Optimism and Pessimism : আশাবাদ এবং নিরাশাবাদ
ঘটনার মূল্যায়নে মানুষ যে দুটি পরস্পর বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারে তাদের আশাবাদ এবং নিরাশাবাদ বলা হয়। ব্যক্তি এবং সমাজের জীবনে যে কোনো ঘটনার তাৎপর্য আছে। সমাজের ঘটনাপুঞ্জ দিয়ে ইতিহাস তৈরি হয়। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যক হচ্ছে সংঘটিত ঘটনাপুঞ্জের তাৎপর্য বিশ্লেষণ। এই বিশ্লেষণ সাধারণভাবে দুটি মনোভঙ্গি নিয়ে মানুষ করে এসেছে। ইতিহাসের বিবর্তনকে কোনো মানুষ সমাজের জন্য মঙ্গলকর বলে মনে করতে পারে। অপর একজন তাকে অমঙ্গলকর বলে ধারণা করতে পারে। অবশ্য ইতিহাসের এই মঙ্গলকর বা আশাবাদী এবং অমঙ্গলকর অর্থাৎ নিরাশাবাদী ব্যাখ্যা একজন ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার দ্বারাই নির্ধারিত হয় না। প্রকৃতি জগতের ন্যায় সমাজ ও নিরন্তর শ্রেণীর দ্বন্ধ,-নতুন ও পুরাতনের বিরোধ চলে আসছে। এই দ্বন্ধে যে ব্যক্তি বা যে শ্রেণী নতুনের পক্ষভুক্ত, ঘটনার ব্যাখ্যা তার হাতে অবশ্যই আশাবাদী হতে বাধ্য। অপর দিকে যে ব্যক্তি সচেতন কিংবা অচেতনভাবে পুরাতনের পক্ষভুক্ত, তার ব্যাখ্যা নিরাশাবাদী হতে বাধ্য। ইতিহাসের যে কোনো পর্যায়কেই যে কেবল আশাবাদী কিংবা নিরাশাবাদী দৃষ্টিকোণ হতে দেখা যায়, তাই নয়। ইতিহাসকে সামগ্রিকভাবেও আশাবাদী কিংবা নিরাশাবাদী হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়। মার্কসবাদ ইতিহাসের বিবর্তনকে আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হতে ব্যাখ্যা করে।
‘The Origin of the Family, Private Property and the State’: ‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং রাষ্ট্রের উৎপত্তি’
এই শিরোনামটি ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এর একখানি গ্রন্থের শিরোনাম, এই গ্রন্থ প্রকাশিথ হয় ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। ‘পরিবার’ ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ এবং রাষ্ট্রকে ধনতান্ত্রিক সমাজের সমাজবিজ্ঞানীগণ মানুষের জীবনের অপরিহার্য এবং চিরন্তন সংস্থা বলে প্রচার করে আসছিল। মার্কসবাদ সর্বপ্রথম সমাজের এরূপ ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করে। সমাজের বিকাশের মার্কসবাদী ব্যাখ্যার প্রকাশ ঘটেছে এঙ্গেলসের বর্তমান পুস্তকে। আমেরিকার বস্তুবাদী সমাজবিজ্ঞানী লিউস হেনরী মর্গানও তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্রাচীন সমাজ’-এ মানুষের আদি অবস্থা থেকে তার সংগঠনগত বিকাশের পর্যায়সমূহকে প্রচুর তথ্য সহকারে তুলে ধরেছিলেন। উক্ত তথ্যসমূহের উপর ভিত্তি করে এবং আধুনিক বিজ্ঞানের অপরাপর গবেষণার সাহায্যে এঙ্গেলস তাঁর উল্লেখিত গ্রন্থে প্রথমে মানুষের আদি সাম্যবাদী অবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করেছেন। মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার বিবাহ এবং পারিবারিক বন্ধনের রীতি প্রকৃতিও যে বিবর্তিত হয়েছে, সে তথ্য এঙ্গেলস এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন। প্রাচীন গ্রিক, রোমান এবং টিউটন সমাজের পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত দ্বারা এঙ্গেলস প্রাচীন গোত্রতান্ত্রিক সমাজের ক্ষয়ের ধারাকে বিশ্লেষণ করে। মানুষের শ্রমের উৎপাদনী ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্রম বিভাগের মধ্য দিয়ে সমাজে দ্রব্যের বিনিময় প্রথা এবং তার পরিণামে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব ঘটে। এই বিবর্তনে কৌম সমাজের ক্ষয় ঘটে এবং অর্থনীতিক শ্রেণীরও সৃষ্টি হয়। সমাজের অর্থনৈতিক উৎপাদনের বিকাশে যখন পরস্পর বিরোধী স্বার্থসম্পন্ন আর্থনীতিক শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে, তখনি শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থে আবশ্যক হয়েছে বিধিবিধান প্রণয়নকারী ও রক্ষাকারী এক সংস্থার। এই সংস্থার নাম রাষ্ট্র। কাজেই এঙ্গেলসের মতে : ১. পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং রাষ্ট্র – এগুলি মানুষের সমাজে কোনো চিরন্তন সংস্থা নয়। অর্থনীতির বিকাশের একটা পর্যায়ে এই সমস্ত সংস্থার উদ্ভব ঘটেছে। ২. রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রভু শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার হওয়া। দ্বন্ধমান সমাজে প্রভু শ্রেণীর প্রয়োজন জোর জবরদস্তির মারফত শোষিত শ্রেণীকে দমিত করে রাখা। রাষ্ট্রের আইন এবং পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা-অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কাঠামো হচ্ছে সেই জবরদস্তি কার্যকর করার মাধ্যম বা যন্ত্র। ৩. সমাজ অনড় এবং অপরিবর্তনীয় নয়। সমাজের অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে। শোষক এবং শোষিত হিসাবে মানুষের শ্রেণীবিভাগ ঐতিহাসিক ঘটনা হলেও তা অবিনশ্বর নয়। সমাজের বিকাশের পরিণামে একদিন শ্রেণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে। একদিন যেমন তার উদ্ভব ঘটেছিল, তেমনি আর একদিন তার বিলোপ ঘটবে। সমাজ আবার শোষক শোষিত শ্রেণীমুক্ত সাম্যবাদী সমাজে পরিণত হবে। সেদিন শোষকশ্রেণী থাকবে না এবং তার স্বার্থরক্ষার জন্য কোনো অত্যাচারমূলক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন থাকবে না। আর তাই সেদিন রাষ্ট্রও অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে। আস্তে আস্তে অত্যাচারমূলক প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
Owen, Robert : রবার্ট ওয়েন(১৭৭১-১৮৫৮ খ্রি.)
রবার্ট ওয়েন ছিলেন একজন ইংরেজ কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী। তার জন্ম একটি সাধারণ কারিগর পরিবারে। কিশোর বয়স থেকেই ওয়েন নিজের জীবিকা নিজে উপার্জন শুরু করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি বৃহৎ আকারে পুঁজিবাদী শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্বও পালন করেন। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার শোষণ এবং অসঙ্গতির বিষয়ে রবার্ট ওয়েনের গভীর এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। এক্ষেত্রে তিনি অন্যান্য কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী চিন্তানায়কদের থেকে পৃথক ছিলেন। শিল্পবিপ্লবে জাত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকদের অমানুষিক শোষণকে ওয়েন তীব্রভাবে সমালোচনা করেন। শ্রমিকদের জন্য তাঁর সহানুভূতি এবং দরদ ছিল আন্তরিক। এই মনোভাব থেকে শোষিত শ্রমিকের মঙ্গলের জন্য তিনি নানা দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার চেষ্টা করেন এবং মানবতাসূচক কারখানা আইনেরও তিনি উৎস ছিলেন। রবার্ট ওয়েন বুঝতে পেরেছিলেন এই শোষণের মূলে আছে সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা। ধর্ম এ শোষণকে সমর্থন করে। এ কারণে ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং ধর্ম উভয়েরই তিনি সমালোচনা করেন। বুর্জোয়া বিবাহ প্রথারও তিনি বিরোধী ছিলেন। রবার্ট ওয়েন ছিলেন যুক্তিবাদী এবং নিরীশ্বরবাদী। মানুষের চরিত্র র্নিধারণে প্রধান ভূমিকা হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থার। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ব্যতীত শোষকের চরিত্র পরিবর্তন করা কিংবা শোষিতকে শোষণমুক্ত স্বাধীন সৃজনশীল মানুষে পরিণত করা সম্ভব নয়। কিন্তু এখানে প্রশ্ন উঠে: সমাজের পরিবর্তন কিভাবে সংঘটিত হবে? বিপ্লবের মাধ্যমে না মহৎ শিক্ষার ফলে? ওয়েন শ্রমিক দরদি হয়েও সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তনে বিপ্লবের ভূমিকা অনুধাবন করতে পারেন নি। তাঁর মতে শিক্ষাই হচ্ছে সামাজিক পরিবর্তন সাধনের মূল উপায়। ধনিক যে শ্রমিককে অন্যায়ভাবে শোষণ করে তার প্রধান কারণ সে তার এই অন্যায় সম্পর্কে অজ্ঞ। মহৎ শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে ন্যায় অন্যায়ের নতুন নীতিবোধ তৈরি করতে হবে। শিক্ষাকে পরিবর্তনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে ওয়েন প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক নতুন ভাব প্রবর্তন করার চেষ্টা করেন। শোষণমুক্ত ভবিষ্যৎ জগৎ কল্পনা করে ওয়েন বলেন যে, ভবিষ্যতে কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থাকবে না। মানুষের সমাজ হবে তিন শত থেকে দু হাজার সংখ্যার এক একটি স্বায়ত্বশাসিত জনসমাজের স্বেচ্ছা সম্মেলন। কাল্পনিক সমাজবাদী চিন্তানায়কদের মধ্যে ওয়েনের ন্যায় শ্রমিক ও সমবায়ী আন্দোলনের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী চিন্তাবিদের সাক্ষাৎ খুব কমই মিলে। শ্রমিক শ্রেণীর ঐতিহাসিক ভূমিকা যথাযথভাবে অনুধাবনে অক্ষম হলেও রবার্ট ওয়েন সব সময়ই শ্রমিক আন্দোলনের অবিচেক সমর্থক ছিলেন।
Panchatantra : পৌরাণিক উপন্যাস
প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের গল্প এবং রূপকথার একটা বড় উৎস ছিল ‘পঞ্চতন্ত্র’ নামের উপাখ্যানগুলি।
Pantheism : সর্বেশ্বরবাদ
সর্বেশ্বরবাদ হচ্ছে একটি দার্শনিক অভিমত। এই মত অনুযায়ী ঈশ্বর বলতে বিশ্বজগতের বাইরের কোনো শক্তি বুঝায় না। ঈশ্বর নৈর্ব্যক্তিক বটে। কিন্তু ঈশ্বর বিশ্বের বাইরের নয়। বিশ্ব বা প্রকৃতিজগৎই ঈশ্বর। সবকিছুতেই ঈশ্বর। সবকিছুই ঈশ্বর। কাজেই সর্বেশ্বরবাদের ঈশ্বর অতিপ্রাকৃতিক কোনো সত্তা নয়। প্রকৃতিই ঈশ্বর। অবশ্য সর্বেশ্বরবাদেরও বিকাশ ঘটেছে। সর্বেশ্বরবাদের এই ব্যাখ্যা যেমন বস্তুবাদী তেমনি পরবর্তীকালে সর্বেশ্বরবাদের ভাববাদী ব্যাখ্যাও ঘটেছে। এই ব্যাখ্যায় প্রকৃতিকে ঈশ্বর না বলে ঈশ্বরকে প্রকৃতি বলা হয়। অর্থাৎ প্রকৃতির অস্তিত্বের একটা যুক্তি থাকা আবশ্যক মনে করে ভাববাদী দার্শনিকগণ বলেছেন প্রকৃতির কারণ হচ্ছে ঈশ্বর। কিন্তু ঈশ্বর যে প্রকৃতির বাইরে থেকে তাকে সৃষ্টি করেছে, এমন নয়। ঈশ্বরের অস্তিত্বের মধ্যেই প্রকৃতির অস্তিত্ব বিদ্যমান।
Papacy : পোপতন্ত্র
পোপের দরবার। পোপকে রোমের বিশপ বলা হয়। এ পদবির উৎপত্তি ঘটেছে গ্রীক পাপাস এবং ল্যাটিন পাপা থেকে। এই পাপার উৎপত্তি ফাদার বা পিতা থেকে। গোড়াতে অনেক বিশপ বা পাদ্রীকে পোপ বলা হত। ক্রমশ পাশ্চাত্যে এই পদবী রোমের বিশপের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে থাকে। কিন্তু সপ্তম পোপ গ্রেগরি কেবলমাত্র রোমের বিশপের ক্ষেত্রে পোপ শব্দ আরোপ যোগ্য বলার হুকুম দেন।
Pareto : পারেতো (১৮৪৮-১৯২৩ খ্রি.)
এলিট বা শ্রেষ্ঠবাদের প্রবক্তাদের অন্যতম হচ্ছেন ইতালির লেখক ভিলফ্রেডো পারেতো। তাঁর পরিচিত একখানি গ্রন্থের নাম ‘দি মাইন্ড এন্ড সোসাইটি’। এলিটবাদের অপর এক প্রবক্তা ছিলেন ইতালিরই মসকা (গায়তানো মসকা : ১৮৫৮-১৯৪১)। তাঁর পরিচিত গ্রন্থের নাম ‘দি রুলিং ক্লাস’। একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ইউরোপে ধনতন্ত্রবাদের পূর্ণতর বিকাশ একদিকে যেমন নানা আর্থিক ও সামাজিক সংকটের সৃষ্টি করেছিল তেমনি অপরদিকে শোষিত শ্রেণীসমূহের মধ্যে চেতনার বিস্তার ঘটছিল। এই সময় কলকারখানাগুলিতে শ্রমিক শ্রেণীর জীবনধারণের সঙ্গে যুক্ত শ্রমের সময়, কাজের নিরাপত্তা, মজুরি বৃদ্ধি প্রভৃতি দাবির ভিত্তিতে জঙ্গি আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। এসব আন্দোলন সমাজতান্ত্রিক দর্শন ও সংগঠনের নেতৃত্বে সাধারণ অর্থনৈতিক চরিত্র অতিক্রম করে রাজনৈতিক চরিত্র ধারণ করতে থাকে। এরই একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রকাশ ঘটে ১৮৭১ সনে প্যারিসের শ্রমিক অভ্যুত্থানে এবং শ্রমিকদের কম্যূন শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টায়। তাঁদের এমন অভ্যুত্থান পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার হাতে নির্মমভাবে দমিত হয়। কিন্তু এসব ঘটনাতে পুঁজিবাদী চিন্তাবিদদের একাংশের মধ্যে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামী দর্শনের পাল্টা হতাশবাদী দর্শন তৈরির প্রয়োজন বোধ দেখা দেয়। ক্রমবর্ধমান সংকট থেকে পুঁজিবাদকে রক্ষার অন্যতম আদর্শগত উপায় হিসাবে সমাজ বিকাশের এবং সমাজ প্রগতির প্রশ্নে সচেতনভাবে হতাশা সৃষ্টির এরা চেষ্টা করে। সংখ্যার চেতনা বা শক্তির কোনো মূল্য নেই। সাধারণ তথা নিষ্পেশিত মানুষ সংখ্যায় যত অধিকই হোকনা কেন এবং গণতন্ত্র বা সাম্যবাদের তারা যত আন্দোলনই করুক না কেন, তাদের নিয়তি হচ্ছে সংখ্যালঘু দ্বারা নির্যাতিত হওয়া। মানব সমাজ দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। একটা হচ্ছে সংখ্যালঘু অপরটি হচ্ছে সংখ্যাগুরু। সংখ্যাগুরুরা সাধারণ। তাঁরা সংখ্যালঘুদের কূটবুদ্ধিতে, দক্ষতায়, বাগ্মীতে, প্রতিশ্রুতিতে বিভ্রান্ত এবং মোহিত হয় এবং সংখ্যালঘু দ্বারাই শাসিত হয়। রবার্ট মিশেল(১৮৭৬-১৯৩৫) তাঁর ‘পলিটিক্যাল পারটিস’ গ্রন্থে ‘আয়রন ল অব অলিগারিটি’ বা ‘সংখ্যালঘুর শাসনের অনিবার্য বিধান’ বলে তত্ত্ব প্রচার করেন। উল্লেখিত লেখকদের রচনায় সমাজের আর্থিক অবস্থা এবং বিকাশের বিশ্লেষণ শূণ্য কিছু নতুন রাজনৈতিক পদ তৈরি করে রাজনৈতিক বিধি ব্যবস্থাকে রহস্যজনক এবং বাঞ্জনীয় কোনো পরিবর্তনের উর্ধ্বে, এরূপ দেখাবার প্রবণতাই অধিক। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর ইউরোপে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভবে এই সমস্ত চিন্তাবিদদের চিন্তা উর্বর উৎসভূমি হিসাবে কাজ করেছে।
Parmenides : পারমিনাইডিস (৬০১-৫ম খ্রি.পূর্ব শতাব্দী)
পারমিনাইডিস ছিলেন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক। কিন্তু তাঁর জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ ইতালির এলিয়া শহরে। এজন্য পারমিনাইডিসকে ‘এলিয়াটিক’ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। পারমিনাইডিস মনে করতেন বিশ্ব হচ্ছে অনড় এবং নিশ্ছিদ্র অবিভাজ্য এক সত্তা। পারমিনাইডিস সত্য মিথ্যার যে তত্ত্ব দাঁড় করান তাতে সত্য হচ্ছে অবিনশ্বর, অবিভাজ্য এবং অপরিবর্তনীয়। আর মিথ্যা হচ্ছে বহু, নশ্বর, বিভাজ্য ও সতত পরিবর্তনশীল। পারমিনাইডিসের এই তত্ত্ব স্পষ্টতইঃ হিরাক্লিটাসের দ্বান্ধিক এবং গতিতত্ত্বের বিরোধী। তার তত্ত্বে ভাববাদ এবং যুক্তিবাদের আভাস পাওয়া যায়। সত্তার গতিহীনতার কথা পারমিনাইডিসিই প্রথম জোরের সঙ্গে উত্থাপন করেন। ইতঃপূর্বের গ্রিক দর্শনের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাকৃতিক জগতের সঙ্গে তার নৈকট্য এবং বস্তুর দৃষ্ট গতি এবং পরিবর্তনকে যথার্থ মনে করা। পারমিনাইডিস গতি ও পরিবর্তনকে অস্বীকার করে প্রাচীন দর্শনে অধিবিদ্যার অতিন্দ্রিয়তার সূত্রপাত করেন।
Patriarchy : পিতৃতন্ত্র
মানুষের সামাজিক বিকাশের একটি ঐতিহাসিক পর্যায় হচ্ছে পিতৃতন্ত্র। মানুষের আদিম সামাজিক সংগঠন ছিল সাম্যবাদী ও মাতৃতান্ত্রিক। পশু শিকারের পরবর্তী পর্যায়ে পশুপালন ও কৃষিকাজ যখন জীবিকার প্রধান উপায় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে তখন মানুষের সামাজিক সংগঠনেও একটা পরিবর্তন সূচিত হয়। ইতঃপূর্বে জীবিকার অধিকতর দুর্বল অবস্থার জন্য এবং পারিবারিক জীবনের অস্থিরতা এবং অসংবদ্ধতার কারণে সন্তানের জননী ছিল বংশের পরিচয় সূচক। এই পর্যায়কে বলা হয় মাতৃতন্ত্র। অর্থনীতির পরিবর্তিত পর্যায়ে মাতৃতন্ত্রের স্থানে পিতার অধিকার জীবিকার্জনে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতে থাকেএ। ্েএএককা এই পর্যায়ে শ্রমের বিভাগ শুরু হয়। পশুপালন ও কৃষিকাজের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ গৃহপালিত পশু এবং ক্ষেত্রের কৃষিকাজের দায়িত্ব গ্রহণ করতে শুরু করে। দ্রব্যবিনিময়ের ব্যবস্থাও ইতোমধ্যে বেশ বিকাশ লাভ করেছে। পশুর বিনিময়ে অন্য মানুষকে দাস হিসাবে লাভ করাও শুরু হয়েছে। পিতৃতন্ত্রের এই পর্যায়ে নারী পুরুষের বিবাহের সম্বন্ধের ধারাও পরিবর্তিত হয়। মাতৃতান্ত্রিক যুগে যৌথ বিবাহ কিংবা এক নারীর বহু স্বামী প্রথাই প্রধান ছিল। বর্তমান পর্যায়ে যৌথ বিবাহের স্থলে যুগ্ম বিবাহ চালু হতে শুরু করে। এখন থেকে পরিবারের এবং সন্তানের মালিক হয়ে দাঁড়ায় পিতা। বংশের সূচকও হয় পিতা। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের লোকসংখ্যা কম হতো না। যুগ্ম বিবাহ মানে এক পত্নীক বিবাহ নয়। পুরুষ একাধিক পত্নী বিবাহ করতে পারত। এবং যে কাউকে বর্জনও করতে পারত। এই পর্যায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, পুরুষই পরিবারের নিয়ন্ত্রক। পুরুষের সন্তানসন্ততি নিয়ে গোত্র তৈরি হতো; উৎপাদনের উপায়, বিনিময় এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকতর বিকাশে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ক্রমে এক পত্নীক পরিবারের রূপ গ্রহণ করে।
Pavlov : পাভলভ (১৮৪৯–১৯৩৬ খ্রি.)
আইভান পেট্রভিচ পাভলভ ছিলেন রুশদেশের একজন বিখ্যাত প্রকৃতি বিজ্ঞানী। বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। পাভলভের প্রধান খ্যাতি কুকুরের রিফ্লেক্স এ্যকশন বা প্রতিবর্ত ক্রিয়ার গবেষণাকে কেন্দ্র করে। এই গবেষণার মাধ্যমে পাভলভ মানুষ এবং পশুর মস্তিষ্কের সঙ্গে বাইরের উত্তেজকের সম্পর্কের বিধান আবিষ্কার করেন। পাভলভের প্রতিবর্তক্রিয়ার তত্ত্বের ভিত্তিতে আধুনিক মনোবিজ্ঞানে বস্তুবাদী এবং আচরণবাদী গবেষণা ও ব্যাখ্যা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
Pentagon : পেন্টাগন
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ দপ্তর (ভারজিনিয়ার আরলিংটন শহরে অবস্থিত)। এরূপ মনে করা হয় যে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এর যত না অধীন পেন্টাগন, তার অধিক পেন্টাগনের অধীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। সংখ্যাগতভাবে পেন্টাগন দ্বারা পঞ্চ বা পঞ্চ বাহুও বুঝানো হয়।
Pentagon Papers : পেন্টাগন পত্রাবলী
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র পলিসির গোপন দলিলপত্র। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মার্কিন নীতির সূত্রসমূহ। গোপন এই দলিলপত্র সরকারকেই একজন কর্মচারী নিজের বিবেক বোধ থেকে ফাঁস করে দেওয়াতে জনসাধারণ এই সব দলিলের বেশ পরিমাণ সম্পর্কে পরিচয় লাভ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠিত হয় এবং মার্কিন যুদ্ধনীতির প্রকাশ এবং সামরিক আক্রমণের নীতি অধিকতর প্রকাশ্যভাবে পরিচালনার দাবী বৃদ্ধি পেতে থাকে।
People : জনতা
সাধারণভাবে কোনো রাষ্ট্র বা দেশের সমস্ত জনসংখ্যাকে জনতা বলা হয়। কিন্তু বর্তমানকালে জনতা শব্দের একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। মার্কসবাদী রাজনীতিক তত্ত্বে জনতা দ্বারা সমগ্র জনসংখ্যাকে বুঝানো হয় না। মার্কস জনতা বলতে কোনো দেশ বা সমাজেই সেই জনসংখ্যাকে বুঝিয়েছেন যে জনাংশ তার অর্থনীতিক এবং ঐতিহাসিক অবস্থানের কারণে সমাজকে বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নততর ভবিষ্যৎ অবস্থায় নিয়ে যেতে সক্ষম। মার্কসবাদের মতে সমাজে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেওয়ার পূর্বকালেই মাত্র জনসংখ্যা এবং জনতা সমার্থক ছিল। কিন্তু সমাজে শোষক এবং শোষিত শ্রেণীর উদ্ভব হওয়া থেকে যে কোনো যুগে কিংবা দেশে জনতা বলতে জনসংখ্যার শোষিত অংশকে বুঝায়। সমাজের বিকাশের কোনো একটা বিশেষ সামাজিক অবস্থার মধ্যে যখন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত হয় তখন জনসংখ্যার সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসেরও পরিবর্তন ঘটে। এক যুগে কিংবা এক পর্যায়ে যে জনতা শোষিত বলে পরিগণিত হয়েছে, পরবর্তীযুগে সে জনতা আর শোষিত না থাকতে পারে। এমন পরিবর্তিত অবস্থায় জনতা বলতে পূর্বের চেয়ে ভিন্নতর জনাংশকে বুঝাবে। এই বিচারের ভিত্তিতে সামন্তবাদী যুগে অগ্রসর শক্তি হিসাবে জনতার মধ্যে বিকাশমান পুঁজিবাদী শ্রেণীও ছিল। কিন্তু পুঁজিবাদী পরিবর্তন সম্পন্ন হওয়ার পরে পুঁজিবাদী শ্রেণী পরিপূর্ণরূপে শোষক এবং সামগ্রিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিতে পরিণত হওয়াতে জনাংশের এই অংশকে আর জনতার অন্তুর্ভুক্ত করা চলে না। এই যুগে জনতা হচ্ছে বৈপ্লবিক চেতনাসম্পন্ন সর্বাধিক পরিমাণে শোষিত, কারখানার শ্রমিক এবং তার সহযোগী শোষিত গরিব কৃষক ও মধ্যবিত্ত। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণীহীন সমাজ সৃষ্টির সূচনায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনসংখ্যা আর জনতা পুনরায় সমার্থক হয়ে দাঁড়াবার সম্ভাবনা প্রাপ্ত হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অর্থনীতিকভাবে কোনো শোষক শ্রেণীর অস্তিত্ব নেই। তাই সেখানে জনতা বলতে সমাজের সমস্ত অধিবাসীকেই বুঝায়।
Peoples Democracy : জনগণতন্ত্র
ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যবর্তী পর্যায়কে আজকাল জনগণতন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বে, এমনকি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্য্ন্ত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সাধারণভাবে গৃহীত মত এই ছিল যে, বিপ্লবের মাধ্যমে ধনতন্ত্র উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শান্তিপূর্ণভাবে এবং পার্লামেন্টারি বা পরিষদীয় গণতন্ত্রের মারফত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা গৃহীত হতো না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যে পূর্ব জার্মানীসহ পূর্ব য়ুরোপের কয়েকটি দেশ সোভিয়েত সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্যে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের হাত হতে মুক্তি লাভ করে। ফ্যাসি-বিরোধী মুক্তিযুদ্ধে এই সমস্ত দেশে এমন একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠে যার নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণীর হলেও তার মধ্যে কেবল শ্রমিক ও কৃষক নয়, জাতীয় ধনিক শ্রেণীরও একটি বৃহৎ অংশ যোগদান করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে এরূপ সার্বিক ঐক্য গঠিত হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। ভারতবর্ষ যখন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত ছিল তখন তার আন্দোলনেও সর্বশ্রেণীক চরিত্র প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু সাধারণ মুক্তি আন্দোলনের জাতীয় ঐক্যের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে পূর্বয়ুরোপীয় জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বেশ কয়েকটি পার্থক্য ছিল। পার্থক্যগুলিকে এভাবে চিহ্নিত করা চলে। ১. রাষ্ট্রীয়ভাবে যে আন্তর্জাতিক শক্তি এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সহায়ক ছিল সে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত দেশ, কোনো ধনতান্ত্রিক দেশ নয়। ২. জাতীয় মুক্তি মোর্চায় শ্রমিক শ্রেণী কেবল অংশীদার ছিল না। শ্রমিক শ্রেণীই এই জাতীয় মুক্তি মোর্চায় সর্বাগ্রে এবং সর্বাধিক সশস্ত্র সংগ্রামী নেতা ছিল। ৩. শ্রমিক শ্রেণী এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আদর্শে সংগঠিত কমিউনিস্ট পার্টি এই মুক্তি মোর্চার নেতৃত্ব দিয়েছে। ৪. জাতীয় পুঁজিবাদী শ্রেণীর সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশ ফ্যাসিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদে সহযোগী শক্তি হিসাবে জনসাধারণের কাছে চিহ্নিত এবং মুক্তিযুদ্ধের সফল অগ্রগতিতে দৈহিকভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াতে পুঁজিবাদ এবং সামন্ততন্ত্রের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি জাতীয় ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সমস্ত কারণে পূর্ব য়ুরোপের কয়েকটি দেশে যুদ্ধশেষে সরাসরি সমাজতন্ত্র কায়েম না হলেও, শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে অপরাপর জাতীয় শ্রেণীর সহযোগিতায় গঠিত রাষ্ট্রীয় কাঠামো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে অবারিত করে দেয়। রাষ্ট্রীয় কাঠামো কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বমূলক না হওয়াতে, অপরাপর শ্রেণীতে উহার অংশ থাকাতে এবং অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ আকারে ব্যক্তিগত মালিকানার অস্তিত্ব থাকাতে এই পর্যায়কে সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিকগণ নয়াগণতন্ত্র বা জনগণতন্ত্র বলে অভিহিত করতে শুরু করেন। চীন এবং এশিয়ার অপর কয়েকটি দেশে মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখিত চরিত্রের কারণে সমাজতন্ত্রের পূর্ববর্তী স্তর হিসাবে জনগণতন্ত্র বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্রীয় এবং অর্থনীতিক ব্যবস্থা। ১৯৭১ সনে বাংলাদেশের সফল মুক্তি আন্দোলনেও জনগণতন্ত্রের বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আত্মপ্রকাশ করেছিল বলে অনেকে মনে করেন।
Peripatetics : পেরিপ্যাটেটিক, এরিস্টটলীয়
গ্রিক শব্দ ‘পেরিপ্যাটেটিকস’ থেকে পেরিপ্যাটেটিক শব্দের উৎপত্তি। শব্দটির অর্থ ছিল চলমান অবস্থাতে কিছু করা। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল তাঁর লাইস্যুম দর্শনাগারে পদচারণা করতে করতে দর্শনের সমস্যাদি নিয়ে আলোচনা করতেন কিংবা বক্তৃতা দিতেন। এ কারণে তাঁর অনুসারীগণকে চলমান বা পেরিপ্যাটেটিক বলে অভিহিত করা হতো। এ্যারিস্টটলের প্রতিষ্ঠিত দর্শনাগার প্রায় এক হাজার বছর পর্যন্ত প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রচার কেন্দ্ররূপে কার্যকর ছিল। এর কার্যকালকে সাধারণত ৩৩৫ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ৫২৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত বলে মনে করা হয়। িএ্যরিস্টটলের মৃত্যুর পরে এই দর্শনাগারের সঙ্গে তাঁর যে সমস্ত অনুসারী যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে থিওফ্রাস্টাস, স্ট্রাটো, এ্যড্রোনিকাস এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
Personality Cult : ব্যক্তিবাদ, ব্যক্তিত্বের বিকার, ব্যক্তিপূজা
রাজনীতিক দল কিংবা আন্দোলনের মধ্যে জনপ্রিয় নেতা নিজের ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সচেতনভাবে অপর সকলকে মোহগ্রস্ত এবং বাধ্য করার চেষ্টা করলে ব্যক্তিত্বের বিকার জন্মলাভ করে। আধুনিককালের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংগঠিত দলের যে অসীম ক্ষমতা, তাতে দলের জনপ্রিয় নেতার মধ্যে এই ত্রুটি প্রকাশের বিশেষ সম্ভাবনা থাকে। লেনিনের মৃত্যুর পরে স্টালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কমিউনিস্ট পার্টি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আদর্শে কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত সংগ্রামী সংগঠন। কেন্দ্রিয় কমিটি এবং যৌথ নেতৃত্বের ভিত্তিতে এই দল পরিচালিত হলেও দলের সাধারণ সম্পাদকের পদটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। স্টালিন তাঁর সুদৃঢ় নেতৃত্বের মাধ্যমে নিজেকে অস্বাভাবিকভাবে জনপ্রিয় করে তোলেন। ক্রমান্বয়ে দলে যৌথ নেতৃত্বের বদলে দলের অনুসারীগণ সকল সাফল্যের মূল হিসেবে স্ট্যালিনের স্তুতিবাদ শুরু করেন। স্টালিনের জীবিতাবস্থায় সমালোচনা করার সাহস না পেলেও ১৯৫৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে অনুষ্ঠিত পার্টির বিংশতি কংগ্রেসে ১৯৫৬ সালে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ক্রুশ্চেভ স্টালিনের ব্যক্তিত্ববাদের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি এরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, স্ট্যালিন তাঁর নিজের একক নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য সংগঠনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি লংঘন করেছেন এবং অমানুষিক দমননীতি প্রয়োগ করে বহুদলীয় কর্মী এবং নেতার অভিমত স্তব্ধ করেছেন-এমনকি তাঁর নির্দেশে অন্যায়ভাবে অন্যায়ভাবে অনেকের জীবন নাশ করা হয়েছে। ক্রুশ্চেভের এই সমালোচনায় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। যাকে এতদিন প্রায় অভ্রান্ত মনীষী বলে বিশ্বের কমিউনিস্ট অনুসারীগণ ভক্তি ও শ্রদ্ধ করে আসছিল ক্রুশ্চেভের বর্ণনায় তিনি অমানষিক নির্যাতনকারী এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিকারগ্রস্থ ডিক্টেটর বলে প্রতিভাত হন। বস্তুর স্টালিনের মৃত্যুর পরে তাঁর এরূপ সমালোচনা একদেশদর্শী এবং প্রতিপক্ষের জবাবহীন সমালোচনা ছিল। এই সমালোচনায় বৈজ্ঞানিক ভারসাম্যের অভাব ছিল। কিছুকাল পরে ক্রুশ্চেভও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব হতে অপসারিত হন। কারণ কমিউনিস্ট অনুসারীগণ ব্যক্তিত্ববাদের সমালোচনাকারী ক্রুশ্চেভের চরিত্রের মধ্যে অতি আত্মবিশ্বাসী এবং মোহবিস্তারকারী প্রগলভতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অন্যান্য লক্ষণের প্রকাশ দেখতে শুরু করেছিলেন। সোভিয়েত রাষ্ট্রের রাজনীতিক নেতৃবৃন্দের সাম্প্রতিককালে স্ট্যালিনের যথাযথ মূল্যায়নের চেষ্টা করছেন বলে মনে হয়। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ‘সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে স্ট্যালিনের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে. দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সঠিক নেতৃত্বদান ও বিজয় অর্জন পর্যন্ত স্ট্যালিনের চরিত্রে মারাত্মক কোনো ত্রুটি দেখা দেয় নি। কিন্তু যুদ্ধপরবর্তীকালে স্ট্যালিনের চরিত্রে অভ্রান্তি এবং বিরাটত্বের ত্রুটি প্রকাশ পেতে আরম্ভ করে।
স্ট্যালিনের একদেশদর্শী সমালোচনার মূলে ছিল সমাজতন্ত্রের আদর্শকে আঘাত করার একটি গূঢ় ইচ্ছা। এই ইচ্ছার পরবর্তী প্রকাশ ঘটে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমাজতন্ত্রের বিরোধী শক্তির সোভিয়েত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে আক্রমণে। এর পরিণতিতে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতন সংঘটিত হয় নব্বই এর দশকে।
Philosophy : দর্শন
জগৎ, জীবন, মানুষের সমাজ, তার চেতনা এবং জ্ঞানের প্রক্রিয়া প্রভৃতি মৌল বিধানের আলোচনাকে দর্শন বলা হয়। মানুষের সামাজিক চেতনার বিকাশের একটা পর্যায়েই মাত্র মানুষের পক্ষে বিশ্লেষণী দৃষ্টি নিয়ে জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে চিন্তা করা সম্ভব হয়েছে। মানুষ তার নিজের উদ্ভব মুহুর্ত থেকেই চিন্তার এরূপ ক্ষমতা দেখাতে সক্ষম ছিল না। মানুষের চেতনার বিকাশের একটা স্তরে মানুষ তার পরিবেশ সম্পর্কে চিন্তা করতে আরম্ভ করে। নিজের জীবনকে অধিকতর নিশ্চিত করে রক্ষা করার প্রয়োজনে মানুষ প্রকৃতি জগতের রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করে। প্রকৃতি, জগৎ এবং পরবর্তীকালে মানুষের নিজের দেহ এবং চেতনা সম্পর্কেও সে চিন্তা করতে শুরু করে। আদিকালে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি খুব অধিক ছিল না। দর্শন ই আদি জ্ঞানের মূল ভান্ডার। জগৎ ও জীবনের প্রত্যেকটি সমস্যা মানুষের কাছে প্রশ্ন আকারে উত্থাপিত হয়। যে প্রশ্নই উপস্থিত হোকনা কেন মানুষ তার একটা জবাব দিয়ে প্রকৃতিকে বশ করার চেষ্টা করেছে। তাই আদি দর্শন একদিকে যেমন সমস্ত জ্ঞানের ভান্ডার তেমনি আবার তার মধ্যে সমস্যার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিত্তিতে সমাধানের বদলে কাল্পনিক সমাধানের সাক্ষাৎ অধিক মেলে। কালক্রমে মানুষের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন দার্শনিক কল্পনা বাস্তব জীবনে ভিত্তিহীন প্রমাণিত হলে তার স্থানে অধিকতর সঠিক সমাধান আবিষ্কৃত হতে থাকে। এইভাবে অধিকতর বাস্তব এবং সুনির্দিষ্ট আলোচনা ভিত্তিতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিকশিত হতে থাকে। পূর্বে প্রকৃতি, পদার্থ, সমাজ, চেতনা, যুক্তি, অর্থনীতি, ধর্ম সবই দর্শনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কালক্রমে তাদের প্রত্যেকে এক একটি ভিন্ন বিজ্ঞান বা আলোচনার শাখায় রূপান্তরিত হতে থাকে। এই বিকাশের পরিণামে বর্তমানে দর্শন বলতে কেবলমাত্র কল্পনার উপর নির্ভরশীল কোনো বিষয় আর অবশিষ্ট নেই। তাই দর্শনের প্রাচীন সংজ্ঞা এবং তার বর্তমান পরিস্থিতি এক নয়। সুনির্দিষ্টভাবে মানুষের জ্ঞান বিকশিত হওয়ার পরেও দর্শনকে অনেকে কল্পনার মধ্যে আবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। এই প্রয়াসে দর্শন জীবনের বাস্তব সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কশূণ্য হয়ে পড়ে। যেখানে প্রাচীনকালে জীবনের সমস্যাই দর্শনের বিকাশ ঘটিয়েছে সেখানে আধুনিককালের এরূপ প্রয়াস দর্শনকে জীবনের সঙ্গে সম্পর্কশূণ্য অবাস্তব কল্পনায় পর্যবসিত করেছে। দর্শনের এই সংকটের সুস্পষ্ট নির্দেশ দেন ঊনবিংশ শতকে কার্ল মার্কস। কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলস দর্শনকে জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে বলেন যে, দর্শন হবে জীবন এবং জগৎকে বৈজ্ঞানিক এবং সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। দর্শন হবে বৃহত্তম সংখ্যক মানুষের স্বার্থে জগৎ এবং সমাজকে পরিবর্তিত করার ভাবগত হাতিয়ার। দর্শন অবাস্তব কল্পনা নয়। দর্শন জগৎ ও জীবনের মৌলিক বিধানের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। আর এই ব্যাখ্যারই অপরনাম হচ্ছে দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদের তত্ত্ব।
দর্শন যেমন মানুষের আদি জ্ঞানভান্ডার, তেমনি তার ইতিহাস জ্ঞানের যে কোনো শাখার চেয়ে প্রাচীন। প্রাচীন গ্রিস, ভারত ও চীনে দর্শনের বিস্ময়কর বিকাশের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিন্তু দর্শনের বিকাশকে দেশ বা জনগোষ্ঠী হিসেবে বিভক্ত করার কোনো বিশেষ তাৎপর্য নেই। জীবন ও জগতের সমস্যা নিয়ে চিন্তাই হচ্ছে দর্শন। মানুষের চিন্তা তার সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। এই কারণে মানুষের সমাজ অর্থনীতিক বিকাশের যে প্রধান পর্যায়গুলি অতিক্রম করে এসেছে দর্শনের বিবর্তনেও সেই পর্যায়গুলির প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। এজন্য দর্শনের ইতিহাসকে গ্রিক, ভারতীয়, চৈনিক, প্রাচ্য, পাশ্চাত্য বা ইউরোপীয়, কিংবা হিন্দু, ইসলামি, বৌদ্ধ প্রভৃতি হিসেবে বিভক্ত না করে দাস সমাজের দর্শন, সামন্তবাদী সমাজের দর্শন, পুঁজিবাদী সমাজের এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজের দর্শন হিসাবে বিশ্লেষণ করা শ্রেয়।
জীবন ও জগতের যে কোনো সমস্যাই গোড়াতে দর্শনের আওতাভুক্ত থাকলেও দর্শনের মূল প্রশ্ন হিসেবে বিশ্বসত্তার প্রকৃতি, মানুষের জ্ঞানের ক্ষমতা অক্ষমতার প্রশ্ন, বস্তু ও ভাবের পারস্পরিক সম্পর্ক, মানুষের চিন্তা প্রকাশের প্রকৃষ্ট উপায় বা যুক্তি এবং মানুষের ন্যায় অন্যায় বোধের ভিত্তি ও তার বিকাশের প্রশ্নগুলি প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত দর্শনের নিজস্ব আলোচনার বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। দর্শনের এই মূল বিষয়কে ‘মেটাফিজিকস, অধিবিদ্যা বা পদার্থ-অতিরিক্ত বিদ্যা বলে অনেক সময় অভিহিত করা হয়। প্রাচীনকালের বিশ্বকোষিক এ্যরিস্টটলের আলোচনারাজিকে ফিজিকস, মেটাফিজিকস, লজিক, এথিকস, পলিটিকস পোয়েটিকস, রেটোরিকস প্রভৃতি ভাগে বিভক্ত করা হয়।
Phylosophy of History : ইতিহাসের দর্শন
মানুষের আর্থনীতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিকাশের ইতিহাসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এবং বিধানের আলোচনাকে ইতিহাসের দর্শন বলা হয়। ইতিহাসের দর্শন নিয়ে প্রাচীন জ্ঞানীগণ আলোচনা করলেও একটি নির্দিষ্ট বিষয় হিসেবে ইতিহাসের দর্শনের বিস্তারিত আলোচনা আমরা অষ্টাদশ শতকের ইউরোপীয় চিন্তাবিদ ভলটেয়ার, হারডার, কনডরসেট, মন্টেসক্যূ প্রমুখের মধ্যে বিশেষভাবে দেখতে পাই। ইতঃপূর্বে চতূর্থ শতকের খ্রিষ্টীয় ধর্মজাযক সেইন্ট অগাস্টিনের দেওয়া ইতিহাসের ধর্মীয় অদৃষ্টবাদী ব্যাখ্যাই প্রচলিত ছিল। প্রচলিত এই ব্যাখ্যাকে খন্ডন করে ভলটেয়ার, মন্টেসক্যূ প্রমুখ চিন্তাবিদগণ ইতিহাসের ব্যাখ্যায় সামগ্রিকতা, অগ্রগতি, কার্যকারণ সম্পর্ক এবং ইতিহাসের গতিতে মানুষের ভৌগলিক এবং সামাজিক পরিবেশের প্রভাবের সত্য প্রতিষ্ঠিত করেন। দার্শনিক হেগেল ইতিহাসকে ভাবের স্ববিধানভিত্তিক বিকাশমান সত্তা বলে ব্যাখ্যা করেন। ইতিহাসের এই ভাববাদী ব্যাখ্যার প্রতি ব্যাখ্যা হিসেবে মার্কস এবং এঙ্গেলস ইতিহাসের দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা উপস্থিত করেন। ইতিহাসের ব্যাখ্যায় দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলা হয়। ইতিহাসের দর্শনে আধুনিককালের ভাববাদী ব্যাখ্যাতাদের মধ্যে টয়েনবি এবং স্পেংলারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের ব্যাখ্যায় ইতিহাসের বিবর্তনে অগ্রগতি এবং কার্যকারণের বিধানকে অস্বীকারের প্রবণতা দেখা দেয়।
Philosophy of Antiquity : প্রাচীন দর্শন
পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তাধারাকে প্রাচীন দর্শন বলে চিহ্নিত করা হয়। এই প্রাচীন দর্শনের বিকাশ ঘটে দাসের শোষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত গ্রিক সমাজে খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে। এবং খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রোমের দাসভিত্তিক সাম্রাজ্যে। দর্শনের এই প্রাচীন পর্যায়ের বিস্তার খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত ধরা যায়। এই প্রাচীন পর্যায়ের ইতিহাসের গোড়ার দিকে গ্রিক দর্শনের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রকৃতিবাদী। সক্রেটিসের পূর্বে গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে প্রধান ছিলেন থেলিস, এ্যানাক্সিমেন্ডার, এ্যানাক্সিমেনিস এবং হিরাক্লিটাস। জগৎ ও জীবনের বিভিন্ন প্রশ্নের ব্যাখ্যায় এই সমস্ত দার্শনিক প্রাকৃতিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে এদের ব্যাখ্যায় নানাপ্রকার রূপক, উপাখ্যান এবং কল্পনার সাক্ষাৎ মিললেও এই যুগের দার্শনিকগণ সমস্ত অস্তিত্বের মূল হিসাবে জল, বায়ু, অগ্নি, মাটি প্রভৃতির একটি কিংবা একাধিক বস্তুকে গ্রহণ করেছেন। হিরাক্লিটাসের দর্শন কেবল বস্তুবাদি ছিল না। তাঁর মতে সকল অস্তিত্বের মধ্যে নিরন্তর পরিবর্তন চলছে। পরিবর্তন সত্য; আপাতদৃশ্য স্থিরতা কিংবা পরিবর্তনহীনতা সত্য নয়। কিন্তু অপরিণত বস্তুবাদী চিন্তার বিকাশে ক্রমাণ্বয়ে ভাববাদী বৈশিষ্ট্যেরও উদ্ভব ঘটতে থাকে। সক্রেটিস এবং প্লেটোর দার্শনিক আলোচনায় এক শক্তিশালী ভাববাদী দর্শনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। দাস এবং অপরাপর শ্রমজীবি সাধারণ মানুষের শোষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন নাগরিকদের নগররাষ্ট্রে অসংগতি ও সংকট যত বৃদ্ধি পেতে থাকে তত সক্রেটিস, প্লেটো এবং এ্যরিস্টটলের ন্যায় প্রভু শ্রেণীভুক্ত চিন্তাবিদগণ তাঁদের রাষ্ট্র এবং সমাজকে সংকটের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দৃশ্যের পেছনে অদৃশ্য সত্তা, চরম উত্তম, ধর্ম, অবস্থার অপরিবর্তনীয়তা প্রভৃতি বিশ্লিষ্ট দার্শনিক ভাবসূত্রের জাল বিস্তার করতে শুরু করেন। প্রাচীন দর্শনের বস্তুবাদী ধারার অধিকতর বিকাশ এমপিডকলিস, এ্যানাক্সোগোরাস লিউসিপাস এবং ডিমোক্রিটাসের চিন্তাধারায় দেখা যায়। বস্তুত দর্শনের সমগ্র ইতিহাসে ভাববাদ ও বস্তুবাদের যে মূল দুটি ধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তার সূত্রপাত প্লেটো এবং ডিমোক্রিটাসের দর্শনেই ঘটে। লেনিন দর্শনের ইতিহাসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, দর্শনের ইতিহাসের মূল ধারার একটিকে প্লেটোর ধারা, অপরটিকে ডিমোক্রিটাসের ধারা বলেও আখ্যাত করা চলে।
Plato : প্লেটো (৪২৮/৪২৭-৩৪৭ খ্রি. পূ)
প্লেটো ছিলেন গ্রিসের ভাববাদী দার্শনিক। তিনি সক্রেটিসের শিষ্য ছিলেন। সক্রেটিসের নিজের কোনো রচনার কথা জানা যায় না। কিন্তু প্লেটো সক্রেটিসকে নায়ক করে বিপুল সংখ্যক সংলাপমূলক দার্শনিক গ্রন্থ রচনা করেন। এই সমস্ত গ্রন্থের মধ্যে রিপাবলিক লজ, এ্যাপোলজি, ক্রিটো, ফিডো, পারমিনাইডিস, থিটিটাস প্রভৃতি সংলাপের নাম বিশেষ বিখ্যাত। প্লেটোর পূর্ববর্তী গ্রিক দার্শনিকদের দর্শন ছিল প্র্রধানত প্রকৃতিবাদী। সে দর্শনে বস্তুর সত্যতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করা হয় নি। কিন্তু প্লেটো তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের বস্তুবাদী ব্যাখ্যাকে সমালোচনা করে ভাববাদী তত্ত্ব তৈরি করেন। তাঁর মতে দৃশ্য জগতের বস্তু সত্য নয়। দৃশ্য জগতের বস্তু হচ্ছে খন্ড সত্য। সমস্ত সৃষ্টির পিছনে এক সত্তা আছে যার চরিত্র বস্তুগত নয়। মূল সেই সত্তা হচ্ছে অ-বস্তু ও ভাব। দৃশ্য বস্তু হচ্ছে সেই ভাবের প্রকাশ। ভাব হচ্ছে অবিনশ্বর এবং অতিন্দ্রিয়। মূল সত্তা রূপ ভাবের কোনো সৃষ্টি কিংবা ক্ষয় নেই। স্থান এবং সময়ের উপরও সে নির্ভর করে না। এই ভাবকে প্লেটো আবার বিশ্বের আত্মা বলেও অভিহিত করেছেন। এই বিশ্ব আত্মার খন্ড প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির আত্মার মধ্যে। আমাদের জ্ঞানের সঠিকতা নির্ভর করে ব্যক্তির আত্মার পক্ষে বিশ্ব আত্মাকে আপন স্মৃতিকে ভাস্বর করে তোলার মধ্যে। জ্ঞানের মধ্যে প্লেটো একটা দ্বান্ধিক পদ্ধতির কথাও উল্লেখ করেছেন। এই দ্বান্ধিক পদ্ধতির দুটি দিক। একদিকে আমরা ক্রমাধিক সাধারণীকরণের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সাধারণ সত্যে আরোহণ করি। অপরদিকে সর্বোচ্চ সাধারণ সত্য থেকে ক্রমান্বয়ে অল্প থেকে অল্পতর সাধারণ সত্যের মাধ্যমে আমরা দৈনন্দিন বিশেষ সত্য বা ভাবে আরোহণ করি। গ্রিসের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল দাসের এবং অপরাপর শ্রমজীবি মানুষের শোষণ। প্লেটো নিজে ছিলেন অভিজাত শাসক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। ‘লজ’ বা বিধান এবং ‘রিপাবলিক’ নামক সংলাপে তিনি যে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন তার ভিত্তিও তাই দাসের শ্রম। রাষ্ট্রের শাসক হবে তাই দার্শনিক সম্প্রদায়। তার রক্ষক হবে সেনাবাহিনী। দার্শনিক এবং সামরিকবাহিনী এরাই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সত্তার অধিকার ভোগকারী স্বাধীন নাগরিক। এদের নিচে অবস্থান হচ্ছে দাস এবং শ্রমজীবি কারিগরের। তারা শ্রম করে শাসন দার্শনিক এবং রক্ষক সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন করবে। শাসক দার্শনিকদের জীবিকার জন্য কোনো চিন্তা করতে হবে না। তাদের কোনো ব্যক্তিগত পরিবার বা সম্পত্তি থাকবে না। কিন্তু তাই বলে তাদের কোনো কিছুর অভাবও থাকবে না। অভাবহীন অবকাশে তারা শাসনের কৌশল আয়ত্ত করবে এবং এইভাবে শাসন বিশেষজ্ঞ হয়ে শাসনক্ষমতার একমাত্র অধিকারী হবে। শিশুকাল হতে শাসকসম্প্রদায়ের সন্তানকে এক সার্বিক শিক্ষার মাধ্যমে শাসক হওয়ার উপযুক্ত গুণে সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে। প্লেটো যেভাবে রাষ্ট্রের শাসন, রক্ষণ এবং উৎপাদনমূলক কাজকে পৃথক করে এক এক সম্প্রদায়ের উপর নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন তার মধ্যে শ্রমবিভাগের গুরুত্ব যে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু প্লেটোর শ্রমবিভাগ এবং আধুনিককালের শ্রমবিভাগ অবশ্যই পৃথক। প্লেটো্ তাঁর এই বিভাগকে কার্যত অনড় শ্রেণিবিভাগে যেমন পরিণত করেছিলেন, তেমনি এই বিভাগকে একটিকে অপর একটি থেকে উত্তম এবং অধম বলেও নির্দিষ্ট করেছিলেন। শাসনের কাজ হচ্ছে সর্বোত্তম কাজ। আর শ্রম দিয়ে উৎপাদন রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও মূল্যায়নের দিক থেকে অধম কাজ। প্লেটোর ভাবগত দর্শন আর সমাজগত তত্ত্ব উভয়ই পরবর্তীকালের ভাববাদী চিন্তার বিকাশে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে।
Plekhanov : প্লেখানভ (১৮৫৬-১৯১৮ খ্রি.)
রুশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী চিন্তাবিদ এবং মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিসাবে জর্জি ভালেন্তিনোভিজ প্লেখানভের প্রসিদ্ধি। প্লেখানভের রাজনীতিক ও তাত্ত্বিক জীবন অবশ্য নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। গোড়াতে তিনি একটি নারোদনিক সংগঠনের নেতা ছিলেন। পরবর্তীকালে রুশদেশ পরিত্যাগ করে যখন বিদেশে যান তখন তিনি মার্কস এবং এঙ্গেলস এর রচনাবলী পাঠ করেন এবং পশ্চিম ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন। এই পর্যায়ে তিনি নারোদবাদ বা সংস্কারবাদী জনতা দল পরিত্যাগ করে বিপ্লবী মার্কসবাদের আদর্শে শ্রমিকের মুক্তি নামক একটা দলের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর তত্ত্বগত রচনায় নারোদবাদ, আইনগত মার্কসবাদ, সংস্কারবাদ এবং বুর্জোয়া দর্শনকে খন্ডন করার চেষ্টা করেন। ১৯০৩ এর পরবর্তী পর্যায়ে মার্কসবাদের সঙ্গে প্লেখানভের মতদ্বৈধ দেখা যায়। মার্কসবাদের অনুসারীগণ বলেন যে, ১৯০৫ এর অভ্যুত্থান এবং প্রতিক্রিয়ার হাতে তার পরাজয়ের তাৎপর্য অনুধাবনে প্লেখানভ ব্যর্থ হন। পরিণামে তিনি বলশেভিকদের বিরোধীপক্ষ মেনশেভিকদের পক্ষ অবলম্বন করেন। ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তাৎপর্যও তিনি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু তা হলেও লেনিন এবং মার্কসবাদীগণ প্লেখানভের তাত্ত্বিক রচনাসমূহকে মার্কসবাদের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিশেষ মূল্যায়ন বলে মনে করেন। তাঁর রচনাসমূহের মধ্যে ‘ইতিহাসের অদ্বৈতবাদী ব্যাখ্যার বিকাশ’, ‘বস্তুবাদের প্রসঙ্গ’ ‘ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
Plotinus : প্লটিনাস (২০৫-২৭০ খ্রি.)
প্লটিনাস গ্রিসের একজন ভাববাদী দার্শনিক। কিন্তু প্লটিনাসের জন্ম হয়েছে মিসরে এবং তিনি জীবন অতিবাহিত করেছেন রোম নগরে। প্লটিনাসকে নব প্লেটোবাদের প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়। প্লটিনাসের ব্যাখ্যায় দর্শন অধিকতর রহস্যময় রূপ ধারণ করে। প্লটিনাসের মতে সৃষ্টি পরিক্রমার উৎস হচ্ছে এক ঈশ্বর। কিন্তু ঈশ্বর হচ্চে মানুষের অনুধাবন বা বর্ণনার উর্ধে্ব। এই এক উৎস প্রথমে বিশ্বপ্রজ্ঞা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বপ্রজ্ঞা পরে জগতের আত্মা এবং ব্যক্তির আত্মা এবং ব্যক্তির দেহরূপে প্রকাশিত হয়। ব্যক্তির দেহ এবং জগতের বস্তুর কোনো সত্য অস্তিত্ব নেই। মানুষের কামনা হবে দেহের ভোগ, বাসনা, আকর্ষণ অতিক্রম করে দেহ হতে আত্মায় এবং আত্মা হতে বিশ্বপ্রজ্ঞায় আরোহণ করে পরিশেষে এক পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যাওয়া।
Plularism : বহুত্ববাদ
একত্ববাদের বিরোধী তত্ত্ব হচ্ছে বহুত্ববাদ। বহুত্ববাদের মতে অস্তিত্বের মূলে আছে বহু এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন সত্তা। এই বহুসত্তার মূলকে কোনো এক সত্তায় পরিণত করা সম্ভব নয়। বহুত্ববাদের একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে লাইবনিজের বহুমোনাডের তত্ত্ব।
Politics : রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি
রাষ্ট্রনীতি বলতে অবশ্য রাষ্ট্র সম্পর্কীয় নীতি বুঝায়। কিন্তু বহুলপ্রচলিত শব্দ রাজনীতি দ্বারা আমরা রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ বা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করার আন্দোলন বুঝাই। এই অর্থে আমরা ‘স্বাধীনতার আন্দোলন’ ‘স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন’ ইত্যাদি কথা ব্যবহার করি। রাজনীতি ব্যাপক অর্থে কেবল রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করার দাবী নয়, রাষ্ট্র এবং সমাজের যে কোনো সমস্যা সমাধানের আন্দোলন বুঝাতে পারে। এই অর্থে শ্রমিকের এবং কৃষকের বা অপরাপর শ্রেণীর আর্থিক অসুবিধাসমূহ দূরীকরণের আন্দোলনও রাজনীতির অংশ। এ কারণে রাজনীতি বলতে কোনো নির্দিষ্ট নীতির বদলে শ্রেণী বিভক্ত সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থরক্ষামূলক সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা বুঝায়। তাই রাজনীতির প্রধান বাহন হচ্ছে সংগঠিত দল। শ্রেণীগত স্বার্থরক্ষার জন্য দলগত প্রচেষ্টা আধুনিককালের সাধারণ সত্য হলেও এই প্রচেষ্টা আধুনিককালেরই বৈশিষ্ট্য নয়। উৎপাদনের উপায়ের ক্ষেত্রে সমাজ দ্বন্ধমান শ্রেণীতে বিভক্ত হওয়ার সময় থেকেই দ্বন্ধমান শ্রেণীর সচেতন অংশ নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য সংঘবদ্ধ প্রয়াস চালিয়ে আসছে। অনেক সময়ে একটা রাষ্ট্রের মধ্যে বহু রাজনীতিক দলের সৃষ্টি এবং কার্যক্রম দেখা যায়। কিন্তু রাজনীতির দলের সংখ্যার আধিক্য একথা বুঝায় না যে এই রাষ্ট্র এত অধিক শ্রেণিতে বিভক্ত। দলের সংখ্যা যতই হোকনা কেন মূলত তাদের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রধান দ্বন্ধমান অর্থনীতিক শ্রেণীর স্বার্থই প্রতিফলিত হয়। বাইরে থেকে এই বৈশিষ্ট্য অনেক সময়ে আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু সমাজ কাঠামোর বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, জীবিকার ভিত্তিতে অর্থনীতিক বিন্যাস নিয়ে তৈরি হয় সমাজের অন্তঃকাঠামো। আর এই অন্তঃকাঠামোর উপর গঠিত শাসনগত এবং রাজনীতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বহিঃকাঠামো। শোষিত শ্রেণীর রাজনীতিক লক্ষ্য থাকে উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা দখলের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দখল করা কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্র দখলের মাধ্যমে পরিণামের উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা থেকে শোষক শ্রেণীকে উচ্ছেদ করা। যে কোনো পর্যায়ের শাসক এবং শোষক শ্রেণীর রাজনীতির লক্ষ্যও থাকে নিজেদের দখলকৃত অবস্থানকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখা। শ্রেণীহীন সমাজ হলে শ্রেণীভিত্তিক রাষ্ট্রের রাজনীতিক অবসান ঘটে এবং রাজনীতি সেখানে রাষ্ট্রীয় এবং অর্থনীতিক শক্তি দখলের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের পরিবর্তে সমাজ ও রাষ্ট্রের আর্থিক সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য দিকের ক্রমিক উন্নতির জন্য মানুষের সমষ্টিগত কর্মকান্ডকে বুঝায়। এমন অবস্থায় রাজনীতির সঙ্গে রাষ্ট্রের সংগঠিত কর্মকান্ডের আর প্রভেদ থাকে না।
Political Thought : রাষ্ট্র চিন্তা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান
Political Thought, History of : রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস
রাষ্ট্র কি, রাষ্ট্রের উদ্ভব কিভাবে ঘটেছে, ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কি, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের পার্থক্যের ভিত্তি কি, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ক, রাষ্ট্র এবং সরকারের পার্থক্য, সরকারের প্রকারভেদ প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় সমস্যার আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় চিন্তা বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান জ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে রূপলাভ করেছে।
মানবজাতির প্রতিটি দেশ বা অঞ্চলেই রাষ্ট্র সম্পর্কিত সমস্যার উপর সেই অঞ্চলের চিন্তাবিদগণ ইতিহাসের আদিকাল থেকে চিন্তা করে এসেছেন। এরূপ অনুমান করা স্বাভাবিক যে রাষ্ট্রমাত্রের সাংগঠনিক একক মানুষ হলেও এবং তার সমস্যা মূলত ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির সম্পর্কের সমস্যা হলেও এই সমস্যার প্রকাশ সব অঞ্চলে সর্বকালে একইভাবে ঘটে নি। মৌলিক ঐক্যের মধ্যেও অঞ্চল থেকে অঞ্চলে সমস্যা এবং সমস্যার সমাধানমূলক চিন্তার পার্থক্য বর্তমানের ন্যায় অতীতেও ছিল।
মানব সভ্যতাকে আজকাল সাধারণত পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্য বা এশিয়া এবং ইউরোপীয় সভ্যতা হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এ বিভাগের কৃত্রিমতা অনস্বীকার্য। কিন্তু এরূপ বিভাগের মূলে যে কিছু পার্থক্য রয়েছে তাও সত্য। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকাশের প্রকৃষ্ট গবেষণা তুলনামূলকভাবে ইউরোপে এশিয়ার চেয়ে অধিক হয়েছে। ফলে এশিয়ার এবং আফ্রিকার মানুষের রাষ্ট্রীয় সত্তার বিকাশ এবং এশিয়া আফ্রিকার চিন্তাবিদদের রাষ্ট্রীয় চিন্তার পরিচয় এখনও প্রধানত অনুদঘাটিত এবং অজ্ঞাত। সে কারণে রাষ্ট্রীয় চিন্তার বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিকাশের ইতিহাস বলতে সাধারণত ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ এবং সে অঞ্চলের চিন্তাবিদদের চিন্তার বিবর্তন এবং ইতিহাস বুঝায়।
ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তার প্রথম এবং উন্নতধরনের সূত্রপাত ঘটে প্রাচীন গ্রিক নগর রাষ্ট্রে এবং গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো এবং এ্যরিস্টটলের চিন্তাধারার মধ্যে।
প্রধানত ভৌগলিক কারণে গ্রিসে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বয়ংসম্পূর্ণ নগররাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এই সমস্ত নগর রাষ্ট্রের মধ্যে এথেন্স এবং স্পার্টা ছিল যথাক্রমে রাজনীতিক চিন্তা এবং গণতন্ত্রের বিকাশ এবং সামরিক শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের জন্য বিশিষ্ট। এথেন্সের সক্রেটিস এবং বিশেষ করে প্লেটো যখন রাষ্ট্রীয় সমস্যার উপর তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেন তখন এথেন্সের গণতন্ত্রের গৌরব ও সমৃদ্ধি বিনষ্ট প্রায়। স্পার্টার সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে এথেন্স নানা রাজনৈতিক সংকটে আবিষ্ট। দাসের শোষনের ভিত্তিতে যে সভ্যতা সমৃদ্ধি লাভ করেছিল সে সভ্যতা খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতক থেকেই ন্যায়, অন্যায়, আনুগত্য, বিদ্রোহ, ব্যক্তির অধিকার ও ক্ষমতা, গুণ ও দাবি প্রভৃতি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে আরম্ভ করেছে। প্লেটো এবং এরিস্টটল উভয় দার্শনিক এথেন্সের সেরা জ্ঞানীদের প্রধান ছিলেন। তাঁরা তাঁদের রচনাসমূহের মধ্যে সংকটগ্রস্থ এথেন্স তথা গ্রিক নগর রাষ্ট্রের পুরাতন রাষ্ট্রীয় আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পান। তাঁরা উভয়ে দাসপ্রথাকে সমর্থন করেছেন এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন। প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে যে আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা রচনা করেছেন তাতে একদল বিশেষভাবে শিক্ষিত ও দক্ষ শাসক বা দার্শনিককে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। প্লেটো রাষ্ট্রের নাগরিকদের যোগ্যতার ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে উল্লেখ করেন যে, ন্যায় মানে হচ্ছে যার যে দায়িত্ব তার সে দায়িত্ব পালন করা। এ্যরিস্টটল প্লেটোর চেয়ে অধিক বাস্তববাদী ছিলেন। তিনি কোনো আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করার বদলে বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করে সরকারের প্রকারভেদ করে প্রত্যেক প্রকার সরকারই কেমন করে স্থাযিত্ব বজায় রাখতে পারে তার পথ নির্দেশ করেন। এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, উদ্ভব, রাষ্ট্রের অন্তর্গত শ্রেণীসমূহের বিশ্লেষণ, সরকারের প্রকারভেদ, কার্যকর রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক শর্ত এবং রাষ্ট্রের মধ্যে অসন্তোষ ও বিদ্রোহের কারণ এবং তার নিবারণের উপায়ের সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক আলোচনা ও সংজ্ঞাদানের চেষ্টা রয়েছে। এদিক থেকে এই গ্রন্থকে রাষ্ট্রীয় সমস্যার অন্যতম আদি বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু প্লেটো এ্যরিস্টটলের রাষ্ট্রীয় আলোচনার সুসংবদ্ধতা সত্ত্বেও একথা সত্য যে, তাঁদের পক্ষে ক্ষয়প্রাপ্ত গ্রিক নগর রাষ্ট্রকে নতুন জীবন দান করা সম্ভব হয় নি। কিছুকালের মধ্যে সম্রাট আলেকজান্ডারের আক্রমণে েএবং পরবর্তীতে রোম সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানে গ্রিক নগর রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। রোম নগরী প্রাচীন নগর রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র সীমানায় সীমাবদ্ধ না থেকে কালক্রমে প্রাচীন ইতিহাসের বৃহত্তম সাম্রাজ্যের আকার গ্রহণ করে। ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের তাত্ত্বিক আলোচনার চেয়ে সাম্রাজ্যের সুষ্ঠ শাসনই রোমের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রধান সমস্যা ছিল। এর ফলে ইতিহাসে রোমের অবদান সূক্ষ্মচিন্তা ও দর্শনের চেয়ে এক-কেন্দ্রিক শাসনের প্রয়োজনীয় আইন কানুন রচনা ও ব্যাখ্যা দান এবং সামরিক বাহিনী চলাচলের সড়ক নির্মাণেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। রোম সাম্রাজ্যের পতনের পরে ইউরোপে যে দীর্ঘ পর্যায়ের সূত্রপাত ঘটে তাকে মধ্যযুগ বলে অভিহিত করা হয়। এই পর্যায়ে খ্রিষ্টধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে এবং পরবর্তীকালে রোমের পোপের নেতৃত্বে এক বৃহৎ যাজক সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়। এই যাজকতন্ত্র কেবল পারলৌকিক নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকেও নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস পায়। সামন্ততন্ত্র যতদিন ইউরোপের প্রধান অর্থনীতিক ব্যবস্থা ছিল ততদিন খ্রিষ্টীয় যাজকতন্ত্র এবং সামন্ততন্ত্র সম্মিলিতভাবে স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্রের এবং কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার বিকাশে বাধা দান করতে থাকে। মধ্যযুগে রাষ্ট্রীয় চিন্তার প্রধান প্রশ্ন ছিল: পোপ বড় না রাজা বড়? এই প্রশ্নে যাজক সম্প্রদায়ভুক্ত চিন্তাবিদ সেন্ট বার্নার্ড, সেলিসবারি জন এবং সেন্ট টমাস এ্যকূইনাস রাজার বিরুদ্ধে ধর্ম তথা পোপের পক্ষ অবলম্বন করে পোপের সর্বাধিক ক্ষমতার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। কিন্তু যন্ত্রশিল্প এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ, ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধে ইসলামের সঙ্গে ইউরোপের পরিচয় এবং এর ফলে প্লেটো এ্যরিস্টটলের রচনার আরবি অনুবাদের ইউরোপ আগমন, ক্রুসেডে পোপের নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকাশ ইত্যাদি ঐতিহাসিক কারণে পোপের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে এবং রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধর্মান্ধ যাজক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা এককালে সমাজের বিকাশের ন্যায় প্রয়োজনীয় এবং প্রগতিশীল ছিল। ম্যাকিয়াভেলি(১৪৬৯-১৫২৭) বোদিন (১৫৩০-১৫৯৬) এবং হবস (১৫৮৮-১৬৭৯) রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রাজা বা শাসকের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।
সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধিকতর বিকাশ লাভ করে। এই সময়ের প্রধান চিন্তাবিদ এবং দার্শনিকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ইংল্যান্ডের বেনথাম (১৭৪৮-১৮৩২), জন লক (১৬৩২-১৭০৪) এবং বার্ক (১৭২০-১৭৯৭)ও ফরাসি দেশের রুশো(১৭১২-১৭৭৮) মন্টেসক্যূ(১৬৮৯-১৭৫৫)। লক এবং রুশো উভয়ই রাষ্ট্রের উদ্ভব ব্যাখ্যার জন্য সামাজিক চুক্তির উল্লেখ করেন। হবসও সামাজিক চুক্তির উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু সামাজিক চুক্তির যে ব্যাখ্যা হবস দেন তা যেমন লক ও রুশোর ব্যাখ্যার পৃথক, তেমনি আবার লক ও রুশোর ব্যাখ্যাও অভিন্ন নয়। হবস সামাজিক চুক্তির ব্যাখ্যা দ্বারা রাজা বা শাসকের একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। লকের মতে, সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব শাসকের উপর অর্পিত হলেও শাসক সার্বভৌম কোনো ক্ষমতা নয়। রুশো লকের এই গণতান্ত্রিক ভাবকে সম্প্রসারিত করে তাঁর সামাজিক চুক্তির ব্যাখ্যায় বলেন যে, চুক্তির মাধ্যমে জনসাধারণ যদি তাদের নিজ নিজ ক্ষমতা কারোর নিকট অর্পণ করে থাকে তবে সে কোনো ব্যক্তিক শাসক নয়। সে হচ্ছে জনসাধারণেরই ‘সাধারণ ইচ্ছা’। জনসাধারণ ইচ্ছে করেই সাধারণ ইচ্ছার নিকট ব্যক্তিগত অধিকারকে অর্পণ করেছে। অর্থাৎ ব্যক্তি যেমন আর স্বাধীন শাসক হিসাবে কার্যকর থাকবে না(প্রাকৃতিক অবস্থায় সে যেরূপ ছিল) তেমনি আবার কোনো স্বৈরতান্ত্রিক ব্যক্তিক শাসকেরও সে অধীন হবে না। সে তার এবং অপর সবার মিলিত সাধারণ ইচ্ছার দ্বারা শাসিত হবে। কাজেই রাষ্ট্রে সরকার জনসাধারণের সাধারণ ইচ্ছার প্রতীক, জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো স্বাধীন সত্তা নয়। তার মানে, সরকার যখন জনসাধারণকে শাসন করে না, জনসাধারণই শাসন করে তখন কোনো ভিন্ন শাসক জনসাধারণকে শাসন করে না, জনসাধারণই জনসাধারণকে শাসন করে। যে ব্যক্তি তার শাসক অধিকার চুক্তির মাধ্যমে ত্যাগ করেছিল সেই আবার সাধারণ ইচ্ছার একক হিসাবে নিজেকে শাসন করার অধিকার লাভ করে। মন্টেসক্যূ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ঐতিহাসিক পদ্ধতির প্রবর্তক বলে খ্যাত। ঊনবিংশ শতকে কার্ল মার্কস এবং এঙ্গেলস রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অর্থনীতিক ভিত্তি বিশ্লেষণ করে এবং অর্থনীতিকে রাষ্ট্রনীতির মূল ব্যাখ্যা করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নতুন চিন্তার যোগান দেন। হেগেলের দ্বন্ধমূলক ঐতিহাসিক পদ্ধতিকে বাস্তব সমাজের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে মার্কস এবং এঙ্গেলস দ্বন্ধমূলক ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। এই পর্যায় থেকে পুঁজিবাদী চিন্তাবিদগণও রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেন। পুঁজিবাদের বিকাশ, তাঁর আভ্যন্তরীণ বিরোধ ও সংকট, নতুন শক্তি হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর জাগরণ ইত্যাদি চিন্তাবিদমাত্রকেই একথা স্বীকারে বাধ্য যে, বর্তমান রাষ্ট্রের ভূমিকা আর সুবিধাভোগী সংকীর্ণ কোনো শ্রেণীর ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষা নয়-রাষ্ট্রের ভূমকা আজ রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয়, সাংষ্কৃতিক সর্বপ্রকার সুবিধাকে বৃহত্তর, এমনকি সমস্ত জনসংখ্যার উপর তার শ্রেণী বা আর্থিক উপার্জনগত যোগ্যতা অযোগ্যতা নির্বিশেষে বিস্তারিত করে দেওয়া।
বর্তমানে রাষ্ট্র সমাজব্যবস্থার দিক থেকে দুই শ্রেণীতে-পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক। এই দুই শ্রেণীর রাষ্ট্রের আর্থিক বুনিয়োদ একেবারে পৃথক বলে উভয় শ্রেণীর রাষ্ট্রীয় সংগঠন অর্থাৎ তার সরকার, আইনসভা, রাজনীতিক দল, ব্যক্তিক অধিকার, রাষ্ট্রের ক্ষমতা ইত্যাকার সমগ্র রাষ্ট্রীয় প্রশ্নই ভিন্ন প্রকারের। একই মাপকাঠি দিয়ে এদের উভয়কে পরিমাপ করা চলে না। সে বিচারে উভয়ের সমস্যার যথার্থ অনুধাবন অসম্ভব হয়ে পড়ে।
Polytheism and Monotheism : বহু ঈশ্বরবাদ এবং একেশ্বরবাদ
বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসকে বহু ঈশ্বরবাদ এবং এক ঈশ্বরে বিশ্বাসকে একেশ্বরবাদ বলে।
আদি গোত্রভিত্তিক সমাজে অলৌকিক শক্তির আধার হিসেবে মানুষ প্রাকৃতিক জগতের বিভিন্ন সজীব বা আজীব বস্তু কিংবা বস্তুর প্রতীককে পূজা করত। গোত্রতান্ত্রিক সমাজের ভাঙ্গনের পরে এবং সমাজ অধিকতর সংগঠিত রূপ নেওয়ার পর্যায়ে গোত্রপ্রতীক বা বস্তুর স্থানে শূণ্যে বা উর্ধ্বস্থানে অবস্থানকারী দেবতাকূলের উদ্ভব ঘটে। মানুষের সমাজে শ্রেণীগত পার্থক্য এবং সামাজিক সম্পর্কগত স্তরক্রম দেবতাদের জগতেও প্রতিফলিত হতো। কিন্তু তখনো সমাজ সুদৃঢ় ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হয় নি। তাই ছোটবড় বিভিন্ন পর্যায়ের দেবতাদের অস্তিত্ব মানুষের কল্পনায় বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন হিসেবে বজায় ছিল। কিন্তু কালক্রমে গোত্রসমাজ ভেঙ্গে দাস ও প্রভু সমাজের উদ্ভব হয়। দাসের শ্রম ও শোষণের ভিত্তিতে প্রভু শাসকগণ বৃহদাকার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করে। এই অবস্থার প্রতিফলনও মানুষের ধর্মীয় কল্পনার মধ্যে ঘটতে দেখা যায়। দেবতাদের মধ্যেও এবার ছোটবড়র তারতম্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। যে দেবতা অধিক শক্তিশালী সে অধিক পূজ্য হতে থাকে। অবশ্য অন্যান্য দেবতাও সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে কম বেশি স্বীকৃতি পায়। সমাজে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন সংঘটিত হয়। সামন্ততান্ত্রিক যুগে একচ্ছত্র সম্রাটের অধীনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূস্বামী এবং তাদের শাসিত অঞ্চলের স্থানে বৃহদাকারের রাষ্ট্র সংগঠিত হতে থাকে। ধর্মেও বহু দেবতাদের স্থানে এক সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ধর্মীয় ধারণায় প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। ইহুদি এবং খৃষ্টান ধর্মের মধ্যে এবং পরবর্তীকালে ইসলামের মধ্যে এক স্রষ্টার কল্পনা প্রকাশিত হয়েছে।
Postmodernism : উত্তর আধুনিকতা
সময় বিশেষ করে সমাজের গতিপ্রবাহ সম্পর্কিত একটি সাম্প্রতিক প্রত্যয়ের প্রচলিত নাম হচ্ছে ‘উত্তর আধুনিকতা’। যখন বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ কথাটি সূর্যের মত প্রধান ছিল, তখন ‘রবীন্দ্রপূর্ব’ কথাটির সাধারণ বোধ্য অর্থ ছিল রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত। কিন্তু যেমন বস্তু, তেমনি প্রত্যয়। কোন কিছুই স্থির বা অপরিবর্তিত নয়। সে কারণে বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রোত্তর বা রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কথাটিও চালু হয়েছিল। এ সব বিমূর্ত প্রত্যয় নিয়ে আলোচনায় নানা অসুবিধা দেখা দেয়। যা নিয়ে আলোচনা তা মূর্ত হলেও নানাজনের নানা মনোভাবভিত্তিক আলোচনা কেবল যে বিমূর্ত হয়ে দাঁড়ায় তাই নয়। বেশ কিছুটা নৈরাজ্যিক বা অনির্দিষ্টও হয়ে পড়ে।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রোত্তর কথাটি অনিবার্য না হলেও তত দুর্বোধ্য নয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সামাজিক, বিশেষ করে সমাজের রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পোস্ট মডার্নিজম বা উত্তর আধুনিকতা কথাটি দেখতে বা শুনতে যত সহজ, তাকে ধরা তত সহজ নয়। ইউরোপ আমেরিকার কথা বাদ দিয়ে আমাদের পরিচিত বাংলাভাষার পরিমন্ডলে ‘উত্তর আধুনিকতা’ দ্বারা কেবল যে, ‘যা আধুনিক নয়’ বুঝার চেষ্টা করা যায়, তাই নয়। উত্তর আধুনিকতাবাদীদের একটি প্রবণতা হচ্ছে বস্তু জগৎকে বুঝার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি. ধারাবাহিকতা এমনকি কোনো কার্যকারণ বা ‘কজ এন্ড এফেক্ট’ রূপ কোনো অনিবার্যতার সম্পর্ককে অস্বীকার করার প্রবণতা। সব কিছু সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, কোনো কিছুই কোনো কিছুর সাথে সম্পর্কিত নয়। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে কোনো কিছুই কোনো কিছুই নয় এরূপ একটি নেতিবাচক ভাবের প্রচার করা।
‘উত্তর আধুনিক’ তথা ‘পোস্ট মডার্নিজম’ কথাকে কারা কিভাবে প্রচলন করেছেন তা এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট নয়। কেবল এটুকু বলা যায়, ইতিহাসে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে তারও বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ উত্তর আধুনিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে যেমন অর্থহীন, তেমনি ভবিষ্যতের চিন্তাও অর্থহীন। অর্থাৎ ‘উত্তর আধুনিক’ একটি নতুন শব্দ বটে, কিন্তু শব্দটির কোনো সুনির্দিষ্ট এবং সাধারণভাবে গ্রাহ্য অর্থ এখনও নিশ্চিত হয় নি।
Pragmetism : প্রয়োগবাদ
প্রাগমেটিজম বা প্রয়োগবাদ আধুনিক দর্শনের একটি অন্তর্মুখী ভাববাদী তত্ত্ব। ইংরেজি প্রাগমেটিজম কথাটির উৎপত্তি ঘটেছে গ্রিক শব্দ ‘প্রাগমা’ থেকে। ‘প্রাগমা’র অর্থ হচ্ছে কার্য সম্পাদিত বা কার্যকৃত। প্রয়োগবাদ সত্য নিরূপণ করে বিচার্য বিষয়ের কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের উপযোগিতার ভিত্তিতে। উইলিয়ামস জেমস প্রয়োগবাদের একজন প্রবক্তা। উইলিয়াম জেমসের মতে, আমরা কোনো কাজ করি কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। কাজেই আমাদের কোনো বিশেষ কর্ম সত্য কিংবা মিথ্যা, যথার্থ কিংব অযথার্থ তার নিরূপক হবে সেই উদ্দেশ্য সাধনে তার ক্ষমতা, অক্ষমতার ভিত্তিতে। কোনো কার্য দ্বারা যদি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধিত হয় তা হলে কাজটি অবশ্যই সত্য। অবশ্য কোনো কিছুর কার্যোপযোগিতা দ্বারা প্রয়োগবাদীগণ প্রমাণ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রমাণিত সর্বজনস্বীকৃত উপযোগিতাকে বুঝায় না। তাদের কাছে উপযোগিতার নির্ধারক হচ্ছে ব্যক্তির নিজস্ব অভিমত। ব্যক্তি যদি মনে করে বিষয়টি উপযোগী তবে তা তার কাছে সত্য।
Predestination, Theory of : নিয়তিবাদ
নিয়তিবাদ হচ্ছে এই বিশ্বাস, পৃথিবীতে যা কিছু ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবে, মানুষের জন্ম, মৃত্যু, ব্যক্তির ইচ্ছা, অনিচ্ছা সব কিছুই ঈশ্বরের দ্বারা পূর্ব নির্দিষ্ট। সব ঘটনাই অনিবার্য, সব অস্তিত্বই অপ্রতিরোধ্য। নিয়তিবাদ স্বীকার করলে জগতের কিংবা মানুষের সমাজের নতুন ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়া কিংবা বিকশিত হওয়ার আর উপায় থাকে না। কেননা জগৎ ও সমাজ কোন্ দিকে যাবে তা ঈশ্বর পূর্বেই নির্দিষ্ট করে রেখেছে। ব্যক্তি সে নির্ধারিত পথ জানে না। তাই তার কাছে ঘটনা নতুন বলে বোধ হয়। সে কারণেই সে মনে করে যে, তার নিজের ইচ্ছামতো ভবিষ্যতের জাগতিক বা সামাজিক পরিবর্তন সংঘটিত হতে পারবে। জগতে কোনো অণুরই স্বাধীনভাবে অনির্দিষ্টপথে অগ্রসর হওয়ার উপায় নেই। নিয়তিবাদের তত্ত্ব মানুষকে পরিণামে সমস্যার পরিমন্ডলে অসহায় নিষ্ক্রিয় প্রাণীতে পরিণত করে। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের মধ্যে পৃথিবীর সবকিছু ঘটনাব কার্যকারণের বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিশ্বে কোনো কিছুই যেমন ইচ্ছা তেমন ঘটতে পারে না। বিশ্বময় নিয়মের রাজত্ব। কিন্তু বিজ্ঞানের নিয়মের রাজত্ব আর নিয়তিবাদ এক কথা নয়। নিয়তিবাদে ঘটনায় ঘটনায় কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। সব ঘটনার মূল কারণ বিধাতার কারণহীন ইচ্ছা।
Predicables : বিধেয়ক
এ্যরিস্টটল তাঁর যুক্তিশাস্ত্রে একটি যৌক্তিক বাক্যে উদ্দেশ্যপদের সঙ্গে বিধেয় পদের সম্পর্কের শ্রেণী নিরূপণের চেষ্টা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত যুক্তিশাস্ত্রে একটি বিধেয় উদ্দেশ্যের সঙ্গে চার রকম সম্পর্কে সম্পর্কিত হতে পারে। বিধেয়র এই সম্ভাব্য সম্পর্ককে এ্যরিস্টটল প্রেডিকেবল বা বিধেয়ক বলেছেন। চার রকম বিধেয়কের নাম হচ্ছে জিনাস বা জাতি, স্পেসিস বা উপজাতি, ডিফারেনশিয়া বা লক্ষণ এবং প্রপ্রিয়াম বা উপলক্ষণ। ‘মানুষ হচ্ছে জীব’ এরূপ বাক্য বললে বিধেয়পদ ‘জীব’, উদ্দেশ্যপদ ‘মানুষ’ এর জাতি বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ ‘জীব’ জাতির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মানুষ। ‘মানুষ যুক্তিবাদী জীব’ বাক্যটিতে ‘যুক্তিবাদী জীব’ বিধেয় পদটি মানুষকে অপরাপর জীব থেকে পৃথকভাবে সূচিত করছে। এ কারণে ‘যুক্তিবাদী জীব’ উদ্দেশ্যপদের ডিফারেনশিয়া বা লক্ষণ।
Primary and Secondary Qualities : মৌল এবং অমৌল গুণ
বস্তুর গুণ কোনটি মৌল এবং কোনটি অমৌল, এই পার্থক্য বিশেষ করে ইংরেজ দার্শনিক লকের(১৬৩২-১৭০৪)রচনায় দেখা যায়। লকের মতে আমরা বস্তুকে শক্ত, নরম, ছোট, বড়, নিরেট, শূণ্য, লাল, নীল, গরম, ঠান্ডা, সুস্বাদযুক্ত, বিস্বাদযুক্ত বলে অভিহিত করি। এরূপ বর্ণনায় সব গুণকেই বস্তুর মধ্যে অস্তিত্বমান বলে মনে করা হয়। কিন্তু বস্তুর উপর আরোপিত সব গুণকে বস্তুর মধ্যে ব্যক্তির ইন্দ্রিয় নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বময় বিবেচনা করা যায় না। লকের মতে যখন আমরা বস্তুকে শক্ত বা নিরেট বা গতিময় বা বিশেষ আকারবিশিষ্ট বলি তখন যথার্থই বস্তুর মধ্যে এই সমস্ত গুণের অস্তিত্ব দেখা যায়। কারণ এই সমস্ত গুণ ব্যক্তির দেখা না দেখার উপর নির্ভর করে না । এই সমস্ত গুণ ব্যক্তির প্রধান বা মৌল গুণ। কিন্তু একটি বস্তুকে যখন লাল বা সবুজ, সুস্বাদযুক্ত, সুগন্ধিযুক্ত প্রভৃতি বলা হয় তখন এই গুণগুলি বস্তুর মধ্যে অস্তিত্বময় থাকে না। এই গুণগুলির অস্তিত্ব নির্ভর করে ব্যক্তির ইন্দ্রিয়াদির উপর। এ কারণে ব্যক্তির এরূপ ইন্দ্রিয় বা মননির্ভর গুণ হচ্চে বস্তুর অমৌল গুণ। লকের পূর্বে গেলিলিও, দেকার্ত, হবস প্রভৃতি দার্শনিকদের রচনাতেও বস্তুর গুণের মধ্যে এই রকম মৌল এবং অমৌল কিংবা প্রধান এবং অপ্রধানরূপ পার্থক্য নিরূপণের প্রয়াস দেখা যায়। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে বস্তুর গুণের মধ্যে এরূপ পৃথকীকরণ সম্ভব নয়। বস্তুর শক্তত্ব বস্তুর মধ্যে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বময় বলেও যেমন সেই গুণকে মানুষের অনুভব করতে হয়, তেমনি বস্তুটি লাল বললেও ‘লাল’ গুণ কেবল মনের সৃষ্টি নয়। বস্তুর সঙ্গে দেহের ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক এবং মনের অনুভবের মাধ্যমেই গুণের সৃষ্টি। দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদ বস্তুর গুণের মধ্যে গঠনগত পার্থক্য স্বীকার করলেও এরূপ মৌল অমৌলরূপ কৃত্রিম পার্থক্যকে স্বীকার করে না। প্রকৃতপক্ষে লকের এই পার্থক্যকরণে যে দুর্বলতা ছিল তার ভিত্তিতে ভাববাদী দার্শনিক বার্কলে এবং অজ্ঞেয়বাদী হউম লকের মৌল, অমৌল সকল গুণকেই মানসিক ভাব মাত্র বলে বর্ণনা করেছেন।
Primitive Communal System : আদি সাম্যবাদী ব্যবস্থা
সমাজের উৎপাদনী শক্তি বলতে উৎপাদনের য্নত্র, যন্ত্র ব্যবহারের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ এবং শ্রমের স্বভাব বা আগ্রহ বুঝায়। বিভিন্ন উপাদান নিয়ে যে উৎপাদনী শক্তি তার মধ্যে যন্ত্রব্যবহারকারীর শ্রমিকে ভূমিকাই প্রধান। শ্রমিক একদিকে যেমন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সম্পদ উৎপাদন করে তেমনি শ্রমের মাধ্যমে যন্ত্রের ক্রমাধিক উন্নতি তারাই সাধন করে, অর্থাৎ যন্ত্রের সঙ্গে শ্রমিকের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক এবং অভিজ্ঞতা যনেত্রর উন্নতির মূল কারণ হিসেবে কাজ করে। শ্রমশক্তির উৎপাদনী ক্ষমতার ক্রমবৃদ্ধির মূলেও শ্রমিক। মানুষের সমাজের বিশেষ পর্যায়ের উৎপাদনী শক্তির অবস্থা প্রকৃতির উপর সেই সমাজের শক্তির পরিমাণের পরিচায়ক। উৎপাদনী শক্তি প্রতি মুহুর্তেই পরিবর্তিত ও উন্নত হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সাধারণত দেখা যায় যে, শ্রমের যন্ত্রের উন্নতি ঘটে প্রথমে। অপেক্ষাকৃত অনুন্নত যন্ত্রের স্থলে উন্নততর যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। উন্নততর যন্ত্রের পরিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য ভিন্নতর শ্রম বা উৎপাদন সম্পর্কের আবশ্যক হয়। অবশ্য একটিমাত্র উন্নত যন্ত্রের আবিষ্কারেই যে ভিন্নতর উৎপাদন সম্পর্কের আবশ্যক হয় এমন কথা বলা হচ্ছে না। ব্যাপকভাবে যন্ত্রের যখন উন্নতি ঘটে তখন দেখা যায় যে, পূর্বকার উৎপাদন সম্পর্ক যেমন উন্নততর যন্ত্র ব্যবহারে উপযুক্ত নয়, তেমনি পুরাতন সম্পর্কের ভিত্তিতে উৎপাদনও আর বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না। উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে এরূপ দ্বন্ধের নিরসন হয় বিপ্লবের মাধ্যমে নতুনতর উৎপাদন সম্পর্ক এবং সমাজ প্রতিষ্ঠায়।
Proof of the existence of God : বিধাতার অস্তিত্বের প্রমাণ
ধর্মের মূল হচ্ছে এই বিশ্বাস যে, বিশ্বের একজন স্রষ্টা আছে। কিন্তু ধর্মের মধ্যে এই দাবির কোনো যুক্তিগত প্রমাণ পাওয়া যায় না। ভাববাদী দর্শন বিভিন্ন যুক্তিদ্বারা বিধাতার অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এ কারণে ধর্ম ও ভাববাদী দর্শন পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ভাববাদী দর্শন বিদাতার অস্তিত্বের পক্ষে তিনরকম যুক্তিগত প্রমাণ উপস্থিত করার চেষ্টা করেছে। যেমনঃ ১. জগতের মধ্যে জন্ম ও মৃত্যুর প্রমাণ দেখা যায়। সবকিছুর সৃষ্টি এবং লয় আছে। সবকিছুর ক্ষেত্রে জন্ম এবং মৃত্যুর কথা যদি সত্য হয় তা হলেও সমগ্র জগৎ সম্পর্কেও একথা সত্য। অর্থাৎ জগৎকেও এক সময় সৃষ্ট হতে হয়েছে। সৃষ্ট হওয়ার অর্থ হচ্ছে যে-সৃষ্টি, তার সত্তা থেকে পৃথক অপর কোনো সত্তার অস্তিত্ব থাকা। পৃথক সেই সত্তার কারণে অর্থাৎ তাঁর ইচ্ছায় এবং চেষ্টায় সৃষ্টের অস্তিত্ব। বিধাতা হচ্ছেন জগতের বাইরের সেই কারণ মূল কারণরূপ সত্তা। এই যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে এই ধারণা যে, বিশ্ব-যে কোনো বিশেষ বস্তুর ন্যায়ই সীমাবদ্ধ অর্থাৎ সসীম এক সত্তা। এবং যেহেতু সে সসীম, সে কারণে তার পক্ষে ভিন্নতর কোনো শক্তি ব্যতীত অস্তিত্বময় হওয়া সম্ভব হয় নি। দর্শনের এ প্রমাণে যুক্তির চেয়ে ধর্মের ন্যায় বিশ্বাসকেই প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করা হয়েছে। বিশ্বজগৎ যে সসীম এটা ভাববাদী দর্শনের অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাসমাত্র। এই যুক্তির প্রকারভেদ আমরা প্লেটো, এরিস্টটল এবং লাইবনিজ দর্শনের মধ্যে পাই। ২. বিশ্বস্রষ্টার দ্বিতীয় দার্শনিক প্রমাণ হচ্ছে ‘উদ্দেশ্যগত’ প্রমাণ। এ প্রমাণের ভিত্তি হচ্ছে এই যুক্তি যে, বিশ্বের সমস্ত ঘটনার মধ্যে উদ্দেশ্যের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে কোনো কিছুই সংঘটিত হয় না। কিন্তু উদ্দেশ্য থাকার অর্থ উদ্দেশ্যের পিছনে এক উদ্দেশ্যদাতা আছে, যার সচেতন চেষ্টাতেই উদ্দেশ্য সাধিত হয়। কাজেই বিশ্ব যখন উদ্দেশ্যহীন নয় তখন বিশ্বের পিছনে অতিজাগতিক এক শক্তি আছে যার ইচ্ছাতে বিশ্ব উদ্দেশ্যময় হয়ে কর্মরত আছে। ৩. তৃতীয় প্রমাণ হচ্ছে : মানুষের মনে আদিকাল হতে বিশ্বস্রষ্টার একটা ভাব বর্তমান আছে। মানুষ মনে করে অসীম শক্তিশালী এবং সম্পূর্ণ এক স্রষ্টা আছে। যদি কোনো সত্তা না থাকে তা হলে মানুষের মনে এরূপ ভাব সৃষ্টি হতে পারতো না। কাজেই এরূপ অসীম শক্তিসম্পন্ন এবং সুসম্পন্ন এক স্রষ্টার অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। অর্থাৎ যা মনে আছে তা অবশ্যই অস্তিত্বে আছে। বিধাতার অস্তিত্বের যে কোনো যুক্তির মূল দুর্বলতা হচ্ছে, একটি বিশ্বাসকে একইভাবে একদিকে সব অস্তিত্বের মূল বা কারণ এবং অপরদিকে সব অস্তিত্বকে সেই বিশ্বাসের প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করার চেষ্টা করা। িএর মধ্যে প্রতিপাদ্যকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করার অসঙ্গতি বিদ্যমান। বিধাতা সব অস্তিত্বের মূলে আছে। সব অস্তিত্ব বিধাতাই সৃষ্টি করেছেন। আবার সব অস্তিত্বই বিধাতার অস্তিত্বকে প্রমাণ করেছে। ভাববাদী জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বিধাতার অস্তিত্বকে এরূপভাবে প্রমাণ করার অসারতা উপলব্ধি করে বলেছিলেন যে, বিধাতা হচ্ছেন অভিজ্ঞতা উর্ধ্ব একটা বোধ। তাঁকে বিশুদ্ধ চিন্তা দ্বারা একজন অনুভব করতে পারেন কিন্তু বাস্তব জগতের দৃষ্টান্ত দ্বারা প্রমাণ করা চলে না। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ বিধাতাকে মানুষের কল্পনা বলে মনে করে। মানুষের এরূপ কল্পনার আবশ্যকতা ছিল কিংবা আছে বলা এক কথা, আর সেই প্রয়োজনের কারণে বিধাতাকে অস্তিত্বময় বলা আর এক কথা। বিশ্ব সসীম নয়। বিশ্বের বাইরে অ-বিশ্ব বা অ-বস্তু বলে কিছু কল্পনা করা চলে না। বিশ্ব হচ্ছে বস্তু। আর বস্তু হচ্ছে গতিময়। বস্তুর বৈচিত্র্য, মানুষ, মন সবই গতিময় বস্তুর রূপ।
Proposition : প্রতিজ্ঞা, যৌক্তিক বাক্য
যুক্তিশাস্ত্রে দুটি পদের মধ্যে একটি সম্পর্কের উল্লেখমূলক বাক্যকে যৌক্তিক বাক্য বলে। ইংরেজিতে যৌক্তিক বাক্যকে প্রপোজিশন বলা হয়। রহিম একজন মানুষ অথবা রহিম হয় একজন মানুষ, একটি যৌক্তিক বাক্যের দৃষ্টান্ত। এখানে ‘রহিম’ এবং ‘মানুষ’ বাক্যের দুটি পদ : উদ্দেশ্য এবং বিধেয় পদ। বাক্যটিতে এ দুটি পদের মধ্যে একটি সম্পর্কের উল্লেখ করা হয়েছে। ইংরেজিতে ক্রিয়াপদকে যৌক্তিক পদের উদ্দেশ্য এবং বিধেয় পদের মধ্যকার সংযোজক বা ‘কপুলা’ বলা হয়। বাংলায় অনেক সময় উদ্দেশ্য ও বিধেয় পদের মধ্যে ক্রিয়াপদ উহ্য থাকে। যুক্তির মাধ্যমে ব্যবহৃত যৌক্তিক বাক্য প্রথমে মনের মধ্যে গঠিত হয়। মনের অপ্রকাশিত বাক্যকে মানসিক বাক্য বলা যায়। ইংরেজিতে একে জাজমেন্ট বলা হয়। উদ্দেশ্য এবং বিধেয় পদের মধ্যকার সম্পর্কটি হ্যাঁ বাচক এবং না বাচক হতে পারে। আবার বিধেয় পদটি উদ্দেশ্য পদের সংখ্যা বা ব্যক্তার্থের সমগ্র কিংবা উহার অংশবিশেষ সম্পর্কে বিবৃত হতে পারে। সম্পর্কের এ প্রকারভেদের ভিত্তিতে যুক্তিশাস্ত্রের প্রচলিত বাক্য-বিন্যাসের ক্ষেত্রে যৌক্তিক বাক্যকে ১. হ্যাঁ বাচক, ২. না বাচক, ৩. সার্বিক এবং ৪. বিশেষ এই চারভাগে ভাগ করা যায়। ‘সকল মানুষ মরণশীল’ ইহা একটি সার্বিক হ্যাঁ বাচক বাক্য। এখানে ‘মরণশীল’ বিধেয় পদটি ‘মানুষ’ পদের সকল সংখ্যা সম্পর্কে হাঁ বাচকরূপে বিবৃত হয়েছে। ‘কোনো মানুষ অমর নয়।’ এখানে ‘অমর’ বিধেয় পদটি ‘মানুষ’ পদের সমগ্র সম্পর্কে না বাচকরূপে বিবৃত হয়েছে। এটি সার্বিক না বাচক বাক্য। ‘কিছু মানুষ সৎ’ এটি একটি বিশেষ হাঁ বাচক বাক্য। এবং ‘কিছু মানুষ সৎ নয়’ এটি একটি বিশেষ না বাচক বাক্য। যৌক্তিক বাক্যের এ প্রকারভেদকে সংক্ষেপে সা. হ্যাঁ; সা, না এবং বি. হ্যাঁ; বি, না রূপে উল্লেখ করা যায়।
Protagoras : প্রোটোগোরাস (৪৮১-৪১১ খ্রি.পূ)
প্রোটোগোরাস ছিলেন একজন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক। প্রচলিত দার্শনিক মতামতের বিরোধী এবং জনপ্রিয় প্রচারকদের সফিস্ট বলা হতো। প্রোটোগোরাসের দর্শনের জন্য তাঁকেও একজন সফিস্ট বলে গণ্য করা হতো। দেবতাদের ব্যাপারে বা ‘অন দি গডস’ নামে তাঁর দেবতা বিরোধী রচনার জন্য প্রোটোগোরাসকে এথেন্স নগর হতে বহিষ্কার করা হয় এবং তাঁর গ্রন্থ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সাধারণত প্রোটোগোরাসকে একজন অবিশ্বাসী এবং চরম প্রয়োগবাদী বলে মনে করা হয়। কিন্তু তাঁর রচনার এরূপ ব্যাখ্যাও করা যায় যাতে প্রোটোগোরাসকে চরম অবিশ্বাসী অর্থাৎ জগৎ, বস্তু কোনো কিছুতেই প্রোটোগোরাস বিশ্বাস করতেন না, একথা বলা যায় না। প্রোটোগোরাস বস্তুবাদী ছিলেন। তাঁর মতে, বস্তু অস্থির এবং সব কিছুর কারণ বস্তুতে নিহিত।
Protestantism : প্রোটেস্টান্টবাদ
গোঁড়া খ্রিষ্ট ধর্ম, ক্যাথলিক বা রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্ট ধর্ম এবং প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টধর্ম-এই তিনটি হচ্ছে খ্রিষ্টধর্মের ইতিহাসে তিনটি প্রধান শাখা। ইউরোপের মধ্যযুগের শেষ পর্যায়ে সংস্কারবাদী আন্দোলনের যুগে প্রোটেস্টান্টদের উদ্ভব ঘটে। প্রোটেস্টান্টবাদ গোঁড়া খ্রিষ্টান ধর্মের ধর্মীয় পুরুষ, যিশু খ্রিষ্টের মাতার অলৌকিক উপাখ্যান কিংবা নরক ও স্বর্গের মধ্যবর্তী কোনো শোধনাগারের কল্পনাকে স্বীকার করে না। প্রোটেস্টান্টদের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রোটেস্টান্টবাদ ঈশ্বর এবং ব্যক্তির মধ্যে অপর কোনো মাধ্যমের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। প্রোটেস্টান্টবাদের মতে ব্যক্তির সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক হচ্ছে প্রত্যক্ষ। ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করতে ব্যক্তির পক্ষে যাজক বা গির্জার কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যক্তির মুক্তি নির্ভর করে ঈশ্বরের উপর তার বিশ্বাস এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর। কোনো ধর্মজাযকের সুপারিশের উপর নয়। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের উপর খ্রিষ্ট যাজক সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র্য আধিপত্যের ক্ষেত্রে প্রোটেস্টান্টবাদের এই অভিমত বিরাট আঘাতস্বরূপ। এর ফলে রাষ্ট্রের উপর রোমের পোপতন্ত্রের আধিপত্যে ভাঙ্গন শুরু হয়। পোপতন্ত্র রাষ্ট্রীয় শাসন এবং ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বলে গণ্য হতে শুরু হয়। প্রোটেস্টান্টবাদ ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তির সাক্ষাৎ সম্পর্কের কথা বলে ব্যক্তির নিজস্ব শক্তি এবং দায়িত্ববোধকে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। সামন্ততন্ত্র এবং ধর্মীয় কুসংস্কার ও প্রতিক্রিয়াশীল বিধিবন্ধন থেকে ব্যক্তির মুক্তি সাধনে এবং বুর্জোয়া বিপ্লবের পথ উন্মুক্ত করণে প্রোটেস্টান্টবাদ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
Proudhon : প্রুধোঁ (১৮০৯-১৮৬৫ খ্রি.)
পিয়েরী জোসেফ প্রুধোঁ ছিলেন ফরাসি রাজনীতিক, দার্শনিক, সমাজতত্ত্ববিদ এবং অর্থনীতিবিদ। তাঁকে নৈরাষ্ট্রবাদের একজন প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। দর্শনের ক্ষেত্রে প্রুঁধো ছিলেন প্রধানত ভাববাদী। তিনি হেগেলের দ্বান্ধিকতাকে সরল এবং স্থুল করে কেবল কেবলমাত্র ভাল, মন্দের দ্বন্ধ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। ইতিহাস হচ্ছে, প্রুধোঁর মতে ভাবের দ্বন্ধ ক্ষেত্র। প্রুধোঁর একটি রাজনৈতিক-অর্থনীতিক উক্তি হচ্ছে : ‘প্রপারটি ইজ থেফট’ বা সম্পত্তি চুরির ধন। কিন্তু এমন উক্তি দ্বারা ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে তিনি নাকচ করেন নি। এ উক্তির আক্রমণের লক্ষ্য ছিল বড় পুঁজিবাদী সম্পদ। প্রুধোঁ কল্পনা করেন যে, উৎপাদনের ক্ষেত্রে একের সঙ্গে অপরের ন্যায্য বিনিময়ের ব্যবস্থা করা হলে পুঁজিবাদের অসঙ্গতি দূর হয়ে যাবে। প্রুধোঁর একখানি পরিচিত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘ফিলসফি অব পভারটি’ বা ‘দারিদ্রের দর্শন’। মার্কস প্রুধোঁর এই গ্রন্থের সমালোচনা করে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন এবং তার নাম দেন ‘পভারটি অব ফিলসফি’ বা ‘দর্শনের দারিদ্র’।
Psycho-Analysis : মনঃসমীক্ষণ
সিগমন্ড ফ্রয়েড(১৮৫৬-১৯৩৯) প্রবর্তিত স্নায়বিক এবং মনোবিকারের বিশেষ নিরাময় পদ্ধতি এবং মনোজগতের বিশেষ বিশ্লেষণকে মনঃসমীক্ষণ বলা হয়। মনঃসমীক্ষণের মতে, মানুষের মন চেতন ও অচেতনে বিভক্ত। মনের চেতন অংশ সামাজিক বিধি নিষেধের প্রভাবে গঠিত। কিন্তু এই চেতন অংশের পরিমাণ বা পরিধি খুবই অল্প।প্রতিমুহুর্তে মানুষের মনের কামনা বাসনা এবং ঘটনার ঘাত প্রতিঘাত থেকে যত ভাবের সৃষ্টি হয় তার খুব অল্প অংশ চেতনার জগতে অবস্থান করে। যৌন অনুভূতি হচ্ছে ব্যক্তির জীবনের প্রধান উদ্দীপক এবং অনুপ্রেরক। যৌন অনুভূতি বলতে যে কেবল দৈহিক অনুভূতি বুঝায় তা নয়। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালবাসা, সন্তানের প্রতি মায়ের মমতা, কন্যার উপর পিতার বাৎসল্য, সমাজে ব্যক্তির প্রতিষ্ঠা, সাহসী কাজ সম্পাদন দ্বারা অপরের প্রশংসা অর্জনের সুখানুভূতি প্রভৃতি সবই যৌনানুভূতির প্রকাশ। ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে ব্যক্তির ইচ্ছা, অনিচ্ছা, কামনা, বাসনা প্রয়োজন খুব কমই পূর্ণ হয়। ব্যক্তি সমাজ ও পরিবেশকে দেখে তার নিজের কামনা বাসনার প্রতিরোধী শক্তি হিসাবে। ব্যক্তির অপূর্ণ বাসনা আপাত দৃষ্টিতে মরে গেলেও প্রকৃতপক্ষ এগুলি মরে যায় না। ব্যক্তির মনের অচেতন ভান্ডারে তারা আশ্রয় গ্রহণ করে এবং প্রতিমুহুর্তে নিজেদের তৃপ্তির পথ অন্বেষণ করে। অপূর্ব এবং অবাঞ্চিত কামনা সচেতন এবং পরিচিতভাবে নিজেদের তৃপ্ত করতে পারে না। চেতনা সামাজিক প্রহরী হিসেবে অচেতনের দ্বারে প্রহরারত থাকে। অবদমিত অপূর্ণ কামনা নিরন্তর চেষ্টা করে প্রহরী চেতনার চোখকে ফাঁকি দিয়ে অচেতনের বদ্ধ গুহা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে ব্যক্তির ইন্দ্রিয়াদিকে ভর করে নিজেদের তৃপ্ত করতে। যে কামনা স্বাভাবিকভাবে তৃপ্ত হতে পারে নি, সে কামনাই ব্যক্তির স্বরূপে কিংবা অরূপে, ব্যক্তির স্নায়বিক বিকারে আত্মপ্রকাশ করে এবং তৃপ্ত হতে চায়। মনঃসমীক্ষণে মানসিক বিকার মুখ্য বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়। মানসিক বিকার নিরাময়ের প্রধান পদ্ধতি হিসাবে মনঃসমীক্ষণ রোগীর স্বতঃস্ফূর্ত এবং অবাধ স্মৃতিচারণের উপর জোর দেয়। মনঃসমীক্ষণবাদের মতে মনোবিকারের মূল কারণ অতৃপ্তি এবং অবদমন। কাজেই নিরাময় হিসাবে প্রয়োজন হচ্ছে অবদমিত কামনাকে ব্যক্তির চেতনার মধ্যে ফিরিয়ে আনা। ব্যক্তির চেতনা নিজের কামনাকে অবদমনের ফলে চিনতে না পারার কারণিই নিজের কামনার প্রকাশের সঙ্গে ব্যক্তির বিরোধ বাধে; ব্যক্তি তাকে সচেতনভাবে না স্বীকার করতে পারে, না তাকে নিজের স্নায়ুকোষ হতে বিতাড়িত করতে পারে। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত স্মৃতিচারণের মাধ্যমে ব্যক্তি যদি দেখতে পায় যে, যে কামনাকে সে আবাঞ্চিত ও বৈরী কামনা বা শক্তি বলে মনে করছে সে কামনা তারই প্রয়োজনের সৃষ্টি, তা হলে এই স্বীকৃতিই অতৃপ্ত কামনার তৃপ্তি ঘটাতে সাহায্য করবে এবং ব্যক্তির চেতনার সঙ্গে অবদমিত কামনার বিরোধও দূরীভূত হবে। এককালে, বিশেষ করে প্রথম মহাযুদ্ধের পরে মনঃসমীক্ষণ বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ব্যক্তির মানসিক জগতের বিশ্লেষণের ফ্রয়েডের বিশেষ অবদানের কথা স্বীকার করেও বলা যায় যে, ফ্রয়েডের এই বিশ্লেষণ প্রধানত ভাববাদী এবং সমাজের বাস্তব অবস্থায় বিবেচনাহীন। ব্যক্তি সামাজিক জীব। সামাজিক পরিবেশ তার কামনা বাসনাকে তৈরি করে এবং তার তৃপ্তি, অতৃপ্তির কারণ হয়। ফ্রয়েডের এ তত্ত্ব ঠিক। এবং এর অনুসিদ্ধান্ত হিসাবে তাই বলতে হয় যে, মনোবিকারের মূল সমাজ, ব্যক্তির মন নিজে নয়। তাই সামাজিক পরিবেশের আনুকূল্য বা প্রতিকূলতাকে কেন্দ্র ব্যক্তির মনোবিকারের বৃদ্ধি বা হ্রাসের, সৃষ্টি বা নিরাময়ের মূল কারণ এবং উপায় হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। সমাজের সঙ্গে সম্পর্কশূণ্যভাবে ব্যক্তির মনকে স্বাধীন সত্তা হিসেবে চিন্তা করলে তার বিকারের সার্থক নিরাময়ের চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। সেই কারণে মনঃসমীক্ষণ ও তার প্রাথমিক চমকের পরে আর তেমন কার্যকর অগ্রগতি সাধনে সক্ষম হয় নি। ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণবাদী অনুসারীদের মধ্যে ইয়ং এবং এ্যাডলারের নাম উল্লেখযোগ্য।