত্রয়োদশ শতকের সেন্ট আলবার্ট, টমাস এ্যকুনাস, ডানস স্কোটাস, রোজার বেকন এবং দ্বাদশ শতকের স্পেনের মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশ (যিনি ইউরোপে আভারস নামে পরিচিত)।
Memory : স্মৃতি, স্মরণ
ব্যক্তির পক্ষে অতীত অভিজ্ঞতাকে মনের মধ্যে ধারণ করে রাখা এবং তাকে চেতনার মধ্যে পুনরায় উপস্থিত করার ক্ষমতাকে স্মৃতি কিংবা স্মরণ করার ক্ষমতা বলা হয়। প্রতিমুহুর্তে ব্যক্তির ইন্দ্রিয়সমূহ বস্তুজগতের সাক্ষাৎ সম্পর্কে আসে। এই সম্পর্কের ফলে ব্যক্তির মনে ঘটনার ছাপ পড়ে। পরবর্তীকালে ব্যক্তি তার প্রয়োজন সাধনের জন্য অতীত অভিজ্ঞতাকে পুনরায় চেতনার মধ্যে নিয়ে আসতে পারে। স্মরণ করার ক্ষমতা মানুষের জন্মগত হলেও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এটি জটিল বিষয় এবং আধুনিক মনোবিজ্ঞানের একটি বিশেষ গবেষণার ব্যাপার। কোনো ঘটনা স্মরণ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজে কতখানি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে-কতখানি তার অনিবার্য্য, এ নিয়েও গবেষণা চলছে। স্মরণ রাখার ক্ষমতার তিনটি ভাগ আছে। প্রথম ভাগ হচ্ছে ব্যক্তির সঙ্গে স্মরণীয় বিষয়ের সাক্ষাৎ সম্পর্ক। দ্বিতীয় ভাগ হচ্ছে তার মনের অচেতন ভান্ডারে স্মরণীয় বিষয়ের অবস্থান। কারণ, যে ঘটনাকে ব্যক্তি কোনো বিশেষ মুহুর্তে স্মরণ করে, তা সর্বক্ষণ তার চেতনায় থাকে না। যে বন্ধুর নামটি আমি এই মুহুর্তে স্মরণ করলাম সে নামটি এর পূর্বমুহুর্তে আমার চেতনায় ছিল না। কিন্তু যখন আমার প্রয়োজন হলো তখন আমি তাকে আমার স্মৃতির ভান্ডার থেকে চেতনার আলোকে উদ্ধার করে আনলাম। চেতনার আলোকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হচ্ছে স্মরণের তৃতীয় ভাগ। অতীতের সব ঘটনাকে আমরা প্রয়োজনমতো চেতনার মধ্যে আনতে পারি নে। কোনো কোনো ঘটনাকে আমরা চেতনার আলোকে আনতে পারি নে এবং কেন অপর কোনো ঘটনাকে পারি কিংবা কোন্ বয়সে আমরা অধিক সংখ্যক ঘটনাকে স্মরণ রাখতে পারি, কোন্ বয়সে খুব অল্প সংখ্যক ঘটনাকে স্মরণ করতে পারি-আমাদের স্মরণ ক্ষমতার এই তারতম্যের রহস্যোদ্ধার এবং স্মরণ করার ক্ষমতা কোনো কৌশলে বৃদ্ধি করা যায় কি না ইত্যাদির পরীক্ষা নিরীক্ষা আধুনিক মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। স্মরণের তিনভাগকে ইংরেজীতে ‘লার্নিং’, ‘রিটেনশন’ এবং ‘রিকল’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। আমরা এ তিনভাগকে যথাক্রমে ‘শিক্ষা’, ‘ধারণ’ ও ‘স্মরণ’ বলে অভিহিত করতে পারি।
Meng Tzu : মেং জু(৩৭২-২৮৯ খ্রি. পূ.)
মেংজু ছিলেন কনফুসিয়াসের অন্যতম অনুসারী। মেংজু ভাববাদী ছিলেন। তাঁর অভিমতে জ্ঞানের শুরু যুক্তি বা প্রজ্ঞায়, ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতায় নয়। মানুষের চরিত্র মূলত উত্তম। মানুষ জন্মগতভাবে মহৎ। কারণ মানুষের মহত্বের মূল হচ্ছে ঈশ্বরের মহত্ত্ব। ভাববাদী হলেও তৎকালীন সামাজিক রাজনীতিক সমস্যায় মেংজুর একটা প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল। শাসক এবং শাসিতের সম্পর্ক উল্লেখ করে মেংজু বলেছিলেন, শাসক হবে শাসিত অর্থাৎ জনসাধারণের স্বার্থসাধনকারী। জনতার স্বার্থবিরোধী হলে শাসককে অপসারিত করার নীতিগত অধিকার জনতার আছে। সামন্ততান্ত্রিক চীন ভূখন্ডের রাষ্ট্রনীতিক ঐক্য সাধনে মেংজুর অভিমতসমূহের একটা বিশেষ অবদান ছিল।
Metaphysics : অধিবিদ্যা, পরাদর্শন
উচ্চতর দর্শন বা সত্তার যথার্থ প্রকৃতির আলোচনামূলক জ্ঞান শাখা।
Mill, John Stuart : জন স্টুয়ার্ট মিল(১৮০৬-১৮৭৩ খ্রি.)
জন স্টুয়ার্ট মিল ছিলেন ঊনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত দার্শনিক, যুক্তিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং নীতিশাস্ত্রবেত্তা। তাঁর গ্রন্থসমূহের মধ্যে ‘সিসটেম অব লজিক’, ‘প্রিন্সিপ্যালস অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’ ‘অন লিবার্টি’ ‘রিপ্রেজেন্টিটিভ গভর্নমেন্ট’ এবং ‘ইউটেলিটারিয়ানিজম’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দর্শনের ক্ষেত্রে স্টুয়ার্ট মিলের মধ্যে হিউম, বার্কলে এবং কোঁতের প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। ভাববাদ এবং বস্তুবাদকে দর্শনের ক্ষেত্রে দুই বিপরীত প্রান্ত হিসেবে মনে করে মিল উভয়কে স্বীকৃতি দিয়ে বলেন যে, বস্তু হচ্ছে অভিজ্ঞতাগত অনুভূতির সম্ভাবনা আর ভাব হচ্ছে মানসিক বোধের প্রকাশ। মানুষের অনুভব বা উপলব্ধির বাইরে বস্তুর কোনো অস্তিত্ব নেই। আর মানুষের অনুভব তার সেন্সেশন বা সংবেদনে সীমাবদ্ধ। যুক্তির ক্ষেত্রে মিল অবরোহী বা ডিডাকটিভ যুক্তির চেয়ে আরোহী বা ইনডাকটিভ যুক্তির উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। আরোহী যুক্তির বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে তিনি সাদৃশ্য, বৈসাদৃশ্য, সহ-পরিবর্তন এবং অবশিষ্টাংশসূচক কয়েকটি পদ্ধতির ব্যাখ্যা করেন। এগুলি মিলের পদ্ধতি নামে বিশেষভাবে পরিচিত। ইংরেজীতে এই পদ্ধতিগুলিকে যথাক্রমে মেথড অব অ্যাগ্রিমেন্ট, মেথড অব ডিফারেন্স, মেথড অব কনকোমিট্যান্ট ভেরিয়েশন এবং মেথড অব রেসিডুস বলা হয়। নীতিশাস্ত্রে মিলকে উপযোগবাদী বলা হয়। তিনি তাঁর পূর্বনামী বেনথামের উপযোগবাদ বা ইউটিলিটারিয়ানিজম তত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তি যে কারোর যে কোনো আচরণের ন্যায় অন্যায়ের মাপকাঠি হবে অধিকতর সংখ্যক মানুষের অধিকতম পরিমাণ সুখ উৎপাদনের উপযোগিতা। যে আচরণ মানুষের এরূপ সুখ উৎপাদনে উপযোগী, সে আচরণ ন্যায্য; যে আচরণ এর অনুপযোগী সে আচরণ অন্যায্য। মিলের মতে অবশ্য সুখের নিরিখ কেবল তার পরিমাণ দিয়েই হবে না। পরিমাণের সঙ্গে গুণের প্রশ্নও বিবেচনা করতে হবে। সুখ কেবল পরিমাণগতভাবে পৃথক নয়। সুখ গুণগতভাবেও পৃথক হতে পারে। অর্থাৎ আমরা কেবল অধিক সুখই যে কামনা করব, তা নয়। আমরা উত্তম সুখেরও বাসনা করব। এবং ‘অধিকতর’ এর চেয়ে ‘উত্তমই’ আমাদের কামনা হবে। তা ছাড়া দৈহিক সুখের চেয়ে মানসিক সুখকে উত্তম বলে মনে করব।
মিল ছিলেন গণতন্ত্র এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার আপসহীন সমর্থক। ব্যক্তি স্বাধীনতার অলঙ্ঘনীয়তার উপর জোর দিতে গিয়ে মিল বলেছিলেন, “এমন যদি হয় যে, সমগ্র মানবজাতি একদিকে এবং একটিমাত্র ব্যক্তি বিপরীত দিকে, সমগ্র মানবজাতি একটি মতের পোষক এবং একটিমাত্র ব্যক্তি ভিন্নমতের পোষক, তা হলেও আমি বলব, ঐ একটি মাত্র ব্যক্তির বিরোধী মতকে দমন করার অধিকার সমগ্র মানবজাতির নেই। যেমন নেই ঐ একটিমাত্র ব্যক্তির(যদি তার সে ক্ষমতা থাকে) মানব জাতির মতকে দমন করার।” অর্থাৎ ব্যক্তিমাত্র চিন্তার স্বাধীনতা এবং তা প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত। সংখ্যা কিংবা শক্তির আধিক্য ব্যক্তির এই মৌলিক স্বাধীনতাকে বিনষ্ট করতে পারে না। সেরূপ করার কোনো অধিকার কারোর নেই।
Monadology : মোনাডতত্ত্ব
গ্রিক শব্দ ‘মোনাস’ হতে ‘মোনাড’। ‘মোনাস’ এর অর্থ একক। প্রাচীন গ্রিক দর্শনের পাইথাগোরীয় ধারার চিন্তাবিদগণ মোনাস বা মোনাড তত্ত্ব ব্যবহার করেছেন। তাঁদের কাছে মোনাড হচ্ছে গাণিতিক একক এবং এই গাণিতিক একক হচ্ছে বিশ্বের মূল একক। সংখ্যা দ্বারাই বিশ্বচরাচর সৃষ্টি হয়েছে। আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনে ‘মোনাড’ পদের বিশেষ ব্যবহার দেখা যায় জার্মান দার্শনিক লাইবেনিজের দর্শনে। তাঁর ‘মোনাডলজি’ বা মোনাড তত্ত্বে লাইবনিজ মোনাডকে জগতের মূল, সরল এবং পরিবর্তনশীল একক বলে ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষের মন বা আত্মাও হচ্ছে মোনাড। লাইবনিজের মতে প্রত্যেকটি মোনাডের মধ্যেই বিশ্ব প্রতিবিম্বিত হয়।
Montesquieu, Charles de : মন্টেসক্যূ (১৬৮৯-১৭৫৫ খ্রি.)
মন্টেসক্যূ অষ্টাদশ শতকের ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁর রচনাবলী ১৭৮৯ সালের ফরাসি ধনতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ সুগম করার কাজে সাহায্য করে। কারণ মন্টেসক্যূ স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রের তীব্র সমালোচক ছিলেন। তিনি রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় বিধানের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করেন। রাষ্ট্র প্রকৃতিজাত সংগঠন এবং তার বিধানের মূলও প্রকৃতি, রাজা কিংবা ঈশ্বর নয়। মন্টেসক্যূর এই তত্ত্ব মধ্যযুগে রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিভূ বলে গণ্য করার যে তত্ত্ব চলে আসছিল সেই কায়েমী তত্ত্বের বিরোধী ছিল। অবশ্য মন্টেসক্যূ রাজতন্ত্রকে পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন নি। তাঁর মতে শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রই হচ্ছে সর্বোত্তম শাসনতন্ত্র। মন্টেসক্যূর অপরতত্ত্ব ভৌগলিকবাদ নামে পরিচিত। এই তত্ত্বে তিনি বলেন, যে কোনো একটি জনগোষ্ঠী বা জাতির দৈহিক, চারিত্রিক এবং রাষ্ট্রীয় চরিত্র নিয়ন্ত্রিত হয় তার প্রাকৃতিক অবস্থান অর্থাৎ তার ভূখন্ডের আকার, জলবায়ু, মাটি প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য দ্বারা। মন্টেসক্যূ নিজে নাস্তিক না হলেও তিনি গীর্জা এবং যাজকতন্ত্রের তীব্র সমালোচক ছিলেন। ‘দি স্টিরিট অব দি লজ’ মন্টেসক্যূর সুবিখ্যাত গ্রন্থ।
More, Thomas : টমাস মুর (১৪৭৮-১৫৩৫ খ্রি.)
কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে টমাস মূরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মধ্যযুগের প্রতিক্রিয়ার প্রাচীর ভেঙ্গে জ্ঞান বিজ্ঞান ও উদার ভাবের নবজাগরণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে টমাস মূর ছিলেন অন্যতম মানবতাবাদী প্রাজ্ঞ পুরুষ। ১৫২৯-১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টমাস মূল ইংল্যান্ডের লর্ড চ্যান্সেলর হিসেবে রাষ্ট্রের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু ধর্ম এবং রাষ্ট্র উভয় ক্ষেত্রে রাজা সার্বভৈৗম শক্তি, একথা টমাস মূর অস্বীকার করাতে তিনি রাজার কোপে পতিত হন। গির্জার উপর রাজার অধিকার অস্বীকার করার অপরাধে টমাস মূরের মাথা কেটে ফেলা হয়। টমাস মূরের রচনা ‘ইউটাপিয়া’ সুপরিচিত গ্রন্থ। ‘ইউটোপিয়া’ শব্দের অর্থ কাল্পনিক বা অসিত্ত্বহীন। টমাস মূর তাঁর ইউটোপিয়াতে একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজের ছবি এঁকেছেন। অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত মুরের ‘ইউটোপিয়া’ সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা বলে বিবেচিত হয়েছে। মুর তাঁর সমকালীন ইংল্যান্ডের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেন। এই সমালোচনার ভিত্তিতে তিনি এমন একটি বিকল্প সমাজের ছবি অঙ্কন করেন, যেখানে জনসাধারণ যৌথভাবে সমস্ত সম্পত্তির মালিক। এই যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে সমষ্টিগত শ্রমের মাধ্যমে সমাজের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষেত্রে সাম্যবাদী নীতির সুবিস্তারিত কল্পনায় টমাস মূরের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়। তাঁর কাল্পনিক রাষ্ট্রে পরিবার হচ্ছে সমাজের মৌল একক। উৎপাদনের প্রধান প্রক্রিয়া হচ্ছে হস্তশিল্প। এ রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক। নাগরিকমাত্রই শ্রমের ক্ষেত্রে এবং উৎপন্ন দ্রব্য ভোগের ক্ষেত্রে একে অপরের সমান। এ রাষ্ট্রে গ্রাম এবং শহর জীবনের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, দৈহিক শ্রম এবং মানসিক শ্রমের মধ্যেও অধম উত্তমের বৈরিতা নেই। এ রাষ্ট্রে মানুষ অনুক্ষণ শ্রমের শেকলে বাধা নয়। মানুষ ছয় ঘন্টা কাজ করে এবং বাকি সময় সে জ্ঞান বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা এবং চিত্তবৃত্তির চর্চায় অতিবাহিত করে। এ রাষ্ট্রে শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তির সামগ্রিক উন্নতি বিধান। শিক্ষার ক্ষেত্রে তত্ত্ব এবং বাস্তবের মধ্যে কোনো বিচ্ছিন্নতা থাকবে না। তত্ত্ব এবং তথ্যের সমাহারের ভিত্তিতে শিক্ষিত হবে ব্যক্তি। টমাস মূরের ইউটোপিয়ার এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকেও তাঁর চিন্তাধারার প্রাগ্রসরতা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অবশ্য একথা সত্য টমাস মূর সেদিন অনুধাবন করতে পারেন নি, অর্থনীতিক ক্ষেত্রে উৎপাদনের এই যৌথ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে সমাজের বাস্তব জীবনের উৎপাদন কৌশলের অর্থাৎ তার যান্ত্রিক কলা কৌশলের বিশেষ বিকাশ। টমাস মুর তাঁর পরিকল্পিত সমাজের বাস্তবায়নে সংগ্রামের আবশ্যকতাও উল্লেখ করেন নি। তিনি কল্পনা করতেন যে, সমাজের এই রূপান্তর শান্তিপূর্ণভাবে ঘটে যাবে।
Morgan, Lewis Henry : লিউস হেনরী মর্গান (১৮১৮-১৮৮১ খ্রি.)
লউস হেনরী মর্গান আমেরিকার একজন বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও নৃতাত্ত্বিক ছিলেন। তাঁর ‘এ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি’ বা ‘প্রাচীন সমাজ’ সমাজ বিকাশের গবেষণায় এক মৌলিক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে মর্গান আমেরিকার আদিম অদিবাসীদের জীবন যাত্রার উপর বিপুল পরিমাণ তথ্যাদি সংগ্রহ করে তার বিশ্লেষণ উপস্থিত করেন। এই তথ্যের গবেষণায় তিনি আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের মধ্যে প্রাচীন সাম্যবাদী জীবনের রেশ আবিষ্কার করেন। মর্গান শ্রেণীসমাজের পূর্বকার অবস্থার বিকাশকে যুগপর্যায়ে বিভক্ত করে দেখাবার চেষ্টা করেন। সে যুগ বিভাগ আজ অত স্বীকৃত না হলেও তাঁর এ তত্ত্ব স্বীকৃত যে, মানুষের জীবনের ইতিহাসে পরিবারের যে একক, তা চিরদিন ছিল না। বিকাশের একটা ঐতিহাসিক পর্যায়েই পরিবারের উদ্ভব ঘটেছে। এবং পরে আবার ইতিহাসের গতিপথে তার বিবর্তন ঘটেছে। বস্তুত মর্গান মানুষের সমাজের বিকাশের একটি বস্তুবাদী এবং ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা উপস্থিত করেছেন। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁর অবদান স্বীকার করে বলেছেন যে, মর্গানের বৈশিষ্ট্য এখানে যে, মর্গান নিজের গবেষণার মাধ্যমে ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে যেন পুনরায় আবিষ্কার করেছেন। এঙ্গেলস তার ‘পরিবার ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ শীর্ষক সুবিখ্যাত গ্রন্থে হেনরী মর্গানের ‘এ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি’র তথ্যসমূহকে কৃতজ্ঞতার সহিত ব্যবহার করেছেন এবং তার মার্কসীয় ব্যাখ্যা পেশ করেছেন।
Mutakallimins : মুতাকাল্লিমিন
‘কালাম বা খোদার বাণী’ থেকে ‘মোতাকাল্লিমিন’ অর্থাৎ যারা খোদার কালাম বা বাণীকে ভিত্তি ধরে সব কিছুকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। মুসলিম দর্শনে কালামবাদীগণ গোঁড়া এবং রক্ষণশীল বলে পরিচিত। এঁরা কোরানের বাণী এবং কোরানে আল্লাহর উপর আরোপিত মানবিক গুণাবলীকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলেন। কালামাবাদীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে ওয়ালিস বিন আতা, জাহিজ, মুআম্মার ইবনে আব্বাস প্রমুখ প্রাক্তন কালামবাদীদের নেতৃত্বে মুক্তবুদ্ধির একটি সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরা কালামবাদ হতে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছিলেন বলে মুতাজিলা বা বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা হতো। কালামবাদকে কেবল অন্ধবিশ্বাস বলা চলে না। মুতাজিলাগণ নিজেদের যুক্তিবাদী বলত। কালামবাদীগণও নিজেদের যুক্তিবাদী বলত। কালামবাদীদের বক্তব্য ছিল যে, অন্ধবিশ্বাস যেমন ইসলামকে রক্ষা করতে পারে না, তেমনি মুতাজিলাদের গ্রিক দর্শনের বিধর্মী যুক্তিও ইসলামের জন্য মারাত্মক। ইসলামকে কোরানের বাণীর যুক্তিগত ব্যাখ্যার ভিত্তিতেই রক্ষা করতে হবে।
Nation : জাতি
সাধারণত কোনো জনসমাজ যদি একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাসকারী হয়, একই ভাষায় তারা ভাবের আদানপ্রদান করে, একই ঐতিহ্য এবং আশা আকাঙ্খার বাহক হয় এবং রাষ্ট্রীয় সীমানায় আবদ্ধ থাকে কিংবা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয় তাহলে এরূপ জনসমাজকে জাতি বলে অভিহিত করা হয়। বাংলায় জাতি শব্দের অবশ্য একাধিক অর্থে ব্যবহার দেখা যায়। যেমন ধর্মের ভিত্তিতেও এক জনসমাজ নিজেকে বা অপর সমাজকে জাতি বলে চিহ্নিত করে থাকে। অনেক সময় হিন্দু কিংবা মুসলমান কিংবা খ্রিস্টান জনসমাজের লোক নিজেদের হিন্দু জাতি বা মুসলিম জাতি বা খ্রিষ্টান জাতির লোক বলে অভিহিত করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যবহৃত ‘জাতি’ সত্তার অস্তিত্ব ইতিহাসে সর্বদা ছিল না। আধুনিককালে জাতিকে সাধারণত রাষ্ট্রের ভিত্তিতে সংগঠিত জনসমাজ বলে মনে করা যায়। কিন্তু একইরূপ জনসমাজের রাষ্ট্ররূপে সংগঠিত অবস্থা ইতিহাসের আদি স্তরে দেখা যায় না। প্রাচীনকালে মানুষ বিভিন্ন গোত্রের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে বাস করত। কিন্তু একটি গোত্রের মধ্যে ঐক্যসূত্রের অস্তিত্ব থাকলেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিধিবিধান দ্বারা সংগঠিত ছিল না। জনসমাজে জীবিকার ক্ষেত্রে শক্তির তারতম্যের উদ্ভবে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের দৃষ্টি থেকে জনসমাজে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উদ্ভব ঘটে। এই পর্যায় দাস পর্যায় বলে পরিচিত। কিন্তু দাস পর্যায়ের জনসমাজকেও জাতি বলা হতো না। সামন্তযুগে ইউরোপের ভূখন্ড বিভিন্ন ভূস্বামী ও সম্রাটের মধ্যে বিভক্ত ছিল। য়ুরোপে জাতিসত্তার উদ্ভব ঘটে সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীদের সংকীর্ণ এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন ভূখন্ডকে একত্রীকরণের মাধ্যমে নতুনতর ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশ সুগম করার প্রয়োজন বোধ ও প্রয়াস হতে। এই প্রক্রিয়ায় ধনতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং য়ুরোপে জার্মান, ফরাসি, ইংরেজ প্রভৃতি জাতি এবং জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হতে থাকে। পরবর্তীকালে এই জাতীয়তাবোধ আবার ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের পরস্পর বিরোধিতা এবং আগ্রাসী মনোভাবের সৃষ্টি করে। একটা ধনিক রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রকে নিজের শত্রু বলে বিবেচনা করে। এর মূলে অবশ্য থাকে একের অর্থনীতিক আধিপত্য অপরের উপর প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির অসঙ্গতি এবং সঙ্কট অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের সৃষ্টি করে এবং এর পরিণামে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে জনসমাজধ্বংসী যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। জাতীয়তাবাদের দুটি রূপ ইতিহাসে সুস্পষ্ট। একটা তার সংগ্রামী ও প্রগতিশীল ভূমিকা। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদ একটা জনসমাজকে মুক্তির সংগ্রামে সংগঠিত করতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। আবার উগ্র জাতীয়তাবাদ একটা জনসমাজের মধ্যে গর্ব, অহংকার এবং আগ্রাসী মনোভাব সৃষ্টি করে মানুষের অমঙ্গলের কারণ হতে পারে। হিটলারের নেতৃত্বে জার্মান জঙ্গি জাতীয়তাবাদ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় এবং পৃথিবীর মহা অকল্যাণ সাধন করে। মানুষের সমাজ থেকে শ্রেণীবিভক্ত শোষণ বিদূরিত হলে মানুষের জাতিভিত্তিক বিভাগের গুরুত্ব হ্রাস পাবে, বিশেষ করে জাতিতে জাতিতে বৈরীমূলক সম্পর্কের আশঙ্কা দূরীভূত হবে বলে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদগণ কল্পনা করেন।
‘এক ভাষা, এক জাতি, এক রাষ্ট্র’ এরূপ অবিমিশ্র রাষ্ট্রের সাক্ষাৎ খুব বিরল। প্রধানত এক ভাষা, এক জাতি, এক রাষ্ট্রের একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই বাংলাদেশের মধ্যে বাংলাভাষী জনসমাজ আবদ্ধ নয়। ভারতীয় ইউনিয়নের পশ্চিম বাংলাও বাংলাভাষী সমাজ অধ্যুষিত। আবার বাংলাদেশের মধ্যে কিছু সংখ্যক পার্বত্য উপজাতির অস্তিত্ব রয়েছে যাদের ভাষা বাংলা হতে ভিন্ন।
জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সীমানা পরিবর্তিত বা বিভক্ত হতে পারে। মহাযুদ্ধের পরে জার্মান জাতি পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানী নামে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছিল। কোরিয়াও বর্তমানে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া নামে বিভক্ত হয়ে আছে। ভিয়েতনামও অনুরূপভাবে বিভক্ত ছিল। ভারতীয় ইউনিয়ন এবং রাশিয়া বহু ভাষা ও বহু জাতির রাষ্ট্র।
National Democracy : জাতীয় গণতন্ত্র
বিপ্লবী শক্তির সমাবেশনের ভিত্তিতে গঠিত একটি বিশেষ রাষ্ট্রীয় কাঠামো। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম, জাতীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা, জনসাধারণের জন্য ব্যাপক রাজনীতিক ও অর্থনীতিক অধিকার স্বীকার, ব্যাপকতম জনসমাজের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সামাজিক কাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের নীতি বাস্তবায়িত করার সম্ভাবনা এবং সর্বোপরি অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কৃষি সংস্কার সাধনের জন্য জাতীয় গণতন্ত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিহিত। সাম্রাজ্যবাদী বন্দিত্ব সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত একটা জাতি ব্যাপকতম জনতার ঐক্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংগঠনে এবং সমাজ জীবনে সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্তবাদের বিরুদ্ধে অর্জিত মুক্তিকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করতে পারে। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সক্রিয় সমর্থনের ভিত্তিতে এরূপ জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ ব্যতিরেকেই সরাসরি শিল্প সমৃদ্ধ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হওয়া বর্তমান বিশ্বে অসম্ভব নয়।
Nationalism : জাতীয়তাবাদ
জাতীয়তাবাদ বলতে প্রধানত পুঁজিবাদী বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশক আদর্শকে বুঝায়। ধনতন্ত্রের বিকাশের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদ বিকাশ লাভ করেছে। পুঁজিবাদ যখন সাম্রাজ্যবাদী যুগে পদার্পণ করে তখন জাতীয়তাবাদেরও দুটি রূপ প্রকাশ পায়। এর একটা রূপ হচ্ছে অপর জাতি ও রাষ্ট্রের আক্রমণকারী ও নিপীড়নকারী আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদের অপর প্রকাশ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তিকামী জনতার ঐক্য সৃষ্টিকারী সংগ্রামী মনোভাব। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র জাতীয়তাবাদকে তার অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য মনে করে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণী অর্থাৎ পুঁজিপতি এবং তার সহযোগী শ্রেণী জাতীয়তাবাদের আওয়াজ তুলে একদিকে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামী সর্বহারা শ্রেণীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে এবং অপরদিকে জাতীয় ঐক্য তৈরি করে অপর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তি সংহত করার এবং তাকে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামী সর্বহারা শ্রেণীর জন্য জাতীয়তাবাদ কোনো সহায়ক আদর্শ নয়। কারণ জাতীয়তাবাদের অর্থ হচ্ছে বিভিন্ন রাষ্ট্রের জনতার মধ্যে স্বাতন্ত্র্য ও বৈরী বোধের সৃষ্টি করা। অপরদিকে সর্বহারা এবং সমাজতান্ত্রিক শক্তির আন্তর্জাতিক ঐক্য। অনেক সময় দেখা যায় যে, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের শাসন ও শোষণের মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি, মুক্তিলাভের পরে রাষ্ট্রীয় শক্তি দখলকারী পুঁজিবাদী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী সর্বহারার নতুনতর সংগ্রামের সাফল্যকে প্রতিরোধ করার জন্য সেই জাতীয়তাবোধকে একটা ভাবগত হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে জাতীয়তাবাদের মোহ সৃষ্টি করে তাকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে পৃথক করে রাখারও প্রয়াস সে পায়।
New Left : নব বাম
বিশ শতকের ষাটের দশকে পাশ্চাত্যের বিদ্যমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, প্রচলিত জীবনধারা, নৈতিক মূল্যবোধ এবং আদর্শের বিরুদ্ধে পাঁতি বুর্জোয়া ছাত্র ও বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে প্রতিবাদী আন্দোলনের যে প্রকাশ ঘটে তা নব বাম আন্দোলন বলে পরিচিত হয়। সামাজিক বাস্তবতার বিরুদ্ধে এ আন্দোলনের একটি স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহাত্মক ভাব থাকলেও এর কোনো সুনির্দিষ্ট এবং বিকল্প সমাজব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল না। এ আন্দোলনের কাছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা যেমন অগ্রাহ্য, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাও তেমনি অগ্রাহ্য। এর ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত এই আন্দোলনের মধ্যে বিকল্পহীন নৈরাজ্যিক এবং নেতিবাচক প্রবণতাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। নবতর বাম আন্দোলন বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার সংকট সম্পর্কে ব্যাপক জনসাধারণের চেতনাকে আলোড়িত করার একটা ভূমিকা পালন করলেও, এর আদর্শহীনতা এবং পরস্পরের মধ্যে অনৈক্য একে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্রের দমনের সহজ শিকারে পর্যবসিত করে আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেয়। বৃহত্তর শোষিত মানুষের আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্নভাবের রাষ্ট্রের একচেটিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মোকাবেলা করতে এ আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
Neoplatonism : নব প্লেটোবাদ
৩য় থেকে ৬ষ্ঠ খ্রিষ্টীয় শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের যুগে প্লেটোর ভাববাদের একটি রূপান্তরকে নব প্লেটোবাদ বলে অভিহিত করা হয়। এর উদ্ভব প্রথমে ঘটে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত মিশরে। রোমের প্লটিনাসের উদ্যোগে একটি নব প্লেটোবাদী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। নব প্লেটোবাদী দর্শনে বস্তুজগৎকে মূল ভাবের একটা রহস্যময় প্রকাশ বলে মনে করা হয়। আসল ভাব বা সত্তার প্রকাশ ঘটে স্তরক্রমে। এই স্তরের একেবারে নিম্নতম পর্যায়ের প্রকাশ হচ্ছে বস্তুজগৎ। বস্তুজগতের উর্ধ্বে হচ্ছে বিশ্ব-আত্মা। বিশ্ব-আত্মাকে অতিক্রম করে আত্মা। আত্মার উপরে হচ্ছ পরম আত্মা বা চরম সত্তা। প্লেটোর মূল দর্শনে ভাবকে ঈশ্বর হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয় নি। কিন্তু নব প্লেটোবাদে প্লেটোর ‘ভাব’ ঈশ্বরে পর্যবসিত হয়ে নব প্লেটোবাদকে এক প্রকার ধার্মিক রহস্যবাদে পরিণত করে। মধ্যযুগের খ্রিষ্টীয় দর্শনের বিকাশে নব প্লেটোবাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এথেন্স নগরীতে প্রোক্লাস সর্বশেষ যে নব প্লেটোবাদী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিলেন তা ৫২৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।
New and Old : নতুন এবং পুরাতন
প্রাকৃতিক জগতের, বিশেষ করে মানুষের সামাজিক জীবনের বিকাশের মূলে রয়েছে নতুন এবং পুরাতনের দ্বন্ধ। সমাজের প্রতি পর্যায়ে যে শক্তি সমাজকে সম্মুখের দিকে অগ্রসর করে দিতে সাহায্য করে সেই শক্তিই হচ্ছে নতুন এবং যা সমাজকে যেমন আছে তেমন অবস্থায় রাখতে চায় কিংবা তার গতি বিপরীতমুখী করার প্রয়াস পায় তা হচ্ছে ‘পুরাতন’। পুরাতনকে ভেঙ্গে এবং অতিক্রম করে নতুনকে আত্মপ্রকাশ করতে হয়। তাই নতুনের আত্মপ্রকাশে একটা উৎক্রমণ বা আকস্মিকতার বৈশিষ্ট্য থাকে। কিন্তু তথাপি নতুন ও পুরাতনের দ্বন্ধ একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। নতুন এবং পুরাতন কথাও আপেক্ষিক।
যা আজ নতুন তা কালক্রমে পুরাতন হয়ে যায়। নতুনের মধ্যে বিরোধী শক্তির উদ্ভব ঘটতে থাকে। এই বিরোধী শক্তি নতুনতর অগ্রসরমান শক্তির ভূমিকা গ্রহণ করে এবং পূর্বকার ‘নতুন’ প্রতিদ্বন্ধে পুরাতনে পর্যবসিত হয়। পর্যায়ক্রমে এই প্রক্রিয়া সর্বদা সর্বঅস্তিত্বেই প্রবহমান। বস্তুত নতুন পুরাতনে দ্বন্ধই বস্তুজগতের গতি এবং জীবনের লক্ষণ। এই দ্বন্ধ কোনো ব্যক্তির মানসিক ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না।
Newton, Issac : আইজাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭ খ্রি.)
সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের বিশ্ববরেণ্য ইংরেজ বৈজ্ঞানিক আইজ্যাক নিউটনকে বলবিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করা হয়। নিউটন বস্তুজগতের সর্বক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। দার্শনিক চিন্তার বিকাশকেও তিনি বিরাটভাবে প্রভাবিত করেছেন। তাঁর মূল গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘ফিলসফি ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেম্যাটিকা।’ ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেম্যাটিকা’ হিসাবে এ গ্রন্থ সর্বজনীনভাবে পরিচিত। তাঁর সর্ব-ব্যাপক মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব সূর্য কেন্দ্রিক সৌরমন্ডলের চিন্তাকে যেমন পরিপূর্ণতা দান করে তেমনি এ তত্ত্ব সমগ্র বিশ্বের সকল বস্তু জগৎ এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়াসমূহকেও ব্যাখ্যার উপায় প্রদান করে। দর্শনের ক্ষেত্রে নিউটন সত্তার বাস্তব অস্তিত্ব এবং মানুষের পক্ষে বিশ্বজগতের জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। অবশ্য কালের প্রেক্ষিতে তিনি বস্তুর মূল গতি ঈশ্বর হতে এসেছে বলে মনে করেন। কিন্তু তত্ত্বের ক্ষেত্রে তাঁর ঘো্ষণা, অনুমানের উপরে আমি কোনো কথা বলি নে, ‘হাইপথেসিস ননফিঙ্গো’ অষ্টাদশ শতকের বিজ্ঞানের বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রধান নীতি হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপে বস্তুবাদী দর্শনের বিকাশে নিউটনের অবদান অবিস্মরণীয়। জ্ঞানের অসীমতার ক্ষেত্রে তাঁর উক্তি, ‘আমি জ্ঞান সমুদ্রের তীরে উপলখন্ড সংগ্রহ করে চলেছি’ গভীর দার্শনিক তাৎপর্যে পূর্ণ অনুপ্রেরণাদায়ক উক্তি।
Nietzsche, Friedrich : ফ্রেড্রিক নিৎসে(১৮৪৪-১৯০০ খ্রি.)
ঊনবিংশ শতকের জার্মানীর ভাববাদী দার্শনিক ফ্রেড্রিক নিৎসে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের অন্যতম পূর্বসূরি ছিলেন। য়ুরোপে পুঁজিবাদ তখন সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র গ্রহণ করতে শুরু করেছে। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির অসঙ্গতি ও সংকট সমাজের অভ্যন্তরে শোষক ও শোষিতের দ্বন্ধকে তীব্র করে সামাজিক বিপ্লবকে অত্যাসন্ন করে তুলছে। এই বাস্তব পরিবেশে পুঁজিবাদের আত্মরক্ষার এবং প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাবের আদর্শগত প্রতিভূ হিসেবে নিৎসের অভিমত প্রকাশিত হয়। নিৎসের দর্শনের মধ্যে তাই জনতা এবং বিপ্লবী মতাদর্শের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার ভাব সুস্পষ্ট। নিৎসের দর্শনের মূল কথা হচ্ছেঃ প্রকৃতি ও প্রাণিজগতে নিরন্তর আত্মরক্ষা ও বাঁচার সংগ্রাম চলছে। এই বাঁচার সংগ্রামের পরিণাম হচ্ছে ক্ষমতা বিস্তারের অদম্য ইচ্ছা। তাই শোষক, শোষিত বা দাস, প্রভু এগুলি প্রকৃতিগত ব্যাপার। শোষণ করা জীবনমাত্রেরই চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য আর দাস হওয়াটাও বাঁচার সংগ্রামে পরাজিত পক্ষের অনিবার্য্য ভাগ্য। পরাজিতের পক্ষে দাসত্ব স্বীকার করা হচ্ছে বাস্তব সত্যের স্বীকৃতি। কিন্তু বাঁচার সংগ্রাম স্বাভাবিক এবং পরাজয়ের পরে দাসত্ব অনিবার্য বলে নিৎসে ঊনবিংশ শতকের ধনবাদী শোষককে ভবিষ্যতের অনিবার্য দাসত্বকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত করেন নি। তাকে সংগ্রামের পরিণামে অনিবার্য পরাজয় থেকে বাঁচবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন তার প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্বের মারফত। এই উদ্দেশ্য নিয়ে ধনবাদী সভ্যতার প্রথম যুগের প্রগতিশীল বুদ্ধিবাদ, উদারতাবাদ, মানবতাবাদ প্রভৃতি ভাবধারাকে দুর্বলচিত্ততা বলে তিনি আখ্যায়িত করেছেন। নিৎসের মতে এই সমস্ত ভাবধারা আসন্ন বিপ্লবকে রোধ করতে অক্ষম। আসন্ন বিপ্লবকে রোধ করতে হলে সমাজের শক্তিধরদের নিজেদের চরিত্রে কাঠিন্য, সাহস, দৃঢ়তা সৃষ্টি করতে হবে। তাদের নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন হতে হবে। গণতন্ত্র এবং মানবতাকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। বস্তুত এই সংকট থেকে সমাজকে রক্ষা করতে পারবে একমাত্র অতিমানুষ যে তার উদ্দেশ্য সাধনে কোনো গণতন্ত্র এবং মানবতাবাদী নীতিরই পরোয়া করবে না। নিৎসের অতিমানুষের আদর্শই বাস্তবায়িত হয়েছিল বিংশ শতকের তৃতীয় শতকে ফ্যাসিবাদী অভ্যুত্থানে এবং তার মনুষ্যত্বের বর্বর নায়ক এ্যাডলফ হিটলারের চরিত্রে। নিৎসে দ্বিধাহীনভাবে বলেছিলেন, শ্রমিক শ্রেণীকে বশে রাখতে হলে তার মধ্যে দাসত্বের মনোভাব এবং পুঁজিবাদী প্রভুদের মাঝে প্রভুত্বের মনোভাব সৃষ্টিতে করতে হবে। নিৎসের মতে বিশ্বে অগ্রগমন বা বিবর্তন বলে কোনো সত্য নেই। বিশ্বে চলছে বিশেষ বিশেষ অবস্থার পৌনঃপুনিক পুনরাবর্তন। ‘জারাথ্রুস্ত্র বললেন’ ‘হিত অহিতকে অতিক্রম করে’ এবং ‘উইল টু পাওয়ার’ বা শক্তির সংগ্রাম নিৎসের গ্রন্থসমূহের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
Nihilism : নাস্তিত্ববাদ
হাঁ বাচক বা অস্তিবাচক সবকিছুকে অস্বীকার করা হচ্ছে নাস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য। নিহিলিজম বা নাস্তিত্ববাদ শব্দের ব্যবহার দেখা যায় রুশ সাহিত্যিক তুর্গেনিভের উপন্যাসে। ঊনবিংশ শতকে রাশিয়ায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীদের নাস্তিত্ববাদী বলে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিপ্লবী কর্মীগণ নৈরাজ্যবাদী বা নাস্তিত্ববাদী ছিল না। গণতান্ত্রিক বিপ্লবী আদর্শ রুশ ভূমিদাস প্রথা ও পুঁজিবাদ ব্যবস্থার যেমন উচ্ছেদ কামনা করেছে, তেমনি তার পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। লেনিন নাস্তিত্ববাদের মধ্যে দুটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর মতে প্রতিক্রিয়াশীল সমাজব্যবস্থা ধ্বংসের দাবি যদি নাস্তিত্ববাদে দেখা যায় তবে তার প্রগতিশীল চরিত্র স্বীকার্য। কিন্তু যে নাস্তিত্ববাদ মানুষের বুদ্ধি, ক্ষমতা সবকিছুকে অস্বীকার করে তার বৈশিষ্ট্য অবশ্যই প্রতিক্রিয়াশীল।
Nominalism : নামবাদ, নামসর্বস্বতা
য়ুরোপের মধ্যযুগীয় দর্শনে সাধারণ ভাবকে বিশেষ বস্তুর নাম বলে আখ্যায়িত করার নাম নামবাদ বলে পরিচিত। রাম, রহিম, সক্রেটিস বিশেষ বিশেষ মানুষের নাম। কিন্তু মানুষ বলতে কি বুঝাবে, এটি দর্শনের একটি প্রশ্ন। এই প্রশ্নে দুটি অভিমতের প্রকাশ দেখা যায়। একটি হচ্ছে বাস্তববাদ। অর্থাৎ বিশেষ বস্তুর যেমন অস্তিত্ব আছে, তেমনি সাধারণ ভাবেরও বাস্তব অস্তিত্ব আছে। এর বিপরীত নাম হচ্ছে নামবাদ। নামবাদের মতে সাধারণ ভাবের কোনো নির্বিশেষ অস্তিত্ব নেই। সাধারণ ভাবও একটি বিশেষ অস্তিত্ব। রহিম যেমন একটি বিশেষ অস্তিত্বের নাম তেমনি মানুষও অপর একটি বিশেষ অস্তিত্বের নাম। নামবাদকে প্রাথমিক বস্তুবাদ বলে বিবেচনা করা যায়। কেননা নামবাদের প্রতিপক্ষে ছিল ভাববাদ। অর্থাৎ সবকিছুই ভাব। ভাবের প্রতিনিধিত্বমূলক কোনো বস্তু আছে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই অভিমতের চরম প্রতিক্রিয়া হিসেবে নামবাদ বিশেষ অবিশেষ সব ভাবকে বিশেষ বস্তুর অস্তিত্ববাচক নাম বলে আখ্যায়িত করে। পরবর্তীকালের দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদ নামবাদের এই রকম নামসর্বস্বতাকে অস্বীকার করে। দ্বন্ধমূলক বা বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের মতে মানুষ বিশেষের সঙ্গে বিশেষের তুলনার ভিত্তিতে সাধারণ চরিত্র বা ভাব আবিষ্কারের ক্ষমতা রাখে। সাধারণভাবে অস্তিত্বহীন নয়। কিন্তু তার অস্তিত্ব বিশেষ অস্তিত্ব নয়। বিশেষের মধ্যেই নির্বিশেষ ভাবের অস্তিত্ব। ‘মানুষ’ বলতে আমরা যে সকল গুণ বিভিন্ন বিশেষ মানুষ পর্যবেক্ষণ করে আবিষ্কার করেছি সে সকল গুণের কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব যেমন বুঝায় না, তেমনি মানুষ বলতে রাম, রহিম, সক্রেটিস প্রভৃতি বিশেষ মানুষের মধ্যে সে সকল গুণের যে বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে তাও বুঝায়। একাদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর নামবাদীদের মধ্যে ডানস স্কোটাস এবং অকামের উইলিয়ামের নাম উল্লেখযোগ্য। নামবাদের ভাববাদী ব্যাখ্যা দেখা যায় পরবর্তীকালে বার্কলে এবং হিউমের দর্শনে এবং সাম্প্রতিককালের শব্দতত্ত্বের মধ্যে।
Non-Aryans : অনার্য
উত্তর পশ্চিম দিক দিয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০-১০০০ শতকের আর্যভাষীদের ভারত আগমনের পূর্বে ভারতে যে সমস্ত জাতির লোক বাস করত তাদেরকে সাধারণত অনার্য বলে আখ্যায়িত করা হয়। পূর্বে ভারতের ইতিহাসের পরিচয় আর্যদের আগমন থেকে দেওয়া হতো। তার পূর্বযুগকে প্রাগৈতিহাসিক যুগ বলা হতো। কিন্তু বিংশ শতকের গোঁড়ার দিকে সিন্ধু নদীর উপকূলে হরপ্পা এবং মহেনজাদারো নগরীর ধ্বংসাবশেষ খননের পরে ভারতের ইতিহাস আর্যপর্ব অতিক্রম করে খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বৎসর পর্যন্ত বিস্তারিত হয়ে গেছে। হরপ্পা এবং মহেনজাদারোতে প্রাচীন ভারতের একটি সুবিকশিত সভ্যতার আভাস পাওয়া গেছে। এই সমস্ত প্রাচীন নগরীতে পোড়া ইট দ্বারা বাড়ি তৈরি করা হতো। নগরীর রাস্তাঘাট পরিকল্পনার ভিত্তিতে তৈরি করা হতো। প্রত্যেক বাড়িতে পানির কূপ এবং গোছলখানার ব্যবস্থা ছিল। অনেকে মনে করেন দক্ষিণ ভারতের আর্যপূর্ব দ্রাবিড় সভ্যতা এবং সিন্ধু উপকূলের এই সভ্যতার মধ্যে যোগসূত্র ছিল। সিন্ধু নদীর সভ্যতা দ্রাবিড় সভ্যতার বিস্তার। আর্যপূর্ব ‘অনার্য’ ভারতীয় অধিবাসীদের মধ্যে একেবারে প্রাচীনকালের পুরাতন প্রস্তর যুগের মানুষ থেকে নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। আধুনিককালে ভারতের সাঁওতাল পরগণাসমূহে ছোটনাগপুর এবং মধ্যভারতের পার্বত্য অঞ্চলে কোল বা মুন্ডা নামক যে উপজাতিদের রেশ দেখা যায়, ঐতিহাসিকদের মতে তারা নব্যপ্রস্তরযুগের ভারতীয়দের উত্তর পুরুষ। আর্যপূর্ব হিসেবে দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় জাতিকেও অনার্য বলা যায়। বর্তমানের তামিলের প্রাচীন নাম দ্রাবিড়। দ্রাবিড় বলতে তামিল, তেলেগু, কানাড়ি, মালয়লাম প্রভৃতি ভাষাভাষীদের পূর্বপুরুষদের বুঝায়। বালুচিস্তানের ব্রাহুই ভাষী অধিবাসীদেরও দ্রাবিড় জাতিভুক্ত মনে করা হয়। বালুচিস্তান ভারতের উত্তর পশ্চিমে। বালুচিস্তানে দ্রাবিড় ভাষার গোষ্ঠীভুক্ত ভাষার সাক্ষাৎ থেকে এরূপ অনুমান করা হয় যে, দ্রাবিড়গণ ভারতের আদি মানুষ নয়। তারাও উত্তর পশ্চিম দিক থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিল। এই দ্রাবিড়দের মধ্যে পরবর্তীকালে আগত আর্যদের লড়াই হয়। এই লড়াই এ দ্রাবিড়গণ পরাজিত হয়ে আর্যদের দাসে পরিণত হয়।
অনার্যদের মধ্যে প্রাচীনকালে উত্তরপূর্ব দিক থেকে ভারতে আগত জনগোষ্ঠীকেও ধরা হয়। ভোটিয়া, নাগা, লেপচা, কিরান্তি প্রভৃতি উপজাতি প্রাচীনকালে উত্তর পূর্ব দিক থেকে আগতদের উত্তর পুরুষ। (দ্র. ক্যামব্রিজ শর্ট হিস্টরি অব ইন্ডিয়া)।
Non Cooperation Movement : অসহযোগ আন্দোলন
ভারতবর্ষের ইংরেজ অধীনতার সময়ে গান্ধীজির নেতৃত্বে ইংরেজ শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সর্বপ্রকার অসহযোগিতার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন অসহযোগ আন্দোলন বলে পরিচিত। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তাঁর অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে অহিংসার ভাবও যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। অহিংসাভাব প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের একটি প্রধান ভাব। জীবমাত্রই ঈশ্বরের সৃষ্টি। ঈশ্বরের কোনো সৃষ্টি বিনষ্ট করা উচিত নয়। এই বোধ থেকে জৈন ধর্ম কোনো প্রকার জীবহত্যাকে অধর্ম বলে বিবেচনা করে।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী একটি বণিক ও জৈনধর্ম বিশ্বাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন ছিলেন। যৌবনে ইংল্যান্ড থেকে আইনবিদ্যা অর্জন করে প্রথমে দেশে, পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় আইনব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় অধিবাসীগণ সরকারের বৈষম্যমূলক ও বর্ণবিদ্বেষী বিধানের ফলে যে নির্যাতন ভোগ করেছিল তার প্রতিরোধে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁর প্রতিরোধের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৈহিক শক্তি দিয়ে প্রতিবাদ নয়, সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে অহিংসভাবে প্রচারের সাহায্যে এবং নির্যাতন সহ্য করার মাধ্যমে তার অসারতা প্রমাণ করার তিনি চেষ্টা করতেন। গান্ধীর ভাষায় অহিংসা অর্থ অন্যায়কারীর নিকট নতি স্বীকার করা নয়। অহিংসার অর্থ স্বৈরাচারী ইচ্ছাশক্তির বিরুদ্ধে নির্যাতিতের সমগ্র আত্মার বোধকে উত্থিত করা। দক্ষিণ আফ্রিকাতে যানবাহন বিশেষ করে রেলওয়ের প্রথম শ্রেণীতে অশ্বেতাঙ্গদের আরোহণ নিষিদ্ধ ছিল। বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গগণ জোর করে এমনকি দৈহিক নির্যাতন করে তাকে প্রথম শ্রেণী হতে নামিয়ে দিত। মহাত্মা গান্ধী সে নির্যাতন হাসিমুখে বরণ করতেন। এই নির্যাতন ভোগের দৃষ্টান্ত ক্রমান্বেয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এবং তাঁর পরিচালিত আন্দোলনের এই অহিংস নীতি এবং অনমনীয় দৃঢ়তা ক্রমান্বয়ে শক্তি গ্রহণ করতে থাকে। এর ফলে ১৯১৪ সনে এশিয়াবাসীর বিরুদ্ধে নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার করা হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় অর্জিত জনপ্রিয়তা নিয়ে ১৯১৪ সালে গান্ধীজি ভারতে প্রত্যাবর্তন করে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ এ যোগদান করেন। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তিনি ইংরেজ সরকারের সহযোগিতা করেন এবং ইংরেজদের জন্য সৈন্য সংগ্রহ করে দেন। তাঁর বিশ্বাস, এরূপ সহযোগিতার ফলে ইংরেজ সরকার ভারতের প্রতি মনোভাব পরিবর্তন করে ভারতকে ‘স্বরাজ’ দান করবে।
কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে ইংরেজ সরকার ভারতে দমননীতি তীব্র করে তোলে। ভারতেও বিচ্ছিন্নভাবে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত এবং বিস্ফোরিত হতে থাকে। ইংরেজ সরকার ‘রাওলাট বিল’ পাশ করে বিনাবিচারে গ্রেপ্তার, আটক এবং নির্যাতনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৯১৯ সনের এপ্রিলে জালিনওয়ালাবাগে একটি প্রতিবাদ সভায় ইংরেজ সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ডায়ার নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে শতশত লোককে হত্যা করে।(দ্র. অমৃতসর হত্যাকান্ড) সমগ্র পাঞ্জাবব্যাপী সামরিক আইন জারি করা হয়।
এরূপ আবহাওয়ায় ভারতের প্রধান রাজনীতিক দল জাতীয় কংগ্রেসও ইংরেজ সরকারের প্রতি তাদের পূর্বকার সহযোগিতার নীতি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
ইংরেজ সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং স্বরাজ লাভের জন্য প্রতিবাদ ও আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্বের দায়িত্ব গান্ধীজির উপর দেওয়া হয়। তিনি অহিংসা এবং অসহযোগের ভিত্তিতে এই আন্দোলন পরিচালনা করা স্থির করেন। ১৯২০ সনে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেস সম্মেলনে এই অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ভারতের বাস্তব পরিস্থিতিতে অসহযোগ আন্দোলন একটি ঐক্যবদ্ধ জঙ্গি স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ লাভ করে। হিন্দু এবং মুসলমান নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে অনৈক্য ছিল তা ১৯১৬ সনের লক্ষ্মো চুক্তিতে অনেকটা দূরীভূত হয়। মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে মুসলিম স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে একটা সমঝোতা হয়। এতদ্ব্যতীত যুদ্ধের ফলে জার্মানীর সহযোগী হিসাবে তুরস্কের পরাজয়ে তুরস্কের সুলতানের প্রতি ইংরেজদের আচরণে ভারতের মুসলমান সম্প্রদায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। তুরস্কের সুলতান তখনো মুসলিম সমাজের খলিফা বলে বিবেচিত হতেন। সেভারস এর চুক্তি অনুযায়ী(১৯২০) হেজাজ রাজ্যকে তুরস্কের অধীনতা মুক্ত করা হয় এবং আরমেনিয়া, থ্রেস, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়ার এবং প্যালেস্টাইনের উপর তুরস্কের কর্তৃত্ব বিলোপ করা হয়। তুরস্কের প্রতি মিত্রশক্তির এরূপ আচরণ ‘খিলাফত’কে ধ্বংস করার নামান্তর বলে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় মনে করে। তারা ‘খিলাফত’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ‘খিলাফত কমিটি’ গঠন করে। মৌলানা মোহাম্মদ আলী এবং মৌলানা শওকত আলী এই খিলাফত কমিটির নেতৃত্ব দেন। কংগ্রেস ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় খিলাফত কমিটিও এই আন্দোলনকে সমর্থন দান করে।
অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা ঘটে ইংরেজদের প্রস্তুত করা এবং ভারতে আমদানী করা পণ্যের বর্জন এবং তাকে ভস্মীভূত করা, মাদকদ্রব্যের পণ্য বয়কট করা নিয়ে। ক্রমান্বয়ে এই আন্দোলন খাজনা এবং ট্যাক্স প্রদান না করা, ইংরেজ সরকারের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্র এবং শিক্ষক দ্বারা বর্জন, এমনকি আইন ব্যবসায়ীদের দ্বারা আইন আদালত বর্জন পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। ইংরেজ সরকার হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে। আন্দোলনকারীরা স্বেচ্ছায় গ্রে্প্তার বরণের নীতি গ্রহণ করে। ইংরেজ সরকার ভারতবাসীদের শান্ত করার জন্য রাজকুমার অর্থাৎ প্রিন্স অব ওয়েলস কে ভারত ভ্রমণে পাঠায়। কিন্তু তাঁর ভারত উপস্থিতির দিন(১৯২১ এর ১৭ নভেম্বর) দেশব্যাপী এক বিরাট প্রতিবাদ হরতাল পালন করা হয়। আন্দোলনের চরমে ৩০,০০০ আন্দোলনকারীকে কারাগারে আবদ্ধ করা হয়। গান্ধীজি এই আন্দোলনকে পুরোপুরি অহিংস রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু আন্দোলন যত ব্যাপকতা ও তীব্রতা লাভ করতে থাকে তত তা তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। ফলে গান্ধীজি আন্দোলন সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি আন্দোলনের রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করেন। আন্দোলন ১৯২১ সনে যখন খুব তীব্র আকার ধারণ করে তখন আহমেদাবাদে কংগ্রেসের সম্মেলন আহবান করা হয়। যদিও দেশব্যাপী দাবী উঠেছিল যে আন্দোলনকে অধিকতর সংগ্রামী করে তুলতে হবে এবং ‘স্বরাজ’ এর অনির্দিষ্ট কথাকে পরিবর্তন করে পূর্ণ স্বাধীনতাকে আন্দোলনের লক্ষ্য বলে ঘোষণা করতে হবে তথাপি আহমেদাবাদের কংগ্রেসের সম্মেলনে স্বাধীনতা অবলম্বন করে সংগ্রামের জঙ্গী আওয়াজ পরিত্যাগ করা হয় এবং জনসাধারণের কাছ থেকে খাজনা ও ট্যাক্স বন্ধের লক্ষ্যও তুলে নেওয়া হয়। এই সম্মেলনেই হসরত মোহানী পরিপূর্ণ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করলে গান্ধীজি ক্ষোভের সঙ্গে একে দায়িত্ববোধের পরিচয়শূণ্য বলে অভিহিত করেন। গান্ধীজি আন্দোলনকে এবার প্রতীকি রূপ দেবার চেষ্টা করেন। অহিংসা রক্ষার সকল সতর্কতা গ্রহণ করে তিনি একটি ছোট গ্রাম বরদলীকে গণঅসহযোগের জন্য নির্বাচিত করে সরকারের নিকট অবিলম্বে সকল বন্দির মুক্তি দাবি করেন। (ফেব্রুয়ারী, ১৯২২) ইতোমধ্যে যুক্তপ্রদেশের(বর্তমান উত্তরপ্রদেশ) চৌরিচৌরা গ্রামে একটি ঘটনা সংঘটিত হয়। এই গ্রামের বিক্ষুব্ধ কৃষকগণ পুলিশী অত্যাচারের প্রতিবাদে একটি থানা ঘেরাও করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই ঘটনায় ২২ জন পুলিশের প্রাণহানি ঘটে। এই ঘটনার সংবাদ গান্ধীজির নিকট পৌছলে গান্ধীজি অবিলম্বে তাঁর অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত করেন।
এই পর্যায়কে অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম পর্যায় বলা চলে। ১৯৩০ সালে পুনরায় সমুদ্রতীরের ডান্ডিতে লবণ আইন অমান্য করে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন।
গান্ধী ছিলেন প্রধানত ভারতের রক্ষণশীল সমাজ এবং প্রতিষ্ঠাকামী ধনিক শ্রেণীর প্রতিভূ। এ শ্রেণী নির্যাতিত শ্রমিক ও কৃষকের জঙ্গি চেতনা এবং সংগঠনকে ভয়ের চোখে দেখত। এই ভীতি থেকে জনতা অধিকতর সংগ্রামী হতে চাইলে নেতৃত্ব তার রাশ টেনে ধরতে চেয়েছে। আন্দোলনের এই সীমাবদ্ধতা সত্বেও গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। ব্যাপক জনতাকে অনুপ্রাণিত করার বিশেষ ক্ষমতা ছিল গান্ধীজির। হিন্দু সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষ তাঁকে সাধুপুরুষের মত ভক্তি করত। ফলে তাঁর পরিচালনায় এই আন্দোলন পূর্বেকার সকল আন্দোলনকে অতিক্রম করে এক ব্যাপক গণআন্দোলনের রূপ গ্রহণ করে।
Nous : নউস
প্রাচীন গ্রিক দর্শনে সকল চিন্তা ও চেতনা কেন্দ্রীভূত সত্তাকে ‘নউস’ বলা হতো। এ্যানাক্সগোরাসের দর্শনে নউসের প্রথম এবং সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এ্যানাক্সগোরাসের মতে আকারহীন আদি বস্তুর আকার ও বৈচিত্র্য প্রাপ্তির মূল শক্তি হচ্ছে ‘নউস’। প্লেটো এবং এরিস্টটলের দর্শনে ‘নউস’কে সব আকারের শেষ আকার বা সব ভাবের সর্বোচ্চ ভাব বলে ব্যাখ্যাত হতে দেখা যায়। প্রাচীন বস্তুবাদী দার্শনিকগণও ‘নউস’ শব্দকে ব্যবহার করেছেন। ডিমোক্রিটাস ‘নউস’কে বলেছেন গোলাকার অগ্নি। থেলিসও নউসকে সৃষ্টির উৎস বলে মনে করেছেন। প্রাচীন দার্শনিকগণের কাছে নউস তাই বস্তু বা সৃষ্টিকর্মের মূল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। প্রাচীন যুগের নউসের মধ্যে যে নির্বিশেষ চরিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় মধ্যযুগের ব্যাখ্যায় সেই চরিত্র আর দেখা যায় না। মধ্যযুগে নউসকে দার্শনিকগণ ব্যক্তির চরিত্র বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন।
Naya : ন্যায়
প্রাচীন ভারতীয় ভাববাদী দর্শনের একটি শাখার নাম ন্যায়। ন্যায় দর্শনের প্রধান জোর ছিল যুক্তি ও জ্ঞানতত্ত্বের উপর। প্রাচীন উপাখ্যানের ঋষি গৌতম ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। ন্যায়বাদ ভারতীয় দর্শনের অনুবাদ। কারণ ন্যায় দর্শনে বিশ্বজগৎ অসংখ্য অণুর সম্মেলনে সৃষ্টি হয়েছে। অসংখ্য অণুর সঙ্গে অসংখ্য আত্মার অস্তিত্বকেও ন্যায় দর্শন স্বীকার করে। আত্মা অণু থেকে আলাদা যেমন থাকতে পারে তেমনি তারা বস্তুর অণুতে মিশেও থাকতে পারে। ঈশ্বর অণু বা আত্মার স্রষ্টা নয়। ঈশ্বর হচ্ছে অণুর সঙ্গে আত্মার সম্মেলনকারী বা বিমুক্তকারী শক্তি। এ্যরিস্টটল যেমন গ্রিসের দর্শনে যুক্তিকে সুসংবদ্ধ করেছিলেন, ভারতীয় দর্শনের ন্যায়ও তেমনি যুক্তিশাস্ত্রকে সর্বপ্রথম সুসংবদ্ধ করে। ন্যায়যুক্তির পাঁচটি স্তর, যথা প্রতিপাদ্য, প্রমাণ, দৃষ্টান্ত, প্রয়োগ এবং সিদ্ধান্ত। ন্যায় দর্শন অনুবেদন (পারসেপশন), অনুমান তুলনা এবং বিভিন্ন ব্যক্তির এবং গ্রন্থের সাক্ষ্যকে জ্ঞানের প্রক্রিয়াস্বরূপ বলে স্বীকার করে। জ্ঞান ও বস্তুর প্র্রধান সূত্রগুলিকেও ন্যায় দর্শন শ্রেণীবদ্ধ করেছে।
Ontology : তত্ত্ববিদ্যা, সত্তাতত্ত্ব, নির্বিশেষ তত্ত্ব
নির্দিষ্ট কোনো অস্তিত্বকে আমরা বিশেষ বলি। বলটি, বৃক্ষটি, লোকটি বিশেষ বস্তু। কিন্তু বিশেষই মূল না বিশেষের পিছনে নির্বিশেষ কোনো সত্তা আছে, এ চিন্তা দার্শনিকদের আদিকালের চিন্তা। এ্র্যারিস্টটল এই প্রশ্নের জবাবে নির্বিশেষ অস্তিত্ব বা সত্তার তত্ত্ব তৈরি করেন। তাঁর মতে বিশেষ হচ্ছে খন্ডিত সত্তা। সমস্ত বিশেষ নিয়ে অখন্ড নির্বিশেষ সত্তা।কিন্তু তাই বলে বিশেষের সমাহার মাত্র নির্বিশেষ নয়। পরন্তু নির্বিশেষের প্রকাশেই বিশেষ এবং বৈচিত্র। বিশেষ নির্বিশেষের প্রশ্নে প্লেটো, এ্যারিস্টটল পূর্বে এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে জগতের বিশেষ বিশেষ বস্তু পরিপূর্ণ সত্তা নয়। পরিপূর্ণ সত্তা বিশেষকে অতিক্রম করে বিরাজমান। নির্বিশেষের সাথে বিশেষের সাদৃশ্যের ভিত্তিতে বিশেষ অস্তিত্বের যথার্থতার পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়। অর্থাৎ নির্বিশেষ হচ্ছে বিশেষের নিয়ামক। প্লেটো-এ্যরিস্টটলের নির্বিশেষের এই তত্ত্ব পরাদর্শন বা পরাবিদ্যা বলে অভিহিত হয়। য়ুরোপের মধ্যযুগের ধর্মীয় দর্শন প্লেটো এ্যরিস্টটলের এই তত্ত্বকে ব্যবহার করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করে। সেন্ট টমাস একুইনিসের মধ্যে এই ব্যাখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতকের পর থেকে নির্বিশেষ অস্তিত্বের তত্ত্ব দ্বারা ভাববাদী দার্শনিকগণ বস্তুমাত্রকেই অস্তিত্বহীন ও ভাব বলে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন। এই প্রয়াসের চরম দেখা যায় জার্মান দার্শনিক উলফের রচনায়। উলফের ব্যাখ্যায় ‘অস্তিত্ব’ ‘বাস্তবতা’ ‘সংখ্যা’ ‘কারণ’-এই সমস্ত ভাবের সঙ্গে বস্তুর কোনো সম্পর্ক নেই। হবস, স্পিনাজো, লক এবং অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বস্তুবাদী দার্শনিকগণ অস্তিত্ত্বের এই ভাববাদী ব্যাখ্যাকে বিজ্ঞানের ভিত্তিতে খন্ডন করেন।
Opium War : আফিম যুদ্ধ
চীনের আধুনিক ইতিহাসে আফিং যুদ্ধ কথাটিও ঘটনা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্যের নানা শক্তি ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য তাদের নৌবহর ইত্যাদি নিয়ে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। চীনের আফিং এর চাষ খুব লাভজনক বলে পাশ্চাত্য শক্তিসমূহ বিবেচনা করে। চীনা সরকার চীনের সঙ্গে অবাধে চীন থেকে আফিং সংগ্রহে বাধাদানের চেষ্টা করে। এ নিয়ে চীনের সঙ্গে পাশ্চাত্য শক্তির সংঘর্ষ এক পর্যায়ে যুদ্ধের রূপ গ্রহণ করে। এই সংঘর্ষই আফিং যুদ্ধ বলে অভিহিত হয়। আফিং কেনা বেচার এই যুদ্ধ ১৮৪২ পর্যন্ত চলে।